আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৭.২০

বিশ

অব্‌লোন্‌স্কি পিটার্সবুর্গে বরাবরের মত খামোকা সময় কাটাননি। বোনের বিবাহবিচ্ছেদ আর নিজের চাকরির ব্যবস্থা করা ছাড়াও পিটার্সবুর্গে বরাবরের মত, যা তিনি বলতেন, মস্কোর ভ্যাপসা হাওয়ার পর তাঁর তাজ হয়ে নেওয়া দরকার ছিল।

মস্কো তার বিলাসী কাফে আর ওমনিবাসগুলো সত্ত্বেও ছিল এক বদ্ধ জলা। এটা সব সময়ই অনুভব করতেন অব্‌লোন্‌স্কি। মস্কোয় বাস করে, বিশেষত তাঁর পরিবারের সান্নিধ্যে থেকে তিনি অনুভব করতেন যে তাঁর মন দমে যাচ্ছে। কোথাও না গিয়ে মস্কোয় দীর্ঘদিন কাটালে স্ত্রীর চড়া মেজাজ আর তিরস্কার, ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য আর শিক্ষা, নিজের কর্মস্থলের ছোটখাট স্বার্থ নিয়ে তিনি অস্থিরই হয়ে উঠতেন; এমন কি ওঁর যে ঋণ আছে, সেটা পর্যন্ত অস্থির করে তুলত তাঁকে। কিন্তু পিটার্সবুর্গে যে মহলটায় তিনি ঘুরতেন, লোকে যেখানে জীবন যাপনই করে, মস্কোর মত উদ্ভিদ হয়ে বেঁচে থাকে না, সেখানে আসা মাত্র আগুনের স্পর্শে মোমের মত তাঁর সমস্ত দুশ্চিন্তা মিলিয়ে যেত, উধাও হত।

স্ত্রী?… আজকেই তিনি প্রিন্স চেচেনস্কির সাথে কথা কয়েছেন। প্রিন্স চেচেস্কির স্ত্রী আর সংসার আছে, পেজ কোরে আছে, পেজ কোরে আছে বয়স্ক ছেলেরা, তাছাড়া আরো একটা অবৈধ সংসারে তাঁর আছে ছেলেমেয়ে; প্রথম সংসারটি ভালো হলেও প্রিন্স চেচেন্‌স্কি নিজেকে বেশি সুখী বোধ করতেন দ্বিতীয় সংসারে। বড় ছেলেকে তিনি দ্বিতীয় সংসারে নিয়ে গেছেন। অলোনস্কিকে তিনি বললেন যে, ছেলের এতে মঙ্গল হবে, সে জীবনের অভিজ্ঞতা পাবে বলে তিনি মনে করেন। মস্কোর লোকেরা কি বলত এতে?

ছেলেমেয়ে? পিটার্সবুর্গে পিতার জীবনযাপনে ছেলেমেয়েরা বাধা হয় না। বিদ্যালাভের জন্য ছেলেমেয়েদের দেওয়া হয় শিক্ষায়তনে আর মস্কোতে, দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রিন্স ভ—বিদঘুটে এই যে ধারণাটা চালু আছে যে জীবনের সমস্ত বিলাস দিতে হবে ছেলেমেয়েদের, মা-বাপের জন্য খাটুনি আর দুশ্চিন্তা, এ ধারণাটা নেই এখানে। লোকে এখানে বোঝে যে সুশিক্ষিত মানুষের যা উচিত সেভাবে জীবন কাটাতে হবে নিজের জন্য।

চাকরি? চাকরিও এখানে সেই ভারবাহী নৈরাশ্যজনক জোয়াল নয় যা সবাই টেনে যায় মস্কোয়; চাকরিতে আকর্ষণ আছে এখানে। দেখা-সাক্ষাৎ, আনুকুল্য, অব্যর্থ রসিকতা, মুখে নানারকমের ভাব ফুটিয়ে তোলার নৈপুণ্য—বাস, লোকে হঠাৎ তাদের ভাগ্য ফিরিয়ে নেয়, যেমন ফিরিয়ে নিলেন ব্রিয়ান্ৎসেভ। তাঁর সাথে অব্‌লোন্‌স্কির দেখা হয়েছিল গতকাল, এখন উনি একজন বড় কর্তা। এ চাকরিতে আকর্ষণ আছে।

বিশেষ করে আর্থিক ব্যাপারে পিটার্সবুর্গী দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব প্রসন্ন করে দিত অব্‌লোন্‌স্কিকে। এ ব্যাপারে চমৎকার একটা কথা বলেছিলেন বার্ৎনিয়াস্কি, তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল কাল—ওঁর যা হালচাল, তাতে বছরে অন্তত পঞ্চাশ হাজার উনি খরচ করেন নিশ্চয়।

ডিনারের আগে কথোপকথনের মধ্যে অব্‌লোন্‌স্কি তাঁকে বলেছিলেন, ‘মনে হয় তোমার যেন মভিস্কির সাথে ঘনিষ্ঠতা আছে। আমার হয়ে দুটো কথা বলবে তাকে। একটা চাকরি খালি আছে, সেটা আমি পেতে চাইছিলাম। এজেন্সির চেয়ারম্যান…’

‘কি জানি, আমার মনে পড়ছে না। রেলওয়ের ওই ইহুদিদের নিয়ে কি দায় ঠেকল তোমার?… যাই বলো, জঘন্য লোক সব!’

অব্‌লোন্‌স্কি বলেননি যে কাজটা কাজের মত; বানিয়ান্‌স্কি সেটা বুঝতেন না।

‘টাকা দরকার, দিন চলছে না।’

‘দিন তো চালাচ্ছ?’

‘দেনার ওপর বেঁচে আছি।’

‘কি বলছ? অনেক?’ সহানুভূতি দেখিয়ে বললেন বানিয়াস্কি।

‘অনেক, হাজার বিশেক।

হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন বানিয়াস্কি। বলেছিলেন, ‘ভাগ্যবান লোক হে! আমার দেনা পনের লাখ আর হাতে কিছু নেই। তাহলেও দেখছ তো দিন কেটে যাচ্ছে!’

আর অব্‌লোন্‌স্কি শুধু মুখের কথায় নয়, কার্যক্ষেত্রে ব্যাপারটার সত্যতা দেখতে পাচ্ছিলেন। জিভাখভের দেনা তিন লাখ, ঘরে কানাকড়িটিও নেই, তবু দিন তো কাটাচ্ছেন আর কাটাচ্ছেন কি চালে! অনেকদিন আগেই কাউন্ট ক্রিসভের বারোটা বেজে গেছে বলে ধরা হয়েছিল, অথচ দুজন রক্ষিতা রেখেছেন উনি। পেত্রস্কি পঞ্চাশ লাখ উড়িয়ে দেন, কিন্তু চলেছেন হুবহু একই হালে, তার ওপর ফিনান্সের কর্তৃপদে বেতন পাচ্ছেন বিশ হাজার। এ ছাড়াও পিটার্সবুর্গের দৈহিক প্রভাব পড়ত অব্‌লোন্‌স্কির ওপর। বয়স যেন কমে যেত তাঁর। মস্কোতে তিনি মাঝে মাঝে তাঁর পাকা চুল দেখতেন, হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন ডিনারের পরই, আড়মোড়া ভাঙতেন, এক-পা এক-পা করে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠতেন সিঁড়ি দিয়ে, তরুণীদের সান্নিধ্যে বেজার লাগত তাঁর, বলনাচে যোগ দিতেন না। পিটার্সবুর্গে কিন্তু দশ বছর বয়স কমে গেছে বলে তাঁর বোধ হত।

ষাট বছরের বৃদ্ধ প্রিন্স পিওত্‌র অব্‌লোন্‌স্কি তাঁকে কাল যা বলেছিলেন, পিটার্সবুর্গে তেমনিই মনে হত তাঁর। সবে তিনি বিদেশ থেকে ফিরেছিলেন।

পিওত্‌র অব্‌লোন্‌স্কি বলেছিলেন, ‘এখানে আমরা বেঁচে থাকতে শিখিনি। বিশ্বাস করবে কি, গ্রীষ্মটা আমি কাটাই বাড়েনে; আর সত্যি বলছি, নিজেকে জোয়ান বলে মনে হত। যুবতী দেখলে আনচান হত মন… খানা পিনা হত অনায়াসে—শক্তি, প্রফুল্লতা। রাশিয়ায় এলাম, স্ত্রীর কাছে যেতে হল, তাও আবার গ্রামে। বিশ্বাস করবে না— দু’সপ্তাহের মধ্যেই ড্রেসিং-গাউন পরেই খেতাম, ডিনারের আগে বেশভূষাটাও করতাম না। যুবতীদের কথা ভাববার সুযোগ কই! একেবারে বুড়িয়ে গেলাম। বাকি ছিল শুধু আত্মাটা বাঁচানো। চলে গেলাম প্যারিস—আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলাম।’

পিওত্‌র অব্‌লোন্‌স্কির মত অব্‌লোন্‌স্কিও বোধ করতেন একই পার্থক্য। মস্কোয় তিনি এমন নেতিয়ে পড়তেন যে বেশি দিন সেখানে থাকতে হলে ব্যাপারটা গড়াত সত্যিই আত্মা বাঁচানোর পর্যায়ে; পিটার্সবুর্গে কিন্তু তিনি আবার দিব্যি মানুষ হয়ে উঠতেন প্রিন্সেস বেত্‌সি ভেরস্কায়া আর অব্‌লোন্‌স্কির মধ্যে অনেকদিন থেকে গড়ে উঠেছিল বিচিত্র একটা সম্পর্ক। অব্‌লোন্‌স্কি বরাবর রহস্য করে তাঁর সাথে ছিনালি করতেন এবং রহস্য করেই অতি অশ্লীল এমন সব কথা বলতেন যা শুনতে বেত্‌সির সবচেয়ে বেশি ভালো লাগবে বলে তিনি জানতেন। কারেনিনের সাথে কথাবার্তাটার পর দিন ওঁর কাছে গিয়ে নিজেকে তাঁর এতই যুবক বলে বোধ হচ্ছিল যে এই ছিনালি আর মুখ খারাপিতে অজ্ঞাতসারে এতই দূরে গিয়ে পৌঁছালেন যে ফেরার পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি, অথচ দুঃখের বিষয় প্রিন্সেসকে তাঁর ভালো লাগত না শুধু নয়, বিছ্‌ছিরিই লাগত। এই সুরটা বাঁধা হয়ে গিয়েছিল কারণ বেত্‌সি সাতিশয় পছন্দ করতেন তাঁকে। তাই প্রিন্সেস মিয়াকায়া আসায় তাঁদের দ্বৈত নিভৃতি ছিঁড়ে যাওয়ায় তিনি খুশি হয়েছিলেন খুবই।

অব্‌লোন্‌স্কিকে দেখে তিনি বললেন, ‘আ, আপনি এখানে। আপনার বেচারি বোনে খবর কি? ওভাবে চাইবেন না আমার দিকে’, তারপর যোগ দিলেন। ‘যে লোকেরা ওঁর চেয়ে লক্ষ গুণ খারাপ তারা যখন ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর ওপর তখন থেকে আমি মনে করে এসেছি যে খুব ভালো কাজই তিনি করেছেন। উনি যে পিটার্সবুর্গে এসেছিলেন, সে খবর আমাকে না দেওয়ায় ভ্রনস্কিকে আমি ক্ষমা করতে পারব না। তাহলে আমি তাঁর কাছে গিয়ে সর্বত্র যেতাম ওঁকে সাথে নিয়ে। ওঁকে আমার ভালোবাসা জানাবেন, কেমন? কেমন? ওঁর কথা আমাকে বলুন।’

‘আপনার বোনের কথা আমাকে বলুন’, হৃদয়ের সরলতাবশে প্রিন্সেস মিয়াকায়ার এই কথাটাকে অকপট জ্ঞানে অব্‌লোন্‌স্কি বলতে শুরু করেছিলেন, ‘হ্যাঁ, অবস্থা ওর সহ্যাতীত…’ কিন্তু প্রিন্সেস মিয়াঙ্কায়ার যা অভ্যাস, তৎক্ষণাৎ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলতে শুরু করলেন।

‘আমি ছাড়া সবাই যা করে থাকে কিন্তু লুকিয়ে রাখে তাই উনি করেছেন; প্রতারণা করতে উনি চাননি এবং চমৎকার কাজ করেছেন। কাজটা আরো এখন তিনি যখন নিজেকে জড়ালেন লিদিয়া ইভানোভনা আর লাঁদোর সাথে, তখন সবাই বলছে উনি ক্ষীণবুদ্ধি, সব কথায় আপত্তি করে আমি আনন্দই পাই, কিন্তু এক্ষেত্রে অপারক।’

‘আচ্ছা, বলুন তো আমাকে, কি এর মানে?’ বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, ‘গতকাল আমি ওঁর কাছে গিয়েছিলাম আমার বোনের ব্যাপার নিয়ে এবং চূড়ান্ত জবাব চেয়েছিলাম। উনি জবাব দিলেন না, বললেন ভেবে দেখবেন, আর আজ সকালে জবাবের বদলে পেলাম সন্ধ্যায় লিদিয়া ইভানোভনার ওখানে যাবার নিমন্ত্রণপত্র।’

‘বটে, বটে’! সহর্ষে বললেন প্রিন্সেস মিয়াকায়া, ‘ওরা লাঁদোর পরামর্শ নেবে।

‘লাঁদোর কাছে কেন? কি জন্যে? এই লাঁদোই বা কে?’

‘সে কি, বিখ্যাত জুল লাঁদো, দিব্যদৃষ্টি জুল লাঁদোকে আপনি চেনেন না? এটিও একটি ক্ষীণবুদ্ধি প্রাণী, কিন্তু আপনার বোনের ভাগ্য নির্ভর করছে ওর ওপর। এই দেখুন, মফস্বলে দিন কাটালে কি হয়, কোনই খবর রাখেন না আপনি। মানে, প্যারিসের এক দোকান-কর্মচারী এই লাঁদো একদিন ডাক্তারের কাছে আসে আর অভ্যর্থনা-কক্ষে ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর ঘুমের মধ্যেই অন্য রোগীদের উপদেশ দিতে থাকে। আর আশ্চর্য সব পরামর্শ। ইউরি মেলেদি স্কি জানেন তো, তিনি অসুস্থ—তাঁর বউ লাঁদোর কথা শুনে তাকে নিয়ে আসেন স্বামীর কাছে। স্বামীর চিকিৎসা করল লাঁদো। আমার মতে কিন্তু কোন উপকার হয়নি, কেননা একই রকম দুর্বল থেকে গেছেন তিনি। তবে ওর ওপর এঁদের বিশ্বাস আছে, নিজেদের সাথে করে এখানে ওখানে নিয়ে যান। রাশিয়াতেও নিয়ে এলেন। এখানে সবাই ছেঁকে ধরল তাকে, সেও সবার চিকিৎসা শুরু করল। কাউন্টেস বেজজুবোভকে সে সারিয়ে তোলে। উনি এত তার অনুরাগিণী হয়ে ওঠেন যে তাকে পোষ্যপুত্র করে নেন।’

‘পোষ্যপুত্র আর কি, ও আর এখন লাঁদো নয়, কাউন্ট বেজজুবোভ। তবে ওটা কোন কথা নয়, কিন্তু লিদিয়া— ওকে আমি খুবই ভালোবাসি, কিন্তু মাথার ঠিক নেই ওর—বলাই বাহুল্য, লিদিয়া এখন লাঁদোর পেছনে ধরনা দিচ্ছে, ওকে ছাড়া লিদিয়া বা কারেনিন কেউ কোন সিদ্ধান্ত নেয় না, তাই এখন এই লাঁদোর বা কাউন্ট বেজজুরোভের হাতে আপনার বোনের ভাগ্য।’

একুশ

বার্নিয়াস্কির ওখানে চমৎকার একটা ডিনার সেরে, প্রচুর পরিমাণ কনিয়াক টেনে অব্‌লোন্‌স্কি কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার বাড়ি পৌঁছলেন নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পরে।

‘কাউন্টেসের ওখানে আরো কে আছেন? ফরাসি?’ কারেনিনের পরিচিত ওভারকোট আর ফিতেটিতে বাঁধা অদ্ভুত একটা বাতুল গোছের কোটের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি।

হল-পোর্টার কাটখোট্টা জবাব দিলেন, ‘কারেনিন কারেনিন আর কাউন্ট বেজজুবোভ।’

‘প্রিন্সেস মিয়াকায়া ঠিকই ধরেছিলেন তো’, সিঁড়িতে উঠতে উঠতে ভাবলেন অব্‌লোন্‌স্কি; ‘আশ্চর্য! তবে ওঁর নেকনজরে থাকা ভালো। অগাধ ওঁর প্রভাব। উনি যদি পমোঙ্কিকে দুটো কথা বলেন, তাহলেই সব পাকা।’

আঙিনায় তখনো বেশ আলো ছিল, কিন্তু বাতি জ্বলছিল কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার পর্দা নামানো ছোট ড্রয়িং- রুমটায়।

বাতির নিচে গোল টেবিলটার কাছে বসে কাউন্টেস আর কারেনিন কি নিয়ে যেন আলাপ করছিলেন মৃদুস্বরে। ড্রয়িং-রুমের অন্য প্রান্তে বেঁটে রোগা একটি লোক দেয়ালের পোর্ট্রেটগুলো দেখছিলেন দাঁড়িয়ে। পাছা তাঁর মেয়েদের মত, পা হাঁটুর কাছে ঢুকে যাওয়া, দেখতে সুপুরুষ, খুবই বিবর্ণ, সুন্দর জ্বলজ্বলে চোখ, লম্বা চুল ঝুলে পড়েছে ফ্রক- কোটের কলারের ওপর। গৃহকর্ত্রী আর কারেনিনের সাথে সম্ভাষণ বিনিময় করার পর অব্‌লোন্‌স্কির দৃষ্টি আপনা থেকেই আবার পড়ল অপরিচিত লোকটির ওপর।

‘মঁসিয়ে লাঁদো!’ যে কোমলতা আর সন্তর্পণতা নিয়ে কাউন্টেস তাঁকে ডাকলেন তাতে চমক লাগল অব্‌লোন্‌স্কির। দুজনের পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি।

লাঁদো তাড়াতাড়ি চেয়ে দেখে কাছে এলেন, হেসে অব্‌লোন্‌স্কির বাড়িয়ে দেওয়া হাতে নিজের ঘর্মাক্ত, অনড় হাত রেখেই তৎক্ষণাৎ ফিরে গেলেন পোর্ট্রেট দেখতে। কাউন্টেস আর কারেনিন অর্থময় দৃষ্টিতে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।

‘বিশেষ করে আজ আপনার দেখা পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত’, চেয়ে মৃদু স্বরে তিনি বললেন, ‘আমি ওঁকে লাঁদো বলে আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম, কিন্তু আসলে উনি কাউন্ট বেজজুবোভ, যা আপনি জানেন নিশ্চয়। শুধু এই খেতাব উনি ভালোবাসেন না।

অব্‌লোন্‌স্কি বললেন, ‘হ্যাঁ, শুনেছি কাউন্টেস বেজজুবোভাকে উনি একেবারে সারিয়ে দিয়েছেন।’

‘আজ আমার এখানে এসেছিলেন তিনি, এমন করুণ লাগছিল!’ কারেনিনের দিকে তাকিয়ে বললেন কাউন্টেস, ‘এটা ওঁর পক্ষে সাংঘাতিক। প্রচণ্ড একটা আঘাত!’

‘নিশ্চিতই উনি যাচ্ছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন কারেনিন।

‘হ্যাঁ, যাচ্ছেন প্যারিসে। কাল উনি কণ্ঠস্বর শুনেছেন’, অব্‌লোন্‌স্কির দিকে চেয়ে বললেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা।

‘আহ্ কণ্ঠস্বর!’ কথাটার পুনরাবৃত্তি করলেন অব্‌লোন্‌স্কি, অনুভব করলেন যে এই মহলটায় অসাধারণ কিছু-একটা ঘটছে, অথবা ঘটার কথা, তার চাবি নেই তাঁর হাতে, এখানে যথাসম্ভব সতর্ক থাকতে হবে তাঁকে।

নামল এক মিনিটের নীরবতা, তারপর কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা যেন কথাবার্তার প্রধান প্রসঙ্গে যাবার জন্য মিহি হেসে অব্‌লোন্‌স্কিকে বললেন : ‘আমি আপনাকে অনেকদিন থেকে চিনি, আরো ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়ে ভারি আনন্দ হল। আমাদের বন্ধুর বন্ধুরা আমাদের বন্ধু। তবে বন্ধু হতে হলে অপরের মন কি অবস্থায় আছে সেটা বিবেচনা দরকার। কিন্তু আমার আশংকা আছে যে কারেনিনের বেলায় আপনি সেটা করছেন না। আপনি বুঝতে পারছেন কি বলতে চাইছি’, তাঁর অপূর্ব ভাবালু চোখ তুলে তিনি বললেন।

‘অংশত, কাউন্টেস, আমি বুঝি যে কারেনিনের অবস্থাটা…’ ব্যাপারটা কি ভালো না বুঝে, সুতরাং ভাসা ভাসা উক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকতে চেয়ে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি।

‘পরিবর্তনটা বাইরের অবস্থায় নয়’, কারেনিন উঠে চলে যাচ্ছিলেন লাঁদোর কাছে, সপ্রেম দৃষ্টিতে তাঁকে অনুসরণ করে কড়া করে বললেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা, ‘অন্তর ওঁর বদলে গেছে, নতুন অন্তর পেয়েছেন তিনি, আর আমার আশংকা ওঁর মধ্যে এই যে পরিবর্তনটা ঘটেছে, তা নিয়ে আপনি পুরো ভাবেননি।’

‘মানে, আমি সাধারণভাবে এই বদলটা কল্পনা করতে পারি। আমরা বরাবরই বন্ধু ছিলাম আর এখন…’ কোমল দৃষ্টিতে কাউন্টেসের দৃষ্টির প্রত্যুত্তর দিয়ে অব্‌লোন্‌স্কি ভাবতে লাগলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই মন্ত্রীর মধ্যে কার কাছে ওঁর হয়ে দুটো কথা বলতে অনুরোধ করবেন সেটা জানা যায় কিভাবে।

‘ওঁর মধ্যে যে পরিবর্তনটা ঘটেছে, তাতে নিকটতমদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ক্ষীণ হতে পারে না; বরং এ পরিবর্তনটায় সে ভালোবাসা বেড়ে ওঠা উচিত। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে আপনি বুঝতে পারছেন না আমাকে। চা খাবেন না?’ ট্রেতে করে চা নিয়ে আসছিল যে চাপরাশিটি তাকে দেখিয়ে তিনি বললেন।

‘পুরোটা নয়, কাউন্টেস। বলাই বাহুল্য ওঁর দুর্ভাগ্য…

‘হ্যাঁ, ওঁর দুঃখ যা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিমাত্রায় এক সুখ, যখন হৃদয় হয়ে উঠেছে নতুন, ভরে উঠেছে সেই সুখে’, প্রেমাতুর দৃষ্টিতে অব্‌লোন্‌স্কির দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।

‘মনে হচ্ছে দুজনের কাছেই সুপারিশ করতে অনুরোধ করা সম্ভব’, ভাবলেন অব্‌লোন্‌স্কি।

বললেন, ‘নিশ্চয় কাউন্টেস, তবে এই পরিবর্তনগুলো এতই গহন ব্যক্তিগত যে অতি ঘনিষ্ঠেরাও তা নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে না।’

‘বরং উলটো! আমাদের তা নিয়ে কথা বলে সাহায্য করতে হবে পরস্পরকে।’

‘হ্যাঁ, তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু প্রত্যয়ের খুবই পার্থক্য থাকে তো, তাছাড়া…’ কোমল হাসি হেসে বললেন অবলোনস্কি।

‘পবিত্র সত্যের ক্ষেত্রে পার্থক্য হতে পারে না।’

‘হ্যাঁ, সে তো বটেই, কিন্তু…’ বিব্রত হয়ে অব্‌লোন্‌স্কি চুপ করে গেলেন। বুঝলেন যে ব্যাপারটা ধর্ম নিয়ে। ‘আমার মনে হয় এখুনি উনি ঘুমিয়ে পড়বেন’, লিদিয়া ইভানোভনার কাছে এসে অর্থপূর্ণ অর্ধস্বরে বললেন কারেনিন।

অব্‌লোন্‌স্কি তাকিয়ে দেখলেন। জানালার কাছে বসে লাঁদো ইজি-চেয়ারের হাতলে দু’হাত রেখে পিঠ হেলান দিয়ে মাথা ঝুলিয়ে বসে আছেন। ওঁর দিকে দৃষ্টিপাত করা হচ্ছে লক্ষ করে, মাথা তুলে শিশুর মত সরল হাসি হাসলেন তিনি।

‘ওঁর দিকে নজর দেবেন না’, লঘু ভঙ্গিতে কারেনিনের দিকে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললেন লিদিয়া ইভানোভনা : ‘আমি লক্ষ করেছি…’ কি-একটা বলতে যাচ্ছিলেন তিনি, এমন সময় চাপরাশি ঘরে ঢুকল চিঠি নিয়ে। লিদিয়া ইভানোভনা দ্রুত চিঠিটা পড়ে মাপ চেয়ে নিয়ে অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় জবাব লিখে দিয়ে ফিরে এলেন টেবিলের কাছে। ‘আমি লক্ষ করেছি’, যে কথাটা শুরু করেছিলেন তা বলে চললেন, ‘মস্কোর লোকেরা, বিশেষত পুরুষেরা ধর্মের ব্যাপারে একান্ত উদাসীন।’

‘না-না, কাউন্টেস, আমার মনে হয়, অতি নিষ্ঠাবান বলে মস্কোর লোকদের নাম-ডাকই তো আছে’, জবাব দিলেন অব্‌লোন্‌স্কি

‘তবে আমি যতটা বুঝেছি আপনি দুঃখের বিষয় উদাসীনদের দলে’, ক্লান্ত হাসিতে তাঁকে বললেন কারেনিন।

‘উদাসীন হয়ে আবার থাকা যায় নাকি!’ লিদিয়া ইভানোভনা বললেন।

‘এ ব্যাপারে আমি ঠিক উদাসীন নই, তবে প্রতীক্ষমাণ’, সবচেয়ে মোলায়েম হাসি হেসে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, ‘আমার মনে হয় না যে এসব প্রশ্ন নিয়ে ব্যস্ত হবার সময় এসেছে আমার।’

কারেনিন আর লিদিয়া ইভানোভনা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।

‘সময় হয়েছে কিনা সেটা জানা আমাদের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়’, কড়া করে বললেন কারেনিন, ‘তৈরি কি তৈরি নই, সে চিন্তা করা আমাদের উচিত নয়। ঐশীশক্তি মানুষের বিচার-বুদ্ধি মেনে চলে না: যারা খুব সচেষ্ট, মাঝে মাঝে তা কৃপা করে না তাদের, আবার মাঝে মাঝে তা আবির্ভাব হয় সেই লোকের অন্তরে যে মোটেই তৈরি ছিল না।’

‘না, মনে হচ্ছে এখনো হয়নি’, বললেন লিদিয়া ইভানোভনা, এই সময়টা তিনি লক্ষ করছিলেন ফরাসিটির ভাবভঙ্গি।

লাঁদো উঠে এলেন তাঁদের কাছে।

‘আপনাদের কথা আমার শোনায় আপত্তি করছেন না তো?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘শুনুন বৈকি, আমি আপনার ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনি’, সস্নেহে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন লিদিয়া ইভানোভনা, ‘বসুন আমাদের সাথে।’

‘শুধু জ্যোতি থেকে যাতে বঞ্চিত না হই তার জন্যে চোখ খুলে রাখা দরকার’, তাঁর আগের কথার খেই ধরে বললেন কারেনিন।

‘আমাদের প্রাণের মধ্যে তিনি যে আছেন সেটা অনুভব করে কি যে সুখ পাই তা যদি জানতেন!’ অতীন্দ্রিয় হাসি হেসে বললেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা।

‘কিন্তু লোকের তো মনে হতে পারে যে অত উঁচুতে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়’, বললেন অব্‌লোন্‌স্কি। ধর্মীয় উচ্চতা মেনে নিয়ে তিনি যে হৃদয়ের সাথে কপটতা করছেন সেটা টের পেলেও পমোর্স্কিকে যিনি একটি কথা বললেই বাঞ্জিত পদটা তিনি পেতে পারেন, তাঁর কাছে নিজের মুক্ত চিন্তা কবুল করার সাহস পেলেন না তিনি।

‘তার মানে, বলতে চান যে নিজের পাপ সে লোককে বাধা দিচ্ছে?’ বললেন লিদিয়া ইভানোভনা, ‘কিন্তু সেটা একটা মিথ্যে ধারণা। বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে পাপ নেই, পাপ ক্ষমা পেয়ে গেছে, মাপ করবেন’, আরেকটা চিঠি নিয়ে চাপরাশিকে ঢুকতে দেখে তিনি বললেন। সেটা পড়ে লিখিত নয়, মৌখিক জবাব দিলেন: ‘বলে দাও কাল গ্র্যান্ড প্রিন্সেসের ওখানে। বিশ্বাসীদের পাপ থাকে না’, আগের কথার জের টেনে বললেন তিনি।

‘কিন্তু নিষ্ক্রিয় বিশ্বাস নিষ্প্রাণ’, প্রশ্নোত্তর বচনামৃত থেকে এই কথাটা স্মরণ করে, এখন শুধু হাসি দিয়ে নিজের স্বাধীনতা বাঁচিয়ে বললেন অবলোন্‌স্কি।

‘এঃই, আবার সেই সেন্ট জেমসের বাণী থেকে উদ্ধৃতি’, কিছুটা ভর্ৎসনার সুরে বললেন কারেনিন এবং চাইলেন লিদিয়া ইভানোভনার দিকে; বোঝা গেল যেন ব্যাপারটা নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেছেন একাধিকবার। ‘কত ক্ষতিই যে করেছে এই জায়গাটার ‘ভুল ব্যাখ্যা! এই ব্যাখ্যাটার মত বিশ্বাস থেকে লোককে আর কিছু সরিয়ে দেয় না। ‘আমি কাজ করছি না, অতএব আমি বিশ্বাসহীন’ কোথাও এ কথা বল হয়নি। বলা হয়েছে বিপরীতটাই।’

‘সৃষ্টিকর্তার জন্যে খাটা, খেটে উপবাস দিয়ে আত্মার মোক্ষলাভ’, বিষাক্ত ঘৃণায় বললেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা, ‘আমাদের সাধুসন্তদের এ এক বিটকেলে চিন্তা… তদুপরি এটা যখন কোথাও বলা নেই। ব্যাপারটা অনেক সহজ-সরল’, উৎসাহ দানের যে হাসিতে তিনি দরবারের নতুন আবহাওয়ায় অপ্রতিভ তরুণী রাজ্ঞী-সহচরীদের উৎসাহ দিয়েছিলেন সেই হাসি নিয়ে তিনি অব্‌লোন্‌স্কির দিকে চাইলেন।

‘আমাদের ত্রাণ করে খ্রিস্ট, আমাদের জন্য তিনি যন্ত্রণা ভুগেছেন। আমাদের ত্রাণ করে বিশ্বাস’, দৃষ্টিপাতে উৎসাহ দিয়ে কাউন্টেসের কথাকে সমর্থন করলেন কারেনিন।

‘আপনি ইংরেজি বোঝেন?’ জিজ্ঞেস করলেন লিদিয়া ইভানোভনা এবং সদর্থক উত্তর পেয়ে তাকে বই খুঁজতে লাগলেন।

‘ইংরেজিতে লেখা বই পড়ে শোনাতে চাচ্ছি, ‘নিরাপদ ও সুখী’ নাকি ‘পক্ষতলে?’ কারেনিনের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বললেন। তারপর বইটা বার করে আবার আসনে বসলেন, খুললেন বইটা, ‘খুবই সংক্ষিপ্ত। কি করে বিশ্বাস লাভ করা যায়, সে পথের বর্ণনা আছে, আর তখন যে সুখ পার্থিবের ঊর্ধ্বে তাতে চিত্ত ভরে ওঠে। বিশ্বাসপ্রাণ লোক অসুখী হতে পারে না। কেননা তখন সে আর একা নয়। এই দেখুন।’ পড়ে শোনাবার উপক্রম করতেই আবার চাপরাশি এল। ‘বরোজদিনা? বলে দাও কাল দুটোর সময়। —হ্যাঁ’—বইয়ের পাতায় আঙুল রেখে অপরূপ ভাবালু চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘এই দেখুন, সত্যিকারের বিশ্বাস কাজ করে কিভাবে। সানিনা মারিকে চেনেন তো? ওর দুর্ভাগ্যের কথা শুনেছেন? একমাত্র সন্তানকে সে হারায়। একেবারে হতাশ হয়ে পড়ে সে। কিন্তু কি হল? বিশ্বাস সে পেল। এখন নিজের সন্তানের মৃত্যুর জন্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছে সৃষ্টিকর্তাকে। এমনি সুখই দেয় বিশ্বাস!

‘হ্যাঁ, এটা খুবই…’ অব্‌লোন্‌স্কি খুশি হয়ে বললেন, কারণ এইবার পড়া শুরু হবে এবং তাঁর খানিকটা সুযোগ হবে সম্বিত ফিরে পাবার। ‘না, দেখা যাচ্ছে আজ কোন অনুরোধ না করাই ভালো’, ভাবলেন তিনি, ‘বেকুবি কিছু না করে ভালোয় ভালোয় এখান থেকে কেটে পড়তে পারলেই হল।’

‘আপনার বোধ হয় বেজার লাগবে’, লাঁদোকে বললেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা, ‘আপনি তো ইংরেজি জানেন না, তবে জিনিসটা খুব ছোট।’

‘ও, আমি বুঝতে পারব’, ঐ একই হাসি নিয়ে কথাটা বলে চোখ মুদলেন লাঁদো।

অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন কারেনিন আর লিদিয়া ইভানোভনা এবং শুরু হল পড়া।

বাইশ

তিনি তাঁর কাছে যেসব নতুন এবং অদ্ভূত কথা শুনলেন, অব্‌লোন্‌স্কি তাতে একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। পিটার্সবুর্গী জীবনের বৈচিত্র্য সাধারণত তাঁকে চাঙ্গা করে মস্কোর অচলতা থেকে টেনে তুলত; তবে এ বৈচিত্র্য তিনি বুঝতেন আর ভালোবাসতেন চেনা-পরিচিত ও ঘনিষ্ঠদের মহলে। কিন্তু এই অনাত্মীয় পরিমণ্ডলে তিনি হতভম্ব, স্তম্ভিত হয়ে যান, কিছুই তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার পঠন শুনতে শুনতে আর নিজের ওপর লাঁদোর সুন্দর, সরল নাকি ধূর্ত দৃষ্টি (নিজেই তিনি জানতেন না ঠিক কি) অনুভব করে মাথার মধ্যে কেমন একটা ভার বোধ হতে থাকল অব্‌লোন্‌স্কির।

তাঁর মাথার মধ্যে হরেক রকম চিন্তা তালগোল পাকিয়ে উঠল। ‘মারি সানিনা আহ্লাদিত যে তার শিশুসন্তান মারা গেছে… এখন একটু ধূমপান করলে হত… ত্রাণ পেতে হলে প্রয়োজন শুধু বিশ্বাস, কিন্তু কি করে তা পাওয়া যায়, সাধু- সন্তেরা জানে না, জানেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা… কিন্তু আমার মাথা এত ভার-ভার লাগছে কেন? কনিয়াক থেকে, নাকি এসব অতি উদ্ভট বলে? তাহলেও মনে হয় এতক্ষণ পর্যন্ত আমি অশোভন কিছু করিনি। কিন্তু তবুও তাঁকে অনুরোধ করা আর চলে না চাকরির জন্যে। শুনেছি ওরা লোককে বাধ্য করে প্রার্থনা করতে। আমাকেও আবার বাধ্য না করে। সেটা হবে বড় বেশি নির্বুদ্ধিতা। কি ছাইভস্ম পড়ছে, কিন্তু উচ্চারণ করছে ভালো। লাঁদো—বেজজুবোভ। কিন্তু বেজজুবোভ কেন?’ হঠাৎ অব্‌লোন্‌স্কি অনুভব করলেন যে তাঁর নিচের চোয়াল অবাধ্য হয়ে ঝুলে পড়ছে হাই তোলায়। হাইটা তিনি চাপা দিলেন তাঁর গালপাট্টা ঠিক করে গা-ঝাড়া দিলেন তিনি। কিন্তু এর পরে তিনি টের পেলেন যে ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছেন, নাক ডাকার উপক্রম হচ্ছে। ‘উনি ঘুমাচ্ছেন’, কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার গলা শুনতে পাওয়া মাত্র তিনি জেগে উঠলেন

তিনি দোষী, দোষ ধরা পড়েছে এমন একটা অস্বস্তিতে অব্‌লোন্‌স্কি আতংকে জেগে উঠলেন। কিন্তু উনি ঘুমাচ্ছেন’ কথাটা যে তাঁর সম্পর্কে নয়, লাঁদো সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটা দেখতে পেয়ে তখনই শান্ত হয়ে এলেন তিনি। ফরাসিটিও ঘুমিয়ে পড়েছেন অব্‌লোন্‌স্কির মত। কিন্তু অব্‌লোন্‌স্কি ভেবেছিলেন তাঁর ঘুমে ওঁরা অপমানিত বোধ করবেন (তবে সবই এমন অদ্ভুত ঠেকছিল যে এটা তিনি ভাবেননি), ওদিকে লাঁদোর ঘুম ওঁদের, বিশেষ করে কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনাকে অসাধারণ খুশি করে দিল।

‘বন্ধুবর’, শব্দ না করে তাঁর সিল্ক গাউনের ভাঁজ সন্তর্পণে ঠিক করতে করতে লিদিয়া ইভানোভন কারেনিনকে তাঁর অভ্যস্ত সম্ভাষণ কারেনিন উত্তেজনাবশে ভুলে গিয়ে ফরাসি ভাষায় ‘বন্ধুবর’ বলে ডাকলেন, ‘হাত বাড়িয়ে দিন ওঁর দিকে, দেখছেন না? শ্শ!’ চাপরাশিকে ঢুকতে দেখে তাকে সাবধান করে দিলেন, ‘কারো সাথে দেখা হবে না।’

ইজি-চেয়ারের পিঠে মাথা হেলিয়ে ফরাসিটি ঘুমাচ্ছিলেন অথবা ঘুমের ভান করছিলেন, হাঁটুর ওপরে রাখা ঘর্মাক্ত হাতের ক্ষীণ নড়াচড়ায় মনে হচ্ছিল কি যেন ধরতে চাইছেন। কারেনিন উঠলেন, ভেবেছিলেন উঠবেন সাবধানে, তাহলেও হোঁচট খেলেন টেবিলে। ফরাসিটির কাছে গিয়ে তিনি তাঁর হাতে নিজের হাত রাখলেন। অবলোন্‌স্কিও ঘুমিয়ে থাকলে নিজেকে জাগিয়ে তোলার জন্য উঠলেন, চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগলেন কখনো একজনকে কখনো অন্যজনকে। না, সবই দেখেছেন জাগ্রত অবস্থায়, টের পেলেন মাথার অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে চলেছে।

চোখ না মেলে ফরাসিটি বললেন, ‘যে এসেছে সবার শেষে, যে কিছু চাইবে ভাবছে সে চলে যাক! ‘যে এসেছে সবার শেষে, যে কিছু চাইবে ভাবছে সে চলে যাক! চলে যাক!’

‘মাপ করবেন, কিন্তু দেখছেন তো… আসুন দশটা নাগাদ, আরো ভালো হয় কাল।’

‘চলে যাক!’ অসহিষ্ণু হয়ে পুনরাবৃত্তি করলেন ফরাসিটি

‘এটা আমার সম্পর্কে, তাই না?’

সমর্থনসূচক জবাব পেয়ে লিদিয়া ইভানোভনার কাছে কি চাইবেন ভাবছিলেন ভুলে গিয়ে, বোনের ব্যাপারটাও বিস্তৃত হয়ে, শুধু যথাসত্বর এখান থেকে কেটে পড়ার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অব্‌লোন্‌স্কি পা টিপে টিপে বেরোলেন। তারপর যেন সংক্রামিত একটা বাড়ি থেকে পালাচ্ছেন এমনভাবে ছুটে গেলেন রাস্তায়। নিজেকে তাড়াতাড়ি সুস্থির করে তোলার জন্য অনেকক্ষণ ধরে কোচোয়ানের সাথে রসিকতা করে আলাপ করতে লাগলেন।

ফরাসি থিয়েটারে শেষ অংকে পৌঁছে, তারপর তাতার সরাইয়ে শ্যাম্পেন খেয়ে অব্‌লোন্‌স্কি যেন খানিকটা হাঁফ ছাড়লেন তাঁর নিজের বাতাসে। তাহলেও এ সন্ধ্যাটায় তিনি স্বাভাবিক হতে পারছিলেন না।

পিটার্সবুর্গে তিনি উঠেছিলেন পিওত্‌র অব্‌লোন্‌স্কির ওখানে, সেখানে ফিরে তিনি বেত্‌সির চিঠি পেলেন। তিনি লিখেছেন, যে আলাপটা শুরু হয়েছিল সেটা শেষ করতে তিনি ভারি ইচ্ছুক, অব্‌লোন্‌স্কি যেন কাল আসেন। চিঠিটা পড়ে মুখ কোঁচকাতে-না-কোঁচকাতেই নিচে থেকে কানে এল বোঝা নিয়ে ওঠা লোকদের ভারী পায়ের আওয়াজ।

অব্‌লোন্‌স্কি দেখতে বেরোলেন। বোঝাটা—জোয়ান হয়ে ওঠা পিওত্‌র অব্‌লোন্‌স্কির। এতই তিনি মাতাল যে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারছিলেন না; কিন্তু অব্‌লোন্‌স্কিকে দেখে তিনি লোকদের হুকুম করলেন তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিতে এবং তাঁকে ধরে গেলেন তাঁর ঘরে। ঘরে গিয়ে সন্ধেটা কেমন কাটালেন, সে গল্প শুরু করেই ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।

মনমরা ছিলেন অব্‌লোন্‌স্কি, যা তিনি হন কদাচিৎ, ঘুমতে পারলেন না অনেকক্ষণ। যা কিছুই তাঁর মনে পড়ছিল, সবই জঘন্য লাগছিল, কিন্তু সবার চেয়ে জঘন্য কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার ওখানে সন্ধেটা কাটানোর স্মৃতি, সেটা একটা লজ্জাকর ব্যাপার যেন।

তিনি কারেনিনের কাছ থেকে পরের দিন পেলেন আন্নার বিবাহবিচ্ছেদে চূড়ান্ত নৃত্যাখ্যান এবং বুঝলেন, কাল তাঁর সত্যিকার অথবা ভান করা ঘুমে ফরাসিটা যা বলেছেন, তারই ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

তেইশ

সাংসারিক জীবনে কোন-একটা ব্যবস্থা নিতে হলে প্রয়োজন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পূর্ণ অমিল, নয় প্রেমময় মিল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কটা যখন এর কোনটাই নয়, রয়েছে তা একটা অনির্দিষ্ট অবস্থায়, কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা যায় না তখন।

কোন কোন পরিবার যে দুজনের কাছেই অসহ্য একটা জায়গায় দিন কাটিয়ে যায় বছরের পর বছর, তার একমাত্র কারণ তাদের মধ্যে পুরো মিল বা অমিল নেই।

সূর্য যখন আর বসন্ত নয়, গ্রীষ্মকালের মত কিরণ দিচ্ছে, বুলভারের সব গাছ অনেকদিন আগেই যখন পাতায় ঢাকা আর পাতাগুলো ধূলিধূসর, তখন এই উত্তাপ আর ধুলোয় ভ্রন্‌স্কি আর আন্নার কাছে মস্কো জীবন হয়ে উঠেছিল অসহ্য; কিন্তু তাঁরা ভজ্‌দৃভিজেনস্কয়ে গেলেন না, যা অনেক আগেই স্থির হয়ে ছিল, বিরক্তিকর মস্কোতেই থাকতে লাগলেন, কারণ তাঁদের মধ্যে ইদানীং মিল ছিল না।

তাঁদের যে জ্বালাটা পার্থক্য করে দিচ্ছিল, বাইরের কোন কারণ ছিল না তার, বোঝাবুঝির সমস্ত চেষ্টায় তা দূর না হয়ে বেড়েই উঠছিল। এটা ছিল আভ্যন্তরীণ জ্বালা, আন্নার পক্ষে তার কারণ ভ্রন্‌স্কির প্রেমে ভাটা, ভ্রন্‌স্কির পক্ষে- উনি যে নিজেকে একটা দুঃসহ অবস্থায় ফেলেছেন, আন্না যে সেটাকে সহনীয় না করে বরং আরো দুঃসহ করে তুলছেন তার জন্য অনুশোচনা। দুজনের কেউ তাঁদের জ্বালার কারণ বলেননি, কিন্তু দুজনেই মনে করতেন যে অন্যায় করছে অপরে এবং ছুঁতো পেলেই পরস্পরের কাছে তা প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন।

আন্না মনে করতেন, ভ্রন্‌স্কি তাঁর আচার-অভ্যাস, চিন্তা-ভাবনা, তাঁর চিত্ত ও দেহের গঠন, সব নিয়ে উদ্দিষ্ট কেবল একটা জিনিসের জন্য—নারীর প্রতি প্রেম, আর এই যে প্রেম কেবল তাঁর প্রতিই উদ্দিষ্ট হওয়া উচিত বলে তিনি বোধ করতেন, সেটা হ্রাস পাচ্ছিল; সুতরাং, তাঁর যুক্তি অনুসারে এই প্রেমের একাংশ তিনি নিশ্চয় সরিয়ে দিচ্ছেন এক বা একাধিক অন্য নারীতে—এবং ঈর্ষা হত তাঁর। ঈর্ষা হত কোন-একজন নারী উপলক্ষে নয়, ভ্রন্‌স্কির প্রেম কমে যাচ্ছে বলে। ঈর্ষার উপলক্ষ না থাকায় সেটা তিনি খুঁজতেন। সামান্য একটু আঁচ পেলেই তাঁর ঈর্ষা সরে যেত একজন থেকে অন্যজনে। কখনো তাঁর ঈর্ষা হত সেই সব বিশ্রী নারীদের জন্য, নিজের অবিবাহিত অবস্থার দরুন ভ্রন্‌স্কি অমন সহজে যাদের সাথে মিলন সম্পর্কে যেতে পারতেন; কখনো ঈর্ষা করতেন উচ্চ সমাজের নারীদের, যাদের সাথে মিশতে পারতেন তিনি; কখনো ঈর্ষা হত কল্পিত এক বালিকাকে নিয়ে, তাঁর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে ভ্রন্‌স্কি যাকে বিয়ে করতে চান। এই শেষ ঈর্ষাটা বেশি যন্ত্রণা দিত তাঁকে, বিশেষ করে এজন্য যে মনখোলা একটা মুহূর্তে ভ্রন্‌স্কি নিজেই অসাবধানে বলে ফেলেছিলেন যে মা তাঁকে এতই কম বোঝেন যে প্রিন্সেস সরোকিনাকে বিয়ে করার জন্য পীড়াপীড়ি করে থাকেন।

আর ঈর্ষাবশে ভ্রন্‌স্কির ওপর রাগ হত আন্নার এবং সব কিছুতে সে রাগের অজুহাত খুঁজতেন তিনি। আন্নার সমস্তই যে দুঃসহ, তার সব কিছুর জন্য তিনি দায়ী করতেন ভ্রন্‌স্কিকে। প্রতীক্ষার যে যন্ত্রণাকর পরিস্থিতিতে তিনি আকাশ-মাটির মাঝখানে ভাসমান জীবন কাটাচ্ছেন মস্কোয়, কারেনিনের দীর্ঘসূত্রিতা আর সিদ্ধান্তে অক্ষমতা, তাঁর নিঃসঙ্গতা—সব কিছুর দায় তিনি চাপাতেন ভ্রন্‌স্কির ওপর। যদি তিনি আন্নাকে ভালোবাসতেন, তাহলে বুঝতেন তাঁর অবস্থার অসহ্যতা এবং এ থেকে উদ্ধার করতেন তাঁকে। আন্না যে গ্রামে নয়, মস্কোয় রয়েছেন, সে তো ওঁরই দোষ। গ্রামে সমাধিস্থ হয়ে থাকতে পারেন না তিনি, যেটা আন্না চাইছিলেন। উচ্চ সমাজ তাঁর আবশ্যক, তাই আন্নাকে এমন ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে তিনি রেখেছেন, যার দুঃসহতা তিনি বুঝতে চান না। ছেলের সাথে তাঁর চিরকালের মত ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, সেটাও ওঁরই দোষ।

মমতার যে বিরল মুহূর্তগুলো দেখা দিত তাঁদের মধ্যে, তাতেও শান্তি পেতেন না আন্না; ভ্রন্‌স্কির মমতায় আন্না এখন দেখতে পাচ্ছেন প্রশান্তি আর আত্মবিশ্বাসের ছায়া যা আগে ছিল না, এতে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠতেন তিনি।

তখন গোধূলি। আন্না একা, ভ্রন্‌স্কি গিয়েছিলেন অবিবাহিতদের ডিনারে, সেখান থেকে তাঁর ফেরার অপেক্ষায় তাঁর স্টাডিতে ( রাস্তার গোলমাল যেখানে শোনা যায় সবচেয়ে কম) আগে-পিছে পায়চারি করতে করতে আন্না ভাবছিলেন গতকালের ঝগড়াটার খুঁটিনাটি কথা। কলহের সমস্ত অপমানকর উক্তিগুলো থেকে তাদের উপলক্ষে ফিরে আন্না শেষ পর্যন্ত কথাবার্তার শুরুটায় পৌঁছলেন। বহুক্ষণ তাঁর বিশ্বাস হল না যে, কলহ শুরু হতে পারে এমন নিরীহ, কারো মনে ঘা না-দেওয়া কথাবার্তা থেকে। অথচ আসলে হয়েছিল তাই-ই। শুরু হয়েছিল এই থেকে যে ভ্রন্‌স্কি হাসাহাসি করছিলেন নারী জিমনাসিয়াম নিয়ে, তাঁর মতে ওগুলো নিষ্প্রয়োজন, আর আন্না তাদের পক্ষ নিয়েছিলেন। সাধারণভাবেই নারী শিক্ষার প্রতি অশ্রদ্ধা ছিল ভ্রন্‌স্কির, বললেন যে হান্না নামে যে ইংরেজ বালিকাটিকে আন্না নিজের তত্ত্বাধানে রেখেছেন, পদার্থবিদ্যার জ্ঞান তার দরকার নেই।

এতে চটে ওঠেন আন্না। নিজের কাজের ওপর একটা অবজ্ঞা এতে দেখতে পেলেন তিনি। এবং ভেবেচিন্তে এমন একটা কথা তিনি বলেন যাতে তাঁর দেওয়া আঘাতটার শোধ দেওয়া যায়।

‘এমন আশা করি না যে আপনি আমাকে, আমার অনুভূতিকে বুঝবেন যে ভালোবাসে সে যেভাবে বুঝতে পারে, তবে সাধারণ সৌজন্যবোধটুকু আশা করেছিলাম’, বলেছিলেন আন্না।

এবং বাস্তবিকই বিরক্তিতে লাল হয়ে ওঠেন ভ্রন্‌স্কি, কি-একটা অপ্রীতিকর কথা বলেন তিনি। আন্নার মনে পড়ল না তিনি নিজে কি জবাব দিয়েছিলেন, কিন্তু ঠিক এই সময় স্পষ্টতই তাঁর মনে ব্যথা দেবার ইচ্ছাতেই বলেন : ‘ও মেয়েটার প্রতি আপনার যা টান তাতে আমার উৎসাহ নেই তা সত্যি, কেননা আমি দেখতে পাচ্ছি যে ওটা অস্বাভাবিক।’

দুর্বহ জীবনকে সইবার জন্য অত কষ্টে আন্না যে জগৎটাকে গড়ে তুলেছিলেন তাকে চুরমার করে দেবার এই নিষ্ঠুরতা, তাঁকে কপট, অস্বাভাবিক বলার এই অন্যায়টায় আন্না ফেটে পড়েন।

‘খুবই দুঃখের কথা যে কেবল স্থুল আর বৈষয়িক ব্যাপারগুলোই আপনার কাছে বোধগম্য আর স্বাভাবিক’, এই বলে আন্না বেরিয়ে যান ঘর থেকে।

গত সন্ধ্যায় ভ্রন্‌স্কি যখন আসেন, আন্নার কাছে, কলহটার কথা তাঁরা তোলেন না, কিন্তু দুজনেই টের পাচ্ছিলেন যে ঝগড়াটা চাপা পড়েছে মাত্র, চুকে যায়নি।

আজ সারা দিন ভ্রন্‌স্কি বাড়ি ছিলেন না, আন্নার এত একা-একা লাগছিল। ভ্রন্‌স্কির সাথে ঝগড়াটায় এত ভার বোধ হচ্ছিল যে সব কিছু ভুলে যেতে, ক্ষমা করতে, ওঁর সাথে মিটমাট করে নিতে চাইছিলেন তিনি। চাইছিলেন নিজেকে দোষী করে ভ্রন্‌স্কিকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করতে।

‘আমার নিজেরই দোষ। আমি খিটখিটে, অসম্ভব ঈর্ষাপরায়ণ। ওর সাথে মিটিয়ে নেব, চলে যাব গ্রামে, সেখানে শান্তিতে থাকব আমি’, মনে মনে বললেন তিনি।

‘অস্বাভাবিক’, হঠাৎ মনে পড়ল তাঁর, যা কথায় ততটা অপমানকর নয়, যতটা তাঁকে ব্যথা দেবার সংকল্পে।

‘জানি কি বলতে চেয়েছিল ও; বলতে চেয়েছিল নিজের মেয়েটাকে ভালো না বেসে পরের শিশুকে ভালোবাসা অস্বাভাবিক। শিশুদের ভালোবাসা, যে সেরিওজাকে আমি ওর জন্যে ত্যাগ করেছি তাকে আমার ভালোবাসার কি বোঝে সে? না, এ শুধু আমাকে ব্যথা দেওয়ার অভিসন্ধি! না, অন্য নারীকে সে ভালোবাসে, তাছাড়া হতে পারে না!

আর নিজেকে শান্ত করতে গিয়ে তিনি বহুবার অতিক্রান্ত চক্র আবার পাড়ি দিয়ে ফিরে এসেছেন আগের সেই তিতিবিরক্তিতে; তা দেখে নিজেকেই ভয় পেয়ে যান তিনি। ‘সত্যিই কি হবার নয়? দোষ মেনে নিতে সত্যিই কি আমি অক্ষম?’ মনে মনে বলে তিনি আবার শুরু করলেন গোড়া থেকে; ‘ও সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, আমাকে ও ভালোবাসে। আমি ভালোবাসি ওকে, দিন কয়েকের মধ্যেই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যাবে। কিসের আর দরকার থাকল? দরকার শান্তি, আস্থা, দোষ মেনে নেব। এবার ও এলে বলব যে আমার দোষ, যদিও দোষ আমার নয়, তারপর চলে যাব।’

এবং আরো ভাবনা যাতে থামে, মনে জ্বলুনি যাতে চাপা পড়ে, তার জন্য ঘণ্টি বাজিয়ে দাসীদের ডেকে ট্রাঙ্কগুলো এনে গ্রামে যাবার জন্য প্যাক করতে বললেন।

দশটায় ভ্রন্‌স্কি এলেন।

চব্বিশ

আন্না দোষী-দোষী বশীভূত ভাব নিয়ে এগিয়ে গেলেন তাঁর দিকে, ‘কি, জমেছিল তো?’

‘সব সময় যে রকম’, এই বলে আন্নার দিকে একবার চাইতেই বুঝলেন যে আন্নার মেজাজ অতি প্ৰসন্ন। এই মেজাজ-বদলে তিনি অভ্যস্তই, আজ তাতে তাঁর খুবই আনন্দ হল, তাই নিজেও অতি প্রসন্ন হয়ে উঠলেন

তিনি হলঘরে ট্রাঙ্কগুলোকে দেখিয়ে বললেন, ‘এ কি দেখছি! হ্যাঁ, এটা ভালো!’

‘হ্যাঁ, চলে যাওয়াই দরকার। আজ আমি গাড়ি করে বেড়াতে বেরিয়েছিলাম, এত ভালো লাগছিল যে গ্রামের জন্যে মন কেমন করে উঠল। এখানে তোমার তো আটকে থাকার কিছু নেই?’

‘আমার শুধু ওটাই বাসনা। পোশাক বদলে এখনই আসছি, কথাবার্তা বলব। চা দিতে বল।’

ভ্রন্‌স্কি তাঁর স্টাডিতে গেলেন। শিশু যখন দুষ্টুমি থামায় তখন লোকে তাকে যা বলে, সেভাবে ‘হ্যাঁ, এটা ভালো’ বলার মধ্যে অপমানকর কিছু-একটা ছিল; আরো বেশি অপমানকর ছিল আন্নার দোষী-দোষী আর ওঁর আত্মনিশ্চিত ভাবের মধ্যে বৈপরীত্য। আন্না টের পেলেন তাঁর মধ্যে সংগ্রামের একটা ঝোঁক মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে; কিন্তু নিজের ওপর জোর খাটিয়ে আন্না সেটা দমন করলেন।

ভ্রন্‌স্কি যখন তাঁর কাছে এলেন, তাঁকে তিনি বললেন অংশত আগে থেকে তৈরি করা কথার পুনরাবৃত্তি করে। দিনটা তাঁর কেমন কেটেছে। কি তাঁর পরিকল্পনা গ্রামে চলে যাবার।

‘জানো, প্রায় প্রেরণা এসে গেছে আমার। বিবাহবিচ্ছেদের জন্যে কি দরকার এখানে অপেক্ষা করার? গ্রামেও তো পারে। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আশা করতে চাই না আমি, বিবাহবিচ্ছেদ সম্বন্ধে কিছু শুনতে চাই না। ঠিক করে ফেলেছি ওটায় আর কিছু এসে যাবে না আমার জীবনে। তুমি কি বল?’

‘হ্যাঁ, ঠিকই!’ আন্নার উত্তেজিত মুখের দিকে অস্বস্তিভরে তাকিয়ে বললেন ভ্রন্‌স্কি।

‘তোমরা কি করলে ওখানে? কে কে ছিল?’ একটু চুপ করে থেকে বললেন আন্না। অতিথিদের নাম করলেন ভ্রন্‌স্কি।

‘ডিনার ছিল চমৎকার, বাইচ-টাইচ দৌড়, সবই বেশ ভালো। কিন্তু মস্কোয় একটা-না-একটা হাস্যকর ব্যাপার ছাড়া কিছু ঘটে না। উদিত হলেন কে-এক মহিলা, সুইডিশ রানীর সন্তরণ শিক্ষিকা, দেখালেন তাঁর বিদ্যা।’

আন্না ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে কি? সাঁতরাল?’

‘কি-একটা লাল সুইমিং কস্টিউম বুড়ি, বদখত চেহারা। তাহলে কবে যাচ্ছি?’

‘কি যে পাগলামি! সাঁতরায় অসাধারণ কিছু?’ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আন্না।

‘মোটেই অসাধারণ নয়। আমি বলব সাংঘাতিক হাঁদামি। তাহলে কবে যাবে ভাবছ?’

‘কবে যাচ্ছি? যত তাড়াতাড়ি হয় ততই ভালো। কাল গুছিয়ে ওঠা যাবে না, পরশু।’

‘বেশ… না, সম্ভব হবে না। পরশু রবিবার, মায়ের কাছে যেতে হবে’, ভ্রন্‌স্কি বললেন অস্বস্তিভরে, কেননা মায়ের নাম করা মাত্র তিনি অনুভব করলেন তাঁর ওপর স্থির সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ। তাঁর অস্বস্তিতে পুষ্ট হল আন্নার সন্দেহ। লাল হয়ে উঠে তিনি, সরে গেলেন ওঁর কাছ থেকে। এখন আর সুইডিশ রানীর সন্তরণ শিক্ষিকা নয়, মনে তাঁর ভেসে উঠল প্রিন্সেস সরোকিনার ছবি, মস্কোর উপকণ্ঠে গ্রামে যিনি থাকেন কাউন্টেস ভ্রস্কায়ার সাথে।

‘তুমি তো কালও যেতে পারো?’ আন্না বললেন।

‘আরে না, যে ব্যাপারটার জন্যে মায়ের কাছে যাচ্ছি, অনুমতিপত্র আর টাকা, সেটা কালকে পাওয়া যাবে না’, উনি বললেন।

‘তাই যদি হয়, তাহলে আদৌ আমরা যাব না।’

‘কেন?’

‘এর পরে আমি যাব না। হয় সোমবার নতুবা কখনোই নয়!’

‘কেন?’ যেন অবাক হয়ে বললেন ভ্রন্‌স্কি, ‘এর তো কোন মানে হয় না!’

‘তোমার কাছে মানে হয় না! কারণ আমাকে নিয়ে তোমার কোন ভাবনা নেই। আমার জীবনটা তুমি বুঝতে চাও না। এখানে একমাত্র যেটা আমাকে ব্যস্ত রেখেছে, সে—হান্না। তুমি বল ওটা ভান। কালই তো তুমি বলেছ যে, আমার মেয়েকে আমি ভালোবাসি না আর ভান করি যে ইংরেজ খুকিটিকে ভালোবাসি, এটা অস্বাভাবিক; জানতে চাই এখানে কোন জীবন আমার পক্ষে স্বাভাবিক হতে পারে!’

মুহূর্তের জন্য আন্নার চৈতন্য হয়েছিল, নিজের সংকল্প ভঙ্গ করছেন দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিজেই যে নিজের সর্বনাশ করছেন তা জেনেও সংযত থাকতে পারলেন না, ভ্রন্‌স্কিরই যে অন্যায় সেটা না দেখিয়ে পারলেন না, পারলেন না ওঁর কাছে নত হতে।

‘আমি ও-কথা কখনো বলিনি; বলেছিলাম, এই আকস্মিক ভালোবাসাটায় আমার সহানুভূতি নেই।’

‘তুমি তোমার স্পষ্টতার বড়াই করো, কিন্তু সত্যি কথাটা বলছ না কেন?

‘বড়াই আমি কখনো করিনি, অসত্য আমি বলি না’, ভেতরে যে রাগটা মাথাচাড়া দিচ্ছিল, সেটাকে চেপে রেখে মৃদুস্বরে বললেন তিনি; ‘খুবই দুঃখের কথা যে, তুমি সম্মান করছ না…’

‘সম্মান কথাটা বানানো হয়েছে শূন্য জায়গাটা আড়াল করার জন্যে, যেখানে প্রেম থাকার কথা। কিন্তু তুমি যদি আর ভালো না বাসো, তবে সেটা বলাই হবে বেশি ভালো আর সৎ।’

‘না, একেবারে অসহ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে!’ চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচিয়ে বললেন ভ্রন্‌স্কি। তারপর আন্নার সামনে থেমে ধীরে ধীরে তিনি বললেন, ‘আমার সহ্যশক্তিকে কেন তুমি পরীক্ষা করো বলো তো’, বললেন এমন ভাব করে যেন আরো অনেক কিছু বলতে পারতেন, কিন্তু নিজেকে সংযত করে বলছেন না, ‘ওর একটা সীমা আছে।’

‘কি আপনি বলতে চান এতে?’ আতংকে আন্না চেঁচিয়ে উঠলেন তাঁর সারা মুখে, বিশেষ করে নিষ্ঠুর ভীষণ চোখে সুস্পষ্ট ঘৃণা দেখে।

‘আমি বলতে চাই…’ শুরু করতে যাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু থেমে গেলেন। ‘আমার প্রশ্ন করা উচিত, কি আপনি চান আমার কাছে।

‘কি আমি চাইতে পারি? আমি শুধু চাইতে পারি যে, আপনি আমাকে যেন ত্যাগ না করেন, যেটা আপনি ভাবছেন’, ভ্রন্‌স্কি যা সম্পূর্ণ করে বলেননি, সেটা বুঝে নিয়ে আন্না বললেন; ‘তবে ওটা আমি চাই না, ওটা গৌণ। আমি চাই ভালোবাসা কিন্তু সেটা নেই। তার মানে সব শেষ হয়ে গেছে!’

তিনি দরজার দিকে গেলেন।

‘দাঁড়াও! দাঁ-ড়াও! ভুরুর অন্ধকার কুঞ্চন বজায় রেখেই তবে হাত দিয়ে আন্নাকে থামিয়ে ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘কি এমন হল? আমি বললাম যে যাওয়াটা তিন দিন পিছিয়ে দিতে হবে, আর তুমি আমাকে বললে যে আমি মিথ্যে বলছি, আমি অসাধু লোক।’

‘হ্যাঁ, আবার বলছি, এমন লোক যে আমার জন্যে সর্বস্ব ত্যাগ করেছে বলে ভর্ৎসনা করে আমাকে’, আন্না বললেন আরো আগেকার একটা কলহে বলা কথাটা স্মরণ করে, ‘অসাধু লোকের চেয়েও এ খারাপ, এ হৃদয়হীন লোক।’

‘নাহ্, সহ্যের একটা সীমা আছে!’ চেঁচিয়ে উঠে উনি ঝট করে আন্নার হাত ছেড়ে দিলেন।

‘আমাকে ও ঘৃণা করে, এটা পরিষ্কার’, আন্না ভাবলেন এবং ফিরে না চেয়ে নীরবে স্খলিত পদে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

‘অন্য নারীকে ও ভালোবাসে, এটা আরো পরিষ্কার’, নিজের ঘরে ঢুকে আন্না ভাবলেন মনে মনে; ‘আমি চাই ভালোবাসা, সেটা নেই। তাহলে সব শেষ’, আগে বলা নিজের কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি, ‘আর শেষ’, আগে বলা নিজের কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি, ‘আর শেষ করে দেওয়াই উচিত।’

‘কিন্তু কি করে?’ নিজেকে প্রশ্ন করলেন তিনি, বসলেন আয়নার সামনের ইজি-চেয়ারে।

তিনি এখন কোথায় যাবেন, ফুফুর কাছে, যিনি তাঁকে মানুষ করেছেন, ডল্লির কাছে, নাকি একলা বিদেশে, কি এখন ভ্রন্‌স্কি করছেন একলা তাঁর স্টাডিতে, ঝগড়াটা কি চূড়ান্ত নাকি মিটমাট হওয়া এখানো সম্ভব, তাঁর সম্পর্কে কি এখন বলাবলি করবে পিটার্সবুর্গে তাঁর ভূতপূর্ব পরিচিতেরা, কারেনিন ব্যাপারাটা কিভাবে দেখবেন, এসব এবং বিচ্ছেদের পর কি হবে তা নিয়ে নানান চিন্তার উদয় হল তাঁর মনে। কিন্তু এতে তিনি একেবারে ভেসে গেলেন না। প্রাণের মধ্যে অস্পষ্ট আরো একটা চিন্তা ছিল, শুধু সেটাই আকর্ষণ করছিল তাঁকে, কিন্তু সে সম্পর্কে সচেতন হতে পারছিলেন না তিনি। কারেনিনের কথা আর একবার ভাবতে গিয়ে তাঁর মনে পড়েছিল প্রসবের পরে তাঁর পীড়া এবং যেসব অনুভূতি তাঁকে তখন রেহাই দিচ্ছিল না, তার কথা। ‘কেন আমি মরলাম না?’ মনে পড়ল তাঁর তখনকার কথা আর তখনকার চিত্তাবেগ। আর হঠাৎ আন্না বুঝতে পারলেন কি রয়েছে তাঁর প্রাণের গভীরে। হ্যাঁ, এটা সেই চিন্তা শুধু যেটাই সব কিছুর সমাধান করবে। ‘হ্যাঁ, মরতে হবে!…’

‘কারেনিন আর ছেলের লজ্জা ও কলংক, আর আমার ভয়ঙ্কর লজ্জা—সব মুছে যাবে মৃত্যুতে। মরব—আর ও পরিতাপ করবে, দুঃখ করবে, ভালোবাসবে, কষ্ট পাবে আমার জন্যে।’ নিজের ওপর সমবেদনার একটা হাসি লেগে রইল তাঁর ঠোঁটে, ইজি-চেয়ারে বসে বাঁ হাতের আংটিটা খুলতে আর পরতে লাগলেন তিনি, মৃত্যুর পর নানা দিক থেকে ওর মনোভাব জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠতে থাকল তাঁর মনে।

ভ্রন্‌স্কির এগিয়ে আসা পদক্ষেপ, ওঁর পদক্ষেপ জাগিয়ে তুলল তাঁকে। যেন নিজের আংটিগুলো রাখা নিয়েই তিনি ব্যস্ত, এমন ভাব করে আন্না তাঁর দিকে এমন কি চেয়েও দেখলেন না।

আন্নার কাছে এসে তাঁর হাতটা টেনে নিয়ে ভ্রন্‌স্কি মৃদুস্বরে বললেন : ‘আন্না, যদি চাও পরশুই যাব। আমি সব কিছুতে রাজি।’

তিনি চুপ করে রইলেন।

‘কি?’ জিজ্ঞেস করলেন অনস্কি।

‘তুমি নিজেই জানো’, এই বলে নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে আন্না ডুকরে উঠলেন।

কান্নার দমকের ফাঁকে ফাঁকে তিনি বলতে লাগলেন, ‘ত্যাগ করো আমাকে, ত্যাগ করো! কালই আমি চলে যাব… তারও বেশি কিছু করব। কে আমি? ব্যভিচারিণী নারী। তোমার গলায় একটা পাথর। তোমাকে কষ্ট দিতে আমি চাই না, চাই না! তোমাকে মুক্তি দেব আমি। তুমি আমাকে ভালোবাসো না, ভালোবাসো অন্য কাউকে!

শান্ত হবার জন্য অনুনয় করতে লাগলেন ভ্রন্‌স্কি। নিশ্চয় করে বললেন যে তাঁর ঈর্ষার সামান্যতম ভিত্তি নেই। ওঁকে ভালোবাসায় কখনো তিনি ক্ষান্ত হননি, হবেন না, এখন তাঁকে ভালোবাসছেন আগের চেয়েও বেশি।

‘আন্না, কেন অমন যন্ত্রণা দাও নিজেকেও, আমাকেও?’ তাঁর করচুম্বন করে বললেন ভ্রন্‌স্কি। এখন তাঁর মুখে ফুটে উঠেছে কোমলতা আর আন্নার মনে হল তিনি যেন কানে শুনছেন তাঁর কণ্ঠস্বরে অশ্রুবর্ষণধ্বনি, হাতে অনুভব করছেন তার আর্দ্রতা। মুহূর্তে আন্নার মরিয়া ঈর্ষা পরিণত হল মরিয়া, আবেগমথিত কোমলতায়। ভ্রন্‌স্কিকে আলিঙ্গন করে তাঁর মাথা, গলা, হাত তিনি চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *