কুকুরদল – ৫১

অধ্যায় ৫১

নতুন খোলা এই রেস্তোরাটি খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখানকার প্রধান আকর্ষণ লবস্টার আর লাইভ মিউজিক। মিউজিকের চেয়ে মিউজিশিয়ানের প্রতিই খাদকদের মনোযোগ দেখা যায়, মিহিকা নামে একটা মেয়ে এখানে গিটার বাজায়। স্বল্পবসনাদের মর্যাদা সর্বকালের তরুণসমাজই দিয়েছে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার উপায় নেই। সব সময় ভিড় লেগেই আছে ‘উই রান দ্য নাইট’-এ।

মুহিবের বর্তমান মাথাব্যথার কারণ যে মেয়েটি, সে টেবিলের অন্যপ্রান্তে বসে আছে। ওপরের গোলাপি আলোয় মেয়েটির হলুদ ফতুয়াকে কমলা দেখাচ্ছে। ছেলেদের পাগল করার জন্য যথেষ্ট আকর্ষণীয় চুলগুলো তার একটা চোখ ঢেকে রেখেছে, অপর চোখটা জ্বলজ্বল করছে তার। মুহিবের কল্পনাশক্তির প্রয়োজন পড়লো না, নিজের অবয়বেই পরিস্কার অনুভব করলো তেজস্ক্রিয়তা। মাথাগরম, মাথা খারাপ একটা মানুষ। প্রথমে মুখ খোলার চেষ্টাও করলো না মুহিব।

“আশা করছি ভালো একটা খবর দিতে এতোদূর এসেছো।” অবশেষে শুরু করলো শিয়া, “ভিডিও ক্লিপ নিয়ে কোনো আপডেট পেয়েছো? গত কয়েকটা সপ্তাহ অসংখ্য চ্যানেল ব্যবহার করে খুঁজেছি ওটা-কোনো সুবিধা করতে পারিনি।”

একটু আগে আলাভোলা চেহারার ওয়েটার এক মগ কফি দিয়ে গেছে, ওতেই নির্বিকার ভঙ্গিতে চুমুক দিলো মুহিব। শিয়ার প্রশ্ন যেন কানে ঢোকেনি তার, চোখ স্টেজের ওপর থেকে ঘুরে আসলো একবার। সুন্দরি গিটারিস্ট নিচু শব্দে একটা সুর তুলছে। চিনতে পারলো মুহিব, বাখের ‘মিনুয়েট’। মাথা নাড়লো সে, মেয়েটা আসলেই দারুণ বাজায়। যৌনতা না খুঁজেও এই রেস্তোঁরায় নিয়মিত আসা যায়, সঙ্গিত চেনার মতো কান থাকলেই হলো। মুহিবের বাসা থেকে খুব বেশি দূরেও না এই নতুন রেস্তোঁরা। আরও কয়েক বছর ঢাকায় ফিরতে পারবে না ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যায় মুহিবের।

“কিছু বলছো না কেন?” কর্তৃত্বপরায়ণ কণ্ঠে জানতে চাইলো শিয়া। কফিতে আরেকবার ধীরস্থির ভঙ্গিতে চুমুক দিলো মুহিব। তারপর মেয়েটার দিকে সরাসরি তাকালো সে, “তোমাকে কিছু কথা বলতে এসেছি আমি এখানে। শুনতে তোমার ভালো নাও লাগতে পারে।”

“আচ্ছা?” সতর্ক হয়ে উঠলো মেয়েটা।

“আমাদের সেমিস্টার ফাইনাল শুরু হবে আগামি সপ্তাহে।” নিচু গলায় কিন্তু প্রতিটা শব্দ স্পষ্ট করে উচ্চারণ করে বলল মুহিব, “এর মধ্যে আমি ঢাকা এসেছি তোমার সাথে দেখা করতে। সত্যি বলতে খুনিদের নিয়ে কথা বলার জন্য এই দৌড়াদৌড়ি করিনি। এই তাড়াহুড়োর কারণ একটাই, আমি তোমার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”

“কার সাথে?”

“তোমার সাথে, অবশ্যই।”

“হোয়াটস দ্য পয়েন্ট?”

“কোনো পয়েন্ট মেক করতে আসিনি আমি। দুনিয়ার সবাই কি কারণে এমনটা মনে করে বলো তো? একটা কিছু করতে হলে তা কোনো একটা পয়েন্ট মেক করার জন্যই করতে হবে, এমনটাই যেন সবার চিন্তা। একজন মুভিমেকাউকে দেখো, সে যদি মনের মতো একটা ছবি বানায়, যে ছবিতে কোনো পয়েন্ট নেই, নিজের গল্পটা বলে গেছে শুধু তো দর্শক হলে গিয়ে গালাগালি করে আসবে তাকে। সাধারণ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকেই ধরো, তাকে গিয়ে বলে আসো সেমিস্টার ফাইনাল আর দিতে হবে না, আজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পরীক্ষা নেই, অ্যাটেন্ডেন্সে কোনো আলাদা মার্কস নেই। সবাইকে সমান গ্রেড দেওয়া হবে আজকে থেকে। ক্লাসরুমে কয়জন যাবে? পড়তে বসবে কয়জন? কারণ ঐ একটাই। কোনো পয়েন্ট মেকিং করার দিক এখানে আর নেই। তোমাকে আজ থেকে মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হলে তুমি কি চাকরি খোঁজার কষ্টে নামবে? কারণ, তোমার তো আর লাগছে না। হোয়াটস দ্য পয়েন্ট?”

“মুহিব, কাজের কথায় আসো।” চাপা গলায় বলল শিয়া, “জানি তুমি গল্প-টল্প লিখো, তাই বলে সবখানে রূপকের প্রয়োগ করার দরকার দেখি না। সরাসরি বলো যা বলার, একটু আগে যেমনটা বললে।”

“আমি বলতে চাইছি, এখন যা যা বলবো তার সঙ্গে তোমাকে সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গগুলো টেনে আনতে হবে না। এটা স্রেফ আমার ব্যক্তিগত উদ্বেগ বলে ধরে নিতে পারো।”

“কোনটা, ঠিক করে বললে?”

“যখন আমাদের ক্যাম্পাসে এলে, তুমি একটা গান ক্যারি করছিলে। নির্ঝর ভাইয়ের সঙ্গে তোমার দেখা হওয়ার ঘটনাটাও খুব শ্রুতিমধুর কিছু না।”

“সো?”

“সাধারণ একটা মেয়ে পিস্তল নিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়ায় না। তারা রাত বিরেতে একা একটা বেশ্যাখানায় ঢুকে পড়ার সাহস রাখে না। তারা এক লাথিতে কাউকে অজ্ঞান করার নিয়ম জানে না।”

“সেলফ ডিফেন্সের কোর্স করা আছে আমার, এটা তোমাদের আগেও বলেছি। ঢাকার অনেক মেয়েই এই ধরণের কোর্স করছে আজকাল, খবর রাখো না হয়তো তুমি।” হতাশার ভঙ্গি করে বলল শিয়া, “ওসব এমন কোনো কঠিন কাজ ছিল না। তাছাড়া, তুমি যেটাকে পিস্তল বলছো, ওটা একটা রিভলভার ছিল। যে কোনো ভার্সিটিতে কিছু হ্যডম থাকে, তাদের সাথে যোগাযোগ থাকলে এসব যোগাড় করা কারও জন্যই কঠিন না।”

তার ভার্সিটির ‘হ্যাডম’রা মুহিবের জন্য শপিং করে মনমতো একটা পিস্তল কিনে এনেছে, সেই কথা অবশ্য শিয়াকে জানালো না সে। প্রসঙ্গে ফিরে এলো সে, “সাধারণ একটা মেয়ে আরেক শহরে অভিযানে পিস্তল নিয়ে যাচ্ছে না রিভলভার, তা নিয়ে ভাবে না।”

“সিরিয়াসলি?” ঘাড় বাঁকা করে তার দিকে তাকালো শিয়া, “এই পুরো কাজটাই বিপজ্জনক। আমি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাববো না তো কে ভাববে? তুমি?”

“মেনে নিলাম। তুমি অনেক কিছুই বলবে সেটা জানতাম। কিন্তু সত্যটা বলবে না সেটাও জানা ছিল। এটা সমস্যা না, আমাকে সব কিছু পরিস্কারভাবে বলার দায়বদ্ধতা তোমার নেই। কিন্তু যেভাবে তুমি আমার কাছে তথ্য গোপন করছো, তাতে করে আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। সেন্সিটিভ ইনফরমেশন যদি পেয়েও থাকি, তোমাকে তা কেন দেবো?”

“কারণ,” সামনে ঝুঁকে এলো শিয়া, “ওরা আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে। তোমার কিছু আসে যায় না, মুহিব। ভাইয়ার খুনিরা ধরা পড়লো কি মারা গেলো তা নিয়ে তোমার মাথাব্যথা নাই। তোমার কেউ ছিল না ভাইয়া। কোনো ইনফরমেশন যদি থাকে তোমার কাছে, সেটা জানার অধিকার আমার আছে। শুধু আমার।“

দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুহিব।

“এসব নিয়ে আলোচনা করে লাভটা কি? কোনো উপসংহারে পৌছুতে পারবে? তুমিও পারবে না, আমিও না।”

“উপসংহার?” কফিতে আরেকবার চুমুক দিলো মুহিব, “তাতে আমি দেড় মাস আগেই পৌঁছে গেছি।”

“সেটা কি?”

“শামসভাইয়ের মার্ডার কেসটা আমি দেখছি। আমি, একা। তুমি ভাইয়ার আপন বোন হতে পারো, এখন থেকে তোমাকে এর সাথে আমি আর ইনভলভ করবো না। খুনিদের সঙ্গে ডিল করবো আমি, তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবো আমি, যা করা লাগে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য, সেটাও করবো আমিই। তুমি এখন আউটসাইডার। তুমি থাকছ সবকিছুর বাইরে।”

এক সেকেন্ডের মধ্যেই হিংস্র হয়ে উঠলো শিয়ার মুখটা, “মানে?”

“ইউ আর আউট। একা একা যা মন চায় করো, কিন্তু আমি অনেকগুলো প্রমাণ জোগাড় করে ফেলেছি রেদোয়ানদের বিরুদ্ধে। তুমি আমাকে ছাড়া কোথাও যেতে পারবে বলে মনে করি না।”

“প্রমাণ?”

“হ্যাঁ, ওরা খুনটা কেন করেছে তা আমি এখন জানি।” এক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকলো মুহিব, “ভিডিও ক্লিপটা দেখেছি আমি।”

*

প্রশ্নপত্র জমা দিতে এসে প্রফেসর রবিন লক্ষ্য করলেন আজ ইউসুফ স্বভাবসুলভ হাসিটি হাসলো না। হাত বাড়িয়ে কাগজগুলো নিলো, বার দুই ‘স্যার, স্যার’-ও করলো। প্রফেসর কেন নিজ হাতে এই কাগজের তাড়াগুলো দিতে আসেন তা নিয়ে ইউসুফ গতবারের মতো আপত্তি তোলার চেষ্টা করছে না আজ, এ নিয়ে ওদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। প্রফেসর যুক্তিবাদী মানুষ, তবে হিউম্যান এরর নিয়ে তিনি যথেষ্টর বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিংবা অতিসতর্ক। সেমিস্টার ফাইনালের প্রশ্ন তিনি অন্য কারও হাত দিয়ে জমা দিতে চান না, এর পেছনে একশ’ একটা কারণ আছে। তবে ইউসুফ বরাবরই প্রাণখোলা একজন মানুষ, এই মরা ক্যাম্পাসে যে কয়জন হাসিমুখে কথা বলতে পারে তাদের একজন সে। এটা মোটেও হাল্কা করে দেখার মতো বিষয় না। খুব কম মানুষই এখানে হাসিমুখে কথা বলে। যেন সরকার উচ্চহারে কর বসিয়েছে হাসির ওপর! অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজগুলো সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে একটা। এখানে বয়লার বিস্ফোরণের ভয় নেই, অত্যাধিক শব্দের মধ্যে বছরের পর বছর থেকে কানের বারোটা বাজিয়ে ফেলার ভয় নেই, তেজস্ক্রিয়তায় ক্যান্সার হয়ে মরার ঝুঁকি নেই, সন্ত্রাসীর গুলিতে মরার ভয় নেই, সিভিল ইউনিয়নের ককটেলে প্রাণ হারানোর ভয় নেই। গোমড়ামুখে থাকার দরকার কি তোদের, ব্যাটা? মনে মনেই কর্মকর্তা, কর্মচারী আর শিক্ষকদের এই প্রশ্ন করে এসেছেন প্রফেসর। রামগড় রের ছানা হয়ে থাকা তো আর অন্যায় নয় যে প্রতিবাদ, মিছিল, র‍্যালি ইত্যাদি করা যাবে সে উপলক্ষ্যে।

ইউসুফ কেমন যেন এড়িয়ে গেলো সব সম্ভাষণ। যেন নব্য রামগড়ুর। হাসতে তার মানা। প্রফেসরের মনে খটকা লেগেছে শুরুতেই, তিনি প্রশ্নটা না করে থাকতে পারলেন না, “কি খবর ইউসুফ? বাসায় সব ভালো তো?”

ইউসুফ অনেক কষ্টে হাসলো এবার, যাকে বলে কাষ্ঠ হাসি, “জি, স্যার। সব ভালো, সব ভালো।”

“তোমাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। কোনো সমস্যা? আমাকে বলতে পারো কিন্তু। যে কোনো

“না স্যার। সমস্যা নেই, সমস্যা নেই।”

অত্যন্ত সন্দেহজনক। আড়চোখে এই প্রতিষ্ঠানে তার প্রিয় কর্মচারিটির দিকে তাকাতে তাকাতেই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ছাড়লেন প্রফেসর রবিন। এক কথা সে দুইবার করে বলবে কেন? মোটেও স্বাভাবিক না লোকটার আজকের আচরণ।

বাইরের ঝলমলে রোদে বেরিয়ে এসে মন ভালো হয়ে গেলো তার। এখানে ওখানে ছেলেমেয়েদের খুচরো খুচরো সব দল। অনেকেই ক্লাসে যাচ্ছে, ল্যাব থেকে ফিরছে। দুটো ব্যাচের সেমিস্টার ফাইনাল চলছে, তিনটে ব্যাচের ক্লাস। এক সঙ্গে সবগুলো ব্যাচের পরীক্ষা নেওয়া হয় না এখানে। প্রশাসনিক ভবন থেকে যন্ত্রকৌশল ভবন পর্যন্ত আসতে আসতেই তিনি ছয়টি খুচরো গ্রুপের পাশ কাটালেন, এদের মধ্যে তিনটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ না কেউ “হোগামারা” শব্দটা ব্যবহার করলো। মুচকি একটা হাসি মুখে ঝুলিয়ে যন্ত্রকৌশল ভবনে পা রাখলেন তিনি, ছেলেমেয়েরা বর্তমান জীবন নিয়ে কতোটা বিতৃষ্ণ, তা এদের শব্দ চয়ন থেকেই অনায়াসে বোঝা যায়। তারা চায় সত্যিকারের কিছু করতে। প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছেলেমেয়েরা ভর্তি হয়ই একটা সত্যিকারের পার্থক্য গড়ে দিতে, টু মেক আ রিয়েল ডিফরেন্স। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে প্রায়োগিক দিকগুলো এখানে দেখানো হয় না। শব্দচয়ন একেবারে ঠিক আছে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা তাদের এর থেকে ভালো কিছু উপহার দিতে পারছে না। অনেকে হয়তো বাইরে গিয়ে কর্মক্ষেত্রে এসে বুঝতে পারবে, এখানকার জীবনটার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তাতে এই মুহূর্তে তাদের কি এসে যায়?

ধার্মিকও জানতে চায় সে একটা ইবাদত কেন করবে। এখানে ছাত্রদের কেউ প্রতিটা জ্ঞানের প্রায়োগিক দিক বা সম্ভাবনার কথা জানায় না। শিক্ষকগণ সিলেবাস শেষ করে দেয় কোনো একভাবে, তারপর সেমিস্টার ফাইনালের প্রশ্ন জমা দিতে যায়, যেমনটা প্রফেসর রবিন মাত্র করলেন। প্রশ্ন বানানোর সময় লক্ষ্য করা হয় সেটা যেন এতো কঠিন না হয় যে সবাই ডাহা ফেল মারবে, অথবা এতো সহজও যেন না হয় যে সবাই পাবে ফোর আউট অব ফোর, এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কখগঘ। কিন্তু যা পড়ানো হচ্ছে তা কেন পড়ানো হচ্ছে সে প্রসঙ্গে আগ্রহোদ্দীপক কথা বলার মানুষ এখানে কম। ক্যাম্পাস লাইফ মানেই এজন্য ছাত্রদের কাছে হোগামারা। ল্যাব হোগামারা। ক্লাস হোগামারা। ক্লাসটেস্ট হোগামারা। তারা শব্দচয়নে ভুল করছে না, কারণ কপাল খারাপ থাকলে আর কোনো কোর্সে শাহাবুজ্জামানের মতো শিক্ষক পড়লে সেই সেমিস্টারে সিলেবাস শেষ হওয়ার সম্ভাবনাও শুন্য।

কমনরুমে যাওয়ার সময় নিচতলার ল্যাবে ভিড় করা একদল ছেলেমেয়ের সামনে পড়ে গেলেন তিনি। শোরগোল চলছিলো, অনেকেই চুপ হয়ে গেলো তাকে দেখে। অন্যান্য শিক্ষকদের সামনে পড়ে গেলে হট্টগোল থেমে যায়, তবে কখনোই তার সঙ্গে এমন প্রতিক্রিয়া কেউ দেখায় না বরং আধডজন ছেলেমেয়ে চলে আসে কুশল বিনিময় করতে। যে অধ্যাপক তাদের সাথে সিগারেট শেয়ার করে খায় তাকে কেউ কর্তৃপক্ষ ভাবে না, বন্ধুত্বের পর্যায়েই ফেলা যায় তার সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্ক। ভালোমতো ছাত্রছাত্রিদের মুখের দিকে তাকালেন তিনি। আজ তাদের চোখেমুখে ভয়। অস্বস্তি। তার দিকে এভাবে তাকানোর মানে কি? তিনি তো কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি কখনও। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় পিঠের ওপর অনেকের দৃষ্টি অনুভব করলেন তিনি। তাতে মিশে আছে বিচারের ছোঁয়া।

কমন রুমের দরজার কাছে পৌঁছে একটু থমকালেন প্রফেসর রবিন। ছেলেগুলোর চোখে কি ছিল? আতঙ্ক?

না সুতীব্র ঘৃণা আর অবিশ্বাস?

*

“ভিডিও ক্লিপে কি ছিল?”

শিয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো মুহিব। খাবার নিয়ে ওয়েটার চলে এসেছে, তাকে টেবিল সাজাতে দিলো তার মতো করে। কান পেতে স্টেজের মেয়েটার বাজানো শুনলো এই ফাঁকে। তাকে গিটার কুইন টাইটল দিতে এখন মুহিবের আর কোনো আপত্তি নেই, ঐ বাদ্যযন্ত্র দিয়েই সে বিথোভেনের নাইনথ সিম্ফনি তুলছে। অপূর্ব।

“আই সেইড—”

একটা হাত তুলে তাকে থামালো মুহিব, “বললাম তো, আমি জানি সেটা। কিন্তু তোমাকে বলবো না।”

একটা বোমার মতোই বসে থাকলো শিয়া। চোখ মুখ লাল হয়ে আসছে তার। লবস্টার মুখ পুড়ে তার দিকে তাকিয়ে চিবুতে শুরু করলো মুহিব। কোনো তাড়াহুড়ো নেই তার কাজে। মেয়েটা কোনো কায়িক পরিশ্রম ছাড়াই হাঁফাচ্ছে, সম্ভবত প্রচণ্ড ক্রোধে।

“তুমি ঠিক কি তা আমি জানি না। সম্ভাবনা আছে কিছু, আন্দাজে ঢিল মারতে পারি। হয়তো সমাজতান্ত্রিক ফ্রন্টের কমরেড, নয়তো অনুশীলন সমিতি। তোমার মতো একটা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ের হাতে রিভলভার দেখলেই যদি বলে দেওয়া যায় ওটা ব্যবহারের ট্রেনিং তার আছে, তখন বাকিটা অনুমান করে নেওয়া কঠিন কিছু না।”

শিয়া এবারও কিছু বলল না। নতুন কোনো অভিব্যক্তির চিহ্নও পড়ছে না তার মুখে, বরং একটু আগের রাগত ভঙ্গিটা সে আশ্চর্য দক্ষতায় লুকিয়ে ফেললো। একটা ভ্রু উঁচু করে ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করলো মুহিব।

“ডিফেন্স মেকানিজম খারাপ না তোমার। যাকগে, তোমার ব্যপারটা আমি বুঝি। দেশকে উদ্ধার করছো। কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য ইত্যাদি ইত্যাদি। সরকারের চোখে তোমরা সন্ত্রাসী ছাড়া আর তো কিছু নও। আরেকটা নকশাল আন্দোলন বাঁধাবে তোমরা খুব সম্ভব। তা তোমাদের লড়াই, আমি এখানে কোনো মন্তব্য করবো না। তোমাদের মতাদর্শের সাথে আমার মতবিরোধ আছে। কিন্তু সেসব নিয়ে আলোচনার জন্য আমি আসিনি এখানে। আজকে আমি এখানে বসে আছি কারণ তোমার ব্যাপারে আমি কেয়ার করি, চাই না তুমি বড় কোনো বিপদে পড়ে যাও। আর তোমার সামনে এখন তেমনই এক বিপদ, শিয়া।”

“হাহ!” এতোটুকুই বলল এবার মেয়েটা। বলল না বলে বরং বলা যায় দুর্বোধ্য এক শব্দ করলো।

“পয়েন্টটা কি, তাই জানতে চাইছিলে তুমি।” শান্তভঙ্গিতেই বলে গেলো মুহিব, “দ্য পয়েন্ট ইজ, আমি একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট। এবার দ্বিতীয় বর্ষে উঠবো কেবল। কয়েকদিন আগে কলেজে পড়তাম। আঠারোই হলো এই তো কয়েক মাস আগে। আমার কথাটা কি তুমি বুঝতে পারছো?”

শিয়াকে এবার সত্যই বিভ্রান্ত দেখায়।

“আমার মতো গতকাল চোখ ফোটা, কৌমার্য না হারানো একটা ছেলে যদি বুঝতে পারে তোমার এরকম একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, তাহলে তোমার জন্য যারা বিপদের কারণ তারা অনায়াসেই তোমাকে চিনতে পারবে। ওরা তোমাকে দেখতে পাবে দশ মাইল দূর থেকে। তারপর সম্ভাবনা আছে বাকি জীবন জেলে কাটানোর, কিংবা ফাঁসির দড়িতে সুন্দরমতো লটকে যাওয়ার।“

“আমি ফাঁসির কথা ভাববো কেন?”

কাঁধ ঝাঁকালো মুহিব, “ফাহাদ হিল্লোলকে খুন করার অপরাধে। গড নোজ এর আগে আর কতোজনকে শুইয়েছো তুমি।”

নিমেষেই শিয়ার চেহারায় ফুটে উঠলো নিখাদ আতঙ্ক। বাঁ হাতটা চট করে নামিয়ে নিচ্ছিলো উরুর দিকে, শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে ফেললো সে। আরও একবার আশ্চর্য দক্ষতায় নির্লিপ্ত এক চাহনি ধারণ করলো সে। স্রেফ ধারণার ওপর ভিত্তি করে এসব ফালতু কথা বলবে বলেই কি ডেকে এনেছো?”

নিরুপায় একটা ভঙ্গি করলো মুহিব, “আমি ডিবির লোক না যে তোমাকে স্বীকার করানোর জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করতে থাকবো। কিন্তু আমি মাত্র মায়ের দুধ ছেড়ে আসা একটা ছেলে, আমার বয়স এখনও বিশ হয়নি, দুনিয়া চিনি না। সেই আমি ঘটনাটার সাথে তোমার সংযোগ ধরতে পারছি। ডিবির লোকেরা কেন পারবে না? তোমার ভালো চাই আমি, শিয়া। নাহলে এভাবে দেখা করে এমন সব কথা বলার দরকার ছিল না যা বলা আমার জন্য ব্রিতকর আর শোনা তোমার জন্য।”

“তোমার সাজেশন কি? হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা? ভাইয়ার সাথে যা হয়েছে তা আমি কখনোই ভুলতে পারবো না যতোদিন না এটার একটা শেষ দেখছি।”

“শামসভাইয়ের ব্যাপারটার শেষ না দেখে আমিও ছাড়ছি না। সেটা নিয়ে তুমি এখন যতো ইচ্ছে ভাবতে পারো, তবে আমি চাই না এই ‘শেষ দেখাদেখি’র জন্য তুমি ঐসব করে বেড়াও। ফাদারের ব্যাপারটা বলছি, মানে, হিল্লোল।”

চোখ টিপ দিয়ে বাকিটা বুঝিয়ে দিতে হলো মুহিবকে। তার আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করতেই যেন এবার এটা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করার চেষ্টাও করলো না শিয়া। এই এক মৌনতাতেই মেয়েটির সম্মতির ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে গেলো। সেলেব্রিটি রাজনীতিককে তাহলে শিয়াই হত্যা করেছে! মুহিবের ভেতরটা অদ্ভুত এক আশঙ্কায় ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।

বলে চললো সে, “এটা একটা হাই প্রোফাইল কেস হয়ে গেছে। তোমার জন্য এটা বিপজ্জনক হবে, সবগুলো গোয়েন্দা সংস্থা নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে তোমাকে খুঁজছে এখন। ফাঁসি খুবই স্বাভাবিক একটা পরিণতি। এটাই তোমাকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করছি আমি, শিয়া। জানি তোমাকে ওরা ট্রেনিং দিয়েছে, মৃত্যুর ভয় তোমার নেই। তবে আমি আশা করেছিলাম তোমার মতো স্মার্ট একটা মেয়ে বিগার পিকচারটা দেখতে পাবে এখানে। আংকেল আন্টি একটা ছেলেকে হারিয়েছে, তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন এখন তুমি। তোমাকে কেউ দেশ আর নিজের স্বার্থে যুদ্ধক্ষেত্রে বুক পেতে দিতে বলছে না।”

“লিসেন-”

মুহিব তাকে এবার বলার সুযোগই দিলো না, “আমাকে ছাতামাথা বুঝিয়ে তোমার লাভ নেই তো। আমার কাছে ইনফরমেশন আছে আর তা আমি তোমাকে দিচ্ছি না। যে সংগঠনের সঙ্গেই জড়িত থাকো তুমি, তারা তোমার বিপদের কারণ নয়। হয়তো রাজনীতিবিদদের তোমরা এখানে ওখানে খুন করে বেড়াচ্ছো, কিন্তু তাতে করে কেউ তোমাদের সন্দেহ করতে পারছে বলে আমার মনে হয় না। চরমপন্থী সমাজতান্ত্রিক দল আর চরমপন্থী ইসলামিস্ট গ্রুপগুলোর মধ্যে এই একটা মিল আছে।” একটু হাসলো মুহিব, “এই এক কারণে দুটোকেই ঘৃণা করি আমি। ইউ আর আ বাঞ্চ অব কাওয়ার্ডস। ঢাকার মেয়রকে মেরে গেলো পঞ্চগড়ের এক আলাভোলা মেয়ে, কোন শার্লক হোমস ধরতে পারবে খুনিকে? মেয়রকে ওই মেয়ে দেখেনি কখনও, এক পার্টিতে আসেনি, এক এলাকায় ছিল না, মেয়র মেয়েটির কোনো ক্ষতি করেনি, পরিচয়ও হয়নি তাদের মধ্যে। কোনো মোটিভ নেই, কানেকশন নেই। আবার দেখো, ব্লগার মেরে ফেলে রাখছে যারা, ভিক্টিম আর মার্ডারারের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। কোনোদিন একবারও নিজেদের মধ্যে কথা হয়নি তাদের। মোটিভ, কানেকশন না থাকলে তুমি খুনিকে কিভাবে ধরবে? হাল্কা ট্রেনিং পাওয়ার পর এরা ক্রাইম সিনে কিছু ফেলেও আসে না। যেমনটা তোমরা করো আরকি।” একটু কাশলো মুহিব, “কিন্তু এই একটা কাজ করতে গিয়ে তুমি ধরা পড়ে যাচ্ছো বলে আমার মনে হয়। কারণটা কি বলতে পারবে?”

শিয়া এবার কিছু বলল না।

“কারণ, তুমি একটা ব্যক্তিগত কাজে তোমার ট্রেনিং ব্যবহার করছো। এতে করে কি হচ্ছে? তোমার মোটিভ থাকছে, কানেকশন থাকছে। বড় ধরণের একটা বোকামি করছো তুমি। ইউ আর মেকিং ইট পার্সোনাল। আমি তোমার থেকে আরও খানিকটা স্মার্টনেস আশা করেছিলাম। এখন থেকে, তোমার আর সবার ভালোর জন্যই, এসব থেকে দূরে থাকছো তুমি।” টিস্যু দিয়ে মুখ মুছলো মুহিব, পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে ছোট্ট এই টেবিলটায়, “আর এটাই চূড়ান্ত থাকলো। শামসভাইয়ের ব্যাপারটা আমি দেখছি। ট্রাস্ট মি অন দিস।”

মুহিবকে প্রথম যেদিন দেখে সেদিনের কথা মনে করার চেষ্টা করলো শিয়া। অনেক সাধাসিধে একটা ছেলে ছিল, বন্ধুদের ছাড়া আর কিছু বোঝে না। সাংবাদিকতায় ঝোঁক আছে, মানবতাপূর্ণ একটা হৃদয় আছে। সেই ছেলেটা অনেকখানি পাল্টে গেছে। বিপদের সঙ্গে চলাফেরা করলে বয়স নাকি দুই মাসে বছর বাড়ে। মুহিবের সঙ্গেও তেমনটা ঘটেছে, ছেলেটা এখন অনেকটাই পরিণত। টেবিল ছেড়ে তার চলে যাওয়া চুপচাপ দেখলো শিয়া, পুরো ব্যাপারটাই ওর পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু প্রতিবাদ করার জায়গাও এখানে নেই, মুহিব ভুল কিছু বলেনি। সবার ভালোর জন্য ওর বাইরে থাকাই উচিত। ছেলেটা কিছু একটা লুকাচ্ছে এবং সেটা স্বীকার করেও গেছে, একেবারে মুখোমুখি। এমন মানুষগুলোকে সে পছন্দ করে।

বিলটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো শিয়া, ওদের ছোট্ট গ্রুপটাকে দুটো মাস দিয়ে দেখা যেতেই পারে। ছেলেগুলোকে যতোটা আন্ডারএস্টিমেট করেছিলো তার চেয়েও বেশি কিছু ওরা ডিজার্ভ করে। রেস্তোঁরা ছাড়ার সময় গিটার হাতে সুন্দরির দিকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকালো একবার, গিটারটা শেখা হয়নি ওর। মেয়েটা এখন মনোযোগ দিয়ে বিথোভেনের ফার এলিস বাজাচ্ছে।

সুরটা শিস দিয়ে ভাজতে ভাজতে রেস্তোঁরা থেকে বেরিয়ে গেলো শিয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *