আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৩.১৫

পনেরো

ভ্রন্‌স্কি যখন আন্নাকে বলেছিলেন যে তাঁর অবস্থাটা সম্ভবপর নয়, বুঝিয়েছিলেন স্বামীকে সব খুলে বলতে, তখন আন্না একগুঁয়ের মত ক্রুদ্ধ হয়ে ভ্রন্‌স্কির কথায় আপত্তি করলেও মনের গভীরে তিনি নিজের অবস্থাটা মিথ্যাময় ও অসাধু বলে টের পাচ্ছিলেন এবং সর্বান্তঃকরণে চাইছেলেন সেটা বদলাতে। ঘোড়দৌড় থেকে স্বামীর সাথে ফেরার পথে উত্তেজনার মুহূর্তে স্বামীকে যখন তিনি সব বলেন, তখন যন্ত্রণা বোধ করলেও এতে তিনি খুশি হয়েছিলেন। স্বামী তাঁকে ছেড়ে রেখে যাবার পর তিনি নিজেকে বোঝান যে তিনি এখন হাঁপ ছাড়লেন, এবার সব কিছু স্থির হয়ে যাবে। নিদেনপক্ষে মিথ্যা ও প্রতারণার কিছু থাকবে না। এবার অবস্থাটা চিরকালের মত স্থির হয়ে গেল, এটা তাঁর কাছে মনে হল সন্দোহতীত। নতুন এই অবস্থাটা খারাপ হতে পারে, কিন্তু তা হবে সুনির্দিষ্ট, অস্পষ্টতা বা মিথ্যা কিছু থাকবে না তাতে। কথাগুলো বলে নিজেকে আর স্বামীকে বা তিনি যে যন্ত্রণা দিয়েছেন তার ক্ষতিপূরণ হবে এই থেকে যে সব স্থিরীকৃত হয়ে যাচ্ছে, ভাবলেন তিনি। সেই সন্ধ্যাতেই ভ্রন্‌স্কির সাথে দেখা হয় তাঁর, কিন্তু তাঁর আর স্বামীর মধ্যে কি ঘটেছে সে কথা কিছুই বললেন না তিনি, যদিও অবস্থাটা স্থিরীকৃত করার জন্য তা বলা দরকার ছিল।

পরের দিন সকালে যখন তাঁর ঘুম ভাঙল, তখন প্রথম তাঁর যা মনে হল সেটা স্বামীকে কি কথা তিনি বলেছেন, আর সে কথাগুলো তাঁর কাছে এত ভয়ংকর লাগল যে ভেবে পেলেন না কি করে এই অদ্ভুত রূঢ় কথাগুলো উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন তিনি আর এ থেকে কি দাঁড়াবে সেটা ঠাউরে উঠতে পারলেন না। কিন্তু কথাগুলো বলা হয়ে গেছে, কারেনিনও চলে গেলেন কিছু না বলে। ‘ভ্রন্‌স্কির সাথে দেখা হল কিন্তু কিছু বললাম না তাকে। যখন সে চলে যাচ্ছিল তখন ইচ্ছে হয়েছিল ওকে ডেকে ব্যাপারটা বলি, কিন্তু মত পালটালাম কেননা প্রথমেই ব্যাপারটা যে বলি নি সেটা অদ্ভুত। কেন আমি চেয়েছিলাম অথচ বললাম না?’ আর এই প্রশ্নের জবাবে লজ্জার রাঙা রঙে ছেয়ে গেল তাঁর মুখ। তিনি বুঝলেন কি তাঁকে এ থেকে আটকে রেখেছিল; বুঝলেন যে তাঁর গ্লানি বোধ হয়েছিল। তাঁর যে অবস্থাটা গতকাল সুস্পষ্ট মনে হয়েছিল, এখন তা লাগল শুধু অস্পষ্ট নয়, নিরুপায়ই। কলঙ্কের কথা ভেবে আতংক হল যা আগে তাঁর মনেই হল হয়নি। স্বামী কি করবে ভেবে ভয়াবহ দুশ্চিন্তা হল তাঁর। ধারণা হল, এখনই তত্ত্বাবধায়ক এসে বাড়ি থেকে বার করে দেবে তাঁকে, সারা দুনিয়ায় রটবে তাঁর কলঙ্ক। নিজেকে তিনি বললেন, বাড়ি থেকে বার করে দিলে কোথায় যাবেন তিনি, উত্তর পেলেন না।

ভ্রন্‌স্কির কথা যখন ভাবলেন, তখন তাঁর মনে হল সে তাঁকে ভালোবাসে না, তাঁকে তার ভার বোধ হতে শুরু করেছে, নিজেকে তিনি ওর কাছে নিবেদন করতে পারেন না আর সে জন্য তার প্রতি বিদ্বেষ বোধ করলেন তিনি। তাঁর মনে হল, স্বামীকে যে কথাগুলো তিনি বলেছেন এবং কল্পনায় অবিরত যার পুনরাবৃত্তি করছেন তা তিনি বলেছেন সবাইকে এবং সবারই কানে গেছে তা। যাদের সাথে তিনি থেকেছেন তাদের চোখের দিকে চাইতে তিনি অক্ষম। দাসীকে ডাকা বা নিচে নেমে ছেলে আর গৃহশিক্ষিকার কাছে যাবার সাহস হল না তাঁর।

দাসী অনেক আগে থেকেই কান পেতে ছিল দরজায়, নিজেই সে ঢুকল ঘরে। আন্না জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে সভয়ে লাল হয়ে উঠলেন। দাসী ঘরে ঢুকেছে বলে মাপ চাইলে এই বলে যে তার মনে হয়েছিল যে তাকে ডাকা হয়েছে ঘণ্টি বাজিয়ে। পোশাক আর একটা চিরকুট নিয়ে এল সে। চিরকুটটা বেত্‌সির কাছ থেকে। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আজ সকারে তাঁর ওখানে লিজা মেকালোভা আর ব্যারনেস টোল্‌স আসছেন তাঁদের ভক্ত কালুজ্‌স্কি আর বৃদ্ধ স্ত্রেমভকে নিয়ে ক্রিকেট খেলার জন্য। ‘আসুন, অন্তত নৈতিকতা নিরীক্ষণ করার জন্যে। অপেক্ষায় রইলাম’, বলে শেষ করেছেন তিনি।

চিরকুটটা পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আন্না।

আনুশ্‌কা ড্রেসিং-টেবিলে সেন্ট ইত্যাদির শিশি-বুরুশ রাখছিল। আন্না তাকে বললেন, ‘কিছু লাগবে না আমার, কিছু না। আমি এখুনি পোশাক পরে বেরোব। চলে যা। কিছুই চাই না আমার, কিছু না।’

আনুশ্‌কা বেরিয়ে গেল। কিন্তু আন্না পোশাক পরতে উঠলেন না, মাথা আর হাত নামিয়ে একই ভঙ্গিতে বসে রইলেন, শুধু মাঝে মাঝে সারা দেহ ঝাঁকিয়ে উঠছিলেন যেন কিছু একটা করার, কিছু একটা বলার জন্য, তারপর আবার নিথর হয়ে যাচ্ছিলেন। অনবরত তিনি বলে যাচ্ছিলেন, ‘হে আল্লাহ্! হে আল্লাহ্!’ কিন্তু ‘হে’ অথবা ‘আল্লাহ্’, কিছুরই কোন অর্থ ছিল না তাঁর কাছে। যে ধর্মে তিনি প্রতিপালিত তাতে তাঁর কোন অবিশ্বাস না থাকলেও তাঁর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য ধর্মের সাহায্য প্রার্থনা তাঁর কাছে স্বয়ং কারেনিনের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনার মত সমান বিজাতীয়। আগে থেকেই তাঁর জানা ছিল যে, ধর্মের সাহায্য সম্ভব কেবল যা তাঁর কাছে জীবনের সমগ্র অর্থ তা বিসর্জন দেওয়ার শর্তে। তাঁর শুধু কষ্ট হচ্ছিল তাই নয়, মনের যে নতুন অবস্থাটা তাঁর আগে কখনো হয়নি, তাতে আতংক হচ্ছিল তাঁর। মনে হচ্ছিল প্রাণের ভেতর সব কিছু দু’খানা হতে শুরু করে। মাঝে মাঝে তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না কিসে তাঁর আতংক, কি তিনি চান। যা ঘটেছে আর যা হবে সেটাতেই কি তাঁর ভয়, সেটাই কি তাঁর ইচ্ছা, নাকি ঠিক কি তিনি চান তা জানা ছিল না তাঁর।

‘উহ্, কি আমি করছি!’ মাথার দু’দিকে ব্যথা বোধ করে মনে মনে বললেন তিনি। সম্বিত ফিরে তিনি দেখলেন যে দুই হাতে তিনি চাঁদির চুল চেপে ধরেছেন। লাফিয়ে উঠে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন।

‘কফি তৈরি, সেরিওজার সাথে মাদমোজেল অপেক্ষা করছেন’, আবার এসে এবং আন্নাকে সেই একই ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে আনুশ্‌কা বলল।

‘সেরিওজা? কেমন আছে সে?’ হঠাৎ চকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন আন্না, সারা সকালের মধ্যে এই প্রথম পুত্রের অস্তিত্বের কথা মনে পড়ল তাঁর।

‘ও খানিকটা দুষ্টমি করেছে মনে হয়’, হেসে জবাব দিলে আনুশ্‌কা।

‘কি দুষ্টুমি?’

‘পিচ ফলগুলো আপনার কোণের আলমারিতে ছিল; মনে হয় চুপি চুপি একটা ও খেয়েছে।’

যে নিরুপায় অবস্থার মধ্যে আন্না ছিলেন, ছেলের কথা মনে পড়িয়ে দেওয়ায় হঠাৎ সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। ছেলেকে নিয়েই মা বেঁচে থাকছে, অতিরঞ্জিত হলেও খানিকটা অপকট এই যে ভূমিকাটা তিনি ইদানীং নিয়েছেন সেটা মনে পড়ল তাঁর, এই ভেবে তাঁর আনন্দ হল যে অবস্থা তাঁর যাই হোক, স্বামী আর ভ্রন্‌স্কি প্রসঙ্গে যে অবস্থাতেই তিনি পড় ন, তা নিরপেক্ষ তাঁর একটা সার্বভৌমত্ব আছে। সে সার্বভৌমত্ব হল তাঁর ছেলে। যে অবস্থাতেই তিনি পড় ন, ছেলেকে তিনি ছাড়তে পারেন না। তাঁকে কলঙ্কিত করে বাড়ি থেকে বার করে দিক না তাঁর স্বামী, তাঁর প্রতি নিরুত্তাপ হয়ে নিজের স্বাধীন জীবন যাপন করতে থাকুক ভ্রন্‌স্কি (আবার তিক্ততা আর তিরস্কারের সাথে ভ্রন্‌স্কির কথা মনে হল তাঁর), ছেলেকে তিনি ছাড়তে পারবেন না। জীবনের রক্ষ্য তাঁর আছে। ছেলে প্রসঙ্গে তাঁর এই অবস্থাটা সুনিশ্চিত করা, তাকে যাতে কেড়ে না নেয় তার ব্যবস্থা করার জন্য সক্রিয় হতে হবে, সক্রিয় হতে হবে। সক্রিয় হতে হবে যথাসম্ভব সত্বর, ওকে কেড়ে নেবার আগেই। চলে যেতে হবে ছেলেকে সাথে নিয়ে। এখন এই একটা কাজ তাঁর করা দরকার। এই যন্ত্রণাকর অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে শান্তি পেতে হবে তাঁকে। ছেলের ব্যাপারে একটা প্রত্যক্ষ কৰ্ম, তাকে নিয়ে এখনই কোথাও চলে যাবার কথা ভেবে তিনি সে শান্তি পেলেন।

তাড়াতাড়ি পোশাক পরে নিলেন তিনি, নিচে নেমে দৃঢ় পদক্ষেপে গেলেন খাবার ঘরে, যেখানে অপেক্ষা করছিল কফি এবং সেরিওজা ও গৃহশিক্ষিকা। আগাগোড়া সাদা পোশাকে টেবিলের কাছে আয়নার নিচে মাথা আর পিঠ নুইয়ে একান্ত মনোযোগের ভাব করে সেরিওজা কি যেন করছিল তার আনা ফুলগুলো নিয়ে। এ ভাবটা আন্নার চেনা, এতে তাকে দেখায় বাপের মত।

গৃহশিক্ষকার মুখখানা খুবই কঠোর। আর সেরিওজা যা প্রায়ই করে, ‘মা!’ বলে এক কর্ণভেদী চিৎকার তুলে থেমে গেল অনিশ্চিত হয়ে; ফুলগুলো ফেলে রেখে ছুটে যাবে মাকে সম্ভাষণ জানাতে নাকি মুকুট গাঁথাটা শেষ করে তারপর যাবে ফুল নিয়ে।

গৃহশিক্ষিকা সম্ভাষণ জানিয়ে সেরিওজা কি করেছে তার একটা বিশদ ও সুনির্দিষ্ট বিবরণ দিতে শুরু করলেন, কিন্তু আন্না সেটা শুনছিলেন না; তিনি ভাবছিলেন গৃহশিক্ষিকাকেও সাথে নেবেন কিনা। ‘নেব না’, স্থির করলেন তিনি, ‘আমি একলা যাব ছেলেকে নিয়ে।’

‘হ্যাঁ, খুব খারাপ’, বলে আন্না ছেলেকে তাকিয়ে দেখলেন কঠোর নয়, ভীরু-ভীরু দৃষ্টিতে যাতে খুশি হল ছেলে চুমু খেলেন তাকে। ‘ও আমার সাথে থাকুক’, বিস্মিত গৃহশিক্ষিকাকে এই বলে আন্না ছেলের হাত না ছেড়ে গিয়ে বসলেন কফির টেবিলে 1

‘মা, আমি…আমি…’, পিচটার জন্য কি তার কপালে আছে, মায়ের মুখভাব দেখে সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে সেরিওজা বলল।

গৃহশিক্ষিকা চলে যেতেই আন্না বললেন, ‘সেরিওজা, খারাপ কাজ করেছিস তুই, কিন্তু আর কখনো করবি না তো? আমার তুই ভালোবাসিস?’

উনি টের পাচ্ছিলেন যে চোখে তাঁর পানি আসছে। ছেলের ত্রস্ত আর সেইসাথে উৎফুল্ল দৃষ্টি লক্ষ্য করে তিনি ভাবলেন, ‘ওকে না ভালোবেসে পারি কি? আমাকে শাস্তি দেবার জন্যে ও কি সত্যিই যোগ দেবে বাপের সাথে? আমার জন্যে মায়া হবে না?’ চোখের পানি গড়িয়ে আসতে শুরু, করেছিল, সেটা চাপা দেবার জন্য আন্না প্রায় দৌড়েই চলে গেলেন বারান্দায়

কয়েক দিনের বজ্রগর্ভ বৃষ্টির পর আবহাওয়া তখন ঠাণ্ডা, পরিষ্কার। আধৌত পল্লবের মধ্যে দিয়ে চুঁইয়ে আসা রোদেও বাতাস কনকনে।

ঠাণ্ডায় আর তাজা বাতাসে নতুন শক্তিতে যে আতঙ্ক তাঁকে পেয়ে বসছিল তাতে কেঁপে উঠলেন তিনি।

সেরিওজা তাঁর পিছু পিছু আসতে যাচ্ছিল। তাকে তিনি ‘যা, মারিয়েটের কাছে যা, বলে পায়চারি করতে লাগলেন বারান্দার খোড়ো মাদুরে। মনে মনে ভাবলেন, ‘সত্যিই কি ওরা করবে না আমাকে, বুঝবে না যে এ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারত না?

থেমে গিয়ে ঠাণ্ডা রোদে ঝকঝকে ধৌত পাতা মেলা অ্যাম্পেন গাছের বাতাসে দোদুল্যমান চুড়োর দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝলেন যে ওরা ক্ষমা করবে না, সবাই এবং সব কিছুই এখন তাঁর প্রতি হবে অনুকম্পাহীন, এই আকাশ, এই গাছপালার মতই। আবার তিনি অনুভব করলেন যে প্রাণের মধ্যে তাঁর দ্বিত্ব শুরু হয়েছে আবার। নিজেকে বললেন, ‘দরকার নেই, দরকার নেই ভাবার। যাবার জন্যে তৈরি হতে হবে। কোথায়? কখন? কাকে সাথে নিয়ে যাব? হ্যাঁ, মস্কোয়। সন্ধ্যার ট্রেনে। সাথে থাকবে আনুশ্‌কা, সেরিওজা আর নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। কিন্তু আগে ওদের দুজনকে চিঠি লেখা দরকার।’ তাড়াতাড়ি তিনি বাড়িতে এলেন নিজের কেবিনেটে টেবিলের সামনে বসে লিখতে শুরু করলেন স্বামীকে :

‘যা ঘটেছে তারপর আমি আপনার বাড়িতে থাকতে পারি না। আমি চলে যাচ্ছি, সাথে নিচ্ছি ছেলেকে। আইন আমার জানা নেই, তাই জানি না মাতাপিতার মধ্যে কার কাছে সন্তান থাকবে; কিন্তু ওকে আমি নিয়ে যাচ্ছি কারণ ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না। উদার হোন, ওকে থাকতে দিন আমার কাছে।’

দ্রুত এবং অন্তরের সাথে এ পর্যন্ত লেখার পর যে উদারতা কারেনিনের মধ্যে নেই বলে আন্নার ধারণা তার দোহাই দিতে গিয়ে এবং মর্মস্পর্শী কিছু-একটা বলে চিঠি শেষ করার জন্য থেমে গেলেন আন্না।

‘নিজের পাপ আর অনুতাপের কথা বলতে আমি অক্ষম, কেননা…’

ভাবনার পারম্পর্য খুঁজে না পেয়ে আবার থেমে গেলেন তিনি। মনে মনে বললেন, ‘না, কোন কিছুর দরকার

নেই।’ চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে উদারতার উল্লেখটা বাদ দিয়ে নতুন করে তা লিখে সীল মারলেন।

দ্বিতীয় চিঠিটা ভ্রন্‌স্কিকে লেখার কথা! ‘স্বামীকে আমি বলেছি’, এই পর্যন্ত লিখে অনেক সময় বসে রইলেন আন্না, আর বেশি লেখার শক্তি ছিল না তাঁর। এটা রূঢ়, নারীসুলভ নয়। ‘তা ছাড়া কি বা ওকে আমি লিখতে পারি?’ নিজেকে বললেন তিনি। আবার লজ্জায় মুখ তাঁর রাঙা হয়ে উঠল, মনে পড়ল তাঁর নিশ্চিন্ত ভাবের কথা, তাঁর প্রতি বিরক্তিতে শুরু করা চিঠিটা তিনি ছিঁড়ে ফেললেন কুটি কুটি করে। ‘কিছুরই প্রয়োজন নেই’, নিজেকে এই বলে লেখার জিনিসপত্র গুটিয়ে রেখে তিনি ওপরে গেলেন, গৃহশিক্ষিকা এবং চাকর-বাকরদের জানালেন যে আজই তিনি মস্কো যাচ্ছেন আর সাথে সাথে লেগে গেলেন জিনিসপত্র গোছগাছের কাজে।

ষোলো

জমাদার, মালী আর চাকর-বাকরেরা পল্লীভবনের সব কামরায় জিনিসপত্র নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। আলমারি আর দেরাজগুলো খোলা, দু’বার তারা দোকানের গেল দড়ির জন্য; মেঝেতে ছড়ানো খবরের কাগজ। দুটো সিন্দুক, ঝোলাঝুলি আর বাঁধাছাঁদা কম্বল নিয়ে আসা হল বাইরের ঘরে। একটা আয়েসী আর দুটো ছেকড়া গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি-বারান্দার কাছে বাঁধাছাঁদার কাজে নিজের ভেতরকার উদ্বেগ ভুলে গিয়ে আন্না তাঁর কেবিনেটে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর যাত্রার থলে গোছাচ্ছিলেন, এমন সময় একটা গাড়ি আসার শব্দের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল আনুশ্‌কা। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আন্না কারেনিনের বজ্রবাহককে দেখতে পেলেন, প্রবেশের দরজায় ঘণ্টি দিচ্ছিল সে।

‘কি ব্যাপার, গিয়ে দেখে আয়’, এই বলে সব কিছুর জন্য প্রস্তুত হয়ে হাঁটুর ওপর হাত রেখে আন্না হেলান দিলেন চেয়ারে। খানসামা নিয়ে এল কারেনিনের লেখা একটা মোটা প্যাকেট।

খানসামা বললেন, ‘ঠিক আছে’, আর লোকটা চলে যেতেই কাঁপা কাঁপা আঙুলে খামটা ছিঁড়লেন। কাগজে আঁটা এক তাড়া ভাঁজ না করা নোট পড়ল তা থেকে। চিঠিটা বার করে তিনি পড়তে লাগলেন তার শেষ দিক থেকে ‘আপনার আসার জন্যে সমস্ত ব্যবস্থা আমি করে রেখেচি এবং আমার অনুরোধ পালনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি।’ শেষ থেকে গোড়ার দিকে তিনি এগিয়ে গেলেন এবং চিঠিটা পড়লেন প্রথম থেকে। পড়ে শেষ করে আন্নার মনে হল তাঁর শীত-শীত করছে, এমন একটা ভয়ংকর বিমর্ষতা তাঁকে পেয়ে বসল যা তিনি আশা করেননি।

সকালে তাঁর আফসোস হয়েছিল এজন্য যে স্বামীকে তিনি ব্যাপারটা বলেছেন, আর চাইছিলেন যেন কথাগুলো বলা হয়নি। এবং এই চিঠিতে মেনে নেওয়া হয়েছে যে কথাগুলো যেন বলানি, আর তিনি যা চাইছিলেন তার সুযোগ দিচ্ছে। কিন্তু তিনি যা কল্পনা করেন চিঠিটা এখন তার চেয়েও ভয়ংকর মনে হল।

‘সঠিক, সঠিক! সব সময়ই ও সঠিক বৈকি!’ মনে মনে আওড়ালেন তিনি, ‘খ্রিস্টান, মহানুভব ব্যক্তি! কি হীন, পাষণ্ড লোক! আমি ছাড়া এটা কেউ বোঝে না, বুঝবে না; আমি এটা বুঝিয়ে বলতে পারব না। সবাই বলে ও ধার্মিক নীতিপরায়ণ, সৎ, বুদ্ধিমান মানুষ; কিন্তু আমি যা দেখেছি তা ওরা দেখেনি। ওরা জানে না কিভাবে আট বছর ধরে সে আমার জীনকে দলিত করেছে, দলিত করেছে আমার ভেতরকার জীবন্ত সব কিছুকে, কদাচ ও ভাবেনি যে আমি একজন জীবন্ত নারী, যার প্রয়োজন ভালোবাসা। জানে না প্রতি পদক্ষেপে ও কিভাবে অপমান করেছে আমাকে আর আত্মতুষ্ট থেকেছে। আমি কি চেষ্টা করিনি, সর্বশক্তিতে চেষ্টা করিনি নিজের জীবনের ন্যায্যতা খুঁজে পেতে? আমি কি চেষ্টা করি না ওকে ভালোবাসতে, আর স্বামীকে ভালোবাসা অসম্ভব হয়ে উঠলে ছেলেকে ভালোবাসতে? কিন্তু সময় কাটতে আমি যে বুঝলাম যে আত্মপ্রতারণা আর সম্ভব নয়, আমি জীবন্ত মানুষ, ভালোবাসা আর বেঁচে থাকা আমার যে দরকার, আল্লাহ্ আমাকে সেভাবে যে গড়েছেন তার দোষ কি আমার? কিন্তু এখন কি করা যায়? ও যদি আমাকে খুন করত, ওকে খুন করত, তাহলে সব আমি সইতাত, সব কিছু মাফ করতাম, কিন্তু ও…

‘ও যে কি করবে তা আমি অনুমান করতে পারি নি কেমন করে? তাই ও করেছে যা ওর হীন চরিত্রের সাথে মেলে। ও হয়ে থাকবে সঠিক আর ধ্বংসোন্মুখ আমাকে আরো খাপ, আরো হীনভাবে ধ্বংস করবে…’

‘আপনি নিজেই কল্পনা করতে পারেন আপনার এবং আপনার পুত্রের ভাগ্যে কি আছে’, চিঠির এই পঙক্তিটা স্মরণ হল তাঁর। ‘ও যে ছেলেকে বেড়ে নেবে এটা তার হুমকি, এবং তাদের নির্বোধ নীতি অনুসারে এটা খুবই সম্ভব। কিন্তু আমি কি জানি না কেন এটা সে বলছে? আমার পুত্রস্নেহে তার বিশ্বাস নেই, কিংবা আমার এই হৃদয়াবেগে তার তাচ্ছিল্য আছে (সব সময়ই সে যেভাবে টিটকারি দিয়েছে), কিন্তু ও জানে যে ছেলেকে আমি ত্যাগ করব না, ছেলেকে ত্যাগ করতে পারি না; যাকে আমি ভালোবাসি এমন কি তার সাথেও জীবন কাটাতে আমি পারব না ছেলেকে ছাড়া, আর ছেলেকে ত্যাগ করে ওর কাছ থেকে পালিয়ে গিয়ে আমি সবচেয়ে কলঙ্কিতা পাষণ্ডা নারীর মত কাজ করব-এটা ও জানে এবং জানে যে আমার দ্বারা তা হওয়া সম্ভব নয়।’

‘আমাদের জীবন আগে যেমন চলেছে তেমনি উচিত’, মনে পড়ল তাঁর চিঠির আরেকটা বাক্য। ‘সে জীবন আগেও ছিল যন্ত্রণাকর, ইদানীং তা হয়েছিল ভয়াবহ। আর এখন কি হবে? আর ও এটা সবই জানে, জানে যে আমি বিশ্বাস নিচ্ছি, ভালোবাসছি এর জন্যে অনুতাপ করতে আমি পারি না; জানে যে মিথ্যা আর প্রতারণা ছাড়া এ থেকে আর কোন ফল হবে না; কিন্তু আমাকে কষ্ট দেওয়াটা চালিয়ে যাওয়া ওর দরকার। আমি চিনি ওকে; জানি যে পানির ভেতর মাছের মত ও মিথ্যার মধ্যে সাঁতরায় আর তাতে তৃপ্তি লাভ করে। না, এ তৃপ্তি আমি তাকে দেব না, ছিঁড়ে ফেলব মিথ্যার এই মাকড়শার জাল যাতে সে জড়াতে চায় আমাকে; যা হবার হোক। মিথ্যা আর প্রতারণার চেয়ে তা ভালো!

‘কিন্তু কিভাবে? আল্লাহ্! আল্লাহ্! আমার মত এমন অভাগা নারী কেউ ছিল কি কখনো?…’

না, ছিঁড়ে ফেলব, ছিঁড়ে ফেলব!’ অশ্রু রোধ করে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। ওকে নতুন আরেকটা চিঠি লেখার জন্য গেলেন লেখার টেবিলের কাছে। কিন্তু অন্তরের গভীরে তিনি টের পাচ্ছিলেন যে কিছুই ছিঁড়ে ফেলার শক্তি হবে না তাঁর, আগের এই অবস্থাটা যতই মিথ্যাময় আর অসম্মানকর হোক তা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা তাঁর হবে না।

টেবিলের সামনে বসলেন তিনি, কিন্তু লেখার বদলে টেবিলে হাত পেতে তার ওপর মাথা রেখে কেঁদে ফেললেন, সারা বুক ফুলিয়ে ফুলিয়ে ডুকরে উঠলেন যেভাবে কাঁদে শিশুরা। তিনি কাঁদলেন কারণ নিজের অবস্থাটা পরিষ্কার করে নেবার, সুনির্দিষ্ট করে নেবার স্বপ্ন তাঁর চূর্ণ হয়ে গেছে বরাবরের মত। আগে থেকেই তাঁর জানা আছে যে সবই থেকে যাবে পূর্বের মতই, থেকে যাবে বরং আগের চেয়েও অনেক খারাপ। তিনি অনুভব করলেন যে সমাজে তাঁর যে প্রতিষ্ঠা সকালে অতি তুচ্ছ মনে হয়েছিল সেটা তাঁর কাছে প্রিয়, স্বামীপুত্রত্যাগিনী, প্রণয়ীর সাথে মিলিতা এক নারীর কলংকিত অবস্থার সাথে সেটা বদলে নেবার ক্ষমতা তাঁর হবে না; যত চেষ্টাই তিনি করুন, নিজের চেয়ে শক্তিশালী তিনি হতে পারবেন না। প্রেমের স্বাধীনতা তিনি অনুভব করবেন না কখনো, সব সময়ই থাকবেন যেকোনো মুহূর্তে স্বরূপমোচনের বিপদ মাথায় নিয়ে এক পাতকিনী স্ত্রী যে স্বামীকে প্রতারণা করেছে অপরের সাথে এক কলংকজনক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য, আর সে ব্যক্তি স্বাধীন, তাঁর সাথে তিনি একই জীবন যাপন করতে পারেন না। তিনি জানতেন যে ব্যাপারটা তাই-ই হবে আর সেটা এত ভয়ংকর যে কি তার পরিণাম সেটা কল্পনা করতে পারলেন না তিনি। অঝোরে তিনি কাঁদতে লাগলেন, শাস্তি পেলে বাচ্চারা যেভাবে কাঁদে।

খানসামার পদশব্দ শুকে তাঁকে সম্বিত ফেরাতে হল। তার দিক থেকে মুখ আড়াল করে তিনি ভান করলেন যেন লিখছেন।

খানসামা জানাল, ‘পত্রবাহক জবাব চাইছে।’

‘জবাব? ও, হ্যাঁ’, আন্না বললেন, ‘খানিক অপেক্ষা করুক। আমি ঘণ্টি দিয়ে ডাকব।’

ভাবলেন, কি আমি লিখতে পারি? একা একা কি স্থির করতে পারি আমি? কি আমি জানি? কি আমি চাই? কি আমি ভালোবাসি?’ আবার তিনি অনুভব করলেন যে অন্তরের ভেতর তাঁর দ্বিত্ব শুরু হচ্ছে। এই অনুভূতিটায় আবার ভয় হল তাঁর এবং নিজের সম্পর্কে ভাবনা থেকে তাঁর মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করতে পারে এমন যে উপলক্ষ প্রথম পেলেন, সেটাই আঁকড়ে ধরলেন। ‘আলেক্সেই-এর সাথে দেখা করতে হবে’ (মনে মনে ভ্রন্‌স্কিকে তিনি এই নামেই ভাবতেন), ‘একলা সেই আমাকে বলতে পারে কি আমার করা উচিত। বেত্‌সির কাছে যাব, হয়ত সেখানে দেখা পাব তার’, নিজেকে তিনি বললেন, অথচ একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন যে গতকালই যখন তিনি ভ্রসিস্কে বলেছিলেন যে তাহলে তিনিও যাবেন না। টেবিলের কাছে গিয়ে স্বামীকে লিখলেন : ‘আপনার চিঠি আমি পেয়েছি। আ।’ ঘণ্টি দিয়ে খানসামাকে ডেকে দিলেন সেটা।

ঘরে ঢুকতে আনুশ্‌কা বললেন, ‘আমরা যাচ্ছি না।’

‘একেবারেই না?’

উঁহু, মোটঘাট খুলো না, থাক কাল পর্যন্ত। আর গাড়িটাকে রেখে দাও। প্রিন্সেসের ওখানে যাব।’

‘কোন পোশাকটা আনব?’

সতেরো

প্রিন্সেস ভেস্কায়া আন্নাকে যে ক্রকেট পার্টিতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, তা হওয়ার কথা দুজন মহিলা আর তাঁদের অনুরক্তদের নিয়ে। মহিলা দুজন বাছাই করা নতুন এক পিটার্সবুর্গ চক্রের প্রতিনিধি, যাকে কিছু-একটা অনুকরণের অনুকরণে ফরাসি ভাষায় বলা হত ‘পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য’। এই মহিলারা অবশ্য সেই উচ্চ চক্রেরই লোক, কিন্তু আন্না যে চক্রে যাতায়াত করতেন তার প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ। তাছাড়া লিজা মেকালোভার অনুরক্ত বৃদ্ধ স্লেভ, পিটার্সবুর্গের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি, কর্মক্ষেত্রে ছিলেন কারেনিনের শত্রু। এসব বিবেচনা করে আন্না যেতে চাননি, প্রিন্সের ভেস্কায়ার চিরকুটটা ছিল এই অনিচ্ছা প্রসঙ্গেই। এখন কিন্তু ভ্রন্‌স্কির দেখা পাবার আশায় তাঁর যেতে ইচ্ছে হল।

প্রিন্সেস ভেস্কায়ার ওখানে আন্না অন; অতিথিদের আগেই এলেন।

আন্না যখন ঢুকছিলেন কামের-ইউঙ্কারের মত আঁচড়ানো গালপাট্টায় ভ্রন্‌স্কির খানসামাও ঢুকছিল তখন। দরজার কাছে থেমে টুপি খুলে সে পথ ছেড়ে দিল আন্নাকে। আন্না তাকে চিনতে পারলেন আর কেবল তখনই তাঁর মনে পড়ল যে গতকাল ভ্রন্‌স্কি বলেছিলেন যে আসবেন না। নিশ্চয় এই বিষয়েই লিখে পাঠিয়েছেন তিনি।

প্রবেশ-কক্ষে তাঁর ওপরের আচ্ছাদন খুলে রাখার সময় তিনি শুনতে পেলেন যে খানসামা কামের-ইউঙ্কারের মত এমন কি র্-র্ উচ্চারণ করেই, ‘কাউন্ট পাঠিয়েছেন প্রিন্সেসকে’ বলে চিরকুটটা দিল।

আন্নার ইচ্ছে হয়েছিল জিজ্ঞেস করে—কোথায় ওর মনিব। ইচ্ছে হয়েছিল ফিরে যাবেন, ভ্রন্‌স্কিকে চিঠি পাঠিয়ে বলবেন তাঁর ওখানে আসতে অথবা নিজেই যাবেন তাঁর কাছে। কিন্তু কোনটাই করা গেল না : ততক্ষণে সামনে বেজে উঠেছে তাঁর আগমন ঘোষণার ঘণ্টি, প্রিন্সেস ভেস্কায়ার খানসামা খোলা দরকার কাছে তাঁর দিকে আধখানা ফিরে দাঁড়িয়ে আছে তিনি ভেতরের ঘরগুলোয় যাবেন বলে।

প্রিন্সেস বাগানে আছেন। এখনই আপনার আসার খবর দেওয়া হবে তাঁকে। বাগানে যেতে আপনি ইচ্ছে করেন কি?’ অন্য একটা ঘরে অন্য একজন খানসামা জানাল তাঁকে।

অনিশ্চয়তা, অস্পষ্টতার অবস্থাটা দাঁড়াল ঠিক বাড়ির মতই, বরং আরো খারাপ কেননা কিছুই করার নেই, ভ্রন্‌স্কির সাথে দেখা হবে না, থাকতে হবে এখানেই, পরের বাড়িতে, তাঁর মেজাজের অতি বিপরীত প্রকৃতির একটা আড্ডায়; কিন্তু তিনি সাজগোজ করে এসেছেন আর জানতেন যে সেটা মানিয়েছে তাঁকে; তিনি একলা নন, চারপাশে আলস্যের এক অভ্যস্ত জমকালো পরিস্থিতি, বাড়ির চেয়ে এখানেই তিনি স্বস্তি বোধ করবেন বেশি; কি করা যায় সেটা তাঁকে ভাবতে হবে না। সবই এখানে হয়ে যায় আপনা থেকেই। সাদা একটা পোশাকের সৌষ্ঠবে চোখ ধাঁধিয়ে বেত্‌সি তাঁর দিকে আসতে আন্না হাসলেন বরাবরের মত। প্রিন্সেস ভেস্কায়া এসেছিলেন তুকেভিচ আর তাঁর একজন আত্মীয়া ভদ্রকন্যাকে সাথে নিয়ে, নামকরা প্রিন্সেসের সাথে মেয়েটা গ্রীষ্মকালটা কাটাচ্ছে বলে তার মফস্বলবাসী পিতামাতার আনন্দের পরিসীমা ছিল না।

সম্ভবত আন্নার চেহারায় বিশেষ কিছু-একটা ছিল, কেননা বেত্‌সি তৎক্ষণাৎ লক্ষ্য করেছিলেন সেটা

‘ভালো ঘুম হয়নি’, যে খানসামাটা তাঁদের দিকে আসছিল আন্নার ধারণামত ভ্রন্‌স্কির নোটটা নিয়ে, তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন আন্না।

‘আপনি এসেছেন বলে ভারি আনন্দ হল’, বেত্‌সি বললেন, ‘ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলেন। এই এখনই ভাবছিলাম ওরা আসতে আসতে এক কাপ চা খেয়ে নিই গিয়ে। আর আপনি আশার সাথে গিয়ে ক্রিকেট গ্রাউন্ডটা পরখ করে দেখলে পারেন’, তুশকেভিচকে বললেন তিনি। ‘আর চা খেতে খেতে প্রাণ খুলে আমরা কথা বলে নিতে পারব। নিবিড়ভাবে আলাপ করা যাবে, তাই না?’ হেসে আন্নার দিকে ফিরে যে হাতটায় আন্না ছাতা ধরে ছিলেন তাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললেন তিনি।

‘সেটা ভালোই হবে, কারণ আপনার এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারব না আমি, বৃদ্ধা ভ্রেদের কাছে যেতে হবে। একশ’ বছর ধরে কথা দিয়ে আসছি’, আন্না বললেন, মিথ্যা তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ হলেও সমাজে সেটা বেরিয়ে এল শুধু সহজে আর স্বাভাবিকভাবেই নয়, এমন কি তৃপ্তিই পেলেন তাতে।

কেন এটা তিনি বললেন যা এক সেকেন্ড তিনি ভাবেননি, সেটা তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না। বললেন শুধু এই একটা চিন্তা থেকে যে ভ্রন্‌স্কি যেহেতু এখানে আসবেন না, তাই এখান থেকে ছাড়ান পেয়ে যেমন করে হোক তাঁর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কেন ঠিক বৃদ্ধা ফ্রেলিনা ভ্রেদে’র কথাই বললেন যাঁর কাছে যাওয়া নাকি তাঁর প্রয়োজন যেমন প্রয়োজন আরো অনেকের কাছে যাবার, সেটা তিনি বোঝাতে পারতেন না, তবে পরে যা দেখা গেছে, ভ্রন্‌স্কির সাথে দেখা করার সবচেয়ে ধূর্ত উপায়ের কথা ভাবতে গিয়ে এর চেয়ে ভালো কিছু খুঁজে পেতেন না তিনি।

মন দিয়ে আন্নার মুখ লক্ষ্য করে বেত্‌সি বললেন, ‘না, আপনাকে আমি ছাড়ব না কিছুতেই। সত্যি, আপনাকে ভালো না বাসলে আমি রাগই করতাম আপনার ওপর। আপনি যেন ভাবছেন যে আমার আন্ডায় মিশলে আপনার মান খোয়া যাবে। ছোট ড্রয়িং-রুমটায় আমাদের চা দাও তো’, খানসামাদের সাথে কথা বলার সময় বরাবর তিনি যা করেন তেমনি চোখ কুঁচকে বললেন তিনি। তার কাছ থেকে নোটটা নিয়ে পড়লেন। ফরাসিতে বললেন, ‘আলেক্‌সেই চাল মেরেছে, লিখেছে আসতে পারবে না।’ কথাটা তিনি বললেন এমন সহজ স্বাভাবিক সুরে যেন ক্রকেটের খেলুড়ে ছাড়া ভ্রন্‌স্কি আন্নার কাছে অন্য তাৎপর্য ধরে এমন চিন্তা তাঁর মাথাতেই আসতে পারে না।

আন্না জানতেন যে বেত্‌সি সবই জানেন, কিন্তু তাঁর উপস্থিতিতে উনি যেভাবে ভ্রন্‌স্কির কথা বলতেন তা শুনে আন্না সব সময়ই মিনিট খানেকের জন্য নিঃসন্দেহ হতেন যে বেত্‌সি কিছুই জানে না।

‘আ!’ উদাসীনভাবে আন্না বললেন যেন এ নিয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ নেই; তারপর হেসে যোগ দিলেন, আপনার সমাজে এলে কারো মান খোয়া যেতে পারে কেমন করে?’ কথার এই মারপ্যাচ, গোপন কথাটা লুকিয়ে রাখা সমস্ত নারীর মত আন্নার কাছেই উপাদেয় লাগত। লুকাবার আবশ্যকতা নয়, যার জন্য লুকানো হল তার উদ্দেশ্যটার জন্যও নয়, গোপন করার ব্যাপারটাই আকৃষ্ট করত তাঁকে। বললেন, ‘আমি পোপের চেয়েও তো আর বেশি ক্যাথলিক হতে পারি না। স্ত্রেমভ আর লিজা মের্কালোভা সমাজের ননীর অধিক ননী। তা ছাড়া সর্বত্র তাঁরা বরণীয়, আর আমি’, ‘আমি’ কথাটায় একটা বিশেষ জোর দিলেন তিনি, ‘আমি কখনো কড়া কি অসহিষ্ণু হতে পারি না। স্রেফ সে সময়ই নেই আমার।’

‘না, আপনি হয়ত চান না যে স্ত্রেমভের সাথে আপনার দেখা হোক? উনি আর কারেনিন নয় লাঠালাঠি করুন কমিটিতে, আমাদের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু সমাজে আমি যতদূর জানি তার ভেতর স্ত্রেমভ সবচেয়ে সজ্জন ব্যক্তি আর ক্রিকেট খেলার নিদারুণ ভক্ত। আপনি নিজেই দেখবেন। আর লিজার বৃদ্ধ প্রণয়ী হিসেবে তাঁর অবস্থাটা হাস্যকর হলেও কিভাবে তিনি এই হাস্যকর অবস্থাটা থেকে বেরিয়ে আসেন তা দেখবার হমোত! ভারি মিষ্টি লোক সাফো শ্টোসকে আপনি চেনেন? নতুন, একেবারে নতুন ধরনের মানুষ।’

‘বেত্‌সি যখন এসব কথা বলে যাচ্ছিলেন, আন্না তখন তাঁর ফুর্তিবাজ বুদ্ধিমন্ত চাউনি থেকে টের পাচ্ছিলেন যে উনি তাঁর অবস্থাটা অংশত বুঝতে পারছেন এবং মতলব আঁটছেন কিছু একটা। ওঁরা ছিলেন ছোট্ট কেবিনেটটায়।

‘কিন্তু আলেকসেইকে চিঠি লিখে পাঠানো দরকার’, টেবিলের সামনে বসলেন তিনি, কয়েক ছত্র লিখে লেফাফায় পুরলেন, ‘লিখলাম ও যেন ডিনারে আসে। আমার এখানে একজন মহিলা ডিনারে থাকছেন পুরুষ সঙ্গী ছাড়া। দেখুন তো, চিঠিটা প্রত্যয়জনক হল কি? মাপ করবেন, এক মিনিটের জন্যে আপনাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে। আপনি দয়া করে সীল মেরে পাঠিয়ে দিন চিঠিটা’, দরজার কাছ থেকে উনি বললেন, ‘আমার ওদিকে কিছু হুকুম-টুকুম দেবার আছে।’ এক মুহূর্ত ও চিন্তা না করে আন্না বেত্‌সির চিটিটা নিয়ে বসলেন এবং না পড়ে নিচে লিখে দিলেন, আপনার সাথে দেখা করার দরকার আছে আমার। ভেদের বাগানে আসুন। আমি সেখানে থাকব ছ’টার সময়।’ সীল মারলেন তিনি আর ফিরে এসে বেত্‌সি আন্নার সমক্ষেই পাঠিয়ে দিলেন চিঠিটা।

আর সত্যিই, ঠাণ্ডা ছোট্ট ড্রয়িং-রুমটায় টেবিল-ট্রেতে করে যে চা আনা হয়েছিল তা নিয়ে অতিথিদের আগমনের আগে যে cosy chat-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রিন্সেস ভেস্কায়া তা জমে উঠল দুজন মহিলার মধ্যে। যাদের আশা করা হচ্ছে, শুরু হল তাদের নিয়ে পরচর্চা, উঠল লিজা মের্কালোভার প্রসঙ্গ।

আন্না বললেন, ‘উনি ভারি মিষ্টি, সব সময়ই ওঁকে ভালো লেগেছে আমার।’

‘ওঁকে আপনার ভালোবাসা উচিত। আপনাকে নিয়ে উনি পাগল। কাল ঘোড়দৌড়ের পর উনি এসেছিলেন আমার কাছে, আপনাকে না দেখতে পেয়ে হতাশ হয়ে উঠেছিলেন। উনি বলেন, আপনি উপন্যাসের এক খাঁটি নায়িকা, যদি উনি পুরুষ হতেন, তাহলে আপনার জন্যে হাজার খানেক আহাম্মকি করতেন তিনি। স্ত্রেমভ তাঁকে বলেন যে এমনিতেই সেটা নাকি তিনি করছেন।

‘আচ্ছা বলুন তো, আমি কখনো ঠিক বুঝতে পারিনি’, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আন্না এমন সুরে জিজ্ঞেস করলেন যে, পরিষ্কার বোঝা গেল যে কোন অলস প্রশ্ন এটা নয়, যে প্রশ্ন তিনি করছেন সেটা যতখানি সমুচিত তার চেয়েও তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ‘বলুন, তো, প্রিন্স কালুজ্‌স্কি, যাঁকে লোকে বলে মিকা, তাঁর সাথে লিজার সম্পর্কটা কি? ওঁদের সাথে আমার দেখা হয়েছে কম। কি সম্পর্ক?’

বেত্‌সির চোখ হেসে উঠল, মন দিয়ে তিনি দেখলেন আন্নাকে। বললেন, ‘নতুন ধরন-ধারন, সবাই ওরা ওটা রপ্ত করেছে। চুলোয় দিয়েছে সমর্কর্তা। তবে চুলোয় দেবারও তো রকম আছে।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু কালুজ্‌স্কির সাথে লিজার সম্পর্কটা কেমন?

বেত্‌সি হঠাৎ মজা পেয়ে বাঁধ ভাঙা হাসি হেসে উঠলেন যা তাঁর ক্ষেত্রে ঘটে কদাচিৎ।

‘আপনি প্রিন্সেস মিয়াগ্‌কায়ার এলাকায় দখল গাড়ছেন। এটা যে এক সাংঘাতিক শিশুর প্রশ্ন’, সংযত হতে চেয়েও তা না পেয়ে বেত্‌সি এক সংক্রামক হাসিতে ফেটে পড়লেন যেভাবে হাসে যে লোকেরা হেসে থাকে কদাচিৎ ‘ওঁদেরকেই জিজ্ঞেস করতে হয়’, বললেন তিনি হাসির অশ্রুজলের মধ্যে।

‘না, হাসবেন না বাপু’, অনিচ্ছাতেও হাসিতে সংক্রামিত আন্না বললেন, ‘কিন্তু আমি কখনো বুঝতে পারিনি এখানে স্বামীর ভূমিকাটা কি আমি বুঝি না।’

‘স্বামী? লিজা মের্কালোভার স্বামী তাঁর জন্যে কম্বল এনে দেন এবং সর্বদাই তাঁর খিদমতে প্রস্তুত। কিন্তু তা ছাড়া আসলে আর কি সেটা কেউ জানতে চায় না। জানেন তো, শালীন সমাজে লোকে সাজসজ্জায় কোন কোন খুঁটিনাটি নিয়ে কিছু বলেও না, ভাবেও না। এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই।’

প্রসঙ্গটা পালটাবার জন্য আন্না জিজ্ঞেস করলেন, ‘রোলান্দাকির উৎসবে আপনি যাচ্ছেন?’

‘সম্ভবত না’, এবং বান্ধবীর দিকে না তাকিয়ে বেত্‌সি সুগন্ধি চা ছোট ছোট স্বচ্ছ পেয়ালায় সাবধানে ঢালতে লাগলেন। একটা পেয়ালা আন্নার দিকে এগিয়ে দিয়ে তিনি মেয়েদের একটা সিগারেট নিয়ে রুপোর খাপে ঢুকিয়ে তা ধরালেন।

‘কি জানেন, আমার অবস্থাটা সৌভাগ্যের বলতে হবে’, চায়ের কাপ হাতে নিয়ে এবার না হেসে শুরু করলেন বেত্‌সি, ‘আমি আপনাকেও বুঝি, লিজাকেও বুঝি। লিজা হল গে সহজসরল স্বভাবের তেমন একটা লোক, বাচ্চাদের মত যে বোঝে না কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ। অন্তত বোঝেনি যখন তার বয়স ছিল খুবই অল্প। এখন সে জানে যে এই না বোঝাটা তাকে মানায়। এখন সে হয়ত ইচ্ছে করেই বুঝতে চায় না’, সূক্ষ্ম হেসে বেত্‌সি বললেন, ‘তাহলেও ওটা তাকে মানায়। মানে, একটা জিনিসকেই শোকাবহ দৃষ্টিতে দেখে যন্ত্রণা পাওয়া সম্ভব আবার সহবভাবে, এমন কি ফূর্তি করেই সেটা দেখা চলে। আপনার ঝোঁক হয়ত বড় বেশি শোকাবহ দৃষ্টিতে দেখা।’

‘আমি নিজেকে যেমন জানি, অন্যদেরও ঠিক তেমনি করে জানার কি যে ইচ্ছে আমার’, আন্না বললেন গুরুত্ব সহকারে, চিন্তিতভাবে, ‘অন্যদের চেয়ে আমি খারাপ নাকি ভালো? আমার মনে হয় খারাপ।’

‘সাঙ্ঘাতিক শিশু সাঙ্ঘাতিক শিশু’, পুনরাবৃত্তি করলেন বেত্‌সি, ‘নিন, ওরা এসে গেছে।

আঠারো

শোনা গেল পদশব্দ, পুরুষের গলা, তারপর নারীকণ্ঠ আর হাসি, এর পর ঢুকলেন প্রত্যাশিত অতিথিরা : সাফো শ্টোস এক স্বাস্থ্যের আধিক্যে জ্বলজ্বলে এক যুবাপুরুষ, যাকে ডাকা হয় ভাস্কা বলে। দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে ভেতরে রক্ত রেখে বর্জিত গোমাংস, কন্দ-ছত্রাক আর বার্গান্ডি সুরা তাঁর উপকারে লেগেছে। মাথা নুইয়ে মহিলাদের দিকে তাকাল ভাস্কা, কিন্তু শুধু এক সেকেন্ডের জন্য। সাফোর পিছু পিছু সে গেল ড্রয়িং-রুমে আর সেখানে তাঁর পিছু পিছুই ঘুরতে লাগল যেন আঁচলে বাঁধা, চকচকে চোখ তার সরছিল না তাঁর ওপর থেকে, যেন তাঁকে সে খাবে। সাফো পোসের চুল সোনালী, চোখ কালো। হাই-হিল জুতোয় ছোট ছোট ক্ষিপ্র পদক্ষেপে তিনি ভেতরে এসে মহিলাদের করমর্দন করলেন সজোরে, পুরুষালী ঢঙে।

আন্না আগে কখনো এই নতুন অসামান্যকে দেখেননি, চমৎকৃত হলেন তাঁর রূপে, বেশভূষার চূড়ান্তপনায়, ব্যবহারের অসংকোচে। নিজের এবং অপরের কোমল সোনালি কেশে রচিত তাঁর কবরী এতই বৃহৎ যে আয়তনে সেটা তাঁর সুঠাম, অতি অনাবৃত, সুডৌল, স্ফীত উরসের সমান। এগোবার ভঙ্গিটা তাঁর এতই প্রখর যে প্রতিটি গতিতেই গাউনের তল থেকে ফুটে উঠছিল জানু ও উরুর রূপরেখা এবং আপনা থেকেই মনে আসছিল ওপরে অত আনগ্ন আর পেছনে ও নিচে এত লুকানো ওঁর সত্যিকারের সুঠাম দেহটার শেষ কোথায়।

বেত্‌সি তাড়াতাড়ি করে এলেন আন্নার সাথে ওঁর পরিচয় করিয়ে দিতে।

‘ভাবতে পারেন, দুজন সৈনিককে আমরা প্রায় চাপা দিতে যাচ্ছিলাম’, সাথে সাথেই উনি চোখ মটকে, হেসে, পোশাকের পুচ্ছদেশ ঝাঁকিয়ে, সেটাকে বড় বেশি এক পাশে টেনে এনে বলতে শুরু করলেন, ‘আমি, ভাস্কার সাথে যাচ্ছিলাম…আরে হ্যাঁ, আপনাদের তো পরিচয় নেই’, এই বলে তিনি ভাস্কার উপাধি জানিয়ে যুবাপুরুষটির পরিচয় দিলেন এবং নিজের ভুলে, মানে অপরিচিতিদের সামনে ওকে তার ডাকনামে ‘ভাস্কা’ বলেছেন বলে লাল হয়ে হেসে উঠলেন।

ভাস্কা আরেকবার মাথা নোয়াল আন্নার উদ্দেশে, কিন্তু কিছু বলল না। সাফোকে সে বলল হেসে : ‘বাজি হেরেছেন। আমরা এসেছি আগে। পাওনা মেটান।’

সাফো আরো ফুর্তিতে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘এখনই তো আর নয়।’

‘বেশ, পরে পাব।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আরে যাঃ!’ গৃহকর্ত্রীর দিকে ফিরলেন তিনি, বেশ লোক আমি…ভুলে গিয়েছিলাম…একজন অতিথি নিয়ে এসেছি আপনার এখানে। এই যে সে।’

অপ্রত্যাশিত যে যুবক অতিথিটিকে নিয়ে এসে সাফো তার কথা ভুলে দিয়েছিলেন, সে কিন্তু এতই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যে তার আপ্যায়নে উভয় মহিলাই উঠে দাঁড়ালেন।

ইনি সাফোর নতুন ভক্ত। ভাস্কার মত ইনিও তাঁর পায়ে পায়ে ঘুরতে লাগলেন।

একটু পরেই এলেন প্রিন্স কালুজস্কি আর লিজা মেকালোভা, সাথে স্ত্রেমভ। কৃষবেশী কৃশতনু মহিলা লিজা মের্কালোভা, মুখখানায় তাঁর প্রাচ্যদেশীয় অলসতা, চোখ দুটো সুন্দর, সবাই যা বলে, অবর্ণনীয়। তাঁর অন্ধকার রঙের পোশাক একেবারে খাপ খেয়ে গেছে তাঁর রূপের সাথে (আন্না তখনই তা লক্ষ্য করে কদর করেছিলেন)। সাফো যেমন প্রখর আর উচ্চকিত লিজা ঠিক তেমনি নরম আর এলানো।

তবে আন্নার যা রুচি, তাতে লিজা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। তাঁর সম্পর্কে বেত্‌সি আন্নাকে বলেছিলেন যে লিজা অবুঝ শিশুর ভাব নিয়েছেন কিন্তু তাঁকে দেখে আন্না অনুভব করলেন যে কথাটা ঠিক নয়। অবুঝ এবং বখে যাওয়া তিনি ঠিকই, কিন্তু মিষ্টি আর নিরীহ এক নারী। অবিশ্যি তাঁর ধরনটা সাফোর মতই তা সত্যি; সাফোর মতই তাঁর আঁচলে বাঁধা হয়ে ঘুরছিল আর চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিল দুটো ভক্ত—একজন যুবক, অন্যজন বৃদ্ধ; কিন্তু তাঁর মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল, যা তাঁর চতুষ্পার্শের ঊর্ধ্বে কাচগুলোর মাঝখানে তাঁর ভেতরে ছিল সাঁচ্চা হীরের টলটলে দ্যুতি। এ দ্যুতি ফুটত তাঁর সুন্দর, সত্যিই অবর্ণনীয় চোখে। গাঢ় বলয়ে ঘেরা এ চোখের ক্লান্ত সুন্দর, সত্যিই অবর্ণনীয় চোখে। গাঢ় বলয়ে ঘেরা এ চোখের ক্লান্ত অথচ সেইসাথে কামাতুর দৃষ্টি সবাইকে অভিভূত করত তার পরিপূর্ণ অকপটতায়। সে চোখের দিকে তাকিয়ে প্রত্যেকের মনে হত সে তাঁর সব কিছু জেনে ফেলেছে আর তা জেনে তাঁকে না ভালোবেসে পারছে না। আন্নাকে দেখে তাঁর মুখখানা আনন্দের হাসিতে জ্বলজ্বল করে উঠল।

‘আহ্ কি খুশি হলাম আপনাকে দেখে!’ আন্নার কাছে গিয়ে তিনি বললেন, ‘কাল ঘোড়াদৌড়ের মাঠে আমি যেই ভাবছিলাম যে আপনার কাছে যাব, ইচ্ছেই না আমার হয়েছিল। সত্যিই ভয়ংকর, তাই না?’ আন্নার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বললেন, মনে হল তাতে তাঁর সমস্ত অন্তর উদ্ঘাটিত হয়ে আছে।

‘হ্যাঁ, ওটা আমাকে অত বিচলিত করবে ভাবতে পারিনি’, আন্না বললেন লাল হয়ে।

এই সময় লোকজনের উঠে দাঁড়াল বাগানে যাবার জন্য।

‘আমি যাব না’, হেসে আন্নার পাশে বসে লিজা বললেন, ‘আপনিও যাবেন না? কি যে এমন শখ ক্রকেট খেলার!’

‘কিন্তু আমার ভালো লাগে’, আন্না বললেন।

‘এই দেখুন, আচ্ছা কি করে আপনার একঘেয়ে লাগে না? আপনাকে দেখেই মেজাজ ভালো হয়ে যায়। আপনি বেঁচে আছেন, আর আমার একঘেয়ে লাগে।’

‘একঘেয়ে মানে? আপনার তো পিটার্সবুর্গের সবচেয়ে ফুর্তিবাজ সমাজ’, আন্না বললেন।

‘হয়ত যারা আমাদের সমাজের নয়, তাদের একঘেয়ে লাগে আরো বেশি : কিন্তু আমরা, আমি তো নিশ্চয়ই ফুর্তি পাই না, সাঙ্ঘাতিক একঘেয়ে লাগে।’

সিগারেট খেয়ে সাফো যুবক দুটোর সাথে চলে গেলেন বাগানে। বেত্‌সি আর স্ত্রেমভ রয়ে গেলেন চায়ের জন্য। ‘একঘেয়ে মানে?’ বেত্‌সি বললেন, ‘সাফো বললে যে কাল আপনাদের ওখানে সবাই খুব আনন্দ করেছে। ‘উঃ, কি যে ক্লান্তকর লেগেছিল!’ বললেন লিজা মের্কালোভা, ‘ঘোড়দৌড়ের পর আমরা সবাই আমাদের ওখানে যাই। সেই একই পুরানো কাসুন্দি! সেই একই ব্যাপার। সারা সন্ধে এলিয়ে রইলাম সোফায়। এতে ফুর্তির কি আছে? না বলুন, কেমন করে আপনি একঘেয়ে লাগতে দেন না?’ আবার তিনি ফিরলেন আন্নার দিকে, ‘আপনার দিকে তাকালেই বোজা যায় এ মহিলা সুখী বা অসুখী হতে পারেন। কিন্তু একঘেয়ে ওঁর লাগে না। শিখিয়ে দিন-না সেটা আপনি করেন কি করে।’

‘কিছুই করি না’, নাছোড়বান্দা প্রশ্নগুলোয় লাল হয়ে জবাব দিলেন আন্না।

‘এই হল যে সেরা পদ্ধতি’, কথোপকথনে ঢুঁ মারলেন স্ত্রেমভ।

বছর পঞ্চাশেক বয়স প্রেমভের, আধপাকা চুল, দেখতে এখনো তাজা, খুবই অসুন্দর চেহারা, কিন্তু মুখখানায় চরিত্র ও বুদ্ধির ছাপ। লিজা মের্কালোভা তাঁর স্ত্রীর ভাইঝি, স্ত্রেমভ তাঁর গোটা অবসর সময়টা কাটাতেন লিজার সাথে। আন্না করেনিনার সাথে দেখা হওয়ায় চাকরি ক্ষেত্রে কারেনিনের শত্রু হলেও স্ত্রেমভ চেষ্টা করলেন শত্রুর স্ত্রীর প্রতি সাতিশয় সৌজন্যপরবশ হতে।

‘কিছুই করি না’, সূক্ষ্ম হেসে তিনি খেই ধরলেন, এটাই সেরা উপায়। আমি বহুদিন থেকে আপনাকে বলছি’, লিজা মেকালোভার দিকে ফিরলেন তিনি, ‘একঘেয়ে যাতে না লাগে তার বন্যে দরকার একঘেয়ে লাগবে কথাটা না ভাবা। এটা হল অনিদ্রার আশংকা থাকলে গুম হবে না, এই ভয়টা না করার মত। এই কথাটাই আন্না আর্কাদিয়েভনা আপনাকে বললেন ‘

‘ও কথাটা আমি বলতে পারলে খুবই খুশি হতাম। কারণ ওটা শুধু বুদ্ধিমানের মত বলা হয়েছে তাই নয়, কথাটা সত্যিও’, হেসে আন্না বললেন।

কিন্তু ধরুন কেন ঘুম আসে না, একঘেয়ে না লেগে পারা যায় না?’

‘ঘুম আনাতে হলে কাজ করতে হয়, মনে ফুর্তি আনতে হলেও কাজ করতে হয়।’

‘কেন আমি কাজ করব যখন আমার কাজে কারো দরকার নেই? আর ইচ্ছে করে ফুর্তির ভান করব, সে আমি পারিও না, চাইও না। ‘

‘আপনি সংশোধনের বাইরে’, লিজার দিকে না তাকিয়ে স্ত্রেমভ বললেন এবং আবার ফিরলেন আন্নার দিকে 1 আন্নার সাথে কালেভদ্রে দেখা হয়ে বলে উনি তাঁকে ছেঁদো কথা ছাড়া অন্য কিছু বলতে পারতেন না, কিন্তু কবে তিনি পিটার্সবুর্গে ফিরছেন, কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা তাঁকে কেমন ভালোবাসেন, এই ধরনের ছেঁদো কথাগুলো বললেন এমন ভাব করে যে বোঝা গেল তিনি সর্বান্তঃকরণে আন্নার প্রীতি অর্জনে এবং তাঁর প্রতি নিজের শ্রদ্ধা এমন কি বেশি কিছু প্রদর্শনে ইচ্ছুক।

শুকেভিচ এসে ঘোষণা করলেন যে সবাই ক্রিকেট খেলোয়াড়দের জন্য অপেক্ষা করছে।

‘না, যাবেন না দয়া করে’, আন্না চলে যাচ্ছেন শুনে মিনতি করলেন লিজা মেকালোভা। স্ত্রেমভ সায় দিলেন তাঁর কথায়।

‘এই দলটা ছেড়ে বৃদ্ধা ভ্রেদে’র কাছে যাওয়া, সে এক বড় বেশি বৈপরীত্য, তা ছাড়া আপনাকে পেয়ে উনি পরচর্চার উপলক্ষ পাবেন আর এখানে ব্যাপারটা অন্যরকম, ভালো ভালো অনুভূতি সঞ্চার করবেন আপনি যা পরর্চ্চার বিপরীত’, আন্নাকে বললেন তিনি।

অনিশ্চয়তার এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন আন্না। বুদ্ধিমান এই মানুষটার প্রশংসাবাক্য, তাঁর প্রতি লিজা মেকালোভার ছেলেমানুষি অনুরাগ, গোটা এই অভ্যস্ত বড়লোকী পরিবেশ—সবই তাঁর কাছে সহজ কিন্তু যা অপেক্ষা করছে সেটা এতই দুঃসহ যে এক মুহূর্তের জন্য তিনি অনিশ্চয়তায় পড়লেন, থেকে গেলে হয়-না, আলোচনার কষ্টকর মুহূর্তটা আরো পিছিয়ে দেবেন কি। কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে একলা বাড়ি ফিরলে কি তাঁর ভাগ্যে আছে সেটা মনে পড়ার, স্মৃতিতেও যা ভয়াবহ, দু’হাতে চুল চেপে ধরার সেই ভঙ্গিটা মনে পড়ায় তিনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

উনিশ

তাঁর জাগতিক জীবন দেখতে লঘুচিত্ত মনে হলেও বেবন্দোবস্ত ভ্রন্‌স্কি দু’চোখে দেখতে পারতেন না। তরুণ বয়সে যখন তিনি করেছিলেন, তখন মুশকিলে পড়ে টাকা চাইতে গিয়ে একবার প্রত্যাখ্যাত হবার পর থেকে তিনি নিজেকে এমন অবস্থায় পড়তে দেননি।

নিজের হাল সব সময় গুছিয়ে রাখার জন্য অবস্থাসাপেক্ষ ঘন ঘন, অথবা মাঝেমধ্যে, বছরে বার পাঁচেক তিনি একলা হয়ে নিজের অবস্থাটা পরিষ্কার করে নিতেন। এটাকে তিনি বলতেন শোধ-বোধ অথবা ধোয়াধুয়ি।

ঘোড়দৌড়ের পরের দিন দেরিতে ঘুম ভেঙে ভ্রন্‌স্কি দাড়ি না কামিয়ে, গোসল না সেরে উর্দি পরলেন এবং টেবিলের ওপর টাকা-পয়সা, বিল, চিঠিপত্র ছড়িয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। পেত্রিৎস্কি জানতেন যে এরকম অবস্থায় তিনি রেগে থাকেন। ঘুম ভেঙে পেত্রিৎস্কি যখন দেখলেন বন্ধু, লেখার টেবিলে ব্যস্ত, তখন চুপচাপ পোশাক পরে ভ্রন্‌স্কির ব্যাঘাত না ঘটিয়ে রেবিয়ে যান।

একান্ত খুঁটিনাটিতে নিজের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সমস্ত জটিলতা যারা জানে এমন প্রত্যেকেই অজান্তে ধরে নেয় যে এসব পরিস্থিতির জটিলতা এবং তা আসন করার মুশকিলটা শুধু তারই ব্যক্তিগত একটা ঘটনা, বিশেষ একটা আপতিকতা, ভাবে না যে অন্যেরাও তারই মত ব্যক্তিগত পরিস্থিতির জটিলতায় আবেষ্টিত। ভ্রন্‌স্কিরও তাই মনে হয়েছিল। অন্য লোক তাঁর মত মুশকিল পড়রে অনেক আগেই হাল ছেড়ে দিত, দুষ্টচারী হতে বাধ্য হত, এ কথা ভেবে ভেতরে ভেতরে ভ্রন্‌স্কির গর্ব হত না এবং তার যুক্তি থাকত না এমন নয়। কিন্তু ভ্রন্‌স্কি টের পাচ্ছিলেন হত না এবং তার যুক্তি থাকত না এমন নয়। কিন্তু ভ্রন্‌স্কি টের পাচ্ছিলেন যে লেজেগোবরে জড়িয়ে পড়তে না হলে ঠিক এখনই তাঁকে হিসাব-নিকাশ করে নিয়ে নিজের অবস্থাটা সুস্পষ্ট করে তুলতে হবে।

সবচেয়ে সহজ হিসেবে ভ্রন্‌স্কি প্রথম যে জিনিসটা হাতে নিলেন সেটা আর্থিক ব্যাপার। যত তাঁর দেনা আছে, চিঠি লেখার একটা কাগজে নিজের ছোট ছোট অক্ষরে তা সব টুকে যোগ দিয়ে দেখলেন যে দাঁড়াচ্ছে সতেরো হাজার কয়েক শ’ রুল-কয়েক শ’টা তিনি বাদ দিলেন পরিষ্কার হয়ে নেবার জন্য। নিজের টাকাকড়ি আর ব্যাঙ্কের খাতা হিসাব করে দেখলেন যে তাঁর থাকছে এক হাজার আটশ’ রুল, নববর্ষের আগে আর কোন টাকা পাবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। দেনার তালিকা আবার পড়ে তিনি তাকে নতুন করে লিখলেন তিন ভাগে ভাগ করে। প্রথম ভাগটায় রইল যেসব দেনা অবিলম্বে শোধ দিতে হবে, অন্তত চাইলে যাতে দেরি না হয় তার জন্য নগদ টাকা রাখতে হবে হাতে। এই ধরনের দেনা ছিল পায় চার হাজার রুব্‌ল : দেড় হাজার ঘোড়ার জন্য আর আড়াই হাজার তাঁর তরুণ বন্ধু ভেনেস্কির জামিন হিসেবে। ভ্রন্‌স্কির উপস্থিতিতে ভেনেস্কির তাসে এই টাকাটা হেরেছিলেন এক ঠগের কাছে। ভ্রন্‌স্কি তখনই টাকাটা দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন (সেটা তাঁর সাথেই ছিল), কিন্তু ভেনেস্কি আর ইয়াভিন জেদ ধরেননি। সেটা ভালোই, কিন্তু ভ্রন্‌স্কি জানতেন যে নোংরা নোংরা এই যে ব্যাপারটায় তিনি অংশ নিয়েছেন শুধু ভেনেস্কির মৌখিক জামিনদার হিসেবে তাতে ঠগটার মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলে তার সাথে আর কোন কথাবার্তা না চালাবার জন্য এই আড়াই হাজার তাঁর দরকার। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ ভাগটার দরুন চাই চার হাজার। দ্বিতীয় ভাগটার আট হাজারটা কম জরুরি দেনা। সেটা হল প্রধানত ঘোড়াদৌড়ের আস্তাবল, ওট আর বিচালির জন্য এবং ইংরেজটি, সহিস ইত্যাদির কাছে। একেবারে নিশ্চিন্ত থাকতে হলে এই দেনা বাবদেও হাজার দুয়েক টাকা দেওয়া দরকার। দোকান, হোটেল, দর্জির কাছে যা ধার, সে ভাগটা এমন যে তা নিয়ে ভাবনা না করলেও চলে। তাই চলতি খরচার জন্য দরকার নিদেনপক্ষ ছ’হাজার, অথচ আছে কেবল এক হাজার আটশ’। ভ্রন্‌স্কির বার্ষিক আয় লোকে এক লক্ষ বলে ধরে, এমন ব্যক্তির পক্ষে এ দেনাটা কোন মুশকিলের ব্যাপার নয়; কিন্তু আসরে তাঁর আয়টা মোটেই এক লাখ নয়।

পিতার বিশাল যে সম্পত্তি থেকে বছরে এক থেকে দু’লাখ অবধি আয় হত সেটা ভাইদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়নি। এক রাশ দেনা নিয়ে বড় ভাই যখন ডিসেম্ব্রিস্ট বিপ্লবীর কন্যা, সম্পত্তিহীনা ভারিয়া চিরকোভাকে বিয়ে করেন, আলেক্‌সেই তখন পিতৃসম্পত্তির সমস্ত আয় বড় ভাইকে ছেড়ে দিয়ে নিজের জন্য শুধু বছরে পঁচিশ হাজার রাখতে বলেন। বড় ভাইকে আলেকসেই তখন জানিয়েছিলেন যে, যতদিন তিনি না বিয়ে করছেন, আর সেটা খুব সম্ভব কখনো ঘটবে না, তত দিন ঐ টাকাতেই তাঁর বেশ চলে যাবে। এবং ব্যয়বহুল একটা রেজিমেন্টের কমান্ডার, সদ্যবিবাহিত বড় ভাইও এ দান গ্রহণ না করে পারেননি। মায়ের নিজস্ব পৃথক সম্পত্তি ছিল, যে পঁচিশ হাজারের কথা হয়েছিল তা ছাড়াও তিনি আরেক্‌সেইকে দিতেন বছরে আরো বিশ হাজার আর সবই উড়িয়ে দিতেন আলেকসেই। ইদানীং আন্নার সাথে আলেকসেইয়ের গুপ্ত সম্পর্কের কথা কানে আসার এবং মস্কো থেকে তাঁর চলে যাওয়ার ঝগড়াঝাঁটি করে তাঁকে টাকা পাঠানো তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে পঁয়তাল্লিশ হাজারে দিন কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে আর এ বছর শুধু পঁচিশ হাজার পেয়ে আলেক্‌সেই পড়েছেন মুশকিলে। এ মুশকিল আসানের জন্য তিনি মায়ের কাছে টাকা চাইতে পারেন না। ইদানীং মায়ের যে শেষ চিঠি তিনি পেয়েছেন সেটা তাঁকে বিশেষ চটিয়ে দিয়েছে এই কারণে যে তাঁকে তিনি সাহায্য করতে রাজী জীবনে এবং রাজসেবায় তাঁর উন্নতির জন্য, কিন্তু সমস্ত সজ্জন লোকের যাতে মাথা হেঁটে হচ্ছে সে জীবন যাপনের জন্য নয়, এমন একটা ইঙ্গিত ছিল তাতে। তাঁকে কিনে নেবার জন্য মায়ের এই আকাঙ্ক্ষায় গভীর অপমানিত বোধ করলেন তিনি, এবং হয়ে উঠলেন তাঁর প্রতি আরো নিরুত্তাপ। কিন্তু মহানুভবের মত তিনি ভাইকে যে কথা দিয়েছেন তা তিনি ফিরিয়ে নিতে পারেন না এবং আন্নার সাথে সম্পর্কে কিছু কিছু আপতিকতার একটা ঝাপসা ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়ে তিনি এখন টের পাচ্ছিলেন যে ঐ মহানুভব কথাগুলো বলা হয়েছিল লঘুচিত্তে, তিনি অকৃতদার, পুরো ঐ এক লক্ষের আয়ই তাঁর দরকার হতে পারে। তবে কথা ফেরত নেওয়া চলে না। যেই তিনি ভ্রাতৃবধূর কথা ভাবতেন, যেই তাঁর মনে পড়ত যে সুবিধা পেলেই মিষ্টি, লক্ষ্মী এই ভারিয়া তাঁকে বলতেন যে তাঁর মহানুভবতা তিনি মনে রেখেছেন, তাতে মূল্য দেন, অমনি বোজা যেত যা দেওয়া হয়েছে তা ফেরত নেওয়া অসম্ভব। নারীকে প্রহার করা, চুরি করা, মিথ্যা কথা বলার মতই অসম্ভব এটা সম্ভব আর উচিত শুধু একটাই আর মুহূর্ত দ্বিধা না করে ভ্রন্‌স্কি তাই স্থির করলেন : কুশীদজীবীর কাছে দশ হাজার ধার করবেন, তাতে অসুবিধে হবে না, সাধারণভাবেই নিজের ব্যয় ছেঁটে ফেলবেন, বিক্রি করে দেবেন দৌড়ের ঘোড়াগুলো। এই স্থির করে তিনি তখনই চিঠি লিখলেন রোলান্দাকিকে, যে একাধিকবার তাঁর ঘোড়াগুলো কিনতে চেয়েছিল। তারপর তিনি ইংরেজটি আর কুশীদজীবীর কাছে লোক পাঠালেন, তাঁর কাছে যে টাকা ছিল সেটা ভাগ করে রাখলেন বিল অনুসারে। এ ব্যাপারটা ঢুকিয়ে তিনি মায়ের চিঠির একটা নিরুত্তাপ রূঢ় জবাব লিখলেন। তারপর পকেট বই থেকে আন্নার তিনটা চিঠি বের করে আবার পড়লেন সেগুলো, পুড়িয়ে ফেললেন এবং গতকাল সন্ধ্যায় আন্নার সাথে তাঁর কথাবার্তা স্মরণ করে চিন্তায় ডুবে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *