৭. জর্জ মেলিস

৩১.

জর্জ মেলিস তার জীবনধারা একেবারে পালটে ফেলেছে। এখন সে এক অনুগত স্বামীর ভূমিকাতে কাজ করছে। শুধু স্বামী নয়, নাতজামাই হিসেবেও তার গুণের কোনো শেষ নেই। সে এখন এমন কোনো কাজ করবে না, যাতে এই বৃদ্ধা মহিলার মনে সামান্যতম সন্দেহ জাগতে পারে।

***

ডঃ জন হার্টলের কাছ থেকে একটা টেলিফোন কল–আমি একজন সাইক্রিয়াটিস্টের সঙ্গে কথা বলেছি। উনি হলেন ডঃ পিটার টেমপ্লেটন। আপনি কবে যাবেন?

 জর্জ মেলিসের কণ্ঠস্বরে বিরক্তি –না, ডাঃ হার্টলে তার কোনো দরকার আছে?

–নিজেকে কী ভেবেছেন? আমরা এই শর্ত করেছিলাম। আমি পুলিশে খবর দিইনি, আপনি একজন সাইক্রিয়াটিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আপনি শর্ত ভাঙলে আমিও কিন্তু ভাঙতে বাধ্য হব।

-না-না, জর্জ চিৎকার করে বলল, কখন যাব?

–ডঃ টেমপ্লেটনের টেলিফোন নাম্বারটা লিখে নিন–৫৫৫৩১৬১। যে কোনো সময় আপনি ওনাকে ফোন করতে পারেন। কিন্তু ফোনটা আজকেই করবেন।

জর্জ চিন্তা করল, শেষ অব্দি আমাকে পাগলের ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে? না, আমি ফাঁদে পড়ে গেছি।

***

ইভ অফিসে ফোন করল –আমি বাড়িতে আছি।

–তুমি বাড়িতে আছো? ঠিক আছে।

 –আমার সঙ্গে রাতে দেখা করো, কেমন?

–ঠিক আছে, রাতে আমি আসব।

–রাত আটটায়, কেমন?

***

ইভকে দেখে জর্জ অবাক হয়ে গেছে। সত্যি শরীরের কোথাও এতটুকু দাগ নেই। সে বিশ্বাস করতে পারছে না।

ইভ বলল–আমি আগের মতোই সুন্দরী কিনা বলল তো? হ্যাঁ, এই সৌন্দর্য বাঁচিয়ে রাখতে হবে। না হলে সব কিছু হাতছাড়া হয়ে যাবে।

-ইভ, আমি অত্যন্ত দুঃখিত।

–হ্যাঁ, ওই ব্যাপারটা ভুলে যাওয়া উচিত। সব কিছু আগের মতোই আছে, তাই না।

দুজনে আবার ভালোবাসার অভিনয় করতে শুরু করল।

তারপর? ষড়যন্ত্রের শেষ পর্বটা শুরু হবে।

***

পিটার টেমপ্লেটনের বয়স বছর পঁয়ত্রিশ। ছফুটের ওপর লম্বা, সুদেহের অধিকারী, দুটি চোখে অসংখ্য বিস্ময় খেলা করছে।

তিনি অনেক কথা জানতে চাইলেন–হ্যাঁ, এই মানুষটিকে দেখে কিছু মনে হচ্ছে না। কিন্তু আসলে এ মানসিক রোগী!

ডাঃ হার্টলে বলেছেন- আপনার সমস্যা আছে।

–হ্যাঁ, আমার তিনটে সমস্যা আছে।

–এক এক করে বলুন।

সব সময় কেমন লজ্জা-লজ্জা করে। তাই আপনার কাছে আসতে পারিনি। ডাক্তার, একজন মেয়ে আমাকে অধিকার করার চেষ্টা করছে।

তার মানে?

–আমি একটা শর্ত করেছি। আমি তাকে আঘাত করেছি, ব্যাপারটা সাংঘাতিক।

 পিটার টেমপ্লেটন অবাক হয়ে তাকালেন। জর্জ মেলিসের সমস্যা অনুধাবন করার চেষ্টা করছেন। তার মানে এই পুরুষ মানুষটা কী করে? নারীদের ওপর অত্যাচার করে এবং তাতে আনন্দ পায়।

কাকে আঘাত করেছেন? স্ত্রীকে?

–না, আমার শালিকে।

 পিটার ব্ল্যাকওয়েল পরিবারের নাম জানেন, খবরের কাগজের পাতায় এই যমজ কন্যার ছবি ছাপা হয়েছে। যখন তারা চ্যারিটি ইভেন্টে যোগ দিয়েছিল, হা, তাদের দেখতে একরকম। পিটারের মনে পড়ল, তার মানে? ওই লোকটা তার শালিকে মেরেছে। কিন্তু কেন? ঘটনাটার মধ্যে যথেষ্ট রহস্য লুকিয়ে আছে। জন হার্টলে নিশ্চয়ই স্বাভাবিক অবস্থা হলে তার সঙ্গে দেখা করতে বলতেন না।

–কীভাবে আঘাত করেছেন?

–আমি তাকে খুবই মেরেছি। আমি তো স্বীকার করছি ডাক্তার, তার সমস্ত শরীরে কালসিটে পড়ে গিয়েছিল।

-আঘাত করার পর আপনার মানসিক অবস্থা কেমন?

–সত্যি কথা বলব? আমি মনে মনে খুবই কষ্ট পাচ্ছি।

–আপনার আর কোনো সমস্যা?

–হ্যাঁ, বাবার জন্য খুবই চিন্তিত। বাবার কয়েকবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে।

–উনি কোথায় আছেন?

–উনি গ্রিসে আছেন।

–আপনার তৃতীয় সমস্যা?

 –আমার স্ত্রী আলেকজান্দ্রাকে কেন্দ্র করে–এটা কি দাম্পত্য কলহ?

–না, স্ত্রী যেন কেমন হয়ে গেছে। সব সময় আত্মহত্যার কথা বলে।

–তাই নাকি? কোনো ডাক্তারের সাহায্য নেননি?

–না, ও ডাক্তারের কাছে যাবে না।

 পিটার ভাবলেন, এই সমস্যার সমাধান কী করে করা সম্ভব?

–ডঃ হার্টলের সঙ্গে কথা বলেছেন?

–না।

–উনি তো আপনাদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান, ওনার সাথে কথা বলা উচিত ছিল। উনি হয়তো একজন ভালো সাইক্রিয়াটিস্টের নাম বলতে পারতেন।

জর্জ মেলিস শান্তভাবে বলল না, আমি চাই না আলেকজান্দ্রার কানে এই খবরটা পৌঁছে যাক। আমি সবকিছুই তাকে না জানিয়ে করতে চাইছি। আমার মনে হয়, ডঃ হার্টলে হয়তো তাকে বলে দেবেন।

–ঠিক বলেছেন, মি. মেলিস, দেখা যাক আমি কী করতে পারি।

***

-ইভ, সমস্যা দেখা দিয়েছে, জর্জ বলল, বিরাট সমস্যা।

–কী হয়েছে?

-তুমি যা বলেছিলে, আমি তাই করেছি। আলেকজান্দ্রা আত্মহত্যা করতে চাইছে, তাই বলেছি।

-হ্যাঁ। তাতে কী হয়েছে?

–লোকটা জন হার্টলের সঙ্গে কথা বলবেন।

–হায়, তাহলে তো ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে গেল।

 ইভ তার রাগকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল ঠিক আছে। আমি হার্টলের সঙ্গে কথা বলব। টেমপ্লেটনের সঙ্গে আর একবার দেখা করার চেষ্টা করো।

***

পরের দিন সকালবেলা ইভ ডঃ হার্টলের সঙ্গে দেখা করতে গেল। তার অফিসে। জন হার্টলে ব্ল্যাকওয়েল পরিবারের সকলকেই ভালোবাসেন। তার চোখের সামনে এই দুটি মেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে। তিনি মারিয়ানা মৃত্যু সংক্রান্ত ঘটনাটা জানেন। কেটির ওপর যে আঘাত করা হয়েছিল, তাও তিনি জানেন। টনিকে একটা স্যানাটোরিয়ামে রাখা হয়েছে, কেটিকে এত কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে, কেটি এবং ইভের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে গেছে তিনি ভাবতেই পারছেন না, এটা কেমন করে ঘটল। তবে এই ব্যাপারে নাক গলাবার আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। তিনি চাইছেন, ওই পরিবারের সকলে যেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয় সেটাই দেখা।

ইভ অফিসে প্রবেশ করল। ডঃ হার্টকে তার দিকে তাকিয়ে বললেন –কেট ওয়েস্টার একটা সাংঘাতিক কাজ করেছেন।

-হ্যাঁ, এত সুন্দর শল্য চিকিৎসা?

ডঃ হার্টলে ইভের হাতে হাত রেখে বললেন তুমি আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছ, ইভ, বলল, তোমার জন্য কী করব?

-এটা অ্যালেক্সের ব্যাপারে একটা আলোচনা।

 ডঃ হার্টলে বললেন কী সমস্যা? জর্জ সংক্রান্ত?

-না, ইভ বলল, জর্জ তার কাজটা ঠিক মতো করছে। অ্যালেক্সের মধ্যে একটা অদ্ভুত মনোবৃত্তি দেখা দিয়েছে, সে খুব হতাশ হয়ে উঠেছে, মাঝে মধ্যে আত্মহত্যা করতে চাইছে।

ডঃ হার্টলে বললেন আমি বিশ্বাস করি না। আলেকজান্দ্রার মতো মেয়ে কখনও আত্মহত্যাপ্রবণ হবে না।

–আমিও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঘটনাটা ঘটতে চলেছে। তাই আপনার কাছে সরাসরি এসেছি। আপনি কিছু একটা করার চেষ্টা করুন। আমি আমার ঠাকুরমাকে হারিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই আমার বোনকে হারাতে পারব না।

–কতদিন ধরে এই অবস্থা?

আমি ঠিক জানি না। বেশ কিছুদিন ধরেই সে একটা অদ্ভুত আচরণ করছে।

–আমি চেষ্টা করছি, কাল সকালে ওকে এখানে পাঠিয়ে দিও। চিন্তা করো না, ইভ। এখন অনেক নতুন ওষুধপত্র বেরিয়ে গেছে।

হার্টলে এগিয়ে গেলেন। হা, ইভ একটা সুন্দর মেয়ে। তাকে কেন এভাবে প্রতারিত করা হল?

ইভ তার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গেল। সে তাকিয়ে থাকল আয়নার দিকে।

***

পরের দিন সকাল দশটা। ডঃ হার্টলের রিসেপশনিস্ট বলল–মিসেস জর্জ মেলিস এখানে এসেছেন ডাক্তার।

-ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।

আলেকজান্দ্রা ভেতরে ঢুকল। শরীরটা বিবর্ণ। হ্যাঁ, তার চোখের তলায় কালি পড়েছে।

জন হার্টলে তার দিকে তাকিয়ে বললেন –তোমার সঙ্গে দেখা হল অনেকদিন বাদে, আলেকজান্দ্রা। বলো তুমি কেমন আছো?

তার কণ্ঠস্বর নীচু –আপনাকে বিরক্ত করছি বলে খারাপ লাগছে, কিন্তু কোথায় যাব বলুন? ইভ না বললে আমি হয়তো এখানে আসতাম না। আমি তো ভালোই আছি।

-কিন্তু তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

রাতে ভালো ঘুম হয় না।

–আর কিছু?

–কত রকম চিন্তা মাথায় আসে।

–কেন আলেকজান্দ্রা?

–আমি কেমন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। জর্জের জন্য চিন্তা হয়। জর্জ আমাকে সুখী রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তবুও আমার মন মানছে কই?

–আর কিছু?

–মনে হচ্ছে নিজেকে মেরে ফেলি।

 –হ্যাঁ, এরকম চিন্তা কখনও করো না।

মেয়েটি মাথা নাড়ল। কিছুই আমার ভালো লাগছে না ডাক্তার। কোনো ওষুধ আছে কি?

ডঃ হার্টলি বললেন আমি তোমাকে ওষুধ লিখে দিচ্ছি। ওষুধ খেলে তুমি ভালো হয়ে উঠবে।

-সত্যি, আমি ভালো হয়ে উঠব?

হার্টলে বললেন অবশ্যই। আবার আমার সঙ্গে দেখা করো কিন্তু কেমন?

আলেকজান্দ্রা ডঃ হার্টলের অফিস থেকে বাইরে এল। রাস্তায় এসে দাঁড়াল। সে দীর্ঘশ্বাস। ফেলল। ইভ নিশ্চয়ই খুশি হবে। হ্যাঁ, প্রেসক্রিপশনটা সে ছিঁড়ে ফেলে দিল।

.

৩২.

কেটি ব্ল্যাকওয়েল খুবই হতাশ হয়েছেন। মিটিংটা অনেকক্ষণ ধরে চলেছে। তিনি মাঝে মধ্যে তিনজন মানুষের দিকে তাকালেন। তারা সকলেই এগজিকিউটিভ বোর্ডের সদস্য। এখন আর এসব ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে, একটা সহজ সুন্দর জীবন হলেই হয়তো ভালো হত।

আলেকজান্দ্রা বলেছিল ঠাম্মা, আমি তো ব্যবসায় জড়াতে চাইছি না। জর্জকে একজন এগজিকিউটিভ করলে কেমন হয়?

ব্রাড রজারসও এই ব্যাপারে মন্তব্য করল–হ্যাঁ, কেটি, নাতনি কিন্তু ভালো কথা বলেছে। কেটি কিছু বলার চেষ্টা করলেন।

–আমরা কোনো একটা বিষয়ে কথা বলছিলাম, কেটি আবার বাস্তবে ফিরে এলেন।

***

জর্জ মেলিস আবার পিটার টেমপ্লেটনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

–মি. মেলিস, আপনার তরফ থেকে কোনো হিংসার কাজ?

–না, আমি হিংসাকে ঘেন্না করি।

–আপনি বলেছেন যে, আপনার মা-বাবা আপনাকে শারীরিক ভাবে নির্যাতন করত।

–হ্যাঁ, এটা সত্যি।

–আপনি কি খুব অনুগত বালক ছিলেন?

–না, সাধারণ।

–সাধারণ বালকেরা তো এমনভাবে শাস্তি পায় না।

 জর্জ বলল–আমি নিয়ম ভাঙতে ভালোবাসতাম।

ও মিথ্যে কথা বলছে। পিটার টেমপ্লেটন ভাবলেন, কিন্তু কেন? ও কি কোনো কিছু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। ডঃ হার্টলের সঙ্গে কথোপকথন মনে পড়ে গেল।

ওর শালিকে ও আঘাত করেছে, জন।

হা, জন হার্টলের কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত উদাসীনতা। এটা আঘাত? জবাই করা হয়েছে। পিটার, সে মেয়েটার গালের হাড় ভেঙে দিয়েছে, তার নাক ভেঙে দিয়েছে, তার শরীরে কোনো হাড় আস্ত রাখেনি। তার পেটে আঘাত করেছে। এমন কী, তার শরীরের সর্বত্র সিগারেটের ছ্যাকা দিয়েছে।

পিটার টেমপ্লেটন বিশ্বাস করতে পারছেন না।

ও তো এত কথা আমাকে বলেনি।

আমি জানি ও বলবে না।

পিটার জর্জের দিকে তাকালেন। জর্জের কথাগুলো তার কানে বাজছে–আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। তাই আমি এখানে আসতে চেয়েছি।

-আবার মিথ্যে কথা।

 মেলিস বলেছে, তার বউ নাকি হতাশায় ভুগছে। সে আত্মহত্যা করতে চাইছে।

আলেকজান্দ্রা কদিন আগে আমার কাছে এসেছিল। আমি তাকে প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছি।

জর্জ মেলিস সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

মনে হয়, নোকটা ভয়ংকর।

***

ডাক্তার কেট ওয়েস্টার ইভ ব্ল্যাকওয়েলের সঙ্গে দেখাই করতে পারছেন না। ইভ তার মনকে অধিকার করে আছে। আহা, ইভ যেন এক সুন্দরী রূপবর্তী দেবী। অসামান্য রূপ আছে তার। কিন্তু তাকে স্পর্শ করা যায় না। তার মধ্যে একটা প্রাণসত্তা কাজ করছে। কেট আবার ইভের কথা চিন্তা করলেন।

তিনি ইভকে তার অ্যাপার্টমেন্টে ফোন করলেন। বললেন–আমি কেট ওয়েস্টার বলছি। আমি কী তোমাকে বিরক্ত করছি? তোমার কথাই কেবল মনে পড়ছে, তুমি এখন কেমন আছো?

-ভালো আছি, কেট আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি এখন কী করছেন?

–কিছুই করছি না। তুমি কি আমার সাথে লাঞ্চ খাবে?

 ইভ হাসল–হা, আমার তাহলে ভালোই লাগবে।

-কখন?

-কাল।

–তাহলে এটাই ঠিক রইল।

***

লাঞ্চটা ভালোই হয়েছিল। ডঃ কেট ওয়েস্টার এক স্কুল ছাত্রের মতো ব্যবহার করলেন। ভালোবাসার ক্ষেত্রে তিনি এক শিক্ষানবিশ। তিনি ন্যাপকিন ফেলে দিলেন। মদ খানিকটা ছলকে পড়ল। ফুলের আধারটা উল্টে গেল। ইভ এসব ব্যাপার দেখে খুবই আনন্দ পেয়েছে।

লাঞ্চের আসর শেষ হয়ে গেল। কেট ওয়েস্টার বললেন আমরা কি আবার কোথাও দেখা করতে পারি?

-হ্যাঁ, কিন্তু এখানে নয়। হয়তো বারবার দেখা হলে আমি আপনার প্রেমে পড়ে যাব।

ডাক্তারবাবু কী বলবেন ভেবে পেলেন না।

ইভ শেষ পর্যন্ত বলল –আপনাকে আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না।

***

জন হার্টলে কেট ওয়েস্টারের সাথে কথা বলছেন।

কেট বললেন–জন, ব্যাপারটা খুব গোপনীয়। আমার মনে হচ্ছে, ইভ ব্ল্যাকওয়েলের ব্যাপারে আপনি সব কথা বলতে পারেননি।

-কী হয়েছে? জর্জ মেলিস তো?

 কেট ওয়েস্টারের মনে হল, এখন এই ব্যাপারটার মধ্যে নিজেকে জড়াতে হবে।

***

জর্জ মেলিস অধৈর্য হয়ে উঠেছে টাকা আছে, উইলটা পরিবর্তিত হয়েছে, এখন আর কীসের জন্য অপেক্ষা?

ইভ তার কৌচে বসেছিল। সে বলল –ব্যাপারটা ভালোভাবে করতে হবে।

সে বুঝতে পারল, জর্জ আর সাহস রাখতে পারছে না।

শেষ পর্যন্ত ইভ সাবধানে বলেছিল –এখন সময় হয়ে গেছে।

কবে?

–আগামী সপ্তাহে।

***

অধিবেশনটা শেষ হয়ে গেল। মেলিস তার বউয়ের কথা একবারও বলেনি। এখন বলল–আলেকজান্দ্রার কথা ভেবে আমার খারাপ লাগছে ডাঃ টেমপ্লেটন। তার অসুখটা বোধহয় সারবে না।

–আমি জন হার্টলের সঙ্গে কথা বলেছি। জন বেশ কয়েকটা ওষুধ লিখে দিয়েছেন।

-আমার মনে হয় এগুলো খেলে সেরে যাবে। ডাক্তার, ওর কিছু হলে আমার খারাপ লাগবে।

পিটার টেমপ্লেটন কথা বলার চেষ্টা করলেন–হ্যাঁ, এই লোকটার মধ্যে একটা অদ্ভুত আবেগ আছে।

তিনি বললেন মি. মেলিস, মেয়েদের সাথে আপনার সম্পর্ক? কিছু বলবেন কী?

-সাধারণ।

 –কিন্তু ওদের আপনি রাগ দেখান?

জর্জ মেলিস বলল–না-না, আমি মেয়েদের আঘাত করতে চাই না।

ডাক্তারের কথা মনে পড়ে গেল নৃশংস আক্রমণ।

পিটার বললেন কোনো সময় মানুষ হঠাৎ অশান্ত হয়ে ওঠে। এমন কিছু কাজ করে পরে যেটা তার মনে থাকে না।

আমি জানি, আপনি কী বলতে চাইছেন। আমি জানি, আমার এক বন্ধু বারবনিতাদের ওপর আঘাত করে।

-একটা সাংঘাতিক খবর, সেই বন্ধু সম্পর্কে কথা বলুন।

-ও বেশ্যাদের দেখতে পারে না। তাদের ভাড়া করে। কাজ শেষ হবার পর আঘাত করে।

জর্জ পিটারের মুখের দিকে তাকালেন। হ্যাঁ, সেখানে সন্দেহের বাতাবরণ।

জর্জ বলে চলল আমার বেশ মনে আছে, আমরা একসঙ্গে জামাইকাতে গিয়েছিলাম। সে আমাকে একটা হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল। দেখা গেল, একটা বেশ্যা মেয়ে বেশি টাকা চাইছে। জর্জের মুখে হাসি, আমার বন্ধু তাকে মারতে শুরু করে দিল।

সে আর কথা বলতে পারেনি।

লোকটা মানসিক রোগী, পিটার টেমপ্লেটন ভাবলেন। কিন্তু এই রোগ কী করে সারানো হবে।

***

হারবার্ট ক্লাব। লাঞ্চের আসরে দুজন মুখোমুখি।

–জর্জ মেলিসের বউ সম্পর্কে সব খবর আমাকে দিন। পিটার টেমপ্লেটন বললেন।

–আলেকজান্দ্রা? দারুণ ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে। আমি তাকে সাহায্য করতে পারব। ওদের আমি ছোট্টবেলা থেকে চিনি। ডাক্তার হার্টলে বললেন, ওরা দুই যমজকন্যা। চট করে আলাদা করা যাবে না।

পিটার জানতে চাইলেন–ওরা কি একেবারে যমজ?

-হ্যাঁ, পৃথিবীর কেউ ওদের দেখে আলাদা করতে পারবে না। ছোটোবেলা থেকে ওরা একসঙ্গে বড়ো হয়ে উঠেছে।

পিটার বললেন আলেকজান্দ্রা কেন আপনার কাছে এসেছে? সে কি ভেবেছে, তার মধ্যে এক ধরনের মানসিক অশান্তি কাজ করছে?

–হ্যাঁ।

–জন, আপনি কি জানেন, যে, মেয়েটি আলেকজান্দ্রা? ইভ নয় তো?

–হ্যাঁ, এটা খুবই সহজ। ইভের কপালে এখনও একটা লাল ক্ষত চিহ্ন আছে। আর আলেকজান্দ্রার কপালে এমন কোনো কাটা দাগ নেই।

হ্যাঁ, ব্যাপারটা কি সত্যি?

–মেলিস সম্পর্কে আর কোনো খবর? –

-মেলিস সম্পর্কে কোনো খবর আমি দিতে পারব না। আরও খবর আনতে হবে। দুজনে অনেকক্ষণ কথা বললেন। কিন্তু? আসল সত্যিটা বোঝা গেল কি?

***

শান্ত সমুদ্র, একজন মহিলা ডুবে যাচ্ছে। সে তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। বড়ো বড়ো ঢেউ আসছে। সে চিৎকার করছে। সে তাড়াতাড়ি সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে। কিন্তু? পিটার টেমপ্লেটনের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি আলো জ্বালালেন। স্বপ্ন তার ভেঙে গেছে।

পরের দিন সকালবেলা তিনি ডিটেকটিভ লেফটেন্যান্ট নিক পাপ্পসকে ফোন করলেন।

***

নিক পাপ্পাস একজন দশাসই চেহারার মানুষ। ছ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা। তিনশো পাউন্ড ওজন। যে কোনো ক্রিমিন্যাল তাকে দেখে ভয়ে কাঁপতে শুরু করে দেয়। তিনি অনেক দিন ধরেই হোমিসাইড বিভাগের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ম্যানহাট্টন অঞ্চলটির দায়িত্ব তার ওপর দেওয়া হয়েছে। পাপ্পাসের অন্যতম ইচ্ছে হল, আততায়ীকে তাড়া করা।

নিক বললেন –হোমিসাইড পাপ্পাস।

-হ্যাঁ, পিটার।

–বন্ধু, কী হয়েছে?

–অনেক কথা আছে। টিনা কেমন আছে?

-দারুণ ভালো। কী করব?

কয়েকটা তথ্য চাই। গ্রিসে তোমার কোনো যোগাযোগ আছে।

-আমার? পাপ্পাস বললেন, একসোজন আত্মীয় আছে সেখানে। তাদের সকলের হাতে টাকা আছে। আমি আবার মাঝে মধ্যে তাদের টাকা পাঠাই।

পিটার জানতে চাইলেন একটা ব্যাপারে সাহায্য করবে?

-বল, কী ব্যাপার?

–জর্জ মেলিসের নাম শুনেছ?

–হ্যাঁ, যারা খাবারের ব্যবসা করে।

–হ্যাঁ।

–হ্যাঁ, ওর সম্বন্ধে আমি জানি না। কী হয়েছে?

–ওর কীরকম টাকা আছে?

–ওর পরিবার খুবই বড়োলোক।

 –হ্যাঁ, ওর নিজস্ব টাকা?

–আমি একটু দেখে বলছি, পিটার। কিন্তু সময় নষ্ট করে কী হবে?

–জর্জ মেলিসের বাবা সম্পর্কে কোনো খবর আছে? সব খবর আমার চাই। ভদ্রলোকের কি কয়েকবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে?

–আমি সব খবর দেব।

 পিটার ওই স্বপ্নটার কথা চিন্তা করলেন। –নিক, আমাকে এখনই ফোন করতে পারবে?

-এখনই?

–হ্যাঁ।

 পাপ্পাসের কণ্ঠস্বর ভেঙে গেছে।

–কিছু বলতে চাও, পিটার?

–এখনই কিছু বলব না। কিন্তু আমি খুব উৎসাহী হয়ে উঠেছি।

***

কেটি ব্ল্যাকওয়েলের শরীরটা ভালো নেই। তিনি ডেস্কে বসে আছেন। টেলিফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। হঠাৎ একটা ভয়ংকর কাঁপুনি, তার শরীর দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল।

তাকে অফিসে শুইয়ে দেওয়া হল। ব্রাড ছুটে এসেছে– কেটি তুমি ভালো আছো তো?

কেটি কথা বলতে পারছেন না। কেমন যেন মাথাটা ঘুরে গেল।

-এখন কি চেক আপ করাবে?

–না ব্রাড, এখন উপায় নেই।

–ঠিক আছে। আমি বরং জন হার্টলেকে ডেকে পাঠাই।

–না, ব্রাড, এব্যাপারে কথা বলো না।

 –তাহলে কাজ চলতে থাকবে।

–হ্যাঁ।

***

পরের দিন সকালবেলা পিটার টেমপ্লেটনের সেক্রেটারি বলল –ডিটেকটিভ পাপ্পাস আপনাকে ডাকছেন?

পিটার ফোনটা ধরে বললেন–হ্যালো নিক?

-একটু কথা বলব।

–হ্যাঁ, বলতে পারো।

-আমি বৃদ্ধ মেলিসের সঙ্গে কথা বললাম। তার কখনও হার্ট অ্যাটাক হয়নি। ছেলেকে তিনি মোটেই দেখতে পারেন না। তার কাছে ছেলে মৃত সন্তান ছাড়া আর কিছুই নয়। জর্জ মেলিসকে এক অসাধারণ রূপবান যুবক বলা যেতে পারে। পুলিশও তাকে ভালো মতো চেনে। সে মাঝে মধ্যেই মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে। গ্রিস ছেড়ে চলে যাবার আগে সে পনেরো বছরের একটা পুরুষ বেশ্যাকে আঘাত করেছিল। ওই বেশ্যাটার মৃতদেহ হোটেলে পাওয়া গেছে। তাকে মেলিস মেরেছে, এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে। বুড়ো মানুষের চেষ্টায় মেলিস সে যাত্রায় বেঁচে যায়। তাকে গ্রিসের বাইরে বের করে দেওয়া হয়। আর কোনো খবর?

পিটার বললেন –ঠিক আছে, অনেক ধন্যবাদ।

-না, ধন্যবাদ জেনে কী করব? আর কোনো খবরের দরকার হলে অবশ্যই বল।

***

ডঃ জন হার্টলে একটা পরীক্ষা করছিলেন। রিসেপশনিস্ট বলল –মিসেস জর্জ মেলিস এখানে এসেছেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে ডাক্তার, কোনো অ্যাপয়মেন্ট নেই। আমি আপনার কথা বলেছি।

জন বললেন –ওকে এখনই এখানে পাঠিয়ে দাও।

আগের থেকে শরীরটা আরও খারাপ হয়ে গেছে। সে বলল আপনাকে বিরক্ত করছি।

–আলেকজান্দ্রা, সমস্যাটা কী?

–ভীষণ খারাপ লাগছে।

–তুমি কি ওষুধ খাচ্ছো?

–হ্যাঁ।

 –তাহলে?

–মানসিক অবসাদটা আরও বেড়ে গেছে। মনের ওপর আমার কোনো অধিকার নেই।

ডাঃ হার্টলে বললেন– তোমার মধ্যে তো কোনো খারাপ দেখছি না। তুমি কেন এমন করছ?

***

তিরিশ মিনিট কেটে গেছে। ইভ তার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসেছে। সে মুখে একটা ক্রিম মেখে ছিল। হালকা হলুদ রঙের। সেটা আস্তে আস্তে তুলে ফেলল। আহা, মুখটা আবার আলোতে উদ্ভাস হয়ে উঠেছে।

***

জর্জ মেলিস পিটার টেমপ্লেটনের উল্টোদিকে বসে আছে। হাসছে এবং আত্মবিশ্বাসী।

–আজ কেমন আছেন?

–অনেক ভালো, ডাক্তার। আমি আগের থেকে সাহসী হয়ে উঠেছি।

–সত্যি কথা?

–হ্যাঁ, কিছু কথা বলার আছে। আমি স্বীকারোক্তি করতে চাইছি।

–সত্যি! সত্যি!

জর্জ বলল–হা, আমার বউ আবার ডাক্তার হার্টলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল। সে আর বেঁচে থাকতে চাইছে না। আমি কি তাকে কোথাও নিয়ে যাব? একটা পরিবর্তন দরকার।

পিটারের মনে হচ্ছে, এই কথাগুলোর অন্তরালে সরল সত্যি লুকিয়ে আছে।

–গ্রিস খুব ভালো জায়গা, পিটার বললেন। ওকে গ্রিসে নিয়ে যান না কেন? পরিবারের সকলের সঙ্গে দেখা হবে।

-না, এখনও সময় আসেনি। অ্যালেক্স সেখানে গেলে মোটেই ভালো থাকতে পারবে না। সমস্যা দেখা দেবে।

এক মুহূর্তের জন্য পিটারের মনে হল, আলেকজান্দ্রার জীবনে এবার সত্যিকারের সমস্যা দেখা দিয়েছে।

***

 জর্জ মেলিস চলে গেছে। পিটার টেমপ্লেটন চেয়ারে বসে আছেন। কোনো কিছুই ভাবতে পারছেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি একটা ফোন করলেন –জন, তুমি কি একটা খবর দেবে? দেখো তো, জর্জ মেলিস তার বউকে নিয়ে কোথায় হনিমুন করতে যাচ্ছে?

–আমি এখনই খবরটা নিচ্ছি।

আমার এক বন্ধু বেশ্যাদের আক্রমণ করত, কথাটা মনে পড়ে গেল।

না, জর্জ মেলিসের বিরুদ্ধে এমন কোনো প্রমাণ নেই, যাতে তাকে দোষারোপ করা যেতে পারে। জন হার্টলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

***

পিটার টেমপ্লেটন কাজ করে চলেছেন। তার বাবা একটা কলেজের কেয়ারটেকার ছিলেন। নেব্রসকাতে। পিটার একটা স্কলারশিপ পেয়েছিলেন, তার মাধ্যমেই এতদূর উঠতে পেরেছেন।

তিনি আলেকজান্দ্রাকে ফোন করলেন।

ডাক্তার, জর্জ আপনার কথা আমাকে বলেছে।

 পিটার অবাক হয়ে গেছেন, জর্জ মেলিস কখনওই এই কথা বলবে না। তিনি বললেন –কী হয়েছে? জর্জ সম্পর্কে কোনো সমস্যা?

-না, আপনি কি লাঞ্চে আসতে পারবেন?

–হ্যাঁ, আসব।

ঠিক হল পরের দিন তারা লাঞ্চের আসরে যোগ দেবেন।

***

কর্ণারের টেবিলে আলেকজান্দ্রা বসে আছে। তার মনটা ভালো নেই। পিটার তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একটা সুন্দর সাদা স্কার্ট পরেছে। ব্লাউজটাও মানানসই। মুক্তোর, একছড়া হার। সব মিলিয়ে অসাধারণ সৌন্দর্য।

আলেকজান্দ্রা কি জর্জের এই অবস্থা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল?

–ডাঃ টেমপ্লেটন, আমার স্বামী ঠিক আছে তো?

–হ্যাঁ, তার কিছুই হয়নি। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

 পিটার বললেন মিসেস মেলিস আপনার স্বামী কি বলেছেন, কেন উনি আমার কাছে আসেন।

-হ্যাঁ, স্বামীর সময়টা ভালো যাচ্ছে না। পার্টনাররা নানা গোলমাল করতে শুরু করেছে। তাই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করছে।

হ্যাঁ, স্বামীর ব্যাপারে মেয়েটা কিছুই জানে না। সে কি জানে, স্বামী তার বোনকে আঘাত করেছিল?

–আপনার সঙ্গে দেখা হবার পর আমার স্বামী তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে।

 মেয়েটি বিড়বিড় করে বলল।

আহা, মেয়েটি এত অসহায়? একে কিনা এইভাবে প্রতারিত করা হচ্ছে? কীভাবে আমি ওকে বলব যে, ওর স্বামী হাজার মেয়ের প্রতি অনুগত। সে মানসিক রোগী। সে একটা অল্পবয়সী পুরুষ বেশ্যাকে হত্যা করেছিল। বাড়ির সকলে তাকে পরিত্যাগ করেছে। কেউ তার সঙ্গে কথা বলতে পর্যন্ত চায় না। এসব কথাগুলো এখন কি বলা উচিত?

আলেকজান্দ্রা বলল–সময় এবং সুযোগ হলে আমাদের উচিত সাইক্রিয়াটিস্টের সাথে দেখা করা।

খাবার এসে গেছে। তারা খেতে খেতে কথা বললেন।

আলেকজান্দ্রা বলল–আপনার সঙ্গে লাঞ্চ খাচ্ছি, ব্যাপারটা ভীষণ ভালো লাগছে।

শেষ পর্যন্ত সত্যিটা এসে গেছে। পিটার কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোনো কথা বলতেই পারছেন না। এটা বলা উচিত হবে কি?

–জন হার্টলে আমাকে সব কথা বলেছেন।

 জর্জ মেলিসের কণ্ঠস্বর মনে পড়ে গেল –ডার্লিং, আমি সারা বাড়ি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

সে পিটারের দিকে তাকাল আপনাকে দেখে ভালো লাগছে, মি, টেমপ্লেটন। আমি কি এখানে আসব?

ছোট্ট একটা সুযোগ এসেছিল, বাতাসে উড়ে হারিয়ে গেল।

***

–নিকের সঙ্গে ডাক্তার দেখা করতে চাইলেন কেন? ইভ জানতে চাইল।

–আমি জানি না, জর্জ বলল–ভগবানকে ধন্যবাদ, ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত অনেক দূর গড়াতে পারেনি।

–আমি এটা ভালো চোখে দেখছি না।

–আমাকে বিশ্বাস করো। এখনও কোনো ক্ষতি হয়নি। আমি আলেকজান্দ্রাকে সব কথা জিজ্ঞাসা করেছি। সে কারও সাথে আলোচনা করতে চাইছে না।

–আমাদের পরিকল্পনাটা তাড়াতাড়ি শুরু করতে হবে। জর্জ মেলিসের মনে হল, এই কথার মধ্যে একটা অদ্ভুত যৌনকাতরতা লুকিয়ে আছে। সে আর অপেক্ষা করতে চাইছে না। সে বলল কখন?

-এখন হলে ভালো হয়।

.

৩৩.

ডঃ হার্টলে কেটি ব্ল্যাকওয়েলকে নিয়মিত চিকিৎসা করছেন। কেটি প্রথমে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে রাজী হননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মত পরিবর্তন করেছেন।

একদিন জন হার্টলে বাড়িতে এসে বললেন–যদি আমি আপনার জায়গায় থাকতাম, তা হলে কী হত বলুন তো, কেটি?

-কেন আমার সমস্যা কী?

–আপনার ওপর অনেক সমস্যা। আপনি কি ইভের খবর রাখেন?

কেটি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালেন, বুঝতে পারলেন তার হৃদয়ের কোথাও একটা নীরব রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তিনি বললেন –কেন, কী হয়েছে?

-ইভ প্রায় মরেই গিয়েছিল, ভয়ংকর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল তার।

–আপনি এ খবর আমাকে দেননি কেন?

–না, ইভ বারণ করেছিল। এই খবরটা পেলে আপনি আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবেন।

–ও এখন কেমন আছে?

এখন ভালো আছে।

 কেটি তাকালেন, শুন্যের দিকে। তারপর বললেন অনেক ধন্যবাদ, ডাক্তার।

–আমি আর একটা প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছি।

ডাক্তার তাকিয়ে দেখলেন। কেটি ব্ল্যাকওয়েল আর সেখানে নেই।

***

ইভ দরজাটা খুলে দিল। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। ঠাম্মা দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই সোজা এবং ঋজু। বয়সের কোনো ছাপ নেই তার আচরণে।

কেটি বললেন আমি কি ভেতরে আসতে পারি?

ইভ বাইরে বেরিয়ে এল। যে ঘটনা ঘটছে সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না—হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভেতরে এসো।

কেটি চারপাশে দেখে অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে ঢুকে গেলেন। তারপর বললেন আমি কি বসতে পারি?

ঠাম্মা, আমি দুঃখিত। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি কি তোমাকে চা দেব? কফি, কিংবা অন্য কিছু?

-না, ধন্যবাদ। তুই কেমন আছিস, ইভ?

–আমি এখন ভালো আছি।

-আমি এইমাত্র ডঃ হার্টলের কাছে একটা খারাপ খবর শুনলাম। তোর নাকি ভয়ংকর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।

ইভ সাবধানে তার ঠাকুরমাকে দেখল। তারপর বলল–হ্যাঁ।

-হ্যাঁ, উনি আরও বললেন, তুই নাকি প্রায় মৃত্যুর উপত্যকায় পৌঁছে গিয়েছিলি। তুই আমাকে খবরটা দিতে চাসনি, পাছে আমি উদ্বিগ্ন হই।

-হ্যাঁ, ইভ মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, উনি ঠিকই বলেছেন, ঠাম্মা।

–তাহলে? তুই আমার জন্য এত চিন্তা করিস?

 কেটির কণ্ঠস্বর আবেগে বুজে গেছে।

ইভ তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলল–হা, আমি সবসময় তোমার কথা ভাবি।

একটু বাদে ইভ তার ঠাম্মার কোলে বসে আছে, কেটি ইভকে সাহায্য করছে সেজে উঠতে। তারপর কেটি বললেন আমি তোকে ক্ষমা করে দিলাম, এখন থেকে তুই আমার কাছেই থাকবি।

ইভ উঠে দাঁড়াল। তার চোখে আনন্দের অশ্রু নতুন করে আবার জীবন শুরু করতে হবে, তাই না ঠাম্মা?

ইভের দিকে তাকিয়ে কেটি বললেন–হ্যাঁ, আমি আবার উইলটা লিখব। তোর যা কিছু আছে সব তোকেই দিয়ে দেব।

-না-না, টাকার জন্য আমি চিন্তা করছি না। আমার একমাত্র চিন্তা তোমাকে নিয়ে।

-তুই তো আমার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। তুই আর আলেকজান্দ্রা, তোরা দুজন ছাড়া আমার আর কে আছে বল?

-আমি তো ভালোই আছি, ইভ বলল। শুধু তোমাকে খুশি দেখতে চাই।

-হ্যাঁ, তোর এই আচরণ আমাকে অবাক করে দিয়েছে ডার্লিং, তুই কবে আমাদের বাড়িতে ফিরে যাবি?

-না না, আমি তো এখানে ভালোই আছি। তুমি যখন ইচ্ছে তখন চলে এসো। তবে তুমি কি জানো, এখানে আমি কত একা থাকি?

কেটি তার নাতনির দিকে তাকালেন এবং বললেন তুই কি আমায় ক্ষমা করবি?

–হ্যাঁ, আমি তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি।

***

কেটি চলে গেলেন। ইভ কড়া স্কচের বোতলে মুখ রাখল। চুপচাপ বসে বসে মদ খেতে থাকল। একটু আগে যে অবিশ্বাস্য নাটকের দৃশ্যাবলি অভিনীত হল, সেগুলো ভাববার চেষ্টা করল। এখন তার আনন্দে চিৎকার করা উচিত। সে আর আলেকজান্দ্রার ওপর বিশাল ব্ল্যাকওয়েল সাম্রাজ্য স্থাপিত হতে চলেছে। আলেকজান্দ্রার হাত থেকে সহজে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। কিন্তু জর্জ মেলিস এখন একটা বিপদ সংকেত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই লোকটাকে জীবন থেকে সরাতেই হবে।

***

ইভ জর্জকে বলল পরিবর্তন করতে হবে। ষড়যন্ত্রটা পালটাবে। কেটি আমাকে সব কিছু দিয়ে দিয়েছে।

জর্জ সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল। বলল –সত্যি? অনেক অনেক ধন্যবাদ।

-এখন যদি আলেকজান্দ্রার কিছু হয় তাহলে সকলে সন্দেহ করবে। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা পরে চিন্তাভাবনা করব।

–না, পরে আমি কখনও ভাবব না।

–তুমি কী বলতে চাইছ?

–আমি বোকা নই ডার্লিং, এখন যদি আলেকজান্দ্রার কিছু হয়, আমি তার সর্বস্ব পাব, তুমি আমাকে ছবির বাইরে রাখতে চাইছ? নিজেকে এত চালাক ভেবো না।

ইভ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল–তুমি কেন ব্যাপারটা জটিল করে তুলছ। তোমার সাথে অন্য একটা কথা আছে। তুমি ডিভোর্স নিয়ে নাও। আমার হাতে টাকা আসবে। আমি তোমাকে…

জর্জের মুখে হাসি–তোমার কথাটা একটা বাচ্চা ছেলে বিশ্বাস করবে। আমাকে বল না। কোনো কিছুই পরিবর্তিত হবে না। অ্যালেক্স আর আমি ডাকহারবারে যাব। শুক্রবার রাতে। আমি প্রতিজ্ঞাটা বজায় রাখব।

***

ইভ আর ঠাকুরমার ঝামেলা মিটে গেছে। এই খবরটা শুনে আলেকজান্দ্রা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল–আবার আমাদের পারিবারিক বন্ধন ফিরে এল।

***

একটা টেলিফোন।

-হ্যালো, ইভ, আমি কি আপনাকে বিরক্ত করছি? আমি কেট ওয়েস্টার বলছি।

প্রতি সপ্তাহে ওই ভদ্রলোক নিয়ম করে দু-তিনবার ফোন করেন। প্রথম দিকে ইভের আচরণ তাকে অবাক করেছিল। পরবর্তীকালে তিনি ইভকে বুঝে ওঠার চেষ্টা করছেন।

ইভ বলল –আমি এখন আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি না। একটু বাইরে যাব।

কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত আকুতি।

-ঠিক আছে, আগামী সপ্তাহে ঘোড়দৌড়ের আসরের দুটো টিকিট আছে, আমি জানি, আপনি ঘোড়ার দৌড় দেখতে ভালোবাসেন।

-দুঃখিত, আমি আগামী সপ্তাহে শহরের বাইরে থাকব।

–আচ্ছা, পরের সপ্তাহে না হয় ঠিক করব আমরা। আপনি কোন খেলা দেখতে ভালোবাসেন?

–আমি সব কটা ঘোড়দৌড় দেখেছি। এখন আর দেখতে ইচ্ছে নেই।

এখন তাড়াতাড়ি সেজে উঠতে হবে। ররি ম্যাককানার সাথে একটা সাক্ষাৎকার করতে হবে। ররি হল এক তরুণ অভিনেতা। ব্রডওয়ের নাটকে মাঝে মধ্যেই নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ইভের থেকে পাঁচ বছরের ছোটো, হা, সে একটা বুনো ঘোড়ার মতো। ইভ চোখ বন্ধ করল যৌনকাতর দৃশ্যগুলি তার মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে। সে বুঝতে পারল দুটি পায়ের ফাঁকে ত্রিভুজ এখন জ্যাবজেবে হয়ে গেছে ঘাম এবং ক্ষরণে। একটা অসাধারণ সন্ধ্যা তাকে চুপি চুপি ডাকছে।

***

বাড়ি ফেরার পথে জর্জ মেলিস আলেকজান্দ্রার জন্য ফুল কিনেছিল। আজ তার মনটা আকাশ ছুঁয়েছে। আহা, কী অবাক করা কাণ্ড, বুড়ি শয়তানি ইভকে সবকিছু ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এতে কোনো কিছু পালটাবে না। আলেকজান্দ্রার অ্যাকসিডেন্টটা হয়ে যাবার পর সে ইভের দায়িত্ব নেবে। সব কিছু পাকাপাকি হয়ে আছে। শুক্রবার আলেকজান্দ্রা তার সাথে ডাকহারবার বেড়াতে যাবে। সে আলেকজান্দ্রার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলেছিল–শুধু তুমি আর আমি, চাকর-বাকরদের সঙ্গে নেব না কেমন?

***

পিটার টেমপ্লেটন কিছুতেই আলেকজান্দ্রা মেলিসের কথা ভুলতে পারছেন না। জর্জ মেলিসের শব্দগুলো তার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমি ওকে কোথাও নিয়ে যাব। ওর একটা পরিবর্তন দরকার।

***

পিটারের কেবলই মনে হচ্ছে আলেকজান্দ্রার সামনে সমূহ বিপদ। কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারছেন না। তিনি নিক পাপ্পাসের কাছেও তাঁর সন্দেহের কথা বলতে পারছেন না। কারণ তার হাতে কোনো প্রমাণ নেই।

***

শহরের মাঝখানে ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেডের এগজিকিউটিভ অফিস, কেটি ব্ল্যাকওয়েল এইমাত্র একটা নতুন ইচ্ছাপত্রে সই করলেন। তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দুই নাতনির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হল।

***

নিউইয়র্ক, টনি ব্ল্যাকওয়েল মনের সুখে ছবি আঁকছেন। স্যানাটোরিয়ামে বসে, আহা, রং আর রঙের খুন খারাপি খেলা। এমন ছবি যা বাচ্চা ছেলেও বুঝতে পারবে না। সেই সব ছবির দিকে তাকিয়ে টনির মুখে স্বর্গীয় হাসি ফুটে উঠছে।

***

শুক্রবার, সকাল দশটা, সাতান্ন মি:।

লা গার্ডিয়া এয়ারপোর্ট, একটা ট্যাক্সি ইস্টার্ন এয়ারলাইনসের শাটল টার্মিনালের সামনে এসে থেমেছে। ইভ ব্ল্যাকওয়েল নেমে এল। সে ড্রাইভারের হাতে একশো ডলারের বিল তুলে দিল।

ড্রাইভার বলল আমার কাছে চেঞ্জ নেই, অন্য কোনো টাকা নেই?

-না।

 –তাহলে আপনি ভাঙিয়ে নিয়ে আসুন।

 –আমার হাতে সময় নেই। আমাকে এখনই ওয়াশিংটন যেতে হবে।

সে তার হাতের কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল –সবটাই রেখে দাও।

 ড্রাইভার অবাক হয়ে গেছে।

ইভ দ্রুত টার্মিনালে ঢুকে পড়ল। সে ডিপারচার গেটের দিকে ছুটে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল এখন ওয়াশিংটন যাব।

-এখুনি প্লেনটা উড়বে ম্যাডাম, আর একটু হলে আপনি উড়তে পারতেন না।

–হ্যাঁ, যেতেই হবে। কোথায় যাব?

–এত চিন্তা করছেন কেন? এক ঘণ্টার মধ্যে আর একটা শাটল ছাড়বে।

-না, আমাকে ওটাই ধরতে হবে।–ঠিক আছে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। এখানে কোনো কফিশপ আছে?

–না, ম্যাডাম, কিন্তু করিডরে কফি মেশিন আছে।

–ধন্যবাদ।

লোকটা ইভের দিকে তাকাল –আহা, এমন সৌন্দর্য আমি জীবনে দেখিনি।

***

শুক্রবার বেলা দুটো।

এটা দ্বিতীয় মধুচন্দ্রিমা, আলেকজান্দ্রা ভাবল। এই পরিকল্পনাটা তাকে উদ্দীপ্ত করেছে। চাকরবাকর কেউ থাকবে না। শুধু আমরা দুজন। অসাধারণ সপ্তাহ শেষের অভিজ্ঞতা। আলেকজান্দ্রা ডাকহারবারের দিকে এগিয়ে চলেছে। জর্জের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এত সুন্দর একটা প্রহর এগিয়ে আসছে। আলেকজান্দ্রা তার পরিচারিকাকে বলল–আমি চলে যাচ্ছি। সোমবার সকালে ফিরে আসব।

আলেকজান্দ্রা সামনের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। টেলিফোনটা আর্তনাদ করতে শুরু করেছে। সে ভাবল, ওটা বাজুক, আমার এখনই অনেক দেরী হয়ে গেছে।

***

শুক্রবার, সন্ধ্যা সাতটা।

জর্জ মেলিস ইভের পরিকল্পনাটা নিয়ে বারবার চিন্তা করল। না, এর মধ্যে কোনো ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটা মোটর লঞ্চ আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। আমরা ডাকহারবারে চলে যাব। আকাশে চাঁদের অকৃপণ জোছনধারা থাকবে। আলেকজান্দ্রা আর আমি পাশাপাশি ভেসে যাব। যখন আমরা সমুদ্রের মধ্যে চলে যাব, আমি যা খুশি করতে পারব। কিন্তু রক্তের কোনো চিহ্ন থাকবে না। তাহলে? তাহলে ধাক্কা দিয়ে শরীরটাকে ফেলে দিতে হবে। তারপর? ট্যাক্সি নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসতে হবে। কোনো একটা অজুহাত দেখালেই চলবে। আলেকজান্দ্রার দেহটা যেন না পাওয়া যায়, সমুদ্রের জল তাকে কোথায় নিয়ে চলে যাবে। যদি বা পাওয়া যায়? তাহলে? না, কিছুই হয়তো হবে না।

মোটর বোটটা ঠিক জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে। সব কিছু ঠিকঠাক, পরিকল্পনামাফিক।

জর্জ এগিয়ে গেল। আকাশে চাঁদের মৃদু আলো। সে অনেকগুলো নৌকা দেখল, কিন্তু কোনটা তার সেই আসল নৌকোটা?

টেলিফোনে কে যেন কথা বলছে, কার জন্য অপেক্ষা করছে, জর্জ ভেতরে এল, সে তাকাল, রিসিভারটা হাতে রাখল। আর বলল, ইভ, সে একটু কিছু ভাবল আমাকে এখন যেতে হবে ইভ। আমার ডার্লিং এই মাত্র এসে গেছে। তোমার সঙ্গে আগামী সপ্তাহে লাঞ্চের আসরে দেখা হবে, কেমন?

সে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে আলেকজান্দ্রাকে আদর করল –তুমি এত তাড়াতাড়ি এলে যে?

–তোমাকে ছাড়া পৃথিবী অন্ধকার। সব কিছু ফেলে ছুটে এসেছি, সে চুমু খেয়ে বলল, তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।

–তোমাকেও আমি ভালোবাসি, চাকরদের আসতে বারণ করেছ?

মুখে হাসি–হ্যাঁ, তুমি যেমন বলেছিলে, শুধু তুমি আর আমি।

ভালোবাসার খেলা শুরু হয়েছে। পাতলা ফিনফিনে সিল্কের ব্লাউজের আড়াল থেকে বুকের দুটো ঈষৎ গোলাপী বৃন্ত জেগে উঠেছে। সেখানে ইচ্ছে করেই হাত রাখল জর্জ। মেয়েটাকে যৌনতার দিক থেকে উদ্দীপ্ত করতে হবে।

আমি ভাবতেই পারছি না, অফিসে বসে শুধু এই সুন্দর মুহূর্তটার কথা চিন্তা করেছি। তুমি আর আমি, আকাশে চাঁদ, ফুরফুরে হাওয়া, মনে হবে স্বর্গ যেন পকেটে।

-তুমি কী নেবে? তোমার জন্য কিছু তৈরি করব কি?

জর্জ স্তনটাকে মুঠিতে ধরার চেষ্টা করে বলল–ডিনার অপেক্ষা করতে পারে প্রিয়তমা, কিন্তু আমি অপেক্ষা করতে পারছি না।

-আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি পোশাকটা পালটে আসি। এক মিনিট লাগবে।

–খুব তাড়াতাড়ি কিন্তু।

জর্জ ওপরে উঠে গেল। ক্লোসেটটা খুলল। পোশাকটা পালটে নিল। স্ন্যাক্স পরল। সোয়েটার আর নৌকো চালাবার জুতো। হা, উপযুক্ত সময়টা এসে গেছে। তার মনে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা, যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

মেয়েটির কণ্ঠস্বর শোনা গেল আমি তৈরি, ডার্লিং। সে তাকাল। দেখতে পেল আলেকজান্দ্রাকে। সোয়েটার পরেছে। কালো স্ন্যাক্স। ক্যানভাসের জুতো। তার লম্বা সোনালী চুল রাত বাতাসে উড়ছে। ছোট্ট নীল রিবন দিয়ে বেঁধে রাখার চেষ্টা করেছে। আহা, সে এত সুন্দরী। কিন্তু এই সৌন্দর্য অবিলম্বে নষ্ট হবে।

-আমিও তৈরি, জর্জ বলল।

***

মোটর লঞ্চটা এগিয়ে চলেছে। সে বলল- এটা কী হচ্ছে?

-ওখানে একটা ছোট্ট দ্বীপ আছে। সেই দ্বীপটাকে আজ আমরা আবিষ্কার করব। আমরা সেখানে মোটর লঞ্চটাকে রাখব। চিন্তা নেই, তোমার ভয় করবে না।

হ্যাঁ, সব কাজ এগিয়ে চলেছে। এই তো, মোটর লঞ্চ তরতর করে এগিয়ে চলেছে, অন্ধকার রাত, মৃদুমন্দ চাঁদের আলো। চমৎকার বাতাস বইছে।

সে বলল–আহা, বন্যতার মধ্যে আলাদা সৌন্দর্য! তুমি আমাকে সুখী করেছ, ডার্লিং।

জর্জের মুখে হাসি –আমিও সুখী হয়েছি।

জর্জ মেলিস আদর দেবার চেষ্টা করল। আহা, এই মেয়েটা যেন মৃত্যুর মধ্যে কোনো যন্ত্রণা না পায়। সে আকাশের দিকে তাকাল। কাছাকাছি কোনো নৌকো চোখে পড়ছে না। অনেক দূরে মৃদু আলোর রেখা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখনই সুযোগ এসেছে।

সে বোটটাকে ঘোরাল। শেষবারের মতো দিগন্ত রেখার দিকে তাকাল। তার হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করেছে।

সে বলল –অ্যালেক্স, আমার দিকে তাকাও।

অ্যালেক্স তাকাল–হ্যাঁ, বীভৎস হাসিতে ভরে উঠছে জর্জের মুখমণ্ডল।

 জর্জ আদেশের সুরে বলল আমার কাছে এসো।

সে এগিয়ে এসেছে। সে জর্জের দিকে তাকাচ্ছে। জর্জ তাকে চুমু দিল উন্মত্তের মতো। তাকে আদর করছে, আরও জোরে, আরও জোরে, কিন্তু? হাত দুটো গলার ওপর নেমে আসছে কেন?

না, সে আর থাকতে পারছে না। কোনোরকমে সে বলল –জর্জ!

জর্জ আরও জোরে তাকে চেপে ধরেছে–এবার–এবার বোধ হয় সেই মুহূর্তটা।, তাকে রেলিং-এর ওপর তুলে দেওয়া হয়েছে। তার পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। সে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করছে।

হঠাৎ জর্জের বুকে অসহ্য যন্ত্রণা। সে ভাবল, তার বোধহয় হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। সে মুখ খোলার চেষ্টা করল। মুখ দিয়ে ঝলকে ঝলকে রক্ত ছুটে আসছে। সে আর আলেকজান্দ্রাকে ধরে রাখতে পারল না। তাকিয়ে থাকল নিজের ক্ষতবিক্ষত শরীরটার দিকে। হ্যাঁ, ক্ষত চিহ্ন দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। তার সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে? শয়তানির মতো? সে হল ওই মেয়েটি, তার হাতে একটা ছুরি লকলক করছে।

মৃত্যুর আগে জর্জ মেলিস অস্পষ্ট আর্তনাদে উচ্চারণ করেছিল ইভ! তুমি!

.

৩৪.

 পরের দিন রাত দশটা। আলেকজান্দ্রা ডাকহারবারে এসে পৌঁছেছে। জর্জের সাথে টেলিফোনে যোগাযযাগ করতে পারছে না। যতবার ফোন করছে, কোনো উত্তর পাচ্ছে না। কী হয়েছে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল। আলেকজান্দ্রা ডাকহারবারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল, ফোনটা বাজল। সে ভেবেছিল, ফোন ধরবে না। গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু পরিচারিকা এসে বলল–মিসেস মেলিস, বোনের ফোন। বোন বলছেন, খুব তাড়াতাড়ি।

আলেকজান্দ্রা টেলিফোনটা ধরল। ইভ বলেছিল –ডার্লিং, আমি ওয়াশিংটন ডিসিতে এখন আছি। সাংঘাতিক সমস্যা হয়েছে। তুই এখুনি আমার কাছে চলে আয়।

–অবশ্যই যাব। কিন্তু কী করে যাব বলতো। আমাকে এখন ডাকহারবারে যেতে হবে, জর্জের সঙ্গে দেখা করতে হবে। সোমবার সকালে ফিরে আসব।

-না-না, আমার সমস্যাটা ভয়ংকর। তোকে ফোনে আমি বলতে পারছি না। তুই আমার সঙ্গে এয়ারপোর্টে দেখা কর। আমি পাঁচটার সময় সেখানে থাকব।

–আমি যাব ইভ, কিন্তু জর্জকে বলতে হবে।

–ব্যাপারটা কেন বুঝতে পারছিস না, অ্যালেক্স। তবে তুই কি খুব ব্যস্ত?

–না-না, আমি পৌঁছে যাচ্ছি। 

-ধন্যবাদ, ডার্লিং, আমি জানি, তুই আমাকে কতটা ভালোবাসিস।

আলেকজান্দ্রা ভাবল, তাকে আমি ফেরাই কী করে? সে নয় অন্য কোনো প্লেন ধরে ওই দ্বীপে পৌঁছে যাবে। সে জর্জের অফিসে ফোন করল। খবরটা দেবার জন্য। জর্জকে পেল না। সে তার সেক্রেটারির কাছে খবরটা পৌঁছে দিল। একঘণ্টা বাদে সে ট্যাক্সি করে বিমানবন্দরের দিকে এগিয়ে গেল। ওয়াশিংটন থেকে একটা প্লেন আসছে। কিন্তু সেই প্লেনে ইভ কোথায়? আলেকজান্দ্রা প্রায় দুঘণ্টা অপেক্ষা করেছিল। ইভের কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। আলেকজান্দ্রা জানে না, কীভাবে ইভের সঙ্গে দেখা করবে। না, অপেক্ষা করাটাই। সার হল। আলেকজান্দ্রা প্লেন ধরে ওই দ্বীপে চলে এল। তখন সে সিডারহিল হাউসের দিকে এগিয়ে চলেছে। বাড়িটা অন্ধকার। জর্জ নিশ্চয়ই এসে গেছে। আলেকজান্দ্রা একটার পর একটা ঘরের আলো জ্বালল। জর্জের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকল। না, জর্জের কোনো চিহ্ন নেই। সে ম্যানহাট্টনের বাড়িতে ফোন করল। কাজের মেয়েটি বলল, মি. মেলিস তো এখানে নেই? আপনারা দুজন তো একসঙ্গে ছুটি কাটাবেন।

-ধন্যবাদ, ম্যাগি। ও বোধহয় কোথাও আটকে গেছে।

এই অনুপস্থিতির অন্তরালে কী কারণ আছে? শেষ মুহূর্তে দরকারী কোনো কাজ? পার্টনাররা হয়তো জর্জের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে জর্জ চলে আসবে। সে ইভের নাম্বারে ফোন করল।

আলেকজান্দ্রা বলল –ইভ? কী রে তুই এলি না কেন?

–সে কী? আমি তো কেনেডিতে অপেক্ষা করছিলাম। তুই তো আসিসনি?

–কেনেডি কেন? তুই তো বললি গুয়াটিয়া।

–না, ডার্লিং, কেনেডি।

–ঠিক আছে, আমি দুঃখিত। আলেকজান্দ্রা বলল, আমি হয়তো ভুল শুনেছি। তুই ঠিক আছিস তো?

ইভ বলল আমার একটা সাংঘাতিক সমস্যা হয়েছিল। ওয়াশিংটনে একটা লোকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সে লোকটার রাজনৈতিক প্রতিপত্তি আছে। ফোনে সবকিছু বলতে পারছি না। ফোন কোম্পানি আমাদের দুজনের ফোন কেড়ে নেবে। সোমবার দেখা হলে সব বলব, কেমন?

আলেকজান্দ্রা বলল ঠিক আছে। হ্যাঁ, পাষাণ ভার মাথা থেকে নেমে গেছে।

 ইভ বলল–এ সপ্তাহের ছুটিটা ভালো করে কাটাস। জর্জ কোথায়?

-জর্জ এখনও আসেনি। আলেকজান্দ্রা তার উদ্বিগ্নতা আড়াল করার চেষ্টা করল। মনে হচ্ছে ব্যবসায়ের কোনো কাজে সে আটকে পড়েছে।

-এখুনি তার কাছ থেকে খবর শুনতে পাবি। শুভরাত, ডার্লিং।

–শুভরাত, ইভ।

আলেকজান্দ্রা রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ভাবল, ইভের হাতে কোনো ভালো ছেলে এলেই বোধহয় ভালো হয়। জর্জের মতো একটা ভালো স্বামী। সে ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত এগারোটা বেজে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে জর্জ চলে আসবে।

সে টেলিফোন করল ব্রোকারেজ ফার্মে, কোনো উত্তর নেই। সে ক্লাবে ফোন করল। না, মি. মেলিসকে কদিন ধরেই সেখানে দেখা যাচ্ছে না।

মধ্যরাত, আলেকজান্দ্রার মন এবার চঞ্চল হয়ে উঠেছে। রাত একটা, তার মনের ভেতর ভয়ের বাতাবরণ। সে জানে না কী করবে? জর্জ কি কোনো ক্লায়েন্টের সঙ্গে বাইরে চলে গেছে? টেলিফোন করতে পারছে না? নাকি অন্য কোথাও উড়ে গেছে? শেষ মুহূর্তে খবরটা দেবার সুযোগ পায়নি? এমনই একটা সমাধান হতে পারে হয়তো। যদি সে পুলিশকে ডাকে, আর যদি জর্জ তখনই ঢুকে পড়ে তাহলে বোকার মতো কাজ হবে।

রাত্রি দুটোর সময় সে পুলিশের সাহায্য নিল। এখানে কোনো পুলিশ পোস্ট নেই। সব থেকে কাছাকাছি থানা আছে ওয়ালডোকা উল্টিতে।

ঘুমন্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল।–ওয়ালডো কাউট্রি সেরিভেল বিভাগ, সার্জেন্ট ল্যাম্বার্ট।

–আমি মিসেস জর্জ মেলিস, সিডারহিল হাউস থেকে বলছি।

–মিসেস মেলিস, কণ্ঠস্বরে তীক্ষ্ণতা, বলুন কী করব?

মনে হচ্ছে, আলেকজান্দ্রা কিন্তু কিন্তু করল, আমার স্বামীর আসার কথা ছিল আজ সন্ধ্যেবেলা। কিন্তু এখনও সে আসেনি।

–দেখছি।

কথার মধ্যে নানান প্রশ্ন।–রাত্রি দুটো। স্বামী এখনও আসেনি? আহা, কত কিছুই তো আছে এখানে। লাল চুলের সর্বনাশিনীরা। বাদামী চুলের বেশ্যারা, সোনালী চুলের মোহিনীরা।

সে বলল–ব্যবসার কাজে হয়তো উনি আটকে গেছেন।

…না-না, সে ফোনও করেনি।

-মিসেস মেলিস, হয়তো এমন অবস্থা যে, উনি ফোন করতে পারেননি। যে কোনো সময় ফোন আসবে।

হ্যাঁ, হয়তো আমি বোকার মতো কাজটা করলাম। পুলিশের সাহায্য নেওয়া উচিত হয়নি। জর্জ তো হারিয়ে যায়নি। সে আসতে একটু দেরী করেছে।

***

সকাল সাতটার ফেরি, সেখানেও জর্জ নেই, আলেকজান্দ্রা ম্যানহাট্টন হাউসে আবার ফোন করল জর্জের কোনো খবর নেই।

আলেকজান্দ্রার মনে নানা সন্দেহের বাতাবরণ। জর্জের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সে হাসপাতালে আছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে, অথবা মরে গেছে। ইভের সাথে ওই ঝামেলাটা না হলে সে ঠিক সময়ে পৌঁছে যেত। কিন্তু জর্জ কোথায় গেল? আলেকজান্দ্রা আবার সব জায়গায় দেখল। কোনো সম্ভাব্য সূত্র আছে কিনা। সব কিছু একই রকম আছে। সে পাহাড়ের দিকে চলে গেল। কী? প্রমোদ তরণীটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে এতটুকু বিপদের আঁচ লাগেনি।

সে আবার পুলিশের কাছে ফোন করল। লেফটেন্যান্ট ফিলিপ বছর কুড়ি ধরে কাজ করছেন। মর্নিং ডিউটিতে ছিলেন। তিনি শুনতে পেলেন জর্জ মেলিস রাতে বাড়ি ফেরেনি। না, এখনই ব্যাপারটা দেখতে হবে।

তিনি আলেকজান্দ্রাকে বললেন মিসেস মেলিস, ওনার কোনো চিহ্ন নেই? আমি নিজেই আসছি।

হ্যাঁ, বাজে সময় নষ্ট হয় তো অন্য কোথাও বসে আছে, কিন্তু ব্ল্যাকওয়েল পরিবারের সম্মানযুক্ত। এ ব্যাপারে এতটুকু ঢিলে দিলে চলবে না।

***

লেফটেন্যান্ট ফিলিপ এসে গেছেন। আলেকজান্দ্রার গল্পটা ভালো করে শুনলেন। সব কিছু দেখলেন। শেষ পর্যন্ত মনে হল, জর্জ মেলিসের সত্যি কোনো সমস্যা হয়েছে। ডাকহারবারে উনি আসেননি কেন? লেফটেন্যান্ট সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলেন। সব জায়গায় ফোন করলেন। জর্জ মেলিসের চিহ্ন পাওয়া গেল না। চব্বিশ ঘণ্টা ধরে নোকটার কোনো হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে? লোকটা গেল কোথায়?

***

লেফটেন্যান্ট স্টেশনে ফিরে এলেন, হসপিটাল এবং মর্গে ফোন করলেন। সব জায়গাতে একই উত্তর পাওয়া গেল। অ্যাকসিডেন্টের কোনো খবর নেই। এবার তিনি তার রিপোর্টার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করলেন। বুলেটিন বের করতে হবে।

বিকেলবেলা কাগজে গল্পটা বেরাল ব্ল্যাকওয়েল সাম্রাজ্যের ভাবী সম্রাজ্ঞীর স্বামী হারিয়ে গেছেন।

পিটার টেমপ্লেটন খবরটা পেলেন ডিটেকটিভ নিক পাপ্পাসের কাছ থেকে। খবরটা পেয়ে তিনি কেমন যেন হয়ে গেছেন। হতেই পারে না, জর্জ এভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল কেন?

এর অন্তরালে কী কারণ থাকতে পারে, উনি বুঝতেই পারছেন না।  

***

তিরিশ মিনিট কেটে গেছে। আলেকজান্দ্রা পিটার টেমপ্লেটনকে ফোন করল। হ্যাঁ, আলেকজান্দ্রার কণ্ঠস্বরে কেমন একটা বিষণ্ণতা –জর্জ হারিয়ে গেছে। সে কোথায় আছে আমি জানি না। কী হবে বলুন তো।

–আমি দুঃখিত মিসেস মেলিস। এমনটি হতেই পারে না।

–আঃ, কী যে হবে আমার।

পিটার ভাবলেন, এখন ওখানে গেলে ভালো হত।

–আমি এখন ডাকহারবারে আছি। নিউইয়র্কে ফিরে যাব আজ বিকেলবেলা। ঠাকুরমার কাছে চলে যাব।

আলেকজান্দ্রা এই সরল সত্যটা বিশ্বাস করতে পারছে না। বেশ কয়েকবার কেটিকে ফোন করল।

কেটি বললেন সোনামনি এত চিন্তা করো না। ও হয়তো ব্যবসার কাজে কোথাও আটকে গেছে। আর তোমার কথা ভুলে গেছে।

কেটি জানেন, এটা নেহাতই একটা সান্ত্বনা।

***

টেলিভিশনে জর্জের হারিয়ে যাবার খবরটা ভেসে উঠেছে। সিডারহিল হাউসের অনেকগুলো ছবি। আলেকজান্দ্রা এবং জর্জের বিয়ের অনুষ্ঠান। জর্জের ক্লোজ আপ ছবি–ওপর দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ দুটো প্রসারিত।

ইভের মনে পড়ল, মৃত্যুকালীন অভিব্যক্তি।

টেলিভিশনে ভাষ্যকার বলছেন এই মানুষটির কোনো চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। এ যেন বাতাসে ভর রেখে হারিয়ে গেছে। পুলিশ মনে করছে, জর্জ মেলিসের ভয়ঙ্কর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। অথবা স্মৃতিভ্রংশ হয়ে গেছে তার।

ইভ হাসল, মনে মনে।

তারা কখনওই মৃতদেহটা খুঁজে পাবে না। জোয়ারের জল তাকে দূর সমুদ্রে নিয়ে গেছে। হতভাগ্য জর্জ, পরিকল্পনাটা সুন্দরভাবে করা হয়েছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে একটু পরিবর্তন আনতে হয়েছে।

ইভ মাইনেতে চলে গিয়েছিল। মোটরবোট নিয়ে কোভে ফিরে আসে। তারপর? আর একটা মোটরবোট নিয়ে ডাকহারবারে। জর্জের জন্য অপেক্ষা করে। হ্যাঁ, সব ব্যাপারটা গুছিয়ে করেছে।

একটা অসামান্য হত্যার পরিকল্পনা। পুলিশ এটাকে রহস্যজনক নিরুদ্দেশ বলেই চিহ্নিত করবে।

ঘোষক বলে চলেছে এবার অন্যান্য খবর।

ইভ টেলিভিশনের সুইচ বন্ধ করে দিল।

 ররির সাথে দেখা করতে হবে। সুন্দর সময়টাকে সে অযথা হত্যা করতে চায় না।

***

পরের দিন সকাল ছটা। মাছ ধরার একটা নৌকো জর্জ মেলিসের মৃতদেহটা পেয়েছে। ব্যাকওয়াটারে পড়েছিল। খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। হ্যাঁ, এটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা। জলে ডুবে মৃত্যু। আর কোনো খবর? খবরটা পালটে গেল। করোনারের অফিস থেকে রিপোর্ট এসেছে। হিংস্র হাঙরের দল তাকে খাবলে খাবলে খেয়েছে। সান্ধ্য সংস্করণে প্রকাশিত হল সেই হৃদয়বিদারক সংবাদ জর্জ মেলিসের মৃত্যুর অন্তরালে মৃত্যুর পরিকল্পনা। গায়ে ছুরির আঘাত।

***

লেফটেন্যান্ট আগের দিনের জোয়ার ভাটার ছবিটা দেখছিলেন। কাজটা শেষ হল। তিনি চেয়ারে ঝুঁকে পড়লেন। মুখে একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি। জর্জ মেলিসের দেহটা দূর সমুদ্রে চলে যেত, নেহাত ব্যাকওয়াটারে আটকে গিয়েছিল তাই। লেফটেন্যান্ট বুঝতে পারছেন না, কী ভাবে এই ঘটনাটা ঘটল। ওখানে তো জর্জের থাকার কথা ছিল না।

***

ডিটেকটিভ নিক পাপ্পাস মাইনেতে উড়ে এসেছেন, লেফটেন্যান্টের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

–আমার ডিপার্টমেন্ট কি আপনাকে সাহায্য করবে? নিক বললেন, জর্জ মেলিস সম্পর্কে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ খবর আমি দেব। তবে এটা আমাদের আলোচনার বাইরে। যদি আপনি আমার সহযোগিতা চান।

গত কুড়ি বছর ধরে লেফটেন্যান্ট সেরিবে ডিপার্টমেন্টে কাজ করছেন। জীবনে এমন ঘটনার সামনে তাকে দাঁড়াতে হয়নি। আসলে এখানে শান্তির বাতাবরণ বিরাজ করে। অনেক বছর আগে একটা মাতাল লোক অন্য লোকের সঙ্গে ঝামেলা করেছিল। এখন জর্জ মেলিসের হত্যাকাণ্ড খবরের কাগজের প্রথম পাতায় চলে এসেছে। সঙ্গত কারণেই লেফটেন্যান্টের মন ভালো নেই। এখন হয়তো নাম কেনা যেতে পারে। নিউইয়র্ক সিটি পুলিশের এই ডিটেকটিভের কাছ থেকে কোন খবর পাওয়া যাবে?

তিনি নিক পাপ্পাসের দিকে তাকিয়ে বললেন আমি জানি না, আপনি আমার কতটা সাহায্য করতে পারবেন।

নিক পাপ্পাস বললেন আমি কি কিছু তথ্য আপনাকে দেব? জর্জ মেলিসের পটভূমিকা সম্পর্কে?

-হ্যাঁ দিতে পারেন।

***

আলেকজান্দ্রা বিছানাতে বসে আছে। এই ঘটনাটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না। জর্জকে কে কেন হত্যা করল? এর অন্তরালে কোন কারণ আছে? পুলিশ বলেছে, তার শরীরে ছুরির আঘাত আছে। কিন্তু কেন? এটা কি একটা দুর্ঘটনা? কেউ তাকে হত্যা করবে না। ডঃ হার্টলে তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেছেন। অবশেষে আলেকজান্দ্রা ঘুমিয়ে পড়ল।

***

জর্জের মৃতদেহটা পাওয়া গেছে এই খবর শুনে ইভ অবাক হয়ে গেছে। কিন্তু এতে ভালোই হল। আলেকজান্দ্রাকে একজন সম্ভাব্য হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কারণ আলেকজান্দ্রা তখন ওই দ্বীপে ছিল।

কেটি কৌচে বসে আছেন। ইভের পাশে, ড্রয়িংরুমে। এই খবরটা কেটিকে যথেষ্ট দুঃখ দিয়েছে।

–কেউ কেন জর্জকে মেরে ফেলল? কেটি জানতে চাইলেন।

ইভ দীর্ঘশ্বাস ফেলল– ঠাম্মা, সত্যি আমি জানি না। অ্যালেক্সের জন্য কষ্ট হচ্ছে।

***

লেফটেন্যান্ট ফেরিলোকটিকে প্রশ্ন করলেন, জানতে চাইলেন মিস্টার অথবা মিসেস মেলিস এই ফেরিতে আসেননি তো, শুক্রবার বিকেলবেলা?

-না, আমি তো ওনাদের দেখিনি, স্যার। আমি সকালের লোকটিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সেও ওদের দেখেনি। তারা বোধহয় প্লেনে চড়ে এসেছে।

–আর একটা প্রশ্ন, শুক্রবার কোনো অচেনা লোক কি ফেরি নিয়েছিল?

-না, লোকটি বলল, আমরা অচেনা লোককে তো আসতে দিই না। গরমকালে দু একজন ট্যুরিস্ট অবশ্য আসে। নভেম্বরে কেউ আসে না।

লেফটেন্যান্ট এয়ারপোর্টের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললেন।

–জর্জ মেলিস ওদিন রাতে আসেনি তো? সে হয়তো ফেরিতে এসেছে।

–ফেরির লোকটি কিন্তু তাকে দেখেনি।

–তাহলে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

মিসেস মেলিস? হ্যাঁ, উনি এখানে এসেছিলেন রাত্রি দশটার সময়। আমার সঙ্গে আমার ছেলে চার্লি ছিল। চার্লি তাকে সিডারহিলে নিয়ে গিয়েছিল। এয়ারপোর্ট থেকে।

–মিসেস মেলিসকে দেখে কী মনে হচ্ছিল?

–হাসিখুশী, ফুটন্ত জলের মতো টগবগে। আমার ছেলেও তার এই খুশীয়াল স্বভাবটা লক্ষ্য করেছিল। সাধারণত মেয়েটি খুবই শান্ত থাকে। সকলের সাথে ধীরে ধীরে কথা বলে। কিন্তু সেই রাতে সে যেন খুব তাড়াতাড়ি আসতে চাইছিল।

–আর একটা প্রশ্ন, সেদিন সন্ধ্যেবেলা কিংবা বিকেলে কোনো অচেনা লোক কি বিমানে এসেছিল? কোনো একদম নতুন ছবি?

-না, যারা আসে তারাই এসেছে।

এক ঘন্টা কেটে গেছে। লেফটেন্যান্ট একের পর এক ফোন করছেন। নিক পাপ্পাসকে একটা ফোন করে বললেন এই খবর পেয়েছি। সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার রাতে মিসেস মেলিস তার ব্যক্তিগত বিমানে ইসলেবোনরা এয়ারপোর্টে নেমেছিলেন রাত্রি দশটার সময়। স্বামী সঙ্গে ছিলেন না। মিস্টার মেলিস কিন্তু প্লেন কিংবা ফেরিতে আসেননি। কেউ তাকে দেখতে পায়নি। তিনি এলেন কী করে?

-হ্যাঁ, একজন দেখেছিল ওই সমুদ্রের জোয়ার।

–আপনি ঠিকই বলেছেন।

–যে তাকে হত্যা করেছে। সে নৌকো থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ভেবেছিল, সমুদ্র তাকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। প্রমোদ তরণীটা দেখেছেন?

-হ্যাঁ, দেখেছি, হিংসার কোনো চিহ্ন নেই, রক্তের কোনো দাগ নেই।

ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের লোককে পাঠানো উচিত। আপনি কি কিছু মনে করবেন?

–না, আমি কিছুই মনে করব না।

***

নিক পাপ্পাস একদল বিশেষজ্ঞকে পাঠালেন। তিনিও নিজে এসে উপস্থিত হলেন। লেফটেন্যান্ট তাদের ব্ল্যাকওয়েল ডকে নিয়ে গেলেন। হা, ওই তো, নৌকোটা বাঁধা আছে।

দুঘন্টা কেটে গেছে। ফরেনসিক এক্সপার্টরা বললেন আমরা একটা জ্যাকপট খেলছি, নিক। রক্তের সামান্য দাগ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ওপর থেকে দেখলে বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

সেদিন বিকেলবেলা, পুলিশ ল্যাবরেটরি ওই রক্তের দাগ পরীক্ষা করল, হা, জর্জ মেলিসের রক্তের গ্রুপের সঙ্গে মিলে গেছে।

তাহলে? কী হতে পারে? কিছুই বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

পিটার এসে পাপ্পাসের সঙ্গে দেখা করলেন।

–পিটার কেমন আছেন?

–কিছু এগোল?

–না, এখনও কিছু বুঝতে পারছি না।

ব্যাপারটা আমাদের অবাক করছে।

 –ওকে কি বাড়ির মধ্যে হত্যা করা হয়?

–না-না, ব্ল্যাকওয়েলদের নিজস্ব প্রমোদ তরণীতে। তারপর মৃতদেহটা ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। লোক্টা ভেবেছিল, সমুদ্রের জল তাকে দূরে নিয়ে যাবে।

-তাই নাকি?

 নিক পাপ্পাস হাত তুলে বললেন আমি এবার চেষ্টা করছি। মেলিস তো আপনার রোগী ছিলেন। বউ সম্পর্কে কোনো কথা কি উনি বলেছেন?

–একথা জিজ্ঞাসা করার অর্থ?

–হা, আলেকজান্দ্রাকে আমি আততায়ী হিসেবে চিহ্নিত করতে চলেছি।

–আপনার কি মাথা খারাপ?

-না, আমার মনে হচ্ছে, আলেকজান্দ্রা কোনো কারণে স্বামীর হাত থেকে অব্যাহতি পেতে চেয়েছিলেন।

–নিক, আলেকজান্দ্রা কেন তার স্বামীকে হত্যা করবে?

–হ্যাঁ, একটা কারণ তো আছেই। সেদিন রাতে আলেকজান্দ্রা এই দ্বীপে এসেছিলেন। কেন দেরী হয়েছিল, তার কোনো গ্রহণযোগ্য কথা বলতে পারেননি। উনি বলেছেন, ভুল এয়ারপোর্টে গিয়েছিলেন বোনের সঙ্গে দেখা করার জন্য।

–বোন কী বলেছেন?

–কী করে বিশ্বাস করব? বোনের কথার সাথে ওনার কথা মিলছে না। আমরা জর্জ মেলিসকে সেই রাতে বাড়িতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটি বলেছেন, উনি জর্জকে দেখেননি। মস্ত বড়ো বাড়ি পিটার, কিন্তু এত বড়ো কি?

..আর একটা খবর শ্রীমতী সব চাকরদের ছুটি দিয়েছিলেন। এটা নাকি জর্জের পরিকল্পনা। কিন্তু জর্জের মুখ তো চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।

পিটার জানতে চাইলেন আলেকজান্দ্রার মোটিভটা কী?

-আপনার কি মনে আছে? আপনি একসময় আমাকে একটা কথা বলেছিলেন। জর্জ নাকি মানসিক দিক থেকে অসুস্থ ছিলেন। যখন তখন অত্যাচার করতেন।

-কে বলেছে এসব কথা?

-হ্যাঁ, আপনিই তো বলেছিলেন, মনে হচ্ছে আলেকজান্দ্রা বোধ হয় এইভাবে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল।

–নিক, আমি একথা বিশ্বাস করি না। ওনাদের দাম্পত্য জীবনটা খুবই সুখের ছিল।

নিক বললেন আমাকে ভুল বুঝবেন না, বন্ধু। আমি ডঃ জন হার্টলের সাথে কথা বলেছি। উনি আলেকজান্দ্রা মেলিসকে ওষুধ দিতেন। কেন বলুন তো? আলেকজান্দ্রা যাতে আত্মহত্যা না করেন!

***

ডঃ জন হার্টলে লেফটেন্যান্ট পাপ্পাসের সাথে কথা বলেছেন।

 ডিটেকটিভ অনেক কথা জানার চেষ্টা করেছেন মিসেস মেলিস কি আপনার কাছে আসতেন?

-আমি দুঃখিত, কোনো রোগীর ব্যাপারে আমি কোনো সাহায্য করতে পারব না।

-ডাক্তার, বুঝতে পারছি। আপনি আমার পুরোনো বন্ধু, আপনি যদি মুখ বন্ধ করে রাখেন তাহলে অসুবিধা হবে। এটা হত্যার ঘটনা। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে একটা ওয়ারেন্ট নিয়ে আসব। তখন আপনার সঙ্গে কথা বলব। আমি যা জানতে চাইছি, সব জবাব আপনাকে দিতেই হবে।

ডঃ হার্টলে তাকিয়ে থাকলেন–হ্যাঁ, আমার রোগিনীর মন ভালো ছিল না। আলেকজান্দ্রার মধ্যে আবেগজনিত সমস্যা দেখা দিয়েছিল।

-কী ধরনের সমস্যা?

 –ও হতাশায় ভুগত। আত্মহত্যা করতে চাইত।

–ও এ কথা বলেছে?

-না, ও একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখত, কেউ ওকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। আমি ওকে ওষুধ দিয়েছি। এই ওষুধে কোনো কাজ হয়নি। আমি আরও বেশি দামের ওষুধ দিয়েছি, আমি জানি না, এই ওষুধ খেয়ে কাজ হয়েছে কিনা?

নিক পাপ্পাস বললেন –আর কিছু?

-না, এটাই আমার শেষ গল্প, লেফটেন্যান্ট।

***

আরও কিছু বলার ছিল, জন হার্টলে বোধহয় সেগুলো বলতে চাননি। হ্যাঁ, জর্জ মেলিস ইভ ব্ল্যাকওয়েলকে কীভাবে মেরেছেন, সে গল্পটা উনি বলেননি। এটা বলা হয়তো উচিত ছিল না। কারণ এর সাথে ব্ল্যাকওয়েল পরিবারের সুনাম জড়িয়ে আছে।

***

পনেরো মিনিট কেটে গেছে, নার্স বললেন, ডঃ কেট ওয়েস্টার লাইনে আছেন, দু নম্বর লাইনে, ডাক্তার।

কেট ওয়েস্টার বললেন –জন, বিকেলে আপনার সঙ্গে কথা বলব।

–কখন?

–পাঁচটা।

 –ঠিক আছে কেট, তখন দেখা হবে।

পাঁচটা বেজেছে। ডঃ হার্টলে কেটকে দেখতে পেয়ে বললেন –ড্রিঙ্ক নেবেন?

-না, ধন্যবাদ। জন, এখন এসেছি বলে ক্ষমা করবেন।

জন হার্টলের সাথে অনেক দিন বাদে কেট ওয়েস্টারের দেখা হল। তারা কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন।

–কেট, বলুন, কী জানতে চাইছেন?

কেট ওয়েস্টার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–জর্জ মেলিস ইভ ব্ল্যাকওয়েলকে মাঝে মধ্যেই মারত, তাই তো?

-কেন?

–ইভ তো প্রায় মরেই গিয়েছিল।

–হ্যাঁ।

-পুলিশের কাছে ঘটনাটা বলা হয়নি, এখন মেলিসের হত্যাকাণ্ডে সব ব্যাপারটা নতুন করে ভাবতে হবে।

তার মানে, আপনি কী বলতে চাইছেন।

–আমি পুলিশকে সব কথা জানাব।

কেট ওয়েস্টার শান্তভাবে বললেন। তারপর বললেন আমি জানি, এই ঘটনাটা ইভ ব্ল্যাকওয়েলের সুনামের পক্ষে ভালো হবে না।

ডঃ হার্টলে বললেন –হ্যাঁ, ইভ কিন্তু যথেষ্ট নামজাদা নারী।

কেট বললেন একটাই কথা বলা যেতে পারে, আমাদের মধ্যে একটা গোপন চুক্তি হলে ভালো হয়।

জন হার্টলে তাকালেন। তিনি বললেন কী ধরনের চুক্তি? এই খবরটা পুলিশের কাছে কখনও জানাবেন না, তাই তো? কিন্তু আপনি তো খুব সুন্দর চিকিৎসা করেছেন। তবে মাথায় একটা ছোট্ট লাল ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। আপনি হয়তো নজর করেননি।

কেট অবাক হয়েছেন কী ক্ষতচিহ্ন?

-কপালে ছোট্ট লাল দাগ। এক-দুমাসের মধ্যে সেটা সেরে যাবে। আপনি নাকি ওকে বলেছেন।

ডঃ ওয়েস্টার অবাক হয়ে গেলেন –এ কী আশ্চর্য ঘটনা?

-শেষ কবে আপনার সাথে ইভের দেখা হয়েছে?

–প্রায় দশদিন আগে। একটা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার জন্যে ইভ এসেছিল। এই চিহ্নটা দেখেই আমি ইভকে চিনতে পেরেছিলাম। এছাড়া আলেকজান্দ্রার সাথে তার চেহারার অদ্ভুত মিল আছে।

কেট মাথা নাড়লেন–হ্যাঁ, আমি খবরের কাগজের পাতায় ইভের বোনের ছবি দেখেছি। অসাধারণ সাদৃশ্য। আপনি হয়তো মাথার ক্ষতচিহ্ন দেখে আলাদা করতে পেরেছেন। কিন্তু এই ক্ষতচিহ্ন থাকার কথা নয়।

ওয়েস্টার বসে থাকলেন, তারপর বললেন–এ বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।

কেট, ওরা দুজনেই কিন্তু যথেষ্ট আকর্ষণীয়া তরুণী, খবরের কাগজ ওদের পেছনে লেগে থাকবে। অনেকে ভাববে, আলেকজান্দ্রা জর্জকে হত্যা করেছে। এটা কখনওই সম্ভব নয়। আমার মনে হয়, এব্যাপারে কোনো ভুল হচ্ছে। ওরা যখন এতটুকু শিশু, তখন থেকে ওদের আমি চিনি।

ডঃ ওয়েস্টার কিন্তু কিছুই শুনছেন না।

***

ডঃ হার্টলের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে কেট ওয়েস্টার ভাবনার সমুদ্রে ডুবে গেলেন। না, কখনওই ওই সুন্দর মুখে ক্ষতের চিহ্ন থাকবে না। কিন্তু জন হার্টলে ওই চিহ্নটা দেখেছেন। তার মানে? ইভের কি আর একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল? সে কি মিথ্যে কথা বলেছে?

তিনি সব দিক থেকে বিচার করার চেষ্টা করলেন।

পরের দিন সকালবেলা কেট ওয়েস্টার ডঃ হার্টলেকে ফোন করে বললেন–জন, আপনাকে বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত। ইভ আপনার সাথে কথা বলতে এসেছিল? আলেকজান্দ্রার ব্যাপারে?

-হ্যাঁ।

–ইভের আসার পর আলেকজান্দ্রা কি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছিল?

–হ্যাঁ, সে পরের দিন আসে। কেন?

-না, আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে। আমি কি জানতে পারি, ইভের বোন কেন এসেছিল?

–আলেকজান্দ্রার মনটা বিষাদাচ্ছন্ন হয়েছিল। ইভ তাকে সাহায্য করতে চেয়েছিল।

তার মানে? ইভকে আলেকজান্দ্রার স্বামী মেরে ফেলতে চেয়েছিল। এখন এই লোকটা মারা গেছে। আলেকজান্দ্রার ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কেট ওয়েস্টার সব কটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করতে থাকলেন। কোনো সমাধানে পৌঁছোতে পারলেন না।

***

শেষ পর্যন্ত তিনি ইভকে ফোন করলেন। ইভের কণ্ঠস্বর- ররি? কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত মাদকতা।

–আমি কেট ওয়েস্টার।

–হ্যালো।

–কেমন আছো?

–ভালো।

–তোমার সঙ্গে দেখা হলে ভালো হত।

–আমি কারও সঙ্গে দেখা করছি না। তুমি হয়তো জানো, আমার জামাইবাবু মারা গেছে। আমি এখন শোক পালন করছি।

ট্রাউজারে হাত মুছলেন কেট–সেই জন্যই তোমার সাথে দেখা করতে চাইছি, ইভ। কয়েকটা খবর দেব।

-কী ধরনের খবর?

–ফোনে বলব না।

–কখন?

–এখন হলে ভালো হয়।

***

ইভের অ্যাপার্টমেন্ট। তিরিশ মিনিট কেটে গেছে। ইভ দরজা খুলে দিল–কী বলতে এসেছ?

কেট বললেন –এই এনভেলাপটা ধরো, কতকগুলো ফটোগ্রাফ।

-কোথা থেকে এল?

–তোমার ছবি?

–কেন কী হয়েছে?

–অপারেশনের পর তোলা হয়েছে।

—দাঁড়াও দেখছি।

–তোমার মাথায় কোনো দাগ নেই? ইভের মুখ পালটে গেল।

–কেট, বসো।

কেট উল্টোদিকে বসলেন। কৌচের একেবারে ধারে। হা, তিনি ইভের দিকে পরিষ্কার তাকাতে পারছেন। অনেক সুন্দরী মহিলাকে দেখেছেন, কিন্তু ইভ ব্ল্যাকওয়েল হল সবার থেকে বেশি সুন্দরী।

–পুরো গল্পটা আমি শুনতে চাইছি।

কিন্তু ইভ কি গল্পটা বলবে?

কেট ওয়েস্টারের কথা বলা শেষ হয়ে গেছে।

ইভ বলল তুমি এখানে বৃথাই সময় নষ্ট করছ। ওই ক্ষতচিহ্ন? আমি আমার বোনের সাথে মজা করছিলাম। আর কিছু নয়। আমার অনেক কাজ আছে।

কেট তখনও বসে আছেন– হা, তোমাকে বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত। পুলিশে যাব নাকি?

–যেখানে খুশী তুমি যেতে পারো।

–হ্যাঁ, এই খবরটা আমি পুলিশের কাছে তুলে দেব।

ইভের মুখমণ্ডলে ভয়ের আকুতি। এই লোকটা কী চাইছে? ও কি আমাকে ভয় দেখাবে?

এই অ্যাপার্টমেন্টে জর্জ মেলিস প্রায়ই আসত। পুলিশের কাছে হয়তো তার প্রমাণ আছে। হা, সে মিথ্যে কথা বলেছে, সে ওয়াশিংটনে গিয়েছিল, জর্জ যেদিন মারা যায়, সেদিন। কিন্তু তার অ্যালিবাইটা টিকবে না। তাহলে? পুলিশ যদি জানতে পারে, জর্জ তাকে প্রায় মেরে ফেলতে চেয়েছিল, তাহলে মোটিভটা পরিষ্কার হবে।

সে বলল–তুমি কী চাইছ? টাকা?

-না।

 –তাহলে কী?

–আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। ইভ, তোমার কিছু হলে আমি বেঁচে থাকব না।

মুখে কষ্টে উপার্জিত হাসি আমার কিছুই হবে না কেট, আমি যে কোনো অবস্থার সঙ্গে লড়াই করব। জর্জ মেলিসের মৃত্যুর সাথে এর কোনো যোগাযোগ নেই। এটা ভুলে গেলেই ভালো হয়।

হাতে হাত, একটু চাপ–ইভ, তোমাকে আমি ভালোবাসি। করোনারের রিপোর্টটা শনিবারে বেরিয়ে যাবে। আমি ডাক্তার। আমাকে ওই রিপোর্টটা পরীক্ষা করতে হবে এবং সব কিছু বলতে হবে।

কেট দেখতে পেল ইভের চোখে ভয়ার্ত ইশারা।

-তাহলে?

–ইভ, আমি একটা কথা বলছি, তুমি কি তা রাখবে?

—কী?

 –একজন স্বামী কিন্তু কখনও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় না।

.

৩৫.

করোনারের রিপোর্ট প্রকাশিত হবার দুদিন আগে বিয়েটা হয়ে গেল। প্রাইভেট চেম্বারের মধ্যে। কেট ওয়েস্টারকে বিয়ে করে ইভ একটা সম্ভাব্য বিপদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাইল।

***

ডিটেকটিভ লেফটেন্যান্ট নিক পাপ্পাসের একটা সমস্যা হয়েছে। জর্জ মেলিসের হত্যাকারী কে, তিনি সেটা জানেন, কিন্তু সর্বসমক্ষে বলতে পারছেন না। তিনি এই সমস্যাটা নিয়ে তার সুপিরিয়র ক্যাপটেন হ্যারল্ডের সাথে কথা বললেন।

হ্যারল্ড পাপ্পাসের কথা শুনে বললেন –নিক, এটা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া। তুমি এখনও তেমন কোনো সূত্র পাওনি। কোর্টের নোক সব শুনলে হাসাহাসি করবে।

লেফটেন্যান্ট পাপ্পাস বললেন আমি জানি, কিন্তু আমার সিদ্ধান্তের কোনো নড়চড় হবে না। আমি কি কেটি ব্ল্যাকওয়েলের সঙ্গে কথা বলব?

-কী জন্য?

–একটুখানি কথা বলতে হবে। উনি হয়তো কোনো খবর জানতে পারছেন না।

–সাবধানে পা ফেলো।

–হ্যাঁ, তাই করব।

 –নিক মনে রেখো, উনি কিন্তু বৃদ্ধা মহিলা।

–তাইতো ওনার কথার ওপর নির্ভর করতে হবে।

.

কেটি ব্ল্যাকওয়েলের অফিস। নিক পাপ্পাস পৌঁছে গেছেন। কেটির বয়স কত হবে? আশি ছাড়িয়ে গেছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু এখনও কী সুন্দর চেহারা। ভাবলে অবাক লাগে।

দুজনের কথাবার্তা এগিয়ে চলেছে।

নিক বললেন ম্যাডাম, জর্জ মেলিসের রিপোর্ট কাল প্রকাশিত হবে। আমার মনে হচ্ছে যে, আপনার নাতনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত।

 কেটি বললেন –আমি বিশ্বাস করি না।

–আমার কথা শুনুন, মিসেস ব্ল্যাকওয়েল। প্রত্যেকটা পুলিশি তদন্ত শুরু হয় কোন মোটিভ, তার ওপর নির্ভর করে। জর্জ মেলিসকে আমরা এক রহস্যময় মানুষ বলতে পারি। উনি আপনার নাতনিকে কেন বিয়ে করেছিলেন? বিয়ে করে প্রভূত অর্থের অধিকারী হয়েছিলেন। আমি শুনেছি, উনি মাঝে মধ্যেই আলেকজান্দ্রাকে শারীরিক ভাবে আঘাত করতেন। আলেকজান্দ্রা ডিভোর্স চেয়েছিলেন। উনি ডিভোর্স দিতে রাজী হননি। তাই আলেকজান্দ্রা ওকে হত্যা করার কথা ভেবেছিলেন। কেটির মুখ সাদা হয়ে গেছে।

–আমি একটা ভালো থিওরি খাড়া করছি। আমি জানি, জর্জ মেলিসের সিডাহিল হাউসে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কীভাবে উনি যাবেন? ডাকহারবার দিয়ে, মেনলাইন থেকে, প্লেন কিংবা ফেরি বোটে অফিস থেকে জানা গেছে, এগুলোর কোনোটাই তিনি ব্যবহার করেননি। এটা এক অলৌকিক ঘটনা? মেলিস কি জলের ওপর দিয়ে হেঁটে গেছেন? একটাই সম্ভাবনা থাকছে। তিনি অন্য কোনো জায়গা থেকে বোট নিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দেন। নাম লিখিয়েছিলেন সোলানজে ডুনাস, চিনতে পারছেন?

-হ্যাঁ। সে তো আমার এই নাতনিদের দেখাশুনা করত। কয়েক বছর আগে ফ্রান্সে ফিরে গেছে।

পাপ্পাসের মুখে হাসি– তারপর? একই ভদ্রমহিলা আর একটা বোট ভাড়া নিয়েছিল, তিন ঘণ্টা বাদে, এই বোটটা সে ফেরত দিয়ে যায়। একই নাম লেখে। আমি সেখানকার লোকদের আলেকজান্দ্রার ছবি দেখাই। হ্যাঁ, এই ছবিটা আলেকজান্দ্রার। কিন্তু ঠিক মতো বলা যাচ্ছে না। কারণ যে মহিলা বোট ভাড়া নিয়েছিল, তার চুলের রং বাদামী।

তাহলে? সে হয়তো মাথায় উইপ পরেছিল।

–আমি বিশ্বাস করি না, আলেকজান্দ্রা তার স্বামীকে হত্যা করেছে।

–আমিও মনে করি না। মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, কিন্তু আমার সন্দেহ ইভ।

ব্ল্যাকওয়েল পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে আছেন।

–আলেকজান্দ্রা এটা করেনি, আমি তার সমস্ত পদক্ষেপের ওপর কড়া নজর রেখেছি। সেদিন সকালে সে নিউইয়র্কে গিয়েছিল, বন্ধুর সাথে দেখা করতে। নিউইয়র্ক থেকে সোজা ওই আইল্যান্ডে উড়ে যায়। সে একসঙ্গে দুটো মোটরবোট ভাড়া নিতে পারে না। কিন্তু আলেকজান্দ্রার মতো দেখতে কেউ একজন নিয়েছিল। সোলানজে ডুনাস নামে সই করেছে। এটা নিশ্চয়ই ইভ, আমি ইভের মোটিভের কথা ভাবতে চিন্তা করলাম। মেলিসের ছবি দেখিয়েছি, ইভের অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের টেনেন্টদের কাছে। তারা বলেছে, এই লোকটা নাকি প্রায় সেখানে যেত। ওই বাড়ির সুপারিটেনডেন্ট জানিয়েছে এক রাতে মেলিস যখন সেখানে ছিল ইভ ভীষণ ভাবে আহত হয়। সেটা কি আপনি জানেন?

…মেলিস তাকে মেরেছিল। এটাই তার স্বভাব। ইভ প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে, ডাকহারবারে যাবার জন্য জর্জকে প্রলুব্ধ করে। তাকে সে-ই হত্যা করেছে।

কেটির দিকে পাপ্পাস তাকালেন। তার সমস্ত চোখে মুখে আতঙ্ক।

–ইভ একটা অ্যালিবাই দিচ্ছে, সে ওয়াশিংটন ডিসিতে ছিল। সে ক্যাব-ড্রাইভারকে বলেছিল, তাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যেতে। একশো ডলারের নোট দিয়েছিল। কিন্তু ওয়াশিংটন শাটলের ব্যাপারটা সে ভুলে গেছে। মনে হয় না সে ওয়াশিংটনে গিয়েছিল। সে একটা বাদামী রঙের উইপ পরেছিল। কমার্শিয়াল প্লেন ধরে মাইনেতে চলে যায়। দুটো বোট ভাড়া করে। মেলিসকে হত্যা করে। শরীরটা সাগরের জলে ফেলে দেয়। প্রমোদ তরণীটা ঠিক জায়গায় রেখে দেয়। অন্য একটা মোটরবোট ধরে ডকে চলে আসে।

কেটি অনেকক্ষণ তাকিয়ে বললেন –এইসব ঘটনাগুলো কি সত্যি ঘটেছে?

-হ্যাঁ, করোনারি রিপোর্টটা পেলে আমি একেবারে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারব। মিসেস ব্ল্যাকওয়েল আপনি কি আমাকে সাহায্য করবেন?

-বলুন।

নিক পাপ্পাসের হৃৎস্পন্দনের গতি অনেক বেড়ে গেছে। তিনি বললেন মিসেস ব্ল্যাকওয়েল?

কেটি তাকালেন।

–জর্জ মেলসিকে যেদিন হত্যা করা হয়েছিল, আমার নাতনি ইভ এবং আমি, দুজনেই ওয়াশিংটন ডিসিতে ছিলাম।

অদ্ভুত একটা অভিব্যক্তি। কেটি ব্ল্যাকওয়েল ভাবলেন –তুমি কি ভাবছ, তোমার জন্য আমি ব্ল্যাকওয়েল সাম্রাজ্য নষ্ট করব? না, আমি তা করতে দেব না।

রিপোর্ট পাওয়া গেল মৃত্যু হয়েছে এক বা একাধিক আততায়ীর আক্রমণের ফলে।

***

আলেকজান্দ্রা অবাক, পিটার টেমপ্লেটন কোর্ট হাউসে পৌঁছে গেছেন। উনি বললেন আপনার কাছে এলাম, আপনাকে সাহস জোগাবার জন্য।

এই ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেলে আপনি কোথাও বেড়াতে যাবেন?

-ইভ আমার সঙ্গে যাবে বলেছে। আলেকজান্দ্রার চোখে যন্ত্রণা। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না জর্জ মারা গেছে। ব্যাপারটা আমার কাছে অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে।

–প্রকৃতি আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, কী করে শোককে সহ্য করতে হয়।

-না, আমি সে শিক্ষা নিতে পারব না। এমন একটা সুন্দর মানুষ, আলেকজান্দ্রা পিটারের দিকে তাকাল, আপনি তো ওর সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন বলুন। ওর মতো মানুষ কি আর আছে?

পিটার শান্তভাবে বললেন– না, একথা আমি হলফ করে বলতে পারি।

***

ইভ বলল–কেট, এবার কী হবে?

কেট তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল–কেন?

-তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটা।

–হ্যাঁ, তুমি তো আমার স্ত্রী।

–তারপর? ব্ল্যাকওয়েলের টাকা?

–টাকার দরকার নেই, ডার্লিং। আমি তো ভালোই আছি।

–আমার টাকা লাগবে।

কেট মাথা নাড়লেন –আমি তোমায় তা দেব।

–আরও বেশি। আমি কি ডিভোর্স ফাইল করব?

–এটা করতে যেও না, কোনো কিছুই পালটায়নি ইভ, পুলিশ হত্যাকারীকে খুঁজে পায়নি। এখনও কিন্তু ব্যাপারটা খোলা আছে। মনে রেখো, হত্যার মামলা কিন্তু বরাবর বেঁচে থাকে। তুমি আমাকে যদি ডিভোর্স করো, আমি কিন্তু পুলিশের কাছে যাব।

-তাহলে? তুমি কি মনে করো, আমি ওকে মেরে ফেলেছি।

–ইভ, তুমি তো হত্যাকারী, একথা কেন অস্বীকার করছ?

–তুমি কেন বলছ?

–না হলে তুমি আমাকে বিয়ে করতে না।

–কুকুরির বাচ্চা, তুমি একথা বলতে পারলে।

–আমি তোমাকে ভালোবাসি।

–আমি তোমাকে ঘেন্না করি। আমি তোমার সাথে প্রতারণা করেছি।

মুখে হাসি –তাও তোমাকে আমি ভালোবাসি।

 আলেকজান্দ্রার সঙ্গে বাইরে যাবার পরিকল্পনাটা বাতিল করা হল।

ইভ বলল আমি আমার সোনামনির সঙ্গে বারবাডোজ যাচ্ছি। হনিমুনে।

বারবাডোজের ব্যাপারটা কেটের একটা সুন্দর পরিকল্পনা।

 ইভ বলল–আমি যাব না।

-হ্যাঁ, হনিমুন না করলে লোকে অবাক হয়ে যাবে। আমরা কেন লোককে প্রশ্ন করার সুযোগ দেব।

***

আলেকজান্দ্রা এখন প্রায়ই পিটার টেমপ্লেটনের সঙ্গে দেখা করতে আসছে। এভাবেই আর একটা নতুন গল্প শুরু হচ্ছে। জর্জের স্মৃতি তার মন থেকে ক্রমশ আবছা হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, পিটার টেমপ্লেটনের সাহচর্য তার ভালো লাগে। মানুষটার ওপর নির্ভর করা যায়।

আমি যখন ইনটার্ন ছিলাম, উনি আলেকজান্দ্রাকে বললেন, আমি একজন পেশেন্টকে দেখতে গিয়েছিলাম। স্টেথোস্কোপ দিয়ে তাকে পরীক্ষা করি। সে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েছিল। সেটাই আমার প্রথম পরীক্ষা।

আলেকজান্দ্রা তাকিয়ে আছে। হ্যাঁ, এই মানুষটির দিকে তাকালে মনে হয় নির্ভরতা এখানে বাসা বেঁধেছে।

***

ইভের হনিমুনটা কেমন হল? অনেক ভালো। কেটের বিবর্ণ শরীর, না, সে সূর্যের সামনে আসতে ভয় পায়। ইভ সারাদিন সূর্যের তাপে দগ্ধা হতে চায়। আহা, এর আগে সে এতক্ষণ একলা কোথাও থাকেনি। তার চারপাশে কতজনের ভিড়। প্লেবয় থেকে শুরু করে বিজনেস টাইফুন। মনে হচ্ছে সে যেন এখানে একা থাকতে এসেছে।

তারপর? কীভাবে এই ব্যাপারটাকে হাল্কা করা যায়? শেষ অব্দি ইভ ভাবল, আর কিছুদিন খেলতে হবে।

***

দুবছর সময় লাগবে কি? কেটি ব্ল্যাকওয়েল ভাবলেন। হ্যাঁ, তার মধ্যে অনেক কিছু পালটে যাবে।

ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড এখন আরও বড়ো হয়ে উঠেছে। আমি চলে যাবার পরে এই ব্যবসার কী অবস্থা হবে? কেটি ভাবতে থাকলেন।

***

হনিমুন থেকে তারা ফিরে এসেছে।

কেট শান্তভাবে বললেন কাজে ফিরতে হবে। অনেকগুলো অপারেশন করতে হবে। তুমি কি আমায় ছাড়া থাকতে পারবে?

ইভ বলল–আমি চেষ্টা করব।

কেট ভোরবেলা উঠে পড়েছেন। ইভের ঘুম ভাঙার আগে। ইভ কিচেনে পৌঁছে গেল। কী আশ্চর্য, কফি তৈরি হয়েছে, ব্রেকফাস্ট রেডি। আহা, ইভের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। ইভ এখন ইচ্ছেমতো টাকা খরচ করতে পারে। কেটকে সে সুখী করতে পেরেছে।

কেট বললেন তুমি এমন কিছু করো না, যাতে আমার ইমেজ নষ্ট হয়।

-তোমার কথা বুঝতে পারছি।

–তুমি ব্যবসার কী জানো? তুমি তো ছোটোবেলা থেকেই সোনার চামচ মুখে মানুষ হয়েছ।

***

 ইভ কোনো কথা বলে স্বামীকে চটাতে চাইল না। সে ররির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে। ররির সাথে ডিনার খায়। নামী দামী রেস্টুরেন্টে। কিন্তু এই লোকটা তার স্বামী। তাকে চটানো উচিত হবে না। রাতে অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই ইভ বাড়িতে ঢুকে পড়ে। কেট তার জন্য ডিনার রান্না করেন। আহা, এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

এমনকি কেট জানতে চান না, সারাদিন তার স্ত্রী কার সান্নিধ্যে কাটিয়েছে।

.

পরের বছর, আলেকজান্দ্রা এবং পিটার এঁকে অন্যকে গভীরভাবে ভালোবাসল। পিটার আলেকজান্দ্রার সাথে সর্বত্র যাচ্ছে। এমনকি টনিকেও একদিন দেখে এলেন অ্যাসাইলামে গিয়ে। যন্ত্রণাটা ভাগ করার চেষ্টা করলেন।

কেটির সঙ্গে দেখা করলেন এক সন্ধ্যেবেলা, কথায় কথায় তিনি তার মনের কথাটা বলে দিলেন।

কেটি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি। তার মনে হল, আলেকজান্দ্রা বোধহয় ভুল করতে চলেছে। কিন্তু এই সমস্যার একটা সমাধান হওয়া দরকার।

শেষ পর্যন্ত কেটি বলেছিলেন-তোমাদের দুজনকে দেখেই স্বার্থপর বলে মনে হচ্ছে। একদিন তোমাদের মন পালটে যাবে। তোমরা কি ছেলেমেয়ে আনতে চাইছ এই পৃথিবীর বুকে?

পিটার হেসে বললেন –এটা আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, এভাবে আমাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন না। অ্যালেক্স এবং আমি আমাদের মতো জীবন কাটাব। আমাদের সন্তান হলে তাদের ওপর আমি কিছু চাপিয়ে দেব না।

কেটি হাসলেন –আমি কিন্তু সকলের ব্যক্তিগত জীবনে থাবা বসিয়েছি। কারণ আমি হলাম এক বাঘিনী, সকলকে তো বাঘিনীর ইচ্ছা মেনে চলতে হবে।

***

হনিমুনের পর দুমাস কেটে গেছে। কেটি শুনলেন আলেকজান্দ্রা গর্ভবতী, আহা, একটা ছেলে এলে ভালো হয়।

***

ইভ বিছানাতে শুয়েছিল। ররির নগ্ন শরীরটা বাথরুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। হ্যাঁ, অসাধারণ দেহ সৌষ্ঠব আছে ররির। সে রোগা অথচ শক্তিশালী। ইভ তাকিয়ে থাকল। ররির কাছ থেকে আরো অনেক কিছু নিংড়ে নিতে হবে। ইভের সন্দেহ, ররির আরও অনেক শয্যাসঙ্গিনী আছে। কিন্তু এ ব্যাপারটা সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে সে ভয় পায়। হয়তো সম্পর্কটাতে চিড় ধরে যাবে।

ররি বিছানার কাছে এল, সে ইভের সমস্ত শরীরে আঙুল ডগার পরশ রাখল। কিন্তু চোখের তলায় এসে অবাক হয়ে গেল। বলল–বেবি, তোমার চোখে দাগ পড়েছে কেন?

প্রত্যেকটা শব্দ ইভকে আঘাত করছে। হ্যাঁ, তার সঙ্গে ররির বয়সের তফাত আছে। ইভ এখন পঁচিশ বছরে পা রেখেছে। তারা আবার ভালোবাসার খেলা খেলতে শুরু করল। কিন্তু এই প্রথম ইভের মন অন্য কোথাও চলে গেছে।

রাত্রি নটার সময় ইভ বাড়িতে ফিরে এল। কেট ওভেনে রোস্ট রান্না করছেন।

তিনি ইভের ঠোঁটে চুমু দিয়ে বললেন ডিয়ার, তোমার কয়েকটা প্রিয় খাবার রান্না করছি।

–কেট, আমার চোখের তলার কালো দাগ তুলে দিতে হবে।

–কোন দাগ?

ইভ দেখাল –এইগুলো।

–কেন? এগুলোকে বলে হাসির রেখা। এগুলো আমি ভালোবাসি।

–না, আমি ঘেন্না করি।

–তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো ইভ, এগুলো তোমার সৌন্দর্যের পক্ষে অন্তরায় হবে না।

-ভগবানের দোহাই, এগুলোকে তুলে দাও। তুমি তো সহজেই তা করতে পারো।

–হা, কিন্তু, তুমি কি এতে খুশি হরে?

–হ্যাঁ, কবে করবে?

 –আগামী ছমাস পারব না। আমার হাতে অনেকগুলো অপারেশন আছে।

–আমি তোমার পেশেন্ট নই, আমি তোমার বউ। আমি যা বলব, সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে তা করতে হবে। কাল হবে?

–না, কাল শনিবার, ক্লিনিক বন্ধ থাকবে।

–ওটা খুলে ফেলো।

 ইভ আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে চাইছে না।

-ও ঘরে এসো। কেট বললেন।

ড্রেসিংরুম, ইভ একটা চেয়ারের ওপর বসল, উজ্জ্বল আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। উনি সন্তর্পণে পর্যবেক্ষণ করলেন। পরিণত হলেন এক অনুভবী শল্য চিকিৎসকে। হ্যাঁ, এবার ওনার আসল কাজ শুরু হবে। ইভ জানে, এর আগে ওই ডাক্তার কীভাবে তার মুখে অলৌকিক কারুকাজ করেছিল। এই অপারেশনটা হয়তো না করলেও চলত, কিন্তু ইভ কোনোমতেই ররিকে হারাতে চাইছে না।

কেট আলো বন্ধ করে দিয়ে বললেন কোনো সমস্যা নেই। আমি কাল সকালে এটা করে দেব।

***

পরের দিন সকালবেলা, ক্লিনিকে তারা দুজন পৌঁছে গেছে।

কেট বললেন সাধারণত একজন নার্স আমাকে সাহায্য করেন। কিন্তু এটা তো ছোটো কাজ, নার্সের দরকার হবে না।

–তুমি তাড়াতাড়ি করবে কিন্তু।

–হ্যাঁ, আমি তোমাকে কষ্ট দেব না।

ইভ দেখল, কেটের হাতে একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ, তিনি ইনজেকশন দিলেন। সামান্য একটু ব্যথা। ইভের দুটি চোখে ঘুমের আচ্ছন্নতা।

ঘুম ভেঙে গেছে। কেট চেয়ারে বসে আছেন।

-কীভাবে হল?

–খুবই ভালো।

 ইভ মাথা নাড়ল, আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

কেট তখনও বসে ছিলেন। ইভের ঘুম ভেঙে গেছে।

-কদিনের মধ্যেই ব্যান্ডেজ খুলে দেব।

–ঠিক আছে।

 প্রত্যেক দিন কেট এসে পরীক্ষা করেন আর বলেন, তুমি সুস্থ হয়ে উঠছ।

-কবে আমি আমার মুখ দেখব আয়নাতে?

 –শুক্রবার দেখতে পাবে।

ইভ প্রধান নার্সকে ডেকে পাঠাল। প্রাইভেট টেলিফোন বসানো হয়েছে। প্রথম যে ফোনটা এল সেটা ররির।

-হাই বেবি, তুমি এখন কোথায়? আমি তো তোমাকে না পেয়ে অধৈর্য হয়ে উঠেছি।

-আমারও তাই অবস্থা, দেখো না ফ্লোরিডাতে আসতে হয়েছে। কী একটা মেডিকেল কনভেনশন আছে। আসছে সপ্তাহে ফিরে যাব।

-কেমন আছো?

–তোমার কথা মনে পড়ছে।

 ইভ ফিসফিসিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করল তোমার সঙ্গে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে।

-হ্যাঁ, ওর কথা আর বলল না।

 খিলখিলে একটা হাসির শব্দ।

ইভ টেলিফোনটা নামিয়ে রাখল।

আলেকজান্দ্রাকে ফোন করল। আলেকজান্দ্রা তার আসন্ন সন্তান সম্পর্কে খুবই উৎফুল্ল। সে বারবার বলছে, আমি অপেক্ষা করতে পারছি না।

ইভ বলল আমার অনেক দিনের ইচ্ছে, আমি একজন ভালো মাসি হব।

ঠাকুরমার সাথে এখন আর দেখা করতে যায় না ইভ। দুজনের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা বাতাবরণের সৃষ্টি হয়েছে। কেন? ইভ জানে না।

কেট কখনও কেটির কথা জিজ্ঞাসা করেনি। এজন্য ইভ তাকে দোষ দিতে পারে না। একদিন হয়তো ইভ ররির কথা চিন্তা করবে, কেটকে তার জীবন থেকে বিদায় দেবে। ররিকে চিরদিনের জন্য দখল করতে হবে। ররি ছাড়া সে বাঁচবে না।

***

শুক্রবার সকালবেলা। ইভের ঘুম ভেঙে গেছে। সে কেটের জন্য অপেক্ষা করছে। কেট কখন আসবে? হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত কেট এলেন, একটা কাজে আটকে পড়েছিলেন। আয়নাটা আনা হল, ইভ আয়নার দিকে তাকিয়ে ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল।

.

উপসংহার

কেটি–১৯৮২

৩৬.

কেটির মনের হল, সময়ের চাকা অতি দ্রুত পেছন দিকে চলে গিয়েছিল। যেসব দিনগুলো বরাবরের জন্য হারিয়ে গেছে, ক্ষণকালের জন্য তারা জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। আহা, কত সুন্দর শীত সকাল ঝরে গেছে বসন্ত সন্ধ্যায়, গ্রীষ্ম হারিয়ে গেছে শরৎ দিনে। একটার পর একটা ঋতু চলে গেছে তার জীবন থেকে। আশি বছর, আরও কিছু বছর। হ্যাঁ, অনেক সময় তিনি তার আসল বয়সটার কথা ভুলে যান। মুখটা আরও পরিণত হয়ে উঠছে। মনটা প্রাচীন হচ্ছে কি? আয়নাতে মুখ দেখলে কেমন যেন যন্ত্রণা হয়। তিনি আর আয়নায় দেখতে চান না নিজেকে। তবে এখনও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালোবাসেন। সেই গর্বিত ভঙ্গি, আভিজাত্যময় চাউনি।

প্রত্যেক দিন অফিসে যান, ঠিকমতো অফিস করেন, মৃত্যুর কথা ভাবনার মধ্যে আনেন না। বোর্ড মিটিং-এ যোগ দেন। বুঝতে পারছেন, আর বেশি দিন এইভাবে কাজ করতে পারবেন না। আশেপাশে যারা বসে থাকে, তারা অত্যন্ত দ্রুত কথা বলে। কেটি তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারছেন না। অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে একটা সংঘর্ষ ঘটে গেছে। হ্যাঁ, তার জগতটা ক্রমশ আরও ছোটো হয়ে আসছে।

কেটির হাতে একমাত্র জীবনরেখা আছে, একটা প্রচণ্ড উৎসাহ, যা তাকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে। তিনি জানেন, একদিন এই পরিবারের কেউ ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেডের দায়িত্ব নেবে। কেটি এখনও পর্যন্ত জানেন না, কে হবে সেই উত্তরাধিকারী, জেমি ম্যাকগ্রেগর এবং মার্গারেট, তিনি এবং ডেভিড, অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছেন, অনেক বিনিদ্র রাত, ইভ? কেটি তার ওপর অনেক আশা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু ইভ একজন হত্যাকারী। কেটি ভাবলেন, ইভকে হয়তো শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। না, শাস্তি তো অনেক হয়ে গেছে।

***

আয়নায় মুখ দেখে ইভ অবাক হয়ে গেছে। হ্যাঁ, সে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। অনেকটা ঘুমের বড়ি খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু কেট পাম্প করে সব বের করে দিয়েছেন। ভালোবাসা এখন কোথায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু কেন? কেট কি এভাবে প্রতিহিংসা নিয়েছেন?

নার্সরা সবসময় ইভকে ঘিরে রেখেছে। ইভ তার স্বামীর পা ধরে বলেছিল আমাকে মরতে দাও, আমি এইভাবে বেঁচে থাকতে চাই না।

কেট বললেন –এখন তুমি আমার। পৃথিবীর কোনো পুরুষ তোমার মুখের দিকে তাকাবে না।

কিন্তু কেন? কেট এভাবে কেন প্রতিশোধ নিয়েছেন? আলেকজান্দ্রা বারবার ফোন করছে, ইভ তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না। এমন কী সে পৃথিবীর কাউকেই তার এই কুৎসিত মুখখানা দেখাবে না। কেট ছাড়া কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। কেট শেষ পর্যন্ত কাজ শেষ করলেন। হ্যাঁ, ইভকে সারাজীবন এই কুৎসিত মুখচ্ছবি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।

রোজ সকাল পাঁচটার সময় কেটের ঘুম ভেঙে যায়। তাকে হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে যেতে হবে।

ইভ আরও ভোরে ওঠে, ব্রেকফাস্ট তৈরি করে। রোজ রাতে সে ডিনারের জন্য রান্না করে। দেরি হলে বসে থাকে। হ্যাঁ, আমার স্বামী কি অন্য কোনো মেয়ের প্রতি অনুরক্ত? এখনও সে কেন ফিরছে না?

দরজাতে পায়ের শব্দ। সে ছুটে যায়, স্বামীকে আদর করে। অনেকক্ষণ তাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। তারা আগের মতো কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। তবু ইভ ভালোবাসার চেষ্টা করে।

একদিন ইভ বলল– ডার্লিং, তুমি তো আমাকে অনেক শাস্তি দিয়েছ, তুমি কি আবার আমার মুখটা ঠিক করে দেবে না?

কেট তার বউয়ের দিকে তাকিয়ে গর্বিত কণ্ঠস্বরে বলেছিলেন, না সোনা, তোমার মুখটা আর ঠিক করা যাবে না।

***

সময় কেটে যাচ্ছে। কেট আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। শেষ পর্যন্ত ইভ তার ক্রীতদাসীতে পরিণত হল। এখন সবকিছুই কেটের ইচ্ছানুসারে পরিচালিত হচ্ছে। হ্যাঁ, এই কুৎসিত মুখ ইভকে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি রেখেছে।

***

আলেকজান্দ্রা এবং পিটারের একটা ছেলে হয়েছে, রবার্ট- ঝকঝকে চেহারার একটি শিশু। কেটির মনে পড়ে গেল টনির কথা। রবার্টের বয়স আট বছর, যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে। কেটি ভাবলেন, হ্যাঁ, এই ছেলেটির ওপর নির্ভর করা যায়।

***

পরিবারের সদস্যরা ওই আমন্ত্রণ লিপি পেয়েছিল একই দিনে, লেখা ছিল শ্রীমতী কেটি ব্ল্যাকওয়েল, তাঁর নব্বইতম জন্মদিন পালন করবেন, সিডারহিল হাউস, ডাকহারবারে, আপনি সবান্ধবে সপরিবারে এই অনুষ্ঠানে আসবেন। ১৯৮২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, রাত ৮টায়।

কেট এই আমন্ত্রণ পত্র পেয়ে ইভের দিকে তাকিয়ে বললেন –আমরা যাব।

-না, আমি যাব না। তুমি একা যাও।

–না, তোমাকে যেতে হবে।

***

টনি ব্ল্যাকওয়েল তার স্যানাটেরিয়ামের বাগানে বসেছিল। আপন মনে ছবি আঁকছিল। একজন এসে বলল–টনি, আপনার চিঠি।

টনি চিঠিটা খুলল, ঠোঁটে একটা অদ্ভুত হাসি আহা, বার্থডে পার্টিতে যেতে আমার ভালোই লাগে।

***

পিটার টেমপ্লেটন এই চিঠিটা পড়ে বললেন কী আশ্চর্য, নব্বই বছর বয়স হয়ে গেল।

-হ্যাঁ, আলেকজান্দ্রা বলল।

তারা ভাবল, ছোট্ট রবার্ট একটা আমন্ত্রণ পত্র পেয়েছে।

.

৩৭.

অতিথিদের যাবার সময় হয়েছে। কেউ ফেরিতে গেলেন, কেউ এরোপ্লেনে, যাবার আগে তারা সকলে সিডারহিলের লাইব্রেরিতে এসেছিলেন। কেটি চারদিকে তাকালেন, আহা, প্রত্যেকে, এই টনি, মুখে হাসি ছিল তার, এখন তাকে মনে হচ্ছে সে বুঝি অন্য জগতের বাসিন্দা। আমার সন্তান, আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। তার ওপর আমি এতখানি নির্ভর করেছিলাম। সে আমার সব স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়েছে।

ওই তো ইভ, সে এক হত্যাকারী। পৃথিবীটা তার পায়ের তলায় থাকত, যদি সে একটু ভালো হত।

কেটি ভাবলেন, অনেক কষ্ট সে পেয়েছে। আহা, আলেকজান্দ্রা, অসাধারণ রূপবতী, শান্ত স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু? আলেকজান্দ্রা কখনও কোম্পানিকে বড়ো করে দেখেনি। ক্রুগার ব্রেন্ট সম্পর্কে তার সামান্যতম আগ্রহ নেই। এমন একটা লোককে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছে, যে কোম্পানির ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চায় না।

এরা দুজনেই বিশ্বাসঘাতিকা। হ্যাঁ, এদের কাউকে আমি বিশ্বাস করব না।

কেটি ভাবলেন, আমি সব কিছু ধ্বংস করব। আমি একটা বিরাট সাম্রাজ্য তৈরি করেছি। কেপটাউনে আমার নামে একটা হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছে। বান্দার মতো লোকেরা যাতে পড়াশোনা করতে পারে, তার জন্য আমি স্কুল তৈরি করেছি। লাইব্রেরি স্থাপন করেছি।

এই ঘরে যারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কতগুলি ভৌতিক অবয়ব। জেমি ম্যাকগ্রেগর এবং মার্গারেট, বান্দা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ডেভিড, আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। কেটি মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, কবে আমি তোমাদের কাছে যাব?

***

ঘরে কে একজন চলে এসেছে। কেটি তাকালেন, আহা, নাতনির ছেলে।

 কেটি বললেন –এসো।

রবার্ট চলে এসেছে।

 রবার্ট বলল–দিদা, তোমার জন্মদিনের পার্টিটা দারুণ হয়েছে। তাই না?

-ধন্যবাদ রবার্ট, তোমার ভালো লেগেছে? স্কুল কেমন লাগে?

–আমার স্কুল ভালো লাগে। আমি আমার ক্লাসে হেড বয়।

কেটি তাকালেন পিটারের দিকে– রবার্টকে ওয়াটের স্কুলে পাঠালে কেমন হয়? এটাই কিন্তু সব থেকে ভালো স্কুল।

পিটার হাসলেন– ঈশ্বরের দোহাই কেটি, রবার্ট যা ভালো মনে করে তাই করবে। গানের প্রতি ওর দারুণ আকর্ষণ আছে। ও একজন ক্লাসিক্যাল মিউজিসিয়ান হতে চায়। জীবনটা ও নিজের মতো কাটাবে।

কেটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন– তুমি ঠিকই বলেছ। আমার অনেক বয়স হয়েছে। আমি এখানে নাক গলাতে চাইছি না। যদি ও গান শিখতে চায়, তাই শিখতে দিও।

উনি রবার্টের দিকে তাকিয়ে বললেন– রবার্ট, আমি কি তোমাকে একটু সাহায্য করব? আমি একজনকে জানি যে জুবিন মেহেটার কাছের বন্ধু।