আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৩.৩০

ত্রিশ

সেপ্টেম্বর মাসের শেষে গোয়াল বানাবার জন্য কাঠ এনে ফেলা হল, গরুর দুধের মাখন বেচে তার লাভ ভাগাভাগি করা হল। কার্যক্ষেত্রে ব্যাপারটা চলতে লাগল চমৎকার, অন্তত লেভিনের তাই মনে হল। সমস্ত জিনিসটা তাত্ত্বিকভাবে প্রতিপন্ন করা এবং রচনাটা শেষ করা যা লেভিনের কল্পনায় অর্থশাস্ত্রে শুধু বিপ্লবই ঘটাবে না, তাকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে করবে একটা নতুন শাস্ত্র-কথা, জমির সাথে জনগণের সম্পর্ক-এর জন্য প্রয়োজন ছিল বিদেশে গিয়ে এই দিক দিয়ে কি করা হয়েছে তা দেখা এবং সেখানে যে যা-কিছু করা হয়েছে সেটা যা দরকার তা নয়-এর অকাট্য প্রমাণ আবিষ্কার করা। গম সরবরাহের জন্য অপেক্ষা করছিলেন লেভিন, টাকাটা পেলেই বিদেশে চলে যাবেন, কিন্তু শুরু হল বৃষ্টি, জমিতে যে শস্য আর আলু তখনো বাকি তা তোলা গেল না, থেমে গেল সমস্ত কাজ, এমন কি গম সরবরাহও। রাস্তায় দুর্গম কাদা; বানের তোড়ে ভেসে গেল দুটো হাওয়া-কল, ক্রমেই খারাপ হতে থাকল আবহাওয়া।

৩০ সেপ্টেম্বর সূর্য দেখা দিল, এবার আবহাওয়া ভালো যাবে এই আশায় লেভিন যাত্রার জন্য মন স্থির করে তৈরি হতে লাগলেন। গম বোঝাই করার হুকুম দিলেন তিনি, বেনিয়ার কাছে গোমস্তাকে পাঠালেন টাকার জন্য, এবং চলে যাবার আগে শেষ নির্দেশাদি দানের জন্য নিজে গেলেন আবাদ দেখতে।

সব কাজ সেরে চামড়ার আচ্ছাদন বেয়ে গড়ানো পানির ধারায় ঘাড়ে পায়ে ভিজে, তবে ভারি চাঙ্গা হয়ে খোশমেজাজে সন্ধ্যার দিকে তিনি ঘরে ফিরলেন। সন্ধ্যায় আবহাওয়া হয়েছিল খারাপ। সর্বাঙ্গ ভেজা, কান আর মাথা ঝটকানো ঘোড়াটা এমন ঘা খাচ্ছিল শিলাবৃষ্টিতে যে পাশকে হয়ে চলছিল সেটা। কিন্তু হুডের তলে দিব্যি ছিলেন লেভিন, খুশি হয়ে তিনি তাকাচ্ছিলেন চারপাশে, কখনো খানা দিয়ে ছুটন্ত ঘোলা পানির স্রোতের দিকে, কখনো ন্যাড়া ডালের ডগায় লেগে থাকা পানির ফোঁটা, কখনো সেতুর তক্তায় পড়ে থাকা শিলার সাদা ছোপ, কখনো আনগ্ন বিচ গাছের চারপাশে ঘন হয়ে জমে ওঠা তখনো সরস, শাঁসালো কলাপাতাগুলোর দিকে। চারপাশে বিমর্ষ আবহাওয়া সত্ত্বেও লেভিনের খুব খুশি লাগছিল। দূরের গ্রামটায় কৃষকদের সাথে তাঁর যে কথাবার্তা হয় তাতে দেখা গেল যে তারা নতুন সম্পর্কে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে। যে জমাদারের বাড়িতে পোশাক শুকিয়ে নেবার জন্য লেভিন উঠেছিলেন, স্পষ্টতই সে তাঁর পরিকল্পনা অনুমোদন করছিল, গরু কেনার সমবায়ে যোগ দেবার প্রস্তাব দেয় সে নিজেই।

‘অটলভাবে শুধু নিজের লক্ষ্যে দিকে এগোনো চাই, তাহলেই সেটা সিদ্ধ হবে’, ভাবছিলেন লেভিন, ‘এর জন্যে খাটাখাটুনির একটা অর্থ আছে বৈকি এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, প্রশ্নটা সাধারণের কল্যাণ নিয়ে। সমস্ত চাষ – আবাদ, প্রধানত লোকদের অবস্থা একেবারে বদলাতে হবে। দারিদ্র্যের বদলে-সাধারণ সমৃদ্ধি, সন্তুষ্টি; শত্রুতার বদলে- মিল, স্বার্থে স্বার্থে যোগ। এক কথা, বিনা রক্তপাতে বিপ্লব, কিন্তু এই যে মহাবিপ্লব প্রথমে সেটা হবে আমাদের উয়েজদে, পরে গুবের্নিয়ায়, রাশিয়ায়, শেষে সারা বিশ্বে। কেননা ন্যায্য একটা ভাবনা ফলপ্রসূ না হয়ে যায় না। হ্যাঁ, এই উদ্দেশ্যের জন্যে খাটার সার্থকতা আছে। আর খাটছি যে আমি, সেই কস্তিয়া লেভিন, বলনাচের আসরে যে গিয়েছিল কালো গলাবন্ধ এঁটে, কিটি শ্যেরবাৎস্কায়া যাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, নিজের কাছেই যে করুণাস্পদ, অকিঞ্চিৎকর, তাতে কিছুই প্রমাণ হয় না। আমার দৃঢ় ধারণা, নিজের সব কিছু স্মরণ করে বেঞ্জামিন ফ্যাঙ্কলিনই নিজেকে এমনি অকিঞ্চিৎকর জ্ঞান করতেন, এমনি আত্মবিশ্বাসহীন। এর কোন মানে হয় না। ওঁরও মনে হয় নিজের এক আগাফিয়া মিখাইলোভনা ছিল, যার কাছে তিনি তাঁর পরিকল্পনাগুলোর কথা খুলে বলতেন।’

লেভিন এসব ভাবতে ভাবতে অন্ধকারে বাড়িতে এসে পৌঁছলেন।

গোমস্তা বেনিয়ার কাছে গিয়ে ফিরে এসেছে গমের জন্য টাকার একাংশ নিয়ে, জমাদারের সাথে কথা বলে নিয়েছে, পথে আসতে আসতে সে শুনেছে যে অন্য লোকদের শস্য সর্বত্রই এখনো খেতেই থেকে গেছে, তাই তাদের যে একশ’ ষাট গাদি তোলা হয়নি সেটা অন্যদের তুলনায় কিছুই নয়।

লেভিন খাওয়া সেরে সচরাচরের মত ইজিচেয়ারে বসলেন বই নিয়ে এবং পড়তে পড়তেই ভেবে চললেন তাঁর রচনা প্রসঙ্গে আসন্ন সফরটার কথা। আজ তাঁর উদ্যোগের পুরো তাৎপর্য বিশেষ স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে তাঁর কাছে, আপনা থেকেই তাঁর চিন্তার মর্মার্থ প্রকাশের মত বাক্যাবলি দেখা দিতে থাকল তাঁর মনে। ভাবলেন, ‘এগুলো লিখে রাখতে হবে, এগুলো হবে সংক্ষিপ্ত মুখবন্ধ যা আগে আমি ভেবেছিলাম নিষ্প্রয়োজন।’ লেখার টেবিলে যাবার জন্য তিনি উঠে দাঁড়ালেন, পায়ের কাছে শুয়ে থাকা লাস্কাও টানটান হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাকাল তাঁর দিকে, যেন জিজ্ঞেস করছে কোথায় যাওয়া হবে। কিন্তু লেখার ফুরসত হল না, কেননা মণ্ডলেরা এল তাঁর কাছে। লেভিনও তাদের সাথে দেখা করতে প্রবেশ-কক্ষে গেলেন।

মণ্ডলদের পরে, অর্থাৎ পরের দিনের কাজের নির্দেশাদি দেওয়া এবং তাঁর কাছে যেসব চাষীর কাজ ছিল তাদের সাথে দেখা করার পর লেভিন তাঁর স্টাডিতে গিয়ে লেখায় বসলেন। লাস্কা শুয়ে পড়ল টেবিলের নিচে; আগাফিয়া মিখাইলোভনা তাঁর নিজের জায়গায় মোজা বুনতে বসলেন।

কিছুক্ষণ লেখার পর হঠাৎ অসাধারণ তীক্ষ্ণতায় তাঁর মনে ভেসে উঠল কিটি, তার প্রত্যাখ্যান, তাকে শেষ দেখার স্মৃতি। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন ঘরে।

‘আরে, ছটফট করার কিছু নেই’, আগাফিয়া মিখাইলোভনা তাঁকে বললেন, ‘ঘরে বসে আছেন কেন? যখন যাবেন ঠিক করেছেন তখন ওই গরম ফোয়ারাগুলোর কাছে গেলেই পারেন।’

‘পরশুই যাচ্ছি আগাফিয়া মিখাইলোভনা। কাজগুলো শেষ করতে হবে। কাজ আবার কি! কৃষকদের আপনি উপকার করেছেন কি কম! লোকে বলে, জার এর জন্যে আপনাকে শিরোপা দেবে। সত্যি অবাক মানি, কৃষকদের জন্যে আপনার কি এত দরদ!’

‘তাদের জন্যে নয়, যা করছি তা নিজের জন্যে।’

বিষয়-আশয় নিয়ে লেভিনের পরিকল্পনার সমস্ত খুঁটিনাটি জানা ছিল আগাফিয়া মিখাইলোভনার। লেভিন প্রায়ই তাঁর ভাবনার সূক্ষ্ম দিকগুলোর কথাও তাঁকে বলতেন, তাঁর সাথে তর্ক আর তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সাথে অমত কম হত না। কিন্তু এখন উনি যা বললেন তা একেবারে ভিন্ন অর্থে বুঝলেন আগাফিয়া মিখাইলোভনা।

তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘নিজের আত্মার জন্যে, তা ভালো, সেই কথাই তো ভাবা চাই। এই তো আমাদের পারফেন দেনিসিচ্ ‘ক’ অক্ষর গোমাংস, কিন্তু যেভাবে মরল, সৃষ্টিকর্তা করুন যেন সবাই মরতে পারে সেভাবে’, বললেন তিনি সম্প্রতি বিগত এক বাঁধা চাক সম্পর্কে, …. আশীর্বাদ নেওয়া, শেষকৃত্য করা, সবই করে গেল।’

‘সে কথা আমি বলছি না’, লেভিন বললেন, ‘আমি বলছি যে এ সব করছি নিজের লাভের জন্যে। চাষীরা যদি ভালো করে খাটে, তাতে আমারই লাভ।’

‘তা আপনি যতই করুন, চাষী যখন আলসে তখন সবই ভস্মে ঘি ঢালা। বিবেক থাকলে কাজ করবে, না থাকলে কিছুই হবার নয়।

‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি নিজেই তো বলছেন যে গোয়ালের কাজে ইভান ভালো করে খাটতে শুরু করেছে।’

‘আমি শুধু একটা কথাই বলি’, আগাফিয়া মিখাইলোভনা জবাব দিলেন স্পষ্টতই হঠাৎ করে নয়, নিজের চিন্তার কঠোর সঙ্গতি অনুসরণ করে, ‘আপনার বিয়ে করা উচিত, এই হল কথা!’

নিজেই তিনি এইমাত্র যা ভাবছিলেন, আগাফিয়া মিখাইলোভনা ঠিক সেটারই উল্লেখ করায় বিরক্ত ও আহত করলেন লেভিন। ভুরু কোঁচকালেন তিনি, কোন জবাব না দিয়ে আবার বসলেন কাজে, কাজটার তাৎপর্য নিয়ে যা ভাবছিলেন, আবার তা আওড়ালেন মনে মনে। স্তব্ধতার মধ্যে মাঝে মাঝে তাঁর কানে আসছিল আগাফিয়া মিখাইলোভনার উল বোনার কাঁটার শব্দ, আর যা তিনি মনে করতে না সেটা মনে পড়ে গিয়ে আবার ভুরু কোঁচকালেন।

ঘণ্টি আর কাদায় গাড়ি টানার চাপা শব্দ শোনা গেল ন’টার সময়।

‘আমাদের এখানে কেউ তাহলে অতিথি এল, আপনার আর বেজার লাগবে না’, উঠে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললেন আগাফিয়া মিখাইলোভনা না, ‘যে কোন অতিথিই আসুক, তাতে খুশি লেভিন।’

একত্রিশ

লেভিন সিঁড়ির অর্ধেকটা পর্যন্ত নেমে প্রবেশ-কক্ষে পরিচিত একটা কাশির শব্দ শুনলেন কিন্তু নিজের পদক্ষেপের শব্দের দরুন শুনলেন অস্পষ্টভাবে আর আশা করলেন যে ভুল শুনেছেন; তারপর চোখে পড়ল পূর্ণ দৈর্ঘ্যে হাড্ডিসার মূর্তিটা, আত্মপ্রবঞ্চনার অবকাশ আর রইল না, তাহলেও তখনো আশা করতে লাগলেন যে তাঁর ভুল হয়েছে, লম্বা যে মানুষটা কাশতে কাশতে কোট খুলছে সে তাঁর বড় ভাই নিকোলাই নয়।

লেভিন বড় ভাইকে ভালোবাসতেন কিন্তু তার সাথে একত্রে থাকাটা সব সময়ই হত একটা যন্ত্রণার ব্যাপার। আর এখন তাঁর মনে যে চিন্তা আসছিল আর আগাফিয়া মিখাইলোভনার যে উক্তিগুলোর প্রভাবে তিনি যখন একটা অস্পষ্ট গোলমেলে অবস্থার মধ্যে রয়েছে, তখন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎটা মনে হল বিশেষ কষ্টকর। হাসিখুশি, সুস্থ, অনাত্মীয় এক অতিথি যে তাঁর অন্তরের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করতে পারবে বলে তিনি আশা করেছিলেন তার বদলে তাঁকে দেখতে হচ্ছে কিনা বড় ভাইকে, যে তাঁকে আদ্যন্ত চেনে, তাঁর অতি অন্তর্নিহিত ভাবনাগুলোকে যে খুঁচিয়ে তুলবে, সব কিছু পুরোপুরি খুলে বলতে বাধ্য করবে তাঁকে। আর সেটা তিনি চাইছিলেন না।

বিছ্‌ছিরি এই মনোভাবটার জন্য নিজেই নিজের ওপর চটে গিয়ে লেভিন ছুটে গেলেন প্রবেশ-কক্ষে। বড় ভাইকে কাছ থেকে দেখামাত্র কিন্তু ব্যক্তিগত হতাশার ভাটা মিলিয়ে গিয়ে তার জায়গায় দেখা দিল করুণা। নিকোলাই ভাইকে তার শীর্ণতা ও রুগ্ণতায় আগে যত ভয়ংকরই লাগুক এখন সে আরো শীর্ণ, আরো রুগ্‌ণ। এ যেন চর্মাবৃত এক কঙ্কাল।

প্রবেশ-কক্ষে লম্বা রোগা গলাটা ঝটকাতে ঝটকাতে মাফলার খুলছিল সে। অদ্ভূত একটা করুণ্যে হাসল। দীন, বাধ্য সে হাসি দেখে লেভিন অনুভব করলেন যে তাঁর গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে উঠছে।

‘এই তো চলে এলাম তোমার কাছে’, ভাইয়ের মুখের ওপর থেকে মুহূর্তের জন্যও চোখ না সরিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় নিকোলাই বলল, ‘অনেকদিন থেকেই আসতে চাইছিলাম, কিন্তু শরীর ভালো যাচ্ছিল না, এখন কিন্তু বেশ ভালো হয়ে উঠেছি’, দাড়িতে বড় বড় রোগা হাত বুলিয়ে বলল সে।

‘বেশ করেছ!’ লেভিন বললেন। আর চুমু খেতে গিয়ে ঠোঁটে বড় ভাইয়ের শরীরের শুষ্কতা অনুভব করে আরো ভয়ঙ্কর লাগল তাঁর, দেখলেন নিজের চোখের সামনে বড় ভাইয়ের বড় বড়, অদ্ভূত রকমের জ্বলজ্বলে চোখ।

কয়েক সপ্তাহ আগে লেভিন বড় ভাইকে লিখেছিলেন যে জমির ছোট যে অংশটুকু অবণ্টিত পড়ে ছিল তার বিক্রি বাবদ প্রায় দু’হাজার রুবলের মত তার ভাগটা সে পেতে পারে।

নিকোলাই বলল যে সে এখন এসেছে টাকাটা নিতে এবং প্রধান কথা নিজের নীড়ে থাকতে, মাটি ছুঁতে যাতে পুরাকালের মহাবীরদের মত আসন্ন ক্রিয়াকলাপগুলোর জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। নিকোলাই আরো কুঁজো হয়ে গেলেও এবং নিজের দৈর্ঘ্যের তুলনায় আশ্চর্যরকম শীর্ণ হয়ে থাকলেও তার গতিবিধি বরাবরের মতই ক্ষিপ্র ও ঝটকা- মারা। লেভিন তাকে নিয়ে গেলেন স্টাডিতে।

অসম্ভব যত্ন সহকারে বড় ভাই পোশাক বদলাল, যা আগে কখনো দেখা যায়নি, পাতলা হয়ে আসা সোজা সোজা চুলগুলোকে আঁচড়াল, তারপর হেসে ওপরে উঠল।

মেজাজ তার অতি স্নেহশীল আর শরীফ, বাল্যকালে লেভিন তাকে বে-রকমটা দেখেছিলেন। এমন কি কজ্‌নিশেভের কথাও সে বলল বিনা বিদ্বেষ। আগাফিয়া মিখাইলোভনাকে দেখে একটু ঠাট্টা করল, জিজ্ঞেস করল পুরানো চাকর-বাকরদের খবরাখবর। পারফেন দেনিসিচ মারা গেছে মুনে বিচলিত হল সে; একটা ভীতি ফুটে উঠল মুখে; তবে সাথে সাথেই সেটা সে বেড়ে ফেলল।

‘ও তো বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিল’, এই বলে প্রসঙ্গটা সে পালটাল, ‘হ্যাঁ, তোমার এখানে একমাস কি দু’মাস থাকব, তারপর মস্কোর। জানো, নিয়াকভ আমাকে একটা চাকরি দেবে বলে কথা দিয়েছে, আমিও কাজই নেব। এখন আমি জীবনটাকে চালাব অন্যভাবে’, বলে চলল সে, ‘জানো, ওই নচ্ছার মহিলাটাকে তাড়িয়ে দিয়েছি।’

‘মারিয়া নিকোলায়েভনাকে? সে কি?’

‘এহ্, ও একটা নচ্ছার মহিলা! আমার বড় ক্ষতি করেছে।’ কিন্তু কি ক্ষতি করেছে সেটা সে বলল না। সে তো আর বলতে পারে না যে মারিয়া নিকোষায়েভনাকে সে ভাগিয়েছে চা’টা কড়া হয় নি বলে, এবং প্রধান কথা, তাড়িয়েছে কারণ ও তার দেখাশোনা করত এমনাবে যেন সে একটা রোগী। ‘তা ছাড়া মোটের ওপর আমি এখন চাই জীবনটা একেবারে বদলে নিতে। বলা বাহুল্য সবার মত আমিও আহাম্মকি করেছি, তবে টাকাকড়িটা সবচেয়ে তুচ্ছ ব্যাপার, ওর জন্যে আমার আফসোস নেই। শুধু স্বাস্থ্য থাকলেই হল আর স্বাস্থ্যটা, দয়াময় সৃষ্টিকর্তা, ভালো হয়েছে।’

লেভিন শুনছিলেন আর ভাবছিলেন, কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলেন না কি বলবেন। নিকোলাইও সম্ভবত একই ব্যাপার বোধ করছিল; লেভিনের অবস্থা কেমন চলছে তা নিয়ে জিজ্ঞেসাবাদ করতে লাগল সে; নিজের কথা বলতে গিয়ে খুশি হলেন লেভিন, কেননা সে কথা তিনি বলতে পারেন ভান না করে। নিজের পরিকল্পনা আর কার্যকলাপের কথা তিনি বললেন বড় ভাইকে।

বড় ভাই শুনছিল, কিন্তু স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল যে ওতে তার আগ্রহ নেই

এই দুটো মানুষ এত আপন, এত ঘনিষ্ঠ যে সামান্যতম একটা ভঙ্গি, গলার স্বর উভয়কেই বলে দিচ্ছিল কথা যা বলতে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি।

এখন ওঁদের দুজনেরই শুধু একটা চিন্তা-নিকোলাইয়ের রোগ ও আসন্ন মৃত্যু-যাতে অন্যসব চিন্তা চাপা পড়েছে। কিন্তু ওঁদের কেউই সে কথা তোলার সাহস পাচ্ছিলেন না, তাই যে একটা জিনিসে তাঁদের মন নিমগ্ন সেটা প্ৰকাশ না করে আর যা-কিছুই তাঁরা বলুন-না কেন, সবই হচ্ছিল মিথ্যে। সন্ধ্যার যে অবসান হল, এখন শুতে যেতে হয়, এতে লেভিনের এত আনন্দ আর কখনো হয়নি। বাইরের কোন লোকের সাথে বা সরকারী কোন সাক্ষাৎকারে এত অস্বাভাবিক ও অসৎ তিনি হননি আর কখনো। এবং এই অস্বাভাবিকতার চেতনা আর তার জন্য অনুশোচনা তাঁকে করে তুলছিল আরো অস্বাভাবিক। নিজের মুমূর্ষ, প্রিয়তম বড় ভাইয়ের জন্য কান্না পাচ্ছিল তাঁর, অথচ কিভাবে সে বেঁচে থাকবে সে আলাপ তাঁকে কিনা শুনে যেতে হচ্ছিল, সায় দিতে হচ্ছিল তাতে।

বাড়িটা ছিল স্যাৎসেঁতে, শুধু একটা ঘরই গরম করা, তাই লেভিন বড় ভাইকে শোয়ালেন নিজেরই শোবার ঘরে, পার্টিশনের ওপাশে।

বড় ভাই শুল, ঘুম এসেছিল কি আসেনি যাই হোক, এপাশ-ওপাশ করছিল রোগীদের মত আর কাশছিল, কাশি যখন থাতমে চাইছল না, কি যেন বিড়বিড় করছিল। মাঝে মাঝে যখন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিল, বলছিল : ‘ওহ্ সৃষ্টিকর্তা!’ মাঝে মাঝে যখন শ্লেষ্মায় শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিল, বিরক্তিতে বলে উঠছিল, ‘ধুঃ শালা!’ এসব শুনতে শুনতে অনেকক্ষণ ঘুম আসেনি লেভিনের। চিন্তাগুলো তাঁর আসছি নানা রকমের, কিন্তু সব চিন্তার শেষটা একই : মৃত্যু।

মৃত্যু, সব কিছুরই যা শেষ, অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে তা ভেসে উঠল তাঁর সামনে। আর সে মৃত্যু রয়েছে এখানেই, তাঁর ভালোবাসার পাত্র বড় ভাইয়ের মধ্যে, ঘুমের ভেতর যে কাতরাচ্ছে, অভ্যাসবশে কখনো সৃষ্টিকর্তা, কখনো শালা বলে উঠতে যার দ্বিধা নেই, আগে তাঁর যা মনে হয়েছিল, সে মৃত্যু মোটেই তেমন সুদূর নয়। সে মৃত্যু আছে তাঁর নিজের মধ্যেই, এটা তিনি টের পাচ্ছেন। আজ যদি না হয় তো আগামী কাল, আগামী কাল না হলে, নয় তিরিশ বছর পরে, কি এসে যায় তাতে? আর কি বস্তু এই অনিবার্য মৃত্যু সেটা তিনি শুধু জানতেন না তাই নয়, কখনো তার কথা ভাবেননি তাই নয়, সে নিয়ে ভাবতে তিনি পারতেনই না, সাহসই হত না তাঁর।

‘আমি খাটছি, কিছু-একটা করতে চাইছি, অথচ ভুলে গিয়েছিলাম যে সবই শেষ হয়ে যায়, আছে মৃত্যু।’

অন্ধকারে খাটে মুচড়ে মুচড়ে বসে তিনি চেপে ধরে থাকছিলেন হাঁটু, ভাবনার চাপে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কিন্তু যত তীব্র হচ্ছিল তাঁর চিন্তা, ততই কেবল পরিষ্কার হয়ে উঠছিল যে ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে তাই, সত্যিই তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, খেয়াল করেননি জীবনের ছোট্ট এই একটা ঘটনা যে মরণ হবে, শেষ হবে সব কিছু, কিছুই শুরু করার মানে হয় না, কিছুই সাহায্য করবে না এক্ষেত্রে। এটা ভয়ংকর, কিন্তু ঘটনাটা তাই-ই।

‘কিন্তু আমি যে এখনো বেঁচে। কি করি এখন, কি করি?’ হতাশায় বলে উঠলেন তিনি। মোমবাতি জ্বেলে সন্তর্পণে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, আয়নার কাছে গিয়ে দেখতে লাগলেন নিজের মুখ আর চুল। হ্যাঁ, রগে দেখা যাচ্ছে পাকা চুল। হাঁ করলেন। পেছন দিককার দাঁত খারাপ হতে শুরু করেছে। অনাবৃত করলেন নিজের পেশীবহুল হাত। হ্যাঁ, শক্তি আছে অনেক। কিন্তু নিকোলাইয়েরও ছিল শক্তসমর্থ দেহ, জীর্ণ ফুসফুসে এখন সে ধুঁকছে। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল ছেলেবেলাকার একটা দৃশ্য : বাচ্চারা শুত একসাথে, অপেক্ষায় থাকত কখন ফিওদর বগদানিচ বাইরে বেরিয়ে যান। অমনি বালিশ ছোঁড়াছুঁড়ি করত তারা, আর হাসত, হাসত এমন বেপরোয়া হয়ে যে ফিওদর বগদানিচকে রীতিমত ভয় পেলেও কূল ছাপিয়ে ওঠা জীবনের সে ফেনিল আনন্দকে থামানো যেত না। ‘আর এখন ওই তো বেঁকে যাওয়া, ফাঁপা বুকখানা… এদিকে আমি জানি না কেন আর কি আমার হবে…’

‘খ্যাক, খ্যাক! ধুঃ শ্যালা! কি করছ ওখানে? ঘুমাচ্ছ না কেন?’ ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

‘এমনি, কে জানে, ঘুম আসছে না।’

‘আমি কিন্তু বেশ ভালো ঘুমিয়েছি। ঘামছিও না। দ্যাখ না কামিজটা নেড়ে। ঘাম আছে?’

লেভিন হাতড়ে দেখলেন, চলে গেলেন পার্টিশনের ওপাশে, মোমবাতি নিবিয়ে দিলেন, কিন্তু ঘুমাতে পারলেন না অনেকক্ষণ। কিভাবে জীবন কাটানো যায় এ প্রশ্নটা তাঁর কাছে খানিকটা পরিষ্কার হয়ে উঠতে না উঠতেই দেখা দিয়েছে সমাধানাতীত এক প্রশ্ন : মৃত্যু

‘হ্যাঁ, ও মরবে, হ্যাঁ, মরবে বসন্ত নাগাদ, কিন্তু কি করে সাহায্য করা যায় ওকে? কি ওকে বলতে পারি? এ ব্যাপারে কি জানি আমি? এটা যে আছে, সে কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম।’

বত্রিশ

অনেক আগেই লেভিন লক্ষ্য করেছিলেন যে, কেউ মাত্রাতিরিক্ত রকমে মেনে নিচ্ছে, সায় দিচ্ছে বলে যখন নিজেরই অস্বস্তি বোধ হয়, তারপর সে লোক কিন্তু অতি সত্বর তার মাত্রাতিরিক্ত দাবি-দাওয়া আর ছিদ্রান্বেষণে হয়ে ওঠে অসহ্য। তিনি অনুভব করছিলেন যে বড় ভাইয়ের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা তাই ঘটবে। এবং সত্যিই নিকোলাইয়ের গোবেচারা ভাব বেশি টিকল না। পরের দিন সকালেই সে হয়ে উঠল খিটখিটে, তন্নতন্ন করে খুঁত ধরতে লাগল ভাইয়ের, ঘা দিচ্ছিল তাঁর সবচেয়ে ঘাতপ্রবণ জায়গাগুলোয়।

লেভিনের নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছিল, অথচ সেটা শুধরে উঠতে পারছিলেন না। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে ওঁরা ভান না করে ঠিক কি ভাবছেন, অনুভব করছেন শুধু সেটাই যদি অকপটে বলতেন, তাহলে তাঁরা খোলাখুলি তাকিয়ে দেখতে পারতেন পরস্পরের দিকে, আর কনস্তান্তিন শুধু বলতেন : ‘তুমি মরছ, মরছ, মরছ!’ আর নিকোলাই শুধু জবাব দিত : ‘জানি মরছি : কিন্তু ভয়, ভয়, ভয় পাচ্ছি!’ আর প্রাণ থেকে কথা বললে আর কিছু বলার থাকত না। কিন্তু সেভাবে চলা যায় না, আর কনস্তান্তিন যেহেতু যা তিনি সারা জীবন চেষ্টা করেও পারেননি তারই চেষ্টা করতেন, অন্যে অনেকে যা চমৎকার চালাতে পারত যা ছাড়া বাঁচা চলে না, তাই তিনি অনবরত চেষ্টা করতেন যা ভাবছেন তা না- বলতে আর টের পেতেন যে সেটা মিথ্যা শোনাচ্ছে, বড় ভাই সেটা ধরতে পারছে আর তিতিবিরক্ত হয়ে উঠছে সে জন্য।

তৃতীয় দিন নিকোলাই ভাইকে বাধ্য করল তাঁর পরিকল্পনা আবার শোনাতে এবং শুধু তার সমালোচনা করল না, ইচ্ছে করেই তা গুলিয়ে ফেলতে লাগল কমিউনিজমের সাথে।

‘তুমি শুধু পরের ধারণা ধার করেছ আর তা বাঁকিয়ে-চুরিয়ে লাগাতে চাইছ যেখানে তা লাগার নয়।’

‘আমি যে তোমাকে বলছি, ওর সাথে এটা কোন মিল নেই। ওরা ব্যক্তিগত মালিকানা, পুঁজি, উত্তরাধিকার—এ সবের ন্যায্যতা অস্বীকার করে, কিন্তু এই প্রধান প্রেরণাটা অস্বীকার না করে’ (এ ধরনের শব্দ ব্যহার লেভিনের নিজের কাছে অরুচিকর, কিন্তু নিজের কাজে মেতে ওঠার পর থেকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি ঘন ঘন এই অরুশ কথাগুলোর আশ্রয় নিচ্ছেন) ‘আমি চাই শুধু শ্রমের নিয়ামন।’

‘সেই তো বলছি, অন্যের ধারণাগুলো নিয়ে তার যেখানে শক্তি সব ছেঁটে ফেলে বোঝাতে চাইছ যে এটা নতুন কিছু’, নিকোলাই বলল রেগে, গলার টাইয়ে দমকা টান দিয়ে।

‘আমার ভাবনার সাথে ও-সবের কোন মিল নেই…’

‘ওদের ক্ষেত্রে’, আক্রোশে চোখে ঝকঝকিয়ে বিদ্রূপভরে হেসে নিকোলাই লেভিন বলল, ‘ওদের ক্ষেত্রে এর অন্তত একটা রূপ আছে, বলা যায় জ্যামিতিক, আছে স্পষ্টতা, নিশ্চয়তা। হয়ত এটা ইউটোপিয়া। কিন্তু ধরা যাক, অতীতের সব কিছু হল মোছা বোর্ড অর্থাৎ অতীতের সব কিছু মুছে ফেলা যায়, সম্পত্তি নেই, পরিবার নেই, শ্রমেরও তাহলে একটা সুব্যবস্থা হল। কিন্তু তোমার কিছুই নেই…’

‘কেন তুমি মিশিয়ে ফেলছ? আমি কমিউনিস্ট ছিলাম না কখনো।’

‘আর আমি ছিলাম এবং দেখতে পাচ্ছি যে ওর সয় হয়নি এখনো, তবে এটা যুক্তিযুক্ত, এর ভবিষ্যৎ আছে, প্ৰথম দিককার। খ্রিস্টধর্মের মত।’

‘আমি শুধু বলতে চাইছি যে শ্রমশক্তিকে দেখতে হলে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পরীক্ষামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে, তাকে অধ্যয়ন করতে হবে, বুঝতে হবে তার বৈশিষ্ট্য, তাহলে…’

‘ওটা একেবারে খামোকাই। এ শক্তি তার বিকাশের মাত্রা থেকে নিজেই নিজের ক্রিয়াকলাপের নির্দিষ্ট একটা রূপ খুঁজে পাবে। আগে সর্বত্র ছিল ক্রীতদাস, পরে পত্তনিদার (metayers), আমাদের এখানেও আছে ভাগ-চাষ, আছে প্রজাবিলি, ক্ষেতমজুরি, আর কি চাও তুমি?’

লেভিন এ কথাগুলোয় হঠাৎ ক্ষেপে উঠলেন, কেননা মনে মনে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন যে কথাটা সত্যি, সত্যি এই যে তিনি কমিউনিজম আর বর্তমান রূপগুলোর মধ্যে একটা ভারসাম্য চাইছেন, যা বড় একটা সম্ভব নয়।

‘আমি উৎপাদনশীলতার সাথে কাজ করার উপায় খুঁজছি নিজের জন্যেও, কৃষি-শ্রমিকের জন্যেও। এমন ব্যবস্থা আমি করতে চাই যে…’ উত্তেজিত হয়ে বললেন তিনি।

‘কিছুই তুমি করতে চাও না; স্রেফ সারা জীবন যেমন কাটিয়েছ, তেমনি চাও মৌলিকার দেখাতে, এটা দেখাতে যে তুমি চাষীদের নেহাৎ শোষণ করছ না, একটা বড় ধ্যান-ধারণা নিয়ে করছ।’

‘তাই ভাবছ? যাক গে, রেহাই দাও আমাকে!’ লেভিন জবাব দিলেন, টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর বাঁ গালের পেশী লাফাচ্ছে, ঠেকানো যাচ্ছে না।

‘তোমার কোন একটা দৃঢ় প্রত্যয় কখনো ছিল না, এখনো নেই। শুধু আত্মাভিমান তুষ্ট করতে পারলেই তোমার হল।’

‘তা বেশ, শুধু রেহাই দাও আমাকে!’

‘তাই দেব! সময় হয়ে গেছে অনেকদিন, চুলোয় যা তুই! ভয়ানক আফশোস হচ্ছে যে এখানে এসেছি!’

পরে বড় ভাইকে শান্ত করার জন্য লেভিন যত চেষ্টাই করুন, নিকোলাই শুনতে চাইল না, বলল যে আলাদা থাকাই অনেক ভালো, ভাই স্পষ্ট বুঝলেন যে, বেঁচে থাকা এখন স্রেফ অসহ্য হয়ে উঠেছে বড় ভাইয়ের পক্ষে।

কনস্তান্তিন যখন আবার তার কাছে এসে অস্বাভাবিক সুরে অনুরোধ করলেন, কোন ব্যাপারে তাকে আঘাত দিয়ে থাকলে সে যেন মাপ করে, নিকোলাইয়ের যাত্রার আয়োজন তখন সারা হয়ে গেছে।

‘আহ্, কি উদারতা!’ হেসে বলল নিকোলাই, ‘তুমি-ই ঠিক, এই যদি তোমার জানতে ইচ্ছে হয়, তা সে তুষ্টি আমি তোমাকে দিতে পারি। তুমি ঠিক, তাহলেও আমি চলে যাব।’

ঠিক যাবার মুখে নিকোলাই চুম্বন করল ভাইকে, হঠাৎ একটা অদ্ভুত গুরুগম্ভীর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল : ‘আমার সম্পর্কে খারাপ কিছু ভেবো না রে কনস্তান্তিন’, গলা তার কেঁপে উঠল।

এই একটা কথাই শুধু অকপটে বলা। লেভিন বুঝলেন যে এতে করে সে বলতে চাইছে : ‘তুমি দেখতে পাচ্ছ আর জানো যে আমার দিন ফুরিয়েছে, হয়ত আমাদের দেখা হবে না আর।’ লেভিন সেটা বুঝলেন, চোখ ফেটে পানি এল তাঁর। বড় ভাইকে আরো একবার চুম্বন করলেন তিনি, কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না, বলার সমর্থ্য ছিল না।

বড় ভাই চলে যাবার দু’দিন পরে লেভিনও যাত্রা করলেন বিদেশে। ট্রেনে দেখা হল কিটির চাচাতো ভাই শ্যেরবাৎস্কির সাথে। ভারি সে অবাক হল লেভিনকে মনমরা দেখে। জিজ্ঞেস করলে : ‘কি হয়েছে তোমার?

‘কিছুই না, এমনি। আনন্দের ব্যাপার দুনিয়ায় কম।

‘কম মানে? কোন-এক মুনসিঙ্গেনে যাওয়ার চেয়ে এসো না আমার সাথে প্যারিসে। দেখবে, কেমন মজা।

‘না, আমার পালা শেষ। মরার সময় হয়েছে!

‘বলিহারি!’ হেসে বললে শ্যেরবাৎস্কি, ‘আর আমি শুরু করার জন্যে মাত্র তৈরি হচ্ছি।’

‘হ্যাঁ, কিছুদিন আগে আমিও তাই ভাবতাম, কিন্তু এখন জানি যে শিগগিরই মরব।’

তিনি ইদানীং যা সত্যি করেই ভাবছিলেন, সেই কথাটাই বললেন লেভিন। সব কিছুতেই তিনি দেখছিলেন মৃত্যু অথবা তার সান্নিধ্য। কিন্তু সেই জন্যই যে ব্যাপারটা তিনি শুরু করেছেন সেটা তাঁকে আকৃষ্ট করছিল আরো বেশি। মৃত্যু না-আসা পর্যন্ত কোন রকমে বেঁচে থাকতে হবে। তাঁর কাছে সব কিছু আচ্ছন্ন করেছে অন্ধকার, আর এই অন্ধকারের জন্যই তিনি অনুভব করছিলেন যে সে অন্ধকারে চলার একমাত্র সূত্র হল তাঁর কাজ, সে সূত্রটা তিনি আঁকড়ে ধরছিলেন প্রাণপণে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *