আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ২.১৫

পনেরো

ছোট নদীটার ওপরে অদূরের একটা ছোট অ্যাম্পেন কুঞ্জে পাখি উড়ে আসার জায়গাটা। বনে এসে লেভিন গাড়ি থেকে নেমে অব্‌লোন্‌স্কিকে নিয়ে গেলেন শ্যাওলা-পড়া চ্যাটচেটে মাঠের এক কোণে, এর মধ্যেই বরফ সেখানে গলে গেছে। নিজে তিনি ফিরলেন অন্য প্রান্তে, যমজ বার্চ গাছের কাছে, নিচু দিককার শুকনো ডালের ফাঁকে বন্দুক রেখে কাফতান (শেরওয়ানির মত পুরুষের রুশী জাতীয় পোশাক) খুলে ফেললেন, বেল্ট টান করে পরখ করলেন হাতের সচলতা।

তাঁদের পেছন পেছন বুড়ি, ধূসর লাস্কা এসেছিল। সতর্ক হয়ে সে বসল লেভিনের সামনে, উৎকর্ণ হয়ে। বড় বনটার পেছনে সূর্য ঢলে পড়ছে; অ্যাম্পেন গাছগুলোর মধ্যে ছড়ানো ছিটানো গোটাকয়েক বার্চ তাদের স্ফীত, ফাটো- ফাটো কোরক নিয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে গোধূলির আলোয়।

বনের যেখানে এখনো বরফ লেগে আছে, সেখান থেকে কানে আসছিল আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ স্রোতোরেখায় পানির ঝিরঝির। কিচির-মিচির করে ছোট ছোট পাখিরা মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছিল গাছ থেকে গাছে।

নিঝুম স্তব্ধতার ফাঁকে ফাঁকে শোনা যাচ্ছিল বরফ-গলা মাটি আর বেড়ে ওঠা ঘাসের চাপে নড়ে-ওঠা গত বছরের ঝরা পাতার খসখস।

‘কি কাণ্ড! ঘাস যে বেড়ে উঠছে তা শোনা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে!’ কচি একটা ঘাসের ফলার কাছে সীসে রঙের সিক্ত, সঞ্চরমাণ অ্যাম্পেন পাতাটা লক্ষ্য করে মনে মনে ভাবলেন লেভিন। নিচের দিকে, কখনো ভেজা, শৈবালাচ্ছন্ন মাটি, কখনো উৎকর্ণ লাস্কা, কখনো টিলার নিচে, তাঁর সামনেকার বনের ন্যাড়া চূড়াগুলো, কখনো সাদা মেঘে ছেঁড়া ছেঁড়া নিবে আসা আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। আলস্যে ডানা নেড়ে বনের অনেক ওপর দিয়ে উড়ে গেল একটা বাজপাখি; আরেকটা বাজপাখি ঠিক একইভাবে একই দিকে উড়ে গিয়ে উধাও হয়ে গেল। বনের মধ্যে আরো সজোরে, শশব্যস্তে কাকলী, তুলল পাখিরা। অদূরে ডেকে উঠল বন-পেঁচা, চমকে উঠে লাস্কা কয়েক পা সাবধানে এগিয়ে মাথা পাশে হেলিয়ে কান পেতে রইল। নদীর ওপার থেকে শোনা গেল কোকিলের ডাক। দু’বার স্বাভাবিকের মত কুহু ডাকার পর গলা ভেঙে, ব্যতিব্যস্ত হয়ে সব গোলমাল করে ফেলল।

‘কি কাণ্ড! এর মধ্যেই কোকিল।’ ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি।

‘হ্যাঁ, শুনছি’, নিজের কানেই যা খারাপ লাগছে, নিজের সে কণ্ঠস্বরে বনের নীরবতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার বিরক্তির সাথে বললেন লেভিন, ‘আর দেরি নেই।’

অব্‌লোন্‌স্কির মূর্তি আবার অদৃশ্য হল ঝোপের পেছনে। লেভিনের চোখে পড়ল কেবল একটা দেশলাইয়ের কাঠির আগুন, তারপর জ্বলন্ত সিগারেটের লাল ঝলক, নীলাভ ধোঁয়া।

খট! খট! শব্দ করল অব্‌লোন্‌স্কির ট্রিগার।

‘কি ওটা ডাকছে?’ টানা একটা আওয়াজের দিকে লেভিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অব্‌লোন্‌স্কি বললেন। যেন খেলা করতে করতে চিহিহি করে ডাকছে কোন ঘোড়ার বাচ্চা।

‘জান না? ও হল গিয়ে মর্দা খরগোশ। যাক, আর কথা নয়! শুনছ, উড়ে আসছে!’ ট্রিগার ঠিক করে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন লেভিন।

শোনা গেল দূর থেকে ভেসে আসা মিহি শিস, আর শিকারীদের কাছে যা খুব পরিচিত, তেমনি মাপা তালে দ্বিতীয়, তৃতীয়, আর তৃতীয় শিসের পর শোনা গেল কোঁকোঁ ডাক।

লেভিন ডানে-বাঁয়ে চোখ ফেরালেন, তারপর ঠিক সামনে ঝাপসা নীল আকাশের পটে অ্যাম্পেন গাছগুলোর চূড়ায় উদ্‌গত কোমল অংকুরের ওপরে দেখা দিল উড়ন্ত পাখি। উড়ে আসছিল সে সোজা লেভিনের দিকে। কাছেই খাপী কাপড় ছেঁড়ার মত সমতাল আওয়াজ শোনা গেল কানের ওপরেই; বেশ দেখা যাচ্ছিল পাখিটার লম্বা ঠোঁট আর গ্রীবা, এদিকে লেভিন যখন তাক করছেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই যে ঝোপের পেছনে অব্‌লোন্‌স্কি দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখান থেকে ঝলকাল লাল বিদ্যুৎ; পাখিটা তীরবেগে পড়তে পড়তে আবার উঠে গেল। আবার বিদ্যুৎ ঝলক দিল শোনা গেল গুলির শব্দ; ডানা নেড়ে যেন বাতাসে ভেসে থাকবার চেষ্টায় পাখিটা এক মুহূর্ত থেমে রইল, তারপর ধপ করে পড়ল প্যাচপেচে মাটিতে।

‘ফসকে গেল নাকি?’ অব্‌লোন্‌স্কি চেঁচিয়ে উঠলেন, ধোঁয়ার জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।

‘এই যে!’ লাস্কাকে দেখিয়ে লেভিন বললেন। একটা কান খাড়া করে ফুঁয়ো ফুঁয়ো লেজের ডগাটা উঁচিয়ে নাড়তে নাড়তে লাস্কা মৃদু পদক্ষেপে, যেন পরিতৃপ্তিটা দীর্ঘায়ত করার বাসনায় নিহত পাখিটাকে নিয়ে আসছিল মনিবের কাছে যেন হাসি ফুটেছে মুখে। ‘যাক, তুমি পারলে বলে আনন্দ হচ্ছে, লেভিন বললেন, তবে স্নাইপটাকে তিনি শিকার করতে পারলেন না বলে ঈর্ষাও হচ্ছিল তাঁর।

‘ডান নলটার গুলি ফসকে যায় বিছ্‌ছিরি ভাবে’, বন্দুকে টোটা ভরে অবলোন্‌স্কি বললেন, ‘শ্‌শ্‌… উড়ে আসছে।’

সত্যিই শোনা গেল কর্ণভেদী, একের পর এক দ্রুতসঞ্চারী শিস। দুটো স্নাইপ কোঁকোঁ না করে শুধু শিস দিয়ে খেলতে খেলতে এ ওর পাল্লা ধরে উড়ে গেল শিকারীদের একেবারে মাথার ওপর দিয়ে। চারটা গুলির শব্দ উঠল, স্নাইপরা ঝট করে সোয়ালোর মত বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

.

চমৎকার পাখি পাওয়া যাচ্ছিল। অব্‌লোন্‌স্কি আরো দুটোকে মারলেন, লেভিনও দুটো, তার একটাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। অন্ধকার হয়ে এল। পশ্চিম আকাশের নিচুতে ঝকঝকে রূপালি শুকতারা বাচগাছগুলোর পেছন থেকে কোমল জ্যোতিতে আলো দিতে থাকল, আর পুবে বিমর্ষ আর্কতুরাস ঝলমল করে উঠল তার রক্তিম আগুনে। লেভিন তাঁর মাথার ওপর সপ্তর্ষিমণ্ডলের তারাগুলোকে কখনো ঠাহর করতে পারছেন, কখনো আবার তা হারিয়ে যাচ্ছে। স্নাইপগুলো আর উড়ে আসছে না এখন; কিন্তু লেভিন স্থির করলেন, বার্চের ডালগুলোর নিচে যে শুকতারাটা দেখা যাচ্ছে, তা ওপরে না উঠে আসা পর্যন্ত এবং সপ্তর্ষি আরও স্পষ্ট না হয়ে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। ডালগুলোর ওপরে উঠে এল শুকতারা, সপ্তর্ষির রথ স্পষ্ট হয়ে উঠর কালচে-নীল আকাশে, কিন্তু লেভিন তবুও দাঁড়িয়ে রইলেন।

‘এবার ফিরলে হয় না?’ বললেন অব্‌লোন্‌স্কি।

বন ততক্ষণে নিঝুম হয়ে এসেছে, একটা পাখিরও নড়াচড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

লেভিন বললেন, ‘আরো একটু থেকে যাই।’

‘তোমার যা ইচ্ছে।’

ওঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন পনের পা দূরে।

হঠাৎ লেভিন বললেন, ‘স্তিভা, তোমার শালী বিয়ে করল, নাকি করবে, কিছুই বলছ না যে?’

লেভিন নিজেকে এতটা শক্ত আর সুস্থির বোধ করছিলেন যে কোন জবাবেই তিনি বিচলিত হবেন না বলে তাঁর ধারণা ছিল। কিন্তু অব্‌লোন্‌স্কি যা বললেন সেটা তিনি আদৌ ভাবতে পারেননি।

‘বিয়ে করার কথা ভাবেওনি, ভাবছেও না। খুবই অসুস্থ, ডাক্তাররা তাকে বিদেশে পাঠিয়েছে। এমন কি প্রাণের আশংকাও করছেন তাঁরা।’

‘বলছ কি!’ চেঁচিয়ে উঠলেন লেভিন, ‘খুবই অসুস্থ? কি হয়েছে? কেমন করে সে?…’

ওঁরা যখন এই কথা বলছিলেন লাস্কা কান খাড়া করে প্রথমে তাকাল আকাশে, তারপর ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে ওঁদের দিকে।

লাস্কা ভাবছিল, ‘গল্প করার খুব সময় পেলে যা হোক। ওদিকে পাখিটা উড়ছে… হ্যাঁ, ওই তো। ফস্কে যাবে…. ‘ কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই দুজনেই শুনতে পেল তীক্ষ্ণ একটা শিস, যেন কেউ চড় মারল কানে, দুজনেই হঠাৎ বন্দুক চেপে ধরল, একই সাথে দুটো ঝলক, দুটো গুলির শব্দ। উঁচুতে উড়ন্ত স্নাইপ মুহূর্তে ডানা গুটিয়ে সরু সরু কিশলয় পিষ্ট করে পড়ল ঝোপে।

‘চমৎকার! দুজনের মার।’ চেঁচিয়ে উঠে লেভিন লাস্কার সাথে ছুটলেন ঝোপের মধ্যে পাখিটাকে খুঁজতে। ও হ্যাঁ, খারাপ লাগছিল কেন?’ মনে পড়ল তাঁর। ‘হ্যাঁ, কিটি অসুস্থ… কি করা যাবে, খুবই দুঃখের কথা’, তিনি ভাবলেন।

‘আরে পেয়ে গেছিস! সাবাস!’ লাস্কার মুখ থেকে উষ্ণদেহী পাখিটাকে টেনে বের করে তাঁর প্রায় ভরে ওঠা ঝোলায় পুরতে পুরতে তিনি বললেন। হাঁক দিলেন, ‘পাওয়া গেছে, স্তিভা!’

ষোলো

লেভিন ঘরে ফেরার পথে কিটির অসুখ এবং শ্যেরবাৎস্কিদের পরিকল্পনার খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলেন এবং যদিও ব্যাপারটা স্বীকার করতে তাঁর লজ্জা হচ্ছিল, তাহলেও যা জানলেন তাতে প্রীতি বোধ হল তাঁর। প্রীতি বোধ হল, কারণ এখনো তাহলে আশা আছে এবং আরো বেশি প্রীতিকর লাগল, কারণ তাঁকে যে অত কষ্ট দিয়েছে, নিজেই সে কষ্ট পাচ্ছে এখন। কিন্তু অব্‌লোন্‌স্কি যখন কিটির পীড়ার কারণ বলতে শুরু করে ভ্রন্‌স্কির নাম উল্লেখ করলেন লেভিন থামিয়ে দিলেন তাঁকে।

‘পারিবারিক খুঁটিনাটি জানার কোন অধিকার নেই আমার, আর সত্যি বলতে কি, আগ্রহই নেই।’

লেভিনের মুখের যে ভাবপরিবর্তন অব্‌লোন্‌স্কির অতি পরিচিত, মুহূর্তের মধ্যে যা তাঁর মুখকে করে তুলেছে ঠিক ততটাই বিমর্ষ যতটা প্রফুল্ল ছিল এক মিনিট আগেও, সেটা চোখে পড়তে প্রায় অলক্ষ্য একটা হাসি ফুটল অব্‌লোন্‌স্কির মুখে। লেভিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘বনের ব্যাপারটা রিয়াবিনিনের সাথে একেবারে ঠিকঠাক করে ফেলেছ?’

‘হ্যাঁ, চুকিয়ে দিলাম। দাম চমৎকার, আটত্রিশ হাজার। আট হাজার অগ্রিম, বাকিটা ছয় বছরের কিস্তিতে। বহু ঝামেলা গেছে, এর চেয়ে বেশি আমাকে কেউ দিচ্ছে না।’

‘তার মানে, পানির দরে ছেড়ে দিলে’, লেভিন বললেন মুখ ভার করে।

‘পানির দরে কেন?’ ভালোমানুষি হাসি নিয়ে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, জানতেন যে এবার সবই বিছ্‌ছিরি লাগতে থাকবে লেভিনের।

‘কারণ, বনটার দাম দেসিয়াতিনা পিছু অন্তত পাঁচশ’ রুল’, লেভিন বললেন।

‘আহ্, গাঁয়ের যত ভদ্রলোক!’ অব্‌লোন্‌স্কি বললেন ঠাট্টার সুরে, শহুরে লোকদের কি যে ঘৃণা তোমাদের!… অথচ কাজের ব্যাপারে আমরা কিন্তু সব সময়ই ব্যবস্থা করি তোমাদের চেয়ে ভালো। বিশ্বাস কর, সব খতিয়ে দেখেছি’, তিনি বললেন, ‘বন বিক্রি হচ্ছে খুবই লাভে, বরং ভয়ই হচ্ছে আবার বেঁকে বসে। এ তো আর সরেস কাঠের বন নয়, সরেস কাঠ কথাটা দিয়ে লেভিনের সমস্ত সন্দেহের অসারতায় তাঁকে একেবারে নিশ্চিত করে তোলার আশায় তিনি বললেন, ‘এতে লাকড়ি কাঠের গাছই বেশি। দাঁড়াবে দেসিয়াতিনা পিছু তিরিশ সাজেনের (সাজেন—রাশিয়ায় প্রচলিত সাবেকী দৈর্ঘ্যের মাপ–২.১ মিটারের মত। এখানে লাকড়ি কাঠের ঘন সাজেনের কথা বলা হচ্ছে) বেশি নয়। অথচ ও আমাকে দিচ্ছে দুশ’ রুব্‌ল করে।’

লেভিন অবজ্ঞাভরে হাসলেন। ভাবলেন, ‘জানি, জানি, এ তো শুধু ওর একার চালিয়াতি নয়, সব শহুরেদেরই ও-ই, যারা গাঁয়ে আসে দশ বছরে বার দুয়েক, দুটো-তিনটা গ্রাম্য লব্‌জ নজরে পড়ায় প্রসঙ্গে-অপ্রসঙ্গে তা ব্যবহার করে একেবারে নিশ্চিত হয়ে ওঠে যে তারা সবই জানে। সরেস কাঠ, তিরিশ সাজেন দাঁড়াবে। যে সব শব্দ বলছে নিজেই তার কিছু জানে না।’

লেভিন বললেন, ‘তোমার দপ্তরে তুমি যা-সব লেখো তা আমি তোমাকে শেখাতে যাব না। দরকার পড়লে তোমার কাছেই পরামর্শ চাইব। অথচ তোমার একেবারে দৃঢ় বিশ্বাস যে বনের বিদ্যা তোমার সবই জানা। এ বিদ্যা সহজ নয়। গাছগুলো তুমি গুণে দেখেছ?’

‘গুণব কি করে?’ বন্ধুর খারাপ মেজাজ ভালো করে তোলার চেষ্টায় হেসে অব্‌লোন্‌স্কি বললেন, ‘যদিও সাগরের বালি, তারার ছটাও গুণে দেখতে পারে বড় দরের মাথা…’

‘হ্যাঁ, রিয়াবিনিনের বড় দরের মাথা তা পারে। আর তুমি যা দিচ্ছ তেমন পানির দরে না পাওয়া গেলে কোন বেনিয়াই গুনে না দেখে কিনবে না। তোমার বনটা আমার চেনা। প্রতি বছর শিকারে যাই ওখানে। তোমার বনের দাম নগদে পাঁচশ’ রুব্ল করে। আর তুমি দু’শ করে নিচ্ছ কিস্তিতে। তার মানে, তুমি ওকে দান করছ তিরিশ হাজার।’

‘নাও বাপু, তেতে উঠো না’, করুণ স্বরে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, ‘আর কেউ অত দিল না কেন?’

‘কারণ অন্য বেনিয়াদের সাথে ও রফা করে নিয়েছে, ঘুষ দিয়েছে। ওদের সকলের সাথেই আমার কাজকর্ম ছিল রে, চিনি ওদের। এরা তো আর কারবারী নয়, মুনাফাখোর। যাতে শতকরা দশ, পনের পাওয়া যাবে তাতে সে হাত দেবে না। ও আছে বিশ কোপেকে এক রুব্‌ল কেনার ধান্ধায়।’

‘নাও, হয়েছে! মেজাজ তোমার খারাপ। ‘

‘এতটুকু নয়’, বাড়ির কাছে আসতে আসতে লেভিন বললেন মুখ ভার করে

গাড়ি বারান্দার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল লোহা আর চামড়ার বেড়ে আঁট করে বাঁধাই একটা গাড়ি, তাকে চওড়া বেল্টে কষে জোতা হৃষ্টপুষ্ট একটা ঘোড়া। গাড়িতে বসে ছিল টেনে কোমরবন্ধ আঁটা রক্তোচ্ছ্বাসে রাঙা-মুখ গোমস্তা, যে রিয়াবিনিনের কোচোয়ানের কাজও করত। রিয়াবিনিন নিজে ছিল বাড়ির ভেতরে, বন্ধুদ্বয়ের সাথে তার দেখা হল প্রবেশকক্ষে। লোকটা মাঝবয়সী, ঢেঙা, রোগাটে, কামানো থুতনিটি সুপ্রকট, ফুলো ফুলো ঘোলাটে চোখ। পরনে তার লম্বা নীল ফ্রক-কোট, বোতাস নেমেছে পাছারও নিচে, পায়ে গোড়ালির কাছে কোঁচকানো, পায়ার ডিমের কাছে সটান হাইবুট, তার ওপর চড়িয়েছেন বড় বড় গালোশ। রুমাল দিয়ে গোটা মুখখানা মুছে, ফ্রক-কোট ঝাড়া দিয়ে, যা এমনিতেই বেশ সঠিক ছিল, হেসে অভিনন্দন জানালেন ওঁদের দুজনকে, অব্‌লোন্‌স্কির দিকে এমনভাবে হাত বাড়িয়ে দিলেন যেন কিছু একটা ধরতে চাইছেন।

‘এই যে, আপনি তাহলে এসে গেছেন’, হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, ‘চমৎকার!’

‘হুজুরের আজ্ঞা অমান্য করার সাহস হল না। যদিও রাস্তাটা ছিল বড়ই খারাপ। সারা রাস্তা ভালোভাবে হেঁটেই এসেছি, তবে পৌঁছেছি সময়মত। গুডমর্নিং, কনস্তান্তিন দ্‌মিত্রিচ’, তাঁরও হাত ধরার চেষ্টা করে উনি বললেন লেভিনের উদ্দেশে, কিন্তু লেভিন ভ্রুকুটি করে এমন ভাব দেখালেন যেন ওঁর হাত তাঁর নজরে পড়েনি, স্নাইপগুলো বার করতে লাগলেন। ‘আমোদ করতে গিয়েছিলেন শিকারে। তা এটা কি পাখি বলুন তো’, স্নাইপটার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রিয়াবিনিন যোগ দিলেন, ‘স্বাদ আছে বুঝি’, এবং অননুমোদনে ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন তিনি, যেন এতে মজুরি পোষায় না বলে তাঁর ঘোর সন্দেহ আছে।

‘কেবিনেটে যাবে?’ অব্‌লোন্‌স্কিকে লেভিন ভ্রূকুটি করে ফরাসি ভাষায় বললেন, ‘যাও-না, সেখানে কথা বলবে।’

‘যেখানে ইচ্ছে সেখানেই দিব্যি চলে যাবে’, রিয়াবিনিন বললেন একটা নাক-সিঁটকানো মর্যাদার ভার নিয়ে, যেন বুঝিয়ে দিতে চান যে কাকে কিভাবে এড়িয়ে যেতে হবে এ নিয়ে অন্যে অসুবিধা বোধ করলেও তাঁর কখনোই কিছুতেই অসুবিধা হয় না।

রিয়াবিনিন কেবিনেটে ঢুকে এমনভাবে চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন যেন দেবপটটা খুঁজছিলেন, তবে সেটা চোখে পড়লেও ক্রস করলেন না। বই-ভরা আলমারি আর তাকগুলোর দিকে তাকালেন তিনি, আর স্নাইপগুলোর ব্যাপারে যা করেছিলেন তেমনি অবজ্ঞাভরে হেসে অননুমোদনের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন, এতে যে মজুরি পোষাতে পারে তা মানতে পারলেন না কিছুতেই।

অব্‌লোন্‌স্কি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি, টাকা এনেছেন? বসুন, বসুন!’

টাকার জন্য আমরা দাঁড়িয়ে থাকি না। এলাম দেখা করতে, কথা বলতে।’

‘কি নিয়ে আবার কথা? বসুন, বসুন।’

‘তা বসা যেতে পারে’, বসে, চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে, যা তাঁর পক্ষে অতি কষ্টকর, রিয়াবিনিন বললেন, ‘কিছু ছাড় দিতে হবে প্রিন্স। নইলে পাপ হবে। আর টাকা চূড়ান্ত রকমে তৈরি, মায় কড়ায় গণ্ডায়। টাকার জন্য কিছু আটকে থাকবে না।’

ইতিমধ্যে লেভিন আলমারিতে বন্দুক রেখে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু থেমে গেলেন বেনিয়ার কথা শুনে। বললেন, ‘পানির দামে বনটা নিলেন তাহলে। আমার কাছে ও এসেছে দেরি করে, নইলে দাম বেঁধে দিতাম আমিই।’

রিয়াবিনিন উঠে দাঁড়িয়ে নীরব হাসি নিয়ে লেভিনকে লক্ষ্য করলেন আপাদমস্তক।

অব্‌লোন্‌স্কির উদ্দেশে হেসে বললেন, ‘কনস্তান্তিন দদ্‌মিত্রিচ বেজায় কৃপণ। ওঁর কাছ থেকে একেবারে চূড়ান্ত কিছুই কেনা যায় না। গম নিয়ে দরাদরি করলাম, দাম দিতে চেয়েছিলাম ভালো।’

‘আমার জিনিস মুফতে কেন দেব আপনাকে? কুড়িয়ে তো পাইনি, চুরিও করিনি।

তা, চুরি করা আজকাল চূড়ান্ত রকম অসম্ভব। আজকাল সবই উত্তমরূপে চলে প্রকাশ্যে আইন মেনে, চুরিচামারি আর নয়, আজকাল সবই দরাজ। আমরা সৎলোকের মতই কথা কয়েছি। বনের জন্য বেশি টাকা ঢাললে তা উশুল তো হবে না। তাই অনুরোধ করছি, অন্তত খানিকটা ছাড় দেওয়া হোক। ‘

‘আপনাদের কথাবার্তা সব শেষ হয়ে গেছে, নাকি হয়নি? যদি শেষ হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে বলার কিছু নেই। আর শেষ না হয়ে থাকলে’, লেভিন বললেন, ‘বনটা আমিই কিনব।’

হঠাৎ রিয়াবিনিনের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। বাজপাখির মত হিংস্র নিষ্ঠুর একটা ভাব ফুটে উঠল তাতে। দ্রুত হাড়খোঁচা আঙুলে ফ্রক-কোটের বোতাম খুলে ফেললেন তিনি, দেখা গেল ট্রাউজারের ওপরে লম্বিত একটা কামিজ, ওয়েস্ট-কোটে পেতলের বোতাম, পকেট ঘড়ির চেন : দ্রুত তিনি বের করলেন একটা পুরানো পেট মোটা মানি-ব্যাগ। তিনি তাড়াতাড়ি ক্রস করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভুরু কুঁচকে মানি-ব্যাগটা দোলাতে দোলাতে বললেন, ‘বেশ, বন আমার। টাকা নাও, বন আমার। রিয়াবিনিমের দরাদরি এরকমই, দু’চার পয়সা নিয়ে তার খাঁই নেই।

লেভিন বললেন, ‘আমি হলে তোমার মত তাড়াহুড়া করতাম না।’

অব্‌লোন্‌স্কি অবাক হয়ে বললেন, ‘বল কি! কথা দিয়েছি যে!’

দড়াম করে দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন লেভিন। রিয়াবিনিন দরজার দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা নেড়ে বলতে লাগলেন : ‘হা রে যৌবনে, একেবারে চূড়ান্ত রকমের ছেলেমানুষি। কিনছি যখন, বিশ্বাস করুন, সেটা সম্মান করে—অব্‌লোন্‌স্কির বন কিনল আর কেউ নয়, রিয়াবিনিন, এই নামটুকুর খাতিরে। আর লাভ যে কি দাঁড়াবে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। সৃষ্টিকর্তাই সাক্ষী। তাহলে দয়া করে সই করে দিন দলিলে….’

এর এক ঘণ্টা পর পকেটে চুক্তিপত্র নিয়ে ফ্রক-কোটের হুকে এঁটে পরিপাটী করে আলখাল্লা চাপিয়ে কারবারী তাঁর কষে পেটাই-করা গাড়িতে চেপে বাড়ি রওনা হলেন।

‘ওহ্, এসব জমিদারের দল!’ গোমস্তাকে বললেন তিনি। ‘সবাই একই জিনিস।’

‘তাই বটে’, ওঁকে লাগাম দিয়ে চামড়ার অ্যাপ্রনে বোতাম আঁটতে আঁটতে গোমস্তা বলল, ‘মিখাইল ইগ্নাতিচ, তা কেনার ব্যাপারটা কি দাঁড়াল?’

‘হুঁ হুঁ…’

সতেরো

বেনিয়া লোকটা তাঁকে যে নোটগুলো তিন মাসের অগ্রিম দিয়েছিলেন, তাতে পকেট বোঝাই করে অব্‌লোন্‌স্কি ওপরে উঠলেন। বনের ব্যাপারটা চুকেছে। টাকা আছে পটেকে। পাখি শিকার হয়েছে চমৎকার। তাই অব্‌লোন্‌স্কির মেজাজ এখন খুবই ভাল। সুতরাং যে বদ মেজাজ লেভিনকে পেয়ে বসেছিল, সেটা ঘোচাবার খুবই একটা ইচ্ছে হল তাঁর। তিনি চাইছিলেন, যেভাবে দিনটার শুরু হয়েছিল, সেভাবেই সন্ধ্যাহারে তার শেষ হোক।

লেভিনের মেজাজটা সত্যিই ভালো ছিল না। নিজের প্রিয় অতিথির প্রতি সুশীল ও সুমধুর হবার সমস্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। কিটির বিয়ে হয়নি, এই খবরটার নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল।

বিয়ে হয়নি কিটির। সে অসুস্থ। অসুস্থ সেই লোকটার জন্য যে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এই অপমান যেন লেভিনকেও লাগল। ভ্রন্‌স্কি প্রত্যাখ্যান করেছেন কিটিকে, আর কিটি তাঁকে, লেভিনকে। অতএব লেভিনকে অশ্রদ্ধা করার অধিকার ভ্রন্‌স্কির আছে। সুতরাং তিনি তাঁর শত্রু। কিন্তু এটা লেভিন সবটুকু ভেবে ওঠেননি। ঝাপ্‌সাভাবে তিনি টের পাচ্ছিলেন যে, এক্ষেত্রে তাঁর পক্ষে অবমাননাকর কিছু-একটা আছে, এবং যা তাঁকে বিচলিত করছিল তাতে নয়, যা তাঁর সামনে এসে পড়ছিল তাতেই চটে উঠছিলেন তিনি। আহাম্মকের মত বন বিক্রি, যে প্রতারণায় অলোনস্কিকে ফেলা হল এবং যা ঘটল তাঁরই বাড়িতে, এতেই পিত্তি জ্বলছিল তাঁর।

‘কি, শেষ হল?’ ওপরে অব্‌লোন্‌স্কিকে দেখে তিনি বললেন, নৈশাহার চলবে?’

‘একেবারেই আপত্তি নেই। গাঁয়ে ক্ষিদে পায় কি, আশ্চর্য! রিয়াবিনিনকে খেতে বললে না কেন?’

‘জাহান্নামে যাক, বেটা!’

‘তবে তুমি ওর সঙ্গ এড়িয়ে চল বটে!’ অব্‌লোন্‌স্কি বললেন, ‘ওর দিকে হাতটাও বাড়ালে না।’

‘কারণ নফরের সাথে আমি করমর্দন করি না। কিন্তু এই লোকের চেয়ে নফরও শতগুণ ভালো।‘

অব্‌লোন্‌স্কি বললেন, ‘কি তুমি প্রতিক্রিয়াশীল হে! কিন্তু সমস্ত সামাজিক সম্প্রদায়কে মিলিয়ে দেওয়াটা?’

‘যার ভালো লাগে, বেশ তো মিলে যাক। আমার বিছ্‌ছিরি লাগে।’

তুমি দেখছি একটা ডাহা প্রতিক্রিয়াশীল।’

‘আমি কি, সত্যি, তা নিয়ে কখনো ভাবিনি। আমি-কনস্তান্তিন লেভিন, ব্যস ‘

‘এবং সেই কনস্তান্তিন লেভিন যার মেজাজ আজ মোটেই ভালো নেই’, হেসে অব্‌লোন্‌স্কি বললেন।

‘হ্যাঁ, মেজাজ ভালো নেই, কিন্তু জান কেন? তোমার এই নির্বোধ বিক্রিটার জন্যে… ‘

অব্‌লোন্‌স্কি মুখ কোঁচকালেন ভালো মেজাজেই যেন নিরপরাধ কোন লোকের দোষ ধরা হচ্ছে, কষ্ট দেওয়া হচ্ছে তার মনে।

বললেন, ‘নাও হয়েছে! কেউ কিছু-একটা বিক্রি করার পরেই তাকে শুনতে হয়নি; ‘এটার দাম অনেক বেশি’, এমনটা ঘটেছে কখনো? অথচ যখন বিক্রি করছে, তখন সে দাম কেউ দেয় না। উঁহু, দেখছি ওই হতভাগ্য রিয়াবিনিনের ওপর তোমার কোন রাগ আছে।’

‘হয়ত আছে। আর জানো কেন? তুমি হয়ত আবার বলবে যে আমি প্রতিক্রিয়াশীল কিংবা আরো ভয়ংকর কিছু- একটা; তাহলেও চারদিক থেকে অভিজাত সম্প্রদায়ের দরিদ্র হয়ে পড়াটা দেখতে আমার বিরক্তি হয়ে, ক্ষোভ হয়, আমি নিজে এ সম্প্রদায়ের একজন এবং সম্প্রদায়ভেদ মিলিয়ে যেতে থাকা সত্ত্বেও আমি এ সম্প্রদায়ের একজন বলে আনন্দ হয় আমার। আর দরিদ্র হয়ে পড়ছে বিলাসের জন্যে নয়, তেমন কিছু-একটা ব্যাপার নয় ওটা; সাড়ম্বরে দিন কাটানো—এটা অভিজাতদের ব্যাপার, ওরাই তা পারে। এখন আমাদের আশেপাশের চাষীরা জমি কিনে নিচ্ছে— আমার তাতে দুঃখ নেই। লোকটা কিছুই করেন না, চাষী খাটছে, কোণঠাসা করছে নিষ্কর্মাকে। তাই তো হওয়া উচিত। চাষীর জন্যে ভারি আনন্দ হয় আমার। কিন্তু কেমন একটা, জানি না কি বলা যায়, নিরীহতার দরুন এই দরিদ্র হওয়াটা দেখলে আমার রাগ হয়। এখানে এক খাজনা-দায়ী পোলীয় চাষী অর্ধেক দামে চমৎকার একটা সম্পত্তি কিনে নিল অভিজাত জমিদার-গিন্নির কাছ থেকে, যিনি বসবাস করেন বিদেশে, নীসে। ওখানে বেনিয়াকে জমি ইজারা দেওয়া হল দেসিয়াতিনা পিছু এক রুব্‌ল হারে, যার দর দশ রুল। আর তুমি খামোকা ওই চোয়াড়টাকে দান করে দিলে তিরিশ হাজার।’

‘তা করবটা কি, গাছ গুনব?’

‘অবশ্য-অবশ্যই শুনতে হবে। তুমি গুনলে না, ওদিকে রিয়াবিনিন গুনল। বেঁচে-বর্তে থাকা, লেখাপড়া করার টাকা থাকবে রিয়াবিনিনের ছেলেমেয়েদের, তোমার ছেলেমেয়েদের কিন্তু সেটি থাকবে না রে!’

‘কিন্তু মাপ কর আমাকে, এই গোনাগুনতির মধ্যে কেমন একটা ছোটলোকামি আছে। আমাদের আছে নিজেদের কাজকর্ম, ওদের নিজেদের, তা ছাড়া লাভও ওদের চাই। তবে যাক গে, ব্যাপরটা ঢুকে গেছে, ব্যস। আর এই ডিম- ভাজা, এটি আমার প্রিয় খাদ্য। তাছাড়া, আগাফিয়া মিখাইলোভনা আমাদের তো দেবেন ওই-যে গাছড়ায় জারানো ভোদ্‌কা।’

খাবার টেবিলে বসলেন অব্‌লোন্‌স্কি রসিকতা শুরু করলেন আগাফিয়া মিখাইলোভনার সাথে, তাঁকে নিশ্চয় করে বোঝালেন যে এমন ভোজন আর নৈশহারা তাঁর দীর্ঘকাল জোটেনি।

আগাফিয়া মিখাইলোভনা বললেন, ‘আপনি যা-হোক তবু তারিফ করছেন, কিন্তু কনস্তান্তিন দৃদ্‌মিত্রিচ, যা-ই ওকে দিই-না, পাঁউরুটির চটা হলেও তাই খেয়েই বেরিয়ে যাবে।’

নিজেকে দখলে রাখার শত চেষ্টা সত্ত্বেও লেভিন ছিলেন মনমরা, চুপ করে রইলেন। অব্‌লোন্‌স্কির কাছে একটা প্রশ্ন করার ছিল তাঁর, কিন্তু মন স্থির করে উঠতে পারছিলেন না, তিনি সেটা কখন কিভাবে করা যায় তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। অব্‌লোন্‌স্কি তাঁর নিজের ঘরে গেলেন নিচু তলায়, পোশাক ছাড়লেন, হাত-মুখ ধুলেন, কুঁচি দেওয়া নৈশ কামিজ পড়ে শুলেন, লেভিন কিন্তু তাঁর ঘরে নানা আজেবাজে কথা বলে ইতস্তত করতে থাকলেন, যা চাইছিলেন সেটা জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছিল না তাঁর।

আগাফিয়া মিখাইলোভনা অতিথির জন্য যে সুগন্ধি সাবান দিয়েছিলেন কিন্তু অব্‌লোন্‌স্কি যা ব্যবহার করেননি, তার দিকে তাকিয়ে মোড়ক খুলে বললেন, ‘কি আশ্চর্য সাবান বানাচ্ছে এরা। তাকিয়ে দ্যাখ, এ যে একেবারে শিল্পকর্ম।’

‘হ্যাঁ, সবই আজকাল কি নিখুঁতই-না হচ্ছে’, অব্‌লোন্‌স্কি বললেন সজল সুপরিতুষ্ট হাই তুলে, ‘যেমন ধর এসব থিয়েটার। প্রমোদভবন… আহ্!’ আবার হাই, ‘সবখানে বিজলী বাতি…..আ-আ-আ!’

‘হ্যাঁ, বিজলী বাতি’, বললেন লেভিন, তা বটে, কিন্তু ভ্রন্‌স্কি এখন কোথায়?’ সাবানটা রেখে দিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

হাই তোলা থামিয়ে অব্‌লোন্‌স্কি বললেন, ‘ভ্রন্‌স্কি? সে এখন পিটার্সবুর্গে। তোমার ঠিক পরেই চলে যায়, তারপর একবারও মস্কো আসেনি। শোন কস্তিয়া, আমি তোমাকে সত্যি বলছি’, টেবিলে কনুই ভর দিয়ে সুন্দর রাঙা মুখে হাত রেখে তিনি বলে চললেন, ভাবাকুল সদাশয় নিদ্রালু চোখে তাঁর তারার মত ছটা, ‘তোমারই দোষ। প্রতিদ্বন্দ্বীকে তুমি ভয় পেলে। আর আমি তখন যা বলেছিলাম, আমি জানি না কার চান্স বেশি। এস্পার-ওস্পার করলে না কেন? আমি তোমাকে তখন বলেছিলাম যে…’ মুখ পুরো না খুলে একটা চিবুক দিয়ে হাই তুললেন তিনি।

তাঁর দিকে তাকিয়ে লেভিন ভাবলেন, ‘আমি যে পাণিপ্রার্থনা করেছিলাম সে কি ও জানে, নাকি জানে না? কেমন একটা কূটকৌশলী ধূর্ত ভাব দেখা যাচ্ছে ওর মুখে।’ এবং লাল হয়ে উঠছেন টের পেয়ে তিনি সরাসরি চাইলেন অব্‌লোন্‌স্কির চোখের দিকে। অবলোন্স্কি বলে গেলেন, ‘কিটির দিক থেকে তখন কিছু থাকলে সেটা ছিল বাইরের চাকচিক্যের আকর্ষণ। এই নিখুঁত আভিজাত্য আর সমাজে তার ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠা প্রভাবিত করেছিল কিটিকে নয়, তার মাকে।’

ভুরু কোঁচকালেন লেভিন। প্রত্যাখ্যানের যে হীনতা তাঁকে সইতে হয়েছিল, সেটা যেন তাজা, সদ্যোহানা একটা আঘাত হয়ে দগ্ধ করল তাঁর হৃদয়। তবে তিনি নিজের বাড়িতে, আর বাড়ির দেয়াল সব সময়ই কিছু কাজ দেয়।

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও’, অব্‌লোন্‌স্কিকে থামিয়ে দিয়ে লেভিন বললেন, ‘বলছ, আভিজাত্য। কিন্তু তোমাকে জিজ্ঞেস করি, ভ্রন্‌স্কি বা আর যে-কেউ হোক না কেন, তার আভিজাত্যটা কিসে, এমন আভিজাত্য যাতে আমাকে হেয় জ্ঞান করবে? ভ্রন্‌স্কিকে তুমি অভিজাত বলে ভাব, আমি ভাবি না। এমন একটা লোক, বাপ যার নেহাত কেউকেটা থেকে বাগিয়ে-টাগিয়ে ওপরে উঠেছে, মায়ের যার সৃষ্টিকর্তা জানেন সংগম নেই কার সাথে…না ভাই, মাপ কর, অভিজাত বলে আমি মনে করি নিজেকে এবং আমার মত লোকদের যারা অতীতের তিন-চার পুরুষ পর্যন্ত অতি উচ্চমানে শিক্ষিত সদ্‌বংশের দিকে আঙুল দেখাতে পারে, (প্রতিভা, এবং বুদ্ধিমত্তা অন্য ব্যাপারে), যাকা কখনো কারো তোষামোদ করেনি, কারো মুখাপেক্ষী থাকেনি, যেভাবে দিন কাটিয়ে গেছেন আমার বাবা, আমার দাদু। এ ধরনের লোক অনেক জানা আছে আমার। আমি যে বনের গাছ গুনে দেখি, এটা তোমার কাছে নীচতা বলে হয়, তিরিশ হাজার তুমি দান করে দাও রিয়াবিনিনকে; কিন্তু তুমি তো পাও খাজনা, জানি না আরো কি-সব পাও, আমি পাই না, তাই বংশ আর পরিশ্রমটাই আমার কাছে মূল্যবান…আমরাই অভিজাত, ওরা নয় যারা বেঁচে থাকে দুনিয়ার শক্তিধরদের কাছ থেকে পাওয়া মুষ্টিভিক্ষায়, দশ কোপেকেই যাদের কিনে নেওয়া যায়।

‘আরে, কার ওপর তুমি খাপ্পা হচ্ছ? আমি তোমার সাথে একমত’, অব্‌লোন্‌স্কি বললেন আন্তরিকতার সাথেই, খুশি হয়ে যদিও বুঝতে পারছিলেন যে দশ কোপকে দিয়ে যাদের কেনা যায়, তাদের দলে তাঁকেও ফেলছেন লেভিন। লেভিনের উত্তাপ ভালো লেগেছিল তাঁর। ‘কার ওপর খাপ্পা হচ্ছ তুমি?’ অবশ্য ভ্রন্‌স্কি সম্পর্কে তুমি যা বলছ তার অনেকখানিই সত্যি নয়, কিন্তু সে কথা আমি বলছি না। সোজাসুজি বলছি তোমাকে, আমি হলে একসাথে চলে যেতাম মস্কোয় এবং…’

‘উঁহু, আমি জানি না তুমি জান কিনা, তবে তাতে কিছু এসে যায় না আমার। তোমাকে বলেই রাখি, আমি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছি, কাতেরিনা আলেক্‌সান্দ্রভনা এখন আমার কাছে একটা গুরুভার, লজ্জাকর স্মৃতি। ‘

‘কেন? কি বাজে কথা!

‘কিন্তু ও-কথা আর নয়। তোমার ওপর যদি রূঢ়তা হয়ে থাকে, ক্ষমা কর ভাই’, লেভিন বললেন। বলার যা ছিল সবখানি বলে ফেলার পর উনি এখন আবার সেই সকাল বেলাকার মানুষ, ‘আমার ওপর রাগ করছ না তো, স্তিভা? রাগ করো না ভাই’, এই বলে তিনি হেসে বন্ধুর হাত ধরলেন।

‘আরে না, এতটুকু না, রাগ করার কিছুই নেই। আমাদের বোঝাবুঝি হয়ে গেল বলে আনন্দই হচ্ছে আমার। আর জান, সকালে পাখি আসে ভালো। আমি হয়ত ঘুমাবই না, শিকার থেকে সোজা স্টেশন।’

‘সেটা তো খুবই ভালোই।’

আঠারো

ভ্রন্‌স্কির ভেতরটা কামলালসায় ভরপুর হয়ে থাকলেও বাইরেটা অপরিবর্তিত, অব্যাহত ধারায় চলতে থাকল আগের মতই সামাজিক আর রেজিমেন্ট-কেন্দ্রিক সম্পর্কাদি ও স্বার্থের অভ্যস্ত পথে। রেমিজেন্টের স্বার্থ ভ্রন্‌স্কির জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়েছিল, সেটা এজন্যও বটে যে রেজিমেন্টেকে তিনি ভালোবাসতেন, কিন্তু আরো বেশি করে এজন্য যে রেজিমেন্টও ভালোবাসত তাঁকে। রেজিমেন্টের লোকেরা ভ্রন্‌স্কিকে শুধু ভালোই বাসত না, শ্রদ্ধাও করত, গর্ব বোধ করত তাঁকে নিয়ে, গর্বটা এজন্য যে বিপুল বিত্তশালী সুশিক্ষিত গুণবান এই যে লোকটার সামনে যত কিছু সাফল্য, আত্মাভিমান, উচ্চাভিলাষের পথ খোলা, তিনি কিনা এ সব কিছু তুচ্ছ করে জাগতিক সমস্ত স্বার্থের মধ্যে থেকে মনেপ্রাণে বরণ করে নিয়েছেন রেজিমেন্ট আর বন্ধুমহলের স্বার্থ। তাঁর সম্পর্কে সাথিদের এই মনোভাব ভ্রন্‌স্কির অজ্ঞাত ছিল না, আর এই জীবনটাকে ভালোবাসা ছাড়াও তাঁর সম্পর্কে যে মনোভাব গড়ে উঠেছে তার পোষকতা করাও নিজের কর্তব্য বলে জ্ঞান করতেন তিনি।

এক কথায়, সঙ্গীদের কারো কাছেই তিনি নিজের প্রেমের কথা বলতেন না, প্রচণ্ড পানোৎসবেও (নিজের ওপর দখল হারাবার মত মাতাল তিনি অবশ্য কখনো হতেন না) তাঁর পেটের কথা কিছু বেরিয়ে পড়ত না, লঘুচিত্ত তাঁর প্রণয় নিয়ে ইঙ্গিত করার চেষ্টা করত, তাদের মুখ বন্ধ করে দিতে পারতেন তিনি। কিন্তু তাহলেও তাঁর প্রেমের কথা জানাজানি হয়ে যায় গোটা শহরে—সবাই কম-বেশি অনুমান করতে পারত কারেনিনার সাথে তাঁর সম্পর্ক—তাঁর প্রেমের ব্যাপারে সবচেয়ে যেটা কষ্টকর তার জন্যই যুবকদের অধিকাংশ ঈর্ষা করত তাঁকে, যথা—কারেনিনের উচ্চ প্রতিষ্ঠা এবং সেই কারণে সমাজের চোখে এই প্রণয়টার দৃষ্টিকটুতা।

আন্নাকে যে ন্যায়পরায়ণা বলা হয়, এটা শুনে শুনে বহু দিন যাদের বিরক্তি ধরে গেছে, ঈর্ষান্বিত সে সব যুবতীদের অধিকাংশ খুশি হল তাদের আন্দাজ-অনুমানে, এবং অপেক্ষায় রইল কবে সামাজিক অভিমত পালটায়। যাতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তাদের ঘৃণার জগদ্দল পাথর নিয়ে। সময় হলে যেসব কাদার দলা তারা ছুঁড়ে মারবে, তা এর মধ্যে তৈরি হয়ে উঠছিল। এই যে সামাজিক কেলেঙ্কারির আয়োজন হচ্ছিল অধিকাংশ বয়স্ক ও উচ্চপদস্থ লোকে অসন্তুষ্ট হচ্ছিলেন তাতে।

ছেলের এই প্রেমলীলার কথা জেনে ভ্রন্‌স্কির মা প্রথমে খুশিই হয়েছিলেন। কেননা তাঁর ধারণা, উঁচু সমাজে একটা কাণ্ড বাঁধালে চৌকশ নবযুবকের যতটা শোভা বাড়ে, তেমন আর কিছুতে হয় না। তাছাড়া যে কারেনিনাকে তাঁর ভারি ভালো লেগেছিল। নিজের ছেলের কথা যিনি অত গল্প করেছিলেন, তিনিও কাউন্টেস ভ্রস্কয়ার মতে যা হওয়া উচিত, তেমনি সুন্দরী সুশীলা নারীর মতই। কিন্তু পরে তিনি জানতে পারলেন যে ভাগ্যোন্নতির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রস্তাব পেয়েও ছেলে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। শুধু রেজিমেন্টে থাকার জন্য যাতে কারেনিনার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, জানতে পান যে উচ্চপদস্থরা এর জন্য তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট, সুতরাং তিনি তাঁর মত পরিবর্তন করেন। তাছাড়া এই যোগাযোগ সম্পর্কে তিনি যা কিছু জেনেছিলেন, তা থেকে এটাও তাঁর ভালো লাগেনি যে ব্যাপারটা তেমন চমৎকার লালিত্যময় নয় যা তিনি অনুমোদন করতে পারেন, এ যে এক ভের্টের-মার্কা মরিয়া আবেগ যার পরিণতি হতে পারে কোন আহাম্মকিতে বলে তিনি শুনেছেন। হঠাৎ তাঁর মস্কো ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি তাঁকে দেখেননি, বড় ছেলের মারফত তিনি দাবি করেন যেন তিনি আসেন তাঁর কাছে।

ছোট ভাইয়ের ওপর বড় ভাইও সন্তুষ্ট ছিলেন না। এ ভালোবাসাটা কেমন, সামান্য নাকি প্রবল, উদ্বেল নাকি নিরাবেগ, পাতক নাকি নিষ্পাপ (সন্তানাদি থাকা সত্ত্বেও তিনি এক নর্তকীকে রক্ষিতা রেখেছিলেন, তাই এ ব্যাপারে তাঁর উদারতা ছিল), এ নিয়ে তিনি মাথা ঘামাননি; কিন্তু তিনি জানতেন যে এই ভালোবাসাটা যাঁদের ভালো লাগার কথা, তাঁদের তা লাগছে না, তাই তিনি ভাইয়ের আচরণ অনুমোদন করেননি।

ভ্রন্‌স্কির সৈন্যদল কাজ আর সমাজ ছাড়াও আরো একটা নেশা ছিল—ঘোড়া, এ নিয়ে পাগল তিনি অফিসারদের এ বছর হার্ডল-রেস হবার কথা আছে। ভ্রনস্কি তাতে নামে লেখান, কেনেন ভালো জাতের একটা বিলাতী মাদি ঘোড়া এবং প্রেমের ব্যাপারটা সত্ত্বেও আসন্ন ঘোড়দৌড় নিয়ে মেতে ওঠেন, যদিও সংযম না হারিয়ে…. অবশ্য এ নেশা দুটো পরস্পরবিরোধীও হয়নি। বরং প্রেম ছাড়াও তাঁর দরকার ছিল কাজ আর ব্যসন, যাতে তাজা হয়ে উঠতে পারেন, তাঁর বড় বেশি উত্তেজিত অনুভূতিটা বিশ্রাম পায়।

উনিশ

ভ্রন্‌স্কি ঘোড়দৌড়ের দিন তাঁর অভ্যস্ত সময়ের আগেই ক্রান্নয়ে সেলো গ্রামে রেজিমেন্টের ক্যান্টিনে বিফস্টিক খেতে এলেন। কড়া সংযম পালনের প্রয়োজন তাঁর ছিল না, কেননা তাঁর ওজন যা দরকার ঠিক তাই—সাড়ে চার পুদ, তবে মুটিয়ে ওঠাও চলে না, তাই ময়দার খাবার আর মিষ্টি জিনিস তিনি এড়িয়ে চলতেন। টেবিলে দুই কনুই রেখে বরাত দেওয়া বিফস্টিকের অপেক্ষায় বসে ছিলেন তিনি, সাদা ওয়েস্ট-কোটের ওপর জ্যাকেটের বোতাম খোলা, প্লেটের ওপর একটা ফরাসি নভেল ছিল, সেটা দেখছিলেন। বইটা দেখছিলেন কেবল যে সব অফিসার আসছে আর যাচ্ছে তাদের সাথে যাতে কথা বলতে না হয়। আর ভাবছিলেন। ভাবছিলেন যে ঘোড়দৌড়ের পর তাঁর সাথে দেখা করার কথা দিয়েছেন আন্না। তাঁর সাথে দেখা হয়নি তিন দিন। স্বামী বিদেশ থেকে ফিরেছেন, ফলে আজকের সাক্ষাৎটা সম্ভব হবে কিনা জানতেন না এবং সেটা কি করে জানা যায় তাও ভেবে পাচ্ছিলেন না। শেষবার তিনি আন্নাকে দেখেছেন তাঁর চাচাতো বোন বেত্‌সির পল্লীভবনে। কারেনিনদের পল্লীভবনে তিনি যেতেন যথাসম্ভব কম। এখন তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল সেখানে যাবার, এবং সেটা কিভাবে সম্ভব করা যায় তাই ভাবছিলেন। ‘অবশ্যই বলব যে ঘোড়দৌড়ে আন্না আসবেন কিনা তা জানার জন্যে বেত্‌সি আমাকে পাঠিয়েছেন। অবশ্যই যাব’, বইটা থেকে মাথা তুলে মনে মনে স্থির করলেন তিনি। তাঁকে দেখতে পাবার সুখকল্পনায় জ্বলজ্বল করে উঠল তাঁর মুখটা।

যে পরিচারক রুপার তপ্ত ডিশে বিফস্টিক এনে দিল, তাকে তিনি বললেন, ‘আমার বাড়িতে একজন লোক পাঠিয়ে বলে দাও যেন তাড়াতাড়ি ত্রয়কা নিয়ে আসে।’ তিনি ডিশটা টেনে নিয়ে খেতে শুরু করলেন।

পাশের বিলিয়ার্ড কক্ষ থেকে শোনা যাচ্ছিল বল মারার শব্দ, কথাবার্তা, হাসি। প্রবেশদ্বারে দেখা দিলেন দুজন অফিসার : একজন অল্পবয়সী, দুর্বল পাতলা মুখ, পেজ কোর থেকে রেজিমেন্টে এসেছে সম্প্রতি; অন্যজন মোটাসোটা বয়স্ক অফিসার, এক হাতে একটা ব্রেসলেট, চর্বি ঢাকা খুদে খুদে চোখ।

ভ্রন্‌স্কি তাকালেন ওঁদের দিকে, তারপর ভুরু কুঁচকে, যেন ওঁদের দেখেননি এমন ভাব করে আড়চোখে বইটার দিকে তাকিয়ে একই সাথে খেতে এবং পড়তে থাকলেন।

‘কি, কাজে নামার আগে একটু খেট মারা হচ্ছে বুঝি?’ ভ্রন্‌স্কির কাছে বসে বললেন মুটকো অফিসার। ‘দেখতেই পাচ্ছ’, ভুরু কুঁচকে, মুখ মুছে এবং তাঁর দিকে না তাকিয়ে ভ্রন্‌স্কি জবাব দিলেন।

মুটিয়ে যাবার ভয় হচ্ছে না?’ ছোকরা অফিসারটির জন্য একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে মুটকো বললেন।

‘কি?’ ভ্রনৃস্কি বললেন রাগত স্বরে, বিতৃষ্ণায় মুখ বিকৃত করলেন, দেখা গেল তাঁর সমান মাপের দাঁতের সারি।

‘মুটিয়ে যাবে বলে ভয় হচ্ছে না?’

‘ওহে, এক বোতল শেরি।’ কোন জবাব না দিয়ে ভ্রন্‌স্কি ডাকলেন পরিচারককে, বইটা অন্য দিকে সরিয়ে পড়ে যেতে লাগলেন।

মুটকো অফিসার সুরার তালিকাটা নিয়ে ফিরলেন ছোকরা অফিসারের দিকে।

তালিকাটা তাকে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি খাবে বেছে নাও।’

‘রাইন ওয়াইন’, ভ্রন্‌স্কির দিকে ভয়ে ভয়ে কটাক্ষে তাকিয়ে ছোকরা অফিসারটি বলল, সামান্য দেখা দেওয়া মোচে আঙুল বুলাতে লাগল সে। ভ্রন্‌স্কি মুখ ফেরাচ্ছেন না দেখে সে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘বিলিয়ার্ড ঘরে যাওয়া যাক।’

মুটকো অফিসার বাধ্যের মত উঠে গেলেন দরজার দিকে 1

এ সময় ঘরে ঢুকলেন দীর্ঘকায় রাশভারি ক্যাপটেন ইয়াভিন, তাচ্ছিল্যভরে অফিসার দুজনের দিকে ওপর থেকে মাথা নুইয়ে তিনি গেলেন ভ্রন্‌স্কির কাছে।

‘আরে, এই যে!’ প্রকাণ্ড হাতে ভ্রন্‌স্কির কাঁধপট্টিতে চাপড় মেরে তিনি বললেন। ভ্রন্‌স্কি রেগেমেগে তাকালেন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ মুখ তাঁর জ্বলজ্বল করে উঠল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ প্রশান্ত ও সুস্থির প্রীতিতে।

‘ভালো বুদ্ধি করেছিস আলিওশা’, জলদগম্ভীর উচ্চকণ্ঠে ক্যাপটেন বললেন, ‘এবার খা, তারপর একপাত্র মদ্য।’

‘নাঃ, ইচ্ছে করছে না।’

যে অফিসার দুজন এই সময় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁদের দিকে উপহাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইয়াভিন বললেন, ‘মানিকজোড়ই বটে!’ ভ্রন্‌স্কির পাশে তিনি বসলেন চেয়ারের পক্ষে বড় বেশি উঁচু আঁটো ব্রিচেস পরা পা দু’খানা তীক্ষ্ণ কোণে বেঁকিয়ে। ‘কাল ক্রাস্নেনস্কি থিয়েটারে এলি না যে? মন্দ করল না নুমেরভা। কোথায় ছিলি?’

ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘ভেস্কয়দের ওখানে।’

‘ও!’ ইয়াভিন মন্তব্য করলেন।

ইয়াভিন জুয়াড়ী, মদ্যপ, কোন নীতির বালাই তাঁর ছিল না। শুধু তাই নয়, বরং ছিল যত গর্হিত সব নীতি। রেজিমেন্টে ইনি ভ্রন্‌স্কির সেরা বন্ধু। ভ্রন্‌স্কি তাঁকে ভালোবাসতেন যেমন তাঁর অসাধারণ দৈহিক শক্তির জন্য, যা প্রকাশ পেত গেলাসের পর গেলাস মদ টানা, না ঘুমানো, অথচ একই রকম থেকে যাবার ক্ষমতায়, তেমনি তাঁর বিপুল নৈতিক শক্তির জন্য, যা প্রকাশ পেত তাঁর ওপরওয়ালা ও বন্ধুদের সাথে তাঁর সম্পর্কের ক্ষেত্রে, যা তাঁর প্রতি তাদের মনে ভীতি ও শ্রদ্ধা জাগাত, প্রকাশ পেত জুয়া খেলায়, আর খেলতেন হাজার হাজার টাকা এবং যত মদই টানুন, খেলতেন এমন সূক্ষ্ম অটল চালে যে ব্রিটিশ ক্লাবের পয়লা নম্বরের জুয়াড়ী বলে ধরা হত তাঁকে। ভ্রন্‌স্কি তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন বিশেষ করে এই কারণে যে, ইয়াভিন তাঁকে ভালোবাসতেন তাঁর নাম বা টাকাকড়ির জন্য নয়, তাঁর নিজের জন্যই, এটা তিনি অনুভব করতেন। সমস্ত লোকদের মধ্যে একা তাঁর কাছেই কেবল ভ্রন্‌স্কি নিজের প্রেমের ঘটনাটা বলতে পারতেন। ভ্রন্‌স্কি টের পেতেন যে সব কিছু ভাবপ্রবণতার প্রতি ইয়াভিন অবজ্ঞা পোষণ করেন বলে মনে হলেও যে প্রবল হৃদয়াবেগে তাঁর জীবন এমন ভরে উঠেছে সেটা তিনিই বুঝতে পারবেন। তাছাড়া তাঁর সন্দেহ ছিল না যে ইয়াভিন নিশ্চয় পরচর্চা আর কেলেঙ্কারিতে এখন আর তৃপ্তি পাচ্ছেন না, এই হৃদয়াবেগটা যেভাবে উচিত সেইভাবেই বুঝবেন, অর্থাৎ জানেন এবং বিশ্বাস করেন যে এই প্রেমটা ঠাট্টা কি মজার ব্যাপার নয়, অতি গুরুত্বপূর্ণ। নিজের প্রেমের কথা ভ্রন্‌স্কি ওঁকে বলেননি, কিন্তু জানতেন যে তিনি সবই জানেন, যা উচিত তা সবই বুঝছেন, সেটা ওঁর চোখে লেখা আছে দেখে ভ্রন্‌স্কির আনন্দ হত।

‘ও, হ্যাঁ!’ ভ্রন্‌স্কি ভের্স্কয়দের ওখানে ছিলেন শুনে মন্তব্য করলেন ইয়াভিন এবং তাঁর যা বদভ্যাস, কালো চোখ জ্বলজ্বল করে মোচের বাঁ দিকটা মুখে পুরলেন।

‘আর কাল তুই কি করলি? জিতেছিস?’ ইয়াভিন জিজ্ঞেস করলেন।

‘আট হাজার। তবে তিন হাজারের নিশ্চয়তা নেই, পাব কিনা সন্দেহ।’

‘তা আমাকে বাজি ধরে হারতেও পারিস’, হেসে বললেন ভ্রন্‌স্কি। (ভ্রন্‌স্কির ওপর বড় একটা বাজি ধরেছিলেন ইয়াভিন)।

‘হারব না কিছুতেই। ভয় শুধু মাখোতিনকে।’

আলাপ চলল আজকের ঘোড়দৌড়ের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে, ভ্রন্‌স্কির চিন্তা শুধু ওটাই।

‘যাওয়া যাক। আমার খাওয়া শেষ’, উঠে দরজার দিকে গেলেন ভ্রন্‌স্কি। ইয়াভিন ও তাঁর বিশাল পা আর লম্বা পিঠ টান করে উঠে দাঁড়ালেন।

‘খেতে আমার দেরি আছে, কিন্তু পান করা দরকার, এখনই আসছি। ওহে, মদ!’ রেজিমেন্টে বিখ্যাত তাঁর গমগমে গলায় শার্সি কাঁপিয়ে হাঁক দিলেন ইয়াভিন। ‘নাঃ দরকার নেই’, তৎক্ষণাৎ আবার তিনি চেঁচালেন, ‘তুই বাড়ি যাচ্ছিস, আমিও যাই তোর সাথে।’ এ কথা বলে বেরিয়ে গেলেন দুজনেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *