অধ্যায় ৫২
সাউন্ডবক্স থেকে হলভাঙা আওয়াজ বেরিয়ে আসছে, করিডোর থেকেই শব্দটা শুনতে পেলো রেদোয়ান। নগরবাউলের নাগর আলী কুমকুম, চাককুম, চুককুম। অন্য কোনো ছাত্র এতো জোরে গান বাজালে তাকে এমন ডলা দেওয়া হতো যেন হলে থাকাকালীন আগামি চারটা বছর বাথরুমেও সে গান ধরার সাহস না পায়। তবে এই শব্দটা আসছে রেদোয়ানের নিজের রুম থেকেই। প্রবল বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো সে। ভেতর থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে অনর্গল, যেন ভিসুভিয়াসের কোনো এক জ্বালামুখের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে রেদোয়ান। দরজাটা পুরোটা খুলে ভেতরে পা রাখলো সে।
চরকারই কারণে আমার বউয়ের কানে সোনা রে…
পেছনে দরজাটা সজোরে বন্ধ করে দিলো প্রতাপশালী ছাত্রনেতা। সিগারেট থেকে মুখ না তুলেই তার দিকে চোখ ফেরালো তোফায়েল।
“দুনিয়া ওলোট পালোট হইয়া যাইতেছে আর তুমি এইখানে বইসা রঙের গান শুনতেছো, মাগির পুত!” চোখ লাল করে হুঙ্কার ছাড়লো রেদোয়ান, “দুনিয়ার খবর কিছু রাখবা না, বালের নেতা হইছো তুমি।”
অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়লো তোফায়েল, “এতো অস্থির হইতেছিস ক্যান? বস আগে। কি হইছে খুইলা বল।”
“আমার ভাইটারে কোন খানকির পোলা মাইরা ফেলছে তা এখন আমি জানি।” সামনের চেয়ারে একটা লাথি মারলো রেদোয়ান। প্রকাণ্ড লাথিতে একটা পা খুলে গেলো সরকারি চেয়ারের, “খানকিটারে আমরা গুরুত্ব দেই নাই। সব শেষ কইরা দিলো মাগি।”
বিছানায় সোজা হয়ে বসলো তোফায়েল, “হোয়াট?”
“সাত আসমান থেকে পড়তেছো, অ্যাঁ? সাক্ষাত ফেরেশতা! তোর উচিত রাজনীতি ছাইড়া দেওয়া। এই দিকটা আমার চোখে আগে পড়লো না ক্যান?”
উঠে দাঁড়ালো তোফায়েল, “একটু থাম। তুই শামসের বোনের কথা বলতেছিস?”
“আর কোন খানকি লাগছে আমাদের পিছে? সব কিছু এখন স্পষ্ট।” ধপ করে খাটের ওপর বসে পড়লো রেদোয়ান, “কোন মাতারি আমাদের ফোন দিয়া বালছাল বকতেছে বুঝতেছো এখন? ঐ মাইয়া।”
“তোর মাথা খারাপ হইয়া গেছে, দোস্ত। জানি হিল্লোল ভাইয়ের ব্যাপারটা অনেক বড় একটা ধাক্কা, জানি আমি। আমার আইডল ছিলেন উনি, দারুণ পার্সোনালিটি। এই রকম একজনরে আমাদের সংগঠন পাইছে সেটা অনেক বড় একটা ব্যাপার ছিল। উনার কেসটা আমার পার্সোনালি দেখার ইচ্ছা ছিল, যদিও উপায় নাই, অনেকগুলা ফোর্স ব্যাপারটা দেখতেছি। আমি আপডেট রাখতেছি রেগুলার। শালারা কিছুই বাইর করতে পারে নাই এখনও খুনি কোনো ক্লু রাইখা যায় নাই। পিউর প্রফেশনাল।”
অ্যাশট্রেটা হাতে ধাক্কায় মেঝেতে ফেলে দিলো রেদোয়ান, “বালের প্রফেশনাল। কামটা করছে শামসের ছোট্ট বোনটা। ডবকা মাগি একটা।”
“অ্যাবসার্ড। হিল্লোল ভাইয়ের সাথে দুই দুইজন গার্ড ছিল। এক্স–মিলিটারি। আমি ওদের একজনকে চিনতাম, শালা কঠিন মাল। ওরা দুইটা মিলে চাইলে এক প্ল্যাটুন আর্মির অ্যাটাকও সারারাত ধরে ঠেকায় রাখতে পারবে। শামসের বোন কি ফোর্সে ছিল কখনও, বা অ্যাকাডেমিতে? হিল্লোল ভাইয়ের ফোন পাওয়ার পর আমি খোঁজ নিয়া দেখছিলাম। শিয়া নাম তার, ফার্স্ট ইয়ার স্টুডেন্ট। ঢাকায় পড়াশোনা করে। রেকর্ড নাই কোনো, মাইয়া মানুষ আর কি বালটা রেকর্ড বানাইবো।”
“সবার চোখেই ধূলা দিয়া ছিল মাগি এতোদিন। কিন্তু এই রেদোয়ানের চোখ এড়ানো এতো সহজ কাম না। ভাইকে ওই খানকিই মারছে।
“অসম্ভব। তুই লজিকটা বোঝা আমাকে, এটা কি করে সম্ভব?”
রেদোয়ানকে অনেকটাই শান্ত মনে হয় এবার। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে তাতে আগুন ধরালো সে, “ভাইয়ের সাথে দেখা করলো যেদিন মাইয়া, সেদিন রাতেই খুন হয় হিল্লোল ভাই। আমি প্রথমে এতো কিছু সন্দেহ করি নাই, তোর মতোই বালছাল ভাবছি। এইটুকু একটা মাইয়ারে সন্দেহ করে কোন পাগলে? সত্যিকারের প্রফেশনালদের কাজ, তোকে আমি নিজেও বলছিলাম এমনটা। বিরোধী দলের চারজনের লিস্ট করে ফালাইছিলাম। এদের একজনকে গান ডাউনও কইরা ফেলছে আমাদের মিলন, ঢাকার সেন্টারে আছে পোলাটা। একই কারণে।”
“আমি জানি। আমার কান এড়ায় না কিছুই।” নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে বলল তোফায়েল।
জোরে জোরে সিগারেটে কয়েকবার টান দিলো রেদোয়ান, “আমাদের দলের মধ্যেও অনেক গ্যাঞ্জাম চলতেছে ভাইয়ের ঘটনাটার পর। যারা যারা বহিষ্কার হইছিলো তাদের সন্দেহ করা হইছে। এদের মধ্যে দুইজনরে গান ডাউন করছে পলাশ গ্রুপ। তারাও ধইরা নিছিলো কাজটা তাদের করা। এরা আবার কয়েক দিন আগে অস্ত্র কিনছিলো শাফকাত ব্যাপারির কাছ থেইকা। বহুত কাবজাব চলতেছিলো গত কয় সপ্তাহ ধইরাই। এর মধ্যে পুঁচকি একটা মাইয়ার দিকে মনোযোগ দিয়ে টাইম নষ্ট করবো কে?”
“কিন্তু তুই এখন ভাবতেছিস কাজটা তার করা?”
মাথা দোলালো রেদোয়ান, “আমি ভাবতেছি না। আমি শিওর।”
“কেমনে?”
“মনে আছে, হিল্লোল ভাই ওইদিন ফোন দিয়া যখন মাগির ব্যাপারে বলছিলেন, আনিসরে দায়িত্ব দিসিলাম মাইয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড ভালোমতো চেক করতে?”
তোফায়েল এবার নড়ে উঠলো। নিরেট তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সেটাকে সে সবসময়ই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে, “মনে থাকবে না কেন? আনিস এতোদিন পর রিপোর্ট দিসে?”
“তাও তো দিতে পারছে। শিয়া মাইয়াটা গার্লস স্কাউট ছিল স্কুলে থাকতে। ওদের ইন্সট্রাক্টর কে ছিল গেস কর্!”
“কে?”
“ফরহাদ গাঙ্গুলী।”
তোফায়েলের অভিব্যক্তিতে চিন্তার ছাপ আরও দুই পোঁচ বেড়ে গেলো নামটা শুনেই। ফরহাদ গাঙ্গুলী একজন স্বঘোষিত শ্রেণিবিরোধী সৈনিক এবং সবপন্থার লোকেদের কাছেই লোকটা এক পরিচিত নাম। আলোচনায় সে এসেছে অনেকবার। প্রথমে নিজের মুসলিম নামের অর্ধেকটা পরিবর্তন করে একটা হিন্দু নাম গ্রহণ করে সে মিডিয়ার সামনে ধর্মিয় সহনশীলতা নিয়ে জ্বালাময়ী এক বক্তব্য দিয়েছিলো। তার বক্তব্যে কোনো ধর্মকে আক্রমণের নমুনা ছিল না। বরং সে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন রেখেছিলো, “এতোদিন আমি ছিলাম এই দেশে সংখ্যাগুরু। এখন তো আমাকে মুসলিমরাও পাথর মারবেন, হিন্দুরাও অবিশ্বাসের চোখে দেখবেন। ঠিক কি না? তবে শ্রেণিবৈষম্যের বিষয়টা আপনারা নিজেরাই ভেবে দেখুন।”
সংবাদ সম্মেলনের পর ঠিকমতোই তার কথা ফলেছিলো। মুসলমানরা আঁতকে উঠেছিলেন, তীব্র সমালোচনা করেছিলেন তার। অনেকেই দাবি জানিয়েছিলেন তাকে ইন্ডিয়ায় খেদিয়ে দেওয়া হোক, প্রসঙ্গক্রমে বার বার এক দেশ বিতাড়িতা লেখিকার কথাও তারা তুলেছিলেন। এমনকি বার ছয়েক তাকে জনসম্মুখেই আক্রমণ করে বসে কতিপয় উৎসাহী জনতা। শেষবার তাকে আক্রমণ করা হয় মসজিদের ভেতর, জুম্মা পড়তে গিয়েছিলো ফরহাদ। এতে করে ফরহাদ গাঙ্গুলীর জনপ্রিয়তা বরং বেড়েছে। গোঁড়া হিন্দুদের একটা দল সে সময় দাবি করতে থাকে ফরহাদ গাঙ্গুলী নাম পাল্টে দুই ধর্মের প্রতি সহনশীলতা দেখালেন, অথচ তিনি জীবনযাপন করেন মুসলিমদের মতো। নামাজ পড়েন মসজিদে, রোজাও নাকি রাখেন, কিন্তু কই মন্দিরে তাকে তো দেখা যায় না। ভণ্ডামির অভিযোগে তাকে জর্জরিত করা হয়েছিলো, ফরহাদ গাঙ্গুলী মুচকি হেসেছিলো কেবল। প্রতিবার তার বিরুদ্ধে করা প্রতিবাদই সেই বক্তব্যকে বার বার সত্য বলে প্রমাণিত করে যাচ্ছিলো। শ্রেণিসংঘাতের যে অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও আরও দিক আছে তা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পেরেছিলেন বটে।
জুম্মার নামাজ পড়তে যাওয়ার অপরাধে ফরহাদ গাঙ্গুলীর ওপর আক্রমণ করার পর থেকেই লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায় সে। রাজনীতির মাঠে তাকে নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত গুজবটা হলো, এর মধ্যেই মস্কোর সহায়তা নিয়ে বড় একটা অপারেশন শুরু করেছে লোকটা। চরমপন্থী এক দল গড়ে তুলেছে এরই মধ্যে, পুণরুজ্জীবিত করেছে “অনুশীলন সমিতি” (এটাই সেই গুজবের সবচেয়ে আতঙ্ক জাগানিয়া তথ্য)। ফরহাদ গাঙ্গুলীর ব্যাপারে দারুণ চমকপ্রদ যে তথ্যটি শোনা যায় তা হলো, সে তার নতুন এই দলটা খুলে বসেছে বিশ্বাসের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াই করে বিশ্বাসভিত্তিক শ্রেণিসংঘাত ধ্বংস করতে। সেই সঙ্গে সরকারি দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের সরিয়ে দেওয়ার পণ নিয়েছে এই চরমপন্থী নেতা। গুজব অস্বীকার করার উপায় ছিল না, দুই বছর নীরবতার পর টানা কয়েক মাসে ষোলোটি ‘রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড’ ঘটে গেছে। অনেকেই মনে করেন এই হত্যাকাণ্ডগুলো ফরহাদ গাঙ্গুলীর অঙ্গুলিহেলনেই ঘটছে। ‘অনুশীলন সমিতি’ সবসময়ই ছিল আতঙ্কের অপরনাম। এই শত্রুকে দেখা যায় না। এর থেকে নকশাল বা সর্বহারাধর্মি আন্দোলন অনেক নিরাপদ মূলধারার রাজনীতিকদের জন্য।
“শিয়া যখন গার্ল স্কাউট, তখন ফরহাদ গাঙ্গুলীর বয়স তো বেশি ছিল না।” হিসেবটা মিলিয়ে দেখলো তোফায়েল।
“না। সেইটাই তো আমাদের সমস্যা করে দিসে। গুজবগুলো মনে হইতেছে এখন সিরিয়াসলি নেওয়া দরকার। মাথা খারাপ কুত্তাটা হয়তো আসলেই একটা ‘অনুশীলন সমিতি’ খুলে বসেছিলো। এই রিক্রুটগুলো যদি স্কাউট বা ঐধরণের জায়গা থেকে আসে তাহলে সেইটা একটা ভয়ের ব্যাপারই।”
“সেই সময় ফরহাদ গাঙ্গুলী তো ফরহাদ গাঙ্গুলী হয় নাই। তারে কেউ চিনতো না, সক্রিয় ছিল না সে।”
“হ, কিন্তু সবাই মনে করে ফরহাদ গাঙ্গুলী অনেক বছর ধরেই এই ধরণের একটা প্ল্যান কইরা রাখছিলো।”
“মাস্টারমাইন্ড হিসাবে তখনও সে তার থিওরি নিয়ে কাজ করতেছিলো ধইরা নিলাম, তাতে করে শামসের বোন তো আর অনুশীলন সমিতির সদস্য হইয়া যায় না।”
“হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফরহাদ গাঙ্গুলীর হাত ধইরা কমিউনিস্ট পার্টিতে চার বছর আগে কে আইছিলো অনুমান কইরা দ্যাখ।”
“চার বছর আগে ওই মাইয়ার উদোম গায়ে ঘুইরা বেড়ানির বয়স ছিল। সে কেমনে কমিউনিস্ট পার্টিতে ঢোকে?”
হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করলো রেদোয়ান, “সে ঢুকতে যাইবো ক্যান? চার বছর আগে পার্টিতে ঢুকছিলো শামস হারামজাদা। তার বোনকে সে পার্টিতে জুটাইছিলো এর দুই বছর পর। বুঝতেছিস এখন বিষয়টা? ফরহাদ গাঙ্গুলীর গ্রুপটা ওদের অনেকদিন ধইরাই চেনে। অনুশীলন সমিতিতে মাইয়াটা জায়গা করে নিলে সেইটা অবাক করার মতো কোনো ঘটনা হইতেছে না।”
কিছুক্ষণ ভাবলো তোফায়েল, “এইসব তথ্য তুমি পাইতেছো কোথায়?”
“সময় তো লাগছেই, একদিনে তো আর ম্যানেজ করতে পারে নাই। দেড় মাস হইয়া গেলো। ভিতরের এক লোকরে ম্যানেজ করছে আনিস।”
“সে এখনও পার্টিতে আছে?”
মাথা নাড়লো রেদোয়ান, “না। ফরহাদ গাঙ্গুলী আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার আগে একদম সলিড পোলাপান বাদে আর সবাইরে দল থেইকা বাইর কইরা দিছে। সেইখানে আমাদের সোর্সও কাটা পড়ছিলো। কিন্তু সে এইটা নিশ্চিত করছে মাইয়াটা গার্লস স্কাউট করার সময় থেকে তার ভাইয়ের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ইনভলভড। কলেজ লাইফে সে তলে তলে অ্যাকটিভ ছিল বলেই ধইরা নেওয়া যায়। এই মাইয়া সলিড জিনিস, এরে আমরা আন্ডারএস্টিমেট করছি।”
ফ্রিজ থেকে একটা বিয়ারের ক্যান বের করলো তোফায়েল। হিসেব এখন আর মিলছে না। চিন্তিত মুখে ক্যানটা খুলে কয়েকবার চুমুক দিয়ে বন্ধুর দিকে ওটা বাড়িয়ে দিলো সে, একই সাথে কেড়ে নিলো তার সিগারেট। শামসের মতো ধ্বজভঙ্গ ছেলের বোন কি করে অনুশীলন সমিতিতে যায়? তোফায়েল অবশ্য জানে মেয়ে বলে কোনো বিপ্লবীকে ছোটো করে দেখার অবকাশ নেই। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে সবাই চেনে। বরং মেয়েরা এ লাইনে ঢুকে গেলে তাদের মতো বিপজ্জনক আর কেউ হতে পারে না। ভয়ঙ্কর দিকটা ঠিক তখনই তার নজরে এলো।
“কাজটা যদি ওই মাইয়াই কইরা থাকে, তাইলে সে তার ভাইরে যারা মারছে তাদের সবাইরে মাইরা ফেলতেছে।” চেষ্টা করেও আতঙ্কের ছাপটা কণ্ঠ থেকে লুকাতে পারলো না তোফায়েল, “ফাহাদ হিল্লোল ভাইয়ের মতো একটা মানুষরে যে টার্গেট করতে পারে তার চেয়ে ডেঞ্জারাস আর কিছু নাই। এরপর কি হইতে যাইতেছে তা কি তুই টের পাইতেছিস?”
মাথা দোলালো রেদোয়ান, “আমাদের সে চেনে।”
“এবার সে আসবে আমাদের দিকে। এতোদিনেও আসে নাই কেন কে জানে! এইখানে কোনো নেগোশিয়েশন বা বার্গেইনিং চলবো না। মাইয়াটা যদি আমাদের খোঁজা শুরু করে, তার মানে সে আমাদের গুলি করার জন্যই খুঁজতেছে।”
রেদোয়ান এতোটা হতাশ হলো না অবশ্য, “ক্যাম্পাসে আমাদের কিছু করতে সাহস করবে না মাগি। কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করলে আমাদের চলবে না। আমি কালকে ঢাকা যামু। মাইয়ার একটা ব্যবস্থা না করে ফিরতেছি না। তার বাসার ঠিকানা আমার কাছে আছে। আনিস ভালোই কাজ দেখাইছে।”
“আমিও যাচ্ছি তোর সাথে। মাইয়া ডেঞ্জারাস।” সিগারেটটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে বলল তোফায়েল।
“না। তুই থাকতেছিস। সম্মেলন কাছে চলে আসতেছে। আমাদের দুইজন ঢাকায় চলে গেলে হইবো না। তুই এদিকটা সামলা, আমি ঐ মাগিকে সামলাইতেছি।”
দশ মিনিট পর ঝড়ের বেগে ঘর ছাড়লো রেদোয়ান। আরও কিছুক্ষণ স্থবিরের মতো বসে বসে সম্ভাবনাগুলো যাচাই করে দেখলো তোফায়েল। একটা ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছে ওরা, এমনটাই মনে হচ্ছে তার। দীর্ঘসময় রাজনীতির মাঠে নির্ভীক পথচলার পর এমন একটা দুশ্চিন্তায় মাখা দিন আসবে তা সে আশা করেনি। যাদের ছত্রছায়ায় ওরা নিরাপদে ছিল, তাদেরই আজ নিরাপত্তা নেই। ওদের ধারণা যদি ভুল না হয়, তাহলে অবশ্য বিপদের কিছু নেই আর। রেদোয়ান ঠিক ঠিক ওই শিয়া মেয়েটাকে ধরে ফেলবে। তার পরিণতি হতে যাচ্ছে ওই বেয়াড়া ভাইটির মতোই। ভাবনাটা সাময়িকভাবে শান্ত করে আনলো তোফায়েলের স্নায়ুগুলো।
ঘর ছাড়লো সে-ও। হলের বাঁধা কর্মচারি জলীল ভাইকে বিচ্ছিরি কয়েকটা গালি দিয়ে রুম পরিস্কার করতে পাঠিয়ে মেয়েদের হলের দিকে বাইক ছোটালো। ইলোরার সাথে গত দুইদিন ধরে দেখা হয়নি। মেয়েটাকে একবার দেখতে খুব ইচ্ছে করছে তার।
*
ল্যাপটপের ডালা বন্ধ করে সোজা হয়ে চেয়ারে বসলো মুহিব। দু-হাত ওপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙলো। অনেকক্ষণ একটানা পড়ার পর এক অদ্ভুত অবসাদ আঁকড়ে ধরে চারপাশ থেকে। কেল্টদের এমন হয় না, নিয়মিত একটানা পড়াশোনা করার অভ্যাস তাদের আছে। এই অবসাদ কেবল সারা বছর ফাঁকিবাজি করা মুহিবের মতো ছাত্রদের জন্য। সিগারেটের প্যাকেটগুলো খুঁজে দেখলো সে, একটা ফিল্টারও পড়ে নেই কোনোটার ভেতর। টানা ছয় ঘণ্টা অঙ্ক কষার মধ্যেই সবগুলো সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো মুহিব। অনেকদিন পর কোনো কারণ ছাড়াই এগিয়ে গেলো শামীমের রুমের দিকে। একবার নক করতেই দরজা খুলে গেলো।
“নিচে চল। চা খেয়ে আসি।” আগের দিনগুলোর মতোই বলল মুহিব।
শামীম তার সাথে শীতল ব্যবহার শুরু করার পর থেকে এরকম প্রস্তাব সে বেশ কয়েকবার নিয়ে এসেছে। তবে প্রতিবারই তাকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে শামীম। এর কারণ অবশ্য এটা নয় যে তার চায়ে অরুচি ধরেছে রাতারাতি। বরং মুহিবের সঙ্গে সে কোথাও যেতে চায় না। বন্ধুর এই বিদ্রোহের পেছনের কারণটা মুহিব বোঝে। তবে কোনোভাবেই সে ভিডিও ক্লিপগুলো শিয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছে না। মেয়েটা সব কিছু জানতে চায়। জেনে ফেললেই সে নতুন কোনো পাগলামি শুরু করবে। বন্দুক হাতে নিয়ে মফস্বলের রাস্তায় রাস্তায় সে তোফায়েল আর রেদোয়ানকে তাড়া করে ফিরছে এমন একটা দৃশ্য মানসপটে ভেসে উঠলো মুহিবের। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝেড়ে চিন্তাটা দূর করে দিলো সে। প্রশ্নই আসে না এর মধ্যে শিয়াকে জড়ানোর। মেয়েটা রাডারের নিচে আছে, নিরাপদ। তাকে কেউ খুঁজছে না এখনও। কিন্তু এসব নিয়ে আর খানিক ঘাটাঘাটি করলে থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়তে পারে। মেয়েটির নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না তখন। মুহিব ভেতর থেকে জানে, ওর ওই গুরুরা, কমিউনিস্ট পার্টিও তখন নাকটা ডুবিয়ে নিজেদের রক্ষা করবে। মেয়েটা এখনও দুনিয়া বোঝেনি।
আজ অবশ্য আপত্তি করলো না শামীম। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে, “চল।”
“পড়ার কি খবর?”
কাঁধ ঝাঁকিয়ে পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করলো শামীম। একটাই মাত্র সিগারেট আছে ওতে। ফস করে লাইটার জ্বালিয়ে আগুন ধরালো ওতে, “চলতেছে। তুই তো দেখলাম একটা ‘রাম’পড়া দিলি। সকাল থেকে কোপাচ্ছিস।”
“ম্যাথ করলাম কিছুটা। অনেক শোদোন আছে এবার কপালে। আক্কাস স্যারের সেট করতে করতেই রাত হয়ে যাবে।”
পরীক্ষা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে বলতে নিচে নেমে এলো দুই বন্ধু। আজিজ মামার চায়ের দোকানটা শামীমদের ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকেও কাছে। তবে ভিন্ন এক রাস্তা ধরে আসতে হচ্ছে এখন, মুহিবের আগের মেস থেকে এলে সরাসরি মেইন রোড ধরেই এখানে পৌছানো যেতো। দোকানটায় পৌছে মন খারাপ হয়ে গেলো মুহিবের, এখানেই লিটুর সাথে শেষবারের মতো বসা হয়েছিলো ওদের। শামীমের মাথাতেও একই ভাবনা। যেন কথার কথা এভাবে বলল, “সেদিন লিটু হারামজাদাকে দেখে আমরা কি অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম মনে আছে? তোফায়েলরে নিয়া কথা বলতেছিলাম। এর মধ্যে ওরে আমরা কেউ আশা করি নাই। জানতাম তো না, ওটাই ওরে সুস্থ অবস্থায় শেষ দেখা হইতে যাইতেছে।”
শামীমকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো না মুহিব। ওরা দু’জনই জানে লিটুর প্রসঙ্গে ভালো ভালো কোনো কথা বলার অবকাশ নেই। ছেলেটার মস্তিষ্ক অনেকখানিই ধ্বংস হয়ে গেছে। এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে যাওয়ার প্রসঙ্গে ডাক্তাররা তাকে নিয়ে আশাবাদী। কিন্তু বেঁচে থাকলেও এতোদিনের অর্জিত সব স্মৃতি, জ্ঞান সবই হারিয়ে ফেলার কথা তার। সম্ভাবনা আছে সে কথা বলতে ভুলে যাবে, সংখ্যা দেখলে চিনবে না। এরপর সান্ত্বনা থাকে কেবল ওই বেঁচে ফেরাটাই। শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে নাকি গত কয়েকদিনে। এই ভালো খবরগুলোও ওদের মনে আনন্দ জাগাতে পারে না। ভেজিটেবল লিটু ভালো না মৃত লিটু ভালো তা একবার ভেবে নিজেকে শাসন করলো মুহিব। ভেজিটেবল হোক, তাও বেঁচে ফিরে আসুক বন্ধু। তার ব্রেনসেল রিকভারের জন্য আলাদা চিকিৎসা দুনিয়ার কোথাও না কোথাও কি থাকবে না?
“কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলি?” নীরবতা ভাঙতেই হয়তো প্ৰসঙ্গ পাল্টে ফেললো শামীম।
“ঐ ব্যাপারে?” আজিজ মামার বাড়িয়ে দেওয়া চায়ের কাপটা নিতে নিতে পাল্টা প্রশ্ন করলো মুহিব।”সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে ফেলেছি। শিয়াকে জড়াচ্ছি না এর মধ্যে।”
মুহিবের শীতল উত্তরে আরও ভোঁতা হয়ে গেলো শামীমের মুখ।
“তোর কথাও ভেবে রেখেছি আমি।” বলে চললো মুহিব, “তুই এই রেসপন্সিবিলিটি আর নিতে চাইছিস না। এটা আমাকে সরাসরি বললেই পারতি, শামসভাইয়ের কেসটা শেষ পর্যন্ত দেখার চাকরি তো তুই করিস না। এমনকি উইটনেসও না তুই, তোর এখানে কোনো দায়বদ্ধতা নাই। কিন্তু আমার আছে। আর আমার দায়বদ্ধতার জন্যই সিদ্ধান্তগুলো আমি-ই নেবো।”
“কি করতে চাইছিস তাহলে?”
“সেটা তোকে বলবো না। এখন থেকে তুই-ও মুক্ত এই কেসটা থেকে ভালো মতো পড়াশোনা কর। পরীক্ষা দে। ঠিকমতো ভার্সিটি লাইফটা শেষ কর। তোকে আমি জড়াচ্ছি না আর।
লজ্জিত দেখালো শামীমকে, “আমি তেমনটা কখনও মিন করি নাই। আমার এই চুপচাপ বসে থাকা ভালো লাগতেছে না, তার মানে এই না যে ঘটনাটার সাথে আর জড়াতে চাইছি না।”
মাথা নাড়লো মুহিব, “সেটা বড় কোনো ব্যাপার না। তুই ধৈর্যের শেষ প্রান্তে চলে এসেছিস। এখন আর ইনভলভ থাকিস না। অধৈর্য হয়ে একটা ভুল করবি, ভুগবো সবাই। আপাতত সাইডে সরে যা। আমি দেখছি এই ব্যাপারটা।”
শামীম আরও কিছুক্ষণ গাঁই-গুঁই করলো। কিন্তু মুহিব তার সিদ্ধান্তে অটল। সে শামীমকে আর জড়াতে দেবে না। এভিডেন্স মেমরি কার্ডটাও নিজের কাছে রেখে দিয়েছে সে, কাজেই বাড়তি ক্ষমতার প্রয়োগ করতে কুণ্ঠাবোধ করলো না সে।
চায়ের বিল দিয়ে, রাতের জন্য পর্যাপ্ত সিগারেট কিনে ওরা যখন নিজেদের রুমে ফিরে এলো, সন্ধ্যা নেমে গেছে। ওদের ফ্ল্যাটের সামনে অপেক্ষা করছিলো ইলোরা। দু’জনের কাউকেই কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে শুধু বলল, “মুহিবের সাথে কথা আছে আমার।”
চাবি বের করা দরজা খোলার সময় মুহিব কেবল ভাবতে পারলো, রাতের জন্য যথেষ্ট সিগারেট মনে হয় কেনা হয়নি আজ।