আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ২.৫

পাঁচ

ভ্রন্‌স্কি হাসি-হাসি চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘একটু অশালীন কিন্তু এমন চমৎকার যে ভীষণ ইচ্ছে করছে বলতে। কারো নাম বলব না কিন্তু।’

‘সে তো আরো ভালো, আমি অনুমান করতে থাকব।’

‘দুটো ফুর্তিবাজ যুবক যাচ্ছে…’

‘নিশ্চয় আপনাদের রেজিমেন্টের অফিসার?’

‘অফিসার বলব না, নেহাৎ আহারান্তে দুটো লোক …‘

‘ঘুরিয়ে বলুন : মাতাল।’

‘হয়ত। যাচ্ছে বন্ধুর বাড়ি খেতে, অতি শরীফ মেজাজে। দেখে সুন্দরী এক নারী ঘোড়ার গাড়িতে করে তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, ওদের দিকে তাকিয়ে দেখে মাথা নাড়ছে আর হাসছে, অন্তত তাই তাদের মনে হয়েছিল। বলাই বাহুল্য ওরা তার পিছু নিল, ঘোড়া ছুটাল পুরোদমে। তাদের অবাক করে দিয়ে যে বাড়িতে তারা যাচ্ছিল তারই ফটকের সামনে গাড়ি থামল সুন্দরীর। ওপরতলায় সুন্দরী ছুটে উঠল। তারা দেখল শুধু খাটো অবগুণ্ঠনের তলে রক্তিম অধর আর ছোট ছোট অনিন্দ্য চরণ।’

‘আপনি এমন অনুরাগে ঘটনাটা বলছেন যে মনে হচ্ছে আপনি নিজেই এ দুইয়ের একজন।’

‘কিন্তু কিছুক্ষণ আগে আপনি আমাকে কি বলেছেন মনে আছে তো? তা যুবকেরা তো গেল তাদের বন্ধুর কাছে, সেখানে আজ তার বিদায় ভোজ। এখানে ঠিকই তারা মদ্যপান করল, হয়ত একটু বেশিই, বিদায় বাসরে যা সব সময়ই ঘটে থাকে। আহারের সময় ওরা জিজ্ঞেস করলে এ বাড়ির ওপরতলায় কে থাকে। কারোরই জানা ছিল না। শুধু, ওপরে কি ‘মামজেলরা’ থাকে, এই প্রশ্নের উত্তরে কর্তার খানসামা জানাল থাকে অনেকগুলোই। খাওয়া-দাওয়ার পর যুবকেরা গেল গৃহকর্তার কেবিনেটে এবং চিঠি লিখলে অপরিচিতার কাছে। লিকলে হৃদয়াবেগে ভরা চিঠি, প্ৰেমঘোষণা, এবং নিজেরাই তা ওপরে নিয়ে গেল যদি চিঠির কোন কিছু বিশেষ বোধগম্য না হয় তা বুঝিয়ে দেবার জন্য।’

‘এ সব বিছ্‌ছিরি কথা আমাকে কেন বলছেন? তারপর?’

‘ঘন্টি দিলে। দাসী বেরিয়ে এল। মেয়েটাকে চিঠি দিয়ে দুজনেই নিশ্চয় করে বলল তারা এমন প্রেমে পড়েছে যে তখনই দ্বারদেশেই মারা যাবে। কিছু বুঝতে না পেরে মেয়েটা কথাবার্তা চালাতে লাগল। হঠাৎ বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক, চিংড়ির মত লাল, গালে সসেজ গোছের গালপাট্টা, ঘোষণা করলেন বাড়িতে তাঁর স্ত্রী ছাড়া আর কেউ থাকে না এবং ভাগিয়ে দিলেন তাদের।’

‘কোত্থেকে জানলেন যে তার গালপাট্টা সসেজ গোছের?’

‘আরে শুনুন। আজ আমি গিয়েছিলাম ওদের মিটমাট করিয়ে দিতে।’

‘তা কি হল?’

‘সেটাই তো সবচেয়ে মজার। জানা গেল, এই সুখী দম্পত্তি হলেন মিঃ টিটুলার কাউন্সিলর এবং মিসেস টিটুলার কাউন্সিলর। টিটুলার কাউন্সিলর নালিশ করলেন, আমি হলাম আপোসকর্তা, আর যেমন-তেমন সালিশ নই, তালেরাও লাগে না আমার কাছে।’

‘মুশকিলটা কি ছিল?’

‘শুনুন-না… যথাযোগ্য মাপ চাইলাম আমরা : ‘আমরা একেবারে মুষড়ে পড়েছি। দুর্ভাগা ভুল বোঝাবুঝিটার জন্য মাপ চাইছি আমরা।’ সসেজ মার্কা গালপাট্টার টিটুলার কাউন্সিলর নরম হতে শুরু করলেন, তবে তিনিও তাঁর মনোভাব প্রকাশ করতে চান আর প্রকাশ করতে শুরু করা মাত্র খেপে উঠলেন এবং কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন। আবার আমার সমস্ত কূটনৈতিক প্রতিভা কাজে লাগাতে হল আমাকে। ‘আমি মানছি যে ওদের আচরণটা ভালো হয়নি। কিন্তু অনুরোধ করি, ওদের ভুল বোঝা, ছোকরা বয়স, এ সব ভেবে দেখুন। তাছাড়া যুবকেরা তখন সবেমাত্র খাওয়া সেরেছে। সেটা বুঝতে পারছেন তো। ওরা সর্বান্তঃকরণে অনুতাপ করছে, অনুরোধ করছে ওদের দোষ মাপ করে দিতে।’ টিটুলার কাউন্সিলর আবার নরম হলেন। ‘আপনার কথা আমি মানছি, কাউন্ট, ক্ষমা করতে আমি রাজি, কিন্তু বুঝতে পারছেন, আমার স্ত্রী, আমার স্ত্রী সতী-সাধ্বী নারী, কোথাকার কি সব ছেলে-ছোকরা, নচ্ছাররা কিনা তার পিছু নিচ্ছে, তার অপমান করছে, আস্পর্ধা দেখাচ্ছে…’ আর বুঝতে পারছেন তো, ওই ছেলে-ছোকরারা কিন্তু ওখানেই দাঁড়িয়ে, ওঁদের মিটমাট করিয়ে দিতে হবে আমাকে। আবার চালু করলাম আমার কূটনীতি, আর ব্যাপারটা যখন চুকিয়ে দেওয়ার কথা, আবার খেপে উঠলেন টিটুলার কাউন্সিলর, লাল হয়ে উঠলেন, খাড়া হয়ে উঠল তাঁর সসেজ এবং আবার আমাকে উথলে উঠতে হল কূটনৈতিক সূক্ষ্মতায়।’

তাঁর বক্সে ঢুকছিলেন জনৈক মহিলা, তাঁকে উদ্দেশ করে হেসে বেত্‌সি বললেন, ‘এটা আপনাকে শোনানো দরকার! উনি ভারি হাসিয়েছেন আমাকে।’

ফরাসি ভাষায় তার সফলতা কামনা করে তার পাখা ধরে থাকা হাতের মুক্ত আঙুলটা বাড়িয়ে দিয়ে তিনি যোগ দিলেন এবং কাঁধ নাড়িয়ে গাউনের উঠে-আসা বডিসটা নিচে নামিয়ে দিলেন যাতে ফুট লাইটের দিকে যাবার সময় যা উচিত, গ্যাসের আলোয় সবার দৃষ্টির সামনে যথাসম্ভব নগ্ন হতে পারেন।

ভ্রন্‌স্কি ফরাসি থিয়েটারে গেলেন। সেখানে সত্যিই তাঁর দেখা করা দরকার ছিল রেজিমেন্ট কমান্ডারের সাথে যিনি এ থিয়েটারের কোন মঞ্চানুষ্ঠান বাদ দেন না। উদ্দেশ্য ছিল, যে মিলন ব্রতে আজ তিনদিন থেকে তিনি ব্যস্ত এবং তাকে মজা পাচ্ছেন তা নিয়ে কমান্ডারের সাথে কথা বলা। ব্যাপারটায় জড়িত ছিলেন পেত্রিৎস্কি যাঁকে তিনি ভালোবাসতেন এবং দ্বিতীয় জন—তরুণ প্রিন্স কেন্দ্রভ, চমৎকার ছোকরা, ভালো সঙ্গী, রেজিমেন্টে ঢুকেছেন সম্প্রতি। তবে প্রধান কথা এক্ষেত্রে রেজিমেন্টের স্বার্থ ছিল জড়িত।

দুজনেই ছিলেন ভ্রন্‌স্কির স্কোয়াড্রনে। রেজিমেন্ট কমান্ডারের কাছে এসে রাজকর্মচারী, টিটুলার কাউন্সিলর ভেনডেন নালিশ করেন তাঁর অফিসারদের বিরুদ্ধে যারা তাঁর স্ত্রীকে অপমান করেছে। ভেনডেন বিয়ে করেছেন ছয় মাস হল, বললেন, মায়ের সাথে তাঁর তরুণী ভাষা গিয়েছিলেন গির্জায়, সেখানে হঠাৎ তাঁর শরীর খারাপ লাগে, সেটা অন্তঃসত্ত্বা থাকার দরুন, আর তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না, বেপরোয়া প্রথম যে ছ্যাকড়া গাড়িটা তিনি সামনে পান, তাতে করে বাড়ি চলে আসেন। এখানে তাঁকে তাড়া করে অফিসাররা, ভয় পেয়ে যান তিনি, আরো বেশি অসুস্থ হয়ে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে ওঠেন ঘরে। এই সময় অফিস থেকে পিরে ভেনডেন ঘন্টি এবং কাদের যেন গলা শুনতে পান, বেরিয়ে এসে তিনি চিঠি হাতে মাতাল অফিসার দুটোকে দেখতে পান এবং তাদের খেদিয়ে দেন। কড়া শাস্তি দাবি করেছেন তিনি।

ভ্রন্‌স্কিকে নিজের কাছে ডেকে রেজিমেন্ট কমান্ডার বললেন, ‘না, না, যাই বলুন, পেত্রিৎস্কি অসম্ভব হয়ে উঠছে। কোন না কোন কাণ্ড ছাড়া একটা সপ্তাহও যায় না। কর্মচারীটি ছাড়বে না, আরো ওপরে যাবে।’

ব্যাপারটার সমস্ত অশোভনতা ভ্রন্‌স্কি দেখতে পাচ্ছিলেন, এখানে ডুয়েলের কোন কথাই উঠতে পারে না, টিটুলার কাউন্সিলরটিকে নরম করে এনে ব্যাপারটা চাপা দেবার জন্য সব কিছু করা দরকার। রেজিমেন্ট কমান্ডার ভ্রন্‌স্কিকে ডেকেছিলেন ঠিক এই জন্যই যে তাঁকে উচ্চবংশীয় বুদ্ধিমান লোক বলে জানতেন। প্রধান কথা রেজিমেন্টের মান- মর্যাদা ওঁর কাছে মূল্যবান। আলোচনা করে তাঁরা ঠিক করেছিলেন যে ভ্রন্‌স্কির সাথে টিটুলার কাউন্সিলরের কাছে গিয়ে পেত্রিৎস্কি আর কেন্দ্রভকে ক্ষমা চাইতে হবে। রেজিমেন্ট কমান্ডার এবং ভ্রন্‌স্কি দুজনেই বুঝেছিলেন যে ভ্রন্‌স্কির নাম এবং পদ টিটুলার কাউন্সিলরকে নরম করে আনায় কাজ দেবে। এবং সত্যিই এই দুটো উপায়ে খানিকটা কাজও হয়েছিল; কিন্তু ভ্রন্‌স্কি যা বললেন, মিটমাটের ফল রয়ে গেছে সন্দেহজনক।

ফরাসি থিয়েটারে এসে ভ্রন্‌স্কি রেজিমেন্ট কমান্ডারের সাথে চলে গেলেন ফয়ে’তে এবং তাঁর সাফল্য-অসাফল্যের কথা বললেন। সব কিছু ভেবেচিন্তে রেজিমেন্ট কমান্ডার ঠিক করলেন কোন শাস্তি দেবার দরজার নেই, কিন্তু পরে তাঁর নিজের পরিতোষের জন্য ভ্রন্‌স্কির সাক্ষাৎকারের সমস্ত খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করতে থাকেন এবং ঘটনার কয়েকটা দিক মনে পড়ে যেতেই শান্ত হয়ে আসা টিটুলার কাউন্সিলর কিভাবে আবার খেপে উঠছিলেন এবং মিটমাটের শেষ অস্ফুট কথাটা শোনা মাত্র কিভাবে ভ্রন্‌স্কি কায়দা করে পেত্রিৎস্কিকে সামনে ঠেলতে ঠেলতে পিঠটান দেন তা শুনে কমান্ডার অনেকক্ষণ হাসি চাপতে পারেননি।

‘যাচ্ছেতাই কাণ্ড, তবে দারুণ মজাদার। কেন্দ্রভের পক্ষে তো আর এই ভদ্রলোকের সাথে লড়া সম্ভব নয়! অমন খেপে উঠেছিল?’ হেসে আবার জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ‘কিন্তু ক্লেয়ারকে আজ কেমন দেখছেন? অপূর্ব!’ নতুন ফরাসি অভিনেত্রী সম্পর্কে বললেন তিনি, ‘যতই দেখি না কেন, প্রতিদিনই নতুন। ওটা শুধু ফরাসিরাই পারে।’

ছয়

প্রিন্সেস বেত্‌সি শেষ অংক সমাপ্ত না হতেই থিয়েটার থেকে চলে গেলেন। ড্রেসিং-রুমে গিয়ে নিজের দীর্ঘ পাণ্ডুর মুখে পাউডার ছিটিয়ে এবং তা মুছে কবরী ঠিক করে নিয়ে প্রকাণ্ড ড্রয়িং-রুমটায় চা এনে দেবার হুকুম দিতে না দিতেই বলশায়া মস্কায়া রাস্তায় তাঁর বিশাল বাড়িটার গেটের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াতে থাকল একটার পর একটা। অতিথিরা গাড়ি থেকে নেমে যেতে লাগলেন প্রবেশপথের দিকে এবং পথচারীদের জ্ঞানদানার্থে যেসব খবরের কাগজ টাঙানো থাকা কাচের ফ্রেমে, রোজ সকালে তা পড়তে অভ্যস্ত দশাসই চাপরাশি নিঃশব্দে মস্ত দরজাটা খুলে অতিথিদের ভেতরে পথ করে দিতে থাকল।

কালচে দেয়ালের প্রশস্ত ড্রয়িং-রুমে ফুঁয়ো-ফুয়ো গালিচা, আলোকোজ্জ্বল টেবিল, মোমবাতির আলোয় ঝকঝকে সাদা টেবিলক্লথ, রুপার সামোভার, চীনা মাটির স্বচ্ছ টি-সেট। প্রায় একই সাথে ঘরখানার এক দরজা দিয়ে তাজা কবরী আর তাজা মুখে ঢুকলেন গৃহস্বামিনী, অন্য দরজা দিয়ে অতিথিরা

গৃহস্বামিনী বসলেন সামোভারের কাছে, দস্তানা খুললেন। অলক্ষ্য পরিচারকদের সাহায্যে চেয়ার সরিয়ে সরিয়ে সমাজ স্থান নিল দু’ভাগে ভাগ হয়ে : একদল সামোভারের কাছে গৃহস্বামিনীর সাথে, অন্য দল ড্রয়িং-রুমের বিপরীত প্রান্তে জনৈক রাষ্ট্রদূতের সুন্দরী পত্নীর কাছে, পরনে তাঁর কালো মখমলের পোশাক, চোখে তীক্ষ্ণ কালো ভুরু। প্রথমটায় বা সব সময়ই হয় অতিথি আগমন, সম্ভাষণ, চায়ের আপ্যায়নে বাধাপ্রাপ্ত আলাপ দুলতে লাগল যেন কোন প্রসঙ্গে নিবন্ধ হওয়া যায় তার অন্বেষণে।

‘অভিনেত্রী হিসেবে উনি অসাধারণ ভালো; বোঝাই যায় কাউলবাখের শিষ্যা’, বললেন রাষ্ট্রদূতপত্নীর চক্রস্থ একজন কূটনীতিক, ‘লক্ষ্য করেছিলেন কিভাবে পড়ে গেলেন… ‘

‘আহ্ নিলসনের কথা থাক। ওঁর সম্পর্কে নতুন কি আর বলার আছে’, বললেন সাবেকী রেশমী গাউন পরা, সোনালি-চুল, ভ্রূহীন, পরচুলা-হীন, রক্তবর্ণা স্থূলাঙ্গী মহিলা। ইনি হলেন বিখ্যাত প্রিন্সেস মিয়াগ্‌কায়া, স্পষ্টভাষণ আর রূঢ়তার জন্য তাঁর উপনাম জুটেছিল ভয়ংকরী শিশু (গেছো খুকি ফরাসি ভাষায়)। প্রিন্সেস মিয়াকায়া বসেছিলেন দু’মহলের মাঝামাঝি, এবং কখনো এ-দল কখনো ও-দলের কথা শুনে যোগ দিচ্ছিলেন দু’পক্ষেরই আলাপে। ‘কাউলবাখ সম্পর্কে ঠিক এই কথাই আমাকে আজ বলেছে তিনজন, যেন নিজেদের মধ্যে আগে কথা হয়ে গিয়েছিল। অথচ কেন যে বুলিটা ওদের মনে ধরে গেল, জানি না।’

এই মন্তব্যে আলাপের তাল কেটে গেল, প্রয়োজন হল নতুন প্রসঙ্গ খোঁজার।

‘কিছু-একটা মজার কথা আমাদের বলুন, তবে তাতে যেন জ্বলুনি না থাকে’, কূটনীতিক যখন ভেবে পাচ্ছিলেন না কি দিয়ে শুরু করবেন, তখন তাঁকে বললেন, রাষ্ট্রদূতপত্নী, ইংরেজিতে যাকে বলে small talk তেমন মার্জিত কথোপকথনে ইনিও অসামান্যা।

কূটনীতিক হেসে বললেন, ‘লোকে বলে সেটা বড় কঠিন, যা জ্বালায় শুধু তা-ই হাস্যকর। তবে চেষ্টা করে দেখি। একটা প্রসঙ্গ দিন-না। আসল ব্যাপারটাই হল প্রসঙ্গ নিয়ে। প্রসঙ্গ পেলে তাতে ফুল তোলা সহজ। আমার প্রায়ই মনে হয়, গত শতকের নামকরা আলাপীদের পক্ষে চাতুর্যের সাথে আলাপ করা আজকাল মুশকিল হত। চতুর সব কিছুতেই লোকের ভারি বিরক্তি ধরে গেছে… ‘

‘সে কথা তো শোনা গেছে অনেক আগেই’, হেসে বাধা দিলেন রাষ্ট্রদূত পত্নী।

আলাপের শুরুটা হল সুন্দর, কিন্তু ঠিক অতটা সুন্দর বলেই তা আবার থেমে গেল। প্রয়োজন হল নির্ভরযোগ্য, সব সময় অব্যর্থ পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া—যথা, পরচর্চা।

‘আপনাদের মনে হয় না যে তুশকেভিচের মধ্যে ১৫শ লুই গোছের কিছু-একটা আছে?’ চোখ দিয়ে টেবিলের কাছে দণ্ডায়মান পাণ্ডুরকেশ সুপুরুষ একটা যুবককে দেখিয়ে তিনি বললেন।

‘আরে হ্যাঁ! এ ড্রয়িং-রুমটার সাথে তাঁর রুচি মেলে, তাই অত ঘন ঘন তিনি দর্শন দেন এখানে।’

এ আলাপটা চলতে থাকল কেননা এ ড্রয়িং-রুমে যা বলা চলে না, তা বলে হতে লাগল, আভাষে ইঙ্গিতে অর্থাৎ

পরচর্চায় এসে গিয়ে সুস্থির হল।

‘শুনেছেন, মালতিশ্যেভাও–মেয়ে নয়, মা–সেও চটকদার গোলাপি পোশাক বানাচ্ছে।

‘বলেন কি! না, এ যে খাসা ব্যাপার!’

‘আমার অবাক লাগে, বুদ্ধিশুদ্ধি থাকলেও—উনি তো বোকা নন—দেখতে পাচ্ছেন না নিজেকে কি হাস্যকর করছেন।’

দুর্ভাগিনী মালতিশ্যেভার নিন্দায় আর ঠাট্টায় প্রত্যেকেরই বলার ছিল কিছু-না-কিছু, আলাপও ফুর্তিতে মুখর হয়ে উঠল জ্বলে ওঠা শিবিরাগ্নির মত।

প্রিন্সেস বেত্‌সির স্বামী, সদাশয় স্থূলকায় মানুষ, এনগ্রেভিং সংগ্রহে পাগল, স্ত্রীর অতিথি এসেছেন শুনে ক্লাবে যাবার আগে ড্রয়িং-রুমে এলেন। নরম গালিচার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে তিনি গেলেন প্রিন্সেস মিয়াঙ্কায়ার কাছে।

বললেন, ‘নিলসনকে কেমন লাগল আপনার?

‘ওঃই, অমন চুপি চুপি কেউ আসে নাকি? আমাকে যা ভয় পাইয়ে দিয়েছেন’, জবাব দিলেন উনি। আমার কাছে অপেরার কথা বলবেন না বাপু, সঙ্গীত আপনি কিছুই বোঝেন না। আমি বরং আপনার মানে নেমে গিয়ে আপনার মাওলিকা আর এনগ্রেভিং নিয়ে কথা বলব আপনার সাথে। তা পুরানা বাজারে সম্প্রতি কি ধন কিনলেন?’

‘দেখতে চান? তবে আপনি ওর মর্ম বুঝবেন না।’

‘দেখান। ওই ওদের, কি যেন বলে ওদের… ওই ব্যাংকারদের কাছে আমি শিখেছি… ওদের চমৎকার চমৎকার এনগ্রেভিং আছে। আমাদের ওরা দেখায়।’

‘সে কি, আপনারা শিউট্সবুর্গদের ওখানে গিয়েছিলেন?’ সামোভারের ওখান থেকে জিজ্ঞেস কররেন কী ‘গিয়েছিলাম ma chere। আমার স্বামীর সাথে আমাকে তারা নিমন্ত্রণ করেছিল। বলল, ডিনারটার সসের দাম হাজার রুল’, সবাই তাঁর কথা শুনছেন টের পেয়ে উচ্চকণ্ঠে বললেন প্রিন্সেস মিয়াঙ্কায়া, ‘কিন্তু অতি ভারি বিছ্‌ছিরি সস, কেমন সবজেটে। ওদেরও ডাকতে হয় তো, আমি সস বানালাম পঁচাশি কোপেকে, সবাই ভারি খুশি। হাজার- রুলী সস বানানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

কর্ত্রী বললেন, ‘এ শুধু মিয়াগ্‌কায়াই পারেন!’

‘আশ্চর্য!’ কে যেন মন্তব্য করলেন।

প্রিন্সেস মিয়াগ্‌কায়ার উক্তিতে সব সময়ই প্রভাব পড়ত একই রকম, আর সে প্রভাবের গোপন রহস্য এই যে এখনকার মত বিশেষ প্রাসঙ্গিক না হলেও বলতেন সহজ কথা যার অর্থ আছে। যে সমাজে তাঁর চলাফেরা, সেখানে এমন কথায় ফল হত অতি সুরসিক টিপ্পনির মত। প্রিন্সেস মিয়াকায়া বুঝতে পারতেন না কেন তাঁর কথা এমন প্রভাব ফেলছে, কিন্তু জানতেন যে ফেলছে এবং সেটা কাজে লাগাতেন।

প্রিন্সেস মিয়াগ্‌কায়া যখন কথা বলছিলেন তখন সবাই তা শুনছিলেন এবং রাষ্ট্রদূতপত্নীর ওখানে আলাপ থেমে গিয়েছিল বলে গৃহস্বামিনী চাইলেন গোটা সমাজকে একজায়গায় জড়ো করতে, রাষ্ট্রদূতপত্নীকে তিনি বললেন, ‘সত্যিই আপনার আর চা লাগবে না? আমাদের এখানে আপনারা উঠে এলে পারেন।’

‘না-না, আমরা এখানে বেশ আছি’, হেসে জবাব দিলেন রাষ্ট্রদূতপত্নী এবং যে আলোচনাটা শুরু হয়েছিল তা চালিয়ে গেলেন।

আলোচনাটা খুবই প্রীতিকর। স্বামী-স্ত্রী কারেনিনদের নিন্দে হচ্ছিল।

‘মস্কো থেকে ফেরার পর আন্না অনেক বদলে গেছে। কি একটা অদ্ভুত জিনিস ঘটেছে ওর ভেতর’, বলছিলেন আন্নার বান্ধবী।

‘প্রধান বদলটা এই যে উনি আলেকসেই ভ্রন্‌স্কির ছায়াকে সাথে নিয়ে এসেছেন’, বললেন রাষ্ট্রদূত পত্নী।

‘তাতে কি? গ্রিমের একটা উপকথায় আছে : একটা লোকের ছায়া নেই, ছায়া সে হারিয়েছে; কিসের জন্য যেন এটা তার শাস্তি। আমি কখনো বুঝতে পারিনি শাস্তিটা কেন। কিন্তু নারীর পক্ষে ছায়া না থাকাটা ভালো লাগার কথা নয়।’

‘তা ঠিক, কিন্তু যে নারীর পেছনে ছায়া থাকে, সাধারণত তার পরিণাম হয় খারাপ’, বললেন আন্নার বান্ধবী। এ কথা কানে যেতে হঠাৎ বলে উঠলেন প্রিন্সেস মিয়াঙ্কায়া, ‘জিব আপনার খসে পড় ক। কারেনিনা চমৎকার লোক। ওঁর স্বামীকে আমার ভালো লাগে না কিন্তু ওঁকে ভারি ভালোবাসি।’

রাষ্ট্রদূতপত্নী বললেন, ‘কেন ভালোবাসেন না স্বামীকে? অতি সজ্জন লোক। আমার স্বামী বলেন, এরকম রাজপুরুষ ইউরোপে কমই আছে।’

‘আমার স্বামীও আমাকে তাই বলেছেন, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না’, বললেন প্রিন্সেস মিয়াগ্‌কায়া, ‘আমাদের স্বামীরা ওসব না বললে আমরা দেখতে পেতাম ব্যাপারটা সত্যিই কি। আমার মতে কিন্তু আলেকসেই আলেক্‌সান্দ্রিভিচ কারেনিন একটা বোকার হদ্দ। আমি এটা চুপি চুপি বলছি… কিন্তু সব পরিষ্কার হয়ে উঠছে তা কি সত্যি নয়? আগে যখন ওঁকে বুদ্ধিমান বলে ভাবতে আমাকে বলা হয়, আমি তন্ন তন্ন করে সব দেখেশুনে বুঝলাম আমিই বোকা, কেননা ওঁর মধ্যে বুদ্ধি কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। তারপর যেই আমি চুপি চুপি বললাম, উনি বোকা, অমনি সব পরিষ্কার হয়ে গেল, তাই না?’

‘আজ আপনি ভারি খাপ্পা।

‘একটুও না। আমার যে গত্যন্তর নেই। আমাদের দুজনের মধ্যে কেউ-একজন তো বোকা। আর জানেন তো, নিজের সম্পর্কে ও-কথা কখনো বলা চলে না।’

‘কেউ নিজের অবস্থায় খুশি নয়, কিন্তু সবাই খুশি নিজের বুদ্ধিতে’, ফরাসি কবিতা উদ্ধৃত করলেন কূটনীতিক।

‘যা বলেছেন’, তাড়াতাড়ি তাঁর দিকে ফিরলেন প্রিন্সেস মিয়াগ্‌কায়া, ‘তবে আসল কথা, আন্নাকে আমি আপনার কবলে ছেড়ে দিচ্ছি না। ভারি ভালো, মিষ্টি মেয়ে। সবাই যদি তাঁর প্রেমে পড়ে যায়, ছায়ার মত পিছু নেয় তাঁর, কি তিনি করবেন?’

‘আমিও তার দোষ ধরার কথা ভাবছিও না’, আত্মসমর্থন করলেন আন্নার বান্ধবী।

‘কেউ যদি ছায়ার মত আমাদের পিছু না নেয়, তার মানে এই নয় যে অন্যের সমালোচনা করার অধিকার আমাদের আছে।’

আন্নার বান্ধবীকে উচিতমত দাবড়ি দিয়ে প্রিন্সেস মিয়াকায়া উঠে দাঁড়ালেন এবং যে টেবিলে সাধারণ আলাপ চলছিল প্রাশিয়ার রাজাকে নিয়ে, রাষ্ট্রদূতপত্নীর সাথে গিয়ে যোগ দিলেন তাতে।

বেত্‌সি বললেন, ‘ওখানে আপনাদের কি পরচর্চা হচ্ছিল?’

‘কারেনিনদের নিয়ে। প্রিন্সেস আলেক্সেই আলেক্‌সান্দ্রভিচ কারেনিনের মূল্যায়ন করেছেন’, হেসে আসন নিয়ে বললেন রাষ্ট্রদূতপত্নী।

‘দুঃখের কথা যে শুনতে পেলাম না’, প্রবেশদ্বারের দিকে তাকিয়ে বললেন গৃহস্বামিনী। ‘আরে, শেষ পর্যন্ত এলেন তাহলে!’ আগন্তুক ভ্রন্‌স্কিকে তিনি হেসে বললেন।

ভ্রন্‌স্কি শুধু সবার সাথে পরিচিত তাই নয়, এখানে যাঁদের তিনি দেখলেন, নিত্য তাঁদের সাথে দেখা হয় তাঁর, তাই যাদের এইমাত্র ছেড়ে গিয়েছে তাদের কাছে যে অনায়াস ভঙ্গিতে লোকে ফেরে সেভাবে ভ্রন্‌স্কি ভেতরে ঢুকলেন। ‘কোত্থেকে আসছি?’ রাষ্ট্রদূত পত্নীর প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘কি করা যাবে, কবুল করতেই হচ্ছে। বুফ অপেরা থেকে। মনে হচ্ছে শতবার গেছি, কিন্তু প্রতিবারেই পেয়েছি নতুন আনন্দ। অপূর্ব! জানি এটা লজ্জার কথা : অপেরায় আমার ঘুম পায়, কিন্তু বুক অপেরাগুলোয় আমি শেষ মিনিট পর্যন্ত বসে থাকি এবং খুশি হয়ে। যেমন আজকে…’

উনি ফরাসি অভিনেত্রীর নাম করে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রদূতপত্নী সরস সভয়ে বাধা দিলেন : ‘ওই ভয়াবহ কাণ্ডটার কথা বলবেন না দয়া করে!

‘বেশ, বলব না, বিশেষ করে এই ভয়াবহতাটা যখন সকলেরই জানা।’

‘এবং অপেরার মত মনোহর হলে সবাই আমরা সেখানে যেতাম’, খেই ধরে বললেন প্রিন্সেস মিয়াকায়া।

সাত

দরজায় পায়ের আওয়াজ শোনা গেল, সেটা যে ম্যাডাম কারেনিনার তা জানা থাকায় প্রিন্সেস বেত্‌সি তাকালেন ভ্রন্‌স্কির দিকে। ভ্রন্‌স্কি দরজার দিকে তাকালেন, মুখে তাঁর একটা নতুন বিচিত্র ভাব ফুটে উঠল। যিনি এলেন, তাঁর দিকে তিনি সানন্দে, একদৃষ্টে, সেই সাথে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে রইলেন। আসন থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। ড্রয়িং- রুমে ঢুকলেন আন্না। দৃষ্টিপাত না বদলে, বরাবরের মত খাড়া দাঁড়িয়ে, উঁচু সমাজের অন্যান্য নারীর চলন থেকে আলাদা তাঁর দ্রুত, দৃঢ়, লঘু কয়েকটা পদক্ষেপে গৃহস্বামিনীর কাছ থেকে তাঁর দূরত্বটা উত্তীর্ণ হয়ে তাঁর করমর্দন করলেন তিনি এবং সেই হাসি নিয়েই তাকালেন ভ্রন্‌স্কির দিকে। ভ্রন্‌স্কি অনেকখানি মাথা নুইয়ে তাঁর দিকে চেয়ার এগিয়ে দিলেন।

আন্না শুধু মাথা নুইয়ে তার প্রত্যুত্তর দিলেন এবং লাল হয়ে উঠে ভুরু কোঁচকালেন। কিন্তু সাথে সাথেই পরিচিতদের উদ্দেশে দ্রুত মাথা নেড়ে এবং এগিয়ে দেওয়া হাতে চাপ দিয়ে তিনি কর্ত্রীকে বললেন, ‘কাউন্টেস লিদিয়ার কাছে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আগেই আসব কিন্তু বসে থাকতে হল। ওখানে ছিলেন স্যার জন। ভারি আকর্ষণীয় লোক।’

‘ও, সেই মিশনারি?’

‘হ্যাঁ, ভারতীয় জীবন সম্পর্কে উনি খুব আগ্রহ জাগাবার মত গল্প করছিলেন।

তাঁর আগমনে ছিন্ন আলাপ ফুঁ দিয়ে নেবানো দীপশিখার মত আবার দপদপিয়ে উঠল।

‘স্যার জন! হ্যাঁ, স্যার জন। আমি ওঁকে দেখেছি। কথা বলেন চমৎকার। ম্যাডাম ভ্লাসিয়েভা একেবারে তাঁর প্রেমে পড়ে গিয়েছেন। ‘

‘আচ্ছা, ভ্লাসিয়েভার ছোট মেয়ে নাকি তপোভকে বিয়ে করছে, সত্যি?’

‘হ্যাঁ, শুনেছি এটা একেবারে স্থির হয়ে গেছে।’

‘ওর বাপ-মায়ের কথা ভেবে আমার অবাক লাগে। লোকে বলে, এটা নাকি প্রণয়ঘটিত বিয়ে।’

‘প্রণয়ঘটিত? কি মান্ধাতা আমলের ধারণা আপনার! প্রণয়ের কথা আজকাল কে বলে?’ বলেন রাষ্ট্রদূত পত্নী।

‘কি করা যাবে? এই নির্বোধ সাবেকী রীতিটা এখনো অচল হয়ে যাচ্ছে না’, বললেন ভ্রন্‌স্কি।

‘এ রীতিটা যারা আঁকড়ে থাকে তাদের কপাল খারাপ। শুধু কাণ্ডজ্ঞান থেকে বিয়েই আমি দেখেছি সুখী।’

‘তা ঠিক, তবে যে প্রণয়কে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না, ঠিক তার আবির্ভাবেই কাণ্ডজ্ঞানের বিয়ে ধূলিসাৎ হয়ে যায় কত বারবার’, ভ্রন্‌স্কি বললেন।

কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানের বিয়ে আমরা তাকে বলি যখন উভয় পক্ষই তাদের পাগলামির পালা শেষ করেছে। ওটা স্কার্লেট জ্বরের মত, কাটিয়ে উঠতে হয়।’

‘বসন্তের টীকা দেবার মত করে কৃত্রিমভাবে প্রণয় জাগাবার টীকা দেওয়াও শিখতে হবে তাহলে।’

প্রিন্সেস মিয়াকায়া বললেন, ‘অল্প বয়সে আমি আমাদের পাদ্রীর প্রেমে পড়েছিলাম। জানি না এতে আমার লাভ হয়েছে কিনা।’

‘না, আমার ধারণা, ঠাট্টা নয়, প্রেম কি জানতে হলে ভুল করা এবং পরে তা শুধরে নেওয়া দরকার’, বললেন প্রিন্সেস বেত্‌সি।

‘এমনকি বিয়ের পরেও?’ রসিকতা করে বললেন রাষ্ট্রদূত পত্নী।

ইংরেজি প্রবচন উদ্ধৃত করে কূটনীতিক বললেন, ‘অনুতাপের সময় কখনো ফুরিয়ে যায় না।’

বেত্‌সি খেই ধরে বললেন, ‘ঠিক এই জন্যই দরকার ভুল করা এবং শোধরানো। আপনি কি মনে করেন?’ উনি জিজ্ঞেস করলেন আন্নাকে, যিনি ঠোঁটে সামান্য লক্ষণীয় স্থির হাসি নিয়ে এই কথাবার্তাটা শুনছিলেন।

‘আমার মনে হয়’, খুলে ফেলা দস্তানা নাড়াচাড়া করতে করতে আন্না বললেন, ‘আমার মনে হয়… যতগুলো মাথা, মনও যদি ইয় ততগুলো, তাহলে যতগুলো হৃদয়, ভালোবাসাও হবে তত রকমের।’

আন্না কি বলেন তার জন্য উদ্বিগ্ন বুকে তাঁর দিকে চেয়েছিলেন ভ্রন্‌স্কি। আন্নার এই কথাগুলো শুনে তিনি হাঁফ ছাড়লেন যেন একটা বিপদ কাটিয়ে উঠেছেন।

হঠাৎ তাঁর দিকে তাকালেন আন্না : ‘মস্কো থেকে চিঠি পেয়েছি। লিখেছে যে কিটি শ্যেরবাৎস্কায়া খুব অসুস্থ।’

‘তাই নাকি?’ ভুরু কুঁচকে ভ্রন্‌স্কি বললেন।

কঠোর দৃষ্টিতে আন্না তাকালেন তাঁর দিকে।

‘এতে আপনার কোন আগ্রহ নেই?’

‘বরং উল্টো, অত্যন্ত আগ্রহী, জানতে পারি কি ঠিক কি আপনাকে লিখেছে?’

আন্না উঠে দাঁড়িয়ে বেত্‌সির কাছে গেলেন।

তাঁর চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এক কাপ চা দিন।’

প্রিন্সেস বেত্‌সি যখন চা ঢালছিলেন, ভ্রন্‌স্কি এলেন আন্নার কাছে।

‘কি আপনাকে লিখেছে?’ আবার জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘আমার প্রায়ই মনে হয় যে পুরুষেরা বোঝে না কোনটা অনুদার যদিও প্রায়ই বলে থাকে সে কথা’, ভ্রন্‌স্কির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আন্না বললেন। ‘আমি অনেকদিন থেকে আপনাকে বলব ভাবছিলাম’, কয়েক পা এগিয়ে কোণের একটা অ্যালবাম টেবিলের কাছে বসে তিনি যোগ করলেন।

ভ্রন্‌স্কি তাঁকে চায়ের কাপ দিয়ে বললেন, ‘আপনার কথার অর্থ ঠিক ধরতে পারছি না।’

আন্না সোফায় তাঁর পাশে দৃষ্টিপাত করলেন, ভ্রন্‌স্কিও তৎক্ষণাৎ বসলেন সেখানে।

তাঁর দিকে না তাকিয়ে আন্না বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনাকে বলতে চাইছিলাম, আপনি খারাপ কাজ করেছেন, খারাপ, অত্যন্ত খারাপ।’

‘আমি কি জানি না যে কাজটা খারাপ হয়েছে? কিন্তু অমন যে হল তার কারণ কে?’

‘এ কথা আমাকে বলছেন কেন?’ কঠোর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আন্না বললেন।

‘আপনি জানেন কেন’, অসংকোচে, সানন্দে জবাব দিলেন ভ্রন্‌স্কি, চোখ না নামিয়ে গ্রহণ করলেন তাঁর দৃষ্টি।

ভ্রন্‌স্কি নন, আন্নাই থতমত খেলেন।

‘এতে শুধু প্রমাণ হয় যে আপনার হৃদয় বলে কিছু নেই’, আন্না বললেন। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি বলছিল, ওঁর যে হৃদয় আছে সেটা তিনি জানেন আর সেই জন্য ভয় করেন তাঁকে।

‘আপনি এখন যে কথাটা বললেন ওটা ভ্রম, ভালোবাসা নয়।’

‘মনে রাখবেন যে ঐ শব্দটা, ঐ অমানুষিক শব্দটা উচ্চারণ করতে আমি আপনাকে মানা করেছি’, আন্না বললেন কেঁপে উঠে; কিন্তু তৎক্ষণাৎ টের পেলেন যে ‘বারণ করেছি’ এই একটা কথাতেই ওঁর ওপর নিজের খানিকটা অধিকার তিনি স্বীকার করে নিচ্ছেন এবং তাতে করে ভালোবাসার কথা বলতে উৎসাহিত করছেন ওঁকে। ‘অনেকদিন থেকে আপনাকে বলব ভাবছিলাম’, দৃঢ়ভাবে ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ দগ্ধানো লালিমায় আরও রাঙা হয়ে তিনি বলে গেলেন, ‘আজ ইচ্ছে করেই আমি এখানে এসেছি আপনার দেখা পাব জেনে। এলাম আপনাকে বলতে যে এটা শেষ হয়ে যাওয়া উচিত। কারো সামনে আমাকে কখনো লাল হয়ে উঠতে হয়নি অথচ কিসের জন্য যেন নিজেকে অপরাধী বলে ভাবতে আপনি আমাকে বাধ্য করছেন।’

ভ্রন্‌স্কি ওঁর দিকে তাকিয়ে অভিভূত হলেন তাঁর মুখের নতুন একটা আত্মিক লাবণ্যে।

‘আমাকে কি করতে বলেন?’ সহজভাবে গুরুত্বসহকারে জিজ্ঞেস করলেন ভ্রন্‌স্কি।

আন্না বললেন, ‘আমি চাই যে আপনি মস্কোয় গিয়ে কিটির কাছে ক্ষমা চাইবেন।’

ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘সেটা আপনি চান না।’

তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে আন্না যা চাইছেন সেটা নয়, জোর করে নিজেকে দিয়ে যা বলাচ্ছেন সেটাই বলছেন। ‘আমাকে যদি আপনি ভালোবাসেন যা আপনি বলছেন’, আন্না বললেন ফিসফিসিয়ে, ‘তাহলে এমন করুন যাতে আমি শান্তিতে থাকি।’

ভ্রন্‌স্কির মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল।

‘আপনি কি জানেন না যে আমার কাছে আপনিই আমার গোটা জীবন, কিন্তু শান্তি আমার নেই, আপনাকে তা দিতেও পারব না। আমার গোটাটাই, ভালোবাসা—হ্যাঁ। আমি আপনাকে আর নিজেকে পৃথক বলে ভাবতে পারি না। আমার কাছে আপনি আর আমি একই। আর ভবিষ্যতে শান্তির কোন সম্ভাবনা আমি দেখতে পাচ্ছি না; আপনার জন্য ও নয়, আমার জন্যও নয়, আমি দেখতে পাচ্ছি কেবল নিরাশার, দুঃখের সম্ভাবনা… অথবা দেখছি সুখের সম্ভাবনা, আহ্ কি সে সুখ! সে কি সম্ভব নয়?’ এই কথাটা তিনি বললেন শুধু তাঁর ঠোঁট নেড়ে, কিন্তু আন্না শুনতে পেলেন।

যা উচিত সেটা বলার জন্য চিত্তের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করলেন আন্না, কিন্তু তার বদলে প্রেমাকুল দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন ভ্রন্‌স্কির ওপর এবং কিছুই বললেন না।

‘এই তো!’ সোল্লাসে ভ্রন্‌স্কি ভাবলেন, ‘যখন আমি একেবারে হতাশ হয়ে উঠেছি, যখন মনে হচ্ছিল এর বুঝি আর শেষ নেই, তখন এই তো! আমাকে ও ভালোবাসে। সেটা ও স্বীকার করছে।’

‘তাহলে আমার জন্য এটা করুন, আর কখনো বলবেন না ঐ সব কথা, ভালো বন্ধু হয়ে থাকব আমরা’, মুখে এই কথা বললেন আন্না, কিন্তু ভিন্ন কথা বলছিল তাঁর চোখ।

‘বন্ধু আমরা হব না, আপনি নিজেই তা জানেন। কিন্তু আমরা সবচেয়ে সুখী নাকি সবচেয়ে দুঃখী লোক হব, সেটা আপনার আয়ত্তে।’

কি একটা বলতে যাচ্ছিলেন আন্না, কিন্তু ভ্রন্‌স্কি বাধা দিলেন।

‘আমি তো শুধু একটা জিনিস চাইছি। আশা করার, এখনকার মত কষ্ট পাবার অধিকার। কিন্তু তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে আমাকে উধাও হতে বলুন, আমি তাই হব। আমার উপস্থিতি যদি আপনার দুঃসহ লাগে, তাহলে আমাকে আর কখনো দেখতে পাবেন না আপনি।’

‘আপনাকে কোথাও তাড়িয়ে দিতে আমি চাই না।’

‘শুধু কিছুই যেন বদলাবেন না। যেমন আছে, তেমনিই সব থাক’, কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন ভ্রন্‌স্কি, ‘ঐ যে আপনার স্বামী।

সত্যিই এই সময় তাঁর শান্ত বিদঘুটে চলনে ড্রয়িং-রুমে ঢুকলেন কারেনিন।

স্ত্রী আর ভ্রন্‌স্কির দিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি গেলেন কর্ত্রীর কাছে, এক কাপ চায়ের সামনে বসে ধীর-স্থির, সব সময় যা শ্রুতিভেদী, তাঁর সেই গলায় বরাবরকার মত রহস্যের সুরে কাকে নিয়ে যেন ঠাট্টা করতে লাগলেন।

গোটা সমাজের ওপর চোখ বুলিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনার রামবুলিয়ে সালোঁ একেবারে জমজমাট। সমস্ত রূপদেবী আর কলালক্ষ্মীই বিরাজমান।’

কিন্তু প্রিন্সেস বেত্‌সি তাঁর এই সুর, যাকে তিনি অবজ্ঞাসূচক ইংরেজিতে বলতেন sneerIng তা সইতে পারতেন না, বুদ্ধিমতী গৃহকর্ত্রী হওয়ায় তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁকে টেনে আনলেন বাধ্যতামূলক সৈন্যভুক্তির গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায়। কারেনিনও অমনি কথোপকথনে মেতে উঠে গুরুত্বসহকারেই নতুন আদেশটা সমর্থন করতে লাগলেন, যাকে আক্রমণ করছিলেন প্রিন্সেস বেত্‌সি।

ভ্রন্‌স্কি আর আন্না বসেই রইলেন ছোট টেবিলটার কাছে।

ভ্রন্‌স্কি, আন্না এবং তাঁর স্বামীর দিকে ইঙ্গিত করে জনৈক মহিলা ফিসফিস করলেন, ‘এটা অশোভন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’

‘কি বলেছিলাম আমি?’ জবাব দিলেন আন্নার বান্ধবী।

কিন্তু শুধু এই মহিলারাই নয়, ড্রয়িং-রুমে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সকলেই, এমন কি প্রিন্সেস মিয়াকায়া এবং স্বয়ং বেত্‌সিও বারকয়েক করে তাকিয়ে দেখছিলেন সাধারণ চক্র থেকে সরে যাওয়া ঐ দুজনের দিকে, এ চক্রটায় যেন ব্যাঘাত হচ্ছিল তাঁদের। শুধু কারেনিন সেদিকে একবারও তাকালেন না, যে আলাপটা শুরু হয়েছিল, বিচ্যুত হলেন না তার আকর্ষণ থেকে।

সবার ওপরেই একটা অপ্রীতিকর ছাপ পড়ছে লক্ষ্য করে প্রিন্সেস বেত্‌সি, কারেনিনর কথা শুনে যাবার জন্য তাঁর নিজের জায়গায় আরেকজনকে বসিয়ে গেলেন আন্নার কাছে।

বললেন, ‘আপনার স্বামীর কথায় স্পষ্টতা আর যথাযথতা আমাকে সব সময়ই অবাক করে দেয়। উনি যখন বলেন, সবচেয়ে তূরীয় ব্যাপারগুলোও তখন বোধগম্য হয়ে ওঠে আমার কাছে। ‘

‘ও, হ্যাঁ!’ সুখের হাসিতে জ্বলজ্বল করে উঠে এবং বেত্‌সি যা বলছিলেন তার একটা কথাও না বুঝে আন্না বললেন। বড় টেবিলটায় উঠে এলেন তিনি, যোগ দিলেন সাধারণ কথাবার্তায় 1

কারেনিন আধঘণ্টাখানেক থেকে স্ত্রীর কাছে এসে তাঁর সাথে বাড়ি যেতে বললেন, তাঁর দিকে না তাকিয়েই আন্না জবাব দিলেন যে নৈশাহারের জন্য তিনি থেকে যাবেন। কারেনিন মাথা নুইয়ে বেরিয়ে গেলেন।

ম্যাডাম কারেনিনার কোচোয়ান, স্থূলকায় বৃদ্ধ তাতারের পক্ষে গেটের কাছে ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া বাঁয়ের ছাইরঙা ঘোড়াটাকে সামলে রাখা কঠিন হচ্ছিল। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল চাপরাশি, খানসামা দাঁড়িয়ে ছিল বাইরের দরজাটা ধরে। ছোট্ট ক্ষিপ্র হাতে তাঁর ফারকোটের হুকে আটকে যাওয়া আস্তিনের লেস ছাড়াতে ছাড়াতে মাথা নিচু করে উৎফুল্ল হয়ে আন্না শুনছিলেন তাঁকে গাড়িতে তুলে দিতে এসে যা বলছিলেন ভ্রন্‌স্কি।

তিনি বলছিলেন, ‘আপনি কিছু বললেন না; ধরা যাক আমিও কিছু দাবি করছি না, কিন্তু আপনি তো জানেন, বন্ধুত্বে আমার কাজ নেই, জীবনের একটা সুখই আমার পক্ষে সম্ভব, এটা সেই শব্দ যা আপনার এত অপছন্দ… হ্যাঁ, ভালোবাসা…’

‘ভালোবাসা…’, ধীরে ধীরে, আভ্যন্তরীণ কোন কণ্ঠস্বরে পুনরুক্তি করলেন আন্না, তারপর হঠাৎ হুকটা ছাড়ানো মাত্র তিনি যোগ দিলেন, ‘কথাটা আমি ভালোবাসি না কারণ ওর তাৎপর্য আমার কাছে বড় বেশি, আপনার পক্ষে যা বোঝা সম্ভব তার চেয়েও অনেক’, তারপর ওঁর মুখের দিকে তাকালেন তিনি, ‘আসি!’

ওঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন আন্না। তারপর শান্ত পদক্ষেপে খানসামার পাশ দিয়ে অন্তর্ধান করলেন গাড়ির ভেতরে।

তাঁর দৃষ্টিপাত, হাতের স্পর্শ যেন আগুন ছুঁইয়ে দিল ভ্রন্‌স্কির দেহে। তাঁর হাতের যেখানটা আন্না স্পর্শ করেছিলেন, সেখানে চুমু খেলেন তিনি, তারপর সুখাবেশে এই চেতনা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন যে গত দু’মাসে যা হয়েছে তার চেয়ে তাঁর লক্ষ্যের অনেক কাছাকাছি তিনি এসে গিয়েছেন আজ সন্ধ্যায়।

আট

ভ্রন্‌স্কির সাথে তাঁর স্ত্রী আলাদা একটা ছোট টেবিলের কাছে বসে কি নিয়ে যেন সজীব কথাবার্তা বলছিলেন, এতে আলেকসেই আলেক্‌সান্দ্রভিচ কারেনিন অস্বাভাবিক বা অশোভন কিছু দেখেননি; কিন্তু তাঁর নজরে পড়েছিল যে ড্রয়িং- রুমের অন্যান্যদের কাছে এটা কেন জানি অস্বাভাবিক এবং অশোভন ঠেকেছিল, সুতরাং তাঁর কাছেও এটা মনে হল অশোভন। ঠিক করলেন, স্ত্রীকে সে কথা বলা দরকার।

কারেনিন বাড়ি ফিরে তাঁর কেবিনেটে ঢুকলেন, যা তিনি সাধারণ করে থাকেন, ইজি-চেয়ারে বসে পোপতন্ত্র সম্পর্কে একটা বইয়ের কাগজ-কাটা ছুরি চাপা দেওয়া জায়গাটা খুললেন এবং পড়ে গেলেন রাত একটা পর্যন্ত যা তাঁর অভ্যাস; শুধু মাঝে-মধ্যে তাঁর টিপ কপালখানা মুছে, মাথা ঝাঁকিয়ে কি একটা যেন তাড়াতে চাইছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে উঠে তিনি তাঁর নৈশ প্রসাধন সারলেন। আন্না তখনো ফেরেননি। বই বগলে করে ওপরে উঠলেন তিনি; কিন্তু তাঁর কর্মক্ষেত্রের ব্যাপার নিয়ে অভ্যস্ত ভাবনা ও পরিকল্পনাদির বদলে আজ রাতে তাঁর মন ভরে ছিল স্ত্রীর ভাবনায়, কি- একটা অপ্রীতিকর তাঁর ঘটেছে তাই নিয়ে। নিজের অভ্যাসের যা বিপরীত বিছানায় তিনি শুলেন না, পিঠের পেছনে হাতে হাত দিয়ে পায়চারি করতে লাগরেন ঘরগুলোয়। উনি শুতে পারছিলেন না, টের পাচ্ছিলেন, যে-অবস্থাটার উদ্ভব হয়েছে, সবার আগে তা নিয়ে ভাবা দরকার।

কারেনিন যখন নিজেই ঠিক করে নেন যে স্ত্রীর সাথে কথা বলা দরকার, তখন জিনিসটা তাঁর কাছে সহজ এবং সাধারণ মনে হয়েছিল; কিন্তু এখন এই নবোদ্ভূত অবস্থাটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে ব্যাপারটা তাঁর কাছে খুবই কঠিন আর জটিল মনে হল।

কারেনিন ঈর্ষাপরায়ণ লোক নন। তাঁর ধারণা ছিল ঈর্ষাকে স্ত্রীকে অপমান করা হয়, অথচ স্ত্রীর প্রতি আস্থা থাকা উচিত। কেন আস্থা, অর্থাৎ পরিপূর্ণ এই নিশ্চিতি পোষণ করা উচিত যে তাঁর যুবতী বধূ সব সময় তাঁকে ভালোবেসে যাবে, এ প্রশ্ন তিনি নিজেকে কখনো করেননি; কিন্তু অনাস্থা তিনি রাখেননি কখনো, তাই আস্থাই রাখাতেন এবং নিজেকে বলতেন তাঁর আস্থা রাখা উচিত। এখন কিন্তু ঈর্ষা যে একটা লজ্জাকর মনোভাব, আর আস্থা রাখা উচিত তাঁর এ প্রত্যয় ভেঙে না পড়লেও অনুভব করছিলেন কেমন একটা অযৌক্তিক আর অবোধগম্য জিনিসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন এবং ভেবে পাচ্ছিলেন না কি করবেন।

কারেনিন এসে দাঁড়িয়েছেন জীবনের মুখোমুখি, তাঁকে ছাড়া স্ত্রী অপর কাউকে ভালোবাসতে পারে এই সম্ভাবনার মুখোমুখি, এবং এটা তাঁর কাছে হয়ে দাঁড়াল অতি অর্থহীন আর দুর্বোধ্য, কেননা খোদ জীবনই হল এটা। সারা জীবন কারেনিন কাটিয়েছেন এবং কাজ করেছেন কাজকর্মচারীদের মধ্যে জীবনের প্রতিফলন নিয়ে যাদের কারবার। যখনই খোদ জীবনের মুখোমুখি হয়েছেন, ততবারই তা থেকে সরে এসেছেন। এখন তাঁর সেইরকম একটা বোধ হল হয় যখন কোন লোক অতল গহ্বরের ওপরকার সেতু দিয়ে নিশ্চিন্তে যেতে যেতে হঠাৎ দেখে যে সেতুটা ভেঙে পড়েছে, ঘূর্ণিজল দেখা দিয়েছে সেখানে। ঘূর্ণিজলটাই আসল জীবন, কারেনিন যে কৃত্রিম জীবন কাটিয়েছেন সেতুটা হল তাই। অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারা তাঁর স্ত্রীর পক্ষে সম্ভব, এ প্রশ্ন তাঁর সামনে দেখা দিল এই প্রথম, তাতে আতংক হল তাঁর।

পোশাক না ছেড়ে সমতাল পদক্ষেপে উনি পায়চারি করছিলেন একটামাত্র বাতিতে আলোকিত খাবার ঘরের শব্দিত পার্কেটে, অন্ধকার ড্রয়িং-রুমের গালিচার ওপর দিয়ে, যেখানে আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল কেবল সোফার ওপরে টাঙানো সম্প্রতি আঁকানো তাঁরই বৃহৎ পোর্ট্রেটটায়, গেলেন আন্নার কেবিনেট পেরিয়ে, সেখানে দুটো মোমবাতির আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আন্নার বান্ধবী আর আত্মীয়-স্বজনের প্রতিকৃতি, লেখার টেবিলে তাঁর বহুপরিচিত সুন্দর সুন্দর আভরণ। সে ঘর পেরিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন শোবার ঘরের দরজা পর্যন্ত, তারপর আবার ফিরছিলেন।

প্রত্যেকটা পাড়ির শেষে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আলোকিত ডাইনিং-রুমের পার্কেটের ওপর তিনি থামছিলেন, মনে মনে বলছিলেন, ‘হ্যাঁ, এটার একটা সমাধান করা উচিত, বন্ধ করা দরকার, নিজের অভিমত দিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে হবে।’ তারপর ফিরছিলেন। ‘কিন্তু কি অভিমত? কিসের সিদ্ধান্ত?’ ড্রয়িং-রুমে নিজেকে তিনি বললেন কিন্তু কোন উত্তর খুঁজে পেলেন না। ‘হ্যাঁ’, কেবিনেটে ঢোকার মুখে ভাবলেন, ‘শেষ পর্যন্ত ঘটেছে-টা কি? অনেকক্ষণ ধরে আন্না কথা বলেছে ওর সাথে। কিন্তু কি হল তাতে? সমাজে নারীরা তো কতরকম লোকের সাথেই কথা বলে থাকে। তা ছাড়া, ঈর্ষা করার অর্থ ওকে আমাকে, দুজনকেই হীন করা’, আন্নার কেবিনেটে ঢুকে তিনি নিজেকে বোঝালেন। কিন্তু এ যুক্তি আগে তাঁর কাছে বেশ ভারিক্কি বোধ হলেও এখন তার আর কোন ভার ছিল না, অর্থ ছিল না। শোবার ঘরের দরজা থেকে তিনি আবার এলেন হলে; কিন্তু, যেই তিনি পেছন ফিরে ঢুকলেন অন্ধকার ড্রয়িং-রুমে, অমনি কি একটা কণ্ঠস্বর তাঁকে বলল ওটা ঠিক নয়, যখন অন্য লোকেদের নজরে পড়েছে, তখন কিছু একটা আছে। ডাইনিং- রুমে তিনি আবার নিজেকে বললেন, ‘হ্যাঁ, এটার একটা সমাধান করে, বন্ধ করে নিজের অভিমত দেওয়া দরকার…’ এবং পুনরায় ড্রয়িং-রুমে মোড় ফেরার সময় উনি নিজেকে বললেন : কি করে সমাধান করা যায়? পরে নিজেকে প্রশ্ন করলেন, কি ঘটেছে? এবং জবাব দিলেন : কিছুই না, স্মরণ করলেন যে ঈর্ষা হল স্ত্রীর পক্ষে অপমানকর একটা মনোভাব, কিন্তু ড্রয়িং-রুমে আবার নিশ্চিত হয়ে উঠলেন যে ঘটেছে কিছু একটা। তাঁর দেহের মত ভাবনাও নতুন কিছুতে উপনীত না হয়ে পাক খাচ্ছিল একই বৃত্তে। সেটা তাঁর খেয়াল হল, কপাল রগড়ে তিনি বসলেন আন্নার কেবিনেটে।

এমন সময় তাঁর টেবিলে ম্যালাকাইট লিখন-সরঞ্জাম আর শুরু করা একটা চিরকুটের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বদলে গেল তাঁর চিন্তা। আন্না সম্পর্কে, কি তিনি ভাবেন, অনুভব করেন, সে নিয়ে ভাবনা হল তাঁর। এই প্রথম স্পষ্ট করে তাঁর কল্পনায় ভেসে উঠল আন্নার ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর ভাবনাচিন্তা, তাঁর আকাঙ্ক্ষা, আর ওঁর যে নিজস্ব একটা জীবন থাকতে পারে, থাকার কথা, এ কথা ভেবে তাঁর এত ভয় হল যে তিনি তাড়াতাড়ি করে সে চিন্তা তাড়াতে চাইলেন। এটা সেই ঘূর্ণিজল যেখানে তাকাতে তাঁর আতঙ্ক হয়। মনে মনে এবং অনুভূতিতে অন্য একজনের স্থলে নিজেকে বসানো, এমন একটা আত্মিক উদ্যোগ কারেনিনের কাছে বিজাতীয়। এরূপ আত্মিক উদ্যোগকে তিনি মনে করতেন ক্ষতিকর, বিপজ্জনক কল্পচারিতা।

তিনি ভাবলেন, ‘সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার এই যে এখন, আমার ব্যাপারটা যখন ঢুকতে চলেছে’ (যে প্রকল্পটা তিনি এখন পাশ করিয়ে নিতে যাচ্ছিলেন, তাঁর কথা ভাবছিলেন তিনি) ‘যখন আমার দরকার একান্ত শান্তি আর প্রাণের সমস্ত শক্তি, এখনই কিনা আমার ওপর ভেঙে পড়ল এই অর্থহীন উদ্বেগ। কিন্তু কি করি? আমি তেমন লোক নই যে অস্থিরতা আর উদ্বেগে ভোগে অথচ সোজাসুজি তাকাবার শক্তি ধরে না।’

‘আমাকে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং চুকিয়ে দিতে হবে’; তিনি বললেন শব্দ করেই।

‘ওর হৃদয়াবেগের প্রশ্ন, কি তার অন্তরে ঘটেছে এবং ঘটতে পারে, সেটা আমার নয়, তার বিবেকের ব্যাপার, ধর্মের ব্যাপার’, মনে মনে তিনি ভাবলেন এবং এই উপলব্ধিতে তাঁর হালকা লাগল যে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য বিধিবিধানের ধারাটি তিনি খুঁজে পেয়েছেন।

‘তাহলে’, স্থির করলেন তিনি, ‘হৃদয়াবেগ ইত্যাদি মূলত ওর বিবেকের প্রশ্ন, ওটা আমার কোন ব্যাপার হতে পারে না। আমার কর্তব্য পরিষ্কার, পরিবারের কর্তা হিসেবে ওকে চালানো আমার কর্তব্য, সুতরাং অংশত আমার দায়িত্ব থাকছে; যে বিপদটা আমি দেখতে পাচ্ছি সেটা দেখাতে হবে ওকে, সাবধান করে দিতে হবে, এমনকি অধিকারও খাটাতে হবে। এ সব ওকে বলতে হবে আমাকে।’ কারেনিন স্ত্রীকে কি বলবেন সেটা পরিষ্কার দানা বেঁধে উঠল তাঁর মাথায়। আর কি বলবেন তা ভেবে তাঁর এই জন্য আফসোস হল যে এমন একটা অলক্ষ্য গার্হস্থ্য ব্যাপারে তাঁর সময় আর চিত্তশক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে; কিন্তু তাহলেও একটা প্রতিবেদনের আকারে তাঁর বক্তব্য এবং পরবর্তী ভাষণ তাঁর মাথায় একটা পরিষ্কার সুস্পষ্ট রূপ নিল।

‘আমাকে এই কথা বলতে এবং বোঝাতে হবে : প্রথমত, সামাজিক মতামত ও শোভনতার তাৎপর্যের ব্যাখ্যা; দ্বিতীয়ত, বিবাহের ধর্মীয় ব্যাখ্যা; তৃতীয়ত, যদি প্রয়োজন হয়, ছেলের কি দুর্ভাগ্য হতে পারে তার উল্লেখ; চতুর্থত, তার নিজের দুর্ভাগ্যের কথা।’ এবং হাত নিচু করে আঙুলে আঙুলে গিঁট বেঁধে কারেনিন আঙুল মটকালেন। হাতে হাত দিয়ে আঙুল মটকানো—এই বিছ্‌ছিরি অভ্যাসটা সব সময়ই তাঁকে শান্ত করে আনত, পৌঁছে দিত একটা সুনির্দিষ্ট অভিমতে, যা এখন তাঁর নিতান্ত প্রয়োজন। গেটের কাছে গাড়ি আসার শব্দ শোনা গেল। কারেনিন হলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

সিঁড়িতে নারীর পদশব্দ। কারেনিন তাঁর বক্তব্যে প্রস্তুত হয়ে গিঁটে গিঁটে আঙুল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, আশা করছিলেন আরেকটা আঙুল মটকানির শব্দ। মটকাল।

সিঁড়িতে পদশব্দ শোনার আগেই তিনি টের পাচ্ছিলেন আন্নার কাছিয়ে আসা, আর নিজের বক্তব্যে তিনি তুষ্ট বোধ করলেও আসন্ন কথোপকথনে তাঁর ভয় হচ্ছিল।

নয়

আন্না হুডের থুপি নাড়তে নাড়তে মাথা নিচু করে আসছিলেন। মুখ তাঁর জ্বলজ্বল করছিল, কিন্তু তার ঝলকটা আনন্দের নয়, ঘোর অন্ধকার রাতে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহ ঝলকের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল তা। স্বামীকে দেখে আন্না মাথা তুললেন, হাসলেন যেন ঘুম ভেঙ্গে উঠছেন।

·

‘এখনো তুমি শোওনি? আশ্চর্য ব্যাপার!’ বলে, হুড খুলে ফেলে না থেমে গেলেন তাঁর ড্রেসিং-রুমে। দরজার পেছন থেকে বললেন, ‘সময় হয়ে গেছে কারেনিন।’

‘আন্না, তোমার সাথে কিছু কথা বলার আছে।’

‘আমার সাথে?’ অবাক হয়ে আন্না বললেন, দরজার পেছন থেকে বেরিয়ে এসে তাকালেন স্বামীর দিকে। ‘কি ব্যাপার? কি নিয়ে?’ বসে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘বেশ, এত দরকার পড়েছে যখন, কথা বলা যাক। তবে ঘুমনোই ছিল ভালো।’

আন্না জিবের ডগায় যা আসছিল তাই বলছিলেন, আর নিজেই সে কথা শুনে অবাক মানছিলেন তাঁর মিথ্যে বলার সামর্থ্যে। কি সহজ, স্বাভাবিক তাঁর কথা, তাঁকে দেখাচ্ছেও ঠিক যেন তাঁর ঘুম পাচ্ছে। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে মিথ্যার দুর্ভেদ্য বর্মে তিনি আবৃত। টের পাচ্ছিলেন কি একটা অদৃশ্য শক্তি তাঁকে সাহায্য করছে, সহায়তা করছে।

‘আন্না, তোমাকে সাবধান করে দিতে হচ্ছে আমাকে’, উনি বললেন।

‘সাবধান?’ আন্না বললেন, ‘কিসের জন্য?’

আন্না এমন সহজে, এত হাসি-খুশিতে তাকিয়ে ছিলেন যে তাঁর স্বামী ওঁকে যেমন জানতেন তেমন যাঁরা জানতেন না, তাঁদের কাছে তাঁর কথার ধ্বনিতে বা অর্থে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ত না। কিন্তু ওঁকে যিনি জানেন, যিনি জানেন যে শুতে পাঁচ মিনিট দেরি হলে আন্না তা লক্ষ্য করেন, তার কারণ বলেন, যিনি জানেন যে সব কিছু আনন্দ, ফুর্তি, দুঃখের কথা তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁকে জানান,—তাঁর যে এখন চোখে পড়ল যে আন্না তাঁর অবস্থা লক্ষ্য করতে চাইছেন না, নিজের সম্পর্কে একটা কথাও বলতে চাইছেন না, তার তাৎপর্য অনেক। তিনি দেখতে পেলেন তাঁর প্রাণের যে গহন আগে সব সময় ছিল তাঁর কাছে উন্মুক্ত, তা এখন রুদ্ধ। শুধু তাই নয়, তাঁর গলার সুর থেকে তিনি দেখতে পেলেন যে আন্না এতে বিব্রত বোধ করছেন না, বরং সোজাসুজি যেন বলছেন : হ্যাঁ রুদ্ধ, তাই হওয়া উচিত, ভবিষ্যতেও তা রুদ্ধ থাকবে। এখন তাঁর নিজেকে সেই লোকের মত মনে হল যে বাড়ি ফিরে এসে দেখে যে বাড়ি তালাবন্ধ। ‘কিন্তু হয়ত চাবিটা এখনো পাওয়া যেতে পারে’, ভাবলেন কারেনিন।

তিনি মৃদুস্বরে বললেন, ‘আমি তোমাকে সাবধান করে দিতে চাই যে নিজের অপরিণামদর্শিতা ও চিত্তচাপল্যে তুমি সমাজে তোমাকে নিয়ে কথা রটবার উপলক্ষ্য যোগাতে পার। আজ কাউন্ট ভ্রন্‌স্কির সাথে’ (নামটা উচ্চারণ করলেন দৃঢ়ভাবে, সুস্থির যতি দিয়ে) ‘তোমার বড় বেশি উচ্ছল কথোপকথন সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।’

তিনি কথা বলার সময় তাকিয়ে ছিলেন তাঁর হাস্যময় এবং অধুনা তার দুর্জ্ঞেয়তায় ভয়ংকর চোখের দিকে এবং কথা বলতে বলতেই টের পাচ্ছিলেন তার সমস্ত নিষ্ফলতা ও অকার্যকারিতা।

‘চিরকালই তুমি ওইরকম। আমার ব্যাজার লাগছে, কখনো-বা এটা তোমার ভালো লাগে না, আবার আমি হাসিখুশি, কখনো-বা সেটাও ভালো লাগে না তোমার। আজ আমার ব্যাজার লাগেনি। তাতে ঘা লেগেছে মনে?’ আনান বললেন যেন ওঁকে একেবারে বোঝেননি, আর উনি যা বলেছিলেন তার ভেতরে ইচ্ছে করেই বুঝি বুঝলেন শুধু শেষ কথাটা। কারেনিন কেঁপে উঠলেন, চেষ্টা করলেন আঙুল মটকাবার।

‘আহ্, আঙুল মটকিও না দয়া করে। একেবারে ভালো লাগে না আমার’, আন্না বললেন।

‘আন্না, একি তুমি?’ জোর করে হাতের চাঞ্চল্য সংযত রেখে বললেন কারেনিন।

‘কিন্তু কি হল?’ অতি অকপট এবং কৌতুকমণ্ডিত বিস্ময়ে আন্না বললেন, ‘কি চাও তুমি আমার কাছ থেকে?’

কারেনিন চুপ করে রইলেন, কপাল আর চোখ রগড়ালেন হাত দিয়ে। দেখতে পাচ্ছিলেন যে তিনি যা চেয়েছিলেন, অর্থাৎ সমাজের চোখে একটা ভুল করা থেকে স্ত্রীকে সাবধান করে দেওয়া—তার বদলে যা আন্নার বিবেকের ব্যাপার, অজ্ঞাতসারেই তাতে তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন, মাথা ঠুকছেন কল্পিত এক দেয়ালে।

তিনি ধীর-স্থির-নিরুত্তাপ গলায় বললেন, ‘তোমাকে আমি যে কথা বলতে চাই, অনুরোধ করি তার সবটা শোনো। আমি মানি, যা তুমি জানো, ঈর্ষা হল অপমানকর হীনতাসূচক একটা মনোভাব, এ মনোভাবে নিজেকে আমি কদাচ চালিত হতে দেব না; কিন্তু শোভনতার নির্দিষ্ট কতকগুলো নিয়ম আছে যা লঙ্ঘন করা চলে না বিনা শাস্তিতে। আজ আমি লক্ষ্য করিনি, কিন্তু সাধারণ যে প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল তা থেকে বলা যায় যে তুমি এমন আচরণ করেছ যা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।’

‘একেবারেই কিছু বুঝতে পারছি না’, কাঁধ কুঁচকে আন্না বললেন। ভাবলেন, ‘ওঁর এতে কিছু এসে যায় না। কিন্তু সমাজের চোখে পড়েছে কিনা, তাই বিচলিত হয়ে উঠেছেন।’

‘তোমার শরীর ভালো নেই কারেনিন’, উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যেতে গেলেন; কিন্তু স্বামী তাঁর আগে গিয়ে যেন থামাতে চাইলেন তাঁকে।

মুখখানা তাঁর অসুন্দর, বিষণ্ণ, আন্না আগে যা কখনো দেখেননি। মাথা পেছনে আর পাশে হেলিয়ে ক্ষিপ্র হাতে চুলের কাঁটা খুলতে লাগলেন। ‘তা, শুনছি যা বলবেন’, আন্না বললেন ধীরভাবে, কৌতুক করে, ‘এমন কি সাগ্রহেই শুনছি, কেননা বুঝতে চাই কি ব্যাপার।

কথা বলার সময় আন্নার অবাক লাগল তাঁর কথার স্বাভাবিক সুস্থির সুনিশ্চিত সুরে আর শব্দনির্বাচনে।

আলেক্সেই আলেক্‌সান্দ্রভিচ কারেনিন শুরু করলেন, ‘তোমার হৃদয়াবেগের সমস্ত খুঁটিনাটিতে যাবার অধিকার আমার নেই, এবং মোটের ওপর সেটাকে নিষ্ফল, এমনকি ক্ষতিকর বলেই আমি মনে করি। নিজের প্রাণের ভেতরটা খুঁড়তে গিয়ে আমরা এমন জিনিস খুঁড়ে বার করি যা অলক্ষ্যে থাকলেই ভালো। তোমার হৃদয়াবেগ, সেটা তোমার বিবেকের ব্যাপার; কিন্তু তোমার দায়-দায়িত্ব দেখিয়ে দিতে আমি তোমার কাছে, নিজের কাছে, সৃষ্টিকর্তার কাছে বাধ্য। আমাদের দুজনের জীবন বাঁধা আর তা বেঁধে দিয়েছেন লোকে নয়, সৃষ্টিকর্তা। এ বাঁধন ছেঁড়া সম্ভব কেবল পাপে আর এ ধরনের পাপের শাস্তি গুরুতর।’

‘কিছুই বুঝছি না। আহ্ সৃষ্টিকর্তা, কি যে ঘুম পাচ্ছে!’ আটকে থেকে যাওয়া কাঁটার খোঁজে চুলে আঙুল চালাতে চালাতে আন্না বললেন।

‘আন্না, দোহাই তোমার, অমন করে বলো না’, নম্রভাবে বললেন স্বামী, ‘হয়ত ভুল হচ্ছে আমার, কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি যা বলছি, সেটা বলছি যেমন নিজের জন্য তেমনি তোমার জন্যও। আমি তোমার স্বামী এবং তোমাকে ভালোবাসি।’

মুহূর্তের জন্য বিশীর্ণ হয়ে উঠল আন্নার মুখ, দৃষ্টিতে কৌতুকের ফুলকি নিবে গেল। কিন্তু ‘ভালোবাসা’ কথাটা আবার ক্ষুব্ধ করে তুলল তাঁকে। মনে মনে ভাবলেন, ‘ভালোবাসে? ভালোবাসতে ও পারে নাকি? ভালোবাসা নামে কিছু- একটা হয়ে থাকে এ কথাটা না শুনলে কখনো সে শব্দটা ব্যবহার করত না। ও যে জানেই না ভালোবাসা কি জিনিস।’

বললেন, ‘কারেনিন, সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না। সুনির্দিষ্ট করে বলো কি তোমার মনে হচ্ছে…’

‘দয়া করে সবটা বলতে দাও। আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি নিজের কথা বলছি না; এক্ষেত্রে প্রধান ব্যক্তি হল আমাদের ছেলে আর তুমি নিজে। খুবই সম্ভব, আবার বলছি, আমার কথাগুলো তোমার কাছে একেবারেই অযথা এবং অপ্রাসঙ্গিক লাগতে পারে; খুবই সম্ভব যে তা আসছে আমার বিভ্রান্তি থেকে। সেক্ষেত্রে অনুরোধ, মাপ কর আমাকে। কিন্তু তুমি নিজে যদি অনুভব কর যে অন্তত খানিকটা ভিত্তি এর আছে, তাহলে মিনতি করি, ভেবে দেখো এবং তোমার অন্তর যদি বলে, তাহলে আমাকে বলো…’

যা বলার জন্য কারেনিন তৈরি হয়েছিলেন তা যে তিনি বললেন না, সেটা খেয়ালই হল না তাঁর।

‘আমার বলবার কিছু নেই, আর সত্যি…’ বহু কষ্টে হাসি চেপে তাড়াতাড়ি বললেন আন্না, ‘সত্যি ঘুমাবার সময় হয়েছে।’

কারেনিন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং আর কিছু না বলে গেলেন শোবার ঘরে।

আন্না যখন শোবার ঘরে এলেন, উনি তখন বিছানায়। শক্ত করে ঠোঁট চাপা, চোখ ফেরালেন না আন্নার দিকে। আন্না শুলেন নিজের বিছানায় এবং প্রতি মিনিট অপেক্ষা করতে লাগরেন যে উনি আরো একবার কথা বলবেন তাঁর সাথে। যা উনি বলবেন তাতে আন্নার ভয়ও হচ্ছিল, আবার সেটা চাইছিলেনও। কিন্তু উনি চুপ করে রইলেন। নিশ্চল হয়ে আন্না অপেক্ষা করলেন অনেকক্ষণ, তারপর ওঁর কথা তিনি ভুলে গেলেন। ভাবছিলেন তিনি অন্য আরেকজনের কথা, তাঁকে তিনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন, টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর কথা ভাবতে গিয়ে বুক তাঁর ভরে উঠছে আকুলতা আর অপরাধজনক আনন্দে। হঠাৎ তাঁর কানে এল মাপা তালে নাক ডাকার প্রশান্ত শব্দ। প্রথমটায় যেন কারেনিন নিজের নাক ডাকার শব্দে ভয় পেয়ে থেমে গেলেন, কিন্তু দুটো নিঃশ্বাসের পর নতুন প্রশান্ত লয়ে নাক ডাকা শুরু হল আবার।

‘দেরি হয়ে গেছে, দেরি, দেরি’, মুখে হাসি নিয়ে ফিসফিস করলেন আন্না। বহুক্ষণ চোখ মেলে নিশ্চল হয়ে শুয়ে রইলেন তিনি, তাঁর মনে হল সে চোখের দীপ্তি তিনি নিজেই অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *