আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ২.২৫

পঁচিশ

সতের জন অফিসার ঘোড়দৌড়ে নামল। দৌড় হওয়ার কথা মঞ্চের সামনে চার ভার্স্ট দীর্ঘ উপবৃত্তে। এতে প্রতিবন্ধক গড়া হয়েছে নয়টি; নদী, ঠিক মঞ্চের সামনে দুই আর্শিন উঁচু নীরেট একটা বড় দেয়াল, শুকনো খাল, পানি ভরা খাল, ঢিপি, আইরিশ ব্যারিকেড (সবচেয়ে কঠিন একটা প্রতিবন্ধক) – খেংরা কাঠি গোঁজা ঢিপি, তার ওপারে ঘোড়ার কাছে অদৃশ্য খাল, ফলে দুই বাঁধা ঘোড়াকে এক লাফে পেরোতে হবে নয় মারা পড়তে হবে; তারপর আরো দুটো পানি ভরা এবং একটা শুকনো খাল, দৌড়ের শেষ মঞ্চের সামনে। তবে শুরুটা বৃত্ত থেকে নয়, সেখান থেকে একশ সাজেন দূরে আর তার মাঝখানেই প্রথম বাঁধা—তিন আর্শিন চওড়া পানিতে ভরা নদী, আরোহীর ইচ্ছেমত তা লাফিয়ে অথবা পানি ভেঙে যাওয়া যাবে।

বার তিনেক সওয়াররা লাইন দিল, কিন্তু প্রতিবারই কারো না কারো ঘোড়া এগিয়ে যায়, সুতরাং আবার শুরু করতে হয় গোড়া থেকে। দৌড় শুরুর ব্যাপারে সমঝদার কর্নেল সেস্ক্রিন চটে উঠতে যাচ্ছিলেন, তবে শেষ পর্যন্ত চতুর্থবারের বার হাঁক দিলেন : ‘ছুট!’ ছুটল সওয়াররা।

সওয়াররা যখন লাইন দিচ্ছিল, সমস্ত চোখ, সমস্ত দূরবীন ছিল তাদের চিত্রবিচিত্র দলটার দিকে নিবদ্ধ। প্রতীক্ষার স্তব্ধতার পর এবার চারদিক থেকে শোনা গেল, ‘শুরু হয়েছে। দৌড়াচ্ছে।’

ভালো করে দেখার জন্য লোকে একা একা বা জোট বেঁধে ছোটাছুটি লাগার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় প্রথম মুহূর্ত থেকেই সওয়ারীদের দলটা লম্বা হয়ে যায়, বেশ দেখা যাচ্ছিল দুই বা তিনজন করে তারা একের পর এক এসে যাচ্ছে নদীটার কাছে। দর্শকদের মনে হয়েছিল ওরা দৌড় শুরু করেছে একসাথে, কিন্তু সওয়ারদের কাছে এক সেকেন্ডের পার্থক্যই তাৎপর্য ধরে অনেক।

উত্তেজিত এবং বড় বেশি স্নায়ুচঞ্চল ফ্লু-ফু প্রথম মুহূর্তটা ফসকায়, কয়েকটা ঘোড়া স্টার্ট নেয় তার আগে, কিন্তু নদী পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে অনুস্কি লাগামে বাঁধা ঘোড়াটাকে প্রাণপণে আয়ত্তে এনে অনায়াসে ছাড়িয়ে গেলেন তিনি সওয়ারকে, এখন তাঁর সম্মুখে শুধু মাধোতিনের পাটকিলে গ্লাদিয়াতর, ভ্রন্‌স্কির সামনেই তার পাছাটা নড়ছে সমতালে, অনায়াসে, আর অপরূপা দিয়ানা সবার আগে অর্ধমৃত কুজোভলেভকে নিয়ে ছুটছে।

প্রথম কয়েক মুহূর্ত ভ্রন্‌স্কির কোন দখল ছিল না, না নিজের ওপর, না ঘোড়ার ওপর। প্রথম প্রতিবন্ধক নদী পর্যন্ত তিনি সামলাতে পারেননি ঘোড়ার গতিবিধি।

গ্লাদিয়াতর আর দিয়ানা নদী পর্যন্ত পৌছায় একসাথে এবং প্রায় একই মুহূর্তে : পলকের মধ্যে তার নদীর ওপর লাফ দিয়ে চলে গেল ওপরে; অলক্ষ্যে ফ্র-ফ্রু যেন উড়ে গেল তাদের পেছনে। কিন্তু ভ্রন্‌স্কি যখন টের পেলেন যে তিনি শূন্যে; ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন তাঁর ঘোড়ার ঠিক পায়ের তলেই কুজোড়লেভ, নদীর ওপারে দিয়ানার সাথে মাটিতে লুটাচ্ছে (লাফের পর কুজোভলেভ লাগামে ঢিল দেন, ঘোড়াও ডিগবাজি খায় তাঁকে নিয়ে)। এসব কথা ভ্রন্‌স্কি বিশদে জানতে পেয়েছিলেন কেবল পরে, তখন কিন্তু তিনি শুধু এটুকু দেখছিলেন যে যেখানে ফু- ফ্রুর নামার কথা সেখানে ঠিক আর পায়ের নিচেই সে মাড়িয়ে দিতে পারে দিয়ানারা পা অথবা মাথা। কিন্তু পড়ন্ত বেড়ালের মত ফ্লু-ফু তার লাফের মধ্যেই পা আর পিঠ বাঁকিয়ে ঘোড়াটাকে এড়িয়ে আগে চলে গেল।

ভ্রন্‌স্কি মনে মনে ভাবলেন, ‘ওহ্ সোনা আমার!’

ভ্রন্‌স্কি নদীর পর পুরোপুরি দখলে আনলেন ঘোড়াটাকে এবং তাকে সংযত রেখে স্থির করলেন বড় প্রতিবন্ধকটা পেরোবেন মাখোতিনের পেছন পেছন আর তার পরে যে দু’শ সাজেন দূরত্বে কোন প্রতিবন্ধক নেই সেখানে ওকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করা যাবে।

জার মঞ্চের সামনে ছিল বড় প্রতিবন্ধকটা। সম্রাট, গোটা দরবার, জনতার দৃষ্টি ওঁদের দিক নিবদ্ধ, ভ্রন্‌স্কি আর এগিয়ে থাকা মাখোতিন যখন শয়তানের (নীরেট দেয়ালটা এই নামেই অভিহিত হত) কাছে আসছিল, তাঁদের দিকে। চারদিক থেকে তাঁর প্রতিদৃষ্টি ভ্রন্‌স্কি টের পাচ্ছিলেন, কিন্তু নিজের ঘোড়ার কান আর ঘাড়, তাঁর দিকে ধেয়ে আসা জমি, গ্লাদিয়াতরের পশ্চাদ্দেশ আর সাদা ঠ্যাং ছাড়া কিছুই দেখছিলেন না, একই ব্যবধান বজায় রেখে দ্রুত তাল ঠুকে গ্লাদিয়াতর ছুটছে সামনে। কোথাও কিছু ধাক্কা না খেয়ে ছোট্ট লেজটা নেড়ে গ্লাদিয়াতর লাফিয়ে উঠল এবং অন্তর্ধান করল ভ্রন্‌স্কির দৃষ্টিপথ থেকে

কে যেন বলে উঠল, ‘সাবাস!’

ঠিক সেই মুহূর্তে ভ্রন্‌স্কির চোখের সামনে, তাঁর সামনেই ঝলক দিল প্রতিবন্ধকের তক্তা। গতি একটুও না বদলিয়ে তাঁর ঘোড়া লাফিয়ে উঠল, পেরিয়ে গেল তক্তা, শুধু পেছনে খট করে উঠল কি যেন। সামনে ছুটন্ত গ্লাদিয়াতর দ্বারা উত্তেজিত হয়ে গোড়াটা প্রতিবন্ধকের সামনে লাফিয়ে উঠেছিল একটু আগেই, তাতে পেছনের খুর ঠুকে গিয়েছিল কিন্তু গতি তার বদলাল না, মুখে একতাল কাদা মেখে ভ্রন্‌স্কি টের পেলেন যে গ্লাদিয়াতরের কাছ থেকে তিনি সেই একই ব্যবধানে রয়েছেন। আবার তাঁর সামনে দেখতে পেলেন তার পশ্চাদ্দেশ, ছোট লেজ, আবার সেই দ্রুতগতি সাদা পা, যা দূরত্ব বাড়িয়ে তুলতে পারছিল না।

ভ্রন্‌স্কি যখন ভাবছিলেন এবার মাখোতিনকে ছাড়িয়ে যেতে হয়, ফ্লু-ফ্লুও তখনি ভ্রন্‌স্কির মনোভাব টের পেয়ে কোনরকম তাগাদা ছাড়াই গতি অনেকটা বাড়িয়ে সবচেয়ে সুবিধানজনক দিক, ভেতরকার দিক থেকে কাছিয়ে আসতে লাগল মাখোতিনের। সে দিকটা মাখোতিন ছাড়ছিল না। বাইরের দিক থেকেও ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব, ভ্রন্‌স্কি এই কথা ভাবতেই ফ্লু-ফ্লুও অমনি গতি বদলিযে সেভাবেই ছুটতে লাগল। ঘামে কালো হয়ে উঠতে শুরু করা ফ্লু-ফ্রুর ঘাড় সমান হয়ে উঠল গ্লাদিয়াতরের পশ্চাদ্দেশের সাথে। কিছুক্ষণ তারা দৌড়াল পাশাপাশি। কিন্তু যে প্রতিবন্ধকটার কাছে তারা আসছিল তার আগে বাইরের বৃত্ত দিয়ে যাতে না যেতে হয় তার জন্য ভ্রন্‌ল্কি লাগাম চালাতে লাগলেন এবং দ্রুত, একেবারে ঢিপিটাতেই ছাড়িয়ে গেলেন মাখোতিনকে। কাদা ছিটকে লাগা তার মুখটা শুধু এক ঝলক দেখতে পেলেন তিনি। তাঁর এমন কি এও মনে হল যে, মাখোতিন হাসছে। ওকে তিনি ছাড়িয়ে গেলেন বটে, কিন্তু টের পাচ্ছিলেন ঠিক কাছেই তার উপস্থিতি, অবিরাম শুনতে পাচ্ছিলেন পেছনে সমতাল খুরের শব্দ আর গ্লাদিয়াতরের নাসারন্ধ্র থেকে দমকা-মারা তাজা নিঃশ্বাস।

পরবর্তী দুটো বাধা, খাল আর ব্যারিয়ার পেরোনো গেল সহজেই, কিন্তু ভ্রন্‌স্কির কানে আসতে লাগল ক্রমেই কাছিয়ে-আসা খুব আর নিঃশ্বাসের শব্দ। তিনি ঘোড়াকে তাগিদ দিলেন, এবং এটা টের পেয়ে খুশি হলেন যে ফ্লু-ফ্রু অনায়াসে গতি বাড়িয়ে চলেছে, গ্লাদিয়াতরের খুরের শব্দ শোনা যেতে লাগল আবার সেই আগের দূরত্ব থেকে।

যেভাবে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ভ্রন্‌স্কি এবং কর্ড যা পরামর্শ দিয়েছিল সেভাবেই এগিয়ে গেছেন তিনি; এখন তিনি সাফল্যে নিশ্চিত। তাঁর উত্তেজনা, আনন্দ ফ্লু-ফ্লু’র জন্য মমতা সবই বেড়ে উঠল। পেছনে একবার তাকিয়ে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল তাঁর, কিন্তু সাহস পেলেন না, চেষ্টা করলেন নিজেকে শান্ত রাখতে, ঘোড়াকে তাড়া না দিতে, যাতে গ্লাদিয়াতরের মধ্যে যতটা শক্তির সঞ্চয় আছে বলে তিনি টের পাচ্ছিলেন ততটা শক্তিই যেন ফ্লু-ফ্রু’ওর থাকে। বাকি আছে কেবল একটা, সবচেয়ে কঠিন বাধা; সেটা যদি তিনি অতিক্রম করতে পারেন অন্যদের চেয়ে আগে, তাহলে তিনিই হবেন প্রথম। ঘোড়া তিনি ছোটালেন আইরিশ ব্যারিকেডের দিকে। ফ্লু-ফ্র’র সাথে দূর থেকেই ব্যারিকেড়টা দেখতে পেয়েছিলেন তিনি, দেখা দিল তাঁর ও ঘোড়ার মুহূর্তের সন্দেহ। ঘোড়ার কানে অনিশ্চিতি চোখে পড়ল তাঁর, চাবুকও উঠিয়েছিলেন, কিন্তু সাথে সাথেই অনুভব করলেন যে সন্দেহ ভিত্তিহীন; ঘোড়া জানে কি তার করা উচিত শরীর টানটান করে সে ভ্রনস্কি যা আশা করেছিলেন ঠিক তেমনি মাত্রা রেখে যথাযথভাবে লাফ দিল আর শূন্যে উঠে গা ছেড়ে দিল জাড্যের শক্তিতে যা তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল খাল ছাড়িয়ে অনেক দূরে; আর ঠিক একই তালে বিনা চেষ্টায় একই পায়ে ফ্লু-ফু চালিয়ে গেল তার দৌড়।

‘সাবাস ভ্রন্‌স্কি!’ একদল লোকের চিৎকার কানে এল তাঁর। তিনি জানতেন এরা তাঁর রেজিমেন্টের লোক এবং বন্ধু-বান্ধব, দাঁড়িয়ে ছিল এই প্রতিবন্ধকটার কাছে; ইয়াভিনের গলা ঠাহর করতে তাঁর ভুল হবার কথা নয়। তবে দেখতে পেলেন না তাঁকে।

‘আরে আমার লক্ষ্মীটি!’ ফ্লু-ফ্রু’কে বললেন মনে মনে, পেছন থেকে আসা শব্দের দিকে কান পেতে রেখে। ‘পেরিয়ে এল দেখছি!’ গ্লাদিয়াতরের খুরের শব্দ শুনতে পেয়ে ভাবলেন তিনি। বাকি রইল কেবল দুই আৰ্শিন চওড়া জলভরা শেষ খালটা। ভ্রন্‌স্কি সেদিকে তাকালেনও না, অনেক ব্যবধানে প্রথম হবার বাসনায় তিনি লাগাম চালাতে লাগলেন বৃত্তাকারে, খুরের তালে তালে ঘোড়ার মাথা উঠিয়ে আর নামিয়ে। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে গোড়া ছুটছে তার শেষ শক্তিতে; শুধু তার গ্রীবা আর ঘাড় ভিজে উঠেছে তাই নয়, মাথা আর তীক্ষ্ণ কানেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে, নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন, দমকা-মারা। কিন্তু তিনি জানতেন যে এই শেষ শক্তিটা বাকি দু’শ সাজেন দূরত্বের পক্ষে যথেষ্ট। নিজেকে মাটির কাছাকাছি বলে টের পাওয়ায় এবং গতির একটা বিশেষ লঘুতা দেখে ভ্রন্‌স্কি গেল যেন নজর না করেই। পেরিয়ে গেল যেন পাখির মত উড়ে; কিন্তু ঠিক এই সময়েই ভ্রন্‌স্কি আতংকে অনুভব করলেন যে ঘোড়ার গতির সাথে তাল রাখতে না পেরে তিনি নিজেই না বুঝে কেমন করে যেন একটা বিছ্‌ছিরি অমার্জনীয় কাণ্ড করে ফেলেছেন, বসে পড়েছেন জিনে। হঠাৎ অবস্থা ওঁর বদলে গেল, বুঝতে পারলেন ভয়াবহ কিছু-একটা ঘটেছে। কি ঘটেছে সেটা বুঝে উঠতে না উঠতেই পাটকিলে ঘোড়ার সাদা পা ঝলক দিল তাঁর কাছে, মাখোতিন দ্রুত ছুটে গেল তাঁর পাশ দিয়ে। ভ্রন্‌স্কির একটা পা ঠেকল মাটিতে, ঘোড়া লুটিয়ে পড়ল সেই পায়ের ওপর। পা’টা ছাড়িয়ে নিতে- না-নিতেই ঘোড়া একপাশে কাত হয়ে পড়ল, ঘড়ঘড়ে শব্দ করে উঠে দাঁড়াবার বৃথা চেষ্টায় শীর্ণ ঘর্মাক্ত ঘাড় বাড়িয়ে গুলি-বেঁধা পাখির মত ধড়ফড় করতে লাগল তাঁর পায়ের কাছে। ভ্রন্‌স্কির আনাড়ি কাণ্ডটায় ঘোড়ার পিঠ ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অনেক পরে। এখন তিনি শুধু দেখলেন মাখোতিন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে আর কর্দমাক্ত অটল মাটির ওপর দাঁড়িয়ে তিনি টলছে, ভয়ানক হাঁপাতে হাঁপাতে তাঁর সামনে পড়ে আছে ফ্লু-ফ্লু, তাঁর দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে তার অপরূপ চোখে তাকিয়ে দেখছে সে। কি ঘটেছে সেটা তখনো না বুঝে ভ্রন্‌স্কি টানাটানি করতে লাগলেন ঘোড়ার লাগাম। আবার ঘোড়া মাছের মত ছটফট করে, জিন ক্যাচকেঁচিয়ে সামনের দু’পা বাড়িয়ে উঠতে চেষ্টা করল, কিন্তু পাছা তুলতে পারল না, সাথে সাথেই লুটিয়ে পড়ল কাত হয়ে, ভ্রন্‌স্কির মুখ রিপুবেগে বিকৃত, বিবর্ণ, নিম্ন চিবুক কম্পমান, তাঁর জুতোর হিল দিয়ে তিনি লাথি মারলেন তার পেটে, আবার টানতে লাগলেন লাগাম। কিন্তু ঘোড়া নড়ল না, পশ্চাদ্দেশ মাটিতে গুঁজে সে তার মুখের দৃষ্টিতে চাইল প্রভুর দিকে।

‘আ-আ-আ!’ মাথা চেপে ধরে গড়িয়ে উঠলেন ভ্রন্‌স্কি, ‘আ-আ-আ! কি আমি করলাম!’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, ‘দৌড়েও হেরে গেলাম! সবই আমার দোষ, কলঙ্কজনক, অমার্জনীয়! আর হতভাগ্য সুন্দর ঘোড়াটাও ধ্বংস হয়ে গেল! আ-আ-আ! আমি কি করলাম!’

লোকে—ডাক্তার, তার সহকারী, রেজিমেন্টের অফিসাররা ছুটে গেল তাঁর কাছে। সখেদে তিনি অনুভব করলেন যে তিনি অক্ষত, নিরাপদ। ঘোড়ার পিঠ ভেঙেছে, সিদ্ধান্ত হল তাকে গুলি করে মারা হোক। কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না ভ্রন্‌স্কি, কথা বলতে পারলেন না কারো সাথে। ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা থেকে খসে পড়া টুপিটা না তুলেই তিনি ঘোড়দৌড়ের মাঠ ছেড়ে চললেন—নিজেই জানেন না কোথায়। নিজেকে হতভাগ্য বোধ হচ্ছিল তাঁর। জীবনে এই প্রথমবার এত গুরুতর দুর্ভাগ্য তাঁর ঘটল, সে দুর্ভাগ্য অপূরণীয় আর তার জন্য তিনি নিজেই দোষী।

ইয়াভিন টুপিটা তুলে নিয়ে তাঁর সঙ্গ ধরলেন, তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। আধ ঘণ্টা বাদে ভ্রন্‌স্কি প্রকৃতিস্থ হলেন, কিন্তু এ দৌড়ের স্মৃতি অনেক-অনেক দিন তাঁর মর্মে জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি হয়ে ছিল।

ছাব্বিশ

কারেনিনের স্ত্রীর সাথে বাইরের সম্পর্ক আগের মতই ছিল। শুধু একমাত্র পার্থক্য হল এই যে, তিনি কাজে ব্যস্ত থাকতে লাগলেন আগের চেয়ে বেশি। আগের বছরগুলোর মতই বসন্ত শুরু হতেই তিনি হাওয়া বদলাতে বিদেশে যান শীতকালের পরিশ্রমে প্রতি বছর ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ফেরাবার জন্য এবং বরাবরের মত জুলাই মাসে ফিরে বর্ধিত কর্মোদ্যোগে কাজে লেগে যান। বরারের মত স্ত্রী উঠে এসেছিলেন পল্লীভবনে আর তিনি থেকে যান পিটার্সবার্গে।

প্রিন্সেস ভেস্কায়ার ওখানে সেই সন্ধ্যার পরে যে কথাবার্তা হয়েছিল তার পরে তিনি আন্নার কাছে নিজের সন্দেহ আর ঈর্ষার কোন প্রসঙ্গ তোলেননি। কারো একটা বর্ণনা দেবার সময় যে সুরে তিনি কথা বলতেন সেটা তাঁর স্ত্রীর প্রতি তাঁর বর্তমান সম্পর্কের সাথে এত খাপ খায়নি আর কখনো। স্ত্রীর প্রতি কিছুটা নিরুত্তাপ হয়ে ওঠেন তিনি। প্ৰথম যে নৈশ আলাপটা আন্না অগ্রাহ্য করেন তার জন্য আন্নার প্রতি তাঁর সম্পর্কে বিরক্তির আভাস থাকত, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। ‘তুমি আমার সাথে বোঝাবুঝি করে নিতে চাওনি’, তিনি যেন মনে মনে বলতেন আন্নাকে, ‘সেটা তোমার পক্ষেই খারাপ। এবার তুমি আমাকে অনুরোধ করবে, আর আমি কিছুই বোঝাতে যাব না। সেটা তোমার পক্ষেই খারাপ’, তিনি মনে মনে কথা বলতেন সেই মানুষের মত, যে আগুন নেভাবার বৃথা চেষ্টা করেছে এবং নিজের ব্যর্থতায় রেগে উঠে বলতে পারত ‘চুলোয় যা! পড়ে মর এর জন্যে।’

রাজকর্মের ব্যাপারে বুদ্ধিমান ও সূক্ষ্মদর্শী এই লোকটা স্ত্রীর প্রতি এরূপ মনোভাবের নির্বুদ্ধিতা বুঝতেন না। বুঝতেন না কারণ নিজের সত্যিকার অবস্থা বুঝতে যাওয়া তাঁর পক্ষে ছিল বড় বেশি ভয়াবহ, তাই মনের মধ্যে যে বাক্সটায় পরিবারের প্রতি, অর্থাৎ স্ত্রী ও ছেলের প্রতি তাঁর হৃদয়াবেগগুলো থাকত সেটা তিনি বন্ধ করে তালা এঁটে সীল মেরে রেখেছিলেন। মনোযোগী পিতা তিনি, শীতের শেষ তিনি সবিশেষ নিরুত্তাপ হয়ে ওঠেন ছেলের প্রতি, স্ত্রীর মত ছেলের ক্ষেত্রেও তিনি একই ঠাট্টার সুর তিনে। ‘আর, যুবাপুরুষ যে!’ ছেলেকে সম্বোধন করতেন তিনি।

কারেনিন মনে করতেন এবং বলতেন যে এবারের মত আর কোন বছরে কাজের এত চাপ তাঁর কখনো হয়নি; কিন্তু সচেতন ছিলেন না যে কাগজগুলো তিনি নিজেই ভেবে বের করছেন আর যে বাক্সটায় থাকত স্ত্রীর এবং ছেলের প্রতি হৃদয়ানুভূতি, তাদের নিয়ে ভাবনা, সেটা না খোলার একটা উপায় এটা, আর যতদিন তা বাক্সে বন্ধ থাকছে ততই ভয়াবহ হয়ে উঠছে সেগুলো। স্ত্রীর আচরণ সম্পর্কে কি তিনি ভাবছেন এ কথা জিজ্ঞেস করার অধিকার যদি কারো থাকত, তাহলে নিরীহ, নম্র কারেনিন কোন জবাব দিতেন না নিশ্চয়, কিন্তু যে লোক এ কথা জিজ্ঞেস করেছে তার ওপর তিনি ভয়ানক চটে উঠতেন। এজন্যই ওঁর স্ত্রীর স্বাস্থ্য কেমন আছে কেই জিজ্ঞেস করল, কারেনিনের মুখে ফুটে উঠত একটা গর্ব আর কঠোরতার ভাব। স্ত্রীর আচরণ ও হৃদয়াবেগ নিয়ে ভাবতে চাইতেন না তিনি এবং সত্যি সত্যিই ভাবতেন না কারেনিনের স্থায়ী পল্লীভবন ছিল পিটার্সহফে, কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা সাধারণত গ্রীষ্মটা কাটাতেন সেখানেই, আন্নার প্রতিবেশী হিসেবে তাঁর সাথে অবিরাম যোগাযোগ রেখে। এ বছর কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা পিটার্সহফে থাকতে চাননি, একবারেও আসেননি আন্না আর্কাদিয়েভনার কাছে, বেত্‌সি আর ভ্রন্‌স্কির সাথে আন্নার অন্তরঙ্গতা যে অস্বস্তিকর, কারেনিনের কাছে এ ইঙ্গিত তিনি করেছেন একাধিকবার। কারেনিন তাঁকে রূঢ়ভাবে থামিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে, তাঁর স্ত্রী সন্দেহের ঊর্ধ্বে এবং সেই থেকে কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভেনাকে তিনি এড়িয়ে চলছেন। তিনি দেখতে চাইতেন না এবং দেখতেন না যে অনেক লোকেই তাঁর স্ত্রীর দিকে চাইছি বাঁকা চোখে, বুঝতে চাইতেন না এবং বুঝতেন না কেন তাঁর স্ত্রী জারস্কোয়ে সেলোতে উঠে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করছেন যেখানে থাকতেন বেত্‌সি ভ্রন্‌স্কির রেজিমেন্ট ছাইনি পেতেছে যেখানে থেকে দূরে নয়। এ নিয়ে নিজেকে ভাবতে তিনি দিতেন না এবং ভাবতেন না; কিন্তু সেই সাথে নিজেকে এ কথা কখনো না বলে এবং কোন প্রমাণ শুধু নয়, সন্দেহের কোন কারণ না পেয়েও তিনি অন্তরের গভীরে গভীরে নিশ্চিত জানতেন যে তিনি প্রতারিত স্বামী, আর সে জন্য গভীর দুর্ভাগ্য বোধ করতেন।

স্ত্রীর সাথে আট বছরের সুখী জীবনে অন্যের বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রী আর প্রবঞ্চিত স্বামীর দিকে তাকিয়ে কতবার না তিনি মনে মনে ভেবেছেন : ‘কি করে এটা ওরা হতে দিচ্ছে? এই বিশ্রী অবস্থাটা থেকে বেরিয়ে আসছে না কেন?’ কিন্তু এখন, বিপদ যখন ভেঙ্গে পড়েছে তাঁরই মাথায়, তখন এই বিশ্রী অবস্থাটা ঢুকিয়ে তিনি জানতেও চাইলেন না। চাইলেন না—কারণ সেটা বড় বেশি ভয়ংকর, বড় বেশি অস্বাভাবিক।

বিদেশ থেকে ফিরে কারেনিন তাঁর পল্লীভবনে গেছেন দু’বার। একবার সেখানে দিবাহার সারেন, দ্বিতীয়বার সন্ধ্যা কাটান নিমন্ত্রিতদের সাথে। কিন্তু কোনবারই রাত কাটাননি, যা করেছেন আগের বছরগুলোয়।

ঘোড়দৌড়ের দিনটা ছিল কারেনিনের কাছে খুবই কর্মব্যস্ত একটা দিন; কিন্তু সকালেই দিনের কর্মসূচি স্থির করার সময় তিনি ভেবেছিলেন তাড়াতাড়ি দিবাহার সেরে তিনি পল্লীভবনে যাবেন স্ত্রীর কাছে, সেখান থেকে ঘোড়দৌড়ে, যেখানে থাকবে গোটা রাজদরবার, তাঁরও সেখানে থাকা উচিত। স্ত্রীর কাছে তিনি যাচ্ছেন কারণ শোভনতার জন্য সপ্তাহে একবার করে সেখানে যাবেন বলে স্থির করেছিলেন। তাছাড়া সেদিন পনেরোই, এই তারিখে খরচার জন্য টাকা দেবার একটা রেওয়াজ গড়ে উিেছল।

তিনি স্ত্রীর সম্পর্কে এটুকু ভাবার পর যেটা স্ত্রীর ব্যাপার নিজের ভাবনার ওপর দখল থাকায় সেখানে নিজের ভাবনা প্রসারিত হতে দিলেন না।

এই সকালটায় কারেনিনের কাজ ছিল প্রচুর। আগের দিন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা পিটার্সবুর্গে আগত একজন নামকরা পর্যটকের চীন ভ্রমণ সম্পর্কে পুস্তিকা পাঠিয়ে লিখেছিলেন যে তাঁকে যেন ডাকা হয়, নানা কারণে লোকটা চিত্তাকর্ষক ও প্রয়োজনীয়। সন্ধ্যায় বইটি কারেনিন পড়ে উঠতে পারেননি, সেটা শেষ করলেন আজ সকালে। তারপর যাজকেরা আসে, শুধু হল রিপোর্ট লেখা, আপ্যায়ন করা, নিয়োগ বরখাস্ত পুরস্কার, পেনশন, মাহিনা দানের হুকুম, পত্রালাপ। অর্থাৎ কারেনিন যাকে বলতেন দৈনন্দিন কাজ যাতে অনেক সময় যায়। তারপর ছিল তাঁর নিজের কাজ, ডাক্তারের আগমন, সরকার। সরকার বেশি সময় নেয়নি। কারেনিনকে প্রয়োজনীয় টাকাটা দিয়ে সে কেবল সংক্ষেপে বিষয়-আশয়ের হাল জানায় যায় বিশেষ ভালো যাচ্ছিল না। কেননা বর্তমান বছরে ব্যক্তিগত সফরের জন্য অনেক খরচ হওয়ায় টান পড়েছে টাকায়। কিন্তু ডাক্তার, পিটার্সবুর্গের নামকরা ডাক্তারটা কারেনিনের সাথে সৌহার্দ্য থাকায় সময় নিলেন অনেক। কারেনিন আজ তাঁকে আশা করেননি, তাঁর আসায় তিনি অবাক হয়েছিলেন আরো এই জন্য যে তিনি খুব মন দিয়ে তাঁর স্বাস্থ্যেও কথা জিজ্ঞেস করেন, বুকে স্টেথস্কোপ লাগিয়ে শোনেন, যকৃৎ টিপে দেখেন। কারেনিন জানতেন না যে তাঁর বন্ধু লিদিয়া ইভানোভনা তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ যাচ্ছে দেখে রোগীকে পরীক্ষা করার জন্য ডাক্তারকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর কাছে যেতে। আমার জন্যে এই কাজটুকু করুন’, বলেছিলেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা।

ডাক্তার জবাব দিয়েছিলেন, ‘এটা আমি করব রাশিয়ার জন্যে, কাউন্টেস।’

কাউন্টেস বলেছিলেন, ‘অমূল্য মানুষ!’

কারেনিনকে পরীক্ষা করে ডাক্তার খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। দেখলেন তাঁর যকৃৎ অনেক বেড়েছে, কমে গেছে পুষ্টি, কোন ফল হয়নি খনিজ জলে।তিনি বরাত করলেন যথাসম্ভব শারীরিক গতিবিধি বাড়িয়ে যথাসম্ভব মানসিক চাপ কমাতে, প্রধান কথা কোনরকম দুশ্চিন্তা চলবে না, যা কারেনিনের কাছে নিঃশ্বাস না নেওয়ার মতই অসম্ভব; চলে গিয়ে ডাক্তার কারেনিনের মনে এমন একটা ধারণা রেখে গেলেন যে তাঁর শরীরে কিছু-একটা গড়বড় হয়েছে যা সারানো যাবে না।

কারেনিনের কাছ থেকে চলে যেতে অলিন্দে ডাক্তারের হয়ে গেল তাঁর সুপরিচিতি, কারেনিনের বাড়ির সরকার স্লিউদিনের সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা ছিলেন সহপাঠী, কালেভদ্রে দেখা হলেও তাঁরা ছিলেন বন্ধু এবং পরস্পরের প্রতি সশ্রদ্ধ, সেই কারণে স্লিউদিনকে ছাড়া আর কাউকে ডাক্তার জানাতেন না রোগী সম্পর্কে তাঁর অভিমত।

স্লিউদিন বললেন, ‘আপনি এসেছেন বলে কি যে খুশি হয়েছি। উনি সুস্থ নন, আর আমার মনে হয়…কিন্তু কি হয়েছে?’

‘হয়েছে এই’, স্লিউদিনের মাথার ওপর দিয়ে গাড়ি আনার জন্য কোচোয়ানকে ইঙ্গিত করে ডাক্তার বললেন, তারপর তাঁর সাদা হাতে নরম দস্তানায় আঙুল ঢুকিয়ে যোগ করলেন, হয়েছে এই-একটা তন্তুকে টান না করে ছেঁড়াবার চেষ্টা করে দেখুন-খুবই কঠিন; কিন্তু যথাসাধ্য টানটান করতে পারলে আঙুলের একটা ভারেই তা ছিঁড়ে পড়বে। আর উনি তাঁর পরিশ্রম আর কর্তব্য-বোধ টানটান হয়ে উঠেছেন একেবারে শেষ মাত্রায়। তাছাড়া বাইরের চাপ পড়ছে, খুবই বেশি চাপ’, অর্থব্যঞ্জকভাবে ভুরু তুলে সমাপ্তি টানলেন ডাক্তার, এবং নিয়ে আসা গাড়িটায় উঠতে উঠতে যোগ করলেন, ‘ঘোড়দৌড়ে যাচ্ছেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেক সময় যাবে বৈকি’, স্লিউদিন কি-একটা বলেছিলেন যা তাঁর কানে যায়নি, তার জবাবে বললেন তিনি।

ডাক্তার অনেক সময় নিয়ে চলে যাবার পর এলেন নামকরা পর্যটক আর কারেনিন তাঁর সদ্যপঠিত পুস্তিকা এবং আগের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে পর্যটককে বিস্মিত করলেন বিষয়টা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও সুশিক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতায়।

তাঁকে পর্যটকের সাথে সাথেই গুবের্নিয়া-প্রধানের আগমন সংবাদ জানানো হল। তিনি পিটার্সবুর্গে এসেছিলেন এবং তাঁর সাথে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারগুলো সারতে হল, তারপর একটা গুরুত্বপূর্ণ জরুরি ব্যাপারে যেতে হল জনৈক ব্যক্তির কাছে। ফিরতে পারলেন কেবল তাঁর আহারের সময় বেলা পাঁচটা নাগাদ। সরকারের সাথে আহার সেরে তিনি তাঁকে আমন্ত্রণ করলেন তাঁর সাথে একত্রে পল্লীভবনে এবং পরে ঘোড়দৌড়ে যেতে।

ব্যাপারটা সম্পর্কে সজ্ঞান না থেকেই স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎকালে এখন কোন তৃতীয় ব্যক্তি যাতে উপস্থিত থাকে তিনি তার প্রয়োজন বোধ করছিলেন।

সাতাশ

আন্না ওপরতলায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আনুশ্‌কার সাহায্যে তাঁর গাউনে শেষ ফিতে আঁটছিলেন। এমন সময় সদরের কাছে নুড়ি মাড়িয়ে যাওয়া চাকার শব্দ শুনতে পেলেন। ভাবলেন, বেত্‌সির তো এত তাড়াতাড়ি আসার কথা নয়।’ জানালা দিয়ে দেখতে পেলেন একটা গাড়ি আর তা থেকে বেরিয়ে আছে একটা কালো টুপি আর কারেনিনের অতি পরিচিত কান। ভাবলেন, ‘দ্যাখো কাণ্ড, কি অসময়ে আসা; রাতে থাকবে নাকি?’ এবং তার ফলে যা ঘটতে পারে সেটা তাঁর কাছে এতই সাংঘাতিক আর ভয়ংকর মনে হল যে মুহূর্তের জন্যও কিছু না ভেবে হাসিখুশি উজ্জ্বল মুখে এগিয়ে গেলেন তাঁর দিকে। মিথ্যাও প্রবঞ্চনার যে ঝোঁক তাঁর পরিচিত নিজের মধ্যে তার উপস্থিতি টের পেয়ে আত্মসমর্পণ করলেন সেই ঝোঁকে, কথা বলতে শুরু করলেন কি বলছেন নিজেই তা না জেনে।

স্বামীর দিকে হাত বাড়িয়ে আর ঘরের লোক স্লিউদ্দিনকে হেসে স্বাগত করে তিনি বললেন, ‘আহ্ বেশ ভালো হল!’ আর প্রথম যে কথাটা তাঁর প্রতারণার ঝোঁক তাঁর মুখে জুগিয়ে দিলে, সেটা হল, ‘রাত কাটাচ্ছ তো? এবার আমরা একসাথে রওনা দেব। দুঃখের কথা বেত্‌সিকে কথা দিয়েছি। সে আমাকে নিতে আসবে।’

বেত্‌সির নাম শুনে মুখ কোঁচকাল কারেনিনের।

তিনি তাঁর বরাবরের রহস্যের সুরে বললেন, ‘আরে না, অবিচ্ছেদ্যকে বিচ্ছিন্ন করতে আমি যাব না। আমি যাব মিখাইল ভাসিলিয়েভিচের সাথে। ডাক্তারও আমাকে হাঁটাহাঁটি করতে বলছে। হেঁটে যাব রাস্তা দিয়ে আর কল্পনা করব যে আছি খনিজ পানির এলাকায়।’

আন্না বললেন, ‘তাড়াহুড়ার কিছু নেই। চা খাবে?’ ঘণ্টি দিলেন তিনি।

‘চা দিন-না, সেরিওজাকে বলুন যে কারেনিন এসেছেন। তা কেমন আছ তুমি? মিখাইল ভাসিলিয়েভিচ আমাদের এখানে আপনারা আসেননি, দেখুন কি সুন্দর আমাদের ঝুল-বারান্দা,’ বললেন তিনি কখনো একে কখনো ওকে লক্ষ্য করে।

কথা বলছিলেন তিনি সহজ-স্বাভাবিক সুরে কিন্তু বড় বেশি এবং বড় তাড়াতাড়ি। নিজেই তিনি তার টের পাচ্ছিলেন, বিশেষ করে মিখাইল ভাসিলিয়েভিচ যে কৌতূহলী দৃষ্টিতে চাইছিলেন তা থেকে তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, উনি কেমন যেন নজর করে দেখছেন তাঁকে

মিখাইল ভাসিলিয়েভিচ তখনই চলে গেলেন বারান্দায়।

আন্না স্বামীর পাশে বসলেন। বললেন, ‘তোমার চেহারা খারাপ দেখাচ্ছে।’

উনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আজ ডাক্তার এসেছিল। এক ঘণ্টা সময় নিয়েছে। মনে হয় আমার বন্ধু-বান্ধবদের কেউ পাঠিয়েছিল। আমার স্বাস্থ্য এদের কাছে খুবই মূল্যবান…’

‘কিন্তু কি সে বলল?’

ওঁর স্বাস্থ্য, কাজকর্মের কথা জিজ্ঞেস করলেন আন্না, বললেন বিশ্রাম দরকার, চলে আসুন তাঁর কাছে।

আন্না এসবই খুশির সুরে বললেন, চোখে ঝিলিক তুলে; কিন্তু কারেনিন সে সুরে কোন তাৎপর্য দিলেন না, তিনি শুধু তাঁর কথা শুনলেন এবং শুধু তাদের সোজাসাপটা মানেটাই ধরলেন। তিনি জবাবও দিলেন সাদাসিধে, যদিও রহস্য করে। আলাপটায় বিশেষত্ব কিছু ছিল না, কিন্তু পরে লজ্জার একটা যন্ত্রণা ছাড়া এই ছোট দৃশ্যটা স্মরণ করতে পারতেন না আন্না।

গৃহশিক্ষিকা সমভিব্যহারের ঘরে ঢুকল সেরিওজা। কারেনিন যদি পর্যবেক্ষণ করার সাহস রাখতেন, তাহলে দেখতে পেতেন যে ছেলেটা ভীরু ভীরু বিহ্বল দৃষ্টিতে চাইল প্রথমে বাবা, পরে মায়ের দিকে। কিন্তু কিছুই তিনি দেখতে চাইছিলেন না এবং দেখলেন না।

‘আ, নবযুবক যে। বেড়ে উঠেছে…সত্যি, একেবারে মরদ। স্বাগত নবযুবক।’

করমর্দনের জন্য তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন সন্ত্রস্ত সেরিওজার দিকে। বাবার সাথে সম্পর্কে সেরিওজা আগেও ছিল সংকুচিত। আর এখন কারেনিন তাকে ‘নবযুবক’ বলে ডাকতে শুরু করা এবং ভ্রন্‌স্কি শুধু না মিত্র এই প্রহেলিকাটা মাথায় ঘুরতে থাকার পর বাপ তার কাছে একেবারে পর হয়ে উঠেছে। মায়ের দিকে সে চাইল যেন সাহায্য প্রার্থনা করে। শুধু মায়ের কাছে থাকলেই সে ভালে বোধ করত। কারেনিন ওদিকে গৃহশিক্ষিকার সাথে কথা বলতে বলতে কাঁধ ধরে রেখেছেন ছেলের, সেরিওজা এমন যন্ত্রণাকর অস্বস্তি হচ্ছিল যে আন্না দেখতে পেলেন যে ছেলেটার কান্না পাচ্ছে।

ছেলে ঘরে ঢুকতেই আন্না লাল হয়ে উঠেছিলেন, আর এখন সেরিওজার অস্বস্তি হচ্ছে লক্ষ্য করে ছেলের কাঁধ থেকে কারেনিনের হাত সরিয়ে দিয়ে, তাকে চুমু খেয়ে নিয়ে গেলেন বারান্দায় এবং তখনই ফিরে এলেন।

নিজের ঘড়ি দেখে বললেন, সময় কিন্তু হয়ে গেছে। বেত্‌সি আসছে না কেন! …

‘হ্যাঁ,’ বলে কারেনিন উঠে দাঁড়িয়ে আঙুল মটকালেন। ‘আমি আরো এলাম তোমাকে টাকা দেবার জন্যে, কেননা রূপকথা শুনে তো আর নাইটিঙ্গেলের পেট ভরে না’, তিনি বললেন, ‘মনে হয়, তোমার এটা দরকার।’

‘না দরকার নেই…ও হ্যাঁ, দরকার আছে’, স্বামীর দিকে না তাকিয়ে মাথার চুলের গোড়া পর্যন্ত লাল হয়ে আন্না বললেন, ‘ঘোড়দৌড়ের পর তুমি এখানে আসবে আশা করি।’

কারেনিন বললেন, ‘হ্যাঁ’, তারপর জানালা দিয়ে অনেক উঁচুতে বসানো ছোট্ট কোচবক্স আর বরারের টায়ার লাগানো বিলাতি গাড়ি আসতে দেখে যোগ করলেন, ‘এই যে পিটার্সহফের সুন্দরী, প্রিন্সেস ভেস্কায়া। কি জমকালো! আহা মরি! তাহলে আমরাও চলি।’

প্রিন্সেস ভেস্কোয়া গাড়ি থেকে নামলেন না শুধু বুট, কেপ আর কালো টুপি পরা তাঁর খানসামা নেমে এল দেউড়ির কাছে।

‘আমি চললাম, আসি’, বলে ছেলেকে চুমু খেযে আন্না স্বামীর কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন, ‘এসে খুব ভালো করেছ।’

আলেক্‌সেই আলেক্‌সান্দ্রভিচ কারেনিন তাঁর হাতে চুমু খেলেন।

‘আসি তাহলে। তুমি চা খেতে আসবে তো, চমৎকার হবে।’ এই বলে আন্না বেরিয়ে গেলেন হাসিখুশিতে ঝলমলিয়ে। কিন্তু স্বামী চোখের আড়াল হতেই হাতের যেখানটায় তাঁর ঠোঁটের ছোঁয়া লেগেছিল সেটা অনুভব করে কেঁপে উঠলেন ঘৃণায়।

আটাশ

যখন ঘোড়দৌড়ের মাঠে কারেনিন পৌঁছলেন, আন্না তখন বেত্‌সির পাশে সেই মঞ্চে বসে ছিলেন যেখানে জমা হয়েছিল গোড়া উঁচু সমাজের লোকজন। স্বামীকে তাঁর চোখে পড়েছিল দূর থেকেই। দুটো মানুষ, স্বামী আর তাঁর প্রণয়ী ছিল তাঁর জীবনের দুই কেন্দ্র, বাহ্যিক অনুভূতির সাহায্য ছাড়াই তিনি টের পাচ্ছিলেন তাঁদের নৈকট্য। দূর থেকেই তিনি অনুভব করছিলেন স্বামী কাছিয়ে আসছেন, আর যে জনতরঙ্গের মধ্যে দিয়ে তিনি এগোচ্ছিলেন, তার ভেতর অজ্ঞাসতারেই লক্ষ্য করছিলেন, তাঁকে। তিনি দেখলেন, মঞ্চের দিকে আসতে আসতে তিনি কখনো তোষামোদে অভিবাদনের উত্তর দিচ্ছিলেন কৃপা প্রদর্শনের ভঙ্গিতে, কখনো সমক্ষকদের অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন প্রীতিভরে, অন্যমনস্কের মত, কখনো সমাজের গণ্যমান্যদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় উদ্গ্রীব হয়ে তাঁর কানের ডগা চেপে ধরা মস্ত গোল টুপিটা খুলছিলেন। এই সমস্ত ধরন-ধারন আন্নার জানা আছে, আর সবই তাঁর কাছে জঘন্য লাগছিল। তাঁর মনে হল, ‘এ সবই কেবল আত্মাভিমান, শুধুই উন্নতির বাসনা-মাত্র এই আছে তার মনের ভেতর। আর বড় বড় কথা, শিক্ষাবিস্তার, ধর্মের জন্যে অনুরাগ—এগোলো কেবল উন্নতি করতে পারার উপায়।’

মেয়েদের মঞ্চের দিকে তাঁর দৃষ্টিপাত থেকে আন্না বুঝেছিলেন যে উকি ওঁকে খুঁজছেন (তিনি সোজা আন্নার দিকেই তাকিয়েছিলেন, কিন্তু মসলিন, রিবন, পালক ছাতা আর ফুলের ভিড়ে তাঁকে চিনতে পারেননি), আন্নাও ইচ্ছে করেই তাঁকে দেখতে না পাওয়ার ভান করলেন।

প্রিন্সেস বেত্‌সি তাঁর উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কারেনিন! আপনি নিশ্চয় স্ত্রীকে দেখতে পাচ্ছেন না; এই যে এখানে!’

কারেনিন তাঁর নিষ্প্রাণ হাসি হাসলেন।

‘এখানে এমন চাকচিক্য যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়’, এই বলে তিনি এলেন মঞ্চে। স্ত্রীর উদ্দেশে হাসলেন তিনি, সদ্য সাক্ষাতের পর আবার স্ত্রীকে দেখে যেভাবে স্বামীর হাসা উচিত, প্রিন্সেস এবং অন্যান্য পরিচিতিদের সম্ভাষণ জানালেন, প্রত্যেককেই দিলেন তাদের উচিতমত প্রাপ্য, অর্থাৎ রহস্য করলেন মহিলাদের সাথে আর মাথা নোয়ালেন পুরুষদের উদ্দেশে। নিচে মঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন কারেনিনের কাছে সম্মানীয়, মনীষা ও শিক্ষাদীক্ষায় সুখ্যাত এক জেনারেল- অ্যাডজুট্যান্ট। কারেনিন কথা বলতে লাগলেন তাঁর সাথে।

দৌড়ের মাঝখানে তখন বিরতি, তাই আলাপে বাধা পড়ার মত কিছু ছিল না। জেনারেল-অ্যাডজুট্যান্ট ঘোড়দৌড়ের নিন্দা করছিলেন, তাতে আপত্তি করে কারেনিন দাঁড়ালেন তার সমর্থনে। আন্না তাঁর একটা কথাও বাদ না দিয়ে শুনছিলেন তাঁর মিহি সমতাল কণ্ঠস্বর আর তাঁর প্রতিটি কথাই তাঁর মনে হচ্ছিল মিথ্যা, কানে বিঁধছিল যন্ত্রণা দিয়ে।

যখন চার ভার্স্টের হার্ডল রেস শুরু হয়, তখন আন্না সামনে ঝুঁকে পড়ে চোখ না সরিয়ে দেখছিলেন যে অনস্কি ঘোড়র কাছে এসে তাতে চাপছেন আর সেই সাথে শুনছিলেন স্বামীর এই অবিশ্রাম বিরক্তিকর কণ্ঠস্বর। ভ্রন্‌স্কির জন্য আশংকায় কষ্ট হচ্ছিল তাঁর, কিন্তু আরো বেশি কষ্ট হচ্ছিল কথার পরিচিত টানা সমেত স্বামীর মিহি গলায় যা কখনো থামবে না বলে মনে হচ্ছিল তাঁর।

আন্না ভাবছিলেন, ‘আমি একটা খারাপ মেয়ে, নষ্টা মেয়ে। কিন্তু মিথ্যে বলতে আমার ভালো লাগে না, সইতে পারি না মিথ্যে, কিন্তু ওর (স্বামীর) খোরাক এই মিথ্যেই। সব ও জানে, সব দেখতে পাচ্ছে; অথচ অমন শান্তভাবে কথা বলতে যখন ও পারছে তখন কি তার অনুভূতির দাম? যদি খুন করত আমাকে, খুন করত ভ্রন্‌স্কিকে, তাহলে বরং সম্মান করতাম ওকে। কিন্তু না, ওর দরকার কেবল মিথ্যা আর শোভনতা’, নিজেকে বোঝাচ্ছিলেন আন্না, কিন্তু ভাবছিলেন না ঠিক কি তিনি চান স্বামীর কাছ থেকে, ঠিক কি বেহারায় তাঁকে দেখতে চান। তিনি বুঝতে পারছিলেন না যে স্বামীর এখনকার অতি বিরক্তিকর এই বাগবাহুল্য তাঁর অন্তরের উদ্বেগ ও অস্থিরতার প্রকাশ মাত্র। চোট খাওয়া শিশু যেভাবে লাফালাফি করে পেশীর সঞ্চালনে বেদনা চাপা দিতে চায়, তেমনি কারেনিনের কাছেও প্রয়োজন ছিল মানসের সঞ্চালন, যা তাঁর স্ত্রীর উপস্থিতিতে, ভ্রন্‌স্কির উপস্থিতি, ক্রমাগত তাঁর নামের উল্লেখ স্ত্রীর সম্পর্কে যে ভাবনা জাগত তা চাপা দেবার জন্য। শিশু যেমন স্বাভাবিকভাবেই লাফালাফি করে, ভালো করে বুদ্ধিমানের মত কথা বলাও ছিল তাঁর পক্ষে তেমনি স্বাভাবিক। তিনি বলছিলেন : সৈন্যদের, ঘোড়সওয়ার অফিসারদের দৌড়ের একটা আবশ্যিক শর্তই হল বিপদের ঝুঁকি। ইংলন্ড যে সামরিক ইতহাসে অশ্বারোহী বাহিনীর চমৎকার কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছে, তার কারণ পশু ও মানুষের এই শক্তিটা সে বাড়িয়ে তুলেছে ঐতিহাসিক দিক দিয়ে।আমার মতে, ক্রীড়ার গুরুত্ব প্রভূত, অথচ বরাবরের মত, আমরা দেখি কেবল ওপরটুক।’

প্রিন্সেস ভেস্কায়া বললেন, ‘ওপরটুকু নয়। শুনছি একজন অফিসার তার পাঁজরার দুটো হাড়ই ভেঙেছে। কারেনিন তাঁর নিজস্ব হাসি হাসলেন যাতে তাঁর দাঁত ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ পেল না।

বললেন, ‘মানছি প্রিন্সেস, এটা ওপরকার নয়, ভেতরকার ব্যাপার, কিন্তু সেটা কোন কথা নয়।’ এবং আবার তিনি ফিরলেন জেনারেলের দিকে যার সাথে কথা বলছিলেন গুরুত্ব সহকারে। ভুলবেন না যে দৌড়াতে নেমেছে সামরিক লোকেরা, যারা এই কাজটা বেছে নিয়েছে এবং নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে প্রত্যেক কাজেরই আছে পদকের উলটো পিঠ। এটা আসে সরাসরি সামরিক কর্তব্যের মধ্যে। ঘুসোঘুসি অথবা স্পেনের তরিয়াদরদের কদর্য খেলাগুলো বর্বরতার লক্ষণ। কিন্তু বিশেষীকৃত ক্রীড়া, সেটা লক্ষণ বিকাশের।’

‘না, দ্বিতীয়বার আমি আর আসব না এখানে; বড় ব্যাকুল লাগে’, বললেন প্রিন্সেস বেত্‌সি, ‘তাই না আন্না?’

‘তা লাগে, তবে চোখ ফেরানো যায় না’, বললেন অন্য এক মহিলা, ‘আমি যদি হতাম রোমের মেয়ে, তাহলে কোন মল্লভূমিতেই হাজির হতে আমি ছাড়তাম না।

আন্না কিছুই বললেন না, দূরবীন না নামিয়ে তাকিয়ে ছিলেন কেবল একটা জায়গাতেই।

এ সময় দীর্ঘকায় এক জেনারেল মণ্ডপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আলাপ থামিয়ে কারেনিন তাড়াতাড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে তবে মর্যাদা নিয়েই নিচু হয়ে তাঁকে অভিবাদন করলেন।

জেনারেল ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি দৌড়াচ্ছেন না?

‘আমার দৌড় আরো কঠিন কাজ’, সসম্ভ্রমে জবাব দিলেন কারেনিন।

এবং যদিও জবাবটার বিশেষ কোন মানে হয় না, তাইলেও জেনারেল এমন ভাব করলেন যেন বুদ্ধিমান লোকের কাছ থেকে একটা বুদ্ধিমান উক্তি শোনা গেল এবং পুরোপুরি বুঝছেন তার মজা কিসে।

‘আছে দুই পক্ষ’, পুরানো তর্কটা আবার চালিয়ে গেলেন কারেনিন, ‘যারা দৌড়াচ্ছে আর যার দেখছে, আর দৃশ্যটাকে ভালোবাসা যে দর্শকদের নিচু মানের সুনিশ্চিত লক্ষণ তা আমি মানি, কিন্তু…’

‘প্রিন্সেস, বাজি!’ বেত্‌সির উদ্দেশে নিচু থেকে শোনা গেল অব্‌লোন্‌স্কির গলা, ‘আপনি কার পক্ষে?’

বেত্‌সি বললেন, ‘আমি আর আন্না প্রিন্স কুজোভলেভের পক্ষে।’

‘আমি ভ্রন্‌স্কির পক্ষে। বাজি দস্তানা।’

‘রাজি!’

‘কিন্তু কি সুন্দর। তাই না?

তাঁর আশেপাশে যখন এসব কথা হচ্ছিল, ততক্ষণ কারেনিন চুপ করে ছিলেন, কিন্তু আবার শুরু করলেন। ‘মানছি, কিন্তু পৌরুষের খেলা…’ চালিয়ে যেতে চাইছিলেন তিনি।

কিন্তু সেই সময়েই দৌড় শুরু হল, থেমে গেল সমস্ত কথাবার্তা। কারেনিনও চুপ করে গেলেন এবং সবাই ওপরে উঠে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল নদীর দিকে। দৌড়ে আগ্রহ ছিল না কারেনিনের। তাই সওয়ারদের দিকে না তাকিয়ে তিনি তাঁর ক্লান্ত চোখ বুলাতে লাগলেন দর্শকদের ওপর। দৃষ্টি তাঁর স্থির হল আন্নার কাছে এসে।

তাঁর মুখটা বিবর্ণ, কঠোর। স্পষ্টতই একজনকে ছাড়া আর কিছুই এবং কাকেও দেখছিলেন না তিনি। খামচে খামচে তিনি চেপে ধরছিলেন পাখা নিঃশ্বাস পড়ছিল না। তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখেই তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলেন তিনি দেখতে লাগলেন অন্যান্য মুখ।

‘হ্যাঁ, ঐ মহিলাটি এবং অন্যান্যরাও অতি উত্তেজিত; তা খুবই স্বাভাবিক’, মনে মনে ভাবছিলেন তিনি। আন্নার দিকে তাকাতে চাইছিলেন না তিনি, কিন্তু আপনা থেকেই চোখ তাঁর চলে যাচ্ছিল সেদিকে। আবার তাঁর মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে চেষ্টা করলেন সে মুখে যা পরিষ্কার লেখা আছে সেটা না পড়তে আর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সভয়ে পড়লেন যা তিনি জানতে চাইছিলেন না।

নদীতে কুজোলেভের প্রথম পতনে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল সবাই, কিন্তু আন্নার বিবর্ণ বিজয়গর্বিত মুখে কারেনিন পরিষ্কার দেখতে পেলেন, যার দিকে আন্না তাকিয়ে ছিলেন, সে পড়েনি। মাখোতিন আর ভ্রন্‌স্কি বড় প্রতিবন্ধকটা পেরিয়ে যাবার পর পরবর্তী অফিসার যখন সেখানে পড়ে গিয়ে মাথা ভাঙলেন এবং দর্শকদের মধ্যে রয়ে গেল আতংকের একটা গুঞ্জন, কারেনিন দেখতে পেলেন যে আন্না ঘটনাটা লক্ষ্যই করলেন না এবং চারিপাশে লোক কি কথা বলাবলি করছে সেটা বোঝা শক্ত হচ্ছিল তাঁর পক্ষে। কারেনিন ক্রমেই ঘন ঘন এবং একাগ্র দৃষ্টিতে চাইছিলেন তাঁর দিকে। ছুটন্ত ভ্রন্‌স্কির দৃশ্যে একেবারে তন্ময় হলেও আন্না টের পাচ্ছিলেন পাশ থেকে স্বামীর নিরুত্তাপ চোখের দৃষ্টি তাঁর ওপর নিবদ্ধ।

আন্না মুহূর্তের জন্য তাকালেন। তাকিয়ে দেখলেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে, একটু ভুরু কুঁচকে আবার মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

যেন তিনি বললেন, ‘আহ্, আমার বয়েই গেল’, এবং তাঁর দিকে আর একবারও তাকালেন না।

খুবই দুর্ভাগ্যজনক হল ঘোড়দৌড়টা। এতে সতের জন সওয়ারের মধ্যে অর্ধেকের বেশি লোক পড়ে গিয়ে হাড়গোড় ভাঙে। দৌড়ের শেষের দিকে সবাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে, সে উত্তেজনা আরো বাড়ে কারণ জার অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।

ঊনত্রিশ

সবাই চিৎকার-চেঁচামেচি করে তাদের অসন্তোষ জানাচ্ছিল, কার যেন বলা একটা উক্তির পুনরুক্তি করছিল : ‘শুধু সিংহ ছেড়ে দেওয়া সার্কাসটাই বাকি।’ সবারই এমন বীভৎস লাগছিল যে ভ্রন্‌স্কি যখন পড়ে যান আর আন্না সরবে হাহাকার করে ওঠেন, তখন সেটা কারো কাছে অস্বাভাবিক কিছু ঠেকেনি। কিন্তু তার পরেই আন্নার যে ভাবান্তর দেখা গেল সেটা নিশ্চিতই অশোভন। একেবারে অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি, ছটফট করতে লাগলেন ধরা পড়া পাখির মত; কখনো উঠে দাঁড়িয়ে কোথায় যেন যাবার উপক্রম করেন, কখনো আবার বেত্‌সিকে বলেন : ‘যাওয়া যাক, যাওয়া যাক।’

কিন্তু বেত্‌সি তাঁর কথা শুনছিলেন না, ঝুঁকে পড়ে তিনি কথা বলছিলেন তাঁর দিকে আগত জেনারেলের সাথে।

কারেনিন আন্নার কাছে এসে সম্ভ্রমভরে হাত এগিয়ে দিলেন।

‘আপনার আপত্তি না থাকলে চলুন যাই’, বললেন ফরাসি, ভাষায়; কিন্তু আন্না শুনছিলেন জেনারেলের কথা, স্বামীকে খেয়াল করলেন না।

জেনারেল বললেন, ‘শুনলাম ওরও পা ভেঙেছে। এ একেবারে অনাসৃষ্টি কাণ্ড।

স্বামীর কথার জবাব না দিয়ে আন্না দূরবীন তুলে দেখতে লাগলেন যে জায়গাটায় ভ্রন্‌স্কি পড়েছেন। কিন্তু সেটা এত দূরে আর এত লোকে ভিড় করেছে যে কিছুই ঠাহর করা যায় না। দূরবীন নামিয়ে উনি চলে যাবার উপক্রম করলেন, কিন্তু এই সময় এক অফিসার ঘোড়া ছুটিয়ে এসে কি যেন খবর দিল জারকে। আন্না মুখ বাড়িযে সেটা শোনাবার চেষ্টা করলেন।

‘স্তিভা! স্তিভা!’ চেঁচিয়ে ভাইকে ডাকতে লাগলেন তিনি।

কিন্তু সে ডাক ভাইয়ের কানে গেল না। আবার চলে যেতে চাইছিলেন আন্না।

‘আপনি যদি যেতে চান তাহলে আমি আরো একবার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি’, আন্নার বাহু ছুঁয়ে বললেন কারেনিন। বিতৃষ্ণায় সরে গেলেন আন্না, তাঁর মুখের দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলেন : ‘না-না, আমাকে রেহাই দিন। আমি এখানেই থাকব।’

এবার তাঁর চোখে পড়ল, ভ্রন্‌স্কি যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখান থেকে বৃত্ত পেরিয়ে একজন অফিসার ছুটে আসছে মঞ্চের দিকে। বেত্‌সি রুমাল নেড়ে তাকে ডাকলেন।

অফিসার খবর আনল যে সাওয়ার জখম হয়নি কিন্তু পিঠ ভেঙে গেছে ঘোড়াটার।

এ কথা শুনে আন্না ধপ করে বসে পড়ে মুখ ঢাকলেন পাখা দিয়ে। কারেনিন দেখতে পেলেন যে আন্না কাঁদছেন, শুধু চোখের পানি নয়, ফোঁপানিও আটকাতে পারছেন না যাতে স্ফীত হয়ে উঠছে তাঁর বুক। কারেনিন তাঁকে সামলে ওঠার সময় দিয়ে আড়াল করে দাঁড়ালেন।

কিছুক্ষণ পরে তিনি আন্নার উদ্দেশে বললেন, ‘তৃতীয় বার আমি আমার হাত এগিয়ে দিচ্ছি।’ আন্না তাঁর দিকে তাকালেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না কি বলবেন। প্রিন্সেস বেত্‌সি এলেন তাঁর সাহয্যে।

‘না, কারেনিন। আমি আন্নাকে এনেছি, ওকে আমিই পৌঁছে দেব বলে কথা দিয়েছি।’

‘মাপ করবেন প্রিন্সেস’, উনি বললেন সম্ভ্রমভরে হেসে, কিন্তু স্থির দৃষ্টিতে চোখে চোখে তাকিয়ে, ‘কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি যে আন্না মোটেই সুস্থ নন, আমি চাই উনি আমার সাথে চলুন।

আন্না সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকালেন চারপাশে, বাধ্যের মত উঠে দাঁড়িয়ে স্বামীর বাহুলগ্না হলেন।

‘আমি লোক পাঠাব ওর কাছে, খবর জেনে তোমাকে বলে আসব’, ফিসফিসিয়ে বললেন বেত্‌সি।

মঞ্চ থেকে বেরোবার পথে যাদের সাথে দেখা হচ্ছিল তাদের সাথে বরাবরের মতই কথা বলছিলেন কারেনিন আর বরাবরের মতই প্রশ্নের জবাব দিয়ে আলাপ চালাতে হচ্ছিল আন্নাকে; কিন্তু তিনি নিজে প্রকৃতিস্থ ছিলেন না, স্বামীর বাহুলগ্না হয়ে যাচ্ছিলেন যেন কোন-এক স্বপ্নের ভেতর দিয়ে

‘জখম হয়েছে কি হয়নি? সত্যি? আসবে কি আসবে না? আজকে কি দেখতে পাব?’ ভাবছিলেন তিনি।

কারেনিনের গাড়িতে তিনি উঠলেন নীরবে, নীরবে বেরিয়ে এলেন গাড়ি-ঘোড়ার ভিড় থেকে। কারেনিন স্বচক্ষে যা দেখেছেন তা সত্ত্বেও তিনি স্ত্রীর সত্যিকার অবস্থা সম্পর্কে ভাবতে চাইছিলেন না। তিনি দেখছিলেন, শুধু বাহ্য লক্ষণ। তাঁর চোখে পড়েছিল যে স্ত্রীর ব্যবহারটা শোভন হয়নি, সেটা তাঁকে বলা তাঁর উচিত বলে তিনি মনে করেছিলেন। কিন্তু এর বেশি কিছু না-বলা শুধু এটুকু বলা তাঁর পক্ষে খুবই কঠিন হচ্ছিল। আন্নার আচরণ কি রকম অশোভন হয়েছে তা বলার জন্য মুখ খুললেন তিনি, কিন্তু অনিচ্ছাক্রমেই বললেন একেবারে অন্য কথা। বললেন, ‘কিন্তু এসব নিষ্ঠুর দৃশ্য দেখার কি ঝোঁক আমাদের। আমি দেখেছি…’

আন্না ঘৃণাভরে বললেন, ‘কি? বুঝতে পারছি না।’

তিনি ক্ষুব্ধ হলেন এবং সাথে সাথেই বলতে শুরু করলেন যা বলতে চাইছিলেন। উনি বললেন, ‘আপনাকে আমার বলা উচিত।’

‘এবার বোঝাপড়া’, আন্না ভাবলেন এবং তাঁর ভয় হল।

‘আপনাকে আমার বলা উচিত যে, আজকে আপনার ব্যবহার অশোভন হয়েছে’, উনি বললেন ফরাসি ভাষায়। স্বামীর দিকে ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে আন্না সরাসরি তাকালেন তাঁর চোখে চোখে, কিন্তু আগের মত আমোদের অন্তরাল তাতে ছিল না, ছিল একটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাব, যা দিয়ে বহু কষ্টে তিনি লুকাতে চাইছলেন তাঁর ত্রাস। উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘কিসে অশোভন ব্যবহার করলাম?’

কোচোয়ানের সামনে খোলা জানালাটার দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘সাবধান!’

তারপর উঠে শার্সি টেনে দিলেন।

‘অশোভন আপনি কি দেখলেন?’ আবার জিজ্ঞেস করলেন আন্না।

‘একজন ঘোড়াওসয়ার যখন পড়ে যায় তখন যে হতাশা আপনি চাপা দিতে পারেননি, সেটা।’

আন্না আপত্তি করবেন ভেবে তিনি কিছুটা অপেক্ষা করলেন; কিন্তু নিজের সামনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন আন্না।

‘আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম যে সমাজে এমনভাবে চলবেন যাতে নিন্দুকেরা অপনার বিরুদ্ধে কিছু বলতে না পারে। এক সময় আমি আমাদের আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের কথা তুলেছিলাম; এখন সে কথা বলছি না। বলছি বাহ্য সম্পর্কের কথা। আপনি অশোভন আচরণ করেছেন। আমি চাই যেন তার পুনরাবৃত্তি না হয়।’

আন্না তাঁর কথার আধখানাও শোনেননি, তিনি ভয় পাচ্ছিলেন তাঁকে আর ভাবছিলেন, ‘সত্যিই কি ভ্রনস্কি ঘায়েল হয়নি। তার সম্পর্কেই কি লোকে বলছিল যে সে অক্ষত, শুধু পিঠ ভিঙেছে ঘোড়ার?’ স্বামীর কথা শেষ হতে আন্না শুধু ভান করা একটা উপহাসের হাসি হাসলেন, কোন জবাব দিলেন না, কেননা স্বামী যা বলছিলেন তা শোনেননি তিনি কারেনিন শুরু করেছিলেন বেশ সাহস নিয়েই, কিন্তু যখন তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন কি কথা তিনি বলছেন, তখন আন্না যে ভয় পাচ্ছিলেন সেটা সঞ্চারিত হল তাঁর মধ্যেও। হাসিটা দেখে একটা অদ্ভুত বিভ্রান্তি তাঁকে পেয়ে বসল।

‘আমার সন্দেহে ও হাসছে। সেবার যা বলেছিল এখন তাই বলবে; আমার সন্দেহের কোন ভিত্তি নেই, ওটা হাস্যকর।’ এখন, সব কিছু যখন অবারিত হবার মুখে তখন তিনি সবচেয়ে বেশি করে চাইছিলেন যে আন্না সেবারের মত উপহাসের সুরে বলুন যে তাঁর সন্দেহের কোন ভিত্তি নেই। তিনি যা জেনেছেন সেটা তাঁর কাছে এত ভয়ংকর যে কোন ভিত্তি নেই। তিনি যা জেনেছেন সেটা তাঁর কাছে এত ভয়ংকর যে তিনি এখন সব কিছু বিশ্বাস করতে প্রস্তুত। কিন্তু আন্নার সন্ত্রস্ত বিমর্ষ মুখের ভাবটা এমন যে প্রতারণারও অবকাশ নেই। বললেন, ‘হয়ত ভুল হচ্ছে আমার। সেক্ষেত্রে ক্ষমা চাইছি।’

‘না, ভুল করেননি’, স্বামীর নিরুত্তাপ মুখের দিকে মরিয়া দৃষ্টিতে আন্না বললেন ধীরে ধীরে, ‘না, ভুল হয়নি আপনার। হতাশ হয়ে উঠেছিলাম আমি, না হয়ে পারি না। আপনার কথা আমি শুনছি, কিন্তু ভাবছি তার কথা। আমি ওকে ভালোবাসি, আমি ওর প্রণয়িনী, আপনাকে আমি সইতে পারি না। ভয় করি, ঘৃণা করি আপনাকে… আপনার যা খুশি করুন আমাকে নিয়ে।

গাড়ির কোণে ঠেস দিয়ে আন্না দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠলেন। কারেনিন নড়লেন না, সম্মুখপানে স্থির দৃষ্টির বদল হল না তাঁর। কিন্তু মুখের ভাব তাঁর হঠাৎ হয়ে উঠল মৃতের মত সুগম্ভীর, পল্লীভবনে যাওয়া পর্যন্ত সেটা বজায় রইল। বাড়ির কাছে এসে তিনি একইভাবে মুখ ফেরালেন আন্নার দিকে

‘বেশ! কিন্তু বাহ্যিক শোভনতা বজায় রাখার দাবি করছি আমি যদ্দিন না, গলা তাঁর কেঁপে গেল, ‘যদ্দিন না নিজের সম্মান রক্ষার ব্যবস্থা করছি এবং সে কথা আপনাকে বলছি।’

আগে তিনি নেমে আন্নাকে নামতে সাহায্য করলেন। চারক-বারকদের সামনে তিনি নীরবে তাঁর হাতে চাপ দিয়ে আবার গাড়িতে উঠে রওনা দিলেন পিটার্সবুর্গে।

ঠিক তাঁর পরেই বেত্‌সির চারপাশি এল আন্নার কাছে চিরকুট নিয়ে :

‘আমি আলেকসেই-এর কাছে লোক পাঠিয়েছিলাম কেমন আছে জানতে। সে লিখেছে যে সুস্থ এবং অক্ষতই আছে, তবে মনমরা।’

আন্না ভাবলেন, ‘সে তো আসবেই! ওকে আমি সব বলে ভালোই করেছি।’

আন্না ঘড়ি দেখলেন। এখনও তিন ঘণ্টা বাকি, শেষ সাক্ষাতের স্মৃতি আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল তাঁর রক্তে।

‘মাগো, কি জ্বলজ্বলে! ভয়ংকর, তবু ভালোবাসি তার মুখ আর ঐ অলৌকিক আলোটা দেখতে… স্বামী! হ্যাঁ… যাগ্‌গে, সৃষ্টিকর্তা, সব চুকে গেছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *