পঁচিশ
আলেক্সেই আলেক্সান্দ্রভিচ কারেনিন যখন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার পুরানো সব চিনেমাটির পাত্র সাজানো, দেয়ালে পোর্ট্রেট টাঙ্গানো আরামপ্রদ স্টাডিটায় ঢুকলেন, গৃহকর্ত্রী তখন সেখানে ছিলেন না। তিনি পোশাক বদলাচ্ছিলেন।
গোল একটা টেবিলের ওপর টেবিলক্লথ পাতা, তার ওপর চীনা টী-সেট আর স্পিরিটে গরম করার একটা রূপালী কেটলি। স্টাডির শোভাবর্ধক পরিচিতদের অসংখ্য পোর্ট্রেটগুলোর দিকে কারেনিন চাইলেন অন্যমনস্কের মত, তারপর একটা টেবিলের কাছে সেখানে রাখা একটা বাইবেল খুললেন। কাউন্টেসের সিল্ক গাউনের মর্মরে তিনি সজাগ হলেন।
‘এখন আমরা শান্তিতে বসতে পারি’, কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা বললেন বিচলিত হাসিমুখে, তাড়াতাড়ি করে সেঁধলেন টেবিল আর সোফার মাঝখানে, ‘চা খেতে খেতে কথা বলা যাবে।’
উপক্রমণিকাস্বরূপ গোটাকত কথার পর কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাল হয়ে তাঁর পাওয়া চিঠিটা দিলেন কারেনিনের হাতে।
চিঠি পড়ে তিনি চুপ করে রইলেন অনেকক্ষণ।
‘আমি মনে মরি না যে আপত্তি করার অধিকার আছে আমার’, চোখ তুলে ভীরু ভীরু গলায় বললেন তিনি।
‘বন্ধু আমার! কারোর মধ্যেই কু কিছু আপনি দেখেন না!’
‘উল্টে বরং, আমি দেখি সবকিছুই কু। কিন্তু ওটা কি ন্যায্য হবে?’
মুখে তাঁর অনিশ্চিতি এবং তাঁর কাছে দুর্বোধ্য একটা ব্যাপারে পরামর্শ, অবলম্বন এবং নির্দেশ ভিক্ষা।
‘না’, ওঁকে বাধা দিলেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা, ‘সবকিছুরই একটা সীমা আছে। দুর্নীতিটা আমি বুঝি, কথাটা বললেন সম্পূর্ণ অকপটে নয়, কেননা নারীকে দুর্নীতিতে ঠেলে দেয় কিসে সেটা তিনি কখনো বুঝতে পারেননি, ‘কিন্তু নিষ্ঠুরতাটা আমি বুঝি না—আর সেটা কার প্রতি? আপনার প্রতি! যে শহরে আপনি রয়েছেন সেখানে থাকা যায় কিভাবে? যতদিন বাঁচা, ততদিন শেখা। আমিও আপনার মহত্ত্ব আর ওর নীচতা বুঝতে শিখছি।’
‘কিন্তু ঢিলটা ছুড়বে কে? কারেনিন বললেন স্পষ্টতই নিজের ভূমিকায় প্রীতিলাভ করে, ‘আমি সবকিছু ক্ষমা করেছি, তাই যেটা ওর কাছে ভালোবাসার দাবি—পুত্রস্নেহ… তা থেকে ওকে বঞ্চিত করতে পারি না।’
‘কিন্তু এটা কি ভালোবাসা, বন্ধু আমার? এটা কি আন্তরিক? ধরে নিচ্ছি আপনি ক্ষমা করেছেন, করছেন… কিন্তু ওই দেবশিশুটির অন্তর আলোড়িত করার অধিকার আছে কি আমাদের? ওর ধারণা মা মারা গেছে। ওর জন্য সে প্রার্থনা করে, তার পাপ ক্ষমা করতে বলে সৃষ্টিকর্তাকে… আর সেটাই ভালো। কিন্তু এখন কি সে ভাববে?’
‘এটা আমি ভাবিনি’, কারেনিন বললেন স্পষ্টতই কথাটায় সায় দিয়ে।
কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে চুপ করে রইলেন। প্রার্থনা করছিলেন তিনি।
প্রার্থনা শেষ করে মুখ থেকে হাত সরিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনি যদি আমার পরামর্শ চান, তাহলে ওটা আমি আপনাকে করতে বলব না। আমি কি দেখতে পাচ্ছি না কি কষ্ট হচ্ছে আপনার, কিভাবে আপনার ক্ষতমুখ খুলে দিয়েছে এটা? কিন্তু ধরা যাক আপনি বরাবরের মতই নিজের কথা ভুলে যাচ্ছেন। কিন্তু তার ফল হবে কি? আপনার নতুন যন্ত্রণা, শিশুটির কষ্ট, তাই তো? ওর মধ্যে মানুষিক কিছু যদি থেকে থাকে, তাহলে নিজেই এটা ও চাইত না। না, আমি দ্বিধা করব না, ও পরামর্শ দেব না, আর যদি আপনি অনুমতি দেন, তাহলে ওকে চিঠি লিখব আমি।’ কারেনিন রাজি হলেন। এবং কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা ফরাসি ভাষায় লিখলেন নিচের এই চিঠি।
‘মহাশয়া,
আপনার কথা মনে করিয়ে দিলে আপনার ছেলের কাছ থেকে কিছু প্রশ্ন আসবে, শিশুটির কাছে যা পবিত্র থাকা উচিত তার প্রতি একটা ধিক্কারের মনোভাব তার প্রাণ বপন না করে সে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া চলে না, তাই আপনার স্বামীর প্রত্যাখ্যানকে খ্রিস্টীয় প্রেমের প্রেরণায় গ্রহণ করতে অনুরোধ করি। আপনার জন্য করুণা মাগছি পরমেশ্বরের কাছে।
কাউন্টেস লিদিয়া’
যে গোপন উদ্দেশ্য কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা নিজের কাছেই লুকিয়ে রেখেছিলেন তা সিদ্ধ হল চিঠিটায়। আন্নাকে তা মর্মান্তিক আঘাত দিয়েছিল।
কারেনিনের বেলায় ঘটল এই যে লিদিয়া ইভানোভনার ওখান থেকে বাড়ি ফিরে সেদিন তিনি তাঁর সচরাচর কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারলেন না, ধর্মপ্রাণ মোক্ষপ্রাপ্ত মানুষের যে চিত্তশান্তি তিনি আগে অনুভব করতেন, খুঁজে পেলেন না সেটা।
যে স্ত্রী তাঁর কাছে অত বেশি অপরাধী, এবং যার তুলনায় কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা তাঁকে ন্যায্যতই বলেন সাধুতুল্য, তার স্মরণোপলক্ষে তাঁর বিচলিত হবার কথা নয়; কিন্তু শান্তি পাচ্ছিলেন না তিনি : যে বইটা তিনি পড়ছিলেন তা বোধগম্য হচ্ছিল না তাঁর, স্ত্রীর সাথে তাঁর সম্পর্কের স্মৃতি, এখন তাঁর যা মনে হল, তার প্রসঙ্গে যে ভুলগুলো তিনি করেছেন তার যন্ত্রণাকর স্মৃতি তাড়াতে পারছিলেন না মন থেকে। বিশেষ করে ঘোড়দৌড় থেকে বাড়ি ফেরার পথে তার বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকৃতি তিনি কিভাবে নিয়েছিলেন (বিশেষত, তিনি যে ওর কাছ থেকে একটা বাহু শোভনতা দাবি করেছিলেন, ডুয়েল লড়তে চাননি), এই স্মৃতিটা অনুশোচনার মত দগ্ধাচ্ছিল তাঁকে। সমান দগ্ধাচ্ছিল ওকে যে চিঠিটা তিনি লিখেছিলেন সেটা মনে পড়ায়; বিশেষ করে তাঁর যে ক্ষমায় কারো প্রয়োজন নেই, অপরের সন্তানের জন্য তাঁর যে যত্ন, সে স্মৃতিটা লজ্জায় আর অনুশোচনায় পুড়িয়ে দিচ্ছিল তাঁর হৃদয়।
ওর সমস্ত আগের সম্পর্কটা এখন মনে মনে নাড়াচাড়া করে এবং বহু দ্বিধার পর যেরকম আনাড়ি কথায় তিনি ওর পাণিপ্রার্থনা করেছিলেন সেটা মনে হতে একই রকম লজ্জা ও অনুশোচনা হচ্ছিল তাঁর।
‘কিন্তু আমার কি দোষ?’ নিজেকে বলছিলেন তিনি, আর এই প্রশ্নটার সাথে সাথে সব সময় আরেকটা প্রশ্নের উদয় হত, যথা : এসব ভ্রন্স্কি, অব্লোন্স্কিয়া… পায়ের মোটা ডিমওয়ালা এসব কামেরহেররা কি বোধ করে অন্যভাবে, ভালোবাসে অন্যভাবে, বিয়ে করে অন্যভাবে? তাঁর মনে ভেসে উঠল পুরো একসারি এসব সুপুষ্ট সবল, অসন্দিগ্ধ লোকদের ছবি যারা সব সময় ও সর্বত্র অজ্ঞাতসারে তাঁর কৌতূহলী মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। মন থেকে এসব ভাবনা তাড়াতে চাইলেন তিনি, নিজেকে বোঝাতে চাইলেন যে তিনি বেঁচে আছেন ইহলোকের সাময়িক জীবনের জন্য নয়, শাশ্বতের জন্য, অন্তরে তাঁর শান্তি ও প্রেম বিরাজমান। কিন্তু এই সাময়িক, অকিঞ্চিৎকর জীবনে তিনি যে কতকগুলি, তাঁর যা মনে হচ্ছিল, অকিঞ্চিৎকর ভুল করেছেন, সেটা তাঁকে এমন দগ্ধাচ্ছিল যেন যে শাশ্বত মোক্ষে তাঁর বিশ্বাস সেটা বুঝি নেই। কিন্তু এই প্রলোভনটা দীর্ঘস্থায়ী হল না, অচিরেই কারেনিনের অন্তরে আবার ফিরে এল সেই প্রশান্তি ও উত্তুঙ্গতাবোধ যার কল্যাণে তিনি যা স্মরণ করতে চান না তা ভুলতে পারেন।
ছাব্বিশ
‘কেমন, কাপিতোনিচ?’ জিজ্ঞেস করল সেরিওজা, জন্মদিনের আগে সে বেরিয়ে ফিরল ফুর্তিতে, গাল রাঙা করে। নিজের ওভারকোট দিচ্ছিল সে পুরনো, ঢ্যাঙা হল-পোর্টারকে যে হাসছিল তার উচ্চতা থেকে ছোট্ট মানুষটার উদ্দেশে। ‘ব্যান্ডেজ-বাঁধা কেরানিটা এসেছিল আজ? বাবা দেখা করেন?’
‘করেন’, আমোদে চোখ মটকে বলল পোর্টার, ‘সেক্রেটারি সাহেব বেরিয়ে যেতেই আমিই খবর দিই। দিন গো, আমি খুলে দিচ্ছি।’
‘সেরিওজা!’ ভেতরকার কামরায় যাবার দরজায় থেমে গিয়ে বলল স্লাভ দেশীয় গৃহশিক্ষকটি, ‘নিজেই কোট খোলো।’
শিক্ষকের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর সেরিওজার কানে গেলেও সে তাতে ভ্রূক্ষেপ করল না। পোর্টারের কোমরবন্ধ ধরে তার মুখের দিকে সে চেয়ে রইল।
‘যা দরকার বাবা সেটা করলেন ওর জন্য?’
সায় দিয়ে মাথা নাড়লে পোর্টার।
ব্যান্ডেজ-বাঁধা যে কেরানিটি কারেনিনের কাছে কিসের যেন প্রার্থী হয়ে আসছে এই সাত বার, তার সম্পর্কে সেরিওজা আর পোর্টার দুজনেই উৎসুক হয়ে উঠেছিল। একবার সেরিওজা তাকে দেখে প্রবেশমুখে, পোর্টারের কাছে করুণভাবে মিনতি করছিল যেন তার খবর দেওয়া হয়, ছেলেমেয়ে নিয়ে মরতে বসেছে।
সেই থেকে তাকে আরো একবার দেখে সেরিওজা আগ্রহী হয়ে ওঠে তার সম্পর্কে
জিজ্ঞেস করল, ‘তা খুশি হয়েছিল তো?’
‘খুশি আবার হবে না! প্রায় লাফাতে লাফাতে যায় এখান থেকে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সেরিওজা শুধাল, ‘কেউ কিছু এনেছে?
‘হ্যাঁ খোকাবাবু’, মাথা নেড়ে ফিসফিসিয়ে পোর্টার বলল, ‘এনেছে, কাউন্টেসের কাছ থেকে।’
সেরিওজা তক্ষুণি বুঝল কি বলতে চাইছে পোর্টার, তার জন্মদিন উপলক্ষে উপহার পাঠিয়েছেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা।
‘কি বলছ? কোথায় সেটা?’
‘কর্নেই নিয়ে গেছে বাবার কাছে। খাসা জিনিসই হওয়ার কথা!’
‘কত বড় জিনিস? এতটা?’
‘সামান্য ছোট। তবে ভালো জিনিস।’
‘বই?’
‘না, কোনো একটা জিনিস। যান, যান, ভাসিলি লুকিচ ডাকছেন’, গৃহশিক্ষকের পদশব্দ এগিয়ে আসতে শুনে তার কোমরবন্ধ ধরে থাকা দস্তানা থেকে আধ-খসা সেরিওজার হাতখানা সাবধানে খসিয়ে পোর্টার চোখ মটকে মাথা নেড়ে দেখাল ভুনিচের দিকে।
‘ভাসিলি লুচি, শুধু এক মিনিট বাদে!’ সেরিওজা বলল তার সেই ফুর্তিবাজ, ভালোবাসার হাসি হেসে যা সব সময় জয় করে নিয়েছে যত্নশীল ভাসিলি লুচিকে।
সেরিওজার এত ফুর্তি লাগছিল, সবকিছু এমন সুখময় মনে হচ্ছিল যে বন্ধু পোর্টারকে তাদের পারিবারিক আনন্দের খবরটা না দিয়ে সে পারছিল না, গ্রীষ্মোদ্যানে বেড়াবার সময় যা সে শুনেছে কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার বোনঝির কাছ থেকে। এই কেরানির জন্য আনন্দ আর সে যে খেলনা পেতে যাচ্ছে তার আনন্দের সাথে ঐ পারিবারিক আনন্দটা মিলে যাওয়ায় সেটা তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সেরিওজার মনে হচ্ছিল আজ এমন দিন যখন সকলেরই আনন্দ আর ফুর্তি হওয়ার কথা।
‘জানো, বাবা আলেক্সান্দর নেভস্কি অর্ডার পেয়েছে?’
‘জানব না কেন? লোকেরা এসেছিল অভিনন্দন জানাতে।’
‘কি, উনি খুশি হয়েছেন?’
‘জারের অনুগ্রহে খুশি আবার না হয়! তার মানে যোগ্যতা দেখিয়েছেন’, পোর্টার বলল কঠোর স্বরে, গুরুগম্ভীর ভাব করে।
সেরিওজা চিন্তামগ্ন হয়ে তাকাল সমস্ত খুঁটিনাটিতে তন্নতন্ন করে দেখা পোর্টারের মুখ, বিশেষ করে পেয়ে যাওয়া দুই জুলপির মাঝখানে ঝুলন্ত থুতনির দিকে যা আর কেউ দেখেনি সেরিওজা ছাড়া যে সব সময় নিচু থেকে ওটা লক্ষ করেছে।
‘তোমার মেয়ে তোমার কাছে অনেক দিন আসেনি?’
পোর্টারের মেয়ে ব্যালে নর্তকী।
‘নিত্য আসার সময় কোথায়? ওদেরও তো অনুশীলন থাকে। আপনারও অনুশীলন আছে খোকাবাবু, যান।’
ঘরে ঢুকে পড়তে বসার বদলে সেরিওজা শিক্ষককে তার এই অনুমানটা জানাল যে উপহারটা নিশ্চয়ই কোন যন্ত্র। ‘আপনি কি মনে করেন?’ জিজ্ঞেস করল সে।
কিন্তু ভাসিলি লুকিচ ভাবছিল কেবল এই যে ওর ব্যাকরণ পড়া দরকার, শিক্ষক আসবেন দুটোর সময়।
‘আচ্ছা, আমাকে বলুন-না ভাসিলি লুকিচ’, হাতে বই নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল সেরিওজা, ‘আলেক্সান্দ নেভস্কি অর্ডারের চেয়ে বড় অর্ডার কি আছে? জানেন তো হবাবা আলেক্সান্দর নেভস্কি অর্ডার পেয়েছেন?’
ভাসিলি লুকিচ বলল যে নেভস্কির চেয়ে বড় হল ভ্লাদিমির।
‘আর তার চেয়ে বড়?’
‘সবার বড় আন্দ্রেই পের্ভোল্ভান্নি।’
‘আর আন্দ্রেইয়ের চেয়ে বড়?’
‘আমি জানি না।’
‘সে কি, আপনি জানেন না মানে?’ কনুইয়ে ভর দিয়ে সেরিওজা ভাবনায় ডুবে গেল।
ভাবনাগুলো তার অতি জটিল এবং রকমারি। সে কল্পনা করল যে বাবা তার হঠাৎ ভ্লাদিমির আর আন্দ্রেই দুই- ই পেয়ে গেছেন আর তার ফলে পাঠে আজ তিনি হবেন অনেক বেশি সদয় আর বড় হয়ে সে নিজেও পাবে সমস্ত অর্ডারই, সেটাও যা হবে আন্দ্রেইয়ের চেয়েও বড়। অর্ডার ভেবে বার করতেই সে হয়ে যাবে তা পাবার যোগ্য। আরো বড় একটা ভেবে বার করুক, অমনি সে তার যোগ্য।
এই ধরনের ভাবনাচিন্তায় সময় কেটে গেল। শিক্ষক যখন এলেন ‘ক্রিয়া বিশেষণের স্থান, কাল ও ধরন’ তখনো শেখা হয়নি। শিক্ষক শুধু অসন্তুষ্ট নন, দুঃখিতই হলেন। এই দুঃখটা সেরিওজাকে বিচলিত করল। তার মনে হচ্ছিল, পড়া যে করেনি তার জন্য তার দোষ কিছু নেই; যত চেষ্টাই সে করুক পড়া সে কিছুতেই করতে পারছিল না : শিক্ষক যতক্ষণ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, ততক্ষণ তার মনে হচ্ছিল সে যেন বুঝতে পারছে, কিন্তু যেই সে একা একা ভাবতে যাচ্ছিল, তখন কিছুতেই মনে করতে আর বুঝতে পারছিল না কেন অমন ছোট্ট আর বোধগম্য একটা শব্দ ‘হঠাৎ’-কে হতে হল ক্রিয়া বিশেষণের ধরন। তাহলেও শিক্ষক দুঃখ পেয়েছেন তার জন্য কষ্ট হচ্ছিল তার, ইচ্ছে হচ্ছিল তাঁকে সান্ত্বনা দিতে।
শিক্ষক যখন চুপ করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, সেই মুহূর্তটার সুযোগ নিলে সে।
হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা মিখাইল ইভানিচ, আপনার জন্মদিন কবে?
‘আপনি বরং নিজের কাজ নিয়ে ভাবলে পারতেন, বুদ্ধিমান জীবের কাছে কোনই মানে নেই জন্মাদনের। অন্যান্য যে সব দিনে কাজ করতে হয়, ওটা তারই মত একটা দিন।’
তাঁর দিকে, তাঁর পাতলা দাড়ি, যে চশমাটা নাকের খাঁজ থেকে খসে এসেছে ডগায়, তার দিকে মন দিয়ে তাকিয়ে দেখে সেরিওজা ডুবে গেল ভাবনায়, ফলে শিক্ষক যা বোঝাচ্ছিলেন, কিছুই তার কানে ঢুকল না। সে বুঝতে পারছিল যে শিক্ষক যা বলছেন, ভাবছেন না তা নিয়ে, যে সুরে কথাগুলো বলা হচ্ছিল, তা থেকে সে টের পাচ্ছিল এটা। ‘কিন্তু সবাই কেন ঠিক করে নিয়েছে ওরা কথা কইবে একই ঢঙে, সবকিছু বিষয়ে, যা ভারি একঘেয়ে, বেদরকারি? কেন উনি ঠেলে সরিয়ে দেন আমাকে, ভালোবাসেন না?’ সখেদে সে জিজ্ঞেস করলে নিজেকে আর ভেবে পেল না উত্তর।
সাতাশ
শিক্ষকের পর পিতার নিকট পাঠ। তিনি না আসা পর্যন্ত সেরিওজা একটা ছুরি নিয়ে খেলা করতে করতে ভাবতে থাকল। তার মনের মত একটা কাজ ছিল বেড়াতে গিয়ে মাকে খোঁজা। সাধারণভাবেই মরণে তার বিশ্বাস ছিল না, বিশেষ করে মায়ের মরণে, যদিও লিদিয়া ইভানোভনা তাকে সেই কথাই বলেছেন এবং বাবা তা সমর্থনও করেছেন কিন্তু মা মারা গেছেন তাকে এ কথা বলার পর এবং বলেছেন বলেই সে বেড়াবার সময় খুঁজে বেড়াত তাঁকে। পুষ্টদেহী, লাবণ্যময়ী, কৃষ্ণকেশী প্রতিটি নারীই ছিল তার মা। এমন নারী দেখতে পেলে মন তার কোমলতায় এত ভরে উঠত যে দম বন্ধ হয়ে আসত, পানি উথলে উঠত চোখে। এই বুঝি উনি তার কাছে এসে মুখাবগুণ্ঠন তুলবেন বলে অপেক্ষা করত সে। দেখা যাবে তাঁর গোটা মুখখানা, হাসছেন তিনি, জড়িত ধরছেন তাকে, তাঁর সুরভি পাচ্ছে সে, অনুভব করছে তাঁর বাহুর কোমলতা, সুখে কেঁদে ফেলবে সে, যেমন একবার ছিল সে তাঁর পায়ের কাছে লুটিয়ে, সুড়সুড়ি দিচ্ছিলেন তিনি, আর হিহি করে হেসে সে কামড় দিচ্ছিল তাঁর আংটি পরা সাদা হাতে। পরে যখন সে ধাই-মার কাছে দৈবাৎ শুনল যে মা তার মরেননি, তার কাছে উনি মরা বলে পিতা আর লিদিয়া ইভানোভনা বুঝিয়েছেন, কারণ মা খারাপ লোক (এটা সে কখনো বুঝতে পারত না, কারণ ভালোবাসত তাঁকে), তখনো তো একইভাবে খুঁজত তাঁকে, প্রতীক্ষা করত তাঁর। আজ গ্রীষ্মোদ্যানে বেগুনি মুখাবগুণ্ঠন ঝোলানো একটি নারীকে সে দেখেছিল, উনিই মা, দুরুদুরু বুকে এই আশা করে তাঁকে লক্ষ করছিল যে, যখন মহিলাটি হাঁটা পথ ধরে আসছিলেন তার দিকে। তবে তিনি সেরিওজার কাছ পর্যন্ত না এসে কোথায় যেন চলে গেলেন। মায়ের প্রতি ভালোবাসার যে জোয়ার সেরিওজা আজ অনুভব করেছিল তা আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রবল। আর এখন পিতার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আত্মভোলা হয়ে ছুরি দিয়ে কাটছিল টেবিলের কিনারা আর জ্বলজ্বলে চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল মায়ের কথা।
‘বাবা আসছেন!’ তাকে সচেতন করে দিলেন ভাসিলি লুচি।
লাফিয়ে উঠল সেরিওজা, পিতার কাছে গিয়ে তাঁর হস্তচুম্বন করলে, মন দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আলেক্সান্দর নেভস্কি অর্ডার পাওয়ায় তাঁর মধ্যে আনন্দের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা খুঁজলে।
‘ভালো বেড়িয়েছিলে তো?’ নিজের ইজি-চেয়ারে বসে বললেন কারেনিন, প্রাচীন অনুশাসন বইখানা টেনে নিয়ে খুললেন। পবিত্র ইতিবৃত্ত প্রতিটি খ্রিস্টানের ভালো জানা থাকা উচিত, সেরিওজাকে কারেনিন এ কথা বারম্বার বললেও নিজে তিনি প্রাচীন অনুশাসন বিষয়ে বলতে গিয়ে বই দেখতেন প্রায়ই আর সেটা নজরে পড়েছিল সেরিওজার।
‘খুব ভালো বাবা’, সেরিওজা বলল চেয়ারে পাশকে ভাবে বসে এবং সেটা দোলাতে দোলাতে, এটা বারণ। ‘নাদেঙ্কার সাথে দেখা হয়েছিল’, (নাদেঙ্কা হল লিদিয়া ইভানোভনার পালিতা তাঁর বোনঝি)। ‘সে বলল, আপনি নতুন তারকা পেয়েছেন। আপনি খুশি হয়েছেন বাবা?’
‘প্রথমত দোলন বন্ধ কর বাপু’, কারেনিন বললেন, ‘দ্বিতীয়ত, পুরস্কারটা নয়, শ্রমই মূল্যবান। আমি চাই যে তুমিও যেন সেটা বোঝো। আর তুমি যদি খাটো, পড়াশুনা কর পুরস্কার পাবার জন্য, তাহলে সে খাটুনিটা মনে হবে একটা বোঝা; কিন্তু তুমি যদি খাটুনিকে ভালোবেসে খাটো’, আজ সকালে একশ আশিখানা কাগজ সই করার বিরক্তিকর খাটুনিতে তিনি বুক বেঁধে ছিলেন নিজের কর্তব্যবোধে, সে কথা মনে হতে বললেন কারেনিন, তাহলে ওই খাটুনিতেই তুমি পুরস্কার পাবে নিজের।’
কোমলতা আর আনন্দে উজ্জ্বল সেরিওজার চোখ ম্লান হয়ে গেল, বাপের দৃষ্টির সামনে সে চোখ নামিয়ে নিলে। এটা সেই পরিচিত সুর যাতে পিতা সব সময় কথা বলতেন তার সাথে, আর সেরিওজাও তা মেনে নিতে শিখে গিয়েছিল। সেরিওজার মনে হত পিতা তার সাথে কথা বলছেন যেন তাঁর কল্পিত এক বালকের উদ্দেশে, বইয়ে যাদের কথা থাকে তেমন একজন, কিন্তু মোটেই যে সেরিওজার মত নয়। আর পিতার কাছে সেরিওজাও সব সময় এই পুস্তকস্থ বালকের কৃত্রিম ভূমিকা নেবার চেষ্টা করত।
‘তুমি এটা বুঝতে পারছ আশা করি?’ বললেন পিতা
‘হ্যাঁ বাবা’, সেরিওজা বলল কল্পিত বালকটির ভূমিকা নিয়ে।
পাঠকটা ছিল বাইবেলের কয়েকটা শ্লোক মুখস্থ করা এবং প্রাচীন অনুশাসনের শুরুটার পুনরাবৃত্তি করা নিয়ে। বাইবেলের শ্লোক সেরিওজা ভালোই জানত, কিন্তু শ্লোক যখন সে বলছিল, তখন রগের দিকে খাড়া বেঁকে যাওয়া বাপের কপালের হাড়ের দিকে নজর পড়ে তার, ফলে তার গোলমাল হয়ে যায়, একটা শ্লোকের শেষ সে একই শব্দে জুড়ে দেয় অন্য শ্লোকের গোড়ায়। কারেনিনের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে সেরিওজা যা বলছে সেটা ও বোঝেনি, এতে বিরক্তি ধরল তাঁর।
মুখ গোমড়া করে তিনি সেরিওজাকে যা বোঝাতে শুরু করলেন সেটা সে শুনেছে বহুবার, কিন্তু কখনো মনে রাখতে পারেনি, কেননা তা বুঝতে পারত সে পরিষ্কার, ‘হঠাৎ’ যেমন করে হয় ক্রিয়া বিশেষণের ধরন, তেমনি। ভীত চোখে সে তাকাল পিতার দিকে, ভাবল শুধু একটা কথাই : আগে মাঝে মাঝে যা হয়েছে পিতা যা বললেন সেটা তাকে দিয়ে আবার পুনরাবৃত্তি করাবেন কিনা; সেটা ভেবে তার এত ভয় হল যে কিছু আর তার মাথায় ঢুকছিল না। কিন্তু পুনরাবৃত্তি করতে তিনি বললেন না, প্রাচীন অনুশাসনের পাঠে চলে এলেন। ঘটনাগুলো সেরিওজা বলল ভালোই, কিন্তু কিছু ঘটনা কিসের পূর্বসূচনা দিয়েছে এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে দেখল কিছুই সে জানে না, যদিও এর জন্য আগেও সে শাস্তি পেয়েছে। যে জায়গাটায় সে কিছুই বলতে না পেরে কাঁচুমাচু খাচ্ছিল, টেবিল চাচচ্ছিল, চেয়ারে দুলছিল, সেটা মহাপ্লাবনের আগেকার পয়গম্বরদের নিয়ে। তাঁদের মধ্যে এনখ ছাড়া আর কারো কথা সে জানত না, যিনি নাকি সশরীরে স্বর্গে গিয়েছিলেন। আগে নামগুলো তার মনে ছিল, কিন্তু এখন একেবারে সেগুলো মুছে গেল মন থেকে, বিশেষ করে এই জন্য যে গোটা প্রাচীন অনুশাসন গ্রন্থের মধ্যে এনখ ছিল তার প্রিয় চরিত্র, আর পিতার ঘড়ির চেন আর আধ-খোলা ওয়েস্ট-কোটের দিকে নিবদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এখন এনখের সশরীরে স্বর্গারোহণ নিয়ে পুরো একসারি চিন্তাধারায় সে ভেসে গেল।
যে মৃত্যুর কথা সেরিওজা প্রায়ই শুনত, তাতে তার আদৌ বিশ্বাস ছিল না। সে বিশ্বাস করত না যে তার প্রিয়জন মরতে পারে, বিশেষ করে সে নিজে মরবে। এটা ছিল তার কাছে একেবারে অসম্ভাব্য ও অবোধ্য একটা ব্যাপার। কিন্তু লোকে তাকে বলত যে সবারই মরণ আছে; যাদের ওপর তার বিশ্বাস ছিল, জিজ্ঞেস করায় তারাও একই কথা বলেছে। ধাইমাও তাই বলেছে যদিও অনিচ্ছায়। কিন্তু এনখ তো মরেননি, তার মানে সবাই মারা যায় না। সে ভাবত, ‘কেন সবাই সৃষ্টিকর্তার চোখে অমনি পুণ্যবান হয়ে পারবে না সশরীরে স্বর্গে যেতে?’ খারাপ লোকেরা, অর্থাৎ সেরিওজা যাদের পছন্দ করত না, তারা মরতে পারে, কিন্তু ভালো লোকদের সবার পক্ষে এনখের মত হওয়া সম্ভব।
‘তা কোন্ কোন্ পয়গম্বর?’
‘এনখ, এনস।’
‘সে তো তুমি আগেই বলেছ। খুব খারাপ সেরিওজা, খারাপ। সমস্ত খ্রিস্টানের পক্ষে যা জানা সবচেয়ে বেশি দরকার তা জানার চেষ্টা যদি না কর’, উঠে দাঁড়িয়ে পিতা বললেন, ‘তাহলে কিসে তোমার আগ্রহ থাকতে পারে? তোমার আচরণে আমি খুশি নই, পিওতর ইগ্নাতিচও’ (ইনি প্রধান শিক্ষক) ‘অখুশি… তোমাকে শাস্তি দিতে হবে।’
পিতা এবং শিক্ষক উভয়েই সেরিওজার ওপর অপ্রসন্ন, এবং সত্যিই সে পড়াশুনায় ছিল খুবই খারাপ। অন্যদিকে তাকে গুণহীন বলা চলত না কোনক্রমেই। বরং শিক্ষক যাদের দৃষ্টান্তস্থল বলে তুলে ধরতেন তেমন অনেক বালকের চেয়ে তার গুণপনা ছিল বেশি। পিতার চোখে, তাকে যা শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছিল তাও সে শিখতে চায় না। আসলে শেখা সম্ভব নয় তার পক্ষে। সম্ভব নয় কারণ পিতা ও শিক্ষক তার কাছে যে দাবি করতেন তার চেয়ে তার প্রাণে ছিল বেশি জরুরি একটা দাবি। এ দাবিটা ওঁদের বিপরীত এবং তার প্রতিপালকদের সাথে সোজাসুজি লড়াই বাধতো তার।
বয়স ওর নয় বছর, এখনো সে শিশু; কিন্তু নিজের প্রাণটাকে সে জানত, সেটা ছিল তার কাছে বড়, আঁখিপল্লব যেমন চোখকে আগলে রাখে, তেমনি নিজের প্রাণটাকে আড়াল করে রাখত সে, ভালোবাসার চাবি ছাড়া সেখানে প্রবেশ ছিল না কারো। শিক্ষক নালিশ করতেন যে শিখতে সে চায় না মোটেই, অথচ জ্ঞানের তৃষ্ণায় প্রাণ ছিল তার পরিপূর্ণ। শিক্ষক নয়, কাপিতোনিচ, ধাই-মা, নাদেঙ্কা, ভাসিলি লুকিচের কাছ থেকে সেই জ্ঞান সঞ্চয় করতো সে। যে জলস্রোতে পিতা আর শিক্ষক চাইছিলেন তাঁদের পানি কলের চাকা ঘোরাতে, সেটা অনেকদিন আগেই চুইয়ে গিয়ে কাজ করছে অন্য জায়গায়।
লিদিয়া ইভানোভনার বোনঝি নাদেঙ্কার কাছে যাবার অনুমতি না দিয়ে পিতা তাকে শাস্তি দিলেন। কিন্তু শাস্তিটা হল শাপে বর। ভাসিলি লুকিচের মেজাজ ভালো ছিল, হাওয়াই কল কি করে বানাতে হয় তা সে দেখাল তাকে। সারা সন্ধেটা এই নিয়ে কাজে আর হাত দিয়ে তার পাখনা ধরে অথবা পাখনার সাথে নিজেকে বেঁধে নিয়ে ঘুরপাক খাওয়া যাবে, তেমন হাওয়াই কল কি করে বানানো যায় তার স্বপ্নে। সারা সন্ধ্যে মায়ের কথা সেরিওজার মনে পড়েনি, কিন্তু বিছানায় শুতেই হঠাৎ মনে পড়ল আর নিজের ভাষায় সে প্রার্থনা করল, কাল, তার জন্ম দিনে মা যেন আর লুকিয়ে না থেকে আসে তার কাছে।
‘ভাসিলি লুচি, চলতি নয়, বাড়তি কি-একটা প্রার্থনা আমি করলাম, জানেন? ‘
‘ভালো পড়াশুনা যাতে হয়?’
‘উঁহু।’
‘খেলনা?’
‘না। আপনি ধরতে পারবেন না। চমৎকার প্রার্থনা, কিন্তু গোপন! যখন ফলে যাবে, তখন বলব আপনাকে ধরতে পারেননি তো?’
‘না, পারছি না, আপনি বলুন, হেসে বলল ভাসিলি লুচি, যেটা তার ক্ষেত্রে ঘটে কদাচিৎ, ‘নিন, শুয়ে পড় ন, আমি বাতি নিবিয়ে দিচ্ছি।’
‘যার জন্য প্রার্থনা করেছিলাম, যা আমি দেখতে পাচ্ছি, তা ভালো দেখতে পাব বাতি ছাড়াই। গোপন কথাটা প্রায় বলে ফেলছিলাম আর-কি!’ খুশিতে খিলখিল করে হেসে বলল সেরিওজা।
বাতি যখন নিয়ে যাওয়া হল, সেরিওজা তখন সাড়া পেল মায়ের। তার কাছে দাঁড়িয়ে স্নেহের দৃষ্টিতে তিনি চেয়ে ছিলেন তার দিকে। কিন্তু তারপর দেখা ছিল হাওয়াই কল, চুরি, সব জড়াজড়ি হয়ে গিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
আটাশ
ভ্রন্স্কি আর আন্না পিটার্সবুর্গ এসে একটি সেরা হোটেলে উঠেছিলেন। নিচের তলায় ভ্রন্স্কি রইলেন আলাদা একটি কামরায় আর শিশুটি, স্তন্যদাত্রী আর দাসীকে নিয়ে চার কামরার বড় একটি স্যুটে আন্না।
আসার প্রথম দিনেই ভ্রন্স্কি যান বড় ভাইয়ের কাছে। সেখানে দেখা হল মায়ের সাথে। মস্কো থেকে তিনি এসেছিলেন কি-একটা কাজে। মা এবং ভ্রাতৃবধূ তাঁকে নিলেন স্বাভাবিকভাবেই; জিজ্ঞেস করলেন বিদেশ ভ্রমণের কথা, চেনা-পরিচিতদের বৃত্তান্ত, কিন্তু আন্না সম্পর্কে চুঁ শব্দটি নয়। পরের দিন সকালে বড় ভাই নিজে ভ্রন্স্কির কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন আন্নার কথা, আলেকসেই ভ্রনস্কি খোলাখুলি তাঁকে বলেন যে কারেনিনার সাথে তাঁর সম্পর্কটা তিনি দেখছেন বিবাহবন্ধনের মত; বিবাহবিচ্ছেদের আশা করছেন উনি, তখন বিয়ে করবেন, আপাতত যে কোন স্ত্রীর মতই তাঁকে স্ত্রী বলে তিনি গণ্য করছেন এবং সে কথাটা যেন তিনি মা আর তাঁর গৃহিণীকে জানিয়ে দেন।
ভ্রন্স্কি বললেন, ‘সমাজ যদি অনুমোদন না করে, আমি তার পরোয়া করি না। কিন্তু আত্মীয়রা যদি আমার সাথে আত্মীয়তা বজায় রাখতে চায়, তাহলে আমার স্ত্রীর সাথেও সমান সম্পর্ক রাখতে হবে।’
বড় ভাই সব সময় ছোট ভাইয়ের যুক্তি মান্য করতেন, সমাজ প্রশ্নটার মীমাংসা না করা পর্যন্ত তিনি জানতেন না তিনি ঠিক নাকি ভুল; নিজের দিক থেকে তিনি এর বিরুদ্ধে খারাপ কিছু দেখেননি, আলেক্সেইয়ের সাথে তিনি দেখা করতে গেলেন আন্নার সাথে।
অন্য সবার সমক্ষে যেমন, তেমনি বড় ভাইয়ের উপস্থিতিতেও ভ্রন্স্কি আন্নাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করে দেখালেন যে, উনি নিকট-পরিচিতাদের একজন। তবে তাঁদের সম্পর্ক যে বড় ভাই জানেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। আন্না যে ভ্রন্স্কির মহাল-বাড়িতে থাকবেন, কথা হল তাই নিয়ে।
নিজের জাগতিক সমস্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও নিজের নতুন পরিস্থিতির দরুন অদ্ভুত একটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছিলেন ভ্রন্স্কি। সমাজ যে তাঁর আর আন্নার জন্য দরজা বন্ধ করে দেবে, এটা তাঁর বোঝার কথা; কিন্তু তাঁর ঝাপসা একটা ধারণা জন্মাল যে সেটা অতীতের ব্যাপার; এখন দ্রুত প্রগতির ফলে (নিজের অজান্তেই তিনি এখন যে কোন প্রগতির পক্ষপাতী হয়ে উঠেছেন) সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে, সমাজ তাঁদের গ্রহণ করবে কিনা সে প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত। ভাবলেন, ‘বলাই বাহুল্য, দরবারের যে সমাজ তা আন্নাকে গ্রহণ করবে না, কিন্তু ঘনিষ্ঠরা ব্যাপারটাকে যেমন উচিত সেভাবে নিতে পারে ও নেওয়া দরকার।’
যদি জানা থাকে যে, অবস্থান্তরে কোন বাধা নেই, তাহলে পা গুটিয়ে একই জায়গায় বসে থাকা যায় কয়েক ঘণ্টা; কিন্তু পা গুটিয়ে তাকে বসে থাকতেই হবে, এটা জানা থাকলে লোকের খিঁচ ধরে, পা দমকা মেরে টান হতে চাইবে যে দিকে তার টান হবার ইচ্ছে। সমাজ সম্পর্কে ঠিক এরকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল ভ্রন্স্কির। সমাজের দরজা তাঁদের জন্য রুদ্ধ, এটা মর্মে মর্মে টের পেলেও তিনি দেখতে চেষ্টা করলেন সমাজ হয়ত বদলেছে, তাঁদেরকে গ্রহণ করবে। কিন্তু অচিরেই তিনি আবিষ্কার করলেন যে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর জন্য সমাজ উন্মুক্ত থাকলেও আন্নার জন্য তা রুদ্ধ। বেড়াল-ইঁদুর খেলার মত লোকে তাঁর জন্য হাত তুলেই হাত নামাচ্ছে আন্নার ক্ষেত্রে।
পিটার্সবুর্গ সমাজের প্রথম যে মহিলাদের সাথে ভ্রন্স্কির সাক্ষাৎ হয়, তিনি হলেন তাঁর সম্পর্কিতা বোন বেত্সি। সানন্দে তিনি স্বাগত করলেন তাঁকে, ‘যাক বাবা! এলেন শেষ পর্যন্ত। আর আন্না? কি যে আনন্দ হচ্ছে! কোথায় উঠেছেন? আপনাদের রমণীয় ভ্রমণের পর আমাদের পিটার্সবুর্গ যে আপনাদের কাছে কি বিছ্ছিরি লাগছে তা বেশ কল্পনা করতে পারছি। কল্পনা করছি রোমে আপনাদের মধুমাস। বিবাহবিচ্ছেদের কি হল? সব ঠিকঠাক?’
ভ্রন্স্কি লক্ষ করলেন যে, বিবাহবিচ্ছেদ এখনো হয়নি জেনে কি-রকম হ্রাস পেল বেত্সির উচ্ছ্বাস।
বললেন, ‘লোকে আমাকে ঢিল ছুঁড়বে, কিন্তু আন্নার কাছে আমি যাব, অবশ্য-অবশ্যই যাব। আপনারা এখানে কত দিন আছেন?’
আর সত্যি, সেই দিনই তিনি যান আন্নার কাছে, কিন্তু গলার সুরটা ছিল না আগের মত। স্পষ্টতই নিজের সাহসিকতায় গর্ববোধ করছিলেন তিনি এবং চাইছিলেন যেন আন্না তাঁর বন্ধুত্বের কদর করেন। ছিলেন মিনিট দশেকের বেশি নয়, সমাজের খবরাখবর দিয়ে যাবার আগে বললেন, ‘বিবাহবিচ্ছেদটা কবে হচ্ছে বললেন না কিন্তু। আমি নয় পরোয়া করি না কিন্তু বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত অন্যান্য কাঠখোট্টারা আপনাদের কাছে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। ওটা আজকাল খুব সহজ। সাধারণ ব্যাপার, আপনারা শুক্রবার চলে যাচ্ছেন? দুঃখের কথা যে আমাদের আর দেখা হচ্ছে না।’
বেত্সির কথার ধরন থেকে ভ্রন্স্কির বোঝা উচিত ছিল সমাজ কি মনোভাব নেবে তাঁর সম্পর্কে, কিন্তু নিজের পরিবারের মধ্যে আরেকবার চেষ্টা করে দেখলেন। মায়ের ওপর তাঁর কোন ভরসা ছিল না। তিনি জানতেন যে, প্রথম পরিচয়ের সময় মা আন্নাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হলেও পুত্রের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার কারণ হওয়ায় এখন তিনি আন্নার উপর হবেন নির্মম। কিন্তু ভ্রাতৃবধূ ভারিয়ার ওপর খুবই ভরসা করেছিলেন তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল যে ভারিয়া ঢিল ছুঁড়বেন না। সহজসরলভাবে দৃঢ়তার সাথে তিনি আন্নার কাছে যাবেন এবং স্বগৃহে বরণ করবেন তাঁকে।
আসার পরের দিনই ভ্রন্স্কি যান তাঁর কাছে এবং তাঁকে একা পেয়ে নিজের বাসনা প্রকাশ করেন।
ভ্রন্স্কির কথা সব শুনে তিনি বললেন, ‘তুমি জানো আলেকসেই তোমাকে কত ভালোবাসি আমি, তোমার জন্য সবকিছু করতে আমি রাজি, কিন্তু চুপ করে ছিলাম, কেননা জানতাম যে তোমার আর আন্না আর্কাদিয়েভনার কোন উপকারে লাগব না’, ‘আন্না আর্কাদিয়েভনা’ নামটা তিনি উচ্চারণ করলেন বিশেষ জোর দিয়ে। ‘ভেবো না আমি নিন্দে করছি। কখনো করিনি; ওঁর জায়গায় আমি হলে একই কাজ করতাম। খুঁটিনাটি কথায় আমি যাচ্ছি না, যেতে পারি না’, ভ্রন্স্কির বিমর্ষ মুখের দিকে ভীরু দৃষ্টিপাত করে তিনি বললেন, ‘কিন্তু যে জিনিসের যা নাম, সেটা স্পষ্ট বলা উচিত তুমি চাও যে আমি ওঁর কাছে যাই, বাড়িতে ডাকি, আর তাতে করে সমাজে সুনাম ফিরবে তাঁর। কিন্তু এটা আমি যে করতে পারি না তা বুঝতে পারছ? মেয়ে আমার বড় হচ্ছে, সমাজে আমাকে থাকতে হবে আমার স্বামীর জন্য। বেশ, আমি নয় গেলাম আন্না আর্কাদিয়েভনার কাছে; উনি বুঝবেন যে নিজের বাড়িতে আমি ডাকতে পারি না ওঁকে, কিংবা এমনভাবে ডাকব যাতে অন্যভাবে যারা ব্যাপারটা দেখে তাদের সাথে সাক্ষাৎ না হয় : তাতে অপমানিত হবেন উনি। আমি তো তাঁকে ওপরে তুলতে পারি না…’
‘হ্যাঁ, শত শত যে নারীদের আপনি স্বাগত করেন তাদের চেয়ে আন্না নিচে নেমে গেছেন বলে আমি মনে করি না’, আরও বিমর্ষ মুখে কথায় বাধা দিলেন ভ্রন্স্কি এবং ভ্রাতৃবধূর সিদ্ধান্ত যে অটল সেটা বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়ালেন নীরবে।
‘আলেক্সেই, রাগ করো না আমার ওপর। বুঝে দেখো ভাই যে আমার দোষ নেই’, ভীরু ভীরু হাসি নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন ভারিয়া।
‘তোমার ওপর রাগ আমি করছি না’, একইরকম বিমর্ষভাবে বললেন ভ্রন্স্কি, কিন্তু এতে আমার কষ্ট হচ্ছে দ্বিগুণ। কষ্ট হচ্ছে এজন্য যে আমাদের বন্ধুত্ব ঘুচে গেল। ঘুচে না গেলেও অন্তত ক্ষীণ হয়ে পড়ল। তুমি বুঝতে পারছ যে আমার পক্ষে এ ছাড়া হত্যন্তর নেই।’
এই বলে চলে গেলেন উনি।
ভ্রন্স্কি বুঝতে পেরেছিলেন যে আর চেষ্টা করে লাভ নেই। পিটার্সবুর্গে এ ক’টা দিন কাটিয়ে দিতে হবে যেন পরের শহরে, আগেকার জগৎটার সাথে সর্ববিধ যোগাযোগ এড়িয়ে, যাতে তাঁর পক্ষে যা অত্যন্ত মর্মান্তিক তেমন কষ্ট ও হীনতা সইতে না হয়। পিটার্সবুর্গের প্রধান একটা বিশ্রী ব্যাপার ছিল এই যে কারেনিন এবং তাঁর নাম যেন সর্ব বিরাজমান। যে কোন বিষয় নিয়ে কথা শুরু হোক না কেন, কারেনিনের প্রসঙ্গে না উঠে যেত না; এমন কোথাও যাবার জায়গা ছিল না, যেখানে তাঁর সাথে দেখা না হওয়া সম্ভব। অন্তত ভ্রন্স্কির তাই মনে হচ্ছিল, যেভাবে জখম আঙুল থাকলে লোকের মনে হয় যে সবকিছুই যেন ঐ জখম আঙুলটায় খোঁচা দিচ্ছে ইচ্ছে করেই।
পিটার্সবুর্গে দিন কাটানো ভ্রন্স্কির কাছে আরো দুঃসহ মনে হচ্ছিল, কারণ আন্নার মধ্যে এসময় নতুন কি-একটা দুর্বোধ্য মনোবৃত্তি দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। কখনো আন্না যেন তাঁকে ভালোবাসছে, কখনো আবার নিরুত্তাপ, তিতিবিরক্ত, দুর্বোধ্য। কিসে তিনি যেন কষ্ট পাচ্ছিলেন আর সেটা ঢেকে রাখছিলেন ভ্রন্স্কির কাছ থেকে, যে আঘাতগুলো ভ্রন্স্কির জীবন বিষিয়ে তুলছে, সূক্ষ্ম বোধের ফলে যা আন্নার পক্ষে আরো বেশি যন্ত্রণাদায়ক হবার কথা, তা যেন আন্না খেয়ালই করছিলেন না।
ঊনত্রিশ
আন্নার রাশিয়ায় আসার একটা উদ্দেশ্য ছিল ছেলেকে দেখা। ইতালি ছাড়ার দিনটা থেকে দেখা করার এই চিন্তাটা তাঁকে কেবলি অস্থির করেছে। আর যত কাছিয়ে এসেছেন পিটার্সবুর্গের দিকে, সাক্ষাতের এই আনন্দ আর তাৎপর্য হয়ে উঠেছে ততই বেশি। দেখা করা যায় কিভাবে নিজেকে সে প্রশ্ন তিনি আর করছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল ছেলের সাথে যখন একই শহরে থাকবেন তখন বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে হঠাৎ একটা পরিষ্কার ধারণা হল তাঁর এবং বুঝলেন যে দেখা করাটা হবে কঠিন 1
ইতিমধ্যেই তাঁর দু’দিন কেটেছে পিটার্সবুর্গে। ছেলের ভাবনা তাঁর মুহূর্তের জন্যও থামেনি, অথচ এখনো দেখা হল না তার সাথে। সরাসরি বাড়ি যাওয়া যেখানে কারেনিনের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে, তার কোন অধিকার নেই বলে তাঁর মনে হচ্ছিল। তাঁকে ঢুকতে না দিতে পারে, অপমান করতে পারে। স্বামীর কাছে চিঠি লিখে একটা যোগাযোগ করা—এ চিন্তা ছিল কষ্টকর, শান্তিতে তিনি থাকতে পারতেন কেবল যখন স্বামীর কথা না ভাবতে হত। ছেলে কখন, কোথায় বেড়াতে যায় জেনে নিয়ে সেই সময় তাকে দেখার কথায় মন উঠছিল না তাঁর; এই সাক্ষাৎটার জন্য মনে মনে কত তৈরি হয়েছে তিনি, কত কথা তাকে বলার আছে, কি ইচ্ছেই না করছে তাকে আলিঙ্গন করতে, চুম্বন করতে। সেরিওজার পুরনো ধাই-মা তাঁকে সাহায্য করতে, পরামর্শ দিতে পারত। কিন্তু কারেনিনের বাড়িতে সে আর ছিল না তখন। এই সমস্ত দোদুল্যমানতা আর ধাই-মাকে খুঁজে বার করার চেষ্টায় কেটে গেল দুই দিন।
কারেনিনের সাথে কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার ঘনিষ্ঠতার কথা জানতে পেরে তৃতীয় দিন বহু কষ্টে আন্না স্থির করলেন ওঁকেই চিঠি লিখবেন, যাতে ইচ্ছে করেই তিনি বলেন যে ছেলেকে দেখবার জন্য অনুমতি নির্ভর করছে স্বামীর মহানুভবতার ওপর। তিনি জানতেন যে চিঠিটা তাঁকে দেখানো হলে নিজের মহানুভবতার ভূমিকা চালিয়ে যাবার জন্য তিনি অনুমতিদানে আপত্তি করবেন না।
হোটেলের যে লোকটি চিঠি নিয়ে গিয়েছিল, সে আন্নার কাছে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও অপ্রত্যাশিত এই উত্তর আনল যে উত্তর দেওয়া হবে না। লোকটিকে ডেকে তার কাছ থেকে আন্না যখন শুনছিলেন কিভাবে সে অপেক্ষা করেছে তার বিশদ বৃত্তান্ত এবং তাকে কিভাবে বলা হল : ‘কোনো উত্তর দেওয়া হবে না’, সে মুহূর্তের মত অত অপমানিত আন্না বোধ করেননি কখনো। নিজেকে অপমানিত, লাঞ্ছিত বোধ করছিলেন আন্না কিন্তু এও বুঝতে পারছিলেন যে নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা ঠিকই করেছেন। দুঃখটা তাঁর আরো বেশি হল এই জন্য যে তিনি একাকী। ভ্রন্স্কিকে তিনি এ কথা বলতে পারেন না, বলতে চানও না। তিনি জানতেন যে ভ্রন্স্কি তাঁর দুঃখের প্রধান কারণ হলেও ছেলের সাথে আন্নার দেখা করাটা তাঁর কাছে অতি গুরুত্বহীন বলে মনে হবে। তিনি জানতেন যে তাঁর কষ্টের সমস্ত গভীরতা হৃদয়ঙ্গম করতে তিনি অক্ষম। তিনি জানতেন, ব্যাপারটা বলল যে নিরুত্তাপ সুরে তিনি কথা কইবেন, তাতে তাঁর সম্পর্কে ঘৃণা হবে আন্নার। আর দুনিয়ায় এটাই তিনি ভয় করতেন সবচেয়ে বেশি, তাই যে ব্যাপারগুলো ছেলেকে নিয়ে, তা সব চেপে রাখতেন তাঁর কাছ থেকে
সারা দিন ঘরে বসে থেকে তিনি শুধু ভাবলেন কি করে দেখা করা যায় ছেলের সাথে। শেষ পর্যন্ত স্থির করলেন স্বামীকে চিঠি লিখবেন। চিঠির বয়ান তিনি ঠিক করে এনেছেন এমন সময় তিনি পেলেন লিদিয়া ইভানোভনার চিঠি। কাউন্টেসের নিরুত্তরতা তিনি মেনে নিয়েছিলেন, সামলে উঠেছিলেন, কিন্তু এই চিঠিটা, চিঠির ছত্রগুলোর মধ্যে তিনি যা পড়লেন তাতে তাঁর পিত্তি এত জ্বলে গেল, তাঁর ন্যায্য, প্রবল পুত্রস্নেহের বিপরীতে এই আক্রোশটা তাঁর কাছে এত জঘন্য লাগল যে তিনি নিজেকে আর দোষী জ্ঞান না করে ক্ষেপে উঠলেন অন্যদের বিরুদ্ধে।
মনে মনে তিনি বললেন, ‘এই অনুভূতিহীনতা অনুভূতির ভান মাত্র। ওদের দরকার কেবল আমাকে অপমান করা আর ছেলেটাকে কষ্ট দেওয়া, আমি তা মেনে নেব! কিছুতেই নয়! ও আমার চেয়ে খারাপ। আমি অন্তত মিথ্যে কথা বলি না।’ এবং তৎক্ষণাৎ তিনি স্থির করলেন যে কাল, সেরিওজার জন্মদিনে তিনি সোজাসুজি চলে যাবেন স্বামীর বাড়িতে, চাকরবাকরদের ঘুষ দেবেন, প্রতারণা করবেন, যে করেই হোক ছেলেকে দেখবেন, আর যে বিকট মিথ্যে দিয়ে ওঁরা তাকে ঘিরেছেন চূর্ণ করবেন সেটা।
খেলনার দোকানে গেলেন তিনি, কয়েকটা খেলনা কিনলেন, ভাবতে লাগলেন কর্মপদ্ধতি। খুব ভোরে যাবেন তিনি, সকাল আটটায়, যখন কারেনিন নিশ্চিতই শয্যা ত্যাগ করেননি। হাতে তাঁর টাকা থাকবে, যা দেবেন পোর্টার ও চাপরাশিকে, যাতে তারা ঢুকতে দেয় তাঁকে, মুখাবগুণ্ঠন না তুলে বলবেন যে তিনি আসছেন সেরিওজার ধর্মপিতার কাছ থেকে অভিনন্দন জানাতে, ছেলের বিছানার কাছে কিছু খেলনা রেখে আসার ভার দেওয়া হয়েছে তাঁকে। শুধু ছেলেকে কি বলবেন সে কথাগুলো তিনি ভেবে উঠতে পারেননি। যতই ভাবুন, কিছুই দাঁড়াচ্ছিল না।
পরের দিন সকাল আটটায় তিনি ছ্যাকড়া গাড়ি থেকে নামলেন একা, তাঁর ভূতপূর্ব বাড়ির সদর দরজায় ঘন্টি দিলেন।
‘দেখ তো কি দরকার। মনে হচ্ছে কে একজন মহিলা’, বলল কাপিতোনিচ, তখনো পোশাক পরা হয়নি, তার, গায়ে একটা ওভারকোট আর পায়ে জুতা চাপিয়ে সে জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখল অবগুণ্ঠন নামিয়ে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে।
পোর্টারের সহকারী আন্নার অপরিচিত এক ছোকরা দরজা খুলতেই আন্না ভেতরে ঢুকে গেলেন, মাফ থেকে তিন রুলের একটা নোট বার করে তাড়াতাড়ি গুঁজে দিলেন তার হাতে।
‘সেরিওজা… সের্গেই আলেক্সেইচ…’ বলে তিনি এগিয়ে যাবার উপক্রম করলেন। নোটটা তাকিয়ে দেখে পোর্টারের সহকারী তাঁকে থামাল কাঁচের দ্বিতীয় দরজাটার কাছে।
জিজ্ঞেস করল, ‘কাকে চাই আপনার?’
ওর কথাগুলো আন্নার কানে যায়নি, কোন জবাব দিলেন না তিনি।
অপরিচিতার বিব্রত অবস্থা দেখে কাপিতোনিচ নিজেই তাঁর কাছে এসে দরজা খুলে ঢুকতে দিয়ে জিজ্ঞেস করল কি তাঁর চাই।
আন্না বললেন, ‘প্রিন্স স্করোদুমোভের কাছ থেকে আসছি সের্গেই আলেকসেইচের কাছে।’
‘উনি এখনো ওঠেননি’, মনোযোগ দিয়ে আন্নাকে লক্ষ করে পোর্টার বলল।
আন্না একেবারেই ভাবেননি যে নয় বছর যে বাড়িটায় তিনি বাস করে গেছেন তার একেবারেই অপরিবর্তিত প্রবেশ-কক্ষ তাঁকে বিচলিত করবে এতখানি। আনন্দের আর কষ্টের একের পর এক স্মৃতি জেগে উঠল মনে, মুহূর্তের জন্য তাঁর স্মরণ হল না কেন তিনি এখানে।
তাঁর ওভারকোট খুলতে খুলতে কাপিতোনিচ বলল, ‘অপেক্ষা করবেন কি?’
আর ওভারকোট খোলার সময় তাঁর মুখের দিকে চেয়ে কাপিতোনিচ চিনতে পারল তাঁকে, নীরবে সে কুর্নিশ করল নিচু হয়ে
বলল, ‘আজ্ঞা হয় হুজুরানি।’
কি-একটা যেন বলতে চেয়েছিলেন আন্না, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। বৃদ্ধের দিকে দোষী-দোষী অনুরোধে একটা দৃষ্টিতে চেয়ে তিনি লঘু পদক্ষেপে দ্রুত উঠতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে সিঁড়ির পৈঠায় জুতা লটকিয়ে কাপিতোনিচ ছুটল তাঁর পাল্লা ধরতে।
‘মাস্টার সাহেব আছেন ওখানে, হয়ত পোশাক পরা হয়নি এখনো। আমি খবর দিচ্ছি।’
বৃদ্ধ কি বলল সেটা বুঝতে না পেরে পরিচিত সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই থাকলেন আন্না।
‘এদিকে, বাঁয়ে আজ্ঞা। মাপ করবেন যে অপরিষ্কার। উনি আছেন আগে যেটা ছিল বৈঠকখানা, সেখানে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল পোর্টার; ‘একটু সবুর করুন হুজুরানি, আমি দেখে আসি’, এই বলে সে পেল্লায় দরজাটা খুলে অন্তর্ধান করলে তার পেছনে। থেমে গিয়ে আন্না অপেক্ষা করতে লাগলেন। ‘এইমাত্র ঘুম থেকে উঠেছেন’, ফিরে এসে পোর্টার বলল।
পোর্টার যখন এই কথা বলল, সেই মুহূর্তে আন্নার কানে এল শিশুর হাই তোলার শব্দ। এই হাইটা থেকেই আন্না চিনতে পারলেন তাঁর ছেলেকে, তাকে যেন জীবন্ত দেখতে পেলেন তাঁর সামনে।
‘যেতে দাও, যেতে দাও, বাপু!’ বলে আন্না ঢুকে গেলেন পেল্লায় দরজাটার ভেতর দিয়ে। দরজার ডান দিকে একটা খাট, সেখানে শুধু একটা বোতাম খোলা কামিজ পরে বসে আছে একটি খোকা, শরীর বাঁকিয়ে সে হাই তোলাটা শেষ করছে। ঠোঁট দুটো বুজে আসতেই তাতে ফুটে উঠল পরমানন্দের ঘুম-ঘুম হাসি, আর হাসি নিয়েই ধীরে ধীরে সে মাধুর্যভরে ফের শুয়ে পড়ল।
নিঃশব্দে তার কাছে গিয়ে ফিসফিস করলেন আন্না, ‘সেরিওজা!’
ওর সাথে বিচ্ছেদের সময়টায় এবং ইদানীং তাঁর যে স্নেহ উথলে উঠেছিল তখন আন্না তাকে কল্পনা করতেন চার বছরের খোকা হিসেবে, যে বয়সটায় তাকে সবচেয়ে ভালোবেসেছিলেন তিনি। ওকে তিনি যে চেহারায় রেখে গিয়েছিলেন, এখন সে আর তেমন নয়; চার বছর ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে গেছে সে, আরো বড় আর রোগা হয়েছে। কি ব্যাপার? কি রোগা ওর মুখখানা, কি ছোট ছোট চুল! কি লম্বা হাত! ওকে যখন তিনি রেখে যান তার পর থেকে কি বদলিয়ে গেছে সে! কিন্তু এ সে-ই, ওই তো তার মাথার গড়ন, তার ঠোঁট, তার নরম গলা, চওড়া কাঁধ।
‘সেরিওজা!’ একেবারে তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে আবার ডাকলেন আন্না।
কনুইয়ে ভর দিয়ে সে উঠে বসল, কি যেন খুঁজতে গিয়ে এলোচুল মাথাটা ফেরাল এদিক-ওদিক, চোখ মেলল। চুপচাপ সম্প্রশ্ন দৃষ্টিতে সে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তার সামনে দণ্ডায়মান নিশ্চল মায়ের দিকে, তারপর হঠাৎ পরম সুখের হাসি মুদে আসা চোখ বুজে সে লুটিয়ে পড়ল বিছানায় নয়, মায়ের কোলে।
‘সেরিওজা! মিষ্টি খোকা আমার!’ দম বন্ধ করে দুই হাতে তার নধর দেহটা জড়িয়ে ধরে আন্না বললেন।
‘মা!’ দেহের নানা জায়গায় তাঁর হাতের ছোঁয়া পাবার জন্য তাঁর বাহুবন্ধনের মধ্যে আঁকুপাঁকু করে বলল সেরিওজা। তখনো চোখ বুজে, ঘুম-ঘুম হাসি নিয়ে সে খাটের পেছন থেকে গোলগাল হাতে গলা জড়িয়ে ধরল তাঁর, ঘেঁষে এল তাঁর বুকে, শুধু শিশুদের ক্ষেত্রেই যা হয় তেমন একটা সুমধুর নিদ্রালু ঘ্রাণ আর উত্তাপে আন্নাকে আচ্ছন্ন করে মুখ ঘষতে লাগল তাঁর কাঁধে আর গলায়।
‘আমি জানতাম’, চোখ মেলে সে বলল, ‘আজ আমার জন্মদিন। জানতাম তুমি আসবে। এক্ষুণি আমি উঠছি।’
এই বলে সে ঘুমে ঢলে পড়ল।
তৃষিতের মত আন্না দেখছিলেন তাকে; দেখছিলেন তাঁর অনুপস্থিতিতে কত বড় হয়েছে সে, বদলিয়ে গেছে। লেপের তল থেকে বেরিয়ে আসা তার এখনকার দীর্ঘ নগ্ন পা তিনি চিনতে পারছিলেনও বটে, আবার পারছিলেনও না, চিনতে পারলেন ওই শীর্ণ গাল, চাঁদিতে ছোট করে ছাঁটা চুলের কুণ্ডলী, যেখানে প্রায়ই চুমু খেতেন তিনি। এ সবই তিনি হাত বুলিয়ে দেখলেন, কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না; কান্নার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছিল তাঁর।
‘মা, কাঁদছ কেন?’ সম্পূর্ণ জেগে উঠে সেরিওজা বলল, ‘কাঁদছ কেন মা?’ সে চেঁচিয়ে উঠল কান্না-মাখা গলায়। ‘আমি? না, কাঁদব না… কাঁদছি আনন্দে। কতদিন তোকে দেখিনি। না, কাঁদব না, কাঁদব না’, কান্নাটা গিলে ফেলে মুখ ফিরিয়ে বললেন আন্না, ‘তোর এখন পোশাক পরার সময়’, নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে যোগ করলেন তিনি কিন্তু ছেলের হাত না ছেড়ে দিয়ে উনি বসলেন খাটের কাছে চেয়ারটায় যেখানে পাট করা ছিল সেরিওজার পোশাক।
‘আমাকে ছাড়া কেমন করে পোশাক পরিস তুই? কেমন করে…’ সহজভাবে আনন্দ করে বলতে চেয়েছিলেন তিনি কিন্তু পারলেন না, আবার তিনি মাথা ঘুরিয়ে নিলেন।
‘ঠাণ্ডা পানিতে আমি হাত-মুখ ধুই না, বাবা মানা করেছেন। আচ্ছা, ভাসিলি লুকিচকে তুমি দেখোনি? ও আসবে এখন। কিন্তু তুমি বসেছ আমার পোশাকের ওপর!’
বলে খিলখিল করে হেসে উঠল সেরিওজা। আন্না ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
‘মাগো, মা-মণি, লক্ষ্মীটি আমার!’ আবার তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল সেরিওজা। যেন আন্নার হাসি দেখে কেবল এখনই সে পরিষ্কার বুঝতে পারল কি ঘটেছে। ‘ওটা খুলে রাখো’, আন্নার মাথা থেকে টুপিটা খুলে নিল সে। তারপর বিনা টুপিতে তাঁকে যেন নতুন করে দেখতে পেয়ে আবার চুমু খেতে লাগল সে।
‘কিন্তু আমার সম্পর্কে কি ভেবেছিলি? ভাবিসনি যে আমি মারা গেছি।’
‘কখনো তা বিশ্বাসই করিনি।’
‘বিশ্বাস করিসনি, সোনা আমার?’
‘আমি জানতাম, আমি জানতাম!’ নিজের প্রিয় বুলিটির পুনরাবৃত্তি করতে লাগল সে, আর আন্নার যে হাতখানা তার মাথায় বুলিয়ে আদর করছিল, সেটা টেনে নিজের মুখে চেপে ধরে চুমু খেতে লাগল