আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ২.১০

দশ

আলেক্‌সেই আলেক্‌সান্দ্রভিচ কারেনিন এবং তাঁর স্ত্রীর সেদিন থেকে শুরু হল নতুন জীবন। বিশেষ কিছু একটা ঘটল না। বরাবরের মত আন্না যাতায়াত করতে থাকলেন সমাজে, প্রায়ই যেতেন প্রিন্সেস বেত্‌সির কাছে, এবং সর্বত্রই দেখা হত ভ্রন্‌স্কির সাথে। কারেনিনের তা চোখে পড়ত, কিন্তু কিছুই করার সাধ্য তাঁর ছিল না। আন্নার কাছ থেকে কৈফিয়ত পাবার সমস্ত চেষ্টা তাঁর কি-একটা আমুদে ভুল বোঝাবুঝির নীরন্ধ্র দেয়ালের সামনে ঠেকে যেত। বাইরেটা রইল একইরকম, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বদলে গিয়েছিল ওঁদের সম্পর্ক। রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকর্মে অমন শক্তিধর লোক কারেনিন এক্ষেত্রে নিজেকে শক্তিহীন বলে অনুভব করতে থাকলেন। যে খ তাঁর ওপর উত্তোলিত বলে তিনি টের পাচ্ছিলেন, কসাইখানার বাধা ষাঁড়ের মত মাথা নামিয়ে তার অপেক্ষা করছিলেন তিনি। এ নিয়ে যতবার তিনি ভেবেছেন, ততবারই মনে হয়েছে যে আরো একবার চেষ্টা করা দরকার, সহৃদয়তা, কোমলতা, বোঝানোর শক্তিতে তাঁকে বাঁচানোর, তাঁর চৈতন্যোদয়ের আশা এখনো আছে, এবং প্রতিদিন তিনি তাঁর সাথে কথা বলার চেষ্টা করতেন। কিন্তু কথা বলা শুরু করে প্রতিবারই তিনি টের পেতেন, অকল্যাণ আর প্রতারণার যে প্রেত আন্নাকে অভিভূত করেছে, তা অভিভূত করছে তাঁকেও, এবং তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন সেই বিষয়ে আর সেই সুরে তিনি কথা বলছেন না। তিনি যা বলছেন তা যারা বলে তাদের নিয়ে আধা-বিদ্রূপের সুরে তিনি অভ্যস্ত সেই সুরে কথা বলতেন তাঁর সাথে নিজের অজ্ঞাতে। অথচ যা আন্নাকে বলা দরকার তা এ সুরে বলা চলে না।

এগারো

আগেকার সমস্ত কামনাকে স্থানচ্যুত করে প্রায় গোটা এক বছর ধরে যা ছিল ভ্রন্‌স্কির জীবনের ঐকান্তিক কামনা, আন্নার কাছে যা ছিল অসম্ভব, ভয়ংকর এবং সেহেতু আরো বেশি মোহনীয় সুখস্বপ্ন, তা তৃপ্ত হল। বিবর্ণ হয়ে, নিচের কম্পমান চোয়াল নিয়ে ভ্রন্‌স্কি দাঁড়িয়ে ছিলেন আন্নার কাছে, মিনতি করছিলেন তাঁকে শান্ত হতে, কেন, কিসের জন্য তা তিনি নিজেও জানতেন না।

তিনি কাঁপা-কাঁপা গলায় বলছিলেন, ‘আন্না, আন্না, সৃষ্টিকর্তার দোহাই, আন্না!… ‘

কিন্তু যত উচ্চ কণ্ঠে তিনি কথা বলছিলেন, ততই নিচে নেমে আসছিল আন্নার একদা গর্বিত, উৎফুল্ল, কিন্তু এখন লজ্জাবনত মাথা, যে সোফায় তিনি বসে ছিলেন, দেহ নোয়াতে নোয়াতে পড়ে গেলেন সেখান থেকে, মেঝেতে, ভ্রন্‌স্কির পায়ের কাছে; তিনি ধরে না ফেললে আন্না লুটিয়ে পড়তেন গালিচায়।

ভ্রন্‌স্কির হাত বুকে চেপে তিনি ফুঁপিয়ে উঠলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা, ক্ষমা কর আমাকে।’

নিজেকে এত অপরাধী আর দোষী বলে তাঁর মনে হচ্ছিল যে দীনহীন হয়ে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া তাঁর করার কিছু ছিল না; এবং এখন, জীবনে যখন ভ্রন্‌স্কি ছাড়া তাঁর আর কেউ নেই, তখন ক্ষমা প্রার্থনা তিনি জানালেন তাঁরই কাছে। তাঁর দিকে তাকিয়ে আন্না দৈহিকভাবে অনুভব করলেন তাঁর হীনতা, কিছু আর বলতে পারলেন না। যার প্রাণ সে হরণ করেছে তার দেহটা দেখে হত্যাকারী যা অনুভব করে, সেই অনুভূতি হচ্ছিল ভ্রন্‌স্কির। প্রাণ হরণ করা এই দেহটা যে তাঁদের ভালোবাসা, তাঁদের ভালোবাসার প্রথম পর্ব। লজ্জার এই ভয়ংকর মূল্য যার জন্য দিতে হয়েছে, সে কথা স্মরণ করায় বীভৎস, ন্যক্কারজনক কিছু একটা ছিল। নিজের আত্মিক নগ্নতার লজ্জা আন্নাকে পিষ্ট করছিল, সেটা সঞ্চারিত হচ্ছিল ভ্রন্‌স্কির মধ্যেও। কিন্তু নিহতের দেহের সম্মুখে হত্যকারীর সমস্ত আতঙ্ক সত্ত্বেও প্রয়োজন দেহটাকে খণ্ডবিখণ্ড করে লুকিয়ে ফেলা, হত্যা করে হত্যাকারী যা পেয়েছে সেটা কাজে লাগানো

আক্রোশে, যেন রিরংসায় হত্যাকারী সে দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাকে টেনে নিয়ে যায়, খণ্ডবিখণ্ড করে; ঠিক সেভাবেই ভ্রন্‌স্কি আন্নার মুখ আর বুক চুমুকে ভরে দিলেন। আন্না তাঁর হাত ধরে রাখলেন, নড়লেন না। হ্যাঁ, এ সেই চুমু যা কেনা হয়েছে লজ্জায়। হ্যাঁ, শুধু এই হাতটাই থাকবে সব সময় আমার—সহাপরাধীর হাত। সে হাত তুলে ধরে আন্না চুমু খেলেন। হাঁটু গেড়ে বসে ভ্রন্‌স্কি তাঁর মুখ দেখতে চাইছিলেন; কিন্তু মুখ ঢেকে রাখলেন আন্না, কিছুই বললেন না। অবশেষে, যেন নিজের ওপর জোর খাটিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, ঠেলে সরিয়ে দিলেন ভ্রন্‌স্কিকে। মুখটা তাঁর একইরকম সুন্দর, কিন্তু আরো বেশি করুণ লাগছিল তাতে করে।

বললেন, ‘সব শেষ। তুমি ছাড়া আমার কেউ আর নেই। সেটা মনে রেখো।

‘আমার যা জীবন সেটা মনে না রেখে আমি পারি কি করে? এক মিনিটের এই সুখের জন্য….

‘কিসের সুখ!’ আতংকে, বিতৃষ্ণায় আন্না বললেন, আর সে আতংক সঞ্চারিত হল অনুস্কির মধ্যেও। ‘সৃষ্টিকর্তার দোহাই, ও নিয়ে একটা কথাও নয়, একটা কথাও নয়!

দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে আন্না সরে গেলেন ভ্রন্‌স্কির কাছ থেকে।

‘আর একটা কথাও নয়’, পুনরুক্তি করলেন তিনি এবং ভ্রনৃস্কির কাছে যা অদ্ভূত মনে হয়েছিল, মুখে তেমন একটা নিরুত্তাপ নৈরাশ্যের ভাব নিয়ে আন্না বেরিয়ে গেলেন। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে নবজীবনে প্রবেশের মুখে যে লজ্জা আনন্দ আর আতংক বোধ করছেন, এই মুহূর্তে তা ভাষায় প্রকাশ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব; তা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল না তাঁর, অযথার্থ শব্দে অনুভূতিটাকে স্থুল করে তুলতে চাইছিলেন না। এবং পরেও, দ্বিতীয়, তৃতীয় দিনেও এই অনুভূতিগুলোর সমস্ত জটিলতা ব্যক্ত করার মত কথা তিনি খুঁজে পেলেন না তাই নয়, প্রাণের ভেতর যা রয়েছে, নিজে নিজেই তা নিয়ে চিন্তা করে দেখার মত ভাবনাও তাঁর এল না।

নিজেকে তিনি বললেন, ‘না, এখন আমি এ নিয়ে ভাবতে পারছি না; ওটা হবে পরে যখন শান্ত হতে পারব।’ কিন্তু ভাবনার জন্য এই প্রশান্তি এল না কখনো। কি তিনি করেছেন, কি তাঁর দশা হবে, কি করা উচিত সে কথা ভাবতে গেলেই প্রতিবার আতংক হত তাঁর, মন থেকে ভাবনাটা তাড়িয়ে দিতেন।

বলতেন, ‘পরে, পরে, যখন সুস্থির হব।’

কিন্তু ঘুমের মধ্যে, নিজের ভাবনার ওপর যখন তাঁর দখল থাকা না, তখন তার সমস্ত কদর্য নগ্নতায় তাঁর অবস্থাটা ভেসে উঠত তাঁর কাছে। প্রায় প্রতি রাতে একই স্বপ্ন হানা দিত তাঁকে। তিনি দেখতেন, দুজনেই ওঁরা তাঁর স্বামী, দুজনেই আদরে ছেয়ে ফেলছেন তাঁকে। কারেনিন তাঁর হাতে চুমু খেয়ে বলছেন : এখন চমৎকার হল! আলেকসেই ভ্রন্‌স্কিও রয়েছেন সেখানে, তিনিও তাঁর স্বামী। আগে এটা অসম্ভব মনে হত বলে অবাক লাগছে আন্নার, হেসে ওঁদের উনি বোঝালেন এটা অনেক সহজ, দুজনেই ওঁরা এখন সন্তুষ্ট আর সুখী। কিন্তু এ স্বপ্ন বিভীষিকার মত পিষ্ট করত তাঁকে, আতংকে ঘুম ভেঙে যেত।

বারো

মস্কো থেকে ফেরার পর প্রথম প্রথম, প্রত্যাখ্যানের যে গ্লানি তার কথা মনে পড়তেই লেভিন প্রতিবার কেঁপে কেঁপে লাল হয়ে উঠলেও নিজেকে বোঝাতেন : ‘পদার্থবিদ্যায় ফেল করে দ্বিতীয় কোর্সেই যখন আমাকে থেকে যেতে হয়, তখনো তো আমার দফা শেষ হয়ে গেল ভেবে এমনি করেই লাল হয়ে কেঁপে উঠতাম; বোনের যে ব্যাপারটার ভার দেওয়া হয়েছিল আমাকে, সেটা পণ্ড করে ফেলার পরও ঠিক এমনি, নিজের দফা শেষ হয়ে গেল বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু কি দাঁড়াল? এখন, সময় যখন কেটে গেছে, তখন মনে করে অবাক লাগে কি করে আমাকে তা কষ্ট দিতে পেরেছিল। এই দুঃখটার বেলাতেই তাই হবে। সময় কেটে যাবে, আমিও নির্বিকার হয়ে উঠব ব্যাপারটায়।’

কিন্তু তিন মাস কেটে গেলেও তিনি ব্যাপারটায় নির্বিকার হয়ে উঠতে পারলেন না, ও কথা মনে পড়লেই সেই প্রথম দিনগুলোর মতই কষ্ট হত তাঁর। শান্ত হতে তিনি পারছিলেন না, কারণ দীর্ঘ দিন ধরে তিনি পারিবারিক জীবনের স্বপ্ন দেখে এসেছেন, নিজেকে তার জন্য পরিণত বলে মনে করেন, অথচ বিয়ে তাঁর হয়নি, আগের চেয়েও বিবাহ তাঁর কাছে সুদূরপরাহত। তাঁর আশেপাশের সবাই বা অনুভব করতেন, তাঁর নিজেরই তেমন একটা পীড়িত অনুভূতি ছিল যে তাঁর বয়সে একা থাকা ভালো নয়। তাঁর মনে পড়ল, মস্কো যাওয়ার আগে তিনি তাঁর গোপালক, সাদাসিধে চাষী নিকোলাই, যার সাথে গল্প করতে তিনি ভালোবাসতেন, তাকে বলেছিলেন, —তা নিকোলাই, ভাবছি বিয়ে করে ফেলা যাক।’ নিকোলাই চট করে জবাব দিয়েছিল যেন ব্যাপারটায় সন্দেহের কোন অবকাশই নেই, ‘অনেকদিন আগেই করতে হত কনস্তান্তিন দৃদ্‌মিত্রিচ।’ কিন্তু বিয়ে এখন তাঁর কাছে আগের চেয়েও সুদূর হয়ে দাঁড়িয়েছে। দখল হয়ে গেছে জায়গাটা, আর এখন কল্পনায় সে জায়গায় তাঁর পরিচিত মেয়েদের কাউকে বসাতে গেলে টের পান যে সেটা একেবারেই অসম্ভব। তাছাড়া প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারটা আর তাতে তিনি যে ভূমিকা নিয়েছিলেন সে কথা মনে হতেই গ্লানির যন্ত্রণা ভোগ করতেন তিনি। নিজেকে তিনি যতই বোঝান যে তাঁর কোন দোষ নেই, এই ঘটনা এবং এই ধরনের অন্যান্য লজ্জাকর ঘটনার স্মৃতিতে তিনি কেঁপে উঠতেন, লাল হয়ে উঠতেন। সমস্ত লোকের মত অতীতে তিনিও এমন কাজ করেছেন যা তিনি খারাপ বলে মানেন, যার জন্য তাঁর বিবেকদংশন হতে পারত, কিন্তু কুকীর্তির স্মৃতি মোটেই এসব তুচ্ছ কিন্তু লজ্জাকর ঘটনাগুলোর মত যন্ত্রণা দিত না। এই ক্ষতগুলো সারছিল না কখনো। এসব স্মৃতির সাথে এখন যোগ হয়েছে কিটির প্রত্যাখ্যান এবং সে সন্ধ্যায় অন্যের চোখে তাঁর অবস্থাটা কি করুণ প্রতিভাত হয়েছে তার কথা। কিন্তু কালস্রোতে আর কাজে ফল হয়েছে। দুঃসহ স্মৃতি ক্রমেই চাপা পড়েছে গ্রাম্য জীবনের ঘটনায়, যা চোখে পড়বার মত না হলেও গুরুত্বপূর্ণ। সপ্তাহে সপ্তাহে তিনি কিটির কথা ভাবতে লাগলেন ক্রমেই কম। কিটির বিয়ে হয়েছে বা দিনকয়েকের মধ্যে হতে চলেছে, এই খবরের জন্য তিনি রইলেন অধীর অপেক্ষায়, তাঁর আশা ছিল দাঁত তুলে ফেলার মত এরকম একটা খবর তাঁকে একেবারে সারিয়ে তুলবে।

ইতিমধ্যে বসন্ত এল, অপরূপ, সামূহিক, বসন্তের প্রতীক্ষা ও প্রতারণা ছাড়াই, এটা তেমনি একটা বিরল বসন্ত যাতে উদ্ভিদ, পশু, মানুষ সবাই খুশি হয়ে ওঠে একসাথে। অপরূপ এই বসন্ত লেভিনকে আরও চাঙ্গা করে তুলল, অতীত সব কিছু বর্জন করে নিজের সবল, স্বাধীন, নিঃসঙ্গ জীবন গড়ে তোলার সংকল্পে দৃঢ় হয়ে উঠলেন তিনি। যত পরিকল্পনা নিয়ে তিনি গাঁয়ে ফিরেছিলেন, তার অনেকগুলোই কার্যকৃত না হলেও প্রধান জিনিসটা, জীবনের শুচিতা তিনি অনুসরণ করে চললেন। পতনের পর যে লজ্জা সাধারণত পীড়া দিত তাঁকে, সেটা তিনি আর বোধ করছিলেন না, অসংকোচে তাকাতে পারতেন লোকেদের চোখের দিকে। ফেব্রুয়ারি মাসেই তিনি মারিয়া নিকোলায়েভনার কাছ থেকে এই মর্মে চিঠি পেয়েছিলেন যে নিকোলাই ভাইয়ের স্বাস্থ্য ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে, কিন্তু উনি চিকিৎসা করাতে চান না। চিঠি পেয়ে লেভিন মস্কো যান ভাইয়ের কাছে, ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া এবং খনিজ জল-চিকিৎসার্থে বিদেশে যাওয়ার জন্য তাকে বোঝান। ভাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এবং তাকে না চটিয়ে টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা এমন চমৎকার উত্রায় যে লেভিন খুশি হয়ে উঠেছিলেন। চাষবাস ছাড়াও, বসন্তে যার জন্য বিশেষ মনোযোগের দরজার হয়, বই পড়া ছাড়াও, লেভিন এ শীতে চাষবাস নিয়ে একটা রচনা লিখতে শুরু করেছিলেন। তার হুকটা হল চাষে জলবায়ু ও মৃত্তিকার মত মেহনতির চরিত্রকেও একটা অনপেক্ষ বস্তু হিসেবে ধরতে হবে, সুতরাং চাষ সম্পর্কে সমস্ত বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত টানতে হবে কেবল জলবায়ু ও মৃত্তিকা থেকে নয়, জলবায়ু মৃত্তিকা এবং মেহনতির নির্দিষ্ট একটা অপরিবর্তনীয় চরিত্রের তথ্য থেকে। তাই একাকিত্ব সত্ত্বেও, অথবা একাকিত্বের দরুনই তাঁর জীবন ছিল অসাধারণ পরিপূর্ণ এবং কেবল মাঝে মধ্যে তাঁর মাথায় যে সব ভাবনা ঘুরছে তা আগাফিয়া মিখাইলোভনা ছাড়া অন্য কাউকে জানাবার একটা অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা বোধ করতেন। অবশ্য তাঁর সাথে পদার্থবিদ্যা, কৃষিতত্ত্ব এবং বিশেষ করে দর্শন নিয়ে আলোচনা কম হত না : দর্শন ছিল আগাফিয়া মিখাইলোভনার প্রিয় বিষয়।

বসন্ত অবারিত হয়ে উঠতে দেরি করছিল। লেন্ট পরবের শেষ সপ্তাহগুলোয় আবহাওয়া ছিল পরিষ্কার, তুহিন। দিনের বেলা রোদে বরফ গলত আর রাতে তাপমাত্রা নামত শূন্যাঙ্কের সাত ডিগ্রি নিচে : বরফের জমাট ত্বক হয়েছিল এমন যে লোকে স্লেজ চালাতো পথঘাট ছাড়াই। ইন্টার পরব শুরু হল তুষারপাতের মধ্যে। কিন্তু হঠাৎ ইস্টার সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনে কালো মেঘ উড়িয়ে বইল গরম বাতাস, তারপর তিন দিন, তিন রাত ধরে চলল উদ্দাম আতপ্ত বৃষ্টি। বৃহস্পতিবার হাওয়ার বেগ কমল, এগিয়ে এল ঘন ধূসর কুয়াশা, প্রকৃতিতে যে অদল-বদল ঘটছে, যেন তার রহস্য চাপা দেবার জন্য। কুয়াশায় পানি ঝরত, ফেটে গিয়ে ভেসে যেত বরফের চাঙড়, দ্রুত বইতো ফেনিল ঘোলাটে স্রোত, আর সন্ধ্যায় ঠিক রাঙা ঢিপিতে কুয়াশা কেটে গেল, কালো মেঘকে হটিয়ে দিল হালকা পেঁজা তুলোর মত মেঘ, আকাশ ফরসা হয়ে শুরু হয়ে গেল আসল বসন্ত। সকালে উদীয়মান উজ্জ্বল সূর্য দ্রুত গ্রাস করতে থাকল পানির ওপর জমে ওঠা বরফের পাতলা চটা, আর উষ্ণ বাতাসের সবটাই কাঁপতে লাগল সঞ্জীবিত মাটির ভাপে ভরে উঠে। সবুজ হয়ে উঠল গত বছরের পুরনো, আর সম্প্রতি অঙ্কুরিত ঘাস, কোরক ফুটল গিল্ডার রোজ আর কার‍্যান্ট ঝোপে, বার্চ গাছে চ্যাটচেটে মদির পত্রপুট। সোনালি রং-ছিটানো উইলো শাখায় গুনগুনিয়ে উঠল উড়ে আসা মৌমাছি। মখমলি শ্যামলিমা আর তুষার লেগে থাকা ন্যাড়া মাঠের ওপর গান ধরল অদৃশ্য ভরত পাখি, নাবাল আর জলাভূমি ভাসিয়ে দেওয়া বাদামি পানির ওপর কাঁদুনি জুড়ল টিট্টিভেরা আর আকাশের উঁচু দিয়ে সারস আর হাঁসেরা উড়ে যেতে লাগল তাদের বাসন্তিক ক্রেংকার তুলে। গোষ্ঠভূমিতে হাম্বা হাম্বা ডাকতে লাগল ন্যাড়া ন্যাড়া, শুধু জায়গায় জায়গায় এখনো লোম লেগে থাকা গরু-বাছুর, ব্যা-ব্যা ডাক ছাড়া অরোমশ মায়েদের ঘিরে খেলা করতে লাগল ভেড়ার বাঁকা-ঠ্যাং বাচ্চাগুলো, পদচিহ্নে ভরা, শুকিয়ে ওঠা হাঁটা পথে ক্ষিপ্রপদ ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি লাগাল, পুকুরে কাপড়-চোপড় নিয়ে গালগল্প জুড়ল চাষী মেয়েরা, আঙিনায় লাঙল আর মই সারাতে ব্যস্ত চাষীদের কুড় ল খটখট শব্দ তুলল। এসে গেছে খাঁটি বসন্ত।

তেরো

লেভিন তাঁর প্রকাণ্ড হাইবুট পরে এবং এই প্রথম মেষচর্ম কোটে নয়, গায়ে সাধারণ একটা গরম জ্যাকেট চাপিয়ে রোদ্দুরে চোখ ধাঁধানো ঝলকানি দেওয়া জলস্রোত ভেঙে, কখনো বরফ কখনো চ্যাটচেটে কাদায় পা ফেলে খামার ঘুরতে গেলেন।

বসন্ত হল পরিকল্পনা আর অনুমানের কাল। বসন্তের যে গাছ তখনো জানে না তার স্ফীত কোরকে ঢাকা অঙ্কুর আর শাখা-প্রশাখা কোন দিকে কিভাবে বেড়ে উঠবে, ঠিক তারই মত লেভিন বাইরে বেরিয়ে নিজে জানতেন না তাঁর প্রিয় কৃষিকর্মের কোন কোন ব্যবস্থার পেছনে তিনি লাগবেন, কিন্তু অনুভব করছিলেন যে অতি সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা আর অনুমানে তিনি ভরপুর। প্রথমে তিনি গেলেন গরুগুলোর কাছে। তাদের বার করে আনা হয়েছে খোঁয়াড়ে, সেখানে রোদে গা গরম করে চিকন লোমে ঝিলিক দিয়ে তারা মাঠে চরতে যাবার জন্য ডাকছিল। সমস্ত খুঁটিনাটিতে চেনা গরুগুলোকে মুগ্ধ নেত্রে লক্ষ্য করে লেভিন তাদের মাঠে নিয়ে যেতে বললেন, আর বাছুরগুলোকে বললেন খোঁয়াড়ে ছেড়ে রাখতে। রাখাল আনন্দে ছুটে গেল চরাবার তোড়জোড় করতে। রাখালিনীরা স্কার্টের খুঁট তুলে সাদা সাদা পায়ে যা এখনো রোদপোড়া হয়ে ওঠেনি, কাদায় প্যাচপ্যাচ করে সরু সরু ডাল হাতে বসন্তের আনন্দে দুরন্ত হয়ে ওঠা বাছুরগুলোর পেছনে ছোটাছুটি করে তাদের তাড়িয়ে আনতে লাগল আঙিনায়।

এ বছরের বাছুরটা হয়েছে অসাধারণ, প্রথম বাছুরগুলো হয়েছে চাষাদের গরুর মত, পাভার বকনাটা তিন মাসেই দেখতে এক বছরের মত বড়—লেভিন তাদের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে ওদের জন্য খাবার টব বার করে আনতে এবং খোঁয়াড়ের মধ্যে ছানি দিতে বললেন। কিন্তু দেখা গেল শরতে তৈরি করা এবং শীতকালে অব্যবহৃত খোঁয়াড়ের বেড়া ভেঙে পড়েছে। ছুতোরকে ডেকে পাঠালেন তিনি যার কাজ করার কথা ছিল মাড়াই কলে। কিন্তু দেখা গেল সে মই সারাচ্ছে, যা মেরামত করা উচিত ছিল লেন্ট পরবের আগেই। এতে লেভিনের ভারি খারাপ লাগল। খারাপ লাগল কারণ যে হেলাফেলার বিরুদ্ধে তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়ে এত বছর ধরে লড়ে আসছেন তার পুনরাবৃত্তি হল। তিনি জানতে পারলেন, খোঁয়াড়ের বেড়া শীতকালে অপ্রয়োজনীয় বোধে সরিয়ে রাখা হয় গাড়ি-লাঙল টানা ঘোড়াদের আস্তাবলে, সেখানে তা ভেঙে পড়ে, কেননা তা বানানো হয়েছিল পলকা করে, বাছুরদের জন্য। তা ছাড়া এও জানা গেল যে মই এবং সমস্ত কৃষি হাতিয়ার যা যাচাই করে দেখে শীতকালেই মেরামত করার হুকুম দেওয়া হয়েছিল এবং ঠিক এই উদ্দেশ্যেই নেওয়া হয়েছিল তিনজন ছুতোরকে, তা মেরামত হয়নি এবং যখন তাদের মাঠে নামার কথা তখন মেরামত করা হচ্ছে মইগুলো। লেভিন গোমস্তাকে ডাকতে পাঠিয়ে তক্ষুনি নিজেই গেলেন তার খোঁজে। ফার লাগানো মেষচর্ম জ্যাকেট পরে এ দিনের সবাইকার মত জ্বলজ্বলে হয়ে হাতে একটা খড় কাটি ভাঙতে ভাঙতে গোমস্তা বেরল মাড়াই ঘর থেকে।

‘ছুতোর মাড়াই কল নিয়ে কাজ করছে না কেন?

‘হ্যাঁ, গতকাল আমি জানাব ভেবেছিলাম; মই মেরামত করা দরকার। জমি তো চষতে হয়।’

‘কিন্তু শীতকালে হচ্ছিলটা কি?

তা ছুতোরকে আপনার দরকার কিসের জন্য?’

‘বাছুর খোঁয়াড়ের বেড়া কোথায়?

‘ঠিক জায়গায় বসাবার হুকুম দিয়েছিলাম। কিন্তু হুকুমে কি আর এসব লোকদের দিয়ে কিছু হয়!’ হাত দুলিয়ে গোমস্তা একটা হতাশার ভঙ্গি করল।

‘এই লোকদের দিয়ে না, এই গোমস্তাকে দিয়ে!’ ফুঁসে উঠলেন লেভিন, ‘আপনাকে আমি রেখেছি কিসের জন্য? চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, কিন্তু এতে কোন কাজ হবে না বুঝে কথার মাঝখানে থেমে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা কি বোনা যাবে?

‘তুর্কিনের ওপাশের জমিটায় কাল কি পরশু শুরু করা যেতে পারে।

‘আর ক্লোভার?’

‘ভাসিলি আর মিশকাকে পাঠিয়েছি, বুনছে। তবে মাঠে নামতে পারবে কিনা জানি না : প্যাচপেচে তো।’

‘কত দেসিয়াতিনা?’

‘ছয়।’

‘সব জমিটা বোনা হল না কেন?’ চেঁচিয়ে উঠলেন লেভিন।

ক্লোভার বোনা হচ্ছে বিশ নয়, মাত্র ছয় দেসিয়াতিনা জমিতে, এটা আরো বিরক্তিকর। তত্ত্ব এবং নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেভিন জানেন ক্লোভার ভালো হয় যথাসম্ভব আগে, প্রায় বরফ থাকতে থাকতে বুনতে পারলে। কিন্তু কখনোই সেটা তিনি করিয়ে উঠতে পারেননি।

‘লোক নেই। হুকুম করে কি আর এসব লোকদের দিয়ে কিছু হয়? তিনজন আসেনি। যেমন এই সেমিওন…’

‘চাল ছাওয়া থামিয়ে রাখতে পারতেন।’

‘তা থামিয়ে রেখেছি।’

‘তাহলে লোকগুলো গেল কোথায়?’

‘পাঁচজন কম্পোত বানাচ্ছে’ (অর্থাৎ কম্পোস্ট সার)। ‘চারজন ওট সরিয়ে রাখছে, পচ না ধরে আবার কনস্তান্তিন দদ্‌মিত্রিচ।’

লেভিন খুব ভালোই জানতেন যে ‘পচ না ধরে আবার’ মানে বিলাতি বীজ ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে—আবার যা হুকুম দিয়েছিলেন, করা হয়নি।

চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, ‘আমি যে লেন্ট পরবের সময়েই বলেছিলাম, পাইপ লাগাও!’

‘ভাবনা করবেন না, সবই হবে সময়মত।’

লেভিন রেগে হাত ঝাঁকালেন, ওট দেখবার জন্য গেলেন গোলাবাড়িতে, সেখান থেকে আস্তাবলে ফিরলেন। ওট এখনো নষ্ট হয়নি। কিন্তু খেতমজুরেরা তা সরাচ্ছে বেলচা দিয়ে যেখানে স্রেফ নিচের গোলায় ঢেলে দিলেই হত। সেই আদেশ দিয়ে এবং সেখান থেকে দুজন লোককে ক্লোভার বোনার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে গোমস্তার ওপর লেভিনের রাগ পড়ে এল। সত্যি দিনটা এত চমৎকার যে রেগে থাকা অসম্ভব।

‘ইগ্নাত!’ কোচোয়ানের উদ্দেশে হাঁক দিলেন লেভিন, আস্তিন গুটিয়ে সে গাড়ি ধুচ্ছিল কুয়ার কাছে, ‘ঘোড়ায় জিন পারও আমার জন্য … ‘

‘কোন্‌টাকে?’

‘ধর কলপিককেই।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

ঘোড়ায় যখন জিন পরানো হচ্ছে, তখন তাঁর দৃষ্টিপথে গোমস্তাকে ঘুরঘুর করতে দেখে তিনি তাকে আবার ডাকলেন মিটমাট করে নেবার জন্য, বসন্তের কাজ আর খামারের পরিকল্পনাদি নিয়ে তার সাথে কথা বলতে লাগলেন। গোবর সার দিতে হবে তাড়াতাড়ি যাতে প্রথম বিচালি কাটার আগেই সব শেষ হয়ে যায়। দূরের মাঠে হাল দিতে হবে না-থেমে যাতে কালো ভাপে তা ধরে রাখা চলবে। ঘাস কাটাতে হবে ভাগ-চাষী দিয়ে নয়, খেতমজুর দিয়ে।

গোমস্তা মন দিয়ে সব শুনল। বোঝা যায়, জোর করে চেষ্টা করছিল কর্তার প্রস্তাবে সায় দিতে; তাহলেও চেহারায় তার লেভিনের অতি পরিচিত পিত্তি-জ্বালানো নৈরাশ্য আর নিরানন্দের ছাপ। সে চেহারা বলছিল, এসবই বেশ ভালো, তবে সৃষ্টিকর্তা যা করেন।

এই মনোভাবে লেভিন যেমন দুঃখ পেতেন তেমন আর কিছুতে নয়। কিন্তু যত গোমস্তা তাঁর এখানে থেকেছে তাদের সবারই মনোভাব ছিল একই। তাঁর প্রস্তাবাদি তারা সবাই নিয়েছে একই ধরনে। তাই এখন আর তিনি চটে ওঠেন না। তবে দুঃখ হয় তাঁর, এবং এই যে কেমন একটা ভৌত শক্তিকে তিনি সৃষ্টিকর্তা যা করেন ছাড়া অন্য কোন নাম দিতে পারছেন না, সব সময়ই যা তাঁর প্রতিবন্ধকতা করছে, তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য আরো বেশি উত্তেজনা বোধ করতেন তিনি।

গোমস্তা বলল, ‘যতটা পেরে উঠব কনস্তান্তিন দদ্‌মিত্রিচ।

‘পেরে না ওঠার কি আছে?’

‘আরো পনেরজনের মত খেতমজুর নিতেই হবে। কিন্তু আসতে চায় না। আজ এসেছিল, সারা গ্রীষ্মের জন্য চাইছে সত্তর রুব্‌ল করে।’

লেভিন চুপ করে রইলেন। আবার ঐ শক্তিটার প্রতিবন্ধকতা। তিনি জানতেন যে যত চেষ্টাই করা যাক, বর্তমান দরে চল্লিশ, সাঁইত্রিশ, আটত্রিশ জনের বেশি খেতমজুর লাগাতে পারবেন না। চল্লিশ জন লাগিয়েছেন, তবে তার বেশি নয়। কিন্তু তাহলেও লড়াই না করে তিনি পারেন না।

‘খেতমজুর নিজেরা না এলে সুরীতে, চেফিরোভকায় লোক পাঠান। খোঁজ করতে হবে।’

‘পাঠাতে হয় পাঠাব’, মন-মরার মত বলল ভাসিলি ফিওদরোভিচ, ‘তারপর ঐ ঘোড়াগুলোও আবার হয়েছে দুবলা।’

‘কিনব। আরে আমি তো জানি’, হেসে যোগ করলেন তিনি, ‘যত কম, আর যত খারাপ আপনি তার পক্ষে। কিন্তু এ বছর আমি আপনাকে আপনার মতে চলতে দেব না। সব করব আমি নিজে।’

‘আপনার দেখছি ঘুম হচ্ছে না। কর্তার নজরে থেকে খাটতে তো আমাদের ফুর্তিই লাগবে…’

‘বার্চ নাবালের ওপাশে তাহলে ক্লোভার বোনা হচ্ছে? যাই, গিয়ে দেখে আসি’, কোচোয়ান যে ঘি-রঙা ছোট্ট কলপিককে নিয়ে এসেছিল, তার ওপর চেপে তিনি বললেন।

কোচোয়ান চিৎকার করল, ‘স্রোত পেরিয়ে যেতে পারবেন না, কনস্তান্তিন দদ্‌মিত্রিচ।’

‘বেশ, তাহলে বন দিয়েই যাব।’

অনেকদিন আটক থাকা, জমা পানির ওপর ঘোঁতঘোঁত করে লাগামে টান মারা তেজী ধীরগামী ঘোড়াটাকে লেভিন চালালেন আঙিনার কাদা দিয়ে ফটকের বাইরে মাঠের মধ্যে।

লেভিনের গোয়ালে আর গোলাবাড়িতে ফূর্তি লেগেছিল, মাঠে গিয়ে ফূর্তি লাগল আরো বেশি। বনের মধ্যে যেখানে কোথাও কোথাও ধেবড়ে যাওয়া পায়ের ছাপ নিয়ে বরফ টিকে ছিল তার ওপর দিয়ে সুন্দর ঘোড়াটার ধীর লয়ে দুলতে দুলতে লেভিন বরফ আর বাতাসের তাজা গন্ধ নিচ্ছিলেন বুক ভরে। তাঁর গাছগুলোর প্রত্যেকটির গুঁড়িতে সঞ্জীবিত শ্যাওলা আর ডালে ফুলে ওঠা কোরক দেখে আনন্দ হচ্ছিল তাঁর। বন থেকে যখন বেরোলেন, সামনে তাঁর দেখা দিল বিশাল বিস্তারে সবুজের গালিচা, কোথাও কোথাও গলন্ত তুষারের অবশেষ ছাড়া একটাও খুঁত নেই তাতে। একটা চাষের ঘোড়া আর তার বাচ্চাকে তাঁর মাঠের সবুজ মাড়াতে দেখে (সামনে একজন চাষীকে পেয়ে ওদের তাড়িয়ে দিতে বলেন) কিংবা ইপাত চাষীকে দেখে ‘কি ইপাত, শিগগিরই বুনছ তো? তাঁর এই প্রশ্নে ‘আগে হাল দিতে হবে যে কনস্তান্তিন দৃদ্‌মিত্রিচ’, ইপাতের বোকার মত এই হাস্যকর উত্তরে—কিছুতেই তাঁর রাগ হল না। যত তিনি এগোতে থাকলেন, ততই খুশি লাগছিল তাঁর, চাষবাস নিয়ে উত্তরোত্তর ভালো ভালো এক-একটা পরিকল্পনা তাঁর মাথায় আসছিল : দ্বিপ্রাহরিক রেখা বরাবর গোটা মাঠে গাছ পুঁতে ঘিরে ফেলতে হবে যাতে তলে বরফ জমে না থাকে; ছ’টা সার-দেওয়া ক্ষেত আর তিনটা মজুত ঘেসো জমিতে ভাগ করে ফেলতে হবে, মাঠের দূর প্রান্তে বানাতে হবে গোয়াল, একটা পুকুর খুঁড়তে হবে, গোবর সারের জন্য তৈরি করতে হবে গরুদের অপসারণযোগ্য বেড়া। তাহলে বোনা যাবে তিনশ দেসিয়াতিনায় গম, একশ’তে আলু, দেড়শ’তে ক্লোভার, উর্বরতা ফুরিয়ে যাওয়া জমি পড়ে থাকবে না এক দেসিয়াতিনাও।

এসব কল্পনা নিয়ে তাঁর মাঠের সবুজ না মাড়িয়ে সাবধানে আলের ওপর ঘোড়াকে ঘুরিয়ে তিনি গেলেন খেতমজুরদের কাছে যারা ক্লোভার বুনছিল। বীজ ভরা গাড়িটা ছিল কিনারে নয়, চষা ক্ষেতের মধ্যেই, শীতকালীন গমের জমি ঢাকায় ছিন্নভিন্ন হয়ে ঘোড়ার খুরে দলে গেছে। দুজন মজুরই বসে ছিল আলের ওপর, নিশ্চয় একই পাইপ টানছিল ভাগাভাগি করে। বীজ মেশানো যে মাটি ছিল গাড়িতে তা গুঁড়ানো হয়নি, চাপ বেঁধে আছে অথবা হিমে জমে গিয়ে দলা পাকিয়েছে। কর্তাকে দেখে ভাসিলি মুনিষ গেল গাড়িটার কাছে আর মিশকা বুনতে লাগল। জিনিসটা অন্যায়, কিন্তু মুনিষদের ওপর লেভিন চটে উঠেছেন কদাচিৎ। ভাসিলি কাছে আসতে লেভিন তাকে ঘোড়া কিনারে সরিয়ে আনতে বললেন।

ভাসিলি বলল, ‘ভাবনা নেই হুজুর, সিধে হয়ে যাবে।’

লেভিন বললেন, ‘তর্ক করো না দয়া করে, যা বলা হচ্ছে কর।’

‘যে আজ্ঞে’, বলে ভাসিলি ঘোড়ার মাথা ধরে টানতে লাগল। ‘আর মাটি কি কনস্তান্তিন দ্‌দ্‌মিত্রিচ’, মন ভেজাবার জন্য ভাসিলি বলল, ‘একেবারে পয়লা নম্বরের। শুধু হাঁটাটা বড় মুশকিল। পুদ খানেক করে কাদা টানতে হচ্ছে।’

লেভিন বললেন, ‘তোমরা মাটি ছাঁকোনি কেন?

‘ও আমরা গুঁড়িয়ে নেব’, বলে ভাসিলি একদলা বীজ নিয়ে মাটি গুঁড়ো করল হাতে।

তাকে যে না-ছাঁকা মাটি দেওয়া হয়েছে, সেটা ভাসিলির দোষ নয়, তাহলেও বিরক্ত লাগল লেভিনের।

নিজের বিরক্তি চেপে যা খারাপ মনে হচ্ছে তার মধ্যে ভালো দেখার একটা পরীক্ষিত পদ্ধতি ছিল লেভিনের। এবারও সে পদ্ধতি তিনি কাজে লাগালেন। দু’পায়েই লেপটে যাওয়া বিরাট দু’দলা মাটি টেনে টেনে কিভাবে চলছে মিকা সেটা তিনি দেখলেন তাকিয়ে তাকিয়ে তারপর ঘোড়া থেকে নেমে ভাসিলির কাছ থেকে বীজের টুকরি নিয়ে বুনতে গেলেন।

‘কতদূর থেমেছ?’

পা দিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে দিল ভাসিলি। লেভিনও যেমন পারেন মাটিতে বীজ ছড়াতে লাগলেন। হাঁটা কঠিন হচ্ছিল, জলা জমিতে যেমন হয়; একটা খাত কেটে লেভিন ঘেমে উঠলেন, দাঁড়িয়ে পড়ে বীজের টুকরিটা দিয়ে দিলেন।

ভাসিলি বলল, ‘তা সাহেব, ওই খাতটার জন্য গ্রীষ্মকালে আমাকে যেন না বকেন।’

‘কিন্তু কেন বকব?’ ফূর্তি করেই লেভিন জিজ্ঞেস করলেন, টের পাচ্ছিলেন তাঁর পদ্ধতিটায় কাজ হয়েছে।

‘গ্রীষ্মকালে দেখবেন। জানানি দেবে। গত বসন্তে আমি যেখানে বুনেছিলাম তাকিয়ে দেখুন। কেমন রুয়েছি! আমি কনস্তান্তিন দদ্‌মিত্রিচ, নিজের বাপের জন্য লোকে যেমন খাটে, তেমনি খেটেছি তো। আমি নিজে খারাপ করে কাজ করতে ভালোবাসি না, অন্যকেও বলি না তা করতে। মালিকেরও মঙ্গল, আমাদেরও মঙ্গল। ওই তো তাকিয়ে দেখলেই’, ক্ষেতটা দেখিয়ে ভাসিলি বলল, ‘মন খুশি হয়ে ওঠে।’

‘বসন্তটা কিন্তু সুন্দর হয়েছে ভাসিলি।’

‘আজ্ঞে এমন বসন্তের কথা বুড়োদেরও মনে পড়ে না। এই তো বাড়ি গিয়েছিলাম। আমাদের বুড়ো কর্তাও গম বুনেছে বেশ খানিক। বলে, রাই থেকে কম যাবে না।’

‘তোমরা গম বুনছ কতদিন?’

‘ও বছর আপনিই তো আমাদের শিখিয়েছিলেন গো। দুই মাপ বীজ দিয়ে দিলেন, তার সিকি খানেক বেচে দিয়ে বাকিটা বুনলাম!

‘তা দেখো, ঢেলাগুলোকে গুঁড়ো কর যেন’, ঘোড়ার কাছে গিয়ে লেভিন বললেন, ‘মিশকার দিকেও চোখ রেখো। ভালো ফলন হলে দেসিয়াতিনা পিছু পঞ্চাশ কোপেক।’

‘দণ্ডবৎ করি। আমরা তো এমনিতেই আপনার কাছে কতই না পাই।’

ঘোড়ায় চেপে লেভিন গেলেন গত বছর যে মাঠে ক্লোভার বোনা হয়েছিল আর এ বছর যে মাঠে বাসন্তিক গম বোনার জন্য হাল পড়েছে সেখানে।

ক্লোভারের অঙ্কুর হয়েছে অপরূপ। গত বছরের গম গাছের নাড়ার তল থেকে তা সর্বত্র মাথা তুলেছে রীতিমত সবুজ হয়ে। ঘোড়ার গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছিল আর প্রতিবার আধগলা হিমেল মাটি থেকে পা তুলবার সময় পচ্‌ পচ্ শব্দ উঠছিল তাতে। চষা খেত দিয়ে যাওয়া আদপেই আর সম্ভব ছিল না। যেখানে বরফ রয়ে গিয়েছিল, শুধু সেখানেই দাঁড়ানো যাচ্ছিল, কিন্তু লাঙল-দেওয়া খাতগুলোতে কাদায় পা ডুবে যাচ্ছিল গোড়ালির ওপর পর্যন্ত। হাল দেওয়া হয়েছে চমৎকার; দিন দুয়েকের মধ্যেই মই দেওয়া আর বীজ বোনা সম্ভব হবে। সবই চমৎকার, সবই হাসিখুশি। পানি নেমে গেছে আশা করে লেভিন ফিরলেন স্রোত দিয়ে। আর সত্যিই স্রোত পেরিয়ে গেলেন তিনি, ভয় পাইয়ে দিলেন দুটো হাঁসকে। মনে মনে ভাবলেন : ‘তাহলে স্নাইপও আছে নিশ্চয়’ আর বাড়ির দিকে যাওয়ার ঠিক মোড়েই দেখা হল বনরক্ষীর সাথে, স্নাইপ সম্পর্কে তাঁর অনুমান সমর্থন করল সে।

দুলকি চালে ঘোড়া ছোটালেন তিনি যাতে বাড়ি গিয়ে খাওয়ার সময় পান এবং সন্ধ্যা নাগাদ তৈরি করে রাখতে পারেন বন্দুকটা

চৌদ্দ

লেভিন খুবই খোশমেজাজে বাড়ির দিকে যেতে যেতে প্রধান প্রবেশ পথের দিক থেকে ঘণ্টির আওয়াজ শুনতে পেলেন। ভাবলেন, হ্যাঁ, ওটা রেল স্টেশনের দিক থেকে, এখনই তো মস্কো ট্রেন আসার কথা… কিন্তু কে হতে পারে? নিকোলাই ভাই নয় তো? ও যে বলেছিল : জল-চিকিৎসাতেও যেতে পারি, তোর কাছেও যেতে পারি।’ প্রথমে তাঁর ভয় হয়েছিল এবং এই ভেবে বিছ্‌ছিরি লাগছিল যে, নিকোলাই ভাইয়ের উপস্থিতি তাঁর এই বাসন্তী সুখানুভূতি পণ্ড করে না দেয় আবার। কিন্তু এ কথা মনে হচ্ছে বলে লজ্জা হল তাঁর এবং তৎক্ষণাৎ তিনি যেন তাঁর প্রাণের আলিঙ্গন মেলে ধরলেন, আর মন ভিজে ওঠা আনন্দে অপেক্ষা করতে লাগলেন, সর্বান্তঃকরণে কামনা করলেন যে ভাই-ই হয় যেন। ঘোড়াকে তাড়া দিলেন তিনি, অ্যাকেসিয়া গাছগুলো পেরিয়ে দেখতে পেলেন স্টেশনের দিক থেকে একটা ভাড়াটে ত্রয়কা আসছে, তাতে ফারকোট পরা এক ভদ্রলোক। না, তাঁর ভাই নয়। ভাবলেন, ‘আহ্ ভালো লোক কেউ যদি হয়, যার সাথে গল্প করা যাবে!’

‘আরে!’ দু’হাত ওপরে তুলে সানন্দে চিৎকার করে উঠলেন লেভিন, ‘আনন্দের অতিথি যে! কি যে খুশি হলাম তোমাকে দেখে!’ অব্‌লোন্‌স্কিকে চিনতে পেরে তিনি চেঁচালেন। ভাবলেন, ‘এবার নির্ঘাৎ জানা যাবে কিটি বিয়ে করেছে কিনা অথবা কবে করবে।’

আর এই চমৎকার বসন্তের দিনে তিনি টের পেলেন যে কিটির কথা স্মরণ করে তাঁর কষ্ট হচ্ছে না।

‘কি, আশা করনি তো?’ স্লেজ থেকে নেমে অবলোনস্কি বললেন, নাকে-গালে-ভুরুতে তাঁর কাদার দলা, কিন্তু ফুর্তিতে আর স্বাস্থ্যে জ্বলজ্বল করছেন। লেভিনকে আলিঙ্গন আর চুম্বন করে বললেন, ‘চলে এলাম। এক : তোমাকে দেখতে; দুই : কিছু পাখি শিকার করতে; তিন : এগুশোভোর বনটা বেচে দিতে।’

‘চমৎকার! কেমন বসন্ত দেখেছ? তা স্লেজে করে এলে কেমন?’

‘গাড়িতে আসা আরও খারাপ হত, কনস্তান্তিন দ্‌দ্‌মিত্রিচ’, পরিচিত কোচোয়ান জবাব দিল।

‘যাক, তোমাকে দেখে আমি ভারি, ভারি খুশি হলাম’, আন্তরিকভাবেই শিশুর মত সানন্দে হেসে লেভিন বললেন।

অভ্যাগতরা এলে যে ঘরে ওঠে, সেখানে অতিথিকে নিয়ে গেলেন লেভিন। সেখানেই আনা হল অব্‌লোন্‌স্কির মালপত্র : ব্যাগ, কেসে রাখা বন্দুক, চুরুটের বটুয়া। হাত-মুখ ধুয়ে পোশাক বদলে নেবার জন্য বন্ধুকে রেখে লেভিন সেরেস্তায় গেলেন হাল-চাষ আর ক্লোভারের কথা বলতে। গৃহের মান-মর্যাদা নিয়ে সদা উদ্বিগ্ন আগাফিয়া মিখাইলোভনা প্রবেশ কক্ষে তাঁকে ধরে খাবার-দাবারের কথা জিজ্ঞেস করলেন।

‘যা ভালো বোঝেন করুন, তবে একটু তাড়াতাড়ি’, এই বলে তিনি চলে গেলেন গোমস্তার কাছে।

যখন ফিরলেন, হাত-মুখ ধুয়ে চুল আঁচড়িয়ে হাসিতে ঝলমল করে অব্‌লোন্‌স্কি বেরিয়ে আসছিলেন তাঁর ঘর থেকে, দুজনে তাঁরা ওপরে উঠলেন।

‘তোমার কাছে আসতে পারলাম বলে কি ভালোই না লাগছে! এবার বোঝা যাবে কি-সব গুহ্য কাণ্ড তুমি এখানে করে থাকো। না, সত্যি, তোমাকে হিংসে হচ্ছে আমার। কি একখান বাড়ি রে, সব কিছুই কি চমৎকার! আলো ঢালা’, প্রাণ-মাতানো অব্‌লোন্‌স্কি বললেন এটা ভুলে গিয়ে যে বসন্ত আর আজকের মত ঝকঝকে দিন আসে না সব সময়। ‘আর তোমার আয়াটিও কি চমৎকার! অ্যাপ্রন-আঁটা সুন্দরী একটা দাসী থাকলে অবশ্য মন্দ হত না, কিন্তু তোমার যা সন্ন্যাসী স্বভাব আর কড়া ধরনধারণ, তাতে এই-ই ভালো।’

নানা আগ্রহোদ্দীপক খবর দিলেন অব্‌লোন্‌স্কি, তার ভেতর লেভিনের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই সংবাদ যে তাঁর ভাই কজ্‌নিশেভ এই গ্রীষ্মে তাঁর কাছে গ্রামে আসার উদ্যোগ করছেন।

কিটি এবং সাধারণভাবে শ্যেরবাৎস্কিদের নিয়ে একটা কথাও অব্‌লোন্‌স্কি বললেন না; শুধু স্ত্রীর পক্ষ থেকে অভিবাদন জানালেন। তাঁর মার্জিত সূক্ষ্মতাবোধে কৃতজ্ঞ লেগেছিল লেভিনের, খুশি হয়েছিলেন এমন অতিথি পেয়ে বরাবরের মত একাকিত্বের সময়ে লেভিনের মনে যত ভাবনা আর অনুভূতি জমে উঠেছিল, তা তিনি আশেপাশের কাউকে জানাতে পারতেন না। এখন অব্‌লোন্‌স্কির কাছে তিনি উজাড় করে দিতে থাকলেন তাঁর বসন্তের কাব্যিক পুলক, কৃষিকর্মের অসাফল্য আর পরিকল্পনা, পঠিত পুস্তকাদি নিয়ে তাঁর ভাবনা আর মন্তব্য, বিশেষ করে তাঁর রচনাটির বিবরণ, যার মূল কথাটা হল, তিনি নিজে খেয়াল না করলেও, কৃষিকাজ নিয়ে সমস্ত পুরানো পুস্তকের সমালোচনা। অব্‌লোন্‌স্কি অতি মনোরম মানুষ, আভাস মাত্রেই সবই বুঝতে পারেন, এবার তাঁকে লাগল আরো মনোরম, লেভিন তাঁর ভেতরে লক্ষ্য করলেন নিজের আত্মপ্রসাদ লাভের মত নতুন একটা শ্রদ্ধা আর কমনীয়তা।

খাওয়াটা যাতে চমৎকার হয়, এ নিয়ে আগাফিয়া মিখাইলোভনা আর বাবুর্চির চেষ্টা-চরিত্রের ফল হল এই যে ক্ষুধার্ত দু’বন্ধুই নাশতা বসে পেট ভরালেন রুটি-মাখন, নোনা মাছ, তার ওপর মাংসের যে পুলি পিঠে দিয়ে বাবুর্চি অতিথিকে অবাক করে দিতে চেয়েছিল, তা বাদ দিয়েই স্যুপ আনতে বললেন লেভিন। কিন্তু অন্য ধরনের ভোজনে অভ্যস্ত হলেও অব্‌লোন্‌স্কির কাছে সবই লাগল চমৎকার আর অপূর্ব—নানারকম ঘাস-গাছড়ায় জারানো ভোদ্‌কা, রুটি, মাখন, বিশেষ করে নোনা মাছ আর ব্যাঙের ছাতা, সাদা সস সহযোগে মুরগি, ক্রিমিয়ার সাদা সুরা।

তিনি গরম খাবারটার পর একটা মোটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘চমৎকার, চমৎকার, আমি তোমার কাছে এলাম যেন গোলমাল আর ঝাঁকুনির পর জাহাজ থেকে নামলাম একটা শান্ত তীরে। তাহলে তুমি বলছ যে মেহনতির ব্যাপারটাকেই বিচার করে দেখতে হবে আর কৃষিকাজের প্রণালী নির্বাচনে চলতে হবে সেই অনুসারে। আমি অবশ্য এ ব্যাপারে নেহাৎ অজ্ঞ, তবে আমার মনে হয় তত্ত্ব আর তার প্রয়োগ মেহনতিকেও প্রভাবিত করবে।’

‘আরে দাঁড়াও : আমি অর্থশাস্ত্রের কথা বলছি না, বলছি কৃষিবিদ্যার কথা। এটা হওয়া উচিত নিসর্গ-বিজ্ঞানের মত, নির্দিষ্ট ঘটনাটাকে আর মেহনতিকে তার অর্থনৈতিক, নরকৌলিক…’

এই সময় জ্যাম নিয়ে এলেন আগাফিয়া মিখাইলোভনা।

অব্‌লোন্‌স্কি নিজের ফুলো ফুলো আঙুলের ডগায় চুমু খেতে বললেন, ‘আহ্ আগাফিয়া মিখাইলোভনা, কি চমৎকার আপনার নোনা মাছ, কি চমৎকার আপনার ভোদ্‌কা!… কি কস্তিয়া, সময় হয়নি কি?’ যোগ দিলেন তিনি

জান্‌লা দিয়ে গাছগুলোর ন্যাড়া-চূড়ার ওপাশে ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকালেন লেভিন।

বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সময় হয়ে গেছে! কুজ্‌মা, গাড়ি ঠিক কর!’

অব্‌লোন্‌স্কি নিজে নিচে নেমে তাঁর বার্নিশ করা বাক্স থেকে ক্যানভাসের ঢাকনি খুলে জুড়ে তুলতে লাগলেন নতুন ফ্যাশনের পেয়ারের বন্দুকটা। কুজ্‌মা মোটা একটা বকশিসের গন্ধ পেয়ে অব্‌লোন্‌স্কিকে ছাড়ছিল না, মোজা আর হাইবুট দুই-ই পরিয়ে দিল তাঁকে, অবলোন্‌স্কিও সেটা তাকে করতে দিলেন।

‘কস্তিয়া, বলে দাও তো, রিয়াবিনির বেনিয়া যদি আসে—আমি ওকে আসতে বলেছি আজ—তাহলে ওকে যেন বসিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হয়।’

‘তুমি বন বিক্রি করছ রিয়াবিনিনকে ‘

‘হ্যাঁ, ওকে তুমি চেনো নাকি?’

‘চিনব না কেন। ওর সাথে ‘উত্তম আর চূড়ান্ত’ একটা কাজ ছিল আমার।’

অব্‌লোন্‌স্কি হেসে ফেললেন। ‘উত্তম আর চূড়ান্ত’ ছিল বেনিয়াটির প্রিয় বুলি।

‘হ্যাঁ, কথা ও বলে আশ্চর্য হাস্যকরভাবে। বুঝেছে যে মনিব কোথায় যাচ্ছে!’ লাস্কার পিঠ চাপড়ে লেভিন যোগ করলেন, কুকুরটা গোঁ-গোঁ করে ঘুরঘুর করছিল লেভিনের কাছে, কখনো তাঁর হাত, কখনো বুট, কখনো বন্দুকটা চাটছিল।

ওঁরা যখন বেরোলেন, গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দার কাছে।

‘গাড়ি জুততে বলেছিলাম যদিও বিশেষ দূর নয়। নাকি পায়ে হেঁটেই যাব?’

অব্‌লোন্‌স্কি গাড়ির দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘না, গাড়িতেই যাওয়া যাক।’ গাড়িতে উঠে বাঘের চামড়ার কম্বলে পা ঢেকে চুরুট ধরালেন তিনি, ‘কেন যে চুরুট খাও না! চুরুট—এ শুধু তৃপ্তিই নয়, এ হল পরিতৃপ্তির পরাকাষ্ঠা আর লক্ষণ। একেই বলে জীবন! কি সুন্দর! ঠিক এভাবেই আমার বাঁচার সাধ!

লেভিন হেসে বললেন, ‘কিন্তু বাধা দিচ্ছে-টা কে?’

‘নাঃ, তুমি সুখী লোক। তুমি যা ভালোবাসো, সবই তোমার আছে। ঘোড়া ভালোবাসো, তা আছে, কুকুর—তাও আছে, শিকার—আছে, চাষবাস—তাও রয়েছে।’

‘বোধ হয় সেটা এজন্য যে আমার যা আছে তাতেই আমার আনন্দ যার নেই তা নিয়ে গুমরে মরি না’, লেভিন বললেন কিটির কথা মনে করে

অব্‌লোন্‌স্কি বুঝলেন, তাকিয়ে দেখলেন তাঁর দিকে, কিন্তু কিছুই বললেন না।

শ্যেরবাৎস্কিদের কথা উঠবে বলে লেভিন ভয় পাচ্ছেন এটা লক্ষ্য করে অবলোন্‌স্কি তাঁর বরাবরের মাত্রাবোধে সে নিয়ে কিছুই বললেন না দেখে লেভিন কৃতজ্ঞ বোধ করেছিলেন তাঁর প্রতি; কিন্তু যা তাঁকে অত কষ্ট দিয়েছিল, সেটা এখন জানার ইচ্ছে হচ্ছিল তাঁর, তবে তা বলার সাহস হল না।

তা তোমার ব্যাপার-স্যাপার এখন কেমন?’ শুধু নিজের কথা ভাবা তাঁর পক্ষে কত খারাপ, সে কথা ভেবে লেভিন বললেন।

অব্‌লোন্‌স্কির চোখ আমোদে চকচক করে উঠল। ‘তুমি তো মানো না যে পেট ভরা থাকলেও আরো একটা মিষ্টি রুটির লোভ সম্ভব; তোমার মতে এটা অপরাধ; আর ভালোবাসা ছাড়া জীবন আমি স্বীকার করি না’, লেভিনের প্রশ্নটা নিজের ধরনের বুঝে উনি বললেন, ‘কি করা যাবে, ওইভাবেই জন্মেছি, তা ছাড়া সত্যি, এতে কারো ক্ষতি হয় কম, অথচ নিজের কত তুষ্টি…

লেভিন বললেন, ‘তার মানে, নতুন কেউ নাকি?’

‘হ্যাঁ ভায়া!… বিষণ্ন-মধুর মেয়েদের তো তুমি জান… যে মেয়েদের তুমি দেখো স্বপ্নে… তা এই মেয়েরা হয়ে ওঠে বাস্তব… ভয়ংকর এই মেয়েরা। কি জান, নারী হল এমন বস্তু যে যতই তাদের খতিয়ে দেখা যাক, সবই নতুন লাগবে।’

‘তাহলে খতিয়ে না দেখাই ভালো।’

উঁহু। কে-একজন গণিতজ্ঞ বলেছিলেন, আনন্দটা সত্য আবিষ্কারে নয়, তার সন্ধানে।’

লেভিন শুনছিলেন চুপ করে আর নিজের ওপর যতই জোর খাটান না কেন বন্ধুর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে পারছিলেন না, বুঝতে পারছিলেন না কি তাঁর অনুভূতি, এমন মেয়েদের অধ্যয়ন করায় কিই-বা আনন্দ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *