আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৭.১০

দশ

ওঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আন্না উঠেছিলেন লেভিনকে দেখার আনন্দটা চাপা না দিয়ে। যে প্রশান্তিতে তিনি তাঁর ছোট্ট চঞ্চল হাতখানা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আর পরিচয় করিয়ে দেন ভরকুয়েভের সাথে, পাটকিলে চুলের সুশ্রী যে মেয়েটা কাজ নিয়ে ওখানেই বসেছিল তাকে বললেন তাঁর প্রতিপাল্য, তাতে লেভিন দেখতে পেলেন উঁচু সমাজের সব সময় সুস্থির ও স্বাভাবিক নারীদের আদব-কায়দা যা তাঁর পরিচিত ও প্রিয়

‘খুব, খুব আনন্দ হল’, পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি আর লেভিনের কাছে তাঁর ঠোঁটের ওই সাধারণ কথাগুলো কেন জানি পেল একটা বিশেষ তাৎপর্য; আমি আপনাকে অনেকদিন থেকে জানি, স্তিভার সাথে আপনার বন্ধুত্ব আর আপনার স্ত্রীর জন্যেও ভালোবাসি আপনাকে… ওকে আমি দেখেছি অল্প, কিন্তু অপরূপ একটি ফুল, ঠিক ফুলেরই ছাপ সে রেখে গেছে আমার মনে। আর শিগগিরই ও কিনা মা হতে চলেছে!’

কথা বলছিলেন উনি অনায়াসে, তাড়াহুড়ো না করে, মাঝে মাঝে দৃষ্টি ফেরাচ্ছিলেন লেভিনের ওপর থেকে ভাইয়ের দিকে আর লেভিন অনুভব করলেন যে তাঁকে গৃহস্বামিনীর ভালোই লেগেছে, আর ওঁর সামনে লেভিনেরও নিজেকে মনে হল অনায়াস, সহজ, ভালো লাগছিল তাঁর, যেন ছেলেবেলা থেকেই আন্নাকে তিনি চেনেন।

‘ইভান পেত্রভিচকে নিয়ে আমি আলেক্সেই-এর স্টাডিতে বসেছি ধূমাপান করার উদ্দেশ্যেই’, ধূমপান করা চলবে কিনা অব্‌লোন্‌স্কি জিজ্ঞেস করায় আন্না বললেন। তারপর লেভিনের দিকে তাকিয়ে উনি ধূমপান করেন কিনা এ প্রশ্নের বদলে কচ্ছপের খোলার বাক্স টেনে নিয়ে সিগারেট বার করলেন একটা।

‘আজ কেমন বোধ করছ?’ বোনকে জিজ্ঞেস করলেন ভাই।

‘ওই একরকম। বরাবরের মত শুধু স্নায়ু।’

লেভিন পোর্ট্রেটটা লক্ষ করছেন দেখতে পেয়ে অব্‌লোন্‌স্কি বললেন, ‘অসাধারণ ভালো, তাই না?’

‘এর চেয়ে ভালো পোর্ট্রেট আমি দেখিনি।’

‘এবং অসাধারণ সাদৃশ্য, তাই না?’ বললেন ভরকুয়েভ।

পোর্ট্রেট ছেড়ে মূলের দিকে তাকালেন লেভিন। তাঁর দৃষ্টি নিজের ওপর টের পেতে বিশেষ একটা দ্যুতি ঝলক দিল আন্নার মুখে। লাল হয়ে উঠলেন লেভিন আর নিজের অপ্রতিভা চাপা দেবার জন্য ভেবেছিলেন জিজ্ঞেস করবেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার সাথে ইদানীং তাঁর দেখা হয়েছে কিনা; কিন্তু ঠিক এই সময় কথা করে উঠলেন আন্নাই : ‘ইভান পেত্রভিচের সাথে ভাশ্যেনকভের ছবি নিয়ে কথা হচ্ছিল। আপনি দেখেছেন?’

‘হ্যাঁ দেখেছি’, লেভিন বললেন।

‘কিন্তু মাপ করবেন, সম্ভবত আপনি কিছু বলতে চাইছিলেন, আমি বাধা দিলাম…’

লেভিন জিজ্ঞেস করলেন ডল্লির সাথে সম্প্রতি কবে তাঁর দেখা হয়েছে।

‘কাল আমার এখানে এসেছিল সে। জিমনাসিয়ামের ওপর মহা খাপ্পা। মনে হয় লাতিনের শিক্ষক গ্রিশার ওপর অন্যায় করেছে।’

‘হ্যাঁ, ছবিগুলো আমি দেখেছি। তেমন একটা ভালো লাগেনি আমার’, আন্না যে প্রসঙ্গটা শুরু করেছিলেন তাতে ফিরে এলেন লেভিন।

এখন লেভিন মোটেই কাজের প্রতি কারিগরের দৃষ্টি থেকে কথা বলছিলেন না, যা তিনি করেছিলেন আজ সকালে। আন্নার সাথে তাঁর আলাপে প্রতিটি কথাই পাচ্ছিল বিশেষ তাৎপর্য। ওঁর সাথে কথা বলতে তাঁর ভালো লাগছিল আর আন্নার কথা শুনতে আরো ভালো।

আন্না বলছিলেন সহজভাবে, বুদ্ধিমানের মত, কিন্তু বুদ্ধিমানের মত হলেও হেলাফেলা করে, নিজের মতামতে কোন বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না, গুরুত্ব অর্পণ করছিলেন সহালাপীর কথায়

কথাবার্তা চলল শিল্পকলায় নতুন ধারা আর বাইবেল সচিত্র করেছেন যে ফরাসি শিল্প তাঁকে নিয়ে। বাস্তববাদকে স্থূলতার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন বলে শিল্পীর সমালোচনা করলেন ভরকুয়েভ। লেভিন বললেন, শিল্পকলায় ফরাসিরা আপেক্ষিকতা টেনে এনেছে সবার থেকে বেশি, তাই বাস্তবতায় প্রত্যাবর্তনের মধ্যে ভারি একটা মঙ্গল দেখছে তারা। মিথ্যে না থাকাতে এখন তারা খুঁজে পাচ্ছে কাব্য।

জীবনে বিদগ্ধ যত থা লেভিন বলেছেন তার কোনটাই এটার মত তৃপ্তি দেয়নি তাঁকে। হঠাৎ কথাটার কদর করতে পেরে উজ্জ্বল হয়ে গেল আন্নার মুখ। হাসলেন তিনি।

বললেন, ‘আমি হাসছি অতি সদৃশ প্রতিকৃতি দেখে লোকে যেমন সানন্দে হাসে। আপনি যা বললেন তাতে আজকের ফরাসি শিল্পের চমৎকার চরিত্রায়ণ করা হয়েছে, চিত্রকলাও বটে, এমন কি সাহিত্যও : জোলা, দোদে। কিন্তু সম্ভবত সব সময়ই এই ঘটে যে কল্পিত, আপেক্ষিক মূর্তিগুলো থেকে এক একটা প্রতীতি গড়ে তোলা হল, আর যতরকম যোগাযোগের পর কল্পিত মূর্তিগুলোয় বিরক্তি ধরে যায়, বেশি স্বাভাবিক সত্য মূর্তির কথা ভাবতে শুরু করে লোকে।

‘একেবারে খাঁটি কথা!’ বললেন ভরকুয়েভ

তাহলে তোমরা ক্লাবে গিয়েছিলে?’ আন্না জিজ্ঞেস করলেন ভাইকে।

‘হ্যাঁ, একেই বলে নারী!’ আত্মহারা হয়ে আন্নার সুন্দর চঞ্চল মুখখানা একাগ্র দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে ভাবলেন লেভিন। আন্নার সে মুখ এখন হঠাৎ বদলে গেল। ভাইয়ের দিকে ঝুঁকে তিনি কি বলছিলেন, সেটা লেভিন শোনেননি। তাঁকে অবাক করে দিলে মুখভাবের এই পরিবর্তন। প্রশান্তিতে অপরূপ আগের ওই মুখখানায় হঠাৎ ফুটে উঠল আশ্চর্য এক ঔৎসুক্য, রোষ, গর্ব। কিন্তু এটা শুধু মিনিটখানেকের জন্য। চোখ কোঁচকালেন তিনি, যেন কিছু-একটা মনে করতে চাইছেন।

‘হ্যাঁ, তবে ওতে কারো আগ্রহ নেই’, এই বলে তিনি ফিরলেন ইংরেজ মেয়েটার দিকে। ইংরেজিতে বললেন, ‘ড্রয়িং-রুমে চা দিতে বলো না।’

মেয়েটা উঠে চলে গেল।

‘কি, পরীক্ষায় পাস করেছে ও?’ জিজ্ঞেস করলেন অব্‌লোন্‌স্কি।

‘চমৎকার। খুবই বুদ্ধিমান মেয়ে, স্বভাবটাও মিষ্টি।’

‘পরিণামে দেখছি নিজের মেয়ের চেয়ে ওকেই বেশি ভালোবাসবে।’

‘এই হল পুরুষের কথা। ভালোবাসায় বেশি কম কিছু নেই। নিজের মেয়েকে ভালোবাসি একভাবে, ওকে অন্যভাবে।’

‘আমি আন্না আর্কাদিয়েভনাকে বলি’, বললেন ভরকুয়েভ, ‘এই ইংরেজ মেয়েটার জন্যে তিনি যা খাটেন, তার শতাংশ যদি খাটতেন রুশ ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের সাধারণ স্বার্থে, তাহলে বড় একটা উপকার হত।’

‘তা যা ভাববেন ভাবুন, আমি পারলাম না। কাউন্ট আলেক্সেই কিরিলিচ’ (এই নামটা করার সময় তিনি সসংকোচ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইলেন লেভিনের দিকে, তিনিও আপনা থেকে সাড়া দিলেন সশ্রদ্ধ সমর্থনের দৃষ্টিতে ‘আমাকে গ্রামে স্কুল নিয়ে কাজ করায় উৎসাহিত করেছিলেন। আমিও গিয়েছিলাম কয়েকবার। ভারি ওরা মিষ্টি, কিন্তু ও কাজটায় মন লাগাতে পারলাম না। আপনি বলছেন—খাটুনি। খাটুনির ভিত্তি তো ভালোবাসা। আর ভালোবাসা কোথা থেকেও পাবার নয়, ফরমাশ দেওয়া যায় না তার। এই মেয়েটাকে আমি ভালোবেসে পেলেছি, নিজেই জানি না কেন।’

এবং আবার তিনি তাকালেন লেভিনের দিকে। আর তাঁর হাসি ও দৃষ্টি লেভিনকে বললেন যে তিনি কথা বলছিলেন কেবল তাঁরই সাথে, তাঁর মতামতে তিনি মূল্য দেন, আর সেইসাথে আগে থেকেই তিনি জানেন যে তাঁরা বুঝতে পারবেন পরস্পরকে।

‘এটা আমি খুবই বুঝি’, লেভিন বললেন, ‘স্কুল এবং সাধারণভাবেই এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে মন বসানো কঠিন 1 তাই আমার মনে হয় লোকহিতকর প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ফল পাওয়া যায় এত কম।’

আন্না চুপ করে রইলেন, তারপর হাসলেন।

‘হ্যাঁ’, সমর্থন করলেন তিনি, ‘আমি কখনো পারিনি। বিটকেলে সব খুকিতে ভরা পুরো একটা অনাথালয়কে ভালোবাসতে হলে যা দরকার তেমন প্রশস্ত হৃদয় আমার নেই। ওটা আমি কখনো পেরে উঠিনি। কত নারীই তো এ থেকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা গড়ে নিয়েছে। আর এখন তো আরো বেশি’, বিমর্ষ বিশ্বাসপ্রবণ মুখভাবে বললেন তিনি বাহ্যত ভাইয়ের উদ্দেশে, কিন্তু আসলে শুধু লেভিনকে; ‘এখন কিছু-একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা আমার পক্ষে যখন খুবই দরকার, তখনও ওটা পারি পারি না।’

হঠাৎ ভুরু কুঁচকে (লেভিন বুঝলেন যে নিজের সম্পর্কে বলতে যাচ্ছেন বলে উনি ভুরু কোঁচকালেন নিজের প্রতিই) প্রসঙ্গ বদলালেন। লেভিনকে বললেন, ‘আমি শুনেছি আপনি খারাপ সমাজসেবী, কিন্তু আমি যেমন পেরেছি পক্ষ নিয়েছি আপনার।’

‘কিভাবে পক্ষ নিলেন?’

‘যেমন যেমন আক্রমণ এসেছে সেই অনুসারে; তবে এখন চা খেতে গেলে হয় না?’ মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো একটি খাতা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

‘আমাকে দিন আন্না আর্কাদিয়েভনা’, খাতাটা দেখিয়ে বললেন ভরকুয়েভ, ‘এর মূল্য আছে।’

‘না, এখনো ঘষামাজা বাকি।’

‘আমি ওকে বলেছি’, লেভিনকে দেখিয়ে বোনকে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি।

‘কেন বলতে গেলে। আমার লেখা—সে ওই জেলে বানানো খোদাই কাজের ঝুড়ির মত, লিজা মেকর্তালোভা আমাকে যা বেচতেন। আমাদের সমাজে তিনি ছিলেন জেলের দায়িত্বে।’ তারপর লেভিনের দিকে ফিরে আন্না বললেন, ‘এই হতভাগ্যরা ধৈর্যের অবতার।’

আর যে নারীকে লেভিনের অসাধারণ ভালো লাগছিল, তাঁর মধ্যে নতুন আরেকটা দিক দেখতে পেলেন তিনি। বুদ্ধি, সৌষ্ঠব আর রূপ ছাড়াও তাঁর ভেতরে ছিল সত্যনিষ্ঠাও। তাঁর কাছ থেকে আন্না তাঁর অবস্থার সমস্ত দুঃসহতা চেপে রাখতে চাননি। ঐ কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন তিনি, মুখভাব তাঁর হঠাৎ হয়ে ওঠে শিলীভূত কঠোর এই মুখভাবে তাঁকে দেখাল আগের চেয়েও সুন্দর; কিন্তু এ মুখভাবটা নতুন; সুখে উদ্ভাসিত ও সুখ সম্পাতী যে ভাবগুলো শিল্পী ধরেছেন তাঁর পোর্ট্রেটে, এটা তার বহির্ভূত। আরেকবার পোর্ট্রেটটা দেখলেন লেভিন, তারপর আন্নাকে, ভাইয়ের বাহুলগ্না হয়ে তিনি তখন যাচ্ছিলেন উঁচু দরজার দিকে আর তাঁর জন্য একটা কোমলতা, একটা মমতা বোধ করলেন লেভিন, যাতে নিজেই তিনি অবাক হলেন।

লেভিন আর ভরকুয়েভকে ড্রয়িং-রুমে যেতে বললেন আন্না, নিজে রয়ে গেলেন ভাইয়ের সাথে কি নিয়ে যেন কথা বলতে। ‘বিবাহবিচ্ছেদ, ভ্রন্‌স্কি, ক্লাবে সে কি করছে তাই নিয়ে, আমার সম্পর্কে?’ ভাবলেন লেভিন। আর অব্‌লোন্‌স্কির সাথে তিনি কি নিয়ে কথা বলছেন, এ প্রশ্নটা তাঁকে এত ব্যাকুল করে তুলেছিল যে শিশুদের জন্য লেখা আন্না আর্কাদিয়েভনার উপন্যাসটার গুণ নিয়ে ভরকুয়েভ যা বলছিলেন সেটা তাঁর কানে যাচ্ছিল না।

চায়ের টেবিলেও চলল সেই একই প্রীতিপ্রদ সারগর্ভ কথোপকথন। আলাপের প্রসঙ্গ হাতড়াবার জন্য এক মিনিটও লাগছিল না তাই নয়, বরং মনে হচ্ছিল যা বলতে চাচ্ছি তা বলে ওঠার সময় হবে না, তাই সাগ্রহেই থেমে গিয়ে শোনা যাচ্ছিল অপরকে। এবং শুধু আন্না নয়, ভরকুয়েভ আর অব্‌লোন্‌স্কিও যাকিছু বলেছেন আন্নার মনোযোগে ও মন্তব্যে তা সবই একটা বিশেষ অর্থ লাভ করছে বলে লেভিনের মনে হল।

আগ্রহোদ্দীপক কথাবার্তাটা শুনতে শুনতে লেভিন সর্বক্ষণ মুগ্ধ হচ্ছিলেন আন্নাকে দেখে—তাঁর রূপে, মনীষায়, বৈদগ্ধ্যে আর সেইসাথে সহজ-সরলতা আর হৃদ্যতায়। তিনি শুনছিলেন, কথা বলছিলেন আর সারক্ষণ ভাবছিলেন আন্নার কথা, তাঁর অন্তর্জীবনের কথা, অনমান করতে চাইছিলেন কেমন তাঁর হৃদয়ানুভূতি। আর আগে তাঁকে অমন কঠোরভাবে সমালোচনা করলেও মনের কি-এক বিচিত্র গতিপথে লেভিন এখন তাঁরই পক্ষ নিলেন, একই সাথে তাঁর আন্নার জন্য কষ্ট আর ভয় হচ্ছিল যে ভ্রন্‌স্কি তাঁকে পুরো বুঝবেন না। দশটার পর অব্‌লোন্‌স্কি যখন যাবার জন্য উঠলেন (ভরকুয়েভ চলে গিয়েছিলেন আগেই), লেভিনের মনে হল তিনি যেন এই মাত্র এসেছে। সখেদে উঠলেন লেভিনও

‘আসুন’, লেভিনের হাত ধরে আকর্ষক দৃষ্টিতে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন আন্না, ‘খুব আনন্দ হল যে বরফ ফেটেছে।’

তাঁর হাত ছেড়ে দিয়ে চোখ কোঁচকালেন আন্না : ‘আপনার স্ত্রীকে বলবেন যে আমি তাকে আগের মতই ভালোবাসি আর আমার অবস্থাটা যদি সে ক্ষমা করতে না পারে, তাহলে কামনা করি সে যেন কখনোই ক্ষমা না করে। ক্ষমা করতে হলে আমি যার মধ্যে দিয়ে গেছি, আগে যেতে হয় তারই ভেতর দিয়ে—আর এ থেকে সৃষ্টিকর্তা তাকে রক্ষা করুন।’

লেভিন লাল হয়ে বললেন, ‘অবশ্যই বলব…’

এগারো

লেভিন বাইরের তুহিন বাতাসে অব্‌লোন্‌স্কির সাথে বেরিয়ে ভাবছিলেন, ‘কি বিস্ময়কর, মধুর আর অভাগা নারী।’

‘এবার কি? আমি তো বলেছিলাম তোমাকে’, লেভিনকে সম্পূর্ণ বিজিত দেখে তাঁকে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি।

‘হ্যাঁ’, চিন্তায় ডুবে থেকে বললেন লেভিন, ‘অসাধারণ নারী! শুধু বুদ্ধিমতীই নন, আশ্চর্য হৃদয়। ভারি কষ্ট হচ্ছে ওঁর জন্যে!’

‘সৃষ্টিকর্তা করলে এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। তাহলে, আগে থেকেই রায় দিয়ে ব’সো না’, গাড়ির দরজা খুলে বলেন অব্‌লোন্‌স্কি, ‘চললাম, তুমি যাবে অন্য রাস্তায়।’

বাড়ি ফেরার সারাটা পথ লেভিন ভাবলেন কেবল আন্নার কথা, তাঁর সাথে যেসব সহজ কথোপকথন হয়েছিল তার কথা। মনে পড়ছিল তাঁর মুখভাবের সমস্ত খুঁটিনাটি। ক্রমেই বেশি করে যেন বুঝতে পারছিলেন তাঁর অবস্থাটা, কষ্ট হচ্ছিল তাঁর জন্য।

কুজ্‌মা বাড়ি পৌঁছতে লেভিনকে বলল যে কাতেরিনা আলেক্‌সান্দ্রভনা ভালো আছেন, বোনেরা এইমাত্র চলে গেলেম ওঁর কাছ থেকে। তারপর দুটো চিঠি দিলে তাঁকে। পরে যাতে ও নিয়ে ভাবতে না হয় তার জন্য লেভিন চিঠি দুটো পড়লেন ওখানেই, প্রবেশ-কক্ষেই। একটা চিঠি গোমস্তা সকোলোভের। সে লিখেছে, গম বিক্রি করা চলে না, দাম দিতে চাইছে কেবল সাড়ে পাঁচ রুল, টাকা পাবার অন্য কোন পথ নেই। দ্বিতীয় চিঠিটা বোনের। তাঁর কাজটা হয়নি বলে তিনি বকুনি দিয়েছেন লেভিনকে।

‘বেশি যখন দিতে চাইছে না, তখন সাড়ে পাঁচ রুব্‌ল দরেই বেচে দেব’, প্রথম যে প্রশ্নটা আগে লেভিনের কাছে খুব কঠিন মনে হয়েছিল, অসাধারণ অনায়াসে তখনই সেটার নিষ্পত্তি করে ফেললেন তিনি। ‘আশ্চর্য, কিভাবে আমার সমস্ত সময় কেটে যাচ্ছে এখানে’, ভাবলেন লেভিন দ্বিতীয় চিঠিটা প্রসঙ্গে। বোন যা করতে বলেছিলেন আজো তা করা হয়নি বলে নিজেকে বোনের কাছে দোষী মনে হল তাঁর। ‘আজ আবার আদালতে যাওয়া হল না, তবে আজকে সত্যি সময় ছিল না তার।’ অবশ্যই ওটা কালকে করবেন স্থির করে গেলেন স্ত্রীর কাছে। যেতে যেতে গোটা দিনটার ওপর মনে মনে চোখে বুলিয়ে নিলেন তিনি। দিনের সমস্ত ঘটনাই কথাবার্তা: যে কথাবার্তা তিনি শুনেছেন আর যাতে তিনি যোগ দিয়েছেন। সমস্ত কথাবার্তাই এমন বিষয় নিয়ে যাতে একলা গ্রামে থাকলে কখনো তিনি ভাবিত হতেন না, কিন্তু এখানে তা বেশ মন টানে। সব কথাবার্তাই বেশ ভালো হয়েছিল, শুধু দুটো জায়গায় তেমন হয়নি। তার একটা— পাইক মাছ সম্পর্কে যে কথাটা তিনি বলেছেন, দ্বিতীয়টা—আন্না সম্পর্কে তাঁর যে একটা করুণ কোমলতা বোধ হচ্ছে, তা যেন ঠিক নয়।

স্ত্রীকে লেভিন দেখলেন মনমরা, ব্যাজার। তিন বোনের ডিনার চলেছিল খুব আনন্দ করেই, কিন্তু তারপর তাঁকে আশা করছিলেন ওঁরা, আশা করে করে সবার একঘেয়ে লাগল, বোনেরা চলে যান, কিটি থাকে একলা।

‘তা কি করলে তুমি?’ কিটি জিজ্ঞেস করল তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে। সে চোখ এত জ্বলজ্বলে যে রীতিমত সন্দেহ জাগায়। কিন্তু লেভিনের সব কিছু বলায় বাধা না দেবার জন্য নিজের উদ্বেগ লুকিয়ে সে অনুমোদনের হাসি নিয়ে শুনে গেল কিভাবে সন্ধেটা কাটিয়েছেন লেভিন।

‘ভ্রন্‌স্কির সাথে দেখা হওয়ায় ভারি খুশি হয়েছি। ওর কাছে নিজেকে বেশ সহজ আর স্বচ্ছন্দ লেগেছিল। চেয়েছিলাম এই অস্বস্তিটা যাতে কেটে যায়, এখন চেষ্টা করব যেন আর কখনো ওর সাথে দেখা না হয়’, বললেন লেভিন এবং কখনো দেখা না হবার চেষ্টা করে তখনই যে আন্নার কাছে যান তা মনে পড়ায় লাল হয়ে উঠলেন তিনি। ‘এই তো, সবাই বলে যে চাষীরা মদ টানে। কিন্তু জানি না কে বেশি টানে, চাষীরা নাকি আমাদের ভদ্রসম্প্রদায়। চাষীরা অন্তত পালেপার্বণে, কিন্তু…’

কিন্তু চাষীরা কেমন মদ খায় তা নিয়ে কিটির আগ্রহ ছিল না। সে দেখল লেভিন লাল হয়ে উঠেছেন, জানতে চাইছিল সেটা কেন।

তারপর কোথায় ছিলে?’

‘স্তিভা ভয়ানক ধরাধরি করলে যেন আন্না আর্কাদিয়েভনার ওখানে যাই।’

আর এই কথা বলে লেভিন লাল হয়ে উঠলেন আরো বেশি এবং আন্নার কাছে গিয়ে তিনি ভালো করেছেন নাকি খারাপ–এ সন্দেহের নিরসন হয়ে গেল চূড়ান্তরূপে। এখন তিনি জানেন যে ও কাজ করা উচিত হয়নি।

আন্নার নামোল্লেখে কিটির চোখ বিস্ফারিত ও উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু জোর করে নিজের অস্থিরতা চেপে সে লেভিনকে ছলনা করল।

শুধু বলল, ‘অ!’

‘আমি গেছি বলে তুমি নিশ্চয় রাগ করবে না। স্তিভা বলল, ডল্লিও তাই চাইছিল’, কিটি বললেন, কিন্তু লেভিন তার চোখে দেখতে পেলেন নিজের ওপর জোর খাটানো এমন একটা প্রয়াস যা তাঁর পক্ষে শুভংকর নয়।

আন্নার কাজকর্ম, কিটিকে তিনি যা বলতে বলেছেন সে সবের বিবরণ দিয়ে তিনি শেষ করলেন, ‘অতি সুন্দর, ভালো, অতি অতি অভাগা এক নারী।’

‘সে তো বটেই, খুবই অভাগা উনি’, লেভিন শেষ করতে কিটি বলল; ‘চিঠি পেলে কার কাছ থেকে?

সে কথা বলে এবং তার শান্ত কণ্ঠস্বরে নিশ্চিন্ত হয়ে লেভিন গেলেন পোশাক ছাড়তে।

ফিরে এসে কিটিকে দেখলেন সেই একই চেয়ারে। কিন্তু তার কাছে যেতে লেভিনের দিকে তাকিয়ে সে ডুকরে কেঁদে উঠল।

‘কি হল? কি হল?’ লেভিন জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে তা আগেই বুঝতে পেরে।

‘ওই বদ মেয়েটার প্রেমে পড়েছ তুমি। সে তোমাকে যাদু করেছে। তোমার চোখেই তা দেখতে পাচ্ছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ!’ কি দাঁড়াবে এ থেকে? ক্লাবে তুমি মদের পর মদ গিললে, জুয়া খেললে, তারপর গেলে… কার কাছে? না, কাল চলে যাব… কালই আমি চলে যাব।’

লেভিন অনেকক্ষণ স্ত্রীকে শান্ত করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত সে প্রবোধ মানল লেভিনের এই কবুলতিতে যে আন্নার প্রতি অনুকল্পা আর সেই সাথে মদ্যের প্রভাবে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, ধরা দেন আন্নার চাতুরীতে, এর পর থেকে উনি এড়িয়ে চলবেন তাঁকে। সবচেয়ে অকপট যে স্বীকৃতি তিনি করেন তার একটা হল এই যে শুধু কথাবার্তা আর খানাপিনা নিয়ে মস্কোয় এতদিন থাকায় তিনি ঝিম মেরে গেছেন। রাত তিনটা পর্যন্ত ওঁদের কথাবার্তা চলে। শুধু রাত তিনটায়ই তাঁদের এতটা মিটমাট হয়ে যায় যে ঘুমতে পেরেছিলেন।

বারো

আন্না অতিথিদের বিদায় দিয়ে বসলেন না, ঘরে পায়চারি করতে লাগলেন। যদিও অজান্তে (সমস্ত যুবাপুরুষদের ক্ষেত্রে ইদানীং তাঁর যা আচরণ) তবু তাঁর প্রতি লেভিনের প্রেম উদ্রেকের জন্য সারাটা সন্ধে সম্ভবপর সব কিছু করলেও, সৎ, বিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রে এক সন্ধ্যায় সেটা যতদূর সম্ভব তা তিনি যে পেরেছেন এটা জানা থাকলেও, এবং লেভিনকে তাঁর ভারি ভালো লাগলেও (পুরুষের দৃষ্টি থেকে ভ্রন্‌স্কি আর লেভিনের মধ্যে প্রচণ্ড পার্থক্য সত্ত্বেও নারী হিসেবে তিনি দুজনের মধ্যেই সেই সাধারণটাকে দেখতে পাচ্ছিলেন যার জন্য কিটি প্রেমে পড়েছিল ভ্রন্‌স্কি আর লেভিন, দুজনেরই) লেভিন বেরিয়ে যেতেই তাঁর সম্পর্কে আর কিছু ভাবলেন না আন্না।

তাঁকে একটা চিন্তাই শুধু নানা আকারে বিচলিত করছিল : ‘অন্যের ওপর, যেমন এই বিবাহিত, স্ত্রীর অনুরাগী এই লোকটির ওপর আমি যদি এত প্রভাব পেলে থাকি, তাহলে আমার সম্পর্কে কেন সে অমন বীতস্পৃহঃ … না, ঠিক বীতস্পৃহ নয়, আমাকে সে ভালোবাসে, আমি তা জানি। কিন্তু নতুন কি-একটা যেন আলাদা করে দিচ্ছে আমাদের। কেন সারটা সন্ধে তার দেখা নেই? স্তিভাকে সে বলতে বলেছে যে ইয়াভিনকে ছেড়ে সে যেতে পারে না, নজর রাখতে হবে তার খেলার ওপর। ইয়াভিন কি খোকা? কিন্তু ধরা যাক কথাটা ঠিক। ও কখনো মিথ্যে বলে না। তবে এই সত্যির মধ্যে আছে আরেকটি সত্যি। অন্য কিছু দায়িত্ব ওর আছে এটা দেখাবার সুযোগ পেয়ে সে খুশি। এটা আমি জানি, সেটা আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার কাছে সেটা প্রমাণ করার কি দরকার? ও আমাকে দেখাতে চায় যে আমার প্রতি তার ভালোবাসায় ওর স্বাধীনতায় ব্যাঘাত ঘটা উচিত নয়। কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণে আমার দরকার নেই, আমার চাই প্রেম। এখানে, মস্কোয় আমার দিন কাঠানোর সমস্ত দুঃসহতা সে যদি বুঝত। এটা কি জীব? না, জীবন নয়, শুধু ফয়সালার প্রতীক্ষা যা ক্রমাগত মুলতবি থাকছে। আবার কোন জবাব নেই! স্তিভা বলছে যে কারেনিনের কাছে সে যেতে পারছে না। আর আমি আরেকবার চিঠি লিখতে পারি না ওকে। কিছুই করতে পারি না আমি, কিছুই শুরু করতে, কিছুই বদলাতে পারি না, শুধু নিজেকে সামলে রেখে অপেক্ষা, অন্যদিকে মন দেবার চেষ্টা—ইংরেজদের সংসারটা, লেখা, পড়া, কিন্তু এ সবই তো আত্মপ্রতারণা, এসবই ঐ মর্ফিয়া। আমার জন্যে ওর মায়া হওয়া উচিত’, মনে মনে ভাবলেন আন্না, টের পাচ্ছিলেন যে আত্মকরুণার অশ্রুজল চোখে জমে উঠেছে।

ভ্রন্‌স্কির দমকা-মারা ঘণ্টি শুনতে পেলেন তিনি, তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছলেন, কিন্তু শুধুই মুছলেন না, প্রশান্তির ভান করে বাতির তলে বসলেন একটা বই খুলে। ভ্রন্‌স্কিকে দেখাতে হবে যে কথামত ঠিক সময়ে আসে নি বলে তিনি অসন্তুষ্ট, কিন্তু শুধুই অসন্তুষ্ট, নিজের দুঃখ, সবচেয়ে বড় কথা আত্মকরুণা দেখানো চলবে না কোনমতেই। নিজেকে তিনি করুণা করতে পারেন, কিন্তু ভ্রন্‌স্কি তাঁকে করুণা করবেন, এ চলে না। সংঘর্ষ তিনি চাইছিলেন না, ভ্রন্‌স্কি সংঘাত চান বলে তাঁকে তিনি ভর্ৎসনা করেছেন। কিন্তু নিজেই আন্না অজ্ঞাতসারে সংগ্রামের পথ নিলেন।

‘ফাঁকা ফাঁকা লাগেনি?’ প্রাণোচ্ছল হাসি-খুশি মেজাজে তাঁর দিকে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলেন ভ্রন্‌স্কি, ‘কি যে এক নেশা—জুয়া!’

‘না, ফাঁকা ফাঁকা লাগেনি। ও বদভ্যাস অনেকদিন হল কাটিয়ে উঠেছি। স্তিভা আর লেভিন এসেছিল।’

‘হ্যাঁ, ওরা তোমার কাছে আসতে চাইছিল। তা কেমন লাগল লেভিনকে?’ আন্নার কাছে বসে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘বেশ ভালো রেগেছে। এই কিছুক্ষণ আগে ওরা গেল। তার ইয়াভিনের কি হল?’

‘জিতছিল, সতের হাজার। আমি ওকে ডাকলাম, ও উঠে আসতে চাইছিল, কিন্তু আবার ফিরল, এখন হারছে।’

‘তাহলে তুমি রয়ে গেলে কেন?’ হঠাৎ তাঁর দিকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন আন্না। মুখভাব তাঁর শীতল, শত্রুভাবাপন্ন। ‘স্তিভাকে তুমি বলেছিলে যে ইয়াভিনকে উঠিয়ে আনার জন্যে তুমি থেকে যাচ্ছ। আর এখন ওকে ফেলে রেখেই চলে এলে।’

ভ্রন্‌স্কির মুখেও দেখা গেল সংগ্রামের একই শীতল প্রস্তুতি।

‘প্রথমত স্তিভাকে আমি তোমাকে কিছুই বলতে বলিনি। দ্বিতীয়ত, আমি মিথ্যা বলি না কখনো। সবচেয়ে বড় কথা আমি থাকতে চেয়েছিলাম, তাই থেকেছি’, বললেন উনি ভুরু কুঁচকে; ‘আন্না, কেন, কেন এসব?’ মিনিটখানেক চুপ করে থেকে আন্নার দিকে ঝুঁকে আর খোলা হাত বাড়িয়ে দিয়ে, আন্না সে হাতের ওপর হাত রাখবেন এই আশা করে বললেন ভ্রন্‌স্কি।

কোমলতার এই আবেদনে আন্না খুশিই হয়েছিলেন, কিন্তু বিদ্বেষের বিচিত্র কি-একটা শক্তি তাঁকে তাঁর হৃদয়াবেগে আত্মসমর্পণ করতে দিল না, যেন সংগ্রামের নীতিতে সেটা অননুমোদনীয়।

‘বটেই তো, তোমার ইচ্ছে হয়েছিল থেকে যেতে, থেকে গেলে। তুমি যা চাও, তাই করো। কিন্তু আমাকে সে কথা বলছ কেন? কিসের জন্যে?’ ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন তিনি; ‘তোমার অধিকার সম্পর্ক কেউ কি প্রশ্ন তুলেছে? তুমি অধিকার চাও, বেশ থাকো অধিকার নিয়ে।

খোলা হাত তাঁর মুঠো হয়ে এল, হেলান দিলেন পেছনে, মুখে ফুটে উঠল আগের চেয়েও একরোখা একটা ভাব। ‘হ্যাঁ, তোমার কাছে এা জেদের ব্যাপার’, ভ্রন্‌স্কির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে তাঁকে যা জ্বালাচ্ছিল হঠাৎ যেন তাঁর সেই মুখভাবের একটা সংজ্ঞা পেয়ে গিয়ে বললেন আন্না; ‘হ্যাঁ, জেদ ছাড়া কিছু নয়। তোমার কাছে প্রশ্নটা আমার ওপর তোমার জয় বজায় থাকবে কিনা তাই নিয়ে কিন্তু আমার কাছে…’ আবার নিজের জন্য করুণা হল তাঁর, প্রায় কেঁদে ফেলতে যাচ্ছিলেন, ‘আমার অবস্থাটা কি যদি তুমি জানতে! এখনকার মত যখন টের পাই তোমার শত্রুতা, হ্যাঁ শত্রুতাই, যদি জানতে আমার কাছে কি তার মানে! যদি জানতে এসব মুহূর্তে আমি সর্বনাশের কতটা কাছাকাছি, কত ভয় পাচ্ছি, ভয় পাচ্ছি নিজেকে!’ কান্না চাপা দেবার জন্য মুখ ঘুরিয়ে নিলেন আন্না।

‘কিন্তু আমরা কেন? কিসের জন্যে?’ আন্নার হতাশা প্রকাশে ভীত হয়ে আবার তাঁর দিকে ঝুঁকে হাত টেনে নিয়ে চুমু খেতে খেতে বললেন ভ্রন্‌স্কি; ‘কিসের জন্যে? আমি কি বাড়ির বাইরে আমোদ-প্রমোদের পেছনে ছুটি? আমি কি নারীদের এড়িয়ে চলি না?’

‘চলবে বৈ কি!’ আন্না বললেন।

‘কিন্তু বল, কি আমি করি যাতে তুমি শান্তিতে থাততে পারো? তুমি যাতে সুখী হও তার জন্যে সব কিছু করতে আমি রাজী’, আন্নার হতাশায় ব্যাকুল হয়ে বললেন তিনি; ‘এখনকার মত এই দুঃখটা থেকে তোমাকে বাঁচাবার জন্যে কি না আমি করতে পারি আন্না!’

‘ও কিছু না, কিছু না!’ আন্না বললেন; ‘আমি নিজেই জানি না : নিঃসঙ্গ জীবন, স্নায়ু… কিন্তু ও নিয়ে কোন কথা নয়। ঘোড়দৌড় কেমন হল? আমাকে তো কিছু বললে না’, শত হলেও জিত যে তাঁরই এ গর্বটা ঢাকার চেষ্টা করে আন্না জিজ্ঞেস করলেন।

রাতের খাবার চাইলেন ভ্রন্‌স্কি, ঘোড়দৌড়ের বিশদ বিবরণ দিতে লাগলেন; কিন্তু তাঁর গলার সুরে, ক্রমশই শীতল হয়ে আসা দৃষ্টি থেকে আন্না বুঝলেন যে তাঁর জিতটা ভ্রন্‌স্কি ক্ষমা করেননি, তাঁর যে একগুঁয়েমির বিরুদ্ধে তিনি লড়েছেন, সেটা আবার জমাট বাঁধছে তাঁর মধ্যে। আগের চেয়ে তিনি এখন আন্নার প্রতি বেশি নিরুত্তাপ, যেন বশ মেনেছিলেন বলে অনুশোচনা হচ্ছে তাঁর। আর যে কথাগুলো তাঁকে জিতিয়ে দিয়েছিল, যথা : ‘আমি ভয়ংকর সর্বনাশের কাছাকাছি, ভয় পাচ্ছি নিজেকে’, তা মনে পড়ায় আন্না বুঝলেন যে এটা বড় বিপজ্জনক এক অস্ত্র, তাকে আর দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা চলবে না। তিনি টের পেলেন, ভালোবাসার যে বাঁধনে তাঁরা বাঁধা, তার সাথে সাথে লড়াইয়ের কি-একটা কুপ্রবৃত্তি জেগে উঠছে তাঁদের মধ্যে, সেটা তিনি তাড়াতে পারছেন না ভ্রন্‌স্কির মন থেকে; তাঁর নিজের মন থেকে তো আরো কম।

তেরো

যাতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠতে না পারে—এমন কোন পরিস্থিতি নেই। বিশেষ করে যখন সে দেখে চারপাশের লোকেরা তারই মত দিন কাটাচ্ছে। তিন মাস আগে লেভিন বিশ্বাসই করতে পরতেন না যে, আজ যে অবস্থায় পড়েছেন তাতে নিশ্চিন্তে ঘুম হবে তাঁর; উদ্দেশ্যহীন অর্থহীন এক জীবন, তদুপরি যে জীবন তাঁর সঙ্গতির বাইরে তা কাটিয়ে, মাতলামির পর (ক্লাবে যা ঘটেছে সেটাকে তিনি এছাড়া অন্য কোন কথায় ব্যক্ত করতে পারেন না), স্ত্রী একদা যে ব্যক্তির প্রেমে পড়েছিল, তাঁর সাথে বিদঘুটে বন্ধুত্ব স্থাপন, যে নারীকে সর্বনষ্টা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না, তাঁর কাছে আরো বিদঘুটে এক যাত্রা, সে নারীর প্রতি তাঁর আকর্ষণ এবং স্ত্রীর মনঃকষ্ট—এত সবের পর এই পরিস্থিতিতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন ভাবতে পারতেন না তিনি। কিন্তু ক্লান্তি, বিনিদ্র রাত আর সুরার প্রভাবে তিনি গভীর ও নিশ্চিন্ত ঘুমে ঢলে পড়েন।

ভোর পাঁচটায় দরজা খোলার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। লাফিয়ে উঠে তাকিয়ে দেখলেন চারিদিকে। শয্যায় তাঁর পাশে কিটি নেই। কিন্তু পার্টিশনের ওপাশে একটা চলন্ত আলো দেখা যাচ্ছিল, কিটির পায়ের শব্দ শুনতে পেলেন লেভিন।

‘কি?… কি হল?’ বলে উঠলেন তিনি আধঘুমে, ‘কিটি? কি হয়েছে?’

‘কিছু না’, মোমবাতি হাতে পার্টিশনের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এসে কিটি বলল; ‘একটু অসুস্থ বোধ হচ্ছিল’, বলল সে অতি মধুর আর অর্থময় একটা হাসি হেসে।

‘তার মানে? শুরু হয়েছে, শুরু হয়েছে?’ সভয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি; ‘ডেকে পাঠাতে হয়’, তাড়াতাড়ি করে তিনি পোশাক পরতে শুরু করলেন।

‘না-না’, কিটি বলল হেসে, হাত দিয়ে লেভিনকে ধরে রেখে, ‘সম্ভবত কিছুই না। অসুস্থ বোধ হয়েছিল মাত্র খানিকটা। এখন কেটে গেছে।’

পালংকের কাছে গিয়ে মোমবাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়ল কিটি, সাথে সাথে শান্ত হয়ে এল। যদিও তার স্তব্ধতা যেটা নিঃশ্বাস চেপে রাখার মত, বিশেষ করে পার্টিশনের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এসে তাঁকে যে কিটি ‘কিছু না’ বলেছিল অতি কোমলতা আর আকুলতায়, সেটা লেভিনের কাছে সন্দেহজনক মনে হলেও তাঁর এত ঘুম পাচ্ছিল যে তৎক্ষণাৎ ঘুমিয়ে পড়লেন। শুধু পরে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের স্তব্ধতা স্মরণ করে লেভিন বুঝেছিলেন নারীজীবনের মহত্তম ঘটনার প্রতীক্ষায় নড়াচড়া না করে তাঁর পাশে শোয়া কিটির মধুর প্রাণের মধ্যে তখন কি ঘটছিল। সকাল সাতটায় তাঁকে জাগিয়ে দিতে তাঁর কাঁধে কিটির ছোঁয়া আর মৃদু ফিসফিসানি। লেভিনকে জাগিয়ে দিতে মায়া আর তাঁর সাথে কথা বলার ইচ্ছা– এ দুয়ের মধ্যে যেন লড়াই চলছিল কিটির।

‘কস্তিয়া, ভয় পেও না। এ কিছু না। কিন্তু মনে হয়… লিজাভেতা পেত্রভনাকে ডেকে পাঠানো দরকার।‘

আবার জ্বালানে হয়েছে বাতি। বিছানার ধারে বসেছিল সে, হাতে বোনার কাজ, ইদানীং এই নিয়েই ব্যস্ত ছিল সে।

‘লক্ষ্মীটি, ভয় পেও না, ও কিছু নয়। আমার ভয় নেই একটুও’; লেভিনের আতংকিত মুখ দেখে সে বলল, তাঁর হাতটা টেনে নিয়ে রাখলে প্রথমে বুকে, পরে ঠোঁটে।

তাড়াতাড়ি করে লাফিয়ে উঠলেন লেভিন, নিজের সম্পর্কে তাঁর কোন সাড় ছিল না, কিটির ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে ড্রেসিং-গাউন পরতে পরতে থামলেন, আর কেবলি তাকিয়ে রইলেন কিটির দিকে। যাওয়া দরকার, কিন্তু চোখ সরাতে পারছিলেন না কিটির ওপর থেকে। তার মুখখানাকে তিনি ভালোবাসেননি কি, তার মুখভাব, তার দৃষ্টিপাত কি লেভিনের চেনা নয়? কিন্তু এমন তাকে তিনি দেখেননি কখনো। এখন ওর যা অবস্থা তাতে কালে ওর মনঃকষ্ট ঘটিয়েছেন বলে নিজেকে কি পাষণ্ড আর ভয়ংকরই না মনে হচ্ছিল তাঁর! রাতে টুপির তল থেকে বেরিয়ে আসা চুলে ঘেরা তার আরক্ত মুখখানা জ্বলজ্বল করছিল আনন্দে আর সংকল্পে।

কিটির চরিত্রে অস্বাভাবিকতা ও কৃত্রিমতা যত কমই থাক তা জানা সত্ত্বেও, তাঁর সামনে যা উদ্ঘাটিত হল, তাতে অভিভূত হয়ে গেলেন লেভিন, সমস্ত আবরণ খুলে রেখে শুধু তার হৃদয়ের কোষকেন্দ্রটা এখন জ্বলজ্বল করছিল তার চোখে। যে কিটিকে তিনি ভালোবাসতেন, এই সহজতায় আর নগ্নতায় তাকে দেখা যাচ্ছিল আরো স্পষ্ট করে। হাসিমুখে কিটি চেয়েছিল লেভিনের দিকে; কিন্তু হঠাৎ ভুরু কেঁপে উঠল তার, মাথা উঁচুতে তুলে, দ্রুত তাঁর কাছে সরে গিয়ে, তাঁর হাতটা টেনে নিয়ে চাপ দিতে লাগল তাঁর দেহে, কিটির তপ্ত নিঃশ্বাস পড়ছিল তাঁর মুখে। কষ্ট হচ্ছিল কিটির আর এ কষ্টের জন্য যেন সে নালিশ করছিল লেভিনের কাছে। আর অভ্যাসবশে প্রথম মুহূর্তে নিজেকে দোষী মনে হল লেভিনের। কিন্তু ওর দৃষ্টিতে যে কমনীয়তা সেটা বলছিল যে ও ভর্ৎসনা তো করছেই না, বরং ওর এই কষ্টের জন্যই তাঁকে ভালোবাসছে। ‘এর জন্যে যদি আমি না এই তাহলে কে আর দায়ী?’ আপনা থেকেই মনে হল লেভিনের, এ কষ্টের জন্য যে দায়ী তাকে খুঁজতে লাগলেন শাস্তি দেবার জন্য; কিন্তু অপরাধীকে পাওয়া গেল না। কষ্ট হচ্ছিল কিটির, তার জন্য নালিশ করছিল অথচ এই কষ্টে একটা জয়গর্ব হচ্ছিল, এই কষ্টে আনন্দ হচ্ছিল, ভালো লাগছিল তা। লেভিন দেখতে পাচ্ছিলেন অন্তরের মধ্যে তার অপরূপ কি-একটা ঘটেছে, কিন্তু কি? লেভিন বুঝতে পারছিলেন না। এটা তাঁর বোধের ঊর্ধ্বে।

‘আমি মায়ের কাছে লোক পাঠিয়েছি। আর তুমি তাড়াতাড়ি করে যাও লিজাভেতা পেত্রভনার কাছে… কস্তিয়া …. কিছু না, কেটে গেল।’

ওঁর কাছ থেকে সরে এসে ঘণ্টি দিলে কিটি।

‘নাও, যাও এবার। পাশা আসছে। আমি ঠিক আছি।’

আর অবাক হয়ে লেভিন দেখলেন যে উল বোনার যে কাজটা নিয়ে এসেছিল রাতে, সেটা তুলে আবার সে বুতে শুরু করেছে।

লেভিন যখন একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, শুনতে পেলেন অন্য দরজা দিয়ে দাসী ঢুকছে। দরজার কাছে লেভিনের কানে এল বিস্তারিত বরাত করছে কিটি, দাসীর সাথে নিজেই সে খাট সরাতে লেগেছে।

পোশাক পরলেন লেভিন, ছ্যাকড়া গাড়ি তখনো পাওয়া যাবে না বলে যতক্ষণ ঘোড়া জোতা হচ্ছিল, তার মধ্যে আবার তিনি ছুটে উঠলেন শোবার ঘরে, পা টিপে, তাঁর মনে হল যেন ডানা মেলে। দুটো দাসী উদ্বিগ্ন মুখে শোবার ঘরে কিসব নতুন ব্যবস্থা করছিল। পায়চারি করতে করতে দ্রুত ঘর তুলে যাচ্ছিল কিটি আর হুকুম দিচ্ছিল।

‘আমি এখন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। লিজাভেতা পেত্রভনার জন্যে লোক গেছে তবে আমিও ঢু মারব। কিছু দরকার আছে কি? আর হ্যাঁ, ডল্লি?’

কিটি চাইলে তাঁর দিকে, বোঝাই যায় লেভিন কি বলছিলেন সেটা সে শুনতে পায়নি।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। যাও, যাও’, দ্রুত বলে গেল কিটি, ভুরু কুঁচকে, তাঁকে যেতে বলার ইঙ্গিতে হাত নেড়ে।

উনি ড্রয়িং-রুমে ঢুকছিলেন, এমন সময় শোবার ঘর থেকে একটা করুণ কাতরানি উঠে তৎক্ষণা থেমে গেল। থেমে গেলেন তিনি, অনেকক্ষণ বুঝতে পারলেন না ব্যাপারটা।

‘হ্যাঁ, কিটিই’, নিজেকে বললেন তিনি, মাথা চেপে ধরে ছুটে নামলেন নিচে

‘সৃষ্টিকর্তা, কৃপা করো! ক্ষমা করো, সাহায্য দাও!’ বারবার করে বলতে লাগলেন ঠোঁটে যেন হঠাৎ এসে যাওয়া কথাগুলো। আর নাস্তিক লেভিন এসব কথার পুনরাবৃত্তি করছিলেন শুধু ঠোঁট দিয়েই নয়। এখন, এই মুহূর্তে উনি বুঝলেন, সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে তাঁর সমস্ত সন্দেহ, বুদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বাস করার যে অসম্ভাব্যতা তিনি নিজের মধ্যে বোধ করেছেন তাতে সৃষ্টিকর্তার কাছে আবেদনে তাঁর একটুও বাধা হচ্ছে না। সে সবই তাঁর প্রাণ থেকে উড়ে গেছে ভস্মের মত। যাঁর হাতে তিনি নিজে, তাঁর আত্মা, তাঁর ভালোবাসা এখন ন্যস্ত, তাঁকে ছাড়া আর কার কাছে আবেদন জানাবেন তিনি?

ঘোড়া তখনো জোতা হয়নি, কিন্তু নিজের মধ্যে দৈহিক শক্তির একটা বিশেষ সঞ্চার বোধ করে আর যা যা করার আছে তার জন্য এক মুহূর্ত ও যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে মন দিয়ে তিনি গাড়ির জন্য অপেক্ষা না করে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন, কুজ্‌মাকে বললেন সে যে গাড়ি নিয়ে তাঁর সঙ্গ ধরে।

রাস্তার মোড়ে তিনি দেখতে পেলেন রাতের একটা স্লেজ তাড়াহুড়া করে ছুটে আসছে তাঁর দিকে। ছোট্ট স্লেজটায় মখমলের জ্যাকেট পরে আর মাথায় রুমাল বেঁধে বসে আছেন লিজাভেতা পেত্রভানা। তাঁর সোনালি চুলে ভরা ছোট্ট মুখখানা চিনতে পেরে উল্লসিত হয়ে তিনি বলতে লাগলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা সুমহান, সৃষ্টিকর্তা সুমহান!’ মুখের ভাব ওঁর গুরুগম্ভীর, এমন কি কঠোরই। গাড়ি থামাতে না বলে তিনি লিজাভেতা পেত্রভনার সাথে আবার ফিরে এলেন ছুটতে ছুটতে।

উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘণ্টা দুই? তার বেশি নয়? পিওত্‌র দ্‌মিত্রিচকে নিয়ে আসুন, তবে দেখবেন, তাড়া দেবেন না যেন। আর হ্যাঁ, ওষুধের দোকান থেকে আফিম নেবেন।

‘সব ভালোয় ভালোয় কেটে যাবে—এ কথা আপনি তাহলে ভাবছেন? সৃষ্টিকর্তা, দয়া কর, সাহায্য কর!’ এই বলতে বলতে লেভিন দেখলেন ফটক দিয়ে তাঁর নিজের স্লেজটা বেরিয়ে আসছে। স্লেজে লাফিয়ে উঠে কুমার পাশে বসে ডাক্তারের কাছে যেতে হুকুম করলেন।

চৌদ্দ

তখনো শয্যা ত্যাগ করেননি ডাক্তার। ভৃত্য জানাল যে, ‘কাল রাত করে শুয়েছেন, হুকুম দিয়েছেন না জাগাতে, তবে শিগগিরই উঠবে। লোকটা বাতির কাঁচ পরিষ্কার করছিল আর মনে হল সে কাজে একান্ত নিমগ্ন। কাঁচের প্রতি ভৃত্যের এই মনোযোগ আর লেভিনের বাড়িতে কি ঘটছে সে সম্বন্ধে উদাসীনতা প্রথমটা স্তম্ভিত করেছিল তাঁকে, কিন্তু তখনই ভেবে দেখে বুঝলেন যে তাঁর মনের আলোড়ন কেউ জানে না, জানতে বাধ্য নয়, তাই এ উদাসীনতার দেয়াল চূর্ণ করে নিজের লক্ষ্য সিদ্ধির জন্য দরকার ধীরস্থির হয়ে, ভেবেচিন্তে, দৃঢ় সংকল্পে কাজ করা। নিজের মধ্যে ক্রমেই দৈহিক শক্তির জোয়ার আর যা যা করার আছে সে সম্পর্কে মনোযোগ ক্রমেই বেড়ে উঠছে অনুভব করে লেভিন নিজেকে বোঝালেন, ‘তাড়াহুড়ো নয়, কিছুই দৃষ্টিচ্যুত করা চলবে না।’

ডাক্তার এখনো ওঠেননি জেনে লেতিনের মনে যত পরিকল্পনা ভেসে উঠছিল তার মধ্যে এটা তিনি বাছলেন : কুজ্‌মাকে চিঠি দিয়ে পাঠানো যাক অন্য ডাক্তারের কাছে আর নিজে তিনি ওষুধের দোকানে যাবেন আফিমের জন্য এবং যখন তিনি ফিরবেন তখনো ডাক্তার যদি না উঠে থাকেন, তাহলে ভৃত্যকে ঘুষ দিয়ে আর রাজি না হলে জোর করে জাগাতে হবে ডাক্তারকে তাতে যা হবে হোক।

ভৃত্য যেভাবে কাঁচ পরিষ্কার করছিল, ঠিক তেমনি ঔদাসীন্যে প্রতীক্ষমাণ কোচোয়ানের জন্য পাউডার ওষুধ বানাচ্ছিল ওষুধখানার রোগামত এক কর্মচারী, আফিম বেচতে অস্বীকার করল সে। লেভিন চেষ্টা করলেন তাড়া না দিতে, উত্তেজিত না হতে, ডাক্তার আর ধাত্রীর নাম করে বোঝাতে লাগলেন কেন আফিমটা দরকার। আফিম দেওয়া হবে কিনা জার্মান ভাষায় সে পরামর্শ চাইলে কর্মচারী আর ওপাশ থেকে সে সম্মতি পেয়ে একটা ছোট শিশি আর ফানেল নিয়ে বড় একটা বয়াম থেকে ছোট শিশিটায় ধীরে ধীরে আফিম ঢাললে, লেবেল লাগালে এবং লেভিনের আপত্তি সত্ত্বেও তাতে সীল মারলে, তারপর জিনিসটা প্যাক করতেও যাচ্ছিল। সেটা আর লেভিনের সহ্য হল না; জোর করে তার হাত থেকে শিশি ছিনিয়ে নিয়ে ছুটে গেলেন ‘কাঁচের বড় দরজাটার দিকে। ডাক্তার তখনো ওঠেন নি আর ভৃত্য এবার গালিচা পাততে ব্যস্ত, ডাক্তারকে জাগাতে সে চাইলে না। লেভিন তাড়াহুড়া না করে দশ রুবলের একটা নোট বার করে ধীরে-সুস্থে কথা বলতে বলতে তবে সেই সাথে সময়ও নষ্ট না করে নোটটা তাকে দিলেন এবং বোঝালেন যে পিওত্‌র দ্‌মিত্রিচ (একদা অতি নগণ্য এই পিওত্‌র দ্‌মিত্রিচ তাঁর কাছে এখন কি বিরাট পুরুষ ও গুরুত্বধারী লোক বলে মনে হচ্ছে!) কথা দিয়েছেন যে ডাক পড়লে যেকোনো সময়েই তিনি আসবেন, নিশ্চয় রাগ করবেন না তিনি, ওঁকে যেন সে জাগিয়ে দেয়।

রাজি হয়ে ভৃত্য ওপরে উঠে গেল, লেভিনকে বলল রুগী দেখার ঘরে অপেক্ষা করতে।

দরজার ওপাশ থেকে লেভিন শুনতে পেলেন ডাক্তার কাশছেন, হাঁটছেন, হাত মুখ ধুচ্ছেন, কি যেন বলছেন। কেটেছিল তিন মিনিট কিন্তু লেভিনের মনে হল সেটা এক ঘণ্টারও বেশি। আর অপেক্ষা করতে পারছিলেন না তিনি।

দরজার একটা ফুটো দিয়ে মিনতি করে তিনি বলতে লাগলেন, পিওত্‌র দ্‌মিত্রিচ, পিওত্‌র দ্‌মিত্রিচ! সৃষ্টিকর্তার দোহাই, মাফ করবেন আমাকে। যেমন অবস্থা সেভাবেই আমাকে নিন। দু’ঘণ্টার বেশি কেটে গেছে।’

‘আসছি, আসছি!’ শোনা গেল কণ্ঠস্বর আর স্তম্ভিত হয়ে লেভিন শুনলেন ঢাক্তার কথাটা বললেন হেসে।

‘এক মিনিটের জন্যে… ‘

‘আসছি।’

ডাক্তারের বুট পরতে গেল আরো দু’মিনিট, আরো দু’মিনিট পোশাক পরতে আর চুল আঁচড়াতে।

‘পিওত্‌র দ্‌মিত্রিচ!’ করুণ কণ্ঠে লেভিন আবার শুরু করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পোশাক পরে চুল আঁচড়িয়ে ডাক্তার ঢুকলেন এই সময়। ‘এসব লোকদের বিবেক বলে কিছু নেই। চুল আঁচড়াচ্ছেন যখন আমরা মারা যাচ্ছি!’ ভাবলেন লেভিন।

‘সুপ্রভাত!’ লেভিনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে এবং নিজের প্রশান্তিতে তাঁকে ঠিক যেন জ্বালাতে জ্বালাতে ডাক্তার বললেন। ‘ব্যস্তসমস্ত হবেন না। তা কি ব্যাপার?’

আদ্যোপান্ত হবার চেষ্টায় লেভিন স্ত্রীর অবস্থা সম্পর্কে যত রাজ্যের নিষ্প্রয়োজন খুঁটিনাটি জানাতে লাগলেন আর ডাক্তার তখনই তাঁর সাথে চলুন, ক্রমাগত এই অনুরোধ করে করে বাধা দিতে থাকলেন নিজেকেই।

‘আরে, তাড়াহুড়া করবেন না। আপনি তো জানেন না এসব ব্যাপার। হয়ত আমার দরকারই হবে না, তিেব কথা যখন দিয়েছি, তখন যাব। কোন তাড়া নেই। বসুন, বসুন-না, কফি চলবে?’

ডাক্তার কি লেভিনকে নিয়ে ঠাট্টা করছেন, চোখে এই প্রশ্ন নিয়ে লেভিন চাইলেন ডাক্তারের দিকে। কিন্তু ঠাট্টা করার কথা ডাক্তার স্বপ্নেও ভাবেননি।

‘জানি সাহেব, জানি’, হেসে ডাক্তার বললেন, ‘আমি নিজেই বিবাহিত লোক। কিন্তু এইরকম সময় আমরা স্বামীরা হয়ে পড়ি অতি করুণ জীব। আমার এক রোগিণী আছে, এই পরিস্থিতিতে তার স্বামী সব সময়ই গিয়ে ঢোকে আস্তাবলে।’

‘কিন্তু কি আপনি ভাবছেন পিওত্‌র দ্‌মিত্রিচ? ভাবছেন কি-সব ভালোয় কেটে যাবে?’

‘সব তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে প্রসব হবে নিরাপদ।’

‘তাহলে আপনি এখনই আমার সাথে আসছেন?’ লেভিন জিজ্ঞেস করলেন বিদ্বেষে কফি নিয়ে আসা চাকরটার দিকে তাকিয়ে।

‘এক ঘণ্টা পরে।’

‘তাহলে আপনি এখনই আমার সাথে আসছেন?’ লেভিন জিজ্ঞেস করলেন বিদ্বেষে কফি নিয়ে আসা চাকরটার দিকে তাকিয়ে।

‘এক ঘণ্টা পরে।’

‘না-না, সৃষ্টিকর্তার দোহাই!’

‘অন্তত কফিটা খেতে দিন।’

ডাক্তার কফি টেনে নিলেন। চুপ করে রইলেন দুজনে।

‘তবে তুর্কিদের পিটিয়ে ঠাণ্ডা করছে বেশ। কালকের তার বার্তাটা পড়েছেন?’ মিহি একটা রুটি চিবাতে চিবাতে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন।

‘না, আমি আর পারছি না!’ লাফিয়ে উঠে বললেন লেভিন, ‘পনের মিনিটের মধ্যে আসছেন তাহলে?’

‘আধ ঘণ্টা পরে।’

‘কথা দিচ্ছেন তো?’

.

যখন বাড়ি ফিরলেন লেভিন, তখন দেখা হল প্রিন্সেসের সাথে, দুজনে মিলে গেলেন শোবার ঘরের দরজায়। প্রিন্সেসের চোখে পানি, হাত তাঁর কাঁপছিল। লেভিনকে জড়িয়ে ধরে তিনি কাঁদলেন।

উদ্বিগ্ন উজ্জ্বল মুখে লিজাভেতা পেত্রভনা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে তাঁর হাত ধরে প্রিন্সেস জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ভাই লিজাভেতা পেত্রভনা?’

‘ভালোই চলছে’, তিনি বললেন, ‘বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওকে শোয়ান। তাতে সহজ হবে।’

লেভিন যখন জেগে উঠে বুঝেছিলেন ব্যাপারটা কি, তখন থেকে তিনি তৈরি হয়েছিলেন যাতে কিছু না ভেবে, কিছু অনুমান না করে, নিজের সমস্ত চিন্তা অনুভূতি রুদ্ধ করে, স্ত্রীকে ব্যাকুল হতে না দিয়ে বরং তাকে সুস্থির করে, তার সাহসে সাহস জুগিয়ে সামনে যা আছে তা সব দৃঢ়ভাবে সহ্য করে যেতে পারেন। কি ঘটবে, কিসে শেষ হবে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র না ভেবে, ব্যথাটা সাধারণত কতক্ষণ চলে জিজ্ঞেস করে তা জেনে নিয়ে, বুক বেঁধে পাঁচ ঘণ্টা সহ্য করে যাবার জন্য মনে মনে তৈরি হয়েছিলেন লেভিন, তাঁর ধারণা হয়েছিল সেটা সম্ভব। কিন্তু ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে তিনি যখন আবার দেখলেন তার কষ্ট, ঘন ঘন তিনি আওড়াতে লাগলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা, ক্ষমা কর, সাহায্য কর!’ মাথা ওপরে তুলে গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন; তাঁর ভয় হল যে এটা তিনি সইতে পারবেন না, কেঁদে ফেলবেন অথবা ছুটে পালাবেন। এমনই যন্ত্রণা হচ্ছিল তাঁর। অথচ কেটেছিল মাত্র এক ঘণ্টা।

কিন্তু এই এক ঘণ্টার পরে কাটল আরো এক, দুই, তিন, সহ্যের যে শেষ সীমা তিনি নিজের জন্য ধার্য করেছিলেন সেই পাঁচ ঘণ্টাও, অথচ অবস্থাটা তখনো একই রকম; আর সব কিছু তিনি সহ্য করে গেলেন, কেনা সহ্য করা ছাড়া করবার আর কিছু ছিল না, প্রতি মিনিটেই তাঁর ভাবনা হচ্ছিল যে সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছেছেন, কিটির প্রতি সমবেদনায় বুক তাঁর এই বুঝি ফাটে।

কাটল মিনিটের পর মিনিট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তাঁর যন্ত্রণা আর আতংক আরো বেড়ে উঠল, হল তীব্রতর।

জীবনের যেসব সাধারণ পরিস্থিতি ছাড়া কোন কিছুই কল্পনা করা যায় না, লেভিনের কাছে তা অন্তর্ধান করল। সময়ের চেতনা হারালেন তিনি। যেসব মুহূর্তে কিটি তাঁকে কাছে ডাকছিল, আর তিনি তার ঘর্মাক্ত হাত ধরছিলেন, যা কখনো অসম্ভব শক্তিতে চাপ দিচ্ছিল তাঁর হাতে, কখনো ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিল, সেই মুহূর্তগুলো মনে হচ্ছিল ঘণ্টার মত, আর ঘণ্টাগুলো মনে হচ্ছিল মিনিট। লিজাভেতা পেত্রভনা তাঁকে পর্দার পেছনে বাতি জ্বালাতে বলায় অবাক লেগেছিল তাঁর, তিনি জানলেন যে তখন সন্ধে পাঁচটা। তাঁকে যদি বলা হত যে এখন সকাল দশটা, তাতেও সমান অবাক হতেন তিনি। যেমন কোথায়, তেমনি কখন সম্পর্কে কোন জ্ঞান ছিল না তাঁর। তিনি দেখছিলেন কিটির আতপ্ত, কখনো বিহ্বল, যন্ত্রণাকাতর, কখনো স্মিত, তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়া মুখখানা। দেখতে পাচ্ছিলেন প্রিন্সেসকেও। রাঙা, টান টান, তাঁর সাদা এলো চুল, চোখে পানি, জোর করে ঠোঁট কামড়ে যিনি কান্না গিলে নিচ্ছিলেন, দেখতে পাচ্ছিলেন ডল্লিকে, ডাক্তারকে, মোটা মোটা সিগারেট টানছিলেন তিনি, দেখতে পাচ্ছিলেন লিজাভেতা পেত্রভনাকে, মুখ তাঁর দৃঢ়, সুপ্রতিজ্ঞ, আশ্বাসদায়ী; বৃদ্ধ প্রিন্সকে, কুঞ্চিত মুখে তিনি পায়চারি করছিলেন হলে। কিন্তু কখন তাঁরা এসেছেন, গেছেন, কোথায় তাঁরা ছিলেন তার কোন ধারণা ছিল না তাঁর। প্রিন্সেস থাকছিলেন কখনো ডাক্তারের সাথে শোবার ঘরে, কখনো স্টাডিতে, যেখানে দেখা দিয়েছে খাবার সাজানো এক টেবিল; কখনো তিনি নন, ডল্লি। পরে লেভিনের মনে পড়েছিল কোথায় যেন পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। একবার তাঁকে টেবিল আর সোফা সরাতে বলা হল। এটা কিটির জন্য দরকার ভেবে সে কাজটা তিনি করলেন উৎসাহ নিয়ে। পরে তিনি জেনেছিলেন যে ওটা তাঁর নিজেরই রাত যাপনের আয়োজন। পরে তাঁকে পাঠানো হল স্টাডিতে ডাক্তারের কাছে কি যেন প্রশ্ন করার জন্য। ডাক্তার উত্তর দিয়ে পৌর পরিষদে কি-একটা গোলমালের কথা বলতে শুরু করেছিলেন। পরে তাঁকে পাঠানো হল শোবার ঘরে প্রিন্সেসের কাছে গিল্টি রুপোর ফ্রেমে বাঁধানো দেবপট নিয়ে যাবার জন্য। প্রিন্সেসের বৃদ্ধা দাসীর সাথে দেবপট পাড়ার জন্য আলমারির ওপরে ওঠেন এবং তার বাতিটা ভেঙে ফেলেন। প্রিন্সেসের দাসী কিটি আর বাতিটা সম্পর্কে তাঁকে কি যেন আশ্বাস দিয়েছিল, দেবপটটা নিয়ে গিয়ে তিনি কিটির শিয়রে সযত্নে বালিশের তলে গুঁজে দিয়েছিলেন। কিন্তু কোথায়, কখন, কেন এসব হচ্ছিল তা জানতেন না তিনি; কেন প্রিন্সেস তাঁর হাত ধরে করুণ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে শান্ত হতে বললেন তাঁকে, এমন কি ডাক্তারও গম্ভীর মুখে সমবেদনার দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে কয়েক ফোঁটা ওষুধ খেতে বললেন তাও তিনি বুঝতে পারেননি।

তিনি শুধু জানতেন আর অনুভব করছিলেন যে একবছর আগে মফস্বল শহরের হোটেলে নিকোলাই ভাইয়ের মৃত্যু শয্যায় যা ঘটেছিল, এখন ঘটছে তেমনই কিছু-একটা। কিন্তু সেটা ছিল দুঃখ আর এটা আনন্দ। কিন্তু সে দুঃখ আর এই আনন্দ দুই-ই সমানভাবে সাধারণ জীবনের পরিস্থিতির বাইরে, এরা সাধারণ জীবনের পরিস্থিতিতে একটা রন্ধ যার ভেতর দিয়ে আভাস দিচ্ছে সমুন্নত কিছু-একটা। দুটো ঘটনাই একইরকম দুঃসহ, বেদনার্ত, এবং এই সমুন্নতি একইরকম চিন্তার অগম্য, প্রাণ যে উঁচুতে উঠছে, আগে তা কখনো ওঠে নি, যক্তি সেখানে প্রাণের নাগাল পায় না।

‘সৃষ্টিকর্তা, ক্ষমা করো, সাহায্য করো’, বারবার বলতে লাগলেন তিনি আর সৃষ্টিকর্তার সাথে এত দীর্ঘ, মনে হবে পরিপূর্ণ বিচ্ছেদের পরও তিনি টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর কাছেই তিনি আবেদন করছেন তেমনি সহজে, বিশ্বাস নিয়ে যেমন করতেন ছেলেবেলায় আর প্রথম যৌবনে

এই সমস্ত সময়টা লেভিন ছিলেন দু’রকম মানসিক অবস্থায়। একটা—যখন তিনি থাকতেন কিটির কাছ থেকে দূরে, ডাক্তারের সাথে, যিনি একটার পর একটা মোটা মোটা সিগারেট খেয়ে তা নেবাতেন ভরা ছাইদানির কানায়, ডল্লি আর প্রিন্সের সাথে, যেখানে কথাবার্তা হত ডিনার, রাজনীতি, মারিয়া পেত্রভনার অসুখ নিয়ে; লেভিন তখন হঠাৎ ক্ষণেকের তরে একেবারে ভুলে যেতেন কি ঘটছে, নিজেকে মনে হত সবে ঘুম-ভাঙা এক মানুষ। অন্যটা—যখন থাকতেন কিটির কাছে, তার শিয়রে, যেখানে সহবেদনায় বুক ফেটেও ফাটত না, অবিরাম উনি প্রার্থনা করে যেতেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। আর প্রতিবার, শোবার ঘর থেকে আসা কাতরানি যখন তাঁকে বিস্মরণ থেকে জাগিয়ে দিত, প্রথম বারের সেই বিচিত্র বিভ্রান্তিটা পেয়ে বসত তাঁকে; প্রতিবার আর্তনাদটা শুনে লাফিয়ে উঠে তিনি ছুটে যেতেন কৈফিয়ৎ দেবার জন্য, আর যেতে যেতেই মনে পড়ত তাঁর দোষ নেই, ইচ্ছা হত রক্ষা করার, সাহায্য করার। কিন্তু কিটির দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারতেন যে উপায় নেই সাহায্য করার, আতংকিত হয়ে বলতেন : সৃষ্টিকর্তা, ক্ষমা করো, সাহায্য করো।’ সময় যত কাটতে লাগল, দুটো মানসিক অবস্থাই হয়ে উঠতে থাকল প্রবল : কিটির কাছে না থাকলে তাকে একেবারে ভুলে গিয়ে তিনিনি হয়ে উঠতেন আরো শান্ত; আর কিটির কষ্ট দেখে নিজের অসহায়ত্ত অনুভব করে তাঁর যে যন্ত্রণা সেটা হত আরো যন্ত্রণাকর। কোথাও ছুটে যাবার জন্য লাফিয়ে উঠতেন তিনি, আর ছুটে যেতেন কিটির কাছে।

কিটি যখন মাঝে মাঝে তাঁকে বারবার ডেকে পাঠাত, কিটির ওপর রাগ হত তাঁর। কিন্তু যেই দেতেন তার বিনীত স্মিত মুখ, শুনতেন তার কথা : ‘আমি বড় কষ্ট দিচ্ছি তোমাকে’, অমনি রাগ হত সৃষ্টিকর্তার ওপর, আর সৃষ্টিকর্তার কথা মনে হতেই তার কাছে তিনি ক্ষমা চাইতেন, করুণা ভিক্ষা করতেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *