৩. মনের মধ্যে পবিত্র আগুনশিখা

১১. ইজে, ফ্রান্স, ১৯২৪

আট বছরের কথা মনে পড়ে যায় থেরেসার। তখন থেকেই তার মনের মধ্যে পবিত্র আগুনশিখা জ্বলে উঠেছিল। তিনি ক্যাথিড্রালে বেড়াতে যেতেন। কখনও মোনাকোতে, কখনও নোতরদামে। প্রতি রোববার ইজের চার্চে যেতেন। প্রার্থনা সভায় যোগ দিতেন।

থেরেসা থাকতেন পাহাড়ের ওপর। মধ্যযুগের এক ছোট্ট গ্রামে। গ্রামটির নাম ইজে। তারই পাশে মন্টিকারলো- এই গ্রামের চারপাশে উঁচু উঁচু টিলা। থেরেসার মনে হত, পৃথিবীর সমস্ত শান্তি এখানে সমাহিত হয়ে আছে। একেবারে ওপরে ছিল একটি মনাষ্ট্রি। তার পাশে কত কী দেখা যায়। ওই দূরে আকাশরেখা, আরও দূরে ভূমধ্যসাগরের জলরাশি।

থেরেসার থেকে এক বছরের ছোটো মনিকা, সে বোধহয় সকলের চোখের মণি। ছোটোবেলা থেকেই তার মনে হয়েছিল ভবিষ্যতে সে এক পরিপূর্ণা যুবতী হয়ে উঠবে। দূতিময় দুটি নীল চোখ ছিল তার। যখন হাসত, মনে হত, স্বর্গের সুষমা তার ওপর ঝরে পড়ছে। এরই পাশাপাশি থেরেসা। তাকে আমরা একটা কুৎসিত হাঁস বলতে পারি। এই মেয়েটিকে নিয়ে বাবা ডিফসের মনে দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। ভবিষ্যতে এই মেয়েটির কী হবে, তা নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত ছিলেন। হায় ঈশ্বর, সর্বত্র খুঁতে ভরা একটি মেয়ে। বাঁচবে কেমন করে?

ভদ্রলোকের কেবলই মনে হত, ভগবান তার সঙ্গে প্রতারণার খেলা খেলেছেন। তবে থেরেসার কণ্ঠস্বরটি ছিল ভারী সুন্দর। যখন সে কথা বলত, মনে হত স্বর্গের কোনো দেবদূতি বুঝি কথা বলছে। চার্চ কয়ারে তার গান শুনে অনেকে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। অনেকের চোখে জেগে ছিল বিস্ময়, থেরেসার বয়স বাড়ল, তার কণ্ঠস্বর আরও সুন্দর হয়ে উঠল। তখন সেই প্রার্থনা সঙ্গীতে প্রধান অংশ নিত। মনে হত সে বুঝি সংগীতের সাথে নিজের আত্মাকে মিলিয়ে দিয়েছে।

স্কুলে মনিকার অনেক বন্ধু ছিল। ছেলে এবং মেয়েরা তার চারপাশে ভিড় করত। সকলেই তার সঙ্গে খেলতে ভালোবাসত। মাঝে মধ্যে মনিকাকে বিভিন্ন পার্টিতে ডাকা হত। থেরেসাকেও বলা হত, কিন্তু অনেক ভাবনা চিন্তা করে। যেহেতু এটাও একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা। থেরেসা সেটা বুঝতে পারত।

শেষ অব্দি কেমন যেন হয়ে গেল সে। যদিও মা-বাবার দিক থেকে ঘৃণা উদাসীনতা কোনো কিছুই ছিল না। তারা তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছিলেন। তবে একথা সত্যি মনিকাকে তারা একটু বেশি ভালোবাসতেন। থেরেসার জীবনে তখন থেকে একটা বিষয়ের অভাব চোখে পড়ে। তা হল নিখাদ ভালোবাসা।

থেরেসা ছিল অনুগত বালিকা। সবাইকে খুশি করার চেষ্টা করত। গান ভালোবাসত, ভালোবাসত ইতিহাস আর বিদেশী ভাষা। স্কুলে দারুণ পরিশ্রম করত। শিক্ষিকারা বলত, মেয়েটার মাথা আছে।

শেষ অব্দি থেরেসা চার্চের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল।.যাজক তাকে খুবই ভালোবাসতেন। যিশুর কাছ থেকেও সে অদৃশ্য ভালোবাসা পেয়েছিল। রোজ সকালে মাস অনুষ্ঠানে যেত। ক্রশের চোদ্দোটা স্টেশন অতিক্রম করত। তারপর? থেরেসার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন হল। সে বোনকে ভালোবাসত। বোনের এই সাফল্যে কখনও ঈর্ষান্বিতা হয়নি।

এবার বালিকা বয়স শেষ করে তারা এল কিশোরী বেলায়। একদিন রাত্রে মা-বাবাকে তার সম্বন্ধে কথা বলতে শুনেছিল থেরেসা। বাবা চিন্তিত মনে বললেন–বড়ো মেয়েটিকে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সারা জীবন ওর ভার বহন করতে হবে।

মা জবাব দিয়েছিলেন– দেখো, একদিন থেরেসা তার মনের সাথীকে খুঁজে পাবে।

বাবা তাচ্ছিল্যতার উত্তর দিয়েছিলেন তুমি কিছু বোঝো না, সুন্দর গলা থাকলেই কি কোনো পুরুষ পছন্দ করে? তারা দেখবে মেয়েটি কেমন শয্যাসঙ্গিনী।

থেরেসা এই কথা শুনে ভয়ে পালিয়ে আসে।

***

তখনও থেরেসা প্রতি রবিবার চার্চে গান গাইছে। এই গানই তার জীবনে একটা বিরাট পরিবর্তন এনে দেয়। মাদাম তুরো, রেডিও স্টেশনের এক ডিরেকটরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। থেরেসার গলা শুনে তিনি সরাসরি থেরেসাকে রেডিওতে গান গাইবার জন্য আমন্ত্রণ জানান।

শেষ অব্দি এল সেই বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্তটি। মাইক্রোফোনের সামনে বসে থেরেসা অবাক হয়ে গিয়েছিল। এখানে কীভাবে গান গাইতে হয়, সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু সে অসাধারণ গান গাইল। তার গান শুনে সকলে বুঝতে পারল, সংগীত আকাশে এক নতুন নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে।

একদিন সকালে সে একটা টেলিফোন পেল। বলা হল, তাকে ফরাসি দেশে যেতে হবে। কে ফোন করেছেন? জ্যাকুইস রাইমু, ফরাসি দেশের অন্যতম স্টেজ ডিরেক্টর।

এই ফোন পেয়ে থেরেসা নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল সে। সব কিছুই স্বপ্ন বলে মনে হয়েছিল তার কাছে। রাইমুর ছবিতে সে অভিনয় করবে? তা কেমন করে সম্ভব?

– থেরেসার বাবা এই কথা শুনে গভীর চিন্তান্বিত হয়ে ওঠেন। তিনি বলেছিলেন, থেরেসা, থিয়েটারের মানুষজনের সঙ্গে মিশতে গেলে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।

মা বলেছিলেন–আমরা তোকে একটা নতুন পোশাক কিনে দেব। ভদ্রলোককে এখানে আমন্ত্রণ জানালে কেমন হয়।

মনিকা এই খবর শুনে কেমন একটা হয়ে যায়। যা কিছু ঘটছে সবই অবিশ্বাস্য। তার বড়দি এখন এক স্টার হবে? এটা কি বিশ্বাস করা যায়?

***

ঠিক সময়ে জ্যাকুইস রাইমু এলেন। ছোটো একটি মেয়ে তাকে অভিনন্দন জানাল। ভদ্রলোকের হৃদয় কেঁপে উঠল। আহা, সুন্দর সাদা পোশাক পরেছে। তবুও শরীরের চড়াই উৎরাইগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

ভদ্রলোক ভেবেছিলেন। এমন চেহারা আর এমন গলা, মনে হয় মেয়েটি কল্পলোকের নায়িকা হয়ে উঠবে।  

রাইমু বললেন তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে আমি নিজেকে খুবই আনন্দিত বলে মনে করছি।

মনিকা উষ্ণ হাসির টুকরো এনে বলেছিল–আপনার নাম আমি অনেকদিন ধরে শুনেছি মঁসিয়ে রাইমু। আপনাকে যে চোখের সামনে দেখতে পাব তা ভাবতেই পারিনি।

–তাহলে এসো, কথা শুরু হোক। একটা সুন্দর প্রেমের গল্প। আমার মনে হচ্ছে। থেরেসা ইতিমধ্যেই ঘরে এসে ঢুকেছে। সে জ্যাকুইস রাইমুর দিকে তাকাল।

–আমি জানি না, আপনি এসেছেন।

অবাক হয়ে রাইমু মনিকার দিকে তাকিয়ে আছেন।

মনিকা বলল ও হল আমার দিদি থেরেসা।

মুখের হাবভাব পরিবর্তিত হচ্ছে। হতাশা গম্ভীর হতাশা এবং বিষাদ।

–তাহলে তুমিই হলে সেই গায়িকা।

–হ্যাঁ।

 উনি মনিকার দিকে তাকিয়ে বললেন তাহলে তুমি কে?

মনিকা অমায়িক হাসি হেসে জবাব দিয়েছিল আমি থেরেসার ছোটো বোন।

রাইমু আবার থেরেসার দিকে তাকালেন। মাথা নাড়লেন। বললেন না, তোমাকে দিয়ে হবে না। আমার নায়িকা হবার পক্ষে তুমি এখনও উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারোনি। তুমি এখনও কিশোরী কন্যা। আমি প্যারিসে চলে যাচ্ছি। কেমন?

দুই বোন অবাক হয়ে গিয়েছিল। আহা, শেষ অব্দি আমার ষড়যন্ত্র কাজ দিয়েছে। মনিকা ভাবল। দিদি তাহলে আর স্টার হতে পারল না।

***

এটাই হল থেরেসার শেষ ব্রডকাস্ট। বোনের দিকে তাকিয়ে থাকল সে। ভাবল, আমি । কি এতই কুৎসিত?

জীবনে কোনোদিন সে জ্যাকুইস রাইমুর মুখখানা ভুলতে পারবে না। উনি কেন আমাকে এমন একটা স্বপ্নের উপত্যকায় নিয়ে গেলেন। হায় ঈশ্বর, আমি কী দোষ করেছি।

এরপর থেকে থেরেসা শুধুমাত্র চার্চেই গান গাইত। অনেক সাধ্য সাধনা করা হয়েছে। সে কিন্তু কখনও মুখ খোলেনি।

***

দশ বছর কেটে গেছে। মনিকা এখন এক সুন্দরী রূপসী যুবতী হয়ে উঠেছেন। একের পর এক বারোটি বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে দিয়েছেন। এসেছেন মেয়রের পুত্র, ব্যাঙ্কারের তনয়, ডাক্তার, উদীয়মান আইনজীবী। ছোট্ট গ্রামের ব্যবসায়ী। তা সত্ত্বেও মনিকার মন ভোলানো সম্ভব হয়নি। কেউ কেউ মধ্যবসয়ী কেউ সবেমাত্র যৌবন দিনে পদার্পণ করেছেন। তাদের অনেকেই বড়োলোক। কেউ শিক্ষিত, কেউ অশিক্ষিত।

সকলকেই মনিকা না বলে দিয়েছেন।

একদিন অবাক হয়ে বাবা জানতে চেয়েছিলেন তুই কী চাইছিস বল তো?

বাবা, এখানকার সব কিছু বিরক্তিকর। আমার স্বপ্নের রাজকুমার প্যারিস শহরে থাকে। তাহলে? মনিকাকে এখনই প্যারিসে পাঠাতে হবে। থেরেসাকেও তিনি সঙ্গে দিলেন। তারা প্যারিসের একটা ছোটো হোটেলে বসবাস করতে শুরু করল–বইস অঞ্চলে।

দুজনের চোখে প্যারিস দুভাবে ধরা পড়েছিল। মনিকা তখন একটির পর একটি চ্যারিটি করে চলেছেন। জাঁকজমকপূর্ণ ডিনার পার্টিতে তার ডাক পড়ছে। সম্ভাব্য প্রেমিকদের সাথে যোগ দিচ্ছেন চায়ের আসরে। এর পাশাপাশি থেরেসা? একটির পর একটি চার্চে যাচ্ছেন। মনটা একেবারে পালটে যাচ্ছে। একদিন এলেন নোতরদামের বিখ্যাত ক্যাথিড্রালে। একদিন চলে গেলেন মার্টিনের ক্যানল স্ট্রিটে।

তারপর? কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল, কিন্তু মনের মতো পুরুষ কোথায়? বাবার সঙ্গে দেখা হল। বাবা জানতে চাইলেন।

শেষ অব্দি মনিকা বলেছিলেন ম্যাক্সিমে ডিনারের আসরে একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার বাবার কয়লার খনি আছে।

মা জানতে চেয়েছিলেন ছেলেটি দেখতে কেমন?

–ওর অনেক পয়সা আছে। দেখতে ভারী সুন্দর। আমাকে ভালোবাসে।

–তোকে বিয়ে করবে কিনা জানলি না।

–ঠিক আছে, আমি জানতে চেষ্টা করব। কিন্তু ওকে আমার ভালো লাগেনি।

–কেন বল তো?

–ও খালি কয়লার গল্প করে। বিরক্তিকর, নিশ্চয়ই বিরক্তিকর।

.

পরবর্তী বছরে মনিকা আবার প্যারিসে আসতে চেয়েছিলেন। থেরেসা বলেছিল, আমি সঙ্গে যাব কি?

মনিকা বলে না দিদি, আমি একাই যেতে পারব।

মনিকা প্যারিসে পৌঁছে গেলেন। থেরেসা বাড়িতে থাকলেন। রোজ সকালে চার্চে যান। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন। বোন যেন ভালো বরের সন্ধান পায়। একদিন একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেল। দেখা হল রাউল জিরাডটের সঙ্গে।

ওই ছেলেটি প্রতি রবিবার চার্চে আসেন। থেরেসার গান শুনে বিমোহিত হয়ে গেছেন। এই ব্যাপারে উনি কিছুই জানতেন না। উনি ভাবতেন, মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতেই হবে।

সোমবার সকালবেলা, রাউল কাউন্টারের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

তিনি থেরেসার দিকে তাকালেন। তার মুখে আলো জ্বলে উঠল। তিনি বুঝতে পারলেন, এই মেয়েটি এক সুগায়িকা।

থেরেসাও তাকিয়ে ছিলেন রাউলের নিকে। কিছু বলতে চাইছিলেন।

রাউল বললেন- আপনার গান আমাকে মুগ্ধ করেছে।

ছেলেটি দেখতে চমৎকার। লম্বা, বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ। ঠোঁট দুটিতে আবেদন আছে। কত বয়স? সবেমাত্র তিরিশ অতিক্রম করেছেন হয়তো। থেরেসার থেকে এক দুবছরের বড়ো হবেন।

তারপর? তারপর শুরু হল আলাপচারিতা। থেরেসার মনে হল, ছেলেটি তার প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ বোধ করছেন। কেন? এ পর্যন্ত থেরেসা প্রেমের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।

কথায় কথায় অনেক কিছুই জানা হল। থেরেসার মুখে হাসি ফুটল।

ছেলেটি বলেছিলেন- কয়েকদিন আগে আমি ইজিতে এসেছি। এই দোকানটা আমার কাকিমার। উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি এখন এখানেই থাকব।

থেরেসা জানতে চেয়েছিলেন, অবশ্যই মনে মনে, কতদিন?

 রাউল বলেছিলেন- আপনি কেন পেশাগতভাবে গান করেন না?

 থেরেসার মনে পড়ে গিয়েছিল রাইমুর অভিব্যক্তি।

না, থেরেসা বলেছিলেন, আপনাকে ধন্যবাদ।

এই লাজুক আভা ছেলেটিকে মুগ্ধ করেছিল। তারপর আরও কিছুদিন চলতে থাকে এই আলাপচারিতা।

ছেলেটি বলেছিলেন– এই শহরটা ভারী সুন্দর। ছোট্ট শহর, তাই তো? আপনি কোথায় জন্মেছেন?

থেরেসা বলেছিল– এইখানে।

পরের দিন থেরেসা কোনো একটা ছুতো করে আবার ওই দোকানে পৌঁছে গেলেন। রাউলকে কী বলবেন, তা নিয়ে সারারাত নিজের সাথে লড়াই করেছেন। কীভাবে কথাবার্তা আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়?

শেষ অব্দি তিনি কিছুই বলতে পারেননি। তবে মাদমোয়াজেল ডিফসকে দেখে রাউল খুশি হয়েছিলেন। আঁর মনে হয়েছিল, তিরিশ বছরের কোনো মহিলা কি কিশোরীর মতো অভিনয় করতে পারেন? তিনি নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পারেননি। তারপর? তারপর কিছুদিনের মধ্যে বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়ে উঠল।

 থেরেসা জানতে চেয়েছিলেন- আপনার কি বিয়ে হয়েছে?

না, আমার সে সৌভাগ্য এখনও হয়নি।

 থেরেসা ভেবেছিলেন, শিগগিরিই তাই হবে।

তারপর মনিকা ফিরে এলেন প্যারিস থেকে। মনিকাও এই ছেলেটিকে ভালোবাসতে শুরু করলেন। মনে হল, তাঁরা একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারেন।

একদিন থেরেসা যখন দোকানের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলেন, দেখতে পেলেন রাউলকে।

 রাউল বলল- মামজেল শুভ সন্ধ্যা, আপনি কি ফাঁকা আছেন? আপনি কি আমার সঙ্গে এক কাপ চা খাবেন?

–অনেক ধন্যবাদ।

 থেরেসার মুখ থেকে সব কথা সেদিন চুরি হয়ে গিয়েছিল। রাউলকে আরও সুন্দর লাগছে কি? রাউল থেরেসার মন জয় করার চেষ্টা করেছিলেন। তারা নিঃসঙ্গতার মধ্যে কথা বলছিলেন।

থেরেসা বলেছিলেন আমার সবসময় একা থাকতে ভালো লাগে।

–আমি বুঝতে পারছি।

–কিন্তু আপনার তো অনেক বন্ধু আছে।

বন্ধু নয়, পরিচিত, তাতে কী হল?

কথা এগিয়ে চলল।

রাউল জানতে চাইলেন– আপনি কাল আমার সঙ্গে লাঞ্চ খাবেন কি?

 এটা একটা অবিশ্বাস্য আমন্ত্রণ। থেরেসা বলেছিলেন- আসতে পারলে ভালো লাগবে।

পরবর্তী দিন দেখা হল। রাউল বলেছিলেন- আমি বিকেল অব্দি ছুটি নিয়েছি। চলুন আমরা নাইসের ধার থেকে ঘুরে আসি।

আহা, প্রকৃতি এখানে কত অবাধ, কত নির্ভার মনে হচ্ছে, পায়ের তলায় কে যেন একটা ম্যাজিক কাপের্ট বিছিয়ে রেখেছে। থেরেসা চুপটি করে বসেছিলেন, মনে হয়েছিল, এ জীবনে এত আনন্দ কখনও আসেনি। কিন্তু? মনিকার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তার।

পরের দিন মনিকা প্যারিস থেকে চলে এলেন। মনিকা ভেবেছিলেন, যে করেই হোক রাউলকে অধিকার করতে হবে।

তারপর? একটির পর একটি ঘটনা দ্রুত ঘটতে থাকে।

শেষ পর্যন্ত রাউল এসে হাজির হলেন থেরেসাদের বাড়িতে।

থেরেসা সকলের সাথে রাউলের পরিচয় করালেন। শেষ অব্দি মনিকা। মনিকার কণ্ঠস্বরে মধু ঝরছে। থেরেসা ভেবেছিলেন, রাউল মনিকার সৌন্দর্য দেখে অবাক হয়ে যাবেন।

থেরেসা সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন, নিঃশ্বাস বন্ধ করে। কিন্তু কই? রাউল তো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

–আপনাকে দারুণ দেখতে।

থেরেসা ভাবতে পারেননি, এই লড়াইতে মনিকাকে তিনি হারিয়ে দেবেন।

 তারপর, তাদের তিনজনকে এখানে সেখানে দেখা গেল। কখনও সন্ধ্যার আঁধার অন্ধকারে, তারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন শহরের জনাকীর্ণ পথ ধরে। কখনও আবার মধ্য দুপুরে হারিয়ে যাচ্ছেন রিমঝিম বৃষ্টির দেশে। নতুন কোনো রেস্টুরেন্টে ঢুকে ডিনারের আসরে হাজির থাকছেন।

তখন থেরেসা এবং রাউল পরস্পরকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছেন। শেষ পর্যন্ত তারা বিয়ে করবেন বলে মনস্থির করলেন। নির্দিষ্ট দিনে থেরেসাকে হাজির হতে হল চার্চে। পাদরি এসে ল্যাটিন মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। আর দশ মিনিটের মধ্যে রাউল সেখানে এসে পড়বেন। থেরেসার অপেক্ষার প্রহর বোধহয় শেষ হয়েছে। নিজের এই সৌভাগ্যকে তিনি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। কিন্তু, রাউল আসছেন না কেন? এত দেরী হচ্ছে কেন?

 একটু বাদে থেরেসা দেখলেন, প্রধান ধর্মযাজক তার দিকে এগিয়ে আসছেন। তিনি থেরেসার হাতে হাত রাখলেন। তার আচরণের মধ্যে উদ্বিগ্নতার ছাপ পড়েছে। থেরেসার হৃৎপিণ্ড দ্রুত লাফাতে শুরু করেছে। 

–কোনো বিপদ হয়েছে কি রাউলের?

উনি বললেন– আমি ঠিক জানি না কেন এত দেরী হচ্ছে।

এবার বাবা এগিয়ে এলেন, বাবা ক্লান্ত গলায় বলেছিলেন- থেরেসা।

-বাবা, কী হয়েছে। আমাকে সব খুলে বলল।

একটু আগে আমরা একটা খবর পেয়েছি। রাউল—

সত্যি বলল। রাউল কি আহত হয়েছে?

–রাউল আধ ঘন্টা আগে শহর থেকে চলে গেছে।

কী বলছ? তাহলে নিশ্চয়ই কোনো দরকারী কাজ পড়েছে। কী বলে গেছে ও?

না, ও তোর বোনের সঙ্গে চলে গেছে। ওরা ট্রেন ধরে প্যারিসের দিকে যাচ্ছে। সংবাদটা অভাবিত, কিন্তু থেরেসা শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন, এর জন্য নিজেকে অভিযুক্ত করে কোনো লাভ নেই।

তারপর? থেরেসার মা এগিয়ে এসেছিলেন। থেরেসার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন আমি ভাবতেই পারছি না থেরেসা তোর নিজের বোন তোর সঙ্গে এমন বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করতে পারে।

থেরেসা হঠাৎ শান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জানতেন এখন দুঃখ করে কোন লাভ নেই। তিনি বলেছিলেন, মা, তুমি কষ্ট পেও না। মনিকার মতো সুন্দরী মেয়েকে রাউল তো ভালোবাসবেই। যে কোন ছেলে হলে তাই করত। এই পৃথিবীর কেউ কখনও আমাকে ভালোবাসবে না।

বাবা চিৎকার করে বলেছিলেন– থেরেসা, দশটা মনিকাকে একসঙ্গে রাখলেও তোর মতো হবে না।

কিন্তু এই সমবেদনায় কোনো লাভ আছে কি?

থেরেসা বাড়িতে ফিরেছিলেন, তারপর? বাবার ঘরে গিয়েছিলেন। বাবার ক্ষুর নিয়ে হাতের শিরা কেটে ফেলেছিলেন!

.

১২.

থেরেসা চোখ মেললেন। ডাক্তারবাবু সামনে তাকিয়ে আছেন। এসে গেছেন গ্রামের যাজকমশাই।

থেরেসা চিৎকার করেছিলেন না, আমাকে মেরে ফেল, আমাকে মেরে ফেল। না, আমি আর বাঁচতে চাই না।

ওই যাজক ভদ্রলোক বলেছিলেন- থেরেসা আত্মহত্যা মহাপাপ। ঈশ্বর এই জীবন আমাদের দিয়েছেন। তিনি জানেন, কখন এই জীবনের অবসান হবে। তোমার বয়স এখন বেশি হয়নি। জীবনের অনেকটাই তোমার সামনে পড়ে আছে।

থেরেসা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন– আমি কেন বেঁচে থাকব? আরও বেশি কষ্ট পাবার জন্য, তাই তো? বিশ্বাস করুন, এ যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

ভদ্রলোক শান্তভাবে বলেছিলেন- মহাত্মা যিশুর কথা স্মরণ করো। তিনি আমাদের সকলের যন্ত্রণার উপশম করেন।

ডাক্তার পরীক্ষা করলেন। বললেন– তোমাকে এখন বিশ্রাম নিতে হবে। আমি তোমার মাকে সব বুঝিয়ে বলেছি।

পরের দিন সকাল হয়েছে। থেরেসা উঠে দাঁড়ালেন। ড্রয়িং রুমে যাবার জন্য তৈরি হলেন।

মা বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। থেরেসা দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন- মা, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি একবার চার্চে যাব। এখনই, তোমরা কেউ আমার সঙ্গে যেও না।

তারপর? থেরেসা সোজাসুজি যাজকের কাছে এলেন, বললেন– সবাই আমাকে প্রতারণা করেছে। আমি এখানেই আশ্রয় নেব। আপনি কি আমাকে সাহায্য করবেন?

কথাগুলো খুবই জোরে বলেছিলেন তিনি। চার্চে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন, এই তরুণীর মনে নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের জন্ম হয়েছে।

.

থেরেসা জানেন না, কী করবেন এখন। যন্ত্রণাটা অসহ্য। ঘুমোত পারছেন না, কোনো কিছু খাওয়ার ইচ্ছে নেই। সব সময় কে যেন তাকে আক্রমণ করছে, স্মৃতি শুধু স্মৃতির মিছিল এগিয়ে চলেছে।

সব কথা মনে পড়ে গেল। এই তো কিছুদিন আগে তারা নাইসের পার ধরে হাঁটছিলেন। তিনি, রাউল এবং মনিকা।

রাউল বলেছিলেন- আহা, আজ সাঁতার দিলে কেমন হয়?

–আমি সাঁতরাতে পারি। কিন্তু থেরেসা সাঁতার কাটতে জানে না।

 –তোমরা যাও না, আমি না-হয় হোটেলে অপেক্ষা করব।

 রাউল এবং মনিকা চলে গিয়েছিলেন।

কত স্মৃতি, কাগনাসে কাটানো একটি সন্ধ্যাবেলা, টুকরো টুকরো স্মৃতি। থেরেসা চোখ বন্ধ করলেন। নিজেকে দোষ দেবার ইচ্ছে হল তার। কী বোকা আমি। চোখের সামনে এত ঘটনা ঘটে গেছে, অথচ আমি নিজেকে সুখী বলে ভেবেছি।

.

রাত হয়েছে, অদ্ভুত স্বপ্ন, নানা ধরনের মানুষের মুখ। একই স্বপ্ন বারবার ফিরে আসছে।

রাউল এবং মনিকা ট্রেনে এগিয়ে চলেছে। দুজনের পরনে কোনো পোশাক নেই। তারা পাগলের মতো একে অন্যকে ভালোবাসছেন।

রাউল আর মনিকা এখন একটা হোটেল ঘরে। তারা ভালোবাসা প্রদর্শন করছেন। রাউলের ঠোঁটে প্রজ্বলিত সিগারেট। হঠাৎ ঘরে একটা বিস্ফোরণ। দুজনের মৃত্যু হল। চিৎকার, শুধু আর্তনাদ। থেরেসার ঘুম ভেঙে গেল।

রাউল আর মনিকা একটা পাহাড় থেকে পড়ে গেছেন নদীতে ডুবে গেছেন।

 মৃত্যু হয়েছে প্লেন ধ্বংসের কারণে।

এত স্বপ্ন কেন? থেরেসার মা এবং বাবা বুঝতে পারলেন, মেয়েকে নিয়ে আরও ভাবনা চিন্তা করতে হবে। তারা সব সময় মেয়ের ওপর নজর রেখেছিলেন।

শেষ অব্দি তারা ঠিক করলেন, মেয়ের জীবনধারা একেবারে পাল্টাতে হবে। থেরেসা জানেন, এ জীবনে আর কেউ তাকে ভালোবাসবে না। ভাললাবাসার অভিনয় করবে না।  শেষ অব্দি তিনি তার নিজস্ব জগত খুঁজে পেলেন, এ এমন এক জগত যেখানে কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না। এ জগতের সবটুকু নীরবতায় ভরা।

একবছর কেটে গেছে। রাউলের চলে যাবার পর থেরেসার পিতা আভিলার দিকে যাত্রা করবেন বলে ঠিক করলেন।

তিনি থেরেসাকে বলেছিলেন সেখানে আমার কিছু কাজকর্ম আছে। তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে? আভিলা একটা ভারী সুন্দর শহর। আমি তোমাকে এখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে চাইছি।

না বাবা, আমি কোথাও যাব না।

 স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে থেরেসার বাবা বলেছিলেন- ঠিক আছে।

তখনই বাটলার এসে ওই ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করেছিল। সে বলেছিল- মিস ডিফসের এই চিঠিখানা এইমাত্র এসেছে।

থেরেসা অবাক হয়ে গেলেন, সেখানে কী লেখা আছে? লেখা আছে- থেরেসা, জানি না, তোমাকে চিঠি লেখার অধিকার আমি হারিয়েছি কিনা। ওই ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটাতে আমি বাধ্য হয়েছি। আমি কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না।

মনিকা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। শুধু আমাকে নয়, দুমাসের একটা বাচ্চা মেয়েকেও। সত্যি কথা বলতে কি, আমি শান্তি পেয়েছি। আর একটা ব্যাপার তোমাকে বলা উচিত, তোমার সাথে এই আচরণ করা কখনও উচিত হয়নি আমার। কেন যে আমি এতখানি নিষ্ঠুর হতে পারলাম! আসলে মনিকা আমাকে জাদু করেছিল। আমি প্রথম থেকেই জানতাম আমার বিয়েটা একটা মারাত্মক ঘটনা। তোমাকেই আমি একমাত্র ভালোবেসেছি। আমি জানি, তোমার কাছেই আমি আমার হারানো সুখ আবার ফিরে পেতে পারি। যখন তুমি এই চিঠিখানা পাবে, তখন আমি তোমার দুয়ারে প্রায় পৌঁছে গেছি।

আমি তোমাকে সারাজীবন ভালোবাসব থেরেসা। বিশ্বাস করো, আমাকে তুমি বিশ্বাস করো, আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি…

না, এই চিঠির বাকিটুকু উনি আর পড়বেন না। রাউলকে আর চোখের দেখা দেখতে চাইলেন না। কী হবে মনিকার দুমাসের বাচ্চাটিকে দেখে।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি চিঠিখানা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন।

থেরেসা চিৎকার করে বলেছিলেন- বাবা, আমাকে এখান থেকে এখনই যেতে হবে। আজ রাতের মধ্যে সম্ভব হবে কি?

মা-বাবা মেয়েকে শান্ত করতে পারেননি। বাবা বলেছিলেন- যদি রাউল আসে, তুই অন্তত একবার তার সঙ্গে কথা বল।

থেরেসা বাবার হাত আঁকড়ে ধরে বলেছিলেন- না, আমি তাকে দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারব না, হয়তো তাকে মেরেই ফেলব।

তখন তাঁর দুচোখে জলের ধারা–তুমি আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

পৃথিবীর যেখানে হোক, সেখানেই তাকে যেতে হবে, তখন তার এমনই মনের অবস্থা।

সেই সন্ধ্যাবেলা থেরেসা আর তার বাবা আভিলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

মেয়ের দুঃখের দিনের অবসান কবে হবে? বাবা ভাবলেন। বাবা সত্যি সত্যি বড়ো মেয়েকে ভালোবাসতেন। শেষ অব্দি থেরেসা নিজেকে খুঁজে পেল চার্চের মধ্যে, ফাদার বেরেনডো, সেখানকার প্রধান যাজক। তার বাবার এক পুরোনো বন্ধু। বাবার অনুরোধে থেরেসা ফাদার বেরেনডোর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সব কথা খুলে বলার চেষ্টা করেছিলেন। শুরু হয়েছিল তার জীবনের একটা নতুন অধ্যায়। কিন্তু প্রথমদিকে তিনি কেমন যেন করতেন। চার্চ তার অশান্ত মনকে শান্ত করতে পারে, এমন ধারণা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল।

ফাদার বেরেনডো হাসতে হাসতে বলেছিলেন- প্রত্যেকের কাছে চার্চের একটা আলাদা আবেদন আছে। এই চার্চই আমাদের আশা ও স্বপ্ন দিতে পারে।

আমার সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে ফাদার। আমি আর নতুন করে স্বপ্ন দেখতে চাইছি না।

ফাদার থেরেসার হাতে তার শীর্ণ হাত রেখেছিলেন। কবজিতে তখনও কাটা দাগ। একটা পাতলা স্মৃতি।

–ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করো। তাঁকে সবকিছু বলল। কিছু লুকিয়ো না।

থেরেসা বসেছিলেন। তারপর? শুরু হল তাঁর আত্মকথন।

পরের দিন সকাল হয়েছে। থেরেসা একা একা চার্চে এলেন। মনটা একেবারে পাল্টে গেছে তার। তিনি বুঝতে পারছেন, দুর্বলতা তার সঙ্গে প্রতিহিংসার খেলা খেলেছে। এর জন্য ঈশ্বরকে দায়বদ্ধ করে কী লাভ?

থেরেসা বলেছিলেন- আমাকে ক্ষমা করো। আমি পাপ করেছি, আমাকে ক্ষমা করো।

ফাদার বেরেনডো সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন প্রিয় কন্যা আমার, ভগবান কি তোমাকে শান্তি দিতে পেরেছেন?

-হ্যাঁ, আমি এখন শান্ত হয়ে গেছি।

ভেবে দেখো, এই বিশ্বাসটাই একমাত্র সত্য। এটাই চিরন্তন, বাকি সব কিছুই মাহুর্তিক।

 তারা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছিলেন।

সন্ধ্যাবেলা থেরেসা হোটেলে ফিরে এলেন।

 বাবা বললেন আমি ইজেতে ফিরে যাব, তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে?

–আমি এখানেই কিছুদিন থাকব।

–তুমি ঠিক থাকবে তো?

–হুঁ, বাবা। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমায় নিয়ে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। এরপর থেরেসা এবং ফাদার বেরেনডোর মধ্যে রোজ দেখা হতে থাকে। ফাদার বেরেনডোর হৃদয় তখন গলতে শুরু করেছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই কুৎসিত দর্শনা মেয়েটির মনে কী আনন্দিত সুখ উজ্জ্বল আত্মা রয়ে গেছে। তারা ঈশ্বরের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতেন। জীবনের আসল অর্থ অন্বেষণ করার চেষ্টা করতেন। থেরেসা বুঝতে পারলেন, চার্চের চার দেওয়ালের মধ্যেই তার আসল শান্তি লুকিয়ে আছে।

এই প্রথম তার মনে হল, তিনি বোধহয় অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছেন।

শেষ অব্দি ফাদার বেরেনডো বলেছিলেন- থেরেসা, তুমি যদি মনে করো, তা হলে মেয়েদের কনভেন্টে থাকতে পারো, দেখবে, সেখানে গেলে তোমার ভালোই লাগবে।

আহা, এমন আমন্ত্রণ তো কেউ আমায় কখনও করেনি।

থেরেসা ভেবেছিলেন।

তার মানে একটা নতুন জীবন?

পরের দিন ফাদার বেরেনডো থেরেসাকে নিয়ে কনভেন্টে গেলেন। সেখানে মাদারের সঙ্গে দেখা হল। মাদার সব কিছু শুনলেন। মাদার বুঝতে পারলেন, এই মেয়েটিকে এখন আশ্রয় নিতে হবে।

আভিলার বিশপ সেই মহান মন্ত্রগুলো উচ্চারণ করছিলেন, তিনি বলছিলেন- হে ঈশ্বর, আমি তোমার ক্ষুদ্র কণা মাত্র। তুমি আমাকে অসীম শান্তির দেশে নিয়ে যাও।

থেরেসা চোখ বন্ধ করে সেই মন্ত্রগুলো বলছিলেন। থেরেসা বলছিলেন– এই পৃথিবীর সর্বত্র অশান্তি, তুমি আমাকে শান্তি দাও।

আমেন!

তারপর? তারপর কত কী তো ঘটে গেল। এই জীবন, এই একাকীত্ব, এই নিঃসঙ্গতা। :

তিরিশ বছর কেটে গেছে, অরণ্য প্রান্তরে শুয়ে দিগন্ত রেখায় সূর্যের আলোর খেলা দেখতে দেখতে সিস্টার থেরেসা ভাবছিলেন– আমি কেন কনভেন্টে এসেছিলাম? আমি ঈশ্বরের কাছে আসতে চাইনি, পরিদৃশ্যমান পৃথিবী থেকে পালাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর, বোধহয় আমার হৃদয়ের বার্তা পড়তে পেরেছিলেন।

এখন থেরেসার বয়স ষাট বছর, গত তিরিশটা বছরকে তিনি জীবনের সবথেকে সুখী সময় হিসাবে চিহ্নিত করতে পারেন। তাকে আবার সেই পৃথিবীর মধ্যে এখন এনে ফেলা হচ্ছে, যে পৃথিবীর ঘটনাবলী থেকে তিনি নিস্তার চেয়েছিলেন।

ভালো লাগছে না, তিনি বুঝতে পারছেন না, কোনটা বাস্তব, আর কোনটা আমাদের কল্পনা। অতীত এবং বর্তমান সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। এমন ঘটনা কেন আমার জীবনে ঘটল। ঈশ্বর কি আমার জন্য অন্য কোনো পরিকল্পনা তৈরি করেছেন? সেটা কী?

.

১৩.

 সিস্টার মেগানের কাছে এই অভিযান ছিল যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি নতুন নতুন দেশ দেখতে ভালোবাসতেন।

তার সহযাত্রীরাও অসাধারণ। অ্যামপারো জিরনকে এক শক্তিশালী মহিলা বলা যেতে পারে। উনি অনায়াসেই বাকি দুজনের সঙ্গে তাল রেখে চলছিলেন। আবার তার মধ্যে নারীত্বের সবকটি গুণই আছে।

ফেলিক্স কারপিওকে এক খাসখেসে গলার ভদ্রলোক বলা যায়। মাথায় কাটা চিহ্ন আছে। লালচে দাড়ি আছে। মানুষটি খুব একটা খারাপ নয়।

মেগানের কাছে সবথেকে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব অবশ্যই জাইমে মিরো। মিনোর শারীরিক শক্তি কতখানি, তার পরিচয় মেগান পেয়েছেন।

তাদের কাঁধে স্লিপিং ব্যাগ আর ঝুলছে রাইফেল। মেগান বলেছিলেন– অনুগ্রহ করে একটা বোঝা আমাকে দেবেন কি?

জাইমে মিরো একটা স্লিপিং ব্যাগ তুলে দিয়েছিলেন।

 মেগানের মনে হল এটা বোধহয় তার নিজের ওজনের থেকেও বেশি। তবু তিনি অভিযোগ করেননি।

পথ শেষ হচ্ছে না, অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে। মাঝে মধ্যেই গাছের শাখা-প্রশাখার আঘাত পেতে হচ্ছে। পোকা কামড়াচ্ছে। চাঁদের আলোর আভায় পথ দেখতে হচ্ছে।

এঁরা কারা? মেগান ভাবছিলেন। এঁরা কী খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অথবা এঁদের ওপর পুলিশ কেন চোখ রেখেছে? মেগান কিছুই জানতেন না। কিন্তু এই নতুন বন্ধুর জন্য তার হৃদয় কেমন করে উঠল।

কথাবার্তা খুবই কম, মাঝে মধ্যে তারা সাংকেতিক ভাষায় কী যেন বলছেন।

লারগো করটেজের নাম বলা হত, রুবিও এবং টমাস মেগানের কাছে শব্দগুলো অপরিচিত। কী হবে? তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। মাঝে মধ্যে ষাঁড়ের লড়াই শব্দদুটি কানে ভেসে আসছে।

সকাল হয়েছে। নীচের উপত্যকা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

জাইমে ফিসফিসিয়ে বললেন- এখানে অপেক্ষা করুন। শান্ত থাকবেন।

জাইমে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

 মেগান বললেন- কী হচ্ছে?

 অ্যামপারো জিরন বলেছিলেন– চুপ করুন।

পনেরো মিনিট কেটে গেল। জাইমে মিরো ফিরে এলেন।

–আমরা সঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছি।

তারা একটু পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে। মেগানের কৌতূহল আকাশছোঁয়া।

জাইমে বললেন– চারপাশে সৈন্যরা আছে, ওরা কিন্তু সশস্ত্র। আরও সাবধান হতে হবে।

আর থাকতে না পেরে মেগান বলেছিলেন– সৈন্যরা আমাদের খুঁজছে কেন?

 জাইমে মিরো জবাব দিলেন– এখন কোনো কথা বলবেন না।

 তারপর? এই মানুষগুলো সম্পর্কে আরও বেশি জানতে হবে।

 আধঘণ্টা কেটে গেছে।

জাইমে বললেন, সূর্য উঠেছে, এখানে রাত অব্দি অপেক্ষা করতে হবে। মেগানের দিকে তাকিয়ে তিনি আরও বলেছিলেন, আমাদের চলার গতি বাড়াতে হবে। না হলে আমরা কেউ বাঁচব না।

স্লিপিং ব্যাগ খোলা হল। ফেলিক্স কারপিও মেগানকে বললেন-সিস্টার, আপনি আমারটা নিতে পারেন। আমি মাটিতে শোবো। আমার কোনো অসুবিধা হবে না।

মেগান বললেন– এটা আপনার আমি কেন নেব?

অ্যামপারো বললেন–ঠিক আছে, কেন এমন ভাবছেন? মাটিতে শুলে আপনাকে মাকড়সা কামড় দেবে।

মেগান স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকে গেলেন।

জাইমে শ্লিপিং ব্যাগটি খুলেছেন। তিনি ব্যাগের মধ্যে হামা দিয়ে ঢুকে গেলেন। অ্যামপারো তার পাশে চলে গেছেন। মেগান বুঝতে পারলেন, এখনই সেখানে কোন ঘটনা ঘটবে। জাইমে মেগানের দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন সিস্টার। অনেকটা পথ সামনে পড়ে আছে।

আর্তনাদের শব্দ, কী হচ্ছে বুঝতে পারা যাচ্ছে না। কারোর যন্ত্রণা হচ্ছে কি? মেগান উঠে বসলেন। শব্দটা আসছে জাইমের স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে থেকে। জাইমে কি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? এটাই তার প্রথম চিন্তা।

আর্তনাদ আরও আরও দীর্ঘ হয়েছে। মেগান অ্যামপারোর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন– আরও তাড়াতাড়ি, এখনই, এখনই।

মেগানের মুখে লজ্জার আভা। সেটা কি সম্ভব? জাইমে মিরো এভাবে ভালোবাসা নিবেদন করছেন?

মেগান বুকে ক্রশচিহ্ন আঁকলেন। তারপর বললেন– ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন। আমি ভাবতে পারছি না যে, এসব দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে হবে।

শব্দ শোনা যাচ্ছে। মেগান ভাবলেন, তিনি বোধহয় এই শব্দগুলো আর সহ্য করতে পারবেন না। তখনই শব্দ থেমে গেল। এবার অন্য কিছু আওয়াজ ভেসে এল। অরণ্য প্রান্তরে কত রকম আওয়াজ। পাখিদের কতরকম আওয়াজ। পাখিদের কিচির-মিচির শব্দ, ঝিঁঝি পোকার গান। ছোটো ছোটো জন্তুদের মুখের শব্দ। বড়দের গগনভেদী চিৎকার। মেগান তখন সব শব্দ ভুলতে চাইছেন। তিনি কনভেন্টের সেই নীরবতার জগতে প্রবেশ করতে চাইছেন। কিন্তু, কত কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। অরফানেজের দৃশাবলী, ভয়ার্ত কিছু স্মৃতি।

.

১৪. আভিলা, ১৯৫৭

ওরা বলত মেগান ভয়ংকর। ওরা বলত মেগান এক নীল চোখের শয়তানি। তখন মেগানের বয়স মাত্র দশ বছর।

ছোট্টবেলায় মেগানকে এই অনাথ আশ্রমে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাকে রাস্তার ধারে ফেলে গিয়েছিল কৃষক বাবা এবং মা। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর মেগানের অজানা।

অনাথ আশ্রমটি দোতলা। হোয়াইট ওয়াশ করা দেওয়াল। আভিলার উপকণ্ঠে। যেখানে নিম্ন মধ্যবিত্তদের বসবাস। প্লাজা দে সানটে ডিসেনটে, মার্সিডিজ, অ্যাঞ্জেলে এরা পরিচালনা করে থাকে।

মেগানের সাথে অন্য বাসিন্দাদের কোনো তুলনা হয় না।

মেগানের চুলের রং সোনালি। দুটি চোখে নীল উজ্জ্বল আভা। আর যারা এখানে আসে, তাদের চোখ কালো, তাদের চুলের রং কালো। প্রথম থেকেই তাই মেগানের ওপর আলাদা নজর দেওয়া হয়েছিল। সে বুঝি এক স্বাধীনসত্তা, এক নেত্রী, সবসময় দুষ্টুমি করে বেড়ায়। যখনই অনাথ আশ্রমের কোনো সমস্যা দেখা দেয়, মার্সিডিজ অ্যাঞ্জেলেস জানেন, মেগান এর অন্তরালে আছে।

বছর ঘুরে গেল। মেগান নানা বিষয়ে গোলমাল শুরু করল। সে বাচ্চাদের নিয়ে একটা দল গড়ে তুলল। এই দলে সে-ই নেত্রী। সকলের মধ্যে সে অত্যন্ত জনপ্রিয়। সেই দলে অনেকের থেকে সে ছোটো, কিন্তু সকলেই তার মত নিয়ে চলতে ভালবাসে। ছোটোবেলা থেকেই সে নানা ধরনের গল্প বলত। তার মনে বন্য কল্পনার উদ্রেক।

-তোমার মা-বাবা কে মেগান?

–তোমার বাবা এক গয়না চোর। সে মধ্যরাতে হোটেলের ছাদে উঠেছিল। বিখ্যাত অভিনেত্রীর হিরো চুরি করতে। যখন সে হিরের টুকরোটা পকেটে পুরতে যাবে, অভিনেত্রীর ঘুম ভেঙে যায়। সে লাইট জ্বেলে দেয়। তাকে দেখতে পায়।

–আমার বাবাকে কি ধরা হয়েছে?

–না, সে ছিল খুবই সুন্দর।

–তারপর কী হল?

–তারা পরস্পরকে ভালোবাসল। বিয়ে করল। তোমার জন্ম হল।

–কিন্তু কেন তারা আমাকে অনাথ আশ্রমে পাঠিয়েছিল? তারা কি আমাকে ভালোবাসত না?

এটাই হল গল্পের সবথেকে শক্ত জায়গা না, তারা তোমাকে ভালোবাসত। তারা সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিল। স্কি খেলায় যোগ দেবে বলে। সেখানে তুষার ঝড় ওঠে। তারা মারা যায়।

তারপর? তারপর তোমাকে এখানে আনা হয়।

এসব মেগানের বানানো গল্পকথা। মাঝে মধ্যে সে এইভাবে গল্প বানাত, আবার কখনও ভাবত, আমার বাবা ছিল গৃহযুদ্ধের এক সৈন্য। সে ছিল ক্যাপ্টেন। তার সাহস ছিল আকাশ ছোঁয়া। যুদ্ধে সে আহত হয়। আমার মা ছিল একজন সেবিকা। তারা পরস্পরকে ভালোবাসে। বিয়ে করে। বাবা আবার রণক্ষেত্রে ফিরে যায়। সেখানেই মারা যায়। আমার মার হাতে পয়সা ছিল না, তাই সে আমাকে অনাথ আশ্রমে রেখে গেছে।

অথবা ভাবত, আমার বাবা ছিল বুলফাইটার। অন্যতম মাতাদোর। স্পেনের সর্বত্র তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। আর মা ছিল এক অসাধারণ ক্লামেনকো নর্তকী। তারা বিয়ে করে। একদিন বিরাট একটা ষাঁড় আমার বাবাকে মেরে ফেলে। আমার মা বাধ্য হয়ে আমাকে এখানে রেখে দেয়।

অথবা সে ভাবত, আমার বাবা অন্য দেশের এক চালক গোয়েন্দা, অথবা গুপ্তচর।

গল্প এগিয়ে চলে, এগিয়ে চলে কষ্টকল্পনা, এদের কোনো সীমা পরিসীমা আছে কি?

ওই অনাথ আশ্রমে তিরিশটি বাচ্চা থাকত। রাস্তার ধারে ফেলে যাওয়া থেকে চোদ্দো বছরের কিশোর পর্যন্ত। বেশির ভাগই স্পেন দেশের। অবশ্য অন্যান্য দেশ থেকেও অনেকে এসেছিল। মেগান বেশ কয়েকটা ভাষা শিখে ফেলল। ডরমেটরিতে শুয়ে থাকত। দশ-বারোটি অন্য বালিকাদের সঙ্গে। অনেক রাত অব্দি তারা গল্প করত। পুতুল আর জামাকাপড় নিয়ে। যারা বড়ো হয়েছিল, তাদের গল্পের মধ্যে অনিবার্য ভাবে যৌনতা ঢুকে পড়ত। এটাই বোধহয় হয়ে দাঁড়ায় তাদের আলাপ চারিতার প্রাথমিক বিষয়বস্তু।

একজন বলেছিল– ভীষণ লাগবে।

আর একজন বলেছিল– তাতে কী হয়েছে, আমি আর থাকতে পারছি না।

তৃতীয়জন বলেছিল–কবে আমার বিয়ে হবে। বিয়ের পরেও আমি স্বামীকে এটা করতে দেব না।

ব্যাপারটা নোংরা।

একটি রাত, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, অনাথ আশ্রমের একটা বাচ্চা ছেলে প্রাইমো কোল্ডে, মেয়েদের ডরমেটরিতে ঢুকে পড়ে সে চট করে মেগানের পাশে শুয়ে পড়ে।

-মেগান, তার গলা কাঁপছে।

মেগান উঠে পড়েছে প্রাইমো, কী হয়েছে?

ছেলেটি নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর বলছে– আমি কি তোর সাথে শুতে পারি? তোর বিছানায়?

-হ্যাঁ, কিন্তু কথা বলবি না।

প্রাইমো তখন তেরো, মেগানও তাই। প্রাইমোকে তার বয়স থেকে ছোটো দেখায়। সে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। রাতের বেলা জেগে ওঠে। অন্য বাচ্চারা তাকে নানাভাবে বিরক্ত করে। মেগান মাঝে মধ্যেই তার সপক্ষে দাঁড়ায়।

প্রাইমো মেগানের পাশে শুয়ে পড়ল। মেগান বুঝতে পারল, জল গড়িয়ে আসছে প্রাইমোর চিবুক থেকে। মেগান প্রাইমোকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

মেগান বলল- তুই ঠিক আছিস তো?

–মেগান প্রাইমোর শরীরটা ধরে নাড়াতে থাকে। দুটো শরীর মিলেমিশে গেছে। হঠাৎ একটা উত্তেজনা।

-প্রাইমো।

–আমার খারাপ লাগছে, তুই আমায় ডাকবি তো?

প্রাইমোর সেটা উঠে দাঁড়িয়েছে, মেগান অনুভব করল।

-মেগান তোকে আমি ভালোবাসি। এই পৃথিবীতে একমাত্র তুই আমার পাশে এসে দাঁড়াস।

–এই পৃথিবীটার কতটুকু তুই দেখলি?

–আমিও তোকে ভালোবাসি।

–আমি তোকে ভালোবাসব, তুই বাধা দিবি না তো?

তারপর নীরবতা।

-তোকে বিরক্ত করলাম। আমি আমার বিছানায় চলে যাচ্ছি।

 প্রাইমোর কণ্ঠস্বরে বেদনা। সে উঠে বসার চেষ্টা করেছিল।

মেগান তাকে শক্ত করে চেপে ধরল। বলল না, আয়, তোর যন্ত্রণার শান্তি দেব। তুই এখানে সারারাত থাকবি?

প্রাইমোর গলা ভেঙে গেছে। কোনোরকমে সে বলল- হ্যাঁ।

প্রাইমো পাজামা পরেছিল। মেগান পাজামার দড়িটা আলগা করল। সেটা খুলে দিল। আহা, এই তো এক পুরুষের চেহারা। মেগান ভাবল, তারপর সে পুংদণ্ডটা হাতে করে ধরল। সে সেটাকে নাড়াতে শুরু করল। প্রাইমো গোঙাতে শুরু করেছে– আঃ, কী ভালো লাগছে রে। একটু বাদে বলল, তোকে আমি সত্যি ভালোবাসি মেগান।

মেগানের শরীরে আগুন জ্বলে উঠেছে। সে বলল আমি তোকে আরও ভালোবাসব।

বেশ কিছুক্ষণ তারা সেইভাবে শুয়েছিল। তারপর প্রাইমো উঠে গেল।

বাকি রাত মেগান ঘুমোত পারেনি। এরপর সে কিন্তু প্রাইমোকে আর কখনও তার সাথে শুতে দেয়নি।

এভাবেই মেগান তার নিষিদ্ধ দেশের স্বপ্ন দেখল।

.

মাঝে মধ্যে ছেলেদের সুপারভাইজারের অফিসে ডাকা হয়। অনেকে তাদের দত্তক নিতে চায়। তখন সে এক দারুণ উত্তেজনা। এই চার দেওয়াল থেকে মুক্তি। আনন্দ, শুধুই আনন্দ।

মেগান অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেছে অনেকেই এই অনাথ আশ্রম থেকে চলে গেল। কেউ গেল কোনো ব্যবসায়ীর বাড়িতে। কৃষক পরিবারে, ব্যাঙ্কারের ঘরে, কিন্তু আমার জন্য কেউ আসে না কেন? অনেকে বলে, সে নাকি সুন্দরী, তবে তার অতীত সম্বন্ধে কিছু জানা নেই।

কেউ বলে, মেয়েটা দুষ্ট, গত মাসে সে নানান দুষ্টুমির কাজ করেছে।

 আবার কেউ বলে, এ মেয়েটা দস্যি, এর মাথায় শয়তানি বুদ্ধি আছে।

কেউ মেগান সম্বন্ধে ভালো কথা বলে না।

প্রতি সপ্তাহে একবার ফাদার বেরেনডো এই অনাথ আশ্রমে আসেন। তিনি অনেক কথা বলেন। তিনি মার্সিডেজ অ্যাঞ্জেলসের হাতে অনেক বই দিয়ে যান। মেগানের সাথেও তার দু-একবার কথা হয়েছে। মেগান জানতে চেয়েছে ফাদার, আমি কবে বাইরে যাব?

ওই বৃদ্ধ পাদরি জবাব দিয়েছেন মেগান, যখন সময় হবে তখন তুমি মুক্তি পাবে।

–আপনি কি জানেন, আমার আসল বাবা-মা কেন আমাকে পথের ধারে ফেলে দিয়েছিল?

–আমার মনে হয়, তারা খুবই দরিদ্র ছিলেন। তাই বোধহয় তোমাকে পালন করার মতো সামর্থ ছিল না।

মেগান আরও একটু বড়ো হয়ে উঠেছে। আরও বেশি শান্ত হয়ে গেছে। ক্যাথোলিক চার্চের নিয়মনীতি সম্পর্কে উৎসাহী। সেন্ট অগাস্টাইনের কনফেসান পড়ে ফেলেছে। সেন্ট ফ্রান্সিসের লেখাও পড়েছে সে। মন দিয়ে। এতখানি পাল্টে গেল কেন সে?

একদিন সে ফাদার বেরেনডোকে বলল– আমি ক্যাথোলিক হতে চাইছি। ফাদার বলেছিলেন– তুমি তো ক্যাথোলিক, মেগান, তুমি কেন চিন্তা করছ?

ফাদার, আমি কি যিশুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করব?

–কেন নয়?

 ফাদার তাকালেন মেগানের মুখের দিকে। আহা, এই মেয়েটি শান্তি পাক। অনন্ত শক্তির অধিকারিনী হয়ে উঠুক। এটাই ছিল তার একান্ত বক্তব্য।

মেগান এখন পনেরো বছরের এক কিশোরী। লম্বা চুলের বন্যা তার মাথায়। গায়ের রং দুধ সাদা। তাকে ভারী সুন্দরী দেখাচ্ছে। অন্য সহচরীদের থেকে একেবারে আলাদা।

একদিন তাকে মার্সিডিজ অ্যাঞ্জেলেসের অফিসে ডাকা হল। ফাদার বেরেনডো সেখানে বসেছিলেন।

-হ্যালো, ফাদার?

–হ্যালো, প্রিয় মেগান?

মার্সিডিজ অ্যাঞ্জেলেস বললেন- মেগান, একটা সমস্যা হয়েছে।

শেষতম শয়তানির বিষয়ে মেগান চিন্তা করছিল। মিস্ট্রেস বললেন- পনেরো বছর বয়স হয়ে গেলে আমরা আর এখানে রাখতে পারি না। তুমি অতি দ্রুত সেই বয়সের দিকে এগিয়ে চলেছ।

মেগান অনেক দিন ধরেই এই বিচিত্র নিয়মটা জানত। কিন্তু এই নিয়মটাকে সে মন থেকে সরিয়ে ফেলেছিল। কারণ এই পৃথিবীতে তার যাবার কোনো জায়গা নেই। সে জানে, কেউ তাকে আশ্রয় দেবে না।

–আমি কি এখান থেকে চলে যাব?

ওই আমাজন ভদ্রমহিলার কোনো উপায় ছিল না। তিনি বললেন–হ্যাঁ, আমাকে তো নিয়ম মানতেই হবে। তুমি কি কোনো বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসেবে যাবে? আমরা ব্যবস্থা। করেছি।

মেগান কথা বলতে পারেনি।

ফাদার বেরেনডো বললেন তুমি কোথায় যেতে চাইছ?

মেগান ভাবল, তার মাথায় একটা চিন্তা এসেছে। যখন তার বয়স বারো বছর, সে সিস্টারসিয়ান কনভেন্টের নাম শুনেছিল। সেখানকার মাদার বেটিনা, তাকেও দু-একবার দেখেছে। তখন থেকেই মেগান ভেবেছে, পরবর্তীকালে সে একজন সেবিকা হবে। ঈশ্বরের মহান সেবিকা। মাদার এইসব মেয়েদের ভালোবাসতেন, বিশেষ করে উজ্জ্বল মুখের ওই মেয়েটিকে।

মেগান জানতে চেয়েছিল মেয়েরা কেন কনভেন্টে যোগ দেয়?

নানা কারণে, আমরা তাদের আশা দিই, আমরা তাদের আসল পথ দেখাই।

 তখনই মেগানের মনে হল, আমি যদি কনভেন্টে যাই, তাহলে কেমন হয়?

 সে বলেছিল- আমি কনভেন্টে যোগ দেব।

ছ সপ্তাহ কেটে গেছে। মেগান সত্যি সত্যি কনভেন্টে এল। আসল জায়গা, এখানে আরও সিস্টার আছে। তারপর? মাথার ওপর আছেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর।

কনভেন্টে তিনি নানা ধরনের কাজ করতেন, তাকে বুক কিপারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সে সাংকেতিক ভাষাটা হারিয়ে গেছে। এখানে এসে তারই চর্চা করল। ৪৭২টি সংকেত আছে; এরই মাধ্যমে সকলে কথা বলে।

অদ্ভুত জীবন, নভেম্বরের সকাল। মৃত্যু সংকেতের সাথে তার পরিচয় ঘটে গেল। এক ধর্মসেবিকা মৃত্যুশয্যায় শায়িতা। এখন শেষ সংকেত দেখাতে হবে। এই সংকেতটা ১০৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে একই রকম রয়ে গেছে। চারদিকে স্তব্ধ পরিবেশ। মাদার রেস এগিয়ে এসেছেন। বাঁ হাতে কিছু ইঙ্গিত করলেন। তিনি ওই ভদ্রমহিলার মাথায় ক্রশচিহ্ন এঁকে দিলেন।

তারপর? চিবুকের ওপর চিহ্ন আঁকা হল।

শেষ প্রার্থনা শোনা যাচ্ছে, এখন এই দেহটিকে একলা রাখা হবে, যাতে আত্মা শান্তি পেতে পারে। পায়ের নীচে একটা মোমবাতি জ্বেলে দেওয়া হল। নিরন্তর আলোকের উৎস।

মেগান বুঝতে পারলেন, এই পৃথিবীতে অনেক কিছু জানবার আছে। পরদিন বিকেলবেলা, প্রার্থনা সভার আসর বসেছে। মেগান একা একা সমাধিক্ষেত্রে চলে গিয়েছিলেন। এখানেই আমাদের শেষ গন্তব্য। মেগান ভেবেছিলেন।

তারপর? মাঝে মধ্যেই মেগান কেমন একলা হয়ে যান। এই কনভেন্ট তাকে নিরাপত্তা দিয়েছে। কিন্তু শান্তি দিয়েছে কি? তার কেবলই মনে হয়, কী একটা যেন হারিয়ে গেছে। কী, তিনি জানেন না। তাঁর কেবলই মনে হয়, বাইরের জগতে এত আনন্দ, এত উল্লাস, এত হাসি।

মেগান একদিন মাদার বেটিনার কাছে গিয়েছিলেন। মাদার বেটিনা বলেছিলেন, মেগান, মাঝে মধ্যে আমাদের সকলের মনে এমন নৈরাশ্যজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়। শয়তান এর অন্তরালে আছে। তুমি এর জন্য ভয় পেও না। দেখবে তোমার মনের এই অবস্থা কখন হারিয়ে গেছে। তুমি আবার শান্ত হবে। চিরশান্তির জগতে ফিরে আসবে।

 কিন্তু, মেগান আর কখনও শান্তির জগতে পা রাখতে পারেননি। তিনি ভেবেছেন, আমার জীবন থেকে শান্তি চিরকালের জন্য চুরি হয়ে গেছে।

.

১৫. নিউইয়র্ক সিটি, ১৯৭৬

চারপাশে সাংবাদিকদের ভিড়। নিউইয়র্ক শহরের ওয়ালড্রফ অ্যাসটোরিয়া হোটেল। এবার শুরু হবে সুন্দরীদের পদযাত্রা। একটির পর একটি লিমুজিন এসে থামবে। গ্রান্ড বলরুমে আলো জ্বলে উঠবে। পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে সম্মানীয় অতিথিরা ইতিমধ্যেই আসতে শুরু করেছেন।

ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আলো জ্বলে উঠেছে। রিপোর্টাররা কিছু বলার চেষ্টা করছেন। ভাইস প্রেসিডেন্টের খোঁজ চলছে।

গভর্ণর অ্যাডামস এসে পড়েছেন। সেনেটরদের দেখা যাচ্ছে। বিদেশী প্রতিনিধিরাও এসে গেছেন। ব্যবসা জগতের মহান নায়কেরাও এবং কিংবদন্তির খ্যাতিমানেরা। তারা কোথায় চলেছেন? তারা এসেছেন এলেন স্কটের জন্মদিনের পার্টিতে যোগ দেবেন বলে। স্কট সাম্রাজ্যের মহারানি, পৃথিবীর অন্যতম বড়ো ধনী সম্প্রদায়। নানা দেশের অয়েল কোম্পানিতে এই পরিবারের মালিকানা আছে। অনেকগুলো ইস্পাত কারখানা আছে। আছে একাধিক ব্যাঙ্কের বিচিত্র ব্যবসা বিন্যাস। আজ সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে যত টাকা পাওয়া যাবে, সব দান করে দেওয়া হবে।

পৃথিবীর সবত্র স্কট ইন্ডাসট্রির পদধ্বনি আঁকা হয়েছে। পঁচিশ বছর আগে এর প্রেসিডেন্ট মিলোস স্কট হঠাৎ মারা গিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী এলেন, এই বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী হয়ে বসেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। কোম্পানির অ্যাসেট লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে।

ওয়ালড্রফ অ্যাসটোরিয়া একটি বিশ্ববিখ্যাত হোটেল। এর গ্রান্ড বলরুমের খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সুন্দর সাজানো হয়েছে এই বিরাট বলরুমটিকে। ব্যালকনিতে আলো জ্বলছে। সমস্ত ঘরে বিরাজ করছে আভিজাত্যের চিহ্ন। অনেকগুলি চেয়ার সাজানো আছে। ঝুলছে উজ্জ্বল ঝাড়বাতি। আর এই সেন্ট্রাল ব্যালকনিতে সম্মানিত অতিথিরা বসবেন। ইতিমধ্যে, প্রায় ছলোজন নারী এবং পুরুষ এসে উপস্থিত হয়েছেন। তাদের সামনে ডাইনিং টেবিল। রূপোর তৈরী বাসনপত্র।

নৈশ আহার শেষ হল। নিউইয়র্ক শহরের গভর্ণর স্টেজে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন- মিঃ ভাইস প্রেসিডেন্ট, ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্রমহিলারা, সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, আমরা এখানে একটা মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য আজ এসেছি। আমরা এসেছি, এমন এক মহিলার যাটতম জন্মদিনকে স্মরণ করতে, যিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করতে পারবেন। ইচ্ছে করলে তিনি এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বা ডাক্তার হতে পারতেন। হতে পারতেন মহতী রাজনীতিবিদ, কিন্তু আবার আমি বলব, মনে করলে এলেন স্কট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রাষ্ট্রপতি হতে পারতেন। আমি প্রথমটাতে ভোট দিতাম। তবে আগামী নির্বাচনে নয়, পরবর্তী কোনো একটি নির্বাচনে।

ভদ্রলোকের কথার মধ্যে কৌতুক ছিল, সকলে হেসে উঠলেন, হাততালি দিলেন।

-কিন্তু এলেন স্কটকে আমরা আরও ভালো পটভূমিকাতে দেখতে পাচ্ছি। তিনি মানুষকে ভালোবাসেন। তিনি পৃথিবীর যে কোন সমস্যার মোকাবিলা করতে চান।

আরও দশ মিনিট ধরে এই ভাষণ চলেছিল। এলেন স্কট এসব কিছুই শুনছিলেন না। ভদ্রলোক কি সত্যি বলছেন? তিনি ভাবছিলেন এঁরা সবাই মিধ্যে কথা বলছেন। স্কট ইন্ডাসট্রিকে কি আমার নিজস্ব কোম্পনি বলা যায়? একসময় মাইলো আর আমি এটা চুরি করেছিলাম। এই চুরির কাজে আমার অবদান ছিল বেশি। তবে তাতে কী বা যায় আসে? আমি তো আর বেশি দিন বাঁচব না।

মনে পড়ে গেল, ডাক্তারের সাবধানবাণী।

মিসেস স্কট, এই ভয়ংকর অসুখ আপনাকে ধীরে ধীরে ভেঙে দিচ্ছে। ক্যানসার আপনার সমস্ত শরীরকে আক্রান্ত করেছে। এই রোগ কোনো দিন সারবে না।

এলেনের মনে হয়েছিল, সত্যি, পৃথিবীতে বোধহয় অন্ধকার বিরাজ করছে।

–আর কতদিন? তিনি জানতে চেয়েছিলেন।

ডাক্তার বলেছিলেন– খুব বেশি হলে একবছর।

খুব বেশি একটা সময় হাতে নেই। তার মানে? অনেক কাজ করতে হবে।

–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ডাক্তার।

চোখ বন্ধ করলে অনেক কথাই মনে পড়ে যায়। তবে? কী একটা কাজ যেন বাকি রয়ে গেছে। শেষ করতে হবে, মৃত্যুর আগে।

গভর্ণরের বলা শেষ হয়ে গেছে। এবার মিসেস স্কটকে উজ্জ্বল আলোর সামনে নিয়ে আসা হবে।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। হাততালির ঝড় বয়ে গেল। আহা, এক রোগা ধূসর চুলের মহিলা। এখনও সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন। ভারী সুন্দর পোশাক পরেছেন। অভিব্যক্তির মধ্যে এমন একটি উজ্জ্বলতা আনার চেষ্টা করছেন, এখন যার অধিকারিনী তিনি নন।

আলোকিত মঞ্চে উঠতে উঠতে হঠাৎ এলেন স্কটের মনে হল, আমার দিকে তাকিয়ে থাকা, আর মৃত তারার আলো দর্শন করা, ব্যাপারটা একই।

এত শব্দ কেন? কেন?

 উনি কথা বললেন– মিঃ ভাইস প্রেসিডেন্ট, সেনেটর, গভর্ণর অ্যাডামস।

 একবছর বাদে, একবছর বাদে এইদিনে আমি এই মঞ্চে আসতে পারব কি?

 বানানো বানানো কিছু শব্দ, শ্রোতারা যা শুনতে ভালোবাসেন, উনি বললেন আমার প্রতি আপনাদের এই কৃতজ্ঞতা, এই ভালোবাসা, আমি কীভাবে এর প্রতিদান দেব?

মন চলে গেল বিয়াল্লিশ বছর আগের পৃথিবীতে।

এলেন তখন এক অষ্টাদশী সুন্দরী, সপ্রতিভ, বহির্মুখী। চাকরি করছে স্কট ইন্ডাসট্রি নামে একটি সংস্থাতে। ইন্ডিয়ানা প্রদেশের গ্যারিতে। সহকর্মীদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়া, একদিন মাইলো স্কট এসেছিলেন এই প্ল্যান্ট পরিদর্শন করতে। সহকর্মীরা সবাই মিলে এলেনকেই পাঠাল, তার সাথে থাকার জন্য।

মাইলো স্কটের বয়স কতই বা হবে? সবেমাত্র তিনের দশকে প্রবেশ করেছেন। লম্বা এবং রোগা, দেখতে খুব একটা খারাপ নন। এলেন ভেবেছিল, ভদ্রলোক মুখচোরা, সব ব্যাপারে উদাসীন।

মিস ডুড্যাস, আপনাকে খাটাচ্ছি বলে আমার খারাপ লাগছে, কাজের ক্ষতি হল কি?

না-না, আমি কিছু মনে করছি না।

 কথা শুরু হল, ভাবতেই পারা যাচ্ছে না। বি স্কটের ভাইয়ের সাথে আমি এত সহজে কথা বলতে পারছি।

মাইলো স্কট সত্যি সত্যি শ্রমিকের সমস্যা নিয়ে ভাবতে চাইছেন। এলেন তাকে একটির পর একটি ডিপার্টমেন্ট ঘুরিয়ে দেখাল। কোথায় কী ধরনের কাজ হয়, তা বলার চেষ্টা করল।

–ব্যাপারটা বিরাট, এলেন, আমি তো ভাবতেই পারিনি।

ভদ্রলোককে দেখে মনে হচ্ছে, উনি বুঝি এক ছোট্ট শিশু, ওনাকে আরও অভিজ্ঞ করে তুলতে হবে।

অ্যাসেমব্লি সেকশনে ওই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। মাথার ওপর একটা কেবল তার আছে, সেখানে ধাতুর বার রয়েছে। লোহার ভারী ওজন। সেটা নীচের দিকে নেমে রয়েছে। মাইলো স্কট ঠিক তার তলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এলেন সেটা দেখতে পেল। সেকেন্ডের ক্ষণ ভগ্নাংশের মধ্যে সে মাইলো স্কটকে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। একটু বাদেই দুটো বড়ো বড়ো ধাতুর বার আছড়ে পড়ল, এলেনের মাথার ওপর। এলেন অজ্ঞান হয়ে গেল।

হাসপাতালে ঘুম ভাঙল তার। ফুলে ফুলে ভরে গেছে এই ঘরটি। যখন এলেন চোখ খুলল, সে ভাবল, আমি বোধহয় মরে গেছি, স্বর্গে পৌঁছে গেছি।

অর্কিডের পাশাপাশি প্রস্ফুটিত গোলাপ। লিলি এবং ক্রিসেনথেমাম, আরও অনেক কিছু, এলেন চিনতে পারল না।

একজন নার্স এলেন- আপনি উঠেছেন মিস ডুড্যাস, আমি এখুনি ডাক্তারকে খবর দিচ্ছি।

–আমি কোথায়?

ব্ল্যাক সেন্টারে, এটা একটা প্রাইভেট হাসপাতাল।

এলেন বিশাল সুইটের চারদিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল, এই খরচ সে জোগাবে কেমন করে?

–আপনি এবার তৈরি হোন।

-কীজন্য?

–প্রেসের লোকেরা অনেকক্ষণ ধরেই আপনার ইন্টারভিউ নেবার চেষ্টা করছেন। আপনার বন্ধুরা বার বার জানতে চাইছেন, আপনি কেমন আছেন? মিঃ স্কট কয়েকবার টেলিফোন করেছেন।

মাইলো স্কট? তিনি ভালো আছেন তো?

–হ্যাঁ, তার কিছু হয়নি। তিনি আজ সকালে এখানে এসেছিলেন। তখন আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন।

–তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?

-হ্যাঁ। নার্স চারদিকে চোখ বুলিয়ে বললেন, বেশির ভাগ ফুলের তোড়া উনিই তো পাঠিয়েছেন।

–অবিশ্বাস্য!

–আপনার মা-বাবা ওয়েটিং রুমে বসে আছেন। আপনি কি তাদের সাথে দেখা করবেন?

-হ্যাঁ, এখুনি করব।

 –ঠিক আছে, আমি ওঁদের পাঠিয়ে দিচ্ছি।

জীবনে এই হাসপাতালে আসতে পারবে, এলেন তা স্বপ্নেও ভাবেনি।

মা-বাবা ঘরে এলেন। এলেনের মা-বাবার জন্ম হয়েছে পোল্যান্ডে। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারেন। বাপ একজন মেকানিক, মধ্য পঞ্চাশ, রুক্ষ্ম মেজাজ, শুকনো চেহারা। মায়ের চেহারায় গ্রাম্য ছাপ আছে। উত্তর ইওরোপীয় টান আছে কথার মধ্যে।

এলেন, তোর জন্য কিছুটা স্যুপ এনেছি।

মম, হাসপাতালে ভালোই খাবার-দাবার দেয়।

–আমার স্যুপ তো পাবি না, তুই খেয়ে নে, তা হলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবি।

বাবা বলেছিল– সকালের কাগজ দেখছিস? আমি তোর জন্য একটা কপি এনেছি। এলেন কাগজটা পড়ে অবাক হয়ে গেল।

বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা আছে- ফ্যাক্টরির কর্মীর অসাধারণ কৃতিত্ব। নিজের জীবন বিপন্ন করে বসকে রক্ষা করার চেষ্টা।

প্রতিবেদনটা এলেন দুবার পড়ল।

–তুই আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছিস। এমন সাহস এল কোথা থেকে?

 এলেন অবাক হয়ে গেল। সাহস না ছাই। মুহূর্তের মধ্যে সে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল। সে হয়তো নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু? সব কেমন ওলোট-পালোট হয়ে গেল।

একটু বাদে মাইলো স্কট নিজে এলেন। তার হাতে ফুলের তোড়া।

তিনি বললেন- এগুলো আপনার জন্য। ডাক্তার বলেছেন আপনার আর কোনো ভয় নেই। আপনার কাছে আমি কীভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব…

-না-না, এত কথা বলছেন কেন?

–আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।

 এলেন উঠে বসার চেষ্টা করছিল। চিনচিনে বেদনা তার হাতে।

–আপনি ঠিক আছেন তো?

হ্যাঁ, এলেন কথা বলার চেষ্টা করল, ডাক্তার কখন আসবেন? ওঁরা কী বলেছেন?

–আপনার হাতের হাড় ভেঙে গেছে, তিন টুকরো হয়ে।

এর থেকে খারাপ খবর আর কিছু দেওয়া যায় কি?

এলেনের চোখ জলে ভরে উঠেছে।

 কীভাবে সবকিছু বলা যাবে? এলেন কেন কাঁদছে? সে তার বান্ধবীদের সাথে নিউইয়র্কে যাবার প্ল্যান করেছিল। দীর্ঘ ছুটি। ফ্যাক্টরির অনেকে যোগ দেবে। ম্যানহাটনে তারা যাবে। আমি এই ভ্রমণটাতে থাকতে পারব না।

পনেরো বছর বয়স থেকে এলেনকে কারখানায় কাজ করতে হয়েছে। সে স্বাধীনচেতা। নিজের পায়ে দাঁড়াতে ভালোবাসে। এখন সে ভাবল, উনি কি হাসপাতালের বিলটা দিয়ে দেবেন? এই ব্যাপারে আমার প্রশ্ন করা উচিত কি?

এলেন ঘুমাচ্ছন্ন কণ্ঠস্বরে বলতে থাকে ফুলের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, মিঃ স্কট। আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে, ভীষণ ভালো লাগছে।

এলেন ঘুমিয়ে পড়েছিল।

পরের দিন সকালবেলা। এক অভিজাত চেহারার মানুষ এসে এলেনের সুইটে প্রবেশ করলেন।

–শুভ সকাল, আপনি এখন কেমন আছেন?

–এখন ভালো আছি।

–আমি স্যাম নরটন। স্কট ইন্ডাসট্রির চিফ পাবলিকেশন অফিসার।

 তাই নাকি? আপনি কি এখানে থাকেন?

না, আমি ওয়াশিংটন থেকে উড়ে এসেছি।

–আমাকে দেখতে?

–না, আপনাকে সাহায্য করতে।

কী ব্যাপারে?

বাইরে প্রেসের লোকেরা অপেক্ষা করছেন। মিস আমার মনে হয় আপনি বোধহয় এর আগে কখনও প্রেস কনফারেন্সের মুখোমুখি হন নি। তাই আমি এসেছি।

–ওরা কী চাইছেন?

–ওরা জিজ্ঞাসা করবে, আপনি কীভাবে মিঃ স্কটের জীবন বাঁচিয়েছেন?

–ওটা তো খুবই সহজ। আমি সব কথা বলে দেব।

নরটন বললেন মিস ডুড্যাস, আমার মনে হয়, আপনাকে সাহায্য করা উচিত।

-কেন? এটা তো সত্যি।

এই মেয়েটি বোধহয় তার অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানে না।

 কিছু একটা এলেনের মনে ভিড় করল। সে চোখ খুলে জিজ্ঞাসা করল- আপনি কি মিঃ স্কটের সঙ্গে দেখা করবেন?

-হ্যাঁ।

–একটা কাজ করবেন?

–হ্যাঁ, বলুন।

–আমি জানি, এই অ্যাকসিডেন্টের অন্তরালে ওনার কোনো দোষ নেই। কিন্তু?

নরটন ভাবলেন, সত্যি কথাটা বলা কি ঠিক হবে? তিনি বললেন– বলতে থাকুন মিস ডুড্যাস।

এলেন বলতে থাকে আমার হাতে খুব একটা বেশি পয়সা নেই। হাসপাতালে শুয়ে আছি বলে বেশ কয়েক দিনের বেতন পাব না। আমি কি হাসপাতালের বিল মেটাতে পারব। যদি মিঃ স্কট কিছু ধার দেন, আমি ফেরত দেব।

নরটনের মুখে একটা অদ্ভুত সরলতা।

নরটন বুঝতে পারলেন, পৃথিবীর সকলে লোভী নয়। তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ঝুঁকে এলেনের মুখে চুম্বন দিলেন। মহিলা সম্পর্কে ধারণা একেবারে পালটে গেল।

তিনি অনেকক্ষণ এলেনের পাশে বসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন– এলেন, মনে হচ্ছে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী হবে। যখনই কোনো সমস্যা হবে, টাকার ব্যাপারে, আমার সাহায্য নিতে ভুলবেন না যেন। এবার আসুন আমরা প্রেস কনফারেন্সের জন্য তৈরি হই।

-কী বলতে হবে, তা আমাকে বুঝিয়ে দেবেন? আমি কেন মাইলো স্কটের জীবন বাঁচিয়েছি, তাই তো? আমি যদি এইভাবে বলি– আমি স্কট ইন্ডাসট্রির একজন কর্মচারী, আমি যখন দেখলাম মাইলো স্কটের মাথার ওপর বিপদ ঝুলছে, আমি ওনাকে বাঁচিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলাম। এর জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করতে হয়েছে আমাকে।

–হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। একটু হাসি- ওকে।

–তাহলেই যথেষ্ট হবে তো? মিঃ নরটন, আমি জানি না, কেন এভাবে আমাকে শেখাতে হচ্ছে।

উনি হাসলেন– এটা হল আমাদের গোপন ব্যাপার।

অন্তত চব্বিশজন সাংবাদিক এসে গেছেন, আলোকচিত্রিদের ভিড় লেগেছে– আকাশবানী, খবরের কাগজ এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে। অসাধারণ গল্প, প্রেস এই গল্পটা ভালোভাবে ছাপাতে চাইছে। বলা হচ্ছে, সুন্দরী এক তরুণী কর্মচারী তার বসের জীবন রক্ষার জন্য অসম সাহসের কাজ করেছেন।

মিস ডুড্যাস, যখন আপনি দেখলেন, ওই লোহার বারটা নীচে নেমে আসছে, প্রথমে আপনি কী ভেবেছিলেন?

এক সাংবাদিকের এই প্রশ্ন শুনে এলেন ক্ষণকালের জন্য স্যাম নটনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর বলেছিল আমার মনে হয়েছিল, মিঃ স্কটকে বাঁচাতে হবে। যদি উনি দুর্ঘটনায় মারা যান, তাহলে নিজেকে দোষারোপ করতে হবে। সারাজীবন আমি বিবেকের দংশনে আঘাত পাব।

প্রেস কনফারেন্স তরতর করে এগিয়ে চলেছে। যখন স্যাম নরটন দেখলেন এলেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, তিনি বললেন, উপস্থিত সাংবাদিকরা, এখানেই কথা বলা শেষ করা উচিত। উনি এখনও সুস্থ নন। ওনাকে এবার ঘুমোতে হবে।

এলেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের মধ্যে একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখেছিল সে। এমপায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর লবিতে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ভেতরে ঢোকার অনুমতি পায়নি। কারণ টিকিট কেনার পয়সা তার হ্যান্ডব্যাগে নেই।

বিকেলে মাইলো স্কট এলেনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। মাইলোকে দেখে এলেন আবার অবাক হয়ে গেছে। এলেন শুনেছিল, মাইলো নিউইয়র্কের বাসিন্দা।

–আমি শুনেছি, আপনি খুব সুন্দরভাবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আপনাকে এক অভিনেত্রীর মতো লাগছে।

–মিঃ স্কট, আমি তো আপনাকে সব কিছুই বলেছি। আমি একজন অভিনেত্রী নই। কিন্তু তখন আমি বিবেকের ডাকে এই কাজটা করেছি।

–আমি জানি, স্যাম নরটন আমাকে সব বলেছেন। এলেন, সাধারণ মানুষের জীবনেও এই বীরত্ব লুকিয়ে থাকে। নিজেকে বাঁচাবার কথা একবারও আপনি ভাবেননি, এটাই আপনার চরিত্রের মহান দিকটিকে ফুটিয়ে তুলেছে।

আমি একটা ব্যাপার আপনাকে বলতে চাই।

–স্যাম বলেছে, হাসপাতালের বিল তো? এ দায়িত্ব আমরা নেব। কয়েক দিনের মাইনে? উনি হাসলেন, মিস ডুড্যাস, আপনি কি জানেন, আপনার কাছে আমি কতখানি কৃতজ্ঞ।

–এত কিন্তু-কিন্তু করবেন না।

–ডাক্তাররা বলেছে, আগামীকাল আপনি হাসপাতাল থেকে ছুটি পাবেন। কাল. আমার সঙ্গে ডিনার খাবেন কি?

এলেন ভাবল, কারো সহযোগিতা এইভাবে ভিক্ষা করা উচিত কি?

 আরও একবার স্কট বললেন– ঠিক আছে, কাল তাহলে ডিনারে…

এভাবেই গল্পটা শুরু হয়েছিল। মাইলোস্কট প্যারিসে এক সপ্তাহ থেকে গেলেন। প্রতি রাতে এলেনের সঙ্গে তার দেখা হত। এলেনের মা-বাবা সন্তুষ্ট, তারা বলেছিলেন, সাবধানে থাকিস। তোর প্রতি এতখানি সদয় কেন উনি? ব্যাপারটার মধ্যে রহস্য আছে।

ধীরে ধীরে এলেনের মন পাল্টে গেল। এলেন বুঝতে পারল, মাইলো স্কট এক ভদ্রলোক। আমার সাহচর্য উনি ভালোবাসছেন। মাইলোকে লাজুক এবং আত্মকেন্দ্রিক বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে উনি তা নন। এলেন খোলামেলা, হো হো করে হাসতে ভালোবাসে। মাইলো সারা জীবনে অনেক মহিলার সংস্পর্শে এসেছেন। অনেকেই স্কট সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী হতে চেয়েছে। তারা বিচিত্র খেলা খেলেছে। এই জীবনে তিনি এলেনের মতো এক মহিলার সন্ধান আগে কখনও পাননি। পরিচয় নেই, এমন এক পুরুষের জন্য কেউ জীবন উৎসর্গ করতে পারে? মনে মনে যে মহিলার কল্পনা তিনি করেছিলেন, এলেনের মধ্যে তারই প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছেন। এলেন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী, আকর্ষণীয়া, আর সব সময় এক কৌতুকপ্রিয়তার জগতে বাস করতে ভালোবাসে। সাতদিন কেটে গেল। দুজনেই অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন, ইতিমধ্যেই তাদের মনে প্রেমের বিকাশ ঘটেছে।

মাইলোস্কট বললেন আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি। তুমি কি আমার প্রস্তাবে রাজী হবে?

এলেন সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছিল। আসলে সে কখনোই বড়োলোকের ফাঁদে পড়বে না। সে জানে, এইসব ব্যবসাদাররা হৃদয়হীন হয়ে থাকেন। স্কট পরিবারের যথেষ্ট খ্যাতি আছে। আমি কেন ইচ্ছে করে ওই বৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করব? বোকর ভূমিকাতে অভিনয় করব না। কিন্তু এলেন জানত, সে এমন একটা খেলায় নেমেছে, যেখানে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।

কিছুদিন বাদে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। গ্রিনউইচে। এলেন এল মানহাটনে। পরিবারের অন্য সকলের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য।

বাইরন স্কট তার ভাইকে এই বলে সম্বোধন করেছিলেন শেষ পর্যন্ত তুই একটা পোল দেশীয় উদ্বাস্তু কন্যাকে বিয়ে করলি? তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?

সুসানও একান্তে স্বামীকে বলেছিলেন- মেয়েটা অর্থের লোভে মাইলোকে বিয়ে করেছে। যখন তার স্বপ্ন ভেঙে যাবে, তখন পাততাড়ি গুটিয়ে পালিয়ে যাবে। আমি বলছি, এ বিয়েটা বেশি দিন টিকবে না।

হায় ভাগ্য, ওঁরা কেউই এলেন ডুড্যাসকে বুঝতে পারেননি।

এলেন বলেছিল- তোমার ভাই আর ভাইয়ের বউ আমাকে পছন্দ করছেন না। কিন্তু আমি তো ওঁদের বিয়ে করিনি। আমি তোমাকেই বিয়ে করেছি। তোমার আর আমার মধ্যে যেন কেউ না আসে। ব্যাপারটা তোমাকে দেখতে হবে। যদি মনে হয় তুমি আমাকে সহ্য করতে পারছ না, তা হলে এখনই মুখের ওপর বলে দাও। আমি বিদায় জানিয়ে চলে যাব।

মাইলো বউকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ভালোবাসা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

মাইলো বলেছিলেন– আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমার সাহসকে শ্রদ্ধা করি, যখন বাইরন আর সুসান তোমার সম্পর্কে সব কিছু জানতে পারবে, দেখবে ওরা কতখানি পাল্টে গেছে।

বরকে জড়িয়ে ধরে এলেন ভেবেছিল, ছেলেটা এখনও বোকা। একে আরও বেশি ভালোবাসা দিতে হবে।

কিছুদিনের মধ্যেই এলেন নতুন পরিবারে মানিয়ে নিল। এখন বাইরন আর সুসানের সঙ্গে সম্পর্কটা অনেক সহজ সরল হয়ে এসেছে। ওই দুজনের চোখে এলেন এক ছোট্ট পোল দেশীয় কন্যা, যে স্কট ফ্যাকটরিতে চাকরি করে।

এলেন ভালোভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করল। বোঝার চেষ্টা করল। সে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল মাইলোর বন্ধুদের স্ত্রীদের দিকে, তারা কীভাবে পোশাক পরেছে, কেমন করে কথা বলছে, সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত। কিছুদিন বাদেই সে মাইলো সমাজের অন্যতম হয়ে উঠল। এটা তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।

.

এলেন মাইলোর চারপাশে নিরাপত্তা বলয় রচনা করেছে। সব কাজে মাইলোকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। স্কট ইন্ডাসট্রির অবস্থানটা বড়োই অদ্ভুত। সমস্ত সম্পত্তির মালিক বাইরন। বাইরনের ছোটোভাই এক মাইনে করা কর্মচারী মাত্র। বাইরন মাঝে মধ্যেই ভাইয়ের প্রতি অপমানজনক উক্তি করেন। মাইলোর কাঁধে ভারী ভারী কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। কেউ তাকে প্রশংসা করে না।

ব্যাপারটা এলেনের চোখে মোটেই ভালো লাগেনি। এলেন এ নিয়ে মাঝে মধ্যেই প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছে।

সময় এগিয়ে চলল। এলেন বুঝতে পারল, মাইলো চরিত্রের দিক থেকে খুবই দুর্বল ধরনের। তিনি কোনো একজনের সাহায্য চাইছেন। এলেন বুঝতে পারল মাইলো কখনওই এই কোম্পানিকে ছাড়তে পারবেন না।

ঠিক আছে, এলেন চিন্তা করল, একদিন এই কোম্পানিটা তো আমার স্বামীর হাতে আসবে, বাইরন চিরদিন বাঁচবেন না। মাইলো হলেন তার একমাত্র উত্তরাধিকারী।

শেষ অব্দি সুসান স্কট একদিন ঘোষণা করলেন, তিনি গর্ভবতী। সংবাদটা এলেনকে আঘাত করেছিল। তার মানে? ওই শিশুটি বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হবে?

একদিন বাইরন স্কট বলল, মেয়ে হয়েছে। কিন্তু আমি তাকে শেখাব কীভাবে কোম্পানি চালাতে হয়।

বেজন্মা, এলেন ভেবেছিল।

মাইলো হেসে জবাব দিয়েছিল দেখেছ, কেমন ফুটফুটে একটা পরী এসেছে আমাদের পরিবারে!