আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ১.১০

দশ

লেভিন যখন অবলোনস্কির সাথে হোটেলে ঢুকলেন তখন অবলোনস্কির মুখভাবের কয়েকটা বৈশিষ্ট্য, মুখের আর গোটা দেহের জ্যোতির যেন-বা একটা সংযত লক্ষ্য না করে তিনি পারেননি। অবলোনস্কি তার ওভারকোট খুলে, টুপিটা মাথায় বাঁকা করে বসিয়ে গেলেন ডাইনিং-রুমে ফ্রক-কোট পরা ভোয়ালে হাতে যে তাতারগুলো তাকে হেঁকে ধরেছিল, তাদের অর্ডার দিতে লাগলেন। যেমন সর্বত্র তেমনি এখানেও তাঁকে সানন্দে স্বাগত করছিল যে পরিচিত, ডাইনে বায়ে তাদের উদ্দেশে মাথা নুইয়ে তিনি গেলেন ব্যুফেতে, মৎস্য সহযোগে ভোদকা পান করলেন এবং কাউন্টারের ওধারে উপবিষ্টা এবং রিবন, লেস, আর কেশকুণ্ডলী শোভিত রঙমাখা ফরাসিনীকে এমন কিছু বললেন যাতে এমন কি সেও অকপটে হেসে উঠল। লেভিন ভোকা খেলেন না শুধু এজন্য যে, আগাগোড়া পরের চুল আর চালের পাউডার আর প্রসাধনী ভিনিগার-এ বানানো ফরাসিনীটি তার কাছে অপমানকর ঠেকেছিল। একটা নোংরা জায়গা থেকে সরে যাবার মত করে তিনি তাড়াতাড়ি করে চলে গেলেন তার কাছ থেকে। তাঁর সমস্ত বুকে ভরে উঠেছিল কিটির স্মৃতিতে, চোখে তার জ্বলজ্বল করছিল জয় আর সুখের হাসি।

‘এখানে হুজুর, এখানে হুজুর কেউ বিরক্ত করবে না আপনাকে, সবচেয়ে বেশি করে তাঁকে যে হেঁকে ধরেছিল সেই বুড়োচুলো তাতারটা বলল, পাছাটা তার প্রকাণ্ড, ফ্রক-কোটের টেইল-দুটো তাতে ফাঁক হয়ে গেছে। আসুন হুজুর’, লেভিনকে সে ডাকল, অবলোনস্কির অতিথির দিকে মনোযোগ দিয়ে সে সম্মান দেখাতে চাইল অবলোনস্কিকে।

ব্রোঞ্জের দেয়াল-রাতির তলে আগে থেকেই টেবিল-ক্লথে ঢাকা গোল টেবিলটার ওপর মুহূর্তে টাটকা আরেকটা টেবিল-ক্লথ বিছিয়ে সে অর্ডারের প্রতীক্ষায় অবলোনস্কির সামনে দাঁড়িয়ে রইল তোয়ালে আর মেনু-কার্ড হাতে নিয়ে।– আপনি যদি বলেন হুজুর, তাহলে আলাদা একটা কেবিনের ব্যবস্থা হতে পারে। তার মহিলার সাথে প্রিন্স গলিৎসিন এখনই চলে যাচ্ছেন। ঝিনুকের টাটকা মাংস পেয়েছি আমরা।’

‘অ, ঝিনুক।

অবলোনস্কি একটু ভাবলেন।

মেনু-কার্ডে আঙুল রেখে তিনি বললেন, ‘পরিকল্পনাটা বদলাব নাকি, লেভিন?’ মুখে তার গুরুতর অনিশ্চিতি ফুটে উঠল, ‘ঝিনুক কি ভালো হবে? তুমি ভেবে দেখো!

‘ফ্লেসবার্গ ঝিনুক, হুজুর, অস্টেন্ড নয়।

‘ফ্লেসবার্গ নয় হল, কিন্তু টাটকা কি

কাল পেয়েছি।’

‘তাহলে ঝিনুক দিয়েই শুরু করব নাকি, তারপর গোটা পরিকল্পনাটা বদলানো যাবে? হ্যাঁ?

‘আমার কাছে সবই সমান। আমার পক্ষে সবচেয়ে বাঁধাকপির স্যুপ আর শস্যদানার মণ্ড। তবে সে তো আর এখানে পাওয়া যাবে না।

‘আ-লা-রুস মণ্ড’ শিশুর ওপর ধাই-মা যেভাবে খুঁকে আসে, সেভাবে লেভিনের ওপর ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলে তাতার।

না, ঠাট্টা নয়। তুমি যা পছন্দ করবে, তাই ভালো। স্কেটিং করে ছুটোছুটি করেছি, খিদে পেয়েছে, তারপর অবলোনস্কির মুখে অসন্তোষের ছায়া দেখে যোগ করলেন, ভেবো না তোমার রুচির তারিফ আমি করি না। তৃপ্তির। সাথে আমি দিব্যি খাব।’

‘তা আর বলতে! তবে যাই কও, এটাই জীবনের একটা পরিতৃপ্তি’, বললেন অবলোনস্কি, তাহলে ভায়া, আমাদের দাও বিশ, নাকি সেটা কম হবে। আচ্ছা, তিরিশটা ঝিনুক আর মূল দিয়ে সিদ্ধ সুপ..’

‘প্রেস্তানিয়ের’, তাতার লুফে নিল কথাটা, কিন্তু অবলোনস্কির ইচ্ছে ছিল না খাদ্যের ফরাসি নাম জানিয়ে সে তুষ্টি পাক।

মূল দেওয়া, বুঝেছ। তারপর গাঢ় সস্ সমেত ত্যুর্বো, তারপর… রোস্টবিফ, কিন্তু দেখো যেন ভালো করে বানানো হয়। তা ছাড়া কাপলুন চলতে পারে, আর বয়াম-জাত শবজি।’

ফরাসি মেনু অনুসারে খাদ্যের নাম না করার যে অভ্যাস ছিল অবলোনস্কির সেটা মনে রেখে তাতার আর নামগুলোর পুনরাবৃত্তি করল না, কিন্তু মেনু-কার্ড অনুসারে সে গোটা অর্ডারটা আওড়ে নিয়ে তৃপ্তি পেল ‘সুপ। প্রেস্তানিয়ের, অ্যার্বো সস বামার্শে, পুলা-আ লেস্ত্রাগ, মাসেদুয়া দ্য ফুই…’ এবং তখনই স্প্রিঙের মত একটা মলাট বাঁধানো মেনু-কার্ড রেখে মদের অন্য কার্ডটা নিয়ে এল অবলোনস্কির কাছে।

‘কি খাওয়া যায়?

‘তোমার যা ইচ্ছে তাই, তবে অল্প, শ্যাম্পেন’, বললেন লেভিন।

‘সেকি? প্রথমেই? তবে ঠিকই বলেছ। সাদা লেবেল ভালো লাগে তোমার?

‘কাশে ব্লাঁ’, খেই ধরল তাতার।

‘বেশ, ঝিনুকের সাথে ওই মার্কাটা আনো, পরে দেখা যাবে।

‘জি আচ্ছ। আর টেবিল-ওয়াইন কিছু?

ন্যুই দাও। না, বরং ক্লাসিকাল শাবলিই ভালো।

‘জ্বি আচ্ছা। আপনার পনিরের অর্ডার দেবেন কি?

‘ও হ্যাঁ, পারমেজান। নাকি তোমার পছন্দ অন্য কিছু।

না, আমার কিছু এসে যায় না, হাসি চাপতে না পেরে বললেন লেভিন।

ফ্রক-কোটের টেইল উড়িয়ে তাতার ছুটে গেল এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল এক প্লেট খুলে ফেলা ঝিনুকের ঝকঝকে ভোলার ভেতর তার শাস আর আঙুলের ফাঁকে ধরা একটা বোতল নিয়ে।

মাড় দেওয়া ন্যাপকিনটা দলা-মোচড়া করে অবলোনস্কি সেটা তার ওয়েস্টকোটে খুঁজলেন এবং শান্তভাবে আয়েস করে হাত রেখে লাগলেন শুক্তি মাংসের সদ্‌গতিতে।

মন্দ নয়’, রুপার চামচে দিয়ে ঝিনুকের খোলা থেকে মাংস ছাড়াতে ছাড়াতে তিনি বললেন, ‘মন্দ নয়! চকচকে সজল চোখে কখনো তাতার, কখনো লেভিনের দিকে তাকিয়ে পুনরুক্তি করলেন তিনি।

ঝিনুকও লেভিন খেলেন যদিও পনিরের সাথে সাদা রুটি তার বেশি ভালো লাগতো। কিন্তু অবলোনস্কিকে তিনি তাকিয়ে দেখছিলেন মুগ্ধ হয়ে। এমন কি তাতারটিও বোতলের ছিপি খুলে পাতলা পানপাত্রে ফেনিল সুরা ঢালতে ঢালতে তার সাদা টাইটা ঠিক করে নিয়ে চাইছিল অবলোনস্কির দিকে।

নিচের পাত্র নিঃশেষ করে অবলোনস্কি বললেন, ‘ঝিনুক তোমার বিশেষ ভালো লাগে না, তাই না? নাকি কিছু একটা দুশ্চিন্তায় আছ? এ্যাঁ?

উনি চাইছিলেন লেভিন যেন হাসিখুশি হয়ে ওঠেন। কিন্তু লেভিনের যে শুধু খুশিই লাগছে না তাই নয়, সংকোচই । লাগছিল। তার মনে যে ভাবনাটা রয়েছে তাতে এই খানাঘরে, এই কেবিনগুলোর মধ্যে যেখানে মহিলাদের নিয়ে । আহার করছে লোকে, এই ছুটোছুটি আর ব্যস্ততার মাঝখানে তার কেমন ভয়-ভয় করছিল, অস্বস্তি হচ্ছিল; ব্রোঞ্জ, আয়না, গ্যাসের আলো আর তাতারদের এই পরিবেশটা অপমানকর ঠেকছিল তাঁর কাছে। ভয় হচ্ছিল, তার হৃদয় যাতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে তাতে বুঝি মালিন্য লাগবে।

বললেন, ‘আমি? হ্যাঁ, আমি একটু চিন্তায় আছি; কিন্তু তা ছাড়াও এই সব কিছু আমাকে ঠেসে ধরছে। আমি একটা গ্রাম্য লোক, তুমি ভাবতেই পারবে না আমার কাছে এ সবই বিকট, তোমার কাছে যে ভদ্রলোককে দেখেছিলাম, তার নখের মত…’

হেসে অবলোনস্কি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি বেচারা গ্রিনেভিচের নখে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলে তা দেখেছিলাম।

লেভিন বললেন, ‘আমি পারি না। তুমি আমার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে দেখার চেষ্টা কর, গ্রাম্য লোকের দৃষ্টিভঙ্গি নাও। গ্রামে আমরা হাত-দুখানা এমন অবস্থায় রাখার চেষ্টা করি যাতে কাজের সুবিধা হয়। তার জন্য নখ কেটে ফেলি, মাঝে মাঝে আস্তিন গুটিয়ে রাখি। আর এখানে লোকে ইচ্ছে করে যতটা পারা যায় নখ রাখে, আর কফে লাগায় পিরিচের মত চওড়া বোতাম যাতে হাত দিয়ে কিছু করতে না হয়।

অবলোনস্কি খুশিতে হেসে উঠলেন।

‘হ্যাঁ, ওর যে স্থল পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই, এটা তার লক্ষণ। কাজ করে ওর মাথা…’

হয়ত তাই। তাহলেও আমার কাছে এটা বিকট লাগে যে আমরা গাঁয়ের লোকেরা কাজে লাগার জন্য তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে নিই, আর তুমি আমি চেষ্টা করছি খাওয়াটা যত পারা যায় লম্বা করতে, আর তাই ঝিনুকের মাংস খাচ্ছি ..’

‘সে তো বলাই বাহুল্য, কথাটা লুফে নিলেন অবলোনস্কি, শিক্ষাদীক্ষার লক্ষ্যই তো এই : সব কিছু থেকে তৃপ্তি হেঁকে নেওয়া।

তাই যদি লক্ষ্য হয়, তাহলে আমি বরং বুনো হয়েই থাকতে চাই।’

এমনিতেই তো তুমি বুনো। বুনো লেভিনরা সবাই।’

দীর্ঘশ্বাস নিলেন লেভিন। মনে পড়ল নিকোলাই ভাইয়ের কথা, লজ্জা আর কষ্ট হল তাঁর, ভুরু কুঁচকে গেল। কিন্তু অবলোনস্কি এমন বিষয় নিয়ে কথা শুরু করলেন যে সাথে সাথেই তাতে আকৃষ্ট হলেন তিনি।

ঝিনুকের শুন্য খড়খড়ে খোলাগুলোকে সরিয়ে দিয়ে তিনি পনির টেনে এনে রীতিমত চোখ চকচক করে বললেন, ‘কি, ওদের ওখানে, মানে শ্যেরবাস্কিদের ওখানে যাবে?

হ্যাঁ, অবশ্যই যাব’, বললেন লেভিন, যদিও আমার মনে হয়েছিল যে প্রিন্স-মহিষী আমাকে ডেকেছেন অনিচ্ছায়।

‘কি বলছ? একেবারে বাজে কথা! এই ওঁর ধরন…ওহে ভাই, স্যুপ দাও!…ওটা ওঁর বড়লোকী স্বভাব’, বললেন অবলোনস্কি, ‘আমিও যাব, কিন্তু কাউন্টেস বানিনার ওখানে রিহার্সালে থাকতে হবে আমাকে। কিন্তু তুমি বুনো নও কি বলে? হঠাৎ তুমি মস্কো থেকে উধাও হলে, কি তার ব্যাখ্যা? তোমার সম্পর্কে শ্যেরবাৎস্কিরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন অবিরাম, যেন আমারই জানার কথা। আর আমি জানি শুধু একটা জিনিস : তুমি সব সময়ই তাই কর যা কেউ করে না।

‘হ্যাঁ’, লেভিন বললেন ধীরে ধীরে, বিচলিত হয়ে, ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, আমি বুনো। তবে আমি যে চলে গিয়েছিলাম তাতে নয়, ফিরে যে এলাম, এতেই আমার বন্যত্ব প্রকাশ পাচ্ছে…’

‘ওহ্, কি সুখী তুমি!’ লেভিনের চোখে চোখে তাকিয়ে তার কথার খেই ধরে বললেন অবলোনস্কি।

কেন?

‘দৌড়বাজ ঘোড়াকে চেনা যায় তার গায়ে দাগা মার্কা দেখে, আর প্রেমিক যুবককে চেনা যায় তার ভাবাকুল চোখ দেখে’, বড় গলায় বললেন অবলোনস্কি, সব কিছুই তোমার সামনে।

‘আর তোমার কি সবই পেছনে?’

না, পেছনে না হলেও ভবিষ্যৎ তোমার, আর আমার আছে বর্তমান–এমনি, গিঠে গিঠে বাঁধা।

‘কেন, কি ব্যাপার?

‘ভালো নয়। মানে, নিজের কথা আমি বলতে চাই না, তার ওপর সব বুঝিয়ে বলা অসম্ভব’, বললেন অবলোনস্কি, ‘তা তুমি মস্কো এলে কেন?… ওহে প্লেটগুলো সরিয়ে নাও!’ তাতারের উদ্দেশে হাঁক দিলেন তিনি।

অবলোনস্কির ওপর থেকে তাঁর গভীরে প্রোজ্জ্বল দৃষ্টি না সরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন লেভিন, ‘আন্দাজ করতে পেরেছ?

‘আন্দাজ করেছি, কিন্তু এ নিয়ে কথা পাড়তে পারছি না। এ থেকেই তুমি বুঝবে আমি ঠিক ধরেছি কি না, অবলোনস্কি লেভিনের দিকে তাকিয়ে বললেন সূক্ষ্ম হাসিতে।

‘কিন্তু তুমি কি বলে? কম্পিত কণ্ঠে লেভিন বললেন, টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর মুখের পেশী কেঁপে কেঁপে উঠছে। ‘তোমার কি মনে হচ্ছে,

লেভিনের চোখ থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে ধীরে ধীরে শাবলির গেলাস নিঃশেষ করে অবলোনস্কি বললেন : ‘আমি? এর চেয়ে ভালো আর কিছু আমার চাইবার নেই। যা হওয়া সম্ভব তা ভেতর এটাই শ্রেয়।

‘কিন্তু তোমার ভুল হচ্ছে না তো? কি নিয়ে আমরা কথা বলছি তা জান তুমি? স্থির দৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে লেভিন বলে উঠলেন, ‘তুমি কি ভাব এটা সম্ভব?

ভাবি যে সম্ভব। অসম্ভব হবে কেন?

‘আরে না-না, সত্যিই তুমি ভাবছ যে এটা সম্ভব না-না, তুমি যা ভাবছ সবটুকু খুলে বল। কিন্তু যদি, যদি প্রত্যাখ্যান আমার কপালে থাকে… আমি এমন কি নিশ্চিতই যে…’

তার আকুলতায় হেসে ফেলে অবলোনস্কি বললেন, কেন ও কথা ভাবছ তুমি?

মাঝে মাঝে আমার এরকমই মনে হয়। তাহলে সেটা যে একটা ভয়াবহ ব্যাপার হবে ওর কাছেও, আমার কাছেও।

মানে, মেয়েদের কাছে অন্তত এক্ষেত্রে ভয়াবহ কিছু নেই, পাণিপ্রার্থনায় প্রত্যেক মেয়েই গর্বিত বোধ করে।

‘হ্যাঁ প্রত্যেকে, কিন্তু সে নয়।’

অবলোনস্কি হাসলেন। লেভিনের এই আবেগপ্রবণতা তিনি বেশ বোঝেন, জানেন যে ওঁর কাছে বিশ্বের সমস্ত মেয়ে দুভাগে বিভক্ত। এক দলে পড়ে কিটি ছাড়া আর সব মেয়ে, সব কিছু মানবিক দুর্বলতা আছে তাদের, অতি মামুলী মেয়ে সব; দ্বিতীয় দলে পড়ে শুধু সে, কোনরকম দুর্বলতা যার নেই, সমস্ত মানবজাতির সে অনেক উর্ধ্বে।

‘আরে দাঁড়াও’, লেভিনের হাত চেপে ধরে তিনি বললেন, সসের পাত্রটা লেভিন ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলেন, সস্ নাও।’

বাধ্যের মত লেভিন সস্ নিলেন, কিন্তু অবলোনস্কিকে খাওয়ার ফুরসত দিলেন না। বললেন : ‘আরে না, না, একটু রোসো তো তুমি। বুঝতে তো পারছ এটা আমার কাছে জীবন-মরণের প্রশ্ন। কারো সাথে কখনো এ নিয়ে কথা বলিনি। তাছাড়া তোমার সাথে যেমন তেমন ভাবে আর কারো সাথেই কথা বলতে পারি না আমি। দেখো, তুমি আর আমি একেবারে ভিন্ন লোক, রুচিতে, দৃষ্টিভঙ্গিতে, সব কিছুতেই; কিন্তু আমি জানি যে তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমাকে বোঝো আর এই জন্যই দারুণ ভালোবাসি তোমাকে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার দোহাই, একেবারে খোলাখুলি সব বলো।’

যা ভাবছি তাই তো তোমাকে বলছি, হেসে বললেন অবলোনস্কি, কিন্তু তোমাকে আর বেশিকিছু বলব? আমার স্ত্রী আশ্চর্য মহিলা’, স্ত্রীর সাথে নিজের সম্পর্কের কথা মনে পড়ায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, তারপর এক মিনিট চুপ করে বলে গেলেন : ‘ওর দিব্যদৃষ্টি আছে, লোকের অন্তর ভেদ করে সে দেখতে পায় তাই নয়। কি ঘটবে তাও তার জানা থাকে, বিশেষ করে বিবাহাদি ব্যাপারে। যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে শাখোস্কায়া ব্রেনতেকে বিয়ে করবে। কারুর বিশ্বাস হতে চাইছিল না, কিন্তু ঘটল ঠিক তাই-ই। আর সে তোমার পক্ষে।

তার মানে!

মানে এই যে তোমাকে সে ভালোবাসে তাই নয়, বলছে যে কিটি অবশ্য-অবশ্যই হবে তোমার বউ।

এ কথায় লেভিনের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল যে হাসিতে সেটা চরিতার্থতার অশ্রুকণার সামিল।

‘এই কথা সে বলছে! চেঁচিয়ে উঠলেন লেভিন, আমি সব সময়ই বলে এসেছি যে অতি চমৎকার লোক তোমার বউটি, কিন্তু যথেষ্ট হল এ সব কথা, উঠে দাঁড়িয়ে লেভিন বললেন।

‘বেশ, কিন্তু বসো তো।’

দৃঢ় পদক্ষেপে লেভিন পিঞ্জরাকৃতি ঘরখানায় দু’বার পায়চারি করলেন, চোখ পিটপিট করলেন যাতে অশ্রু দেখা যায় এবং কেবল তারপরেই ফিরে এলেন নিজের আসনে। বললেন, বুঝতে পারছ, প্রেম নয় এটা। প্রেমে আমি পড়েছি, কিন্তু এটা সে জিনিস নয়। আমার নিজের অনুভূতি এটা নয়, বাইরেকার কি-একটা শক্তি আচ্ছন্ন করেছিল আমাকে। আমি তো চলেই গেলাম, কেননা ঠিক করলাম ও সব হবে না, বুঝেছ, ওটা পৃথিবীতে যা হয় না তেমন একটা সুখ; নিচের সাথে লড়াই চালিয়েছি আমি, এখন দেখতে পাচ্ছি ওটা ছাড়া জীবন অর্থহীন। ফয়সালা করা দরকার…’

‘কিন্তু তুমি চলে গিয়েছিলে কেন?

‘আহ্ দাঁড়াও! ইস্, কত যে ভাবনা ঘুরছে মাথায়! কত কি জিজ্ঞেস করার আছে! শোন বলি, এই-যে বললে, এতে যে কি করে দিলে আমাকে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। এতই আমি সুখী যে জানোয়ারই বনে গেছি । সব ভুলে গিয়েছিলাম। আজকে আমি শুনলাম যে নিকোলাই ভাই…জানো তো, সে এখানে… অথচ তার কথা ভুলে গেছি। আমার মনে হয় সেও যেন সুখী। ওটা একটা পাগলামি গোছের। কিন্তু একটা জিনিস সাঘাতিক… এই যেমন তুমি বিয়ে করেছ, এই অনুভূতিটা তোমার জানা আছে… এটা সাঘাতিক যে আমরা বয়স্ক, প্রেমের পথ নয়, পাপের পথ অতিক্রম করে এসেছি, হঠাৎ মিলিত হতে যাচ্ছি নিষ্পাপ, নিষ্কলংক একটা প্রাণীর সাথে; এটা বীভৎসতা, তাই নিজেকে অযোগ্য বলে না ভেবে পারা যায় না।

‘তোমার পাপ তো তেমন বেশি নয়।

‘আহ্‌, তাহলেও’, লেভিন বললেন, তাহলে, নিজের জীবনের পাতাগুলো পড়তে গিয়ে আমি কেঁপে উঠি, অভিশাপ দিই, তিক্ত বিলাপ করি…’ হ্যাঁ!

অবলোনস্কি বললেন, তা কি আর করা যাবে, দুনিয়াটাই যে অমনি ধারায় গড়া।

‘শুধু একটা সান্ত্বনা ওই প্রার্থনাটা যা সবসময় আমার ভালো লাগতো–আমাকে ক্ষমা কর আমার পুণ্যকর্মের জন্য নয়, তোমার অনুকম্পাভরে। শুধু এভাবেই সে ক্ষমা করতে পারে।

এগারো

লেভিন তার পানপাত্রটা খালি করে ফেললেন, তারপর দুজন চুপচাপ বসে রইলেন।

লেভিনকে অবলোনস্কি জিজ্ঞেস করলেন, একটা কথা তোমাকে আমার বলা দরকার। ভ্রনস্কিকে চেনো তুমি?

না, চিনি না। কিন্তু কেন?

‘আরেকটা আনো’, অবলোনস্কি বললেন তাতারকে। পানপাত্র ভরে দিচ্ছিল সে, আর ওঁদের কাছে ঘুরঘুর করছিল ঠিক যে সময়টিতে তার দরকার থাকত না।

‘ভ্রনস্কিকে আমার জানতে হবে কেন?

‘জানতে হবে, কেননা সে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের একজন।

‘কে এই ভ্রনস্কি জিজ্ঞেস করলেন লেভিন, এই কিছুক্ষণ আগেও তাঁর যে শিশুসুলভ উল্লসিত মুখভাব অবলোনস্কিকে মুগ্ধ করেছিল হঠাৎ তা হয়ে উঠল রাগত আর অপ্রীতিকর।

‘ভ্রনস্কি হলেন কাউন্ট কিরিল ইভানোভিচ ভ্রনস্কির এক ছেলে এবং পিটার্সবুর্গের গিল্টি-করা যুবসমাজের শ্রেষ্ঠ নির্দশন একটা। ভেরে যখন কাজ করতাম, তখন চিনতাম তাকে। সৈন্য রিক্রুটিঙের ব্যাপারে তিনি এসেছিলেন সেখানে। সাঙ্ঘাতিক ধনী, সুপুরুষ, বিস্তৃত যোগাযোগ, এইডডেকং, সেইসাথে ভারি মোলায়েম, চমৎকার লোক। না, নেহাৎ একজন চমৎকার লোকের চেয়েও বেশি। এখানে যখন আমি ওঁকে দেখলাম, তখন তিনি যেমন সুশিক্ষিত, তেমনি বুদ্ধিমান; এ লোক অনেক দূর যাবে।

লেভিন ভুরু কুঁচকে চুপ করে রইলেন।

‘তা উনি এখানে দেখা দিয়েছেন তুমি চলে যাবার কিছু পরেই, আর আমি যতদূর বুঝছি, কিটির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন আর বুঝতেই তো পারো, মা…’

‘মাপ কর, কিছুই আমি বুঝছি না’, লেভিন বললেন মুখ হাঁড়ি করে কপাল কুঁচকিয়ে, সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ল নিকোলাই ভাইয়ের কথা এবং কি জানোয়ার তিনি যে তাকে ভুলতে পারলেন।

‘আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও, হেসে তাঁর হাত ধরে বললেন অবলোনস্কি, ‘আমি যা জানি শুধু তাই তোমাকে বলেছি, তবে আবার জানাই, এই সূক্ষ্ম, সুকোমল ব্যাপারে যতটা অনুমান করা সম্ভব তাতে আমার মনে হয় চান্তা তোমার দিকেই বেশি।

লেভিন চেয়ারে আবারা ধপাস করে বসে পড়লেন, মুখ তার বিবর্ণ হয়ে উঠল।

তাঁর পানপাত্র পূর্ণ করে দিতে দিতে অবলোনস্কি বলে চললেন, ‘আমি পরামর্শ দেব যথাসত্বর ব্যাপারটার হেস্ত নেস্ত করে ফেলতে।

‘না, ধন্যবাদ, কিন্তু পান করতে আমি আর পারছি না’, গেলাস ঠেলে দিয়ে লেভিন বললেন, মাতাল হয়ে পড়ব… কিন্তু তুমি আছ কেমন? স্পষ্টতই কথার মোড় ফেরাবার জন্য বললেন লেভিন।

‘আরেকটা কথা, সমস্যাটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলল, এই আমার পরামর্শ। আজই কথা বলতে বলছি না, বললেন অবলোনস্কি, ‘চলে যাও কাল সকালে। চিরায়ত রীতিতে প্রস্তাব দিও। তারপর সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ…’।

কই, তুমি যে কেবলি বল শিকারের জন্য আমার ওখানে আসবে? এসো-না বসন্ত কালে’, লেভিন বললেন।

অবলোনস্কির সাথে এই আলাপটা শুরু করেছিলেন বলে এখন তিনি সর্বান্তঃকরণে অনুতপ্ত। কোন এক পিটার্সবুর্গ অফিসারের প্রতিযোগিতা নিয়ে কথাবার্তাটায়, অবলোনস্কির প্রস্তাব আর পরামর্শে তার বিশেষ অনুভূতিতে মালিন্য লেগেছে। অবলোনস্কি হাসলেন। তিনি বুঝেছিলেন কি চলছে লেভিনের ভেতরটায়।

বললেন, যার কোন এক সময়। আহ্ ভাই, নারী–এই স্কুপটা দিয়েই সব কিছু ঘুরছে। এই যেমন আমার অবস্থাটা খারাপ, অতি খারাপ। আর সবই ঐ নারীদের জন্য। তুমি আমাকে খোলাখুলি বলো তো, চুরুট বের করে অন্য হাতে পানপাত্র নিয়ে তিনি বলে চললেন, ‘তুমি উপদেশ দাও আমাকে।’

‘কিন্তু কি ব্যাপার?

ব্যাপার এই। ধরা যাক তুমি বিবাহিত, স্ত্রীকে ভালোবাসো, কিন্তু অন্য নারীর প্রেমে মেতে উঠেছ…’

‘মাপ কর, এটা আমি একেবারেই বুঝি না, যে যেন…যতই বলো, যেমন বুঝি না কেন আমি ভরপেট খাওয়া দাওয়ার পরই রুটিখানার পাশ দিয়ে যাবার সময় চুরি করব কিনা একটা বন রুটি।’

অবলোনস্কির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল সচরাচরের চেয়েও বেশি।

‘কেন নয়? মাঝে মাঝে বন রুটি এমন গন্ধ ছাড়ে যে লোভ সামলানো দায়।

নিজের পাথিব কামনা-বাসনাকে
যদি আমি পরাজিত করে থাকি, সে তো চমৎকার;
আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলেও
আনন্দটুকু তো পাওয়া গেল।

জার্মান ভাষায় এই বলে অবলোনস্কি শুধু সূক্ষ্ম হাসলেন। না হেসে পারলেন না লেভিনও।

অবলোনস্কি বলতে লাগলেন, না, এটা ঠাট্টার কথা নয়। ভেবে দেখো, এ নারী মিষ্টি, নম্র, প্রেমময়ী একটা প্রাণী, বেচারা, নিঃসঙ্গিনী, সব বিসর্জন দিয়েছে আমার জন্য। এখন, কাণ্ডটা যখন হয়েই গেছে–ভেবে দেখো–সত্যিই কি ওকে ত্যাগ করতে পারি? ধরা যাক, পরিবার টিকিয়ে রাখার জন্য ছাড়াছাড়ি হল, কিন্তু ওর জন্য কি করুণা হবে না, ওর একটা ব্যবস্থা করব না, সহনীয় করে তুলব না ওর জীবন?

কিন্তু মাপ কর ভাই, তুমি তো জানো, আমার কাছে সমস্ত নারী দু’ভাগে বিভক্ত… মানে, না… সঠিক বলল : নারী আছে এবং আছে… মনোরমা পতিতা আমি দেখিনি, দেখবও না, আর কাউন্টারের ওই চাচর চিকুর দোলানো রঙ-করা ফরাসিনীর মত যারা, তারা আমার কাছে জঘন্য জীব, সব পতিতাই তাই।

‘আর বাইবেলোক্ত পতিতা?’

‘আহ চুপ কর তো! খ্রিস্ট যদি জানতেন কথাগুলোর কি অপব্যবহার হবে, তাহলে কখনোই তিনি তা বলতেন না। কেননা সারা খ্রিস্ট উপদেশামৃত থেকে লোকে মনে রেখেছে কেবল ঐটুকুই। তবে আমি বলছি যা ভাবি তা নয়, যা অনুভব করি। পতিতা নারীদের প্রতি আমার একটা বিতৃষ্ণা আছে। তুমি ভয় পাও মাকড়শায়, আমি এই কদর্য জীবগুলোকে। মাকড়শাদের নিয়ে তুমি নিশ্চয় অনুসন্ধান চালাওনি, তাদের ধরন-ধারন জানো না? আমিও সেইরকম।’

‘তোমার পক্ষে এ সব কথা বলতে আর কি; এ ঠিক ডিকেন্সের ওই ভদ্রলোকটির মত, যিনি বাঁ হাতে সমস্ত মুশকিলে প্রশ্নগুলোকে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলতেন ডান কাঁধের ওপর দিয়ে। কিন্তু বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করা তার জবাব নয়। কি করা যাবে, তুমি বলো আমাকে, কি করি? বৌ বুড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ আমি জীবনে ভরপুর। দেখতে না দেখচে টের পেতে হয়, বৌকে যতই শ্রদ্ধা করি, সপ্রেম ভালোবাসা আর সম্ভব নয়। তারপর হঠাৎ দেখা দিল প্রেম, তুমিও ডুবলে, একেবারে ডুবলে!’ বিষন্তাশায় বললেন অবলোনস্কি।

লেভিন ঠোঁট কুঁচকে হাসলেন।

হ্যাঁ, ডুবেছি’, অবলোনস্কি বলে চললেন, কিন্তু কি করা যায়?

বন রুটি চুরি করতে যেও না।’

হেসে উঠলেন অবলোনস্কি।

‘আহা আমার নীতিবান! কিন্তু ভেবে দেখো। রয়েছে দুটো নারী। একজন দাবি করছে শুধু নিজের অধিকার, আর সে অধিকার হল ভালোবাসা যা তুমি দিতে অক্ষম; অন্যজন তোমার জন্য সব কিছু ত্যাগ করেছে, অথচ কিছুই দাবি করছে না। কি করা যাবে তখন, কি কর্তব্য? এ এক ভয়ংকর ট্রাজেডি।’

‘এ ব্যাপারে আমার উপদেশ যদি শুনতে চাও, তাহলে আমি বলব যে এক্ষেত্রে কোন ট্রাজেডি ঘটেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কেন, তা বলি। আমার মতে প্রেম… দু’ধরনের প্রেমই, মনে আছে তো? প্লেটো যার সংজ্ঞা দিয়েছেন তার সিম্পোজিয়ামে’, দু’ধরনের প্রেমই লোককে পরখ করার কষ্টিপাথর। একদল লোক শুধু এক ধরনের প্রেম বোঝে, অন্য দল অন্যটা। যারা অনিষ্কাম প্রেমই বোঝে, খামোকাই তারা ট্রাজেডির কথা বলছে। এরকম প্রেমে কোন ট্রাজেডিই হতে পারে না। সুখদানের জন্য বিনীত ধন্যবাদ’, ব্যাস, ফুরিয়ে গেল ট্রাজেডি। আর নিষ্কাম প্রেমে ট্রাজেডির কথাই ওঠে না, কেননা এরূপ প্রেমে সবই উজ্জ্বল আর নির্মল, কেননা…’

এই সময় লেভিনের মনে পড়ল তার নিজের পাপ আর তা নিয়ে আত্মগ্লানির কথা। তাই হঠাৎ তিনি যোগ করলেন : ‘তবে তুমিও হয়ত ঠিক, খুবই তা সম্ভব… কিন্তু আমি জানি না, সত্যিই জানি না।’

অবলোনস্কি বললেন, ‘কি জানো, তুমি খুবই লক্ষ্যনিষ্ঠ লোক। এটা তোমার গুণও বটে, দোষও বটে। তোমার নিজের চরিত্র লক্ষ্যনিষ্ঠ আর চাও যেন গোটা জীবন অন্বিত হয়ে ওঠে লক্ষ্যনিষ্ঠ ঘটনায়, অথচ এটা হয় না। এই যে তুমি প্রশাসনিক রাজপুরুষদের কার্যকলাপ ঘৃণা কর, কারণ তোমার ইচ্ছে যেন ব্যাপারটা চলে একটা লক্ষ্য মেনে, এটা হয় না। তুমি এও চাও, একজন ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপের যেন সব সময়ই একটা লক্ষ্য থাকে, প্রেম আর পারিবারিক জীবন যেন সব সময় একসাথে মিলে যায়। অথচ সেটা হয় না। জীবনের সমস্ত বৈচিত্র্য, সমস্ত মাধুরী, সমস্ত সৌন্দর্য গড়ে ওঠে ছায়া আর আলো দিয়ে।

লেভিন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কোন জবাব দিলেন না তিনি। মগ্ন ছিলেন নিজের চিন্তায়, অবলোনস্কির কথা কানে যাচ্ছিল না।

হঠাৎ দুজনেই টের পেলেন যে তাঁরা যদিও বন্ধু এবং একসাথে খানাপিনা করেছেন, যাতে তাদের আরো কাছাকাছি আসার কথা, তাহলেও প্রত্যেকে ভাবছেন শুধু নিজের ব্যাপার নিয়ে, অপরের জন্য কারোর মাথাব্যথা নেই। আহারের পর নৈকট্যের পরিবর্তে এই চূড়ান্ত বিযুক্তির অভিজ্ঞতা অবলোনস্কির হয়েছে একাধিক বার এবং জানতেন এ সব ক্ষেত্রে কি করা উচিত।

‘বিল!’ বলে চিৎকার করে তিনি গেলেন পাশের কক্ষে এবং তৎক্ষণাৎ পরিচিত একজন অ্যাডজুট্যান্টের দেখা পেলেন, তার সাথে শুরু করে দিলেন জনৈকা অভিনেত্রী আর তার পৃষ্ঠাপোষককে নিয়ে আলাপ। অ্যাডজুট্যান্টের সাথে কথা কয়ে অবলোনস্কি তৎক্ষণাৎ লেভিনের সাথে কথাবার্তা থেকে হাঁপ ছেড়ে হালকা হবার আমেজ পেলেন। লেভিন সব সময়ই তাকে আহ্বান করতেন বড় বেশি মানসিক ও আত্মিক প্রয়াসে।

তাতার যখন ছাব্বিশ রুবল আর কিছু কোপেক, সেই সাথে ভোদুকার জন্য বখশিসের বিল নিয়ে এল, গ্রামবাসী যে লেভিন অন্য সময়ে তার ভাগের এই চৌদ্দ রুবল বিল দেখে আঁতকে উঠতেন, এবার তিনি ভ্রূক্ষেপও করলেন না, হিসাব মিটিয়ে দিলেন এবং বাড়ি ফিরলেন পোশাক বদলিয়ে শ্যেরবাৎস্কিদের ওখানে রওনা দেবার জন্য, যেখানে তাঁর ভাগ্য স্থির হয়ে যাবে।

বারো

এখন প্রিন্সেস কিটি শ্যেরবাঙ্কায়ার বয়স আঠারো বছর। সমাজে সে বেরোচ্ছে এই প্রথম শীত। এখানে তার সাফল্য তার দু’বোনের চেয়ে বেশি, এমন কি প্রিন্স-মহিষীর প্রত্যাশাকেও তা ছাড়িয়ে গেছে। মস্কোর বলনাচগুলোতে যেসব তরুণ যোগ দিত, তাদের প্রায় সবাই যে কিটির প্রেমে পড়েছিল শুধু তাই নয়, সেই প্রথম শীতেই দেখা দিল। গুরুত্বের সাথে বিবেচনার যোগ্য দুজন পাত্র ও লেভিন, এবং তিনি চলে যাওয়ার পরেই আবির্ভূত হন কাউন্ট ভ্রনস্কি।

শীতের গোড়ায় লেভিনের আগমন, তার ঘন ঘন যাতায়াত, কিটির প্রতি তার সুস্পষ্ট অনুরাগ প্রিন্স ও প্রিন্স মহিষীর মধ্যে কিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতর আলোচনা ও তাঁদের মধ্যে কলহের উপলক্ষ হয়ে উঠেছিল। প্রিন্স ছিলেন লেভিনের পক্ষে, বলতেন যে কিটির জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু তিনি কামনা করেন না। আর নারীদের প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার স্বভাবসিদ্ধ অভ্যাসে তার স্ত্রী বলতেন যে কিটির বয়স বড় কম, লেভিনের যে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংকল্প আছে, সেটা কোন কিছুতেই তিনি প্রকাশ করেননি, ওঁর জন্য কিটির টান নেই ইত্যাদি নানা যুক্তি দিতেন; কিন্তু প্রধান কথাটা তিনি বলেননি যে মেয়ের জন্য তিনি যোগ্যতর পাত্রের অপেক্ষায় আছেন, লেভিনকে তাঁর ভালো লাগে না, তাঁকে বোঝেন না তিনি। লেভিন যখন অকস্মাৎ চলে গেলেন, প্রিন্স-মহিষী খুশিই হলেন, সগৌরবে স্বামীকে বললেন, ‘দেখছ তো, আমার কথাই ঠিক।’ আর যখন উদয় হল ভ্রনস্কির, তখন তিনি আরো খুশি হলেন তার এই অভিমতে নিশ্চিত হয়ে যে কিটির হওয়া উচিত নেহাৎ ভালো রকম নয়, চমৎকার একটা বিয়ে।

মায়ের কাছে নস্কি আর লেভিনের মধ্যে কোন তুলনাই হতে পারে না। মায়ের ভালো লাগতো না যেমন লেভিনের উদ্ভট, উকট সব মতামত, সমাজে তার আনাড়িপনা (যেটা তার গর্বপ্রসূত বলে তিনি ধরে নিয়েছিলেন), তেমনি, মহিলাটির ধারণায়, গরু-বাছুর চাষী-বাসী নিয়ে গাঁয়ের কি-একটা বুনো জীবন;এটাও তার পছন্দ হয়নি যে লেভিন তার মেয়ের প্রেমে পড়ে এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করেছেন দেড় মাস, যেন কিসের আশা করছিলেন, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন, যেন ভয় পাচ্ছিলেন, পাণিপীড়িনের প্রস্তাব দিলে কি ওঁদের বড় বেশি সম্মান দেখানো হবে, আর । ভেবেই দেখেননি, যে-বাড়িতে বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে, সেখানে যাতায়াত করলে নিজেকে ব্যক্ত করে বলা দরকার। আর হঠাৎ কিছুই না বলে কয়ে তিনি চলে গেলেন। এতই ও অনাকর্ষণীয় যে কিটি তার প্রেমে পড়েনি, এটা ভালোই হয়েছে, ভেবেছিলেন মা।

সব দিক দিয়েই ভ্রনস্কি তৃপ্ত করেছিলেন মায়ের আকাঙ্ক্ষা। অতি ধনী, বুদ্ধিমান, অভিজাত, দরবারে যে চমৎকার একটা সামরিক কেরিয়ার গড়ে তুলতে চলেছেন, মনোহর একটা লোক। এর চেয়ে ভালো কিছুর আশা করা যায় না।

বলনাচগুলোয় ভ্রনস্কি স্পষ্টতই কিটির দিকে সবিশেষ মনোযোগ দিতেন নাচতেন তার সাথে, তাঁদের বাড়ি যেতেন, ফলে তার সংকল্পের শুরুত্বে সন্দেহের অবকাশ ছিল না। তাহলেও এই সারাটা শীত ছিলেন একটা অদ্ভুত অস্থিরতা আর উত্তেজনার মধ্যে।

ফুফুর ঘটকালিতে প্রিন্স-মহিষীর নিজের বিয়ে হয়েছিল ত্রিশ বছর আগে। পাত্র সম্পর্কে আগে থেকেই জানা ছিল সব কিছু, এল সে কনে দেখতে, তাকেও দেখা হল; কার কেমন লেগেছে সেটা জেনে ঘটকী ফুফু জানালেন পরস্পরকে; ভালোই লেগেছিল দু’পক্ষের; তারপর নির্ধারিত দিনে পিতামাতার কাছে এল পাণিপীড়নের প্রত্যাশিত প্রস্তাব এবং তা গৃহীত হল। সবই চলেছিল অতি সহজে আর নির্বিঘ্নে। অন্তত প্রিন্স মহিষীর তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু নিজের মেয়েদের বেলায় তাকে টের পেতে হয়েছিল যে এই বিয়ে দেওয়াটা মোটেই তেমন সহজ, সরল, আপাত-সাধারণ ব্যাপার নয়। তার বুড়ো দু’মেয়ে ডল্লি আর নাটালির বিয়েতে কতরকম ভয়ই-না তার করেছে, কত ভাবনা ফিরে ভাবতে হয়েছে, খরচ করেছেন কত টাকা, কত খিটিমিটি বেধেছে স্বামীর সাথে। এখন ছোট মেয়ের বেলায় তাঁকে সইতে হচ্ছে সেই একইরকম ভয়, একইরকম সন্দেহ, আর আগের চেয়ে স্বামীর সাথে আরো বেশি কলহ। বৃদ্ধ প্রিন্স সমস্ত পিতার মতই ছিলেন নিজের মেয়েদের সম্মান ও নিষ্পপতা নিয়ে অতিশয় খুঁতখুঁতে আর কড়া। তার মেয়েদের, বিশেষ করে তার আদরিণী কিটি সম্পর্কে তিনি ছিলেন অবিবেচকের মত স্নেহে ঈর্ষায় পীড়িত, মা মেয়ের নাম ডোবাচ্ছে বলে প্রতি পদে তিনি একটা তুলকালাম কাণ্ড বাধাতেন। প্রথম মেয়েদের সময় থেকেই স্ত্রী এতে অভ্যস্ত, কিন্তু এবার তিনি অনুভব করছিলেন যে প্রিন্সের খুঁতখুতানির ভিত্তি এখন আছে বেশি। তিনি দেখছিলেন যে সাময়িক কালে সমাজের রীতিনীতি অনেক বদলে গেছে, এতে মায়ের দায়িত্ব হয়ে উঠেছে অনেক কঠিন, তিনি দেখছেন যে কিটির সমবয়সীরা নানান সব সমিতি গড়ে তুলছে, কিসব কোর্সে যোগ দিচ্ছে, অবাধে আলাপ করছে পুরুষের সাথে, একা একা রাস্তায় বেরোচ্ছে গাড়ি করে, অনেকে উপবেশনের ভঙ্গিতে অভিবাদনও করছে না আর সবচেয়ে বড় কথা, সকলেরই দৃঢ় বিশ্বাস, স্বামী নির্বাচন তাদেরই ব্যাপার, পিতামাতার নয়। এসব তরুণী, এমন কি বৃদ্ধেরাও ভাবতো এবং বলত, এখন আর লোকে আগের মত মেয়ের বিয়ে দেয় না। কিন্তু কি করে এখন মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়, সেটা প্রিন্স-মহিষী জানতে পারেননি কারো কাছ থেকে। সন্তানের ভাগ্য স্থির করে দেবে মা-বাপে–এই ফরাসি রেওয়াজ এখন অগ্রহণীয়, ধিকৃত। মেয়েদের অবাধ স্বামীনতার ইংরেজ কেতাও অগ্রাহ্য এবং রুশ সমাজে অসম্ভাব্য। ঘটকালির রুশী রীতি বিকট, এবং সবাই, এমন কি প্রিন্স-মহিষীও হাসাহাসি করেছেন তা নিয়ে। কিন্তু মেয়ে কিভাবে বিয়ে করবে, তার বিয়ে দেওয়া হবে কেমন করে, সেটা কেউ জানে না। এ ব্যাপারে প্রিন্স-মহিষী যাদের সাথে কথা বলেছেন, তারা শুধু বলেছেন একটা কথাই? ও সব ছাড় ন, একালে ও সব সেকেলে প্রথা ঝেড়ে ফেলাই উচিত। বিয়ে তো করতে যাচ্ছে মা-বাপে নয়, তরুণ-তরুণীরা, তাই যা বোঝে সেইভাবে। ঠিকঠাক করে নিক। যার মেয়ে নেই, তার পক্ষে এ কথা বলা সহজ, অথচ প্রিন্স-মহিষী বুঝতেন যে মেলামেশায় মেয়ে এমন লোকের প্রেমে পড়তে পারে যে তাকে বিয়ে করতে অনিচ্ছুক অথবা এমন লোক, যে স্বামী হবার অযোগ্য। এবং তাকে যতই বোঝানো হোক যে আমাদের কালে নবীনদের উচিত নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য স্থির করে নেওয়া, তিনি সেটা বিশ্বাস করতে পারেননি, যেমন তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না যে কোন কালেই পাঁচ বছর বয়সী শিশুর সেরা খেলনা হওয়া উচিত গুলিভ পিস্তল। তাই বড় মেয়েদের চেয়ে কিটির জন্য তার দুশ্চিন্তা ছিল বেশি।

এখন তার ভয় হচ্ছিল যে ভ্রনস্কি আবার যেন তার মেয়ের প্রতি ওই সবিশেষ মনোযোগেই সীমিত না থাকেন। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে মেয়ে তার প্রেমে পড়েছে, কিন্তু এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন যে লোকটা সৎ ও কাজ তিনি করবেন না। কিন্তু সেইসাথে তার জানা ছিল যে বর্তমানের অবাধ মেলামেশায় একটা মেয়ের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া কত সহজ এবং সাধারণভাবে পুরুষেরা এই অন্যায়টাকে কত লঘু চোখে দেখে। গত সপ্তাহে কিটি মাকে বলেছিল মাজুরকা নাচের সময় ভুক্তির সাথে কি কথাবার্তা হয়েছিল তার। কথাবার্তাটি খানিকটা আশ্বস্ত করে প্রিন্স মহিষীকে; কিন্তু সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে তিনি পারেননি। কিটিকে ভ্রনস্কি বলেছিলেন যে তাঁরা, দু’ভাই-ই সব কিছু ব্যাপারেই মায়ের কথামত চলতে এত অভ্যস্ত যে তার পরামর্শ না নিয়ে গুরুতুপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত কখনো গৃহীত হয় না। এখন আমি পিটার্সবুর্গ থেকে মায়ের আগমনের অপেক্ষা করছি একটা বিশেষ সৌভাগ্য হিসেবে’, বলেছিলেন : ভ্রনস্কি।

কিটি তার মাকে এটা বলেছিল কথাগুলোয় কোন গুরুত্ব না দিয়ে। কিন্তু মা জিনিসটাকে নিয়েছিলেন অন্যভাবে। তিনি জানতেন যে বৃদ্ধা যে কোন দিন এসে পড়বেন বলে অপেক্ষা করা হচ্ছে, ছেলের নির্বাচনে বৃদ্ধা খুশি হবেন, তাই মাকে আঘাত দেবার ভয়েই নাকি ছেলে এখনো পাণিপ্রার্থনা করছে না এটা তার কাছে অদ্ভুত ঠেকেছিল; তাহলেও বিয়েটা তিনি এত চাইছিলেন, এবং তার চেয়েও বেশি করে চাইছিলেন দুর্ভাবনা থেকে শান্তি যে তাই-ই তিনি বিশ্বাস করতেন। বড় মেয়ে ডল্লি যে স্বামীকে ছেড়ে যাবে বলে ঠিক করেছে তা চোখে দেখা তাঁর কাছে এখন যতই কষ্টকর হোক, ছোট মেয়ের যে ভাগ্য নির্ধারিত হতে চলেছে তার জন্য অস্থিরতাই তাঁর অন্য সমস্ত অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আজ লেবিনের আবির্ভাবে আরো নতুন দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছি তার। তার ধারণা, লেভিনের প্রতি এক সময় টান ছিল মেয়ের, অতিরিক্ত সততাবশে সে আবার স্কিকে প্রত্যাখ্যান না করে বসে, এবং সাধারণভাবেই লেভিনের আগমনে সমাপ্তির মুখে এসে পড়া ব্যাপারটা আবার গোলমালে না পড়ে, বিলম্বিত না হয়, এই ভয় করছিলেন তিনি।

বাড়ি ফিরে প্রিন্স-মহিষী লেভিন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও কি অনেকদিন হল এসেছে?

‘আজ, মামা।

‘একটা কথা আমি বলতে চাই…’ মা শুরু করলেন এবং তাঁর গুরুগম্ভীর উত্তেজিত মুখ দেখে কিটি টের পেল কথাটা হবে কি নিয়ে।

লাল হয়ে উঠে ঝট করে দায়ের দিকে ফিরে সে বললে, মা, মিনতি করছি, বলল না। আমি জানি, সব জানি।

মা যা চাইছিলেন, সেও চাইছিল তাই, কিন্তু মায়ের চাওয়ার পেছনকার উদ্দেশ্যগুলো আঘাত দিচ্ছিল তাকে।

‘আমি শুধু বলতে চাই যে একজনকে আশা দিয়ে …’

মা, লক্ষ্মী মা আমার, সৃষ্টিকর্তার দোহাই, বলল না। ও নিয়ে কথা বলতে ভারি ভয় লাগে।

‘আচ্ছা, বলব না, বলব না, মেয়ের চোখে পানি দেখে মা বলল, কিন্তু একটা কথা, সোনা আমার, আমাকে কথা দাও যে আমার কাছ থেকে তুমি লুকিয়ে রাখবে না কিছু। রাখবে না তো?

কখনো না, কোন কিছুই না, আবার লাল হয়ে উঠে মায়ের চোখে চোখে তাকিয়ে বলল কিটি, কিন্তু এখন আমার বলার কিছু নেই। আমি… আমি… যদি আমি বলতে চাইতাম, তাহলেও জানি না কি বলব, কেমন করে বলব… আমি জানি না…’।

‘এইরকম চোখ নিয়ে তুমি মিথ্যে বলতে পারো না’, মেয়ের ব্যাকুলতায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে মা ভাবলেন হাসিমুখে। হাসিমুখে, কেননা মেয়ের প্রাণের ভেতর যা চলেছে সেটা বেচারির কাছে কি বিপুল আর অর্থময়ই না মনে হচ্ছে।

তেরো

 আহারের পর থেকে সান্ধ্য পার্টি শুরু হওয়া পর্যন্ত কিটির অনুভূতিটা এমন হয়েছিল যে, লড়াইয়ে নামার আগে একটা তরুণের অনুভূতি যে রকম হয়। বুক তার ভয়ানক ঢিপঢিপ করছিল, কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না।

সে অনুভব করছিল, ওঁদের দুজনের মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ হচ্ছে এই যে সন্ধ্যায়, সেটা তার ভাগ্যনির্ধারক হওয়ার কথা। অনবরত তার কল্পনায় ভেসে উঠছিলেন ওঁরা দুজন, কখনো আলাদা আলাদা, কখনো দুজন একসাথে। অতীতে লেভিনের সাথে তার সম্পর্কের কথা সে স্মরণ করছিল পুলকে আর দরদে। শৈশবের স্মৃতি, তার প্রয়াত ভাইয়ের সাথে লেভিনের বন্ধুত্বের স্মৃতিতে তার সাথে কিটির সম্পর্কে লাগছিল একটা কাব্যিক মাধুর্যের ছোঁয়া। কিটির প্রতি তাঁর ভালোবাসা যাতে কিটি কাব্যিকে মাধুর্যের ছোঁয়া। কিটির প্রতি তার ভালোবাসা যাতে কিটি সুনিশ্চিত, সেটা ছিল তার কাছে অহংতৃপ্তি আর আনন্দের ব্যাপার। লেভিনের কথা ভাবাটা তার কাছে সহজ। কিন্তু ভ্রনস্কির কথা ভাবতে গেলে কি একটা সংকোচ গোল বাধাতো, যদিও তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় মার্জিত আর শান্ত; কেমন একটা মিথ্যাচার এসে পড়ত–ভ্রনস্কির দিক থেকে নয়, তিনি ছিলেন খুবই সহজ আর মিষ্টি স্বয়ং কিটির দিক থেকেই, যে ক্ষেত্রে লেভিনের কাছে সে নিজেকে অনুভব করত একেবারে সহজ আর পরিষ্কার। কিন্তু আবার যেই ভাবত ভ্রনস্কির সাথে তার ভবিষ্যতের কথা, অমনি তার সামনে ভেসে উঠত একটা জ্বলজ্বলে সুখময় পরিপ্রেক্ষিত; লেভিনের বেলায় ভবিষ্যৎটা দেখাতো ঝাপসা।

সন্ধ্যার জন্য সাজগোজ করতে ওপরে উঠে কিটি আয়নার তাকিয়ে সানন্দে লক্ষ্য করল যে আজকের দিনটা তার একটা ভালো দিন, নিজের সমস্ত শক্তি আছে তার পরিপূর্ণ দখলে আর সেটা দরকার আসন্নের জন্য; নিজের মধ্যে সে অনুভব করছিল বাইরের একটা প্রশান্তি এবং গতিভঙ্গিমায় অসংকোচ সৌষ্ঠব।

সাড়ে সাতটায় ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই চাপরাশি খবর দিল : কনস্তান্তিন দৃমিত্রি লেভিন। প্রিন্স-মহিষী তখনো তাঁর ঘরে আর প্রিন্স বেরিয়ে এলেন না। কিটি ভাবল, ‘ঠিক যা ভেবেছিলাম, সমস্ত রক্ত ধেয়ে এল তার হৃৎপিণ্ডে। আয়নার নিজের পাণ্ডুরতা দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠল সে।

এখন সে নিশ্চিত জানে যে আগে আগে তিনি এসেছেন শুধু কিটিকে একা পেয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন বলে। এখন এই প্রথম গোটা ব্যাপারটা তার কাছে প্রতিভাত হল একেবারে অন্য, নতুন একটা দিক থেকে। কেবল এখনই। সে বুঝল যে প্রশ্নটা কেবল একা তাকে নিয়ে নয়–করে সাথে সে সুখী হবে, কাকে সে ভালোবাসছে, এই নয়–এই মুহূর্তে তাকে আঘাত দিতে হবে এমন একজনের মনে যাকে সে ভালোবাসে। এবং আঘাত দিতে হবে নিষ্ঠুরভাবে…কিসের জন্য? এজন্য যে সে ভারি ভালো লোক, ভালোবাসে তাকে, তার প্রণয়াসক্ত। কিন্তু করবার কিছু নেই। এটাই দরকার, এটাই উচিত।

‘সৃষ্টিকর্তা, এটা কি আমাকে নিজেকেই বলতে হবে ওকে?’ কিটি ভাবলে, কিন্তু কি বলব? সত্যিই কি ওকে বলব যে আমি ওকে ভালোবাসি না? কিন্তু সে তো মিথ্যে বলা হবে। কি বলি তাকে? বলব কি ভালোবাসি অন্যকে? না, সে অসম্ভব। আমি চলে যাব এখান থেকে, চলে যাব।

দরজার কাছে ও চলেই গেছে, এমন সময় লেভিনের পদশব্দ কানে এল। না, এটা অসাধুতা। আমার ভয় পাবার কি আছে? আমি খারাপ তো কিছু করিনি। যা হবার, হবে! সত্যি কথাই বলব। ওর কাছে আমার অস্বস্তি লাগতে পারে না। ওই এসে গেছে, তার বলিষ্ঠ আর ভীরু মূর্তি, তার দিকে নিবদ্ধ তার জ্বলজ্বলে চোখ দেখে মনে মনে বলল সে। সোজাসুজি তার মুখের দিকে তাকাল যেন ক্ষমা প্রার্থনা করছে, হাত এগিয়ে দিল।

ফাঁকা ড্রয়িংরুমে চোখ বুলিয়ে লেভিন বললেন, আমি ঠিক সময়ে নয়, মনে হচ্ছে বড় বেশি আগে এসে পড়েছি। যখন দেখলেন যে তার আশা সফল হয়েছে, মন খুলতে কেউ তাকে বাধা দেবে না, মুখখানা তার হয়ে উঠল বিষণ্ণ-গভীর।

‘আরে না, এই বলে কিটি বসল একটা টেবিলের কাছে।

না বসে, আর মনোবল যাতে না হারায় সে জন্য কিটির দিকে না তাকিয়ে তিনি শুরু করলেন, আমি আপনাকে একলা পেতেই চেয়েছিলাম।’

মা এখনই বেরোবেন। গতকালের পর খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। গতকাল…’

সে কথা বলছিল যদিও নিজেই জানত না কি বলছে তার ঠোঁট, লেভিনের ওপর থেকে মিনতিভরা কোমল দৃষ্টি সে সরিয়ে নিচ্ছিল না।

লেভিন তাকালেন ওর দিকে; কিটি লাল হয়ে উঠে চুপ করে গেল।

‘আমি আপনাকে বলেছি যে অনেকদিনের জন্য এসেছি কিনা জানি না… সব নির্ভর করছে আপনার ওপর…’

কিটি ক্রমশ মাথা নুইয়ে আনল। ভেবে পাচ্ছিল না আসন্নের কি জবাব দেবে।

লেভিন পুনরুক্তি করলেন, ‘সব আপনার ওপর নির্ভর করছে। আমি বলতে চাইছিলাম… আমি বলতে চাইছিলাম… আমি এই জন্যই এসেছি… যে… বলব, আমাকে বিয়ে করুন!’ কি বলছেন তা খেয়াল না করেই তিনি বলে যাচ্ছিলেন; কিন্তু সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক জিনিসটা বলা হয়ে গেছে টের পেয়ে থেমে গেলেন এবং তাকালেন কিটির দিকে।

লেভিনের দিকে না তাকিয়ে সে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। পরমানন্দের অনুভূতি হচ্ছিল তার। সুখাবেশে ভরে উঠেছিল হৃদয়। একেবারেই সে আশা করেনি যে লেভিনের প্রেম-স্বীকৃতি তার ওপর এমন প্রবল রেখাপাত করবে। কিন্তু এ অনুভূতিটা টিকল শুধু এক মুহূর্ত। ভ্রনস্কির কথা মনে পড়ল তার। লেভিনের দিকে তার উজ্জ্বল সত্যনিষ্ঠ চোখ মেলে এবং তার মরিয়া মুখখানা দেখে তাড়াতাড়ি করে সে জবাব দিলে :

‘সে হতে পারে না… মাপ করবেন আমাকে…’

এক মুহূর্ত আগেও কিটি ছিল লেভিনের কত আপন, তাঁর জীবনের পক্ষে কত জরুরি! আর এখন সে হয়ে গেল তার কত পর। তার কাছ থেকে কত সুদূর!

তিনি কিটির দিকে না তাকিয়ে বললেন, ‘এছাড়া আর কিছু হতে পারত না।

তিনি মাথা নুইয়ে চলে যাবার উপক্রম করলেন।

চৌদ্দ

প্রিন্স-মহিষী এ সময় ঘরে ঢুকলেন। ওদের একা দেখে এবং মুখভাবে হতাশা লক্ষ্য করে তার আতঙ্ক হয়েছিল। লেভিন তাকে অভিবাদন করলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। কিটি চোখ না তুলে চুপ করে রইল। মা ভাবলেন, হায় সৃষ্টিকর্তা! রাজি হয়নি তাহলে, এবং প্রতি বৃহস্পতিবার সচরাচর যে হাসি দিয়ে তিনি অভ্যাগতদের বরণ করেন, তাতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তাঁর মুখ। আসন নিয়ে তিনি লেভিনের গ্রামের জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। আবার বসলেন লেভিন, অতিথিদের আগমনের অপেক্ষা করতে লাগলেন যাতে অলক্ষ্যে চলে যেতে পারেন।

পাঁচ মিনিট বাদে ঢুকলেন কিটির বান্ধবী, গত শীতে বিবাহিতা, কাউন্টেস নর্ডস্টন।

রোগা, হলদেটে, রুগ্‌ণ, স্নায়বিক চেহারার এক মহিলা ইনি, কালো চোখ দুটো জ্বলজ্বলে। কিটিকে ভালবাসতেন তিনি, আর অনূঢ়াদের প্রতি বিবাহিতাদের ভালোবাসার ক্ষেত্রে সব সময় যা ঘটে থাকে, তার এ ভালোবাসা প্রকাশ পেত সুখ সম্পর্কে তাঁর আদর্শ অনুসারে কিটির বিয়ে দেবার বাসনায়, তাই চাইতেন যে ভ্রনস্কিকে সে বিয়ে করুক। শীতের গোড়ায় লেভিনকে তিনি প্রায়ই এদের এখানে দেখেছেন এবং কখনোই তাঁকে পছন্দ হয়নি। লেভিনের সাথে দেখা হলে তার বরাবরের প্রিয় কাজ হত তাঁকে নিয়ে তামাসা করা।

‘উনি যখন তার মহিমার শিখর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে দেখেন : হয় আমার সাথে মননশীল কথাবার্তা বন্ধ করেন কারণ আমি বোকা, নয় কৃপা করে আমার পর্যায়ে নেমে আসেন,–তখন সেটা আমার খুব ভালো লাগে। আমি ভারি ভালোবাসি : এই নেমে আসা! আমাকে যে উনি দেখতে পারেন না, তাতে আমি খুব খুশি, উনি বলতেন।

উনি ঠিকই বলতেন, কেননা সত্যিই লেভিন ওঁকে দেখতে পারতেন না এবং যা নিয়ে তার গর্ব ছিল এবং যা তিনি নিজের গুণ বলে মনে করতেন–তাঁর স্নায়বিকতা, স্থল ও ঐহিক সব কিছুর প্রতি তাঁর সূক্ষ্ম অবজ্ঞা ও উদাসীনতা– তার জন্য লেভিন ঘৃণা করতেন তাঁকে।

নর্ডস্টন আর লেভিনের মধ্যে এমন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যা উঁচু সমাজে প্রায়ই দেখা যায়, যথা, দুজন ব্যক্তি বাহ্যত বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে পরস্পরকে ঘৃণা করছে এমন মাত্রায় যে পরস্পরকে গুরুত্ব দিয়ে নিতে, এমন কি কেউ কারো দ্বারা আহত হতেও অক্ষম।

কাউন্টেস নর্ডস্টন তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লেন লেভিনের ওপর।

‘আরে, কনস্তান্তিন দৃমিত্রিচ যে! আবার এলেন আমাদের ব্যভিচারী ব্যাবিলনে’, ওঁর দিকে তাঁর ছোট্ট হলদেটে হাত বাড়িয়ে তিনি বললেন, তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল যে শীতের গোড়ায় লেভিন একবার বলেছিলেন যে মস্কো হল ব্যাবিলন। তা ব্যাবিলনেরই চরিত্র শোধরাল নাকি আপনার চরিত্রই নষ্ট হল?’ মুচকি হেসে কিটির দিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি যোগ দিলেন।

‘আমার কথা আপনি এত মনে রাখেন দেখে কৃতার্থ বোধ করছি কাউন্টেস’, ইতিমধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে তখনই অভ্যাসবশত কাউন্টেস নর্ডস্টনের সাথে রসিকতা-শত্রুতার সম্পর্ক পাতলেন, ‘নিশ্চয় কথাগুলো আপনার মনে খুব ছাপ ফেলেছিল।’

বাঃ, তা নয়ত কি? আমি সব টুকে রাখি। কি কিটি, আবার স্কেটিং করেছিস বুঝি?…’ ।

কিটির সাথে কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। এখন চলে যাওয়া যতই অস্বস্তিকর হোক, সারা সন্ধে এখানে বসে থেকে কিটিকে দেখার চেয়ে সে অস্বস্তিকরতা মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে সহজ। কিটি মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল তাঁর দিকে এবং তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছিল। উনি উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু উনি চুপ করে আছেন দেখে প্রিন্স-মহিষী তাকে জিজ্ঞেস করলেন?

মস্কোয় আপনি এসেছেন অনেক দিনের জন্য? আপনি তো মনে হয় জেমস্তৃতোর কর্মকর্তা, বেশি দিন থাকা তো আপনার চলে না।

লেভিনের কঠোর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কাউন্টেস নর্ডস্টন ভাবলেন, কিছু একটা হয়েছে ওঁর, কেন জানি তর্কে নামছেন না। কিন্তু আমি ওঁকে টেনেবোর করব। ভারি মজা লাগে কিটির সামনে ওঁকে অপদস্থ করতে এবং তা করব।’

কাউন্টেস বললেন, ‘কনস্তান্তিন দৃমিত্রিচ, আমাকে একটু বুঝিয়ে দিন তো-আপনি তো এ ব্যাপারগুলো সবই জানেন–আমাদের কালুগা গ্রামে সব চাষী আর সব মাগীগুলো তাদের যা কিছু ছিল মদ খেয়ে উড়িয়েছে, এখন আমাদের আর খাজনা-পত্র কিছু দিচ্ছে না। কি এর মানে? আপনি তো সব সময়ই চাষীদের খুব প্রশংসা করেন।

এই সময় ঘরে এলেন আরেকজন মহিলা, লেভিন উঠে দাঁড়ালেন।

মাপ করবেন কাউন্টেস, আমি সত্যিই এ সব ব্যাপার কিছু জানি না, আপনাকে কিছু বলতেও পারব না, এই বলে তিনি তাকালেন মহিলার পিছু পিছু আসা জনৈক সামরিক অফিসারের দিকে।

ইনিই নিশ্চয় ভ্রনস্কি’, ভাবলেন লেভিন এবং সেটা যাচাই করার জন্য তাকালেন কিটির দিকে। ইতিমধ্যে কিটি ভ্রনস্কিকে দেখে চকিত দৃষ্টিপাত করল লেভিনের দিকে। অজান্তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা চোখের সেই একটা দৃষ্টিপাত থেকেই লেভিন বুঝলেন যে কিটি এই লোকটিকে ভালোবাসে, নিজে মুখে কিটি সে কথা বলল যা দাঁড়াতো, বুঝলেন তেমনি সুনিশ্চিত হয়ে। কিন্তু কি ধরনের লোক ইনি?

এখন–ভালো হোক, মন্দ হোক–লেভিন থেকে না গিয়ে পারেন না; তাঁকে জানতে হবে, কিটি যাকে ভালোবেসেছে, কেমনধারা লোক সে।

কিছু কিছু লোক আছে যারা কোন-না-কোন দিক থেকে সৌভাগ্যবান প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা পেলে তার ভেতর ভালো যা কিছু সব বরবাদ করে শুধু খারাপটাই দেখতে উগ্রীব; উল্টো দিকে আবার কিছু লোক আছে যারা এই সৌভাগ্যবান প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে দেখতে চায় কি কি গুণের জন্য সে তাদের পরাভূত করল, এবং বুক টনটন করলেও তার মধ্যে খোঁজে শুধু ভালোটাই। লেভিন ছিলেন এই ধরনের লোক। কিন্তু প্রনস্কির মধ্যে ভালো আর আকর্ষণয়ের খোঁজ পেতে তার বেগ পেতে হল না। সাথে সাথেই তা চোখে পড়ল। ভ্রনস্কি ছিলেন মধ্যম দৈর্ঘ্যের সুগঠিত দেহের মানুষ, কালো চুল, সহৃদয়, কান্তিমান মুখে অসাধারণ প্রশান্তি আর দৃঢ়তা। তার মুখে এবং মূর্তিতে, ছোট করে ছাঁটা কালো চুল আর সদ্য কামানো থুতনি থেকে শুরু করে চওড়া আনকোরা উর্দি পর্যন্ত সব কিছুই সাধারণ, অথচ সুচারু। মহিলাকে পথ ছেড়ে দিয়ে তিনি প্রথম প্রিন্স-মহিষী, পরে কিটির কাছে গেলেন।

কিটির দিকে যখন তিনি যাচ্ছিলেন তাঁর সুন্দর চোখজোড়া বিশেষ একটা কমনীয়তায় ঝলমল করে উঠল; প্রায় অলক্ষ্য একটা সুখ আর নম্র বিজয়ের হাসি নিয়ে (লেভিনের তাই মনে হল), তিনি সাবধানে সম্মান দেখিয়ে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করলেন এবং বাড়িয়ে দিলেন তার ছোট তবে চওড়া হাত।

সবাইকে সম্ভাষণ জানিয়ে কয়েকটা করে কথা বলে উনি বসলেন লেভিনের দিকে না তাকিয়ে, ওঁর ওপর থেকে লেভিনের দৃষ্টি সরছিল না।

‘আসুন আলাপ করিয়ে দিই’, লেভিনকে দেখিয়ে প্রিন্স-মহিষী বললেন, কনস্তান্তিন দৃমিত্রি লেভিন, কাউন্ট আলেকসেই কিরিলোভিচ ভ্রনস্কি।

ভ্রনস্কি উঠে দাঁড়ালেন এবং বন্ধুর মত লেভিনের চোখের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

তাঁর সহজ খোলামেলা হাসি হেসে বললেন, এই শীতে মনে হয় আমার সাথে আপনার আহারের কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে আপনি চলে গেলেন।

কনস্তান্তিন দমিত্ৰিচ শহর, আর আমাদের শহুরেদের দেখতে পারেন না, ঘৃণা করেন, বললেন কাউন্টেস নর্ডস্টন।

‘আমার কথাগুলো যখন আপনি এত মনে রাখেন তখন আপনার ওপর তা নিশ্চয় খুব চাপ ফেলে’, লেভিন বললেন এবং এই কথাগুলো যে আগেই বলেছেন সেটা মনে পড়ে যাওয়ায় লাল হয়ে উঠলেন।

ভ্রনস্কি লেভিন আর কাউন্টেস নর্ডস্টনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনি সব সময়ই গ্রামে থাকেন? আমার মনে হয় শীতকালে একঘেয়ে লাগে, তাই না?

‘কোন কাজ থাকলে একঘেয়ে নয়, তা ছাড়া নিজেকে তো আর একঘেয়ে লাগে না’, তীক্ষ্ণ জবাব দিলেন লেভিন।

‘গ্রাম আমি ভালোবাসি’, লেভিনের গলার সুর লক্ষ্য করে এবং লক্ষ্য করেননি এই ভাব করে কি বললেন।

কাউন্টেস নর্ডস্টন বললেন, কিন্তু আশা করি কাউন্ট সব সময় গ্রামে থাকতে রাজি হবেন না।

জানি না, গ্রামে আমি থাকিনি বেশিদিন’, ভ্রনস্কি বলে চললেন, তবে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল আমার। মায়ের সাথে নীস্-এ শীত কাটাবার সময় গায়ের জন্য, বাকলের জুতা আর চাষীগুলো নিয়ে রুশী গায়ের জন্য আমার যে মন কেমন করেছিল তেমন আর কোথাও হয়নি। জানেনই তো, নীস্ এমনিতেই একটা একঘেয়ে জায়গা। নেপলস, সরেন্তোও তাই, ভালো লাগে শুধু অল্প সময়ের জন্য। আর ঠিক সেখানেই বড় বেশি মনে পড়ে রাশিয়া, ঠিক তার গাঁয়ের কথাই… সেগুলো ঠিক যেন…’।

তিনি বলে যাচ্ছিলেন কিটি লেভিন, উভয়কেই লক্ষ্য করে ও একজনের ওপর থেকে আরেকজনের দিকে তাঁর শান্ত, অমায়িক দৃষ্টি ফিরিয়ে–বলে যাচ্ছিলেন স্পষ্টতই যা তার মাথায় আসছিল।

কাউন্টেস নর্ডস্টন কিছু একটা বলতে চাইছেন লক্ষ্য করে তিনি কথাটা শেষ না করেই থেমে গেলেন, মন দিয়ে শুনতে লাগলেন তাকে আলাপ মুহূর্তের জন্যও থামছিল না, ফলে প্রসঙ্গের ঘাটতি পড়লে বৃদ্ধা প্রিন্স-মহিষীর সব সময়ই মজুদ থাকত যে দুটো ভারি কামান ও ক্লাসিক আর আধুনিক শিক্ষা এবং বাধ্যতামূলক সৈনিকবৃত্তি, তা আর ব্যবহার করতে হল না, আর কাউন্টেস নর্ডস্টনেরও লাগা হল না লেভিনের পেছনে।

সাধারণ আলাপে যোগ দেবার ইচ্ছে হচ্ছিল লেভিনের, কিন্তু পারছিলেন না; প্রতি মুহূর্তে তিনি নিজেকে বলছিলেনঃ ‘এবার যেতে হয়, কিন্তু চলে গেলেন না, কি যেন আশা করছিলেন।

আলাপ চলল প্ল্যানচেত টেবিল আর প্রেতাত্মা নিয়ে। কাউন্টেস নর্ডস্টন প্রেতবাদে বিশ্বাসী, কি কি অলৌকিক কাণ্ড তিনি দেখেছেন সে কথা বলতে লাগলেন তিনি।

‘আহ্ কাউন্টেস, সৃষ্টিকর্তার দোহাই! অবশ্য-অবশ্যই ওদের সাথে আমার যোগাযোগ করিয়ে দিন। অসাধারণ কিছু আমি দেখিনি, যদিও তার খোঁজে থেকেছি সর্বত্র’, হেসে বললেন ভ্রনস্কি।

‘বেশ, আগামী শনিবার, জবাব দিলেন কাউন্টেস নর্ডস্টন, আর কনস্তান্তিন দৃমিত্রিচ, এসবে বিশ্বাস করেন? লেভিনকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘কেন জিজ্ঞেস করছেন? জানেনই তো আমি কি বলব।’

কিন্তু আমি আপনার মত জানতে চাইছি।’

লেভিন বললেন, আমার মত শুধু এই যে, এসব প্ল্যানচেত টেবিলে প্রমাণ হয় যে, শিক্ষিত সমাজ কৃষকদের চেয়ে উন্নত নয়। তারা চোখ দেওয়ায়, মারণ, উচাটন বশীকরণে বিশ্বাস করে, আর আমরা…’

‘সে কী! আপনি বিশ্বাস করেন না?’

বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।

কিন্তু আমি যদি স্বচক্ষে দেখে থাকি?’

কৃষক মেয়েরাও বলে যে, তারা বাস্তুভূতকে দেখেছে।

‘তার মানে আপনি ভাবছেন, আমি মিথ্যে বলছি?’ নিরানন্দ হাসি হেসে উঠলেন তিনি।

না-না, মাশা। কনস্তান্তিন দুমিত্রিচ বলছেন যে, উনি বিশ্বাস করতে পারেন না, লেভিনের পক্ষ নিয়ে লাল হয়ে বলল কিটি। সেটা লেভিন বুঝলেন এবং উত্যুক্তি তার আরো বেড়ে গেল। ভেবেছিলেন জবাব দেবেন, কিন্তু কথাবার্তা অপ্রীতিকর হয়ে উঠবে-এমন আশঙ্কা দেখা দিতেই তখনই তার খোলামেলা প্রসন্ন হাসি নিয়ে সাহায্যে এলেন ভ্রনস্কি। জিজ্ঞেস করলেন, ‘সম্ভব বলে আপনি একেবারে স্বীকার করেন না কেন, বলুন তো? বিদ্যুতের অস্তিত্ব আমরা মানি– যা কেউ দেখিনি; কেন আরো একটা নতুন শক্তি সম্ভব হবে না, যা আমাদের কাছে এখনো অজ্ঞাত, যা…’।

‘বিদ্যুৎ যখন আবিষ্কৃত হয়, ক্ষিপ্রগতিতে বাধা দিয়ে বললেন লেভিন, তখন দেখা গিয়েছিল শুধু ঘটনাটা, জানা ছিল না কোত্থেকে তা ঘটছে এবং কি তা করতে পারে তাকে কাজে লাগাবার আগে বহু যুগ কেটে যায়। প্রেতবাদীরা কিন্তু শুরু করেছেন প্ল্যানচেত টেবিলকে দিয়ে লিখিয়ে। প্রেতাত্মারা আসছে তাদের কাছে, তারপর বলতে লাগলেন যে অজ্ঞাত শক্তি আছে।

ভ্রনস্কি মন দিয়ে লেভিনের কথা শুনছিলেন, যা তিনি সব সময় শুনে থাকেন। স্পষ্টতই আকৃষ্ট বোধ করছিলেন। তাঁর কথায়।

‘তা ঠিক, কিন্তু প্রেতবাদীরা বলেন : এ শক্তিটা কি তা বর্তমানে আমরা জানি না। কিন্তু শক্তি আছেই, আর ঐ পরিস্থিতিতে তা সক্রিয় হচ্ছে। শক্তিটা কি তা বের করুন বিজ্ঞানীরা। কেন এটা নতুন কোন শক্তি হতে পারবে না, আমি তার কোন কারণ দেখছি না। যদি তা…’

কারণ, বাধা দিলেন লেভিন, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে যতবারই আপনি উল দিয়ে রজন ঘষবেন, ততবারই দেখা যাবে। নির্দিষ্ট একটা ঘটনা। আর এক্ষেত্রে ঘটছে প্রতিবার নয়, তার মানে প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়।’

সম্ভবত, কথাবার্তাটা ড্রয়িং-রুমের পক্ষে বড় বেশি ভারী হয়ে উঠছে অনুভব করে ভ্রনস্কি আর আপত্তি করলেন না। প্রসঙ্গ ফেরাবার চেষ্টায় ফুর্তিতে হেসে তিনি ফিরলেন মহিলাদের দিকে। বললেন, ‘আসুন কাউন্টেস, এখনই চেষ্টা করে দেখা যাক, কিন্তু লেভিনের ইচ্ছে, যা ভেবেছেন তা পুরো বলবেন।

তিনি বলে চললেন, আমি মনে করি যে কোন একটা নতুন শক্তি দিয়ে নিজেদের আজব কাণ্ডগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য প্রেতবাদীদের এই প্রচেষ্টা একেবারে অসার্থক। তারা সরাসরি আত্মিক শক্তির কথা বলছেন আর চাইছেন তার। একটা বস্তুগত পরীক্ষা চালাতে।’

সবাই অপেক্ষা করছিলেন কখন উনি শেষ করবেন, লেভিনও টের পাচ্ছিলেন সেটা।

‘আর আমি মনে করি, চমৎকার মিডিয়া হবেন আপনি’, বললেন কাউন্টেস নর্ডস্টন, ‘আপনার মধ্যে ভাবাবেগের মত কি-একটা যেন আছে।

মুখ খুলতে গিয়েছিলেন লেভিন, ভেবেছিলেন কিছু একটা বলবেন, কিন্তু লাল হয়ে গিয়ে কিছুই আর বললেন না।

ভ্রনস্কি বললেন, ‘আসুন, কাউন্টেস, এখনই টেবিলের পরীক্ষা হয়ে যাক। আপনার আপত্তি নেই তো প্রিন্সেন?

উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রনস্কি এদিক-ওদিক তাকিয়ে টেবিল খুঁজতে লাগলেন।

কিটি টেবিল ছেড়ে উঠে পাশ দিয়ে যাবার সময় চোখাচোখি হয়ে গেল লেভিনের সাথে। তার ভারি কষ্ট হচ্ছিল লেভিনের জন্য। কষ্টটা আরো হচ্ছিল এই কারণে যে ওঁর দুর্ভাগ্যের হেতু সে-ই। তার চাহনি বলছিল, ‘পারলে আমাকে ক্ষমা করুন, আমি ভারি সুখী।

আর লেভিনের দৃষ্টি জবাব দিলে, ঘৃণা করি সবাইকে। আপনাকেও, নিজেকেও। টুপি তুলে নিলেন তিনি, কিন্তু চলে যাবার নির্বন্ধ তার ছিল না। ছোট টেবিলটা ঘিরে সবাই জুটতে চাইছে আর লেভিন চাইছেন যেতে–এমন সময় ঘরে ঢুকলেন বৃদ্ধ প্রিন্স। মহিলাদের সাথে সম্ভাষণ বিনিময় করে ফিরলেন লেভিনের দিকে। সানন্দে তিনি শুরু করলেন, ‘আরে! অনেকদিন হল নাকি? আমি জানতাম না যে তুমি এখানে! ভারি খুশি হলাম আপনাকে দেখে।

বৃদ্ধ প্রিন্স লেভিনকে কখনো বলছিলেন তুমি’, আবার কখনো ‘আপনি। লেভিনকে আলিঙ্গন করে তার সাথেই কথা জুড়লেন, খেয়াল করলেন না ভ্রনস্কিকে। ভ্রনস্কি উঠে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে অপেক্ষা করছিলেন–কখন প্রিন্স ফিরবেন। তার দিকে।

কিটি টের পাচ্ছিল, যা ঘটে গেছে তার পর বাবার এই মনোযোগ লেভিনের পক্ষে কত দুঃসহ। সে এও দেখল যে, বাবা শেষ পর্যন্ত ভ্রনস্কির অভিবাদনের জবাবে কি নিরুত্তাপ প্রত্যভিবাদন দিলেন এবং কি অমায়িক বিহ্বলতায় ভ্রনস্কি তাকিয়ে ছিলেন তার বাবার দিকে, বুঝবার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু বুঝতে পারছিলেন না কেন, কিসের জন্য তার প্রতি বিরূপতা সম্ভব। লাল হয়ে উঠল কিটি।

কাউন্টেস নর্ডস্টন বললেন, প্রিন্স, কনস্তান্তিন দৃমিত্রিচকে আমাদের ছেড়ে দিন। আমরা একটা পরীক্ষা করতে চাই।’

‘কি পরীক্ষা? টেবিল চালনা? কিন্তু ভদ্র মহোদয় ও মহোদয়ারা, মাপ করবেন আমাকে, আমার ধারণা, কলেচুকো’ খেলায় মজা বেশি’, ভ্রনস্কির দিকে তাকিয়ে এবং তিনি-ই যে ব্যাপারটার হোতা তা আন্দাজ করে বৃদ্ধ প্রিন্স বললেন, কলেচুকো’র তবু একটা মানে হয়।’

ভ্রনস্কি অবাক হয়ে তার অচঞ্চল চোখে প্রিন্সের দিকে তাকালেন এবং সামান্য হেসে তখনই কাউন্টেস নর্ডস্টনের সাথে আলাপ শুরু করলেন–আগামী সপ্তাহে বড় রকমের একটা বলনাচের ব্যাপার নিয়ে।

কিটির দিকে তিনি ফিরলেন, আশা করি আপনি আসবেন। আসবেন তো?’

তাঁর কাছ থেকে বৃদ্ধ প্রিন্স সরে যেতেই লেভিন অলক্ষ্যে বেরিয়ে গেলেন, এ সন্ধ্যার শেষ যে ছাপটা তার মনে রইল, সেটা বলনাচ নিয়ে ভ্রনস্কির প্রশ্নের জবাবে কিটির হাসিমাখা সুখী-সুখী মুখখানি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *