অধ্যায় ৫০
ব্যাগটা বিছানার পাশে আছড়ে ফেললো মুহিব। দরজার নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে আজকের পত্রিকা, এক হাতে চোখ ঘষতে ঘষতে অন্য হাতে ওটা তুলে নিলো সে। গতকাল এল ক্লাসিকোয় হেরেছে মাদ্রিদ, তাই চলে এসেছে প্রথম পাতায়। নাক কোঁচকালো ও, বাইরের দুটো ফুটবল ক্লাবের খবর কি করে এদেশের দৈনিকের প্রথম পাতার খবর হয়? দেশে মনে হয় খবরের অভাব পড়েছে। মনে পড়ে যায়, শামসের খবরটা পত্রিকাগুলোয় স্থান পেয়েছিলো বড়জোর দুই সপ্তাহ, তাও স্থানীয়গুলোয়। সারা দেশে যাচ্ছে এমন পত্রিকাগুলো একবার খবর করেই খালাস, দ্বিতীয় একটা খবর তারা দেয় খুনী ধরা পড়লে, তবে এই দেশে খুনী ধরা পড়ে কদাচিৎ।
দরজার কাছে মৃদু শব্দ হলো। তাকিয়ে শামীমকে দেখতে পেলো সে। টলতে টলতে ঢুকছে, হাতে একটা সিগারেট। গতকাল সারারাত জেগে আজ বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ক্লাস করেছে। তার খবর হয়ে গেছে। মুহিবকে সিগারেটটা অফার পর্যন্ত করলো না, নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। গত দেড়টা মাস ধরে এমনটাই করে আসছে ওরা আগের মতো প্রাণোচ্ছল আড্ডা আর একবারও বসেনি। ক্লাস, ক্লাস টেস্ট, ল্যাব, ঘুম, মুভি দেখা, সিগারেট খাওয়া। অনেকটা একে অন্যকে এড়িয়ে চলার মতোই। শুধুই কথা বলার জন্য শেষ কবে একসাথে বসেছে? তূর্ণা আপুর বাসায়, এটা মুহিব নিশ্চিত করেই মনে করতে পারে।
“আমার অ্যাশট্রেটা কই?” রুমের দরজার কাছে শামীমের গলাটা শুনে পত্রিকা থেকে মুখ তুলে তাকালো মুহিব।
খাটের নিচ থেকে অ্যাশট্রেটা বের করে তার দিকে বাড়িয়ে ধরলো ও। চুপচাপ ওটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো বন্ধু, এইটুকুই। দিনকাল কেমন যাচ্ছে তা নিয়ে আড্ডা নয়, ক্লাসে সাবুর বিদঘুটে সব ইংরেজি নিয়ে মজা করা নয়, একেবারেই ঠাণ্ডা আর চমকহীন জীবনযাপন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা সিগারেট ধরালো মুহিব নিজেও। ক্লাসগুলো যাচ্ছে অসহ্য রকম বিরক্তি নিয়ে, কাছিয়ে আসহে সেমিস্টার ফাইনাল। এসময় অন্য দিকে মাথা দিলে প্রকৌশলবিদ্যার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, ডাহা ফেল মারা ছাড়া গতি থাকবে না। সেখানে সবচেয়ে কাছের বন্ধুর সঙ্গে শীতল সম্পর্ক ধরে রাখতে হচ্ছে এবং এটাই মুহিবের একমাত্র সমস্যা না। এর চেয়ে বড় সমস্যাতে ওরা আটকে আছে। ওরা সবাই।
মুহিব, শামীম, ইলোরা।
সেদিন রাতে তূর্ণা আপুর বাসায় মেমরি কার্ডটা আবিষ্কার গত দেড় মাসে পাওয়া একমাত্র ভালো খবর ছিল। তারপর যা যা ঘটেছে তার একটা লিস্ট করলো মুহিব।
প্রথমেই আসবে ফাহাদ হিল্লোলের মৃত্যু।
দেশ আলোড়িত হয়েছিলো এই ঘটনায়। ওরা এটাকে আর দশটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডই ধরে নিয়েছিলো, তবে অসঙ্গতিটা প্রথম দেখতে পায় শামীম। রেদোয়ানের বাবা একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, তা অজানা ছিল না কারও। মহানগরের রাজনীতিতে ভদ্রলোকের জন্য সম্মানের একটা আসন রয়েছে। ছেলে যে বাবার আলোর নিচে অন্ধকার ছড়াচ্ছে তা তেমন চোখে পড়ার মতো নয়, আলোর তীব্রতা এতোই প্রবল। ওরা বার বার শুনে এসেছে রেদোয়ানদের পরিবারের প্রায় সবাই রাজনীতির সাথে জড়িত। রীতিমতো পলিটিকাল ফ্যামিলি!
“শামীম সেদিন এই দৈনিকটিই হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলো। মুহিবের দিকে ছুঁড়ে মেরেছিলো ওটা, “চাচা। আপন চাচা!”
তখনও ছুরির আঘাত সেরে উঠতে অনেক দেরি। অনড় শুয়ে থেকে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে ছিল মুহিব। আশা করছিলো বরাবরের মতোই নাটুকেপনা শেষ করে নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেবে বন্ধুবর।
“রেদোয়ানের বাবা হচ্ছে ভিক্টিমের চাচা। ফাহাদ হিল্লোল তার আপন ভাতিজা।”
“তো?” পত্রিকাটা গায়ের ওপর সরাতে সরাতে নির্লিপ্তভঙ্গিতে বলেছিলো মুহিব।
“তোকে শিয়া জানিয়েছিলো, ফাহাদ হিল্লোলের ব্যক্তিগত নাম্বার সে তার ভাইয়ের খাতায় পেয়েছে। তাই না? আর তূর্ণা আপু পরিস্কার বলল হিল্লোলের সঙ্গে শামসভাই দেখা করে এসেছিলেন। ওটা আপুকে জানিয়েছিলেন তিনি, মার্ডারের আগের দিন।”
“হুঁ, তাতেই বা কি? তোর পয়েন্টটা কি?”
“বলতে চাইছি, আমরা জানি শামসভাই এই লোকটার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। এর দুই দিন পর তাকে তুই আবিষ্কার করলি গলা ফাঁক অবস্থায়। তাই না?”
“হুম।”
“আমি বলতে চাইছি, ফাহাদ হিল্লোলের অনেক সুনাম ছিল। দুর্নীতির অভিযোগ কখনোই পাওয়া যায়নি তার নামে। বরং যতোজন ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত নিজের দলের লোকজনকে তিনি দুর্নীতির অভিযোগে পদচ্যুতির জন্য বাধ্য করেছিলেন, তাতে করে দলের অনেকেও তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিল।”
“পত্রিকায় তেমনটাই বলা হয়েছে। দলের প্রত্যেককে শেলটার দেবে সিনিয়র নেতারা। এমনটাই আশা করে সবাই। সেখানে ইনি চলছিলেন উল্টাস্রোতে। ভালোমানুষীর দাম এখানকার মাঠে নেই। হিল্লোলের শত্রুর অভাব ছিল না, এজন্যই খুন হতে হয়েছে তাকে। রাজনৈতিক অন্তর্কোন্দল নতুন কিছু তো না। তার সাথে শামসভাই দেখা করতে গেলেই খুনের পেছনে শামসভাইয়ের মার্ডারের যোগসূত্র আবিষ্কৃত হয় না।”
শামীম অধৈর্য হয়ে উঠলো, “আমার কথাটা শোন, শামসভাই প্রমাণসহ গেলেন ফাহাদ হিল্লোলের কাছে। হিল্লোল দেখলেন রেদোয়ান এবার ফেঁসে যাচ্ছে, প্রমাণ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা গোঁয়ার ছেলে। নিজের চাচাতো ভাইকে ফাঁসিতে ঝোলানোর মতো নীতিবান লোক তিনি ছিলেন কি না তা আমরা জানি না। তিনি মুখে কিছু না বললেও, কাজিনকে একটা ফোন দিয়ে ঘটনাটা জানিয়ে দিলেন। এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?”
“সেটা হতেই পারে। এতে করে ফাহাদ হিল্লোলের মার্ডারের সাথে শামসভাইয়ের যোগাযোগ আবিষ্কার করার কিছু নেই। বরং উল্টোটা-তোর থিওরি ঠিক থাকলে শামসের মার্ডারের সঙ্গে হিল্লোল জড়িত। শামসের মৃত্যুর জন্য হিল্লোল দায়ি থাকলেও কি এসে যায়? লোকটা তো মারাই গেছে। রেদোয়ান বা তোফায়েলকে ফাটকে পোড়ার মতো জিনিস হাতে পেয়েও আটকে বসে আছি। এখনও আমরা শামস মার্ডারের সাথে ওদের কানেক্ট করার মতো কিছু পাইনি।”
শামসের লুকিয়ে রেখে যাওয়া মেমরি কার্ডে পাওয়া ভিডিওগুলো ওরা দেখেছে। ওরা জানে ঠিক কি কারণে প্রাণ হারাতে হয়েছে শামসকে, কেন ওরা এতো মরিয়া হয়ে উঠেছিলো তথ্যগুলো ফেরত পাওয়ার জন্য। ভিডিওটা যারা দেখে ফেলেছে তাদের কেন হত্যা করতেই হতো খুনিদের। অথচ, এই ভিডিও নিয়ে কি করবে তা এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি ওরা। এটা অনেক বড় একটা দায়িত্ব, বলেছিলো তূর্ণা। অনেক, অনেক বড় একটা দায়িত্ব। তার কথার অর্থ ওরা সবাই ভালোমতো বুঝতে পেরেছে। এই ভিডিওটা একবারই ব্যবহার করার সুযোগ পাওয়া যাবে। এটা নিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব। পাবলিক করে দিতে পারে, তাতে করে জটিলতা আরও বাড়বে না এমনটা বলা যায় না। ভালো একজন উকিল নিয়ে দাঁড়ালে অপরাধীরা নিজেদের সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে যেতে পারে। ভিডিও পাবলিক করা উচিত হবে কি না তা
নিয়ে ওরা দুই দিন আলোচনায় বসেছে। কোনোদিনই ফলপ্রসূ উপসংহারে পৌঁছানো যায়নি।
বাদীপক্ষকে প্রস্তুত করে আবারও মামলা তোলা যায় আদালতে, সেখানে দারুণ এক আলামত হিসেবে কাজে আসবে এই ভিডিও। সংশ্লিষ্টদের সবাইকেই জেলের ঘানি টানতে হবে। এ থেকে কোনো মুক্তি নেই তাদের, ফাঁসিও হয়ে যেতে পারে কারও কারও। তবে এখানে তূর্ণার আপত্তি আছে। খুনিরা পুরোনো অপরাধের শাস্তি পেলোই ধরা যাক, তাতে করে তূর্ণার কি লাভ? শামসকে খুন করার অপরাধে তো তাদের অভিযুক্ত করতে পারছে না কেউ।
“ভিডিওটা এমনভাবে কাজে লাগাতে হবে যেন এক ঢিলে সব পাখি মরে।” লাল টকটকে মুখে বলেছিলো সে, “তার আগ পর্যন্ত কেউ যেন জানতে না পারে এটার কথা। নট ইভেন শিয়া।”
ওরা একমত ছিল। সামনাসামনি আলোচনা ছাড়া শিয়ার সঙ্গে ভিডিওগুলো নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে মুহিবেরও ছিল না। শামীম অবশ্য মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো, শিয়ার সঙ্গে লুকোচুরি করা উচিত হচ্ছে না। শামসভাইয়ের আপন বোন সে, ভাইকে কেন খুন হতে হয়েছে তা জানার অধিকার কারও থাকলে সেটা তারই। তবে মুহিব তার বিরোধীতা করেছিলো, “খুব স্পর্শকাতর একটা বিষয় এটা। এই ভিডিও নিয়ে কি করতে চাইছি সে ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে আসতে না পারলে ওকে জানানো যাবে না। শামসভাইয়ের বোন বলে ওকে জানাতে চাইছিস না? আমি বরং একই কারণে ওকে জানাবো না।”
এরপর শামীম নতুন সেই ইঙ্গিত দেওয়ার পর শিয়াকে জানানোর প্রশ্নই আসে না। চোখ বড় বড় করে পত্রিকাটা তুলে নিয়েছিলো সে, “ফাহাদ হিল্লোলকে খুনটা করেছে শিয়া, আমার বিশ্বাস এটা। তোর সাথে এর মধ্যে আর কথা হয়েছে?”
মাথা নেড়েছিলো মুহিব, “না। শেষবার যখন কথা হয় শামস-হিল্লোলের মিটিংয়ের ব্যাপারে সে জানতে পেরেছিলো কেবল।”
শামীমের দৃঢ় বিশ্বাস ফাহাদ হিল্লোলের রক্ত শিয়ার হাতেই লেগে আছে। মুহিবকে সে তার পয়েন্টটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো, “দ্যাখ, শিয়া তার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। সে চাইছে ওদের সরিয়ে দিতে। আদালতের দীর্ঘসূত্রিতার দরকার নাই, তোকে ঠিক যেমনটা বলেছিলো জাকি। শিয়াই মেরেছে হিল্লোলকে! জড়িতদের একে একে সরিয়ে দেবে সে। আমাদের কেবল তার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তুই শুধু রেদোয়ান-তোফায়েলের ব্যাপারে ওকে একটু উস্কে দিলেই…”
রক্তক্ষরণে দুর্বল ছিল মুহিব তখনও। নাক থেকে ব্যান্ডেজ তখনও সরাতে পারেনি। তার মধ্যেই ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসেছিলো সে। গা থেকে সরিয়ে রেখেছিলো কম্বল।
“তোর কোনো ধারণা আছে, ফাহাদ হিল্লোল কোন লেভেলের মানুষ ছিল?”
“অবশ্যই।”
“তাকে যে অনেকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রি বলে ডাকতো, তা কি জানিস?”
“সবাই জানে এসব—”
“তার বাড়িতে ছিল দু’জন বডিগার্ড। সব সময় থাকে তারা। এদের প্রত্যেকেই হাইলি ট্রেইনড, এক্স-মিলিটারি। পেপারের খবরটা ভালো মতো পড়েছিস নিশ্চয়? দু’জন দশাসই এক্স-মিলিটারিকে খুন করে ফাহাদ হিল্লোলকে স্ট্রাইক করেছে যারা, তারা আর যাই হোক, সতেরো আঠারো বছরের মেয়ের দল না। এরা অ্যাসাসিন। শিয়ার পক্ষে সম্ভবই না এমন একটা কাজ একা নামানো। একটা পিস্তল যোগাড় করে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করা এক ব্যাপার আর আর্মির লোকজনের সাথে একা যুদ্ধ করে বেঁচে ফেরা আরেক ব্যাপার।”
“কিন্তু সে এমন একটা কাজ করে দেখিয়েছে–“
“অসম্ভব। তোর এসব পাগলামি ভাবনা বাদ দে। পেশাদার খুনিরা হিল্লোলকে খুন করেছে, শিয়ার মতো একজন ফার্স্ট ইয়ার স্টুডেন্ট না।” শীতল কণ্ঠে নিজের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলো মুহিব, “আর তর্কের খাতিরে ধরা যাক, ফাহাদ হিল্লোলকে খুনটা করেছে শিয়াই। সেইক্ষেত্রে তো আরও ভয়ঙ্কর হলো বিষয়টা। তাকে আর কিছুই জানানো যাবে না। খুন হয়ে যাওয়া ভিক্টিমের আত্মীয়দের ঐ কেসে কাজ করার অনুমতি এমনকি পুলিশ ডিপার্টমেন্টও দেয় না, জানিস? কারণটা বুঝতে পারছিস তো এখন? শিয়া আপন ভাইয়ের কেসে অনেকটা ইনভলভড় হয়েছে, আর কোনোভাবেই তাকে জড়ানো যাবে না। যা করার আমাকে আর তোকে করতে হবে। একটা কেস দাঁড় করাতে হবে, গোলাগুলি করে প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা বাদ দে। শিয়াকেও এর মধ্যে জড়াবি না।”
শামীম তার কথা একেবারেই মানতে পারেনি-সেই থেকে শুরু। মুহিব–শামীমের লেগে গিয়েছিলো ওখান থেকে। ধীরে ধীরে এখন মুখ দেখাদেখিও বন্ধ একরকম। শামস হত্যাকাণ্ডের ঝামেলাটা আজীবন বয়ে বেড়াতে রাজি নয় শামীম, তবে মুহিব তাড়াহুড়ো করে কোনো ভুল পদক্ষেপ নিতে নারাজ। রাতে সিগারেট শেষ হয়ে গেলে হয়তো সিগারেট চাওয়া, শামীমের অ্যাশট্রেটা ভালো-ওটা মাঝে মাঝেই মুহিব নিজের রুমে নিয়ে চলে আসে। মুখ দেখাদেখি বন্ধ হলেও শেয়ারিং বন্ধ হয়নি। এসব নিয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি দু’জনের কেউই। বরং শেয়ারিংয়ের ঘটনাটায় এগিয়ে এসেছিলো শামীম নিজেই।
তূর্ণার বাড়িতে ঘটে যাওয়া সেদিনের আবিষ্কারের পর খারাপ খবরের তালিকায় আরও একটা যুক্ত হয়েছিলো অচিরেই, যেখানে বাধ্য হয়েই শামীমকে এগিয়ে আসতে হয়েছিলো। ওদের ব্যাচের ছেলেদের হলে সিট দেওয়া হয়ে গেছে তখন, রেজাল্টের ভিত্তিতে অবশ্যই। মুহিব জানে বিভাগে সে বিশ বা বাইশতম। সিট পেলো বিভাগের সত্তরজন, কিন্তু মুহিব পেলো না। ওর পরের পঞ্চাশজন পেলেও সে কেন পেলো না তা নিয়ে প্রশ্ন করার দরকার পড়েনি, ওদের সিট অ্যালোট পড়েছিলো তোফায়েলদের হলে। মুহিবের নাম কাটা পড়ায় কেউ আশ্চর্য হয়নি।
ছুরি খাওয়ার পর থেকে শামীমের মেসেই থাকছিলো মুহিব, এক রুমে থেকে একে অন্যকে এড়িয়ে চলা কিভাবে সম্ভব তা এদের না দেখলে বাইরের কেউ বুঝতে পারবে না। তবে হলের অ্যালোটিদের নাম প্রকাশ হওয়ার পরদিন অনেকদিন পর মুহিবকে ডেকে নিচে নিয়ে গেছিলো শামীম, একসাথে চা খেয়েছিলো। তারপর প্রস্তাবটা দিয়েছিলো, “আকাশ, লিখন ওরা তো আমার পাশের রুমটা ছেড়ে দিচ্ছে। সব শালার হলে সিট হয়ে গেছে। তুই উঠে পড় ওখানে। বালের মেসটা ছেড়ে দে।”
মুহিব এই প্রস্তাব পছন্দ করেছিলো। মেসে তার হরিহর আত্মা নেই, লিটু পাশের রুমে ছিল, সে পড়ে আছে ইন্ডিয়ায়। ডাক্তার এই সপ্তাহে বলছেন অবস্থার অবনতি ঘটেছে, তো ঐ সপ্তাহে বলছেন উন্নতি ঘটছে। মুহিব বা শামীমের পাসপোর্টই নেই। ভিসা আদায় করা তো অনেক পরের কথা, চাইলেও বন্ধুকে দেখে আসার উপায় ওদের ছিল না। কাজেই, মেস ছেড়ে দিয়ে শামীমের ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে মুহিব। মুখ দেখাদেখি যথারীতি বন্ধ আছে। এমনকি আজও শামীম এসে ওর ঘর থেকে অ্যাসট্রে নিয়ে গেলো, কিন্তু বন্ধুসুলভ আড্ডার প্রশ্নই আসবে না। মুহিবের মনে হয় ঐ ভিডিওটা ওরা খুঁজে না পেলেই ভালো হতো।
ভিডিওটা খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত নিজেদের সেরাটা দিয়ে ওটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে ওরা সবাই। তখন মনে হচ্ছিলো, “মেমরি কার্ডটা খুঁজে বের করো, এই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রমাণ যোগাড় হয়ে যাবে, জিতে যাবে তোমরা।” তবে বাস্তবতা এতো সহজ নয়, ছিল না কখনও।
ভিডিও আবিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর ইলোরা মনেপ্রাণে ঘৃণা করছে তোফায়েলকে। তার “দেখি ছেলেটা কেমন” নীতি স্রেফ খড়কুটোর মতো উড়ে গেছে। একজন প্রেমিকার জীবন তছনছ করে তোলার জন্য যা যা দরকার ঐ ভিডিওতে ছিল। অথচ তাকে এখনও প্রেমের অভিনয় চালিয়ে যেতে হচ্ছে, কারণ পুরো ব্যাপারটাই গোপনীয়তার দাবিদার। এর চেয়ে খারাপ আর কারও জীবনে ঘটতে পারে না।
ঐ মেমরি কার্ড খুঁজে পাওয়ার কারণে তুর্ণার জীবনেও এসেছে আমূল পরিবর্তন, সে এখন খুনিদের সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার মিছিলে শামিল হয়েছে। আগের ভীরু মেয়েটি আর নেই, তোফায়েল বা রেদোয়ান তার কি ক্ষতি করতে পারে তা নিয়ে বেশি ভাবছে না আর।
আর শামীম-মুহিবের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের শুরুটাও তো ওখান থেকেই। তবে বন্ধু হিসেবে শামীম প্রথম শ্রেণির। ফাহাদ হিল্লোলের মৃত্যুর পর শিয়াকে সে নিজে থেকেও সব বলে দিতে পারতো। কিন্তু মুহিবের কথা ভেবে তেমন কিছু করেনি।
মুহিবও চায় না এসব নিয়ে চার বছর পার করতে, তবে তাড়াহুড়ায় সে কোনোদিনও সায় দেবে না। একইভাবে প্রতিশোধের নেশায় অন্ধ হয়ে থাকা একজন ভাই হারানো বোনকে তো অবশ্যই সে এধরণের একটা ব্যাপারে জড়াবে না। শিয়াকে একবারই কাজে নামতে দেখেছে সে, পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন একটা বুলেট ওই মেয়েটা। পিস্তল নিয়ে এই মফস্বলের আনাচে কানাচে ঘোরা শুরু করেছিলো, নির্ঝরকে লাথি মেরে অজ্ঞান করেছে, এক মাগিকেও ভাড়া করে কাজ করিয়ে নিয়েছে। এই ধরণের বেপরোয়া মেয়েকে নতুন শিকার দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। শামীম বন্ধুত্বের খাতিরে এখনও শিয়াকে কিছু বলেনি, তবে তার ধৈর্যের মেয়াদ কেয়ামত পর্যন্ত থাকার কথা নয়।
এখনও শিয়া জানে না তার ভাইকে কেন খুন করা হয়েছে। মেমরি কার্ডটা সে উদ্ধার করতে চায়, ভিডিও ক্লিপে কি আছে দেখতে চায়। মুহিবের কাছে ওটা আছে সে এখনও জানে না। এই পাগলাটে মেয়েটা যদি এসব জেনে ফেলে, কি ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া সে দেখাবে?
মাথা ঝাঁকিয়ে সিগারেটটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো মুহিব। এর উত্তর জানা দূরে থাকুক, প্রশ্নটাই সে মনের পর্দায় আনতে চায় না।