আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৮.৫

পাঁচ

স্তূপাকৃতি বস্তাগুলো থেকে যে তির্যক সান্ধ্য ছায়া এসে পড়েছিল প্ল্যাটফর্মের ওপর, সেখানে লং ওভারকোট আর নরম টুপি পরিহিত ভ্রন্‌স্কি পকেটে হাত ঢুকিয়ে খাঁচায় বন্দী জানোয়ারের মত পায়াচারি করছিলেন—বিশ পা এগিয়ে আবার ঝট করে ফিরছিলেন। কাছে এগিয়ে যেতে কর্নিশেভের মনে হল ভ্রন্‌স্কি তাঁকে দেখতে পেয়েছেন কিন্তু ভান করছেন যে দেখেননি। তাতে কিছু এসে যায় না কজ্‌নিশেভের, ভ্রন্‌স্কির প্রতি কোন ব্যক্তিগত ক্ষোভের ঊর্ধ্বে তিনি।

এই মুহূর্তে কর্নিশেভের চোখে ভ্রন্‌স্কি হলেন বিপুল এক সাধনায় গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, তাঁকে উৎসাহিত ও সমর্থন করা নিজের কর্তব্য বলে ধরেছিলেন তিনি। গেলেন ভ্রন্‌স্কির কাছে।

ভ্রন্‌স্কি থামলেন, কজনিশেভের দিকে তাকিয়ে চিনতে পারলেন তাঁকে, তাঁর দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে সজোরে করমর্দন করলেন।

‘সম্ভবত আমার সাথে দেখা হোক, এটা আপনি চাননি’, বললেন কজ্‌নিশেভ, ‘কিন্তু আপনার কোন উপকারে লাগতে পারি না কি?’

‘এমন কেউ নেই যার সাথে সাক্ষাৎ আমার কাছে এত কম অপ্রতীতিকর মনে হবে’, ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘মাপ করবেন। আমার জীবনে প্রীতিকর আর কিছু নেই।

‘আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি চাইছিলাম আপনার কাজে লাগতে’, ভ্রন্‌স্কির সুস্পষ্ট বেদনার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন কজ্‌নিশেভ; ‘রিস্তিচ কি মলানের কাছে একটা চিঠি দেব কি আপনার জন্যে?’

‘জ্বি না!’ যেন কষ্ট করে কথাটার মানে ধরতে পেরে বললেন ভ্রন্‌স্কি, ‘আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আসুন, হাঁটা যাক। ওয়াগনের ভেতরে বড় গুমোট। চিঠি? না, ধন্যবাদ আপনাকে; মরবার জন্যে কোন সুপারিশ পত্র লাগে না। হয়ত তুর্কীদের কাছে…’ ভ্রন্‌স্কি বললেন শুধু মুখ দিয়ে হেসে, চোখে রয়েই গেল ক্রুদ্ধ-আর্ত ভাবটা।

‘হ্যাঁ, কিন্তু লোকের সাথে সম্পর্কে তো আপনাকে যেতেই হবে, সেটা সহজ হয় যদি লোকটা তৈরি থাকে। তবে আপনার যা অভিরুচি। আপনার সংকল্পের কথা শুনে খুবই আনন্দ হয়েছিল আমার। স্বেচ্ছাসৈদিকদের এত সমাতলোচনা হচ্ছে যে আপনার মত লোক তাতে যোগ দিয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদাই বাড়িয়ে দিচ্ছেন।’

ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘মানুষ হিসেবে আমি এজন্যে ভালো যে নিজের জীবনের কোন দাম নেই আমার কাছে। আর আক্রমণে যাওয়া, খুন করা বা হওয়ার মত দৈহিক উদ্যম আমার যথেষ্ট—এটা আমি জানি। নিজের জীবন দান করার মত একটা উপলক্ষ আছে বলে আমি খুশি। এ জীবনে আমার কোন প্রয়োজন নেই শুধু নয়, আমার কাছে তা ঘৃণ্য। কারো হয়ত আমার জীবনে প্রয়োজন থাকতে পারে’, দাঁতের ক্ষান্তিহীন ব্যথায় স্থির হয়ে তিনি মুখ বিকৃত করলেন, তাঁর উক্তিতে যে ভাব ফুটিয়ে তুলতে চাইছিলেন তিনি, ব্যথাটার দরুন তা পেরে উঠছিলেন না।

‘এই আমি বলে রাখছি, আপনি নবজন্ম লাভ করবেন’, কজ্‌নিশেভ বললেন মর্মস্পৃষ্ট হয়ে; ‘জোয়াল থেকে নিজের ভাইদের মুক্তি এমন একটা লক্ষ্য যার জন্যে মৃত্যু ও জীবন দুই-ই বরণীয়। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে বাইরের সাফল্য আর অন্তরের শান্তি দিন’, হাত বাড়িয়ে দিয়ে যোগ করলেন তিনি।

কজ্‌নিশেভের বােিয় দেওয়া হাতে সজোরে চাপ দিলেন ভ্রন্‌স্কি।

‘হ্যাঁ, অস্ত্র হিসেবে আমি কোন কাজে লাগতে পারি। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমি—বিধ্বস্ত’, থেমে থেমে তিনি বললেন।

শক্ত দাঁতের টনটনে ব্যথা মুখ লালায় ভরে তুলে কথা বলতে বাধা দিচ্ছিল। রেল লাইনের ওপর ধীরে ধীরে মসৃণভাবে গড়িয়ে যাওয়া ইঞ্জিনের চাকার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন তিনি।

হঠাৎ অন্য একটা জিনিস, যন্ত্রণা নয়, ভেতরকার একটা কষ্টকর অস্বস্তি মুহূর্তের জন্য তাঁকে ভুলিয়ে দিলে দাঁতের ব্যথা। লোকোমোটিভ আর রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে যে পরিচিতের সাথে তিনি কথা বলছিলেন, মর্মান্তিক ঘটনাটার পর যার সাথে তাঁর দেখা হয়নি, তারই প্রতিক্রিয়ায় হঠাৎ আন্নাকে মনে পড়ে গেল তাঁর, মানে উন্মত্তের মত স্টেশনের ব্যারাকে যখন তিনি ছুটে ঢোকেন, তখন যেটুকু অবশিষ্ট ছিল আন্নার, সেটাই : ব্যারাকের টেবিলের ওপর নির্লজ্জের মত পরের দৃষ্টির সামনে শায়িত রক্তাক্ত দেহ যা কিছু আগেও ভরপুর ছিল জীবনে; অক্ষত মাথাটা পেছন দিকে হেলানো, তা থেকে বেরিয়ে এসেছে ঘন কেশগুচ্ছ, রগের কাছে কোঁকড়ানো চুল, অপরূপ আননে আধখোলা লাল মুখে ঠোঁটের কাছে করুণ আর বুজিয়ে-না-দেওয়া চোখে স্থির হয়ে যাওয়া সাংঘাতিক মুখভাব যেন সেই ভয়ংকর কথাটা বলছে—কলহের সময় ভ্রন্‌স্কিকে আন্না যা বলেছিলেন : তাঁকে অনুতাপ করতে হবে।

প্রথমবার, সেও রেল স্টেশনে, আন্নাকে যেমন দেখেছিলেন, সেই মূর্তিতে তাঁকে স্মরণ করার চেষ্টা করলেন ভ্রন্‌স্কিরহস্যময়ী, অপরূপা, প্রেমদেবী, সুখের অন্বেষী ও তার বরদা, শেষ মুহূর্তটায় তাঁকে যেমন লেগেছিল, তেমন কঠোরা-প্রতিহিংসিকা নয়। তাঁর সাথে সেরা মুহূর্তগুলো মনে করতে চাইলেন তিনি; কিন্তু সে মুহূর্তগুলো বিষিয়ে গেছে চিরকালের মত। সবার কাছেই যা নিষ্প্রয়োজন, কিন্তু অমোঘ অনুতাপের শাসানি কার্যকর করার বিজয়োল্লাসেই শুধু মনে পড়ল তাঁকে। দাঁতের ব্যথা আর টের পাচ্ছিলেন না তিনি, কান্নার দমকে বিকৃত হয়ে উঠল মুখ।

বস্তাগুলোর কাছ দিয়ে নীরবে দু’বার গিয়ে নিজেকে সংযত করে তিনি শান্তভাবে কজ্‌নিশেভকে জিজ্ঞেস করলেন : ‘কালকের তারাবার্তার পর আপনি আর কিছু পাননি? হ্যাঁ, তিনবার পরাস্ত হয়েছে, কিন্তু চূড়ান্ত সংঘর্ষ আশা করা হচ্ছে আগামী কাল।’

আর মিলানকে রাজা ঘোষণা আর তা থেকে কি বিপুল ফলাফল সম্ভব, তা নিয়ে আলোচনা করে দ্বিতীয় ঘণ্টির পর তাঁরা চলে গেলেন যে যাঁর ওয়াগনের দিকে।

ছয়

সের্গেই ইভানোভিচ কজ্‌নিশেভ ঠিক কখন মস্কো থেকে বেরোতে পারবেন জানা না-থাকায় তাঁর জন্য লোক পাঠাতে বলে টেলিগ্রাম করেননি ভাইকে। কাতাভাসোভ আর কজ্‌নিশেভ যখন স্টেশনে একটা কাটখোট্টা গাড়ি ভাড়া করে সর্বাঙ্গে ধুলো মেখে কালো হয়ে বেলা বারোটায় পত্রোভ্স্কয়ে ভবনের গাড়ি-বারান্দায় পৌঁছলেন, লেভিন বাড়ি ছিলেন না। অলিন্দে পিতা আর বোনের সাথে বসে ছিল কিটি, ভাশুরকে চিনতে পেরে ছুটে সে নিচে নেমে এল।

‘আপনার লজ্জা হয় না, একটা খবরও দিলেন না’, কজ্‌নিশেভের করমর্দন করে তাঁর চুমু পাবার জন্য ললাট এগিয়ে দিয়ে বলল কিটি।

‘আমরা চমৎকার চলে এসেছি, আপনাদেরও বিরক্ত করতে হল না’, কজ্‌নিশেভ বললেন, ‘আমি এমন ধুলোমাখা যে ছুঁতে ভয় পাচ্ছি। অনেক কাজ ছিল জানতাম না কখন ছাড়া পাব।’ তারপর হেসে যোগ দিলেন, ‘আর আপনারা সেই আগের মতই স্রোতের বাইরে নিজেদের শান্ত খাঁড়িতে উপভোগ করছেন শান্ত সুখ। ইনি আমাদের বন্ধু ফিওদর ভাসিলিচ, শেষ পর্যন্ত সময় করে এলেন যা হোক। ‘

‘না, আমি কৃষ্ণকায় নই, গা ধুলেই হয়ে যাব মানুষ’, নিজের স্বভাবসিদ্ধ রসিকতার সুরে কিটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাসলেন কাতাভাসোভ। মুখ নোংরা থাকায় খুবই ঝকঝক করে উঠল তাঁর দাঁত।

‘কস্তিয়া ভারি খুশি হবে। গেছে খামার বাড়িতে। এখনই তো এসে পড়ার কথা।’

‘সেই কৃষিকর্ম নিয়েই আছে। ঠিক এই খাড়িতেই’, কাতাভাসোভ বললেন, ‘আর শহরে আমরা সার্বীয় যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তা আমার বন্ধুবর কি ভাবছে এ নিয়ে? নিশ্চয় জনমনিষ্যি যা ভাবে তেমন নয়।’

‘হ্যাঁ, ওই এমনি, মানে, সব লোকের মতই’, খানিকটা অপ্রতিভ হয়ে কজ্‌নিশেভের দিকে দৃষ্টিপাত করে কিটি বলল, ‘তাহলে আমি ওকে ডাকতে লোক পাঠাচ্ছি। বাবাও আমাদের এখানে আছেন। উনি সম্প্রতি ফিরেছেন বিদেশ থেকে।’

লেভিনের জন্য লোক পাঠিয়ে, ধূলিধূসর অতিথিদের হাত-মুখ ধোয়া, একজনকে স্টাডিতে, অন্যজনকে ডল্লির বড় ঘরটায় তোলা এব তাঁদের প্রাতরাশের ব্যবস্থা করে কিটি ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে উঠল ঝুল-বারান্দায়, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এ অধিকারটা থেকে বঞ্চিত ছিল সে। বলল, ‘এঁরা কজ্‌নিশেভ আর কাতাভাসোভ, প্রফেসর।’

প্রিন্স বললেন, ‘ওই, এই গরমে বরদাস্ত হবে না।’

পিতার মুখে উপহাসের একটা ভাব লক্ষ করে হেসে কিটি তাঁকে যেন মিনতি করে বলল, ‘না বাবা, সুন্দর মিষ্টি লোক উনি, কস্তিয়াও ওঁকে খুব পছন্দ করে।’

‘আমাকে নিয়ে ভাবনা নেই।’

‘শোন লক্ষ্মীটি, ওঁদের কাছে যাও তুমি’, বোনকে বলল কিটি, ‘ওঁদের নিয়ে থাকো। স্টেশনে ওঁরা স্তিভাকে দেখেছেন, ভালো আছে সে। আমি চললাম মিতিয়ার কাছে। কি যে হয়েছে, চায়ের পর থেকে ওকে দুধ দিইনি। এখন জেগে উঠেছে, নিশ্চয় কাঁদছে, স্তনে দুধের সঞ্চার টের পেয়ে দ্রুত পায়ে সে চলে গেল শিশুকক্ষে।

এবং সত্যিই, কিটি শুধু অনুমান করেছিল তাই নয় (শিশুর সাথে তার যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি তখনো), নিজের বুকে দুধের স্ফীতি থেকে সে নিশ্চিতই জানত যে শিশুটির পেট খালি।

শিশুকক্ষের কাছে আসার আগেই সে জানত যে ছেলেটা কাঁদছে। আর সত্যিই কাঁদছিল সে। তার গলা শুনতে পেয়ে গতি বাড়াল কিটি। কিন্তু যত দ্রুত শুধু ক্ষুধার্ত ও অধীর।

‘অনেকক্ষণ ধরে, ধাই-মা, অনেকক্ষণ ধরে?’ চেয়ারে বসে দুধ দেওয়ার জন্য তৈরি হতে হতে কিটি বলল হড়বড় করে। ‘আহ্, দিন-না আমাকে তাড়াতাড়ি, ইস, বড় ধীর আপনি, টুপির ফিতেটা পরেই নয় বাঁধতেন!’

ক্ষুধার্ত চিৎকারে ঝটকা দিল শিশু।

‘অমন করতে নেই যে মা’, বললেন আগাফিয়া মিখাইলোভনা। প্রায় সব সময় তিনি এখন কাটান শিশুকক্ষেই, ‘ওকে ঠিকমত গুছিয়ে তো দিতে হবে। হাত ঘোরালে নাড় দেব, নইলে নাড় কোথায় পাব’, মায়ের দিকে কোন মন না দিয়ে তিনি গাইতে লাগলেন শিশুটির উদ্দেশে।

মায়ের কাছে মিতিয়াকে এনে দিলে ধাই-মা। স্নেহকোমল মুখে আগাফিয়া মিখাইলোভনাও এলেন সাথে সাথে।

‘চিনতে পারছে। সৃষ্টিকর্তার দিব্যি, বৌমা কাতেরিনা আলেক্‌সান্দ্রভনা, চিনতে পেরেছে আমাকে!’ শিশুর চিৎকারের ওপর গলা চড়িয়ে বললেন আগাফিয়া মিখাইলোভনা।

কিন্তু কিটি তাঁর কথা শুনছিল না। শিশুিটির অধৈর্যের মত বেড়ে উঠছিল তারও অধৈর্য।

অধৈর্যের পলে ব্যাপারটা অনেকক্ষণ উৎরাচ্ছিল না। যা দরকার সেটা না ধরতে পেরে রেগে উঠছিল শিশুটি 1 অবশেষে স্তন্যপানের ব্যর্থতায় রুদ্ধশ্বাস মরিয়া চিৎকারের পর সড়গড় হল ব্যাপারটা। মা আর ছেলে দুজনেই একই সাথে সুস্থির হয়ে চুপ করে গেল।

‘আহা বেচারি, ঘামে একেবারে নেয়ে উঠেছে’, শিশুর গা হাতড়ে ফিসফিসিয়ে বলল কিটি, ‘কেন আপনি ভাবছেন যে ও চিনতে পারছে?’ টুপির তল থেকে বেরিয়ে আসা, কিটির যা মনে হয়েছিল, দুষ্টু দুষ্টু চোখ, সমান তালে ফুলে ফুলে ওঠা গাল আর গোলাপী তালু নিয়ে যে হাতটা শূন্যে বৃত্ত রচনা করছিল তার দিকে কটাক্ষে তাকিয়ে যোগ দিল সে।

‘হতে পারে না’, আগাফিয়া মিখাইলোভনা চিনেছে বলায় কিটি বলল হেসে, ‘কাউকে যদি চিনতে পারে তাহলে আমাকেই চিনত আগে।’

কিটি হাসল। কেননা যদিও সে বলছিল যে চেনা সম্ভব নয়, তাহলেও তার প্রাণ ব্লছিল যে তার মিতিযা শুধু আগাফিয়া মিখাইলোভনাকেই চিনতে পারে তাই নয়, সব কিছু ও জানে আর বোঝে। এবং সে জানে আর বোঝে এমন অনেক কিছু যা আর কেউ জানে না, এবং কিটি তা জেনেছে, বুঝতে শুরু করেছে শুধু ওরই কল্যাণে। আগাফিয়া মিখাইলোভনা, ধাই-মা, দাদু, এমন কি পিতার কাছেও মিতিয়া শুধু একটি জীবন্ত সত্তা যা কেবল বৈষয়িক পরিচর্যা দাবি করে; কিন্তু মায়ের কাছে সে অনেক আগেই হয়ে উঠেছে একটি নৈতিক সত্তা, যার সাথে আত্মিক সম্পর্কের একটা গোটা ইতিহাস জড়িত।

আগাফিয়া মিখাইলোভনা বললেন, ‘বেশ, ও যখন উঠবে, সৃষ্টিকর্তা দেন তো নিজেই দেখতে পাবেন। আমি যদি এমনি করি, অমনি সে জেগে উঠবে। সোনা আমার, এমন জ্বলজ্বল করে উঠবে যেন রোদঝলমল দিনটি।’

কিটি ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বেশ-বেশ, তখন দেখা যাবে। এখন যান, ঘুমিয়ে পড়ছে ও।’

সাত

আগাফিয়া মিখাইলোভনা পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেলেন; ধাই-মা পর্দা নামিয়ে দিয়ে খাটিয়ার নেটের ভেতর ঢুকে পড়া মাছিগুলো আর জানালার শার্সিতে ঝটপট করা ভীমরুলটাকে ভাগিয়ে দিয়ে বসল। মা আর ছেলেকে বার্চ গাছের একটা শুকনো পল্লব দিয়ে হাওয়া করতে লাগল। বলল, ‘গরম বাপু, কি গরম! সৃষ্টিকর্তা যদি এক পশলা বৃষ্টিও দিতেন।

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, শ্-শ্-শ্…’ সামান্য জবাব দিয়ে শিশুকে মৃদু দোলাতে দোলাতে। কব্জির কাছে যেন সুতোয় টানা নাদুসনুদুস যে হাতখানা সে কখনো চোখ মেলে কখনো বুজে সামান্য দোলাচ্ছিল সেটাকে সস্নেহে চেপে ধরছিল কিটি। হাতটায় অস্থির লাগছিল কিটির; ইচ্ছে হচ্ছিল তাতে চুমু খায়, কিন্তু ভয় পাচ্ছিল পাছে জেগে যায় যদি। শেষ পর্যন্ত হাতটার নড়নচড়ন থেমে গেল, মুদে এল চোখ। শুধু মাঝে মধ্যে ছেলেটা তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকল, লম্বা লম্বা বাঁকা আঁখিপল্লব কিছুটা তুলে যে চোখ মেলে সে মায়ের দিকে তাকাচ্ছিল, অন্ধকারে তা মনে হচ্ছিল কালো আর সজল। ধাই-মা হাওয়া করা বন্ধ করে ঢুলতে লাগল। ওপর থেকে ভেসে এল বৃদ্ধ প্রিন্সেসের গুরুগুরু কণ্ঠস্বর আর কাতাভাসোভের হাসির শব্দ।

‘বোঝা যাচ্ছে আমাকে ছাড়াই এদের আলাপ জমে উঠেছে’, কিটি ভাবল; ‘তাহলেও দুঃখে কথা যে কস্তিয়া নেই। নিশ্চয় আবার গেছে মক্ষিকাশালায়। ওখানে সে যে ঘন ঘন যায়, তাতে মন খরাপ লাগলেও আমি খুশি। অন্য ব্যাপার থেকে এতে মন গেছে ওর। এখন সে বসন্ত কালের চেয়ে অনেক ভালো, হাসি-খুশি। তখন সে হয়ে ওঠে এমন মনমরা, এমন কষ্ট পাচ্ছিল যে ওর জন্যে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। কি মজার লোক বাপু’, হেসে ফিসফিস করল কিটি

তার স্বামী সে জানত কিসে কষ্ট পাচ্ছিলেন। এটা হল সৃষ্টিকর্তার অবিশ্বাস নিয়ে। কিটির কাছে কেউ যদি জিজ্ঞেস করত সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস না রাখলে তিনি ভবিষ্যতে ধ্বংস পাবেন বলে সে মনে করে কিনা, তাহলে তাকে সায় দিতেই হত যে হ্যাঁ, ধ্বংস পাবেন। তাঁর অবিশ্বাসে অসুখী হয়নি কিটি; এবং অবিশ্বাসীর যে মোক্ষলাভ হতে পারে না, সেটা মানলেও স্বামীর অন্তরটাকে দুনিয়ায় সব কিছুর চেয়ে ভালোবাসায় সে তাঁর অবিশ্বাসের কথা ভেবেছিল হাসি নিয়ে, মনে মনে বলেছিল তিনি মজার লোক।

‘সারা বছর ধরে দর্শনের বইগুলো সে পড়ছে কেন?’ কিটি ভাবল, ‘এসব বইয়ে সবই যদি লিখে দেয়ো থাকে তাহলে সেটা ওর আয়ত্ত হয়ে যাবার কথা। আর তাতে যদি অসত্য থাকে, তাহলে কি দরকার পড়ার? নিজেই সে তো বলেছে যে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করতে সে চায়। তাহলে কেন বিশ্বাস করছে না? অনেক ভাবে বলেই কি? আর ভাবা সম্ভব কেবল একলা থাকলে। কেবলি একা, একা। আমাদের সাথে সব কথা আলোচনা করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ধারণা অতিথিদের ওর ভালো লাগবে, বিশেষ করে কাতাভাসোভকে। ওঁর সাথে তর্ক করতে সে ভালোবাসে’, ভাবলে সে আর তখনই চিন্তাটা সরে গেল যাতে চমকে উঠল সে, এমন কি মিতিয়াকেও ত্রস্ত করে তুলল। এতে চোখ খুলে সে কড়া চাউনিতে তাকাল কিটির দিকে। ‘মনে হচ্ছে ধোপানি এখনো বিছানার চাদরগুলো দিয়ে যায়নি, আর অতিথিদের সমস্ত চাদরই ব্যবহৃত হচ্ছে। আগাফিয়া মিখাইলোভনাকে বলে না রাখলে তিনি হয়ত ব্যবহৃত চাদরই দিয়ে বসবেন কজ্‌নিশেভকে’, এ ভাবতেই মুখে রক্তোচ্ছ্বাস দেখা দিল তার।

‘হ্যাঁ, বলে রাখব’, এই ভেবে সে ফিরল আগের চিন্তায় এবং তার মনে পড়ল গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক কি-একটা বত্যাপার পুরো ভেবে দেখা হয়নি, সেটা কি মনে করার চেষ্টা করল সে। ‘হ্যাঁ, কস্তিয়া অবিশ্বাসী’, মনে পড়তেই আবার মুখে তার হাসি ফুটল।

‘নয় অধার্মিক! মাদাম টাল অথবা, তখন আমি বিদেশে থাকতে যা হতে চাইছিলাম, তার চেয়ে বরং এমনিই থাক বরাবর। না, ও ভান করবে না কখনো।’

তাঁর সদাশয়তার আরেকটা দিক সম্প্রতি যা লক্ষ করেছে কিটি সেটা মনে পড়ল তার। দু’সপ্তাহ আগে অব্‌লোন্‌স্কির কাছ থেকে একটা অনুতপ্ত চিঠি পান ডল্লি। তাতে তিনি তাঁর ঋণ পরিশোধের জন্য ডল্লির মহাল বেচে তাঁর সম্মান বাঁচানোর মিনতি করেছেন তাঁকে। ডল্লি একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, ঘৃণা হয়েছিল স্বামীর ওপর, রাগ হয়েছিল, মায়াও হচ্ছিল, ভেবেছিলেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন, না করে দেবেন, তবে শেষ পর্যন্ত মহালের একাংশ বিক্রি করতে রাজি হলেন। অগোচরে মন ভিজে ওঠা হাসিতে কিটির মনে পড়ল তার নিজের স্বামী তখন পড়েছিলেন কি হতভম্ব অবস্থায়, তাঁর মনে যে চিন্তাটা ছিল, কিটির কাছে কতবার সেটা পাড়তে গেছেন আনাড়ির মত, শেষ পর্যন্ত ডল্লির অভিমানে আতঘাত না দিয়ে তাঁকে সাহায্যের একমাত্র উপায় হিসেবে প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিটি তার নিজের অংশটা বিক্রি করে দিক। আগে এটা কিটির খেয়াল হয়নি।

‘কি সে অধার্মিক? কাউকে, এমন কি শিশুকেও যেন দুঃখ না দিতে হয় তার জন্যে এত তার উৎকণ্ঠ। নিজের জন্যে কিছু নয়, সবই পরের জন্যে। কজ্‌নিশেভ তো মনেই করেন যে, কস্তিয়ার কর্তব্য হল তাঁর গোমস্তা হওয়া। ওর বোনও তাই। এখন ডল্লি তার ছেলেপেলে নিয়ে ওরই আশ্রয়ে। আর এসব চাষী রোজই আসে তার কাছে, যেন সে বাধ্য ওদের উপকার করতে।’

কিটি ছেলের গালে ঠোঁট ঠেকিয়ে মিতিয়াকে ধাই-মার কাছে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, শুধু তোর বাবার মত হবি। শুধু ওর মত।’

আট

লেভিনের মতে তাঁর আদরের বড় ভাইকে মরতে দেখার মুহূর্ত থেকে, তাঁর বিশ থেকে চৌত্রিশ বছরের মধ্যে অলক্ষ্যে তাঁর বাল্য ও কৈশোরের যে সমস্ত বিশ্বাসকে স্থানচ্যুত করেছিল যে সকল নতুন প্রত্যয়, তার ভেতর দিয়ে জীবন ও মৃত্যুর প্রশ্নটাকে প্রথমবার দেখে তাঁর ভয় হয়েছিল মরণে ততটা নয়, জীবনেই, কোত্থেকে তা এল, কোন লক্ষ্যে, কেন, জীবনটাই বা কি সে সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান না থাকায়। দেহসত্তা, তার বিনাশ, বস্তুর অক্ষয়তা, শক্তির নিত্যতার নিয়ম, বিকাশ—এসব কথাই তাঁর পূর্বতন বিশ্বাসের স্থান নিয়েছিল। কথাগুলি আর তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট বোধ মননের ক্ষেত্রে খুবই ভালো; কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রে তা থেকে কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না, নিজেকে লেভিনের মনে হচ্ছিল সেই লোকের মত যে একটা মসলিন পোশাকের জন্য বিনিময় করেছে তার গরম ফারকোট আর হিমে প্রথম বেরিয়েই কোন যুক্তিতর্কের অপেক্ষা না রেখে নিজের গোটা শরীর দিয়েই নিঃসন্দেহ হয়েছে সে নগ্ন, যন্ত্রণাকর অমোঘ মৃত্যু তার শিরোধার্য।

সেই মুহূর্ত থেকে, নিজে সচেতন না হয়ে আগের মত জীবন কাটালেও নিজের অজ্ঞানতায় এই ভয়টা অনুভব না করে লেভিন পারতেন না।

তাছাড়া তিনি ঝাপসাভাবে টের পেতেন, যেগুলিকে তিনি প্রত্যয় বলেছেন, সেগুলি শুধু অজ্ঞানতাই নয়, এগুলি এমন একটা চিন্তাধারা যাতে তাঁর যা দরকার সে জ্ঞান লাভ অসম্ভব।

বিবাহের পর প্রথম সময়টায়, নতুন আনন্দ আর যেসব কর্তব্য তিনি স্বীকার করে নিচ্ছিলেন, সেগুলিতে এসব ভাবনা একেবারে চাপা পড়ে গিয়েছিল; কিন্তু স্ত্রীর প্রসবের পর মস্কোয় যে সময়টা তিনি কাটিয়েছেন দাবি করেছে।

তাঁর কাছে প্রশ্নটা এ রকম : ‘আমার জীবনের প্রশ্নে খ্রিস্টধর্ম যেসব উত্তর দেয়, তা যদি স্বীকার না করি, তাহলে কোন উত্তর আমি মানব?’ এবং তাঁর প্রতীতির অস্ত্রাগারে শুধু উত্তর নয়, উত্তর গোছের কিছু-একটাও তিনি খুঁজে পেলেন না।

তাঁর অবস্থা দাঁড়িয়েছিল খেলনা আর বন্দুকের দোকানে খাবার কিনতে যাওয়া লোকের মত।

এখন তিনি আপনা থেকে, নিজের অগোচরে প্রতিটি বই, প্রতিটি আলাপ, প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে খুঁজছিলেন এসব সমস্যা সম্পর্কে কি তাদের মনোভাব, কি তাদের সমাধান।

এ ব্যাপারে তাঁর সবচেয়ে অবাক লাগছিল, পীড়িত বোধ হচ্ছিল এই দেখে যে তাঁর মহল ও বয়সের অধিকাংশ লোকে ওঁরই মত আগেকার বিশ্বাস বর্জন করে, ওঁরই মত নতুন প্রত্যয় গ্রহণ করলেও এতে কোন সর্বনাশ দেখছেন না, খুবই তুষ্ট আর শান্ত তাঁরা। তাই প্রধান প্রশ্নটা ছাড়াও অন্যান্য প্রশ্নও লেভিনকে জ্বালাচ্ছিল : ‘এই লোকগুলি কি অকপট? ভান করছে না তারা? নাকি যেসব প্রশ্নে তিনি ভাবিত তাতে বিজ্ঞান যে উত্তর দেয় সেটা ওরা তাঁর চেয়ে অন্যরকমভাবে পরিষ্কার করে বোঝে?’ আর এসব লোকের মতামত, যেসব বইয়ে তার উত্তর আছে, সেগুলি তিনি সযত্নে অনুধাবন করছিলেন।

তিনি এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করার পর থেকে একটা জিনিস দেখলেন যে নিজের তারুণ্য ও বিশ্ববিদ্যালয়কালীন বন্ধু-বান্ধবদের কথা স্মরণ করে তিনি যে ধরে নিয়েছিলেন ধর্মের কাল ফুরিয়েছে, তা আর নেই, সেটা ভুল। তাঁর জীবনে যত ভালো লোক আর আপনজন তিনি দেখেছেন, সবাই ধর্মবিশ্বাসী। বৃদ্ধ প্রিন্স, তাঁর যে অত অনুরাগী সেই ভভ, সের্গেই ইভানিচ, সমস্ত নারীই—সবাই ধর্মপ্রাণা, তিনি বাল্যকালে যেরকম বিশ্বাস করতেন, তাঁর স্ত্রীও তেমনি বিশ্বাসী। শতকরা নিরানব্বই জন রুশী, যে চাষীদের জীবন তাঁর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্মান জাগিয়েছে, তারা সবাই ধর্মবিশ্বাসী।

তিনি অনেক বই পড়ার পর আরেকটা জিনিসে নিঃসন্দেহ হলেন যে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি যে সব লোক মানেন, তার ভেতর অন্য কিছুর সন্ধান তাঁরা পান না, এবং যেসব প্রশ্নের উত্তর ছাড়া তাঁর কাছে জীবন ধারণ অসম্ভব, সেগুলো তাঁরা বিনা ব্যাখ্যায় নাকচ করে দিতেন। আর যাতে তাঁর আগ্রহ থাকার কথা নয়, উত্তর দিতেন তেমন সব প্রশ্নের : যেমন, জীবদেহের বিকাশ, অন্তরাত্মার যান্ত্রিক ব্যাখ্যা ইত্যাদি।

এছাড়া তাঁর স্ত্রীর প্রসবকালে আরো একটা আশ্চর্য জিনিস ঘটেছিল। অধার্মিক তিনি প্রার্থনা করতে শুধু করেন আর যতক্ষণ প্রার্থনা করেছিলেন, বিশ্বাস রেখেছিলেন। কিন্তু সে মুহূর্তটা কেটে যেতেই তিনি তখনকার এই ভাবাবেগকে জীবনের সাথে মেলাতে পারেননি। কেননা তখনকার আত্মিক দশা তাঁর কাছে ছিল মূল্যবান, সেটাকে দুর্বলতা বলে মানলে সে মুহূর্তগুলোর অপমান করা হয়। তিনি নিজের সাথে নিজের এক যন্ত্রণাকর দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন, তা থেকে বেরিয়ে আসার তাঁর সমস্ত চিত্তশক্তি জন্য নিয়োগ করেন।

নয়

তিনি এসব চিন্তা-ভাবনায় কখনো অল্প আবার কখনো বেশি কষ্ট পেতেন। কিন্তু চিন্তাগুলো কখনো ছেড়ে যেত না তাঁকে। তিনি বই পড়তেন, ভাবতেন, আর যত পড়তেন আর ভাবতেন, ততই অনুভব করতেন যে, তাঁর লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে তিনি

ইদানীং মস্কোয় থাকাকালে এবং গ্রামে বস্তুবাদে তিনি তার উত্তর খুঁজে পাবেন না বলে নিঃসন্দেহ হয়ে তিনি আবার পড়েন প্লেটো, স্পিনোজা, ক্যান্ট, শেলিঙ, হেগেল, শোপেনহাওয়ার। অর্থাৎ সে সব দার্শনিকের রচনা যাঁরা জীবনকে ব্যাখ্যা করেছেন বস্তুবাদী ভিত্তিতে নয়।

তিনি যখন পড়তেন অথবা নিজেই অন্যান্য মতবাদ, বিশেষ করে বস্তুবাদ খণ্ডনের যুক্তি ভেবে বার করতেন, তখন চিন্তাগুলো তাঁর কাছে মনে হত কার্যকরী। কিন্তু প্রশ্নের মীমাংসা তিনি বইয়ে পড়ে অথবা নিজে ভেবে বের করার পর দাঁড়াত সেই একই ব্যাপার। আত্মা, ইচ্ছা, স্বাধীনতা, সার প্রভৃতি অস্পষ্ট শব্দগুলোর নির্দিষ্ট সংজ্ঞা অনুসরণ করে দার্শনিকদের অথবা তাঁর নিজেরই পাতা এসব শব্দের ফাঁদে তিনি যখন ইচ্ছে করে ধরা দিতেন, তখন কিছু-একটা যেন বুঝতে শুরু করছেন বলে মনে হত। কিন্তু নির্দিষ্ট সূত্র অনুসরণ করে ভেবে যাতে তিনি সন্তোষ লাভ করেছিলেন, চিন্তার সেই কৃত্রিম ধারা ভুলে গিয়ে জীবন থেকে তাতে আবারা মাত্র কৃত্রিম এসব গঠন তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ত আর পরিষ্কার হয়ে উঠত যে বুদ্ধি ছাড়া জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অন্য কিছুর ওপর যা নির্ভরশীল নয় তেমন সব শব্দেরই পুনর্বিন্যাস থেকে গড়ে উঠেছিল গঠনগুলি।

একবার শোপেনহাওয়ার পড়ার সময় তিনি তাঁর ইচ্ছার স্থানে প্রেম শব্দটি বসান এবং এই নতুন দর্শন ঝেড়ে না ফেলা পর্যন্ত দিন দুয়েক তাঁকে তা সান্ত্ব না দিয়েছিল, কিন্তু পরে জীবন থেকে দৃষ্টিপাত করা মাত্র তাও দূলিসাৎ হয়ে যায়, দেখা গেল সেটা শীতে মসলিন পোশাকের মত অকেজো।

বড় ভাই কজ্‌নিশেভ তাঁকে খোমিয়াকভের আধ্যাত্মিক রচনাবলি পড়ার পরামর্শ দেন। লেভিন খোমিয়াকভের দ্বিতীয় খণ্ড পড়লেন এবং তাঁর তার্কিক, মার্জিত, সুরসিক চাল তাঁকে প্রথমটা বিরূপ করে তুললেও উপাসনালয় সম্পর্কে তাঁর মতবাদ তাঁকে অভিভূত করল। প্রথমে তাঁকে অভিভূত করল এই ভাবনা যে, ঐশ্বরিক সত্য মানুষের লভ্য নয়। লভ্য প্রেমে সম্মিলিত নির্দিষ্ট একদল মানুষের, যথা—উপাসনালয়ের কাছে। এই ভেবে তাঁর আনন্দ হল যে বিদ্যমান, সক্রিয় যে উপাসনালয়গুলি সব রকম বিশ্বাসের লোক নিয়ে চলছে, যার শীর্ষে সৃষ্টিকর্তা। সুতরাং যা পবিত্র, নিষ্পাপ, তাতে বিশ্বাস রাখা কত সহজ; সুদূর তুরীয় এক সৃষ্টিকর্তা, ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি ইত্যাদি দিয়ে শুরু না করে এই উপাসনালয়ের কাছ থেকেই সৃষ্টিকর্তা, সৃষ্টি, পতন, পাপমোচনে বিশ্বাস লাভ করে এগোনো সম্ভব। কিন্তু পরে ক্যাথলিক লেখক রচিত গির্জার ইতিহাস আর রুশী সনাতনী লেখকের গির্জার ইতিহাস পড়ে এবং মর্মার্থের দিক থেকে অকল্মষ দুটো উপাসনালয়ই পরস্পরকে খণ্ডন করছে দেখে তিনি খোমিয়াকভের গির্জা মতবাদেও বিশ্বাস হারালেন এবং দার্শনিক ইমারতটার মত এটাও ধূলিসাৎ হয়ে গেল।

তিনি সারা এই বসন্তটা আত্মস্থ ছিলেন না। দারুণ মানসিক যন্ত্রণা ভোগেন।

‘আমি কে, আমি কেন এখানে,—তা জানা না থাকলে বাঁচা চলে না আর জানতে আমি পারছি না। সুতরাং বাঁচা চলে না আমার’, মনে মনে ভাবতেন লেভিন।

‘অনন্ত কালে, অনন্ত বস্তুপিণ্ডে, অনন্ত শূন্যদেশে জেগে উঠল জীবসত্তার বুদ্বুদ, কিছুক্ষণ টিকে থেকে তা ফেটে যাবে, আর সে বুদ্বুদ আমি।’

এ সিদ্ধান্তটা যন্ত্রণাকর একটা অসত্য, কিন্তু এই নিয়ে যুগযুগের মানবিক চিন্তার শেষ ও একমাত্র পরিণাম এটাই। এই শেষ বিশ্বাসটার ওপর গড়ে উঠেছে মানবিক চিন্তার অন্বেষার প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে সব কিছু এটা ছিল আধিপত্যকারী প্রত্যয়। অন্য সব ব্যাখ্যার চেয়ে যতই হোক এটা ছিল বেশি পরিষ্কার, আর অজ্ঞাতসারে, কখন, কেমন করে নিজেই না জেনে লেভিন এটাকেই গ্রহণ করেন।

কিন্তু এটা শুধু অসত্য ছিল তাই নয়, এটা ছিল কি-একটা অশুভ শক্তির নিষ্ঠুর বিদ্রূপ। এমন একটা অশুভ, বিরক্তি জাগানো শক্তি, নতিস্বীকার করা চলে না যার কাছে।

এ শক্তির কবল থেকে উদ্ধার পেতে হবে। আর সে উদ্ধার সকলেরই আয়ত্তে। অশুভের ওপর এই নির্ভরশীলতা ছিন্ন করা দরকার। আর তার একটাই উপায়—মৃত্যু

স্বাস্থ্যবান পুরুষ এবং বিবাহে সুখী, লেভিন বার কয়েক আত্মহত্যার এত কাছাকাছি এসেছিলেন যে রশিগুলো সব লুকিয়ে রাখতে লাগলেন যাতে গলায় ফাঁস না দিতে হয়, ভয় পেতেন বন্দুক নিয়ে চলতে, পাছে গুলি করে বসেন নিজেকে। কিন্তু লেভিন নিজেকে গুলিও করলেন না, গলায় রশিও দিলেন না। বেঁচেই থাকতে লাগলেন বহালতবিয়তে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *