১. গল্প শুরুর আগে

দি ডুমস ডে কনসপিরেসি (ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র) –- সিডনি সেলডন

গল্প শুরুর আগে

কমান্ডার রবার্ট বেলামি মার্কিন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তাঁকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজে পাঠানো হয়েছে। সুইজারল্যান্ডে একটি আবহাওয়া বেলুন ধ্বংস হয়ে গেছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য ছিল। বেলামির দায়িত্ব হল দশজন প্রত্যক্ষদর্শীকে খুঁজে বের করা, তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, তারা যাতে সব বিবরণ গোপনীয়তার মধ্যে জানাতে পারে, তা দেখা।

এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেলামির একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাকেও চক্রান্তের শিকার হতে হচ্ছে। একটা অনিয়ন্ত্রিত শক্তি তার ওপর কঠিন কঠোর নজর রেখেছে। এই বেলুন ধ্বংস হওয়াটা মারাত্মক ষড়যন্ত্রের অংশবিশেষ, যে ষড়যন্ত্রটা অবিশ্বাস্য এবং ভয়ঙ্কর।

ওয়াশিংটন থেকে জুরিখ, রোম থেকে প্যারিস, এই গল্প বেলামির জীবনের অতীতকে প্রকাশ করেছে। যে রমণীকে তিনি ভালোবাসতেন, সেই রমণী কেন ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারেননি? বন্ধুরা কেন তার ভয়ঙ্কর শত্রুতে পরিণত হয়েছেন? শুধু তাই নয়, সুইজারল্যান্ডের আল্পস পাহাড় চূড়ায় সত্যি সত্যি কী ঘটনা ঘটেছিল, বেচারী রবার্ট বেলামি তা কোনোদিন জানতেই পারবেন না।

জীবন কাটাও উত্তেজনাকর মুহূর্তের মধ্যে একটি প্রাচীন চিনা প্রবাদ।

অবতরণিকা

উটেনডরফ সুইজারল্যান্ড, রোববার, ১৪ই অক্টোবর, তিনটে বেজে পঞ্চাশ মিনিট। এখানে বিরাজ করছে ভয়ঙ্কর নীরবতা। কথা বলা যাচ্ছে না। দুঃস্বপ্নের আভাস। প্রত্যেক প্রত্যক্ষদর্শীর মনে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। একজন অজ্ঞান হয়ে গেছে, একজন বমি করছে, এক ভদ্রমহিলা কাঁপছে। অন্য একজন ভাবছে, আমার বোধহয় হার্ট অ্যাটাক হবে। বয়স্ক ধর্মযাজক মালা জপছেন। বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকছেন। পিতা-পিতা, আমাকে রক্ষা করুন। সকলকে রক্ষা করুন। এই ভয়ঙ্কর ঘটনার হাত থেকে। আমরা শেষ পর্যন্ত শয়তানকে দেখতে পেয়েছি। পৃথিবীর শেষের সেদিন ঘনিয়ে এসেছে। বিচারের দিন।

.

আমরা সেডন এভানে, রোরবার, ১৪ অক্টোবর, রাত নটা।

.

একটা খবর এসেছে, অত্যন্ত গোপনীয়। এন এস থেকে পাঠানো হয়েছে কমসেকের ডেপুটি ডাইরেক্টরের কাছে। কী বিষয়ে? অপারেশন ডুমস ডে।

রোববার, অক্টোবর ১৪, নটা বেজে পনেরো মিনিট। একটা ফ্ল্যাশ মেসেজ, বলা হয়েছে চরম গোপনীয়। এন এস-র কাছ কাছ থেকে ডেপুটি ডিরেক্টর। লেখা আছে নেভাল ইনটেলিজেন্স, ১৭ ডিস্ট্রিক্ট, বিষয় কমান্ডার রবার্ট বেলামি।

এখনই কাজ শুরু করতে হবে।

সংবাদটা শেষ হয়ে গেছে।

.

প্রথম পর্ব

শিকার

০১.

সোমবার, ১৫ই অক্টোবর

.

হাসপাতালটা লোকে পরিপূর্ণ। ভিয়েতনাম। সুশান বিছানাতে ঝুঁকেছেন। ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। সাদা নার্সের পোশাক। বলছেন- ঘুম ভাঙুক নাবিক, আমি আপনাকে মরতে দেব না।

সুশানের কণ্ঠস্বর, নাবিক যন্ত্রণা ভুলে গেছেন। টেলিফোনের শব্দ। রবার্ট বেলামি জেগে উঠেছেন। ঘুমটা ভাঙাতে চাইছেন না। সকাল চারটে। টেলিফোন ধরছেন– এখন কি ডাকার সময়?

-কমান্ডার বেলামি?

 পুরুষ কণ্ঠ।

-হ্যাঁ।

–আপনার জন্য একটা জরুরি খবর আছে। আপনি এক্ষুনি ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির হেড কোয়াটারে চলে যান। জেনারেল হিলিয়াড আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। ঠিক ছটার সময়।

কমান্ডার রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। অবাক হলেন। কী ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছেন না।

সুশান আগের সন্ধ্যাবেলা ফোন করেছিলেন রবার্ট?

 সুশানের কণ্ঠস্বর- হ্যালো সুশান।

 তুমি ভালো আছে তো, রবার্ট?

দারুণ আছি।

তারপর? এখন বেলামিকে তৈরি হতেই হবে। সময় দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, সুশানের কথা মনে পড়ছে কেন?

তিনি বিছানা থেকে উঠলেন। লিভিংরুমের দিকে চলে গেলেন। খালি পায়ে। সুশান নেই, কেমন অগোছালো পরিবেশ। সুশানের ছবি চারদিকে ছড়ানো আছে। স্মৃতির অনুবর্তন- তারা স্কটল্যান্ডে গিয়ে মাছ ধরছেন। থাইল্যান্ডের একটি বুদ্ধ মন্দিরের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। রোমে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রত্যেকটা ছবি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

উনি কিচেনে গেলেন, কফি তৈরি করলেন। ভোর চারটে বেজে পনেরো মিনিট, কিচেন ক্লকঘোষণা করছে। একটি নাম্বারে ফোন করলেন। কণ্ঠস্বর শোনা গেল।–অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার?

-হ্যালো?

—অ্যাডমিরাল?

ইয়েস।

-আপনার ঘুম ভাঙানোর জন্য দুঃখিত স্যার। ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির কাছ থেকে একটা ফোন এসেছে।

-কেন?

 –আমি জানি না, ছটার মধ্যে জেনারেল হিলিয়াডের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

–তোমাকে বোধহয় ট্রান্সফার করা হবে।

 –কিছুই বুঝতে পারছি না।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রবার্ট, তুমি মিটিং-এর পর আমাকে ফোন করো, কেমন?

নিশ্চয়ই করব, স্যার।

কানেকশনটা কেটে গেল। রবার্ট ভাবলেন, এই বৃদ্ধ লোককে চিন্তা করিয়ে কী লাভ? উনি নেভাল ইনটেলিজেন্সের প্রধান ছিলেন, দু-বছর আগে। ওনাকে জোর করে অবসর দেওয়া হয়েছে। একটা গুজব আছে, নেভি তাকে বাজে জায়গায় ফেলে দিয়েছিল। উনি যেতে রাজী হননি।

কফির কাপটা বাথরুমে ঢেলে দিলেন তিনি। আয়নায় নিজের ছবি দেখলেন। বছর চল্লিশ বয়স হয়েছে। সুঠাম চেহারা, পাতলা শরীর চোখে মুখে আভিজাত্য। ঘন কালো চুল। কালো চোখ। বুকে একটা দাগ আছে। একবার বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন, তারই স্মৃতিচিহ্ন।

সুশান? সেটা তো অতীত। এখন বর্তমান। উনি চান করলেন, দাড়ি কামালেন। ক্লোসেট থেকে পোশাক বার করলেন। তারপর? নতুন অভিযান।

.

০২.

ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি, বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থিত। সি আই এ-র অফিসের থেকেও দ্বিগুণ।

তখনও অন্ধকার, কমান্ডার বেলামি প্রথম গেটে ঢুকলেন।

 রিসেপশনিস্ট এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল আপনাকে কীভাবে সাহায্য করব?

–আমি কমান্ডার বেলামি। জেনারেল হিলিয়াডের সঙ্গে দেখা করব।

–আপনার পরিচয়পত্র দেখাবেন কি?

 রবার্ট বেলামি ওয়ালেট বার করলেন। আই ডি কার্ডটা তুলে নিলেন।

ধন্যবাদ, কমান্ডার।

এবার এগিয়ে যাওয়ার পালা।

এক মিনিট কেটে গেছে। রবার্ট বেলামি একটা বৈদ্যুতিক গেটের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সশস্ত্র প্রহরী এগিয়ে এল কমান্ডার বেলামি?

-হ্যাঁ।

আপনার পরিচয়পত্র?

একই ঘটনা। এটা কি চিড়িয়াখানা নাকি? ওনাকে ওয়ালেট খুলতে হল। কী আর করা যাবে।

আর এক ইউনিফর্ম পরা সশস্ত্র প্রহরী এগিয়ে এসেছে। বেলামি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছেন না। সে গাড়ির লাইসেন্স প্লেটের দিকে তাকাল। তারপর বলল- আপনি সোজা এগিয়ে যান। সামনেই প্রশাসক ভবন। সেখানে কেউ একজন থাকবেন।

দরজাটা খুলে গেল। রবার্ট গাড়িটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। বিরাট সাদা বাড়ি। সাধারণ পোশাক পরা এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন।

অক্টোবরের ঠাণ্ডা তাঁকে কাঁপিয়ে দি

য়েছে। –এখানে আপনার গাড়িটা রাখতে হবে, কমান্ডার। আমরা এর দেখাশোনা করব।

 রবার্ট বেলামি গাড়িটা রাখলেন।

–আমি হ্যারিসন কেলার। আমি আপনাকে জেনারেল হিলিয়াডের অফিস পর্যন্ত নিয়ে যাব।  

ওঁরা পাশাপাশি হেঁটে চলেছেন। কমান্ডার বেলামি?

 ক্যামেরার শব্দ। ধন্যবাদ।

রবার্ট কেলারের দিকে তাকলেন– কী?

মাত্র এক মিনিট সময় লাগবে। এক মিনিট কেটে গেছে। রবার্ট বেলামির হাতে একটা পরিচয়পত্র তুলে দেওয়া হল। এর ওপর ছবি লাগানো আছে।

–এটা সবসময় পরে ঘুরবেন।

–ঠিক আছে।

 বিরাট করিডর। বেলামি বুঝতে পারছেন, অনেকগুলো সিকিউরিটি ক্যামেরা তাক করা আছে হলের দুপাশে।

–কত বড়ো এই বাড়িটা?

 –কুড়ি লক্ষ স্কোয়ার ফুট, কমান্ডার।

–কী বলছেন?

-হ্যাঁ, এটা হল পৃথিবীর সবথেকে লম্বা করিডর। ৯৮০ ফুট। এখানে শপিং সেন্টার আছে, কাফেটেরিয়া, পোস্টাফিস, স্ন্যাক্স বার, হাসপাতাল, দাঁতের ডাক্তারের চেম্বার, স্টেট ব্যাঙ্কের অফিস, ড্রাই ক্লিন শপ, জুতোর দোকান, নাপিতের দোকান। আরও কত কি?

তার মানে? বাড়ির বাইরে একটা বাড়ি, তাই তো? রবার্ট ভাবলেন।

কত জন কাজ করেন?

 –অন্তত ষোলো হাজার।

 রবার্ট কেলারের মনে হল, এখানে আমার কী দরকার?

অবশেষে দুজনের দেখা হল।

 মনে হচ্ছে, এটা বোধহয় চায়ের আসরে নেমতন্ন। দুজনে হাতে হাত দিলেন।

বসুন, এক কাপ কফি খেতে খেতে কথা বলব।

 ইয়েস, স্যার।

–হ্যারিসন?

ধন্যবাদ।

 বাজারে শব্দ হল।

দরজাটা খুলে গেল। ট্রে-তে করে কফি। ড্যানসি পেস্ট্রি। রবার্টের বুকে প্রতীক চিহ্নটি নেই। কফি ঢালা হয়েছে। অসাধারণ গন্ধ।

জেনারেল জানতে চাইলেন- আপনি কী খাবেন?

ব্ল্যাক কফিটা দারুণ

–ডিরেক্টর বলেছেন, আমি যেন আপনার সঙ্গে দেখা করি।

 –ডিরেক্টর? এডওয়ার্ড হ্যাঁন্ডারসন? বাইরের জগতের এক মহানায়ক। হৃদয়হীন বলা হয় তাকে। জনগণের সামনে কখনও দেখা যায় না।

–আপনি কতদিন নেভাল ইনটেলিজেন্স গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত আছেন?

 রবার্ট বললেন- পনেরো বছর।

তার আগে আপনি ভিয়েতনামের এয়ার স্কোয়াড্রন ছিলেন। কী তাই তো?

 –হ্যাঁ, স্যার।

 –সেখানে আপনি কী করেছেন?

 ডাক্তারের কথা মনে পড়ল হ্যাঁ, বিপদের হাত থেকে বেঁচে গেছেন রবার্ট। সুশানের কথাও মনে পড়ল। চোখ খোলো। আমি তোমাকে মরতে দেব না। আহা, কী সুন্দর মুখখানা, ঘন কালো চুল। বাদামী চোখের তারা। ঈশ্বরের আশীবাদের মতো হাসি। রবার্ট কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বলতে পারেননি।

জেনারেল হিলিয়াড কিছু বলার চেষ্টা করছেন।

 রবার্ট অতীতে হারিয়ে গিয়েছিলেন। এবার ফিরে এলেন বর্তমানে।

আমাদের একটা সমস্যা হয়েছে, কমান্ডার আপনার সাহায্য চাইছি। ব্যাপারটা খুবই গোপনীয়। গতকাল সুইজ আলপসে আমাদের একটা বেলুন ধ্বংস হয়ে গেছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামরিক বস্তু ছিল। বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটার মধ্যে কতখানি গুরুত্ব লুকিয়ে আছে।

রবার্ট ভাবতেই পারছেন না, কেন তাকে ডেকে এসব কথা বলা হচ্ছে।

-সুইস সরকার ওই বেলুন থেকে জিনিসগুলো সরিয়ে নিয়েছে। মনে হচ্ছে, দুর্ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী আছে। এটা খুব উল্লেখযোগ্য। তারা কী রেখেছেন, সেটা জানতে হবে। আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন।

-হ্যাঁ, আমি ওদের সাথে কথা বলব। ওদের পেট থেকে কথা বার করতে হবে। তাই তো?

–ঠিক তা নয়, ওদের সাথে যোগাযোগ করুন।

–ওরা সকলেই কি সুইজারল্যান্ডের বাসিন্দা।

না, আমরা ঠিক জানি না। ওঁরা কোথা থেকে এসেছেন। অথবা ওঁরা আসলে কে? ওঁদের একটি মাত্র খবর আমাদের হাতে আছে। তা হল, ওঁরা সকলেই টুরিস্ট। তারা ওই অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছিলেন। পাশেই একটা গ্রাম, সেখানে বেলুনটা ধ্বংস হয়।

উনি হ্যারিসন কেলারের দিকে তাকালেন- উটেনডরফ।

জেনারেল আবার রবার্টের দিকে তাকালেন, ভ্রমণার্থীরা বাস থেকে নেমে পড়েছিলেন। তারা ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর তারা যে যার জায়গায় ফিরে গেছেন।

-জেনারেল হিলিয়াড, তাদের কোনো রেকর্ড নেই, তাহলে কীভাবে বের করব?

–আপনি ঠিকই ধরেছেন। আপনাকে আরও তৎপর হতে হবে আমি জানি, আপনার পটভূমি চমৎকার। আপনাকে এন এস-তে ট্রান্সফার করা হল।

–আমি ভাবছিলাম, সুইজ সরকারের সঙ্গে কাজ করব।

না, আপনাকে একাই করতে হবে। আমি অন্য কাউকে এই ব্যাপারে জড়াতে চাইছি না। ব্যাপারটার গুরুত্ব আছে বলে বুঝতে পারছেন।

জেনারেল একটি চিরকুট লিখে রবার্টের হাতে দিয়ে বললেন- যখনই প্রয়োজন হবে এখানে এসে যোগাযোগ করবেন, আপনার জন্য একটা প্লেন অপেক্ষা করছে। ওই প্লেন আপনাকে জুরিখে নিয়ে যাবে। এখন থেকে আপনার ওপর নিরাপত্তা থাকবে। আপনাকে আমাদের লোক অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যাবে। যা দরকার, সঙ্গে সঙ্গে প্যাক করুন। এখনই এয়ারপোর্টে চলে যান।  

–ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করে দেখছি।

তারপর? কেলারের হাতে ফাইল ক্যাবিনেট। উনি একটা মস্ত বড়ো ম্যানিলা এনভেলপ রবার্টের হাতে তুলে দিলেন।

বিভিন্ন ইউরোপিয়ান মুদ্রায় ৫০ হাজার ডলার আছে। এছাড়া আর ২০ হাজার ইউ এস ডলার দেওয়া হল। আপনাকে আরও কিছু স্মারকপত্র দেওয়া হবে, লুকিয়ে থাকার আদর্শ মুখোশ।

জেনারেল হিলিয়াডের মুখে শয়তানি হাসির টুকরো। একটা ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হল।

-ওটা হয়তো লাগবে না। জেনারেল যে পরিমাণ ক্যাশ দিয়েছেন, তাতে যথেষ্ট হবে। আমার হাতে একটা ক্রেডিট কার্ড আছে।

সেটাও নিতে হবে।

–ঠিক আছে, রবার্ট কার্ডটা পরীক্ষা করলেন। এমন একটা ব্যাঙ্কের নাম লেখা আছে, যার নাম রবার্ট কখনও শোনেননি।

এটা ব্ল্যাঙ্ক চেক-এর সমান। এর জন্য কোনো তথ্য বা নথির দরকার হয় না। এই কার্ডের ওপর যে টেলিফোন নম্বর দেওয়া আছে সেটা করলেই হবে। সব সময় কার্ডটা রাখবেন। ওই প্রত্যক্ষদর্শীদের খুঁজে বের করতেই হবে– সকলকে। এখন থেকেই কাজটা শুরু হল।

মিটিং শেষ হয়ে গেছে। হ্যারিসন কেলার রবার্টকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

ইনি ক্যাপটেন ডগারথি, উনি আপনাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবেন। ওঁরা হাতে হাত দিলেন।

কমান্ডার, আপনি তৈরি? ক্যাপটেন ডগারথি জানতে চাইলেন।

 কীসের জন্য তৈরি? রবার্ট ভাবলেন। তিনি আবার বললেন আমাকে আদেশ করা হয়েছে, আপনি সোজা অ্যাপার্টমেন্টে যাবেন, সেখান থেকে অ্যানড্রজ এয়ারফোর্স বেসে। ওখানে একটা প্লেন আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

রবার্ট বললেন- আমি প্রথমে আমার অফিসে যাব।

-ঠিক আছে, আমি সেখানে আপনার সঙ্গে যাব। গাড়িতে অপেক্ষা করব।

 তার মানে? রবার্টকে এখন চোখের আড়াল করা সম্ভব নয়।

ক্যাপ্টেন ডগারথি বললেন–আপনার গাড়ির ব্যবস্থা আমরা করছি। এখন থেকে আপনি সরকারী গাড়িতে যাবেন।

জীবনের একটা নতুন অভিজ্ঞতা শুরু হল রবার্ট ভাবলেন।

.

০৩.

অটোয়া, কানাডা, রাত বারোটা।

তার কোড নাম জানুস। বারোজন লোকের সঙ্গে কথা বলছেন। মিলিটারি কমপাউন্ডের মধ্যে একটা ঘর।

–আপনারা সকলেই জানেন, অপারেশন ডুমস ডে আবার শুরু হয়েছে। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী আছেন। তাদের সকলকে খুঁজে বের করতে হবে।

 রাশিয়ান ভদ্রলোক বললেন- আমরা কী করে করব?

–ওনার নাম কমান্ডার রবার্ট বেলামি।

তাকে কীভাবে নির্বাচন করা হয়েছে? জার্মান ভদ্রলোকের প্রশ্ন।

উনি নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কম্পিউটার সার্চ করে ওনার নাম পাওয়া গেছে।

জাপানি ভদ্রলোক জানতে চাইলেন– ওনার যোগ্যতা?

উনি একজন পরিণত ফিল্ড অফিসার। ছটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। অসাধারণ রেকর্ড আছে। বারবার উনি নিজের অপরাজেয়তা প্রমাণ করেছেন। ওনার কোনো আত্মীয় পরিজন নেই।

-উনি এই ব্যাপারটার গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল?

–নিশ্চয়ই, আমরা বুঝতে পারছি, উনি হয়তো সবকটা প্রত্যক্ষদর্শীকে জোগাড় করে ফেলবেন।

-উনি কি জানেন, এই অভিযানের উদ্দেশ্য কী?

প্রশ্নটা করেছেন এক ফরাসি ভদ্রলোক।

-না।

 –তাহলে এই প্রত্যক্ষদর্শীদের জোগাড় করে কী লাভ?

চিনা ভদ্রলোকের প্রশ্ন।

–ওনাকে যথেষ্ট অর্থ দেওয়া হবে।

.

০৪.

 নেভাল ইনটেলিজেন্স-এর হেড কোয়ার্টার। মস্ত বড়ো। পেন্টাগনের পঞ্চমতলা জুড়ে অবস্থিত। পৃথিবীর সবথেকে বড় অফিস বিল্ডিং।

অফিসের মধ্যে সমুদ্র-সচেতন আবহাওয়া। ডেস্ক এবং ফাইল ক্যাবিনেটগুলোর রং অলিভ সবুজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এমনটি করা হয়েছে।

ডেস্কের ভদ্রলোক বললেন- কমান্ডার, শুভ প্রভাত। আপনার পাশ দেখাবেন কি? কমান্ডার এখানে সাত বছর ধরে কাজ করছেন। নিয়মটা একই রকম আছে। উনি পাশ দেখালেন।

ধন্যবাদ, কমান্ডার।

ক্যাপ্টেন ডগারথির কথা মনে পড়ে গেল রবার্টের। এক মহান ব্যক্তি, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

রবার্ট অফিসে গেলেন। সেক্রেটারি বারবারা ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে।

শুভ প্রভাত কমান্ডার, অ্যাকটিং ডিরেক্টর আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন।

 ওনাকে একটু অপেক্ষা করতে বলল। অ্যাডমিরাল হুইট্যাকারকে দাও, প্লিজ।

এক মিনিট বাদে রবার্টের সাথে অ্যাডমিরালের কথা হল।

রবার্ট, তোমার কথা বলা শেষ হয়ে গেছে?

কয়েক মিনিট আগে।

 কীরকম মনে হল?

ব্যাপারাটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কি আমার সঙ্গে ব্রেকফাস্টে আসবেন?

–হ্যাঁ, আমরা কোথায় যাব?

–আমি আপনার জন্য একটা পাশ রেখে যাচ্ছি।

এক ঘন্টার মধ্যে আসছি।

 রবার্ট রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ভাবলেন, আজ আমি অ্যাডমিরালের জন্য ভিজিটারস পাশ রাখছি। কয়েক বছর আগে আমি ছিলাম এক অনভিজ্ঞ তরুণ, ব্যাপারটা ভাবতে অদ্ভুত লাগছে।

ইন্টারকমটা বেজে উঠল।

কমান্ডার?

—অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার কখন আসবেন?

–এখনই আসবেন। ওনার জন্য একটা পাশের ব্যবস্থা করো।

 এবার, অ্যাকটিং ডিরেক্টরের কাছে রিপোর্ট দিতে হবে।

.

০৫.

ডাসটিন ফরনটন, নেভাল ইনটেলিজেন্সের অ্যাকটিং ডিরেক্টর। তাকে এক বিখ্যাত অ্যাথলেট বলা হয়ে থাকে। একসময়ে ফুটবল খেলায় যথেষ্ট নাম করেছিলেন। শক্তপোক্ত মানুষ। অ্যানাকোলিসের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। ভাগ্য আজ তাকে এখানে এনে দিয়েছে।

পুরোনো দিনের কথা তিনি আর মনে রাখতে চান না। এখন কাজে খুবই ব্যস্ত হয়েছেন।

তবুও মাঝে মধ্যে মনে পড়ে যায়, বিশেষ করে ইলিনরকে তিনি ভুলতে পারেন না। অসম্ভব যৌবনবতী চেহারা, কাম দ্বারা আচ্ছন্না। ডাসটিন ফরনটনের প্রেমে পড়েছিলেন ফুটবল খেলার আসরে। ভেবেছিলেন যে ছেলেটি এইভাবে বল খেলতে পারেন, না জানি তিনি শরীরের খেলায় কত ওস্তাদ হয়ে উঠবেন। যদি শরীরের মতোই পুংদণ্ডটা উদ্ধত হয়, তাহলে কী হবে?

ছমাস কেটে গেছে। ইলিনর এবং ডাসটিন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। এটাই হল শুরু, ডাসটিন তার শ্বশুরের হয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। তিনি এমন এক স্বপ্ন জগতের বাসিন্দা হয়ে গেলেন, যা আগে কখনও ভাবেননি।

উইলার্ড স্টোন, ফরনটনের শ্বশুরমশাই, এক রহস্যে ঢাকা মানুষ। অনেক অর্থের মালিক। রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে। কিন্তু সবকিছু গোপনীয়তার মধ্যে রাখতে ভালোবাসেন। সত্তর বছর বয়সে পা দিয়েছেন। সাবধানে চলাফেরা করেন। ঝকঝকে চেহারা, ধূর্ততার ছাপ।

ওনার সম্পর্কে অনেক গুজব আছে। তিনি নাকি মালয়েশিয়াতে তার এক প্রতিদ্বন্দ্বীকে খুন করেছিলেন। এক আমীরের প্রিয় পত্নীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। নাইজেরিয়াতে একটি সফল বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে ওই দেশের সরকার অনেক অভিযোগ এনেছিল। শেষ পর্যন্ত অভিযোগগুলো তুলে নেওয়া হল। এখানে অর্থের কথা বলা হয়, ঘুষ এবং উপঢৌকন। উনি নাকি গুরুত্বপূর্ণ নথি হাফিস করতে পারেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের হাওয়া করে দেন। স্টোন একাধিক রাষ্ট্রপতি এবং রাজার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। তাকে আমরা নগ্ন ক্ষমতার প্রতীক বলতে পারি। কলোরাডো পাহাড়ে তার বিরাট সম্পত্তি পড়ে আছে। প্রতি বছর সেখানে বিখ্যাত বিজ্ঞানী, শিল্পপতি এবং রাজনৈতিক নেতারা আসনে। তারা আলোচনায় যোগ দেন। অবাঞ্ছিত অতিথিদের আটকাবার জন্য সশস্ত্র পাহারা থাকে।

উনি মেয়ের বিয়েতে সম্মতি দিয়েছেন, বিয়েটা যাতে ভালোভাবে হয়, তা দেখেছেন। নতুন জামাইকে পেয়ে খুবই খুশি হয়েছেন। জামাইয়ের মধ্যে অনেকগুলো গুণ আছে।

বিয়ের পর বারো বছর কেটে গেছে। স্টোন ডাসটিনকে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত করে পাঠালেন। কয়েক বছর বাদে প্রেসিডেন্ট তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রপুঞ্জের দূত করে পাঠালেন। এবার অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার ও এন আই এ-র ডিরেক্টর থেকে অপসারিত হলেন। ফরনটন সেই জায়গাটা নিলেন।

একদিন উইলার্ড স্টোন তার জামাইকে বললেন- এটাই হল শুরু। তোমার জন্য অনেক বড়ো পরিকল্পনা আছে। তুমি ভাবতেই পারবে না।

দু বছর কেটে গেছে, রবার্টের সাথে ও এ আই এ-র অ্যাকটিং ডিরেক্টরের দেখা হল।

কমান্ডার, বসুন। আপনার রেকর্ড তো খুবই ভালো।

 উনি কী বোঝাতে চাইছেন?

ফরনটন বললেন- অ্যাডমিরাল হুইট্যাকারের খবর কী? ভাবতেই পারছি না, উনি কীভাবে অফিস চালিয়ে গেছেন। আমি আমার কাজগুলো তাড়াতাড়ি করতে চাই। আশা করি আপনি আমার বক্তব্য বুঝতে পেরেছেন।

-হ্যাঁ, আমি চেষ্টা করব।

একমাস কেটে গেছে। রবার্টকে পূর্ব জার্মানিতে পাঠানো হল। এক বিজ্ঞানীকে ধরে আনতে হবে। অভিযানটা খুবই কঠিন। পূর্ব জার্মানিতে বিরুদ্ধ পক্ষিরা সক্রিয়। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রবার্ট ওই মানুষটিকে ছিনিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাকে একটা নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হয়। ওয়াশিংটনের সাথে গোপন যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ডাসটিন ফরনটনের কাছ থেকে একটি খবর গেল রবার্টের কানে। বলা হয়, অবস্থা পাল্টে গেছে। এখন আর এই কাজে মন দিয়ে লাভ নেই।

রবার্ট জানতে চেয়েছিলেন এই বিজ্ঞানীর কী হবে?

ফরনটন জবাব দিয়েছিলেন- এটা ওনার নিজস্ব সমস্যা, আপনি নিরাপদে এখানে ফিরে আসুন।

রবার্ট ভেবেছিল, মানুষ এত নীচ এবং নির্মম হয় কী ভাবে? রবার্ট ভেবেছিলেন, উনি যদি পূর্ব জার্মানিতে ফিরে যান, তাহলে জনগণ ওনাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।

একটা ব্যবস্থা করুনরি, ওনাকে সঙ্গে ঘ হয়েছিল

–দেখা যাক কী করতে পারি, ওনাকে সঙ্গে নিয়ে আসুন।

শেষ অব্দি ভদ্রলোককে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ডাসটিন ফরনটন সেই থেকেই রবার্টের ওপর রেগে আছেন। রবার্ট অবাধ্য হবার চেষ্টা করেছিলেন।

ডাসটিন ফরনটনের অফিস, রবার্ট ভাবলেন, এবার কী ঘটতে চলেছে। এমন একটা কাজ? না, ডাসটিন ফরনটনকে তিনি বিশ্বাস করেন না।

ফরনটন ডেস্কের ওপাশে বসেছিলেন।

–আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন কেন?

হ্যাঁ, আমি কমান্ডারের সাথে কথা বলতে উৎসুক। বসুন।

–আপনাকে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সিতে বদলি করা হয়েছে? কেন বলুন তো?

কেন আমি জানি না। তাছাড়া এখান থেকে আমি তো আর ফিরব না। এটাই আমার শেষতম কাজ।

-কেন?

–আমি চাকরিটা ছেড়ে দেব।

 রবার্ট ভাবছিলেন, এই কথা শুনে ওনার মুখের কী প্রতিক্রিয়া হবে। ফরনটন যে অবাক হয়েছেন তা বোঝা গেল না। রাগ করেছেন, তাও নয়। শান্তি পেয়েছেন? বোধহয় না। শেষ পর্যন্ত রবার্টের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন- কেন? কোনো গোপন কারণ?

রবার্ট তার অফিসে ফিরে গেলেন। সেক্রেটারিকে বললেন- বারবারা, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, এক ঘণ্টা পর বেরোব।

–এমন একটা জায়গা, যেখানে ওরা আপনাকে খুঁজে পাবে না।

 জেনারেল হিলিয়াডের কথাগুলো রবার্টের মনে পড়েছিল। তিনি বললেন না।

–আপনি কার সঙ্গে কথা বলবেন বলেছিলেন?

-সেটা বাতিল করো, রবার্ট ঘড়ির দিকে তাকালেন। এখন অ্যাডমিরাল হুইট্যাকারের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

.

পেন্টাগনে ব্রেকফাস্ট, গ্রাউন্ড জিরো কাফেতে। এমন নাম কেন দেওয়া হয়েছে? ভাবা হয়েছিল, হয়তো এক সময় এখানে আণবিক বোমার আঘাত হবে। রবার্ট কোণের টেবিলের ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে কিছুটা গোপনীয়তা আছে। অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার সময় সম্পর্কে খুবই সচেতন। তাঁকে আজ বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। আজ মনে হচ্ছে, বয়সটা বোধহয় কমে গেছে।

অ্যাডমিরাল বসে জিজ্ঞাসা করলেন রবার্ট, এন এস-এতে কেমন লাগছে?

রবার্ট বললেন- জানি না, ভবিষ্যতে কী হবে। অ্যাডমিরাল, জেনারেল হিলিয়াড আমাকে তিন হাজার মাইল দূরে পাঠাতে চাইছেন। দশজন প্রত্যক্ষদর্শীকে বের করতে হবে। একটা আবহাওয়া বেলুন ফেটে গেছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে। কিছু কিছু ঘটনা আমি বুঝতে পারছি না।

অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার অবাক হয়ে বললেন- জেনারেল কেন এই কাজ করেছেন? অবশ্য তার পরিকল্পনা আমি বুঝব কেমন করে?

অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার রবার্টের দিকে তাকালেন। কমান্ডার বেলামি তার অধীনে কাজ করেছেন ভিয়েতনামে। ওই স্কোয়াড্রনে তিনি ছিলেন সব থেকে সেরা পাইলট। অ্যাডমিরালের পুত্র, এডওয়ার্ড রবার্টের সাথে কাজ করেছেন। একদিন প্লেনটাকে গুলি করে নামানো হয়েছে। এডওয়ার্ড মারা যায়। রবার্ট কোনো মতো বেঁচে যান। অ্যাডমিরাল হাসপাতালে গিয়ে মৃত পুত্রের মুখ দেখেছিলেন। ডাক্তাররা বলেছিলেন, দুঃখ করে কী করবেন? উনি তো দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। সমস্ত শরীর তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছে রবার্টের। তাও তিনি ফিসফিসানি কণ্ঠস্বরে বললেন- এডওয়ার্ডের কথা চিন্তা করলে খুবই খারাপ লাগছে।

অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার রবার্টের হাতে হাত রেখে বললেন- যতটা সম্ভব তুমি তা করেছ। তুমি কবে সেরে উঠবে?

অ্যাডমিরালের মনে তখন রবার্ট ছেলের মতো, যে ছেলে এডওয়ার্ডের জায়গা গ্রহণ করতে পারে।

রবার্ট

–অ্যাডমিরাল

–তোমার কাজটা সফল হবে তো?

কারণ এটা আমার শেষ কাজ।

–সত্যি চাকরি ছেড়ে দেবে?

–হ্যাঁ।

-ফরনটন?

–ওর সাথে আলোচনা করব না।

–এর পর কী করবে কিছু ভেবে দেখেছ?

–অন্য কিছু করব, এমন কিছু, যা আমার করতে ভালো লাগবে।

যদি ওরা তোমাকে ছাড়তে না চায়?

 –ওদের হাতে আর কোনো বিকল্প আছে কি? মনকে একবার প্রশ্ন করুন তো?

.

০৬.

রিভার এনট্রান্সের কাছে লিমুজিনটা দাঁড়িয়েছিল।

-আপনি কি তৈরি কমান্ডার? ক্যাপটেন ডগারথি জানতে চাইলেন।

 রবার্ট বললেন- হা।

ক্যাপ্টেন ডগারথি রবার্টকে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে চলে গেলেন। রবার্ট জানেন না, তিনি কোথায় চলেছেন। তিনি কিছু জিনিসপত্র প্যাকেটে ঢুকিয়ে নিলেন। অন্তত এক সপ্তাহ যাতে থাকা যেতে পারে। শেষ অব্দি সুশানের একটা বাঁধানো ছবি নিলেন। ওই ছবিটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। আহা, ব্রাজিলে ওই মেয়েটি এখন কেমন আছে? উনি ভাবলেন। আমার মনে হয়, সময়টা সুশানের ভালো যাচ্ছে না।

এসব কথা ভেবে ভীষণ লজ্জা করল।

.

লিমুজিন এয়ারফোর্স বেসে এসে গেছে। একটা প্লেন দাঁড়িয়েছিল এয়ারপোর্টে।

 ক্যাপ্টেন ডগারথি হাতে হাত রেখে বললেন- তোমার ভাগ্য যেন সদয় হয়, কমান্ডার।

 রবার্ট কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলেন।

 ক্রুরা ভেতরে বসেছিলেন। ফ্লাইটের আগে ভালো করে দেখছেন সব কিছু।

পাইলট, কোপাইলটকে দেখা গেল। নেভিগেটর এবং স্টুয়ার্ট। সকলেই এয়ার ফোর্সের ইউনিফর্ম পরেছেন। রবার্ট এই জাতীয় বিমানের সাথে খুবই পরিচিত। এর মধ্যে ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি থাকে। বাইরের দিকে লেজের কাছে থাকে অতি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যানটেনা। সব মিলিয়ে বিমানটাকে মস্ত বড়ো মাছের মতো দেখাচ্ছে। যে মাছ নদীতে আনন্দে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। এই বিমানের ভেতর দিকের রং হল নীল, তাই কেবিনটাকেও নীল রঙে রঙিন করা হয়েছে।

রবার্ট বুঝতে পারলেন, তিনিই এই বিমানের একমাত্র যাত্রী। পাইলট তাকে দেখে মাথা নীচু করলেন। বললেন– কমান্ডার, আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আপনি সিটবেল্ট পরে নিন। এবার আমরা উড়ান শুরু করব।

রবার্ট সিট বেল্ট পরে নিলেন। প্লেনটা উড়তে শুরু করেছে। তারপর? সীমাহীন শূন্যতা।

.

ভিয়েতনাম, সেখানে উনি ছিলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। ওনাকে রোজার নামে একটি এয়ার ক্রাফট কেরিয়ারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। উনি পাইলটদের শিক্ষা দিতেন। কীভাবে নতুন আক্রমণ করা যায়, সে বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতেন, ওনার অধীনে একটা বম্বব্লাস্ট স্কোয়াড্রন ছিল। ব্যাংককে বেশ কয়েক সপ্তাহ ওনাকে থাকতে হয়েছিল। তখন চোখ থেকে ঘুম চলে গিয়েছিল। এই শহরটা একটা ডিজনিল্যান্ডের মতো। পুরুষ জন্তুদের আনন্দ দেওয়ার অনেক উপকরণ ছড়ানো আছে। সেখানেই এক অসাধারণ রূপবতী থাই সুন্দরীর সঙ্গে তার দেখা হয়। পরবর্তীকালে এই মহিলা তার জীবনের সবকিছু হয়ে ওঠে। তার কাছ থেকে বেশ কয়েকটি থাই শব্দ শিখেছিলেন তিনি।

রবার্টের সব কথাই মনে পড়ে যায়। পরে ব্যাংকককে মনে হয়েছিল একটা দূরবর্তী স্বপ্ন। যুদ্ধটা ছিল চরম বাস্তব। এটা ছিল আতঙ্ক। ভিয়েতনাম সম্পর্কে মার্কিন দেশের মানুষের মন তখন বিষিয়ে উঠেছে।

আজ কত কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে।

তবে সেখানে কিন্তু তিনি কর্তব্যে অবহেলা করেননি। প্রতিটি দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছেন।

নতুন একটা দল তৈরি হল। নাম দেওয়া হল টপগান। এই দলের ওপর নতুন দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। তারা কমান্ডার বেলামিকে সব ব্যাপারে সাহায্য করবে। অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার বেলামিকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন- কমান্ডার, এটা খুব সুন্দর চাকরি, তাই নয় কি?

–অনেক ধন্যবাদ, অ্যাডমিরাল। চলুন, আমরা কাজটা শুরু করি।

 –আমি তো তৈরি আছি।

রবার্টকে চৌত্রিশ ঘণ্টার অভিযানে পাঠানো হল। অবিরাম বোমাবর্ষণ করতে হবে। এটা ছিল ব্যাকের সিক্সের জন্য তাঁর পঁয়ত্রিশতম অভিযান।

.

তারা হ্যানয়ের ওপর দিয়ে উড়ে গেলেন। চলেছেন ফুঁ থো এবং ইয়েন বে-র দিকে। এডওয়ার্ড হুইট্যাকার রবার্টের পাশে বসে আছেন র‍্যাডার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। শত্রুপক্ষের তরফ থেকে কোনো আঘাত আসতে পারে কি না তা দেখছেন।

আকাশের বুকে স্বাধীনতার আস্বাদন। নীচে লাইটগান থেকে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। অন্ধকারের বুকে একটুকরো আলোর রেখা। পঞ্চান্ন মিলিমিটারের সেল ছুটে আসছে। কালো আকাশের অন্ধকার।

এডওয়ার্ড বললেন– আমরা কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।

রজার?

–এ-৬৪ ইনট্রডার এগিয়ে চলেছে। রবার্ট সবদিকে নজর রেখেছেন।

রেডিওতে একটা গলা শোনা গেল- রোমিও, চারটের সময় কাজটা শুরু হবে।

রবার্ট তাকিয়ে দেখলেন একটা মিক ছুটে আসছে। তিনি বিমানটাকে অন্য দিকে নিয়ে গেলেন। মিকটা তখনও তাড়া করছে। রবার্টের মুখ সাদা হয়ে গেছে। এক হাজার ফুট, দুশো ফুট, চারশো ফুট–

এডওয়ার্ড চিৎকার করলেন– আমরা কেন অপেক্ষা করছি?

 রবার্ট শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। তারপর গুলিবর্ষণ শুরু হল।

এডওয়ার্ড বললেন- শেষ অব্দি আমরা বেঁচে গেছি।

 রবার্ট তখনও কাজ করে চলেছেন।

ইন্টারকমে একটা সুন্দর শব্দ ভেসে উঠল। রোমিও, কাজটা ভালো হয়েছে।

এবার প্লেনটা তার লক্ষ্য বস্তুর কাছাকাছি এসে গেছে।

এডওয়ার্ড বললেন- এখান থেকেই কাজ শুরু হোক। তিনি একটা লাল বোতাম টিপলেন। বোমাগুলিকে ছেড়ে দেওয়া হল। সেগুলো ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামছে। মিশন

সফল হয়েছে। রবার্ট এবার বিমানটাকে চালিয়ে ক্যারিয়ারের দিকে নিয়ে গেলেন।

হঠাৎ সামনে আর একটা বম্বারের আগমন।

এডওয়ার্ড বললেন– আক্রমণ করুন এখনই।

 দুজনেই লাল আলো জ্বেলে দিলেন। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।

 রেডিওতে একটা কথা শোনা গেল রোমিও ফ্রম এটা হল টাইগার। সাংঘাতিক বিমান।

 রবার্ট সেকেন্ডের ক্ষণ ভগ্নাংশে সিদ্ধান্ত নিয়ে বললেন- এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ছি।

 আবার লড়াই শুরু হয়ে গেল। এডওয়ার্ড বললেন তাড়াতাড়ি, আরও তাড়াতাড়ি না হলে দেরি হয়ে যাবে।

রবার্ট অলটোমিটারের দিকে তাকালেন। কাঁটাটা ক্রমশ ঝুলে যাচ্ছে। তিনি রেডিও মাইক হাতে নিয়ে বললেন- রোমিও, কোন বেসে যাবে। আমরা কি আক্রমণ করব?

-হ্যাঁ, এখনই।

–নাকি আমরা ফিরে যাব।

না, কিছুক্ষণ বাদে শোনা গেল, চার্লি এসে গেছে। এসবই সঙ্কেতে কথাবার্তা হচ্ছে। এডওয়ার্ড তার চার্টের দিকে তাকিয়ে বললেন– সাত মিনিট সময় আছে। তার মধ্যে সব কিছু করতে হবে।

অবশেষে এই অভিযানটা সম্পূর্ণ সফল হয়েছিল।

তারপর? রবার্টের মনে হল বুকের ভেতর অসম্ভব যন্ত্রণা। রক্ত শুধু রক্ত। কিন্তু কেন? বুলেট ঢুকতে শুরু করেছে? বেঁচে থাকার কোনো আশা নেই।

শেষ অব্দি রবার্ট সব শক্তি কেন্দ্র করে লড়াই করার চেষ্টা করলেন। তাকালেন এডওয়ার্ডের দিকে। বললেন- আমি দুঃখিত।

আবার এক নতুন যুদ্ধের উন্মাদনা শুরু হবে।

রবার্টের আঘাতটা সাংঘাতিক। হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। সেখানে তাঁকে মরফিন দেওয়া হল। বুকের ওপর ব্র্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে।

এখন কতদিন এখানে থাকতে হবে কে জানে?

শান্ত পরিবেশ। রণক্ষেত্রের উন্মাদনা এখানে আসতে পারে না।

রবার্ট শুয়ে শুয়ে অনেক কিছু ভাবতে থাকেন। তখনই সাদা ইউনিফর্ম পরা এক মহিলার মুখ ভেসে উঠে। তিনি কিছু কথা বলার চেষ্টা করছেন। এখানে অনেকে মিলে কথা বলছেন। রোগিদের যন্ত্রণা, ডাক্তাররা আদেশ দিচ্ছেন। নার্সরা ছুটোছুটি করছে।

এখানে কোনো কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে আছে পরবর্তী আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে তাকে এক অদ্ভুত যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। পরে তিনি জানতে পেরেছিলেন, ওই নার্সের নাম সুশান ওয়ার্ড। তিনি অপারেশনে সাহায্য করেছিলেন। এমন কি তিনি তাঁর নিজের রক্ত দিয়ে রবার্টের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন।

যখন অপারেশনটা হয়ে গেল, সার্জেন বললেন- আমরা বৃথা সময় নষ্ট করলাম। পেশেন্ট বাঁচবে না, দশ শতাংশ সম্ভাবনা নেই।

ডক্টর জানতেন না, রবার্ট বেলামি কে? সুশান ওয়ার্ড কে, তাও তিনি জানতেন কি? রবার্ট যখন চোখ খুললেন, সুশান দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাতে হাত রেখে। অদ্ভুত একটা পরিস্থিতি।

শেষ অব্দি রবার্ট বেঁচে গেলেন। শুধু বেঁচে যাওয়া নয়, আবার জীবন প্রবাহ। প্রতি মুহূর্তে সুশান পাশে থেকেছেন। সারা শরীরে ঘাম, সুশান মুছে দিয়েছেন। সুশান বলেছেন আমি কথা দিচ্ছি, ভগবান আপনার মঙ্গল করবেন। এখন শুতে চলে যান।

.

সুশান, অপারেটিং রুমের প্রধান নার্স, তাকে ওই হাসপাতালের সেরা সেবিকা বলা হয়ে থাকে। ছোট্ট একটা শহরে তাঁর জন্ম হয়েছিল। ভালোবাসত ফ্রাঙ্ক প্রেসকত নামে একটি ছেলেকে। মেয়রের ছেলে। সকলে জানত, একদিন তাদের মধ্যে বিয়ে হবে।

সুশানের একটি ছোটো ভাই ছিল, মাইকেল। তাকেও সে খুব যত্ন করত। মাইকেলের আঠারো নম্বর জন্মদিনে তাকে ভিয়েতনামে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সুশান তাকে রোজ চিঠি লিখতেন। তিন মাস কেটে গেছে। সুশানের পরিবার একটা টেলিগ্রাম পেল। টেলিগ্রামটা। খোলার আগেই তারা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, কী লেখা আছে।

ফ্রাঙ্ক প্রেসকত এই খবরটা শুনতে পেলেন। তিনি বললেন-সুশান, আমি খুবই দুঃখিত। মাইকেলকে আমি খুবই ভালোবাসতাম। এসো, বিয়ের কাজটা সেরে ফেলা যাক।

সুশান তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন- না, আমাকে অন্য একটা কাজ করতে হবে। সেটা অনেক বড়ো কাজ।

–আমাকে বিয়ে করবে না?

না, আমি এখন ভিয়েতনামে যাব।

সুশান ওয়ার্ড নার্সিং স্কুলে ভর্তি হলেন। সে ভিয়েতনামে এগারো মাস ছিলেন। অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করেছে। শুধু কমান্ডার রবার্ট বেলামিকেও নয়, তার হাতের পরশে অনেক সৈন্য মৃত্যুর মুখ থেকে জীবনের উন্মাদনায় ফিরে আসতে পেরেছে। সুশানের এই কার্যকারিতা দেখে অনেকে অবাক হয়ে গেছে। কীভাবে সে মৃতের দেহে প্রাণ সঞ্চার করেন?

তিনি প্রথমেই একজন পেশেন্টের রেকর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যেমন, বেলামি তিনি জন্মেছেন শিকাগোর কাছে একটি ছোট্ট শহরে। শহরটির নাম হারবে। কলেজে পড়তে পড়তেই নেভির ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। পেনসাগোলাতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। বিয়ে হয়নি।

প্রত্যেকদিন রবার্টের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। রবার্ট একটু করে সেরে উঠছেন। তখনও হেঁটে যাচ্ছেন মৃত্যু ও জীবনের এক সংকীর্ণ উপত্যাকা দিয়ে। ছ-ছটি দিন কেটে গেছে। রবার্ট তখনও ভুল বকছেন। একদিন বিছানায় বসে শূন্য দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে সুশানকে বললেন– আমি কি স্বপ্ন দেখছি? আপনি স্বপ্ন না সত্যি?

সুশান বলেছিলেন- হ্যাঁ, আমি সত্যি।

না, সব কথা স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। ঈশ্বর আপনাকে পাঠিয়েছেন আমাকে সেবা করার জন্য।

সুশান রবার্টের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন- যদি আপনার মৃত্যু হত, আমি নিজেকে মেরে ফেলতাম।

রবার্টের চোখ খুলে গেল– আমি কোথায় আছি?

আমরা একটা আর্মি হাসপাতালে আছি।

কবে আমি এসেছি?

ছদিন আগে।

–এডি কোথায়?

–আমি দুঃখিত, এ ব্যাপারটা বলতে পারব না।

 –অ্যাডমিরালকে সব বলতে হবে।

 সুশান রবার্টের হাতে হাত রেখে বললেন– উনি সব জানেন। উনি এখানেই আছেন।

ধীরে ধীরে রবার্টের উন্নতি হতে থাকল। ডাক্তাররা অবাক হয়ে গেলেন।

.

রবার্ট কি সুশানকে ভালোবেসেছেন? হয়তো তাই, যখন সুশান ক্ষতচিহ্ন পরিষ্কার করেন, তখন রবার্টের শুধুই মনে পড়ে বোমা বর্ণের শব্দ। সুশান বলেন- না, ওখানে আমাদের গান গাওয়া হচ্ছে।

রবার্টকে অন্য একটা ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সুশান বললেন– এবার আমার কাজের ছুটি। হয়তো অন্য কেউ আপনার দায়িত্ব নেবে। না, আমার শুভেচ্ছা সর্বদা আপনার সঙ্গেই থাকবে।

দু সপ্তাহ কেটে গেল। তারা বিয়ে করলেন। এক বছর পর রবার্টের ক্ষতটা সম্পূর্ণ সেরে গেল। সুশান সব সময় পাশে পাশে থেকেছেন। ছায়ার মতো। ভালোবাসার সাথে গভীর মমত্ববোধ। অসম্ভব প্রাণশক্তি। রবার্ট ভালোবেসে ছিলেন সুশানের সৌন্দর্যকে। শুধু তাই নয়, তার মধ্যে একটা স্বাভাবিক কৌতুকপ্রিয়তা আছে।

বিয়ের প্রথম বার্ষিকী। রবার্ট বললেন- তুমি বিশ্বের সব থেকে সুন্দরী রমণী, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু তাই নয়, তোমার এই করুণা এবং মমতা আমার খুবই ভালো লাগে। এ ব্যাপারে কেউ তোমার সাথে লড়াইতে পেরে উঠবে না।

সুশান রবার্টকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন- হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ।

ভালোবাসা, তার অন্তর্নিহিত অর্থ আরও পরিস্ফুটিত হল। তারা একে অন্যকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। বন্ধু-বান্ধবরা ঈর্ষার চোখে তাকিয়ে থাকতেন। যখনই কেউ এক পবিত্র সুন্দর আলোচনা করতেন তাঁরা রবার্ট এবং সুশানের উদাহরণ দিতেন। একে অন্যের সম্পূর্ণ পরিপূরক। সুশানকে আমরা এক আবেদনি মহিলা বলতে পারি। মনে হয় তিনি যেন আগুন ধরা উন্মাদনা নিয়ে বসে আছেন। একদিন বিকেলবেলা, তারা ডিনার পার্টিতে যাবেন, রবার্টের দেরি হয়েছে। রবার্ট শাওয়ারে ছিলেন। সুশান বাথরুমে এলেন। সুন্দর পোশাক পরলেন। স্ট্র্যাপ ছাড়া ইভনিং গাউন।

রবার্ট বললেন- তোমাকে ভারী সেকসি দেখাচ্ছে। এসো, আমরা সেই খেলাটা শুরু করি।

সুশান বলেছিলেন– না, দেরী হয়ে যাবে?

এক মুহূর্ত বাদে রবার্ট তাকে সম্পূর্ণ নগ্না করলেন। দুজনে একসঙ্গে শাওয়ারের তলায় স্নান করলেন।

তারা আর পার্টিতে যাননি।

সুশান জানতেন রবার্টের কখন কী দরকার হবে। কীভাবে তাকে আরও বেশি সাহায্য করা যাবে। ড্রেসিং রুমের টেবিলে মাঝে মধ্যেই সুশান ভালোবাসার চিরকূট পেতেন। অথবা জুতোর তলায় কাগজের টুকরো গোঁজা থাকত। মাঝে মধ্যে ফুল উপহার হিসেবে আসত তার হাতে।

তারপর? অসাধারণ হাসি আর আনন্দময়তা। দুজনে অনুভব করতেন।

ইন্টারকমে পাইলটের কণ্ঠস্বরআমরা জুরিখে নামতে চলেছি। দশ মিনিট সময় আছে কমান্ডার।

রবার্ট বেলামির চিন্তাধারা ছিন্ন হয়ে গেল। আবার তিনি চরম বাস্তবে ফিরে এলেন। হ্যাঁ, এখন চোখের সামনে শুধুই আলপস পাহাড়। সুইজারল্যান্ড, আর কিছু নেই।

–সিটবেল্ট ভালো করে বেঁধে নিন, প্লিজ।

 বিমানটা অন্ধকার অরণ্যের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে। রানওয়ে দেখা গেল। জুরিখ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।

নোয়েলের অ্যাডিয়েশন বিল্ডিং। এটাই প্রধান টার্মিনাল। আকাশটা পরিষ্কার।

পাইলট বললেন– এটা সুন্দর একটা রবিবারের সকল। কিন্তু বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আছে। এখানে আপনার কোনো ঘড়ি লাগবে না। শুধু একটা ব্যারোমিটার লাগবে কমান্ডার, আমি কি আপনার জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করব?

না, ধন্যবাদ, রবার্টের মনে হল, এখন তাকে একলাই চলতে হবে। তিনি একটা মিনিবাসে উঠে বসলেন। তাকে এয়ারপোর্ট হোটেলে যেতে হবে। শুরু হবে স্বপ্নবিহীন পথ চলা।

.

০৭.

দ্বিতীয় দিন, সকাল আটটা

পরের দিন সকালে রবার্ট ডেস্কের পাশে বসে থাকা ক্লার্কের সঙ্গে কথা বললেন। স্থানীয় ভাষায় কথা বললেন। জার্মান টান ছিল।

জানতে চাওয়া হল, রবার্ট এখানে কতদিন থাকবেন?

রবার্ট কি জানেন? হয়তো এক ঘণ্টা, একমাস অথবা একবছর কিংবা দুবছর।

আরও কিছু কথা হয়েছিল।

ক্লার্ক অবাক হয়ে রবার্টের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন- ঠিক আছে, এই কাগজগুলো ভরতি করে দিন।

রবার্ট গাড়ির ভাড়ার দাম দিয়ে দিলেন। তার কালো ক্রেডিট কার্ড বের করলেন। জেনারেল হিলিয়াড এই কার্ডটা তাকে দিয়েছিলেন। ক্লার্ক এটা দেখলেন। তারপর বললেন কোনো সমস্যা?

না, কোনো সমস্যা নেই।

একটা গাড়ি ভাড়া করা হল, ধূসর বর্ণের ওপেল ওমেগা। রবার্ট এয়ারপোর্ট হাইওয়ে দিয়ে চলেছেন ডাউনটাউন জুরিখের দিকে। সুইজারল্যান্ড তার খুবই ভালো লাগে। সারা বিশ্বের অন্যতম সুন্দর এক রাষ্ট্র। এখানে অনেকবার তিনি এসেছেন। কিন্তু এইভাবে স্পাইগিরি করতে এই প্রথম। তিনি সুইস ইনটেলিজেন্স এজেন্সি সম্পর্কে অনেক খবর নিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তারা অসাধারণ কাজ করেছিল। এই সংস্থার প্রধান কাজ হচ্ছে, গুপ্তচরদের বিরুদ্ধে কঠিন হয়ে ওঠা। তারা রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্যতম সংস্থা। জেনেভাতে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন অধিবেশন হয়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন। তখন তাদের কাজের চাপ আরও বেড়ে যায়।

পঁচিশ মিনিট কেটে গেছে। গাড়িটা ব্যস্ত শহরে চলে এসেছে। সেটা গ্রান্ড হোটেলের দিকে এগিয়ে চলেছে। চারপাশে সুইজ সভ্যতার ছাপ। লেক জুরিখকে চোখে পড়ল। গাড়িটা হোটেলের বাইরে রাখা হল। রবার্টের এবার আসল কাজ শুরু হবে। রবার্ট সুইজারল্যান্ডের একটা ম্যাপ ইতিমধ্যে কিনে ফেলেছিলেন। সেই ম্যাপের ওপর চোখ রেখে বুঝতে পারছেন, এবার কোনদিকে যাবেন।

সুন্দর শরৎ সকাল। সামনের কাজটার কথা ভাবছেন। কীভাবে শুরু করা যায় ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।

এখনও পর্যন্ত তার হাতে কী তথ্য আছে? রবিবার, ১৪ অক্টোবর, উটেনডরফ। এছাড়া আর কোনো তথ্য নেই।

কিছু মনে করার চেষ্টা করলেন। যাঁরা এই দেশে ট্যুরিস্ট হিসেবে আসেন, তারা দুটি প্রধান শহর থেকে যাত্রা শুরু করেন। হয় জুরিখ, অথবা জেনেভা। রবার্ট ভালোভাবে চিন্তা করলেন। কোথায় শুরু করা যায়? অনেকগুলো কোম্পানির নাম আছে, সানসাইন টুর, সুইজ ট্যুর, ট্যুর সার্ভিস। আরও কত কি? প্রত্যেকটা অফিসে যেতে হবে। খুঁটিয়ে সব দেখতে হবে। তিনি সব কটা ঠিকানা লিখে নিলেন। টুর সার্ভিস থেকেই তার অভিযান শুরু হল।

ক্লার্কের সাথে কথা শুরু হল।

রবার্ট জানতে চাইলেন–আমার বউ গত রোববার ট্যুরে অংশ নিয়েছিল। সে তার টাকার ব্যাগটা বাসে ফেলে যায়। আসলে উটেনডরফের কাছে যে বেলুনটা ফেটে গিয়েছিল, সেটা দেখতে গিয়ে সে খুব উৎসাহিত হয়ে ওঠে। তাই ভুলে গেছে।

ক্লার্ক বলল- আপনার ভুল হচ্ছে মশাই, আমাদের ট্যুর কখনও উটেনডরফে যায় না।

–ও, দুঃখিত।

পরবর্তী অভিযানটা মোটামুটি ভালো হল।

–আপনারা কি উটেনডরফে যান?

 ক্লার্কের মুখে হাসি। আমাদের ট্যুর সব জায়গায় যায়। আমরাই সবথেকে নামী সংস্থা। আপনি কোথায় যাবেন?

–গত রোববার আপনারা কি সেখানে গিয়েছিলেন? একটা বেলুন ফেটে গিয়েছিল?

 ক্লার্ক কিছু ভাববার চেষ্টা করলেন না, আমরা তো সেখানে যাইনি।

–তাহলে ওই ঘটনাটার কথা আপনারা জানেন না?

না।

ধন্যবাদ।

.

তৃতীয় অফিসটা শহরের এককোণে অবস্থিত। বাইরের আলোয় লেখা আছে সানসাইন টুর।

রবার্ট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন– শুভ দ্বিপ্রহর। আমি আপনাদের ট্যুর বাস সম্বন্ধে কয়েকটা কথা জানতে চাইছি। আমি শুনেছি একটা বেলুন উটেনডরফের কাছে ভেঙে গিয়েছিল। আপনাদের ড্রাইভার আধঘণ্টা দাঁড়িয়েছিল।

-না-না, মাত্র পনেরো মিনিট, আমাদের খুব পরিষ্কার নির্দেশ আছে।

অবশেষে সফলতা এল।

–আপনি কেন এ ব্যাপারে এত আগ্রহী, জানতে পারি কি?

রবার্ট তাঁর নির্দেশ পত্রটা বের করলেন। বললেন– আমি একজন রিপোর্টার। আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা প্রতিবেদন লিখতে চলেছি। এটা ট্রাভল অ্যান্ড লেজার পত্রিকাতে প্রকাশিত হবে। বলা হবে, সুইজারল্যান্ডের বাসগুলো কত ভালোভাবে কাজ করে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করা হবে। আমি কি ওই ড্রাইভারের সাথে কথা বলতে পারি?

-হ্যাঁ, আপনার ওই লেখাটা খুবই ভালো হবে। খুবই ভালো। আমরা এ ব্যাপারে গৌরব বোধ করি।

-হ্যাঁ, গৌরব বোধ করাই উচিত।

—আমাদের কোম্পানির নাম থাকবে তো?

নিশ্চয়ই। বড়ো বড়ো করে থাকবে।

–আমি তো কোনো অসুবিধা দেখছি না।

ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলা যাবে?

–আজ তো ওর ছুটি।

 উনি কাগজে কিছু একটা লিখলেন।

রিপোর্টার বেলামি ঠিকানা পেয়ে গেছেন। নামটাও পেয়ে গেছেন।

সে কাপেলে থাকে, ছোট্ট একটা গ্রাম। এখান থেকে ৪০ কিলোমিটার। এখন গেলে হয়তো তাকে পেয়ে যাবেন।

–অনেক ধন্যবাদ। আর একটা ব্যাপারও জানতে চাইছি। সেদিন কতগুলো টিকিট বিক্রি হয়েছিল বলুন তো? বলতে পারবেন?

-হ্যাঁ, আমাদের কাছে সব রেকর্ড থাকে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন… রবিবার, সাতজন প্যাসেঞ্জার ছিলেন।

সাতজন? সম্পূর্ণ অচেনা অজানা যাত্রী এবং ড্রাইভার।

 রবার্ট অন্ধকারে হেঁটে যাবেন কী করে?

–ওই প্যাসেঞ্জারদের নাম দেওয়া যাবে কি?

–এতে কী লাভ? ওরা তো টিকিট কাটেন, জায়গা দেখেন, আবার চলে যান। ওদের সম্পর্কে আমরা বেশি কিছু লিখতে পারি না।

আপনাকে আবার ধন্যবাদ।

 ক্লার্ক বলল- ওই প্রতিবেদনের একটা কপি আমাদের দেবেন কিন্তু।

–অবশ্যই দেব, রবার্ট জবাব দিলেন।

যেখান থেকে বাসগুলো ছাড়ে, রবার্ট সেখানে গেলেন। হয়তো এখানেই হারানো সূত্রের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। বাসটার রঙ বাদামি এবং রূপোলির সংমিশ্রণ। আলপাইন রাস্তার ওপর দিয়ে সহজে যেতে পারে।

রবার্ট গাড়িতে ফিরে এলেন। ম্যাপের দিকে তাকালেন। কোন দিক দিয়ে যাওয়া যায়? আলপসের দিকে যাত্রা করতে হবে। তার আগে ওই কাপেল গ্রামে যেতে হবে।

উনি দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চললেন। ছোট্ট একটা পাহাড়কে অতিক্রম করলেন। আহা, পাহাড়ের পাদদেশে গাড়িটা উঠে চলেছে। একটার পর একটা ছোটো গ্রাম পেছনে পড়ে রইল। শেষ অব্দি উনি কাপেলে এসে পৌঁছোলেন। গাড়িটা রেস্টুরেন্টের পাশে দাঁড় করালেন।

ওয়েট্রেস, একটা টেবিল পরিষ্কার করছিল। ঝকঝকে জার্মান ভাষায় তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। রিপোর্টার শুনে ওয়েটার অবাক হয়ে গেছে। এবার আসল জায়গায় যাত্রা শুরু হবে।

হ্যাঁ, এই তো সেই বাড়িটা, ঠিকানা মিলে যাচ্ছে।

মোটাসোটা এক ভদ্রমহিলা, মুখে গোঁফের আভাস, বেরিয়ে এলেন। আপনি কে?

–মি. বেকারম্যান বাড়িতে আছেন?

–কেন? কী দরকার? ভদ্রমহিলার আচরণে সন্দেহ।

রবার্ট বিশ্বজয়ী হাসি হেসে বললেন আপনি বোধহয় শ্রীমতী বেকারম্যান? তিনি তার রিপোর্টারের পরিচয়পত্র দেখিয়ে বললেন, আমি সুইজারল্যান্ডের বাস ড্রাইভারদের সম্বন্ধে একটা আর্টিকেল লিখতে চাইছি। আপনার স্বামীকে আমরা অন্যতম সেরা বাস ড্রাইভার হিসেবে নির্বাচিত করছি।

ভদ্রমহিলার মুখের রঙ উজ্জ্বল হয়ে উঠল– হ্যাঁ, আমার হানস এ ব্যাপারে সত্যিই অতুলনীয়।

-মিসেস বেকারম্যান, ওনার সাথে এক্ষুনি কথা বলতে হবে।

-হানসের ইন্টারভিউ? পত্রিকাতে প্রকাশিত হবে? ভদ্রমহিলা গদগদ, ভেতরে আসুন, ভেতরে আসুন, প্লিজ।

রবার্ট ভেতরে গিয়ে বসলেন। ছোটো সাজানো একটা লিভিংরুম। সেখানেই তাকে বসতে হল।

এই বাড়িটার সর্বত্র একটা সুন্দর নীরবতার ছাপ আছে। সাধারণ কাঠের ফার্নিচার। এককোণে একটা ফায়ার প্লেস। লেসের পর্দা ঝুলছে। রবার্ট ভাবতে থাকলেন, এখান থেকেই আমাকে শুরু করতে হবে। এটাই আমার একমাত্র সূত্র। কিন্তু কীভাবে?

একটু বাদে টাক মাথার পাতলা চেহারার এক মানুষ সামনে এসে দাঁড়াল। তার গায়ের রং বিবর্ণ। লম্বা মোটা গোঁফ আছে। সে বলল, গুড আফটারনুন, হেড?

স্মিথ, গুড আফটারনুন। রবার্টের কণ্ঠস্বর আন্তরিক। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য খুবই আগ্রহী, মি. বেকারম্যান।

–আমার বউ সব বলেছে। আপনি নাকি ড্রাইভারদের নিয়ে একটা গল্প লিখছেন। আমাকে নির্বাচন করেছেন।

কথার মধ্যে জার্মান ছাপ সুস্পষ্ট।

রবার্ট হাসলেন ঠিকই বলেছেন। আমার এই পত্রিকাতে আপনার ছবি প্রকাশিত হবে। আপনি তো খুব ভালোভাবেই বাস চালিয়েছেন।

-হ্যাঁ, আপনি কি রোববার দুপুরবেলার সেই দুর্ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইছেন?

–হ্যাঁ, আমাকে সব কিছু জানতে হবে।

বসুন। আমি বলছি।

রবার্ট বসলেন।

বেকারম্যান বললেন– আমি কিন্তু আপনাকে ড্রিঙ্ক দিতে পারছি না। বাড়িতে খাওয়া ছেড়েই দিয়েছি। পেটে হাত দিয়ে বললেন, আলসার হয়েছে। ডাক্তাররা খাওয়া কমাতে বলেছেন।

তারপর রবার্টের দিকে তাকিয়ে বললেন- হ্যাঁ, বলুন কী জানতে চান?

–আপনি ওই যাত্রীদের কথা বলুন, ওরা রবিবার ওই বাসে ছিলেন। আপনারা তো উটেনডরফের কাছে থামলেন, সেখানে বেলুনটা ফেটে গিয়েছিল। তাই তো?

হানস বেকারম্যান বললেন– কী বলছেন আপনি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কী বেলুন!

–যে বেলুনটা ফেটে গিয়েছিল।

তার মানে রকেট? মহাকাশযান?

রবার্টের অবাক হবার পালা– না-না, আমি ওই বেলুনটার কথা বলেছি।

–তার মানে উড়ন্ত চাকি?

রবার্টের তখন অবস্থা খুবই শোচনীয়। মেরুদণ্ড দিয়ে ঠাণ্ডা শিহরণ।

আপনি কি একটা ফ্লাইং সসার দেখেছেন?

 –হ্যাঁ, তার মধ্যে মৃতদেহ ছিল।

–গতকাল সুইজ আলপসে ন্যাটোর একটা আবহাওয়া বেলুন ধ্বংস হয়ে গেছে। তার মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য ছিল। ব্যাপারটা খুবই গোপনীয়।

রবার্ট শান্ত হয়ে বসার চেষ্টা করে বললেন মি. বেকারম্যান, সত্যি বলুন তো আপনি কী ধরনের ফ্লাইং সসার দেখেছেন?

–হ্যাঁ, আমি স্পষ্ট দেখেছি। আকাশ দিয়ে ভাসতে ভাসতে উড়ে যাচ্ছিল।

তার মধ্যে মৃত মানুষ ছিল কী করে জানলেন?

ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য! কী ছিল আমি কী করে বলব? অদ্ভুত তাদের চোখের গড়ন। তারা সিলভার মেটালিক রঙের স্যুট পরেছিল। ব্যাপারটা দেখে আমি খুবই ভয় পেয়েছিলাম।

রবার্টের মনে চিন্তা। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন আপনার যাত্রীরা সকলে দেখেছিল।

-হ্যাঁ, তারা সকলেই দেখেছিলেন। আমরা সেখানে পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলাম। যাত্রীরা বলেছিলেন, আরও বেশিক্ষণ দাঁড়াতে, কিন্তু কোম্পানির নির্দেশ আছে, সময় নষ্ট করা চলবে না।

রবার্ট জানেন, এই প্রশ্নটা করা উচিত নয়। তবুও জানতে চেষ্টা করলেন মি. বেকারম্যান, কোনো যাত্রীর নাম বলতে পারবেন কি?

–মিস্টার, আমি তো বাস চালিয়ে থাকি। প্যাসেঞ্জাররা জুরিখ থেকে টিকিট কেনেন। তারা নানা দিকে ঘুরতে চলে যান। কেউ তাদের নাম বলেন কি?

রবাট শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে বললেন– আপনি তাদের কাউকে চিনতে পারবেন না?

একটা কথা বলতে পারি, এই দলে কোনো শিশু ছিল না, শুধু পুরুষরা।

–শুধু পুরুষরা?

না-না, একজন মহিলা ছিলেন।

 না, এভাবে খড়ের গাদায় সঁচ খোঁজা সম্ভব নয়। রবার্ট ভাবলেন, কী করে আমি আসল জায়গায় পৌঁছোব।

–মি. বেকারম্যান, ওই ট্যুরিস্টরা দুদিক থেকে বাসে উঠেছিলেন, তাই তো? ট্যুর শেষ হয়ে গেল, তারা নানা দিকে ছিটকে গেলেন?

মি. স্মিথ, আপনি ঠিকই বলেছেন।

–প্যাসেঞ্জারদের সম্পর্কে কোনো তথ্য? তারা কী কথা বলেছিলেন? কোনো বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন?

–মিস্টার, আপনি কেন এই ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছেন? ওঁরা কি কোনো সমস্যার সৃষ্টি করেছেন? করেননি তো। তাহলে আমি কেন এ ব্যাপারে মত দেব? জার্মানরাই ঝামেলা করে থাকে।

রবার্টের সমস্ত শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তিনি বললেন–কী ধরনের? কোন্ জার্মানরা?

-সবাই আকাশের ওই উড়ন্ত বস্তুটা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বারবার বকবক করতে থাকেন। তাকে ইউনিভারসিটিতে লেকচার দিতে হবে পরের দিন সকালবেলা, দেরী হলে তিনি ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারবেন না।

এভাবেই শুরু হতে পারে গল্পটা।

–তার চেহারা সম্পর্কে কিছু মনে আছে?

–না।

–কিছুই না।

–তিনি একটা কালো ওভারকোট পরেছিলেন।

মি. বেকারম্যান, আপনি কি বলবেন যে, কীভাবে উটেনডরফে যাওয়া যায়? আপনি কি আমাকে নিয়ে যাবেন?

–আজ আমার ছুটির দিন, আমি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকব।

–আমি যদি আপনাকে টাকা দিই? দুশো মার্ক? চারশো মার্ক?

 বেকারম্যানের মুখে হাসি–ঠিক আছে, চলুন। দিনটা আজ ভারী সুন্দর।

তারা দক্ষিণদিকে এগিয়ে গেলেন। গ্রাম্যপথ পার হলেন। লুজেনের দিকে, আহা, চোখ জুড়ানো দৃশ্যপট। রবার্ট তখন অন্য কথা ভাবছেন।

এবার সারেন অতিক্রম করার পালা। পথ চলে গেছে ইন্টারলাকেনের দিকে।

–আর কতদূর?

 হানস বললে- আমরা এবার এসে গেছি।

এক ঘণ্টা ধরে গাড়ি চালানো হল।

 হানস বলল- ওই পাশেই আমরা দেখতে পাব।

রবার্টের হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে। তিনি এমন কিছু দেখতে চলেছেন, যা তার চেতনাকে অবাক করে দেবে।

গাড়িটা থানে চলে এল।

 হানস বলল- ওইখানে।

 রবার্ট নামলেন, হাইওয়ের ধারে।

–এই গাছেদের তলায়।

রবার্টের শরীরে উত্তেজনা চলুন, আমরা দেখে আসি। একটা ট্রাক এগিয়ে চলেছে। ট্রাকটা চলে গেল। রবার্ট এবং হানস রাস্তা পার হলেন। রবার্ট ওই বাস ড্রাইভারকে অনুসরণ করছেন। ঘন গাছের আচ্ছাদিত জায়গা। এখান থেকে হাইওয়ে দেখা যাচ্ছে না। তারা আরও ভেতর দিকে এগিয়ে গেলেন।

বেকারম্যান বলল- ওই তো, ওটা আছে।

 না, ওই আবহাওয়ায় বেলুনটাকে দেখা গেল না, তার অবশেষ খণ্ডগুলিকে চোখে পড়ল।

.

০৮.

রবার্ট ভাবলেন, নাঃ, আমি বোধহয় সফলতা পাব না। হানস ওই ধাতব বস্তুর দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু, তার মুখে একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি। না-না, ঈশ্বরের দোহাই, এগুলো ছিল না।

-কোনগুলো?

 বেকারম্যান মাথা নেড়ে বলল– এগুলোকে গতকাল আনা হয়েছে।

হয়তো ওই সবুজ পোশাক পরা লোকেরা এগুলো ফেলে দিয়েছে।

 না, অরা কেউ বেঁচে ছিল না। তারা মরে গেছে।

 –মরে গেছে?

 কাজটা ভালোভাবে এগিয়ে চলেছে।

রবার্ট বেলুনের কাছে এগিয়ে গেলেন। ভালোভাবে পরীক্ষা করলেন। রিবাট অ্যালুমিনিয়াম এনভেলাপ। চোদ্দো ফুট ব্যাসযুক্ত। ঘন জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছে। সব কিছুকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, জেনারেল হিলিয়াড বলেছিলেন। তাহলে এগুলো কোথা থেকে এল?

রবার্ট চারদিকে ঘুরে বেড়াতে থাকলেন। ভিজে ঘাসের ওপর তার জুতোর চিহ্ন আঁকা হল। সামান্যতম সূত্র পাওয়া যায় কী? না, এই ধরনের বেলুন মাঝে মধ্যেই উড়িয়ে দেওয়া হয়। আবহাওয়া সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য। বছরের পর বছর এমন কাজ করা হচ্ছে এর মধ্যে অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।

ড্রাইভার তখনও বলে চলেছে- না, এগুলো পরে এসেছে, আমি বলতে পারি।

রবার্ট ঠিক করলেন, ভালোভাবে দেখতে হবে। আরও কাছে এগিয়ে গেলেন। ওপরে ওঠার চেষ্টা করলেন। একটা বস্তুকে হাতের ওপর নিলেন। হ্যাঁ, এর মধ্যে কী আছে?

–ভিজে হয়ে গেছে। রবার্ট বললেন। গতকাল বৃষ্টি হয়েছে, মাটি এখনও ভিজে।

রবার্ট হামাগুড়ি দিলেন। বেলুনের তলায় পৌঁছে গেলেন। এটা তো শুকনো থাকা উচিত।

পাইলট বলেছিলেন- গত রোববার এখানটা খুবই শুকনো ছিল। যেদিন বেলুনটা ধ্বংস হয় সারাদিন বৃষ্টি হয়, তারপর?

কী?

 যখন আপনি ওই উড়ন্ত চাকিটাকে দেখতে পান, তখন বৃষ্টি ছিল কি?

বেকারম্যান বলল- না, একটা সুন্দর বিকেলবেলা।

সূর্য ছিল?

–হ্যাঁ, সূর্যের তাপ ছিল।

 গতকাল বৃষ্টি হয়েছে?

–হুঁ।

তার মানে যদি বেলুনটা এখানে সারা রাত্রি থাকত, তার তলার মাটিটা শুকনো থাকত। অথবা সামান্য সাঁতসেঁতে থাকত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এটা একেবারে ভিজে গেছে। বাকি অঞ্চলের মতো।

–তার মানে আপনি কী বলতে চাইছেন?

–আমি বলতে চাইছি, কেউ এই বেলুনটাকে এখানে এনে রেখেছে। বৃষ্টি শুরু হবার পর। নাঃ, এই সম্ভাবনার অন্তরালে কী তথ্য লুকিয়ে রয়েছে।

–আপনি এ ব্যপারে এত উৎসাহী কেন বলুন তো?

রবার্ট ভাবলেন, হ্যাঁ, সত্যিই তো। তার মানে? সুইজারল্যান্ডের সরকার কি চাইছেন জায়গাটাকে সকলের চোখের আড়ালে রাখতে তাই এই প্রস্তুতি?

রবার্ট ভিজে ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে গেলেন। চারপাশে ঘোরাঘুরি করলেন বোকার মতো।

হানস রবার্টের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল আপনি কোন পত্রিকার রিপোর্টার মশাই।

–ট্রাভল অ্যান্ড লেজার।

বাঃ, আপনি আমার একটা ছবি নেবেন তো? অন্যেরা যেমন নিয়েছেন।

কী বললেন?

 ফটোগ্রাফার আমার ছবি নিয়েছে।

 রবার্টের মুখে বিস্ময় আপনি কার কথা বলছেন?

ফটোগ্রাফার। একজন ছবি নিয়েছে। তিনি বলেছেন, ছবির কপি পাঠিয়ে দেবেন। কোনো কোনো প্যাসেঞ্জারের হাতেও ক্যামেরা ছিল।

রবার্ট বললেন– দাঁড়ান-দাঁড়ান। ওই উড়ন্ত চাকির সামনে ছবি নেওয়া হয়েছে।

–আমি তো তাই বোঝাতে চাইছি।

ফটোগ্রাফার আপনাকে প্রিন্ট দেবেন বলেছেন?

–হ্যাঁ।

তার মানে ওনার কাছে নিশ্চয়ই আপনার নাম-ঠিকানা আছে?

–হ্যাঁ, না হলে উনি কী করে পাঠাবেন।

রবার্টের মনে হল, তার শরীরের ভেতর শীতল শিহরণ। এবার ব্যাপারটা অনেক সহজ হবে। সাতজন অচেনা অজানা পর্যটকের সন্ধানে ছুটে বেড়াতে হবে না। একজন ফটোগ্রাফার পাওয়া গেল।

–মি. বেকারম্যান, আপনি কেন তার কথা আগে বলেননি?

–আপনি তো খালি টুরিস্টদের সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন।

 –তার মানে উনি ট্যুরিস্ট নন?

হানস মাথা নেড়ে বলল– না, তার গাড়িটা হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে ছিল। আকাশের ওই বস্তুটা দেখে ভদ্রলোক অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। উনি ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে শুরু করেন। তারপর ওই উড়ন্ত চাকির তলায় আমাদের সকলকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন।

উনি ওনার নাম বলেছেন?

–না।

 –ওনার সম্পর্কে কিছু মনে পড়ছে?

–হ্যাঁ, উনি আমেরিকার বাসিন্দা। কিংবা ইংলিশম্যান।

উনি গাড়িতে ছিলেন?

–হ্যাঁ।

উনি কোন্ দিকে গেলেন?

 উদিকে, উনি বোধহয় বার্নে যাবেন। ওনার গাড়িতে কিছু সমস্যা ছিল।

 রবার্ট বললেন–অনেক ধন্যবাদ, আপনার সাহায্য আমি মনে রাখব।

-ওই পত্রিকার প্রবন্ধটা আমাকে পাঠাবেন কিন্তু।

-হ্যাঁ, এই নিন আপনার টাকা। আপনার সাহায্যের জন্য আরও একশো মার্ক দিলাম। আমি কি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব?

তারা গাড়ির কাছে এলেন। বেকারম্যান দরজাটা খুলতে যাবে, সে রবার্টের দিকে তাকিয়ে বলল আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। পকেট থেকে এক টুকরো ধাতব বস্তু বের করল। সিগারেট লাইটারের মতো দেখতে। তার ভেতর একটা সাদা স্ফটিক রয়েছে।

–এটা কী?

 –এটা আমি রোববার পেয়েছি।

রবার্ট জিনিসটার দিকে তাকালেন। কাগজের মতো হালকা, বালির মতো রং। এক দিকটা তীক্ষ্ণ। তার মানে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এর একটা অংশ নিশ্চয়ই আছে। এটা কি ওই আবহাওয়া বেলুনের কোনো অংশ? নাকি উড়ন্ত চাকির?

–এটা হয়তো আপনার ভাগ্য পরিবর্তনে সাহায্য করবে।

বেকারম্যান টাকাটা তার ওয়ালেটে ভরে ফেলল। তারপর বলল- হ্যাঁ, এটা নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করবে।

.

কোথা থেকে কাজটা শুরু হবে? অজানা উড়ন্ত বস্তু সম্পর্কে রবার্ট অনেক প্রতিবেদন পড়েছেন। বেশির ভাগ বিশ্বাস করেননি। তাঁর কেবলই মনে হয়েছে, দুর্বল মানুষেরাই এর অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে। কিন্তু এখন? ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে। হ্যাঁ, ধারাবাহিক গল্পের উন্মাদন। সত্যি সত্যি এমন অজানা কিছু বস্তু কি মহাকাশ থেকে আসে? না সবটাই আমাদের দুর্বল মনের কল্পনা?

.

০৯.

জেনেভাতে একটা সাংবাদিক সম্মেলন। সুইস সরকার এই সম্মেলন ডেকেছে। পঞ্চাশ জন সাংবাদিক হাজির আছেন। বাইরে উৎসাহী মানুষের ভিড়। টেলিভিশন থেকে অনেকে এসেছেন। রেডিও এবং বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে। অন্তত বারোটি বিদেশী রাষ্ট্রের সংবাদ সংগ্রাহকেরা এসেছেন। তারা সকলে একসঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।

–আমরা জানতে পেরেছি, এটা নাকি আবহাওয়া বেলুন ছিল না।

 –এটা কি ফ্লাইং সসার?

 –এখানে কিছু অজানা অচেনা মানুষকে দেখা গেছে।

তারা কি বেঁচে আছে? সরকার কেন জনগণের কাছ থেকে সত্যটা গোপন করতে চাইছে।

প্রেস অফিসার তার গলা চড়িয়ে বললেন- ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়রা, আমাদের মধ্যে গোলমাল হচ্ছে। আমরা এই গোলমাল মেটানোর জন্য প্রেস কনফারেন্স ডেকেছি। আমরা অনেক সময় আকাশে উপগ্রহ দেখে থাকি, তারা ফুটতে দেখি। কিন্তু এই বিষয়ে যা বলা হয়, সেটা গুজবে ভরা। অনেকে বিশ্বাস করে, সত্যি সত্যি উড়ন্ত চাকি আছে। আমি জোরের সঙ্গে বলছি, সেদিন যে বস্তুটা আকাশ থেকে ভেঙে পড়ে সেটা ছিল একটা আবহাওয়া বেলুন। যদি আপনারা দেখতে চান তাহলে যেতে পারেন।

পনেরো মিনিট কেটে গেছে। দুটো বাস ভরতি রিপোর্টার আর টেলিভিশন ক্যামেরাম্যানরা এগিয়ে চলেছেন উটেনডরফের দিকে। তারা ওই আবহাওয়া বেলুনের অবশিষ্ট অংশ দেখবেন। তারা নামলেন, ভিজে ঘাসের ওপর দিয়ে এগিয়ে গেলেন। চারপাশে ছড়ানো ছেটানো কত কিছু।

প্রেস অফিসার বললেন- এই হল আপনাদের সেই রহস্যাবৃত ফ্লাইং সসার। এটাকে ভেভি এয়ারবেস থেকে ছাড়া হয়েছে। আমি জোরের সঙ্গে বলছি, এমন কোনো উড়ন্ত চাকির সন্ধান পাওয়া যায়নি। আমাদের সরকার তাই এই বিষয় নিয়ে আর কোনো আলোচনা করতে রাজী নয়। আমাদের সরকারের প্রধান এবং প্রথম সিদ্ধান্ত হল সত্য এবং তথ্যের ওপর আস্থা রাখা। যদি এই ব্যাপারে আমাদের হাতে নতুন কোনো তথ্য আসে, তাহলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তা সকলের কাছে জানাব। যদি আর কোনো প্রশ্ন না থাকে তাহলে…

তিনি তার কথা শেষ করলেন না।

.

১০.

ভার্জিনিয়া, এয়ারফোর্স বেস, নিরাপত্তার আবরণে মোড়া। বাইরে চারজন সশস্ত্র মানুষের প্রহরা। তারা সবদিকে তাকিয়ে আছেন।

অফিসাররা জানেন, এখন সময়টা বড়োই খারাপ। বিজ্ঞানী এবং ডাক্তারদের ওপর কাজের চাপ বাড়বে।

   এ পর্যন্ত মাত্র তিনজন আগন্তুককে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

চতুর্থ আগন্তুক সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাকে ব্রিগেডিয়ার ট্যাক্সটন অভিবাদন করলেন। এই ভদ্রলোকের হাতে নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে। তিনি বললেন, আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

-আমিও ব্যাপারটা দেখার জন্য আগ্রহ বোধ করছি।

 ভেতরের ঘরে যাত্রা শুরু হল। জেনারেল দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। বললেন এখানে আসুন।

জানুস চেম্বারের ভেতর ঢুকে পড়লেন। এই ঘরের একেবারে মধ্যিখানে ওই মহাকাশ যানটা রয়েছে। টেবিলের ওপর দুজন অচেনা মানুষের মৃতদেহ। একজন প্যাথোলজিস্ট শব্দ ব্যবচ্ছেদ করছেন।

জেনারেল ট্যাক্সটন তাকালেন। আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এটা বোধহয় মূল মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ট্যাক্সটন বোঝাবার চেষ্টা করলেন।

দুজন এসে ভালোভাবে মহাকাশ যানটা পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। আনুমানিক ৩৫ ফুট বাসযুক্ত। ভেতর দিকটা মুক্তোর মতো আকৃতির। বড়ো ছোটো হতে পারে এমন একটা সিলিং রয়েছে। তিনটে কৌচ আছে, চেয়ার আছে।

এখানে এমন কিছু আছে যা আমরা এখনও পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। খুব আধুনিক কার্যপদ্ধতি। অপটিক্যাল পদ্ধতি আছে, লাইফস্ক্যান পদ্ধতি আছে। যোগাযোগের ব্যবস্থা, শব্দ বিশ্লেষণের ক্ষমতা। এই যন্ত্রগুলো দেখে আমরা অবাক হয়ে গেছি। কীভাবে এগুলো সম্ভব হচ্ছে, আমরা বুঝতে পারছি না।

জানুস প্রশ্ন করলেন- এখানকার অস্ত্রগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন।

সবেমাত্র গবেষণা শুরু হয়েছে।

–কীভাবে শক্তি সরবরাহ হয়েছে?

–এখানে বোধহয় হাইড্রোজেন ভরে দেওয়া হয়েছে। হাইড্রোজেন থেকেই শক্তির উৎসটা পাওয়া গেছে। যে দুজন মানুষকে পেয়েছি আমরা, তাদের ওপর পরীক্ষা চলছে। তৃতীয় কৌচের ওপর আর একজন ছিল।

জানুস প্রশ্ন করলেন একজনকে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই তো?

–হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।

–দেখি,ওই আগন্তুকের চেহারা কেমন?

টেবিলের ওপর দুজনের শরীর, জানুস তাকিয়ে থাকলেন। অদ্ভুত রকমের দেখতে। মানুষের মতো, অথচ মানুষ নয়। মাথায় এতটুকু চুল নেই। চোখের পাতা নেই, চোখ দুটো পিংপং বলের মতো।

যে ডাক্তার শব ব্যবচ্ছেদ করেছেন, তিনি বললেন- একজনের হাত কেটে নেওয়া হয়েছে। রক্তের কোনো চিহ্ন নেই। একটা অদ্ভুত সবুজ পদার্থ আছে শিরার মধ্যে, বেশির ভাগটাই বের করা হয়েছে।

জানুস প্রশ্ন করলেন- সবুজ তরল পদার্থ?

 ডাক্তার বললেন- এটা বোধহয় গাছপালা থেকে পাওয়া গেছে

। দুজন পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন।

–জানুস, এরা কি মৃত, না বেঁচে আছে, ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না। হঠাৎ দেখা গেল কিছুটা সবুজ পদার্থ বেরিয়ে আসছে, হাতের মতো আকৃতি ধারণ করেছে।

–আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গিতে এরা মৃত, কিন্তু ওখানে মৃত্যুর সংজ্ঞা কী, আমরা এখনও জানি না। হয়তো এরা সুপ্ত অবস্থায় আছে।

জানুস অবাক হয়ে এই নতুন তৈরি হওয়া হাতটার দিকে তাকিয়ে আছে।

–তার মানে? এটা কি সুপ্ত অবস্থায় আছে? এখন প্রাণের স্পন্দন জেগেছে।

–হ্যাঁ, আরও কিছুক্ষণ দেখতে হবে।

.

গ্রিনহাউস ল্যাবোরেটরিতে নানা বিষয়ে গবেষণা চলছে। ওয়াশিংটন ডি সির বাইরে। তার দেওয়ালের ওপর লেখা আছে– এখানে এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় যে, বাইরের কেউ জানতে পারবে না।

প্রফেসার র‍্যাকম্যান এই বিষয়টির দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি বললেন– চালর্স ডারউইন প্রথম প্রমাণ করেছিলেন যে, গাছেরাও চিন্তা করতে পারে। পরে বারব্যাঙ্ক এই ব্যাপারটা নিয়ে আরও আলোচনা করেন।

এটা কি সত্যি বলে মনে হয়।

-হ্যাঁ, অনেক বিজ্ঞানী এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তারা বলেছেন যে, মানুষের আবির্ভাবের অনেক বছর আগেও ফুলেরা এই পৃথিবীতে ছিল। তাদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।

অধ্যাপক র‍্যাকম্যান আরও বললেন- এই ঘরে যা কিছু আছে, সবই জীবন্ত। গাছেরা ভালোবাসতে পারে, ঘৃণা জাগাতে পারে, তাদের যন্ত্রণা আছে, উত্তেজনা আছে, ঠিক প্রাণীদের মতো। এমন কি জগদীশচন্দ্র বসু প্রমাণ করেছেন, তারা শব্দ শুনে চিনতে পারে। শব্দের দিকে আকর্ষিত হয়।

কীভাবে এই প্রমাণটা করা হয়েছে?

–আমি দেখাতে পারি। র‍্যাকম্যান টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে একটা পলিগ্রাফ মেশিন ছিল। র‍্যাকম্যান তাকে গাছের সঙ্গে যুক্ত করলেন। ওই পলিগ্রাফ মেশিনের সূচকটা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ছিল। উনি বললেন, একটু দেখুন।

গাছের কানে কানে তিনি বললেন–মনে হচ্ছে, তুমি খুব সুন্দর, অন্য গাছেরা তোমার মতো নয়।

জানুস অবাক হয়ে দেখলেন– ওই সূচকটা একটু সরে গেছে।

প্রফেসার বললেন-তুমি নোংরা, তুমি কুৎসিত, তোমাকে মরতে হবে। তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?

সূচকটা কাঁপতে শুরু করল। সেটা ক্রমশ ওপর দিকে উঠছে।

 জানুস বললেন- হায় ঈশ্বর, আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না।

র‍্যাকম্যান বললেন–হ্যাঁ, এই ব্যাপারগুলো আমাদের ভাবিয়ে তোলে। শেষ অব্দি আমরা বুঝতেই পারি না, মানুষ এবং উদ্ভিদের মধ্যে সত্যি কোনো তফাত আছে কিনা।

জানুস অবাক হয়ে সব কথা শুনতে থাকলেন। তিনি ভাবলেন- এখন ওই হারিয়ে যাওয়া মানুষটিকে নিয়ে ভাবতে হবে। পরক্ষণেই তার মনে হল, মানুষ অথবা অজানা কোনো জীবন্ত বস্তু কে তার খবর রাখে!