৫১.
রবার্টের জীবন বেঁচে গেল। যে মুহূর্তে লিপো ট্রিগারে হাত দিয়েছিলেন, আলোর বিচ্ছুরণ, এক মুহূর্তের জন্য। রবার্ট সরে গেলেন। বুলেটটা তার ডান হাতে লাগল। না, মুখে লাগেনি।
লী আবার বন্দুকটা তুলেছেন, আবার আঘাত হানতে হবে। রবার্ট আঘাত করলেন, বন্দুকটা লী-র হাত থেকে ছিটকে পড়ল। লী, রবার্টের সঙ্গে লড়বার চেষ্টা করলেন। না, রবার্টের যন্ত্রণা হচ্ছে। তার জ্যাকেট রক্তে ভিজে গেছে। তিনি সামনের দিকে ঘুষি মারলেন। লীর মুখে যন্ত্রণার ছাপ। হ্যাঁ, এবার লোকটাকে মেরে ফেলতে হবে। রবার্ট বারবার ঘুষি মারতে থাকলেন। একে অন্যকে আঘাত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কেউ ঠিকমতো সুযোগ পাচ্ছেন না।
না, কে এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জিতবেন?
সময় বোধহয় লী-কে সাহায্য করেছিল। রবার্ট ভাবলেন, তিনি সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে লীকে লাথি মারলেন। লীও বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। রবার্ট নিজেকে সরিয়ে দিলেন। জোর মারামারি শুরু হয়ে গেছে।
লী সামনের দিকে তেড়ে এসেছেন। তারপর? দুজন গ্লাস টেবিলের কাছে পৌঁছে গেছেন। রবার্ট মাটিতে পড়ে গেলেন। নড়তে চড়তে পারছেন না। রবার্ট ভাবলেন, ওরা জিতে গেছে, আমি হেরে গেছি। চেতনা হারাচ্ছি। লী এবার খেলাটা শেষ করবেন। নাঃ, কিছু ঘটল না। রবার্ট মাথা তুললেন। লী পাশে শুয়ে আছেন। চোখ দুটো খোলা, সিলিং-এর দিকে তাকানো, কাঁচের টুকরো ঢুকে গেছে তার বুকের মধ্যে।
রবার্ট বসে থাকার চেষ্টা করলেন। অসম্ভব যন্ত্রণা। এক্ষুনি একজন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। একটা নাম মনে পড়ল এজেন্সি নামটার কথা বারবার বলত, আমেরিকান হসপিটাল, হিলসিনজার লিয়ন হিলসিনজার।
ডাঃ হিলসিনজার এবার বাড়ি যাবেন। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। নার্স চলে গেছে। উনি ফোনটা তুললেন- ডাঃ হিলসিনজার বলছি।
–আমি রবার্ট বেলামি, আপনার সাহায্য চাইছি। ভীষণ আঘাত পেয়েছি আমি। আপনি কি সাহায্য করবেন?
–আপনি কোথায়?
–আমি আধঘন্টার মধ্যে আমেরিকান হাসপাতালে আসছি।
–আমি পৌঁছে যাব, এমারজেনসি রুমে চলে যাবেন।
–ডাক্তার, এই ফোনের কথা কাউকে বলবেন না।
আমি কথা রাখার চেষ্টা করব।
ডাক্তার হিলসিনজার একটা নাম্বারে ফোন করলেন।
কমান্ডার বেলামির কাছ থেকে একটা ফোন এসেছে। আমি আধঘন্টার মধ্যে আমেরিকান হাসপাতালে পৌঁছে যাব।
ধন্যবাদ ডাক্তার।
ডাক্তার হিলসিনজার রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। রিসেপশন দরজা খুলে গেল। রবার্ট বেলামি দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে একটা বন্দুক।
রবার্ট বললেন– ভাবলাম, এখানেই আমার চিকিৎসা হলে ভালো হয়।
ডাক্তার অবাক হয়ে গেছেন, উনি বললেন- আপনার তো হাসপাতালে যাবার দরকার ছিল। •
হা, হাসপাতালটা মর্গের খুব কাছাকাছি, তাই না?
ডাঃ হিলসিনজার বাধা দেবার চেষ্টা করলেন। বললেন- ঠিক আছে, আমি আপনাকে ঘুমের ওষুধই দেব।
না, চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। বাঁ হাতে বন্দুকটা ধরা। যদি আমি এখান থেকে বেঁচে বেরোতে না পারি, তাহলে আপনাকে বাঁচিয়ে রাখব না।
…তাহলে এখনই কাজ শুরু করুন।
হিলসিনজার পাশের ঘরে রবার্টকে নিয়ে গেলেন। এখানে বিভিন্ন ওষুধপত্র আছে। রবার্ট জ্যাকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে রেখেছেন, বন্দুকটা এখন হাতে ধরা আছে। হিলসিনজার হাতে একটা যন্ত্র নিয়েছেন। রবার্টের আঙুল ট্রিগারে চাপা।
হিলসিনজার বললেন- আমি শার্টটা কেটে ফেলব।
-হ্যাঁ, আঘাতটা টাটকা। বুলেটটা এখনও ওখানে আছে।
হিলসিনজার বললেন আমি আপনাকে ঘুমের ওষুধ দেব।
-না, এক্ষুনি এটা বার করে দিন।
ডাক্তার পাশের ঘরে চলে গেলেন। একটা কাচি তিনি নিয়ে এসেছেন। রবার্ট ঘুমের সঙ্গে লড়াই করার চেষ্টা করছেন। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আঃ, ডাঃ হিলসিনজার দাঁড়িয়ে আছেন।
উনি ফরসেপটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। রবার্ট চিৎকার করছেন। আলো জ্বলে উঠল চোখের সামনে। না, আর বোধহয় বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
-ওটা বেরিয়ে এসেছে। ডাক্তার হিলসিনজার বললেন।
রবার্ট দাঁড়িয়ে আছেন, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছেন।
ডাক্তার হিলসিনজার বললেন- আপনি ঠিক আছেন?
রবার্ট তার হারানো কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়েছেন- হ্যাঁ, ব্যান্ডেজটা বেঁধে দিন।
ডাক্তার পার-অক্সাইড ঢুকিয়ে দিলেন। রবার্ট দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁতে দাঁত চেপে। আঃ, ডাক্তার ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন।
–আমার জ্যকেটটা ফেরত দিন।
–আপনি এখান থেকে যেতে পারবেন না।
–আমার জ্যাকেটটা ফেরত দিন। কণ্ঠস্বর ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে।
অনেকটা রক্ত পড়ে গেছে, এখান থেকে গেলে আপনি বাঁচবেন না।
রবার্ট জানেন, ওখানে থাকলে আরও ক্ষতি হবে। পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। টেবিলের একধারে পড়ে গেলেন।
ডাক্তার হিলসিনজার আবার বললেন- ওঠার চেষ্টা করবেন না।
রবার্টের চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আমাকে যেতেই হবে।
উনি জানেন, চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার হিলসিনজার আবার ফোন করবেন। রবার্টের চোখে একটা সার্জিক্যাল টেপ পড়ে গেল। হিলসিনজার এটা ব্যবহার করেছিলেন।
চেয়ারে বসুন।
–কেন?
রবার্ট তাঁর বন্দুকটা তুললেন, বসুন।
হিলসিনজার বসলেন। রবার্ট টেপটা খুললেন। আঃ, এখন এই অস্ত্রটাই হাতে আছে আমার। সেটা মস্ত বড়ো হয়ে গেছে। তিনি হিলসিনজারের কাছে গেলেন চুপচাপ বসে থাকুন। আমি কোনো ক্ষতি করব না।
টেপ দিয়ে ডাক্তারের হাত দুটো বাঁধলেন, চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে দিলেন।
–এটা কি সত্যি দরকার ছিল? আমি কিছুই করতাম না।
চুপ করে বসে থাকুন।
ডাক্তারের দিকে তাকালেন, মনে হল, এবার বোধহয় উনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন।
.
মহাশূন্যে যেন ভেসে চলেছেন, মেঘের রাজত্বে। কে যেন বলল- জেগে ওঠো, জেগে ওঠো। কে বলল? জ্যাকেটের পকেটে কিছু একটা রয়েছে। চোখ দুটো বন্ধ, টিস্টাল, ঘুম থেকে আবার জাগরণ।
রবার্ট? এক মহিলার কণ্ঠস্বর। শান্ত এবং সৌন্দর্যে ভরা।
রবার্ট এখন একটা শান্ত সবুজ উদ্যানে একা। বাতাসে সংগীতের শব্দ। উজ্জ্বল আলোর নিশানা চারদিকে। এক মহিলা তার সঙ্গে উড়ে চলেছে। লম্বা এবং আকর্ষণীয়া। মুখখানা গোল। অপূর্ব গায়ের রং। তুষার সাদা গাউন তার পরনে। কণ্ঠস্বরে মাদকতা আছে।
-রবার্ট, তোমাকে আর কেউ কোনোদিন আঘাত করতে পারবে না। তুমি এসো, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি।
রবার্ট চোখ খুললেন। অনেকক্ষণ সেখানে বসে ছিলেন। হঠাৎ মনের ভেতর উত্তেজনা, হ্যাঁ, একাদশ প্রত্যক্ষদর্শী? বোঝা গেছে। কোথায় গেলে তার সঙ্গে দেখা হবে।
.
৫২.
তেইশ নম্বর দিন, প্যারিস, ফ্রান্স। অ্যা
ডমিরাল হুইট্যাকারকে ফোন করা হল। ডাক্তারের অফিস থেকে।
–অ্যাডমিরাল, আমি রবার্ট বলছি।
কী হচ্ছে, রবার্ট?
–আপনি কি জানুসের নাম শুনেছেন?
অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার বললেন কেন? না, শুনিনি।
রবার্ট বললেন তিনি হলেন এক সিক্রেট সংস্থার প্রধান। সাধারণ মানুষকে হত্যা করাটাই তার কাজ। তিনি এখন আমাকে হত্যা করতে চাইছেন। তাকে থামাতেই হবে।
কীভাবে তোমাকে সাহায্য করব?
–প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বসতে হবে। আপনি কি একটা মিটিং-এর ব্যবস্থা করতে পারবেন?
কিছুক্ষণ নীরবতা।
–আমি ঠিক জানি না। চেষ্টা করতে পারি।
–জেনারেল হিলিয়াড এই ব্যাপারে যুক্ত আছেন।
–কীভাবে?
–আরও অনেকে যুক্ত আছেন। ইউরোপের প্রায় সব কটি দেশের ইনটেলিজেন্স সংস্থা একসঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আমি বেশি কথা বলতে পারছি না। শুধু হিলিয়াডকে বলবেন, আমি এগারো নম্বর প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান পেয়েছি।
কীসের এগারো নম্বর প্রত্যক্ষদর্শী?
–অ্যাডমিরাল, আর বেশি কিছু বলতে পারছি না। হিলিয়াড ব্যাপারটা জানেন। তিনি যেন আমার সঙ্গে সুইজারল্যান্ডে আসেন।
সুইজারল্যান্ড?
একমাত্র আমিই এগারো নম্বর প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান পেয়েছি। উনি যদি কথা না শোনেন, তা হলে গোলমাল হয়ে যাবে। আমি জুরিখে যাচ্ছি, তার জন্য অপেক্ষা করব। বলবেন, জানুস যেন সুইজারল্যান্ডে আসেন। নিজে।
রবার্ট, তুমি কী করছ, বুঝতে পারছ তার পরিণতি কী হবে?
-হা, আমি দুটো বিষয়ে বলতে চাইছি, দুটো শর্ত, আমাকে সুইজারল্যান্ডে নিরাপদে পৌঁছোতে হবে। জেনারেল হিলিয়াড এবং জানুস যেন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আর একটা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলব।
রবার্ট, আমি সবরকমভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করব। কীভাবে তোমার সঙ্গে দেখা করব?
–আমি আপনাকে ফোন করব?
কতক্ষণ সময় লাগবে?
–এক ঘণ্টা, ঠিক আছে?
রবার্ট?
–হ্যাঁ, ঠিক আছে। মনে রাখবেন, আমি এখনও বেঁচে আছি। আমাকে আর দুঃখ দেবেন না!
.
এক ঘণ্টা কেটে গেছে। রবার্ট আবার অ্যাডমিরাল হুইট্যাকারের সঙ্গে কথা বললেন।
জেনারেল হিলিয়াডকে মনে হল, এই খবর শুনে খুব ভয় পেয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, তোমার কোনো ক্ষতি করা হবে না। তোমার শর্তগুলো মেনে নেওয়া হবে। তিনি জুরিখের দিকে উড়ে চলেছেন। কাল সকালে পৌঁছে যাবেন।
জানুস?
জানুস একই প্লেনে থাকবেন।
রবার্টের মনে শান্তি–ঠিক আছে, অ্যাডমিরাল। আর প্রেসিডেন্ট?
–আমি নিজে কথা বলেছি, তুমি কোথায় তার সঙ্গে কথা বলবে?
–হায় ঈশ্বর। ধন্যবাদ।
–জেনারেল হিলিয়াডের একটা প্লেন আছে সেটা তোমাকে উড়িয়ে আনবে?
না, আমি প্যারিসে আছি, আমার একটা গাড়ি চাই। আমি নিজেই চালাব। আমি হোটেল লিটারেতে আছি।
–আমি দেখছি, কী করা যায়?
.
রাস্তার ধারে রবার্ট হাঁটছেন। হোটেলের দিকে এগিয়ে গেলেন। একটা কালো মার্সিডেজ সেডান গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে কেউ নেই। সাদা কালো পুলিশ কার তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইউনিফর্ম পরা পুলিশম্যান হুইলের ধারে বসে আছেন। দুজন সাদা পোশাক পরা পুলিশ। রবার্ট এলেন। ফরাসি সিক্রেট সার্ভিসের লোক। রবার্টের মনে হল, আবার কোনো সমস্যা দেখা দেবে নাকি? আমি কি আবার ফাঁদে পড়ে গেলাম? একটাই মাত্র বাঁচার রাস্তা আছে। এগারো নম্বর প্রত্যক্ষদর্শী, হিলিয়াড কি বিশ্বাস করবেন? এটাই কি যথেষ্ট।
উনি সেডানের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার দিকে তাকিয়ে আছে সব কিছু।
রবার্ট ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসলেন। ভেতর দিকে তাকালেন– হ্যাঁ, চাবি আছে।
ড্রাইভারের সিটের দিকে তাকালেন কে? জেনারেল হিলিয়াড কি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন? নাকি অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার? এখন একটা ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটবে।
উনি চাবিটা ঘোরালেন। ইনজিনটা প্রাণ পেয়েছে। হ্যাঁ, সিক্রেট সার্ভিসের লোকেরা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওরা কেউ বাধা দিচ্ছে না। রবার্ট আরও সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। পুলিশের একটা গাড়ি সামনে এল। না, থামানো হল না। লাল আলো জ্বেলে গাড়িটা চলে গেল। মনে হচ্ছে সব ট্রাফিক বোধহয় গলে যাবে। না, শেষ পর্যন্ত ওরা আমায় বিশ্বাস করেছেন।
মাথায় হেলিকপ্টারের শব্দ। রবার্ট তাকিয়ে দেখলেন। লেখা আছে ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল পুলিশ। হিলিয়াডকে দেখা গেল। তিনি কি সুইজারল্যান্ডে এসে গেছেন? আমার শেষ প্রত্যক্ষদর্শী!
.
রবার্ট বিকেল চারটের সময় সুইজ সীমান্তে পৌঁছে গেলেন। ফরাসি পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। ওদিকে সুইজ পুলিশের গাড়ি। কোনো অসুবিধা হল না। রবার্ট এগিয়ে চলেছেন। ধন্যবাদ অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার, শেষ অব্দি আমি বাঁচার একটা পথ পেয়েছি। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে হবে। জেনারেল হিলিয়াড বোধহয় এখন আর আমার ক্ষতি করতে পারবেন না। মনে পড়ল, সাদা পোশাক পরা ওই মেয়েটিকে। উনি ওই মেয়েটির কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন।
তাড়াতাড়ি রবার্ট, আমরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
আমরা সবাই তার মানে? আরও কেউ? সকলের সাথে যোগাযোগ করতে হবে, রবার্ট ভেবেছিলেন।
.
জুরিখ। রবার্ট ডলডার গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে থামলেন। জেনারেলের জন্য একটা নোট লিখলেন।
-জেনারেল হিলিয়াড কি এসেছেন? তার হাতেই এই নোটটা তুলে দেবেন।
বাইরে চলে গেলেন। দুদিকে পুলিশ কার। তিনি ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বললেন, এখন থেকে আমি আমার নিজের ইচ্ছে মতো যাব।
. ড্রাইভার বলল- ঠিক আছে, কমান্ডার।
রবার্ট তাঁর গাড়িতে চড়ে বসলেন- উটেনডরফের দিকে এগিয়ে চলেছেন। ওই উড়ান চাকিটা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। গাড়ি এগিয়ে চলেছে। অনেক দুঃখজনক স্মৃতি মনে পড়ল। অনেকগুলো জীবন অকারণে চলে গেল।
আমি জানুসের মুখ দেখতে চাই। রবার্ট ভাবলেন এবং তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকব।
.
একই রকম সৌন্দর্য, আল্পসের গায়ে কি রক্তের ছিটে লেগেছে? গাড়িটা আরও সামনে দিকে এগিয়ে গেল। এখানেই বেকারম্যান ওই আবহাওয়া বেলুনটা দেখতে পেয়েছিলেন। তখন থেকেই দুঃস্বপ্নের সূত্রপাত হয়।
হাজার হাজার স্মৃতি, কোনটা ছেড়ে কোনটা রবার্ট মনে রাখবেন। বলা হয়েছিল, জেনারেল হিলিয়াডকে সব কথা বলতে হবে।
জেনারেল হিলিয়াডের কথা– সবকটা প্রত্যক্ষদর্শীর অনুসন্ধান করতে হবে। সকলের যাত্রা শুরু হয়েছিল জুরিখ থেকে। বার্ন, লন্ডন, মিউনিখ, রোম, অরভিয়েটো, ওয়াকো, ফোরথ স্মিথ, কিয়েভ, ওয়াশিংটন, বুদাপেস্ট- রক্তের মিছিল শুধু এগিয়ে চলেছে।
মেয়েটি অপেক্ষা করছিলেন। রবার্ট জানতেন, ওনার আসল পরিচয় কী।
রবার্ট, তুমি এসেছ, অনেক ধন্যবাদ, মেয়েটি মনে মনে বললেন।
আমি এসেছি, শেষ পর্যন্ত। কিন্তু, এ যেন অন্য জগত।
রবার্ট বললেন- কিছু লোক আমার ক্ষতি করতে চাইছে। যদি তুমি চলে যাও এখন, তাহলে ভালো হয়।
–আমি যেতে পারব না।
রবার্ট ভাবলেন, বাঁ হাত দিয়ে তার পকেট স্পর্শ করলেন। হ্যাঁ, একটা অদ্ভুত ধাতু, তার মধ্যে ওই ক্রিস্টালটা আছে।
মুখে আলো ধন্যবাদ রবার্ট।
রবার্ট হাতে করে ক্রিস্টালটা তুলে দিলেন।
রবার্ট জানতে চাইলেন– কী হল?
–আমি এখন আমার বন্ধুদের সাথে কথা বলতে পারব? তারা আমাকে সাহায্য করতে আসবেন।
জেনারেল হিলিয়াডের সেই শব্দগুলো মনে পড়ল ওরা এই গোটা গ্রহের ওপর ওদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করবে।
জেনারেল হিলিয়াড কি ঠিক কথা বলেছেন? যদি ভিনগ্রহের বাসিন্দারা সবকিছু দখল করে তা হলে কী হবে? রবার্ট ঘড়ির দিকে তাকালেন। এক্ষুনি জেনারেল হিলিয়াড এবং জানুস আসবেন। রবার্ট ভাবলেন। হ্যাঁ, হেলিকপ্টারের শব্দ শোনা গেল।
বন্ধুরা, তোমরা এসো, তোমরা সকল কিছু ধ্বংস করে দাও।
হেলিকপ্টারটা এসে গেছে।
জানুসের মুখের দিকে তাকাতে হবে একটা অদ্ভুত সম্ভাবনা।
দরজাটা খুলে গেল। সুশান বেরিয়ে আসছেন।
.
আকাশে উড়ছে এই যন্ত্রনটা। সমস্ত আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, এখন তাড়াতাড়ি করতে হবে। দূর থেকে আরও দূরে চলে যাচ্ছে স্বপ্নের পৃথিবী।
.
৫৩.
এক মুহূর্তের জন্য রবার্টের চিন্তাধারা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। হৃদয় হাজার ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। না, এই ঘটনাটা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। সুশান? সুশান এক মুহূর্ত তাকালেন, রবার্টের দিকে এগিয়ে এলেন। কিন্তু মন্টে বাঙ্কস তার হাতে হাত রেখেছেন।
রবার্ট, চলে যাও, চলে যাও। ওরা তোমায় মেরে ফেলবে।
রবার্ট সামনের দিকে এগিয়ে এলেন–হ্যাঁ, জেনারেল হিলিয়াড আর কর্নেল ফ্রাঙ্ক জনসন হেলিকপ্টার থেকে নামছেন।
জেনারেল হিলিয়াড বললেন–কমান্ডার, আমি এসে গেছি। তিনি রবার্টের দিকে এগিয়ে গেলেন। সাদা পোশাক পরা মেয়েটি, হ্যাঁ, এই বোধহয় এগারো নম্বর প্রত্যক্ষদর্শীর, তাই তো? হ্যাঁ, খেলাটা শেষ হয়ে গেল।
না, বলেছিলেন জানুসকে সঙ্গে আনবেন?
হ্যাঁ, জানুস আপনাকে দেখার জন্য উদগ্রীব।
রবার্ট হেলিকপ্টারের দিকে তাকালেন। অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার দাঁড়িয়ে আছেন।
-তুমি আমাকে দেখতে চাইছ, রবার্ট?
রবার্ট বিশ্বাস করতে পারছেন না, একটা লাল ছবি তার চোখের সামনে।
অ্যাডমিরাল সামনের দিকে এগিয়ে এলেন– আপনি কিছুই বুঝতে পারছেন না? আপনি কতগুলো জীবন নিয়ে চিন্তা করছেন। আমরা পৃথিবীকে বাঁচাতে চাইছি। এই পৃথিবীটা আমাদের, বুঝতে পারছেন?
সাদা পোশাক পরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন- যদি আপনারা যুদ্ধ করতে চান, তৈরি হোন। আমরা আপনাদের হারিয়ে দেব।
উনি রবার্টের দিকে তাকালেন– তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছ। তোমাকে আমি সন্তানের মতো স্নেহ করতাম। আমি ভেবেছিলাম, তুমি এডওয়ার্ডের জায়গাটা নেবে। তুমি কেন একাজ করলে? তুমি বাড়িতে থাকতে পারতে, বউয়ের সাথে সুখের সংসার।
অনুশোচনার সুর- না, আমার কোনো প্রিয় নোক এই কাজ করবে না।
রবার্ট দাঁড়িয়ে আছেন। কথা বলতে পারছেন না।
–তোমাদের বিয়েটা আমি ভেঙে দিয়েছিলাম। কারণ তোমার ওপর আমার অগাধ আস্থা ছিল।
–আপনি ভেঙেছেন?
হ্যাঁ, মনে আছে? সি আই এ তোমাকে পাঠিয়েছিল ফক্সের অনুসন্ধান করতে। ফক্স বলে কিছু ছিল না। আমি এইভাবে তোমার মন ভাঙতে চেয়েছিলাম।
–এসব আপনার প্রচেষ্টা? আপনি এতগুলো মানুষকে হত্যা করলেন? আপনি কি পাগল?
না, তাদের কেন মেরে ফেলা হয়েছে বলে তো? যাতে তারা আর কোনো গুজব ছড়াতে না পারে। এখন আমরা সম্পূর্ণ তৈরি। আর একটু সময় লাগবে। সেই সময়টা তুমি আমাদের দিয়েছ।
সাদা পোশাক পরা মেয়েটি সবকিছু শুনছিলেন। তিনি কিছুই বললেন না। তার ভাবনা এখন অনেক দুরে বিস্তৃত হয়েছে। এক্ষুনি ওরা আসবে।
আকাশের দিকে সবাই তাকিয়ে দেখলেন। হ্যাঁ, একটা মস্ত বড়ো সাদা মেঘ। ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসছে। তারপর? সমুদ্রে ঝড়, লস এঞ্জেলস, নিউইয়র্ক, টোকিও- হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু। দেখা যাচ্ছে, উজ্জ্বল সূর্য, মৃত পশুর মিছিল।
চিন, দাঙ্গা বেঁধে গেছে, ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষ, শুরু হয়েছে পারমাণবিক যুদ্ধ। তারপর মানুষ আবার তার আদিম অবস্থানে ফিরে গেছে।
এটা একটা কল্পনা। দৃশ্যটা হারিয়ে গেল। নীরবতা আর কিছু নেই।
অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার বললেন- কী হল? গণ আতঙ্ক। এর কোনো অর্থ আছে কি?
উনি ওই গ্রহান্তরের মানুষের কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন– আমি আপনাকে ওয়াশিংটনে নিয়ে যাব। আপনার সম্পর্কে কিছু খবর নিতে হবে। তারপর রবার্টের দিকে তাকালেন।-তুমি শেষ হয়ে গেছে। ফ্রাঙ্ক জনসনকে বললেন- হ্যাঁ, এবার আপনার দায়িত্ব।
কর্নেল জনসন পিস্তলটা বার করে নিলেন। সুশান মন্টের কাছ থেকে সরতে চাইছিলেন। রবার্টের কাছে তিনি যেতে চাইছিলেন। অ্যাডমিরাল চিৎকার করে বললেন- এক্ষুনি ওকে মেরে ফেলল।
কর্নেল জনসন বন্দুকটা তাক করলেন।
তারপর বললেন- অ্যাডমিরাল, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
অ্যাডমিরাল অবাক হয়ে গেছেন–আপনি কী বলছেন? আমি বলছি, ওকে মেরে ফেলতে।
না, আমি আপনার সংস্থায় কেন ঢুকেছি বলুন তো? আমি চেয়েছিলাম যাতে কমান্ডার বেলামিকে হত্যা না করা হয়। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তিনি রবার্টের দিকে ফিরে বললেন, দুঃখিত, আমি আপনাকে ভুল বুঝেছি।
অ্যাডমিরাল হুইট্যাকারের মুখ লজ্জায় লাল। তা হলে? আপনি ক্ষতি করেছেন? আমাদের সংস্থায়।
–এই সংগঠনের কথা বলে আর লাভ নেই? খেলাটা শেষ হয়ে গেছে, অ্যাডমিরাল।
আকাশে আলো এবং শব্দ। মস্ত বড়ো আকাশ যানটা ধীরে ধীরে নেমে আসছে। তারা সকলে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন। একটির পর একটি। আকাশটা ঢেকে গেছে।
সাদা পোশাক পরা মানুষটি রবার্টের দিকে তাকালেন। হয়তো কিছু বলার ছিল- আমি চলে যাচ্ছি, মেয়েটি বলতে চেয়েছিলেন। উনি অ্যাডমিরাল হুইট্যাকারের দিকে তাকালেন। জেনারেল হিলিয়াড এবং মন্টে বাঙ্কস, আপনারা সবাই আমার সঙ্গে আসুন।
অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার বললেন- না, আমি যাব না।
উনি হাত বাড়ালেন। এক মুহূর্ত, তারপর–তিনজন ধীরে ধীরে ওপর দিকে উঠে যচ্ছেন। কে যেন সম্মোহন করছে।
অ্যাডমিরাল চিৎকার করছেন না, আমি যাব না।
আর্তনাদের শব্দ। না, এবার কী হবে?
সুশান রবার্টের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। সত্যি, রবার্ট, তুমি ছাড়া আর কেউ এখানে নেই। হা, সকলে–সকলে চলে গেছে।
সাদা পোশাক পরা মেয়েটি ওই মহাকাশ যানে ঢুকে পড়লেন। আলো জ্বলে উঠেছে। তারপর? মহাকাশযান যাত্রা শুরু করল। তারপর ওই ছোটো জাহাজগুলো সকলের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল।
-রবার্ট! সুশান রবার্টের দিকে তাকিয়ে আছেন। সুশানের মুখে হাসি।
এভাবেই হয়তো একটা নতুন গল্প শুরু হল
লেখকের সংযোজনা— এই উপন্যাসটি লেখার সময় বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছি। অজানা উড়ন্ত চাকিকে অনেকে দেখেছেন। যাঁরা মহাশূন্যে গেছেন, তারাও দেখেছেন এই মহাকাশযানকে। বিজ্ঞান এখনও এই রহস্যের সমাধান করতে পারেনি। আমরা জানি না, সত্যি সত্যি একদিন গ্রহান্তরের জীব এসে পৃথিবীটা দখল করবে কিনা? অবশ্য এখন থেকে সেই কল্পিত দৃশ্যের কথা ভেবে ভীত সন্ত্রস্ত হবার কোনো কারণ নেই।