নোয়েলে ও ক্যাথারিন, এথেন্স, ১৯৪৬
১৫.
ল্যারি ডগলাস এবং নোয়েলে পেজ কে কাকে অতিক্রম করবে? ল্যারি ভাবছে, চাকরিটা ভালো, কিন্তু ওই মেয়েটি? ওর প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।
ক্যাথারিন? মাঝে মধ্যে ল্যারির সাথে কাউন্ট পাপ্পাসের সাথে পার্টিতে যায়। পলকেও সঙ্গে নেয়। তার কো-পাইলট। গ্রিক মহিলাদের মধ্যে অসাধারণ কামনা আছে, আগুন রাঙা উত্তেজনা। তার সাথে এক নতুন মেয়ের পরিচয় হয়েছে। হেলেনা। ডেমিরিসের হয়ে কাজ করে। তারা এথেন্সের এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। সে আর ল্যারি একবার একটা হোটেলে গিয়েছিল। হ্যাঁ, হেলেনার সৌন্দর্য দেখলে অবাক হতে হয়। রোগা, চোখের তারা কালো, এমন একটা আকর্ষণী ক্ষমতা, যা প্রতিরোধ করা যায় না।
সবাই জানে, ল্যারির জীবনটা খুবই সুন্দর এবং মসৃণ।
হয়তো তাই, কিন্তু ওই সোনালি চুলের উপপত্নী? সে বোধহয় সমস্ত আনন্দ নষ্ট করবে।
নোয়েলে পেজের কাছ থেকে ল্যারি এখন দূরত্ব বজায় রাখে। ল্যারি ভাবে আমাকে আরও শান্ত ও সংযমী হতে হবে। নোয়েলে আমাকে বোকা ভাবছে। আমি কী বা করতে পারি। নাঃ, চাকরিটা আমি ছাড়ব না।
মাঝে মধ্যেই সে পলের ওপর দায়িত্ব দেয়, নোয়েলের দেখাশোনা করতে। তা সত্ত্বেও চোখাচোখি হয়ে যায় বৈকি।
নভেম্বর মাস শেষ হয়ে আসছে। একদিন খুব সকালবেলা, ল্যারিকে বলা হল, নোয়েলে পেজকে নিয়ে আমস্টারডামে যেতে হবে। সেইদিন বিকেলে। ল্যারি এয়ারপোর্টে গিয়ে সব দেখল। একটা খারাপ রিপোর্ট পেল। আর্মস্টারডামের আবহাওয়াটা মোটেই ভালো নয়। ঘন কুয়াশায় চারদিক আচ্ছন্ন। বিকেলের দিকে কোনো কিছু দেখা যায় না। ল্যারি সঙ্গে সঙ্গে ডেমিরিসের সেক্রেটারিকে ফোন করল– বলল, কিছুতেই আমস্টারডাম যাওয়া সম্ভব নয়।
সেক্রেটারি পনেরো মিনিট বাদে জানালেন, মিস পেজ দুটোর সময় এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাবেন। প্লেনটা যেন চালানো হয়।
ল্যারি আবার এয়ারপোর্টে গেল। ভাবল, হয়তো আবহাওয়ার কিছু উন্নতি হয়েছে। কিন্তু একই রিপোর্ট পাওয়া গেল।
পল চিৎকার করল জেসাস ক্রাইস্ট, না, কিছুতেই আজ যাত্রা করা উচিত নয়।
ল্যারি ভাবল, আর্মস্টারডামটা বোধহয় কোনো ব্যাপার নয়। এটা দুজনের ইচ্ছার লড়াই। নোয়েলে পেজ কেন যেতে চাইছে? ইচ্ছে করে মৃত্যুকে বরণ করার জন্য? ল্যারি কি এখন জীবনের সংশয় নিয়ে ঘুরবে? ওই বোকা কুকুরিটার সাথে? সে ডেমিরিসকে ফোন করার চেষ্টা করল। ব্যাপারটা আলোচনা করতে হবে। ডেমিরিসকে পাওয়া গেল না। উনি মিটিং-এ ব্যস্ত আছেন। ল্যারি ফোনটা নামিয়ে রাখল। তাকাল, তার কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। তাকে এয়ারপোর্ট যেতেই হবে।
সে একটা বেজে তিরিশ মিনিটে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল। তিনটে পর্যন্ত নোয়েলে আসেনি।
পল বলল- উনি হয়তো মত পাল্টেছেন।
ল্যারি ব্যাপারটা জানে, সময় কেটে যাবে, সে আরও রেগে যাবে। হ্যাঁ, এটা একটা ফাঁদ। এই ফাঁদ থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারছে না। ল্যারি টারমিনাল বিল্ডিং-এ দাঁড়িয়ে আছে। এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলছে। ডেমিরিসের রোলস গাড়িটা ঢুকে পড়ল। নোয়েলে পেজ বেরিয়ে এল। ল্যারি এগিয়ে এসে তার কাছে পৌঁছে গেল।
–আমার মনে হচ্ছে, আজ না যাওয়াই উচিত মিস পেজ, আর্মস্টারডামের এয়ারপোর্টে ঘন কুয়াশা, কিছু দেখা যাচ্ছে না।
নোয়েলে ল্যারিকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেল। তারপর পলের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল- আমাদের প্লেনে অটোমেটিক অবতরণ যন্ত্র আছে, তাই না?
পল বলল- হ্যাঁ, আছে।
–তাহলে আমি অবাক হচ্ছি। মিঃ ডেমিরিস এমন এক পাইলট রেখেছেন, যে ভীতুর ডিম। আমি পরে ওনার সাথে এ বিষয়ে কথা বলব।
নোয়েলে প্লেনের দিকে এগিয়ে গেল।
পল বলল–কী হয়েছে বুঝতে পারছি না ল্যারি। উনি তোমাকে মোটেই পছন্দ করছেন না।
ল্যারি তাকিয়ে থাকল। তার সোনালি চুল এলোমেলো বাতাসে উড়ছে। না, জীবনে কেউ ল্যারিকে এতটা অপমান করেনি।
পল জানতে চাইল আমরা তাহলে উড়ান শুরু করি?
–হ্যাঁ। তারা প্লেনের দিকে এগিয়ে গেল।
নোয়েলে পেজ কেবিনে বসল। ফ্যাশান ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ রাখল। ল্যারি তার দিকে তাকাল। কথা বলতে সাহস হচ্ছে না। সে ককপিঠে গিয়ে বসল। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি মেলে দিল।
দশ মিনিট বাদে টাওয়ার থেকে ক্লিয়ারেন্স পাওয়া গেল। এখন প্লেনটা আর্মস্টারডামের দিকে উড়ে চলেছে।
প্রথম দিকে কোনো মনে রাখার মতো ঘটনা ঘটেনি। নীচে সুইজারল্যান্ড, তুষার ঢাকা অসাধারণ অঞ্চল। এবার জার্মানি, তখন সন্ধ্যের অন্ধকার ঘণীভূত হচ্ছে। ল্যারি আবার জানতে চাইল, আমস্টারডামের অবস্থা কেমন? খবর এল ঘন কুয়াশা, উত্তর সাগর থেকে আসছে। তা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। না, আজ ভাগ্যটা সত্যিই খারাপ। যদি তীব্র বাতাস এসে কুয়াশাকে সরিয়ে দেয়, তাহলে ভালো। তাহলেই সমস্যার সমাধান হবে। সে বুঝতে পারছে না, এখন আর্মস্টাডামে যাবে, নাকি, অন্য কোনো বিমানক্ষেত্রে অবতরণ করবে। ফিরে গেলেই বোধহয় ভালো হয়। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। কিন্তু নোয়েলের কাছে যাবার সাহস তার নেই।
মিউনিখ, অবস্থা আরও খারাপ। ল্যারি চিন্তা করল, সে ব্রাসেলস, কোলন অথবা লুক্সেমবার্গে নামতে পারে।
অথবা আমস্টারডাম।
ল্যারি কথা বলতে শুরু করেছে। বলল, পেশ্যাল ফ্লাইট ১৯, মিউনিখ টাওয়ার, আমরা আর্মস্টারডাম যাচ্ছি।
পল সবকিছু শুনছে। সে বলল আমার জীবনবীমাটা দ্বিগুণ করা উচিত ছিল। নাঃ, এ যাত্রায় বোধহয় ফিরতে পারব না।
ল্যারি বলল- সত্যি, আমারও একই কথা মনে হচ্ছে।
পরবর্তী ঘন্টা, ল্যারি কাজে মগ্ন। বারবার আবহাওয়ার প্রতিবেদনটা হাতে নিচ্ছে। তিরিশ মিনিট। আমস্টারডাম থেকে একইরকম রিপোর্ট আসছে ঘন কুয়াশা। বিমানক্ষেত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দুটি একটি জরুরি অবতরণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
ল্যারি আবার কনট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করল–আমরা আমস্টারডামের দিকে। এগিয়ে চলেছি। কোলন থেকে ৭৫ মাইল দূরে আছি।
শব্দ শোনা গেল, আমস্টারডামে টাওয়ার, আমাদের বিমানক্ষেত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আপনি কোলনে চলে যান, কিংবা ব্রাসেলসে অবতরণ করুন।
ল্যারি হ্যান্ডমাইকে বলল- খুব দরকার আছে। আর্মস্টারডামে নামতেই হবে।
পল তাকিয়ে আছে। পলের সমস্ত অভিব্যক্তিতে বিস্ময়।
নতুন একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল–আমস্টারডাম এয়ারপোর্টের চিফ অফ অপারেশন বলছি– এখানে ঘন কুয়াশা। কিছু দেখা যাচ্ছে না। আপনি কেন নামতে চাইছেন?
ল্যারি জবাব দিল- জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। শুধু আর্মস্টারডাম পর্যন্ত পৌঁছোতে পারব।
পলের চোখ কপালে উঠে গেছে। সে আবার চিৎকার করে বলছে-কী হচ্ছে? যা জ্বালানি আছে, আমরা চিন পর্যন্ত উড়তে পারব।
রেডিওটা নীরব হয়ে গেছে। আবার তা প্রাণবন্ত হয়ে উঠল টাওয়ার, স্পেশ্যাল ফ্লাইট ১৯। আচ্ছা, অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। প্লেনটাকে নিয়ে আসুন।
ল্যারি সুইচ টিপল। পলের দিকে তাকাল। দেখলে তো কেমন কাজ হল।
পল বুঝতে পারছে, কী ঘটনা ঘটতে চলেছে।
শেষ অব্দি কী হবে কেউ জানে না।
আমস্টারডাম কনট্রোল টাওয়ার- আমি অবতরণ করতে চলেছি। রাডার ঠিক আছে।
তারপর? পারস্পরিক বার্তা বিনিময় হচ্ছে। ল্যারি তখনও জানে না, শেষ অব্দি ঠিকমতো সে নামতে পারবে কিনা।
ধীরে ধীরে বিমানটা নামছে ৬০ ফুট-৪০ ফুট-২০ ফুট- অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ল্যারি বিমানটা চালাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সে তাকিয়ে থাকল, না, এবার বোধহয় ভাগ্যের হাতে সবকিছু ছেড়ে দিতে হবে। ল্যারি বুঝতে পারল, তার দুটো পা ঠকঠক করে কাঁপছে। সে পলের দিকে তাকাল, বলল– পল, কী হবে?
একবার কেবিনের দিকে তাকাল, নোয়েলে ফ্যাশান ম্যাগাজিনে নিমগ্না। এত ঘটনা তাকে। স্পর্শ করতেই পারছে না।
শেষ অব্দি ল্যারি ঘোষণা করল- আমস্টারডাম।
আমস্টারডাম, ঘনীভূত নৈঃশব্দ। নোয়েলে মার্সিডেজ-৩০০-র ব্যাকসিটে বসে আছে। ল্যারি সামনে ড্রাইভারের পাশে। পলকে এয়ারপোর্টে থাকতে হয়েছে। প্লেনটা দেখভালের জন্য। কুয়াশা এখনও ঘন। গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে।
সিটি স্কোয়ার।
পাশে একটা হোটেল, তারা লবিতে পৌঁছে গেল। নোয়েলে ল্যারিকে বলল রাত্রি দশটায় আমাকে নিতে এসো।
তারপর সে এলিভেটরের দিকে এগিয়ে গেল। ম্যানেজার উঠে এসেছেন। একটা বেলবয় ল্যারিকে ছোট্ট সিঙ্গেল রুমের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। এটা হোটেলের পেছন দিকে অবস্থিত। রুমটা কিচেনের পাশে। জানলা দিয়ে অনেক শব্দ আসছে। নানা খাবারের গন্ধ। ল্যারি ওই ছোট্ট ঘরের দিকে তাকাল। মনে মনে ভাবল, আমার কুকুরটাও বোধহয় এখানে থাকবে না। কথাগুলো তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল।
ছেলেটি বলল- মিস পেজ বলেছেন, সবথেকে সস্তার ঘরটা আপনার জন্য ব্যবস্থা করতে।
-ঠিক আছে, ল্যারি কিছু বলতে পারছে না। বাথরুমটা হলের এককোণে। ল্যারি চান করার কথা চিন্তা করল। না, শূয়োরের মতো গন্ধ বেরোচ্ছে গা দিয়ে। হোটেল বারের দিকে এগিয়ে গেল। তিন নম্বর মারটিনটা সবেমাত্র শেষ করেছে, ঘড়ির দিকে তাকাল দশটা বেজে পনেরো। মাথায় আলোড়ন। নোয়েলে বলেছিল, ঠিক দশটার সময় আসতে। ল্যারির মনের মধ্যে ভয়ের অনুভূতি। সে বিল দিয়ে এলিভেটরের দিকে এগিয়ে গেল।
নোয়েলে এমপারার স্যুইটে আছে, সে করিডর দিয়ে ছুটছে। কেন এই কাজটা করল? দরজায় আঘাত করল। কেউ উত্তর দিল না।
ল্যারি নবটা ঘোরাল। দরজাটা বন্ধ। সে লিভিং রুমে গেল।
এক মুহূর্ত দাঁড়াল। বলল- মিস পেজ, তার মানে? কোনো উত্তর নেই।
-কোস্টা ডার্লিং, আমি দুঃখিত, আমি বলেছি আগে, এটা করা তোমার উচিত হয়নি। আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
বাথরুম থেকে একটা শব্দ শুনতে পেল। এগিয়ে গেল। বাথরুমের দরজাটা খোলা। ভেতরে গেল। নোয়েলে তখনই বেরিয়ে এল। সাওয়ারের তলা থেকে। ছোট্ট একটা টার্কি তোয়ালে তার মাথায় জড়ানো। বাকি শরীরটা একেবারে খোলা।
নোয়েলে পেজ তাকাল। ল্যারি দেখতে পেল। ল্যারির ঠোঁটে ক্ষমা, সে কিছু বলতে পারছে না। নোয়েলে উদাসীনভাবে বলল- ওই তোয়ালেটা দাও তো।
মনে হচ্ছে, ল্যারি বোধহয় তার পরিচারিকা। অথবা আদরের কোনো বাবু বোধহয়। ল্যারি ভীষণ রেগে গেছে। কিন্তু সেই রাগ প্রকাশ করবে কেমন করে? নোয়েলেকে দেখে তার মনে এখন অন্য পৌরুষ জেগেছে।
সে এগিয়ে গেল। তোয়ালেটা তুলে দেবার চেষ্টা করল। না, এভাবে প্রতিশোধ নেওয়া যায় না। কিন্তু এখন কী করা যাবে? অদ্ভুত একটা অনুভূতি। ওই নগ্ন শরীর। নোয়েলে পেজ হেঁটে চলেছে। কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। সে বেডরুমের দিকে চলে গেল।
ল্যারির মনে অন্য চেতনা। সে ক্ষমা চাইবে। হ্যাঁ, মদ খেয়েছে, দেরি হয়ে গেছে। অনেক-অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফিরে আসার উপায় নেই। তাহলে?
কী যেন ঘটে যাচ্ছে? কী হবার ছিল আর কী ঘটে চলেছে। না, ল্যারি কিছু ভাবতে পারছে না। ল্যারি ডেমিরিস সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছে। ল্যারি জানে, ডেমিরিস ভয়ঙ্কর মানুষ। এই ঘটনার কথা যদি ডেমিরিসের কানে যায়, তা হলে কী হবে? কিন্তু শরীর, মিলে মিশে একাকার। নোয়েলে বিছানাতে শুয়ে আছে। দুটি হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। তার চোখে আমন্ত্রণ। ল্যারি নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারল না। পোশাক খুলে সে নোয়েলের ওপর নিজেকে স্থাপন করল। পুংদণ্ডটা তার যোনির ভেতর প্রবেশ করিয়ে দিল। আঃ, এত আনন্দ। এত সুখ। এত উৎসাহ।
সব কিছু হয়ে গেল। নোয়েলের চোখ বন্ধ। সে বলল তোমাকে ধন্যবাদ।
ল্যারির মনে হল, এটাও কোনো ফাঁদ নয় তো? নাঃ, এখন আমাকে সবকিছু ভুলে যেতে হবে। এই জগৎ, এই পৃথিবী– সবকিছু।
.
নোয়েলে ও ক্যাথরিন, এথেন্স, ১৯৪৬
১৬.
ক্যাথারিন এখন একা। বুঝতে পারছে না। কী করবে ল্যারির ভালোবাসা, কিছুটা পাল্টে গেছে কি? সারাদিন তাকে অ্যাপার্টমেন্টে একাই থাকতে হয়। চারপাশে কী ঘটছে তা অনুধাবন করার চেষ্টা করে। খারাপ কোনো সংকেত? না, ল্যারি কেন পাল্টে গেল! আগের মতো আমাকে আর ভালোবাসে না। আফ্রিকাতে কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের সঙ্গে একটি সাফারি থেকে চলে আসার পর ক্যাথারিন এখন ল্যারিকে একান্তভাবে চায়। কিন্তু পায় না। ল্যারি বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকে। মনে হয়, এখন যেন যুদ্ধ চলেছে। কিন্তু কোনো শত্রু নেই।
না, একজন শত্রু আছে, তার খবর হয়তো ক্যাথারিন জানে না।
ল্যারি বলল আমার উন্নতি হয়েছে। সাতশো বেশি পাব, কেমন লাগছে?
অসাধারণ, কবে থেকে? কীভাবে?
বলব, সব কিছু।
–তবে আমরা দেশে ফিরব না? এখানেই চিরকাল থাকব নাকি?
ভেবে দেখো তো, দিনটা কী সুন্দর এখানে।
–কিন্তু আমেরিকা আমাকে এখনও ডাকে।
-আমেরিকার নিকুচি করেছে। চার বছর আমি সেখানে গাধার মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। দুটো মেডেল গলায় ঝুলিয়েছি। ওরা কি আমাকে যুদ্ধ ফেরত বৈমানিক হিসেবে ডাক দিয়েছে!
–এটা সত্যি নয়।
–তুমি?
–আমি কী?
ক্যাথারিন কথা বাড়াতে চাইল না। সে বলল- কিছুই না। তুমি খুব ক্লান্ত। চলো, আমরা ঘুমোতে যাই।
না, ল্যারি বারে চলে গেল। ড্রিঙ্ক তৈরি করল। বলল, আর্জেন্টিনা নাইট ক্লাব। নতুন খুলছে। আমি পলকে বলেছি। আমি সেখানে যোগ দেব। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করব।
ক্যাথারিন বলল– ল্যারি, আমরা কতদিন গল্প করিনি বলল তো? এসো, আমরা বসে গল্প করি।
-কী করব বলো? কাজ আমাকে ব্যস্ত রাখে। আমি কি তোমাকে চাই না?
ক্যাথারিন মাথা নাড়ল। অপমান এবং লজ্জায় জানি না, কিছুই জানি না।
ল্যারি হাত বাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে এল। তার চোখে মুখে বালকোচিত উন্মাদনা। সত্যি কথা বলব? এসো, আমরা সারারাত দুজনে গল্প করি, কেমন?
ক্যাথারিন অবাক হয়ে যায়। ল্যারিকে সে ঠিক মতো বুঝতে পারে না। তার কেবলই মনে হয়, ল্যারির মধ্যে দুটো বিপরীত অনুভূতি কাজ করছে।
সপ্তাহের শেষ দিন, তারা কেউ অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বাইরে গেল না। ল্যারি রান্না করল। আগুনের সামনে বসে থাকল। কথা বলল। গান গাইল।
রবিবারের রাত। অসাধারণ ডিনার। ল্যারি এবার শোবার চেষ্টা করছে। ক্যাথারিন তাকিয়ে আছে।
আবার আদর। ল্যারি বাথরুমে, নগ্ন। এখনও কী সুন্দর তাকে দেখতে। আঃ, এই পুরুষ আমার।
তারপর?
ল্যারি বলল- আসছে সপ্তাহে বড় ব্যস্ত থাকব। এভাবে দেখা করার সুযোগ হয়তো হবে না।
সে বাথরুমে ঢুকে গেল। ক্যাথারিন তখনও বসে আছে। তার ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি।
হেলেনকে নিয়ে গোলমাল, এই অসাধারণ সুন্দরী গ্রিক যুবতী। এক তপ্ত গ্রীষ্মের বিকেল বেলা, ক্যাথারিন বাজার করতে বেরিয়েছে। ল্যারি শহরে নেই। পরদিন ল্যারি ফিরবে। ক্যাথারিন ভেবেছে ল্যারি ফিরলে দারুণ রান্না করে খাওয়াবে। ক্যাথারিন বাজার থেকে বেরিয়েছে, দুহাতে জিনিসপত্র। একটা ট্যাক্সি বেরিয়ে গেল। ল্যারিকে ট্যাক্সিতে বসে থাকতে দেখা গেল। তার হাত একটি মেয়ের কাঁধে। মেয়েটির পরনে স্টুয়ার্টের ইউনিফর্ম, ক্যাথারিন এক ঝলক দেখল। ওরা হাসছে। ট্যাক্সিটা চোখের বাইরে চলে গেল।
ক্যাথারিন দাঁড়িয়ে আছে, সব কথা হারিয়ে ফেলেছে সে। তার হাত থেকে থলে পড়ে গেছে। দুই পথচারী এসে তা তুলে দিয়েছে। ক্যাথারিন কোনরকমভাবে থলেগুলো তুলে নিল। তার মন চিন্তা করতে পারছে না। একবার ভাবল, নিশ্চয়ই চোখের ভুল। ট্যাক্সিতে ল্যারি, থাকতেই পারে না। অন্য কেউ, একই রকম দেখতে। কিন্তু সে জানে পৃথিবীতে ল্যারির মতো পুরুষ আর একজনও নেই। সে হল ঈশ্বরের এক আদি ও অকৃত্রিম সৃষ্টি। তাহলে? কে ওই বাদামী চুলের মেয়েটি? আরও-আরও কতজন? ক্যাথারিন কিছু ভাবতে পারল না।
ক্যাথারিন সমস্ত রাত জেগে কাটিয়ে দিল। ভাবল, ল্যারি হয়তো ফিরে আসবে। না, ল্যারি এল না। তার মানে? সব কিছু মিথ্যে? কেমন করে? ল্যারি মিথ্যক? প্রতারক? না, এই পুরুষের সঙ্গে এক মুহূর্ত থাকা সম্ভব নয়।
পরের দিন বিকেলবেলা, ল্যারি এসে আনন্দের সঙ্গে বলল কী হয়েছে?
ক্যাথারিন জানতে চাইল- তুমি কখন শহরে ফিরেছ?
ল্যারি অবাক– এক ঘন্টা আগে। কেন?
কালকে একটা মেয়ের সঙ্গে তোমাকে আমি ট্যাক্সিতে দেখেছি।
ক্যাথারিন পরিষ্কার বলল। এইভাবেই আমার বিয়ে শেষ হয়ে গেল। এখন ল্যারি নিশ্চয়ই অস্বীকার করার চেষ্টা করবে। আমি ওকে মিথ্যুক বলব। ওকে ছেড়ে চলে যাব। আর কখনও ফিরে আসব না।
ল্যারি দাঁড়িয়ে আছে। ল্যারি কিছুক্ষণ পর বলল- না, আমি ছিলাম। আমি গতকাল এথেন্স থেকে ফিরে এসেছি। হেলেনা নামে একটা মেয়েকে তুলে নেবার জন্য। তাকে নিয়ে ক্রিটে যেতে হবে। ডেমিরিস সেখানে অপেক্ষা করছেন। হেলেনা ডেমিরিসের কাছে কাজ করে, স্টুয়ার্টের।
–কিন্তু?
…এটা হতেও পারে। ল্যারি হয়তো সত্যি বলছে। নাকি বানানো কৌশল।
–তুমি আমাকে ফোন করোনি কেন?
ল্যারি বলল- আমি করেছিলাম, কোনো উত্তর পাইনি। তুমি বোধহয় ছিলে না তাই তো?
-হ্যাঁ, আমি বাজারে গিয়েছিলাম।
–আমার খিদে পায়নি। এসব প্রশ্ন আমার খিদেটাকে নষ্ট করে দেয়।
ল্যারি দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। ক্যাথারিন দাঁড়িয়ে আছে। তার ডান হাত তখনও তোলা। সে হয়তো ল্যারিকে আবার আমন্ত্রণ জানাবে।
.
ক্যাথারিন জিন নিয়ে বসেছে। এইভাবেই জীবনটাকে সে নষ্ট করবে। সন্ধ্যে সাতটা, ল্যারি বাড়িতে আসেনি কেন? রাত নটা, ল্যারি এসেছে কিন্তু কথা বলেনি। ক্যাথারিন ব্র্যান্ডি খাচ্ছে, সময়টাকে হত্যা করছে। রাত দশটা। কয়েকটা ব্র্যান্ডি শেষ হয়ে গেছে। ল্যারি কেন এমন ব্যবহার করছে।
ক্যাথারিন কিছুই বুঝতে পারছে না, সত্যিই ল্যারি কি তাকে ঠকাচ্ছে? সে জানে না। অনেক কীর্তি ধরা পড়ে যাচ্ছে। একদিন ক্যাথি ল্যারির ইউনিফর্মের ট্রাউজারে হাত দিয়েছিল। ধোপর বাড়ি পাঠাতে হবে। সে দেখতে পেল, একটা রুমাল, বীর্যের দাগ রয়েছে। তার জাঙ্গিয়ার ওপর লিপস্টিকের চিহ্ন।
সে বুঝতে পারল, ল্যারি এখন অন্য কোনো মেয়ের কজায়।
কে সেই মেয়েটি? তাকে আমি হত্যা করতে চাই- এটাই হল ক্যাথারিনের শেষতম সিদ্ধান্ত।
.
নোয়েলে এবং ক্যাথারিন, এথেন্স ১৯৪৬
১৭.
সময় ক্যাথারিনের সবথেকে বড় শত্রু। আবার সময় ল্যারির বন্ধু। রাতের অন্ধকার, আর্মস্টারডাম, অলৌকিক অবস্থা। ল্যারি নিজের কথা ভাবে। এটা কি আমার ভাগ্য? উত্তর পায় না।
কত কথাই তার মনে পড়ে যায়। নানান দ্বীপপুঞ্জের ওপর ঘুরে বেড়নোর দিনগুলো। একটির পর একটি আঘাত।
হ্যাঁ, আকাশের সেই সম্রাট। কিন্তু মাটির পৃথিবীতে? সেখানে অন্য অনেক ঘটনা ঘটে যায়। ল্যারি তার খবর রাখে না।
আর্মস্টারডামের রাত, নোয়েলের সাথে শরীরের মিলন। তারপর? কত কী তো ঘটে গেল। প্যারিস, একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানো
আমি কত ভাগ্যবান। আবার নোয়েলকে পাচ্ছি। নোয়েলে বলেছিল– এখন তুমি আমার, আমার একার।
তার কণ্ঠে কেমন এক অদ্ভুত আকুতি। সত্যিই তো, তার কাছে সব কিছু হারাতে ইচ্ছে করে।
নোয়েলে এখন আমার অধিকারে, আমি তাকে দখল করব।
ল্যারি জানে না, এই ভাবনাটা কতখানি সত্যি হবে। নাকি সবই এক স্বপ্ন।
.
মরক্কো থেকে ল্যারি ফিরে এসেছে। হেলেনাকে নিয়ে ডিনার খাচ্ছে। সমস্ত রাত কাটিয়েছে সে তার অ্যাপার্টমেন্টে।
সকালবেলা, সে প্লেন চেক আউট করতে গেল। লাঞ্চ খেল পলের সঙ্গে।
পল জিজ্ঞাসা করল–কী ব্যাপার? তুমি কি জ্যাকপটের বাজি জিতেছ নাকি?
ল্যারি বলল- প্রিয় বালক, আগুন নিয়ে খেলতে যেও না। আমার মতো ধুরন্ধর হলে তবেই সামলাতে পারবে।
লাঞ্চটা চমৎকার। ল্যারি হেলেনাকে নেবার জন্য বেরিয়ে পড়ল। হেলেনা তার সঙ্গে ফ্লাইটে যাবে।
সে অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় শব্দ করল। অনেকক্ষণ বাদে হেলেনা শান্তভাবে খুলে দিল। হেলেনার শরীরে এক টুকরো সুতো নেই। ল্যারি অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে যেন চিনতে পারছে না। কী হয়েছে? চোখে মুখে ক্ষতচিহ্ন। এখানে সেখানে ফুলে গেছে। মনে হচ্ছে কেউ তাকে প্রচণ্ড পিটিয়েছে।
হায় ঈশ্বর- ল্যারি চীৎকার করল কী হয়েছে?
হেলেনা মুখ খুলল, ল্যারি দেখল তার সামনের দাঁতটা তুলে নেওয়া হয়েছে।
সে বলল– তুমি যাবার পরেই দুজন লোক এসেছিল।
–তুমি পুলিশকে ডাকলে না কেন? ল্যারি জানতে চাইল।
–আমি বাধা দিলে তারা আমাকে হত্যা করত, ল্যারি।
হেলেনা কথা বলতে পারছে না, দরজাটা ধরার চেষ্টা করছে।
–ওরা কিছু চুরি করেছে?
না, ওরা জোর করে ঢুকে আমাকে ধর্ষণ করেছে। আমাকে প্রচণ্ড মেরেছে।
কাপড় পড়ে নাও, আমি হাসপাতালে নিয়ে যাব তোমাকে।
না, মুখের এই অবস্থা, আমি যাব কেমন করে?
ল্যারি ডাক্তারকে ফোন করল, এই ডাক্তার তার বন্ধু।
–আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আমি থাকতে পারছি না। আধ ঘন্টার মধ্যে আমাকে উড়তে হবে। ফিরে এসে তোমার সঙ্গে দেখা করব কেমন?
কিন্তু তাকে আর দেখা যায়নি। দুদিন বাদে ল্যারি ফিরে এল, দেখল অ্যাপার্টমেন্টটা খালি। ল্যান্ড লেডি জানালেন, ওই মেয়েটি চলে গেছে। কোথায় গেছে বলে যায়নি। ল্যারি অবাক। নোয়েলেকে সে ভালোবেসেছে, কিন্তু এই মেয়েটি, এই মেয়েটিকেও সে ভালোবাসা দিয়েছে।
শেষ অব্দি, নোয়েলের কাছেই সে আত্মসমর্পণ করবে? নোয়েলে বলেছিল– তুমি আর কোনো মেয়ের সাথে শোবে না কিন্তু। আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও, যদি তেমন কোনো ঘটনা আমার কানে আসে, মেয়েটিকে আমি জীবন্ত খেয়ে ফেলব।
ল্যারি সব বুঝতে পারছে, দুয়ে দুয়ে চার। নোয়েলের কণ্ঠস্বর–তুমি শুধু আমার। তারপর? অন্য একটা কথা। অন্য একটা আনন্দ। সে জানে, নোয়েলে অসাধারণ যৌনবতী। নোয়েলের সান্নিধ্য তাকে আরও উদ্দীপ্ত করবে। তা সত্ত্বেও? হেলেনাকে সে ভুলবে কেমন করে?
পরদিন ব্রেকফাস্টের আসর, ল্যারি নোয়েলের দিকে তাকিয়ে আছে। নোয়েলে বুঝতে পারছে না। নোয়েলের মুখে একটা অদ্ভুত অনুভূতি। নোয়েলে ভয়ংকর, সে সুন্দরী এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই সৌন্দর্যের মধ্যে একটা রুক্ষতা আছে। অন্য কোনো নারীকে সে সহ্য করতে পারে না।
প্রথম থেকেই নোয়েলে বারবার বলেছে, আমার সাথে দু নম্বরী খেলা খেলতে চেয়ো না। নোয়েলে আরও বলেছে- বাতাসে গুজব ভেসে বেড়ালে আমি তা ধরে নেব।
ল্যারি বলেছে– আমরা একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করতে পারি না? যেখানে আমরা দুজন নিশ্চিন্তে নিরিবিলিতে শরীর বিনিময় করব।
নোয়েলে মাথা নেড়েছে- এথেন্সে নয়, কেউ আমাদের দেখে ফেলবে। ব্যাপারটা ভাবতে হবে।
দুদিন কেটে গেছে, ডেমিরিস ল্যারিকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ল্যারি ভেবেছে কী ব্যাপারে আলোচনা হবে। নোয়েলের সাথে আমার সম্পর্ক? গ্রিক ধনকুবের কি তা জানতে পেরেছে?
না, ডেমিরিস শান্তভাবে কথা বলছেন। নতুন প্লেনের ব্যাপারে আলোচনা করতে হবে।
ডেমিরিস বললেন আমি একটা বহুবার প্লেন কিনতে চাইছি। তোমাকে সেটা দেখতে হবে।
ল্যারির মুখে উজ্জ্বল আলো দারুণ প্লেন। এর ওজন এবং সাইজটা খুবই ভালো। আহা, এমন অসাধারণ একটা সম্পত্তি।
কতজন যাত্রীদের বহন করতে পারবে?
-নজন, তার সঙ্গে একজন পাইলট। নেভিগেটর ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। ঘন্টায় চারশো আশি মাইল বেগে উড়তে পারবে।
ব্যাপারটা সুন্দর। তুমি কি প্লেনটা দেখবে? আমাকে একটা রিপোর্ট দেবে?
–আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।
–ডগলাস, মিস পেজ কাল সকালে বার্লিন যাবে। তুমি তার সঙ্গে উড়বে তো?
-হ্যাঁ, স্যার, সে শান্তভাবে বলল, মিস পেজ এখন কেমন আছেন? আগের থেকে ভালো তো?
ডেমিরিস তাকালেন না, সত্যি কথা বলতে কী, আজ সকালেও সে তোমার সম্পর্কে অভিযোগ করেছে।
ল্যারি অবাক হয়ে তাকাল। তারপর আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারল। সে বলল আমি চেষ্টা করছি মিঃ ডেমিরিস, আমি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি।
ডেমিরিস ঘাড় নাড়লেন–হ্যাঁ চেষ্টা করো। আমি জানি তুমি সেরা পাইলট। তোমাকে আমি দোষ দিতে পারছি না।
.
কণ্ঠস্বর পরিষ্কার, সংকেতটা পৌঁছে গেছে।
বাড়িতে ফিরে ল্যারির মনে হল, আমি কী বোকা। নোয়েলে আমাকে নিয়ে খেলা খেলতে চাইছে। আমার সম্পর্কে সে মনোভাব পাল্টাবে না। তবে ডেমিরিস সন্দেহ করতে পারেন। আমাদের মধ্যে একটা সুন্দর পুরোনো সম্পর্ক আবার নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে। ডেমিরিস কী চাইছেন? আমাদের একসঙ্গে আনতে? না, এটা একটা মিথ্যে চিন্তা।
বার্লিনের দিকে এরোপ্লেন উড়ে চলেছে। ল্যারি হুইলের দিকে তাকাল। পল বসে আছে। সে নোয়েলের কাছে চলে গেল।
পল জানতে চাইল কী হচ্ছে? ভয় করে না?
না, আমার এ বিষয়ে ভয় নেই। ল্যারি হাসল।
–ভাগ্য তোমার সহায়ক হোক।
ধন্যবাদ।
ল্যারি ককপিটটা বন্ধ করে দিল। লাউঞ্জে গেল। নোয়েলে বসে আছে। দুজন সহকারিনী দুপাশে আছে। ল্যারি বসলো নোয়েলের পাশে।
নোয়েলে শান্তভাবে বলল–সাবধান, এখানে যারা কাজ করে তারা সবাই কনস্ট্যানটিনের গুপ্তচর।
ল্যারি বিমান সেবিকার দিকে তাকাল। হেলেনার কথা মনে পড়ল তার।
নোয়েলে বলল- আমি একটা জায়গা পেয়েছি।
–অ্যাপার্টমেন্ট?
–একটা বাড়ি, তুমি জানো রাফিনা কোথায়?
–না।
–এটা সমুদ্রের ধারে একটা ছোট্ট গ্রাম। এথেন্স থেকে একশো কিলোমিটার উত্তরে। সেখানে একটা শান্ত সুন্দর ভিলা পাওয়া গেছে।
কার নামে ভাড়া নেবে?
–আমি এটা কিনেছি, অন্য একজনের নামে।
ল্যারি অবাক হয়ে গেছে। নোয়েলে একটা ভিলা কিনতে পারে? সে বলল– চমৎকার, আমি কবে দেখতে যাব?
-ক্যাথারিনের কাছ থেকে তুমি আসতে পারবে তো? কোনো সমস্যা?
ল্যারি অবাক হয়ে নোয়েলের মুখের দিকে তাকাল। এই প্রথম নোয়েলে তার স্ত্রীর কথা বলেছে। ল্যারি অবশ্য বিয়ের ব্যাপারে কোনো কিছু গোপন করেনি। অদ্ভুত একটা অনুভূতি। হ্যাঁ, ভাবতে হবে, ক্যাথারিনকে চিরকালের মতো ছেড়ে।
নোয়েলে উত্তরের জন্য প্রতীক্ষা করছে। ল্যারি বলল- এখনই পারব না, এখন আমি আসব যাব, যখন খুশি, আমার ইচ্ছা।
নোয়েলে মাথা নাড়ল, খুশি এবং ইচ্ছা ঠিক আছে, কনস্ট্যানটিন একটা জাহাজ কিনতে চলেছে। আমি তার সঙ্গে যাব না, আমরা দশটা দিন পাব। দশ দিন, সুখ এবং আনন্দ। কী বুঝলে? তুমি এখন চলে যাও।
ল্যারি ককপিটে চলে গেল।
পল অনেক কিছু জানতে চাইল। ল্যারি কিন্তু কিছুই বলল না।
ল্যারি একটা গাড়ি পেয়েছে, কিন্তু সেই গাড়িটা সে ব্যবহার করল না। সে একটা গাড়ি ভাড়া করল। নোয়েলে সবকিছু বলে দিয়েছিল। ল্যারি এখন রাফনার দিকে ছুটে চলেছে। নোয়েলে আগেই সেখানে পৌঁছে গেছে।
রাস্তাটা চমৎকার, আঁকাবাঁকা পথ, আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ল্যারি সেখানে পৌঁছে গেল। সমুদ্রের গর্জন শুনতে পেল। এই তো সেই ছোট্ট গ্রামটা। আহা, গ্রামের বাইরে বিস্তীর্ণ প্রান্তর।
ল্যারি এগিয়ে চলেছে দরজার দিকে। বেলে হাত দিল। ইলেকট্রিক গেটটা খুলে গেল। সে গাড়িটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। গেট বন্ধ হয়ে গেল। বিশাল একটা বাড়ি। মাঝে ঝরনা আছে। ফুল ফুটেছে। মনে হয় এ বুঝি ভূমধ্যসাগরীয় ভিলা। কোনো দুর্গ হতে পারে। দরজা খুলে গেল। নোয়েলে এসে দাঁড়িয়েছে। সাদা সুতির পোশাক। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। তারপর? আলিঙ্গন এবং চুমুর বর্ষণ।
নোয়েলে বলল- এসো আমার বাড়ি দেখে যাও।
অসাধারণ সাজসজ্জা। বিরাট ঘর। কাজ করা সিলিং। লিভিং রুম। লাইব্রেরী। ডাইনিংরুম। পুরোনো আমলের কিচেন। কুকিং রেঞ্জ। দোতলায় বেডরুম।
ল্যারি জানতে চাইল- তোমার চাকর বাকর?
-তুমিই আমার সব।
তার মানে? রান্নাবান্না কে করবে? ঘর পরিষ্কার?
–আমরা এখান থেকে চলে যাবার পর দুজন আসবে, তারা আমাদের দেখতে পাবে না। আমি একটা এজেন্সীর মাধ্যমে সব ব্যবস্থা করেছি।
ল্যারি অবাক হয়ে গেল।
নোয়েলের কণ্ঠস্বরে উদ্বিগ্নতা-কখনও কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসকে কম বোঝার চেষ্টা করো না। এ ব্যাপারে কিছু জানতে পারলে ও কিন্তু দুজনকেই মেরে ফেলবে।
না-না, ওই বুড়ো এমন করতেই পারে না।
আবার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর, ও দুজনকেই মারবে।
নোয়েলের কণ্ঠস্বর, এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতায় ভরা।
-সত্যি কথা বলছ?
-হ্যাঁ, ল্যারি, তুমি কি জানো ও কতখানি নির্মম?
–তা বলে আমাদের হত্যা করবে?
-ও কিন্তু বুলেট ব্যবহার করবে না। অনেক রকম উপায় আছে, মানুষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার।
এসো, আমরা বেডরুমে যাই।
হাতে হাতে, ওরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে গেল। নোয়েলে বলল- আমাদের চারটে বেস্ট বেডরুম আছে। আমরা সবকটাতেই পাল্টে পাল্টে শোব। সে সবথেকে বড়ো বেডরুমে ঢুকল। সমুদ্রের সব কিছু দেখা যাচ্ছে জানলা দিয়ে। ল্যারি দেখতে পেল, একটা সুন্দর টেরাসে। সেটা সাগরের জলে চলে গেছে। একটা ডক, প্রমোদ তরণী। মোটর বোট সবকিছু।
–এই বোটের মালিক কে?
নোয়েলে তার ঠোঁটে চুমুর চিহ্ন আঁকতে আঁকতে বলল- তুমি, এটাই আমার তরফ থেকে তোমাকে উপহার।
খুলে গেছে পোশাকের শেষতম আবরণ, এখন নোয়েলে সম্পূর্ণ উলঙ্গা। তারা এই অবস্থাতেই সমস্ত বিকেলটা বিছানাতে শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিল।
.
দশটা দিন কোথা থেকে উড়ে গেল। নোয়েলে কত রকমভাবে ল্যারিকে খুশি করেছে। কখনও সে হয়েছে এক পরিচালিকা। ল্যারির প্রত্যেকটা উদ্ধত আচরণ সহ্য করেছে। অসভ্য ইচ্ছা। বাধা দেয়নি। ল্যারির কেবলই মনে হয়েছে, এই জগতে সেই রাজা। কত কী আছে এখানে। লাইব্রেরীতে প্রিয় লেখকের বই, অসংখ্য রেকর্ড। নোয়েলে রান্নাও ভালো জানে। অসাধারণ পদ বেঁধেছে। তারা কখনও নীল জলে স্নান করেছে। ভালোবেসেছে। রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বলা যেতে পারে, তারা এখানে নিজেদের বন্দী করে রেখেছে। কারো সাথে দেখা করেনি। প্রত্যেক দিন ল্যারি নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছে। নোয়েলে তার কাছে নতুনভাবে আবির্ভূত হয়েছে। মানুষকে উত্তেজিত করার এত কৌশল এই মেয়েটি জানে? যৌনতার পরম পরিপ্রেক্ষি। মাঝে মাঝে সে অবশ্য ব্যবসা এবং রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করেছে। কিন্তু ল্যারি এখন সেদিকে মন দিতে পারছে না।
তারা পকার খেলেছে, রামি খেলেছে, ল্যারি জিততে পারেনি। নোয়েলে তাকে নিয়ে দাবা খেলায় বসেছে। এই খেলাতেও ল্যারির কোনো আগ্রহ নেই।
রোববার, অসাধারণ পিকনিক। তারা বীচের ওপর বসে আছে। সূর্যের নীচে, প্রতিটি মুহূর্তকে আনন্দঘন করতে চাইছে। নোয়েলে তাকিয়ে আছে, দুজন মানুষের দিকে, বীচের দিকে এগিয়ে আসছে।
নোয়েলে বলেছেচল, আমরা ভেতরে যাব।
ল্যারি অবাক না-না, এরা বোধহয় সাধারণ গ্রামবাসী, বেড়াতে বেরিয়েছে।
–জিনিসগুলো গুছিয়ে নিতে হবে।
এখনই?
–হ্যাঁ, নাহলে সন্দেহ হতে পারে।
তারা সবকিছু তুলে নিয়েছে। বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে। সন্ধ্যে অব্দি ল্যারি কোন কথা বলেনি। সে লাইব্রেরীতে বসেছে। তার মন সন্দেহে ভরে গেছে। নোয়েলে কিচেনে কাজ করছে।
রাত হয়েছে। তখনও ল্যারি লাইব্রেরিতে বসে। নোয়েলে জিজ্ঞাসা করেছে, এখন আর চিন্তা করে কী হবে?
–ওরা গ্রামবাসী, এভাবে সব সময় চিন্তা করছ কেন? আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে সকলের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে হবে।
নোয়েলে জানে, এই স্বীকারোক্তির মধ্যে কোনো মিথ্যে নেই। অনেকগুলো বছরের কথা তার মনে পড়ে গেল। সে ল্যারিকে সরিয়ে দেবার পরিকল্পনা করেছিল। এখন, এখন অন্যভাবে ল্যারিকে ধ্বংস করছে। এর মধ্যে একটা বন্য উন্মাদনা আছে। নোয়েলে এবং ল্যারি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা জানে কীভাবে দিন কেটে গেছে। বিশেষ করে আমস্টারডামের ওই উড়ান। মৃত্যুর হাতছানি। ল্যারির পাশে নোয়েলে, ককপিটে। একে অন্যকে সহ্য করতে পারছে না।
শেষ অব্দি, প্যারিসের পথে হাঁটতে হাঁটতে ল্যারি বলেছিল– চল, আমরা বিয়ে করি। আমরা একটা ছোট্ট নীড়ের সন্ধান করব।
সবকিছু মনে পড়ছে। নোয়েলের কাছে জীবনটা অন্য রকম হয়ে উঠছে। শেষ অব্দি নোয়েলে চিন্তা করল, ল্যারিকে আমার রাজ্যের সম্রাট করতে হবে। এমন ভালোবাসা তাকে আমি দেব, যে ভালোবাসা সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না।
.
নোয়েলে এবং ক্যাথারিন এথেন্স ১৯৪৬
১৮.
ল্যারি আর নোয়েলের কাছে পরবর্তী তিনমাস কেটে গেছে স্বর্গীয় আনন্দ ও উন্মাদনার মধ্যে। এ বোধহয় যাদুর জগৎ। ল্যারি শুধু ভালোবাসা পেয়েছে। আকাশে উড়েছে। মাঝে মধ্যে রাফিনাতে গেছে। সপ্তাহ শেষের দিন কাটিয়েছে। নোয়েলে তাকে এখন আরও আপন করে নিয়েছে। একে অন্যকে অপরিসীম ভালোবাসা দিয়েছে। মাঝে ডেমিরিসের কথা চিন্তা করেছে। ল্যারি কখনও কখনও ভিলাতে একেবারে একা থেকেছে। মন পরিপূর্ণ হয়েছে হিংসা এবং রাগে। নোয়েলের কথা ভেবেছে। নোয়েলে আর ডেমিরিস এখন একসঙ্গে বাস করছে। ব্যাপারাটা ভাবতে গেলে মাথাটা গরম হয়ে যায়।
পরের সপ্তাহ, নোয়েলের সাথে দেখা হয়েছে। এ কী? নোয়েলে এত উৎসাহী কেন?
নোয়েলে জানতে চেয়েছে-তুমি আমাকে মনে করেছ?
–হ্যাঁ।
–তাহলে? ডেমিরিস কেমন?
–ঠিক আছে।
কী ধরনের ঠিক আছে?
–আমি অন্য কিছু ভাবছি।
কী ভাবছ? হয়তো কথাটা ভালো শোনাবে না, কনস্ট্যানটিনের সাথে যখন আমি থাকি, তখন তোমার কথা মনে পড়ে। ল্যারি আমি তোমাকে বলেছি, আমি কোনো কিছুর সাথে তোমাকে ভাগ করতে পারব না। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?
ল্যারি অবাক, একটা সত্য ধীরে ধীরে তার কাছে উন্মোচিত হচ্ছে। নোয়েলে আবার জানতে চাইছে– সত্যি তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও?
-তুমি তো জানো আমি তোমাকে কতখানি চাই।
কিন্তু কীভাবে? ডেমিরিসকে একথা বলা যাবে?
নোয়েলে মাথা নেড়েছে না, ডেমিরিস কিছুই বুঝতে পারবে না। আমাদের আরও চালাক হতে হবে। ডেমিরিস কি আমার শরীরের সম্রাট নাকি? আমি ওকে ত্যাগ করব, ও আমার কিছুই করতে পারবে না। এক দুমাস বাদে তুমি চাকরিটা ছেড়ে দেবে। আমরা অন্য কোথাও চলে যাব। হয়তো মার্কিন দেশে। সেখানে গিয়ে আমরা বিয়ে করব, আমার কাছে অনেক টাকা আছে। সারা জীবন কেটে যাবে। আমি তোমার জন্য একটা চাটার্ড এয়ার লাইন কিনে দেব। অথবা একটা ফ্লাইং স্কুল তৈরি করব। কিংবা তুমি যা চাও।
ল্যারি অবাক হয়ে গেছে। নোয়েলের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না এমন একটা কোনো দিন ঘটতে পারে।
শেষ পর্যন্ত ল্যারি জানতে চেয়েছে আমার স্ত্রী? তার কী হবে?
–তুমি ডিভোর্স দাও।
–ও কি আমাকে ডিভোর্স দেবে?
ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে পারো।
–ঠিক আছে আমি দেখছি।
–তোমাকে আমি দুঃখ দেব না ডার্লিং। আমি কথা দিচ্ছি। নোয়েলে বলল।
.
ক্যাথারিনের জীবন এখন এক নিঃসঙ্গতার মধ্যে দিয়ে কেটে চলেছে। সে বুঝতে পারছে না, কীভাবে এই অন্ধকার থেকে আলোর জগতে পা রাখবে। বহুদিন ল্যারি বাড়িতে আসছে। এ ব্যাপারে ক্যাথারিন আর কারো সঙ্গে যোগাযোগ করে না। যখন ক্যাথারিন প্রথম এথেন্সে এসেছিল, মাঝেমধ্যেই সে উইলিয়াম ফ্রেসারকে চিঠি লিখত। নানা খবর পাঠাত। এখন ল্যারিকে নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ক্যাথারিন আর ফ্রেসারকে চিঠি লিখতে চাইছে না। ফ্রেসারের গত তিনটি চিঠির উত্তর সে দেয়নি। এমন কী শেষতম চিঠিটা সে খুলে পর্যন্ত দেখেনি। কেউ তাকে করুণা করুক, এটা সে মোটেই চাইছে না।
একদিন একটা কেবল এল তার কাছে। সেটা টেবিলের ওপর পড়ে আছে। ডোরবেলের শব্দ পাওয়া গেল। উইলিয়াম ফ্রেসার এসে দাঁড়িয়েছেন। ক্যাথারিন অবাক হয়ে গেছে বিল? বিল ফ্রেসার?
উইলিয়াম ভেতরে ঢুকলেন, দেখতে পেলেন, কী যেন একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা।
–বিল ডার্লিং, এখানে কেন এসেছ?
ফ্রেসার বললেন- আমি ব্যবসার কাজে এথেন্সে এসেছি, তুমি আমার কেবল পাওনি?
ক্যাথারিন মনে করার চেষ্টা করল। শেষ পর্যন্ত সে বলল- হ্যাঁ, এটা বোধহয় ওখানে রয়ে গেছে। আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম।
ক্যাথারিন দ্রুত শোবার ঘরে চলে গেল, চারপাশ অগোছালো।
ফ্রেসার জানতে চাইলেন ক্যাথারিন তুমি ঠিক আছে তো?
–হ্যাঁ, একটু ড্রিংক চলবে কি?
–সকাল এগারোটা। এখনই ড্রিংক?
ক্যাথারিন বলল–তুমি ঠিক বলেছ, বিল, এখন ড্রিংক করা উচিত নয়। আমি তোমার আগমনটাকে এভাবেই স্বাগত সম্ভাষণ জানাতে চেয়েছিলাম। সারা পৃথিবীতে তুমিই হলে একমাত্র মানুষ, যে আমার সাথে সকাল এগারোটায় ড্রিংক খেতে পারো।
ক্যাথারিনের কথাবার্তা অগোছালো। ক্যাথারিন জিজ্ঞাসা করল গ্রিক ব্র্যান্ডি চলবে? একসময় আমার এটা ভালো লাগত না। এখন ভালো লাগছে।
ফ্রেসার ড্রিংক হাতে বসলেন, জিজ্ঞাসা করলেন- ল্যারি কোথায়?
ল্যারি? সে বোধহয় কোথায় প্লেন ওড়াচ্ছে। সে পৃথিবীর সবথেকে ধনী মানুষের হয়ে কাজ করে। তুমি জানো তো? ডেমিরিস, সেই এখন ল্যারির সর্বস্ব।
–তুমি ড্রিংক করো ল্যারি জানে?
ক্যাথারিন গ্লাসটা নামিয়ে রাখল, বলল–এটা কী ধরনের প্রশ্ন হল? কে বলেছে আমি ড্রিংক করি? আমার পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তুমি কি এখনও আমার পেছনে লাগবে?
ক্যাথারিন?
কী বলছো?
–তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার সাহায্যের প্রয়োজন।
ক্যাথারিন চীৎকার করে বলল- না, না, কেউ করুণা করুক, আমি তা চাইছি না।
ফ্রেসার ক্যাথারিনের দিকে তাকালেন– এখনই আমাকে একটা কনফারেন্সে যেতে হবে, আজ রাতে আমার সঙ্গে ডিনার করবে।
ক্যাথারিন বলল- ঠিক আছে আমি যাব।
–তোমাকে আমি আটটার সময় তুলে নেব।
বিল ফ্রেসার দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। ক্যাথারিন এলোমেলো পায়ে বেডরুমে পৌঁছে গেল। ক্লোসেটের দরজাটা খুলল, দেয়ালে একটা আয়না ঝুলছে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকল। না, এ কী চেহারা হয়েছে আমার? অনেক কথাই মনে পড়ে গেল। মোটেল রুম, রন ফিডারসন বলেছিল, ক্যাথি, সারা জীবনে আমি তোমার মতো সুন্দরী মেয়েকে কখনও দেখতে পাব না।
বিল ফ্রেসার, হাতে হাত রেখে বলেছিলেন- তুমি এত সুন্দরী ক্যাথারিন? ল্যারি বলেছিল- ক্যাথি, তুমি অসাধারণ।
সে আবার আয়নার দিকে তাকাল। আয়না যেন হো হো করে হেসে উঠেছে। বলছে কে তুমি? এক বিষণ্ণ রমণী, ক্যাথারিন চীৎকার করছে, আশাহীনভাবে, অনেকক্ষণ বাদে ডোরবেলের শব্দ, বিল ফ্রেসারের কণ্ঠস্বর– ক্যাথারিন তুমি কোথায়?
ডোরবেল বেজেই চলেছে। ক্যাথারিন কি একা? সে কি আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।
পরদিন সকালবেলা, ক্যাথারিন ট্যাক্সি নিয়েছে। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। ডাক্তারের নাম নিকোডেস, এক মোটা চেহারার মানুষ। চোখের তারায় কমনীয়তা আছে।
নার্স ক্যাথারিনকে তার প্রাইভেট অফিসে নিয়ে গেল। ডাক্তার বললেন মিসেস ডগলাস বসুন।
ক্যাথারিন বসল। ভীষণ ভয় পেয়েছে সে। সমস্ত শরীরটা ঠকঠক করে কাঁপছে।
–আপনার সমস্যা কী?
কীভাবে শুরু করব আমি? ক্যাথারিন ভাবতে থাকে। সে জল খায়।
ডাক্তার জানতে চায়–আপনার কত বয়স?
ক্যাথারিন জবাব দেয়–আঠাশ।
–আপনি কি আমেরিকান?
–হ্যাঁ।
–এখন এথেন্সে বাস করেন?
–হ্যাঁ।
কত বছর এখানে আছেন?
–এক হাজার বছর। সেই কবে এখানে এসেছিলাম…
ডাক্তার হাসলেন– বাঃ ভালো বলেছেন তো। তিনি ক্যাথারিনকে সিগারেট দিলেন। ক্যাথারিন সিগারেট ধরাল। ডাক্তার কি দেখতে পাচ্ছেন? আমার হাত কাঁপছে।
–মিসেস ডগলাস বলুন– আপনাকে কী ধরনের সাহায্য করব।
ক্যাথারিন অসহায়ভাবে বলতে থাকে। আমি জানি না। আমি কিছুই বলতে পারছি না।
কী রকমের মনে হচ্ছে।
–আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। আমি কেমন কুৎসিত দেখতে হয়ে গেছি।
–আপনি কি ড্রিংক করেন মিসেস ডগলাস?
–কোনো কোনো সময়ে।
কতটা?
–ঠিক থাকে না।
–আজকে ড্রিংক করেছেন?
না।
ডাক্তার বললেন আপনি অসুন্দরী কে বলেছে? আপনার ওজনটা একটু বেশি হয়ে গেছে। আপনি চুলের যত্ন নিচ্ছেন না। আপনার মুখের তলায় কালি পড়েছে। সেই সুন্দরী মহিলা এখনও লুকিয়ে আছে, আমি কথা দিচ্ছি, আপনি অত চিন্তা করবেন না।
ক্যাথারিন কেঁদে ফেলল। বুঝতে পারছে, এখন এভাবে কাদা উচিত নয়। বেশ কয়েকবার বেলের শব্দ। ডাক্তার অপেক্ষা করলেন। ক্যাথারিনের কান্না থেমে গেল। ক্যাথারিন বলল আমি দুঃখিত, আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?
ডাক্তার নিকোডেস জবাব দিলেন–ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে আপনার ওপর নির্ভর করছে। আপনার কী সমস্যা তা তো আমি বুঝতে পারলাম না।
–আমার দিকে ভালো করে তাকান।
–এটা কোনো সমস্যা নয়, এটা একটা ব্যাপার মাত্র। ঠিক করে বলুন তো কি হয়েছে? আপনার স্বামী কী বেঁচে আছেন?
-হ্যাঁ, কিন্তু সে মাঝে মধ্যে বাড়িতে আসে, ছুটি এবং সপ্তাহের শেষে।
–আপনি কি তার সঙ্গে থাকেন?
যখন সে বাড়ি আসে।
–উনি কি করেন?
–উনি কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের পার্সোনাল পাইলট।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের মুখ পাল্টে গেল।
ক্যাথারিন জানতে চাইল- আপনি কি আমার স্বামীর নাম জানেন?
-না, মিসেস ডগলাস, আপনি কি স্বামীকে ভালোবাসেন?
ক্যাথারিন কিছু বলার চেষ্টা করেছিল– ভালোবাসা? এই শব্দটার সাথে কত বছর তার পরিচয় নেই।
শেষ পর্যন্ত সে বলল- হ্যাঁ, আমি ভালোবাসি।
–উনি কি আপনাকে ভালোবাসেন?
ক্যাথারিন ল্যারির অন্যান্য শয্যাসঙ্গিনীর কথা ভাবল। সে জানে না সত্যি সত্যি ল্যারি তাকে ভালোবাসে কিনা। তাই কথা বলতে পারল না। শেষ কালে বলল- আমি জানি না।
–আপনার কখনও মানসিক বিকলন হয়েছে?
–না, কখনও হয়নি। তাহলে আমি? এখন কি করব।
ডাক্তার আর হাসছেন না। তিনি বললেন- মানুষের মন এক রহস্যের ভাণ্ডার। কখন দুঃখ কখন যন্ত্রণা, কেউ জানে না।
ক্যাথারিন হঠাৎ বলল– মাঝে মধ্যে ভীষণ ভয় লাগে, তখন আমি মদ খাই। মদ খেলে শরীরটা চাঙা হয়ে ওঠে।
না, আপনি মদ খান জীবন থেকে পালাবেন বলে।
আমি কী করব তখন?
আমি আপনাকে একটা ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেব। তারা আপনাকে ভালোভাবে পরীক্ষা করবে। আপনাকে ড্রিংক করা একদম ছাড়তে হবে। আমি একটা ডায়েট চার্ট লিখে দিচ্ছি।
ঠিক আছে।
উনি আরও বললেন– আপনি জিমে যাবেন। সেখানে নিয়মিত শরীর চর্চা করবেন। মিসেস ডগলাস মনে রাখবেন, কয়েক মাসের মধ্যে আপনি ভালো হবেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আপনার মনটা ভালো হয়ে যাবে। আয়নার দিকে তাকালে মন অহংকারে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। যখন স্বামী আপনার দিকে তাকাবেন, তিনিও আকর্ষণ বোধ করবেন।
ক্যাথারিন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে বুঝি বিশ্বাস করতে পারছে না।
এটা একটা পরিকল্পনা, আপনাকে করতেই হবে।
ক্যাথারিন বলল- আমি কথা দিচ্ছি করব।
মদ খাওয়া বন্ধ না করলে কিছুই হবে না। আমি জানি ব্যাপারটা খুব কষ্টকর।
–না, আমি করতে পারব।
ডাক্তার ঠিক কথাই বলেছেন। পালিয়ে যাবার জন্যই আমি মদের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করি। আমার একটা নির্দিষ্ট জীবনরেখা চাই।
–আমি কখনও একফোঁটা মদ খাব না।
ক্যাথারিন বলল।
ডাক্তার তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনাকে আমি বিশ্বাস করি শ্রীমতী ডগলাস।
ক্যাথারিন উঠে দাঁড়াল, তারপর বলল– আজ থেকেই আমার নতুন জীবন শুরু হবে তাই তো?
ডাক্তার কার্ডে কিছু একটা লিখে দিলেন। তারপর বললেন- এটা ক্লিনিকের ঠিকানা। আমি পরে আপনাকে ডেকে পাঠাব।
ক্যাথারিন রাস্তায় বেরিয়ে এল। ট্যাক্সি নিল। ভাবল, কী হবে এভাবে শরীরকে কষ্ট দিয়ে?
ল্যারির কথা মনে পড়ল। ল্যারি এখন কোথায় আছে?
ক্যাথারিন সালোনির কাছে চলে গেল। অসাধারণ বিউটি পার্লার। ভেতরে ঢুকে পড়ল। মারবেল পাথরের সাজানো ঘর। এক রিসেপশনিস্ট ক্যাথারিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল- বলুন কী করব?
কাল সকালে অ্যাপয়েমেন্ট হবে?
ভদ্রমহিলা মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, ম্যাডাম, আর কিছু?
ক্যাথারিন বলল– আমি এখানে আসব। আমি নিয়মিত এখানে এসে শরীরচর্চা করতে চাইছি।
রিসেপশনিস্ট মেয়েটি অবাক হয়ে বলতে থাকে- ঠিক আছে। আপনাকে সাহায্য করব।
ক্যাথারিন বাইরে বেরিয়ে এল। মাদাম পিরিস, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, সামনে সাইনবোর্ড। এই সেই মাদাম পিরিস। কাউন্ট পাপ্পাস যার কথা বলেছিলেন।
পথটা অন্ধকার, কোণে একটা বার আছে। টেবিল চেয়ার ছড়ানো, ক্লান্ত ওয়েটার, এগিয়ে এল। গ্রিক ভাষায় প্রশ্ন করল। ক্যাথারিন বলল– আমি কিছুই ড্রিংক করব না। আমি মাদাম পিরিসের সাথে কথা বলতে চাই। উনি কি আছেন?
একটা ফাঁকা টেবিল, হলের এক ধারে ক্যাথারিন চেয়ারে বসে পড়ল। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে।
উনি বললেন আপনি কে? আপনি কেন এসেছেন এখানে?
ক্যাথেরিন জবাব দিল- ম্যাডাম, আপনি তো ভবিষ্যদ্বাণী করেন। আমি জানতে চাইছি ভবিষ্যতে আমার কী ঘটবে।
ওই মহিলা বসলেন। হাত তুললেন, ওয়েটার এল। দুটো ট্রের ওপর কালো কফির মগ রয়েছে।
ক্যাথারিন বলল আমার কিছু লাগবে না।
–একটু খানি খেতে হবে।
ক্যাথারিন অবাক হয়ে তাকাল। কাপটা তুলে নিল। চুমুক দিল। খুব শক্তিশালী এবং তেতো। কাপটা নামিয়ে রাখল।
মহিলা বললেন–আরো খেতে হবে। ক্যাথারিন বাধা দেবার চেষ্টা করল। তারপর ভাবল, না, ভদ্রমহিলাকে চটিয়ে কী লাভ? সে আরেকটু খেল। মুখটা বিস্বাদ হয়ে গেছে।
আরও একবার।
ক্যাথারিন কাঁধ ঝাঁকিয়ে আরও একবার খেল। তলায় থকথকে কী একটা পড়ে আছে। মাদাম পিরিস মাথা নাড়লেন। কাপটা ক্যাথারিনের কাছ থেকে তুলে নিলেন। কাপটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, ক্যাথারিন চুপ করে বসে আছে। আমার মতো এক বুদ্ধিমতী কিনা এখানে এসেছে? এক বৃদ্ধা মহিলা আমার ভাগ্য বলবেন? ফাঁকা কফি কাপের দিকে তাকিয়ে।
ভদ্রমহিলা আস্তে আস্তে বললেন। আপনি দূর থেকে এসেছেন।
ক্যাথারিন বলল- হ্যাঁ।
মাদাম পিরিস ক্যাথারিনের চোখের দিকে তাকালেন। এই মহিলার শরীরে কী একটা আছে। ক্যাথারিন অবাক হয়ে গেছে।
বাড়ি চলে যান।
–আমি বাড়ি থেকেই তো আসছি।
না, বলছি না, অনেক দূর থেকে আপনি এসেছেন।
এবার ক্যাথারিন অবাক হয়ে গেছে। হ্যাঁ, আমেরিকা। আমতা আমতা করে সে বলে।
–যে চুলোয় হোক, পালান-পালান–এক্ষুনি। এখান থেকে পালিয়ে যান।
–কেন?
ক্যাথারিনের সমস্ত শরীর আচ্ছন্নতা, সে ভীষণ ভয় পেয়েছে। সে জানতে চাইল- সত্যি করে বলুন তো কোনো বিপদের সম্ভবনা আছে কি?
ভদ্রমহিলার সমস্ত শরীর কাঁপছে। তিনি চীৎকার করে বললেন–বিপদ? বিপদচারদিকে বিপদ।
-কী বলছেন?
চলে যান, ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বরে একটা উদ্বিগ্নতা। মনে হল, উনি বোধহয় পিঞ্জরাবদ্ধ একটা জন্তু।
ক্যাথারিন বলল- আপনি মিছিমিছি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। বলুন কী হয়েছে?
–পালাও পালাও, যদি বাঁচতে চাও তাহলে পালাও। বিপদ! ভয়ংকর বিপদ।
ক্যাথারিন নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। কোনো রকমে সে বলল- কী ধরনের বিপদ বলবেন কি?
ভদ্রমহিলার মুখে করুণ ছায়া, মৃত্যু, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
উনি উঠলেন, ভেতরের ঘরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
ক্যাথারিন অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিল। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বুঝি স্তব্ধ হয়ে গেছে। হাত কাঁপছে। পা কাঁপছে।
বাইরে উজ্জ্বল আলো, সে ভেতর থেকে বাইরে চলে এসেছে। তার মনটা আবার আগের মতো হল। এক বৃদ্ধা রমণীর কাছে সে এইভাবে বসেছিল? মিছিমিছি ভয় পেয়েছিল? না, এখন থেকে সে আরও সাহসিকা হয়ে উঠবে।
ক্যাথারিন অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল। লিভিং রুমের দিকে গেল। মনে হচ্ছে সে যেন এখানে প্রথমবারের মতো এসেছে। এ কী? চারপাশে সব ছড়ানো ছেটানো রয়েছে। ক্যাথারিন বিশ্বাস করতে পারছে না, সে কিছু বুঝতে পারেনি কেন?
ল্যারি বেডরুমে, একটা সুটকেশ পড়ে আছে বিছানার ওপর। সে আরেকটা সুটকেশ গোছাচ্ছে, ক্যাথারিন এল। বলল- এগুলো রেডক্রশের জন্য। আমি রেখে দিয়েছি।
ল্যারি বলল– আমি চলে যাচ্ছি।
ডেমিরিসের সাথে আরেকটা উড়ান?
না, এটা আমার নিজস্ব। আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।
ল্যারি জিজ্ঞাসা করল আলোচনা করার আর কিছু নেই?
ক্যাথারিন বেডরুমে গেল, আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করল। বলল- অনেক কিছু আলোচনা করার আছে। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম, ডাক্তার বলেছেন আমি আবার আগের মতোই সুন্দরী হয়ে উঠব। আমি আর মদ খাবো না।
ক্যাথি, ব্যাপারটা হয়ে গেছে, আমি ডিভোর্স চাইছি।
শব্দগুলো ক্যাথারিনকে আঘাত করেছে। সে দাঁড়াতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে বুঝি এবার পড়ে যাবে। সে কোনো রকমে বলল- হ্যাঁ, আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। আমারই দুভার্গ, আমি তোমাকে ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু দেখো আমি এখন পরিবর্তন চাইছি।
ল্যারি তাকাল, সে বলল- আমি অন্যজনকে ভালোবাসি। সত্য স্বীকার করছি। আমি ডিভোর্স চাইছি।
ক্যাথারিন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। সে লিভিংরুমে চলে গেল। কৌচে বসল। গ্রিক ফ্যাশান ম্যাগাজিনের দিকে তাকাল। হ্যাঁ, ল্যারির সব গোছানো হয়ে গেছে। ল্যারির কণ্ঠস্বর আমার অ্যাটর্নি তোমার সঙ্গে কথা বলবে।
ক্যাথারিন দরজাটা বন্ধ করল। ক্যাথারিন সেখানে অনেকক্ষণ বসে ছিল। ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিল। তারপর সেন্টার টেবিলের দিকে গেল, সেখানে মেডিসিনের বাক্সটা পড়ে আছে। সে একটা ব্রেড বের করল। তার হাতের ওপর আঘাত করল। ধমনী কেটে গেছে, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে বেরোচ্ছে।
.
নোয়েলে এবং ক্যাথারিন, এথেন্স– ১৯৪৬
১৯.
সাদা ভূতেরা চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা যেন একটা অদ্ভুত ভাষায় কথা বলছে। কী ভাষা ক্যাথারিন তা বুঝতে পারছে না। তার কেবলই মনে হচ্ছে, এই যন্ত্রণা সে বোধহয় সহ্য করতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত আমি কি পাগল হয়ে যাব? ভীত সন্ত্রস্ত ক্যাথারিন ভাবতে থাকে।
পাঁচদিন কেটে গেছে, ক্যাথারিনকে হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে। পাঁচদিন বাদে সে প্রথম চোখ খুলেছে, দেখেছে নিজে হাসপাতালের ছোট্ট ঘরে শুয়ে আছে। সাদা পোশাক পরা নার্স তার দিকে তাকিয়ে আছে। ডাঃ নিকোলাস স্টেথিসকোপ দিয়ে তাকে পরীক্ষা করছেন।
ডাক্তার ক্যাথারিনের দিকে তাকালেন কি ঘুম ভেঙেছে?
ক্যাথারিন চারপাশে তাকাল। বুঝতে পারল না কী ঘটেছে। সে বলল– আমি কি নরকে?
-হ্যাঁ।
কদিন?
–পাঁচদিন।
সে হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকাল। হ্যাঁ, আমি এটা করেছি।
সে বলল– আমি দুঃখিত। দেখল বিল ফ্রেসার বসে আছেন চেয়ারে। তার দিকে তাকিয়ে আছেন। টেবিলে ফুল এবং চকোলেট।
ফ্রেসার আনন্দের সঙ্গে বললেন- তোমাকে ভালো লাগছে।
কী বলছ?
ক্যাথারিন, এমন করতে আছে?
–বিল, আমি দুঃখিত।
–তোমার জন্য ফুল আর চকোলেট এনেছি। এরপরে তোমাকে বই দেবো।
ক্যাথারিন ফ্রেসারের দিকে তাকাল। এই সুন্দর মুখ, আমি কেন একে ভালোবাসতে পারলাম না? যাকে আমি ঘেন্না করি তাকে ভালোবাসা দিলাম?
–আমি এখানে কি করে এলাম?
–অ্যাম্বুলেন্সে।
আমাকে কে দেখল?
ফ্রেসার বলতে চাইলেন– আমি তোমাকে অনেক বার ফোন করেছিলাম। তোমার উত্তর পেলাম না। আমি দরজা ভেঙে ঢুকেছি।
–অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু আমি কি বেঁচে উঠব?
–হ্যাঁ, ফ্রেসার বললেন, আমাকে বাড়িতে ফিরতে হবে। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব।
ফ্রেসার ক্যাথারিনের কপালে একটা চুমু দিলেন। ক্যাথারিন চোখ বন্ধ করল। চোখ খুলল, এখানে কেউ নেই। মনে হল মধ্যরাত।
পরের দিন সকালবেলা ল্যারি দেখা করতে এসেছিল। ক্যাথারিন তাকে ডেকেছে। সে একটা চেয়ারে বসল।
ক্যাথি, তুমি কেমন আছ?
দারুণ, আত্মহত্যার প্রবণতা আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছে।
–এভাবে এমন কাজ করলে কেন?
–তোমার কি খারাপ লেগেছে?
ক্যাথারিন, আমি এভাবে বিদায় চাইনি। আমি একটা ডিভোর্স চেয়েছি মাত্র।
ক্যাথারিন তাকাল, এই সুন্দর চেহারার পুরুষ, তার বিবাহিত স্বামী। এখন কেমন যেন হয়ে গেছে। কত বছরের স্বপ্ন? সাত বছর কি? এত ভালোবাসা? এত আশা? বিল ফ্রেসারের কথা মনে পড়ল, ওয়াশিংটনের দিনগুলি, বন্ধু-বান্ধব, হুল্লোড়-আলোচনা। শেষবার যখন দেখা হয়েছিল, শেষ হাসি, শেষ আনন্দ।
ল্যারির দিকে তাকিয়ে ক্যাথারিন বলল না, আমি তোমাকে ডিভোর্স দেব না!
.
ল্যারি নোয়েলের সঙ্গে দেখা করল। সেই রাতে। একটা ফাঁকা জায়গাতে। ক্যাথারিনের সঙ্গে তার যা কথা হয়েছে সেটা সংক্ষেপে জানিয়ে দিল। নোয়েলে বলল- ওকি ওর মন পরিবর্তন করবে?
না ও ভীষণ জেদী, মরে গেলেও মন পাল্টাবে না।
–তুমি ওর সঙ্গে আবার কথা বলার চেষ্টা করো।
.
ল্যারি কথা বলল। তিন সপ্তাহ ধরে। কিন্তু কিছুতেই ক্যাথারিন রাজি হচ্ছে না। তাকে টাকা দিতে চাইল। প্রার্থনা করল। ভয় দেখাল। কোনো কিছুতেই ক্যাথারিনের মন পাল্টাছে না। ক্যাথারিন এখনও পাগলের মতো ল্যারিকে ভালোবাসে।
ক্যাথারিন বলল তুমি আমার স্বামী, আমি মৃত্যু পর্যন্ত তোমাকে স্বামী হিসাবেই সম্মান করব।
.
নোয়েলের কাছে সব কথা ল্যারি জানাল। নোয়েলে মাথা নাড়ল- ঠিক আছে।
-ঠিক আছে কী?
তারা সমুদ্রের ধারে ওই ভিলাতে শুয়ে আছে। দুজনের গায়ের ওপর সাদা ভোয়ালে ঢাকা। ভেতরে হাতের অসভ্য খেলা চলেছে।
ল্যারি বুঝতে পারছে না, নোয়েলে এবার কী করতে চলেছে। নোয়েলে কি শেষ পর্যন্ত ক্যাথারিনকে মেরে ফেলবে নাকি?
হঠাৎ হেলেনার কথা মনে পড়ে গেল ল্যারির।
.
টেরাসে বসে তারা রাতের খাবার খাচ্ছে। নোয়েলে বলল- তোমার কী মনে হয় ল্যারি? ওই মেয়েটির আর বেঁচে থাকার অধিকার নেই। ও তোমার জীবনটা অতীষ্ঠ করে তুলবে। শুধু তোমার নয়, আমাদের দুজনেরই, ডার্লিং।
.
ওরা বিছানাতে শুয়ে সিগারেট পান করছে। সিগারেটের গন্ধ ওদের মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি জাগিয়ে তুলেছে।
–নোয়েলে, তুমি আমাকে ক্ষমা করো, ও নিজেকে একবার মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। পারেনি। ওকে বাঁচতে দাও।
–আমি কখনওই তা করব না, এটাই আমার শেষ কথা।
নোয়েলে তার নগ্ন পা দিয়ে ল্যারির পায়ের ওপর চাপ দিল। দুটি শরীর এখন আরও কাছে এগিয়ে আসছে। একটিতে কমনীয়তা, অন্যটিতে কাঠিন্য। ল্যারি আর্তনাদ করল। আনন্দে আর ভালোবাসায়। তার মনের আকাশ থেকে ক্যাথারিন তখন সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে।
মাঝরাতে ল্যারির ঘুম ভেঙে গেল। সমস্ত শরীরে ভয়ের শিহরণ। ঠান্ডা ঘামের স্রোত বয়ে চলেছে। সে ভাবল, নোয়েলে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, নোয়েলে তো পাশেই শুয়ে আছে। সে নোয়েলেকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল। বাকি রাত তার চোখে ঘুম নেই। সে ভাবল, নোয়েলে যদি চলে যায়, তাহলে কী হবে?
সকাল হয়েছে, নোয়েলে ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে।
ল্যারি বলল– ধরা পড়ে গেলে কী হবে?
না, ব্যাপারটা এত সুন্দরভাবে করব, পুলিশ বুঝতেই পারবে না।
–নোয়েলে, ল্যারি বলল, সবাই জানে আমার সাথে স্ত্রীর ভালো সম্পর্ক নেই। ক্যাথারিনের কিছু হলে পুলিশ কিন্তু আমাকেই সন্দেহ করবে।
-না, কখনও করবে না। দেখো না, আমার পরিকল্পনাটা কীভাবে কার্যকরী হয়।
ব্রেকফাস্টের আসর, নোয়েলে আর ল্যারি কথা বলছে।
ল্যারির কিছুই ভালো লাগছে না।
নোয়েলে বলল- কেন, চা-টা ভালো হয়নি বুঝি?
এবার তারা প্রমোদ তরণীতে বেরিয়েছে। অনেক-অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। কল্পনা এসে গ্রাস করছে তাদের। বাস্তব হারিয়ে যাচ্ছে।
নোয়েলে বলল- মনে হবে একটা অ্যাকসিডেন্ট। পুলিশ আসবেই না। এথেন্সের পুলিশরা খুবই চালাক।
–তাহলে তারা কি তদন্ত করবে না?
–না, অ্যাকসিডেন্টটা এখানে হবে না।
–কোথায় হবে?
–ইওনিয়াতে। নোয়েলে হাসল। তাকে দেখে মনে হল, সে বুঝি এক ভয়ঙ্কর রমণী।
এবার সে তার পরিকল্পনাটার কথা বলল। ল্যারি বাধা দেবার চেষ্টা করল। প্রতিটি বাধা নোয়েলে কাটিয়ে দিল। নোয়েলের কথা বলা শেষ হয়ে গেছে। ল্যারি স্বীকার করল, এই পরিকল্পনার মধ্যে কোনো ত্রুটি নেই। হ্যাঁ, এভাবেই আমরা ক্যাথারিনের হাত থেকে বাঁচতে পারব।
.
পল খুবই ভয় পেয়েছে। গ্রিক পাইলটের মুখ সবসময় আনন্দে উজ্জ্বল থাকে। কিন্তু এখন এত ভয় কেন? কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের সাথে তার দেখা করার কথা ছিল না। কিন্তু দেখা করতেই হবে।
মিঃ ডেমিরিস, আমি অত্যন্ত দুঃখিত।
কী হয়েছে? প্লেনের কোনো খবর?
না, এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ডেমিরিস তাকালেন। বেশ বোঝা গেল, তার এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। তিনি কখনওই এ ব্যাপারে নিজেকে জড়াতে চান না। তার অনেক কিছু করার আছে। তেমন কিছু হলে সেক্রেটারিরাই সামলে দেবে।
পল বলার চেষ্টা করছে। কিছুই বলতে পারছে না। অবশেষে সে বলল– এটা মিস পেজের ব্যাপারে।
এক মুহূর্তের নীরবতা।
ডেমিরিস বললেন- ঠিক আছে, বলতে থাকো। কী হয়েছে?
পল আবার ভাবছে, বলাটা উচিত হবে কিনা?
মিস পেজ আর ল্যারি ডগলাস..সে তাকিয়ে দেখল ডেমিরিসের মুখের দিকে। তারা রাফিনাতে একটা বীচ হাউসে থাকে একসঙ্গে।
ডেমিরিস সিগারেটের ছাই ঝাড়লেন সোনার তৈরি একটা অ্যাশট্রের মধ্যে। পল ভাবছে, এখনই বোধহয় বিস্ফোরণ দেখা দেবে। ডেমিরিসকে সত্যি কথাটা বলে আমি কি ভুল করলাম?
–আমার বোন, ওখানকার একটা ভিলার হাউসকিপার, সে দেখেছে, ওরা দুজন বিচে শুয়ে আছে। সে মিস পেজকে চিনতে পেরেছে। কারণ, খবরের কাগজে মিস পেজের ছবি বেরোয়। কদিন আগে সে আমাকে এই কথাটা বলেছে। আমি তার সাথে ল্যারির আলাপ করিয়ে দিয়েছি। সে বলেছে, এই লোকটিকে মিস পেজের পাশে দেখা গেছে।
ডেমিরিসের অলিভ কালো চোখ তাকিয়ে আছে। সেখানে কোনো অভিব্যাক্তি নেই।
–এই খবরটা আপনাকে জানিয়ে গেলাম।
ডেমিরিস কথা বললেন মিস পেজ তার ব্যক্তিগত জীবনে কী করবে, সেটা তারই ব্যাপার। আমি চাই না, কেউ তার ওপর স্পাইগিরি করুক।
পল আমতা আমতা করতে থাকে বিশ্বাস করুন মিঃ ডেমিরিস, আমি শুধু আপনাকে বোঝাতে চেয়েছি।
তোমার ভুল হয়েছে, আর কিছু বলার আছে।
না, স্যার। পল সেখান থেকে পালিয়ে গেল।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস চেয়ারে বসলেন। তার কালো চোখ দুটি সিলিং-এ আবদ্ধ হয়েছে। তিনি কোনো কিছুই দেখছেন না।
.
পরদিন সকাল নটা। পল একটা খবর পেলেন। তাকে এখনই কঙ্গোতে যেতে হবে, ডেমিরিসের খনি কোম্পানিতে। সেখানে দশদিন কাটাতে হবে।
বুধবার, তিন নম্বর ফ্লাইটটা ধ্বংস হয়ে গেল, কঙ্গোর ঘন অরণ্যে। পলের দেহটার কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। অথবা বিমানের ধ্বংসাবশেষ।
.
দু সপ্তাহ কেটে গেছে। ক্যাথারিনকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ল্যারি তার সাথে দেখা করতে এসেছিল।
শনিবার সন্ধ্যেবেলা। ক্যাথারিন কিচেনে বসে ওমলেট তৈরি করছে। সে শুনতে পায়নি, সামনের দরজা খুলে গেছে। সে জানত না, ল্যারি এসে ঢুকে পড়েছে। সে ল্যারিকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।
ল্যারি বলল- তোমাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আমি দেখতে এসেছি, তুমি কেমন আছো?
ক্যাথারিনের মনে হল, সে বোধহয় আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সে বলল- আমি ভালো আছি। সে প্যান থেকে ওমলেটটা তুলে নিল।
ল্যারি বলল– ভারী সুন্দর গন্ধ। ডিনার খাবার সময় নেই। তুমি কি আমাকে একটা দেবে?
ল্যারির দিকে অবাক হয়ে ক্যাথারিন তাকাল।
ক্যাথারিন ভাবতেই পারছে না, ল্যারি কেন এসেছে?
ডিনার খাওয়া হয়ে গেছে। ল্যারি ক্যাথারিনকে সাহায্য করল। বাসনগুলো ধুয়ে রাখল। তার দিকে তাকিয়ে ক্যাথারিন ভাবল, সব কিছু আর আগের মতো হতে পারে না কি?
–ভালো লেগেছে, তোমার সান্নিধ্য, তোমাকে ধন্যবাদ, ক্যাথি।
এভাবেই দেখা হওয়াটা শেষ হল।
তিনদিন কেটে গেছে। ল্যারি ফোন করেছে মাদ্রিদ থেকে। সে বাড়িতে আসবে। ক্যাথিকে নিয়ে ডিনার খেতে যাবে। ক্যাথি রিসিভারটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বলল- হ্যাঁ, আমি আজ রাত্রিরে ফাঁকা আছি।
.
ছোট্ট একটি রেস্টুরেন্ট। সমুদ্রের ধারে। ক্যাথারিন কিছুই খাচ্ছে না। ল্যারি সামনে বসে আছে।
ল্যারি জিজ্ঞাসা করল- অন্য কিছু অর্ডার দেব?
ক্যাথারিন বলল- আজ আমার লাঞ্চ খেতে দেরি হয়েছে। সে মিথ্যে বলল।
কদিন কেটে গেছে। আবার ল্যারির ডাক এসেছে। তারা একটা সুন্দর রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সারল। পুরোনো পামগাছে সাজানো। লম্বা পথ চলে গেছে। আমের সাজানো বাগানো।
পরের দিন রোববার। ক্যাথারিনকে নিয়ে ল্যারি ভিয়েনাতে গেল। তারা সাচার হোটেলে ডিনার খেল। সেই রাতেই ফিরে এল। সন্ধ্যেটা দারুণ কেটেছে। মদ এবং আনন্দে পরিপূর্ণ। মোমের আলোয় চারপাশ স্বপ্নিল দেখাচ্ছিল। ক্যাথারিনের মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি। তার কেবলই মনে হচ্ছে, সেই আগের ক্যাথারিন ডগলাসের মৃত্যু হয়েছে। তারা অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এল।
ক্যাথারিন বলল–তোমাকে ধন্যবাদ ল্যারি, এমন একটা সুন্দর দিন তুমি আমাকে উপহার দিলে।
ল্যারি এগিয়ে এসেছে। সে ক্যাথারিনের হাতে হাত রাখল। তাকে চুমু দিল। ক্যাথারিন ল্যারিকে জোরে ঠেলে সরিয়ে দিল। তার শরীরটা শক্ত হয়ে গেছে। তার মনে একটা অদ্ভুত ভয় জেগেছে। না, সে বলল।
ক্যাথি?
না।
–ঠিক আছে। আমি বুঝতে পেরেছি।
–হ্যাঁ, কী বুঝেছ?
–আমি জানি, আমার ব্যবহার তোমাকে কষ্ট দিয়েছে, তুমি কি আমাকে একটা সুযোগ দেবে? আমি আবার তোমাকে ভালোবাসব।
ল্যারির এসব কথা শুনে ক্যাথারিন আরও অবাক হয়ে গেছে। সে ঠোঁট বন্ধ করল। এখন কি কাঁদবে? শেষ পর্যন্ত সে বলল, অনেক দেরি হয়ে গেছে ল্যারি, আর কোনো উপায় নেই।
ল্যারি ধীরে ধীরে করিডর দিয়ে হেঁটে গেল।
সেই সপ্তাহে আবার ল্যারির ফোন। সে ফুল পাঠিয়েছে। সঙ্গে ছোট্ট চিঠি। তারপর বিভিন্ন দেশের স্মারক, উড়ন্ত পাখি। ক্যাথারিন বুঝতে পারছে না, ল্যারি কী চাইছে? অসাধারণ এই সংগ্রহ, একটা পোরসিলিনের, একটা জেট পাথরের, একটা টি কাঠের।
ফোন বেজেই চলেছে, ক্যাথারিন ল্যারির কণ্ঠস্বর শুনতে পেল- এটা একটা চমৎকার গ্রিক রেস্টুরেন্ট, এরা চাইনিজ খাবার দেয়। মনে হয়, আমরা যেন পিকিং-এ বসে খাচ্ছি। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।
গল্পটা কি আবার শুরু হবে? ধীরে ধীরে। ল্যারি আর কাছে আসার সাহস করছে না। হয়তো ক্যাথি বাধা দেবে। ক্যাথি কীভাবে তার আবেগকে লুকিয়ে রাখবে? শেষ পর্যন্ত তারা খাবার আসরে বসল, হাসল। অনেক ব্যক্তিগত কথা।
প্রতি রাতে এখন তাদের দেখা হচ্ছে। কোনো কোনো সময় ক্যাথারিন বাড়িতেই খাবার তৈরি করে। কখনও ল্যারি তাকে বাইরে নিয়ে যায়। একবার ক্যাথি জানতে চেয়েছিল, সেই মেয়েটির খবর কী?
ল্যারি জবাব দিয়েছে ব্যাপারটা মিটে গেছে। ল্যারি আর কথা বলেনি। সে বুঝতে পারে, ল্যারি বোধহয় এখন আবার তাকেই ভালোবাসতে চাইছে।
কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে, কিন্তু কী, সেটা ক্যাথারিন বুঝতে পারছে না।
.
ভোর চারটে বেজে গেছে। সমস্ত রাত তারা হোটেলে ছিল। একটা অসাধারণ সন্ধ্যে। ক্যাথারিন নতুন পোশাক পরেছে।
অন্ধকার করিডর। ল্যারি বলল– ডার্লিং, আর একবার সুযোগ দেবে। আমরা যদি আর একটা হনিমুনে যাই?
–কোথায়? ল্যারির হাতে নিজেকে নিঃশেষে সম্পূর্ণ করতে করতে ক্যাথি জানতে চেয়েছিল।
ল্যারির মুখে দুষ্ট হাসি। অন্ধকারে তার চোখ জ্বলছে। সে বলল– আমি একটা ছুটি নেব। শনিবার গেলে কেমন হয়? ছোট্ট একটা জায়গার সন্ধান পেয়েছি। জায়গাটার নাম ইওনিয়া!
.
নোয়েলে ও ক্যাথারিন, এথেন্স, ১৯৪৬
২০.
নয় ঘণ্টার মধ্যে তারা ইওনিয়াতে পৌঁছে গেল। ক্যাথারিনের কাছে এখনও ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে। সামনে এজিয়ান সাগর। ছোটো ছোটো কটেজ, তারপর গাছের সারি। লেবু আর চেরি। আপেল ও কমলালেবু চোখে পড়ল। শান্ত সমাহিত জীবনযাত্রা।
ক্যাথারিন বলল– দেখো, কী সুন্দর এই সাইপ্রাস গাছগুলো।
ল্যারি তাকিয়ে আছে, প্রকৃতি এখানে অসাধারণ সৌন্দর্যে নিজেকে সাজিয়েছে।
তারা ছোটোখাটো গ্রামের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াল। খটমট নামগুলো।
বিকেলের দিকে তারা রিয়র নামে একটা গ্রামে পৌঁছোলো। পাশ দিয়ে রিও নদী বয়ে চলেছে। ফেরীবোটে চড়ে বসল। পাঁচ মিনিট বাদে এগিয়ে গেল পিপিরাসের দিকে।
ক্যাথারিন আর ল্যারি একটা বেঞ্চে বসেছে। ফেরীর ওপর। দূরে একটা বড়ো দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে ঢাকা। কীসের অন্ধকার? কুয়াশা? ক্যাথারিনের কাছে সব কেমন অবাক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে বোধহয় প্রাচীন যুগে ফিরে গেছে। সেই গ্রিক সভ্যতার যুগ। নৌকোটা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। ক্যাথারিন ওই দ্বীপটাকে আরও ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছে। একটা পাহাড়, পঁচিশ মিনিট কেটে গেছে। পিপিরাসের ছোটো বন্দর, ক্যাথারিন আর ল্যারি এখন ইওনিয়ার আরও কাছাকাছি।
লেখা আছে পিনডারস পাহাড়ের ওপর এর অবস্থান। এই পাহাড় আল্পসের দিকে চলে গেছে। ইওনিয়াকে দেখলে মনে হয়, দু-মাথাওয়ালা ঈগল পাখির মতো। লেক পামভোটিস, বোধহয় ঈগল পাখির নখর। এখানে নৌকো করে যাওয়া যায়। সবুজ জল।
ল্যারি বলল- শব্দগুলো আমাকে আকর্ষণ করছে।
তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। তারা হোটেলের দিকে গাড়ি করে চলেছে। একতলা একটা বাড়ি। পাহাড়ের ওপর। আশেপাশে অনেকগুলো বাংলো আছে। সেখানে অতিথিরা মাঝে মধ্যে আসে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন।
তিনি বললেন- হনিমুন করতে এসেছেন?
ক্যাথারিন ল্যারির দিকে তাকাল। বলল, কী করে জানলেন?
–এখানে তো আপনাদের মতো যুগলরাই আসে। ভদ্রলোক বললেন।
হোটেলের লবির দিকে তারা এগিয়ে চলেছে। অসাধারণ লিভিংরুম। বেডরুম, বাথরুম। কিচেন আর টেরাসে। সাইপ্রাস গাছে ঢাকা। লেকের ছবি দেখা যাচ্ছে।
–অসাধারণ, এই সবকিছু তোমার।
–আমি সব নেব।
সুখী তো?
–জীবনে এত সুখ আমি কখনও পাইনি। আমাকে ছেড়ে তুমি কখনও যাবে না তো?
ব্যাকুলতা ঝরে পড়ছে ক্যাথারিনের কণ্ঠস্বরে।
ল্যারির শক্ত সমর্থ দুটি হাত এখন ক্যাথারিনকে জড়িয়ে ধরেছে। ল্যারি বলল- না, আমি শপথ করছি, আর কখনও তোমাকে ছাড়ব না।
ক্যাথারিন জিনিসপত্র খুলতে শুরু করল।
ল্যারি লবিতে চলে গেছে। রুম ক্লার্কের সঙ্গে কথা বলছে।
ল্যারি জানতে চাইল এখানে কী কী সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়?
–ওই যে গুহাগুলো দেখা যাচ্ছে, ওখানে কি যাওয়া যায়?
–না, ওগুলো এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে।
সব কটা গুহার মুখ খোলা?
কয়েকটা খোলা হয়েছে। বেশির ভাগ বন্ধ।
ল্যারি বলল- ঠিক আছে, দেখতে হবে।
যদি আপনারা পাহাড়ে উঠতে চান, তাহলে মাউন্ট জোমেরকাতে যাবেন। মিসেস ডগলাস কি ওপরে উঠতে ভয় পান?
-না, ল্যারি হাসল। ও ভালো চড়তে পারে।
–তাহলে ভালোই লাগবে। এখন আবহাওয়াটা খুবই ভালো। ঝড়ের আশঙ্কা নেই। আনন্দে থাকুন স্যার।
-ঠিক আছে, দেখা যাক কী হয়!
.
ল্যারি বাংলোতে ফিরে এল। তারা ভিলেজে যাবে ডিনার খেতে। পাহাড়ি পথ। পাথরের ওপর দিয়ে চলে গেছে। এখানে একটাই বড়ো রাস্তা। কিং জর্জ এভিনিউ। দু-তিনটে ছোটো ছোটো রাস্তা আছে। ছড়ানো ছেটানো বাড়ি আর অ্যাপার্টমেন্ট।
কিং জর্জ এভিনিউর মধ্যে রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটার নাম নেওয়া হয়েছে পেনসিলভেনিয়া এভিনিউ, গ্রাম নয়, এই নামটা বলে ক্যাথারিন খেপাতে চাইল।
টাউন স্কোয়ার, ছোট্ট পার্ক, উঁচু টাওয়ার। আলো জ্বলছে ঘড়ির ওপর। প্লাটানা গাছের সারি দেখা যাচ্ছে।
ক্যাথারিন আর ল্যারি বাজারে ঢুকে পড়ল। প্রত্যেকটা দোকানে ভিড়।
ক্যাথারিন ভেবেছে, এবার একটা ছেলে আসুক তার কোলে। কথায় কথায় প্রস্তাবটা রেখেছে ল্যারির কাছে। কোনো অজ্ঞাত কারণে ল্যারি প্রত্যেকবারই প্রত্যাখান করেছে। বলেছে, আমার চালচুলোর ঠিক নেই, আগে থিতু হতে দাও, তারপর ভাবব।
ল্যারির পাশে হাঁটতে হাঁটতে ক্যাথারিন ভাবল, এবার তো ল্যারি আরও অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। প্রস্তাবটা একবার পাড়লে কেমন হয়? আহা, আমরা তো মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে এসেছি।
ওরা একটা মুভি থিয়েটারের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। সকাল হয়েছে। ক্যাথারিন এবং ল্যারি গ্রামের পথে গাড়ি ছুটিয়ে দিয়েছে। সরু পথ, আবিষ্কারের নেশা। তারা জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল। সেখানে একটা বাড়ি দেখতে পেল, পুরোনো দুর্গের মতো।
ক্যাথারিন জানতে চাইল- এটা কী? ল্যারি বলল- আমি বুঝতে পারছি না।
এসো, আমরা অভিযান শুরু করি।
ল্যারি তার গাড়িটা আরও কাছে নিয়ে গেল। ছাগল আর ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে। বাড়িটা একদম ফাঁকা। দরজার সামনে তারা গিয়ে দাঁড়াল।
ক্যাথারিন বলল– এটা বোধহয় রূপকথার গল্প।
ল্যারি জানতে চাইল- সত্যি তুমি ঢুকবে?
–হ্যাঁ।
ল্যারি গাড়িটাকে আরও কাছে নিয়ে এল। সে বলল মনে হচ্ছে বাড়িতে কেউ নেই।
ক্যাথারিন বলল- হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা।
দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল। কালো পোশাক পরা এক সিস্টার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
ক্যাথারিন বলল– আমি দুঃখিত। আমরা জানতাম না, এখানে কেউ থাকে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
ওই সিস্টার দুজনের দিকে তাকালেন। ভেতরে আসার আহ্বান করলেন। ওরা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। বিরাট একটা উঠোন, মস্ত বড়ো কমপাউন্ড। কেমন যেন রহস্যের গন্ধ মাখা। ক্যাথারিনের মনে হল, কিছু একটা সে শুনতে পাচ্ছে না। হ্যাঁ, মানুষের গলার শব্দ।
সিস্টারের দিকে তাকিয়ে সে বলল– এটা আসলে কী?
সিস্টার কোনো কথা বলছেন না। তিনি ওদের সেখানে থাকতে বললেন। তারপর একটা পুরোনো পাথরের বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলেন। কমপাউন্ডের একদিকে।
ক্যাথারিন ফিসফিসিয়ে বলল– কী হচ্ছে বলো তো?
সমুদ্র দেখা যাচ্ছে, পাশে সমাধিক্ষেত্র, সাইপ্রাস গাছে ঢাকা।
-আমার একদম ভালো লাগছে না। ল্যারি বলল।
আমার মনে হচ্ছে, আমরা বোধহয় কয়েক শতাব্দী পেছনে চলে এসেছি।
জানলা দিয়ে দেখা গেল, কয়েকটা মুখ তাকিয়ে আছে। সকলেই মহিলা। সকলের পরনে কালো পোশাক।
ল্যারি বলল- এটা বোধহয় কোনো ধর্মস্থান।
লম্বা রোগা এক ভদ্রমহিলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসছেন। তার পরনেও যাজিকার পোশাক। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি বুঝি করুণার প্রতিমূর্তি।
তিনি বললেন- আমি সিস্টার থেরেসা। কীভাবে সাহায্য করব?
ক্যাথারিন বলল– আমরা পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ঢুকে পড়েছি।
–এখানে অতিথি বলতে কেউ আসে না। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা কারমেলাইটের যাজিকা, আমরা নীরবতার মধ্যে জীবন পালন করি।
ল্যারি জানতে চাইল- কতদিন?
সারা জীবন আমরা কোনো কথা বলব না। একমাত্র আমিই কথা বলার অনুমতি পেয়েছি। তাও দরকার হলে।
ক্যাথারিন অবাক হয়ে গেছে। সে বলল এখানে কেউ কোনোদিন বাস করেছে? বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে?
সিস্টার থেরেসা হাসলেন না, কোনো কারণ নেই। আমরা এই চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী থাকতে ভালোবাসি।
ক্যাথারিন বলল- বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইছি।
সিস্টার মাথা নাড়লেন– না-না, ঈশ্বরের কাছে সবকিছু সমর্পণ করুন।
ক্যাথারিন এবং ল্যারি এবার বাইরে বেরিয়ে এল। বিরাট দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। ক্যাথারিন তাকাল। এটা একটা বন্দীশালার মতো। মানুষ কীভাবে এখানে থাকে? ক্যাথারিন ভাবল। ওই যুবতী মেয়েদের দল। আবার তাদের মুখ– উৎসুক এবং আগ্রহী, জানলা দিয়ে। এই পৃথিবী থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। তারা নীরবতার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন। সমাধিক্ষেত্রের অন্ধকার। না, ক্যাথারিনের মনে হল, জীবনে কোনো দিন সে জায়গাটাকে ভুলতে পারবে না।
.
নোয়েলে এবং ক্যাথারিন, এথেন্স, ১৯৪৬
২১.
পরের দিন সকালবেলা, ল্যারি গ্রামে গেছে। ক্যাথারিনকে সঙ্গে যেতে বলেছিল, সে যেতে চায়নি। তার ঘুম পেয়েছে।
ল্যারি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথারিন উঠে পড়ল। সেখানে একটা জিমনাসিয়াম আছে। আগের দিন সে দেখে এসেছে। এক মহিলা, গ্রিক আমাজান, তাকে ল্যাংটো হতে বলল। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু দেখল।
সে বলল- আপনি খুব আলসে, শরীরটা সুন্দর, কাজ করেন না কেন?
–আমি কাজ করতে চাইছি, ক্যাথারিন বলল, আপনি আমাকে সাহায্য করবেন?
সেই আমাজন ক্যাথারিনের দিকে আবার তাকাল। কী করতে হবে, তা বলার চেষ্টা করল।
ল্যারি ফিরে এসেছে। ক্যাথারিন কোনো কথা বলেনি! কদিনের মধ্যেই তার চেহারায় পরিবর্তন এসেছে।
ল্যারি বলল- মনে হচ্ছে, জায়গাটা তোমার ভালো লেগেছে। তোমাকে একেবারে পাল্টে দিয়েছে এটা।
ক্যাথারিন বলল- হ্যাঁ, আমি এখন পাল্টে গেছি।
রবিবার সকালবেলা, ক্যাথারিন চার্চে গেল। সে কোনোদিন গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের প্রার্থনা দেখেনি। এটা ছোট্ট গ্রাম, চার্চটাও খুবই ছোটো। তবে সুন্দর করে সাজানো। প্রধান যাজক হালকা চেহারার মানুষ। কালো দাড়ি আছে তার। তিনি একটা আগুন এবং লালরঙের জোব্বা পরেছেন। লম্বা কালো হ্যাট তার মাথায়। ক্যাথারিনের মনে হল, উনি বোধহয়, হারানো পৃথিবীর বাসিন্দা।
গ্রিক ভাষায় মন্ত্র পাঠ শুরু হল। ভদ্রলোক নেমে এলেন। তারপর বেদীর ওপর উঠে গেলেন।
পরের দিন সকালে ক্যাথারিন এবং ল্যারি বাংলো টেরাসে ব্রেকফাস্ট খেয়েছিল। লেকের জলের দিকে অনিমিখ তাকিয়ে ছিল। দিনটা সুন্দর। সূর্যের উজ্জ্বল আলো। আলসেমি ভরা বাতাস বইছে। অল্পবয়সী ওয়েটার খাবার দিল। ক্যাথারিন একটা নেগলি পরেছে। ওয়েটার যখন এল, ল্যারি চট করে ক্যাথারিনের হাতে হাত রেখে ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল- রাত্তিরটা চমৎকার।
ওয়েটার হাসল। সেখান থেকে চলে গেল।
ক্যাথারিন লজ্জা পেল। ল্যারি সকলের সামনে এমন আচরণ করে কেন? সে অনেকটা পাল্টে গেছে, ক্যাথারিন ভাবল। আগে তো সে এমন করত না। যখনই কোনো বেলবয় ঘরে এসে ঢোকে ল্যারি আমাকে জড়িয়ে ধরে? সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে সে কী প্রমাণ করতে চাইছে? সে কি প্রমাণ করতে চাইছে তার স্ত্রীকে খুবই ভালোবাসে?
ল্যারি বলল- আমি একটা সুন্দর প্ল্যান করেছি। পাহাড়ের ওপর উঠব।
ক্যাথারিন বলল- না, পাহাড়ে উঠতে আমার খুব একটা ভালো লাগছে না। তাছাড়া কী খটমট নাম বললে, উচ্চারণ করতেই পারছি না। উঠব কেমন করে?
–এসো, ওখান থেকে কত সুন্দর দেখাবে চারদিক।
ক্যাথারিন তবুও রাজী হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত ল্যারি বলল– তাহলে আমি একাই যাব। তার কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতা।
–ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি, দেখি তোমাকে সাহায্য করতে পারি কিনা।
ল্যারির মুখে পরিবর্তন এবার আসল অভিযানটা শুরু হবে, আগে ক্যাথারিন কিন্তু কখনও কোনো পাহাড়ে চড়েনি।
.
তারা গ্রামের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেল। এখান থেকেই পাহাড়টার যাত্রা শুরু হয়েছে। গাড়িটা সেখানে রাখা হল। একটা ছোটো ফুডস্ট্যান্ড রয়েছে। ল্যারি স্ট্যান্ডউইচ কিনল। ফুল ক্যানডিবার এবং কফির থার্মোস।
সে বলল- ভারী সুন্দর, আমার বউ আর আমি এখানে সারারাত থাকব। মালিকের সামনে সে ক্যাথারিনকে চুমু খেল। লজ্জায় ক্যাথারিনের গাল আবার লাল হয়েছে।
.
এখান থেকেই যাত্রা শুরু হবে। দুটো পথ এগিয়ে গেছে। দুটো উল্টোদিকে। কোন্ পথে সুবিধা? এই পথটা একটু বড়ো, চওড়াও বলা যেতে পারে।
ল্যারি সামনে এগিয়ে চলেছে। ক্যাথারিন তাকে অনুসরণ করছে। সূর্যের আলো সরাসরি এসে পড়েছে। ঘাম ঝরছে শরীর থেকে। বাতাস একটু ঠান্ডা হয়েছে। ক্যাথারিন ভাবল, ভারী সুন্দর সমাহার, দিনটা চমৎকার, ভালোবাসার মানুষ পাশে আছে– আর কী চাই?
ক্যাথারিন ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। ক্যাথারিন বলল- দুঃখিত, আমি আর হাঁটতে পারছি না। অনেকটা সময় লাগছে।
ল্যারি জবাব দিল না, এভাবেই চেষ্টা করতে হবে।
পথটা খুব সরু হয়ে গেছে। দুজন পাশাপাশি চলতে পারছে না। ক্যাথারিন হাঁফাচ্ছে।
ল্যারি হঠাৎ একটা বাঁকের মুখে এসে দাঁড়াল। সেখানে একটা ছোট্ট কাঠের ব্রিজ আছে। নালা বয়ে চলেছে।
ল্যারি সেই ব্রিজের ওপর পা রাখল। নাঃ, চারদিকে তাকাল, ওপারে যাবে কী করে? নীচে খাদ, অন্তত হাজার ফুট হবে।
ক্যাথারিন চিৎকার করল– ল্যারি?
ক্যাথারিন ওই ব্রিজের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
–এই ব্রিজটা কি পার হতে হবে? না, এটা সম্ভব নয়।
–আমাদের উঠতে হবে।
না, তুমি ছেলেমানুষি করো না।
কত লোক এই ব্রিজটা রোজ পার হচ্ছে বলো তো?
ক্যাথারিন তখনও ব্রিজের দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। ল্যারি ব্রিজের মাঝখানে পৌঁছে গেছে।
ক্যাথারিন ব্রিজের ওপর পা দিল, সেটা দুলতে শুরু করেছে। সে তাকাল উপত্যকার দিকে। সমস্ত মনে ভয়ের আতঙ্ক। না, এটা এখন আর আনন্দের মধ্যে নেই। ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর। ক্যাথারিন দেখল, ল্যারি প্রায় ওদিকে পৌঁছে গেছে। সে দাঁতে দাঁত চাপল। কোনোরকমে ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটতে চেষ্টা করল। বারবার পড়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা পা ফেলছে সাবধানে। পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিজটা প্রচণ্ডভাবে দুলে উঠছে। ল্যারি আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। ক্যাথারিন আর হাঁটতে পারছে না। একহাতে শক্ত করে দড়িটা ধরে আছে। নীচের দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে।
ল্যারি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ক্যাথারিনের মুখে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত ক্যাথারিন ল্যারির কাছে এসে পৌঁছোল। আতঙ্কে কেমন যেন হয়ে গেছে সে।
ক্যাথারিন বলল না, আমি কেন এখানে এলাম? এক্ষুনি ফিরতে হবে।
ল্যারি অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল– আমরা তো আসল জায়গাতে এখনও যাইনি ক্যাথি।
না, অনেক কিছু দেখেছি। আর দেখব না।
ল্যারি ক্যাথারিনকে জড়িয়ে ধরে বলল- এত ভয় পাচ্ছো কেন? ওপরে একটা সুন্দর শান্ত জায়গা আছে। আমরা সেখানে পিকনিক করব।
ক্যাথারিন বলল- ঠিক আছে।
–এই তো সোনা মেয়ের কথা। ল্যারি বলল। সে আবার হাঁটতে শুরু করল। ক্যাথারিন তাকে অনুসরণ করছে।
হা, জায়গাটা অসাধারণ নৈঃশব্দ্যের আবরণে ভরা। পোস্টকার্ডে যেমন দেখা যায়।
ল্যারিকে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে। চারপাশে কত ফুলের সমারোহ।
হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তারা আসল জায়গাটায় পৌঁছে গেল। একটা বাঁকের মুখে এসে দাঁড়াল। কিন্তু ক্যাথারিন আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না। ধ্বস শুরু হয়েছে। সে চিৎকার করল। ল্যারি ফিরে এসেছে। ল্যারি ক্যাথারিনের একটা হাতে হাত দিল। তাকে ওপর দিকে তুলে আনল। ক্যাথারিনের মনে হল, সে বুঝি মরেই যাবে। ল্যারির দিকে তাকাল, তারপর? তারা ঠিক জায়গাতে পৌঁছে গেল।
.
ক্যাথারিন শুয়ে আছে। ঠান্ডা বাতাস তাকে শাস্তি দিচ্ছে। আতঙ্কটা কেটে গেছে। ভয়ের আর কিছু নেই।
ল্যারি জিজ্ঞাসা করল- এখন কেমন লাগছে?
ক্যাথারিন মাথা নাড়ল। সে আবার জানতে চাইল- ভয়ের আর কিছু নেই তো?
ল্যারির মুখে হাসি না, আমরা সেই জায়গাটা পার হয়ে এসেছি।
ক্যাথারিন বলল- আহা, আমি যেন সম্রাজ্ঞী। সে হাসল। ল্যারির মুখে হাসি। সময়টা কেন অনন্তকাল হয় না। সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। তারা কতদূরে এসে পড়েছে।
ল্যারি অবাক হয়ে ক্যাথারিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা এখন একেবারে কোণে চলে এসেছে। সাংঘাতিক একটা জায়গা। পা ফসকালেই খাদের মধ্যে। অবধারিত মৃত্যু। ল্যারি ঝুঁকে দাঁড়াল। ক্যাথারিনের মুখের ওপর মেঘের খেলা। সে বোধহয় ঢাকা পড়ে গেল।
ক্যাথারিন বলল চলো, আর থাকতে ইচ্ছে করছে না।
ঘন কুয়াশার মধ্যে ক্যাথারিনের মুখ হারিয়ে গেল।
ল্যারি ভাবল– এখন সে কী করবে? ঘন কুয়াশা। সে কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে?
ক্যাথি আরও সামনে এগিয়ে গেছে। বিপজ্জনক বাঁকের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বাতাসের মধ্যে কেঁপে যাচ্ছে তার কণ্ঠস্বর- ল্যারি, অসাধারণ, তুমি এখানে এসো।
ল্যারি আসার চেষ্টা করছে। তাদের মধ্যে তিন ফুটের ব্যবধান। শেষ পর্যন্ত তারা হাতে হাত রাখতে পেরেছে।
সত্যি, মনে হচ্ছে তারা যেন স্বর্গে পৌঁছে গেছে।
এবার ফিরে আসতে হবে। ফেরার পথে ল্যারি একটাও কথা বলেনি। তার মনে কী একটা ভাব জেগেছে। কেন? ল্যারি হয়তো এখানে আরও কিছুটা সময় থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু ক্যাথারিন শেষ পর্যন্ত রাজী হয়নি।
অবশেষে তারা হোটেলে ফিরে এল। পরের দিন সকালবেলা রিসেপশন ক্লার্কের সাথে ল্যারি কথা বলছে।
ল্যারি বলল- ওই যে গুহাগুলোর কথা বলছিলেন, ওগুলো কেমন?
ক্লার্ক বলল- তেরামার গুহা, ভারী সুন্দর। ওটা অবশ্যই দেখতে যাবেন।
-হ্যাঁ, আমি খুব একটা আগ্রহী নই, কিন্তু আমার বউ তো গুহায় ঢোকার জন্য পাগল।
ক্লার্ক বলল- স্যার, একটা কথা বলব, কিছু মনে করবেন না, একজন গাইডকে সঙ্গে নেবেন।
-কেন?
নতুন যে গুহাগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে, সেখানে আলো কম, মাঝে মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটছে। অনেক মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে। গাইডকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই ভালো।
ল্যারি ক্যাথারিনের খোঁজে এল। ক্যাথারিন বাগানে শুয়ে ছিল। বই পড়ছিল। ওক গাছের নীচে। ল্যারি তার মনোবাসনা ব্যক্ত করল।
ক্যাথারিনের মুখে আনন্দ। তাহলে? গুহাতে প্রবেশ করতে পারব আমরা।
ল্যারি বলল- হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই যাব। আমি একটু শহরে যাচ্ছি। জিনিসপত্র কিনে নিয়ে এক্ষুনি আসব। তুমি কি সঙ্গে যাবে?
–না, ক্যাথারিন বলল, আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
ক্যাথারিন চোখ বন্ধ করল। গতকালের কথা মনে পড়ল। উত্তেজনা এবং আনন্দ–পাশাপাশি বয়ে চলেছে।
.
শহরে গিয়ে ল্যারি একটা দোকানে ঢুকে পড়ল। সে ফ্লাশলাইট কিনল। কয়েকটা ব্যাটারি, আরও টুকিটাকি জিনিসপত্র।
দোকানদার জানতে চেয়েছিল– আপনারা কি হোটেলে থাকছেন?
ল্যারি বলল- না, আমি এথেন্সের দিকে যাচ্ছি। পথ চলতি এই দোকানটা দেখতে পেলাম।
লোকটি বলল– সাবধানে থাকবেন।
ল্যারি বলল- কেন?
ঝড় আসছে, শুনতে পাচ্ছেন ওই মেঘগুলো চিৎকার করছে।
ল্যারি তাকাল– হ্যাঁ, ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটবে। সে তিনটের সময় হোটেলে ফিরে এল। বিকেল চারটে, ল্যারি এবং ক্যাথারিন তখন নতুন পথে যাত্রা শুরু করছে। এলোমেলো বাতাস বইছে। উত্তর থেকে কালো মেঘ ছুটে আসছে। সূর্যের মুখ ঢাকা পড়েছে।
.
তেরামার গুহাইওনিয়া থেকে তিরিশ কিলোমিটার পূর্বে অনেক বছর ধরে তা তেমনই আছে। স্ট্যালাগমাইট আর ট্যালাগটাইট পাহাড় দিয়ে তৈরি। মানুষের মুখের প্রতিকৃতি। কখনও মনে হচ্ছে বিরাট প্রাসাদ। মনে হচ্ছে, কেউ যেন এগুলো তৈরি করেছে।
ক্যাথারিন আর ল্যারি যখন গুহাতে এসে পৌঁছোল, তখন ঘড়িতে সন্ধ্যে ছটা বেজেছে। এক ঘণ্টা পরে এটা বন্ধ হয়ে যাবে। ল্যারি দুটো টিকিট কিনল। একটা প্যামপ্লেট পেল সে। গাইড এসে দাঁড়াল। বলল– পঞ্চাশ ডাকমা, আমি আপনাকে সব দেখিয়ে দেব।
ল্যারি হাসল, বলল– গাইডের দরকার নেই। তার কণ্ঠস্বরে তিক্ততা ঝরে পড়ছে। ক্যাথারিন অবাক হল। সে ক্যাথারিনের হাত ধরে বলল– ভেতরে এসো।
-গাইড নিলে না কেন?
-কেন? এটা একটা দুষ্ট চক্র। আমরা তো গুহা দেখতে যাব, প্যামপ্লেটটা পড়লেই সবকিছু জানা যাবে।
প্রবেশ পথটা বেশ বড়ো। আলো দিয়ে সাজানো। ভেতরে ফ্ল্যাশ আলো জ্বলছে। অনেক ট্যুরিস্টের ভিড়। মাথাটা ক্রমশ নীচু হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে উড়ন্ত পাখি, বিরাট দৈত্য ক্রাউন আর ফুল।
ক্যাথারিন বলল- বাঃ, কী সুন্দর। এর বয়স কত? কেউ জানে না।
তার গলার শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। একটা টানেল ভেতরের দিকে চলে গেছে। এখানটা অন্ধকার। ভেতরে আরও সুন্দর সুন্দর প্রতিকৃতি।
শেষ অব্দি ক্যাথি বলল- চলো, আর ঢুকতে হবে না।
ল্যারি বলল– ভেতরে অনেক কিছু দেখার আছে। হোটেল ক্লার্ক বলেছে, নতুন অংশটাই আরও গুরুত্বপূর্ণ। ওটা আমাদের দেখতেই হবে।
ক্যাথারিন জিজ্ঞাসা করল- ওটা কোথায়?
-ওখানে, ল্যারি আঙুল তুলে দেখাল।
তারা গুহার একেবারে প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে। একটা মস্ত বড়ো কালো পাথর, চারদিকে অন্ধকার।
ক্যাথারিন বলল না, ওখানে আমি যাব না।
ল্যারি তার হাতে হাত রেখে বলল- ভয় পেও না, ক্লার্ক বলেছে, ফ্ল্যাশ আলো আনতে। সে পকেট থেকে ফ্ল্যাশ লাইট বের করল। চারপাশ আলোয় ভরে গেল।
ক্যাথারিন দাঁড়িয়ে। টানেলের দিকে তাকিয়ে এটা কী বড়ো? তুমি ঠিক বলছ, এটা নিরাপদ?
–অবশ্যই, স্কুলের ছেলেরা এখানে বেড়াতে আসে।
ক্যাথারিন তবুও যাবে না। সে অন্য ট্যুরিস্টদের সঙ্গে যাবার চেষ্টা করল। ব্যাপারটা তার কাছে মোটেই ভালো লাগছে না।
তারা টানেলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কয়েক ফুট এগিয়ে গেছে। প্রধান আলোটা বন্ধ হয়ে গেল। এখন আলো বলতে কিছুই নেই। ল্যারির ফ্ল্যাশলাইট শুধুমাত্র জ্বলছে। ল্যারির মুখের প্রতিচ্ছবি। সে আবার সুন্দর সুন্দর প্রতিকৃতিগুলো দেখতে পেল।
এখানে টানেলটা ছোটো হয়ে গেছে। পাথর তীক্ষ্ণ, হাঁটতে গেলে হাতে পায়ে লাগবে।
ডার্লিং, এবার ফিরলেই তো ভালো হয়। সন্ধ্যে হয়ে আসছে।
নটা পর্যন্ত খোলা থাকে, ল্যারি জবাব দিল। আমি একটা বিশেষ গুহার সন্ধান করছি। এটা সবেমাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। সেটা নাকি অসম্ভব ভালো।
ক্যাথারিন আর যেতে চাইছে না। কিন্তু কী করে ল্যারিকে ফেরাবে?
ল্যারি বলল– ভেতরে এসো।
ক্যাথারিন বলল- ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।
ল্যারি আরও সামনে এগিয়ে গেছে।
ল্যারি হন্তদন্ত হয়ে এগোচ্ছে।
ক্যাথারিন বলল তুমি কিছু ফেলেছ? মনে হল কী যেন শব্দ পেলাম।
–আমি একটা পাথরে আঘাত করেছিলাম। তাড়াতাড়ি হাঁটতে হবে।
এই কেভের ছাদটা খুব নীচু। শেওলা ধরা। ক্যাথারিন অনেক কিছু ভাবছে। শেষ পর্যন্ত সে বলল- না, ভালো লাগছে না।
–এমন কথা কেন বলছ, ক্যাথি? এটা তো একটা গুহা।
–তুমি কেন এটার পেছনে পড়েছ, বলো তো?
ল্যারি বলল- যেহেতু এখানে কেউ আসে না।
তারা ভেতরে পৌঁছে গেল। ক্যাথারিন আর কিছু ভাবতে পারছে না।
রাস্তাটা খুবই সরু। ক্যাথারিন বলল– কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে বলো তো? আমরা কি চিনদেশে পৌঁছে যাব নাকি?
ল্যারি বলল– না, আর কয়েক পা ফেললেই আমরা আসল জায়গায় চলে যাব।
পরিবেশটা ভীষণ ঠান্ডা, সঁতসেঁতে, সূর্যের আলো ঢোকে না। খালি ফ্ল্যাশলাইটের আলো। পথটা আরও সরু হয়ে গেছে।
–এখানে নিওন সাইন থাকা দরকার ছিল। আমরা হয়তো অনেক দূর চলে এসেছি।
ল্যারি বলল– না, আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি।
ক্যাথি বলল– ভীষণ শীত করছে। চলো, চলে যাই।
ল্যারি বলল– আমরা পৌঁছে গেছি ক্যাথি। চোখ টিপে সে বলল, রাতে তোমায় গরম করে দেব।
–ঠিক আছে। ক্যাথারিন সাবধানে এগোতে থাকে।
তারা টানেলের দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। ফ্ল্যাশলাইটটা গোলমাল করতে শুরু করেছে। সামনে ঘন কালো পাহাড়ের হাতছানি। ক্যাথারিন পেছন ঘুরে তাকাল। সম্পূর্ণ অন্ধকার।
ল্যারি বলল– আমরা বোধহয় ভুল পথে এসে গেছি। চলো ফিরি, আর যেতে হবে না।
-না, আমি আগে যাব, তুমি দাঁড়াও।
–তুমি কোথায় যাচ্ছো?
কয়েক ফুট এগোতেই হবে।
–শব্দটা শোনা যাচ্ছে না। আমি কি তোমার সঙ্গে যাব?
-না, আমি যাচ্ছি। ক্যাথারিন আমি দেখব, কোথায় শেষ বাঁকটা আছে। আমি দশ সেকেন্ডের মধ্যে আসব।
ক্যাথারিন দাঁড়িয়ে আছে, ল্যারি তাকে রেখে চলে গেল।
অন্ধকার চারপাশে, আলো কোথাও নেই। কী হবে? ক্যাথারিনের হৃৎস্পন্দন বুঝি স্তব্ধ হয়ে গেছে। সময় এগিয়ে চলেছে।
ল্যারি কিন্তু আর ফিরল না!
.
ক্যাথারিন অপেক্ষা করেছে, অন্ধকারের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে যাবার চেষ্টা করেছে। চিৎকার করে ডেকেছে ল্যারি বলে। শব্দটা প্রতিধ্বনিত হয়ে তার কাছে ফিরে এসেছে।
শেষ পর্যন্ত সে অবচেতনার অন্ধকারে তলিয়ে গেল। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এখানে এতটুকু আলো নেই। চারপাশ ঘন অন্ধকার।
তারপর? যতটুকু শক্তি ছিল, ডাকবার চেষ্টা করেছে। না, বৃথা অন্বেষণ।
এবার? অজ্ঞান হওয়া ছাড়া উপায় কী?
.
সে শুয়ে ছিল পাথরেব ওপর। এখন বোধহয় আবার চেতনার জগতে ফিরে আসতে চাইছে। তার সমস্ত শরীর শক্ত আর ঠান্ডা হয়ে গেছে। রক্ত গড়িয়ে আসছে। হ্যাঁ, সে পাথরে আঘাত পেয়েছে।
আরও কোনো জন্তু? বিষাক্ত বাদুড়ের দল তাকে আক্রমণ করেছে।
সে বাদুড় সম্পর্কে কিছুই জানে না। তারা মানুষের রক্ত চুষে খায়। হাজার হাজার বাদুড়। আরও কিছু খবর সে পেয়েছিল। এরা হল সেই ভয়ঙ্কর ভ্যাম্পায়ার। মাথা থেকে চিন্তা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। পাথরে হাত-পা ছড়ে যাচ্ছে।
সে ভাবল, এখানে বসে থেকে কী লাভ? কিছু তো একটা করতে হবে। পায়ে পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল। না, ল্যারির খোঁজ আর পাওয়া যাবে না।
অনেক কথাই তার মনে পড়ল। নতুন পোশাক পরে ল্যারি পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে। ল্যারি কি এবার আমাকে মা হতে দেবে?
জুতো খুলে ফেলল, খালি পায়ে হাঁটছে, আস্তে আস্তে, পাথরের গায়ে হাত দিয়ে দিয়ে। বিশাল একটা অভিযান। শেষ পর্যন্ত সে একটা শব্দ শুনতে পেল। অদ্ভুত শব্দ। কীসের? বোঝা যাচ্ছে না। হাজার হাজার, কী উড়ে যাচ্ছে? হ্যাঁ, এই সেই ভয়ঙ্কর বাদুড়ের দল।
শেষ অব্দি, তার মনে পড়েছিল, সে ল্যারির নাম ধরে ডাকল। এরপর? এরপর চাপ-চাপ অন্ধকার।
.
গুহার ঠান্ডা মেঝের ওপর সে শুয়ে আছে। তার চোখ দুটি বন্ধ। তার মন কিন্তু কথা বলছে। সে বুঝতে পারল, ল্যারি আমাকে মারতে চেয়েছিল। অবচেতনার অন্ধকারে আলো জ্বলে উঠেছে। তার মানে? ল্যারি অন্য কাউকে ভালোবাসে। ডিভোর্স চাইছে। আমি ডিভোর্স দিতে রাজী হয়নি। এ সবই ল্যারির অভিনয়। ল্যারি বলেছে, গাইড লাগবে না। আমরা একটা ভুল জায়গায় এসে গেছি।
…তুমি এখানে দাঁড়াও…দশ সেকেন্ডের মধ্যে আমি ফিরে আসব। তারপরেই অন্ধকার।
ল্যারি ফিরে আসেনি। সব মনে হচ্ছে, বানানো ষড়যন্ত্র। ক্যাথারিন জানে, সে বোধহয় এখান থেকে আর বেরোতে পারবে না। ল্যারি এমনটিই চেয়েছিল। তাকে জীবন্ত সমাধি দেওয়া হল।
ক্যাথারিন কী করবে? একটা গুমগুমে শব্দ। চারপাশ শুধুই অন্ধকার। মৃত্যু তুমি কি আমাকে গ্রহণ করবে? ভ্যাম্পায়াদের ওড়াওড়ি। না, আর্তনাদ ছাড়া আর কী বা এখন করতে পারে সে?