১১.
প্যারিস, ফ্রান্স
পুলিশ হেডকোয়ার্টার। হেনার্ড স্ট্রিটে। প্যারিসের মধ্যে। সেখানে এক প্রশ্নোত্তরের পালা চলেছে। ইফেল টাওয়ারের সুপারিটেনডেন্টকে প্রশ্ন করছেন দুজন ডিটেকটিভ। একজনের নাম আন্দ্রে বেলমন্ডো এবং অপরজন পিয়েরে মারাইস।
ইফেল টাওয়ার সুইসাইড ইনভেসটিগেশনঃ
সোমবার, ৬ মে
সকাল ১০ টা।
বিষয়- রেনেপাসকেল
বেলমন্ডো– মঁসিয়ে পাসকেল, আমরা একথা কী বিশ্বাস করব যে, মার্ক হ্যারিস, যিনি ইফেল টাওয়ারের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে পড়ে গেছেন, তাকে খুন করা হয়েছে।
পাসকে খুন? কিন্তু আমি তো বারবার বলছি, এটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা।
মারাইস না, তিনি হয়তো এভাবে পড়ে যেতেন না। এর অন্তরালে অন্য কিছু আছে।
বেলমন্ডো–আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারেছি যে, উনি সেই সপ্তাহের শেষের দিকে স্ত্রীর সাথে বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা করেছিলেন। ওনার স্ত্রী হলেন কেলি, এক বিখ্যাত মডেল। .
পাসকেল- আমি দুঃখিত। কিন্তু আমাকে কেন এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।
মারাইস কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার করার জন্য। কটার সময় সেই রাতে রেস্টুরেন্টটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?
পাসকেল-রাত দশটার সময়। কারণ বাইরে ঝড় উঠেছিল। জ্বলেভার্ন একেবারে ফাঁকা। আমি চিন্তা করেছিলাম
মারাইস কখন এলিভেটর বন্ধ করে দেওয়া হয়?
পাসকেল এলিভেটরগুলো মাঝরাত অব্দি চালু থাকে। কিন্তু সেই রাতে কেউ ইফেল টাওয়ার দেখতে আসেননি এবং হোটেলেও কোনো মানুষজন ছিলেন না। আমি রাত দশটায় এলিভেটরগুলো বন্ধ করে দিই।
বেলমন্ডো যে এলিভেটরটা অবজারভেশন ডেকে গেছে, সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?
পাসকেল- হ্যাঁ, সবগুলো।
মারাইস– তাহলে এলিভেটর ছাড়া কেউ গোপনে যাবে কী করে?
পাসকেল না, সবকটা এলিভেটর বন্ধ ছিল। আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।
বেলমন্ডো– আমি ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি। মঁসিয়ে হ্যারিসকে অবজারভেশন ডেক থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমরা ভালোভাবে সবকিছু পরীক্ষা করেছি। মাথায় একটা ছিদ্র চোখে পড়েছে। সিমেন্টেও ফাটল দেখা গেছে। তার মানে? যদি ভেতর দিকটা বন্ধ থাকে, এলিভেটর কাজ না করে, তাহলে উনি অত ওপরে উঠলেন কী করে?
পাসকেল– আমি জানি না, এলিভেটর ছাড়া অসম্ভব।
মারাইস– মঁসিয়ে হ্যারিসকে একটা এলিভেটরের সাহায্যে অবজারভেশন টাওয়ারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর হত্যাকরী বা হত্যাকারীরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বেলমন্ডো- অচেনা মানুষ কি এলিভেটরগুলো চালাতে পারে?
পাসকেল– না, অপারেটররা কখনও এলিভেটর ছেড়ে যায় না। সেই রাতে বিশেষ চাবির সাহায্যে এলিভেটরগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
মারাইস– কতগুলো চাবি থাকে?
পাসকেল– তিনটে, আমার কাছে একটা, আর দুটো গোপন জায়গায় রেখে দেওয়া হয়।
বেলমন্ডো– আপনি জানেন, দশটার সময় শেষ এলিভেটর বন্ধ হয়েছিল?
পাসকেল- হ্যাঁ।
মারাইস– কে ওটা চালাচ্ছিলেন?
পাসকেল- ডথ জেরার্ড
মারাইস– আমি ওনার সঙ্গে কথা বলব?
পাসকেল- হ্যাঁ। মারাইস আরও একটু গুছিয়ে বলুন।
পাসকেল সেই রাত থেকেই ডথ কাজে আসছেন না। আমি ওনার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। কোনো উত্তর নেই। আমি ওনার বাড়িউলির সাথে কথা বলেছি।
না, উনি যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছেন।
.
বাতাসে মিলিয়ে গেছেন? ব্যাপারটা সকলকে অবাক করেছে। বিশেষ করে সেক্রেটারী জেনারেল ক্লাউডে রেনাউট। তিনি ইন্টারপোলের হেড কোয়ার্টারে বসে আছেন। খর্বাকৃতি একজন মানুষ, বছর পঞ্চাশ বয়স, অনেক দিন ধরে পুলিশের সাথে যুক্ত আছেন। গত কুড়ি বছরের এক অসামান্য অভিজ্ঞতা।
প্রধান আলোচনা কক্ষ। ইন্টারপোলের সাততলার হেড কোয়ার্টার। এই অপিসের সাথে ৭৮টি দেশের ১২৬টি পুলিশ সংগঠনের প্রতক্ষ্য সংযোগ আছে। অফিসটা প্যারিসের ছ-মাইল পশ্চিমে অবস্থিত।
বারোজন মানুষ বিরাট ঘরে বসে আছেন, ডিটেকটিভ বেলমভো গত এক ঘন্টা ধরে তাদের নানাভাবে প্রশ্ন করছেন।
সেক্রেটারী জেনারেল রেনাউট বললেন- তাহলে আপনি এবং ডিটেকটিভ মারাইস এই ব্যাপারে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি। ওই হত্যাকারিরা কীভাবে ঢুকল এবং কীভাবে বেরিয়ে গেল? এই ব্যাপারটা আপনি তো বলেননি?
-মারইস এবং আমি সকলকে জিজ্ঞাসা করেছি।
–ঠিক আছে আপনারা আসতে পারেন।
দুজন গোয়েন্দা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সেক্রেটারী জেনারেল এবার অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন–আপনাদের অনুসন্ধানের ফলে আমরা কী জানতে পেরেছি? আমরা প্রাইমা নামে একজন মানুষের নাম পেয়েছি?
-হ্যাঁ, কিন্তু কে প্রাইমা?
আমরা জানি না, নিউইয়র্কের মৃত মানুষের জ্যাকেটের পকেটে এই নামটা পাওয়া গেছে। মনে হচ্ছে এই ব্যাপারে কোনো একটা যোগাযোগ আছে।
উনি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন ভদ্রমহোদয়রা, এর ভেতর একটা অদ্ভুত রহস্য আছে। অনেক বছর ধরে আমি এই অফিসে আছি। আমরা অনেক ধরনের সমস্যার সমাধান করেছি। তার মধ্যে ধারাবাহিক হত্যাকারী আছে, আন্তর্জাতিক গ্যাং আছে, আত্মহত্যা আছে। প্রত্যেকটা ঘটনাকেই আমরা কল্পনার মধ্যে আনতে পারি। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা কী করে ঘটল আমি ভাবতেই পারছি না। আমি নিউইয়র্ক অফিসে একটা নোটিস পাঠাচ্ছি।
.
ফ্রাংক বিগ্রে মানহাট্টান ডিটেকটিভদের প্রধান, তিনি ফাইলটি পড়ছিলেন, একটু আগে সেক্রেটারী জেনারেল রেনাউট যেটা পাঠিয়েছেন। আর্ল গ্রিনবার্গ এবং রবার্ট সেই ঘরে প্রবেশ করলেন।
–আপনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, স্যার?
বিগ্রে কাগজটা থেকে পড়তে থাকলেন–ইন্টারপোল এই নোটিশটা সকালে পাঠিয়েছে। ছ-বছর আগে আপিরা ইসো নামে এক জাপানী বিজ্ঞানী আত্মহত্যা করেছিলেন। তিনি টোকিওর এক হোটেল ঘরের সিলিং থেকে ঝুলে পড়েন। তার স্বাস্থ্য খুব ভালো ছিল, তার প্রমোশন হয়েছিল, মনটা ভালোই ছিল।
-জাপান, তার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?
আমাকে শেষ করতে দিন, তিন বছর আগে সুইজারল্যান্ডের এক বিজ্ঞানী ম্যাডেলাইন স্মিথেরও অদ্ভুতভাবে মৃত্যু হয়। তিনি জুরিখের অ্যাপার্টমেন্টে গ্যাস খুলে দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। উনি গর্ভবতী ছিলেন, যে ছেলেটি ওঁর গর্ভে ছিল তার পিতাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। বন্ধুরা জানিয়েছেন উনি খুব সুখী মহিলা ছিলেন।
ভদ্রলোক দুজন ডিটেকটিভের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন- গত তিনদিনে অনেকগুলো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গেছে। বার্লিনের বাসিন্দা সোনঝা ভারব্রুগকে তার বাথটবে মৃত অবস্থায় দেখা গেছে। একই রাতে আমেরিকান মার্ক হ্যারিসকে ইফেল টাওয়ার থেকে পড়ে আত্মহত্যা করতে দেখা গেছে। একদিন বাদে কানাডার গ্যারি রেনল্ডসের অদ্ভুত পরিণতি হয়েছে। ডেনভারের এক পাহাড় থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়।
গ্রিনবার্গ এবং রবার্ট মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। তারা আরও অবাক হয়ে গেছেন।
–গতকাল আপনারা রিচার্ড স্টিভেন্সের মৃতদেহ পেয়েছেন। নদীর তীরে তাই তো?
আর্ল বললেন- এইসব ব্যাপারের মধ্যে কোনো সন্দেহ আছে কি?
বিগ্রে বললেন- হ্যাঁ, সবকটা ঘটনার মধ্যে একটা অদ্ভুত যোগসূত্রটা আছে।
গ্রিনবার্গ অবাক হয়ে গেছেন– কী? দু-বছর আগে জাপানে যে ঘটনা ঘটেছিল, সুইজারল্যান্ডে তিন বছর আগে, গত কয়েকদিন ধরে এখানে যেসব ঘটনা ঘটছে সবগুলোর ভেতর একটা সাধারণ যোগসূত্রতা আছে?
বিগ্রে গ্রিনবার্গের হাতে নোটিশটা তুলে দিলেন। সেখানে লেখা আছে- ইন্টারপোল বিশ্বাস করে যে একটি গোপন সংগঠন, কিংসলে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের সঙ্গে কোনো না কোনো সম্পর্ক ছিল। এই কোম্পানির প্রধান হলেন ট্যানার কিংসলে। তিনি প্রেসিডেন্সিয়াল সায়েন্স কমিটির চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল অ্যাডভান্স ক্যামিং ইনস্টিটিউটের প্রধান, ডিফেন্স পলিসি বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত আছেন। আমার মনে হয় মিঃ গ্রিনবার্গ, আপনি অবিলম্বে মিঃ কিংসলের সাথে কথা বলুন।
.
পাঁচ মিনিট কেটে গেছে। আর্ল গ্রিনবার্গ ট্যানার কিংসলের সেক্রেটারীর সাথে কথা বলছেন। তারপর রবার্টের দিকে তাকিয়ে বললেন- মঙ্গলবার সকাল দশটায় আমরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছি। দেখা যাক এই ব্যাপারে আর কিছু এগোনো যায় কি না। এখন মিঃ কিংসলে ওয়াশিংটনে আছেন।
স্টেট সিলেকট কমিটি, ওয়াশিংটন, পরিবেশের ওপর আলোচনা হবে। দুজন সদস্য বসে আছেন। তারা ট্যানার কিংসলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
ট্যানার কিংসলে, চল্লিশ বছর বয়স, লম্বা এবং সুন্দর। ইস্পাতের মতো নীল তার দুই চোখের তারা। সব সময় বুদ্ধির দীপ্তিতে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। রোমানদের মতো লম্বা নাক, সুন্দর চিবুক, এমন একটা অভিব্যক্তি যা দেখলে মনে হয় আভিজাত্যের ছাপ আছে।
এই কমিটির প্রধান হলেন বয়স্ক সেনেটার পাউলিন মারি। নিজস্ব আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। তিনি ট্যানারের দিকে তাকালেন এবং বললেন- মিঃ কিংসলে, আপনি বলুন।
ট্যানার বললেন- ধন্যবাদ সেনেটার, তার কথা এগিয়ে চলল আমাদের কোনো কোনো রাজনীতিবিদ ভাবছেন যে পৃথিবীটাকে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করা যেতে পারে, আপনারা নিশ্চয়ই গ্লোবাল ওয়ারমিং এবং রিনিআউস এফেক্টের কথা শুনেছেন। ওজোন স্তরে ফুটো হয়ে গেছে। এর ফলে পৃথিবীর বেশির ভাগ জায়গাতে খরা এবং বন্যা দেখা দিচ্ছে। ব্যাপারটা চিন্তা করার মতো। দক্ষিণ মেরুতে ওজোন স্তরের গর্ত মস্ত বড় হয়ে গেছে। সেটা এখন এক কোটি স্কোয়ার মাইলে পৌঁছে গেছে। ভেবে দেখুন!
.
…আমরা হ্যারিকেন দেখতে পাচ্ছি, সাইক্লোন, টাইফুন এবং সাংঘাতিক সামুদ্রিক ঝড়। ইউরোপের সর্বত্র প্রকৃতি এইভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে। এখন ভাবতে হবে কী করে আমরা পরিবেশকে আবার দূষণমুক্ত করব।
…গত গরমকালে তাপ প্রবাহে ইউরোপে কুড়ি হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কিছু করতে পারিনি। আমাদের সরকার ডিয়েটো প্রোটোকলকে মানতে চাইছেন না। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, পরিবেশের বিশ্ব সম্মেলনে এই বিষয়ে আলাপ আলোচনা হয়েছিল।
সেনেটার গ্লুভেন বললেন– মিঃ কিংসলে, এটা কিন্তু বিতর্ক সভা নয়। আপনি একটু শান্তভাবে কথা বললে ভালো হবে।
ট্যানার তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা এ ব্যাপারে সকলেই অবহিত আছি। কিন্তু কেন কিছু করছি না? অর্থের অভাব? না, বাতাসকে পরিচ্ছন্ন করতে গেলে কত টাকা লাগে? আর বাতাসকে দূষিত করলে? কত গ্যালন গ্যাস?
সেনেটার আবার বললেন মিঃ কিংসলে?
কিংসলে বললেন-আমি ক্ষমা চাইছি। সেনেটার, আমার মন ভালো নেই। আমি বুঝতে পারছি আমাদের বিশ্বটা নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে অথচ আমরা কোনো প্রতিরোধ করতে পারছি না।
কিংসলে আরও ত্রিশ মিনিট ধরে কথা বলেছিলেন। কথা বলা হয়ে গেলে, সেনেটার ভ্যান বললেন- মিঃ কিংসলে, আপনি কি আমার অফিসে আসবেন?
এখানেই আলোচনা শেষ করে দেওয়া হল!
.
সেনেটার ভ্যানের অফিস, সুন্দরভাবে সাজানো। আভিজাত্যের ছাপ আছে। ডেস্ক টেবিল, ছটা চেয়ার, ফাইলিং কেবিনেট, সর্বত্র তার মেয়েলি হাতের ছাপ। বর্ণ রঙীন ফেব্রিক আছে, আছে সুন্দর চিত্রাবলী এবং ফটোগ্রাফ।
ট্যানার ঢুকলেন, দুজন অফিসার দাঁড়িয়েছিলেন, সেনেটার ভ্যান লিভেনও ছিলেন।
–এঁরা আমার সহকারিনী, কোরাইন মারফি আর ক্যারোলি ট্রস।
কোরাইন, লাল চুলের এক আকর্ষনীয়া, চরিত্রের মহিলা। ক্যারোলি, তার চুলের রংও লাল, বছর কুড়ি বয়স। তারা সেনেটারের পাশে বসলেন।
বসুন মিঃ কিংসলে, সেনেটার বললেন। ট্যা
নার তাকালেন। বললেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
কিছু ব্যাপারে পরিষ্কার আলোচনা করাই উচিত।
–আপনার কোম্পানি, কিংসলে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ, আমাদের সরকারের সাথে অনেকগুলো প্রকল্পের অংশীদার। আপনি আবার সরকারি নীতির সমালোচনা করছেন। এটা কী ব্যবসার পক্ষে খারাপ না?
ট্যানার ঠাণ্ডা গলায় বললেন- এটা ব্যবসার ব্যাপার নয় সেনেটার, এটা মানবিকতার প্রশ্ন। আমরা একটা ভয়ংকর সম্ভাবনার দিকে সুনিশ্চিতভাবে এগিয়ে চলেছি। আমি চাইছি সেনেট যেন এই ব্যাপারে আরও অর্থ দান করে।
সেনেটার বললেন কিন্তু এই অর্থের অনেকটাই তো আপনার পকেট থেকে বেরিয়ে যাবে।
–তাতে কী হয়েছে? আমি চাই বেশি দেরি হবার আগেই যেন কাজ শুরু হয়।
কোরাইন শান্তভাবে বললেন- অদ্ভুত লাগছে, আপনি এক অবাক স্বভাবের মানুষ। ট্যানার তার দিকে তাকিয়ে বললেন মিস মারফি, যদি আপনি তাই মনে করেন, তাহলে হয়তো আমি সেই দলভুক্ত।
ক্যারোলি বললেন- আপনি যেটা করতে চাইছেন তার তারিফ করতেই হবে।
সেনেটার ভ্যান তার সহকারিনীদের দিকে তাকালেন। চোখ থেকে রাগ ঝরে পড়ছে। তারপর ক্যারোলির দিকে তাকিয়ে বললেন- এ বিষয়ে আমি এখনই প্রতিশ্রুতি দিতে পারছি না, সহকারীদের সাথে কথা বলতে হবে, তাদের মাথায় ব্যাপারটা ঢোকাতে হবে, আমি ঠিকসময় আপনাকে জানাব।
ধন্যবাদ সেনেটার, এখন আমি আসতে পারি?
এভাবেই অধিবেশনটা শেষ হল।
.
১২.
যে মুহূর্ত থেকে সবাই জানতে পারল মার্কের মৃত্যুর খবর, কেলি হ্যারিসকে ফোনের বন্যা সামলাতে হল। ফুলের স্তবক আসছে, অসংখ্য ই-মেল।
স্যাম মোডোসের কাছ থেকে টেলিফোন এল কেলি, আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার মন ভালো নেই। যখনই মার্কের কথা মনে পড়ছে, তখন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে–কেলি আমি কি তোমার জন্য কিছু করব?
না, ধন্যবাদ স্যাম।
–দেখো আমাদের সঙ্গে যেন ভালো সম্পর্ক বজায় থাকে।
আরও গোটা বারো টেলিফোন এসেছে। মার্কের বন্ধুরা এবং সেইসব মডেলদের কা থেকে, যারা কেলির সঙ্গে কাজ করে থাকে।
বিল লাগনার, মডেলিং সংস্থার প্রধান, টেলিফোন করলেন। তিনি শোক প্রকাশ ক বললেন- কেলি, আমি বুঝতে পারছি এখন আপনার মনের অবস্থা খুবই খারাপ। বি কাজ করলে বোধহয় আপনি এই শোককে সামলাতে পারবেন, যখন কাজে যোগ দে তখন আমাকে জানাবেন- নিশ্চয়ই।
কখন থেকে যোগ দেবেন?
–মার্ক যখন আবার ফিরে আসবে।
এই কথা বলেই কেলি টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন।
.
আবার ফোনটা বেজে উঠল– কেলি বললেন কে?
–মিসেস হ্যারিস?
আমি কি এখনও মিসেস হ্যারিস, কেলি ভাবলেন, হ্যাঁ, আমি তো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মার্কের স্ত্রী হিসেবে বেঁচে থাকব।
–আমি ট্যানার কিংসলের অফিস থেকে বলছি।
–যে অফিসে মার্ক চাকরি করত?
–মিঃ কিংসলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। আপনি কি ম্যানহাট্টানে আসতে পারবেন? কোম্পানির হেড কোয়ার্টারে একটা জরুরী মিটিং আছে।
কেলি এখন স্বেচ্ছাস্বাধীন, তিনি তার এজেন্সিকে বলেছেন সব বুকিং নষ্ট করতে। কিন্তু ট্যানার কিংসলে কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন?
জানি কি শুক্রবার প্যারিস ছাড়তে পারবেন?
–হ্যাঁ, শুক্রবার। ঠিক আছে।
–ঠিক আছে। ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের টিকিট পাঠিয়ে দেওয়া হল। আপনি ডবল এয়ারপোর্টে চলে যাবেন। নিউইয়র্কে আপনার জন্য গাড়ি থাকবে।
.
ট্যানার কিংসলে সম্পর্কে অনেক কথা কেলি শুনেছিলেন মার্কের কাছে। ভদ্রলোক সত্যিই এক জীবন্ত প্রতিভা। তার সঙ্গে কাজ করে আনন্দ আছে।
অ্যাঞ্জেল ছুটে এসেছে, কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, কেলি তাকে আদর করলেন- কী হবে বলতো? আমি যখন থাকব না তখন তুই কার কাছে থাকবি। কয়েক দিনের মধ্যেই আমি ফিরে আসব কেমন?
.
কেলি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন, শ্রমিকরা কাজ করছে, নতুন একটা এলিভেটার লাগানো হবে।
বাড়িটা সুপারিনটেনডেন্ট ফিলিপ্পে সেনড্রে-র, এক লম্বা আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের মানুষ। উষ্ম ব্যক্তিত্ব। এই খবরটা তাকেও ব্যথা দিয়েছে। মার্কের সমাধিতে তিনি উপস্থিত ছিলেন।
কেলি ফিলিপ্পের কাছে চলে গেলেন। ফিলিপ্পে দরজা খুলে দিলেন।
কেলি বললেন- অনুগ্রহ করে একটা কাজ করে দেবেন?
ভেতরে আসুন, ম্যাডাম হ্যারিস, কী কাজ?
–তিন চারদিনের জন্য নিউইয়র্কে যাব। আপনি কি আমার কুকুরছানাটার দায়িত্ব নেবেন?
নিশ্চয়ই, কেন কিছু মনে করব? আনা, মারিয়া এবং আমি তাকে খুব ভালোবাসি।
অনেক ধন্যবাদ।
.
শুক্রবার সকালবেলা, কেলি অ্যাঞ্জেলকে নিয়ে ফিলিপ্পে সেনড্রের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে গেলেন।
কয়েকটা কাগজের ব্যাগ হাতে তুলে দিলেন। বললেন–এখানে অ্যাঞ্জেলের প্রিয় খাবার আছে। আছে এমন কিছু খেলনা যেটা খেলতে সে ভীষণ ভালোবাসে।
ফিলিপ্পে একটু পিছিয়ে গেলেন। কেলি দেখলেন মেঝেতে অনেকগুলো খেলনা পড়ে আছে, কেলি হেসে বললেন– অ্যাঞ্জেল, তুই ভালো লোকের কাছেই থাকবি। অ্যাঞ্জেলের দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে বললেন- গুডবাই অ্যাঞ্জেল, ফিলিপ্পে, আপনাকে আবার ধন্যবাদ।
.
যে সকালে কেলি যাবার চেষ্টা করেছিলেন, সেই সকালেই নিকোলে প্যারাডিস, হ্যাঁনসি অ্যাপার্টমেন্টের রিসেপশনিস্ট দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন। ধূসর বর্ণের এক মহিলা, চেহারাটা খুবই ছোটো, ডেস্কের আড়ালে বসলে মাথা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না।
উনি কেলির দিকে তাকিয়ে বললেন- তোমাকে না দেখলে খারাপ লাগে। কবে আসবে?
কেলি বললেন তাড়াতাড়ি ফিরব।
কেলি এবার এয়ারপোর্টের দিকে এগিয়ে চলেছেন। এয়ারপোর্টে অসম্ভব ভিড়। যেমনটি হয়ে থাকে। টিকিট কাউন্টার থেকে দোকান, রেস্টুরেন্ট, সিডি, এসকেলেটার, সব জায়গায়তেই মানুষের ছড়াছড়ি।
যখন কেলি পৌঁছল, এয়ারপোর্ট ম্যানেজার তাকে একটা প্রাইভেট লাউঞ্জে নিয়ে গেলেন। পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে গেছে, এবার উড়ান পাখি যাত্রা শুরু করবে। কেলি বোর্ডিং গেটের দিকে তাকালেন। একজন ভদ্রমহিলা তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কেলি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে উনি সেলফোনটা বের করে একটা ফোন করলেন।
.
কেলি এয়ারপ্লেন সীটে বসে আছেন। মার্কের কথা ভাবছেন। হঠাৎ মনে হল, সকলেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। কেন? কেলির মনে হল, ওই রাতে মার্ক কেন ইফেল টাওয়ারের অবজারভেশন ডেকে গিয়েছিল? কারোর সঙ্গে কথা বলতে কি? কেন মার্ক আত্মহত্যা করল? আমরা তো ভালোই ছিলাম, আমরা একে অন্যকে ভালোবাসতাম। কিন্তু না, মার্ক কখনও আত্মহত্যা করতে পারে না। কেলি চোখ বন্ধ করলেন। চিন্তাধারা অনেক দুরে পৌঁছে গেল! প্রথম দেখা কথাতে মার্ক কেড়েছেন।
.
এটা তাদের প্রথম দেখা করা। কেলি একটা সুন্দর কালো রঙের স্কার্ট পরেছিলেন। উঁচু কলারওয়ালা সাদা ব্লাউজ। যাতে মার্ক কোনোভাবেই প্রলোভিত হতে না পারেন। কেলি বুঝতে পারলেন তিনি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
কেলি দরজাটা খুলে দিলেন, মার্ক দাঁড়িয়ে আছেন, মুখে হাসি। হাতে একটা বাক্স, আরেকটা পেপার ব্যাগ। তিনি একটা ধূসর রঙের স্যুট পড়েছেন সবুজ শার্ট, লাল টাই, বাদামী রঙের জুতো। কেলি দেখে হেসে ফেলেছিলেন। আসলে স্টাইল সম্পর্কে মার্কের কোনো ধারণা ছিল না।
–ভেতরে এসো। কেলি বলেছিলেন।
আশা করি আমার দেরি হয়নি।
না, একদমই না। আসলে মার্ক পঁচিশ মিনিট আগে এসেছিল।
মার্ক কেলির হাতে বাক্সটা তুলে দিয়ে বললেন- এটা তোমার জন্য।
পাঁচ পাউন্ড ওজনের চকোলেট, অনেক বছর ধরে কেলিকে হীরের আংটি দেওয়া হয়েছে, ফারের কোট, পেন্ট হাউস, কিন্তু কেউ কখনও তাকে চকোলেট দেয়নি। তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তিনি হেসে বললেন– ধন্যবাদ।
মার্ক ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললেন- এগুলো অ্যাঞ্জেলের জন্য।
অ্যাঞ্জেল লাফাতে লাফাতে ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে। সে মার্কের দিকে এগিয়ে গেল, লেজ নাড়াতে নাড়াতে।
মার্ক অ্যাঞ্জেলকে কোলে তুলে নিলেন, বললেন– ও এখনও আমাকে মনে রেখেছে।
কেলি বললেন- এ কিন্তু আমার সারাক্ষণের সঙ্গিনী। আমি কখনও ওকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই পারি না।
মার্ক কেলির দিকে তাকিয়ে আছেন, চোখের ভাষায় অনেক কিছু বলতে চাইছেন তিনি।
.
বিকেলটা কেটে গিয়েছিল অনাস্বাদিত আনন্দের মধ্যে দিয়ে। মার্কের সান্নিধ্য উপভোেগ করা যায়। মার্কের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার পরিপূর্ণ।
মার্ক বললেন- আবার কবে দেখা হবে?
-আমি ঠিক সময় বলে দেব। তুমি সকার গেম দেখতে ভালোবাসো?
মার্কের মুখে কেমন একটা কালো ছাপ। হ্যাঁ আমি দেখতে খুব ভালোবাসি।
মার্ক মিথ্যে কথা বলেছিলেন, কেলি বলেছেন–শনিবার রাতে চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই আছে। তুমি কি যাবে?
মার্ক জবাব দিয়েছেন- হ্যাঁ, গেলে ভালোই লাগবে।
.
সন্ধ্যেটা কেটে গেল। তারা কেলির অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং- এ ফিরে এসেছেন। কেলি অত্যন্ত উত্তেজিত।
একটা গুড নাইট কিস?
হবে কী? তিনি ভেবেছিলেন।
কেলির দরজা, মার্ক তাকালেন, বললেন- তোমাকে দেখে আমার কী মনে হয়েছিল জানো?
কেলির নিঃশ্বাস বন্ধ, এই তো, খোলস ছেড়ে আসল লোকটা বেরিয়ে আসছে।
–তোমার বুক দুটো খুবই সুন্দর।
–তোমার পা খুবই লম্বা।
না, কী মনে হয়েছিল?
–তোমার চোখের তারায় ধূসর বিষণ্ণতা।
কেলির জবাব দেবার আগেই মার্ক বললেন– শুভরাত কেমন?
কেলি একেবারে অবাক হয়ে গেছেন!
.
১৩.
শনিবার রাতে মার্ক এলেন, তিনি আরেক বাক্স ক্যানডি এনেছেন, মস্তো বড়ো পেপার ব্যাগে।
তিনি বলল- এই ক্যানডি তোমার জন্য, পেপার ব্যাগে যা আছে তা অ্যাঞ্জেলের জন্য।
কেলি ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলেছিলেন- আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, অ্যাঞ্জেলও তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।
আবার একই ঘটনা, অ্যাঞ্জেল লাফিয়ে মার্কের কোলে উঠে গেছে।
কেলি জানতে চাইলেন- সত্যি তুমি খেলা দেখতে যাবে?
কেলি সুনিশ্চিত এর আগে মার্ক কখনও সকার খেলা দেখেনি।
.
স্টেডিয়ামে অনেক মানুষের ভিড়। সেন্ট জার্মেইন্স স্টেডিয়াম। সাতষট্টি হাজার মানুষ ভিড় করেছে। চ্যাম্পিয়ানশিপের খেলা শুরু হবে।
কেলি এবং মার্ক তাদের সীটের দিকে চলে গেলেন। কেলি বললেন– এই টিকিটগুলো সহজে পাওয়া যায় না।
–তুমি সকার খেলা যে এত ভালোবাসো আমি ভাবতেই পারছি না।
কেলি হাসতে ভুলে গেছেন। এবার খেলাটা শুরু হবে।
বেলা দুটো, দুটো দলই স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়েছে। ব্যান্ডে জাতীয় সংগীতের সুর বেজে উঠেছে। একদিকে লায়ন, অন্য দিকে মার্কসওয়েব। প্রথমেই একজন খেলোয়াড় এসে দাঁড়াল। কেলি ব্যাপারটা মার্ককে বলতে চেয়েছিল।
মার্ক গড়গড়িয়ে বলে চলেছেন- ওর নাম গ্রেগরি কাওপে। ও হল লীগের সব সেরা গোলি। সে একাধিকবার চ্যাম্পিয়ানশিপ জিতেছে।
কেলি অবাক হয়ে মার্কের দিকে তাকিয়ে আছেন।
এবার ঘোষক বলছেন– সিডনি গোভৌ।
মার্ক সঙ্গে সঙ্গে বললেন চোদ্দ নম্বর। অসাধারণ খেলেছে গত সপ্তাহে।
কেলি আবার অবাক হয়ে গেছেন।
প্রত্যেকটা খেলোয়াড় সম্পর্কে মার্কের খুঁটিনাটি জ্ঞান আছে।
এবার খেলা শুরু হল। মার্ক মাঝে মধ্যেই মন্তব্য করছেন। কেলি অবাক হয়েছেন আরও একবার।
আঃ এমন একটা মানুষ তাকে না ভালোবেসে আমি কী করব?
.
লেডিস এবং জেন্টলম্যান, অনুগ্রহ করে সীটবেল্ট বেঁধে নিন, ঠিক জায়গায় থাকুন। আমরা কেনেডি এয়ারপোর্টের দিকে এগিয়ে চলেছি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিমান সেখানে অবতরণ করবে।
কেলি আবার বর্তমানে ফিরে এলেন। তিনি এখন নিউইয়র্কেচলেছেন, ট্যানার কিংসলের সাথে দেখা করতে, এই লোকটির অধীনে মার্ক চাকরি করত।
.
গণমাধ্যমকে কেউ খবরটা বলে দিয়েছে। যখন প্লেনটা ল্যান্ড করল, তারা কেলির জন্য। অপেক্ষা করছিল। রিপোর্টাররা চারপাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টেলিভিশন ক্যামেরা তাক করে আছে।
–কেলি, আপনি এখন কেমন আছেন?
বলবেন আপনার স্বামীর কী হয়েছিল?
পুলিশ কি তদন্ত শুরু করেছে?
আপনার স্বামী কি ডিভোর্স চাইছিলেন?
আপনি কি এখানেই থেকে যাবেন?
–এই খবরটা শুনে আপনার মনের অবস্থা কী হয়েছিল?
কেলি দেখতে পেলেন একটা সুন্দর মুখের মানুষকে। দাঁড়িয়ে আছেন এবং হাত নাড়ছেন।
উনি হলেন বেন রবার্টস, নেটওয়ার্ক টেলিভিশনের অন্যতম চরিত্র। কেলিকে এর আগেও উনি ইন্টারভিউ করেছেন। এখন ওনাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। কেলি দেখলেন বেন ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে আসছেন।
–হাই বেন, কেলি কি তোমার শো-তে নামবে নাকি?
–তোমার আর কেলির একটা ছবি নেবো?
বেন কেলির কাছে পৌঁছে গেছেন। রিপোর্টাররা আরও সামনে আসার চেষ্টা করছেন।
বেন বললেন- ওকে এভাবে বিরক্ত কোরো না। তোমরা পরে কথা বোলো।
রিপোর্টাররা পথ করে দিচ্ছে।
বেন কেলির হাতে হাত রেখে বললেন আমি অত্যন্ত দুঃখিত, মার্ককে খুবই ভালো বাসতাম।
কেলি এবং বেন সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। তিনি জিজ্ঞেস করল–তুমি নিউইয়র্কে কেন এসেছো?
ট্যানার কিংসলের সঙ্গে কথা বলতে।
উনি কিন্তু খুব শক্তিশালী মানুষ। উনি তোমার সব দায়িত্ব নেবেন বলে আমার বিশ্বাস।
ওঁরা লাগেজ কাউন্টারে পৌঁছে গেলেন।
বেন বলল- কেলি যদি কখনও আমাকে দরকার হয় তাহলে ফোন করো। নেটওয়ার্কেই আমাকে পাবে।
ইউনিফর্ম পরা ড্রাইভার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে বলল- আপনি মিসেস হ্যারিস? আমি কলিন। গাড়িটা বাইরে আছে। মিঃ কিংসলে আপনার জন্য পেনিংসে হোটেলে জায়গা রেখেছেন। আপনি কি টিকিট দেবেন? আমি ল্যাগেজের দায়িত্ব নেবো।
দশ মিনিট কেটে গেছে, কেলি এখন হোটেলের দিকে চলেছেন। ট্রাফিকের মধ্যে দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে।
কলিন বলল– মিঃ কিংসলের সেক্রেটারী আপনাকে ফোন করবেন, একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হবে, যখন খুশি গাড়িটা ব্যবহার করবেন।
ধন্যবাদ। কেলি অবাক হয়ে গেছেন, আমি এখানে কেন এসেছি?
এবার বোধহয় এই প্রশ্নের উত্তরটা তিনি মানতে পারবেন!
.
১৪.
ট্যানার কিংসলে সান্ধ্য সংস্করণের শিরোনাম পড়ছিলেন, লেখা আছে ইরানে শিলাবৃষ্টি, বাকিটা আর তিনি আর পড়তে চাইছেন না। গরমকালে শিলাবৃষ্টি? মাঝেমধ্যে তুষার ঝড় ট্যানার সেক্রেটারীকে ডেকে পাঠালেন। সেক্রেটারী এলে তিনি বললেন, ক্যাথি, এই আর্টিকেল সেনেটার ভ্যান গ্লভেনের কাছে পাঠিয়ে দাও, তার তলায় একটা নোট লিখে দেবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলশ্রুতি।
কিংসলে ঘড়ির দিকে তাকালেন। দুজন ডিটেকটিভ আধ ঘণ্টার মধ্যে আসবেন। তিনি অফিসের দিকে তাকালেন, এই অফিসটা তার নিজের হাতে তৈরি। তিনি জানেন এই অফিসটা করতে তাঁকে কত পরিশ্রম করতে হয়েছে।
আজ এটা পৃথিবীর অন্যতম সেরা পাওয়ার হাউসে পরিণত হয়েছে। শুরুটা কিন্তু এমন ছিল না অর্থাৎ একটা অলৌকিক কাজ করা হয়েছে।
.
দাদা অ্যানড্রুর জন্মের পাঁচ বছর বাদে ট্যানারের জন্ম হয়েছিল। তাদের মা বাবার মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। মা আরেক জনকে বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে যায়। বাবা ছিল বিজ্ঞানী, ছেলেরা ছোটোবেলা থেকেই বাবাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে।
সত্যি কথা বলতে কী, দাদার থেকে পাঁচ বছরের ছোটো আমি, এই ব্যাপারটা ট্যানারকে হীনমন্যতায় ভুগিয়ে ছিল। ট্যানার সায়েন্স ক্লাসের সবসেরা সম্মান পায়, তাকে বলা হয় অ্যানড্রু পাঁচ বছর আগেই এই সম্মানটা পেয়েছে। পরিবারের ঐতিহ্য বজায় রাখতে হবে।
ট্যানার একবার বাগ্মী প্রতিযোগিতায় জিতে গিয়েছিলেন। অধ্যপক বললেন– ধন্যবাদ, ট্যানার, তুমি দ্বিতীয় কিংসলে হিসেবে এই পুরস্কারটা পেলে।
টেনিসের ম্যানেজার ঘোষণা করলেন আমার মনে হয় তুমি তোমার দাদা অ্যানড্রুর মতো সফল হবে।
ট্যানার যখন স্নাতক হলেন, তখন বলা হল, তোমার ভাষণটা ভারী সুন্দর হয়েছে। অ্যানড্রুর কথা বারবার মনে পড়ছিল।
তার মানে, ট্যানার দাদার ছায়াতেই বেড়ে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে দ্বিতীয় সেরা উপাধি দেওয়া হল, কারণ অ্যানড্রু বরাবরই প্রথম হয়ে গেছেন।
.
দুই ভাইয়ের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য ছিল। দুজনেই দেখতে সুন্দর, বুদ্ধিমান এবং যথেষ্ট প্রতিভাসম্পন্ন। তাদের বয়স ক্রমশ বাড়ল, এবার দেখা গেল কিছু বৈসাদৃশ্য। অ্যানড্রুকে আমরা উদাসীন স্বভাবের মানুষ বলতে পারি, অন্তর্মুখী। ট্যানার কিন্তু বহির্মুখী, উচ্চাকাঙ্খী। অ্যানড্রু মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বার বার হোঁচট খেতে ভালোবাসেন। ট্যানার অনায়াসেই মেয়েদের আকর্ষণ করেন চুম্বকের মতো।
জীবন সম্পর্কে তারা দুজন দু-ধরনের ধারণায় বিশ্বাস করেন। অ্যানড্রু সমাজসেবা করতে ভালোবাসেন। ট্যানার চাইতেন আরও শক্তিশালী এবং বড়োলোক হতে।
.
অ্যানড্রু কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট হলেন, চাকরি করলেন, লিঙ্ক ট্যাঙ্কের হয়ে। অনেক কিছু শিখলেন, কীভাবে মানুষকে সাহায্য করতে হয়। পাঁচ বছর বাদে অ্যানড্রু নিজেই একটা কোম্পানি খোলার কথা চিন্তা করলেন।
অ্যানড্রু এই বিষয়টা নিয়ে ট্যানারের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।
ট্যানার উত্তেজিত ব্যাপারটা দারুণ। আমরা সরকারের সাথে ব্যবসা করব।
না-না এটা আমার ইচ্ছে নয়। আমি সাধারণ মানুষকে সাহায্য করতে চাইছি।
তার মানে?
তৃতীয় বিশ্বের অনেক মানুষ দরিদ্রতার জালে জর্জরিত। তারা কৃষির আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু জানতে পারছে না। আমি তাদের হাতে সাহায্যের ভাণ্ডার তুলে দেব।
ট্যানার অবাক হয়ে গেছেন। উনি বললেন- সে কী? তাহলে কোম্পানীর কী হবে?
অ্যানড্রু বললেন– আমি টাকার কথা চিন্তা করছি না ভাই, আমরা তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষিত মানুষদের পাঠাবো। তারা নতুন ভাবে কৃষিকাজ করবে। তাদের জীবনধারা একেবারে পাল্টে যাবে। আমি তোমাকে পার্টনার করতে চাইছি। আমাদের এই দলটাকে কিংসলে গ্রুপ বলা হবে। তোমার কি কিছু বলার আছে?
ট্যানার কী যেন চিন্তা করে বললেন– সত্যি কথা বলতে কি তোমার পরিকল্পনাটা খারাপ নয়। আমরা প্রথমে ওইসব দেশের সঙ্গে কথা বলব। তারপর বড়ো বড়ো দেশের সঙ্গে চুক্তি করব।
ট্যানার, এই পৃথিবীটাকে আরও সুন্দর গ্রহ করে তুলতে হবে।
ট্যানার হাসলেন, হ্যাঁ, এখন আপোস করতে হবে। তারপর? তারপর নিজেই আমি আমার সাম্রাজ্য গড়ে তুলব।
ট্যানার এবং অ্যানড্রু হাতে হাত রাখলেন, বললেন- এভাবেই আমাদের যাত্রা শুরু থোক।
.
ছমাস কেটে গেছে, দুভাই বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন, ছোট্ট ইটের বাড়ির সামনে। তাদের চোখে মুখে অসন্তোষের ছাপ।
অ্যানড্রু জিজ্ঞেস করলেন-কীভাবে কাজ করছে আমাদের কিংসলে গ্রুপ?
–অসাধারণ, ট্যানার তার কণ্ঠস্বরে কৌতুক এনে বললেন।
–পৃথিবীর সর্বত্র আমরা আনন্দ পৌঁছে দিচ্ছি ট্যানার, ভেবে দেখো, ইতিমধ্যে আমরা কয়েকজন প্রশিক্ষককে তৃতীয় বিশ্বে পাঠিয়ে দিয়েছি।
ট্যানার কিছু বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বললেন না। বুঝতে পারলেন, সময় এসেছে, এবার নতুন করে সবকিছু ভাবতে হবে। হা, কিংসলে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের জন্ম হবে।
.
জন হিথল, অ্যানড্রুর কলেজ বন্ধু, অনেক টাকা লগ্নি করেছেন। অন্তত এক লক্ষ ডলার। বাকিটা অ্যানড্রু বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে তুলেছেন।
ছজন মানুষকে কেনিয়াতে পাঠানো হয়েছে, সোমালিয়া এবং সুদানে। সেখানকার সাধারণ মানুষদের মধ্যে চেতনার উদ্ভাবন ঘটাতে হবে। তবে টাকা পয়সা কিছুই আসছে না।
ট্যানার একদিন বললেন– অ্যানড্রু, বড়ো বড়ো কোম্পানীর সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলে আমরা চালাব কী করে?
স্ট্যানার এটা কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
এবার ট্যানারের অবাক হবার পালা।
–ভেবে দেখো, সিজ ব্লাড কর্পোরেশন কিন্তু আগ্রহী।
অ্যানড্রু হেসে বললেন- আমরা আমাদের আসল কাজটা করব।
ট্যানার আর নিজেকে চেপে রাখতে পারলেন না। তাঁদের দুজনের নিজস্ব ল্যাবরেটরী আছে, তারা দুজনেই নিজস্ব প্রকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে ভালোবাসেন। অ্যানড্রু অনেক সময় মাঝরাত পর্যন্ত কাজ করেন।
একদিন সকালবেলা, ট্যানার প্ল্যান্টে এসেছেন, অ্যানড্রু তখনও সেখানে ছিলেন। ট্যানারকে দেখে অ্যানড্রু লাফিয়ে উঠলেন, বললেন নতুন প্রজেক্টটা নিয়ে আমি অত্যন্ত উত্তেজিত। আমি একটা দারুণ ব্যাপার আবিষ্কার করতে চলেছি।
ট্যানারের মন তখন অন্য ব্যাপারে চলে গেছে। গত রাতে এক লাল চুলের মহিলার সাথে তার দেখা হয়েছে। তারা দুজন বারে একসঙ্গে মদ খেয়েছেন। তিনি ওই মহিলার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন। স্মরণযোগ্য সময়।
-হ্যাঁ, ট্যানার, এইভাবে ব্যাপারটা শুরু করলে কেমন হয়?
ট্যানার বললেন- অ্যানড্রু পেড?
অ্যানড্রু হাসলেন। হ্যাঁ, এর সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে হবে।
ট্যানার কিন্তু তখনও তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা ভাবছেন। সত্যিই এইভাবে কাজ শুরু করলে একদিন আমি পৃথিবীটাকে পায়ের তলায় আনতে পারব।
.
সন্ধ্যেবেলা ট্যানার ককটেল পার্টিতে বসেছিলেন। মহিলার সুন্দর কণ্ঠস্বরে তার তন্দ্রা ভেঙে গেল মিঃ কিংসলে, আমি কিন্তু আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি।
ট্যানার তাকালেন, তার হতাশা আটকে দেবার চেষ্টা করলেন। কে কথা বলছে? সাধারণ চেহারার এক তরুণী। তার চোখের তারা উজ্জ্বল বাদামী, অদ্ভুত একটা হাসি আছে। ট্যানার এই মেয়েটির শারীরিক সৌন্দর্যের কথা ভুলে গেলেন। না, মেয়েটি বোধহয় সেখানে নিজেকে প্রকাশ করতে চায় না।
ট্যানার বললেন- কী খারাপ? তিনি ওই মেয়েটির কাছ থেকে পালিয়ে যাবার রাস্তা খুঁজছিলেন।
–আমি পাউলিন কুপার। বন্ধুরা আমাকে পাওলা বলে ডেকে থাকেন। আপনি আমার বোন জিনির সাথে ডেটিং করেছেন। জিনি আপনাকে পাওয়ার জন্য পাগল।
জিনি? জিনি? ছোট্টখাট্টো? লম্বা? কালো? সোনালী? ট্যানার দাঁড়িয়ে থাকলেন, হাসছেন। মনে করার চেষ্টা করছেন। অনেকগুলো মুখ ভেসে আসছে।
–জিনি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছে।
–অনেকেই তো চেয়েছে, হ্যাঁ, আপনার বোন খুবই সুন্দরী।
ট্যানারের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল- আপনি তাকে মনে করতে পারছেন না?
ট্যানার অপ্রস্তুত- হা, আমি চেষ্টা করছি।
আমি এইমাত্র তার বিয়ের পার্টিতে যোগ দিয়ে এলাম।
ট্যানারের চোখে আনন্দ তাহলে জিনির বিয়ে হল।
-হ্যাঁ, একটুখানি নীরবতা, কিন্তু আমি আরেকটা কথা বলতে চাইছি, আপনি কি কাল রাতে ডিনার খাবেন?
ট্যানার মেয়েটির দিকে ভালোভাবে তাকালেন। না, মেয়েটি হয়তো তাঁর দলভুক্ত নয়, তবে শরীরটা খুব একটা খারাপ না। হ্যাঁ, একে সহজেই টোপ দেওয়া যেতে পারে। ট্যানার ভাবলেন, বেসবল টিমের সঙ্গে তার দেখা করতে হবে। একজন মহিলাকে উদ্ধার করতে হবে।
মেয়েটি তখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে– আমি টাকা দেব।
ট্যানার হাসলেন- ঠিক আছে আসব।
মেয়েটি বলল- আমাকে একবার পরখ করে দেখতে পারেন।
ট্যানারের মুখে হাসি আচ্ছা চেষ্টা করব।
.
পরের দিন সন্ধ্যেবেলা, তারা একটা সুন্দর রেস্টুরেন্টে বসে আছেন। পাওলা ক্রিমরঙের দোপাড় সিল্কের ব্লাউজ পরেছেন, একটা কালো স্কার্ট। হাইহিল জুতো। ট্যানার তার পা থেকে মাথা অবধি সবকিছু দেখলেন। মনে হচ্ছে, সে বোধহয় নিজেকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে, সে বোধহয় কোনো একটা উত্তেজক দেশের রাজকুমারী।
ট্যানার দাঁড়িয়ে উঠে বললেন- শুভ সন্ধ্যা।
পামলা বললেন- হ্যাঁ, শুভ সন্ধ্যা।
পাওলা বললেন- আমরা কথাটা শুরু করি। আমার কিন্তু কোনো বোন নেই।
ট্যানার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন কিন্তু তুমি যে বললে…
মুখে হাসি আমি তোমার প্রতিক্রিয়াটা লক্ষ্য করছিলাম। আমি অনেক কথা তোমার সম্পর্কে জেনেছি। তোমার প্রতি আমার আগ্রহের শেষ নেই।
মেয়েটি কি এখন যৌনতার কথা বলবে?
–আমি তোমার চরিত্রের কয়েকটা দিককে ভালোবাসি।
–তুমি কি সত্যি আমার সম্পর্কে আগ্রহী?
-হ্যাঁ।
এভাবেই কথা শুরু হল। ট্যানার হাতে হাত রেখে বললেন–হ্যাঁ, তোমার মধ্যে একটা আলাদা আভিজাত্য আছে। এটা অত্যন্ত গভীর এবং একান্ত। তোমার সাথে আজ রাতটা ভালোভাবেই কাটবে।
-হ্যাঁ, তুমি কি ক্লান্ত বোধ করছে ডার্লিং।
ট্যানার আবার তাকালেন। চোখের ভেতর একটা অদ্ভুত নিরাপত্তা। মেয়েটিকে আগ্রহী বলা যেতে পারে কি?
ট্যানার বললেন- হ্যাঁ, আমি সবসময় ক্লান্ত বোধ করি রাজকুমারী।
মেয়েটির মুখে হাসি ঠিক আছে, তাহলে কোথাও চেষ্টা করা যাবে? অন্তত আজ রাতে?
ট্যানার কেমন যেন হয়ে গেছেন। এতদিন তিনি মেয়েদের নিয়ে খেলা করেছেন। তারপরে বললেন- তুমি কী বলতে চাও?
–আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই।
মেয়েটির মুখে একটা অদ্ভুত প্রত্যয়। এসো, একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।
.
১৫.
কিংসলে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ, ওয়ার্ল্ড হেড কোয়ার্টার, ম্যানহাট্টানে অবস্থিত। ইস্ট নদীর কাছে পাঁচ একর জমির ওপর বিরাট একটা বাড়ি। একটা নয়, চারটে পাশাপাশি কংক্রিটের বাড়ি। দুটো ছোটো স্টাফ হাউস। চারপাশে বিদ্যুৎ তারের আবরণ।
সকাল দশটা, ডিটেকটিভ আর্ল গ্রিনবার্গ এবং রবার্ট লবিতে ঢুকে পড়েছেন।
ডিটেকটিভ গ্রিনবার্গ টেবিলের ওপর পড়ে থাকা অসংখ্য পত্রিকার দিকে তাকালেন। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙের একটা কপি হাতে তুলে নিলেন। রবার্টের দিকে তাকিয়ে বললেন- এগুলো বোধহয় দাঁতের ডাক্তারের চেম্বারে পড়ে থাকে?
তারা সামনে এগিয়ে এলেন। বললেন– মিঃ ট্যানার কিংসলের সাথে কথা বলব। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে।
-হ্যাঁ, উনিও আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি একজন সহকারীকে পাঠাচ্ছি।
রিসেপশনিস্ট বোতাম টিপলেন। একটু বাদে এক সুন্দরী কিশোরী কন্যা সামনে এসে দাঁড়াল।
–এঁরা ট্যানারের সাথে দেখা করতে যাবেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে।
–আমি রেটরা টাইলার, কিংসলের এক সহকারিনী। আমাকে অনুসরণ করুন প্লীজ।
দুজন ডিটেকটিভ হেঁটে চলেছেন। প্রত্যেকটা করিডরের কাছে প্রহরা আছে।
এটা ট্যানারের ওয়েটিং রুম, ক্যাথি বসে আছেন। ট্যানারের সেই সহকারিনী।
-গুড মর্নিং, শুভ সকাল ভদ্রমহোদয়রা, আপনারা ডানদিকে চলে যান।
ট্যানারের প্রাইভেট অফিস, ডিটেকটিভরা ভেতরে ঢুকলেন। তাদের চোখেমুখে বিস্ময়।
বিরাট অফিস, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো। সাউন্ড প্রুফ দেয়াল আছে। টেলিভিশন আছে। সারা শহরে কী ঘটছে তার টাটকা ছবি ফুটে উঠছে। হ্যাঁ আছে ব্যস্ত কনফারেন্স রুম, ল্যাবরেটরী, আরও কত কি।
আধুনিক বিজ্ঞানের সমস্ত ব্যবস্থা।
স্ক্রিনের ওপর বিভিন্ন শহরের নাম ভেসে উঠছে। মিলান, জোহানসবার্গ, জুরিখ, মাদ্রিদ, এথেন্স। চারপাশে বইয়ের সমারোহ।
.
ট্যানার কিংসলেকে মেহগনি ডেস্কের আড়ালে বসে থাকতে দেখা গেল। পোশাকটা ভারী সুন্দর। হালকা ধূসর বর্ণের, হালকা নীল শার্ট এবং নীল রঙের চেক দেওয়া টাই।
ট্যানার উঠে দাঁড়ালেন, বললেন গুড মর্নিং ভদ্রমহোদয়রা।
এবার ডিটেকটিভরা বসলেন। কথা শুরু হল।
বলা হল– গোয়েন্দারা, আমরা কিন্তু আজকের জীবনধারা সম্পর্কে কোনো কথা বলবো না। একটা ব্যাপার মনে রাখবেন, জীবন আজ আরও দুঃসহ হয়ে উঠেছে।
রবার্ট বললেন– মিঃ কিংসলে, আমি একটা প্রশ্ন করব।
-হ্যাঁ। আপনি যে কোনো প্রশ্ন করতে পারেন। তবে আমার বক্তব্যটা আগে শুনে নিন। আমরা বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করি। তাই দেশের নিরাপত্তাটা আমাদের ওপর ন্যস্ত হয়েছে। আমরা যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নজর রেখেছি। মাইক্রো বায়োলজি থেকে পরিবেশের বিষয় সবই আমরা নজরে রেখেছি। আমাদের অত্যন্ত শিক্ষিত বিজ্ঞানী দল আছে। আছে নানা বিষয়ের সমালোচকেরা।
রবার্ট অবাক হয়ে বললেন- ব্যাপারটা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ।
–আমাদের গবেষকদের পঁচাশি শতাংশের মধ্যে অত্যন্ত উঁচু ডিগ্রী আছে। পঁয়ষট্টি শতাংশ হল পি এইচ ডি।
বাঃ, দারুণ কাজ করেছেন তো?
–আমার দাদা অ্যানড্রু এই কোম্পানীটা স্থাপন করেছিল। সে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে সাহায্য করতে চেয়েছিল। আমরা সেখানে অনেকগুলো পরিকল্পনা শুরু করেছি।
হঠাৎ টেলিভিশন সেটে বজ্রপাত দেখা গেল। তার মানে? কী হচ্ছে?
ডিটেকটিভ গ্রিনবার্গ বললেন আপনারা আবহাওয়া নিয়ে পরীক্ষা করছেন?
হ্যাঁ, এটাও আমাদের একটা অন্যতম কাজ। কিন্তু এখানে আমরা সফলতাকে অর্জন করতে পারিনি। এই পরীক্ষাটা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।
–এটা সফল হলে কি আমরা জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম?
-হ্যাঁ, কিছুটা অন্তত পারতাম। অনেকে এই ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করেছেন। ১৯০০ সালে নিকোলা টেসলা ওয়েদার সম্পর্কে প্রথম আলোচনা করেছিলেন। তিনি অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক তথ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে আমরা বেতার তরঙ্গের সাহায্যে বাতাসের আয়নমণ্ডলকে প্রভাবিত করতে পারি। ১৯৫৮ সালে আমাদের নিরাপত্তা পরিষদও এই ব্যাপারে কাজ করে। তারা আয়নোস্ফেয়ারের মধ্যে তামার ছুঁচ পাঠিয়েছেন। দশ বছর বাদে প্রজেক্ট প্রোপাইলের জন্ম হয়। সরকার লাওসে বর্ষাকালে সময়সীমা বাড়াবার চেষ্টা করেছিল। তাতে হোচিমিন অঞ্চলে আরও বেশি পরিষ্কার আবহাওয়া পাওয়া যায়।
ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কাজ করেছে?
হ্যাঁ, স্থানীয়ভাবে। সমস্যা হচ্ছে আমরা সারা পৃথিবীর আবহাওয়াকে পরিবর্তন করতে পারি না। একটা কথা মনে রাখবেন, দক্ষিণ গোলার্ধে আশি শতাংশ সমুদ্র আছে, উত্তর গোলার্ধে সমুদ্রের আয়তন ষাট শতাংশ। এই বৈসাদৃশ্যের ফলেই আমরা বিশ্বব্যাপী কাজের সফলতা অর্জন করতে পারি না।
তাছাড়া, গ্রিনবার্গ বললেন, আমরা এখানে কেন এসেছি মিঃ কিংসলে?
ট্যানার তাকালেন, হ্যাঁ, এই প্রশ্নটার উত্তর আমি দিচ্ছি। কিংসলে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপকে একটা অভিজ্ঞ সংস্থা বলা যেতে পারে। আমার চারজন সহকারীর মৃত্যু হয়েছে, রহস্যজনকভাবে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আমরা আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে অনুসন্ধান শুরু করেছি। পৃথিবীর সমস্ত প্রধান শহরে আমাদের তদন্তকারী অফিসাররা আছেন। আঠারোশো জন সদস্য আছেন। সকলের সাথে যোগাযোগ রাখা কোনোমতেই সম্ভব নয়। কিন্তু যখন আমরা দেখলাম যে আমাদের দুজন সঙ্গীকে হত্যা করা হয়েছে, তারা নাকি অনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তখন আমরা আরও সতর্ক হয়ে উঠেছি। একটা কথা মনে রাখবেন, আমি কিছুতেই কিংসলে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের সুনাম নষ্ট হতে দেব না। আমরা অতি শীঘ্র এই রহস্যের উন্মোচন করব।
গ্রিনবার্গ বলতে চেষ্টা করলেন মিঃ কিংসলে, আরও কিছু বলার আছে। দু বছর আগে জাপানের এক বিজ্ঞানী আত্মহত্যা করেছিলেন। তিন বছর আগে সুইজারল্যান্ডের এক বিজ্ঞানী…
ট্যানার বাধা দিয়ে বললেন- হ্যাঁ, জুরিখের ওই ঘটনা, এ দুটোর কোনোটাই কিন্তু আত্মহত্যার ঘটনা নয়। তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
দুজন গোয়েন্দা পরস্পরের দিকে তাকালেন, বিস্ময়াবিষ্ট চোখে।
রবার্ট বললেন- এ ব্যাপারে আপনি এত নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে?
ট্যানারের কণ্ঠস্বর কঠিন হয়ে উঠেছে– তাদের হত্যা করা হয়েছে আমার কারণে?
-আপনি কী বলতে চাইছেন?
আকিরা ছিলেন এক দারুণ বিজ্ঞানী। তিনি একটি জাপানি ইলেকট্রনিক্স সংস্থায় কাজ করছিলেন। এই সংস্থাটির সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল। আমার মনে হয় আমরা তাকে বাঁচাবার মতো ভালো বাতাবরণ দিতে পারিনি। আমি তাকে এখানে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। সেই আমন্ত্রণ তিনি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এ ব্যাপারে খুব উত্তেজিত ছিলেন।
ট্যানার তার কণ্ঠস্বর স্থির রাখার চেষ্টা করলেন– আমরা ব্যাপারটা গোপন রেখেছিলাম। তিনি ওই সংস্থা ছেড়ে দেবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। হয়তো কাউকে এই কথাটা বলে থাকবেন। কারণ এই সংবাদ খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে।
ট্যানার আবার কিছুক্ষণ চুপ করলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন- যেদিন এই খবরটা কাগজে বেরোয়, সেদিনই তাকে একটি হোটেল ঘরে নিহত অবস্থায় দেখা গেল।
রবার্ট জিজ্ঞাসা করলেন মিঃ কিংসলে, অন্য কোনো কারণও তত থাকতে পারে।
ট্যানার মাথা নেড়ে বললেন– না, এটা আত্মহত্যার কোনো ঘটনা নয়। আমি একদল অনুসন্ধানী মানুষকে সেখানে পাঠিয়েছিলাম। তারা আমার নিজস্ব সংস্থার লোক। তারা সব ব্যাপারের ওপর নজর রেখেছিলেন। সেখানে গিয়ে তারা হয়তো কোনো খারাপ কিছু দেখতে পাননি। তবে আমি এখনও মনে করছি, ইসোর জীবনটা আত্মহননের পথে শেষ হয়নি, এমন কোনো ট্রাজেডি আছে, যার রহস্য হয়তো কোনোদিন উদঘাটিত হবে না।
-তাহলে আপনি কেন এত সুনিশ্চিত যে, তাকে হত্যা করা হয়েছিল?
গ্রিনবার্গ জানতে চাইলেন।
–আপনারা তো ম্যানডেলাইন স্মিথের কথা বললেন। জুরিখে তিনি নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন তিন বছর আগে। আপনি কি জানতেন যে, ম্যানডেলাইন স্মিথ তার কোম্পানি ছেড়ে আমাদের সংস্থায় যোগ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন?
গ্রিনবার্গ জানতে চাইলেন তাহলে আপনি বলেছেন যে, এই দুটি মৃত্যুর মধ্যে একটা যোগসূত্ৰতা আছে?
ট্যানারের মুখ যেন পাথর- হ্যাঁ, তারা দুজনেই একই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এটি হল টোকিও ফাস্ট ইনডাসট্রিয়াল।
ঘরের ভেতর থমথমে নীরবতা।
রবার্ট বললেন আমি একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারছি না। যদি একজন কর্মী সংস্থা ছাড়তে চান, তাহলে কেন তাকে মেরে ফেলা হবে?
-ম্যানডেলাইন স্মিথ কিন্তু সাধারণ কর্মী ছিলেন না। ইসোও তাই ছিলেন না। তারা ছিলেন বিখ্যাত পর্দাথবিদ। তারা যে কোনো সমস্যা সমাধান করতে পারতেন। একটি কোম্পানির ভবিষ্যৎ তাদের ওপর নির্ভর করছিল। তাই সংস্থা চায় নি যে, তারা কোম্পানি ছেড়ে দিন।
-সুইস পুলিশ কি এই ব্যাপারে তদন্ত করেছিল?
-হ্যাঁ, তারা তদন্ত করে। আমরাও করেছিলাম। কিন্তু আমরা কোনো কিছুই প্রমাণ করতে পারিনি, সত্যি কথা বলতে কি, আমরা এখনও ওই মৃত্যুরহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করছি। একদিন আমরা এই রহস্য উদঘাটন করবই। আমাদের সংস্থার সাথে পৃথিবীর সব অঞ্চলের পুলিশ মহলের যোগাযোগ আছে। ভালো খরব পেলে আমি নিশ্চয়ই তা আপনাদের জানাব।
গ্রিনবার্গ বললেন- ঠিক আছে। এখন আমরা আসছি।
ট্যানারের টেলিফোন বেজে উঠল- হ্যালো, দুজন ডিটেকটিভ আমার অফিসে বসে আছেন। তারা আমাকে সবরকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ঠিক আছে, আমি সময় মতো জানাব।
উনি রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন।
গ্রিনবার্গ জানতে চাইলেন– মিঃ কিংসলে, এখানে আপনারা কি কোনো অনুভবী ব্যাপার নিয়ে গবেষণা করছেন?
-হ্যাঁ, আমরা এমন একটা বিষয় নিয়ে গবেষণা করছি, যার মাধ্যমে ছজন মানুষের মৃত্যুরহস্য সম্পর্কে জানা যাবে। ডিটেকটিভ গ্রিনবার্গ, আমাদের সঙ্গে অন্তত একশো জন বুদ্ধিজীবী যুক্ত আছেন। তারা পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ। তারা অনেকেই এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। আমরা এখানে কোনো মানব বোমা তৈরি করছি না।
দরজা খুলে গেল। অ্যানড্রু কিংসলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। তার হাতে অনেক কাগজপত্র। ভাইয়ের সঙ্গে চেহারার কিছুটা মিল আছে। তবে তার চেহারায় একটা বিষণ্ণতার ছায়া। মাথার চুল ক্রমশ পাতলা হতে শুরু করেছে। মুখমণ্ডলে গাম্ভীর্য। পাশাপাশি ট্যানার কিংসলে? উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছেন। অ্যানড্রুকে দেখলে মনে হয়, তিনি বুঝি কোন ব্যাপারে পরাস্ত।
–এই কাগজগুলো, এইগুলোই আছে, তুমি দেখতে পারো। আমি এখনও শেষ করতে পারিনি।
অ্যানড্রু, ঠিক আছে, পুলিশ ডিটেকটিভের দিকে তাকিয়ে ট্যানার বললেন, এ আমার ভাই অ্যানড্রু, আর এঁরা হলেন ডিটেকটিভ গ্রিনবার্গ ও রবার্ট।
অ্যানড্রু তাকালেন, চোখের তারায় কোনো শান্তির চিহ্ন নেই।
অ্যানড্রু, তোমার নোবেল পুরস্কারের কথা বলবে না?
অ্যানড্রু মাথা চুলকে বললেন- হ্যাঁ, নোবেল পুরস্কার।
উনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ট্যানার বললেন আমি বলেছিলাম, অ্যানড্রু এই কোম্পানিটা স্থাপন করেছিল। তাকে সাত বছর আগে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একটা পরীক্ষা সে শেষ করতে পারেনি, তারপর থেকেই তার মনটা পাল্টে যায়।
-হ্যাঁ, ওনার চরিত্রের মধ্যে একটা আকর্ষণ আছে।
আর্ল গ্রিনবার্গ উঠে দাঁড়ালেন, বললেন ঠিক আছে, আমরা আর সময় নষ্ট করব না। যোগাযোগ রক্ষা করব।
ট্যানার বললেন- ঠিক আছে, আগে এই সমস্যা সমাধান হোক, তারপর।
.
১৬.
ট্যানার সেই মেয়েটিকে ভুলতে পারেননি, যাকে রাজকুমারি বলে ভেবেছিলেন। মনে পড়ে গেল, একসময় কীভাবেই না জড়িয়ে পড়েছিলেন। ভাবা হয়েছিল, এই ব্যাপারটা আরও উন্নত হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি।
.
তিনদিন কেটে গেছে। ট্যানার ফোন করলেন রাজকুমারি?
–কে কথা বলছেন?
ট্যানার ভেবেছিলেন, ফোনটা নামিয়ে রাখবেন। কতজন এই মেয়েটিকে রাজকুমারি নামে ডেকে থাকে?
কোনোরকমে নিজের রাগ শান্ত করার চেষ্টা করে, উনি বললেন- আমি ট্যানার কিংসলে বলছি।
–তুমি কেমন আছো? কিন্তু কণ্ঠস্বরে উদাসীনতা।
আমি হয়তো একটা ভুল করেছি, ট্যানার ভাবলেন। আর কখনও এই মেয়েটিকে আমি ডাকব না। তবুও উনি বললেন- আমি ভেবেছিলাম, তুমি আজ বোধহয় আমার সাথে ডিনারে যাবে। কিন্তু মনে হচ্ছে, তুমি ব্যস্ত আছে। ব্যাপারটা ভুলে যাওয়া যাক।
-কেন?
ট্যানার আবার আটকে পড়লেন তিনি ওই মেয়েটিকে শিক্ষা দিতে পারলেন না।
.
চার ঘণ্টা কেটে গেছে। ট্যানার একটা টেবিলে বসে আছেন। ছোটো ফরাসি রেস্টুরেন্ট। তিনি মনে মনে উদগ্রীব। ব্যাপারটা হল, মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছে।
–প্রিনসেস, তোমাকে আমি কতদিন দেখিনি? ট্যানার বললেন।
মেয়েটির মুখে হাসি তোমাকেও আমি খুব মিস্ করেছি। তোমার মধ্যে একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। তুমি সকলের থেকে আলাদা।
গত দিনটা বুঝি আবার ফিরে এসেছে। এমন রোমান্টিক মুহূর্ত তাদের জীবনে খুব একটা বেশি আসেনি। কথা এগিয়ে চলল, খাওয়া-দাওয়া তার পাশাপাশি।
এই মেয়েটি অসামান্যা সুন্দরী, আবেদনি এবং ইচ্ছুক। এমন একটি মেয়ের আগমন ঘটতে চলেছে আমার জীবনে, ট্যানার ভাবলেন।
ট্যানার বললেন- তোমার কথা বল।
-আমার বাবা খুবই ধনী মানুষ। অসীম ক্ষমতার অধিকারী। ছোটোবেলা থেকে আমি বকে গিয়েছিলাম। মিশতাম পরিচারিকা এবং বাটলারদের সঙ্গে। সুইমিংপুলে হৈ-হৈ হত। র্যাটক্লিপকে মনে পড়ে। তারপর? শেষ অব্দি আমার বাবা সব ব্যাপারেই হেরে গেল। মারা গেল সে। আর আমি এক রাজনৈতিক নেতার খপ্পরে গিয়ে পড়লাম।
কাজটা তোমার কেমন লাগে?
না, মোটেই ভালো লাগে না। আমি উত্তেজক জীবনের সন্ধানে মগ্ন।
.
পরের দিন ট্যানার অবার ফোন করলেন রাজকুমারি?
–আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম ট্যানার। তার কণ্ঠস্বরে আমন্ত্রণ।
ট্যানার বললেন- তুমি এখন কোথায়?
–আজ রাতে ডিনার হবে কি?
ট্যানারের মুখে হাসি কোথায় যাব?
ম্যাক্সিমে এলে কেমন হয়?
বুঝতে পারা যাচ্ছে, যে কোনো কারণেই তোক মেয়েটি আরও কাছে আসতে চাইছে।
.
৫৫ নম্বর স্ট্রিট, ডিনারের আসর, ট্যানার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন। হ্যাঁ, সৌন্দর্যের একটা আলাদা দীপ্তি আছে। আত্মনির্ভরতা এবং বুদ্ধির সংমিশ্রণ। হ্যাঁ, এই মেয়েটিকে আমরাস্বাধীন চেতা বলতে পারি।
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনর্গল আলোচনা এগিয়ে চলেছে। মেয়েটির জ্ঞানের বহর দেখে ট্যানার অবাক হয়েছেন।
–রাজকুমারির জীবন সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?
মেয়েটি ট্যানারের দিকে তাকাল। তারপর বলল- আমি জানি, ক্ষমতাই মানুষকে সাহসী এবং সুখী করে তোলে।
–তাহলে তোমার আমার মধ্যে দারুণ মিল আছে।
–একথা তুমি কতজন মেয়েকে বলেছ ট্যানার?
তুমি কি এসব কথা বলা বন্ধ করবে? আমি সকলের সাথে আলাদাভাবে মিশি। তুমি এমন কিছু করো না, যাতে আমি দুঃখ পাব।
–হ্যায় ডার্লিং, তুমি আমার সান্নিধ্যে যদি হতাশ হও তাহলে শাওয়ারের তলায় চলে যাও।
ট্যানার উঠে দাঁড়ালেন। নাঃ, কথা বলে আর লাভ নেই। কিন্তু কোথায় যাব?
–কেন আমার জায়গাতে।
–তোমার জায়গা?
–হ্যাঁ, আমার ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে পার্ক এভিনিউতে।
তুমি কি আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে?
.
ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্ট, অসাধারণ, সুন্দরভাবে সাজানো। ট্যানার চারদিকে তাকালেন। ভারী ভালো এবং আভিজাত্যের ছাপ। আহা, অসাধারণ চিত্রকলার সংগ্রহ। একটা ভালো টেবিল আছে, ঝাড়বাতি ঝুলছে। ছটা সুন্দর চেয়ার, সাজানো কৌচ।
ট্যানার বললেন- ভারী সুন্দর।
মেয়েটি বলল- তুমি আমার বেডরুমে এসো।
বেডরুমের দেওয়ালের রং পরিষ্কার সাদা। সাদা ফার্নিচারে পরিপূর্ণ। মস্ত বড় একটা আয়না ঝুলছে।
ট্যানার বললেন- আঃ, এত সুন্দর।
পাউলা ট্যানারের পোশাক খুলতে খুলতে বলল- আমরা পরে কথা বলব।
পোশাক খোলা হয়ে গেছে। সে নিজের পোশাকের দিকে হাত দিল। আহা, এমন সুন্দর একটি যৌন আবেদনি শরীর। সে ট্যানারের গলা জড়িয়ে ধরে বলল- এসো, আমরা অসভ্য খেলা শুরু করি।
তারা বিছানাতে শুয়ে আছে। এবার খেলাটা শুরু হবে। ট্যানার সবকিছুতে হাত দেবার চেষ্টা করল। আবেদনি জায়গাগুলোতে হাতের পরশ রাখল। তারপর বুঝতে পারল, এবার মেয়েটির দিক থেকে প্রত্যুত্তর দেবার সময় হয়েছে। হ্যাঁ, এমন সুন্দর আদর। ট্যানার চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। প্রতিটি আঙুলের টোকা তাকে অন্য জগতের বাসিন্দা করে দিচ্ছে। এমন সুন্দর উপহার যে তিনি কোনোদিন পাবেন ভাবতেই পারেননি। শেষ অব্দি উত্তেজনার চরম সীমায় পৌঁছে গেলেন।
তারা সমস্ত রাত ধরে কথা বলেছিলেন। কত কথা, রাজকুমারি ট্যানারকে অবাক করে দিয়েছে। তার কৌতুকবোধ, তার আবেদন, তার চোখের তারায় উজ্জ্বল উপস্থিতি- নাঃ, ট্যানার বোধহয় পাগল হয়ে যাবেন।
.
একদিন সকালবেলা অ্যানড্রু ট্যানারকে বললেন, তুমি এত খুশী কেন? এর অন্তরালে কোনো মেয়ে আছে কি?
ট্যানার ঘাড় কাত করলেন- হ্যাঁ।
ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ, তুমি কীভাবে বিয়ে করবে?
–আমি এখনও অতটা ভাবিনি।
অ্যানড্রু বললেন– কথাটা বলা উচিত।
ট্যানার বললেন- হ্যাঁ, একদিন বলব।
পরের দিন রাত্রিবেলা, ট্যানার রাজকুমারির অ্যাপার্টমেন্টে বসে আছেন।
ট্যানার বলতে শুরু করলেন রাজকুমারি, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাইছি। যে কথা আমি কখনও কোনো মেয়েকে বলিনি।
কী কথা ডার্লিং।
–আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি।
এক মুহূর্তের নীরবতা।
পাউলা দুহাত বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে এসে বলল- ওঃ, ট্যানার।
–হ্যাঁ, তুমি কী জবাব দেবে?
–আমি তোমাকে বিয়ে করব ডার্লিং। কিন্তু আমার একটা সমস্যা আছে।
কী সমস্যা?
না, সমস্যাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে আরও সাহস এবং শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। সব জিনিসটা পাল্টাতে হবে। ভবিষ্যটা যেন আরও উন্নত হয়।
ট্যানার হাতে হাত দিলেন। কোনো সমস্যা নেই। আমার হাতে অনেকগুলো ব্যবসা আছে রাজকুমারি। একদিন আমি আরও বেশি টাকা আয় করব।
না, তোমার ভাই আছে, তোমরা দুজন। তোমার ভাই কখনও চাইবেন না যে, তোমার কোম্পানিটা আরও বড়ো হোক। তাই এখন অন্য কিছু ভাবতে হবে।
ট্যানার বললেন- আচ্ছা, তুমি আমার ভাই অ্যানড্রুর সঙ্গে দেখা করো। কেমন?
.
পরের দিন তারা তিনজন লাঞ্চের আসরে বসেছেন। পাউলা আকর্ষনীয়া। অ্যানড্রু ভাবলেন, ভাইয়ের জীবনে কোন মহিলার আগমন ঘটতে চলেছে, এই ব্যাপারটা ভেবে খুবই চিন্তিত ছিলেন। না, পাউলাকে আমরা অনায়াসে এক বুদ্ধিমতী রমণী বলতে পারি। অ্যানড্রু ভাবলেন, ভাইয়ের নির্বাচনটা সঠিক হয়েছে।
পাউলা বলল আমার মনে হচ্ছে, কিংসলে গ্রুপ একদিন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে, অ্যানড্রু সারা পৃথিবীতে এত মানুষের কাছে আমরা সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছি। ট্যানার এ ব্যাপারে সব কিছু জানিয়েছে।
-হ্যাঁ, আমরা চেষ্টা করছি।
তার মানে, আপনি কোম্পানিটাকে আরও বড়ো করবেন তো?
না, আমি সেই অর্থে বলছি না। আমি আরও বেশি দেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলব। সেখানে সাহায্য পাঠাব।
ট্যানার সঙ্গে সঙ্গে বললেন– তাহলে আমাদের আরও নতুন নতুন চুক্তিতে সই করতে হবে, তাই তো?
অ্যানড্রুর চোখে হাসি ট্যানার, তুমি এত তাড়াতাড়ি কাজ করতে চাও কেন? এত তাড়াতাড়ির কী আছে? দেখা যাক না, কীভাবে কাজটা শুরু হয়। অন্যকে সাহায্য করাটাই জীবনের সবথেকে বড়ো ধর্ম।
ট্যানার রাজকুমারির দিকে তাকালেন।
পরের দিন ট্যানার রাজকুমারিকে টেলিফোন করে বললেন- রাজকুমারি, কখন তোমাকে তুলে নেব?
ওদিকে একটা ছোট্ট নীরবতা– ডার্লিং, আমি খুব দুঃখিত। আজ বোধহয় তোমার সঙ্গে বেরোতে পারব না।
ট্যানার অধৈর্য হয়ে উঠেছেন- কোনো সমস্যা?
না, আমার এক বন্ধু শহরে এসেছে। তাকে দেখতে যাব।
–পুরুষ বন্ধু? ট্যানারের মনে হিংসা। আমি বুঝতে পারছি না, তা হলে কাল রাতে?
–না, কালকেও হবে না। আমরা সোমবার যাব, কেমন?
তার মানে? পাউলা এখন অন্য কারও সঙ্গে এই সপ্তাহান্তিক ছুটিটা কাটাবে? ট্যানার ফোন নামিয়ে দিলেন। তিনি রেগে গেছেন এবং হতাশ হয়েছেন।
.
সোমবার রাত। রাজকুমারি ক্ষমা চেয়ে বলল- আমি খুব দুঃখিত। ডার্লিং, আমার এক পুরোনো বয়ফ্রেন্ড শহরে এসেছিল। শুধু আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য।
ট্যানারের মনে একটা ছবি ভেসে উঠল। ওই রাজকুমারির অসাধারণ অ্যাপার্টমেন্টে সেই ছবিটা ছিল।
–ও কে?
আমি দুঃখিত, আমি ওর নাম বলতে পারব না। ও ভীষণ পরিচিত ব্যক্তিত্ব। ও চায় না যে, সকলের কানে ওর নাম পৌঁছে যাক।
–তুমি কি ওকে ভালোবাসো?
ট্যানারের হাত ধরে পাউলা বলল– না।
ট্যানার প্রশ্ন করলেন আর ওই ছেলেটি? সে কি তোমাকে ভালোবাসে?
পাউলা বলল- হ্যাঁ।
ট্যানার ভাবলেন- যে করেই হোক এই মেয়েটির মন জয় করতে হবে।
.
পরের দিন সকাল চারটে বেজে আটান্ন মিনিট, অ্যানড্রু কিংসলের ঘুম ভেঙে গেল টেলিফোনের শব্দে।
সুইডেন থেকে একটা কল আছে, অনুগ্রহ করে ফোনটা একটু ধরবেন?
একমুহূর্ত বাদে সুইডিস টানে কতগুলো শব্দ ভেসে এল- অনেক-অনেক অভিনন্দন মিঃ কিংসলে, নোবেল কমিটি আপনাকে এ বছর নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে। ন্যানো টেকনোলজির বিষয়ে আপনার উদ্ভাবনী গবেষণা পদার্থবিজ্ঞানে আপনাকে এই পুরস্কার এনে দিয়েছে।
নোবেল পুরস্কার! সংলাপ শেষ হয়ে গেল। অ্যানড্রু কোনো রকমে পোশাক পরে অফিসে চলে গেলেন। ট্যানার আসার সঙ্গে সঙ্গে অ্যানড্রু তার ঘরে ঢুকে গিয়ে খবরটা দিলেন।
ট্যানার ছুটে এসে অ্যানড্রুকে জড়িয়ে ধরলেন- আহা, অ্যানড্রু, আমি ভাবতেই পারছি না।
এবার ট্যানারের সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।
পাঁচ মিনিট বাদে ট্যানার রাজকুমারির সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন- ডার্লিং, তুমি কি বুঝতে পারছ এর ফলাফল কী হবে? কিংসলে গ্রুপের হাতে একটা নোবেল পুরস্কার। এখন আমরা আরও বড়ো ব্যবসা করতে পারব। সরকারের তরফ থেকেও আমাদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করা হবে। করপোরেশনগুলো এগিয়ে আসবে। আমি কথা দিচ্ছি সুন্দরী, তোমার পায়ের তলায় এখন সমস্ত পৃথিবী।
-হ্যাঁ, ব্যাপারটা আমি ভাবতেই পারছি না।
–তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?
ট্যানার, একথাটা কেন বার বার জিজ্ঞাসা করে বলো তো? তুমি ছাড়া আমি আর কাকেই বা বিয়ে করব?
ট্যানার রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। তিনি ভাইয়ের অফিসে গিয়ে বললেন- অ্যানড্রু, আমি বিয়ে করতে চলেছি।
অ্যানড্রু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন- একটা ভালো খবর। কখন বিয়ের ঘটনাটা হবে?
-খুব তাড়াতাড়ি। স্টাফদের সবাইকে জানানো হবে।
.
ট্যানার তার অফিসে গেলেন, পরের দিন সকালবেলা।
অ্যানড্রু অপেক্ষা করছিলেন।
তার পরনে একটা উৎসবের পোশাক।
–এটা কেন পরেছ?
অ্যানড্রু বললেন- আমি তোমার বিয়ের জন্য তৈরি হচ্ছি। খরবটা আমার কাছে খুবই আনন্দের।
–অনেক ধন্যবাদ, অ্যানড্রু।
খবরটা আগুনের মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে বিয়ের দিন ঘোষিত হয়নি। ট্যানার কাউকে কিছু বলেননি, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি এবং অঙ্গভঙ্গি, বলে দিচ্ছিল, তাড়াতাড়ি তিনি বিয়ে করতে চলেছেন।
.
ট্যানার তার ভাইয়ের অফিসে গেলেন– অ্যানড্রু, নোবেল পাওয়া সূত্রে সকলের সাথে আমাদের যোগাযোগ হবে। প্রাইজ মানিটা নিয়ে কী হবে?
অ্যানড্রু বাধা দিয়ে বললেন- পুরস্কারের অর্থ দিয়ে আমরা উগান্ডাতে আরও বেশি মানুষকে সাহায্য করব।
ট্যানার শান্তভাবে বললেন কিন্তু তুমি এই টাকা দিয়ে ব্যাবসাটাকে আরও বড়ো করে তুলতে পারো?
অ্যানড্রু মাথা নেড়ে বললেন– আমি যে আদর্শে বিশ্বাস করি, সেই আদর্শের জন্য আমি সারা জীবন লড়াই করব ট্যানার।
ট্যানার অনেকক্ষণ ধরে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন- এটা তোমার কোম্পানি অ্যানড্রু।
.
ট্যানার রাজকুমারিকে ফোন করে বললেন আমি ওয়াশিংটন যাচ্ছি ব্যবসার কাজে। দু-দিন তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারব না।
পাউলা পেছনে লেগে বলল না, কোনো স্বর্ণকেশিনী নয়, বাদামী চুলের মেয়ে নয়, নয় কোনো লাল চুলের ললনা।
না-না, কোনো আশা নেই। পৃথিবীতে তুমিই হলে একমাত্র মেয়ে, যাকে আমি সত্যি সত্যি ভালোবাসি।
ব্যাপারটা আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
.
পরের দিন সন্ধ্যেবেলা ট্যানার রাজধানী পেন্টাগনে বসে আছেন। আর্মি চিফ অফ স্টাফ জেনারেল অ্যালান বারটনের সঙ্গে কথা হচ্ছে।
আমার মনে হচ্ছে, আপনার প্রস্তাবটা খুবই আগ্রহজনক। আমরা এই ব্যাপারে কতগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করব।
জেনারেল বারটন বললেন।
আপনাদের পরীক্ষানিরীক্ষাগুলো মাইক্রোনানো টেকনোলজির সঙ্গে জুড়তে হবে। আমার ভাই এ বিষয়ে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
-হ্যাঁ, আমরা খবরটা পেয়েছি।
-উনি এত উত্তেজিত যে, আরও কাজ করতে চাইছেন।
মিঃ কিংসলে, এই ক্ষেত্রে খুব বেশি নোবেল লোরেট পাওয়া যায় না।
জেনারেল উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তারপর বললেন– এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এবং একান্ত গোপনীয়। যদি এটা কাজ করে তাহলে আমাদের সৈন্যবাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আণবিক ন্যানো টেকনোলজির সাহায্যে আমরা পৃথিবীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারব। এখনও পর্যন্ত আমরা এই ব্যাপারে খুব একটা উন্নতি করতে পারিনি। এখন যেসব চিপগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে বেশি কাজ হচ্ছে না। আরও ক্ষুদ্র চিপ আবিষ্কার করতে হবে। যদি এটা সম্ভব হয়, তা হলে মিলিটারি জগতে একটা বিপ্লব ঘটে যাবে, তা আমি বলতে পারি।
ট্যানার বললেন– পরীক্ষা করার সময় কোনো ঝামেলা হবে না তো? দেখবেন, এ ব্যাপারে যেন ভাইয়ের কোনো ক্ষতি না হয়।
না, আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা সবরকম যন্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্য করব। আমাদের দু-তিনজন বিজ্ঞানী আপনার ভাইয়ের সঙ্গে পরীক্ষা করবেন।
তাহলে আমি এগিয়ে যাচ্ছি।
–হ্যাঁ, আমি সবুজ সংকেত দিলাম।
নিউইয়র্কে ফিরে আসতে আসতে ট্যানার ভাবলেন, এখন যে করেই হোক অ্যানড্রুকে বোঝাতেই হবে।
.
১৭.
অ্যানড্রু তার অফিসেই ছিলেন। একটা রঙিন বুকলেটের দিকে তাকিয়ে আছেন। নোবেল কমিটি তার কাছে বুকলেটটা পাঠিয়েছে এবং একটা চিঠিও পাঠিয়েছে- কবে আপনি আসবেন, সেই প্রত্যাশায় বসে আছি।
স্টকহলম কনসার্ট হলের ছবি ছাপা আছে, আর আছে নোবেল প্রাপকদের ছবি। রাজা কার্ল শোলোবসে আছেন। আমি সেখানে যাব অ্যানড্রু ভাবলেন।
দরজা খুলে গেল। ট্যানার ঢুকে বললেন- কিছু কথা বলতে হবে ভাই।
অ্যানড্রু বুকলেটের দিকে তাকিয়ে বললেন- হ্যাঁ, ট্যানার, বলল।
ট্যানার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন– এইমাত্র আমি কিংসলে গ্রুপের হয়ে একটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। সরকারের সঙ্গে একটা পরীক্ষা করতে হবে।
কী বিষয়ে পরীক্ষা?
বিজ্ঞানের একটা নতুন বিষয়, ন্যানো টেকনোলজি, সরকার তোমার সাহায্য চাইছে।
অ্যানড্রু মাথা নেড়ে বললেন- না, আমি এই ব্যাপারে যোগ দিতে পারি না। এই ব্যাপারটা এখানে করা হয় না।
না, টাকার জন্য চিন্তা করো না অ্যানড্রু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা এর ওপর নির্ভর করছে। সৈন্যদলের কাছে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তুমি এটা তোমার দেশের জন্য করছ। দেশ এখন তোমাকে চাইছে।
ট্যানার আবার ভাইয়ের দিকে তাকালেন।
শেষ পর্যন্ত অ্যানড্রু বললেন- ঠিক আছে। কিন্তু এই প্রথম ও শেষবারের মতো আমি আমার গবেষণার বাইরে কাজ করতে রাজী হলাম। আশা করি ট্যানার, তুমি ভবিষ্যতে আমাকে আর এধরনের কোনো আবদার করবে না।
ট্যানার হাসলেন– হ্যাঁ, আমি আবার বলছি, দাদা, তোমার জন্য আমি কতখানি গর্বিত।
.
রাজকুমারিকে ফোন করা হল। ভয়েস মেলে একটা সংবাদ পাঠানো হল– ডার্লিং, আমি ফিরে এসেছি। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা হতে চলেছে। গবেষণা শেষ হয়ে গেলে তোমাকে বলব। তোমাকে আমার অসীম ভালোবাসা।
.
দুজন সেনা বিশেষজ্ঞ এসে পড়েছেন। তাঁরা অ্যানড্রুর সঙ্গে কথা বলছেন। অ্যানড্রু প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু যখনই তিনি এই প্রকল্পের কথা শুনলেন, তখন তার উৎসাহ বেড়ে গেল। উত্তেজনার পারদ মাত্রা ক্রমশ চড়তে থাকল। যদি সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়, তাহলে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নবদিগন্তের দুয়ার হবে উম্মোচিত।
এক ঘন্টা কেটে গেছে। অ্যানড্রু দেখলেন, কিংসলে গ্রুপের দরজা দিয়ে একটা আর্মি ট্রাক ঢুকে পড়ছে। দুজন আর্মি স্টাফ সঙ্গে আছে, সশস্ত্র সেনারা আছে। তিনি কর্নেলকে অভিবাদন জানালেন।
–আমি এসে গেছি মিঃ কিংসলে, বলুন কী করতে হবে?
–আমি এটা এখান থেকে পরিচালনা করব, অ্যানড্রু বললেন, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
-হ্যাঁ, স্যার। কর্নেল দুজন সৈন্যকে ট্রাকের পেছনে দাঁড়াতে বললেন। তারপর বললেন, ট্রাকটা খালি করো। দেখো, কোনো অসুবিধা না হয়।
ট্রাক থেকে একটা ছোটো ধাতব বস্তু নামানো হল।
কিছুক্ষণের মধ্যে দুজন সহকারী ওই বাক্সটাকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গেলেন।
অ্যানড্রু বললেন- এটাকে টেবিলের ওপর রাখুন। সাবধানে।
–এটা খুবই হালকা।
আপনারা কী ভেবেছেন, এটা ভারী হবে?
দুজন সহকারী অবাক হয়ে গেছেন– কী বলছেন?
অ্যানড্রু মাথা নেড়ে বললেন- না-না, ভুলে যান।
দুজন বিশিষ্ট রসায়নবিদ এসেছেন, একজনের নাম পেরি স্ট্যানফোর্ড, অন্যজন হারভে ওয়াকার। তারা এই প্রকল্পে অ্যানড্রুর সঙ্গে কাজ করবেন।
তারা নিরাপত্তামূলক পোশাক পরেছেন।
এবার পরীক্ষা শুরু হবে।
অ্যানড্রু বললেন আমি পোশাকটা পরে আসছি।
তিনি করিডর দিয়ে একটা বন্ধ ঘরে ঢুকে গেলেন। ঘরটা খুললেন। ভেতরে নানা ধরনের পোশাক রয়েছে। মুখোশ আছে, চোখের গগলস, বিশেষ ধরনের জুতো, হাতের গ্লাভস।
অ্যানড্রু পোশাক পরলেন। ট্যানার দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি অ্যানড্রুকে শুভেচ্ছা জানালেন।
.
অ্যানড্রু ফিরে এলেন ল্যাবরেটরিতে। স্ট্যানফোর্ড এবং ওয়াকার অপেক্ষা করছিলেন। তারা একটা বন্ধ ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। বাতাস পর্যন্ত এই ঘরের ভেতর ঢুকতে পারে না। দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। বাতাসের মধ্যে উত্তেজনার গন্ধ।
-সব ঠিক আছে?
স্ট্যানফোর্ড মাথা নাড়লেন ঠিক আছে।
ওয়াকার বললেন- ঠিক আছে।
-মুখোশ?
নিরাপত্তামূলক গ্যাস মুখোশ পরা হল।
অ্যানড্রু বললেন- এবার তাহলে শুরু হচ্ছে। তিনি ওই ধাতব বাক্স থেকে ঢাকনা খুলে ফেললেন। ভেতরে ছটা বস্তু রয়েছে।
তিনি আবার বললেন– খুব সাবধান, এই বস্তুগুলোর তাপমাত্রা শূন্যর থেকে ২২ ডিগ্রি নীচে।
গ্যাস মাস্কের আড়ালে থেকে অ্যানড্রু কথা বলছেন। কথাগুলো ঠিকমতো বুঝতে পারা যাচ্ছে না।
স্ট্যানফোর্ড এবং ওয়াকার অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন।
অ্যানড্রু প্রথম বাক্সটা খুললেন। একটা হিসহিসে শব্দ বেরিয়ে এল। বাষ্প বেরিয়ে আসছে। ঠাণ্ডা মেঘের ধারা।
অ্যানড্রু বললেন- ঠিক আছে। আমরা যে কাজটা করব– তার চোখ দুটো আরও বড়ো বড়ো হয়ে উঠেছে। মুখে চকের মতো সাদা পদার্থ ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। তিনি কথা বলছেন, কিন্তু কথা বলতে পারছেন না।
স্ট্যানফোর্ড এবং ওয়াকার অবাক হয়ে গেছেন। তারা দেখছেন, অ্যানড্রুর সমস্ত শরীরে কাঁপন ধরেছে। ওয়াকার ধীরে ধীরে বাক্সটা বন্ধ করে দিলেন। স্ট্যানফোর্ড একটা বোম টিপলেন। মস্ত বড়ো পাখা ঘুরতে শুরু হল। বিষাক্ত গ্যাস ল্যাবোরেটরি থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল। বাতাস এখন পরিষ্কার। দুজন বিজ্ঞানী দরজা খুলে অ্যানড্রুকে নিয়ে বাইরে এলেন।
ট্যানার হলওয়েতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে গেছে। তার চোখে মুখে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি।
তিনি অত্যন্ত দ্রুত ওখানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কী হয়েছে?
স্ট্যানফোর্ড বললেন– ভয়ংকর দুর্ঘটনা।
কী ধরনের দুর্ঘটনা?
ট্যানার এখন উন্মাদের মতো হয়ে গেছেন। আমার ভাইয়ের কিছু হয়নি তো?
চারপাশে মানুষ জনের ভিড়।
৯১১- কে এক্ষুনি ডাকতে হবে। আমরা ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।
.
কুড়ি মিনিট কেটে গেছে। অ্যানড্রু সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালের ইমারজেন্সি বিভাগে শুয়ে আছেন। তার মুখে এখন অক্সিজেন মুখোশ। তার হাতে বিশেষ ইনজেকশন দেওয়া হল। দুজন ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করছেন।
ট্যানার বললেন- অনুগ্রহ করে আমার দাদাকে ঠিক করে তুলুন।
একজন ডাক্তার বললেন মিঃ কিংসলে, আপনি এঘর থেকে বেরিয়ে যান।
না, ট্যানার চিৎকার করে বললেন আমি এখানে আমার ভাইয়ের সঙ্গে থাকব।
অ্যানড্রু অজ্ঞান। তিনি অ্যানড্রুর হাতে হাত রাখলেন। হাতে চাপ দিয়ে বললেন, ভাই, উঠে পড়ো। তোমাকে ভীষণ দরকার।
কোনো সাড়া শব্দ নেই।
ট্যানারের চোখে জল তুমি ভালো হয়ে যাবে, আমরা পৃথিবীর সেরা ডাক্তারদের এখানে উড়িয়ে আনব।
তিনি ডাক্তারদের দিকে তাকিয়ে বললেন- একটা প্রাইভেট কেবিনের ব্যবস্থা করুন।
চব্বিশ ঘণ্টা যেন নার্স থাকে। আমি ঘরে একটা খাট রাখতে চাইছি। আমি ওর সঙ্গে থাকব।
–মি. কিংসলে, আমাদের পরীক্ষাটা শেষ করতে দিন।
–ঠিক আছে, আমি তাহলে হলঘরে অপেক্ষা করছি।
.
অ্যানড্রুকে নানারকম পরীক্ষা করা হল। স্ক্যান করা হল। কোথাও কোনো গোলমাল আছে কিনা দেখা হল। তারপর তাকে একটা কেবিনে নিয়ে যাওয়া হল। ট্যানার হলওয়েতে বসেছিলেন, অপেক্ষা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত ডাক্তাররা অ্যানড্রুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
ট্যানার লাফিয়ে উঠলেন। জিজ্ঞাসা করলেন ভাই কি ঠিক হয়ে গেছে?
ডাক্তার চিন্তিত মুখে বললেন আমরা ওনাকে এখনই ওয়ালটার রিড আর্মি মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাব। ওয়াশিংটনে। আরও পরীক্ষা করতে হবে। তবে একটা কথা বলছি মিঃ কিংসলে, আমি কিন্তু আশা দেখতে পাচ্ছি না।
আপনারা কী বলছেন? ভাইকে সুস্থ হতেই হবে। মাত্র কয়েক মুহূর্ত আমার ভাই ওই ল্যাবোরেটরিতে ছিল।
ডাক্তাররা আর কোনো কথা বললেন না। তারা তাকিয়ে দেখলেন, ট্যানারের চোখ জলে ভরে উঠেছে।
ট্যানার ওয়াশিংটনে চলে গেলেন, অচেতন ভাইকে নিয়ে। ফ্লাইটটা মোটেই ভালো ছিল না। বারবার তিনি ভাগ্যকে দোষারোপ করছেন। আর, অচেতন ভাইয়ের কানে কানে শোনাচ্ছেন আশার বাণী ডাক্তাররা বলেছে, তুমি ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে ঠিক হতেই হবে। তুমি কয়েকদিন বিশ্রাম নেবে।
ট্যানার ভাইয়ের হাতে হাত রেখে বললেন– সকলের স্বার্থে তোমায় ঠিক হতে হবে। আমরা সুইডেনে যাব, নোবেল পুরস্কার আনতে।
.
পরবর্তী তিনদিন ট্যানার অ্যানড্রুর ঘরে একটা খাটে শুয়েছিলেন, সব সময় ভাইয়ের পাশে পাশে থাকতেন, কখনও তাকে দেখা যেত, ওয়াল্টার রিডের ওয়েটিং রুমে বসে আছেন।
ট্যানার প্রশ্ন করলেন– কীরকম দেখছেন? আমার ভাই বাঁচবে তো?
-হ্যাঁ, খুবই খারাপ অবস্থা। এখনও উনি যে বেঁচে আছেন, সেটাই সৌভাগ্যের ব্যাপার। ওই পরীক্ষামূলক গ্যাসটা কী ছিল, তা আমরা বুঝতে পারছি না। কিন্তু সেটা মারাত্মক বিষাক্ত।
ডাক্তার, কী হবে? আমরা কি অন্য কোনো জায়গা থেকে ডাক্তার নিয়ে আসব?
-তাতে কোনো লাভ হবে না। আমার মনে হচ্ছে, ওই বিষাক্ত গ্যাস আপনার ভাইয়ের মাথার কোশগুলোকে নষ্ট করে ফেলেছে।
ট্যানার চিৎকার করে বললেন– এর কি কোনো ওষুধ নেই?
একজন ডাক্তার শান্তভাবে বললেন মিঃ কিংসলে, এখনও পর্যন্ত এই রোগের কোনো ওষুধ বেরোয়নি। আসলে আমরা জানি না, এই বিষটা প্রকৃত কী? আমি দুঃখিত, মনে হচ্ছে, আর কোনো দিন আপনার ভাই বোধহয় স্মৃতিশক্তি ফিরে পাবেন না।
ট্যানার অবাক হয়ে গেছেন। তার সমস্ত মুখ সাদা হয়ে গেছে। অসহায় আর্তনাদে তিনি মুষ্টিবদ্ধ দুটি হাত আকাশের দিকে তুলে দিলেন।
আপনার ভাইয়ের ঘুম ভেঙেছে, আপনি দেখা করতে যেতে পারেন, কিন্তু দোহাই, বেশিক্ষণ থাকবেন না।
ট্যানার অ্যানড্রুর হাসপাতাল ঘরে ঢুকে পড়লেন। অ্যানড্রুর চোখ দুটো ভোলা। অ্যানড্রু অতিথির দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই।
ফোনটা বেজে উঠল। ট্যানার উঠে গেলেন উত্তর দেবার জন্য।
জেনারেল বারটনের ফোন। যে ঘটনাটা ঘটেছে, সেটা ভেবে আমি অত্যন্ত দুঃখিত।
শুয়োরের বাচ্চা, আপনি বলেছিলেন, আমার ভাইয়ের কোনো ক্ষতি হবে না।
–আমি জানি না, এটা কী করে হল? কিন্তু আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি
ট্যানার রিসিভারটা নামিয়ে দিলেন। তিনি ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন।
–আমি কোথায়? আমি কোথায়?
অ্যানড্রুর আর্তনাদ।
–তুমি ওয়াল্টার রিড হাসপাতালে আছো, ওয়াশিংটনে।
–কেন? কী হয়েছে?
তুমি অসুস্থ।
কী হয়েছিল?
–পরীক্ষার সময় কোনো গোলমাল।
আমি মনে করতে পারছি না।
সব ঠিক হয়ে যাবে। ভয় পেও না। আমি দেখছি।
ট্যানার দেখলেন, অ্যানড্রুর চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি শেষবারের মতো ভাইয়ের দিকে তাকালেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
.
রাজকুমারি হাসপাতালে ফুল পাঠিয়েছে। ট্যানার ভেবেছিলেন, তাকে ডেকে পাঠাবেন। কিন্তু সেক্রেটারি বললেন– উনি ফোন করেছেন। উনি শহরের বাইরে চলে যাচ্ছেন। শহরে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
এক সপ্তাহ কেটে গেছে, অ্যানড্রু এবং ট্যানার নিউইয়র্কে ফিরে এসেছেন। অ্যানড্রুর কী অবস্থা, তা কিংসলে গ্রুপের সকলেরই কানে পৌঁছে গেছে। অ্যানড্রু না থাকলে কীভাবে এই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কাজ করবে? যখন দুর্ঘটনার বিষয়টি সকলের কানে পৌঁছে গেল, বোঝা গেল কিংসলে গ্রুপের সম্মান আগের থেকে অনেক কমে যাবে।
ট্যানার ভাবলেন– এতে আর কী বা ক্ষতি হবে? আমি এখন পৃথিবীর রাজা হব। আমার প্রিতমা রাজকুমারিকে আরও অনেক কিছু দিতে পারব। সে যা চেয়েছিল, কয়েক বছর পরে…
ট্যানারের সেক্রেটারি ফোনে বললেন- লিমুজিনের ড্রাইভার আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
ট্যানার অবাক হলেন– ওকে পাঠিয়ে দাও।
ইউনিফর্ম পরা ড্রাইভার ঢুকে বললেন- ট্যানার কিংসলে।
-হ্যাঁ।
–আমি আপনাকে চিঠিখানা দিতে চাইছি।
ট্যানার একটা এনভেলাপ পেলেন। ড্রাইভার বেরিয়ে গেল।
ট্যানার ওটা খুললেন। রাজকুমারির হাতের লেখা। নিশ্চয়ই একটা আনন্দের খবর।
লেখা আছে- প্রিয়তম, ব্যাপারটা কাজ করতে শুরু করেছে। আমি জানি, তুমি আর এখন আমাকে বেশি কিছু দিতে পারবে না। তাই আমি অন্য একজনকে বিয়ে করতে চলেছি। তবে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা চিরদিন অটুট থাকবে। একটা কথা ভেবে দেখো, শেষ পর্যন্ত দুজনের ভালোর জন্য আমাকে এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে হল।
ট্যানারের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ তিনি ওই চিরকুটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর সেটা ওয়েস্ট বাসকেটে ফেলে দিলেন।
হ্যাঁ, বড্ড দেরী হয়ে গেল, জয়কে ছিনিয়ে আনতে।
.
১৮.
পরের দিন। ট্যানার শান্তভাবে তার ডেস্কে বসেছিলেন।
সেক্রেটারি ফোন করলেন– মিঃ কিংসলে, কয়েকজন এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে।
–তারা কারা?
–অনেকে স্যার।
–পাঠিয়ে দাও।
বিভিন্ন বিভাগ থেকে অনেকে এসেছেন।
তারা বললেন– আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি মিঃ কিংসলে।
বসুন।
ওঁরা বসলেন। কী সমস্যা?
–আমরা সকলে খুবই চিন্তিত। আপনার ভাইয়ের যে দুর্ঘটনাটা ঘটে গেছে, আমাদের মনে হচ্ছে কিংসলে গ্রুপ বোধহয় আর ব্যবসা করতে পারবে না।
ট্যানার মাথা নাড়লেন কেন? আমাকে একটু শান্তভাবে ভাবতে দিন। আমার মনে হয় না, অ্যানড্রুর অবস্থা খুবই খারাপ হবে। আমি বলছি, আমি চেষ্টা করব, যাতে আমাদের ব্যবসার কোনো ক্ষতি না হয়। আমি সকলকে জানাব।
গুঞ্জন ধ্বনি শোনা গেল– অনেক ধন্যবাদ।
ট্যানার দেখতে পেলেন, সকলে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
.
অ্যানড্রুকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হল। ট্যানার তাকে নিয়ে একটা ছোট্ট স্টার্ফ হাউসে গেলেন। সেখানে তাকে বিশ্রাম নিতে হবে।
অ্যানড্রুর অবস্থার কথা ভেবে কর্মচারীরা অবাক হয়ে গেছে। আহা, কী অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত একজন মানুষ। এখন জড়বুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে উঠেছেন। সারাদিন অ্যানড্রু তার চেয়ারে বসে থাকেন, জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আধো ঘুম আধো চেতন অবস্থায়। কিংসলে গ্রুপে ফিরে আসার পর তিনি একটু খুশি হয়েছিলেন বলে মনে হল। কিন্তু চারপাশে কোন্ ঘটনা ঘটে চলেছে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
ট্যানার ভাইকে তখনও ভালোবাসেন। ভাইয়ের জন্য জীবন পর্যন্ত বাজি রাখতে চাইছেন তিনি।
.
কিংসলে গ্রুপের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেছে। যখন অ্যানড্রু এটা চালাতেন, চারপাশে উত্তেজনা ছিল। এখন সবকিছুই গতানুগতিক। এটা বোধহয় আর চালানো যাবে না। ট্যানার বিভিন্ন দিকে এজেন্টদের পাঠালেন কোম্পানির হয়ে নতুন ক্লায়েন্ট জোগাড় করতে। ব্যবসা ক্রমশ বেড়ে উঠল, ট্যানার কোম্পানির নাম পরিবর্তন করলেন। নতুন নামকরণ করা হল কিংসলে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ। অনেকদিন ধরেই তিনি এটা ভেবেছিলেন।
রাজকুমারির বিদায় সম্ভাষণ, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। যে সমস্ত সদস্যরা ভেবেছিলেন যে, বিয়েটা অনুষ্ঠিত হবে, তারা ভাবলেন এখন ট্যানার কীভাবে এই আঘাতটা সহ্য করবেন।
দু-দিন কেটে গেছে, চিঠি পাবার পরে। খবরের কাগজের পাতায় একটা খবর প্রকাশিত হল। ট্যানারের প্রেমিকা এক গণমাধ্যম কুবের এডমন্ড বার্কলেকে বিয়ে করতে চলেছে। তার মানে? ট্যানার বোধহয় আরও বেশি দুঃখ পাবেন।
.
একদিন সন্ধ্যেবেলা, ট্যানারকে মেনসাতেআমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ডেকে পাঠানো হল। সেখানে কে আই জি-র অনেক সদস্য ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ট্যানার এই আমন্ত্রণটা গ্রহণ করলেন।
ট্যানার পরের দিন সকালে হেডকোয়ার্টারে এলেন। তার সঙ্গে এক সুন্দরী মহিলাকে দেওয়া হল। মেয়েটির চেহারাতে ল্যাটিন ছাপ আছে, গভীর চোখের তারা, অলিভ পাতার মতো গায়ের রং। শরীরের মধ্যে যৌন আবেদন আছে।
ট্যানার তার সাথে কর্মচারীদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন–ইনি হলেন সেবাসটিয়ানা কর্টেজ, গত রাতে উনি মেনসাতে ভাষণ দিয়েছিলেন। অসামান্য বুদ্ধিমতী।
ট্যানারের আবেদন আরও পাল্টে গেল। তিনি সেবাসটিয়ানাকে অফিসে বসালেন। তারপর তারা লাঞ্চ করতে চলে এলেন ট্যানারের নিজস্ব ডাইনিং রুমে।
একজন কর্মচারী সেবাসটিয়ানার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, ইন্টারনেটে। তিনি হলেন মিস আরজেনৰ্টিনা, তার বাড়ি সিনসিনাটিতে। সেখানে তিনি এক বিখ্যাত ব্যবসায়ীর স্ত্রী।
সেবাসটিয়ানা এবং ট্যানার লাঞ্চের পর অফিসের দিকে এলেন। ট্যানার সেক্রেটারিকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, এখন যেন কোনো টেলিফোন কল না দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ কেটে গেছে। রিসেপশন রুমে ট্যারের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ইন্টারকমের মাধ্যমে, ওটা ভুল করে ভোলা ছিল।
–ডার্লিং, চিন্তা করো না, আমরা দেখব, যাতে এটা কাজ করে।
সেক্রেটারিরা অবাক হয়ে সংলাপ শুনছেন।
–আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। আমার স্বামী কিন্তু ঈর্ষাকাতর।
তুমি কিছু ভেবো না, সব ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও।
বোঝা গেল কোন্ ঘটনা ঘটতে চলেছে।
কর্মচারীরা অবাক হয়ে ভাবল, ট্যানার কী তাড়াতাড়ি রাজকুমারিকে ভুলে গেলেন।
কেউ কেউ হেসে উঠেছেন, কেউ আবার রাগে ফেটে পড়তে চাইছেন।
-তোমাকে এখনই বাড়ি যেতে হবে। তাই তো?
–হ্যাঁ, থাকলে পারতে ভালো হত। কিন্তু আমি অসহায়।
.
ট্যানার এবং সেবাসটিয়ানা অফিস থেকে চলে গেলেন। অনেকে ভাবলেন, এবার বোধহয় একটু ছুটি পাওয়া যাবে।
কদিন বাদে ট্যানার একটা সোনা বাঁধানো ফোনের কথা বললেন। ফোনটা বানো হল। বলা হল, এই ফোন যেন কেউ না ধরে।
তখন থেকে ট্যানার মাঝে মধ্যে ওই সোনার ফোনে কথা বলেন। প্রতি মাসের শেষে কিছু দিনের জন্য কোথায় উধাও হয়ে যান। সকলেই জানতেন উনি কোথায় যাচ্ছেন। কিন্তু কেউ কোনো প্রশ্ন করার সাহস করতেন না।
ট্যানারের জীবনে আবার আনন্দ ফিরে এসেছে। সহকারীরা সকলে এই মুহূর্তটাকে স্বাগত জানালেন।
.
১৯.
ডায়ানা স্টিভেন্সের মাথার ভেতর শব্দগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে আমি রন জোনস, আমি আপনার পেপার ওয়ার্কটা পেয়েছি। আর যে পরিবর্তন সেগুলোও করেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না, কেন আপনি এ ধরনের অনুরোধ করলেন। এক ঘণ্টা আগে আপনার স্বামীর দেহটা সমাহিত করা হয়েছে।
কীভাবে এতটা ভুল হল? দুঃখে শোকে ডায়ানা কিছুই বলতে পারছেন না। এখন কি আবার দেহটাকে ভোলার কথা বলা যায়? না, আমার কোনো সেক্রেটারি নেই, কে এই ধরনের কথা বলবে? হয়তো কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। রিচার্ডের নামের সাথে অন্য কোনো নাম গোলমাল হয়ে গেছে।
রিচার্ডের ছাইতে ভরা একটা পাত্র ডায়ানার হাতে তুলে দেওয়া হল। ডায়ানা অবাক হয়ে গেলেন। ভাবলেন, এর মধ্যে রিচার্ড কী সত্যি সত্যি আছে? তার হাসি? যে দুটি হাত বারবার আমাকে আলিঙ্গন করত, যে উষ্ণ ঠোঁট আমাকে আদর করত, যে মন ছিল উছলতায় ভরা, যে কণ্ঠস্বর বলত– সোনা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। সবকিছু আজ স্বপ্ন, সেই প্রচণ্ড আমোদ, উদ্বেগ, আনন্দ, কামনা, বাসনা, সব কিছু কী এই ছোট্ট কাসকেটের মধ্যে বন্দি থাকতে পারে?
টেলিফোন বাজছে।
মিসেস স্টিভেন্স?
–হ্যাঁ।
–ট্যানার কিংসলের অফিস থেকে বলছি। আপনি কি অনুগ্রহ করে মিঃ কিংসলের সঙ্গে একবার দেখা করবেন?
.
দুদিন আগে ঘটনাটা ঘটে গেল। এখন ডায়ানা কিংসলে গ্রুপের অফিসের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। রিসেপশন ডেস্কের কাছে এসে গেলেন।
আমার নাম ডায়ানা স্টিভেন্স। ট্যানার কিংসলের সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছি।
–হ্যাঁ, মিসেস স্টিভেন্স, আমরা সকলেই মিঃ স্টিভেন্সের শোচনীয় খবরটা শুনেছি। ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক।
ডায়ানা ঢোক গিলে বললেন ঠিকই তো।
.
ট্যানার রেডট্রা টাইলারের সঙ্গে কথা বলছিলেন– দুটো মিটিং আছে। তারপর একটু সময় পাব।
তার একজন সহকারী চলে গেলেন। ইন্টারকমে শব্দ হল– মিসেস স্টিভেন্স এসেছেন, মিঃ কিংসলে।
ট্যানার বোম টিপলেন, ডায়ানা স্টিভেন্সকে দেখা গেল টেলিভিশন স্ক্রিনের ওপর। তার সোনালি চুল গিট বাঁধা। তিনি একটা সাদা রঙের পোশাক পরেছেন। তার সঙ্গে নীল স্ট্রাইপ দেওয়া স্কার্ট, সাদা রাউজ। চেহারার মধ্যে বিবর্ণতা।
ওনাকে পাঠিয়ে দিন।
ডায়ানা ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে এলেন।
উনি উঠে গিয়ে বললেন- মিসেস স্টিভেল, আপনি এসেছেন বলে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ডায়ানা বললেন সুপ্রভাত।
-হ্যাঁ, বসুন।
ডায়ানা চেয়ারে বসলেন।
–আমি কী বলব? আপনার স্বামীর হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে আমরা অবাক হয়ে গেছি। আমি জানি, এই ব্যাপারের সমাধান নিশ্চয়ই হবে।
যদি আপনি কিছু মনে না করেন, তাহলে কয়েকটা প্রশ্ন করব?
করুন।
–আপনার স্বামী কি কখনও তার কাজ নিয়ে কথা বলতেন?
ডায়ানা মাথা নাড়লেন না। এটা হল জীবনের আর একটা অংশ।
হলের এককোণে রেডট্টা টাইলার একটা মেশিন চালিয়ে দিয়েছেন। তার সঙ্গে চলছে একটা টেলিভিশন রেকর্ডার। ট্যানারের অফিসে যেসব ঘটনা ঘটছে, সবকিছু সেখানে ধরা থাকছে।
–আমি জানি, এ ব্যাপারটা আলোচনা করা আপনার কাছে কতখানি কষ্টকর। ট্যানার বললেন, কিন্তু আপনি সাহায্য না করলে সত্যটা কীভাবে উদঘাটিত হবে?
উনি আবার বললেন আপনি কী জানেন যে, আপনার স্বামীর সাথে ড্রাগসের একটা যোগসূত্র ছিল।
ডায়ানা অবাক হয়ে গেছেন, শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন- আপনি কী বলছেন? রিচার্ডের সঙ্গে এই যোগসূত্র! না, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারছি না।
–মিসেস স্টিভেন্স, আপনি কি জানেন, পুলিশ তার পকেটে মাফিয়া দলের একটা চিঠি পেয়েছে, এই চিঠির মাধ্যমে আপনার স্বামীকে ভয় দেখানো হয়েছে।
রিচার্ড কি ড্রাগ চক্রের সঙ্গে যুক্ত? না, আমি চিন্তা করতে পারছি না। রিচার্ডের কি একটা গোপন একক জীবন ছিল, যার কথা আমি জানতাম না? না-না, তা কখনও হতে পারে না।
ডায়ানার হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করেছে। মনে হল মুখে যেন রক্ত জমেছে। না, তারা ওকে হত্যা করেছে আমাকে শাস্তি দেবার জন্য।
ডায়ানা বললেন– মিঃ কিংসলে, রিচার্ড এই ধরনের…
ট্যানারের কণ্ঠস্বরে সহানুভূতি– আমি খুবই দুঃখিত। কিন্তু আমি সত্যি কথাই বলছি।
ডায়ানা ভাবলেন, অন্তরালে আর একটা জীবন? হতে পারে কি?
ট্যানার কিংসলে তার অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে বললেন–মিসেস স্টিভেন্স, আমি আপনাকে বেশিক্ষণ আটকে রাখব না। ভবিষ্যতে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে, কেমন? যদি আপনাকে সাহায্য করার কিছু থাকে, তাহলে বলবেন।
ট্যানার একটা ড্রয়ার খুললেন। বিজনেস কার্ড বের করে বললেন- এতে আমার। প্রাইভেট সেল ফোন নাম্বার দেওয়া আছে। যে কোনো সময় ফোন করতে পারেন।
ডায়ানা কার্ডটা নিলেন। এখানে শুধুমাত্র ট্যানারের নাম এবং ফোন নাম্বার দেওয়া আছে।
ডায়ানা উঠে দাঁড়ালেন। তার দুটি পা ঠকঠক করে কাঁপছে।
–আপনাকে কষ্ট দেবার জন্য দুঃখিত। আমাকে মনে পড়লে ডাকবেন।
ডায়ানা কথা বলতে পারছেন না। কোনো রকমে বললেন- ধন্যবাদ। তিনি অফিস থেকে বাইরে চলে এলেন।
ডায়ানা রিসেপশন রুমে এলেন। তিনি একজন মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। সে যেন কাউকে বলছে– যদি আমি এক সন্দেহজনক মানুষ হয়ে থাকি, তাহলে বলব কে আই জি-র ওপর কেউ বোধহয় অভিশাপ বর্ষণ করছে। এবার তোমার স্বামী, মিসেস হ্যারিস, আমরা সবাই এই ঘটনাটা শুনে অবাক হয়ে গেছি। কীভাবে ওই ঘটনাটা ঘটল। না, এভাবে মৃত্যু ভাবাই যায় না।
একই ঘটনা? তার মানে? অন্য একজনের স্বামীর ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ডায়ানা তাকালেন, এক অসাধারণ রূপবতী আমেরিকান মহিলা। কালো স্ন্যাকস পরেছে, সিঙ্কের সোয়েটার, তার হাতে আছে একটা সুন্দর মরকতের আংটি, শুধু তাই নয়, হিরের তৈরি বিয়ের আংটিও দেখা গেল। ডায়ানার মনে হল, ওনার সঙ্গে কথা বললে হয়তো ভালো হয়।
ডায়ানা এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ট্যানারের সেক্রেটারি ওই মহিলাকে বললেন-মিঃ কিংসলে আপনাকে ডেকেছেন।
ডায়ানা দেখতে পেলেন কেলি হ্যারিস ট্যানারের অফিসের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
.
ট্যানার উঠে দাঁড়ালেন। কেলিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন- মিসেস হ্যারিস, আপনি এসেছেন বলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আশা করি, ফ্লাইট ভালো ছিল।
-হ্যাঁ, খুবই ভালো।
–আপনি কী নেবেন? কফি?
কেলি মাথা নাড়লেন।
-আমি জানি, মিসেস হ্যারিস, ব্যাপারটা কতখানি ভয়ংকর। তবুও আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে হবে।
রেডট্টা টাইলার আবার তার কাজে বসে গেছেন। টেলিভিশনের স্ক্রিনে কেলিকে দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটা কথা টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করে নেওয়া হচ্ছে।
–আপনার সাথে স্বামীর সম্পর্ক কেমন ছিল?
–খুবই আন্তরিক।
উনি আপনার প্রতি কতখানি বিশ্বস্ত ছিলেন?
কেলি অবাক হয়ে তাকালেন আমাদের মধ্যে কোনো গোপনীয়তা ছিল না। মার্ককে আমি খুবই সৎ বিশ্বস্ত যুবক বলতে পারি। তার মতো এমন ভোলা মনের মানুষ আমি কখনও দেখিনি।
কেলি শব্দ হারিয়ে ফেলেছেন।
উনি কি আপনার সঙ্গে কাজের কথা বলতেন?
না, মার্ক এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা করত না।
–আপনি কি জানেন যে, মার্কের অনেক রাশিয়ান বন্ধু ছিল?
কেলি তাকালেন, একটু অবাক হয়ে গেছেন মিঃ কিংসলে, আপনি কেন আমাকে এসব প্রশ্ন করছেন?
–আপনি কি জানতেন যে, আপনার স্বামী একটা মস্ত বড় ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যার ফলে অনেক টাকা আয় করতে পারতেন?
কেলি একেবারে অবাক –না, এ ব্যাপারে মার্ক আমায় কোনো কথা বলেনি।
–মার্ক কি কখনও ওলগার বিষয়ে কিছু বলেছিলেন?
কেলির মাথা ঘুরছে মি. কিংসলে, বলুন তো আপনি কী জানতে চাইছেন?
প্যারিসের পুলিশ আপনার স্বামীর পকেটে একটা চিরকূট পেয়েছে। তাতে লেখা আছে, কিছু গোপন তথ্য। তলায় লেখা আছে, ভালোবাসা ওলগা।
কেলি চুপ করে বসে রইলেন। অবাক হয়ে গেছেন না, আমি কিছুই জানি না।
–এই যে আপনি বললেন, স্বামী আপনার সঙ্গে সব কথা আলোচনা করতেন? তাহলে আমরা একটা কথা বলতে পারি যে, আপনার স্বামী অন্য মহিলার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন।
কেলি উঠে দাঁড়ালেন না, যে মার্কের কথা আমি বলছি, সে এ কাজ করতেই পারে না। আমি আবার বলছি, আমাদের মধ্যে কোনো গোপনীয়তা ছিল না।
কিন্তু যে কারণে আপনার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে, সে বিষয়টা আপনি জানেন না।
কেলি বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাবেন। মিঃ কিংসলে, আমার শরীর ভালো নেই। মাথাটা ঘুরছে। আমি কি বাইরে যাব?
কিংসলে বললেন–হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, এই কার্ডটা রাখুন, যখন দরকার হবে, আমাকে ডাকবেন।
কেলি মাথা নেড়ে অফিস থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
.
কেলির মাথায় নানা প্রশ্ন। ওলগা কে? মার্ক কেন রাশিয়ানদের সাথে যুক্ত ছিল? তাহলে সে কি একজন স্পাই?
মিসেস হ্যারিস?
–হ্যাঁ।
বাইরে এক সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, মাথায় সোনালি চুল। তিনি বললেন আমার নাম ডায়ানা স্টিভেন্স। আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হত। ওখানে একটা কফিশপ আছে। আপনি কি একবার যাবেন?
কেলি বললেন না, আমার শরীরটা খারাপ।
এই ব্যাপারটার সাথে আপনার স্বামীর মৃত্যুরহস্য জড়িয়ে আছে।
কেলি জানতে চাইলেন মার্ক? কী হয়েছে?
ব্যাপারটা গোপনীয়।
.
ট্যানারের অফিস, ইন্টারকমে সেক্রেটারির কণ্ঠস্বর ভেসে এল- মিঃ হিভরড এখানে আছেন।
–ওনাকে পাঠিয়ে দাও।
একটু বাদে হিভরড এলেন- শুভ সন্ধ্যা জন।
কী হল ট্যানার? মনে হচ্ছে আমাদের কোম্পানির সকলকেই বোধহয় মেরে ফেলা হবে।
–হ্যাঁ, আসল রহস্যটা বের করতে হবে। তিনজন মারা গেছেন। এর মধ্যে কোন যোগসূত্রতা আছে কী? কিন্তু এর ফলে আমাদের কোম্পানির সুনাম অনেকাংশে নষ্ট হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে রিচার্ড স্টিভেন্সের এবং মার্ক হ্যারিসের বিধবা পত্নীরা এসেছিলেন। আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। আপনি কি রেকর্ডটা শুনবেন?
-হ্যাঁ, এবার শুনব।
–এটা হল ডায়ানা স্টিভেন্সের ইন্টারভিউ। ট্যানার একটা বোতাম টিপলেন। স্ক্রিনের ওপর ইন্টারভিউটা ভেসে উঠল। ডানদিকে একটা গ্রাফ রয়েছে। ডায়ানার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে লাইনগুলো একবার ওপরে যাচ্ছে, একবার নীচে নামছে।
কোনো কোনো সময় সেটা একেবারে স্থির থাকছে।
ট্যানার আর একটা বোতাম টিপলেন। এটা শ্ৰীমতী মার্ক হ্যারিস। যাকে ইফেল টাওয়ারের ওপর থেকে ঠেলে হত্যা করা হয়েছে।
আবার টেলিভিশন স্ক্রিনের ওপর কেলির ছবি ভেসে উঠল। কথাবার্তা এগিয়ে চলেছে। গ্রাফটাও এদিক ওদিক করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটা দাঁড়িয়ে গেছে।
জন হিভরড জানতে চাইলেন- স্ক্রিনের ওপর এই লাইনগুলো কী?
–একে আমরা ভয়েস অ্যানালাইজার বলতে পারি। যদি কেউ মিথ্যে কথা বলে থাকেন, তা হলে তরঙ্গের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর মধ্যে কোনো তার লাগে না। এটা হল পলিগ্রা। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি দুই মহিলাই ঠিক কথা বলেছেন। তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।
জন হিভরড অবাক– আপনি কী বলতে চাইছেন? কী জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা বাড়াতে হবে?
–আমার মনে হচ্ছে ওদের জীবন এবার বিপদের মধ্যে কাটবে। তারা স্বামীদের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিলেন। কোনো কোনো সময় হয়তো স্বামীদের কাছ থেকে গোপন কথা শুনে থাকবেন, সেই কথাগুলো মেমারি ব্যাঙ্কের মধ্যে জমা হয়েছে। কোনো এক সময় মনে পড়বে। সেই মুহূর্ত থেকে জীবনটা আরও অশান্ত হয়ে উঠবে। যে লোকেরা স্বামীদের হত্যা করেছে, তারাই ওদের হত্যা করতে চাইবে।
-তাহলে? আমরা এখন কী করব?
–আমরা নতুন একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি। আমি স্টিভেন্সের অ্যাপার্টমেন্টে একটা যন্ত্র বসানোর কথা বলেছি। সেখানে ক্যামেরা, টেলিফোন, মাইক্রোফোন সব কিছু থাকবে। আমরা এখান থেকে সব কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ করব।
জন হিভরড জানতে চাইলেন– কেলি হ্যারিসের ব্যাপারটা কী হবে?
–তিনি তো হোটেলে আছেন, দুর্ভাগ্যবশত আমরা এখনও ওখানে এই যন্ত্রগুলো বসাতে পারিনি। কিন্তু আমার লোকেদের বলেছি, তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করতে। আমি চাইছি, কে আই জি-র তরফ থেকে একটা অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করা হোক। হত্যাকারীকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লক্ষ ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে।
–এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন ট্যানার, এটা কী জরুরি?
জন হিভরড বাধা দেবার চেষ্টা করলেন।
হ্যাঁ, এটা করতেই হবে। এটা কিন্তু কে আই জি-র তরফ থেকে হবে না। এটা আমি ব্যক্তিগতভাবে ঘোষণা করব। এইভাবে আমার সাথে কোম্পানির নাম যুক্ত হবে। আমি জানতে চাইছি, এই রহস্যের অন্তরালে কী আছে?
.
২০.
কফিশপ, কে আই জি হেডকোয়ার্টারের সামনে, ডায়ানা স্টিভেন্স এবং কেলি হ্যারিস এককোণে বসলেন। কেলি অপেক্ষা করছেন, ডায়না কখন কথা বলতে শুধু করবেন।
ডায়ানা জানেন না, কীভাবে কথা বলা শুরু হবে। ভয়ংকর একটা ঘটনা, শ্রীমতী হ্যারিস? রিচার্ডের মতো আপনার স্বামীর মৃত্যু কী করে হল?
এভাবেই তো কথাটা শুরু হতে পারে।
কেলি একটু অধৈর্য– আপনি বলেছেন, আপনি আমার স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারে অনেক কিছু জানেন। আপনি কি মার্ককে চিনতেন?
-না, ওনাকে আমি চিনতাম না।
কেলি রেগে গেছেন তাহলে?
–আমি ওনার মৃত্যুর বিষয়ে কথা বলতে চাইছি।
কেলি উঠে দাঁড়ালেন না, এর জন্য কথা বলার মতো আমার সময় নেই।
তিনি হাঁটতে শুরু করলেন।
-একটু অপেক্ষা করুন, আমার মনে হচ্ছে, আমাদের দুজনেরই একই সমস্যা। আমরা একে অন্যকে সাহায্য করতে পারব।
কেলি বললেন- আপনি কী বলতে চাইছেন?
–আপনি একটু বসবেন কি?
অনিচ্ছুকভাবে কেলি বসলেন। তারপর বললেন- বলুন?
–আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব।
ওয়েটার এসে জানতে চাইল কী চাইছেন?
কেলি বললেন- কিছুই না।
ডায়ানা বললেন–দুটো কফি। কেলি ডায়ানার দিকে তাকিয়ে বললেন- আমর জন্য চা আনবে।
–ঠিক আছে ম্যাডাম। ওয়েটার চলে গেল।
ডায়ানা বললেন আমি আর আপনি…
এক অল্পবয়সী মেয়ে কেলির দিকে তাকিয়ে বলল- আপনার একটা অটোগ্রাফ নেব?
কেলি তাকিয়ে আছেন- তুমি জানো আমি কে?
না, আমার মা বলছেন, আপনি নাকি খুবই বিখ্যাত।
না-না, আমি মোটেই বিখ্যাত নই।
–তাই নাকি। মেয়েটি চলে গেল।
ডায়ানা কেলির –দুটো কফি। কেলি ডায়ানার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন আপনার আসল পরিচয় কী, আমি জানতে পারি কি?
-না-না, তার কোনো দরকার নেই। বলুন, মিসেস স্টিভেন্স।
ডায়ানা, এই নামেই ডাকবেন। আমি শুনেছি আপনার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে।
-হ্যাঁ, তাকে খুন করা হয়েছে।
কেলি ভাবছেন, ওলগার বিষয়টা এখানে বলা উচিত হবে কিনা।
আমার স্বামীকেও হত্যা করা হয়েছে। ওরা দুজনেই কে আই জি-তে কাজ করতেন।
কেলি অধৈর্য হয়ে জানতে চাইলেন তাই নাকি? অনেক মানুষ এখানে কাজ করে। দুজনের যদি ঠাণ্ডা লাগে? আপনি কি এপিডেমিক বলবেন?
ডায়ানা বললেন না, এবার ব্যাপারটা গুছিয়ে বলছি।
কেলি আবার অধৈর্য না, আমি আর থাকব না।
তিনি পার্স হাতে নিয়ে ওঠবার চেষ্টা করলেন।
না, আমার কথাটা একটু শুনুন।
ডায়ানা বাধা দেবার প্রাণপণ চেষ্টা করে বললেন, আজ আমার কথা বলার মতো মানসিকতা নেই। কিন্তু…।
ডায়ানার কণ্ঠস্বর সমস্ত কফিশপে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
অবাক হয়ে ডায়ানা এবং কেলি শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করলেন।
ডায়ানার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে কাউন্টারে বসানো একটা টিভি সেট থেকে। ডায়ানা কোটরুমে দাঁড়িয়ে আছেন সাক্ষী হিসেবে।
একজন চেয়ারে বসে আছে, ওকে বেঁধে ফেলা হল। আলটিয়েরিকে মনে হচ্ছে প্রশ্ন করা হবে। দুজন পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আলটিয়েরির হাতে একটা বন্দুক। কিছু কথা বলার চেষ্টা করছে।
সঞ্চালকের কণ্ঠস্বর–ইনি হলেন ডায়ানা স্টিভেন্স, মাফিয়া সর্দার অ্যানথনি আলটিয়েরির বিচার সভা। জুরিরা একটা বিষয়ে সুনিশ্চিত যে ঐ অপরাধটা সংঘটিত হয়েছে।
দু-বছর আগে ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল, অ্যানথনি আলটিয়েরি তার একজন সহকর্মীকে হত্যা করেছিলেন। ডায়ানা স্টিভেন্সের সাক্ষ্য সেই কথা বলে। কিন্তু জুরিরা এ বিষয়ে অন্য মতবাদ প্রকাশ করেছেন।
কেলি অবাক হয়ে সেটের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। স্ট্যান্ডে আর একজন সাক্ষী এসে দাঁড়িয়েছেন, আলটিয়েরির আইনজ্ঞ প্রশ্ন করলেন– ডাঃ রাসেল, আপনি কি নিউইয়র্কে প্রাকটিস করেন?
-না, আমি বোস্টনে প্রাকটিস করি।
–ওই দিনে আপনি কি আলটিয়েরির চিকিৎসা করেছিলেন? হার্ট প্রবলেমের জন্য?
-হ্যাঁ, সকাল নটার সময় আমি তাকে অবজারভেশনে রেখেছিলাম, সারাদিন তিনি সেখানেই ছিলেন।
-তার মানে উনি অক্টোবরের ১৪ তারিখে নিউইয়র্কে আসতেই পারেন না।
না।
আর একজন সাক্ষীকে দেখা গেল।
–আপনার পেশা কী?
–আমি বোস্টন পার্ক হোটেলের ম্যানেজার।
–১৪ অক্টোবর তারিখে আপনার ডিউটি ছিল?
–হ্যাঁ, আমার ছিল।
–আপনি কি অদ্ভুত কিছু দেখেছিলেন?
–আমি পেন্টহাউস সুইট থেকে একটা ফোন পেয়েছিলাম। বলা হয়েছিল, ওখানে ডাক্তার পাঠাতে হবে।
কী ঘটেছিল?
–আমি ডাঃ রাসেলকে পাঠিয়েছিলাম, আমরা পেন্টহাউসে গেলাম, অ্যানথনি আলটিয়েরির অবস্থা কেমন, তা দেখতে।
আপনারা কী দেখলেন?
-মিঃ আলটিয়েরি মেঝের ওপর শুয়ে আছেন। মনে হচ্ছিল, উনি বোধহয় আমাদের হোটেলে মারা গেছেন।
ডায়ানার মুখ বিবর্ণ। ওরা মিথ্যে কথা বলছে, দুজনেই।
অ্যানথনি আলটিয়েরিকে ইন্টারভিউ করা হল।
–মিঃ আলটিয়েরি, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার কী পরিকল্পনা?
–আমি জানি না, আমি সমস্ত ব্যাপারটা শান্তভাবে নেবার চেষ্টা করছি। হয়তো কয়েকটা পুরোনো ঋণ শোধ করতে হবে।
কেলি কোনো কথা বলতে পারছেন না। ডায়ানার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন–আপনি ওনার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলেন?
-হ্যাঁ, আমি ওনাকে খুন করতে দেখেছি।
কেলির সমস্ত শরীরটা কাঁপছে, চায়ের কাপে শব্দ হচ্ছে। তিনি বললেন আমি এখনই এখান থেকে চলে যাব।
–আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন?
-কেন? আপনি কী করেছেন, তা জানেন? আপনি মাফিয়াদের সর্দারকে চটিয়েছেন। তিনি এখন জেল থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কয়েকটা পুরোনো দেনা চোকাবেন। হ্যাঁ, আপনারও এখন ভয় পাওয়া উচিত।
কেলি উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলে কয়েকটা পয়সা ছুঁড়ে দিলেন। তারপর বললেন–মিসেস স্টিভেন্স, বাঁচবার চেষ্টা করুন।
–আমরা কিন্তু এখনও আমাদের স্বামীদের বিষয়ে আলোচনা করিনি।
–ওসব ব্যাপার ভুলে যান, কেলি দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। ডায়ানা অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন।
ডায়ানা বললেন– মনে হচ্ছে, আপনি বোধহয় একটু বেশি অভিনয় করছেন?
–তাই মনে হচ্ছে? কেলি আবার বললেন- আপনি কী বোকা না? আপনার মাথায় কিছু ঢুকছে না, আমি বুঝতে পারছি না।
স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন। এক মুহূর্তের জন্য কেলির মনে হল, মার্ক এক সময় এভাবেই পড়ে যাচ্ছিলেন।
ডায়ানা এগিয়ে গেল। রাস্তার ওপাশ থেকে দুটো গুলির শব্দ। একটু আগে ওই দুই মহিলা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে বুলেট বর্ষণ হল। বিস্ফোরণ, কেলি তাকালেন। মনে হল, উনি বোধহয় ম্যানহাট্টানে পৌঁছে গেছেন।
ডায়ানা চিৎকার করে বললেন–ঈশ্বর, এখনও কী আমরা প্রার্থনা করব?
এখান থেকে এখনই বেরিয়ে যান।
কেলি ডায়ানাকে নিয়ে কলিনের কাছে চলে গেলেন, লিমুজিনের পাশে। কলিন গাড়ির দরজাটা ঠেলে খুলে দিল। কেলি এবং ডায়ানা ট্যাক্সিতে বসলেন।
কলিন জানতে চাইলেন- কীসের শব্দ?
দুজন একেবারে অবাক হয়ে গেছেন। ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছেন।
শেষ পর্যন্ত কেলি বললেন- না, কোথায় আপনাকে ছেড়ে দেব? কোথায় আছেন?
ডায়ানা গভীর শ্বাস নিলেন। কলিনকে ঠিকানা দিলেন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর।
তারা নীরবতার মধ্যে বসে আছেন। এই মাত্র যে ঘটনাটা ঘটে গেল তার জন্য তৈরি ছিলেন না।
গাড়িটা ডায়ানার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ডায়ানা কেলির দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনি আসুন না, হয়তো আরও কিছু ঘটনা ঘটবে।
কেলি বললেন- না, ধন্যবাদ মিসেস স্টিভেন্স।
ডায়ানা কেলির দিকে তাকালেন। মাথা নাড়লেন। গাড়িটা চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল।
কেলি দেখলেন, ডায়ানা দোতলায় উঠে যাচ্ছেন। কেলির মনে হল, এবার বোধহয় আমি শান্তি পাব।
কলিন বলল- মিসেস হ্যারিস, আপনি কোথায় যাবেন?
হোটেলে ফিরব, কলিন।
অ্যাপার্টমেন্ট থেকে একটা আর্তনাদের শব্দ।
কেলি এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর গাড়ির দরজাটা খুলে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর ঢুকে পড়লেন। ডায়ানা তার ঘরের দরজাটা খোলা রেখেছেন। ঘরের ভেতর ডায়ানা দাঁড়িয়ে আছেন।
কী হয়েছে?
-কিছু-কিছু একটা এখানে আছে। হয়তো চোর ঢুকেছিল। রিচার্ডের ব্রিফকেসটা টেবিলের ওপর ছিল দেখতে পাচ্ছে। এখানে অনেক দরকারী কাগজ ছিল। তারা রিচার্ডের বিয়ের আংটিটা রেখে গেছে।
কেলি বললেন- আপনি এখনই পুলিশে খবর দিন।
-হ্যাঁ, ডিটেকটিভ গ্রিনবার্ডের কার্ডটার কথা মনে পড়ল ডায়ানার। তিনি ফোনের রিসিভার তুললেন।
–ডিটেকটিভ আর্ল প্রিনবার্ডকে দেবেন একবার?
–হ্যাঁ, গ্রিনবার্ড।
–ডিটেকটিভ গ্রিনবার্ড, আমি ডায়ানা স্টিভেন্স। এখানে একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেছে। আপনি কি একবার অ্যাপার্টমেন্টে আসবেন?
ডায়ানা একটুখানি চুপ করলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন- উনি আসছেন, আপনি একটু থাকবেন কি?
কেলির কঠিন কণ্ঠস্বর– না, আপনার ব্যাপারে আমি নাক গলাব না। আমি বলছি, কেউ আপনাকে হত্যা করতে চাইছে। আমি প্যারিসে চলে যাচ্ছি, গুডবাই।
ডায়ানা দেখলেন, কেলি বাইরে গেলেন। লিমুজিনে গিয়ে বসলেন।
কলিন জানতে চাইল- কোথায়?
–হোটেলে ফিরে যাব, প্লিজ।
হোটেলে থাকলেই কেলি বোধহয় নিরাপদে থাকবেন।