৫. বিয়ের পর ছমাস

২১.

বিয়ের পর ছমাস কেটে গেছে। হপম্যান কোম্পানির সাথে ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেডের সংযুক্তিকরণ শেষ হয়েছে। ফ্রেডরিক হপম্যানের ওপর আরও বেশি কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। টনি অবাক হয়ে গেছে, শেষ পর্যন্ত মা এ বিয়েটা মানল কী করে?

প্রথম থেকেই বিয়েটা অসাধারণ সফলতার দিকে এগিয়ে চলেছে। মারিয়ানা এবং টনি –একে অন্যকে পাগলের মতো ভালোবাসছে।

যখন টনি ব্যবসার কাজে বাইরে যায়, মারিয়ানা তার সঙ্গে থাকে। তারা একসঙ্গে খেলা করে, একসঙ্গে আনন্দ করে, প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করার চেষ্টা করে। টনি ভাবে, আহা, জীবন এত সুন্দর!

টনি এবং মায়ের মধ্যে যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছিল, মারিয়ানা সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে। তাই সময়টা এখন তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে।

শেষ পর্যন্ত কেটি এবং মারিয়ানার মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে টেলিফোনে তারা অনেকবার কথা বলে। সপ্তাহে অন্তত একবার লাঞ্চের আসরে চলে যায়।

একবার মারিয়ানা একটু অসুস্থ হয়ে পড়ল। সে কেটিকে বলল –ডাবল হুইস্কি দিতে হবে।

মারিয়ানা কিন্তু শুধুমাত্র ওয়াইন ছাড়া আর কিছুই খায় না।

কেটি জানতে চাইলেন মারিয়ানা কী হয়েছে?

ডাক্তার হার্টলের সঙ্গে দেখা করে এলাম।

 কেটির মনে আশঙ্কা–কেন?

-না, এমনি…।

 মনে হল মারিয়ানা কিছু একটা বলতে চাইছে না।

কয়েকদিন আগেই ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল। কিন্তু কেন?

***

ডঃ হার্টলে বললেন মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, তোমার বয়স কত?

–তেইশ।

–তোমার পরিবারের কারও হার্টের অসুখ আছে?

–না।

–ক্যানসার?

–না।

–তোমার মা বাবা বেঁচে আছেন?

–বাবা বেঁচে আছেন, মা মোটর অ্যাকসিডেন্টে মারা যান।

–তোমার কখনও মামস হয়েছে?

–না।

–হাম?

–হ্যাঁ, দশ বছর বয়সে।

–হুপিং কাশি?

–না।

–শরীরে কোনো কাটাছেঁড়া। টনসিল?

–তখন আমার নবছর বয়স।

 –অন্য কোনো কারণের জন্য তোমায় কি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল?

–হ্যাঁ।

কবে?

-আমি তখন মেয়েদের হকি টিমে ছিলাম। একবার একটা খেলা খেলতে খেলতে আমি। চোখে অন্ধকার দেখি। হাসপাতালে গিয়ে আমার চোখ খুলে যায়, আমি সেখানে দুদিন ছিলাম।

–ওই খেলার সময় তোমার দেহে কোথাও আঘাত লেগেছিল?

–না, আমার চোখ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।

–তখন তোমার কত বয়স?

–ষোলো।

 জন হাটলে মারিয়ানার দিকে তাকিয়ে বললেন সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন কোথাও কি ব্যথা লাগে?

মারিয়ানা একটু ভেবে বলল –হ্যাঁ, ডানদিকে। কয়েকদিন ব্যথাটা থাকে।

-মাথা ব্যথা করে? চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়?

—হ্যাঁ, কিন্তু এখন সেই ঝামেলা চলে গেছে। ডঃ, হার্টলে আমার কি কিছু হয়েছে?

–আর কয়েকটা টেস্ট করতে হবে।

কী ধরনের টেস্ট?

–সেরিব্রাল অ্যানজিওস্কম, কিন্তু তুমি এমন কিছু ভেবো না।

 তিনদিন কেটে গেছে। মারিয়ানা ডঃ হার্টলের কাছ থেকে একটা ফোন পেয়েছে। এখুনি তাকে ওখানে যেতে হবে।

ডঃ হার্টলে বললেন তোমার সমস্যা সমাধান হয়েছে।

–কিছু খারাপ?

-না, পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে তোমার একটা ছোট্ট স্ট্রোক হয়েছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা খুবই সাধারণ। বিশেষ করে অল্প বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে। এর জন্য চিন্তা করার কিছু নেই।

মারিয়ানা অবাক হয়ে গেছে। তার মানে? এটা কি আবার হতে পারে?

-না, তুমি এখন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে।

 –আমি আর টনি মাঝে মধ্যে ঘোড়ায় চড়ি। টেনিস খেলি। তা হবে তো?

-হ্যাঁ, বেশি কিছু করার চেষ্টা করো না? টেনিস খেলা থেকে যৌনতার আসরে চলে যেও। কোনো সমস্যা নেই।

মারিয়ানা উঠে দাঁড়াল। জন হার্টলে বললেন মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, যদি সন্তানের মা হবার কথা ভেবে থাকো, কোনো ছেলেকে দত্তক নিলেই ভালো হয়।

মারিয়ানা অবাক হয়ে গেছে –এই যে আপনি বললেন, আমি পুরোপুরি স্বাভাবিক।

-হ্যাঁ, কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। গর্ভাবস্থা হলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা হতে পারে, কারণ গর্ভকালীন শেষ ছ থেকে আট সপ্তাহ খুব ভয়ংকর। তখন ব্লাডপ্রেশারের চাপ বেড়ে যায়।

মারিয়ানা আর কথা বলতে পারছে না। টনির শব্দ তার কানে ভাসছে তোমার কোলে আমি একটা সন্তান উপহার দেব, মারিয়ানা তোমার মতো সুন্দর এক জলপরি।

মারিয়ানা কেটিকে বলল আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি ডাক্তারের চেম্বার-থেকে সোজা আপনার কাছে ছুটে এসেছি।

কেটি জানেন তাকে এখন এই যন্ত্রণাটা কীভাবে সহ্য করতে হবে।

তিনি বললেন ঠিক আছে আমি দেখছি, অত চিন্তা করার কিছু নেই।

–কেটি, টনি এবং আমি সন্তানের জন্য পাগল হয়ে উঠেছি।

-মারিয়ানা, ডঃ হার্টলের কথা মনে রাখতে হবে। কয়েক বছর আগে তোমার একটা ছোট্ট সমস্যা হয়েছে। অত ভাবছ কেন?

শেষ পর্যন্ত কেটি বললেন টনিকে এই খবরটা দিও না কিন্তু।

কেটি মনে মনে ভাবলেন, ডঃ জন হার্টলেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। যাতে এই খবরটা টনির কানে কোনো মতেই না পৌঁছোয়।

***

তিনমাস কেটে গেছে। মারিয়ানা এখন গর্ভবর্তী, টনির মনে আকাশ ছোঁয়া আনন্দ। ডঃ জন হার্টলে অবাক হয়ে গেছেন।

তিনি মারিয়ানাকে বললেন আমি এখনই গর্ভপাতের ব্যবস্থা করছি।

-না, ডঃ হার্টলি, সন্তানটা আমার চাই।

মারিয়ানা কেটিকে গিয়ে সব কথা খুলে বলল, কেটি জন হার্টলের অফিসে গিয়ে বললেন–আমার পুত্রবধূকে অ্যাবরশনের কথা কেন বলেছেন?

–কেটি, আমার মনে হচ্ছে, এই ছেলেটার জন্ম দিলে ও হয়তো বেঁচে থাকবে না।

–না, আপনি কিছু জানেন না, এভাবে ওকে ভয় দেখাবেন না।

***

আটমাস পরবর্তী ঘটনা, ফেব্রুয়ারির সকাল চারটে, মারিয়ানার প্রসব যন্ত্রণা উঠেছে, তার আর্তনাদ টনিকে ভাবিয়ে তুলেছে।

টনি বলল– চিন্তা করো না ডার্লিং, আমি এখনই তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।

 মারিয়ানা ভাবল, ডঃ হার্টলের কথাটা হয়তো টনিকে বলা উচিত ছিল।

মারিয়ানা এবং টনি হাসপাতালে পৌঁছে গেল। সব কাজই অত্যন্ত দ্রুত করা হচ্ছে। টনি ওয়েটিং রুমে বসে আছে। মারিয়ানাকে পরীক্ষার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল।

এখনই অপারেশন করতে হবে।   

***

হাসপাতাল করিডরে সিজারের মেশিন। একটা শব্দ শোনা গেল। আরে এই তো লেমান!

টনি তাকাল, হ্যাঁ, এই ভদ্রলোককে সে ডোমিনিকের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এ দেখেছিল। এর নাম হচ্ছে বেন। সেই লোকটনির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। হিংসা অথবা প্রতিহিংসা? ডোমিনিক কিছু বলেছে?

একটু বাদেই ডোমিনিক সেখানে এসে হাজির হল। ডোমিনিক বেনকে বলল মেয়েটি এখন ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে। সে টনিকে দেখে অবাক হয়ে গেল।

টনি, তুমি এখানে কী করছ?

–আমার স্ত্রী সন্তান প্রসব করছে।

–তোমার মা কী ব্যবস্থা করেছে? বেন জানতে চাইল।

–তুমি কী বলতে চাইছ?

ডোমিনিক আমাকে সব কিছু বলেছে তুমি তো মায়ের হাতের থোকা।

-বেন, আর কথা বলো না।

–কেন সত্যিটা বললে রাগ করো নাকি?

টনি ডোমিনিকের দিকে তাকিয়ে বলল –এ কী বলছে?

–কিছুই না। বেন, চলল, আমরা এখান থেকে চলে যাই।

 বেন কিন্তু ব্যাপারটায় মজা পাচ্ছিল দুধ খাওয়া খোকা? তুমি সুন্দরী মডেলদের সাথে শোবে? তোমার মা তোমার জন্য কী নিয়ে আসবে। তুমি প্যারিসে ছবির প্রদর্শনী করবে, তোমার মা ব্যবস্থা করবে।

সীমা ছাড়িয়ে যেও না বেন।

 –আমি ছাড়াচ্ছি কি? ও কী জানে?

 টনি জিজ্ঞাসা করল–আমার মা প্যারিসে এগজিবিশনের ব্যবস্থা করেছিল, সত্যি?

ডোমিনিক বলল–আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না।

–তার মানে? তোমরা জর্জকে টাকা দিয়েছিলে আমার ছবির প্রদর্শনের জন্য?

–টনি, জর্জ তোমার ছবিগুলো সত্যিই ভালোবাসতেন।

–ওই আর্টফিটিং এর কথাটা বলবে নাকি?

–অনেক হয়েছে বেন। ডোমিনিক যাবার চেষ্টা করছিল।

টনি তার হাতে হাত রেখে বলল–হ্যাঁ, কী হয়েছে বলো? মা কি ওনাকেও টাকা দিয়েছিল?

-হ্যাঁ, ডোমিনিকের শব্দ এবার কমে গেছে। ফিসফিসানি কণ্ঠস্বর।

কিন্তু উনি যে আমার ছবিগুলোকে ঘেন্না করলেন?

-না টনি, উনি তোমার ছবিগুলোকে কখনওই খারাপ বলেননি। উনি তোমার মাকে বলেছিলেন যে, ভবিষ্যতে তুমি এক মস্ত বড় আর্টিস্ট হবে।

অবিশ্বাস্য। আমার মা ভদ্রলোককে পয়সা দিয়েছিলেন আমাকে ধ্বংস করার জন্য।

-না, তোমাকে ধ্বংস করার জন্য নয়, ওনার মতে ছবি এঁকে কেউ বড়ো হতে পারে না।

পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেছে। তার মানে? আমি আমার নিজের জীবনের পথে চলতে পারব না।

তখন অপারেটিং রুমে ডাক্তাররা মারিয়ানার জীবনকে বাঁচাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। রক্তচাপ খুব নেমে গেছে। হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত। তাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। রক্ত সংবহন চলেছে। কিন্তু কোনো কিছুই কাজ করছে না। সেরিব্রাল হেমারেজ শুরু হয়ে গেছে।

দুটো যমজ কন্যার জন্ম হয়েছে।

***

ডাক্তার ম্যাটসান টনির কাছে খবরটা দিলেন।–আপনি আনন্দ করুন। দুটি কন্যার জনক হয়েছেন।

টনি জিজ্ঞাসা করল–মারিয়ানা? সে ভালো আছে?

ডাক্তার ম্যাটসান বললেন না, আমরা দুঃখিত। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে…

-কী হয়েছে? একটা আর্তনাদ। না, আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। ও মরে যেতে পারে না।

মি. ব্ল্যাকওয়েল, মারিয়ানা মারা গেছে।

 –ও কোথায়? আমি ওকে দেখব।

–এখন যেতে পারবেন না।

–তোমরা …তোমরা আমার বউকে মেরে ফেলেছ। তোমরা ওকে হত্যা করেছ।

টনি ডাক্তারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করল। দু জন ছুটে এসে টনিকে সরিয়ে নিল।

–মি. ব্ল্যাকওয়েল, ব্যাপারটা ভালোভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করুন।

টনি উন্মাদের মতো চিৎকার করে বলছে আমি আমার বউকে দেখব।

 ডঃ জন হার্টলে এসে গেছেন ওকে যেতে দাও। আমাদের একা থাকতে দাও।

ডঃ ম্যাটসান এবং অন্যান্যরা চলে গেলেন। টনি বাচ্চা ছেলের মতো কান্নাকাটি করছে।

–জন, ওরা মারিয়ানাকে মেরে ফেলেছে।

–হ্যাঁ, টনি, আমি দুঃখিত। কেউ তাকে মারেনি। কয়েক মাস আগে আমি বলেছিলাম, মারিয়ানার পক্ষে মা হওয়া সম্ভব নয়।

অনেকক্ষণ বাদে টনি বলল আপনি কী বলছেন?

–মারিয়ানা তোমাকে বলেনি? তোমার মা কিছু বলেনি?

টনি আবার তাকাল আমার মা?

-হ্যাঁ, উনি ভেবেছিলেন। আমি বোধহয় মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছি। উনি মারিয়ানাকে অভয় দিয়েছিলেন। আমি দুঃখিত টনি, আমি বাচ্চা দুটোকে দেখেছি, ভারী সুন্দর।

টনি সেখান থেকে চলে গেল।

***

কেটির বাটলার দরজাটা খুলে দিল, টনির জন্য।

–গুড মর্নিং, মি. ব্ল্যাকওয়েল।

–গুড মর্নিং, লেস্টার।

 বাটলার টনির দিকে তাকিয়ে আছে সব কিছু ঠিক আছে তো স্যার?

টনি কী বলবে বুঝতে পারছে না। তারপর বলল এক কাপ কফি হবে লেস্টার?

 টনি দেখল বাটলার কিচেনের দিকে চলে গেল।

হা, টনি ট্রফি রুমে ঢুকে পড়েছে। সে ক্যাবিনেটের কাছে গেল। সেখানে অনেকগুলো বন্দুক সাজানো আছে। সে তাকিয়ে থাকল। ক্যাবিনেটটা খোলো, কে যেন বলল।

সে ক্যাবিনেটটা খুলল। একটা রিভলবার বের করল। ব্যারল দেখে নিল। হ্যাঁ, লোড করা আছে।

ওপরে চলে যাও, টনি!

টনি সিঁড়িতে পা ফেলে ফেলে ওপরের দিকে যাচ্ছে। সে জানে, এটা হয়তো তার মায়ের কুফল। কিন্তু, এখনই শেষ করতে হবে। কেটি তার জীবনে এমনভাবে বাধার সৃষ্টি করবে, না, এই ঘটনাটা ঘটলে কোম্পানিটা মরে যাবে।

টনি কেটির বেডরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

কে যেন তাকে বলছে এখনই দরজাটা খুলতে হবে।

 টনি দরজাটা খুলল–কেটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

–টনি কী হয়েছে?

টনি সাবধানে রিভলবারটা তুলে ধরল। তারপর ট্রিগারে হাত দিল।

.

২২.

বাইশ যমজ মেয়ে দুটিকে দেখে সকলেই অবাক হয়ে গেছে। আহা, এমন সুন্দর চেহারা। ডাক্তাররা তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন অবাক চোখে।

গত কয়েক দিন খুব খারাপ অবস্থায় কেটে গেছে। জন হার্টলে এই দিনগুলোর কথা কখনওই ভুলতে পারবেন না। যখন তিনি কেটি ব্ল্যাকওয়েলের বেডরুমে পৌঁছোলেন, চারপাশ থমথম করছে। বাটলারের কাছ থেকে একটা ফোন পেয়েছেন। কেটি মেঝের ওপর শুয়ে আছেন। কোমা অবস্থায় চলে গেছেন। দুটো বুলেটের চিহ্ন। রক্ত ছুটে আসছে। টনি ক্লোসেটের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের জামাকাপড়গুলো কাঁচি দিয়ে কেটে দিচ্ছে।

ডাঃ হার্টলে কেটির দিকে তাকালেন, অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করলেন। পালস বোঝার চেষ্টা করলেন। খুবই দুর্বল, মুখটা নীল হয়ে গেছে। ইনজেকশন দেওয়া হল।

ডঃ হার্টলি জিজ্ঞাসা করলেন–কী হয়েছে?

বাটলার বলল–আমি কিছুই জানি না স্যার। মি. ব্ল্যাকওয়েল আমাকে বললেন, কফি তৈরি করতে। আমি কিচেনে ছিলাম। বুলেটের শব্দ পেয়ে ছুটে এলাম। দেখি মিসেস ব্ল্যাকওয়েল মেঝেতে পড়ে আছেন। মি. ব্ল্যাকওয়েল বলছেন, মা, তোমাকে আর কষ্ট দেব না। আমি তোমাকে মেরে ফেলতে চাই। তারপর উনি ক্লোসেটের কাছে গিয়ে পোশাকগুলো ছিঁড়তে শুরু করেছেন।

-টনি, তুমি কী করছ?

–আমি মাকে সাহায্য করছি। আমি কোম্পানিটা ধ্বংস করব। মারিয়ানাকে ওরা মেরে ফেলেছে, আপনি সবই জানেন।

কেটিকে এমারজেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হল। তাকে রক্ত দেওয়া হল। বুলেট বের করা হল।

তিনজন নার্স টনিকে একটা অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়েছে। ডাঃ হার্টলি টনিকে ইনজেকশন দিলেন। টনি শান্ত হল। অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। ডঃ হার্টলির ফোন পেয়ে ব্রাড রজারস ছুটে এসেছে।

ডঃ হার্টলে কেটির সঙ্গে কথা বলতে গেছেন

জ্ঞান ফিরে পেয়ে কেটি প্রথমেই বললেন আমার ছেলে কোথায়?

–কেটি, চিন্তা করবেন না। তার দায়িত্ব আমরা নেব।

 টনিকে একটা প্রাইভেট স্যানিটোরিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

–জন, সে আমাকে মারতে চাইছে কেন?

–মারিয়ানার মৃত্যুর জন্য সে আপনাকে দায়ী করেছে।

–এটা পাগলামি।

 জন, হার্টলে কোনো কথা বললেন না।

ডঃ হার্টলে চলে যাবার পর কেটি অনেকক্ষণ শুয়ে ছিলেন এই শব্দগুলো বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি মারিয়ানাকে খুবই ভালোবাসেন। কারণ মারিয়ানা টনিকে সুখী করেছে। টনি, আমি তোমার জন্য সব কিছু করেছি। আর তুমি কিনা আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করলে। হ্যাঁ, আমি তো মরতে চাই না। কিন্তু? আমি বাঁচব কী করে!

শেষ পর্যন্ত কেটি ভাবলেন, এটা আমাকে সহ্য করতেই হবে। আমি আবার উঠে দাঁড়াব, কোম্পানি আবার নতুন জীবন ফিরে পাবে।

.

পঞ্চম খণ্ড

 ইভ ও আলেকজান্দ্রা
১৯৫০-১৯৭৫

২৩.

ডাকহারবারের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ কেটিকে ধীরে ধীরে সারিয়ে তুলল।

টনিকে এখন একটা ব্যক্তিগত অ্যাসাইলামে রাখা হয়েছে। সেখানে তাকে নানাভাবে পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে। কেটি প্যারিস থেকে মনোবিশারদদের উড়িয়ে নিয়ে এসেছেন। ভিয়েনা এবং বার্লিন থেকেও অনেককে আনা হয়েছে। তারা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ করেছেন, এখন চলেছে নিরাময়ের পালা।

.

ফ্রেডরিক হপম্যান তার দুই নাতনিকে নিয়ে খুবই খুশি। তিনি বললেন- আমি মেয়ে দুটিকে আমার সঙ্গে জার্মানিতে নিয়ে যাব।

মারিয়ানার মৃত্যুর খবর তার বয়স অন্তত কুড়ি বছর বাড়িয়ে দিয়েছে, কেটির মনে হল। ভদ্রলোককে দেখলে কেটির মন কেঁপে ওঠে। না, টনির শিশুকন্যাদের তিনি কিছুতেই ছেড়ে দেবেন না।

তিনি বললেন- ফ্রেডরিক, একজন মহিলা ছাড়া এদের দেখাশুনো করবে? মারিয়ানা নিশ্চয়ই চেয়েছিল, এই মেয়ে দুটি এখানেই বড়ো হোক। আপনি ইচ্ছে মতো এসে ওদের সাথে দেখা করে যাবেন।

শেষ পর্যন্ত ফ্রেডরিক এই মতটা মেনে নিতে বাধ্য হলেন।

***

কেটির বাড়িতে যমজ কন্যাদের নিয়ে আসা হল। তাদের জন্য একটা সুন্দর নার্সারি অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করা হল। এক তরুণী ফরাসি ভদ্রমহিলাকে রাখা হল গর্ভনেস হিসেবে। মেয়েটির নাম সোলঞ্জ ডুনাস।

আগে যে মেয়েটির জন্ম হয়েছিল তার নাম রাখা হল ইভ, পরেরটির নাম দেওয়া হল আলেকজান্দ্রা। তাদের দেখতে একেবারে একরকম। আলাদা করার সামান্যতম উপায় নেই।

কেটি এখন অনেকটা সময় নাতনিদের মধ্যে কাটাতে ভালোবাসেন। আবার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন তিনি। একদিন ব্যবসার জগৎ থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেবেন। তখন এই দুই কন্যার হাতেই বিরাট সাম্রাজ্যের ভার অর্পণ করতে হবে।

***

যমজ কন্যার প্রথম জন্মদিন। কেটি একটা সুন্দর পার্টি দিয়েছিলেন। একই রকম দেখতে দুটো বার্থডে কেক আনা হল। বন্ধুরা অনেক উপহার এনেছেন। এবার দ্বিতীয় জন্মদিন এসে গেল। কেটি বুঝতেই পারছেন না, কী দ্রুত সময় কেটে যাচ্ছে।

দেখতে দেখতে মেয়ে দুটির বয়স হল পাঁচ বছর।

ইভ তার বোনকে হত্যা করার চেষ্টা করল। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। সব ব্যাপারে ইভ দিদিগিরি ফলাবার চেষ্টা করে।

প্রথম থেকেই আলেকজান্দ্রাকে সে যথেষ্ট ঘেন্না করে। পৃথিবীর সব সুখ সে তার মুঠো বন্ধ করবে, এমন একটা অদম্য বাসনা জেগেছে তার মনের মধ্যে। কিন্তু কেন? রাতের বেলা সোলাঞ্জ দুই কন্যকে যথেষ্ট দেখাশোনা করে। দুজন চিৎকার করে প্রার্থনা করে। এবার ইভ চোখ বন্ধ করে কিছু বলার চেষ্টা করে। তার মনে একটাই বাসনা, ঈশ্বর যেন আলেকজান্দ্রাকে মেরে ফেলে। শেষ অব্দি ইভের এই ইচ্ছেটা ঈশ্বর পূরণ করলেন না। ইভ চিন্তা করল সে, আলেকজান্দ্রাকে মেরে ফেলবে।

কদিন বাদেই পাঁচ বছরের শুভ জন্মদিনের অনুষ্ঠান হবে। ইভ কিছুতেই আলেকজান্দ্রার সাথে আর একটা আলে ঝলমল পার্টিতে উপস্থিত হতে পারবে না। হ্যাঁ, সমস্ত উপহার আমার। বন্ধুবান্ধবরা শুধু আমার সঙ্গেই গল্প করবে।

***

আগামী কাল জন্মদিন। ইভ বিছানাতে শুয়ে আছে, জেগে আছে। বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে আলেকজান্দ্রার কাছে চলে গেল।

সে বলল- আলেক্স, চল আমরা কিচেনে যাব। জন্মদিনের কেকগুলো দেখব।

আলেকজান্দ্রার চোখে ঘুম– সকলে ঘুমিয়ে আছে।

–আমরা কারও ঘুম ভাঙাব না।

–ডুনাস জেগে উঠলে রাগ করবে। সকালেই তো কেকগুলো দেখব।

না, আমি এখন সেগুলো দেখব। তুই কি আমার সঙ্গে আসবি, নাকি আসবি না?

আলেকজান্দ্রা চোখ রগড়ে ঘুম তাড়িয়ে নিল। এখন জন্মদিনের কেক দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। কিন্তু দিদির ডাক সে না শুনে থাকবে কী করে?

সে বলল– আমি আসছি।

 আলেকজান্দ্রা বিছানা থেকে নামল। চটি পরল। দুজনেরই পরনে গোলাপি নাইলনের নাইট গাউন।

ইভ বলল– কোনো শব্দ করবি না।

তারা বেডরুমের সামনে চলে এল। লম্বা করিডর পার হল। পাশেই ডুনাসের বেডরুম। ধীরে ধীরে সিঁড়িতে গিয়ে পা রাখল। বিরাট কিচেন। দুটো বড়ো বড়ো গ্যাস স্টোভ। ছটা ওভেন। তিনটে রেফ্রিজারেটর। আর একটা চলমান ফ্রিজার।

রেফ্রিজারেটরের মধ্যে ইভ জন্মদিনের কেকগুলো দেখতে পেল। একটাতে লেখা আছে শুভ জন্মদিন আলেকজান্দ্রা, আর একটাতে লেখা আছে শুভ জন্মদিন ইভ।

আগামী বছর থেকে এখানে একটা মাত্র কেক থাকবে।

ইভ আলেকজান্দ্রার কেকটা রেফ্রিজারেটর থেকে বার করল। সেটাকে টেবিলের ওপর রেখে মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিল। তারপর বলল- আমি দেখব মোমের আলোয় কেকটা কেমন দেখায়।

না-না, এটা কখনও করিস না। কেকটা নষ্ট হয়ে যাবে। মিসেস টাইলার রাগ করবে।

-না, উনি কিছু মনে করবেন না। ইভ আর একটা ড্রয়ার খুলল। এবার দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালতে হবে।

–আমি বিছানায় চলে যাচ্ছি।

–ঠিক আছে যা, আমি একাই পারব।

 –আমায় কী করতে হবে?

–তুই মোমবাতিগুলো জ্বেলে দে।

আলেকজান্দ্রা ভয় পেয়েছে– আগুন লাগতে পারে। বারবার ওদের বলা হয়েছে, কখনওই দেশলাই কাঠি নিয়ে না খেলতে। তারা জানে, যেসব ছেলেমেয়েরা এই আদেশ না মানে, তাদের কী হয়। কিন্তু আলেকজান্দ্রাকে এ কাজ করতেই হবে। ইভ তাকিয়ে থাকল, তুই এদিকটা জ্বালা।

আলেকজান্দ্রা মোমের ওপর ঝুঁকে দাঁড়াল, ইভের দিকে পেছন ফেরা। হঠাৎ ইভ একটা দেশলাই জ্বালিয়ে দিল। একটা কাঠি সে হাতের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল। আগুন জ্বলে উঠল। ইভ আগুনের টুকরোটা আলেকজান্দ্রার পায়ে ফেলে দিল। আলেকজান্দ্রা বুঝতে পারল, কী ঘটতে চলেছে। সে চিৎকার করল- হেল্প! হেল্প!

ইভ তাকিয়ে আছে জ্বলন্ত নাইট গাউনের দিকে। হ্যাঁ, জিতে গেছে সে, আলেকজান্দ্রার সমস্ত শরীরটা পুড়তে শুরু করেছে।

ইভ বলল- দাঁড়িয়ে থাক। আমি বালতি করে জল আনছি, সে প্যান্ট্রিতে চলে গেল। আনন্দে তার মন তখন আকাশ ছুঁয়েছে।

***

এক হরর ছবি আলেকজান্দ্রার জীবন বাঁচিয়ে দিল। ব্ল্যাকওয়েলের রাঁধুনির নাম মিসেস টাইলার। সে এক পুলিশ সার্জেন্টের রক্ষিতা। মাঝে মধ্যেই তার সঙ্গে শয্যা ভাগ করে। সেই রাতে সে একটা মোশন পিকচার দেখতে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে তার প্রেমিককে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি অব্দি এল।

এক ঘন্টা আগেই তারা পৌঁছে গেছে। টাইলার পেছন দিকের দরজাটা খুলে দিয়েছে। আলেকজান্দ্রার আর্তনাদ তার কানে প্রবেশ করল। টাইলার এবং সার্জেন্ট ডগারথি তাড়াতাড়ি কিচেনে ঢুকে পড়ল।

এ কী? সার্জেন্ট আলেকজান্দ্রাকে বাঁচাবার চেষ্টা করলেন। নাইট গাউনটাতে আগুন জ্বলে গেছে। হ্যাঁ, শরীরের অনেকটা পুড়ে গেছে। কিন্তু এখনও আগুন চুল স্পর্শ করতে পারেনি। আলেকজান্দ্রা অচেতন হয়ে মেঝের ওপর পড়ে আছে। টাইলার জল ঢেলে আগুন শিখা নিভিয়ে দিলেন। তখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

সার্জেন্ট ডগারথি বললেন–এখনই একটা অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। মিসেস ব্ল্যাকওয়েল কি বাড়িতে আছেন?

-হ্যাঁ, উনি ওপরে ঘুমোচ্ছন।

 –ওনাকে এখনই ডাকতে হবে।

মিসেস টাইলার অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করল। প্যান্ট্রি থেকে বাটলারের চিৎকার ভেসে এল– ইভ কাঁদছে এবং তার হাতে জলের পাত্র।

–আলেকজান্দ্রা কি মরে গেছে? ইভ জানতে চাইল মরে গেছে?

 মিসেস টাইলার ইভকে আদর করে বলল– না, সে ঠিক আছে। সে আবার ভালো হয়ে যাবে।

–এটা আমার ত্রুটি, ইভ কাঁদতে কাঁদতে বলল। সে আলো জ্বালাতে চেয়েছিল। আমি তাকে একাজ করতে কেন দিলাম?

***

আলেকজান্দ্রার শরীরটা ভালোভাবেই পুড়ে গেছে। ডঃ হার্টলে কেটিকে বলেছিলেন। হয়তো এ যাত্রায় ও বেঁচে যাবে। এখন পোড়ার যন্ত্রণা অনেক উপশম হয়ে যায়।

কেটি অবাক হলেন- কী করে ঘটনাটা ঘটল? তিনি ভাবলেন, ইভের দিকে আরও নজর দিতে হবে।

ইভের কিছু হয়েছে?

-না, এই মেয়েটা নিজেকে দোষারোপ করতে চাইছে। সে এখন থেকে দুঃস্বপ্ন দেখবে। কেন এই ঘটনা ঘটল বলুন তো? ইভ খুব আবেদনি।

ছোটো ছেলেমেয়েরা এমনই করে থাকে। কোনো সমস্যা হলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। কেমন?

***

ইভ একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা বাতিল করে দেওয়া হল। ইভ ভাবল, আমি আরও একবার আলেকজান্দ্রার কাছে হেরে গেলাম।

আলেকজান্দ্রার ক্ষতচিহ্নগুলো মিলিয়ে গেল। হ্যাঁ, এখন আর কোথাও কোনো কলঙ্কের দাগ নেই। ইভের মন একটা অদ্ভুত আবেগে পরিপূর্ণ।

কেটি বললেন– চিন্তা করো না, এমন ঘটনা ঘটতেই পারে। এর জন্য নিজেকে দোষ দিয়ে কী লাভ?

না, ইভ নিজেকে দোষ দিচ্ছে না। মিসেস টাইলারকে সে দোষী করতে চাইছে। টাইলার কেন এসে সব ব্যাপারটা গোলমাল করে দিল।

***

এখানে নৈঃশব্দ্য এবং শান্তি বিরাজ করছে। টনির দিন কাটছে এক অদ্ভুত নীরবতার মধ্যে দিয়ে।

মাঝে মধ্যে কেটি সেখানে যান। সুপারের সাথে কথা বলেন। তিনি জানেন, টনি হয়তো আর কোনোদিন সুস্থ সবল জীবনে প্রবেশ করতে পারবে না।

.

২৪.

পরের দুবছর কেটে গেল ঘটনাবিহীনতার মধ্যে। আলেকজান্দ্রা ধীরে ধীরে কেটির হৃদয় হরণ করেছে। এই মেয়েটিকে আরও বেশি নিরাপত্তা দিতে হবে। গরমের ছুটিতে ইভ এবং আলেকজান্দ্রাকে নিয়ে যাওয়া হল বাহামাতে। আলেকজান্দ্রা জলে ডুবে মরতে বসেছিল, ইভও সাঁতার কাটছিল। শেষ অব্দি একজন মালী তাকে বাঁচিয়ে দেয়।

পরের বছর দুই বোন গিয়েছিল পিকনিকে। আলেকজান্দ্রা পাহাড়ের চূড়ো থেকে পড়ে যায়। কোনোরকমে একটা গাছের ডাল ধরে বেঁচে যায়।

কেটি ইভকে বললেন- বোনের ওপর নজর রাখতে পারিস না? এ কীরে? তুই তাহলে কেমন দিদি?

ইভ বলেছিল– ঠাম্মা, এবার থেকে বোনকে আমি আরও ভালোভাবে দেখব।

কেটি পাগলের মতো দুজনকে ভালোবাসেন। তাদের বয়স এখন সাত বছর। দুজনেই একই রকম হাসিখুশী পরির মতো সুন্দরী। মাথায় নরম সোনালী চুলের বন্যা। বালিকাসুলভ কোমল চেহারা। ম্যাকগ্রেগরের মতো চোখ পেয়েছে। একরকম দেখতে। কিন্তু ব্যক্তিত্বের দিক থেকে একেবারে আলাদা। আলেকজান্দ্রার কোমল লাবণ্য টনির কথা মনে করায়। ইভ যেন তারই এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি কেটি ভাবতে থাকেন।

রোলস রয়েসে করে ড্রাইভার তাদের স্কুলে নিয়ে যায়। আলেকজান্দ্রা এসব বড়োলোক মোটেই পছন্দ করে না। ইভ আবার এগুলো নিয়ে আনন্দ করতে ভালোবাসে। কেটি প্রত্যেক সপ্তাহে নাতনিদের হাতে যথেষ্ট টাকা তুলে দেন। কীভাবে তারা টাকা খরচ করছে, তার হিসাব রাখতে বলেন। ইভের পয়সা সব শেষ হয়ে যায়। আলেকজান্দ্রার কাছ থেকে সে ধার করে। সে হিসাবপত্রের খাতায় কারচুপি করে। ভাবে, ঠাম্মা কিছুই বুঝতে পারবে না। কেটি অবশ্য সবকিছু বুঝতে পারেন, কিছু বলতে চান না। সাত বছর বয়স, এখন থেকেই কেমন পাকা হিসাবরক্ষক হয়ে উঠেছে।

***

 শুরু থেকেই কেটি একটা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন। এই স্বপ্ন হল, টনি হয়তো একদিন সেরে উঠবে। সে ক্রুগার ব্রেন্টে চলে আসবে। সময় কেটে গেল, স্বপ্নটা ধূসর হয়ে যাচ্ছে।

***

১৯৬২- ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড আরও বড়ো হয়েছে। নতুন নেতৃত্বের দরকার। কেটি তার সত্তরতম জন্মদিন পালন করলেন। চুলের রং সাদা হতে শুরু করেছে। এখনও চেহারাটা খুব আকর্ষণীয়। তিনি জানেন, সারা পৃথিবী তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

বারো বছর বয়স হয়েছে যমজ কন্যা দুটির। তারা এখন বালিকা থেকে কিশোরী হবার দিকে এগিয়ে চলেছে। কেটি আগের মতোই আরও বেশি সময় কাটাচ্ছেন দুই নাতনির সঙ্গে।

ইস্টারের সপ্তাহে তিনি তাদেরকে নিয়ে ডাকহারবারে গেলেন কোম্পানির নিজস্ব প্লেনে। মেয়ে দুটি সম্পত্তি দেখে অবাক হয়ে গেল। জোহানেসবার্গেও তারা হয়তো একদিন যাবে। কিন্তু ডাকহারবার তাদের খুব ভালো লেগেছে।

মেয়ে দুটিকে এখনও একই রকম দেখতে লাগে। কেটির মনে হয়, স্বভাবে এই পরিবর্তন না থাকলেই বোধহয় ভালো হত। বারান্দায় বসে মাঝে মধ্যে তিনি তার দুই নাতনির দিকে তাকিয়ে থাকেন। হ্যাঁ, ইভ শেষ পর্যন্ত নেত্রী হবে। আলেকজান্দ্রা তাকে অনুসরণ করবে। ইভের মধ্যে একটা সহজাত প্রবৃত্তি আছে, আলেকজান্দ্রা নমনীয়। ইভ অ্যাথলেটের মতো কঠিন, আলেকজান্দ্রা এখনও মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনার মুখে পড়ে।

***

ইভকে একটা ভালো স্কুলে পাঠাতে হবে। কেটি অনেক ভাবনা-চিন্তা করলেন। সাউথ ক্যারোলিনার একটি স্কুলের কথা মনে পড়ল। কেটি হেডমিস্ট্রেসকে বলেছিলেন। আমার দুই নাতনি খুব ভালো। কিন্তু ইভ একটু বেশি চালাক। তাকে আমি এক অসাধারণ মেয়ে বলতে পারি। সে যেন সব সুযোগ সুবিধা পায়।

–আমাদের সব ছাত্রীরা একই রকম সুবিধা পায়, মিসেস ব্ল্যাকওয়েল। এবার ইভের বোনের কথা বলুন।

–আলেকজান্দ্রা ভীষণ ভালো মেয়ে, কেটি বললেন, আমি কিন্তু মাঝে মধ্যে আসব।

নতুন স্কুলে পড়াশুনা শুরু হল। ইভ অতি সহজেই নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিল। কিন্তু আলেকজান্দ্রা তখনও তার মুখচোরা স্বভাবটা বজায় রেখেছে। কেটি শেষ পর্যন্ত ভাবলেন, এখানে সবকিছু তার মনের মতো চলবে। শুধু একটা সমস্যা থেকে যাচ্ছে। সে হল ওই আলেকজান্দ্রা।

***

সকালবেলা তারা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেড়াতে যায়। বেশির ভাগ মেয়েরাই জাম্পারের সুযোগ নিয়েছে। কেটি নাতনিদের বারোতম জন্মদিনে উপহার দিলেন। যে ভদ্রলোক ঘোড়ায় চড়া শিক্ষা দেন, তিনি হলেন জেরোমে ডেভিস। তিনি সব কিছু পর্যবেক্ষণ করেন। আহা, ইভের সোনালী চুল সকালের রোদে ভাসতে ভাসতে উড়ে চলেছে অসাধারণ একটা ছবি। মিস্টার ডেভিস ভাবলেন, কোনো কিছুই ইভকে স্তব্ধ করতে পারবে না।

টমি নামে আর একজন আলেকজান্দ্রাকে বিশেষ ভালোবাসেন। আলেকজান্দ্রা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেছে। এবার বাঁদিকে ফিরবে। আলেকজান্দ্রা এবং ইভ বিভিন্ন রঙের রিবন পরেছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে।

এভাবেই তাদের ক্লাস এগিয়ে চলেছে।

একবার একটা দুঘর্টনা ঘটে গেল।

আলেকজান্দ্রার ঘোড়াটা হঠাৎ বুনো হয়ে উঠেছে। সে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। শেষ পর্যন্ত ডেভিস এসে আলেকজান্দ্রাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।

 স্কুলের দিনগুলো কেটে চলেছে। দেখা গেল, তারা খুবই খুশি। তবে আলেকজান্দ্রা এখনও মাঝে মধ্যে তার বাড়ির কথা চিন্তা করে।

***

কয়েক মাস কেটে গেছে, আর একটা অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে গেল। কয়েকটি মেয়ে মারুজিহানা খাচ্ছিল। ইভ এই নিষিদ্ধ ড্রাগ তাদের সরবরাহ করেছে। এই ঘটনাটা মানতে চাইল না। শেষ পর্যন্ত আলেকজান্দ্রার লকেটের ভেতর পুরিয়া পাওয়া গেল।

ইভ বলল- ও একাজ কখনও করতে পারে না। কেউ এটা পুরে দিয়েছে।

 কেটিকে হেডমিস্ট্রেস ডেকে পাঠালেন। হ্যাঁ, তাকে একটু বলে দিতে হবে।

***

পঞ্চদশ জন্মদিন, কেটি দুই নাতনিকে নিয়ে সাউথ ক্যারোলিনাতে গেলেন। সেখানে একটা বিরাট পার্টি দেওয়া হল। ইভ অল্প বয়সী ছেলেদের দিকে চলতে শুরু করেছে। হ্যাঁ, ছেলেরাও তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করছে।

কিন্তু আলেকজান্দ্রা এসব মোটেই ভালোবাসে না। সে তার ঠাম্মাকে দুঃখ দিতে চায় না। তাই এই পার্টিতে যোগ দেয়। ইভ সাজতে ভালোবাসে, আলেকজান্দ্রা পড়াশুনার দিকে নজর দিতে চায়। ছবি আঁকাতে তার সহজাত প্রতিভা। ডাকহারবারে বাবার আঁকা ছবিগুলোর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আহা, বাবা কেন এখন অ্যাসাইলামে, মাঝে মধ্যে ভগবানকে প্রশ্ন করে।

আলেকজান্দ্রা জানে না, কোনোদিন বাবার সাথে তার দেখা হবে কিনা।

***

স্কুলে দ্বিতীয় বছর। ইভ গর্ভবতী হয়ে পড়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে তার শরীরটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। সে কথা বলতে পারছে না। সকালের ক্লাসে আসতে পারছে না। মাঝে মধ্যেই মাথা ঘুরছে। শেষ পর্যন্ত তাকে ইনফারমারিতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। হেডমিস্ট্রেস সব কিছু পরীক্ষা করে বুঝতে পারলেন, ঘটনাটা সাংঘাতিক।

ডাক্তার বললেন- ইভ গর্ভবতী।

-এটা কী করে ঘটল?

একই রকম ভাবে।

-ও তো একেবারে বাচ্চা মেয়ে।

 –হ্যাঁ, ও তো গর্ভধারণ করতে পারে।

ইভ কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইল না। আমি কাউকে সমস্যায় ফেলব না।

তারপর? তুমি আমার কথা শোনো। আর বলো কী করে ঘটেছে?

ইভ বলল- আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। সে কেঁদে ফেলল।

হেডমিস্ট্রেস আরও আঘাত পেয়েছেন। তিনি ইভকে বললেন– কে এটা করেছে?

— মিস্টার পার্কিংসন।

—ইংরাজির শিক্ষক।

ইভ কেন এই ঘটনায় জড়িয়ে পড়ল? ভদ্রমহিলা বিশ্বাস করতে পারছেন না।

জোসেফ পার্কিংসন এক শান্ত স্বভাবের মানুষ। স্ত্রী এবং তিনটি ছেলেমেয়ে আছে তার। তিনি আট বছর ধরে এই স্কুলে পড়াচ্ছেন। কিন্তু ঘটনাটি সত্যি ঘটে গেছে? হেডমিস্ট্রেস তাকে ডেকে পাঠালেন। ইভ সত্যি কথাই বলেছে। তিনি হেডমিস্ট্রেসের মুখোমুখি বসলেন। তার সমস্ত মুখ থরথর করে কাঁপছে।

–আপনি নিশ্চয়ই জানেন কেন আপনাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, মিঃ পার্কিংসন?

–হ্যাঁ, আমি জানি।

—এটা ইভের ব্যাপার।

–হ্যাঁ, আমি অনুমান করছি।

–ইভ বলেছে, আপনি তাকে ধর্ষণ করেছেন?

পার্কিংসন অবাক হয়ে তাকালেন– হায় ঈশ্বর, আমাকে ইচ্ছে করে প্রলুব্ধ করা হয়েছে।

তার মানে? আপনি কী বলছেন? মেয়েটি—

ওকে আর মেয়ে বলবেন না। ও একটা শয়তানি।

ঘাম মুছে ভদ্রলোক বললেন-  সমস্ত সেমিস্টারে সে সামনের রো-তে এসে বসত। তার পোশাকের এখান সেখান খুলে রাখত ইচ্ছে করে। আমার দিকে এগিয়ে আসত। এমন কিছু প্রশ্ন করত, যার উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। নিজেকে আরও ভালোভাবে উন্মুক্ত করত। আমি এ ব্যাপারগুলো উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছিলাম। ছ-সপ্তাহ আগে সে আমার বাড়িতে এল। আমার মেয়ে এবং স্ত্রী বাড়িতে ছিল না। তারপর? আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারি নি।

ভদ্রলোক কেঁদে ফেললেন।

ইভকে অফিসে নিয়ে আসা হল। ইভের মনোভাব এখন অনেক শান্ত। সে পার্কিংসনের চোখের দিকে তাকাল। হ্যাঁ, ঘটনা ঘটে গেছে।

এবার পুলিশের চিফের সামনে দাঁড়াতে হল ইভকে।

–ইভ বলল, কী ঘটেছে?

ইভ শান্তভাবে বলল- মিঃ পার্কিংসন বলেছিলেন, তিনি আমার সাথে ইংরাজি পড়া নিয়ে আলোচনা করবেন। তিনি রোববার বিকেলবেলা আমাকে তার বাড়িতে ডেকেছিলেন। বাড়িতে তিনি একলা ছিলেন। তিনি বলেছিলেন বেডরুমে যেতে। আমি তাকে অনুসরণ করে দোতলায় চলে গেলাম। তিনি আমাকে বিছানাতে ফেলে বলাৎকার করলেন।

–এটা একটা মিথ্যে কথা। এটা ঘটে গেছে।

কেটিকে ডেকে পাঠানো হল। হ্যাঁ, পুরো ঘটনাটা তার সামনে বলা হল। ঠিক করা হল, এই ঘটনাটাকে চেপে দিতে হবে। মিঃ পার্কিংসনকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। এমন কী আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে তাকে ওই রাজ্য থেকে চলে যেতে হবে, এমন কথাও বলা হল।

কেটি আর একটা কাজ করলেন। তিনি স্কুলটা তুলে দিলেন।

ইভ এই ঘটনাটা শুনে বলেছিল- ঠাম্মা, স্কুলটা আমি কিন্তু ভালোবাসতাম।

***

কয়েক মাস পরে ইভ খবর পেল, আলেকজান্দ্রা সুইজারল্যান্ডে চলে গেছে, সেখানে গিয়ে পড়াশুনা করবে।

.

২৫.

ইভের কাছে জগৎটা শূন্য হয়ে গেছে, জীবন উদ্দেশ্যবিহীন, ইভ এখন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সে বিজ্ঞানী হতে চাইছে অথবা গাইয়ে। সার্জেন্ট, পাইলট কিংবা অভিনেত্রী। সে সব কিছু করতে চাইছে, কিন্তু কিছুই করতে পারছে না।

পাশে একটা স্কুল, ইভ তখন সপ্তদশী, সব ছাত্ররা তার প্রতি আকর্ষিত। সে সকলের সাথেই কথা বলে, সে নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারছে না। বুঝতে পারে, তার এই শরীরটা দিয়েই সকলকে জয় করতে হবে। একটা চুম্বন, একটু আলিঙ্গন, বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। কিন্তু কেন?

ইভ এখন আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর সবথেকে বড়ো সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারিণী। একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসছে তার কাছে। সব প্রস্তাব সে ছিঁড়ে ফেলছে। সে জানে, একদিন তাকে একটা ভালো পাত্র দেখতেই হবে।

***

শনিবারের রাত। আলেকজান্দ্রার সাথে এক ফরাসি ছাত্রের দেখা হল। তার নাম রেনে। দেখতে খুব একটা ভালো নয়। কিন্তু মনের ভেতরে বুদ্ধি আছে। আছে সংবেদনশীলতা। আলেকজান্দ্রা ভাবল। এই ছেলেটি চমৎকার। তারা পরের শনিবার শহরের কোনো এক জায়গায় দেখা করার চেষ্টা করল।

তখন থেকে আলেকজান্দ্রা রেনের সাথে মাঝে মধ্যে সময় কাটায়। একদিন কথায় কথায় সে ইভের কাছে বলেছিল- রেনে কিন্তু অন্যছেলেদের মতো নয়, সে লাজুক, ভারী সুন্দর। আমরা শনিবার থিয়েটার দেখতে যাব।

–তুই ওকে কতটা ভালোবাসিস?

অনেকটা, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, ও আমাকে ভালোবাসে কিনা?

 ইভ বলল- তুই কি ওর সঙ্গে বিছানায় গিয়েছিস?

ইভ, না-না, রেনে কিন্তু ওই ধরনের ছেলে নয়। ও খুবই লাজুক।

–তা হলে? এভাবে কি ভালোবাসা হয়?

না, আমি ওভাবে কাউকে ভালোবাসতে চাই না।

শনিবার, আলেকজান্দ্রা থিয়েটার হলের সামনে পৌঁছে গেছে। রেনেকে কোথাও দেখা গেল না। আলেকজান্দ্রা এক ঘণ্টা অপেক্ষা করল। কিন্তু রেনে কোথায়? সে একা একা একটা কাফেতে কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারপর স্কুলে ফিরে এল। ইভ তার ঘরেতে নেই। আলেকজান্দ্রা আলো বন্ধ করে দিয়েছে। রাত দুটোর সময় ইভ ঢুকে পড়ল।

আলেকজান্দ্রা বলল- তুই কোথায় গিয়েছিলি?

–আমি আমার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তোর সন্ধ্যেটা কেমন কাটল?

–ও আসেনি।

–সে কী? তুই যে বললি ছেলেটা খুবই ভালো।

–হ্যাঁ, কিছু একটা হয়েছে, হয়তো।

অ্যালেক্স, তুই অন্য কাউকে খোঁজার চেষ্টা কর।

আলেকজান্দ্রা অবাক হয়ে গেছে কেন একথা বলল ইভ? সে কি সত্যি খারাপ? বোনের তুলনায়?

আলেকজান্দ্রা যেসব ছেলেদের ভালোবাসে, ইভ তাদের দখল করতে চায়। এক সপ্তাহ বাদে রেনের সঙ্গে হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে গেল।

রেনে বলল- কী হয়েছে?

-তুমি আমাকে ফোন করোনি কেন?

ফোন?

–হ্যাঁ, ইভ?

আলেকজান্দ্রা। আমি দুঃখিত, আমায় এক্ষুনি যেতে হবে। সে চলে গেল।

আলেকজান্দ্রা বুঝতে পারল, আসলে, কোন ঘটনাটা ঘটেছে।

সন্ধ্যেবেলা আলেকজান্দ্রা এসে ইভকে সব কথা বলল। ইভ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল–না-না, ও তোকেই ভালোবাসে, হয়তো ঠিক মতো চিনতে পারেনি!

ইভের চারপাশের পৃথিবী আরও বর্ণরঙিন হয়ে উঠেছে। ইভ জানে, এই সুন্দর শরীরটা দিয়ে পুরুষদের জয় করতে হবে। অন্তত দু-ডজন ছেলে তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। ছ-জন শিক্ষকের দৃষ্টি আছে তার দিকে। হ্যাঁ, স্কুলে এই ঘটনাটা সকলে জেনে গেছে। ইভ সকলের মাথা চিবিয়ে খাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।

***

আলেকজান্দ্রা ডরমেটরিতে ফিরে এসেছে। এটাই শেষ কাজ। সে দেখল, ইভ গোছগাছ করছে।

–কোথায় যাচ্ছিস? 

 বাড়ি যাবো।

বাড়ি? এখন?

–অ্যালেক্স, এখানে থেকে কী হবে? আমরা কিছুই শিখব না। সময় নষ্ট হচ্ছে।

–এমন কথা কেন বলছিস?

–হ্যাঁ, রোজ সকালে উঠে আমার এই কথাটা মনে হয়। তুই কি যাবি?

, আমি যাব না এখন।

–অ্যালেক্স, তুই থাক। আমি নিউইয়র্কে চলে যাব। যে পৃথিবীতে আমরা ছিলাম, সেখানে যাব।

হেডমিস্ট্রেসকে কী বলবি?

সব কিছু বলে দিয়েছি।

 উনি কী বললেন?

 উনি বললেন, ইচ্ছে করলে আমি যেতে পারি।

আলেকজান্দ্রা বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বলল– আমি এখন কী করব, বুঝতে পারছি না।

–তোর ব্যাপার তুই ভালোবোঝার চেষ্টা কর।

 আলেকজান্দ্রা ক্লোসেটের কাছে চলে গেল। স্যুটকেস গোছাতে শুরু করল।

ইভ এসে বলল আমি কিন্তু তোকে বাধ্য করছি না।

আলেকজান্দ্রা বলল- আমি একা থাকব কী করে।

ইভ বলল- ঠিক আছে, ঠাম্মাকে ফোন করে সব কথা বলে দিস।

আলেকজান্দ্রা বলল- ঠাম্মা বোধহয় এ ব্যাপারটা মানতে চাইবে না।

ইভ বলল– ওই বুড়ির জন্য চিন্তা করে কী হবে। আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব।

আলেকজান্দ্রা স্কুলটা ছাড়তে চাইছিল না, কিন্তু ইভ চলে যাচ্ছে, সে থেকে কী করবে?

***

কেটি ব্ল্যাকওয়েলের বন্ধু-শত্রু- দুই-ই আছে। ব্যবসার ক্ষেত্রে এটা হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। দুই নাতনির কথা মাঝে মধ্যে তিনি চিন্তা করেন। তাঁ, একটা অনভিপ্রেত গর্ভপাতের ঘটনা।

তারপর? কেটি শুনলেন, দুই নাতনি ফিরে আসছে, তা হলে একটা দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটে গেল।

***

মেয়েরা ফিরে এল। কেটি তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি ইভকে সিটিংরুমে নিয়ে গেলেন। বললেন- তোমার সম্পর্কে অনেক খারাপ খবর শুনেছি। আমি জানতে চাই, তোমাকে কি স্কুল থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে?

-না, আমাদের বার করে দেওয়া হয়নি। অ্যালেক্স আর আমি ঠিক করলাম, স্কুল থেকে চলে আসব।

-কেন? ছেলেদের সাথে জড়িয়ে পড়া।

ঠাম্মা, এ ব্যাপারে তোমার সাথে পরে কথা বলব।

 বলো কেন এসেছ?

–অ্যালেক্সই বদমাইসি করেছে।

–অ্যালেক্স কী করেছে?

–না, ওকে দোষ দিও না। ও বাধ্য হয়ে এটা করেছিল। এটাতে ওর কোনো হাত ছিল না।

তার মানে? তুমি আগে বলোনি কেন?

–ও নিজেকে হত্যা করতে চেয়েছিল ঠাম্মা, আমি অ্যালেক্সের জন্য কত চিন্তা করি, তুমি কি তা জানো?

কেটি অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেন- ইভ কেঁদো না। সোনা, বলো কী হয়েছে? ব্যাপারটা তোমার আমার মধ্যেই থাকবে।

কেটি আলেকজান্দ্রার দিকে তাকালেন। অসাধারণ, এই মেয়েটা এমন, বাইরে দেখতে কী সুন্দর, ভেতরটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। হ্যাঁ, আলেকজান্দ্রাকে নিয়ে অনেক হয়েছে, আর কোনো দুঃখজনক ঘটনা তিনি ঘটতে দেবেন না।

***

পরবর্তী দুবছর ইভ এবং আলেকজান্দ্রা মিসেস পরটারের স্কুলে পড়াশুনা শেষ করল। ইভ মারামারি ঝগড়াতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কোনো কিছু তাকে সুখী করতে পারছে না। আর এখন কেটির বয়স হয়েছে উনআশি।

একুশতম জন্মদিন, কেটি তার নাতনিদের নিয়ে প্যারিসে গেলেন। অনেক কিছু কিনে দিলেন।

ছোট্ট একটা ডিনার পার্টির আয়োজন করা হল। সেখানে কাউন্ট আলফ্রেড নিজে এসেছিলেন। তাঁর স্ত্রী এসেছিলেন। কাউন্টেস ভিভিয়েন। তাকে দেখতে খুবই সুন্দর। মধ্য পঞ্চাশ বয়স হয়েছে। কাউন্টের মাথায় চুল ঈষৎ ধূসর। শরীরের মধ্যে অ্যাথলেটের ছাপ আছে।

ইভ কারও দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে চোরা চোখে কাউন্ট আলফ্রেডকে দেখছে। ওই মুটকি মেয়েটাকে নিয়ে আলফ্রেড নিশ্চয়ই খুশি হতে পারেন না। আলফ্রেড কী জানেন, যৌনতার আসল খেলা কাকে বলে? ইভ মনে মনে শপথ করল, এই চ্যালেঞ্চটা তাকে জিততে হবে।

পরের দিন ইভ আলফ্রেডকে ফোন করল। আমি ইভ বলছি, আমাকে কি আপনি মনে রেখেছেন?

–তোমাকে আমি কী করে ভুলে যাব কিশোরী কন্যা? তুমি আমার বন্ধু কেঁটির সবথেকে সুন্দরী নাতনি।

-হ্যাঁ, আপনার কথা শুনে ভালো লাগছে কাউন্ট। আপনাকে আমি কি বিরক্ত করেছি? আমি আমার ঠাম্মাকে একটা ব্যাপারে চমক দেব। আমি জানি না, এটা কী করে ঘটবে? ওয়াইনের বিষয়ে আমায় কিছু জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আপনি কি আমায় সাহায্য করবেন?

-হ্যাঁ, তুমি কীভাবে সার্ভ করবে, তার ওপর নির্ভর করছে।

–আমি কিছু মনে রাখতে পারছি না, আমি কি একবার যাব?

এসো, আমি সব ব্যবস্থা করে রাখছি।

 ইভ রিসিভারটা সাবধানে নামিয়ে রাখল। হ্যাঁ, এই লাঞ্চের সময় কাউন্টকে বধ করতে হবে।

***

তারা একটা ছোট্ট হোটেলে এসে দেখা করল। আলোচনাটা সংক্ষিপ্ত। ইভ মারিওইয়োরের কথা শুনছিল। শেষ পর্যন্ত বলল- আলফ্রেড, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

কাউন্ট অবাক হয়ে গেছে- তুমি কী বলছ?

-আমি তোমাকে ভালোবাসি।

কাউন্ট মদে চুমুক দিয়ে বললেন- এটা হচ্ছে ভিনটেজইয়ার, তিনি ইভের হাতে হাত রাখলেন। বললেন- এসো, আমাদের ভালোবাসা শুরু হোক।

-না, আমি সে ভালোবাসার কথা বলছি না, আলফ্রেড।

কাউন্ট অবাক হয়ে ইভের চোখের দিকে তাকালেন। তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। মেয়েটির বয়স একুশ বছর, তিনি মধ্য বয়স অতিক্রম করেছেন। বিবাহিত সুখী মানুষ। তিনি কী করে এই মেয়েটির ফাঁদে জড়িয়ে পড়বেন? মাত্র তিনদিন আগে দেখা হয়েছে। তার কথা হারিয়ে গেছে। তিনি মেয়েটির দিকে তাকালেন। একটা বুক খোলা স্কার্ট পরেছে। পাতলা সবুজ সোয়েটার, বুকের সবকিছু পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে। ব্রেসিয়ার পরেনি। ইচ্ছে করেই হয়তো। এমন কী কাউন্ট তার উঁচু দুটো স্তনবৃন্ত দেখতে পেলেন। তিনি পরিচ্ছন্ন অসহায় মুখে তাকালেন। সবকিছু হারিয়ে গেছে শব্দরা কোথায় হারিয়ে গেছে।

-তুমি কী বুঝতে পারছ না, আমি কোন ভালোবাসার কথা বলছি? কাউন্ট আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না। ইভের পাতা ফাঁদে পা দিতেই হল। তারা একটা ছোট্ট হোটেলে গিয়ে পৌঁছোল। হা, কাউন্ট স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, শরীরের খেলাতে ইভ সত্যি পারদর্শিনী। একফোঁটা একুশ বছরের মেয়ে হলে কী হবে। কাউন্টকে সে হারিয়ে দিয়েছে। পরিপূর্ণ তৃপ্তি বলতে যা বোঝায় সেদিনের শরীর সঙ্গমে কাউন্ট তাই লাভ করেছেন।

ব্যাপারটা হয়তো সেখানেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু ইভের দুর্ভাগ্য, তা হল না। শেষ পর্যন্ত অতি উৎসাহী এক ভদ্রমহিলা তাদের হোটেল থেকে বেরোতে দেখেন। এই দুজনের ছবি খবরের কাগজের পাতায় ছাপা হয়েছিল। ভদ্রমহিলা দুজনকেই চিনে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে কেটিকে সব কথা বলেছিলেন। কেটি তখন একেবারে রেগে গেছেন। তিনি ভেবেছিলেন, এর অন্তরালে হয়তো আলেকজান্দ্রা আছে, কিন্তু না, ব্যাপারটা গোলমেলে বোঝা গেল।

ইভের সাথে সরাসরি কথা হল। ইভের ব্যবহারে তিনি তিতি-বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। ইভ যেভাবে পরিবারের নাম ডোবাচ্ছে, তাতে তো তিনি চিন্তিত। শেষ পর্যন্ত তিনি পরিষ্কার বললেন– ইভ, আমি তোমাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করছি। তোমাকে মাসে মাসে একটা টাকা দেওয়া হবে। তুমি এখন থেকে আর আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবে না। তুমি নিউইয়র্কে গিয়ে আলাদা অ্যাপার্টমেন্টে থাকবে। আর যদি তোমার কোনো কেচ্ছার খবর আমার কানে পৌঁছোয়, তা হলে মাসিক টাকাও আমি বন্ধ করে দেব, মনে রেখো। কেমন?

ইভ ভাবতে পারেনি, সামান্য দু-এক ঘন্টার শরীর ছোঁয়ার খেলা তার জীবনে এত বড়ো বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সে স্থির দৃষ্টিতে ওই বৃদ্ধা শয়তানিকে দেখল। তারপর রাগে গরগর করতে থাকল। হ্যাঁ, যে করেই হোক, আলেকজান্দ্রাকে সরিয়ে দিতেই হবে। একটার পর একটা ছবি তার মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠল। আলেকজান্দ্রা প্রত্যেকবারই বেঁচে যাচ্ছে। এবার কোনো কথা বলে বোধহয় ঠাকুরমার কান ভারী করে তুলেছে।

***

আলেকজান্দ্রা দিদির এই প্রস্তাবটা বিশ্বাস করতে পারছে না। এই প্রথম দিদিকে ছেড়ে তাকে একলা থাকতে হবে। এক মুহূর্তে তার জগৎটা শূন্য হয়ে গেল। প্রথমে সে দিদির সঙ্গে নিউইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দিদির ব্যবহারে ভয় পেয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত আমতা আমতা করে বলল- তোর সঙ্গে প্রায় দেখা হবে তো?

মুখে শয়তানি হাসি এনে ইভ জবাব দিল- হ্যাঁ, তুই ভাবতেই পারবি না।