অধ্যায় ৫৮
একপাশে নদীর তীর, অপরপাশে চর। মাঝে ভেসে চলছে ছইতোলা এক নৌকা। গলুইয়ের কাছে বসে থাকতে খারাপ লাগতো না ইলোরার, যদি না গা ঘেঁষে বসে থাকতো অনাকাঙ্খিত পুরুষ। তোফায়েল ওর কোমর জড়িয়ে রেখেছে এক হাতে, যেন তাকে যখন ইচ্ছে ধরতে পারা তার জন্মগত অধিকার। কোনোদিন প্রেমের প্রস্তাব আদান-প্রদান হয়েছিলো কি না মনে করার চেষ্টা করলো ইলোরা। তেমন কিছু ঘটেনি ওদের মাঝে, তবে আর যে কোনো ছেলের মতোই তোফায়েল পরিচয়ের কয়েক মাসের মধ্যে ওর গায়ে হাত দেওয়া শুরু করেছে। এই মুহূর্তে পেটে ছেলেটার স্পর্শ অনুভব করে ইলোরার শরীর ঘৃণায় ঘিন ঘিন করে উঠলো।
“সময়টাই যাইতেছে খারাপ।” স্বভাববিরুদ্ধ এক কণ্ঠে বলল তোফায়েল, “প্রথমে তোমার ওই বন্ধুটা, তারপর রেদোয়ান।”
রেদোয়ানের নামটা কানে ঢুকতে ঘিনঘিনে ভাবটা আরও বেড়ে গেলো ইলোরার। তোফায়েলের হাতের স্পর্শটিকে এখন মনে হচ্ছে বৃশ্চিকের পদচারণা। ওকে ধরে রেখে লোকটার সাহস হলো কি করে রেদোয়ানের নাম মুখে নেওয়ার? ইলোরা দাঁতে দাঁত চেপে গলুইয়ে বসে রইলো।
“আমি তো ভাবছিলাম তোমার বন্ধু ভালো হইয়া যাইবো। ইন্ডিয়া নিয়া গেলো যখন, খোঁজ নিয়া দেখছি আমি। নারায়ণ হেলথ ক্লিনিকে এই রোগের ট্রিটমেন্টের পর নাকি কোনো রোগি মারা যায় নাই। কিন্তু হইলো উল্টাটা।”
লিটুর কথা মনে করার ইচ্ছে ইলোরার ছিল না। ছেলেটার ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে সে, ওরা সবাই। হারামজাদা মরলো কোন সাহসে? এটা সে কি করে করতে পারলো? দুঃখবোধের চেয়ে ক্রোধটা বেশি হচ্ছে কেন ইলোরা জানে না। ওরা ধরেই নিয়েছিলো বন্ধুকে ফিরে আসতে হবে। আসতেই হবে। তা না করে যেন কথার খেলাপ করেছে লিটু। তার জন্য দুঃখ পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। হাতের কাছে আরেকবার পেলে তাকে কেমন পেটান যে পেটাতো ইলোরা, রাগে ওর হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যায়।
“রেদোয়ান ভাইয়ের কি হয়েছে আবার?” প্রসঙ্গটা পাল্টাতে প্রশ্নটা করা, তোফায়েলের মতো একটা মানুষের মুখে লিটুর ব্যাপারে আলোচনা শোনার কোনো ইচ্ছে তার নেই।
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তোফায়েল। তার আবেগ দেখে পিত্তি জ্বলে গেলো ইলোরার, তবুও প্রেমে মরে যাচ্ছি ধরণের একটা মুখ নিয়ে বসে থাকতে হলো ওকে গলুইয়ে। আবেগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কোমরে চেপে থাকা তোফায়েলের হাতের ওপর কোমলভাবে একটা হাতও রাখলো। ওদের প্রেম দেখে মাঝি ছোকরাটা পেছনের গলুইয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলো। ভাগ্যিস মানুষ অন্যদের মনের কথা পড়তে জানে না!
“একটা মিটিংয়ে ঢাকা গেছিলো। সেখান থেকে সে নিখোঁজ। তারে পাওয়া যাইতেছে না কয়েকদিন ধরে।” ইলোরার কাঁধে থুতনি রাখলো ছাত্রনেতা। পাতলা জামা ভেদ করে তার খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো কাঁধের চামড়ায় পিন ফোটালো যেন।”আমারে রেদোয়ান মিটিংয়ে আসতে বলল। ঢাকা গেলাম যে গত সপ্তাহে, ঐ দিনের কথা। আমি গিয়া দেখি ওখানে কেউ নাই। ঘটনা বুঝলাম না।”
“কেউ নাই মানে কি?” তোফায়েলের দিকে মুখ ঘোরাতে গিয়ে তার গালে ইলোরার গাল ঘষে গেলো।
“বুঝলাম না সেটাই। পুরা পরিস্কার দেখলাম বাড়িটা। কারও কোনো চিহ্ন নাই।” পেছনে একবার তাকিয়ে মাঝিকে দেখে নিলো তোফায়েল, “গোপন একটা মিটিং ছিল। বিরোধীদলের এক ইনফর্মার আমাদের কিছু ইনফরমেশন শেয়ার করতে রাজি হইছিলো। রেদোয়ানের খালার বাড়ির বেজমেন্টে মিটিং ঠিক করলাম আমরা। খালা সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া থাকেন, কারও জানার কথা না যে ওখানে আমরা দেখা করতেছি। এর মধ্যে রেদোয়ানের কি হইলো বুঝলাম না।”
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসি খালার বাড়ির চাবি রেদোয়ানের হাতে থাকতেই পারে। কিন্তু তোফায়েল সেই বাড়িতে ঢুকে ‘সবকিছু ফাঁকা’ দেখলো কি করে? চাবি পেলো কোথায়? এধরণের প্রশ্ন করে তাকে বিব্রত করলো না ইলোরা। এসব প্রশ্নের উত্তর তার এমনিতেই জানা আছে। ভিডিওগুলো সে দেখেছে। ওসব করার জন্য প্রবাসি আত্মীয়ের পরিত্যক্ত বাড়িই তো দরকার!
গোপন মিটিং তো ছিলই! মনে মনে ভাবলো ইলোরা। গোয়া মাইরা বেড়াইতেছিলা! তবে মুখে বাক্য দুটো উচ্চারণ করার মতো সাহস করতে পারলো না। মুহিবের নিষেধ, কোনোভাবেই এখন তোফায়েলকে চটানো যাবে না। ছেলেটা কি করতে চাইছে কে জানে! তূর্ণার বাসা থেকে বের হয়ে আসার পর থেকে সবকিছু থেকে ওদের অফিশিয়ালি অব্যহতি দিয়েছে।
“আজকের পর থেকে শামসভাইয়ের কেসটায় তোরা আর কেউ সরাসরি ইনভলভড হবি না।” ভিডিওটা দেখার পর মুহিব বলেছিলো, “এটা খুব বেশি সেনসিটিভ। যতো কম লোক কাজ করবে ততোই ভালো।”
শামীম যথারীতি গোয়ারের মতো গাঁ-গাঁ করে উঠেছিলো, “আর কাজ করার জন্য তুই কিভাবে নির্বাচিত হলি? আমি নই কেন? ইলোরা কেন নয়?”
একটা মাত্র বাক্যে তার মুখ থামিয়ে দিয়েছিলো মুহিব, “এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গেলে মাথাটা কার কাটা পড়বে শুনি? তোর, না ইলোরার? সেই রাতে সাক্ষী ছিল কে জানি? আমার মাথার নিরাপত্তার দায়িত্ব তোকে বা ইলোরাকে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারবো না।”
অকাট্য যুক্তি। এর ওপর কথা বলার উপায় ওদের ছিল না। মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে ইলোরার, তবে শামীমের মুখের দিকে তাকিয়ে সে মেনে নিয়েছে। শামীম যে গোঁয়ার, সে-ই যখন ফুঁসতে ফুঁসতে মেনে নিলো তখন আর প্রতিবাদ করে লাভ কি? মুহিব এর পর আর কোনো অভিযানে গিয়েছে কি না তা ওরা জানে না। শিয়ার সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ নেই। রেদোয়ানের হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে শামস মার্ডারের কোনো যোগসূত্র আছে কি না তাও ইলোরা জানে না। তার জানার বিশেষ ইচ্ছেও নেই। ছেলেগুলোর ওপর অসম্ভব বিরক্ত সে।
মুহিব তাকে জেনেশুনে একটা খুনি-ধর্ষকের সঙ্গে ঘোরাফেরা করার অনুরোধ করলো কি করে? ইলোরার মাঝে মাঝে এতো রাগ হয়! সেদিন তাকে আরও বেশি মারা উচিত ছিল। বাকিটা মনে পড়তে খোলা নদীর বুকে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো ইলোরা। তোফায়েল এখনও তার কাঁধে থুতনি ঘষছে, সে এসবের কিছুই খেয়াল করলো না। ক্ষতিপূরণ হিসেবেই হয়তো, খুনিটার হাতের ওপর আবারও হাত বুলিয়ে দিলো ইলোরা।
তোফায়েল এখনও কি কি নিয়ে যেন কথা বলে যাচ্ছে, তার কথায় মন ছিল না ইলোরার। চরের কাশফুলগুলো এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নৌকা ধীরে ধীরে চরের দিকে যাবে এখন। তোফায়েল এই ধরণের ঘোরাঘুরি ইদানিং রুটিন মেনে করছে। বাইকে করে ওকে হল থেকে নিয়ে আসে। নদীর পাড়ে এসে নৌকা ভাড়া করে। চরে নেমে ওর শরীরের জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘টেপাটেপি’র জন্য নদীর ছই খুব একটা প্রাইভেট না বলে দাবি করেছিলো প্রথমদিন, সেই থেকে চালাচ্ছে। এখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে তাকে যেতে দেয়নি ইলোরা। চার দেওয়ালের ভেতর যে কোনো ধরণের ডেট বাদ দিয়েছে।
মুহিব পুরোটাই শুনেছে সে রাতে, তারপরও ওকে ধৈর্য ধরতে বলেছে সে। বলেছে আর কয়েকটা দিন এমনটা চালিয়ে যেতে। ইলোরা জানে না বেশিদিন সে চালাতে পারবে কি না! চরের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। আরও কাছে চলে এসেছে কাশফুলগুলো। আর কিছুক্ষণ পর ওখানে নামতে হবে ভাবতেই রোমকূপগুলোয় ঘৃণার তীব্রতা বেড়ে গেলো।
*
ছোট্ট বাইনোকুলারটা চোখ থেকে নামিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখলো মুহিব। হাতের সিগারেটের ফিল্টারটা পকেট থেকে বের করে আনা প্যাকেটের মধ্যেই ফেললো। সিগারেট আর তার ফিল্টার নিয়ে মাত্র কয়েক মাস আগেই বেশ জঘন্য অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে তার। এই অভিজ্ঞতার পূণরাবৃত্তি আর ঘটবে না। দুটো প্যাকেট নিয়ে এখানে সময় কাটিয়েছে সে। একটা প্যাকেটে সিগারেট রেখেছে, আরেক প্যাকেটকে করেছে অ্যাশট্রে। একটা ফিল্টারও আজ এখানে ওখানে পড়ে থাকবে না।
আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ঘন কাশবনের ভেতর ঢুকে গেলো মুহিব। কাশবনের ভেতর খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। চরের কাশবনে চলার সময় কানজোড়াকে অবশ্যই খাড়া করে রাখা লাগবে। নারীকণ্ঠের শীৎকার আর পুরুষকণ্ঠের গোঙানি যেদিক থেকে আসবে সেদিকে পা বাড়ানো যাবে না। নয়তো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব নয়। থলথলে পেট আর চর্বির দলা দেখে সপ্তাহখানেকের জন্য চা খাওয়ার রুচি হারাতে হতে পারে।
এমন একটা শীৎকারধ্বনি খানিক বাম থেকে ভেসে এলো। ওটাকে সচেতনভাবে এড়িয়ে এগিয়ে গেলো মুহিব। কাশবনের মাঝে এসে দাঁড়ালে মনে হয় শুরু আছে, শেষ নেই। স্থানে স্থানে উঁচুনিচু ভূমি। চরের জমি নিয়েও মারামারি করে স্থানীয়রা। অনেকটা দূরে গিয়ে কাশবন শেষ, ফসলের জমি শুরু। স্থায়ী চরে চাষবাস ভালোই হয়। মফস্বল শহরটির খাদ্যচাহিদা সম্পূর্ণভাবে মেটাতে সক্ষম এই এক চর। বর্ডার বেশি দূরে না হওয়ায় গাঁজার গুদামও আছে এখানে। চরের চারপাশে পানিতে স্পিডবোট নিয়ে বিজিবি টহল দিলেও, ডাঙায় গাঁজার ভাণ্ডার সম্পূর্ণ নিরাপদ।
কাশবন ঠেলে চাষের জমির এক প্রান্তে বেরিয়ে এলো মুহিব। খানিক দূরে একটা জটলা। স্থানীয় সাত-আটজন ছেলে গোল হয়ে বসে আছে। উৎকট গন্ধ থেকেই বোঝা গেলো গাঁজা টানছে। মুহিবের দিকে কেউ কেউ তাকালো, তবে বিশেষ গুরুত্ব দিলো না। সরাসরি জটলার দিকে তাকালো না মুহিব, সিগারেটে কয়েকবার জোরে জোরে টান দিয়ে সরে এলো ওখান থেকে।
চাষের জমিগুলো শেষ হয়েছে পাঁচ কিংবা সাতশ’ মিটার সামনে। তার ওপাড়ে আরেকদফা উঠে গেছে কাশবন। বাইনোকুলারটা গলা থেকে তুলে সেদিকে আরেকবার তাকালো মুহিব। তোফায়েল ইলোরার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে, নির্জনতার দিকে একটা মেয়েকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তটা ছাত্রনেতা উপভোগ করছে তা মুহিবের বাইনোকুলারেও পরিস্কার দেখা গেলো। চকচকে ধর্ষক-চোখজোড়া শেষবারের মতো দেখে নিলো মুহিব। বাইনোকুলারটা আরও একবার বুকের ওপর ঝুলিয়ে দিয়ে আইল ধরে জমির ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু করলো সে।
অনেকটা দূরে বামদিকে একটা মাচায় কয়েকজন শুয়ে আছে। ফসলের দেখভাল হয়তো তারাই করছে। তাদের নিয়ে মুহিব ভাবছে না, ওকে নিয়েও তারা বিশেষ আগ্রহ দেখালো না-গাঁজাখোরদের মতোই। বাইনোকুলার আর ক্যামেরা ঝোলানো অনেক ছেলেই এদিকে প্রতিদিন আসে। পাখি দেখে নয়তো পাখির ছবি তোলে। দৃশ্যটা এতোই সাধারণ আর পুরাতন, বাড়তি মনোযোগের যোগ্য বলে স্থানীয়রা মনে করছে না। মুহিব অবশ্য এমনটাই আশা করেছিলো। এর আগেও তিনদিন চরে এসেছে সে, তোফায়েল আর ইলোরাকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। ইলোরার শরীরে তখন হয়তো পড়েছে নতুন নতুন দাগ, তবে এটুকু মুহিবকে মেনে নিতে হয়েছে।
আগুন না নিভিয়েই সিগারেটের গোড়াটা ‘অ্যাশট্রে প্যাকেটে’ ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে দিলো মুহিব। ভেতরের অক্সিজেন শেষ হয়ে গেলে এমনিতেও নিভে যাবে। তাড়াহুড়ো না করে আরেকটা সিগারেট বের করলো তারপর।
“এগুলো কোনো ব্যাপার না।” নিজেকেই শোনালো যেন।
কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই আইল বেয়ে ওপাশের কাশবনে পৌছে গেলো সে। মুহিব যখন চাষের জমির মাঝখানে আইল ধরে হাঁটছিলো, তোফায়েল-ইলোরা ওপাড়ের কাশবনে ঢুকে পড়েছে। তাদের খুঁজে বের করার জন্য ব্যস্ত হলো না মুহিব। কাশবনের সামনে দাঁড়িয়ে শান্তভঙ্গিতে সিগারেটটা শেষ করলো সে, তারপর ফিল্টারটা যত্ন করে রেখে দিলো ‘অ্যাশট্রে প্যাকেট’-এর ভেতর।
দুলকি চালে হেঁটে কাশবনের ভেতর ঢুকলো তারপর। মুহিব জানে, কোনদিকে যেতে হবে। গত তিনদিনই ওরা এদিকে এসেছে। গন্তব্যের দিকে আরও কয়েক পা এগিয়ে যেতে শুনতে পেলো ইলোরার কামার্ত চাপা চিৎকার। কিছুটা যন্ত্রণাও মিশে আছে যেন তাতে।
ওদিকে কাশবনের একটা অংশে আলোড়ন উঠছে
আরও কাছে চলে এসেছে এখন মুহিব। দু’জন মানুষের হাঁফানোর শব্দ ও শুনতে পেলো এবার। মৃদু ধ্বস্তাধ্বস্তি হচ্ছে কাশবনের ভেতর। আলোড়নটা বেড়েছে কিছুটা। শেষ ক’টা কাশফুলের পর্দা পার করে জায়গাটার মাঝে এসে থামলো মুহিব।
তোফায়েল ইলোরাকে মাটির সঙ্গে চেপে রেখেছে, পাগলের মতো মেয়েটিকে চুমু খাচ্ছে সে। চুমুর চেয়ে বেশি খাচ্ছে কামড়। ইলোরার ওপরের ঠোঁট কেটে ফেলেছে এরই মধ্যে, রক্তের ছাপ মুহিব পরিস্কার দেখতে পেলো। লম্পট ছাত্রনেতার এক হাত মুহিবের সবচেয়ে কাছের বান্ধবির উরুসন্ধিতে, অপর হাতটা মেয়েটার বুকের ওপর যেন আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে।
“ডু ইট, র্যাড!” ভরাট গলায় বলে উঠলো মুহিব।
ধ্বস্তাধ্বস্তি থেমে গেলো। কাশবনের আলোড়ন স্তিমিত হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। ইলোরার ওপর থেকেই মুখ ঘুরিয়ে মুহিবের দিকে তাকালো ছাত্রনেতা। পুরো দৃশ্যটা বোঝার জন্য তার সময় লাগলো ঝাড়া পাঁচ সেকেন্ড, তারপর গত একটা বছর যেন সূর্যস্নাত দিনের মতোই ফকফকা হয়ে উঠলো তার কাছে। সব অজানা প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিয়েছে মুহিবের উদ্ধৃত বাক্যটা। ইলোরা যখন ছাত্রনেতাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে নিজের শরীর থেকে নামিয়ে দিচ্ছে, তখনও বিহ্বলের মতো মুহিবের দিতে তাকিয়ে ছিল সে।
দুই পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ এক ছাত্র, যাকে সে নিজের ক্ষমতাবলে সরকারি হলে উঠতে দেয়নি। ঈর্ষার বিষে জড়িয়ে যাকে সে পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গিয়ে ছুরি মেরেছে। সাধারণ এই ছাত্রটিকে তোফায়েল কখনোই হুমকি বলে মনে করেনি। সাধারণ সেই ছাত্রটির ছড়ানো পা আর একই সরলরেখায় ডান হাতে ধরে থাকা বিম্রিদর্শন পিস্তলটা তার ‘সাধারণ’ পরিচয়টিকে নাকচ করে দিচ্ছে। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ছেলেটির মুখে কয়েক সপ্তাহ পুরোনো কিছু ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট দেখা যায়।
“তুমি!” অবিশ্বাস ভরা গলায় বলে উঠলো তোফায়েল, “সেই রাতে–”
“আমিই। শামসভাইকে আপনারা আমারই চোখের সামনে খুন করেছিলেন।” মিষ্টি হাসিতে ভরে গেলো মুহিবের মুখ, ট্রিগারে চেপে বসছে আঙুল, “প্রকৃতি আজ ভারসাম্য রক্ষা করবে। এটা শামসভাইয়ের জন্য।”
ইলোরা তখনও হামাগুড়ি দিয়ে তোফায়েলের শরীর থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে, খপ করে ওর একটা হাত ধরে ফেললো ছাত্রনেতা। চমকের প্রথম ধাক্কাটা কেটে যেতেই করণীয় ঠিক করে ফেলেছে সে। এই মুহূর্তে মেয়েটিকে টেনে নিজের শরীরের ওপর নিয়ে আসার চেষ্টা করছে, মানব-বর্মের পেছনে থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা।
তার থেকে কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে ছিল মুহিব। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ট্রিগার টেনে ধরলো সে।
কানে তালা ধরানো শব্দে গুলি বেরিয়ে গেলো পিস্তল থেকে। একবার, দুইবার, অসংখ্যবার।
ম্যাগাজিনের রাউন্ডগুলো ফুরিয়ে যেতে স্লাইড ছিটকে গেলো একসময়।
নিস্তব্ধতা নেমে এলো চরের বুকে, এক সেকেন্ডের জন্য। তারপর ইলোরার গগণবিদারী চিৎকার ভেঙে দিলো সেই নীরবতা। সাদা জামার এখানে ওখানে মেখে গেছে তোফায়েলের রক্ত, মুখের ওপর স্প্রের মতো ছিটকে গেছে খানিকটা। আটটা বুলেট চরের মাটিতে একেবারে গেঁথে ফেলেছে প্রতাপশালী ছাত্রনেতাকে। এখনও বাম হাতটা ধীরে ধীরে নড়ছে তার।
গোঙানির ফাঁকে কেবল বলতে পারলো, “পানি!”
এই একটা শব্দ উচ্চারণ করতে তোফায়েলকে যেন সর্বশক্তি খরচ করতে হলো। ইলোরার চিৎকারের ফাঁকে কোনোমতে শোনা গেলো আর্তনাদটুকু।
পেছনে কাশবনের বাইরে চাষের জমি থেকে নতুন এক ধরণের হট্টগোল শোনা যায়। এদিকেই ছুটে আসছে চরের বাসিন্দারা। মুহিবের মনের পর্দায় চর অধিবাসিদের নিয়ে যতো ভয়ানক বর্ণনা পড়েছে জীবনে, সব ভেসে ওঠার কথা ছিল। তবে তেমন কিছু ঘটলো না আজ। সদ্য উদ্ভুত হট্টগোলটা তাকে স্পর্শই করছে না যেন। সহজাত শান্ত ভঙ্গিতে ম্যাগাজিন রিলিজ করে শার্টের ভেতরের শোল্ডার হোলস্টার থেকে আরেকটা বের করে নিলো। সেমি–অটোমেটিকটা রিলোড হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুপথযাত্রী ছাত্রনেতার দিকে আরও একবার অস্ত্রটা তাক করলো মুহিব। দস্তনাজোড়ায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছিলো তখন।
ইলোরার চিৎকার আর পেছনের জমির হট্টগোল, দুটোই থেমে গেলো পিস্তলের বেসুরো গর্জনে। অষ্টমবারের মতো হাতের তালুয় পিস্তলটার ধাক্কা অনুভব করতেই নড়ে উঠলো মুহিব। স্লাইডটা বেরিয়ে যাওয়ার আগেই ছুটতে শুরু করেছে কাশবন ভেঙে সামনের দিকে।
নতুন করে পাওয়া গুলির শব্দের সঙ্গে পেছনের হট্টগোল দশ সেকেন্ডের মতো থেমে গিয়েছিলো, টলে উঠেছিলো চরের বীরপুরুষদের সাহসিকতা। তবে গুলির শব্দ থেমে যেতে আরও একবার গর্জে উঠলো ওরা। পাতলা জ্যাকেটে ঢেকে রাখা শোল্ডার হোলস্টারে তখন পিস্তলটা গুঁজে নিচ্ছে মুহিব। দৌড়ের তালে তালে তার গলায় ঝুলে থাকা বাইনোকুলারজোড়া প্রবল বাতাসে অবাধ্য কাশফুলের মতোই লাফাচ্ছে। কোমরের কাছে আটকে থাকা ক্যাপটা মাথায় চাপাতে চাপাতে চরের উঁচুনিচু জমি ধরে প্রাণপণে ছুটতে থাকলো মুহিব।
স্পিডবোটটা একেবারে চরের সঙ্গে লেগে ছিল, অস্ত্রসহ সরাসরি ওটার গায়েই আছড়ে পড়লো মুহিব। বোটের পাশে বড় করে লাল কালিতে লিখা নামটা পড়তে পারলো অনায়াসে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি)।