1 of 2

কুকুরদল – ৩৭

অধ্যায় ৩৭

গলার কাছে ডলতে ডলতে একটা করুণ গান ছেড়ে দিলো নির্ঝর। ধূলোবালিযুক্ত এক কাঁচাপাকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে তার গাড়ি। এদিকে গরম বেশ, নির্ঝরের গাড়িতে এসি নেই। বসে বসে ঘামা আর করুণ সুরের গান শোনা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। পেছনের সিটে চুপচাপ বসে বসে সিগারেট টানছে বন্ধুবর জাকি। তাকে এই গরমের যন্ত্রণা স্পর্শ করছে বলে মনে হচ্ছে না। নির্বিকার ভঙ্গিতে আখক্ষেত দেখছে সে। তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে নির্বিকার মঞ্জুর। এতো গরমেও ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাচ্ছে সে। তার কাজ অতি সামান্য, তার আগ পর্যন্ত ঘুমাতে বাঁধা নেই।

“গরমে মইরা গেলাম ব্যাটা।” বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করলো নির্ঝর।

“কাম বেশিক্ষণের না। টেনশন লইস না। ফিরতি পথে আমিই ড্রাইভ করতেছি। তুই রেস্ট করিস।” পেছনের জানালা দিয়ে সিগারেটটা ড্রাইভিং সিটের জানালায় ঠেলে দিলো সে, “নে, বিড়ি খা।”

“এই কাজটা আমার পছন্দ হইতেছে না, দোস্ত।” সিগারেট নিয়ে বলল নির্ঝর, “ঐ গ্রুপটা থেকে দূরে থাক। ওদের ঘাটানো উচিত হইতেছে না।”

মৃদু হাসলো জাকি, “ঘাড়ে একটা লাথি খেয়েই মুখ দিয়ে মিউ মিউ বাইর হইতাছে তোমার। একটা মাইয়ার লগে পারো না, আবার বুঝাও কোনটা করা দরকার আর কোনটা দরকার না।”

রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে তার দিকে তাকালো নির্ঝর, “ঐটা কোনো অ্যামেচার লাথি ছিল না। আমি কি করে জানবো মাইয়া কারাতে না কুংফু ট্রেনিং নেয়। তুইও তো জানতি না। আমার জায়গায় তুইও ধরা খাইতে পারতি। তাছাড়া, লাথিটা বড় ব্যাপার না, যেই নোংরা একটা জায়গায় আমাকে ছয়টা ঘণ্টা কাটাতে হয়েছে সেটা তোকে ফেস করতে হয় নাই।”

রাত তিনটার দিকে নির্ঝরকে মুক্তি দিয়েছিলো শিয়া। নৈশ অভিযান শেষে হোটেলে ফিরে এসে তবেই মুহিবকে উদ্ভূত পরিস্থিতির ব্যাপারে ফোন দিয়েছিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছিলো মুহিব আর শামীম। হোটেল ম্যানেজমেন্ট এতো রাতে ‘গেস্ট’ অ্যালাউ করতে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো। এদেশে সব ধরণের কর্তৃপক্ষ চরমভাবে যৌনতা বিরোধী। অবিবাহিত একটা ছেলে আর একটা মেয়ে রাতে দেখা করলেই তারা ভাবে “ইয়ে” করতে যাচ্ছে। এবং “ইয়ে” করলেই তাদের মাথাব্যথার কারণ সেটা কিভাবে হচ্ছে তার উত্তর রহস্যে ঘেরা। হোটেল কর্তৃপক্ষও বলল, ‘পরিবেশ’ রক্ষার্থে তারা এমন সময় বিপরীত লিঙ্গের অতিথি অ্যালাউ করেন না। যেন ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে রাত কাটালে পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যায়, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ে দেশটা একেবারেই ডুবে যায়! টাকা কথা বলল তারপর, আর ওরা দু’জনই তিনতলায় শিয়ার রুমে ওঠার অনুমতি পেলো।

সিঙ্গেল বক্স খাটের পাটাতন তুলে ভেতরে নির্ঝর ভাইকে শুয়ে থাকতে দেখে ওরা হাসবে না কাঁদবে তা ঠিক করতে সময় নিয়েছিলো। তারপর ছাদ কাঁপিয়ে হেসেছিলো বটে। নির্ঝরের কান লাল হয়ে গেলো স্মৃতিটা মনে পড়তেই। ওরা তিনজন ওর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়েছিলো তারপর। মুখের ভেতর থেকে বের করেছিলো হলুদ রঙের একটা ব্রা। মুহিব আর শামীমের হাসি তখন দেখে কে! শিয়ার মুখ অবশ্য পুরোটা সময় শ্রাবণের মেঘের মতোই কালো। ঠাণ্ডা গলায় একবার বলেছিলো কেবল, “গেট লস্ট।”

তিনজন যখন বেরিয়ে আসছে হোটেল থেকে, শামীম সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছিলো, “মন খারাপ করবেন না ভাই। এই মেয়ে ভুল করে মেরে দিলে কখনো সরি বলে না। আমাকেও আজ পর্যন্ত বলে নাই।”

“শামস কখনও বলে নাই তার বোন এরকম একটা জিনিস।” আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল জাকি, “কিন্তু তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার পরিকল্পনায় শামসের ফ্যামিলিকে জড়াইতেছি না। এই কাজটা শুধু মুহিব আর শামীম করতেছে। আমার মতে মুহিব ছেলেটা বেটার ক্যান্ডিডেট। শামীম হবে তার সাইডকিক। হেল্পিং হ্যান্ড হিসাবে একজন ব্যাকআপ থাকা ভালো।”

নির্ঝর খুব সন্তুষ্ট হতে পারলো না।”মেয়েটা ওদের ফ্রেন্ড–”

“আরে রাখো তোমার ফ্রেন্ড। ওদের কারও ক্ষতি তো করতেছি না আমরা। এই ব্যাপারটার একটা নিষ্পত্তির করার জন্য মুহিবের আগ্রহ জেনুইন। সে এখনও বুঝতে পারে নাই, নিষ্পত্তির একটাই উপায় আছে এখানে। তাকে আমরা খালি ব্যাপারটা বোঝাবো।”

“আর সে তোরে স্যালুট দিয়া বুইঝা যাবে?” খুক খুক করে কাশলো নির্ঝর, যেন হাসি চাপাতে চেষ্টা করছে, “তোর বা মঞ্জুরের মতো গাটস আমার না থাকতে পারে, মানুষ আমি তোদের চেয়ে ভালো চিনি। মুহিবকে দেখে যতোটা নলাচোদা লাগে তেমনটা ভাবলে ভুল করবি। এই ছেলে তোর থেকেও টাফ, মার্ক মাই ওয়ার্ডস। আমার ধারণা তোফায়েল–রেদোয়ানের থেকেও এ টাফার। খিঁচ খেয়ে থাকে, আলোয় আসে না দেখে কেউ তারে চেনে না। সেজন্য তাকে আর দশজন জেনারেল স্টুডেন্টের মতো ভাবিস না।”

“আমি জানি। সে টাফ বলেই আমি কাজটা তাকে দিয়ে করাতে চাইতেছি। তোর কি মনে হয়, শামীমকে ধরে একটা পিস্তল ধরায় দিলে সে কাউকে গুলি করতে পারবে? নিজেরই প্যান্ট খারাপ করে ফেলবে।”

নিজের বক্তব্য থেকে সরে এলো না নির্ঝর, “তাছাড়া, ওদের ক্ষতি তুই করছিস না সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এই কাজে তারা নামার পর ক্ষতির সম্ভাবনা প্রচুর থাকে। এমন না যে ভুলচুক হয়ে গেলে তুই সেটা সামাল দিতে পারবি। এরকম একটা বিপদে তাদের ঠেলে দিচ্ছিস জানলে শামসের বোন বিষয়টাকে হাল্কাভাবে নেবে না।”

কাঁধ ঝাঁকালো জাকি, “মেয়েটার প্রেমে পড়েছিস নাকি? সে কোন জিনিসটাকে কিভাবে নেবে তা দিয়ে আমাদের দরকার কি? আমি শামসের ফ্যামিলিকে ঝামেলায় জড়াবো না বলেছি। মুহিব বা শামীম তার ফ্যামিলি না। একবারও কি বলেছি, আমার সব সিদ্ধান্ত আমি শামসের ফ্যামিলির কাছ থেকে ভেরিফাই করিয়ে আনবো?”

চুপ হয়ে গেলো নির্ঝর। বন্ধুটির মধ্যে সবকিছুই তার ভালো লাগে, কিন্তু একবার একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে তাকে নড়ানো যায় না। এটা তার পছন্দ না। যদিও এভাবে অনেক সময় অনেক কাজ ঠিকমতো উদ্ধার করে নিতে পারে একজন সফল দলনেতা। তবে নির্ঝর এই মুহূর্তে বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখছে। শামসের সঙ্গে যা ঘটে গেছে তার পেছনে জাকির ভুল প্রতিক্রিয়া দায়ি। শামসের মৃত্যুর জন্য নির্ঝর নিজেকেও দায়ি করে। সেদিন বোকার মতো তোফায়েল গ্রুপের কাছে ধরা না পড়লে জাকি কখনও শামসকে এমন একটা বিপদে ফেলে দিতো না। মাঝে মাঝে শামসের ওপরও রাগ হয় ওর আরে ব্যাটা, প্রায় চার বছর ধরে বন্ধুত্ব আমাদের, তুই একটা ঝুঁকি নিবি তো আমাদের বলে নিবি না? নাকি সে ভেবেছিলো একই সংগঠনের সদস্য বলে তোফায়েলের কুকীর্তি জাকিও ধামাচাপা দিতে চাইবে?

অমুক দলের ছাত্রনেতা তমুক করার অপরাধে দল থেকে বহিষ্কার এধরণের নেগেটিভ সংবাদ এড়িয়ে চলতে চায় সংগঠন। নিজেদের মধ্যে ঝামেলা থাকলে গুরু পাপে লঘু দণ্ড হয়। রেপিস্টকে পুলিশ-জেলের মুখোমুখি হতে হয় না। বরং সে কেন্দ্রীয় সভাপতির পদ হারিয়ে সাধারণ সদস্যে পরিণত হয়। খুনিকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয় না, বড়জোর পদত্যাগ করে সাধারণ সদস্যে নেমে আসতে হয়। অপরাধীর লঘুদণ্ড হোক আর যাই হোক, সংগঠনের নাম যেন নষ্ট না হয়। সেদিক থেকে শামসের ভয় অমূলক ছিল না। সে হয়তো তোফায়েলকে আরও বড় কোনো ধাক্কা দিতে চেয়েছিলো। তারপরও কি সে ওদের তিনজনকে বিশ্বাস করতে পারতো না?

“সময় হয়েছে।” গলা নামিয়ে বলল জাকি 1

মঞ্জুরকে একবার আলতো করে স্পর্শ করতেই নিমেষে জেগে উঠলো সে। চোখ পিটপিট করে এক সেকেন্ডের মধ্যে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হয়ে গেলো। জাকি গ্রুপের মাসল তাকে এমনি এমনি বলা হয় না। দরজার খুলে বেরিয়ে এলো জাকি।

“ভাই, দেরি কেন?” সানগ্লাস পরতে পরতে জানতে চাইলো সে। যার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছোঁড়া হয়েছে সে ধূলোমাখা পথে সহজাত ভঙ্গিতে খালি পায়ে হাঁটছে।

কাশেম মোল্লার পরণে লুঙ্গি আর একটা ছেঁড়া স্যান্ডগেঞ্জি। কাঁধে আর দশটা দিন মজুরের মতোই বস্তা, হাতে একটা বেলচা। গ্রামীণ পরিবেশে এদের দেখা পাওয়া যায়। সদরে ঘণ্টা প্রতি কামলা খাটতে এই বেশেই যায় তারা। মাঝে কয়েক মাস নিবিড়ভাবে দিনমজুরের জীবন পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছিলো নির্ঝরকে, এদের ছোটো ছোটো বিষয়গুলো নিয়ে খুশি হয়ে যাওয়ার এক অপার্থিব ক্ষমতা আছে তা ওর ভালো লেগেছিলো।

কাশেম মোল্লার মুখে হাসি ফুটে উঠলো, “বুঝেন না? একটু দেইখা শুইনাই তো চলাফেরা করন লাগে।” প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলতে সময় নিলো না সে, ঘোরেল লোক।”আপনারে এইদিকে দেখতে পামু তা ভাবি নাই। ভাবছিলাম কাওরে পাঠায়া দেবেন। নিজেই আইসা পড়ছেন দেখি মিয়াভাই।”

জাকির কপাল মৃদু ভাঁজ খেয়ে গেছে। কাশেম মোল্লা এই দিকটা নজরে আনবে বলে সে ভাবেনি। কিন্তু লোকটা চালাক, ঠিক ঠিক ধরে ফেলেছে। এখন তার কৌতূহল মেটাতে বাড়তি কিছু টাকা দিতেই হবে। নয়তো এক কান দু’কান করতে করতে রাষ্ট্র হয়ে যেতে পারে খবরটা। স্টেট ইউনভার্সিটির সম্ভাব্য সভাপতি জাকি সীমান্ত এলাকা থেকে নিজে গিয়ে অস্ত্র কিনেছে। নিজ শহরের পরিচিত চ্যানেল ব্যবহার না করার অর্থ একটাই, সংগঠনের স্বার্থে এই অস্ত্র কেনা হচ্ছে না। কথাটা অবশ্য সত্য।

কাশেম মোল্লার সঙ্গে বাড়তি কোনো ঘনিষ্ঠতা দেখালো না জাকি, “কাহিনী আছে কিছু। আসেন, ভিতরে বসেন। দেখান জিনিসগুলা।”

জাকি বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলো। নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে পথের চারপাশে নজর রাখতে থাকলো সে। কাশেম মোল্লার দিন-মজুর বস্তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে সাত সাতটি পিস্তল। সবগুলোই গুলিশূন্য। অস্ত্র বিক্রি করতে এসে বুলেট নিয়ে আসে না এরা। সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য ক্রেতার সম্ভাব্য ডাকাতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

মঞ্জুর গোলাবারুদ সম্পর্কে বেশ ভালো জ্ঞান রাখে। সরকারি কলেজে পড়ার সময় চাঁদাবাজিতে হাত পাকিয়ে এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই জ্ঞান কাজে লাগাতে পারেনি জাকির কারণে। ছেলেটার জীবনের একটা নতুন লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে জাকি। পেশির পরিবর্তে একই জগতে কাজে লাগানো শিখিয়েছে মগজ। এটা একটা কারণ, জাকি যদি কোনো বিশতলা বিল্ডিং দেখিয়ে বলে, “মঞ্জুর, ছাদে উঠে লাফ দিয়ে পড়।” মঞ্জুর কোনো প্রশ্ন না করে সেই বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠে লাফ দেবে।

এই মুহূর্তে একটা পিস্তল পছন্দ করছে মঞ্জুর। পিস্তল পছন্দের পেছনে মুহিবের অস্ত্র স্পর্শে অনভিজ্ঞতার সঙ্গে বিবেচনায় আনা হচ্ছে তার শারীরিক গঠন, সহজে লক্ষ্যভেদের লক্ষ্যে যথাসম্ভব কম রিকয়েল ইত্যাদি।

আজ এই গ্রাম্য এলাকায় জানালা তোলা এক গাড়ির ভেতর মুহিবের জন্য একটা আগ্নেয়াস্ত্র কেনা হচ্ছে, উদ্দেশ্য কাউকে আহত করা বা ভয় দেখানো নয়। একজন উঠতি ছাত্রনেতাকে গুলি করে হত্যা করা। অথচ যার জন্য এতো আয়োজন, সেই মুহিবের বিষয়টা নিয়ে কোনো ধারণা নেই। বড় মঞ্চে ওঠার আগে এই একটা কাজই এখন বাকি।

মুহিবকে বোঝাতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *