কুকুরদল – ৫৯

অধ্যায় ৫৯

কোটটা হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে অন্ধকারেই একটা সিগারেট ধরালেন প্রফেসর রবিন গত কয়েকদিন ধরে সিগারেট খাওয়াটা বেড়েছে। তথ্য গোপন করার পর তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিলো দেড় সপ্তাহ আগে। তারই প্রেক্ষিতে আজকে শুনানিতে হাজির হতে হয়েছে তাকে, সেখানে সব ধাড়ি ধাড়ি প্রফেসর এমন সব শিশুসুলভ প্রশ্ন করেছেন মেজাজ খাপ্পা হয়ে আছে সেই থেকে। তিনি এই কারণ দর্শানোর নোটিশের ব্যাপারটা বোঝেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজস্ব নীতি থেকে এটা করতেই পারে। এখানে চাকরি শুরু করার সময় প্রফেসর রবিন ব্যক্তিগত অনেক তথ্যই গোপন করেছেন। এই তথ্যগুলো ক্যালটেকেও গোপন ছিল। জানতো কেবল বোর্ড অব ডিরেক্টররা। এটা নিয়ে তার কখনোও সমস্যায় পড়তে হয়নি, বরং ওয়ার হিরো হিসেবে বোর্ড তাকে সম্মানই করতো। পাগলাটে ধরণের বিদ্রোহী চেতনা থাকার পরও এজন্য ক্যালটেকে কেউ প্রফেসর রবিনকে ঘাঁটাতে আসেনি। অথচ এখানে তাকে এমন সব মানুষ মূল্যায়নের চেষ্টা করছেন যারা অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানের বিচারে তার থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছেন।

এদের মূল ক্ষোভটা তথ্য গোপনের কারণে নয়, আমেরিকার সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে একটা র‍্যাংকে কাজ করাটাই তাদের কাছে অপরাধ। সেই সঙ্গে তিনি যুদ্ধ করেছেন ইরাকিদের বিরুদ্ধে। স্টেট ইউনিভার্সিটিকে অনেকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদ্রাসা ভার্সন’ বলে ব্যাঙ্গ করে থাকেন। এই ব্যাঙ্গ অযথা করা হয় না, বোর্ডের সব সদস্যরাই ইসলামী অনুশাসন নিজে মানেন, অপরকে মানানোর চেষ্টা করেন। তাদের সামনে ইরাকের মুসলিম ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা একজন ইউএস আর্মি বসে থাকলে সে কোনো সহানুভূতি পাবে না এটা জানা কথা। তবুও বোর্ডের কথা শুনে মনে হলো তারা চাকরিটা খাচ্ছে না। বরং সামাজিকভাবে তাকে হেয় করার জন্যই এতো আয়োজন।

বেশিদিন এখানে পা রাখেননি, এর মধ্যেই অনেকের গাত্রদাহের কারণ হয়েছেন প্রফেসর। এর একটা প্রতিক্রিয়া থাকবে, তাই স্বাভাবিক। যারা বয়সে অর্ধেক ছাত্রদের সঙ্গে প্রতিশোধ-প্রতিশোধ খেলতে পারেন এক দশক ধরে, তারা নিজেদের সমকক্ষ সহকর্মীর সঙ্গে কেমন আচরণ করতে পারেন সে ব্যাপারে প্রফেসরের হাল্কা ধারণা ছিল। এখন তেমনটাই ঘটছে। তবুও সৌভাগ্যের বিষয়, এখনও কোনো অতি-উৎসাহী র‍্যাডিকেলাইজড ছাত্র নাসারা

প্রফেসরকে হত্যা করার জন্য অস্ত্র হাতে তার ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েনি।

“লাকি মি।” বিড়বিড় করে ফ্রিজের তালা খুলে একটা বিয়ার ক্যান বের করলেন প্রফেসর।

পেছনের আলোটা জ্বলে উঠলো তখনই। ক্যান নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রফেসর দেখতে পেলেন একজন অতি-উৎসাহী ছাত্র অস্ত্র হাতে তার ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছে।

ক্লান্ত ভঙ্গিতে পিস্তলটা নাড়ালো মুহিব, “আপনার সঙ্গে কথা আছে আমার, প্রফেসর। অতিরিক্ত থাকলে একটা বিয়ারের ক্যান আমাকেও দিন। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। ফ্রিজে তালা মেরে রাখেন কেন?”

*

দ্বিতীয় বিয়ারের ক্যানটায় শেষ চুমুক দিয়ে থামলো মুহিব। আধঘণ্টা ধরে টানা কথা বলে যাওয়ার পরিশ্রমে হাঁফিয়ে উঠেছে স্বরতন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সবগুলো অঙ্গ। বিয়ারের সঙ্গে সমানে চলেছে সিগারেট, ঘরটা একেবারে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে আছে। একাকি থাকা একজন মানুষের তুলনায় ঘরটা যথেষ্ট পরিপাটি সাজানো। ফুলদানিতে ছেয়ে আছে, তাদের মধ্যে কোনো মতে দম নিয়ে বেঁচে আছে সত্যিকারের কিছু ফুল গাছ। ড্রইংরুমে জীবিত গাছ লাগানোর মতো পাগলামি করতে পারে এমন একজন মানুষকেই চেনে সে। তিনি এখন সামনের গদিওয়ালা চেয়ারে আয়েশ করে শরীর এলিয়ে মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছেন। মুহিব থেমে যেতে আরেকটা সিগারেট ধরালেন প্রফেসর রবিন

“দ্যাট’স ইট?” যেন নিশ্চিত হতেই জানতে চাইলেন তিনি, “আমাদের যে ছাত্রটি খুন হয়েছে বলে গুজব উঠছে সেটা ছাত্রনেতা তোফায়েল সরকার?”

মাথা দোলালো মুহিব, কিছুটা বিস্মিতও দেখাচ্ছে তাকে, “ আপনারা এখনও জানেন না?”

“খবরটা আমি এখানে আসার আগমুহূর্তে জানতে পারি। থানা থেকে ভিসি স্যারকে ফোন করা হয়েছে। চরের ওপর কাকে যেন গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। সাথে একটা মেয়ে ছিল। পুলিশ বলছে ওরা দু’জনই স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রি। এখনও পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি, পুলিশ কিছুই ছাড়তে চাইছে না শুনলাম। সরাসরি ভিসি স্যারকে জানাবে তারা। রিপোর্টাররা নিশ্চয় ছেঁকে ধরেছে এতোক্ষণে তাদের।”

“লাশ সনাক্ত করতে খানিক সময় লাগতে পারে।” মাথা নিচু করে বলল মুহিব, “মোট ষোলোবার গুলি করেছি আমি ওকে। অন্তত সাতটা কেবল মাথাতেই।”

“আমি এখনও তোমার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না।” সত্যিটাই বললেন প্রফেসর, মুহিব খুনের ব্যাপারে স্বীকার করার পর থেকেই তার ক্ষেত্রে ‘আপনি-তত্ত্ব’ বাদ দিয়েছেন তিনি। হাত বাড়ালেন ড্রইং রুম সংলগ্ন টেলিফোনটার দিকে। পিস্তলটা তোলার চেষ্টা করলো না মুহিব, টি-টেবিলে নিষ্পাপভঙ্গিতে শুয়ে আছে অস্ত্রটা।

দুটো ফোন করলেন ভদ্রলোক। প্রথমটা থানায়, দ্বিতীয়টা উপাধ্যক্ষের ব্যক্তিগত নাম্বারে। মিনিট পাঁচেক পর টেলিফোন থেকে হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। পায়চারি করলেন ঘরময়। এমন এক চমকের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না একদমই।

“ওরা বলছে খুনি এসেছিলো বিজিবির স্পিডবোটে করে। ওটা দিয়েই নদীপথে পালিয়ে গেছে সে, প্রত্যক্ষদর্শিদের মতে।”

মাথা দোলালো মুহিব, “পদ্মাপাড়ের ঘাটে বিজিবির সবগুলো টহল বোট সাধারণ নৌকাগুলোর সঙ্গেই বাঁধা থাকে। জিরো সিকিউরিটি। তবে ওখান থেকে বোট সরাতে আমাকে দু’দিন টানা পরিকল্পনা করতে হয়েছে।”

চুপ করে রইলেন প্রফেসর রবিন।

“এরচেয়ে ভালো গেটঅ্যাওয়ে প্ল্যান আর হতো না, ওই পরিস্থিতিতে।” নিজেকে সমর্থন করতেই বলল মুহিব, “বর্ডার গার্ডের বোটে করে খুনি কেটে পড়ছে, এটা কে আশা করতে পারতো? তাছাড়া নদীর বুকে ওদেরগুলোই সবচেয়ে দ্রুতগামী।”

আবারও আগের আসনে এসে বসলেন প্রফেসর। অন্তর্ভেদি দৃষ্টি মেলে তাকালেন মুহিবের দিকে। চোখ সরালো না ছেলেটা, অপেক্ষা করছে।

“বেশ। তুমি কাজটা করেছো। একটা মার্ডার করেছো তুমি। এটাকে জাস্টিফাই করার জন্য অনেক বড় একটা গল্পও শুনিয়েছো আমাকে, যেই গল্পের সারমর্ম ছিল তোমার এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।” এক মুহূর্তের বিরতি দিয়ে জানতে চাইলেন তিনি, “কিন্তু আমাকে এসব বলার দরকার কি ছিল? তুমি অপরাধ স্বীকার করছো আমার সামনে, কেন?”

প্রফেসরের চোখে চোখ রেখেই উত্তরটা দিলো মুহিব, “আমার কর্মকাণ্ডের বিচারের ভারটা আমি আপনার ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি। চাইলে আপনি আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারেন। এই যে সামনে পিস্তলটা দেখছেন, এটাই মার্ডার উইপন। আমার ভাগ্য এখন আপনার হাতে।”

চুলে হাত বোলালেন প্রফেসর, স্পাইকের দফারফা হয়ে গেলো। গভির ভাবনায় পড়ে গেছেন। এই ফাঁকে সামনের প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট তুলে নিলো মুহিব। প্রফেসরের সিদ্ধান্ত যদি তার ভাগ্যের অনুকূলে না যায়, হতে পারে অনেকটা লম্বা সময়ের জন্য এটাই তার শেষ সিগারেট।

“আমার নাগরিক দায়িত্ব তোমার ব্যাপারটা অথরিটিকে জানানো।

“ অবশেষে বললেন তিনি।

মুহিব এই কথার কোনো উত্তর দিলো না। মনোযোগ দিয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছে সে।

“ওই মেয়েটার কি হবে? ইলোরার? তোমারই তো বান্ধবি সে। তাকে এরকম একটা পরিস্থিতিতে ফেলে দিলে কেন?”

“পুলিশ তার কিছু করতে পারবে না।” দ্বিধা ছাড়াই বলল মুহিব, “ও এসবের কিছুই জানতো না। আমি যে তোফায়েলকে গুলি করবো তা শুধু জানতো আমার এক বন্ধু।” ইচ্ছে করেই শামীমের নামটা উল্লেখ করলো না মুহিব, “তাকেও আমি শেষ মুহূর্তে জানিয়েছি। আমার ওই বন্ধুও জানতো না কাজটা আমি কবে করবো। কিভাবে করবো। ইলোরা তো একেবারেই অন্ধকারে ছিল। একজন গোবেচারা প্রেমিকা, হাজার শত্রু থাকা ছাত্রনেতার সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় উপস্থিত ছিল যে –এ ছাড়া এখানে ইলোরার আর কোনো ভূমিকা নেই। পুলিশ যেহেতু শুটারকে চিনতে পারছে না, মেয়েটার সঙ্গে যোগসাজ তারা খুঁজে বের করতে পারবে না।”

“কিন্তু মেয়েটাকে ব্যবহার করেই তুমি তোমার শিকাউকে ওই তুলনামূলক নির্জন চরে নিয়ে গেছো।”

“হ্যাঁ। আর কোনো উপায় খুঁজে পাইনি। শহরের মধ্যে কাজটা করলে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হতো।”

“তুমি নিশ্চিত, মেয়েটা সেফ?”

মাথা দোলালো মুহিব।

“আর আরেকটা ছেলের কথা বললে, রেদোয়ান। ওকেও মেরে ফেলেছে তোমার সেই ঢাকাই বান্ধবি?” যেন সবগুলো তথ্য একত্রীভূত করার চেষ্টা করছেন তিনি।

“বান্ধবি বলা যায় না তাকে ঠিক, এই ক্ষেত্রে আমরা একসাথে কাজ করেছিলাম।”

“মেয়েটা কমিউনিস্ট পার্টির, তাই তো?”

“হুঁ।”

“অনুশীলন সমিতি তাহলে। এইদেশে তারা এতো সক্রিয় হয়েছে তা জানতাম না।”

“অনুশীলন সমিতি? আপনি কি করে নিশ্চিত হচ্ছেন?” কয়েকবার চোখের পাতা পিটপিট করলো মুহিব।

“বামপন্থিদের অনেক চরমপন্থি গ্রুপ আছে, তবে সবচেয়ে দক্ষ তারাই। রাজনীতিক ফাহাদ হিল্লোলের ঘটনাটা আমি পেপারে বিস্তারিত পড়েছি। অত্যন্ত দক্ষ একটি দল না হলে ওই কাজটা কেউ পুল করতে পারতো না। অথচ বাড়ির বাবুর্চি বলেছে গোলাগুলির শব্দ শুনে সে প্রথমেই পুলিশে ফোন করেছে। তারপর বেরিয়ে এসে পরিস্কার দেখেছে একটা মেয়ে পাঁচিল টপকে বাইরে চলে যাচ্ছে। তার কথা পুলিশ তেমন পাত্তা দেয়নি, অ্যালকোহলিক শেফের আবার সাক্ষ্য! তবে পত্রিকাওয়ালারা খেয়েছে ভালোই। একা একজন যদি এমন একটা কাজ নামাতে পারে, তাহলে সে হয় এক্স-মিলিটারি, নয়তো অনুশীলন সমিতি।”

“হতে পারে। মেয়েটা আমাকে কখনোই তার রাজনৈতিক পরিচয় জানায়নি।” শিয়ার নামটাও সচেতনভাবে গোপন রেখে চলেছে মুহিব।

“মেয়েটি এখন কোথায়? মানে, টর্চারের পর…”

“ওদের সংগঠনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক ডাক্তারের বাড়িতে ছিল কয়েকদিন। তিন-চারমাস লাগবে পুরোপুরি সারতে, এর মধ্যে দৌড়ঝাঁপ একেবারেই নিষিদ্ধ তার জন্য।”

“তবুও সে সৌভাগ্যবতী। এরকম একজন সিরিয়াল রেপিস্টের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছে।” স্বস্তির সুরেই বললেন প্রফেসর। মুহিব খুশি হলো, তার মানে ভদ্রলোক তার আধ ঘণ্টার বকবকানির পুরোটাই মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন।

“পুরোটা সময় ওকে অসংখ্যবার বলেছি এর মধ্যে সরাসরি না আসতে। অথচ তাকে ঠেকানোর সাধ্য মনে হয় না কারও ছিল। ভীষণ জেদি মেয়ে। আর ট্রেনিংপ্রাপ্তা তো, সাহস বেশি। সাহসিকতা আর বোকামির মধ্যে পার্থক্যটা খুবই সূক্ষ্ম। ভাগ্যিস বেঁচে ফিরেছে।”

“আমার মনে হয়েছে এই মেয়েটার কারণেই আজ তোমাকে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছে। উগ্রবাদী একজনই পরিস্থিতি খুব দ্রুত তাঁতিয়ে তুলতে পারে।”

প্রফেসরের বক্তব্য একেবারে ভুল নয়। শিয়া দৃশ্যপটে উদয় না হলে কয়েক মাসের মধ্যেই শুন্যহাতে ফিরে আসতে হতো মুহিবদের। গোয়েন্দাগিরির যে অভিযান তারা চালাচ্ছিলো তা থেমে আসতো, নয়তো চরমপন্থা ছাড়া গতি নেই বুঝতে পেরে মুহিব-শামীম পিছিয়ে আসতো। অনুশীলন সমিতির মেয়েটিই তাদের প্রথমবারের মতো শিখিয়েছে, দরকারে কঠিন পথ বেছে নিতে হবে। মুহিব জানে, তার মানসিক পরিবর্তন আনতে এই মেয়েটি কেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শিয়ার সঙ্গে পরিচয় না হলে পিস্তল তুলে একজন মানুষকে গুলি করা তার পক্ষে কোনোদিনও সম্ভব ছিল না। সে সারাজীবনই সাধারণ, পড়াশোনা করা ছাড়া আর কোনো কাজ করেনি কখনও। হঠাৎ সেই খোলস থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পর্যাপ্ত সাহস তাকে দিয়েছে পরিবেশ, সেই পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অবশ্যই শিয়া।

“যাই হোক, তারপরও তোমাদের কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব অবশ্যই তার ওপর চাপিয়ে দেবো না।” প্রফেসর দ্রুতই কথা ঘুরিয়ে ফেললেন, “একজন মানুষকে মেরে ফেলেছো তুমি। নরহত্যা করার মতো একটা অপরাধ করেছো। এটা তোমার কাজ, মেয়েটিকে দূষবো না সেজন্য। তুমি একটা অন্যায় করেছো, মুহিব। একটা বড় অন্যায়কে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আরেকটা বড় একটা অন্যায় নিজেই করেছো। তুমি কি বুঝতে পারছো বিষয়টা?”

“অবশ্যই। আমি জানি আমি কি করেছি। কাজটাকে অন্যায় না মনে করলে অনায়াসে চেপে যেতে পারতাম, স্যার। আমাকে পুলিশ কখনোই ছুঁতে পারতো না। আপনার কাছে এসে অপরাধ স্বীকার করছি, কারণ আমি জানি না কাজটা করা আমার উচিত হয়েছে কি না।”

“আমার কাছে তুমি কি আশা করছো?”

“আপনার সিদ্ধান্ত অবশ্যই। আপনি যদি পুলিশে ফোন দেন, আমি এখানেই বসে থাকবো। এভিডেন্সসহ। ধরা দেবো, আমার কোনো আপত্তি নেই। এই পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে সঠিক আর ভুলের মধ্যে যদি কেউ পার্থক্য করতে পারে, সে আপনি।” একটু থেমে যোগ করলো মুহিব, “তাছাড়া, নরহত্যা আপনিও করেছেন। ইরাক ওয়ারে। ২৩শে নভেম্বর, ২০০৬।”

ক্যাম্পাসে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো প্রফেসর রবিনের কীর্তির কথা। সেদিন কমন রুমে তিনি যা বলেছিলেন তা ভেতরের কেউ বাইরে নির্ঘাত রাষ্ট্র করে দিয়েছে। এ নিয়ে প্রফেসরের বিশেষ আপত্তি ছিল না। তিনি যখন চুপ ছিলেন, প্রতিপক্ষ তার ইতিহাস ঘেঁটে বের করেছে। ক্যাম্পাসে ছড়িয়েছে, উপাধ্যক্ষের কাছে লাগিয়েছে। কতোটা সত্য বা মিথ্যে, এসব প্রশ্ন করার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি। এরচেয়ে তার বক্তব্য রাষ্ট্র হওয়াই স্বস্তিদায়ক।

“আমি যুদ্ধে ছিলাম।” ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন প্রফেসর, “যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নরহত্যা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তুমি একজন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করেছো।”

মুখ বাঁকালো মুহিব, “আপনি এদের নিরস্ত্র বলেন? শান্তি অবস্থায় তারা আমাদের সমান সুযোগ দিয়েছে কোনোদিনও? পিস্তল হাতে তারা সমান সুযোগ পাবে কেন?”

মাথা নাড়লেন প্রফেসর, “তারা নরকের কীট হতেই পারে। তাই বলে তুমি নিজেকে তাদের কাতারে নামালে কেন?”

“আপনি জানেন, কাজটা না করলে অদূর ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারতো। তার ভিডিও ক্লিপগুলোই…

“তুমি কিন্তু এখনও বলোনি ভিডিওগুলোতে কি পেয়েছিলে?”

“কি পাইনি!” দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুহিব, “বারো-তেরো বছরের একটা মেয়েকে রেপ করেছিলো ওরা দুই বছর আগে। ওটার ফুটেজ আছে। আমরা পরে টাইমস্ট্যাম্প মিলিয়ে নিউজপেপার ঘেঁটে বের করেছি, মেয়েটা নিখোঁজ ছিল। অর্থাৎ, ওরা রেপ করে মেয়েটাকে মেরে ফেলেছে। প্রাপ্তবয়স্কারাও ওদের থেকে রক্ষা পায়নি, অবশ্যই। মোট নয়টা ফুটেজ পেয়েছি আমরা, তাদের মধ্যে দুটো মেয়েকে চিনেছি। এদেরকে করা হয়েছিলো ধর্ষণ। ওরাই মামলা করেছিলো তোফায়েল–রেদোয়ানের বিরুদ্ধে। মামলা পরে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় তাদের পরিবার। তবে ওদের দাবি মোটেও মিথ্যে ছিল না। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে অন্য তিনটা ফুটেজ দেখতে। রেদোয়ান ছেলেটা স্যাডিস্ট। সে ভিক্টিমদের শরীরের প্রায় সবখানে কাটাছেঁড়া করেছে। পিন ঢুকিয়েছে।” একটু ইতস্তত করলো মুহিব, “শুধু তোফায়েল আর রেদোয়ানেরও ফুটেজ আছে। তারা দু’জনই হয় উভকামী, নয়তো ধর্ষণের সময় যৌনতায় অভ্যস্ত ছিল দেখে নিজেদের মধ্যেও ওরকম সম্পর্কে জড়িয়ে গেছিলো। এইসব ফুটেজ বাইরে বেরিয়ে গেলে ওদের আত্মহত্যা করতে হতো। পারিবারিক সুনাম তাদের রক্ষা করতে পারতো না কোনোভাবেই। বিশেষ করে ঐ বাচ্চা মেয়েটার সাথে ওরা যা করেছে…”

“মুহিব আর বলতে পারলো না। ওর গলা ধরে এসেছে। প্রফেসরের খানিক আগে বলা কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়, উপলব্ধি করলো। দেড় মাস আগেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে জাকির প্রস্তাবটা নিবে। তার পেছনে শিয়ার মারমুখী চরিত্রটির চেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল একটি ভিডিও ক্লিপের। অসামান্য সুন্দরি এক ফুটফুটে শিশুর সঙ্গে রেদোয়ান আর তোফায়েলের মেতে ওঠার ভিডিও। তূর্ণার বাড়িতে মেমরি কার্ডটি আবিষ্কার করার মুহূর্তটাই ওর ভবিষ্যত নির্ধারণ করে দিয়েছিলো।

“তাহলে। তুমি নিজেকে একজন পানিশার মনে করছো। এভাবেই গ্লোরিফাই করতে চাইছো তোমার অন্যায়। যে অপরাধীদের কোনোদিনও আইনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে না, তাদের শাস্তি দিয়ে নিজেকে মহিমান্বিত কেউ বলে ধরে নিচ্ছো। বলতে চাইছো, তোমাকে পাশের ভার্সিটিতে নিয়ে গিয়ে তোফায়েলের ছুরি মারার ঘটনার সাথে তোমার তাকে গুলি করার সম্পর্ক নেই?”

মাথা নাড়লো মুহিব, “সেদিন আমি বরং স্বস্তি পেয়েছিলাম। তোফায়েল যখন আমাকে ছুরি মারে, তার খানিক আগেই প্রথমবারের মতো জাকি আমাকে তার পরিকল্পনা খুলে বলেছিলো। আমি ভেবেছিলাম তোফায়েল আমাকে মেরেই ফেলবে। পরে যখন সে ইলোরার কথা তুললো, স্বস্তির সাথে মার খেয়েছি। কুত্তাটা ইলোরার প্রেমে পড়েছিলো, সত্যিকারের প্রেম। অবাক হয়েছি খুব।”

“এরকম হয়।” মাথা দোলালেন প্রফেসর, “বিখ্যাত কিছু সিরিয়াল কিলার আছে, যাদের বউ-বাচ্চা সবই ছিল। এমন রেপিস্ট আছে যারা তাদের ভিক্টিমকে রেপ করে মেরে ফেলতো। আবার নিজের স্ত্রীর সামনে কিন্তু তারা দায়িত্বপরায়ণ প্রেমময় স্বামি। নিজের মেয়ে, স্ত্রীকে সত্যিই ভালোবেসেছে তারা। সংসার করেছে। সেই সঙ্গে নির্দিষ্ট সময় পর ঠিকই নতুন শিকার খুঁজে নিয়েছে। এটা একধরণের অ্যাডিকশন। পল বার্নার্ডো ছিল এরকম এক বউপ্রেমিক কানাডিয়ান এক সিরিয়াল কিলার-সিরিয়াল রেপিস্ট। এদের আচরণ এতোটাই অসুস্থ, মানসিক সমস্যার কাতারেই ফেলা যায়। তোমাদের ওই তোফায়েল আর রেদোয়ান ছিল এমনই দু-জন অ্যাডিক্ট।”

“তাদের বিচার আপনি এদেশের আদালতে করতে পারতেন না।” দৃঢ় গলায় বলল মুহিব।

“সম্ভবত।” উদাস হয়ে গেলেন যেন প্রফেসর, “বাগদাদে ছিলাম সেদিন, রাত দেড়টার মতো বাজে। আমি অস্থায়ী ল্যাবে কাজ করছি, নতুন কিছু বিস্ফোরক তারা বানাতে শুরু করেছে। একটা স্যাম্পল ছিল হাতের কাছে, তাও বিস্ফোরিত স্যাম্পল। রিভার্স এঞ্জিনিয়ারিং করে এটার কার্যকারণ বোঝার দায়িত্বটা আমি নিজেই নিয়েছিলাম। আইইডি আমার পছন্দের বিষয়। তখনই খবরটা এলো, আমাদের ক্যাম্প থেকে মাইল পাঁচেক উত্তরে একটা নতুন সিচুয়েশন দেখা দিয়েছে। কোনো এক নতুন ধরণের এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস ওরা দেখেছে, পেট্রোলে যারা ছিল। কাছে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। এরকম পরিস্থিতিতে আমাদের খবর দেওয়ার কথা। এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্টদের কাজ তখন থেকে শুরু। একটা হামভিতে করে রওনা দিলাম আমরা, এটা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলাম খুব, মনে আছে। হামভিরা আইইডির কাছে তুলোর মতো। তলে একটা পড়লে গাড়িসহ উড়ে যেতে হবে। কিন্তু সেন্টার চাইলো ওতে করেই আমরা যাই, যেহেতু ক্যাম্প থেকে কাছে। গেলাম। বোমাটা দেখলাম, খুব জটিল কিছু না। সমস্যা একটাই, রিমোটলি কন্ট্রোল করা হয় ওধরণের ডেটোনেশনে। একটা বোমা রিমোট কন্ট্রোলড হলে আর কন্ট্রোলারকে তুমি দেখতে না পেলে, কোনোদিনও বোমার কাছে ঘেঁষতে চাইবে না তুমি। দেখা গেলো ব্লাস্ট রেডিয়াসে পা রাখলে আর বোমাটা দূর থেকে ফাটিয়ে দেওয়া হলো।”

মাথা দোলালো মুহিব। সিরিয়াল রেপিস্টের সঙ্গে প্রফেসরের যুদ্ধের সময়কার অভিজ্ঞতার সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছে না বলে খানিক বিভ্রান্ত। নতুন একটা সিগারেট ধরালেন প্রফেসর, সময় নিলেন যথেষ্ট।

“ভেতরে এক্সপ্লোসিভ গ্রুপটা ঢুকে পড়েছিলাম। আমাদের কাছে সিগন্যাল জ্যামার ছিল। এটা নিয়ে আমিও কাজ করছিলাম। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় বোমা পাওয়া গেলে আগে জ্যামার বসিয়ে তবেই কাজ ধরতাম আমরা। জ্যামার অন করে মাত্রই বোমাটা নিয়ে পড়লাম, একটু অন্যরকম। একটু নতুন ধাঁচের। আমার মনোযোগ ওটার ওপরই ছিল, পুরোপুরি। এমন সময় বাইরে নরক ভেঙে পড়লো।” অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়লেন তিনি, “প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ, জানালা দিয়ে কয়েক রাউন্ড ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো যখন আমরা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিলাম। জ্যামারসহ বোমাটা ওখানে রেখে সিঁড়ি পর্যন্ত এসেছি; পুরো টিমসহ উড়ে গেলাম।”

প্রফেসরের প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে নিলো মুহিব। আনমনে সিগারেট টানছেন তিনি, তাকিয়ে আছেন নিজের কাটা পড়া হাতটার দিকে। এমন অবস্থায় সিগারেট ধরানো ছাড়া আর কি করা যায় মুহিবের জানা ছিল না।

“আমি আজও জানি না আমার হাতটা কেটেছিলো কিসে। জ্যামার দিয়েও কেন সিগন্যাল ঠেকাতে পারিনি তাও জানি না। শুধু মনে আছে সিঁড়ির গোড়ায় চিৎ হয়ে পড়ে আছি। বাম হাত কেন, শরীরের কোথাও কিছু অনুভব করতে পারছি না। শক ওয়েভ। প্রাইভেট মার্টিন কোথা থেকে দৌড়ে এলো, আমার মনে হচ্ছিলো আসমান থেকে নেমে আসা এক দেবদূত যেন। আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, এক হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল। বিল্ডিংয়ের বাইরে তখন বাকিরা একটা পেরিমিটার বানিয়ে সিকিউর করেছে। আমাদের সখের হামভি ওখানে গুলি খেয়ে একাকার, গানার লরেন্স মারা গেছিলো টারেটেই। পাল্লা খুলে তার আড়াল থেকে ইরাকিদের দিকে গুলি চালাচ্ছিলো নেথান। আমার কলারের কাছে ধরে টেনে নিয়ে আসছিলো মার্টিন, বাম দিক থেকে তখনই বেরিয়ে এসেছিলো ওরা। তিনজন ইরাকি, যেন সাক্ষাৎ আজরাইল। আমি জানি না কখন আমার অক্ষত হাতে সার্ভিস পিস্তলটা এসেছে, আর কখন আমি গুলি চালিয়েছি। মার্টিনের পেছনটা কাভার দিতে দিতেই দেখলাম হামভির ভেতর ঠেলেঠুলে আমাকে তুলে দিলো ওরা। গাড়ি ছাড়লো প্ল্যাঙ্কেট, দ্বিতীয় হামভিটাকে ফেলেই পালিয়ে আসি আমরা সেদিন। ওখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় ওরা যখন আমার হাতে একটা টর্নিকেট বাঁধছিলো, প্রথমবারের মতো লক্ষ্য করেছিলাম হাতটা নেই।

চুপ হয়ে গেলো ওরা দু’জনই।

“ওই একবারই মানুষ মারতে হয়েছে আমাকে। সেলফ ডিফেন্স ছিল, অবশ্যই। তখন ওদের গুলি করতে না পারলে আজ আমাকে এখানে বসে কথা বলতে হতো না।”

মুচকি হাসলো মুহিব, “আপনি বলতে চাইছেন আপনার আর কোনো উপায় ছিল না? জাস্টিফাই করতে চাইছেন নিজের কর্মকাণ্ড?”

“আমার আসলেই কোনো উপায় ছিল না–”

“যুদ্ধে না গেলেই পারতেন।” থমথমে মুখে বলল মুহিব। এর উত্তর প্রফেসরের কাছে ছিল না।

“যাই হোক, সবার কাছে নিজের কারণটাই গুরুত্বপূর্ণ।” একটা হাত সামনে বাড়িয়ে দিলো মুহিব, “এখানে রক্তের দাগ আছে আমাদের, স্যার। জাস্টিফাইড হোক আর না হোক, দাগটা থাকবে।”

“যুদ্ধে না গেলে আমি পারতাম না। আমি আমার কাজে দক্ষ ছিলাম। আর আমার ভাই-ব্রাদাররা মরছিলো ইরাকে বসে। আমার সার্ভিস তাদের প্রাণ বাঁচাতে পারতো–”

“তারমানে আপনি যুদ্ধে গেছিলেন প্রাণ বাঁচাতে। প্রাণ নিতে নয়।” বিদ্রুপের হাসি হাসলো মুহিব, “সাক্ষাৎ ডেসমন্ড ডসের মতো কথা বলছেন। যাকগে, এটা জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ না যে আপনি যুদ্ধে কেন গিয়েছিলেন। তবে যুদ্ধে না গেলে আপনি মানুষ খুন করার পরিস্থিতি এড়াতে পারতেন। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সাইন আপ করার অর্থই তো খুনের জন্য প্রস্তুত হওয়া। ভুল বললাম?”

প্রফেসর এটা নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করলেন না।

গলা নরোম করলো মুহিব, “আমি আপনাকে বুঝি, স্যার। জানি, কেন আপনি মসজিদে যান না। আপনি সুন্নি-কুর্দি-শিয়ার লড়াই নিজের চোখে দেখে ক্লান্ত। আপনি আর কোনো পক্ষ নিতে চান না। আপনার দেশে ফিরে আসার কারণটাও আমি জানি। আপনি মারা যাবেন যে কোনো দিন।”

ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন প্রফেসর।

“আপনার মেডিকেল ফাইলগুলোও দেখেছি আমি, আলমারির চিপায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। ওখানে তালা মারা উচিত ছিল আপনার, ফ্রিজে না মেরে। ফেটাল ফ্যামিলিয়াল ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত আপনি, মস্তিষ্কে প্রিয়ন নিয়ে ঘুরছেন। গত এক বছর ধরে ঘুমাননি। এক সেকেন্ডের জন্যও ঘুমাতে পারেননি, রোগটা এমনই।” মাথা নাড়লো মুহিব, “আপনার ফ্রিজ ভর্তি ড্রাগস, আমার ধারণা। হেরোইন না কোকেন আমি জানি না, জানতেও চাই না। আমি আপনাকে জাজ করছি না। টানা এক বছর ধরে এক সেকেন্ডও ঘুমাতে না পারলে আমিও হিরোইঞ্চি হয়ে যেতাম। মাফ করবেন, আপনার রিপোর্ট আমাকে ইন্টারনেটের সাহায্যে বুঝতে হয়েছে। বোঝায় ভুল থাকতে পারে।”

সেকেন্ড পাঁচেকের জন্য চুপ হয়ে গেলেন প্রফেসর। মুহিবের ধাক্কাটা সামলানোর চেষ্টা করছেন। তারপর মাথা নাড়লেন, “তোমার ধারণা ঠিক আছে। আমেরিকার সেরা ডাক্তাররা আমাকে দেখেছেন। এখনও ফেটাল ফ্যামিলিয়াল ইনসমনিয়ার কোনো ট্রিটমেন্ট আবিষ্কৃত হয়নি। টানা এক-দেড় বছর জেগে থাকার পর মৃত্যু, এটাই আমাদের মতো রোগিদের ভাগ্য। আমি আমার ভাগ্য মেনে নিয়েছি। ডাক্তাররা চেয়েছিলো আমি ওদের গিনিপিগ হই, ইরাকের পর তেমন কিছুতে আমি আর রাজি হতে প্রস্তুত না।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, “এজন্যই আমাকে কনফেস করেছো? কারণ আমি আর বেশিদিন টিকবো না।”

“উঁহু। আমি তো আর এসব জানতাম না। চুরি করে আপনার ঘরে ঢোকার পর বোর হচ্ছিলাম। ফ্রিজ খোলা থাকলে আলমারি ঘাঁটার দরকার পড়তো না অবশ্য। আপনাকে কনফেস করার ইচ্ছে আমার ছিল। কারণটা এরই মধ্যে বলে ফেলেছি, আমি মনে করি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার মতো ভুল আর ঠিকের পার্থক্য কেউ করতে পারবে না। আপনি যদি আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেন, আমি সেটা মেনে নেবো। আমি বলতে চাইছি, তোফায়েলকে খুন করে অপরাধ আমি করেছি। আর সেই অপরাধের বিচার হবে আপনার আদালতে।”

পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে হাতে পেঁচালেন প্রফেসর। তারপর সামনের টেবিল থেকে তুলে নিলেন পিস্তলটা। দক্ষ হাতে ম্যাগাজিন রিলিজ করে ভেতরটা দেখলেন। সম্পূর্ণ লোড করা আছে অস্ত্রটা। জাকি তাকে তিনটা ম্যাগাজিন দিয়েছিলো, তৃতীয় ম্যাগাজিনের দিকে প্রফেসরের আনন্দমাখা চাহনি দেখে মুহিব নিশ্চিত হলো এই মানুষটা স্রেফ আমেরিকানদের প্রাণ বাঁচাতে যাননি যুদ্ধে।

ধীরে ধীরে অস্ত্রটা মুহিবের দিকে তাক করলেন প্রফেসর, “তোমাকে যদি পুলিশের হাতে না তুলে দেই, আমার আদালতে বেকসুর খালাস পেয়ে গেলে তুমি কি করবে? আরেকটা অপরাধে অবশ্যই জড়াবে তুমি। একটা খুন করে ফেলেছো, দ্বিতীয় আরেকটা খুন করতে তোমার হাত কাঁপবে না। যেমন, আমার আদালতে তোমার মৃত্যুদণ্ডের রায় হলে তোমাকে এখানেই গুলি করতে আমার হাত কাঁপবে না। প্রথম খুনের পর থেকে ওই কাঁপুনি কেটে যায়।”

প্রফেসর নিষ্কম্প ধরে রেখেছেন অস্ত্রটা। রুমাল ব্যবহার করে তিনি হাতল আর ট্রিগার একই সঙ্গে অদ্ভুত দক্ষতায় কাভার করেছেন। এই অস্ত্রে প্রফেসরের হাতের ছাপ পাওয়া যাবে না। তিনি কি মুহিবকে সন্দেহ করছেন?

বড় করে দম নিলো মুহিব, “আপনি আমাকে বেকসুর খালাস দিলে আমি আজ রাতের ট্রেনে করে ঢাকা যাবো। ট্রেনে সিকিউরিটি কম। পিস্তলটা সাথে নিয়ে যাচ্ছি যেহেতু, সিকিউরিটির কথা ভাবা লাগছে। বাসে ঝুঁকি বেশি। ট্রেনে সার্চ হলে আমি অস্ত্রটা ফেলে দিতে পারবো কোথাও।”

“পিস্তল নিয়ে ঢাকা গিয়ে কি করবে? আরেকজনকে খুন করবে?” ট্রিগারে রুমালের ওপর দিয়েই আঙুল চেপে বসলো প্রফেসর রবিনের।

হাসলো মুহিব। অস্ত্রের মুখে হাসিটা তেমন জমলো না।

“ঢাকায় রেদোয়ানের এক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসি খালার বাড়ি আছে। ওখানে এই পিস্তলটা লুকিয়ে রাখবো। এটুকুই আমার কাজ। বাকিটা পুলিশ করবে।”

“ওখানে তুমি ঢুকছো কি করে?”

“দারোয়ান নেই ওখানে। পুরো বাড়িটাই তালাবদ্ধ পড়ে থাকে। সেই তালার চাবি রেদোয়ানের কাছে ছিল। এখন সেটা আছে আমার কমিউনিস্ট বান্ধবির কাছে। ওর থেকে নিয়ে নেবো। রেদোয়ানের লাশটা ওদের পার্টির লোকজন একেবারে গায়েব করে দিয়েছে। কেউ তাকেও খুঁজে পাবে না। তবে আমার রেখে আসা পিস্তলটা খুঁজে পাবে। পুলিশ ধরে নিতে পারে, তোফায়েলকে রাজনৈতিক কারণে রেদোয়ানই খুন করে গা ঢাকা দিয়েছে।”

“পুলিশকে এতো বোকা ভাবার কারণ নেই। এটা খুব অযৌক্তিক একটা গল্প হয়ে যাবে।”

কাঁধ ঝাঁকালো মুহিব, “তাতে কি এসে যায়? এভিডেন্স আছে রেদোয়ানের খালার বাড়িতে। যে খালার বাড়িটা গত কয়েক বছর ধরে রেদোয়ানই দেখাশোনা করে আসছে। দুইয়ে দুইয়ে মিলে কতো? চার। পুলিশ একটা কেস ক্লোজড করে দিতে পারলে সেটা ওপেন কেন রাখবে? তার ওপর থাকবে রেদোয়ানের পরিবারের চাপ।”

“অস্ত্রটা ওরা খুঁজে পাবে কি করে?”

“ব্যবস্থা করা ব্যাপার হবে না।”

“বেশ। একজনকে খুন করলে। অপর একজন মৃত ব্যক্তির নামে দোষ চাপিয়ে নিজে মুক্ত হয়ে যাচ্ছো। খুব ভালো প্ল্যান। এটা আরেকটা দিক ইঙ্গিত করে। অপরাধে তোমার মাথা আছে।” পিস্তলটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলেন প্রফেসর, “তোমাকে ছেড়ে দিলে তুমি আরও কতো মানুষের ক্ষতি করবে কে জানে!”

দুই ভ্রু উঁচু করলো মুহিব, “আমাকে যতোটা চেনেন তাতে করে কি সেধে গিয়ে ঝামেলায় জড়ানোর মতো মানুষ মনে হচ্ছে?”

আবারও মাথা নাড়লেন তিনি, “তা হয়তো তুমি নও। তবে যারা এই লাইনে আছে তারা তোমাকে ঠিকই খুঁজে নেবে।”

শ্রাবন্তীর বাবার চেহারাটা ভেসে উঠলো মুহিবের মনের চোখে। প্রাক্তন মেয়র। জাকির কথাও মনে পড়লো। এই লাইনের লোক। মুহিব কাজটা করেছে জানতে পারলে তারা তাকে ভবিষ্যতে আরও কাজে লাগাতে চাইবে।

“ওরা আমাকে দিয়ে কোনো অপরাধ করাতে পারবে না। একটা আলামতও আমি ক্রাইম সিনে ফেলে আসিনি। এই এক এভিডেন্স, যেটা ধরে আছেন, ওটা রেদোয়ানের খালার বাড়িতে ফেলে আসলেই আমার কাজ শেষ। এই লাইনের লোকজন আমার ব্যাপারে জানতে পারবে না কখনোই। জাকির মুখের কথা ছাড়া আর কোনো প্রমাণ নেই এখানে।”

নিষ্প্রাণ চোখজোড়া এরপরও দীর্ঘ ত্রিশটা সেকেন্ড অপলক তাকিয়ে থাকলো মুহিবের দিকে। তারপর অস্ত্রটা নামিয়ে আবারও টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলেন প্রফেসর রবিন 1

“যাও। নিজের ভাগ্য গড়ে নাও।” অবশেষে বললেন তিনি। রুমালটা খুলে আবারও পকেটে ভরে রাখলেন।

গ্লাভসজোড়া হাতে গলিয়ে অস্ত্রটা তুলে নিলো মুহিব। শোল্ডার হোলস্টারে ভরে রাখলো। ওজনটা বেশ উপভোগ করার মতোই। প্রফেসরের অনুমতি নিয়ে প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে নিলো সে। জানালা গলে বাড়ির ভেতর ঢুকলেও, বেরুলো সদর দরজা দিয়ে। দরজার চৌকাঠে যখন, পেছন থেকে আরেকবার ডাক শোনা গেলো অদ্ভুত প্রফেসরের।

“মি. মুহিব।”

“জি, স্যার?’

“আশা করি আমার অসুখটার ব্যাপারে কাউকে বলবেন না।”

মুচকি হাসি ফুটে উঠলো মুহিবের। শ্রদ্ধেয় মানুষটা তাকে পাল্টাপাল্টি শ্রদ্ধা জানালে এতো খুশি লাগবে তা তো সে আগে কখনও ভাবেনি!

“কাউন্ট মি অন দিস, স্যার।” হাসিমুখেই উত্তর দিলো মুহিব, পেছনে টেনে দিলো দরজাটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *