আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৪.২০

বিশ

কারেনিন হল ঘরে বেত্‌সিকে অভিবাদন জানিয়ে স্ত্রীর কাছে ফিরে এলেন। আন্না শুয়ে ছিলেন, কিন্তু তাঁর পদশব্দ শুনে তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন আগের ভঙ্গিতে, ভীত চোখে চাইলেন তাঁর দিকে। দেখতে পেলেন যে আন্না কাঁদছিলেন ‘আমার ওপর আস্থার জন্যে আমি তোমার প্রতি খুবই কৃতজ্ঞা’, গোবেচারার মত তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন রুশীতে যা বেত্‌সির সামনে বলেছিলেন ফরাসিতে, বসলেন তাঁর কাছে। যখন তিনি রুশী ভাসায় বলেন এবং তাঁকে সম্বোধন করেন ‘তুমি’ বলে, তখন এই ‘তুমি’টা আন্নাকে অসহ্য জ্বালাতে। ‘আর তোমার সিদ্ধান্তের জন্যেও খুবই কৃতজ্ঞা। আমিও মনে করি, ও যখন চলেই যাচ্ছে, তখন কাউন্ট ভ্রন্‌স্কির এখানে আসার প্রয়োজন নেই কোন-ও। তবে…’

‘আমি যখন বলেছি, তখন কি দরকার তা আবার আওড়ে?’ এমন বিরক্তিতে আন্না তাঁকে থামিয়ে দিলেন যা তিনি দমন করে উঠতে পারেননি। ‘প্রয়োজন নেই কোন-ও’, আন্না ভাবলেন, ‘যে নারীকে সে ভালোবাসে, যার জন্যে সে মরণ চেয়েছিল, আত্মহত্যা করতে, যে নারী তাকে ছাড়া বাঁচতে পারে না, তার কাছে থেকে বিদায় নেবার কোনও- ও প্রয়োজন নেই!’ ঠোঁট চেপে আন্না তাঁর জ্বলজ্বলে চোখে তাকালেন তাঁর ফুলো ফুলো শিরায় ভরা হাতের দিকে, যা তিনি এক হাত দিয়ে অন্যটাকে ঘষছিলেন।

‘ও নিয়ে আর কোন কথা নয়’, আন্না যোগ করলেন খানিকটা শান্ত হয়ে।

‘প্রশ্নটায় সিদ্ধান্তের ভার আমি তোমাকে দিয়েছিলাম আর দেখে খুবই আনন্দ হচ্ছে যে…’ কারেনিন বলতে শুরু করেছিলেন।

‘আমার ইচ্ছা আপনার সাথে মিলে গেছে’, কথাটাকে দ্রুত শেষ করে দিলেন আন্না এই বিরক্তিতে যে উনি ধীরে ধীরে তাই বলছেন যা তিনি আগেই জানেন কি বললেন।

‘হ্যাঁ’, সমর্থন করলেন তিনি, ‘আর অতি কঠিন পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলানো প্রিন্সেস ভেস্কায়ার পক্ষে একেবারেই অনুচিত। বিশেষ করে উনি…’

‘লোকে ওঁর সম্পর্কে যা বলে থাকে, তা কিছুই বিশ্বাস করি না আমি’, ঝট করে বললেন আন্না, ‘আমি জানি যে উনি আমাকে সত্যি করেই ভালোবাসেন।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন কারেনিন। উদ্বিগ্ন হয়ে আন্না নাড়াচাড়া করতে লাগলেন তাঁর ড্রেসিং গাউনের গুছি, তাঁর দিকে চাইছিলেন শারীরিক বিতৃষ্ণার একটা যন্ত্রণাকর অনুভূতি নিয়ে, যার জন্য নিজেকে তিনি তিরস্কৃত করলেও সেটা দমন করতে তিনি অক্ষম। এখন তাঁর শুধু একটাই কামনা-তাঁর বিরক্তিকর উপস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়া।

‘আমি ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়েছি’, বললেন কারেনিন।

‘আমি তো সুস্থ; ডাক্তার আমার কি দরকার?’

‘না, তোমার জন্যে নয়, বাচ্চাটা কাঁদছে। শুনছি স্তন্যদাত্রীর দুধ নাকি কম।’

‘যখন এ নিয়ে মিনতি করেছিলাম, তখন কেন খাওয়াতে দাওনি আমাকে? যাক-গে’ (কারেনিন বুঝলেন এই ‘যাক-গে’ কথাটার মানে কি) ‘বাচ্চাটাকে মারা হচ্ছে’ ঘণ্টি দিয়ে আন্না শিশুটিকে আনতে বললেন। ‘আমি ওকে খাওয়াতে চেয়েছিলাম, দেওয়া হল না। এখন দোষী বলে ধরা ধরছি না। … ‘

‘না, ধরছেন! সৃষ্টিকর্তা, কেন মরলাম না!’ ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি, ‘মাপ করো আমাকে, স্নায়ু আমার বিকল, অন্যায় করেছি’, সংযত হয়ে বললেন তিনি, ‘কিন্তু চলে যাও… ‘

‘না, এভাবে চলতে পারে না’, স্ত্রীর কাছ থেকে চলে যেতে যেতে ভাবলেন কারেনিন।

সমাজের চোখে নিজের অবস্থার অসম্ভাবিতা, তাঁর প্রতি স্ত্রীর ঘৃণা এবং সাধারণভাবে যে রূঢ়, রহস্যময় শক্তি তাঁর আত্মিক প্রবণতা অগ্রাহ্য করে তাঁর জীবন চালাচ্ছে, তাঁর কাছ থেকে দাবি করছে আজ্ঞাপালন, স্ত্রীর সাথে তাঁর সম্পর্কের পরিবর্তন, সেটা আজকের মত এত স্পষ্টভাবে কখনো প্রতিভাত হয়নি তাঁর কাছে। তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন যে গোটা জগৎ এবং স্ত্রী তাঁর কাছ থেকে কি যেন দাবি করছে, কিন্তু ঠিক কি সেটা বুঝতে পারছিলেন না তিনি। টের পাচ্ছিলেন যে এর ফলে প্রাণে তাঁর এমন একটা আক্রোশ জেগে উঠছে যা চুরমার করে দিচ্ছে তাঁর প্রশান্তি, তাঁর সব কিছু, মহত্ত্ব। তিনি ভেবেছিলেন ভ্রন্‌স্কির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ভালো হবে আন্নার পক্ষে, কিন্তু সবাই যদি সেটা অসম্ভব বলে গণ্য করে, তাহলে তিন সে সম্পর্কে নতুন করে অনুমোদনে রাজি, শুধু সন্তানদের কলঙ্কিত না করতে, তাদের না হারাতে, নিজের অবস্থা না বদরাতে পারলেই হল। এটা যতই বিছ্‌ছিরি হোক, যে বিচ্ছেদের আন্না একটা নিরুপায় অবস্থায় পড়বে এবং তিনি যা ভালোবাসেন তা সব কিছু হারাবেন, তার চেয়ে এটা যতই হোক ভালো। কিন্তু নিজেকে দুর্বল বোধ করছিলেন তিনি; আগে থেকেই তাঁর জানা ছিল যে সবাই তাঁর বিরুদ্ধে, এখন সেটা তাঁর কাছে স্বাভাবিক ও উত্তম মনে হচ্ছে, কেউ সেটা তাঁকে করতে দেবে না, তাঁকে বাধ্য করবে খারাপটা করতে যেটা তাদের মনে হচ্ছে কর্তব্য।

একুশ

বেত্‌সি হল ঘর থেকে বেরোতে-না-বেরোতেই দরজায় অব্‌লোন্‌স্কির সাথে দেখা। তিনি এলিসেয়েভ দোকান থেকে তাজা শামুক কিনে ফিরছেন। ‘ওহো, প্রিন্সেস! কি আনন্দ হল দেখা পেয়ে!’ তিনি বললেন, ‘আমি দিয়েছিলাম আপনাদের ওখানে।’

‘শুধু এক মিনিটের জন্যে’, দস্তানা পরতে পরতে হেসে বেত্‌সি বললেন, ‘কেননা আমি চলে যাচ্ছি।’

‘দস্তানা পরাটা রাখুন প্রিন্সেস, দিন আপনার করচুম্বন করতে। করচুম্বনের মত পুরানো আদব-কায়দার প্রত্যাবর্তনে আমি যতটা কৃতার্থ তা আর কিছুতে নয়।’ তিনি বেত্‌সির করচুম্বন করলেন, ‘কখন দেখা হবে?’

‘আপনি তার যোগ্য নন’, হেসে বললেন বেত্‌সি।

‘উঁহু, খুবই যোগ্য। কেননা আমি খুব গুরুত্বমনা লোক হয়ে উঠেছি। কেননা নিজের ব্যাপার-স্যাপার আমি গুছিয়ে আনছি শুধু তাই নয়, অন্যের পারিবারিক ব্যাপারও’, বললেন তিনি একটা অর্থপূর্ণ মুখভাব করে।

‘আহ্, খুবই আনন্দের কথা!’ উনি যে আন্নার কথা বলছেন সেটা তৎক্ষণাৎ অনুমান করে বেত্‌সি বললেন। হল ঘরে ফিরে এসে তাঁরা দাঁড়ালেন একটা কোণে। অর্থপূর্ণ ফিসফিসানিতে বেত্‌সি বললেন, ‘উনি ওকে মারছেন, মারছেন। এ ভাবা যয় না।…’

‘আমার খুবই ভালো লাগছে যে আপনিও তাই ভাবেন’, মুখে একটা গুরুতর মর্মবেদনা নিয়ে মাথা নেড়ে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, ‘এই জন্যেই আমি এলাম পিটার্সবুর্গে।

বেত্‌সি বললেন, ‘সারা শহর এই নিয়ে বলাবলি করছে। এ অবস্থা কম্পনীয় নয়। আন্না কেবলই চেপে থাকছে। উনি বোঝেন না যে নিজের হৃদয়াবেগ নিয়ে যারা তামাশা করতে পারে না, আন্না তাদেরই একজন। দুয়ের একটা : হয় উনি ওকে সরিয়ে নিয়ে যান, দৃঢ়তা দেখান, নয় বিবাহবিচ্ছেদ। না হলে এটা তাকে গুমরে মারছে।’

‘ঠিক, ঠিক…’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, ‘সেজন্যেই আমি এসেছি। মানে ঠিক সে জন্যেই নয়…আমাকে দরবারের ওমরাহ করা হয়েছে, কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় তো। কিন্তু বড় কথা, এ ব্যাপারটার বিধি-ব্যবস্থা করতে হয়।’

‘তা সৃষ্টিকর্তা আপনাকে সাহায্য করুন’, বললেন বেত্‌সি।

প্রিন্সেস বেত্‌সিকে অলিন্দ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে, দস্তানার ওপরে যেখানে স্পন্দিত হচ্ছিল নাড়ি সেখানে চুমু খেয়ে আর এমন একটা অশোভন মিছে কথা বলে যাতে বেত্‌সি ভেবে পাচ্ছিলেন না রাগ করবেন নাকি হাসবে, অবলোন্স্কি গেলেন বোনের কাছে। দেখলেন তাঁর চোখে পানি।

যে ফুর্তির মেজাজ নিয়ে অব্‌লোন্‌স্কি এসেছিলেন, তা সত্ত্বেও তখনই তিনি দরদী অনুবেদনার মত কাব্যিক একটা সুরে পৌঁছে গেলেন যা আন্নার মনোভাবের সাথে মেলে। জিজ্ঞেস করলেন কেমন সে আছে, কেমন কেটেছে সকালটা।

‘খুব, খুবই খারাপ। সারা দিনটা, সকালটাও, যত দিন গেছে, যা আসবে, সবই’, বললেন তিনি।

‘আমার মনে হচ্ছে তুমি বিষাদে গা ভাসাচ্ছ, গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা দরকার। জীবনকে দেখা দরকার সোজাসুজি, সেটা কঠিন, কিন্তু…’

আমি শুনেছি মেয়েরা নাকি লোককে ভালোবাসা এমন কি তাদের পাপের জন্যেও’, হঠাৎ শুরু করলেন আন্না, ‘কিন্তু আমি তাকে দেখতে পারি না তার ধর্মাত্মাতার জন্যে। আমি থাকতে পারি না ওর সাথে। বুঝে দ্যাখো, ওর চেহারাটাই আমার একটা শারীরিক প্রতিক্রিয়া ঘটায়। পাগল করে দেয় আমাকে, ওর সাথে থাকতে আমি পারি না, পারি না। কি আমি করব? আমি ছিলাম অসুখী, ভাবতাম এর চেয়ে বেশি অসুখী হওয়া অসম্ভব, কিন্তু যে ভয়াবহ অবস্থায় আমি নিজেকে এখন দেখছি, সেটা কল্পনা করিনি। বিশ্বাস করবে কি, সহৃদয় চমৎকার মানুষ, আমি ওর কড়ে আঙুলেরও যোগ্য নেই তা জেনেও, আমি তাকে সইতে পারি না। তার মহানুভবতার জন্যেই আমি ঘৃণা করি তাকে আমার কিছুই বাকি নেই একটা জিনিস ছাড়া…’

তিনি বলতে চেয়েছিলেন মরণ, কিন্তু অব্‌লোন্‌স্কি সেটা বলতে দিলেন না। বললেন, ‘তুমি রুগ্ন, উত্ত্যক্ত। বিশ্বাস কর, তুমি সব কিছু ভয়ংকর বাড়িয়ে বলছ। কিছুই ভয়াবহ নেই এ ব্যাপারে।’

অব্‌লোন্‌স্কি হাসলেন। তাঁর জায়গায় এ রকম নৈরাশ্যজনক ব্যাপারে জড়িত অন্য কেউ হলে হয়ত হাসতে পারত না (হাসিটা মনে হতে পারত নিষ্ঠুর), কিন্তু তাঁর হাসিটায় ছিল এত সহৃদয়তা, প্রায় নারীসুলভ কোমলতা যে আন্না আহত বোধ করলেন না, বরং নরম হলেন, শান্ত বোধ করলেন। তাঁর মৃদ্যু সান্ত্বনাদায়ক কথা আর হাসিতে বাদাম তেলের চেয়েও উকপার হল। অচিরেই আন্না অনুভব করলেন সেটা। বললেন, ‘না স্তিভা, আমার সর্বনাশ হয়েছে, সর্বনাশ হয়েছে! সর্বনাশের চেয়েও বেশি। এখনো সর্বনাশ হয়নি, বলতে পারছি না যে সব শেষ, বরং টের পাচ্ছি যে শেষ হয়নি, আমি যেন টানটান এক তন্ত্রী, যা শিগগিরই ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু এখনো শেষ হয়নি, আর শেষটা ভয়ংকর…’

‘ও কিছু নয়, তন্ত্রীটাকে আস্তে আস্তে আলগা করে দিলেই হল, এমন কোন অবস্থা নেই যা থেকে উদ্ধারের পথ মিলবে না।’

‘আমি অনেক ভেবেছি। শুধু একটা…’

তাঁর ত্রস্ত দৃষ্টিপাত থেকে তিনি আবার বুঝতে পারলেন যে আন্নার মতে এই একটা উপায় হল মৃত্যু। সেটা তিনি তাঁকে বলতে দিলেন না। বললেন, ‘মোটেই না। শোন বলি, আমি যেভাবে দেখছি, তুমি তোমার অবস্থাটা দেখতে পারছ না সেভাবে। আমার খোলাখুলি মত তোমাকে বলি, শোনা’, আবার তিনি সন্তর্পণে হাসলেন তাঁর মোলায়েম হাসি, ‘গোড়া থেকে শুরু করি। তুমি যে লোকটাকে বিয়ে করেছ, সে তোমার চেয়ে বিশ বছরের বড়। বিয়ে করেছে না ভালোবেসে, অথবা ভালোবাসার স্বাদ না জেনে। ধর যাক, এটা ভুল হয়েছিল।’

‘সাংঘাতিক ভুল!’ বললেন আন্না।

‘কিন্তু আবার বলি, এটা একটা বাস্তব ঘটনা। তারপর, বলা যাক, নিজের স্বামীকে নয় অন্য লোককে ভালোবাসার দুর্ভাগ্য হয়েছে তোমার। এটা দুর্ভাগ্য; কিন্তু একটা ঘটে যাওয়া ব্যাপার। তোমার স্বামী এটা মেনে নিযে ক্ষমা করেছে। প্রতিটি বাক্যের পর আন্না আপিত্ত করবে এই ভেবে তিনি থামছিলেন, কিন্তু আন্না কিছুই বললেন না, ‘এই হল ব্যাপার। এখন প্রশ্নটা এই : স্বামীর সাথে তুমি থাকতে পারবে কি? সেটা কি তুমি চাও? ও কি তা চায়?’

‘কিছুই কিছুই জানি না আমি।’

‘কিন্তু তুমি নিজেই তো বললে যে ওকে সইতে পারো না।’

‘সে কথা আমি বলিনি। আমি তা অস্বীকার করছি। কিছুই আমি জানি না, কিছুই বুঝছি না।’

‘তা বেশ, তবে শোনো…’

‘তুমি বুঝতে পারছ না। আমি টের পাচ্ছি যে মুখ থুবড়ে পড়ছি কোন-এক অতল গহ্বরে, কিন্তু নিজেকে বাঁচানো আমার উচিত নয়। তা আমি পারি না।’

‘ভাবনা নেই, তোশক বিছিয়ে দিয়ে আমরা তোমাকে ধরে ফেলব। আমি বুঝতে পারছি তোমাকে, বুঝতে পারছি যে তোমার যেটা ইচ্ছে, যেটা অনুভূতি সেটা বলার মত জোর তুমি পাচ্ছ না।’

‘কিছুই কিছুই আমি চাই না…শুধু সব শেষ হয়ে গেলে বাঁচি।’

‘কিন্তু সেটা তো স্বামী দেখতে পাচ্ছে এবং জানে। এতে তোমার চেয়ে তার কষ্ট কম হচ্ছে বলে ভাবো কি? তুমিও কষ্ট পাচ্ছ, সেও কষ্ট পাচ্ছে, এ থেকে কি দাঁড়াতে পারে? অথচ বিবাহবিচ্ছেদ সব জট খুলে দেবে’, তাঁর এই মুখ্য কথাটা বলে পেলতে কম বেগ পেতে হয়নি অব্‌লোন্‌স্কিকে, অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তিনি চাইলেন আন্নার দিকে।

কোন জবাব দিলেন না আন্না, শুধু নেতিবাচক ভঙ্গিতে নাড়ালেন চুল-ছাঁটা মাথা। কিন্তু আন্নার মুখে হঠাৎ অতীত লাবণ্যের উদ্ভাস থেকে তিনি বুঝতে পারলেন যে আন্না এটা চাইছেন না কেবল এজন্য যে এটা একটা সম্ভাবনাহীন সৌভাগ্য বলে মনে হচ্ছে তাঁও।

‘ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে তোমাদের জন্যে। ব্যাপারটা ঠিকঠাক করতে পারলে কি সুখীই না হতাম!’ অব্‌লোন্‌স্কি বললেন আরো সাহস নিয়ে হেসে, ‘কিছু বলো না, কিছু না! শুধু আমি যেভাবে অনুভব করছি সেভাবে বলতে যদি আমাকে দিতেন সৃষ্টিকর্তা। আমি যাচ্ছি ওর কাছে।’

আন্না চিন্তামগ্ন উজ্জ্বল চোখে তাঁর দিকে তাকালেন, তবে কিছু বললেন না।

বাইশ

অব্‌লোন্‌স্কি তেমনি একটা ভাব নিয়ে কারেনিনের স্টাডিতে গেলেন—নিজের দপ্তরে কর্তার চেয়ারে বসে যেমন ভারিক্কী ভাব হত। তিনি পিঠের পেছনে হাত দিয়ে ঘরে পায়চারি করছিলেন, তাঁর স্ত্রীর সাথে অব্‌লোন্‌স্কি যা নিয়ে কথা বলেছেন, তিনি সেই বিষয়েই ভাবছিলেন।

অবলোন্‌স্কি হঠাৎ তাঁর কাছে অনভ্যস্ত একটা বিব্রত ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যাঘাত করলাম না তো?’ এই বিব্রত ভাবটা গোপন করার জন্য নতুন ধরনের ঢাকনা দেওয়া সদ্যক্রীত সিগারেট কেসের চামড়া ওঁকে তিনি একটা সিগারেট বের করলেন।

কারেনিন অনিচ্ছাসহকারে জবাব দিলেন, ‘না। তোমার দরকার আছে কিছুর

অব্‌লোন্‌স্কি নিজের অনভ্যস্ত সঙ্কোচে নিজেই অবাক হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি চাইছিলাম… আমার দরকার কিছু… হ্যাঁ, আমার কথা বলা দরকার।’

অনুভূতিটা এমন অপ্রত্যাশিত আর অদ্ভূত যে তাঁর বিশ্বাস হল না এটা তাঁর বিবেকের কণ্ঠস্বর, সেটা তাঁকে বলছে যে তিনি যা স্থির করেছেন সেটা খারাপ। যে ভীরুতা তাঁকে পেয়ে বসেছিলেন, নিজের ওপর জোর খাটিয়ে সেটার সাথে লড়লেন তিনি।

তিনি লাল হয়ে কারেনিনকে বললেন, ‘আশা করি তুমি বিশ্বাস কর যে, বোনকে আমি ভালোবাসি। আর তোমার প্রতি আমার সত্যিকারের আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা আছে।’

কারেনিন কোন উত্তর না দিয়ে পায়চারি থামালেন। কিন্তু তাঁর মুখে আত্মবলি মেনে নেবার একটা ভাব অভিভূত করল অব্‌লোন্‌স্কিকে।

তিনি তখনো তাঁর অনভ্যস্ত সংকোচের সাথে লড়তে লড়তে বললেন, ‘আমি চেয়েছিলাম, বোন সম্পর্কে, তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলব ভাবছিলাম।’

কারেনিন একটা বিষণ্ণ বাঁকা হাসি হাসলেন। তাকালেন শ্যালকের দিকে। কোন কথা না বলে তাঁকে টেবিলের কাছে শুরু করা একটা চিঠি টেনে নিয়ে দিলেন।

‘আমিও সব সময় সেই কথাই ভাবছি। এটা আমি লিখতে শুরু করেছিলাম এই কথা ভেবে যে বলার যা, সেটা লিখে বলাই ভালো, আমার উপস্থিতি ওকে উত্ত্যক্ত করে’, এই বলে তিনি দিলেন চিঠিটা।

চিঠিটা নিয়ে তাঁর প্রতি নিবদ্ধ নিষ্প্রভ চোখের দিকে হতবুদ্ধি বিস্ময়ে তাকিয়ে পড়তে শুরু করলেন অব্‌লোন্‌স্কি। ‘আমি দেখতে পাচ্ছি যে আমার উপস্থিতি আপনার কাছে পীড়াদায়ক। সেটা বিশ্বাস করা আমার পক্ষে যত কষ্টকরই হোক, ব্যাপারটা তা-ই, অন্য কিছু হতে পারবে না। আপনাকে কোন দোষ দিচ্ছি না আমি, সৃষ্টিকর্তা সাক্ষী যে আপনাকে রুগ্ন দেখে আমি সর্বান্তঃকরণে স্থির করেছিলাম আমাদের মধ্যে যা ঘটেছিল তা ভুলে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করব। যা আমি করেছি তার জন্য আক্ষেপ আমি করছি না, করবও না কখনও; শুধু একটাই আমার কামনা ছিল- আপনার কল্যাণ, আপনার অন্তরের কল্যাণ, এখন দেখছি সেটা সম্ভব হয়নি। আপনি নিজের বলুন কিসে আপনার সত্যিকারের সুখ, চিত্তের প্রশান্তি লাভ হতে পারে। আমি আপনার অভিলাষ, আপনার ন্যায়বোধের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করছি।’

অব্‌লোন্‌স্কি চিঠিটা ফেরত দিয়ে একই রকম হতবুদ্ধিতায় তাকিয়ে রইলেন জাতামার দিকে, ভেবে পাচ্ছিলেন কি বলবেন। এই নীরবতা উভয়ের পক্ষেই এত অস্বস্তিকর হয়েছিল যে কারেনিনের দিক থেকে চোখ না সরিয়ে অব্‌লোন্‌স্কি যখন চুপ করে ছিলেন, তখন রুগ্নের মত ঠোঁট তাঁর কাঁপছিল।

কারেনিন মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘ওকে আমি এটাই বলতে চেয়েছিলাম।’

‘হুঁ. হুঁ…’, কান্নায় গলার মধ্যে একটা দলা পাকিয়ে ওঠায় কোন উত্তর দিতে পারলেন না অব্‌লোন্‌স্কি। অবশেষে বললেন, ‘হ্যাঁ, বুঝতে পারছি আপনাকে।’

কারেনিন বললেন, ‘আমি জানতে চাই, সে কি চায়!

‘আমার আংশকা, নিজের অবস্থাটা সে নিজেই বুঝতে পারছে না। বিচারক সে নয়’, সুস্থির হয়ে বললেন অলোক্কি, ‘অবদমিত সে, তোমার মহানুভবতায় সে অবদমিতই। এ চিঠি যদি সে পড়ে, কিছু বলার শক্তি থাকবে না তার, শুধু আরো নীচে মাথা নত করবে।’

‘তাহলে কি করা যায় এ অবস্থায়? কিভাবে বুঝিয়ে বলি…কি করে জানা যায় তার ইচ্ছে?’

‘আমার অভিমত জানতে যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে বলব যে আমি মনে করি, এ অবস্থাটা ঢুকিয়ে দেবার জন্যে যা যা ব্যবস্থা প্রয়োজন বলে তুমি মনে কর, সেটা সোজাসুজি বলা নির্ভর করছে তোমার ওপরেই।’

কারেনিন তাঁর কথায় বাধা দিয়ে বললেন, ‘তার মানে তোমার ধারণা যে অবস্থাটা ঢুকিয়ে দেয়া দরকার। কিন্তু কিভাবে?’ চোখের সামনে হাতের একটা অনভ্যস্ত ভঙ্গি করে তিনি যোগ করলেন, ‘উদ্ধারের কোন উপায় দেখতে পাচ্ছি না।’

অব্‌লোন্‌স্কি উঠে দাঁড়িয়ে চাঙ্গা হয়ে বললেন, ‘যে কোন অবস্থা থেকেই উদ্ধারের উপায় থাকে। এক সময় তুমি সব কিছু চুলোয় দিতে চেয়েছিলে…এখন যদি তোমার এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, পরস্পরের সুখ সম্ভব নয়…

‘নানাভাবেই সুখ কথাটা বোঝা চলে। কিন্তু ধরা যাক আমি সব কিছুতে রাজী, নিজে কিছু চাই না। সেক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা থেকে উদ্ধারের উপায়টা কি হবে?’

‘আমার মত যদি জানতে চাও’, অব্‌লোন্‌স্কি বললেন সেই ভিজিয়ে দেওয়া মোলায়েম হাসি নিয়ে, যে হাসিতে কথা বলেছিলেন আন্নার সাথে। সহৃদয় হাসিটা এতই প্রত্যয়জনক যে নিজের দুর্বলতা অনুভব করে কারেনিন অজ্ঞাতসারে তাতে আত্মসমর্পণ করলেন, অব্‌লোন্‌স্কি যা বলবেন তাতে বিশ্বাস করতে তৈরি হয়ে গেলেন তিনি। ‘এটা সে বলবে না কখনো। কিন্তু শুধু একটা জিনিসই সম্ভব, একটা জিনিসই সে চাইতে পারে’, বলে গেলেন অব্‌লোন্‌স্কি, ‘এটা হল সম্পর্ক এবং তার সাথে জড়িত সমস্ত স্মৃতির অবসান। আমার মতে, তোমাদের অবস্থায় নতুন সম্পর্কের বোঝাবুঝি হওয়া দরকার। শুধু উভয় পক্ষের স্বাধীনতায় সে সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব।

কারেনিন বিতৃষ্ণায় বাধা দিলেন, ‘বিবাহবিচ্ছেদ!’

অব্‌লোন্‌স্কি পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘যে স্বামী-স্ত্রী তোমাদের মত অবস্থায় পড়েছে, তাদের পক্ষে সব দিক দিয়ে এটাই সর্বোত্তম উপায়। কি করা যাবে যদি স্বামী-স্ত্রী দেখে যে একত্রে জীবনযাপন সম্ভব নয়? সেটা তো ঘটতে পারে সব সময়ই।’ কারেনিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজলেন। অব্‌লোন্‌স্কি সংকোচ ক্রমেই কাটিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, ‘এক্ষেত্রে শুধু একটা কথা ভাবার আছে, স্বামী-স্ত্রীর কেউ একজন অন্য কাউকে বিবাহ করতে চায় কিনা। যদি না চায়, তাহলে ব্যাপারটা খুবই সহজ।’

কারেনিন ব্যাকুলতায় মুখ কুঁচকে নিজের মনে কি বিড়বিড় করলেন, কোন উত্তর দিলেন না। অবলোন্‌স্কির কাছে যেটা খুবই সহজ মনে হয়েছে, কারেনিন তা নিয়ে হাজার হাজার বার ভেবেছেন। আর এটা তাঁর মনে হয়েছিল শুধু খুব সহজ নয়, একেবারে অসম্ভব। বিবাহবিচ্ছেদের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো এখন তাঁর জানা থাকার সেটা তাঁর কাছে অসম্ভব মনে হচ্ছিল। কারণ নিজের আত্মমর্যাদা আর ধর্মবোধে ব্যভিচারের মথ্যিা অভিযোগ তিনি নিজের কাঁধে নিতে পারেন না, আর যে স্ত্রীকে তিনি ক্ষমা করেছেন, ভালোবাসেন, তাঁকে লোকসমক্ষে অনাবৃত করে দেখানো, কলঙ্কিত করা তো আরো কম অনুমোদনীয়। আরো অন্যান্য গুরুতর কারণেও বিবাহবিচ্ছেদ অসম্ভব ঠেকেছিল।

যদি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে তাহলে ছেলেটার কি হবে? তাকে মায়ের কাছে রেখে দেওয়া চলে না। বিয়ে-ভাঙা মায়ের থাকবে নিজস্ব অবৈধ সংসার, সেখানে ছেলের অবস্থা এবং লালন-পালন নিশ্চয়ই হবে খারাপ। তাকে কি নিজের কাছে রাখবেন? উনি জানতেন যে সেটা হবে তাঁর পক্ষ থেকে একটা প্রতিহিংসা, এটা তিনি চাইছিলেন না। তাছাড়া বিবাহবিচ্ছেদ কারেনিনের কাছে সবচেয়ে অসম্ভব মনে হচ্ছিল। কারণ এতে সায় দিয়ে তিনি আন্নাকে মারবেন। মস্কোয় দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার এই কথাটা তাঁর মনে বিঁধেছিল যে, বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি শুধু নিজের কথাই ভাবছেন। ভাবছেন না যে, এতে করে আন্নাকে তিনি ঠেলে দিচ্ছেন অমোঘ ধ্বংসে। নিজের ক্ষমা, সন্তানদের প্রতি তাঁর স্নেহের সাথে এই কথাগুলো মিলিয়ে এখন তিনি নিজের মত তার একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছেন। বিবাহবিচ্ছেদের রাজী হাওয়া, আন্নাকে মুক্তি দেওয়ার অর্থ, তাঁর ধারণায়, জীবনের শেষ অবলম্বন, যে সন্তানদের তিনি ভালোবাসেন তাদের হারানো, আর সাধুতার পথে আসার শেষ আশ্রয়স্থল কেড়ে নিয়ে আন্নাকে ধ্বংসে পাঠানো। আন্না যদি হন বিবাহবিচ্ছিন্ন নারী, তাহলে উনি জানতেন যে তিনি মিলিত হবেন ভ্রন্‌স্কির সাথে আর এ মিলন হবে অবৈধ, পাতক, কেননা গির্জার অনুশাসনে স্বামী জীবিত থাকতে দ্বিতীয় বিবহা হতে পারে না। ‘আন্না মিরিত হবে ওর সাথে আর বছর দুই বাদে হয় সে-ই তাকে ত্যাগ করবে, নয় আন্না নিজেই নতুন একটা সম্পর্ক পাতাবে, ভেবেছিলেন তিনি, ‘আর অবৈধ বিবাহবিচ্ছেদের রাজী হয়ে আমি তার ধ্বংসের জন্যে অপরাধী হব।’ তিনি শতেক বার এ নিয়ে ভেবেছেন এবং একেবারে নিশ্চিত হয়েছেন যে, শ্যালক যা বলেছেন বিবাহবিচ্ছেদটা মোটেই তেমন সহজ শুধু নয়, বরং একেবারে অসম্ভব। অব্‌লোন্‌স্কির একটা কথায়ও তাঁর বিশ্বাস ছিল না, সব কথায়ই তাঁর আপত্তি ছিল হাজারখানেক, কিন্তু কথাগুলো তিনি শুনলেন এটা অনুভব করে যে পরাক্রান্ত রূঢ় যে শক্তিটা তাঁর জীবনকে চালাচ্ছে, যার ইচ্ছা পালন করতে হতে হবে, তাঁকে, তাঁর কথায় সেই শক্তিই প্রতিফলিত হচ্ছে।

‘এখন শুধু প্রশ্ন হল : কিভাবে, কি শর্তে তুমি বিবাহবিচ্ছেদে সম্মত হবে। কিছুই সে চায় না, তোমাকে অনুরোধ করার সাহসও তার নেই। তোমার মহানুভবতার ওপর সবই সে ছেড়ে দিয়েছে।’

‘হায় আল্লাহ্! কিসের জন্যে?’ বিবাহবিচ্ছেদের যে আইন-কানুনে স্বামী দোষটা নিজের ঘাড়ে নেয় তা স্মরণ করে এবং ভ্রন্‌স্কি যেভাবে মুখ ঢেকেছিলেন, লজ্জায় সেই ভঙ্গিতে হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে মনে মনে ককিয়ে উঠলেন কারেনিন।

‘আমি বুঝতে পারছি, তুমি খুবই উতলা হয়ে আছ। কিন্তু যদি ভেবে দ্যাখো…’

কারেনিন মনে মনে ভাবলেন, ‘ডান গালে চপেটাঘাত খেলে বাঁ গাল পেতে দিয়ো; যে তোমার কাফতান দিয়েছে, তাকে কামিজটাও দিয়ে দাও।’

তাঁর খেঁকী গলায় উনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমি নিজেই কলংক নেব। ছেলেকে পর্যন্ত দিয়ে দেব, কিন্তু…বাদ দিলে হয় না এসব? তবে তুমি যা চাও, কর…’

তিনি ঘুরে গিয়ে জানালার কাছে একটা চেয়ারে বসলেন। যাতে শ্যালক তাঁর মুখ না দেখতে পান। তাঁর তিক্ত লাগছিল, তিনি লজ্জা পাচ্ছিলেন। কিন্তু এই তিক্ততা আর লজ্জার সাথে সাথে নিজের নতির মহত্ত্বে একটা আনন্দ আর কোমলতাও বোধ করছিলেন তিনি 1

বিচলিত হয়েছিলেন অবলোনস্কি। তিনি চুপ করে রইলেন।

তিনি বললেন, ‘আমাকে বিশ্বাস কর, কারেনিন। আন্না তোমার মহানুভবতার কদর করবে। তবে বোঝা যাচ্ছে, এটা সৃষ্টিকর্তারই ইচ্ছা!’ কথাটা বলেই টের পেলেন ওটা বোকামি হয়েছে। নিজের বোকামিতে অনেক কষ্টে হাসি চাপতে পারলেন।

কিছু-একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলেন কারেনিন, কিন্তু চোখের পানিটা বাধা হয়ে দাঁড়াল।

অব্‌লোন্‌স্কি বললেন, ‘এটা একটা সর্বনাশা দুর্ভাগ্য, সেটা মেনে নিতে হবে। বাস্তব ঘটনা বলে এ দুর্ভাগ্যকে আমি মেনে নিচ্ছি এবং আমি চেষ্টা করছি তোমাকে আর ওকে সাহায্য করতে।’

তিনি যখন জামাতার ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তখন ওঁর জন্য কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু কাজটা সাফল্যের সাথে করা গেছে বলে তুষ্টি লাভে তাতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। কেননা তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, কারেনিন তাঁর কথা ফিরিয়ে নেবেন না। এই তুষ্টির সাথে মিশে ছিল তাঁর মনে উদিত আরো একটা চিন্তা; যথা : এ ব্যাপারটা চুকে গেলে তিনি স্ত্রী ও ঘনিষ্ঠদের এই প্রশ্ন করবেন : ‘আমার সাথে সম্রাটের পার্থক্য কি? সম্রাট বিবাহবিচ্ছেদ করে দেন, কিন্তু তাতে কারো কোন উপকার হয় না, আর আমি যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটালাম তাতে তিনজনেই স্বস্তি পেল…কিংবা : কিসে আমার আর সম্রাটের মধ্যে মিল? যখন…যাক গে, ভালো কিছু-একটা ভেবে দেখা যাবে’, তিনি হেসে নিজেকেই এসব কথা বললেন।

তেইশ

যদিও হৃৎপিণ্ডকে তা স্পর্শ করেনি তবুও ভ্রন্‌স্কির ক্ষতটা ছিল খুবই বিপজ্জনক। তিনি কয়েক দিন জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে ছিলেন। তিনি যখন প্রথম কথা বলার মত অবস্থায় ফিরে আসেন, তখন ভ্রাতৃবধূ ভারিয়াই শুধু ঘরে ছিলেন। তিনি কঠোর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ভারিয়া! আমি আচমকাই নিজেকে গুলি করে ফেলেছিলাম। বড়ই বোকার মত কাজ করে ফেলেছি! দয়া করে আর এ নিয়ে কখনো কোন কথা বলো না, –এ কথাটা সবাইকেই বলে দেবে।’

ভারিয়া তাঁর এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে তাঁর ওপর ঝুঁকে পড়ে তাঁর মুখের দিকে আনন্দের হাসি নিয়ে তাকালেন। চোখ দুটো উজ্জ্বল, জ্বরতপ্ত নয়, কিন্তু চাহনিটা একটু কঠোর

ভারিয়া বললেন, ‘যাক বাবা! ব্যথা করছে না?’

তিনি বুকটা দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে সামান্য ব্যথা আছে।’

‘দাও তাহলে, নতুন করে ব্যান্ডেজটা করে দিই।’

যতক্ষণ পর্যন্ত ভারিয়া ব্যান্ডেজ করছিলেন, ভ্রন্‌স্কি ততক্ষণ তাঁর প্রশস্ত চিবুক চেপে নীরবে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ব্যান্ডেজ শেষ হলে উনি বললেন : ‘আমি ভুল বকছি না। আমি ইচ্ছে করেই নিজেকে গুলি করেছি—এমন কথাবার্তা যেন না হয়, তুমি দয়া করে সেই ব্যবস্থা কর।’

ভারিয়া একটা জিজ্ঞাসু হাসি হেসে বললেন, ‘সে কথা কেউ বলবে না। তবে আশা করি, তুমি আর আচমকা গুলি করে বসবে না!’

তিনি বিষণ্ণ হাসি হেসে বললেন, ‘না-করারই কথা। তবে ভালো হত…’

এ কথা এবং ভারিয়া যে হাসিতে ভয় পেয়েছিলেন তা সত্ত্বেও ব্যথা যখন কেটে গেল আর তিনি আরোগ্য লাভ করতে লাগলেন, তখন তিনি অনুভব করছিলেন যে তিনি তাঁর দুঃখের একাংশ থেকে একেবারে মুক্ত। যে লজ্জা আর হীনতা তিনি আগে বোধ করছিলেন, এই কাণ্ডটা করে তা যেন তিনি ধুয়ে-মুছে ফেলেছেন। কারেনিন সম্পর্কে এখন তিনি ভাবতে পারেন শান্তচিত্তে। তাঁর সমস্ত মহানুভবতা তিনি স্বীকার করলেন, নিজেকে আর হীন বোধ হচ্ছিল না। এটা ছাড়াও পুনরায় তিনি ফিরতে পারলেন পূর্বতন জীবনধারায়। অসংকোচে লোকের চোখে চোখে তাকানো যে সম্ভব সেটা দেখতে পেলেন তিনি, নিজের অভ্যাস অনুসারে দিন কাটাতে পারেন। যে একটা ভার তিনি বুক থেকে নামাতে পারছিলেন না, সেটা হল এই যে অনুভূতিটা দমন করার সংগ্রাম না থামালেও প্রায় হতাশার সীমানায় পৌঁছনো এই আক্ষেপটা তাঁকে রেহাই দিচ্ছিল না যে আন্নাকে তিনি হারিয়েছেন। স্বামীর কাছে নিজের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার পর এখন আন্নাকে যে ছেড়ে যেতে হচ্ছে, অনুতপ্ত আন্না আর তাঁর স্বামীর মাঝখানে আর কখনো যে তাঁর দাঁড়ানো চলবে না, এই সিদ্ধান্তটা তিনি দৃঢ় করে নিয়েছিলেন, মনে মনে; কিন্তু আন্নার ভালোবাসা হারাবার আক্ষেপ তিনি দূর করতে পারছিলেন না প্রাণের ভেতর থেকে, তাঁর সাথে সুখের যে মুহূর্তগুলো তাঁর কেটেছে, তখন যার কদর তিনি করেছেন কম আর এখন যা তাদের সমস্ত মাধুর্য নিয়ে হানা দিচ্ছে তাঁকে, তা স্মৃতি থেকে তিনি মুছে ফেলতে পারছিলেন না।

তাশখন্দে তাঁর একটা কাজের ব্যবস্থা করেন সেপুখোভস্কয় আর ভ্রন্‌স্কি কোন রকম দ্বিধা না করে রাজি হয়ে যান। কিন্তু যাত্রার সময় যত কাছিয়ে আসতে লাগল, ততই যে আত্মত্যাগ তিনি উচিত বলে গণ্য করেছিলেন সেটা তাঁর কাছে দুঃসহ হয়ে উঠল।

তাঁর ক্ষতটা সেরে গেল। তাশখন্দে যাবার তোড়জোড়ের জন্য বাইরে বেরোতে লাগলেন তিনি 1

তিনি ভাবছিলেন, ‘তাকে শুধু একবার দেখে তারপর কবরে যাওয়া যায়, নিশ্চিন্তে মরা যায়।’ বিদায় নিতে গিয়ে বেত্‌সিকে সে কথা তিনি বলেন। বেত্‌সি তাঁরই দূতী হয়ে আন্নার কাছে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে নেতিবাচক উত্তর

এনে দেন।

ভ্রন্‌স্কি খবরটা পেয়ে ভাবলেন, ‘এটাই বরং ভালো। ওটা দুর্বলতা, তাতে আমার শেষ শক্তিও ফুরিয়ে যেত।’ বেত্‌সি নিজেই পরের দিন তাঁর কাছে এলেন এবং বললেন যে, কারেনিন বিবাহবিচ্ছেদ রাজি, – অব্‌লোন্‌স্কির কাছ থেকে তিনি এ খবরটা পেয়েছেন। সুতরাং তাঁর সাথে ভ্রন্‌স্কি দেখা করতে পারেন।

বেত্‌সিকে বিদায় দেবেন—এ সময়টাও তর সইল না, নিজের সমস্ত সিদ্ধান্ত ভুলে গিয়ে, কখন দেখা করা যায়, স্বামী কোথায়—এসব কিছুই জিজ্ঞেস না করে ভ্রন্‌স্কি তৎক্ষণাৎ কারেনিনদের ওখানে রওনা দিলেন। কাউকে এবং কোন কিছুর প্রতি দৃষ্টিপাত না করে দ্রুত পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে উঠে গেলেন। প্রায় ছুটে গিয়ে আন্নার ঘরে ঢুকলেন। ঘরে কেউ আছে কি নেই, সে কথা না ভেবে, না লক্ষ্য করে আন্নাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। চুমোয় চুমোয় তাঁর মুখ, বাহু, গাল—সব কিছু ভরিয়ে দিলেন

এ সাক্ষাৎটার জন্য আন্না তৈরি হয়েই ছিলেন। কি বলবেন—তাও ভেবে রেখেছিলেন। কিন্তু এর ফলে কিছুই বলে উঠতে পারলেন না; তাঁকেও ভ্রন্‌স্কির প্রেমাবেগ আচ্ছন্ন করল। আন্না ওঁকে, নিজেকে শান্ত করতে চাইছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে বড় দেরি হয়ে গেছে। তাঁর মধ্যে ভ্রন্‌স্কির আবেগ সঞ্চারিত হল। তাঁর ঠোঁট এমনভাবে থরথর করে কাঁপছিল যে, তিনি অনেকক্ষণ কোন কথাই বলতে পারলেন না।

ভ্রন্‌স্কির হাত নিজের বুকে চেপে ধরে আন্না অবশেষে বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি আমাকে জিনে নিয়েছ। আমি তোমার, শুধুই তোমার। ‘

ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই হওয়া উচিত! আমরা যতক্ষণ বেঁচে আছি, এই-ই হতে হবে। এখন তা আমি জেনেছি।’

আন্না ক্রমাগত বিবর্ণ হয়ে ভ্রন্‌স্কির মাথা জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তা ঠিক। তাহলেও যা সব ঘটে গেল, তার পরে এর মধ্যে ভয়াবহ কি-একটা যেন আছে।’

তিনি মাথা তুলে হাসিতে নিজের সবল দাঁত বিকশিত করে বললেন, ‘সবই কেটে যাবে! সবই কেটে যাবে! আমরা মহা সুখী হব! এর মধ্যে ভয়াবহ ধরনের কিছু-একটা আছে বলেই আমাদের ভালোবাসা আরো প্রবল হয়ে উঠব। অবশ্য আরো প্রবল হওয়া যদি সম্ভব হয়।’

আন্না এবার আর হাসিতে জবাব না দিয়ে পারলেন না। সেটা অবশ্য ভ্রন্‌স্কির কথার উদ্দেশে নয়, তাঁর প্রেমাকুল চোখটার উদ্দেশে। আন্না তাঁর হাত নিয়ে নিজের ঠাণ্ডা গাল আর ছাঁটা চুলে বুলাতে লাগলেন।

‘এই ছেঁটে ফেলা চুলে তোমাকে চেনাই মুশকিল। তোমাকে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে। যেন খোকা। কিন্তু কি ফ্যাকাশে হয়ে গেছ তুমি।’

আন্না হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, ভীষণ দুর্বল’, আবার কাঁপতে লাগল তাঁর ঠোঁট।

ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘আমরা ইতালিতে যাব। সেখানে গিয়ে তুমি ভালো হয়ে উঠবে।’

ভ্রন্‌স্কির চোখের দিকে তাকিয়ে কাছ থেকে আন্না বললেন, ‘আমরা স্বামী-স্ত্রী হব—এটা কি সত্যিই সম্ভব! নিজেদের পরিবার নিয়ে তোমার সাথে একা থাকব?

‘এটা ভেবেই শুধু আমার ভেবে অবাক লাগে যে, ব্যাপারটা কেমন করে কখনো অন্য কিছু হতে পারত।’

ভ্রন্‌স্কির মুখ এড়িয়ে চিন্তিতভাবে আন্না বললেন, ‘স্তিভা বলছে, উনি সব কিছুতে রাজি। কিন্তু ওঁর মহানুভবতা আমি গ্রহণ করতে পারি না। আমি বিবাহবিচ্ছেদ চাই না, এখন আমার আর কোন কিছুতেই কিছু এসে যায় না। শুধু জানি না উনি সেরিওজা সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত নেবেন।’

কিছুতেই ভ্রন্‌স্কি বুঝতে পারলেন না যে, মিলনের এই মুহূর্তে উনি ছেলের কথা, বিবাহবিচ্ছেদের কথা ভাবতে পারলেন, স্মরণ করতে পারলেন কি করে? এতে কি কিছু এসে যায়?

অনুস্কি নিজের হাতে আন্নার হাতটা নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, ‘ও কথা তুলো না। ও সব ভেবো না’, একথা বলে নিজের প্রতি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন; তাতেও আন্না তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলেন না।

আন্না বললেন, ‘হায় সৃষ্টিকর্তা! আমি কেন যে মরলাম না! মরলেই সবচেয়ে ভালো হত’, এবং নিঃশব্দ কান্নায় দু’গাল বেয়ে সমানে চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল; কিন্তু ভ্রন্‌স্কির মনে ব্যথা না দেবার জন্য মুখটায় হাসি-হাসি ভাব ধরে রাখতে চেষ্টা করলেন।

এক সময় ভ্রন্‌স্কির ধারণা ছিল, তাশখন্দের প্রশংসার্হ ও বিপজ্জনক চাকরিটা প্রত্যাখ্যান করা হত একটা অপমানজনক ও অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু তিনি এখন একটুও না ভেবে সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন আর তাঁর আচরণে ওপরওয়ালাদের অননুমোদন লক্ষ্য করে এক মুহূর্ত দেরি না করে সাথে সাথেই সামরিক বাহিনীর চাকরিটা ছেড়ে দিলেন।

কারেনিন এক মাস পরে পিটার্সবুর্গের নিজের বাড়িতে ছেলেকে নিয়ে একা পড়ে রইলেন এবং বিবাহবিচ্ছেদ না করে, বিবাহবিচ্ছেদের প্রস্তাব দৃঢ়তার সাথে অগ্রাহ্য করে, আন্না ভ্রন্‌স্কির সাথে বিদেশে চলে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *