৬. কর্নেল র‍্যামন আকোকা

৩১.

কর্নেল র‍্যামন আকোকাকে দেখা গেল। সহকারীদের সঙ্গে গভীর গোপন আলোচনায় মেতে উঠেছেন। বিরাট এক ম্যাপ টেবিলের ওপর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কর্নেল বললেন– মিরো এখন বাসকোর অধিকৃত অঞ্চলের দিকে চলেছেন। এটা সুনিশ্চিত।

তার মানে? বারগোস ভিক্টোরিয়া লগরনো, পাম্পালোনা অথবা সান সেবাসটিয়ান?

 আকোকা ভাবলেন, সান সেবাসটিয়ানে পৌঁছোনোর আগেই লোকটাকে ধরতে হবে।

টেলিফোনে কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

আপনি কিন্তু সময় হারাচ্ছেন।

.

বারগোসের দিকে রাস্তা চলে গেছে। জাইমে শান্তভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন। শেষ অব্দি তিনি কথা বললেন- ফেলিক্স, সান সেবাসটিয়ানে পৌঁছে একটা কাজ করতে হবে। রুবিওকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনতে হবে।

–সিস্টার লুসিয়ার খবর কী?

মেগান জানতে চাইলেন।

 সিস্টার লুসিয়া কি ধরা পড়েছেন?

জাইমে বললেন– লুসিয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। পুলিশ তাকে খুনের আসামি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এখন জিজ্ঞাসাবাদের পালা চলেছে।

এই খবরটা মেগানকে অবাক করে দিল। সিস্টার লুসিয়াকে মেগান ভালোইবাসতেন।

একটু বাদে সামনে তিনটে ট্রাক দেখা গেল, সৈন্যদলে ভরতি।

 জাইমে পাশের রাস্তাটার দিকে যাবার চেষ্টা করলেন। হাইওয়ে এন ১২০

সান ডোমিংগো, সামনের দিকে, সেখানে একটা পুরোনো দুর্গ আছে। আমরা আজ রাতটা এখানেই কাটাব।

দূর থেকে দুর্গের রেখা দেখা গেল। পাহাড়ের একেবারে ওপরে। জাইমে গ্রামের পথ ধরেছেন। ধীরে ধীরে দুর্গন্টা আরও কাছে এসে গেল। কয়েকশো গজ দূরে একটা মস্ত বড়ো লেক।

জাইমে গাড়িটা থামালেন। সবাই ধীরে ধীরে নেমে এলেন।

এবার গাড়িটার অন্তিম দশা ঘটাতে হবে। জাইমে অ্যাক্সিলেটারে চাপ দিলেন। গাড়িটাকে উঁচু পাহাড়ের ওপর থেকে ধাক্কা দেওয়া হল। একটু বাদে গাড়িটা লেকের জলে ডুবে গেল। পাপের কোনে চিহ্ন রইল না কোথাও।

মেগান একবার ভেবেছিলেন, তাহলে আমরা লগরনো যাব কী করে? পরমুহূর্তেই তিনি বুঝতে পারলেন, আর একটা গাড়ি তৈরি করা হবে।

পরিত্যক্ত এই দুর্গ, বিশাল পাথরের প্রাচীর, বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য।

ফেলিক্স মেগানকে বললেন– পুরোনো দিনে এখানেই রাজকুমাররা থাকতেন। অনেক সময় আবার বন্দীদের এখানে আটকে রাখা হত।

তারা পাথরের দরজার ভেতর প্রবেশ করলেন। এখানেই আজ রাতে থাকতে হবে। মেগান ভাবলেন।

জাইমে বললেন- তোমরা তোমাদের ঘর পছন্দ করে নাও।

অ্যাম্পারো মেগানের দিকে তাকিয়ে বললেন- সিস্টার, আমাকে অনুসরণ করুন।

কয়েকটা পাথরের ছোটো ছোটো ঘর চোখে পড়ল। ঠাণ্ডা এবং পরিত্যক্ত। কয়েকটা বেশ বড়ো।

অ্যাম্পায়রা সবথেকে বড়ো ঘরে ঢুকে বললেন– জাইমে আর আমি এখানেই শোবো।

তিনি মেগানের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কণ্ঠস্বরে বললেন আপনি কি ফেলিক্সের সাথে শোবেন?

মেগান কোনো কথা বললেন না।

অথবা, অ্যাম্পায়ো বলতে থাকলেন, ইচ্ছে হলে আপনি জাইমের সঙ্গে শুতে পারেন। ভয় নেই, জাইমে আপনার কোনো ক্ষতি করবে না।

মেগান রাগত স্বরে জবাব দিলেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এর মধ্যে আমাকে জড়াবেন না।

.

এক ঘন্টা বাদে জাইমে এবং ফেলিক্স দুর্গে ফিরে এসেছেন। জাইমে দুটো খরগোস ধরেছেন। ফেলিক্স কাঠ নিয়ে এসেছেন। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কাঁচা মাংস ঝলসানো, আঃ, এটাই বোধহয় উপাদেয় খাবার।

ফেলিক্স বললেন- হে ভদ্রমহিলারা, আজ রাতের ডিনারে এর থেকে বেশি ব্যবস্থা করতে পারিনি। লগরনোতে গিয়ে সুস্বাদু খাবার খাওয়াব, কথা দিচ্ছি।

খাওয়া-দাওয়ার পাট শেষ হল, এবার ঘুমোত হবে।

অ্যাম্পারো বললেন- এসো, এসো, আমাদের বেডরুমটা কেমন, একবার দেখবে এসো।

মেগান দেখতে পেলেন, হাতে হাত রেখে ওঁরা ওপরের দিকে চলে গেলেন।

 ফেলিক্স জানতে চাইলেন সিস্টার, আপনি কোথায় শোবেন ঠিক করেছেন?

হ্যাঁ, আমার জন্য ভাববেন না। শুভরাত্রি। মেগান বললেন।

মেগানের হাতে ফেলিক্স একটা শ্লিপিং ব্যাগ তুলে দিয়ে বললেন- শুভ রাত্রি, সিস্টার।

মেগান চোখ বন্ধ করলেন। চারপাশের লোকগুলোর ভাবগতিক ভালো নয়। কেউ সন্ত্রাসবাদী, কেউ খুনি, কেউ ব্যাঙ্ক ডাকাত। ঈশ্বর জানেন, এদের পরিণতি কী হবে! আমাকে আর কতদিন এদের সঙ্গে থাকতে হবে।

কিন্তু, যদি আমরা অন্য দিক দিয়ে দেখি, তাহলে। এঁদের একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কীজন্য টাকা চুরি করছে? দেশকে স্বাধীন করার জন্য। আহা, সে একজন সাহসী মানুষ। মেগান শুনতে পেলেন জাইমে আর অ্যাম্পায়রা হাসাহাসি করছেন। তিনি একটা ছোট্ট ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লেন। ঠাণ্ডা মেঝের ওপর শুয়ে পড়লেন। ঈশ্বরকে বললেন, আমাকে ক্ষমা করো! কিন্তু কেন? আমি কী করেছি?

জীবনে এই প্রথমবার শুতে যাবার আগে মেগান ভগবানের নাম স্মরণ করতে পারলেন না। ইতিমধ্যেই তিনি শ্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন।

আমি এখানে কী করব? কনভেন্টের কথা মনে পড়ছে। ওই অনাথ আশ্রম, কে আমাকে সেখানে রেখে গেছে? আমি জানি না, আমার বাবা কে ছিলেন? সাহসী যোদ্ধা, নাকি এক মহান বুলফাইটার।

তারপর? মেগান ঘুমিয়ে পড়লেন। অন্তহীন নিরাপত্তা।

.

ওই বন্দীশালার মধ্যে লুসিয়া কারমাইন সত্যি বোধহয় এক কিংবদন্তীর নায়িকা।

প্রহরী বলেছিল- এই ছোট্ট পুকুরে আপনি একটা বড়ো মাছ। ইতালি সরকার একজনকে পাঠিয়েছেন আপনার জন্য। আমি কি আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেব।

না, আমার বন্ধু কেমন আছে?

–ও বোধহয় বেঁচে যাবে।

 লুসিয়া প্রার্থনা করলেন, আবার তাকালেন ওই পাথরের প্রাচীরের দিকে। ভাবলেন, এখান থেকে আমি কবে বেরোব এবং কীভাবে?

.

৩২.

পুলিশ চ্যানেলে খবর পৌঁছে গেছে। ব্যাঙ্কে সাংঘাতিক ডাকাতি হয়েছে। কীভাবে, সেটাও অনেকে জানে।

এক ঘণ্টা কেটে গেছে, কর্নেল আকোকা ভেলাডোরিতে পৌঁছে গেছেন।

–আমাকে সঙ্গে সঙ্গে কেন খবর দেওয়া হল না?

দুঃখিত কর্নেল। ব্যাপারটা চোখের পলক ফেলার আগেই ঘটে গেছে।

হাতের মুঠোয় পেয়েও তাকে ধরতে পারলাম না।

 –এটা আমাদের দোষ নয়।

–এখনই ব্যাঙ্ক ক্যাশিয়ারকে ডেকে পাঠাও।

কাঁপতে কাঁপতে ক্যাশিয়ার এসে হাজির।

কী করব স্যার, লোকটার হাতে ছুরি ছিল। ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদী।

তার মানে জাইমে মিরো?

এবার আকোকা সুনিশ্চিত হলেন।

–সে কি একা এসেছিল?

হ্যাঁ, সে আমাকে ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু আমি কিছু করতে পারিনি।

 দাঁতে দাঁত চেপে আকোকা সংকল্প করলেন– যে করেই হোক লোকটাকে ধরতে হবে।

.

তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। সেই স্বপ্নের মধ্যে কতগুলো কণ্ঠস্বর, কতগুলো ছায়া-ছায়া ছবি। ব্যাঙ্ক ডাকাতি, এটা আমার জন্য নয়, এটা একটা মহান কাজের জন্য। কণ্ঠটা আরও উচ্চকিত।

মেগান চোখ খুললেন। উঠে বসলেন। অদ্ভুত সব কিছু। কিন্তু এই শব্দগুলো? কোথা থেকে আসছে? ভেতর থেকে কি?

তাকিয়ে থাকলেন ক্যাসেলের সামনে। সৈন্যদের তাঁবু মনে হয় তা হলে? ওরা আমাদের ধরে ফেলবে। জাইমে কোথায়? এখনই জাইমেকে জাগিয়ে তুলতে হবে।

মেগান পায়ে পায়ে চলে গেলেন সেই ঘরটির মধ্যে, যেখানে জাইমে আর অ্যাম্পায়রা শুয়ে আছেন। ঘরটি ফাঁকা। তিনি রিসেপশন হলে এলেন। জাইমে এবং অ্যাম্পায়ো সামনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ফিসফিস করে কথা বলছেন।

ফেলিক্স বললেন- আমি পেছন দিকটা দেখে এসেছি। সেখান দিয়েই পালাতে হবে।

-কেন? আমরা জানলা গলে পালাব?

জানলা খুবই ছোটো।

তার মানে? মেগান ভাবলেন, আমাদের ধরে ফেলা হয়েছে!

জাইমে বললেন- ইস, একটুর জন্য ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল।

অ্যাম্পায়রা জানতে চাইলেন, তাহলে এখন কী হবে?

–হয়তো ওরা এমনি এসেছে। এখানে চুপচাপ থাকতে হবে, ওরা চলে যাবার পর…

কিন্তু সামনের দরজাতে শব্দ হল। থমথমে কণ্ঠস্বর– দরজাটা খুলে ফেলতে হবে, এখনই।

জাইমে এবং ফেলিক্স চোখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। বন্দুক উদ্যত।

আবার সেই কণ্ঠস্বর ভেতরে কেউ আছে, দরজা খুলে ফেলো।

আম্পারো আর মেগানকে বলা হল, এখান দিয়ে চলে যাও।

শেষ হয়ে গেছে, মেগান ভাবলেন, অ্যাম্পায়রা জাইমে এবং ফেলিক্সর আড়ালে চলে গেলেন। কত জন সৈন্য? অন্তত দুজন। সুযোগ একটা নিতে হবে।

মেগান সামনের দরজাটা খুলে দিলেন। তারপর বললেন- হায় ঈশ্বর, ভগবান আপনাদের পাঠিয়েছেন। আপনারা না এলে যে কী হত!

.

৩৩.

আর্মি অফিসার মেগানের দিকে তাকালেন– আপনি কে? এখানে কী করছেন? আমি ক্যাপ্টেন রডডিগুয়েজ, আমরা…

ক্যাপ্টেন, আপনি ঠিক সময়ে এসেছেন। আমার দুই শিশুপুত্রের টাইফয়েড হয়েছে। আমি একজন ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছিলাম।

টাইফয়েড?

-হ্যাঁ, জ্বরে ওরা কাঁপছে। ওরা অত্যন্ত অসুস্থ। আপনি কি আপনার সৈন্যদের ডেকে আনবেন, ওদের বাইরে নিয়ে যেতে হবে।

–সিনোরা, আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? ভয়ংকর অসুখ।

তাতে কী হয়েছে। ওরা আপনার সাহায্য প্রার্থী। ওরা এখনই মরে যাবে হয়তো। মেগান অসহায়ের মতো আর্তনাদ করতে থাকলেন। ভদ্রলোকের চোখেমুখে বীভৎস অসহায়তা।

–আমি এখন চলে যাচ্ছি।

–না, এমন করবেন না।

–ভেতরে চলে যান, আমি পুলিশকে খবর দিচ্ছি। অ্যাম্বুলেন্স আসবে।

–কিন্তু?

–এটা একটা আদেশ, সিনোরা। ভেতরে চলে যান।

উনি বললেন– সার্জেন্ট আমরা এখনই এখান থেকে চেলে যাব।

 মেগান দরজাটা বন্ধ করলেন।

জাইমে মেগানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন অসাধারণ, অসাধারণ অভিনয়, আপনি কী। করে শিখলেন?

মেগান বললেন- আমি যখন অনাথ আশ্রমে ছিলাম, তখন শিখেছিলাম কীভাবে বাঁচতে হয়। আশা করি ভগবান আমাকে ক্ষমা করবেন।

ক্যাপ্টেনের মুখখানা দেখতে পেলে ভালো হত। টাইফয়েড, হায়। জাইমে হাসলেন। মেগানের দিকে তাকালেন সিস্টার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

সৈন্যরা চলে গেল।

জাইমে বললেন- এখুনি এখানে পুলিশ আসবে, যাইহোক, আমরা এখনই লগরোনোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করব।

.

পনেরো মিনিট কেটে গেছে। এবার যাত্রা শুরু হবে।

আধ ঘণ্টা পর তারা একটা সেডান গাড়ির কাছে এসে থামলেন।

জাইমের পাশে মেগান বসেছেন। ফেলিক্স এবং অ্যাম্পায়ো পেছনের সিটে। জাইমে মেগানের দিকে তাকালেন। টাইফয়েড! আবার তিনি হেসে উঠলেন।

গাড়ি এগিয়ে চলেছে। মাঝে মধ্যেই দুজনের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে। জাইমের দৃষ্টিতে ফুটেছে কৃতজ্ঞতা।

পুরোনো দিনের ঘটনা? তিনি কি জানতে চাইবেন?

হা, মেগান ধীরে ধীরে বলছেন, আমার মা-বাবার পরিচয় আমি জানি না। পনেরো বছর আমি কনভেন্টে ছিলাম। পনেরো বছর!

–সিস্টার, আপনার কথা শুনে অবাক লাগছে। মনে হচ্ছে, আপনি বুঝি অন্য গ্রহের বাসিন্দা।

মেগান চোখ বন্ধ করলেন। জাইমে জানতে চাইলেন– আপনি কি আবার কনভেন্টে ফিরতে চাইছেন।

–অবশ্যই।

-কেন? এত বড়ো পৃথিবী, এত আনন্দ কবিতা, পিকাসো, লোরকা, পিজারো, ডেসেটো করটেজ, এমন সোনার দেশ, সব কিছু ছেড়ে আপনি ওই অন্ধকারায় ফিরে যাবেন?

হঠাৎ মেগানের মনে হল, আপাত রুক্ষ ওই মানুষটির মনে এক টুকরো ভালোবাসার আগুন আছে।

জাইমে বললেন– আপনার সাথে আগে আমি কথা বলিনি, আসলে চার্চ সম্পর্কে আমার মনোভাব খুব একটা ভালো নয়।

তাই কি? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।

হয়তো তাই। জাইমে ভাবলেন। চার্চ মাঝে মধ্যে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার আচরণ করে।

তিনি বললেন- আপনার চার্চ ফ্রাঙ্কোকে সাহায্য করেছিল। সাধারণ অসহায় মানুষের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার করে।

–সত্যি কি? আমি বিশ্বাস করি না।

-হ্যাঁ, আপনি হয়তো ইতিহাস পড়েননি, অথবা সব জেনেও চুপ করে আছেন।

কথা এগিয়ে চলেছে, পথ ফুরিয়ে আসছে। শেষ অব্দি তারা পথের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেলেন।

এখনও কিছুটা বাকি আছে, ঘন অরণ্য সামনে।

জাইমে বললেন- আমরা লগরোনোর তিরিশ মাইলের মধ্যে চলে এসেছি। দুদিনের মধ্যে হয়তো আর কারও সাথে কারও দেখা হবে না। কাল আমরা ভিক্টোরিয়ার দিকে যাব। তারপর লগরোনো। সিস্টার, আপনি কি মেনডাভিয়ার কনভেন্টে চলে যাবেন?

মেগান জানতে চাইলেন- আপনি কী বলছেন?

–আপনি কি আমার জন্য চিন্তিত, সিস্টার?

মেগানের চিবুকে রক্তাভা।

–আমার কিছুই হবে না, জাইমে বললেন, আমি সীমান্ত পেরিয়ে ফ্রান্সে চলে যাব। মেগান বললেন- ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি আপনি সুস্থ জীবন লাভ করুন।

–প্রার্থনা করুন, শুধু আমার জন্য নয়, সকলের জন্য। এখন একটু ঘুম দরকার। কাল আমরা লিয়নে পৌঁছে যাব।

মেগান শুতে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন, অ্যাম্পায়রা তার দিকে তাকিয়ে আছেন। ঘৃণা, . শুধু ঘৃণা ঝরছে অ্যাম্পায়োর দুটি চোখের তারায়।

না, কোনো মানুষ আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কেউ না, মেগান ভাবলেন।

.

৩৪.

 সকাল হয়েছে, তারা ভিক্টোরিয়ার কাছে একটি গ্রামে পৌঁছে গেছেন। গ্যারেজের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন। জাইমে গ্যারেজের মধ্যে ঢুকে পড়লেন।

মেকানিক জানতে চাইলেন- কী হয়েছে?

জাইমে বললেন– এই গাড়িটা মোটেই কাজ করছে না। এটার কোনো গতি নেই। বুড়ো মেয়ের মতো, শক্তি নেই।

–আমার স্ত্রীর মতো মনে হয়, মেকানিকমুখ খিঁচিয়ে বলল, কারবুলেটরে কোনো অসুবিধা?

জাইমে কাঁধ ঝাঁকালেন– গাড়ি সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। আমার একটা জরুরি দরকার আছে। কালকে মাদ্রিদ পৌঁছোতে হবে। আজ বিকেলের মধ্যে গাড়িটা সারাতে পারবেন?

দুটো কাজ আছে, তারপর।

–আমি দ্বিগুণ দেব।

 মেকানিকের মুখে উজ্জ্বলতা– দুটোর সময় আসুন।

–ঠিক হবে কি? আচ্ছা, কিছু খেয়ে আমরা আসছি।

জাইমে তাকালেন অন্যদের দিকে। তারা এই কথাবার্তা শুনছিলেন।

 জাইমে বললেন- ভাগ্য ভালো, আমাদের গাড়ি ঠিক হবে। চলুন, কোথাও খাওয়া যাক।

ফেলিক্স অবাক হয়ে জানতে চাইলেন– জাইমে, গাড়িটা তো চমৎকার। তবে গ্যারেজে কেন?

জাইমে হাসলেন পুলিশ গাড়িটার ওপর নজর রাখবে। চোরাই গাড়ি তো। বেশিক্ষণ তারা এই ব্যাপারে মাথা ঘামাবে না। দুটোর মধ্যে সব ফাঁকা হবে। তারা পথেঘাটে সব খোঁজ করবে। গ্যারেজে ঢু মারবে না।

জাইমের বুদ্ধিকে মেগান প্রশংসা করলেন।

জাইমে বললেন- এখুনি একটা ফোন করতে হবে। একটু অপেক্ষা করো।

অ্যাম্পারো জাইমের সঙ্গে যাবার জন্য চেষ্টা করলেন। মেগান এবং ফেলিক্স তাকিয়ে থাকলেন।

ফেলিক্স মেগানের দিকে তাকিয়ে বললেন- কেমন লাগছে সিস্টার? জাইমের সাহচর্য?

হঠাৎ মনে হল একরাশ লজ্জা এসে মেগানকে আচ্ছন্ন করেছে।

মেগান শান্তভাবে বললেন- মানুষটা কিন্তু চমৎকার।

হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, একজন দেশপ্রেমিক এবং বিদ্রোহীর মধ্যে কী তফাত? কার শক্তি কত বেশি তাই তো? এছাড়া আর কোনো তফাৎ আছে কি?

মোটর যাত্রাটা চমৎকার। মনে হচ্ছে, প্রকৃতি আরও বেশি উদার হয়ে উঠেছে। জাইমেকে সব সময় এই মানসিক কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হয়। তবুও মুখের কোণে হাসি। মন নিরুদ্বেগ। এত শক্তি উনি কোথা থেকে পান?

জাইমে এবং মেগান টুকটাক কথাবার্তা বলছেন। তারা পরস্পরের প্রতি আরও অনুরক্ত হয়ে উঠছেন। অ্যাম্পায়রা চোখ স্থির রেখেছেন। সবকিছু তাকে শুনতে হবে।

জাইমে বললেন- তখন আমি এক ছোট্ট ছেলে ছিলাম, ভেবেছিলাম একজন মহাকাশযাত্রী হব। দেখলাম, আমার মা-বাবা, ভাই-বোন সকলকে মারা হল। বন্ধুদের হত্যা করা হল। ভয়ংকর একটা ঘটনা, রক্তাক্ত পৃথিবী। মাথা থেকে আকাশ হারিয়ে গেল। নক্ষত্র, মুখ লুকোল। মনে হল তারা বুঝি লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষের দূরের বস্তু। স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিলাম। এই রক্তাক্ত পৃথিবীতে বাঁচতে হবে, মাথা উঁচু করে। তাই তো আমি হাতে বন্দুক নিয়েছি। আজ আমার পরনে সন্ত্রাসবাদীর পোশাক।

–কিন্তু এর থেকে মুক্তি নেই। এই অনিশ্চয়তার জীবন?

মেগান জানতে চাইলেন।

-জানি না, যিশুখ্রিস্টকে আমার ভালো লাগে না। মহম্মদ এবং গান্ধি, আইনস্টাইন এবং চার্চিল। ভাবুন তো, এঁদের মধ্যে কোনো তফাৎ আছে কি? না, কোনো কিছুই আমি ভাবতে চাই না।

এখন আমার সামনে একটাই পথ। যে করেই হোক দেশের স্বাধীনতা আনতেই হবে।

মেগানের মনের ভেতর শীতলতা, তিনি বুঝতে পেরেছেন, জাইমের মধ্যে ছাই চাপা আগুন আছে। কিন্তু জাইমে কি সফল হবেন তার এই প্রয়াসে।

শেষ পর্যন্ত একটা সুন্দর হোটেলের সামনে তারা পৌঁছোলেন। চিকেনের টুকরো, কফি, আরও কত কী। ভীষণ-ভীষণ খিদে পেয়েছিল। সকলেই খুশি হয়েছেন, এক পাত্র রেড ওয়াইন। তাও খাওয়া হল। মেগান ভাবলেন, অনেক দিন বাদে এমন একটা সুন্দর খাওয়ার আসর।

অপূর্ব রেড ওয়াইন, একটির পর একটি ডোক, শরীরটা উষ্ণ হয়ে গেল। জাগল নব উন্মাদনা, আহা, আগে কেন আমি এর স্বাদ পাইনি। মেগান ভাবলেন।

ডিনারের সময় জাইমে সব কিছু দেখছিলেন। বলা হল, একজন বিশ্বাসঘাতক এসে গেছে। কী করে তাকে সরানো যাবে? কে সে? কেন ফেলিক্স?

ফেলিক্সের কথা মনে পড়ে গেল। মুখটা বিস্বাদ হয়ে গেল।

আম্পায়রা জানতে চাইলেন- এবার কোথায় যাব আমরা?

–জানি না, যখন-তখন আমাদের পরিকল্পনা পাল্টাতে হবে।

জাইমে মেগানের দিকে তাকালেন। সিস্টার, আপনি কি মেনডাভিয়াতে যাবেন?

মেগান অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে জাইমের দিকে তাকালেন। কী করা যায়? এই পুরুষকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।

কিন্তু ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কেউ জানে না আগামীকাল কী ঘটবে।

.

সকাল হয়েছে, জাইমে নেমে এলেন সিঁড়ি দিয়ে। একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। সেখানেই রাত কেটেছে। পোশাক একেবারে পাল্টে গেছে। দেহের রং কালো কুচকুচে, মাথায় পরচুল, মস্ত বড়ো পাকানো গোঁফ। ছেঁড়া ফেঁড়া পোশাক। দশ বছর বয়স বেড়ে গেছে।

জাইমে বললেন- শুভ সকাল, মনে হচ্ছে কণ্ঠস্বর কাঁপছে।

তারপর? মেগানের অবাক হবার পালা। কতগুলো বাড়িতে জাইমে বসবাস করেন। এত বন্ধু এবং সহগামী?

মেগান ভাবলেন, এই মানুষটির জন্য হয়তো আমাকে আর চিন্তা করতে হবে না।

.

অ্যাম্পায়রা ব্রেকফাস্ট তৈরি করেছেন। মোটামুটি খারাপ নয়। চাও তৈরি করেছেন। চিপস। হটস চকোলেট। খেতে খেতে কথা হচ্ছে।

–আমরা কতদিন এখানে থাকব?

জাইমে বললেন– সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনিয়ে আসা অব্দি।

হঠাৎ টেলিফোনটা আর্তনাদ করে উঠল। অ্যাম্পায়রা ছুটে গেলেন। ফোন ধরলেন। ফিরে এসে বললেন- প্যাকো ডাকছে।

-কোথায়?

–গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর সে দেবে। তোমাকে এখনই টাইম স্কোয়ারে চলে যেতে হবে। পনেরো মিনিটের মধ্যে।

চিন্তিত মনে জাইমে ভাবতে থাকেন, তাহলে এখনই যাত্রা করা উচিত।

ইতিমধ্যে খবর পৌঁছে গেছে, কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু কে? জাইমে ভাবতে পারছেন না। ফেলিক্স অথবা অ্যাম্পারো? তা কী করে হবে? এ দুজনকেই তিনি অত্যন্ত ভালোবাসেন।

জাইমে বেরিয়ে গেলেন। মেগান ইতস্তত পায়চারি করছেন। মনটা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ভালো নেই। টেলিফোন বেজে উঠল- ঝনঝনাত শব্দে।

অ্যাম্পায়োর কণ্ঠস্বর– আমার টাকাটা? কখন আমি পাব? হ্যাঁ, জাইমে বেরিয়ে গেছে। হেঁটে হেঁটে, সে যাচ্ছে। সকলকে ওখানে আসতে বলে দাও। মিনিট পনেরোর মধ্যেই পার্কে পৌঁছে যাবে। মনে রেখো, তুমি কিন্তু কথা দিয়েছ ওকে মারবে না। কথা ঠিক থাকবে তো?

তাহলে? অ্যাম্পারোই আসল শয়তান। ভয়ের একটা অনুভূতি। শীতল শিহরণ। এখন কী হবে? অসহায় মেগান ভাবতে থাকেন।

দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পথে বেরিয়ে এসেছেন। ছুটছেন, একটির পর একটি গলি পার হচ্ছেন। অত্যন্ত দ্রুত। অবশেষে তিনি পৌঁছে গেলেন ওই পার্কটার কাছে।

.

জাইমে যথাস্থানে পৌঁছে অবাক হলেন, পুলিশের এত ব্যস্ততা কেন? বেশ কয়েকটা মিলিটারী জীপ দাঁড়িয়ে আছে। তা হলে এটা কি প্যাকোর কোনো চাল নাকি? অথবা অ্যাস্পারো? না, তা কেমন করে হবে। এরা দুজন আমার অনেক দিনের বন্ধু। বিপদ আপদে পাশে দাঁড়িয়েছে।

দূর থেকে জাইমেকে দেখে মেগান বুঝতে পারলেন, এ বার আর কোনো উপায় নেই। জাইমে ধরা পড়েছেন। ফাঁসি হবে তার। শেষ চেষ্টা করা যেতে পারে কি? তখনই চোখে পড়ল, প্যারাম্বুলেটরে একটি শিশু একা বসে আছে। তার মা এইমাত্র দোকানে ঢুকে পড়েছে। এই সুযোগটা নিলেন মেগান। অতি দ্রুত চলে এলেন প্যারাম্বুলেটরটার কাছে। অসহায় শিশুটিকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন পার্কের দিকে। তারপর অবাক করে দিলেন জাইমে মিরোকে। দাম্পত্যকলহ শুরু হয়েছে। একে অন্যকে নানাভাবে অভিযুক্ত করছেন। কে কতটা অপদার্থ তা প্রমাণ করার চেষ্টা চলেছে। পুলিশ অফিসার একবার তাকালেন। ওহ, দেশজুড়ে এত অশান্তি আর এরা কিনা সেই খিটখিটে মেজাজটা বজায় রেখেছে। অতি দ্রুত মেগান আর জাইমে পার্ক থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। না, পুলিশ এখন অন্যান্যদের নিয়ে ব্যস্ত। সকলের পকেট সার্চ করা হচ্ছে। বিভিন্ন তথ্য চেয়ে পাঠানো হচ্ছে।

একটু বাদেই পুলিশ অফিসারের মনে হল, ছেলেটা তারস্বরে চিৎকার করছে কেন? কী অবাক, একালের মা-বাবার এই হয়েছে এক কাজ। প্যারাম্বুলেটরটা পার্কের এক কোণে দাঁড় করানো আছে। তাই বোধহয় ছেলেটি এত চিৎকার করছে। খিদে অথবা ভয়েতে। আর ঝগড়া করেছিল যে বর-বউ, তারা কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে।

জাইমেকে ফিরে আসতে দেখে অ্যাম্পারো অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ।

–এ কী জাইমে? প্যাকোর সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি?

জাইমের শরীর দিয়ে গরম আভা বেরোচ্ছে। চোখে ফুটেছে রক্ত চাউনি। জাইমে বললেন, এবার তোমার পালা অ্যাম্পারো। তুমি তো জানো, আমার অভিধানে ক্ষমা শব্দটা নেই।

জাইমে পিস্তল তুললেন–এক-দুই-তিন। এখুনি অ্যাম্পায়োর শরীরটা ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। অ্যাম্পায়রা চিৎকার করে বলতে থাকেন জাইমে, এটা কী জীবন? এটা জীবনের এক বিকৃত অধ্যায়। সারাদিন লুটতরাজ, পুলিশের ভয়ে রাতের পর রাত জেগে থাকা, আমি কি এই জীবনটা চেয়েছিলাম। তোমাকে ভালোবেসে আমি সন্ত্রাসবাদীদের দলে নাম লিখিয়েছি। আমার একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে। সোনালি স্বপ্ন। তোমাকে বিয়ে করে আমি সুখী হতে চেয়েছিলাম। তুমি কি আমার সেই স্বপ্নকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলে।

চুপ করো অ্যাম্পারো, চুপ করো। তোমার বকবকানি শোনার মতো সময় আমার হাতে নেই, তুমি আমাকে ভালোবাসো, কিন্তু তুমি আমাকে চরম বিপদের মধ্যে ঠেলে দিলে কী করে? আজ মেগান না থাকলে আমি বেঁচে ফিরে আসতে পারতাম না।

ফেলিক্স এসে বাধা দিয়েছেন- এমন কাজ করবেন না, ক্ষমা করুন, আমি কথা দিচ্ছি,  ভবিষ্যতে যদি অ্যাম্পারো এই কাজ আবার করে, তাহলে আমি ওকে মেরে ফেলব।

অবশেষে একটা রফা হল, ঠিক হল, সবাই অ্যাম্পায়োর ওপর কড়া নজর রাখবেন। বেচাল কিছু করলে মৃত্যুই হবে তার একমাত্র শাস্তি।

জাইমে অতি দ্রুত বললেন– এখান থেকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। যে কোনো মুহূর্তে অ্যাম্পায়োর বন্ধুরা এসে পড়তে পারে।

.

৩৫.

আকোকা প্রচণ্ড রেগে গেছেন। ভাবতে পারছেন না, কীভাবে মিরোকে হাতের মধ্যে পেয়ে ছেড়ে দেওয়া হল।

ম্যাপটা টেবিলের ওপর মেলে ধরা হয়েছে। ওরা এখন কোথায় যেতে পারে? বাসকো অধিকৃত অঞ্চলে? তার মানে উত্তর-পূর্ব দিকে? নাকি লগবোনো? কিংবা ফ্রান্স সেবাসটিয়ান। আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- কর্নেল, সময় কিন্তু হাত পিছলে চলে যাচ্ছে। সকলে খবরের কাগজ পড়েছেন। সারা পৃথিবীর প্রতিটি দেশ কিন্তু আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

প্রাইম মিনিস্টার, আমার ওপর ভরসা রাখুন।

রাজা জোয়ান কারলোস গোটা ব্যাপারটা তদন্ত করতে বলেছেন। আমি কিন্তু আর বেশি দিন ঝুলিয়ে রাখতে পারব না।

–মাত্র কয়েকটা দিন। ইতিমধ্যে আমি মিরো আর ওই সিস্টারদের ধরে ফেলব। সামান্যক্ষণ নীরবতা।

আটচল্লিশ ঘণ্টা।

অপাস মুনডো, মনে পড়ে গেল, এই সংস্থার কাছেই কর্নেল আকোকা দায়বদ্ধ। কিন্তু রাজা কথা বললে কী হবে? স্পেনের বিখ্যাত শিল্পপতিরা রেগে গেছেন বলা হয়েছে জাইমে মিরোকে এখনই স্তব্ধ করতে হবে। এরকম অনিশ্চিত অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসা গুটিয়ে আমরা অন্য কোথাও চলে যাব।

তার মানে? জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ? কোথায় এখন আমরা তাঁকে খুঁজব?

.

রিকার্ডো আর গ্রাসিলার এই স্বপ্নের পরিভ্রমণ এবার শেষ হয়ে গেল।

এই কদিন তারা একে অন্যকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। কথায় কথায় ভবিষ্যতের রূপকথা তৈরি করেছেন। আহা, রিকার্ডো কথা দিয়েছেন, তিনি গ্রাসিলাকে পৃথিবীর সেরা বাড়ি উপহার দেবেন।

চোখ বন্ধ করে গ্রাসিলা ভেবেছেন– সারা জীবনটা আমি সকলের সঙ্গে ভাগ করে ছোট্ট ঘরে কাটিয়েছি। প্রথম জীবনে একটুকরো ঘরের ভেতর আমি, আমার মা আর ওই অচেনা অজানা পুরুষদের দল। তারপর কনভেন্টের ছোট্ট ঘর। সিস্টারদের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকা।

পরমুহূর্তেই গ্রাসিলার মনে হচ্ছে, রিকার্ডো একজন সৈনিক, একটি আদর্শের জন্য জীবনপাত করছেন। তিনি কি ফরাসি দেশের শাক্তজীবন পছন্দ করবেন? এ ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। কতদিন? কতদিন সময় লাগবে এই বিল্পব সমাপ্ত করতে।

সরকার আলোচনার চেষ্টা করছেন।ইটি একিন্তু সব প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে। উগ্রপন্থীদের আক্রমণের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ভালো লাগছে না, জাইমের সঙ্গে আলোচনা করতে।

এখন পিছিয়ে যাওয়া উচিত কি? রিকার্ডো এই উত্তর কোথায় পাবেন?

 স্বপ্ন দেখতে দোষ কি? স্বপ্ন দেখা চলতে থাকুক।

.

সমস্ত রাত্রি ধরে তারা এগিয়ে চলেছেন। এলবুরবো এবং ফ্লোরিয়াকে পাশ কাটিয়ে, সামনে একটা পাহাড়ের চূড়ো। দূরে লগরোনো দেখা যাচ্ছে। আকাশ রেখা। গ্রাসিলা এবং রিকার্ডো শহরের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেলেন।

একটা বাড়িতে লেখা আছে- সাকুগ্যাপন। পৃথিবীর সবথেকে উল্লেখযোগ্য সার্কাস। জাপান থেকে এসেছে। এক সপ্তাহের জন্য। চব্বিশে জুলাই থেকে শুরু হবে।

 রিকার্ডো বললেন- এখানে, এখানেই আজ-বিকেলে ওদের সঙ্গে দেখা হবে।

.

মেগান, জাইমে, অ্যাম্পারো এবং ফেলিক্সও ওই সার্কাস পোস্টারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সকলের মনের ভেতর উত্তেজনা এবং আলোড়ন। অ্যাম্পারোকে চোখে চোখে রাখতে হবে। ভিক্টোরিয়ার ওই ঘটনার পর থেকে অ্যাম্পারো একলা হয়ে গেছেন। সবসময় তাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে।

জাইমে ঘড়ির দিকে তাকালেন সার্কাস শুরু হবে, এবার ভেতরে যেতে হবে।

.

লগরোনোর পুলিশ হেড কোয়াটারস। কর্নেল র‍্যামন আকোকা শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।

সব কিছু ঠিক-ঠাক আছে তো?

–হ্যাঁ, আপনি চিন্তা করবেন না।

 আকোকার সময়সীমা ক্রমশ কমে আসছে। জানা গেছে, ওই সিস্টাররা মিরোর সঙ্গে চলেছেন, সঙ্গে অনুগামীরা আছেন। কনভেন্টে পৌঁছোনোর আগেই ধরতে হবে। অরণ্যের সবখানে সৈন্যবাহিনীকে সজাগ থাকতে হবে।

জাইমে মিরো যদি বাধা দেবার চেষ্টা করে? এ ব্যাপারটাও ভাবা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে ওকে হত্যা করতে হবে।

–আর সিস্টারদের ক্ষেত্রে। তাদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা। স্থির চোখে আকোকা জবাব দিয়েছিলেন।

আর্দালি এসে খবর দিল, এক আমেরিকান দেখা করতে চাইছেন। উনি সিস্টারদের সম্পর্কে কিছু খবর দেবেন।

অ্যালান টাকার প্রশ্ন করলেন আমি জানি আপনারা অ্যাবে সিস্টারসিয়ানের সিস্টার মেগান সম্পর্কে খোঁজ করছেন? তাই তো?

কর্নেল তাকালেন– এ ব্যাপারে আপনার কী অভিমত?

–আমিও ওনার খোঁজ করছি।

অবাক কাণ্ড, কর্নেল আকোকা ভাবলেন, এই আমেরিকান ওই নানকে কেন খুঁজছেন?

-কেন বলুন তো?

কর্নেল, ব্যাপারটা ব্যক্তিগত এবং গোপনীয়। যদি কোনো খবর পান আমাকে জানাবেন কি?

টেলিফোন নম্বর এবং ঠিকানা কর্নেলের হাতে তুলে দেওয়া হল।

আকোকা বললেন ঠিক আছে আমি জানাব।

.

সমস্ত দেশ এখন হন্যে হয়ে ওই চারজন সিস্টারকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যে প্রেস রিপোর্টাররা কর্নেলের কাছে হাজির হচ্ছেন।

ওঁরা এখন উত্তর দিকে এগিয়ে চলেছেন। অ্যালান টাকার ভাবলেন ওরা নিশ্চয়ই ফ্রান্স সেবাসটিয়ন পৌঁছোবেন। এখুনি সেখানে পৌঁছোতে হবে। এলেন স্কটের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখা উচিত হবে কি? ঠিক ধরা যাচ্ছে না, শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে উনি এলেন স্কটকে ফোন করলেন।

.

সার্কাস শুরু হতে চলেছে, অসম্ভব ভিড় হয়েছে। মেগানরা সেখানে পৌঁছে গেছেন। আসন নির্দিষ্ট ছিল, দুটো আসন ফাঁকা ছিল।

কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। রিকার্ডো এবং সিস্টার গ্রাসিলার তো এখানে আসার কথা ছিল। আগুন চোখে জাইমে তাকালেন অ্যাম্পায়োর দিকে– এটা কি তোমার খেলা?

না, আমি শপথ নিয়ে বলতে পারি, এ ব্যাপারটা আমি কিছুই জানি না।

জনগণের মধ্যে থেকে একটা চিৎকার একজন বাইসাইকেলে চালক ঢুকে পড়েছে। অসামান্য খেলা দেখাচ্ছে।

প্রশিক্ষিত একটা ভাল্লুক, তারপর জোকারদের হাসাহাসি। জাইমে তাকিয়ে আছেন। এত চিন্তায় নিমগ্ন যে, চেনা-অচেনা ঠাহর করতে পারছেন না। সময় এগিয়ে চলেছে।

আর মাত্র পনেরো মিনিট, তার মধ্যে যদি-ওরা না আসে– কণ্ঠস্বর শোনা গেল। রিকার্ডো এবং গ্রাসিলা এসে বসে পড়েছেন।

চোখে চোখে কথা হল।

–খবরের কাগজ দেখেছেন।

খবরের কাগজ? আমরা তো পাহাড়ে ছিলাম।

 জাইমে বলতে থাকেন- রুবিওকে জেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

রিকার্ডো অবাক হলেন কী করে?

বাজে গোলমালে পেটে আঘাত পেয়েছিল। পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে যায়।

 রিকার্ডো শান্ত হয়ে গেছেন।

কী করে বার করব?

 জাইমে হাসলেন– সেটা আমার পরিকল্পনা।

গ্রাসিলা জানতে চাইলেন সিস্টার লুসিয়া? সিস্টার থেরেসা?

মেগান বললেন- সিস্টার লুসিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কোনো এক হত্যার অপরাধে সে নাকি অপরাধী। থেরেসা মারা গেছেন।

গ্রাসিলা ক্রশ এঁকে বললেন– হায় ঈশ্বর।

খেলা এগিয়ে চলেছে। কিন্তু, কেউ কি খেলার দিকে দৃষ্টি দিতে পারছেন? মেগান আর গ্রাসিলা ভাবলেন, একে অন্যকে অনেক কিছু বলতে হবে। শুরু হয়ে গেল কনভেন্টে শেখা ওই প্রতীক ভাষায় কথা বলা। দুজন পুরুষ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছেন।

–রিকার্ডো আর আমি বিয়ে করতে চলেছি।

–বাঃ, সুন্দর খবর।

–তোমার কী হয়েছে?

কিন্তু, এই প্রশ্নের উত্তর দেবার ইঙ্গিত মেগান কখনও শেখেননি। এখন অপেক্ষা করতে হবে।

জাইমে বললেন- আমরা বাইরে যাব। ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে সেটা আমাদের মেনডাভিয়াতে নিয়ে যাবে। সেখানে আমরা দুজন সিস্টারকে ছেড়ে দেব।

জাইমে অ্যাম্পায়োর হাতে হাতে দিলেন। শক্ত করে।

 তারা বাইরে এলেন। রিকার্ডো বললেন–জাইমে, গ্রাসিলা আর আমি বিয়ে করতে চলেছি।

জাইমের মুখ আলোক উদ্ভাস– চমৎকার কথা। ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ।

তিনি গ্রাসিলার দিকে ফিরে বললেন- গ্রাসিলা, আপনার ভাগ্য ভালো। আমি কথা দিচ্ছি, এত ভালো বর আপনি কোথাও পেতেন না।

মেগান দুজনের হাত ধরে বললেন- আপনাদের জীবন শান্ত সুন্দর সুখী হোক।

মেগান ভাবলেন, এখন আমি কী করব? কোথায় যাব? ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

.

আকোকা একটা রিপোর্ট পেলেন।

এক ঘন্টা আগে ওঁদের সার্কাসে দেখা গেছে। ইতিমধ্যে ওঁরা হয়তো অন্য কোথাও চলে গেছেন। একটা নীল সাদা ভ্যানে চড়ে। কর্নেল, ওরা মেনডাভিয়ার দিকে এগিয়ে চলেছেন।

তাহলে? কর্নেল আকোকা হাসলেন, আমরা অনুসরণের প্রান্তসীমায় এসে গেছি। হ্যাঁ, জাইমে মিরোর সঙ্গে লড়াই করে আনন্দ আছে। তিনি এক সফল প্রতিদ্বন্দ্বী, এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কর্নেল আকোকা দেখতে পেলেন, শক্তিশালী বাইনোকুলার দিয়ে, নীল সাদা ভ্যানটা একটা পাহাড়ের পাদদেশের দিকে এগিয়ে চলেছে। এবার তার যাত্রাপথ নীচের কনভেন্টের দিকে। গাছের আড়ালে সৈন্যদল দাঁড়িয়েছিল। কনভেন্টের চারপাশে সেনাবাহিনী পৌঁছে গেছে। এখন পালাবার কোনো পথ নেই। ধীরে ধীরে সৈন্যরা সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। কর্নেল আকোকা তার ওয়াকিটকিকে ব্যস্ত রেখেছেন।

কাজকর্ম ঠিক মতো এগিয়ে চলেছে। সৈন্যদের দুটি স্কোয়াডের হাতে অটোমেটিক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। যে যার পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। রাস্তাটা ধীরে ধীরে আটকে দেওয়া হচ্ছে।

চিৎকার ভেসে এল আপনারা ধরা পড়েছেন। যদি বাঁচতে চান, তাহলে হাত তুলে বাইরে আসুন। আর যদি বাধা দেবার চেষ্টা করেন, তাহলে সকলকে হত্যা করা হবে।

দীর্ঘক্ষণের নীরবতা, তারপর ভ্যানের দরজা খুলে গেল। তিনজন পুরুষ এবং তিনজন ভদ্রমহিলা, কাঁপতে কাঁপতে হাত তুলে দিলেন।

আকোকা অবাক হয়ে গেলেন। না, জাইমে নেই, এরা একদল অচেনা অজানা অতিথি।

.

৩৬.

কনভেন্টের অবস্থান পাহাড়ের ওপর দিকে। জাইমে এবং অন্যান্যরা দেখলেন, আকোকা কী করতে চলেছেন। ওই ভীত সন্ত্রস্ত যাত্রীরা বেরিয়ে এসেছেন। হাত তুলেছেন, সবকিছু বুঝি একটা দুঃস্বপ্ন।

জাইমে মিয়োর মনে পড়ল সেই সংলাপ।

–আপনি কে? আপনারাই বা কে?

–আমরা লগরোনোর বাইরে এক হোটেলে কাজ করি।

 –আপনারা এখানে কী করছেন?

–একজন আমাদের হাতে পাঁচ হাজার পেস্তা দিয়ে বলেছে, এই ভ্যানটা কনভেন্টে নিয়ে যেতে হবে।

কে সে?

–জানি না। আমি কখনও তাকে চোখে দেখিনি।

 –এটা কি তারই ছবি?

এই হল সেই ভদ্রলোক।

জাইমে বললেন- এবার আমরা এখান থেকে চলে যাব!

.

একটা সাদা স্টেশন ওয়াগন, লগরোনোর দিকে ফিরে যাচ্ছে। আড়চোখে মেগান জাইমের দিকে তাকালেন।

–আপনি কী করে জানলেন?

কর্নেল আকোকা কনভেন্টে অপেক্ষা করছেন, তাই তো? তিনি আমাকে বলেছেন–

কী?

–একটা শিয়াল নিজেকে চতুর বলে ভাবে মেগান। আমি যদি নিজেকে আকোকার জায়গাতে বসাতাম তাহলে? আমি কোথায় কঁদ পাততাম?

ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে।

–তা হলে? আপনাকে কনভেন্টে রেখে আসব?

ফেলিক্স জানতে চাইলেন- এবার কী হবে?

জাইমে বললেন- আমরা আর স্পেনে থাকব না। আমরা সোজা সান সেবাসটিয়ানে যাব। সেখান থেকে ফ্রান্সে। তারপর, মেগানের দিকে তাকিয়ে বললেন, সেখানেও একটা সিস্টারসিয়ান কনভেন্ট আছে।

কোনো কথাই অ্যাম্পায়োর সামনে বলা হচ্ছে না। অ্যাম্পায়োকে আর কেউ বিশ্বাস করছেন না।

তার মানে? এবার সোজা সান সেবাসটিয়ান। সান সেবাসটিয়ানে বাসকোর আধিপত্য বেশি। সেখানে আকোকার কোনো ষড়যন্ত্র সফল হবে না।

স্টেশন ওয়াগন লগরোনো শহরকে ছাড়িয়ে বাইরের দিকে চলে গেল।

ফেলিক্স বললেন– সান সেবাসটিয়ানের সব কটা পথের ওপর কিন্তু পুলিশের নজর থাকবে।

জাইমে বললেন– আমরা ট্রেনে চড়ব।

–সৈন্যরা ট্রেনগুলোকে অনুসরণ করবে। প্রত্যেক কামরাতে সৈন্য থাকবে। রিকার্ডো বললেন।

জাইমে বললেন– আমি অতটা ভাবছি না। আমাদের বন্ধুরা সর্বত্র ছড়ানো আছে। তারাই আমাদের সাহায্য করবে।

হাইওয়ের ধারে একটি টেলিফোন বুথ, কাউকে ফোন করতে হবে। জাইমে অ্যাম্পায়োকে অনুসরণ করতে থাকেন। বুথের ভেতর নিয়ে যান। দরজা বন্ধ করে দেন। হাতে উদ্যত পিস্তল।

কী বলতে হবে, জানো তো?

হ্যাঁ।

অ্যাম্পায়ো একটি নম্বর ডায়াল করলেন। কণ্ঠস্বর শোনা গেল– আমি অ্যাম্পায়ো জিরন। কর্নেল আকোকা আমার টেলিফোনের জন্য অপেক্ষা করছেন।

অ্যাম্পারো জাইমের দিকে তাকালেন- বন্দুকটা কথা বলার চেষ্টা করছে।

একটু বাদে আকোকার কণ্ঠস্বর– আপনি কোথায়?

 বন্দুকটা কপালে শক্ত করে চেপে বসেছে– আমরা লগরোনো ছাড়লাম।

-আপনার বন্ধুরাও সঙ্গে আছে?

হ্যাঁ।

জাইমের মুখ কয়েক ইঞ্চি দূরে। মুখে জন্তুর অভিব্যক্তি।

–আমরা এখন বারসিলোনার দিকে এগিয়ে চলেছি। সাদা গাড়িতে, প্রধান হাইওয়ে ধরে। জাইমে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। বাঃ, এই তো লক্ষ্মী মেয়ে, আমার কথা শোনা য়েছে।

.

ট্রেন যাবে সান সেবাসটিয়ানের দিকে। জাইমে ঠিক করলেন, যেখানে সাধারণ মানুষরা বসে, যে ট্রেন প্রত্যেক স্টেশনে থামে, সেই এক্সপ্রেসে উঠে পড়তে হবে। এই সময় নিশ্চয়ই আকোকার লোকজন বারসিলোনার পথঘাট অবরুদ্ধ করেছে। আমরা আলাদা আলাদা ভাবে ট্রেনের টিকিট কাটব। ট্রেনের শেষ কমপার্টমেন্টে আমাদের দেখা হবে।

জাইমে অ্যাম্পায়োকে বললেন- তুমি প্রথমে যাবে। আমি ঠিক তোমার পেছনে থাকব।

কর্নেল আকোকা যদি কোনো ফাঁদ পেতে থাকেন, তাহলে সেই ফাঁদে প্রথমে অ্যাম্পায়োকে পা দিতে হবে। তিনি পালাবার পথ পাবেন না।

অ্যাম্পায়রা স্টেশনের দিকে হেঁটে গেলেন। জাইমে তাকিয়ে থাকলেন, না, কাছে পিঠে কোনো সৈন্য চোখে পড়ছে না।

টিকিট কাটার পালা চলেছে, জাইমে মেগানের পাশের সিটে বসবেন। অ্যাম্পায়রা ঠিক উল্টোদিকে ফেলিক্সের পাশে। অন্যদিকে রিকার্ডো এবং গ্রাসিলা।

জাইমে মেগানকে বললেন- তিন ঘণ্টার মধ্যে আমরা সান সেবাসটিয়ানে পৌঁছে যাব। রাতটা সেখানেই কাটাব। সকালে ফ্রান্সে ঢুকব।

ফ্রান্সে ঢোকার পর?

–চিন্তা করবেন না, সীমান্তের পাশেই সিস্টারসিয়ান কনভেন্ট আছে। আপনি কি ওখানে থাকতে চাইছেন না? 

তার মানে? আমি কী চাইছি? মেগান কিছুই চাইছে না। একবার মনে হচ্ছে কনভেন্টে ফিরে গেলেই ভালো হবে। বাইরের পৃথিবীর এই সমস্যা আর ভালো লাগছে না। পরমুহূর্তে মনে হচ্ছে, না, এখানে আমি কত প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছি। মেগানের আবার মনে হল, জাইমে মিরো বোধহয় আমার জীবনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে চলেছেন।

প্রত্যেকটি ছোটো ছোটো গ্রামে এই ট্রেন থামছে। গ্রাম্য চাষীরা উঠে পড়ছে, বিষণ্ণ মুখের বউয়ের দল, উঠতি ব্যবসায়ী, চটপটে সেলসম্যান, চিৎকার হচ্ছে, কিচিরমিচির শব্দ।

পাহাড়ি পথে ট্রেন এগিয়ে চলেছে।

শেষ অব্দি সান সেবাসটিয়ান।

জাইমে বললেন মেগান, বিপদ কেটে গেছে। এটা আমাদের শহর। এখানে আমিই রাজা, একটা সেডান দাঁড়িয়ে ছিল স্টেশনের সামনে, ড্রাইভার হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানালেন, বোঝা গেল, সত্যি আর কোনো ভয় নেই।

মেগান দেখলেন, জাইমে অ্যাম্পায়োকে চোখে চোখে রেখেছেন। অ্যাম্পারে পালাবার চেষ্টা করলেই ধরে ফেলা হবে।

জাইমে, ড্রাইভার বলল, প্রেস বলছে, কর্নেল আকোকা নাকি তোমাকে খোঁজার চেষ্টা করছেন?

জাইমে হাসলেন, খুঁজতে থাকুক। জিল, আমি তো বিপদের বাইরে চলে এসেছি।

আফেনিদা সানচো দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। সমুদ্র সৈকতের দিকে। গরমকাল, আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। জনাকীর্ণ পথঘাট, সমুদ্রসৈকত প্রাণবন্ত। ছোটো ছোটো প্রমোদ তরণী। আরও ছোটো নৌকো, দূরে পাহাড়, অসাধারণ দৃশ্যপট। মনে হচ্ছে এখানে অপার শান্তি বিরাজ করছে।

জাইমে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় থাকব আমরা?

হোটেল নিজায়। লারগো করটেজ তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

আহা, আবার পুরোনো সেই বন্ধুবান্ধব…

.

নিজা একটা মাঝারি আকারের হোটেল। প্লাজা জুয়ান ডে-তে ওপর। সান মারটিন স্ট্রিটের ওপর। একটা বার্থস্কোয়ারের মধ্যে ধবধবে সাদা বাড়ি। বাদামী রঙের সাদার। মস্ত বড়ো নীল চিহ্ন। ছাদের ওপর, হোটেলের পেছনে দিকে, সমুদ্রের তলায়।

লারগো করটেজ হোটেলের মালিক, নিজে ছুটে এসেছেন, বিরাট চেহারার মানুষ।

–স্বাগতম, অনেক দিন ধরেই ভাবছি, কখন আপনি আসবেন।

জাইমে কাঁধ ঝাঁকালেন কয়েক দিন দেরি হয়ে গেছে তাই তো?

লারগো বললেন- আমি সব পড়েছি, খবরের কাগজে কী সব লিখছে। মেগান এবং গ্রাসিলার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন– আপনাদের ঘর তৈরি।

জাইমে বললেন- আমরা আজ রাতে এখানে থাকব। কাল ফ্রান্সে চলে যাব। একজন ভালো গাইড চাই। যিনি সবকিছু জানেন।

–আমি ব্যবস্থা করব। হোটেল মালিক বললেন তাহলে আপনারা মোট ছজন?

জাইমে অ্যাম্পায়োর দিকে তাকিয়ে বললেন- পাঁচ।

করটেজ জিজ্ঞাসা করলেন নাম লিখিয়েছেন? বলুন না হয়, আমি লিখে নিচ্ছি। ঘরে যান, হাত মুখ ধোন। তারপর আমরা একটা চমৎকার খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করব।

–অ্যাম্পারো আর আমি একটু বাদে যাচ্ছি, গলাটা ভেজাতে হবে। জাইমে বললেন। আমরা পরে আসছি।

লারগো বললেন– ঠিক আছে আপনি যেমন ভালো মনে করবেন।

মেগান সন্তর্পণে জাইমেকে লক্ষ্য করতে থাকেন। অবাক হয়ে গেছেন। অ্যাম্পায়রাকে নিয়ে নিশ্চয়ই একটা পরিকল্পনা আছে। এটা কি শান্ত শীতল হত্যাকাণ্ড? ব্যাপারটা ভাবতে গেলে গা ঘিনঘিন করে।

অ্যাম্পায়রা যেতে ইতস্তত করছেন। কিন্তু তাকে যেতেই হবে।

জাইমে অ্যাম্পায়রাকে বারের এককোণে নিয়ে গেলেন। লবির পাশে।

ওয়েটার এসে গেছে।

জাইমে বললেন– এক গ্লাস ওয়াইন।

 এক গ্লাস, অ্যাস্পারো তাকালেন।

 তারপর পকেট থেকে কী একটা বের করলেন জাইমে। সেটা খুললেন।

শেষ চিৎকার অ্যাম্পায়োর গলায় আমার কথা শোনো। বোঝার চেষ্টা করো আমি কেন এটা করেছি। আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তুমি কি পাগল হয়ে গেছে?

ওয়েটার এসে গেছে, মদের গ্লাসটা রেখে দিয়েছে। জাইমে সাদা পাউডারটা ওই মদে মিশিয়ে দিলেন। ভালো করে নাড়লেন, অ্যাম্পায়োর সামনে গ্লাসটা রাখলেন। কঠিন কণ্ঠস্বরে বললেন, এখুনি খেয়ে ফেলো।

–দেখো, মৃত্যুর অনেকগুলো পথ আছে, এটাই সবথেকে সহজ এবং যন্ত্রণাবিহীন। যদি তোমাকে আমি আমাদের ছেলেদের হাতে ছেড়ে দিই, তাহলে কী হবে?

জাইমে, আমি তোমাকে এখনও ভালোবাসি, আমাকে বিশ্বাস করো, প্লিজ।

–এটা, এখুনি তোমায় খেতে হবে।

কণ্ঠস্বরে কাঠিন্য।

অ্যাম্পায়রা তাকালেন। তারপর গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললেন- তোমার মৃত্যুর আশঙ্কায় আমি এটা পান করছি।

জাইমের ঠোঁটে শয়তানি হাসি। অ্যাম্পায়ো পুরো মদটা খেয়ে ফেলেছেন। ঢকঢক করে।

অ্যাম্পায়রা বললেন– এবার কী হবে?

চলো, ওপর তলায়, তোমাকে আমি বিছানাতে শুইয়ে দেব। তুমি ঘুমিয়ে পড়বে। অ্যাম্পারোর চোখ জলে ভরে এসেছে। তুমি একটা বোকা, জাইমে, আমি মরতে চলেছি। কিন্তু এখনও আমি বলছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং ভালোবাসব।

কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। জাইমে উঠলেন। অ্যাম্পায়োকে হাতের মধ্যে নিলেন। অ্যাম্পারো হাঁটতে পারছেন না। সমস্ত ঘর জুড়ে বুঝি ভূমিকম্প শুরু হয়েছে।

জাইমে…

 অ্যাম্পায়োকে নিয়ে লবির দিকে হেঁটে চলেছেন জাইমে। লারগোরটেজ অপেক্ষা করছেন।

জাইমে বললেন- আমি ওনাকে ঘরে দিয়ে আসছি। কেউ যেন বিরক্ত না করে।

করটেজ দেখতে পেলেন অ্যাম্পায়রাকে নিয়ে জাইমে ওপর তলায় উঠে যাচ্ছেন।

.

ঘরে বসে মেগান অনেক কিছু ভাবছিলেন। সান সেবাসটিয়ান একটি উৎসব মুখরিত শহর। মধুচন্দ্রিমার লোভে নব বিবাহিত নারী-পুরুষের ভিড়। প্রেমিক-প্রেমিকারা এই সুযোগে প্রেম করতে ব্যস্ত।

জাইমে কী করছেন? মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা এখনই হয়ে গেছে।

 অনেকগুলো চিন্তা, কিন্তু আমার মনে ভিড় করছে কেন? আমি কী করতে পারি!

.

রিকার্ডো শিস দিয়ে দিয়ে পোশাক পালটাচ্ছিলেন। মনটা আজ চমৎকার তরতাজা। আমিই পৃথিবীর রাজা। ফরাসি দেশে গিয়ে আমরা বিয়ে করব। কোথায়? সুন্দর একটা চার্চে, আগামীকাল?

ঘরে বসে গ্রাসিলা চান করছিলেন। ঈষদুষ্ণু জল। রিকার্ডোর কথা ভাবছিলেন। মনে মনে হাসলেন, আমি সত্যি সত্যি ওকে খুশি করব, ঈশ্বর তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

.

ফেলিক্স কারপিও জাইমে এবং মেগানের কথা ভাবছিলেন। আহা ওদের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক? হয় কি? কিন্তু এইসব সিস্টাররা তো ভগবানের অংশবিশেষ। রিকার্ডো সিস্টার গ্রাসিলার ডাক দিয়েছে? নাঃ, এটা বোধহয় উচিত হয়নি।

.

পাঁচজন এসেছেন হোটেলের ডাইনিং রুমে। অ্যাম্পায়োর কথা কেউ জিজ্ঞাসা করছেন না।

জাইমের দিকে তাকিয়ে মেগানের মনে হল, কিছু একটা ঘটে গেছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন করা উচিত হবে না।

লারগো করটেজ খাবার সাজাতে ব্যস্ত। অসাধারণ সব পদ, খেতে খুবই ভালো লাগে। অনেক দিন বাদে এমন জমজমাট খাওয়ার আসর। কী না নেই সেখানে? টমেটো থেকে শসা, মদে ভেজানো রুটির টুকরো, সবুজ সবজির স্যালাড, ভাত আর চিকেন, গোরুর মাংসের টুকরো, সসে ডোবানো, শেষকালে সরবত। অনেক দিন বাদে এত সুন্দর খাবার।

 খাওয়া শেষ হয়ে গেল। মেগান বললেন- ঘুম পাচ্ছে, আমি এবার বিছানাতে যাব।

জাইমে বললেন আপনার সঙ্গে কথা আছে।

তিনি লবির একেবারে কোণে চলে গেলেন।

কাল…জাইমে কী জিজ্ঞাসা করবেন? মেগান কোথায় যাবেন? তিনি আর কখনই কনভেন্টের মধ্যে যাবেন না।

জাইমে জিজ্ঞাসা করলেন– আপনি কনভেন্টে ফিরবেন না, তাই তো?

মেগান বললেন- হা, জাইমে, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার মন বিক্ষিপ্ত।

জাইমে হাসলেন– মেগান, খুব তাড়াতাড়ি এই লড়াইটা শেষ হয়ে যাবে। আমরা আবার : সুখের স্বপ্ন দেখব। আমি বলছি, এখন আমার চারপাশে বিপদ, কিন্তু আপনি কি আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। ফ্রান্সে আমার অনেক বন্ধু আছে। তাদের কাছে আপনি শান্ত এবং নিরাপদ থাকবেন।

মেগান তাকালেন- জাইমে, আমায় একটু সময় দেবেন।

–তা হলে? আপনি আমার প্রস্তাবে একেবারে না বলছেন না, তাই তো?

মেগান বললেন- হ্যাঁ, আমি প্রস্তাবটা একেবারে প্রত্যাখ্যান করতে পারছি না।

সে রাতে কারো চোখে ঘুম ছিল না। অনেক কিছু ভাবতে হবে। অনেক লড়াই, মেগান তাকিয়ে ছিলেন, অতীতের স্মৃতির আন্দোলন। কতগুলো বছর কেটে গেছে অনাথ আশ্রমে, তারপর কনভেন্টে, এবার আলোকোজ্জ্বল বর্ণময় একটি জগত। জাইমে মিরো দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করছেন। আমি কাকে বিশ্বাস করব।

কোনদিকে যাব…

 সকাল হল, এ প্রশ্নের উত্তর তখনও অজানা।

.

গ্রাসিলা কনভেন্টের কথা ভাবছিলেন। কনভেন্টের দিনগুলো কেমন ছিল? ঈশ্বরের কাছাকাছি ছিলাম, এখন তা আমি পাব না…

জাইমে ভাবছিলেন মেগানের কথা। মেগানকে কখনওই কনভেন্টে রাখা উচিত হবে না। মেগানকে আমি আমার বান্ধবী করব। কিন্তু মেগান কি উত্তর দেবেন…

ফেলিক্স অ্যাম্পায়োর মৃতদেহটা কীভাবে সরাকেন সেকথা চিন্তা করছিলেন। না, লারগো করটেজের ওপর এ দায়িত্ব দিতে হবে।

.

সকাল হয়েছে, লবিতে দেখা হল।

মেগানের দিকে তাকিয়ে জাইমে বললেন–সুপ্রভাত। আপনার কাছে কোনো উত্তর এসেছে?

 সমস্ত রাত ধরে এর উত্তর খুঁজেছেন মেগান- হ্যাঁ, জাইমে এসেছে।

–আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করবেন?

–জাইমে।

 লারগো করটেজ তাড়াতাড়ি এলেন। ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু আর সময় আছে কি? জোস ফেব্রিয়ান, আপনাদের গাইড। সে আপনাদের পাহাড়ি পথে ফ্রান্সে পৌঁছে দেবে। সে হল সান সেবাসটিয়ানের সেরা গাইড।

জাইমে বললেন– আপনাকে দেখে খুশি হয়েছি জোস, আপনি কী ভাবছেন?

–প্রথমে আমরা পায়ে হেঁটে যাব। তারপর বর্ডারের ও প্রান্তে পৌঁছে যাব। সেখানে গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু আর সময় নেই। এখুনি চলে আসুন।

যাত্রা শুরু হল।

লারগো করটেজ বললেন– ভালোভাবে পৌঁছে যাবেন কিন্তু।

 জাইমে বললেন– ঠিক আছে, সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ।

তাঁরা স্কোয়ারের দিকে এগিয়ে চললেন। সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ল, একদল সৈন্য সামনে এসে রাস্তা আটকে দিয়েছে। কর্নেল র‍্যামন আকোকা এবং কর্নেল সোসটেলোকে দেখা গেল।

জাইমে পেছন দিকে তাকালেন না, পালাবার কোনো পথ নেই। এখন প্রত্যক্ষ লড়াই শুরু হবে।

জাইমে অভ্যাসবশত তার বন্দুকে হাত দিলেন।

কর্নেল আকোকা বললেন মিরো চেষ্টা করবেন না, তাহলে বুলেট দিয়ে আপনার

জাইমে পালাবার চেষ্টা করছিলেন, দৌড়ে এখান থেকে বেরোনো যাবে কি? কিন্তু আকোকা জানলেন কী করে? জাইমে দেখলেন, দরজার পাশে অ্যাম্পারো দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে গম্ভীর হতাশার ছাপ।

ফেলিক্স বললেন আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি ভেবেছিলাম, জাইমে আপনি মেয়েটাকে একেবারে

আমি ওকে ঘুমের ট্যাবলেট দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ও আচ্ছন্ন হয়ে থাকবে। এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল কী করে?

কর্নেল আকোকা এগিয়ে এলেন। বললেন– খেলাটা হয়ে গেছে।

তাড়াতাড়ি সৈন্য এসে হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিল।

ফেলিক্স এবং রিকার্ডো জাইমের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কোনো আদেশ? জাইমে মাথা নাড়লেন। বুঝতে পারলেন, এখন আর উপায় নেই।

জাইমে জানতে চাইলেন- আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে?

কয়েকজন পথচারীর চোখে ঘটনাটা ধরা পড়েছে। মুহূর্তের মধ্যে খবর ছড়িয়ে যাচ্ছে।

কর্নেল আকোকা বললেন– আমরা আপনাকে মাদ্রিদে নিয়ে যাব। সেখানে মিলিটারি ট্রায়াল হবে। আপনাকে ফাঁসি দেওয়া হবে। আর যদি আমার হাতে ক্ষমতা থাকত, আমি এখানেই আপনাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিতাম।

জাইমে বললেন– সিস্টারদের ছেড়ে দেওয়া হোক।

না, এই ষড়যন্ত্রে তারাও যোগ দিয়েছেন। তাদেরও একই অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করা হবে।

কর্নেল আকোকা সিগন্যাল দিলেন। সৈন্যবাহিনী এবার তৎপর হতে শুরু করেছে। মিলিটারি ট্রাক এগিয়ে চলবে।

কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশ পালটে গেল। হাজার হাজার মানুষ উন্মত্তের মতো ছুটে আসছে। বাড়ির বউরা রান্না ফেলে ছুটে আসছে। স্কুল-কলেজের ছাত্রদের দেখা যাচ্ছে। ব্যবসাদাররা দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকের হাতে শর্টগান, অনেকের হাতে রাইফেল। তারা বাসকোপন্থী। এটা তাদের স্বদেশভূমি। এখানে জাইমের অসাধারণ আধিপত্য। প্রথমে কয়েকশো, তারপর কয়েক হাজার। রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। মিলিটারি ট্রাক সামনে পেছনে কোনো দিকে যাবার সুযোগ পাচ্ছে না।

কর্নেল আকোকা চিৎকার করতে থাকেন আমি কিন্তু গুলি করতে বাধ্য হব।

জাইমে বললেন হাসতে হাসতে আকোকা, এটা আমার রাজত্ব। আপনি কিছুই করতে পারবেন না। আমি যদি বলি, তাহলে এই উন্মত্ত জনতা আপনাকে ছিঁড়ে খাবে। দেখছেন তো সকলেই সশস্ত্র। আপনার দশ-বারো জন পুলিশ কতক্ষণ লড়াই করবে?

তাহলে? আমাদের ছেড়ে দিন। না হলে বাঁচবেন না।

হতভম্বের মতো আকোকা সেই সিদ্ধান্ত নিলেন। জাইমে আর মেগান ট্রাক থেকে নেমে এলেন। অন্যরা তাদের অনুসরণ করলেন। কর্নেল আকোকা অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছেন। সমস্ত মুখ রাগে থমথম করছে।

জনগণের মধ্যে উল্লাস ধ্বনি শোনা গেল।

তারা নানাভাবে টিটকিরি করতে শুরু করেছে। টুকরো টুকরো মন্তব্য ভেসে আসছে। শেষ অব্দি আমরা মুক্ত হতে পেরেছি অবাক হয়ে গেছেন মেগান, এমন অভিজ্ঞতা তার জীবনে কখনও হয়নি।

তারপর? মেগান তাকালেন জাইমের চোখের দিকে।

তখনও জনগণের ভিড়।

 কে যেন ছুটতে ছুটতে আসছে– আপনি সিস্টার মেগান?

–হ্যাঁ, আমিই সিস্টার মেগান।

নিঃশ্বাসের মধ্যে নিরাপত্তা আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে। ভীষণ জরুরি। আমার . নাম অ্যালান টাকার। আপনি আমার সঙ্গে আসবেন?

একলা?

–হ্যাঁ, আপনাকে আসতেই হবে।

–প্লিজ, আমি এখন আসতে পারব না।

–আসুন, এই কথাটা বলার জন্য আমি নিউইয়র্ক থেকে ছুটে এসেছি।

–আমাকে খুঁজতে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

 –সবই বোঝাব, আমাকে একটু সময় দিন।

 ওই অচেনা অজানা ভদ্রলোক মেগানকে বগলদাবা করে রাস্তার পাশ দিয়ে চলে গেলেন। মেগান তাকিয়ে থাকলেন। জাইমে মিরো দাঁড়িয়ে আছেন, তারই জন্য অপেক্ষা করছেন।

.

অ্যালান টাকারের সঙ্গে সংলাপ মেগানের জীবনটাকে পাল্টাতে পারবে কি?

 –আমি যার কাছ থেকে আসছি, তিনি আপনাকে দেখবার জন্য উদগ্রীব।

–কে?

এক ভদ্রমহিলা, তিনি আমেরিকায় থাকেন।

 অ্যালান টাকার ভাবলেন, সব কথা খুলে বলা উচিত হবে কিনা। 

–আপনি সিস্টার মেগান তো? কিন্তু আপনার নাম মেগান নয়, আপনি হলেন প্যাট্রিসিয়া।

হঠাৎ মেগানের মনে হল, তার কষ্টকল্পনা কোথায় হেঁটে যাচ্ছে। হ্যাঁ, একটা অনুভূতি।

–আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, কিন্তু আমাকে বোঝাবেন কি?

–আপনার জন্য একটা পাশপোর্টের ব্যবস্থা করব।

মেগান তাকালেন। হোটলের সামনে জাইমে দাঁড়িয়ে আছেন।

আমাকে একটু সময় দিন।

 মেগান ফিরে এলেন।

জাইমে জানতে চাইলেন ওই লোকটা তোমাকে বিরক্ত করছিল?

-না-না।

 জাইমে মেগানের হাত ধরলেন–এসো, এখন থেকে আমরা দুজন একসঙ্গে থাকব, মেগান।

আপনার নাম মেগান নয়, আপনি প্যাট্রিসিয়া।

 মেগান তাকালেন জাইমের সুন্দর মুখের দিকে।

 হ্যাঁ, আমরা একসঙ্গে থাকব। কিন্তু প্রথমেই জানতে হবে, আমি কে?

—জাইমে, আমি তোমার সঙ্গে থাকব। কিন্তু আর একটা দরকারী কাজ আছে।

তার মানে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?

 কয়েক দিনের জন্য, হয়তো কয়েক মাস। কিন্তু কথা দিচ্ছি, আমি ফিরে আসব।

–আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি লারগো করটেজের সঙ্গে যোগাযোগ রেখো।

আমি আসব। আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম। হা, কিন্তু একবার এলেন স্কটের সঙ্গে দেখা করতেই হবে।

.

৩৭.

চার্চের শান্ত পরিবেশ, ল্যাটিন ভাষায় মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ঈশ্বর এই নব বিবাহিতকে আশীর্বাদ করুন।

গ্রাসিলা মন দিয়ে সব শব্দগুলো শোনার চেষ্টা করছেন। কত কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে তার। আজ আমি বিশ্বের সুখীতমা মহিলা। হে ঈশ্বর, তুমি আমার প্রতি আর একটু সদয় হও।

যাজক আরও বললেন– পৃথিবীতে সব শান্তি এখন যেন ওই দম্পতিকে আশ্রয় করে।

হঠাৎ গ্রাসিলার মনে হল, আমি কি এভাবে বিয়ে করতে পারি? তিনি চিৎকার করে বললেন, নানা, আমার অন্যায় হচ্ছে। আমি তো এখনই বিবাহিত।

মাথা নাড়ছেন গ্রাসিলা, উন্মাদের মতো আচরণ করছেন।

 রিকার্ডো অবাক হয়ে গেছেন। রিকর্ডো বললেন- গ্রাসিলা কী বলছ তুমি?

গ্রাসিলা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন– আমি আমার জীবন যিশুকে দান করেছি। আমি আর কাউকে বিয়ে করতে পারি না। ডার্লিং রিকার্ডো, এটা জীবন উৎসর্গ নয়, এটা আশীর্বাদ। কনভেন্টের মধ্যে গিয়ে আমি মানসিক শান্তি পেয়েছিলাম। আমি জানি তুমি আমাকে অনেক কথার বাণী শুনিয়েছ, তোমার সঙ্গে কাটানো সময় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আমি কোনো দিন তা ভুলতে পারব না। কিন্তু আমাকে আমার জগতে ফিরতেই হবে।

তোমাকে অনেক কষ্ট দিলাম, আমি শপথ ভাঙতে পারব না। তোমার জন্য আমি বিশ্বাসঘাতিকা হতে পারব না। আমি জানি আমি তোমাকে সুখী করতে পারব না, তুমি আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো।

রিকার্ডো তাকিয়ে আছেন, ভেঙে পড়া একটা পুরুষ। কোনো শব্দ তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে না। মনে হচ্ছে, তিনি বোধহয় মারা গেছেন।

গ্রাসিলা তাকালেন তাঁর ভাঙাচোরা মুখের দিকে। হৃদয়ের শব্দ তিনি শুনতে পাচ্ছেন। তিনি শেষবারের মতো রিকার্ডোর মুখে চুম্বন চিহ্ন এঁকে দিলেন। বললেন– আমি সত্যি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি। আমি সবসময় তোমার জন্য প্রার্থনা করব। চোখে জল। গ্রাসিলা বললেন, তোমার জীবন সুখের হোক!

.

৩৮.

শুক্রবার সন্ধ্যেবেলা, আরান্ডা ডে ডুয়েরোর হাসপাতালে একটা মিলিটারী অ্যাম্বুলেন্স ঢুকে পড়েছে। দুজন পুলিশ সামনের দরজা খুলে নেমে এলেন।

রুবিও আরজানোকে নিতে হবে, অর্ডার আছে। কাগজটা তিনি তুলে দিলেন।

সুপারভাইজার তাকালেন– আমি তো তাকে ছাড়তে পারব না। আর্মি অ্যাডমিনিসট্রেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

ঠিক আছে। কোথায় তাকে পাব?

সুপারভাইজার বললেন- সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি সপ্তাহের শেষে ছুটিতে বাইরে গেছেন।

-এটা আমাদের সমস্যা নয়, এই হল রিলিজ অর্ডার, কর্নেল আকোকা সই করেছেন। আমি কি তাকে ডেকে আনব? আমি কি বলব, আপনারা এই অর্ডারটাকে গ্রাহ্য করছেন না?

না-না, এটার কোনো দরকার নেই। আমি ওই বন্দীকে তৈরি রাখছি।

আধ মাইল দূরে সিটি জেলের সামনে দুজন গোয়েন্দা বেরিয়ে এলেন। একটা পুলিশের গাড়ির মধ্যে থেকে। তারা ভেতরে প্রবেশ করলেন। তারা ডেস্ক সার্জেন্টের দিকে এগিয়ে গেলেন।

একজন বললেন– আমরা লুসিয়া কারমাইনকে নিতে এসেছি।

 সার্জেন্ট তাকালেন দুই গোয়েন্দার দিকে।

–এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলেনি তো?

একজন ডিটেকটিভ চিৎকার করে বললেন- এটাই হচ্ছে লাল ফিতের বাঁধন, তিনি বললেন এই হল রিলিজ অর্ডার।

কর্নেল আকোকা সই করেছেন।

–ঠিক আছে। আপনারা মেয়েটিকে কোথায় নিয়ে যাবেন?

–মাদ্রিদে। কর্নেল নিজে প্রশ্ন করবেন।

–সত্যি? আমরা একবার কথা বলব।

–কোনো প্রয়োজন আছে কি? একজন ডিটেকটিভ বাধা দেবার চেষ্টা করলেন।

মিস্টার, বলা হয়েছে এই মেয়েটির ওপর কড়া নজর রাখতে হবে। এমন কী ইতালিয় সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। কর্নেল আকোকা যদি এই মেয়েটিকে ডেকে থাকেন, তা হলে আমি সেটা জানব।

–আপনি কিন্তু সময় নষ্ট করছেন।

 –আমার হাতে অনেক সময় আছে মিস্টার।

উনি ফোনের রিসিভার তুলে নিলেন। বললেন, কর্নেল আকোকার সঙ্গে কথা বলতে হবে। মাদ্রিদে।

ডিটেকটিভ বললেন- বৃথা সময় নষ্ট করছেন। এখন কর্নেলকে পাবেন না।

ফোন বেজে উঠল।

কর্নেল অফিস।

সার্জেন্ট তাকালেন ডিটেকটিভদের দিকে বিজয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে। হ্যালো, আমি ডেস্ক সার্জেন্ট বলছি- আরাভার পুলিশ স্টেশন থেকে। কর্নেল আকোকার সঙ্গে কথা বলব।

গোয়েন্দা বারবার অধৈর্য হয়ে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন।

–আঃ, কখন এই খেলাটা শেষ হবে?

কর্নেল আকোকা?

–হ্যাঁ, কে কথা বলছেন?

–দুজন গোয়েন্দা এসেছেন কর্নেল, তারা একজন বন্দীকে মুক্ত করতে চাইছেন?

লুসিয়া কারমাইন?

–হ্যাঁ, স্যার।

–আপনি কি আমার সই করা অর্ডারটা দেখেননি?

–হ্যাঁ, স্যার দেখেছি।

–তা হলে আবার ফোন করতে গেলেন কেন? এক্ষুনি মেয়েটিকে ছেড়ে দিন।

 সার্জেন্ট উঠলেন, তার আভিজাত্য বজায় রাখার চেষ্টা করলেন– আমি মেয়েটিকে নিয়ে আসছি।

পুলিশ স্টেশনের পাশে একটা ছোট্ট গলি, একজন ছেলে নজর করল এক ভদ্রলোক টেলিফোন পোলের তারটা কেটে দিলেন। নেমে এলেন তরতর করে।

ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল- তুমি ওখানে কী করছিলে?

ভদ্রলোক ছেলেটির মাথায় হাত দিয়ে বলল আমার এক বন্ধুকে সাহায্য করছিলাম। কত বড়ো বন্ধু তুমি তা পরে জানতে পারবে।

.

তিন ঘণ্টা কেটে গেছে। উত্তরের এক ফাঁকা ফার্ম হাউসে লুসিয়া ও রুবিও আরজানোর দেখা হল।

.

রাত তিনটে, কথা শোনা গেল– কমিটি এখনই আপনার সঙ্গে কথা বলবে।

-হ্যাঁ, স্যার। কোথায়?

–কর্নেল, একটা লিমুজিন পাঠানো হয়েছে। এখুনি চলে আসুন।

–ইয়েস স্যার।

রিসিভারটা রেখে দিলেন। থরথর করে কাঁপছেন। সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়াগুলো ফুসফুঁসে প্রবেশ করছে।

লিমুজিন এসে যাবে, আমাকে এখনই তৈরি হতে হবে।

তিনি বাথরুমে গেলেন, আয়নায় প্রতিবিম্ব, পরাজয়ের প্রতিচ্ছবি।

জয়ের কাছে এসে গিয়েছিলাম, পারলাম না।

কর্নেল আকোকা দাড়ি কামালেন। খুবই সাবধানে। তারপর চান করলেন। গরম জলে। পোশাক পরে নিলেন।

এক ঘণ্টা কেটে গেছে। বাইরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি জানেন, এই বাড়িটার সঙ্গে আর কখনও তার দেখা হবে না।

তাহলে? এবার কী হবে?

 কালো লিমুজিন, দরজা খুলে গেল। দুজন মানুষ, ভেতরে চলে আসুন কর্নেল।

অন্ধকার রাস্তার বুক চিরে এগিয়ে গেল ওই লিমুজিন।

.

মনে হচ্ছে এটা একটা স্বপ্ন। আমি তাকিয়ে আছি সুইজ আলপসের দিকে। আমি স্বাধীন।

জাইমে মিরো সব কিছু ব্যবস্থা করছেন। যাতে উনি লিরিকে পৌঁছোতে পারেন। গতরাতে এখানে এসে পৌঁছেছেন।

সব কিছু স্বপ্ন? আহা, এত সুন্দর পাহাড় আর আমি এখনও বেঁচে আছি।

.

নটা বাজার কিছুক্ষণ আগে একজনকে দেখা গেল ল্যাক হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে।

মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক দরজাটা খুলে দিলেন– আসুন, বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে কি?

লুসিয়া হাসলেন– না, মোটে না।

আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?

 –আমার বাবার একটা অ্যাকাউন্ট আছে। তিনি আমাকে আসতে বলেছেন।

–ওটা কি নম্বরযুক্ত অ্যাকাউন্ট?

হা।

নম্বরটা কত?

B2A14920।

উনি মাথা নাড়লেন এক মুহূর্ত। উনি ভল্টের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। ব্যাঙ্কের কাজ শুরু হয়েছে। লুসিয়া ভাবলেন, সবকিছু ঠিক ঠাক আছে।

ভদ্রলোক ফিরে এলেন। কোনো অভিব্যক্তি আছে কি?

–আপনার বাবার অ্যাকউন্ট?

–হ্যাঁ, অ্যানজেলো কারমাইন।

 –অ্যাকাউন্টে দুজনের নাম আছে।

 –আর একটা নাম কী?

লুসিয়া কারমাইন।

তার মানে এই পৃথিবীতে আমিই রানি।

–অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে?

–এককোটি তিরিশ লক্ষ ডলার। এটা আপনি কীভাবে নেবেন? ব্যাঙ্কার জানতে চাইলেন।

–এটা ব্রাজিলের রিও শহরের একটা ব্যাঙ্কে ট্রান্সফার করতে হবে।

করে দিচ্ছি। আজ বিকেলের মধেই পৌঁছে যাবে। ব্যা

পারটা খুবই সহজ।

লুসিয়া এক ট্রাভেল এজেন্সির কাছে গেলেন। বিরাট পোস্টারে ব্রাজিলের ছবি।

 তিনি ভেতরে ঢুকলেন।

–আপনাকে কী করে সাহায্য করব?

ব্রাজিলের দুখানা টিকিট কাটতে হবে।

রুবিও কোথায়? ব্রাজিলে আমরা একসঙ্গে যাব।

সারাজীবন আমরা পায়ের ওপর পা দিয়ে কাটাব।

সবকিছু ঠিক হয়েছে কি? ওই দুর্ঘটনা? ওই ভয়ংকর সম্ভাবনা? বাবা এখনও জেলখানায়? আমার দুভাই? বেনিটো পাটাস? বাসকেটা? পুলিশ আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আকোকার লোকেরা? জাইমে মিরো। থেরেসা? সোনার ক্রশ? রুবিও আরজানো? ডিয়ার রুবিও তুমি আমার জন্য আর কত কষ্ট করবে?

ঝরনায় পড়ে যাওয়া? বারের গোলমাল?

হোটেলে ফিরে এলেন লুসিয়া। টেলিফোন নিলেন।

কী বলব? কাকে ফোন করব? অপারেটর বললেন, কোন নাম্বার? লুসিয়া জবাব দিলেন না। তাকিয়ে থাকলেন, তুষার বৃত আল্পস চূড়ার দিকে। দুটো আলাদা জীবন রুবিও এবং আমি। আমরা দুই ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। আমি অ্যানজেলে কারমাইনের কন্যা।

নাম্বার প্লিজ।

 সে এক চাষার ছেলে, এই কাজটাকেই সে ভালোবাসে। আমি কি তাকে দূরে নিয়ে যেতে পারব না?

–আপনাকে কী করে সাহায্য করব? অপারেটর জানতে চাইলেন।

 লুসিয়া বললেন না, ধন্যবাদ। তিনি রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।

 তারপরের দিন, সুইজ এয়ার ফ্লাইটে লুসিয়া চলেছেন রিওর দিকে।

রুবিওকে সঙ্গে নেননি। তিনি জানেন, এই পৃথিবীতে তিনি একেবারে একা।

.

৩৯.

টাউন হাউস। সুন্দর সাজানো ড্রয়িং রুম। দরকারি আলোচনা চলেছে। অ্যালান টাকারের জন্য অপেক্ষা, মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে উনি আসবেন। না, এখন আর মেয়ে নয়, এক পূর্ণবয়স্কা যুবতী। একজন সিস্টার। কী বিষয়ে আলোচনা হবে।

দেখতে চমৎকার, সুন্দরী রূপসী এবং লাবণ্যবতী। টাকারের মুখে হাসি– শ্ৰীমতী স্কট, ইনি হলেন মেগান।

এলেন বললেন- ঠিক আছে আমি কথা বলব। আপনি এখন যেতে পারেন।

 হাসি মিলিয়ে গেল। অ্যালান বললেন– গুডবাই।

 তারপর? কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন। কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে কী? বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

এলেন মেগানকে ভালোভাবে অবলোকন করলেন- আপনি বসতে পারেন।

মেগান বসলেন। দুজন পরস্পরকে মাপছেন। একজনের চোখে বিস্ময়, অন্য জনের চোখে কৌতূহল।

এলেন ভাবছেন, মেয়েটির মধ্যে মায়ের ছায়া আছে। এক অসাধারণ রূপবতী। সেই অ্যাকসিডেন্টের রাত, ঝড়। প্লেনে আগুন ধরে যাওয়া।

সবাই বলেছিল, মেয়েটি মারা গেছে। কিন্তু?

তারপর নীরবতা ভাঙল- আমি এলেন স্কট, স্কট ইন্ডাসট্রির প্রেসিডেন্ট। আপনি কি নাম শুনেছেন?

-না।

শোনার কথা নয় অবশ্য, এটা মনে মনে।

কীভাবে আসল কথাটা পাড়া যায়। একটা গল্প বানাতে হবে। কিন্তু মেগানের মুখের দিকে তাকিয়ে এলেনের মনে হল, প্যাট্রিসিয়াকে বিশ্বাস করতেই হবে। এলেন ভাবলেন, এই মেয়েটির ওপর সব চাবিকাঠি তুলে দেব? চোখে জল আসছে কি? না, এখন সত্যিটা বলতেই হবে।

এলেন স্কট হাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন– আপনাকে একটা গল্প বলব। আমি কি আপনাকে তুমি বলে ডাকতে পারি?

.

এটা ছিল তিন বছর আগের ঘটনা। প্রথম বছর এলেন স্কট খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মেগানকে সহকারিনী হিসেবে নিযুক্ত করলেন। মেগানের কাজ করার ক্ষমতা এবং বুদ্ধিদীপ্তি দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন।

মেগান অতি সহজে যে কোনো বিষয় ধরতে পারছেন।

সারদিন ধরে তুমি কী করে কাজ করো?

মেগান হাসলেন। ভাবলেন, আমি তো কনভেন্টে ছিলাম, ভোর চারটেতে আমাকে উঠতে হত। না হলে সিস্টার বেটিনা বকতেন।

এলেন স্কট চলে গেছেন। মেগান এখনও শিখে চলেছেন। শেষ অব্দি এলেন তাকে দত্তক নিয়েছিলেন।

ব্যাপারটা ভাবতে অবাক লাগে। মেগান ভেবেছিলেন, যতদিন আমি অনাথ আশ্রমে ছিলাম কেউ আমাকে দত্তক নেয়নি। আর এখন কিনা আমার নিজের পরিবারের কেউ একজন আমাকে দত্তক নেবেন।

সত্যি, পৃথিবীটা বড়ো অদ্ভুত।

.

৪০.

 জাইমে মিরো একটু চিন্তা করছেন। একজন নতুন লোককে দেখা যাচ্ছে। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে।

তিনি ফেলিক্স কারপিওকে বললেন- কী হচ্ছে বলুন তো?

আমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়, আমাদের সঙ্গে যাবে।

 জাইমে বললেন– না, আমি বিপদের গন্ধ পাচ্ছি।

তারা সেভাইলে এসেছেন, বিকেলবেলা, অনেকগুলো ব্যাঙ্ক পরিদর্শন করা হয়েছে। শেষ অব্দি একটাকে নির্দিষ্ট করা হল। রাস্তার ধার, বেশি ট্রাফিকের ভিড় নেই। কাছাকাছি একটা ফ্যাক্টরি আছে। সবকিছু চমৎকার।

ফেলিক্স জানতে চাইলেন– কোনো বিপদের সম্ভাবনা?

–না, বিপদ নয়। তবে আমি ভবিষ্যতের সবকিছু দেখতে পাই। মনে হচ্ছে একটা বিপদ আসতে পারে।

–তাহলে আজকের মতো ব্যাপারটা বন্ধ রাখলে কী হয়?

না, আজ আমাকে কাজটা শেষ করতেই হবে।

ব্যাঙ্কে জনা ছয়েক কাস্টমার ছিলেন। ফেলিক্সের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। তিনি সকলকে ভয় দেখালেন। জাইমে ক্যাশরুমের দিকে চলে গেলেন। সিল্কের মতো মসৃণ তার গতি।

শেষ অব্দি ব্যাপারটা অত সহজে হল কি?

সর্বত্র পুলিশ গিজগিজ করছে। জাইমে এবং ফেলিক্সকে দেখা গেল। একজন ডিটেকটিভ চিৎকার করলেন, অস্ত্র ফেলে দিন।

জাইমে ক্ষণ ভগ্নাংশ ভাবলেন। তারপর তার অস্ত্র গর্জন করে উঠল।

৪১.

৭২৭ বিমান পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে, গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মাথার ওপর দিয়ে। দিনটা শুকনো, ঘটনাবহুল। মেগান ভাবলেন, এখনও অনেকটা যাত্রা বাকি।

ক্যালিফোর্নিয়া যেতে হবে, অনেক কাজ আছে। সান ফ্রান্সিকোতে নতুন ফ্যাক্টরি। মাথার ওপর বোঝ।

মেগান ভাবলেন– কেউ কি আমাকে প্রতারণা করার চেষ্টা করবে? সিস্টারসিয়ান কনভেন্টের কথা মনে পড়ল।

স্টুয়ার্ট বললেন মিস স্কট, কিছু লাগবে কি?

মেগান খবরের কাগজের দিকে তাকালেন। বললেন– আমাকে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকাটা দেবেন?

প্রথম পাতার গল্প, জাইমে মিরোর ছবি, লেখা আছে– জাইমে মিরো, ই টি এন নেতা, বাসকোপন্থী, প্রচণ্ডভাবে আহত, পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে গতকাল এক ব্যাঙ্ক ডাকাতির সময়, সেভাইলে, ফেলিক্স কারপিওর মৃত্যু হয়েছে। সেও এক ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদী ছিল। দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ মিরোকে সন্ধান করছিল।

বেশ কিছুক্ষণ মেগান বসেছিলেন স্তব্ধ হয়ে। অতীতের অনেক কথাই তার মনে পড়ছিল। সেটা একটা দূরাগত স্বপ্নের মতো মনে হয়, শেষ বিকেলের আলোয় কে বুঝি একগাদা ছবি তুলেছে আবছা, তাই মুখগুলো স্পষ্ট বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

এই যুদ্ধ অবিলম্বে শেষ হবে। আমরা সবকিছু মুঠো বন্দী করতে পারবে। কারণ জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে, তুমি কি আমার জন্য একটু অপেক্ষা করবে?

কথাগুলো এখনও কানে বাজছে, আমি কি ভুল করলাম? জাইমেকে রণক্ষেত্রে একা ফেলে?

 না, টেলিফোনটা ধরতে হবে। পাইলটকে বললেন- আমরা নিউইয়র্কে ফিরে যাব।

.

একটা লিমুজিন অপেক্ষা করছে। মেগান অফিসে এলেন। বেলা দুটো বেজেছে। লরেন্স গ্ৰে অপেক্ষা করছেন। তিনি হলেন অ্যাটর্নি, এখন কাজ থেকে ছুটি নিয়েছেন।

মেগান বললেন– জাইমে মিরো, তার সম্পর্কে কী জানেন?

–এক ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদী, ই টি এন-র সঙ্গে যুক্ত। আমার মনে হচ্ছে উনি বোধহয় ধরা পড়েছেন।

–হ্যাঁ, এবার বিচার শুরু হবে। আমার কিছু কাজ আছে। কাকে আমরা দেশের সেরা আইনবিদ বলতে পারি।

কারটিস হেম্যান।

–না, একজন ঘাতক আইনজীবী চাই।

–মাইক রসন?–একশো বছরের জন্য তাকে কিনে নেওয়া হয়েছে মেগান।

 –চুক্তিগুলো ভাঙতে হবে। আমি তাকে মাদ্রিদে পাঠাব। আমার নিজের কাজে।

–আমরা স্পেনের পাবলিক ট্রায়ালে যোগ দিতে পারি না।–

-হ্যাঁ, আমরা পারি। আইন তাই বলছে।

অ্যাটর্নি ভাবলেন, আমি কি একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব?

-হ্যাঁ, বলুন।

 –আমি চেষ্টা করব।

–তাহলে? ব্যাপারটা মনে থাকে যেন।

.

কুড়ি মিনিট কেটে গেছে। লরেন্স গ্রে মেগানের অফিসে প্রবেশ করেছেন।

মাইক রসন ফোনে আছেন, তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।

মেগান ফোন ধরলেন– মিঃ রসন, আপনার গলা পেয়ে ভালোই লাগছে। আপনি তো জানেন, স্কট ইন্ডাসট্রিতে কত ঝামেলা। আমি এমন একজনকে চাইছি, যিনি আমাদের সমস্ত আইনের বিষয়টা সামলে নেবেন। আপনার নামটাই প্রথম মনে পড়ছে। এর জন্য যথেষ্ট পারিশ্রমিক দেওয়া হবে।

মিস স্কট?

বলুন।

–আপনি একথা কেন বলছেন?

–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

–রাত দুটো বেজেছে। আপনি রাত দুটোর সময় কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেন?

মিঃ রসন।

–আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি। একজন অন্যজনকে বিশ্বাস করব। আপনি বলছেন স্পেনে যেতে হবে। বাসকো সন্ত্রাসবাদীর পক্ষে দাঁড়াতে হবে, যাকে পুলিশ ধরেছে।

না, সে কোনো সন্ত্রাসবাদী নয়। বলতে চাইছিলেন। কিন্তু মেগান সেকথা বললেন না। বললেন- হ্যাঁ।

আপনার সমস্যা কী? তিনি কী স্কট ইন্ডাসট্রির কোনো শত্রু?

 –তিনি–

–আমি দুঃখিত, আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব না। আমি এত কাজের চাপে আছি যে গত ছমাস ধরে বাথরুম যেতে পারছি না। আমি অন্য কয়েকজন আইনজ্ঞের নাম বলতে পারি।

না, মেগান ভাবলেন, জাইমে মিরো আমাকে চাইছেন। তারপর? একটা অদ্ভুত অসহায়তা। স্পেন আর একটা জগৎ, আর একটা সময়, তার কণ্ঠস্বর কাঁপতে থাকে ঠিক আছে, আপনাকে অনুরোধ করার জন্য দুঃখিত।

কী বললেন? আপনার নিজস্ব ব্যাপার, আপনি কি সত্যি কথাটা বলবেন? আমি জানতে চাইছি, স্কট ইন্ডাসট্রির সর্বাধিনায়িকা কেন এক স্পেনদেশীয় উগ্রপন্থীর জন্য এতখানি দরদ দেখাচ্ছেন। কালকে কি লাঞ্চের আসরে একবার দেখা হবে?

হ্যাঁ, দেখা হবে।

–লে সারকাতে একটার সময়।

.

লে সারকা।

মাইক রসন বললেন– ছবি দেখুন। আমি কিছু গল্প বলব।

তার উচ্চতা খুব একটা বেশি নয়। পোশাক পরিচ্ছেদের মধ্যে অবহেলার ছাপ। কিন্তু মনটা কম্পিউটারের মতো চলমান। চোখের তারায় হাজার সূর্যের আলো। সবসময় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

মাইক রসন বলতে থাকেন- এবার প্রথম থেকে বলুন তো?

মেগান বললেন– উনি আমার ভালো বন্ধু। আমি চাই না, ওনাকে এভাবে মেরে ফেলা হোক।

রসন ঝুঁকে বসলেন- আমি খবরের কাগজের পাতায় পড়েছি, ডন জুয়ান কারলোসের সরকার মিরোকে মেরে ফেলতে পারে। আপনার বন্ধুর বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ আছে।

মেগানের মুখের রং পাল্টাচ্ছে। যা সত্যি তা আমাকে বলতেই হবে। মিরো অনেকগুলো ব্যাঙ্ক ডাকাতি করেছেন, মানুষকে হত্যা করেছেন, বোমা মেরে গাড়ি উড়িয়ে দিয়েছেন।

উনি হত্যাকরী নন, উনি একজন মহান দেশপ্রেমিক। দেশের জন্য লড়াই করছেন।

 হতে পারে, বলুন আমাকে কী করতে হবে?

–ওনাকে বাঁচাতে হবে।

–মেগান, আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি, আপনাকে সত্যিটা বলে চাই, যিশুখ্রিস্ট থাকলেও বোধহয় ওনাকে বাঁচাতে পারবেন না। আপনি কি অলৌকিক কোনো ব্যাপার বিশ্বাস করেন?

–হ্যাঁ, আমি করি। বলুন, আপনি আমাকে সাহায্য করবেন কিনা?

বলুন তো, কেন আপনি এত উদ্বিগ্ন।

–ছজন লইয়ারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তাদের কেউ মিরোকে সাহায্য করতে চাইছেন না। কোর্ট তাঁর বিরুদ্ধে আদেশ জারি করতে চলেছে। বন্ধু, এখন আর অলৌকিক কোনো ঘটনা ঘটবে কি? যিশু কি জেগে উঠেছেন? জানি না, তবে একটা লাঞ্চে আপনি আমাকে ডেকেছিলেন, তার জন্য ধন্যবাদ।

.

বিচার শুরু হল ১৭ সেন্টেম্বর, মেগান তার সহকারীকে বললেন আমার সমস্ত অ্যাপয়ন্টমেন্ট ক্যানসেল করো। আমি এখন মাদ্রিদে উড়ে যাব।

–সেখানে কতদিন আপনি থাকবেন?

বলতে পারছি না।

.

এরোপ্লেনে বসে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঠিক হল। প্লেন এখন আটলান্টিক পার হচ্ছে। মেগান ভাবলেন, আমার হাতে টাকা আছে, আমার হাতে ক্ষমতা আছে। প্রথানমন্ত্রী হলেন আসল চাবিকাঠি। এই মামলা শুরু হবার আগে তার কাছে পৌঁছাতে হবে। না হলে বড্ড দেরি হয়ে যাবে।

.

প্রধানমন্ত্রী লিও পোলডো মার্টিনেজের সঙ্গে মেগান একটা অ্যাপয়ন্টমেন্ট ঠিক করলেন। মাদ্রিদে পৌঁছোনোর চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে। ওই ভদ্রলোক মেগানকে মনক্লো প্যালেসে ডেকেছেন, লাঞ্চের আসরে।

মেগান বললেন আমি জানি, আপনি খুব ব্যস্ত। তাই এই আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ।

 মিস স্কট, আপনি যখন স্কট ইন্ডাসট্রির প্রধান, আপনাকে বিশেষ খাতির তো করতেই হবে। বলুন, আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

মেগান বললেন আমি এখানে এসেছি আপনাকে সাহায্য করার জন্য। স্পেনে আমাদের কয়েকটা ফ্যাক্টরি আছে। আমরা আরও বেশি ফ্যাক্টরি স্থাপন করতে চাইছি।

প্রধানমন্ত্রীর চোখ জ্বলে উঠেছে সত্যি?

-হ্যাঁ, স্কট ইন্ডাসট্রি এখানে একটা বিরাট ইলেকট্রনিক্স প্ল্যান্ট খুলবে। অনেক মানুষের চাকরির সংস্থান হবে। যদি একটা সফল হয়, আমরা আরও অনেকগুলো ফ্যাক্টরি খুলব।

কিন্তু আমার এই স্পেন কেন?

–অন্য দেশের কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবেই এই দেশটাকে ভালোবাসি। তবে এখানে গৃহযুদ্ধের ব্যাপার আছে, তাতে অনেক আধিকারিক আসতে চাইছেন না।

-সত্যি!

–হ্যাঁ, আপনাদের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত বিপক্ষে গেছে। আমি বলব কি?

কারোর নাম কি মনে পড়ছে?

–হ্যাঁ, জাইমে মিরো।

 –জাইমে? আমরা ইলেকট্রনিক্স ফ্যাক্টরিটা স্থাপন করতে চাইছি না।

মেগান বললেন, আরও অনেক কিছু আমরা চাই, এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে।

প্রধানমন্ত্রী বললেন– একটা ছোট্ট সমস্যা আছে।

–কী সমস্যা? আমরা কি পরে কথা বলব?

–মিস স্কট, স্পেনের আভিজাত্য এবং সম্মানকে আমরা এভাবে বিক্রি করতে পারি না। কেউ ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়ে কোনো কাজ করাবে তা পারবে না। আমাকে বিশ্বাস করুন, আপনি এখানে এসেছেন, একটা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, তাই তো? না, আপনার ফ্যাক্টরি এখানে করার দরকার নেই।

মেগান ভাবলেন, ব্যাপারটা আরও খারাপ হয়ে গেল।

 ছ সপ্তাহ ধরে এই বিচার চলেছিল।

মেগান পুরো সময়টা মাদ্রিদে ছিলেন। প্রত্যেক দিন খবর সংগ্রহ করতেন। মাইক রসনের সঙ্গে কথা হত।

বন্ধু, এবার মনে হয় আপনার চলে আসা উচিত।

–মনের দিক থেকে সায় পাচ্ছি না।

মেগান চেষ্টা করলেন জাইমের সঙ্গে দেখা করতে।

বিচারের শেষ দিন, মেগান কোর্টঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাজার মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেছেন। সাংবাদিকরা এসেছেন। মেগান থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।

–কী হয়েছে?

–জাইমেকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে।

.

৪২.

ঠিক করা হল, সকাল পাঁচটার সময় ফাঁসির আদেশ কার্যকর হবে। অনেক মানুষের ভিড় জমেছে মাদ্রিদে। কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে। ব্যারিকেড করা হয়েছে। জনগণ যাতে উন্মত্ত না হয়ে উঠতে পারে, তার ব্যবস্থা। চারপাশে সশস্ত্র প্রহরা।

জেলখানার ভেতর মাঝে মধ্যেই বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী লিও পোলডো মার্টিনেজ নিজে এসেছেন। জি ও ইর নতুন প্রধান আলোনজো সেবাসটিয়ান। তার পাশাপাশি আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।

ওয়ার্ডেন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। সারা জীবন তিনি সরকারকে সাহায্য করে গেছেন। দুষ্কৃতিদের ধরেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন– দেখুন, সব ব্যাপারটা যেন নিখুঁতভাবে হয়। মিনোর ফাঁসির ব্যাপারে কোনো গোলমাল হলে সাংঘাতিক অবস্থা হবে।

আধিকারিকরা বললেন– আমরা সব বিপদের সম্ভাবনাকে খুঁটিয়ে দেখছি। আপনি এ বিষয়ে কিছু চিন্তা করবেন না।

জেলখানার ভেতর রক্ষী থাকবে তো?

–হ্যাঁ, এখন প্রহরা আরও বেশি করা হয়েছে। জাইমে মিরোকে একটা সিকিউরিটি, সেলের ভেতর আটকে রাখা হয়েছে। তিন তলাতে। অন্য বন্দীদের অন্য সেলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুজন সশস্ত্র প্রহরীকে সব সময়ের জন্য রাখা হয়েছে। আমি লকডাউনের ব্যবস্থা করেছি। এই ফাঁসির আদেশ কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত কড়াকড়ি ব্যবস্থা চালু থাকবে।

প্রধানমন্ত্রী খুশি হয়েছেন। ঠিক আছে, কোথাও কোনো ত্রুটি চোখে পড়ছে না।

এভাবেই অধিবেশনটা শেষ হয়ে গেল।

.

সকাল সাতটা বেজে তিরিশ মিনিট। জেলখানার সামনে ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে।

কিছু দেবেন কি?

 জেলখানার একজন রক্ষী জানতে চাইল।

ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে সে বলল- আপনি কি এখানে নতুন এসেছেন?

-হ্যাঁ, জুলিও কোথায়?

–ও আজ অসুস্থ।

আজ সকালে কোনো কিছু দেব না, বিকেলে আসব।

 কিন্তু রোজ সকালে

 –হ্যাঁ, আজ দেবার কিছুই নেই।

ট্রাকটা ধীরে ধীরে রাস্তার মধ্যে হারিয়ে গেল। ওয়ার্ডেনের কাছে খবর পৌঁছে গেল।

সকাল আটটা বেজেছে। রাস্তাতে একটা গাড়িবোমা ফাটল। বেশ কয়েকটা গাড়িতে আগুন লেগে গেছে। সাধারণ অবস্থা হলে হয়তো প্রহরীরা খুব একটা সতর্ক হত না। কিন্তু এখন ওপরতলার কড়া নির্দেশ আছে। তারা তল্লাসি করতে শুরু করল।

ওয়ার্ডেনের কাছে খবর পৌঁছে গেল।

ওয়ার্ডেন বললেন- ওরা শেষ মুহূর্তে আঘাত হানতে পারে। আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।

.

সকাল নটা বেজে পনেরো মিনিট। একটা হেলিকপ্টারকে দেখা গেল জেলখানার ওপর উড়ে যেতে। তার গায়ে লেখা আছে স্পেনের সবথেকে বিখ্যাত সংবাদপত্রের নাম। সঙ্গে সঙ্গে দুটি অ্যান্টি এয়ারক্রাফট বন্দুক উন্মুখ হয়ে রইল। লেফটেন্যান্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি পতাকা ওড়ালেন। হেলিকপ্টারটিকে সংকেত করলেন।

ফোন করা হল, ওয়ার্ডেন, মাথার ওপর একটা কপ্টার উড়ছে।

–কোনো চিহ্ন?

–মনে হচ্ছে, সব থেকে বিখ্যাত কাগজ লা প্ৰেনসা, কিন্তু নতুন রং করা হয়েছে।

একটা গুলি করা। যদি না মরে তা হলে আকাশের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটাও।

—ঠিক আছে।

গুলি করা হল। পাইলটের ভয়ার্ত মুখছবি। আবার গুলি করা হল। হেলিকপ্টারটা আকাশে হারিয়ে গেল।

লেফটেন্যান্ট ভাবলেন, এবার আর কী ঘটনা ঘটবে?

.

সকাল এগারোটা, মেগান স্কট জেলখানার রিসেপশন অফিসে হাজির হয়েছেন। তাকে অত্যন্ত বিবর্ণ দেখাচ্ছে।

–আমি ওয়ার্ডেনের সঙ্গে দেখা করতে চাইছি।

–আপনার কি অ্যাপয়ন্টমেন্ট করা আছে নাকি?

–না, তা হলে?

–আমি দুঃখিত, ওয়ার্ডেন আজ সকালে কারও সঙ্গে দেখা করবেন না। আপনি বরং বিকেলে ফোন করুন।

-বলুন মেগান স্কট এসেছেন।

ভদ্রলোক মেগানের দিকে তাকালেন। তা হলে? ইনি হলেন সেই বিখ্যাত আমেরিকান ভদ্রমহিলা যিনি জাইমে মিরোকে ছাড়াবার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। আহা, উনি বললেন আচ্ছা, আমি ওয়ার্ডেনকে বলছি।

পাঁচ মিনিট কেটে গেছে। মেগানকে দেখা গেল ওয়ার্ডেনের অফিসে বসে থাকতে। বেশ কয়েকজন আধিকারিক সেখানে পৌঁছে গেছেন।

মিস স্কট আপনার জন্য কী করতে পারি?

আমি জাইমে মিরোর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

দীর্ঘশ্বাস– না, সেটা সম্ভব নয়।

কিন্তু

–মিস স্কট, আমরা সকলেই আপনার পরিচয় জানি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা কোনো সাহায্য করতে পারব না। আমরা, স্পেনদেশীয় বাসিন্দারা সকলের আভিজাত্য এবং পদমর্যাদা বুঝতে পারি। আমাদের মনেও আবেগ আছে, মাঝে মধ্যে আমাদের এমন একটা অবস্থার সামনে দাঁড়াতে হয়, সব আবেগকে হত্যা করতে হয়।

ভদ্রলোকের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে কিন্তু আজ, মিস স্কট, আজ একটা বিশেষ দিন, অনেক বছর ধরে আমরা ওই লোকটিকে অনুসন্ধান করেছি। আজ সব নিয়মনীতি মেনে চলতেই হবে। তাই জাইমে মিরোর সঙ্গে সাক্ষাৎকার হবে না।

মেগান চেষ্টা করলেন– আমি কি এক মুহূর্তের জন্যও দেখা করতে পারব না?

 প্রিজন বোর্ডের একজন সদস্য কথাটা ভাবলেন। মেগানের মুখে উদগ্রীব উৎকণ্ঠা।

–আমি দুঃখিত, ওয়ার্ডেন বললেন।

–আমি কি একটা খবর পাঠাতে পারি? কণ্ঠস্বর আবেগে বুজে আসছে।

–একটা মৃত লোককে খবর পাঠিয়ে কী লাভ? এক ঘন্টা সময় আছে। তারপর তো এই পৃথিবীতে জাইমে মিরো বলে কেউ থাকবে না।

কিন্তু, এখনও সময় আছে, যদি একদল বিচারক আবার নতুন করে রায় ঘোষণা করেন?

 –সেটা হওয়া সম্ভব নয়। আমি পনেরো মিনিট আগে খবর পেয়েছি। প্রাণভিক্ষার জন্য মিরোর শেষ আবেদন অগ্রাহ্য করা হয়েছে। সুতরাং ফাঁসির ঘটনা ঘটবেই।

তিনি উঠলেন, সকলে তাকে অনুসরণ করলেন। মেগান তাকালেন ঠিক আছে, ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন।

মেগান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

.

বারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকি আছে। জাইমে মিরোর সেলের দরজা খুলে গেল। ওয়ার্ডেন এবং তার দুই সহকারী ভেতরে ঢুকলেন। চারজন সশস্ত্র প্রহরীকে দেখা গেল।

ওয়ার্ডেন বললেন- সময় হয়েছে।

জাইমে তার বিছানা থেকে উঠলেন। তার হাতে হাতকড়া, পায়ে লোহার বেড়ি ঠিক আছে, আমি প্রস্তুত।

জাইমে ফাঁকা করিডরের দিকে এগিয়ে গেলেন। এত শেকল থাকাতে ভালোভাবে হাঁটতে পারছেন না। চারপাশে সশস্ত্র প্রহরা।

জাইমে বললেন- কোথায় যাব?

ওয়ার্ডেন বললেন- ফসি কাঠের দিকে।

ব্যাপারটা বলতে খারাপ লাগে। কিন্তু কোনো উপায় নেই। এভাবেই এক-একজনকে ফাঁসি দেওয়া হবে। জনগণের চোখের বাইরে, সাংবাদিকরা প্রবেশ করতে পারবেন না।

করিডর দিয়ে সেই মৃত্যুকালীন শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে। বাইরে হাজার লোকের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। জাইমে–জাইমে–জাইমে-মনে হচ্ছে, শব্দ যেন আক্রমণ করছে।

–ওরা আপনাকে ডাকছে, একজন রক্ষী বললেন।

না, ওরা নিজেরা সাহস পাওয়ার চেষ্টা করছে। ওরা স্বাধীনতার জন্য চিৎকার করছে। পরবর্তীকালে ওরা হয়তো অন্য কারো নামে জয়ধ্বনি দেবে। আমি মারা যাব, কিন্তু সংগ্রাম চলতে থাকবে।

দুজন সিকিউরিটি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ছোট্ট একটা চেম্বার আছে। তার পাশে লোহার দরজা।

–ঠিক সময়ে আমি এসে গেছি, তাই তো?

–ভদ্রলোক এসে গেছেন ফাদার, ওয়ার্ডেন বললেন, ফাদার, আপনি কিন্তু তার সামনে এগোবেন না।

কিন্তু, আমাকে যে—

–শেষ প্রার্থনা? বন্ধ ঘরের মধ্যে থেকে তা বলতে হবে।

 একজন দরজাটা খুলে দিল। ফাদার ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চারপাশে সশস্ত্র প্রহরা। ভদ্রলোকের চেহারাটা বিশাল।

ওয়ার্ডেন মাথা নাড়লেন। জাইমেকে দাঁড় করিয়ে রাখা হল। প্রহরীরা বাইরে। সবুজ দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

ঘরের ভেতর কয়েকজন সহকারী বসে আছেন। হাতের শেকল খুলে দেওয়া হল। তারপর? দড়ি দিয়ে বাধা হল জাইমেকে।

ওয়ার্ডেন জাইমের দিকে তাকালেন। বললেন- কোনো অসুবিধা নেই। আপনি কী বলছেন ভগবান তা শুনতে পাবেন।

–আপনি কি মুখে কাপড় চাপা দিতে চাইছেন?

ওয়ার্ডেন জানতে চাইলেন।

না।

ওয়ার্ডেনকে অবাক দেখাল।

 বাইরে জনগণের চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

পাঁচ মিনিট কেটে গেছে। সবুজ দরজা খুলে গেল।

 ডাক্তার বললেন- এবার সময় হয়েছে।

সব কিছু পরপর ঘটে যাচ্ছে। জাইমে মিরোর দেহটা বন্দীশালার পেছন দিকে নিয়ে আসা হবে। তারপর একটা ভ্যানের ওপর তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু, যে মুহূর্তে প্রহরীরা তৎপর হয়ে উঠল, জনগণ উন্মত্ত হয়ে খেপে উঠেছে।

কণ্ঠস্বর ক্রমশ উচ্চকিত হয়ে উঠছে। পুরুষ এবং নারীরা বুক চাপড়ে আর্তনাদ করছে। ছোটো ছেলেরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। কী ঘটছে তারা বুঝতে পারছে না।

ড্রাইভার বলল– কীভাবে যাব বুঝতে পারছি না।

.

দুপুর দুটো বেজেছে। সকলে প্রধানমন্ত্রী মাটিনেজের কাছে হাজির হয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বললেন– আমি সকলকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। কাজটা নিখুঁতভাবে সম্পূর্ণ করার জন্য।

ওয়ার্ডেন বললেন- প্রধানমন্ত্রী, আমরা এখানে এসেছি পদত্যাগ করার জন্য।

মার্টিনেজ অবাক হয়ে গেলেন- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কী হয়েছে?

-এটা মানবিকতার ব্যাপার হে মহামান্য প্রধানমন্ত্রী, একটা মানুষকে এভাবে হত্যা করা উচিত কি? হয়তো হত্যাই তার কাজের একমাত্র দণ্ড। কিন্তু এইভাবে? এটা নৃশংস, আমরা কেউ সমর্থন করতে পারছি না।

–আরও একবার চিন্তা করা উচিত। আপনাদের ভবিষ্যৎ, আপনাদের পেনশন।

না, আমরা বিবেক নিয়ে বাঁচতে চাই। ওয়ার্ডেন তিনটে কাগজ প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিলেন- এখানে আমাদের পদত্যাগপত্র আছে।

.।

রাত হয়েছে, ভ্যান ধীরে ধীরে ফরাসি সীমান্তে পৌঁছে গেল। সেখানে একটা ফার্ম হাউস আছে।

এটাই হল আসল জায়গা। লাশটাকে সরিয়ে ফেলতে হবে। না হলে পচা গন্ধ বেরোবে।

ফার্ম হাউসের দরজা খুলে গেল। এক ভদ্রমহিলা, মধ্য পঞ্চাশ, জিজ্ঞাসা করলেন আনা হয়েছে?

-হ্যাঁ, ম্যাডাম। কোথায় এটাকে রাখা হবে?

–পার্লারের মধ্যে।

–ঠিক আছে। কবর দিতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না।

ভদ্রমহিলা দেখলেন একটা দেহকে ব্যাগের মধ্যে পুরে আনা হয়েছে।

–অনেক ধন্যবাদ।

লোক দুটো চলে গেল। ভদ্রমহিলা তাকিয়ে আছেন।

পেছনের ঘর থেকে আর একজনকে দেখা গেল। এবার ব্যাগটা খুলে ফেলা হল। জাইমে মিরো শুয়ে আছেন। হেসে বললেন– সব ব্যাপারটা অলৌকিক। কিন্তু যদি সত্যি সত্যি হত?

মেগান জানতে চাইলেন- কী খাবে? হোয়াইট ওয়াইন, নাকি রেড?

.

৪৩.

মাদ্রিদের বারাজাস এয়ারপোর্ট। প্রাক্তন ওয়ার্ডেন গোমেজ এবং তার প্রাক্তন সহকারীরা দাঁড়িয়ে আছেন।

মনে হচ্ছে, এইভাবে কাজটা না করলেই বোধহয় ভালো হত। পঞ্চাশ লক্ষ ডলার, আমরা একটা গোটা দ্বীপ কিনতে পারব।

একজন বললেন- আমি সুইজারল্যান্ড যাব, সেখানে অনেকগুলো গ্লেসিয়ার কিনব।

আলোচনা এগিয়ে চলেছে।

একজন বললেন আমি একটা হাসপাতাল খুলব। মেগান স্কটের এই দানটা আগেই গ্রহণ করা উচিত ছিল। শেষ পর্যন্ত ভাবলাম, ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাছাড়া একটা কথা বলব, আমি কিন্তু জাইমে মিরোকে সত্যি ভালোবাসি।

.

৪৪.

ফরাসি দেশ, সুন্দর আবহাওয়া, চারপাশে সোনালি ফসলের হাতছানি। আহা, প্রতিবছর মানুষের সুখ যেন উপছে ওঠে, রুবিও আরজানো ভাবলেন, কী সুন্দর এই প্রকৃতি!

প্রথম বিয়ে, এক বছর আগে, যমজ সন্তানের জন্ম, একটা মানুষ কি এত সুখী হতে পারে?

বৃষ্টি পড়তে শুরু করল, রুবিও ট্রাক্টরের ওপর চড়ে বসেছেন। অনেক কাজ বাকি আছে। যমজ দুই শিশুর কথা ভাবছেন। ছেলেটা বড়ো হয়ে একজন শক্তিশালী কৃষক হয়ে উঠবে। কিন্তু বোনটি? সে কী করবে? সে কি তার মনের মানুষকে কষ্ট দেবে?

ট্রাক্টরটা শব্দ করে এগিয়ে চলেছে।

লুসিয়া হাসলেন তুমি ঠিক সময়ে এসে গেছে। ডিনার তৈরি।

.

মাদাম প্রাওরেস বেটিনার দিন কাটছে অস্থিরতার মধ্যে। এমন কিছু ঘটনা ঘটে গেছে, যা তার বিশ্বাসের বাইরে।

অনেক দিন বাদে সিস্টারসিয়ান কনভেন্ট আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। স্বয়ং রাজা ডন জুয়ান কারলোস নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সিস্টার গ্রাসিলা এবং অন্যান্য সিস্টারদের মাদ্রিদে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে আবার তারা নৈঃশব্দ্যের জগতে ফিরে গেছেন।

প্রাতরাশ শেষ হয়ে গেছে। মাদার প্রাওরেস দাঁড়িয়ে আছেন তার অফিসে। তার টেবিলের ওপর পড়ে আছে ওই সোনার ক্রশটি।

আহা, পৃথিবীতে কত অলৌকিক ঘটনাই না ঘটে যায়।

.

শেষ কথা

১৯৭৮– মাদ্রিদ শহরে কিছুটা শান্তি ফিরে এসেছে। বাসকোদের হাতে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার তুলে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা নিজস্ব পতাকা তুলতে পারবেন। নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করতে পারবেন। একটা আলাদা পুলিশ প্রশাসন দেওয়া হবে। ই টি এন-র সঙ্গে সরকারের সম্মানজনক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। মাদ্রিদের মিলিটারী গভর্ণর পদত্যাগ করেছেন। ফ্রাঙ্কো যাঁকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন, সেই লুইস ব্ল্যাঙ্কা এখন দায়িত্ব নিয়েছেন।

হিংসার ঘটনা ক্রমশ কমে আসছে।

গত তিনবছরে ই-টি-এন-র সন্ত্রাসবাদীরা ছশো জনকে হত্যা করেছিলেন। বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। ই-টি-এন এখন অনেক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। কম করে পঁচিশ লক্ষ বাসকো সমর্থক। এখন চোরাগোপ্তা আক্রমণ কমে এসেছে।

অপাস মুনডোর কাজ আরও বেড়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কেউ আলোচনা করতে চান না।

.

সিস্টারসিয়ান কনভেন্ট আগের মতোই নির্দিষ্ট নিয়মনীতি মেনে এগিয়ে চলেছে। সারা পৃথিবীতে তার শাখা ছড়িয়ে পড়েছে। স্পেনেই আছে সাতটি।

সেখানে একই রকমভাবে ঈশ্বরের বন্দনা করা হয়, রাতের অন্ধকারে নৈঃশব্দ্যের প্রহর ঘনীভূত হয়ে ওঠে।

 হায়, সময়ের বালুকাবেলায় কত না পদচিহ্ন আঁকা হয়। মানুষের ছোটো ছোটো সুখ দুঃখের জলছবি–মহাকাল শুধু তাকিয়ে থাকে, কোনো ব্যাপারেই সে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হয় না।