কুকুরদল – ৫৫

অধ্যায় ৫৫

চোখ মেলতেই প্রথম যে অনুভূতিটা শিয়ার হলো, ভারি কিছু দিয়ে চেপে রাখা হয়েছে তার মাথা। দপ দপ করে লাফাচ্ছে একটা শিরা। বরাবর ওপরে একটা এনার্জি বাল্ব জ্বলছে, ওটার আলোর তীব্রতা যন্ত্রণাটা আরও বাড়িয়ে দিলো। গলাও শুকিয়ে খস খস করছে। ভেতরে কেমন যেন ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি হলো ওর, সেই সাথে গলার কাছে এসে থামলো উদগত বমির ভাবটা। ঠিক তখনই লক্ষণগুলোকে ধরতে পারলো ও। বিবমিষার দুর্বলতাটা সে একটা ক্ষেত্রেই কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

কেউ একজন তাকে অ্যানাসথেসিয়া দিয়েছে।

যন্ত্রণার নানাদিক আছে এখানে, ঘাড়ের কাছে অনেকগুলো শিরা টনটন করছে। প্রপোফল ছিল নাকি ড্রাগসে? হতে পারে। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডার সঙ্গে আতঙ্কের একটা প্রবাহ টের পেলো এবার। ঠিক তাই। নয়তো এখানে এলো কিভাবে তা মনে করতে পারছে না কেন? প্রপোফলের সঙ্গে সাময়িক স্মৃতি হারানোর ব্যাপারটা আসে। ডাক্তারের চেম্বারে এটা খুব একটা বড় ব্যাপার না। অপারেশন থিয়েটারে রোগি কিভাবে এলো অথবা বাড়ি থেকে কেমন করে হাসপাতালে পৌছালো তা তাদের মনে না করলেও চলে। কিন্তু এই মুহূর্তে শিয়ার জানা প্রয়োজন সে বাসা বা ভার্সিটিতে না থেকে এখানে কি করছে।

এই মুহূর্তে সে আছেটা কোথায়?

চারপাশে তাকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। গলার কাছে আটকে রেখেছে বেল্ট-জাতীয় কিছু দিয়ে। মাথা নড়ানোর বিশেষ উপায় নেই। খুব বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে। সাদা একটা ছাত, তার থেকেও বেশি সাদা এনার্জি বাল্বটা চোখের ওপর অত্যাচার করছে। একটা সিলিং ফ্যানও দেখা যাচ্ছে ওপরে।

সর্বশেষ স্মৃতি কোনটা তা মনে করার চেষ্টা করলো শিয়া। মায়ের মাথা ঠিক হয়ে গেছে। হ্যাঁ, ওটাই তো। বাবা বেশ উদ্বেলিত হয়েছিলো এটা নিয়ে। কতোগুলো মাস পর স্বাভাবিক আচরণে ফিরে এসেছে মা। শামসভাইয়ের মৃত্যুর পর শামসভাই!

লাফ দিয়ে উঠে বসতে চাইলো শিয়া, পারলো না। দু-হাতের কব্জি, গলা আর দুই পা বেল্ট দিয়ে খাটের সঙ্গে আটকে রেখেছে ওরা। কোমরের নিচে একটা কিছু দিয়ে ধনুকের মতো বাঁকা একটা অবস্থানে নিয়ে এসেছে তাকে। এতোক্ষণে আরও একটা বিষয় খেয়াল করলো সে।

এই অবস্থানে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়!

নিজের শরীর দেখার চেষ্টা করলো শিয়া, গলার বেল্টটার কারণে মাথা ঘোরানো যাচ্ছে না। তবে শরীরের সঙ্গে কোনো পোষাকের স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো বার বার। চেতনানাশকের সাইড ইফেক্ট হিসেবে শিরদাঁড়ার ঠাণ্ডা অনুভূতিটা আছে, তার সঙ্গে এসেছিলো ভয়। এবার তাদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেলো অস্বস্তি। অচেনা অপরিচিত মানুষদের মধ্যে বন্দি অবস্থায় নগ্ন শুয়ে থাকার মধ্যে স্বস্তিদায়ক কিছু নেই।

এটা কি তার ট্রেনিংয়ের কোনো একটা অংশ হতে পারে? কে জানে! ছয় মাস পর পর অ্যাসেটদের আচমকা আক্রমণ করা হয় সমিতির পক্ষ থেকে। সেটার জন্য হলেও সব সময় একজন সদস্যকে প্রস্তুত থাকতে হয়। শিয়া কিভাবে স্নায়ু ঢিল দিয়েছিলো?

এই বন্দিদশা অনুশীলন সমিতির পক্ষ থেকে হলে সবচেয়ে ভালো হয় তার জন্য। তবে সবচেয়ে খারাপ হতে পারে কোন ক্ষেত্রে? শিয়া ভাবার চেষ্টা করলো তার ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে কারা। প্রথমেই আসবে ওই সংসদ সদস্যের নাম। যাকে তার নিজের বেডরুম সংলগ্ন বাথরুমের ভেতরে গুলি করে হত্যা করেছিলো সে। কাজটা একেবারে নিখুঁত হয়েছিলো। কারও পক্ষেই সেই কাজের সাথে শিয়ার সম্পর্ক বের করে আনা সম্ভব না। আধখাপচা কাজ হয়েছিলো ফাহাদ হিল্লোলের বেলায়। ওটা একেবারেই পরিচ্ছন্ন ছিল না। একেবারেই না।

সম্ভাবনা যাচাই করতে করতেই পাঁচটা বেল্টের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বলটা খুঁজে বের করতে পারলো সে। বাম হাতের বেল্টের নিচে দুটো রিভেট, এদের একটা নড়বড়ে। লম্বা আঙুলগুলো দিয়ে রিভেটটা স্পর্শ করার চেষ্টা করলো, সুবিধা করতে পারলো না। একবার জোরে টান দিয়ে ধরতেই শব্দ করে নড়ে উঠলো রিভেটটা। একটা স্ট্রাকচারে যতো দুর্বলতা ততো বেশি ‘ক্যাঁচকোঁচ’। আরেকবার টান দিতে বেশ জোরে শব্দ হলো। বাম দিকে একটা দরজা খুলে যাওয়ার শব্দ হলো সেই সঙ্গে।

ঘরের ভেতর এই মাত্র যে প্রবেশ করলো সে একজন পুরুষ। শরীরের ওপর আছড়ে পড়া লোলুপ দৃষ্টি ষষ্ঠ ইন্দ্ৰীয়ে ধরতে পারছে শিয়া। ধীরে ধীরে বন্দি-বিছানার কাছে এগিয়ে আসছে মানুষটা। এনার্জি বাল্বের ঠিক পাশে এসে থামলো একটা মুখ। ঠাণ্ডা আর ঘামে ভেজা পিচ্ছিল একটা হাত আচমকাই চেপে বসলো ওর স্তনে। স্তনবৃত্ত ওপরের দিকে এতো জোরে টেনে ধরলো লোকটা, তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে উঠতে চাইলো শিয়ার শরীর।

অথচ এক চুলও নড়লো না সে, মুখে এসে পড়েনি যন্ত্রণার কোনো ছাপ। এখনও একদৃষ্টে লকলকে লোভ জমে থাকা পুরুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সে। এই মানুষটাকে ও খুব ভালো মতোই চেনে।

স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে এদের সে অনুসরণ করেছিলো।

মানুষটার নাম রেদোয়ান।

তার ভাইয়ের গলায় এই মানুষটাই ছুরি চালিয়েছিলো।

*

পরীক্ষার হল থেকে বের হওয়ার পর কিছু অলিখিত নিয়ম মেনে চলতে হয়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হলো আজিজ মামার টঙে উপস্থিত থাকা পরীক্ষায় ডাহা ফেল মারলো কি ছক্কা, তা কোনো বড় ব্যাপার না। সেমিস্টার ফাইনাল মানেই তিন ঘণ্টার ব্রেইন স্টর্মিং আজাব, আর তা থেকে পরিত্রাণের পর সবাই অতীত ভুলে যেতে চায়। মুহিব-শামীম প্রথম এবং অলঙ্ঘনীয় নিয়মটা মেনে আজিজ মামার টঙে চলে এসেছে। এই দোকানটা অবশ্য ওদের প্রাইভেট আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। ক্যাম্পাসের মেইনগেট থেকে বেশ খানিকটা দূরে হওয়ায় এখানে ছাত্রদের ভিড় সব সময়ই কম। আশেপাশের মেসে যারা থাকে তাদের সবাই পরীক্ষার ধকল সামলে ক্যাম্পাসের ভেতরের কোনো চায়ের আড্ডায় বসে পড়েছে। এদের মধ্যে অনুপস্থিত থাকবে কেবল কেল্টু সম্প্রদায়। তারা পরের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে এখনই ঘরদোর বন্ধ করে পড়তে বসে গেছে নির্ঘাত।

নতুন কেনা বেনসনটায় আগুন ধরিয়ে ভক ভক করে ধোঁয়া ছাড়লো শামীম, “একটা বোঝা কমলো।”

“হুঁ।” অন্যমনস্ক হয়ে বলল মুহিব। গতকাল রাত থেকে তার মাথায় পরীক্ষা ছাড়া আর কিছু ছিল না। তবে এখন বিপদটা কেটে যেতেই আবারও অন্যান্য সব দুশ্চিন্তা ঝাঁপির মতো ঢেকে ফেলেছে ওকে।

“হুঁ হা করিস না। আজকের দিনটা চিল কর। মাথার ওপর দিয়ে তো আর কম যায় নাই।” আজিজ মামার দেরাজ খুলে আরেকটা বেনসন নিজ হাতে বের করে নিলো সে। পুরাতন কাস্টোমারদের সঙ্গে এই সৌজন্যতার সম্পর্ক আজিজ মামা রাখেন। মুহিবের দিকে বাড়িয়ে ধরলো সে ওটা, “নে, সিগারেট খা।”

সিগারেটটা নিয়ে ধরালো মুহিব। পরীক্ষা ভালো দিয়ে শামীমের মন খুব ভালো হয়ে আছে। তার সঙ্গে গুরুগম্ভির আলোচনা করে এখন মুড নষ্ট করিয়ে দেওয়ার মানে হয় না। এসব কথা ওকে রাতেও বলা যাবে। শামীম অবশ্য বন্ধুর দুশ্চিন্তার আসল কারণটা ধরতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে না। তার মাথায় এখনও সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনা, সেমিস্টার ফাইনাল নিয়েই নানা রকম গুনগুন করছে সে। মুহিবের ইচ্ছে করলো কেল্টটাকে ধাক্কা দিয়ে বেঞ্চ থেকে ফেলে দিতে।

“এরপরের পরীক্ষায় পাশ করতে যেয়ে জান বের হয়ে যাবে।” শামীম বলে যাচ্ছে, “দুই ফাঁকিবাজ কোর্স নিলো সবচেয়ে কঠিন কোর্সে। আমার মনে হয় তারাও এটা ভালো পারে না। নাহলে একজন মাত্র ছয়টা আর আরেকজন আটটা ক্লাস নিলো কি করে ছয় মাসে? পালিয়ে থাকার কারণ তো দেখি না।”

মুহিবের পক্ষে চুপ করে থাকাটা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। অবস্থা অনেকটা এরকম, সে ভাবছে রকেট সায়েন্স নিয়ে আর পাশে বসে থাকা বন্ধুর আলোচনা কম্পিউটার গেমস নিয়ে। সিগারেটের ওপর ঝাল ঝেড়ে শান্ত হতে হলো ওকে। ফিল্টারটা একেবারে চুপসে গেলো এবার।

“আগামিকাল আমাদের সব চোথাপাতি যোগাড় করে ফেলতে হবে। এবার আমরা পাঁচদিন টানা পড়া দেবো। তারপর দেখি পরীক্ষা কি করে খারাপ হয়!”

এমন প্রতিজ্ঞা প্রায় সবাই করে থাকে প্রথমদিনে। তারপর দিন গড়াতে থাকলেও প্রতিজ্ঞার প্রতি সুবিচারের লক্ষণ কেউ দেখায় না। শেষে সেই পরীক্ষার আগের দুই রাত পড়ে টেনেটুনে সিলেবাস শেষ করে পরীক্ষার হলে বসা। মুহিবের চিন্তা অবশ্য এতো গভিরে গেলো না। সরাসরি বন্ধুর দিকে তাকালো সে, চোখে বিরক্তি।

এতোক্ষণে বুঝলো শামীম, তবে বুঝলো ভুলটা। পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর দ্বিতীয় অলঙ্ঘনীয় নিয়ম–পরীক্ষা নিয়ে কথা বলা যাবে না। ফাইট ক্লাবের সেই বিখ্যাত শর্তটা কি করে এসেছিলো তা এখন ওরা জানে।

“সরি, পরীক্ষা নিয়ে আর একটা শব্দও আমার মুখ থেকে—” কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলা শুরু করেছিলো শামীম, তাকে মাত্র পাঁচটা শব্দ উচ্চারণ করেই থামিয়ে দিলো মুহিব

“আমি তোফায়েলকে গুলি করতে চাচ্ছি।”

শামীমের চেহারাটা হয়েছে দেখার মতো। কাতল মাছের মতো হা হয়ে গেছে সে। চোখগুলো যতোটা বড় হয়েছে, কোনোমাত্রার কঠিন সেমিস্টার ফাইনালের প্রশ্ন দেখেই এমনটা হওয়ার কথা নয়।

“কি বললি তুই?” দ্রুত গলা নামিয়ে ফেললো শামীম।

“এখানে বসে তসবিহ টিপে একশ বার বলে জিকির করা যায় এমন কিছু বলি নাই। চোরের মতো ফিসুরফাসুর বন্ধ কর।” সিগারেটে আরও জোরে টান দিলো মুহিব, “অনেক আগেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি। এটাই একমাত্র সমাধান। কিন্তু সাহস পাচ্ছি না।”

“অবশ্যই পাওয়া উচিত না সাহস।” উৎসাহের কমতি নেই এখন শামীমের গলায়, “এসব কি ভাবা শুরু করেছিস? আমাদের দিয়ে এসব হয়? করেছি কখনও আমরা এসব কাজ?”

মুচকি হাসলো মুহিব, “আগেই বলেছিলাম তোকে এখানে জড়াচ্ছি না আমি। ‘আমরা’র প্রসঙ্গই আসে না। কাজটা করবো আমি। কবে আর কিভাবে কিছুই জানতে পারবি না তুই। অর্থাৎ বাই অ্যানি চান্স যদি ধরা পড়ে যাই আমার অ্যাকমপ্লিস হিসেবে তোকে কেউ আটকাতে পারবে না। কাজটা করবো আমি, একা আমি। শুধু সাহস হচ্ছে না।

“তুই এটা করতে পারবি না।” মাথা নাড়লো শামীম।”তোর মধ্যে এসব নেই।”

রেখে-ঢেকে গুড়গুড় করে বলতে হচ্ছে ওদের কথা। মুহিবের ওপর খাপ্পা হয়ে গেলো শামীম হঠাৎ করেই। এমন একটা কাজ করার সিদ্ধান্ত তার বন্ধুটি নিতে পারলো কি করে? নিজেকেও খানিকটা দুষলো না এমন নয়। বন্ধুর সঙ্গে এই মামলার একটা নিষ্পত্তি আনার জন্য বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই কি সে চাপ দিয়ে যাচ্ছে না? তারপরও এ কেমন সমাধান বের করেছে মুহিব? ঠাণ্ডা মাথায় সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে একজন মানুষকে মেরে ফেলার! তবে তার সঙ্গে তোফায়েলের পার্থক্য কি রইলো?

“আমার দিকে এভাবে তাকানোর দরকার নেই।” সিগারেটের অবশিষ্টাংশটা মাটিতে ফেলে তাকে পিষে ফেললো মুহিব, “এটা আমি সখের বশে করতে চাইছি না। দোষটা তার, লোকটা আর কোনো রাস্তাই খোলা রাখেনি। আমি এখনও হয়তো নিষ্পত্তির রাস্তা খুঁজতাম, কিন্তু ইলোরার দিকটাও আমাদের ভাবতে হবে।”

শামীম তবুও বাঁকা করে তাকালো তার দিকে।

“কি হলো? কিছু বলার থাকলে বলে ফ্যাল। আমার সিদ্ধান্ত তাতে করে পাল্টাবে না। তোকে জানানোটা উচিত মনে হলো তাই জানালাম। নাহলে জানতিও না।”

“নতুন নতুন প্রেম শুরু করলে সব কিছু জটিলভাবে চিন্তা করে ছেলেরা। তোকেও এমনটা দেখতে হবে ভাবিনি।” দৃষ্টির ব্যাখ্যা দিলো শামীম।

হাহা করে হাসলো মুহিব, “ভালো বলেছিস। আজিজ মামা, আরও দুটো বেনসন দেন। আর দুটো দুধ চা।”

চমকের ধাক্কা কেটে গেছে শামীমের। রসিকতা রেখে কাজের কথা শুরু করলো ওরা। বন্ধু একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, আর মুহিবকে সে চেনে। একবার একটা কিছু করতে চাইলে সেটা না করে পিছিয়ে আসার মতো মানুষ মুহিব নয়। কাজটা করবে বলেছে মানে সে এটা করবেই। শামীম তাকে বারণ করতে গেলে আরও খারাপ হতে পারে পরিস্থিতি। অন্য দিক থেকে আলোচনাটা এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে শামীম অবশ্য কোনো কমতি রাখলো না।

“সাহস পাচ্ছিস না বললি যে, ব্যাপারটা আমার সাথে আলোচনা করতে পারিস।”

আজিজ মামা চায়ের কাপ দিয়ে গেলে উত্তরটা দিলো মুহিব, “আগে আর পরের ব্যাপারে আমার কোনো ভয় নেই। আমি জানি দুটোই সামলে নিতে পারবো। মানে, কাজটার আগে এবং কাজটা শেষ হওয়ার পর

মুহিব বিভ্রান্ত হয়ে গেলে এমন ভাঙা ভাঙা বাক্যে কথা বলে, এটা শামীম জানে। তার বক্তব্য বুঝে নিতে অবশ্য সমস্যা হলো না এতে করে।”তুই ভাবছিস যখন সময় হবে, মানে ঠিক তোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে হারামজাদা, তখন তুই কাজটা করতে পারবি কি না?”

“ঠিক তাই। এটা খুব বিভ্রান্তির। শেষ মুহূর্তের আগ পর্যন্ত জানা সম্ভব না কিন্তু…তখন যদি আমি টের পাই আমার মধ্যে জিনিসটা আসলেই নেই, তাহলে কি হবে বুঝতে পারছিস? তোফায়েল কিন্তু আমাকে ছেড়ে দেবে না। ওটা হয়ে যাবে একটা ডু অর ডাই সিচুয়েশন। তাছাড়া এখন পর্যন্ত ওরা কেউ জানে না আমরা কতোদূর পর্যন্ত এগিয়ে এসেছি। এটা ওদের জন্য সারপ্রাইজিং এলিমেন্ট পুরোটাই। কিন্তু ওর দিকে যখন আমি তাক করবো, মানে ওটা।”

অর্ধবাক্যেই বুঝে নিলো শামীম।

“তখনই শেষ হবে এলিমেন্ট অব সারপ্রাইজ। আমরা কতোখানি জানি তা জেনে যাবে তোফায়েলও। আর আমি যদি কাজটা শেষ করতে না পারি, তাহলে আমাদের সবারই খবর আছে। আমি তো ইতিহাস হয়েই যাবো, তুই, ইলোরা কিংবা শিয়াও বাঁচবে না।”

চায়ের কাপটা সামনের টেবিলে নামিয়ে রেখে বন্ধুর দিকে সরাসরি তাকালো শামীম, “কাজটা না করলে হয় না, দোস্ত?”

মাথা নাড়লো মুহিব, “আমাকে একটা সমাধান দেখা। এটা ছাড়া এমন একটা রাস্তা দেখিয়ে দে যেটা ধরে আমি এগিয়ে গেলে ইলোরা রেপড হবে না, আমি জাকিদের মাস্টারপ্ল্যান থেকে রক্ষা পাবো, তোফায়েল বা রেদোয়ান আর আমাদের জন্য হুমকি হয়ে থাকবে না, শিয়া একটা নিরাপদ জীবন পাবে আর শামসভাইয়ের জন্য জাস্টিস আনা যাবে। দেখিয়ে দে সেই পথ? আমি ওটাই অনুসরণ করবো।”

এরকম কোনো পথ শামীমের জানা ছিল না। একেবারেই চুপ হয়ে গেলো সে। ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারছে মুহিবের হাতে আসলেই আর কোনো পথ খোলা নেই। একটা পথ অবশ্যই আছে, তা হলো পৃথিবীটাকে জাহান্নামে যেতে দেওয়া। চোখ কান বন্ধ করে মেসের গর্তে লুকিয়ে থাকা, যেন কিছুই ঘটেনি। শামসভাইয়ের মার্ডারের ব্যাপারে ওরা কেউ কিছু জানে না। যেন মুহিবকে তোফায়েল তাজউদ্দীন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গিয়ে ছুরি মারেনি, যেন ইলোরাকে সে যৌন নির্যাতন করেনি কিংবা শিয়ার সঙ্গে ওরা যথেষ্ট জড়িয়ে যায়নি।

এমন নির্বিকারত্ব দেখানো মুহিবের পক্ষে তো বটেই, এমনকী শামীমের জন্যও অসম্ভব।

পকেটে একটা ভাইব্রেশন টের পেয়ে চিন্তা সমুদ্র থেকে উঠে এলো শামীম। ডিসপ্লেতে নামটা দেখে অবাকই হলো। এই নাম্বার থেকে এখন ফোন আসার কথা নয়। বেসুরো চিৎকার করে ডেকে উঠলো মুহিবের ফোনটাও। পকেট থেকে যন্ত্রটা বের করলো সে-ও। শামীমের দিকে বিভ্রান্ত হয়ে তাকালো একবার। তারপর মাথা নেড়ে দোকানের বাইরে চলে গেলো ফোন রিসিভ করার জন্য।

কাঁপা হাতে নিজের ফোন রিসিভ করলো শামীম। অন্যপ্রান্তের কথাগুলো ওর কান বেয়ে ভেতরে ঢুকলেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত যেন পৌছাচ্ছে না। হাতের সাথে এখন শরীরটাও কাঁপছে ওর। ফোন রেখে চায়ের কাপটা তুলে নিলো অযথাই, চা খেতে আর ইচ্ছে করছে না। বমি বমি করছে। চায়ের কাপ ধরা হাতটাও যেভাবে কাঁপছে, লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে অনায়াসে। দ্রুত কাপটা নামিয়ে রাখতে গিয়ে উল্টেই ফেললো শামীম। আজিজ মামা হাহাকার ছেড়ে ছুটে আসলেন, উদ্বেগ নিয়ে কিছু একটা বলে যাচ্ছেন তিনি, কিছুই শুনতে পেলো না সে।

বাইরে থেকে ফিরে আসছে মুহিব, কান থেকে ফোনটা নামিয়ে স্রেফ টেবিলের ওপর ওটাকে ছুঁড়ে মারলো সে। বিকট শব্দে ডিসপ্লেটা ভাঙলো, ওখান থেকে ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেলো লেনোভোর স্মার্টফোনটা। দড়াম করে এক লাথি মেরে ওটাকে রাস্তার মাঝখানে পাঠিয়ে দিলো মুহিব। প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে নড়িয়ে দিলো আজিজ মামার দোকানের দেওয়াল।

দুই বন্ধু এখন একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে।

এখনও কেঁপে চলেছে শামীম। মুহিবের চেহারায় অসহায়ত্বের চেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে ক্রোধ। এই ক্রোধ কার ওপর সে জানে না। আবারও বাজতে শুরু করেছে শামীমের ফোন। ফোনটা রিসিভ না করে কেটে দিলো সে। মুহিব আর শামীমের ফোনে আজ অসংখ্য কল আসবে। সবাই তাদের একটাই খবর দেওয়ার জন্য ফোন করতে থাকবে।

একটা দুঃসংবাদ।

অবশেষে বাক্যটা উচ্চারণ করলো মুহিব। যে মেসেজটা ভিন্ন কলারের মাধ্যমে একটু আগে পেয়েছে ওরা। যে বাক্যটি উচ্চারণ করার জন্য ওরা মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

“আধঘণ্টা আগে মারা গেছে লিটু। আগামিকাল ওর লাশ নিয়ে দেশে আসবে বাদল ভাই।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *