৩. ক্যাথারিন আলেকজান্ডারের জীবন

ক্যাথারিন, ওয়াশিংটন, হলিউড, ১৯৪১

০৭.

ক্যাথারিন আলেকজান্ডারের জীবনে একটা নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। সে বোধহয় উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে। বিল ফ্রেসার এখন শহরে। রোজ রাতে তার সাথে ডিনারে যেতে হচ্ছে। কোনো থিয়েটার, কনসার্ট অথবা অপেরা। ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া গেছে। বিল ভাড়া দিতে চেয়েছিলেন। ক্যাথারিন বাধা দিয়েছে। বিল প্রায়ই সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় কিনে আনেন। দামী জুয়েলারি। ক্যাথারিন প্রথমে নিতে রাজী হয়নি। পরে গ্রহণ করেছে।

ক্যাথারিন ভাবল, সে বোধহয় বিলের উপপত্নী হয়ে গেছে। এইভাবে জীবন কাটাবে? ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

ফ্রেসার আরও চিন্তিত মনে হচ্ছে। যুদ্ধের চাপ ক্রমশ বাড়ছে। কাজ বেড়ে গেছে। এখন কাছে আসবার সময় কমে গেছে।

বিজ্ঞাপনের সংস্থা এখনও চলেছে। যেটা ফ্রেসার স্থাপন করেছিলেন, চালাচ্ছেন ওয়ালেস, মাঝে মধ্যে ক্যাথারিন সেখানে যায়।

ফ্রেসার একরাতে ডিনারের পর বলেছিলেন ক্যাথারিন তুমি কি আমার অ্যাড এজেন্সিতে কাজ করবে? নাকি আমার সঙ্গেই থাকবে?

-বিল, আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই। অন্য কোথাও গেলে আমি ছটফট করব।

 কথাটা আন্তরিক। ক্যাথারিন মিথ্যে বলেনি।

একদিন বিকেলবেলা, ক্যাথারিন কিছু কাজ শেষ করেছে। ফ্রেসার অফিসে প্রবেশ করলেন।

আজ তুমি বাইরে বেড়াতে যাবে?

–হ্যাঁ, আমরা কোথায় যাব?

ভার্জিনিয়াতে, মা-বাবার সাথে ডিনার খাব।

 ক্যাথারিন অবাক হয়ে গেছে আমার কী হবে?

–কিছুই হবে না। আমি বলব, তুমি আমার এক সহকারিনী, তোমাকে আমি ডিনারের আসরে নিয়ে এসেছি।

ক্যাথারিনের মনে আশা নিরাশার আন্দোলন। সে বলল- আমি অ্যাপার্টমেন্টে যাচ্ছি। পোশাক পাল্টে আসছি।

–তোমাকে সাতটার সময় তুলে নেব, কেমন?

.

ফ্রেসারের বাড়ি, ভার্জিনিয়া পাহাড়ের পাদদেশে। হারানো দিনের ফার্ম হাউস। সাত একর জমি। সতেরোশো শতাব্দীর ভাস্কর্য।

ক্যাথারিন অবাক হয়ে গেছে এমন কোনো কিছু আমি কখনও দেখিনি।

ফ্রেসার বলেছে এটা হল আমেরিকার অন্যতম ব্রিডিং ফার্ম।

গাড়ি এগিয়ে গেছে। কত ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে।

–এটা আর একটা জগত, ক্যাথারিন বলল, তোমার ছেলেবেলা এখানেই কেটেছে?

ফার্মের ভেতর শৈশব? ব্যাপারটা কেমন বলল তো?

 না, এটা তো একটা খামার নয়, মনে হচ্ছে, তুমি একটা জগতের রাজা।

বাড়ির সামনে ওরা এসে গেল। ফ্রেসার বলল- মা-বাবা, আগের দিনের মানুষ। তবে চিন্তা করো না। ভয় পেও না কিন্তু।

ক্যাথারিন বলল- না, ভয় শব্দটাকে আমি কবেই বাতিল করেছি।

একজন বাটলার এগিয়ে এল। দরজা খুলে দিল। তার মুখে হাসি।

একটু বাদে কর্নেল ফ্রেসার আর তার স্ত্রীকে আসতে দেখা গেল। মনে হল তারা যেন গত শতাব্দীর নায়ক-নায়িকা। ক্যাথারিন কী করবে, ভেবে উঠতে পারছে না। কর্নেল ফ্রেসার যে এককালে ভারী সুন্দর চেহারার যুবক ছিলেন, তা বোঝা যাচ্ছে। তিনি ক্যাথারিনের দিকে এগিয়ে গেলেন।

হ্যাঁ, দুজনের মধ্যে দারুণ মিল আছে। বিলকে দেখে বোঝা যায়, উনি কর্নেলের সন্তান।

ক্যাথারিনের মনে হল, ওই দুজন তার দিকে নিরীক্ষণের চোখ মেলে দিয়েছেন। সমস্ত সন্ধ্যে জুড়ে অনেক প্রশ্ন করা হল। ক্যাথারিন জবাব দেবার চেষ্টা করেছে। মা-বাবার কথা, ছোট্ট শৈশবের কথা। এক ফুল থেকে অন্য ফুলে চলে যাওয়া। ছোটোখাটো আনন্দ ও দুঃখ-যন্ত্রণা। বিল ফ্রেসার পাশেই বসেছিলেন। ডিনারটা সাংঘাতিক। মোমের আলো জ্বলছে। আগেকার দিনের বিরাট ডাইনিং রুম। মার্বেলের তৈরি ফায়ার প্লেস।

পুরোনো রুপোর জিনিসপত্র, পুরোনো টাকা এবং পুরোনো মদ- কখনও খারাপ হয় না।

ক্যাথারিন বিল ফ্রেসারের দিকে তাকাল। উষ্ণ আতিথেয়তা। এমন জীবন? এই জীবনটাকে আমি কি মুঠোবন্দি করতে পারব?

ক্যাথারিন জানে, ফ্রেসার তাকে ভীষণ ভালোবাসে। সে ও ফ্রেসারকে ভালোবাসে। কিন্তু কীসের একটা অভাব, উত্তেজনা।

ক্যাথারিন মনকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করল– আমি অনেক বেশি কিছু চাইছি। যা পেয়েছি তাতেই তো আমার সুখে থাকা উচিত।

এবার আবার বাড়ির পথে যাত্রা। ফ্রেসার জানতে চাইলেন

সন্ধ্যেটা কেমন লাগল?

–তোমার মা-বাবাকে আমার ভালো লেগেছে।

 –তোমাকেও ওদের ভালো লেগেছে।

না, খারাপ চিন্তাগুলো মন থেকে তাড়াতে হবে।

পরের দিন সন্ধ্যেবেলা, জকিক্লাবে ক্যাথারিন আর ফ্রেসার ডিনার সারছে।

ক্যাথারিনকে ফ্রেসার বললেন আমি লন্ডনে যাব এক সপ্তাহের জন্য। তোমার জন্য একটা সুন্দর কাজের ব্যবস্থা করেছি। তুমি আর্মি এয়ারপোর্টের ওপর নজর রাখবে। সেখানে একটা ফিল্ম তৈরি হবে। এম জি ও স্টুডিও। হলিউডে। তুমি কি সেই ছবিটার পরিচালনা করতে পারবে?

ক্যাথারিন তাকিয়ে থাকল– আমি কি করে পারব? আমি তো কখনও এ ধরনের ফিল্ম পরিচালনা করিনি।

ফ্রেসার বললেন– ভয় পাবার কিছু নেই। অনেকে থাকবে, তারাই তোমাকে শিখিয়ে দেবে। সত্যিকারের সৈন্যরা এই ফিল্মে অভিনয় করবে। ব্যাপারটা দারুণ মজার।

-কেন?

বুঝতেই তো পারছ, অভিনয়ের ব্যাপারে ওদের কোনো জ্ঞান নেই। তোমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। আমি জেনারেল ম্যারফিউজের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি গ্ল্যামার শব্দটার ওপর জোর দিয়েছেন। গ্ল্যামার বেচেই তো আমাদের খেতে হবে।

আমাকে কী করতে হবে?

–তুমি দেখবে, সব কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা? তোমার অনুমতি ছাড়া কোনো কাজই শেষ পর্যন্ত হবে না। লস এঞ্জেলসে যে প্লেনটা উড়বে, সেখানে তোমার টিকিট কাটা আছে। কাল সকাল নটার সময়।

ক্যাথারিন মাথা নেড়ে বলল- ঠিক আছে।

–তুমি কি আমার কথা চিন্তা করবে?

–হ্যাঁ, তুমি তো তা জানো।

–আমি তোমার জন্য একটা সুন্দর উপহার আনব।

–উপহার আমি চাই না, সাবধানে ফিরে এসো। বিল, পরিবেশ ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে।

–হ্যাঁ, তবে আমার জন্য চিন্তা করো না।

কথাবার্তা এগিয়ে চলেছে। যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি। বিল ক্যাথারিনকে তার অ্যাপার্টমেন্টে ছেড়ে দিলেন।

ক্যাথারিন শোবার জন্য প্রস্তুত হল। সে ভাবল, বিলের সঙ্গে গেলে কেমন হত? না, ব্যাপারটা বড্ড বেশি কাল্পনিক হয়ে যাচ্ছে।

জীবনে এমন কিছু প্রশ্ন আছে, যার সঠিক উত্তর আমাদের জানা নেই।

.

আহা, এক অসাধারণ দৃশ্য। সূর্য অস্তাচলে, পাম গাছের ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ক্যাথারিনকে তার ঘরে নিয়ে গেল। সুন্দর বাংলো প্রধান বাড়িটার কাছে। টেবিলের ওপর একগুচ্ছ ফুল। ম্যানেজমেন্টের তরফ থেকে একখানি শুভেচ্ছাপত্র। তার পাশাপাশি আরও একটি ফুলের গোছা তুমি যেখানে আমিও সেখানে থাকব, ভালোবাসা, বিল।

অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ক্যাথারিনের হাতে তিনটে টেলিফোন মেসেজ তুলে দিল। এসেছে অ্যালান বেনজামিনের কাছ থেকে। উনি হলেন এই শিক্ষানবিশ চলচ্চিত্রের প্রযোজক। ক্যাথারিন বিলের কার্ডটি মন দিয়ে পড়ছিল। ফোনটা আর্তনাদ করল।

সে বলল– কে? বিল?

–না, অ্যালান বেনজামিন।

–ক্যালিফোর্নিয়াতে আপনাকে স্বাগত মিস আলেকজান্ডার। আমি করপোরাল অ্যালান বেনজামিন, এই ছবিটার প্রোডিউসার।

করপোরাল? ক্যাথারিন ভাবল, একজন ক্যাপ্টেন কিংবা কর্নেলকে দায়িত্ব দিলে বোধহয় ভালো হত।

–আমরা কাল শু্যটিং শুরু করব। সৈন্যদের ভূমিকায় অভিনেতারা থাকবে। ব্যাপারটা আপনি জানেন তো?

-আমি শুনেছিলাম।

সকাল নটায় শুটিং শুরু হবে। আটটার সময় আপনি তৈরি থাকবেন। আপনি কি জানেন কী কী জিনিস লাগবে?

ক্যাথারিন বলল- হ্যাঁ, আমার সব জানা আছে।

সত্যি কথা বলতে কি, আর্মি এয়ারের জন্য কী কী জিনিস লাগে, ক্যাথারিনের সে বিষয়ে বিন্দু বিসর্গ জ্ঞান নেই।

সাড়ে সাতটার সময় গাড়ি থাকবে। আধঘণ্টার মধ্যেই আপনি মেট্রোয় পৌঁছে যাবেন। আমি তোরো নম্বর স্টেজে আপনার সঙ্গে দেখা করব।

ভোর চারটে, ক্যাথারিন ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেছে তার। টেলিফোন বাজছে। একটা লিমুজিন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

তিরিশ মিনিট কেটে গেছে। ক্যাথারিন এগিয়ে চলেছে মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ারের স্টুডিওর দিকে।

পৃথিবীর সবথেকে বড় মোশান পিকচার স্টুডিও। বত্রিশটা স্টেজ আছে। একটা বিরাট প্রশাসনিক ভবন।

ক্যাথারিনকে সব কিছু বুঝিয়ে দেওয়া হল। অল্প বয়সী একটি মেয়ে তার পথ প্রদর্শিকার কাজ করছে। তাকে তেরো নম্বর স্টেজে নিয়ে যাওয়া হল।

মেয়েটি উৎসাহের আতিশয্যে বলল– ভেতরে গেলে বুঝতে পারবেন, এটা একটা সাজানো শহর। এখানে ছ হাজার মানুষ একসঙ্গে খাবার খেতে পারে। প্রথম প্রথম খুব অদ্ভুত লাগবে। আমাদের কোনো কিছু দরকার লাগে না।

ক্যাথারিন বাঁধা দিয়ে বলল- কেন দর্শকদের প্রয়োজন তো সব সময় আছে?

সাজানো রাস্তা দিয়ে তারা হেঁটে চলেছে। একটা সুন্দর দুর্গ। তারপর একটা লেক। সানফ্রানসিসকো থিয়েটারের লবি। শুধু লবিটা আছে, আর কিছু নেই।

ক্যাথারিন হেসে উঠেছে, মেয়েটি তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

–কোনো কিছু খারাপ লাগছে?

–না, ক্যাথারিনের সংক্ষিপ্ত জবাব। সব কিছুই দারুণ।

এক্সট্রারা রাস্তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাউবয় আর ইনডিয়ানরা গল্প করছে। একজন কোথা থেকে সামনে এসে দাঁড়াল। মধ্যযুগের নাইট, হাতে অস্ত্র ধরা আছে। সাঁতারের পোশাক পরা একদল তরুণী। খিলখিল করে হাসছে।

গাইড বলল- আমরা এসে গেছি।

ক্যাথারিন সাউন্ড স্টেজের দিকে এগিয়ে গেল। লেখা আছে– যখন লাল আলো জ্বলবে তখন ভেতরে আসবেন না। আলো নিভে গেল। ক্যাথারিন ভেতরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু দরজাটা ঠেলল সে।

আর একটা দরজা, এটাও খুব শক্ত।

 অবশেষে একেবারে শেষ ঘরে গিয়ে পৌঁছোল সে। এখানে সবাই খুব ব্যস্ত।

ক্যাথারিন জানতে চাইল- মিঃ অ্যালান বেনজামিন কোথায়?

কেউ একজন বলল- লিটল করপোরাল? ওই তো উনি সেখানে।

একজনকে দেখা গেল। করলোরালের স্ট্রাইপ দেওয়া পোশাক পরেছেন।

–আর পারা যাচ্ছে না, উনি বিরক্তি প্রকাশ করছেন। আমি সব কিছু সাজাবার চেষ্টা করছি। এখানে সবাই রাজা, কেউ ইনডিয়ান হতে চায় না।

ক্যাথারিন বলল- মাফ করবেন, আমি ক্যাথারিন আলেকজান্ডার।

ছোট্ট চেহারার লোকটি বললেন- ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এবার আসল লোক এসে গেছে। ওয়াশিংটন থেকে ওকে পাঠানো হয়েছে।

ক্যাথারিন কী বলবে, বুঝতে পারছে না। লিটল করপোরাল আবার বললেন- এখানে আমি কী করছি, জানা আছে কি? আমি একটা মস্ত বড়ো চাকরি করি। কেন যে মরতে এই কাজে হাত দিলাম।

সব জায়গায় শুধু বিশৃঙ্খলা। ক্যাথারিন বুঝতে পারল, অলৌকিক কিছু না ঘটলে এই ব্যাপারটা সামলানো যাবে না।

একজন এগিয়ে এসে বলল- আপনাকে হলিউড স্বাগত জানাচ্ছে। আমি টম ওব্রায়ান।

–অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, আপনার বন্ধু ওই করলোরাল এই ছবিটা পরিচালনা করবেন। আমি সাহায্য করব।

আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ হল। ওব্রায়ানকে দেখা গেল ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে। এক্সট্রা জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে।

এবার বোধহয় শু্যটিংটা শুরু হবে।

মেয়েরা হেসে গড়িয়ে পড়ছে। একজন দীর্ঘদেহী মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে এলেন। ভারী সুন্দর দেখতে। চুলের রং নীল এবং কালোর মাঝামাঝি। চোখের তারা গভীর। তার গলাতে একটা অদ্ভুত গাম্ভীর্য আছে। উনি বললেন- আপনার জন্য কোনো সাহায্য?

আপনি কি আমাকে কাজ করতে দেবেন?

–হ্যাঁ, অবশ্যই দেব।

 ক্যাথারিন ইউনিফর্মগুলো ভালো করে পরীক্ষা করল- হ্যাঁ, মোটামুটি খারাপ হয়নি।

ওই ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন বস্, ঠিকঠাক সব উতরে যাবে তো?

কে ক্যাপ্টেনের ভূমিকাতে নামবেন, আপনি জানেন কি?

–কেন আমি পারব না?

না, আপনার সেই গুণ নেই।

–ফাস্ট লেফটেন্যান্ট?

না।

–সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট?

–আমি ঠিক বলতে পারছি না।

আর কোনো ভূমিকা কি নেই আমার জন্য?

–আছে, এই মেডেলগুলো গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন? আপনি কি খুব সাহসী?

ভদ্রলোকের মুখে হাসি হা, এই ছবিটার মধ্যে রং আনতে চাইছি।

একটা ব্যাপার আমরা ভুলে গেছি, ক্যাথারিন মনে করিয়ে দিল, এখন কিন্তু যুদ্ধ হচ্ছে না।

লোকটি বললেন- আপনি ঠিকই বলেছেন। কিছু মেডেল কমাতে হবে।

ক্যাথারিন বলল– সবকটা মেডেল খুলে ফেলুন।

লোকটি বললেন- ঠিক আছে বস্।

প্রথম পর্বটা ভালোভাবে উতরে গেল। এবার লাঞ্চের সময় হয়েছে। ক্যাথারিন ক্যানটিনের দিকে চলে গেল। এককোণে বসল। ইউনিফর্ম পরা সৈন্যরা গোগ্রাসে খাবার খাচ্ছে।

একজন লোক সন্দেহভরা দৃষ্টিতে ক্যাথারিনকে দেখছে। সে এগিয়ে এসে ক্যাথারিনের পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। তাকে দেখে বুঝতে পারা যাচ্ছে, মতলবটা মোটেই ভালল নয়।

লোকটা বাজে বকবক করছে, ক্যাথারিনের চোখে মুখে বিরক্তির অভিব্যক্তি।

অবশেষে লোকটার হাত থেকে মুক্তি পেল সে।

তারপর? চলে যাবার আগে লোকটা তার নাম জানিয়ে গেল। সে বলল আমি ল্যারি ডগলাস।

ক্যাথারিন অবাক হয়ে গেল।

.

ফ্রেসার লন্ডন থেকে পরের দিন রাতে ফোন করলেন, ব্যাপার স্যাপার কেমন চলছে জানতে চাইলেন। সারাদিন কী ঘটেছে ক্যাথারিন সব জানিয়ে দিল।

পরদিন সকালবেলা দরজার বেলটা শব্দ করছে। ক্যাথারিন বাংলোর দরজা খুলে দিল। ডেলিভারি বয় দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একগোছা গোলাপ ফুল।

ক্যাথারিন আলেকজান্ডার?

হা।

–এখানে সই করুন।

–আঃ, ভারী সুন্দর গোলাপ।

–পনেরো ডলার লাগবে।

ক্যাথারিন তার হাতে ডলারটা তুলে দিল। কার্ডে লেখা আছে– আমি এই গোলাপ ফুলের দাম দিতে পারতাম। কিন্তু এখন আমার চাকরিটা চলে গেছে। তবুও ভালোবাসা এবং শুভেচ্ছা- ল্যারি।

ক্যাথারিন অবিশ্বাস্য চোখে কার্ডের দিকে তাকিয়ে আছে।

ডেলিভারি বয় জিজ্ঞাসা করল- কী বলব? আমি ফুলগুলো রেখে যাব কি?

 ক্যাথারিন রেগে গেল না, এই ফুলগুলো তুমি নিয়ে যাও।

ছেলেটি ক্যাথারিনের দিকে তাকাল। বলল–হ্যাঁ, উনি তাই বলেছিলেন। উনি বলেছিলেন, আপনি ফুলগুলো পেয়ে হেসে উঠবেন। তারপর রেগে যাবেন।

ক্যাথারিন বলল না, আমি কিন্তু হাসছি না।

এই ঘটনাটা সারাদিন ক্যাথারিনের মনকে ব্যস্ত রেখেছে। মিঃ ল্যারি ডগলাস। সত্যি কি? এই ভদ্রলোক অনেক স্বর্ণকেশিনীর সঙ্গে শয্যা ভাগ করে নিয়েছে। বাদামী চুলের মেয়েদের কাছে গেছে শরীর অন্বেষণে। এই মানুষটিকে মনের আকাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতেই হবে।

সন্ধ্যে সাতটা, ক্যাথারিন তখনও স্টেজে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও অনেক কাজ বাকি। আছে। 

তিনদিন পর শু্যটিং প্রায় শেষ হয়ে এল। ক্যাথারিন খুব চাপের মধ্যে আছে। টম ওব্রায়ান কিন্তু সাংঘাতিক ভালো কাজ করেছেন।

শনিবার সকালবেলা। ক্যাথারিন এবার উড়ান পাখির সওয়ার হয়ে ওয়াশিংটনে ফিরবে। একটা শহর ছাড়তে পেরে সে মনে মনে খুবই আনন্দ পেয়েছে। সোমবার সকাল। কাজের পাহাড় জমে গেছে।

লাঞ্চের আগে সেক্রেটারি অ্যানি বলল– কে একজন ল্যারি ডগলাস আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। তিনি হলিউড থেকে ফোন করেছেন। আপনি কি কথা বলবেন?

–না, ওনাকে বলে দাও, আমি কখনওই কথা বলব না।

তারপর? কী যেন মনে হল ক্যাথারিনের। সে বলল- ঠিক আছে, আমিই বলছি।

গুড মর্নিং। অনেকদিন বাদে তোমার গলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। তুমি গোলাপ ভালোবাসো না?

–ডগলাস, ক্যাথারিন কিছু বলতে চাইল, গোলাপ ভালোবাসি, কিন্তু তোমাকে ভালোবাসি না। তোমার সম্পর্কে কোনো কিছু শুনতে চাই না। ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছে তো?

–তুমি আমার সম্পর্কে কিছু জানো কি?

–হ্যাঁ, আমি সব জানি, তুমি ভবিষ্যতে আমাকে আর ডেকো না।

.

কাঁপতে কাঁপতে ক্যাথারিন রিসিভারটা নামিয়ে রাখল। তার চোখে জল এসেছে, দুঃখে নয়, জ্বালা-যন্ত্রণায়। কী সাহস লোকটার।

তিনদিন কেটে গেছে, লরেন্স ডগলাসের অনেকগুলো ছবি। লেখা আছে– বসকে দিলাম, ল্যারির কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা।

অ্যানি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ছবিগুলোর দিকে। বলছে– হায় ঈশ্বর, এ যে সত্যি দেখছি।

ক্যাথারিন বলল- সব কিছুই মিথ্যে, শুধু কাগজটাই সত্যি, যার ওপর ছবিগুলো ছাপা হয়েছে।

পরের দুসপ্তাহ ল্যারি ডগলাস অন্তত বারোবার ফোন করেছে।

ক্যাথারিন অ্যানিকে বলে দিয়েছে, এই ফোনগুলো যেন তাকে না দেওয়া হয়।

অ্যানি বেচারী কিছুই বুঝতে পারছে না। শেষ অব্দি ক্যাথারিন ফাইলের পাহাড়ে ডুবে গেল।

রোববার সকালে বিল ফ্রেসার ফিরলেন। ক্যাথারিন এয়ারপোর্টে গেল স্বাগত জানাতে। উনি বললেন- ক্যাথি, কী ভালো লাগছে বলো তো? তুমি এসেছ?

–আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।

আমার কথা মনে পড়েছে?

হ্যাঁ।

হলিউড কেমন?

-মোটামুটি, ছবিটি শেষ হয়েছে। বিল, একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না। যখন তুমি কোথাও যাবে, আমাকে নিয়ে যাবে তো?

-হ্যাঁ, আমিও প্রতি মুহূর্তে তোমাকে মনে করেছি। কিছু আলোচনা করতে হবে।

কখন করব?

 –আগে সত্যি করে বললো, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?

–ভীষণ-ভীষণ মিঃ ফ্রেসার।

তাহলে আজ আমরা সেই ভালোবাসার শুভ উৎসব পালন করি কেমন? চলো, জেফারসন ক্লাবে গিয়ে ডিনার খাব। তার পরেই, বিল বললেন, অনেকগুলো ফোন করতে হবে। তুমি আটটার সময় ক্লাবে আসবে কেমন?

ক্যাথারিন অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গেল। কিছু কাঁচাকুচি করতে হবে। ইস্ত্রির কাজ বাকি আছে। টেলিফোনের পাশে হেঁটে গেল। ভাবল, যে কোনো সময় রিং-এর শব্দ হবে। বুঝতে পারল, ল্যারি ডগলাসএখন পাগলের মতো হয়ে গেছে। কিন্তু আমার কী বা করার আছে?

শেষ পর্যন্ত ফোনটা বেজে উঠল।

–ফ্রেসার বলছি, ঠিক আছে তো সুন্দরী?

–না, এইমাত্র স্নান সারলাম।

আঃ, খারাপ লাগছে। তোমার স্নানের দৃশ্য দেখতে পেলাম না।

–আমারও খারাপ লাগছে সোনা।

–ঠিক সময়ে এসো কিন্তু।

 বিলের কথা ভাবতে ভাবতে সময় এগিয়ে চলেছে। উইলিয়াম ফ্রেসার। এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। নিজের নামের পাশে লেখা হবে শ্রীমতী উইলিয়াম ফ্রেসার। এক অসাধারণ অনুভূতি।

.

জেফারসন ক্লাব গ্রে স্ট্রিটে অবস্থিত। এই ক্লাবের মেম্বার হওয়া খুব একটা সহজ নয়। বংশ পরম্পরাতেই সদস্যপদ বিতারিত হয়ে থাকে।

উইলিয়াম ফ্রেসারের বাবা এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার ফ্রেসার খেতে আসে। ফরাসি খাবার তারা বেশি পছন্দ করে। ফ্রেসার বসেছিলেন। ক্যাথারিন ঢুকল।

আমার একটু দেরি হয়েছে।

 –তাতে কী হয়েছে? তোমাকে আজ ভারী সুন্দরী দেখাচ্ছে।

–হ্যাঁ, আমার নিজেরও তাই মনে হচ্ছে।

সত্যি বলছ ক্যাথি।

কথা এগিয়ে চলেছে।

ফ্রেসার বললেন- তুমি একটু ড্রিঙ্ক নেবে?

-না, তোমাকে ধন্যবাদ।

–তোমার স্বভাবটা আমি খারাপ করছি।

 –তুমি তো আমাকে এখনই খারাপ করে দিয়েছ।

সুখ, সুখ বুঝি উপছে পড়ছে।

তখনই ল্যারিকে দেখা গেল। মুখে হাসি। ক্যাথারিনকে দেখতে পেয়েছে। তার পরনে আর্মি পোশাক।

সে এগিয়ে এল। বলল- হ্যালো বিল। অনেক দিন বাদে আপনাকে দেখলাম।

ক্যাথারিন অবাক বিস্ময়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মন এখন নানা বিষাদে আচ্ছন্ন। সে কথা বলতে পারছে না।

ফ্রেসার বললেন- ক্যাথি, এ হল ক্যাপ্টেন লরেন্স ডগলাস। ল্যারি, এ হল মিস আলেকজান্ডার ক্যাথারিন।

ল্যারি তাকাল পরিষ্কার চোখে। চোখ থেকে কৌতুক ঝরছে।

মিস আলেকজান্ডার, আমি বলেছিলাম না, জীবনটা খুব ছোট্ট, কোথাও না কোথাও আবার আমাদের দেখা হবে।

ক্যাথারিন কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনা করে মুখ বন্ধ করল।

ফ্রেসার শান্তভাবে সব কিছু দেখলেন। ক্যাথারিন কিছু বলবে, এই আশায় তাকিয়ে ছিলেন।

ফ্রেসার প্রশ্ন করলেন– ল্যারি, তুমি আমাদের সঙ্গে বসবে কি?

–সত্যি, আমি বসলে কারও আপত্তি নেই তো?

না-না, বসে পড়ো।

 ল্যারি ক্যাথারিনের পাশের চেয়ারে বসল।

কী খাবে?

 –স্কচ আর সোডা, ল্যারি জবাব দিল।

 –আমিও তাই নেব। ক্যাথারিন বলল, ডাবল।

ফ্রেসার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

তুমি বলেছিলে, আমাকে কয়েকটা খারাপ স্বভাব শেখাবে। সেটা আজ থেকেই শুরু হোক।

–ড্রিঙ্কের অর্ডার দেওয়া হল। ফ্রেসার ল্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন- তোমার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। তুমি নাকি দারুণ লড়াই করেছ।

ক্যাথারিন ল্যারির দিকে তাকিয়ে আছে।

সে বলল– এই মেডেলগুলো?

–হ্যাঁ।

 –এগুলো কোথা থেকে এসেছে?

 –আর্মি কার্নিভালে পেয়েছিলাম।

 ফ্রেসার হাসলেন কার্নিভাল? ল্যারি আর এ এফ-এর এক সম্মানীয় সদস্য। সে হল আমেরিকান স্কোয়াড্রনের নেতা। এগুলো তার সাহসের পরিচায়ক।

ক্যাথারিন ল্যারির দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে এখন শ্রদ্ধা এসেছে।

ফ্রেসার বললেন-তুমি তো বলবে ভাই এখানে আসছ। তাহলে আরও জমজমাট উৎসব হত।

না, এটাই আমার ভালো লাগছে। ল্যারি বলল। সে ক্যাথারিনের দিকে তাকিয়ে আছে। অপলক।

-সত্যি কথা বলতে কী হলিউডে থাকতে থাকতেই আমি ব্যাপারটা আঁচ করেছিলাম। তুমি নাকি একটা ট্রেনিং ফিল্ম প্রোডিউস করছ?

সে সিগারেট ধরাল। দেশলাইটা পকেটে রাখল– আমি ওখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তো ছিলে না।

ফ্রেসার বললেন আমাকে লন্ডন যেতে হয়েছিল। ক্যাথারিন ওখানে ছিল। তোমাদের মধ্যে দেখা হয়নি কেন? ব্যাপারটা খুব আশ্বর্যের। 

ক্যাথারিন ল্যারির দিকে তাকাল। ল্যারিও তার দিকে তাকাচ্ছে। চোখে কৌতুক এবং বিস্ময়।

কথা এগিয়ে চলেছে।

ড্রিঙ্ক এসে গেছে। ক্যাথারিন আর একটার জন্য বলল। ব্যাপারটা খুবই খারাপ লাগছে। কিন্তু এই সন্ধ্যার ব্যথার্ত স্মৃতি তাকে ভুলতেই হবে।

ফ্রেসার জানতে চাইলেন, ল্যারি কীভাবে রণক্ষেত্রে সময় কাটিয়েছে।

 ল্যারির গল্প শুরু হয়েছে।

ক্যাথারিনের কিছু খেতে ভালো লাগছে না। কী খাচ্ছে, সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। সে মাঝে মধ্যে ল্যারির দিকে তাকাচ্ছে। কী আশ্চর্য, ল্যারি এখনও আমাকে এভাবে দেখছে কেন?

ল্যারি হাসি মুখে বলল- মিস আলেকজান্ডার, আপনি বোধহয় এই আলোচনা শুনতে রাজী নন। নাহ, এমন কিছু কথা বলা দরকার, যাতে আপনিও যোগ দিতে পারবেন।

ক্যাথারিন বলল- না, আমার জীবন বৈচিত্র্যবিহীন। আমি বিলের সঙ্গে কাজ করি।

-হ্যাঁ, আমি তাই জানি। ল্যারি বলল। বিলের দিকে তাকিয়ে সে বলল এই মেয়েটির মধ্যে তুমি কী গুণ দেখেছ?

ফ্রেসার বললেন মেয়েটা খুব ভাগ্যবতী। তোমার কি এখনও বিয়ে হয়নি?

ল্যারির মুখে হাসি কে আমাকে বিয়ে করবে?

বেজন্মা, ক্যাথারিন ভাবল। সে জানে, অন্তত বারোজন মেয়ের সাথে ল্যারির গোপন সম্পর্ক আছে। কিছু কিছু একেবারেই নিষিদ্ধ। কিছু সবার সমানে উন্মুক্ত। তাকে বলা যেতে পারে যৌন সম্রাট।

ক্যাথারিন প্রশ্ন করল ব্রিটিশ মেয়েরা কেমন?

শান্তভাবে ল্যারি বলল ওরা ভারী সুন্দর স্বভাবের। তবে আমি তো আকাশে উড়ে বেড়াতেই ভালোবাসি, মেয়েদের সাথে মেশার সময় থাকে না।

ক্যাথারিন বুঝতে পারল, আবার একটা ডাহা মিথ্যে।

সে বলল- আহা, বেচারী ওই মেয়েদের জন্য আমার খারাপ লাগছে।

ফ্রেসার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। ক্যাথি এভাবে কথা বলছে কেন? তিনি বললেন ক্যাথি, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

ল্যারি বলল- আর এক রাউন্ড ড্রিঙ্ক হয়ে যাক।

 ফ্রেসার বললেন– ক্যাথারিনের অনেকটা হয়ে গেছে।

না, অনেকটা হয়নি। এবার আমি বাড়ি যাব।

–ঠিক আছে, ফ্রেসার ল্যারির দিকে তাকালেন-ক্যাথারিন কিন্তু কখনও ড্রিঙ্ক করে না।

মনে হচ্ছে, তোমাকে দেখে ও উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। ক্যাথারিন ভাবল, জলের গ্লাসটা ল্যারির দিকে ছুঁড়ে মারলে কেমন হয়। আঃ, ঘৃণা ক্রমশ বাড়ছে।

পরের দিক সকালবেলা। হ্যাংওভার তখনও কাটেনি। ক্যাথারিন আনমনে শুয়ে আছে। আলসেমিতে হাই তুলছে। অনেক কিছু ভাবার চেষ্টা করছে। ল্যারি ডগলাস? কেন এল আবার আমার জীবনে? ধীরে ধীরে সে উঠে বাথরুমে গেল। শাওয়ারের তলায় দাঁড়াল। ঠাণ্ডা জল, সমস্ত শরীরে একটা সুন্দর অনুভূতি।

পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে সে ডেস্কে গিয়ে বসল। অ্যানি বলল- কী হয়েছে, একবার, ভেবে দেখো তো?

আজ সকালে?

–দেখো, সকালের-কাগজ।

প্রথম পাতায় ল্যারি ডগলাসের ছবি। লেখা আছে- আমেরিকার আর এ এফ বীর ওয়াশিংটনে ফিরেছে। তাকে একটা নতুন পদের প্রধান করা হয়েছে। দু কলমের প্রতিবেদন।

অ্যানি বলল- ব্যাপারটা উত্তেজক।

ক্যাথারিন বলল- ভয়ঙ্কর খারাপ। এসো, আমরা কাজ শুরু করি।

অ্যানি অবাক হয়ে গেছে। আমি খুবই দুঃখিত। আমি ভেবেছিলাম, ও তো তোমার বন্ধু। তোমার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।

না, ও আমার বন্ধু নয়, তুমি বলতে পারো, ও আমার শত্রু। ব্যাপারটা ভুলে গেলে বোধহয় ভালো হয়।

অ্যানি বলল- ঠিক আছে, আমি কখনও এবিষয় নিয়ে আলোচনা করব না। কিন্তু একটা খবর না দিয়ে পারছি না। ও কিন্তু তোমাকে তিনবার ফোন করেছে।

ক্যাথারিন বলল– তুমি কেন আগে বলোনি?

ব্যাপারটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে তোমাকে জানাইনি।

–ও কোনো নাম্বার রেখেছে?

না।

–ঠিক আছে।

এবার ক্যাথারিন কাজে যোগ দিল। অ্যানিকে বলল, যদি ডগলাস ফোন করে, রিসিভারটা আমাকে দিও, কেমন?

একটু বাদেই কাজের চাপে ডুবে গেল সে।

উইলিয়াম ফ্রেসারকে বিয়ে করতে হবে। এটাই ক্যাথারিনের শেষ সিদ্ধান্ত। সন্ধ্যে ছটা বেজে গেছে, এখনও কোনো ফোন আসছে না কেন?

অ্যানিকে সে বলল- ডগলাস ফোন করলে বলল, আমি চলে গেছি।

–গুড নাইট, মিস আলেকজান্ডার।

ক্যাথারিন এলিভেটরে পা দিল। ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল। বিল ফ্রেসার নিশ্চয়ই আমাকে বিয়ে করতে চাইবে। এখনই ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা দরকার।

এলিভেটরের দরজা খুলে গেল। ল্যারি দাঁড়িয়ে আছে। দেওয়ালের ওপর হেলান দিয়ে। সবকটা মেডেল এবং রিবন সে ছড়িয়ে দিয়েছে, সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের পোশাক পরেছে, তার মুখে হাসি।

সে বলল- এখন আমাকে ঠিক মানিয়েছে তো?

 ক্যাথারিনের চোখে ঘৃণা এবং বিস্ময়।

কী করে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে, বুঝতে পারছে না।

তারা পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে।

শেষ অব্দি ক্যাথারিন বলল- তুমি আমাকে একা থাকতে দাও। আমি এখন বিলের।

–বিয়ের আংটি কোথায়?

ক্যাথারিন সামনের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু এই মানুষটিকে এড়িয়ে কোথায় যাবে? ল্যারি কাছে এগিয়ে এসেছে। তার হাতে হাত রেখেছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করেছে।

ক্যাথি বলল- আমার কাছ থেকে তুমি কী চাইছ?

-সব কিছু। আমি তোমাকে চাইছি।

না, তা আর হয় না। তুমি অন্য কোনো শরীর নিয়ে মাতামাতি করো।

ক্যাথারিন ধাক্কা মেরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

–তুমি কী বলতে চাইছ?

–আমি জানি না, আমি জানি না। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। আমি মরতে চাইছি।

–এসো, আমার হাতে তোমার ওষুধ আছে।

 তারা গ্যারেজের দিকে এগিয়ে চলল।

–আমরা কোথায় যাচ্ছি?

–আমার গাড়িটা ওখানে পার্ক করা আছে।

ক্যাথারিন অবাক চোখে ল্যারির দিকে তাকিয়েছে। সে ভাবতে পারছে না, এখন কী করবে?

ল্যারি বলল– কোথায় যাবে? তোমার ফ্ল্যাটে, নাকি আমার বাড়িতে?

ক্যাথারিন মাথা নাড়ল যে কোনো জায়গাতে।

–তাহলে আমার বাড়িতেই যাই।

গাড়ি এগিয়ে চলেছে। উইলিয়াম ফ্রেসারের ছায়া ক্রমশ ঘণীভূত হচ্ছে।

ল্যারি টুকটাক গল্প করছিল। সে কথার মধ্যে আন্তরিকতা আছে। ক্যাথারিন জবাব দিতে পারছে না। শেষ অব্দি তারা শহরের এক প্রান্তে পৌঁছে গেল।

ল্যারি বলল- এই আমার বাড়ি।

ক্যাথারিন জানে, আর কোনো দিন ল্যারির ডাকে সে সাড়া দেবে না।

ল্যারির অ্যাপার্টমেন্টটা ভারী সুন্দর। দেওয়ালের রং মনকে আকর্ষণ করে। তারা এগিয়ে গেল। ল্যারি ক্যাথারিনের কোট খুলে দিল। ক্যাথারিন ঠান্ডায় কাঁপছে।

–তোমার কি শীত করছে?

–না।

–তুমি কি ড্রিঙ্ক নেবে?

–না।

হাতে হাত রাখল ল্যারি। এবার শুরু হল চুম্বন বৃষ্টি। ক্যাথারিনের হঠাৎ মনে হল, তার শরীরে বোধহয় আগুন লেগেছে। কোনো কথা না বলে ল্যারি তাকে বেডরুমে নিয়ে গেল। দুজনেই ধীরে ধীরে নিজেদের উন্মুক্ত করল। বিছানাতে ক্যাথারিন শুয়ে আছে। সম্পূর্ণ নগ্নিকা। ল্যারি পাশে এসে বসল।

শুরু হল ভালোবাসাবাসির অবুঝ খেলা। ল্যারির আগ্রাসী হাত ক্যাথারিনের সমস্ত শরীরে খেলা করছে। সে যেন এক নতুন জগত আবিষ্কার করছে। এত আনন্দ? এত উত্তেজনা? শেষ অব্দি ল্যারি তার আঙুল ঢুকিয়ে দিল অভ্যন্তরে। ধীরে ধীরে খুলে দিল সবকিছু। এবার? এবার আবেদনের চরম মুহূর্ত।

ক্যাথি? আবেগে গলা বুজে আসছে।

কী যেন একটা হয়ে গেছে। সুখ এবং আনন্দ। দুজনেই চাইছে অতীতকে ভুলে যেতে।

ক্যাথারিন, বাধা দেবার চেষ্টা করল না।

শেষ অব্দি সে বলল- তুমি আমাকে ভুলে গেলে কেমন করে?

ব্যাপারটা আমার কাছে একটা দুঃস্বপ্ন।

আবার দেখা হবে তো?

কেউ কাউকে ছাড়তে চাইছে না।

ক্যাথি, তুমি একটা অন্য মেয়ে, পৃথিবীতে একা এবং অনন্যা, তুমি কি তা জানো?

ক্যাথি জবাব দিতে পারছে না- হ্যাঁ, একবার তার মনে হল। অ্যালিস কিংবা সুসান, মার্গারেট কিংবা লানা, সবাই কি ল্যারির কাছে অন্য জগতের বাসিন্দা।

-তোমার সাথে আমার যখন প্রথম দেখা হয়, তখন থেকেই আমি তোমাকে অনন্যা রূপসী হিসেবে মেনে এসেছি।

ক্যাথি ভাবল- সব মিথ্যে কথা। জানেত কিংবা ইভলিন, রুথ কিংবা জর্জিয়া, নামের পর নামের মিছিল।

ল্যারি বলল- ভীষণ খিদে পেয়েছে। তুমি কি জানো আমি কী খেতে ভালোবাসি?

-হ্যাঁ, আমি জানি।

তাহলে, এখনই শুরু হোক শরীর বিস্ফোরণ। কেউ কাউকে ছাড়তে চাইছে না।

ল্যারি পা দুটো দুদিকে ফাঁক করে দিল। তার দণ্ডটা ঢুকিয়ে দিল। ক্যাথারিন সাহায্য করছে। ঝড় উঠেছে। এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে।

সবকিছু শেষ হয়ে গেল। ওরা পোশাক পরে নিল। গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি এগিয়ে চলেছে মেরিল্যান্ডের দিকে। এখানে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট আছে। সেটা বেশি রাত অব্দি খোলা থাকে। কাঁকড়া আর শ্যাম্পেন।

পরদিন সকাল পাঁচটা ক্যাথারিন উইলিয়াম ফ্রেসারের নাম্বারে ফোন করল। অনেকক্ষণ ধরে রিং-এর আর্তনাদ। আশি মাইল দূরবর্তী কোনো একটা জায়গা থেকে।

বিলের ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর- হ্যালো।

–হ্যালো বিল, আমি ক্যাথারিন।

ক্যাথারিন, সমস্ত সন্ধ্যে জুড়ে আমি তোমাকে ফোন করেছি। তুমি কোথায়? ঠিক আছো তো?

আমি ভালো আছি। আমি মেরিল্যান্ডে আছি। ল্যারি ডগলাসের সাথে। এইমাত্র আমরা বিয়ে করলাম!

.

 নোয়েলে, প্যারিস, ১৯৪১

০৮.

টাক মাথার ডিটেকটিভ তার ডেস্কে বসে আছেন। সিগারেট পুড়ছে। ভাঙা দাঁত। মনটা বিশেষ ভালো নেই। না, খবরগুলো সব ভুল হয়ে গেছে। মিস পেজের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছেন। এখন কী হবে ভাবতেই পারছেন না।

সুন্দরী কোনো মহিলা, আমার ক্লায়েন্ট হতে পারে কি? শুভ সন্ধ্যা মাদমোয়াজেল, বারবেড বললেন, ভেতরে আসুন।

মেয়েটি ঢুকে পড়ল, নোয়েলে, আহা, শরীরে মডেলের চিকনতা। ক্রিস্টিয়ান বারবেড তাকিয়ে থাকলেন। বললেন- বসুন। চেয়ার এগিয়ে দিলেন। ব্যান্ডি খাবেন? অন্য কিছু?

নোয়েলে কিছুই চাইল না। সে বলল– আপনার রিপোর্ট?

আঃ, খালি রিপোর্ট আর রিপোর্ট। বারবেড ভাবলেন– অনেক খবর আছে। প্রথম খবর, আপনার বন্ধু ক্যাপ্টেন হয়েছেন। তাকে অন্য একটা স্কোয়াড্রনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

–আর কিছু?

–মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে এখন উনি আছেন।

ছুটিতে?

না, ওনাকে আর এ এফ থেকে বাতিল করা হয়েছে। উনি এখন ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি এয়ার ক্রপসের ক্যাপটেন।

নোয়েলে খবরটা শুনেছে। মুখের অভিব্যক্তি শূন্যতায় ভরা। বারবেড একটা কাগজ দিলেন। বললেন- এটা বোধহয় আপনার ভালো লাগবে।

নোয়েলে কাঁপছে। ক্লিপিংটা নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজ থেকে আনা হয়েছে। ল্যারি ডগলাসের ছবি, তার বউয়ের ছবি। নোয়েলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। কী করবে বুঝতে পারছে না।

নোয়েলে বলল- ওয়াশিংটনে আপনার কোনো করসপনডেন্ট নেই? একজনকে রাখতেই হবে। প্রত্যেক সপ্তাহের ঘটনা আমাকে জানাতে হবে।

ঘর থেকে সে চলে গেল। ক্রিস্টিয়ান বারবেড একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছেন।

নোয়েলে তার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গেল। বেডরুমে গেল। ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। এনভেলাপ থেকে কাগজের টুকরোটা বের করল। ভালো করে পড়ল। হ্যাঁ, ল্যারির ছবি। যেরকম মনে আছে, আর একটা ছবি, সেটা তো কোনো পত্রিকায় ছাপা হয় না।

নোয়েলে প্রতিদিন ল্যারির কথা ভেবেছে। ঘৃণা অথবা ভালোবাসা।

 ল্যারির নববিবাহিতা বধূটি। হ্যাঁ, সুন্দরী, বয়স বেশি নয়। মুখে বুদ্ধির ছাপ আছে। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি।

শত্রুর মুখ, এমন একটা মুখ, যা মনটাকে নষ্ট করেছে।

নোয়েলে অনেকক্ষণ এই ফটোগ্রাফটির দিকে তাকিয়ে ছিল। বলতে গেলে সমস্ত সন্ধ্যেটা।

বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে গেছে। আরমান্দ গটিয়ার বেডরুমে প্রবেশ করেছেন। নোয়েলে তাকে বাইরে যেতে বলেছে। তিনি বাইরে বসে আছেন– ড্রয়িংরুমে। বুঝতেই পারছেন, আজ নায়িকার মন ভালো নেই।

শেষ পর্যন্ত নোয়েলে বিছানা থেকে উঠল। না, তাকে তো আবার বেঁচে থাকতেই হবে।

 থিয়েটার শেষ হয়ে গেছে। নোয়েলে গটিয়ারের কাছে চলে এল। ভালোবাসার অভিনয় করল।

সমস্ত রাতে সে কর্নেল মুলারের স্বপ্ন দেখেছিল। আলবিনো গেস্টাপো। জীবনটা তছনছ করে দিতে চাইছে। ল্যারির কথা মনে পড়ে গেল। ল্যারির মুখ। নোয়েলের সমস্ত শরীরে শীতল ঘামের শিহরণ। হৃদয়ের গতি অত্যন্ত দ্রুত হয়েছে। সে বেডসাইড ল্যাম্পটা বন্ধ করে দিল। সিগারেট ধরাল। একগাদা ছবি হেঁটে চলেছে। ইসরায়েল কাটজ কেমন আছেন?

একটা পা কেটে দেওয়া হয়েছিল, তীক্ষ্ণ কুঠার দিয়ে। মানুষটার এত শক্তি?

নোয়েলে জানে না, গেস্টাপো তাকে গ্রেপ্তার করবে কিনা। এটা কি স্বপ্ন? ভয়ের উচ্চারণ? ইসরায়েল কাটজ কি কোনো সাহায্য করতে পারবেন?

নোয়েলে অনেকক্ষণ বিছানাতে শুয়ে থাকল। হা, ওই ভদ্রলোক আমার জীবনে একটা বড়ো সাহায্য করেছিলেন। ল্যারির বেবিকে আমি হত্যা করেছি। আমি চাকরি করছি, এর অন্তরালেও ইসরায়েলের হাত আছে।

নোয়েলে ভাবল, সময় হলে ইসরায়েল নিশ্চয়ই আবার সাহায্য করবেন।

নোয়েলের সামনে এখন সমস্যার পাহাড়। কর্নেল মুলার তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছেন। স্বপ্নটা ভেঙে গেল। ইসরায়েল কাটজকে কি প্যারিসের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে? সবকটা পথ বন্ধ। নাজিরা চারপাশে পাহারা দিচ্ছে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা কেমন করে করা হবে।

আরমান্দ গটিয়ারের মনটা ভালো নেই। নাজিরা যে কোনো মুহূর্তে আক্রমণ শানাতে পারে। কর্নেল মুলার এবং জেনারেল সিডার, এই দুজনে মিলে প্যারিসের বুকে নরকের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছেন।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা নোয়েলের স্বপ্নটা সফল হল কি? সে আর আরমান গটিয়ার একটা পার্টিতে গিয়েছিল। সেলসি রোকাস এই পার্টিটা ডেকেছিলেন। শিল্প ও সংগীতের এক পৃষ্ঠপোষক। অনেকে সেখানে এসেছিলেন, বিশিষ্ট ব্যাঙ্কাররা, শিল্পীরা, রাজনৈতিক নেতারা। শহরের সেরা সুন্দরীরা। নোয়েলের মনে হল, সে এখানে একেবারেই বেমানান।

এবার ডিনারের ঘোষণা করা হবে। মিনিট পনেরো বাকি আছে। দরজা ঠেলে কে যেন ঢুকে পড়ল। তার সমস্যা সমাধান হতে চলেছে। সে চলে গেল লেসলির কাছে।

বলল- ডারলিং, আমাকে অ্যালবার্ট টেলরের পাশে বসতে দেবেন?

.

অ্যালবার্ট টেলর হলেন ফরাসি দেশের সবথেকে নামকরা চিত্রনাট্যকার। বছর ষাট বয়স হয়েছে, চুলের রং সাদা। কাঁধ এখনও যথেষ্ট দৃঢ়। ফরাসিরা এত উচ্চতা বিশিষ্ট হয় না। তিনি যে কোনো জনতার মধ্যে নিজেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারেন। চোখ দুটো সবসময় ঘুরছে, কোনো কিছুর সন্ধান করছেন বুঝি।

তাঁর নতুন নাটকে নোয়েলে যদি প্রধান অভিনেত্রী হয়, তা হলে তিনি খুবই খুশি হবেন। ইতিমধ্যে পাণ্ডুলিপির একটা কপি পাঠানো হয়েছে। ডিনারের আসর।

নোয়েলে বলল- আপনার নতুন নাটকটা পড়লাম অ্যালবার্ট। দারুণ হয়েছে।

 মুখে উজ্জ্বলতা- আপনি অভিনয় করবেন তো?

নোয়েলে হাতে হাত রাখে- হ্যাঁ, আমি করব। আরমাল আমাকে আর একটা নাটকের দায়িত্ব দিয়েছে।

ভদ্রলোকের মুখে ঘৃণা- তাহলে? আমরা সারদিন কাজ করতে পারব।

-হ্যাঁ, আপনার সাহচর্য আমার ভালো লাগবে। আপনার লেখার আমি দারুণ ভক্ত। আমি বুঝতে পারি না, কীভাবে আপনারা মানুষের মনের কথাকে লিখতে পারেন।

কাঁধে ঝাঁকানি– যেভাবে আপনি অভিনয় করেন, এটা হল আমাদের ব্যবসা। এভাবেই আমরা জীবিকা সংগ্রহ করে থাকি।

–না, এটাকে পেশা বলবেন না। এটা একটা অলৌকিক ক্ষমতা।

 মুখে হাসি আমি জানি, আমি লেখার চেষ্টা করেছি।

সত্যি।

–কিন্তু রণে ভঙ্গ দিয়েছি। নোয়েলে বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলল। সে অ্যালবার্ট টেলরের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে দিল। স্বর নামিয়ে আনল। আমার হিরোইন তার প্রেমিককে বাইরে নিয়ে যেতে চাইছে। নাজিরা ওই প্রেমিককে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

তার মানে? ব্যাপারটা সহজেই সমাধান করা যায়। লোকটাকে জার্মান ইউনিফর্ম পরিয়ে দিন। সে গটগট করে হেঁটে যাবে।

না, তা সম্ভব নয়। সে আহত এবং অসুস্থ। তার একটা পা নেই, সে হাঁটতে পারে না।

অনেকক্ষণ চিন্তা। তারপর উত্তর–সাইন নদীর ওপরে একটা বাঁধ ভেসে যাবে।

–আচ্ছা বলুন।

প্যারিস থেকে যেসব জাহাজ অথবা বাস যাচ্ছে, সেগুলোর ওপর নজর রাখা হচ্ছে কি?

হা।

–তাহলে নাজিদের সাহায্য নিতে হবে।

কীভাবে?

–আপনার হিরোইন, সে কি খুব সুন্দরী?

–হ্যাঁ।

-তাহলে আপনার হিরোইনকে একটা জার্মান পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে। উঁচু পদের মানুষ। এটা কি সম্ভব?

নোয়েলের দিকে উনি আবার তাকালেন।

 নোয়েলে বলল- হতে পারে।

তাহলে? অফিসারের সঙ্গে প্রেমের খেলা। ভালোবাসার লটকা-লটকি। সপ্তাহের শেষে প্যারিসের বাইরে তারা কোথাও চলে যাবে। হিরোর বন্ধুরা তাকে গাড়ির ডিকিতে লুকিয়ে রাখবে। অফিসারের গাড়ি। পুলিশ সহজে নজর দেবে না।

যদি এটা বন্ধ থাকে, তাহলে?

অ্যালবার্ট টেলর ওয়াইনে মুখ দিলেন। ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলেন। বললেন, না, সাধারণত তা হয় না।

আরও পাঁচ মিনিট নোয়েলের সঙ্গে কথা বললেন। কণ্ঠস্বর খুবই চাপা। কথা শেষ হয়ে গেল। বললেন– শুভ ভাগ্য। আশা করি আমার বুদ্ধিটা কাজে দেবে।

তারপর তিনি নোয়েলের দিকে আর ফিরেও তাকাননি।

.

পরের দিন সকালবেলা, নোয়েলে জেনারেল সিডারকে ফোন করল। সুইচবোর্ডে অপারেটরের গলা। কিছুক্ষণ বাদে নোয়েলে সঠিক জায়গাতে পৌঁছোতে পারল।

–কে জেনারেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন?

নোয়েলে পেজ।

–আমি দুঃখিত। জেনারেল এখন কনফারেন্স করছেন। তাকে বিরক্ত করা যাবে না।

–কিছুক্ষণ বাদে আমি ফোন করতে পারি কি?

–আজ সারদিন ধরে তারে কনফারেন্স আছে। আপনি একটা চিঠি লিখে আপনার মনের কথা খুলে বলুন।

নোয়েলে ভাবল, চিঠি দিয়ে কী লাভ? সে বলল- ঠিক আছে, ওনাকে বলবেন, আমি ফোন করেছিলাম।

এক ঘণ্টা বাদে ফোনটা চিৎকার করতে শুরু করেছে আমাকে ক্ষমা করো, ওরা বুঝতেই পারেনি। তোমার একটা ফোনের মূল্য আমার কাছে কতখানি।

–আমারও ক্ষমা চাওয়া উচিত। আমি জানি, আপনি খুবই ব্যস্ত।

–তোমার জন্য কী করব?

–ডিনারে কী বলেছিলেন মনে আছে?

–হ্যাঁ।

–আমি অনেক কিছু ভাবছি। অনেক দিন আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি হানস। আপনাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।

–আজ রাতে একসঙ্গে ডিনার খাবে?

কণ্ঠস্বরে জেগেছে কৌতূহল। প্যারিসে নয়, আমরা অন্য কোথাও যাব। প্যারিস থেকে কিছুটা দূরে।

-কোথায়?

–কোনো একটা বিশেষ জায়গায়। আপনি কি এটরাটাট গেছেন?

না।

–একটা ছোট্ট গ্রাম। একশো কিলোমিটার দূরে। লে হারের কাছে। ওখানে একটা পুরোনো সরাইখানা আছে।

ব্যাপারটা সত্যি ভালো লাগছে নোয়েলে। কিন্তু আমি এখন যাব কী করে? আমি তো একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাঝখানে।

-ঠিক আছে, আজকে নয়, অন্য একদিন।

–আচ্ছা। কবে তোমার সুযোগ ও সময় হবে?

শনিবার, সন্ধ্যেবেলা শো-এর পর।

–আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব। আমরা এরোপ্লেনে যাব?

–না, আমরা ড্রাইভ করব। এটা ভারী সুন্দর।

–ঠিক আছে, আমি থিয়েটার থেকে তোমাকে তুলে নেব।

–আমি বাড়িতে আসব। পোশাক পালটাব। অ্যাপার্টমেন্টে আসবেন। ঠিক আছে?

–ঠিক আছে সুন্দরী তোমার যা ইচ্ছে। তাহলে শনিবার সন্ধ্যেবেলা দেখা হবে।

নোয়েলে বলল- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে ফরাসি দেশের সবথেকে বুদ্ধিমান মানুষ এই পরিকল্পনাটা করেছেন।

নোয়েলে তার অ্যাপার্টমেন্টের এনট্রান্সের বাইরে চলে এল। লাউঞ্জে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় সে যেন খবরের কাগজ পড়ছে। শীতের বাতাস। সবকিছু কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

লোকটি হঠাৎ লম্বা হয়ে দাঁড়াল।

.

নোয়েলের অভিনয় শেষ হয়েছে, কর্নেল মুলার ব্যাকস্টেজে দাঁড়িয়ে আছেন। নোয়েলের মনে একটা আতঙ্কের পরিবেশ। খুব তাড়াতাড়ি কাজ করতে হবে। দেরী করা চলবে না।

–আমি সামনে থেকে আপনার অভিনয় দেখলাম ফয়লিন পেজ, প্রতিটি রজনীতে আপনি আরও উন্নতি করছেন।

কর্নেল মুলারের কণ্ঠস্বর, গলার ভেতর কোমলতা এবং তীক্ষ্ণতার সুর।

–আপনাকে ধন্যবাদ কর্নেল, আমি পোশাক পাল্টে আসছি, কেমন?

নোয়েলে ড্রেসিং রুমের ভেতর ঢুকে গেল। কর্নেল তাকে অনুসরণ করছেন।

সে আর একটু ভেতরে গেল। টেকো অ্যালবিনো কর্নেল পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। এরপর তিনি আর্মচেয়ারে বসলেন। নোয়েলে একটু কী যেন ভাবল, সামনেই পোশাক পাল্টাতে শুরু করল। সে জানে, কর্নেল সমকামী, এটাই হয়েছে সমস্যা, তার সবথেকে দামী অস্ত্রটা সে ব্যবহার করতে পারছে না। তার যৌনতা।

–আমার কানে একটা চড়াই কিচিরমিচির করছে, কর্নেল মুলার বললেন, সে আজ রাতে পালাবার চেষ্টা করবে।

নোয়েলের হৃৎপিন্ড স্তব্ধ হয়ে গেছে। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, মেকাপ তুলতে : তুলতে সে কিছু বলার চেষ্টা করল– কেআজ পালাবে?

আপনার বন্ধু ইসরায়েল কাটজ।

নোয়েলে হতভম্ব। সব কথা মনে পড়ে গেল বুঝি। এতই বোকা সে, ব্রেসিয়ারটা পর্যন্ত খুলে ফেলল।

–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, ও মনে পড়েছে, সেই অল্প বয়সী ইনটান, যে কয়েক মাস আগে আমাকে নিউমোনিয়া থেকে সারিয়েছিল।

–শুধু নিউমোনিয়া নয়, গর্ভপাতেও সাহায্য করেছিল।

কর্নেলের কণ্ঠস্বর, আগের মতো নিস্পৃহ এবং নিরাপত্তাহীন।

নোয়েলে অবাক হয়ে গেছে। জার্মানরা এত শক্তিশালী? পেটের খবর জানল কী করে?

চলচ্চিত্র শুরু হয়ে গেছে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেষ পরিণতি জানা যাবে। ইসরায়েল কাটজ হয় জীবিত, অথবা মৃত কোনটা ঘটবে?

কর্নেল মুলার বললেন আপনি বলছেন, কয়েক সপ্তাহ আগে কাটজের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে কাফেতে, তাই তো?

না, কর্নেল আমি এমন কথা কখনও বলিনি।

 কর্নেল নোয়েলের মুখের দিকে তাকালেন। বললেন– ভালো জিনিস আমারও ভালো লাগে। কিন্তু আপনাকে ধ্বংস করতে হাত কাঁপবে আমার।

কর্নেল মুলার আবার তাকালেন। কেটে কেটে বললেন- ফয়লিন, আমি আপনাকে সাংঘাতিক শিক্ষা দেব। আর সেটা আমি তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করব। একটু বাদে তিনি বললেন, জেনারেল সিডারকে বলেছি এই অভিযানটা বন্ধ রাখতে।

নোয়েলের মনে হল, এবার সত্যি বুঝি সে মরে যাবে– কর্নেলরা বুঝি জেনারেলদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আলোচনা করে?

–না, এক্ষেত্রে করবে না, কর্নেল মুলার বললেন, জেনারেল সিডার তার অভিযান বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।

তিনি ঘর থেকে চলে গেলেন। নোয়েলের হৃৎপিন্ড তখনও ধুকধুক করে এগিয়ে চলেছে। সে সোনার ঘড়িটার দিকে তাকাল। পোশাক পরতে শুরু করল।

.

 এগারোটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট, বিশ্বস্ত গুপ্তচর মারফত খবর পেয়েছে– জেনারেল সিডার এখন তার অ্যাপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে আসছেন। গুপ্তচরের কণ্ঠস্বরে কাঁপুনি।

গাড়িতে ড্রাইভার আছে?

না, মাদমোয়াজেল, এই উনি এসে পড়লেন বলে।

 নোয়েলে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল। বেডরুমে চলে গেল। লাগেজ গুলো পরীক্ষা করল। কোথাও যেন কোনো ভুল না হয়। ডোরবেলের শব্দ। নোয়েলে লিভিংরুমে গেল। দরজাটা খুলে দিল।

করিডরে জেনারেল সিডার দাঁড়িয়ে আছেন। তার ড্রাইভার, এক অল্পবয়সী ক্যাপ্টেন পেছনে। সিডারকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। চারকোল রঙের স্যুট পরেছেন। হালকা নীল শার্ট, কালো টাই।

শুভ সন্ধ্যা।

তিনি ভেতরে ঢুকলেন।

নোয়েলে বলল- আমার ব্যাগ বেডরুমে আছে।

ধন্যবাদ ফয়লিন, ক্যাপ্টেন ড্রাইভার বলল। সে বেডরুমে ঢুকে গেল।

সারাদিন আমি তোমার কথাই ভেবেছি, জেনারেল সিডার বললেন। ফোন করিনি, ভেবেছি, তুমি যদি মত পাল্টাও।

–আমি আমার শপথ রাখতে চেষ্টা করি।

ক্যাপ্টেন বেরিয়ে এসেছে। একহাতে মেকাপ কেস, অন্যহাতে ওভারনাইট ব্যাগ।

সে জিজ্ঞাসা করল আর কিছু আছে।

নোয়েলে বলল- না, আর কিছু নেই। নোয়েলে আর কিছু বলতে চাইল, একটু ড্রিঙ্ক করলে কেমন হয়? যাবার আগে মনটা তরতাজা হবে।

সে শ্যাম্পেন নিয়ে এল। কিছুটা বরফ আনল।

জেনারেল বললেন আমি বানাচ্ছি।

-কীজন্য আমাদের এই পান উৎসব?

হাসতে হাসতে নোয়েল বলল– অভিযান এটরাটাট।

গ্লাসে গ্লাসে ঠোকাঠুকি। পান শুরু হল। নোয়েলে তার গ্লাস নামিয়ে রাখল। রিস্টওয়াচের দিকে তাকাল। জেনারেল কথা বলছেন। নোয়েলে কিছুই শুনছে না। নীচে কী ঘটছে, সে কথাই নোয়েলে চিন্তা করছে। এখন তাকে আরও সাবধানী হতে হবে। তার অভিব্যক্তির মধ্যে একটা কাঠিন্য আনতে হবে।

কী চিন্তা করছ?

–কিছুই না।

 তুমি আমার কথা শুনছ না?

–আমি অন্য কিছু ভাবছিলাম কি? ভাবছি এই অভিযানটা কেমন হবে?

–তোমার আচরণ আমাকে অবাক করে দেয়।

–সব মেয়েরাই তো রহস্যের রত্নখনি।

–না, ওদের কেউ তোমার মতো না। তুমি অসাধারণ রূপবতী, আবার তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে।

–হানস, আপনি কি দুঃখিত?

–না-না, আমি ভাবছি, দিনগুলো কেমন ভাবে কাটবে? একটা রোমান্টিক অভিযান।

–আর কিছু বলবেন কি?

–না, আমি সমস্যার সমাধান করতে ভালোবাসি, এবার আমি তোমাকে সমাধান করব।

 কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে নোয়েলে বলল– সমাধান হয়ে গেলে জীবনটা পানসে হয়ে যায় নাকি?

জেনারেল গ্লাস নামিয়ে রেখে বললেন এবার আমরা বেরোব, তাই তো?

 নোয়েল খালি শ্যামপেনের গ্লাসগুলো হাতে নিল। বলল– এগুলো সিঙ্কে রেখে আসছি।

সে কিচেনের মধ্যে চলে গেল। তার নিতম্বের গতি এবং চঞ্চলতা জেনারেলকে অবাধ্য করে তুলেছে। এমন একটি মেয়ে, দেখা যাক, অথচ কর্নেল মুলার বলেছিলেন যে, এই অভিযানটা বাতিল করতে। রাইকের মহামান্য অধিপতি, কর্নেল মুলার বোধহয় ঠিক বুঝতে পারছেন না।

নোয়েলে কিচেন থেকে বেরিয়ে এল। তার মুখে বিরক্তি এবং উদ্বিগ্নতার ছাপ আপনার ড্রাইভার কটা ব্যাগ নিয়ে গেছে?

দুটো।

 –হায়, ভুল হয়ে গেছে, আর একটা কেস পড়ে আছে।

নোয়েলে টেলিফোনের দিকে গেল। বলল- জেনারেলের ড্রাইভারকে একবার আসতে বলো তো।

রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।

জেনারেল বললেন– যদি আমাকে খুশি করতে চাও, তাহলে বেশি পোশাক নিয়ো না কিন্তু।

আরমান্দ গটিয়ারের একটা ছবি, দেওয়ালে টাঙানো, পিয়ানো বাজাচ্ছেন।

জেনারেল জানতে চাইলেন আরমান গটিয়ার কি জানেন, তুমি আমার সঙ্গে যাচ্ছো।

-হা, নোয়েলে নির্ভেজাল মিথ্যে বলল।

 ডোরবেলের শব্দ। নোয়েলে দরজাটা খুলে দিল। ক্যাপ্টেন জানতে চাইল– মনে হচ্ছে, আর একটা ব্যাগ রয়ে গেছে।

-হ্যাঁ, নোয়েলে বলল, ওটা বেডরুমে আছে।

ক্যাপ্টেন বেডরুমে ঢুকে গেল।

জেনারেল জানতে চাইলেন– আমরা কবে বাড়িতে ফিরব?

নোয়েলে বলল– আমি তো অনেকদিন থাকতে রাজী আছি। কিন্তু সোমবার বিকেলের মধ্যে ফিরতেই হবে। অর্থাৎ আমাদের হাতে দুদিন থাকবে।

ক্যাপ্টেন বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল– ক্ষমা করবেন ফয়লিন, সুটকেসটা কেমন দেখতে?

–বিরাট আকারের, নীল রঙের। নোয়েলে বলল, সে জেনারেলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি একটা নতুন গাউন কিনেছি। সেটা ওখানেই ভাঙব।

প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন সে, হাসি দিয়ে উদ্বিগ্ন ঢাকার চেষ্টা করছে।

ক্যাপ্টেন আবার ফিরে এল আমি দুঃখিত, আমি ঠিক খুঁজে পাচ্ছি না।

নোয়েলে বলল– আমি দেখছি, সে বেডরুমে পৌঁছে গেল। ক্লোসেটগুলো খুলে খুলে দেখতে থাকল।

–বোকা কাজের মেয়েটা বোধহয় এটা কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। তারা তিনজন ক্লোসেট দেখছে। শেষ পর্যন্ত জেনারেল ব্যাগটাকে পেলেন।

বললেন– এটা তো ফাঁকা বলে মনে হচ্ছে।

নোয়েলে তাড়াতাড়ি ব্যাগটা খুলল। তারপর বলল- ইস, মেয়েটা কী বোকা। আমার নতুন ড্রেসটা ও বোধহয় অন্য পোশাকের মধ্যে খুঁজে দিয়েছে। ওটা বোধহয় একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

জেনারেল হাসলেন, নোয়েলেকে ভারী ভালো লাগছে তার।

নোয়েলে বলল– ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠছি আমি, মনে হচ্ছে আমি যেন স্কুল কিশোরী।

এবার যেতে হবে, জেনারেল তাড়া দিলেন। তা না হলে ঠিক সময়ে পৌঁছোনো যাবে না।

ওরা লবিতে নেমে এসেছে। সেই কমরেড তখনও দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ চকের মতো সাদা। নোয়েলের মনে হল, কিছু একটা ভুল হয়ত হয়েছে। সে ওই লোকটির দিকে তাকাল। কোনো সংকেত? লোকটির কিছু বলার আগেই জেনারেল নোয়েলের হাতে হাত রাখলেন। অতি দ্রুত বাইরে চলে এলেন।

লিমুজিনটা দরজার সামনে দাঁড় করানো। রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা। ড্রাইভার দরজাটা খুলে দিল। নোয়েলে ঢুকে পড়ল। লবির দিকে তাকাল। লোকটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারা যাচ্ছে না, পরিকল্পনাটা সফল হল কিনা–এই উত্তেজনাটা বহন করাই কষ্টকর।

জেনারেল জানতে চাইলেন- তুমি ঠিক আছে তো?

নোয়েলের হাত-পা কাঁপছে, সে তবুও হাসার চেষ্টা করছে।

নোয়েলে বলল- একজন বন্ধু আমাকে ফোন করবে। ওর জন্য একটা মেসেজ রেখে আসতে হবে।

ভেতরে যাবার চেষ্টা করছিল, জেনারেল তার হাতে হাত রেখে বললেন– অনেক দেরী হয়ে গেছে সোনামনি। এখন থেকে তুমি শুধু আমার কথাই ভাববে।

গাড়িটা চলতে শুরু করল।

.

পাঁচ মিনিট কেটে গেছে, কালো মার্সিডিজ এসে থামল। কর্নেল মুলার নামলেন, গেস্টাপোর আর দুজন প্রতিনিধি।

গুপ্তচর বলল- ওরা চলে গেছেন।

 কর্নেল চিৎকার করলেন কোনদিকে? সঙ্গে কে ছিল?

ফয়লিন পেজ।

–এবার কী হবে? কর্নেল জানতে চাইলেন।

 গুপ্তচর বলল- মঁসিয়ে, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। মেয়েটি এক আর্মি অফিসারের সঙ্গে বেরিয়ে গেল।

-কোথায় যাবে কিছু শুনেছ?

–না মঁসিয়ে, মাদমোয়াজেল পেজ সেটা আমাকে বলেননি। লোকটা হাসছে।

 কর্নেল ওই বুড়ো লোকটির দিকে তাকালেন। বললেন– ওরা নিশ্চয়ই বেশি দূর যেতে পারবে না।

এখন রাস্তায় খুব একটা গাড়ি থাকে না। হু-হু করে লিমুজিন ছুটে চলেছে। ওয়েস্ট রোড ধরে। প্যারিসকে টা-টা গুডবাই করে। মারসেইলের পাশ দিয়ে মানটাসকে এড়িয়ে। শেষ অব্দি গাড়িটা ভিসিতে এসে পৌঁছোল।

নোয়েলের মনে হল, এখনও অলৌকিক ঘটনা ঘটে। প্যারিস থেকে তারা বাইরে বেরিয়ে এল, অথচ কোনো জায়গায় গাড়িটাকে পরীক্ষা করা হল না।

বলতে না বলতে একটা গাড়ি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আর্মি লেফটেন্যান্ট গাড়ি থেকে নেমে এলেন। বললেন- আপনার স্বীকৃতিপত্র দেখাবেন।

জেনারেল সিডারের মুখ রাগে থমথম করছে। তিনি বললেন– আমি জেনারেল সিডার। এখানে এসব কী নাটক হচ্ছে?

লেফটেন্যান্ট বললেন- জেনারেল, আমি জানতাম না, এটা আপনার গাড়ি।

জেনারেলের চোখে রাগ কী হচ্ছে এখানে?

–আমাদের আদেশ দেওয়া হয়েছে, প্যারিস থেকে যেসব গাড়ি বাইরে যাচ্ছে, সেগুলো তল্লাশি করতে। সব কটা রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

জেনারেল নোয়েলের দিকে তাকিয়ে বললেন- গেস্টাপোর নিকুচি করেছে। সোনা, আমি দুঃখিত।

নোয়েলের মনে হল, তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কী হবে এখন?

সে জানে, ট্রাঙ্কের ভেতর কী আছে। যদি পরিকল্পনাটা কাজ করে থাকে ইসরায়েল কাটজ সেখানে লুকিয়ে আছেন। এক্ষুনি তাকে ধরে ফেলা হবে। আমাকেও বন্দী হতে হবে।

জার্মান লেফটেন্যান্ট ড্রাইভারের দিকে তাকালেন।

 লাগেজ কমপার্টমেন্টটা এখনই খুলতে হবে।

 লাগেজ ছাড়া ওখানে আর কিছু নেই, ক্যাপ্টেন বলল, আমি নিজে হাতে তুলেছি।

 ক্যাপ্টেন আমি দুঃখিত, আমার ওপর এই ধরনের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

ড্রাইভার দরজাটা খুলে দিল। সামনে এসে দাঁড়াল। নোয়েলের মন এখন কাজ করতে শুরু করেছে। এখনই কিছু একটা করতে হবে। সে জেনারেলের দিকে তাকাল।

–হানস, আমরা কি এখান থেকে নেমে যাব? আমাদেরও কি পরীক্ষা করা হবে?

রাগে তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে।

 জেনারেলের কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য তিনি বললেন, ড্রাইভার তুমি গাড়িতে চলে এসো।

লেফটেন্যান্টের দিকে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন- আপনি কি জানেন? এসব আদেশগুলো জার্মান আর্মি জেনারেলদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? আমি কখনও লেফটেন্যান্টের কাছ থেকে কোনো অর্ডার শুনব না। রাস্তাটা খালি করে দিন।

লেফটেন্যান্ট জেনারেলের রাগী মুখের দিকে তাকালেন। বললেন- ইয়েস জেনারেল সিডার, আমি তাই করছি।

গাড়ি এগিয়ে চলল। নোয়েলে একটু শান্তি পেল। সমস্যাটা কেটে গেছে। ইসরায়েল কাটজ কি ট্র্যাঙ্কের মধ্যে আছেন? এখনও বেঁচে আছেন কি?

জেনারেল নোয়েলের দিকে তাকালেন, এখনও রাগ ঝরে পড়ছে তার চোখ থেকে। তিনি বললেন আমি দুঃখিত, এটা অদ্ভুত যুদ্ধ। গেস্টাপোদের মনে করে দেওয়া উচিত, যুদ্ধ চালায় সৈনিকেরা।

এবং সৈনিকদের চালায় আপনার মতো জেনারেলরা।

–ঠিকই বলেছ, সৈনিকদের মাথায় আছে জেনারেলরা। চলো, আমি ফিরে এসে কর্নেল মুলারকে উচিত শিক্ষা দেব।

.

দশ মিনিট কেটে গেছে। গেস্টাপো হেডকোয়াটারে ফোন এল।

–গাড়িটা চলে গেছে, লেফটেন্যান্ট খবর দিলেন।

–কতক্ষণ আগে?

অফিসার জানতে চাইলেন।

দশ মিনিট।

–গাড়িটা পরীক্ষা করেছিলে?

লেফটেন্যান্ট বললেন– না স্যার, জেনারেল অনুমতি দেননি।

–কোন দিকে যেতে পারে বলে অনুমান।

লেফটেন্যান্ট আমতা আমতা করে বলতে থাকেন, রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা চলে গেছে সমুদ্রের দিকে। অন্যটি রুয়েনের দিকে। আমি বুঝতে পারছি না, গাড়িটা কোন পথে যাবে।

কাল সকাল নটায় গেস্টাপো হেডকোয়াটারে এসে রিপোর্ট করো, কেমন?

লেফটেন্যান্ট বললেন- ঠিক আছে তাই করব।

কর্নেল মুলার বিভিন্ন জায়গায় ফোন করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন আমার গাড়িটা এখনই বের করো। আজ রাতে আরশোলা অভিযানে বের হতে হবে।

.

লে হাবরে রাস্তাটা ভারী সুন্দর। সাইন নদীর পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। দূরে ছোটোখাটো পাহাড় দেখা যাচ্ছে। উর্বর কৃষিক্ষেত্র।

লিমুজিনে গা এলিয়ে দিয়েছে নোয়েলে। জেনারেল সিডার গল্প করছেন। ফেলে আসা– দিন যাপনের গল্পকথা।

–ব্রিটিশরা, অদ্ভুত জাতি, তিনি বললেন, শান্তির সময় তাদের সাথে কথা বলা যায় না। যুদ্ধবাজদের দ্বারাই তারা নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলে। তুমি কি জানো? একজন ব্রিটিশ নাবিক কখন সবথেকে বেশি খুশি হয়? যখন জাহাজটা ডোবে।

লে হাবরেতে তারা পৌঁছে গেল। সকাল হতে আর বেশি বাকি নেই। এরপরেই এটাটাট।

আমরা কি একটু থামব? ভীষণ খিদে পেয়েছে।

সিডার মাথা নাড়লেন ঠিক আছে, যে রেস্টুরেন্টগুলো সারা রাত খোলা থাকে, সেখানে ঢু মারতে হবে।

–কিছু একটা এখানে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। নোয়েলে মন্তব্য করল।

ক্যাপ্টেন জলের ধারে গাড়িটাকে দাঁড় করাল।

 নোয়েলে বেরিয়ে এল। জেনারেল তাকে অনুসরণ করলেন।

ডক কর্মীদের জন্য এটা সারারাত খুলে রাখা হয়। নোয়েলে বলল।

মোটরের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মেকানিকরা কাজ করছে। নোয়েলের মনে হচ্ছে, পেটের ভেতর যেন কেমন একটা অস্বস্তি। সে জেনারেল সিডারের দিকে তাকাল। তারা রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে গেল।

নোয়েলে বলল- আপনার ড্রাইভার কফি খাবে না?

না, সে গাড়িতে থাকুক।

যে করেই হোক ড্রাইভারকে গাড়ি থেকে নামাতে হবে। না হলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু এখন নোয়েলে কী করবে।

তারা কাফেতে চলে গেল। হঠাৎ নোয়েলে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল। জেনারেল এগিয়ে এলেন। তার শরীরটাকে তুলে ধরলেন। প্রশ্ন করলেন- তুমি ঠিক আছো?

ড্রাইভার ছুটে এসেছে।

-আমি দুঃখিত। পায়ে ভীষণ লেগেছে। মনে হচ্ছে গোড়ালিটা বোধহয় ভেঙে গেছে।

জেনারেল গোড়ালিতে হাত দিলেন। হা, কিন্তু কোথায়? এখানে তো কোনো ফোলা দাগ নেই। হঠাৎ টান পড়েছিল। তুমি কি দাঁড়াতে পারবে?

না, আমি পারব না।

 ড্রাইভার এসে গেছে। দুজনে মিলে নোয়েলেকে কোলে তুলে নিলেন। নোয়েলে কোন মতে সামনে একটা পা ফেলল। আঃ, ভীষণ ব্যথা করছে।

সে বলল- আমি দুঃখিত, হয়তো বসতে পারব।

-ঠিক আছে, তোমাকে ওখানে বসিয়ে দিচ্ছি। জেনারেল সিডার বললেন। টেবিলের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন।

দুদিকে দুই পুরুষ, কোনো রকমে নোয়েলে হেঁটে চলেছে। মাঝে মধ্যেই সে গাড়িটার দিকে তাকাচ্ছে। না, কিছুই ঘটছে না।

জেনারেল জিজ্ঞাসা করলেন– তুমি একা যেতে পারবে তো?

–হ্যাঁ, আমি পৌঁছে যাব।

 কর্নার টেবিলের ওপর তাকে বসানো হল। চেয়ার এনে দেওয়া হল।

 জেনারেল প্রশ্ন করলেন- খুব যন্ত্রণা হচ্ছে?

–অল্প অল্প, ভয় নেই হানস, এই অভিযানটা আমি নষ্ট হতে দেব না।

.

যখন নোয়েলে এবং জেনারেল হানস কাফেতে বসেছিলেন, তখন মুলার তার দুজন লোক নিয়ে লে হাবরেতে পৌঁছে গেছেন। পুলিশ স্টেশনের বড়োবাবুকে ঘুম থেকে টেনে তোলা হল। জানা গেল, জেনারেলের পাশে আর একটা মস্ত বড়ো গাড়িকে থমকে থেমে দাঁড়াতে দেখা গেছে। ওয়াটার ফ্রন্টের পাশেই গাড়িটা পার্ক করা আছে।

কর্নেল মুলারের গালভরা হাসি। আমাকে এখনই সেখানে নিয়ে চল।

গেস্টাপো অটোমোবাইল এগিয়ে আসছে। নোয়েলে দেখতে পেল। থরথর করে কাঁপতে থাকল সে। সে বলল

কী হয়েছে?

–আমি বুঝতে পারছি না। সিডার বললেন, তিনি লিমুজিনের দিকে হেঁটে গেলেন। নোয়েলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলেছে।

এখানে আপনারা কী করছেন? জেনারেল কর্নেল মুলারের কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করলেন।

–আপনাকে বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত। আমি আপনার গাড়ির ট্রাঙ্কটা একবার দেখব।

লাগেজ ছাড়া কিছুই নেই।

নোয়েলে সেখানে পৌঁছে গেছে। সে কথোপকথন শুনতে পেল। জেনারেল এবং গেস্টাপোর লোকেরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছেন।

–জেনারেল, আমি জানি, ওখানে এক এমন লোক বসে আছে, যে থার্ডরাইকের সবথেকে বড়ো শত্রু। আপনার ওই বান্ধবী হল লোকটির সহকারিণী।

জেনারেল দীর্ঘক্ষণ তাকালেন। তারপর নোয়েলের মুখের দিকে দেখলেন।

নোয়েলে বলল- উনি কী বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

জেনারেল নোয়েলের গোড়ালির দিকে তাকালেন। তারপর বললেন- ঠিক আছে, এটা খোলা হোক।

ট্র্যাঙ্কটা তোলা হল। নোয়েলে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। কী আশ্চর্য, এখানে কেউ নেই?

ড্রাইভার চিৎকার করল– কেউ সব লাগেজ নিয়ে চলে গেছে।

কর্নেল মুলারের মুখ সাদা হয়ে গেছে তার মানে? লোকটা পালিয়ে গেছে।

 জেনারেল জানতে চাইলেন কে?

–লে কাফার্ড, কর্নেল মুলার বললেন। ইসরায়েল কাটজের আসল নাম। সে প্যারিস থেকে এখানে এসেছে ওই ট্রাঙ্কের মধ্যে বসে।

জেনারেল চিৎকার করলেন ব্যাপারটা অসম্ভব। এই ট্র্যাঙ্কটা বন্ধ করা ছিল। লোকটা মরে যেত।

কর্নেল মুলার ট্র্যাঙ্কটাকে দেখলেন। তার একজন লোককে বললেন, তুমি ভেতরে যাও

লোকটা ট্র্যাঙ্কের ভেতর গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ল। কর্নেল ডালাটা ফেলে দিলেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন। চার মিনিট কেটে গেল। তারা সকলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। প্রত্যেকের মনে নিজস্ব চিন্তা। নোয়েলের কাছে মনে হল, সময়টা বোধহয় অনন্ত।

কর্নেল মুলার ট্র্যাঙ্কের ঢাকনা খুলে দিলেন। লোকটা অচৈতন্য হয়ে পড়েছে।

জেনারেল সিডার কর্নেলের দিকে তাকালেন। মুখে সুখের অভিব্যক্তি কী, এখানে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে? তাহলে আপনি বলছেন, ওই মৃতদেহটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এবার বলুন আপনার জন্য আমি কী করতে পারি কর্নেল।

গেস্টাপো অফিসার অসহায় হয়ে মাথা নাড়লেন। তাঁর শরীরে রাগ এবং হতাশার চিহ্ন।

জেনারেল সিডার তার ড্রাইভারকে বললেন- চলো, আমরা এগিয়ে যাব।

 নোয়েলে তখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে।

গাড়ি এগিয়ে চলেছে এটরাটাটের দিকে।

কর্নেল মুলার দাঁড়িয়ে আছেন। ওয়াটারফ্রন্টের কাছে। না, কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

পরের দিন বিকেলবেলা অক্সিজেন ট্র্যাঙ্কের একটা খালি বোতল পাওয়া গেল। সেটা পড়ে আছে, ব্যবহার করা হয় না এমন একটা ওয়ার হাউসের মধ্যে।

নোয়েলে আর জেনারেল সিডার সপ্তাহ শেষের ছুটিতে দারুণ কাটালেন।

নোয়েলে প্যারিসে ফিরে এল সোমবার বিকেলবেলা। একটু বাদেই তাকে স্টেজে নামতে হবে।

.

ক্যাথারিন, ওয়াশিংটন, ১৯৪১-১৯৪৪

০৯.

উইলিয়াম ফ্রেসারের চাকরিটা ক্যাথারিন ছেড়ে দিল। ল্যারিকে বিয়ে করার কিছুক্ষণ বাদে। ফ্রেসার তার সঙ্গে লাঞ্চ খেতে বলেছিলেন। মনে হল, এই সংবাদটা পেয়ে উনি যেন আর একটু বুড়ো হয়ে গেছেন। আহা, ভদ্রলোকের জন্য মুঠোভরা সহানুভূতি।

দিনগুলো ভালোই কেটে গিয়েছিল।

ফ্রেসার বললেন– তা হলে তুমি এখন এক বিবাহিতা মহিলা, তাই তো?

-হ্যাঁ, এমন কত ঘটনাই তো ঘটে থাকে।

ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটে গেল। আমি লড়াই করার সুযোগ পেলাম না।

–আমিও বাছার সুযোগ পাইনি। ক্যাথারিন বলল, এটা শুধু ঘটে গেল।

ল্যারি ছেলে কেমন?

–মোটামুটি খারাপ নয়।

ক্যাথারিন, ফ্রেসার কিন্তু কিন্তু করতে থাকেন, তুমি ল্যারি সম্পর্কে কতটুকু জানো?

 –আমি তাকে ভালোবাসি, বিল, আমি জানি সেও আমাকে ভালোবাসে। এভাবেই গল্পটা শুরু হয়েছে।

ক্যাথারিন? সাবধানে থেকো কিন্তু। ল্যারি কিন্তু একেবারে অন্যরকম।

–কেন? ক্যাথারিন জানতে চাইল।

 বিল কিছু বলার চেষ্টা করলেন– হাতে হাত।

 ফ্রেসার শেষ পর্যন্ত বললেন- সত্যি তুমি চাকরিটা ছেড়ে দেবে?

ল্যারি চাকরি করা মেয়ে পছন্দ করে না। ও রক্ষণশীল স্বভাবের। ওর বিশ্বাস, স্বামীরাই রোজগার করে স্ত্রীদের খাওয়াবে।

–যদি কখনও মত পরিবর্তন হয়, আমাকে জানিও কিন্তু।

অফিসে নানা কথাবার্তা। কাকে ক্যাথারিনের জায়গাতে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে আলোচনা। ক্যাথারিন জানে, বিল ফ্রেসারের সান্নিধ্য সে আর পাবে না। বিল ফ্রেসার তার জীবনে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জীবন তত বহমানা তটিনীর মতো। মোহনার দিকে এগিয়ে যায়। অতীতকে ভুলতে হবে। রক্তক্ষরণ হলেও। নিজেকে নিজেই বলল ক্যাথারিন, এখন আমি অসহায়।

ব্যাপারটা হঠাৎই ঘটে গেছে। যখন ঘটে গেছে, আর পিছিয়ে এসে কী লাভ।

.

ল্যারি আরও ভালোবাসছে তাকে। তারা এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াল। পাহাড় আর নদীর সাথে ভাব ভালোবাসা।

অবশ্য সাগর দেখতে ক্যাথারিন ভয় পায়। সে সাঁতার জানে না। ল্যারি বলেছে, এবিষয়ে চিন্তা নেই। কারণ সে আছে, আছে নিরাপত্তার আবরণ।

ল্যারি আরও বেশি ভালোবাসছে। ক্রমশ সহনযোগ্য হয়ে উঠছে। তারা এক শনিবার রাতে চলে গেল মেরিল্যান্ডে। তিনমাস হয়ে গেছে, ছোট্ট রেস্টুরেন্টে ডিনার সারল।

পরের দিন, রবিবার সতেরোই ডিসেম্বর, জাপানিরা পালহারবার আক্রমণ করল।

.

একটা বেজে বত্রিশ মিনিট। আমেরিকা জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। জাপানি আক্রমণের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। সোমবার, ল্যারিকে অ্যান্ড্রজ এয়ারবেসে ডেকে পাঠানো হল। ক্যাথারিনকে এখন একলা তার অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে হবে। ঘটনাটা নিজের চোখে দেখার জন্য সে ট্যাক্সি নিয়ে ক্যাপিটল বিল্ডিং-এ চলে গেল। সকলের হাতেই পোর্টেবল রেডিও। তারা খবর শুনতে ব্যস্ত। সে বুঝতে পারল, কিছু একটা ঘটেছে। সে দেখতে পেল, লিমুজিনের দরজা খুলে গেল। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট নেমে এলেন। দুই পাশে দুই সহকারী, পুলিশের লোজনরা চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে। জনতা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। তারা কিছু একটা বলতে চায়।

পাঁচ মিনিট বাদে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ঢুকে গেলেন। রেডিও মারফত তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। তিনি কংগ্রেসের যুগ্ম অধিবেশনে ভাষণ দিচ্ছেন। তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে বলিষ্ঠতার আভাস। আছে এক শপথ।

আমেরিকা এই ভয়ঙ্কর ঘটনাকে মনে রাখবে। আমরা জানি, এই যুদ্ধে ন্যায়ের জয় হবে। ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করবেন।

রুজভেল্ট ক্যাপিটলে পৌঁছোবার পনেরো মিনিট বাদে যুদ্ধ ঘোষিত হল। দু-একজন ছাড়া সকলেই এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছে। ভোটের ফলাফল ৩৮০ বনাম ১। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট দশ মিনিট ধরে ভাষণ দিলেন। আমেরিকান কংগ্রেসে এত সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ ঘোষণা কেউ করেননি।

বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোক আনন্দে হাততালি দিচ্ছে। হ্যাঁ, সকলেই রুজভেল্টের এই মতামতকে অনুমোদন দিয়েছে। এখন শুধুই প্রতিহিংসা। শেষ অব্দি আমেরিকার টনক নড়েছে।

ক্যাথারিন লোকগুলোর মুখের দিকে তাকাল। একদিন আগে ল্যারির মুখে এমনই একটা আশার ছাপ ছিল, তার মানে সব আমেরিকানরাই যুদ্ধ চাইছে। ক্যাথারিন যুদ্ধ ভালোবাসে না। যুদ্ধ তাকে একক করে দেবে।

ঘটনাগুলো পরপর ঘটতে থাকে। ওয়াশিংটনে শহরের সর্বত্র এখন খাকি পোশাক পরা মানুষের ভিড়।

বাতাসের ভেতর উত্তেজনার পরশ মাখা। শান্তি শব্দটা হারিয়ে গেছে।

ল্যারি এয়ারবেসে ষোলো থেকে আঠারো ঘণ্টা কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। মাঝে মধ্যে তাকে সারা রাত থাকতে হয়। অনেক কিছুই একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে।

একদিন ক্যাথারিন জিজ্ঞাসা করল- আমরা এই যুদ্ধটাতে কি হেরে যাব?

ল্যারি তার দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে এটা নির্ভর করছে, কত তাড়াতাড়ি আমরা প্রতিশোধ নিতে পারব, তার ওপরে। সবাই ভেবেছিল, জাপানিরা হল কুতকুতে চোখে ছোট্ট চেহারার মানুষ। ধারণাটা ভেঙে গেছে। তারা শক্ত সমর্থ। মরতে ভয় পায় না। বরং আমরাই নরম মনের মানুষ।

.

জাপানিদের কিছুতেই রোখা যাচ্ছে না। রোজই তারা কোথাও না কোথাও দারুণ সাফল্য অর্জন করছে। ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জে আক্রমণ চলেছে। গোয়াম অধিকার করল। বোর্নিও দখল করল। জেনারেল ম্যাক আর্থার ম্যানিলাকে একটা ওপেন সিটি হিসেবে ঘোষণা করলেন। আমেরিকান টুপরা আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হল।

এপ্রিল মাসের একদিন, রণক্ষেত্র থেকে ল্যারি ক্যাথারিনকে ফোন করল। বলল– ডাউনটাউনে ডিনার খেতে হবে।

ক্যাথারিন জানতে চাইল- কীসের জন্য এই আয়োজন?

–আজ রাতে তোমায় বলব। উত্তেজনা ধরা পড়ছে।

টেলিফোনটা নামিয়ে রাখল ক্যাথারিন। তার মনে চিন্তা, কী ব্যাপার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

বিকেল পাঁচটা। ক্যাথারিন সুন্দরভাবে সেজেছে। বিছানাতে বসে আছে। নিজেকে দেখছে ড্রেসিং আয়নাতে।

হয়তো ল্যারির কোনো প্রোমেশন হয়েছে। তাই জন্য এই আনন্দ উৎসব। অথবা যুদ্ধ সম্পর্কে ভালো খবর।

ক্যাথারিনের মনে হল, সে বোধহয় খবরটা বিশ্বাস করতে পারবে না। হ্যাঁ, ওখানে গিয়ে জানতে হবে।

সন্ধ্যে সাতটা বেজেছে, ক্যাথারিন হোটেলের ডাইনিং রুমে হেঁটে গেল। ল্যারি তখনও আসেনি। সে একটা টেবিলে বসল। ড্রিঙ্ক নেবে না বলে জানাল। অবশেষে মারটিনের জন্য অর্ডার দিল।

ওয়েটার সেটা নিয়ে এল। সে দেখল, ল্যারি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ল্যারির উদ্বিগ্ন চোখ টেবিলে ঘুরে যাচ্ছে। অনেকের সাথে কথা বলছে সে। তার শরীরে একটা দারুণ পরিবর্তন এসেছে।

–আমি দুঃখিত, ক্যাথি, একটু দেরী হয়ে গেল। সারাদিন হুল্লোড় হয়েছে।

ল্যারি বসল। মারটিনের জন্য অর্ডার দিল। ক্যাথারিনকে ড্রিঙ্ক করতে দেখল, কোনো কথা বলল না।

ক্যাথারিন ক্রমশ ভাবছে- বলো-বলো কী জন্য এই আয়োজন?

সে আর একটা মারটিন নিল। ল্যারির দিকে তাকিয়ে আছে। ল্যারি কেন কথা বলছে না। ল্যারির মুখে ভালোবাসার আদল।

অবশেষে ল্যারি বলল- ক্যাথি, কী ঘটেছে তুমি ভাবতেই পারবে না। আমাকে বিদেশে যাত্রা করতে হবে।

চলচ্চিত্রটা ভেঙে গেল। সবকিছু অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে। ল্যারি পাশেই বসে আছে। তবু কত দূরে। ক্যাথারিন তাকাল। সবদিকে তার দৃষ্টিপাত।

ল্যারি আবার বলল– ক্যাথারিন, তুমি ঠিক আছ তো?

ক্যাথারিন মাথা নাড়ল। বলল- ভালো খবর শুনলে আমার মনের অবস্থা এমনই হয়।

–আমি কী বলেছি, তুমি বুঝতে পারছ তো?

–হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি।

মনে মনে সে বলল– আজ থেকে আমি আরও একলা হয়ে গেলাম ডারলিং। জানি কীভাবে দিন কাটবে। আমি জানি স্ত্রীদের এভাবেই একা থাকতে হয়। হাসতে হাসতে তারা স্বামীদের রণক্ষেত্রে পাঠায়।

ল্যারি বলল- তুমি কাঁদছ?

–না, কাদব কেন? ক্যাথারিন কান্না লুকোবার চেষ্টা করল। আমি তো এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবার শক্তি পেয়েছি।

ল্যারি বলল- ওরা আমাকে একটা পুরো স্কোয়াড্রন দিচ্ছে।

–সত্যি? ক্যাথারিন তার মুখে বানানো অহংকারের ছাপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল।

মনে পড়ে গেল, যখন ল্যারি একটা ছোট্ট ছেলে ছিল, তারই মুখে শোনা গল্প, সে বানানো প্লেন নিয়ে খেলা করত। এখন একটা লম্বা চওড়া যুবক, তাকে পুরো স্কোয়াড্রন দেওয়া হয়েছে। খেলা করার জন্য। এগুলো কিন্তু কোনো খেলনা নয়। এখানে আঘাত করলে রক্ত ঝরে, মৃত্যু পর্যন্ত হয়।

ক্যাথারিন বলল– আমি কি আর একটা ড্রিঙ্ক নিতে পারি? তোমাকে কখন যেতে হবে।

–আগামী মাসে।

ল্যারিকে দেখে মনে হচ্ছে, যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। কী আশ্চর্য এমন মানুষ, আমার দিকে কখনও তাকিয়ে থাকে না।

যুদ্ধের সংগীত বেজে উঠেছে। ল্যারি বলল যাবার আগে অনেক সময় পাওয়া যাবে।

কীসের জন্য সময় ক্যাথারিন ভাবল। একটা পরিবার তৈরি করা? আমাদের ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভারমন্ডটেস্ট স্কি খেলতে যাওয়া, নাকি আরও একটু বুড়িয়ে যাওয়া?

–আজ রাতে কী নেবে? ক্যাথারিন ভেবেছিল, বলবে, আমি কাউন্টি হাসপাতালে যাব। তোমার একটা আঙুল কেটে দেব। অথবা তোমার কানের ভেতর পারদ পুরে দেব। যাতে তুমি আর কখনও রণক্ষেত্রে যেতে না পারো।

সে বলল শান্তভাবে চলো, বাড়িতে যাই। তোমাকে ভীষণ কাছে পেতে ইচ্ছে করছে।

–হ্যাঁ, তার কণ্ঠস্বরে একটা বন্য আবেগ এবং তীব্র অনুভূতি।

.

চারটে সপ্তাহ দ্রুত চলে গেল। ঘড়ির কাঁটা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। রাতে দুঃস্বপ্ন। ক্যাথারিন ল্যারিকে পৌঁছে দেবার জন্য এয়ারপোর্টে এসেছে। ল্যারি কথা বলছে অনর্গল। চেহারার মধ্যে উদ্বিগ্নতার ছাপ নেই। মনে হচ্ছে একটা ক্যালিডোস্কোপে বুঝি অনেকগুলো রঙিন ছবি। ল্যারির-চুম্বন। ল্যারি প্লেনে ঢুকে যাচ্ছে। শেষবারের মতো হাত নাড়া। ক্যাথারিন দাঁড়িয়ে থাকল। প্লেনটা আকাশের বুকে উড়ে গেল। চোখের আড়ালে চলে গেল। প্রায় একঘণ্টা সে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে ছিল। অন্ধকার নেমে এল। গাড়ি চালিয়ে তার ফাঁকা অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এল।

.

পালহারবার আক্রমণ করার পর একবছর কেটে গেছে। জাপানিদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো আক্রমণ শানানো হয়েছে। মোটামুটি গোটা দশেক। মিত্রশক্তি তিনটেতে জিতেছে। দুটোর প্রভাব পড়েছে সাংঘাতিক। এখনও নানা জায়গাতে লড়াই চলছে।

ক্যাথারিন যুদ্ধের খবর আগ্রহ নিয়ে পড়ে। কোথায় কী ঘটেছে সবকিছু। উইলিয়াম ফ্রেসারের কাছে আরও খবর জানতে চায়। ল্যারি রোজ চিঠি লেখে। কিন্তু আট সপ্তাহ পরে ল্যারির পঞ্চম চিঠি এল। চিঠির মধ্যে শুধুই আশার কথা। উত্তেজনার অনুভূতি। চিঠিটা সেনসার করা হয়েছে। ক্যাথারিন বুঝতে পারল না। সত্যি সত্যি কী ঘটেছে? সত্যি কি ল্যারি এখন ভালো অবস্থায় আছে?

রাতের অন্ধকার ক্রমশ ঘন হচ্ছে। ঘণ্টাগুলো আরও দীর্ঘ। বিছানাতে শুয়ে ক্যাথারিন নানা দুঃস্বপ্ন দেখে। বুঝতে পারে না, ল্যারি এই লড়াইতে জিততে পারবে কিনা। জীবনটা এরকম কেন? একই মুদ্রার দু-দিক, একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে দুঃখ।

উইলিয়াম ফ্রেসারের সঙ্গে লাঞ্চে গেল। ক্যাথারিন জানে, তাকে এখনও অনেক দিন কাজ করতে হবে। কিন্তু এই কাজ সে কখনও করবে না।

ল্যারির কোনো খবর?

–গত সপ্তাহে চিঠি পেয়েছি।

কী বলল?

চিঠির ভাষ্য অনুসারে লড়াইটা বোধহয় ফুটবল খেলা। প্রথম অর্ধে আমরা হেরে গেছি। এবার আবার নতুন খেলা হবে।

উইলিয়াম ফ্রেসার মাথা নাড়লেন– এটাই হল ল্যারির স্বভাব। কখনও হারতে শেখেনি।

–কিন্তু, এটা যুদ্ধ নয়, এটা ফুটবল খেলা। বিল, তুমি দেখো, কত লক্ষ মানুষের মৃত্যু হবে।

ক্যাথারিন, আমি সব বুঝতে পারছি, কিন্তু কী করব বলো? তাই হয়তো এটাকে আমরা ফুটবলের মতো সহজ বলে ভাবি।

ক্যাথারিন ভাবল, সে আবার কাজে ফিরে যাবে। সৈন্যবাহিনী মেয়েদের জন্য একটা দল তৈরি করেছে। সেখানে যোগ দিলে কেমন হয়? তাও তো ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটবে।

একদিন কথায় কথায় বিলকে মনের ভাবটা বলে দিল।

বিল ক্যাথারিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন- ক্যাথারিন, সরকার ওয়ারবন্ড বিক্রি করতে চাইছে। তুমি সাহায্য করতে পারো।

দু সপ্তাহ কেটে গেছে ক্যাথারিন সেই কাজে যোগ দিয়েছে। ব্যাপারটা শুনতে হাস্যকর। কিন্তু এটা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

অনেক বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে সে এল। এমন কি অনেকের সাথে লাঞ্চও খেল। জীবনটা পাল্টে গেল কি?

দেখা হল ক্যারি গ্র্যান্টের সঙ্গে। তাকে এই পৃথিবীর সবথেকে ধনী ব্যক্তি বলা যেতে পারে।

.

 ক্যাথারিন হয়তো কিছুই জানত না। ছ-মাস আগের ঘটনা। বিল ফ্রেসার তাকে বলেছিলেন– ওয়ানেস টারনালে একটা সমস্যা হয়েছে। ক্যাথারিন সেই বিজ্ঞাপন কোম্পানির অ্যাকাউন্টটা দেখাশোনা করত। নতুন একটা ক্যাম্পেন শুরু হয়েছিল। ক্লায়েন্ট ভারী খুশি। কয়েক সপ্তাহ বিল ক্যাথারিনকে আর একটা কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আর একটা বিজ্ঞাপন সংস্থা। ক্যাথারিনকে অন্তত গোটা ছয়েক অ্যাকাউন্ট দেখতে হত। কাজটা সে ভালোই করেছে। ফ্রেসার তাকে ভালো মাইনে দিতেন। কিছুটা কমিশন।

বড়োদিনের আগে ফ্রেসার অফিসে এলেন। অন্য স্টাফরা বাড়ি চলে গেছে। ক্যাথারিন শেষ মুহূর্তের কাজে ব্যস্ত ছিল।

উনি বললেন- এ কী? এখনও কাজ করছ? আনন্দ করো।

না, এটাই তো জীবন, ধন্যবাদ বিল।

–আমাকে ধন্যবাদ দিও না। তুমি অনেক আয় করেছ, কিছুটা খরচ করো। তুমি কি পার্টনারশিপে রাজী হবে।

ক্যাথির চোখে বিস্ময়- পার্টনারশিপ? তার মানে?

–গত ছমাসে যেসব অ্যাকাউন্টের কাজ হয়েছে, তার সব কটাতেই তোমার হাতের পরশ আছে।

–তোমার একজন পার্টনার আছে না?

–হ্যাঁ, কিন্তু আমি সন্তুষ্ট নই।

উনি হাত বাড়িয়ে দিলেন, ক্যাথারিন হাতে হাত রাখল। তারপর চিবুকে একটা চুমুর চিহ্ন।

ক্যাথি বলল– তাহলে এখন থেকে আমরা পার্টনার। আমি কি তোমাকে একটা চুমু দিতে পারি?

ক্যাথি দেখল, বিল তাকে জড়িয়ে ধরেছেন।

ক্যাথি, আবেগে তার কণ্ঠস্বর বুজে আসছে।

ক্যাথারিন বিলের ঠোঁটে হাত দিল এখন কিছু বলো না বিল, প্লিজ, এইভাবে থাকতে দাও।

তুমি কি জানো, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি?

–আমিও তোমায় ভালোবাসি।

এই কথাগুলো কতবার বলা হয়েছে, বলতে বলতে উত্তেজনা হারিয়ে গেছে কি?

–আমি কোনো কিছুই ভাবছি না। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলাব না।

ক্যাথি বলল- হ্যাঁ, তোমাকে ধন্যবাদ বিল। যদি কোনো সমস্যা হয়, আমি তোমার পাশে থাকব।

বিল বললেন- তোমার এই আশ্বাস আজ সারারাত আমাকে জাগিয়ে রাখবে।

.

 নোয়েলে, প্যারিস, ১৯৪৪

১০.

গত এক বছর ধরে আরমান্দ গটিয়ার বিয়ে নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন। প্রথমদিকে তিনি নোয়েলেকে খুব একটা পাত্তা দিতেন না। এখন পরিবেশটা একেবারে উল্টো হয়ে গেছে। যখনই খবরের কাগজে তাকে ইন্টারভিউ দিতে হয়, নোয়েলে সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। যখন ওনারা একসঙ্গে কোথাও যান, নোয়েলে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কেউ ওনার দিকে ফিরেও তাকায় না।

নোয়েলেকে এক সুখী সফল রক্ষিতা বলা যেতে পারে। গটিয়ারের জীবনকে সে আরও আরামপ্রদ করে তুলেছে। এখন পটিয়ার ফ্রান্সের অন্যতম সুখী মানুষ। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, মনে তিনি একবিন্দু শান্তি পাননি। তিনি জানেন নোয়েলের মন অধিকার করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। একদিন নোয়েলে তাঁর জীবন থেকে অন্য কোথাও চলে যাবে।

তিনি বুঝতে পারলেন, মেয়েরা এমনই হয়ে থাকে। অথচ তিনি কিন্তু নোয়েলেকে পাগলের মতো ভালো বেসেছিলেন। নোয়েলে তাঁর জীবনের একমাত্র দামী সম্পদ হয়েছিল। তিনি সমস্ত রাত জেগে থাকলেন। ভাবলেন, আমি কী দোষ করেছি? ভালোবাসার খেলায় কেন হেরে গেলাম? গটিয়ারের মন বিস্ময়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি ভাবলেন, নোয়েলের সঙ্গে কথা বললে কেমন হয়?

কিন্তু এই স্বপ্ন সফল হবে কি? একবার চেষ্টা করতে দোষ কি!

.

ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে। নোয়েলে নিজস্ব জীবনে আরও সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। রাজনীতির মানুষজন, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক সকলের সাথেই তার সুন্দর সম্পর্ক। সকলের কাছে সে এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। সকলেই তার সঙ্গে কথা বলার জন্য উদগ্রীব। সে সব ব্যাপারে মন্তব্য দিচ্ছে। নানা বিষয়ে জ্ঞানের পরিসীমা বাড়িয়ে তুলেছে। শিল্প থেকে স্থাপত্য, সংস্কৃতি থেকে মদ্যপান, কোনো ব্যাপারেই সে বিন্দুমাত্র পিছিয়ে নেই।

আরমান্দ গটিয়ারের কাছে সব খবর আসছে। মনে হচ্ছে নোয়েলে বোধহয় এক রানি! মন্ত্রীদের নিয়ে বসে আছে। এটাই হল নোয়েলের চরিত্রের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য। যেখানেই যায়, সেখানেই সকলের মন জয় করে।

দিন কেটে গেল। গটিয়ারের মন নিরাসক্তিতে ভরে গেল।

হাঁ, নোয়েলে এখনও পর্যন্ত কনসট্যানটিন ডেমিরিসের সঙ্গে দেখা করেনি। ওই মানুষটি নোয়েলের জীবন নাটকে প্রবেশ করলে নতুন করে আবার চিত্রনাট্য লিখতে হবে।

.

কনসট্যানটিন ডেমিরিস বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী মানুষ। তার কোনো সরকারী ক্ষমতা নেই হয়তো, কিন্তু তিনি নিয়মিতভাবে প্রধানমন্ত্রী কেনাবেচা করে থাকেন। এরই পাশাপাশি কার্ডিনাল অ্যামবেসাডর অথবা রাজা। সারা পৃথিবীতে দু-তিনজন ধনী ব্যক্তি আছেন। তাদের ধনৈশ্বর্য কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ডেমিরিস তাদের মধ্যে একজন। বিরাট জাহাজবাহিনী আছে তার, একটি এয়ারলাইন্স, খবরের কাগজ, ব্যাঙ্ক, ইস্পাতের কারখানা, সোনার খনি। নানা জায়গাতে তার সফল পদচিহ্ন আঁকা হয়েছে।

 তার আছে বিশ্বের অন্যতম সেরা শিল্পসংগ্রহ, আছে অনেকগুলো ব্যক্তিগত বিমান। খান কুড়ি অ্যাপার্টমেন্ট এবং ভিলা। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়ানো।

কনসট্যানটিন ডেমিরিসের উচ্চতা খুব একটা বেশি নয়। বুকটা চওড়া। দেখে আকর্ষণ লাগে না। চেহারার মধ্যে গ্রিক ছাপ আছে। জামাকাপড়ের ব্যাপারে উদাসীন। তাকে আমরা সুন্দর পোশাক পরা মানুষদের তালিকাতে ফেলব না। অথচ, গুজব শোনা গেছে, কম করে পাঁচশো স্যুট আছে তার।

 ডেমিরিস যেখানে যান, সকলকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেন। অচেনা ব্যক্তিরা তার দিকে তাকিয়ে থাকে। খবরের কাগজ এবং ম্যাগাজিনে তাঁকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়। তার ব্যক্তিগত জীবন, ব্যবসায়িক অভিযান ইত্যাদি।

প্রেমের কাছে তিনি এক স্মরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। সাংবাদিক বন্ধু কিছু জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাব দেন সফলতা অর্জন করতে হলে আরও-আরও বেশি বন্ধু-বান্ধব দরকার। আর তুমি যদি খুব সফল হতে চাও, তাহলে শত্রুর সংখ্যা বাড়াতে হবে।

কতজন কর্মচারী কাজ করে জানতে গেলে ডেমিরিস বললেন- কেউ না, এটা একটা মন্দির, যখন ব্যবসার মধ্যে ক্ষমতা আর টাকা এসে যায়, ব্যবসাটা একটা ধর্মে পরিণত হয়। অফিস হল উপাসনালয়।

তিনি গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু ধর্মের উন্মাদনাকে ভালোবাসেন না। বিশ্বাস করেন সেই আপ্তবাক্যে ভালোবাসার নামে যতগুলো হত্যার ঘটনা ঘটেছে, ঘৃণার নামে তার হাজার ভাগের একটিও কমেনি।

তাঁর বিয়ে হয়েছে এক গ্রিক পরিবারে, স্ত্রী অত্যন্ত রূপসী। অভিজাতা মহিলা, যখন ডেমিরিস প্রমোদ তরণীতে বেড়াচ্ছিলেন, স্ত্রী তার সাথে যোগাযোগ করেনি। তার সঙ্গে ছিলেন এক সুন্দরী অভিনেত্রী। কোনো কোনো সময় ব্যালে নতর্কী। অথবা অনুরাগিনী। তার ব্যক্তিগত জীবনে রোমান্স কিংবদন্তি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বর্ণ রঙিন ইতিবৃত্ত। তিনি নাকি দশ বারোজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রীকে শয্যাসঙ্গিনী করেছেন। সেরা বন্ধুদের স্ত্রীরাও তার ব্যক্তিত্বে আকর্ষিত হয়েছে। পনেরো বছর বয়সী এক কিশোরী উপন্যাস রচয়িতা সম্প্রতি স্বামী হারিয়েছে, এমন একজন শোকাচ্ছান্না বিধবা, তার সম্পর্কে আরও অনেক গুজব আছে। তিনি নাকি এমন একদল সিস্টারের কৌমার্য হরণ করেন, যারা তার কাছ থেকে নতুন একটা কনভেন্টের বায়না করেছিল।

ডেমিরিসকে নিয়ে ছ-ছটা বই লেখা হয়েছে। কোনো বইতেই তার সফলতার আসল রহস্য ধরা পড়েনি। বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব। কনসট্যানটিন ডেমিরিস, নিজস্ব একটি জীবনধারা আছে তার। কিছু অন্তরঙ্গ বন্ধু। জীবন শুরু করেছিলেন টেবেডার হিসেবে। এমন একটি পরিবারে তার জন্ম যেখানে চোদ্দোজন ভাইবোন। টেবিলে যথেষ্ট খাবার থাকত না। অতিরিক্ত খাবারের জন্য রীতিমতো মারামারি করতে হত। ডেমিরিস সবসময় আরও বেশি খাবার চাইতেন। যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জিতে যেতেন।

ছোটোবেলা থেকেই অঙ্কে মাথাটা পাকা ছিল। তিনি জানতেন, কীভাবে পা ফেললে আমরা সফলতার পথে এগিয়ে যাব।

বুদ্ধিটা ছিল খুবই তীক্ষ্ণ এবং ধারালো। সুন্দরী রমণী শয্যাসঙ্গিনী হবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি কখনওই তাকে প্রশংসা করতেন না। তার ব্যক্তিত্বের দিকে তাকাতেন না। পৃথিবীটা একটা মস্ত বড়ো বাজার, কেনা-বেচা চলেছে। তিনি জানেন, কিছু রমণীকে টাকা দিয়ে কিনতে হবে। কারও কাছে ক্ষমতার ভেট পাঠাতে হবে। আর খুবই কম দু-একজন, হ্যাঁ, ভালোবাসার বৃষ্টিপাত।

এখন যে সমস্ত মানুষ তার সঙ্গে দেখা করতে আসে, সকলেই প্রার্থী। দাঁতব্য চিকিৎসালয়ের জন্য চাঁদা, নতুন একটা ব্যবসায়িক প্রস্তাবনা। এর বাইরে আর কিছু নেই।

রিপোর্টাররা সব সময় তার পাশে ঘোরাফেরা করে। তাকে বিশ্বের অন্যতম সুসভ্য জাতির প্রতীক ধরা হয়। এর মধ্যে আর একটা ডেমিরিস আছেন, তিনি হত্যাকারী, তিনি ভয়ঙ্কর জেদি এবং একগুঁয়ে। সেই খবর কেউ রাখে না।

ষোল বছরের ডেমিরিস প্রথম ব্যবসা শুরু করেছিলেন। স্পাইরস নিকোলস নামে এক বৃদ্ধ মানুষের সঙ্গে। ডেমিরিস জাহাজীদের কাছে গরম খাবার বিক্রি করতেন। একরাতে পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেলেন। তারপর? নতুন জীবন শুরু হল।

পরবর্তী কুড়ি বছর ধরে স্পাইরস নিকোলস মাংস পাঠানোর ব্যবসাতে লেগেছিলেন। বিয়ে করলেন। তিনটি সন্তান হল। গ্রিসের অন্যতম ধনী মানুষে পরিণত হলেন। এই কবছর ডেমিরিস নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছেন। চোখের সামনে নিকোলাস সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন। যখন তিনি দেখলেন, নিকোলস খুব শক্তিশালী, ডেমিরিস ভাবতে শুরু করলেন।

নিকোলসের ব্যবসা তখন ডালপালা বিস্তার করে চলেছে। তিনি অনেকগুলো দোকানে নিয়মিত মাংস সরবরাহ করছেন। কনসট্যানটিন ডেমিরিস এবার ব্যাঙ্কের সাহায্য নিলেন। ব্যাঙ্ক নিকোলসকে সাহায্য করেছিল। নিকোলস অনেক টাকা ধার নিলেন। ঠিক সময়ে টাকা দিতে পারলেন না। ব্যাঙ্ক আইনগত ব্যবস্থা নিতে শুরু করল। ডেমিরিসের হাতে বেশ কয়েকটা কাগজপত্র ছিল। সংবাদপত্রের মাধ্যমে গল্পটা প্রকাশিত হল। অন্য পাওনাদাররাও ছুটে এল। তখন ডেমিরিসের জয় জয়কার। নিকোলস কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। নিকোলসকে দেউলিয়া বলে ঘোষণা করা হল। পরের দিন তিনি আত্মহত্যা করলেন।

ডেমিরিস বুঝতে পারলেন, এবার রণক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হবে। কী করা যায়? ভাবতে ভাবতে ডেমিরিস তার বউ মেলিনার সাথে কথা বললেন।

ডেমিরিস জানতে চাইলেন– কী মনে হয় জানো? আমরা সবাই ঈশ্বরের অনুগ্রহে অভিনয় করছি। কিন্তু সকলেই ভালো অভিনেতা নই।

-মানুষের জীবন নষ্ট করা উচিত নয় কোস্টা।

নষ্ট করা বলছ কেন? এটাই হল সুবিচার।

সুবিচার নয়, প্রতিহিংসা।

–তা বলতে পারো। এইসব নিয়েই তো মানুষ।

ডেমিরিসের মনে চিন্তা, কী করে আরও উন্নত হওয়া যায়।

এবার শুরু হল তার নিত্য নতুন অভিযান। বাসেলের একটা সুইস ব্যাঙ্কারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। অন্য ব্যাঙ্কারদের সঙ্গে কথা হল- এই তরুণ গ্রিককে টাকা দেওয়া হবে কি? শেষ অব্দি ডেমিরিস তুরস্ক থেকে টাকা ধার করলেন।

তিনি আরও বেশি প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠলেন। আরবের কুবেরের সঙ্গে কথা হল। সেখানে কী করা যায় ভাবতে লাগলেন। একটা তেলের খনি লিজ নিলেন। লক্ষ লক্ষ ডলার পকেটে এল।

এবার অন্য দিকে নজর দিতে হবে। ডেমিরিসের বুদ্ধিটা ছিল খুবই পাকা। দেখা গেল, সবকটা খেলাতেই তিনি জয়লাভ করেছেন। দাবাখেলার সম্রাট হয়ে গেলেন। কয়েক বছরের মধ্যে।

.

নোয়েলে পেজের রবিবার, কে এসেছেন? তিনি প্যারিসে এসেছেন কায়রোতে যাবেন। আরও কেউ একজন। ডেমিরিস নোয়েলকে দেখলেন, বুঝতে পারলেন, এই মেয়েটিকে যে করেই হোক অধিকার করতে হবে। কেন? ডেমিরিস জানেন, জয়লাভ করতে হলে রূপসী সুন্দরীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। দেখা গেল নোয়েলে জামাকাপড় গুছিয়ে কনসট্যানটিন ডেমিরিসের যাত্রাসঙ্গিনী হল। অভিযান গ্রিস।

.

নোয়েলে পেজ এবং কনসট্যানটিন ডেমিরিস বিশ্বজোড়া গুজবের উৎস। আলোকচিত্রী ও সাংবাদিকদের রাতের ঘুম ছুটে গেছে। ডেমিরিসের স্ত্রীর ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার নেবার চেষ্টা করা হচ্ছে। মেলিনা কথা বলতে চাইছেন না। শুধু একবার বলেছেন, আমার স্বামীর অনেক বান্ধবী আছে। এতে অন্যায় কিছু নেই।

ভেতরে ভেতরে তিনি ফুঁসে উঠেছেন। মা-বাবার কাছে সব কথা বলেছেন। কোস্টা একেবারে দুবৃত্তের মতো আচরণ করছে। এগুলো ব্যবসায়িক অভিযান? ছবিতে দেখেছেন, কনসট্যানটিনোপল টোকিও অথবা রোমে নোয়েলের সাথে ডেমিরিস দাঁড়িয়ে আছেন। মেলিনা এক গর্বিত আর অহংকারী রমণী। এই অন্যায় এবং অপমানের প্রতিশোধ তাকে নিতেই হবে। কিন্তু স্বামীকে তিনি সত্যিই ভালোবাসেন। চরম বাস্তবটা স্বীকার করতে ক্ষতি কী? এই পৃথিবীতে কিছু পুরুষ আছেন, যাঁরা এক নারীতে তৃপ্ত হতে পারেন না। তারা স্ত্রীকে ভালোবাসেন অন্য নারীর সাথে শয্যা বিনিময় করেন। এমন কিছু হলে আমার কী হবে? মেলিনা কিন্তু কখনও কনস্ট্যানটিনের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি। তিনি জানেন এভাবে মানুষের চরিত্র পাল্টানো সম্ভব নয়।

নোয়েলে কি আমার স্বামীকে ভালোবেসেছে। এখানেই তাঁর আপত্তি। শরীরের সংযোগ, মুহূর্তের ঘটনা, ভালোবাসা থেকে যায়। যদি কখনও এ ধরনের খবর তার কানে আসে। তিনি হয়তো আত্মহত্যা করবেন।

ডেমিরিসের কাছে নোয়েলে একটা দারুণ আকর্ষণ ছিল। নোয়েলে একটা জীবন্ত ধাঁধা। একটা অঙ্ক- যার শেষ উত্তর আমরা জানি না। এই ব্যাপারটাই বোধহয় ডেমিরিসকে অবাক করে দিয়েছিল।

এই জীবনে চলার পথে ডেমিরিস অসংখ্য মহিলার সংস্পর্শে এসেছেন। অনেকের সাথে যৌন সংসর্গ করেছেন। কিন্তু নোয়েলের মতো কাউকে দেখেননি।

নোয়েলে তার জীবনকে ধীরে ধীরে অধিকার করছে। শেষ অব্দি ডেমিরিস ভাবলেন, যৌনতার আশ্রয় নিলে কেমন হয়? এমন এক মহিলা, যাকে সত্যি সত্যি আমি শ্রদ্ধা করি। তার শরীরের আবেদন আমাকে পাগল করে দেবে। তার মানসিক চিন্তা আমাকে অবাক করে দেবে। নোয়েলের মধ্যে অনেকগুলো গুণ আছে। পাকা রাঁধুনি সে। পুরুষ বধের মন্ত্র শিখেছে সযত্নে।

শেষ পর্যন্ত ডেমিরিস একটা দ্বীপ কিনে ফেললেন। সেখানে সুন্দর সাজানো বাংলো তৈরি হল।

তারপর? নোয়েলের শুভ আবির্ভাব। ডেমিরিস বললেন- কেমন লাগছে বলো?

–অসাধারণ।

 সত্যি ডেমিরিসের শিল্প-চেতনাকে তারিফ করতেই হবে।

শুরু হল এক নতুন জীবন। আগে ডেমিরিস তিন চারজন রক্ষিতার সাথে রাত কাটাতেন। এখন তিনি নোয়েলে, ছাড়া আর কাউকে ভাবতেই পারছেন না।

বিশাল একটি প্রমোদ তরণীতে নোয়েলে বসে আছে। ১৩৫ ফুট লম্বা। সবসময় ক্রু আছে, দুটো স্পিডবোট। সুইমিং পুল। বারোটি সুন্দর সাজানো কেবিন। মস্ত বড়ো অ্যাপার্টমেন্ট। অ্যান্টিক জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো।

যখন মন খুশিয়াল হয়ে ওঠে, ডেমিরিস এই প্রমোদ তরণীতে বসে থাকেন। নোয়েলের সাথে ভালোবাসার খেলা খেলতে থাকেন। এটাই হল তার ব্যক্তিগত দিক। এখানে সকলের প্রবেশ নিষেধ। মেলিনা বাড়িতে আছে। থাক না। নোয়েলে এখন আমার শয্যাসঙ্গিনী। তিনি কখনও মেলিনা এবং নোয়েলেকে একসঙ্গে আনেননি। এই ব্যাপারে দারুণ ওয়াকিবহাল।

নোয়েলে সবরকম সাহায্য করেছে। ছোট্ট মেয়েটি এখন অনেক শক্তিশালী হয়ে গেছে। সে জানে, জীবনটা কোথা থেকে কোথায় চলে আসতে পারে। একদা মারসেইলের অ্যাপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। ভাবত, ওখানে বোধহয় পৃথিবীর সব থেকে বড়ো জাহাজের অবস্থান। নোয়েলে কিন্তু ডেমিরিসের অর্থ কিংবা খ্যাতির দ্বারা আকৃষ্ট হয়নি। তার বুদ্ধি এবং শক্তি নোয়েলেকে অবাক করে দিয়েছে। দৈত্যের মতো মন এবং ইচ্ছাশক্তি আছে ডেমিরিসের। এত শক্তি দেখাই যায় না।

নোয়েলের কাছে তখনও অনেকগুলো আমন্ত্রণ আসছে। বড়ো বড়ো ছবিতে অভিনয় করার জন্য। কিন্তু নোয়েলে আর অভিনেত্রী হতে চাইছে না। জীবন নাটকে সে এক ব্যস্ততমা নায়িকা এখন। এমন এক চিত্রনাট্য, যা প্রতি মুহর্তে পাল্টে যাচ্ছে। সে রাজা, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রদূতদের সাথে রাতের ডিনার সারছে। সকলেই তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকছে। ডেমিরিসের উপপত্নী, তাকে খাতির করে চলতেই হবে।

পৃথিবীর অনেক কিছু নোয়েলে জেনে গেছে। সে ডেমিরিসের কানে মিথ্যে কথা বলতে পারে অনর্গল, ডেমিরিস বুঝতেও পারেন না!

.

 এই ব্যক্তিগত দ্বীপে এলে ডেমিরিসের মনে হয়, তিনি বুঝি স্বর্গের বাসিন্দা হয়ে গেছেন। যত্নে সাজিয়েছেন এই দ্বীপটিকে। অতিথিশালা, শিকার করার জন্য সংরক্ষিত অরণ্যমালা, টলটলে নীল জলের লেক, ছোট্টো চিড়িয়াখানা, একটা বন্দর, যেখানে প্রমোদ তরণী বিশ্রাম নিতে পারে। একটা বিমানক্ষেত্র যেখানে তার প্রাইভেট বিমান অবতরণ করতে পারে। আশিজন পরিচারক আছে, সশস্ত্র প্রহরীর দল সব সময় পাহারা দিচ্ছে। এই দ্বীপের নীরবতা নোয়েলেকে আকর্ষণ করে। ভীষণ ভালো লাগে, যখন এখানে কেউ থাকে না, নোয়েলের মনে হয়, সে বুঝি জগতের সম্রাজ্ঞী। কনসট্যানটিন ডেমিরিস তাকে ভালোবাসার চেষ্টা করেন। কখনও কখনও নোয়েলে একা সাগর সৈকতে ঘুরে বেড়ায়। জীবনটা কোথা থেকে কোথায় এসে গেছে। নোয়েলে অবাক হয়ে যায়।

.

 ল্যারি ডগলাস এখন কোথায়? অন্য কোনো পৃথিবীর বাসিন্দা বোধহয়, গোপন দ্বীপপুঞ্জে লড়াইতে অবতীর্ণ। স্ত্রীর কথা মাঝে মধ্যে মনে পড়ে? স্ত্রীর কাছ থেকে চিঠি আসছে। নোয়েলে প্যারিসে গিয়েছিল। ক্রিস্টিয়ান বারবেডের সঙ্গে দেখা করতে। প্রতিমাসে অন্তত একবার যায়। ওই টেকো মাথা পিটপিটে চোখের ডিটেকটিভের কথা শুনতে। ল্যারি সম্পর্কে সব শেষ খবর এখনও নোয়েলেকে আকর্ষণ করে।

ফ্রান্সে ফিরে গিয়ে সে বারবেডের সঙ্গে দেখা করল। সেবার কিছু সমস্যা হয়েছিল ভিসা পেতে। কাস্টমস অফিসের সাথে যোগাযোগ করল। আধঘণ্টা তাকে বসে থাকতে হয়েছিল। কনসট্যানটিন ডেমিরিসের সঙ্গে ফোনে কথা বলল। দশমিনিট বাদে কথা বলার সুযোগ পেল। একজন জার্মান অফিসার ছুটে এলেন। সরকারের তরফে ক্ষমা চাইলেন। নোয়েলেকে স্পেশ্যাল ভিসা দেওয়া হল। এরপর তাকে আর কখনও আটকানো হয়নি।

ছোটোখাটো চেহারার ডিটেকটিভ তাকিয়ে আছেন নোয়েলের দিকে। পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তিনি কি আর একটু অর্থবান হয়ে গেছেন। কনসট্যানটিন ডেমিরিসের সাথে মক্কেলের সম্পর্ক আছে শুনে তিনি খুশি হলেন। আহা, আর্থিক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ডেমিরিস কি এই ব্যাপারটা জানেন? তার রক্ষিতা ল্যারি ডগলাস সম্পর্কে চিন্তিত? কতটা খবর দেওয়া যেতে পারে? ডেমিরিসের কানে কানে?

নোয়েলে পেজ কি আমাকে যথেষ্ট টাকা দেবে? মুখে চাবি মেরে রাখার জন্য।

ল্যারির স্ত্রী একটা চিঠি পেল। কী লেখা আছে– ক্রিস্টিয়ান বারবেড নোয়েলেকে জানিয়েছেন। উনি এখন লড়াইতে ব্যস্ত আছেন। বিরাট স্কোয়াড্রনের নেতা।

ক্যাথারিনের চিঠিতে লেখা ছিল– আমি প্রশান্ত মহাসাগরের কোথাও আছি।

ক্রিস্টিয়ান বারবেড বললেন নোয়েলেকে লড়াইটা চলছে কুয়মে।

…তোমাকে প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ছে ক্যাথি। সব খবর ভালোভাবে বলতে পারছি না। আমরা বোধহয় শেষ অব্দি জয়লাভ করব।

দুটি ঘটনা পাশাপাশি ঘটে চলেছে। ক্যাথারিন স্বামীর কথা চিন্তা করছে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছে। সে যেন ভালোভাবে ফিরে আসতে পারে। নোয়েলে ল্যারির প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রেখেছে। সেও চাইছে, ল্যারি ঠিকভাবে ফিরে আসুক। যুদ্ধটা শেষ হয়ে যাক। ল্যারি ডগলাস ঘরে আসুক, কী অবাক, ক্যাথারিন এবং নোয়েল পৃথিবীর দুই রমণী একই প্রার্থনায় মগ্ন এখন।