১. ভূমিকা-প্রকরণ : ভাষা

প্রথম অধ্যায়–ভূমিকা-প্রকরণ

ভাষা

আমাদের মনে সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা ক্রোধ-হর্য প্রভৃতি যে-সমস্ত ভাব জাগে, আমরা বিভিন্ন উপায়ে সেগুলি অন্যের কাছে প্রকাশ করিয়া থাকি। কান্নার মধ্য দিয়া অবোধ শিশু নিজের অভাব মাকে জানাইতে চায়; ইঙ্গিত-ইশারাই বাকশক্তিহীন বোবার ভাব-প্রকাশের একমাত্র উপায়; মনোলোকের ধ্যানলব্ধ অপরূপকে তুলির রেখায় রূপায়িত করিবার জন্যই শিল্পীর অতন্দ্র সাধনা। মানুষ আমরা, কথাবার্তার মধ্য দিয়াই মনোভাব প্রকাশের কাজটি সারিয়া লই। এই কথাবার্তার নাম ভাষা। ভাষার ব্যাকরণ-সম্মত একটি সংজ্ঞার্থ এইভাবে নির্দেশ করা যায়।–

১। ভাষা : মনোভাব-প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা সম্পাদিত, কোনও বিশিষ্ট জনসমাজে প্রচলিত, প্রয়োজনমতো বাক্যে প্রযুক্ত হইবার উপযোগী শব্দসমষ্টিকে ভাযা বলে।

এইভাবেই ক্রমবিবর্তনের পথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জনসমাজে নানান ভাষার সৃষ্টি হইয়াছে। ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা ইংরেজী ভাষায়, জামান জাতি জার্মান ভাষায়, রুমানিয়ার অধিবাসিগণ রুমানিয়ান ভাষায়, বিহারীরা হিন্দী ভাষায়, অসমীয়ারা অসমীয়া ভাষায় কথাবার্তা বলেন। আমরা বাঙালী। শৈশবে সুমধুর ‘মা’ বুলির মধ্য দিয়া যে ভাষার সঙ্গে আমাদের পরিচয় আরম্ভ হইয়াছে, সেই বাংলা ভাষাই আমাদের মাতৃভাষা। ব্যাকরণের রীতিসম্মত পথে বাংলা ভাষার সংজ্ঞার্থটি এইভাবে নির্দেশ করা চলে।

২। বাংলা ভাষা : মনের বিচিত্র ভাব-প্রকাশের জন্য বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা সম্পাদিত, বাঙলী-সমাজে প্রচলিত, প্রয়োজনমতো বাংলা বাক্যে প্রযুক্ত হইবার উপযোগী শব্দসমষ্টির নাম বাংলা ভাষা।

শুধু ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গেই নয়, পূর্ববঙ্গ (আধুনিক বাংলাদেশ), আসামের কতকাংশ, ত্রিপুরা, বিহারের সাঁওতাল পরগনা, মানভূম, সিংভূম, পূর্ব পুর্ণিয়া প্রভৃতি স্থানের প্রায় পনেরো কোটি লোকের মাতৃভাষা এই বাংলা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষাগুলির মধ্যে উৎকর্ষের বিচারে বাংলা ষষ্ঠ স্থানাধিকারিণী।

প্রায় এক হাজার বৎসর পূর্বে মাগধী অপভ্রংশ হইতে যে বাংলা ভাষার অঙ্কুরোদ্গম হয়, তাহাই ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়া বর্তমানে ফলপুষ্পে সুশোভিত এক স্নিগ্ধচ্ছায় মহীরুহে পরিণত হইয়াছে।

অবশ্য বাংলা ভাষার ঊষালগ্ন হইতে কবিতাই ছিল ভাবপ্রকাশের একমাত্র

বাহন। বাংলা গদ্যের সৃষ্টি হইয়াছে একেবারে আধুনিক যুগে–উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমের দিকে। সেই হিসাবে বাংলা গদ্যের বয়স মাত্র দুই শত বৎসর। অথচ এই অল্পদিনেই রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ শিল্পিগণের দৌলতে বাংলা কী অপূর্ব শৌর্য আর সৌকুমার্যই না পাইয়াছে! এই সম্পশালিনী বাংলা ভাষার গতি-প্রকৃতি জানিতে হইলে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ভালোভাবে আয়ত্ত করা আবশ্যক। বাংলা ব্যাকরণ কাহাকে বলে?

৩। বাংলা ব্যাকরণ : যে শাস্ত্রপাঠে বাংলা ভাষার স্বরূপটি বিশ্লেষণ করিয়া বুঝিতে পারা যায় এবং লিখন-পঠনে ও আলোচন-আলাপনে সেই বাংলা ভাষা শুদ্ধরূপে প্রয়োগ করিতে পারা যায়, সেই শাস্ত্রকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।

বাংলা ভাষা ও উপভাষা

প্রতিটি মানুষ জন্মসূত্রে কোনো-না-কোনো ভাষার অধিকারলাভ করে। সে যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, সেইখানে বাবা-মা এবং অন্যান্য আত্মীয় পরিজনদের মুখ হইতে যে ভাষা সে শুনিতে পায়, তাহাই তাহার মাতৃভাষা। সেই ভাষায় কথা বলিবার জন্য তাহাকে সচেতনভাবে বিশেষ কোনো প্রচেষ্টা করিতে হয় না; চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, শ্বাসক্রিয়ার মতোই নিতান্ত স্বাভাবিক স্বয়ংক্রিয় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সে তাহার মাতৃভাষায় কথা বলিতে শিখিয়া যায়। মানবশিশু অরণ্যে প্রতিপালিত হইলে জনসমাজে লালিত অন্যান্য শিশুদের মতো কথা কহিতে পারে না, বাকশক্তিহীন হইয়া থাকে–নেকড়ে-বালক রামুই (যে আশৈশব নেকড়ে দ্বারা লালিত-পালিত হইয়াছিল) তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

মনে রাখিতে হইবে, ভাষা কতকগুলি ধ্বনির সমষ্টি হইলেও যেকোনো রকমের ধ্বনিই ভাষা নয়। একটি বস্তুর সহিত অপর কোনো বস্তুর সংঘর্ষ বা । ঘর্ষণ হইলে, ভারী ধাতব বস্তু মাটিতে পড়িয়া গেলে কিংবা কেহ হাততালি দিলে বা আছাড় দিয়া জামাকাপড় কাচিলে নানা ধরনের ধ্বনির সৃষ্টি হয়। বলা বাহুল্য, উৎপন্ন এই ধ্বনিগুলির কোনোটিই ভাষা নয়। আবার, ভাষার দ্বারা মানুষ মনের বিচিত্র ভাবপ্রকাশ করে বলিয়া, নানাপ্রকার অঙ্গভঙ্গি বা কিছু অর্থবোধক ইঙ্গিত ইশারার দ্বারা মানুষ নিজ মনোভাব প্রকাশ করিলেও ভাষা-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সেগুলি ভাষা বলিয়া গণ্য হয় না। ইঙ্গিতের দ্বারা ভাষার কাজ কিছু চলিলেও “ঙ্গিত ভাষা নয়, ভাষার বিকল্প এক পরিপোক মাত্র। ভাষাকে অবশ্যই মানুষেরই বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি হইতে হইবে। পশুপক্ষী তো তাহাদের কষ্ঠোগীর্ণ বিভিন্ন ডাকের মাধ্যমে নিজেদের মনের ভাব এবং শারীরিক প্রয়োজন দলের অন্যান্য পশুপক্ষীকে বুঝাইতে পারে; কিন্তু মানবের ও পশুপক্ষীর কণ্ঠনিঃসৃত ধানিপ্রবাহের মধ্যে মূলগত পার্থক্য হিয়াছে। যে-বুদ্ধি মানুষের মুখে ভাষা জোগাইয়াছে, ইতর প্রাণীর ডাকের মধ্যে সেই পরিশীলিত বুদ্ধির নিদারুণ অভাব থাকিয়া গিয়াছে; তাই তাহা কেবল কাকলি-কূজন-হ্রেষা-বৃংহণ-এই সীমাবদ্ধ রহিয়া গিয়াছে, ভাষা হইয়া উঠিতে পারে নাই।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ভাষা মানুষের বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনিসমষ্টি হইলেও এরূপ কিছু ধ্বনির সমন্বয়-মাত্রই কিন্তু ভাষা নয়; জ্বরের ঘোরে অসুস্থ রোগীর ভুল বকা, শিশুর অস্ফুট চিৎকার বা পাগলের অর্থহীন প্রলাপ–এগুলির প্রতিটিই মানুষের বাগ্যন্ত্রের মাধ্যমে উচ্চারিত ধ্বনি বটে, কিন্তু ইহাদের কোনোটিই ভাষা বলিয়া গ্রাহ্য নয়, কারণ এই ধ্বনিগুলি কোনো বিশেষ বস্তু বা ভাবের বাহন বা প্রতীক নয়। একজন মানুষের আকাঙ্ক্ষা, স্পৃহা, বেদনা, উত্তেজনা প্রভৃতি মনের কোনো-না-কোনো চিন্তার সম্পদকে অন্য একজন মানুষের মনে পোঁছাইয়া দিয়া তাহারও অন্তরে অনুকূল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করাই ভাষার প্রথম ও প্রধান কাজ। মানুষের মনোরাজ্যের ভাবসম্পদকে অপরের কাছে পৌঁছাইবার জন্য চিন্তার একটি বাহনের প্রয়োজন; ভাষা–মানুষের চিন্তার ধ্বনিমাধ্যম প্রকাশ–হইল সেই উন্নততর প্রকাশমাধ্যম। ভাষা চিন্তার শুধু বাহনই নয়, প্রসুতিও বটে; ভাষার অবলম্বন ব্যতিরেকে মানুষের চিন্তাশক্তি বিচরণে অক্ষম।

তবে শুধুমাত্র ক্ষুধা-তৃষ্ণা বা অন্যান্য জৈব বৃত্তি প্রকাশের তাগিদেই ভাষার। সৃষ্টি হয় নাই; তাহাই যদি হইত, তাহা হইলে জীবজন্তুরাও ভাষার জন্ম দিতে সক্ষম হইত। নিজেদের জৈব চাহিদাকে অপরের মনে সঞ্চার করিয়া সমস্যার সহজতর সমাধানে ভাষা মানুষকে সহায়তা করিলেও একমাত্র জৈব বৃত্তির তাড়নাই মানুষের মুখে ভাষার জন্ম দেয় নাই; তাহা হইলে মানুষ তো পশুনাদ বা

জীবজন্তুর মতো মুখের অস্ফুটধ্বনি ও ইঙ্গিতের দ্বারা নিজ প্রয়োজন মিটাইয়াই ক্ষান্ত হইত। কিন্তু বাস্তবিকভাবে সভ্যতার পথে অগ্রসর হইয়া আপন মনের উন্নততর চিন্তা ও ভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যেই মানুষ ভাষার সৃষ্টি করিয়াছে। এই ভাষার উৎস তাহার মনে; ভাষার সহিত মানুষের আত্মার অবিচ্ছেদ্য যোগ। তাই পাশ্চাত্ত্য মনীষী প্লেটো বলিয়াছেন : “চিন্তা ও ভাষা প্রধানত একই; উভয়ের মধ্যে কেবল এইটুকুই পার্থক্য রহিয়াছে যে, আত্মার নিজের সহিত নিজের কথোপকথন হইল চিন্তা, আর আমাদের চিন্তা হইতে ধ্বনির আশ্রয়ে ওষ্ঠাধরের মধ্য দিয়া যে প্রবাহটি বহিয়া আসে, তাহাই হইল ভাষা।”

ভাষা বলিলে আমরা মুখের ভাষা এবং লেখাপড়ার ভাষা–এই দুই ধরনের ভাষা বুঝি। মুখের ভাষার ব্যবহারে দুই প্রকার সীমাবদ্ধতা আছে; পরস্পর আলাপ ও বার্তাবিনিময় তখনই সম্ভব হয় যখন বক্তা ও শ্রোতা একই সময়ে একই স্থানে অবস্থিত থাকেন। বর্তমান কালে বিজ্ঞানের সমূহ অগ্রগার ফলে অবশ্য দূরভাষ (টেলিফোন), চলমান দূরভাষ (মোবাইল ফোন) বা বেতার (রেডিও), দূরদর্শন (টেলিভিশন) ইত্যাদি ব্যবস্থার সুবিধার কারণে বক্তা ও শ্রোতা শুধু সমকালবর্তী হইলেই চলে, সন্নিহিতভাবে থাকিবার প্রয়োজন হয় না। আবার, গ্রামোফোন ও টেপ-রেকর্ডারের ক্ষেত্রে বক্তা ও শ্রোতা সমস্থানে তো থাকেনই না, এমনকি সমকালেও থাকেন না; তবে সেক্ষেত্রে ভাষার কাজ যে আলাপচারিতা, তাহা চলে না; শুধু একতরফা বলা বা শোনাই হয়। তাই গ্রামোফোন ও রেকর্ডার মুখের ভাষা বহন করিলেও প্রকৃতপক্ষে লেখার ভাষার মতোই কাজ করে।

মুখের ভাষা যে স্থানে এবং যে সময়ে বলা হয়, সাধারণভাবে শুধুমাত্র সেই স্থান ও সময়ের মানুষই তাহা শুনিতে পান। অজ্ঞাতকে জানিবার উদগ্র নেশায় যুগ-যুগান্তর ধরিয়া মানুষ যে অতন্দ্র সাধনা করিয়া চলিয়াছে, নিজের জ্ঞান-সাধনার সেই দুর্লভ সম্পাজিকে, ভাব-ভাবনার সমূহ ফসলকে, নিজের বক্তব্যগুলিকে পরবর্তী কালের মানুষজনের কাছে পৌঁছাইয়া দিবার চিরন্তন আকাঙ্ক্ষাও তো তাহার রহিয়াছে। মুখের ভাষার সাহায্যে এক স্থানের ও এক কালের মানুষের পক্ষে অন্য স্থানের ও কালের মানুষের কাছে আপন অভিজ্ঞতাপ্রসূত ও সাধনালব্ধ বক্তব্য-বিষয়গুলি পোঁছাইয়া দিবার অক্ষমতার দুর্লঙ্ঘ্য বাধা তাহাকে অতিক্রম করিতেই হইবে। মুখের ভাষার এই স্থান-কালের দ্বিবিধ সীমাবদ্ধতাকে জয় করিয়া অনুপস্থিত অজ্ঞাত অনাগত উদ্দিষ্টদের কাছে ইহাকে সযত্ন পৌঁছাইয়া দিতে মানুষ একটি অমূল্য মাধ্যম আবিষ্কার করিল মুখনিঃসৃত বাঙ্গয় ধ্বনির এক দৃশ্যরূপ সৃষ্টি করিল, যাহাকে লিপি-পদ্ধতি বলা হয়।

লিপিবদ্ধ হইলে তবেই তো ভাষা স্থায়িত্ব লাভ করিতে পারে। লিপির উদ্ভবের মাধ্যমে মানুষের মুখের ভাষার স্থায়ী রূপায়ণ সম্ভব হইয়াছে। ইহার দ্বারা মুখের ভাষাকে যেমন এক স্থান হইতে স্থানান্তরে লইয়া যাওয়া যায়, তেমনি ইহাকে এক কাল হইতে সার্থকভাবে পরবর্তী কালের জন্য রাখিয়া দেওয়াও যায়। ফলে মুখে বলা ও কানে শোনার সেই ভাষা চোখে দেখা ও পড়িবার বস্তুতে রূপায়িত হইয়া গেল; প্রধানত শ্ৰব্য ভাষা দৃশ্য লিপিতে পরিবর্তিত হইল। সুতরাং, লিপির সংজ্ঞার্থ কী বলিতে পারি?

৪। লিপি ও ভাষার স্থানান্তরযোগ্য এবং পরবর্তী যুগের জন্য সযত্ন সংরক্ষণযোগ্য এক সাংকেতিক দৃশ্যরূপ ও স্থায়ী উপস্থাপনাকেই লিপি বলা হয়। মানবমনের সুচিন্তিত ভাব-সম্পদকে স্থান-কালের সীমা অতিক্রম করিয়া চিরস্থায়ী করিয়া তুলিতে এই যে লিপির উদ্ভব, তাহা যুগে যুগে মানুষের দীর্ঘকালব্যাপী নানা পরিকল্পনা-প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি। আদিমকাল হইতে চিত্রলিপি, গ্রন্থিলিপি, ভাবলিপি, চিত্রপ্রতীকলিপি, ধ্বনিলিপি (শব্দলিপি, দললিপি ও বর্ণলিপি) প্রভৃতির নানা স্তরের মাধ্যমে ক্ৰমবিকাশ ঘটিয়া আধুনিককালে লিপির এই বর্তমান রূপটি গড়িয়া উঠিয়াছে।

স্থান ও কালের ব্যবধানে অবস্থিত অগণিত শ্রোতা ও পাঠকের উদ্দেশ্যে লেখার ভাষা ব্যবহৃত হয়; তাই লেখার ভাষার গঠন মুখের ভাষা হইতে কিছুটা পৃথক্‌, ধারাবাহিক আদর্শের সনুসারী। লেখার ভাষা লেখকের সুস্থ মস্তিষ্কপ্রসূত ও লেখনী-নির্গত একমুখী স্রোতের ধারা, তাহা অবাধ স্বচ্ছন্দগতি; ইহাতে বাধা যেমন নাই, আলাপেরও কোনো অবকাশ নাই। মুখের ভাষা একেবারে আটপৌরে সহজ সরল স্বতঃস্ফূর্ত সাবলীল; কিন্তু লেখার ভাষা পোশাকী, তাই খানিকটা কৃত্রিম। মুখের ভাষা ক্ষণিক, লেখার ভাষা স্থায়ী; বক্তা মনে যাহা ভাবেন হয়তো তাহাই বলিতে পারেন, কিন্তু লেখক মননশীল, সংযত; মনের চিন্তা-ভাবনাকে পরিশীলিত ও মার্জিত করিয়া তবেই তিনি কলমের মুখে আনেন।

স্থান ও গোষ্ঠীবিশেষে মুখের ভাষায় অল্পবিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু লেখার ভাষায় কথ্য বা মৌখিক ভাষার সর্বজনগ্রাহ্য সাধারণ রূপটিই পরিগৃহীত হয়। তাই অঞ্চলভেদে কথ্য ভাষায় রূপভেদ থাকিলেও লেখার ভাষায় আঞ্চলিক বৈচিত্র্য বা বৈষম্য থাকে না।

ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিসমষ্টির কোনো সুনির্দিষ্ট সর্বসাধারণ রূপ নাই। বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন প্রকার ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহৃত হয়, কারণ, প্রতিটি ভাষারই ধ্বনি, শব্দ বা পদবিন্যাস রীতির নিজস্ব কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য রহিয়াছে। ইংরেজী ভাষার ধ্বনি সমাবেশ-বিধি, পদগঠন-পদ্ধতি বা বাক্যনির্মাণ-রীতি বাংলা, সংস্কৃত বা হিন্দী ভাষার নিয়মাবলীর সহিত পুরাপুরি মিলিয়া যায় না। আবার বিশ্বব্যাপী বিপুল মানবগোষ্ঠীর সকলেই তো আর একই ভাষা ব্যবহার করেন না।

৫। ভাষা-সম্প্রদায় : যে জনসমষ্টি নিজেদের মধ্যে ভাবপ্রকাশ ও ভাববিনিময়ের জন্য একই ধরনের ধ্বনিসমষ্টির বিধিবদ্ধ বিশিষ্ট রূপটি ব্যবহার করে, ভাষা-বিজ্ঞানীরা তাহাকে একটি ভাষা-সম্প্রদায় বা ভাষা-গোষ্ঠী (Speech Community) বলিয়া আখ্যা দিয়াছেন।

যেমন : ছাত্রছাত্রীরা তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছ থেকে শেখে’–এই ধ্বনিসমষ্টি একটি নির্দিষ্ট ক্রম-অনুসারে বিন্যস্ত করিয়া যে ভাব প্রকাশ করা হইয়াছে, তাহা শুধু বাঙালীরাই ব্যবহার করেন এবং ইহার দ্বারা প্রকাশিত ভাবটি কেবল বাঙালীরাই বুঝিতে পারেন। তেলুগু, মারাঠী বা উর্দু ভাষাভাষী মানুষেরা, যদি তাহারা বাংলা ভাষা না জানেন, কিছুতেই এই বাক্যটির অর্থ বুঝিতে পারিবেন না। সেইজন্য বাঙালীদের একটি ভাষা-সম্প্রদায় বলা যায়। এই একই ভাব প্রকাশের জন্য অন্যান্য ভাষা-সম্প্রদায় অন্য ধরনের ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহার করিবেন। যেমন, এক্ষেত্রে ইংরেজরা বলিবেন–”Students learn from their teachers, বিদেশে এইরকম ফরাসী, চীনা, জাপানী, জার্মান প্রভৃতি নানা ভাষা-গোষ্ঠী যেমন রহিয়াছে, আমাদের দেশেও তেমনি গুজরাটী, তামিল, কানাড়ী, অসমিয়া, ওড়িয়া প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষা-সম্প্রদায় আছে।

কিন্তু এক-একটি ভাষা-সম্প্রদায় যে ভাষার মাধ্যমে ভাববিনিময় করে, সেই গোষ্ঠীর সকলেই যে সেই নির্দিষ্ট ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহার করিয়া সম্পূর্ণ অবিকৃতভাবে সেই ভাষায় কথা বলেন, তাহা না-হইতেও পারে। কথ্য ভাষা ধরিয়া বিচার করিলে দেখা যায়, ভাষা-সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বৃহৎ সমাজে ব্যবহৃত ভাষায় অল্পবিস্তর বৈষম্য থাকে। পাশাপাশি অঞ্চলের মৌখিক ভাষায় এই বৈষম্য সর্বদা খুব স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান না হইতে পারে, কিন্তু যে ভাষা-গোষ্ঠীর এলাকা বিস্তৃত এবং লোকসংখ্যা অনেক বেশি, সেই গোষ্ঠীর দুই প্রান্তে বসবাসকারী লোকেদের মধ্যে বার্তাবিনিময় ঘটিলে এক অঞ্চলের লোকের মুখের কথা অন্য অঞ্চলের মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণরূপে বোধগম্য না হইবার যথেষ্ট সম্ভাবনা। রহিয়াছে। প্রধানত ধ্বনি-পরিবর্তনের মধ্য দিয়াই এই রূপান্তর লক্ষ্য করা যাইলেও শব্দের রূপে এবং প্রয়োগেও এই পার্থক্য দেখা যায়।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ-সংলগ্ন বিহার ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের প্রান্তিক অঞ্চল, প্রতিবেশী অঞ্চল মানভূম, সিংভূম, অসম রাজ্যের কাছাড় ও ত্রিপুরা রাজ্যের বাঙালী-অধ্যুষিত বিশাল জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষা-সম্প্রদায়ের মানুষ। ইহা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের হুগলী-হাওড়া অঞ্চলের সহিত বাংলাদেশের বরিশালের কথ্য ভাষার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। যেমন : প্রথম অঞ্চলের লোকেরা যেখানে বাড়ি, চাকর, ঢাক, ভাই, ছিল, পেয়েছে বলেন, দ্বিতীয় অঞ্চলের লোকেরা সেখানে যথাক্রমে বারি, চাহর, ডাক, বাই, আছিল ও পাইছে বলেন। পশ্চিমবঙ্গের ‘ছেলে’ বরিশালের মানুষের কথ্য ভাষায় ‘পোলা’ বা ‘ছাওয়াল’-এ পরিণত হইয়াছে, পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা ‘সঙ্গে’ বলিলে বাংলাদেশের লোকেরা বলেন ‘লগে’ বা ‘সাথে’।

একই ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত দুটি অঞ্চলের মধ্যে দূরত্বজনিত ব্যবধান যত বৃদ্ধি পায়, দুটি স্থানের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্রটিও ততই ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া পড়ে; ফলে তাহাদের উচ্চারিত ধ্বনি, ভাষারীতি, এমন কি বাচনভঙ্গিমার মধ্যেও যথেষ্ট তফাত দেখিতে পাওয়া যায়। বীরভূম ও বর্ধমান, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া অঞ্চলগুলি পাশাপাশি অবস্থিত বলিয়া এই অঞ্চলের অধিবাসীদের মুখের ভাষা অনেকটা একইরকম; বীরভূমের লোকের কথা বর্ধমানের লোকেরা সহজেই বুঝিতে পারেন। অথচ পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার কোন মানুষ বাংলাদেশের চট্টগ্রামের লোকেদের কথ্য ভাষা প্রায় কিছুই বুঝিতে পারিবেন না। উভয়ে একই ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও দুটি অঞ্চলের দূরত্বগত ব্যবধান, যোগাযোগের মেলামেশার ও কথাবার্তা বলার সুযোগের নিদারুণ অভাবই উভয়ের মধ্যে উচ্চারিত ধ্বনির ও ভাষারীতির বিস্তর পার্থক্য গড়িয়া তুলিয়াছে। অঞ্চলবিশেষে কথ্য ভাষার মধ্যে এই স্বাতন্ত্র্য হইতেই উপভাষা সৃষ্টি হয়। তাহা হইলে উপভাষার সংজ্ঞার্থ কী বলিতে পারি?

৬। উপভাষা ও একই ভাষা-সম্প্রদায়ের অন্তর্গত অঞ্চলভেদে দৈনন্দিন ব্যবহারিক কাজে ও কথাবার্তায় ধ্বনিগত, রূপগত এবং বিশিষ্ট বাগধারাগত বৈশিষ্ট্য লইয়া যে ভাষা প্রচলিত থাকে, তাহাকে উপভাষা বলে। একই ভাষার অন্তর্গত এক-একটি বিশেষ অঞ্চলে প্রচলিত উপভাষাগুলির বিশেষ রূপের সহিত আদর্শ ভাষা বা সাহিত্যিক ভাষার ধ্বনি, রূপ ও বাধারার ব্যবহারে অনেক পার্থক্য থাকে।

সব ভাষা-গোষ্ঠীরই উপভাষা থাকে না। সাধারণত ক্ষুদ্র ভৌগোলিক সীমার মধ্যে নিতান্ত অল্পসংখ্যক মানুষ লইয়া কোনো ভাষা-সম্প্রদায় গড়িয়া উঠিলে সেখানে কোনো উপভাষা পরিলক্ষিত হয় না। কারণ, ছোট্ট পরিসরে সকলের সহিত সকলের ঘনিষ্ঠ আদান-প্রদান, বাগবিনিময়ের পরিপূর্ণ সুযোগ থাকায় ব্যক্তি বিশেষের উচ্চারণ-দোষ কিংবা ভুল প্রয়োগজনিত বিভেদ গড়িয়া উঠিবার কোনো অবকাশই থাকে না। কিন্তু একটি বিশাল এলাকা জুড়িয়া কোটি কোটি মানুষ লইয়া গড়িয়া উঠা ভাষা-সম্প্রদায়ের মধ্যে উপভাষার উদ্ভব অনিবার্য। কারণ, বৃহৎ ভূখণ্ডে এক অঞ্চলের মানুষের সহিত অতি-দূরবর্তী অন্য অঞ্চলের মানুষের মেলামেশা ও কথাবার্তার সুযোগ ক্ষীণ হওয়ায় কালক্রমে উভয় স্থানের কথ্য ভাষার তফাত গড়িয়া উঠে, যাহা হইতে আঞ্চলিক ভাষা-গোষ্ঠী বা উপভাষার। সৃষ্টি হয়। এইভাবেই বাংলা ভাষা-গোষ্ঠী পাঁচটি প্রধান ঔপভাষিক অঞ্চলে বিভক্ত হইয়া গিয়াছে–রাঢ় অঞ্চলে রাঢ়ী উপভাষা, বরেন্দ্রভূমি অঞ্চলে বরেন্দ্রী উপভাষা, বঙ্গাল ভূমিতে বঙ্গালী, ঝাড়খণ্ড অঞ্চলে ঝাড়খণ্ডী এবং কামরূপে কামরূপী উপভাষার সৃষ্টি হইয়াছে।

ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, জলপ্লাবন ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে কিংবা রাষ্ট্রবিপ্লবের ফলে কোনো উপভাষা-সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুত কিছু পরিবার সমষ্টিগতভাবে স্বদেশ ত্যাগ করিয়া অন্যত্র উপনিবেশ গড়িয়া তুলিয়া বসবাস করিতে পারে। মূল স্থান হইতে পরিভ্রষ্ট এবং প্রধান ভাষা-সম্প্রদায় হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন সেই উপভাষা কালক্রমে সুযোগ পাইলে একটি মূল ভাষা-সম্প্রদায়ে পরিণত হইতে পারে। লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাইলে, জীবিকা ও শিক্ষা সহজলভ্য হইলে, মনীষী ও বলিষ্ঠ লেখকের আবির্ভাব ঘটিলে, কিংবা ধর্মবাণীর বাহনরূপে গৃহীত হইলে উপভাষা আপন পথ ধরিয়া বিকশিত হইয়া কালক্রমে নূতন ভাষা বলিয়া পরিগণিত হয়। এক সময় সমগ্র মধ্য-ইউরোপে জার্মানিক ভাষা প্রচলিত ছিল। খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দের কিছু পূর্বে এই ভাষা-সম্প্রদায়ের একাধিক দল বিচ্ছিন্ন হইয়া ইংলন্ডে আসিয়া উপনিবিষ্ট হইয়াছিল; সেই দলের একটি উপভাষা নিজের পথ ধরিয়া বিকশিত হইয়া আধুনিক কালের শ্রেষ্ঠ ভাষা ইংরেজীতে পরিণত হইয়াছে। জার্মানিক ভাষা-সম্প্রদায়ের আরো কয়েকটি দল বিচ্ছিন্ন হইয়া বিভিন্ন দেশে গিয়া আইসল্যান্ডিক, নরওয়েজীয়, সুইডিশ, দিনেমার, ওলন্দাজ প্রভৃতি ভাষার সৃষ্টি করিয়াছে, আর যে দলটি ওইখানেই থাকিয়া গিয়াছিল, তাহাদের উপভাষাই কালক্রমে আধুনিক জার্মান ভাষায় পরিণত হইয়াছে।

সারা পৃথিবীর প্রায় চার হাজার ভাষাকে তাহাদের মূলীভূত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে প্রধানত তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের পদ্ধতির সাহায্যে যে কয়েকটি ভাষা-বংশে বগীকৃত করা হইয়াছে, তাহাদের মধ্যে নানা কারণে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হইল ইন্দো-ইউরোপীয় বা মূল আর্য ভাষাবংশ। এই ভাষাবংশ হইতে জাত ভাষাগুলি পৃথিবীর দুই বিশাল মহাদেশ এশিয়া ও ইউরোপের বহু অঞ্চলে প্রচলিত রহিয়াছে। শুধু ভৌগোলিক বিস্তারেই নয়, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতেও এই ভাষাবংশ হইতে জাত প্রাচীন ও আধুনিক ভাষাগুলি পৃথিবীতে প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। এই বংশের প্রাচীন ভাষা সংস্কৃত, গ্রীক ও ল্যাটিন এবং আধুনিক ভাষা ইংরেজী, জার্মান, ফরাসী, ইতালীয়, বাংলা প্রভৃতি সাহিত্য-সৃষ্টিতে এতই সমৃদ্ধ যে, ব্যাস-বাল্মীকি-হোমার-ভার্জিল-কালিদাস এবং শেক্সপীয়ার-গ্যেটে-দান্তে-পেত্রার্ক রবীন্দ্রনাথের অবিস্মরণীয় অবদান এখন আর কোনো বিশেষ ভাষা বা ভাষা বংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকিয়া সমগ্র বিশ্বসাহিত্যেরই অমূল্য সম্পরূপে বিবেচিত হয়।

বাংলা ভাষার আদি উৎস এই মূল আর্য ভাষাবংশ হইতে দীর্ঘকাল ব্যাপিয়া নানারূপ স্বাভাবিক পরিবর্তন ও ক্রমবিকাশের ধারায় মধ্যবর্তী অনেকগুলি স্তর পার হইয়া বাংলা ভাষা জন্মলাভ করিয়াছে। মূল আর্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী তাহাদের আদি বাসস্থান দক্ষিণ রাশিয়ার উরাল পর্বতের পাদদেশ হইতে আনুমানিক ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের নিকটবর্তী সময় হইতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়াইয়া পড়িতে শুরু করে। ভারতীয় আর্য উপশাখাঁটি আনুমানিক ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ভারতে প্রবেশ করিবার পর হইতে প্রাচ্য, প্রাচ্যা প্রাকৃত, মাগধী প্রাকৃত, মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ প্রভৃতি নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়া আনুমানিক ৯০০ হইতে ১০০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বাংলা ভাষাটির জন্ম দিয়াছে।

ভৌগোলিক, রাষ্ট্রিক, সামাজিক ইত্যাদি কারণে যেমন এক ভাষা হইতে একাধিক উপভাষার উদ্ভব হইতে পারে, তেমনি কোনো একটি উপভাষা শক্তিশালী হইয়া অন্য উপভাষাগুলিকে নিজের আওতায় আনিয়া কিংবা লুপ্ত করিয়া এককভাবে পূর্ণ ভাষারূপে উদ্ভূত হইতেও পারে। বহুজনভাষিত কোনো ভাষায় সামান্য কিছুও স্থায়ী সাহিত্যকীর্তি রচিত হইলে সেই ভাষা কখনই পুরাপুরি মুখের ভাষা হইতে পারে না; সাহিত্যে শিক্ষায় বক্তৃতায় আইন-আদালতে বেতার-দূরদর্শন বা সংবাদপত্রে সর্বত্রই ভাষা-সম্প্রদায়ের অন্তর্গত সকলে ভাষাটির একটি সর্বজনীন আদর্শ রূপ ব্যবহার করেন, কিন্তু শিক্ষিত মনের অনুশীলনের বাহিরে, ঘরে ও প্রতিদিনের কাজকর্মে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকেরা নিজের অঞ্চলে হুবহু ভাষার সেই শিষ্টরূপটির পরিবর্তে আঞ্চলিক উপভাষাই ব্যবহার করেন।

যে ভাষা-সম্প্রদায়ে একাধিক উপভাষা রহিয়াছে, সেখানে ভদ্র-সমাজে ও লেখাপড়ায় সর্বজনব্যবহার্য শিষ্টভাষাটির মুলে কোনো একটি বিশেষ উপভাষা থাকে। সেই উপভাষাটির সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রিক সামাজিক বা বাণিজ্যিক প্রাধান্যের জন্য কিংবা উপভাষাটিতে বলিষ্ঠ যশস্বী কবি-সাহিত্যিক-মনীষীর আবির্ভাবের কারণে সেই বিশেষ উপভাষাটিই প্রবল ও বহুব্যবহৃত হইয়া অন্যান্য উপভাষাগুলিকে আচ্ছন্ন করিয়া একচ্ছত্র হইয়া উঠে। সুতরাং দেখা যাইতেছে, ভাষার মধ্যে যেমন কয়েকটি উপভাষা থাকে, তেমনি কয়েকটি উপভাষা হইতে। নূতন ভাষাও গড়িয়া উঠে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলা ও অসমিয়া প্রথমে একই ভাষার দুটি উপভাষা ছিল; পরে ইহাদের মধ্যে আঞ্চলিক পার্থক্য বৃদ্ধি পাইল, উভয় জনগোষ্ঠী সংস্কৃতির দিক্ হইতে পৃথক্‌ হইয়া গেল, দুটি উপভাষাতেই কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টি হইতে লাগিল এবং উপভাষা-দুটির কথ্য রূপের মধ্যে পারস্পরিক বোধগম্যতার অভাব দেখা দিল। ফলে আঞ্চলিক রূপ-দুটিকে বাংলা ও অসমিয়া নামে দুইটি স্বতন্ত্র ভাষারূপে চিহ্নিত করা হইল।

ভাষা ও উপভাষা-বিষয়ে এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা করা হইল, তাহা হইতে, আশা করি, এইটুকু বুঝিতে পারিয়াছ যে, কালগত স্থানগত সামাজিক রাজনীতিক সাহিত্যিক প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে ভাষা ও উপভাষার মধ্যে নানা পার্থক্য থাকিলেও উভয়ের মধ্যে একটি অটুট নাড়ির যোগ রহিয়াছে। উপভাষা ভাষার কোনো উপবিভাগ নহে। সবগুলি উপভাষাই বাংলা ভাষার বিশিষ্ট রূপটি প্রকাশ করিতেছে। ইহাদের কোনো একটিকে বাংলা ভাষারূপে চিহ্নিত করা যায় না; আবার কোনো একটিকে বাদ দিয়াও বাংলা ভাষার পরিচয় পাওয়া যায় না। গদ্য-পদ্য সাধু-চলিত সব ধরনের লেখ্য ভাষাও যেমন বাংলা, বাঁকুড়া মেদিনীপুর চট্টগ্রাম ঢাকা নদীয়ার মানুষের কথ্য ভাষাও তেমনই বাংলা।

ভাষা-বিজ্ঞানের আধুনিক ধারণার ভিত্তিতে বলা যায়, কোনো ভাষা-গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভাব-বিনিময়ের একটি বিমূর্ত নিরাকার ব্যবস্থা (Abstract System) হইল ভাষা, আর উপভাষা সেই ব্যবস্থার মূর্ত (Concrete) গঠন অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ব্যবহারিক রূপ। সব উপভাষারই কথ্য (মৌখিক) ও লেখ্য (লিখিত) দুইটি রূপ আছে; তবে লেখ্য-রূপটি সমাজের সর্বস্তরে মান্যতা পায় বলিয়া কোনো ভাষার পরিচয় দিতে হইলে কেবল তাহার লেখ্য রূপটিরই উদাহরণ দেওয়া হয়। কিন্তু লেখ্য ভাষাও তো একটি উপভাষা মাত্র। এই লেখ্য উপভাষার দুইটি রূপ–গদ্য ও পদ্য; ভাষারীতি অনুযায়ী, বাংলা গদ্যের সাধু ও চলিত দুইটি উপবিভাগ রহিয়াছে।

কথ্য উপভাষা দৈনন্দিন কথাবার্তায় এবং লেখ্য উপভাষা সাহিত্য-রচনায় ও চিঠিপত্র লেখায় ব্যবহৃত হয়। তবে কথ্য বা লেখ্য যাহাই হউক না কেন, প্রতিটি উপভাষাই সম-মর্যাদাসম্পন্ন, কোনোটিই অন্য কাহারও তুলনায় উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট নয়। সবগুলি উপভাষার কথ্য ও লেখ্য রূপের সমবায়েই ভাষার প্রকৃত রূপটি উদঘাটিত হয়।

প্রতিটি ঔপভাষিক অঞ্চলের মানুষকে তাহার নিজস্ব উপভাষার মৌখিক রূপটির পাশাপাশি লেখ্য রূপটির সহিতও পরিচিত হইতে হয়। শিক্ষার্থীরাও বিদ্যালয়ে সহপাঠীদের সহিত কথ্য ভাষা-রূপটি ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে পাঠগ্রহণের সময় পাঠ্যপুস্তকের লেখ্য ভাষা-রূপটির সহিতও পরিচিত হইয়া যায়।

ভাষা ও উপভাষার পারস্পরিক সম্পর্ক

১) ভাষা একটি বৃহৎ অঞ্চলে প্রচলিত; উপভাষা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অঞ্চলে প্রচলিত।

২) ভাষার একটি সর্বজনীন আদর্শ রূপ থাকে; উপভাষা সেই আদর্শ ভাষার (Standard Language) আঞ্চলিক রূপ।

৩) ভাষায় কালজয়ী সাহিত্যকীর্তি রচিত হয়; উপভাষায় সাধারণত লোকগীতি বা লোকসাহিত্যই রচিত হয়, উচ্চাঙ্গের সাহিত্য বিশেষ রচিত হয় না।

৪) ভাষার নির্দিষ্ট ব্যাকরণ থাকে, বৈয়াকরণরা সেই ব্যাকরণ গ্রন্থাকারে রচনা করেন; উপভাষায় সাধারণত কোনো ব্যাকরণ লিখিত হয় না।

৫) একটি আদর্শ ভাষার এলাকার মধ্যে লেখ্য রূপটি এক হইলেও একাধিক উপভাষা প্রচলিত থাকে; তাই জনগণের মুখের ভাষা অঞ্চলভেদে বিভিন্ন হয়।

৬) ধ্বনি, রূপ এবং বাগধারার ব্যবহারে ভাষার সহিত উপভাষার বিশেষ ধরনের পার্থক্য দেখা যায়।

৭) একই ভাষা হইতে বিভিন্ন কারণে একাধিক উপভাষার সৃষ্টি হয়; উপভাষায় মননশীল সাহিত্য-ব্যাকরণ-চর্চার কারণে উপভাষা স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা পায়।

একই ভাষাভাষী এলাকার অন্তর্গত একাধিক অঞ্চলের ভাষায় আঞ্চলিক রূপগুলির মধ্যে যতদিন পর্যন্ত পারস্পরিক বোধগম্যতা (mutual intelligibility), থাকে, অর্থাৎ এক উপভাষার শ্রোতা যখন অন্য উপভাষার বক্তার কথা বুঝিতে পারেন, ততদিন পর্যন্ত সেই আঞ্চলিক রূপগুলিকে উপভাষা বলা হয়। কিন্তু আঞ্চলিক রূপগুলি পৃথক্ হইতে হইতে পারস্পরিক বোধগম্যতার সীমা অতিক্রম করিয়া গেলে তাহাদের আলাদা ভাষার উপভাষা বলা হয়। কিন্তু এই সাধারণ মানদণ্ডটির ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, নোয়াখালি বা চট্টগ্রামের বাঙালী নিজস্ব বাচনভঙ্গিমায় দ্রুত কথা বলিলে কলকাতা-হাওড়ার বাঙালী তাহার প্রায় কিছুই বুঝিতে পারিবেন না–যদিও বঙ্গালী ও রাঢ়ী একই বাংলা ভাষার দুইটি উপভাষা। অথচ উড়িষ্যা রাজ্যের ও পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের লোকেরা পরস্পরের মুখের ভাষা ভালোই বুঝিতে পারেন, যদিও বাংলা ও ওড়িয়া ভিন্ন ভাষা। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা বেতারে পঠিত অসমিয়া ভাষার সংবাদ শুনিয়া বা দূরদর্শনে প্রদর্শিত সংবাদ, নাটক ইত্যাদি দেখিয়া মোটামুটি বুঝিতে পারেন, কিন্তু বাংলা ও অসমিয়া আলাদা ভাষা।

তাহা হইলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে–দুই প্রান্তবর্তী উপভাষা পরস্পর সুবোধ্য না হইলে কিংবা সুবোধ্য হইলে কীভাবে বুঝা যাইবে তাহারা একই ভাষার অন্তর্গত কিনা। এক্ষেত্রে বক্তাকে প্রশ্ন করিয়া জানিতে হইবে–তিনি কোন্ ভাষায় কথা বলিতেছেন। দীঘার মানুষটি বলিবেন যে তিনি বাংলা ভাষায় কথা বলিতেছেন, কিন্তু চন্দনেশ্বরের ব্যক্তিটি জানাইবেন যে তিনি ওড়িয়া ভাষায় কথা বলিতেছেন। এক্ষেত্রে পাশাপাশি দুটি অঞ্চলের মানুষ একে অন্যের কথা ভালোভাবে বুঝিতে পারিলেও তাহাদের কথ্য উপভাষা দুটি ভিন্ন ভাষার অন্তর্গত। অপরপক্ষে, মৈমনসিংহের ও বর্ধমানের দুজন বক্তাই জানাইবেন যে, তাহারা বাংলা ভাষায় কথা বলিতেছেন, যদিও উভয়ের পারস্পরিক বোধগম্যতা প্রায় নাই বলিলেই চলে। সুতরাং, বক্তার নিজস্ব ভাষা-ধারণাটিই ভাষা-উপভাষা সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

একই ভাষার অন্তর্গত দুটি ভিন্ন উপভাষার মানুষ সভা-সমিতিতে, কোনো গণমাধ্যমে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে সর্বজনবোধ্য একটি সাধারণ ভাষাছাঁদ ব্যবহার করেন। যশোহরের বাসিন্দা ঘরোয়া কথাবার্তায় বঙ্গালী উপভাষা ব্যবহার করেন, পুরুলিয়ার অধিবাসী ঝাড়খণ্ডী উপভাষা ব্যবহার করেন, কিন্তু শিষ্ট সমাজে বাগবিনিময়ে কিংবা লেখায় তাহারা উভয়েই মান্য বাংলা উপভাষাটিই ব্যবহার করিয়া থাকেন।

আমাদের বাংলা ভাষায় বেতার-দূরদর্শনের নানা অনুষ্ঠানে, সংবাদপত্রের সংবাদ-পরিবেশনে, বক্তৃতা-ভাষণে ভাগীরথী নদীর উভয় তীরবর্তী কলকাতা হাওড়া ও সন্নিহিত অঞ্চলের মানুষের মার্জিত মৌখিক ভাষা ব্যবহৃত হয়। এই কথ্যভাষাটি পূর্ব ও দক্ষিণ রাঢ়ী উপভাষার অংশ। রাজনীতিক, আর্থনীতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক দিক্‌ হইতে গুরুত্বপূর্ণ কলকাতা ও তৎসন্নিহিত এলাকা; দেশের নানা স্থানের জনগণকে, এমনকি বিদেশীদেরও বিভিন্ন কাজের প্রয়োজনে এই জায়গায় আসিতে হয়; স্বাভাবিকভাবেই এই প্রভাবশালী অঞ্চলের কথ্য উপভাষাটিই সমগ্ৰ উপভাষা-অঞ্চলের মান্য উপভাষা হইয়া গিয়াছে।

পৃথিবীর প্রাচীন ও আধুনিক অন্যান্য সব ভাষার মতো বাংলা ভাষারও উপভাষা রহিয়াছে (যাহাদের সংখ্যা পাঁচ)। এইবার সেগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় গ্রহণ করিব।

উপভাষাগুলির ভৌগোলিক এলাকা ও ভাষাতাত্ত্বিক পরিচয়

(১) রাঢ়ী উপভাষা

মধ্য-পশ্চিম বাংলার এই উপভাষাটির ভৌগোলিক এলাকা বৃহত্তম। নিম্ন-দামোদর অঞ্চল হইতে ভাগীরথীর পূর্ব তীরের অঞ্চল পর্যন্ত এই উপভাষার স্থান। এই কথ্য উপভাষাটি সাধারণত পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, হাওড়া, হুগলী, নদীয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলার অধিবাসীরা ব্যবহার করেন।

এক-একটি উপভাষার অভ্যন্তরেও আবার নানা আঞ্চলিক পার্থক্য গড়িয়া উঠিতে পারে। উপভাষার (Dialect) মধ্যে গড়িয়া উঠা পৃথক্‌ আঞ্চলিক রূপকে বিভাষা (Sub-dialect) বলে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান উপভাষা রাঢ়ী; বিশাল ভৌগোলিক অঞ্চল ধরিয়া বিরাজ করার ফলে এই উপভাষাটির ভিতরও আবার অঞ্চল-বিশেষের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়–বর্ধমান-বীরভূমের লোকেরা যেভাবে কথা বলেন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসিন্দা ঠিক সেইভাবে বলেন না; পূর্ব মেদিনীপুরের কথ্য ভাষাটির সহিত কলকাতা-হাওড়ার মানুষের কথ্য ভাষার বেশ ফারাক দেখা যায়।

যদিও রাঢ়ী উপভাষাটির পূর্ব ও পশ্চিম–এই দুটি প্রধান বিভাগ রহিয়াছে, তবু সূক্ষ্মভাবে বিচার করিলে এই উপভাষাটিকে চারিটি ভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলি ভৌগোলিক অঞ্চলসহ উল্লিখিত হইল?

ক) পূর্ব-মধ্য রাঢ়ী ও কলকাতা, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনা।

খ) পশ্চিম-মধ্য রাঢ়ী : বর্ধমান, বীরভূম, পূর্ব বাঁকুড়া, হুগলী।

গ) উত্তর-মধ্য রাঢ়ীঃ নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ মালদহ।

ঘ) দক্ষিণ-মধ্য রাঢ়ী ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর।

রাঢ়ী উপভাষাগুচ্ছের কেন্দ্রীয় উপভাষা হইতে আধুনিক বাংলা চলিত ভাষার উদ্ভব হইয়াছে।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :

(১) আদ্য অ-কারের বিকৃত উচ্চারণ–অ-কারের পরে কিংবা পরবর্তী ব্যঞ্জনে ই ঈ উ ঊ ঋ য-ফলা থাকিলে, অথবা পরবর্তী ব্যঞ্জনটি ক্ষ (খিয়) বা জ্ঞ (গঁ) হইলে শব্দের আদিতে স্থিত ‘অ’-এর উচ্চারণ ‘ও’ হয়। যেমন : রবি (রোবি), অতি (ওতি), নদী (নোদি), মধু (মোর্ধ), বক্ষ (বোকখো ), সত্য (সোত), লক্ষ (লোখো), সন্ধ্যা (সোর্ধ), অরুণ (ওরুন্), অতুল (ওতুল), অমিত (ওমি)।

একদল (Mono-syllabic) শব্দের শেষে ন থাকিলে শব্দের আদিতে স্থিত ‘অ’ ‘ও’-কারের মতো উচ্চারিত হয়। যেমন : মন (মোন), জন (জো), বন (বোন্), ধন (ধোন্)।

(২) শব্দের মধ্যে বা শেষে স্থিত ব্যঞ্জনযুক্ত ই’ বা ‘উ’ বর্তমান বাংলাদেশের বঙ্গালী উপভাষায় ব্যঞ্জনটির অব্যবহিত পূর্বে উচ্চারিত হয়। এই প্রক্রিয়াকে অপিনিহিতি বলে। [ পৃঃ ১১০-১১১ দেখ ] যেমন : দেখিয়া > দেইখ্যা, করিয়া > কইর‍্যা, রাখিয়া > রাইখ্যা, শুনিয়া > শুইন্যা। পশ্চিমবঙ্গের রাঢ়ী উপভাষায় এই অপিনিহিতিরই পরবর্তী স্তর অভিশ্রুতি দেখা যায় [ পৃঃ ১১১-১১২ দেখ ]–অপিনিহিতি-জাত ই’ বা ‘উ’ ঠিক পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির সহিত মিশিয়া যায়, পরবর্তী স্বরটিকেও পরিবর্তিত করে। যেমন : দেইখ্যা > দেখে, কইর‍্যা > করে, রাইখ্যা > রেখে, শুইন্যা > শুনে, আইল > এল। এই অভিশ্রুতি রাঢ়ী উপভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

(৩) স্বরসঙ্গতির [ পৃঃ ১০৯-১১০ দেখ ] ফলে শব্দের মধ্যে পাশাপাশি বা কাছাকাছি অবস্থিত ভিন্ন স্বরধ্বনি একই স্বরধ্বনিতে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। যেমন : দেশি দিশি, বিলাতি–বিলিতি।

(৪) শব্দমধ্যস্থ নাসিক্য ব্যঞ্জন লুপ্ত হইয়া পূর্ববর্তী হ্রস্বস্বরটি দীর্ঘস্বর ও অনুনাসিক হইয়াছে। যেমন–চন্দ্র > চাঁদ, বন্ধ > বাঁধ; ইহাকে নাসিকীভবন [পৃঃ ৯৩ দেখ] বলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাসিক্যব্যঞ্জনের লোপ না হইলেও স্বরধ্বনিটি সানুনাসিক হইয়াছে। ইহা স্বতোনাসিকীভবন। [ পৃঃ ৯৩-৯৪ দেখ ] যেমন : পুস্তক > পুথি > পুঁথি; দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের (বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মানভুম, বীরভূম অঞ্চলে) বিভাষায় অস্থানে এমন অনুনাসিকের প্রচুর আগম দেখা যায়। যেমন : চা > চাঁ, কুকুর > কুঁকুর, খোকা > খোকা, সাপ > সাঁপ, কাঁচ > কাঁচ, ঘোড়া > ঘোড়া, হয়েছে ১ হইছে, হাসপাতাল > হাসপাতাল, হাসি > হাঁসি, ঘুড়ি > খুঁড়ি, টাকশাল > টাকশাল ইত্যাদি।

(৫) শব্দের প্রথম স্বরধ্বনিতে স্পষ্টভাবে শ্বাসাঘাত থাকিলে শব্দের শেষে অবস্থিত ব্যঞ্জনটির মহাপ্রাণ ধ্বনি (বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ণ) অল্পপ্রাণ ধ্বনিতে (বর্গের প্রথম ও তৃতীয় বর্ণ) পরিবর্তিত হইয়া যায়। যেমন : দুধ > দুদ, মাছ > মাছ, বাঘ ১ বাগ, সাঁঝ > সাঁজ, অবধি > অবদি, ধাই > দাই, মধু > মদু।

(৬) কখনও কখনও ঘোষধ্বনি (বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম বর্ণ) অঘোষধ্বনিতে (বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণ) পরিণত হয়। যেমন : ফারসী গুলাব > গোলাপ, ইংরেজী লর্ড (Lord) > লাড় > লাট।

আবার কোনো কোনো সময় শব্দের অন্তে অবস্থিত অঘোষধ্বনি ঘোষধ্বনিতে পরিবর্তিত হইয়া যায়। যেমন : ছত্র > ছাত > ছাদ, কাক > কাগ, শাক > শাগ।

(৭) ‘ল’ কোথাও কোথাও ‘ন’-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন : লেবু > নেবু, লঙ্কা > নঙ্কা, লুচি > নুচি, লবণ > নুন, লোহা > নোয়া, লাউ > নাউ।

(৮) শব্দমধ্যস্থ ‘র’ পরবর্তী ‘ল’-এর প্রভাবে ‘ল্‌’-এ পরিবর্তিত হয়। যেমন : সরল (উচ্চারণ–সোরলো) > সল, করল (কোরলো) > কল, ধরল > ধল, পারলাম > পাল্লাম, করলাম > কলাম, পারলে > পালে।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :

(১) কর্তৃকারকের বহুবচনে ‘গুলি’ ‘গুলো’ ‘গুলা’ প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। যেমন : ছেলেগুলো পুকুরে সাঁতার কাটছে। মেয়েগুলো চমৎকার নাচছিল। কিন্তু কর্তৃকারক ছাড়া অন্যান্য কারকের বহুবচনে ‘দের বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যেমন : কর্মকারক–তিনি আমাদের মিষ্টি খাওয়ালেন। করণকারক–তোদের দ্বারা একাজ হবে না। অপাদান–কথাটা তাদের কাছে শুনলাম।

(২) দ্বিকর্মিক ক্রিয়ার দুইটি করিয়া কর্ম থাকে–প্রাণিবাচক কর্মটিকে গৌণ কর্ম এবং বস্তুবাচক কর্মটিকে মুখ্য কর্ম বলে। ক্রিয়াটিকে কাহাকে প্রশ্ন করিয়া যে উত্তর পাই তাহা গৌণ কর্ম, আর কী প্রশ্ন করিয়া পাওয়া উত্তরটি মুখ্য কর্ম। রাঢ়ীতে গৌণ কর্মটি ‘কে’ বিভক্তিযুক্ত হয়, কিন্তু মুখ্য কর্মটি শুন্য বিভক্তিযুক্ত থাকে। যেমন : বিপ্লববাবু অর্পিতাকে (গৌণ) কলমটি (মুখ্য) দিলেন। শান্তনু সংগীতাকে (গৌণ) ক্যামেরা (মুখ্য) দেখাল।

সম্প্রদানকারকেও ‘কে’ বিভক্তির প্রয়োগ হয়। যেমন : ভিখারীকে ভিক্ষা দাও। দীনদুঃখীকে অন্নবস্ত্র দিলাম।

(৩) অধিকরণকারকে ‘এ’ ও ‘তে’ বিভক্তির প্রয়োগ হয়। যেমন : “ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে।” ছেলের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে বাবা ঘরে বসে দুশ্চিন্তা করছেন, আর মা দরজায় উদ্বিগ্নমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

(৪) সদ্য অতীত কালে প্রথমপুরুষের অকর্মক ক্রিয়াপদে ‘ল’ বিভক্তি যুক্ত হয়। যেমন : সে গেল। পাখিটা ছিল। তারা পেল। কিন্তু সকর্মক ক্রিয়াপদে ‘-লে’ বিভক্তি যুক্ত হয়। মেয়েরা বলে। ছেলেরা দিলে। তারপরে সবাই মজা করে খাবারগুলো খেলে।

(৫) সদ্য অতীতকালে উত্তমপুরুষের পদে ‘-লুম > -নু’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যেমন : আমরা দেখলাম। আমি বললুম (বানু)। আমরা করলুম (করনু)। ‘-লাম’, ‘-লেম’ বিভক্তিও প্রযুক্ত হয়। যেমন : আমরা অবাক হয়ে দেখলাম; এইমাত্তর খবরটা শুনলেম। “এলেম আমি কোথা থেকে।” “ঝুলি হতে দিলেম তুলে একটি ছোটো কণা।”

(৬) যৌগিক ক্রিয়াপদে মূল ধাতুর সহিত ‘আছ’ ধাতু যোগ করিয়া তাহার সহিত ক্রিয়ার কাল ও পুরুষের বিভক্তি যোগ করিয়া ঘটমান বর্তমান ও ঘটমান অতীতের রূপ গঠন করা হয়। যেমন : (কর + ইতে) + (আছ + ই) = করিতেছি > করছি। আমরা করছি। (ক + ইতে) + (আছ + ইল) = করিতেছিল > করছিল। সে করছিল।

(৭) মূল ক্রিয়ার অসমাপিকার রূপের সহিত ‘আছ’ ধাতু যোগ করিয়া তাহার সহিত ক্রিয়ার কাল এবং পুরুষবাচক বিভক্তি যোগ করিয়া পুরাঘটিত বর্তমান ও পুরাঘটিত অতীতের ক্রিয়ারূপ গঠন করা হয়। যেমন : (ক + ইয়া) + (আছ । + এ = করিয়াছে > করেছে। তারা করেছে। (ক + ইয়া) + (আছ + ইল)। = করিয়াছিল > করেছিল। সে করেছিল।

(২) বঙ্গালী উপভাষা

এটি প্রধানত পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের উপভাষা হইলেও সাধারণভাবে সমগ্র পূর্ববঙ্গেরই উপভাষা। এই উপভাষাটি রাঢ়ী উপভাষার মতোই অনেকখানি ভৌগোলিক অঞ্চল জুড়িয়া বিরাজ করিতেছে। এটি বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান উপভাষা।

বঙ্গালীর দুইটি বিভাষা–(ক) বিশুদ্ধ বঙ্গালী, যেটি ঢাকা, ফরিদপুর, মৈমনসিংহ, বরিশাল, খুলনা, যশোহর অঞ্চলে প্রচলিত এবং (খ) চাটিগ্রামী, যেটি চট্টগ্রাম ও নোয়াখালি এলাকায় প্রচলিত। ইহা ছাড়া সন্দীপ, শ্রীহট্ট, কাছাড়, ত্রিপুরা ও চাকমা অঞ্চলেও এই উপভাষাটি প্রচলিত আছে।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :

(১) বঙ্গালী উপভাষায় অপিনিহিতির প্রাচুর্য দেখা যায়, যেখানে শব্দমধ্যস্থ বা শেষস্থ ‘ই’ বা ‘উ’ তাহার পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনটির ঠিক পূর্বে উচ্চারিত হয়। অভিশ্রুতি ও স্বরসঙ্গতি নাই বলিয়া সরিয়া-আসা স্বরধ্বনিতে প্রাচীনত্ব খানিকটা রক্ষিত আছে। যেমন : আজি > আইজ (আ + জ + ই > আ + ই + জ), রাখিয়া > রাইখ্যা, করিয়া > কইর‍্যা, দেখিয়া > দেইখ্যা। ইহা ছাড়া–ফলা-যুক্ত ব্যঞ্জন, জ্ঞ ও ক্ষ-এর পূর্বেও অপিনিহিতির মতো একটি ই-গরের আগম হয়। যেমন : বাক্য > বাইক, যজ্ঞ > ইগ্‌গোঁ, কাব্য > কাইব্ব, সত্য > সইত্ত, ব্রাহ্ম > ব্রাইন্ম, রাক্ষস> রাইখ, লক্ষ > লইখো, গদ্য > গইল, পদ্য > পইদ্দ।

(২) নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনির (ঙ, ন, ম্ ইত্যাদির) লোপ হয় না, ফলে এই লোপের প্রভাবে পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির নাসিক্যীভবনের প্রক্রিয়া রাঢ়ী উপভাষার মতো বঙ্গালী উপভাষায় দেখিতে পাওয়া যায় না। রাঢ়ী উপভাষার চন্দ্রবিন্দু এই উপভাষায় ন-কারে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। যেমন : বন্ধন (তৎসম) > বাঁধন (রাঢ়ী) > বান্ধন (বঙ্গালী), চন্দ্র > চাঁদ > চান্দ, ক্ৰন্দন > কাঁদন > কান্দন, রন্ধন > রাঁধন ১ রান্ধন।

(৩) উচ্চ-মধ্য অর্ধ-সংবৃত সম্মুখ স্বরধ্বনি ‘এ’ বঙ্গালীতে নিম্ন-মধ্য অর্ধ-বিবৃত সম্মুখ স্বরধ্বনি অ্যা’-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন : দেশ (এ-কারের স্বাভাবিক উচ্চারণ) > দ্যাশ, শেষ > শ্যা, মেঘ > ম্যাঘ, নেতা > ন্যাতা, লেখা > ল্যাখা, রেখা > র‍্যাখা, সেতু > স্যাতু, কেন > ক্যান, তেল > ত্যাল।

(৪) উচ্চ-মধ্য অর্ধ-সংবৃত পশ্চাৎ স্বরধ্বনি ‘ও’ উচ্চ-সংবৃত পশ্চাৎ স্বরধ্বনি ‘উ’-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন : লোক > লুক, ভোর > ভুর, দোষ > দুষ, চোর .. > চুর, বোন > বুন, সোদপুর > সুদপুর, পোলা > পুলা, ঘোড়া > ঘুড়া।

(৫) সঘোষ মহাপ্রাণ বর্ণ (বর্গের চতুর্থ বর্ণ ঘ,,,, ভ) সঘোষ অল্পপ্রাণ (বর্গের তৃতীয় বর্ণ গ, জ, জু, দ, ব) রূপে উচ্চারিত হয়। এগুলি উচ্চারণকালে স্বরতন্ত্রী-দুটি যুক্ত হইয়া স্বরপথ রুদ্ধ করিয়া দেয় এবং বাহির হইতে বায়ু আকর্ষণ করিয়া উচ্চারণ করিতে হয়। এইজন্য এগুলি রুদ্ধস্বরপথ-চালিত অন্তর্মুখী ধ্বনি; কেহ কেহ এগুলিকে কণ্ঠনালীয় স্পর্শযুক্ত অবরুদ্ধ-ধ্বনিও বলিয়াছেন। যেমন : ভাই > বাই, ভাত > বাত, ঘর > গর, ঘা > গা’, ঘোড়া > ঘুড়া > গুড়া।

(৬) তাড়িত ধ্বনি ড’, ‘ঢ় কম্পিত ধ্বনি ‘র’-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন : বাড়ি > বারি, বড় > বর, ঘোড়া > ঘোরা।

(৭) চ, ছ, জ প্রভৃতি ঘৃষ্টধ্বনি বালীতে প্রায় উষ্মধ্বনিরূপে উচ্চারিত হয়। বর্ণগুলি উচ্চারণকালে বাতাসে বাগ্যঙ্কের সামান্য ঘর্ষণে উষ্মধ্বনির স্পর্শ লাগে বলিয়া চ্’ ছ’ ও ‘জ’ যথাক্রমে ‘ৎস্, স্’ এবং ইংরেজী Z-এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন : কিছু > কিৎসু (কি), গাছতলা > গাতলা, খেয়েছে > খাইসে, করছে > করসে, যাও > Zও, জানতে : ZIন্তি, শুনছে > শুনসে।

(৮) শব্দের আদিতে ও মধ্যে স্থিত হকার লুপ্ত হইয়া অ-কার উচ্চারিত হয়। যেমন : হয় > অয়, শহর > শর, কাহন > কাওন।

(৯) স ও শ-স্থানে হ উচ্চারিত হয়। যেমন : শাক > হাগ, বসো > বহা, সে > হে, সকল > হগল, শালা > হালা, শুন > হুন।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য : (১) শব্দরূপে কর্তৃকারকে সর্বত্র ‘এ’ বিভক্তি হয়। যেমন : রামে গেছে। শ্যামে খাইছে। মাযে ডাকে। রহিমে দেখে। বাপে কলো।

(২) গৌণ কর্মে এবং সম্প্রদানকারকে ‘-রে’ বিভক্তি যোগ হয়। যেমন : আমাবে বাত দাও। অগোরে খাইতে দাও। শ্যামেরে কইসি। গরিব মানূসেরে ক’টা টাকা দাও।

(৩) অধিকরণকারকে ‘-ত’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যেমন : বাড়িত থাকুম। হাঁড়িত ভাত।

(৪) কর্তৃকারক ছাড়া অন্য কারকে বহুবচনে ‘-গো’ বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। যেমন : আমাগো খাইতে দিবা। তোমাগো বাত দিবা কি? অগো দশটা টাকা দিবা। আমাগোর (আমাদের), তোমাগোর (তোমাদিগের)।

(৫) রাঢ়ী উপভাষায় যাহা সাধারণ বর্তমানের ক্রিয়ারূপ, বঙ্গালী উপভাষায় তাহাই ঘটমান বর্তমান অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন : মায়ে ডাকে (ডাকিতেছে)। বাপে কয় (বলিতেছে)।

(৬) সদ্য অতীতে উত্তমপুরুষের ক্রিয়ায় ‘-লাম’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যেমন : আমরা দেখিলাম। আমি খাইলাম। আমরা পাইলাম।

(৭) রাঢ়ীতে ঘটমান বর্তমানের যাহা বিভক্তি, তাহাই বঙ্গালীতে পুরাঘটিত বর্তমানের বিভক্তিরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন : আমি করসি (< করছি) [ আমি করিয়াছি অর্থে ]। রাঢ়ীতে করছিশব্দের অর্থ করিতেছি, কিন্তু করসি’বঙ্গালীতে করিয়াছি’ বোঝায়।

(৮) মধ্যমপুরুষের সাধারণ ভবিষ্যৎ কালে ‘-বা’ বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। তুমি বাড়ি যাবা। তোমরা খাবা না?

(৯) উত্তমপুরুষে সাধারণ ভবিষ্যৎ কালে ‘-মু’ ও ‘-উম’ বিভক্তি যুক্ত হয়। যেমন : আমি খামু (খাইব অর্থে)। আমরা খেলুম (খেলিব)। আমি দেখুম (দেখিব না। আমরা রাতে যামু (যাইব)।

(১০) রাঢ়ীতে অতীত কালের ক্রিয়ার সহিত যুক্ত নঞর্থক অব্যয়টি ‘নি’, কিন্তু বঙ্গালীতে তাহা ‘নাই’। যেমন : আমরা খাই নাই (খাইনি অর্থে)। তুমি যাও নাই (যাওনি)? আমি দেখি নাই (দেখিনি)।

(১১) অসমাপিকার সাহায্যে গঠিত যৌগিক ক্রিয়ায় সম্পন্ন কালের মূল ক্রিয়াটি আগে বসে, অসমাপিকা ক্রিয়াটি পরে বসে। যেমন : শ্যাম পাসে গিয়া (চলিয়া গিয়াছে অর্থে)।

(১২) বঙ্গালীর প্রধান বিভাষা চাটিগ্রামীতে সৃষ্ট ব্যঞ্জনে ব্যাপক উষ্মীভবন লক্ষণীয়। যেমন : কালীপূজা > খালীফুজা।

(১৩) ক্রিয়ার ঘটমান বর্তমানের রূপ—’ত্যাছি’, ‘-ত্যাছ’, ‘-ত্যাহে’ দ্বারা নিষ্পন্ন হয়। আমরা কইত্যাছি (করিতেছি অর্থে)। তুমি খাইত্যাছ (খাইতেছ)। তারা ঘুমাইত্যাছে (ঘুমাইতেছে)।

(৩) বরেন্দ্রী উপভাষা

পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা রাঢ়ী এবং উত্তরবঙ্গের উপভাষা বরেন্দ্রীর মধ্যে খুব অল্প পার্থক্য দেখা যায়, কারণ ইহারা মূলত একই উপভাষা ছিল। পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গের উপভাষা বঙ্গালী এবং বিহারের ভাষা বিহারী উত্তরবঙ্গের ভাষার সহিত কিছুটা মিশিয়া যাওয়ায় ইহাদের প্রভাবে এই উপভাষাটিতে কিছু স্বাতন্ত্র্য গড়িয়া উঠে। ফলে বরেন্দ্রী একটি স্বতন্ত্র উপভাষায় পরিণত হয়।

এই উপভাষাটি বরেন্দ্রভূমি অর্থাৎ উত্তরবঙ্গেই প্রচলিত। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া ইত্যাদি অঞ্চলে এই উপভাষাটির প্রচলন আছে।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :

(১) বরেন্দ্রীর স্বরধ্বনি অনেকাংশে রাঢ়ীরই মতো; রাঢ়ীর মতো বরেন্দ্ৰীতেও অনুনাসিক স্বরধ্বনি রক্ষিত আছে। তবে ‘এ’ স্থানে ‘অ্যা’ ব্যবহৃত হয়। যেমন : দ্যাও, দ্যান, দ্যাশ, ত্যাল, ম্যাগ।

(২) সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি (বর্গের চতুর্থ বর্ণ ঘূ, ঝ, ঢ, ধ, ভ) কেবলমাত্র শব্দের আদিতে বজায় থাকিলেও শব্দের মধ্য ও অন্ত্য অবস্থানে প্রায়ই অল্পপ্রাণ হইয়া গিয়াছে। যেমন : বাঘ > বাগ, বিঘ্ন > বিগ্ন, আধখানা > আদখানা, মেঘ > ম্যাগ।

(৩) রাঢ়ীতে শ্বাসাঘাত সাধারণত শব্দের আদিতে পড়ে, বরেন্দ্ৰীতে শ্বাসাঘাতের কোনো সুনির্দিষ্ট স্থান নাই।

(৪) বঙ্গালী উপভাষার প্রভাবে বরেন্দ্ৰীতে জ প্রায়ই Z-এর মতো উচ্চারিত হয়।

(৫) শব্দের আদিতে যেখানে ‘র’ থাকিবার কথা নয়, সেইখানে ‘র’-এর আগম হয়। যেমন : আম > রাম, ইন্দুর > র‍্যান্দুর।

আবার, যেখানে ‘র’ থাকিবার কথা, সেইখানে র-এর লোপ হয়। রক্ত > অক্ত, রং > অং, রস > অস, রাস্তা > আস্তা। ইহার ফলে ‘আমের রস’ উত্তরবঙ্গের উচ্চারণে রামের (র-কারের আগম) অস’ (র-কারের লোপ) হইয়া দাঁড়ায়।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :

(১) শব্দ ও ধাতুরূপে বরেন্দ্র মোটামুটি রাঢ়ীরই মতো, তবে অধিকরণ কারকে কখনও-কখনও ‘-ত’ বিভক্তির প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন : ঘরত (ঘরে) থাক। বাড়িত (বাড়িতে) আছে। ঘরভ গেলাম। বনত বাগ আসে।

(২) সামান্য অতীতকালে উত্তমপুরুষে ‘লাম’ বিভক্তি যোগ হয়। যেমন : আমরা দেখলাম। আমি গেলাম। কলা (গাছ) গাড়লাম।

(৩) অতীতকালবাচক ক্রিয়াপদের প্রথমপুরুষে ‘-ল’ প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়। যেমন : আইল (আসিল বা এল), খাইল (খাইল বা খেল)।

(৪) পুরাঘটিত বর্তমান কালের ক্রিয়ায় অন্তিম ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব হয়। যেমন : আইচ্চে (আসিয়াছে বা এসেছে), খাইচ্চে (খাইয়াছে বা খেয়েছে)।

(৫) গৌণকর্মে ‘কে’ ‘ক’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। হামাক (আমাকে) দাও। (৬) অসমাপিকা ক্রিয়ার অভিশ্রুতি হয়। করিয়া > করে, দেখিয়া > দেখে।

(৭) সম্বন্ধপদে বহুবচনে ‘-দের’ বিভক্তির প্রয়োগ হয়। আমাদের, তাদের, তোমাদের।

.

(৪) কামরূপী (রাজবংশী) উপভাষা

এটি উত্তর-পূর্ব বঙ্গের উপভাষা। বরেন্দ্রী উত্তরবঙ্গের উপভাষা বলিয়া আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, বরেন্দ্রী উপভাষার সহিত কামরূপের ভাষাতাত্ত্বিক সাদৃশ্য বেশী থাকিবার সম্ভাবনা, কারণ এই দুইটি উপভাষার অঞ্চলের ভৌগোলিক নৈকট্য অন্যান্যদের তুলনায় বেশী। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা যায়, কামরূপীর সহিত বরেন্দ্রীর সাদৃশ্য খুব কমই আছে, কারণ বরেন্দ্রী প্রধানত রাঢ়ী উপভাষা হইতেই সৃষ্ট হইয়াছে। কামরূপী উপভাষাটি বরেন্দ্রী ও বঙ্গালী উপভাষাদ্বয়ের মধ্যবর্তী কতকগুলি বৈশিষ্ট্যে ইহা উত্তরবঙ্গের এবং কোনো কোনো বৈশিষ্ট্যে পূর্ববঙ্গের উপভাষার অনুরূপ। তবে, বঙ্গালীর সহিতই কামরূপী উপভাষার সাদৃশ্য বেশী রহিয়াছে। কামরূপী উপভাষাটিকে কামরূপের (অসমের) নিকটবর্তী অঞ্চলে বঙ্গালী উপভাষার রূপান্তর বলা যায়। কামরূপী উপভাষার পূর্ব অঞ্চলের বৈচিত্র্য হইতে অসমিয়া ভাষাটির উদ্ভব ও বিকাশ হইয়াছে।

জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দক্ষিণ দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, রংপুর, শ্রীহট্ট, কাছাড়, ত্রিপুরা, পশ্চিম গোয়ালপাড়া অঞ্চলে এই উপভাষাটি প্রচলিত।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :

(১) সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি (বর্গের চতুর্থ বর্ণ ঘূ, ঝ, ঢ, ধ, ভ) শব্দের আদিতে বজায় থাকিলেও মধ্য ও অন্ত্য অবস্থানে প্রায়ই অল্পপ্রাণ (বর্গের তৃতীয় বর্ণ) হইয়া যায়। সমঝা > সজা, বোঝা > বোজা।

(2) শ্বসাঘাতের তেমন নির্দিষ্ট স্থান নাই। তবে শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাতের জন্য ‘অ’ ‘আ’ হইয়া যায়। যেমন : অসুখ > আসুখ, অনল > আনল, অতি > আতি, কথা > কাথা।

(৩) বঙ্গালীর মতো কামরূপীতেও ‘ড’ ও ‘ঢ’ পরিবর্তিত হইয়া যথাক্রমে ‘র’ ও ‘রহু’-তে পরিণত হইয়াছে। যেমন : বাড়ি > বারি, আষাঢ় > আসার, শাড়ি > শারি। তবে কোচবিহারের উচ্চারণে ‘ড়’ অপরিবর্তিতই আছে।

(৪) শব্দের আদিতে স্থিত ‘ও কখনও কখনও ‘উ’-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন : গোপাল > গুপাল, সোনালী > সুনালি, তোমার > তুমার, কোন্ > কুন্। তবে উচ্চারণের এই পরিবর্তনও উপভাষা অঞ্চলটির সর্বত্র প্রচলিত নয়; কেননা, কোচবিহার, গোয়ালপাড়া প্রভৃতি জায়গায় ‘কোন্ উচ্চারণই চালু।

(৫) শব্দের অন্তে অবস্থিত ‘অ’ ধ্বনি ও-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন : হইত > অইতো, বসিত >বইতো। কখনও কখনও শব্দের শেষস্থ ‘অ’ ধ্বনি উ’-রূপেও উচ্চারিত হয়। যেমন : দুঃখ > দুখু, তুচ্ছ > তুচ্ছ।

(৬) জু’ z-এর মতে, ‘ছ’ স-এর মতে, ‘ছ’ স-এর মতো এবং শ, ষ, স’ হ-এর মতো উচ্চারিত হয়। কিন্তু এই উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্যটিও উপভাষা অঞ্চলের সর্বত্রই দেখা যায় না; দিনাজপুরে ‘‘ এবং গোয়ালপাড়া রংপুর এলাকায় ‘স’-এর উচ্চারণ অপরিবর্তিতই আছে।

রূপাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :

(১) গৌণকর্মে ও সম্প্রদানকারকে ‘ক’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। মোক ভুলালি। হামা আমাকে) দাও। মোক খিদান লাগিছে। বাপ (বাবাকে) দাও।

(২) অধিকরণকারকে-ত’ বিভক্তির প্রয়োগ হয়। যেমন : পাছৎ (পশ্চাতে), ঘরৎ (ঘরে), ঘরগুলাৎ (ঘরগুলোতে), বারিৎ (বাড়িতে)।

(৩) ক্রিয়াপদের আগে নঞর্থক উপসর্গের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন :–যাও, না-লেখিম। . . .

(৪) কর্মকারকে ‘রে’ বিভক্তির প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন : চাকররে, তারে। (৫) সামান্য অতীতকালে ক্রিয়াপদের উত্তমপুরুষে নু’ বিভক্তি দেখা যায়। যেমন : সেবা কমু (করিলাম)। বারি গেনু (যাইলাম)।

অতীতকালে মধ্যমপুরুষে এবং ভবিষ্যৎকালে ক্রিয়াপদে ‘উ’ বিভক্তি যুক্ত হয়। যেমন : মুই করল (আমি করিলাম)। তুই করবু (করিবি)

অতীতকালে প্রথমপুরুষে ‘-ল’ ব্যবহৃত হয়। যেমন : কইল্‌ (বলিল), জিঘাইল্‌ (জিজ্ঞাসা করিল), ধরিল্‌, আইল্‌।

(৬) উত্তমপুরুষের একবচনের সর্বনামে ‘আমি’-র পরিবর্তে ‘মুই’ ও ‘হাম’ ব্যবহৃত হয়।

(৭) সম্বন্ধপদে ‘-র’ ‘-ক’ বিভক্তি হয়। যেমন : বাপোক (বাপের), ছাগলের।

(৫) ঝাড়খণ্ডী উপভাষা

দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত বঙ্গ এবং বিহারের কিছু অংশের এই উপভাষাগুচ্ছ তিনটি প্রধান স্তবকে বিভক্ত। দুই মেদিনীপুর জেলার উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশের কথ্যভাষাটি রাঢ়ীর অন্তর্গত, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের কথ্য ভাষাগুলিকে দণ্ডভুক্তীয় স্তবক বলা হয়, এবং মেদিনীপুরের পশ্চিম প্রান্তের ধলভূমের ও মানভূমের কথ্য ভাষাগুলিকে কেন্দ্রীয় ঝাড়খণ্ডী বলা যায়।

মোটামুটিভাবে সাঁওতাল পরগনা, পশ্চিম বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, দক্ষিণ-পশ্চিম বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুর, ধলভূম, মানভূম, সিংভূম অঞ্চলে এই উপভাষার প্রচলন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে এই ঘন বনজঙ্গল-সমাকীর্ণ অঞ্চলকে ‘ঝারিখণ্ড’ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। ভাষা-বিজ্ঞানীদের অভিমত-অনুসারে, বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে প্রায় আড়াই হাজার বর্গমাইল জুড়িয়া এই উপভাষাটি প্রচলিত।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :

(১) সানুনাসিক স্বরধ্বনি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়; কোনো নাসিক্যবর্ণের (ঙ্‌, ঞ্‌, ণ্‌, ন্‌, ম্) লোপ না হওয়া সত্ত্বেও স্বলোনাসিকীভবনের প্রচুর উদাহরণ এই উপভাষায় পাওয়া যায়। যেমন : চাঁ, উঁট, আঁটা, খোঁকা, হঁইছে, কুঁকুর, ঘোঁড়া, সাঁবান, দুঁধ, সাঁপ, পারলিঁ।

(২) শব্দের আদিতে স্থিত ও-কারকে অ-কার-রূপে উচ্চারণের বহুল প্রবণতা দেখা যায়। মোর > মর্‌, লোক > লক্‌, শোক > শক্‌, তোর > তর্‌, চোর > চর্‌।

(৩) শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাতের ফলে কখনও কখনও মধ্যস্বর লুপ্ত হয়। এবং অন্তস্থিত ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব হয়। যেমন : দুইটা > দুট্টা (ই লুপ্ত, ট > ট্ট), বড় > বড্ড।

(৪) শব্দের অল্পপ্রাণ ধ্বনিকে মহাপ্রাণ ধ্বনিতে পরিণত করার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন : পুকুর > পুখুর, শালিক > শালিখ, পতাকা > ফৎকা, দূর > ধুর।

(৫) অপিনিহিতি ও বিপর্যাসের ফলে শব্দের মধ্যে নবাগত কিংবা বিপর্যস্ত স্বরধ্বনিটির ক্ষীণ স্বর থাকিয়া যায়, তাহার লোপ হয় না, অভিশ্রুতিজনিত পরিবর্তনও হয় না। যেমন : রাতি > রাইত, কালি > কাইল, সন্ধ্যা > সাঁইঝ।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :

(১) নামধাতুর ব্যাপক ও বিচিত্র প্রয়োগ ঝাড়খণ্ডী উপভাষার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। যেমন : আজ রাতকে ভারি জাড়াবে। পখুরের জলটা গঁধাচ্ছে। হমর ঘরে চর সাঁদাইছিল। মাঠটা খুব ঘাঁসাবে। হাতটা খুব ব্যথাচ্ছে। জলটা ঘোলাচ্ছে।

(২) ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়াপদে স্বার্থিক ‘-ক’ প্রত্যয়ের বহুল প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন : সে বাড়ি যাবেক নাই। তুমি খাবেক। সে মারবেক।

(৩) ক্রিয়াপদে ‘আছ’ ধাতুর পরিবর্তে বটু’ ধাতুর প্রয়োগ হয়। যেমন : কে বটে লকটি? উটা মাঠ বটে। যাই বটে। কে বট আপনি? ই, মিছা কথা বটে।

(৪) নিমিত্তার্থে ‘কে’ বিভক্তি ব্যবহৃত হয়; রাঢ়ী উপভাষার মতো হেতু, নিমিত্ত, জন্য ইত্যাদি অনুসর্গ ব্যবহৃত হয় না—“বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্‌” (জলের নিমিত্ত অর্থে = জল আনিতে)। ঘাসকে গেল্‌ছে।

সম্প্রদানকারকেও ‘কে’ বিভক্তির ব্যবহার দেখা যায়। যেমন : “বাড়ীকে বিদায় হইল পবন কুঙর।”

অধিকরণকারকেও ‘কে’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যেমন : জলকে (জলে অর্থে) যাবি নি? আইজ রাইতকে (রাতে) ভারি জাড়াবে (শীত পড়বে)।

(৫) অপাদানকারকে ‘-নু’, ‘-লে’, ‘-রু’ বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। মায়ের-লে মাউসীর দরদ (মায়ের চেয়ে মাসির দরদ)।

(৬) নেতিবাচক বাক্যে নঞর্থক অব্যয় সমাপিকা ক্রিয়ার আগে বসে। মায়কে রাখতে নাই পারলি (পারলাম না)। চুনটুকু কেনে নাই দিলি (দিলি না)?

(৭) সম্বন্ধপদে শূন্যবিভক্তির প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন : “ঘাটশিলা (ঘাটশিলার) শাড়ী কুনি (কুনির) মনে নাই লাগে।”

অধিকরণেও শূন্যবিভক্তি প্রযুক্ত হয়। “রাইত (রাতে) ছিলি ঘাটশিলা টাঁইড়ে।”

(৮) বহুবচন বুঝাইতে ‘গুলা’ ও ‘গুলান’ ব্যবহৃত হয়। যেমন : পাথরগুলা, লোকগুলান, মুনিশগুলান।

এখন শ্রদ্ধেয় ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের অনুসরণে একখানি ছোট্ট অনুচ্ছেদ উপরি-উক্ত পাঁচটি উপভাষায় কীভাবে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে, তাহারই নিদর্শন দেখাইতেছি।–

রাঢ়ী (কলকাতা ও তাহার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কথ্য) : “একজন লোকের দুটি ছেলে ছিল। তাদের মধ্যে ছোটোটি বাপকে বলে—”বাবা, আপনার বিষয়ের মধ্যে যে ভাগ আমি পাবো, তা আমাকে দিন। তাতে তাদের বাপ তার বিষয়-আশয় তাদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন।”

বঙ্গালী (ঢাকা-মানিকগঞ্জ অঞ্চলে কথ্য) : “য়্যাক্ জনের দুইডী ছাওয়াল আছিলো। তাগো মৈদ্দে ছোটডি তার বাপেরে কৈলো—’বাবা, আমার বাগে যে বিত্তি-ব্যাসাদ পরে, তা আমারে দ্যাও।’ তাতে তিনি তা বিষয়-সোম্পত্তি তাগো মৈদ্দে বাইটা দিল্যান্।”

এই উপভাষাই চট্টগ্রাম অঞ্চলে কথিত হইলে পরপৃষ্ঠায় লিখিতভাবে পরিবর্তিত হইয়া যায় :

“ওগ্‌গোয়া মাইনষের দুয়া পোয়া আছিল্‌। তার মৈদ্দে ছোড়ুয়া তার বা-যে কইল্‌-–বা-জি, অঁওনর সম্পত্তির মৈদ্দে যেই অংশ আঁই পাইয়ম্‌, হেইইন আঁরে দেওক।’ ত-অন, তারার বাপ তারার মৈদ্দে নিজের সম্পত্তি ভাগ করি দিল্‌।”

বরেন্দ্রী (মালদহে কথ্য) : “য়্যাক্‌ ঝোন্ মানুসের দুটো ব্যাটা আছলো। তার ঘোর বিচে ছোট্‌কা আপ্‌র বাবা কহলে, বাব ধন্-করির যে হিস্যা হামি পামু, সে হামা দে। তাৎ তাই তারঘোরকে মাল-মাত্তা সব বাটা দিলে।”

কামরূপী (কোচবিহারে কথ্য) : “এক জনা মান্‌সির্‌ দুই কোনা বেটা আছিল্‌। তার মদ্দে ছোট জন উয়ার বাপোক্ কইল্‌, ‘বা, সম্পত্তির যে হিস্যা মুই পাইম্‌, তাক্‌ মোক্ দেন। তাতে তাঁয় তার মালমাত্তা দোনো ব্যাটা বাটিয়া-চিরিয়া দিল্‌।”

ঝাড়খণ্ডী (মানভূমে কথিত) : এক লোকের দুটা বেটা ছিল; তাদের মাঝে ছুটু বেটা তার বাপকে বল্লেক, বাপ্ হে, আমাদের দৌলতের যা হিস্বা আমি পাব, তা আমাকে দাও। এতে তার বাপ আপন দৌলৎ বাখরা করে তার হিস্বা তাকে দিলেক।”

সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা

পৃথিবীর সকল উন্নত ভাষার মতোই বাংলা গদ্যেরও দুইটি রূপ–সাহিত্যিক রূপ ও মৌখিক রূপ। বাংলা ভাষার যে রূপটির আশ্রয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম হইতেই বাংলা গদ্য-গ্রন্থাদি রচিত হইয়া আসিতেছে, সেই সাহিত্যিক রূপটির নাম সাধু ভাষা। আর বাংলা ভাষার যে রূপটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া জনসাধারণের মুখে মুখে ফিরিয়া দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত আটপৌরে প্রয়োজন মিটাইয়া থাকে, সেই মৌখিক পটির নাম চলিত ভাষা। এই ভাষা আমাদের একেবারে মুখের ভাষা–মায়ের মুখ হইতে শেখা ভাষা। এই ভাষাতেই আমরা আমাদের বুকের সমস্তরকম কথা–কী হাসিকান্নার, কী আনন্দ-বেদনার, কী ভয়ভাবনার–সহজেই প্রকাশ করিয়া থাকি। কিন্তু চলিত ভাষা ও কথ্য ভাষা কদাপি এক নয়–কথাটি মনে রাখিও।

মুসলমান যুগে অসংখ্য আরবী ও ফারণী শব্দ যেমন জনগণের মুখের ভাষাকে পুষ্ট করিয়াছে, ইংরেজ আমলেও তেমনি ইংরেজী, ফরাসী, পোর্তুগীজ, ওলন্দাজী প্রভৃতি ইওরোপীয় ভাষার কত শব্দ স্বরূপে বা তদ্ভব আকারে এই মৌখিক ভাষায় যে প্রবেশলাভ করিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। বিদেশী শব্দকে এইভাবে আত্মসাৎ করিয়া স্বদেশী করিবার অলৌকিক ক্ষমতা রহিয়াছে বাংলার এই লৌকিক ভাষাটির।

সাধু ভাষা

কিন্তু বাংলা গদ্যসৃষ্টির প্রথম যুগে যে-সমস্ত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের হাতে গদ্যসৃষ্টির ভার পড়ে, তাহারা লৌকিক বাংলার এই মৌখিক রূপটিকে আমল দেওয়া তো দূরের কথা, লেখার মধ্যে যত বেশী পারিলেন সংস্কৃত শব্দ প্রবেশ করাইয়া ভাষাকে ক্রমশঃ দুর্বোধ করিয়া তুলিতে লাগিলেন। ফলে সংস্কৃতের দুর্ভেদ্য সন্ধি সমাসের বেড়াজালে আবদ্ধ হইয়া, আভিধানিক শব্দাবলীর দুর্বহভারে নিষ্পেষিত হইয়া নবসৃষ্ট বাংলা গদ্যের নাভিশ্বাস উঠিতে লাগিল।

এই অপমৃত্যুর হাত হইতে বাংলা গদ্যকে বাঁচাইলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তৎসম শব্দের পাশাপাশি প্রয়োজনমতো তম্ভব দেশী বিদেশী প্রভৃতি মৌখিক ভাষার শব্দকে স্থান দিয়া তিনি বাংলা গদ্যে ভাষার একটি শ্রীক্ষেত্র-রচনার প্রয়াস পাইলেন। ফলে মৌখিক ভাষার সহিত লেখ্য ভাষার কৃত্রিম ব্যবধানটি ক্রমশঃ লোপ পাইতে লাগিল। ভাষাকে তিনি শুধু সর্বজনবোধ্যই করিয়া তুলেন নাই, যৌবনলাবণ্যেও স্নিগ্ধ করিয়া তুলিয়াছেন। বঙ্কিম-নির্দেশিত এই ভাষাই আদর্শ সাধু ভাষা (Standard Literary Bengali) নামে পরিচিত হইয়া আসিতেছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র প্রভৃতি শিল্পিগণ এই ভাষাতেই শিল্পসুষমামণ্ডিত সাহিত্যসম্ভার সৃষ্টি করিয়াছেন।

এই সাধু ভাষা-সম্বন্ধে আচার্য সুনীতিকুমার বলিয়াছেন, “সাধু ভাষা সমগ্র বঙ্গদেশের সম্পত্তি। ইহার চর্চা সর্বত্র প্রচলিত থাকাতে, বাঙ্গালীর পক্ষে ইহাতেই লেখা সহজ হইয়াছে। এই ভাষার ব্যাকরণের রূপগুলি (বিশেষতঃ ক্রিয়াপদের ও সর্বনামের) প্রাচীন বাংলার রূপ; এইসমস্ত রূপ সর্বত্র মৌখিক বা কথিত ভাষায় আর ব্যবহৃত হয় না। এই সাধু ভাষা মুখ্যতঃ পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন মৌখিক বা কথিত ভাষার উপর প্রতিষ্ঠিত; তাহা হইলেও, পূর্ববঙ্গেরও বহু রূপ ও বৈশিষ্ট্যের প্রভাব ইহার উপর পড়িয়াছে।” (আয়ত রূপ দুইটি আমাদের দেওয়া।)

এই সাহিত্যিক সাধু ভাষার দুইটি রূপ বর্তমানে দেখা যায়।–

(১) একটি তৎসম শব্দবহুল গম্ভীর আভিজাত্যপূর্ণ অথচ প্রাঞ্জল মধুর ধ্বনিমুখর রূপ।

(২) অন্যটি তৎসম তদ্ভব দেশী বিদেশী প্রভৃতি শব্দের পরিমিত ব্যবহারে সরল স্পষ্ট অথচ প্রসাদগুণসম্পন্ন রূপ।

খ্যাতিমান্ সাহিত্যিকগণের রচনা হইতে প্রথমপ্রকারের সাধু ভাষার কয়েকটি নিদর্শন দেখাইতেছি।

(ক) বাল্মীকির বামপার্শ্বে এক পরম রূপবান্ যুবাপুরুষ চিত্রিত পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া বিবিধ বর্ণবিভূষিত কুসুমাসনে উপবিষ্ট ছিলেন। ঐ আসনের সৌরভে সর্বস্থান আমোদিত হইতেছিল। তিনি নাকি উজ্জয়িনীনিবাসী নৃপতি-বিশেষের সভাসদ থাকিয়া নৃপতি অপেক্ষা শতগুণে কীর্তিদেবীর প্রিয়পাত্র হইয়াছেন। তাঁহার বামপাশ্বে মাঘ, ভারবি, ভবভূতি, ভারতচন্দ্র প্রভৃতি স্ব স্ব মর্যাদানুসারে যথাক্রমে এক এক অশেষ শোভাকর উৎকৃষ্ট আসনে উপবিষ্ট ছিলেন। কিন্তু বৃদ্ধ বাল্মীকির যেরূপ স্বভাবসিদ্ধ সরল ভাব ও অকৃত্রিম শোভা, তাহাদের কাহারও সেরূপ নহে।

–অক্ষয়কুমার দত্ত।

(খ) যাঁহারা বাক্যে অজেয়, পরভাষাপারদশী, মাতৃভাষাবিরোধী, তাঁহারাই বাবু। যাঁহাদিগের চরণ মাংসস্থিবিহীন শুষ্ক কাষ্ঠের ন্যায় হইলেও পলায়নে সক্ষম; হস্ত দুর্বল হইলেও লেখনীধারণে এবং বেতন-গ্রহণে সুপটু; চর্ম কোমল হইলেও সাগরপার-নির্মিত দ্রব্যবিশেষের প্রহার-সহিষ্ণু, তাঁহারাই বাবু। যাঁহারা বিনা উদ্দেশ্যে সঞ্চয় করিবেন, সঞ্চয়ের জন্য উপার্জন করিবেন, উপার্জনের জন্য বিদ্যাধ্যয়ন করিবেন, বিদ্যাধ্যয়নের জন্য প্রশ্ন চুরি করিবেন, তাহারাই বাবু।

–বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

(গ) কুমারসম্ভবের কবি অকালবসন্তের আকস্মিক উৎসবে, পুষ্পশরের মোহবর্ষণের মধ্যে, হরপার্বতীর মিলনকে চূড়ান্ত করিয়া তোলেন নাই।…. কবি গৌরীর প্রেমের সর্বাপেক্ষা কমনীয় মূর্তি তপস্যার অগ্নির দ্বারাই উজ্জ্বল করিয়া দেখাইয়াছেন। সেখানে বসন্তের পুষ্পসম্পদ ম্লান, কোকিলের মুখরতা স্তব্ধ। অভিজ্ঞানশকুন্তলেও প্রেয়সী যেখানে জননী হইয়াছেন, বাসনার চাঞ্চল্য যেখানে বেদনার তপস্যায় গাম্ভীর্যলাভ করিয়াছে, যেখানে অনুতাপের সঙ্গে ক্ষমা আসিয়া মিলিয়াছে, সেইখানেই রাজদম্পতির মিলন সার্থক হইয়াছে। প্রথম মিলনে প্রলয়, দ্বিতীয় মিলনেই পরিত্রাণ। এই দুই কাব্যেই শান্তির মধ্যে মঙ্গলের মধ্যে যেখানেই কবি সৌন্দর্যের সম্পূর্ণতা দেখাইয়াছেন, সেখানেই তাঁহার তুলিকা বর্ণবিরল, তাহার বীণা অপ্রমত্ত।

–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

(ঘ) এই আকাশ-বাতাস স্বর্গ-মর্ত পরিব্যাপ্ত করিয়া দৃষ্টির অন্তরে-বাহিরে আঁধারের প্লাবন বহিয়া যাইতেছে, মরি! মরি! এমন অপরূপ রূপের প্রস্রবণ আর কবে দেখিয়াছি! এ ব্রহ্মাণ্ডে যাহা যত গভীর, যত সীমাহীন–তাহা ততই অন্ধকার। অগাধ বারিধি মসিকৃষ্ণ; অগম্য গহন অরণ্যানী আঁধার; সর্বলোকাশ্রয়, আলোর আলো, গতির গতি, জীবনের জীবন, সকল সৌন্দর্যের প্রাণপুরুষও মানুষের চোখে নিবিড় আঁধার। কিন্তু সে কি রূপের অভাবে? যাহাকে বুঝি না, যাহার অন্তরে প্রবেশের পথ দেখি না–তাহাই তত অন্ধকার! মৃত্যু তাই মানুষের চোখে এত কালো, তাই তার পরলোকের পথ এমন দুস্তর আঁধারে মগ্ন! তাই রাধার দুই চক্ষু ভরিয়া যে রূপ প্রেমের বন্যায় জগৎ ভাসাইয়া দিল তাহাও ঘনশ্যাম।

–শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

(ঙ) এ নারী (রাজলক্ষ্মী) অন্নদা নয়। নারীর সেই আদি শক্তিমূর্তির প্রকাশ ইহাতে নাই–সংসার হইতে দূরে প্রায় শ্মশানে সর্বত্যাগের সাধনা এ নয়। সংসার-রঙ্গমঞ্চ হইতে একটু দূরে–তাহারই পুরোভাগে যে পরম সুন্দর রসিক শেখরের দেউলখানি দাঁড়াইয়া আছে, এই নারী তাহারই প্রাঙ্গণে পিছনের দুয়ার খুলিয়া প্রবেশ করিয়াছে। সেখানে সকলের অগোচরে সে এক অপূর্ব রসের আবেশে কীর্তন করে; দয়িতের দর্শন-লাভ ঘটিলে সারাদেহে আরতির দীপ জ্বালাইয়া সে যখন নৃত্য করিতে থাকে, তাহার অঙ্গের মণিভূষণ সেই দীপরশ্মিতে ঝলকিয়া উঠে, মহার্ঘ দুকূল-বসনে অতি-পিনদ্ধ কটিতট ও উরসচুড়া সেই নৃত্যচ্ছন্দে গুমরিয়া উঠে, কণ্ঠের রুদ্ধ রাগিণী চরণের মঞ্জীরঝঙ্কারে মুখরিত হয়। নারীর এ আরেক রূপ, সেই এক নারীই এখানে এক পরম রসের পিপাসায় জীবনের খর-কণ্টককাননে ক্ষতবিক্ষত হইয়াও বিষ-পুষ্প হইতে মধুপানের দুঃসাধ্য-সাধন করে।

–মোহিতলাল মজুমদার।

(চ) উত্তরজীবনে নীলকুন্তলা সাগরমেখলা ধরণীর সঙ্গে তাহার খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটিয়াছিল। কিন্তু যখনই গতির পুলকে তাহার সারাদেহ শিহরিয়া উঠিতে থাকিত, সমুদ্রগামী জাহাজের ডেক হইতে প্রতিমুহূর্তে নীল আকাশের নব নব মায়ারূপ চোখে পড়িত, হয়তো দ্রাক্ষাকুঞ্জবেষ্টিত কোন নীল পর্বতসানু সমুদ্রের বিলীন চক্রবালসীমায় দূর হইতে দূরে ক্ষীণ হইয়া পড়িত, দুরের অস্পষ্ট আবছায়া দেখিতে-পাওয়া বেলাভূমি এক প্রতিভাশালী সুরস্রষ্টার প্রতিভার দানের মতো মহামধুর কুহকের সৃষ্টি করিত তাহার ভাবময় মনে–তখনই তাহার মনে পড়িত এক ঘনবর্ষার রাতে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির শব্দের মধ্যে এক পুরানো কোঠার অন্ধকার ঘরে, রোগশয্যাগ্রস্ত এক পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের মেয়ের কথা।

–বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

উদ্ধৃত অনুচ্ছেদগুলির অন্তর্গত আয়তাক্ষর শব্দগুলি দেখ। যতই দিন যাইতেছে, এইসমস্ত অ-তৎসম শব্দ ততই বেশী পরিমাণে ভাষায় তৎসম শব্দাবলীর মধ্যেও কেমন করিয়া নিজেদের স্থান করিয়া লইতেছে, তাহা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ইহাই তো জীবন্ত ভাষার প্রকৃতি। প্রাণের প্রেরণাতেই সে আপনার চলার পথ। করিয়া লয়। চতুর্থ অনুচ্ছেদে তার ও পঞ্চম অনুচ্ছেদে এ এই সংক্ষিপ্ত সর্বনামগুলি এবং শেষের অনুচ্ছেদে খুৰ, ডেক, জাহাজ এই বিদেশী শব্দগুলিও এখানে আদৌ অবাঞ্ছিত হয় নাই।

এইবার দ্বিতীয়প্রকারের সাধু ভাষার কয়েকটি উদাহরণ দিতেছি।–

(ক) তখন সেই স্ত্রীলোক ঠাকুরদাসকে বলিলেন, বাবাঠাকুর, জল খাইও না, একটু অপেক্ষা কর। এই বলিয়া নিকটবর্তী গোয়ালার দোকান হইতে সত্বর দই কিনিয়া আনিলেন, এবং আরও মুড়কি দিয়া, ঠাকুরদাসকে পেট ভরিয়া ফলার করাইলেন; পরে তাঁহার মুখে সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া, জিদ করিয়া বলিয়া দিলেন, যে দিন তোমার এরূপ ঘটিবেক, এখানে আসিয়া ফলার করিয়া যাইবে।

–ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

লক্ষ্য কর, বিদ্যাসাগরমহাশয়ের মতো সংস্কৃতভক্ত লেখকও সাধু রীতির খাতিরে দই মুড়কি পেট ফলার প্রভৃতি শব্দকে বাতিল করিয়া শব্দগুলির তৎসম প্রতিশব্দ দিবার জন্য আগ্রহ দেখান নাই। ইহাকে বলে বাংলা ভাষার নাড়ীজ্ঞান। সাধু-চলিত রীতির ব্যাপারে শব্দনির্বাচন-সম্বন্ধে কোনোপ্রকার গোঁড়ামিরই প্রশ্রয় নয়, কিন্তু পদ-সম্বন্ধে–বিশেষভাবে ক্রিয়াপদ, সর্বনামপদ আর কয়েকটি অব্যয়ের–যথাক্রমে পূর্ণাঙ্গ বা সংক্ষিপ্ত রূপ-সম্বন্ধে আমাদের হুশিয়ার থাকিতেই হইবে।

(খ) যখন নসীবাবুর তালুকের খাজনা আসে, তখন মানুষ-কোকিলে তাহার গৃহকুঞ্জ পুরিয়া যায়–কত টিকি, ফোঁটা, তেড়ি, চশমার হাট লাগিয়া যায় কত কবিতা, শ্লোক, গীত, হেটো ইংরেজী, মেঠো ইংরেজী, চোরা ইংরেজী, ছেঁড়া ইংরেজীতে নসীবাবুর বৈঠকখানা পারাবতকাকলীসংকুল গৃহসৌধবৎ মুখরিত হইয়া উঠে। যখন তাহার বাড়িতে নাচ গান যাত্রা পর্ব উপস্থিত হয়, তখন দলে দলে মানুষ-কোকিল আসিয়া তাহার ঘরবাড়ি আঁধার করিয়া তুলে–কেহ খায়, কেহ গায়, কেহ হাসে, কেহ কাসে, কেহ তামাক পোড়ায়, কেহ হাসিয়া বেড়ায়, কেহ মাত্রা চড়ায়, কেহ টেবিলের নীচে গড়ায়।

–বঙ্কিমচন্দ্র।

(গ) দেশের লোক যে-সকল শব্দ বুঝে অথচ সত্য সত্য ইতুরে কথা নয়, যে-সব কথা ভদ্রলোকের কাছে কহিতে আমরা লজ্জিত হই না, সেইসকল কথায় মনের ভাব ব্যক্ত করিলে লোকে সহজে বুঝিতে পারিবে, ভাষাও ভাল হইবে। … এখন বাংলাকে সংস্কৃত ও ইংরেজীর হাত হইতে মুক্ত করিয়া সহজ ও সরল করা আবশ্যক হইয়াছে।

–হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

(ঘ) আমাদের এক পুরুষ পূর্বে লোকের সংস্কার এই ছিল যে, চলিত শব্দ পুস্তকে ব্যবহার করিলে সে পুস্তকের গৌরব থাকে না। সেইজন্য তাঁহারা বরফের পরিবর্তে তুষার, ফোয়ারার পরিবর্তে প্রস্রবণ, ঘূর্ণির পরিবর্তে আবর্ত, গ্রীষ্মের পরিবর্তে নিদাঘ প্রভৃতি আভাঙ্গা সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করিয়া গ্রন্থের গৌরব। রক্ষা করিতেন। অনেক সময়ে তাঁহাদের ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দ সংস্কৃতেও তত চলিত নহে, কেবল সংস্কৃত অভিধানে পাওয়া যায় মাত্র।

–হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

[শাস্ত্রীমহাশয়ের এই মূল্যবান্ মন্তব্যটি বঙ্গভাষার অনুশীলনকারী এত্যেকটি ছাত্রছাত্রী শিক্ষক-অধ্যাপকের স্মরণ রাখা অত্যাবশ্যক। ]

(ঙ) অকস্মাৎ ইন্দ্র সোজা উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল “আমি যাব।” আমি সভয়ে তাহার হাত চাপিয়া ধরিলাম।–“পাগল হয়েচ ভাই!” ইন্দ্র তাহার জবাব দিল না। ডিঙিতে ফিরিয়া গিয়া লগিটা তুলিয়া কাঁধে ফেলিল। একটা বড়ো ছুরি পকেট হইতে বাহির করিয়া বাঁ হাতে লইয়া কহিল, “তুই থাক শ্রীকান্ত; আমি এলে ফিরে গিয়ে বাড়িতে খবর দিস–আমি চললুম।”

–শরৎচন্দ্র।

(চ) সর্বজয়ার ঘুম আসে না–সে বিছানায় উঠিয়া বসে। বাহিরে শুধু একটানা হুসহুস জলের শব্দ; ক্রুদ্ধ দৈত্যের মতো গর্জমান একটানা গোঁ গোঁ রবে ঝড়ের দমকা বাড়ীতে বাধিতেছে। জীর্ণ কোঠাখানা এক-একবারের দমকায় যেন থরথর করিয়া কাপে…ভয়ে তাহার প্রাণ উড়িয়া যায়।…গ্রামের একধারে বাঁশবনের মধ্যে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে লইয়া সে নিঃসহায়! মনে মনে বলে–ঠাকুর, আমি মরি তাতে খেতি নেই–এদের কি করি? এই রাত্তিরে যাই বা কোথায়?… মনে মনে বসিয়া ভাবে–আচ্ছা যদি কোঠা পড়ে তবে দালানের দেয়ালটা বোধ হয় আগে পড়বে–যেমন শব্দ হবে অমনি পানচালার দোর দিয়ে এদের টেনে বার করে নেবো।

–বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

উদ্ধৃত অনুচ্ছেদগুলি ভালো করিয়া লক্ষ্য কর। এখানে আয়তাক্ষর শব্দগুলি তৎসম। ইহাদের সংখ্যা কেমন কমিয়া আসিয়াছে দেখ। পক্ষান্তরে তদভব দেশী এবং আরবী ফারসী ইংরেজী প্রভৃতি বিদেশী শব্দ সাধু ভাষায় আর অপাক্তেয় থাকিতেছে না। এমন-কি কথোপকথনেও ক্রমশঃ কথ্য ভাষার স্থান হইতেছে। “ইতুরে” “নেবো” “হয়েচ” তো একেবারে মুখের ভাষা। একমাত্র সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের পূর্ণাঙ্গ রূপের দ্বারাই সাধু ভাষা আপনার অস্তিত্ব রক্ষা করিতেছে। মোট কথা, সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের পূর্ণ রূপের দ্বারাই আধুনিক বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সাধু ভাষার জাতিনির্ণয় করা হয়।

চলিত ভাষা

তৎসম শব্দবহুল পণ্ডিতী সাধু ভাষা যে একটা কৃত্রিম ভাষা–’অস্বাভাবিক ভাষা, ইংরেজী-শিক্ষিত বাঙালী মনীষিগণ তাহা বুঝিতে পারিলেন। অন্যদিকে জনগণের মুখে মুখে নিত্যবহমানা চলিত ভাষা আরবী ফারসী ইংরেজী ওলন্দাজী প্রভৃতি ভাষার ভাণ্ডার হইতে অসংখ্য শব্দগ্রহণ করিয়া প্রতিদিন পরিপুষ্ট হইতে লাগিল। চলিত ভাষার আশ্চর্যরকমের এই স্বী-করণ (assimilation)-শক্তি দেখিয়া এই ভাষাতেই প্যারীচাঁদ মিত্র (টেকচাঁদ ঠাকুর) ‘আলালের ঘরের দুলাল এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোম পেঁচার নকশা’ রচনা করিয়া পণ্ডিতী বাংলার প্রতিদ্বন্দী ভাষার বীজবপন করিলেন। উনবিংশ শতাব্দীতেই এই দুঃসাহসিক কাজের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র প্যারীচাঁদ মিত্রকে “এতদিনে বিষবৃক্ষের মূলে কুঠারাঘাত হইল” বলিয়া স্বাগত জানাইলেন। “আলালের ঘরের দুলাল”-ই বাঙালীকে জানাইল যে, “যে-বাঙ্গালা সর্বজনমধ্যে কথিত ও প্রচলিত, তাহাতেও গ্রন্থ রচনা করা যায়, সে রচনা সুন্দরও হয়, এবং যে সর্বজন-হৃদয়-গ্রাহিতা সংস্কৃতানুযায়িনী ভাষার পক্ষে দুর্লভ, এ ভাষার তাহা সহজ গুণ।”

চলিত ভাষার এত প্রশংসা করিলেও বঙ্কিমচন্দ্র নিজে এই ভাষায় কোনো গ্রন্থরচনা করেন নাই; এমন-কি কথোপকথনেও তিনি সাধু ক্রিয়াপদই অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছেন–ক্কচিৎ চলিত ভাষার সংক্ষিপ্ত ক্রিয়ার রূপ প্রয়োগ করিয়াছেন। অথচ তাঁহার পূর্বগামী দত্ত-কবি শ্রীমধুসূদন নাটকাবলীর সংলাপে চলিত ভাষার সার্থক প্রয়োগ করিয়াছেন।

চলিত ভাষার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ ছিল যে-বাংলার বিভিন্ন জেলায় চলিত ভাষার রূপ বিভিন্ন। চট্টগ্রাম অঞ্চলের চলিত ভাষায় গ্রন্থরচনা করিলে বীরভূম-বাঁকুড়ার লোক বুঝিবেন না; আবার বীরভূম-বর্ধমানের আঞ্চলিক ভাষায় গ্রন্থরচনা করিলেও তেমনি নোয়াখালি-চট্টগ্রামের লোকের পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করা দুরূহ হইবে। অথচ সমস্ত আঞ্চলিকতার ঊর্ধ্বে বলিয়া সাধু ভাষায় এইসমস্ত সমস্যাই আসে না।

উনবিংশ শতকের চলিত ভাষার শ্রেষ্ঠ সমর্থক বেদান্তকেশরী স্বামী বিবেকানন্দ এ সমস্যার মীমাংসা-পথ দেখাইয়া দিলেন। “তবে বাঙ্গালা দেশের স্থানে স্থানে রকমারি ভাষা, কোটি গ্রহণ করব? প্রাকৃতিক নিয়মে যেটি বলবান হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে, সেইটিই নিতে হবে। অর্থাৎ কলকেতার ভাষা। পূর্ব-পশ্চিম, যে দিক্‌ হতেই আসুক না, একবার কলকেতার হাওয়া খেলেই দেখছি সেই ভাষাই লোকে কয়। তখন প্রকৃতি আপনিই দেখিয়ে দিচ্ছেন যে কোন ভাষা লিখতে হবে। যত রেল এবং গতাগতির সুবিধা হবে, তত পূর্ব-পশ্চিমী ভেদ উঠে যাবে, এবং চট্টগ্রাম হতে বৈদ্যনাথ পর্যন্ত ঐ কলকেতার ভাষাই চলবে। ….. যখন দেখতে পাচ্ছি যে, কলকেতার ভাষাই অল্প দিনে সমস্ত বাঙ্গালা দেশের ভাষা হয়ে যাবে, তখন যদি পুস্তকের ভাষা এবং ঘরে কথা-কওয়া ভাষা এক করতে । হয় তো, বুদ্ধিমান অবশ্যই কলকেতার ভাষাকে ভিত্তিস্বরূপ গ্রহণ করবেন।” [ বাঙ্গালা ভাষা–রচনাকাল ১৯০০ সাল। উদ্ধৃতিটির অংশবিশেষ আমরা প্রয়োজনমতো আয়তাক্ষর করিয়া লইয়াছি। ]

কার্যতঃ তাহাই হইয়াছে। রাজনীতিক প্রতিপত্তি ও আর্থনীতিক বনিয়াদ সুদৃঢ় থাকায় কলিকাতার শিক্ষিত জনগণের মৌখিক শিষ্ট ভাষার উপর ভিত্তি করিয়া সাহিত্যের উপযোগী এক আদর্শ চলিত ভাষা গড়িয়া উঠিয়াছে। দীর্ঘদিনের শিক্ষা সংস্কৃতির পীঠস্থান ভাগীরথী-তীরবর্তী নবদ্বীপ-শান্তিপুরের চলিত ভাষাও এই সাহিত্যিক চলিত ভাষারই একটি প্রধান অঙ্গ। কিন্তু গোটা বাংলা দেশেরই ঐতিহ্য এই চলিত ভাষার মূলে ক্রিয়াশীল। তাই শিক্ষিত মংস্কৃতিমান্ এবং মার্জিত রুচিবোধ-সম্পন্ন বাঙালী এই ভাষাকেই সার্বজনীন চলিত ভাষা (Standard colloquial Bengali) বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী (বীরবল) হইতে আরম্ভ করিয়া আধুনিক যুগের বহু লোককান্ত সাহিত্যিক এই ভাষায় সাহিত্য রচনা করিয়া আসিতেছেন। ঊনবিংশ শতকের অপাঙক্তেয় মৌখিক ভাষা আপন স্বভাবগুণে এখন গদ্যসাহিত্যে সাধু ভাষার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া উঠিয়াছে। এমন-কি দর্শন-বিজ্ঞান সাহিত্য-সমালোচনা প্রভৃতি গুরুগম্ভীর বিষয়ের গ্রন্থাবলীও এখন এই চলিত ভাষায় রচিত হইতেছে।

বর্তমান চলিত ভাষার দুইটি রূপ দেখা যায়।–

(১) তৎসম শব্দের বহুল প্রয়োগে সুললিত ঝঙ্কারমুখর চলিত ভাষা।

(২) তৎসম, তদ্ভব, দেশী, বিদেশী প্রভৃতি বিভিন্ন জাতীয় শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগে : সহজ ও সরল চলিত ভাষা।

এখন বিখ্যাত কয়েকজন লেখকের রচনা হইতে প্রথমপ্রকারের চলিত ভাষার কয়েকটি নিদর্শন তুলিয়া দিতেছি।

(ক) এই পৃথিবীর সঙ্গে সমুদ্রের সঙ্গে আমাদের যে একটা বহুকালের গভীর আত্মীয়তা আছে, নির্জনে প্রকৃতির সঙ্গে মুখোমুখি করে অন্তরের মধ্যে অনুভব

করলে সে কি কিছুতেই বোঝা যায়। পৃথিবীতে যখন মাটি ছিল না, সমুদ্র একেবারে একলা ছিল, আমার আজকেকার এই চঞ্চল হৃদয় তখনকার সেই জনশূন্য জলরাশির মধ্যে অব্যক্তভাবে তরঙ্গিত হতে থাকত, সমুদ্রের দিকে চেয়ে তার একতান কলধ্বনি শুনলে তা যেন বোঝা যায়। আমার অন্তরসমুদ্রও আজ একলা বসে বসে সেইরকম তরঙ্গিত হচ্ছে, তার ভিতরে কী একটা যেন সৃজিত হয়ে উঠছে। কত অনির্দিষ্ট আশা, অকারণ আশঙ্কা, কতরকমের প্রলয়, কত স্বৰ্গনরক, কত বিশ্বাস-সন্দেহ, কত লোকাতীত প্রমাণাতীত অনুভব এবং অনুমান, সৌন্দর্যের অপার রহস্য, প্রেমের অতল অতৃপ্তি–মানবমনের জড়িত জটিল সহস্ররকমের অপূর্ব অপরিমেয় ব্যাপার।

–রবীন্দ্রনাথ।

(খ) লিখিত ভাষায় আর মুখের ভাষায় মূলে কোনো প্রভেদ নেই। ভাষা দুয়েরই এক, শুধু প্রকাশের উপায় ভিন্ন। এক দিকে স্বরের সাহায্যে, অপর দিকে অক্ষরের সাহায্যে। বাণীর বসতি রসনায়। শুধু মুখের কথাই জীবন্ত। যত দূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সেই ভাষায় লিখতে পারলেই লেখা প্রাণ পায়।…. ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ হতে মানুষের মুখে নয়। উলটোটা চেষ্টা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।

–প্রমথ চৌধুরী।

(গ) অনেকে রবীন্দ্রনাথকে জীবনশিল্পী আখ্যা দিয়েছেন। কথাটা বুঝবার চেষ্টা করা যাক। প্রত্যেক যথার্থ শিল্পীই জীবনশিল্পী, কেননা জীবনের উপাদানকে তারা শিল্পে পরিণত করেন। …. কারো হাতে জীবন অনেক উপাদান যুগিয়ে দেয়, কারো হাতে দেয় না। কেউ সেই উপাদানের সম্যক সদ্ব্যবহা। করেন, কেউ করতে অক্ষম হন। রবীন্দ্রনাথের হাতে জীবন পর্যাপ্ত উপাদান যুগিয়ে দিয়েছে এ বলা যথেষ্ট নয়, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সমস্তটাকে শিল্পে পরিণত করতে সমর্থ হয়েছেন, কিছু আর কাঁচামাল হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকেনি। জীবনের এমন সামগ্রিক Sublimation সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। তার ফল হয়েছে এই যে, অভিনব বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যে পূর্ণ রবীন্দ্র-সাহিত্য আমরা পেয়েছি; আর একটি ফল হয়েছে–রবীন্দ্রনাথের জীবনটাকে আমরা পাইনি। যাঁর সম্যক্ জীবন শিল্পে রূপান্তরিত, শিল্পের বাইরে তাকে আর কিভাবে পাওয়া সম্ভব?

–প্রমথনাথ বিশী।

(ঘ) বিচার-বিতর্ক করছে রামকৃষ্ণ। মনের মুখোমুখি বসে করছে অনেক খণ্ডন-প্রতিপাদন। সংসার নারীকে ভোগবতী করেছে, তুই একে ভগবতী কর। ক্ষণিক মর্তসীমা ছেড়ে চলে আয় ভূমার নিকেতনে।…. ঘরে তোর তিন দেবতা–পিতা, মাতা, স্ত্রী। তোর এই শেষ দেবতাকে প্রতিষ্ঠিতা করে যা সংসারে। সেই তোর সদাকারা সদানন্দা স্বয়ংপ্রভা প্রতিমা। নিত্যা অক্ষর সুধা। সুধা তৃক্ষরে নিত্যে। নারীর উত্তুঙ্গতম গৌরবের মুকুট পরিয়ে দে তার মাথায়। ভবনেশ্বরীর মধ্যে ভুবনেশ্বরীকে দ্যাখ।

–অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত।

(ঙ) চৈতন্যজীবন এবং চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণব-সাধনার সমগ্র ঐতিহ্যটিকে স্বীকৃত (assimilate) করে নিয়ে, সেই সাধন-ঐতিহ্যের প্রতিভূরূপেই যেন গোবিন্দদাস কাব্য-রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। তাই, তার রচনায় কবিকথাকে ছাপিয়ে একটা। সমগ্র যুগের যৌথ-সাধনা যেন কথা বলে উঠেছে। … এই যুগবাণী ও যুগ-সাধনার একমাত্র প্রাণকেন্দ্র ছিলেন চৈতন্যদেব। চৈতন্য-ঐতিহ্যের সঙ্গে স্বয়ং চৈতন্যদেবকে নিজ কবিপ্রাণ-চেতনার একীভূত করে নিয়ে গোবিন্দদাস পদরচনায় বৃত হয়েছিলেন। “মম হৃদয়-বৃন্দাবনে কানু ঘুমায় প্রেম-প্রহরী রহঁ জাগি।”–সাধনার ঐকান্তিকতায় কবি আপন হৃদয়কে কানুর চিরন্তন বিশ্রামকেন্দ্র নিত্যবৃন্দাবনে পরিণত করেছেন; আপন প্রেমময় কবিচেতনাকে সদাজাগ্রত প্রহরীরূপে রক্ষা করেছেন সেই প্রেমতীর্থের দ্বারে;-কানুর প্রশান্ত নিদ্রাটি যেন ভেঙে না যায়। গোবিন্দদাসের প্রায় সমগ্র কবিতায় এই নিষ্ঠা-বিশ্বাসপূর্ণ প্রেম নিত্যবৃন্দাবনের বংশীধ্বনির সুরটিকে অনুরণিত করেছে।

–ভূদেব চৌধুরী।

(চ) (স্বামীজী) নারীর সামনে তিনটি আদর্শ চরিত্র উপস্থিত করেছেন–সীতা, সাবিত্রী ও দময়ন্তী। ….. সর্বাগ্রে সীতাকে এনেছেন, কারণ স্বামীজীর নিঃসংশয় ধারণায় সীতার তুল্য চরিত্র অতীতে আঁকা হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। আশ্চর্য, বিদ্যাসাগরের এই ধারণা, মধুসূদনেরও। সীতার বন্দনায় হিন্দু সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, অজ্ঞেয়বাদী বিধবাবিবাহ-প্রবর্তনকারী বিদ্যাসাগর এবং ধর্মান্তরিত মধুসূদন জোটবদ্ধ। সীতার মধ্যে আছে নিঃশেষ আত্মবিলয়, সাবিত্রীর মধ্যে জ্বলন্ত আত্মঘোষণা। প্রেম যে অমৃত, প্রেমের স্পর্শে যে মৃতদেহে জীবন সঞ্চারিত হয়, একথা সাবিত্রী প্রমাণ করলেন মৃত্যু-সংগ্রামে জয়ী হয়ে। শঙ্করীপ্রসাদ বসু।

উদ্ধৃত অনুচ্ছেদগুলি তৎসম শব্দবহুল সাধু ভাষারই কাছাকাছি আসিয়া পড়িয়াছে। মাত্র সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের সংক্ষিপ্ত রূপগুলিই উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রক্ষা করিতেছে। এইবার দ্বিতীয়প্রকারের চলিত ভাষার কয়েকটি নিদর্শন দিতেছি।

(ক) রাগী মানুষ কথা কইতে না পারলে যেমন ফুলে ফুলে ওঠে, সকাল বেলাকার মেঘগুলোকে তেমনি বোধ হোলো। বাতাস কেবলই শ ষ স, এবং জল কেবলি বাকি অন্তবর্ণ য র ল ব হ নিয়ে চণ্ডীপাঠ বাধিয়ে দিলে আর মেঘগুলো জটা দুলিয়ে ভ্রুকুটি করে বেড়াতে লাগল। অবশেষে মেঘের বাণী জলধারায় নেবে পড়ল। নারদের বীণাধ্বনিতে বিষ্ণু গঙ্গাধারায় বিগলিত হয়েছিলেন একবার, আমার সেই পৌরাণিক কথা মনে এসেছিল। কিন্তু এ কোন্ নারদ প্রলয়বীণা বাজাচ্ছে? এর সঙ্গে নন্দীভৃঙ্গীর যে মিল, দেখি, আর ওদিকে বিষ্ণুর সঙ্গে রুদ্রের প্রভেদ ঘুচে গেছে।

–রবীন্দ্রনাথ।

(খ) চলিত ভাষায় কি আর শিল্পনৈপুণ্য হয় না? স্বাভাবিক ভাষা ছেড়ে একটা অস্বাভাবিক ভাষা তয়ের করে কি হবে? যে ভাষায় ঘরে কথা কও, তাতেই তো সমস্ত পাণ্ডিত্য গবেষণা মনে মনে কর; তবে লেখবার বেলা ও একটা কি কিম্ভূতকিমাকার উপস্থিত কর? যে ভাষায় নিজের মনে দর্শন-বিজ্ঞান চিন্তা কর, দশজনে বিচার কর–সে ভাষা কি দর্শন-বিজ্ঞান লেখবার ভাষা নয়? যদি না হয় তো নিজের মনে এবং পাঁচজনে ও-সকল তত্ত্ববিচার কেমন করে কর? স্বাভাবিক যে ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করি, যে ভাষায় ক্রোধ দুঃখ ভালবাসা ইত্যাদি জানাই, তার চেয়ে উপযুক্ত ভাষা হতে পারেই না; সেই ভাব, সেই ভঙ্গি, সেই সমস্ত ব্যবহার করে যেতে হবে। ও ভাষার যেমন জোর, যেমন অল্পের মধ্যে অনেক, যেমন যেদিকে ফেরাও সেদিকে ফেরে, তেমন কোনো তৈরী ভাষা কোনও কালে হবে না। ভাষাকে করতে হবে–যেমন সাফ ইস্পাত, মুচড়ে মুচড়ে যা ইচ্ছে কর–আবার যে-কে-সেই, এক চোটে পাথর কেটে দেয়, দাঁত পড়ে না।

–স্বামী বিবেকানন্দ।

(গ) এক সময়ে হঠাৎ দেখি সবাই স্বদেশী হুজুগে মেতে উঠেছে। এই স্বদেশী হুজুগটা যে কোথা থেকে এল তা বলতে পারি নে। এল এইমাত্র জানি, আর তাতে ছেলে বুড়ো মেয়ে বড়োলোক মুটেমজুর সবাই মেতে উঠেছিল। সবার ভিতরেই একটা তাগিদ এসেছিল। কিন্তু কে দিলে এই তাগিদ? সবাই বলে হুকুম আয়া। আরে এই হুকুমই বা দিলে কে, কেন? তা জানে না কেউ–জানে কেবল হুকুম আয়া। তাই মনে হয়, এটা সবার ভিতর থেকে এসেছিল। বড়োছোটো মুটেমজুর–সব যেন এক ধাক্কায় জেগে উঠল। সবাই দেশের জন্য ভাবতে শুরু করলে–দেশকে নিজস্ব কিছু দিতে হবে। দেশের জন্য কিছু করতে হবে।

–অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

(ঘ) রঙিন চুষিকাঠি ফেলে আমরা যখন ট্যাঁ-ট্যাঁ করে চেঁচাব, আর তুমি ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে রেখে দুদ্দাড় শব্দে ছুটে আসবে, ছুটে এসে আমাদের। কোলে টেনে নেবে, তখন আমরাও বুঝব তুমি আমাদের মা। সকলের মা হয়ে আমার একলার মা।

–অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত।

উপরের উদাহরণগুলি হইতে, আশা করি, সাধু ও চলিত ভাষারীতি-সম্বন্ধে তোমাদের ধারণা কিছুটা স্পষ্ট হইয়াছে। এখন এই দুইটি ভাষারীতির সংজ্ঞার্থ নির্ণয় করা যাক।

৭। সাধু ভাষা : বাংলা ভাষার যে বিশেষ রীতির আশ্রয়ে ক্রিয়াপদ ও সর্বনামপদের পূর্ণাঙ্গতা অক্ষুণ্ণ থাকে, তাহাকে সাধু ভাষা বলা হয়। ভাষার এই রূপটি একান্তরূপে লেখ্য রীতি, কখনই মৌখিক রীতি নয়।

৮। চলিত ভাষা : বাংলা ভাষার যে বিশেষ রীতির আশ্রয়ে ক্রিয়াপদ ও সর্বনামপদ সংক্ষিপ্ত রূপলাভ করে, তাহাকে চলিত ভাষা বলা হয়। এই রীতি মূলতঃ মৌখিক, কিন্তু বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক হইতে এই রীতির আশ্রয়েই ক্রমশঃ ব্যাপক হারে সর্ববিধ গ্রন্থ রচিত হইতেছে। এমনও বলা যায়–চলিত ভাষার চাপে সাধু ভাষা বর্তমানে কোণঠাসা হইতে চলিয়াছে।

এখন সাধু ও চলিত এই দুইটি ভাষারীতির মধ্যেকার মৌলিক প্রভেদটুকু আমাদের বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা দরকার।–

(১) সাধু ভাষায় কতকগুলি সর্বনাম পূর্ণাঙ্গ, কিন্তু চলিতে সেগুলি সংক্ষিপ্ত। যেমন, তাহার–তার; তাহাকে–তাঁকে; যাহাদিগকে–যাদের; কাহাকেও–কাউকে, কাকে, কারুকে; কেহ–কেউ ইত্যাদি। [‘তাঁর’ পদটি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ প্রভৃতি সাহিত্যিকগণ সাধু বাংলাতেও প্রয়োগ করিয়াছেন।]

(২) সাধু ভাষায় ক্রিয়াপদের রূপগুলি পূর্ণাঙ্গ ও সুনির্দিষ্ট, কিন্তু চলিত বাংলায় ক্রিয়াগুলি সংক্ষিপ্ত ও লবিশেষে একাধিক রূপপ্রাপ্ত। যেমন, করিতেছে–করছে (উচ্চারণ কোরছে); যাইতেছিলাম–যাচ্ছিলাম, যাচ্ছিলেম, যাচ্ছিলুম; লিখিয়াছিলেন–লিখেছিলেন; শিখাইবেন–শেখাবেন; দৌড়িয়া–দৌড়ে; দৌড়াইয়া (ণিজন্ত)–দৌড়িয়ে; বিকাইয়া–বিকিয়ে; পৌঁছিয়া–পৌঁছে; পৌঁছাইয়া (ণিজন্ত)–পৌঁছিয়ে; সাজাইয়া–সাজিয়ে বা সাজায়ে (কবিতায়); ছড়াইয়া–ছড়িয়ে; লওয়াইয়াছিলাম–নিইয়েছিলাম; আইস–এসো; উঠিয়া–উঠে (অসমাপিকা): উঠে (সমাপিকা)–ওঠে; ফেলিয়া–ফেলে (আদ্য এ-কারের উচ্চারণ স্বাভাবিক); ফেলে (সমাপিকা–আদ্য এ-কারের উচ্চারণ বিকৃত ও ফ্যালে)–ফেলে (রূপে ও উচ্চারণে কোনো পরিবর্তন নাই); দেখিয়া–দেখে (অসমাপিকা–আদ্য এ-কারের উচ্চারণ খাঁটী); দেখে (সমাপিকা–উচ্চারণ : দ্যাখে)–দেখে (রূপে ও উচ্চারণে অপরিবর্তিত); নাই–নেই; বলিতে নাই–বলতে নেই; করি নাই–করিনি; আসিও–এসো; আসিলাম–এলাম, এলুম, এলেম; আসিলে–এলে; আসেন নাই–আসেননি; আসিলেন না–এলেন না; আসিতেছেন–আসছেন; আসিয়াছেন–এসেছেন; দেখিতেছে–দেখছে; দেখিয়াছে–দেখেছে; বসিতেছিল–বসছিল; বসিয়াছিল–বসেছিল; খাইতেছিল–খাচ্ছিল; খাইয়াছিল–খেয়েছিল; ফিরিতেছিলাম–ফিরছিলাম, ফিরছিলুম, ফিরছিলেম, ফিরতেছিলেম; লাগিতেছিল–লাগছিল, লাগতেছিল; লইতে–নিতে; লইয়া–নিয়ে; লইবেন–নেবেন।

চলিত ভাষার বিকল্প রূপগুলো কী কবিতায় কী গদ্যে এখন ব্যাপকভাবে প্রযুক্ত হইতেছে। যেমন : “তোমাকে রাত্তিরে যে বলেছিলুম।”–শরৎচন্দ্র। “সেখানেও পাথর পড়তে শুরু করলে।”–বিভূতিভূষণ। “আন্দাজ হয়ে গিয়েছে, তাই বুঝলুম।”–সৈয়দ মুজতবা আলী। “ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম গ্রামের পথে পথে, … অপূর্ব এক স্বপ্নসম লাগতেছিল চক্ষে মম… আমি মনে ভাবতেছিলেম এ কোন্ মহারাজ।”–রবীন্দ্রনাথ।

(৩) সাধু রীতির কয়েকটি অনুসর্গ চলিত রীতিতে সংক্ষিপ্ত হইয়া যায়। দিয়া–দিয়ে; হইতে–হতে; হইয়া–হয়ে। চাইতে, থেকে–কেবল চলিতে চলে। দ্বারা, অপেক্ষা, চেয়ে–সাধু চলিত উভয় রীতিতেই চলে।

(৪) পদবিন্যাসপদ্ধতির দিক দিয়া সাধু রীতিতে ক্রিয়াপদটি বাক্যের শেষে বসিয়া থাকে, কিন্তু চলিত রীতিতে সেটি বাক্যের ভিতরে চলিয়া আসায় ভাষার গতিশক্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।

ইহা ছাড়া বাগবিধির দিক দিয়াও এই উভয় শ্রেণীর ভাষার কিছুটা পার্থক্য রহিয়া গিয়াছে।

বাংলা সাহিত্যে সাধু ও চলিত দুইটি ভাষাই আপন-আপন ঐশ্বর্য-সম্ভার লইয়া সমান্তরাল পথে চলিতেছে। কৃৎ-তদ্ধিত-সমাস-যোগে নূতন নূতন ঝঙ্কারমুখর শব্দসৃষ্টির সুযোগ সাধু ভাষায় যেমন রহিয়াছে, জাতিনির্বিচারে তৎসম তদ্ভব দেশী বিদেশী শব্দনির্বাচনের স্বাধীনতা, নিজস্ব অজস্ব বাগবিবি ও পদবিন্যাসপদ্ধতিও তেমনই চলিত ভাষাকে দিয়াছে স্বচ্ছন্দ লীলায়িত গতিবেগ। এই দুই ভিন্ন জাতীয় ভাষার আন্তর-প্রকৃতিটি ছাত্রছাত্রীদের ভালোভাবে জানিয়া রাখা আবশ্যক। নচেৎ রচনায় সাধু-চালতের মিশ্রণ ঘটিবার সমূহ সম্ভাবনা। “তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার করিয়া দিয়েছ সোজা।”–রবীন্দ্রনাথ। “গোলোকে হল না ঠাঁই শিবজটা বাহি তাই শতধারা ধরণীতে ঝরিল।”–যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।–কবিতায় এইরূপ সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ আদৌ দোষাবহ নয়, কারণ সেখানে ছন্দের বাঁধনটাই বড়ো কথা। কিন্তু গদ্যরচনার ক্ষেত্রে সাধু ও চলিতের মিশ্রণ বিন্দুমাত্র চলে না। কোনো লেখক সাধু কিংবা চলিত যে রীতিতে কোনো একটি বিশেষ লেখা আরম্ভ করিয়াছেন, সেই রীতিতেই একটানা লিখিয়া লেখাটি শেষ করিয়াছেন। গদ্যরচনা-সম্বন্ধে ইহাই সর্বাপেক্ষা মূল্যবান্ কথা। আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদেরও এই বিষয়ে বিশেষ যত্নবান্ থাকিতে হইবে। সাধু না চলিত, কোন্ রীতিতে লিখিলে বক্তব্যবিষয়টি বেশ পরিস্ফুট করা যায়, তাহা ভাবিয়া লইয়া সেই রীতিতে আরম্ভ করিয়া গদ্যরচনাটি একটানা সেই রীতিতেই লিখিবে। এইভাবে অবহিত থাকিলে রচনাটি আর সাধু-চলিতের মিশ্রণে গুরুচণ্ডালী-দোষদুষ্ট হইবার সম্ভাবনা থাকিবে না।

তবে শব্দনির্বাচন-সম্বন্ধে একটি মূল্যবান্ কথা মনে রাখিবে–সাধু রীতির রচনায় সকল শব্দকেই যে সংস্কৃতঘেঁষা (তৎসম) হইতে হইবে, এমন কোনো নিয়ম নাই; আবার চলিত ভাষার রচনায় যে শ্রবণরঞ্জন তৎসম শব্দ থাকিবে না, কেবল হালকা তদভব দেশী বিদেশী শব্দই থাকিবে, এমনটিও নয়। রবীন্দ্রনাথ, স্বামীজী, প্রমথ চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, রাজশেখর, বিভূতিভূষণ, অচিন্ত্যকুমার, বুদ্ধদেব বসু প্রভৃতি সাহিত্য-রথীদের রচনায় সেই উদারতারই পরিচয় পাই। আসল কথা, রচনাটি যেন শ্রুতিমধুর হয়, সেইদিকেই লক্ষ্য রাখিবে।

এ বিষয়ে একটি অভ্যাস এখন হইতে তোমাদের গড়িয়া তুলিতে হইবে–সাধু হইতে চলিত ও চলিত হইতে সাধু রীতিতে রূপান্তরিত করিবার অভ্যাস। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হইল, লক্ষ্য কর?

॥ সাধু হইতে চলিত ॥

(ক) বাড়ির বাহিরে আমাদের যাওয়া বারণ ছিল, এমনকি বাড়ির ভিতরেও আমরা সর্বত্র যেমন-খুশি যাওয়া-আসা করিতে পারিতাম না। সেইজন্য বিশ্বপ্রকৃতিকে আড়াল-আবডাল হইতে দেখিতাম। বাহির বলিয়া একটি অনন্ত প্রসারিত পদার্থ ছিল যাহা আমার অতীত, অথচ যাহার রূপ শব্দ গন্ধ দ্বার-জালনার নানা ফাঁক-ফুকর দিয়া এদিক-ওদিক হইতে আমাকে চকিতে ছুঁইয়া যাইত। সে যেন গরাদের ব্যবধান দিয়া নানা ইশারায় আমার সঙ্গে খেলা করিবার নানা চেষ্টা করিত। সে ছিল মুক্ত, আমি ছিলাম বদ্ধ–মিলনের উপায় ছিল না, সেইজন্য প্রণয়ের আকর্ষণ ছিল প্রবল। আজ সেই খড়ির গণ্ডি মুছিয়া গেছে, কিন্তু গণ্ডি তবু ঘোচে নাই। দূর এখনো দূরে, বাহির এখনো বাহিরেই।–রবীন্দ্রনাথ।

লক্ষ্য কর, সাধু ভাষায় রচিত অনুচ্ছেদটিতে আড়াল-আবডাল, ফাঁক-ফুকর প্রভৃতি আটপৌরে শব্দ অবাধে স্থানলাভ করিয়াছে। বাংলা ভাষার প্রকৃতিই এই। অনুচ্ছেদটিকে চলিত ভাষায় রূপ দিলে কী হইবে, দেখ।–

[ চলিত ]

বাড়ির বাইরে আমাদের যাওয়া বারণ ছিল, এমন-কি বাড়ির ভিতরেও আমরা সর্বত্র যেমন-খুশি যাওয়া-আসা করতে পারতাম না। সেজন্য বিশ্বপ্রকৃতিকে আড়াল-আবডাল থেকে দেখতাম। বাহির বলে একটি অনন্ত-প্রসারিত পদার্থ ছিল যা আমার অতীত, অথচ যার রূপ শব্দ গন্ধ দ্বার-জালনার নানা ফাঁক-ফুকর দিয়ে এদিক-ওদিক থেকে আমাকে চকিতে ছুঁয়ে যেত। সে যেন গরাদের ব্যবধান দিয়ে নানা ইশারায় আমার সঙ্গে খেলা করবার নানা চেষ্টা করত। সে ছিল মুক্ত, আমি ছিলাম বদ্ধ–মিলনের উপায় ছিল না, সেজন্য প্রণয়ের আকর্ষণ ছিল প্রবল। আজ সেই খড়ির গণ্ডি মুছে গেছে, কিন্তু গণ্ডি তবু ঘোচেনি। দূর এখনো দূরে, বাহির এখনো বাহিরেই।*

[* ‘বাহির’ শব্দটি কবি অন্যত্র চলিত ভাষায় অটুট রাখিয়াছেন—“পথে বাহির হতে চায়, সকল কাজের পথে।” (মেঘলা দিনে : লিপিকা )]

(খ) সে একবার ভট্টচায্যিমশায়ের, একবার পিসেমশায়ের পায়ে পড়িতে লাগিল। কহিল ছেলেরা অমন করিয়া ভয় পাইয়া প্রদীপ উলটাইয়া মহামারী কাণ্ড বাধাইয়া তোলায় সে নিজেও ভয় পাইয়া গাছের আড়ালে গিয়া লুকাইয়াছিল। ভাবিয়াছিল, একটু ঠাণ্ডা হইলেই বাহির হইয়া তাহার সাজ দেখাইয়া যাইবে। কিন্তু ব্যাপার উত্তরোত্তর এমন হইয়া উঠিল যে, তাহার আর সাহসে কুলাইল না।

–শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

অনুচ্ছেদটিতে গাছ আড়াল ঠাণ্ডা প্রভৃতি অ-তৎসম শব্দ সহজেই ঠাঁই পাইয়াছে; এমন-কি সাধু ভাষাতেও ভট্‌চায্যিমশায় ভট্টাচার্যমহাশয় হয় নাই। অনুচ্ছেদটি চলিত ভাষায় রূপান্তরিত করিলে দাঁড়াইবে–

[ চলিত ]

সে একবার ভট্‌চায্যিমশায়ের, একবার পিসেমশায়ের পায়ে পড়তে লাগল। বলল, ছেলেরা অমন করে ভয় পেয়ে প্রদীপ উলটিয়ে মহামারী কাণ্ড বাধিয়ে তোলায় সে নিজেও ভয় পেয়ে গাছের আড়ালে গিয়ে লুকিয়েছিল। ভেবেছিল, একটু ঠাণ্ডা হলেই বার হয়ে তার সাজ দেখিয়ে যাবে। কিন্তু ব্যাপার উত্তরোত্তর এমন হয়ে উঠল যে, তার আর সাহসে কুলাল না।

(গ) “দেখ, আমি প্রাচীরে প্রাচীরে মেও মেও করিয়া বেড়াই, কেই আমাকে মাছের কাটাখানাও ফেলিয়া দেয় না। মাছের কাটা, পাতের ভাত, নামায় ফেলিয়া দেয়, জলে ফেলিয়া দেয়, তথাপি আমাকে ডাকিয়া দেয় না। তোমাদের পেট ভরা, আমার পেটের ক্ষুধা কি প্রকারে জানিবে! হায়! দরিদ্রের জন্য ব্যথিত হইলে তোমাদের কি কিছু অগৌরব আছে? আমার মত দরিদ্রের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া, লজ্জার কথা সন্দেহ নাই। যে কখন অন্ধকে মুষ্টি-ভিক্ষা দেয় না, সেও একটা বড় রাজা পরে পড়িলে রাত্রে ঘুমায় না–সকলেই পরের ব্যথায় ব্যথিত হইতে রাজি। তবে ছোটলোকের দুঃখে কাতর! ছি! কে হইবে?”–বঙ্কিমচন্দ্র।

লক্ষ্য কর–সাহিত্যসম্রাট প্রায় দেড় ডজন তৎসম শব্দের পাশাপাশি হালকা অনুকার-বাচক অব্যয় মেও, মাছ কাঁটা পাত ভাত পেট নরদামা ফাঁপর প্রভৃতি অ-তৎসম শব্দ প্রয়োগ করিয়া ভাষার শ্রীক্ষেত্র রচনা করিয়াছেন। অ-তৎসম শব্দগুলির তৎসম প্রতিশব্দ যথাক্রমে মৎস্য কণ্টক পাত্র অন্ন উদর পয়ঃপ্রণালী বিপ ইত্যাদি প্রয়োগ করিবার প্রয়োজন অনুভব করেন নাই। ইহাকেই বলে বাংলা ভাষার নাড়ীজ্ঞান। অনুচ্ছেদটিকে চলিত ভাষায় রূপ দিলে কী দাঁড়ায় দেখ।–

[ চলিত ] “দেখ, আমি প্রাচীরে প্রাচীরে মেও মেও করে বেড়াই, কেড আমাকে মাছের কাটাখানাও ফেলে দেয় না। মাছের কাঁটা, পাতের ভাত, নামায় ফেলে দেয়, জলে ফেলে দেয়, তথাপি আমাকে ডেকে দেয় না। তোমাদের পেট ভরা, আমার পেটের ক্ষুধা কি প্রকারে জানবে! হায়! দরিদ্রের জন্য ব্যথিত হলে তোমাদের কি কিছু অগৌরব আছে? আমার মত দরিদ্রের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া, লজ্জার কথা সন্দেহ নেই। যে কখন অন্ধকে মুষ্টি-ভিক্ষা দেয় না, সেও একটা বড় রাজা ফাঁপরে পড়লে রাত্রে ঘুমায় না–সকলেই পরের ব্যথায় ব্যথিত হতে রাজি। তবে ছোটলোকের দুঃখে কাতর! ছি! কে হবে?”

(ঘ) আমরা ভৃত্যকে অনায়াসে মারিতে পারি, প্রজাকে অনায়াসে অতিষ্ঠ করিতে পারি, গরিব মূর্খকে অনায়াসে ঠকাইতে পারি–নিম্নতনদের সহিত ন্যায় ব্যবহার করা, মানহীনদের সহিত শিষ্টাচার করা নিতান্তই আমাদের ইচ্ছার ‘পরে নির্ভর করে, অপরপক্ষের শক্তির পরে নয়–এই নিরন্তর সংকট হইতে নিজেদের বাঁচাইবার জন্যই আমাদের দরকার হইয়াছে নিম্নশ্রেণীয়দের শক্তিশালী করা। সেই শক্তি দিতে গেলেই তাহাদের হাতে এমন একটি উপায় দিতে হইবে যাহাতে ক্রমে তাহারা পরস্পর সম্মিলিত হইতে পারে–সেই উপায়টিই তাহাদের সকলকেই লিখিতে-পড়িতে শেখানো।

–রবীন্দ্রনাথ।

[ চলিত ] আমরা ভৃত্যকে অনায়াসে মারতে পারি, প্রজাকে অনায়াসে অতিষ্ঠ করতে পারি, গরিব মুখকে অনায়াসে ঠকাতে পারি–নিম্নতনদের সঙ্গে ন্যায় ব্যবহার করা, মানহীনদের সঙ্গে শিষ্টাচার করা নিতান্তই আমাদের ইচ্ছার ‘পরে নির্ভর করে, অপরপক্ষের শক্তির ‘পরে নয়–এই নিরন্তর সংকট থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্যই আমাদের দরকার হয়েছে নিম্নশ্রেণীয়দের শক্তিশালী করা। সেই শক্তি দিতে গেলেই তাদের হাতে এমন একটি উপায় দিতে হবে যাতে ক্রমে তারা পরস্পর সম্মিলিত হতে পারে–সেই উপায়টিই তাদের সকলকেই লিখতে-পড়তে শেখানো।

(ঙ) টাকা যে কি জিনিস, তাহাও ভাল করিয়া চিনি। মুখে অনেকেই ‘টাকা অতি তুচ্ছ’, ‘অর্থ অনর্থের মূল’ বলিয়া থাকে; কিন্তু জগৎ এমনই ভয়ানক স্থান : যে, টাকা না থাকিলে তাহার স্থান কোথাও নাই–সমাজে নাই, স্বজাতির নিকটে নাই-ভ্রাতাভগ্নীর নিকট একটি কথা বলিবার সুযোগও নাই। স্ত্রীর ন্যায় ভালবাসে বল ত জগতে আর কে আছে? টাকা না থাকিলে অমন অকৃত্রিম ভালবাসারও আশা নাই; কাহারও নিকট সম্মান নাই। টাকা না থাকিলে রাজায় চিনে না, সাধারণে মান্য করে না, বিপদে জ্ঞান থাকে না। জন্মমাত্র টাকা, জীবনে টাকা, জীবনান্তেও টাকা, জগতে টাকারই খেলা। মীর মোশারফ হোসেন।

[ চলিত ]

টাকা যে কি জিনিস, তাও ভাল করে চিনি। মুখে অনেকেই টাকা অতি তুচ্ছ’, ‘অর্থ অনর্থের মূল’ বলে থাকে; কিন্তু জগৎ এমনই ভয়ানক স্থান যে, টাকা না থাকলে তার স্থান কোথাও নেই–সমাজে নেই, স্বজাতির নিকটে নেই–ভ্রাতাভগ্নীর নিকট একটি কথা বলবার সুযোগও নেই। স্ত্রীর ন্যায় ভালবাসে বল ত জগতে আর কে আছে? টাকা না থাকলে অমন অকৃত্রিম ভালবাসারও আশা নেই; কারও নিকট সম্মান নেই। টাকা না থাকলে রাজায় চেনে না, সাধারণ মান্য করে না, বিপদে জ্ঞান থাকে না। জন্মমাত্র টাকা, জীবনে টাকা, জীবনান্তেও টাকা, জগতে টাকারই খেলা।

(চ) ছাত্রগণের অনেকের বিশ্বাস, অন্ততঃ কার্যতঃ পরিচয় পাই, যেন বাঙ্গালা ভাষা মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে সঙ্গে অনায়াসে বাঙ্গালীর আয়ত্ত হয়, যেন তাহার জন্য কোন সাধনার, কোন পরিশ্রমের প্রয়োজন নাই। কেবল গলার স্বর থাকিলেই কি কেহ সুগায়ক হইতে পারে? না, একটা যন্ত্র হাতের কাছে থাকিলেই যে-সে সুবাদক হইতে পারে? যেমন সুগায়ক, সুবাদক হইতে বহু পরিশ্রম করিতে হয়, তেমনি সুলেখক হইতে গেলে এই ছাত্রজীবন হইতেই রীতিমতো রচনা অভ্যাস করিতে হইবে।

–মহম্মদ শহীদুল্লাহ।

[ চলিত ] ছাত্রগণের অনেকের বিশ্বাস, অন্ততঃ কার্যতঃ পরিচয় পাই, যেন বাঙ্গালা-ভাষা মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে সঙ্গে অনায়াসে বাঙ্গালীর আয়ত্ত হয়, যেন তার জন্য কোন সাধনার, কোন পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই। কেবল গলার স্বর থাকলেই কি কেউ সুগায়ক হতে পারে? না, একটা যন্ত্র হাতের কাছে থাকলেই যে-সে সুবাদক হতে পারে? যেমন সুগায়ক, সুবাদক হতে বহু পরিশ্রম করতে হয়, তেমনি সুলেখক হতে গেলে এই ছাত্রজীবন থেকেই রীতিমতো রচনা অভ্যাস করতে হবে।

(ছ) জীবনমৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াইয়া এই স্বার্থত্যাগ এই বয়সে কয়টা লোক করিয়াছে? … তাহার এতবড় স্বার্থত্যাগ আমি মানুষের দেহ ধরিয়া ভুলিয়া যাই কেমন করিয়া? কেমন করিয়া ভুলি, যাহার হৃদয়ের ভিতর হইতে এত বড় অযাচিত দান এতই সহজে বাহির হইয়া আসিল–সে হৃদয় কি দিয়া কে গড়িয়া। দিয়াছিল। তার পরে কতকাল কত সুখ-দুঃখের ভিতর দিয়া আজ এই বার্ধক্যে উপনীত হইয়াছি। কত দেশ, কত প্রান্তর, নদনদী পাহাড়-পর্বত বন-জঙ্গল ঘাঁটিয়া ফিরিয়াছি, কত প্রকারের মানুষই না দুটো চোখে পড়িয়াছে, কিন্তু এত বড় মহাপ্রাণ ত আর কখনও দেখিতে পাই নাই!–শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

অনুচ্ছেদটিতে পাহাড়’ ‘জঙ্গল’ ‘চোখ’ ‘মুখোমুখি’ প্রভৃতি অতৎসম শব্দ এবং খাঁটী বাংলা ক্রিয়া ঘাঁটিয়া’ কত সহজেই না ঠাঁই পাইয়াছে। ফলে রচনাটি গুরুচণ্ডালী-দোষে দুষ্ট হইয়াছে, এমন সিদ্ধান্তে আসিবার স্পর্ধা কাহারও হইবে কি? অনুচ্ছেদটি চলিতে রূপান্তরিত করিলে দাঁড়াইবে–

[ চলিত ] জীবনমৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই স্বার্থত্যাগ এই বয়সে কটা লোক করেছে? … তার এতবড় স্বার্থত্যাগ আমি মানুষের দেহ ধরে ভুলে যাই কেমন করে? কেমন করে ভুলি, যার হৃদয়ের ভিতর থেকে এত বড় অযাচিত দান এতই সহজে বার হয়ে এল–সে হৃদয় কি দিয়ে কে গড়ে দিয়েছিল! তার পরে কতকাল কত সুখ-দুঃখের ভিতর দিয়ে আজ এই বার্ধক্যে উপনীত হয়েছি। কত দেশ, কত প্রান্তর, নদনদী পাহাড়-পর্বত বন-জঙ্গল ঘেঁটে ফিরেছি, কত প্রকারের মানুষই না দুটো চোখে পড়েছে, কিন্তু এত বড় মহাপ্রাণ ত আর কখনও দেখতে পাইনি!..

(জ) দুধ আমার বাবও নয়। দুধ মঙ্গলার, দুহিয়াছে প্রসন্ন। অতএব সে দুগ্ধে আমারও যে অধিকার, বিড়ালেরও তাই; সুতরাং রাগ করিতে পারি না। তবে চিরাগত একটি প্রথা আছে যে, বিড়ালে দুধ খাইয়া গেলে, তাহাকে তাড়াইয়া মারিতে যাইতে হয়। আমি যে সেই চিরাগত প্রথার অবমাননা করিয়া মনুষ্যকুলে। কুলাঙ্গার-স্বরূপ পরিচিত হইব, ইহাও বাঞ্ছনীয় নহে। কি জানি, এই মার্জারী যদি স্বজাতিমণ্ডলে কমলাকান্তকে কাপুরুষ বলিয়া উপহাস করে? অতএব পুরুষের ন্যায় আচরণ করাই বিধেয়। ইহা স্থির করিয়া সকাতরচিত্তে, হস্ত হইতে হুঁকা। নামাইয়া, অনেক অনুসন্ধানে এক ভগ্ন যষ্টি আবিষ্কৃত করিয়া সগর্বে মার্জারী প্রতি ধাবমান হইলাম।

–বঙ্কিমচন্দ্র।

[ গোটাপাঁচশেক তৎসম শব্দের পাশাপাশি দুধ বাপ হুঁকা প্রভৃতি অতৎসম শব্দ বেমালুম ঠাঁই পাইয়াছে। আরও লক্ষণীয় যে, ভারিক্কি চালের তৎস্য মার্জারী-র পাশেই হালকা চালের তৎসম ‘বিড়াল’, তৎসম ‘দুগ্ধ’ শব্দের পাশেই বাংলা ‘দুধ’, ‘নহে’-র পাশে নয়, এমন-কি, পূর্ণাঙ্গ সর্বনাম ‘তাহাই’ না লিখিয়া সংক্ষিপ্ত রূপ তাই–অদ্ভুত সহাবস্থান। সাধু রীতির খাতিরে লেখক এই শব্দগুলিকে বর্জন বা ইহাদের তৎসম প্রতিশব্দ প্রয়োগ করেন নাই। তাহার কি তৎসম শব্দভাণ্ডারে টান পড়িয়াছিল? নিশ্চয়ই নয়। সাধু রীতির গদ্যরচনাতেও তৎসম শব্দের পাশাপাশি তদ্ভব, দেশী, বিদেশী প্রভৃতি সর্বশ্রেণীর শব্দ অবাধে স্থান পাইতে পারে, সাহিত্যসম্রাট আমাদের চোখে আঙুল দিয়া তাহা প্রায় সার্ধ শতাধিক বর্ষ পূর্বেই দেখাইয়া দিয়াছেন।

আসল কথা–সাধু বা চলিত যেকোনো রীতিতে শব্দের প্রসঙ্গ আদৌ বিবেচ্য নয়, বিবেচ্য হইল পদের প্রসঙ্গ। অর্থাৎ সর্বনাম ক্রিয়া ও কিছু অব্যয়পদ (অনুসর্গ)। সাধুরীতিতে এই তিন শ্রেণীর পদের পূর্ণরূপ থাকিবে, চলিত রীতিতে ইহাদেরই সংক্ষিপ্ত রূপ দিতে হইবে। ইহাই স্থিরীকৃত পথ। ]।

[ চলিত ] দুধ আমার বাপেরও নয়। দুধ মঙ্গলার, দুয়েছে প্রসন্ন। অতএব সে দুগ্ধে আমারও যে অধিকার, বিড়ালেরও তাই; সুতরাং রাগ করতে পারি না। তবে চিরাগত একটি প্রথা আছে যে, বিড়ালে দুধ খেয়ে গেলে, তাকে তাড়িয়ে মারতে যেতে হয়। আমি যে সেই চিরাগত প্রথার অবমাননা করে মনুষ্যকুলে কুলাঙ্গার-স্বরূপ পরিচিত হব, এও বাঞ্ছনীয় নয়। কি জানি, এই মার্জারী যদি স্বজাতিমণ্ডলে কমলাকান্তকে কাপুরুষ বলে উপহাস করে? অতএব পুরুষের ন্যায় আচরণ করাই বিধেয়। এটা স্থির করে সকাতরচিত্তে, হস্ত হতে হুঁকা নামিয়ে, অনেক অনুসন্ধানে এক ভগ্ন যষ্টি আবিষ্কৃত করে গর্বে মার্জারী প্রতি ধাবমান হলাম।

॥ চলিত হইতে সাধু ॥

সাধু ভাষায় কেবল তৎসম শব্দে অধিকার, এই ধারণার বশবর্তী হইয়া কেহ কেহ চলিত ভাষার রচনাকে সাধু ভাষায় রূপান্তরিত করিবার সময় চলিতের সকল শব্দের তৎসম প্রতিরূপ দিবার জন্য তৎপর হইয়া উঠেন। ইঁহাদের মধ্যে সকলেই আবার তৎসম শব্দনির্বাচন-ব্যাপারে একমতও নহেন। কেহ সাধারণ একটি পরিচিত তৎসম শব্দেই সন্তুষ্ট, কেহ-বা গালভরা অথচ দাঁতভাঙা তৎসম শব্দ না হইলে অগ্নিশর্মা হইয়া পড়েন, যেমন, কেহ ‘মৃত’ শব্দেই তৃপ্ত, কেহ-বা ‘হবি’ না পাইলে তৃপ্ত নহেন, আবার কাহারও-বা একান্ত আভিধানিক শব্দ ‘আজ্য’ না হইলে মন উঠিবে না। সুতরাং তৎসম শব্দনির্বাচনের সীমারেখাঁটি কোথায়? সেইজন্যই সুধীজন-স্বীকৃত পন্থাটিই আমাদের অবলম্বন করিতে হইবে অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া কেৰল সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের পূর্ণরূপের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া রূপান্তরাধন করিলেই চলিবে।

(ক) সাহিত্যের তিনি রসজ্ঞ সাধক ছিলেন, সেইজন্য তিনি যা পাঠ দিতেন তা জমা করবার নয়, তা হজম করবার, তা হয়ে উঠত ছেলেদের মনের খাদ্য। তিনি দিতেন তাদের মনকে অবগাহন-স্নান, তার গভীরতা অত্যাবশ্যকের চেয়ে অনেক বেশি। ভাষাশিক্ষার মধ্যে একটা অনিবার্য শাসন থাকে, সেই শাসনকে অতিক্রম করে দিতে পারতেন সাহিত্যের উদার মুক্তি।

–রবীন্দ্রনাথ।

[ সাধু ] সাহিত্যের তিনি রসজ্ঞ সাধক ছিলেন, সেইজন্য তিনি যাহা পাঠ দিতেন তাহা জমা করিবার নয়, তাহা হজম করিবার, তাহা ছেলেদের মনের খাদ্য হইয়া উঠিত। তিনি তাহাদের মনকে অবগাহন-স্নান দিতেন, তাহার গভীরতা অত্যাবশ্যকের চেয়ে অনেক বেশি। ভাষাশিক্ষার মধ্যে একটা অনিবার্য শাসন থাকে, সেই শাসনকে অতিক্রম করিয়া (তিনি) সাহিত্যের উদার মুক্তি দিতে পারিতেন।

সাধু রীতিতে আয়তাক্ষর ক্রিয়াপদগুলির স্থান-পরিবর্তন ঘটিয়াছে, লক্ষ্য কর।

(খ) তিনি অপূর্ণনয়নে বিষণ্ণবদনে বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। তিনি যেন সন্দেহাকুল স্মৃতি, নিপতিত সমৃদ্ধি, বিহত শ্রদ্ধা, প্রতিহত আশা, মিথ্যা-অপবাদ গ্রস্ত কীর্তি। হনুমান অনুমান করলেন, ইনিই সীতা, কারণ, রাম যে-সকল ভূষণের কথা বলেছিলেন তা এঁর অঙ্গে রয়েছে, অন্যান্য ভূষণ ও উত্তরীয় যা ঋষ্যমূকে ফেলে দিয়েছিলেন তা নেই।

–রাজশেখর বসু।

[ সাধু ]

তিনি অশ্রুপূর্ণনয়নে বিষণ্ণবদনে বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলিতেছেন। তিনি যেন সন্দেহাকুল স্মৃতি, নিপতিত সমৃদ্ধি, বিহত শ্রদ্ধা, প্রতিহত আশা, মিথ্যা-অপবাদগ্রস্ত কীর্তি। হনুমান অনুমান করিলেন, ইনিই সীতা, কারণ, রাম যে-সকল ভূষণের কথা বলিয়াছিলেন তাহা ইহার অঙ্গে রহিয়াছে, অন্যান্য ভূষণ ও উত্তরীয় যাহা ঋষ্যমূকে ফেলিয়া দিয়াছিলেন তাহা নাই।

(গ) সেই কোটি বৎসর আগেকার দিনে যেদিন সমুদ্রের গর্ভ থেকে নতুন জাগা পঙ্কস্তরের মধ্যে পৃথিবীর ভাবী অরণ্য আপনার জন্মের প্রথম ক্রন্দন উঠিয়েছে–সেদিন পশু নেই, পাখি নেই, জীবনের কলরব নেই, চারদিকে পাথর পাঁক আর জল। কালের পথে সমস্ত জীবের অগ্রগামী গাছ, সূর্যের দিকে জোড় হাত তুলে বলেছে, আমি থাকব, আমি বাঁচব, আমি চিরপথিক, মৃত্যুর পর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অন্তহীন প্রাণের বিকাশতীর্থে যাত্রা করব রৌদ্রে-বাদলে–দিনে-রাত্রে। গাছের সেই রব আজও উঠছে বনে-বনে, পর্বতে-প্রান্তরে; তাদেরই শাখায় পত্রে ধরণীর প্রাণ বলে বলে উঠছে, আমি থাকব, আমি থাকব।

–রবীন্দ্রনাথ।

[ সাধু ] সেই কোটি বৎসর আগেকার দিনে যেদিন সমুদ্রের গর্ভ হইতে নতুন-জাগা পঙ্কস্তরের মধ্যে পৃথিবীর ভাবী অরণ্য আপনার জন্মের প্রথম ক্রন্দন উঠাইয়াছে–সেদিন পশু নাই, পাখি নাই, জীবনের কলরব নাই, চারিদিকে পাথর পাঁক আর জল। কালের পথে সমস্ত জীবের অগ্রগামী গাছ, সূর্যের দিকে জোড় হাত তুলিয়া বলিয়াছে, আমি থাকিব, আমি বাঁচিব, আমি চিরপথিক, মৃত্যুর পর মৃত্যুর মধ্য দিয়া অন্তহীন প্রাণের বিকাশতীর্থে যাত্রা করিব রৌদ্রে-বাদলে দিনে-রাত্রে। গাছের সেই রব আজও বনে-বনে, পর্বতে-প্রান্তরে উঠিতেছে; তাহাদেরই শাখায় পত্রে ধরণীর প্রাণ বলিয়া বলিয়া উঠিতেছে, “আমি থাকিব, আমি থাকিব।

(ঘ) এগুলো শোধরাবার লক্ষণ এখন হচ্ছে; এখন ক্রমে বুঝবে যে, যেটা ভাবহীন প্রাণহীন–সে ভাষা, সে শিল্প, সে সংগীত কোনো কাজের নয়। এখন বুঝবে যে, জাতীয় জীবনে যেমন যেমন বল আসবে, তেমন তেমন ভাষা শিল্প সংগীত প্রভৃতি আপনা-আপনি ভাবময় প্রাণপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। দুটো চলিত কথায় যে ভাবরাশি আসবে, তা দু-হাজার ছাদি বিশেষণেও নাই। তখন দেবতার মূর্তি দেখলেই ভক্তি হবে, গহনা-পরা মেয়ে-মাত্রই দেবী বলে বোধ হবে, আর বাড়ি ঘর দোর সব প্রাণস্পন্দনে ডগমগ করবে।

–স্বামী বিবেকানন্দ।

[ সাধু] এগুলো শোধরাইবার লক্ষণ এখন হইতেছে; এখন ক্রমে বুঝিবে যে, যেটা ভাবহীন প্রাণহীন–সে ভাষা, সে শিল্প, সে সংগীত কোনো কাজের নয়। এখন বুঝিবে যে, জাতীয় জীবনে যেমন যেমন বল আসিবে, তেমন তেমন ভাষা শিল্প সংগীত প্রভৃতি আপনা-আপনি ভাবময় প্রাণপূর্ণ হইয়া দাঁড়াইবে। দুইটি চলিত কথায় যে ভাবরাশি আসিবে, তাহা দুই-হাজার ছাদি বিশেষণেও নাই। তখন দেবতার মূর্তি দেখিলেই ভক্তি হইবে, গহনা-পরা মেয়ে-মাত্রই দেবী বলিয়া বোধ হইবে, আর বাড়ি ঘর দোর সব প্রাণস্পন্দনে ডগমগ করিবে।

(ঙ) ভীষ্মের অনুমতিক্রমে সহদেব কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য যথাবিধি নিবেদন করলেন, কৃষ্ণও তা নিলেন। চেদিরাজ শিশুপাল কৃষ্ণের এই পূজা সইতে পারলেন না; তিনি সভামধ্যে ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরকে ভর্ৎসনা করে কৃষ্ণের নিন্দা করতে লাগলেন।

–রাজশেখর বসু।

তিন পঙক্তির চলিত রীতির এই অনুচ্ছেদটিতে অন্ততঃ সাতটি তৎসম শব্দ রহিয়াছে; ‘নিবেদন করলেন’, ভৎর্সনা করে’, ‘নিন্দা করতে’ প্রভৃতি সংযোগমূলক ক্রিয়াগুলির প্রথমাংশও তৎসম; সেই সঙ্গে ‘নিলেন’ খাঁটী বাংলা চলিত রীতির ক্রিয়াপদ, সইতে পারলেন’ চলিত রীতির যৌগিক ক্রিয়া–কোনোটাই বেমানান হইয়াছে কি? চলিত রীতির অনুচ্ছেদে তৎসম শব্দ আদৌ থাকিবে না, অথবা আগাগোড়াই তৎসম শব্দের বাহুল্য থাকিবে–কোনোটাই ঠিক নয়। অশ্লীল ছাড়া তৎসম ভব দেশী বিদেশী সকল শ্রেণীর শব্দই অবাধে ঠাঁই পাইবে। বাংলা ভাষার এই মোদ্দা কথাটি আগে বুঝিতে হইবে। এখন প্রদত্ত অনুচ্ছেদটিকে সাধু রীতিতে রূপান্তরিত করিলে কী দাঁড়ায় দেখ।–(পরিবর্তিত শব্দগুলি আয়ত অক্ষরে দেখানো হইল)।

[ সাধু ]

ভীষ্মের অনুমতিক্রমে সহদেব কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য যথাবিধি নিবেদন করিলেন, কৃষ্ণও তাহা লইলেন। চেদিরাজ শিশুপাল কৃষ্ণের এই পুজা সহিতে পারিলেন না; তিনি সভামধ্যে ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরকে ভৎর্সনা করিয়া কৃষ্ণের নিন্দা করিতে লাগিলেন।

(চ) তোমাদের বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য সব জেনে কিছু না জানা, আমাদের জ্ঞানের উদ্দেশ্য কিছু না জেনে সব জানা। তোমাদের পরলোক স্বর্গ, আমাদের ইহলোক নরক। কাজেই পরলোক তোমাদের গম্য, ইহলোক আমাদের ত্যাজ্য। তোমাদের ধর্মমতে আত্মা অনাদি নয় কিন্তু অনন্ত, আমাদের ধর্মমতে আত্মা অনাদি কিন্তু অনন্ত নয়–তার শেষ নির্বাণ। পূর্বেই বলেছি, প্রাচী ও প্রতীচী পৃথক্‌। আমরাও ভালো, তোমরাও ভালো–শুধু তোমাদের ভালো আমাদের মন্দ ও আমাদের ভালো তোমাদের মন্দ। সুতরাং অতীতের আমরা ও বর্তমানের তোমরা, এই দুয়ে মিলে যে ভবিষ্যতের তারা হবে–তাও অসম্ভব।

–প্রমথ চৌধুরী।

[ সাধু ]

তোমাদের বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য সব জানিয়া কিছু না জানা, আমাদের। জ্ঞানের উদ্দেশ্য কিছু না জানিয়া সব জানা। তোমাদের পরলোক স্বর্গ, আমাদের ইহলোক নরক। কাজেই পরলোক তোমাদের গম্য, ইহলোক আমাদের ত্যাজ্য। তোমাদের ধর্মমতে আত্মা অনাদি নয় কিন্তু অনন্ত, আমাদের ধর্মমতে আত্মা অনাদি কিন্তু অনন্ত নয়–তাহার শেষ নির্বাণ। পূর্বেই বলিয়াছি, প্রাচী ও প্রতীচী পৃথক। আমরাও ভালো, তোমরাও ভালো–শুধু তোমাদের ভালো আমাদের মন্দ ও আমাদের ভালো তোমাদের মন্দ। সুতরাং অতীতের আমরা ও বর্তমানের তোমরা, এই দুইয়ে মিলিয়া যে ভবিষ্যতের তাহারা হইবে-তাহাও অসম্ভব।

(ছ) আজ আমাদের অনেকেরই ঘুম ভেঙেছে। আমার বিশ্বাস এখন দেশে এমন একজনও ভারতবাসী নেই যে এই প্রাচীন পবিত্র মাতৃভূমির নষ্ট-গৌরব বিলুপ্ত-সম্মান পুনরুজ্জীবিত না দেখতে চায়। কিন্তু কেবল চাইলেই ত মেলে না, পাবার উপায় করতে হয়। এই উপায়ের পথেই যত বাধা, যত বিঘ্ন, যত মতভেদ। এবং এইখানেই একটা বস্তুকে আমি তোমাদের চিরজীবনের পরমসত্য বলে অবলম্বন করতে অনুরোধ করি। এ কেবল পরের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা। যার যা দাবি তাকে তা পেতে দাও। তা সে যেখানে এবং যারই হোক।

–শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

[ সাধু ] আজ আমাদের অনেকেরই ঘুম ভাঙিয়াছে। আমার বিশ্বাস এখন। দেশে এমন একজনও ভারতবাসী নাই যে এই প্রাচীন পবিত্র মাতৃভূমির নষ্ট-গৌরব বিলুপ্ত-সম্মান পুনরুজ্জীবিত না দেখিতে চায়। কিন্তু কেবল চাহিলেই ত মিলে না, পাইবার উপায় করিতে হয়। এই উপায়ের পথেই যত বাধা, যত বিঘ্ন, যত মতভেদ। এবং এইখানেই একটা বস্তুকে আমি তোমাদের চিরজীবনের পরমসত্য বলিয়া অবলম্বন করিতে অনুরোধ করি। এ কেবল পরের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা। যাহার যাহা দাবি তাহাকে তাহা পাইতে দাও। তাহা সে যেখানে এবং যাহারই হউক।

(জ) সকালের আলোয় উদ্ভাসিত শ্যামলতা দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে অপরূপ প্রসন্নতায়। ওয়ান অব দি ফিয়ার্সেস্ট ফরেস্ট! বিশ্বাস হয় না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি বাতাসে আকার-অবয়বহীন পত্রাবরণ সবুজ সমুদ্রের মতো দুলছে, চক্র দিচ্ছে পাখির দল–এখান থেকে মৌমাছির মতো দেখায় পাখিগুলোকে; জানালার ঠিক নিচেই ইস্পাতের ফলার মতো পাহাড়ী নদীটার নীলিমোজ্জ্বল রেখা–দুটো একটা নুড়ি ঝকমক করে মণিখণ্ডের মতো। বেশ লাগে।

–নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়।

উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটিতে তৎসম তদ্ভব বিদেশী প্রভৃতি নানান শব্দভাণ্ডারের সমাবেশে শব্দের শ্রীক্ষেত্র বসানো হইয়াছে। সবুজ, সমুদ্র, চক্র, পাখি, পাহাড়ী নদী–একেবারে পাশাপাশি ঠাঁই পাইয়াছে। একটি গোটা বাক্যই তো ইংরেজী শব্দের। অথচ এতটুকু বেমানান লাগে কি? চলিত ভাষার অনুচ্ছেদটিতে প্রায় দেড় ডজন তৎসম শব্দ প্রাকৃতিক বর্ণনাটিকে কি গাম্ভীর্যমণ্ডিত করে নাই? বিষয়বস্তুটিকে গুরুগম্ভীর রাখিয়া ভাষারীতির পরিবর্তন ঘটাইলে কী দাঁড়ায় দেখি।–

[ সাধু ] সকালের আলোয় উদ্ভাসিত শ্যামলতা অপরূপ প্রসন্নতায় দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়া রহিয়াছে। ওয়ান অব দি ফিয়ার্সেস্ট ফরেস্ট! বিশ্বাস হয় না। তাকাইয়া তাকাইয়া দেখি বাতাসে আকার-অবয়বহীন পত্রাবরণ সবুজ সমুদ্রের মতো দুলিতেছে, পাখির দল চক্র দিতেছে–এখান হইতে পাখিগুলাকে মৌমাছির মতো দেখায়; জানালার ঠিক নিচেই ইস্পাতের ফলার মতো পাহাড়ী নদীটির নীলিমোজ্জ্বল রেখা–দুটি একটি নুড়ি মণিখণ্ডের মতো ঝকমক করে। বেশ লাগে।

লক্ষ্য কর–সমাপিকা ক্রিয়াগুলিকে সাধু রীতির নিয়মানুযায়ী বাক্যের শেষে ঠাঁই দেওয়া হইয়াছে।

সুতরাং চলিত রীতির রচনায় তৎসম শ একেবারে বর্জনীয় এবং সাধু রীতির রচনায় তৎসম ব্যতীত অন্য শব্দ অপাঙক্তেয়–দুইটি সিদ্ধান্তই সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও সর্বনাশা। বাস্তবক্ষেত্রে কথাবার্তায়, আলাপ-আলোচনায়, শ্রেণীকক্ষে পাঠদানে, পত্রাদিলিখনে আমরা তো চলিত রীতিটিই অবলম্বন করি, কিন্তু তৎসম শব্দ কি বর্জন করিতে পারি? শিক্ষার্থি-শিক্ষক-অভিভাবক প্রত্যেককেই অষ্টাদশ শতাব্দীসুলভ সংস্কার হইতে মুক্ত হইয়া বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী হইতে হইবে। এ বিষয়ে ২৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীমহাশয়ের লিখিত (গ) ও (ঘ) চিহ্নিত অনুচ্ছেদ-দুইটি ভালো করিয়া লক্ষ্য কর।

বাংলা লেখ্য উপভাষা : গদ্য ও পদ্যরূপের পার্থক্য

আধুনিক বাংলা ভাষার প্রধান বৈচিত্র্য দুই প্রকারের–একটি মৌখিক বা কথ্য রূপ, অন্যটি তাহার সাহিত্যিক বা লেখ্য রূপ। ইতঃপূর্বে আমরা কথ্য উপভাষার পাঁচটি প্রধান আঞ্চলিক রূপগুলি লইয়া আলোচনা করিয়াছি। এইবার লেখ্য রূপটির বিষয়ে কতকগুলি কথা বলিব।

পূর্বেই জানিতে পারিয়াছ যে, অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষাভাষীদের মুখের কথায় বিস্তর পার্থক্য থাকিলেও সকলেই লেখার সময় সর্বজনবোধ্য একটি সাধারণ ভাষাছাঁদই ব্যবহার করেন। সর্বসাধারণের গ্রহণযোগ্য সেই পরস্পরবোধ্য সর্বজনীন আদর্শ সাহিত্যিক রূপটিকে গদ্য ও পদ্য দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। সাধু ও চলিত রীতি-দুইটির যেকোনো একটিতেই গদ্য লিখিত হইতে পারে; পদ্যে সাধু বা চলিত যেকোনো রীতি ছাড়াও দুইটি রীতির মিশ্রণও চলিতে পারে।

এখন আমরা বাংলা লেখ্য উপভাষার গদ্য ও পদ্যরূপের পার্থক্য ও পারস্পরিক রূপান্তরের বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করিব।

(১) গদ্য সাধু অথবা চলিত যেকোনো একটি রীতিতে লেখা হয়। যে রীতিতে রচনাটির লেখা শুরু করা হয়, শেষ পর্যন্ত সেই রীতিটিই অনুসরণ করিয়া রচনাটিকে শেষ করিতে হয়। গদ্যে সাধু-চলিতের মিশ্রণ ঘটানো গুরুতর অপরাধ।

কিন্তু পদ্যরচনার ক্ষেত্রে সাধু বা চলিত যেকোনো রীতিতে লেখা যায়, এমন কি উভয়রীতির মিশ্রণও আদৌ দোষাবহ নয়; কারণ পদ্যের ক্ষেত্রে ছন্দের বাঁধনটুকু অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা সাহিত্যে বহু প্রথিতযশা কবির কাব্যেও এই মিশ্ররীতি অনুসৃত হইয়াছে।

আমরা এখন বিভিন্ন কবির রচনা হইতে সাধু, চলিত ও মিশ্র রীতির পদ্যরূপের কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতেছি।

সাধু রীতির পদ্য : (ক)
‘ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে’
অক্ষর পড়িছে নেত্রে,
বুঝিতে পারি না অর্থ, থাক তবে আজ।
নিঃশব্দে চুম্বিয়া দিনু মুছিয়া নয়ান।

–অক্ষয়কুমার বড়াল।

(খ) রাজকুলে জন্মিয়া পড়িলে রাজকুলে।
দুই কুল উজ্জ্বল করিলে গুণে শীলে৷

–কৃত্তিবাস ওঝা।

(গ) ত্বরায় আনিল নৌকা বামাস্বর শুনি।

–ভারতচন্দ্র রায়।

(ঘ) তৃষ্ণায় আকুল বঙ্গ করিত রোদন।

–মধুসূদন দত্ত।

(ঙ) সমুখে রাখিয়া স্বর্ণমুকুর
বাঁধিতেছিল সে দীর্ঘ চিকুর
আঁকিতেছিল সে যত্নে সিঁদুর সীমন্তসীমা-’পরে।

–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

(চ) বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা
“আমারে দেখিতে যাইয়ো কিন্তু, উজান-তলির গাঁ।”

–জসীমউদ্দিন।

চলিত রীতির পদ্য :

(ক) কেয়াফুলে ঘুণ লেগেছে
পড়তে পরাগ মিলিয়ে গেছে,
মেঘের সীমায় রোদ জেগেছে, আলতা-পাটি শিম।

–সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।

(খ) আমরা ছেড়েছি টিকির আদর
আমরা ছেড়েছি ধুতি ও চাদর,
আমরা হ্যাট বুট আর প্যান্ট কোট পরে
সেজেছি বিলাতি বাঁদর।

–দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।

(গ) শুনে মহা রেগে ছুটে যাই বেগে আনি তার টিকি ধরে।

–রবীন্দ্রনাথ।

(ঘ) দেশমাতাকে পূজব গো    ব্যথীর ব্যথা বুঝব গো,
ধন্য হবে দেশের মাটি ধন্য হবে অন্নজল।

–গোলাম মোস্তফা।

(ঙ) সভা ভেঙে গেল, ছত্রাকারে ছড়িয়ে পড়ল ভিড়।

–সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

মিশ্র রীতির পদ্য :

(ক) মিটিল সব ক্ষুধা, সঞ্জীবনী সুধা
এনেছে অশরণ লাগি রে।

–রজনীকান্ত সেন।

[ মিটিল = সাধু; এনেছে (< আনিয়াছে) = চলিত ]

(খ) কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হব–কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমির গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে;

–জীবনানন্দ দাশ।

[ আসিব, রহিবে = সাধু; ভেসে (< ভাসিয়া), হব (< হইব), কেটে যাবে (< কাটিয়া যাইবে) = চলিত ]

(গ) আঘাতের ব্যথা, ভাই আজ বুঝিয়াছি আমি,
হংসের ব্যথায় প্রাণ হয়েছে বিকল।

–নবীনচন্দ্র সেন।

[ বুঝিয়াছি = সাধু; হয়েছে (< হইয়াছে) = চলিত ]

(ঘ) ঝরঝর ধারে ভিজিবে নিচোল,
ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল;

–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

[ভিজিবে = সাধু; যেতে (< যাইতে), হয়েছে (< হইয়াছে) = চলিত]

(ঙ) জুয়াচোরে যদি কেঁদে ধার ঢায়, ধার করে দেবে এনে,
ছাগল বেচিয়া শুধিয়াছে ধার, শেখে না ঠেকিয়া জেনে।

–কুমুদরঞ্জন মল্লিক।

[ বেচিয়া, শুধিয়াছে, ঠেকিয়া = সাধু; কেঁদে (< কাদিয়া), চায় (< চাহে), করে (< করিয়া), দেবে (< দিবে), এনে (< আনিয়া), শেখে (< শিখে), জেনে (< জানিয়া) = চলিত ]

(চ) ‘ব্যক্তি’ ডুবে যায় ‘দলে’    মালিকা পরিলে গলে
প্রতি ফুনে কে-বা মনে রাখে?

–কালিদাস রায়।

[ পরিলে = সাধু; ডুবে (< ডুবিয়া) = চলিত ]

(ছ) আমার লাগিয়া ভাই কর প্রাণরক্ষা।
তোমা বিনা বিদেশে মাগিয়া খাব ভিক্ষা ৷৷

–কৃত্তিবাস ওঝা।

[ লাগিয়া, মাগিয়া = সাধু; খাব (< খাইব) = চলিত ]

(জ) ওই শোনো তার ঘোর নির্ঘোষ, দুলিয়া উঠিল জটাভার।
শুরু হয়ে গেছে গুরু-গুরু রব–নাসা-গর্জন ঝার।

–মোহিতলাল।

[ দুলিয়া উঠিল = সাধু; শোনো (< শুন), তার (< তাহার), হয়ে গেছে (< হইয়া গিয়াছে) = চলিত ]

(২) অনেকগুলি সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ শুধুমাত্র পদ্য উপভাষাতেই ব্যবহৃত হয়। গদ্য উপভাষায় সেগুলি লিখিতে হইলে শব্দগুলির গদ্যরূপ (গদ্যে ব্যবহৃত রূপ) লিখিতে হয় । পদ্যে লিখিত রূপে শব্দগুলি গদ্যে প্রয়োগ করা সমীচীন নয় [পৃঃ ৫৫ দেখ ]। আমরা বিশিষ্ট কবিদের রচনা হইতে এইরূপ কিছু শব্দের উদাহরণ উল্লেখ করিতেছি–বন্ধনীমধ্যে শব্দগুলির গদ্যরূপগুলিও দিলাম।

সর্বনাম :

(ক) ব্রহ্মচারী বলে মোর (আমার) একলব্য নাম।–কাশীরাম।

(খ) মোরা (আমরা) একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।–নজরুল।

(গ) মোদের (আমাদের) মতো তাই ওরা আর ছুটে নাকো মোহের পিছু।–গোলাম মোস্তফা।

(ঘ) কাল নাগে খাইল মোরে (আমাকে) চক্ষু মেলি চাও।–নারায়ণদেব।

(ঙ) মম (আমার) হৃদয়-বৃন্দাবনে কানু ঘুমায়ল, প্রেম-প্রহরী রহুঁ জাগি।–গোবিন্দদাস।

(চ) হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব (তোমার) বিবিধ রতন।–মধুসূদন দত্ত।

(ছ) যারে (যাকে) তুমি নীচে ফেল, সে তোমারে (তোমাকে) বাঁধিবে যে নীচে।–রবীন্দ্রনাথ।

ক্রিয়াপদ :

(ক) যেখানে যাহারে জড়ায়ে (জড়াইয়া) ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি (ছাড়িয়া)। –জসীমউদ্দিন।

(খ) অন্নপূর্ণা উত্তরিলা (উত্তরণ করিলেন) গাঙ্গিনীর তীরে। –ভারতচন্দ্র।

(গ) অলক্ষিতে কুকুরের রুধিলেক (রোধ করিল) রা। –কাশীরাম দাস।

(ঘ) সূতবৃদ্ধে প্রণমিলে (প্রণাম করিলে) পিতৃ-সম্ভাষণে। –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

(ঙ) করুণে বরষিছে (বর্ষণ করিতেছে) মধুর সান্ত্বনা।–রজনীকান্ত সেন।

(চ) সবারে মিলায়ে (মিলাইয়া) যদি ভাবি একসাথে।–প্রিয়ংবদা দেবী।

(ছ) ছেলেরা মেতেছে খেলায় করিছে (করিতেছে) চড়ুইভাতি।–কুমুদরঞ্জন।

(জ) কাণ্ডারী বলো ডুবিছে (ডুবিতেছে) মানুষ, সন্তান মোর মা’র। –নজরুল।

(ঝ) মুখ বিস্ফারি’ (বিস্ফারিত করিয়া) আরও জল পশু চায়, কলসী উজাড়ি (উজাড় করিয়া) সমস্ত বারি ঢালিয়া দিলেন তায়।–কবিশেখর।

(ঞ) কি বলিয়া নিবারিব (নিবারণ করিব) তাহার ক্রন্দন।–কৃত্তিবাস।

(ট) বৃন্দাবন ভ্রমে তাহা পশিল (প্রবেশ করিল) ধাইয়া। কৃষ্ণদাস কবিরাজ।

(৩) পদ্যরূপে শব্দের সঙ্গে ‘রে’ বিভক্তি যুক্ত হয়। শব্দগুলি গদ্যে ব্যবহৃত হইলে ‘কে’ বিভক্তি যুক্ত হয়। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখ :

গদ্যরূপগুলি সংশ্লিষ্ট শব্দের পর বন্ধনীমধ্যে দেখানো হইল।

(ক) আমারে (আমাকে) রাজার সাজে    বসায়ে সংসার-মাঝে
কে তুমি আড়ালে কর বাস। –রবীন্দ্রনাথ।

(খ) এরে (ইহাকে) ভিখারী সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে।–ঐ।

(গ) লভিয়া আরাম আমি উঠিলাম, তাহারে (তাহাকে) ধরিল জ্বরে।–ঐ।

(ঘ) পাপীরে (পাপীকে) যে ভালোবাসে, আমি ভালোবাসি তারে (তাকে),
সেই জন প্রেম-অবতার। –নবীনচন্দ্র সেন।

(ঙ) ঈশ্বরীরে (ঈশ্বরীকে) পরিচয় করেন ঈশ্বরী। –ভারতচন্দ্র রায়।

(চ) মোর অশ্রু তোমারে (তোমাকে) কাঁদায়। –যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।

(ছ) কল্পনাবে (কল্পনাকে) দিল মুক্তি, ক্ষিপ্র গতি, গভীর আকৃতি। –কবিশেখর।

(জ) হেথায় সবারে (সবাইকে) হবে মিলিবারে আনতশিরে।–রবীন্দ্রনাথ।

(৪) স্বরভক্তির ব্যাপক প্রয়োগ পদ্যেই দেখা যায়; গদ্যে ব্যবহৃত হইলে যুক্ত-ব্যঞ্জন-সমন্বিত মূল শব্দটিই সাধারণত লেখা হয়। [১০৬-০৮ পৃঃ দ্রষ্টব্য]

এই বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তির প্রয়োগ প্রাচীন বাংলা কাব্যসাহিত্যেও যথেষ্ট ছিল, আধুনিক কবিতাতেও আছে। কবিতায় ছন্দের মাধুর্যসৃষ্টিতে বিপ্রকর্ষের অবদান অনস্বীকার্য। কতকগুলি উদাহরণ (বন্ধনীমধ্যে মূল শব্দসহ) দেখ :

(ক) বিশ্ব যখন নিদ্রা মগন (< মগ্ন) গগন অন্ধকার। –রবীন্দ্রনাথ।

(খ) যতনে (< যত্নে) হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে।–কমলাকান্ত।

(গ) মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশ (< স্পর্শ) খানি দিয়ো। –রবীন্দ্রনাথ।

(ঘ) জীবনে মরণে জনমে জনমে (< জন্মে) প্রাণনাথ হৈও তুমি। –চণ্ডীদাস।

(ঙ) সুখের লাগিয়া যে করে পিরীতি (< প্রীতি) দুখ যায় তারি ঠাই। –ঐ।

(চ) নয়ন না তিরপিত (< তৃপ্ত) ভেল। –বিদ্যাপতি।

(ছ) দুখানি করুণ আঁখি মানে না যুকতি (< যুক্তি)। –রবীন্দ্রনাথ।

(জ) আকুল শরীর মোর বেয়াকুল (< ব্যাকুল) মন। –বড়ু চণ্ডীদাস।

(ঝ) অমিয়া-সাগরে সিনান (< স্নান করিতে সকলি গরল ভেল। ….. পিয়াস লাগিয়া জলদ সেবিনু বজব (< বজ্র) পড়িয়া গেল। –জ্ঞানদাস।

(ঞ) রজনী শাঙন ঘন ঘন দেয়া-গরজন (< গর্জন)।
রিমিঝিমি শবদে (< শব্দে) বরিষে (< বর্ষে। –ঐ।

(ট) স্বপনে (স্বপ্নে) দেখিলুঁ যে শ্যামল বরণ (বর্ণ) দে। –ঐ

(৫) গদ্যে নামধাতু খুব বেশী ব্যবহৃত না হইলেও পদ্যে ইহান প্রভূত ব্যবহার দেখা যায়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাহার কাব্যে এক নূতন ধরনের নামধাতুজ ক্রিয়ার ব্যাপক প্রয়োগ করিয়াছেন। পরবর্তীকালে অনেক কবিই তাহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াছেন (২৫০-২৫১ পৃষ্ঠার আলোচনা দ্রষ্টব্য)। যেমন :

(ক) যাচ্ছে কারা হনহনিয়ে। –সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।

(খ) ছায়া ঘনাইছে বনে বনে। –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

(গ) তটে উত্তরিলা তরি, তারা উত্তরিলা। –ভারতচন্দ্র রায়।

(ঘ) স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থাণুর ললাটে। –মধুকবি।

(ঙ) সশঙ্ক লঙ্কেশ শূর অরিলা শঙ্করে। –ঐ

(চ) স্মরিব সত্যে দূরিব মিথ্যা ভয়। –রবীন্দ্রনাথ।

(ছ) তারি মাঝে ডিঙা আমার মসমঁসিয়ে চলে।

(জ) পায়স-পয়োধি সপসপিয়া পিষ্টক-পৰ্বত কচমচিয়া …..।

(ঝ) পাটের ডগা লকলকিয়ে উঠে।

(ঞ) জোয়ার যখন মিশিয়ে যাবে কুলে, থমথমিয়ে আসবে যখন জল।

(৬) কতকগুলি ক্রিয়া-বিভক্তি কেবলমাত্ৰ কবিতাতেই ব্যবহৃত হয়; গদ্যে ইহাদের প্রয়োগ ক্কচিৎ দেখা যায়। যেমন :–

উত্তমপুরুষে অতীতকালে কবিতায় ‘-লেম’ বিভক্তির প্রয়োগ :

(ক) খোকা মাকে শুধায় ডেকে, ‘এলেম আমি কোথা থেকে।’ –রবীন্দ্রনাথ।

(খ) ঝুলি হতে দিলেম তুলে একটি ছোটো কণা। –ঐ।

(গ) দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ। –ঐ।

(ঘ) শুধালেম আমি কৌতূহলী ‘কী এনেছ’ বলি। –ঐ।

(ঙ) চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।….
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে ওর সাথিদের সঙ্গে।….
একটুকু রইলেম চুপ করে; তারপর বললেম,
আমি চললেম একা। –ঐ।

এক্ষেত্রে গদ্যে সাধারণত ‘-লাম’ বিভক্তি যুক্ত হয়। আয়তাক্ষর শব্দগুলি গদ্যে সাধুতে যথাক্রমে আসিলাম বা এলাম (চলিতে এলুম), দিলাম (দিলুম), দেখিয়াছিলাম (দেখেছিলাম, দেখেছিলুম) প্রভৃতি রূপ পায়।

প্রথমপুরুষে সাধারণ অতীতে ‘লে বিভক্তির প্রয়োগ :

খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে আমাকে করলে নমস্কার।….
এক সময় আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।…
ও বললে, ‘থাক, এখন যাও ওদিকে।’ –রবীন্দ্রনাথ।

চেহারায় চলিত অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো হইলেও আয়তাক্ষর তিনটি ক্রিয়াপদই সমাপিকা। গদ্যে প্রযুক্ত হইলে এগুলির সাধু (চলিত রূপটি বন্ধনীমধ্যে) রূপগুলি যথাক্রমে হইত–করিল (করল), জানাইল (জানাল), বলিল (বলল)।

উত্তমপুরুষে অতীত কালের ক্রিয়ায় ‘-নু’ বিভক্তির প্রয়োগ :

(ক) কহিনু তারে অন্ধকারে দাঁড়ায়ে রমণী। –রবীন্দ্রনাথ।

(খ) তুলিনু যূথী, তুলিনু জাতী, তুলিনু চাঁপাফুল।
দুজনে মিলি সাজায়ে ডালি বসিনু একাসনে,
নটরাজেরে পূজিনু একমনে।…..
আবার ভাঙা ভাগ্য নিয়ে দাঁড়ানু দ্বারে এসে
দেখিনু আমি নটরাজের দেউল দ্বার খুলি। –ঐ।

(গ) সে বছরে কঁকা পেনু কিছু টাকা করিয়া দালালগিরি। –ঐ।

(ঘ) দশ মাস গর্ভে ধরে পুষিনু তোমায়। –কৃত্তিবাস ওঝা।

(ঙ) ইহাতে বুঝিনু তুমি দেবতা নিশ্চয়। –রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়।

(চ) জানিনু কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল রক্ষঃপুরে। –মধুসূদন দত্ত।

(ছ) বেসুরে ধরিনু গান–হায়, হত ভগবান। –যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।

(জ) এতটুকু তারে ঘরে এনেছি সোনার মতন মুখ। –জসীমউদ্দিন।

আয়তাক্ষর শনগুলি গদ্যে প্রযুক্ত হইলে যে রুপ পায়, তাহা সাধুতে (বন্ধনীমধ্যে চলিতে) যথাক্রমে হয়–বলিলাম (বললাম), তুলিলাম (তুললাম), বসিলাম (বসলাম), পূজা করিলাম (পূজা করলাম), দাঁড়াইলাম (দাঁড়ালাম), দেখিলাম (দেখলাম), পাইলাম (পেলাম), পুষিলাম (পুষলাম), বুঝিলাম (বুঝলাম), জানিলাম (জানলাম), ধরিলাম (ধরলাম), আনিয়াছিলাম (এনেছিলাম)।

নিত্যবৃত্ত অতীত কালে উত্তমপুরুষের ক্রিয়ায় ‘-তেম’ বিভক্তির প্রয়োগ :

(ক) ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতেম পাখির পায়। –লালন ফকির।

(খ) ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন। –রবীন্দ্রনাথ।

তেমনি যেতেম, পারতেম, শুনতেম, পেতেম ইত্যাদি রূপগুলি পদ্যে ব্যবহৃত হয়। গদ্যে ব্যবহৃত হইলে ইহাদের রূপগুলি যথাক্রমে হইত–দিতাম (দিতুম), হইতাম (হতাম/হতুম), যাইতাম (যেতাম/যেতুম), পারিতাম (পারতাম/পারতুম), শুনিতাম (শুনতাম/শুনতুম), পাইতাম (পেতাম/পেতুম)।

(৭) গদ্য-কবিতা ছাড়া পদ্যে অন্ত্যমিল বা মধ্যমিল অথবা উভয় ধরনের মিলই থাকে। কবিতার প্রতিটি চরণ সমদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট হইতে পারে, আবার ছোটো-বড়োও হইতে পারে। যেমন :

চুপ চুপ–-ওই ডুব
দ্যায় পানকৌটি,
দ্যায় ডুব টুপ টুপ
ঘোমটার বউটি। –সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।

কবিতাটিতে স্তবকের প্রথম ও তৃতীয় চরণে অন্ত্যমিল (ডুব–টুপ) এবং দ্বিতীয় ও চতুর্থ চরণে অন্ত্যমিল (কৌটি–বউটি) রহিয়াছে।

মুখে দেয় জল, শুধায় কুশল, শিরে দেয় মোর হাত;
দাঁড়ায়ে নিঝুন, চোখে নাই ঘুম, মুখে নাই তার ভাত। –রবীন্দ্রনাথ।

পঙক্তি-দুইটির ভিতরে ছয় মাত্রার পর্বদুটির মধ্যে (জল–কুশল এবং নিঝুম–ঘুম) মিল রহিয়াছে, এবং পঙক্তি-দুটির শেষেও মিল আছে (হাত-ভাত)। এই প্রকারের মধ্যমিল ও অন্ত্যমিলের আরও একটি দৃষ্টান্ত :

বিশ্বের ক্রন্দন-বিচলিত নারায়ণ
আঁখি তার অশ্রুতে ভরিল–
গোলোকে হল না ঠাঁই, শিবজটা বাহি’ তাই
শতধারা ধরণীতে ঝরিল। –যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।

এখানে প্রতিটি চরণে আট মাত্রার দুটি পর্বে মধ্যমিল (ক্রন্দন–নারায়ণ ও ঠাঁই–তাই) আছে, আবার চরণান্তিক মিলও আছে (ভরিল–ঝরিল)।

শ্রীমতীরে হেরি পুঁথি রাখি ভূমে দ্রুতপদে গেল কাছে।

কহে সাবধানে তার কানে-কানে,
“রাজার আদেশ আজি কে না জানে–
এমন করে কি মরণের পানে ছুটিয়া চলিতে আছে।” –রবীন্দ্রনাথ।

এখানে সব পঙক্তিই সমান দৈর্ঘ্যের নয়; লক্ষ্য কর, ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত কবিতাটিতে প্রতিটি বড়ো পঙক্তিতে ছয় মাত্রার তিনটি করিয়া পূর্ণ পর্ব ও দুই মাত্রার একটি খণ্ড পর্ব আছে; মধ্যবর্তী দুটি ছোটো পঙক্তিতে ছয় মাত্রার দুইটি করিয়া পর্ব আছে। ছোটো পঙক্তির প্রথমটিতে পৰ্বান্তিক মিল (ধানে-কানে) এবং পঙুক্তি-দুটির অন্ত্যমিলও (কানে-জানে) আছে; আবার বড়ো পঙক্তি দুটির মধ্যেও অন্ত্যমিল (কাছে-আছে) রহিয়াছে।

গদ্যে কোনোরকম অন্ত্যমিল ৰা মধ্যমিলের ব্যাপার থাকে না; ছন্দোবদ্ধ কবিতার মতো কোনো চরণই গদ্যে ছন্দ-অনুযায়ী পর্বে ভাগ করিয়া লেখা হয়, বাক্যগুলিও ছোটো-বড়ো বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের না হইয়া পাতার একপ্রান্ত হইতে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়; শুধুমাত্র অনুচ্ছেদ শুরুর পক্তিটি সামান্য ছোটো আকৃতির হয়, শেষ পঙক্তিটিও কম দৈর্ঘ্যের হইতে পারে, কিন্তু অনুচ্ছেদের মাঝের প্রতিটি পঙক্তিই পাতার প্রস্থ-অনুসারে সমদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট হয়।

(৮) পদ্যে একটি বাক্য একাধিক পঙক্তিতে বিন্যস্ত হইতে পারে, কিন্তু গদ্যে প্রয়োজনে একটি পঙক্তিতে একাধিক ছোটো বাক্যও থাকতে পারে। গদ্যে বাক্যের মধ্যে দরকারমতো অর্ধচ্ছেদ (;) উদ্ধৃতি-চিহ্ন (“ ”) পাদচ্ছেদ (,) পদ-সংযোজক চিহ্ন (-) ইত্যাদি ছেদচিহ্ন এবং বাক্যের শেষে পূর্ণচ্ছেদ (1) জিজ্ঞাসা-চিহ্ন (?) বা বিস্ময়সূচক চিহ্ন (!) বসে। কিন্তু কবিতায় ছেদচিহ্ন ব্যবহারের রীতি অন্যরকম। প্রাচীন বাংলায় সাধারণত পয়ার ছন্দে কবিতা রচিত হইত; সেখানে প্রথম পঙক্তির শেষে একটি এবং দ্বিতীয় পক্তির শেষে দুটি পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহৃত হইত। এইভাবে বিজোড় পক্তিতে (I) এবং জোড় পঙক্তির শেষে () ছেদচিহ্ন লেখা হইত–বাক্য সমাপ্ত হউক বা না-ই হউক। যেমন :

যার নায়ে পার করে ভবপারাবার।
ভাল ভাগ্য পাটুনি তাহারে করে পার।। –ভারতচন্দ্র।

দেখ, ভাবের সমাপ্তি না হইলেও প্রথম পঙক্তির শেষে ছেদচিহ্ন পড়িয়াছে।

বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের সার্থক প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্তের রাচত চতুর্দশপদী কবিতার (Sonnet) একটি উদাহরণ দেখ।

চন্দ্রচূড়-জটাজালে আছিলা যেমতি
জাহ্নবী, ভারত-রস ঋষি দ্বৈপায়ন,
ঢালি সংস্কৃত-হ্রদে রাখিলা তেমতি;
তৃষ্ণায় আকুল বন্ধ করিত রোদন।

লক্ষ্য কর, সনেটটিতে প্রাচীন পয়ারের মতো কারণে-অকারণে প্রতিটি পঙক্তির শেষেই পুচ্ছেদ পড়ে নাই; ডাবের প্রবাহ পঙক্তির পর পঙক্তি অতিক্রম করিয়া যেখানে শেষ হইয়াছে, সেইখানে ছেদচিহ্ন বসিয়াছে। এক্ষেত্রে দরকারে পত্তির মধ্যবর্তী কোনো জায়গাতেও পূর্ণচ্ছেদ বসিতে পারে। যেমন :

হৃৎপিণ্ড করিয়া ছিন্ন রক্তপদ্ম-অর্ঘ্য-উপহারে
ভক্তিভরে জন্মশোধ শেষ পূজা পৃজিয়াছে তারে
মরণে কৃতাৰ্থ করি প্রাণ। শুনিয়াছি, তারি লাগি
রাজপুত্র পরিয়াছে ছিন্ন কস্থা, বিষয়ে বিরাগী
পথের ভিক্ষুক। মহাপ্রাণ সহিয়াছে পলে পলে
সংসারের ক্ষুদ্র উৎপীড়ন, বিধিয়াছে পদতলে
প্রত্যহের কুশাঙ্কুর, ….. –রবীন্দ্রনাথ।

কবিতার একটি বাক্য গদ্য-রূপান্তরে গঠনপ্রকৃতি-অনুসারে একাধিক বাক্য হইতে পারে। যেমন :

একেলা জগৎ ভুলে   পড়ে আছি নদীকুলে,
পড়েছে নধর বট হেলে ভাঙাতীরে;
ঝুরুষুরু পাতাগুলি কাঁপিছে সমীরে। –অক্ষয়কুমার বড়াল।

গদ্য-রূপান্তর : জগৎ ভুলিয়া [ আমি ] নদীকূলে একেলা পড়িয়া আছি। নধর বট [ গাছটি ] ভাঙাতীরে হেলিয়া পড়িয়াছে। পাতাগুলি সমীরে ঝুরুঝুরু [শব্দে] কাঁপিতেছে। দেখ, কবিতার একটি বাক্য গদ্যে তিনটি বাক্যে পরিণত হইয়াছে।

(৯) বাংলা গদ্যে সাধারণত কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া–এই পদস্থাপন-রীতি অনুসৃত, হয়, বিশেষ্যের আগে বিশেষণ বসে, কিন্তু কবিতায় সবসময় এই স্বাভাবিক অন্বয় বজায় থাকে না। ছন্দ, অলংকার, পৰ্বান্তিক বা পদান্তিক মিলের কারণে কখনও কখনও ক্রিয়াপদ বাক্যের শেষে না বসিয়া আগেও বসে। যেমন :

(ক) নমিয়া বুদ্ধে মাগিয়া লইল পাদনখকণা তাঁর।
স্থাপিয়া নিভৃত প্রাসাদকাননে।
তাহারি উপরে রচিলা যতনে
অতি অপরূপ শিলাময় স্তূপ শিল্পশোভার সার।–রবীন্দ্রনাথ।

প্রথম বাক্যে ‘মাগিয়া লইল’ এবং দ্বিতীয় বাক্যে অমাপিকা ক্রিয়া স্থাপিয়া ও সমাপিকা ক্রিয়া চলা’ বাক্যের মাঝামাঝি বসিয়াছে।

(খ) নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়। –নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

সমাপিকা ক্রিয়া ‘নেমেছে’ রাক্যের একেবারে গোড়ায় বসিয়াছে।

(গ) মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ,
ফসফরাসের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকল
মিছিলের সেই মুখ।…..
আমাকে উজ্জীবিত করে সমুদ্রের একটি স্বপ্ন
মিছিলের একটি মুখ। –সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

তিনটি সমাপিকা ক্রিয়ার কোনোটিই বাক্যের শেষে বসে নাই।

বিশেষণপদটি বিশেষ্যের পরেও বসে। যেমন :

(ক) মন্দ নয়, সে পাত্র ভালো–
রঙ যদিও বেজায় কালো। –সুকুমার রায়।

দেখ, ‘ভালো’ ও ‘কালো’ বিশেষণপদ-দুটি তাহাদের বিশেষ্যপদ যথাক্রমে ‘পাত্র’ ও ‘রঙ’-এর পরে বসিয়াছে।

(খ) দূরে দূরে গ্রাম দশবারোখানি, মাঝে একখানি হাট।

এক্ষেত্রেও ‘গ্রাম’ বিশেষ্যপদটির সংখ্যাবাচক বিশেষণপদ ‘দশবারোখানি’ বিশেষ্যের পরে বসিয়াছে।

(১০) পদ্যের ছন্দ নিয়মিত; ফলে পড়িবার ও আবৃত্তি করিবার সময় নির্দিষ্ট সময় অন্তর কোনো ছেদচিহ্ন না থাকিলেও ছন্দের মাধুর্যরক্ষার কারণে যতিচিহ্নের জন্য প্রয়োজনে শব্দের মাঝখানেও সামান্যতম মুহূর্তের জন্য থামিতে হয়; এই বিরতিটুকু ছেদচিহ্নের জন্য থামার সময়ের চেয়েও অনেক কম সময়ের জন্যই, কিন্তু এটুকু না হইলে আবৃত্তিটি শ্রুতিসুখকর হয় না। যেমন :

(ক) সবচেয়ে যে / ছোটো পিড়ি/খানি–
সেইখানি আর / কেউ রাখে না / পেতে…
ছোট্ট যে জন / ছিল রে সব/চেয়ে
সেই দিয়েছে / সকল শুন্য / করে।  –সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।

চার মাত্রার ছড়ার ছন্দে রচিত কবিতাটিতে প্রতিটি চরণে চার মাত্রার দুইটি পূর্ণ পর্ব এবং দুই মাত্রার একটি করিয়া খণ্ড পর্ব আছে। দেখ, ছন্দের প্রয়োজনে প্রথম চরণে ‘পিঁড়িখানি’ ও তৃতীয় চরণে ‘সবচেয়ে’ শব্দদুটির মধ্যেই যতিচিহ্ন পড়িয়াছে।

(খ) পিতার ধর্ম / শোণিতের স্রোতে /
মুছিয়া ফেলিল / রাজপুরী হতে, /
সঁপিল যজ্ঞ- / অনল-আলোতে / বৌদ্ধশাস্ত্র/রাশি। –রবীন্দ্রনাথ।

ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত কবিতাটিতে ছোটো পঙক্তিতে ৬ মাত্রার দুইটি করিয়া পর্ব আছে; বড়ো পঙক্তিতে ৬ মাত্রার তিনটি পূর্ণ ও ২ মাত্রার একটি খণ্ড পর্ব আছে; ‘বৌদ্ধশাস্ত্ররাশি’ শব্দটির মধ্যেই যতি পড়ায় সামান্যতম মুহূর্তের জন্যও থামিতে হয়, যেমন ‘ধর্ম’ ‘স্রোতে’ ‘ফেলিল’ শব্দগুলির পর ছেদচিহ্ন না থাকায় শুধু যতিচিহ্নের জন্য বিরতি দরকার হয়। যতিচিহ্নের উপর ছন্দের দোলা নির্ভর করে, ছেদচিহ্নের উপর বাক্যের অর্থ নির্ভর করে।

কিন্তু গদ্যে অর্থ-অনুসারে থামিতে হয়, পদ্যের মতো নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিয়মিত ছন্দের প্রয়োজনে থামিতে হয় না।

পদ্যের অংশ-বিশেষের সহিত তাহার গদ্য-রূপান্তরের তুলনা

কবিতায় ছন্দ ও অলংকারের তাগিদে কবি-শিল্পীরা কিছু শব্দকে মানানসই করিয়া সংক্ষিপ্ত (কিংবা প্রয়োজনে বিস্তৃত ও তৃপ্ত > তিরপিত) অথচ অর্থবহ আকারে প্রয়োগ করেন। সেই বিশেষ শব্দগুলি শুধু কবিতার ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট রূপে প্রযোজ্য। গদ্যের ক্ষেত্রে সেই কথাগুলিকে পূর্ণাঙ্গ রূপেই লিখিতে হয়। ইহাকেই বিশেষ শব্দের গদ্য-রূপ লেখা বলে। কবিতায় প্রযোজ্য কোনো কথা গদ্য-রচনার ক্ষেত্রে কীভাবে প্রযুক্ত হয়, তাহা দেখাইয়া দেওয়ার নামই গদ্য-রূপ লেখা। সুতরাং, কোনো পদ্যাংশকে গদ্যে রূপান্তর করিতে হইলে কবিতায় প্রযোজ্য বিশেষ কথাগুলি গদ্য-রূপে লিখিতে হয়। যেমন : বয়ান-বদন; নারিবে–পারিবে না; হেনকালে–এমন সময়ে; কভু–কখনও; সবে–সকলে, সকলকে; পশিব-প্রবেশ করিব ইত্যাদি।

প্রসঙ্গত মনে রাখিও, গদ্যরূপ ও অর্থ কদাপি এক জিনিস নয়। ‘লভিনু’ শব্দের গদ্যরূপ ‘লাভ করিলাম’, কিন্তু অর্থ ‘পাইলাম’; ‘বারতা’ শব্দের গদ্যরূপ ‘বার্তা’, কিন্তু অর্থ ‘সংবাদ’। অবশ্য গদ্যরূপ ও অর্থ কোনো কোনো শব্দের ক্ষেত্রে একই হইতেও পারে। যেমন, ‘যবে’ শব্দের গদ্য-রূপ ও অর্থ দুটিই ‘যখন’; সেইরূপ, তোমারে–তোমাকে; কভু কখনও; হেনকালে–এমন সময়ে।

গদ্য-রচনায় কোন্ দি কোথায় স্থাপন করিতে হয়, তাহার সুনির্দিষ্ট নিয়ম রহিয়াছে; কিন্তু ছন্দ আর পদান্তিক মিলের প্রয়োজনে কবিতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে গদ্যের বাক্য-নির্মাণ-রীতিটি রক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাই কবিতার কোনো বাক্যকে গদ্যে রূপান্তরিত করিতে হইলে গদ্যের নিয়মেই পদগুলিকে যথাযথ স্থাপন করিতে হয়। এই রীতিকে অন্বয় বলে। যেমন :

(ক) নমি তোমা নরদেব।–হে নরদেব! তোমায় নমস্কার করি।

(খ) আমি রব নিষ্ফলের হতাশের দলে।–আমি নিষ্ফলের হতাশের দলে রহিব।

এখন বাংলা সাহিত্যের কয়েকজন বিখ্যাত কবির কয়েকটি নির্বাচিত পদ্যাংশের গদ্য-রূপ দেওয়া হইল। প্রতিটি ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন হইতেছে, ভালো করিয়া লক্ষ্য কর।

(ক) যবে কৃপ আসি
তোমারে পিতার নাম শুধালেন হাসি,
কহিলেন ‘রাজকুলে জন্ম নহে যার
অর্জুনের সাথে যুদ্ধে নাহি অধিকার’–
আরক্ত আনত মুখে না রহিল বাণী,
দাঁড়ায়ে রহিলে, সেই লজ্জা-আভাখানি
দহিল যাহার বক্ষ অগ্নিসম তেজে
কে সে অভাগিনী? অর্জুনজননী সে যে।

–‘কর্ণকুন্তীসংবাদ’ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

গদ্য-রূপ : যখন কৃপ আসিয়া হাসিয়া তোমার পিতার নাম জিজ্ঞাসা করিলেন, বলিলেন, “রাজকুলে যাহার জন্ম নয়, অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে (তাহার) অধিকার নাই”, (তখন তোমার) আরক্ত আনত মুখে বাণী রহিল না; (তুমি কেবল) দাঁড়াইয়া রহিলে। (তোমার) সেই লজ্জা-আখানি অগ্নিসমান-তেজে যাহার বক্ষ দহন করিল, কে সে অভাগিনী? সে যে অর্জুনজননী।

লক্ষ্য কর, কাব্যাংশে না থাকিলেও গদ্য-রূপান্তর করিবার সময় ভাবের পরিপূর্ণতার জন্য বন্ধনীমধ্যে প্রদত্ত শব্দগুলি লেখা হইয়াছে।

(খ) চন্দ্রচূড়-জটাজালে আছিলা যেমতি,
জাহ্নবী, ভারত-রস ঋষি দ্বৈপায়ন,
ঢালি সংস্কৃত-হ্রদে রাখিলা তেমতি;
তৃষ্ণায় আকুল বঙ্গ করিত রোদন।
কঠোরে গঙ্গায় পুজি ভগীরথ ব্রতী,
(সুধন্য তাপস ভবে, নর-কুল-ধন!)
সগর-বংশের যথা সাধিলা মুকতি,
পবিত্রিলা আনি মায়ে, এ তিন ভুবন;
সেই রূপে ভাষা-পথ খননি স্ববলে,
ভারত-রসের স্রোতঃ আনিয়াছ তুমি
জুড়াতে গৌড়ের তৃষা সে বিমল জলে!
নারিবে শোধিতে ধার কভু গৌড়ভূমি।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
হে কাশি, কবীশদলে তুমি পুণ্যবান্।।

–‘কাশীরাম দাস’ : মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

গদ্য-রূপ : জাহ্নবী যেমন চন্দ্রচূড়-জটাজালে (আবদ্ধা) ছিলেন, ঋষি দ্বৈপায়ন তেমনি ভারত-রকে সংস্কৃত-হ্রদে ঢালিয়া রাখিলেন; তৃষ্ণায় আকুল (হইয়া) বঙ্গ রোদন করিত। ভবে সুধন্য তাপস নরকুল-ধন ভগীরথ ব্ৰতী কঠোরভাবে গঙ্গাকে পূজা করিয়া যেমন সগরবংশের মুক্তি সাধন করিলেন, মাকে আনিয়া এ তিন ভুবন পবিত্র করিলেন; সেইরূপে স্ববলে ভাষা-পথ খনন করিয়া তুমি সে বিমল জলে গৌড়ের তৃষ্ণা জুড়াইতে ভারত-রসের স্রোতঃ আনিয়াছ! গৌড়ভূমি (সেই) ধার কখনও শোধ করিতে পারিবে না। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। হে কাশি, তুমি কবীশদলে পুণ্যবান্।

(গ) জ্বলে শৈলে সূর্যকিরণবিম্ব,
দলিত ছিন্ন কুজঝটি;
যেন তুষারে ধবলগিরির শৃঙ্গ–
ধেয়ানমগ্ন ধূর্জটি।
ওই সানুর সোপান-মালার ঊর্ধ্বে
শৃঙ্গচরণ-রঞ্জিকা;
শোভে অভ্র-সুষমা, যেন রে শুদ্ধা
গৌরকান্তি অম্বিকা।
তথা অর্ধ-ধূসর ভূধরখণ্ড
দাঁড়ায়ে প্রান্তে গৌরবে;
যেন নন্দীর মতো রুদ্র প্রহরী
দলিছে চরণে রৌরবে।
সেথা স্তব্ধ চপল-বাসনা মানসে।
হত লালসার উগ্রতা,
রাজে মৌন মুক্ত শংকর-পদে
তাপসীর চারু শুভ্রতা।

–‘হিমাচলে বিজয়চন্দ্র মজুমদার।

গদ্য-রূপ : শৈলে সূর্যকিরণবিম্ব জ্বলিতেছে, (তাহাতে) কুজ্ঝটিকা দলিত ছিন্ন (হইতেছে); তুষারে (আচ্ছন্ন) ধবলগিরির শৃঙ্গ যেন ধ্যানমগ্ন ধূর্জটি (হইয়াছে)। ওই সানুর সোপান-মালার ঊর্ধ্বে শৃঙ্গচরণ-রঞ্জিকা অসুষমা শোভা পাইতেছে, ওরে (উহা) যেন শুদ্ধা গৌরকান্তি অম্বিকা। সেখানে অর্ধ-ধূসর ভূধরখণ্ড (এক) প্রান্তে গৌরবে দাঁড়াইয়া (আছে); নন্দীর মতো রুদ্র-প্রহরী যেন রৌরবকে চরণে দলিত করিতেছে! যেস্থানে) মৌন মুক্ত শংকর-পদে তাপসীর চারু শুভ্রতা বিরাজ করে, সেখানে মানসে পেল না স্তব্ধ হয় এবং) লালসা. উগ্রতা হত (হয়)।

(ঘ) নিঃশব্দে চুম্বিয়া দিনু মুছিয়া নয়ান।
স্নান জ্যোৎস্না মুখে লোটে,
ঈষৎ বিভিন্ন ঠোঁটে
এখনো কাঁপিছে যেন ক্ষুব্ধ অভিমান!
ভিজা ভিজা আঁখিপাতা,
নেতিয়ে পড়েছে মাথা,
শ্বসিছে নিশ্বাসে কত অব্যক্ত বেদনা।
তুলিলাম বুকে করি;
নয়নে রয়েছে ভরি–
তার মৃত জননীর বিস্মৃত প্রার্থনা।

–‘শিশু আজ সন্ধ্যাবেলা’ : অক্ষয়কুমার বড়াল।

গদ্য-রূপ : [ সাধু ] নিঃশব্দে চুম্বন করিয়া (তাহার) নয়ন মুছিয়া দিলাম। ম্লান জ্যোৎস্না (তাহার) মুখে লুটিতেছে, ঈষৎ বিভিন্ন ঠোঁটে ক্ষুব্ধ অভিমান যেন এখনো কাঁপিতেছে! (এখনও তাহার) আঁখিপাতা ভিজা ভিজা (রহিয়াছে), মাথা লইয়া পড়িয়াছে, কত অব্যক্ত বেদনা নিশ্বাসে শ্বাস ফেলিতেছে। (তাহাকে) বুকে করিয়া তুলিলাম; (দেখি) তাহার মৃত জননীর বিস্মৃত প্রার্থনা (তাহার) নয়নে ভরিয়া রহিয়াছে।

[ চলিত ] নিঃশব্দে চুম্বন করে (তার) নয়ন মুছে দিলাম। ম্লান জ্যোৎস্না (তার) মুখে লুটচ্ছে, ঈষৎ বিভিন্ন ঠোঁটে ক্ষুব্ধ অভিমান যেন এখনো কাঁপছে! (এখনও তার) আঁখিপাতা ভিজে ভিজে (রয়েছে), মাথা নেতিয়ে পড়েছে, কত অব্যক্ত বেদনা নিশ্বাসে শ্বাস ফেলছে। (তাকে) বুকে করে তুললাম; (দেখি) তার মৃত জননীর বিস্মৃত প্রার্থনা (তার) নয়নে ভরে রয়েছে।

(ঙ) সুস্থ হইয়া তৃষিত পশুটি জীবন পাইল ফিরে,
কান ঝাড়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াল ধীরে।
কহিল শিষ্য, “এতদূর প্রভু এসে
তীর্থযাত্রা বিফল করিলে শেষে?”
কহিলেন সাধু, “দেখ ভাই মোর প্রভুর করুণা কত!
আমারে জানিয়া ক্লান্তকাতর কলসীর ভারে নত,
আগায়ে এলেন, নিলেন আমার দান,
দীর্ঘ পথের ঘটালেন অবসান।
জীবের মাঝারে শিবের বাস যে, পাপী সেই ভূলে যেবা,
জীবের সেবাই তাইতো শিবের সেবা।”

–‘তীর্থফল’ : কবিশেখর কালিদাস রায়।

গদ্য-রূপ : তৃষিত পশুটি সুস্থ হইয়া জীবন ফিরিয়া পাইল, কান ঝাড়া দিয়া ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইল। শিষ্য কহিল, “প্রভু, এতদুর আসিয়া শেষে তীর্থযাত্রা বিফল করিলে?” সাধু কহিলেন, “ভাই, আমার প্রভুর করুণা কত (তাহা) দেখ! কলসীর ভারে আমাকে ক্লান্তকাতর (ও) নত জানিয়া (তিনি) আগাইয়া আসিলেন, আমার দান লইলেন, দীর্ঘ পথের অবসান ঘটাইলেন। জীবের মাঝে যে শিবের বাস, (ইহা) যে ভুলিয়া যায়, সেই পাপী, জীবের সেবাই তাইতো শিবের সেবা।”

(চ) সবাই যখন বুদ্ধি যোগায় আমরা করি ভুল।
সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব, আমরা ভাঙি কূল।
দারুণ রাতে আমরা তরুণ রক্তে করি পথ পিছল।
আমরা ছাত্রদল ৷৷
মোদের    চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল, বক্ষে ভরা যাক,
কণ্ঠে মোদের কুণ্ঠাবিহীন নিত্যকালের ডাক!
আমরা     তাজা খুনে লাল করেছি সরস্বতীর শ্বেতকমল।
আমরা ছাত্রদল ৷৷
ওই     দারুণ উপপ্লবের দিনে আমরা দানি শির,
মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে বিংশ শতাব্দীর।

–‘ছাত্রদলের গান’ : কাজী নজরুল ইসলাম।

গদ্য-রূপ : [ চলিত ] সবাই যখন বুদ্ধি বোগায়, আমরা (তখন) ভুল করি। সাবধানীরা সব বাঁধ বাঁধে, আমরা কুল ভাঙি। তরুণ আমরা দারুণ রাতে রক্তে পথ পিছল করি। আমরা ছাত্রদল। আমাদের চক্ষে জ্ঞানের মশাল জ্বলে, বক্ষে ভরা বা (বিরাজ করে), আমাদের কণ্ঠে কুণ্ঠাবিহীন নিত্যকালের ডাক (শোনা যায়)। আমরা তাজা খুনে সরস্বতীর শ্বেতকমল লাল করেছি। আমরা ছাত্রদল। ওই দারুণ উপপ্লবের দিনে আমরা শির দান করি, আমাদের মধ্যে বিংশ শতাব্দীর মুক্তি কাঁদছে।

(ছ) দারুণ শীতের সাঁঝ     হে আমার নটরাজ!
কোন্ রূপে এসেছিল দ্বারে?
অশ্রুর সাগরমন্থ    হে আমার নীলকণ্ঠ।
ভাগ্যে ফিরাইনি একেবারে।
শীতাতপে দিগম্বর,   দিশাহীন পথচর,
দেহ টলে ক্ষুধার নেশায়,
অন্তর-শ্মশানে চিতা    সারি সারি নির্বাপিতা,
তাহারই বিভূতি ফুটে গায়।
সর্বাঙ্গে হাড়ের মালা, শিরায় ফণীর জ্বালা,
গণ্ডে ঝরে জাহ্নবী উতলা।
কৃষ্ণাচতুর্দশী-শেষে। তোমারি ললাটে এসে
অস্ত গেছে শেষ শশিকলা!
হে মোর বঞ্চিতরাজ।     নিঃশেষে বুঝেছি আজ–
আমার দুয়ারে আঙিনায়
ঘুরিয়া ঘুরিয়া আস, কাঁদি বলে ভালোবাস,
মোর অশ্রু তোমারে কাঁদায়।
তোমার প্রসাদকামী স্বগৃহে সন্ন্যাসী আমি,
এ জীবন নিলে সফল–
অনাদি দুঃখের স্রোতে তোমারি নয়ন হতে
ঝরে-পড়া একফোঁটা জল।

–‘কচি ডাব’ : যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।

গদ্য-রূপ [ চলিত ভাষায় ] : (এই) দারুণ শীতের সাঁঝ হে আমার নটরাজ, কোন্ রূপে (তুমি আমার) দ্বারে এসেছিলে? অশ্রুর সাগরম হে আমার নীলকণ্ঠ। ভাগ্যে (তোমাকে) একেবারে ফেরাই নি! শীতাতপ দিগম্বর (তুমি) দিশাহীন পথচর, ক্ষুধার নেশায় (তোমার) দেহ টলে, (তোমার) অন্তর-শ্মশানে সারি সারি চিতা নির্বাপিতা, তারই বিভূতি (তোমার) গায়ে ফোটে। (তোমার) সর্বাঙ্গে হাড়ের মালা, শিরায় ফণীর জ্বালা, উতলা জাহ্নবী গণ্ডে ঝরছে। কৃষ্ণাচতুর্দশী-শেষে শেষ শশিকলা তোমারই ললাটে এসে অস্ত গেছে! হে আমার বঞ্চিতরাজ! আজ নিঃশেষে বুঝেছি (যে), কাদি বলে (তুমি আমায়) ভালোবাস, ঘুরে ঘুরে আমার দ্বারে আঙিনায় আস, আমার অশ্রু তোমাকে কাঁদায়। তোমার প্রসাদকামী আমি স্বগৃহে সন্ন্যাসী, তোমারই নয়ন হতে (এই) অনাদি দুঃখের স্রোতে ঝরে-পড়া একফোঁটা জল (আমার) এ জীবন নিলে সফল (করেছে)।

[ লক্ষ্য কর, সাধু-চলিত মিশ্ররীতির এই পদ্যাংশটিতে চলিতের দিকে সামান্য বেশী ঝোঁক রহিয়াছে বলিয়া গদ্যরূপটি চলিত ভাষায় লেখা হইল। ]

অনুশীলনী

১। ভাষা কাহাকে বলে? তোমাদের মাতৃভাষার নাম কী?

২। সাধু বাংলা ও চলিত বাংলা-সম্বন্ধে দুইটি পৃথক্ প্রবন্ধ রচনা কর।

৩। সাধু ভাষা ও চলিত ভাষার পার্থক্য নির্দেশ কর।

৪। (ক) উদাহরণসূচক দুইটি বাক্যের সাহায্যে বাংলা সাধু ও চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদ ও সর্বনামের কীরূপ প্রভেদ ঘটিয়া থাকে, তাহা বুঝাইয়া দাও।

(খ) তোমাদের ‘উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে সাধু ও চলিত ভাষা-সম্বন্ধে যে আলোচনা পড়িলে, তাহা কোন্ রীতিতে লেখা? উত্তরের সমর্থনে যুক্তি দেখাও।

৫। কবিতায় সাধু ও চলিতের মিশ্রণ হইয়াছে, পাঠ-সংকলন হইতে এমন তিনটি উদাহরণ সংগ্রহ কর।

৬। নিম্নলিখিত অনুচ্ছেগুলি সাধু না চলিত কোন্ রীতিতে রচিত এবং শব্দনির্বাচনের বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ করিয়া বিপরীত ভাষারীতিতে রূপান্তরিত কর ।

(ক) দিনকাল বিলকুল বদলে গিয়েছে, লোকেও খুব সেয়ানা হয়েছে, তাদের ঠকানো সহজ নয়। বিনা মেহনতে শুধু চালাকি করে ঢের ঢের রোজগার করব, এ মতলব এ যুগে আর চলবে না। যে খাটবে না, দুবেলা পেটের ভাতেও তার দাবি নেই দুনিয়ায়।

(খ) অনেকক্ষণ পর্যন্ত ….. কাঁদিল না। (সাগরসংগমে নবকুমার : পৃ-৫৭)

(গ) তুষার-নদীর উপর …. পতিত হইলাম। (ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে : পৃ-৬৫)

(ঘ) এখানে যেন তাহার ….. সহায়তা প্রাপ্ত হন নাই। (বিদ্যাসাগর : পৃ–৭১)

(ঙ) কলকাতায় ফিরে … ছিলেন ভালো। (ছিন্নপত্র ও পৃ-৭৩)

(চ) পুষ্করিণী নির্জন হইয়া … বলা অসম্ভব। (ঘর ও বাহির : পৃ-৭৫)

(ছ) ওই ড্যাবা-ড্যাব …… কেবলই গড়াচ্ছে। (বলাই : পৃ-৭৭)

(জ) ফরাসিরা আরও পরে …… ভাবনা সকলের। (বঙ্গোপসাগরে : পৃ-৮২)

(ঝ) মেঘের মধ্যে …… ঝুঁকে রয়েছে। (আরোহণ : পৃ–৯০)

(ঞ) মা-মরা এই …. অন্ন জুটে না। (মহেশ : পৃ-১০৬)

(ট) ফলিত জ্যোতিষে …… বলেছিলাম কিনা? (বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও পৃ-১১৪)

(ঠ) তারপর ধরুন …. করে রাখবে? (পল্লিসাহিত্য ও পৃ-১২৪)

(ড) এদিকে পৃথিবী ….. জ্বলতে লাগল। (অগ্নিদেবের শয্যা : পৃ–১৩১)

(ঢ) গুলির শব্দ থামতেই মুমূর আর্তনাদে ভরে উঠল বাতাস। আশপাশের ঘরগুলো কান্নায় ভেঙে পড়ল। কী বীভৎস সে দৃশ্য, কী করুণ সে কান্না, কী মর্মভেদী সে আর্তনাদ! প্রতাপসিংহের বছর-দশেকের ছেলে কিরপাল সিং বাবার হাত ধরে এসেছিল। ছেলেবেলা থেকে দেশপ্রেমের মন্ত্রে সে দীক্ষা নিক, এই ছিল তার বাবার ইচ্ছা। বুকে গুলি খেয়ে বাবার বুকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। –বিধিচক্র।

(ণ) বিধাতা আমাকে যে এত সৌভাগ্যসুখ দিয়াছেন তাহা সকলের সহিত বণ্টন করিয়া না লইলে ইহার সফলতা কোথায়? উৎসব ইহারই উপলক্ষ। সেইজন্য আমাদের উৎসবে ভাবের প্রাধান্য–বাহিরের সমারোহ তাহার প্রধান অঙ্গ নহে। তিব্রতা স্ত্রীর হাতের সামান্য লোহা ও মাথার সিন্দুর যেমন আমাদের মনে একটি অনির্বচনীয় লক্ষ্মীশ্রী সূচিত করিয়া দেয়, নেত্রঝলসানো অলংকাররাজি তাহা পারে না,-প্রীতিবিকশিত উৎসবের সামান্য মঙ্গলঘট ও চূতপল্লবগুচ্ছ সেইরূপ আমাদের অন্তরে একটি শিবসুন্দর ভাব সঞ্চারিত করিয়া তুলে, সহস্র তাড়িতলোক ও বিলাস উৎসব সে শুভ কমনীয়তা সঞ্চার করিতে পারে না। –বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

(ত) সকল কাযেই ভুলমাদ আমাদের শিক্ষক। যে ভ্রমে পতিত হয়, ঋতপথ তাহারই প্রাপ্য। বৃক্ষ ভুল করে না, প্রস্তরখণ্ডও এমে পতিত হয় না, পশুকুলে নিয়মের বিপরীতাচরণ অত্যল্পই দৃষ্ট হয়; কিন্তু ভুদেবের উৎপত্তি লম-প্রমাদপূর্ণ নরকুলেই। দন্তধাবন হইতে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত কর্ম, নিদ্রাভঙ্গ হইতে শয্যায় পর্যন্ত সমস্ত চিন্তা–যদি অপরে আমাদের জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নির্ধারিত করিয়া দেয়, তাহা হইলে আমাদের আর চিন্তা করিবার কী থাকে? মননশীল বলিয়াই না আমরা মনীষী, মুনি? –স্বামী বিবেকানন্দ।

(থ) ঈশ্বরের যে ইচ্ছা, বুদ্ধির জগতে বিজ্ঞানই সিংহাসন নিক। স্বচ্ছ দৃষ্টি ও দৃঢ় প্রমাণেরই জয়জয়কার হোক। জড়বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান–এরাই তো প্রকৃতীশ্বরের জীবন্ত ধর্মগ্রন্থ। এদেরকে বাদ দিলে চলবে না, কিন্তু ওদের বাইরে আর জায়গা নেই তাও নয়। বুদ্ধির জগতের বাইরে রয়েছে আরেকটা বোধির জগৎ। স্বল্পকল্পনার স্বপ্নরহস্যের জগৎ নয়, প্রতীয়মানের ঊর্বে অননুভূয়ের জগৎ। আপেক্ষিকের ঊর্ধ্বে অব্যাহতের। তাকেই বা বাদ দেব কেন? ইন্দ্রিয়তান্ত্রিক বুদ্ধির বিজলী-আলোর ঊর্ধ্বে স্বয়ংপ্রভ বোধির জ্যোৎস্নাকেও উপভোগ করব না কেন? –অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত।

(দ) সমাধির উপর ফুল-ছড়ানো-প্রথা এদের দেশে জানা নাই। আমার উৎসাহে সে নিকটের একটা বুনন শিউলিগাছের তলা হইতে কিছু ফুল সংগ্রহ করিয়া আনিল। ভানুমতী ও আমি দুজনেই ফুল ছড়াইয়া দিলাম রাজা দো পান্নার সমাধির উপরে। ঠিক সেই সময় ডানা ঝটপট করিয়া একদল সিল্লী ডাকিতে ডাকিতে উড়িয়া গেল বটগাছটার মগডাল হইতে–যেন ভানুমতী ও রাজা দোর সমস্ত অবহেলিত অত্যাচারিত প্রাচীন পূর্বপুরুষগণ আমার কাজে তৃপ্তিলাভ করিয়া সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন–সাধু! সাধু! কারণ আর্যজাতির বংশধরের এই বোধ হয় প্রথম সম্মান অনার্য রাজ-সমাধির উদ্দেশে।–বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

(ধ) শিল্পী দিলেন সৃষ্টিকে রূপ, সৃষ্টি দিয়ে চলল এদিকের সুর ওদিকে, অপূর্ব এক ছন্দ উঠল জগৎ জুড়ে! আমাদের এই শুকনো পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম বর্ষার প্লাবন বুক পেতে নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে বললে-রসিক, সবই তোমার কাছ থেকে আসবে, আমার কাছ থেকে তোমার দিকে কি কিছুই যাবে না? সবুজ শোভার ঢেউ একেবারে আকাশের বুকে গিয়ে ঠেকল; ফুলের পরিমল, ভিজে মাটির সৌরভ বাতাসকে মাতাল করে ছেড়ে দিলে; পাতার ঘরের এতটুকু পাখি; সকাল-সন্ধ্যা আলোর দিকে চেয়ে সেও বললে–আলো পেলেম তোমার, সুর নাও আমার। তারপর একদিন মানুষ এল; সে বললে–কেবলই নেব, কিছু দেব না? দেব এমন জিনিস যা নিয়তির নিয়মের বাইরের সামগ্রী; তোমার রস আমার শিল্প এই দুই-ফুলে-গাঁথা নবরসের নির্মিত নির্মাল্য ধর। –অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

(ন) বোধ হয়, এই কারণেই গোরর উপরেও তাহার প্রচণ্ড শখ। তাহার গোরু চাই সর্বাঙ্গসুন্দর,-কাঁচা বয়স, বাহারে রঙ, সুগঠিত শিং, সাপের মতো লেজ এবং আরও অনেককিছু গুণ না থাকিলে গোরু তাহার পছন্দ হয় না। আরও একটা কথা–এ চাকলার মধ্যে তাহার গোরর মতো গোরু যেন আর কাহারও না থাকে। গোরুর গলায় সে ঘুঙুর ও ঘন্টার মালা ঝুলাইয়া দেয়, দুইটি বেলা ছেঁড়া চট দিয়া তাহাদের সর্বাঙ্গ ঝাড়িয়া মুছিয়া দেয়, শিং দুইটিতে তেল মাখায়, সময়ে সময়ে তাহাদের পদসেবাও করে, কোন দিন পরিশ্রম বেশী হইলে তাহাদের পা টিপিতে টিপিতে বলে, কেষ্টর জীব! –তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

(প) ভাষার সমৃদ্ধি হয় কৃতী লেখকের প্রভাবে; কিন্তু তার ক্রমিক মন্থর পরিবর্তনে জনসাধারণের হাতই বেশী। সাধারণ মানুষ ব্যাকরণ-অভিধানের বশে চলে না। কয়েকজন শব্দের উচ্চারণে বা প্রয়োগে ভুল করে, তারপর অনেকে সেই ভুলের অনুসরণ করে, তার ফলে কালক্রমে নূতন শব্দ, নূতন অর্থ আর নুতন ভাষার উৎপত্তি হয়। ভাষা মাত্রেই পূর্ববর্তী কোনও ভাষার বিকার বা অভ্রংশ এবং একাধিক ভাষার মিশ্রণ! শব্দ অর্থ আর ভাষার এই স্বাভাবিক অভিব্যক্তি বা evolution বারণ করা যায় না। –রাজশেখর বসু।

(ফ) বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু জলভারাবন মেঘে আকাশ ভরা। এতদিন শ্রাবণের দেখা ছিল না, যেই বিশে-একুশে হয়েছে অমনি যেন কোনোমতে ছুটতে ছুটতে শেষ ট্রেনটা ধরে হঠাৎ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির। কম হাঁপাচ্ছে না–তার হাঁপানির বেগে আমাদের শালবন বিচলিত, আমলকীবন কম্পান্বিত, তালবন মর্মরিত, বাঁধের জল কল্লোলিত, কচি ধানের খেত হিল্লোলিত, আর আমার এই জানলার খড়খড়িগুলো ক্ষণে ক্ষণে খড়খড়ায়িত।–রবীন্দ্রনাথ।

(ব) প্রত্যুত্তরে আমি একটি ছোট্ট নিশ্বাস চাপিয়া ফেলিলাম–পাছে সে শুনিতে পায়। কিন্তু এই গাঢ় অন্ধকার রাত্রিতে, এই জলরাশি এবং এই দুর্জয় স্রোতের সঙ্গে সাঁতার জানা এবং না-জানার পার্থক্য যে কি, তাহা ভাবিয়া পাইলাম না। সেও আর কোন কথা কহিল না। বহুক্ষণ এইভাবে চলার পরে কি একটা যেন শোনা গেল–অস্ফুট এবং ক্ষীণ; কিন্তু নৌকা যত অগ্রসর হইতে লাগিল, ততই সে শব্দ স্পষ্ট এবং প্রবল হইতে লাগিল। –শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

(ভ) বিদেশে তো কিছুতেই তার মন টেকে না; কাজের ফাঁকে একটু সুযোগ পেলেই তাই সে মাকে ফোন করে। কাল রাতেই ফোন করে জার্মানি থেকে বলল, “থেকে-থেকেই তোমাদের জন্য মন কেমন করে; এ মন নিয়ে এমন কষ্ট করে এখানে থেকে কী লাভ হবে, বলতে পার? তাই ভাবছি, সব তল্পিতল্পা গুটিয়ে আসছে মাসেই দেশে ফিরে যাব।”

৭। ধ্বনিমাত্রই যে ভাষা নয়, তাহা কয়েকটি উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও। কয়েকটি দেশী ও বিদেশী ভাষার নাম উল্লেখ কর।

৮। ভাষা-গোষ্ঠী বলিতে কী বুঝ? কয়েকটি ভাষা-গোষ্ঠীর নাম লিখ। ৯। ভাষা ও উপভাষার পারস্পরিক সম্পর্কটি বুঝাইয়া দাও ।

১০। বাংলা ভাষায় কথ্য ও লেখ্য উপভাষাগুলির কত রকমের বৈচিত্র্য দেখা যায়? বাংলার আঞ্চলিক উপভাষাগুলি কী কী?

১১। প্রতিটি কথ্য উপভাষার ভৌগোলিক এলাকা নির্দেশ কর। প্রত্যেকটি উপভাষার অন্তত তিনটি করিয়া রূপগত ও ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।

১২। বাংলা লেখ্য উপভাষায় পদ্য ও গদ্যরূপের পার্থক্যগুলি উদাহরণসহ বুঝাইয়া দাও। ১৩। ভাষা সমস্ত কথ্য ও লেখ্য উপভাষার সমাহার–মন্তব্যটির যাথার্থ বিচার কর।

১৪। নিম্নলিখিত শব্দগুলি কোন্ উপভাষার শব্দ, বুঝাইয়া দাও? ত্যাল, নেবু, কান্দে, কুঁকুর, আমের রামবাগান, চুর, দেখনু, বড্ড, ম্যাগ, সইত্ত, হগল।

১৫। নিম্নলিখিত শব্দগুলির মধ্যে যেগুলি কেবলমাত্র পদ্যেই ব্যবহৃত হয়, সেগুলিকে আলাদা চিহ্নিত করিয়া তাহাদের গদ্য-রূপ লিখ।

সদা, বয়ানে, সনে, রোধিছে, গরজে, কভু, পরমাদ, রোপিনু, যথা, হেন, তব, তোমা, শুধালেন, জাগিয়ে, দাঁড়ায়ে, হানিল, ঘুমিয়ে, ঘুমায়ে, পানে, ভোলে, ভাসিয়ে, ভাসায়ে, ত্যজিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *