1 of 2

কুকুরদল – ৪৩

অধ্যায় ৪৩

মা-বাবার ঘরে অপরাধীর মতো মুখ করে বসে আছে শিয়া। সাধারণত এই ঘরে সে রাজকন্যার সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত। ক্লাস নাইনে যখন ফেসবুক খুলেছিলো তখন “ওয়ার্কস অ্যাট ড্যাডি’স লিটল প্রিন্সেস” দিয়েছিলো আবেগে। পরে অবশ্য বুঝেছিলো এটা কতোটা লেইম দেখায়। ক্লাস টেনে তার মধ্যে এই উপলব্ধি এলেও আজ তার অনেক ক্লাসমেটকে এধরণের আদিখ্যেতা করতে দেখে। আরে বুড়ি ধিঙ্গি মেয়ে, তোমার বয়সে কতোজন নিজের খরচ নিজে চালাচ্ছে। আর তুমি আছো ড্যাডির প্রিন্সেস হয়ে। যত্তোসব!

মা জানতে চাইলেন, “সুভাষ তো হিন্দুদের নাম মনে হচ্ছে।”

বাবা কিছু বললেন না। তিনি ভাষা হারিয়েছেন। মসজিদ কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি আশা করেননি তার নিজের মেয়ে এমন একটা কাণ্ড করে বসবে। এলাকার লোকজন জেনে ফেললে কি ভয়ানক কাণ্ডটাই না ঘটবে! কাজিফুরী জামে মসজিদের মসজিদ কমিটির মাথা মুনতাসিরসাহেবের মেয়ে একটা হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করেছে!

শিয়া মৃদু গলায় জানালো, “সুভাষের বাবা-মা হিন্দু। কিন্তু ও নাস্তিক।” মুনতাসিরসাহেব তার কলেজ শিক্ষকের রাশভারি কণ্ঠের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর টোনটা ব্যবহার করে জানতে চাইলেন, “ছেলে কি মুসলিম হতে রাজি আছে?”

শিয়ার মনে হলো বাবার কণ্ঠ কুয়োর নিচ থেকে ভেসে আসছে। পুরো সত্যটা বলে তাদের মনে আর কষ্ট দিতে ইচ্ছে করলো না ওর। এমনিতেও ভাইয়ার ঘটনার পর থেকে এই বাড়িতে অনেকদিন ধরে হাসি-আমেজ নেই। আপাতত অর্ধসত্যও বেশ ভালো কাজে আসবে।

শিয়া বলতে পারলো না, সুভাষ কোনো ধর্মে আর বিশ্বাস আনবে বলে মনে হয় না। সে চায় ধর্মের বেড়াজালমুক্ত একটা বাংলাদেশ। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করার জন্য কতোকিছু সাজিয়ে রেখেছে সমাজ। ধর্মের কারণে দু’জন মানুষ একে অন্যকে বিয়ে করতে পারবে না। দেশে হিন্দু বিবাহ আইন আছে। মুসলিম বিবাহ আইন আছে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বিয়ের আইন আছে। নাস্তিকদের বিয়ের আইন নেই।

সে শুধু বলল, “সুভাষ মুসলমান হবে। ওটা নিয়ে তোমরা ভাববে না। তবে এর জন্য তাকে সময় দিতে হবে।”

মেয়ের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন মুনতাসিরসাহেব। ছেলেটা মরে গেলো। যে গেছে সে তো গেছেই, এখন মনে হচ্ছে এই মেয়েকেও যে কোনো দিন হারাতে হবে। নাস্তিকের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। এরচেয়ে ঐ শামসের জুনিয়রদের কারও সঙ্গে কিছু হলেও ভালো লাগতো। সেদিন বাড়ি ফিরে ওদের ড্রইং রুমে দেখে ভেবেছিলেন মুহিব ছেলেটার সাথে তার কিছু থাকলেও থাকতে পারে। ছেলেগুলো ভদ্র, মুসলিম অন্তত। সুভাষ হিন্দুর ছেলে, তারওপর নাস্তিক। মুরুব্বি মানবে না। আখিরাত অনিশ্চিত, নিজে আগুনে জ্বলবে সাথে করে তার মেয়েটাকেও নিয়ে যাবে।

“তুই চাইছিসটা কি তাহলে?” কুয়োর আরও নিচ থেকে ভেসে আসা গলায় জানতে চাইলেন তিনি।

“তোমরা তোমাদের আমেরিকার প্রবাসি পাত্রকে না করে দাও। পাত্রদের নিয়ে আর ঘাটাঘাটি না করো, এমনটাই চাইছি। তোমাদের ভড়কে দেওয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না, সত্যি। একটার পর একটা ছেলে দেখছো কেন বলো তো? বোঝা হয়ে গেলাম?”

মুনতাসিরসাহেব এর জবাব না দিয়ে আঙুলের ইশারায় মেয়েকে বিদায় হতে বললেন। এ নিয়ে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন। আলোচনা কোনো সুস্থ মানুষের সঙ্গে করতে পারলে ভালো হতো। স্ত্রীর মাথায় ইদানিং কিঞ্চিৎ সমস্যা দেখা যাচ্ছে। সে স্বীকার করছে না তার আর কোনো সন্তান আছে বা ছিল। সরাসরি এ নিয়ে কথা হয়নি অবশ্য। বিষয়টা তিনি প্রথম বুঝতে পারলেন দুই মাস আগে। বাড়ি ফিরে দেখলেন শামসের একটা গেঞ্জি দিয়ে স্ত্রী জানালার গ্রিলে লেগে থাকা ময়লা সাফ করছেন।

ব্যস্ত হয়ে তিনি বলেছিলেন, “করছোটা কি?”

স্ত্রী উত্তর করলেন, “গ্রিলের ময়লা দেখেছো? থাকো তো সারাদিন বাইরে। আমি না থাকলে বাড়িঘর সব কি অবস্থা যে হয়।”

“এটা তো শামসের জামা। ওর জামা দিয়েই কি মোছা লাগতো গ্রিলটা?” আহত হয়ে জানতে চেয়েছিলেন তিনি।

থেমে গেছিলো স্ত্রীর হাত। বিভ্রান্তি খেলা করে গেছিলো মুখজুড়ে। তারপর পাল্টা জানতে চেয়েছিলেন, “শামসটা কে জানি? নামটা খুব পরিচিত ঠেকছে।”

এ নিয়ে গোপনে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি। ডাক্তার ভদ্রলোক বলেছেন, এটা তার স্ত্রীর ডিফেন্স মেকানিজম। তিনি এমন একটা সংবাদ পেয়েছিলেন যেটা সহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না। শুরুর কয়েকটা দিন তিনি মানসিক ভারসাম্যহীনের মতোই আচরণ করেছিলেন। তবে তিনি বুদ্ধিমতী একজন মানুষ। নিজেকে পুরোপুরি উন্মাদ হওয়া থেকে রক্ষা করতেই তার অবচেতন এই ডিফেন্স মেকানিজম দাঁড় করিয়েছে। এখানে তিনি তার ছেলের সম্পূর্ণ স্মৃতি সাময়িকভাবে বিস্মৃত হয়েছেন। ঠিক যেন পাথর চাপা দিয়ে রেখেছেন ঐ স্মৃতিগুলোকে। এর ফলে তিনি স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে এসেছেন। ছেলেই যদি না থাকে তবে ছেলের অকালে খুন হওয়ার ঘটনাও থাকতে পারে না। খুব সহজ হিসাব।

স্ত্রীর মতো হিসাব সহজ করতে পারলে মুনতাসিরসাহেব বেঁচে যেতেন। কিন্তু সে উপায় তো রাখা হয়নি। একমাত্র জীবিত সন্তানের জন্য পাত্র দেখছিলেন। একেবারে আমেরিকান প্রবাসি পাত্র। দেশের যা দুর্দিন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে আছে ক্ষ্যাপাটে কুকুরের আস্তানা। এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েকে পড়ানোর সাহস তার আর নেই, অথচ একসময় ছেলে আর মেয়ের এই পড়াশোনার জন্যই কতো গর্বিত ছিলেন তিনি! নিজের অবস্থাটা তিনি বুঝতে পারছেন। তার অবস্থা হয়েছে ঘর পোড়া গরুর মতো। তিনি এখন আকাশে মেঘ দেখলেও মনে করছেন ওসবই আগুনের ধোঁয়া। ছেলেকে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে হারিয়েছেন, মেয়েকেও হারাতে চাইছেন না। সেজন্যই দেশ টপকে বিদেশে পাত্র খোঁজা। অথচ বিয়ের জন্য চাপাচাপি করতেই মেয়ে তাদের এটা কি শোনালো?

মসজিদ কমিটির সদস্য হলেও তিনি বাস্তবতা বোঝেন। এদেশে অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েরা প্রেম ইত্যাদি করে। এখন এমনই হয়ে গেছে যুগ, সবখান থেকে ধর্মকর্মের ওপর থেকে সম্মান উঠে যাচ্ছে। তাই বলে একজন হিন্দু নাস্তিক ছেলেকে পছন্দ করতে হবে? অবশ্য ধর্মিয় দৃষ্টিকোণ থেকে মেয়ের ওপর তার সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। সে একজন বিপথগামী ছেলেকে দ্বীনের পথে নিয়ে আসছে। তার মায়ের সঙ্গে আলোচনায় এই দিকটাও গুরুত্ব পাবে।

বাবা-মা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এখন কি নিয়ে আলোচনা করছেন তা শিয়া জানে। ওটা তার জন্য ভাবনার বিষয় না। সে ভিন্ন একটা বিষয় নিয়ে এখন উত্তেজিত। ভাইয়ার হলের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মধ্যে সে একটা ঠিকানা পেয়েছে।

ছেলেরা ডায়েরি রাখে না সাধারণত। ভাইয়া তো ডায়েরি রাখার মতো মানুষই না। তবে অগোছালো স্বভাবের কারণে হাতের কাছে সব সময় আলগা নোটপ্যাডও সে রাখতো না। এটা একটা ভালো কারণ হতে পারে, ঠিকানাটা অক্ষত অবস্থায় তার কাছে এসেছে। নতুবা কেউ ছিঁড়ে তথ্যটা গোপন করার চেষ্টা করতে পারতো।

বড় ভাইয়ের ক্লাসের খাতাগুলো খুলে চোখ বোলাচ্ছিলো শিয়া। ইংরেজিতে নানা বিদঘুটে জিনিস লিখা ভেতরে। বেশিরভাগ পৃষ্ঠাই ইকুয়েশনে ভর্তি। এসব কাঠখোট্টা জিনিস পড়তে পড়তেই তো যে কারও মরে যাওয়ার কথা। ভাইয়া ওখানে তিন তিনটা বছর টিকে ছিল কি করে? বোরিং ক্লাসরুমের প্রতিচ্ছবি বিভিন্ন পৃষ্ঠার আঁকা কার্টুনগুলো। ভাইয়ার আঁকার হাত খুব ভালো ছিল না, তবে একেবারে খারাপও না। একটা খরগোশের নিচে লিখা, “উই ডিড নট গ্রো আপ”। আরেকটা পৃষ্ঠায় অবাস্তবরকমের বড় বড় স্তনসহ এক নগ্ন নারীদেহের ছবি। ওপরে লিখা পিআইডি কন্ট্রোলার। এসব দেখে হেসে কুটি কুটি হয়েছিলো শিয়া।

তারপরই পেয়েছিলো ঐ পৃষ্ঠাটা। তাড়াহুড়া করে একটা ঠিকানা লিখা, পেন্সিল দিয়ে। বড় বড় অগোছালো অক্ষরে লেখা দেখেই বোঝা যায়, ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছিলো ভাইয়া। অপরপ্রান্ত থেকে একটা ঠিকানা লিখতে বলা হয়েছিলো। হাতের কাছে একটা পেন্সিল পেতে ওটাই তুলে নিয়েছিলো সে। ক্লাসের খাতা টান দিয়ে খুলে যে কোনো এক সাদা কাগজ বের করেছে। ঠিকানা আর ফোন নাম্বার লিখে কোনোমতে বিপর্যয় এড়িয়েছে।

ডায়েরি না রাখলেও এই বয়সের ছেলেরা এই কাজটা হামেশাই করে। মোবাইল বের করে পৃষ্ঠাটার একটা ছবি তুলে মেসেঞ্জারে মুহিবকে ওটা পাঠিয়ে দিলো শিয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *