আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৫.৫

পাঁচ

গির্জায় ছিল গোটা মস্কো, আত্মীয় পরিচিত সবাই। বিবাহানুষ্ঠানের সময় আলো-ঝলমল গির্জায়, সুসজ্জিত নারী ও ললনা, সাদা টাই, ফ্রককোট, আর ফৌজী উর্দি পরা পুরুষদের ভিড়ে শালীনতা মেনে মৃদু কথোপকথনের আর বিরাম ছিল না। সেটা চালাচ্ছিল প্রধানত পুরুষেরাই, মেয়েরা ছিল অনুষ্ঠানের সমস্ত খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণে তন্ময়, সব সময়ই এগুলি তাদের পবিত্র অনুভূতিকে নাড়া দেয়।

কনের সবচেয়ে কাছের মহলটায় ছিলেন তার দুই বোন, ডল্লি এবং বিদেশ থেকে আগত ধীর-স্থির সুন্দরী বড় বোন লভা।

‘বিয়েতে মারি এ কি-একটা বেগুনি গাউন পরে এসেছে, প্রায় কালো বললেই চলে’, বললেন কর্সুনস্কায়া।

‘ওর গায়ের যা রঙ, তাতে এটাই একমাত্র উদ্ধার’, মন্তব্য করলেন দ্রুবেৎস্কায়া, ‘কিন্তু আমার অবাক লাগছে, বিয়ের অনুষ্ঠানটা করা হল সন্ধ্যায় কেন। এ যে বেনিয়াদের রেওয়াজ…’

‘সন্ধ্যায়ই আরও সুন্দর লাগে। আমারও বিয়ে হয়েছিল সন্ধ্যায়’, বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কর্মনস্কায়া। তাঁর মনে পড়ল সে দিনটায় কি মধুর দেখিয়েছিল তাঁকে, স্বামী ছিল কি হাস্যকর রকমের প্রেমোন্মাদ আর এখন সবই কি অন্যরকম।

‘লোকে বলে, দশ বারের বেশি যে শাফের হয়, তার বিয়ে হয় না। আত্মরক্ষার জন্য আমি দশম বার শাফের হব ভাবছিলাম, কিন্তু বেদখল হয়ে গেছে আমার জায়গাটা’, সুন্দরী প্রিন্সেস চার্স্কায়াকে বলছিলেন কাউন্ট সিনিয়াভিন। তাঁর ওপর সুন্দরীর নজর ছিল।

চার্কায়া জবাবে শুধু হাসলেন। কিটিকে দেখছিলেন তিনি আর ভাবছিলেন কবে আর কিভাবে তিনি কাউন্ট সিনিয়াভিনের সাথে দাঁড়াবেন কিটির অবস্থায় এবং কেমন করে তিনি ওঁকে মনে করিয়ে দেবেন আজকের এই রসিকতার কথাটা।

বর্ষীয়সী রানী-সহচরী নিকোলায়েভাকে শ্যেরবাৎস্কি বলছিলেন যে তিনি কিটির কুন্তলের ওপর মুকুট তুলে ধরবেন বলে ঠিক করেছেন যাতে সে সুখী হয়।

‘পরচুলা পরতে হত না’, বললেন নিকোলায়েভা। অনেক আগেই তিনি স্থির করে রেখেছেন, যে বৃদ্ধ বিপত্নীকটির জন্য তিনি টোপ ফেলছেন, তার সাথে বিয়ে হলে সেটা হবে নিতান্ত সাদামাটা, ‘এসব রঙচঙ আমার ভালো লাগে না। ‘ দারিয়া দমিত্রিয়েভনাকে কজ্‌নিশেভ রসিকতা করে বোঝাচ্ছিলেন যে বিয়ের পরই চলে যাওয়ার রেওয়াজটা ছড়াচ্ছে কারণ নববিবাহিতরা সব সময়ই খানিকটা লজ্জা পায়।

‘আপনার ভাইয়ের গর্ব হওয়ার কথা। আশ্চর্য মিষ্টি মেয়ে কিটি। মনে হয় আপনার ঈর্ষা হচ্ছে, তাই না?’

‘আমি ওটা কাটিয়ে উঠেছি দারিয়া দ্‌মিত্রিয়েভনা’, জবাব দিলেন তিনি আর মুখখানা তাঁর হঠাৎ হয়ে উঠল বিমর্ষ, গুরুগম্ভীর

অব্‌লোন্‌স্কি শ্যালিকাকে বলছিলেন বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে তাঁর কৌতুকের কথা।

‘ফুলের মুকুটটা ঠিক করে দিতে হয়’, ওঁর কথা না শুনে জবাব দিলেন শ্যালিকা।

‘ওর চেহারাটা এত খারাপ হয়ে গেছে, কি দুঃখের কথা’, লজ্জাকে বলছিলেন কাউন্টেস নস্টন, ‘যাই বলুন, 3 কিটির কড়ে আঙুলেরও যোগ্য নয়। তাই না?’

‘তা কেন, ওকে আমার খুবই ভালো লাগে। আর সেটা আমার ভাবী জামাতা বলে নয়’, জবাব দিলেন লভা, ‘আর কি সুন্দর চালিয়ে যাচ্ছে! এ অবস্থায় অমন থাকতে পারা—হাস্যকর না দেখানো সহজ নয়। ওকে কিন্তু হাস্যকরও লাগছে না, কাঠখোট্টাও নয়। বোঝা যায় যে বিচলিত।’

‘মনে হচ্ছে আপনি এটা চাইছিলেন?’

‘প্রায়। কিটি বরাবরই ভালোবেসেছে ওকে।’

‘তা বেশ, দেখা যাক ওদের মধ্যে কে আগে দাঁড়াবে গালিচায়; আমি কিটিকে বলে রেখেছি।’

‘ওতে কিছু এসে যায় না’, উত্তর দিলেন লভা, ‘আমরা সব সময়ই বাধ্য স্ত্রী। ওটা আমাদের ধাত।’

‘আর আমি ইচ্ছে করেই ভাসিলির আগে গিয়ে দাঁড়াই আর আপনি, ডল্লি ‘

ডল্লি দাঁড়িয়ে ছিলেন কাছেই, ওঁদের কথা শুনছিলেন, কিন্তু জবাব দিলেন না। ভারি ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন তিনি। চোখে তাঁর পানি এসে গিয়েছিল, না কেঁদে কিছু বলতে তিনি পারতেন না। কিটি আর লেভিনের জন্য আনন্দ হচ্ছিল তাঁর; মনে মনে নিজের বিয়ের দিনটায় ফিরে গিয়ে তিনি দেখছিলেন জ্বলজ্বলে-মুখ অব্‌লোন্‌স্কিকে, ভুলে গেলেন নিজের বর্তমান, মনে পড়ছিল কেবল তাঁর প্রথম নিষ্কলংক ভালোবাসার কথা। তিনি স্মরণ করলেন শুধু নিজেকে নয়, নিকট ও পরিচিত সমস্ত নারীদেরই; স্মরণ করলেন তাদের একমাত্র জয়জয়ন্তীর দিনটা যখন কিটির মতই বুকের মধ্যে ভালোবাসা, আশা আর ভয় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মুকুটের তলে, অতীতকে বিদায় দিয়ে প্রবেশ করেছিল রহস্যময় ভবিষ্যতে। এই ধরনের যত নববধূর কথা তাঁর মনে হল, তার মধ্যে ছিলেন তাঁর মিষ্টি আন্নাও, যাঁর সম্ভাব্য বিবাহবিচ্ছেদের বৃত্তান্ত তিনি শুনেছেন সম্প্রতি। তিনিও এমনি কমলা রঙের ফুলে আর অবগুণ্ঠনে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিষ্কলুষ মূর্তিতে। আর এখন?’

‘ভারি অদ্ভুত’, বললেন তিনি।

ক্রিয়াকর্মের সমস্ত খুঁটিনাটি লক্ষ করছিলেন শুধু বোনেরা, বান্ধবীরা এবং আত্মীয়-স্বজনেরাই নয়; বাইরের মেয়েরা, দর্শনার্থীরাও পাছে বরকনের কোন একটা ভঙ্গি, কোন একটা মুখভাব দৃষ্টিচ্যুত হয় এই ভয়ে উদ্বেল হৃদয়ে দম বন্ধ করে সব লক্ষ্য করছিলেন এবং নির্বিকার পুরুষদের রহস্য করে বলা অথবা অবান্তর উক্তির উত্তর দিচ্ছিলেন না, প্রায়শ শুনছিলেনই না।

‘অমন কাঁদো-কাঁদো মুখ কেন? নাকি বিয়ে করছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে?’

‘অমন সুকুমার একজন বরকে বিয়ে করতে গেলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে আবার কি আছে? প্রিন্স নাকি?’

‘সাদা রেশমের পোশাকেও কি ওর বোন? শোন শোন ডিকন এবার কেমন করে হেঁকে ওঠে : নারী ভয় করো তোমার পতিকে।’

‘চুদোভের ঐকতান দল?’

‘না, সিনোদের।’

‘চাপরাশিকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলছে যে বর এখুনি ওকে নিয়ে যাবে নিজের মহালে। বলছে, সাংঘাতিক বড়লোক। সেই জন্যই বিয়ে দিলে।’

‘না, দুটোতে মানিয়েছে বেশ।

‘আর আপনি মারিয়া ভ্লাসিয়েভনা আমাকে বলছিলেন যে কুনোলিন আজকাল কেউ আর ওরকম পরে না। আলতা রঙের পোশাকে ওই ওকে দেখুন, শুনছি নাকি রাষ্ট্রদূতের বৌ, কি মেখলা… একবার এদিকে, আবার ওদিক।’

‘আহা, বেচারি কনে, বধ করার আগে যেন সাজানো মেষটি! যতই বলো, করুণা হয় আমাদের বোনদের দেখলে।’

গির্জার দরজা দিয়ে যারা সেঁধতে পেরেছিল, এই ধরনের কথাবার্তা চলছিল সে সব দর্শনার্থীদের মধ্যে।

ছয়

আংটি-বদল অনুষ্ঠান হয়ে যাবার পর গির্জার একজন লোক গোলাপি রঙের এক টুকরো রেশমী বস্ত্র পেতে দিলে গির্জার মাঝখানে গ্রন্থপীঠটার সামনে, ঐকতান দল শুরু করল জটিল ও নিপুণ একটি স্তোত্র, যাতে তারা ও উদারা স্বরগ্রাম বাজছিল সংঘাতে। যাজক ঘুরে কনেকে। গালিচায় প্রথম যে পা দেবে পরিবারে তারই থাকবে প্রাধান্য, এই সুলক্ষণটা নিয়ে কতবার কত কথাই না তাঁরা শুনেছেন, কিন্তু গালিচার দিকে কয়েক পা তাঁরা যখন এগিয়ে গেলেন, তখন কিটি’বা লেভিন কারুর সে কথা মনে পড়ল না। এক দলের মতে লেভিন প্রথম পদক্ষেপ করেছেন, অন্য দলে দুজনে গেছে একসাথেই, এই নিয়ে তুমুল মন্তব্য ও বিতর্কও কানে গেল না তাদের।

পরিণয় বন্ধনে আবদ্ধ হতে তারা রাজি আছে কিনা, অন্য কাউকে বাগ্দান করেছে কিনা, এসব চলতি প্রশ্নের যেসব জবাব তাঁদের নিজেদের কানেই অদ্ভুত শোনাল, তারপর শুরু হল নতুন আচার। প্রার্থনার কথাগুলোর মানে বোঝার চেষ্টা করে তা শুনছিল কিটি, কিন্তু মনে ধরতে পারছিল না। অনুষ্ঠান যত এগোচ্ছিল, মন তার ততই ভরে উঠছিল একটা বিজয়বোধ আর সমুজ্জ্বল আনন্দে, মনোনিবেশের ক্ষমতা থাকছিল না তার।

প্রার্থনা করা হল : ‘উহাদিগে আরও দান করো শুচিতা ও গর্ভফল, উহাদিগে আহ্লাদিত করো পুত্র ও কন্যার মুখদর্শন করাইয়া।’ স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল, সৃষ্টিকর্তা আদমের পঞ্চরাস্থি থেকে স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং ‘তার জন্য মানুষ পিতা ও মাতাকে ত্যাগ করিয়া স্ত্রীতে আসক্ত হইবেক এবং দুই দেহ এক হইবেক, আর ইহা মহারহস্য’; প্রার্থনা করা হল, সৃষ্টিকর্তা আইজাক ও রেবেকাকে, জোসেফ মোজেস আর জিপ্পোরাকে যেমন দিয়েছেন, এদেরও তেমনি উর্বরতা আর আশীর্বাদ দিন, এরা যেন নিজেদের পুত্রের পুত্রদের দেখে যায়। এসব শুনতে শুনতে কিটি ভাবছিল, ‘সবই অপূর্ব, এছাড়া অন্য কিছু হতে পারত না’, তার দীপ্ত মুখে জ্বলজ্বল করছিল সুখের হাসি যা অজ্ঞাতসারে সঞ্চারিত হচ্ছিল অন্যদের মধ্যেও যারা তাকাচ্ছিল তার দিকে।

যাজক যখন ওদের মুকুট পরালেন আর শ্যেরবাৎস্কি তিন বোতাসের দস্তানা পরা কাঁপা-কাঁপা হাতে সে মুকুট কিটির মাথার অনেক ওপরে তুলে ধরে রাখলেন, তখন কেউ-কেউ যেন পরামর্শ দিল, ‘পুরোপুরি পরিয়ে দিন!

‘পরিয়ে দিন!’ হেসে ফিসফিস করল কিটি।

কিটির দিকে চাইলেন লেভিন, তার মুখের আনন্দ ঝলকে অভিভূত বোধ করলেন তিনি; অজ্ঞাতসারে সে আনন্দটা সঞ্চারিত হল তাঁর মধ্যেও। কিটির মতই তিনি উদ্‌ভাসিত আর খুশি হয়ে উঠলেন।

বাইবেল পাঠ এবং শেষ শ্লোকে ডিকনের যে কণ্ঠনির্ঘোষের জন্য বাইরের লোক অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল তা শুনতে ভালো লাগছিল তাঁদের। ভালো লাগছিল চ্যাপ্টা পাত্র থেকে পানি-মেশানো উষ্ণ সুরা পান করতে। আর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগল যখন যাজক তাঁর আঙরাখা তুলে দু’হাতে ওঁদের নিয়ে গেলেন গ্রন্থপীঠ প্রদক্ষিণে আর জলদগম্ভীর গলায় একক গায়ক গেয়ে উঠল : ‘উল্লাস করো ইসায়া’। মুকুটবাহক শ্যেরবাৎস্কি আর চিরিকভও কনের কলাপে জড়িয়ে গিয়ে কেন জানি হাসছিল, আনন্দ হচ্ছিল তাদেরও, কখনো দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল তারা আর যাজক থেমে গেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল বর-কনের ওপর। আনন্দের যে ফুলকি জ্বলে উঠেছিল কিটির মধ্যে, মনে হল তা যেন গির্জায় উপস্থিত সকলের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছে। আর তাঁর যা ইচ্ছা হচ্ছে, যাজক আর ডিকনও সেইভাবে হাসতে চাইছেন বলে মনে হল লেভিনের।

ওঁদের মাথার ওপর থেকে মুকুট তুলে নিয়ে যাজক পাঠ করলেন শেষ প্রার্থনা, অভিনন্দন জানালেন নবদম্পতিকে। লেভিন চাইলেন কিটির দিকে, এমনটা তাকে আগে আর কখনো দেখেননি। তার মুখে সুখের যে নতুন প্রভা দেখা দিয়েছে, তাতে অপরূপ লাগছিল তাকে। লেভিন তাকে কিছু-একটা বলতে চাইছিলেন, কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলেন না অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে কিনা। যাজক উদ্ধার করলেন তাঁকে। সহৃদয় মুখে হাসি নিয়ে মৃদুস্বরে তিনি বললেন, ‘চুম্বন করুন স্ত্রীকে, আর আপনি চুম্বন করুন স্বামীকে।’ ওঁদের হাত থেকে মোমবাতি নিয়ে নিলেন তিনি।

সন্তর্পণে স্মিত ওষ্ঠপুটে চুম্বন করলেন লেভিন, তারপর কিটিকে বাহুলগ্না করে নৈকট্যের একটা নতুন বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন গির্জা থেকে। এটা যে সত্যি তা বিশ্বাস হচ্ছিল না তাঁর, বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। শুধু যখন তাঁদের ভীরু ভীরু বিস্মিত দৃষ্টির বিনিময় হচ্ছিল, কেবল তখনই বিশ্বাস করছিলেন তিনি, কেননা অনুভব করছিলেন ওঁরা এখন এক।

নৈশাহারের পর নবদম্পতি সেই রাতেই চলে গেলেন গ্রামে।

সাত

আন্না আর ভ্রন্‌স্কি একসাথে ইউরোপ ভ্রমণ করছেন আজ তিন মাস। তাঁরা যান ভেনিস, রোম এবং নেসে এখন সত্য এসেছেন ছোট একটি ইতালীয় শহরে কিছুকাল এখানে কাটাবেন বলে।

পকেটে হাত গুঁজে, অবজ্ঞাভরে চোখ কুঁচকে সমীপবর্তী এক ভদ্রলোককে কি-একটা কড়া জবাব দিচ্ছিল সুদর্শন চেহারার হেড ওয়েটার, পমেড মাখানো ঘন চুল তার ঘাড় থেকে পাট করা, পরনে ফ্রক-কোট, বাতিস্ত শার্টে ঢাকা চওড়া বুক, গোল পেটের ওপর একগোছা দোলক। ঢোকবার অন্য মুখ থেকে সিঁড়ির দিকে পদশব্দ যেতে শুনে সে ঘুরে দাঁড়াল এবং তাদের ওখানে সেরা ঘরগুলো ভাড়া নিয়েছেন যে রুশী কাউন্ট, তাঁকে দেখে সসম্ভ্রমে পকেট থেকে হাত বার করে মাথা নুইয়ে জানাল যে কুরিয়ার এসেছিল, পালাৎসো ভাড়া নেওয়া চলবে, সরকার চুক্তি সই করতে রাজি।

‘আ, খুশি হলাম’, ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘উনি কি ঘরে আছেন?’

ওয়েটার বলল, ‘উনি বেড়াতে বেরিয়েছিলেন, তবে এখন ফিরেছেন।’

চওড়া কানার নরম টুপিটা মাথা থেকে খুলে ভ্রন্‌স্কি তাঁর ঘর্মাক্ত কপাল আর চুপ মুছলেন। চুল নেমে এসেছে কানের আধখানা পর্যন্ত, উল্টো দিকে তা আঁচড়ানোয় ঢাকা পড়েছে টাকটা। এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে লক্ষ করছিলেন। অন্যমনস্কভাবে সে দিকে চেয়ে চলে যাবার উপক্রম করলেন তিনি।

ওয়েটার বলল, ‘এ ভদ্রলোক রুশী, আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।’

পরিচিতদের হাত এড়িয়ে কোথাও যাবার নেই বলে বিরক্তি আর নিজের একঘেয়ে জীবনে বৈচিত্র লাভের বাসনার একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে যে ভদ্রলোক খানিকটা সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন, তাঁর দিকে আরো একবার চাইলেন ভ্রন্‌স্কি; আর একই সাথে জ্বলজ্বল করে উঠল দুজনেরই চোখ।

‘গোলেনিশ্যেভ!’

‘ভ্ৰনস্কি!’

সত্যিই ইনি গোলেনিশ্যেভ, পেজ কোরে থাকাকালে ভ্রন্‌স্কির বন্ধু। কোরে গোলেনিশ্যেভ ছিলেন উদারনৈতিক মতবাদের লোক, কোর থেকে বেরন অসামরিক পদ নিয়ে, ফৌজে কোথাও কাজ করেননি। কোর থেকে উত্তীর্ণ হবার পর দুই বন্ধুর একেবারে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, পরে দেখা হয়েছিল কেবল একবার।

সে সাক্ষাৎটা থেকে ভ্রন্‌স্কি বুঝেছিলেন যে গোলেনিশ্যেভ কি-সব উচ্চমার্গীয় উদারনৈতিক ক্রিয়াকলাপে আত্মনিয়োগ করেছেন এবং সে কারণে ভ্রন্‌স্কির ক্রিয়াকলাপ ও পদে নাক সিঁটকাবার ইচ্ছে হচ্ছিল তাঁর। তাই গোলেনিশ্যেভের সাথে সাক্ষাতের সময় ভ্রন্‌স্কি লোকদের সামনে বরাবর যা করে থাকেন তেমন একটা শীতল ও গর্বিত ভাব ধারণ করেছিলেন যা শুধু তিনিই পারেন, যাতে বোঝানো হয় : ‘আমার জীবনধারা আপনার ভালো লাগতেও পারে, নাও লাগতে পারে, ওতে আমার কিছুই এসে যায় না; কিন্তু আমার সাথে পরিচয় রাখতে চাইলে সম্মান করতে হবে আমাকে।’ ভ্রন্‌স্কির ভাবভঙ্গিতে গোলেনিশ্যেভ ছিলেন ঘৃণাভরে উদাসীন। এ সাক্ষাৎটায় তাঁদের মনোমালিন্য বেড়ে যাবে বলেই মনে হতে পারত। এখন কিন্তু পরস্পরকে চিনতে পেরে জ্বলজ্বলে মুখে তাঁরা চেঁচিয়ে উঠলেন আনন্দে। ভ্রন্‌স্কি কখনো ভাবতেই পারেননি যে গোলেনিশ্যেভকে দেখে এত খুশি হবেন, তবে সম্ভবত তিনি নিজেই জানতেন না কত একঘেয়ে লাগছিল তাঁর। গত সাক্ষাৎকার যে অপ্রীতিকর ছাপ ফেলেছিল সেটা তিনি ভুলে গেলেন; আন্তরিক আনন্দোজ্জ্বল মুখে তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রাক্তন বন্ধুর দিকে। গোলেনিশ্যেভের মুখেও আগের শংকার ছায়া কেটে গিয়ে ফুটে উঠল একই রকম আনন্দ।

‘কি যে খুশি হলাম তোকে দেখে!’ অমায়িক হাসিতে নিজের শক্ত সাদা দাঁত উদ্ঘাটিত করে ভ্রন্‌স্কি বললেন।

‘আমি অবশ্যই ভ্রন্‌স্কি নামটা শুনছিলাম, কিন্তু কোন ভ্রন্‌স্কি, জানতাম না। খুব আনন্দ হচ্ছে!’

‘চল যাই। কি করছিস তুই?’

‘এখানে আমি আছি এই দ্বিতীয় বছর। কাজ করছি।’

‘আ!’ দরদ দিয়েই বললেন ভ্রন্‌স্কি, ‘চল যাই।’

এবং রুশীদের যা অভ্যাস, চাকর-বাকরদের কাছ থেকে যেটা লুকিয়ে রাখতে চান সেটা রুশ ভাষায় না বলে বলতে লাগলেন ফরাসিতে।

‘কারেনিনার সাথে তোর পরিচয় আছে? একসাথে ভ্রমণ করছি আমরা, আমি ওঁর কাছে যাচ্ছি’, মন দিয়ে গোলেনিশ্যেভের মুখভাব লক্ষ করতে করতে তিনি বললেন ফরাসি ভাষায়।

‘বটে! আমি জানতামই না’ (যদিও জানতেন)–নির্বিকারভাবে জবাব দিলেন গোলেনিশ্যেভ, ‘কতদিন হল এসেছিল?’ যোগ দিলেন তিনি।

‘আমি? এই চার দিন’, আবার মন দিয়ে বন্ধুর মুখভাব নজর করে ভ্রন্‌স্কি বললেন।

‘না, ও সজ্জন লোক, ব্যাপারটাকে নিচ্ছে যেভাবে নেওয়া উচিত’, গোলেনিশ্যেভের মুখভাব এবং কথাবার্তার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেবার তাৎপর্য ধরতে পেরে ভ্রন্‌স্কি ভাবলেন মনে মনে, ‘আন্নার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, যা উচিত সেইভাবেই ও নিচ্ছে।’

আন্নার সাথে এই তিন মাস বিদেশে কাটাবার সময় যত নতুন নতুন লোকের সাথে ভ্রন্‌স্কির আলাপ হয়েছে, সব সময়ই তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, আন্নার সাথে তাঁর সম্পর্কটা কিভাবে নিচ্ছেন এই নতুন লোকটি এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষদের মধ্যে যেমন উচিত তেমন একটা উপলব্ধি দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু যদি তাঁকে এবং উচিতমত বুঝতেন তাঁদের প্রশ্ন করা হত এই উপলব্ধিটা ঠিক কি, তাহলে তিনি এবং তাঁরা বড়ই মুশকিলে পড়তেন।

আসলে ভ্রন্‌স্কির ধারণা অনুসারে ‘যেমন উচিত’ সেভাবে যাঁরা বুঝছেন, তাঁরা মোটেই সেটা বুঝতেন না, চারিপাশের জীবনের সব দিক থেকে যত জটিল ও অসমাধিত প্রশ্ন ঘিরে ধরে, তাদের প্রসঙ্গে সুসভ্য লোকেরা যে মনোভাব নেন, সাধারণভাবে এঁরাও চলতেন সেভাবে—চলতেন ভদ্রভাবে, আভাস-ইঙ্গিত ও অশোভন প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেন। তাঁরা ভাব করতেন যেন অবস্থাটার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তাঁরা পুরো বোঝেন, বলতে কি স্বীকার এবং অনুমোদনই করেন, তবে মনে করেন যে এ সব বোঝাতে যাওয়া অনুচিত ও অনাবশ্যক।

ভ্রন্‌স্কি তৎক্ষণাৎ অনুমান করে নিলেন যে গোলেনিশ্যেভ ওইরকম একজন লোক, সুতরাং তাঁকে পেয়ে তাঁর আনন্দ হল দ্বিগুণ। আর সত্যিই তাই। কারেনিনার কাছে যখন গোলেনিশ্যেভকে নিয়ে যাওয়া হল, তাঁর সাথে তিনি এমন ব্যবহার করতে লাগলেন যা ভ্রন্‌স্কির পক্ষে মাত্র আশা করাই সম্ভব। স্পষ্টতই, উনি অনায়াসে এমন সমস্ত আলাপই এড়িয়ে গেলেন যা অস্বস্তিকর হতে পারত।

আন্নাকে তিনি আগে দেখেননি, তাই তাঁর রূপে এবং আরো বেশি করে যেরকম সহজভাবে নিজের অবস্থাটা তিনি নিচ্ছেন, তাতে অভিভূত হলেন তিনি। ভ্রন্‌স্কি যখন গোলেনিশ্যেভকে নিয়ে আসেন, তখন রাঙা হয়ে ওঠেন আন্না, আর শিশুসুলভ এই যে লালিমাটা তাঁর খোলামেলা সুন্দর মুখখানায় ছড়িয়ে পড়েছিল, তা অসাধারণ ভালো লাগল গোলেনিশ্যেভের। বিশেষ করে তাঁর এটা ভালো লাগল যে বাইরের লোকের কাছে যাতে ভুল বোঝার অবকাশ না থাকে, সে জন্য ভ্রন্‌স্কিকে তিনি যেন ইচ্ছে করেই ডাকছিলেন ডাকনাম ধরে, আর বললেন যে ওঁর সাথে নতুন ভাড়া নেওয়া একটা বাড়িতে তাঁরা উঠে যাচ্ছেন, এখানে যাকে বলে পালাৎসো। নিজের অবস্থা সম্পর্কে এই সোজাসুজি, খোলাখুলি মনোভাব গোলেনিশ্যেভের ভালো লাগল। আন্নার দিল-খোলা হাসিখুশি প্রাণবন্ত হাবভাব দেখে এবং কারেনিন ও ভ্রন্‌স্কি দুজনকেই চিনতেন বলে গোলেনিশ্যেভের মনে হল তিনি পুরোপুরি বুঝতে পারছেন আন্নাকে। তাঁর মনে হল আন্না যেটা কখনোই বুঝতে পারেননি সেটা তিনি বুঝতে পারছেন, যথা : স্বামীকে অসুখী করে, তাঁকে ও পুত্রকে ছেড়ে এসে, নিজের সুনাম হারিয়ে কি করে তিনি নিজেকে প্রাণবন্ত, হাসিখুশি, সুখী বলে অনুভব করতে পারেন।

‘গাইড-বইয়ে ওটার কথা আছে’, ভ্রন্‌স্কি যে পালাৎসোটা ভাড়া নিচ্ছেন, সে প্রসঙ্গে বললেন গোলেনিশ্যেভ, ‘একটা তিনতোরেত্তোও আছে সেখানে। তাঁর শেষ জীবনের কাজ।’

‘শুনুন বলি-কি, চমৎকার আবহাওয়া, ওখানে যাওয়া যাক। আরেকবার বাড়িটা দেখে আসি’, ভ্রন্‌স্কি বললেন আন্নাকে।

‘খুব ভালো, এখনই আমি টুপি পরে নিচ্ছি। বলছেন, গরম?’ দরজার কাছে থেমে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ভ্রন্‌স্কির দিকে চেয়ে আন্না বললেন। আবার জ্বলজ্বলে রঙ ছড়িয়ে পড়ল তাঁর মুখে।

তাঁর চাউনি থেকে ভ্রন্‌স্কি টের পেলেন যে আন্না বুঝতে পারছেন না গোলেনিশ্যেভের সাথে ভ্রন্‌স্কি কিরকম সম্পর্ক পাতাতে চান, এবং ভ্রন্‌স্কি যা চাইছিলেন সেভাবে চলেছেন কিনা ভেবে ভয় পাচ্ছেন আন্না।

আন্নার দিকে দীর্ঘ কমনীয় দৃষ্টিপাত করলেন তিনি।

বললেন, ‘না, তেমন গরম নয়।’

এবং আন্নার মনে হল তিনি সব বুঝতে পেরেছেন, প্রধান ব্যাপারটা হল এই যে আন্নার ব্যবহারে তিনি খুশি। তাঁর দিকে হেসে দ্রুত চলনে আন্না বেরিয়ে গেলেন।

দুই বন্ধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন, দুজনের মুখেই একটা বিব্রত ভাব। স্পষ্টতই, আন্নাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গোলেনিশ্যেভ তাঁর সম্পর্কে কি-একটা যেন বলতে চাইছিলেন কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলেন না সেটা কি, আর ভ্রন্‌স্কি সেটা জানতেও চাইছিলেন, ভয় ও পাচ্ছিলেন।

কিছু-একটা আলাপ চালাবার জন্য ভ্রন্‌স্কি শুরু করলেন, ‘তাহলে এই ব্যাপার। তাহলে তুই এখানেই বাসা বেঁধেছিস? ওই একই কাজ নিয়ে আছিস? ভ্রন্‌স্কি শুনেছিলেন যে গোলেনিশ্যেভ কি-একটা যেন লিখছিলেন, সেটা স্মরণ হওয়ায় কথা চালিয়ে গেলেন তিনি।

‘হ্যাঁ, ‘দুই মূলনীতি’র দ্বিতীয় অংশ লিখছি আমি’, এ জিজ্ঞাসায় পরিতোষ লাভ করায় উত্তেজিত হয়ে গোলেনিশ্যেভ বলে উঠলেন, ‘মানে, সঠিক বলল, এখনো লিখতে শুরু করিনি, তবে মালমসলা জোগাড় করছি। প্রথম অংশটার চেয়ে একটা হবে অনেক বিস্তারিত, প্রায় সমস্ত প্রশ্নই আলোচিত হবে তাতে। আমাদের রাশিয়ায় লোকে বুঝতে চায় না যে আমরা বাইজান্টিয়ামের উত্তরাধিকারী’, এই বলে একটা লম্বা চওড়া উত্তেজিত ব্যাখ্যা তিনি শুরু করলেন।

প্রথমটায় ভ্রন্‌স্কির অস্বস্তি হচ্ছিল এই জন্য যে ‘দুই মূলনীতি’র প্রথম অংশের কথা তিনি জানতেন না অথচ লেখক তার উল্লেখ করছিলেন এমনভাবে যেন ওটা সকলের পড়া। কিন্তু পরে, গোলেনিশ্যেভ যখন তাঁর বক্তব্যগুলো রাখছিলেন এবং ভ্রন্‌স্কি তা অনুসরণ করতে পারছিলেন, তখন ‘দুই মূলনীতি’ না জেনেও তিনি তাঁর কথা শুনছিলেন বিনা আগ্রহে নয়, কেননা গোলেনিশ্যেভ কথা বলছিলেন ভালো। কিন্তু যে ক্ষিপ্ত সুরে গোলেনিশ্যেভ তাঁর বিষয়বস্তুর আলোচনা করছিলেন সেটায় ভ্রন্‌স্কির বিস্ময় ও বিরক্তি বোধ হল। গোলেনিশ্যেভ যত বলে যাচ্ছিলেন ততই ধকধক করতে লাগল তাঁর চোখ, কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে আপত্তিকে দেখা যাচ্ছিল ততই তাড়া, মুখভাব হয়ে উঠছিল ততই শংকাবহ ও ক্ষুব্ধ। কোরে গোলেনিশ্যেভকে একটি রোগা প্রাণবন্ত সহৃদয় ও উদার ছেলে বলে ভ্রন্‌স্কির মনে আছে, সব সময়ই সে ছিল পয়লা নম্বরের ছাত্র, তাই এ উষ্মার কারণ ভ্রন্‌স্কি বুঝতে পারছিলেন না, বিরূপ বোধ করছিলেন তিনি।বিশেষ করে এটা তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না যে বড় ঘরের ছেলে হয়েও গোলেনিশ্যেভ নিজেকে এক পঙ্ক্তিতে ফেলছেন কি-সব লিখিয়েদের সাথে, যারা তাঁকে চটাচ্ছে এবং তিনি ওদের ওপর রাগছেন। এর কি কোন মানে হয়? এটা ভ্রন্‌স্কির ভালো লাগছিল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও উনি টের পাচ্ছিলেন যে গোলেনিশ্যেভ দুঃখী, তাই কষ্ট হচ্ছিল ওঁর জন্য। উনি যখন আন্নার প্রবেশ পর্যন্ত লক্ষ না করে অধৈর্য ও উত্তেজিত হয়ে নিজের ভাবনাগুলো বলে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর চঞ্চল এবং যথেষ্ট সুন্দর মুখে সে দুঃখটা দেখা যাচ্ছিল যা পড়ে প্রায় উন্মত্ততার মত।

আন্না যখন টুপি আর ক্যাপ পরে সুন্দর হাতে দ্রুত ছাতা নাড়াচাড়া করতে করতে ভ্রন্‌স্কির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, তখন তাঁর ওপরে স্থিরনিবদ্ধ গোলেনিশ্যেভের কাতর দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে ভ্রন্‌স্কি বাঁচলেন, প্রাণচুর্য ও আনন্দে ভরপুর তাঁর অপরূপ বান্ধবীর দিকে চাইলেন নতুন একটা প্রেমাকুল দৃষ্টিতে। সহজে সচেতন হয়ে উঠতে পারছিলেন না গোলেনিশ্যেভ, প্রথম দিকে তিনি হয়ে রইলেন বিষণ্ণ, মনমরা। কিন্তু সবার প্রতি সুপ্রসন্ন আন্না (সে সময় তিনি যা ছিলেন) নিজের সহজ ও হাসি-খুশি ভাবভঙ্গিতে অচিরেই চাঙ্গা করে তুললেন তাঁকে। কথোপকথনের নানা প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা করে আন্না তাঁকে নিয়ে এলেন চিত্রকলার কথায়। এ বিষয়ে খুবই ভালো বলছিলেন তিনি, আন্নাও শুনছিলেন মন দিয়ে। পায়ে হেঁটে গিয়ে ভাড়া করা বাড়িটা তাঁরা দেখলেন।

ওঁরা যখন ফিরে এলেন, গোলেনিশ্যেভকে আন্না বললেন, ‘একটা জিনিসে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। ভালো একটা স্টুডিও হবে আলেক্সেইয়ের। অবশ্য-অবশ্যই তুমি এই ঘরখানা নেবে’, ভ্রন্‌স্কিকে তিনি বললেন রুশীতে আর ‘তুমি’ বললেন কেননা আন্না বুঝেছিলেন যে তাঁদের নিঃসঙ্গতায় গোলেনিশ্যেভ হয়ে দাঁড়াবেন ঘনিষ্ঠ লোক, তাঁর কাছ থেকে কিছু লুকোবার প্রয়োজন নেই।

‘তুই ছবি আঁকিস নাকি?’ দ্রুত ভ্রন্‌স্কির দিকে ফিরে বললেন গোলেনিশ্যেভ 1

লাল হয়ে উঠে ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘হ্যাঁ, অনেক আগে চর্চা করতাম, এখন অল্পস্বল্প শুরু করেছি।’

পুলকিত হাসিমুখে আন্না বললেন,’খুবই গুণ আছে ওর। আমি অবশ্য বিচারক নই। তবে সমঝদাররাও বলেছেন ঐ একই কথা।’

আট

নিজের মুক্তি ও দ্রুত স্বাস্থ্যোদ্ধারের এই সময়টায় আন্না নিজেকে অমার্জনীয় রকমের সুখী ও জীবনানন্দে ভরপুরে বলে অনুভব করছিলেন। স্বামীর দুঃখের কথা স্মরণ করে সুখ তাঁর মাটি হচ্ছিল না। সে স্মৃতিটা একদিক থেকে এতই ভয়ংকর যে তার কথা ভাবাই যায় না। অন্যদিকে স্বামীর দুঃখ তাঁকে এত বেশি সুখ দিয়েছে যে আসেই না অনুতাপের কোন কথা। তাঁর পীড়ার পর যা যা ঘটেছিল : স্বামীর সাথে মিটমাট, বিচ্ছেদ, ভ্রন্‌স্কির জখম হবার খবর, তাঁর আবির্ভাব, বিবাবিচ্ছেদের আয়োজন, স্বামীগৃহ ত্যাগ, পুত্রের কাছ থেকে বিদায়—এ সব স্মৃতি তাঁর কাছে মনে হত বিকারগ্রস্ত একটা স্বপ্ন যা থেকে তিনি জেগে উঠেছেন কেবল বিদেশে, ভ্রন্‌স্কির সাথে। স্বামীর যে অনিষ্ট তিনি করেছেন, তার স্মৃতিটায় বিতৃষ্ণার মত একটা অনুভূতি হত তাঁর, আরেকটা লোক আঁকড়ে ধরায় যে লোকটা ডুবতে বসেছে সে যখন লোকটার হাত ছাড়িয়ে ভেসে ওঠে, তখন তার যা অনুভূতি হত, এটা অনেকটা তাই। ও লোকটা ডুবল। বলাই বাহুল্য, কাজটা খারাপ কিন্তু নিজে বাঁচার ওহাই ছিল একমাত্র উপায়, ওই ভয়ংকর ঘটনাটার কথা বরং না ভাবাই ভালো।

শান্ত হবার মত একটা মাত্র যুক্তি তিনি পেয়েছিলেন, তখন বিচ্ছেদের প্রথম মুহূর্তে এবং এখন, যা ঘটেছে তা সব যখন মনে পড়ত তাঁর, তখন তিনি স্মরণ করতেন সেই একমাত্র যুক্তিটা। ভাবতেন, ‘ওই মানুষটাকে অসুখী করা ছিল আমার পক্ষে অপরিহার্য, কিন্তু আমি সে দুঃখটা থেকে নিজে লাভবান হতে চাই না; আমিও তো কষ্ট ভুগছি এবং বুগে যাব, যা ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান তা আমি হারিয়েছি—হারিয়েছি সুনাম আর ছেলেকে। আমি খারাপ কাজ করেছি, তাই সুখ আমি চাই না, বিচ্ছেদ চাই না আমি, কলংক আর ছেলের সাথে বিচ্ছেদের জন্য কষ্ট সয়ে যাব।’ কিন্তু কষ্ট সইবার যত আন্তরিক ইচ্ছাই আন্নার থাক, কষ্ট তাঁর হচ্ছিল না। লজ্জার ব্যাপারও কিছু হয়নি। তাঁদের দুজনের মধ্যেই যে কাণ্ডজ্ঞান ছিল প্রভূত পরিমাণে তাতে বিদেশে রুশী মহিলাদের তাঁরা এড়িয়ে যেতেন, বিছছিরি অবস্থায় তাঁরা পড়তে দেননি নিজেদের, এবং সর্বত্র এমন লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন যাঁরা ভান করতেন যে ওঁদের পারস্পরিক সম্পর্কটা তাঁরা পুরোপুরি বোঝেন, এমন কি তাঁরা নিজেরা যা বোঝেন তার চেয়েও ভাল। যে ছেলেটিকে তিনি ভালোবাসতেন তার সাথে বিচ্ছেদটাতেও প্রথম দিকে কষ্ট হত না তাঁর। মেয়েটা, ওঁর সন্তান এত মিষ্টি আর আন্নার এত ন্যাওটা যে কেবল এই মেয়েটাই যেদিন থেকে তাঁর আছে, ছেলের কথা আন্নার মনে পড়ত কদাচিৎ।

আরোগ্য লাভের ফলে জীবনের বর্ধিত চাহিদা ছিল এত প্রবল এবং পরিস্থিতি ছিল এত নতুন আর ভালো যে আন্না অনুভব করতেন তিনি অমার্জনীয় রকমের সুখী। ভ্রন্‌স্কিকে তিনি যত বেশি করে জানছিলেন, ততই বেশি ভালোবাসছিলেন তাঁকে। ভালোবাসছিলেন তাঁর নিজের জন্যও এবং আন্নার প্রতি তাঁর ভালোবাসার জন্যও। তাঁর ওপর আন্নার পরিপূর্ণ আধিপত্য ছিল তাঁর কাছে নিয়ত একটা আনন্দ। ভ্রন্‌স্কির সান্নিধ্য সব সময়ই ছিল মনোরম। ভ্রন্‌স্কির স্বভাবের যতগুলো দিক তিনি ক্রমেই বেশি করে জানছিলেন ততই তা হয়ে উঠছিল তাঁর কাছে অনির্বচনীয় মধুর। বেসামরিক পোশাকে তাঁর বাইরের যে চেহারা বদলে গিয়েছিল, সেটা আন্নার কাছে তেমনি আকর্ষণীয় হয়ে উঠল যা হয়ে থাকে তরুণী প্রেমিকার ক্ষেত্রে। ভ্রন্‌স্কি যা-কিছু বলতেন, ভাবতেন, করতেন—সবেতেই আন্না দেখতে পেতেন উন্নত, মহনীয় কিছু-একটা। ভ্রন্‌স্কিকে নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাসে নিজেই তিনি ভয় পেয়ে যেতেন প্রায়ই : আন্না খুঁজেছেন কিন্তু অসুন্দর কিছু পাননি তাঁর মধ্যে। ওঁর কাছে নিজের নগণ্যতা প্রকাশ করার সাহস হত না তাঁর। তাঁর মনে হয়েছিল ভ্রন্‌স্কি এটা জেনে ফেললে শিগগিরই আর ভালোবাসবেন না তাঁকে; আর এখন তাঁর ভালোবাসা হারাবার ভয়টা ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে বড়, যদিও তার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু তাঁর প্রতি ভ্রন্‌স্কির মনোভাবে কৃতজ্ঞতা বোধ না করে আর সেটাকে তিনি কতটা কদর করছেন তা প্রকাশ না করে তিনি পারেননি। তাঁর মতে, রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপে ভ্রন্‌স্কির একটা যোগ্যতা ছিল এবং তাতে বিশিষ্ট একটা ভূমিকা তিনি নিতে পারতেন, কিন্তু আন্নার জন্য নিজের উচ্চাশা তিনি বিসর্জন দিয়েছেন আর সে জন্য সামান্যতম খেদ করেননি কখনো। আগের চেয়েও ভ্রন্‌স্কি এখন আন্নার প্রতি অনুরাগী ও ভক্ত, আর আন্না যাতে তাঁর অবস্থার অস্বস্তিকরতা কখনো না অনুভব করেন, অনুক্ষণ এই উদ্বেগ বোধ করতেন ভ্রন্‌স্কি। অমন পুরুষালী একটা মানুষ, অথচ আন্নার সাথে সম্পর্কে কদাচ তাঁর বিরুদ্ধতা তো করেনইনি, বরং নিজের ইচ্ছাশক্তিই তাঁর থাকত না, মনে হত না করে পারেনি যদিও তাঁর প্রতি ভ্রন্‌স্কির মনোযোগের এই তীব্রতাটাই, যত্নের যে পরিবেশে তিনি তাঁকে ঘিরে রাখছেন সেটাই মাঝে মাঝে পীড়া দিতো তাঁকে 1

অন্য দিকে, দীর্ঘ দিন ধরে যা কামনা করে এসেছেন তা পুরোপুরি সফল হলেও ভ্রন্‌স্কি সুখী হননি পুরোপুরি। অচিরেই তিনি অনুভব করলেন যে সুখের যে পর্বত তিনি আশা করেছিলেন তার একটিমাত্র কণিকা তাঁকে দিয়েছে তাঁর কামনার চরিতার্থতা। এই চরিতার্থতা তাঁর কাছে দেখিয়ে দিল তেমন একটা বরাবরের ভুল যা লোকে করে বসে কামনার সিদ্ধিটাকেই সুখ বলে ভেবে। আন্নার সাথে এক হবার পর যখন তিনি বেসামরিক পোশাক গায়ে চাপান, তখন প্রথম প্রথম সাধারণভাবে স্বাধীনতার যে মাধুর্য আগে তিনি জানতেন না, সেটা ও ভালবাসার স্বাধীনতা অনুভব করে তুষ্ট ছিলেন, তবে বেশি দিন নয়। শিগগিরই তিনি টের পেলেন যে তাঁর প্রাণের মধ্যে জেগে উঠছে বাসনার বাসনা, মন-পোড়ানি। নিজের ইচ্ছা নির্বিশেষেই তিনি প্রতিটি ক্ষণিক খেয়ালকে আঁকড়ে ধরতেন, ভাবতেন সেটাই তাঁর কামনা ও লক্ষ্য। দিনের ষোলটা ঘণ্টা কিছু না কিছু নিয়ে থাকতে হত, কেননা পিটার্সবুর্গে সমাজ-জীবনের যা পরিস্থিতি ছিল তাতে অনেকটা সময়ই কেটে যেত, সে মহলের বাইরে বিদেশে তাঁরা ছিলেন অবাধ স্বাধীনতায়। আগেকার বিদেশ ভ্রমণগুলোয় অবিবাহিত জীবনের যেসব তৃপ্তি নিয়ে ভ্রন্‌স্কি মেতে থাকতেন, তার কথা এখন ভাবাই চলে না, কেননা এই ধরনের একটা ঘটনা, পরিচিতদের সাথে বেশি রাত করে রাতের খাবার আন্নাকে অপ্রত্যাশিত ও অনুচিত রকমে বিমর্ষ করে তুলেছিল। তাঁদের সম্পর্কের অনির্দিষ্টতায় স্থানীয় ও রুশী সমাজের সাথে মেশাও চলে না। দর্শনীয় স্থান এমনিতেই যে সব দেখা হয়ে গেছে, সে কথা না বললেও ওটা একজন ইংরেজের কাছে যে দুর্বোধ্য তাৎপর্য ধরে, তাঁর কাছে, একজন রুশী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাছে সে তাৎপর্য ধরে না।

ক্ষুধার্ত পশু যেমন সামনে যা-কিছু পায় তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খাদ্য পাবার আশায়, ভ্রন্‌স্কিও তেমনি একেবারে অজ্ঞাতসারে মেতে উঠছিলেন কখনো রাজনীতি, কখনো নতুন একটা বই, কখনো ছবি নিয়ে।

তারুণ্যে যেহেতু তাঁর ছবি আঁকায় হাত ছিল আর টাকাগুলো নিয়ে কি করবেন ভেবে না পেয়ে যেহেতু এনগ্রেভিং সংগ্রহে লেগেছিলেন, তাই এখন চিত্রকলাতেই এসে থামলেন, চর্চা করতে লাগলেন তার, এবং তাঁর যে অনিয়োজিত বাসনা পরিতৃপ্তি চাইছিল, সেটা নিয়োগ করলেন তাতে।

একটা শিল্পবোধ তাঁর ছিল, সঠিকভাবে এবং সুরুচির সাথে ছবি নকল করতে পারতেন, তাই তিনি ভাবলেন যে শিল্পী হবার জন্য যা দরকার সেটা তাঁর আছে, এবং ধর্মীয়, ঐতিহাসিক অথবা বাস্তববাদী—কোন ধরনের চিত্রকলা তিনি অবলম্বন করবেন এই নিয়ে কিছুটা দোলায়মানতার পর ছবি আঁকতে লাগলেন। সব ধরনের চিত্রকলাই তিনি বুঝতেন, তার যে কোনটাতেই অনুপ্রাণিত হতে পারতেন; কিন্তু এটা তিনি ভাবতে পারতেন না যে কোন কোন ধারার চিত্রকলা আছে তা আদৌ না জেনে, যা আঁকছেন সেটা সুপরিচিত কোন ধারার মধ্যে পড়বে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে প্রাণের মাঝে যা আছে তাতেই অনুপ্রাণিত হওয়া যায় সরাসরি। যেহেতু এটা তিনি জানতেন না এবং সরাসরি জীবন থেকে নয়, শিল্পে ইতিমধ্যেই রূপ পেয়েছে যে জীবন তার মাধ্যমে অনুপ্রেরণা লাভ করতেন, তাই তিনি অনুপ্রাণিত হতেন অতি দ্রুত এবং অনায়াসে, আর তেমনি দ্রুত এবং অনায়াসে তিনি এই ফললাভ করলেন যে তিনি যেটা এঁকেছেন সেটা যে ধারার ছবি তিনি অনুকরণ করতে চাইছিলেন, হয়েছে প্রায় তার মতই।

অন্যান্য ধারার মধ্যে তাঁর ভালো লেগেছিল ফরাসি ধারা, যা লাবণ্যময় ও চমকপ্রদ, আর সেই ধারায় তিনি আন্নার প্রতিকৃতি আঁকলেন ইতালীয় পোশাকে। ছবিটা তাঁর কাছে, আর যারা সেটা দেখেছিল তাদের কাছে মনে হয়েছিল অতি সাৰ্থক।

নয়

পুরানো অবেহিলত পালাৎসোটার উঁচু সিলিং ঢালাই করা, দেয়ালে ফ্রেস্কো, মোজেয়িক করা মেঝে, লম্বা লম্বা জানালায় হলদে রঙের ভারী ভারী পর্দা, কুলুঙ্গিতে আর ফায়ার-প্লেসের ওপর ফুলদানি, ক্ষোদাই কাঠের দরজা,

ছবি টাঙ্গানো বিষণ্ণ হলঘর—ওঁরা এখানে উঠে আসার পর এই পালাৎসো তার বাহ্যিক চেহারাতেই ভ্রন্‌স্কির মনে মনোরম এই একটা বিভ্রম জাগাল যে তিনি রুশী জমিদার ও অবসর নেওয়া ঘোড়সওয়ার অফিসার একটা নন, বরং শিল্পের সুধী অনুরাগী ও পৃষ্ঠপোষক, নিজেও একটু আধটু এঁকে থাকেন, প্রিয়তমা নারীর জন্য যিনি ত্যাগ করেছেন সমাজ, যোগাযোগ, উচ্চাভিলাষ।

পালাৎসোতে এসে ভ্রন্‌স্কি যে ভূমিকাটা বেছে নিয়েছিলেন সেটা খুবই উৎরে গিয়েছিল, গোলেনিশ্যেভ মারফত চিত্তাকর্ষক কয়েকটি লোকের সাথে আলাপ করে প্রথম দিকটা বেশ স্বচ্ছন্দ ছিলেন। জনৈক ইতালীয় প্রফেসরের পরিচালনায় তিনি প্রকৃতির স্থিরচিত্র আঁকতেন এবং চর্চা করতেন মধ্যযুগীয় ইতালীয় চিত্রকলা নিয়ে। মধ্যযুগীয় ইতালীয় চিত্রকলা ভ্রন্‌স্কিকে ইদানীং এতই মুগ্ধ করেছিল যে মধ্যযুগের কায়দায় টুপি পরতে আর কাঁধের ওপর কম্বল চাপাতে শুরু করেছেন, সেটা তাঁকে খুবই মানাতো।

গোলেনিশ্যেভ একদিন সকালে তাঁর কাছে এলে ভ্রন্‌স্কি তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমরা দিন কাটিয়ে যাচ্ছি কিন্তু কিছুই জানি না। মিখাইলোভের ছবি দেখেছিস তুই?’ সত্য আসা রুশী পত্রিকাটা এগিয়ে দিয়ে এই শহরেই যে রুশী শিল্পী বাস করেন, যাঁর ছবি নিয়ে অনেকদিন জনশ্রুতি ছড়াচ্ছিল, আগে থেকেই কিনে নেওয়া সে ছবিটা তিনি শেষ করেছেন—তাঁকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধটা দেখালেন। অসাধারণ এক শিল্পীকে উৎসাহ ও সাহায্য দেওয়া হয়নি বলে প্রবন্ধে ভর্ৎসনা করা হয়েছে সরকার ও শিল্প অকাদমিকে।

‘দেখেছি’, গোলেনিশ্যেভ বললেন, ‘বলা বাহুল্য তাঁর গুণ নেই এমন নয়, তবে একেবারে বাজে একটা ধারা অনুসরণ করছেন। খ্রিস্ট ও ধর্মীয় চিত্রকলা সম্পর্কে সেই একই ইভানোভ-স্ট্রাউস্-রেনান্ মার্কা দৃষ্টিভঙ্গি।

‘কি দেখানো হয়েছে ছবিতে?’ জিজ্ঞেস করলেন আন্না।

‘পিলাতের সামনে খ্রিস্ট। নব্য ধারার সমস্ত বাস্তবতা দিয়ে খ্রিস্টকে আঁকা হয়েছে ইহুদি করে।’

আর ছবির বিষয়বস্তুটা গোলেনিশ্যেভের অন্যতম একটা প্রিয় প্রসঙ্গ হওয়ায় তিনি বলতে শুরু করলেন : ‘এমন উৎকট ভুল ওঁরা কেমন করে করতে পারেন আমি ভেবে পাই না। মহান প্রাচীনদের শিল্পে একটা সুনির্দিষ্ট রূপ আছে খ্রিস্টের। ওঁরা যদি সৃষ্টিকর্তা নয়, বিপ্লবী কি প্রাজ্ঞকে আঁকতে চান, তাহলে ইতিহাস থেকে নিন-না সক্রেটিস কি ফ্র্যাঙ্কলিন, কিংবা শারলত্ কর্দেকে, কিন্তু খ্রিস্টকে নয়। ওঁরা এমন ব্যক্তিকে নিচ্ছেন যাকে শিল্পের জন্য নেওয়া চলে না আর তারপর…’

‘আচ্ছা, সত্য নাকি, এই মিখাইলোভ খুব দুরবস্থায় আছেন?’ ভ্রন্‌স্কি জিজ্ঞেস করলেন এই ভেবে যে ছবি ভালো হোক, মন্দ হোক রুশী পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তাঁর উচিত শিল্পীকে সাহায্য করা।

‘তেমন বড় একটা মনে হয় না। উনি প্রতিকৃতি আঁকেন চমৎকার। ওঁর আঁকা ভাসিল্‌চিকভার প্রতিকৃতিটা দেখেছিস? তবে মনে হয় উনি যেন আর পোর্ট্রেট আঁকতে চাইছেন না। সেক্ষেত্রে অভাবেই পড়েছেন হয়ত। আমি বলছিলাম যে…’

‘আন্না আর্কাদিয়েভনার একটা পোর্ট্রেট আঁকতে ওঁকে বলা যায় না কি?’ ভ্ৰন্‌স্কি বললেন।

আন্না বললেন, ‘আমার আবার কেন? তোমার ছবিটার পর আমি আর কারো পোর্ট্রেট চাই না। বরং আনিকে আঁকুন’ (নিজের মেয়েটাকে তিনি এই নামে ডাকতেন) ‘ওই তো সে’, যোগ দিলেন আন্না। সুন্দরী ইতালিয়ান স্তন্যদাত্রী বাগানে নিয়ে এসেছিল মেয়েটাকে। জানালা দিয়ে তার দিকে তাকিয়েই আন্না তখনই অলক্ষ্যে চাইলেন ভ্রন্‌স্কির দিকে। সুন্দরী স্তন্যদাত্রীর মুখ ছবিতে এঁকেছিলেন ভ্রন্‌স্কি। আন্নার জীবনে ওই মেয়েটাই তাঁর একমাত্র গোপন দুঃখ। ভ্রন্‌স্কি তার ছবি আঁকতে গিয়ে তার সৌন্দর্য আর মধ্যযুগীয়তায় মুগ্ধ হতেন, আর আন্না যে স্তন্যদাত্রীটিকে ঈর্ষা করতে ভয় পাচ্ছেন সেটা নিজের কাছেও স্বীকার করার সাহস হত না এবং সেই কারণেই তাকে আর তার ছোট ছেলেটির ওপর বিশেষ করে আদর ও স্নেহ বর্ষণ করতেন।

ভ্রন্‌স্কিও জানালায় আর আন্নার চোখের দিকে তাকালেন, তারপর তখনই গোলেনিশ্যেভের দিকে ফিলে বললেন, ‘কিন্তু তুই এই মিখাইলোভকে চিনিস?’

‘দেখা হয়েছিল। পাগলাটে আর একেবারে অশিক্ষিত। মানে ওই যেসব বুনো নয়া লোকদের আজকাল সচরাচর দেখা যায় তাদেরই একজন; মানে ওই যেসব স্বাধীনচিন্তাকরা নিমিষে নাস্তিকতা নেতি আর বস্তুবাদের শিক্ষা পেয়ে থাকে।’ আন্না আর ভ্রন্‌স্কি দুজনেই যে কথা বলতে চাইছেন সেটা লক্ষ না করে অথবা লক্ষ করতে না চেয়ে গোলেনিশ্যেভ বলে গেলেন, ‘আগে স্বাধীনচিন্তকরা হতেন এমন ব্যক্তি যাঁরা ধর্ম, আইন, নৈতিকতার শিক্ষায় বেড়ে উঠতেন, তারপর নিজে সংগ্রাম আর কষ্ট করে পৌঁছতেন স্বাধীন চিন্তায়। কিন্তু এখন একধরনের আঁকাড়া স্বাধীনচিন্তকের আবির্ভাব ঘটছে যারা বেড়ে উঠছে এমন কি এ কথাটা পর্যন্ত না জেনেই যে আইন, নৈতিকতা, ধর্ম বলে কিছু-একটা ছিল, আছে প্রামাণ্য ব্যক্তি, এরা সব কিছু উড়িয়ে দেবার মনোবৃত্তিতে লালিত অর্থাৎ বুনো। উনিও তেমনি। যতদূর ধারণা উনি মস্কোর এক আর্দালির ছেলে, কোন শিক্ষা পাননি। শিল্প একাডেমিতে ঢুকে যখন নাম করেন, নেহাৎ নির্বোধ নন বলে শিক্ষালাভ করতে চেয়েছিলেন। এবং তাঁর কাছে যা মনে হয়েছিল শিক্ষার উৎস, অর্থাৎ পত্রপত্রিকা, তাকেই অবলম্বন করেন। আগের কালে লোকে, ধরা যাক, একজন ফরাসি শিক্ষালাভ করতে চাইলে কি করত, সমস্ত চিরায়ত লেখকদের রচনা অধ্যয়ন করত : অধ্যাত্মবাদী, ট্রাজেডি-কার, ঐতিহাসিক, দার্শনিকদের লেখা, মানে মনীষার সব কিছু যা তার প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের এখানে লোকে সোজাসুজি গিয়ে পড়ে নেতিবাচক সাহিত্যে, দ্রুত আয়ত্ত করে নেতি বিদ্যার সমগ্র সারার্থ—ব্যস, হয়ে গেল! শুধু তাই নয়, বিশ বছর আগে সে এ সাহিত্যে পেতে পারত প্রামাণিকের বিরুদ্ধে, চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সংগ্রামের লক্ষণ, এ সংগ্রাম থেকে সে বুঝতে পারত যে অন্য কিছু-একটাও ছিল; কিন্তু এখন সে সোজা গিয়ে পড়ে পারত যে অন্য কিছু-একটাও ছিল; কিন্তু এখন সে সোজা গিয়ে পড়ে এমন একটা ভাবনায় যা পুরানো দৃষ্টিভঙ্গির সাথে লড়তে গা পর্যন্ত করে না, স্রেফ বলে দেয় : কিছুই নেই, আছে বিবর্তন, স্বাভাবিক নির্বাচন, অস্তিত্বের সংগ্রাম—ব্যস, হয়ে গেল। আমার প্রবন্ধে আমি…’

‘শুনুন এক কাজ করা যাক’, অনেকক্ষণ ধরে ভ্রন্‌স্কির সাথে চুপিসারে মুখ চাওয়া-চাওনি করার পর এটা জেনেই যে শিল্পীটির শিক্ষাদীক্ষায় ভ্রন্‌স্কির কোন আগ্রহ নেই, তিনি চাইছেন শুধু তাঁকে সাহায্য করতে আর পোর্ট্রেটের ফরমাশ দিতে, আন্না বললেন। ‘শুনুন’, কথায় পেয়ে বসা গোলেনিশ্যেভকে দৃঢ়ভাবে থামিয়ে দিলেন তিনি, ‘চলুন যাই ওঁর কাছে!’

সচেতন হয়ে উঠে গোলেনিশ্যেভ রাজি হলেন সাগ্রহেই। তবে শিল্পী দূরের পাড়ায় থাকতেন বলে ঠিক হল একটা গাড়ি নিতে হবে।

এক ঘণ্টা বাদে গোলেনিশ্যেভের পাশে বসা আন্না আর সামনের সীটে বসা ভ্রন্‌স্কিকে নিয়ে গাড়ি এসে থামল দূরের পাড়ায় সুন্দর একটি নতুন বাড়ির সামনে। জমাদারের বৌ তাঁদের কাছে আসতে জানা গেল মিখাইলোভ তাঁর স্টুডিওতে লোকদের আসতে দেন, কিন্তু এখন তিনি দু’পা দূরে তাঁর বাসায়। তাই নিজেদের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে মেয়েটাকে তাঁর কাছে পাঠানো হল এই অনুরোধ জানিয়ে যে তাঁর ছবি দেখতে তিনি যেন অনুমতি দেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *