আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৮.১০

দশ

তিনি কে এবং কেন তিনি বেঁচে আছেন—এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে গিয়ে লেভিন কোন উত্তর পেতেন না, হতাশ হয়ে উঠতেন। কিন্তু এ নিয়ে আত্মজিজ্ঞাসা যখন তিনি বন্ধ করতেন, তখন মনে হত যেন তাঁর জানা আছে তিনি কে এবং কেন তিনি বেঁচে আছেন। কেননা দৃঢ়ভাবে সুনির্দিষ্ট কাজ করে তিনি বেঁচে থাকছিলেন; ইদানীং তিনি খাটছেন এমন কি আগের চেয়েও সুনির্দিষ্ট ও দৃঢ়ভাবে।

জুন মাসের গোড়ার দিকে গ্রামে এসে তিনি ফেরেন তাঁর অভ্যস্ত ক্রিয়াকলাপে। কৃষিকর্ম, চাষী আর প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক, সংসার দেখাশোনা, বোন আর বড় ভাইয়ের বিষয়-আশয়, স্ত্রী, তাঁর আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক, ছেলেটার জন্য যত্ন, আর এ বসন্তে মৌমাছি শিকারের যে নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল, তাতেই কেটে যেত তাঁর সবটা সময়।

তিনি এসব কাজে ব্যাপৃত থাকতেন এজন্য নয় যে, আগের মত কোন-একটা সাধারণ নীতি দিয়ে তা সমর্থন করছিলেন নিজের কাছে; উল্টো বরং, এখন একদিকে সাধারণের উপকারার্থে তাঁর পূর্বেকার উদ্যোগগুলির নিষ্ফলতায় আশাভঙ্গ হয়ে এবং অন্যদিকে নিজের ভাবনা আর প্রচুর পরিমাণ যে কাজ চারদিক থেকে তাঁর ঘাড়ে এসে পড়ছিল তাতে ব্যস্ত থেকে সাধারণ উপকারের সব রকম ভাবনা তিনি একেবারে ছেড়ে দিলেন। এ কাজগুলোয় তিনি ব্যস্ত থাকতেন শুধু এজন্য যে, তিনি যা করছেন সেটা করা উচিত বলে তাঁর মনে হত—তিনি অন্য কিছু পারেন না। আগে (আর সেটা প্রায় শৈশব থেকে গোটা পূর্ণবয়স্কতা পর্যন্ত) যখন তিনি সকলের জন্য, মানবজাতির জন্য, রাশিয়ার জন্য। গোটা গ্রামের জন্য কিছু-একটা মঙ্গল করার চেষ্টা করেন, তখন দেখেছেন যে এ নিয়ে ভাবনাটা বেশ সুখপ্রদ। কিন্তু কাজটা সব সময়ই হত বেখাপ্পা, ওটা অবশ্যই প্রয়োজন এমন পূর্ণ নিশ্চয়তা পাওয়া যেত না, আর না, আর খাস যে কাজটা প্রথমে অত বৃহৎ বলে মনে হয়েছিল, তা কমতে কমতে মিলিয়ে যেত শূন্যে; বিবাহের পর এখন কিন্তু জীবনকে যখন তিনি ক্রমেই সংকুচিত করে আনছিলেন নিজের গণ্ডিতে, তখন নিজের কাজকর্মের ভাবনাটা তাঁকে সুখ না দিলেও এই নিশ্চয়তা অনুভব করতেন যে তাঁর কাজের প্রয়োজন আছে, দেখতে পাচ্ছিলেন যে আগের চেয়ে কাজগুলো চলছে অনেক স্ফূর্তিতে, ক্রমেই তা বৃহদাকার হয়ে উঠছে।

এবার উনি যেন ইচ্ছার বিরুদ্ধেই লাঙলের মত ক্রমেই মাটির গভীরে কেটে বসছেন, ফলে হলরেখা না টেনে তিনি আর মুক্তি পাবেন না।

পিতা-পিতামহেরা যেভাবে দিন কাটিয়েছেন, শিক্ষার সেই পরিবেশে, ছেলেমেয়েদের সেভাবে মানুষ করে যে পরিবারকে চলতে হবে তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। খিদে পেলে খাদ্য গ্রহণের মত তা প্রয়োজন, আর তার জন্য খাদ্য প্রস্তুত করা যেমন প্রয়োজন তেমনি সমান প্রয়োজন ছিল পক্রোভ্স্কয়ের বিষয়কর্মটা এমনভাবে চালানো যাতে আয় হয়। এতেও সন্দেহ ছিল না যে ঋণ পরিশোধ করে যেতে হবে, বংশসূত্রে প্রাপ্ত জমিকে এমন অবস্থায় রেখে যেতে হবে যে ছেলে তার উত্তরাধিকার পেয়ে তেমনিভাবে ধন্যবাদ জানাবে যেভাবে দাদুকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন লেভিন, তিনি যা কিছু গড়েছেন, রোপণ করেছেন, তার জন্য। এর জন্য দরকার জমি খাজনায় বিলি না করা, দরকার নিজেই তা চষা, গরু-বাছুর রাখা, জমিতে গোবর সার দেওয়া, বন বসানো।

কজ্‌নিশেভ ও বোনের সম্পত্তি না দেখা, যেসব চাষী উপদেশের জন্য তাঁর কাছে আসতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, তাদের কাজগুলো করে না দেওয়াও চলে না, যেমন চলে না কোলে ধরে রাখা শিশুকে ফেলে দেওয়া। সন্তানাদি সমেত আমন্ত্রিত শ্যালিকা এবং নিজের স্ত্রী-পুত্রের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যও যত্ন নেওয়া প্রয়োজন, খানিকটা সময় তাঁদের সাথে না কাটিয়েও চলত না।

এবং এসবের সাথে পাখি শিকার আর মৌমাছি মৃগয়ার নতুন নেশাটা মেলায় ভরে উঠেছিল লেভিনের গোটা জীবন, ভাবতে গেলে যার কোন অর্ত থাত না তাঁর কাছে।

কিন্তু কি করতে হবে সেটা দৃঢ়ভাবে জানা ছাড়াও তিনি ঠিক তেমনি জানতেন কিভাবে এসব করতে হবে, আর কোন কাজটা অন্যগুলোর চেয়ে জরুরি। তিনি জানতেন যে শ্রমিক নিয়োগ করতে হবে যথাসম্ভব সস্তায়; কিন্তু আগেই তাদের মজুরির চেয়ে সস্তা টাকা দাদন দিয়ে খবন্দী করা চলবে না, যদিও সেটা খুবই লাভজনক। গবাদির খাবার শেষ হয়ে এলে কৃষকদের কাছে খড় বেচা চলতে পারে, যদিও কষ্ট হয় তাদের জন্যই। কিন্তু সরাইখানা আর পানশালায় বেশ আয় হলেও তা তুলে দিতে হবে। গাছ কাটার জন্য শাস্তি দিতে হবে যথাসম্ভব কড়া করে, কিন্তু গরু চরাবার জন্য জরিমানা নেওয়া চলে না; আর পাহারাদারদের খেদ বৃদ্ধি আর কৃষকদের ভয় হ্রাস পেলেও চারণরত পশুদের আটকে রাখা চলে না।

পিওত্‌র মাসে মাসে শতকরা দশ হারে সুদ দিচ্ছে মহাজনকে। দেনাটা মিটিয়ে ফেলার জন্য তাকে ধার দেওয়া দরকার; কিন্তু কৃষকদের বকেয়া পড়া খালাসি খাজনা মাপ করা বা তা শুধবার মেয়াদ পিছিয়ে দেওয়া চলবে না। ঘেসো জমির সবটাই কাটা হয়েছে, এবং ঘাস বেচা হয়েছে লাভে। এটা দেখতে গোমস্তার অবহেলা করা চলবে না ঠিকই, কিন্তু যে আশি দেসিয়াতিনায় কচি বন লাগানো হয়েছে সেখানকার ঘাস কাটা বারণ। বাপ মারা গেছে বলে কাজের মৌসুমে যে শ্রমিক বাড়ি চলে যায়, তার জন্য কষ্ট হলেও সেটা মাপ করা চলে না। এক মাস কাজে অনুপস্থিতির দরুন টাকাটা কেটে রাখতে হবে তার পাওনা থেকে; ওদিকে বৃদ্ধ আর একেবারে অকর্মণ্যদের মাসোহারা না দেওয়াটা কিন্তু ঠিক নয়।

লেভিন এটাও জানতেন যে, বাড়ি ফিরে প্রথমে যেতে হবে স্ত্রীর কাছে যে খানিকটা অসুস্থ; তিন ঘণ্টা ধরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে যে কৃষকরা তারা আরো খানিক অপেক্ষা করতে পারে। জানতেন যে মৌচাক বসাবার সমস্ত আনন্দ সত্ত্বেও কাজটা তিনি বুড়োকে দিয়ে সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকবেন, আর যে চাষীরা মক্ষিকালয়ে তাঁর পাত্তা পেল কথা বলবেন তাদের সাথে।

ভালো করছেন কি খারাপ করছেন সেটা তিনি জানতেন না এবং এখন তা নিয়ে যুক্তিবিস্তার তো দূরের কথা, সে সম্পর্কে কোন কথাবার্তা বা ভাবনাও এড়িয়ে যেতেন।

বিচার করতে গেলে সন্দেহের উদ্রেক হত, কোটা উচিত কোটা অনুচিত তা স্থির করতে পারা হত মুশকিল। যখন তিনি কিছু না ভেবেচিন্তে শুধুই জীবনযাপন করতেন, প্রাণের মধ্যে তিনি এক অভ্রান্ত বিচারকের উপস্থিতি টের পেতেন যিনি ঠিক করে দিতেন আচরণের দুই বিকল্পের মধ্যে কোটা ভালো কোটা খারাপ, আর যেমন উচিত তেমন কিছু-একটা না করলে সেটা সাথে সাথেই টের পেতেন।

তিনি কে এবং কেন দুনিয়ায় দিন কাটাচ্ছেন তা না জেনে, জানার সম্ভাবনাটুকু না দেখতে পেয়ে বেঁচে থাকছিলেন তিনি। আর এ অজ্ঞেয়তা তাঁকে এত পীড়িত করত যে আত্মহত্যা করে বসবেন বলে ভয় পেতেন, অথচ সেই সাথে তিনি তাঁর নিজের একটা বিশিষ্ট, সুনির্দিষ্ট জীবনপথ পেতে চলছিলেন।

এগারো

লেভিনের কাছে সেদিনটা খুবই কষ্টকর, যেদিন কজ্‌নিশেভ পত্রোভ্স্কয়েতে আসেন। তখন কাজে তাড়া করার একটা জোর মৌসুম, শ্রমে আত্মদানের অসাধারণ একটা তীব্রতা দেখায় লোকে, যা জীবনের অন্য পরিস্থিতিতে দেখা যায় না, তাকে খুবই মূল্যবান বলে ধরা চলত যদি এই গুণগুলি যে লোকেরা প্রকটিত করছে তারা নিজেরাই তার কদর করত, যদি প্রতি বছর তার পুনরাবৃত্তি না ঘটত, যদি এই তীব্রতার পরিণাম না হত অমন সাদাসিধে।

রাই আর ওট শস্য কাটা, আঁটি বাঁধা, গাড়ি বোঝাই করে পাঠানো, ঘেসো জমি পুরো ছাঁটা, পতিত জমিতে হাল দেওয়া, বীজ মাড়াই করা, শীতকালীন বপন—এসবই মনে হবে সহজ, সাধারণ; কিন্তু এগুলি করে উঠতে পারার জন্য দরকার গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই যেন খাটে, আর এই তিন-চার সপ্তাহ খাটে যেন সচরাচরের চেয়ে তিন গুণ বেশি। শুধু ভাস, কালো রুটি আর পেঁয়াজ খেয়ে যেন ঝাড়াই করে, মাড়াই করে, পাঁজ যেন বয়ে নিয়ে যায় রাতে, সারা দিন-রাতে যেন না ঘুমায় দু’তিন ঘণ্টার বেশি। এবং সারা রাশিয়ায় প্রতি বছর এই চলে।

জীবনের বেশির ভাগটা গ্রামে এবং কৃষকজনের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে থাকায় লেভিন টের পেতেন যে, কাজের সময়ে এই সাধারণ উত্তেজনা সঞ্চারিত হচ্ছে তাঁর মধ্যেও।

ভোরে তিনি যান প্রথম রাই বপন আর ওটা গাদা করে নিয়ে যাওয়া দেখতে, স্ত্রী এবং শ্যালিকার শয্যাত্যাগ নাগাদ বাড়ি ফিরে তাঁদের সাথে কফি খান এবং আবার পায়ে হেঁটে যান খামার বাড়িতে, যেখানে বীজ তৈরির জন্য বসানো একটি নতুন ঝাড়াই যন্ত্র চালু হবার কথা।

সারা দিনটা লেভিন গোমস্তা আর কৃষকদের সাথে কথা বললেন, বাড়িতে স্ত্রী, ডল্লি, তাঁর ছেলেপেলে। শ্বশুরের সাথে কথা বলে নিজের বিষয়কর্ম ছাড়াও শুধু একটা কথাই ভাবছিলেন। সব কিছুতে খুঁজছিলেন তাঁর এই প্রশ্নের সাথে কোন একটা যোগাযোগ : কে আমি, কোথায় আমি, কেন আমি এখানে?’

শস্যাগার নতুন করে ছাওয়া হয়েছে, সদ্য চাঁছা অ্যাম্পেন কড়ি আর তখনো পল্লব লেগে থাকা হাজেল ডালের থেকে গন্ধ আসছে। এখানে ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে লেভিন তাকালেন খোলা ফটক দিয়ে : সেখানে মাড়াই আঙিনা থেকে শুকনো কটু ধুলো দাপাদাপি করছে, খেলছে; তপ্ত রোদে জ্বলজ্বলে আঙিনার ঘাসের দিকে, গোলা থেকে সদ্য নিয়ে আসা তাজা খড়ের দিকে, ফুটকি-মাথা ধবলী-বুক যে চাতকগুলো শিস দিয়ে সাঁ করে চালার নিচে উড়ে গিয়ে দোরের কাছে দপদপে সিলুয়েট রচনা করছিল তাদের দিকে। শস্যাগারের অন্ধকার আর ধুলোর মধ্যে যে মানুষগুলো কাজ করছে তাদের দিকে চাইলেন আর অদ্ভুত একটা চিন্তা মনে এল তাঁর।

ভাবলেন, ‘কেন এসব করা হচ্ছে? কেন আমি এখানে দাঁড়িয়ে ওদের খাটাচ্ছি? কত যে ওদের চাড়, সবাই ওরা আমাকে তা দেখাবার জন্য অত ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে কি কারণে? বুড়ি মাত্রেনা (অগ্নিকাণ্ডে কড়ি খসে পড়ে তার ওপর, আমি তখন তার চিকিৎসা করি) কেন অত খাটছে’, শীর্ণ যে বৃদ্ধা আঁকশি দিয়ে দানা সরাতে সরাতে অসমান শক্ত মেঝের ওপর রোদে পোড়া কালচে খালি পায়ে ছটফট করছিল তার দিকে চেয়ে ভাবলেন লেভিন, ‘তখন সে সেরে উঠেছিল; কিন্তু আজ না হোক, কাল না হোক, দশ বছরের মধ্যে কবর দেওয়া হবে ওকে, কিছুই তার থাকবে না, লাল স্কার্টে সাজগোজ করা ওই মেয়েরও না, যা থেকে থেকে অমন নিপুণ নরম ভঙ্গি ভঙ্গিতে জেড়ে ফেলছে মঞ্জরির খুদ। ওটাও মারা যাবে, ওই দাগ-দাগালি ঘোড়াটা, বুক যার নুয়ে এসেছে মাটি পর্যন্ত আর ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে নাসারন্ধ্র বিস্ফারিত করে, তার পায়ের তল থেকে অবনত চাকাটা ডিঙিয়ে যাচ্ছে। ওকেও কবর দেওয়া হবে, আর কোঁকড়া-চুল, খুদে ভরাট নরম দাড়ি আর সাদা কাঁধের ওপর ছেঁড়া কামিজটা সমেত যোগানদার ফিওদরকেও। অথচ ও শস্যের আঁটি খুলছে, কি-সব হুকুম দিচ্ছে, ধমকাচ্ছে মেয়েদের আর চটপট বেল্ট পরাচ্ছে চাকায়। আর প্রধান কথা শুধু ওদের নয়, আমাকেও গোর দেবে, কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না আমার। কি জন্যে?’

এসব ভাবছিলেন তিনি আর সেই সাথে ঘড়ি দেখে ঠিক করছিলেন ঘণ্টায় মাড়াই হল কতটা। এটা জানা তাঁর দরকার, সেই অনুসারে আগামী দিনের কাজ দিতে হবে।

‘এক ঘণ্টা হয়ে এল অথচ মাত্র শুরু হচ্ছে তৃতীয় গাদিটা’, এই ভেবে লেভিন গেলেন যোগানদারের কাছে আর যন্ত্রের ঘর্ঘর আওয়াজ ছাপিয়ে বললেন যেন শস্য দেয় অল্প করে।

‘ফিওদর, অল্প অল্প করে দিবি! দেখছিস—আটকে যাচ্ছে, কাজ তাই তরতরিয়ে চলছে না। সমান সমান কর! যোগানদারের ঘর্মাক্ত মুখে ধুলো লেপটে গিয়ে তা কালো হয়ে উঠেছে। সেও চিৎকার করে কি জবাব দিল, কিন্তু কাজ চালাতে লাগল লেভিন যা চাইছিলেন সেভাবে নয়।

লেভিন যন্ত্রের কাছে গিয়ে ফিওদরকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই শস্য যোগাতে লাগলেন।

চাষীদের তিনি যোগানদারের সাথে শস্যাগার থেকে বেরিয়ে, বীজ তৈরি করার জন্য মেঝের ওপর পরিপাটি করে রাখা হলদে রাই শস্যের গাদির কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলেন তার সাথে।

যোগানদার দূর গ্রামের লোক, যেখানে লেভিন প্রথমে জমি দিয়েছিলেন সমবায়ের ভিত্তিতে। এখন তা খাজনায় দেওয়া হয়েছে সরাইখানার মালিককে।

এই জমি সম্পর্কে লেভিন কথাবার্তা বলতে লাগলেন ফিওদরের সাথে, জিজ্ঞেস করলেন সামনের বছর প্লাতন জমিটা নেবে কিনা। প্লাতন ঐ গাঁয়েরই সমৃদ্ধ কর্মিষ্ঠ চাষী।

‘দর বেশি। প্লাতন পেরে উঠবে না, কনস্তান্তিন দ্‌দ্‌মিত্রিচ’, ঘর্মাক্ত বুক থেকে মঞ্জরি ঝেড়ে ফেলে জবাব দিলে ফিওদর।

‘তাহলে কিরিল্লোভ কি করে পারছে?’

‘মিতিউখা’ (কিরিল্লোভকে চাষীরা ঘৃণা করে এই নামে ডাকত) ‘লাভ ওঠাতে কেন পারবে না, কনস্তান্তিন দ্‌মিত্রিচ! লোকটা শুষে নিজেরটুকু বের করে নেয়। চাষাভূষাকে কোন দয়া করে না। আর ফোকানিচ চাচা (বৃদ্ধ প্লাতনকে সে এই বলে ডাকে), ‘সে কি লোকের গা থেকে ছাল খসাতে যাবে? কাউকে ঋণ দেয়, কাউকে ছেড়ে দেয় এমনি। পেরে উঠবে না। মনিষ্যির মত ব্যবহার।’

‘কেন সে এমনি ছেড়ে দেয়?’

‘মানে, লোক তো নানান রকমের; কেউ দিন কাটায় কেবল নিজের অভাব মেটাবার জন্যে, যেমন—মিতিউখা তার পেট ভর্তি করে চলেছে, কিন্তু ফোকানিচ বুড়ো—হক্ মানুষ, আত্মার জন্যে ও বাঁচে, সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে।’

লেভিন প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে মানে? আত্মার জন্যে কিভাবে বাঁচে?’

‘সেটা তো জানা কথা, ন্যায়মতে, ধর্মমতে চলা। লোক তো নানান রকমের। আপনাকেই ধরুন কেন, আপনিও মানুষের প্রতি অন্যায় করবেন না…’

লেভিন উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, বুঝলাম! এবার চলি!’ নিজের ছড়িটা নিয়ে দ্রুত চলতে লাগলেন বাড়ির দিকে। ফোকানিচ বেঁচে আছে আত্মার জন্য, চলে ন্যায়মতে, ধর্মমতে,—চাষীটার এই কথায় কোথাকার রুদ্ধ কক্ষ থেকে যেন ভেঙে বেরোল এক ঝাঁক অস্পষ্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা। তাঁর মাথায় সবই একটা লক্ষ্যে পাক খেতে লাগল, আলোয় তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল।

বারো

লেভিন লম্বা লম্বা পা ফেলে বড় রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। কান পেতে ছিলেন, তাঁর চিন্তাগুলোর দিকে ততটা নয় (তখনো তিনি তা গুছিয়ে উঠতে পারেননি), যতটা তাঁর প্রাণের অবস্থার দিকে, কখনো এমন অবস্থা হয়নি তাঁর।

যে কথাটা চাষী বলল সেটা তাঁর প্রাণের মধ্যে একটা বৈদ্যুতিক ফুলকির কাজ করে পুরো এক ঝাঁক বিচ্ছিন্ন, অশক্ত, পৃথক পৃথক যে ভাবনাগুলো তাঁকে ছেড়ে যেত না কখনো, তাদের রূপান্তরিত ও ঘনীভূত করল একাকার অখণ্ডতায়। জমি দেওয়া নিয়ে যখন কথা বলছিলেন, তখনো এ ভাবনাগুলো তাঁর মন জুড়ে ছিল তাঁরই অলক্ষ্যে।

প্রাণের মধ্যে নতুন কি-একটা অনুভব করলেন তিনি, কি সেটা তখনো তা না জেনেও সেই নতুনকে তিনি হাতড়ে দেখতে লাগলেন আনন্দের সাথে।

‘নিজের জন্যে নয়। সৃষ্টিকর্তার জন্যে বাঁচা। কোন্ সৃষ্টিকর্তা? ও যা বলেছে, তার চেয়ে বাজে কথা হয় কিছু? ও বলল, নিজের অভাব মেটাবার জন্যে বাঁচা উচিত নয়, অর্থাৎ যা আমাদের বোধগম্য, যা আমাদের আকর্ষণ করে, যা আমরা চাই, তার জন্যে বাঁচা উচিত নয়, উচিত দুর্বোধ্য কিছু-একটার জন্যে, সৃষ্টিকর্তার জন্যে বাঁচা, যাঁকে কেউ বোঝে না, সংজ্ঞা দিতে পারে না তাঁর। কিন্তু কি হল? ফিওদরের এই বাজে কথাগুলো কি আমি বুঝিনি? আর বুঝে কি সন্দেহ করেছি তাদের ন্যায্যতায়? তাদের মনে হয়েছে নির্বোধ, অস্পষ্ট, অযথার্থ?

‘না, আমি ওকে বুঝেছি, ঠিক ও যেমন বোঝে তেমনি। জীবনে যা কিছু আমি বুঝেছি, এ কথাগুলো বুঝলাম তার চেয়ে পরিপূর্ণ আর পরিষ্কার করে। জীবনে আমি এতে সন্দেহ করিনি, সন্দেহ করতে পারি না। আর আমি শুধু একা নই, সবাই। সারা বিশ্ব পুরোপুরি এটা বোঝে। শুধু এই একটাতেই তারা নিঃসন্দেহ, সব সময়ই তার মেনে নেয়।

‘ফিওদর বলছে যে কিরিল্লোভ বেঁচে আছে তার পেটের জন্যে। এটা বোধগম্য এবং যুক্তিযুক্ত, যুক্তিবাদী প্রাণী হিসেবে আমরা সবাই পেটের জন্যে ছাড়া অন্য কোনভাবে বাঁচতে পারি না। কিন্তু ফিওদর বলে দিল পেটের জন্যে বেঁচে থাকা খারাপ, বাঁচা উচিত ন্যায়ের জন্যে, সৃষ্টিকর্তার জন্যে আর পলকেই আমি বুঝতে পারলাম তাকে! এবং আমি আর অতীত যুগের কোটি কোটি লোক, এখন যারা বেঁচে আছে, চিত্ত-সম্পদে দীন চাষীরা আর প্রাজ্ঞরা যাঁরা এ নিয়ে ভেবেছেন, লিখেছেন, একই কথা বলেছেন অস্পষ্ট ভাষায়, সবাই আমরা একটা ব্যাপারে সম্মত: কিসের জন্যে বাঁচা উচিত এবং কি ভালো। সমস্ত লোকের সাথে দৃঢ়ভাবে, পরিষ্কার করে আমি একটা জিনিস জানি আর সে জানাটাকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না, তা যুক্তি-বহির্ভূত, তার পেছনে কোন কারণ নেই। কোনরকম ফলাফলও তার থাকতে পারে না।

‘শুভের পেছনে যদি কারণ থাকে, তাহলে সেটা আর শুভ নয়। যদি তার ফলাফল দেখা দেয়—পুরস্কার, তাহলে সেটাও শুভ নয় আর। দাঁড়াচ্ছে শুভ কারণ পরিণামের পরম্পরা-বহির্ভূত।

‘আর শুভকে তো আমি জানি, সবাই জানি আমরা।

‘আমি যার খোঁজ করেছি, সে অলৌকিককে পাইনি যা আমাকে নিঃসন্দেহ করে তুলতে পারত, তার জন্যে খেদ হয়। আর এই তো সে, অলৌকিক, একমাত্র যা সম্ভবপর, নিরন্তর বিদ্যমান। সব দিক থেকে বেষ্টন করে আছে আমাকে, অথচ আমি তা লক্ষ্য করিনি!

‘এর চেয়ে বড় অলৌকিক আর কি হতে পারে?’

‘সত্যিই কি আমি সব কিছুর সমাধান পেয়ে গেছি? সত্যিই কি আমার ভোগান্তির অবসান হল এবার?’ ধূলিময় রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ভাবলেন লেভিন, গরম কি ক্লান্তি টের পাচ্ছিলেন না তিনি, উপশম অনুভব করছিলেন দীর্ঘ যন্ত্রণার। সে অনুভূতি এত আনন্দময় যে, মনে হচ্ছিল তা অবিশ্বাস্য। উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল তাঁর। আর বেশি এগোবার শক্তি না থাকায়, তিনি রাস্তা থেকে নেমে বনে ঢুকলেন। বসলেন অ্যাম্পেন গাছের ছায়াতলে না-কাটা ঘাসের ওপর। ঘর্মাক্ত মাথা থেকে টুপিটা খুলে কনুইয়ে ভর দিয়ে রসালো ঝাঁকড়া বন্য ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লেন।

‘হ্যাঁ, সুস্থির হয়ে ভাবা দরকার’, তাঁর সামনের অদলিত ঘাসগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে, ডাঁটি বেয়ে উঠন্ত, আঙ্গেলিকার পাতায় পথরুদ্ধ একটা সবুজ পোকাকে লক্ষ্য করতে করতে ভাবলেন লেভিন। ‘সব গোড়া থেকে – পোকাটাকে যাতে বাধা না দেয় আঙ্গেলিকার পাতাটা ঘুরিয়ে আর পোকাটা যাতে অন্য ডাঁটিতে চলে যায় তার জন্য অন্য একটা ঘাস নুইয়ে নিজেকে বললেন তিনি। ‘কেন আমার আনন্দ হচ্ছে? আমি কি আবিষ্কার করলাম?’

‘আমি আগে বলতাম যে আমার দেহে, ঐ ঘাসটার, ঐ পোকাটার দেহে (বটে, ও ডাঁটিতে যেতে চাইছিল না, ডানা মেলে উড়ে গেল) পদার্থবিদ্যক, রাসায়নিক, শারীরবৃত্তীয় নিয়ম অনুসারে বস্তুর রূপান্তর ঘেেছ। এই অ্যাম্পেন গাছগুলো, মেঘ, কুয়াশার ছোপ, সবাইকে নিয়ে আমাদের সবার মধ্যে চলেছে বিকাশ। কি থেকে বিকাশ? কিসে বিকাশ? চিরন্তন বিকাশ আর সংগ্রাম?… চিরন্তনে যেন কোন অভিমুখ আর সংগ্রাম থাকা সম্ভব! এই দিকে অতি প্রখর চিন্তা নিয়োগ করেও আমার জীবনের অর্থ, আমার প্রেরণা ও প্রয়াসের অর্থ উদ্‌ঘাটিত হচ্ছিল না দেখে অবাক লেগেছিল আমার। অথচ আমার ভেতরকার প্রেরণার অর্থ এত পরিষ্কার যে, সব সময় সেই অনুসারেই চলি। আর চাষীটা যখন বলল তার কথাটা : সৃষ্টিকর্তার জন্য, আত্মার জন্য বাঁচা, আমি তখন অবাক হয়ে গেলাম, ভীষণ আনন্দ হল আমার।

‘আমি কিছুই আবিষ্কার করিনি। আমি যা জানতাম শুধু সেটা জানালাম। যে শক্তি শুধু অতীতে নয়, এখনো আমাকে জীবন দিয়ে যাচ্ছে তাকে বুঝলাম। আমি মুক্তি পেয়েছি ছলনা থেকে, জেনেছি কর্তাকে।’

এবং বিগত দুই বছরে তাঁর চিন্তার ধারাটা তিনি সংক্ষেপে আওড়ে নিলেন মনে মনে, নৈরাশ্যজনকরূপে পীড়িত প্রিয়জন বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পরিষ্কার, স্বতঃস্পষ্ট ভাবনা দিয়ে যার শুরু।

তখন সেই প্রথমবার পরিষ্কার করে এটা বুঝতে পেরে যে প্রত্যেক মানুষের এবং তাঁরও সামনে যন্ত্রণা, মৃত্যু, চিরবিস্মরণ ছাড়া আর কিছু নেই। তিনি স্থির করেন যে এভাবে বাঁচা চলে না, হয় জীবনের এমন একটা ব্যাখ্যা পাওয়া দরকার যাতে তা কোন এক পিশাচের জঘন্য বিদ্রূপ বলে মনে না হয়, নতুবা দরকার আত্মহত্যা।

কিন্তু উনি এর কোনটাই করলেন না। বেঁচে রইলেন তিনি, ভাবতে থাকলেন, অনুভব করে গেলেন। এমন কি এই সময়টাতেই বিবাহ করেন, অনেক আনন্দানুভূতি হয়েছে তাঁর, নিজের জীবনের অর্থ কি তা না ভাবলে নিজেকে সুখীই বোধ করেছেন।

এর অর্থ কি? এর অর্থ উনি ঠিকই জীবননির্বাহ করেছেন, কিন্তু ভেবেছেন ভুল।

মাতৃস্তন্যের সাথে সাথে যেসব আত্মিক সত্যে পুষ্ট হয়েছেন তিনি, বেঁচে থেকেছেন তাই নিয়ে (যদিও সে সম্পর্কে সচেতন না হয়ে), অথচ চিন্তা করেছেন’ এসব সত্যকে শুধু গ্রহণ না করে নয়, সর্বোপায়ে তাদের এড়িয়ে গিয়ে 1

এখন তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল যে তিনি যেসব বিশ্বাসে লালিত শুধু তারই কল্যাণে তিনি বেঁচে থাকতে পারেন।

‘কি আমি হতাশ, কি জীবন কাটাতাম যদি না থাকত এই বিশ্বাসগুলো? যদি না জানতাম যে, নিজের প্রয়োজনের জন্যে নয়, জীবনধারণ করা উচিত সৃষ্টিকর্তার জন্যে? আমি হয়ত লুঠ করতাম, মিথ্যে বলতাম, খুন করতাম। আমার জীবনের যা সর্বাধিক আনন্দ তার কিছুই থাকত না।’ এবং কিসের জন্য বাঁচছেন তা না জানলে তিনি যে পাশবিক সত্তায় পরিণত হতেন, প্রচুর কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করেও তিনি তা ধরতে পারলেন না।

‘আমি আমার প্রশ্নের জবাব খুঁজেছিলাম। কিন্তু চিন্তা আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না, তা খাপ খায় না প্রশ্নের সাথে। স্বয়ং জীবনই আমাকে জবাব দিয়েছে, কি ভালো, কি খারাপ তার জ্ঞানে। আর ও জ্ঞানটা আমি অর্জন করিনি, সকলের সঙ্গে তা প্রদত্ত হয়েছে আমাকে। প্রদত্ত হয়েছে, কারণ কোথা থেকেও আমি তা পেতে পারি না।

‘কোত্থেকে তা পেলাম? যুক্তি দিয়ে কি আমি এই প্রত্যয়ে পৌঁছেছি যে প্রতিবেশীকে টুটি চিপে না মেরে ভালোবাসা উচিত? এ কথা আমাকে বলা হয় আমার শৈশবে আর আমি সানন্দে তা বিশ্বাস করি, কারণ আমাকে তাই বলা হয়, যা ছিল আমার প্রাণে। আর কে আবিষ্কার করল এটা? যুক্তি নয়। যুক্তি আবিষ্কার করেছে অস্তিত্বে জন্যে সংগ্রাম, আমার ইচ্ছা পূরণে যা বাধা দেয় তাদের নির্মূল করার নিয়ম। এটা যুক্তির সিদ্ধান্ত। কিন্তু অন্যকে ভালোবাসাটা যুক্তি আবিষ্কার করতে পারে না। কেননা সেটা যুক্তিহীন।’

তিনি ঘাসের শিষ না ভেঙে উপুড় হয়ে তা দিয়ে বিনুনি বুনতে বুনতে মনে মনে ভাবলেন, হ্যাঁ, গর্ব।’

তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘আর মননের গর্ব শুধু নয়, নির্বুদ্ধিতাও। সবচেয়ে বড় কথা, ধূর্ততা, মননের ধূর্ততাই। মননের কারচুপিই।’

তেরো

ছেলেমেয়েদের সাথে ডল্লির একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ল লেভিনের। কেউ না থাকায় ছেলেমেয়েরা মোমবাতির আগুনে র‍্যাম্পবেরি ভাজছিল, দুধ খাচ্ছিল ফোয়ারার মত করে। মা তাদের এই কাজ দেখতে পেয়ে লেভিনের উপস্থিতিতে তাদের বোঝাতে শুরু করেন যে, তারা যেটা ভাঙছে সেটার জন্য বড়দের কত খাটতে হয়েছে, খেটেছে তাদের জন্য; পেয়ালা যদি তারা ভাঙে, তাহলে চা খাবার পাত্র থাকবে না। আর দুধ যদি ফেলে দেয়, তাহলে তাদের খাবার থাকবে না কিছুই, না খেয়ে মারা যাবে।

ছেলেমেয়েরা মায়ের এ কথাগুলো যে শান্ত, বিষণ্ণ অবিশ্বাসে শুনছিল, সেটা অবাক করেছিল লেভিনকে। তাদের শুধু দুঃখ হয়েছিল এই যে চমৎকার একটা খেলা বন্ধ হয়ে গেল, মা যা বলছিলেন তার একটা কথাও তারা বিশ্বাস করেনি। বিশ্বাস করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা তাদের ব্যবহারে যা লাগছে সে সব জিনিসের মোট পরিমাণ তাদের কল্পনাতীত, তারা ভাবতেই পারে না, যে-জিনিসগুলো তারা ভাঙছে, তাই দিয়েই তারা বেঁচে আছে।

ওরা ভেবেছিল : ‘এসবই স্বতঃসিদ্ধ, এতে আগ্রহোদ্দীপক বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। কেননা এ সবই সব সময় থেকেছে ও থাকবে। সব সময়ই একই রকম। ও নিয়ে আমাদের ভাববার কিছু নেই, সব সময় ওগুলো তৈরি; অথচ আমাদের নিজস্ব নতুন কিছু-একটা ভেবে বার করার ইচ্ছে হচ্ছে। তাই আমরা কাপে র‍্যাম্পবেরি দিয়ে মোমবাতির আগুনে ভাজছি, দুধ খাচ্ছি সোজা পরস্পরের মুখে ফোয়ারা ঢেলে। এটা মজার আর মানুষের জীবনের অর্থ খুঁজতে গেছি?’ ভেবে চললেন লেভিন।

‘সমস্ত দার্শনিক তত্ত্ব যখন মানুষের পক্ষে অস্বাভাবিক, বিচিত্র এক চিন্তাপথে তাকে সেই জ্ঞান দেয় যা সে অনেক দিন থেকে জানে, এত নিশ্চিতরূপে জানে যে তাছাড়া বাঁচতে পারে না, তখন দর্শনগুলোও কি সেই কাজই করছে না? সমস্ত দার্শনিকের তত্ত্বের বিকাশে কি পরিষ্কার করে এটা দেখা যাচ্ছে না যে, চাষী ফিওদরের মত আগে থেকেই তাদের নিঃসন্দেহে জানা আছে জীবনের প্রধান অর্থ কি এবং মোটেই বেশি স্পষ্ট করে নয়। শুধু সন্দেহজনক মননের পথে তারা সেখানে ফিরতে চায় যা সকলেই জানে?

‘কিন্তু শিশুদের যদি ছেড়ে দিয়ে বলা হয় নিজেরাই তারা তাদের কাপ ইত্যাদি বানিয়ে, দুধ দুইয়ে নিক তাহলে দুষ্টুমি আর করবে কি? তারা না খেয়ে মারা যাবে। আমাদের ঝোঁক আর চিন্তা নিয়ে আমাদেরও ছেড়ে দেওয়া হোক একেশ্বর ও স্রষ্টার কোন বোধ ছাড়াই! কিংবা সু কি তা না বুঝে, কু কি তার নৈতিক ব্যাখ্যা না দিয়ে?

‘এই বোধগুলি ছাড়া বানাও দেখি কিছু!’

‘আমরা শুধু ভাঙি। কেননা প্রাণের দিক থেকে আমাদের পেট ভরা। ঠিক ওই শিশুগুলির মত!

‘চাষীটার সাথে আনন্দময় একই সাধারণ জ্ঞান আমার হল কোথা থেকে যাতে প্রাণ জুড়ায়? আমি কোত্থেকে তা পেলাম?

‘আমি সৃষ্টিকর্তার একটা ধারণায় লালিত খ্রিস্টান। আমাকে ধর্ম যা দেয়, সেই সব আধ্যাত্মিক আশীর্বাদে পূর্ণ করেছি জীবন, সেই সব আশীর্বাদে আমি অনুপ্রাণিত, তার ওপরেই বেঁচে আছি, অথচ ওই শিশুদের মত কিছু না বুঝে ওগুলো ভাঙছি, অর্থাৎ তাই ভাঙতে চাইছি যার ওপর বেঁচে আছি। কিন্তু জীবনের গুরুত্ব ধরে এমন মুহূর্ত আসা মাত্রই শীতার্ত, ক্ষুধার্ত শিশুদের মতই আমি তাঁর কাছে যাই। নষ্টামির জন্যে শিশুদের তো ধমক দেয় মা, আর তাদের চেয়ে আমি কম অনুভব করি যে আমার বাসন ভাঙার ছেলেমানুষি চেষ্টায় আমার দায়িত্ব ধরা হচ্ছে না।

‘হ্যাঁ, যা আমি সঠিক জানি তা জেনেছি যুক্তি দিয়ে নয়, ওটা আমাকে প্রদত্ত, আমার জন্যে আবিষ্কৃত, হৃদয় দিয়ে, বিশ্বাস দিয়ে আমি সেই প্রধান জিনিসটা জানি যা প্রচার করে গির্জা।

‘গির্জা? গির্জা!’ কথাটার পুনরাবৃত্তি করলেন লেভিন, অন্য পাশে কাত হয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে তাকিয়ে রইলেন সুদূরে। ওপার থেকে নদীর কাছে আসছিল যে গরুর পাল, তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

‘কিন্তু গির্জা যা প্রচার করে, আমি কি তা সবই বিশ্বাস করতে পারি?’ নিজেকে পরখ করে, তাঁর বর্তমান প্ৰশান্তি নষ্ট করতে পারে এমন সব কিছু ভেবে দেখে মনে মনে বললেন তিনি। ইচ্ছা করে তিনি গির্জার সেই সব শিক্ষা স্মরণ করতে লাগলেন, যা তাঁর কাছে সবচেয়ে অদ্ভুত মনে হয়েছে, প্রলোভিত করেছে তাঁকে; ‘সৃষ্টি? কিন্তু অস্তিত্বের ব্যাখ্যা আমি করব কি দিয়ে? অস্তিত্ব দিয়েই? কিছু দিয়েই নয়?—শয়তান আর পাপ? কু’য়ের কি ব্যাখ্যা দেব আমি?…পাপস্খালনের ..

‘না, আমি কিছু জানি না, জানতে পারি না, শুধু সকলের মত আমাকেও যা বলা হয়েছে সেটা ছাড়া।’

এখন তাঁর মনে হল গির্জার এমন একটা শিক্ষাও ছিল না যা নষ্ট করছে প্রধান জিনিসটা—সৃষ্টিকর্তায়, মানুষের একমাত্র কর্তব্য হিসেবে শুভে বিশ্বাস।

প্রয়োজন মেটানোর বদলে সত্যের সেবা করাটা থাকতে পেরেছে গির্জার প্রতিটি বিশ্বাসে। প্রতিটি শিক্ষা এটাকে লঙ্ঘন তো করেইনি, বরং যা প্রধান জিনিস, পৃথিবীতে নিত্য ঘটমান অলৌকিক যাতে ঘটতে থাকে তার জন্য সেটা প্রয়োজন। লক্ষ লক্ষ ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ, প্রাজ্ঞ আর মূর্খ, শিশু আর বৃদ্ধ—সবার সাথে, চাষীর সাথে ভভ, কিটি, কাঙাল, আর রাজা-রাজড়াদের সাথে নিঃসন্দেহে একই কথা বোঝা এবং চিত্তের সেই জীবন গড়ে তোলা সম্ভব হয় এ অলৌকিকে, শুধু তার জন্যই বাঁচা সার্থক, শুধু তাকেই আমরা মূল্য দিই।

তিনি চিত হয়ে শুয়ে উঁচু নির্মেঘ আকাশ দেখাতে লাগলেন। ‘আমি কি জানি না যে ওটা অসীম শূন্যদেশ, গোল গম্বুজ নয়? কিন্তু যতই আমি চোখ কুঁচকে দৃষ্টি শানিত করি, শূন্যদেশের অন্তহীনতা সম্পর্কে আমার জ্ঞান সত্ত্বেও ওটাকে গোল আর সমীম ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই না আমি। ওটাকে যখন আমি দেখি একটা কঠিনাকার নীল গম্বুজ হিসেবে, তখন আমি নিঃসন্দেহে সঠিক, আরো দূরে দেখার চেষ্টা করার চেয়ে বেশি সঠিক।’

লেভিন ভাবনায় ক্ষান্ত হলেন, শুধু রহস্যময় যে কণ্ঠস্বরগুলো কি নিয়ে যেন আনন্দে আর উদ্বেগে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছিল, তাদের দিকে কান পেতে রইলেন।

তিনি নিজের সুখে বিশ্বাস করতে ভয় পেয়ে ভাবলেন : ‘সত্যিই কি এটা বিশ্বাস? সৃষ্টিকর্তা, তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ!’ যে কান্না উদ্‌গত হতে যাচ্ছিল সেটা গিলে, তিনি দু’হাতে অশ্রুপূর্ণ চোখের পানি মুছে বিড়বিড় করতে লাগলেন।

চৌদ্দ

সামনের দিকে তাকিয়ে লেভিন গরুর পাল দেখছিলেন। তারপর দেখলেন তাঁর কেলে ঘোড়া জোতা গাড়িটা। কোচোয়ান পালের কাছে গিয়ে, রাখালকে কি যেন বলল; তারপর একেবারে কাছে শুনতে পেলেন গাড়ির চাকার শব্দ আর তাগড়া ঘোড়ার ফোঁৎফোঁৎ শব্দ। কিন্তু ভাবনায় তিনি এমন ডুবে ছিলেন যে কোচোয়ান কেন তাঁর কাছে আসছে তা নিয়ে মাথা ঘামাননি। সেটা তাঁর মনে হয় কেবল পরে যখন কোচোয়ান একেবারে তাঁর কাছে এসে চিৎকার করে বলল, ‘গিন্নিমা পাঠিয়েছেন। আপনার বড় ভাই এসেছেন, আরো কে-একজন ভদ্রলোক।’

গাড়িতে উঠে বসে লেভিন লাগাম টেনে নিলেন।

স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠা লোকের মত অনেকক্ষণ সংবিৎ ফিরছিল না তাঁর। পাছার দিকে আর বল্গার ঘর্ষণে ঘাড়ের কাছে ফেনায়িত পুষ্ট ঘোড়ার দিকে চাইলেন তিনি, তাকালেন পাশে বসা কোচোয়ান ইভানের দিকে, মনে পড়ল যে তিনি বড় ভাইয়ের আসার প্রতীক্ষায় ছিলেন, তাঁর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে নিশ্চয় অস্থির হয়ে উঠেছে স্ত্রী, বড় ভাইয়ের সাথে অতিথি কে এলেন অনুমান করার চেষ্টা করলেন। এবং বড় ভাই, স্ত্রী আর অভ্যাগতকে তাঁর সম্পর্ক এখন অন্যরকম হবে।

‘বড় ভাই আর আমার মধ্যে সব সময় যে পর-পর ভাবটা ছিল তা আর থাকবে না, তর্ক করব না আর; কিটির সাথে ঝগড়া হবে না কখনেই; যে অতিথি এসেছেন তিনি যেই হোন না কেন, তাঁর প্রতি হব মমতাময়, উদার; লোকদের সাথে, ইভানের সাথে সম্পর্ক হবে অন্যবিধ।’

অস্থিরতায় ফোঁৎফোঁৎ করে পুরুষ্টু যে ঘোড়াটা ছুটতে চাইছিল, তাকে কড়া লাগামে সংযত রেখে তিনি পাশে বসা ইভানের দিকে তাকালেন। কর্মহীন হাত দুটো দিয়ে কি করা যাবে ভেবে পাচ্ছিল না সে, নিজের কামিজ চেপে ধরছিল। লেভিন তার সাথে কথা বলার অজুহাত খুঁজছিলেন। ভেবেছিলেন বলবেন খামোকাই ইভান ঘোড়াটা জুতেছে বড় বেশি উঁচু করে, কিন্তু সেটা তিরস্কারের মত শোনাবে, ওদিকে ওঁর ইচ্ছে হচ্ছিল দরদ দিয়ে কথা বলেন। অন্য কিছু মাথায় আসছিল না তাঁর।

‘আপনি ডান দিকে চালান, এখানে একটা কাটা গুঁড়ি আছে’, লেভিনের লাগাম ঠিক করে দিয়ে কোচোয়ান বলল। ‘মাপ কর, লাগাম ছুঁয়ো না, শেখাতে এসো না আমাকে!’ কোচোয়ানের এই হস্তক্ষেপে রেগে গিয়ে বললেন লেভিন। বরাবরের মতই হস্তক্ষেপে রাগ হয়ে যায় তাঁর, আর তখনই সখেদে টের পেলেন যে তাঁর প্রাণের আবেগ তৎক্ষণাৎ বাস্তবের সাথে তাঁর সম্পর্ক বদলে দিতে পারে ভেবে কি ভুলই না তিনি করেছেন।

বাড়ি পৌঁছতে যখন সিকি ভার্স্ট বাকি লেভিন দেখলেন গ্রিশা আর তানিয়া ছুটে আসছে তাঁর দিকে। ‘কস্তিয়া খালু! মা-ও আসছে, দাদুও, সের্গেই ইভানিচ, আরো কে-একজন’, গাড়িতে উঠে বলল তারা। ‘কে?’

‘সাঙ্ঘাতিক ভয়ানক লোক! হাত দিয়ে এরকম করে’, গাড়িতে উঠে দাঁড়িয়ে কাতাভাসোভের ভঙ্গি নকল করে বলল তানিয়া।

‘বয়স্ক, নাকি যুবক?’ তানিয়ার ভঙ্গিটায় কার কথা যেন মনে পড়ায় হেসে জিজ্ঞেস করলেন লেভিন। ‘শুধু অসহ্য কেউ না হলে বাঁচি!’ ভাবলেন তিনি।

কেবল রাস্তায় মোড় নিয়ে লেভিন দেখতে পেলেন কারা আসছে তাঁর দিকে, চিনতে পারলেন -হ্যাট মাথায় কাতাভাসোভকে, যিনি হাত দোলাচ্ছিলেন তানিয়া যা দেখিয়েছিল ঠিক সেভাবেই।

দর্শনের কথা বলতে খুবই ভালোবাসতেন কাতাভাসোভ, যদিও তার ধারণাগুলো নিতেন প্রকৃতিবিদদের কাছ থেকে যাঁরা দর্শনের চর্চা কখনো করেননি; সম্প্রতি মস্কোয় তাঁর সাথে অনেক তর্ক হয়েছিল লেভিনের।

আর তাঁকে চিনতে পেরে ‘তেমন যে একটা আলাপের কথা লেভিনের। প্রথম মনে পড়েছিল, তাতে স্পষ্টতই কাতাভাসোভ ধরে নিয়েছিলেন যে তিনি জিতেছেন।

লেভিন ভাবলেন, ‘না, তর্ক করে লঘুচিত্তে নিজের ভাবনা ব্যক্ত করতে যাব না কিছুতেই।’

গাড়ি থেকে নেমে বড় ভাই আর কাতাভাসোভকে স্বাগত জানিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন স্ত্রীর খবর। ‘মিতিয়াকে সে নিয়ে গেছে কলোকে’ (এটা বাড়ির কাছে একটা উপবন)। ‘ওখানেই তাকে রাখতে চাইছিল, বাড়ির ভেতর বড় গরম’, ডল্লি বললেন।

স্ত্রীকে লেভিন সব সময় বলেছেন ছেলেকে বনে না নিয়ে যেতে, ভাবতেন ওটা বিপজ্জনক, তাই সংবাদটা ভালো লাগল না তাঁর।

‘জায়গা থেকে জায়গায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে’, হেসে বললেন বৃদ্ধ প্রিন্স, ‘আমি ওকে পরামর্শ দিয়েছি ঠাণ্ডি ঘরে নিয়ে যেতে।’

‘কিটি মক্ষিকালয়ে যেতে চাইছিল। ভেবেছিল তুমি সেখানে। আমরাও সেখানেই যাচ্ছি’, ডল্লি বললেন।

‘তা কি করছ তুমি?’ অন্যদের কাছ থেকে সরে ভাইয়ের কাছে এসে বললেন কজ্‌নিশেভ।

‘বিশেষ কিছু না। বরাবরের মত কৃষিকাজ নিয়ে আছি’, উত্তর দিলেন লেভিন। ‘কিন্তু তুমি কত দিনের জন্যে? আমরা অনেকদিন থেকে তোমার পথ ছেয়ে রয়েছি।’

‘সপ্তাহ দুয়েক থাকব। মস্কোয় কাজ আছে মেলা।’

এই কথায় চোখাচোখি হল দুই ভাইয়ের আর চিরকাল বন্ধুর মত, প্রধান কথা, সহজ সম্পর্কে থাকার বরাবরকার যে ইচ্ছেটা এখন বিশেষ তীব্র হয়ে উঠেছে, তা সত্ত্বেও লেভিন টের পেলেন যে তাঁর দিকে চাইতে তাঁর অস্বস্তি হচ্ছে। চোখ নামিয়ে নিলেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না কি বলবেন।

কথোপকথনের এমন একটা প্রসঙ্গ লেভিন বাচাছিলেন যা কজ্‌নিশেভের ভালো লাগবে আর মস্কোয় তাঁর কাজ বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন সেই সার্বীয় যুদ্ধ আর স্লাভ প্রশ্ন থেকে তাঁর মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করতে পারবে। কজ্‌নিশেভের বইয়ের কথা পাড়লেন লেভিন। বললেন, ‘কি, সমালোচনা বেরোল আপনার বইয়ের ‘

অভিসন্ধিমূলক প্রশ্নটায় হাসলেন কজ্‌নিশেভ। ‘ও নিয়ে কেউ আর ভাবে না, আমি তো সবচেয়ে কম’, বললেন তিনি। তারপর অ্যাম্পেন গাছের মাথায় যে সাদা মেঘ জমেছিল, ছাতা দিয়ে তার দিকে দেখিয়ে যোগ দিলেন, ‘ওই দেখুন, দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা, বৃষ্টি নামবে।’

আর শত্রুতা নয়, পরস্পরের মধ্যে যে নিরুত্তাপ সম্পর্ক লেভিন অত এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন, এই কথাগুলো বলা মাত্র ভাইদের মধ্যে আবার ফিরে এল তা।

লেভিন গেলেন কাতাভাসোভের কাছে। বললেন : ‘আপনি যে এলেন খুব ভালো করেছেন।’

‘অনেকদিন থেকেই আসব-আসব করছিলাম। এবার আলাপ করব, দেখব। স্পেনসার পড়েছেন?’

‘না, শেষ করিনি’, লেভিন বললেন, ‘তবে ওঁকে এখন আমার দরকার নেই আর।’

‘সে কি, অতি মনোগ্রাহী? কেন, বলুন তো?’

‘মানে, আমি এই চূড়ান্ত নিশ্চয়তায় পৌঁছেছি যে আমি যেসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবিত, তার উত্তর ওঁর বা অনুরূপ ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। এখন…’

কিন্তু কাতাভাসোভের শান্ত, আমুদে মুখভাবে হঠাৎ ভারি অবাক লাগল লেভিনের এবং এই কথাবার্তাটায় স্পষ্টতই নিজের মানসিক অবস্থাটা বিঘ্নিত হয়েছে বলে এত কষ্ট হল তাঁর যে নিজের সংকল্পের কথা মনে হতে থেমে গেলেন। ‘তবে সে নিয়ে পরে কথা হবে, তিনি যোগ করলেন; ‘মৌচাকে যেতে হলে এই হাঁটাপথটা ধরা ভালো’, বললেন তিনি সবার উদ্দেশে।

সরু হাঁটাপথটা দিয়ে তাঁরা পৌঁছলেন ঘাস-না-কাটা একটা মাঠে, তার একটি জ্বলজ্বলে কাউ-হুইটের নীরন্ধ্র ঝোঁপ, তার মাঝে মাঝে কালচে-সবুজ হেলেবোরের উঁচু উঁচু ঝাড়। সেখানে লেভিন কচি অ্যাম্পেন গাছগুলোর তাজা ছায়ায় বসালেন অতিথিদের। যে আগন্তুকেরা মৌমাছিতে ভয় পায় তাদের জন্য ইচ্ছে করেই তিনি বেঞ্চি আর গুঁড়ি পেতেছিলেন সেখানে, আর নিজে পাশের পথ দরে গেলেন ছেলেপেলে আর বড়দের জন্য রুটি, শশা আর টাটকা মধু আনতে।

ক্ষিপ্ৰ পদক্ষেপ যথাসম্ভব কম করার চেষ্টা করে, ক্রমেই ঘন ঘন পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া মৌমাছিদের গুঞ্জন শুনতে শুনতে তিনি একটা কুটির পৌঁছলেন। ঢোকবার মুখেই একটা মৌমাছি তাঁর দাড়িতে জড়িয়ে গিয়ে রেগে গোঁ-গোঁ করে উঠল, কিন্তু সাবধানে লেভিন তাকে মুক্ত করলেন। ছায়াচ্ছন্ন অলিন্দের দেয়ালে টাঙানো জাল নিয়ে পরলেন, হাত ঢোকালেন পকেটে, তারপর ঢুকলেন বেড়া দেওয়া মক্ষিকালয়ে, সেখানে ঘাস-কাটা একটা জায়গায় সারি সারি মৌচাক, প্রত্যেকটি খুঁটির সাথে বাকলের ফালি দিয়ে বাঁধা, প্রত্যেকটি চাকই তাঁর পরিচিত, প্রত্যেকটিরই নিজ নিজ ইতিহাস আছে; আছে পুরানো মৌচাক, আবার ছিটে বেড়ার গা বেয়ে এই বছরেই বসানো নতুনগুলো। চাকের মুখগুলোয় চোখ ধাঁধিয়ে একই জায়গায় পাক দিয়ে গিজগিজ করছে পুরুষ আর অন্যান্য মৌমাছিরা এবং সেখান থেকে কর্মী মাছিরা বরাবর একই দিকে উড়ে যাচ্ছে ফুটন্ত লিন্ডেন গাছের লক্ষ্যে—আহরণের জন্য আবার চাকে ফিরে আসছে আহরণ নিয়ে।

অবিরাম শোনা যাচ্ছিল নানা ধ্বনি, কখনো কাজে ব্যস্ত দ্রুত উড্ডীয়মান কর্মী মাছির গুঞ্জন, কখনো পুরুষ মাছির ভেঁপু, কখনো শত্রুর কাছ থেকে আহরণ রক্ষায় প্রস্তুত, হুল ফুটাতে উদ্যত সান্ত্রী মাছিদের হুঁশিয়ারি। বেড়ার ওপাশে বৃদ্ধ মৌমাছিপালক একটা গোঁজ চাঁচছিল। লেভিনকে সে দেখতে পায়নি। লেভিন তাকে না ডেকে দাঁড়িয়ে রইলেন মৌচাকের মাঝখানে।

যে বাস্তবতা ইতিমধ্যেই তাঁর মেজাজকে দমিয়ে দিতে পেরেছে, তা থেকে সংবিৎ ফিরে পাওয়ার জন্য একলা হবার সুযোগ পেয়ে খুশি হয়েছিলেন তিনি।

তাঁর মনে পড়ল যে, ইভানের ওপর তিনি চটে উঠেছিলেন, বড় ভাইয়ের প্রতি শীতলতা দেখিয়েছেন, কাতাভাসোভের সাথে কথা বলেছেন বাতুলের মত।

তিনি ভাবলেন, ‘মানসিক ঐ অবস্থাটা কি ছিল সত্যিই ক্ষণিক, কোন চিহ্ন না রেখে তা মিলিয়ে যাবে?’

কিন্তু সেই মুহূর্তে নিজের মনোভাব ফিরল তাঁর মধ্যে, সানন্দে তিনি অনুভব করলেন তাঁর ভেতরে নতুন ও গুরুতর কিছু-একটা ঘটেছে। প্রাণের যে প্রশান্তি তিনি পেয়েছেন, বাস্তবতা শুধু সাময়িকভাবে সেটাকে আচ্ছন্ন করতে পারে, কিন্তু গোটাগুটি সেটা রয়ে গেছে তাঁর মধ্যে।

ঠিক যেমন মৌমাছিগুলো তাঁকে ঘিরে উড়ে উড়ে ভয় দেখিয়ে আর আনমনা করে পরিপূর্ণ দৈহিক প্রশান্তি থেকে তাঁকে বঞ্চিত করতে চাইছিল, কুঁকড়ে যেতে, ওদের পরিহার করতে তাঁকে বাধ্য করছিল, ঠিক তেমনি গাড়িতে ওঠার সাথে সাথে সাংসারিক চিন্তা তাঁকে আচ্ছন্ন করে তাঁর আত্মিক প্রশান্তি হরণ করে; কিন্তু যতক্ষণ তিনি ওদের মধ্যে ছিলেন, ততক্ষণই টিকে থেকেছে সেটা। মৌমাছিগুলো সত্ত্বেও দৈহিক শক্তি তাঁর মধ্যে যেমন অক্ষুণ্ণ, তাঁর তেমনি ছিল সদ্য পাওয়া আত্মিক শক্তিও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *