আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৮.১

এক

ইতিমধ্যে দুই মাসের মত কেটে গেছে। সময়টা গ্রীষ্মের মাঝামাঝি। অথচ এখনই মস্কো থেকে বেরোবার আয়োজন করলেন সের্গেই ইভানোভিচ কজ্‌নিশেভ।

কজ্‌নিশেভের জীবনে নিজস্ব কতকগুলো ঘটনা ঘটে গেছে এই সময়ের মধ্যে। ছয় বছর ধরে পরিশ্রমের ফল, ইউরোপ ও রাশিয়ায় রাষ্ট্রপাটের ভিত্তি ও রূপ সমীক্ষার অভিজ্ঞতা’ নামে তাঁর বই সমাপ্ত হয়েছিল এক বছর আগেই এ বইয়ের কিছু কিছু অধ্যায় ও ভূমিকা প্রকাশিত হয় সাময়িক পত্রাদিতে, অন্যান্য অংশ কজ্‌নিশেভ পড়ে শোনান নিজ মহলের লোকদের কাছে। ফলে এ বইয়ে বিবৃত ধ্যান-ধারণা পাঠকসমাজের কাছে একেবারে অভিনব ঠেকা সম্ভব ছিল না; তাহলেও কজ্‌নিশেভ আশা করেছিলেন যে, বইটি প্রকাশিত হলে সমাজের ওপর গুরুতর ছাপ ফেলবে। বৈজ্ঞানিক চিন্তায় বিপ্লব না ঘটালেও প্রচণ্ড আলোড়ন তুলবে বিজ্ঞান জগতে।

গত বছর সযত্ন পরিমার্জনার পর বইটা প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল।

এ বই সম্পর্কে কারো মতামত জানতে না চাইলেও, বইটা কেমন কাটছে বন্ধুদের এ প্রশ্নে অনিচ্ছায় এবং কৃত্রিম ঔদাসীন্যে উত্তর দিলেও, বই কেমন বিক্রি হচ্ছে, এমন কি পুস্তক বিক্রেতাদের কাছেও সে প্রশ্ন না করলেও সমাজে ও সাহিত্যজগতে বইটির যে প্রাথমিক ছাপ ফেলার কথা, সেটা তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এবং অসহ্য মনোযোগসহকারে অনুসরণ করছিলেন।

এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, তিন সপ্তাহ কাটল—কিন্তু সমাজের ওপর কোন ছাপ লক্ষিত হল না। তাঁর বন্ধুরা, বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা মাঝে মাঝে বইটির কথা বলতেন স্পষ্টতই সৌজন্যবশে। তাঁর অন্য পরিচিতেরা বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে আগ্রহী না হওয়ায় তাঁর কাছে বইটার কথা বলতেন না আদপেই। তখন অন্য ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত সমাজ রইল সম্পূর্ণ নির্বিকার। সাহিত্যেও বইটা সম্পর্কে এক মাসের মধ্যে কোন লেখা বেরোয়নি।

সমালোচনা লেখার জন্য কত সময় দরকার সেটা খুঁটিয়ে হিসাব করেছিলেন কজ্‌নিশেভ, কিন্তু দু’মাসও কেটে গেল, সমালোচনা একইরকম নীরব।

শুধু গলা বসে যাওয়া অপেরা-গায়ক দ্রাবান্তিকে নিয়ে ‘উত্তরী গুবরে’ পত্রিকার একটি পরিহাস প্রবন্ধে কথায় কথায় কজ্‌নিশেভের বই সম্পর্কে তাচ্ছিল্যসূচক কয়েকটা মন্তব্য করে বোঝানো হয় যে বহু আগেই বইটি সবার চোখে নিন্দিত হয়ে একটা সাধারণ হাসাহাসির উপলক্ষ ঘটিয়েছে।

অবশেষে তৃতীয় মাসে ভারিক্কী এক পত্রিকায় বেরোল সমালোচনা প্রবন্ধ। প্রবন্ধের লেখককে কজ্‌নিশেভ চিনতেন। গলুসভের ওখানে তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল একবার।

প্রবন্ধলেখক খুবই তরুণবয়সী, অসুস্থ রম্য লেখক, লেখায় খুব তুখোর, কিন্তু শিক্ষাদীক্ষা অসাধারণ কম, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভীরু।

লেখকটি সম্পর্কে কজ্‌নিশেভের একান্ত তাচ্ছিল্য থাকলেও প্রবন্ধটি তিনি পড়তে শুরু করেন একান্ত শ্রদ্ধাভরে। দেখা গেল ভয়াবহু প্ৰবন্ধ।

বোঝাই যায় যে রম্য লেখক গোটা বইটাকে এমনভাবে বুঝেছেন যা বোঝা চলে না। কিন্তু উদ্ধৃতিগুলো তিনি বাছাই করেছেন এমন কায়দা করে যে বইটা যারা পড়ে নি (বোঝা যাচ্ছে প্রায় কেউ-ই তা পড়েনি) তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে বইটি গুরুগম্ভীর, তদুপরি অপ্রাসঙ্গিক (যা দেখানো হয়েছে প্রশ্ন চিহ্নগুলো দিয়ে) শব্দের বাণ্ডিল ছাড়া আর কিছু নয়, এবং লেখক অকাট একটি মূর্খ। এবং সবই বলা হয়েছে এমন রসিকতা করে যে কজ্‌নিশেভ নিজেই অমন রসিকতায় পরাঙ্মুখ হতেন না; আর সেটাই হল ভয়ংকর ব্যাপার।

যে একান্ত সততার সাথে কজ্‌নিশেভ সমালোচকের যুক্তিগুলির ন্যায্যতা খতিয়ে দেখছিলেন, তা সত্ত্বেও তাঁকে হাস্যাস্পদ করার জন্য তুলে ধরা ভুলত্রুটিতে মুহূর্তের জন্যও থামছিলেন না,—এ তো বোঝাই যাচ্ছিল যে ওগুলো বাছা হয়েছে ইচ্ছে করেই—কিন্তু তখনই প্রবন্ধলেখকের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ও আলাপের সমস্থ খুঁটিনাটি তিনি স্মরণ করতে লাগলেন অজ্ঞাতসারেই।

নিজেকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ওর মনে কি আম আঘাত দিয়েছি কিছুতে?’

এবং সাক্ষাতের সময় তিনি যে তরুণটির ব্যবহৃত একটি শব্দের অজ্ঞতা শুধরে দিয়েছিলেন তা মনে পড়ায় কজ্‌নিশেভের কাছে প্রবন্ধটির অর্থ পরিষ্কার হয়ে যায়।

এ প্রবন্ধের পর বইটা সম্পর্কে মুখে এবং মুদ্রণে উভয়েই নামল মৃত্যুর মত নীরবতা এবং কজ্‌নিশেভ দেখলেন যে অত দরদে আর খেটে ছয় বছর ধরে যা তিনি রচনা করেছেন, তা নিশ্চিহ্নে ভেসে গেছে।

কজ্‌নিশেভের অবস্থা আরো দুঃসহ দাঁড়িয়েছিল এজন্য যে বইটা শেষ করার পর টেবিলে বসে করার মত কাজ তাঁর আর ছিল না, আগে সেটাতেই তাঁর সময় যেত বেশি।

কজ্‌নিশেভ ছিলেন বুদ্ধিমান, সুশিক্ষিত, সুস্থ, কর্মঠ,—তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না তাঁর এই সক্রিয়তা কোথায় কাজে লাগাবেন। ড্রয়িং-রুমে, কংগ্রেসে, সম্মেলনে, কমিটিতে-যেখানে কথাবার্তা বলা যেত তেমন সবখানেই কথাবার্তা বলে কাটত তাঁর সময়ের একাংশ। কিন্তু বহুকালের নাগরিক হওয়ায় তাঁর কুণ্ঠা হত শুধু কথাবার্তা বলে যেতে (মস্কোয় এসে তাঁর অনভিজ্ঞ ভ্রাতাটি যা করেছেন), ফলে আরো অণেক অবসর ও মানসিক শক্তি তাঁর রয়ে গিয়েছিল

তাঁর পক্ষে সৌভাগ্যের কথা যে বইয়ের ব্যর্থতা হেতু তাঁর এই দুঃসময়টায় ভিন্নধর্মীর প্রশ্ন, সমাজে আগে যা জ্বলছিল মাত্র ধিকিধিকি, এবং কজ্‌নিশেভও—যিনি আগেই ছিলেন এ প্রশ্নের অন্যতম উত্থাপক, তিনি এতে পুরোপুরি আত্মনিবেদন করলেন।

কজ্‌নিশেভ যে মহলের লোক সেখানে স্লাভ প্রশ্ন ও সার্বীয় যুদ্ধ নিয়ে যত লেখালেখি ও আলোচনা হত তেমন আর কিছু নিয়ে নয়। সময় কাটাবার জন্য অবসরভোগী জনতা সাধারণত যা করে থাকে, তা এখন করা হতে লাগল স্লাভদের সাহায্যার্থে। বলনাচ, কনসার্ট, ডিনার, ভাষণ, মহিলাদের পোশাক, বিয়ার, শুঁড়িখানা—সবই স্লাভদের প্রতি সহানুভূতির সাক্ষ্য বহন করতে থাকল।

এই উপলক্ষে সে সময় যা বলাবলি ও লেখালেখি হত, তার অনেকগুলির খুটিনাটিতে সায় ছিল না কজ্‌নিশেভের। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন স্লাভ প্রশ্ন পরিণত হচ্ছে তেমনি এক হুজুগে যা সব সময় একটার পর অন্যটা এসে সমাজকে ব্যস্ত রাখার উপলক্ষ হয়; এও দেখতে পাচ্ছিলেন যে এ ব্যাপারে অনেক লোকই জুটেছে স্বার্থগৃধু, উচ্চাহংকারী উদ্দেশ্য নিয়ে। তিনি স্বীকার করতেন যে পত্রিকায় নিষ্প্রয়োজন ও অতিরঞ্জিত অনেক কিছু ছাপা হচ্ছে শুধু নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ আর চিৎকার করে অন্যদের হারিয়ে দেবার উদ্দেশ্য নিয়ে। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে সমাজের এই সাধারণ জোয়ারে সামনে লাফিয়ে এসে সবার চেয়ে বেশি চিৎকার জুড়ছিল তারা যারা জীবনে ব্যর্থকাম, ক্ষোভ পুষে রেখেছে মনে : ফৌজ ছাড়া সর্বাধিনায়ক, মন্ত্রণালয় ছাড়া মন্ত্রী, সংবাদপত্র ছাড়া সাংবাদিক, পার্টি অনুগামী ছাড়া পার্টি কর্তা। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে লঘুচিত্ত ও হাস্যকর অনেককিছু আছে এর মধ্যে; কিন্তু স্বীকার করে নিতেন সন্দেহাতীত ক্রমবর্ধমান উদ্দীপনাকে যা সমাজের সমস্ত শ্রেণীকে একত্রে মেলাচ্ছে, যার প্রতি সহানুভূতি পোষাণ না করে পারা যায় না। একই ধর্মবিশ্বাসী স্লাভ ভ্রাতাদের রক্তস্নানে জাগছিল উৎপীড়িতের প্রতি সহানুভূতি আর উৎপীড়কদের প্রতি রোষ। বড় একটা আদর্শের জন্য সংগ্রামী সার্ব আর মন্টেনেগ্রীনদের বীর্য সারা জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তুলছিল শুধু কথায় নয়, কাজে ভ্রাতাদের সাহায্য করার আকাঙ্ক্ষা।

তবে কজ্‌নিশেভের কাছে আনন্দজনক একটা দিকও ছিল এর মধ্যে : সেটা হল জনমতের আত্মপ্রকাশ। জনসমাজ সুনির্দিষ্ট রূপে ব্যক্ত করল তার বাসনা। কজ্‌নিশেভ যা বলতেন, স্ফূর্তি পেয়েছে জনগণের প্রাণ। আর এ ব্যাপারটায় যত তিনি জড়ালেন, ততই তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল যে এটা এমন একটা সাধনা যা বিশাল আয়তন লাভ করে যুগান্তর ঘটাতে বাধ্য।

এই মহতী সাধনায় পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন তিনি, বইয়ের ভাবনা ভুলে গেলেন।

এখন তাঁর সমস্ত সময়ই এত কর্মব্যস্ত যে তাঁর কাছে লেখা সমস্ত চিঠি ও দাবির জবাব দিতে পারছিলেন না তিনি।

সরা বসন্ত ও গ্রীষ্মের একাংশ এ সবে ব্যাপৃত থেকে কেবল জুলাই মাসে গ্রামে ভাইয়ের কাছে যাবার তোড়জোড় করলেন।

গেলেন দু’সপ্তাহ বিশ্রাম নেবেন আর সেই সাথে জনগণের মধ্যে যা পূতাধিক পূত, গ্রামের দূরান্ত বিজনে জাতীয় প্রাণের সে উচ্ছ্বাস দেখে মুগ্ধ হবেন বলে যার সম্পর্কে রাজধানী ও শহরের লোকেরা নিঃসন্দেহ। কাতাভাসোভ লেভিনকে কথা দিয়েছিলেন তিনি তাঁর ওখানে যাবেন। বহুদিন থেকে কথাটা রাখার চেষ্টা করার পর এখন কজ্‌নিশেভের সাথে তিনিও গেলেন।

দুই

আজ অসাধারণ জনাকীর্ণ কুর্স্ক রেল স্টেশনে সের্গেই ইভানোভিচ কজ্‌নিশেভ আর কাতাভাসোভ এসে গাড়ি থেকে নেমে পেছনে জিনিসপত্র নিয়ে চাপরাশি এল কিনা দেখতে-না-দেখতেই চারটা ছ্যাকড়া গাড়িতে এসে পড়ল স্বেচ্ছাব্রতী সৈনিকরা। ফুল নিয়ে মহিলারা তাদের বরণ করলেন, পেছন পেছন স্টেশনে ভিড় ঢুকে পড়ল।

যে মহিলারা স্বেচ্ছাসৈনিকদের বরণ করতে এসেছিলেন, তাঁদের একজন হল থেকে বেরিয়ে কজ্‌নিশেভের দিকে ফিরে ফরাসি ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনিও বিদায় জানাতে এসেছেন?’

‘না প্রিন্সেস, আমি নিজেই যাত্রী। ভাইয়ের কাছে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেব। আপনি সব সময়ই বিদায় জানাতে আসেন বুঝি?’ প্রায় অলক্ষ্য একটা হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কজ্‌নিশেভ।

‘সে কি আর পারা যায়!’ প্রিন্সেস বললেন, ‘আমাদের এখান থেকে আটশ’ জন গেছে, তাই না? মালভিনস্কি বিশ্বাস করলে না আমার কথা।’

‘আটশ’র বেশি। সরাসরি যাদের মস্কো থেকে পাঠানো হয়নি তাদের ধরলে হাজারের বেশি’, বললেন কজ্‌নিশেভ।

‘এই তো দেখুন। আমি তাই বলেছিলাম’, সহর্ষে তাঁর কথা লুফে নিলেন মহিলা, ‘আর এখন চাঁদা উঠেছে প্রায় দশ লাখ, তাই না?’

‘তারও বেশি, প্রিন্সেস।’

‘আর আজকের তারবার্তাটা কেমন, দেখেছেন? আবার পরাস্ত হল তুর্কীরা।’

‘হ্যাঁ পড়েছি’, কজ্‌নিশেভ জবাব দিলেন। শেষ সংবাদ নিয়ে কথা বলছিলেন ওঁরা। তাতে সমর্থিত হয়েছে যে পর পর তিন দিন সমস্ত পয়েন্টে পরাস্ত হয়ে পালাচ্ছে তুর্কীরা এবং চরম একটা সংঘর্ষের আশা করা হচ্ছে আগামী কাল। ‘ও হ্যাঁ, একটি নওজোয়ান, চমৎকার লোক, যুদ্ধে যেতে চায়। জানি না কিসব প্রতিবন্ধ দেখা দিয়েছে। আমি ওকে জানি, অনুরোধ করি একটা চিঠি লিখে দিন। কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা জানিয়েছেন।’

যে লোকটা যুদ্ধে যেতে চায় তার সম্পর্কে প্রিন্সেস যা জানেন বিস্তারিত জেনে নিয়ে কজ্‌নিশেভ প্রথম শ্রেণীর ওয়েটিং-রুমে গিয়ে যাঁর ওপর ব্যাপারটা নির্ভর করছিল তাঁর কাছে একটা চিঠি লিখে দিলেন প্রিন্সেসের হাতে।

‘জানেন কাউন্ট ভ্রন্‌স্কি, সেই যে… এই ট্রেনেই যাচ্ছেন’, চিঠিটা নিয়ে বিজয়গর্বে বহু অর্থপূর্ণ হাসি নিয়ে তিনি বললেন।

‘আমি শুনেছিলাম যে উনি যাবেন, কিন্তু জানতাম না কবে। এই ট্রেনেই?’

‘আমি দেখেছি ওঁকে। এখানেই আছেন তিনি। একা মা বিদায় জানাতে এসেছেন। যাই বলুন, এর চেয়ে ভালো কিছু উনি করতে পারতেন না।’

‘ও হ্যাঁ, বটেই তো।’

ওঁরা যখন কথা বলছিলেন, তাঁদের পাশ দিয়ে জনস্রোত চলল ভোজনালয়ের দিকে। তাঁরাও এগিয়ে গেলেন, শুনলেন পানপাত্র হাতেএকজন ভদ্রলোক স্বেচ্ছাসৈনিকদের উদ্দেশে উচ্চকণ্ঠে বক্তৃতা দিচ্ছেন। ‘ধর্মের জন্যে, মানবজাতির, আমাদের ভাইদের সেবায়’, ক্রমেই গলা চড়াতে চড়াতে বললেন ভদ্রলোক; ‘মহাকর্মে আপনাদের আশীর্বাদ করছে মস্কো মা-জননী। জিন্দাবাদ!’ চিৎকার করে সজল চোখে তিনি শেষ করলেন।

সবাই চিৎকার করল : ‘জিন্দাবাদ!’ আরো একদল জনতা হুড়মুড়িয়ে হলে ঢুকে প্রিন্সেসকে প্রায় উলটে ফেলে দিচ্ছিল আর-কি 1

‘আরে, প্রিন্সেস যে! কেমন আছেন?’ ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে এক গাল হেসে সানন্দে অব্‌লোন্‌স্কি বললেন, ‘সত্যি, চমৎকার বললে, দরদ ঢেলে, তাই না? ব্রেভো! আর কজ্‌নিশেভ, আপনিও আপনার পক্ষ থেকে কয়েকটা কথা বললে পারতেন, মানে, সমর্থন করে আর-কি? এটা আপনার এত ভালো আসে’, কোমল শ্রদ্ধাশীল সন্তর্পণ হাসি হেসে যোগ দিলেন তিনি, কজ্‌নিশেভের হাত টেনে নিয়ে তাঁকে এগিয়ে আনলেন।

‘না, আমি এখুনি চলে যাচ্ছি।’

‘কোথায়?’

কজ্‌নিশেভ জবাব দিলেন, ‘গ্রামে, ভাইয়ের কাছে।

‘তাহলে আমার স্ত্রীর সাথে দেখা হবে। আমি ওকে চিঠি দিয়েছি, কিন্তু আপনিই বোধ হয় আগে পৌঁছবেন। বলে দেবেন—এ্যাঁ, আমার সাথে দেখা হয়েছে, সব অল রাইট। কি তা সে বুঝবে। তবে দয়া করে ওকে বলবেন যে আমি সংযুক্ত… কমিশনের সদস্য নিযুক্ত হয়েছি। মানে, সে বুঝতে পারবে। জানেন তো মানবিক জীবনের ছোটখাট দুঃখ- কষ্ট’, যেন ক্ষমা প্রার্থনা করে ফিরলেন প্রিন্সেসের দিকে, ‘আর প্রিন্সেস মিয়াগ্‌কায়া—লিজা নয়, বিবিশ পাঠাচ্ছেন এক হাজার রাইফেল আর বারোজন নার্স, আমি বলেছি আপনাকে?’

‘হ্যাঁ, শুনেছি’, অনিচ্ছায় উত্তর দিলেন কজ্‌নিশেভ।

‘দুঃখের কথা যে আপনি চলে যাচ্ছেন’, বললেন অব্‌লোন্‌স্কি; ‘কাল আমরা ডিনার দিচ্ছি দুজন স্বেচ্ছাসৈনিকের জন্যে—পিটার্সবুর্গের দিমের্-বার্নিয়াস্কি আর আমাদের ভেসেলোভস্কি, গ্রিশা। দুজনেই লড়াইয়ে যাচ্ছে। ভেসেলোভস্কির বিয়ে হল এই সেদিন। বাহাদুর ছেলে! তাই না প্রিন্সেস?’ মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

জবাব না দিয়ে প্রিন্সেস তাকালেন কজ্‌নিশেভের দিকে। কিন্তু কজ্‌নিশেভ আর প্রিন্সেস যেন তাঁকে এড়াতে চাইছেন এতে এতটুকু দমলেন না অব্‌লোন্‌স্কি। হেসে তিনি চাইছিলেন কখনো প্রিন্সেসের টুপির পালকের দিকে, কখনো অন্য কোথাও, যেন কি-একটা মনে করতে চাইছেন। মগ নিয়ে যাচ্ছিলেন এক মহিলা, তাঁকে দেখে নিজের কাছে ডেকে পাঁচ রুবলের একটা নোট ফেললেন মগে।

‘যতক্ষণ পয়সা আছে, এই মগগুলোকে দেকলে আমি স্থির থাকতে পারি না’, বললেন তিনি, ‘আহ্ কি খবর আজকের। বাহবা মন্টেনেগ্রীন!’

প্রিন্সেস যখন বললেন যে ভ্রন্‌স্কি এই ট্রেনেই যাচ্ছেন, অব্‌লোন্‌স্কি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কি বলছেন আপনি!’ মুহূর্তের জন্য দুঃখ ফুটে উঠল তাঁর মুখে, কিন্তু এক মিনিট পরেই যখন প্রিতি পায়ের ওপর দুলতে দুলতে আর গালপাট্টা ঠিক করতে করতে তিনি ঢুকলেন যে ভ্রন্‌স্কি ছিলেন, ততক্ষণে বোনের শবদেহের ওপর তাঁর বুকভাঙ্গা কান্নাটা তিনি একেবারে ভুলে গিয়েভস্কিকে দেখছিলেন কেবল বীর আর পুরানো বন্ধু হিসেবে।

‘সমস্ত দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও ওর ভালো দিকটারও কদর করা উচিত’, অবলোন্‌স্কি চলে যেতেই প্রিন্সেস বললেন কজ্‌নিশেভকে, ‘একেবারে পুরোপুরি রুশী, স্লাভ চরিত্র! শুধু আমার আশংকা আছে যে ওকে দেখে ভালো লাগবে না ভ্রন্‌স্কির। যতই বলুন, লোকটার জীবন আমার কাছে মর্মস্পর্শী। ট্রেনে ওঁর সাথে কথা বলুন-না’, অনুরোধ করলেন প্রিন্সেস।

‘হ্যাঁ, সুযোগ পেলে হয়ত বলব।’

‘ওঁকে কখনো পছন্দ হয়নি আমার। কিন্তু এই ব্যাপারটায় অনেক পাপ ধুয়ে যায়। উনি শুধু নিজে যাচ্ছেন না, একটা স্কোয়াড্রনও সাথে নিচ্ছেন নিজের খরচায়।’

‘হ্যাঁ, শুনেছি।’

ঘণ্টি শোনা গেল, সবাই ভিড় করল দরজাগুলোর দিকে।

‘ওই যে উনি’, ভ্রন্‌স্কিকে দেখিয়ে বললেন প্রিন্সেস। পরনে তাঁর দীর্ঘ ওভারকোট, চওড়া কানার কালো টুপি, যাচ্ছিলেন মায়ের হাত ধরে। তাঁর পাশে যেতে যেতে অব্‌লোন্‌স্কি কি যেন বলছিলেন উত্তেজিত হয়ে।

ভুরু কুঁচকে ভ্রন্‌স্কি তাকিয়ে ছিলেন সামনে, অব্‌লোন্‌স্কি যা বলছিলেন, তা যেন শুনছিলেন না।

কজ্‌নিশেভ আর প্রিন্সেস যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, নিশ্চয় অব্‌লোন্‌স্কির ইঙ্গিতেই সেদিকে তাকিয়ে নীরবে টুপি তুললেন ভ্রন্‌স্কি। বুড়িয়ে আসা যন্ত্রণার্ত মুখ তাঁর মনে হল পাথর হয়ে গেছে।

প্ল্যাটফর্মে এসে মায়ের জন্য নীরবে জায়গা ছেড়ে দিয়ে তিনি আশ্রয় নিলেন ওয়াগনের ভেতর দিকে।

প্ল্যাটফর্মে শোনা গেল : ‘সৃষ্টিকর্তা, জারকে রক্ষা করো’, সঙ্গীত, তারপর ‘হুররে!’ আর ‘জিন্দাবাদ!’ চিৎকার বুক-বসে যাওয়া অতি তরুণ ঢ্যাঙা একজন স্বেচ্ছাসৈনিক মাথার ওপর ফেল্ট টুপি আর ফুলের গোছা দুলিয়ে কুর্নিশ করছিল খুবই চোখে পড়ার মত। তার পেছন থেকে এগিয়ে এসে কুর্নিশ করল দুজন অফিসার আর তেলচিটে টুপি পরা দেড়েল এক প্রৌঢ়।

তিন

সের্গেই ইভানোভিচ কজ্‌নিশেভ কাতাভাসোভকে সাথে করে প্রিন্সেসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে লোকে ঠাসাঠাসি একটা ওয়াগনে উঠলেন।

সারিৎসিনো স্টেশনে ট্রেনকে অভ্যর্থনা করল ‘গৌরব তব’ গান গেয়ে তরুণ একটি দলের ছিমছাম কোরাস। স্বেচ্ছাসৈনিকেরা আবার মাথা বাড়িয়ে কুর্নিশ করল, কিন্তু কজ্‌নিশেভ সেদিকে মন দিলেন না; স্বেচ্ছাসৈনিকদের নিয়ে তাঁকে এত খাটতে হয়েছিল যে তাদের সাধারণ টাইপ তাঁর জানা হয়ে গেছে, সেদিকে কোন আগ্রহ ছিল না তাঁর 1 কাতাভাসোভ কিন্তু তাঁর বিদ্যচর্চায় ব্যস্ত থাকায় স্বেচ্ছাসৈনিকদের লক্ষ করার সুযোগ পাননি, ভয়ানক উৎসুক হয়ে তিনি কজ্‌নিশেভকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন তাদের সম্পর্কে।

কজ্‌নিশেভ পরামর্শ দিলেন দ্বিতীয় শ্রেণীতে গিয়ে নিজেই তাদের সাথে কথাবার্তা বলুন। পরের স্টেশনে কাতাভাসোভ তাই করলেন।

ট্রেন থামতেই তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে গিয়ে পরিচয় করে নিলেন স্বেচ্ছাসৈনিকদের সাথে। ওয়াগনের এক কোণে বসে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছিল তারা। বোঝা যাচ্ছিল যে তারা জানে যে যাত্রী এবং আগন্তুক কাতাভাসোভের মনোযোগ তাদের দিকেই। সবচেয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছিল বুক-বসা তরুণটি। বোঝা যায় সে টেনে এসেছে, বলছিল তাদের শিক্ষায়তনে কি-একটা ঘটনার কথা। তার সামনে বসে ছিল অস্ট্রীয় গার্ড উর্দির গেঞ্জি পরা একজন অফিসার, এখন আর তাকে যুবক বলা যাবে না। হাসিমুখে কাহিনীটা শুনছিল সে, আবার কথককে থামিয়েও দিচ্ছিল। গোলন্দাজ উর্দি পরা তৃতীয় জন তাদের কাছে কাছে বসে ছিল স্যুটকেসের ওপর। চতুর্থ জন ঘুমাচ্ছিল।

তরুণটির সাথে কথা বলে কাতাভাসোভ জানলেন যে এটি মস্কোর এক ধনী সওদাগর। বাইশ বছর বয়স না হতেই বিশাল সম্পত্তি উড়িয়েছে। তাকে কাতাভাসোভের ভালো লাগল না, কারণ সে ছিল আহ্লাদ-পাওয়া, ক্ষীণদেহী, মেয়েলী গোছের এক মানুষ; এখন, বিশেষ করে মদ্যপানের পর সে যে একটা বীরত্ব দেখাচ্ছে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে সে বড়াই করছিল অতি কুৎসিত ধরনে।

দ্বিতীয় জন, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারকেও বিশ্রী লাগল কাতাভাসোভের। বোঝা গেল লোকটা সব কিছুতেই হাত পাকিয়েছে। রেলওয়ের কাজে ছিল সে, হয় সে কর্মাধ্যক্ষ, নিজেই একটা কারখানা চালু করে এবং এসব কথাই সে বলছিল নেহাৎ অকারণে আর পণ্ডিতী শব্দের অপব্যবহার করে।

পক্ষান্তরে তৃতীয় জন গোলন্দাজকে কাতাভাসোভের খুবই ভালো লাগল। লোকটি নিরহংকার চুপচাপ মানুষ, অবসরপ্রাপ্ত গার্ড অফিসারের জ্ঞান আর বেনিয়া-পুত্রের বীর্যবান আত্মোৎসর্গের কাছে স্পষ্টতই নতশির, নিজের কথা কিছুই বলছিল না। কাতাভাসোভ যখন বললেন সার্বিয়ায় সে যাচ্ছে কোন প্রেরণায়, বিনীতভাবে সে বলল : ‘সবাই যে যাচ্ছে। সার্বদেরও তো সাহায্য করা দরকার। ওদের জন্যে কষ্ট হয় বৈকি।’

‘বিশেষ করে ওখানে গোলন্দাজ কম’, বললেন কাতাভাসোভ।

‘গোলন্দাজ বাহিনীতে আমি আছি বেশি দিন নয়; আমাকে পদাতিক কি ঘোড়সওয়ার বাহিনীতেও বহাল করতে পারে।’

‘পদাতিক কেন, যখন সবচেয়ে বেশি দরকার গোলন্দাজদের?’ গোলন্দাজটির বয়স আন্দাজ করে কাতাভাসোভ ধরে নিয়েছিলেন যে তার পদস্থ সৈনিক হবার কথা।

‘গোলন্দাজ বাহিনীতে আমি বেশি দিন নই। আমি হলাম পদচ্যুত শিক্ষার্থী অফিসার’, এই বলে সে বোঝাতে লাগল কেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি।

সব মিলিয়ে এগুলো বিশ্রী একটা ছাপ ফেলে কাতাভাসোভের ওপর। স্বেচ্ছাসৈনিকেরা যখন পান করার জন্য স্টেশনে নেমে যায়, কাতাভাসোভ তখন কারো সাথে কথা বলে নিজের বিরূপ মনোভাবটা যাচাই করে দেখতে চান। ফৌজী ওভারকোট পরা একজন বৃদ্ধ যাত্রী স্বেচ্ছাসৈনিকদের সাথে কাতাভাসোভের কথাবার্তা শুনছিলেন সারাটা সময়। তাঁকে একলা পেয়ে কাতাভাসোভ বললেন :

‘হ্যাঁ, ওখানে এই যেসব লোক যাচ্ছে, তাদের অবস্থা কত হরেক রকমের’, নিজের মত প্রকাশ, আর সেই সাথে বৃদ্ধের মতামত জানার জন্য অনির্দিষ্ট একটা মন্তব্য করলেন তিনি।

বৃদ্ধ সামরিক বাহিনীর লোক, দুটো অভিযানে যোগ দিয়েছেন। সৈনিক কি বস্তু সেটা তিনি জানতেন এবং এই লোকগুলোর চেহারা দেখে, কথাবার্তা শুনে, আর যে উৎসাহে তারা মদের ফ্লাস্ক শূন্য করছিল তাতে বৃদ্ধ তাদের খারাপ সৈনিক বলেই গণ্য করেছিলেন। তাছাড়া তিনি ছিলেন মফস্বল শহরের লোক। তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল বরবেন তাঁর শহরের একটি লোক, চোর এবং মদ্যপ, কেউ যাকে কাজে নিচ্ছিল না, সে চলে গেছে বিনা মেয়াদের সৈনিক হয়ে। কিন্তু জনসমাজের বর্তমান মেজাজ জানা থাকায় সমাজের বিরোধী মত প্রকাশ, বিশেষ করে স্বেচ্ছাসৈনিকদের নিন্দা যে বিপজ্জনক সেটা বুঝে তিনিও অনুসরণ করলেন কাতাভাসোভকে।

চোখে হাসির ঝিলিক নিয়ে তিনি বললেন, ‘কি করা যাবে, লোকের দরকার আছে ওখানে।’ এবং যুদ্ধের শেষ সংবাদ নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন তাঁরা, শেষ কবর অনুসারে তুর্কীরা যখন সমস্ত পয়েন্টে বিধ্বস্ত তখন আগামী কাতল সংঘাতের আশা করা যায় কিভাবে, তা নিয়ে নিজেদের বিহ্বলতা দুজনেই লুকিয়ে রাখলেন পরস্পরের কাছ থেকে। দুজনেই নিজেদের মতামত প্রকাশ না করে চলে গেলেন যে যার ওয়াগনে।

নিজের ওয়াগনে ফিরে সত্যের অনিচ্ছাকৃত অপলাপ করে কজ্‌নিশেভকে কাতাভাসোভ বললেন স্বেচ্ছাসৈনিকদের দেখে কি তাঁর মনে হয়েছে; মনে হয়েছে চমৎকার লোক এরা।

স্বেচ্ছাসৈনিকদের আবার গান আর হর্ষধ্বনিতে অভিনন্দন জানানো হল শহুরে বড় স্টেশনটায়। আবার মগ নিয়ে দেখা দিলেন চাঁদা-তুলিয়েরা। স্বেচ্ছাসৈনিকদের ফুল দিলেন স্থানীয় মহিলারা, তাদের সাথে সাথে গেলেন বুফেতে; তবে এ সবই ছিল মস্কোর তুলনায় অনেক সামান্য ও ক্ষীণ।

চার

মফস্বল শহরের ট্রেন স্টেশন। এখানে ট্রেন থামলে বুফেতে না গিয়ে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে লাগলেন কজ্‌নিশেভ। ভ্রন্‌স্কির ওয়াগনের কাছ দিয়ে তিনি প্রথমবার যাবার সময় লক্ষ করেছিলেন যে জানালা পর্দায় ঢাকা। কিন্তু দ্বিতীয়বার যেতে জানালার কাছে দেখলেন বৃদ্ধা কাউন্টেসকে। তিনি কাছে কজ্‌নিশেভকে ডাকলেন। বললেন, ‘এই যাচ্ছি, ওকে পৌঁছে দেব কুর্স্ক পর্যন্ত।

‘হ্যাঁ, শুনেছি’, জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ভেতর দিকে তাকিয়ে বললেন কজ্‌নিশেভ। কামরায় ভ্রন্‌স্কি নেই দেখে তিনি যোগ দিলেন, ‘ওঁর পক্ষ থেকে কি চমৎকার কাজ!’

‘ওর ওই দুর্ভাগ্যের পর আর কিই-বা ওর করার ছিল?’

কজ্‌নিশেভ বললেন, ‘কি সাংঘাতিক ব্যাপার!’

‘কি যে আমি সয়েছি! ভেতরে আসুন-না…’ কজ্‌নিশেভ ভেতরে গিয়ে তাঁর পাশে সোফায় বসার পর পুনরুক্তি করলেন তিনি, ‘কি যে আমি সয়েছি! কল্পনা করা যায় না! ছয় সপ্তাহ ও কারো সাথে কথা বলেনি আর কিছু মুখে তুলেছে কেবল আমি যখন কাকুতি-মিনতি করেছি। এক মিনিটও ওকে একলা ছেড়ে রাখা চলত না। যা দিয়ে আত্মহতত্যা করা সম্ভব এমন সব কিছু বলা তো যায় না। আপনি তো জানেন, ওই নারীর জন্যে একবার সে গুলি করে নিজেকে’, ঘটনাটা স্মরণ করে ভুরু কুঞ্চিত হয়ে উঠল বৃদ্ধার; ‘হ্যাঁ, এমন নারীর যেভাবে শেষ হবার কথা সেটা পর্যন্ত হীন, কদর্য।’

কজ্‌নিশেভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বিচারের ভার আমাদের নয়, কাউন্টেস। তবে আমি বুঝি আপনার পক্ষে কি কঠিন হয়েছিল।’

‘আহ্, সে কথা আর বলবেন না! আমি ছিলাম আমার মহাল বাড়িতে। ও আসে আমার কাছে। একটা চিঠি এল, ও জবাব লিখে পাঠিয়ে দিল। আমরা তখন জানতামই না যে সে এখানে, স্টেশনে। সন্ধ্যায় আমি সবে শুতে গেছি, দাসী খবর দিল যে স্টেশনে একজন মহিলা ট্রেনের নীচে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কেমন যেন বজ্রাঘাত হল! বুঝতে পারছিলাম এ সেই-ই। প্রথম যা বললাম, সেটা—ওকে যেন না বলা হয়। কিন্তু ততক্ষণে সব বলা হয়ে গেছে। তার কোচোয়ান সেখানে ছিল। সব ও দেখেছে। আমি যখন ছুটেত গেলাম তার ঘরে, ও আর তখন স্বমূর্তিতে নেই— দেখে ভয় হয়। একটা কথাও না বলে ঘোড়া হাঁকিয়ে চলে গেল সেখানে। কি সেখানে হয়েছিল জানি না, লোকেরা ওকে নিয়ে এল একেবারে যেন মরা। আমি ওকে চিনতেই পারিনি। ডাক্তার বললেন সম্পূর্ণ হতবল। তারপর শুরু হল প্রায় মস্তিষ্ক বিকৃতি। আহ্, বলার আর কি আছে! হাতের ঝটকা মেরে বললেন কাউন্টেস; সাংঘাতিক সময়! না, যাই বলুন, বদ নারী। কি এই মরিয়া কামাবেগ! নিজেকে অসাধারণ বলে দেখানো। তাই দেখাল। ধ্বংস করল নিজেকে, আর দুটো চমৎকার মানুষকে—নিজের স্বামী আর আমার অভাগা ছেলেটাকে

কজ্‌নিশেভ জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্বামী আছে কেমন?’

‘আন্নার মেয়েটাকে উনি নিয়েছেন। প্রথমদিকে আমার আলেক্সেই রাজি হয়ে যায় সব কিছুতেই। কিন্তু আমরা চেষ্টা করি যাতে দুজনের দেখা না হয়। তাঁর পক্ষে, স্বামীর পক্ষে এই বরং ভালো। আন্না ওঁকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু আমার বেচারা ছেলেটা সব দিয়েছিলে তাকে। তার জন্যে ও ত্যাগ করে সব কিছু–কেরিয়ার, আমাকে, অথচ সে একটুও মায়া করলে না, ইচ্ছে করে ওকে একেবারে ধ্বংস করে ছাড়লে। না, যাই বলুন, তার মৃত্যুটাই হল ধর্মহীনা দুরাত্মা নারীর মৃত্যু। সৃষ্টিকর্তা আমাকে ক্ষমা করুন, কিন্তু আমার ছেলের সর্বনাশ দেখে তার স্মৃতিকে আমি ঘৃণা না করে পারি না।

‘এখন কেমন আছে ও?’

‘সৃষ্টিকর্তা সাহায্য করেছেন আমাদের—সার্বিয়ার এই যুদ্ধটা। আমি বুড়ি মানুষ, এ ব্যাপারের কিছুই বুঝি না। কিন্তু ওর জন্যে এই যুদ্ধটা পাঠিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। মা হিসেবে বলাই বাহুল্য ভয় পাই আমি; প্রধান কথা শুনছি নাকি পিটার্সবুর্গে এটাকে বাঁকা চোখে দেখা হচ্ছে। কিন্তু কি করা যাবে! শুধু এই জিনিসটাই চাঙ্গা করে তুলতে পারে তাকে। ইয়াভিন—ওর বন্ধু, জুয়ায় সব হেরেছে, সার্বিয়ায় যাবে ঠিক করে। ও আসে আলেক্‌সেইয়ের কাছে, ওকেও বুঝিয়ে রাজি করায়। এখন এই নিয়ে মেতে উঠেছে সে–আপনি ওর সাথে কথা বলুন দয়া করে, আমি ওকে অন্যদিকে ফেরাতে চাই। ভারি ও মনমরা। তার ওপর আরো বিপদ—দাঁত ব্যথা করছে। সে আপনাকে দেখলে খুবই খুশি হবে। কথা বলুন ওর সাথে। অন্য দিকে হাঁটছে ও।

ট্রেনের উল্টো দিকে চলে গেলেন কজ্‌নিশেভ এবং বলে গেলেন যে তিনিও কথা বলতে পেরে খুবই খুশি হবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *