কুকুরদল – ৬০

অধ্যায় ৬০

ধানমন্ডি লেকের পাড়ে বসে আছে একজোড়া তরুণ-তরুণী। সানগ্লাস আর টিশার্টে দারুণ দেখাচ্ছে মুহিবকে, তবে হলুদ ফতুয়া পরে আসা শিয়ার চেহারা পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। নাকের ওপর এখনও ব্যান্ডেজ, এক মেকআপ বক্স ঘষেছে মুখের ওপর। তারপরও চোখের পাশে, থুতনির ওপর কালশিটে বেরিয়ে পড়েছে। ওটুকু রঙিন চশমা ঢেকেও কুলোতে পারেনি। তার গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকা মেয়েটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলো মুহিব। তাকে হলুদ ছাড়া আর কোনো রঙের জামা পরে আসতে দেখেছে কি না মনে করার চেষ্টা করছে। দেখেনি। পছন্দের রঙটা অন্যরকম এই মেয়ের, সচরাচর হলুদকে সবাই বিরক্তির চোখেই দেখে।

“বকের মতো আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে বলে ফেলো কি বলবে।” যান্ত্রিক কণ্ঠে বলল শিয়া, “আগাম সতর্কবার্তা : ইদানিং অল্পতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার।”

হাসলো মুহিব, “সরি। তোমাকে বাইরে আনার ইচ্ছে ছিল না আমার। বিশ্রাম দরকার এখন তোমার, অনেক ধকল গেছে।”

মাথা নাড়লো শিয়া, “আমি চাইছিলাম তোমার সাথে একটু কথা বলতে। বাইরে আসাটাই ঠিক আছে, বাসায় এসব নিয়ে কথা বলা যেতো না।”

এদিকে ওদিকে অনেক কপোত-কপোতী দেখা যাচ্ছে। মুহিব-শিয়াকেও যে কেউ প্রেমিক-প্রেমিকা ভেবেই ভুল করবে। শিয়া মুহিবের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। এই ভঙ্গিটার মধ্যে কামের স্থান নেই, আহত শরীর নিয়ে বেশিক্ষণ সোজা হয়ে বসে থাকা মেয়েটির জন্য পরিশ্রমের। মুহিব ভেবে পায় না, এমন অত্যাচারের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সে কোন সাহসে বাইরে এলো। আনমনে ফিচার ফোনটা হাতে নাড়াচাড়া করতে শুরু করলো সে। লিটুর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে নিজের স্মার্টফোনটা ভেঙে ফেলেছিলো রাগে-ক্ষোভে-বেদনায়। ছাত্রজীবনের চিরন্তন সঙ্গি অর্থসঙ্কট নতুন একটা স্মার্টফোন কেনার সুযোগ তাকে দেয়নি। পরদিনই একটা সস্তা ফিচার ফোন কিনে নিতে হয়েছিলো তাকে। নতুন ফোনে প্রথম ফোনকল ছিল শিয়ার।

শিয়ার পরিণতির কথা জানার পর মুহিব বুঝতে পেরেছিলো হাতে আর বেশি সময় নেই। ইলোরাকে জোর দিয়েছিলো অভিনয় চালিয়ে যাওয়ার জন্য। লম্পট তোফায়েলকে সুযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে গ্রহণ করেছে। সপ্তাহব্যাপী অনুসরণের পর কাজটা করে ফেলেছে মুহিব। প্রায় একটা বছর ধরে টেনে আনা বোঝাটি অবশেষে ওর কাঁধ থেকে নেমে যাবে। শেষ ধাপ হিসেবে শিয়ার সঙ্গে দেখা করে চাবিটা সংগ্রহ করতে এসেছে সে। তারপর মার্ডার উইপনটি আলগোছে রেখে আসবে ছাত্রনেতা রেদোয়ানের তত্ত্বাবধায়নে থাকা বাড়ির ভেতর। পুলিশের চোখে ওটা পড়ার কারণ সৃষ্টি করে দেবে। ব্যালিস্টিকস পরীক্ষা করলেই খুনির ‘পরিচয়’ বেরিয়ে যাবে।

রেদোয়ানের বাবা দেশ তোলপাড় করে ফেলছেন ছেলেকে খুঁজতে, পিস্তল আবিষ্কারের পর পুলিশ দ্বিগুণ উৎসাহে তাকে খুঁজতে শুরু করবে। তবে তাকে কখনোই পাওয়া যাবে না আর। সেদিন কি ঘটেছে তার সামান্য বর্ণনা শিয়া একটু আগে মুহিবকে দিয়েছে। ধর্ষিতা অবস্থায় সে রেদোয়ানকে খুন করেছিলো। তারপর তার দুর্ভোগ পেয়েছিলো নতুন মাত্রা। তিন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কোলের ওপর এক ওজনদার লাশ নিয়ে আহত শরীরের একটা মেয়ে রাতারাতি পালিয়ে যেতে পারে না। রেদোয়ানের লাশটা এক হাত দিয়েই টেনে খাট থেকে ফেলে দিয়েছিলো সে। তারপর গোটা খাটটা নিয়ে কাত হয়ে পড়েছিলো একপাশে। প্রয়োজনীয় নড়াচড়া সবগুলো ক্ষতমুখ খুলে দিয়েছিলো তখন, প্রবল শারীরিক যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করে খাটসহই মেঝেতে হিঁচড়ে চলেছিলো শিয়া। রেদোয়ানের খোলা প্যান্টের পকেট থেকে চাবিটা বের করেছিলো বাম হাতে, তারপর নিজেকে মুক্ত করে প্রথমেই খুঁজেছিলো নিজের পোষাক আর সামগ্রি।

পাশের ঘরে সব পাওয়া গেছিলো, ফোনটা বের করে সুভাষকে ডেকেছিলো সে। কোথায় বন্দি হয়ে আছে তা জানার জন্য প্রয়োজন ছিল লোকেশন। সবচেয়ে কষ্টকর অংশটি ছিল আহত শরীরে পোষাকগুলো পরে নেওয়া। মুহিবকে বলতে সঙ্কোচ হয়নি, অন্তর্বাসগুলো পরার সাহস সে করতে পারেনি। স্পর্শকাতর প্রতিটি অঙ্গেই অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিলো শিয়া। চূড়ান্তমাত্রার সতর্কতা ধরে রেখে গ্যারেজে বেরিয়ে এসে বুঝতে পারলো পুরো বাড়িতে আর কেউ নেই। গুগল ম্যাপস খুলে নিজের অবস্থান জেনে নিয়ে সুভাষকে আবারও ফোন দিয়েছিলো সে। মিনিট বিশেকের মধ্যে চলে এসেছিলো ভারি ওভারকোট পরা সুভাষ।

গ্যারেজের ভেতর ঢুকেই দুটো চটপটে চেহারার সাবমেশিনগান দু’হাতে বের করে জানতে চেয়েছিলো বিল্ডিংয়ে আছে কয়জন? শত্রুসংখ্য শুন্য জেনে প্রথমেই বাইরে পার্ক করে রাখা গাড়িটায় শিয়াকে নিয়ে অনুশীলন সমিতির গোপন চিকিৎসালয়গুলোর একটায় পৌছে যায় তারা। সেখানে শিয়ার দায়িত্ব ডাক্তার নিয়ে নিতে আবারও বন্দিশালা বাড়িটায় ফিরে আসে সুভাষ। এবার ট্রাংক থেকে কাভার-আপ টুলস, ব্লিচ, প্লাস্টিক শিট এবং গোলাপি এক বালতি বের করে বেজমেন্টে নেমে যায় সে। আধঘণ্টা পর প্রতিটি ফোঁটা রক্ত স্রেফ উধাও হয়ে যায়। ঝাঁ চকচকে বাড়িটাকে পেছনে ফেলে ট্রাংকে প্লাস্টিক শিট পেঁচানো এক মৃতদেহ নিয়ে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় মিশে গিয়েছিলো সুভাষ

রেদোয়ানের লাশ সে ঠিক কিভাবে গায়েব করেছে, তা শিয়া জানতে চায়নি। তবে অনুশীলন সমিতি কোনো লাশ গায়েব করে দিলে তা পরে আর কোথাও আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

“আমি চলে যাচ্ছি। আর হয়তো দেখা হবে না।” নিচু গলায় বলল শিয়া পাঁজরে মেয়েটির মেরুদণ্ড অনুভব করলো মুহিব, “কোথায়?”

“প্রথমে, রাশিয়া। তারপর স্পেন। ওখানে এক ভার্সিটিতে আমার ফুল ফ্রি স্টুডেন্টশিপ নেওয়া হয়ে গেছে।” মুহিবের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো সে, “এগুলো কিন্তু ক্লাসিফায়েড তথ্য। তোমাকে বললাম।”

মাথা দোলালো মুহিব। মানুষের গোপন কথা সে গোপন রাখতে জানে।”আমাকে সরিয়ে দিচ্ছে ওরা দেশ থেকে।” নিচু কণ্ঠেই বলে চলেছে শিয়া, “আমি কম্প্রোমাইজড। যেমনটা বলে না, মাই কাভার হ্যাজ বিন ব্লোন। সরকারি ছাত্রনেতা নাগাল পেয়ে গেছে, মানে আমাকে দিয়ে এই দেশে আর কাজ হবে না। বড় কোনো শাস্তি হতে পারতো, তবে সুভাষ আমাকে খুঁজে পাওয়ার কারণে রিপোর্টটা সে-ই করেছে। আমি যে ব্যক্তিগত কারণে এসবে জড়িয়েছি সেটা ওর রিপোর্ট পড়ে কেউ বুঝবে না। ছেলেটা অনেক করলো আমার জন্য।”

“কিন্তু তোমাকে আর দেশে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। স্পেনে করবে কি? অনুশীলন সমিতির কাজ?”

“হয়তো। মস্কো থেকে যেমনটা বলে। দেখি কি করা যায়। তবে ওখানে আমি নিরাপদে থাকবো। এখানে আমি সব আসলেই ভজঘট পাকিয়ে ফেলেছি। কাজের মধ্যে ব্যক্তিগত স্বার্থ টানলে সেটা কতো ভয়ানক হতে পারে তা তো নিজের চোখেই দেখলাম। রুকি মিসটেক।“

মেয়েটার হাতে আলতো করে চাপড় দিলো মুহিব, “ভেবো না। সব ভালো তার, শেষ ভালো যার। আর আমাদের শেষটা ভালো হয়েছে। ভাইয়ার খুনিকে তুমি একইভাবে নিকেশ করেছো এটার চেয়ে ভালো খবর আর হয় না। এদিকে আমিও শেষ সূতোটা কেটে বাদ দিয়েছি। আর কেউ আমাদের খুঁজবে না। আমরা এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ।”

অনেকটা যন্ত্রণা নিয়ে সোজা হয়ে বসলো শিয়া। ভালোমতো তাকালো মুহিবের মুখের দিকে, “তোমাকে ধন্যবাদ, মুহিব। তুমি না থাকলে সম্ভব হতো না। ভাইয়াকে আর কোনোদিন দেখতে পাবো না, কিন্তু ওকে যারা মেরেছে তাদের আমরা ছেড়ে দেইনি। তাই না?”

কেমন যেন আর্দ্র হয়ে উঠেছে শিয়ার চোখজোড়া। মুহিব এই প্রসঙ্গটা আর টানলো না।

“কি নিয়ে পড়তে যাচ্ছো স্পেন?”

“কালচার।” আবেগ সংবরণ করে হাসলো শিয়া, “আয়রনিক না?”

হাসলো মুহিবও, “তুমি ওখানে দারুণ করবে।”

ঘণ্টাখানেক পর বিদায় নেওয়ার সময় শিয়া মুহিবকে জড়িয়ে ধরেছিলো, শারীরিক সব যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করেই। কপালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে বলেছিলো, “আই উইল অলওয়েজ লাভ ইউ লাইক আ ব্রাদার। যে কোনো সমস্যায় পড়লে আমাকে অবশ্যই জানাবে। অবশ্যই।”

“দেশে এলে আমার সাথে দেখা না করে যেতে পারবে না, এই শর্তে এটা মেনে নেওয়া যায়।” মাথা চুলকিয়ে বলেছিলো মুহিব, “কাকে কিডন্যাপ করতে এলে না মারতে ফিরলে তা আমার জানার দরকার নেই। তুমি দেশে আসলেই আমার সাথে দেখা করে যাবা।”

একে অন্যকে কথা দিয়ে ওরা যখন বিপরীত দিকে হেঁটে যাচ্ছিলো, দু’জনই মনে মনে স্বীকার করে নিয়েছিলো এই প্রতিশ্রুতি কেবলই মুখের কথা। ওদের আর দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই জীবনে নয় অন্তত। শোল্ডার হোলস্টারে পিস্তলের ওজন অনুভব করছিলো মুহিব, প্রতি পদক্ষেপেই বেড়ে চলেছিলো তার আত্মবিশ্বাস। অনেক, অনেকদিন পর, ছেলেটা নিজের গন্তব্য কোথায় তা ঠিক ঠিক জানতে পেরেছে। হোলস্টারের স্ট্র্যাপ খোঁচা দিচ্ছে পুরোনো এক ছুরির ক্ষতে, অনুভূতিটাকে সঙ্গি করে গন্তব্যের পথে পা বাড়ালো মুহিব।

.

পরিশিষ্ট

ঘিঞ্জি একটা গলির মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন এই শহরের প্রাক্তন এক মেয়র। বিরোধীদলের হয়ে রাজনীতি করার কারণে বর্তমানে তার প্রভাব প্রতিপত্তি শুন্যের কোঠায় বলে যে গুজবটা রয়েছে, তার বিপরীতে সাক্ষ্য দিতেই যেন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আট-নয়জন ভয়াল দর্শন যুবক। এদের তিনজনের হাতে পাইপ। দুইজন ধরে আছে শটগান। মফস্বলের কিছু গলিতে এমন ঘটনা ঘটে যায় মাঝে মাঝেই, তেমন কারও নজরে পড়ে না বিষয়টা। এলাকার বাইরে যারা থাকে তারাও জানে এলাকা খারাপ, রাতে এদিকটায় ঘেঁষে না। এলাকার ভেতরে যারা থাকে তাদের জন্য এসব গা সওয়া হয়ে এসেছে। কোনো গলিতে ঢুকতে গিয়ে একটা শটগান নজরে এলে তারা গতিপথ পরিবর্তন করে অন্য গলি ধরে বাড়ি ফেরে।

রাত প্রায় দুটো। এই গলিতে চাঁদের আলো এসে ঢোকে না। দিনে সূর্যের ছোঁয়াও পায় না তেমন। ঘুটঘুটে অন্ধকারে পাইপধারীরা সপাসপ পাইপ চালিয়ে যেতে থাকলো। থ্যাপ-থপ জাতীয় শব্দ হচ্ছে গলির অন্ধকার থেকে কাশেম মোল্লা শুরুতে একবার “মা গো মা!” করে চিৎকার করে উঠেছিলো, তারপর থেকে দাঁতে দাঁত চেপে মার খেয়ে যাচ্ছে। লিয়াকত হোসেনের হাত অনেক লম্বা। তিনিই এদিকের অলিখিত প্রভু। ক্ষমতায় থাকুন আর না থাকুন, তিনি মারলে চুপচাপ মার খেয়ে যাওয়াটাই নিয়ম। সবখানেই সেরের ওপর সোয়া সের থাকে। লিয়াকত হোসেন মাটির তল দিয়ে চলেন, তিনি আড়াই সের।

পাইপওয়ালারা মেপে মেপে পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত হয়ে এলো খুব সম্ভব। কপালের ঘাম মুছে তাদের একজন কাশেম মোল্লার কলার ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো। শটগানওয়ালাদের একজন সঙ্গে সঙ্গে তার গলার নিচে শটগান চেপে ধরে। থুতু দিয়ে দুটো ভাঙা দাঁত নোংরা গলির ওপর ফেলে দিলো কাশেম মোল্লা। এদের ঢঙ দেখতে তার বিরক্তি লাগছে। মেরে ফেলতে চাইলে লিয়াকতসাহেব মেরেই ফেলতে পারতেন। এতো ‘ডলাডলি’র দরকার ছিল না। তিনি একটা তথ্য চাইছেন, কাশেম মোল্লাকে আরেকবার সুযোগ দিলেই তো সে বলে দেয়। প্রাণ আগে না বিশ্বস্ততা আগে? সে বসায়ি মানুষ, তার কাছে প্রাণটাই অগ্রাধিকার পেলো।

রক্তাক্ত মুখটাকে চুল টেনে আলোর সামনে ধরা হলো। বীভৎস দৃশ্যটির দিকে অপলক তাকিয়ে থেকেই একটা চুরুট বের করে যত্ন করে তাতে আগুন ধরালেন লিয়াকত হোসেন।

“পাত্তিটা চিনতে পারলা তো? নাকি আরও কয়েক মিনিট আরামে নেওয়া লাগবে?” ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নটা করলেন তিনি, গল গল করে ধোঁয়া ছাড়লেন নিচুশ্রেণির অস্ত্রবসায়ির মুখে।

চ্যালাদের একজন একটা ছবি আবারও বাড়িয়ে ধরলো কাশেম মোল্লার মুখের সামনে। এই ছবিটা সরাসরি এভিডেন্স রুম থেকে এসেছে। আলোচিত তোফায়েল হত্যাকাণ্ডের এভিডেন্স বক্সের ভেতর এভাবেই শুয়ে ছিল অস্ত্রটা। এই অস্ত্রের মালিক রেদোয়ান, অপর প্রভাবশালী ছাত্রনেতা। অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে তারই খালার বাড়ি থেকে। বন্ধুহত্যার পর গত ছয় মাস ধরে ফেরারী আসামীর কাতারে নাম উঠে গেছে রেদোয়ানের। পুলিশ তার টিকিটাও ছুঁতে পারেনি। পুরো গল্পটায় অনেকগুলো ফাঁক আছে। লিয়াকত হোসেনের চোখে এরকম ফাঁক এড়ায় না। নিজের মেয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াশোনা করছে, এই খবরগুলো খুব কাছ থেকে নজরে রেখেছিলেন তিনি। ফাঁক বোজানোর জন্য সেই তখন থেকে অস্ত্রবসায়ি কাশেম মোল্লাকে ধরে এনে বানানো হচ্ছে। তবে অস্ত্রটা সে বার বার না চেনার ভান করে যাচ্ছে।

এবার অবশ্য অস্বীকার করলো না লোকটা, “এইটা আমার থেইকা আলাদা কিনছিলো স্টেটের নেতা। একলা আইসা কিন্যা নিয়া গেছিলো।”

তোতাপাখির গানে সন্তুষ্ট হলেন লিয়াকত হোসেন। নেতারা এসে অস্ত্র কিনবে না কখনোই, এসব নিচুশ্রেণির চ্যালাচামুণ্ডার কাজ। তবে রেদোয়ানকে যদি নিজে এসে অস্ত্র কেনা লাগে, তার অর্থ সে গোপনে একটা কাজ করতে চাইছিলো-যে কাজটা সে তার চ্যালাচামুণ্ডাকে জানাতে চাইছে না। তোফায়েলকে গুলি করার ব্যাপারটা অবশ্যই নিজ সংগঠনের কাউকে জানতে দিতে চাইবে না একই সংগঠনের ছাত্রনেতা। কাজেই গোপনীয়তা অনস্বীকার্য।

“আমি দেইখাই কইছিলাম স্যার, এইটা ভেজাইল্লা একটা কিছু হইতেছে। নাইলে জাকি ভাই নিজে আইবো ক্যান?” এখনও গান গেয়ে যাচ্ছে কাশেম মোল্লা।

কোঁচকানো ভ্রু আরও কুঁচকে গেলো লিয়াকতসাহেবের। যতোটা আশা করেছিলেন তার থেকেও চমৎকার রাজনৈতিক রসদ পেয়ে যাচ্ছেন তিনি! আজকের দিনটা দারুণভাবে সৌভাগ্য বয়ে আনতে যাচ্ছে তার জীবনে I অস্ত্রবসায়ি এই মুহূর্তে স্টেট ইউনিভার্সিটির নবনির্বাচিত সভাপতির নাম নিয়েছে। অথচ তিন মাস আগেও সভাপতির পদে জাকি জিতবে–এমনটা বাজি ধরার মতো বোকা কেউ ছিল না। পদটা জেতার জন্য তার দরকার ছিল বড় অঙ্কের টাকা আর একটা মিরাকল! লিয়াকতসাহেব মিরাকলে বিশ্বাস করেন না। ঘটনা তার সামনে এখন স্পষ্ট।

ইশারা করলেন একবার। সাত-আটজন চ্যালা অস্ত্রবসায়িকে ধরে একটা মাইক্রোতে উঠে পড়লো। এই লোককে হাতছাড়া করা যাবে না। শেকড় থেকে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে শহরের ক্ষমতাচক্রে। তাতে এক গুরুত্বপূর্ণ কার্ড হয়ে যাবে একজন নিম্নশ্রেণির অস্ত্রব্যবসায়ি, তা হয়তো আক্কাস মোল্লা ও কোনোদিন কল্পনা করেনি। মাইক্রোটা রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলে অবশিষ্ট দু’জনকে নিয়ে নিজের গাড়িতে চেপে বসলেন লিয়াকত হোসেন।

ড্রাইভার কাম ডানহাত জুলফিকার নীরবতা ভাঙলো অনেকক্ষণ পর।

“জাকি গ্রুপটারে আন্ডারএস্টিমেট করার দিন এখনও আসে নাই।”

 উত্তর দিলেন না প্রাক্তন মেয়র। জুলফিকারের সঙ্গে তিনি পুরোপুরি একমত।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *