আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ১.২৫

পঁচিশ

নিকোলাই লেভিন কপাল কুঁচকে, মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জোর করে বলে চলল, ‘দেখছ তো তাই’, বোঝা যাচ্ছিল কি বলবে বা করবে তা ঠিক ভেবে পাচ্ছিল না সে। ‘ঐ যে দেখছ তো, ঘরের কোনে বেঁধে রাখা কি সব লোহার রড দেখাল সে, ‘দেখছ? আমরা নতুন যে কাজে হাত দিচ্ছি এটা তার শুরু, এটা হল উৎপাদনী কর্মশালা…’

কনস্তান্তিন বড় একটা শুনছিলেনই না। ভাইয়ের পীড়িত ক্ষয়রোগগ্রস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। উৎপাদনী কর্মশালা নিয়ে ভাই যা বলছে সেটা শুনে যেতে পারছিলেন না তিনি। বোঝা যাচ্ছিল ঐ কর্মশালা হল শুধু তার আত্মগ্লানি থেকে বাঁচার শেষ ভরসা। নিকোলাই লেভিন বলে চলল :

‘কি জানো, পুঁজি দলন করছে মেহনতীদের—আমাদের মেহনতীরা, চাষীরা খাটুনির সব কষ্ট সইছে, আর এমন অবস্থায় আছে যে যতই খাটুক, জান্তব দশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। তাদের রোজগারের যেটুকু লাভ থেকে তারা নিজেদের অবস্থা উন্নত করতে, খানিকটা অবকাশ আর তার ফলে শিক্ষা পেতে পারত, বাড়তি এই সমস্ত রোজগারটা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে পুঁজিপতিরা। আর সমাজটা এমন ভাবে গড়ে উঠেছে যে যতই তারা খাটবে ততই লাভ হবে বেনিয়াদের, জমিদারদের আর ওরা সব সময়ই থাকবে ভারবাহী পশু। এই ব্যবস্থাটা বদলে দেওয়া দরকার’, এই বলে শেষ করে সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল ভাইয়ের দিকে।

‘সে তো বটেই’, ভাইয়ের হাড় বেরিয়ে আসা গালের ওপর রক্তিমাভা ফুটতে দেখে কনস্তান্তিন বললেন।

‘তাই আমরা একটা কামারশালা খুলছি, সেখানে তৈরি সমস্ত মাল, আর লাভ, আর প্রধান কথা উৎপাদনের যা হাতিয়ার তার মালিক হবে সকলেই।’

কনস্তান্তিন লেভিন বললেন, কামারশালাটা হবে কোথায়?’

‘কাজান গুবের্নিয়ার ভদ্রেম গ্রামে।’

‘কিন্তু গ্রামে কেন? আমার মনে হয় গ্রামে এমনিতেই কাজ প্রচুর। কামারশালা, তা গ্রামে কেন?’

‘কারণ চাষীরা এখন আগের মতই গোলাম, আর এই গোলামি থেকে তাদের উদ্ধার করতে চাওয়া হচ্ছে, এটা তোমার আর কনিশেভের কাছে প্রীতিকর নয়’, আপত্তিতে বিরক্ত হয়ে বলল নিকোলাই লেভিন।

এই সময় নিরানন্দ নোংরা ঘরখানার দিকে তাকিয়ে কনস্তান্তিন লেভিন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাতে যেন আরো চটে উঠল নিকোলাই।

‘তোমার আর সের্গেই ইভানিচের অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গি আমার জানা। জানি যে তার সমস্ত মেধাশক্তি সে কাজে লাগায় বর্তমান অভিশাপটাকে ন্যায্য প্রতিপন্ন করার জন্য।’

‘আরে না, সের্গেই ইভানিচের কথা তুলছ কেন?’ হেসে লেভিন বললেন।

‘সের্গেই ইভানিচ? তাহলে শোনো!’ সের্গেই ইভানিচের উল্লেখে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল নিকোলাই লেভিন, ‘শোনো কেন… যাকগে, বলার কি আছে? শুধু একটা কথা… আমার কাছে তুমি এলে কেন? তুমি এটা ঘৃণা কর তা বেশ, বেরিয়ে ভালোয় ভালোয় যাও!’ টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচাল সে, ‘বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও!’

‘একটুও ঘৃণা করি না আমি’, ভয়ে ভয়ে বললেন কনস্তান্তিন লেভিন, ‘এমন কি আমি তর্কও করছি না।’

এই সময় ফিরল মারিয়া নিকোলায়েভনা। সক্রোধে নিকোলাই লেভিন চাইলে তার দিকে। দ্রুত তার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে কি যেন সে বলল।

শান্ত হয়ে ভারি ভারি নিঃশ্বাস ফেলে নিকোলাই লেভিন বলল, ‘আমি অসুস্থ, মেজাজ হয়েছে খিটখিটে। তার ওপর তুমি আবার বলছ সের্গেই ইভানিচ আর তার প্রবন্ধের কথা। এ একেবারে ছাইভস্ম, মিথ্যে কথা, আত্মপ্রতারণা। ন্যায় যে লোক দেখে নি সে কি লিখতে পারে তার কথা? ওর প্রবন্ধ আপনি পড়েছেন?’ সে জিজ্ঞেস করল ক্রিৎস্কিকে, আবার টেবিলের কাছে বসে তার অর্ধেকটায় ছড়িয়ে থাকা সিগারেটের টুকরোগুলো সরিয়ে জায়গা করতে করতে সে বলল।

‘না, পড়িনি’, বাজার মুখে বললেন ক্রিৎস্কি, বোঝা যায় আলোচনায় যোগ দেবার বাসনা তাঁর নেই।

‘কেন পড়েন নি?’ এবার ক্রিৎস্কির ওপরেই বিরক্ত হয়ে নিকোলাই লেভিন জিজ্ঞেস করল।

‘কারণ ও নিয়ে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।’

‘মাপ করবেন, সময় নষ্ট হবে জানলেন কোত্থেকে? অনেকের কাছে প্রবন্ধটা দুর্বোধ্য, মানে তাদের নাগালের বাইরে। কিন্তু আমার ব্যাপারটা ভিন্ন, আমি ওর ভাবনার তল পর্যন্ত দেখতে পাই, জানি কোথায় এর দুর্বলতা।’

সবাই চুপ করে রইলেন। ধীরে ধীরে উঠে টুপি নিলেন ক্রিৎস্কি।

‘খেয়ে যাবেন না? তাহলে আসুন। কাল কামারকে নিয়ে আসবেন কিন্তু।’

ক্রিৎস্কি বেরিয়ে যেতেই নিকোলাই লেভিন হেসে চোখ মটকাল।

বলল, ‘ওর অবস্থাও কাহিল, আমি তো দেখতে পাচ্ছি…’

কিন্তু এই সময় দরজার ওপাশ থেকে ক্রিৎস্কি ডাকলেন তাকে।

‘আবার কি দরকার পড়ল?’ এই বলে নিকোলাই করিডরে গেল তাঁর কাছে। একা রইলেন মারিয়া নিকোলায়েভনা আর লেভিন। কনস্তান্তিন তাকে বললেন : ‘আমার ভাইয়ের সাথে আপনি আছেন কত দিন?’

মারিয়া বলল, ‘এই দ্বিতীয় বছর। স্বাস্থ্য ওঁর ভারি ভেঙে পড়েছে। মদ খান প্রচুর।’

‘মানে, কি খায়?’

‘ভোদ্‌কা। আর সেটা ওঁর পক্ষে ক্ষতিকর।’

‘সত্যিই অনেক খায় কি?’ ফিসফিসিয়ে বললেন লেভিন।

‘হ্যাঁ’, ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল সে, সেখানে দেখা গিয়েছিল নিকোলাই লেভিনকে।

‘কি নিয়ে কথা হচ্ছিল তোমাদের?’ ভুরু কুঁচকে একজনের পর আরেক জনের ওপর ভীত দৃষ্টিপাত করে বলল, ‘এ্যাঁ, কি নিয়ে?’

‘বিশেষ কিছুই নয়’, বিব্রত হয়ে জবাব দিলেন কনস্তান্তিন।

‘বলতে যদি না চাও, সে তোমাদের ইচ্ছে। তবে ওর সাথে আলাপের কিছু নেই। এটা একটা ছুকরি, আর তুমি সাহেব লোক’, বলল সে ঘাড় ঝাঁকিয়ে

তারপর গলা চড়িয়ে আবার সে বলে উঠল, ‘আমি যে দেখতে পাচ্ছি তুমি সব বুঝেছ, খতিয়ে দেখেছ, আমার গোল্লায় যাওয়ায় করুণা হচ্ছে তোমার।

‘নিকোলাই মিত্রিচ্, নিকোলাই মিত্রিচ!’ আবার তার কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল মারিয়া নিকোলায়েভনা।

‘বেশ, ঠিক আছে, ঠিক আছে!… কিন্তু খাবার কোথায়! আহ্ এই যে’, ট্রে হাতে ওয়েটারকে আসতে দেখে সে বলল, ‘এখানে, এখানে রাখো’, রেগে এই কথা বলে সে তখনই ভোদ্‌কা নিয়ে পানপাত্রে ঢালল এবং খেল তৃষিতের মত। সাথে সাথে শরীফ মেজাজে ভাইকে বলল, ‘খাবে? যাক, সের্গেই ইভানিচের কথা থাক। তোমাকে দেখে আমি খুশি হয়েছি। যতই বলো না কেন, আমরা তো আর পর নই। নাও, খাও-না। তা কি করছ, বল?’ পরিতৃপ্তির সাথে এক টুকরো রুটি চিবাতে চিবাতে আরেক পাত্র মদ ঢেলে বলল, ‘কেমন আছ?’

কি লোলুপতায় ভাই খাবার আর মদ গিলছে, সভয়ে তা দেখে এবং তার মনোযোগ চাপা দেবার চেষ্টা করে কনস্তান্তিন জবাব দিলেন, ‘গাঁয়ে থাকি একা যেমন আগে থাকতাম, চাষবাস দেখি।’

‘বিয়ে করনি কেন?’

‘ঘটে উঠল না’, লাল হয়ে বললেন কনস্তান্তিন।

‘কেন? আমার অবশ্য অন্য কথা। নিজের জীবন আমি নষ্ট করেছি। আমি বলেছিলাম এবং বলছি, যখন আমার দরকার ছিল তখন আমার অংশটা পেলে আমার জীবন হত অন্যরকম।’

তাড়াতাড়ি কথাবার্তাটা অন্য খাতে ঘোরাতে চাইলেন কনস্তান্তিন দ্‌মিত্রিচ। বললেন, ‘আর জানো, তোমার ভানিউকা আমার ওখানে পত্রোভস্কয়েতে একজন কেরানি।’ নিকোলাই ঘাড় ঝাঁকিয়ে ভাবনায় ডুবে গেল।

‘হ্যাঁ বটে, বল তো কি হচ্ছে পক্রোভস্কয়ে-তে? বাড়িটা কি আস্তো আছে, আর বাচগাছগুলো, আমাদের পাঠশালাটা? আর ঐ মালী ফিলিপ, বেঁচে আছে এখনো? কি যে মনে পড়ে কুঞ্জ ঘর আর সোফাটার কথা। দেখো কিন্তু, বাড়ির কিছুই অদলবদল করবে না। তবে বিয়েটা করে ফেলো তাড়াতাড়ি তারপর আবার যেমন ছিল তেমনি করে রাখো। আমি তখন যাব তোমার কাছে, অবশ্য বৌটা যদি ভালো হয়।’

লেভিন বললেন, ‘এখনই চলে এসো। কি চমৎকার যে হবে!’

‘তোমার কাছেই যেতাম যদি জানা থাকত যে সের্গেই ইভানিচকে দেখতে হবে না।’

‘ওর দেখাই পাবে না। আমি থাকি ওর কাছ থেকে একেবারে স্বাধীনভাবে।’

‘কিন্তু যতই বল, ওর আর আমার মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে তোমায়’, ভয়ে ভয়ে ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল। এই ভীরুতাটা কনস্তান্তিনের মর্ম স্পর্শ করল।

‘এ ব্যাপারে যদি আমার পুরো স্বীকৃতিটা শুনতে চাও, তাহলে বলি শোনো, সের্গেই ইভানিচের সাথে তোমার ঝগড়ায় আমি কোন পক্ষই নেব না। অন্যায় তোমাদের দুজনেরই। তোমারটা বাইরের দিক থেকে বেশি, ওরটা ভেতরের দিকে।’

‘বটে! এটা তুমি বুঝেছ তাহলে, বুঝেছ?’ আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল নিকোলাই।

‘কিন্তু যদি জানতে চাও, তাহলে আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমার সাথে বন্ধুত্বকেই মূল্য দিই কেননা…’

‘কেন, কেন?’

কনস্তান্তিন বলতে পারলেন না যে মূল্য দেন কারণ নিকোলাই দুর্ভাগা, বন্ধুত্ব তার প্রয়োজন। কিন্তু নিকোলাই টের পেল যে ঠিক ঐ কথাটাই কনস্তান্তিন বলতে চাইছিলেন। ভুরু কুঁচকে আবার সে ভোদ্‌কা ঢালতে গেল।

‘আর না নিকোলাই মিত্রিচ!’ পানপাত্রের দিকে মোটা সোটা অনাবৃত হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে বলল মারিয়া নিকোলায়েভনা।

‘ছাড়ো বলছি! পেছনে লেগো না! মেরে ঢিট করব!’ চেঁচিয়ে উঠল সে।

ভীরু ভীরু সহৃদয় একটা হাসি ফুটল মারিয়া নিকোলায়েভনার মুখে, তাতে সাড়া দিল নিকোলাই, মেয়েটা ভোদ্‌কা নিল।

নিকোলাই বললেন, ‘আরে ভেবো না যে ও কিছু বোঝে না। আমাদের সবার চেয়ে ও বোঝে ভালো। সত্যি ওর মধ্যে সুন্দর, মিষ্টি কি-একটা যেন আছে, তাই না?’

‘আপনি আগে মস্কোয় আসেননি কখনো?’ কনস্তান্তিন বললেন কিছু-একটা বলতে হয় বলে।

‘আরে ওকে আপনি-আপনি করো না। এতে ও ভয় পায়। বেশ্যাবাড়ি থেকে পালাতে চেয়েছিল বলে যখন ওকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তখন সালিশ হাকিম ছাড়া কেউ ওকে আপনি বলেনি কখনো। সৃষ্টিকর্তা, এসব কি মাথামুণ্ডু হচ্ছে দুনিয়ায়!’ হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘যতসব নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান, সালিশ হাকিম, জেমভো, কি সব অনাসৃষ্টি ব্যাপার!’

এবং এসব নতুন প্রতিষ্ঠানের সাথে তার সংঘাতের কথা বলতে লাগল সে।

কনস্তান্তিন লেভিন শুনে যাচ্ছিলেন। কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মানে হয় না, ভাইয়ের এই মতটায় তাঁরও সায় ছিল এবং সে কথা প্রায়ই বলেছেনও, এখন কিন্তু ভাইয়ের মুখ থেকে সে কথা শুনতে বিছুছিরি লাগল তাঁর। ঠাট্টা করে বললেন, ‘পরপারে গিয়ে এসব বোঝা যাবে।’

‘পরপারে? এহ্, পরপার আমার ভালো লাগে না!’ ভাইয়ের মুখের দিকে ভীত বন্য চোখ মেলে সে বলল, ‘মনে হতে পারে, অপরের আর নিজের এসব নীচতা, গণ্ডগোল থেকে বেরিয়ে যেতে পারা তো ভালোই। কিন্তু ভয় পাই মরণকে, সাঙ্ঘাতিক ভয় পাই’, কেঁপে উঠল সে, ‘হ্যাঁ, কিছু-একটা পান কর। শ্যাম্পেন খাবে? নাকি চলে যাব কোথাও? চল জিপসীদের কাছে যাই! জানো, জিপসীদের আর রুশ গান আমি ভারি ভালোবেসে ফেলেছি।’

ওর জিব জড়িয়ে আসছিল, লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছিল বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে। মাথার সাহায্যে কনস্তান্তিন বোঝালেন যে কোথাও যাবার দরকার নেই, তাকে একেবারে মাতাল অবস্থায় শুইয়ে দিলেন।

মাশা কথা দিল দরকার হলে চিঠি লিখবে কনস্তান্তিনকে এবং নিকোলাই লেভিনকে ভাইয়ের কাছে গিয়ে থাকার জন্য বোঝাবে।

ছাব্বিশ

কনস্তান্তিন লেভিন সকালে মস্কে ছেড়ে সন্ধ্যায় বাড়ি পৌঁছলেন। পথে রেলের কামরায় তিনি সহযাত্রীদের সাথে কথা বলেন রাজনীতি, নতুন রেল পথ ইত্যাদি নিয়ে এবং মস্কোতে যা হয়েছিল, ঠিক তেমনি অর্থবোধের গোলমাল, নিজের ওপরেই অসন্তোষ, কি নিয়ে যেন একটা লজ্জা পেয়ে বসে তাঁকে; কিন্তু যখন নিজের স্টেশনে নামলেন, চিনতে পারলেন কাফতানের কলার তুলে দেওয়া কানা কোচোয়ান ইগ্নাতকে, স্টেশনের জানলা দিয়ে এসে পড়া আবছা আলোয় দেখলেন তাঁর গালিচা পাতা স্লেজখানা, লেজ-বাঁধা, আংটা আর থুপিতে সাজানো তাঁর ঘোড়াগুলোকে, স্লেজে মাল চাপাতে চাপাতেই ইগ্নাত যখন জানাচ্ছিল গ্রামের খবর, বলছিল ঠিকাদার এসেছে, বাচ্চা দিয়েছে পাভা, তখন উনি টের পেলেন যে গোলমেলে ভাবটা মিলিয়ে যাচ্ছে, কেটে যাচ্ছে লজ্জা আর নিজের ওপর অসন্তোষ। এটা তিনি অনুভব করেছিলেন শুধু ইগ্নাত আর ঘোড়াগুলোকে দেখেই। কিন্তু যখন তিনি তাঁর জন্য আনা মেষচর্মের কোট পরে ঢাকাঢুকো দিয়ে স্লেজে বসে রওনা দিলেন, ভাবতে লাগলেন গ্রামে আসন্ন ব্যবস্থা-বন্দোবস্তের কথা, দেখতে লাগলেন দন জাতের বাড়তি ঘোড়াটাকে, আগে যা ছিল দৌড়ের ঘোড়া, এখন গতর ভেঙে পড়লেও তেজ বজায় রেখেছে, তখন তিনি বুঝতে শুরু করলেন কি তাঁর হয়েছিল। স্বীয় সত্তা অনুভব করলেন তিনি, অন্য কিছু হবার সাধ তাঁর নেই। এখন তিনি চাইলেন শুধু আগের চেয়েও বেশি ভালো হতে। প্রথমত, উনি ঠিক করলেন, বিবাহ থেকে যে অসামান্য সুখ- শান্তি তাঁর পাবার কথা, সেদিন থেকে তার আর কোন ভরসা তিনি করবেন না, ফলে বর্তমানকে এমন তাচ্ছিল্য করবেন না তিনি। দ্বিতীয়ত, জঘন্য হৃদয়াবেগে আর কখনোই নিজেকে ভেসে যেতে তিনি দেবেন না, পাণিপ্রার্থনা করার সময় যার স্মৃতি তাঁকে এত যন্ত্রণা দিয়েছে। তারপর নিকোলাই ভাইয়ের কথা স্মরণ করে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করলেন যে তাকে কখনো ভোলা চলবে না, তার ওপর নজর রাখবেন, দৃষ্টিচ্যুত করবেন না তাকে যাতে মুশকিলে পড়লে সাহায্যের জন্য তৈরি থাকতে পারেন। আর সেটা ঘটবে শিগগিরই, এটা টের পাচ্ছিলেন তিনি। তারপর কমিউনিজম নিয়ে ভাইয়ের যে কথাবার্তাকে তিনি তখন হালকা করে দেখেছিলেন সেটা এখন তাঁকে ভাবাতে লাগল। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজার ব্যাপারটা তিনি বাজে কথা বলে গণ্য করতেন, কিন্তু লোকদের দারিদ্র্যের সাথে তুলনায় নিজের উদ্বৃত্তটা তাঁর কাছে সব সময়ই মনে হত অন্যায়। এখন তিনি মনে মনে ঠিক করলেন যে আগে অনেক খাটলেও এবং বিলাসে দিন না কাটালেও নিজেকে পুরোপুরি ন্যায়পরায়ণ বলে অনুভব করার জন্য এখন খাটবেন আরো বেশি করে এবং বিলাসে গা ভাসাবেন আরো কম। আর এসব করা তাঁর পক্ষে এত সহজ মনে হল যে সারা রাস্তা তিনি নানা প্রীতিকর কল্পনায় ডুবে গেলেন। একটা নতুন, উত্তম জীবন যাপনের আশায় চাঙ্গা হয়ে তিনি বাড়িতে পৌঁছলেন সন্ধ্যা আটটার পর।

বৃদ্ধা আয়া আগাফিয়া মিখাইলোভনা। এখন যিনি তাঁর সংসার দেখাশোনা করেন, তাঁর ঘরের জানালা থেকে আলো এসে পড়ল বাড়ির সামনেকার চাতালের বরফে। এখনো ঘুমাননি তিনি। কুজ্‌মাকে তিনি জানিয়ে দিলেন। ঘুম- ঘুম অবস্থায় খালি পায়ে সে ছুটে গেল অলিন্দে। কুজ্‌মাকে প্রায় উলটে ফেলে শিকারী কুকুর লাস্কাও ছুটে গিয়ে ডাক ছাড়তে লাগল, গা ঘষতে লাগল তাঁর হাঁটুতে, চাইছিল উঠে দাঁড়িয়ে তার সামনের দু’থাবা তাঁর বুকে রাখতে, তবে সাহস পাচ্ছিল না।

‘বড় তাড়াতাড়ি যে বাপু’, বললেন আগাফিয়া মিখাইলোভনা।

‘মন কেমন করছিল আগাফিয়া মিখাইলোভনা। পরের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া ভালো, তবে নিজের বাড়ি আরো ভালো’, এই বলে তিনি গেলেন নিজের স্টাডিতে।

মোমবাতি নিয়ে আসায় ধীরে ধীরে আলো হয়ে উঠল ঘরটা। ফুটে উঠল পরিচিত সব খুঁটিনাটি : হরিণের শিশু, বইয়ের তাক, চুল্লির একটা পাশ, বায়ু চলাচলের পাটা যা বহুকাল মেরামত করা হয়নি, বাপের সোফা, মস্তো টেবিলটা, তাতে পাতা-খোলা বই, ভাঙা ছাইদানি, তাঁর হস্তাক্ষরে লেখা নোটখাতা। এসব দেখে মুহূর্তের জন্য তাঁর সন্দেহ হল আসবার পথে যে নতুন জীবনের কল্পনা তিনি করছিলেন তা গড়ে তোলা সম্ভব কিনা। তাঁর জীবনের এসব চিহ্নগুলো যেন তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলছিল : ‘না, আমাদের ছেড়ে তুমি যেতে পারবে না, আর কেউ তুমি হবে না, হয়ে থাকবে তাই যা ছিলে : সন্দেহ, নিজের ওপর চিরকাল অসন্তোষ, সংশোধনের ব্যর্থ চেষ্টা আর হতাশা, সুখের আশা আর নিরন্তন তার প্রতীক্ষা নিয়ে যা পাওনি, তোমার পক্ষে যা পাওয়া অসম্ভব।’

কিন্তু এ কথা বলছিল জিনিসগুলো, অন্তরের ভেতরটা বলছিল যে বিগতের বশবর্তী থাকার প্রয়োজন নেই, সব কিছু করা তোমার পক্ষে সম্ভব। সে কথায় কান দিয়ে তিনি গেলেন ঘরের কোণটায় যেখানে ছিল তাঁর এক-এক পুদ ওজনের দুই ডাম্ব-বেল, নিজেকে চাঙ্গা করে তোলার চেষ্টা সেগুলো তুলে ব্যায়াম করতে লাগলেন। দরজার বাইরে পদশব্দ শোনা গেল। তাড়াতাড়ি ডাম্ব-বেল নামিয়ে রাখলেন তিনি।

ঘরে ঢুকে গোমস্তা বলল যে, সৃষ্টিকর্তার দয়ায় সবই ভালোয় ভালোয় চলছে, তবে শুকিয়ে তোলার নতুন ব্যবস্থাটায় বাক-হুইট পুড়ে গেছে। এ খবরটায় পিত্তি জ্বলে গেল লেভিনের। শুকাবার নতুন ব্যবস্থাটা লেভিনের বানানো এবং খানিকটা তাঁরই উদ্ভাবন। গোমস্তা সব সময়ই ছিল তার বিরুদ্ধে, এখন চাপা বিজয়োল্লাসে ঘোষণা করছে যে বাক-হুইট পুড়ে গেছে। লেভিন একেবারে নিঃসন্দেহ যে বাক-হুইট যদি ধরে গিয়ে থাকে, তাহলে শত বার যে সব ব্যবস্থা নেবার কথা তিনি বলেছিলেন তা নেওয়া হয়নি। বিরক্ত লাগল তাঁর, গোমস্তাকে বকুনি দিলেন। তবে একটা জরুরি, আনন্দের কথা : পাভা বাচ্চা দিয়েছে, এটি মেলা থেকে কেনা তাঁর সেরা, দামী গরু।

‘কুজ্‌মা, আমার ওভার-কোটটা দাও। আর তুমি লণ্ঠন আনতে বল। গিয়ে দেখে আসি’, গোমস্তাকে হুকুম করলেন। বাড়ির পেছনেই দামী গরুগুলোর গোয়াল। লাইলাক গাছগুলোর কাছে তুষারস্তূপ পেরিয়ে আঙিনা দিয়ে তিনি গোয়ালে গেলেন। হিমে জমাট দরজা খুলতেই গোবরের উষ্ণ ভাপ নাকে এল, লণ্ঠনের অনভ্যস্ত আলোয় অবাক হয়ে টাটকা খড়ের ওপর খচমচ করে উঠল গরুরা। ঝলক দিল ওলন্দাজ গরুর মসৃণ ছোপ-ছোপ কালো পিঠ। ঠোঁটে আংটা পরানো ষাঁড় বের্কুত শুয়ে ছিল, ভেবেছিল উঠে দাঁড়াবে, কিন্তু মত বদলে শুধু বার দুয়েক ফোঁস ফোঁস করল যখন তার কাছ দিয়ে যাচ্ছিল লোকেরা। হিপোপটেমাসের মত বিপুলকায়, রক্তিম সুন্দরী পাভা পেছন ফিরে বাছুরটাকে আড়াল করে তাকে শুঁকতে শুরু করল।

লেভিন স্টলের ভেতর ঢুকে পাভার দিকে তাকিয়ে দেখে লালচে-ছোপ বাছুরটাকে খাড়া করলেন তার লম্বা নড়বড়ে পায়ের ওপর। পাভা হাম্বা করে উঠতে চাইছিল, কিন্তু লেভিন যখন বাচ্চাটাকে তার দিকে এগিয়ে দিলেন, তখন শান্ত হয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাচ্চাটাকে চাটতে লাগল তার খড়খড়ে জিব দিয়ে। বাচ্চাটা খুঁজে খুঁজে নাক গুঁজল তার মায়ের পেটের নিচে, লেজ দোলাতে লাগল।

‘এখানটায় আলো দাও ফিওদর, লণ্ঠন আনো’, বাছুরটারকে দেখতে দেখতে বললেন লেভিন, ‘একেবারে মায়ের মত! যদিও রংটা পেয়েছে বাবার। দিব্যি হয়েছে। লম্বা, চওড়া। ভাসিলি ফিওদরোভিচ, দিব্যি হয়েছে তাই না?’ বাছুরটার জন্য আনন্দে তিনি বাক-হুইটের কথা একেবারে ভুলে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন গোমস্তাকে।

গোমস্তা বলল, ‘খারাপ হতে যাবে কেন? আপনি চলে যাবার পরের দিন ঠিকাদার সেমিওন এসেছিল। ওকে ফরমাশ দিতে হবে কনস্তান্তিন দ্‌মিত্রিচ। আর শুকাবার যন্ত্রটার কথা তো আগেই বলেছি।’

এই একটা কথায়ই লেভিন ডুবে গেলেন তাঁর সম্পত্তির খুঁটিনাটিতে। এ সম্পত্তি যেমন বড়, তেমনি জটিল। গোয়াল থেকে উনি সোজা গেলেন দপ্তরে, গোমস্তা আর ঠিকাদার সেমিওনের সাথে কথাবার্তা বলে বাড়ি ফিরলেন, সোজা ওপরতলার বৈঠকখানায় চলে গেলেন।

সাতাশ

পুরানো আমলের একটা বড় বাড়িটা। লেভিন তাতে একা থাকলেও সমস্ত বাড়িটাই গরম রাখার ব্যবস্থা করতেন, ব্যবহার করতেন বাড়িটা। জানত যে এটা বোকামি, এমন কি খারাপই এবং তাঁর বর্তমান নতুন পরিকল্পনার বিরোধী। কিন্তু লেভিনের কাছে বাড়িটা গোটা একটা জগৎ। এই জগতে দিন কাটিয়েছেন এবং প্রয়াত লেভিনের কাছে মনে হত সব কিছু পূর্ণতার পরাকাষ্ঠা, নিজের স্ত্রী, নিজের পরিবারকে নিয়ে সেটা পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্ন ছিল তাঁর।

তাঁর নিজের মাকে বড় একটা মনে পড়ে না। তাঁর সম্পর্কে তাঁর যা ধারণা, সেটা তাঁর কাছে পূত-পবিত্র একটা স্মৃতি, তাঁর মা যেমন নারীর অপূর্ব, পবিত্র আদর্শ, তাঁর পত্নীরও হওয়া উচিত তারই পুনরাবৃত্তি।

নারীকে বিবাহ ছাড়া ভালোবাসা তিনি কল্পনাও করতে পারতেন না—শুধু তাই নয়, সর্বাগ্রে তিনি সংসারের কথা ভাবতেন। তার পরে যে নারী তাঁকে সে সংসার দেবে, তাঁকে। তাই বিবাহ সম্পর্কে তাঁর ধারণাটা ছিল তাঁর অধিকাংশ চেনা-পরিচিতদের মত নয়, যাদের কাছে বিয়েটা হল নানান সামাজিক ব্যাপারের একটা। লেভিনের কাছে এটা জীবনের প্রধান ব্যাপার, যার ওপর নির্ভর করছে জীবনের সমস্ত সুখ। আর এখন সেটা ত্যাগ করতে হবে।

লেভিন সব সময় যে ছোট বৈঠকখানাটায় চা খেতেন সেখানে নিজের ইজি-চেয়ারে যখন বসলেন বই নিয়ে আর আগাফিয়া মিখাইলোভনা চা এনে তাঁর বরাবরকার ‘আমিও বসি বাছা’ বলে ঠাঁই নিলেন জানালার কাছে, তখন যত আশ্চর্যই হোক, স্বপ্নগুলো ছেড়ে গেল না তাঁকে, এ ছাড়া তিনি বাঁচতে পারেন না। ওকে নিয়ে হোক বা অন্য কাউকে নিয়েই হোক, এ ঘটবেই। বই পড়তে লাগলেন তিনি, যা পড়লেন তা নিয়ে ভাবছিলেন, থেকে থেকে ভাবনা থামিয়ে শুনছিলেন আগাফিয়া মিখাইলোভনার অনর্গল বকবকানি; সেই সাথে মহালের আর ভবিষ্যৎ পারিপারিক জীবনের অসংলগ্ন নানান ছবি ভেসে উঠতে লাগল তাঁর কল্পনায়। তিনি অনুভব করছিলেন যে তাঁর অন্তরের গভীরে কি-একটা যেন এসে পড়েছে, দৃঢ় হচ্ছে, বাসা পেতে বসছে।

ধর্মভয় নেই প্রখরের, ঘোড়া কেনার জন্য লেভিন তাকে যে টাকা দিয়েছিলেন তা দিয়ে সে বেদম মদ খাচ্ছে, পিটিয়ে আধমরা করেছে বৌকে—আগাফিয়া মিখাইলোভনার এসব কথা শুনছিলেন লেভিন; শুনছিলেন আর বই পড়ে যাচ্ছিলেন, পাঠ থেকে মনে যে সব ভাবনার উদয় হচ্ছিল লক্ষ করছিলেন তার গতি। এটা ছিল তাপ নিয়ে টিন্ডালের আত্মতুষ্টি আর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতির জন্য তাঁর সমালোচনার কথা। হঠাৎ একটা সুখচিন্তা ভেসে উঠল মনে : ‘দু’বছর পরে আমার পালে থাকবে দুটো ওলন্দাজ গরু, পাভা নিজেও হয়ত বেঁচে রইবে তখনো, তাছাড়া বারোটি বেকুত-এর বকনা, এর সাথে বিজ্ঞাপনের জন্য যোগ করা যাবে এই তিনটিকে চমৎকার!’ তিনি আবার বইয়ে মন দিলেন।

‘বেশ, বিদ্যুৎ আর তাপ না হয় একই জিনিস, কিন্তু একটা প্রশ্নের সমাধানে এক ধরনের রাশির জায়গায় আরেকটা বসানো যায় কি সমীকরণে? যায় না। তাহলে দাঁড়াল কি? প্রকৃতির সমস্ত শক্তির মধ্যে সম্পর্ক তো সহজ বোধেই টের পাওয়া যায়… ভারি সুখের কথা যে পাভা-র বকনটি হবে লালের ছোপ দেওয়া গরু আর সমস্ত পালটা যাতে যোগ দেবে এই তিনটা… চমৎকার! বৌ আর নিমন্ত্রিতদের সাথে যাব গরু দেখতে… বৌ বলবে, কনস্তান্তিন আর আমি এই বাছুরটাকে পেলেছি সন্তানের মত। অতিথিরা বলবে, এতে আপনার এত আগ্রহ কেন বলুন তো? ওর যাতে আগ্রহ তার সবেতেই আমি সাগ্রহী। কিন্তু কে সে?’ মস্কোয় যা ঘটেছে তা মনে পড়ল তাঁর… ‘কিন্তু করা যায় কি?… আমার তো দোষ নেই। কিন্তু এখন সবই চলবে নতুন খাতে। জীবন সেটা হতে দেবে না, অতীত হতে দেবে না, এটা বাজে কথা। ভালোভাবে, অনেক ভালোভাবে বাঁচার জন্য লড়তে হবে…’ মাথা তুলে তিনি ডুবে গেলেন চিন্তায়। লেভিনের আগমনে বুড়ি লাস্কার আনন্দ তখনো যায়নি, আঙিনায় ছুটে গিয়ে ডাক ছেড়ে সে ফিরল লেজ নাড়তে নাড়তে, সাথে নিয়ে এল বাতাসের গন্ধ, লেভিনের কাছে গিয়ে সে মাথা গুঁজল তাঁর হাতে, লেভিনের আদর কেড়ে করুণ সুরে গুঁইগুঁই করতে লাগল।

আগাফিয়া মিখাইলোভনা বললেন, ‘শুধু কথা বলে না যা। কুকুর তো… তবে বোঝে যে মনিব ফিরেছে, কিন্তু মন খারাপ।’

‘মন খারাপ হবে কেন?’

‘আমার কি চোখ নেই বাছা? এতদিনেও বাবুদের কি বুঝিনি? সেই ছোট থেকে আছি বাবুদের সংসারে। ও কিছু নয় বাপু। স্বাস্থ্য ভালো আর বিবেক পরিষ্কার থাকলেই হল।’

একদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন লেভিন, কেমন করে তাঁর ভাবনা ধরতে পেরেছে ভেবে অবাক লাগল তাঁর ‘কি, আরো চা আনব?’ এই বলে পেয়ালা নিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

লাস্কা তাঁর হাতে ক্রমাগত মুখ গুঁজছিল। লেভিন তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। সাথে সাথেই লাস্কা তাঁর পায়ের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে বেরিয়ে আসা পেছনের থাবাটায় মাথা রাখল। এখন সব ভালো, সব ঠিক আছে—এটা জানাবার জন্য সামান্য হাঁ করল সে, ঠোঁট চাটল আর বুড়ো দাঁতের কাছে চ্যাটচেটে জিবটা গুছিয়ে রেখে চুপ করে গেল পরমানন্দের প্রশান্তিতে। লেভিন মন দিয়ে লক্ষ করলেন তার এই শেষ কাণ্ডটা।

মনে মনে ভাবলেন, ‘তাহলে আমিও তাই! আমিও তাই করব! ভাবনা নেই… সবকিছু ঠিকঠাকই আছে!’

আটাশ

আন্না আর্কাদিয়েভনা বলনাচের পরে সেদিনই ভোরে তাঁর মস্কো ছাড়ার খবর দিয়ে স্বামীর কাছে টেলিগ্রাম পাঠালেন।

‘না-না, যেতে হবে! যেতেই হবে’, তাঁর সংকল্প পরিবর্তনটা তিনি ভাবীকে বোঝালেন এমন সুরে যেন এত কাজের কথা তাঁর মনে পড়েছে যে গুনে শেষ করা যায় না, ‘না, এখন বরং যাওয়াই ভালো!’

বাড়িতে খেলেন না অব্‌লোন্‌স্কি, কথা দিলেন বোনকে গাড়িতে তুলে দেবার জন্য আসবেন সাতটার সময়।

কিটিও এল না, চিরকুট লিখে পাঠাল যে তার মাথা ধরেছে। ছেলেমেয়ে আর ইংরেজ মহিলাটির সাথে খাওয়া সারলেন শুধু ডল্লি আর আন্না। শিশুরা একনিষ্ঠ নয় অথবা খুবই সজাগ বলেই কিনা কে জানে, তারা অনুভব করছিল, যেদিন তারা আন্নার অত ভক্ত হয়ে পড়েছিল, আজ তিনি মোটেই সেদিনের মত নন, তিনি আর ব্যস্ত নন ওদের নিয়ে, হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল ফুফুর সাথে তাদের খেলা, তাঁর প্রতি ভালোবাসা, তিনি যে আজ চলে যাচ্ছেন এতে মোটেই তাদের মনোযোগ দেখা গেল না। আন্না সারা সকাল ব্যস্ত ছিলেন যাত্রার তোড়জোড় নিয়ে। মস্কোর পরিচিতদের কাছে চিরকুট লিখলেন আন্না, হিসাবপত্র টুকে রাখলেন, মালপত্র গোছালেন। ডল্লির মনে হল উনি সুস্থির মেজাজে নেই, আর এই যে উদ্বেগের মেজাজ নিজেকে দিয়ে ডল্লির ভালোই জানা, তা বিনা কারণে ঘটে না আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা চাপা দেয় নিজের ওপর অসন্তোষ। খাওয়ার পর আন্না সাজগোজ করছে গেলেন নিজের ঘরে, ডল্লিও তাঁর সাথে সাথে এলেন।

ডল্লি তাঁকে বললেন, ‘আজ কেমন অদ্ভুত লাগছে তোমাকে!’

‘আমি? তাই মনে হচ্ছে তোমার? অদ্ভূত নই, তবে বিগড়ে আছি। ওটা আমার হয়। কেবলি কান্না পাচ্ছে। খুব বোকামি, কিন্তু কেটে যাবে’, তাড়াতাড়ি এই বলে আন্না তাঁর রক্তিম মুখ নোয়ালেন খেলনার মত থলেটার দিকে যাতে তিনি রাখছিলেন তাঁর নৈশ টুপি আর বাতিস্ত রুমাল। চোখ তাঁর অসম্ভব চকচক করছিল, অবিরাম পানি দেখা দিচ্ছিল তাতে, ‘পিটার্সবুর্গ থেকে নড়তে চাইছিলাম না, এখন এখান থেকে যেতেও মন সরছে না।’

তাঁর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডল্লি বললেন, ‘তুমি এখানে একটা উপকার করে গেলে। আন্না তাঁর দিকে কান্নাভেজা চোখে তাকালেন।

‘ডল্লি, ও-কথা বলো না। কিছুই আমি করিনি, করতে পারতামও না। প্রায়ই আমার অবাক লাগে কেন লোকে ষড়যন্ত্র করে আমাকে নষ্ট করার জন্য। কি আমি করেছি, কিইবা করতে পারতাম। ক্ষমা করার মত প্রচুর ভালোবাসা ছিল তোমার বুকের ভেতর।’

‘তুমি নইলে কি যে ঘটত সৃষ্টিকর্তাই জানেন। কি সৌভাগ্য তোমার!’ ডল্লি বললেন, ‘প্রাণটা তোমার পরিষ আর আর ভালো।’

‘ইংরেজরা যা বলে, প্রত্যেকের নিভৃত কক্ষেই কংকাল থাকে।

‘তোমার আবার কংকাল কি? তোমার সবই তো পরিষ্কার।’

‘আছে’, হঠাৎ বলে উঠলেন আন্না আর অশ্রুর পর অপ্রত্যাশিত ধূর্ত উপহাসের হাসিতে কুঞ্চিত হয়ে উঠল তাঁর ঠোঁট।

‘তা তোমার কংকালগুলো মোটেই গোমড়া নয়, মজাদার।’

‘না, গোমড়া। কাল নয়, আজকেই আমি যাচ্ছি কেন জান? এই যে স্বীকৃতিটা আমাকে পিষে মারছে সেটা তোমাকে বলতে চাই’, এই বলে আন্না দৃঢ়ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে পড়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন ডল্লির দিকে 1

আর ডল্লি অবাক হয়ে দেখলেন আন্না আকর্ণ লাল হয়ে উঠেছেন, গ্রীবায় লম্বিত চুলের কালো কুণ্ডলী পর্যন্ত।

আন্না বলে গেলেন, ‘হ্যাঁ, কিটি কেন খেতে এল না জানো? আমার ওপর তার ঈর্ষা হয়েছে। আমি নষ্ট করে ফেলেছি… বলনাচটা যে তার কাছে আনন্দের না হয়ে যন্ত্রণাকর হয়েছে আমি তার কারণ। কিন্তু সত্যি বলছি, সত্যি, আমার দোষ নেই, কিংবা দোষ সামান্য’, তিনি ‘সামান্য’ কথাটা সরু গলায় টেনে টেনে বললেন।

‘আহ্, কথাটা হল ঠিক স্তিভার মত’, হেসে উঠলেন ডল্লি।

আন্না আহত হলেন।

ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আরে না, না, আমি স্তিভা নই। আমি এ কথা বলছি কারণ আমি মুহূর্তের জন্যও নিজের ওপর নিজেকে সন্দিহান হতে দিই না।’

কিন্তু যখন তিনি এ কথা বলছিলেন, তখনই তিনি টের পেলেন যে তিনি ঠিক বলছেণ না; নিজেকে তিনি যে সন্দেহ করেছিলেন শুধু তাই নয়, ভ্রন্‌স্কির কথা ভেবে তিনি দোলায়িত বোধ গকরেছিলেন, এবং ভ্রন্‌স্কির সাথে আর যাতে দেখা না হয় শুধু এজন্যই যা ইচ্ছে ছিল তার আগেই তিনি চলে আসেন ওখান থেকে।

‘হ্যাঁ, স্তিভা আমাকে বলছিল যে তুমি ওর সাথে মাজুরকা নেচেছ আর সে… ‘

‘তুমি ভাবতে পারবে না কি হাস্যকর ব্যাপার দাঁড়াল। আমি শুধু ভেবেছিলাম ঘটকীয় কাজ করব আর হঠাৎ কিনা দাঁড়াল একেবারে অন্যরকম। হয়ত আমার অনিচ্ছাতেই আমি…’

লাল হয়ে উঠে থেমে গেলেন তিনি।

ডল্লি বললেন, ‘ওহ্ ওরা ওটা তখনই বোঝে!’

তাঁকে বাধা দিলেন আন্না, ‘কিন্তু ওর দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকলে আমি হতাশ হয়ে পড়তাম। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস এ সবই ভুলে যাবে ও, কিটিও আর ঘৃণা করবে না আমাকে।’

‘তবে আন্না, সত্যি বলতে, কিটির এ বিয়ে আমি বিশেষ চাই না। ভ্রন্‌স্কি যদি এক দিনেই তোমার প্রেমে পড়ে যেতে পারে, তাহলে এটা ভেঙে যাওয়াই ভালো।’

‘মাগো, সে যে ভারি বোকামি হবে!’ আন্না বললেন, আর তাঁর মনের ভাবনাটা কথায় ব্যক্ত হতে শুনে পরিতোষের গাঢ় রঙ আবার ফুটে উঠল তাঁর মুখে। ‘তাই আমি চলে যাচ্ছি কিটিকে শত্রু করে দিয়ে, যাকে বড় ভালোবাসি আমি। ইস, কি মিষ্টি মেয়ে! কিন্তু তুমি ঠিকঠাক করে দিও এটা, ডল্লি? করবে তো?’

ডল্লির হাসি চাপা দায় হয়েছিল। আন্নাকে তিনি ভালোবাসতেন কিন্তু তাঁরও দুর্বলতা আছে দেখে তৃপ্তিও পেলেন তিনি।

শত্রু? সে অসম্ভব।’

‘আমি তোমাদের যেমন ভালোবাসি, তোমরাও সবাই আমাকে তেমনি ভালোবাসো, এই তো আমার সাধ। আর এখন আমি আরো বেশি করে তোমাদের ভালোবাসছি’, আন্না চোখে পানি নিয়ে বললেন, ‘আহ্, আজ কি বোকার মত করছি!’

তিনি মুখে রুমাল বুলিয়ে সাজ-পোশাক করতে লাগলেন।

বিলম্বিত অব্‌লোন্‌স্কি এলেন ঠিক রওনা হবার মুখে। মুখটা লাল। গন্ধ বেরোচ্ছে মদ আর চুরুটের।

ডল্লির মধ্যেও আন্নার ভাবাবেগ সঞ্চারিত হল। শেষবারের মত আলিঙ্গন করার সময় তিনি ফিসফিসিয়ে ননদকে বললেন, ‘মনে রেখো আন্না, আমার জন্য তুমি যা করেছ তা জীবনে ভুলব না। মনে রেখো, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি আর চিরকাল নিজের সেরা বন্ধু বলে ভালোবেসে যাব।’

আন্না তাঁকে চুমু খেয়ে চোখের পানি আড়াল করে বললেন, ‘কিসের জন্য বুঝছি না।’

‘তুমি আমাকে বুঝেছ, বুঝতে পারছ। বোন আমার, তাহলে এসো!’

ঊনত্রিশ

ওয়াগনে ঢোকার পথ আগলে ভাই দাঁড়িয়ে ছিলেন তৃতীয় ঘণ্টি পড়া পর্যন্ত। তাঁকে শেষবার বিদায় জানাবার সময় আন্না আর্কাদিয়েভনার মনে প্রথম যে চিন্তাটা এল সেটা এই : ‘যাক, সৃষ্টিকর্তার দয়ায় সব তাহলে চুকে গেল!’ আনুষ্কার সাথে নিজের গদি-আঁটা বেঞ্চিতে বসে তিনি ঘুম-কামরার আধা-আলোয় তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। ‘যাক, কাল সেরিওজা আর কারেনিনকে দেখতে পাব, আগের মতই অভ্যস্ত জীবন চলবে ভালোভাবে।’

সমস্তটা দিন তিনি যে দুশ্চিন্তার মেজাজে ছিলেন সেই মেজাজেই তিনি যাত্রার জন্য গুছিয়ে বসতে লাগলেন একটা সন্তুষ্টি আর পারিপাট্য নিয়ে। ছোট ছোট নিপুণ হাতে তিনি একটা লাল থলে খুললেন আর বন্ধ করলেন, একটা বালিশ বের করে রাখলেন কোলের ওপর, নিখুঁতভাবে পা কম্বলে জড়িয়ে শান্ত হয়ে আসন নিলেন। অসুস্থ একজন মহিলা শোবার আয়োজন করছিলেন, অন্য দুজন মহিলা কথা বলতে লাগলেন আন্নার সাথে, স্থূলকায়া এক বৃদ্ধা পা ঢেকে তাপের অব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর অসন্তোষ জানালেন। কয়েক কথায় মহিলাদের প্রশ্নের উত্তর দিলেন আন্না, কিন্তু কথোপকথন থেকে কোন আকর্ষণের আশা নেই দেখে তিনি একটা লণ্ঠন আনতে বললেন আনুষ্কাকে, সিটের হাতলের সাথে সেটাকে বেঁধে নিজের হ্যান্ড ব্যাগ থেকে পাতা কাটার ছুরি আর একটা ইংরেজি নভেল বের করলেন। প্রথমটা তাঁর পড়ায় মন বসছিল না, গোড়ায় ব্যাঘাত হচ্ছিল মানুষের ব্যস্ততা আর হাঁটাহাঁটিতে; তারপর ট্রেন যখন ছাড়ল, শব্দগুলোয় কান না পেতে পারা গেল না। শেষ বাঁ দিকের জানালায় ঝাপট মারা, শার্সিতে লেপটে যাওয়া তুষারকণা, একদিকে তুষারে ছাওয়া পোশাকে যে কন্ডাক্টর পাশ দিয়ে চলে গেল তার চেহারা, বাইরে কি ভয়াবহ বরফ ঝড় চলছে তা নিয়ে আলাপে মনোযোগ আকৃষ্ট হল তাঁর। তারপর সেই একই ব্যাপার চলতে থাকল : ঝকঝক শব্দে সেই একই ঝাঁকুনি, জানালায় সেই দ্রুত বদল, আধা-অন্ধকারে সেই একই মুখগুলোর ঝলক, সেই একই কণ্ঠস্বর। ফলে আন্না পড়তে শুরু করলেন এবং পঠিত বিষয় বোধগম্যও হতে থাকল। দস্তানা পরা চওড়া হাতে, যার একটা ছেঁড়া, কোলের ওপর লাল থলেটা চেপে আনুষ্কা ঢুলতে শুরু করলে। আন্না আর্কাদিয়েভনা পড়ছিলেন আর বুঝতে পারছিলেন যে পড়তে অর্থাৎ অন্য লোকের জীবনের প্রতিফলন দেখতে তাঁর ভালো লাগছে না। নিজেই তিনি বড় বেশি বাঁচতে চান। যখন পড়ছিলেন উপন্যাসের নায়িকা রোগীর কি রকম সেবাযত্ন করছেন, তখন তাঁর নিজেরই ইচ্ছে হচ্ছিল নিঃশব্দে রোগীর ঘরে ঘুরে বেড়াতে; যখন পড়ছিলেন পার্লামেন্ট সভ্যের বক্তৃতার কথা, তখন তাঁর নিজেরই ইচ্ছে হচ্ছিল সেরকম বক্তৃতা দিতে; যখন পড়ছিলেন লেডি মেরি তাঁর ভ্রাতৃবধূকে চটিয়ে দিয়ে এবং নিজের দুঃসাহসে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘোড়ায় চেপে ধাওয়া করেছেন একপাল কুকুরের পেছনে তখন আন্নাও তাই করতে চাইছিলেন। কিন্তু করার কিছু ছিল না, ছোট ছোট হাতে মসৃণ ছুরিটা নাড়াচাড়া করতে করতে তিনি জোর করে পড়ে চললেন।

উপন্যাসের নায়ক তখন ব্রিটিশ সুখ, ব্যারন খেতাব আর সম্পত্তি অর্জন করতে চলেছে, আন্নারও ইচ্ছে হল তার সাথে তিনিও সম্পত্তিতে যান কিন্তু হঠাৎ তাঁর মনে হল নায়কের এর জন্য লজ্জা হওয়ার কথা এবং তাঁর নিজেরই লজ্জা হচ্ছে। কিন্তু কেন নায়কের লজ্জা হবে? ‘কেন আমার লজ্জা?’ আহত বিস্ময়ে তিনি প্রশ্ন করলেন নিজেকে। বই বন্ধ করে পাতা কাটার ছুরিটা দুহাতে শক্ত করে ধরে আন্না সীটে হেলান দিলেন। লজ্জার কিছু নেই। মস্কোর সব স্মৃতি তিনি বেছে বেছে দেখলেন। সবই ভালো, প্রীতিকর। মনে পড়ল বলনাচ, মনে পড়ল ভ্রন্‌স্কিকে, তাঁর প্রেমে পড়া বশীভূত মুখ। মনে পড়ল তাঁর সাথে নিজের গোটা সম্পর্কটার কথা; এতে লজ্জা পাবার মত কিছু ছিল না। আর সেই সাথে, স্মৃতিচারণের ঠিক এখানটাতেই লজ্জাবোধ বেড়ে উঠল। যখন ভ্রন্‌স্কির কথা মনে করছিলেন ঠিক তখনই ভেতরকার কোন একটা কণ্ঠস্বর যেন তাঁকে বলছিল : ‘দরদ, বড় বেশি দরদ, মদিরতা।’

‘তাতে কি হয়েছে?’ আসনের জায়গা বদলিয়ে দৃঢ়ভাবে তিনি বললেন নিজেকে। ‘তাতে কি দাঁড়াল? এটাকে সোজাসুজি দেখতে কি ভয় পাই আমি কি হল এতে? প্রতিটা চেনাজানা লোকের ক্ষেত্রে যা হয় তা ছাড়া এই বাচ্চা অফিসারটির সাথে আমার অন্য কোন সম্পর্ক আছে কি, থাকতে পারে কি?’ অবজ্ঞাভরে হাসলেন তিনি, বই টেনে নিলেন, কিন্তু যা পড়ছিলেন তার কিছুই আর মাথায় ঢুকছিল না। কাগজ-কাটা ছুরিটা তিনি ঘষলেন শার্সিতে, তারপর তার মসৃণ ঠাণ্ডা গা-টা চেপে ধরলেন গালে, আর হঠাৎ আসা আনন্দে প্রায় সশব্দেই হেসে উঠছিলেন আর কি। তিনি অনুভব করছিলেন যে তাঁর স্নায়ুগুলো মোচড় দেওয়া বেহালার তারের মত টান-টান হয়ে উঠছে। টের পাচ্ছিলেন যে ক্রমেই বড় বড় হয়ে উঠছে তাঁর চোখ, তাঁর হাত-পায়ের আঙুলগুলো স্নায়বিক বিক্ষেপে নড়ছে, ভেতর থেকে কি যেন চাপ দিচ্ছে তাঁর নিঃশ্বাসে, আর দোলায়মান এই আধা-অন্ধকারের সমস্ত মূর্তি আর ধ্বনি অসাধারণ স্পষ্টতায় অভিভূত করছে তাঁকে। অবিরাম সন্দেহের এক-একটা মূহূর্ত এসে পড়ছিল তাঁর ওপর—গাড়িটা সামনে যাচ্ছে, নাকি পেছনে, নাকি দাঁড়িয়েই আছে। ওঁর কাছে ও কে, আনুষ্কা নাকি বাইরের কোন লোক? ‘হাতলে ওটা কি, ফার কোট নাকি কোন জানোয়ার? আর আমি-বা এখানে কেন? এটা আমি নাকি অন্য কেউ?’ এই ঘোরের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে ভয় হচ্ছিল তাঁর। কিন্তু কি যেন তার ভেতর ঠেলে বসছিল, খুশিমত তিনি তাতে আত্মসমর্পণ করতেও পারেন, নাও পারেন। সম্বিত ফিরে পাবার জন্য তিনি উঠে দাঁড়ালেন, কম্বলটা সরিয়ে ফেললেন, কেপ খসিয়ে নিলেন গরম পোশাকটা থেকে। এক মুহূর্তের জন্য সম্বিত ফিরে পেলেন তিনি, বুঝতে পারলেন লম্বা ওভারকোট পরা যে লোকটা ঢুকল, যাকে একটা বোতাম নেই, বুঝতে পাররেন যে সে থার্মোমিটার দেখছে, দরজা দিয়ে তার পেছনে আসছে হাওয়া আর বরফের ঝাপটা; কিন্তু পরে আবার সব গুলিয়ে গেল… দীর্ঘ কটি পুরুষটি কি যেন কামড়াতে লাগল দেয়ালে। বৃদ্ধা তার ঠ্যাং বাড়াতে লাগল গোটা ওয়াগন বরাবর। কামরা ভরে তুলল কালো মেঘে, তারপর কিসের যেন ভয়ংকর ক্যাচক্যাচ ঠকঠক শব্দ উঠল যেন কাউকে কেটে কুটিকুটি করা হচ্ছে। তারপর চোখ ধাঁধিয়ে গেল লাল আলোয়, শেষে সব ঢাকা পড়ে গেল একটা দেয়ালে। আন্না টের পেলেন যে, তিনি পড়ে যাচ্ছেন কিন্তু তাতে ভয় না পেয়ে তাঁর খুশিই লাগছিল। পোশাকে জড়াজড়ি হয়ে তুষার-কণায় ছাওয়া একটা লোক কি যেন চেঁচিয়ে বলল তাঁর কানে। সম্বিত ফিরে আন্না উঠে দাঁড়ালেন; তিনি বুঝতে পারলেন যে কোন স্টেশনে এসেছেন আর ঐ লোকটা কন্ডাক্টর। যে কেপটা খুলে ফেলেছিলেন সেটা আর রুমাল দিতে বললেন আনুষ্কাকে। সেগুলো পরে গেলেন দরজার দিকে 1

আনুষ্কা বলল, ‘নামছেন নাকি?’

‘হ্যাঁ, এখানে ভীষণ গরম। একটু নিঃশ্বাস নিই গিয়ে।

আন্না দরজা খুললেন। তাঁর দিকে বাতাস আর তুষারকণার ঝাপটা ধেয়ে এল, তাঁর সাথে দরজা নিয়ে হুটোপুটি বাধাল। আন্নার এতে মজাই লাগল। দরজা খুলে তিনি নেমে গেলেন। বাতাস যেন ঠিক এরই অপেক্ষায় ছিল, সোল্লাসে শনশনিয়ে জাপটে ধরে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইল তাঁকে, কিন্তু পাদানির ঠাণ্ডা রেলিং আঁকড়ে গাউন চেপে ধরে

প্ল্যাটফর্মে নামলেন আন্না, গেলেন ওয়াগন পেরিয়ে। পৈঠায় বাতাসের জোর ছিল প্রচণ্ড, কিন্তু প্ল্যাটফর্মে ওয়াগনের আড়ালে তা শান্ত। পরিতৃপ্তিতে বুক ভরে তুষারমথিত হিমেল নিঃশ্বাস নিয়ে তিনি ওয়াগনের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্ল্যাটফর্ম আর আলোকিত স্টেশনটাকে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *