আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ১.২০

বিশ

আন্না সারাটা দিন বাড়িতে, অর্থাৎ অব্‌লোন্‌স্কিদের ওখানে কাটালেন। পরিচিত কারো সাথে দেখা করলেন না। আন্নার আসার খবর পেয়ে তাঁরা সেদিনই এসে হাজির হয়েছিলেন। সকালটা তিনি কাটালেন ডল্লি আর ছেলেমেয়েদের সাথে। ভাইকে চিঠি লিখে পাঠালেন তিনি যেন অবশ্য-অবশ্যই বাড়িতে খান। লিখলেন, ‘চলে এসো, সৃষ্টিকর্তা করুণাময়।’

বাড়িতেই খেলেন অব্‌লোন্‌স্কি; কথাবার্তা হল সাধারণ। স্ত্রী তাঁর সাথে কথা বললেন ‘তুমি’ বলে, যেটা আগে বলছিলেন না। স্ত্রী-স্বামীর মধ্যে সম্পর্কে একইরকম অনাত্মীয়তা রয়ে গেল, কিন্তু ছাড়াছাড়ির প্রশ্ন আর ছিল না এবং ব্যাখ্যা করে মিটিয়ে নেবার সম্ভাবনা দেখতে পেলেন অব্‌লোন্‌স্কি।

খাওয়ার ঠিক পরেই এল কিটি। আন্না আর্কাদিয়েভনাকে কিটি চিনত, তবে খুবই সামান্য। বোনের কাছে কিটি এল একটু ভয়-ভয় মনেই, পিটার্সবুর্গের উচ্চ সমাজের এই যে মহিলাকে সবাই এত প্রশংসা করে, তিনি কিভাবে তাকে গ্রহণ করবেন এই নিয়ে তার শংকা ছিল। কিন্তু কিটিকে ভালো লাগল আন্না আর্কাদিয়েভনার—এটা সে তখনই টের পেল। স্পষ্টতই আন্না মুগ্ধ হয়েছিলেন কিটির রূপ ও তারুণ্যে এবং কিটি সচেতন হতে না হতেই অনুভব করল যে সে শুধু আন্নার প্রভাবে পড়েছে তাই নয়, তাঁকে ভালোবেসেও ফেলেছে, যেভাবে কোন তরুণী ভালোবাসতে পারে বয়সে বড় বিবাহিত কোন মহিলাকে। আন্নাকে উঁচু সমাজের মহিলা বা আট বছর বয়স্ক ছেলের মা বলেও মনে হল না। বরং গতির নমনীয়তা, সতেজ ভাব আর মুখের যে সজীবতা কখনো তাঁর হাসিতে, কখনো দৃষ্টিতে ফুটে উঠত তাতে তাঁকে বিশ বছরের তরুণীর মতই লাগে, অবশ্য যদি তাঁর সে মুখ গম্ভীর, মাঝে মাঝে বিষণ্ন ভাবে ধারণ না করত। সেটায় বিস্মিত ও আকৃষ্ট বোধ করল কিটি। সে অনুভব করছিল যে আন্না একেবারে সহজ মানুষ, কিছুই লুকিয়ে রাখেন না, তবু কিটির কাছে অনধিগম্য জটিল কাব্যিক আগ্রহের একটা উঁচু ধরনের জগৎ যেন তাঁর মধ্যে বিরাজমান।

ডল্লি যখন আহারের পর উঠে গেলেন তাঁর ঘরে, আন্না দ্রুত চলে গেলেন ধূমপানরত ভাইয়ের কাছে। ফুর্তি করে চোখ মটকে তাঁর ওপর ক্রুশ করে চোখ দিয়ে দরজার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘যাও স্তিভা, সৃষ্টিকর্তা তোমার মঙ্গল করুন!’

আন্নার কথা ধরতে পেরে তিনি চুরুট ফেলে দিয়ে অন্তর্ধান করলেন দরজার ওপাশে।

অব্‌লোন্‌স্কি চলে যেতে তিনি ফিরলেন সোফায়, সেখানে রইলেন শিশু পরিবৃত হয়ে। তা যে এই ফুফুকে ভালোবাসেন সেটা তাদের চোখে পড়েছিল বলেই কি, অথবা তারা নিজেরাই তাঁর মধ্যে একটা বিশেষ মাধুর্য অনুভব করেছিল বলেই হোক, তবে বড় দুটো আর তাদের দেখাদেখি ছোটরাও, শিশুদের বেলায় যা প্রায়ই ঘটে থাকে, আহারের আগে থেকেই নতুন ফুফুকে ছেঁকে ধরেছিল, সঙ্গ ছাড়ছিল না তাঁর। কি করে ফুফুর যথাসম্ভব কাছ ঘেঁসে বসা যায়, তাঁকে ছোঁয়া যায়, তাঁর ছোট্ট হাতখানা নিয়ে চুমু খাওয়া যায়, খেলা করা যায় তাঁর আংটি নিয়ে, অন্তত তাঁর পোশাকের কুঁচি নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায় এই নিয়ে যেন একটা খেলা শুরু হয়ে গেল তাদের মধ্যে।

নিজের জায়গায় বসে আন্না বললেন, ‘নাও, নাও, আগে যে যেমন বসেছিলাম।’

এবং আবার গ্রিশা তাঁর হাতের তল দিয়ে মাথা গলিয়ে পোশাকের ওপর মাথা রাখলে, গর্বে আর সুখে জ্বলজ্বল করে উঠল সে।

‘তা বলনাচটা হচ্ছে কখন?’ কিটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘সামনের সপ্তাহে। চমৎকার নাচ। যেখানে সব সময়ই ফুর্তি লাগে তেমনি ধরনের একটা।’

‘কিন্তু এমন বলনাচ আছে কি যেখানে সব সময়ই ফুর্তি জমে?’ স্নিগ্ধ রহস্যের সুরে বললেন তিনি।

‘আশ্চর্য লাগলেও আছে। বব্রিশ্যেভদের ওখানে সব সময় জমে, নিকিতিনদের ওখানেও, কিন্তু মেঝকোভদের ওখানে সব সময়ই একঘেয়ে। আপনি কি লক্ষ্য করেননি?’

‘না, বোন, ফুর্তির বলনাচ আমার আর নেই’, আন্না বললেন আর কিটি তার চোখে দেখল সেই বিশেষ জগৎ যা তার কাছে অনুদ্ঘাটিত, ‘আমার কাছে শুধু তেমন বলনাচই সম্ভব যা কম দুঃসহ, কম একঘেয়ে … ‘

‘বলনাচে আপনার একঘেয়ে লাগে কেমন করে?’

‘কেন একঘেয়ে লাগবে না আমার?’ জিজ্ঞেস করলেন আন্না।

কিটি লক্ষ্য করল যে কি উত্তর আসবে সেটা আন্নার জানা।

‘আপনি সব সময় সবার চেয়ে সেরা বলে।’

লাল হয়ে ওঠার সামর্থ্য আন্নার ছিল। লাল হয়ে তিনি বললেন :

‘প্রথমত, কখনোই তা নই। দ্বিতীয়ত, যদি হইও তাতে আমার কি এসে গেল?’

কিটি জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এই বলনাচে যাবেন?’

‘আমার মনে হয় না গিয়ে চলবে না। এই নে’, তিনি বললেন তানিয়াকে, ক্রমশ সরু হয়ে আসা তাঁর সাদা আঙুল থেকে সহজে খসে আসা একটা আংটি টানাটানি করছিল সে।

‘আপনি গেলে ভারি খুশি হব আমি। বলনাচে আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে আমার।’

‘অন্তত যদি যেতে হয়, তাহলে এই ভেবে প্রবোধ মানব যে এতে আপনি আনন্দ পেয়েছেন… গ্রিশা টানাটানি করিস না রে, এমনিতেই সব আলুথালু হয়ে আছে’, বেরিয়ে আসা যে একগোছা চুল নিয়ে গ্রিসা খেলছিল, সেটা ঠিক করে নিয়ে বললেন তিনি।

‘বলনাচে আমি আপনাকে কল্পনা করছি ভায়োলেট রঙের পোশাকে।’

‘ঠিক ভায়োলেট রঙই হতে হবে কেন?’ হেসে জিজ্ঞেস করলেন আন্না, ‘নাও ছেলেমেয়েরা, যাও এবার, যাও। শুনছ না, মিস গুল ডাকছেন চা খেতে’, ছেলেদের হাত থেকে নিজেকে খসিয়ে তাদের ডাইনিং-রুমে পাঠাতে পাঠাতে বললেন তিনি 1

‘আর আমি জানি কেন আপনি আমাকে বলনাচে ডাকছেন। এই বলনাচটা থেকে আপনার আশা অনেক, তাই আপনার ইচ্ছে হচ্ছে সবাই যেন সেখানে থাকে, তাতে যোগ দেয়।’

‘কি করে জানলেন? হ্যাঁ, তাই।’

‘ওহ্ কি চমৎকার আপনাদের এই বয়সটা’, আন্না বলে চললেন, ‘বেশ মনে আছে, সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ের ওপরকার নীল কুয়াশার মত এই কুয়াশাটা যে আমার চেনা। এ কুয়াশা পুলকে ছেয়ে দেয় ওই বয়সটাকে, যখন শৈশব এই শেষ হল বলে, আর এই বিশাল সুখী মহলটা থেকে কেবলি বেরিয়ে আসছে পথ, আর সারি সারি এই কক্ষগুলোয় ঢুকতে যেমন আনন্দ হচ্ছে, তেমনি ভয়ও করছে যদিও মনে হচ্ছে এ হর্ম্য যেন উজ্জ্বল আর অপরূপ…কে না গেছে এর ভেতর দিয়ে?

নীরবে হাসল কিটি। আন্নার স্বামী আলেক্‌সেই আলেক্সান্দ্রভিচ কারেনিনের অকাব্যিক চেহারাটা মনে করে সে ভাবল, ‘কিন্তু কেমন করে উনি গেলেন এর ভেতর দিয়ে? ওঁর সমস্ত রোমান্সটা জানতে আমার ভারি ইচ্ছে।’

‘আমি কিছু কিছু জানি। স্তিভা আমাকে বলেছে, অভিনন্দন জানাই আপনাকে, লোকটিকে আমার ভারি ভালো

লেগেছে’, আন্না বলে চললেন, ‘ভ্রন্‌স্কির সাথে আমার দেখা হয়েছে রেল স্টেশনে।’

‘আরে, উনি গিয়েছিলেন সেখানে?’ লাল হয়ে জিজ্ঞেস করল কিটি, ‘স্তিভা কি বলেছে আপনাকে?’

‘বকবক করে স্তিভা আমাকে সবই বলে ফেলেছে। আমিও খুব খুশি হয়েছি। কাল আমি ট্রেনে এসেছি প্রস্কির মায়ের সাথে’, আন্না বলে চললেন, ‘মা-র মুখে কেবলি ছেলের কথা; এটি ওঁর আদরের ছেলে; মায়েরা কিরকম পক্ষপাতী হয় তা আমি জানি, কিন্তু …‘

‘মা আপনাকে কি বললেন?

‘সে অনেক! আমি জানি যে ও মায়ের আদরের ছেলে, তাহলেও দেখেই বোঝা যায় সে বীরব্রতী… যেমন, ম বলেছেন সে তার সব সম্পত্তি ভাইকে দিয়ে দিতে চেয়েছিল, ছেলেবেলাতেই অসাধারণ একটা কাণ্ড করেছে সে, পানিতে ডোবা থেকে একটা মেয়েকে বাঁচিয়েছে। মোট কথা বীর…’ হেসে বললেন আন্না। স্টেশনে যে দু’শ রুবুল দিয়েছেন, সেটা স্মরণ করলেন তিনি।

কিন্তু ওই দু’শ রুলের কথাটা উনি বললেন না। কেন জানি সেটা মনে করতে তাঁর খারাপ লাগছিল। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে ঘটনাটার সাথে তাঁরও যেন কিছু-একটা যোগ আছে যা থাকা উচিত ছিল না।

আন্না বললেন, ‘কাউন্টেস আমাকে খুব করে তাঁর ওখানে যেতে বলেছেন। বুড়িকে দেখতে যেতে আমার আনন্দই হবে, কালই যার। তবে, থাক, বাবা, স্তিভা ডল্লির ঘরে রয়েছে অনেকক্ষণ’, আলাপের প্রসঙ্গ বদলিয়ে যোগ করলেন আন্না এবং উঠে দাঁড়ালেন, কিটির মনে হল কেন জানি অসন্তুষ্ট হয়েছেন তিনি।

‘না-না, আগে আমি! না আমি!’ চা-পর্ব শেষ করে আন্না খালার কাছে ছুটে আসতে আসতে ছেয়ে-মেয়েরা চেঁচাচ্ছিল।

‘আমরা সবাই একসাথে’, এই বলে আন্না হাসতে হাসতে ছুটে গেলেন তাদের দিকে, উল্লাসে চেঁচামেচি করা এই গোটা দলটাকে এবং সবাইকে জড়িয়ে ধরে ঢিপ করে ফেললেন।

একুশ

ডল্লি তাঁর ঘর থেকে বেরোলেন বড়দের চায়ের সময়। অবলোন্স্কি বেরোলেন না। তিনি নিশ্চয় পেছনের দরজা দিয়ে স্ত্রীর ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন।

ডল্লি আন্নার দিকে ফিরে বললেন, ‘আমার ভয় হচ্ছে, ওপরে তোমার শীত করবে। আমার ইচ্ছে তোমাকে নিচে নামিয়ে আনি, দুজনে কাছাকাছিও থাকা যাবে।’

‘আরে না, আমার জন্য ভাবনা নেই’, ডল্লির মুখের দিকে তাকিয়ে মিটমাট হয়ে গেছে কিনা আন্দাজ করার চেষ্টা করে বললেন আন্না।

ভাবী বললেন, ‘এখানে আলো হত বেশি।’

‘তোমাকে বলছি যে সবখানে এবং সব সময় আমি অঘোরে ঘুমাই।’

‘কি নিয়ে কথা হচ্ছে’, স্টাডি থেকে বেরিয়ে বৌকে উদ্দেশ করে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি।

তাঁর গলার সুরে কিটি এবং আন্না দুজনেই বুঝলেন যে মিটমাট হয়ে গেছে।

‘আমি চাইছি আন্নাকে নিচে নামিয়ে আনতে, তবে পর্দা টাঙাতে হবে নতুন করে। কিন্তু কেউ সেটা পারবে না, করতে হবে আমাকেই’, জবাবে স্বামীকে বললেন ডল্লি।

‘পুরো মিটমাট হয়েছে কিনা সৃষ্টিকর্তাই জানে না’, তাঁর নিরুত্তাপ অচঞ্চল গলা শুনে আন্না ভাবলেন।

স্বামী বললেন, ‘আহ্ ডল্লি, বাড়িয়ে বলো না। বল তো আমিই করে দিচ্ছি…’

‘হ্যাঁ, মিটমাট হয়েছে তাহলে’, ভাবলেন আন্না।

‘তুমি যে কি করবে তা বেশ জানা আছে সাহেব’, ডল্লি বললেন, ‘মাতভেইকে এমন কিছু করার হুকুম দেবে যা করা যায় না, আর নিজে যাবে বেরিয়ে। সেও সব গোলমাল করে বসবে।’ আর এ কথা বলার সময় ডল্লির ঠোঁটের কোন কুঁচকে উঠল তাঁর অভ্যস্ত শ্লেষের হাসিতে।

‘একেবারে! একেবারে মিটমাট, এক্কেবারে’, ভাবলেন আন্না, ‘মহান সৃষ্টিকর্তা!’ এবং তিনিই যে এর হেতু এতে খুশি হয়ে ডল্লির কাছে গিয়ে চুমু খেলেন তাঁকে।

‘মোটেই না। আমাকে আর মাতভেইকে এত তাচ্ছিল্য কেন কর বল তো?’ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে প্রায় অলক্ষ্য একটু হেসে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি।

বরাবরের মত সারাটা সন্ধ্যা ডল্লি স্বামীকে ঠাট্টা করে চললেন আর অব্‌লোন্‌স্কি রইলেন হাসিখুশি তুষ্ট হয়ে, কিন্তু শুধু ততটা যাতে না প্রকাশ পায় যে মার্জনা লাভ করায় তিনি তাঁর অপরাধ ভুলে গেছেন।

সাড়ে ন’টার সময় অব্‌লোন্‌স্কিদের বাড়িতে চায়ের আসরে সবিশেষ আনন্দময় প্রীতিকর পারিবারিক সান্ধ্যালাপটা ক্ষুণ্ণ হল বাহ্যত অতি সাধারণ একটা ঘটনায় কিন্তু সেই সাধারণ ঘটনাটাই কেন জানি সবার কাছে মনে হল অদ্ভুত। পিটার্সবুর্গের সাধারণ পরিচিতদের কথা বলতে বলতে আন্না ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমার অ্যালবামে ছবি আছে। ভালো কথা, আমার সেরিওজাকেও দেখাব তোমাদের’, গর্বিত মায়ের হাসি নিয়ে যোগ করলেন তিনি।

দশটার সময় যখন সাধারণত তিনি ছেলের কাছ থেকে বিদায় নিতেন এবং বলনাচে যাবার আগে নিজে শুইয়ে দিতেন তাকে, এখন তার কাছ থেকে এত দূরে আছেন ভেবে বিষণ্ণ লাগল তাঁর; এবং যা নিয়েই কথাবার্তা চলুক, থেকেই থেকেই তাঁর মন চলে যাচ্ছিল তাঁর কোঁকড়া-চুলো সেরিওজার পানে। তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল তার ছবিটা তাকিয়ে দেখে তার গল্প করে শোনায়, প্রথম অজুহাতের সুযোগ নিয়ে তিনি তাঁর লঘু, দৃঢ়চিত্ত চলনে উঠে গেলেন অ্যালবাম আনতে। ওপরে, তাঁর ঘরে যাবার সিঁড়িটা উঠেছিল। প্রধান সিঁড়ির উষ্ণ চাতাল থেকে।

ড্রয়িং-রুম থেকে বেরোতেই সদর হলঘরে ঘণ্টি শোনা গেল।

ডল্লি বলল, ‘কে এল আবার?’

কিটি টিপ্পনি কাটলে, ‘আমার জন্য এসে থাকলে আগেই এসেছে, আর কারো কারো পক্ষে দেরি করে।’

‘নিশ্চয় কাগজ নিয়ে এসেছে’, যোগ করলেন অব্‌লোন্‌স্কি আর আন্না যখন সিঁড়ির কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, চাকর ওপরে উঠছিল অভ্যাগতের খবর দিতে আর অভ্যাগত নিজে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাতির কাছে। নিচে তাকিয়ে আন্না তখনই চিনতে পারলেন ভ্রন্‌স্কিকে, এবং হঠাৎ তাঁর বুকের মধ্যে দুলে উঠল আনন্দ আর সেই সাথে ভয়ের একটা বিচিত্র অনুভূতি। ওভারকোট না ছেড়ে ভ্রন্‌স্কি দাঁড়িয়ে ছিলেন, কি যেন বার করছিলেন পকেট থেকে। আন্না যখন সিঁড়ির মাঝামাঝি উঠেছেন, ভ্রন্‌স্কি চোখ তুলতেই দেখতে পেলেন তাঁকে, মুখের ভাবে ফুটে উঠল কেমন একটা লজ্জা আর ভয়। আন্না সামান্য মাথা নত করে চলে গেলেন আর তার পরেই শোনা গেল আগতকে ভেতরে আসবার জন্য উচ্চৈস্বরে ডাকছেন অব্‌লোন্‌স্কি আর অনুচ্চ নরম, অচঞ্চল গলায় আপত্তি করছেন ভ্রন্‌স্কি।

অ্যালবাম নিয়ে আন্না যখন ফিরলেন, ভ্রন্‌স্কি তখন আর নেই। অব্‌লোন্‌স্কি বলছিলেন, নামকরা যে ব্যক্তিটি শহরে এসেছেন তাঁর জন্য যে ডিনার দেওয়া হচ্ছে তার কথা জানতে এসেছিলেন তিনি।

যোগ করলেন তিনি, ‘কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে চাইল না। আশ্চর্য লোক বটে।’

কিটি রাঙা হয়ে উঠল। তার মনে হল, কেন তিনি এসেছিলেন আর কেনই বা ভেতরে ঢুকলেন না, কেবল সে- ই বুঝেছে একা। সে ভাবছিল, ‘আমাদের ওখানে গিয়েছিল ও, আমাকে না পেয়ে ভেবেছিল আমি এখানে; আর ভেতরে যে ঢুকল না তার কারণ বড় দেরি হয়ে গেছে, তা ছাড়া আন্না রয়েছেন এখানে।’

কিছু না বলে সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে আন্নার অ্যালবাম দেখতে লাগলেন।

যে ডিনারের আয়োজন হচ্ছে তার খুঁটিনাটি জানার জন্য একটা লোক এসেছিলেন বন্ধুর কাছে কিন্তু ভেতরে ঢোকেননি, এর মধ্যে অসাধারণ বা অদ্ভুত কিছু নেই। কিন্তু সবার কাছেই এটা মনে হল অদ্ভূত। তবে আন্নার কাছেই সবচেয়ে বেশি করে অদ্ভুত আর বিশ্রী লাগল

বাইশ

আলোয় ঝলমলে ফুলের টব আর পাউডার মাখা এবং লাল কাফতান পরা সব চাপরাশি শোভিত প্রশস্ত সিঁড়িতে মায়ের সাথে কিটি যখন উঠল, বলনাচ তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে। হল থেকে আসছে গতিবিধির সমতাল মর্মর, যেন মধুচক্র, আর যখন তাঁরা গাছগুলোর মাঝখানকার চাতালে আয়নার সামনে কবরী আর পোশাক ঠিক করে নিচ্ছিলেন, হলে শোনা গেল অর্কেস্ট্রার বেহালায় প্রথম ওয়াজ নাচ শুরুর সন্তর্পণ সুস্পষ্ট সুর। অন্য এক আয়নার সামনে চাঁদির পাকা চুল সামলে আতরের গন্ধ ছড়িয়ে যেতে গিয়ে সিঁড়িতে তাঁদের সাথে ধাক্কা খেলেন বেসামরিক পোশাকের এক বৃদ্ধ, তাঁর কাছে অপরিচিত কিটিকে দেখে স্পষ্টতই মুগ্ধ হয়ে সরে গেলেন তিনি। ভয়ানক নিচু কাটের ওয়েস্ট কোট পরা শ্মশ্রুহীন এক তরুণ, উঁচু সমাজের যে ছোকরাদের বৃদ্ধ প্রিন্স শ্যেরবাৎস্কি বলতেন ন্যাকামণি তাদেরই একজন, যেতে যেতেই তার সাদা টাই ঠিক করতে করতে অভিবাদন করল ওঁদের উদ্দেশে এবং পাশ দিয়ে চলে গিয়ে আবার ফিরে এল কিটিকে কোয়াড্রিল নাচে আমন্ত্রণ জানাতে। কিটির প্রথম কোয়াড্রিল আগেই ভ্রন্‌স্কিকে দিয়ে রাখায় তরুণটিকে সে দ্বিতীয় নাচটা দিতে বাধ্য হল। দরজার কাছে দস্তানায় বোতাম আঁটতে আঁটতে ওঁদের পথ করে দিলেন সামরিক এক অফিসার এবং মোচে তা দিতে দিতে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল গোলাপি কিটির দিকে।

সাজসজ্জা, কবরী আর বলনাচের সব কিছু প্রস্তুতিতে কিটির প্রচ্যুর মেহনত আর কল্পনাশক্তির প্রয়োজন পড়লেও এখন তার গোলাপি আস্তরের ওপর জটিল ‘ত্যুল’ গাউনে বলনাচে নামল এমন স্বচ্ছন্দে আর সহজে যেন এসব রোজেট, লেস, সাজসজ্জায় নানা খুঁটিনাটির জন্য তার বা বাড়ির লোকেদের এক মুহূর্তও মাথা ঘামাতে হয়নি, যেন এই ত্যুল, লেস, ওপরে দুটো পাতা সমেত গোলাপ গোঁজা উঁচু কবরী নিয়েই সে জন্মেছে।

হলে ঢোকার মুখে প্রিন্স-মহিষী যখন তার কটির গুটিয়ে আসা রিবন ঠিক করে দিতে চাইলেন, কিটি আস্তে সরে গেল। তার মনে হচ্ছিল যে তার পোশাকের সব কিছুই আপনাআপনিই সুন্দর আর সৌষ্ঠবমণ্ডিত হওয়ার কথা, কিছুই সংশোধন করার প্রয়োজন নেই।

এটা ছিল কিটির এক সৌভাগ্যের দিন। গাউন আঁট হয়ে বসেনি কোথাও, বার্থা লেস কোথাও ঝুলে পড়েনি, দলামোচড়া হয়নি রোজেটগুলো, ছিঁড়েও যায়নি; উঁচু বাঁকা হিলের ওপর গোলাপি জুতোজোড়া খামচে ধরছে না, বরং ফূর্তি পাচ্ছে পা। সোনালি চুলের ঘন গুছি তার ছোট্ট মাথাটিতে খাপ খেয়ে গেছে তার নিজের চুলের মত। গড়ন না বদলিয়ে যে লম্বা দস্তানা তার হাত জড়িয়ে ছিল তার তিনটে বোতামই আঁটা, খসে আসেনি। ভারি একটা কোমলতায় তার গ্রীবা ঘিরে আছে কণ্ঠালংকারের কালো মখমল বন্ধনী। অপূর্ব সে মখমল, বাড়িতে আয়নায় নিজের গলা দেখে কিটি টের পেয়েছিল কি জানাতে চায় মখমলটি। আর সব কিছুতে খুঁতখুঁতি থাকলেও মখমল অপরূপ। এবং এখানে, এই বলনাচেও আয়নায় ওটা দেখে হাসি ফুটল কিটির মুখে। অনাবৃত কাঁধ আর হাতে মর্মরের শীতলতা অনুভব করল কিটি, এই অনুভূতিটা তার খুবই ভালো লাগে। জ্বলজ্বল করছিল তার চোখ, নিজের আকর্ষণীয়তার চেতনায় না হেসে পারছিল না তার রক্তিম ঠোঁট। হলে ঢুকে নাচের আমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষমাণ মহিলাদের ত্যুল-রিবন-লেস-রঙের ভিড়টায় পৌঁছতে-না-পৌঁছতেই (এরকম ভিড়ে কিটি কখনো দাঁড়িয়ে থাকেনি বেশিক্ষণ), ওয়াজে নাচার আমন্ত্রণ এল, আর আমন্ত্রণ করলেন কিনা নৃত্যের সেরা নাগর, বলনাচের পদাধিকারে প্রথম পুরুষ, তার খ্যাতনামা পরিচালক, আসরের অধিকারী, সামমণ্ডিত বিবাহিত সুপুরুষ এগুরুশকা কর্জুনস্কি। কাউন্টেস বানিনার সাথে তিনি প্রথম পালা ওয়াল্জ নাচ শেষ করে তাঁর এখতিয়ার, অর্থাৎ নৃত্যাবতীর্ণ কয়েক জোড়া নাচিয়ের ওপর চোখ বুলিয়ে দেখতে পেলেন কিটি আসছে, অমনি ছুটে গেলেন নৃত্যের পরিচালকদের পক্ষেই শুধু যা শোভা পায় তেমন একটা হেলা-ফেলা স্বাচ্ছন্দে এবং মাথা নত করে, সে রাজি আছে কিনা এমন কি সেটুকুও জিজ্ঞেস না করেই কিটির ক্ষীণ কটিদেশ আলিঙ্গনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিটি তাকিয়ে দেখল কাকে দেওয়া যায় তার হাতের পাখা, গৃহকর্ত্রী হেসে সেটা নিলেন।

‘ঠিক সময়ে এসে গিয়ে ভারি ভালো করেছেন’, কর্মনস্কি তার কোমর জড়িয়ে ধরে বললেন। ‘দেরি করে আসা সত্যি কি যে এক বদভ্যাস।’

কিটি তার বাঁ হাত বেঁকিয়ে রাখল তাঁর কাঁধে, গোলাপি জুতা পরা তার ছোট ছোট পা মেঝের চিকন পার্কেটের ওপর অনায়াসে তাল মেলাল সঙ্গীতের সাথে।

ওয়াজের প্রথম ধীর লয়-ছন্দ শুরু করে কিটিকে উনি বললেন, ‘আপনার সাথে ওয়াজ নাচা একটা আরাম। কি লঘুতা, কি লঘুতা, কি সঠিকতা’, সে কথাই তিনি ওকে বললেন যা বলতেন তাঁর প্রায় সমস্ত সুপরিচিতাদের।

কিটি হাসল তাঁর প্রশংসায় এবং তাঁর কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল হলঘরে। এমন নবাগতা সে নয়, যার কাছে বলনাচে সমস্ত লোকের মুখ মিলে যায় একক একটা ঐন্দ্রজালিক অনুভূতিতে; আবার বলনাচে ঢুঁ মেরে বেড়ানো তেমন কুমারীও সে নয়, যার কাছে সব মুখই চেনা, যাতে একঘেয়েমি লাগে; সে ছিল এই দুইয়ের মাঝামাঝি,—উত্তেজনা বোধ করছিল সে, কিন্তু সেই সাথে পর্যবেক্ষণ করার শক্তি রাখার মত দখলও ছিল তার নিজের ওপর। হলের বাম কোণে সে দেখল সমাজ চূড়ামণিদের জোট। সেখানে ছিল অসম্ভব রকমের অনাবৃত দেহে কর্সুনস্কির স্ত্রী, সুন্দরী লিদা, ছিলেন গৃহকর্ত্রী, নিজের টাক নিয়ে সেখানে জ্বলজ্বল করছেন ক্রিভিন, সমাজশ্রেষ্ঠরা যেখানে, সেখানে তিনি থাকেন সব সময়ই; কাছে যাবার সাহস না পেয়ে ছোকরারা তাকিয়ে দেখছিল সেদিকে; সেখানেই কিটির চোখে পড়ল স্তিভা, পরে দেখতে পেল কালো মখমলের পোশাকে আন্নার অপরূপ মূর্তি। তিনি-ও ছিলেন সেখানে। যে সন্ধ্যায় কিটি লেভিনকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তার পর থেকে সে আর তাঁকে দেখেনি। কিটি তার দূরবীক্ষণ দৃষ্টিতে তখনই চিনতে পারল তাঁকে। এটাও লক্ষ্য করল যে, ভ্রন্‌স্কি তাকিয়ে আছেন তার দিকে।

‘আরো এক পালা হবে নাকি? হাঁপিয়ে পড়েননি তো?’ সামান্য হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলেন কর্মনস্কি।

‘না-না, আপনাকে ধন্যবাদ।’

‘কোথায় পৌঁছে দেব আপনাকে?’

‘মনে হচ্ছে কারেনিনা রয়েছে ওখানে…ওঁর কাছে আমাকে নিয়ে চলুন।

‘যেখানে বলবেন, সেখানেই।’

কর্সুনস্কিও তাঁর পদক্ষেপ সংযত করে ওয়াল্জ নাচতে নাচতে চলে গেলেন হলের বাঁ কোণের সেই ভিড়টার দিকে। ফরাসি ভাষায় ক্রমাগত বলতে থাকলেন, ‘ভদ্রমহিলাগণ, মাপ করবেন! মাপ করবেন, মাপ করবেন ভদ্রমহিলাগণ’, এবং লেস্, ত্যুল, রিবনের সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে এদিক-ওদিক করে, কারো একটা পালক পর্যন্ত না ছুঁয়ে তাঁর নৃত্যসঙ্গিনীকে এমন সজোরে ঘোরালেন যে উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ল মিহি মোজা পরা তার তন্বী পা, পোশাকের পিছ-ঝুল গিয়ে জড়িয়ে পড়ল ক্রিভিনের হাঁটুতে। কর্মনস্কি মাথা নত করে খোলা বুক টান করে তাকে আন্না আর্কাদিয়েভনার কাছে নিয়ে যাবার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিটি লাল হয়ে ক্রিভিনের হাঁটু থেকে তার ঝুল খসিয়ে নিল। মাথা তখনো ঘুরছিল কিছুটা, আন্নার সন্ধানে তাকিয়ে দেখল চারদিকে। কিটি অবশ্য-অবশ্যই যা চেয়েছিল তেমন ভায়োলেট পোশাকে আন্না আসেননি। পরনে তাঁর নিচু কাটের কালো মখমলের গাউন, উদ্ঘাটিত তাঁর সুঠাম কাঁধ, বুক, যেন পুরানো হাতির দাঁতে খোদাই করা ছোট্ট ক্ষীণকায় মণিবন্ধ, সুডৌল বাহু। গোটা গাউন ভেনিসিয়ান লেসে সেলাই করা। নিজের কালো চুলে ভেজাল কিছু নেই, সেখানে প্যান্সি ফুলের ছোট একটা মালা, সাদা সাদা লেসের মাঝখানে কালো কোমরবন্ধেও তাই। কবরীর ছাঁদ চোখে পড়ার মত নয়, চোখে পড়ে শুধু তাঁর মাথার ওপরে আর পেছনে অনবরত খসে আসা কোঁকড়া চুলের ছোট ছোট স্বেচ্ছাচারী কুণ্ডল, যাতে খোঁপার শোভা বেড়েছে। দৃঢ় গ্রীবা যেন খোদাই করা, তাতে মুক্তার মালা।

আন্নাকে প্রতিদিন দেখেছে কিটি, তাঁর অনুরক্ত হয়ে উঠেছিল, চাইছিল অবশ্য-অবশ্যই তাঁকে ভায়োলেট পোশাকে দেখতে। কিন্তু এখন কালো পোশাকে তাঁকে দেখে সে টের পেল যে তাঁর সমস্ত লাবণ্য সে বুঝতে পারেনি। এখন তাঁকে সে দেখল একেবারে নতুন, নিজের কাছে অপ্রত্যাশিত এক রূপে। এখন সে উপলব্ধি করল যে ভায়োলেট পোশাক ওঁর পক্ষে অসম্ভব। ওঁর লালিত্য ঠিক এখানে যে সব সময়ই উনি তাঁর সাজসজ্জার ঊর্ধ্বে উঠে যান, বেশভূষা ওঁর কখনোই লক্ষণীয় হওয়া সম্ভব নয়। ফলাও লেস সমেত তাঁর গায়ের এই কালো পোশাকটাও চোখে পড়ছে না; ওটা কেবল একটা কাঠামো, চোখে পড়ছে কেবল ওঁকে সহজ, স্বাভাবিক, সুচারু, সেই সাথে হাসিখুশি, সজীব।

উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন বরাবরের মত অসাধারণ সিধে হয়ে, কিটি যখন এই দলটার কাছে আসে তখন তিনি গৃহকর্তার সাথে কথা বলছিলেন তাঁর দিকে সামান্য মাথা ফিরিয়ে।

‘না-না, আমি ঢিল ছুঁড়ছি না’, ওঁর কি-একটা কথায় তিনি বলছিলেন, ‘তবে আমি ঠিক বুঝি না’, কাঁধ কুঁচকে উনি বলে চললেন, এবং তখনই কিটির দিকে তাকালেন কোমল হাসিমুখে। তার সাজসজ্জায় রমণীর ত্বরিত দৃষ্টিপাত করে মাথা নাড়লেন অলক্ষ্যে কিন্তু কিটি বুঝল যে ওটা তার সাজ ও রূপ অনুমোদনের ভঙ্গি।—’আপনি হলে ঢুকছেন নাচতে নাচতে’, যোগ করলেন তিনি।

কর্সুনস্কি আন্না আর্কাদিয়েভনাকে আগে কখনো দেখেননি। তাঁর উদ্দেশে মাথা নত করে তিনি বললেন, ‘ইনি আমার একজন বিশ্বস্ত সহায়। বলনাচের আসরকে প্রিন্সেস হাসি-খুশি আর সুন্দর করে তুলতে সাহায্য করেন। আন্না আর্কাদিয়েভনা, ওয়াজের পালা’, আবার মাথা নত করে বললেন তিনি।

গৃহকর্তা বললেন, ‘আপনাদের কি পরিচয় ছিল?’

‘কার সাথে আমাদের পরিচয় নেই? সাদা রঙের নেকড়ের মত আমি আর আমার স্ত্রীকে চেনে সবাই’, জবাব দিলেন কর্সুনস্কি, ‘ওয়াজের পালা, আন্না আর্কাদিয়েভনা।’

আন্না বললেন, ‘পারা গেলে আমি নাচি না।’

কর্সুনস্কি জবাব দিলেন, ‘কিন্তু আজকে ওটি চলবে না।’

এই সময় এগিয়ে এলেন ভ্রন্‌স্কি।

‘তা আজকে যখন না নাচলে চলবে না, তখন চলুন’, ভ্রন্‌স্কির অভিবাদন খেয়াল না করে আন্না বললেন এবং দ্রুত হাত রাখলেন কর্মুনস্কির কাঁধে।

ভ্রন্‌স্কির অভিবাদনের প্রত্যুত্তর আন্না ইচ্ছে করে দিলেন না, এটা লক্ষ্য করে কিটি ভাবলে, ‘কেন ওর ওপর উনি অসন্তুষ্ট?’ ভ্রন্‌স্কি কিটির কাছে এসে প্রথম কোয়াড্রিলের কথাটা মনে করিয়ে দিলেন এবং এই কয়দিন তাকে দেখার আনন্দলাভ ঘটেনি বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন। আন্নার ওয়াজ নাচ কিটি দেখছিল মুগ্ধ হয়ে আর শুনে যাচ্ছিল ভ্রন্‌স্কির কথা। ভ্রন্‌স্কি তাকে নাচতে ডাকবেন বলে অপেক্ষা করছিল কিটি, কিন্তু উনি ডাকলেন না, অবাক হয়ে কিটি তাকাল তাঁর দিকে। ভ্রন্‌স্কি লাল হয়ে উঠে তাড়াতাড়ি করে তাকে আমন্ত্রণ জানালেন কিন্তু তার ক্ষীণ কটি জড়িয়ে ধরে প্রস্কি নাচ শুরু করতেই হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গীত। ভ্রন্‌স্কির মুখ ছিল কিটির একেবারে কাছে, সেদিকে তাকাল কিটি এবং ভালোবাসায় ভরপুর এই যে দৃষ্টিতে সে ভ্রন্‌স্কির দিকে তাকিয়ে ছিল ভ্রন্‌স্কি যার প্রতিদান দেননি, সেটা পরে অনেক দিন, বেদনার্ত লজ্জায় তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করেছে, কয়েক বছর পরেও।

‘Pardon, pardon! ওয়াজ, ওয়াজ হোক!’ হলের অন্য প্রান্ত থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন কর্সুনস্কি এবং নাচ শুরু করে দিলেন—সামনে যে ললনাকে প্রথম পেলেন তাকে নিয়েই।

তেইশ

ভ্রন্‌স্কি কয়েক পালা ওয়াজ নাচলেন কিটিকে নিয়ে। এর পর কিটি মায়ের কাছে এসে নস্টনের সাথে কয়েকটা কথা বলতে-না-বলতেই ভ্রন্‌স্কি এলেন প্রথম কোয়াড্রিলের জন্য। কোয়াড্রিল নাচের সময় উল্লেখযোগ্য কোন কথা হল না, ছেঁড়া ছেঁড়া আলাপ চলল কখনো কর্সুনস্কি দম্পতিকে নিয়ে, যাদেরকে তিনি ভারি মজা করে বলেছিলেন চল্লিশ বছরে মিষ্টি শিশু, কখনো ভবিষ্যৎ সাধারণ রঙ্গালয় নিয়ে; শুধু একবার আলাপটা কিটিকে খুব বিচলিত করেছিল যখন লেভিনের কথা জিজ্ঞেস করেন ভ্রন্‌স্কি, এখানে সে আছে কিনা এবং যোগ দেন যে লোকটিকে তাঁর খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু কোয়াড্রিল নাচ থেকে কিটির বেশি কিছু প্রত্যাশা ছিল না। দুরুদুরু বুকে সে অপেক্ষা করছিল মাজুরকা নাচের। তার মনে হয়েছিল মাজুরকাতেই সব সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। কোয়াড্রিল নাচের সময় উনি যে মাজুরকার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন না, তাতে কোন দুশ্চিন্তা হয়নি তার। আগেকার বলনাচগুলোর মত সে যে ওঁর সাথেই মাজুরকা নাচবে তাকে কোন সন্দেহ ছিল না কিটির, নাচছে বলে পাঁচজনের মাজুরকা আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করল সে। শেষ কোয়াড্রিল পর্যন্ত কিটির কাছে গোটা আসরটা ছিল আনন্দঘন বর্ণ, ধ্বনি আর গতির এক ঐন্দ্রজালিক স্বপ্ন। যখন বড় বেশি সে ক্লান্ত বোধ করে বিশ্রাম চায়, তখনই কেবল সে নাচেনি। কিন্তু নীরস যে তরুণটিকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব ছিল না, তার সাথে শেষ কোয়াড্রিল নাচের সময় সে পড়ে গেল ভ্রন্‌স্কি আর আন্নার মুখোমুখি। একেবারে সেই আসার পর থেকে সে আন্নার কাছাকাছি আর থাকেনি, এখন হঠাৎ তাঁকে দেখল আবার একটা নতুন, অপ্রত্যাশিত রূপে। সাফল্যজনিত উত্তেজনার যে চেহারাটা তার নিজের কাছেই অতি পরিচিত, সেটা সে দেখল আন্নার মধ্যে। যে উল্লাস তিনি সঞ্চার করেছেন তার মদিরায় আন্না মাতাল। এই অনুভূতিটা কিটির জানা, চেনে সে তার লক্ষণগুলোকে, তা সে দেখতে পেল আন্নার মধ্যে, দেখল চোখে ঝলকে ওঠা কাঁপা কাঁপা ছটা, সুখ আর উত্তেজনার হাসিতে আপনা থেকে বেঁকে যাওয়া ঠোঁট, গতির সুপ্রকট সৌষ্ঠব, যথার্থ আর লঘুতা।

সে মনে মনে ভাবল, ‘কে সে? সবাই, নাকি একজন?’ যে বেচারী ছোকরার সাথে সে নাচছিল কথোপকথনের খেই হারিয়ে ফেলে সে আর তা খুঁজে পাচ্ছিল না। কর্মুনস্কি সবাইকে কখনো বৃহৎ বৃত্ত’, কখনো-বা ‘শেকল’ নাচাচ্ছিল, বাহ্যত তাঁর ফুর্তিবাজ উচ্চকণ্ঠ আদেশ মেনে চলছিল কিটি। কথাবার্তায় ছোকরাকে কোন সাহায্য না করে কিটি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, ক্রমেই হিম হয়ে আসছিল তার বুক। ‘না, জনতার উচ্ছ্বাসে আন্না মাতাল হননি, এ শুধু একজনের প্রশংসা। এই কি সেই একজন? ভ্রন্‌স্কিই কি?’ প্রতি বার আন্নার সাথে তিনি যখন কথা বলছিলেন, আন্নার চোখে ঝলক দিচ্ছিল আনন্দের ছটা, সুখের হাসিতে বেঁকে যাচ্ছিল তাঁর রক্তিম ঠোঁট। আনন্দের এই লক্ষণগুলো যেন জোর করে চেপে রাখার চেষ্টা করছিলেন তিনি, কিন্তু আপনা থেকেই তা ফুটে উঠছিল তাঁর মুখে। ‘কিন্তু ভ্রন্‌স্কি?’ ভ্রন্‌স্কির দিকে তাকিয়ে ভয় পেল কিটি। আন্নার মুখের মুকুরে যা পরিষ্কার ধরতে পেরেছিল কিটি, তা সে দেখল ভ্রন্‌স্কির মধ্যেও। কোথায় গেল তাঁর বরাবরকার ধীর-স্থির ভঙ্গি, নিশ্চিন্ত প্রশান্ত মুখভাব? না, এখন উনি আন্নার সাথে কথা বলার সময় প্রতিবার সামান্য মাথা নোয়াচ্ছেন, যেন লুটিয়ে পড়তে চান আন্নার সামনে, তাঁর দৃষ্টিতে শুধুই বশ্যতা আর শংকার ছাপ। ‘আমি অপমান করতে চাই না’, প্রতিবার তাঁর দৃষ্টি যেন বলছিল। ‘নিজেকে আমি বাঁচাতে চাই, কিন্তু জানি না কেমন করে।’ মুখে তাঁর এমন একটা ভাব যা আগে সে কখনো দেখেনি।

দুজনের সাধারণ পরিচিতদের নিয়ে কথা বলছিলেন তাঁরা, একান্ত অকিঞ্চিৎকর আলাপ, কিন্তু কিটির মনে হল তাঁদের প্রতিটা কথাতেই তাঁদের ও কিটির ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। এবং এটা আশ্চর্য যে সত্যিই তাঁরা বলাবলি করছিলেন ইভান ইভানোভিচের ফরাসি বুকনি কি হাস্যকর এবং এলেৎস্কায়ার জন্য আরো ভালো বর জোটানো যেত, অথচ এসব কথাই তাৎপর্যময় হয়ে উঠছে তাঁদের কাছে আর কিটির মত তাঁরাও সেটা টের পাচ্ছেন। এখন বলনাচের গোটা আসর, সমস্ত উঁচু সমাজ, সবই কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল কিটির অন্তরে, শুধু শীলতার যে কঠোর বিদ্যালয়ের মধ্যে দিয়ে সে গেছে, সেটাই ধরে রাখছিল তাকে, বাধ্য করছিল তার কাছে যা প্রত্যাশা সেটা করতে, যথা, নাচা, প্রশ্নের জবাব দেওয়া, এমন কি হাসাও। কিন্তু ঠিক মাজুরকা শুরুর আগে যখন চেয়ারগুলো ঠিক করে রাখা হল, কিছু কিছু জুটি সরে গেল ছোটটা থেকে বড় হলঘরে, হতাশা আর আতংকের মুহূর্ত এল কিটির সামনে। পাঁচজনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে কিটি এবং এখন সে আর, কেননা উঁচু সমাজে তার সাফল্য খুবই বেশি, এখনো পর্যন্ত সে আমন্ত্ৰণ পায়নি, এমন কথা ভাবতেই পারেনি কেউ। সে অসুস্থ, মাকে এই কথা বলে বাড়ি চলে যাওয়াই উচিত ছিল তার, কিন্তু সেটুকু ক্ষমতাও তার ছিল না। একেবারে বিধ্বস্ত বলে তার মনে হচ্ছিল নিজেকে।

ছোট ড্রয়িং-রুমটার নিভৃতে গিয়ে সে বসে পড়ল একটা ইজি-চেয়ারে। তার তন্বী দেহ ঘিরে মেঘের মত ভেসে উঠল পোশাকের হাওয়াই স্কার্ট; বালিকার মত শীর্ণ, কমনীয়, অনাবৃত, শক্তিহীন একটা বাহু ডুবে গেল গোলাপি পোশাকের ভাঁজের মধ্যে; অন্য হাতটায় পাখা নিয়ে ছোট ছোট ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে হাওয়া করতে লাগল তার আতপ্ত মুখমণ্ডলে। কিন্তু সবে ঘাসের ওপর গিয়ে বসেছে, এখনই রংধনু ডানা মেলে ফরফর করে উঠবে এমন এক প্রজাপতির মত দেখালেও ভয়ংকর এক হতাশায় ভেঙে যাচ্ছিল তার বুক।

‘আর হয়ত ভুল হয়েছে আমার, অমন কিছু ঘটেনি?’

যা দেখেছে সেটা আবার মনে মনে স্মরণ করতে চাইল সে।

‘কিটি, এ আবার কি? গালিচার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে তার কাছে এসে বললেন কাউন্টেস নক্স্টন, ‘এ আমি বুঝতে পারছি না।’

কিটির নিচের ঠোঁট কেঁপে উঠল, তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল সে।

‘কিটি, মাজুরকা নাচ্ছ না তুমি?’

‘না’, অশ্রুতে কম্পমান কণ্ঠে কিটি বলল।

‘আমার সামনেই ওকে সে মাজুরকা নাচে ডাকল’, নষ্টন বললেন, ‘কে ‘ও’ আর কে ‘সে’, এটা কিটি বুঝবে বলে তাঁর জানাই ছিল। ‘ও বলল : কেন, প্রিন্সেস শ্যেরবাৎস্কায়ার সাথে নাচবেন না আপনি?’

কিটি বলল, ‘আহ্, ওতে আমার কিছু এসে যায় না!

কিটি নিজে ছাড়া আর কেউ বুঝছিল না তার অবস্থা, কেউ জানত না যে এই সেদিন সে একজনকে প্রত্যাখ্যান করেছে যাকে হয়ত সে ভালোই বাসতো এবং প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ বিশ্বাস করছিল অন্য একজনকে।

কর্সুনস্কিকে পাকড়াও করে তাঁর সাথে মাজুরকা নেচে কাউন্টেস নস্টন তাঁকে বললেন তিনি যেন কিটিকে নাচে ডাকেন।

কিটি নাচল প্রথম জুটিতে। সৌভাগ্যবশত কথা বলার প্রয়োজন তার ছিল না, কেননা, কর্মুনস্কি অনবরত ছোটাছুটি করে তাঁর কর্তৃত্ব ঠিক রাখছিলেন। ভ্রন্‌স্কি আর আন্না বসেছিলেন একেবারে প্রায় তার সামনেই। তাঁদের সে দেখেছিল তার দূরের দৃষ্টিতে, দেখেছিল কাছ থেকেও যখন জুটিতে জুটিতে তাঁরা মুখোমুখি হন, আর যত বেশি দেখল ততই সে নিঃসন্দেহ হয়ে উঠল যে তার দুর্ভাগ্য ঘটে গেছে, সে দেখল যে জনাকীর্ণ এই হলে নিজেদের একলা করে নিয়েছেন তাঁরা। ভ্রন্‌স্কির যে মুখভাবে সব সময়ই থাকত অমন একটা দৃঢ়তা আর স্বাধীনতার ছাপ, সেখানে কিটিকে বিমূঢ় করে দেখা দিয়েছে কেমন একটা অসহায়তা আর বশ্যতা, দোষ করলে বুদ্ধিমান কুকুরের মুখে যা ফুটে ওঠে।

আন্না হাসছিলেন, সে হাসি সঞ্চারিত হচ্ছিল তাঁর মধ্যেও। কিছু-একটা ভাবনা পেয়ে বসছিল আন্নাকে, অস্কিও হয়ে উঠছিলেন গুরুগম্ভীর। কি-একটা অপ্রাকৃত শক্তি কিটির চোখ টেনে ধরছিল আন্নার মুখে দিকে। নিজের সাধারণ কালো পোশাকে আন্না অপরূপ, অপরূপ তাঁর ব্রেসলেট-শোভিত পুরুষ্টু হাত, অপরূপ তাঁর মুক্তার মালা পরা দৃঢ় গ্রীবা, অপরূপ তাঁর কবরী এলোমেলো করা কুঞ্চিত কেশদাম, অপরূপ তাঁর ছোট ছোট পা আর হাতে ললিত লঘু গতি, সজীবতায় সুন্দর তাঁর মুখখানা অপরূপ; কিন্তু এই অপরূপতার মধ্যে ভয়াবহ, নিষ্ঠুর কিছু-একটাও যেন ছিল।

আগের চেয়েও কিটি মুগ্ধ হল তাঁর রূপে, আর ক্রমে কষ্ট পেতে লাগল বেশি করে। নিজেকে দলিত মনে হল তার, সেটা ফুটে উঠল তার মুখভাবে। মাজুরকা নাচে মুখোমুখি হয়ে ভ্রন্‌স্কি যখন তাকে দেখতে পান, চট করে চিনে উঠতে পারেননি—এতই বদলে গিয়েছিল কিটি!

‘চমৎকার নাচের আসর’, ভ্রন্‌স্কি বললেন কিছু-একটা বলতে হয় বলে।

কিটি বলল, ‘হ্যাঁ।’

মাজুরকার মাঝামাঝি কর্সুনস্কি উদ্ভাবিত একটা জটিল নৃত্যভঙ্গিমা অনুসরণ করে আন্না চলে এলেন বৃত্তের মাঝখানে, দুজন নৃত্য-সহচরকে নিয়ে একজন মহিলা আর কিটিকে ডাকলেন নিজের কাছে। যেতে যেতে কিটি ভীত চোখে তাকাল তাঁর দিকে। আন্না চোখ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আর হেসে চাপ দিলেন তার হাতে। কিন্তু কিটি মুখে শুধু একটা হতাশা আর বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়ে সে হাসির প্রত্যুত্তর দিল দেখে আন্না তার কাছ থেকে সরে অন্য মহিলার সাথে খুশির আলাপ জুড়লেন।

কিটি মনে মনে ভাবলে, ‘হ্যাঁ। বিজাতীয়, দানবিক আর সুমধুর কি-একটা আছে ওঁর মধ্যে।’ নৈশাহারের জন্য থেকে যাবার ইচ্ছে ছিল না আন্নার, কিন্তু গৃহকর্তা পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন।

‘হয়েছে, হয়েছে আন্না আর্কাদিয়েভনা’, আন্নার অনাবৃত একটা হাত বগলদাবা করে কর্সনস্কি বললেন, ‘কতিলিওন নিয়ে চমৎকার একটা আইডিয়া আছে আমার! অপূর্ব!’

তিনি আন্নাকে টেনে আনার চেষ্টা করে খানিকটা এগুলেন। অনুমোদনের হাসি হাসলেন গৃহকর্তা।

‘না, আমি থাকব না’, হেসে আন্না জবাব দিলেন; কিন্তু সে হাসি সত্ত্বেও যেরকম দৃঢ়কণ্ঠে তাঁর জবাবটা হয়েছিল, তাতে গৃহকর্তা আর কর্সুনস্কি দুজনেই বুঝলেন যে আন্না থাকবেন না।

‘না, পিটার্সবুর্গে সারা শীতকালে যত না নেচেছি, মস্কোয় আপনাদের এই একটা আসরেই নাচলাম তার চেয়ে বেশি’, কাছেই দণ্ডায়মান ভ্রন্‌স্কির দিকে তাকিয়ে আন্না বললেন, ‘রওনা দেবার আগে খানিকটা বিশ্রাম দরকার।’

ভ্রন্‌স্কি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কালই চলে যাচ্ছেন নাকি—সত্যি করে?’

আন্না জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, তাই ভেবেছি’, যেন প্রশ্নের এই সাহসিকতার বিস্মিত হয়েই; কিন্তু এ কথা বলার সময় চোখের দপদপে অদম্য ঝলক আর হাসিটা পুড়িয়ে দিয়ে গেল ভ্রন্‌স্কিকে।

আন্না আর্কাদিয়েভনা চলে গেলেন, রাতের খাবারের জন্য রইলেন না।

চব্বিশ

শ্যেরবাৎস্কিদের ওখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় লেভিন মনে মনে ভাবছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমার মধ্যে বিছুছিরি, অরুচিকর কিছু-একটা আছে’, ভাইয়ের কাছে তিনি রওনা দিলেন পায়ে হেঁটেই, ‘আমার সাথে অন্য লোকের বনে না। বলে, আমি নাকি অহংকরী। না, আমার অহংকারটুকুও নেই। অহংকার থাকলে নিজেকে অমন অবস্থায় ফেলতাম না আমি।’ ভ্রন্‌স্কির কথা মনে হল তাঁর—সুখী, সহৃদয়, বুদ্ধিমান, প্রশান্ত সে সন্ধ্যায় তিনি যে ভয়াবহ অবস্থায় পড়েছিলেন, ভ্রন্‌স্কি নিশ্চয় কখনো তাকে পড়েননি। ‘হ্যাঁ, কিটির ওঁকেই পছন্দ হওয়া কথা। সেটাই উচিত, কারো ওপর, কিছুর বিরুদ্ধে আমার নালিশ নেই। আমার নিজেরই দোষ। আমার জীবনের সাথে সে তার জীবন মেলাতে চাইবে, এ কথা ভাবার কি অধিকার ছিল আমার? কে আমি? কিই-বা আমি? নগণ্য একটা লোক, আমাকে কারো প্রয়োজন নেই।’ নিকোলাই ভাইয়ের কথা মনে পড়ল তাঁর এবং সানন্দে সেই চিন্তায় ডুবে গেলেন। ‘দুনিয়ার সব কিছুই খারাপ আর জঘন্য ওর এই কথা কি সত্যি নয়? নিকোলাই ভাই সম্পর্কে বড় একটা ন্যায়বিচার আমরা করছি না এবং করিনি। অবশ্য প্রকোফি, যে ওকে দেখেছিল ছেঁড়া কোটে, মাতাল অবস্থায়, তার চোখে ও একটা ঘৃণার্হ লোক। কিন্তু আমি তো তাকে অন্যরকম জানি। আমি ওর প্রাণটা চিনি, জানি যে আমি ওরই মত। আর আমি ওর খোঁজে যাওয়ার বদলে গেলাম ডিনার খেতে, তারপর এলাম এখানে।’ লেভিন একটা লাইট পোস্টের কাছে গিয়ে ভাইয়ের ঠিকানাটা পড়লেন, সেটা ছিল তাঁর মানি-ব্যাগের মধ্যে। তারপর একটা গাড়ি ডেকে নিকোলাই ভাইয়ের জীবনের যেসব ঘটনা তাঁর জানা ছিল তা স্মরণ করতে লাগলেন ভাইয়ের জীবনের যে সব ঘটনা তাঁর জানা ছিল তা স্মরণ করতে লাগলেন ভাইয়ের কাছে যাবার লম্বা রাস্তাটায়। মনে পড়ল, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তার পরের বছরটা বন্ধুবান্ধবদের উপহাস অগ্রাহ্য করে সে দিন কাটিয়েছে সন্ন্যাসীর মত, কঠোরভাবে মেনে চলেছে ধর্মের সমস্ত ক্রিয়াকর্ম, উপাসনা, উপবাস, পরিহার করেছে সমস্ত ভোগসুখ, বিশেষ করে রমণীদের; তারপর হঠাৎ তার ধৈর্য টুটল, গিয়ে পড়ল অতি ইতর সব লোকেদের সাহচর্যে, শুরু করল অতি বল্গাহীন বেলেল্লাপনা। সেই ছেলেটির কথা স্মরণ হল তাঁর, লালনপালন করবে বলে যাকে সে এনেছিল গ্রাম থেকে আর রাগের মাথায় এমন তাকে পিটিয়েছিল যে অঙ্গহানির দায়ে ব্যাপারটা গড়ায় আদালতে। তারপর মনে পড়ল ঠগ খেলোয়াড়টার ঘটনা, যার কাছে সে তাসে হারে, একটা হুন্ডিও লিখে দেয়, তারপর নিজেই তার বিরুদ্ধে এই বলে নালিশ করে যে লোকটা তাকে ঠকিয়েছে। (সের্গেই ইভানিচ যা শোধ দেন, এটা সেই টাকা।) মনে পড়ল, হৈ-হাঙ্গামার জন্য তার এক রাত্রি হাজত বাসের কথা। ভাই কনিশেভ নাকি তার মায়ের সম্পত্তির অংশ দেননি, এই বলে তাঁর বিরুদ্ধে লজ্জাকর মোকদ্দমার কথাটাও মনে এল। আর শেষ ঘটনাটা হল সে যখন পশ্চিম প্রদেশে চাকরিতে যায়, ‘সেখানে গ্রাম মাতব্বরকে মারপিট করার জন্য সোপর্দ হয় আদালতে। এ সবই ভয়ানক জঘন্য, কিন্তু নিকোলাই লেভিনকে যারা জানত না, জানত না তার ইতিহাস, তার অন্তঃকরণ, তাদের কাছে যতটা জঘন্য লাগার কথা, লেভিনের কাছে মোটেই সেরকম মনে হল না।

লেভিনের মনে পড়ল, নিকোলাই যখন ছিল ধার্মিকতা, উপবাস, সাধুসন্ন্যাসী, গির্জায় উপাসনার পর্বে, যখন সে সাহায্য, তার উদ্দাম স্বভাবকে বেঁধে রাখার বল্লা খুঁজছিল ধর্মে, তখন কেউ তাকে সমর্থন তো করেইনি, বরং সবাই, সে নিজেও হাসাহাসি করেছে তাকে নিয়ে। লোকে টিটকারি দিয়েছে তাকে, বলেছে ‘নোয়া’, সন্ন্যাসী, আর যখন তার বাঁধন ছিঁড়ল, কেউ তাকে সাহায্য করেনি, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আতঙ্কে, ঘৃণায়।

লেভিন অনুভব করছিলেন যে জীবনের সব কিছু কদর্যতা সত্ত্বেও নিকোলাই ভাই মনেপ্রাণে, তার অন্তরের গভীরে তাদের চেয়ে বেশি অসৎ নয় যারা তাকে ঘৃণা করে। ও যে একটা উদ্দাম চরিত্র আর কিসে যেন বিড়ম্বিত মানসিকতা নিয়ে জন্মেছে সেটা তো তার দোষ নয়। তবু সব সময় ও ভালো হতে চেয়েছে। ‘সব কিছু বলব তাকে, সব কিছু বলতে বাধ্য করব ওকে, দেখাব যে আমি ওকে ভালোবাসি, তাই ওকে বুঝি’, রাত এগারোটায় ঠিকানায় লেখা হোটেলটার দিকে যেতে যেতে লেভিন এই স্থির করলেন মনে মনে।

লেভিনের জিজ্ঞাসার জবাবে খানসামা বলল, ‘ওপরে, বারো আর তেরো নম্বর কামরা।’

‘ঘরে আছে?’

‘থাকার কথা।’

বারো নম্বরের দরজা আধ-খোলা, সেখান থেকে এক ফালি আলোর মধ্যে আসছিল কদর্য আর দুর্বল তামাকের ধোঁয়া, শোনা যাচ্ছিল লেভিনের কাছে অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর; কিন্তু তখনই লেভিন টের পেলেন যে ভাই এখানেই; তার কাশি শোনা গেল।

যখন তিনি দরজায় ঢুকলেন, অপরিচিত কণ্ঠস্বর বলছিল : ‘কতটা বিচক্ষণতা আর সচেতনতার সাথে ব্যাপারটা চালানো হবে তার ওপরেই সব নির্ভর করছে।’

ঘরে উঁকি দিলেন কনস্তান্তিন লেভিন, দেখলেন কথা বলছেন একটা যুবক, একমাথা তাঁর চুল, গায়ে সাবেকী ধাঁচের রুশী কোট। একটা মেয়ে বসে আছে সোফায়, মুখে বসন্তের দাগ, উলের পোশাকটায় কফ নেই, কলারও সাদামাটা। ভাইকে দেখা যাচ্ছিল না। কনস্তান্তিনের বুক টনটন করে উঠল এই ভেবে যে, ভাই তার দিন কাটাচ্ছে কি- সব অনাত্মীয় লোকদের মাঝে। কেউ কনস্তান্তিনের আসার শব্দ শুনতে পায়নি, তিনিও তাঁর ওভার-স্যু খুলতে খুলতে শুনতে লাগলেন রুশী কোট পরা ভদ্রলোকটি কি বলছেন। কথা হচ্ছিল কি-একটা উদ্যোগ নিয়ে।

‘চুলোয় যাক এসব সুবিধাভোগী শ্রেণী’, কাশির মধ্যে শোনা গেল ভাইয়ের গলা, ‘মাশা, রাতের খাবার কিছু জোগাড় কর তো আমাদের জন্য। আর মদ দাও যদি থেকে থাকে, নইলে লোক পাঠাও।’

মেয়েটা উঠে পার্টিশনের ওপাশে যেতেই দেখতে পেল কনস্তান্তিনকে।

বলল, ‘কে একজন ভদ্রলোক, নিকোলাই দমিত্রিচ।’

নিকোলাই লেভিনের রাগত কণ্ঠ শোনা গেল, ‘কাকে চাই?’

আলোয় এসে কনস্তান্তিন লেভিন বললেন, ‘আমি এসেছি!’

‘আমি-টা কে?’ আরো রাগত শোনাল নিকোলাইয়ের গলা। শব্দ শুনে বোঝা গেল কিছু-একটাতে ধাক্কা খেয়ে ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে সে, দরজায় লেভিন দেখলেন অতি পরিচিত তবু বন্যতায় আর রুগ্নতায় স্তম্ভিত করার মত তাঁর ভাইয়ের বিশাল, শীর্ণ, কুজো হয়ে আসা মূর্তি, বড় বড় চোখে ভীতি 1

তিন বছর আগে কনস্তান্তিন লেভিন যখন তাকে শেষ বার দেখেন, তার চেয়েও এখন সে রোগা। গায়ে একটা খাটো জ্যাকেট। হাত আর চওড়া হাড়গুলো মনে হচ্ছিল আরো বিরাট। চুল পাতলা হয়ে এসেছে, সেই একই সোজা মোচ ঝুলে পড়েছে ঠোঁটের ওপর, সেই একই চোখ বিচিত্র আর সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আগন্তুকের দিকে।

‘আরে কস্তিয়া যে’, ভাইকে চিনতে পেরে হঠাৎ বলে উঠল সে, চোখ তার জ্বলজ্বল করে উঠল আনন্দে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই সে তাকাল যুবকটির দিকে এবং মাথা আর ঘাড়ের এমন একটা ঝটকা-মারা ভঙ্গি করল যেন টাই এঁটে বসেছে, ভঙ্গিটা কনস্তান্তিনের অতি পরিচিত; একেবারেই অন্য একটা রুক্ষ, আর্ত, নিষ্ঠুর ভাব ফুটে রইল তার রোগাটে মুখে।

‘আপনাকে আর সের্গেই ইভানিচকে, দুজনকেই লিখেছিলাম যে আপনাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক রাখতেও চাই না। কি তোমার, কি আপনার দরকার পড়ল?’

কনস্তান্তিন যা কল্পনা করেছিলেন, সে মানুষ ভাই একেবারেই নয়। তার কথা ভাবার সময় তার চরিত্রের সবচেয়ে কষ্টকর আর খারাপ দিক, যার জন্য তার সাথে কথা বলা এত কঠিন হয়ে ওঠে, কনস্তান্তিন তা ভুলে গিয়েছিলেন। এখন তার মুখ, বিশেষ করে এই ঝটকা-মারা মাথা ফেরানো দেখে সে সবই মনে পড়ে গেল তাঁর।

ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘কোন দরকারে আসিনি। শুধু তোমাকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল।’

ভাইয়ের ভয় দেখে স্পষ্টতই নরম হয়ে এল নিকোলাই। ঠোঁট কেঁপে উঠল তার। বলল, ‘ওঃ, এমনি এসেছ? ভেতর এস, বস। রাতের খাবার খেয়ে যাবে? মাথা, তিন প্লেট খাবার এনো। আচ্ছা থাক, দাঁড়াও। জান, ইনি কে?’ রুশ কোট পরা ভদ্রলোককে দেখিয়ে সে বলল ভাইকে, ‘ইনি ক্রিৎস্কি, কিয়েভে থাকতেই আমার বন্ধু। অতি অসামান্য লোক। বলাই বাহুল্য, পুলিশ ওঁর পেছনে লেগেছে, কেননা উনি বদমাশ নন।’

এবং নিজের অভ্যাসমত ঘরের সব লোকদের দিকে তাকাল সে। দরজার কাছে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছিল, সে যাবার উপক্রম করছে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি যে বললাম, দাঁড়াও।’ তারপর কনস্তান্তিনের যা ভালোই জানা, কথাবার্তা চালাবার সেই অক্ষমতা, সেই আনাড়ীপনায় সবার দিকে আরেক বার তাকিয়ে ভাইকে বলতে লাগল ক্রিৎস্কির কাহিনী : দরিদ্র ছাত্রদের জন্য সাহায্য সমিতি আর রবিবারের স্কুল চালাবার জন্য কেমন করে তিনি বিতাড়িত হন বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে, তারপর তিনি হন গ্রাম্য স্কুলের একজন মাস্টার, অবশেষে কি কারণে যেন সোপর্দ হন আদালতে।

‘আপনি কিয়েভ ইউনিভার্সিটির ছাত্র?’ একটা অস্বস্তিকর নীরবতা দেখা দেওয়ায় সেটা দূর করার জন্য ক্রিৎস্কিকে জিজ্ঞেস করলেন কনস্তান্তিন লেভিন।

‘হ্যাঁ, ছিলাম কিয়েভে’, ভুরু কুঁচকে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন ক্রিৎস্কি।

ভাইকে বাধা দিয়ে মেয়েটাকে দেখিয়ে নিকোলাই লেভিন বলল, ‘আর এই মেয়েটা আমার জীবনসঙ্গিনী, মারিয়া নিকোলায়েভনা। আমি ওকে এনেছি গণিকালয় থেকে’, এ কথা বলার সময় সে ঘাড় ঝাঁকাল, ‘কিন্তু ওকে ভালোবাসি, মান্য করি, আর আমার বন্ধুত্ব যারা চায়’, গলা চড়িয়ে ভুরু কুঁচকে সে যোগ করল, ‘তাদের সবার কাছে অনুরোধ করি ওকে ভালোবাসতে, মান্য করতে। যাই হোক না কেন, ও আমার স্ত্রী, যে যাই বলুক। তাহলে এবার জানলে তো কাদের নিয়ে ব্যাপার। আর যদি তোমার মনে হয় যে হেয় হয়ে যাচ্ছ, তাহলে পথ দেখো, দরজা খোলা।’

আবার চোখ তার সপ্রশ্ন দৃষ্টি বুলিয়ে নিল সবার মুখে।

‘কেন হেয় হয়ে যাব, বুঝতে পারছি না।’

‘তাহলে মাথা, তিনজনের খাবার আনতে বল, ভোদ্‌কা আর সুরা… না, না, না, দাঁড়াও… আচ্ছা দরকার নেই… যাও।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *