৩৮.
রকেনডরফ, জার্মান দেশের এক বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট। ভারী সুন্দর সাজানো। বার্লিনের আনন্দ এবং সফলতার চিহ্ন।
ডায়ানা ভেতরে গেলেন, ভদ্রমহিলা বললেন কীভাবে সাহায্য করব?
–আমি আগেই আসন সংরক্ষণ করেছি, আমার নাম স্টিভেন্স, মিস ফ্রঙ্ক এক্ষুনি আসবেন আমার সঙ্গে দেখা করতে।
–ওদিকে চলে যান।
ভদ্রমহিলা কোণের টেবিল দেখিয়ে দিলেন। ডায়ানা চারদিকে তাকালেন। অন্তত জনা চল্লিশেক খদ্দের। বেশির ভাগই ব্যবসাদার। ডায়ানার টেবিলের উল্টোদিকে এক সুন্দর পোশাক পরা ভদ্রলোক একা বসে আছেন।
ডায়ানা কিছুক্ষণ বসলেন। হাইজি ফ্রঙ্কের সঙ্গে কীভাবে কথাবার্তা শুরু করা যায়, ভাবতে থাকলেন। হাইজি কতটা জানেন, কে জানে?
ওয়েটার এসে মেনুকার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলল– কী নেবেন?
-দেখছি, ডায়ানা মেনুকার্ডের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এইসব জার্মান ডিসগুলো কেমন খেতে, এ বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ডায়ানা ঘড়ির দিকে তাকালেন। কুড়ি মিনিট হয়ে গেল। হাইজি আসছেন না কেন?
ওয়েটার এসে বলল- ফয়লান, এবার কি আপনি অর্ডার দেবেন?
–আমি আর একটু অপেক্ষা করব। আমার অতিথির জন্য।
দশ মিনিট কেটে গেছে। ডায়ানা ভাবলেন, কী হল? কোথাও বিপদের চিহ্ন।
আরও পনেরো মিনিট কেটে গেছে, ওয়েটার এসে বলল আমি কি আপনার জন্য কিছু দেব?
না, ধন্যবাদ। যে কোনো সময় আমার অতিথি চলে আসবেন।
নটা বেজে গেল সময় হাইজি ফ্রঙ্ক তখনও আসেননি, ডায়ানার মনে হল হাইজি বোধহয় কখনওই আসবেন না।
ডায়ানা উঠলেন। দেখলেন কাছাকাছি দুজন মানুষ বসে আছে। পোশাক পরিচ্ছদ খুবই নোংরা। ডায়ানার দিকে তাকাচ্ছে। তার মনে হল এরা কারা? তিনি দেখলেন, ওয়েটার সেই টেবিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লোকদুটো কোনো খাবারের কথা বলছে না। তারা বোধহয় খেতে চাইছে না। ডায়ানা বুঝতে পারলেন, এবার এখান থেকে পালাতে হবে।
হাইজি ফ্রঙ্ক এসে গেছেন, ডায়ানার মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। কোথা দিয়ে পালানো যায়? কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে বসে থাকতে হবে। কিন্তু উঠে গেলেই ওরা আক্রমণ করবে। সেলফোনটা ব্যবহার করব কী? কিন্তু কাকে?
ডায়ানা অসহায়ভাবে ভাবলেন, যে করেই হোক এখান থেকে আমাকে বেরোতে হবে।
তিনি চারপাশে তাকালেন। সুন্দর চেহারার এক যুবাপুরুষ টেবিলে বসে আছেন। কফি খাচ্ছেন।
ডায়ানা তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন- শুভ সন্ধ্যা।
ভদ্রলোক অবাক হয়ে গেছেন। তিনি বললেন- শুভ সন্ধ্যা।
ডায়ানা তার দিকে আমন্ত্রণ হাসি ছুঁড়ে দিলেন, ঝকঝকে ইংরাজিতে বললেন- আমরা দুজনেই একা।
-হ্যাঁ।
—আপনি কি আমার কাছে আসবেন?
ভদ্রলোক এক মুহূর্ত কী যেন চিন্তা করে ডায়ানার টেবিলের দিকে হেঁটে এলেন।
একা একা বসে খাওয়া যায় না। ডায়ানা বললেন।
–হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন।
আমি ডায়ানা স্টিভেন্স।
আমার নাম গ্রেগ হলিডে।
স্যাম মিরোজের কাছে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেটা কেলি হ্যারিসকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বাড়ি ফেরার পর থেকে তিনি সমস্ত রাস্তা মনটিমার্টের এখানে সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দেখেছেন, কেউ তাকে অনুসরণ করছে কিনা। না, কে এই কাজটা করছে তা আমাকে জানতেই হবে। তবে আমি প্যারিস ছেড়ে অন্য কোথাও যাব।
ভোরবেলা, কেলি একটা ছোটো কাফেতে ঢুকে পড়লেন। এককাপ কফি খেলেন। হঠাৎ উত্তরটা তার কানে ভেসে এল মার্কের সেক্রেটারি, মার্ককে মেয়েটি ভালোবাসত, কেলি ভাবলেন, এই মেয়েটির সঙ্গে যোগযোগ করতে হবে।
সকাল নটা, কেলি টেলিফোন কিওস থেকে একটা ফোন করলেন। নম্বরটা খুবই পরিচিত। মহিলা অপারেটর ভারী ফরাসি উচ্চারণে বললেন কিংসলে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ।
–আমি ইভোনো রিনাইসের সঙ্গে কথা বলব।
–একটু অপেক্ষা করুন।
একটু বাদে কেলি কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন।
–ইভোনো, কীভাবে আমি সাহায্য করব আপনাকে।
–ইভোনো, আমি কেলি হ্যারিস বলছি।
গলার মধ্যে হারানো ছন্দ মিসেস হ্যারিস!
ট্যানার কিংসলের অফিসে একটা নীল রঙের আলো জ্বলে উঠল।
ট্যানার টেলিফোনটা তুলে নিলেন। নিউইয়র্কে এখন রাত্রি তিনটে। তিনি এখনও অফিস ছেড়ে যাননি। কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে।
ট্যানার ফোনের কথাবার্তা শুনছেন। প্যারিসে কী কথা হচ্ছে, সব তার কানে পৌঁছে যাচ্ছে।
–আমি খুবই দুঃখিত, মিঃ হ্যারিসের যে ঘটনাটা ঘটে গেল, সেটা চিন্তা করলে আমার খুব খারাপ লাগে।
ধন্যবাদ ইভোনো, আপনার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আপনি কি কোথাও আসবেন? লাঞ্চের সময় ফাঁকা আছেন?
-হ্যাঁ।
–তাহলে কোথায়?
–আপনি কি কাফে প্যারিস চেনেন?
–হ্যাঁ।
ট্যানার কিংসলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা মাথায় নিলেন।
বারোটার সময়।
–আমি ওখানে যাব।
ট্যানার কিংসলের ঠোঁটে পাতলা হাসির চিহ্ন। আহা, আরাম করে তুমি তোমার শেষ লাঞ্চটা খেয়ে নাও। তিনি ড্রয়ারটা খুললেন। একটা সোনালি রঙের টেলিফোন হাতে নিলেন।
উত্তর ভেসে এল।
ট্যানার বললেন- ভালো খবর আছে, দুজনকেই পাওয়া গেছে।
অনেকক্ষণ ধরে শুনলেন। তারপর বললেন– ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। এবার কিন্তু আমি কোনো ওজোর আপত্তি শুনব না।
.
সাজানো হোটেল। ৬৮৫ ফুট টাওয়ারে অবস্থিত। ইস্পাত আর কাঁচ দিয়ে তৈরি হয়েছে। বাড়িটা সত্যিই সুন্দর। অনেক মানুষের ভিড় বার এবং রেস্টুরেন্টও আছে ৫৬ নম্বর তলাতে।
কেলি এই প্রথম এখানে এলেন। ইভোনো পনেরো মিনিট পরে এসেছেন। আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
এর আগে কেলি মাত্র কয়েকবার ইভোনোর সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু ইভোনোর কথা তার মনে আছে। ইভোনো ছোটো চেহারার এক ব্যক্তিত্বশালিনী ভদ্রমহিলা। কিন্তু মুখখানা ভারী সুন্দর। মার্কের মুখে অনেকবার ইভোনোর প্রশংসা শুনেছেন।
–আপনি আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি, কেলি বললেন।
–আপনার জন্য কী করব? মিঃ হ্যারিস দারুণ আকর্ষণীয় মানুষ ছিলেন। অফিসের সকলে তাকে শ্রদ্ধা করতেন। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, কীভাবে ঘটনাটা ঘটে গেল।
-হ্যাঁ, এই ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে চাইছি। ইভোনো, আপনি তো আমার স্বামীর কাছে পাঁচ বছর ধরে কাজ করেছেন, তাই তো?
-হ্যাঁ।
–আপনি নিশ্চয়ই সব ব্যাপারের খুঁটিনাটি জানতেন।
–হ্যাঁ।
আপনি কি গত কয়েক মাসে আমার স্বামীর আচরণে কোনো তফাত দেখতে পেয়েছিলেন? তার কোনো বক্তব্যকে অদ্ভুত বলে মনে হয়েছিল আপনার কাছে? তাঁর কোনো কথা অথবা তার কোনো বাচনভঙ্গি?
ইতোনো বললেন– না, আমি ঠিক বলতে পারছি না।
কেলি জানতে চাইলেন ভালো করে ভেবে দেখুন তো, এই ব্যাপারটা জানতে পারলে আমি রহস্যটা বের করতে পারব।
কেলি ভদ্রমহিলার চোখের তারার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন- আপনি কি ওলগা সম্পর্কে কোনো কথা শুনেছেন।
ইতোনো অবাক হয়ে গেছেন- ওলাগা? সে কে?
আপনি কি তার পরিচয় সত্যি জানেন না?
–না, আমি জানি না।
কেলির মনে হল বুক থেকে পাথরের ভার নেমে গেছে। তিনি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন–ইভোনো, আপনি ইচ্ছে করেই সব ব্যাপার চেপে যাচ্ছেন। দোহাই, আমাকে এভাবে বিভ্রান্ত করবেন না।
ওয়েটার এসে গেছে, কিছু খাবার বলা হল।
কেলি ইভোনোর দিকে তাকিয়ে বললেন– ব্যাপারটা পুরোপুরি বলবেন?
মৃত্যুর কয়েকদিন আগে মিঃ হ্যারিসকে খুবই আতঙ্কিত বলে মনে হয়েছিল। তিনি আমাকে বললেন, এক্ষুনি ওয়াশিংটন ডিসি-র একটা প্লেনের টিকিট কাটতে হবে।
-আমি সেটা জানি। সেটা একটা ব্যবসায়িক পরিভ্রমণ।
না, আমি এই ব্যাপারটাকে অন্য চোখে দেখতে চাইছি। খুব দারুণ একটা কিছু। ভয়ংকর সংবাদ হয়তো তিনি শুনেছিলেন। তাই এত তাড়াতাড়ি যাবার আগ্রহ প্রকাশ। করেছিলেন।
এ ব্যাপারে আপনার কী অভিমত?
–না, আমি আর কিছু জানি না। ব্যাপারটা খুব গোপন ছিল। আর কী বলব?
কেলি আরও অনেকক্ষণ কথা বললেন। প্রায় একঘন্টা ছিলেন সেখানে। ইভোনো কিন্তু আর কোনো তথ্য দিতে পারেন নি।
লাঞ্চ শেষ হয়ে গেছে। কেলি বললেন- আমাদের এই দেখা করার বিশদ ব্যাপারটা গোপন রাখবেন আশা করি।
-হ্যাঁ, এ ব্যাপারে চিন্তা করবেন না মিসেস হ্যারিস। আমি কাউকে বলব না। আমি কাজে চলে যাচ্ছি।
তার ঠোঁট কাঁপছে কিন্তু ব্যাপারটা আর আগের মতো হবে না।
-আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ইভোনো।
মার্ক কেন ওয়াশিংটন যাচ্ছিল? কেন জার্মানি, ডেনভার এবং নিউইয়র্ক থেকে অদ্ভুত টেলিফোন এসেছিল।
.
কেলি এলিভেটরে চলে এলেন। লবিতে নামতে হবে। ডায়ানাকে এক্ষুনি ফোন করতে হবে। উনি কী বের করেছেন জানতে হবে। হয়তো বা…
কেলি বাড়িটার সামনের দিকে চলে এলেন। তিনি দেখতে পেলেন, দুজন মানুষ, দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে কেলির চোখের দিকে। চোখে চোখে ইঙ্গিত হয়ে গেল। কেলি বুঝতে পারলেন, এখান থেকে এখনই পালাতে হবে। তার মানে? ইভোনো আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন?
দুজন ইচ্ছে করেই কেলির কাছাকাছি চলে এসেছে। তারা আশেপাশের লোককে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে।
কেলি শেষবারের মতো তাকালেন। দেওয়ালের সাথে নিজেকে সাঁটিয়ে রেখে দিলেন। না, আর কিছু করার নেই। দুজন আরও কাছে চলে এল। কেলি ফায়ার অ্যালার্মের সঙ্গে লাগানো ছোট্ট হাতুড়িটা হাতে তুলে নিলেন। কাঁচটা ভেঙে দিলেন। ফায়ার অ্যালার্মটা বাজতে শুরু করেছে।
কেলি চিৎকার করলেন আগুন! আগুন!
সর্বত্র আতঙ্কের বাতাবরণ, লোকজন ছুটে পালাবার চেষ্টা করছে। অফিস ফাঁকা হয়ে গেল। দোকান থেকে মানুষ উৰ্দ্ধশ্বাসে বেরিয়ে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টে কেউ থাকতে চাইছে না। এখন বাইরে যাবার জন্য ব্যস্ত এবং ব্যাকুল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গোটা হলঘরে নারকীয় অবস্থা। সবাই পালাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। দুজন কেলিকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করল। কিন্তু পাওয়া গেল না। কেলি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছেন!
.
রকেনডরফ রেস্টুরেন্ট, অনেক মানুষের ভিড়। ডায়ানা গ্রেগ হলিডেকে বললেন, আমার এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি। মনে হচ্ছে সে বোধহয় আসতে পারবে না।
-খুবই খারাপ, আপনি বার্লিনে কী বেড়াতে এসেছেন?
–হ্যাঁ।
শহরটা চমৎকার। আমি একজন বিবাহিত সুখী মানুষ। আপনার সঙ্গে যেতে পারি। কিন্তু একটা অনুরোধ আছে, আমি সে সব জায়গা দেখতে বলব, আপনি সেখানে যাবেন তো?
ব্যাপারটা খুবই ভালো হবে। ডায়ানা উত্তর দিলেন। তিনি প্রবেশ পথের দিকে তাকালেন। দুজন তোক দরজা দিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। তার মানে ওরা নিশ্চয়ই আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করবে। এবার আমাকে উঠতে হবে।
ডায়ানা বললেন সত্যি কথা বলতে কি, আমি একটা দলের সঙ্গে এসেছি। উনি ঘড়ির দিকে তাকালেন। তারা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনি কি আমাকে ট্যাক্সি অব্দি পৌঁছে দেবেন?
ভদ্রলোক অনুসরণ করলেন। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে। তারা বাইরে চলে এসেছেন। ডায়ানার মনে আনন্দের আশ্বাস। একা থাকলে তোক দুটো আমাকে আক্রমণ করত। কিন্তু পাশে একজন পুরুষ মানুষ আছেন, এখন মনের ভয় অনেকটা কমে গেছে।
ডায়ানা এবং গ্রেগ হলিডে বাইরে এসে গেছেন। ওই দুজনকে কাছে কোথায় দেখা গেল না। রেস্টুরেন্টের সামনে একটা ট্যাক্সি এসে গেছে। মার্সিডিজের পাশে সেটা দাঁড়িয়ে আছে।
ডায়ানা বললেন আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুবই ভালো লাগছে মিঃ হলিডে।
মিঃ হলিডে হাসলেন, ডায়ানার হাতে হাত দিলেন এত জোরে, ডায়ানার মনে হল, সমস্ত শরীর ব্যথা হয়ে গেল।
উনি অবাক হয়ে তাকালেন। বললেন- কী?
–আসুন আমরা এই গাড়িতে যাই। ভদ্রলোক শান্তভাবে বললেন। তিনি ডায়ানাকে মার্সিডিজের দিকে নিয়ে যেতে চাইলেন। হাতের মুঠি ক্রমশ শক্ত হচ্ছে।
-না, আমি ওখানে যাব না।
তারা গাড়ির কাছে পৌঁছে গেছেন। ডায়ানা দেখতে পেলেন, রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা দুজন লোক গাড়িতে বসে আছে। সামনের সিটে। ডায়ানা প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন। বুঝতে পারলেন, কীভাবে তাঁকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। আতঙ্কের পরিবেশে তিনি চিৎকার করতে চেষ্টা করলেন।
তিনি বললেন না।
মনে হল, কেউ বুঝি তাকে জোর করে গাড়িতে ফেলে দিয়েছে।
গ্রেগ হলিডে গাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
গাড়িটা রাস্তায় বেরিয়েছে। ডায়ানা তখনও চিৎকার করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছে না।
গ্রেগ হলিডে তার দিকে তাকালেন। মুখে নির্লিপ্তির হাসি– আপনি ভালোভাবে বসুন। আমি আপনাকে আঘাত করব না। কালকের মধ্যে আপনি বাড়ি যাবার ঠিকানা খুঁজে পাবেন।
উনি ড্রাইভারের স্টিট থেকে একটা জিনিস বের করলেন। হাইপোডারমিক নিডিল।
হলিডে বললেন- আপনাকে একটা উপহার দেব, কোনো ক্ষতি করবে না। ঘণ্টা দুয়েকের জন্য আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন।
উনি ডায়ানার হাতে ইনজেকশনটা পুশ করার চেষ্টা করলেন।
ড্রাইভার চিৎকার করেছে একজন পথচারী মার্সিডিজের সামনে এসে পড়েছে। ড্রাইভার ব্রেক টেনে দিয়েছে। আঘাত থেকে বাঁচবার জন্য। কিন্তু হলিডের মাথা ড্রাইভারের পাশের ধাতবখণ্ডে লেগে গেছে।
হলিডে বসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না।
ডায়ানা হলিডের হাত ধরে আছেন। ওই হাতে হাইপোডারমিক নিডিলটা ধরা আছে। হাত মুচড়ে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। শেষ অব্দি নিডিলটা হাতের মধ্যে ঢুকে গেল।
হলিডে তখনও চিৎকার করছেন না। আর্তনাদ।
আতঙ্ক এবং উত্তেজনা। ডায়ানা বুঝতে পারলেন, হলিডের সমস্ত শরীরটা বিষে নীল হয়ে গেল। কাঁপতে কাঁপতে কেমন কুঁকড়ে গেলেন তিনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার মৃত্যু হল। সামনের সিটে বসে থাকা দুজন বুঝতে পেরেছে, এবার কী হয়েছে।
ডায়ানা দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে পড়লেন। এবার তাকে অন্য দিকে যেতে হবে।
.
৩৯.
সেলফোনের শব্দটা তাকে অবাক করেছে। তিনি সাবধানে ফোনটা ধরে বললেন হলো?
-হাই কেলি?
ডায়ানা, তুমি কোথায়?
–মিউনিখে, তুমি কোথায়?
–আমি লন্ডনে আছি, একটা প্লেনে।
স্যাম মিরোজের সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘটনাটা বলল।
কেলি চিংকার করতে চেষ্টা করেছিলেন, হ্যাঁ, দেখা হলে সবকিছু বলব। কোনো খবর পেয়েছ?
না, বেশি কিছু পাইনি। এবার কী করব বলল তো? আমরা এলোমেলো ছুটে চলেছি। গ্যারি রেনল্ডসের পরিকল্পনাটা নষ্ট হয়ে গেছে। ডেনভারের কাছে। সেখানে একবার যেতে হবে। এটাই বোধহয় শেষ সুযোগ।
-ঠিক আছে।
শোক সংবাদ লেখা হয়েছে, গ্যারি রেনল্ডসের এক বোন আছে। তিনি ডেনভারে থাকেন। তিনি হয়তো কিছু বলতে পারবেন। আমরা গ্রাউন্ড প্যালেস হোটেলে দেখা করব? আমি এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছি। বার্লিনে, তিন ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব।
আমি হিতরা থেকে প্লেনে চাপব।
–ঠিক আছে। হ্যারিয়েট রিচার্ড স্টোন নামে ঘর বুক করা হবে কেমন?
–কেলি?
–ঠিক আছে।
.
ট্যানার তার অফিসে একা। সোনালি ফোনে কথা বলছেন- শেষ পর্যন্ত ওরা পালাতে পেরেছে। স্যাম মিরোজের অবস্থা খুব খারাপ। গ্রেগ হলিডে মারা গেছে। তিনি এক মুহূর্তের জন্য চিন্তা করে আবার বললেন- ডেনভার ছাড়া আর কোথাও যাবার নেই। এটাই বোধহয় শেষতম অভিযান। ডেনভারে ধরতেই হবে। আর কোনো উপায় থাকবে না। তাঁ, তা না হলে কিন্তু পুরো ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাবে। হ্যাঁ, গুডবাই।
.
অ্যানড্রু অফিসে বসে আছেন। তার মনটা আকাশে ভেসে চলেছে। একটার পর একটা খণ্ডচিত্র চোখের পর্দায় ফুটে উঠছে। এখন আমি কোথায়?
ভাই ট্যানারের কণ্ঠস্বর– তোমাকে মরতেই হবে। তুমি কেন বেঁচে উঠলে? ডাক্তাররা বলেছে, তুমি নাকি কদিন বাদে এখান থেকে ছাড়া পাবে। আমি তোমাকে কে আই জি-তে একটা অফিস দেব। দেখো, আমি কীভাবে তোমাকে ব্যবহার করি। তুমি কিছুই বুঝতে পারবে না। তুমি তো এখন জড়বুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে গেছে। আমি তোমার ওইসব প্রকল্পগুলোকে বাজে কাগজের বাক্সে ফেলে দেব। আমি একটা সোনার খনির সন্ধান পেয়েছি। অ্যানড্রু? অ্যানড্রু…
অ্যানড্রুর ঘুম ভেঙে গেল বোধহয়। হ্যাঁ, তিনি শুনতে পাচ্ছেন, ট্যানার তার নাম ধরে তাকাছেন।
ট্যানার ডাকছেন– অ্যানড্রু উঠে দাঁড়ালেন, পায়ে পায়ে ভাইয়ের অফিসের দিকে এগিয়ে গেলেন।
ট্যানার বললেন আমি তোমার কাজের মধ্যে মাথা গলাতে চাইছি না। মুখে কৌতুক।
ট্যানার ভাইকে একমুহূর্তের জন্য পর্যবেক্ষণ করে আবার বললেন– অ্যানড্রু, তুমি এখন কিছুই করতে পারবে না। তুমি চাষ করতে পারবে না, ফসল তুলতেও পারবে না। আমি জানি না, তোমাকে কতদিন বাঁচিয়ে রাখা উচিত।
.
কেলি ডেনভারে এসেছেন, ডায়ানার আগেই। তিনি গ্রাউন্ড প্যালেস হোটেলে নাম লিখিয়েছেন।
আজ বিকেলবেলা আমার এক বান্ধবী আসবেন।
দুটো ঘর লাগবে কি?
–না, একটা ডাবল বেড হলেই চলবে।
.
ডায়ানার প্লেন ডেনভার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছে, তিনি ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলের দিকে এগিয়ে চলেছেন। হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে এসে নিজের পরিচয় দিলেন।
ক্লার্ক বললেন মিসেস স্টো আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। উনি ৬৩৮ নম্বর ঘরে আছেন।
যাক, বিপদের মুহূর্তগুলো আমরা পার হতে পেরেছি।
কেলি অপেক্ষা করছিলেন। দুজনে হাতে হাত দিলেন।
–অনেকদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি।
আমিও তোমাকে প্রতি মুহূর্তে ভেবেছি। অভিযানটা কেমন হল। কেলি জানতে চাইলেন।
-খুবই খারাপ।
ডায়ানা তার দিকে তাকিয়ে বললেন- প্যারিসে কী হয়েছিল?
কেলি একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে বললেন- ট্যানার কিংসলে, বার্লিনে কী হয়েছে।
ডায়ানা একই রকমভাবে জবাব দিলেন। ট্যানার কিংসলে।
কেলি একটা টেবিলের দিকে হেঁটে গেলেন। টেলিফোন ডিরেক্টরি নিলেন। সেটা নিয়ে ডায়ানার কাছে এলেন। গ্যারির বোনের নামে লুইস রেনল্ডস। তার ফোন নম্বরটা টেলিফোন বইতে আছে। তিনি ম্যারিয়ন স্ট্রিটে থাকেন।
-ঠিক আছে। ডায়ানা ঘড়ির দিকে তাকালেন। আজ রাতে কিছু করা উচিত হবে না। কাল সকালে আমরা ফোনটা করব।
.
ডিনার শেষ হল, মধ্যরাত পর্যন্ত তারা কথা বললেন। এবার ঘুমোতে হবে।
ডায়ানা বললেন শুভরাত্রি। তিনি আলো নিভিয়ে দিলেন। এখন এখানে শুধুই অন্ধকার।
কেলি চিৎকার করলেন না, আলোটা জ্বেলে দিন।
ডায়ানা তাড়াতাড়ি আলোটা জ্বেলে দিলেন। আমি ভুলে গিয়েছিলাম কেলি, সত্যি আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
-হ্যাঁ, আগে আমি অন্ধকারকে ভয় পেতাম। মার্ক আমার জীবনে আসার আগে পর্যন্ত। মার্ককে হত্যা করার পর…কেলি কথা বলতে পারছেন না, নিজের আতঙ্কিত আবেগকে দমন করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
একদিন হয়তো আমি অন্ধকারকে আর ভয় পাব না।
–এর জন্য ভয় পেও না। একদিন এই অবস্থা থেকে আমরা নিশ্চয়ই উদ্ধার পাব।
পরের দিন সকালবেলা, ডায়ানা এবং কেলি হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারা ট্যাক্সি লাইনে গিয়ে একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসলেন। কেলি ড্রাইভারের হাতে লুইস রেনল্ডসের বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে দিলেন। এটা ম্যারিয়ন স্ট্রিটে অবস্থিত।
পনেরো মিনিট কেটে গেছে। ড্রাইভার বললেন, আমরা এসে গেছি।
কেলি এবং ডায়ানা জানলার দিকে তাকালেন। তারা বুঝতে পারলেন, এই বাড়িটার আর অস্তিত্ব নেই। সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুধু পোড়া কাঠের টুকরো দাঁড়িয়ে আছে। পঁড়িয়ে আছে কংক্রিটের ভিত।
কেলি চিংকার করে বললেন- ওরা হেনাকে মেরে ফেলেছে। তার মানে আমাদের পথচলা শেষ হয়ে গেল।
ডায়ানা তখনও ভাবছেন, হয়তো একটা শেষ পন্থা এখনও অবশিষ্ট আছে।
.
রে ফাউলার, ডেনভার এয়ারপোর্টের ম্যানেজার। ডায়ানা এবং কেলির দিকে তাকালেন। বললেন দেখা যাক, আমি কী করতে পারি। আপনারা দুজন একটা প্লেন দুর্ঘটনা নিয়ে তদন্ত করছেন, কিন্তু আপনাদের হাতে কাগজপত্র কই? এয়ার ট্রাফিক কনট্রোলারকে প্রশ্ন করতে চাইছেন? হয়তো উনি আপনাদের কিছু তথ্য দেবেন।
ডায়ানা এবং কেলি পরস্পরের দিকে তাকালেন।
কেলি বলার চেষ্টা করলেন- হ্যাঁ, আমরা…
কথারা হারিয়ে গেছে।
–কী বলছেন, বলুন।
–আপনি কি আমাদের সাহায্য করতে পারবেন?
–কেন সাহায্য করব?
–মিঃ ফাউলার, আমরা একটা সত্যি ঘটনা জানতে চাইছি, সত্যি সত্যি বলুন তো গ্যারি রেনল্ডসের কী হয়েছিল? এটা কি একটা দুর্ঘটনা?
রে ফাউলার মুখের দিকে তাকালেন। বললেন– ব্যাপারটা খুবই অবাক করছে আমাকে। তিনি আবার বলতে থাকলেন- হাওয়ার্ড মিলারের সাথে এব্যাপারে কথা বলতে পারেন। যখন ওই অ্যাকসিডেন্টটা হয়েছিল, তখন হাওয়ার্ড দায়িত্বে ছিলেন। এই হল ওনার ঠিকানা। আমি ওনাকে ফোন করে বলে রাখব।
ডায়ানা বললেন- আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
রে ফাউলার বললেন- আপনাদের জন্য এতটা কাজ কেন করছি বলুন তো? আমিও তদন্ত কমিটির ওপর বিশ্বাস করি না। আমরা প্লেনটার ভগ্নাবশেষ পেয়েছিলাম। তবে ব্ল্যাক বক্সটা পাওয়া যায়নি। সেটা কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে।
হাওয়ার্ড মিলার একটা ছোটো বাড়িতে বাস করেন। এয়ারপোর্ট থেকে ছ-মাইল দূরে। খর্বাকৃতি মানুষ, বছর চল্লিশ বয়স। দরজা খুলে দিলেন। ডায়ানা এবং কেলিকে লক্ষ্য করে বললেন– ভেতরে আসুন, রে ফাউলার আমাকে সব কিছু বলেছেন। বলুন, কী করব?
আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি মিঃ মিলার।
বসুন।
দুই ভদ্রমহিলা কৌচে বসলেন।
কফি চলবে কি?
না, ধন্যবাদ।
গ্যারি রেনল্ডসের প্লেন দুর্ঘটনার বিষয় তো?
–হ্যাঁ। এটা কী নেহাত একটা দুর্ঘটনা, নাকি এর অন্তরালে..
হাওয়ার্ড মিলার কাধ কঁকিয়ে বললেন– সত্যি কথা বলতে কি, আমিও আসল ব্যাপার জানি না। আমি অনেক দিন ধরে এখানে চাকরি করছি, কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আমার কখনও হয়নি। সবকিছুই নিয়মনীতি মেনে চলছিল। গ্যারি রেনল্ডস নীচে নামবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন। আমরা সবুজ সংকেত দেখিয়ে ছিলাম। পরের মুহূর্তে মনে হল, তিনি বোধহয় মাত্র দু-মাইল দূরে। হঠাৎ আর একটা খবর এল, মাঝ আকাশে হারিকেন দেখা দিয়েছে। কিন্তু আবহাওয়া দপ্তর থেকে তেমন কোনো সংকেত পাঠানো হয়নি। পরবর্তীকালে আমি আবার রিপোর্টগুলো পরীক্ষা করেছিলাম। তখন আকাশে এমন কোনো ঝোড়ো বাতাস ছিল না। সত্যি কথা বলতে কি, মনে হচ্ছে, উনি বোধহয় মদ খেয়েছিলেন, কিংবা ড্রাগ নিয়েছিলেন। কয়েকটা খবর শুনতে পেয়েছিলাম, প্লেনটা একটা উঁচু পাহাড়ে ধাক্কা খেয়েছিল।
কেলি বলল– ব্ল্যাকবক্স পাওয়া যায়নি, তাই না?
হাওয়ার্ড মিলার চিন্তা করে বললেন- হ্যাঁ, এটাও ভেবে দেখার মতো বিষয়। আমরা সব কিছু পেয়েছি। ব্ল্যাক বক্সের কী হল? তদন্ত কমিটি এই ব্যাপারে রিপোর্ট দিয়েছে। আমি আমার সন্দেহের কথা বারবার বলেছিলাম। আপনি জানেন, কেউ যদি কোনো অপরাধমূলক কাজ করে থাকে, তার আচরণে সেটা ফুটে ওঠে।
-হ্যাঁ।
আমার মনে হচ্ছে, এর মধ্যে একটা রহস্য আছে। কিন্তু কী রহস্য আমি তা বলতে পারব না। আমার কাছ থেকে আপনারা আর কোনো সাহায্য পাবেন না।
মিলার দুই ভদ্রমহিলার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন আমার মনে হচ্ছে গ্যারির বোন বোধহয় আপনাদের আরও ভালো খবর দিতে পারবেন।
কেলি অবাক হয়ে গেছেন– কী বলছেন?
উনি হাসপাতালে আছেন, আহা, হতভাগিনী রমণী। মাঝরাতে বাড়িতে আগুন ধরে গিয়েছিল। মনে হয়, আততায়ীরা ওনাকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল।
ডায়ানা জিজ্ঞাসা করলেন- কী হয়েছিল?
ফায়ার ডিপার্টমেন্টের লোকরা বলছেন, এটা ইলেকট্রিক্যাল শর্ট সার্কিট। লুইস হামাগুড়ি দিয়ে সামনের দরজা দিয়ে বাইরে চলে এসেছিলেন। লনে পৌঁছে যান। এই সময়ের মধ্যে দমকলের লোকেরা তাকে উদ্ধার করে। শরীরটা একেবারে পুড়ে গিয়েছে।
ডায়ানা শান্ত থাকার চেষ্টা করলেন- উনি কোন্ হাসপাতালে আছেন?
–ইউনিভারসিটি অফ কলোরাডো হাসপাতালে। বার্ন সেন্টারে আছেন।
.
রিসেপশন ডেস্কের নার্স বললেন- আমি দুঃখিত, মিসেস রেনলন্ডসের কাছে কোনো অতিথিকে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
কেলি জানতে চাইলেন- ওনার কত নম্বর ঘর বলবেন কি?
-না, আমি বলব না।
–খুব দরকার আছে, ডায়ানা বললেন। ওনাকে দেখার জন্য আমরা এখানে এসেছি।
উপযুক্ত অনুমতি ছাড়া কেউ সেখানে যেতে পারে না।
ভদ্রমহিলার গলায় এক ধরনের কর্তৃত্ব এবং ঔদ্ধত্য।
ডায়ানা এবং কেলি পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন।
–আচ্ছা, ধন্যবাদ।
তারা বাইরের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমরা কী করব?
কেলি বললেন- একটা শেষ সুযোগ নিতে হবে।
–আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা এসেছে।
.
ইউনিফর্ম পরা একজন বার্তাবাহককে দেখা গেল। তিনি পার্শেল নিয়ে রিসেপশন ডেস্কের দিকে এগিয়ে আসছেন। তিনি বললেন, লুইস রেনল্ডসের জন্য একটা প্যাকেট আছে।
নার্স বললেন– আমি এটা সই করব।
বার্তাবাহক বললেন- না, আমাকে বলা হয়েছে, এটা ওনার হাতে তুলে দিতে হবে। ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নার্স বললেন– তাহলে আমি আপনার সঙ্গে যাব?
–ঠিক আছে চলুন।
ভদ্রলোক ওপরে উঠে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত ৩৯১ নম্বর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। নার্স দরজাটা খুললেন। বার্তাবাহক প্যাকেটটা নার্সের হাতে দিয়ে বললেন- আপনি এটা নিয়ে যেতে পারেন।
.এবার বার্তাবাহক নেমে এলেন, নীচে। ডায়ানা এবং কেলি বসে আছেন। তারা অপেক্ষা করছেন।
উনি বললেন- ৩৯১ নম্বর ঘর।
ধন্যবাদ। ডায়ানা শান্তভাবে বললেন। তিনি ওই লোকটির হাতে কিছু টাকা দিলেন।
দু-জন এবার সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় চলে এলেন। করিডর দিয়ে হেঁটে গেলেন। নার্স যখন টেলিফোনে কথা বলছিলেন, ততক্ষণ অপেক্ষা করলেন। ভদ্রমহিলা বুঝতেই পারলেন না। তারা আবার ৩৯১ নম্বর ঘরে ঢুকে গেলেন।
লুইস রেনল্ডস বিছানাতে শুয়ে আছেন। চারদিকে অনেকগুলো টিউব। শরীরের এখানে সেখানে নল ঢোকানো আছে। হ্যাঁ, বুঝতে পারা যাচ্ছে, মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছেন। শরীরটা ভীষণভাবে পুড়ে গেছে। সর্বাঙ্গে ব্যান্ডেজ। চোখ দুটো বন্ধ। কেলি এবং ডায়ানা বিছানার কাছে এগিয়ে গেলেন।
ডায়ানা শান্তভাবে বললেন মিস রেনল্ডস, আমি ডায়ানা স্টিভেন্স, উনি কেলি হ্যারিস। আমাদের স্বামীরা কে আই জি-তে কাজ করতেন।
লুইস রেনল্ডস কোনো রকমে চোখ খোলার চেষ্টা করলেন। কথা বলতে পারছেন না। ফিসফিসানি কণ্ঠস্বরে বললেন– কী বলছেন?
কেলি বললেন- আমাদের স্বামীরা কে আই জি-তে কাজ করতেন। তাদের দুজনকেই হত্যা করা হয়েছে। আপনার ভাইয়ের ক্ষেত্রে কোন ঘটনা ঘটেছিল তা আমরা জানি, আপনি কি এ ব্যাপারে কিছু জানেন?
লুইস রেনল্ডস কথা বলার চেষ্টা করলেন না, আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারব না। গ্যারি তো মরেই গেছে। এখন আর কথা বলে কী হবে?
তার দুটি চোখে আসন্ন অশ্রুর ইশারা।
ডায়ানা ঝুঁকে পড়ে বললেন– মৃত্যুর আগে আপনার ভাই কী কিছু বলেছিলেন?
–গ্যারি একটা দারুণ মানুষ ছিল। কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে আসছে। প্লেন দুর্ঘটনায় তাকে হত্যা করে হয়েছে।
ডায়না শান্তভাবে বললেন ভালো করে চিন্তা করে বলুন তো, উনি কি আসন্ন মৃত্যুকে দেখতে পেয়েছিলেন?
লুইস রেনল্ডস চোখ দুটো বন্ধ করলেন।
লুইস রেনল্ডস, ঘুমিয়ে পড়বেন না, দেখুন ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার বলুন, আপনার ভাই এমন কোনো কথা বলেছিলেন যা আমাদের তদন্তে সাহায্য করবে।
লুইস রেনল্ডস এবার চোখ খুললেন। ডায়ানার দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনারা
ডায়ানা বললেন আমার তাই মনে হচ্ছে, আপনার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে।
লুইস রেনল্ডস বললেন- হ্যাঁ, আমি জানি।
ঘরের ভেতর ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গেল বুঝি।
-কেন? কেলি জানতে চাইলেন।
–প্রাইমা, ফিসফিসানি কণ্ঠস্বর।
কেলি সামনে এগিয়ে এলেন প্রাইমা?
–হাঁ, গ্যারি আমাকে সব কথা বলেছিল। মারা যাবার কদিন আগে। ওই মেশিনটা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। সারা পৃথিবীর আবহাওয়াকে। গ্যারি? সে কখনও ওয়াশিংটন যেতে পারল না।
ডায়ানা প্রশ্ন করলেন– ওয়াশিংটন?
–হ্যাঁ, সবাই-সবাই ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন। কোনো এক সেনেটরের সঙ্গে কথা বলতে। প্রাইমার বিষয়ে আলোচনা করতে। গ্যারি বলেছিল, প্রাইমার মোটেই সুবিধের নয়।
কেলি প্রশ্ন করলেন- ওই সেনেটরের নাম মনে আছে?
না।
–একবার চিন্তা করুন।
লুইস রেনল্ডস কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে বললেন- সেনেটর।
-সেনেটর কে?
–কেলি জানতে চাইলেন।
লেবিন রুবেন ভ্যান রুবেন। আমার ভাই তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিল। কিন্তু…
দরজাটা খুলে গেল, এক ডাক্তার সাদা জ্যাকেট পরেছেন, হাতে স্টেথিস্কোপ। তিনি ভেতরে চলে এলেন। ডায়ানা এবং কেলির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। রেগে বললেন- আমি বলেছি না, এখানে কোনো ভিজিটর আসবেন না।
কেলি বললেন আমি দুঃখিত। আমরা একটা ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলাম।
–এখান থেকে এখনই চলে যান।
দুজন ভদ্রমহিলা লুইস রেনল্ডসের দিকে তাকালেন। বললেন গুডবাই, ভালো হয়ে উঠুন, কেমন?
ভদ্রলোক তাকিয়ে থাকলেন। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তিনি আস্তে আস্তে বিছানার দিকে এগিয়ে এলেন। লুইস রেনল্ডসের মাথার নীচে একটা বালিশ রেখে দিলেন।
.
৪০.
কেলি এবং ডায়ানা মেন লবিতে চলে এসেছেন।
ডায়ানা বললেন রিচার্ড এবং মার্ক তাই ওয়াশিংটন যাচ্ছিলেন। সেনেটর ভ্যান রুবেনের সঙ্গে দেখা করতে।
–আমরা কী করে তার সাথে যোগাযোগ করব?
ব্যাপারটা খুবই সহজ। ডায়ানা তার সেলফোন বের করলেন।
কেলি বারণ করার চেষ্টা করলেন না, চলো আমরা বাইরে থেকে ফোন করি।
তারা সেনেট অফিস থেকে টেলিফোন নাম্বারটা পেয়ে গেছেন। ডায়ানা পাবলিক ফোন থেকে কথা বললেন সেনেটর ভ্যান রুবেনের অফিস?
-হ্যাঁ।
–আমি সেনেটরের সঙ্গে কথা বলতে চাইছি।
কী জন্য জানতে পারি?
ডায়ানা বললেন, এটা একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার।
–আপনার নাম?
নাম শুনে কী কোনো লাভ আছে?
–আমি দুঃখিত। আমি লাইন দিতে পারব না।
লাইন কেটে দেওয়া হল। ডায়ানা কেলির দিকে তাকিয়ে বললেন- আমরা আমাদের আসল নাম ব্যবহার করব না।
ডায়ানা আবার ফোন করলেন সেনেটর ভ্যান রুবেনের অফিস?
…আমার কথা শুনুন। এটা কোনো উড়ো ফোন নয়। সেনেটরের সঙ্গে এখনই কথা বলতে হবে। আমি আমার নাম বলতে পারছি না।
–তাহলে আমি লাইন দিতে পারব না।
আবার লাইনটা কেটে দেওয়া হয়।
ডায়ানা আবার ফোন করলেন সেনেটর ভ্যান রুবেনের অফিস?
…আমার কথা শুনুন, আপনি আপনার কাজ করবেন, কিন্তু এটা জীবন ও মৃত্যুর প্রশ্ন। আমি একটা পে ফোন থেকে কথা বলছি। আমি এই নাম্বারটা দিতে পারি, সেনেটরকে বলুন উনি যেন এখনই ফোন করেন।
ডায়ানা নাম্বারটা দিলেন। বুঝতে পারলেন, সেক্রেটারি ফোনটা নামিয়ে রেখেছেন।
কেলি বললেন- এবার কী করব?
–আমরা অপেক্ষা করব।
দু-ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ডায়ানা বললেন না, এই পরিকল্পনাটা নষ্ট হয়ে গেল।
ফোনটা বেজে উঠল। ডায়ানা ছুটে গেলেন হ্যালো?
একটা অপরিচিত মহিলার কণ্ঠস্বর– আমি সেনেটর ভ্যান রুবেন, আপনি কে?
ডায়ানা ফোনটা ধরে কেলির দিকে তাকিয়ে আছেন। না, এমন করে ফোনটা রাখতে হবে, দুজনেই কথা শুনতে পান। ডায়ানার গলা আটকে গেছে। তিনি কোনোরকমে বললেন– সেনেটর, আমার নাম ডায়ানা স্টিভেন্স, আমার সাথে কেলি হ্যারিস আছে। আপনি কি আমাদের চেনেন?
না, এই দুটো নাম আমি কখনও শুনিনি। বলুন, কেন আমাকে ফোন করতে বলেছেন?
–আমাদের স্বামীরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। এইজন্য তাদের হত্যা করা হয়েছিল।
কিছুক্ষণের নীরবতা–ওঃ মাই গড, রিচার্ড স্টিভেন্স এবং মার্ক হ্যারিস?
-হ্যাঁ।
–হ্যাঁ, আমার সঙ্গে একটা অ্যাপয়মেন্ট ছিল। কিন্তু আমার সেক্রেটারি একটা ফোন পেয়েছিল, বলা হয়েছে, ওরা নাকি পরিকল্পনা পাল্টে ফেলেছেন। তার মানে? ওঁরা মারা গেছেন?
-এই ফোনটা কিন্তু তারা করেননি, ডায়ানা বললেন, তাদের হত্যা করা হয়। যাতে তারা আপনার সঙ্গে দেখা করতে না পারেন।
কী? সেনেটর যেন খুব আহত হয়েছেন, কেন এই ঘটনা ঘটল?
–যাতে আসল সত্যিটা প্রকাশিত না হয়। কেলি এবং আমি ওয়াশিংটনে আসতে চাইছি। আপনার সাথে দেখা করতে চাইছি। যে কথা আমাদের স্বামীরা বলতে পারেননি, সেই কথা শোনাতে চাইছি।
কিছুক্ষণের নীরবতা– আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করব। কিন্তু আমার অফিসে নয়। এখানে এলে সবাই জেনে যাবে। যদি আপনাদের কথা সত্যি হয়ে থাকে, ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর। আমার একটা বাড়ি আছে, সাউদম্পটনে, লং আইল্যান্ডে। আমি সেখানে দেখা করব। আপনারা কোথা থেকে কথা বলছেন?
–ডেনভার?
–এক মিনিট।
তিন মিনিট কেটে গেছে। সেনেটর লাইনে এলেন। ডেনভার থেকে নিউইয়র্কের পরবর্তী ফ্লাইট সোজাসুজি লা ওয়াদিয়াতে চলে আসে। এটা ১২-২৫ মি. ছাড়বে রাত। নিউইয়র্কে সকাল ৬-০৯ মি. এসে পৌঁছোবে। যদি এই ফ্লাইটটা ভরতি থাকে তাহলে….
না, আমরা এই ফ্লাইটেই যাব।
কেলি ডায়ানার দিকে তাকালেন অবাক হয়ে ডায়ানা, আমরা যদি ধরতে না পারি?
ডায়ানা হাসলেন– না, আমরা ঠিকই যাব।
–এয়ারপোর্টে এসে দেখবেন একটা ধূসর রঙের, লিঙ্কন টাউন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, এই গাড়িতে আপনারা চড়বেন। ড্রাইভার এশিয়ান। তার নাম কুনিও। সে আপনাদের আমার বাড়িতে নিয়ে আসবে। আমি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করব।
–অনেক ধন্যবাদ সেনেটর।
ডায়ানা রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। আঃ, এতদিনে বোধহয় সত্যি সত্যি একটা। সমাধানের পথ পাওয়া গেল।
উনি কেলির দিকে তাকিয়ে বললেন- ব্যাপারটার শুভ সমাপ্তি ঘটতে চলেছে।
কেলি প্রশ্ন করলেন– আমরা ওই ফ্লাইটে যাব কী করে?
–আমি একটা পরিকল্পনা করেছি।
.
হোটেল একটা রেন্টাল কারের ব্যবস্থা করেছিল। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে ডায়ানা এবং কেলি এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলেন।
কেলি বললেন– জীবনে আমি কখনও এত উত্তেজিত এবং আতঙ্কিত একসঙ্গে হইনি।
–আমি ভাবতে পারছি না, এর মধ্যে আতঙ্কের কী আছে?
অনেকেই ওই সেনেটরের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, কিন্তু অনেকের স্বপ্ন সফল হয় না। ডায়ানা, ব্যাপারটা ভেবে দেখতে হবে। ভেবে দেখো তো, যাঁরা সেনেটরের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন তাদের ভাগ্য কী হয়েছে?
না, এখনই এত খারাপ কথা ভাবছ কেন?
কেলি মাথা নেড়ে বললেন- হ্যাঁ, এটা না হলেই ভালো হয়।
–আমি জানি, একটা অস্ত্র আমাদের আছে। আমাদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি।
–হ্যাঁ, এই অস্ত্রটা কি ভোঁতা হয়ে যায় নি?
কেলি গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন।
–দেখো, কী হচ্ছে?
ডায়ানা তাকালেন কী?
–আমায় কিছু একটা করতে হবে।
তারা একটা বিউটি পার্লারের সামনে দাঁড়ালেন। কেলি দরজাটা খুললেন।
ডায়ানা প্রশ্ন করলেন- তুমি এখন কী করবে?
-আমি একটা নতুন এয়ার প্রুফ কিনব।
–এখন? তুমি কি ঠাট্টা করছ?
না, আমি ঠাট্টা করছি না।
-এখন? কেলি, আমরা এখন এয়ারপোর্টে যাব। একটা প্লেন ধরতে হবে। এখন কী প্রসাধন কেনার সময়?
–ডায়ানা, তুমি জানো না, কী ঘটনা ঘটতে চলেছে। যদি আমি মারা যাই, আমি যেন ভালো অবস্থায় থাকি।
ডায়ানা কিছু বলার চেষ্টা করলেন, বলতে পারলেন না। কেলি সত্যি সত্যি বিউটি পার্লারের মধ্যে ঢুকে গেছেন!
.
কুড়ি মিনিট কেটে গেছে। কেলি বেরিয়ে এসেছেন। একটা কালো উইপ পরেছেন। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।
চলুন, এবার আমরা শেষ অভিযানে অংশ নিই।
.
৪১.
-সাদা রঙের লেকসাস আমাদের অনুসরণ করছে, কেলি বললেন।
–হ্যাঁ, কিন্তু কেন?
–কেন বলো তো?
–ভালোভাবে দেখতে হবে।
গাড়িটা ক্রমশ এয়ারপোর্টের দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু লেখা আছে, এই রাস্তায় অন্য কোনো গাড়ি ঢুকতে পারবে না।
প্রহরী এগিয়ে এল। সে গাড়িটাকে ছেড়ে দিল।
লেকসাসে যারা বসেছিল, তারা দেখতে পেল কেলি এবং ডায়ানা ভেতরে চলে গেছেন।
টারম্যাকের দিকে তারা এগিয়ে চলেছেন। লেকসাস গেটে পৌঁছে গেছে। প্রহরী বলল, এটা ব্যক্তিগত প্রবেশ পথ।
–কিন্তু ওই গাড়িটাকে কেন ছেড়ে দেওয়া হল।
প্রহরী আবার বলল- এটা ব্যক্তিগত প্রবেশ পথ। দরজাটা প্রহরী বন্ধ করে দিল।
.
টারম্যাকের পাশে অনেক মানুষের ভিড়। একটা জাম্বো জেট দাঁড়িয়ে আছে। ডায়ানা এবং কেলি ভেতর দিকে চলে গেলেন। হাওয়ার্ড মিলার অপেক্ষা করছিলেন।
–আপনারা এসে গেছেন?
হ্যাঁ, এই ব্যবস্থার জন্য ধন্যবাদ।
হ্যাঁ, আমি আনন্দিত। মনে হচ্ছে, এবার বোধহয় সবকিছুর শেষ হবে।
সুইস রেনলন্ডসকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। উনি না বললে আমরা ব্যাপারটা বুঝতেই পারতাম না।
হাওয়ার্ড মিলারের অভিব্যক্তি পাল্টে গেল।
লুইস রেনল্ডস কাল রাতে মারা গেছেন।
দুই ভদ্রমহিলা এই শোক সংবাদটা সহ্য করতে পারছেন না। বেশ কিছুক্ষণ বাদে কেলি বললেন- আমি অত্যন্ত দুঃখিত।
কী হয়েছিল? ডায়ানার জিজ্ঞাসা।
হঠাৎ হার্টফেল।
হাওয়ার্ড মিলার তাকালেন জেটের দিকে। এটা এখনই ছাড়বে। আমি দরজার কাছে দুটো সিটের ব্যবস্থা করেছি।
–আপনাকে আবার ধন্যবাদ।
.
মিলার দেখলেন, কেলি এবং ডায়ানা র্যাম্পে ঢুকে গেছেন। একটু বাদে ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। এবার প্লেনটা আকাশে উড়বে।
কেলি ডায়ানার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমরা পেরেছি, আমরা সমস্ত প্রতিকুলতাকে জয় করতে পেরেছি। আমরা এখন কী করব?
-ভ্যান রুবেনকে কী বলব?
–আমি ও ব্যাপার নিয়ে এখনও চিন্তা করতে পারিনি। ডায়ানা বললেন, তুমি কি প্যারিসে ফিরে যাবে?
-হ্যাঁ, এটা নির্ভর করছে। তুমি কি নিউইয়র্কে থাকবে?
–হ্যাঁ।
কেলি বললেন আমি হয়তো কিছুদিনের জন্য নিউইয়র্কে থাকব।
তাহলে আমরা দুজনে একসঙ্গে প্যারিসে যাব।
ওঁরা বসে আছেন, পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছেন।
ডায়ানা বললেন রিচার্ড এবং মার্ক কত খুশিই হবে, যদি এই ব্যাপারটা ঠিকমতো শেষ হয়। আমরা ওদের অপূর্ণ কাজ শেষ করব। তাই তো?
-হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।
ডায়ানা জানালা দিয়ে তাকালেন, আকাশের দিকে। বললেন– রিচার্ড, তোমাকে ধন্যবাদ।
কেলি ডায়ানার দিকে তাকিয়ে আছেন, কথা বলতে পারছেন না।
রিচার্ড, আমি জানি, তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো ডার্লিং, আমরা তোমার কাজ শেষ করতে চলেছি। আমরা এই ঘটনার প্রতিশোধ নেব। তুমি এবং তোমার বন্ধুদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার কোনো ক্ষমা নেই। তোমাকে হয়তো আমি আর ফিরিয়ে আনতে পারব না। কিন্তু এটাই হবে তোমার প্রতি আমার শেষ শ্রদ্ধা। তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো, প্রিয়তম?
.
প্লেনটা ডেলা গারডিয়া এয়ারপোর্টে নেমে পড়েছে। কিছুক্ষণ দেরি হয়েছে। সাড়ে তিন ঘণ্টা, ডায়ানা এবং কেলি প্রথম নেমে এলেন। ডায়ানার মনে পড়ল, সেনেটর ভ্যান রুবেনের কথাগুলো যখন আপনারা এয়ারপোর্ট থেকে নামবেন, ধূসর রঙের একটা লিঙ্কন টাউন কার দাঁড়িয়ে থাকবে। এই গাড়িতে চড়ে সোজা আমার বাড়িতে চলে আসবেন।
গাড়িটা টার্মিনাল এন্ট্রাসের মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। তার গায়ে একজন জাপানি ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ড্রাইভারের পোশাক পরা। তিনি এগিয়ে এলেন। কেলি এবং ডায়ানাকে দেখে হাত নেড়ে ইশারা করলেন মিসেস স্টিভেন্স? মিসেস হ্যারিস?
-হ্যাঁ।
–আমি কুনিও, উনি দরজাটা খুলে দিলেন। দুই ভদ্রমহিলা গাড়িতে উঠলেন।
এক মুহূর্ত বাদে তারা সাউদম্পটনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন।
দুঘণ্টা সময় লাগবে, কুনিও বললেন। দুপাশের দৃশ্যাবলি অসাধারণ।
না, এখন আর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার মতো মন অথবা সময় কোনো কিছুই নেই। কীভাবে ব্যাপারটা বোঝানো যেতে পারে, দুজনে সেই চিন্তায় মগ্ন। সেনেটরকে সবকিছু সংক্ষেপে বলতে হবে, যাতে উনি ব্যাপারটা সত্যি সত্যি বুঝতে পারেন।
কেলি ডায়ানার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন সেনেটর কি এই আতঙ্কের ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন? আমরা কতটা তার কাছে খুলে বলব?
-হ্যাঁ, উনি একমাত্র নিরাপত্তা দিতে পারেন। তিনি জানেন, কী করে বিষয়গুলি সমাধান করতে হয়।
আমি বুঝতে পারছি।
দু-ঘন্টা কেটে গেছে। টাউন কার শেষ পর্যন্ত একটা বিরাট বেলে পাথরের ম্যানসনে ঢুকে পড়ল। শ্লেট দিয়ে তার ছাদ তৈরি করা হয়েছে। দু-দিকে উঁচু চিমনি আছে, অষ্টাদশ শতাব্দীর স্থাপত্য বিদ্যার ছাপ। মস্ত বড় বাগান। তারা দেখতে পেলেন, পরিচালকদের থাকার জন্য আলাদা কোয়ার্টার তৈরি হয়েছে। গ্যারেজটাও আলাদা।
গাড়িটা সামনের দরজার কাছে থেমে গেল। কুনিও বললেন আমি এখানে অপেক্ষা করছি। দরকার পড়লে ডাকবেন।
ধন্যবাদ।
একজন বাটলার এসে দরজাটা খুলে দিল– সুপ্রভাত, ভেতরে আসুন। সেনেটর আপনাদের জন্য বসে আছেন।
দুজন ভদ্রমহিলা প্রবেশ করলেন। লিভিং রুমটা সুন্দর, ছিমছাম সাজানো। প্রাচীন ফার্নিচারের চিহ্ন আছে। কৌচ এবং চেয়ারের ছড়াছড়ি। দেওয়ালের ধারে একটা মস্ত বড়ো ফায়ার প্লেস। সেখানে ধাতব পাত্রে আগুন জ্বলছে। মোমের মতো আভা প্রকাশিত হচ্ছে।
বাটলার বলল- ওই দিকে।
কেলি এবং ডায়ানা বাটলারকে অনুসরণ করে একটা মস্ত বড়ো ড্রয়িংরুমে ঢুকে পড়লেন।
সেনেটর ভ্যান রুবেন বসে আছেন। তিনি একটা হালকা নীল রঙের সিল্কের সুট পরেছেন। মানানসই রঙের ব্লাউজ। তার চুলগুলো সুন্দরভাবে সাজানো। না, ডায়ানা যেমন ভেবেছিলেন, তার থেকেও আকর্ষণীয়।
—আমি পাউলিন ভ্যান রুবেন।
ডায়ানা স্টিভেন্স।
–কেলি হ্যারিস।
–আপনাদের সঙ্গে দেখা হওয়াতে আমি খুবই আনন্দিত। অনেক কষ্ট করে আপনারা এসেছেন, তাই তো?
কেলি সেনেটর ভ্যান রুবেনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেছেন। তার মানে?
ট্যানার কিংসলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল– তার মানে, তোমরা খুবই ভাগ্যবতী, কিন্তু ভাগ্য বোধহয় এবার শেষ হয়ে আসছে।
ডায়ানা এবং কেলি পেছন ফিরে তাকালেন ট্যানার কিংসলে এবং হ্যারি ফ্লিন্ট ঘরের দিকে এগিয়ে আসছেন।
ট্যানার বললেন- এবার মিঃ ফ্লিন্ট…
হ্যারি ফ্লিন্ট একটা পিস্তল তুলল। কোনো কথা বলা হল না। সে দুজন ভদ্রমহিলার দিকে তাক করে গুলি ছুঁড়ল। পাউলিন ভ্যান রুবেন এবং ট্যানার কিংসলে দেখলেন, কেলি এবং ডায়ানার শরীর কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে গেছে।
ট্যানার সেনেটর ভ্যান রুবেনের দিকে তাকিয়ে বললেন- মহামান্য রাজকুমারি, গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে গেল কেমন?
.
৪২.
ফ্লিন্ট জিজ্ঞাসা করলেন এই দুটো মৃতদেহ নিয়ে আমি এখন কী করব?
ট্যানার এতটুকু ইতস্তত করলেন না। তিনি বললেন, পায়ে ভারী পাথর বেঁধে আটলান্টিকে ফেলে দিয়ে এসো। কোনো চিহ্ন রেখো না।
ফ্লিন্ট ঘর থেকে চলে যাবার আগে বলল- কোনো সমস্যা নেই।
ট্যানার সেনেটার ভ্যান রুবেনের দিকে তাকিয়ে বললেন- রাজকুমারি, গল্পটা শেষ যখন, আমরা আমাদের কাজ শুরু করি, কেমন?
রুবেন উঠে এলেন। তিনি ট্যানারকে একটা চুম্বন উপহার দিলেন।
–বেবি, অনেক দিন আমি ওটার স্বাদ পাইনি।
–হ্যাঁ, আমিও তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।
–অনেক দিন একটা উত্তেজনার মধ্যে সময় কেটে গেল। আর কিছু ভালো লাগছে না।
ট্যানার আরও কাছে এলেন- এখন থেকে আমরা একসঙ্গেই থাকব। আমরা তিন-চার মাস ধরে একসঙ্গে কাজ করব। আর কী করব? তোমার মৃত স্বামীর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করব? তারপর? তারপর আমরা পরস্পরকে বিয়ে করব। তাই তো?
ভদ্রমহিলার ঠোঁটে হাসি-হা, এটা আর একটু তাড়াতাড়ি করলে হয় না? মনে করো একমাস?.
–হ্যাঁ, তোমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখব।
–আমি সেনেট থেকে গতকাল পদত্যাগ করেছি। তারা বুঝতে পেরেছে, আমি আমার স্বামীর জন্য কতখানি শোকাহত।
চমৎকার। এবার আমরা অনায়াসে মেলামেশা করতে পারব। আমি তোমাকে কে আই জি সম্পর্কে অনেক কথা বলব। হ্যাঁ, যে সব ফাইল আগে দেখাতে পারিনি, সেগুলো অনায়াসে দেখাতে পারব।
.
ট্যানার এবং পাউলিন লাল ইটের তৈরি বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। সামনে একটা ইস্পাতের দরজা আছে। দরজার মধ্যিখানে ছোট্ট ছিদ্র। ট্যানারের হাতে একটা চাবি। তার মাথায় গ্রিক যোদ্ধার মূর্তি আঁকা।
পাউলিন দেখলেন, ট্যানার সেই চাবিটা ঢুকিয়ে দিলেন। দরজাটা খুলতে শুরু করল। ঘরটা বিরাট। চারপাশে বড়ো বড়ো কম্পিউটার এবং টেলিভিশন স্ক্রিন আছে। জেনারেটার এবং ইলেকট্রনিক্স চোখে পড়ল। মধ্যে একটা কনট্রোল প্যানেল রয়েছে।
ট্যানার বললেন- রাজকুমারি, প্রাইমার সঙ্গে দেখা করো। এটা হল গ্রাউন্ড জিরো। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারব। উপগ্রহের মাধ্যমে এই ঘরটা সংযুক্ত। এর সাহায্যে আমরা পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলের আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারি। আমরা যে কোনো জায়গায় ঝড় আনতে পারি। আমরা বৃষ্টি বন্ধ করে দুর্ভিক্ষকে ডাকতে পারি। আমরা বিমানবন্দরে কুয়াশার সৃষ্টি করতে পারি। হ্যারিকেন আনতে পারি। সাইক্লোন সৃষ্টি করতে পারি। এভাবেই আমরা বিশ্বের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করব।
ওনার মুখের কোণে হাসি আমি আমার কিছু ক্ষমতা ইতিমধ্যেই দেখিয়েছি। অনেকগুলো দেশ আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা এখনও পর্যন্ত সেই কাজে সফল হতে পারেনি।
ট্যানার একটা বোম টিপলেন। টেলিভিশন স্ক্রিনটা আলোকিত হয়ে উঠল।
–এখানে যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটা হল আমরা ভবিষ্যতে কী করব।
উনি পাউলিনের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললেন- একটা ব্যাপার করলেই আমরা প্রাইমাকে কাজে লাগাতে পারব। প্রাইমা আমাদের ওপর সবুজ ঘরের প্রভাব বিস্তার করবে। সেটা খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করা হবে। তুমি কি জানো, কে এই প্রকল্পের অধিকর্তা? কার মাথা থেকে এই প্রকল্পটা বেরিয়েছিল? তুমি অবাক হবে। সে, সে হল আমোর দাদা, অ্যানড্রু। হ্যাঁ, অ্যানড্রু সত্যি এক মহাপ্রতিভাশালী ব্যক্তি, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
পাউলিন অবাক হয়ে বিরাট যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে আছেন– আমি বুঝতে পারছি না, এটা কীভাবে বিশ্বের আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রিত করবে।
দেখো, আমি খুব সহজে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ইচ্ছে হলে আমরা উষ্ণ বাতাসকে ওপর দিকে ছেড়ে দেব। ঠাণ্ডা বাতাসের সংস্পর্শে আসবে। তারপর তাদের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটাবে। যদি মনে করো, তাহলে বাতাসকে আমরা আর্জ করতে পারব।
-না, এভাবে আমাকে ভয় দেখিও না। আমাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলল ডার্লিং।
দুঃখিত। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় আছে, সব কিছু তুমি কি বুঝতে পারবে?
ট্যানার বললেন।
–আমি বোঝার চেষ্টা করব।
–আমি সংক্ষেপে বলে দিচ্ছি। এর সঙ্গে মাইক্রো লাসের সংযুক্ত আছে। তুমি ন্যানো টেকনোলজির নাম তো শুনেছ। এইটাও আমার ভাইয়ের অবদান। এইভাবে আমরা বিশ্বের বাতাসের বুকে নানা ঝড়-ঝঞ্ঝার সৃষ্টি করব। আমরা অক্সিজেন বন্ডের সাথে হাইড্রোজেনের সংমিশ্রণ ঘটাব। ওজোন এবং জল তৈরি হবে। মুক্ত স্বাধীন অক্সিজেন বাতাসে ফিরে যাবে। তাকে আমরা 0, বলব। আমার ভাই এই ব্যাপারটাও আবিষ্কার করেছে। সে এমন একটা যন্ত্র বের করেছে, যার সাহায্যে মহাবিশ্বের লাসের কণা এখানে চলে আসবে। 0, বন্ডের সঙ্গে আর একটা অক্সিজেন যুক্ত হয়ে ওজোন অর্থাৎ 0, তৈরি করবে। এর সঙ্গে জল অর্থাৎ A,O পাওয়া যাবে।
–আমি এখনও পর্যন্ত তোমার কথার আসল মানেটা বুঝতে পারছি না।
-তুমি তো জানো, বিশ্বের আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে জল। অ্যানড্রু এমন একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে, যার সাহায্যে আমরা বেশি পরিমাণ জল তৈরি করতে পারব। সেই জলকে আমরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে দেব। আরও বেশি লাসের, আরও বেশি বাতাস। এইভাবে আমরা জল ও বাতাসের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তার করতে পারব।
উনি এক মুহূর্ত কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন- আমি আকিরা ইসোর সাথে কথা বলেছিলাম, টোকিওতে, তারপর জুরিখে গিয়ে ম্যাডলাইন স্মিথের সাথে দেখা করি। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ওরা দুজন এই সমস্যা সমাধানের পথে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। আমরা ওনাদের হাতে একটা ভালো চাকরি তুলে দিয়েছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল, আমাদের সবকিছুর ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে। কিন্তু ওঁরা আমার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছেন। তাই শেষ পর্যন্ত ওনাদের মেরে ফেলা হল।
দীর্ঘশ্বাস- আমি তোমাকে বলেছি, আমার চারজন বিখ্যাত আবহাওয়াবিদ আমার সঙ্গে কাজ করছেন। এই প্রযুক্তির ব্যাপারে।
-হ্যাঁ,
–তাঁদের মধ্যে একজন হলেন ফ্রানজ ভারব্রুগ, উনি বার্লিনে থেকে কাজ করছিলেন। একজন মার্ক হ্যারিস, প্যারিস, একজন গ্রে রেনল্ডস, ভ্যাঙ্কুবার এবং রিচার্ড রেনল্ডস, নিউইয়র্ক। তারা নানাভাবে বাতাসকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেখলাম, তারা বিভিন্ন দেশে বসে কাজ করছেন, সুতরাং একে অন্যের সাথে কিছুতেই মেলাতে পারবেন না। তাই এই প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্য কী, সেটা সকলের কাছে অজানা থেকে যাবে। কিন্তু কিছু একটা উপায়ে তারা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। তারা ভিয়েনাতে এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমার পরিকল্পনা কী, জানতে চেয়েছিলেন। আমি প্রাইমার কথা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে, এই প্রকল্পটা আমাদের সরকারের হাতে তুলে দেব। আমরা ভাবতেই পারিনি যে, তারা এই কাজে এত দক্ষ হয়ে উঠবেন। শেষ পর্যন্ত আমি একটা ফাঁদ পাতলাম। তারা রিসেপশন রুমে বসেছিলেন। আমি সেনেট অফিস থেকে একটা ফোন করলাম। যাতে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রাইমার কথা শোনা গেল। সকালবেলা তারা তোমার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইল। ব্যাপারটা একেবারে মিথ্যে, শেষ পর্যন্ত তাদের শেষ করে দেওয়া হল।
ট্যানারের মুখে হাসি দেখো, কী করে কাজটা আমি করেছি।
কম্পিউটার স্ক্রিনের ওপর পৃথিবীর একটা মানচিত্র ফুটে উঠেছে। নানা জায়গাতে ছোটো ছোটো বিন্দু এবং চিহ্ন আছে।
ট্যানার একটা সুইচে হাত দিলেন। ম্যাপটা পর্তুগালকে আলোকিত করল।
ট্যানার বললেন- এটাই হল পর্তুগালের কৃষিসমৃদ্ধ উপত্যকা। যে সমস্ত নদী সেখানে আছে, সেই নদী থেকে জলসেচের ব্যবস্থা করা হয়। এই নদীগুলোর স্পেনে উৎপত্তি হয়েছে এবং আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে। ভেবে দেখো, যদি ওই নদীর জলসরবরাহ কমে যায়, তাহলে পর্তুগালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খরা দেখা দেবে। আবার যদি জল সরবরাহ বেড়ে যায়, তাহলে কী হবে? তাহলে পর্তুগাল বন্যায় ডুবে যাবে।
ট্যানার একটা বোতাম টিপলেন। স্ক্রিনের ওপর একটা হলুদ গোলাপি প্রাসাদ ফুটে উঠল। বাইরে সশস্ত্র প্রহরী। চারপাশে সুন্দর সবুজ বাগান। উজ্জ্বল আলোয় ঝকমক করছে।
–এটা হল প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ।
ছবিটা ঘুরে গেল, ডাইনিং রুম দেখা গেল। একটা পরিবার বসে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছে।
উনি হলেন পর্তুগালের প্রেসিডেন্ট। তার স্ত্রী এবং দুই শিশুও বসে আছে। তারা কথা বলছেন, পর্তুগিজ ভাষায়। আমরা ইংরাজিতে শুনতে পাচ্ছি। আমার কাছে এ ধরনের অসংখ্য ন্যানো ক্যামেরা আছে, মাইক্রোফোন আছে, ওই প্রাসাদে সেগুলো বানো আছে। প্রেসিডেন্ট কিন্তু এবিষয়ে কিছুই জানে না। তার প্রধান সিকিউরিটি গার্ড আমার হয়ে কাজ করেন।
প্রেসিডেন্টকে এক ভদ্রলোক বললেন- আজ সকাল এগোরোটার সময় এমবাসিতে আপনার সঙ্গে একটা মিটিং আছে। তারপরে আপনি লেবার ইউনিয়নের একটি সভায় ভাষণ দেবেন। দুপুর একটার সময় মিউজিয়ামে যেতে হবে। বিকেলে আমরা একটা সংবর্ধনার আয়োজন করেছি।
ব্রেকফাস্ট টেবিলের ফোনটা বেজে উঠল। প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়িয়ে বললেন-হ্যালো?
ট্যানারের কণ্ঠস্বর- ইংরাজি থেকে পর্তুগীজ ভাষায় সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করা হচ্ছে।
ট্যানার বললেন- মিঃ প্রেসিডেন্ট?
প্রেসিডেন্ট অবাক হয়ে গেছেন আপনি কে?
সঙ্গে সঙ্গে পর্তুগীজ ভাষা থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করে ট্যানারকে শোনানো হল।
–আমি একজন বন্ধু।
–আপনি কী করে আমার বেডরুমের নাম্বার পেলেন?
–সেটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। আপনি আমার কথা শান্তভাবে শুনুন। আমি আপনার দেশটাকে ভালবাসি। আমি চাই না, এই দেশটার কোনো ক্ষতি হোক। যদি আপনি আমার কথা না শোনেন তাহলে ভয়ঙ্কর ঝড় দেখা দেবে। আপনার দেশটা বিশ্বের মানচিত্র থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে। আপনি আমাকে অবশ্যই দু-কোটি ডলার পাঠাবেন, সোনার হিসাবে দেবেন। আর যদি আপনি আমার কথা শুনতে রাজী না থাকেন, তা হলে সেই ডলার আমি ফিরিয়ে দেব।
স্ক্রিনের ওপর তার মুখ ভেসে উঠল। প্রেসিডেন্ট ফোনটা নামিয়ে রেখেছেন। তিনি তার বউকে বলছেন কোনো উন্মাদ মানুষ বোধহয় আমার ফোন নাম্বারটা পেয়ে গেছে। সে বোধহয় সম্প্রতি পাগলা গারদ থেকে ছাড়া পেয়েছে।
ট্যানার পাউলিনের দিকে তাকিয়ে বললেন- এটা আমরা তিনদিন আগে রেকর্ড করেছিলাম। এখন শোনো গতকাল আমাদের কী কথা হয়েছে।
বিরাট গোলাপি প্রাসাদের ছবিটা আবার ফুটে উঠল। একই রকম সুন্দর সাজানো বাগান। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশে ঘন মেঘের আস্তরণ, থেকে থেকে বাজ পড়ছে। বিদ্যুৎ চমক। :
ট্যানার একটা বোম টিপলেন। টেলিভিশনের ওপর আর একটা ছবি এসে গেল। প্রেসিডেন্টের অফিস। তিনি কনফারেন্স টেবিলে বসে আছেন। চারদিকে সহকারীরা বসে আছেন। প্রেসিডেন্টের মুখ রাগে থমথম করছে।
টেলিফোনটা বাজতে শুরু করল।
ট্যানার বললেন- এখন?
প্রেসিডেন্ট টেলিফোনটা নিয়ে বললেন- হ্যালো?
–গুড মর্নিং, মিঃ প্রেসিডেন্ট।
–আপনি আমার দেশটাকে নষ্ট করে দিচ্ছেন। আপনি শস্যের ক্ষতি করছেন। জায়গায় জায়গায় বন্যা দেখা দিয়েছে। গ্রামগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- এটা কতদিন চলতে থাকবে?
প্রেসিডেন্টের কণ্ঠস্বরে আকুতি ঝরে পড়ছে।
যত দিন পর্যন্ত আমার প্রার্থিত টাকা না পাব, ততদিন এই ঘটনা ঘটতে থাকবে। তারা দেখলেন, প্রেসিডেন্ট তার দাঁতে দাঁত চেপেছেন। এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করেছেন। তারপর তিনি বললেন- তাহলে আপনি ঝড় থামিয়ে দেবেন?
–হ্যাঁ।
কীভাবে টাকাটা দেওয়া হবে?
-রাজকুমারি, আমরা ইতিমধ্যে টাকাটা পেয়ে গেছি। দেখো, প্রাইমা আরো কী করতে পারে। এগুলো হল আমাদের আগেকার পরিকল্পনা।
ট্যানার আর একটা বোতাম টিপলেন। হ্যারিকেন দেখা গেল। আছড়ে পড়ছে স্পেনের ওপর।
–এটা জাপানে হয়েছে, ট্যানার বললেন। এই সময় ওখানকার আবহাওয়া শান্ত থাকা উচিত।
উনি আর একটা বোতাম টিপলেন। একটা তুষার ঝড়ের চিহ্ন পাওয়া গেল। আকাশ থেকে বড়ো বড়ো বরফ মাটিতে পড়েছে। একের পর এক গাছেদের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
–এটা ফ্লোরিডার ছবি। সেখানকার তাপমাত্রা এখন শুন্যের নীচে নেমে গেছে। জুন মাসে। ভাবতে পারো? শস্য ধুয়ে মুছে গেছে।
উনি আর এটা বোতাম টিপলেন। বিশাল স্ক্রিনের ওপর টরনেডোর ছবি ফুটে উঠেছে। টরনেডোর আক্রমণে বাড়িঘর ভেঙে পড়ছে।
উনি বললেন একটা দুর্ঘটনার ছবি। তুমি দেখতে পাচ্ছো, প্রাইমা যা খুশি তাই করতে পারে।
পাউলিন আরও কাছে এসে শান্ত গলায় বললেন তার বাবার মতো, তাই তো?
ট্যানার টেলিভিশন সেটটা বন্ধ করলেন। তিনি তিনটে ডিভিডি নিলেন। দেখালেন পাউলিনকে। তারপর বললেন- এখানে উল্লেখযোগ্য আলাপচারিতা আছে। আমি পেরু, মেক্সিকো এবং ইতালিতে করেছিলাম। তুমি কি জানো কীভাবে সোনা হস্তান্তরিত হয়? আমরা ট্রাক পাঠিয়ে দিই, তাদের ব্যাঙ্কে। তারা সোনা দিয়ে ভরতি করে দেয়। ক্যাশ টোয়েন্টি টু নামে একটা সংকেত আছে। এইভাবেই গোল্ড অর্থাৎ সোনাটা চলে যায়। আমি এই ঝড়কে চিরস্থায়ী করব, উপযুক্ত টাকা না পেলে ঝড় থামবে না।
পাউলিন তাকিয়ে আছেন, একটু উত্তেজিত-ট্যানার কীভাবে তোমার এই ফোনগুলোকে চিহ্নিত করা যায়?
ট্যানার হাসছেন– হা, অনেকে চেষ্টা করেছে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। একটা চার্চের সঙ্গে, একটা স্কুলের সঙ্গে। তৃতীয়টা ঝড়ের সৃষ্টি করবে। চতুর্থটা আছে ওভাল অফিসে, হোয়াইট হাউসে।
পাউলিন হাসছেন।
দরজা খুলে গেল। অ্যানড্রু প্রবেশ করেছেন।
অ্যানড্রু পাউলিনের পাশে বসলেন। মুখে অদ্ভুত অভিব্যক্তি–আমি কি আপনাকে চিনতে পারছি? একটু বাদে তিনি বললেন- হ্যাঁ, আপনি এবং ট্যানার তো বিয়ে করতে চলেছেন। আমাকে নিতবর করা হয়েছে, আপনিই তো সেই মহামান্য রাজকুমারি?
পাউলিন বললেন- অ্যানড্রু, আপনি পাশে বসুন।
না, আপনি কেন চলে গিয়েছিলেন? আপনি কি ট্যানারকে ভালোবাসেন না?
ট্যানার বললেন- কথাটা বুঝিয়ে বলা যাক। ও চলে গিয়েছিল কারণ ও আমাকে ভালোবাসে।
ট্যানার পাউলিনের হাতে হাত রেখে বললেন–বিয়ের পর ও আমাকে ফোন করেছিল। ও এক ধনী প্রভাবশালী ব্যক্তিকে বিয়ে করেছে। স্বামীর সাহায্যে ও কে আই জি-তে আরও উপকার করতে পারবে। সেই জন্যই এই ঘটনাটা ঘটেছিল।
ট্যানার পাউলিনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন– প্রতি মাসে আমরা গোপনে মিলিত হতাম।
কণ্ঠস্বরে গর্ব ফুটে বেরোচ্ছে পরবর্তীকালে ও রাজনীতিতে আকর্ষণ বোধ করে। শেষ পর্যন্ত সেনেটর হয়েছিল।
অ্যানড্রুর মুখে বিরক্তি কিন্তু সেবাসটিয়ানা? সেবাটিয়ানা কোথায়?
ট্যানার হাসলেন- সেবাসটিয়ানা করটেজ, তাকে আমি রাস্তায় ফেলে দিয়েছি। অফিসের সকলে তার কথাই জানে। তার ফলে কী হয়েছে? রাজকুমারি আর আমি সকলের সন্দেহের বাইরে থাকতে পেরেছি। বলতে পারো, এটাও আমার একটা ষড়যন্ত্র।
অ্যানড্রু বললেন- ও, তাই নাকি?
–এসো অ্যানড্রু। ট্যানার কনট্রোল সেন্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন। ট্যানার বললেন তুমি মনে করতে পারছ? তুমি এটা তৈরি করেছিলে। এটার কাজ শেষ হয়ে গেছে।
অ্যানড্রুর চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়েছে প্রাইমা?
ট্যানার একটা বোতাম টিপলেন। বললেন–হ্যাঁ, এইভাবে আমরা আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রিত করছি।
তিনি আর একটা বোম টিপে বললেন– নির্দিষ্ট জায়গা। ভাইয়ের দিকে তাকালেন, ব্যাপারটা খুবই সহজ, তাই না?
অ্যানড্রু বললেন- হ্য, আমার সবকিছু মনে পড়ছে।
ট্যানার পাউলিনের দিকে তাকিয়ে বললেন- এভাবেই শুরু হয়েছিল সবকিছু।
ট্যানার পাউলিনের হাতে হাত রেখে বললেন– আমি আরও তিরিশটা দেশের ওপর গবেষণা শুরু করে দিয়েছি। অচিরেই সেই দেশের সব খবর আমার হাতে আসবে। আমরা আরও বেশি ক্ষমতা ও অর্থ পাব।
পাউলিন আনন্দের সঙ্গে বললেন– আঃ, একটা কম্পিউটার এত কাজ করতে পারে?
–দুটো কম্পিউটার আছে। তোমার জন্য একটা অদ্ভুত জিনিস অপেক্ষা করছে। তুমি কি টামুয়া দ্বীপের নাম শুনেছ? দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে?
না।
–এটা আমরা কিনেছি। ষাট বর্গমাইল, অসাধারণ একটা জায়গা। এটার অবস্থান ফরাসি পলিনিয়েশান দ্বীপপুঞ্জের ওপর। এখানে সুন্দর বিমানবন্দর তৈরি করা হয়েছে। প্রমোদ তরণী ভিড়তে পারে এমন একটা জাহাজ জেটি বানানো হয়েছে। সব কিছু আছে। তারপর একটু থেমে উনি বললেন- এটা হল প্রাইমা-২।
পাউলিন বললেন তার মানে সেখানে আর একটা
ট্যানার হাসছেন– হ্যাঁ, তোমার অনুমান ঠিক। জানি না, কবে এই প্রকল্পটা শুরু হবে। আসলে ওই দুজন নষ্টা মেয়েছেলে আমাদের কষ্ট দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাদের আমরা বাতিল করে দিতে পেরেছি। এবার পৃথিবী আমাদের হাতের মুঠোয় বন্দী হতে চলেছে।
.
৪৩.
কেলি প্রথম চোখ খুললেন তিনি শুয়ে আছেন, একেবারে নগ্ন। কংক্রিট বেসমেন্টের মেঝের ওপর। হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়েছে। চেন দিয়ে বাঁধা। দেওয়ালের সঙ্গে। ছোট্ট জানালা, ঘরের একেবারে কোণে। দেখা গেল, মস্ত বড়ো একটা দরজা।
কেলি ডায়ানার দিকে তাকালেন। ডায়ানাকেও সম্পূর্ণ নগ্নিকা করা হয়েছে। হাতে হাত কড়া পরানো হয়েছে। দেখা গেল, তাদের জামাকাপড় ঘরের এককোণে জড়ো হয়ে পড়ে আছে।
ডায়ানা বললেন আমরা কোথায়?
–আমরা নরকে।
কেলি হাতকড়াটা পরীক্ষা করলেন। শক্ত করে হাতে এঁটে বসে আছে। দাগ পড়ে গেছে। তিনি দু-চার ইঞ্চির বেশি হাত সরাতে পারছেন না। তারপর বললেন- আমরা ওদের ফাঁদে পা দিলাম?
কণ্ঠস্বরে তিক্ততা ঝরে পড়ছে।
-হ্যাঁ, এই ব্যাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগেনি।
কেলি চারপাশে তাকিয়ে বললেন- আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
–ওরা জিতে গেল, ওরা কীভাবে আমাদের স্বামীদের হত্যা করেছে, সেই খবরটা আমরা জেনেছি। ওরা আমাদেরও মেরে ফেলবে। কিন্তু, বিশ্ববাসীর কাছে সব কথা বলতে হবে। কিংসলে ঠিকই বলেছেন, শেষ পর্যন্ত বোধহয় আমরা আর ভাগ্যের সাহায্য পাব না।
-না, গল্পটা এখানে শেষ হয়নি।
দরজা খুলে গেল। হ্যারি ক্লিন্টকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। হ্যারি ফ্লিন্টের মুখে হাসি। সে দরজাটা বন্ধ করল। চাবিটা পকেটে নিল। বলল, আমি তোমাদের ডাই লুকিং বুলেট দিয়ে গুলি করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, তোমাদের মেরেই ফেলব। কিন্তু ভাবলাম, মৃত্যুর আগে একটু মজা করে নিই।
ফ্লিন্ট পায়ে পায়ে সামনে এগিয়ে এল।
দুজন মহিলা চোখে চোখে তাকালেন, হ্যাঁ, ফ্লিন্টকে দেখা যাচ্ছে। শার্ট এবং ট্রাউজার খুলে ফেলছে।
ফ্লিন্ট বলল– দেখো, কীভাবে আমি খেলাটা শুরু করি। সে তার অন্তর্বাসটাও খুলে ফেলল। পুংদণ্ডটা শক্ত এবং খাড়া হয়ে উঠেছে। ফ্লিন্ট তাকিয়ে দেখল, ডায়ানার দিকে এগিয়ে এল।
–এসো বেবি, তোমাকে দিয়েই না-হয় শুরু করা যাক।
কেলি বাধা দিয়ে বললেন- একটু অপেক্ষা করো যুবাপুরুষ। তুমি আমাকেই আক্রমণ করো। আমি অনেক দিন ধরেই তৃষিতা।
ডায়ানা অবাক হয়ে কেলির দিকে তাকিয়ে আছেন–কেলি?
ফ্লিন্ট কেলির দিকে চলে গেল। বলল- ঠিক আছে, তুমি কি এটা ভালোবাসো?
ফ্লিন্ট নীচু হয়ে বসল। কেলির ওপর চড়ে বসার চেষ্টা করল।
কেলি বলল- হা, অনেক দিন আমি এটার স্বাদ পাই নি।
ডায়ানা চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হলেন। না, এই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা তিনি চোখের সামনে দেখতে পারবেন না।
কেলি তার দুটি পা ফাঁক করে দিয়েছেন। ফ্লিন্ট সেখানে পুংদণ্ডটি প্রবেশ করার চেষ্টা করছে।
কেলি ইতিমধ্যে তার ডান হাতটা একটুখানি তুলেছেন। কোনো রকমে মাথার পরচুলাটা নামিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। হাতটা নেমে এল। দেখা গেল, একটা তীক্ষ্ণ কাটা যুক্ত চিরুনি, তার সাথে ইস্পাতের পিন যুক্ত হয়েছে। অত্যন্ত দ্রুত উনি সেই ইস্পাতের পিন ঢুকিয়ে দিলেন হ্যারি ফ্লিন্টের গলার ভেতর। হ্যাঁ, রক্ত ছুটে আসছে।
ফ্লিন্ট চিৎকার করার চেষ্টা করেছিল। না, গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ বেরিয়ে এল। হুড়মুড় করে রক্ত বেরোচ্ছে। ডায়ানা অবাক হয়ে গেছেন। কোনো মতে চোখ খুললেন।
কেলি ডায়ানার দিকে তাকিয়ে আছেন- ডায়ানা। তুমি এখন আরাম করতে পারো।
তারপর? কেলির মুখে হাসি। লোকটা মরে গেছে।
ডায়ানার হৃৎপিণ্ড জোরে শব্দ করতে শুরু করেছে। হ্যাঁ, উনি বোধহয় আর বেঁচে থাকতে পারবেন না। চোখ মুখের রং পাল্টে গেছে। ভৌতিক অপচ্ছায়া।
কেলি বললেন- তুমি ঠিক আছে।
–আমি ভেবেছিলাম, ও বোধহয় তোমাকে…
কথা বন্ধ হয়ে গেছে। এক মুহূর্ত হ্যারি ফ্লিন্টের রক্তাক্ত মৃতদেহের দিকে তাকালেন। ভয়ে কাঁপছেন।
–এই কথাটা তুমি আমায় আগে বলোনি কেন?
হ্যাঁ, মাথার ভেতর অমন একটা অস্ত্র লুকানো ছিল।
–আসলে এটাকে যে কাজে লাগাতে হবে, আমি ভাবতেই পারিনি, আমি তোমাকে ভয় দেখাতে চাইনি। এসো, এখান থেকে বেরোতে হবে তো।
-কী করে?
–আমি পথটা বলব।
কেলি পা বাড়িয়ে দিলেন। ফ্লিন্টের প্যান্টটা সেখানে পড়েছিল। কোনোরকমে পায়ের আঙুল টাউজার অব্দি পৌঁছে গেল। না, আরও দু-ইঞ্চি যেতে হবে। আর একটু আর একটু। এক ইঞ্চি শেষ পর্যন্ত সফলতা।
কেলির মনে আনন্দ। তিনি কোনোভাবে ট্রাউজারটাকে সামনের দিকে টানতে শুরু করলেন। হ্যাঁ, হাত দিয়ে ধরা যাচ্ছে, পকেটে হাত দিলেন। চাবিটা কোথায়? যে চাবি দিয়ে হাত কড়া ভোলা যাবে। চাবিটা পাওয়া গেল। একটু পরে হাত দুটো মুক্ত হয়েছে। উনি দ্রুত ডায়ানার কাছে চলে গেলেন।
হায় ঈশ্বর, তুমি তো অলৌকিক ঘটনা ঘটালে? ডায়ানা বললেন।
–হ্যাঁ, আমার নতুন পরচুলাটাকে স্বাগত বলতেই হবে। এবার এখান থেকে পালাতে হবে।
তারা কাপড় তুলে নিলেন। তাড়াতাড়ি পরে নিলেন। কেলি দরজাটা খুলে দিলেন। ফ্লিন্টের পকেট থেকে চাবিটা ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে।
তারা দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। চারপাশে নীরবতা। না, ফাঁকা করিডর।
–পেছন দিকে নিশ্চয়ই কোনো রাস্তা আছে। ডায়ানা বললেন।
কেলি মাথা নাড়লেন– ঠিক আছে, তুমি ওই দিকে যাও, আমি অন্যদিকে যাব।
–না কেলি, আমরা আর কোনোদিন আলাদা হব না।
কেলি ডায়ানার হাতে হাত রেখে বললেন– হ্যাঁ, আমরা তো এখন অংশীদার।
.
কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে। দুজন মহিলা গ্যারেজে এসে পৌঁছে গেছেন। একটা জাগুয়ার, আর একটা টয়েটো গাড়ি আছে।
–কোন গাড়িটা নেবে? কেলি জানতে চাইলেন।
জাগুয়ারটাতে চড়লে সবাই দেখতে পারে। আমরা টয়েটো নেব।
–আমার মনে হয় চাবিটা আছে।
–হ্যাঁ, ছিল। ডায়ানা তাকালেন।
–আমরা কোথায় যাব? কেলি জিজ্ঞাসা করলেন।
–ম্যানহাট্টানে, এখনও পর্যন্ত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঠিক করতে পারিনি।
–খবরটা ভালই, কেলি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
–একটা জায়গায় গিয়ে ঘুমোতে হবে। কিংসলের কাছে এই খবরটা পৌঁছে যাবে। উনি নিশ্চয়ই আমাদের খোঁজার জন্য পাগল হয়ে উঠবেন। কোথায় থাকা যায় বলো তো?
কেলি চিন্তা করছেন– একটা ভালো ব্যাপার ভাবতেই হবে।
ডায়ানা তাকিয়ে আছেন কী ব্যাপার?
কেলি বললেন আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা এসেছে।
.
৪৪.
তারা হোয়াইট টাওয়ারের দিকে চলেছেন। ম্যানহাট্টান থেকে পঁচিশ মাইল উত্তরে।
ডায়ানা বললেন- হ্যাঁ, শহরটা সুন্দর। এখন আমরা কী করব?
–এখানে আমার এক বন্ধু আছে। তিনি আমাদের দায়িত্ব নিতে পারবেন।
–ওনার সম্পর্কে সব কথা বলো।
কেলি বললেন আমার মায়ের সাথে এক মাতালের বিয়ে হয়েছিল। মাতাল বাবা মাকে মেরে আনন্দ পেত। আমি যখন নিজের পায়ে দাঁড়ালাম, মায়ের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম, আমি ভেবেছিলাম, মাকে বলব ওই লোকটাকে ডির্ভোস দিতে। আমার এক মডেলের বন্ধু এই জায়গাটার কথা বলেছিল। এখানে একটা বোর্ডিং হাউস আছে। গ্রেস সাইডাল নামে এক ভদ্রমহিলা সেই বোর্ডিং হাউসটা চালিয়ে থাকেন। তিনি খুবই ভালো স্বভাবের। আমি আমার মাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর একটা অ্যাপার্টমেন্ট পেয়েছিলাম। প্রত্যেকদিন আমি গ্রেসের বোর্ডিং হাউসে আসতাম। মাও জায়গাটাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। কারণ এখানে তার মতো হতভাগিনীরাই বোর্ডার হিসেবে ছিল। আমি শেষ পর্যন্ত মায়ের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে পাই।
কথা বলা শেষ হয়ে গেছে।
ডায়ানা জানতে চাইলেন– তারপর কী হয়েছিল?
–মা আবার তার স্বামীর কাছে ফিরে গিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত ওঁরা বোর্ডিং হাউসে পৌঁছে গেছেন।
.
গ্রেস সাইডালের বয়স বছর পঞ্চাশ। এখনও উত্তেজনা এবং কর্মশক্তিতে টগবগ করে ফুটছেন। তিনি দরজা খুলে দিলেন। কেলিকে দেখে তার মুখে আলোর উদ্ভাস।
কেলি? তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন। তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে।
কেলি বললেন– ইনি আমার বন্ধু, ডায়ানা।
তারা পরস্পরকে হ্যালো বললেন।
এই ঘরটা তোমাদের জন্য রেডি। গ্রেস বললেন, সত্যি কথা বলতে কি, এটা হল তোমার মায়ের ঘর। আমি একটা অতিরিক্ত শয্যা পাতার ব্যবস্থা করছি।
গ্রেস সাইডাল বেডরুমের দিকে হেঁটে গেলেন। তারা একটা সুন্দর লিভিং রুমে এসে পৌঁছে গেছেন। দেখলেন, আরও অনেক মহিলা বসে বসে তাস খেলছেন। কেউ আবার অন্যান্য খেলাতেও মন দিয়েছেন।
গ্রেস জানতে চাইলেন- তোমরা এখানে কতদিন থাকবে?
কেলি এবং ডায়ানা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বললেন– ঠিক বলতে পারছি না।
গ্রেস সাইডাল হেসে বললেন- কোনো সমস্যা নেই। যতদিন খুশি থাকতে পারো।
ঘরটা সত্যি সাজানো এবং পরিষ্কার।
গ্রেস সাইডাল চলে গেলেন। কেলি ডায়ানাকে বললেন- এখানে আমরা নিরাপদে থাকতে পারব। আমি ভাবছি, একটা কথা। আমাদের নাম বোধহয় গিনেস বুকে উঠে যাবে। তুমি ভাবতে পারছ, ওরা কতবার আমাদের হত্যার চেষ্টা করেছে।
–হ্যাঁ, ডায়ানা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন।
কেলি শুনতে পেলেন ডায়ানা বলছেন- রিচার্ড, তোমাকে ধন্যবাদ।
কেলি কথা বলার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু ভাবলেন, কথা বলে কোনো লাভ নেই।
.
অ্যানড্রু ডেস্কে বসে আছেন। অনেক স্বপ্ন দেখছেন। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে থাকার স্বপ্ন-হা, যে শব্দগুলো তার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল…হ্যাঁ, আমি শেষ পর্যন্ত এটা আবিষ্কার করতে পেরেছি। হ্যাঁ, অ্যানড্রুকে বাঁচিয়ে রাখার উপায়। আমার মনে হচ্ছে, এটা এখনই দেখাতে হবে।
হ্যাঁ, আমি কীভাবে বেঁচে থাকব?
একজন ডায়ানাকে নিয়ে একদিকে চলে গেছেন। মুখে গ্যাসের মুখোশ পরা।
–আমি এই মুখোশের ওপর একটা ছোট্ট ফুটো করে দেব। বাইরে থেকে কিছু মনে হবে না। তা হলেই যথেষ্ট হবে।
বিছানা থেকে আনডু সব কিছু দেখলেন থেকে অ্যানড্রু সব কিছু দেখলেন। ট্যানার ওই মুখোশটা নিয়ে একটা ঘরে চলে গেলেন। সেখানে অনেকগুলো বালিশের ওয়াড় পড়ে আছে। মুখোশটা সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হল।
তারপর? ট্যানার ভাবলেন, ভাইকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করবেন। কিন্তু ভীষণ-ভীষণ ক্লান্তি লাগছে তার। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
.
ট্যানার, অ্যানড্রু এবং পাউলিন ট্যানারের অফিসে ফিরে এসেছেন।
ট্যানার তাঁর সেক্রেটারিকে বললেন– সকালের কাগজগুলো নিয়ে আসতে।
ট্যানার প্রথম পাতাগুলো পড়লেন- দেখো, দেখো গুয়াতেমালাতে প্রচণ্ড ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে। পেরু, মেস্কিকো এবং ইতালিতেও ঝড় শুরু হয়েছে।
পাউলিনের দিকে তাকিয়ে উত্তেজনা ভরা অভিব্যক্তিতে তিনি বললেন- হ্যাঁ, এটা তো শেষের শুরু। এই কদিনে প্রকৃতি আরও বিপর্যস্ত হবে।
কারবালো ঘরে ঢুকে পড়েছে– মিঃ কিংসলে?
–আমি এখন খুব ব্যস্ত। কী হয়েছে?
–ফ্লিন্ট মরে গেছে।
ট্যানার লাফিয়ে উঠলেন– সে কী? তুমি কী বলছ? কী হয়েছে?
–স্টিভেন্স এবং হ্যারিস ওকে মেরে ফেলেছে।
–এটা অসম্ভব।
হা, ও মরে গেছে। ওরা পালিয়ে গেছে। সেনেটরের গাড়িটা নিয়ে গেছে। আমরা পুলিশে জানিয়েছি। পুলিশ গাড়িটাকে হোয়াইট টাওয়ারে পেয়েছে।
ট্যানারের কণ্ঠস্বর গম্ভীর আমি ভাবতেই পারছি না। তোমরা এখনই হোয়াইটটাওয়ারে চলে যাও। সঙ্গে দশ বারোজনকে নিয়ে যাবে। প্রত্যেকটা হোটেল দেখবে, বোর্ডিং হাউস, শপ হাউস। ওরা কোথায় লুকিয়ে থাকবে? আমি তোমাদের পঞ্চাশ লক্ষ ডলার পুরস্কার দেব। তাড়াতাড়ি।
-হ্যাঁ, যাচ্ছি স্যার।
কারবালো দরজা দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
.
গ্রেস সাইডালের বোর্ডিং হাউস। ডায়ানা এবং কেলি বসে আলোচনা করছেন।
ডায়ানা বললেন প্যারিসের ঘটনাটার জন্য আমি দুঃখিত। সত্যি কী হয়েছে বলে
–আমি জানি না, ওই পরিবার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
–তোমার পোষা কুকুর অ্যাঞ্জেল?
–ওর বিষয় নিয়ে আমি আর কথা বলতে চাইছি না।
–আমি দুঃখিত। ব্যাপারটা সত্যি হতাশাব্যঞ্জক। কী ঘটছে কিছুই মাথায় আসছে না। কে আই জি-র লড়াইতে আমরা কী জিততে পারব? সারা পৃথিবীতে আমরা বড় একা।
কেলি মাথা নাড়লেন– তুমি ঠিকই বলেছ। ভবিষ্যতে কী হবে, কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
এক মুহূর্তের নীরবতা।
ডায়ানা বললেন- হ্যাঁ, এবার ভাবতে হবে।
.
কারবালের লোকেরা শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যেকটা হোটেলে গিয়ে তারা খাতাপত্র পরীক্ষা করছে। বোর্ডিং হাউস বাদ দিচ্ছে না। তাদের হাতে ডায়ানা আর কেলির ছবি আছে। তোরা এসপ্ল্যান হোটেলে পৌঁছে গেল। ক্লার্কের কাছে ছবি দুটো এনে দেখানো হল।
–এই দুজন ভদ্রমহিলার কাউকে দেখেছেন কি? ধরাতে পারলে পঞ্চাশ লক্ষ ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে।
ক্লার্ক মাথা নাড়লেন না, আমি দেখিনি।
রেনেসাঁ হোটেল একই প্রশ্ন। পঞ্চাশ লক্ষ? আঃ, যদি পেতাম।
ক্রাউন প্লাজা ক্লার্ক বলছে, যদি পেতাম, তাহলে নিশ্চয়ই বলতাম।
লিনসে কারবালো গ্রেস সাইডালের বোর্ডিং হাউসে গিয়ে পৌঁছেছে।
সুপ্রভাত। আমার নাম কারবালো। সে দুই মহিলার ছবি দেখাল। এই দুজনকে চেনেন কী? পঞ্চাশ লক্ষ ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে।
গ্রেস সাইডালের মুখ উজ্জ্বল আলোয় দীপ্তিমান হা, কেলি!
.
ট্যানারের অফিস, ক্যাথি অরডোনেট খুবই খুশি। নানা জায়গা থেকে ফ্যাক্স আসছে। এত বেশি সংখ্যায় যে বেচারী তা পরিচালনা করতেই পারছে না। ই-মেল ভরতি হয়ে গেছে। সে অনেকগুলো কাগজ নিয়ে ট্যানারের অফিসে ঢুকে পড়ল। ট্যানার এবং পাউলিন ভ্যান রুবেন একটা কৌচে বসে কথা বলছিলেন।
ট্যানার তার দিকে তাকিয়ে বললেন– কী আছে?
মেয়েটি হেসে বলল- ভালো খবর। আমরা একটা ডিনার পার্টির আয়োজন করব।
–কেন? কী হয়েছে?
হাতের কাগজগুলো ধরে সে বলল– সকলেই আসতে চাইছে। সকলেই হ্যাঁ বলেছে।
-কোথায় আসছে? আমাকে দেখতে দিন।
ক্যাথি কাগজগুলো ট্যানারের হাতে তুলে দিল।
ট্যানার প্রথম ই-মেলটা চিৎকার করে পড়লেন– আমরা কে আই জি-র হেডকোয়ার্টারে শুক্রবার আসছি, ডিনারের আসরে। প্রাইমার সঙ্গে পরিচিত হব। দেখব, কীভাবে আপনি সারা বিশ্বের আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চলেছেন? তলায় লেখা আছে টাইমস পত্রিকার সম্পাদক।
ট্যানারের মুখ সাদা। তিনি পরবর্তী ই-মেলটার দিকে তাকালেন– আপনি প্রাইমার সঙ্গে কথা বলার জন্য যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তার জন্য ধন্যবাদ। হ্যাঁ, কে আই জি-র হেডকোয়ার্টারে ওই আবহাওয়া নিয়ন্ত্রক কম্পিউটারটি দেখার জন্য আমরা উদগ্রীব হয়ে আছি। তলায় লেখা আছে নিস উইকের সম্পাদক।
একটির পর একটি চিঠি আর ই-মেল, সি বি এস, এম বি সি, সি এন এন, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, চিকাগো ট্রিবিউন, সকলেই– সকলেই প্রাইমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছেন।
পাউলিন বসে আছেন, কথা বলতে পারছেন না।
ট্যানার ভীষণ রেগে গেছেন, তিনি বললেন- এ সব কী হচ্ছে?
.
ইন্টারনেট কাফে, ডায়ানা কম্পিউটারের ওপর কাজ করে চলেছেন। তিনি কেলির দিকে তাকিয়ে বললেন- আর কিছু বাকি রইল কি?
কেলি বললেন–হ্যাঁ, অনেকগুলো বাকি আছে। ভ্যানিটি ফেয়ার, মাদমোজায়েল, ডিনার রাইজেস।
ডায়ানা হাসছেন– না, ইতিমধ্যেই কিংসলের পেট ভরে গেছে। বেশি দিলে বোধহয় বদহজম হবে।
.
কারবালো, গ্রেস সাইডালের দিকে তাকালেন- আপনি কেলিকে চেনেন?
–হ্যাঁ, সে হল বিশ্বের অন্যতম সেরা মডেল।
কারবালোর মুখ উজ্জ্বল সে এখন কোথায়?
গ্রেস তাকালেন। আমি তো তার সাথে কোনোদিন যোগযোগ করতে পারিনি। তবে তাকে দেখার খুব ইচ্ছে আছে আমার।
কারবালোর মুখ লাল- এই যে বললেন, আপনি তাকে চেনেন?
-হ্যাঁ, আমি কেন, সবাই তাকে চেনে। সে হল এক সুন্দরী রূপসী যুবতী। কী তোমাকে জিজ্ঞাসা করলে, তুমিও তো একই উত্তর দেবে, তাই না?
–কোথায় সে থাকতে পারে, কোনো ধারণা আছে?
গ্রেস চিন্তা করে বললেন- না, আমার কোন ধারণা নেই। তবে একটা কথা বলতে পারি
-কী কথা?
-আজ সকালে তার মতো দেখতে এক মহিলাকে এখান থেকে বাসে উঠতে দেখেছি। তার সঙ্গে আর একজন মহিলা ছিল।
–কোথায় যেতে পারে?
বাসটা ভারমন্টের দিকে যাচ্ছে।
ধন্যবাদ, কারবালো অত্যন্ত দ্রুত বেরিয়ে গেল।
.
ট্যানার সমস্ত ফ্যাক্সগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। পাউলিনের দিকে তাকিয়ে বললেন কী শুরু হয়েছে বলে তো? কুকুরীর বাচ্চাদুটো আমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। প্রাইমার সাথে কাউকে পরিচয় করাব কী করে?
অনেকক্ষণ চিন্তা করে তিনি আবার বললেন আমার মনে হচ্ছে, প্রাইমাকে মেরে ফেলতে হবে। পার্টি শুরু হবার একদিন আগে। বোমা বিস্ফোরণ করে।
পাউলিন তাকালেন, তারপর হাসলেন- প্রাইমা-২?
ট্যানার মাথা নাড়ছেন ঠিকই বলেছ। আমরা সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াব। আমরা শেষ পর্যন্ত টামুয়াতে গিয়ে দ্বিতীয় প্রাইমার জন্ম দেব।
ক্যাথি অরডোনেটের কণ্ঠস্বর ভেসে এল ইন্টারকমে। সে অত্যন্ত ভয় পেয়েছে। সে ট্যানারের অফিসের ফোন বাজিয়ে বলল– মিঃ কিংসলে, ফোন বেজেই চলেছে। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পাস্ট, ল্যারি কিং, সকলে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।
–ওদের বলে দাও, আমি এখন মিটিং-এ বসে আছি। ট্যানার পাউলিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখান থেকে পালাতে হবে।
উনি অ্যানড্রুর পিঠে হাত রেখে বললেন- অ্যানড্রু, তুমি আমার সঙ্গে এসো।
–হ্যাঁ, ট্যানার, যাব। তোমাকে আমি সবরকমের সাহায্য করব।
.
ওঁরা তিনজন ইটের বাড়ির বাইরে এলেন। প্রাইমার সঙ্গে এখনই দেখা করতে হবে। ট্যানার অ্যানড্রুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ওপর একটা দায়িত্ব দেওয়া হল। রাজকুমারি এবং আমি এখনই চলে যাচ্ছি। কিন্তু ছটার সময় তুমি এই কম্পিউটারটা বন্ধ করে দেবে। ব্যাপারটা খুবই সহজ। তুমি এই বিরাট লাল বোতামটা দেখতে পাচ্ছো তো?
অ্যানড্রু মাথা নেড়ে বললেন- হ্যাঁ তোমার সঙ্গে পরে দেখা হবে।
ট্যানার এবং পাউলিন বেরিয়ে গেলেন।
অ্যানড্রু তাকিয়ে থাকলেন- তোমরা আমাকে সঙ্গে নেবে না?
না, তুমি এখানেই থাকবে। মনে রেখো, ছটার সময় তিনবার বোতাম টিপতে হবে।
–আমি মনে রাখব।
ওনারা বাইরে এলেন।
পাউলিন জিজ্ঞাসা করলেন, যদি ও মনে না রাখে কী হবে?
ট্যানার হাসছেন– কিছুই হবে না। ঠিক সময়ে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটবে। আমি একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইছি, অ্যানড্রু যেন বিস্ফোরণের সময় ঘরের মধ্যে থাকে।
.
৪৫.
কে আই জি-র ৭৫৭, প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে। আকাশ ঝকঝকে নীল। কালো মেঘের চিহ্ন মাত্র নেই। পাউলিন এবং ট্যানার দুজনে মেন কেবিনের একটা কৌচে বসে আছেন।
পাউলিন বললেন- ডার্লিং, তুমি কত বুদ্ধিমান, কেউ তা জানতেই পারল না।
-হ্যাঁ, কিন্তু আমি আমার বুদ্ধিমত্তার কথা কী করে বলব বলল তো? তাহলে তো আমাকে দারুণ সমস্যার মুখে দাঁড়াতে হবে।
পাউলিন তাকালেন কোনো সমস্যা নয়। আমরা একটা দেশকে কিনে নেব। সেখানে আমরাই শাসন করব। তাহলে ওরা কেউ আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না।
ট্যানার হাসলেন। পাউলিন হাতে হাত রেখে বললেন- তোমার কাছে আমি কী দেখেছিলাম বলো তো? তোমার চরিত্রের এমন কী, যা আমাকে আকর্ষণ করেছিল?
না, আমার যতদূর মনে পড়ছে, তুমি আমায় দেখে খুবই অশান্ত হয়ে উঠেছিলে।
–হ্যাঁ, তোমার মধ্যে একটা উদ্যম আছে, সেটাই আমাকে স্পর্শ করেছিল।
তারপর? দীর্ঘ প্রতীক্ষিত আকাঙ্খী চুম্বন।
দূরে আকাশের বুকে বজ্রপাত।
ট্যানার বললেন আমরা টামুয়ায় চলেছি। আমি কথা দিচ্ছি পাউলিন, এ জায়গাটা তোমার ভালো লাগবে। আমরা এক কিংবা দু-সপ্তাহ সেখানে থাকব। কোনো কিছু ভাবব না। তারপর সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করব। যেসব বছরগুলো হারিয়ে গেছে, সেগুলোকে ফিরে পাবার চেষ্টা করব।
পাউলিন তাকালেন- হ্যাঁ, আমি কথা দিচ্ছি, সেই বছরগুলো আমি ফিরিয়ে দেব।
-হ্যাঁ, প্রত্যেক মাসে আমরা টামুয়াতে ফিরে আসব। ইতিমধ্যে দু-নম্বর প্রাইমা কাজ করতে শুরু করবে। তুমি আর আমি আমাদের সম্ভাব্য জায়গাগুলোকে তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেলল।
পাউলিন বললেন- আমরা ইংল্যান্ডে ঝড় তৈরি করব। কিন্তু ওরা বুঝতেও পারবে না।
ট্যানারের মুখে চওড়া হাসি- সমস্ত পৃথিবীটা আমাদের পায়ের তলায় এসে যাবে।
একজন স্টুয়ার্ট বললেন– স্যার, আপনাকে কিছু দেব কি?
ট্যানার বললেন- না, আমাদের সবকিছু আছে।
না, এই কথার মধ্যে কোনো মিথ্যে নেই। দূর আকাশে আবার বজ্রপাত।
–মনে হচ্ছে, ঝড় হবে। পাউলিন বললেন, খারাপ আবহাওয়ার মধে আকাশ ভ্রমণ করতে আমার মোটেই ভালো লাগে না।
ট্যানার বললেন- ভয় পেও না ডার্লিং। আকাশে কোনো মেঘ নেই।
তিনি অন্য কিছু চিন্তা করছেন। ভাবছেন, না, আমরা কেন আবহাওয়া নিয়ে এত চিন্তা করছি। তাকে তো আমরা নিয়ন্ত্রন করছি।
তিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন- হ্যাঁ, আর একটু বাদে প্রাইমার শেষ সংকেত সূচিত হবে।
হঠাৎ বৃষ্টি পড়তে শুরু হল। বেশ বড়ো বড়ো ফোঁটায়।
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। ঠিক আছে, কয়েক ফোঁটা মাত্র বৃষ্টি।
ট্যানার বলার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ কালো মেঘে সমাচ্ছন্ন হল। বারবার বজ্রপাতের আর্তনাদ। প্লেনটা একবার ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে, অসহায়ের মতো নীচের দিকে নেমে আসছে। ট্যানার জানালা দিয়ে তাকাবার চেষ্টা করলেন– বাইরে কী ঘটছে, সেটা বুঝতে পারছেন না। হ্যাঁ, এবার বড় বড় শিলা পড়তে শুরু করেছে।
ট্যানার বললেন- দেখো, দেখো, প্রাইমা? কোথায়? আমরা…
এক মুহূর্ত কেটে গেছে। প্রচণ্ড হ্যারিকেন আছড়ে পড়েছে প্লেনটার ওপরে। তাকে নিয়ে ছেলে খেলা করছে।
ভয়ে পাউলিন চিৎকার করতে শুরু করলেন।
.
লাল ইটের তৈরি ওই বাড়িটা। অ্যানড্রু কিংসলে প্রাইমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তার আঙুলগুলো চাবির ওপর খেলা করছে। হ্যাঁ, প্রতিভাধর সব কিছু ভুলে যান, কিন্তু স্মৃতি থেকে যায়। তিনি স্ক্রিনের দিকে তাকাচ্ছেন- হ্যাঁ, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ভাইয়ের প্লেনটা আকাশে উড়ছে, আবার ছুটে আসছে। ৩৫০ কিমি. বেগে।
তিনি আর একটা বোম টিপে দিলেন।
.
ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস অফিসে গোলমাল বেঁধে গেছে। আলাস্কা থেকে মিয়ামি, ফ্লোরিডা সব জায়গাতেই এক উত্তেজনা। আবহাওয়াবিদরা অবাক চোখে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী ঘটছে একটু বুঝতে পারা যাচ্ছে না। কিন্তু ঘটছে, এটা তো সত্যি।
.
লাল ইটের ওই বাড়িটা, অ্যানড্রু নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। আহা, এ সুন্দর একটা জায়গা। হ্যাঁ, শেষ অব্দি তৈরি হয়েছে, টরনেড়ো, আরও আরও উঁচুতে… সারা পৃথিবী তা পরিব্যপ্ত করবে।
ট্যানার তখনও ওই জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছেন। প্লেনটা অসহায়ভাবে দুলছে। যে কোনো মুহর্তে পড়ে যেতে পারে। এসে পড়েছে-এসে পড়েছে, ঘণ্টায় ৩২০ মাইল বেগে ছুটে আসা ওই শয়তান ঝড়। ট্যানারের মুখে আর্তনাদ, ভয় এবং উত্তেজনায় তিনি ঠকঠক করে কাঁপছেন। এই তো, এই তো ওই দৈত্য।
তিনি চিৎকার করলেন দেখো, এত উঁচুতে কখনও টরনেড্ডা তৈরি হয় না। আমি এটা তৈরি করেছি। এটা একটা অলৌকিক ঘটনা। একমাত্র ঈশ্বর– বোধহয় আমাদের বাঁচাতে পারেন।
.
লাল ইটের ওই বাড়িটা। অ্যানড্রু আর একটা সুইচে হাত দিলেন। দেখতে পেলেন স্ক্রিনের ওপর, প্লেনটায় বিস্ফোরণ ঘটে গেল। টুকরো টুকরো বস্তুগুলো চারপাশে ছিটকে পড়ছে। হ্যাঁ, খণ্ড-বিখণ্ড মৃতদেহ।
অ্যানড্রু কিংসলে লাল বোতামটা তিনবার টিপে দিলেন।
.
৪৬.
কেলি এবং ডায়ানা পোশাক পরে নিলেন। গ্রেস সাইডাল দরজায় হাত রেখে বললেন ব্রেকফাস্ট তৈরি হয়েছে।
–আসছি, কেলি বললেন।
ডায়ানা বললেন– এই ব্যাপারটা বোধহয় কাজ দেবে। দেখা যাক গ্রেসের কাছে আজ সকালের খবরের কাগজ আছে কিনা।
তারা বাইরে এলেন। এখানে বিনোদনের আসর। কয়েকজন বসে আছেন টেলিভিশনের সামনে। কেলি এবং ডায়ানা সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। ডাইনিং রুমের দিকে। হঠাৎ একটা কথা শুনে তারা থমকে গেলেন।
…এই মাত্র সংবাদ পাওয়া গেল, ট্যানার কিংসলে এবং প্রাক্তন সেনেটর পাউলিন ভ্যান রুবেনের মৃত্যু হয়েছে। তারা প্লেনে ছিলেন। পাইলট, কোপাইলট এবং স্টুয়ার্টের মৃত্যু হয়েছে।
দুই ভদ্রমহিলা ভয়ে আতঙ্কে নিশ্চুপ। তারা পরস্পরের দিকে তাকালেন। তারপর টেলিভিশন সেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। স্ক্রিনের ওপর কে আই জি-র বাড়ির ছবি তুলে ধরা হয়েছে।
বলা হচ্ছে… কিংসলে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপকে আমরা বিশ্বের সবথেকে বড়ো সংস্থা বলতে পারি। তিরিশটি দেশে এই সংস্থার অফিস আছে। আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অভাবিত ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই অঞ্চল দিয়ে ট্যানার কিংসলের ব্যক্তিগত প্লেনটা উড়ছিল। পাউলিন ভ্যানরুবেন হলেন সেনেট কমিটির প্রাক্তন প্রধান। এই কমিটি পরিবেশ বিষয়ে আলোচনা করে থাকে।
ডায়ানা এবং কেলি তখনও শুনছেন, উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছেন।
…আর একটা বিষয় আমাদের অবাক করে দিয়েছে, পুলিশ সেই রহস্যটা সমাধান করতে পারছে না। প্রেসকে ডাকা হয়েছিল প্রাইমার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য। প্রাইমা হল কে আই জি-র একটা নতুন কম্পিউটার। এই কম্পিউটারের সাহায্যে আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। কিন্তু গতকাল কে আই জি-তে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। প্রাইমার একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। দমকলের লোকেরা অ্যানড্রু কিংসলের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহ খুঁজে পেয়েছে। এই ঘটনায় একমাত্র উনি মারা গেছেন।
ডায়ানা বললেন- ট্যানার কিংসলে মারা গেছেন।
-আবার, আবার বলো? আস্তে আস্তে।
ট্যানার কিংসলে আর বেঁচে নেই।
কেলি নিঃশ্বাস ফেললেন- হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত আমরা বিপদমুক্ত হতে পেরেছি। তিনি ডায়ানার দিকে তাকিয়ে বললেন,- জীবনটা এখন বোধহয় আর আগের মতো খারাপ হবে না।
ডায়ানা বললেন আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমরা আজ রাত্রিরে কোথায় থাকব? ওয়ালড্রপ অ্যাসটোরিয়া টাওয়ারসে শোবো কি?
কেলি বললেন- হ্যাঁ, আমি কিছু মনে করব না।
তারা গ্রেস সাইডালকে বললেন গুডবাই।
গ্রেস জিজ্ঞাসা করলেন কেলি, তুমি আবার আসবে তো?
কেলি জানে না, ভবিষ্যতে আর কখনও এখানে আসা হবে কিনা।
.
ওয়ালড্রপ টাওয়ারস-এর প্রেসিডেনসিয়াল স্যুইট। একজন ওয়েটার টেবিলে এসে দাঁড়িয়েছে। সে ডায়ানার দিকে তাকিয়ে বলল- কখন আপনাদের খাবার দেব?
–ঠিক সময়ে, কেমন?
কেলি তাকিয়ে আছেন, তিনি কোনো কথা বলছেন না। তারা চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
ডায়ানা বললেন আমি ভাবতে পারছি না, কী করে এই ঘটনাটা ঘটল।
গ্লাসে ভরতি শ্যামস্পেন, পাশে কেউ যেন বসে আছে, এমন ভঙ্গিতে ডায়ানা বললেন রিচার্ড, এখনও তোমাকে আমি ভালোবাসি।
ঠোঁটে গ্লাস তুলে নেওয়া হল।
কেলি বললেন- এক মুহূর্ত অপেক্ষা করো।
ডায়ানা তাকালেন।
কেলি পাশের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে বললেন- মার্ক, তোমাকে আমি এখনও ভালোবাসি।
তারপর? তারপর কেলি জানতে চাইলেন, এবার আমরা কী করব?
ডায়ানা বললেন আমি ওয়াশিংটনে যাব। ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের অফিসে। সেখানে গিয়ে বলব, আমি কী কী জানি।
কেলি বললেন– না, আমরা দুজনে একসঙ্গে ওয়াশিংটনে যাব। বলব, আমরা কী জানি।
ডায়ানা বললেন ঠিক আছে। তিনি চিন্তা করে বললেন। আমরা একটা ভালো কাজ করেছি। হ্যাঁ, আমাদের মৃত স্বামীরা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে।
কেলি বললেন- হ্যাঁ, সমস্যাটা সমাধান করা হয়েছে। আমরা এখন কী করব?
কী?
–আমরা একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলব।
ডায়ানা হাসলেন– তুমি কি ঠাট্টা করছ?
কেলি বললেন- না, আমার কথা শুনে কি তাই মনে হচ্ছে?
.
ডিনার শেষ হয়ে গেছে। তারা টেলিভিশন দেখছেন। প্রত্যেকটা চ্যানেলে ট্যানার কিংসলের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। কেলি দেখছেন, তিনি চিন্তা করছেন একটা প্রবাদ বাক্য। যখন তুমি সাপের মাথা কেটে দেবে, সাপটা মরে যাবে।
এই প্রবাদ বাক্যটা শুনে ডায়ানা জানতে চাইলেন- কী হয়েছে?
কেলি বললেন- ব্যাপারটা দেখা যাক। আমি এখনই প্যারিসে ফোন করতে চাইছি। পাঁচ মিনিট কেটে গেছে। নিকোলে পারাডেসের কণ্ঠস্বর– কেলি! কেলি। তোমার ফোন পেয়ে আমরা খুশি হয়েছি।
কেলির হৃৎপিণ্ড বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন উনি কী করবেন? ওরা কি অ্যাঞ্জেলকে মেরে ফেলেছে?
কীভাবে তোমার কাছে পৌঁছোব?
আপনি কি খবরটা শুনেছেন?
-হ্যাঁ, সারা পৃথিবী খবরটা জানে। জেরোমে মালো এবং আলফানসো এখান থেকে চলে গেছে।
–ফিলিপ্পে এবং তার পরিবার?
–তারা কালকে আসছেন।
ব্যাপারটা সুন্দর।
কেলি পরবর্তী প্রশ্ন করতে গিয়ে থমকে গেলেন। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করলেন অ্যাঞ্জেল?
–অ্যাঞ্জেল আমার অ্যাপার্টমেন্টে আছে। তুমি যদি সাহায্য না করতে, তাহলে ওরা অ্যাঞ্জেলকে মেরে ফেলত।
কেলি আনন্দমুখর কণ্ঠস্বরে বললেন– খবরটা শুনে ভালো লাগছে।
এবার কী করতে হবে বলো?
-ওকে এয়ার ফ্রান্সের ফ্লাইটে তুলে দিন, যে ফ্লাইটটা নিউইয়র্কে আসবে। আমি ওকে তুলে নেব। তারপর? ইচ্ছে হলে আমাকে ওয়ালড্রপ টাওয়ারসে ফোন করুন।
–আমি তোমার কথা মতো কাজ করব।
–অনেক ধন্যবাদ। কেলি রিসিভার নামিয়ে দিলেন।
ডায়ানা জানতে চাইলেন অ্যাঞ্জেল ঠিক আছে?
–হ্যাঁ।
–আমার ভালো লাগছে।
হ্যাঁ, আমার খুব ভালো লাগছে। তুমি টাকাটা নিয়ে কী করবে?
ডায়ানা অবাক কী টাকা?
-কে আই জি পঞ্চাশ লক্ষ ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করেছে। সেটা নিশ্চয়ই আমাদের হাতে আসবে।
–কিন্তু কিংসলে মারা গেছেন।
–তাকে কী? কে আই জি তো বেঁচে আছে।
ওঁরা হাসলেন।
কেলি জানতে চাইলেন– ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে তুমি কী করতে চাইছ? তুমি কি আবার আঁকাআঁকি শুরু করবে?
ডায়ানা বললেন না।
-সত্যি?
–হ্যাঁ, একটা মাত্র ছবি আমাকে আঁকতে হবে। সেন্ট্রাল পার্কের ভেতর।
তার কণ্ঠস্বর ভেঙে গেল দুজন প্রেমিক প্রেমিকা সেখানে গিয়েছিল, বৃষ্টির মধ্যে পিকনিক করতে। তারপর? আমি দেখছি, তুমি কী করবে? তুমি কি আবার মডেলিং-এর জগতে ফিরে যাবে?
না, আমি পারব না।
ডায়ানা তাকালেন।
-হ্যাঁ, হয়তো, আমি তখন রানওয়েতে ছিলাম। আমি দেখতে পাচ্ছি, মার্ক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উড়ন্ত বৃষ্টির মতো চুম্বন ছুটে আসছে। হ্যাঁ, আমি কাজে ফিরে যাব।
ডায়ানা হাসলেন ভালো কথা।
তারা একঘন্টা ধরে টেলিভিশন দেখলেন।
ডায়ানা বললেন- এবার ঘুমোবার সময় হয়েছে।
পনেরো মিনিট কেটে গেছে। তারা পোশাক খুলে ফেললেন। তারা বিরাট শয্যায় গা এলিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, মস্ত বড় অভিযান শেষ হল।
কেলি বললেন আমার ঘুম পাচ্ছে ডায়ানা। আলোগুলো নিভিয়ে দাও।
.
উপসংহার
বাতাস সম্পর্কে যা বলা হল, অথবা আবহাওয়ার পরিবর্তন, বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, সেটা সম্ভব। এই মুহূর্তে দুটো মহাশক্তিশালী দেশ বিশ্বের আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। তাদের মধ্যে একটি হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যটি রাশিয়া। অন্যান্য দেশও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তারা এখনও পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সফলতা অর্জন করতে পারেনি। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই এই বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। নিকোলা টেসটা নামে এক বিজ্ঞানী প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন। তিনি মহাশূন্যের ভেতর এক ধরনের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ পাঠাতে চেয়েছিলেন। তাঁর গবেষণা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এর ফল হতে পারে মারাত্মক। আমরা আবহাওয়াকে আমাদের কাজে লাগাতে পারি। অথবা তাকে একটা বিধ্বংসী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।
এরজন্য কতগুলো উল্লেখযোগ্য জিনিস চাই।
১৯৬৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিসে একটা বিষয়ে পেটেন্ট দেওয়া হয়। বলা হয়, এর সাহায্যে আমরা সমুদ্রের জলকে বাষ্পে পরিণত করতে পারব। এবং এই যন্ত্রই বাষ্পকে আকাশে ঠেলে দিতে পারবে।
১৯৭১ সালে আর একটা পেটেন্ট দেওয়া হয়। এই পেটেন্ট দেওয়া হয়েছিল ওয়েসটিন হাউস ইলেকট্রিক করপোরেশনকে। এর সাহায্যে আমরা আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটাতে পারব।
১৯৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কমিটি আবহাওয়ার বিষয়ে একটা গবেষণা করেছিল। বিজ্ঞানীরা আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, তা নিয়ে গবেষণা হতে থাকে। এর জন্য প্রতিরক্ষা বিভাগকে সজাগ করে দেওয়া হয়। বলা হয়, এর সাহায্যে আমরা সমুদ্রের বুকে কৃত্রিম ঝড়ের সৃষ্টি করতে পারব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে ১৯৭৯ সালে ঠাণ্ডা যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই ব্যাপারে রাষ্ট্রপুঞ্জ একটি শর্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। বলা হয়, এখন থেকে কোনো দেশই আবহাওয়ার কাছে ষড়যন্ত্রমূলক প্রতিশ্রুতি করতে পারবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।
এইভাবেই হয়তো এই জাতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবসান ঘটানো হয়। ১৯৭৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের পরীক্ষা করে। এর ফলে তারা উত্তর উইসকনসিন অঞ্চলে ছ-ঘণ্টা বৃষ্টিপাত ঘটাতে সমর্থ হয়েছিল। প্রচণ্ড ঝড়ের সৃষ্টি করা হয়। ১৭৫ মাইল প্রতি ঘন্টা বেগে ঝড় ছুটে যায়। এর ফলে প্রায় পাঁচ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে। রাশিয়া ইতিমধ্যে নিজস্ব পদ্ধতি এবং পরিকল্পনা নিয়ে গবেষণা করতে থাকে।
১৯৪২ সালে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবর অনুসারে জানা গেছে যে, রাশিয়ান কোম্পানিরা পৃথিবীর আবহাওয়া নির্ধারণ এবং নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
এইভাবেই দুটি দেশে আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। ৮০ সালে এখানে কিছু কিছু দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে।
একটি প্রতিবেদন মারফত জানা গেছে যে, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ৮০০ মাইল দূরে গত দু-মাসে ভয়ংকর সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি ১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে টাইমস পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকাতে আর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, এটি পড়লে আমরা জানতে পারি, কীভাবে সমুদ্রের স্বাভাবিক গতিবিধিকে রুদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
পৃথিবীর নানা স্থানে প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করেছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, বৃষ্টিপাত, খরা, বন্যা প্রভৃতি বিপর্যয় দেখা গেছে।
একটা কথা মনে রাখতে হবে। তা হল, আবহাওয়া একটি অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র। এই অস্ত্রকে ঠিকমতো ব্যবহার করা উচিত। আবহাওয়ার ওপরে বিশ্বের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে। যদি আমরা ভূমিকম্প কিংবা খরার সম্মুখীন হই, তাহলে অর্থনীতিতে তার ঋণাত্মক প্রভাব পড়তে পারত।
আমরা এখন আরও শান্তিতে ঘুমোতে পারব। কারণ এক বিশ্বমাপের রাজনৈতিক নেতা বলেছেন– প্রত্যেকেই আবহাওয়া সম্পর্কে কথা বলার অধিকার রাখবেন। কিন্তু একে কেউ পরিবর্তন করতে পারবেন না।
এটাই বোধহয় এই মুহূর্তের শাশ্বত সত্য।