১১.
তিন নম্বর দিন, বার্ন, বুধবার, অক্টোবরের ১৭ তারিখ।
বার্ন হল রবার্টের অন্যতম প্রিয় শহর। শহরটা মস্ত বড়ো। অনেকগুলো সুন্দর মনুমেন্ট আছে। আছে পুরোনো পাথরের তৈরি বাড়ি। অষ্টাদশ শতাব্দীর স্মৃতিরেখা। সুইজারল্যান্ডের রাজধানী। বিশ্বের অন্যতম স্মরণযোগ্য শহর। বার্নে যারা বসবাস করে, তাদের স্বভাব চরিত্র একেবারে আলাদা। তাদের কথার মধ্যে একটা আভিজাত্য আছে। শান্ত প্রকৃতির। এর আগে রবার্ট বেশ কয়েকবার বানে এসেছিলেন। সুইজ সিক্রেট সার্ভিসের হয়ে কাজ করেছেন। তাদের হেডকোয়ার্টারে গেছেন।
রবার্ট এসে পনেরোটা ফোন করলেন। কোথায় ফটোগ্রাফারের গাড়িটা আছে সেটা বের করতে হবে। সেই গ্যারাজের সামনে পৌঁছে গেলেন। মেকানিকের সঙ্গে কথা হল। ভদ্রলোকের নাম ম্যানডেল। চল্লিশ বছর বয়স। চেহারাটা রোগা। বুঝতে পারা যাচ্ছে, যথেষ্ট বিয়ার গেলেন।
রবার্ট বললেন– শুভ সন্ধ্যা।
–আমি কী করতে পারি?
–আপনার সঙ্গে কথা আছে।
দশ মিনিট কেটে গেছে।
সকালে আপনি ফোন করেছিলেন? কী হয়েছে বলুন তো? কোনো সমস্যা?
রবার্ট বললেন– না, আমি একটা সার্ভে করছি। আমি একজন ড্রাইভারের সন্ধান করছি।
–তাহলে অফিসে আসনু। গত রোববারের গাড়িটার কথা বলছেন তো?
ম্যানডেল ফাইল ক্যাবিনেট থেকে একটা ফাইল বের করলেনহ্যাঁ, ঠিকই বলছি।
ম্যানডেল একটা কার্ড নিয়ে বললেন, যে ড্রাইভার উড়ন্ত বস্তুর ছবি তুলেছিল?
–হ্যাঁ, আপনি কি ওটা দেখেছেন?
–হ্যাঁ।
–কেমন দেখতে বলতে পারেন?
ম্যানডেল বললেন– জীবন্ত বলে মনে হচ্ছিল। ওখান থেকে আলো বেরোচ্ছিল। প্রথমে নীল, তারপর হলুদ, তারপর সবুজ। অপূর্ব, কথায় বর্ণনা করা যাবে না। ভেতরে ছোটো ছোটো প্রাণীরা বসেছিল। মানুষ নয় কিন্তু।
কজন?
দুজন।
জীবন্ত?
মৃত বলে মনে হচ্ছিল। আমি বন্ধুদের বলেছি, তারা হাসাহাসি করেছে। আমার বউ ভেবেছে, আমি বোধহয় মাতাল হয়ে পড়েছিলাম। আমি কী দেখেছি, তা বোঝাতে পারব না।
–গাড়িটার কথা এবার বলুন।
–গাড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বিয়ারিং পুড়ে গিয়েছিল।
ড্রাইভারকে টাকা দিয়েছিলেন কীভাবে?
–আমি ক্যাশ টাকা দিয়েছি।
সুইস ফ্রাঙ্কে।
না, স্যার, পাউন্ডে।
–আপনি কি ঠিক বলছেন?
–হ্যাঁ। আমি বলছি।
মি. ম্যানডেল, ওই গাড়িটার লাইসেন্স নাম্বার দেখা যাবে?
ম্যানডেল বললেন–হ্যাঁ, ওটা ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। জেনেভা থেকে নেওয়া হয়েছিল।
লাইসেন্স নাম্বারটা দেবেন?
–কেন বলুন তো?
নাম্বারটা লিখে উনি রবার্টের হাতে তুলে দিলেন।
–এটার সঙ্গে উড়ন্ত চাকির কী সম্পর্ক?
রবার্ট বললেন- না, আমি ইন্টারন্যাশনাল অটো ক্লাব থেকে এসেছি। আমাদের ক্লাব নতুন ট্রাকের ওপর একটা গবেষণা করছে।
রবার্ট গ্যারাজ থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তার মানে? দুজন মৃত বিদেশীকে পাওয়া গেল। জেনারেল হিলিয়াড কি মিথ্যে কথা বলেছেন? রবার্টকে আবিষ্কার করতে হবে, কেন একটা উড়ন্ত চাকি ধ্বংস হয়ে গেছে।
তার মানে? একটাই সম্ভাবনা হতে পারে, সেই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনাটার কথা ভেবে রবার্টের রক্ত হিম হয়ে গেল।
.
১২.
বিশাল ওই বড়ো উড়োজাহাজটা। মনে হচ্ছে, সেটা বোধহয় এখন একেবারে নিস্পন্দ। বাইশ হাজার মাইল ঘণ্টায় উড়তে পারে পৃথিবীর গতির সাথে পাল্লা রেখে। দুজন সেখানে বসে আছে। মনিটরের ভেতর একটা গ্রহের ছবি দেখা যাচ্ছে। গ্রহটার নাম বসুন্ধরা। তারা অনেকগুলো ছবি তুলেছে।
এইসব অদ্ভুত দর্শন প্রাণীদের দেখতে অবাক লাগে। তারা নীচের দিকে তাকাল। ধু ধু জলরাশি। বেইট বেলিয়ারির চোখে দেখা গেল। আমাজন বৃষ্টি-অরণ্য। একটির পর একটি অঞ্চল।
তারা টেলিপ্যাথির মাধ্যমে কথা বলে থাকে।
অনেক নীচে এই পৃথিবীর প্রান্তর। রবার্ট জেনারেল হিলিয়াডকে ফোন করলেন।
–আফটারনুন কমান্ডার, রিপোর্ট করার মতো কিছু আছে কি?
–ওই আবহাওয়া বেলুন সম্পর্কে, মনে হচ্ছে, ওটা বোধহয় একটা উড়ন চাকি।
–হ্যাঁ, আমি জানি। আমি সব কথা আগে বলতে পারিনি, অসুবিধা ছিল।
কিছুক্ষণের নীরবতা।
জেনারেল হিলিয়াড আবার বললেন– আপনাকে জানাতে বাধ্য হচ্ছি কমান্ডার, তিন বছর আগে আমাদের সরকারের সাথে একটা লড়াই হয়েছিল। ওই উড়ন চাকিগুলো ন্যাটো এয়ার বেসে এসেছিল। তখন থেকে আমরা যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছি।
রবার্টের রক্ত জমাট হয়েছে ওরা কী বলেছে?
–ওরা আমাদের ধ্বংস করতে চাইছে।
–কেন?
জানি না, ওরা বোধহয় আমাদের ওপর প্রতিশোধ নেবে। ওরা এখানে এসে আমাদের দখল করবে। আমরা সকলেই ওদের দাস হয়ে যাব। এই ব্যাপারটা থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে।
রবার্ট অবাক হয়ে জানতে চাইলেন– সব মানুষের কাছে এই ভয়ংকর খবরটা পৌঁছে দেওয়া তোতা উচিত।
কিছুক্ষণ নীরবতা– ব্যাপারটা ওভাবে ভাববেন না কমান্ডার, ১৯৩৮ সালে অর্সান নামে এক তরুণ অভিনেতা একটা রেডিও ব্রডকাস্ট করেছিল। নাম দিয়েছিল বিশ্বের যুদ্ধ। অন্য জায়গা থেকে কিছু মানুষ এসে পৃথিবী দখল করেছে এমন কথা বলা হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। আমেরিকার সর্বত্র মানুষ ভীষণ ভয় পেয়েছে। তারা বাড়ি থেকে পালাবার চেষ্টা করছে। টেলিফোনে একটার পর একটা শব্দ ভেসে আসছে। হাইওয়েগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে মরে গেছে। সম্পূর্ণ বিশৃংঙ্খলা অবস্থা। তাই আমাদের শক্তিশালী হয়ে উঠতে হবে। সবশেষে আমরা মানুষকে জানাব সবকিছু। তাই আপনি দেখুন ওই প্রত্যক্ষদর্শীদের পাওয়া যায় কিনা। তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
রবার্ট, বুঝতে পারলেন।
–হ্যাঁ আমি বুঝতে পারছি।
–শুনলাম আপনি নাকি একজনের সঙ্গে কথা বলেছেন।
–হ্যাঁ দুজনকে পেয়েছি।
–নাম?
–হানস বেকারম্যান, তিনি হলেন ট্যুর বাসের ড্রাইভার। উনি কাপেলে থাকেন।
–দ্বিতীয় জন?
–ম্যানডেল, বার্নে তার একটা গ্যারেজ আছে। তিনিও দেখেছেন।
–আর কারো নাম পাওয়া গেছে?
–এখনও পাইনি, চেষ্টা করছি। আশা করি কয়েকদিনের মধ্যেই সফল হব।
রবার্ট রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। তার মন এখন চঞ্চল। উড়ন চাকির ব্যাপারটা সত্যি? মহাকাশের অতিথিরা সত্যি? সাংঘাতিক।
রবার্টের মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা। জেনারেল হিলিয়াড তাকে এই কাজটা করতে দিয়েছেন, কিন্তু সবকিছু বলেননি কেন? ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হবে।
.
অ্যাভিসেন্ট্রাল কার কোম্পানীর অফিস। জেনেভা শহরের বুকে অবস্থিত। রবার্ট অফিসে ঢুকে পড়লেন। ডেস্কের ওধারে এক মহিলা বসেছিলেন। বলুন কী করব?
রবার্ট একটুকরো কাগজ দেখালেন, তাতে লাইসেন্স নম্বরটা দেওয়া আছে।
–এই গাড়িটা আপনারা গত সপ্তাহে ভাড়া দিয়েছিলেন, কে ভাড়া নিয়েছিল, জানতে পারি কি?
কণ্ঠস্বরে রাগ এবং অসহিষ্ণুতা।
ক্লার্ক বললেন আমি দুঃখিত, এই খবর আমি দেব না।
-কেন? আমি একটা মস্ত বড়ো ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।
–আমি বুঝতে পারছি না কী সমস্যা হয়েছে?
–আমি সমস্যাটা বুঝিয়ে বলছি। গত রোববার এই গাড়িটা হাইওয়ের ওপর দিয়ে ছুটে গিয়েছিল। অনেক ক্ষতি হয়েছে। কোনো রকমে লাইসেন্স নম্বরটা আমি পেয়েছি। লোকটা পালিয়ে গেছে।
ক্লার্ক রবার্টের দিকে তাকিয়ে বললেন- ঠিক আছে, আমি দেখছি।
উনি ঘরের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত বাদে ফিরে এলেন। উনি বললেন- ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টের কথা তো লেখা নেই।
আমি এটা রিপোর্ট করে দিচ্ছি। আপনার কোম্পানীকে আমি এইজন্য দায়বদ্ধ করব। আমার গাড়িটার ক্ষতি হয়েছে, আপনারা কিন্তু তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন। আমারটা একেবারে নতুন পর্সে গাড়ি, দেখা যাক আমি শেষ পর্যন্ত কী করতে পারি।
–আমি দুঃখিত, কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টের কথা বলা হয়নি। আমরা তার দায়িত্ব নেব কেন?
-দেখুন, আমি আপোসে ব্যবস্থা করতে চলেছি। আমি আপনার কোম্পানীকে দায়বদ্ধ করব না, ওই মানুষটা যদি ড্যামেজের টাকা দিয়ে দেয়, তাহলেই আমি সন্তুষ্ট। আমার গাড়িটা একেবারে তুবড়ে গেছে। আমি পুলিশকে ডাকতে পারতাম। ওই লোকটির নাম আর ঠিকানা আমাকে দিন। আমি ওর সঙ্গে সরাসরি কথা বলব। এটা আমাদের ব্যাপার, আপনি কেন নাক গলাতে আসছেন?
ক্লার্ক কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন। তারপর বললেন– আচ্ছা, আমি নাম দিচ্ছি। ওর নাম লেসলি।
.
–ঠিকানা?
–২১৩, ক্লোক রোড, লন্ডন।
উনি তাকালেন– আপনি ঠিক বলছেন আমাদের কোম্পানীকে কোনো ঝামেলায় জড়ানো হবে না?
-না, আমি এক কথার মানুষ। এটা আমার আর লেসলির মধ্যে ব্যক্তিগত সংঘাতের ব্যাপার।
কমান্ডার রবার্ট বেলামি এবার সুইস এয়ার ফ্লাইটে চলেছেন লন্ডনের দিকে।
.
অন্ধকারের উনি একা বসে আছেন। সবকিছু ভাবার চেষ্টা করছেন।
টেলিফোনের শব্দ। –ডেনস কথা বলছি।
–ডেনস, জেনারেল ইলিয়াট।
বলে যান।
কমান্ডার বেলামি দুজন প্রত্যক্ষদর্শীকে সনাক্ত করেছেন।
বাঃ, কাজটা ভালোভাবেই এগোচ্ছে।
–হ্যাঁ।
কমান্ডার এখন কোথায়?
–উনি লন্ডনে আছেন। উনি তিন নম্বর প্রত্যক্ষদর্শীকে সনাক্ত করতে চলেছেন।
আমি কি সবকথা বলে দেব? খবর দিতে থাকলেন। নোভাবেড নিশ্চয়ই এই ঘটনাটার কথা জানে।
–আমি সব বুঝতে পারছি স্যার। এবার ফ্ল্যাশ আলো জ্বলে উঠল, কেবল খালি সংবাদ পাঠাচ্ছে।
.
১৩.
মধ্যরাত, ইটেনডক থেকে পনেরো মাইল দূরবর্তী ছোট্ট একটা ফার্ম হাউস। সেখানে ন্যাগিন্সের পরিবারের সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা তারা ভাবতেও পারেনি। বড় ছেলেটি আকাশে একটা হলুদ আলোর বিচ্ছুরণ দেখতে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি সে ছুটে এসেছে, আলোটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।
উঠোনের ওপর জার্মান কুকুরটা বিকট স্বরে ডাকতে আরম্ভ করেছে। বয়স্ক ভদ্রলোক সেখানে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সব আলো নিভে গেল। টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করলেন, লাইনটা ডেড হয়ে গেছে।
বেশ কিছুক্ষণ আলোগুলো নেভানো ছিল। তার মনে হল, এক সুন্দরী মহিলা বোধহয় সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছে।
.
১৪.
জেনেভা, একটা বেজেছে।
সরকারী মন্ত্রী হেড কোয়ার্টারে বসে আছেন। সুইস ইনটেলিজেন্স এজেন্সির অফিসে। কেবল ডিরেক্টর নানা কাজে ব্যস্ত আছেন।
হানস বেকারম্যান এবং ফিচ ম্যানডেল, একটা খবর ভেসে এল। এখনও কোনো সমস্যা হয়নি, গ্রেট মিনিস্টার, আমি দেখছি।
–হ্যাঁ, এখনই চেষ্টা করো।
.
পরের দিন সকালবেলা, হানস বেকারম্যানের পেটে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। নাঃ, ওই রিপোর্টারের নিকুচি করেছে। টাকাটা না দিলে আমি বোধহয় এমনভাবে খেতাম না। ওই ম্যাগজিনগুলো নিয়ে কী হবে?
উনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। হানস গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছে। পথে এক মহিলার সাথে দেখা হল। মহিলা বোধহয় গাড়িতে লিফট চাইছে। বয়েস কম, দেখতে সুন্দরী। হানস রাস্তার ধারে গাড়িটা থামাল। মহিলা ক্রমশ এগিয়ে আসছে।
হানস বলল– আমি কি করে সাহায্য কবব? কাছে আসতে বুঝতে পারল, ও আরও সুন্দরী।
–আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে লড়াই হয়েছে। সে আমাকে এখানে ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে।
ব্যাপারটা খুবই খারাপ।
–আপনি কি আমাকে জুরিখ পর্যন্ত নিয়ে যাবেন?
–উঠে আসুন, উঠে আসুন।
ফিচ গাড়ির দরজা খুলে দিল। মহিলা উঠে পাশে বসল।
–অনেক ধন্যবাদ। আমার নাম কাবেজ।
—আমি হানস।
–হানস, আপনি না থাকলে কী হত বলুন তো?
–আমার তো সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। আপনার মতো এক সুন্দরী মহিলা আমার পাশে বসে আছে।
কিন্তু, আমি তো ভালো লোকের হাতেই এসে পড়েছি।
হানস অবাক হয়ে চোখের দিকে তাকাল।
–আমার মনে হয় সত্যিই আপনি খুবই সুন্দর।
মুখে হাসি এই কথাটা কখনও আমার বউকে বলবেন না যেন।
—ও আপনি বিবাহিত, একটু হতাশার ছাপ। কেন সুন্দর পুরুষরা সকলে বিবাহিত হয়। আপনাকে খুব বুদ্ধিমান বলে মনে হচ্ছে।
মেয়েটি আবার বলল, বয়ফ্রেন্ডের কথা মনে হচ্ছে। তার স্কার্ট বেশ খানিকটা উঠে গেছে। উরুর অনেকটা প্রকাশিত। হানস সে দিকে তাকাল।
মেয়েটি বলে চলল–আমি তো বয়স্ক লোককেই বেশি পছন্দ করি। আমি জানি বয়স্ক লোকেরা তরুণদের থেকে আরও বেশি যৌন আবেদনময় হয়ে ওঠে। মেয়েটির মুখে হাসি। –হানস, সেক্সের খেলা খেলতে আপনার কেমন লাগে?
গলা খাঁকারি দিয়ে হানস বলল- হ্যাঁ, এতো স্বাভাবিক ব্যাপার।
-হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। আমি কিছু কথা কি আপনাকে বলব? আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া হয়েছে। ওকে আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি কি আপনাকে ভালোবাসা দেব?
হানস বুঝতে পারছে না ভাগ্য তার এত সহায়ক হবে। মেয়েটি তার উরুতে থাপ্পড় মেরে বলল- সত্যিই আমি এমন ভালোবাসব আপনি কোনো দিন ভুলবেন না।
আঃ, ভারী সুন্দর শরীর আর স্বাস্থ্য।
হানস বলল- আমাকে তো কাজ করতে হবে। অনেক কাজ আছে।
মাত্র কয়েক মিনিট লাগবে। এই রাস্তাটা অরণ্যের ভেতর চলে গেছে। চলুন না সেখানে আমরা চলে যাই।
হানস ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। নিঃশ্বাস গরম হচ্ছে।
–আচ্ছা, আমি এখনই যাচ্ছি।
হানস গাড়িটাকে ঘুরিয়ে নিল, হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে। ছোট্ট একটা রাস্তা চলে, গেছে ঘন বনের মধ্যে। এই দিকে কোনো লোকের নজর পড়ে না।
মেয়েটি হানসের উরুতে হাত দিয়ে বলল আপনার পা দুটো খুবই শক্তিশালী।
বেকারম্যান বক্তব্য রাখল- আমি একসময় দৌড়বীর ছিলাম।
-দেখি আপনার ট্রাউজার খুলুন তো।
সে সঙ্গে সঙ্গে বেল্টে হাত দিল। প্যান্টটা খুলে ফেলল।
–কী বিরাট! হানসের গলায় গোঙানি।
–আমি কি এখানে একটা চুমু খাব?
–হ্যাঁ, হানসের মনে হল, বউ কিন্তু এভাবে ওই পুংদন্ডটাকে কখনও আদর করেনি। বেকারম্যান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখ বন্ধ করল। সুন্দর হাল্কা হাত তার পুংদন্ডে খেলা করছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে, কী যেন ঘটে যাচ্ছে। সুখ, আর সুখ। কিন্তু হঠাৎ, সূঁচের পরশ। সামান্য বেদনা।
সমস্ত শরীরটা শক্ত হয়ে গেছে। চোখ উল্টে গেছে। সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। মেয়েটি দেখল, হা, বেকারম্যান বোধহয় কথা বলতে পারছে না। মেয়েটি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। ওই শরীরটা প্যাসেঞ্জার সীটে ফেলে দিল। তারপর গাড়িটাকে চালিয়ে হাইওয়ের একধারে নিয়ে এল। এখান থেকেই পাহাড়ের পথটা শুরু হয়ে গেছে। রাস্তাটা ফাঁকা হওয়া অবধি সে অপেক্ষা করল। গাড়ির দরজাটা খুলল। গ্যাস ফেডালে চাপ দিল। গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। সে বাইরে চলে এল। দাঁড়িয়ে থাকল, গাড়িটা ধীরে ধীরে উপত্যকা থেকে গড়িয়ে পড়ছে। পাঁচ মিনিট কেটে গেছে, একটা কালো লিমুজিন এসে থেমেছে। প্রশ্ন করছে- কোনো সমস্যা?
না, কোনো সমস্যা নেই।
.
ফিচ ম্যানডেল তার অফিসে বসে ছিল, এবার গ্যারেজটা বন্ধ করতে হবে। দুজন লোক এসেছে।
সে রেগে গিয়ে বলল– এখন বন্ধের সময়। এখন আর হবে না।
একজন বলল- আমাদের গাড়িটা হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে। একটা লোক পাওয়া যাবে?
–আমার বউ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ একটা নেমতন্ন আছে। আপনি বরং অন্য কোনো গ্যারেজ দেখুন।
আগন্তুকদের একজন বলল- আমি দুশো ডলার দিতে পারি। গাড়িটা এক্ষুনি সারিয়ে তুলতে হবে।
অন্যজন বলল- না, ওকে একেবারে তিনশো করে দাও।
ওরা ভেতরে ঢুকে গেল। বলল- হ্যাঁ, আপনার যন্ত্রপাতিগুলো চমৎকার।
ম্যানডেলের মুখে হাসি তা যা বলতে, আমি অনেক কষ্টে গ্যারেজটা তৈরি করেছি।
–তাহলে? একটু চলুন না, কতক্ষণ আর লাগবে, আধ ঘন্টার মধ্যে হয়ে যাবে।
ম্যানডেল ভাবতেই পারছে না, তিনশো ডলার! এত টাকার হাতছানি? সে যাবার জন্য তৈরি হল, সঙ্গে সঙ্গে একজন আগন্তুক তাকে ধাক্কা দিল। পাশেই হাইড্রোলিক মেশিনটা রয়েছে। ধাক্কা সামলাতে না পেরে ম্যানডেল মেশিনের তলায় পড়ে গেল। অবাক হয়ে সে দেখল, মেশিনটা ধীরে ধীরে তার ওপর নেমে আসছে। শেষ পর্যন্ত বাধা দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল সে, কিন্তু সফল হয়নি। একটু বাদে একটা আর্তনাদ বাতাসে মিলিয়ে গেল। শরীরটা রক্তাক্ত হয়ে গেছে।
দুই আগন্তুক সঙ্গে সঙ্গে গ্যারেজ থেকে চলে গেল।
দুটি কেবল গ্রাম সঠিক জায়গায় পৌঁছে গেল। তার মানে? দুজনকেই খতম করা সম্ভব হয়েছে।
.
অটোয়া, কানাডা। রাত বারোটা। ড্যানসে বারোজনের সঙ্গে কথা বলছেন।
ভালোই এগিয়েছি আমরা। দুজন প্রত্যক্ষদর্শীর কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছে। কমান্ডার এখন তৃতীয় জনের সন্ধানে মগ্ন আছেন।
–আর কোনো খবর আছে? ওই ইটালীয় সম্পর্কে?
–না, খবর থাকলে সঙ্গে সঙ্গে দেব।
–আরও তাড়াতাড়ি করতে হবে, বিপদের গন্ধ পাচ্ছি যেন।
অচেনা কণ্ঠস্বর।
না একসপ্তাহ সময় দিন, আটচল্লিশ ঘণ্টা বাদে আবার দেখা হবে কেমন?
.
১৫.
চতুর্থ দিন, লন্ডন, বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর।
লেসলির রোল মডেল হল রবীন রিক। এক বিখ্যাত মানুষ। লেসলি এই ভদ্রলোকের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানের ওপর নজর রাখে।
মা একদিন বলেছিল- তুমি তো পৃথিবীর সব কথা শুনে নিয়েছ।
এই ছোটো ছেলেটি যখন শুতে যায়, তখনও সেই কথাই ভাবতে থাকে। হ্যাঁ, সমস্যা, দেখা দিয়েছে। কী জন্য? সে তার খবর রাখে না। ধীরে ধীরে দিন কেটে যাচ্ছে, অনেকের কথা মনে পড়ছে। সে জানত, এইটুকু চেহারা নিয়ে অভিনয় করা সম্ভব না। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, মনের ভেতর সব সময় একটা কষ্ট। ভাবল, ডাস্টির সুখ, ডাস্টিং হকম্যান, পিটার কক, সকলেই তো বেঁটে।
লেসলি কী কাজে দেবে? শেষ পর্যন্ত অনেক ভাবতে ভাবতে সে ঠিক করল, ক্যামেরাম্যান হয়েই জীবনটা কাটাতে হবে। ফটো তোলার ব্যাপারটা খুব সহজ। যে কোনো লোক তা করতে পারে। সত্যিকারের ফটো তুলতে গেলে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। অনেক বুদ্ধি দিতে হয়। শেষ অবধি লেসলি এই ব্যাপারটা আরও ভালো করে রপ্ত করেছিল। সে জানে, যে কোনো ভালো মুখের অন্তরালে ভালো ফটোগ্রাফার থাকে। মায়ের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে লেসলি তার ফটোগ্রাফি ব্যবসাটা শুরু করে দিল।
মা একদিন তাকে বলেছিল– কম করে শুরু করলে, স্বপ্নটা থাকবে বিরাট। লেসলি সেই আপ্ত বাক্য মেনে চলেছে। সে ছোটো ছোটো কাজ করতে থাকে। ফটোগ্রাফিতে তার কোনো বুদ্ধি ছিল না। প্রথম প্রথম সে যা পেত তারই ছবি তুলত। ছবিগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাত। বেশির ক্ষেত্রে সেগুলো ফিরে আসত। লেসলি নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিত। পৃথিবীর বিখ্যাত সব মানুষকেই এভাবে পরাজয়ের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। সে জানত, একদিন তার কথা সকলের মুখে মুখে ফিরবে।
হঠাৎ একদিন একটা সুযোগ এল। তার এক মাস ব্রিটিশ পাবলিশিং ফার্মের হয়ে কাজ করতেন। হাভার্ড কলিন্স। তিনি এসে একটা প্রস্তাব দিলেন। সুইজারল্যান্ডের ওপরে কপিটেবিল বই প্রকাশ করতে হবে।
-ওরা এখনও ফটোগ্রাফারের কথা চিন্তা করেনি। লেসলি, তুই যদি এখনই সুইজারল্যান্ড যেতে রাজি থাকিস, তাহলে একটা ভালো কাজ পাবি।
লেসলি ক্যামেরা নিয়ে চলল সুইজারল্যান্ডের দিকে। সে জানত, এই সুযোগটা হাত ছাড়া করা উচিত হবে না। শেষ পর্যন্ত বোকার আমার বুদ্ধির তারিফ করতে চলেছে। সে একটা গাড়ি ভাড়া করল জেনেভাতে, সমস্ত দেশটা ঘুরে বেড়াল। নানা দৃশ্যের ছবি তুলল। আহা, সুন্দর ঝরনা, তুষার ঢাকা এক একটা পাহাড়চূড়া। সূর্যাস্তের এবং সূর্যোদয়ের ছবি। চাষীরা চাষ করছে, তারপর সে তার জীবনধারা পাল্টে ফেলল। সে তখন পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। মোটরের গোলমাল দেখা দিল। হাইওয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, মনে ঘৃণা। সবসময় আমার বেলা এই ঘটনা ঘটে কেন? বসে আছে।
সে গ্যাসোলিন ট্রাকের দিকে তাকাল একটা লিফট পাওয়া যাবে? আমাকে কোনো গ্যারেজে নিয়ে যেতে পারবে?
ট্রাক ড্রাইভার মাথা নেড়ে বলল–না, আজ রোববার, আজ তো এখানে কোনো গ্যারেজ খোলা নেই। আপনাকে বারন পর্যন্ত যেতে হবে।
বারন? পঞ্চাশ কিলোমিটার?
ট্রাক ড্রাইভার বলল না, রোববার ওখানে ছাড়া কিছুই পাবেন না এখানে।
সে ট্রাক চালিয়ে দিল।
–ঠিক আছে, আমি বারন যেতে চাইছি। কিছু কি করা যাবে?
–দেখা যাক, কোনো ড্রাইভারকে পাই কিনা।
লেসলি তাকিয়ে আছে, না, কেউ আমাকে সাহায্য করছে না। অনেক টাকা খরচা হয়ে গেছে, ছবি তুলতে। এখন আমাকে গ্যারেজের পেছনে টাকা ঢালতে হবে। দু ঘণ্টা সময় লাগবে, তারপর হয়তো সাহায্যকারী হিসেবে কেউ আসবে।
গাড়িটাকে ট্রাকের সঙ্গে বাঁধা হল। হঠাৎ আকাশে আলোর শিখা। বিস্ফোরণের শব্দ। সে অবাক হয়ে তাকাল, আকাশ থেকে উজ্জ্বল বস্তু খসে পড়ছে। এখানে একটা টুর বাস দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণ আগে সেটা এসে থেমেছে। পর্যটকরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। লেসলি একটু চিন্তা করল। একবার ভাবল ছবি তুলবে। তারপর ভাবল না চলেই যাওয়া ভালো। অবাক হয়ে গেছে সে। কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। অবাক বিস্ময়ে সে ওই উড়ন্ত চাকির দিকে তাকিয়ে থাকল। অনেক দিন থেকেই সে উড়ন্ত চাকির গল্প শুনেছে। এরা যে আছে তা বিশ্বাস করেনি। এখন বিশ্বাস করতে বাধ্য হল।
পর্যটকেরা তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। বিরাজ করছে নীরবতা। তার পাশের মানুষটি অজ্ঞান হয়ে গেল। আরেকজন বমি করতে শুরু করেছে। এক বৃদ্ধ যাজক ছিলেন। তিনি জপের মালা জপছেন। কেউ বলল– এটা তো উড়নচাকি।
লেসলি বর্তমানের বুকে ফিরে এসেছে। একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে চলেছে। আমি কি ছবি তুলব? এমন ছবি, শতাব্দীতে যা একবারও পাওয়া যায় না। পৃথিবীর কোনো পত্রিকা কিংবা সংবাদপত্রে কি এই ছবি বাতিল বলে গণ্য হবে? সুইজারল্যান্ডের ওপর কপি টেবিল বুক? হ্যাঁ, এই ছবিটা সকলকে অবাক করে দেবে।
ভাগ্য খুলে গেল। সে ভাবল, এই ফটোগুলো আমি সবকাগজে কাছে। বেচাতে পারব। লন্ডন টাইমস, সান, মের, মিরার ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট কাগজ। বিদেশেও পাঠাতে পারব। প্যারিস অথবা অন্য কোথাও।
তার মন তখন আনন্দে লাফাচ্ছে। সে চিন্তা করতে গিয়ে বেশ কিছুটা সময় নষ্ট করল। তারপর ছবি তুলতে শুরু করল। কাউকে এই কথা বলল না।
এবার গাড়িটা যাত্রা করতে শুরু করবে।
লেসলি ক্যামেরার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছে।
দুজন হাইওয়ের ওপর চলে গেল। লেসলি ট্যুরিস্টদের দিকে তাকিয়ে বলল– ক্ষমা করবেন।
সে তার ফোকাসটা ঠিক করল। উড়নচাকির ছবির সাথে ওই মানুষগুলোর ছবি? কেমন হবে ব্যাপারটা? সে কালো সাদায় ছবি নিল। রঙীন ছবিও তুলল। যতবার সাটারের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, লেসলি ভাবল, দশলক্ষ পাউন্ড, আরও দশলক্ষ পাউন্ড।
যাজক তার কাছে এসেছেন। তিনি বললেন- এটা কি শয়তানের মুখ?
শয়তান! ওর তো অন্তরুদ্ধ মুখ দেখতে পাচ্ছি। এই প্রথম উড়ন্তচাকির অস্তিত্ব প্রমাণিত হতে চলেছে। পরক্ষণেই লেসলির মনে হল, ওরা যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে, তাহলে কী হবে?
ওখানে নজন প্রত্যক্ষদর্শী জুড়িয়ে আছে। সে তাদের দিকে তাকাল। বলল– ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়রা, আপনারা কি এখানে ছবি নেবেন, পাশাপাশি দাঁড়ান। আমি সকলকে একটা করে প্রিন্ট পাঠাব, পয়সা নেব না।
সাংঘাতিক উত্তেজনা। প্যাসেঞ্জাররা পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ল। ওই উড়নচাকির ধ্বংসাবশেষের সামনে।
পাদ্রী সাহেব দূরে চলে গেলেন। তিনি বললেন না, এটা শয়তানের হাত। আমি ওখানে যাব না।
কিন্তু লেসলির দরকার ছিল ওই যাজককে। উনি থাকলে ব্যাপারটা আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।
লেসলি বলল– একবার এসে দাঁড়ান। তাহলে ভালোই হবে।
একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়াবেন। শেষ পর্যন্ত যাজক এসে গেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা ছড়িয়ে গেল, ভারী ভালো হয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকুন।
সে গোটা ছয়েক ছবি তুলল, পেন্সিল এবং কাগজ নিয়ে বলল- আপনাদের নাম ঠিকানা দিয়ে দিন। সকলকে প্রিন্ট পাঠাব।
সে কাউকেই প্রিন্ট দেবে না। খালি লোকগুলোকে জানিয়ে রাখতে চাইছে। খবরের কাগজ বিশ্বাস না করলে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে।
হঠাৎ সে দেখল, কজনের হাতে ক্যামেরা আছে। কিন্তু সে আর কোনো ক্যামেরাম্যানকে এখানে অনুমতি দেবে না। তা কেমন করে সম্ভব?
সে বলল- যাদের হাতে ক্যামেরা আছে, আমার কাছে তুলে দিন। আমি আপনাদের হয়ে ছবি তুলে দেব। ব্যাপারটা আরও ভালো হবে।
ক্যামেরাগুলো অতি দ্রুত তার হাতে এসে গেল। সে নীচু হয়ে ক্যামেরার গর্তে হাত দিল। উজ্জ্বল সূর্যের আলো ঢুকে পড়ল। নেগেটিভগুলোর বারোটা বেজে গেল। আমি এক পেশাদার মানুষ। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটাকে নষ্ট করব কেমন করে?
দশমিনিট বাদে লেসলি সকলের নাম ঠিকানা পেয়ে গেছে। সে শেষবারের মতো উড়নচাকির ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকাল, তারপর বলল- হ্যাঁ, মা ঠিক কথাই বলেছিল, একদিন আমি মস্ত বড়ো হয়ে উঠব।
সে ইংল্যান্ডে ফেরার মতো সময় হাতে রাখতে চাইছে না। এই ফটোগ্রাফগুলো এখনই প্রিন্ট করতে হবে।
.
কে রিং বাজাচ্ছে? পুলিশ স্টেশন, ইউটানডাস অঞ্চল। সমস্ত সন্ধ্যে ধরে টেলিফোন রিং বাজছে। আমার বাড়ির পাশে কেউ ঘোরাঘুরি করছে।
সেখানে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠেছে।
গোরুগুলো চীৎকার করছে। নেকড়ে এসেছে মনে হয়।
আমার জল কেউ শুষে নিচ্ছে।
তারপর? চীফ, হাইওয়েতে অনেকগুলো নতুন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এটা কি দুঃস্বপ্ন? সমস্ত গাড়ি বন্ধ হয়ে গেছে।
-কেন কী জন্য?
–এমন একটা রাত এল, যার কথা সে কখনও ভুলতে পারবে না।
.
১৬.
রবার্ট ভাবতে থাকেন, কতদিন ধরে এই কাজ করতে হবে? তাদের গতিবিধি সম্পর্কে তিনি কিছুই ভাবতে পারছেন না। কয়েক বছর ধরে? না, মনে হচ্ছে এর থেকে মুক্তি নেই।
.
হিথরো বিমান বন্দর, রবার্ট বাইরে বেরিয়ে এলেন। ট্যাক্সি নিলেন, জনাকীর্ণ শহর, কত পরিচিত ল্যান্ডমার্ক। সুশানের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন বোধহয়। সেই সোনালী দিনগুলো কীভাবে কেটে গেছে। আমরা আমাদের নিজস্ব সুখকে কিনেছিলাম। আমাদের নিজস্ব উত্তেজনা ছিল। গল্পটা এক সুখী সম্পৃক্ত সমাপ্তির দিকে এগিয়ে গেছে।
হঠাৎ সমস্যা দেখা দিল, হঠাৎ একদিন অ্যাডমিরাল হুইট্যাকারের ফোন, রবার্ট এবং সুশান তখন থাইল্যান্ডে বেড়াচ্ছিলেন। নেভি থেকে রবার্টকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, ছমাস হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে তিনি আর কখনও অ্যাডমিরালের সঙ্গে কথা বলেননি। ওরিয়েন্টাল হোটেল ব্যাংকক, ফোনটা বেজে উঠল– রবার্ট, অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার?
অ্যাডমিরাল! আপনার কণ্ঠস্বর শুনে ভালো লাগছে।
–আপনাকে অনুসন্ধান করা তো খুবই শক্ত। এখন কী করছেন?
বিরাট হনিমুন কাটাচ্ছি।
সুশান কেমন আছে? আপনার স্ত্রীর নাম তো সুশান তাই না?
–হ্যাঁ, ও ভালো আছে। আপনাকে ধন্যবাদ।
-কত তাড়াতাড়ি আপনি ওয়াশিংটনে আসতে পারবেন?
–আপনি কী বলছেন?
–এখনও ঘোষণা করা হয়নি। আপনাকে একটা নতুন কাজের দায়িত্ব দেব। আপনাকে আর্মি সতেরো নম্বর ডিস্ট্রিক্ট নাভাল ইনটেলিজেন্সির ডিরেক্টর করা হয়েছে। আপনি কি এখনই আসতে পারবেন?
রবার্টের মাথা ঘুরতে থাকে নাভাল ইনটেলিজেন্স? অ্যাডমিরাল, আমি তো এসবের কিছুই জানি না।
–আপনি জানতে পারবেন রবার্ট, দেশের জন্য আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। আপনি কখন আসতে পারবেন?
–ভেবে দেখছি।
–সোমবার সকাল নটায় চলে আসুন, সুশানের জন্য আমার ভালোবাসা রইল।
রবার্ট সুশানের কাছে সব কথা খুলে বললেন।
নাভাল ইনটেলিজেন্স? ব্যাপারটা শুনতে ভালোই লাগছে।
সন্দেহে আকুল কণ্ঠস্বরে রবার্ট বলেছিলেন- কী কাজ মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না।
–ওখানে গিয়েই একবার দেখো না।
রবার্ট সুশানের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন- তুমি কী চাইছ? এটায় আমি যোগ দেব?
সুশান গলা জড়িয়ে বলেছিলেন- আমি তোমাকে সব সময় আমার কাছে পেতে চাই। তবে কাজে থাকাটাই তো ভালো। কয়েক সপ্তাহ ধরে তুমি যেন কেমন হয়ে গেছ।
–তুমি কি আমার থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইছ? তাহলে এই হনিমুনটা শেষ হয়ে গেল।
সুশান ঠোঁটে হাত দিয়ে বলেছিলেন- না, আমি সব সময় তোমাকে কাছে পেতে চাই, হে আমার প্রিয় নাবিক বন্ধু।
রবার্ট ভাবতেই পারেননি, এভাবে একটা মারাত্মক গল্প শুরু হতে পারে। তিনি ওয়াশিংটনে ফিরে এলেন। অ্যাডমিরাল হুইট্যাকারের সঙ্গে কথা বললেন।
ভদ্রলোক বলেছিলেন- এই কাজে যথেষ্ট সাহস দরকার। দরকার আত্মনিবেদনের আকাঙ্খ, না হলে কখনই আপনি এই কাজটা করতে পারবেন না। আপনি হয়তো জানেন যে, আমাদের দেশে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠন কত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এখন বিশ্বের অন্তত দুটি দেশ আণবিক বোমা নিয়ে কাজ করছে। তারা বিশ্বজোড়া সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে। আমার ওপর একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি একটা গুপ্তচর সংস্থা তৈরি করতে চলেছি। এই সংস্থা সর্বত্র জাল বিছিয়ে রাখবে। আমরা সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করব। আপনি আমার সহায় হবেন?
শেষ পর্যন্ত রবার্ট ওই চাকরিটা নিতে রাজি হয়েছিলেন, অবাক হয়ে গেলেন এতে এত উত্তেজনা আছে জেনে। সুশানের জন্য ভার্জিনিয়াতে একটা সুন্দর অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করা হল, রবার্টকে বিভিন্ন জায়গাতে পাঠানো হল। প্রথমে তিনি গেলেন সি আই এর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেটা ভার্জিনিয়ার গ্রাম অঞ্চলে অবস্থিত। বাইশ মাইল দূরে একটা মস্ত বড়ো ফার্ম, চারপাশে পাইন গাছের ঘন অরণ্য। দশ একর জমির ওপর মূল ভবনটা অবস্থিত। প্রধান গেট থেকে দু মাইল দূরে তার অবস্থান।
রবার্ট যত্ন করে সবকিছু শিখলেন। বুঝতে পারলেন, তাকে অনেক রকম কাজ করতে হবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরও অনেক শিক্ষানবীশ এসেছেন সেখানে। রবার্ট থাকতেন ব্যাচেলার অফিসের এক কোয়াটার্সে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে একটা করে ঘর দেওয়া হয়েছে। বাথরুমটা অন্যের সাথে ভাগাভাগি করতে হত।
সে এক কঠিন কঠোর পরীক্ষা পদ্ধতি। অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হল।
সেখানকার প্রধান ছিলেন কর্নেল ফ্রাঙ্ক জনসন। তিনি স্বাগত জনিয়েছিলেন। তার কাছ থেকে ভাষণ শুনতে শুনতে রবার্টের মনে হয়েছিল, এই জীবনে অনেক কিছু করার আছে।
ক্লাশ শুরু হল, দিনগুলো হু হু করে কেটে গেল। রবার্ট মনে মনে উত্তেজনা অনুভব করলেন।
.
হা, প্রতিটি মুহূর্তে জীবনকে নতুন করে বোঝার এক আশ্চর্য আনন্দ। কত গোপন সংকেত শিখতে হচ্ছে। চোখের দৃষ্টিতে, হাতের তালুতে, কথা না বলে মনের ভাব যেভাবে প্রকাশ করা যায়।
কর্নেল জনসনকে আরও ভালো লেগে গেল রবার্টের। শোনা গেল হোয়াইট হাউসের সঙ্গে তার নাকি ভালো সম্পর্ক আছে। একদিন হঠাৎ ফার্ম থেকে উনি চলে গেলেন। কদিন বাদে আবার এসে উপস্থিত হলেন।
.
রন নামে এক এজেন্ট একটি কাজ করছিলেন। তিনি ব্যবহারিক দিকগুলো দেখাশোনা করেন। কর্নেল জনসনও মাঝে মধ্যে ক্লাশে আসছেন। একদিন, একদল শিক্ষার্থী বসে আলোচনা করছেন, রবার্টের শিক্ষক বললেন এবার আমরা আসল কাছে নামব। এতদিন পর্যন্ত আপনারা যা শিখেছেন, সেটারই পরীক্ষা করা হবে।
.
রবার্ট বাসে চড়ে রিচমন্ডে এলেন। রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে থাকলেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনি ট্যাকারগুলোকে চিহ্নিত করলেন। সেখানে দুটো ছিল একটা রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল, আরেকটা অটোমোবাইল। রবার্ট রেস্টুরেন্ট এবং দোকানে ঘুরতে লাগলেন। কিন্তু, আসল খবরটা পাওয়া যাচ্ছে না। রবার্ট একটা ডিপার্টমেন্ট স্টোরে গেলেন। সেখানে গিয়ে কিছু লোকের সঙ্গে কথা বললেন। ত্রিশ মিনিট কেটে গেছে, পোশাক পাল্টে ফেলেছেন। এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছেন। কোলে একট শিশু। তাকে আর চেনাই যাচ্ছে না।
এই দিন তিনি বোধহয় সব কাজে জয়লাভ করেছিলেন।
.
আবার শুরু হল প্রশিক্ষণের পালা। ওয়াটার গেটের কথা বলা হল। সি আই এ-র কী কী কোড আছে তাও শেখানো হল। হ্যাঁ, সকলের ছদ্মবেশ খুবই সুন্দর হয়েছে। রবার্ট নিজেকে দেখে চিনতে পারছেন না।
এইভাবে ক্লাশ উতরে গেল। মাঝেমধ্যেই কর্নেল জনসন রবার্টকে ডেকে আলোচনা করতেন। একদিন কথায় কথায় তিনি বললেন– রবার্ট, আপনার বিবাহিত জীবন কেমন? সুখের তো?
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন, স্যার।
আরেকদিন বললেন- অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার আপনাকে নাকি সন্তানের মতো স্নেহ করেন? আপনি কি তা জানেন?
হ্যাঁ, রবার্টের মনে পড়ে গেল এডওয়ার্ডের মৃত্যুকাতর মুখখানি।
তারা আনুগত্য এবং দেশপ্রেম বিষয়ে আলোচনা করলেন। কর্তব্যবোধ এবং মৃত্যুর কথাও বললেন।
রবার্ট, একাধিকবার আপনার সঙ্গে মৃত্যুর দেখা হয়েছে। আপনি কি মরতে ভয় পান?
না, রবার্ট মুখে বললেন, মনে মনে ভাবলেন, ভালো কাজের জন্য মৃত্যুবরণ, কিন্তু বাজে ব্যাপারে নয়।
চার মাসের এই প্রশিক্ষণ শিবির। এই সময় কাউকে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অনুমতি দেওয়া হত না। মাঝে মধ্যে রবার্টের মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত। কতদিন সুশানকে দেখেননি, সুশানের সাথে ফোনে কথাবার্তা বলতে পারছেন না। শেষ অবধি চারমাস কেটে গেল।
কর্নেল জনসন রবার্টকে তার অফিসে ডেকে পাঠালেন। তিনি বললেন কমান্ডার, আপনি সুন্দরভাবে সবকিছু শিখে নিয়েছেন। আমার মনে হচ্ছে আপনার ভবিষ্যৎটা খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। কর্নেল জনসন রবার্টের দিকে তাকালেন। পাঁচমিনিট বসে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত একটা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছোলেন। তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। টেলিফোন নিয়ে একটা ফোন করলেন।
.
সুশান রবার্টের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলে দিলেন। পরনে ফিনফিনে রাত পোশাক, যৌবনের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সুশান এগিয়ে এসে রবার্টকে আলিঙ্গন করলেন। বললেন- হাই নাবিক, তুমি কি একটা সুন্দর সময় পেতে চাইছ।
-হ্যাঁ, রবার্ট বললেন, তোমাকে জড়িয়ে ধরে আছি, এটাই তো আমার কাছে সুখীতম সময়।
–দেখো, কতদিন তোমাকে কাছে পাইনি বলো তো? যদি তোমার কিছু ঘটত তাহলে আমি মরে যেতাম।
আমার কিছু হত না।
শপথ করছ।
–হ্যাঁ, শপথ করছি।
রবার্টের মুখের দিকে তাকিয়ে সুশান বললেন- তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
ব্যাপারটা বিচ্ছিরি, কঠিন একটা কোর্স। রবার্ট স্বীকার করলেন। সত্যি, রাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা ঘুম হত। কত কিছু বোঝার আছে।
সুশান বললেন–তুমি কি চাইছ আমি তা বুঝতে পারছি। পাঁচ মিনিট সময় দাও, সবকিছু খুলে ফেলল।
সুশান পাশের ঘরে চলে গেলেন।
আঃ, এমন সৌভাগ্য আমার। রবার্ট নিজেকে উন্মুক্ত করতে শুরু করলেন।
সুশান ফিরে এলেন, শান্তভাবে বললেন- হ্যাঁ, আমি এই অবস্থায় তোমাকে আরও ভালোবাসি।
প্রশিক্ষকের কণ্ঠস্বর মনে পড়ে গেল, অনেক সময় আপনাদের একেবারে উলঙ্গ হয়ে কাজ করতে হবে। অর্থাৎ আপনারা কোনো সহযোগী পাবেন না। কিন্তু এখন? এখন শব্দটার অন্য একটা মানে আছে।
সুশান তাঁকে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলেন। টবে সুগন্ধী উষ্ম জল। ঘরটা অন্ধকার। বেসিনের ওপর চারটে মোমের আলো জ্বলছে।
সুশান তার রাত পোশাকটা খুলে দিয়ে বললেন– ডার্লিং, এই বাড়িতে তোমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, তিনি বাথটবে উঠে গেলেন। রবার্ট তাকে অনুসরণ করলেন।
-সুশান?
–কোনো কথা বলো না, আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকো।
রবার্ট বুঝতে পারলেন, সুশানের দুষ্টু হাত দুটো তার শরীরের সর্ব অঙ্গ স্পর্শ করছে। আহা, এমন চড়াই উৎড়াই, রবার্ট কত ক্লান্ত তা ভুলে গেলেন। ওই ঈষদুষ্ণু জলে তারা অনেকক্ষণ পারস্পরিক ভালোবাসা নিবেদন করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সুশান বলেছিলেন– অনেক গল্প কথা হল, অনেক আনন্দ হল, এবার এসো, আমরা কিছু কঠিন বিষয়ের অবতারণা করি।
আবার ভালোবাসা, আবার উদ্দামতা, রবার্ট ঘুমিয়ে পড়লেন। সুশানকে জড়িয়ে ধরে। ভাবলেন, জীবনটা কেন এইরকম হয় না বরাবরের মতো!
.
১৭.
পরের সোমবার সকালবেলা। রবার্ট তার কাজে যোগ দিলেন। পেন্টাগনের অফিসে গিয়ে। অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার বললেন– রবার্ট, আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। কর্নেল
জনসনের সঙ্গ আপনার কেমন লেগেছে?
রবাটের মুখে হাসি, উনি যথেষ্ট আকর্ষণীয় মানুষ। কফি খেতে খেতে অ্যাডমিরাল প্রশ্ন করলেন আপনি কাজ করবেন তো?
-হ্যাঁ।
–আপনাকে রোডেশিয়া যেতে হবে।
.
নাভাল ইনটেলিজেন্সের কাজ খুবই উত্তেজক, রবার্ট ভাবতেই পারেননি। নতুন নতুন কাজের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। যে সমস্ত কাজ অত্যন্ত স্পর্শ কাতর, সেই কাজের দায়িত্ব রবার্টের ওপর দিয়ে দেওয়া হয়। পানামাতে গিয়ে তাকে একটা গোপন ড্রাগচক্র ভাঙতে হল। যেতে হল ম্যানিলাতে, মার্কিন দূতাবাসের ওপর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে। মরক্কো যেতে হয়েছিল, গেলেন দক্ষিণ আমেরিকা এবং পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে। সুশানের সাথে দীর্ঘদিন দেখা হয় না, এই ব্যাপারটাই তাঁকে ক্লান্ত এবং উদ্বিগ্ন করে রাখে। সুশানের কাছ থেকে দূরে যেতে মন চায় না, তবুও যেতে হয়।
রবার্ট যখন বাড়ি ফিরে আসেন, সুশান তাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেন। উন্মাদ বন্য ভালোবাসা। কিন্তু মাত্র কয়েক দিনের জন্য।
রবার্ট সুশানের সাথে কাজের গতি প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন না। এই ব্যাপারে তাকে শপথ করতে হয়েছে। মনে হয়, সুশান যেন তার জীবনের এক অজানা আগন্তুক। কিন্তু কী করবেন, কাজের সাথে তো আর বিশ্বাসঘাতকতা করা যায় না।
রবার্ট মধ্য আমেরিকা থেকে ফিরে এলেন। একসপ্তাহ বাদে।
সুশান বললেন– রবার্ট, একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
কী সমস্যা? রবার্ট জানতেন কোন্ সমস্যার কথা বলা হচ্ছে।
–আমার ভয় হচ্ছে, আমরা বোধহয় পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমি তোমাকে হারাতে চাইছি না। আবার এই বিরহ সহ্য করতে পারছি না।
সুশান..
.–হা, আমার কথা শেষ করতে দাও। গত চারমাসে আমরা কতটুকু সময় একসঙ্গে কাটিয়েছি বলো তো? মাত্র দু সপ্তাহ। যখনই তুমি বাড়িতে আসো, মনে হয় তুমি যেন এক আগন্তুক, তুমি আর আমার স্বামী নও।
রবার্ট এগিয়ে এসে সুশানকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন- তুমি তো জানো সোনা, তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি।
সুশান বললেন– না, এমন করে কথা বলো না। তুমি কথা দাও ভবিষ্যতে কাজের চাপ কমিয়ে দেবে।
–আমি বলতে পারছি না, অ্যাডমিরাল হুইট্যাকারের সাথে কথা বলতে হবে।
কখন?
–এখনই।
.
কমান্ডার অ্যাডমিরাল এখনই আপনার সাথে কথা বলবেন।
অ্যাডমিরাল তার ডেস্কে বসেছিলেন। কাগজ পত্রে সই করছেন। রবার্টকে দেখে তিনি হাসলেন–রবার্ট ধন্যবাদ, এবং অনেক–অনেক শুভেচ্ছা। বেল সালভাডোরে আপনি দারুণ কাজ করেছেন।
–আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
কফি খাবেন কি?
না, ধন্যবাদ অ্যাডমিরাল।
–আপনি আমার সঙ্গে কী বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছেন? বলুন আমি কী করতে পারি?
শুরু করাটা সত্যিই কষ্টকর। স্যার, ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত। আমি মাত্র দুবছর আগে বিয়ে করেছি।
–হ্যাঁ, আমি শুনেছি সুশান খুব ভালো মেয়ে।
-হ্যাঁ, আমিও সেটা জানি, কিন্তু সমস্যা হল আমাকে বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। আমার বউ তা নিয়ে খুবই দুঃখ প্রকাশ করে। এটাই তো হওয়া স্বাভাবিক, তাই নয় কি?
অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার চেয়ারে ঝুঁকে বললেন- ঠিক আছে, আপনি যে পদে যুক্ত আছেন সেখানে এই ধরনের স্বার্থ ত্যাগ তো করতেই হবে।
রবার্ট বললেন আমি আমার বিয়েটাকে শহীদ করতে চাইছি না। ব্যাপারটা আমার কাছে বোঝার মতো হয়ে গেছে।
অ্যাডমিরাল বললেন- ঠিক আছে। আপনি কী বলতে এসেছেন?
–আমাকে এমন একটা কাজ দিন যাতে বাড়ি থেকে বেশি দিন দূরে থাকতে না হয়।
বাড়ির কাছাকাছি থাকতে চান?
–হ্যাঁ।
অ্যাডমিরাল বললেন কিন্তু আমি তো তা বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, দেখতে হবে।
-ঠিক আছে, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
–সুশানকে বলবেন আমি সমস্যাটা সমাধান করার চেষ্টা করছি।
–আমি কীভাবে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছি না।
অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার হাত নেড়ে বললেন– আপনি আমার কাছে অত্যন্ত মহার্ঘ মানুষ। আপনাকে আমি হারাতে দেব না। এখন বাড়ি চলে যান, বিরহ কাতরা বউয়ের পাশে গিয়ে বসুন।
.
রবার্ট সুশানকে এই খবরটা দিলেন। সুশান আনন্দে অধীর হয়ে উঠেছেন। তিনি এগিয়ে এসে রবার্টকে জড়িয়ে ধরে বললেন- ডার্লিং, সত্যিই একটা শুভ সংবাদ এনেছ আমার জন্য।
–আমি কয়েক সপ্তাহ ছুটি নেব। দ্বিতীয় মধুচন্দ্রিমাতে যাব।
–আমি জানি না, হনিমুন বলতে কি বোঝায়? তুমি আমাকে দেখাও।
রবার্ট কথা রেখেছিলেন।
অ্যাডমিরাল হুইট্যাকার পরের দিন সকালে রবার্টকে ডেকে আনলেন। বললেন গতকাল যেসব কথা বলেছিলাম সে নিয়ে আলোচনা আছে।
অ্যাডমিরাল আরও বলতে থাকলেন একটা জিনিস এসেছে। তার কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য। সি আই এ কে ধ্বংস করার চেষ্টা হচ্ছে। সিক্রেট ইনফরমেশনের ভেতর কিছু গুপ্তচর ঢুকে পড়েছে। তার মধ্যে একজন স্পাইকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। তার সংকেত নাম হল দি ফক্স অর্থাৎ খেকশিয়াল। সে এখন আর্জেন্টিনাতে আছে। এজেন্সির বাইরে কাউকে দরকার। সি আই–এ-র ডেপুটি ডিরেক্টর আপনার কথা বলেছেন। আপনি বোধহয় এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন।
রবার্ট বললেন- না স্যার, আমি যেতে চাইছি না।
–কিন্তু রবার্ট, আপনি ছাড়া তো হবে না, আপনি এর আগে কখনও আমার কথার। অমান্য করেননি। আমি বুঝতে পারছি এতে আপনার কত ক্ষতি হবে।
স্যার, আমাকে ভাবতে সময় দিন।
রবার্ট, আপনি আগের মতোই থাকবেন আশা করি।
কী ব্যাপার অ্যাডমিরাল?
–ডেপুটি ডিরেক্টর বলেছেন আপনাকে একবার দেখা করতে। আপনি যাবেন তো?
–হ্যাঁ, আমি নিশ্চয়ই যাব।
.
পরের দিন সকাল বেলা, রবার্ট ল্যাংলের কাছে গেলেন এই ব্যাপারে দেখা করার জন্য।
ডেপুটি ডিরেক্টর বললেন- কমান্ডার বসুন, তিনি আরও বললেন আপনার সম্পর্কে অনেক কথা আমি শুনেছি। আপনার কর্তৃত্ব এবং কৃতকার্যতা আমাকে অবাক করেছে।
ডেপুটি ডিরেক্টরের বয়স বছর ষাটেক, চোয়ালটা সরু, সাদা চুল, পাকানো গোঁফ আছে। রিয়েল থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও এস এসিতে ছিলেন। তারপর সি আই এ-তে চলে আসেন।
উনি বললেন- কমান্ডার, আপনার সিদ্ধান্তকে আমি শ্রদ্ধা করছি। সত্যি কথা বলতে কী, একটা ব্যাপারে আমি আপনাকে ডেকে এনেছি। আমাদের দেশের প্রেসিডেন্ট এই ব্যাপারটায় যুক্ত আছেন। যে করেই হোক ফক্সের মুখোশ খুলতে হবে।
তিনি আরও বললেন– প্রেসিডেন্টের কাছে আপনার কথা বলছি। উনিও একজন দায়িত্ব সম্পন্ন স্বামী। উনি আপনার ওপর কোনো অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেবেন না। আশা করি কমান্ডার, আপনি এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন।
রবার্ট ভাবলেন, তাহলে? দ্বিতীয় হনিমুনটা পিছিয়ে দিতে হবে।
.
রবার্ট এই খবরটা সুশানের কাছে বললেন। আরও বললেন– এরপর কথা দিচ্ছি, আর কখনও দেশের বাইরে যাব না। হয়তো চাকরিটা ছেড়ে দেব, কিন্তু তোমাকে হারাতে পারব না।
সুশান বলেছিলেন আমার কাছে কি এত সময় তুমি দিতে পারবে? এমন একটা সুন্দর দিন যখন কেউ তোমার এবং আমার মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ রচনা করতে পারবে না?
.
ফক্সকে অনুসরণ করার ব্যাপারটা খুব একটা সহজ নয়। রবার্ট কখনও জীবনে হতাশ হন না, কিন্তু এবার তাকে হতাশ হতে হল। আর্জেন্টিনা, টোকিও, চীন, মালয়েশিয়া, যেখানে যেখানে ফক্সের থাকার সম্ভাবনা, সেখানেই রবার্ট হাজির হয়েছেন।
দিন গড়িয়ে গেল সপ্তাহে, সপ্তাহ গড়িয়ে গেল মাসে। রবার্ট ভেবেছেন, আজই বোধহয় কাজটা শেষ হয়ে যাবে। প্রত্যেক দিন নিয়ম করে সুশানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। কথাটা শুরু হয় এইভাবে- ডার্লিং, কয়েক দিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরব, তারপর… মনে হচ্ছে আসছে সপ্তাহে বাড়ি যাব, শেষ পর্যন্ত আমি জানি না কবে ছুটি পাব।
রবার্ট ফোনেতে আর আশা প্রকাশ করেন না। তিনি জানেন না ফক্সকে অনুসন্ধান করার কাজ সত্যিই শেষ হবে কিনা, হয়তো হবেই না, দুমাস কেটে গেল, আরও পনেরো দিন, মনে হচ্ছে, সফলতা বুঝি দূর আকাশের তারা!
.
সুশানের কাছে রবার্ট ফিরে এলেন, সুশানের মনোভাব অনেকখানি পাল্টে গেছে। শান্ত স্বভাবের হয়ে গেছেন তিনি। আগের মতো উচ্ছ্বাস নেই, অনুভবী শক্তি হারিয়ে গেছে।
রবার্ট বললেন- ডার্লিং, আমি দুঃখিত, আমি জানতাম না এই কাজটা শেষ করতে কতদিন লাগে।
রবার্ট, আমি জানি ওরা তোমাকে কখনও ছাড়বে না।
–তুমি কী বলছ?
সুশান মাথা নাড়লেন– আমি ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল হসপিটালে একটা কাজ করতে যাব।
রবার্ট অবাক হয়ে গেছেন, সত্যি কথা বলছ?
হা, আমি আবার নার্সের জীবিকা শুরু করব। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি তোমার অপেক্ষায় বাড়িতে বসে থাকতে পারব না। তুমি নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো তো? তুমি জীবিত না মৃত সেটা ভাবলেও আমার অবাক লাগে।
সুশান? রবার্টের আর্তনাদ।
–প্রিয়তম, ব্যাপারটা এখানে মিটিয়ে ফেললাম। যখন তুমি থাকবে না, আমাকে দেশের জন্য কিছু একটা করতে দাও। তাহলে হয়তো আমার অপেক্ষা করার প্রহরটা আরও সহজ হবে।
রবার্টের কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিল না।
তিনি অ্যাডমিরাল হুইট্যাকারের কাছে গিয়ে তার ব্যর্থতার কথা বললেন।
অ্যাডমিরাল খুবই সহানুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তি।
-হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, আমার খুবই খারাপ লাগছে রবার্ট, দেখি আপনাকে ভবিষ্যতে আর এমন দায়িত্ব দেব না।
রবার্ট বললেন- সুশান নার্সের চাকরিতে যোগ দিতে চলেছে।
অ্যাডমিরাল বললেন- বাহ! ব্যাপারটা ভালোই। এতে আপনার ওপর চাপ কিছুটা কমবে। এখন আপনি কাডে অনেক বেশি সময় দিতে পারবেন।
না, রবার্ট কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন, তিনি বুঝতে পারলেন, বিয়েটা এবার ভাঙনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
.
সুশান ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল হসপিটালে কাজ করতে চলে গেলেন। তাকে অপারেটিং রুমের নার্স হিসেবে কাজ করতে হবে। যখন রবার্ট বাড়ি আসতেন, সুশান ছুটি নেবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু সেটাও বোধহয় আর সম্ভব ছিল না। তাকে আরও–আরও বেশি কাজে জড়িয়ে দেওয়া হল।
তিনি ফিরে এসে রবার্টকে তার রুগীদের সম্পর্কে গল্প বলতেন। আরও কত কথা হতো। রবার্ট এবার গেলেন তুরস্কতে, একটা দরকারী কাজ ছিল। ফিরে এসে সুশানকে নিয়ে একটা হোটেলে ডিনার করতে গেলেন।
সুশান অনর্গল বলেই চলেছেন রুগীদের গল্পকথা। রবার্ট শুনতে চাইছেন না, রবার্ট ভাবছেন এই কি সেই সুশান, যাকে আমি কত ভালোবাসতাম।
শেষ পর্যন্ত এক নতুন রুগীর কথা বলা হল। বিমান দুর্ঘটনায় সাংঘাতিকভাবে আহত। বাঁচার আশা ছিল না। সুশান নিজের হাতে তাকে শুশ্রূষা করেছেন। সুশান মারফত রবার্ট জানতে পারলেন, সমস্ত নার্স এই যুবকের জন্য পাগল হয়ে উঠেছে।
রবার্ট অবাক হয়ে গেছেন, তার মানে? সুশানের মন কি পাল্টে গেল?
এই প্রথম মনের ভেতর সন্দেহ ঢুকল, তারপর ডিনার এসে গেল।
.
পরের শনিবার, রবার্ট পর্তুগালে চলে গেলেন। কয়েক সপ্তাহ বাদে ফিরে এলেন। সুশান আনন্দঘন মুখে অভিবাদন জানালেন।
অভিমানী চুম্বন বিতরণ, বলা হল, মন্টে আজ প্রথম হাঁটতে পারছে।
–মন্টে কে?
-মন্টে ব্যান্ডস, এটাই হল তার নাম। ডাক্তাররা বিশ্বাস করতে পারছেন না, কিন্তু আমরা। এই অসাধ্যকে সাধ্যাতীত করেছি।
–ওর সম্পর্কে আরও কিছু বল।
–ও সত্যিই অসাধারণ। আমাদের সব সময় উপহার দেয়। প্রচুর পয়সা আছে। নিজের প্লেন আছে, বিচ্ছিরিভাবে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছিল।
কী ধরনের উপহার?
ছোটো ছোটো জিনিস, ক্যানডি, ফুলের তোড়া, বই, রেকর্ড, ও সকলকে দামী ঘড়ি দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমরা নিতে চাইনি।
— …ওর হাতে একটা প্রামোদ তরণী আছে, পোলো খেলার মাঠ আছে,
রবার্ট বুঝতে পারলেন, এবার বোধহয় তাকে হারতে হবে।
সুশান রোজই ওই পেশেন্টর গল্প বলতে থাকেন।
একদিন তিনি বললেন, হ্যাঁ, ওর আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য, রবার্ট। ও সব ব্যাপারে চিন্তা করতে ভালোবাসে। জকি ক্লাব থেকে আজ লাঞ্চও আনিয়েছিল, সকলকে খাওয়াল।
রবার্ট ভাবতে পারছেন না কী করবেন? শেষ পর্যন্ত তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তোমার ওই সুন্দর যুবকটি কি বিবাহিত?
-না, ডার্লিং। কেন এই প্রশ্ন করছ?
–আমার অবাক লাগছে।
ঈশ্বরের অনুগ্রহ, তুমি কি হিংসুটে হয়ে উঠছ?
না, তা হব কেন?
রবার্ট যখন বাড়ি থাকে না, সুশান আর ওই রোগী সম্পর্কে কোনো কথা বলেন না। তিনি অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু রবার্ট বেশ বুঝতে পারেন, কোথায় যেন একটা পরিবর্তন ঘটে চলেছে।
পরের দিন ছিল সুশানের জন্মদিন। রবার্ট উৎসাহের সঙ্গে বললেন- আমরা একসঙ্গে আজকের দিনটি পালন করব। বাইরে যাব, হোটেলে ডিনার খাব।
রাত্রি আটটা অবধি আমাকে হাসপাতালে থাকতে হবে।
–ঠিক আছে, আমি তোমাকে সেখান থেকে তুলে নেব।
–মন্টে তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য আগ্রহী। আমি মন্টেকে তোমার সব কথা বলেছি।
–আমিও তার সঙ্গে দেখা করতে যাব।
রবার্ট হাসপাতালে এলেন। রিসেপশনিস্ট বললেন সুশান এখন অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে কাজ করছেন। তিনতলায়।
রবার্ট এলিভেটরে পা রাখলেন। সুশান তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আগেকার সেই পরিচিত সাদা পোশাক পরেছেন, ওঃ, এখনও কী অসাধারণ রূপসী।
সুশান হাসলেন, হ্যালো রৰার্ট, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমার কাজ শেষ হবে। এসো তোমার সাথে আমি মন্টের আলাপ করিয়ে দিই।
বিশাল একটা প্রাইভেট রুম, বই আর ফুলে পরিপূর্ণ। ফলের বাস্কেট রয়েছে। মন্টে, এ হল আমার স্বামী রবার্ট।
রবার্ট দাঁড়ালেন। বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটির মুখের দিকে তাকালেন। রবার্টের থেকে তিন-চার বছরের বড়ো হবেন হয়তো।
কমান্ডার, আপনার সঙ্গে দেখা করতে পেরে আমি নিজেকে আনন্দিত বলে মনে করছি। সুশান আপনার সব কথা আমাকে বলেছে।
কত কথা? বুঝতে পারা যাচ্ছে না।
সুশান আপনার জন্য খুবই গর্বিত।
মনে হচ্ছে আপনি এবার ছাড়া পাবেন। রবার্ট জানতে চাইলেন।
–হ্যাঁ, এই অলৌকিক ঘটনাটা কিন্তু আপনার স্ত্রী ঘটিয়েছে।
–এটাই হল ওঁর বৈশিষ্ট্য।
মনে পড়ে গেল, অনেক দিন আগের একটা ছবি, মৃত্যুপথযাত্রী রবার্টকে এইভাবে সুশান জীবনের উপত্যকায় ফিরিয়ে এনেছিলেন।
.
জন্মদিনের ডিনার, সুশান তার ওই পেশেন্ট সম্পর্কে কথা বলতে উদগ্রীব।
–ডার্লিং, তুমি এ ধরনের ব্যবহার করলে কেন?
সুশান জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, কথাবার্তা আর এগোচ্ছে না। মনে হচ্ছে, ডিনারটা। এখন শেষ করতে পারলেই ভালো হয়, নীরবতার মধ্যে দিয়ে উৎসব পালিত হল।
পরের দিন সকালবেলা, রবার্ট তখন অফিস যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, সুশান বললেন রবার্ট, তোমার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে।
রবার্ট অবাক হয়ে সুশানের দিকে তাকালেন। হ্যাঁ, বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, কোথায় যেন ভাঙনের গান বেজে উঠেছে।
সুশান কঠিন চোখে রবার্টের দিকে তাকিয়ে বললেন- শোনো রবার্ট, একথা অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র উপায় নেই যে, তোমাকে আমি ভীষণভীষণ ভালোবাসি। পৃথিবীতে আর কখনও কোনো পুরুষকে বোধহয় এতটা ভালোবাসতে পারব না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, দাম্পত্য জীবন শুধু ভালোবাসার ওপর নির্ভর করে না।
একটুখানি থেমে সুশান আবার বললেন- দেখো রবার্ট, গত চার মাসে আমরা কঘণ্টা একসঙ্গে কাটিয়েছি বলো তো? এইভাবে চলতে দেওয়া উচিত নয়। শেষ পর্যন্ত আমি ঠিক করেছি, বিয়েটা ভেঙে দিতে হবে।
রবার্টের মনের মধ্যে বিদ্যুৎ চমক, অবিশ্বাস্য কিছু শব্দ দ্রুত বেরিয়ে আসছে, সুশানের মুখ থেকে। রবার্ট অবাক হয়ে বললেন- কী বলছ সুশান? তুমি কি সত্যি সত্যি আমাকে হারাতে চাইছ?
সুশান রবার্টকে জড়িয়ে ধরে বললেন–হ্যাঁ, আমি অন্য একজনকে বিয়ে করতে চলেছি।
কে?
সুশানের মুখে হাসি। –মন্টে, মন্টে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।
সুশানের এই কথা শুনে রবার্টের মনে হল, তিনি বোধহয় পাগল হয়ে যাবেন।
তিনি বলার চেষ্টা করলেন সুশান, আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করা যায় কি?
সুশানের মুখ-চোখ এখন অনেক শান্ত, নির্লিপ্তির ভঙ্গিতে তিনি বললেন- না রবার্ট, গল্পটা শেষ হয়ে গেছে।
সুশান রেনোতে চলে গেলেন, ডিভোর্স করার জন্য। কমান্ডার রবার্ট বেলামি, দু-সপ্তাহের ছুটি নিলেন, শুধু মদ খেয়ে এই ব্যথাটা ভুলবেন বলে।
.
পুরোনো স্মৃতি বারবার ফিরে আসে। পুরোনো কথার গুঞ্জন। রবার্ট এফ. বি. আই-এর এক বন্ধুকে ফোন করলেন। এর আগে ওই ভদ্রলোকের সাথে রবার্টের ভালো সম্পর্ক ছিল। উনি হলেন অ্যাল, উনি ফোন ধরলেন, রবার্ট ওঁকে বিশ্বাস করেন।
–ক্রে, আমায় একটা সাহায্য করতে পারবে?
কী সাহায্য? তোমার এক ডাক্তার দরকার। তুমি কী করে সুশানকে ছেড়ে দিলে? খবরটা সর্বত্র চাউর হয়ে গেছে।
–একটা মস্ত বড়ো গল্প, বলতে পারো বিষাদঘন অভিজ্ঞতা।
–রবার্ট, আমার খুবই খারাপ লাগছে, মেয়ে হিসেবে সুশান চমৎকার। ঠিক আছে বলো আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি।
তুমি কি কম্পিউটার চালনা করো? সবাইকার খবর সেখানে থাকে।
–হা কী করতে হবে? নামটা বলো।
মন্টি ব্যস, তার সম্পর্কে সব খবর জানতে চাইছি।
–ঠিক আছে, কী কী বলতে হবে বলো?
সবকিছু, তোমার ফাইলে আছে কি? বিশ্বাস করো, এটা আমার খুবই দরকার। কীভাবে উনি এত টাকা আয় করেছেন, সেটাই আমি জানতে চাইছি।
-ঠিক আছে আমি বলব।
ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত, পাঁচ কান করো না যেন।
–ঠিক আছে। কাল সকালে তোমাকে জানাচ্ছি। একটা লাঞ্চ কিন্তু পাওনা আছে।
–হ্যাঁ, খাওয়াব।
রবার্ট রিসিভারটা রেখে দিলেন। ভাবলেন, এভাবে কি আমি সুশানকে আর কোনো দিন ফিরে পাব? না, তাহলে কেন এ মিথ্যে অনুসন্ধান করছি।
.
সকালবেলা, ফরনটন রবার্টকে ডেকে পাঠালেন। জানতে চাইলেন কমান্ডার, আপনি কী বিষয়ে কাজ করছেন?
–আমি সিঙ্গাপুরের এক কূটনীতি বিশারদের ওপর ফাইল তৈরি করছি।
–এতে আপনার অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে, তাই তো? কমান্ডার, আপনি কি ভুলে গেছেন, আমরা মার্কিন দেশের কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে ফাইল তৈরি করতে পারি না?
রবার্ট অবাক আপনি কী বলতে চাইছেন?
–এফ বি আই-এর কাছ থেকে আমি খবর পেয়েছি, আপনি এমন কাজ করছেন, যা করা আপনার পক্ষে উচিত নয়।
রবার্ট খুবই রেগে গেলেন তিনি বলার চেষ্টা করলেন, এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।
–এফ বি আই-এর কম্পিউটারকে এ ব্যাপারের জন্য ব্যবহার করা যায় না। আমরা কোনো সাধারণ নাগরিককে বিরক্ত করতে পারি না। আশা করি, আমার বক্তব্য আপনি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন।
রবার্ট অফিসে ফিরে গেলেন, এফ বি আই-কে ফোন করলেন। অ্যালকে ডেকে পাঠানো হল। এক মিনিট বাদে অপারেটর বলল– অ্যালকে চাকরিতে আর রাখা হয়নি।
রবার্ট অবাক হয়ে গেছেন- কী বলছেন?
–এজেন্টকে অন্য কোথাও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
–কোথায়?
–সেটা আমরা জানি না, জানলেও বলতে পারব না।
তারপর? আরও কিছু খবর শোনা গেল। সব শুনে রবার্টের রক্ত হিম হয়ে গেছে। শোনা গেল, তার প্রিয় বন্ধু রাস্তার অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। তখন তিনি মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন। তার শরীরটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
রবার্ট রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। মনে নানা চিন্তা।
চারপাশে কী ঘটছে, কিছুই বুঝতে পারা যচ্ছে না। মন্টে ব্যাঙ্ককে সব ব্যাপার থেকে রক্ষা করা হচ্ছে কেন? রবার্ট ভাবলেন, সুশান বোধহয় একটা ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ল।
সুশানের সঙ্গে আজ বিকেলে একবার দেখা করতেই হবে।
.
সুশান তার নতুন অ্যাপার্টমেন্টে বসেছিলেন। এম স্ট্রিটে একটা সুন্দর সাজানো ডুপ্লেক। রবার্ট অবাক হয়ে গেছেন। এই ফ্ল্যাটটা নিশ্চয়ই তার নতুন স্বামী কিনে দিয়েছেন।
সুশান, তোমার সাথে এমন ব্যবহার করেছি বলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।
কী ব্যাপার বলো তো? গুরুত্বপূর্ণ কিছু কি?
না, আমি কীভাবে শুরু করব। বুঝতে পারছি না।
রবার্ট ভাবলেন, আমি কি বলতে পারি, সুশান, তোমাকে বাঁচাবার জন্য আমি ছুটে এসেছি?
কী হয়েছে?
–মনটি সম্পর্কে কিছু খবর।
সুশানের ভ্রুকুটিতে বিরক্তি কী খবর?
এটাই সবথেকে শক্ত মুহূর্ত। মন্টে ব্যাঙ্কের সবকিছু এফ বি আই-এর কম্পিউটারে ছিল। সেই খবর রবার্ট জানতে পারেননি। এমন কী যে মানুষকে বলা হয়েছিল, খবর জানতে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। রবার্ট আমতা আমতা করে বলতে থাকেন সুশান, সুশান, আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটার মধ্যে কোনো গোলমাল আছে।
–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
সুশান, উনি এত টাকা কোথা থেকে পাচ্ছেন?
–মন্টে এক সফল ব্যবসায়ী। আমদানি রপ্তানির ব্যবসা করে।
সেই পুরোনো অজুহাত। রবার্ট ভাবলেন।
না, এখন আর কোনো গল্পকথা বলে সুশানকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।
—তুমি কী বলতে চাইছ? বলো তো।
–আমি খালি ভাবছি, ওই যুবাপুরুষ কি তোমার ঠিক জীবনসঙ্গী?
–আঃ, রবার্ট। সুশানের কণ্ঠস্বরে অধৈর্য।
–আমার এখানে আসা উচিত হয়নি। আমি দুঃখিত।
সুশান এগিয়ে এলেন। রবার্টকে চুমু দিয়ে বললেন- আমি বুঝতে পেরেছি, কেন তুমি এসেছ?
সুশান কিন্তু কিছুই বুঝতে পারেননি। মন্টে ব্যাঙ্কসের ওপর একটা তদন্ত করা হচ্ছিল। সেই খবরটা নেভাল ইনটেলিজেন্স অফিসে পৌঁছে যায়। যে ভদ্রলোক এই তদন্তের কাজে যোগ দিয়েছিলেন, তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
.
রবার্ট ব্যাপারটা ভালোভাবে মেনে নেবার চেষ্টা করছেন। তিনি তার এক বন্ধুকে ফোন করলেন, ওই ভদ্রলোক ফোবরস ম্যাগাজিনে চাকরি করেন।
রবার্ট, অনেক দিন তোমার কথা শুনিনি, কেমন আছো তুমি?
রবার্ট সব কথা বুঝিয়ে বললেন।
মন্টে বাঙ্কস? আমার মনে হচ্ছে তার নাম ফোরবস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এখনই তার সম্পর্কে সব খবর দেব কী করে? আর কিছু?
রবার্ট পাবলিক লাইব্রেরিতে গেলেন হু হু নামে যে বইটি আছে, সেখানে মন্টে ব্যাঙ্কসের নাম খুঁজে পেলেন না। তিনি মাইক্রো ফাইল দেখলেন। ওয়াশিংটন পোস্টের সব কটি সংখ্যা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন। মন্টে ব্যাঙ্কসের ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল কি? হা, সেই সম্পর্কে একটা ছোট্ট খবর আছে। ব্যাঙ্কসকে এক বিখ্যাত ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তা হলে? আমি হয়তো ভুল করছি। মন্টে বাসের চরিত্রে কোনো কলঙ্ক নেই। যদি উনি এক পাই বা ক্রিমিনাল হয়ে থাকেন, ড্রাগ চোরাইচালানকারীদের সঙ্গে যুক্ত, তাহলে আমাদের সরকার কখনও এতটা সাহায্য করত না। তার মানে? আমি বোধহয় সুশানকে বিরক্ত করার চেষ্টা করছি।
.
আবার সেই একাকীত্বের জীবন, নিঃসঙ্গতা এবং অন্ধকার রাত্রি। ঘুম আসে না, মনের ভেতর হতাশার সঞ্চরণ। মাঝে মধ্যে রবার্ট একা একা সুশানের জন্য চোখের জল ফেলেন। সর্বত্র সুশানের স্মৃতি। এই অ্যাপার্টমেন্টের সবখানে সুশান এখনও জীবন্ত হয়ে আছেন। পুরো ব্যাপারটা ভাবতে বসে রবার্ট নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করেন। সুশানের কণ্ঠস্বর, সুশানের হাসি, সুশানের উষ্ণতা আহা, সুশানের শরীর, চড়াই-উৎরাই, সবই রবার্টের মনে পড়ে যায়। বিছানাতে শায়িতা উলঙ্গ সুশান। আদরের জন্য অপেক্ষা। সবকিছু সবকিছু।
রবার্ট, তুমি আর একা একা থেকো না।
বন্ধুদের কণ্ঠস্বর। কেউ বলেছে, রবার্ট, তোর জন্য একটা শরীর ব্যবস্থা করেছি। ডবশ। তুই ভোগ করবি না?
হ্যাঁ, এইসব মেয়েরা সুন্দরী, যৌনবতী, কিন্তু এদের সাথে রবার্টের মনের দেওয়া নেওয়া চলবে কেমন করে? এদের কেউ মডেল, কেউ সেক্রেটারি, কেউ বিজ্ঞাপন সংস্থার উঁচু পদে কাজ করে, কেউ সবেমাত্র বিবাহ বিচ্ছেদ করেছে, কেউবা আইন বিশারদ। কিন্তু এদের কেউই সুশান নয়। এদের মধ্যে অনেক কিছুই সাধারণ আছে, কিন্তু সুশানের মতো আভিজাত্য? কৌতুকপ্রিয়তা? নাঃ, আমি আর নতুন করে জীবনটা শুরু করব না।
সি আই এর মধ্যে একটা গুপ্তচর ঢুকে পড়েছে, তাকে খেকশিয়াল নামে ডাকা হয়। ডেপুটি ডিরেক্টর এই কাজটা আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন।
না, অ্যাডমিরাল, আমি পারব না। আমি আমার বউকে নিয়ে আবার হনিমুনে যাচ্ছি।
নতুনভাবে জীবনটা শুরু করা যায় কি? যার শেষটা হবে খুবই সুন্দর। না, জীবন কখনও দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না। রবার্ট এখন একা।
— রবার্টকে নিজের হাতে বাজার-হাট করতে হয়। রান্না করতে হয়। তার মানে? দিনগুলো এখন খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে কাটছে। ওয়াশিংটনে টেলিফোন করলেন, ডিনারের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন প্রিয় বন্ধুদের। কিন্তু, রবার্ট এ ব্যাপারেও কেমন নিরাসক্ত। মনে পড়ে, ওই মেয়েটি, দুজনের জন্য কেমন সুন্দর ডিনারের ব্যবস্থা করেছিল।
রবার্ট বলেছিলেন- হ্যাঁ, আপনার রান্নার হাতটা দেখছি ভারী সুন্দর।
হঠাৎ আলাপ হওয়া ওই মেয়েটি বলল- হ্যাঁ, সর্বত্রই আমার এই চিহ্ন তুমি দেখতে পাবে। এসো, তোমাকে আমি আরও বেশি ভালোবাসা দেব।
মেয়েটি তাড়াতাড়ি রবার্টের বুকে তার আঙুল রাখল। জিভে জিভে খেলা শুরু হল।
না, ব্যাপারটা আমি এমন করে ভাবছি কেন? এভাবে কি আর কাউকে ভালোবাসা যায়?
হঠাৎ মনের ভেতর কেমন একটা অনুভূতি। রবার্টের প্রথমবার মনে হল, সে নপুংসক। সে আর কখনও কোনো নারীকে তৃপ্ত করতে পারবে না।
মেয়েটি বলেছিল– এসো সোনা, সবকিছু আবার ভালোভাবে শুরু হোক। আমি জানি, তুমি এখন ক্লান্ত ধ্বস্ত। আমার কাছে রোগের উপশম আছে।
রবার্টের মনে হল, না, একা একা দিন কাটাতে হবে। আমি সুশানকে কষ্ট দেব না। আবার ভালোবাসার চেষ্টা করব।
কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে, ও ও আই-এর এক উজ্জ্বল চোখের সেক্রেটারি। বিছানাতে সাংঘাতিক খেলোয়াড়। শরীরের সবখানে আঙুলের ছোঁয়া রাখে। সব কিছুতে মুখের পরশ। কিন্তু না, রবার্টের যৌনচেতনা আর জাগছে না। সুশানকে পেতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। শেষ পর্যন্ত রবার্ট এইসব অভিযান ছেড়ে দিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, ডাক্তারের কাছে যাবেন পরামর্শ করতে। লজ্জা মনে হল। এই সমস্যার সমাধান আছে কি? না, কোনো সমাধান নেই।
কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে শুরু করলেন। প্রতি সপ্তাহে সুশান অন্তত একবার করে ফোন করেন- লন্ড্রিতে তোমার শার্ট আছে, আনতে ভুলো না কিন্তু। আমি কি একজন কাজের মেয়ে পাঠাব? অ্যাপার্টমেন্টটা পরিষ্কার করবে। মনে হচ্ছে, সব জায়গা নোংরা হয়ে গেছে।
প্রত্যেকটি ফোনের পর নীরবতা, নিঃসঙ্গতা, একাকীত্বের যন্ত্রণা–সব মিলেমিশে একাকার।
বিয়ের আগের রাত, সুশানের ফোন রবার্ট, কালকে আমরা বিয়ে করতে চলেছি।
রবার্ট নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছেন। কেমন যেন মাথাটা ঘুরছে তাঁর।
সুশানের আর্তনাদের শব্দ।
–আমি মন্টেকে ভালোবাসি। তোমাকেও ভালোবাসি অবশ্য। মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তোমাকে ভালোবেসে যাব। একথা আমি অস্বীকার করতে পারব না।
রবার্ট এখন কী বলবেন?
কিছুক্ষণের নীরবতা।
রবার্ট, তুমি ঠিক আছে তো?
–হা, ভালো আছি। আমাকে একটা সাহায্য করবে?
বল। –
-আমরা যেখানে হনিমুনে গিয়েছিলাম, লক্ষ্মীটি, সেখানে মন্টেকে নিয়ে যেও না, কেমন।
রবার্ট ফোনটা নামিয়ে রাখলেন। আবার মদ খেতে শুরু করলেন।
হ্যাঁ, অতীতের কথা মনে পড়ছে। ভাবতেই পারছি না, সুসান এখন অন্য আর একজনের। তাকে বর্তমানের মধ্যেই বাস করতে হবে। কাজ করতে হবে। আরও বেশি কাজ। সময় হয়েছে। লেসলির সঙ্গে কথা বলতে হবে। সেই ফটোগ্রাফার, যিনি অসাধারণ কিছু ছবি তুলেছিলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের নাম যিনি জানেন।
রবার্ট এবার তার কাজের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন।
.
১৮.
লেসলির মন আকাশে উড়ছে। লন্ডনে ফিরে আসার পর মনে হল, এই অতি মূল্যবান ফিল্ম নিয়ে সে এখন কোথায় যাবে? হাতের মুঠোয় স্বর্গ, সবকিছু, কিন্তু এখন কী করা যায়?
ভাবতে ভাবতে লেসলি ফিল্মটা গুটিয়ে রাখল। রিলগুলো একটা ট্যাঙ্কের মধ্যে ভরে দিল। ডেভলপ করতে হবে। ৬৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা দরকার। এগারো মিনিট কেটে গেছে। কাজ শুরু হয়ে গেছে।
ভীষণ-ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়েছে সে। যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে। না, কিছুই বুঝতে পারা যাচ্ছে না।
শেষ অব্দি নেগেটিভগুলো পরীক্ষা করল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। এই তো, আহা, অসাধারণ।
প্রত্যেকটা ছবিকে একটুকরো হিরে বলা যেতে পারে। পৃথিবীর যে কোনো ফাটোগ্রাফার এমন ছবি তুলতে পেরে গর্বিত বোধ করতে পারে। ওই অদ্ভুত আকাশযানের সবকিছু পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। এমন কি, দুজন আগন্তুকের শরীরও।
লেসলির মনে হল, এখানে এমন কিছু আছে, যা ভালোভাবে দেখা দরকার। যেখানে ওই আকাশানটা পড়ে গেছে, সেখানে তিনটে ছোটো ছোটো কৌচ দেখা যাচ্ছে। তবে দুজন আগন্তুক। আর একজন? না, আরও একটা ব্যাপার সে স্পষ্ট দেখতে পেল। একজনের হাত কেটে নেওয়া হয়েছে।
তার মানে? এরা কি একহাতের মানুষ, নাকি অন্য কিছু? লেসলি ভাবল, এই ছবিগুলো নিয়ে এখনই আমাকে ছুটতে হবে। মা ঠিকই বলেছিল। আমি এক প্রতিভাধর মানুষ। যখন আমি আবার এই ফিল্মগুলো ডেভেলপ করব, আমার নিজস্ব ম্যানসনে চলে যাব। ইটন স্কোয়ারে।
মহার্ঘ্য বস্তুগুলো হাতে রেখে লেসলি দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে, সে যেন সোনার খনির সন্ধানে জয়ী হয়েছে। এবার? এবার আমার আসল কাজ শুরু হবে।
অনেক দিন ধরে সে ভালো কাজের জন্য মাথা খুঁড়েছে। এখন আর অপেক্ষা করতে। পারছে না। এবার ছুটতে হবে। কোথায় যাওয়া যায়। ভাবতে ভাবতে লেসলি এগিয়ে চলেছে। সুখী সম্পৃক্ত জীবনের যাত্রাপথে।
.
রেস্টুরেন্টের এককোণে সে বসে আছে। এবার আসল লোকের সঙ্গে দেখা হবে। দুজন পরিচিতকে দেখতে পেল। বুঝতে পারল, একজন মাইকেল কায়েন, অন্যজন রজার মুর। আঃ, ভাবতেই পারা যাচ্ছে না। মা বেঁচে থাকলে, কত খুশি না হতেন। এইসব মুভি স্টারদের সম্পর্কে সে কত কথাই পড়েছে। দুজন বসে বসে গল্প করছেন। আর মাঝে মধ্যে লেসলির দিকে তাকাচ্ছেন। কেন?
লেসলি লাঞ্চ শেষ করেছেন, দুজন অভিনেতার পাশ দিয়ে হেঁটে গেছে। ওপরে গিয়ে টেলিফোন বুথের সামনে দাঁড়িয়েছে। সান পত্রিকার নাম্বারটা পেয়ে গেছে।
–আমি আপনাদের পিকচার এডিটরের সঙ্গে কথা বলতে চাইছি।
–উড়ন্তচাকির ছবি পেলে কেমন হবে? এমন কী দুজন অচেনা অজানা মানুষের ছবিও পাওয়া যাবে।
ফোনের অপর দিক থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল- যদি ছবিগুলো ভালো হয়, তাহলে আমরা ব্যবহার করতে পারব।
না, আমি সত্যি বলছি, যারা প্রত্যক্ষদর্শী তাদের সকলের নাম ঠিকানা তুলে দিতে পারব। এঁদের মধ্যে একজন ধর্মযাজক আছেন।
সঙ্গে সঙ্গে গলা পাল্টে গেল কোথায় এই ছবিগুলো নেওয়া হয়েছে?
– কথা দেখা হলে বলব, আপনি কি সত্যি রাজী আছেন?
–যদি ছবিগুলি সত্যি হয়ে থাকে, আমরা রাজী আছি।
কাজ এবার শুরু হয়েছে।
–ঠিক আছে, আমি যোগাযোগ করছি।
আবার দুটো ফোন করা হল। প্রত্যেকবারই একই জবাব পাওয়া গেছে। লেসলি বুঝতে পারল, প্রত্যক্ষদর্শীদের নাম ঠিকানা লিখে রাখাটায় আসল কাজ হয়েছে। কী ভালো হবে, ছবির তলায় তার নাম প্রকাশিত হবে।
সে রেস্টুরেন্ট থেকে বাইরে এল। আসার আগে ওই দুই ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বলল- আমাকে অটোগ্রাফ দেবেন?
দুজন টুকরো কাগজে নাম লিখে দিলেন।
ধন্যবাদ।
লেসলি বাইরে বেরিয়ে এসেছে। সে আটোগ্রাফটা ছিঁড়ে ফেলল। ভাবল, না, কদিন বাদে ওঁরাই আমার অটোগ্রাফ নেবেন। আমি এ কী বোকামির কাজ করছি!
.
১৯.
রবার্ট ট্যাক্সি নিয়ে হোয়াইট চ্যাপেলের দিকে চলেছেন। শহরের মধ্যে দিয়ে পথ এগিয়ে গেছে। এটাকে আমরা লন্ডনের সবথেকে ব্যস্ত অঞ্চল বলতে পারি। শেষ অব্দি তিনি ঠিক জায়গাতে এসে পৌঁছোলেন। জ্যাক দ্য রিভারের জন্য এই জায়গাটা একসময় বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল।
ট্যাক্সিটা লেসলির বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে। রাস্তাঘাট কেমন অপরিচ্ছন্ন। শেষ অব্দি তিনি ২১৩ এ, গ্রোগ রোড়ে পৌঁছে গেলেন। ট্যাক্সি ছেড়ে দিলেন। দোতলা বাড়ি। ছোটো ছোটো ফ্ল্যাটে পরিণত করা হয়েছে। এর মধ্যে এমন এক মানুষের অবস্থান, যার হাতে প্রত্যক্ষদর্শীদের নাম ঠিকানা আছে।
.
লেসলি লিভিংরুমে বসেছিল। দরজার বেল আর্তনাদ করল। সে তাকাল। একটা ভয়, আবার আবার শব্দ হচ্ছে। সে ফটোগুলো নিয়ে গেল। ডাকরুমের মধ্যে পৌঁছে গেল। পুরোনো প্রিন্টের মধ্যে সেগুলো ঢুকিয়ে দিল। লিভিংরুমে ফিরে এল। দরজা খুলে দিল।
–আপনি কে?
–আমি কি ভেতরে আসতে পারি?
–হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?
রবার্ট তার পকেট থেকে ডিফেন্স মন্ত্রকের দেওয়া একটা পবিচয় পত্র বের করলেন। বললেন আমি এখানে দরকারী কাজে এসেছি। মিস্টার মাদারশেড, আমরা এখানে কথা বলতে পারি, কিংবা মন্ত্রণা সভায় যেতে পারি।
এটা একটা বাজে কথা। তিনি দেখতে পেলেন, এই কথাগুলো লেসলিকে দারুণ প্রভাবিত করেছে।
লেসলি আমতা আমতা করতে থাকে কী বিষয় নিয়ে আপনি কথা বলতে চাইছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
রবার্ট ঘরে ঢুকে পড়লেন– আঃ, এখানে কি কোনো মানুষ থাকতে পারে?
আপনি কী বলবেন? এখানে কী করছেন?
–আপনি যে ফটোগ্রাফগুলো তুলেছেন সে সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাইছি।
কী আশ্চর্য, লোকটা জেনে গেছে? তার মানে? ভরে একটা শিহরণ।
লেসলি বলার চেষ্টা করেন আপনি কোন ফটোর কথা বলছেন?
রবার্ট শান্তভাবে বললেন- উড়ন্ত চাকির সামনে আপনি যেগুলো তুলছিলেন।
মাদার শেড রবার্টের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর বলল- হ্যাঁ, সেগুলো আপনাকে দিতে পারলে ভালো হত।
-কেন আপনি ছবিগুলো তোলেননি?
আমি চেষ্টা করেছিলাম।
কী বলছেন, চেষ্টা করেছিলেন?
–হ্যাঁ, ছবিগুলো ওঠেনি। আমার ক্যামেরায় গোলমাল ছিল। এইবার নিয়ে দ্বিতীয়বার এই ঘটনাটা ঘটল। আমি নেগেটিভগুলো পরীক্ষা করেছিলাম। ফিল্মটাই নষ্ট হল। আপনি তো জানেন, ফিল্মের দাম কত?
রবার্ট বুঝতে পারলেন লোকটা ভুল বকতে শুরু করেছে। ভয় পেয়েছে। রবার্ট সহানুভূতিসম্পন্ন কণ্ঠস্বরে বললেন- আহা, ছবিগুলো থাকলে ভালোই হত।
প্রত্যকদর্শীদের সম্পর্কে তিনি কিছুই বললেন না। যদি মাদারশেড ফটো সম্পর্কে মিথ্যে কথা বলে থাকে, তাহলে এই তালিকার সম্পর্কেও সে মিথ্যে কথা বলবে। রবার্ট চারদিকে তাকালেন। ফটোগ্রাফগুলো কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সহজেই পাওয়া যেতে পারে। এই ফ্ল্যাটে বেশি কিছু নেই। একটা ছোটো লিভিং, একটা বেডরুম, একটা বাথরুম, আর কী আছে– ক্লোসেট।
লোকটাকে চাপ দিলেই হয়তো আসল জিনিসটা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু, এই ফটোগ্রাফগুলো নিয়ে আমি কী করব। আমাকে তো প্রত্যক্ষদর্শীদের তালিকাটা বের করতেই হবে।
মাদারশেড দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল– আহা, ছবিগুলো থাকলে আমি বড়োনোক হতে পারতাম।
রবার্ট বললেন- ওই আকাশযানটা সম্পর্কে বলুন তো।
মাদারশেড কাঁধে ঝাঁকুনি দিল। তার কণ্ঠে বিরক্তি।
আমি ভুলতে পারব না। ওই জাহাজটাকে মনে হয়েছে, ওটা বোধহয় জীবন্ত। ওর ভেতর একটা শয়তানি চিহ্ন আছে, ভয়ের বাতাবরণ, কেন তা বলতে পারব না।
বাসে যে সব প্যাসেঞ্জাররা ছিলেন তাদের সম্পর্কে?
মাদারশেড তাকাল। আমি তাদের সকলের নাম ঠিকানা জানি।
না, মাদারশেড বলতে থাকে, না, আমি তো তাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। তারা সকলেই অচেনা আগন্তুক।
–ঠিক আছে, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ছবিগুলো ওঠেনি বলে খারাপ লাগছে।
–আমারও খারাপ লাগছে, মাদারশেড বলল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
শেষ পর্যন্ত আমি জিতে গেছি, জীবনযুদ্ধে।
রবার্ট দরজার তলার দিকে তাকিয়ে আছেন। চাপ দিলেই খুলে যাবে। পুরোনো দিনের তালা। তিনি তালা খুলে ফেললেন। মধ্যরাত। এবার কী অভিযান শুরু হবে। না, পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ওই তালিকাটা আমার হাতে এসে গেলে, বাকি কাজটা করতে আর দেরি হবে না।
.
মাদারশেডের বাড়ির কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাটে রবার্ট উঠলেন। জেনারেল হিলিয়াডকে ফোন করলেন।
–আমি ইংরাজ প্রত্যক্ষদর্শীর নাম পেয়ে গেছি জেনারেল।
–ঠিক আছে। আরও বলুন কমান্ডার।
–লেসলি মাদারশেড, সে হোয়াইট চ্যাপেলে থাকে, ২১৩এ, গ্রোগ রোড।
বাঃ, আমি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছি।
রবার্ট আর কিছু বললেন না, ওই অন্যদের নামের তালিকা অথবা ছবিগুলো। তিনি জানেন, এটাই হল তুরুপের তাস।
.
ব্রম্পটন রোড- সেখানেই আছে রেগির একটা দোকান। ছোট্টো দোকান। কিন্তু অনেকেই এখানে নিয়মিত আসেন।
কাউন্টারের ধারে একটা ফোন, উলের সোয়েটার পরা একজন ফোনে কথা বলছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি ইস্টএন্ডের বাসিন্দা। কী কথা? বুঝতে পারা যাচ্ছে কি?
রেগি কি শুনতে পাচ্ছো?
আমি বিশপ বলছি।
–রেগি, কথাটা কমে এল, ফিসফিসানি। আমাদের ক্লায়েন্টের নাম মাদারশেড লেসলি। ২১৩এ, গ্রোগ রোডের বাসিন্দা। আদেশটা যেন এখনই পালন করা হয়।
-ভেবে রাখবেন, এটা পালন করা হয়ে গেছে।
.
২০.
আহা, দিবাস্বপ্ন– লেসলি হারিয়ে গেছে। তাকে পৃথিবীর সমস্ত প্রেস ইন্টারভিউ করছে। স্কটল্যান্ডে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে দক্ষিণ ফ্রান্স। একটা সুন্দর প্রমোদ তরণী কিনেছে সে। বলা হচ্ছে, মহারানি আপনাকে ডেকেছেন।
স্বপ্ন ভেঙে গেল, কলিংবেলের শব্দ। লেসলি দরজার দিকে তাকাল। এগারোটা, লোকটা কি আবার ফিরে এসেছে? সে দরজাটা খুলে দিল। একজন খর্বাকৃতি মানুষ। চোখে চশমা, মুখটা কেমন যেন।
লোকটা বলল-রাত এগারোটায় আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আমি শুনলাম, আপনি একজন ফটোগ্রাফার।
–তাতে কী হয়েছে?
–আপনি কি পাশপোর্টের ফটো তোলেন?
পাশপোর্টের ফটো? লেসলি মনে মনে হাসল। কিছুদিন বাদে যে হবে এই পৃথিবীর রাজা, তাকে এমন প্রশ্ন করা হচ্ছে? মাইকেল অ্যাঞ্জেলোকে বোধহয় বাথরুমের ছবি আঁকার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে!
না, লেসলি কঠিনভাবে বলল। সে দরজাটা বন্ধ করার জন্য এগিয়ে গেল।
-আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। সকাল আটটায়। আমার প্লেন টোকিওতে যাবে। আমার পাশপোর্টের ছবিটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই জন্য আমি আপনার কাছে এসেছি।
লোকটার চোখে জল।
মাদারশেড বলল- আমি দুঃখিত। আমি সাহায্য করতে পারব না।
–আমি আপনাকে একশো পাউন্ড দেব।
— লেসলির মুখে হাসি। লোকটা ভেবেছে কী? যার হাতে একটা দুর্গ আর একটা প্রমোদ তরণী, তাকে একশো পাউন্ড!
লোকটা তখনও বলে চলেছে, দুশো অথবা তিনশো পাউন্ড। দেখুন, আমাকে যে করেই হোক ওই প্লেনে উঠতেই হবে। তা না হলে আমি চাকরিটা হারাব।
তিনশো পাউন্ড, একটা পাশপোর্ট ছবি নেবার জন্য। দুশ সেকেন্ডের খেলা। মাদারশেড ভাবতে শুরু করল। তার মানে? এক মিনিটে আঠারোশো পাউন্ড। এক ঘণ্টায় কত? যদি সে রোজ আট ঘণ্টা করে কাজ করতে পারে তা হলে?
-কী আমার কথা শুনবেন কি?
মাদারশেড তাকাল। ভেতরে আসুন। ওই দেওয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়ান।
-ধন্যবাদ।
মাদারশেড ভাবল, একটা বোলারের ক্যামেরা থাকলে ভালো হত। ব্যাপারটা আরও সহজ হত। সে তার ভিভিটার ক্যামেরাটা নিয়ে বলল ওখানে দাঁড়ান।
দশ সেকেন্ড, কাজটা হয়ে গেছে।
–কিছুক্ষণের মধ্যেই ডেভেলপ করে দেব, আপনি কি একটু বাদে আসতে পারবেন?
–যদি আমি এখানে থাকি?
–আচ্ছা বসুন।
মাদারশেড ক্যামেরাটা নিয়ে ডার্করুমে চলে গেল। এবার ডেভলপিং-এর কাজ শুরু হবে। কোনো তাড়া আছে কি? পনেরো মিনিট কেটে গেছে। মাদারশেডের মনে হল, সে যেন পোড়া গন্ধ পাচ্ছে। এটা কি তার স্বপ্ন? সে দরজাটা খোলার চেষ্টা করল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে।
মাদারশেড চিৎকার করল- হ্যালো? কী হয়েছে?
কোনো শব্দ ভেসে আসছে না।
-হ্যালো? সে আবার দরজায় হাত দিল। মনে হচ্ছে, এটা বোধহয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কোনো উত্তর নেই। বিস্ফোরণের শব্দ। সব হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। পোড়া গন্ধ সমস্ত ফ্ল্যাটে ছড়িয়ে পড়েছে। সে বুঝতে পারল, ফ্ল্যাটে আগুন লেগেছে। তাই বোধহয় ওই লোকটা পালিয়ে গেছে, কাউকে ডাকতে গেছে।
লেসলি আবার দরজায় ধাক্কা দিল- না, সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না।
সে চিৎকার করছে কেউ কি আছে? এখান থেকে আমাকে উদ্ধার করো।
দরজা দিয়ে হু-হু করে ধোঁয়া ঢুকতে শুরু করেছে। মাদারশেড বুঝতে পারল, এখন আগুনের তাপ আরও বেশি হবে। সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে হাঁফাতে শুরু করে, জ্বলে যাচ্ছে। সব কিছু জ্বলে যাচ্ছে, সে অচেতন হয়ে পড়ল। হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসে পড়ল। ভগবান, আমাকে এখনই মেরে ফেলো না। আমাকে অনেক বড়োনোক হতে হবে।
.
ক্লার্ক রেগি কথা বলছি।
–আমার আদেশ পালিত হয়েছে?
–হ্যাঁ, ঠিক সময়ে আমরা দিয়ে এসেছি। রান্নাটা একটু বেশি ঝাল হয়ে গেছে, স্যার।
বাঃ, চমৎকার।
রবাট গ্রোগ রোডে এসে পৌঁছোল, রাত্রি দুটো। এবার আসল কাজটা শুরু হবে। ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়েছিল। এত ট্রাফিক? রবার্ট সামনে এল। এ কী? একতলাটা একেবারে ভস্মীভূত।
রবার্ট এক ফায়ারম্যানকে জিজ্ঞাসা করল– কী করে ঘটল?
–আমরা জানি না। আপনি একটু সরে যাবেন কি?
–আমার এক ভাই এই ফ্ল্যাটে থাকে, সে কি বেঁচে আছে?
–না, বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই।
রবার্ট দেখল, দুজন একটা দেহকে নিয়ে স্ট্রেচারে চাপিয়েছে। তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়া হবে।
রবার্ট আর্তনাদ করে ওঠে আমি আমার ভাইয়ের সঙ্গে থাকতাম। আমার সব জামাকাপড় ভেতরে আছে। আমি কি একবার ভেতরে যাবার অনুমতি পাব?
ফায়ার ব্রিগেডের লোকটি মাথা নেড়ে বলল- না, ভেতরে গিয়ে কোনো লাভ নেই, স্যার। ওখানে কী দেখবেন? মুঠো মুঠো ছাই ছাড়া আর কিছু নেই।
তার মানে? ফটোগ্রাফগুলো সব ধ্বংস হয়ে গেল? প্রত্যক্ষদর্শীদের নামের তালিকা?
আঃ, রবার্ট ভাবল, জীবনটা কেন এত বিষাদঘন!
.
ওয়াশিংটন। ডাসটিন ফরনটন তার শ্বশুরের সঙ্গে এইমাত্র লাঞ্চ শেষ করলেন। এটা তার নিজস্ব ডাইনিং রুম। ডাসটিনকে কেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। শক্তিশালী শ্বশুরের সামনে এলে তিনি কেমন যেন হয়ে যান।
উইলার্ড স্টোন ভালো মুডে আছেন– গত সন্ধ্যায় আমি প্রেসিডেন্টের সাথে ডিনারের আসরে বসেছিলাম। ডাসটিন, তোমার কাজে উনি খুবই খুশি হয়েছেন।
সবই আপনার কৃপা।
–তুমি চমৎকার কাজ করেছ। তুমি আমাদের দেশকে রক্ষা করেছ।
হা, চেষ্টা করছি।
–ঠিক কথা, ভালোভাবে কাজ করে যাও। ডাসটিন, ভেবে দেখো, এর ওপর তোমার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
একজন ঘরে এসে বলল- মি. স্টোন, ওঁরা এসে গেছেন। ওঁরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
স্টোন তার জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন- আমি লাঞ্চ শেষ করে আসছি। আমায় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। একদিন আমি তোমায় সব বুঝিয়ে বলব।