কুকুরদল – ৫৪

অধ্যায় ৫৪

কমনরুমের ভেতর হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন প্রফেসর রবিন। সহকর্মিরা তাকে কিছু একটা বলছে, তাদের কোনো কথাই নিজের কানে ঢুকছে বলে তার মনে হলো না। শাহাবুজ্জামানকে স্পষ্টই দেখলেন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে তার দিকে একবার তাকাতে। ওদিকে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে লোকটা। মুখ নড়ছে সমান তালে, মনে হয় পান খাচ্ছে।

“আমরা দুঃখিত।” মনির বলল। এই একটা কথাই অনেকক্ষণ পর কানে এলো যেন তার।

“হেড স্যারের সাথে এটা নিয়ে কথা বলেছিলাম আমরা। লাভ হচ্ছে না। উনি এটা এভাবেই খেলতে চাইছেন।” বিষণ্ন মুখে নীতু বলল।

মাথা দোলালেন প্রফেসর, “ফাইন। এটা নিয়ে তোমাদের কিছু করার নেই। আমি দেখছি বিষয়টা।”

ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন প্রফেসর রবিন জামান খান। অবশেষে আলোচনাটা শুরু হয়েছে। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি কি লড়াইটা চালিয়ে যাবেন না সরে যাবেন চুপচাপ। হাতঘড়িটা চোখের সামনে নিয়ে একবার দেখলেন, দশটা পঞ্চাশ বাজে প্রায়। একটু পর ওয়ান-থ্রির সঙ্গে একটা ক্লাস ছিল। সেই ক্লাস নিয়ে ভাবার প্রয়োজনীয়তা আজ ফুরিয়েছে।

এই মুহূর্তে প্রফেসর রবিন বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন প্রাক্তন শিক্ষক।

উপাধ্যক্ষ একটু আগে তার চাকরিটা খেয়েছেন।

বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু এটা ছিল না অবশ্যই। ছাত্রদের আন্দোলনের পর থেকেই টিচার্স কমিউনিটির রাঘব বোয়ালরা তার ওপর বিরক্ত। এরপর তিনি বাকিদের সুরে সুর মেলাননি। ছাত্রদের টাইট দেওয়ার মতো যে কয়টি নতুন নীতি নির্ধারিত হয়েছে তাদের একটাও তিনি মেনে চলেননি। এতোদিন চলাফেরাও করেছেন দাপটের সঙ্গে, যেন এই চাকরির থোরাই কেয়ার করেন। কতোবার কতো সিনিয়র শিক্ষকের মুখের ওপর তাদের ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছেন, অনেকেই

অনেকেই অপমানিত বোধ করেছেন এসব ঘটনায়। শাহাবুজ্জামানসহ আরও ডজনখানেক শিক্ষকের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হয়েছে শুধুমাত্র তার জন্য। ওদের গ্রুপটাকে অনায়াসে অ্যান্টি-প্রফেসর-রবিন গোত্র বলে চালিয়ে দেওয়া চলে। উপাধ্যক্ষের সঙ্গে তাদের কেউ না কেউ সব সময়ই প্রফেসরের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন, তবে বাস্তবতাটি সবাই জানে।

একে ওকে বিব্রত করার অপরাধে একজন প্রফেসরের চাকরি চলে যেতে পারে না। তিনি কোনো ধরণের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে নেই, প্রতিটা কাজ সময়ের মধ্যেই শেষ করে দেন, এমনকি তার বিরুদ্ধে ছাত্রিকে ধর্ষণের অভিযোগটা পর্যন্ত নেই। এমন একটা মানুষকে প্রশাসনে ঢুকিয়ে ফেলার পর তাকে আর বের করে দেওয়া চলে না। এতো অল্প সময়ের ব্যবধানে তো নয়ই। অথচ একটা মহল গত দেড় দুই মাস ধরে রাত দিন এক করে এই কাজটা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা কোনোদিন সফল হতে পারবে বলে তিনি মনে করেননি। অথচ তাই হলো, ওরা হাড়ির খবর বের করে ফেললো কি করে?

শাহাবুজ্জামানের ফোনে কথা বলা মনে হয় শেষ হয়েছে। চেয়ার ঠেলে এদিকেই আসছে চালিয়াত ধরণের মানুষটা। প্রফেসর রবিনের দু-হাত সামনে এসে থামলো সে, থমথমে মুখ। একটু আগের হাসিটা নিখুঁতভাবে লুকিয়ে ফেলেছে গম্ভির মুখখানার আড়ালে।

“তাহলে, এই ব্যাপার!” মুখ বাঁকিয়ে বলল সে, “দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আপনার কথা বার্তা শুনেই আমার বোঝা উচিত ছিল আসলে। এই দেশে কি করতে এসেছেন? গুপ্তচরগিরি? কাদের হয়ে কাজ করছেন বলেন তো? সিআইএ?”

একটা প্রশ্নেরও উত্তর না দিয়ে থমথমে মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন প্রফেসর রবিন।

“এখন আর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছেন না যে বড়ো? শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না? ডিকশনারি এনে দেবো?”

মনির এগিয়ে এলো রক্ষাকারীর ভূমিকায়, “স্যার, প্লিজ, পরিবেশটা নষ্ট করবেন না।”

তাকে হাত উড়িয়ে বাতিল করে দিলো শাহাবুজ্জামান, আজ বাগে পেয়েছে প্রতিপক্ষকে। ”চামচাদের দিয়ে নিজেকে ঢাকছেন। সাবাশ। যতো গর্জে ততো বর্ষে না। কোথায় আপনার দেশপ্রেমের বুলি? সঠিক আর ভুলের ওপর কতো লেকচার যে এই ঘরে বসে দিয়েছেন। আপনি তো নিজেই গালাদ। ছি ছি, মুসলমানের সন্তান হয়ে আপনি…..”

“একচুল নড়লেন না প্রফেসর রবিন। মুখ এখনও শ্রাবণের মেঘের মতোই থমথমে। দৃঢ় গলায় শাহাবুজ্জামানের প্রশ্নটার সমাপ্তি টানলেন তিনি, “ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। সো হোয়াট?”

হাকারবিনের নির্লজ্জ স্বীকারোক্তি শুনে দূরে বসে থাকা প্রবীণ অধ্যাপক হামিদুর রহমান মুখে হাত চাপা দিলেন। তাকে পাত্তাও দিলেন না প্রফেসর রবিন। চেয়ার টেনে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, সামনে বাড়িয়ে দিয়েছেন অক্ষত হাতটা। শাহাবুজ্জামানের নাকের সামনে।

দেখতে চান? দেখে নিন প্রাণভরে।” চাপা স্বরে বললেন হাকারবিন, “ইয়েস, এই হাত দিয়েই তিনজন ইরাকিকে গুলি করে মেরেছি আমি। তারিখটা শুনতে চান? ২৩শে নভেম্বর, ২০০৬।

যে যার জায়গায় থমকে দাঁড়ালো ঘরে উপস্থিত সবাই। মনিরও কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। হাকারবিনের চোখ জ্বলছে নিশাচর প্রাণিদের মতো। বলে চললেন তিনি, “বাংলাদেশিদের সেন্টিমেন্ট আমি খুব ভালো মতো জানি, খুব ভালো মতো করে। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ চিন্তাটা মস্তিষ্ক দিয়ে করে না, করে ‘ইয়োটা দিয়ে।” প্রফেসর খুব নোংরা একটা শব্দ উচ্চারণ করলেন, “২০০১ সালে যখন টুইন টাওয়ার ভাঙলো, এই দেশে অনেক মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলো। তারা মাথায় পাগড়ি পেঁচিয়ে স্লোগান দিয়েছিলো ‘বাংলা হইবো তালেবান, আমরা হবো আফগান’। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভাঙার কারণে মারা গেছিলো তিন হাজার মানুষ। আহত ছিল ছয় হাজার। এই তিন হাজারের মধ্যে বাংলাদেশি মারা যান ৫০ জন। অথচ বাংলাদেশে অনেক বড় একটা গোষ্ঠি আজও মনে করে আমেরিকার টুইন টাওয়ার ভেঙে দেওয়াটা খুব চমৎকার একটা কাজ হয়েছে। তারা এই নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই তাদের মুখ হাসি হাসি হয়ে যায়, চোখে থাকে গর্ব। তারা মনে করে ওই সন্ত্রাসী হামলাটি চালিয়ে আমেরিকাকে ‘দেখিয়ে’ দেওয়া গেছে। তিন হাজার খেটে খাওয়া মানুষের লাশ তাদের চোখ এড়িয়ে যায়! লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে এটা, শাহাবুজ্জামান, এটা। আমার ইরাকি মারার গল্পটা গর্বের। নাথিং টু বি অ্যাশেইমড অফ।”

“আপনি তাহলে সত্যিই ইউএস আর্মির সাথে ছিলেন?” নীতুর কণ্ঠে অবিশ্বাস।

“অবশ্যই। আমার চাকরিটা খাচ্ছে এখন, দেখতে পারছো না?” গম্ভির মুখেও এক চিলতে হাসি দেখা গেলো এবার, “তথ্য গোপন করার অভিযোগে!” টেবিলে থাবা দিয়ে উঠলেন তিনি, “অবশ্যই তথ্য গোপন করেছি। এই দেশে কয়টা মানুষ সঠিক আর ভুল বোঝে? এরা শুধু বোঝে মুসলমান, হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান আর নাস্তিক। গবেটের দল।”

“আপনার হাতটা…?” মনির প্রশ্নটা শেষ করতে পারলো না, কেমন যেন সঙ্কোচ হলো।

“ওইদিনই গেছিলো। ২৩শে নভেম্বর, দুই হাজার ছয়। অসংখ্য রিপোর্ট আছে, নেটে সার্ফ করলেও পাবে। অনেক নিউজ মিডিয়ায় সেদিনের শিরোনাম করেছিলো আ ডে ইন হেল। আইইডি মানে কি, বোঝো?”

“ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস।” হলিউডি মুভি দেখে দেখে এই বোমাগুলো সম্পর্কে জানতে বাকি নেই মনিরের।

“কারেক্ট। গৃহস্থালী জিনিসপাতি দিয়েই বোমা বানিয়ে ফেলতো ওরা। এমন সব জিনিস দিয়ে, যাদের সুপারমার্কেটে কিনতে পাওয়া যায়। অথবা, যোগাড় করে নেওয়া চলে। অ্যাসিটোন পারঅক্সাইড, গানপাউডার, বাথরুম ক্লিনার, কারেন্টের তার, ঘড়ির ব্যাটারি এমন কিছু নাই এইসবে ব্যবহার করা বাকি রেখেছিলো ইরাকিরা। আমেরিকান সৈনিকদের যারা ইরাকে নিহত হয়েছিলো তাদের পঁয়ষট্টিভাগই মারা গেছিলো এসব আইইডির কারণে। আমরা এদের বলতাম দ্য ডেভিল’স মাদার। হাইলি আনস্টেবল। হাইলি।” ধীরে ধীরে আগের চেয়ারটায় বসে পড়লেন প্রফেসর রবিন।

শামসুজ্জামান থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। তার বিস্মিত চোখের সামনেই প্রফেসর রবিনকে ঘিরে একটা ভিড় জমে উঠলো। সবাই তাকে কেন্দ্ৰ করে টেবিলের চারপাশে বসে পড়তে শুরু করেছে। নিজের অতীতের এই দিকটা নিয়ে মানুষটা আজকের আগে একবারও মুখ খোলেনি। চেপে রাখা রহস্যময় ঘটনাগুলো জানার জন্য এই ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকেই নিজেদের একটা কিডনি বিসর্জন দিতে পারে। এমনকি সেই দলে শাহাবুজ্জামানও পড়ে, যদিও স্বীকার করবে না।

“আর্মিতে এই একটা কারণেই আমার জায়গা হয়েছিলো।” অযথাই স্পাইক করা চুলে একবার হাত বোলালেন, “যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আমি গিয়ে অ্যাকাডেমিতে নাম লিখাইনি। তখন আমি ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটায় গবেষণা করছি, ডক্টরেটটা সেরে ফেলাই আমার জীবনের ধ্যানজ্ঞান। ইরাকের যুদ্ধ নিয়ে কথা হতো প্রতিটা আড্ডায়, চায়ের কাপে ঝড় উঠতো, তবে আর্মিতে যোগ দিয়ে যুদ্ধে যাবে? এমন রিসার্চার আমি তেমন দেখিনি। আমি তো হাফ-আমেরিকান, ফুলগুলোও তেমন আগ্রহ দেখায়নি কখনও। আমাদের বয়সও সৈনিক হওয়ার তুলনায় বড় বেশি ছিল অবশ্য।”

মনিরের প্রশ্নবোধক দৃষ্টির অর্থটা তিনি ঠিক ঠিক ধরে নিলেন, “আমার মা নিউ ইয়র্কে থাকতেন। তিনি একজন খাঁটি আমেরিকান, মানে যদি তেমনটা কাউকে বলা চলে আরকি। নানা-নানীর মতো আমার মাও জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিক। বাবার সাথে মায়ের ডিভোর্সটা হয়েছিলো অনেক অনেক আগে। আমার তখন পাঁচ কি ছয় বছর বয়স। বাবা আমাকে নিয়ে ফিরে এসেছিলেন দেশে, আমি এখানেই পড়াশোনা করে গেলাম। এই ভার্সিটি থেকে পাশ করলাম বিএসসি, কোনোদিনও আশা করিনি এখানে শিক্ষক হতে পারবো।” এবার সত্যিকারের একটা হাসি ফুটলো তার মুখে, “আমার পজিশন ছিল ডিপার্টমেন্টে একশ ছয় তম। মানে, শেষের দিক থেকে চৌদ্দ।”

ফোঁৎ জাতীয় একটা শব্দ করলেন শাহাবুজ্জামান। ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হয়ে তিনি কি এমন অর্জন করতে পেরেছেন তা ভেবে দেখার বৃথা চেষ্টা করলেন হয়তো। তবে তার নাক থেকে বেরিয়ে আসা বিদঘুটে শব্দ প্রফেসর রবিনকে মোটেও বিচলিত করতে পারলো না।

“অনেক বন্ধু হায়ার স্টাডিজের জন্য বাইরে চলে যেতে চাইলো। ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। দিনে বারো ঘণ্টা করে কাজ করবো আর মাস শেষে পঁচিশ-ত্রিশ হাজার টাকা বেতন? ছোহ। কয়লাখনির শ্রমিকদের বেতন এর চেয়ে বেশি, পরিশ্রমও ঢের কম। তবে তো কয়লাশ্রমিক হলেই পারতাম। মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দরকার কি ছিল? বলছি না পরিশ্রমটা খারাপ, কিন্তু সেই অনুপাতে টাকা দেবে না কেন অথরিটি? যাক সেসব কথা, সব মিলিয়ে আমি আমার ইউএস সিটিজেন কার্ড খেলার কথা ভাবতে শুরু করেছি তখন। আমেরিকা আমারও দেশ। ওখানেই আমি জন্মেছি, আমার মা আমেরিকান। মাকে খুঁজে বের করতে হলো একটু কষ্ট করে, বাবা সম্পর্ক একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলেন।”

শ্রোতারা সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছে। তাদের মুখগুলো একবার দেখে নিলেন হাকারবিন। এদের কেউ তার আমেরিকান নাগরিকত্ব বা ইরাক যুদ্ধের অবদান নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। শুভানুধ্যায়ী হিসেবে পছন্দের একজনের জীবনের অংশবিশেষ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছে কেবল। তবে শাহাবুজ্জামান আর হামিদুর রহমান তার দিকে ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছে।

“মাকে খুঁজে বের করলাম। সফটওয়ার ফার্ম খুলে ফেলেছে ততোদিনে মা আর তার প্রেমিক। মোট দশ না বারোজন মিলে, বেশ ভালো আয় হয় ওখানে। ওরা আমাকে আমন্ত্রণই জানালো চলে আসার জন্য। আমিও উড়ে গেলাম, ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম, টিউশন ফি নিয়েও আমার ভাবনা ছিল না। রীতিমতো গবেষক হয়ে গেলাম। কিন্তু সমস্যাটা হলো ওখানেই, আমার কাজটাকে আমি ভালোবাসতাম। এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট বনে গেলাম কয়েক মাসের মধ্যে। আমার কিছু ভালো ভালো রিসার্চ আছে ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভের ওপর, কে জানতো এটাই পরে আমার জন্য কাল হবে! এরমধ্যে ইরাকের যুদ্ধ বেঁধে গেলো, আমার ডক্টরেটও শেষ হলো ঠিকমতো। রিসার্চ ফ্যাসিলিটি আছে একটা ম্যাসাচুয়েটস-এ। ওখানে মিলিটারি পারপাসে কিছু বিজ্ঞানী সব সময় কাজ করেন। আমার রেপুটেশন অনায়াসে ওখানে আমার জায়গা করে দিলো। ভালো বেতন, ব্লন্ড গার্লফ্রেন্ড, অবিবাহিত জীবন, আমার জন্য তখন সব ঠিকঠাক চলছে।”

প্রফেসরের এই বর্ণনায় জুনিয়র শিক্ষকদের দলটার সবাই কেমন যেন উদাস হয়ে গেলো।

“ততোদিনে দুই-আড়াই বছর ধরে আমেরিকান সৈনিকেরা ইরাকে গিয়ে যুদ্ধ করছে, আর প্রাণ হারাচ্ছে। আমাদের বেশিরভাগ সৈন্য মারা গেলো আইইডিতে। কোনো কোনোটা তার দিয়ে ডেটোনেট করা হচ্ছে, কোনোটা রিমোট সিগন্যালে, মোবাইল ফোন কলের মাধ্যমে। কতো রকম ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ যে বানানো সম্ভব, আর কতোভাবে যে তাদের ডেটোনেশন সম্ভব আমি ইরাকে গিয়ে দেখেছি। একদিন আমাদের ফ্যাসিলিটিতে এসে উপস্থিত হলেন ইউএস আর্মির একজন মেজর। তিনি তখন আইইডি এক্সপার্টদের সাথে কথা বলে বেড়াচ্ছেন দেশব্যাপী। আমার সাথে দেখা করলেন। উনার সাথে এক মিনিট কথা বলেই বুঝতে পারলাম আমার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা শেষ তাদের। ইরাক ক্রাইসিস নিয়ে কথা ওঠাতে তিনি সময় নিলেন দুই মিনিট, তারপর আমাকে প্রস্তাবটা দিলেন সাত মিনিটের মাথায়। ওখানে এক্সপ্লোসিভ ক্রাইসিসটা খুব জটিল হয়ে গেছিলো তখন। সরেজমিনে না দেখলে এক্সপার্টদের ছবি দিয়ে বোঝানো সময়সাপেক্ষ বটে, আর সময়টা ইউএস গভর্নমেন্টের ছিল না। দেশপ্রেমে টইটম্বুর আমি তাকে ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম সম্ভবত আলোচনা শুরুর সাড়ে আট মিনিট পার হওয়ার আগেই।”

“দ্যাট’স ইট?” নীতুর চোয়াল ঝুলে পড়লো।

“অবশ্যই। অনেক হিসাব নিকেশ করে যুদ্ধে যেতে যারা চায় তাদের কেউ আসলে যুদ্ধে যেতে পারে না। যুদ্ধ এমন একটা জিনিস, যেখানে যেতে হলে তোমাকে হুট করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মাসব্যাপী পরিকল্পনা করে সিভিলিয়ানের যুদ্ধ হয় না।”

টেবিল ঘিরে থাকা অনেকেই মাথা দোলালো বিজ্ঞের মতো। যেন একেকজন কয়েকটা করে যুদ্ধে গেছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হোক আর রিকশাওয়ালা, এই দেশের সবাই যুদ্ধের প্রসঙ্গ আসলে মাথা এভাবেই দোলায়, বিজ্ঞের মতো। পূর্বপুরুষের যুদ্ধের গৌরব নিজেদের জীবনে এনে কল্পনা করে বীর হয়। অবশ্য পূর্বপুরুষের বিক্রম নিজের মনে করার প্রবণতাটা একেবারে অমূলক বলা যায় না, কোটার ব্যবস্থা যেহেতু নাতি-নাতনীর জন্যও রাখা হয়েছে।

“বেতন হয়ে গেছিলো রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে যা পাচ্ছিলাম তার তিনগুণ, আপত্তি করার কিছু ছিল না। তার ওপর আছে দেশকে সেবা করার সুযোগ। বাংলাদেশে দেশের সেবা করার কনসেপ্টটা বেশি মধুর ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই দেশে আমার সেবার মূল্যায়ন কেউ করেনি। ভার্সিটিতে পড়ার সময় আমি ড্রেনেজ সিস্টেম ক্লিন রাখার একটা ডিজাইন দিয়েছিলাম। ‘বাস্কেট–ড্রেনেজ সিস্টেম’ নাম দিয়েছলাম ওটার। খুব সহজ কনসেপ্ট, রাস্তা থেকে ফেলে দেওয়া জিনিস ড্রেনে পড়ে ভেসে চলে যায়। বর্ষাকালে ঠেলাটা আমরা বুঝতে পারি ঠিকঠাক। কিন্তু যদি কোনো জায়গায় ড্রেনে শক্ত ময়লা পড়লে সেটা ওখানেই একটা নেটে আটকে যেতো, আর তরলগুলো প্রবাহিত হতো সারা শহরজুড়ে একেবারে নিষ্কাশনের মুখ পর্যন্ত, তবেই কিন্তু আর চুইংগাম থেকে শুরু করে বোতল আটকে থাকে না ড্রেনের তলায়। ওগুলো আটকাবে সব নেট কিংবা বাস্কেটে। মাসে একবার নেট পরিস্কার করলেই খেল খতম। আর নেট পরিস্কার না করলেও কোনো সমস্যা নেই, পানির ফ্লো কখনোই আটকে যাবে না, কারণ সবগুলো সলিড ওয়েস্ট একজায়গায় জড়ো হতে পারছে না কিন্তু। এই মোড়ে দুই কেজি, ঐ মোড়ে তিন কেজি আটকে আছে নেটে, সামনের মোড়ে পাঁচ কেজি জমে ড্রেন আটকে যাচ্ছে না সেজন্যই। বুঝতে পারছো না কনসেপ্টটা?”

মাথা দোলালো সবাই। দারুণ একটা আইডিয়া। এটা প্রয়োগ করা হলে নগরবাসির জীবনযাত্রা অনেকটা সহজ হয়ে আসবে।”পানির নিচে রাস্তা ভালো” সাইনবোর্ডের দরকার আর পড়বে না। পানিঘটিত সব সমস্যা এক নিমেষে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।

“তৎকালীন সড়ক ও জনপথ মন্ত্রীর উপস্থিতিতে একটা আইডিয়া কনটেস্ট হয়েছিলো আমাদের ক্যাম্পাসে সে বছর। ওখানে আমার ডিজাইনসহ আইডিয়াটা প্রেজেন্ট করে আমি ফার্স্টও হলাম। মন্ত্রীসাহেব অনেক ভালো ভালো কথা বলেছিলেন। এটা প্রয়োগের সব ব্যবস্থা করবেন ইত্যাদি। আমি এতো খুশি হয়েছিলাম! মনে হচ্ছিলো একটা সত্যিকারের কাজ করলাম প্রকৌশলী হিসেবে। মেকিং আ ডিফরেন্স। তারপর তো বোঝই, মন্ত্রণালয়ের দু’জন ইঞ্জিনিয়ার আমাকে বললেন এই ডিজাইন প্রয়োগ করা সম্ভব না। অনেক বেশি আনুসঙ্গিক কাজ—দুই বছর লাগবে প্রয়োগ করতেই। তাই তারা ওটা বাতিল করে দিলেন। আর আমার প্রাইজ মানি ছিল পাঁচ হাজার টাকা। আমি ওই খামটা নিয়ে এলাম তৎকালীন হেডের কাছ থেকে। খুলে দেখলাম ভেতরে আছে পাঁচশ টাকা। এই ছিল আমার দেশকে সেবা করতে চাওয়ার প্রতিদান। আর দুই বছরের ঝামেলা দেখিয়ে যে ওরা কাজ করলো না, ওই ঘটনার পর আঠারো বছর পার হয়েছে, ঢাকার রাস্তায় এখন বর্ষাকালে কি হয় আপনারা সবাই জানেন।”

প্রফেসর রবিনের মুখটা এখন দেখাচ্ছে অত্যন্ত দুঃখি একজন মানুষের মতো।

“বাংলাদেশে দেশসেবার মূল্যায়ন না হলেও আমেরিকায় হলো। দুই হাজার ছয়ের এপ্রিলে আমার সংক্ষিপ্ত কমব্যাট ট্রেনিং শেষ হলো। গাট্টিবোঁচকা নিয়ে চলে এলাম ইরাক। আহা, তখন দেশটাকে যদি দেখতে। প্রতিদিন একশ বোমা বিস্ফোরণ। আমার কিছু কাজ আমেরিকান সৈনিকদের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে। কাউন্টার সিগন্যাল পাঠিয়ে ডেটোনেটরের অবস্থান ধরে ফেলার একটা মেকানিজম আমিই আবিষ্কার করি সেখানে। ওটাকে ডিভাইসে রূপ দেন আমার কলিগেরা। যাই হোক, ইরাকের দিনগুলো অনেক বেদনার, অনেক ভাই-ব্রাদার হারিয়েছি আমরা ওখানে। যোদ্ধাদের অনেকের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিলো, বয়েস তখন মাত্র সাতাশ আমার, ওদের অনেকে আমার চেয়ে ছোটো, অনেকে বড়। তবে প্রতিবারই ওরা যখন টহলে বের হতো আমি জানতাম না আর ওই মুখগুলো দেখতে পাবো কি না। অনেক সময় পেতামও না। অস্টিন আর রজার ফ্রাই হয়ে গেলো মসুলে যখন পোস্টিং ছিল আমার। বাংলাদেশের নিরাপদ মাটিতে বসে যুদ্ধে হতাহত শুনে খুশি হতে খুব ভালো লাগে আপনাদের, কিন্তু ওই ছেলেগুলোর বেশিরভাগই হাসিখুশি নগরবাসি। বাবা ডাকপিয়ন, মা স্কুল শিক্ষিকা। সাধারণ ঘরের ছেলে সব। যাই হোক, নভেম্বর এলো।”

বড় করে একটা দম নিলেন প্রফেসর রবিন, “আমি ২৩শে নভেম্বরের কথা মনে করতে চাই না। পরবর্তিতে জানতে পেরেছিলাম ওই একদিনেই ইরাকে ৩৬০টি আক্রমণ প্রতি-আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিলো। একদিনেই মারা গেছিলো ৩১৮ জন। আহতের সংখ্যা ইউএস আর্মির ভাষ্যমতে ৩৭৩ জন।” কাটাহাতের কনুইটা নড়ালেন তিনি, “আমি সেই ৩৭৩ জনের একজন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *