১৬.
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর। আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাস এক শোচনীয় ঘটনা ঘটে গেল। হলিউডে ধর্মঘট দেখা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়ার মধুচন্দ্রিমা শুরু হয়েছে। জোসেফ ম্যাক কার্থি নামে একজন নিজেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবতে শুরু করেছেন। তিনি একটি বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন। তিনি বললেন মার্কিন সৈন্যদলে অনেক সাম্যবাদী মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
কতজন? প্রশ্ন করা হয়েছিল।
তিনি বললেন, কয়েকশো।
তার এই উত্তর সকলের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করল। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় এই নিয়ে কত উদ্বেগ আর উত্তেজনা।
তিনি আরও একটা সাংঘাতিক খবর দিলেন। তিনি বললেন, নৌবাহিনী এবং প্রতিরক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে অনেক কম্যুনিস্ট ঢুকে পড়েছেন। তিনি ইন্টারভিউ দিতে শুরু করলেন, কতজন এসেছে সেই সংখ্যাটা ক্রমশ বাড়তে থাকল।
একটা তদন্তকারী কমিটি গঠিত হল। বেশ কয়েকজন সেনেট সদস্য ওই কমিটির অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। দেশ জুড়ে দারুণ আতঙ্ক।
ম্যাক কার্থির নাম তখন ক্রমশ বাড়ছে। তিনি আরও উল্টোপাল্টা মন্তব্য করতে থাকলেন। সাধারণ মানুষকে সাম্যবাদী হওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হল। তারা আত্মপক্ষ সমর্থনের বিন্দুমাত্র সুযোগ পেল না। প্রতিরক্ষা দপ্তরের ওপর অন্ততদন্ত কমিটির হানা শুরু হল। হলিউডকেও এর আওতাভুক্ত করা হল।
লেখক, প্রযোজক এবং পরিচালকরা নানাভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। হ্যাঁ, অনেক কম্যুনিস্ট হয়তো বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঢুকে পড়েছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে কে সাচ্চা সাম্যবাদী আর কে নয় সেই বিচার কে করবে?
দশজন লেখকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল, তাদেরকে গ্রেপ্তার করে কারাগৃহে পাঠানো হল। তিনশো চব্বিশ জনকে কালো তালিকাভুক্ত করা হল। চোখের সামনে কত অসহায় জীবন স্তব্ধ হয়ে গেল।
হলিউডের অবস্থা তখন শোচনীয়। হলিউড থেকে একটা ঘোষণা করা হল, যে মানুষের সাথে কম্যুনিস্ট পার্টির সামান্য যোগসূত্ৰতা থাকবে, তাকে আর কোনো কাজ করতে দেওয়া হবে না। এভাবেই দশ বছরের বিধি নিষেধ আরোপিত হল।
আর কেও-র স্টুডিওর সাথে ভোরে যুক্ত ছিলেন, তিনি পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করলেন যে কম্যুনিস্ট হবার অপরাধে যদি তার চাকরি যায় তাহলেও তিনি বিন্দুমাত্র ভয় পাবেন না। একটা কমিটি গঠিত হল, চারদিকে ব্যাপক বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়েছে। চিত্রনাট্যকাররা যে গিল্ড তৈরি করেছিলেন সেখানে উত্তপ্ত বাদানুবাদ শুরু হল।
অনেকেই লেখক সত্ত্বাকে সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। একজন মানুষ রাজনৈতিক মতবাদে যে কোনো দলের অনুগামী হতে পারে, এজন্য কেন তাকে শাস্তিভোগ করতে হবে?
একদিন সকালে মারভিন নামে এক স্টুডিও একজিকিউটিভ আমাকে তার অফিসে ডেকে পাঠালেন। মারভিন কী ধরনের কাজ করেন সে বিষয়ে আমার কোনো নির্দিষ্ট ধারণা ছিল না। আমি শুনেছিলাম তিনি নাকি প্রতি সপ্তাহে তিন হাজার ডলার করে পান, তাঁকে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। অভাবিত কোনো দৃশ্য দেখালে বিপদ ঘন্টি বাজাতে হবে এটাই তার কাজ।
চল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেছে, মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে, উনি আমাকে বসতে বললেন, উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- রাইটার্স গিল্ডের মিটিং-এ আপনি অ্যালবার্টের স্বপক্ষে ভোট দিয়েছেন?
হ্যাঁ, কদিন আগে আমরা একটা মিটিং করেছিলাম, সেখানে নতুন বোর্ড অব ডাইরেক্টার নির্বাচিত হয়েছে, এটা রুদ্ধদ্বার অধিবেশন, ওনার প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়ে গেছি। বললাম- হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?
উনি জিজ্ঞাসা করলেন কেন?
আমি বললাম- ওনার একটা উপন্যাস পড়ে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। আমি চাই ওনার মতো সুখ্যাত লেখকরা যেন এই গিল্ডে প্রবেশের অনুমতি পান।
আপনাকে কেউ কি প্ররোচিত করেছে?
আমি রেগে গিয়ে বললাম না, আমি আমার বিবেকের তাগিদে ভোট দিয়েছি।
–কেউ নিশ্চয়ই আপনাকে প্রভাবিত করেছে।
আমার কণ্ঠস্বর তখন ক্রমশ চড়ছে–মারভিন, আমার উত্তর আমি দিয়েছি। উনি একজন ভালো লেখক। তাই ওনাকে ভোট দিয়েছি।
উনি ওনার সামনে পড়ে থাকা এক টুকরো কাগজের দিকে নজর দিলেন। তারপর বললেন- গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আপনি কি স্টুডিও পাড়াতে গিয়ে শিশুদের জন্য টাকা সংগ্রহ করেছেন?
এবার আমার রাগ আকাশ ছুঁয়েছে। উনি যা বলছেন তা সত্যি, এমন কী আমি নিজেও চাঁদা দিয়েছি। তারপর স্টুডিওতে গিয়ে সকলের কাছে হাত পেতেছি। যে সমস্ত শিশুদের বাবা জেলে বন্দী তাদের অসহায় মুখগুলো আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে।
আমি কোনো সময় রেগে যাই না, কিন্তু তখন ধৈর্য হারালাম।
আমি বললাম- মারভিন, আমি দোষী, আমার এটা করা উচিত হয়নি। হ্যাঁ, ওই শিশুগুলো খিদের জ্বালায় ছটফট করে মরুক, তাদের বাবারা জেল খাটুক, ছেলেদের মুখে কেন খাবার অন্ন তুলে দেবো! তারা মরলেই আমাদের আনন্দ।
আমি চিৎকার করে চলেছি তখন। উনি বললেন- শান্ত হোন, শান্ত হোন, বাড়িতে চলে যান, তারপর ভালো করে ভাবুন কার প্ররোচনায় আপনি অ্যালবার্টকে ভোট দিয়েছেন। কাল সকালে আপনার সঙ্গে দেখা হবে।
আমি অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম, উত্তেজনায় সমস্ত শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। এভাবে অপমানিত হতে হবে তা ভাবতেই পারিনি।
সমস্ত রাত ঘুমোতে পারিনি। আমি শেষ পর্যন্ত একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, সকাল নটা, আমি মারভিনের অফিসে ফিরে এসেছি।
আমি বললাম- আমি কাজটা ছেড়ে দিচ্ছি, আপনি আমার শর্তটা ছিঁড়ে ফেলতে পারেন। এই স্টুডিওতে আমি আর থাকব না।
আমি দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। উনি বললেন- এখনই তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেবেন না। নিউইয়র্কের সাথে আমি কথা বলেছি। যদি আপনি একটা মুচলেকা দিয়ে বলেন যে আপনি কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য নন অথবা কম্যুনিস্ট ভাবধারা পছন্দ করেন না তাহলে আপনাকে রাখা হবে। পুরো ব্যাপারটা আমরা ভুলে যাব।
উনি আমার দিকে এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন- আপনি কি এটা সই করবেন?
আমি কাগজটার দিকে তাকিয়ে শান্ত হয়ে বললাম হ্যাঁ, কারণ আমি কম্যুনিস্ট নই, আর কখনই কম্যুনিস্ট হব না।
এটা একটা বাজে অভিজ্ঞতা, কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। অনেক উজ্জ্বল মুখচ্ছবি মনে পড়ল, যাদের আর কখনও হলিউডে দেখতে পার না।
.
১৯৪৮ সালের ফ্রেব্রুয়ারী মাস, মোশান পিকচার অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য সম্ভাব্য প্রাপকদের তালিকা ঘোষিত হয়েছে। আমি পাঁচটি ক্ষেত্রে সম্ভাব্য তালিকায় স্থান পেয়েছি। দি ব্যাচেলার অ্যান্ড দি ববি সক্সার নামে একটা মৌলিক চিত্রনাট্য লেখার জন্য আমার এই সম্মান। সহকর্মীদের কাছ থেকে শুভ সংবাদ ভেসে এল। এজেন্ট এবং বন্ধুরা এই সাফল্যের জন্য আমাকে অভিনন্দিত করলেন। আমি জানি অস্কার জেতার সামান্যতম সম্ভাবনা আমার নেই।
ছবিগুলো সত্যিই জনপ্রিয়, একটার পর একটা হলে অসংখ্য মানুষের সমাবেশ।
ডোনা হলওয়ের কাছ থেকে একটা খবর পেলাম। উনিও আমাকে অভিনন্দিত করেছেন। ডোনার সাথে আমার অনেক দিনের বন্ধুত্ব। আমরা অনেক সময় সিনেমা দেখতে যাই একসঙ্গে। কনসার্ট শুনতে যাই। উনি আমার সাহচর্য ভালোবাসেন।
যেদিন অস্কার পুরস্কার ঘোষিত হবে সেদিন ডোনা আবার ফোন করলেন। উইলিয়াম মরিসের কাজ ছেড়ে উনি এখন কলোম্বিয়া স্টুডিওতে কাজ করছেন। হ্যারি কোহনের ব্যক্তিগত সহকারিনী হিসেবে। কোহনকে আমার ঈর্ষা করতে ইচ্ছে হয়, কারণ ডোনার মতো একজন কাজের মেয়ে পেয়েছেন উনি।
ডোনা প্রশ্ন করলেন- অস্কার দেখতে যাবেন তো?
–আমি যাচ্ছি না।
–ডোনা অবাক কেন কী হয়েছে?
–ডোনা, জেতার সামান্যতম সম্ভাবনা নেই। আমি গিয়ে বিড়ম্বিত হব?
–একথা বলবেন না, আমি বলছি অস্কার জেতার সম্ভাবনা আছে, আপনি অবশ্যই যাবেন।
–আপনি কি আমার সঙ্গে যাবেন?
–হ্যাঁ, আমি যাব এবং আপনাকে হাসি মুখে স্টেজে উঠতে দেখব।
সাইন অডিটরিয়াম, ২০তম অ্যানুয়াল অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের অনুষ্ঠান। এটা টেলিভিশনের মাধ্যমে দেখানো হয়নি, কিন্তু দুশো এবিসি রেডিও স্টেশন-এর ধারাবিবরণী প্রকাশ করেছে।
জর্জ মারফি, একজন অসামান্য অভিনেতা, তাকেও দেখতে পেলাম, ডোনা এবং আমি সীটে গিয়ে বসলাম।
ডোনা আমার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলেন- আপনি কি চিন্তিত?
আমি দৃপ্ত কণ্ঠে না বললাম, চোখে মুখে চিন্তার কোনো ছাপ নেই। আমি জানি এই সন্ধ্যাটা হল সেই সব সৃজনশীল মানুষদের জন্য যারা অনেক পরিশ্রমে এতটা পথ পার হয়েছেন। আমি তো নেহাত এক দর্শক, আমি কেন উদ্বিগ্ন হব।
উৎসব শুরু হয়ে গেছে। একে একে বিজয়ীরা মঞ্চে উঠে যাচ্ছেন। অস্কার পুরস্কার গ্রহণ করছেন। আমি বসে আছি, সব কিছু দেখছি, মনে কোনো আবেগ বা উত্তেজনা নেই।
শেষ পর্যন্ত সবসেরা চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার ঘোষিত হবে। জর্জ মারফি ঘোষকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন- এই বিষয়ের জন্য যাদের নির্বাচিত করা হয়েছে তারা হলেন?
জর্জ মারফি একটা এনভেলাপ খুললেন। আমরা সকলে তাকিয়ে আছি। উনি চিৎকার করে বললেন- সেরা চিত্রনাট্যকারের সম্মান পেয়েছেন সিডনি সেলডন, ব্যাচেলার অব দ্য ববি সার চিত্রনাট্যের জন্য।
আমার সমস্ত শরীর হিমশীতল হয়ে গেছে। আমি বুঝতেই পারছি না, এইভাবে পুরস্কৃত হব কোনো দিন।
জর্জ মারফি আবার আমার নাম ধরে ডাকছেন।
ডোনা আমাকে ঠেলা দিয়ে বললেন- উঠে দাঁড়ান।
আমি ঘোরের মধ্যে উঠে দাঁড়ালাম। টলমল পায়ে স্টেজের দিকে এগিয়ে চলেছি। অডিয়েন্স হাততালি দিতে শুরু করেছে।
জর্জ মারফি আমার হাতে হাত রেখে বললেন অভিনন্দন।
আমি কোনোরকমে ধন্যবাদ জানালাম।
জর্জ মারফি বললেন– মিঃ সেলডন, আপনি কিছু বলুন, কোথা থেকে এই গল্পের প্লটটা আপনার মাথায় এল।
আমি কী করে সব কথা বলব? আমি তখন বললাম– যখন নিউইউর্কে ছিলাম তখন অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে, আমি লিখতাম মানুষের দিকে তাকিয়ে, সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই এই গল্পটা লিখেছি।
আমি কী বলেছি কিছুই জানি না, মনে হচ্ছে আর কথা বলতে পারব না। আমি সকলের দিকে তাকালাম, অনেকের নাম মনে পড়ে গেল, তারপর সীটে ফিরে এলাম।
ডোনা প্রশ্ন করলেন- কেমন লাগল? কেমন অনুভূতি।
না, এত আনন্দ জীবনে কখনও হয়নি। কিন্তু আরেকটা বিষয় ভেবে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই সম্মান কি সত্যিই আমার? আমার থেকে আরও ভালো কাজ অনেকে করেছেন, কিন্তু ভাগ্য দোষে তারা হয়তো সেরা শিরোপা পাননি।
উৎসব এগিয়ে চলেছে, কিন্তু স্টেজে কী হচ্ছে তা দেখার মতো ইচ্ছে আমার নেই। রোনাকে দেখা গেল অস্কার পুরস্কার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ ডাবল লাইফ সম্পর্কে কথা বলছেন। লরেট্টা, এক অভিনেত্রী, দি ফারমারিস ডটারের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন। আমি আর সেখানে বসে থাকতে পারছি না। এই রাতটা আমার জীবনে স্মরণীয় রাত হয়ে থাকবে। আমি কি একজন মনোবিশারদের কাছে যাব? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমার মধ্যে কোনো অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে।
.
ভদ্রলোকের নাম ডাঃ জুড মারনার। বন্ধুরা তার কথাই বলেছিলেন।
বিরাট চেহারার মানুষ, চুলের রং রূপালী হতে শুরু করেছে। উনি শান্তভাবে আমার সমস্যার কথা জানতে চাইলেন।
আমি ওনার দিকে তাকিয়ে নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভারসিটির কথা ভাবলাম। আমার সমস্যা কোথায় তাই তো বুঝিয়ে বলতে পারছি না। সব কথা বলার চেষ্টা করলাম। এমনকি কয়েক দিন আগে যে অস্কার পেয়েছি সে কথাও বললাম। কিন্তু আমার মনে সুখ কোথায়? মনের ভেতর সব সময় হতাশার অন্ধকার।
উনি প্রশ্ন করলেন এই হতাশাচ্ছন্ন অবস্থা সব সময় কি থাকে?
হা কেন এমন হয় বলুন তো?
গত কয়েক বছরের স্মৃতি রোমন্থন করার চেষ্টা করুন। দেখুন তো এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে কী যা আপনার মনকে বিষাদঘন করেছে।
অনেক কথাই মনে পড়ল, কিন্তু সুখের মুহূর্ত তত বেশি আছে, দুঃখের মুহূর্ত কোথায়?
আমি গল্প বলা শুরু করলাম, গল্প কিন্তু নয়, আমার ফেলে আসা জীবনের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা, নিউইয়র্কের সংগীত রচয়িতা ম্যাকসিচের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
আরেকটা কঠিন প্রশ্ন উনি বললেন- আপনি কি কখনও আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন?
অনেক দিনের আগের একটা ছবি মনে পড়ে গেল, বাবা ঠিক সময় না এলে আজ আমি বেঁচে থাকতাম না।
প্রশ্নোত্তরের পালা চলল, শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-আপনার মধ্যে হতাশাচ্ছন্ন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর অন্তরালে মস্তিষ্কের কিছু ব্যাপার আছে। সব সময় আপনি দুঃখের জগতে বাস করতে ভালোবাসেন।
উনি আমার দিকে আবার তাকিয়ে বললেন- অন্তত কুড়ি লক্ষ আমেরিকাবাসী এই রোগে ভুগছে। দশটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবারে অন্তত একজনকে এই রোগী হিসেবে পাওয়া যাবে। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে তারা এই রোগের শিকার হন। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এই রোগে আচ্ছন্ন ছিলেন। যেমন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের মতো শিল্পী, হারম্যান মেলভিল, এডগার অ্যালান পো, ভার্জিনিয়া উলফের মতো সাহিত্যিকেরা ইত্যাদি।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। তারাও কি আমার মতো একই সমস্যায় ভুগছেন?
আমি জানতে চাইলাম– কতদিন সময় লাগবে এই রোগ থেকে সেরে উঠতে?
উনি বললেন- এই রোগের কোনো শুশ্রূষা নেই।
-তাহলে?
কয়েকটা ওষুধ দিচ্ছি, নিজেকে শান্ত সংযত রাখার চেষ্টা করুন। অনেকের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হয়। তারা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠেন। এই ব্যাপারটাই সাংঘাতিক।
আমার মন আবার বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে উঠল।
নিজের শব্দের ওপর এবং কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করবেন।
আমার নিঃশ্বাস বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে।
ডাঃ মারনার আবার বললেন– নানা ধরনের বিশৃংখলা দেখা দিতে পারে। অনেকে মাসের পর মাস কেমন গুম মেরে বসে থাকেন। অনেকে আবার কারো সাথে কথা বলতে চান না। কেউ কেউ মনে মনে বিড় বিড় করেন।
ওনার অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম, সমস্ত শরীর থরথর পরে কাঁপছে, আমি ভালো আছি, নিজের মনকে প্রবোধ দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করি।
অস্কার সম্পর্কে অনেকগুলো প্রবাদ বাক্য জড়িয়ে আছে। যদি একবার তুমি অস্কার জেতো, তুমি এটা আর জিততে চাইবে না। আবার অস্কার জিতলে তুমি কোনো কাজ করতে পারবে না।
অস্কার জেতার পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে, স্যামি আমার অফিসে এসে প্রবেশ করলেন, অনেক অনেক অভিনন্দন, কোথায় আছে ওই পুরস্কারটা?
-স্যামি এত আনন্দ করার কী আছে? তুমি কি ভাবছ এটা আমার বাড়ির ছাদ?
উনি হেসে উঠলেন।
–স্যামি, এই পুরস্কার জেতা আমার কাছে একটা আঘাতের মতো।
উনি বললেন আমি জানি, আমি আপনার ভাষণ শুনেছি, কিন্তু আরেকটা কথা জানতে চাইছি, আপনি এখন কী করছেন? সাত বছরের চুক্তি করে ফেলেছেন?
আমি বিশ্বাস করছি না, এটা বোধহয় অস্কার পুরস্কারের ফলশ্রুতি, আমার মনে হল।
অনেকগুলো শর্ত নিয়ে আলোচনা করতে হবে, আমি ওয়েস্ট উডে পৌঁছে গেলাম।
একটা ছোট্ট বাড়ির ভেতর, এখানে একটা ছোট্ট বেহুরুম আছে, একটা লিভিং রুম, কিচেন এবং দুটো বাথরুম। বাড়িটার সাথে একটা গ্যারেজ আছে। টনি কার্টিস এবং গ্যানেট লে –এই দুজন বিখ্যাত অভিনেতা কয়েকটা বাড়ি দূরে থাকে। তাদের গাড়ি আছে কিন্তু গাড়ি রাখার জায়গা নেই। একদিন ডিনারে উনি বলল আমাদের একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তুমি কি তোমাদের গ্যারেজটা ভাড়া দেবে?
আমি বলেছিলাম– তুমি এটা ব্যবহার করতে পারো কিন্তু ভাড়া হিসেবে আমি কিছু নেব না। তখন থেকে ওদের গাড়িটা আমার গ্যারেজে থাকে। আমার বাড়িটা খুবই ছোটো ছিল, সেখানে পার্টি দিতে পারতাম না। মাঝে মধ্যে আমাকে পার্টির আয়োজন করতে হয়, এখন কোথায় বেশি জায়গা পাব। ভাগ্যক্রমে একটা ভালো ফিলিপিনো পাঁচকের সন্ধান পেয়েছি। সে বাড়িটাকে পরিষ্কার রাখে। এম জিএমের সঙ্গে কাজ শুরু হল, গুরুত্বপূর্ণ অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল। ইরা গারসউইন স্ত্রীকে নিয়ে ডিনার খেতে এলেন। স্ত্রীর নাম লী। কার্ক ডগলাস, সিড কিয়েসার, সকলেই আসতে শুরু করেছেন। এলেন অনেক বিখ্যাত মানুষজন। জুলেস মাঝেমধ্যেই আসেন, তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তার স্ত্রী ডেরিসের সাথে আলাপ হল। মাঝেমধ্যে আমরা মেঝেতে বসে গল্প করি, যথেষ্ট চেয়ার বাড়িতে নেই। কেউ সেদিকে মাথা ঘামায় না।
রবার্টের সঙ্গে আলাপ করে আনন্দ পেয়েছিলাম। ডিজনি স্টুডিওর প্রধান মেকাপ ম্যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রয়াল এয়ারফোর্সের হয়ে কাজ করেছেন। সুন্দর প্রমোদ তরণীর মালিক, বলা যেতে পারে বিশ্ব পরিভ্রমণ করেছেন।
১৯৪৬, স্কিফার ওরিটা একটা ছবিতে কাজ করছিলেন। রিটা তখন যথেষ্ট জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তিনি এবং স্কিফার মেক্সিকোতে চলে যাবার পরিকল্পনা করলেন। ছবিটা অনেক দিন আটকে থাকল।
প্রত্যেক শনিবার সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে জিনের আসর বসত। জনা ছয়েক অতিথি নিয়মিতভাবে আসতেন। আসতেন জেরি ডেভিস নামে একজন লেখক এবং প্রযোজক, আসতেন পরিচালক স্ট্যানলি ডোনেন, আরও কয়েকজন। এলিজাবেথ টেলার তখন সবেমাত্র উনিশ বছরের কিশোরী, তিনিও স্ট্যানলির সঙ্গে আসতেন। প্রত্যেক শনিবার তিনি লাঞ্চ তৈরি করতেন।
এলিজাবেথকে দেখে মনে হত এক প্রতিভাশালিনী অভিনেত্রী। তার কথা বলার মধ্যে একটা মত্ত মাদকতা ছিল। ভবিষ্যতে তিনি যে কিংবদন্তীর নায়িকা হয়ে উঠবেন, তার পরিস্ফুটন তখন থেকেই চোখে পড়েছিল। ভাবতেই পারা যায় না, প্রত্যেক শনিবার উনি আমার রান্নাঘরে বসে স্যান্ডউইচ তৈরি করতেন।
এম জি এমের সাথে সিডের একটা চুক্তিপত্র হয়েছে। মেয়েটি অসম্ভব যৌনবতী এবং প্রতিভাশালিনী। তিনি ব্যালার রোসাতে যোগ দিয়েছেন, তেরো বছর বয়সে। নাচের ভঙ্গিমাটি চমৎকার। আমি তাকে কয়েকবার কয়েক জায়গাতে নিয়ে গিয়েছি। প্রত্যেক শনিবার সন্ধেবেলা তাকে আসতে বলতাম, কিন্তু যে কোনো কারণেই সিড সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে চাইতেন না।
আমি প্রশ্ন করেছিলাম–কী সমস্যা?
সিড বলতেন- আসছে শনিবার জবাব দেব।
উনি কিন্তু সমস্যার কথা কখনও বলেননি। কিছুদিন বাদে খবরের কাগজের পাতায় প্রকাশিত হল সেই সংবাদটি। উনি এক বিখ্যাত শিল্পী টনি মার্টিনকে বিয়ে করছেন। সিড আমাকে ফোন করে বললেন –সিডনি, খবরটা শুনেছেন আশা করি।
-হ্যাঁ, মনে হয় বিবাহিত জীবনটা সুখেই কাটবে।
পরবর্তীকালে সিডকে ভুলেই গিয়েছিলাম, তখন আরেকটা কাজ নিয়ে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।
এম জি শ্রমের গল্পবিভাগের প্রধান কেনেথ ম্যাককেন্না একদিন আমাকে তার অফিসে ডেকে পাঠালেন। পঞ্চান্ন বছর বয়স হয়েছে, শরীরটা চমৎকার ঝকঝকে রেখেছেন।
কোনো সম্ভাষণ নয়- উনি পরিষ্কার বললেন, আপনার জন্য একটা কাজ আছে, সে বোট।
একটা অসাধারণ চুক্তিপত্র, সোবোটকে আমরা একটি সংগীত সমৃদ্ধ সিনেমা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। এই সিনেমাটা সকলেরই ভালো লাগবে, কিন্তু একটা ছোট্ট সমস্যা আছে।
আমি বলেছিলাম- কেনেথ, দুটো দৃশ্যের লেখা শুরু হয়েছে। আমি কিছু মৌলিক বিষয় ঢোকাতে চাইছি।
উনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন না, আপনার সাথে আমাদের চুক্তি আছে, একথা কখনই বলবেন না।
আমি সোবোট লিখিনি, তখন অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তিনমাসের ছুটি আছে, ভাবলাম ইওরোপ থেকে ঘুরে আসব। প্রস্তাবটা অভাবনীয়, একটা ফরাসী জাহাজ ভাড়া করা হল।
ন্যাটলি এবং ম্যারিকে সব খবর দিলাম। রিচার্ড এবং জোয়ানের কাছে খবর পৌঁছে গেল, তারা নিউইয়র্কে এল, আমাকে বিদায় জানাতে।
যাত্রীদের মধ্যে চার্লস ম্যাক আর্থার ছিলেন, তার সাথে আগেই আমার দেখা হয়েছে। উনি অসাধারণ চিত্রনাট্যকার। ফ্রন্ট পেজের মতো একটা সুন্দর ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন। জাম্বো এবং টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ওনারই লেখা। ওর স্ত্রী ছিলেন আমেরিকার সব থেকে সুন্দরী অভিনেত্রী হেলেন হায়াস।
চার্লসের সাথে তার দেখা হয়েছিল একটা পার্টিতে। প্রথম দেখাতেই চার্লসের হৃদয় গলে যায়। তিনি একমুঠো বাদাম হেলেনের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন আমার ইচ্ছেয় ও ভালোবাসায় এই বাদাম হীরক কণায় পরিণত হবে।
কিছুদিন বাদে ওদের বিয়ে হল। পরের বছর হেলেনের জন্মদিন, চার্লস তাঁর হাতে সত্যিকারের হীরে তুলে দিয়ে বলেছিলেন –মনে হয় এগুলো বোধহয় বাদাম ছাড়া আর কিছু নয়।
অন্যান্য সহযাত্রীদের মধ্যে বোসলিন্ত রাসেলের কথা বলা উচিত। তার স্বামী ফ্রেড ব্রিসন, এক বিখ্যাত প্রযোজক। ছিলেন এলসা ম্যাক্সওয়েল, এক বিখ্যাত মানুষ, কলমি ম্যাডাম নামে একটি চলচ্চিত্রের রচয়িতা।
সমুদ্র ভ্রমণের প্রথম দিন, চার্লস আমার কাছে এসে গল্প করতে শুরু করলেন। তিনি বললেন–এলসার কাছে আপনার নাম পৌঁছে গেছে। আজকের রাতে ডিনারে আপনি আসবেন তো?
চার্লি! আমি তার ডিনার পার্টিতে যোগ দিলে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করব।
ওনার মুখে হাসি। সত্যি কথা বলছেন তো?
সন্ধ্যার অন্ধকারে এলসা এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। বললেন –মিঃ সেলডন, আজ রাতে আমি একটা ছোট্ট ডিনার দিচ্ছি, আপনি এলে আমি খুশি হব।
–আমি নিশ্চয়ই যাব।
ডিনারটা অসাধারণ। অতিথিরা সত্যিই আনন্দ করেছেন। খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে গেল, আমি যাবার জন্য উদ্যত, একজন স্টুয়ার্ট বললেন ক্ষমা করবেন মিঃ সেলডন, টেবিলে তিন ডলার পড়ে আছে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম আমি মিস ম্যাক্সওয়েলের অতিথি।
-হা স্যার, তাই তিন ডলার দেওয়া হচ্ছে।
আমি রেগে গেলাম।
চার্লি আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
আমি বললাম কী ব্যাপার? এই টাকাটা কেন দেওয়া হচ্ছে?
চার্লি হাসলেন– সিডনি, এইভাবেই ওই ভদ্রমহিলা সকলকে এক জায়গায় জড়ো করেন। তাই উনি কিছু টাকা দিতে চান।
ব্যাপারটা আমাকে অবাক করেছে। লন্ডনে এলাম। স্যাভয় হোটেলে উঠলাম। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, ইংল্যান্ডে তার খারাপ প্রতিচ্ছায়া পড়েছে। জীবনযাত্রায় টানাটানি চলেছে। সব কিছুতেই অপ্রতুলতা। রুম সার্ভিস ওয়েটার সকালে এল, আমি বললাম –আঙুরের রস পাওয়া যাবে? ডিম সেদ্ধ? শুয়োরের মাংস আর টোস্ট?
তার মুখের ছবি পালটে গেল স্যার, স্যার, এসব পাওয়া যাচ্ছে না। আপনাকে ব্যাঙের ছাতা খেতে হবে।
তাই খাব কী আর করা যায়!
দিন এগিয়ে গেল, রাতে রেস্টুরেন্টে খেতে যাচ্ছি। খাবার মতো কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। পরদিন সকালে টনি মার্টিনের ফোন পেয়ে অবাক হয়ে গেলাম।
টনি বললেন– আপনি এই শহরে এসেছেন আমাকে বলেননি তো?
–আমি খুব ব্যস্ততার মধ্যে আছি।
–আপনি আজ আমার শো দেখতে আসবেন তো?
-না। এই মানুষটিকে আমি ঘৃণা করি। কারণ আমার ভালোবাসার মেয়েকে উনি বিয়ে করেছেন।
–আপনার বক্স অফিসের টিকিট থাকবে। উনি আবার বললেন শো শেষ হয়ে গেলে আসবেন কিন্তু।
উনি ফোনটা ছেড়ে দিলেন। শো দেখতে যাবার এতটুকু ইচ্ছে আমার নেই। আমি ব্যাকস্টেজে গিয়ে বলব উনি অসাধারণ অভিনয় করেছেন।
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত আমি নাটকটা দেখতে গেলাম, দর্শকরা তাকে অত্যন্ত ভালোবাসে। আমি ব্যাকস্টেজে গিয়ে তাকে অভিনন্দন জানালাম। সিড সেখানে বসেছিল। সিডকে দেখে আমি এগিয়ে গেলাম। সিড আমার সাথে টনির পরিচয় করিয়ে দিল।
-আজ রাতে আমাদের সাথে ডিনার খেতে হবে। টনি বলেছিলেন।
আমি মাথা নেড়ে বললাম- না আমার অন্য কাজ আছে।
টনি মার্টিম পরে আমার এক অন্যতম বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন। তারপর ডিনারটা আমি খেয়েছিলাম, একটা প্রাইভেট ক্লাবে। আমি জানতাম না লন্ডনের প্রাইভেট ক্লাবে রেশনিং এর ঝামেলা নেই।
ওয়েটার জিজ্ঞাসা করেছিল–আজ কী খাবেন? ভেড়ার মাংস?
ওয়েটার আবার জানতে চাইল–মাংসের সাথে ডিম চলবে তো?
লন্ডনে আসার পর সেই প্রথম ডিমের স্বাদ পেলাম।
এরপর আমি সিড আর টনির সাথেই রাতগুলো কাটাতাম। তাদের মধুচন্দ্রিমার গল্প শুনতাম।
এক রাত, টনি আমাকে বললেন আমরা কাল সকালে প্যারিস যাচ্ছি, আপনি আমাদের সঙ্গে যাবেন।
আমি কোনো কথা বললাম না।
আমরা প্যারিসের দিকে উড়ে গেলাম। শহরটা চমৎকার সুন্দর। উনি একটা সুন্দর লিমুজিন ভাড়া করেছিলেন। সবকটা ট্যুরিস্ট স্পট ঘুরে ঘুরে দেখা হল।
রবিবার সকালবেলা, টনি আমাদের নিয়ে ঘোড়ার দৌড় দেখতে গেলেন। কিন্তু আগের দিন খাওয়ায় কিছু গোলমাল হয়েছিল। আমরা সকলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছি।
টনি ফোন করে বললেন –সিড এবং আমার শরীরের অবস্থা ভালো নয়। আমরা হয়তো ট্রাকে যেতে পারব না।
–আমিও পারব না।
–নীচে একটা লিমুজিন দাঁড়িয়ে আছে, আপনার জন্য, ওটাতে চড়ে বসুন।
টনি?
-না, গেলে হয়তো ভালোই লাগবে।
আমি একা গিয়েছিলাম, অর্ধ অচেতন অবস্থায়। কী ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারিনি।
আমি ফরাসি ভাষা জানি না, কোনোরকমে ভাঙা ভাঙা ইংরাজি দিয়ে কথাবার্তা চালাচ্ছি।
ঘোড়দৌড়ের লড়াইটা চমৎকার, আমি দুনম্বর ঘোড়ার পেছনে বাজি ধরলাম, কিছু টাকাও হাতে পেয়েছিলাম, এই অভিযানের কথা আমি কখনও ভুলব না। ভাবলাম প্রত্যেক বছর অন্তত একবার ইউরোপে আসতেই হবে।
আগস্ট মাস, ডোরে আর কেওর প্রধান হিসেবে সই করেছেন।
আমাকে ন্যানসি গোস নামে একটি ছবির চিত্রনাট্য লেখার জন্য বলা হয়েছে। এখানে বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীরা অভিনয় করবেন।
জো পাস্টারনক এই ছবিটার প্রয়োজক। মধ্যবয়সী হাঙ্গেরীয় মানুষ, কথার মধ্যে হাঙ্গেরীয় টান আছে। এম জি এম আসার আগে তিনি ইউনিভারসালের হয়ে বেশ কয়েকটা কাজ করেছেন। ইউনিভারসালের অবস্থা এখন ভালো নয়, অনেক টাকার ধার দেনা হয়ে গেছে। ডেনা নামে এক অল্পবয়েসী অভিনেত্রীকে এমজিএম থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সে ইউনিভারসালে যোগ দিয়েছিল, জো পাস্টারনক ডেনাকে সঙ্গে নিয়ে থ্রি স্মার্ট গার্লস নামে একটি ছবি তৈরি করেছেন।
অবাক কাণ্ড, ছবিটা সকলের হৃদয় জয় করল। রাতারাতি ডেনা এক বিখ্যাত অভিনেত্রী হয়ে গেলেন। ইউনিভারসাল মরে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেল। এরপর জো পাস্টারনক এমজিএমে যোগ দিলেন এক প্রযোজক হিসেবে।
একদিন ডোরে একটা মিটিং ডাকলেন। সকলেই অফিসে বসে আছেন, ডোরে বললেন –আমাদের একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। টি অ্যান্ড সিমপ্যাথি নামে একটা ছবি আমি এইমাত্র কিনেছি। ব্রডওয়েতে এই ছবিটা হিট হয়েছিল কিন্তু সেনসার অফিস এই ছবিটা প্রদর্শনের অনুমতি দিচ্ছে না। এতে সমকামিতার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। আমরা ব্যাপারটাকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার চেষ্টা করছি। আমি আপনাদের মন্তব্য শুনতে চাইছি।
কিছুক্ষণের নীরবতা, একজন প্রযোজক বললেন সমকামীতার বদলে আমরা লোকটিকে অ্যালকোহলিক করতে পারি।
আরেকজন মন্তব্য করলেন- হ্যাঁ, তাকে তো ড্রাগে আসক্ত করা যায়।
–তাকে প্রতিবন্ধী করে দিন।
অনেকগুলো কথা ভেসে এল, কোনোটাই মনঃপুত নয়।
আবার কিছুক্ষণের নীরবতা, জো পাস্টারনক বললেন– ব্যাপারটা খুবই সহজ, এই ছবিটা যেমনই আছে তেমনই রাখুন। মানুষটা সমকামী এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সবশেষে মনে হবে এসবই একটা স্বপ্ন।
এভাবেই মিটিংটা শেষ হয়ে গেল।
ন্যানসি গোস টুরাওর শুটিং শুরু হয়েছে। এই শ্যুটিং-এ আমার সাথে লুইসের পরিচয় হল। অসামান্য অভিনেতা। থিয়েটারের জগতে যুক্ত ছিলেন। রাজকীয় আভিজাত্য আছে শরীরের মধ্যে, তীক্ষ্ণ নাক এবং উজ্জ্বল গায়ের রং। কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য আছে। তিনজন অভিনেত্রীকে পর পর বিয়ে করেছিলেন। কথার মধ্যে কৌতুক ঝরে ঝরে পড়ছে। দি ম্যাগনিফিসেন্ট ইয়াংকি-তে অসাধারণ অভিনয় করেছেন।
লুইস একদিন আমার বাড়িতে এলেন ডিনার খাবার জন্য।
আমরা দুজনে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। এই ভাবে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।
একজন এজেন্ট আমার সাথে এক সুন্দরী অল্পবয়েসী সুইডিস অভিনেত্রীর পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার নাম ইনগ্রিড। সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে ইউনিভারসালের একটা পরীক্ষাতে বসেছে। আমাদের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠল।
কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে, রবিবার সকালবেলা, আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। দরজায় বেলটা বেজে উঠল। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। ভোর চারটে। এখন কে এল? আমি কোনো রকমে আলখাল্লা জড়িয়ে দরজা খুলে দিলাম। একজন ভদ্রলোক হাতে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে ভেতরে এল।
সে বলল–কুকুরীর বাচ্চা, তোকে আমি মেরে ফেলব।
আমি অবাক হয়ে গেছি। আমাকে মরতে হবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি বললাম।
-না, তুই আমার বউ-এর সাথে শুয়েছিস।
ওর বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি কখনও বিবাহিতা মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করি না।
আমি বললাম- কে আপনার স্ত্রী আমি কিছুই জানি না।
ইনগ্রিড। সে বন্দুকটা তুলে বলল।
আমি আমতা আমতা করে বলি, এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন, ইনগ্রিড কিন্তু কখনও আমাকে বলেনি সে বিবাহিতা।
–ওই কুকুরী আমাকে বিয়ে করেছে, তাই এই দেশে আসার ভিসা পেয়েছে সে।
আমি বললাম- এখনই আঘাত করবেন না। এটা একটা নতুন খবর। তার হাতে বিয়ের আংটি নেই, সে স্বামীর কথা উচ্চারণ করেনি। আমি কীভাবে জানব। আপনি বসুন, আসুন কথা বলা যাক।
লোকটা শেষ পর্যন্ত বুঝল, আমার সমস্ত শরীর দরদর করে ঘামছে।
লোকটা বলল –আমি এরকম নই, আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি, আর ও আমার সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে।
-আমি আপনাকে দোষ দিচ্ছি না, আসুন একটু ড্রিংক করা যাক।
আমি ড্রিংক তৈরি করলাম, পাঁচ মিনিট কেটে গেছে, সে আমাকে তার জীবনের গল্পটা শোনাল। সে একজন লেখক, ইউরোপে তার সঙ্গে ইনগ্রিডের আলাপ হয়েছিল। ইনগ্রিড হলিউডে আসার জন্য ছটফট করছিল, লোকটারও মনে তাই ইচ্ছে।
আমি বললাম আপনি একটা চাকরি চাইছেন? আমি সেই চাকরির ব্যবস্থা করব। আমি মেট্রোতে কেনেথ ম্যাককেন্নার সঙ্গে কথা বলব।
লোকটার মুখে উজ্জ্বল আলো–সত্যি বলবেন?
পাঁচ মিনিট কেটে গেছে, সে এবং তার বন্দুক চোখের সামনে থেকে কোথায় হারিয়ে গেছে।
আমি আলো জ্বালোম, বুঝতে পারছি তখনও ঘোরটা কাটেনি। আবার ঘুমিয়ে পড়লাম, সামনের দরজায় শব্দ হল।
তার মানে? লোকটা কি আবার ফিরে এসেছে? সে কি তার মন পালটেছে? আমাকে মেরে ফেলবে?
আমি দরজা খুলে দিলাম, ইনগ্রিড দাঁড়িয়ে আছে। তার সমস্ত শরীরে রক্তের দাগ। মুখ ফুলে গেছে, চোখের তলায় কালো কালশিটে পড়েছে। ঠোঁট দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। আমি তাকে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে নিলাম।
সে কোনোরকমে বলল–সেলডন, তোমায় কিছু কথা বলার আছে।
-না, তুমি কেন বলোনি তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি বিছানাতে শুয়ে পড়ো। আমি ডাক্তার ডেকে আনছি।
আমি এক ডাক্তারের ঘুম ভাঙালাম। এক ঘণ্টা কেটে গেছে, ইনগ্রিডের অবস্থা সত্যিই শোচনীয়। সমস্ত শরীরে কাটা চিহ্ন, হাতের হাড় ভেঙে গেছে।
ডাক্তার চলে গেছেন। ইনগ্রিড বলল –আজ সকালে ইউনিভারসালে যেতে হবে, স্ক্রিনটেস্ট আছে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম না, টেস্টটা আজ বাদ দিতে হবে।
আমি তাই করেছিলাম।
ইনগ্রিড সন্ধেবেলা চলে গেল, তারপর? কোথায় গেল সে?
***
১৯৪৮, একটা নতুন প্রযোজনার দল তৈরি হয়েছে, তারা একদিন আমার সঙ্গে স্টুডিওতে দেখা করতে এল।
তারা বলল–আমরা ব্রডওয়েতে একটা ছবি নামাচ্ছি। ওয়ারস চার্লিং, এটা চার্লিস আন্ট নামে একটা ক্লাসিক উপন্যাসের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে। চিত্রনাট্যটা আপনি লিখবেন? আমরা আপনার নামটাই প্রচার করতে চাইছি।
আমি এই কাজটা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছি। চার্লিস আন্ট গল্পটা আমি জানি। গল্পটা অসাধারণ। ভেবেছিলাম এটা জনসাধারণের মন জয় করবে।
ফ্রাঙ্কের সঙ্গে কোথায় দেখা হবে?
ফ্রাঙ্ক বেশ কয়েকজন প্রিয় গান লিখেছে।
পাস্টারনকে দেখা গেল তার স্টুডিওতে, ত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে, যথেষ্ট প্রতিভা আছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী। যুদ্ধের সময় যে গানগুলি লোকের মুখে ফিরতে তার অনেকগুলো তারই লেখা।
আমরা দুজন মত বিনিময় করলাম।
আমি ডোরের কাছে চলে গেলাম। তিনমাসের ছুটি চাইলাম। ব্রডওয়েতে একটা শো। দেখাতে যেতে হবে।
ডোরে মাথা নেড়ে বলেছিলেন- ব্রডওয়েতে যাবেন? অনিশ্চিত অন্ধকার। ভালো থাকতে পারবেন তো?
আমি জোরের সাথে মাথা নেড়েছিলাম। তারপর আরেকটা প্রস্তাব এল, নতুন একটা ছবির চিত্রনাট্য লিখতে হবে। ছবিটার নাম হল অ্যানি গেট ইওর গান।
এটা ব্রডওয়ের সব থেকে বড়ো হিট হয়েছিল। তিন বছর ধরে একনাগাড়ে চলে।
১৯৪৫, হারবার্ট এবং ডরোথি ফেইলড, রিচর্ড রজার্স ও অসকারের সাথে একটা চুক্তি করেছে। তারা নতুন ছবি দেখাতে চাইছে।
নিউইয়র্কে কার্ন এলেন, তার একটা স্ট্রোক হয়েছিল, কদিন বাদে তিনি মারা যান। প্রস্তাবটা সেখানেই হয়তো থেমে যেত। ইতিমধ্যে আরভিন বার্লিনের সাথে রজার্সের যোগাযোগ হল। বেশ কয়েকটা হিট ছবি উপহার দেওয়া হল।
আমি নানা বিষয় নিয়ে চিন্তা করছি। হোয়ারস চার্লির খবর কী? আরভিন বার্লিনের সাথে আবার কাজ করার সুযোগ হবে।
আমি ডোরের প্রস্তাবটা উপেক্ষা করতে পারলাম না।
শেষ পর্যন্ত আমার সিদ্ধান্তের কথাটা মার্টিনকে জানিয়ে দিলাম।
আমার সিদ্ধান্তটা সঠিক বলে প্রমাণিত হল।
.
১৭.
আরভিন বার্লিনের সঙ্গে কাজ করার একটা উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতা। তার শক্তি কোনোদিন ফুরিয়ে যায় না। প্রত্যেকটি ব্যাপারের ওপর সংবেদনশীল নজর রাখেন।
আর্থার ফ্রেড তার অফিসে বসেছিলেন। আমাকে দেখে বললেন আমি একশোভাগ সুনিশ্চিত এটা জগত জয় করতে চলেছে।
আমি বললাম –আর্থার, কোন্ চরিত্রে কে অভিনয় করবেন সে সম্পর্কে কিছু ভেবেছেন?
-অ্যানির চরিত্রে জুডি গারলান্ড, একটা তরুণ অভিনেতাকে পাওয়া গেছে, তার নাম হাওয়ার্ড কিল, সে ফ্রাঙ্কের চরিত্রে অবতীর্ণ হবে। বাফেলো বিল সাজবে লুই কালোরন। জর্জ সিডনিকে পরিচালনা করতে বলা হবে।
জুডির সাথে আবার দেখা হবে, ভাবতে ভালো লাগছে। আর্থার ফ্রেড আমাকে বলে। ছিলেন–আপনাকে নিউইয়র্ক এবং শিকাগোতে নিয়ে যাব, নাটকটা দেখার জন্য।
এক্সেল মারমান নিউইয়র্কে অ্যানির চরিত্রে অভিনয় করেছেন। শিকাগোতে এই চরিত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন ম্যারি মাটিন।
–আমি কখন যাব?
–কাল সকাল নটার সময় প্লেন ছাড়বে।
এটা একটা দারুণ ছবি। দেখা গেল দর্শকেরা ভালো ভাবেই গ্রহণ করেছে। আমি শিকাগোতে গিয়ে ম্যারি মার্টিনের অভিনয় দেখলাম।
ম্যারি কিন্তু সম্পূর্ণ নিজের করে সংলাপটাকে সাজিয়েছে। তার অ্যানি এক লাজুক মহিলা, তার চরিত্রের ভেতর একটা কোমনীয়তা আছে। আমি ভাবলাম এথেল মারম্যানের অভিনয়টাও দেখতে হবে। সেটাও দেখে নিলাম, তার অভিনয়ের মধ্যে উত্তেজনার ছাপ আছে।
শেষ পর্যন্ত আমি ঠিক করলাম, আমার অ্যানি গাম্ভীর্য এবং তারুণ্যের সংমিশ্রণে তৈরি হবে। তার মধ্যে অনেক মৌলিক বিষয় থাকবে।
প্রথম এবং দ্বিতীয় অঙ্কের মধ্যে অনেকটা সময় থাকছে। প্রথম অঙ্ক যেখানে শেষ হচ্ছে সেখানে দেখানো হচ্ছে অ্যানি ইওরোপে চলে যাচ্ছে। দ্বিতীয় অঙ্কের শুরুতে সে ইওরোপ থেকে ফিরে আসছে। কিন্তু এই দুটি অঙ্কের মধ্যবর্তী সময়সীমায় কে সেতু বন্ধন করবে?
আমি দেখাতে চেয়েছিলাম অ্যানি বিভিন্ন দেশে ঘুরছে, অথবা একটা দেশেই বসে আছে। ভেবেছিলাম বিরতিটা লম্বা না ছোটো করব। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। তাহলে অনেক বেশি জায়গাতে শুটিং করতে হবে। প্রযোজক কি চাইবেন?
আমি আর্থার ফ্রেডকে অফিসে ডাকলাম। এই সমস্যাটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। একঘণ্টা বাদে সেক্রেটারী এসে অ্যাপয়েন্টমেন্টটা বাতিল করে দিল। আমি পরের দিন আবার দেখা করতে চেয়েছিলাম। সেটাও বাতিল হয়ে গেল। পর পর তিনদিন এই ঘটনা ঘটল। তৃতীয়দিন বিকেলবেলা স্যামি আমার অফিসে এসে বসলেন, উনি বললেন- আর্থার ফ্রেডের অফিস থেকে আসছি, আপনার আচরণে উনি খুব দুঃখ পেয়েছেন।
-কেন কী হয়েছে?
–আর্থার বললেন আপনি নাকি লেখাটা এখনও শুরু করেননি।
–আমি তো আলোচনা করতে চেয়েছিলাম।
বুঝতে পারলাম আর্থার ফ্রেড এই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে মোটেই আগ্রহী নন। তিনি ছবির অন্যান্য বিষয়গুলি দেখাতে চাইছেন, সংগীত পরিচালনা, নৃত্য সংযোজনা, অভিনেত্রীদের আচার-আচরণ। একটার পর একটা দৃশ্য কীভাবে তুলে ধরা হবে সেই বিষয়ে নজর দিতে চাইছেন না। মনে পড়ল, ইস্টার প্যারাডের চিত্রনাট্য শোনার পর তার অভিব্যক্তি কেমন হয়েছিল।
আর্থার ফ্রেডের একটা অনবদ্য গুণ আছে, তিনি সঠিক লোককে সঠিক কাজের দায়িত্ব দেন। আমি নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম, চিত্রনাট্য লেখার কাজ এগিয়ে চলল, চিত্রনাট্য লেখা শেষ হল, পরের দিন জর্জ সিডনি আমার অফিসে এলেন।
–আমি কি সত্যি কথা বলব নাকি মিথ্যে প্রশংসা করব?
আমার মুখ শুকনো। সত্যিটা জানতে চাইছি। জর্জ সিডনি বললেন- কী কাজ হয়েছে? তারপর তার চোখ জ্বলে উঠল- আমরা একটা অসাধারণ ছবির জন্ম দিতে চলেছি।
এবার বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা অভিমত শুনতে পেলাম। আর্থার ফ্রেড বললেন –সিডনি, আপনি সঠিক বিষয়টা ধরতে পেরেছেন।
জুডি এসে গেছেন, সময় এগিয়ে চলেছে, জুডির যখন কাজ থাকে না তখন তিনি আমার অফিসে এসে গল্পগুজবে মেতে ওঠেন।
জুডির মনের মধ্যে আশঙ্কা সিডনি সবকিছু ঠিকঠাক হবে তো?
–জুডি চিন্তা করবেন না, দেখবেন সকলের মনে এই ছবিটা দাগ কাটবে।
আমি জুডির দিকে তাকালাম, মেকাপের আড়ালে বিষণ্ণ দুটি চোখ।
আমি গুজব শুনতে পাচ্ছি, জুডি নাকি ঠিকমতো শ্যুটিং-এ আসছেন না। মাঝে মধ্যে সংলাপ ভুলে যাচ্ছেন। তার জন্য শু্যটিঙের কাজে অনেক ক্ষতি হচ্ছে। তিনি জর্জ সিডনিকে রাত্রি দুটোর সময় ফোন করে জানাচ্ছেন যে পরের দিনের সেট বাতিল করতে।
শেষ পর্যন্ত শুটিং বন্ধ হয়ে গেল। জুডি গারলাভকে সরিয়ে দেবার কথা ঘোষণা করা হল। আমার মন বিষাদে আচ্ছন্ন। জুডির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম, শুনলাম জুডি নাকি ইওরোপে চলে গেছেন, হতাশ হয়ে।
এবার অ্যানির ভূমিকাটা বেটি গ্যারেটকে দেওয়া হল, অল্পবয়েসী এক প্রতিভাশালী অভিনেত্রী, শেষ পর্যন্ত তার এজেন্টদের ঝামেলায় এই চরিত্রটি সে হাতে পায়নি।
এবার বেটি হ্যাটনের সঙ্গে কথা হল। বেটি অ্যানির চরিত্রে অভিনয় করবে।
একদিন সকালবেলা, শ্যুটিং চলছে, আরভিন বারিলিন আমার অফিসে এসে বললেন –সিডনি, চলুন আমরা ব্রডওয়েতে একসঙ্গে একটা ছবি তৈরি করি।
আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। আরভিনের সঙ্গে কাজ করা যে কোনো মানুষের স্বপ্ন। আমি বললাম, ঠিক আছে, কী লিখতে হবে বলুন?
–আমার মনে একটা গল্প এসেছে। উনি গল্পটা বলতে শুরু করলেন। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম।
আমি বললাম সাড়ে বারোটার সময় লাঞ্চ খেতে যেতে হবে, আমাকে এখন যেতে হচ্ছে, ফিরে আসি। তারপর গল্প শুনবো।
–কোথায় যাবেন?
–বেভারলি হিলসে, ব্রাউন ডারবিতে।
–চলুন আপনার সঙ্গে যাচ্ছি।
আরভিন বারলিন আমার গাড়িতে উঠে বসলেন। আমি রেস্টুরেন্টে চলে গেলাম। আরভিন সেখানে বসে তার গল্পটা আমাকে শোনাতে শুরু করলেন। এক ঘণ্টা ধরে লাঞ্চ খাওয়া চলতে থাকল। তার চোখে মুখে একটা অদ্ভুত আশার বিচ্ছুরণ।
সেদিন বিকেলবেলা আরভিন বললেন–তিনি লস এঞ্জেলসে যাবেন। কারণ একজন নতুন গায়ক তার গানে গলা মেলাবেন। এখন আরভিনের বয়স ষাট বছর। ভদ্রলোক সৃজনশীলতার চূড়ায় উঠে গেছেন।
বিগত বছরগুলো খুব একটা সদয় ছিল না। আরভিন যখন নব্বইতে পা দিলেন, তখন তার শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। টমি টিউন নামে এক ব্রডওয়ের প্রযোজক তাকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন আরভিন ব্রডওয়ের এক সংগীত মুখর সিনেমাতে আমি আপনার কয়েকটা গান ব্যবহার করতে চাইছি।
-না, আপনি তা পারেন না।
–কেন?
আরভিন বলেছিলেন– অনেকেই আমার গান গাইছে।
আমার দুর্ভাগ্য, শেষ পর্যন্ত ওই স্বপ্নটা সফল হয়নি।
অ্যানি গেট ইওর গান চিত্রনাট্যটা ভালোই লিখেছিলেন। এই ছবিতে অনেকগুলো মোচড় ছিল।
জর্জ সিডনির পরিচালনায় কাজ শুরু হল। ১৯৫০ সালে ছবিটা মুক্তি পেল। সমালোচকেরা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন।
১৯৫০- ভ্যারাইটি পত্রিকাতে জনপ্রিয় ছবির তালিকা প্রকাশিত হল। তার মধ্যে আমার চিত্রনাট্যের তিনটি ছবি স্থান পেয়েছে। দ্য ব্যাচেলার অ্যান্ড দ্য ববি সক্সার, ইস্টার প্যারাড এবং অ্যানি গেট ইওর গান।
***
হতাশার মুহূর্ত হারিয়ে গেছে, আমি ভাবলাম আর কখনও ডাক্তারের শরণাপন্ন হব না। ডোনা হলওয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, তার সাহচর্য আমাকে আনন্দ দিচ্ছে।
একদিন ডিনারের পর ডোনা বলল –মেরিলিন মনরোর সঙ্গে দেখা করবে?
-হ্যাঁ, আমি অবশ্যই যাব।
মেরিলিন মনরোকে সেক্স সিম্বল বলা যায়, জনপ্রিয় সুপারস্টার। উন্মাদ মায়ের সন্তান, অচেনা পরিবেশের মধ্যে শৈশব কাটিয়েছেন। বিয়েটা ফলপ্রসূ হয়নি। অ্যালকোহল এবং, ট্যাবলেটের সঙ্গে লড়াই করেছেন। কিন্তু কোনো কিছুই তার প্রতিভাকে হত্যা করতে পারেনি।
পরের দিন ডোনা বলল মেরিলিনের সাথে শুক্রবার রাতে ডিনার খেতে যেতে হবে। তার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে তাকে তুলে নিতে হবে।
ডোনা ঠিকানাটা দিল।
আমি শুক্রবার রাতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। মারলিন মনরো, জেন্টলমেন প্রেফার ব্লোন্ডস, হান্ড টু ম্যারি এ মিলিওনেয়ার, মানকি বিজনেসের মতো অসাধারণ ছবিতে অভিনয় করেছেন, ক্যারি গ্রান্টের বিপরীতে।
সেই সন্ধেবেলা এল, আমি মেরিলিনের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে গেলাম, একজন ভদ্রমহিলা আমাকে ভেতরে ডেকে নিল।
–মিস মনরো কয়েক মিনিটের মধ্যেই আসছেন, উনি পোশাক পরছেন।
দেখতে দেখতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে গেল, মেরিলিনি তার বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলেন, রূপের এমন ঝলক দেখে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেছে।
উনি আমার হাতে হাত রেখে বললেন –সিডনি, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগছে। আপনার লেখা আমার ভালো লাগে।
আমরা বেভারলি হিলসের একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার খেলাম।
আমি বললাম নিজের গল্প বলুন।
উনি কথা বলা শুরু করলেন। মাঝেমধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন রাশিয়ান সাহিত্যিকের নাম বলছিলেন। যেমন হস্তো ভস্কি, পুশকিন। তার মানে? এই সুন্দর সুন্দর আড়ালে একটা উজ্জ্বল মস্তিষ্ক লুকিয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি শুনলাম উনি আর্থার মিলার এবং এলিয়া কাজানের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়েছিলেন। এই দুজন ওনার গুরু হিসাবে চিহ্নিত। সন্ধেটা আমি কখনও ভুলতে পারবো না, কিন্তু ওনার সঙ্গে আর কখনও কোথাও যাবার সুযোগ হয়নি।
কদিন বাদে উনি আর্থার মিলারকে বিয়ে করেছিলেন।
১৯৬২ সালের আগস্ট মাস, আমি আমার ডাক্তারের সাথে তার বাড়িতে বসে খাওয়া দাওয়া সারছি। হঠাৎ একটা ফোন এল, তিনি টেবিলে এসে বললেন আমি এখনই আসছি।
দু ঘন্টা বাদে উনি ফিরে এলেন।
–আমি দুঃখিত, উনি বললেন, একজন পেশেন্টের মৃত্যু হয়েছে, সে হল মেরিলিন মনরো। তখন মেরিলিনের বয়স মাত্র ছত্রিশ বছর।
***
হ্যারি কোহনের সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, তখনই মনে হয়েছিল, তিনি ভবিষ্যতে এক কেউকেটা হয়ে উঠবেন। ডোনা হলওয়ের সাথে কলম্বিয়া পিকচার্সের প্রযোজনা বিভাগের প্রধান।
হ্যারির সাথে আমার সম্পর্কটা বরাবরই ভালো ছিল। হ্যারি আমাকে অনেক বিষয়ে সাহায্য করেছে। হ্যারির কথা আমি ভুলতে পারব না।
হ্যারি কোহনের বয়স যখন মাত্র কুড়ি বছর, তখন তার সেরা বন্ধু ছিলেন হ্যারি রুবি। তারা দুজনে মিলে নানা ধরনের কাজ করতে শুরু করেন। প্রথমে বাসে যোগ দিয়েছিলেন। কোহন ছিলেন কন্ডাকটার, হ্যারি রুবি টিকিট নিতেন। তাদের মধ্যে ছিল অচ্ছেদ্য বন্ধন। পরবর্তীকালে তারা দুজনেই হলিউডে আসেন। তারা অতীত দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকেন। হ্যারি কোহন তখন একটা স্টুডিও চালাচ্ছেন, হ্যারি রুবি নিজেকে এক সফল সংগীত রচয়িতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
হ্যারি রুবি বলতে থাকেন সেই দিনগুলো ডায়নোসরের মতো হারিয়ে গেছে।
হ্যারি রুবি মেয়েদের দিকে তাকান, তারপর তাকান কোহনের দিকে।
-তুমি সপ্তাহে আঠারো ডলার করে পেতে, আমি কুড়ি, তাই তো? হ্যারি কোহনের মুখ লাল হয়ে গেছে।
হ্যারি কোহনের সাথে কয়েকটা ডিনার পার্টিতে যোগ দিয়েছিলাম। প্রথমে তার সাথে আমার সম্পর্কটা ভালো ছিল না, তারপর সম্পর্কটা সরল হয়ে উঠল।
আমি বলেছিলাম রোজ সকাল নটায় আমি নিয়মিত লিখতে বসি, যেমন অফিসের যাত্রীরা অফিসে যায়।
তার মানে? তুমি কি লেখাটাকে একটা ব্যাবসা বলে মনে করো নাকি?
–তা হয়তো করি না, কিন্তু লেখার প্রতি আমি অত্যন্ত অনুগত।
দুজনে তর্ক-বিতর্ক শুরু হল, আমাকে উনি লাঞ্চে নিমন্ত্রণ জানালেন। উনি বললেন সেলডন, একজন প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তার আগে দেখব ভদ্রলোক কতখানি অনুগত।
-তার মানে?
-উনি শুধু আমার জন্যই কাজ করবেন। আমি একজন দামী পরিচালককে ভাড়া করতে পারি, একটা ফ্লপ হলে কী হবে? তার দাম অনেক কমে আসবে।
একদিন হ্যারি কোহনের অফিসে বসে আছি, স্টুডিও ম্যানেজারের কণ্ঠস্বর সন্টারকসে শোনা গেল।
-হ্যারি, ডোনা কথা বলতে চাইছেন। টনির রেজিমেন্টকে বাইরে পাঠানো হয়েছে। ডোনা তার সঙ্গে যেতে চাইছেন। সানফ্রান্সিসকোয়।
টনি আওয়েন, ডোনার স্বামী, একজন প্রযোজক–কোহন বললেন না এটা কখনই হতে পারে না।
এক মিনিট বাদে স্টুডিও ম্যানেজার ছুটে এসেছেন হ্যারি, ডোনা খুব ভেঙে পড়েছেন। অনেক দিন বাদে স্বামীর সঙ্গে দেখা হচ্ছে, তাকে আটকে রাখা কি উচিত হবে?
কোহন আবার বললেন না, আমি কখনই ছাড়ব না।
স্টুডিও ম্যানেজার আবার এলেন। বললেন হ্যারি, ডোনা কিন্তু কাঁদছেন। তিনি চলে যাচ্ছেন।
হ্যারি বললেন –ঠিক আছে, আমরা ওনাকে আর নেব না।
আমি কোহনের দিকে তাকালাম, অবাক হয়ে গেছি। কোন্ জীবন্ত দস্যুর সঙ্গে আমাকে ঘর করতে হচ্ছে।
***
জর্জ অরওয়েলের একটা অসাধারণ উপন্যাস পড়েছিলাম ১৯৮৪ সালে। এই উপন্যাসে বলা হয়েছিল রাশিয়াতে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শুরু হবে। আমি ঠিক করলাম এটাকে নিয়ে একটা চিত্রনাট্য লিখব। আমি আরওয়েলের কাছে চিঠি পাঠালাম, অনুমতি চাইলাম।
ডোরের কাছে চলে গেলাম। ডোরে বললেন–বইটা আমিও পড়েছি, কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে অনেক কথাই বলা হয়েছে, যেটা প্রযোজনা করা যাবে না।
-ডোরে, এটা একটা অসাধারণ নাটক হতে পারত।
–আরওয়েলের সাথে আলোচনা করলে ভালো হয়।
আমি ভাবলাম, তারপর বললাম ঠিক আছে আমি, আরওয়েলকে সবকিছু জানাচ্ছি।
***
প্রিয় মিঃ সেলডন, ৯ আগস্টের চিঠির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি বুঝতে পারছি এই বইয়ের ভেতর যে রাজনৈতিক বিতর্ক আছে তা নিয়ে আপনি চিন্তিত। এই বইতে সাম্যবাদের কথাই বলা হয়েছে। সাম্যবাদ একদিন সামগ্রিক মতবাদ হয়ে উঠবে এই সম্ভাবনার কথাই ঘোষণা করা হয়েছে। আমি জানি এই মতবাদ ইংরাজি ভাষাভাষিদের সমৃদ্ধ দেশের কাছে একটা আঘাত। আমি রাশিয়ার কথাও চিন্তা করছি। আমি কখনোই ব্রিটেনের লেবার পার্টিকে আক্রমণ করতে চাইছি না। আপনি এই চিত্রনাট্যটা করতে পারবেন কি? জানি না আমেরিকার গণমাধ্যম এটাকে কীভাবে নেবে?
ডোরা তখন খুবই ব্যস্ত, ১৯৮৪-র বইটা চিত্রনাট্য করব না এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম!
.
১৮.
সেনেট ম্যাকেনা আমার সাথে যোগাযোগ করলেন। রিচ ইয়ং অ্যান্ড প্রিটি নামে একটা ছবির চিত্রনাট্য লিখতে হবে। জেন ড্যানিয়েল ওয়েন্ডেল এবং তরুণী গায়িকা ভিক ডামন সেই ছবিতে অভিনয় করবেন। খুবই সুন্দর কুশীলব। এই গল্পটা এমন এক মহিলাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত যিনি তার মেয়েকে পরিত্যাগ করেছেন। অনেক বছর বাদে মেয়ের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
একদিন সকালে জুলেস আমার সাথে দেখা করে বললেন –ডেরিস এবং আমি আপনার সাথে ডিনার খাব আজ। আমি কি আর কাউকে সঙ্গে আনব?
সেই সন্ধ্যায় জুলেস এবং ডেরিস এক অল্পবয়েসী ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এলেন।
-এ হচ্ছে ফার্নানো লামাস, আপনার ছবিতে সে অভিনয় করবে।
ফার্নানডোর কথার মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকার উচ্চারণ আছে। একদিন সে একজন খুব ভালো অভিনেতা হয়ে উঠবে এ বিশ্বাস আমার ছিল। কয়েকটি ছবিতে সে অভিনয় করেছিল।
রিচ ইয়ং অ্যান্ড প্রিটির সেট তৈরি হয়েছে, শু্যটিঙের প্রথম দিন। ডরোথি কুপারের সহযোগিতায় চিত্রনাট্য লিখে ফেলেছি। এটা ভিক ডামিনের প্রথম ছবি, স্পষ্টতই তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন। পরিচালক ছিলেন নরম্যান টাওরফ, এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক।
টাওরফ বললেন- এবার শুটিং শুরু হবে।
ভিক ডামন বললেন মাফ করবেন মিঃ টাওরফ, একটু জল খেতে পারি?
নরম্যান বলেছিলেন- না, এখন জল খাওয়া চলবে না।
এইভাবেই শ্যুটিং শুরু হল।
বক্স অফিসে খুব একটা সফল হতে পারেনি।
আমি তখন রুথ ব্রুকসের সঙ্গে কাজ করছি তার একটা বিখ্যাত সংস্থা আছে। অনেকগুলো ছবির কাজ করতে হবে। নতুন একটা ছবির টাইটেল নাম দিলাম থ্রি গাইস নেৰ্ড মাইক।
স্পিনকে সেটা দেখালাম, খুব একটা খারাপ হয়নি। নতুন পরিচালককে নেওয়া হল।
বিভিন্ন খবরের কাগজের পাতায় সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেই আমাকে তীক্ষ্ণভাবে আক্রমণ করেছেন।
এবার জাস্ট দিস ওয়ানসের চুক্তি করতে হল। ম্যাক্সট্রেলের লেখা একটা গল্পের নাট্যরূপ আমাকে লিখতে হবে। এমন একটা মানুষের জীবন যে মানুষটি খুবই কৃপণ, পৈত্রিক সম্পত্তি টিপে টিপে খরচা করে।
লেখাটা শেষ হল, ক্যারি গ্রান্টকে দেখালে কেমন হয়? স্টুডিও লেখাটা ক্যারির কাছে পাঠিয়ে দিল। উনি রাজি হলেন না।
পিটার লফোর্ডকে প্রধান ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল। জ্যানেট লে এবং লুইস স্টোন জাজ হার্ডিকেও ডাকা হল।
একবছর কেটে গেছে, ছবিটা প্রকাশিত হল। ক্যারি আমাকে বলেছিলেন- সিডনি, তুমি অভিনয় করলে না কেন?
জাস্ট দিস ওয়ানস আমার খুব পরিচিত এবং প্রিয় সিনেমা।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী, কেনেথ ম্যাককান্না আমাকে ডেকে পাঠালেন।
আমরা ব্রডওয়ের একটা থিয়েটার কিনেছি, রিমেন্স টু বি সিন নামে। আমি সমালোচনাগুলো পড়লাম, খুব ভালো সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। হাওয়ার্ড লিন্ডসে এবং রাসেল ক্রাওসে এটা লিখেছেন। এটা একজন মহিলা ব্যান্ড সিংগারের জীবন অবলম্বনে লেখা হয়েছে। ওই ভদ্রমহিলাকে একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হয়। তার বিত্তশালী কাকাকে কে বা কারা হত্যা করে। তাকেই সম্ভাব্য হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ছবিটা দারুণ, কিছু কিছু ঘাত প্রতিঘাত আছে।
আমি নিউইয়র্কে চলে এলাম, ট্রেনে বসে রিমেন্স টু বি সিনের চিত্রনাট্যটা পড়লাম।
লেলান্ড হেওয়ার্ডের সাথে লাঞ্চ খেলাম প্লাজা হোটেলে। তিনি পামেলা চার্চিলকে বিয়ে করেছিলেন, বিয়ে করেছিলেন মার্গারেট স্যালিভান এবং ন্যানসি হককে, সকলেই জগত সেরা সুন্দরী। ভদ্রলোকের মধ্যে আলাদা একটা পৌরুষ আছে। নিজেকে সফল করতে পারেন।
লেলান্ড টেবিল থেকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন –আপনার সাথে দেখা হয়েছে বলে ভালো লাগছে।
আমরা ছবিটার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলাম।
অসাধারণ অভিনেতা অভিনেত্রীদের জড়ো করা হয়েছে। কাকে ছেড়ে কার নাম বলব।
আমি হলিউডে ফিরে গিয়ে চিত্রনাট্য লেখার কাজে মনোনিবেশ করলাম। তিনমাস বাদে সেটা শেষ হল, আমি প্রযোজক আথরের হাতে তুলে দিলাম, উনি বললেন, লেখাটা ভালো হয়েছে। এখনই শ্যুটিং শুরু হবে।
কে কোন ভূমিকাতে অভিনয় করবে তা কি ভেবেছেন?
জুডি এবং ভ্যানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।
কদিন কেটে গেছে, ডোরে আমাকে তার অফিসে ডাকলেন। বেঞ্জামিন গুডম্যানের চরিত্রে লুইস ক্যালহানন আসছে।
আমি বললাম হ্যাঁ উনি একজন দারুণ অভিনেতা।
-একটা সমস্যা।
–কী সমস্যা?
–অভিনয়টা উনি করতে চাইছেন না, কারণ সংলাপ বিশেষ কিছু নেই।
ডোরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- লুইসের সাথে আপনার যোগাযোগ কেমন? ভালো তো?
আমি বললাম– হ্যাঁ।
–তাহলে আপনি কথা বলুন। উনি অভিনয় করলে এই ছবিটা একটা অন্য মাত্রা পাবে।
পরের দিন রাত্রিবেলা আমি ক্যালহাননকে একটা ডিনারে নেমন্তন্ন করলাম। তিনি এসে বললেন–যদি কেউ আমাদের দেখে ফেলে তাহলে সর্বনাশ। আমার একটা মুখোশ পরে আসা উচিত ছিল।
আমি আপনার সমস্যা বুঝতে পারছি, আপনি কেন বেঞ্জামিন গুডম্যানের চরিত্রে অভিনয় করতে চাইছেন না?
–এটা কী কোনো চরিত্র হল? তবে আপনার চিত্রনাট্যটা ভালো হয়েছে।
আমি বললাম–লুই, এটা একটা মস্তবড় ছবি হবে, আপনি না থাকলে খারাপ লাগবে। আপনার চরিত্রটা ছোটো হতে পারে, কিন্তু গল্পের সাথে জুড়ে গেছে। আপনার অভিনয়ের ওপর এই ছবিটা দাঁড়িয়ে থাকবে।
আমি আরও আধঘণ্টা ধরে বুঝিয়ে ছিলাম, শেষ পর্যন্ত উনি রাজি হয়েছিলেন।
বক্স অফিসে যা রিভিউ প্রকাশিত হল তা আমাদের অবাক করে দিয়েছে। ক্যালহাননের নাম লোকের মুখে মুখে ঘুরছে।
প্রত্যেক বছর এম জি এমের মুভির একটা প্রদর্শনী হয়ে থাকে। অনেকে দেখতে আসেন।
-আপনি ছবি প্রযোজনা করবেন?
আমি অবাক কী করে করব?
–আমরা সেটা চিন্তা করছি, আজ থেকে আপনি হলেন একজন প্রযোজক।
–আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না।
উনি বললেন সব শিখিয়ে দেওয়া হবে।
আমার বয়স চৌত্রিশ বছর। আমি অস্কার পেয়েছি। এখন প্রোডিউসার হতে চলেছি। কোন্ কোম্পানি, যারা এই ব্যাপারে এক নম্বর। তখন মনে হল, আমার মনে আনন্দ থাকা উচিত কিন্তু ভয় লাগছে কেন? আমি এত চিন্তিত কেন?
রাতে ঘুমোত পারিনি। মধ্য রাতে পোশাক পরে বাইরে বেড়াতে বেরোলাম। একটার পর একটা অভাবিত ঘটনা ঘটে চলেছে। মনে পড়ে গেল, বাবা সে রাতে আমাকে পথে ডেকে নিয়েছিল। বলেছিল, প্রত্যেকটা দিন একটা আলাদা বার্তা নিয়ে আসবে, সিডনি। জীবন একটা উপন্যাসের মতো। শেষ পাতায় পৌঁছোনো না পর্যন্ত আমরা জানি না, কোন্ গল্পটা আমাদের জন্য লেখা হয়েছে।
সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেল। আমি চিন্তা করলাম এবার আমি প্রযোজক হব। এক্ষেত্রে যদি কোনো পদস্খলন হয়ে যায় তা হলে আবার লেখকের জীবন যাপন করব।
— আমি স্টুডিওতে গেলাম। আমাকে একটা মস্ত বড়ো অফিস দেওয়া হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম, মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ারের মতো এখানেও সরল সাদা সিধে উপস্থাপনা থাকবে। কিন্তু এখানে সব কিছুই রাজকীয়।
প্রোডিউসারদের হাতে রাইটারদের তালিকা তুলে দেওয়া হয়। যখন চিত্রনাট্যটা শেষ হয়ে যায়, তখন কাস্টিং ডিপার্টমেন্টের সাথে কথা বলতে হয়-কে কোন ভূমিকাতে অবতীর্ণ হতে পারে তার একটা তালিকা তৈরি করতে হয়।
শেষ পর্যায়ে এজেন্টদের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। অনেক ঝামেলা ঝক্কি পোহাতে হয়।
একদিন সন্ধেবেলা আমি খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। হলিউডের বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমার অতিথি হিসেবে যারা এসেছিলেন, সেই তালিকার দিকে চোখ বুলালে অবাক হতে হয়। এসেছিলেন আলফ্রেড নিউমাইন, চেহারাটা ছোটো হলে কী হবে সৃজনশীলতায় ভরপুর। তাকে অনেকবার অস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এমন নামকরা সংগীত বিশেষজ্ঞের সন্ধান খুব একটা পাওয়া যায় না। তিনি দুশোরও বেশি ছবিতে গান দিয়েছেন।
এসেছিলেন ভিক্টর ইয়ং, তাকে ২২তম অস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। তিনি বেশ কয়েকটা ছবির গান লিখেছেন।
ছিলেন ডিমিত্রি টায়োমকিন, যিনি বেশ কয়েকটা ছবির গান লিখেছিলেন।
আর ছিলেন জোহনি গ্রিন, যাঁর চিত্রনাট্য এবং গান সকলের মন জয় করেছে।
অ্যান্ড্রে প্রেভিনকেও চোখে পড়ল। এই ভাবেই সেদিন সন্ধ্যায় অনেক বিশিষ্ট মানুষ আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন।
***
এর পাশাপাশি এক অল্প বয়সী অভিনেত্রীর কথা বলা উচিত। আমি ছোট্ট পিয়ানোর পাশে এসে বসেছি। বলা হল, আমি এখন পিয়ানো বাজাব।
আমি পিয়ানো বাজাতে শুরু করলাম। কে যেন বলল- সিডনি, বাধা দিচ্ছি বলে দুঃখিত। কাল সকালে, ডাকব, কেমন?
আমি উঠে দাঁড়ালাম–জেনেথ, আমি মোটেলে যাব কি?
আমি মোটেলে পৌঁছে গেলাম, পাঁচ মিনিট সেখানে ছিলাম। আমি ফিরে এলাম। আবার পিয়ানো বাজাতে শুরু করেছি। কী আশ্চর্য। পিয়ানো কোথায়? অতিথিরা কে কোথায় চলে গেছেন? আমি সকলের মুখের দিকে তাকালাম। উত্তর নেই!
মনের ভেতর একটা অদ্ভুত আতঙ্ক।
.
১৯.
আমি একজন প্রযোজক, আমার অফিসে সবসময় কর্ম ব্যস্ততা। ব্যাপারটা ভাবতে কেমন অবাক লাগছে।
সকাল থেকে ঘড়ির কাটা ধরে কাজ শুরু হয়। কতরকম কাজ করতে হয়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়ে যায়।
ভালো লাগে, আবার এত উত্তেজনা ভালো লাগে কি? কত অ্যাপয়মেন্ট, সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্মেলন, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাথে আলোচনা।
ডোরের সাথে কথা বলছি। একটার পর একটা ছবির অভিযান শুরু হচ্ছে। লাঞ্চ করার সময় পাচ্ছি না। দেখা হল জিসা নামে এক কিশোরী বাদামী চুলের কন্যার সাথে। জিসা আমার সাথে সহজেই অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে। তাকে নিয়ে লাঞ্চ খেতে গেলাম। হলিউডের বাজারে তখন জিসা সকলের হট ফেবারিট। সে আমার সাথে পরিচিত হয়ে খুবই আনন্দিত। তার মাধ্যমে জর্জিয়ার সাথে আলাপ হল। জর্জিয়ার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম- তুমি কি অভিনেত্রী হতে চাও? এর মধ্যে কোনো অভিনয় করেছ?
জর্জিয়া বলল দু একটা ছবিতে।
আমি আরও ভালোভাবে তাকে দেখলাম। হ্যাঁ, তার চরিত্রের মধ্যে একটা চুম্বক আকর্ষণ আছে। রাজকীয় অনুভব আছে তার চেহারার মধ্যে, বুদ্ধিদীপ্ত দুটি বাদামী চোখের তারায় আনন্দের উদ্ভাস। প্রতিশ্রুতি জ্বলজ্বল করছে। কণ্ঠস্বরে তীক্ষ্ণতা।
আমি বললাম তুমি আমার অফিসে এসো, দুজনে একসঙ্গে লাঞ্চ খাব।
জর্জিয়া কোনো কথা বলল না।
পরের দিন অফিস যাবার সময় ডেভিসকে দেখতে পেলাম। আমার প্রিয় বন্ধু।
-জেরি, আমি একজনকে বিয়ে করতে চলেছি।
–সে কে?
–না-না, এখনই বলব না।
পনেরো মিনিট বাদে জিসা আর জর্জিয়া আমার অফিসে এসেছে।
আমি বললাম –বসো।
আমরা নানা বিষয় নিয়ে গল্প করলাম।
আমি জর্জিয়াকে বললাম তুমি কি আমার সাথে ডিনার খাবে? তোমার ফোন নম্বর কত?
জর্জিয়া বলল না, আমি খুব ব্যস্ত থাকব।
জিসা জর্জিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল–বোকামি করো না। সিডনি একজন প্রযোজক।
জর্জিয়া বলল না, আমি অভিনয় করতে চাইছি না।
জিসা জর্জিয়ার ফোন নাম্বারটা আমাকে দিল। জর্জিয়া খুব ভেঙে পড়েছে।
আমি বললাম–কেন, তুমি কি ডিনার খাবে না?
জর্জিয়া উঠে বলল আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে বলে ভালো লাগছে মিঃ সেলডন।
আমি অনুভব করলাম, ঘরের পরিবেশের মধ্যে কেমন শৈত্যতা বিরাজ করছে।
ওরা দুজন চলে গেল- ব্যাপারটা কী?
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। জর্জিয়াকে টেলিভিশনে দেখা গেছে। মোশন পিকচারে, ব্রডওয়েতে, স্টেলার ভূমিকাতে সে অসাধারণ অভিনয় করেছে। সর্বত্র তার প্রশংসা প্রকাশিত হয়েছে।
পরের দিন সকালে জর্জিয়াকে ফোন করলাম। ডিনারে আমন্ত্রণ জানালাম।
জর্জিয়া বলল –আমি খুবই ব্যস্ত।
আমি পরপর তিন-চার দিন ফোন করে একই উত্তর পেলাম।
পঞ্চম দিনে আমি বললাম –জর্জিয়া, শুক্রবার রাতে আমি একটা ডিনার পার্টি দিচ্ছি। বিখ্যাত প্রযোজক এবং পরিচালকরা সেখানে আসবেন। আমার মনে হয়, তুমি সেখানে এলে ভালোই হবে। অন্তত তোমার কেরিয়ারের কথা চিন্তা করে এসো।
অনেকক্ষণ বাদে সে বলল- চেষ্টা করব।
তার মানে? সে আমার সাথে একা সময় কাটাতে চাইছে না।
সত্যি সত্যি আমি একটা মস্ত বড়ো পার্টির আয়োজন করেছিলাম।
শেষ পর্যন্ত ওই পার্টিটা জমে উঠল। বেশ কয়েকজন পরিচালক এবং প্রযোজক এসেছিলেন। তারা ইতিমধ্যেই জর্জিয়ার অভিনয় দেখেছেন।
সন্ধ্যাটা শেষ হয়ে গেল।
আমি জর্জিয়াকে বললাম কেমন লাগল?
-ধন্যবাদ।
–আমি কি তোমাকে বাড়িতে পাঁছে দেব?
–না, আমার গাড়ি আছে, সন্ধেটার জন্য ভালো লাগল।
–এক মুহূর্ত অপেক্ষা করো। তুমি কি একা একা আমার সঙ্গে ডিনার খাবে?
জর্জিয়া বলল ঠিক আছে, তার কথার মধ্যে উৎসাহ ঝরে পড়ছে।
আমি পরের দিন সকালে বললাম আজকে রাতে যাবে?
এই প্রথম সে বলল–হ্যাঁ, যাব।
–আমি তোমাকে ৭-৩০ মি. এ তুলে নেব।
এভাবেই শুরু হয়েছিল।
আমরা চাসেনস ডিনার খেলাম। একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা বলছি, তার কথার মধ্যে শুধুই অভিনয় থাকবে। কিন্তু সে খুব সহজ সরলভাবে কথা বলছে।
সে বলেছিল অনেক মেয়ের সাথে তুমি ঘুরে বেড়াও, তুমি কি আমাকে তাদের তালিকা ভূক্ত করতে চাইছ?
আমি বলেছিলাম না, জর্জিয়া। তুমি একবার সুযোগ দিয়ে দেখো।
সে বলেছিল ঠিক আছে, আমি সুযোগ দিলাম।
জর্জিয়ার সাথে প্রতি সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে। যতই তাকে দেখছি, ততই ভালোবেসে ফেলছি। তার মধ্যে একটা সুন্দর স্বভাব আছে। আমরা অনেক বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করি। আমরা একে অপরের প্রতি আরও অনুগত হয়ে উঠলাম।
তিনমাস কেটে গেছে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম- এসো, এবার আমরা বিয়ের আসরে যাব।
পরের দিন আমরা ভেগাসে চলে গেলাম। আমি, মা এবং মারতিকে হলিউডে আসতে বলেছিলাম। জর্জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। তারা একে অন্যকে ভালোভাবে নিল। মা জর্জিয়াকে একশোটা প্রশ্ন করেছিল। তারপর মা বলেছিল মেয়েটা সত্যিই ভালো।
আমি ভেবেছিলাম, ইওরোপে যাব মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে। বেভারি হিলসে একটা ছোট্ট বাড়ি কিনেছি।
বাবা আর তার নতুন বউ অ্যান তখন লস এঞ্জেলসে থাকছে। আমি বাবাকে জর্জিয়ার কথা বললাম।
বাবা আনন্দে হাততালি দিয়ে বলেছিল দারুণ। কবে যাব? বিয়েতে তোকে কী দেব?
বাবা তখন একটা ব্যবসা শুরু করেছে। আমার বাড়ির চারপাশে অ্যালুমিনিয়ামের পাঁচিল তুলে দিল। খুবই প্রয়োজন ছিল।
আমি কেনেথ ম্যাককেন্নাকে বললাম-তিনমাসের ছুটি নেব।
জর্জিয়া আর আমি ভাসতে ভাসতে ইওরোপ চলেছি। এটা স্বপ্নের মধুচন্দ্রিমা। লন্ডন, প্যারিস, রোম এবং ভেনিস যাব। এত সুখী আর কখনও হইনি।
শেষ পর্যন্ত ফিরে আসার সময় হল। লস এঞ্জেলসে ফিরে এলাম। বাবা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
আমরা বাড়িতে ফিরে এলাম। বাবা বলল–এ জিনিসটা তোদের ভালো লাগবে।
-হা, অ্যালুমিনিয়ামের পাঁচিলটা শেষ হয়েছে।
বাবা আরও বলল–এটাই আমার উপহার।
জর্জিয়া তখন বেশ কয়েকটা টেলিভিশনে অভিনয় করছে।
এক রাতে জর্জিয়া একটা স্বপ্ন দেখল। সেই স্বপ্নটা খুব একটা ভালো ছিল না।
তার ঘুম ভেঙে গেছে।
***
১৯৫২র বসন্তকাল। এম জি এম-এ ফিরে এসেছি। ড্রিম ওয়াইফ নামে একটা ছোটো গল্পের চিত্ররূপ দিতে হবে। অ্যালফ্রেড লেভিটের লেখা।
যৌনতার লড়াই। অবিবাহিত একজন অন্যের প্রতি অনুরক্ত। ঘটনাটা হাসির দিকে গড়িয়ে চলেছে।
আমি এক তরুণ চিত্রনাট্য লেখককে খুঁজে পেলাম। হার্বাট বেকার। চিত্রনাট্যটা ভালোই হয়েছে।
প্রকল্পটা শেষ হল। সন্ধেবেলা আমি কাজ করছি। টেলিফোনে কার কণ্ঠস্বর। হার্বাট বেকার।
আমি বললাম–কী খবর? এক ঘন্টা কেটে গেছে। বেকার আসছেন না কেন?
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম।
সকাল চারটে বেজে গেছে। ড্রিম ওয়াইফাস্ট-এর চিত্রনাট্য শেষ হল। এবার কাস্টিং নিয়ে ভাবতে হবে।
কাকে নেওয়া যেতে পারে? আমি ক্যারি গ্রান্ট এবং ডেবোয়রা কেরকে চেয়েছিলাম।
ক্যারির সাথে কথা হল। ক্যারি চিত্রনাট্যটাকে ভালো বলে ঘোষণা করেছে।
পরবর্তী দিনে একটা খারাপ খবর এল। ক্যারি অন্যান্য ছবি নিয়ে ব্যস্ত।
আমি ক্যারির সাথে লাঞ্চের ব্যবস্থা করলাম। বললাম –ক্যারি। পরিচালকরা বলছেন, আপনি নাকি ফাঁকা নেই।
ক্যারি বললেন –কে এটা পরিচালনা করবেন?
কে?
–আপনি।
–আমি? আমি তো কখনও কোনো ছবি পরিচালনা করিনি।
–আমি চাইছি, আপনি এটার পরিচালক হোন।
ওই বছরটা আমি ভুলতে পারব না। একজন মানুষ কত উঁচুতে উঠতে পারে!
আমি ডোরের সাথে দেখা করে বললাম –ক্যারি চাইছেন, আমি যেন ড্রিম ওয়াইফ-এর পরিচালনা করি।
ডোরে বললেন –হ্যাঁ, আজ থেকে আপনি একজন পরিচালক হলেন।
ব্যাপারটা অলৌকিক। কয়েক বছর আগে আমি এইসব মানুষদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতাম। তারপর চিত্রনাট্য লেখা শুরু করি। এবার প্রযোজনা। সব শেষে পরিচালনা। আর কী বাকি থাকল।
আমার মন আনন্দে নাচছে। আমি অন্য সব পরিচালকদের কথা চিন্তা করলাম। যাঁদের সাথে ক্যারি কাজ করেছেন। আলফ্রেড হিচকক, জর্জ কুকার, লিও ম্যাককারি, হাওয়ার্ড হগস, আমি কি তাদের দলভুক্ত হব?
ডোরে বললেন –এক মুহূর্ত সিডনি। আপনি এই ছবির লেখক, পরিচালক এবং প্রযোজক। সমস্ত প্রশংসা কিন্তু আপনারই প্রাপ্য।
ব্যাপারটা আমার মনে থাকবে।
–আমার নাম কি প্রযোজক হিসেবে দেব?
–হ্যাঁ, দিতে পারেন।
এই কথাটাই আমার পেশাকে প্রায় ধ্বংস করেছিল।
কে কোন ভূমিকাতে অভিনয় করবেন? এখানে মধ্যপ্রাচ্যের এক রূপবতী রাজকুমারীর কথা আছে। আমি বেটা নামে এক অভিনেত্রীর কথা শুনেছিলাম। বেটা তখন লন্ডনে থাকেন। সাউথ প্যাসিফিকে অভিনয় করেছেন।
পরের দিন সকালবেলা আমাদের জাহাজ এগিয়ে চলল লন্ডনের দিকে। একটা অলৌকিক সমুদ্রযাত্রা। আমি ইওরোপে চলেছি দ্বিতীয় মধুচন্দ্রিমা যাপন করব বলে। যে মেয়েটিকে। ভালোবাসতাম, সে হয়েছে আমার জীবন সঙ্গিনী।
ট্রেন ধরে লন্ডনে পৌঁছে গেলাম। সেখানে কদিন থেকে এলাম প্যারিসে। হোটেল ল্যাংকাস্টারে উঠেছিলাম।
ইউনাইটেড আর্টিস্টদের প্যারিস অফিসে ফোন করলাম। ম্যানেজার বানসের সঙ্গে কথা বললাম। এখানে অবশ্য আর কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। জর্জিয়া আর আমি নানা জায়গা বেড়িয়ে এলাম। ম্যাক্সিমে ডিনার সারলাম।
পরের দিন সকালবেলা। জর্জিয়া তখনও ঘুমোচ্ছ। আমি বললাম- চলো, দশটার সময় ফিল্ম দেখতে যাব। তুমি কি তৈরি হবে না?
–আমার ভালো লাগছে না। তুমি একা যাও না। রাতে কোথাও ডিনার খেয়ে থিয়েটার দেখব।
-ঠিক আছে। আমি তাড়াতাড়ি আসছি।
ইউনাইটেড আর্টিস্ট একটা লিজিন পাঠিয়েছে। আমাকে তারা হেডকোয়ার্টারে নিয়ে গেল। মিঃ বানসের সঙ্গে দেখা হল। মাথার চুলের রং রুপোলী। রোগা চেহারার ভদ্রলোক।
তিনি বললেন আমরা সোজা থিয়েটারে চলে যাই।
আমরা মস্ত বড়ো থিয়েটারে প্রবেশ করলাম। এখানে বিভিন্ন সিনেমা প্রদর্শন করা হয়।
ছবিটা শুরু হল। ফরাসি দেশীয় ওয়েস্টার্ন ছবি। খুবই বাজে উপস্থাপনা। আমি বুঝতে পারলাম স্যামস স্পিগাল এতে মোটেই আগ্রহী হবেন না।
আমি দরজার দিকে তাকালাম। মিঃ বানস এবং এক অপরিচিত ভদ্রলোক কথা বলছেন।
ওই ভদ্রলোক বলছেন- জানুকের সাথে কথা হয়েছে। এটা কখনও হবে না। হ্যারি ওয়ার্নারও আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তা সত্ত্বেও হয়নি।
কীসের কথা বলা হচ্ছে।
আমি বললাম আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?
উনি বললেন আমার নাম জেট হ্যারিস।
আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। তিনজনের কথাবার্তা শুরু হল।
আমরা হোটেলে পৌঁছে গেলাম। জর্জিয়াকে ফোন করলাম। জর্জিয়া নেমে এসেছে। জেটকে দেখে সে খুবই অবাক হয়ে গেছে।
জেট আমার কাজের প্রশংসা করলেন। জেট হ্যারিস একটা ছবির দায়িত্ব আমার ওপর দিতে চাইছেন।
আবার কথাবার্তা শুরু হল।
আমরা ইশান নদীর ধারে একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে গেলাম। ওয়েটার জিজ্ঞাসা করল- কী ধরনের ওয়াইন খাবেন?
কেউ কিছু বলার আগে জেট বললেন –বিয়ার হলেই ভালো হয়?
ওয়েটার বলল স্যার, এখানে বিয়ার দেওয়া হয় না। শুধু ওয়াইন দেওয়া হয়।
জেট আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন –চলুন, আমরা এখান থেকে চলে যাব।
আমি বললাম- জেট?
জেট বললেন –বিয়ার না হলে আমি খেতে পারি না।
বিরক্ত হয়ে আমরা সবাই হোটেল থেকে বাইরে এলাম।
জর্জিয়া আর আমি যথেষ্ট বিভ্রান্ত। ট্যাক্সি ধরে হোটেলে ফিরে এলাম। সেখানেই ডিনার খেলাম।
ল্যাসি জেটকে বললেন, এই ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত। আমি জানি কোথায় গেলে বিয়ার পাওয়া যাবে। কাল রাতে সেখানে যাব।
পরের দিন জেট আর আমি নতুন ছবির কাজ শুরু করলাম। সেদিন বিকেলে বুশ আমাকে তুলে নিয়ে গেল।
ল্যাসি জেটকে বলেছিলেন এই জায়গাটা আপনার ভালোই লাগবে। সেখানে বিয়ার খাওয়া হল।
পরের দিন জেট আমাদের স্যুইটে এসেছিলেন। আরও কিছু আলোচনা করার জন্য।
সকালে জর্জিয়া আর আমি ব্রেকফাস্টের জন্য বেরোতে যাচ্ছি।
হোটেল ম্যানেজার বললেন মিঃ সেলডন, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব। আপনার অতিথি আমার পরিচারিকাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে।
-আমি ওনাকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করব।
সত্যি এই ব্যাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না।
একদিন ব্ল্যাকফরেস্ট ঘুরে এলাম। সেখানে একটা সুন্দর ঝরনা আছে। দক্ষিণ পশ্চিম জার্মানিতে। রাইন এবং নেকটার নদীর মধ্যবর্তী জায়গাতে। দুপাশে পাইন অরণ্য, আছে উপত্যকা এবং ছোটো ছোটো লেক। জেট জায়গাটা ভালোবাসতে পারেননি।
আমরা অনেক কিছু দেখলাম।
একদিন জর্জিয়াকে বললাম, মিউনিখে চলে যাব।
জর্জিয়া বলল–হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে।
জেট আমাদের ঘরে এসেছেন।
আমি বললাম–জেট, জর্জিয়া আর আমি মিউনিখে যাচ্ছি। এখন আর আপনার সঙ্গে কাজ করতে পারব না।
উনি বললেন ঠিক আছে, আমি দেখছি অন্য কী করা যায়।
কয়েক ঘন্টা বাদে জর্জিয়া আর আমি ট্রেনে উঠে বসেছি। আমাদের গন্তব্য মিউনিখ।
আমরা হোটেলে এলাম। ল্যাসিকে ফোন করতে হবে। তখনই আবার হার্নিয়াটা কষ্ট দিল। অসম্ভব যন্ত্রণায় ছটফট করছি।
জর্জিয়া বলল আমি কি একজন ডাক্তারকে ডাকব?
আমি বললাম না, আমাকে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকতে হবে। দু-একদিন বাদে আবার ঠিক হয়ে যাবে।
শেষ অব্দি সে আমাকে বিছানায় তুলে শুইয়ে দিল। বলল–ল্যাসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
এক ঘণ্টা বাদে ল্যাসি এসে গেলেন।
আমি বললাম এবার বোধহয় পরিকল্পনাটা সফল হবে না।
ল্যাসি বললেন –পল হর্নকে ডেকে আনব। তিনি একজন ফিজিওথেরাপিস্ট। তিনি অনেকের হার্নিয়া সারিয়ে দিয়েছেন।
পরের দুদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেটে গেল। তৃতীয় দিন ল্যাসির অফিসে যোগাযোগ করলাম। সেখানে পল হর্নের সঙ্গে দেখা হল। বছর চল্লিশ বয়স। লম্বা চেহারার মানুষ। আবার একটা নতুন ছবির কাজ শুরু হল।
পরের দিন সকালে আমার শুশ্রূষা শুরু হল। আমাকে অনেকক্ষণ টেবিলের ওপর শুয়ে থাকতে হয়। ঘণ্টা দুয়েক। সারাদিন ধরে এই পদ্ধতি কেবলই চলেছে।
পল হর্ন আমার অসুখটা অনেকটা সারাবার চেষ্টা করছেন।
তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। এবার পরিশেবা শেষ হবে।
পল জিজ্ঞাসা করলেন– এখন কেমন বোধ করছেন?
আমি বললাম খুবই ভালো লাগছে।
উনি বললেন আপনি হয়তো সেরে গেছেন।
ওনার কথাটা সত্যি, এরপর আর কখনও আমাকে এই কষ্ট ভোগ করতে হয়নি। হর্ন। একজন ডাক্তার নন, কিন্তু আমার অসুখটা সারিয়ে দিয়েছেন। এবার আমাকে হলিউডে ফিরতে হবে।
***
এম জি এম-এ কাজ শুরু হল। ডোরে বললেন আমরা ইজিপসিয়ান থিয়েটারে ড্রিম ওয়াইফটা দেখাব।
একটা মস্ত বড় প্রযোজনা। অনেক মানুষের ভিড় জমেছে। ছবিটা শুরু হল। জর্জিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল –অসম্ভব ভালো উপস্থাপনা।
ছবিটা শেষ হল, সবাই হাততালি দিচ্ছে।
পরের দিন বিভিন্ন খবরের কাগজে সমালোচনা বেরোল। বেশির ভাগই প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
আমি বুঝতে পারলাম, এবার বোধহয় স্বপ্নটা সত্যি সত্যি সফল হল।
.
২০.
বেভারলি ডাইভের অফিসে এলাম। আমার এজেন্টের সঙ্গে দেখা হল। একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা, ফোনটা তখনও পর্যন্ত আসেনি।
সিনেমার ক্ষেত্রে চিত্রনাট্য হল সব থেকে বড়ো অস্ত্র। সেক্ষেত্রে আমি জয়যুক্ত হয়েছি। কিন্তু অনেকগুলো স্বপ্ন এখনও সফল হয়নি।
আমার মনে হতাশার আবরণ, জর্জিয়া মাঝে মধ্যে টেলিভিশনের পর্দায় মুখ দেখাচ্ছে। এতে খরচ পোষানো যাচ্ছে না।
নতুন কিছু কাজ করতেই হবে, এম জি এম-এর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। নতুন কাজের সন্ধানে কোথায় যাব।
অবশ্য অভিনেতা অথবা পরিচালকদের থেকে লেখকদের অবস্থাটা ভালো। লেখকের হাতে অনেকগুলো সম্ভাবনা থাকে।
এই দুঃখের দিনে জর্জিয়া বারবার সহানুভূতি জানিয়েছে। বলেছে তোমার মধ্যে অনেক সম্ভাবনা আছে। তুমি এক মহান লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
আমি কিছু লিখতে পারছি না। আমার মাথাটা একেবারে খালি হয়ে গেছে। আবেগের দিক থেকে আমি একটা মৃত মানুষে পরিণত হয়েছি।
***
১৯৫৩ সালের ৩০ জুলাই– হলিউড রিপোর্টার এবং হলিউড ভ্যারাইটিতে বিরূপ সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। ড্রিম ওয়াইফকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় দেখানোর ব্যবস্থা করা হল। এই মুভি সম্পর্কে তেমন কোনো বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়নি।
তার মানে এই মুভিটা কি মরে যাবে? আমি অবাক হয়ে গেছি।
আবার সমালোচনা- ভালো-মন্দ মেশানো।
***
একদিন সকালে ফোনটা বাজল, আমার এজেন্ট ফোন করেছে। বলা হল, প্যারামাউন্টে আগামীকাল সকালে যেতে হবে। প্রোডাকশনের প্রধান ডন হার্ডম্যানের সঙ্গে কথা বলতে হবে। •
ডন লেখক হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন। গোটা বারো সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন।
তার সাথে দেখা হল। পঞ্চাশ বছরের ভদ্রলোক, আন্তরিক আতিথেয়তা আছে। আমাকে দেখে উনি খুবই খুশী হলেন।
মার্টিন এবং লুইস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হল। উনি একটা নতুন ছবি তৈরি করতে চলেছেন। আমাকে চিত্রনাট্যটা লিখতে হবে।
আমি যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলাম। হতাশা আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল। এখন সেই হতাশা অনেকখানি কেটে গেল।
গল্পটা এক তরুণ মানুষকে নিয়ে, যে বারো বছরের ছেলের ছদ্মবেশ ধরতে ভালোবাসে। পরবর্তীকালে সে একটা ডাকাতির কাজে জড়িয়ে পড়েছিল। দি মেজর অ্যান্ড দি মাইনর নামে যে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল, এটা তারই রিমেক।
চিত্রনাট্য লেখা শেষ হল। আমি ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করতে বসলাম।
ডিন এবং জেরিকে বলেছিলাম–শেষটা কেমন হয়েছে একবার দেখবেন তো?
জেরি বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করেছিলেন।
অবশেষে ছবিটা আত্মপ্রকাশ করল। বক্স অফিসে ভালোই হিট হয়েছে। আমার হারানো পেশাটা আবার আমি ফিরে পেয়েছি। বেল আমি এয়ারে একটা সুন্দর বাড়ি কিনলাম। সেখানে সাঁতারের পুল আছে, নয়ন জুড়ানো বাগান আছে। পৃথিবীর সব কিছু আবার সঠিক হয়ে গেছে।
আমি ভাবলাম–জর্জিয়াকে নিয়ে ইউরোপে যেতে হবে।
***
১৯৫৫ সালের ১৪ই অক্টোবর–আমাদের মেয়ে ম্যারির জন্ম হয়। আমার গাফিলতির জন্য ঠিক সময়ে জর্জিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি।
আমি এই খবরে খুবই আনন্দিত হয়ে উঠলাম। একটার পর একটা কাজ আসছে, তারই মধ্যে বাড়িতে সময় দিতে হচ্ছে। সান্তা মোনিকা বুলেভার্দের হাসপাতালে আমার মেয়ের জন্ম হল।
হাসিখুশিতে ভরা স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ছোট্ট শিশু। ম্যারির জন্মের পর জর্জিয়া আর আমি গোসিকোকে খবরটা দিয়েছিলাম। সে বোধহয় এই মেয়েটির গডফাদার হবে। সে রাজী হল। আমাদের আনন্দ আকাশ ছোঁয়া।
ম্যারিকে হাসপাতাল থেকে তিনদিন বাদে বাড়িতে নিয়ে আসা হল। আমাদের পরিচারিকা লাউরা তাকে জর্জিয়ার কোলে তুলে দিল।
জর্জিয়া বলল এখন থেকে আমি এর দেখাশোনা করব।
সুখের দিন আবার শুরু হয়েছে।