আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ২.৩০

ত্রিশ

যেখানে লোকেরা এসে জোটে তেমন সব জায়গার মত শ্যেরবাৎস্কিরা যে ছোট জার্মান স্বাস্থ্যপল্লীতে এসেছিলেন সেখানেও সমাজের যেন একটা কেলাসন ঘটেছিল। যাতে সে সমাজের প্রতিটি সদস্যের এক-একটা সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় স্থান স্থির হয়ে যায়। জলকণা যেমন ঠাণ্ডায় সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় রূপে হিম-স্ফটিকের বিশেষ একটা আকার নেয়, ঠিক তেমনি স্বাস্থ্যপল্লীতে নবাগতরা প্রত্যেকে তৎক্ষণাৎ তাদের স্বাভাবিক স্থানটিতে স্থিতিলাভ করে।

প্রিন্স শ্যেরবাৎস্কি স্ত্রী ও কন্যাসহ যে বাসা নিয়েছিলেন, তাঁর যা নামডাক এবং যেসব পরিচয় স্থাপিত হয়েছিল তাতে সাথে সাথেই তিনি কেলাসিত হয়ে গেলেন তাঁদের নির্দিষ্ট ও পূর্বনির্ধারিত স্থানে।

সে বছর স্বাস্থ্যপল্লীতে খাঁটি এক নৈকষ্য জার্মান প্রিন্স থাকায় সমাজের কেলাসন ঘটল আরও সোৎসাহে। প্রিন্স- মহিষীর ইচ্ছে হল অবশ্য-অবশ্যই তাঁর মেয়েকে নিয়ে যাবেন জার্মান। প্রিন্সেসের কাছে এবং পরের দিনই সে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করলেন তিনি। প্যারিসে ছাপা অতি সাধারণ, অর্থাৎ অতি বাহারে একটা গ্রীষ্মকালীন পোশাকে লাবণ্যভরে কিটি নিচু হয়ে অভিবাদন জানাল। প্রিন্সেস বললেন, ‘আশা করি, এই সন্দুর মুখখানায় গোলাপেরা ফিরে আসবে শিগগিরই’, আর শ্যেরবাৎস্কিদের কাছে তৎক্ষণাৎ নির্ধারিত হয়ে গেল জীবনের নির্দিষ্ট একটা ধারা যা থেকে আর বেরিয়ে আসা চলে না। শ্যেরবাৎস্কিদের পরিচয় হল জনৈক ইংরেজ লেডির পরিবার, জার্মান কাউন্টেস আর গত যুদ্ধে আহত তাঁর ছেলের সাথে, একজন সুইডিশ পণ্ডিত এবং ম. কানুট ও তাঁর বোনের সাথে। তবে অজ্ঞাতসারেই শ্যেরবাৎস্কিদের প্রধান সমাজ হয়ে দাঁড়াল মস্কোর মহিলা মারিয়া ইয়েভগেনিয়েভনা রতিশ্যেভা এবং তাঁর কন্যা যাকে কিটির ভালো লাগত না। কেননা কিটির মতই সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ভালোবাসার জন্য, আর মস্কোর একজন কর্নেল, কিটি তাকে জানত ছেলেবেলাতে, দেখেছে উর্দি আর কাঁধপট্টি পরা চেহারায়, কিন্তু এখানে ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ আর রঙচঙা গলাবন্ধনী পরা খোলা ঘাড়ে লাগত অসম্ভব হাস্যকর আর বিরক্তিজনক। কেননা ওর হাত থেকে রেহাই মিলত না—এদের নিয়ে। এসব যখন পাকাপোক্ত হয়ে গেল তখন ভারি একঘেয়ে লাগত কিটির এবং সেটা আরও এজন্য যে প্রিন্স চলে গেলেন কার্লাডে আর কিটি একা রইল মায়ের সাথে। যাদের সে জানত তাদের সম্পর্কে তার কোন আগ্রহ ছিল না, টের পেত যে ওদের কাছ থেকে নতুন কিছু আর মিলবে না। স্বাস্থ্যপল্লীতে তার প্রধান মানসিক ঔৎসুক্য ছিল যাদের সে জানত না তাদের লক্ষ্য করা, তাদের নিয়ে অনুমান। কিটির যা স্বভাব তাতে লোকের মধ্যে সবচেয়ে ভালোটাই সে দেখতে চাইত, বিশেষ করে যাদের সে চিনত না। এবং এখন কে কি, কেমন তাদের সম্পর্ক, কি ধরনের লোক তারা, এসব অনুমান করতে গিয়ে কিটি কল্পনায় দেখতে অতি আশ্চর্য আর চমৎকার সব চরিত্র আর তার সমর্থন পেত নিজের পর্যবেক্ষণে।

এ ধরনের লোকদের ভেতর কিটি আকৃষ্ট হয়েছিল স্বাস্থ্যপল্লীতে জনৈকা রুগ্ন রুশী মহিলার সাথে আগত একটা রুশী বালিকায়। মহিলাকে সবাই বলত মাদাম টাল। ইনি খুবই উঁচু সমাজের লোক, কিন্তু এত অসুস্থ যে হাঁটতে পারতেন না, শুধু ভালো আবহাওয়ার বিরল দিনগুলোতেই দেখা দিতেন ঠেলা চেয়ারে। তবে প্রিন্স-মহিষী বোঝালেন, রোগের জন্য ততটা নয়, অহংকারবশেই মাদাম শ্টাল রুশীদের কারো সাথে পরিচয় রাখেন না। রুশী মেয়েটা মাদাম শ্টালের সেবাশুশ্রূষা করত। তাছাড়া স্বাস্থ্যপল্লীতে গুরুতর রুগ্ন ছিল অনেকেই, তাদের সবার সাথে ও মিশত, অতি স্বাভাবিকভাবে দেখাশুনা করত তাদেরও। কিটি যা লক্ষ্য করেছে, রুশ মেয়েটা মাদাম টালের আত্মীয় নয়, আবার মাইনে করা সাহায্যকারিণীও নয় সে, মাদাম টাল তাকে ডাকতেন ভারেঙ্কা বলে, অন্যেরা বলত মাদমোয়াজেল ভারেঙ্কা। মাদাম টাল এবং তার কাছে অপরিচিত অন্যান্যদের সাথে মেয়েটার সম্পর্ক লক্ষ্য করায় কিটির কৌতূহলের কথা ছেড়ে দিলেও যা প্রায়ই হয়, মাদমোয়াজেল ভারেঙ্কার প্রতি একটা অব্যাখ্যাত অনুরাগ বোধ করত সে, আর চোখ- াচোখি হলে টের পেত, তাকেও ভালো লাগে মেয়েটার।

মাদমোয়াজেল ভারেঙ্কার প্রথম যৌবন বিগত এমন নয়, কিন্তু সে যেন যৌবনহীন এক সত্তা : তাকে ঊনিশও বলা যায়, ত্রিশও বলা যায়। তার আকৃতি বিচার করলে মুখের রুগ্ন বিবর্ণতা সত্ত্বেও তাকে কুশ্রীর চেয়ে বরং সুশ্রীই বলতে হয়। শরীরের বড় বেশি কৃশ আর মাঝারি দৈর্ঘ্যের সাথে মাথাটা বেমানান না হলে তার গড়নটা ভালোই : কিন্তু পুরুষের কাছে তার আকর্ষণ থাকার কথা নয়। সে ছিল এখনো পাপড়ি মেলে রাখা সুন্দর একটা ফুল যা বিবর্ণ হয়ে গেছে গন্ধহীন। তাছাড়া পুরুষের কাছে আকর্ষণীয় হওয়া তার পক্ষে আরও এই কারণে সম্ভব নয় যে কিটির মধ্যে যা ছিল বড় বেশি পরিমাণে সেটায় ঘাটতি ছিল তার, যথা—জীবনের সংযত বহ্নি আর নিজের আকর্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা।

তাকে সব সময় মনে হত কাজে ব্যস্ত আর তাতে সন্দেহ থাকারও কথা নয়, এবং সেজন্যই মনে হত বাইরের কোন কিছুতে তার আগ্রহ থাকতে পারে না। নিজের সাথে এই বৈপরীত্যের দরুনই কিটি আকৃষ্ট হত তার দিকে। কিটি অনুভব করত তার ভেতরে, তার জীবনধারার মধ্যে কিটি এমন কিছুর সন্ধান পাবে যা এখন সে খুঁজে মরছে যন্ত্রণায় : জীবনে আগ্রহ, জীবনের মর্যাদা—এবং সেটা সমাজে পুরুষের সাথে বালিকার যে সম্পর্কটা কিটির কাছে কদর্য লাগে, খরিদ্দারের প্রত্যাশায় পশরার লজ্জাকর প্রদর্শনী বলে মনে হয় তার বাইরে। নিজের অজানা বান্ধবীটিকে কিটি যতই লক্ষ্য করছিল ততই সে নিঃসন্দেহ হয়ে উঠল যে মেয়েটাকে সে যা কল্পনা করেছে ঠিক সেইরকমেরই নিখুঁত প্রাণী সে, ততই তার সাথে ভাব করার তার ইচ্ছে হচ্ছিল।

দিনে বার কয়েক করে দেখা হত মেয়ে দুটোর আর প্রতি বার কিটির চোখ বলত : ‘কে আপনি? কি রকম লোক আপনি? আপনি তো সেই অপরূপ মানুষ যা আমি কল্পনা করেছি, তাই না? তবে দোহাই আপনার’, দৃষ্টি তার যোগ দিত, ‘ভাববেন না যে আমি জোর করে আপনার সাথে ভাব করতে চাইব। স্রেফ আপনাকে দেখে মুগ্ধ হই আমি, ভালোবাসি আপনাকে।’—’আমিও ভালোবাসি আপনাকে, ভারি ভারি মিষ্টি আপনি। সময় থাকলে আরও বেশি ভালোবাসতাম, দৃষ্টি দিয়ে জবাব দিত অজানা মেয়েটা। আর সত্যিই কিটি দেখেছে যে মেয়েটা সব সময়ই ব্যস্ত; হয় সে একটা রুশ পরিবারের ছেয়েমেয়েদের নিয়ে আসছে প্রস্রবণ থেকে, নয় রোগীণীর জন্য কম্বল এনে তাকে টাকা দিচ্ছে, অথবা চেষ্টা করছে তিতিবিরক্ত কোন রোগীকে খুশি করতে কিংবা কফির সাথে খাবার মত বিস্কুট কিনে দিচ্ছে কারও জন্য।

শ্যেরবাৎস্কিরা আসার অল্প কিছু পরেই সকালের প্রস্রবণে দেখা দিতে থাকল আরো দুটো লোক, সকালের বিরূপে মনোযোগ আকর্ষণ করল তারা। একজন ভারি লম্বা, কিছুটা কুঁজো একটা পুরুষ, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হাত গায়ে মাপসই নয় এমন একটা খাটো পুরানো ওভারকোট, কালো কালো নিরীহ অথচ সেই সাথে ভয়ংকর চোখ, অন্যজন সুশ্রী একটা নারী, মুখে দাগ-ফুটকি, পরনে অতি কদর্য রুচিহীন পোশাক। এরা যে রুশী তা জানতে পেরে কিটি কল্পনায় এক অপূর্ব মর্মস্পর্শী রোমান্স রচনা করতে শুরু করেছিল। কিন্তু প্রিন্স-মহিষী স্বাস্থ্যাবাসের তালিকা থেকে জেনে এলেন যে এরা নিকোলাই লেভিন আর মারিয়া নিকোলায়েভনা, কিটিকে তিনি বোঝালেন কি বদলোক এই লেভিন, লোক দুটো সম্পর্কে কিটির সব স্বপ্ন উবে গেল। মা তাকে যা বলেছেন তার জন্য ততটুকু নয়, যতটুকু লোকটা কনস্তান্তিনের ভাই বলে, এ দুটো লোককে হঠাৎ কিটির মনে হল অতিমাত্রায় অপ্রীতিকর। এই লেভিন এখন তার মাথা ঝাঁকাবার অভ্যাস দ্বারা একটা অদম্য বিতৃষ্ণা জাগিয়ে তুলল কিটির মনে

তার মনে হল, বড় বড় ভয়ংকর যে চোখ দিয়ে লোকটা একদৃষ্টে তাকে দেখে, তাতে ফুটে উঠছে বিদ্বেষ আর বিদ্রূপ। সে ওর সাথে সাক্ষাৎ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে লাগল।

একত্রিশ

দিনটা খুবই বিছ্‌ছিরি। সারাটা সকালই বৃষ্টি পড়েছে। রোগীরা গ্যালারিতে ভিড় করেছে ছাতি নিয়ে।

মা আর মস্কো কর্নেলের সাথে কিটি যাচ্ছিল। ফ্রাঙ্কফুর্টে রেডিমেড কেনা তার ইউরোপীয় ফ্রক-কোটটা নিয়ে ফুর্তিতে বাবুয়ানি দেখাচ্ছিল কর্নেলটি। গ্যালারির এক পাশ দিয়ে যাচ্ছিল লেভিন। তাকে এড়াবার জন্য ওরা চলল অন্য পাশ দিয়ে। নিচের দিকে কান নামানো কালো একটা টুপি আর গাঢ় রঙের একটা পোশাক পরে ভারেঙ্কা অন্ধ একটা ফরাসি মহিলাকে নিয়ে যাচ্ছিল গ্যালারি বরাবর আর কিটির সাথে দেখা হলেই প্রতিবার বন্ধুর মত তারা দৃষ্টি বিনিময়ে করছিল।

নিজের অচেনা বন্ধুকে অনুসরণ করে আর সে যে প্রসবণের কাছেই এবং তাদের সাক্ষাৎ হতে পারে এটা লক্ষ্য করে কিটি বলল, ‘মা, ওর সাথে একটু কথা বলব?’

মা বললেন তা তোর যখন অতই ইচ্ছে, তাহলে আমি নিজেই ওর কাছে যাব। ওর মধ্যে কি এমন পেলি তুই? সঙ্গিনী তো। যদি চাস, মাদাম শ্টালের সাথে পরিচয় করে নেব। আমি ওঁর বৌমাকে চিনতাম—গরবে মাথা তুলে যোগ দিলেন প্রিন্স-মহিষী।

কিটি জানত যে মাদাম টাল যেন ইচ্ছে করেই তাঁর সাথে পরিচয় এড়িয়ে গেছেন বলে প্রিন্স-মহিষী ক্ষুব্ধ। পীড়াপীড়ি করল না কিটি। ফরাসিনীকে যখন ভারেঙ্কা গেলাস এগিয়ে দিচ্ছিল তখন তাকে দেখে কিটি বললেন, ‘আশ্চর্য, কি মিষ্টি! দ্যাখো, দ্যাখো, কত সহজ আর মিষ্টি।’

‘তো মাতন-এ আমার মজাই লাগছে’, প্রিন্স-মহিষী বললেন, ‘না, বরং ফিরে যাই।’ লেভিন তার সঙ্গিনী আর একজন ডাক্তারের সাথে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে দেখে যোগ করলেন তিনি। উচ্চকণ্ঠে সক্রোধ লেভিন কি যেন বলছিল ডাক্তারকে।

পেছনে ফেরার জন্য ওঁরা ঘুরতেই হঠাৎ আর উচ্চকণ্ঠ নয়, শোনা গেল চিৎকার। লেভিন থেমে গিয়ে চ্যাঁচাচ্ছিল, ডাক্তারও চটে উঠেছে। ভিড় জমে গেল তাদের ঘিরে। কিটিকে নিয়ে প্রিন্স-মহিষী তাড়াতাড়ি সরে গেলেন আর ব্যাপারটা কি জানার জন্য কর্নেল যোগ দিল ভিড়ে।

কয়েক মিনিট পরে সে এসে তাঁদের সঙ্গ ধরল।

প্রিন্স-মহিষী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হল ওখানে?’

কর্নেল জবাব দিল, ‘লজ্জার ব্যাপার! ভয় শুধু একটা জিনিসে–বিদেশে রুশীর সাথে সাক্ষাৎ। এই ঢ্যাঙা ভদ্রলোকটি গালাগালি করছিলেন ডাক্তারকে, ঠিকমত চিকিৎসা করছেন না বলে শাসাচ্ছিলেন, লাঠিও আস্ফালন করেছেন। একেবারে লজ্জার কথা!’

প্রিন্স-মহিষী বললেন, ‘ইস, কি বিচ্ছিরি! তা শেষ হল কিসে?’

‘হ্যাঁ, ওই যে, ওই ব্যাঙের ছাতা টুপি মাথায় মেয়েটা, রুশী বোধ হয়, ও এসে সামলালে, ধন্যবাদ ওকে’, বললে কর্নেল।

‘মাদমোয়াজেল ভারেঙ্কা?’ রুশি হয়ে জিজ্ঞেস করল কিটি।

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, সবার আগে সে ছুটে আসে, ভদ্রলোকটার হাত ধরে নিয়ে যায় তাঁকে। ‘

‘দেখলেন তো মা’, মাকে বলল কিটি, ‘অথচ ওর প্রশংসায় আমি পঞ্চমুখ বলে আপনি অবাক হন। ‘

পরের দিন থেকে অজানা বান্ধবীটিকে লক্ষ্য করে কিটির চোখে পড়ল যে মাদমোয়াজেল ভারেঙ্কার অন্য সমস্ত তত্ত্বাবধানস্থ লোক-এর যে সম্পর্ক, লেভিন আর মহিলাটির সাথেও তার সে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাদের কাছে যেত সে, কথাবার্তা বলত, মহিলাটি বিদেশী ভাষা জানত না বলে তার দোভাষীর কাজ করে দিত।

ভারেঙ্কার সাথে পরিচয় করার জন্য মাকে আরও বেশি করে পীড়াপীড়ি করতে লাগল কিটি। আর যে মাদাম টাল কেমন একটা গুমর দেখিয়ে থাকেন, তাঁর সাথে পরিচয়ের জন্য যেন প্রথম এগিয়ে আসাটা প্রিন্স-মহিষীর পক্ষে যতই অপ্রীতিকর লাগুক, ভারেঙ্কা সম্পর্কে খবরাখবর নিলেন তিনি আর এ পরিচয়ে ভালো বিশেষ কিছু না হলেও খারাপ কিছু হবে না জেনে তিনি নিজেই প্রথম গেলেন ভারেঙ্কার কাছে, পরিচয় করলেন তার মেয়ে যখন প্রস্রবনে গেছে আর ভারেঙ্কা রুটির দোকানের সামনে থেমেছে, সেই সময়টা বেছে নিয়ে প্রিন্স-মহিষী গেলেন তার কাছে।

‘আপনার সাথে পরিচয় করতে দিন’, মর্যাদায় ভরা হাসি হেসে তিনি বললেন, ‘আমার মেয়ে আপনার প্রেমে পড়েছে’, বললেন, ‘আমাকে হয়ত আপনি চেনেন না, আমি…’

‘এটা পারস্পরিকের চেয়েও বেশি’, তাড়াতাড়ি করে জবাব দিলে ভারেঙ্কা।

প্রিন্স-মহিষী বললেন, ‘কাল আমাদের অভাগ্য দেশবাসীর কি উপকারই-না আপনি করেছেন।’

ভারেঙ্কা লাল হয়ে উঠল। বলল, ‘কই, মনে পড়ছে না তো। কিছুই করিনি মনে হয়।’

‘সে কি, ওই লেভিনকে যে একটা বিছ্‌ছিরি কাণ্ড থেকে উদ্ধার করলেন।’

‘ও হ্যাঁ, তার সঙ্গিনী আমাকে ডাকে। আমি ওকে শান্ত করার চেষ্টা করি। খুবই ও অসুস্থ, ডাক্তারের ওপর খুশি নয়। এই ধরনের রোগীদের সেবা-শুশ্রূষা করার অভ্যাস আছে আমার।’

‘শুনেছি যে আপনি থাকেন মেঁতনে, আপনার বড় কাকী বোধ হয় মাদাম শ্টালের সাথে। আমি ওঁর বৌমাকে জানতাম।’

‘না, উনি আমার বড় কাকী নন। আমি ওঁকে মা বলি, তবে ওঁর আপনার আমি নই। আমাকে উনি মানুষ করেছেন’, জবাব দিতে গিয়ে আবার লাল হয়ে উঠল ভারেঙ্কা।

কথাগুলো সে বললে এত সহজে, সহজ খোলামেলা মুখখানা ছিল এত মিষ্টি যে প্রিন্স-মহিষী বুঝলেন কেন তাঁর কিটি ভারেঙ্কার এত অনুরাগী।

জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা এই লেভিনের কি হল?’

‘ও চলে যাচ্ছে’, জবাব দলে ভারেঙ্কা।

মা তার অজানা বন্ধুর সাথে পরিচয় করেছেন, এই আনন্দে জ্বলজ্বলে হয়ে এই সময় প্রস্রবণ থেকে ফিরল কিটি। ‘তাহলে কিটি তোর ভয়ানক যা ইচ্ছা ছিল আলাপ করার মাদমোয়াজেল…’

‘স্রেফ ভারেঙ্কা’, হেসে সে বললে, ‘সবাই আমাকে তাই বলে ডাকে।

আনন্দে লাল হয়ে উঠল কিটি। অনেকক্ষণ ধরে করমর্দন করল তার নতুন বান্ধবীর সাথে, সে হাত তার প্রত্যুত্তর দিল না, স্থির হয়ে রইল তার করবন্ধনে, কিন্তু মাদমোয়াজেল ভারেঙ্কার মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল মৃদু, উৎফুল্ল, যদিও কিছুটা বিষণ্ণ হাসিতে, দেখা গেল বড় বড় কিন্তু সুন্দর, দাঁতগুলো।

বললে, ‘আমি নিজেই অনেকদিন থেকে চাইছিলাম।’

‘কিন্তু আপনি সব সময় এত ব্যস্ত…’

‘আরে মোটেই না, কোন কাজই নেই আমার’, জবাব দিলে ভারেঙ্কা, কিন্তু সেই মুহূর্তেই তার নবপরিচিতদের ছেতে যেতে হল, কেননা জনৈকা অসুস্থার ছোট ছোট দুই রুশ মেয়ে ছুটে এল তার কাছে।

চিৎকার করে বলল, ‘ভারেঙ্কা, তোমাকে মা ডাকছে!’

তাদের সাথে সাথে চলে গেল ভারেঙ্কা।

বত্রিশ

তার সম্পর্ক ভারেঙ্কার অতীত আর মাদাম টালের সাথে এবং স্বয়ং মাদাম শ্টাল সম্পর্কে প্রিন্স-মহিষী যেসব খুঁটিনাটি জানলেন তা এই :

মাদাম শ্টাল সম্পর্কে একদল বলত যে তিনি স্বামীকে জ্বালিয়ে মেরেছেন, আরেক বলত যে স্বামীই তাঁর নীতিহীন আচরণে তাঁকেই জ্বালিয়েছেন। হীন সব সময়ই ছিলেন এক রুগ্ন, উচ্ছ্বাসপ্রবণা মহিলা। স্বামীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে যখন তাঁর প্রথম সন্তান হয়, সেটা জন্মলগ্নেই মারা যায়। মাদাম শ্টালের সংবেদনাধিক্য জানা থাকায় সংবাদটায় তাঁর মৃত্যু ঘটতে পারে এই আশংকায় তাঁর আত্মীয়রা সেই রাতেই, পিটার্সবুর্গের সেই গৃহেই আর সেই রাতে দরবারী বাবুর্চির যে মেয়েটার জন্ম হয়েছিল তাকে তাঁর সন্তান বলে চালায়। মেয়েটা ভারেঙ্কা। ভারেঙ্কা তাঁর মেয়ে নয়, এটা জানতে পারেন মাদাম টাল, কিন্তু মেয়েটাকে মানুষ করেই যান, সেটা আরো এই জন্য যে এই ঘটনার পর ভারেঙ্কার আত্মীয়-স্বজন কেউ ছিল না।

দশ বছরের বেশি মাদাম টাল বিদেশ থেকে নড়েননি, থাকতেন দক্ষিণে, শয্যাশায়ী। কেউ কেউ বলত যে, মাদাম শ্টাল অতি পরোপকারী ধর্মপ্রাণী মহিলার একটা ভড়ং জুটিয়েছেন, কেউ কেউ আবার বলত যে আসলে তিনি অতি নীতিনিষ্ঠ এক মানুষ, তাঁকে যেমন দেখায় তেমনি অপরের মঙ্গলের জন্যই তিনি দিন টাকান। কেউ জানত না— কি তাঁর ধর্ম।—ক্যাথলিক, প্রটেস্ট্যান্ট নাকি রুশী সনাতনী। কিন্তু একটা ব্যাপার নিঃসন্দেহে, সমস্ত গির্জা আর ধর্মমতের প্রধানদের সাথে তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ক

ভারেঙ্কা তাঁর সাথে সব সময়ই বিদেশে থেকেছে, এবং মাদাম শ্টালকে যারা জানত, মাদমোয়াজেল ভারেঙ্কাকে তারা যা বলে ডাকত, তাকেও তারা তেমনি জানত আর ভালোবাসত।

এসব খুঁটিনাটি জেনে প্রিন্স-মহিষী তাঁর কন্যার সাথে ভারেঙ্কার ভাব করায় উদ্বেগের কিছু দেখলেন না, সেটা আরও এই জন্য যে ভারেঙ্কার শিক্ষা-দীক্ষা ছিল চমৎকার : দিব্যি বলত ফরাসি, ইংরেজি, আর প্রধান কথা, মাদাম শ্টালের কাছ থেকে ভারেঙ্কা এই বার্তা আনল যে অসুস্থতাবশত প্রিন্স-মহিষীর সঙ্গ পরিচয়স্থাপনে তিনি বঞ্চিত বলে খুব দুঃখিত।

ভারেঙ্কার সাথে পরিচিত হয়ে কিটি কেবলই তার অনুরক্ত হয়ে উঠতে লাগল তার ভেতর নতুন নতুন গুণ আবিষ্কার করতে শুরু করল প্রতিদিন।

ভারেঙ্কা ভালো গান গায় শুনে প্রিন্স-মহিষী সন্ধ্যায় তাকে গাইতে ডাকলেন নিজের বাড়িতে।

‘কিটি বাজায়, পিয়ানো আছে আমাদের, তেমন ভালো নয় অবশ্য, তবে আপনি আমাদের খুবই আনন্দ দেবেন’, প্রিন্স মহিষী বললেন তাঁর হাসির ভান নিয়ে যা কিটির কাছে এখন ঠেকল খুবই অপ্রীতিকর, কারণ সে দেখতে যাচ্ছিল যে গাইবার ইচ্ছে ভারেঙ্কার নেই। তবে ভারেঙ্কা এল সন্ধ্যায়, এল তার সুরলিপির খাতা নিয়ে। প্রিন্স-মহিষী নিমন্ত্রণ করেছিলেন সকন্যা মারিয়া ইয়েভগেনিয়েভনা আর কর্নেলকে।

অপরিচিত লোকেরা এখানে আছে, এতে মনে হল ভারেঙ্কা সম্পর্কে নির্বিকার, সাথে সাথেই সে গেল পিয়ানোর কাছে। নিজেই সে নিজের সঙ্গত করতে পারত না, কিন্তু সুরগুলো তুললে চমৎকার। কিটি ভালো বাজালে তার সাথে।

প্রথম গানটা খাশা গাওয়া হলে প্রিন্স-মহিষী বললেন, ‘অসাধারণ গুণী আপনি।’

সকন্যা মারিয়া ইয়েভগেনিয়েভনা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে প্রশংসা করলেন।

জানালার দিকে তাকিয়ে কর্নেল বলল, ‘দেখনু কত লোক জুটেছে আপনার গান শুনতে’, সত্যিই জানালার নিচে বেশ একটা ভিড় জমেছিল।

‘আপনার আনন্দ পেয়েছেন বলে আমি ভারি খুশি’, সহজভাবে বলল ভারেঙ্কা।

সগর্বে কিটি চাইল তার বান্ধবীর দিকে। তার নৈপুণ্য, কণ্ঠস্বর, মুখভাবে সে উচ্ছ্বসিত, কিন্তু তার চেয়েও বেশি এজন্য যে ভারেঙ্কা স্পষ্টতই তার গান সম্পর্কে কিছু ভাবছিল না, প্রশংসায় সে একেবারে নির্বিকার; যেন শুধু জিজ্ঞেস করছিল : আরও গাইতে হবে, নাকি এই যথেষ্ট?

তিনি মনে মনে ভাছিল ‘আমি হলেকি গর্বই-না হত? জানালার নিচে ওই ভিড় দেকে কি আনন্দই-না হত আমার! অথচ ওর কিছুই এসে যায় না। ও শুধু চলেছে আপত্তি না ক’রে মাকে খুশি করার ইচ্ছায়। কি আছে ওর ভেতর? সব কিছু তুচ্ছ করে স্বাধীন, নিশ্চিন্ত হবার শক্তি সে পায় কোথা থেকে? কি যে হচ্ছে করে সেটা জানতে, তার কাছ থেকে সেটা শিখতে!’ প্রশান্ত ওই মুখখানার দিকে তাকিয়ে কিটি ভাবলে। প্রিন্স-মহিষী ভারেঙ্কাকে আরও গাইতে বললেন, সেও আরেকটা গান গাইলে তেমনি শান্ত গলায়, চমৎকার, সুন্দর পিয়ানোর কাছে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে, রোগা রোদপোড়া হাতে তাল দিয়ে।

খাতায় পরের গানটা ছিল ইতালীয়। কিটি তার মুখবন্ধ বাজিয়ে তাকাল ভারেঙ্কার দিকে।

‘এটা থাক’, লাল হয়ে উঠে বলল ভারেঙ্কা।

সভয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিটি তাকিয়ে রইল ভারেঙ্কার মুখে।

‘মানে অন্য একটা’, পাতা উলটিয়ে তাড়াতাড়ি সে বলল, তখনই সে বুঝেছিল যে গানটার সাথে কিছু-একটার সম্পর্ক আছে।

সুরলিপিতে আঙুল দিয়ে ভারেঙ্কা বলল, ‘না, এটা গাওয়া যাক।’ আগের মতই একই রকম শান্ত নিরুত্তাপ সুন্দর গলায় সে গানটা গাইল।

গান শেষ হতে সবাই ধন্যবাদ দিল, তাকে গেল চা খেতে। কিটি আর ভারেঙ্কা গেল বাড়ির লাগোয়া বাগানটায়। কিটি বলল, ‘ওই গানটার সাথে আপনার কোন স্মৃতি বিজড়িত আছে, তাই না?’ তারপর তাড়াতাড়ি করে যোগ দিলে, ‘না-না, কিছু বলতে হবে না। শুধু জানতে চাই, সত্যি কিনা?’

‘না, তা কেন? বলব’, সহজভাবে উত্তরের অপেক্ষা না করে ভারেঙ্কা বলে গেল ‘হ্যাঁ, এটা স্মৃতিই বটে। একসময় তা খুবই কষ্টকর ছিল। একটা লোককে আমি ভালোবাসতাম, গানটা গেয়েছিলাম তার কাছে।’

বড় বড় চোখ মেলে কিটি নীরবে সহৃদয়ে চাইল ভারেঙ্কার দিকে।

‘আমি ওকে ভালোবেসেছিলাম, সেও আমাকে ভালোবাসত; কিন্তু মায়ের আপত্তি ছিল, বিয়ে করে সে অন্যকে। এখন সে থাকে আমাদের কাছ থেকে সামান্য দূরে মাঝে মাঝে দেখতে পাই তাকে। আপনি ভাবেননি যে আমারও একটা রোমান্স ছিল?’ সে বলল মুখ তার সামান্য খেলে গেল সেই আগুনটা যা একদিন তাকে গোটাই জ্বালিয়ে তুলেছিল বলে কিটি অনুভব করল।

‘ভাবিনি মানে? আমি যদি পুরুষ হতাম, তাহলে আপনাকে জানার পর আর কাউকে ভালোবাসতে আমি পারতাম না। শুধু বুঝি না, মায়ের জন্যে কেমন করে সে ভুলতে পারল আপনাকে, অসুখী করল। হৃদয় বলে কিছু ছিল না ওর। ‘আরে না, খুব ভালো লোক সে, আমিও অসুখী নই; বরং খুবই সুখী। তাহলে, আর আর গান গাইব না তো?’ বাড়ির দিকে যেতে গিয়ে সে বলল।

‘কি ভালো আপনি, কি ভালো!’ তাকে থামিয়ে চুমু খেয়ে চেঁচিয়ে উঠল কিটি, ‘আমি যদি অন্তত কিছুটা আপনার মত হতে পারতাম!’

‘কেন, আপনাকে হতে হবে অন্য কারো মত? আপনি যা, তাতেই তো আপনি ভালো’, তার বিনতী ক্লান্ত হাসি হেসে বলল ভারেঙ্কা।

‘না, মোটেই আমি ভালো নই। কিন্তু আমাকে বলুন তো…দাঁড়ান, দাঁড়ান, একটু বসা যাক’, আবার তাকে বেঞ্চিতে নিজের পাশে বসিয়ে বলরে কিটি, ‘আচ্ছা, বলুন তো, একজন আপনার ভালোবাসাকে তাচ্ছিল্য করল, চাইল না, সেটা কি অপমানকর নয়।’

‘না, তাচ্ছিল্য সে করেনি। আমার বিশ্বাস, আমাকে সে ভালোই বেসেছিল। তবে সে ছিল বাধ্য ছেলে…’

‘তা ঠিক, কিন্তু যদি মায়ের ইচ্ছেয় নয়, নিজেই সে?…’ কিটি বলল, টের পাচ্ছিল যে নিজের গোপনে ব্যথা সে ফাঁস করে ফেলছে, লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠা তার মুখ ডুবিয়ে দিচ্ছে তাকে।

‘তাহলে সে খারাপ কাজ করত, তার জন্যে আমার কোন কষ্ট হত না’, বুঝতে পারছিল সে ব্যাপারটা তাকে নিয়ে নয়, কিটিকে নিয়ে।

‘কিন্তু অপমান? অপমান যে ভোলা যায় না, ভোলা যায় না’, কিটি বলল শেষ বলনাচের সময় সঙ্গীত বিরতিতে তার দৃষ্টির কথা মনে করে।

‘অপমান কিসে? আপনি তা খারাপ কিছু করেননি?

‘খারাপের চেয়েও খারাপ, লজ্জা।’

ভারেঙ্কা মাথা নেড়ে হাত রাখলে কিটির হাতে।

বলল, ‘লজ্জা কিসে? যে লোকটা আপনার সম্পর্কে উদাসীন তাকে তো আর আপনি বলতে পারেন না যে তাকে ভালোবাসেন?’

‘অবশ্যই না একটা কথাও আমি বলিনি, কিন্তু সে তো জানত। না-না, চোখের চাহনি, হাবভাব,সে তো আছে। একশ’ বছর বাঁচলেও তা ভুলব না।’

‘তাতে কি হল? বুঝতে পারছি না আমি। আসল কথা, আপনি তাকে এখন ভালোবাসেন কিনা’, ভারেঙ্কা বলল সোজাসাপটা।

‘ঘৃণা করি ওকে; নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারছি না।’

‘তা কি হল?’

‘লজ্জা, অপমান।’

‘সব কিছু এমন করে মনে লাগা কি ভালো। এমন কোন মেয়ে নেই যার এ অভিজ্ঞতা হয়নি’, বলল ভারেঙ্কা, ‘এগুলো তেমন গুরুত্বের কিছু নয়।’

‘কিন্তু কোটা গুরুত্বের?’ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে কৌতূহলে জিজ্ঞেস করল কিটি।

‘অনেক কিছুই’, হেসে বলল ভারেঙ্কা।

‘কিন্তু কি?’

‘আহ্, অনেক কিছু’, ভেবে পাচ্ছিল না ভারেঙ্কা কি বলা যায়। তবে এই সময় জানালা থেকে শোনা গেল প্রিন্স- মহিষীর গলা :

‘কিটি ঠাণ্ডা পড়ছে! হয় শাল নিয়ে যা, নয় ঘরের ভেতর আয়।’

‘সত্যি সময় হয়ে গেছে’, উঠে দাঁড়িয়ে ভারেঙ্কা বলল, ‘আমাকে আবার এখন মাদাম বের্তের কাছে যেতে হবে। ডেকে পাঠিয়েছেন।’

উদগ্র ঔৎসুক্যে কিটি তার হাত ধরে রইল, দৃষ্টিতে সানুনয় জিজ্ঞেস : ‘কি এটা, কি এই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা এমন প্রশান্ত দেবে? আপনি জানেন বলুন, আমাকে!’ কিন্তু কিটির দৃষ্টি কি জিজ্ঞাসা করছিল তা মোটেই বোঝেনি ভারেঙ্কা, তার শুধু মনে হল যে তাকে আজ আবার মাদাম বের্তের কাছে যেতে হবে আর বারোটায় পৌঁছতে হবে মায়ের সাথে চা-পানের জন্য। ঘরে ঢুকে তার সুরলিপি গুটিয়ে সে বিদায় নিলে সকলের কাছ থেকে। উদ্যোগ করছিল যাবার।

কর্নেল বলল, ‘আপনাকে আমি পৌঁছে দেব, কেমন?

প্রিন্স-মহিষী সমর্থন করলেন, ‘সত্যি, রাত হয়েছে, একলা যাবে কেমন করে। আমি অন্তত পারাশাকে পাঠাই।’ কিটি দেখল যে ওকে পৌছে দেবার কথায় ভারেঙ্কাকে হাসি চাপতে হল কষ্ট করে।

‘না-না, আমি সব সময় একাই যাই। কখনো কিছুই হয় না আমার’, টুপি নিয়ে সে বলল। আরেকবার চুমু খেলে কিটিকে, তবে কোনটা যে গুরুত্বপূর্ণ তা কিছুই না বলে সতেজ পদক্ষেপে মিলিয়ে গেল গ্রীষ্মের আধো-আঁধারিতে, কি যে গুরুত্বপূর্ণ, কি তাকে দিচ্ছে এই ঈর্ষণীয় প্রশান্তি আর মর্যাদা, সে সাথে করেই সে রহস্য নিয়ে গেল।

তেত্রিশ

কিটির মাদাম টালের সাথে পরিচয় হল এবং ভারেঙ্কার সাথে বন্ধুত্বের সাথে সাথে সে পরিচয় তার ওপর প্রবল প্রভাব ফেলল তাই নয়, সান্ত্বনাও যোগাত তার দুঃখে। সান্ত্বনাটা এখানে যে এই পরিচয়ের কল্যাণে তার কাছে উদ্‌ঘাটিত হল এক নতুন জগৎ, অতীতের সাথে যার কোন মিল নেই, অপরূপ সমুন্নত এক জগৎ যার উচ্চতা থেকে শান্তভাবে দেখা যায় ওই অতীতকে। সে আবিষ্কার করল যে এতদিন যাবৎ প্রবৃত্তিনির্ভর যে জীবন সে পেয়ে এসেছে, তাছাড়াও আছে এক আত্মিক জীবন। সে জীবন তার কাছে আবির্ভূত হল ধর্মের মধ্য দিয়ে, ছোটবেলা থেকে কিটি যে ধর্মের সাথে পরিচিত, গির্জায় প্রভাবী ও সান্ধ্য যে উপাসনায় পরিচিতদের দেখা মিলতে পারত, পুরোহিতের সাথে স্লাভ স্তোত্র মুখস্থ করতে হত, তার সাথে এ ধর্মের কোন মিল নেই। এ হল সমুন্নত রহস্যময় এক ধর্ম, অপরূপ সব ধ্যান- ধারণা অনুভূতির সাথে তা জড়িত, যাতে বিশ্বাস হয় বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে বলে শুধু নয়, ভালোবাসা যায় বলে। কিটি এসব জানতে পারে কারও কথা শুনে নয়। মাদাম শ্টাল কিটির সাথে কথা বলতেন যেন সে এক মিষ্টি শিশু, যাকে দেখে নিজের তারুণ্যের স্মৃতিতে মুগ্ধ হওয়া চলে। শুধু একবার তিনি বলেছিলেন যে মানুষের সমস্ত দুঃখ- কষ্টে সান্ত্বনা মেলে শুধু প্রেমে ও বিশ্বাসে, আমাদের যন্ত্রণায় কোন কষ্টই যিশু খ্রিস্টের কাছে তুচ্ছ নয়। তবে সাথে সাথেই তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। কিন্তু তাঁর প্রতিটি ভাবভঙ্গি, প্রতিটি কথায়, কিটি যাকে স্বর্গীয় বলত, তাঁর তেমন প্রতিটি দৃষ্টিপাতে, ভারেঙ্কার কাছ থেকে তাঁর যে জীবন-কাহিনী কিটি শুনেছিল বিশেষ করে তা থেকে, সব কিছু থেকে কিটি জানল ‘কি গুরুত্বপূর্ণ’, কি সে এতদিন জানত না।

কিন্তু মাদাম শ্টালের চরিত্র যতই সমুন্নত হোক, যতই মর্মস্পর্শী হোক তাঁর জীবন-কাহিনী, যতই উঁচুদরের, স্নিগ্ধ হোক-না কেন তাঁর কথা, তাঁর এমন কয়েকটা দিক কিটির চোখে পড়ল যা বিচলিত করল তাকে। কিটি লক্ষ করল যে, তার আত্মীয়-স্বজনদের কথা জিজ্ঞেস করে মাদাম টাল হাসতেন তাচ্ছিল্যভরে—যা খ্রিস্টীয় করুণার বিপরীত। আরও চোখে পড়ল যে জনৈক ক্যাথলিক যাজকের সাথে কিটি যখন তাঁকে দেখে, মাদাম টাল তখন চেষ্টা করে তাঁর মুখ রাখছিলেন বাতির ছায়ায় এবং বিশেষ রকমের কেমন একটা হাসি ছিল তাঁর মুখে। এই দুটো দিক যত তুচ্ছ‍ই হোক, কিটি বিচলিত হত তাতে, মাদাম টাল সম্পর্কে সন্দিহান বোধ করত সে। তবে ভারেঙ্কা, একাকিনী, আত্মীয়- স্বজনহীনা, বন্ধু-বান্ধবহীনা, প্রচণ্ড আশাভঙ্গ; কিছুই যে চায় না, কিছুতে কোন খেদ নেই, এমন একটা পূর্ণতার প্রতিমূর্তি ছিল সে যা কিটির কাছে কেবল স্বপ্ন। ভারেঙ্কাকে দেখে সে বুঝেছিল যে দরকার কেবল নিজেকে ভুলে যাওয়া, ভালোবাসতে হবে অন্যদের, তাহলেই মিলবে প্রশান্তি, সুখ, অপূর্বতা। কিটি তাই হতে চাইছিল। সবচেয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ কি’, সেটা এখন পরিষ্কার বুঝতে পেরে শুধু তাতেই উল্লসিত না হয়ে কিটি মনপ্রাণ নিবেদন করল এই নবোদ্‌ঘাটিত জীবনের জন্য। মাদাম টাল এবং অন্যরা যাদের নাম তিনি বলেছিলেন তাঁরা কি করেছেন, ভারেঙ্কার কাছ থেকে সে কাহিনী শুনে কিটি তার ভবিষ্যৎ জীবনের একটা ছক করে ফেলল। মাদাম শ্টালের ভাইঝি আলিনা সম্পর্কে তার কাছে অনেক গল্প করেছিল ভারেঙ্কা। কিটিও যেখানেই থাকুক তার মত অভাগাদের খুঁজে বের করবে, যথাসাধ্য সাহায্য করবে তাদের, বাইবেল দেবে, পাপী, তাপী, মুমূর্ষুদের কাছে বাইবেল পড়ে শোনাবে। আলিনা যা করতো, সেভাবে পাপীদের কাছে বাইবেল পড়ে শোনানোটা কিটির কাছে খুবই প্রীতিকর লেগেছিল। তবে এ সবই আপাতত তার গোপন স্বপ্ন, সে কথা সে তার মা বা ভারেঙ্কা, কাউকেই বলেনি।

কিন্তু বড় আকারে নিজের পরিকল্পনা হাসিল করার প্রতীক্ষায় থাকলেও এখনই, এই স্বাস্থ্যপল্লীতেই, যেখানে রুগ্ন আর অভাগা অনেক, সেখানেই ভারেঙ্কাকে অনুকরণ করে কিটি তার নবনীতি প্রয়োগের সুযোগ পেল সহজেই।

প্রথমে প্রিন্স-মহিষীর নজরে পড়েছিল শুধু এই যে তিনি যাকে বলতেন তার মাতন, সেই মাদাম শ্টাল এবং বিশেষ করে ভারেঙ্কার খুবই প্রভাবে পড়েছে কিটি। তিনি দেিেছলেন যে কিটি কেবল ভারেঙ্কার কাজকর্ম অনুকরণ করছে না, অজ্ঞাতসারে তার চলন, বলন, চোখ মিটমিট করার ধরনও নকল করছে। তবে পরে প্রিন্স-মহিষী লক্ষ্য করলেন যে এই মোহটা ছাড়াও মেয়ের মধ্যে ঘটছে কি একটা যেন গুরুতর আত্মিক ওলট-পালট।

প্রিন্স-মহিষী দেখলেন যে রোজ সন্ধ্যায় মাদাম শ্টালের উপহার দেওয়া ফরাসি বাইবেল পড়ছে কিটি যা আগে সে পড়ত না; সমাজের পরিচিতদের সে এড়িয়ে যাচ্ছে, ভারেঙ্কার তত্ত্বাবধানাধীন রোগীদের, বিশেষ করে পেত্রভ নামে এক রুগ্ন চিত্রকরের দরিদ্র পরিবারের দেখাশোনা করছে। স্পষ্টতই কিটির গর্ব হত এই জন্য যে এই পরিবারে সে করুণাময়ী ভগিনীর ব্রত পালন করছে। এ সবই খুব ভালো, তার বিরুদ্ধে আপত্তির কিছু দেখলেন না প্রিন্স-মহিষী, আর সেটা আরও এজন্য সে পেত্রভের স্ত্রী ছিলেন অতি সুচরিতা মহিলা আর জার্মান প্রিন্সেস কিটির ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করে তার প্রশংসা করতেন, তাকে বলতেন সান্ত্বনা দাত্রী দেবী। এ সবই খুব ভালো হত যদি বাড়াবাড়ি না থাকত। কিন্তু প্রিন্স-মহিষীর চোখে পড়ল যে মেয়েটা তার চরমে গিয়ে পৌঁছছে, সে কথা তিনি তাকে বললেনও।

ফরাসি ভাষায় বললেন, ‘কখনোই কোন ব্যাপারেই চরমে যেতে নেই।’

মেয়ে কিন্তু কোন উত্তর দিল না; সে শুধু মনে মনে ভাবলে, যে খ্রিস্টশীলে বলা হয়েছে এক গালে চড় খেলে অন্য গাল পেতে দেবে, কাফতান কেড়ে নিলে দিয়ে দেবে কামিজটাও, তা অনুসরণে কোন চূড়ান্তপনার কথা আসে? কিন্তু এই চূড়ান্তপনাটা প্রিন্স-মহিষীর ভালো ঠেকল না এবং আরও বেশি ভালো ঠেকল না যে তিনি টের পাচ্ছিলেন, কিটি তার অন্তরটা পুরো মেলে ধরতে অনিচ্ছুক। সত্যিই কিটি তার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুভবগুলো লুকিয়ে রাখছিল মায়ের কাছ থেকে। লুকিয়ে রাখত এজন্য নয় যে সে তার মাকে শ্রদ্ধা করত না, ভালোবাসতো না, কেবল এই জন্য যে উনি তাঁর মা। মাকে ছাড়া সে বরং অন্য সকলের কাছেই এগুলি খুলে বলতে পারত।

‘কেন যেন আন্না পাভলোভনা অনেকদিন আমাদের এখানে আসেনি’, পেত্রভা সম্পর্কে প্রিন্স-মহিষী বললেন। ‘একদিন আমি ডেকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু কিসে যেন ওকে অসন্তুষ্ট মনে হল।

‘কই, আমি তো লক্ষ্য করিনি, মা’, কিটি লাল হয়ে বলল।

তুই অনেকদিন ওদের ওখানে যাসনি?

‘কাল আমরা বেড়াতে যাবার তোড়জোড় করছি পাহাড়ে’, কিটি বলল।

‘তা বেশ তো, যা’, মেয়ের বিচলিত মুখের দিকে তাকিয়ে এবং তার কারণ অনুমানের চেষ্টা করে প্রিন্স-মহিষী জবাব দিলেন।

সেদিনই খেতে এল ভারেঙ্কা, জানাল যে কাল পাহাড়ে যাবার ব্যাপারে মত পালটেছেন আন্না পাভলোভনা। প্রিন্স- মহিষী লক্ষ্য করলেন যে কিটি আবার লাল হয়ে উঠেছে।

‘কিটি, পেত্রভদের সাথে তোর কোন মনোমালিন্য হয়নি তো?’ ভারেঙ্কা চলে যাবার পর জিজ্ঞেস করলেন প্রিন্স- মহিষী। ‘আমাদের এখানে ছেলেমেয়েদের পাঠানো, নিজেই বা আসা বন্ধ করল কেন?’

কিটি বলল যে, তাদের ভেতর কিছুই হয়নি এবং সে একেবারেই বুঝতে পারছে না কেন আন্না পাভলোভনাকে তার ওপর যেন অসন্তুষ্ট বলে মনে হচ্ছে। নিতান্ত সত্যি কথাই বলল কিটি। তার প্রতি আন্না পাভলোভনার মনোভাব বদলাবার কারণ সে জানত না, তবে অনুমান করতে পারছিল। যে জিনিসটা সে অনুমান করছিল, সেটা সে মাকে বলতে পারত না, নিজেকেও না। এটা এমন একটা জিনিস যা জানা থাকলেও নিজের কাছে পর্যন্ত তা বলা যায় না। ভুল করাটা এতই ভয়ঙ্কর আর লজ্জার ব্যাপার।

এই পরিবারটির সাথে কিটি তার সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করতে লাগল বারম্বার। দেখা হলে আন্না পাভলোভনার গোলগাল সহৃদয় মুখে যে সরল আনন্দ ফুটে উঠতো, সে কথা মনে পড়ল তার; মনে পড়ল রোগীকে নিয়ে তাদের গোপন কথাবার্তা, কাজ করা তার বারণ, কাজ থেকে তার মন সরিয়ে বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্য তাদের চক্রান্ত; তাকে ‘আমার কিটি’ বলে যে ডাকত, কিটিকে ছাড়া যে শুতে চাইতো না, যে ছোট ছেলেটা তার ন্যাওটা হয়ে উঠেছিল তার কথা। কি ভালোই-না ছিল সব! তারপর মনে পড়ল লম্বা-ঘাড়, বাদামী কোট গায়ে শীর্ণাধিকশীর্ণ পেত্রভকে; তাঁর পাতলা হয়ে আসা কোঁকড়া চুল, সপ্রশ্ন নীল চোখ যাতে প্রথম-প্রথম ভয় লাগত কিটির, কিটির উপস্থিতিতে নিজেকে উৎফুল্ল উৎসাহিত দেখাবার জন্য তাঁর রুগ্ন প্রয়াস। সমস্ত ক্ষয়রোগীকে দেখেই তার যে বিতৃষ্ণা বোধ হত, তাঁর ক্ষেত্রেও যে বিতৃষ্ণা কাটিয়ে ওঠার জন্য কিটির প্রচেষ্টা, তাঁকে কি বলবে তা ভেবে ঠিক করার জন্য তার উদ্যোগ মনে পড়ল কিটির। উনি যে ভীরু-ভীরু মর্মস্পর্শী দৃষ্টিতে তার দিকে চাইত, তাতে সমবেদনা, অস্বস্তির বিচিত্র অনুভূতি এবং পরে দয়া-দাক্ষিণ্যের যে চেতনা জাগত, তা মনে পড়ল। কি ভালোই-না ছিল এই সব কিছুই! তবে এ সবই ছিল প্রথম দিকটায়। এখন, কয়েক দিন আগে হঠাৎ মাটি হয়ে গেল সব কিছু। আন্না পাভলোভনা কিটিকে দেখে একটা ভান করা ঔৎসুক্য প্রকাশ করলেন এবং ক্রমাগত লক্ষ্য করতে লাগলেন তাকে আর স্বামীকে।

তার উপস্থিতিতে পেত্রভের এই মর্মস্পর্শী আনন্দই কি আন্না পাভলোভনার শীতলতার কারণ?

‘হ্যাঁ’, মনে পড়ল কিটির, ‘আন্না পাভলোভনার মধ্যে কি যেন একটা ছিল অস্বাভাবিক, তাঁর সদয়তার সাথে যা মোটেই মেলে না, দু’দিন আগের মতও নয় যখন সখেদে তিনি বলেছিলেন, ‘এই তো, কেবলি আপনার অপেক্ষায় থেকেছে, আপনাকে ছাড়া কফি খেতেও চাইছিল না যদিও দুর্বল হয়ে পড়েছে ভয়ানক।’

‘হ্যাঁ, আমি যখন পেত্রভকে কম্বল দিলাম, সেটাও বোধ হয় তার খারাপ লেগেছিল। এ সবই নেহাৎ সহজ ব্যাপার, কিন্তু এমন অপ্রস্তুতের মত সে জিনিসটা নিলে আর এত বেশিক্ষণ ধরে ধন্যবাদ জানাল আমাকে যে আমার নিজেরই অপ্রস্তুত লাগছিল। তারপর আবার আমার ওই পোর্ট্রেটটা; ভারি চমৎকার এঁকেছে। কিন্তু প্রধান কথা তার দৃষ্টিটা— বিব্রত আর কমনীয়। হ্যাঁ-হ্যাঁ, তাই বটে!’ সভয়ে মনে মনে পুনরুক্তি করল কিটি, ‘না-না, এ হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। ভারি করুণ লাগে যে ওকে।’

তার নবজীবনের মাধুর্য এই সন্দেহটা বিষাক্ত করে দিল।

চৌত্রিশ

জল-চিকিৎসার কোর্স শেষ হবার আগে প্রিন্স শ্যেরবাৎস্কি যিনি কার্লসবাডের পর বাডেন-বাডেন আর কিসিনগেনে রুশ বন্ধুদের কাছে গিয়েছিলেন, তাঁর কথায় রুশী প্রাণে ডুব দিতে, তিনি ফিরে এলেন স্ত্রী-কন্যার কাছে।

প্রবাসজীবন সম্পর্কে প্রিন্স ও প্রিন্স-মহিষীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একেবারে বিপরীত। প্রিন্স-মহিষীর কাছে সবই লাগত অপরূপ, রুশ সমাজে তাঁর দৃঢ় প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও প্রবাসে তিনি চেষ্টা করতেন ইউরোপীয় মহিলাদের মত হতে যা তিনি ছিলেন না,–কেননা তিনি হলেন রুশী ভদ্রঘরের মেয়ে,—তাই দেখাবার ভান করতেন এজন্য যে তাঁর খানিকটা বিব্রত লাগছে। উলটো দিকে প্রবাসের সব কিছু বিছ্‌ছিরি লাগত প্রিন্সের, পীড়িত বোধ করতেন ইউরোপীয় জীবনে, নিজের রুশী অভ্যাসাদি আঁকড়ে থাকতেন আর ইচ্ছে করে দেখাতে চাইতেন যে উনি আসলে যা তার চেয়েও কম ইউরোপীয়। প্রিন্স ফিরলেন রোগা হয়ে, গালের চামড়া ঝুলে পড়েছে, কিন্তু অত্যন্ত খোশ মেজাজে। মেজাজ আরও শরিফ হয়ে উঠল যখন দেখলেন কিটি একেবারে সেরে উঠেছে। মিসেস শ্টাল ও ভারেঙ্কার সাথে কিটির সৌহার্দের খবরে এবং কিটির মধ্যে কি একটা পরিবর্তন প্রিন্স-মহিষী লক্ষ্য করেছেন সেটা জানায় প্রিন্স বিচলিত হন এবং তাঁকে ছাড়াই কেউ বা কিছু মেয়েকে আকৃষ্ট করল সাধারণত তিনি যে ঈর্ষা বোধ করতেন সেটা মাথাচাড়া দিলে, ভয় হল মেয়ে আবার তাঁর প্রভাব থেকে সরে তাঁর কাছে অনায়ত্ত কোন ক্ষেত্রে গিয়ে না পড়ে। কিন্তু তাঁর মধ্যে সব সময়ই যে প্রসন্নতা আর প্রফুল্লতা দেখা যেত, কার্লসবাডের পানিতে যা বিশেষ বেড়ে উঠেছিল, তার সমুদ্রে তলিয়ে গেল এসব অপ্রীতিকর সংবাদ।

আসার পরের দিন প্রিন্স তাঁর লম্বা ওভারকোট পরে স্টার্চ দেওয়া কলারের ফুলে ওঠা গাল আর রুশী বলিরেখা নিয়ে অতি খোশ মেজাজে মেয়ের সাথে গেলেন প্রস্রবণে।

চমৎকার ছিল সকালটা; বাগানওয়ালা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হাসিখুশি বাড়ি, ফুর্তিতে কর্মরতা বিয়ার-টানা রক্তিমাননা, রক্তপানি জার্মান পরিচারিকাদের চেহারা, জ্বলজ্বলে সূর্য চোখ জুড়াচ্ছিল; কিন্তু যতই তাঁরা প্রস্রবণের কাছে এসে পড়ছিলেন ততই ঘন ঘন দেখা যাচ্ছিল রুগ্নদের, সচ্ছল জার্মান জীবনের পরিস্থিতিতে তাদের চেহারা মনে হচ্ছিল আরও শোচনীয়। এই বৈপরীত্যে কিটি এখন আর অবাক হয় না। এসব পরিচিত মুখ আর তাদের স্বাস্থ্যের যে অবনতি বা উন্নতি কিটি লক্ষ্য করত, কিটির কাছে তার স্বাভাবিক ফ্রেম ছিল এই জ্বলজ্বলে রোদ, পল্লবের উৎফুল্ল ঝলক, সঙ্গীতের ধ্বনি, কিন্তু প্রিন্সের কাছে জুন মাসের প্রভাতী আলো আর ঝলক, ফ্যাশন-চল, ফুর্তি-জাগানো ওয়াল্জ বাজাচ্ছে যে অর্কেস্ট্রা তার ধ্বনি, বিশেষ করে স্বাস্থ্যবর্তী পরিচারিকাদের চেহারা ইউরোপের সর্বপ্রান্ত থেকে আগত, ভগ্নমনে চলমান শবগুলির সাথে মেলায় কেমন যেন অশালীন আর কদর্য ঠেকল।

আদরের কন্যা যখন তাঁর বাহুলগ্না হয়েছে তখন একটা গর্ব আর যৌবন ফিরে আসার মত একটা অনুভূতি হলেও এখন নিজের বলিষ্ঠ চলন, মেদপুষ্ট দীর্ঘ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য যেন অস্বস্তি আর লজ্জা হল। নিজেকে প্রায় জনসমক্ষে নগ্ন কোন লোকের মত মনে হল তাঁর 1

‘তোর নতুন বন্ধুদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দে তো’, কনুই দিয়ে মেয়ের হাতে চাপ দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি তোর এই অখাদ্য সোডেনকেও ভালোবেসে ফেলেছি তোকে এমন সারিয়ে তুলেছে বলে। শুধু বড় মন খারাপ লাগে তোদের এখানে। এ লোকটা কে?’

পরিচিত অপরিচিত যাদের দেখা গেল, কিটি বলল তারা কে। বাগানে ঢোকার মুখে দেখা হল অন্ধ মাদাম বের্তে আর তাঁর সহচরীর সাথে। কিটির গলা শুনতে পেয়ে বৃদ্ধা ফরাসিনীর মুখখানা যে রকম মর্মস্পর্শী হয়ে উঠল তাতে আনন্দ হল প্রিন্সের। তখনই উনি অত্যধিক ফরাসি সৌজন্য কথা বলতে লাগলেন প্রিন্সের সাথে, তাঁর এমন চমৎকার মেয়ে বলে প্রিন্সকে প্রশংসা করলেন, একেবারে আকাশে তুললেন কিটিকে, বললেন সে একটি রত্ন, মুক্তা, সান্ত্বনাদাত্রী দেবী।

‘তাহলে ও দুই নম্বর দেবী’, প্রিন্স বললেন হেসে, ‘মাদমোয়াজেল ভারেঙ্কাকে কিটি বলে দেবী পয়লা নম্বরের।’

‘ও, মাদমোয়াজেল ভারেঙ্কা, সে সত্যিকারেরই দেবী, এতে আর বলার কি আছে, কথার সূত্র ধরে বললেন মাদাম বের্তে।

গ্যালারিতে দেখা হয়ে গেল স্বয়ং ভারেঙ্কার সাথেই। মনোরম একটা লাল হাত-ব্যাগ নিয়ে সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল তাদের দিকে।

কিটি তাকে বলল, ‘এই যে বাবা এসে গেছেন। ‘

ভারেঙ্কার সব কিছু যেমন সহজ, স্বাভাবিক, তেমনিভাবে সে একটা ভঙ্গি করল যা মাথা নোয়ানো আর অর্ধোপবেশন অভিনন্দনের মাঝামাঝি এবং তৎক্ষণাৎ প্রিন্সের সাথে স্বাভাবিক সহজ কথাবার্তা শুরু করল যা সে করে সবার সাথেই।

‘বলাই বাহুল্য আমি আপনার কথা জানি, খুবই জানি’, প্রিন্স তাকে বললেন হেসে; কিটি বুঝল তাকে ভালো লেগেছে প্রিন্সের, তাই আনন্দ হল তার, ‘কোথায় যাবার অত তাড়া আপনার?’

‘মা এখানে আছেন’, কিটির দিকে ফিরে সে বলল, ‘সারা রাত তাঁর ঘুম হয়নি, ডাক্তার বলেছেন বাইরে বেরোতে। আমি তাঁর কাজ নিয়ে যাচ্ছি।’

‘তাহলে এটিই পয়লা নম্বরের দেবী!’ ভারেঙ্কা চলে যেতে বললেন প্রিন্স।

কিটি দেখতে পাচ্ছিল যে প্রিন্স ভারেঙ্কাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে চান কিন্তু তা পারছেন না, কারণ ভারেঙ্কাকে তাঁর ভালো লেগেছে।

‘তা এবার তোর সব বন্ধুদের দেখা যাবে’, যোগ দিলেন প্রিন্স, ‘মাদাম টালকেও, যদি আমাকে চিনতে তাঁর আপত্তি না থাকে।’

‘ওঁকে তুমি চিনতে নাকি, বাবা?’ মাদাম শ্টালের উল্লেখে প্রিন্সের চোখে বিদ্রূপের শিখা জ্বলে উঠতে দেখে সভয়ে জিজ্ঞেস করল কিটি।

‘ওঁর স্বামীকে চিনতাম, ওঁকেও খানিকটা, পাইয়েটিস্টদের দলে উনি নাম লেখাবার আগে।’

‘পাইয়েটিস্ট কি বাবা?’ কিটি বলল, মিসেস শ্টালের ভেতরকার যে গুণাবলির সে অত কদর করে, তার আবার কোন নাম থাকতে পারে ভেবে তয় হয়েছিল তার।

‘আমি নিজেই ঠিক জানি না। শুধু এটুকু জানি যে, সব কিছুর জন্য উনি ধন্যবাদ দেন সৃষ্টিকর্তাকে! যত কিছু দুর্ভাগ্য ঘটেছে, স্বামী যে মারা গেল, তার জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ। হাস্যকরই দাঁড়াচ্ছে। কেননা দুজনের বনিবনা ও ছিল না।’

‘এ কে? কি করুণ মুখ!’ বেঞ্চিতে বসা একটা অদীর্ঘদেহী রোগীকে দেখে প্রিন্স জিজ্ঞেস করলেন। লোকটার পরনে বাদামি ওভারকোট, সাদা পেন্টালুন যা তার মাংসহীন পায়ের হাড়ের ওপর অদ্ভুত সব ভাঁজ ফেলেছে।

ভদ্রলোক তাঁর পাতলা হয়ে আসা কোঁকড়া চুল থেকে স্ট্র হ্যাট খানিকটা তুললেন, দেখা দিল টুপির দরুন অসুস্থ-রক্তিম একটা উঁচু কপাল।

কিটি লাল হয়ে উঠে বলল, ‘ইনি পেত্রভ, চিত্রকর। আর উনি তাঁর স্ত্রী’, কিটি যোগ দিলে আন্না পাভলোভনাকে দেখিয়ে। ওঁরা যখন এগিয়ে আসছিলেন ঠিক সেই সময়েই ভদ্রমহিলা যেন ইচ্ছে করেই পথ থেকে ছুটে গেলেন ছেলেকে আনতে।

‘কি করুণ আর কি মিষ্টি ওঁর মুখ!’ প্রিন্স বললেন, ‘তুই ওঁর কাছে গেলি না যে? কি যেন উনি বলতে যাচ্ছিলেন তোকে?’

‘বেশ, তাহলে যাই’, নির্দ্বিধায় ঘুরে এল কিটি, ‘আজ কেমন আছেন?’ পেত্রভকে জিজ্ঞেস করল সে।

লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পেত্রভ সসংকোচে তাকালেন প্রিন্সের দিকে।

প্রিন্স বললেন, ‘এটা আমার মেয়ে। আসুন পরিচয় করা যাক।’

মাথা নুইয়ে হাসলেন চিত্রকর, উদ্ঘাটিত হল আশ্চর্য ঝকঝকে সাদা দাঁত।

‘কালকে আমরা আপনাকে আশা করেছিলাম, প্রিন্সেস’, কিটিকে তিনি বললেন।

কথাটা বলতে গিয়ে তিনি টলে উঠলেন, আর সেটার পুনরাবৃত্তি করে দেখাতে চাইলেন যে ওটা তাঁর ইচ্ছে করে করা।

‘আমি আসব ভেবেছিলাম, কিন্তু ভারেঙ্কা বলল যে আন্না পাভলোভনা তাকে বলতে পাঠিয়েছেন যে আপনারা যাবেন না।’

‘যাব না মানে?’ লাল হয়ে উঠে এবং তৎক্ষণাৎ কেশে ফেলে পেত্রভ বললেন, চেয়ে চেয়ে খুঁজতে লাগলেন স্ত্রীকে, ‘আনেতা, আনেতা!’ জোরে ডাকলেন তিনি, তাঁর সরু সাদা ঘাড়ে দড়ির মত ফুটে উঠল মোটা মোটা শিরা।

আন্না পাভলোভনা কাছে এলেন।

‘আমরা যাব না, এ কথা তুমি প্রিন্সেসকে বলতে পাঠিয়েছিলে কেন?’ গলা ভেঙে গিয়ে উত্ত্যক্ত স্বরে ফিসফিস করলেন তিনি।

‘ধন্যবাদ, প্রিন্সেস!’ আন্না পাভলোভনা বললেন একটা ভান করা হাসি হেসে, যা মোটেই তাঁর আগেকার হাসির মত নয়। প্রিন্সকে বললেন, ‘পরিচয় করে খুব খুশি হলাম। সবাই অনেকদিন থেকে আপনাকে আশা করছিল।’

‘আমরা যাব না, এ কথা বলতে পাঠালে যে বড়’, আরো রেগে, স্পষ্টতই গলার স্বর তাঁকে মানছে না, যেমনটা চেয়েছিলেন কথায় তেমন সুর ফুটছে না বলে আরো উত্ত্যক্ত হয়ে ভাঙা গলায় আরেকবার ফিসফিস করলেন চিত্রকর।

‘ওহ্ সৃষ্টিকর্তা! আমি যে ভেবেছিলাম আমরা যাচ্ছি না’, স্ত্রী জবাব দিলেন বিরক্তিভরে 1

‘কেন, যখন…’ কাশি এল তাঁর, হতাশায় হাত ঝাঁকালেন 1

প্রিন্স টুপিটা সামান্য তুলে চলে গেলেন মেয়েকে সাথে করে।

‘ওহ্!’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রিন্স, ‘ওহ্, কি অভাগা!’

‘হ্যাঁ, বাবা’, কিটি বলল, ‘আর জানো, ওঁর তিনটা ছেলেমেয়ে। কোন চাকর-বাকর নেই, আয়ও নেই বললেই হয়। কি খানিকটা পান একাডেমি থেকে।’ চাঙ্গা হয়ে শোনাতে লাগল কিটি, তার সাথে আন্না পাভলোভনার সম্পর্কের বিচিত্র পরিবর্তনের ফলে তার মধ্যে যে উত্তেজনা জেগেছিল, চেষ্টা করল সেটা চাপা দিতে।

আরে, ওই তো মাদাম টাল’, কিটি বলল একটা ঠেলা গাড়ি দেখিয়ে, তাতে ছাতার নিচে ধূসর আর নীলে জড়ানো কি একটা পড়ে ছিল বালিশে ঠেস দিয়ে।

তিনিই মাদাম টাল। তাঁর পেছনে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে ছিল একজন ঘণ্ডা গোছের জার্মান মুনিষ, যে তাঁকে ঠেলে নিয়ে যায়। পাশেই শণচুলো এক সুইডিশ কাউন্ট, কিটি তাকে নামে চেনে। জনকতক রোগী ঠেলাটার কাছে ঘুরঘুর করছে, মহিলাটিকে দেখছে যেন তিনি অদ্ভূত একটা ব্যাপার।

প্রিন্স এগিয়ে গেলেন তাঁর কাছে। সাথে সাথেই কিটি তাঁর চোখে দেখতে পেল বিদ্রূপের শিখা যা তাকে বিচলিত করেছিল। প্রিন্স মাদাম টালের কাছে গিয়ে কথা বললেন চমৎকার ফরাসি ভাষায় যা আজকাল খুব কম লোকেই বলে আর সেটা বললেন অসাধারণ সশ্রদ্ধ ও সুমধুর ভঙ্গিতে।

‘জানি না আমাকে আপনার মনে আছে কিনা, তবে আমার কন্যার প্রতি আপনার সহৃদয়তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দেব বলে আমার কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে হবে।’

‘প্রিন্স আলেক্‌সান্দর শ্যেরবাৎস্কি’, মাদাম টাল বললেন তাঁর স্বর্গীয় চোখ তুলে আর তাতে অসন্তোষ নজরে পড়ল কিটির, ‘খুব খুশি হলাম। আপনার মেয়েকে ভারি ভালোবেসে ফেলেছি আমি।’

‘আপনার স্বাস্থ্য এখনো খারাপ যাচ্ছে?’

‘হ্যাঁ, ওতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি’, এই বলে মাদাম টাল পরিচয় করিয়ে দিলেন সুইডিশ কাউন্টের সাথে।

প্রিন্স বললেন, ‘আপনি কিন্তু বদলেছেন খুবই কম। দশ কি এগারো বছর আপনাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি।’

‘হ্যাঁ, সৃষ্টিকর্তা আমাদের ক্রুশ দেন, আর বইবার শক্তিও দেন। প্রায়ই অবাক লাগে, এ জীবন লম্বা হয়ে চলেছে কিসের লক্ষ্যে?…ওই দিকটায়!’ বিরক্তিভরে তিনি বললেন ভারেঙ্কাকে, যে ঠিকমত তাঁর পায়ে কম্বল ঢাকা দিতে পারছিল না।

‘নিশ্চয় ভালো কাজ করার জন্য’, প্রিন্স বললেন হাসি চোখে।

‘সে বিচারের ভার আমাদের নয়’, প্রিন্সের মুখভাব লক্ষ্য করে মাদাম শ্টাল বললেন, ‘তাহলে বইটা আমাকে পাঠাচ্ছেন তো প্রিয়বর কাউন্ট? অনেক ধন্যবাদ আপনাকে’, যুবক সুইডিশটিকে বললেন তিনি।

‘এই!’ কাছেই দণ্ডায়মান মস্কো কর্নেলকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রিন্স। মস্কো কর্নেল এসে জুটল তাঁদের সাথে। মাদাম শ্টালকে অভিবাদন করে মেয়ে আর কর্নেলকে নিয়ে প্রিন্স চলে গেলেন।

‘এই আমাদের আভিজাত্য, প্রিন্স!’ শ্লেষ করার ইচ্ছায় বললেন মস্কো কর্নেল, তাঁর সাথে মাদাম শ্টালের পরিচয় নেই বলে তাঁর ওপর কর্নেলের একটা রাগ ছিল।

‘সেই একই রকম রয়ে গেছে’, প্রিন্স জবাব দিলেন।

‘ওঁর অসুখের আগে আপনি ওঁকে জানতেন প্রিন্স, মানে শয্যাশায়ী হবার আগে?’

‘হ্যাঁ, শয্যাশায়ী হন আমার সাথে পরিচয় থাকার সময়েই’, প্রিন্স বললেন।

‘শুনেছি, দশ বছর উঠে দাঁড়াতে পারছেন না।’

‘উঠে দাঁড়ান না। কারণ, ওঁর পা খাটো। ওঁর গড়নটা খুবই কুৎসিত….’

‘হতে পারে না, বাবা!’ চেঁচিয়ে উঠল কিটি।

‘কু-লোকে তাই বলে। তোর ভারেঙ্কাকে জবর সইতে হচ্ছে’, প্রিন্স যোগ করলেন, ‘ওহ্, ধন্য এসব রোগী মর্যাদাবতী!’

‘আহ্, না বাবা!’ উত্তেজিত হয়ে আপত্তি করল কিটি, ‘ভারেঙ্কা ওঁকে মহাপুরুষ জ্ঞান করে। তাছাড়া কত ভালো কাজ করেন উনি। যাকে খুশি জিজ্ঞেস কর না। সবাই ওঁকে আর আলিনা টালকে জানে।’

‘তা হতে পারে’, কনুই দিয়ে কিটির হাতে চাপ দিয়ে প্রিন্স বললেন, ‘তবে ভালো কাজটা এমনভাবে করাই ভালো যাতে যাকেই জিজ্ঞেস করা যাক কেউ জানবে না।’

কিটি চুপ করে গেল কিছুই তার বলার নেই বলে নয়; বাবার কাছেও সে তার গোপন ভাবনা উদ্‌ঘাটিত করতে চাইছিল না। তবে আশ্চর্য ব্যাপার, পিতার দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নেবে না, তার পূততমে তাঁকে প্রবেশ করতে দেবে না বলে কিটি যতই তৈরি হোক, মাদাম শ্টালের যে মহামানবের মূর্তি সে তার প্রাণের মধ্যে বহন করে এসেছে পুরো এক মাস, সেটা চিরকালের মত অদৃশ্য হল পোশাক পরানো মানুষরূপী এক মূর্তির মত, যখন বোজা যায় যে ওটা পোশাক। রইল শুধু খর্বপদ এক নারী যে শুয়ে থাকে কারণ গড়নটা তার কুৎসিত, আর নিরীহ ভারেঙ্কাকে সে কষ্ট দেয় কারণ কম্বলটা সে ঠিকমত জড়াতে পারেনি। কল্পনার কোন প্রয়াসেই আগের মাদাম টালকে আর ফেরানো গেল না।

পঁয়ত্রিশ

ঘরের লোকজন, চেনা-পরিচিত, এমন কি যে জার্মান বাড়িওয়ালার ওখানে তাঁরা উঠেছিলেন, তাঁকেও–প্রিন্স তাঁর খোশমেজাজে সংক্রমিত করলেন। কিটির সাথে প্রস্রবণ থেকে ফিরে এবং কর্নেল, মারিয়া ইয়েঙ্গেনিয়েভনা আর ভারেঙ্কাকে কফি খেতে নিমন্ত্রণ করে প্রিন্স বাগানে বাদাম গাছের তলায় টেবিলে আর চেয়ারগুলো এনে সেখানে টেবিল সাজাতে বললেন। প্রিন্সের ফুর্তিতে বাড়িওয়ালা আর চাকর-বাকররাও চাঙ্গা হয়ে উঠল। তাঁর বদান্যতার কথা তারা জানত। আধঘণ্টা পরে ওপরতলার বাসিন্দা, হামবুর্গের রুগ্‌ণ ডাক্তারও বাদাম গাছের তলে সমবেত হাসি-খুশি সুস্থ রুশীদের এই দলটাকে জানালা দিয়ে দেখতে লাগল ঈর্ষাভরে। পাতাগুলোর কম্পমান ছোট ছোট ছায়ার তলে, সাদা টেবিলক্লথের ওপর কফিপট, রুটি, মাখন, পনির, ঠাণ্ডা ফাউল সাজানো টেবিলের কাছে বসে বেগুনি রিবন লাগানো টুপি পরে প্রিন্স-মহিষী কাপ আর মাখন মাখানো রুটি এগিয়ে দিচ্ছিলেন। প্রিন্স বসেছিলেন অন্য প্রান্তে, খেতে খেতে উচ্চকণ্ঠে ফুর্তিতে কথা বলছিলেন। নিজের কাঝে প্রিন্স রাখলেন তাঁর কেনা জিনিসগুলো—খোদাই করা ছোট ছোট বাক্স, হুইসিল, নানা ধরনের কাগজ-কাটা ছুরি, যা তিনি গাদা গাদা কিনেছিলেন প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে। সেগুলো তিনি সবাইকে বিলি করতে লাগলেন, দাসী লিস্হেন আর গৃহস্বামীকেও। এঁর সাথে তিনি হাসি-ঠাট্টা করছিলেন তাঁর মজাদার ভুল-ভাল জার্মান ভাষায়, বোঝাচ্ছিলেন যে কিটি সেরে উঠেছে এখানকার পানির গুণে নয়, তাঁর বাড়ির চমৎকার খানা, বিশেষ করে প্রন স্যুপের জন্য। প্রিন্স-মহিষী, কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থাকার গোটা সময়টাই তাঁর মধ্যে এত সজীবতা আর ফুর্তি কখনো দেখা যায়নি। বরাবরের মত কর্নেল হাসছিলেন প্রিন্সের রসিকতায়। কিন্তু ইউরোপের প্রসঙ্গে, যা তিনি মন দিয়ে অধ্যয়ন করেছেন বলে ভাবতেন, তিনি পক্ষ নিলেন প্রিন্স-মহিষীর। রসিক প্রিন্স যা-কিছু বলছিলেন তাতে হেসে কুটিপাটি হচ্ছিলেন দয়াবতী মারিয়া ইয়েঙ্গেনিয়েভনা আর কিটি কখনও দেখেনি, প্রিন্সের রসিকতায় ভারেঙ্কাও ক্ষীণ তবে সংক্রামক হাসিতে নেতিয়ে পড়ছিল।

এ সবে আনন্দ হচ্ছিল কিটির, তাহলেও দুশ্চিন্তাও তাড়াতে পারছিল না। তার বন্ধুদের সম্পর্কে এবং যে জীবনটা সে এত ভালোবেসেছিল সে সম্পর্কে তাঁর হাসি-খুশি মতামত দিয়ে বাবা অজ্ঞাতসারে তাকে যে সমস্যায় ফেলেছিল তার সমাধান করতে পারছিল না সে। এই সমস্যার সাথে যোগ হয়েছিল পেত্রভদের সাথে তার সম্পর্কের পরিবর্তন যা আজ এর সুস্পষ্ট আর অপ্রীতিকর রূপে প্রকাশ পেয়েছে। সবাই হাসি-খুশি, কিন্তু কিটি তা হতে পারছে না, এতে আরও বেড়ে উঠছিল তার যন্ত্রণা। ছেলেবেলায় যখন শাস্তিস্বরূপ তাকে তার ঘরে বন্ধ করে রাখা হত আর তার কানে আসত বোনেদের উচ্ছল হাসি, তার যেমন লাগত, তেমনি একটা অনুভূতি হচ্ছিল তার।

‘তা রাজ্যের এই জিনিসগুলো কিনলে কেন?’ স্বামীকে কফির কাপ এগিয়ে দিয়ে হেসে বললেন প্রিন্স-মহিষী। ‘মানে বেড়াতে বেরোই। দোকানের কাছাকাছি হতেই জার্মান ভাষায় পীড়াপীড়ি করে : ‘বাবাজি, হুজুর, জাঁহাপনা।’ কিন্তু যেই ‘জাঁহাপনা’ বলে অমনি আর পারি না, খসে যায় দশ টালার।

‘এ শুধু একঘেয়ে লাগার ফলে’, প্রিন্স-মহিষী বললেন।

‘একঘেয়েমির ফলে তো বটেই। এত একঘেয়ে যে ভেবে পেতাম না কি করি।’

‘একঘেয়ে লাগবে কেন, প্রিন্স? জার্মানিতে এখন মন লাগার মত জিনিস কত’, বললেন মারিয়া ইয়েঙ্গেনিয়েভনা।

‘হ্যাঁ, মন লাগার সব জিনিসই আমি জানি : প্রন স্যুপ জানি, মটরশুটির সসেজ জানি। সবই জানা।’

‘না, যাই বলুন প্রিন্স, তাদের প্রথা-প্রতিষ্ঠান খুবই চিত্তাকর্ষক’, বললেন কর্নেল।

‘চিত্তাকর্ষক কিসে? সবাই ওরা তামার পয়সার মত তুষ্ট : সবাইকে হারিয়েছে। কিন্তু আমি তুষ্ট থাকব কিসে? আমি তো কাউকে হারাইনি। শুধু নিজেই নিজের হাইবুট খুলে নিজেই রাখ দরজার বাইরে। সকালে উঠে তখনই পোশাক পরে সালোঁতে যাও অখাদ্য চা খেতে। এ কি আর বাড়ির মত! তাড়াহুড়া না করে ঘুম ভাঙল, রাগ হল কিছু- একটায়, গজগজ করলাম, সুস্থ হয়ে উঠলাম ভালোরকম, সব কিছু ভেবে দেখলাম, তাড়াহুড়া নেই। ‘

‘কিন্তু সময় যে টাকা-আপনি সেটা ভুলে যাচ্ছেন’, বললেন কর্নেল।

‘কোন সময়! এমন সময় কাছে যখন গোটা মাসের দাম এক পয়সা, আবার এমন সময় আসে কখন কোন টাকাতেই আধঘণ্টা সময়ও কেনা যাবে না। তাই না কিটি? কি হল তোর, অমন ব্যাজার যেঃ

‘আমি ঠিক আছি।’

‘চললেন কোথায়? বসুন আরও কিছুক্ষণ’, ভারেঙ্কাকে বললেন প্রিন্স।

‘আমার বাড়ি যেতে হবে’, উঠে দাঁড়িয়ে ভারেঙ্কা বলল এবং আবার হেসে লুটিয়ে পড়ল।

পোশাক ঠিক করে নিয়ে সে বাড়ির ভেতর ঢুকল টুপি নেবার জন্য। টিকিও গেল তার পিছু পিছু। ভারেঙ্কাকে পর্যন্ত এখন অন্যরকম লাগছে। আগে তাকে যা বলে কল্পনা করেছিল তার চেয়ে খারাপ নয়, কিন্তু অন্যরকম।

‘ওহ্, অনেকদিন এমন হাসিনি’, ছাতা আর ব্যাগ নিয়ে ভারেঙ্কা বলল, ‘কি সুন্দর লোক আপনার বাবা!’ কিটি চুপ করে রইল।

‘আবার কখন দেখা হবে?’ জিজ্ঞেস করল ভারেঙ্কা।

‘মা পেত্রভদের ওখানে যাবে ভাবছিল। আপনি থাকবেন সেখানে?’ ভারেঙ্কাকে একটু বাজিয়ে দেখবার জন্য কিটি বলল।

‘থাকব’, ভারেঙ্কা বলল, ‘ওরা চলে যাবার তোড়জোড় করছে। আমি কথা দিয়েছি যে বাঁধাছাঁদায় সাহায্য করব।’

‘তাহলে আমিও যাব।’

‘না-না, আপনি কেন?’

‘কেন নয়? কেন নয়? কেন নয়?’ চোখ বড় বড় করে বলল কিটি ভারেঙ্কাকে যেতে না দিয়ে তার ছাড়া চেপে ধরল, ‘না-না, একটু দাঁড়ান, কেন নয়?

‘এমনি; আপনার বাবা এসেছেন। তাছাড়া আপনার সামনে ওঁরা সংকোচ বোধ করেন।’

‘না, আপনি বলুন, কেন আপনি চান না যে পেত্রভদের ওখানে আমি ঘনঘন যাই। আপনি সেটা চান না তো? কেন?’

ভারেঙ্কা শান্তভাবে বলল, ‘আমি তো তা বলিনি।’

‘না, বলুন দয়া করে!’

ভারেঙ্কা বলল, ‘সব বলব?’

‘সব, সব!’

‘বলার বিশেষ কিছু নেই, শুধু এই যে মিখাইল আলেক্সেয়েভিচ (এটি চিত্রকরের নাম) আগে তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু এখন যেতে চাইছেন না’, হেসে বলল ভারেঙ্কা।

‘তারপর! তারপর!’ বিষণ্নভাবে ভারেঙ্কার দিকে তাকিয়ে কিটি তাড়া দিল।

‘মানে, কেন জানি আন্না পাভলোভনা বলছিলেন যে উনি যেতে চাইছেন না কারণ আপনি এখানে আছেন। অবশ্য এটা বলা সঙ্গত হয়নি, কিন্তু এই নিয়ে, আপনাকে নিয়ে ঝগড়া বাঁধে। আর জানেনই তো, রোগীরা কেমন খিটখিটে হয়।’

কিটি আরও বেশি ভ্রূকুটি করে চুপ করে রইল আর ভারেঙ্কা একাই কথা বলে গেল, চেষ্টা করল তাকে নরম, শান্ত করে আনতে, দেখতে পাচ্ছিল যে কিটি ফেটে পড়তে যাচ্ছে, তবে জানত না সেটা কান্নায় নাকি কথায়।

‘তাই আপনার না যাওয়াই বরং ভালো…আপনি বুঝে দেখুন, রাগ করবেন না…’

‘আমার ঠিকই হয়েছে, ঠিকই হয়েছে!’ ভারেঙ্কার হাত থেকে ছাতটা কেড়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে বলল কিটি, তাকিয়ে রইল বন্ধুর চোখ এড়িয়ে।

বান্ধবীর ছেলেমানুষি রাগ থেকে হাসি পেয়েছিল ভারেঙ্কার, কিন্তু ভর হল ওর মনে ঘা লাগবে। বলল, ঠিক হয়েছে মানে? আমি বুঝতে পারছি না।’

‘ঠিক হয়েছে কারণ এ সবই ছিল ভান, প্রাণ থেকে নয়, ভেবেচিন্তে করা। যে লোকটা আপন নয়, পর, তার জন্যে কি দায় ঠেকেছিল আমার? আর এখন দাঁড়াল যে ঝগড়ার কারণ হলাম আমি, আমাকে যা করতে বলা হয়নি, তাই আমি করেছি। এ জন্যে যে এ সবই ভান! ভান করার?’ আস্তে করে বলল ভারেঙ্কা।

ইস, কি বোকামি, কি নোংরামি! আমার তো কোনই দরকার ছিল না… সব ভান!’ ছাতাটা খুলতে খুলতে আর বন্ধ করতে করতে কিটি বলল।

‘কিন্তু কি উদ্দেশ্য?’

‘লোকের কাছে, নিজের কাছে, সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে ভালো বলে দেখাবার জন্যে, সবাইকে প্রতারিত করার জন্যে। না, এখন আর আমি ওদিকে যাচ্ছি না! খারাপ হব, কিন্তু অন্ততপক্ষে মিথ্যাচারী হব না, প্রতারক হব না!’

‘প্রতারক আবার কে?’ ভর্ৎসনার সুরে বলল ভারেঙ্কা, ‘আপনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন…’ কিন্তু ক্ষিপ্ততার দমক পেয়ে বসেছিল কিটিকে, ভারেঙ্কাকে সে কথা শেষ করতে দিল না।

‘আমি আপনার কথা বলছি না, মোটেই আপনার কথা নয়। আপনি নিখুঁত। হ্যাঁ, আমি জানি যে আপনি একেবারে নিখুঁত। কিন্তু কি করা যাবে যদি আমি খারাপ হয়ে থাকি? আমি খারাপ না হলে এটা ঘটত না। বেশ, আমি যা তাই হই, কিন্তু ভান করব না। আন্না পাভলোভনাকে নিয়ে কি আমার দায়! ওরা যেমন চায় তেমনি থাকুক, আমিও থাকব যেমন চাই। আমি তো আর অন্য লোক হয়ে যেতে পারি না… এ কিছুই তা নয়, তা নয়!…’

‘কিন্তু কি তা নয়?’ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল ভারেঙ্কা।

‘সব কিছুই তা নয়। আমি প্রাণের তাগিদে ছাড়া অন্য কোনভাবে চলতে পারি না, আর আপনি চলেন নীতি মেনে। আমি আপনাকে ভালোবেসেছিলাম স্রেফ এমনি, আর আপনি আমাকে ভালোবেসেছেন আমাকে বাঁচাবার জন্যে, আমাকে শিখিয়ে তোলার জন্যে!

ভারেঙ্কা বলল, ‘আপনি আমার ওপর অন্যায় করছেন।’

‘অন্যের সম্পর্কে আমি কিছুই বলছি না, বলছি নিজের সম্পর্কে।’

‘কিটি!’ শোনা গেল মায়ের গলা, ‘বাবাকে তোর প্রবালগুলো দেখা।’

বন্ধুর সাথে মিটমাট না করে গর্বিত ভঙ্গিতে কিটি টেবিলের ওপর প্রবালের বাক্সটা নিয়ে চলে গেল মায়ের কাছে। ‘কি হল তোর? এত লাল হয়ে উঠেছিস?’ মা-বাবা দুজনেই একসাথে বলে উঠলেন।

কিটি বলল, ‘ও কিছু না। আমি এখুনি আসছি’, এই বলে যেখান থেকে এসেছিল, ছুটে গেল সেদিকেই। ভাবছিল, ‘এখনও ও এখানে! হায় সৃষ্টিকর্তা! কি বলব ওকে? কি করলাম আমি, কি বললাম! কিসের জন্যে মনে ঘা দিলাম ওর কি করি আমি? কি বলব ওকে?’ এই ভেবে দরজার কাছে থেমে গেল কিটি।

টুটি পরে ছাতা হাতে টেবিলের কাছে বসে ছিল ভারেঙ্কা, কিটি যে স্প্রিটা ভেঙে ফেলেছে, দেখছিল সেটাকে। মাথা তুলল সে।

‘ভারেঙ্কা, ক্ষমা করুন আমাকে, ক্ষমা করুন!’ তার কাছে গিয়ে কিটি বলল ফিসফিসিয়ে, ‘কি যে বলেছি কিছু মনে নেই আমার। আমি…’

ভারেঙ্কা হেসে বলল, ‘সত্যি, আপনার মনে দুঃখ দেবার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না।’

সবই মিটমাট হয়ে গেল। কিন্তু যে জগৎটায় কিটি দিন কাটাচ্ছিল, পিতা আসার পর বদলে গেল তার সবটুকুই। যা কিছু সে শিখেছিল, তা সবই যে সে বর্জন করল তা নয়, কিন্তু বুঝতে পারল যে যা সে হতে চায় তা হতে পারবে বলে ভেবে সে আত্মপ্রতারণা করেছে। যেন সম্বিত ফিরল তার; যে উঁচুতে সে উঠত চেয়েছিল ভান বা বড়াই না করে তাতে টিকে থাকার সমস্ত দুরূহতা টের পেল সে; তাছাড়া দুঃখ, ব্যাধি, মৃত্যুর যে জগৎটায় সে ছিল, অনুভব করছিল তার সমস্ত দুঃসহতা, একটাকে ভালোবাসার জন্য সে যে শক্তি প্রয়োগ করছিল, সেটা যন্ত্রণাকর লাগল তার কাছে। ইচ্ছে হল, যত তাড়াতাড়ি পারে চলে যায় তাজা হাওয়ায়, রাশিয়ায়, এগুশোভোতে, সেখানে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তার বোন চলে গেছে বলে সে চিঠিতে জেনেছে।

কিন্তু ভারেঙ্কার জন্য তার ভালোবাসা হ্রাস পেল না। বিদায় নেবার সময় কিটি অনুরোধ করল সে যেন রাশিয়ার আসে তাঁদের কাছে।

ভারেঙ্কা বলল, যাব যখন আপনি বিয়ে করবেন।’

‘আমি কখনো বিয়ে করব না।’

‘তাহলে আমি কখনও যাব না।’

‘বেশ, তাহলে এর জন্যেই বিয়ে কবর আমি। দেখবেন, যে কথা দিলেন, মনে রাখবেন!’ কিটি বলল।

যে ভবিষ্যদ্বাণী ডাক্তার করেছিলেন তা ফলে গেল। কিটি রাশিয়ায় বাড়ি ফিরল আরোগ্যলাভ করে। আগের মত নিশ্চিত আর হাসি-খুশি সে হয়ে উঠল না বটে, তবে মনের শান্তি ফিরল। তার কাছে মস্কোর দুঃখটা শুধু স্মৃতি হয়ে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *