আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ১.১৫

পনেরো

লেভিনের সাথে তার কি কথা হয়েছে–সান্ধ্য বাসর শেষ হলে কিটি মাকে বলল আর লেভিনের জন্য তার কষ্ট হলেও এই ভেবে তার খুশি লাগছিল যে, তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। তার সন্দেহ ছিল না যে সে উচিত কাজই করেছে। কিন্তু শয্যায় অনেকক্ষণ ঘুম এল না তার। একটা ছবি কিছুতেই ছেড়ে যাচ্ছিল না তাকে। সেটা ভুরু কোঁচকানো লেভিনের মুখ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার পিতার কথা শোনবার সময় সে ভুরুর তল থেকে মন মরার মত চাইছিল তার সদয় চোখ, যখন তিনি দৃষ্টিপাত করছিলেন তার আর ভ্রনস্কির দিকে। তাঁর জন্য এত কষ্ট হল যে চোখ ভরে উঠল পানিতে। কিন্তু ওঁর বদলে যাকে সে বেছেছে, তখনই তার কথা ভাবল সে। তার স্পষ্ট মনে পড়ল সেই পৌরুষব্যঞ্জক দৃঢ় মুখমণ্ডল, সেই উদার স্থৈর্য আর তার সব কিছু থেকে বিকিরিত সবার প্রতি সহায়তা; মনে পড়ল নিজের প্রতি তার ভালোবাসা যাকে সে ভালোবেসেছে এবং আবার প্রাণ তার ভরে উঠল আনন্দে, সুখের হাসি নিয়ে সে বালিশে মাথা দিলে। নিজেকে সে বলছিল, কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কি করি? আমার তো দোষ নেই; কিন্তু অন্তরের কণ্ঠস্বর বলছিল ভিন্ন কথা। কিসের জন্য তার অনুতাপ হচ্ছে–লেভিনকে আকৃষ্ট করেছে, নাকি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছে বলে, তা সে জানত না। কিন্তু নানা দুশ্চিন্তায় সুখ ওর বিষিয়ে যাচ্ছিল। সৃষ্টিকর্তা দয়া কর, সৃষ্টিকর্তা দয়া কর, সৃষ্টিকর্তা দয়া কর! ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত নিজের জন্য এই প্রার্থনা করে গেল সে।

এই সময় নিচে, প্রিন্সের ছোট পাঠকক্ষে চলছিল স্নেহের মেয়েকে নিয়ে মা-বাপের মধ্যে ঘন ঘন কলহের একটা।

‘কি বলছি? এই বলছি!’ দু’হাত আস্ফালন করে এবং সাথে সাথেই ড্রেসিং-গাউনটা ঠিক করে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রিন্স, বলছি যে, আপনার গর্ববোধ নেই, মর্যাদাবোধ নেই। মেয়ের নাম ডোবাচ্ছেন, তাকে ধ্বংস করছেন এই হীন, নির্বোধ ঘটকালি করে!’

‘কিন্তু দোহাই, সৃষ্টিকর্তার দোহাই প্রিন্স, কি আমি করলাম? প্রিন্স-মহিষী বললেন কাঁদো-কাঁদো হয়ে।

মেয়ের সাথে কথা কওয়ার পর তিনি খুশি হয়ে প্রিন্সের কাছে এসেছিলেন সচরাচরের মত শুভরাত্রি জানাতে এবং যদিও লেভিনের প্রস্তাব ও কিটির প্রত্যাখ্যানের কথা জানাবার কোন অভিপ্রায় তার ছিল না, তাহলেও স্বামীকে এই ইঙ্গিত দেন যে তার মনে হচ্ছে, ভ্রনস্কির ব্যাপারটা শেষের মুখে এসে পড়েছে, ওঁর মা এলেই স্থির হয়ে যাবে সব। এ কথা শুনেই প্রিন্স খেপে ওঠেন এবং অশালীন গালাগালি দিয়ে চেঁচাতে থাকেন।

কি আপনি করেছেন? করেছেন এই : প্রথমত আপনি টোপ ফেলে বর ধরেছেন, গোটা মস্কো সে কথা বলাবলি করবে এবং যুক্তিসহকারেই। আপনি যদি সান্ধ্য বাসরের আয়োজন করেন, তাহলে সবাইকে ডাকুন। শুধু বাছাই করা পাত্রদের নয়। ডাকুন সমস্ত এই ন্যাকামণিদের (মস্কোর যুবকদের প্রিন্স এই নাম দিয়েছিলেন), পিয়ানোবাদক ভাড়া করুন, নাচানাচি করুক সবাই–আজকের মত কেবল পাত্রদের জোটানো নয়। আমার দেখতেও বিছুছিরি লাগে, বিছুছিরি, আর আপনি যা চেয়েছিলেন–পেয়েছেন, মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছেন মেয়েটার। লেভিন হাজার গুণ ভালো লোক। আর এই পিটার্সবুর্গী সাহেব–এদের বানানো হয় যন্ত্রে, সবাই ওরা একই ধাঁচের এবং সবাই ওঁছা। ও যদি বনেদি ঘরের প্রিন্সও হয়, তাহলেও ওকে কোন দরকার নেই আমার মেয়ের!

‘কিন্তু আমি কি করেছি?

করেছেন এটা…’ রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রিন্স।

বাধা দিয়ে প্রিন্স-মহিষী বললেন, ‘তোমার কথা শুনতে গেলে মেয়ের বিয়ে হবে না কখনো। আর তাই যদি হয়, তাহলে গায়েই চলে যাওয়া দরকার।

সেই ভালো।

‘শোনো, আমি কি পাত্র ধরার সন্ধানে আছি? কখনো তা করিনি। নেহাৎ একটা যুবক এবং অতি উত্তম যুবক প্রেমে পড়েছে এবং মনে হয় মেয়েটাও…’।

হ্যাঁ, আপনার মনে হচ্ছে। মেয়েটা যদি সত্যিই প্রেমে পড়ে থাকে আর বিয়ে করার কথা উনি ততটাই ভাবছেন যতটা আমি, তাহলে? ওহ! ওঁকে যদি কখনো চোখে না দেখতে হত!… ‘ও প্রেতবাদ, ও নীস, ও বলনাচ…’, আর এই প্রতিটা শব্দের পর প্রিন্স স্ত্রীকে অনুকরণ করে আধবসা হয়ে অভিবাদনের ভঙ্গি করতে লাগলেন, এই করেই আমরা দুর্ভাগা করে তুলব কিটিকে, এই করে সত্যিই ওর মাথায় ঢুকবে…’

কিন্তু তুমি তা ভাবছ কেন?

‘আমি ভাবছি না, জানি; এ ব্যাপারে আমাদের চোখ আছে, মেয়েদের নেই। একজন লোককে আমি দেখতে পাচ্ছি যার গুরুত্বপূর্ণ সংকল্প আছে, সে লেভিন; তিতির-টিতিরও আমি দেখতে পাই। যেমন এই… শুধু আমোদ আহ্লাদ হলেই যার হল।

মাথায় ঢুকিয়েছ যতসব…’

‘এ সব কথা তোমার মনে পড়বে, যখন আর সময় থাকবে না। যেমন ডল্লির বেলায়।

নাও হয়েছে, হয়েছে। এ সব কথা আর তুলব না’, ডল্লির কথা মনে পড়ায় ওঁকে থামিয়ে দিলেন প্রিন্স-মহিষী।

সে তো তোফা! শুভ রাত্রি!

পরস্পরের ওপর ক্রস করে ওঁরা চুম্বন বিনিময় করলেন। কিন্তু দুজনেই টের পাচ্ছিলেন যে ওঁরা নিজের নিজের মত আঁকড়েই রইলেন। যে যার ঘরে গেলেন স্বামী-স্ত্রী।

প্রথমটায় প্রিন্স-মহিষীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আজকের সন্ধ্যায় কিটির ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। ভ্রনস্কির অভিপ্রায়ে কোন সন্দেহই থাকতে পারে না; কিন্তু স্বামীর কথাগুলোয় তিনি গোলমালে পড়লেন। নিজের ঘরে এসে তিনি ঠিক কিটির মতই ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার সামনে কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করলেন : ‘সৃষ্টিকর্তা দয়া কর! সৃষ্টিকর্তা দয়া কর! সৃষ্টিকর্তা দয়া কর!

ষোলো

ভ্রনস্কি জানতেন না–পারিবারিক জীবন কি। যৌবনে তার মা ছিলেন উঁচু সমাজের মনোহারিণী মহিলা। বিয়ে করার সময় এবং বিশেষ করে তার পরে বহু প্রেমলীলা করেছেন তিনি, গোটা সমাজই তা জানত। পিতাকে ভ্রনস্কির প্রায় মনেই পড়ে না। তিনি শিক্ষা পান পেজেস কোরে।

স্কুল থেকে চমৎকার তরুণ অফিসার হয়ে বেরিয়ে এসেই তিনি পিটার্সবুর্গের ধনী সামরিক অফিসারদের মহলে গিয়ে পড়েন। কখনো কখনো সমাজে গেলেও তার প্রেমের সমস্ত আকর্ষণগুলো ছিল সমাজের বাইরে।

বিলাসবহুল আর রুক্ষ পিটার্সবুর্গ জীবনের পর ভ্রনস্কি মস্কোতে প্রথম অনুভব করলেন সমাজের একটা মনোরম নিষ্পাপ বালিকার সাথে সান্নিধ্যের মাধুর্য, যে ভালোবেসেছে তাকে। কিটির সাথে তার সম্পর্কে খারাপ কিছু থাকতে পারে, এটা তার কল্পনাতেই আসেনি। বলে তিনি নাচতেন প্রধানত তার সাথেই; খেতেন ওঁদের বাড়িতে। তার সাথে তিনি যে সব কথা বলতেন, সাধারণতই তা বলা হয়ে থাকে সমাজে, যত বাজে কথা, কিন্তু সেই বাজে কথাকেই তিনি অজান্তে কিটির কাছে বিশেষ অর্থময় করে তুলতেন। সবার সমক্ষে যা বলতে পারেন না তেমন কোন কথা কিটিকে না বললেও তিনি অনুভব করছিলেন যে কিটি ক্রমেই তার মুখাপেক্ষী হয়ে উঠছে এবং যত তা অনুভব করছিলেন ততই সেটা তার ভালো লাগছিল, কিটির প্রতি তার মনোভাব হয়ে উঠছিল কোমল। তিনি জানতেন না যে, কিটির কাছে তার এই ধরনের আচরণের একটা নির্দিষ্ট নাম আছে। এটা হল বিবাহের সংকল্প না করে বালিকার মন ভোলানো আর এই ভোলানোটাই হল তাঁর মত চমৎকার যুবকদের ভেতর প্রচলিত গর্হিত আচরণের একটা। তাঁর মনে হচ্ছিল এই তৃপ্তি আবিষ্কার করেছেন তিনিই প্রথম এবং সে আবিষ্কারে পরম আনন্দ পাচ্ছিলেন তিনি।

 সে সন্ধ্যায় কিটির মা-বাবা কি কথা বলেছেন তা যদি তিনি শুনতে পেতেন, তিনি যদি নিজেকে পরিবারের দৃষ্টিকোণে নিয়ে গিয়ে জানতে পারতেন যে কিটিকে তিনি বিয়ে না করলে সে অসুখী হবে, তাহলে ভয়ানক অবাক লাগত তার এবং সেটা বিশ্বাস করতে পারতেন না। তিনি বিশ্বাসই করতে পারতেন না যে তাকে এবং বড় কথা কিটিকে যা এমন তৃপ্তি দিচ্ছে সেটা খারাপ কিছু হতে পারে। তার যে বিয়ে করা উচিত, এটা তিনি বিশ্বাস করতে পারতেন আরো কম।

বিয়ে তার কাছে সম্ভবপর বলে কদাচ মনে হয়নি। পারিবারিক জীবন তিনি শুধু যে ভালোবাসতেন না তাই নয়, যে অবিবাহিত দুনিয়ায় তার বাস, সেখানকার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে পরিবারে, বিশেষ করে স্বামী হিসেবে নিজেকে কল্পনা করা তার কাছে মনে হত বিজাতীয়, তার চেয়েও বেশি হাস্যকর। কিটির মা-বাবা কি বলাবলি করেছেন তাঁর কোন সন্দেহ না থাকলেও সে সন্ধ্যায় শ্যেরবাৎস্কিদের ওখান থেকে বেরিয়ে তিনি অনুভব করছিলেন যে তার আর কিটির মধ্যে যে গোপন আত্মিক সংযোগ ছিল, সেটা সে সন্ধ্যায় এত দৃঢ়ীভূত হয়ে উঠেছে যে কিছু-একটা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু কি করা সম্ভব এবং উচিত সেটা তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না।

বরাবরের মত নির্মলতা আর স্নিগ্ধতার একটা প্রীতিকর অনুভূতি নিয়ে–যা এসেছে অংশত সারা সন্ধ্যে তিনি ধূমপান করেননি বলে এবং সেইসাথে তাঁর প্রতি কিটির ভালোবাসায় তাঁর মন গলে যাবার একটা নতুন অনুভূতি থেকে–শ্যেরবাৎস্কিদের ওখান থেকে বেরিয়ে ভ্রনস্কি ভাবছিলেন, ‘সবচেয়ে যেটা অপূর্ব, সেটা আমরা কেউ কিছু বলিনি। কিন্তু দৃষ্টিপাত আর কথার ধ্বনিভঙ্গির এই অদৃশ্য কথোপকথনে আমরা পরস্পরকে এত বুঝতে পেরেছি যে কথাটা সে মুখ ফুটে যদি বলতও, তার চেয়েও আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আমাকে সে ভালোবাসে। আর কি মধুর, সহজ, এবং বড় কথা, আস্থায় তা ভরা! আমি নিজেই নিজেকে অনুভব করছি আরো ভালো, আরো নির্মল বলে। আমি অনুভব করছি যে আমার একটা হৃদয় আছে, অনেক ভালো কিছু আছে আমার ভেতর। কি মিষ্টি প্রেমাকুল চোখ। যখন সে বলল : খুবই…’

‘তা কি হল? কিছুই না। আমারও ভালো লাগছে। ওরও ভালো লাগছে। তারপর সন্ধেটা কোথায় শেষ করা যায় এই নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি। ক্লাবে? এক হাত বেজিক খেলা, ইনাতভের সাথে শ্যাম্পেন? না, যাব না। Chateau des fleurs, সেখানে থাকবে অবলোনস্কি, গান, ক্যানক্যান নাচ। উঁহু, বিরক্তি ধরে গেল। শ্যেরবাৎস্কিদের আমি এই জন্যই ভালোবাসি যে নিজেই আমি ভালো হয়ে উঠি। ঘরেই ফেরা যাক।তিনি সোজা গেলেন দ্যুসসো হোটেলে নিজের কামরায়। ঘরে নৈশাহার আনতে বললেন, তারপর ধরাচুড়া খুলে বালিশে মাথা ঠেকাতে-না-ঠেকাতেই বরাবরের মত তার গভীর শান্ত ঘুমে ঢলে পড়লেন।

সতেরো

মাকে আনার জন্য প্রস্কি গেলেন পিটার্সবুর্গ রেল স্টেশনে–পরদিন বেলা এগারোটায় আর বড় সিঁড়িতে প্রথম যাকে দেখলেন তিনি অবলোনস্কি, এসেছেন বোনের জন্য, তিনি একই ট্রেনে আসছেন।

‘আরে হুজুর যে!’ চেঁচিয়ে উঠলেন অবলোনস্কি, কাকে নিতে এসেছ?

মাকে’, অবলোনস্কির সাথে দেখা হলে সবারই মুখে হাসি ফোটে, ভ্ৰস্কিও হেসে করমর্দন করে একসাথে উঠতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে, পিটার্সবুর্গ থেকে আজ ওঁর আসার কথা।’

‘ওদিকে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি রাত দুটো পর্যন্ত। শ্যেরবাৎস্কিদের ওখান থেকে গিয়েছিলে কোথায়?

‘হোটেলে’, বললেন ভ্রনস্কি, ‘স্বীকারই করছি, কাল শ্যেরবাৎস্কিদের ওখান থেকে মনটা এত ভালো লাগছিল যে কোথাও যাবার ইচ্ছে হল না।’

‘দৌড়বাজ ঘোড়াকে চেনা যায় তার গায়ে দাগা মার্কা দেখে, আর প্রেমিক যুবককে চেনা যায় তার ভাবাকুল চোখ দেখে, ঘোষণা করলেন অবলোনস্কি, ঠিক আগে যেমন করেছিলেন লেভিনের কাছে।

ভ্রনস্কি এমন ভাব করে হাসলেন যেন এতে তিনি আপত্তি করছেন না। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আলাপের প্রসঙ্গ পালটালেন।

জিজ্ঞেস করলেন, আর তুমি কাকে নিতে এসেছ?

অবলোনস্কি বললেন, ‘আমি? আমি এসেছি একটা সুন্দরী মহিলার জন্য।

বটে!

ফরাসি ভাষায় বললেন, এটা যে খারাপভাবে বোঝে, ধিক তাকে! বোন আন্নার জন্য।

ভ্রনস্কি বললেন, ‘ও, কারেনিনা?’

‘তুমি নিশ্চয় চেনো?’

মনে হচ্ছে চিনি। কিন্তু বোধ হয় না… সত্যি ঠিক মনে নেই, অন্যমনস্কভাবে বললেন ভ্রনস্কি, কারেনিনা নামটার সাথে সাথে কি-একটা যেন কাটখোট্টা আর একঘেয়ে তার কল্পনায় আবছা ভেসে উঠেছিল।

‘কিন্তু আমার নামজাদা ভগ্নিপতি কারেনিনকে জানো নিশ্চয়। সারা দুনিয়া তাকে চেনে।

‘মানে ওই নামে চিনি, আর চোখের দেখায়। জানি তিনি বুদ্ধিমান, সুশিক্ষিত, এবং কি ধরনের যেন ধর্মপ্রাণ… তবে জানই তো এটা আমার… আমার এখতিয়ার নয়’, বললেন ভ্রনস্কি।

‘কিন্তু উনি অসাধারণ মানুষ ও একটু রক্ষণশীল, কিন্তু চমৎকার লোক’, অবলোনস্কি মন্তব্য করলেন, ‘চমৎকার লোক।

‘সে তো তাঁর পক্ষে ভালোই’, হেসে ভ্রনস্কি বললেন। আরে তুমি এখানে’, দরজার কাছে দাঁড়ানো মায়ের ঢ্যাঙা বৃদ্ধ খানসামাকে দেখে বললেন তিনি, ‘এদিকে এসো।’

সকলের কাছেই অবলোনস্কির যা আকর্ষণ তা ছাড়াও ভ্রনস্কি তাঁর প্রতি বিশেষ অনুরাগ বোধ করছিলেন আরো এই জন্য যে তিনি তাকে একত্রে ধরেছেন কিটির সাথে।

হেসে তার হাতটা নিয়ে ভ্রনস্কি বললেন, তাহলে কি, রবিবারে কিন্নরীপ্রধানার জন্য নৈশভোজ হচ্ছে?

‘অবশ্যই। আমি চাঁদা তুলছি। ও হ্যাঁ, কাল আমার বন্ধু লেভিনের সাথে পরিচয় হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন অবলোনস্কি।

হবে না মানে? কিন্তু কেন জানি উনি চলে গেলেন তাড়াতাড়ি।

‘ভারি ভালো লোক, বলে চললেন অবলোনস্কি, তাই না?

ভ্রনস্কি বললেন, ‘জানি না কেন সমস্ত মস্কোওয়ালাদের মধ্যে, অবশ্য যার সাথে কথা বলছি তিনি ছাড়া, রহস্য করে যোগ দিলেন তিনি, রুক্ষ কি-একটা যেন আছে। এই একেবারে উত্তেজিত, ক্রুদ্ধ, যেন সব কিছু দিয়ে টের পাওয়াতে চায় কি-একটা…’

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছে বটে, সত্যি আছে…’, ফুর্তিতে হেসে উঠলেন অবলোনস্কি।

‘কি, শিগগিরই আসছে কি?’ রেল কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলেন ভ্রনস্কি।

‘ট্রেন আসছে’, জবাব দিল সে।

ট্রেন যত কাছিয়ে আসে ততই তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় স্টেশনে, ছুটোছুটি করে মুটেরা, দেখা দেয় সশস্ত্র পুলিশ আর কর্মচারী, এগিয়ে যায় যারা আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের জন্য এসেছিল। হিমেল ভাপের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছিল ভেড়ার চামড়ার খাটো কোট আর ফেল্টের নরম হাই-বুট পরা মজুরেরা বাকা রেল লাইন ডিঙিয়ে যাচ্ছে। শোনা গেল দূরের লাইনে ইঞ্জিনের হুইসিল আর ভারী কি-একটা চলাচলের আওয়াজ।

‘না’, ভ্রনস্কিকে বললেন অবলোনস্কি, কিটি প্রসঙ্গে লেভিনের সংকল্পের কথা জানাবার ভারি ইচ্ছে হচ্ছিল তাঁর না, তুমি আমার লেভিনকে সম্ভবত ঠিক বোঝনি। অতি উত্তেজনাপ্রবণ লোক সে, অপ্রীতিকর হয়েও ওঠে তা সত্যি, কিন্তু মাঝে মাঝে সে হয়ে ওঠে ভারি ভালো। অতি সৎ ন্যায়নিষ্ঠ লোক, মনটাও সোনার। কিন্তু কাল ছিল একটা বিশেষ কারণ’, অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বলে চললেন অবলোকি, একেবারেই ভুলে গেলেন বন্ধুর প্রতি তার অকৃত্রিম দরদ যা তিনি কাল অনুভব করেছিলেন, এবং এখন ঠিক সেইরকম দরদই অনুভব করছেন শুধু ভ্রনস্কির প্রতি, হ্যাঁ, কারণ ছিল যাতে তার পক্ষে বিশেষ সুখী অথবা বিশেষ অসুখী হওয়া সম্ভব।’

ভ্রনস্কি থেকে গিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন ও তার মানে? নাকি সে কাল তোমার শ্যালিকার কাছে প্রস্তাব দিয়েছে?

অবলোনস্কি বললেন, হয়ত। কাল আমার এমনি কিছু-একটা মনে হয়েছিল। হ্যাঁ, ও যখন আগেই চলে গেছে, আর মন-মেজাজও ভালো ছিল না, তখন এটা তাই… অনেকদিন থেকে ও প্রেমে পড়েছে, ওর জন্য ভারি কষ্ট হয় আমার।’

‘বটে!… তবে আমি মনে করি কিটি ওর চেয়ে ভালো পাত্রের ভরসা করতে পারে।’ এই বলে ভ্রনস্কি বুক টান করে আবার হাঁটা শুরু করলেন, ‘তবে আমি তো ওকে চিনি না’, যোগ করলেন তিনি, হ্যাঁ, এ এক বিছছিরি অবস্থা! এজন্যই বেশির ভাগ লোক পছন্দ করে ক্লারাদের সাহচর্য। সেখানে অসাফল্যে প্রমাণ হয় যে টাকা ততটা নেই। আর এখানে-মর্যাদাটাই বিপন্ন। যাক গে, ট্রেন এসে গেছে।’

সত্যিই দূরে হুইসিল দিল ইঞ্জিন। কয়েক মিনিট বাদে কেঁপে-কেঁপে উঠল প্ল্যাটফর্ম, ফেস-ফোঁস করে ভাপ ছেড়ে ঢুকল ইঞ্জিন, হিমে সে ভাপ নুয়ে পড়ছিল নিচের দিকে, ধীরে ধীরে, মাপ তালে মাঝের চাকার সাথে লাগানো পিস্টন রড বেঁকে যাচ্ছে আর টান হচ্ছে, আঁটসাঁট পোশাকে হিমানীতে আচ্ছন্ন ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে আছে, টেন্ডারের পেছনে ক্রমেই ধীরে আর প্ল্যাটফর্মকে বেশি করে কাঁপিয়ে এল মালপত্রের ওয়াগন, তাতে ঘেউ-ঘেউ করছে একটা কুকুর, শেষে প্যাসেঞ্জার ওয়াগনগুলো কেঁপে-কেঁপে এসে থামল।

চটপটে কন্ডাক্টর হুইসিল দিতে দিতে লাফিয়ে নামল ট্রেন থেকে। তার পেছনে একের পর এক অধীর যাত্রী ও নিজেকে টানটান করে চারদিকে কড়া চোখে তাকাতে থাকল এক গার্ড অফিসার; খুশির হাসি হেসে থলি হাতে নামল এক শশব্যস্ত বেনিয়া; কাঁধে বস্তা ঝুলিয়ে কৃষক।

অবলোনস্কির পাশে দাঁড়িয়ে ভ্রনস্কি দেখছিলেন ওয়াগনগুলো আর তা থেকে নামা যাত্রীদের। তিনি তখন মায়ের কথা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলেন। কিটি সম্পর্কে এখন তিনি যা জানলেন সেটা উদ্বুদ্ধ আর উল্লসিত করেছিল তাকে। আপনা থেকেই বুক তার টান হয়ে উঠেছিল, জ্বলজ্বল করে উঠেছিল চোখ। নিজেকে তিনি বিজয়ী বলে ভাবছিলেন।

‘কাউন্টেস ভ্ৰনস্কায়া এই কম্পার্টমেন্টে’, ভ্রনস্কির কাছে এসে জানাল চটপটে সেই কন্ডাক্টর।

কন্ডাক্টরের কথায় চৈতন্য ফিরল তার, মা আর তার সাথে আসন্ন সাক্ষাতের কথা ভাবতে হল। আসলে মায়ের প্রতি তার কোন শ্রদ্ধা ছিল না এবং সে সম্পর্কে সচেতন না থেকেই ভালোবাসতেন না তাকে, যদিও যে মহলে তাঁর জীবনযাত্রা সেখানেকার বোধ, নিজের শিক্ষাদীক্ষা অনুসারে অতিমাত্রায় বাধ্যতা আর শ্রদ্ধা ছাড়া মায়ের সাথে অন্য কোন সম্পর্ক তিনি কল্পনা করতে পারতেন না আর বাইরে যতই তিনি হতেন বাধ্য ও সশ্রদ্ধ, মনে মনে ততই তিনি তাঁকে কম শ্রদ্ধা করতেন, কম ভালোবাসতেন।

আঠারো

ভ্রনস্কি কন্ডাক্টরের পেছন পেছন ওয়াগনটায় উঠলেন। একজন মহিলা বেরিয়ে আসছিলেন, তাঁকে পথ দেবার জন্য থামলেন কম্পার্টমেন্টে ঢোকার মুখে। উঁচু সমাজের লোকদের অভ্যস্ত মাত্রাবোধে ভ্রনস্কি মহিলার চেহারার দিকে একবার তাকিয়েই বুঝলেন, ইনি উঁচু সমাজের লোক। ক্ষমা চেয়ে তিনি ভেতরে যাবার উপক্রম করছিলেন, কিন্তু মহিলাটির প্রতি আরেকবার তাকিয়ে দেখার তাগিদ বোধ করলেন তিনি–সেটা এই জন্য নয় যে মহিলা অতীব সুন্দরী, তাঁর সমস্ত দেহলতা থেকে সুচারুতা আর সংযত ভঙ্গিমালাবণ্য দেখা গিয়েছিল বলে নয়, এই জন্য যে ভ্রনস্কির পাশ দিয়ে উনি যখন যাচ্ছিলেন তখন তার মিষ্টি মুখখানায় ভারি কমনীয়, স্নেহময় একটা ভাব দেখা গিয়েছিল। ভ্রনস্কি যখন মুখ ফেরালেন, তিনিও মুখ ফিরিয়েছিলেন। ঘন আঁখিপল্লবে তার উজ্জ্বল ধূসর যে চোখ দুটো কালো বলে মনে হয় তা বন্ধুর মত নিবদ্ধ হল ভ্রনস্কির মুখে, যেন তাকে চিনতে পেরেছেন, পরমুহূর্তেই কাকে যেন খুঁজতে চলে গেলেন এগিয়ে আসা ভিড়ের মধ্যে। এই সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাতেই ভ্রনস্কির চোখে পড়ল তার মুখের সংযত সজীবতা, উজ্জ্বল চোখ আর বঙ্কিম রক্তিম ঠোঁটে ঈষৎ হাসির মাঝখানে তার ঝিলিমিলি। যেন তাঁর সত্তা পূর্ণ হয়ে হয়ে তার উদ্বুত্তটা তার ইচ্ছার অপেক্ষা না করেই আত্মপ্রকাশ করছে কখনো চোখের ছটায়, কখনো হাসিতে। ইচ্ছে করেই তিনি তাঁর চোখের ছটা চাপা দিতে চেয়েছেন, কিন্তু তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা দেখা দিয়েছে তার প্রায় অলক্ষ্য হাসিতে।

ভ্রনস্কি ভেতরে গেলেন। মা তার রোগাটে বৃদ্ধা, কালো চোখ, কুণ্ডলী করা চুল। ছেলেকে দেখে চোখ কুঁচকে তিনি পাতলা ঠোঁটে সামান্য হাসলেন। সোফা থেকে উঠে দাসীকে থলে দিয়ে তিনি ছোট্ট শুকনো হাত বাড়িয়ে দিলেন ছেলের দিকে, তারপর তার মাথা তুলে চুম্বন করলেন মুখে।

‘টেলিগ্রাম পেয়েছিলি? ভালো তো?

সৃষ্টিকর্তার কৃপা।’

‘ভালোয় ভালোয় এসেছ তো?’ মায়ের পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন পুত্র, অজান্তে তার কান ছিল দরজার ওপাশে একটা নারীকন্ঠের দিকে। উনি জানতেন যে ঢোকার মুখে যে মহিলাকে দেখেছিলেন, এটি তারই গলা।

কণ্ঠস্বর বলছিল, তাহলেও আমি আপনার সাথে একমত নই।’

‘ওটা পিটার্সবুর্গী দৃষ্টিভঙ্গি মান্যবরা।

‘পিটার্সবুর্গী নয়, নিতান্ত নারীসুলভ’, উত্তর দিলেন তিনি।

‘তা আপনার হস্তচুম্বন করতে দিন।

‘আসুন, আবার দেখা হবে ইভান পেত্রভিচ। তাঁ, দেখুন তো, আমার ভাই এখানে আছে কিনা, আমার কাছে। পাঠিয়ে দিন’, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মহিলা বললেন এবং আবার ঢুকলেন কম্পার্টমেন্টে।

ভ্ৰনস্কায়া তাঁকে বললেন, ‘কি, ভাইকে পেলেন?

এবার ভ্রনস্কির স্মরণ হল, ইনিই কারেনিনা।

উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘আপনার ভাই এখানেই। মাপ করবেন, আমি আপনাকে চিনতে পারিনি, তাছাড়া আমাদের পরিচয় এত সামান্য, ভ্রনস্কি মাথা নোয়ালেন, ‘আমার কথা নিশ্চয় আপনার মনে নেই।’

উনি বললেন, ‘আরে না, আমি আপনাকে চিনতে পারতাম, কেননা সারা পথটাই বোধহয় আপনার মায়ের সাথে আমরা আপনার কথা গল্প করতে করতে এসেছি’, তার যে সজীবতা বহিঃপ্রকাশ চাইছিল, অবশেষে তাকে হাসিতে পথ ছেড়ে দিয়ে বললেন, কিন্তু আমার ভাই তো এখনো এল না।’

‘ওকে ডেকে আন আলিওশা’, বললেন বৃদ্ধা কাউন্টেস।

ভ্রনস্কি প্ল্যাটফর্মে নেমে চিৎকার করলেন : ‘অবলোনস্কি!’

কিন্তু ভাইয়ের জন্য কারেনিনা বসে রইলেন না, তাঁকে দেখা মাত্র দৃঢ় লঘু পায়ে বেরিয়ে এলেন ওয়াগন থেকে। আর ভাই কাছে আসতেই যে দৃঢ়, ললিত ভঙ্গিতে তিনি বাঁ হাতে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে এনে প্রগাঢ় চুম্বন করলেন, তাতে আশ্চর্য লেগেছিল ভ্রনস্কির। চোখ না সরিয়ে ভ্রনস্কি তাকিয়ে ছিলেন কারেনিনার দিকে, নিজেই জানতেন না কেন হাসছেন। কিন্তু মা তার অপেক্ষায় আছেন মনে পড়ায় আবার উঠলেন ওয়াগনে।

কারেনিনা সম্পর্কে কাউন্টেস বললেন, সত্যি, ভারি মিষ্টি, তাই না? ওঁর স্বামী ওঁকে উঠিয়ে দেন আমার কামরায়। আমি ভারি খুশি, সারা রাস্তা আমরা গল্প করেছি। কিন্তু তুই…’, এরপর ফরাসি ভাষায় বললেন, ‘এখনো তোমাকে আদর্শ প্রেম টানছে। সে ভালোই প্রিয়বর, ভালোই।’

জানি না কি বলতে চাইছেন, নিরুত্তাপ গলায় জবাব দিলেন পুত্র, মা, তাহলে যাওয়া যাক।

কাউন্টেসের কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য কারেনিনা আবার এলেন ওয়াগনে। ফুর্তির সুরে তিনি বললেন, তাহলে কাউন্টেস, আপনি আপনার ছেলেকে পেলেন, আমি আমার ভাইকে। আমার সব কাহিনী শেষ, এর পর আর বলার কিছু নেই।

‘আরে না, না, ওঁর হাত ধরে বললেন কাউন্টেস, আপনার সাথে আমি সারা দুনিয়া ঘুরে আসতে পারি, একটুও বিরক্তি লাগবে না। আপনি তেমনি একজন মিষ্টি মেয়ে যার সাথে কথা বলা বা চুপ করে থাকা, দুই-ই সমান আনন্দের। আর আপনার ছেলের কথা কিছু ভাববেন না : কখনো ছেড়ে থাকা যাবে না, এটা তো চলে না।

একেবারে খাড়া শরীরে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কারেনিনা, চোখ দুটো তার হাসছিল।

ছেলেকে বুঝিয়ে বললেন কাউন্টেস, ‘আন্না আর্কাদিয়েভনার ছেলে আছে একটা, বোধ হয় আট বছর বয়স। কখনো তাকে ছেড়ে থাকেননি, এবার রেখে এসেছেন বলে কষ্ট পাচ্ছেন।

কারেনিনা বললেন, হ্যাঁ, সারাটা সময় কাউন্টেস আর আমি গল্প করেছি, আমি বলেছি আমার ছেলের কথা, উনি। ওঁর। মুখ ওঁর আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল হাসিতে, ভ্রনস্কির উদ্দেশে স্নিগ্ধ হাসি।

রঙ্গলীলার যে বলটা ছোঁড়া হয়েছিল সেটা তৎক্ষণাৎ লুফে নিয়ে কি বললেন, তাতে নিশ্চয় ভারি ক্লান্ত হয়েছেন আপনি। কিন্তু বোঝা গেল এসবের কথাবার্তা চালিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিল না কারেনিনার, উনি বৃদ্ধা কাউন্টেসের দিকে ফিরলেন : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কাল কি করে যে সময় কেটে গেল খেয়ালই করিনি। আসি তাহলে, কাউন্টেস।

কাউন্টেস বললেন, ‘বিদায় ভাই, দিন আপনার সুন্দর মুখখানায় একটু চুমু দিই। বুড়িদের মত স্রেফ সোজাসুজিই বলছি, আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেছি।

কথাটা যেভাবেই বলা হোক, বোঝা গেল কারেনিনা মনেপ্রাণে সেটা বিশ্বাস করেছেন এবং তাতে খুশি হয়ে উঠেছেন; লাল হয়ে তিনি সামান্য নত হয়ে মুখ পাতলেন কাউন্টেসের ঠোঁটের কাছে, আবার সিধে হয়ে ঠোঁট আর চোখের মাঝখানে চঞ্চল সেই হাসি নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন ভ্রনস্কির দিকে। বাড়িয়ে দেওয়া ছোট্ট হাতখানায় চাপ দিলেন তিনি আর কেমন যেন সতেজে কারেনিনা তাঁর হাতটা নিয়ে সজোরে এবং অসংকোচে ঝাঁকুনি দিলেন, তাতে খুশি লাগল তার। কারেনিনা চলে গেলেন তার রীতিমত পুরুষ্টু দেহের পক্ষে দ্রুত, আশ্চর্য অনায়াস গতিভঙ্গিমায়।

‘ভারি মিষ্টি’, বললেন বৃদ্ধা।

পুত্রও তাই ভাবছিলেন। কারেনিনার সৌষ্ঠবমণ্ডিত মূর্তি দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত ভ্ৰভ্রনস্কি তাকিয়ে ছিলেন তাঁর দিকে, মুখে তার হাসিটা লেগেই ছিল। জানলা দিয়ে তিনি দেখলেন কারেনিনা ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাঁকে বাহুলগ্ন করে সোৎসাহে কি-একটা বলতে শুরু করলেন, অবশ্যই এমন কোন কথা যার সাথে ভ্রনস্কির কোন সম্পর্ক নেই এবং তাতে মন খারাপ হয়ে গেল তার।

‘কি মা, আপনি পুরোপুরি সুস্থ তো?’ মায়ের দিকে ফিরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন আবার।

‘সব ভালো, দিব্যি সুন্দর। আলেক্সান্দার ভারি ভালো ব্যবহার করেছে। মারিও খুব সুন্দরী হয়ে উঠেছে, ভারি মন টানে।

এবং আবার শুরু করলেন সেই কথা বলতে যাতে তাঁর সবচেয়ে বেশি আগ্রহ, অর্থাৎ নাতির খ্রিস্টদীক্ষা, যার জন্য তিনি পিটার্সবুর্গ গিয়েছিলেন, এবং বড় ছেলের ওপর জারের বিশেষ আনুকূল্যের কথা।

‘এই তো, লাভ্রেন্তি এসে গেছে’, জানালার দিকে তাকিয়ে একি বললেন, ‘আপনার অসুবিধা না হলে এবার যাওয়া যেতে পারে।

কাউন্টেসের যাত্রাসঙ্গী বৃদ্ধ খানসামা গাড়িতে উঠে জানালা যে সব তৈরি। কাউন্টেসও উঠে দাঁড়ালেন যাবার জন্য।

ভ্রনস্কি বললেন, যাওয়া যাক, এখন লোক কম।

দাসী নিল একটা থলে আর কুকুটাকে। খানসামা আর একজন মুটে নিল অন্য মালগুলো। কিন্তু মাকে বাহুলগ্ন করে ভ্রনস্কি যখন গাড়ি থেকে নামলেন, হঠাৎ ব্ৰস্ত মুখে জনকয়েক লোক ছুটে গেল পাশ দিয়ে। ছুটে গেলেন অসামান্য রঙের টুপি মাথায় স্টেশন-মাস্টারও। স্পষ্টতই অস্বাভাবিক কিছু-একটা ঘটেছে। ট্রেনের লোকেরা ছুটে গেল পেছন দিকে।

‘কি?… কি ব্যাপার?… কোথায়?… ঝাঁপিয়ে পড়েছিল!… কাটা পড়েছে!…’ যারা যাচ্ছিল তাদের মধ্যে থেকে শোনা যাচ্ছিল এসব কথা।

অবলোনস্কি এবং তার বাহুলগ্না বোনও ভীত মুখে লোকেদের ফেলে রেখে ফিরে এসে দাঁড়ালেন ওয়াগনের সামনে।

মহিলারা গাড়িতে উঠলেন এবং ভ্রনস্কি আর অবলোনস্কি লোকেদের পিছু পিছু গেলেন দুর্ঘটনার বিশদ খবর জানতে।

একজন পাহারাওয়ালা, হয় সে ছিল মাতাল নয় প্রচণ্ড শীতের জন্য এত বেশি জামা-কাপড় জড়ানো যে পেছন দিকে যাওয়া ট্রেনের শব্দ শুনতে পায়নি, এবং চাপা পড়ে।

ভ্রনস্কি আর অবলোনস্কি ফেরার আগেই মহিলারা এ খবর জানতে পান খানসামার কাছ থেকে।

অবলোনস্কি আর ভ্রনস্কি দুজনেই দেখেছিলেন বিকৃত লাশটা। স্পষ্টতই অবলোনস্কির কষ্ট হচ্ছিল। চোখ-মুখ কুঁচকে ছিলেন তিনি, মনে হল এই বুঝি কেঁদে ফেলবেন।

‘উহ্ কি বীভৎস! উঁহু, আন্না, তুমি যদি দেখতে! উহ্ কি বীভৎস!’ বলছিলেন তিনি।

ভ্রনস্কি চুপ করেছিলেন, তার সুন্দর মুখ গম্ভীর, তবে প্রশান্ত।

উহ, আপনি যদি দেখতেন কাউন্টেস’, বললেন অবলোনস্কি, বউ গিয়েছে সেখানে,.. তার দিকে তাকিয়ে দেখতেও ভয় হয়… লাশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে সে। লোকে বলছে, লোকটার একার রোজগারে বিরাট একটা সংসার চলতো। কি ভয়ঙ্কর?

‘ওর জন্য কিছু-একটা করা যায় না?’ বিচলিত হয়ে কারেনিনা বললেন ফিসফিস করে।

ভ্রনস্কি তার দিকে তাকিয়ে তখনই নেমে গেলেন গাড়ি থেকে।

দরজার কাছে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমি এখনই আসছি মা।’

কয়েক মিনিট পরে উনি যখন ফিরলেন, অবলোনস্কি তখন কাউন্টেসকে নতুন গায়িকার কথা বলছিলেন আর ছেলের প্রতীক্ষায় কাউন্টেস অধীর হয়ে তাকাচ্ছিলেন দরজার দিকে।

ভেতরে ঢুকে ভ্রনস্কি বললেন, ‘এবার চলি।’

সবাই বেরোলেন একসাথে। মাকে নিয়ে ভ্রনস্কি চললেন আগে আগে। পেছনে ভাইয়ের সাথে কারেনিনা। ফটকের মুখে ভ্রনস্কিকে ধরলেন স্টেশন-মাস্টার।

‘আমার অ্যাসিস্টেন্টকে আপনি দু’শ রুল দিয়েছেন। দয়া করে বলুন এটা কার জন্য।

‘বিধবার জন্য, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন ভ্রনস্কি, এ আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে?

‘আপনি দিয়েছেন?’ পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন অবলোনস্কি এবং বোনের হাতে চাপ দিয়ে যোগ করলেন, ‘খুব ভালো করেছেন, খুব ভালো করেছেন! ভারি ভালো ছেলে, তাই না? আমার শ্রদ্ধা রইল কাউন্টেস।

বোনের সাথে তিনি থেমে গিয়ে খুঁজতে লাগলেন কারেনিনার দাসীকে।

যখন তারা বেরোলেন, ভ্রনস্কির গাড়ি ততক্ষণে ছেড়ে গেছে। যারা বেরিয়ে আসছিল, তারা তখনো বলাবলি করছিল দুর্ঘটনাটা নিয়ে।

‘দেখো কেমন বীভৎস মরণ!’ পাশ দিয়ে যেতে যেতে কে একজন বলল, ‘শুনছি, দু’টুকরো হয়ে গেছে।

আরেকজন বলল, আমি উল্টো মনে করি, এই তো সবচেয়ে সহজ, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু।

‘ওরা ব্যবস্থা নেবে না কেন?’ বলল তৃতীয় জন।

কারেনিনা গাড়িতে বসলেন, অবলোনস্কি অবাক হয়ে দেখলেন তার ঠোঁট কাঁপছে, চোখের পানি চেপে রেখেছেন বহু কষ্টে।

কিছু দূরে যাবার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হল তোমার, আন্না?’

আন্না বললেন, এটা একটা অলক্ষণ।

অবলোনস্কি বললেন, ‘যত বাজে কথা! তুমি এসেছ এটাই প্রধান ব্যাপার। তোমার ওপর কত যে ভরসা করে আছি ভাবতে পারবে না।’

আন্না জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, এই ভ্রনস্কি তোমার অনেক দিনের চেনা?

‘হ্যাঁ। জানো, আমরা আশা করছি ও কিটিকে বিয়ে করবে।’

‘তাই নাকি? আস্তে করে বললেন আন্না, তারপর যেন অনাবশ্যক অসুবিধাজনক কিছু-একটাকে দেহ থেকে ঝড়ে ফেলার জন্য মাথা ঝাঁকিয়ে যোগ দিলেন, এবার কোতার কথা শোনা যাক। বল কি তোমার ব্যাপার। তোমার চিঠি পেয়ে এই চলে এলাম।

হ্যাঁ, তোমার ওপরেই সব ভরসা’, বললেন অবলোনস্কি।

‘তা, সব আমাকে বল।

অবলোনস্কি বলতে শুরু করলেন।

অবলোনস্কি বাড়ি এসে বোনকে নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার হাতে চাপ দিয়ে অফিসে চলে গেলেন।

উনিশ

ডল্লি যখন ছোট ড্রয়িং-রুমটায় বসেছিলেন শণচুলো গোলগাল একটা খোকার সাথে—শুনছিলেন তার ফরাসি ভাষার পাঠ, আন্না তখন ভেতরে ঢুকলেন। ছেলেটি এখন হয়ে উঠেছে তার বাবার মতই দেখতে। ছেলেটি পড়ছিল আর জামার একটা আলগা বোতাম পাকিয়ে পাকিয়ে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করছিল। কয়েক বার তার হাত সরিয়ে দিয়েছেন ডল্লি, কিন্তু গোলমাল হাতটা আবার এসে ঠেকেছে সেখানে। মা বোতামটা ছিঁড়ে রেখে দিলেন নিজের পকেটে।

‘হাত সামলে রাখ গ্রিশা’, বলে মা আবার তাঁর শাল বোনায় মন দিলেন। এটি তিনি বুনছেন অনেক দিন থেকে মনঃকষ্টের মুহূর্তে এটি টেনে নিতেন, এখন বুনছিলেন একটা স্নায়বিক উত্তেজনায়, আঙুল দিয়ে দিয়ে ঘর গুনছিলেন। বোন আসছেন কি আসছেন না এটা তাঁর কোন দায় নয়, কাল স্বামীকে এ কথা বলে পাঠালেও তিনি তাঁর আসার জন্য সব তৈরি করে রেখেছিলেন এবং অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন ননদের।

তাঁর নিজের দুঃখে ডল্লি একেবারে মূহ্যমান। তাহলেও তাঁর মনে ছিল যে ননদ আন্না পিটার্সবুর্গের একজন অতি নামজাদা লোকের স্ত্রী, পিটার্সবুর্গ সমাজের একজন নামীদামী মহিলা। এই পরিস্থিতির কারণে স্বামীকে যা বলে পাঠিয়েছিলেন, তা তিনি করলেন না, অর্থাৎ বললেন না যে ননদ আসছেন। ডল্লি ভাবলেন, ‘হ্যাঁ, যতই হোক, আন্নার তো কোন দোষ নেই। ওঁর মধ্যে ভালো ছাড়া মন্দ আমি কিছু দেখিনি, আর আমার সম্পর্কে তাঁর ব্যবহারে আমি কেবল প্রীতি আর বন্ধুত্বই দেখেছি।’ অবশ্য পিটার্সবুর্গে কারেনিনদের ওখানে তাঁর বসবাসের যে স্মৃতিটুকু তাঁর মনে আছে তাতে ওঁদের বাড়িটাই তাঁর ভালো লাগেনি; তাঁদের গোটা পারিবারিক জীবনযাত্রার মধ্যে কি-একটা যেন মিথ্যা ছিল। ‘কিন্তু ওঁকে গ্রহণ করব না কেন? শুধু আমাকে যেন সান্ত্বনা দিতে না আসেন’, ভাবলেন ডল্লি, ‘সমস্ত সান্ত্বনা, আর উপদেশ, আর খ্রিস্টীয় ক্ষমার কথা আমি হাজার বার ভেবে দেখেছি, ও সব কাজের কিছু নয়।

এই কয়দিন ডল্লি একা ছিলেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে। নিজের দুঃখের কথা উনি কাউকে বলতে চাননি, আর মনের মধ্যে সে দুঃখ পুষে রেখে তিনি অন্য কিছু বলতেও পারতেন না। তাহলেও তিনি জানতেন যে আন্নাকে যে করেই হোক না কেন সব বলবেন। আর কখনো তিনি বলবেন ভেবে খুশি হচ্ছিলেন, আবার কখনো রাগ হচ্ছিল এই ভেবে যে ওঁর কাছে, স্বামীর বোনের কাছে নিজের অপমানের কথা বলতে হবে, আর তাঁর মুখ থেকে শুনতে হবে উপদেশ আর সান্ত্বনার তৈরি বুলি।

যা প্রায়ই ঘটে থাকে, উনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রতি মুহূর্তে অতিথির জন্য অপেক্ষা করছিলেন এবং ঠিক সেই মুহূর্তটাই খেয়াল করলেন না যখন অতিথি এসে গেছেন, কেননা ঘণ্টি কানে যায়নি তাঁর।

গাউনের খসখস আর ততক্ষণে দরজায় লঘু পদশব্দ শুনে তিনি ফিরে তাকালেন, তাঁর কাতর মুখে আপনা থেকেই ফুলে উঠল আনন্দ নয়, বিস্ময়। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি আলিঙ্গন করলেন ননদকে।

চুমু খেয়ে বললেন, ‘সে কি, এর মধ্যেই এসে গেছ?’

‘তোমাকে দেখে কি আনন্দই না হচ্ছে ডল্লি!’

‘আমারও আনন্দ হচ্ছে’, ক্ষীণ হেসে এবং আন্নার মুখের ভাব দেখে তিনি জানেন কিনা সেটা অনুমান করার চেষ্টা করে ডল্লি বললেন। আন্নার মুখে সহানুভূতির ছায়া লক্ষ্য করে ভাবলেন, ‘নিশ্চয় জানে।’, ‘চল, তোমার ঘরে তোমাকে দিয়ে আসি’, বোঝাবুঝির মুহূর্তটা যথাসম্ভব পেছিয়ে দেবার চেষ্টা করে ডল্লি বললেন।

‘এই গ্রিশা? আরে, কি বড়ই না হয়ে উঠেছে!’ ওকে চুমু খেয়ে এবং ডল্লির ওপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে আন্না থেমে গেলেন এবং লাল হয়ে উঠলেন, ‘না, কোথাও এখন আর যেতে চাই না বাপু।

রুমাল আর টুপি খুললেন তিনি, সবদিকে তাঁর কালো চুলেল কুণ্ডল, একগোছা আটকে গিয়েছিল টুপিতে, মাথা ঝাঁকিয়ে সেটা ছাড়ালেন।

প্রায় ঈর্ষা নিয়ে ডল্লি বলল, ‘সুখে স্বাস্থ্যে সব সময়ই জ্বলজ্বল কর তুমি।’

‘আমিঃ… তা হ্যাঁ’, বললেন তিনি, ‘আরে তানিয়া না? সৃষ্টিকর্তা! আমার সেরিওজার সমবয়সী।’ ছুটে আসা একটা মেয়েকে দেখে বলে উঠলেন আন্না, কোলে নিয়ে চুমু খেলেন তাকে। ‘কি সুন্দর মেয়ে, কি সুন্দর! দেখাও না ওদের সবাইকে।’

এক-এক করে ওদের নাম করলেন তিনি, এবং শুধু নাম নয়, কার কোন বছর, কোন মাসে জন্ম, কার কেমন স্বভাব, কি রোগে ভুগেছে এ সবই মনে করে বললেন তিনি এবং ডল্লি তার কদর না করে পারলেন না।

‘বেশ, চলুন ওদের কাছে’, ডল্লি বললেন, ‘শুধু ভাসিয়া ঘুমাচ্ছে, এটাই যা আফসোস।’

ছেলেদের দেখে এসে ওঁরা একলা ড্রয়িং-রুমে বসলেন কফি নিয়ে। আন্না ট্রে-টা নিয়েছিলেন, পরে তা সরিয়ে রাখলেন। বললেন, ‘ডল্লি, ও আমাকে বলেছে।’

শীতল দৃষ্টিতে ডল্লি তাকালেন আন্নার দিকে। এর পর ভান করা সহানুভূতির বুলি আশা করছিলেন তিনি; কিন্তু আন্না তেমন কিছু বললেন না। বললেন, ‘ডল্লি লক্ষ্মীটি, ওর হয়ে তোমাকে কিছু বলব না, সান্ত্বনা দিতে যাব না, সে অসম্ভব। কিন্তু, লক্ষ্মী আমার, শুধু কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে তোমার জন্য।’

তাঁর জ্বলজ্বলে চোখের ঘন পক্ষ্মতল থেকে হঠাৎ টলমল করে উঠল অশ্রু। তিনি ঘেঁষে বসলেন ভাবীর দিকে, নিজের ছোট্ট সজীব হাতে চেপে ধরলেন তাঁর হাত। ডল্লি সরে গেলেন না, কিন্তু বদল হল না মুখের নীরস ভাবটায়। বললেন : ‘আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে লাভ নেই। যা ঘটেছে তারপর সবই গেছে, সবই ডুবেছে।’

আর এই কথাটা বলামাত্র হঠাৎ নরম হয়ে এল তাঁর মুখভাব। ডল্লির শুকনো রোগা হাতখানা তুলে চুমু খেয়ে আন্না বললেন : ‘কিন্তু ডল্লি, কি করা যায়, কি করা যায়? এই ভয়ংকর অবস্থায় কি করলে ভালো হবে? সেটাই ভাবা দরকার।’

ডল্লি বললেন, ‘সব শেষ, সব চুকে গেছে। আর সবচেয়ে খারাপ কি জান, আমি ওকে ত্যাগ করতে পারি না; ছেলেপেলেরা রয়েছে, আমি যে বাঁধা। কিন্তু ওর সাথে ঘর করতেও আমি পারব না, ওকে দেখলেই যন্ত্রণা হয় আমার।

‘ডল্লি, বোনটি আমার, ও আমাকে বলেছে, কিন্তু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই, সব কিছু আমাকে বল।’

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ডল্লি তাকালেন তাঁর দিকে।

আন্নার মুখে দেখা গেল অকৃত্রিম সহমর্মিতা আর ভালোবাসা।

হঠাৎ ডল্লি বললেন, ‘বেশ তাই হোক। কিন্তু আমি গোড়া থেকে সব বলব। তুমি জানো আমার বিয়ে হয় কিভাবে? মায়ের শিক্ষাগুণে আমি শুধু নিরীহ নয়, বোকাই ছিলাম। কিছুই জানতাম না আমি। আমি জানি লোকে বলে, স্বামী তার আগের জীবন সম্পর্কে স্ত্রীকে সব কিছু বলবে। কিন্তু স্তিভা…’ নিজেকে সংশোধন করে নিলেন তিনি, ‘অব্‌লোন্‌স্কি আমাকে কিছুই বলেনি। তোমার বিশ্বাস হবে না, কিন্তু এতদিন পর্যন্ত আমি ভেবে এসেছি, আমিই একমাত্র নারী যাকে ও জানে। এভাবেই কাটিয়েছি আট বছর। তুমি বুঝে দেখো, আমি শুধু তাকে অবিশ্বস্ততায় সন্দেহ করিনি তাই নয়, ভাবতাম ওটা অসম্ভব। তারপর এই ধরনের ধারণা নিয়ে হঠাৎ, ভেবে দেখো, এসব বীভৎসতা, এই কদর্যতা… তুমি আমাকে বোঝার চেষ্টা কর। নিজের সুখে একেবারে নিঃসন্দেহ থাকার পর হঠাৎ…’ ডল্লি বলে চললেন তাঁর ফোঁপানি চেপে, ‘পাওয়া গেল চিঠি, ওর চিঠি ওর প্রণয়িনীর কাছে। আমারই গভর্নেসের কাছে। না, এটা বড় বেশি সাঙ্ঘাতিক!’ উনি তাড়াতাড়ি করে রুমাল চাপা দিলেন মুখে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে চললেন, ‘একটা আসক্তির ব্যাপার হলেও নয় বুঝতাম। কিন্তু ভেবে চিন্তে ধূর্তামি করে আমাকে প্রতারণা… কিন্তু কার সাথে? ওকে নিয়ে আবার সেইসাথে আমার স্বামী হয়ে থাকা… এটা সাঙ্ঘাতিক! তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না।‘

‘না না, আমি বুঝতে পারছি ডল্লি, বুঝতে পারছি’, তাঁর হাতে চাপ দিয়ে বললেন আন্না।

ডল্লি বলে চললেন, ‘আমার অবস্থা যে কি সাঙ্ঘাতিক সেটা ও বোঝে বলে তুমি ভাবছ? এক বিন্দু না! ও দিব্যি সুখে-স্বচ্ছন্দে আছে।’

‘না, না’, তাড়াতাড়ি করে বাধা দিলেন আন্না, ‘ও নেহাৎ কৃপাপাত্র, অনুশোচনায় মরছে…’

‘ওর পক্ষে অনুশোচনা কি সম্ভব?’ একদৃষ্টে ননদের মুখের দিকে তাকিয়ে বাধা দিলেন ডল্লি।

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমি ওকে জানি। ওকে দেখে কষ্ট হচ্ছিল আমার! দুজনেই তো আমরা ওকে জানি। ওর মনটা ভালো, কিন্তু গর্ব আছে তো, আর এখন একেবারে হতমান… প্রধান যে জিনিসটা আমাকে নাড়া দিয়েছে’, (আন্না অনুমান করে নিলেন প্রধান কোন জিনিসটা ডল্লিকে নাড়া দিতে পারে), ‘দুটো ব্যাপার তাকে দগ্ধে মারছে : ছেলেমেয়েদের সামনে লজ্জা, আর তোমাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও… হ্যাঁ, হ্যাঁ, দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি করে তোমাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও’, আপত্তি করতে ওঠা ডল্লিকে তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে তিনি বললেন, ‘তোমাকেই কষ্ট দিয়েছে, তোমাকে শেষ করে ফেলেছে। ও কেবলি বলছে, ‘না, না, আমাকে ও ক্ষমা করবে না।’

চিন্তামগ্নের মত ডল্লি ননদের দিকে না তাকিয়ে তাঁর কথা শুনে যাচ্ছিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি বুঝি যে ওর অবস্থাটা দুর্বিষহ; নির্দোষের চেয়ে দোষীর হাল হয় খারাপ, যদি সে বুঝে থাকে যে তার দোষেই এই দুর্ভাগ্য। কিন্তু কি করে ক্ষমা করি, ওই মেয়েটার পর কি করে থাকি তার স্ত্রী হয়ে? ওর সাথে থাকা এখন আমার কাছে যন্ত্রণা, ওর প্রতি আমার অতীত ভালোবাসাটা আমি ভালোবাসি বলেই…’

ফোঁপানিতে তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গেল।

কিন্তু যতবার তিনি নরম হয়ে আসছিলেন, ততবারই যেটা তাঁকে জ্বালাচ্ছে, আবার সেই কথা বলতে শুরু করছিলেন তিনি।

‘ওর যে বয়স কম, ও যে সুন্দরী’, ডল্লি বলে চললেন, ‘আমার যৌবন, আমার রূপ কে হরণ করেছে জানো আন্না? ও আর তার ছেয়েমেয়েরা। ওর জন্য খেটে গেছি আমি, সেই খাটুনিতেই আমার সব কিছু গেছে, আর এখন তাজা, ইতর একটা প্রাণীকে মনোরম লাগবে বৈকি। ওরা নিশ্চয় নিজেদের মধ্যে আমার কথা বলাবলি করেছে, কিংবা যা আরো খারাপ, চুপ করে থেকেছে, বুঝেছ?’ আবার চোখে ওঁর ফুটে উঠল আক্রোশ, ‘আর এর পর ও আমাকে বলবে… ওকে আমি কি আর বিশ্বাস করব? কখনো না। না, যা ছিল আমার সান্ত্বনা, আমার খাটুনির পুরস্কার, যন্ত্রণা, সব চুকে গেছে… তুমি বিশ্বাস করবে কি? এই তো, গ্রিশাকে পড়াচ্ছিলাম : আগে এটা ছিল আনন্দের ব্যাপার, এখন কষ্ট। কেন আমি খাটছি, চেষ্টা করে যাচ্ছি? ছেলেপিলে নিয়ে কি হবে আমার? সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার এই যে মন আমার হঠাৎ পালটে গেছে। ভালোবাসা, কোমলতার বদলে ওর প্রতি আমার আছে কেবল আক্রোশ, হ্যাঁ আক্রোশ। আমি ওকে খুন করতে পারি…’

‘ডল্লি, বোন আমার, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু নিজেকে কষ্ট দিও না। তুমি এত অপমানিত, এত উত্তেজিত হয়েছ যে অনেক জিনিসকে তুমি দেখছ একটু অন্যভাবে।’

ডল্লি শান্ত হয়ে এলেন, মিনিট দুয়েক চুপ করে রইলেন ওঁরা।

‘কি করা যায় আন্না, ভেবে বল, সাহায্য কর আমাকে। আমি অনেক ভেবে দেখেছি, কিন্তু পথ পাচ্ছি না।‘

আন্না কিছুই ভেবে উঠতে পারলেন না, কিন্তু ভাবীর প্রতিটা কথা, প্রতিটা মুখভাবে সরাসরি সাড়া দিচ্ছিল তাঁর হৃদয়।

এই বলে শুরু করলেন আন্না, ‘শুধু একটা কথা বলি, আমি ওর বোন, ওর চরিত্র আমার জানা, জানি ওর সব কিছু ভুলে যাবার’, (কপালের সামনে হাতের একটা ভঙ্গি করলেন তিনি), ‘এই সামর্থ্য, পুরোপুরি আসক্তি তবে আবার পুরোপুরি অনুশোচনার এই প্রবণতা। যা সে করেছে সেটা করতে পারল কিভাবে তা এখন আর তার বিশ্বাস হচ্ছে না, বুঝতে পারছে না।’

ডল্লি বাধা দিলেন, ‘না, বোঝে, বুঝেছে! কিন্তু আমার কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ… আমার পক্ষে কি এটা সহজ?’

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমাকে যখন ও ঘটনাটা বলেছিল, তখন তোমার অবস্থাটা কত ভয়ঙ্কর তা আমি বুঝিনি, সেটা তোমার কাছে স্বীকার করছি। আমি শুধু দেখেছিলাম ওকে, দেখেছিলাম যে পরিবার ভেঙে পড়ছে; ওর জন্য মায়া হয়েছিল আমার, কিন্তু তোমার সাথে কথা বলার পরে আমি নারী হিসেবে অন্য কিছু দেখছি; দেখছি তোমার যন্ত্রণা, বলতে পারব না তোমার জন্য কি যে কষ্ট হচ্ছে আমার! কিন্তু ডল্লি, বোন আমার, তোমার যন্ত্রণা আমি বেশ বুঝতে পারছি, শুধু একটা জিনিস আমি জানি না… জানি না… জানি না ওর জন্য তোমার প্রাণের ভেতর কতটা ভালোবাসা এখনো আছে। সেটা তুমি জানো—এতটা কি আছে যাতে ওকে ক্ষমা করা সম্ভব। যদি থাকে, তাহলে ক্ষমা কর।’

‘না’, ডল্লি শুরু করেছিলেন, কিন্তু আরেকবার তাঁর হাতে চুমু খেয়ে আন্না থামিয়ে দিলেন তাঁকে। বললেন, ‘দুনিয়াটা আমি তোমার চেয়ে বেশি জানি। স্তিভার মত এসব লোকেদের আমি চিনি, জানি কিভাবে তারা এই ব্যাপারগুলোকে দেখে। তুমি বলছ, মেয়েটার সাথে ও তোমার কথা বলাবলি করেছে। তা সে করেনি। এসব লোকে বিশ্বাসহানির কাজ করতে পারে, কিন্তু নিজেদের গৃহ আর গৃহিণী তাদের কাছে পবিত্র। এই ধরনের মেয়েদের ওদের কাছে কেমন যেন অবজ্ঞাই পেয়ে থাকে, পরিবারের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে ওঠে না। ওরা যেন দুর্লঙ্ঘ্য কি-একটা রেখা টানে পরিবার আর এদের মধ্যে। আমি ঠিক বুঝি না, কিন্তু ব্যাপারটা এই রকমই।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু ও তো চুমু খেয়েছে ওকে…’

‘শোনো ডল্লি, বোনটি আমার। স্তিভা যখন তোমার প্রেমে পড়েছিল তখন তো আমি ওকে দেখেছি। সে সময়টা আমার বেশ মনে আছে যখন সে আমার কাছে তোমার কথা বলতে গিয়ে কাঁদতো, ওর কাছে কি কাব্য আর সমুন্নতির উপলক্ষ ছিল তুমি। আমি এও জানি যে তোমার সাথে ওর যত দিন কেটেছে ততই ওর চোখে তুমি উঁচু হয়ে উঠেছ। ওকে নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম, প্রতিটা কথায় ও যোগ দিত : ‘ডল্লি আশ্চর্য মেয়ে।’ ওর কাছে তুমি সব সময়ই ছিলে এবং আছ স্বর্গের দেবী। ওর এই আসক্তিটা প্রাণ থেকে নয়…’

‘কিন্তু আসক্তির যদি পুনরাবৃত্তি ঘটে?’

‘আমি যতটা বুঝি হওয়া সম্ভব নয়…’

‘কিন্তু তুমি ক্ষমা করতে পারতে?’

‘জানি না, বিচার করে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়… না, সম্ভব’, খানিকটা ভেবে নিয়ে মনে মনে অবস্থাটা মানদণ্ডে চাপিয়ে আন্না বললেন, ‘না, সম্ভব, সম্ভব, সম্ভব। হ্যাঁ, আমি হলে ক্ষমা করতাম। ঠিক একইরকম থেকে যেতাম না নিশ্চয়, কিন্তু ক্ষমা করতাম, এবং এমনভাবে করতাম যে কিছু হয়নি, একেবারেই কিছু হয়নি।

‘সে তো বটেই’, তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললেন ডল্লি। যেন অনেক বার যা ভেবেছিলেন তাই বলছেন, ‘না হলে তো ওটা ক্ষমাই নয়। যদি ক্ষমা করতে হয়, তাহলে পুরোপুরি, পুরোপুরি। নাও, চল তোমাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাই’, উঠে দাঁড়িয়ে ডল্লি বললেন এবং যেতে যেতে আন্নাকে আলিঙ্গন করে বললেন, ‘ভারি খুশি হয়েছি, তুমি এসেছ বলে। মনটা হালকা হল, খুবই হালকা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *