আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৭.১৫

পনেরো

বেলা কত হয়েছে তা লেভিনের চেতনা ছিল না। মোমবাতিগুলো সব পুড়ে গেছে। ডল্লি এইমাত্র এসেছিলেন স্টাডিতে, ডাক্তারকে বললেন একটু গড়িয়ে নিতে। বুজরুক এক সম্মোহকের গল্প বলছিলেন ডাক্তার, সোফায় বসে লেভিন তা শুনছিলেন আর চেয়ে থাকছিলেন তাঁর সিগারেটের ছাইয়ের দিকে। তখন একটা বিরতি চলছিল আর নিজের মধ্যে ডুবে গেলেন তিনি। কি ঘটছে এখন তিনি একেবারে ভুলে গেলেন। ডাক্তারের গল্প শুনে তা বুঝতেও পারছিলেন হঠাৎ শোনা গেল একটা বিসদৃশ চিৎকার। সেটা এত ভয়ংকর যে লেভিন লাফিয়েও উঠলেন না, শুধু ভীত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ডাক্তারের দিকে। ডাক্তার মাথা হেলিয়ে চিৎকারটা শুনলেন, তারপর হাসলেন অনুমোদন ব্যক্ত করে। সবই এতই অস্বাভাবিক যে কিছুই আর অবাক করছিল না লেভিনকে। ‘সম্ভবত এমনটা হওয়াই দরকার’, এই ভেবে বসেই রইলেন সোফায়। কার চিৎকার এটা? লাফিয়ে উঠে, পা টিপে টিপে তিনি গেলেন শোবার ঘরে, লিজাভেতা পেত্রভনা, প্রিন্সেসকে পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন শিয়রে তাঁর জায়গায়। চিৎকারটা থেমে গেছে, কিন্তু কি-একটা যেন বদল হয়েছে এখন। কি সেটা তিনি দেখছিলেন না, বুঝছিলেনও না,দেখতে বা বুঝতে চাইছিলেনই না। তবে সেটা তিনি বুঝতে পারলেন লিজাভেতা পেত্রভনার মুখ দেখে : লিজাভেতা পেত্রভনার মুখ কঠোর, বিবর্ণ আর আগের মতই দৃঢ়সংকল্প, যদিও চোয়াল তাঁর সামান্য কাঁপছিল, ছোখ তাঁর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কিটির দিকে। কিটির আতপ্ত, বেদনাবিকৃত মুখে চুলের গোছা লেপটে গেছে ঘামে। লেভিনের দিকে সে মুখ ফেরানো, খুঁজছিল তাঁর দৃষ্টি। হাত তুলে সে লেভিনের হাত খুঁজছিল, নিজের ঘর্মাক্ত হাতে লেভিনের ঠাণ্ডা হাত নিয়ে সে চেপে ধরল নিজের মুখে।

‘যেও না, যেও না! ভয় পাচ্ছি না আমি, ভয় পাচ্ছি না!’ দ্রুত বলে গেল সে; ‘মা, মাকড়ি খুলে নাও, অসুবিধা হচ্ছে; তুমি ভয় পাচ্ছ না? শিগগিরই, শিগগিরই, লিজাভেতা পেত্রভনা…’

দ্রুত কথা বলে যাচ্ছিল সে, চেষ্টা করছিল হাসার। কিন্তু হঠাৎ বিকৃত হয়ে উঠল তার মুখ, লেভিনকে ঠেলে সরিয়ে দিলে।

‘না, এ যে ভয়ংকর! আমি মারা যাব, মারা যাব! চলে যাও, চলে যাও!’ বলল সে আর আবার বিসদৃশ চিৎকার। মাথা চেপে ধরে লেভিন ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

এ সময়ে ডল্লি তাঁকে বললেন, ‘কিছু না, কিছু না, সব ঠিক আছে!’

কিন্তু যে যাই বলুক, লেভিন অনুভব করলেন যে এবার সর্বনাশ হল। পাশের ঘরে দরজার ঝনকাঠে মাথা রেখে শুনতে লাগলেন এমন সব চিল্লানি আর গর্জন যা তিনি কখনো শোনেননি এবং জানতেন যে চিৎকার করছে একদা যে ছিল কিটি। সন্তানের সাধ বহু আগেই ঘুচে গিয়েছিল তাঁর। এ শিশুর ওপর তাঁর এখন ঘৃণাই হল। কিটি বেঁচে থাক, এমন কি এটাও তিনি আর চাইছিলেন না, শুধু চাইছিলেন বীভৎস এই যন্ত্রণাটা থামুক।

ডাক্তার ঘরে ঢুকতে তিনি তাঁর হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডাক্তার! কি এটা? কি এটা? সৃষ্টিকর্তা!’

‘শেষ হতে যাচ্ছে’, ডাক্তার বললেন। আর বলার সময় তাঁর মুখ ছিল এত গুরুগম্ভীর যে শেষ কথাটাকে লেভিন ধরে নিলেন মৃত্যু বলে।

আত্মবিস্মৃত হয়ে তিনি ছুটে গেলেন শোবার ঘরে। প্রথম যা দেখতে পেলেন সেটা ছিল লিজাভেতা পেত্রভনার মুখ। সে মুখ আরো ভ্রূকুটিত, আরো কঠোর। কিটির মুখ আর নেই। যেখানে তা আগে ছিল সেখানে রয়েছে আর্তিতে আর নির্গত চিৎকারে ভয়াবহ কিছু-একটা। খাটের বাজুতে মাথা ঠেকিয়ে তিনি অনুভব করছিলেন বুক তাঁর এবার ফাটবে। ভয়াবহ চিৎকারগুলো থামছিল না, হয়ে উঠছিল আরো ভয়াবহ এবং যেন আতংকের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না লেভিনের, কিন্তু চিৎকার যে থেমে গেছে তাতে সন্দেহ ছিল না, শোনা যাচ্ছিল শুধু মৃদু ব্যস্ততা, খসখসানি আর চকিত নিঃশ্বাসের শব্দ, কিটির ভাঙা ভাঙা, জীবন্ত, সুখী, কোমল কণ্ঠ আস্তে করে বললেন : ‘শেষ হল।’

লেভিন মাথা তুললেন। কম্বলের ওপর দুর্বল হাত এলিয়ে অসাধারণ সুন্দরী, সুমন্দ কিটি নীরবে চেয়েছিল তাঁর দিকে, হাসবার চেষ্টা করছিল কিন্তু পারছিল না।

আর যে ভয়াবহ রহস্যময়, অপার্থিব জগতে লেভিনের এই বাইশ ঘণ্টা কাটল, সেখান থেকে তিনি হঠাৎ ফিরে এলেন আগেকার প্রাত্যহিক জগতে, কিন্তু তাতে সুখের একটা নতুন, অসহ্য ভাতি। টান-টান তন্ত্রীগুলো সব ছিঁড়ে গেল। আনন্দের ফোঁপানি আর চোখের পানি যা তিনি আগে ভাবতে পারেন নি, তা এমন প্রবল রেগে তাঁর দেহ কাঁপিয়ে উচ্ছসিত হয়ে উঠল যে বহুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না তিনি।

শয্যার কাছে নতজানু হয়ে স্ত্রীর হাত টেনে নিলেন ঠোঁটের কাছে, চুম্বন করলেন আর আঙুলের ক্ষীণ চাপে কিটি সাড়া দিলে সে চুম্বনে। ইতিমধ্যে ওদিকে, খাটের শেষে লিজাভেতা পেত্রভনার সুনিপুণ হাতে মোমবাতির শিখার মত দপদপ করছিল একটি মানব জীবন, যে জীব আগে ছিল না, সবার মত একই অধিকারে, নিজের কাছে একই তাৎপর্য নিয়ে যে বেঁচে থাকবে, বংশ বিস্তার করবে।

‘বেঁচে আছে! বেঁচে আছে! তাতে আবার খোকা! ভাবনা করবেন না!’ লেভিন শুনলেন লিজাভেতা পেত্রভনার গলা, কাঁপা কাঁপা হাতে যিনি পিঠ চাপড়াচ্ছিলেন শিশুর।

‘মা, সত্যি?’ কিটি বলল।

জবাব দিল শুধু প্রিন্সেসের ফোঁপানি।

আর ঘরের ভেতর নীরবতার মাঝখানে, তার চাপা গলা থেকে সম্পূর্ণ অন্য একটা কণ্ঠস্বর সন্দেহাতীত জবাব দিল মায়ের প্রশ্নে। এ হল কে জানে কোথা থেকে আবির্ভূত নতুন এক মানব সত্তার দুঃসাহসী, স্পর্ধিত, অবুঝ চিৎকার। কিছু আগে যদি লেভিনকে বলা হত যে কিটি মারা গেছে, তিনিও মারা গেছেন তার সাথে, তাঁর সন্তানেরা দেবদূত, সৃষ্টিকর্তা তাঁদের সামনে—একটুও অবাক হতেন না তিনি। কিন্তু এখন বাস্তব জগতে ফিরে চিন্তার প্রবল প্রয়াসেই তাঁকে বুঝতে হল কিটি বেঁচে আছে, ভালো আছে, অমন মরিয়া চিৎকার করা প্রাণীটি তাঁরই ছেলে। কিটি বেঁচে আছে, শেষ হয়েছে যন্ত্রণা। আর তিনি অবর্ণনীয় সুখী। এটা তিনি বুঝতে পারছিলেন, এবং সে জন্যই তিনি সুখে ভরপুর। কিন্তু শিশুটি? কোত্থেকে, কি জন্য, কে সে…? এটা তিনি বুঝতে পারছিলেন না কিছুতেই, স্বাভাবিক হতে পারছিলেন না ব্যাপারটায়। এটা তাঁর মনে হল অবান্তর, অতিরিক্ত, তাতে অভ্যস্ত হতে তাঁর অনেক দিন লেগেছিল।

ষোলো

ন’টার পর লেভিনের ঘরে বসে প্রসূতিকে নিয়ে কথাবার্তা বলছিলেন বৃদ্ধ প্রিন্স, সের্গেই ইভানোভিচ কজ্‌নিশেভ আর অব্‌লোন্‌স্কি, অন্যান্য বিষয় নিয়েও কথা হল। আর এই কথাবার্তাগুলোয় লেভিনের অজান্তে মনে পড়ছিল কি ঘটেছে আজ সকাল পর্যন্ত, মনে পড়ল এর আগে কাল কেমন তিনি ছিলেন। যেন একশ’ বছর কেটে গেছে তারপর কি এক দুর্গম উচ্চতায় তিনি আছেন বলে মনে হচ্ছিল তাঁর, সেখানে থেকে তিনি চেষ্টা করে নেমে আসছিলেন যাতে কথাবার্তা বলছিলেন যাঁদের সাথে তাঁরা ক্ষুব্ধ না হন। তিনি আলাপে যোগ দিচ্ছিলেন আর অবিরাম ভেবে যাচ্ছিলেন তাঁর স্ত্রী, তার এখনকার অবস্থার খুঁটিনাটি, তাঁর ছেলের কথা, তার অস্তিত্বটা মেনে নেবার চেষ্টা করছিলেন। বিয়ের পর গোটা নারী জগৎ তাঁর কাছে নতুন একটা, তদবধি অজানা অর্থ বহন করেছিল, এখন তাঁর বোধে তা এত উঁচুতে উঠে গেছে যে কল্পনায় তা ধরতে পারছিলেন না লেভিন। ক্লাবে গতকালের ডিনার নিয়ে আলাপ শুনছিলেন তিনি আর ভাবছিলেন : ‘কি এখন হচ্ছে কিটির? ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি? আর আলাপের মাঝখানে, বাক্যটা শেষ না হতেই উনি লাফিয়ে উঠে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন ঘর থেকে।

প্রিন্স বললেন, ‘কাউকে পাঠিয়ে জানিও কিটির কাছে আমার যাওয়া চলবে কিনা।’

‘ঠিক আছে, এখনই’, না থেমে জবাব দিয়ে লেভিন গেলেন কিটির কাছে।

কিটি ঘুমাচ্ছিল না, মৃদুস্বরে মায়ের সাথে কথা বলছিল শিশুর আসন্ন খ্রিস্ট দীক্ষার পরিকল্পনা নিয়ে।

কিটি এখন পরিচ্ছন্ন, চুল তার আঁচড়ানো, মাথায় কি-একটা নীল জিনিস দেওয়া নাইট ক্যাপ, কম্বলের ওপর হাত বার করে এনে চিত হয়ে শুয়ে আছে সে, লেভিনের চোখে চোখ রেখে দৃষ্টি দিয়ে সে তাঁকে নিজের কাছে ডাকছিল। আর লেভিন যত কাছে আসছিলেন, কিটির এমনিতেই উজ্জ্বল দৃষ্টি হয়ে উঠছিল আরো উজ্জ্বল। মুখে তার পার্থিব থেকে অপার্থিবে সেই পরিবর্তন যা দেখা যায় মুমূর্ষুর ক্ষেত্রে; কিন্তু ওদের ক্ষেত্রে সেটা বিদায়, এক্ষেত্রে স্বাগতম। প্রসবের মুহূর্তে যে ধরনের ব্যাকুলতা লেভিন অনুভব করেছিলেন, আবার তেমন একটা ব্যাকুলতা দেখা দিল তাঁর বুকের মধ্যে। কিটি তাঁর হাত টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করল তাঁর ঘুম হয়েছে কিনা। উত্তর দিতে পারলেন না লেভিন, নিজের দুর্বলতায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

কিটি বলল, ‘আমি কিন্তু একটু হঠাৎ পালটে গেল ওর মুখের ভাব।

শিশুর চিঁচিঁ কান্না শুনে সে বলল, ‘ওকে আমার কাছে দিন লিজাভেতা পেত্রভনা, আমার কাছে দিন, কস্তিয়াও দেখবে।’

‘তা বাবা দেখুক’, লালমত, আঁকুপাঁকু করা, অদ্ভুত কি-একটা বস্তু তুলে এনে বললেন লিজাভেতা পেত্ৰভনা; তবে দাঁড়ান, ওকে তৈরি করে নিই’, এবং আঁকুপাঁকু করা লাল জীবটিকে খাটের ওপর রেখে, তার আচ্ছাদন খুলে আবার নতুন করে মুড়ে, মাত্র একটা আঙুল দিয়ে তাকে ঘুরিয়ে কি যেন ছিটালেন।

ক্ষুদে এই করুণ জীবটি দেখে লেভিন প্রাণপণে চেষ্টা করলেন প্রাণের মধ্যে ওর প্রতি পিতৃস্নেহের কোন লক্ষণ খুঁজে পেতে। তিনি অনুভব করলেন কেবল বিতৃষ্ণা। কিন্তু ওর যখন আচ্ছাদন খোলা হল, ঝলক দিল জাফরান রঙের সরু সরু হাত, পা, তাতেও আবার আঙুলও, যখন লেভিন দেখলেন লিজাভেতা পেত্রভনা কিভাবে বাড়িয়ে দেওয়া এই হাতগুলোকে নরম স্প্রিঙের মত টিপে টিপে মোটা কাপড়ে জড়াচ্ছেন, তখন এই জীবটির জন্য এত কষ্ট হল তাঁর, এত ভয় হল যে লিজাভেতা পেত্রভনা ওর ক্ষতি করে ফেলবেন যে লেভিন হাত চেপে ধরলেন ওঁর।

লিজাভেতা পেত্রজাভেতা পেত্রভনা হাসলেন।

‘ভয় নেই, কোন ভয় নেই!

সাজগোজ হবার পর শিশুটি যখন পরিণত হল আঁটসাঁট একটি পুতুলে, লিজাভেতা পেত্রভনা তখন যেন নিজেদের কাজের জন্য গর্ব নিয়ে তাকে দোলাতে দোলাতে তুলে ধরলেন যাতে লেভিন ছেলেকে দেখতে পান তার সমস্ত শোভায়।

আড়চোখে কিটিও তাকিয়ে ছিল সেদিকে।

‘আমাকে দিন, আমাকে দিন!’ বলে কিটি প্রায় উঠতেই যাচ্ছিল।

‘কি করছেন কাতেরিনা আলেক্‌সান্দ্রভনা, অমন কাজও করবেন না! সবুর, করুন, দেব। এখন আমরা বাবাকে দেখাচ্ছি কেমন বাহাদুর খোকা!’

এই বলে লিজাভেতা পেত্রভনা এক হাতে লেভিনের কাছে তুলে ধরলেন এই অদ্ভূত লাল টলমলে জীবটিকে, অন্য হাতে শুধু আঙুল দিয়ে ঠেক দিলেন কাঁথায় ঢাকা পড়া তার নড়বড়ে মাথা। এর আবার দেখি নাকও, বাঁকা চোখ, পুপুত করা ঠোঁট।

‘সুন্দর খোকা!’ বললেন লিজাভেতা পেত্রভনা।

হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন লেভিন। সুন্দর এই খোকাটি তাঁর মধ্যে কেবল বিতৃষ্ণা আর করুণাই জাগাচ্ছিল। যার আশা করেছিলেন তিনি, এটা মোটেই তা নয়।

লিজাভতা পেত্রভনা যখন শিশুকে মাই ধরতে শেখাচ্ছিলেন, লেভিন ঘুরে দাঁড়ালেন।

হঠাৎ খিলখিল হাসির শব্দে মাথা তুললেন তিনি। হাসছিল কিটি। শিশু মাই টানতে পেরেছে।

‘নিন, হয়েছে, হয়েছে’, বললেন লিজাভেতা পেত্রভনা, কিন্তু কিটি শিশুটিকে ছাড়ল না। তার বুকের ওপরেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।

‘এবার দ্যাখো’, লেভিন যাতে শিশুটিকে দেখতে পায় সেভাবে তাঁর দিকে তাকে ফিরিয়ে কিটি বলল। শিশুটির বুড়োর মত কুঞ্চিত মুখ হঠাৎ আরো কুঞ্চিত করে হাঁচল সে।

হেসে, মমতার চোখের পানি কোনক্রমে চেপে লেভিন স্ত্রীকে চুম্বন করে বেরিয়ে গেলেন অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর থেকে। যা তিনি আশা করেছিলেন, ক্ষুদ্র জীবটির জন্য তাঁর হৃদয়াবেগ মোটেই তেমন হল না। তার ভেতর হাসি-খুশি আনন্দময় ছিল না কিছুই; বরং এটা নতুন একটা যন্ত্রণাকর ত্রাস, আঘাতপ্রবণতার নতুন একটা ক্ষেত্রের চেতনা। আর প্রথম দিকে এই চেতনাটা ছিল এত যন্ত্রণাদায়ক, অসহায় এই জীবটি যাতে কোন কষ্ট না পায় তার জন্য আশংকা ছিল এত প্রবল যে শিশুটি যখন হাঁচে তন অলক্ষ্যে একটা বিচিত্র বোধাতীত আনন্দ, তাঁর এমন কি গর্বই হয়েছিল।

সতেরো

অব্‌লোন্‌স্কির অবস্থাটা খারাপই দাঁড়িয়েছিল। বনের দুই-তৃতীয়াংশের টাকা ইতিমধ্যেই খেয়ে ভুষ্টিনাশ, আর প্রায় সবটাই তিনি অগ্রিম নিয়েছিলেন কারবারীর কাছ থেকে। আরো টাকা সে দিতে চায়নি আরো এজন্য যে দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা এই প্রথম বার তাঁর সম্পত্তির ওপর সরাসরি অধিকার ঘোষণা করে এই শীতে বনের শেষ তৃতীয়াংশের জন্য অর্থপ্রাপ্তির রসিদে সই দিতে অস্বীকার করেন। বেতনের সমস্ত টাকা চলে যাচ্ছিল সাংসারিক খরচায় আর নিরন্তর ছোটখাট দেনা মেটানোয়। মোটেই টাকা ছিল না।

অব্‌লোন্‌স্কির মতে, ব্যাপারটা অস্বস্তিকর, বিছ্‌ছিরি, এমনভাবে চলতে পারে না। তাঁর মতে এর কারণ তিনি বেতন পাচ্ছেন বড় কম। যে পদে তিনি আছেন সেটা স্পষ্টতই পাঁচ বছর আগে ছিল খুবই ভালো, কিন্তু এখন নয়। ব্যাংকের ডিরেক্টার পেত্রভ পাচ্ছে বারো হাজার; কোম্পানির একজন ডিরেক্টার স্তেন্তিৎস্কি পাচ্ছে সতের হাজার; ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মিতিন—পঞ্চাশ হাজার। ‘বোঝাই যাচ্ছে যে আমি ঘুমাচ্ছিলাম, আমার কথা ওরা ভুলেই গেছে’, নিজের সম্পর্কে ভাবলেন অব্‌লোন্‌স্কি। এবং তিনি কান পেতে, চোখ মেলে রইলেন আর শীতের শেষে আবিষ্কার করলেন খুবই ভালো একটা পদ, তার জন্য খালা-ফুফু, কাকা-চাচা, বন্ধু-বান্ধব মারফত প্রথমে আক্রমণ চালালেন মস্কো থেকে, তারপর ব্যাপারটা যখন পরিপক্ক হয়ে উঠল, তখন বসন্তে নিজেই গেলেন পিটার্সবুর্গে। বছরে হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার বেতনের তেমন সব চাকরির এটা একটা যা এখন আগেকার আরামে ঘুষ পাবার জায়গাগুলোর চেয়ে সংখ্যায় বেশি হয়ে উঠেছি; এটা হল দক্ষিণ রেলপথ আর ব্যাংকের ক্রেডিট-ব্যালান্স নিয়ে সম্মিলিত এজেন্সির কমিশন চেয়ারম্যানের পদ। অন্যান্য সমস্ত পদের মত এখানেও দরকার ছিল বিপুল জ্ঞান আর সক্রিয়তা যা একটি মানুষের মধ্যে মেলানো ভার। আর যেহেতু এই গুণগুলি কারো মধ্যে একত্রে মিলেছে এমন লোক ছিল না, তাই অসাধু লোকের চেয়ে সাধু লোকেরই চাকরিটা নেওয়া ভালো। আর অব্‌লোন্‌স্কি শুধু সাধু নন (বিনা স্বরাঘাতে) সাধুই (স্বরাঘাতে জোর দিয়ে), অর্থাৎ সেই বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে যাতে মস্কোয় যখন বলা হয় : সাধু কর্মকর্তা, সাধু লেখক, সাধু পত্রিকা, সাধু প্রতিষ্ঠান, সাধু ধারা, তখন ধরা হয় যে ঐ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানটি শুধু অসাধু নয়, প্রয়োজন হলে সরকারকে খোঁচা দিতেও পারে। এই বিশেষ অর্থেই অব্‌লোন্‌স্কি সাধু। মস্কোর যেসব মহলে তিনি ঘুরতেন সেখানে চালু হয় কথাটা, তাঁকে ধরা হত সাধু লোক বলে, তাই অন্যের চেয়ে পদটা পাবার বেশি অধিকার তাঁরই।

এ পদটায় বছরে সাত থেকে দশ হাজার প্রাপ্য আর অব্‌লোন্‌স্কি নিজের সরকারি চাকরি না ছেড়ে সেটা নিতে পারেন। পদটা নির্ভর করছিল দুটো মন্ত্রক, একজন মহিলা আর দুজন ইহুদির ওপর; এঁদের পটিয়ে রাখা সত্ত্বেও প্রয়োজন ছিল পিটার্সবুর্গে গিয়ে তাঁদের সাথে দেখা করার। তাছাড়া বোন আন্নাকে অব্‌লোন্‌স্কি কথা দিয়েছিলেন যে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কে কারেনিনের চূড়ান্ত জবাব তিনি আনবেন। তাই ডল্লির কাছ থেকে পঞ্চাশ রুব্‌ল চেয়ে নিয়ে উনি রওনা দিলেন পিটার্সবুর্গে।

কারেনিনের স্টাডিতে বসে রুশী ফিনান্সে দুরবস্থার কারণ সম্পর্কে তাঁর রিপোর্ট শুনতে শুনতে অব্‌লোন্‌স্কি অপেক্ষা করছিলেন কখন উনি শেষ করবেন যাতে তাঁর নিজের আর আন্নার ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলা যায়।

পাঁশনে ছাড়া কারেনিন এখন পড়তে পারেন না সেটা নামিয়ে রেখে তিনি যখন ভূতপূর্ব শ্যালকের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন, অব্‌লোন্‌স্কি বললেন, ‘হ্যা, এটা খুবই ঠিক কথা, খুঁটিনাটিতে খুবই ঠিক, তাহলেও আমাদের কালের নীতি হল স্বাধীনতা।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি স্বাধীনতাকে ধারণ করে অন্য একটা নীতি পেশ করছি’, ‘ধারণ’ কথাটার ওপর জোর দিয়ে, রিপোর্টের কোন জায়গায় সেটা বলা হয়েছে সেটা শ্রোতাকে পড়ে শোনাবার জন্য আবার পাঁশনে পরতে পরতে বললেন কারেনিন।

এবং পাতাগুলোর ধারে বড় করে ছাড় দেওয়া কারো সুন্দর হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটির অতি প্রত্যয়জনক জায়গাটা বার করে তা পড়ে শোনালেন।

‘ব্যক্তিবিশেষের লাভের জন্যে নয়, সাধারণ কল্যাণের জন্যে—ধনীগরিব সমানভাবে সকলের জন্যে আমি সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিরোধী’, পাঁশনের ওপর দিয়ে অব্‌লোন্‌স্কির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন; ‘কিন্তু ওঁরা এটা বুঝতে পারেন না, ওঁরা শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত এবং বুলিতে ভেসে যান।’

অব্‌লোন্‌স্কি জানতেন যে কারেনিন যখন ওঁরা, সেই লোকেরা যাঁরা তাঁর প্রকল্প গ্রহণ করতে চাননি, রাশিয়ার সমস্ত দুর্দশার জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁরা কি করছেন আর ভাবছেন সে কথা পাড়েন, তখন বুঝতে হবে যে তাঁর বক্তব্য শেষ হয়ে এসেছে; তাই স্বাধীনতার নীতি বিসর্জন দিয়ে তিনি সাগ্রহেই সায় দিলেন তাঁর কথায়। কারেনিন চুপ করে গেলেন, চিন্তায় ডুবে গিয়ে ওল্টাতে লাগলেন তাঁর পাণ্ডুলিপির পাতা।

‘হ্যাঁ, ভালো কথা’, বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, ‘পমোর্কির সাথে দেখা হলে তুমি যদি ওঁকে একটু বলো যে দক্ষিণ রেলপথের ক্রেডিট-ব্যালান্স নিয়ে সম্মিলিত এজেন্সির কমিশন চেয়ারম্যানের যে পদটা খালি আছে, আমি তাতে যেতে চাই।’

বাঞ্জিত পদটার নাম তাঁর কাছে এতই অভ্যস্ত যে ভুল না করে তা বলে গেলেন গড়গড় করে।

কারেনিন জিজ্ঞেস করলেন নতুন এই কমিশনের কাজটা কি, তারপর চিন্তামগ্ন হলেন। তিনি ভেবে দেখছিলেন কমিশনের কাজকর্মে তাঁর প্রকল্পের বিরোধী কিছু আছে কিনা। কিন্তু নতুন এই সংস্থার ক্রিয়াকলাপ যেহেতু অতি জটিল আর তাঁর প্রকল্প যেহেতু অতি বিস্তৃত একটা ক্ষেত্র নিয়ে, তাই তখনই ভেবে দেখা সম্ভব হল না, পাঁশনে খুলে বললেন:

‘হ্যাঁ, ওঁকে আমি বলতে পারি অবশ্যই। কিন্তু তুমি নিজে এ পদটায় যেতে চাচ্ছ কেন?’

‘ভালো বেতন, নয় হাজার পর্যন্ত, আর আমার সঙ্গতি…’

‘নয় হাজার’, কথাটার পুনরুক্তি করে ভুরু কোঁচকালেন কারেনিন। মোটা বেতনটায় তাঁর মনে হল যে এদিক থেকে অব্‌লোন্‌স্কির প্রস্তাবিত ক্রিয়াকলাপ তাঁর প্রকল্পের প্রধান কথার বিরোধী, যার ঝোঁক সব সময়ই মিতব্যয়ের দিকে।

‘আমি দেখতে পাচ্ছি এবং এ খসড়াটায় লিখেওছি যে আমাদের কালে মোটা বেতন হল আসলে আমাদের পরিচালনার ভুল অর্থনৈতিক নীতির লক্ষণ।’

‘কিন্তু কি চাও তুমি?’ বললেন অবলোন্‌স্কি, ‘নয় ধরলাম যে ব্যাংকের ডিরেক্টার পাচ্ছে দশ হাজার—সে তার যোগ্য। কিংবা ইঞ্জিনিয়ার পাচ্ছে বিশ হাজার। যা বলবে বলো, কাজের মত কাজ তো!’

‘আমি মনে করি যে বেতন হল পণ্যের দাম, তাকে মেনে চলা উচিত জোগান আর চাহিদার নিয়ম। বেতন যদি ধার্য হয় এ নিয়মের বাইরে, যেমন আমি যখন দেখি যে দুজন ইঞ্জিনিয়ার বেরোল একই ইনস্টিটিউট থেকে, একই তাদের জ্ঞান ও গুণ, অথচ একজন পাচ্ছে চল্লিশ হাজার, অন্যজনকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে দুই হাজারে; কিংবা যখন ব্যাঙ্ক কোম্পানির ডিরেক্টার পদে বহাল করা হয় কোন আইনজীবী বা হুসারকে, যাদের ও ব্যাপারে কোন বিশেষজ্ঞতা নেই, তখন আমি সিদ্ধান্ত করি যে বেতন ধার্য হচ্ছে জোগান ও চাহিদার নিয়ম না মেনে। এটা একটা অন্যায় সুবিধা, এমনিতেই তা গুরুত্বপূর্ণ, তাছাড়া রাষ্ট্রীয় সেবায় তা কুফল ফলায়। আমি মনে করি…’

জামাতাকে বাধা দেবার সুযোগ করে নিলেন অব্‌লোন্‌স্কি।

‘কিন্তু তুমি মানবে যে এক্ষেত্রে নতুন এবং নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয় একটা প্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে। যা বলবে বলো, কাজের মত কাজ! সেটা যাতে সাধুতার সাথে চলে জোর দেওয়া হচ্ছে তার ওপর’, ‘সাধুতা’ কথাটার ওপর জোর দিয়ে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি।

কিন্তু ‘সাধু’ কথাটার মস্কো অর্থ কারেনিনের বোধগম্য ছিল না।

‘সাধুতা হল শুধু নেতিবাচক একটা গুণ’, বললেন তিনি।

‘তাহলে তুমি আমার বড় উপকার করবে’, বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, ‘যদি আমার জন্যে পমোঙ্কিকে দুটো কথা বলো। এমনি কথায় কথায়…’

‘কিন্তু এটা মনে হয় বেশি নির্ভর করছে বলগারিনভের ওপর’, কারেনিন বললেন।

তাঁর পক্ষ থেকে বলগারিনভের এতে পুরো মত আছে’, অব্‌লোন্‌স্কি বললেন লাল হয়ে।

বলগারিনভের উল্লেখে তিনি লাল হয়ে উঠেছিলেন কারণ সেদিন সকালেই তিনি গিয়েছিলেন ইহুদি বলগারিনভের কাছে আর সাক্ষাৎটা একটা বিছ্‌ছিরি ছাপ রেখে গেছে তাঁর মনে। অব্‌লোন্‌স্কির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, যে কাজটা তিনি চাইছেন সেটা নতুন, জীবন্ত আর সৎ কাজ; কিন্তু আজ সকালে, বোঝা যায় ইচ্ছে করেই বলগারিনভ তাঁকে অন্যান্য উমেদারদের সাথে প্রতীক্ষা-কক্ষে বসিয়ে রেখেছিলেন দু’ঘণ্টা, তখন হঠাৎ অস্বস্তি হয়েছিল তাঁর।

অস্বস্তি হয়েছিল কি এজন্য যে ওঁকে, রিউরিকের বংশধর প্রিন্স অব্‌লোন্‌স্কিকে দু’ঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছে ইহুদির প্রতীক্ষা-কক্ষে; নাকি শুধু সরকারি চাকরিতে যাবার যে রেওয়াজ পূর্বপুরুষেরা রেখে গেছেন তা ভঙ্গ করে নতুন একটা ক্ষেত্রে যাচ্ছেন বলে—সে যাই হোক, ভারি অস্বস্তি বোধ করেছিলেন তিনি। এই দু’ঘণ্টা ফুর্তি করে প্রতীক্ষা-কক্ষে পায়চারি চালিয়ে, গালপাট্টা ঠিক করে,অন্য উমেদারদের সাথে কথা বলে এবং ইহুদির জন্য বেহুদা অপেক্ষার যে কৌতুকটা পরে বলবেন সেটা ভেবে ভেবে তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলেন অপরের, এমন কি নিজের কাছেও তাঁর অস্বস্তি চাপা দিতে।

কিন্তু কেন এই গোটা সময়টা তাঁর অস্বস্তি আর বিরক্তি লাগছিল : সেটা কি এজন্য যে ‘ইহুদির জন্য বেহুদা অপেক্ষার’ কৌতুকটা তেমন উত্তাল না, নাকি অন্য কিছুর জন্য সেটা তিনি জানতেন না। শেষ পর্যন্ত বলগারিনভ যখন তাঁকে গ্রহণ করলেন অতি সসম্ভ্রমে, স্পষ্টতই তাঁকে হেয় করতে পেরে উল্লসিত হয়ে এবং প্রায় অগ্রাহ্য করলেন তাঁর আর্জি, তখন ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ভুলে যাবার চেষ্টা করেছিলেন অব্‌লোন্‌স্কি। শুধু এখন সেটা মনে পড়ায় লাল হয়ে উঠলেন

আঠারো

‘তোমার কাছে এখন আরো একটা ব্যাপার আছে’, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এবং এই অপ্রীতিকর অনুভূতিটা ঝেড়ে ফেলে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, ‘আন্নার ব্যাপার।

অব্‌লোন্‌স্কি আন্নার নাম করতেই কারেনিনের মুখখানা বদলে গেল একেবারে: আগেকার সজীবতা হারিয়ে তাতে ফুটে উঠল ক্লান্তি, প্রাণহীনতা।

‘কি আপনি চাইছেন আমার কাছে?’ ইজি-চেয়ারে ঘুরে বসে পাঁশনেটা ক্লিক করে বললেন তিনি।

‘সিদ্ধান্ত, যেকোন একটা সিদ্ধান্ত, কারেনিন। এখন আমি তোমার কাছে আবেদন করছি’ (অপমানিত স্বামী হিসেবে নয়’, বলতে চেয়েছিলেন অবলোনস্কি কিন্তু তাতে সব মাটি হবে এই ভয়ে তার বদলে বললেন) : ‘রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা হিসেবে নয়’ (এ কথাটাও তেমন দাঁড়াল না), ‘নিতান্ত মানুষ, সহৃদয় লোক আর খ্রিস্টান হিসেবে। ওকে তোমার করুণা করা উচিত’, বললেন তিনি।

‘মানে, ঠিক কিসের জন্যে?’ মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন কারেনিন।

‘হ্যাঁ, করুণা। তুমি যদি দেখতে যা আমি দেখেছি—সারা শীত আমি কাটিয়েছি ওর সাথে—তাহলে করুণা করতে ওকে। সাঙ্ঘাতিক অবস্থা তার, হ্যাঁ, সাঙ্ঘাতিক।’

‘আমার মনে হয়’, কারেনিন বললেন সরু, প্রায় চিল্লানির গলায়, ‘আন্না আর্কাদিয়েভনা যা চেয়েছিলেন সবই তো পেয়েছেন।’

‘আহ্, সৃষ্টিকর্তার দোহাই কারেনিন, অনুযোগ-অভিযোগ এখন বাদ দাও! যা ঘটেছে, ঘটে গেছে। জানো কি সে এখন চাইছে, প্রতীক্ষা করেছে তার—বিবাহবিচ্ছেদ।’

‘কিন্তু আমি মনে করেছিলাম যে ছেলেকে আমার কাছে রাখার প্রতিশ্রুতি দাবি করলে আন্না আর্কাদিয়ে না বিবাহবিচ্ছেদে আপত্তি করবেন। আমি সেই জবাবই দিয়েছি এবং ভেবেছিলাম যে ব্যাপারটা ঢুকে গেল। আমি মনে করি ব্যাপারটা চুকে গেছে’, তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন কারেনিন।

‘দোহাই সৃষ্টিকর্তা, উত্তেজিত হয়ো না’, জামাতার জানু ছুঁয়ে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, ‘ব্যাপারটা চুকে যায়নি। তুমি অনুমতি করলে আমি ব্যাপারটার বিবরণ দিচ্ছি—ব্যাপারটা ছিল এই: তোমাদের যখন ছাড়াছাড়ি হয়, তোমার আচরণ ছিল মহৎ, যতটা মহৎ হওয়া সম্ভব; ওকে তুমি সব কিছু দিয়েছিলে, মুক্তি, এমন কি বিবাহবিচ্ছেদও। সে এটার কদর করে। না-না, সত্যি বলছি, এটার কদরই করে সে। এমন মাত্রায় যে তোমার প্রতি নিজের অপরাধ বোধের এই প্রথম মুহূর্তগুলোয় সে সব কিছু ভেবে দেখেনি, দেখতে পারতও না। সব কিছু সে ত্যাগ করল। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি, সময় দেখাল যে তার অবস্থা যন্ত্রণাদায়ক। দুঃসহ।’

‘আন্না আর্কাদিয়েভনার জীবনে আমার আগ্রহ নেই’, ভুরু তুলে কথায় বাধা দিলেন কারেনিন।

‘সেটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলে না’, নরম সুরে আপত্তি করলেন অব্‌লোন্‌স্কি; ‘ওর অবস্থাটা ওর পক্ষে যন্ত্রণাকর আর কারো কোন লাভ নেই তাতে। তুমি বলবে যে ওর যা প্রাপ্য তাই পেয়েছে। ও সেটা জানে এবং তোমার কাছে কিছু চাইছে না। সোজাসুজি সে এই কথাই বলে যে কিছু চাইবার সাহস তার নেই। কিন্তু আমি, আমরা সমস্ত আত্মীয়রা, যারা তাকে ভালোবাসে তারা অনুরোধ করছি, মিনতি করছি তোমাকে। কেন ও কষ্ট পাবে? তাতে কার কি উপকার?’

‘মাপ করুন, কিন্তু মনে হচ্ছে আপনি আমাকে অভিযুক্তের পর্যায়ে ফেলছেন’, বললেন স্কারেনিন।

‘আরে না-না, একটুও না, তুমি আমাকে বুঝে দেখো’, আবার জামাতার হাত ছুঁয়ে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, যেন তিনি নিঃসন্দেহ যে এই ছোঁয়াটায় উনি নরম হয়ে আসবেন; ‘আমি শুধু একটা কথা বলব : ওর অবস্থাটা যন্ত্রণাকর, সেটা তুমি সহজ করে দিতে পারে, তোমার কোন ক্ষতি হবে না তাতে। আমি ব্যবস্থা করে রাখব, তোমার নজরেই পড়বে না। তুমি তো কথা দিয়েছিলে।’

‘কথা দিয়েছিলাম আগে। ধরে নিয়েছিলাম ছেলের প্রশ্নে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তাছাড়া আমি আশা করেছিলাম যে আন্না আর্কাদিয়েভনার যথেষ্ট মহানুভবতা থাকবে…’ বিবর্ণ হয়ে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে অতি কষ্টে কথাটা উচ্চারণ করলেন কারেনিন।

‘সব কিছু সে তোমার উদারতার ওপর ছেড়ে দিচ্ছে। সে শুধু একটা অনুরোধ করছে, মিনতি করছে, যে দুঃসহ অবস্থার মধ্যে সে আছে, তা থেকে উদ্ধার করো তাকে। ছেলেকেও এখন আর সে দাবি করছে না। কারেনিন, তুমি দয়ালু মানুষ। ওর অবস্থায় নিজেকে একটু কল্পনা করে দ্যাখো। ওর অবস্থায় বিবাহবিচ্ছেদ ওর কাছে জীবন-মরণের প্রশ্ন। তুমি যদি আগের কথা না দিতে, তাহলে ও অবস্থাটা মেনে নিয়ে গ্রামে গিয়ে থাকত। কিন্তু তুমি কথা দিয়েছিলে, চিঠি লিখেছে তোমাকে, মস্কোয় এসেছে। ওখানে প্রতিটি সাক্ষাৎ ওর বুকে ছুরির মত বেঁধে, থাকে সে ছয় মাস ধরে, সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছে প্রতিদিন। এ যে মৃত্যুদণ্ডিতকে গলায় ফাঁস পরিয়ে হয় মৃত্যু নয় মার্জনার আশ্বাস দিয়ে মাসের পর মাস ধরে রাখার মত। মায়া করো ওকে, তারপর সব কিছু ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি…তোমার খুঁতখুঁতি….

‘আমি ও কথা বলছি না, ও কথা নয়…’ জঘন্যভাবে বাধা দিলেন কারেনিন, ‘কিন্তু হয়ত আমি যে কথা দিয়েছিলাম তার অধিকার আমার ছিল না।’

‘তার মানে কথা ফেরত নিচ্ছ?’

‘যা সম্ভব তা পূর্ণ করতে আমি কখনো আপত্তি করিনি, কিন্তু প্রতিশ্রুতিটা কি পরিমাণে সম্ভবপর তা ভেবে দেখার জন্যে সময় চাই আমার।’

‘না, কারেনিন!’ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, ‘এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। নারীর পক্ষে আদৌ যা হওয়া সম্ভব তেমনি অভাগা সে, তুমি আপত্তি করতে পারো না যে…’

‘প্রতিশ্রুতি যে পরিমাণে সম্ভবপর। তোমাকে মুক্ত চিন্তার লোক বলে জানি। কিন্তু আমি ধর্মবিশ্বাসী, গুরুত্বপূর্ণ এমন একটা ব্যাপারে খ্রিস্টীয় নীতির বিপরীতে যেতে আমি পারি না।’

‘কিন্তু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ে, এবং আমাদের এখানেও, যতদূর আমি জানি বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত’, অলোকি বললেন, ‘আমাদের গির্জাও তা অনুমোদন করেছে। এবং আমরা দেখিছি…’

‘অনুমোদিত, কিন্তু এই অর্থে নয়।’

‘কারেনিন, তোমাকে এখন চেনাই দায়’, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি; ‘তুমিই কি সব ক্ষমা করোনি (আমরা তা মূল্য দিয়েছি), খ্রিস্টীয় অনুভূতিতে চালিত হয়ে আত্মত্যাগে প্রস্তুত ছিলে না কি? তুমিই তো বলেছিলে, কামিজ নিলে, কাফতানটাও দিয়ে দেবে। আর এখন…’

‘অনুরোধ করছি’, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে, বিবর্ণ হয়ে, কম্পিত চিবুকে চিঁচিঁ করে বলে উঠলেন কারেনিন, ‘আপনাকে অনুরোধ করছি এ আলোচনা…বন্ধ করুন।’

‘আহ্ বটে! তবে তোমার মনে যদি আঘাত দিয়ে থাকি তাহলে ক্ষমা করো, ক্ষমা করো আমাকে; ব্ৰিতভাবে হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি; ‘তবে আমি হলাম গিয়ে দূত, যা বলতে বলা হয়েছিল, শুধু তাই বলেছি।’

কারেনিনও হাত বাড়িয়ে দিয়ে খানিক ভেবে বললেন : ‘সবটা ভেবে দেখে কিছু-একটা নির্দেশ পেতে হবে আমাকে। আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমি আপনাকে জানাব পরশু’, কিছু-একটা কথা চিন্তা করে উনি বললেন।

উনিশ

অব্‌লোন্‌স্কি চলে যাবার উপক্রম করছিলেন, এমন সময় কর্নেই এসে খবর দিল : ‘সের্গেই আলেক্‌সেয়িচ! জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন অব্‌লোন্‌স্কি, কিন্তু তখনই মনে পড়ল তাঁর।

বললেন, ‘ও, সেরিওজা! ‘সের্গেই আলেক্‌সেয়িচ’–আমি ভেবেছিলাম কোন ডিপার্টমেন্ট কর্তা হবে বুঝি। মনে পড়ল তাঁর, ‘আন্না ওকে দেখে যেতে বলেছিল।’

মনে পড়ল, ওঁকে বিদায় দেবার সময় ভীরু-ভীরু করুণ চোখে তাকিয়ে আন্না বলেছিলেন : ‘যতই হোক, তুমি দেখা করো ওর সাথে। সবিস্তারে জেনে নিও কোথায় সে আছে, কে দেখাশুনা করছে তার। আচ্ছা স্তিভা… যদি সম্ভব হয়! সম্ভব কি?’

‘যদি সম্ভব হয়’ কথাটার মানে অব্‌লোন্‌স্কি বুঝেছিলেন যে ছেলেকে তাঁর কাছে দিয়ে যদি বিবাহবিচ্ছেদ সম্ভব হয়… এখন অব্‌লোন্‌স্কি দেখতে পাচ্ছেন, ও নিয়ে ভাবাই চলে না, তাহলেও ভাগ্নেকে দেখতে পাবেন বলে তিনি খুশি।

শ্যালককে কারেনিন মনে করিয়ে দিলেন যে ছেলেকে মার কথা কখনো বলা হয় না এবং অনুরোধ করলেন যে আন্নার কথা তিনি যেন মনে না পড়িয়ে দেন।

‘মায়ের সাথে ওই যে সাক্ষাৎটা আমরা ক-ল্প-না করিনি, তারপর খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে সে’, বললেন কারেনিন, ‘আমরা তো ভয় করছিলাম বুঝি বাঁচবেই না। তবে বিচক্ষণ চিকিৎসা আর গ্রীষ্মে সমুদ্র স্নান তাকে ভালো করে তোলে। এখন ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। সত্যিই, বন্ধুদের ভালো প্রভাব পড়েছে ওর ওপর। এখন সে একেবারে সুস্থ, পড়াশুনাও করছে ভালো।’

‘আরে, কি সুন্দর নওলকিশো! সেরিওজা আর নয়, একেবারে গোটাগুটি সের্গেই আলেক্‌সেয়িচ!’ নীল জ্যাকেট আর লম্বা প্যান্ট পরা চওড়া-কাঁধ সুশ্রী যে ছেলেটা ঘরে ঢুকল উদ্দাম ভঙ্গিতে, অকুণ্ঠে, তার উদ্দেশে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি। ছেলেটাকে সুস্থ, হাসি-খুশি দেখাচ্ছিল। মামার উদ্দেশে সে মাথা নোয়াল যেন উনি অচেনা কোন লোক, কিন্তু তারপর চিনতে পেরে লাল হয়ে উঠল, তাড়াতাড়ি করে সরে গেল সে, যেন কিছু-একটায় সে আহত, ক্রুদ্ধ বোধ করছে। বাপের কাছে গিয়ে স্কুলে পাওয়া মার্ক-শীট সে দেখাল।

‘তা ভালোই তো’, পিতা বললেন, ‘এখন যেতে পারো।’

‘রোগা হয়ে ও বেড়ে উঠেছে, এখন আর শিশু নয়, বালক। এটা আমি ভালোবাসি’, অব্‌লোন্‌স্কি বললেন, ‘আমাকে চিনতে পারছ?’

ছেলেটা চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল পিতার দিকে।

‘পারছি, মামা’, ওঁর দিকে তাকিয়ে এটুকু বলে আবার সংকুচিত হয়ে উঠল ছেলেটা।

মামা তাকে কাছে ডেকে তার হাত ধরলেন।

‘তা কেমন চলছে?’ ছেলেটার সাথে কথা বলার আগ্রহে কিন্তু কি বলবেন ভেবে না পেয়ে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি। লাল হয়ে ছেলেটা কোন জবাব না দিয়ে সন্তর্পণে মামার হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল। অব্‌লোন্‌স্কি ওর হাত ছেড়ে দিতেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে পিতার দিকে চেয়ে ছাড়া-পাওয়া পাখির মত দ্রুত পদক্ষেপে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

মাকে সেরিওজা শেষ দেখার পর এক বছর কেটেছে। সেই থেকে মায়ের সম্পর্কে কোন কথা সে শোনেনি। এই বছরেই তাকে স্কুলে দেওয়া হয়, ভাব হয় বন্ধুদের সাথে, তাদের সে ভালোবাসে। মায়ের সাথে সাক্ষাতের পর যেসব কল্পনা আর স্মৃতি তাকে অসুস্থ করে তুলেছিল, তা আর তার মনে আসত না। যখন মনে আসত, ত্রস্তে তা সে মন থেকে তাড়াত, মনে করত ওটা লজ্জার কথা, মেয়েদেরই তা সাজে, বালক এবং সঙ্গী পদবাচ্যদের নয়। সে জানত যে পিতামাতার কলহ আর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, এও জানত যে পিতার কাছেই তাকে থাকতে হবে, চেষ্টা করত তাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবার।

মায়ের মত দেখতে মামাকে যখন সে দেখল, ভালো লাগেনি তার, কেননা তাতে সেই সব স্মৃতিই জাগছিল যা সে মনে করত লজ্জাকর। ভালো লাগেনি আরো এই কারণে যে স্টাডির দরজার কাছে অপেক্ষা করার সময় কতকগুলো কথা তার কানে এসেছিল, বিশেষ করে পিতা ও মামার মুখভাব দেখে সে অনুমান করতে পেরেছিল যে ওঁদের মধ্যে নিশ্চয় কথাবার্তা হয়েছে মাকে নিয়ে। যে পিতার সাথে সে আছে, যাঁর ওপর সে নির্ভরশীল, তাঁর কোন দোষ ধরতে না চেয়ে এবং প্রধান কথা, যে ভাবালুতাকে সে অত হীন বলে গণ্য করত তাতে আত্মসমর্পণ না করার জন্য, এই যে মামা এসেছেন তার শান্তি ভঙ্গ করতে তাঁর দিকে না তাকাবার, যেসব কথা তিনি মনে পড়িয়ে দিচ্ছেন তা নিয়ে না ভাবার চেষ্টা করল সে।

কিন্তু তার পেছন পেছন বেরিয়ে গিয়ে অব্‌লোন্‌স্কি যখন তাকে দেখতে পেলেন সিঁড়িতে, কাছে ডাকলেন, জিজ্ঞেস করলেন স্কুলে অবসর সময়গুলো কিভাবে সে কাটায়, পিতা না থাকায় সে তখন কথা বলতে লাগল মামার সাথে।

প্রশ্নের উত্তরে সে বলল, ‘এখন আমাদের রেল-রেল খেলা চলছে। জানেন, খেলাটা এরকম : দুজন বসে বেঞ্চির ওপর। এরা হল প্যাসেন্জার। একজন বেঞ্চির ওপরে দাঁড়ায়। বাকি সবাইকে জোতা হয়। গাড়ি টানা চলে হাত দিয়েও কিংবা বেল্ট দিয়েও। সমস্ত হলের মধ্যে দিয়ে চলি। দরজা খোলা হয় আগে থেকেই। কিন্তু কন্ডাক্টর হওয়া তখন সহজ নয়!’

‘যে দাঁড়িয়ে থাকে?’ হেসে জিজ্ঞেস করলেন অব্‌লোন্‌স্কি।

হ্যাঁ, এতে দরকার যেমন সাহস তেমনি চটপটে চাল, বিশেষ করে গাড়ি যদি হঠাৎ থামে, কিংবা যদি কেউ পড়ে যায়।’

‘হ্যাঁ, এটা ঠাট্টার ব্যাপার নয়’, এখন আর শিশুর মত নয়, পুরো অকপট নয়, মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সজাগ চোখ দুটোর দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিপাত করে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি। আর আন্নার কথা পাড়বেন না বলে কারেনিনকে আশ্বাস দিলেও, তিনি আর পারলেন না।

হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাকে তোমার মনে পড়ে?’

‘না, পড়ে না’, লাল টকটকে হয়ে চোখ নামাল সে। তার কাছ থেকে আর কোন কথা বার করতে পারলেন না মামা।

আধ ঘণ্টা পরে স্লাভ দেশীয় গৃহশিক্ষক সেরিওজাকে দেখতে পেল সিঁড়িতে, অনেকক্ষণ ধরতে পারল না সে রাগে ফুঁসছে নাকি কাঁদছে।

‘নিশ্চয় চোট খেয়েছ, কখন পড়ে গিয়েছিলে?’ জিজ্ঞেস করল গৃহশিক্ষক, ‘আমি তো বলেছিলাম যে খেলাটা বিপজ্জনক। অধ্যক্ষকে বলা দরকার।’

‘চোট খেলেও কারো নজরে পড়েনি। নিশ্চয় করে বলছি।’

‘তাহলে?’

এখন আর শুধু গৃহশিক্ষককে নয়, সে গোটা দুনিয়াকে বলল : ‘আমাকে রেহাই দিন! মনে পড়ে, নাকি পড়ে না… তাতে ওঁর কি দরকার? কেন আমার মনে পড়বে? আমাকে শান্তিতে থাকতে দিন!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *