৩১.
কিয়েভ, সোভিয়েত ইউনিয়ন।
অন্যসব গ্রাম্য রমণীর মতো ওলগাও পেরোস্ত্রেীয়াতে আক্রান্ত হয়েছিল। তাদের জীবন ধারাটা একেবারে পাল্টে গেছে। আগের মতো আর সেই নিয়মশৃঙ্খলা নেই।
তিনি লাইব্রেরিতে কাজ করছেন। একটা স্কোয়ারের পাশে, কিয়েভ শহরের কেন্দ্রস্থলে, গত সাত বছর ধরে। এখন তার বয়স হল বত্রিশ। কখনও কোনোদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে যাননি। চেহারাটা সত্যি আকর্ষণীয়। ওজন বেড়েছে বটে, রাশিয়াতে পৃথুলা মেয়েদের ভালোবাসার চোখে দেখা হয়। একজনের সাথে ছোট্ট একটা প্রেমের ঘটনা ঘটেছিল। ভদ্রলোক তাকে সরিয়ে দূরে চলে গেছেন। তিনি হলেন ডিমিত্রি, লেনিনগ্রাডে থাকেন এখন। আর একজন আইভান, তাকেও ওলগা ভালো বেসেছিলেন। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। আইভান। এখন মস্কোর বাসিন্দা। ওলগা চেয়েছিলেন মস্কোতে যেতে, আইভানের কাছে থাকতে, কিন্তু সম্ভব হয়নি।
বত্রিশ বছর জন্মদিনটা এগিয়ে আসছে। ভাবলেন, পৃথিবীর অন্য কোনো জায়গায় যেতে হবে। আবার কোনদিন লৌহ যবনিকা পড়ে যাবে। তিনি প্রধান লাইব্রেরিয়ানের কাছে গেলেন। তার অনুমতি নিলেন। আহা, কোথায় যাওয়া যায়? কৃষ্ণসাগর? সামারখন্দ? ইবলিসি? না, সোভিয়েত দেশের মধ্যে উনি কোথাও যাবেন না। উনি লাইব্রেরির তাক থেকে বইগুলো ভরতে থাকলেন। আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা। না, অতদূরে যাব কী করে? ইওরোপের মানচিত্র, সুইজারল্যান্ড- হ্যাঁ, এখানেই আমাকে যেতে হবে।
সুইজারল্যান্ড, অদ্ভুত আকর্ষণে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। একদা সুইজ চকোলেট খেয়েছিলেন। এখনও সব মনে আছে। উনি মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন। রাশিয়াতে ক্যান্ডি পাওয়া যায়। চিনি কম, তেতো স্বাদ। আহা, ওই চকোলেটের সন্ধানে আরও একবার সুইজারল্যান্ডে…।
এবোফটেড উড়ান, জুরিখের পথে, অসাধারণ। আগে উনি কখনও উড়ান পাখিতে চড়ে বসেননি। জুরিখের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নামলেন। বাতাসের ভেতর একটা অন্য সুবাস। কেন? সত্যিকারের স্বাধীনতা? ওলগা ভাবলেন। বেশি টাকা হয়তো খরচ করতে পারবেন না। যা আছে তাই দিয়েই আনন্দ করতে হবে।
হোটেলের রিসেপশন ক্লার্ককে বললেন–এই প্রথম আমি সুইজারল্যান্ডে এলাম, এখানে কী কী দেখব বলুন তো?
ভদ্রলোক বললেন অনেক কিছু দেখার আছে মিস, এই শহরটা দিয়ে শুরু করুন। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
ওলগা জুরিখ শহরটাকে ভালোবেসেছিলেন। এই শহরের একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। মানুষজনের পরনে সুন্দর পোশাক। দামী দামী অটোমোবাইল ছুটে চলেছে। জুরিখের সবাই কি কোটিপতি নাকি? দোকানগুলো? আহা, অসাধারণ, সব কিছুই কিনতে ইচ্ছে করে। চকোলেটের আবরণ দেওয়া কলা, চকোলেট বিন, লিকারে পরিপূর্ণ, চার দিকে শুধু খাবারের আহ্বান।
এক সপ্তাহ ধরে ওলগা নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন। মিউজিয়ামে গেলেন। অলস সময় কাটালেন। চার্চে গেলেন। একাদশ শতাব্দীর গির্জা।
সময় দ্রুত কমে আসছে।
হোটল ক্লার্ক বললেন সানসাইন ট্যুরিস্ট বাস কোম্পানি আল্পসে যাচ্ছে। আমার মনে হয় আপনার যাওয়া উচিত।
ওলগা জবাব দিয়েছিলেন চেষ্টা করব।
শুরু হল নতুন এক যাত্রা, অসাধারণ দৃশ্যপট। আল্পস পাহাড়, তুষারে ঢাকা।
তারপর? একটা ঘটনা চোখের সামনে ঘটে গেল। উড়ন্ত চাকি, দেখা গেল। বিস্ফোরণের শব্দ। কানাডিয় ব্যাঙ্কার তার পাশে বসে ছিলেন। তিনি সব কথা বুঝিয়ে বললেন। ওলগার বিশ্বাস হচ্ছিল না। ভয় পাওয়া উচিত, কী হাসা উচিত, বুঝতে পারছিলেন না। শেষ অব্দি ওলগা চিন্তা করলেন, দিমিত্রি কিংবা আইভান পাশে থাকলে ছুটির প্রহর আরও আনন্দঘন হয়ে উঠত। এখন রাশিয়াতে ফিরে গিয়ে কাজে মন দেওয়া সত্যি অসম্ভব ব্যাপার।
.
এয়ারপোর্ট থেকে কিয়েভ শহরের কেন্দ্রস্থলে এগিয়ে চলেছে গাড়িটি, নতুন তৈরি করা হাইওয়ে। এই প্রথম রবার্ট কিয়েভে এসেছেন। অসাধারণ স্থাপত্য দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছেন। বাসটা ড্যানিফার হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। কয়েকজন যাত্রী নেমে গেলেন। রবার্ট ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত আটটা। লাইব্রেরি নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে গেছে। তাকে কাল সকাল অব্দি অপেক্ষা করতে হবে। তিনি একটা হোটেলে ঢুকে পড়লেন। বারে বসে ড্রিঙ্ক করলেন। ডাইনিং রুমে গিয়ে রাশিয়ান স্যালাড খেয়ে দেখলেন। আহা, অসাধারণ স্বাদ আর গন্ধ।
এবার কোথায় কীভাবে থাকবেন? রবার্ট ভাবলেন। না, কারও সাহায্য আমি নেব না। ডিনার শেষ হয়ে গেল। ডেস্কে বসে থাকা লোকটির সাথে গল্প করলেন। কিয়েভ হল ইউক্রেনের অন্যতম প্রাচীন শহর। ইওরোপীয় আদল আছে সর্বত্র। ড্যানিফার নদী বয়ে চলেছে। সবুজ উদ্যান আছে। গাছে ঢাকা সরণি। চার্চ আছে। ধার্মিক উন্মাদনা।
হঠাৎ সুশানের মুখটা ভেসে উঠল। সুশানকে ফোন করলে কেমন হয়।
-হ্যালো?
অনেক দূর থেকে সেই যৌন আবেদনময়ী কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
ব্রাজিলে কেমন আছো?
–রবার্ট, আমি তোমাকে অনেকবার ফোন করেছি, কিন্তু উত্তর পাইনি।
–আমি তো বাড়িতে অনেক দিন নেই।
–তাহলে ভালো আছে তো?
এক মুহূর্ত নীরবতা।
ভালো আছি। মন্টে কেমন আছে?
–ও ভালো আছে রবার্ট। আমরা জিব্রাল্টার যাব, আগামী কাল, ইয়েটে চড়ে বেড়াব।
–আহা, আমাকে ডাকবে না?
সামান্য কিছু কথা হল।
শেষ অব্দি সুশান বলেছিলেন– রবার্ট, প্রতি মুহূর্তে তোমাকে মনে পড়ে। নিজের দিকে নজর রেখো কেমন?
তখনই রবার্টের মনে হল, বিশাল রাশিয়ান ভূখণ্ডে তিনি একেবারে একা।
.
বারে নম্বর দিন।
পরের দিন সকালবেলা, লাইব্রেরি খুলছে, দশ মিনিট আগে। রবার্ট বিরাট বাড়িটিতে ঢুকে পড়লেন। রিসেপশন ডেস্কের কাছে গিয়ে বললেন- আমি ওলগার সাথে কথা বলতে চাইছি।
–ওই তো উনি আসছেন।
ধন্যবাদ।
কী বিষয়ে কথা বলা যায়?
এক মহিলাকে দেখা গেল, এগিয়ে আসতে। ভদ্রমহিলা লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে গেলেন। নিজের পরিচয় কীভাবে দেবেন রবার্ট?
তিনি বললেন- আমি রাশিয়ার পরিবর্তিত অর্থনীতির ওপর একটা প্রবন্ধ লিখতে চলেছি। সাধারণ রাশিয়ানদের ওপর এর কী প্রভাব, সেটা আমাকে জানতে হবে। সত্যি করে বলুন তে, রাজনীতির এই পালাবদল কি আপনার জীবনকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পেরেছে?
ভদ্রমহিলা কাঁধ কঁকিয়ে বললেন- গরবাচভের আগে আমরা আমাদের মুখ খুলতে পারতাম না। এখন আমরা অনায়াসে মুখ খুলতে পারি। সত্যিকারের স্বাধীনতা পেয়েছি।
রবার্ট আর একটা কৌশল খেললেন- সত্যি কি? আপনি তো এখন ভ্রমণ করতেও পারছেন?
-হ্যাঁ, কী করে ভ্রমণ করব? এক বুড়ো স্বামী আর ছ-ছটি ছেলেমেয়ে আমার কাঁধে চাপানো, জানেন?
রবার্ট অবাক হয়ে গেছেন। আপনি তো সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলেন?
সুইজারল্যান্ড? আমি জীবনে কোনোদিন সুইজারল্যান্ড যাইনি।
রবার্ট অবাক– সত্যি বলছেন?
হা। ওই মেয়েটির কাছে যান, ও কিন্তু সুইজারল্যান্ড থেকে ঘুরে এসেছে।
ভদ্রমহিলা একটা কালো চুলের মেয়েকে দেখালেন।
-ওর নাম কী? রবার্ট জানতে চাইলেন।
—ওলগা, একই নাম। আমার মতো।
রবার্টের দীর্ঘশ্বাস- ধন্যবাদ।
এক মুহূর্ত কেটে গেছে। রবার্ট দ্বিতীয় ওলগার সাথে কথা বলছেন।
–আমি রাশিয়ার পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থা সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখছি।
মহিলা বললেন- ঠিক আছে বলুন, কী করতে হবে?
–ওলগা বলুন তো, এই পরিবর্তন আপনার জীবনে কতখানি তফাত এনে দিয়েছে?
ছ-বছর আগেকার ঘটনা, ওলগা এক বিদেশীর সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেতেন। এখন সহজেই বললেন- আগের মতো সবকিছু আছে।
অজানা আগন্তুক জানতে চাইলেন– সত্যি কোনো নতুন ঘটনা ঘটেনি?
না, তবে আমরা এখন দেশের বাইরে যেতে পারছি।
–আপনি কি এর মধ্যে কোথাও গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, আমি সুইজারল্যান্ড ঘুরে এলাম। দারুণ সুন্দর জায়গা।
কারও সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি?
–অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা বাসে করে আল্পস দেখতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ ওলগার মনে হল, ওই মহাকাশযান সম্পর্কে কোনো কথা বলা উচিত কিনা? এই ব্যাপারটা নিয়ে তিনি কোনো বিদেশীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন কি?
রবার্ট বললেন- ওই বাসে আপনার সহযাত্রী কারা ছিলেন?
ওলগা বলতে থাকেন। তারা সকলেই খুব বন্ধুত্বের আচরণ করেছেন। এইভাবে তারা পোশাক পরেছিলেন। খুবই ধনী। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন।
–আপনি তার সাথে কথা বলেছেন?
–হ্যাঁ, উনি কার্ড দিয়েছেন।
কার্ডটা আছে?
না, ওটা আমি ফেলে দিয়েছি। এই ধরনের জিনিস রাখা উচিত নয়।
আবার ওলগা বললেন– ওনার নাম আমি মনে রেখেছি। পারকার, আমেরিকান পেনের মতো নাম, কেভিন পারকার। রাজনীতির এক বিখ্যাত মানুষ। তিনি বলেছিলেন, সেনেটররা কীভাবে ভোট দেয়।
রবার্ট অবাক হয়ে গেছেন সে কথা উনি বলেছিলেন?
হা, সেখানে নানা ধরনের উপহার দেওয়া হয়। আর এইভাবে ভোট কিনে নেওয়া হয়। আমেরিকাতে নাকি এমনই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে।
রবার্ট আর ওলগা বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন। কিন্তু আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর পাওয়া গেল না।
.
রবার্ট জেনারেল হিলিয়াডকে হোটেল রুম থেকে ফোন করলেন- আমি রাশিয়ান সাক্ষীর সাথে কথা বললাম। তাঁর নাম ওলগা। সে কিয়েভের প্রধান লাইব্রেরিতে কাজ করে। আমি এখনই রাশিয়ান সরকারের সাথে কথা বলছি।
ফ্ল্যাশ আলো জ্বলে উঠল। অত্যন্ত গোপনীয়। অপারেশন ডুমস ডে। আট নম্বর সাক্ষী ওলগা কিয়েভ। খবরটা শেষ হয়ে গেল।
সেই সন্ধ্যেবেলা রবার্ট এরোফটেড এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছেন। আধঘণ্টা কেটে গেল, আরও পঁচিশ মিনিট। তিনি এখন ওয়াশিংটন ডিসির দিকে এগিয়ে চলেছেন। এয়ার ফ্রান্সের ফ্লাইটে।
.
রাত্রি দুটো। ওলগা একটা গাড়ির শব্দ পেলেন। তার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে। এই অ্যাপার্টমেন্টের দেওয়াল এত পাতলা যে, রাস্তার সব শব্দ শোনা যায়। তিনি বিছানা থেকে উঠলেন। জানলায় তাকালেন। সাধারণ পোশাক পরা দুজন তোক একটা কালো গাড়ি থেকে নেমে আসছেন। এই জাতীয় গাড়ি সরকারী মানুষেরা ব্যবহার করে। তারা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর সামনে এলেন। তাঁদের দেখে ওলগার বুকের ভেতর একটুখানি কাঁপন। অনেকদিন ধরেই এই ঘটনাটা ঘটছে। এক-একজন রাতের অন্ধকারে গায়েব হয়ে যাচ্ছে। সে কোনোদিন ফিরে আসছে না। তাদেরকে গুলাগে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাইবেরিয়াতে। ওলগা অবাক হয়ে গেলেন। এবার ওই সিক্রেট পুলিশ অফিসার কেন এসেছেন? সে ভাবল। কিন্তু তারপরেই দরজাতে শব্দ। আমি এখন কী করব? ওরা কি আমাকে চাইছে? হয়তো ভুল হয়েছে।
ওলগা দরজা খুলে দিলেন। দুজন সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
কমরেড ওলগা?
–হ্যাঁ।
–আমরা রাশিয়ান সিক্রেট সার্ভিস থেকে আসছি।
এক ভদ্রলোক বললেন আমি সার্জেন্ট ভ্লাদিমির।
ওলগার মনে আতঙ্কের শিহরণ। কিন্তু আমাকে কেন? মনে হচ্ছে কোনো ভুল হয়েছে বোধহয়।
উরি হাসতে হাসতে বললেন- আপনি সুইজারল্যান্ড বেড়াতে গিয়েছিলেন, তাই তো?
ওলগা আমতা আমতা করে বলতে থাকেন–হ্যাঁ, কিন্তু তার জন্য আমি তো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগাম অনুমতি নিয়েছি।
চাদিমির বললেন– কীসের অনুমতি? দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার জন্য? আপনি সেখানে গিয়ে স্পাইয়ের কাজ করেছেন। আপনাকে এক্ষুনি আমাদের সঙ্গে হেড কোয়ার্টারে যেতে হবে।
হেডকোয়ার্টার? ওলগার সমস্ত শরীরে শীতল শিহরণ।
দুই আগন্তুক পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে মিনতি করার ভঙ্গিতে ওলগা বললেন—-না, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি সত্যিই বলছি, কিছু জানি না।
উরির ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। তিনি বললেন- আপনি ওভারকোটটা পরে নিন। বাইরে ভীষণ ঠাণ্ডা। এখানে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করার মতো সময় নেই।
ওলগাকে বাইরে আসতে হল। কালো গাড়িতে বসতে হল। অন্ধকার রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। দুই পুলিশ অফিসার নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন, ঠাট্টা মসকরা করছেন, ওলগা বেশ বুঝতে পারছেন, তার সামনে এখন একটা ভীষণ বিপদ। তাকে হয়তো সাইবেরিয়াতে নির্বাসন দেওয়া হবে। তিনি জানেন, জেলের জীবন ভয়ঙ্কর। পুরুষ রক্ষীরা যে কোনো সময় ধর্ষণ করবে। সমকামীদের শিকার হতে হবে। আর কোনোদিন হয়তো তিনি স্বাধীনতার আলো দেখতে পাবেন না। কিন্তু আমার কী দোষ? ওলগা বারবার ভাবতে থাকেন।
শেষ পর্যন্ত আশার আলোর ঝলকানি।
উরি হঠাৎ বললেন–কুমারি কন্যা, আপনাকে দেখে আমাদের ভালো লেগেছে। আসুন, একটা দেওয়া-নেওয়ার খেলা শুরু হোক।
ভাদিমির বললেন আপনি আমাদের মনের মতো কাজ করবেন, ব্যাপারটা শেষ করতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। তারপর এই বিষয়টা আমরা ভুলে যাব। আপনাকে নিয়ে আর কোনোদিন টানাটানি করা হবে না। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন।
ওলগা ভীত কণ্ঠস্বরে বলে ওঠেন– আপনারা কী চাইছেন? টাকা? বিশ্বাস করুন, আমার হাতে কিন্তু বেশি টাকা নেই। আমি টাকা দিতে পারব না।
একজন হো-হো করে হেসে উঠলেন, উরি, তিনি বললেন- না সুন্দরী, তোমার কাছ থেকে আমরা টাকা দাবি করছি না। ভগবান তোমাকে টাকার থেকে দামী জিনিস দিয়েছেন। সেটা আমরা দুজনে ভোগ করব। তুমি কিন্তু বাধা দিতে পারবে না।
ওলগা ভাবলেন, ব্যাপারটা এখানেই মিটে গেলে বোধহয় ভালো হয়। না হলে দারুণ ক্ষতি হবে। জেলের ভয়ঙ্কর কত…
উনি বললেন- ঠিক আছে, আপনাদের কথায় আমি রাজী, কিন্তু আমার ফ্ল্যাটে যাবেন কি?
দুজনেই হোহো করে হেসে উঠলেন– না, সেখানে আর যাব না। আমরা ওই ফাঁকা বাগানটাতে গিয়ে বসি।
কনকনে রাত। ওলগাকে নেমে আসতে হল। একজন তার কানের ওপর ট্রিগার রেখেছেন। বললেন– এখনই সব কিছু খুলে ফেলুন। তাড়াতাড়ি। আবার আমার মন হয়তো পাল্টে যাবে।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। ওলগা ওভার কোটটা খুললেন। ফিনফিনে রাত পোশাকটাও খুলতে বাধ্য হলেন। চাঁদের অলৌকিক আলো, জোৎস্নায় ভরে যাচ্ছে চারপাশ।
দুজন মুগ্ধ বিস্ময়ে ওই নগ্নিকা ওলগার দিকে তাকিয়ে আছেন। আহা, ঈশ্বরের অনবদ্য সৃষ্টি!
উরি এগিয়ে এসে স্তনবৃন্ত মুচড়ে দিলেন। ওলগা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার কানে বন্দুক ঠেকিয়ে দেওয়া হল। বলা হল– সুন্দরী, আর একটি শব্দ উচ্চারণ করলে তোমাকে কিন্তু আমরা নরকের অন্ধকারে ঠেলে দেব।
প্রথমেই উরির পালা। তিনি জোর করে ওলগাকে ভোগ করলেন। অনেকক্ষণ ধরে।
এবার ভ্লাদিমিরের পালা, ম্লাদিমির আরও কষ্ট দিলেন। আঃ, সব ব্যাপারটা ভালো ভালোয় মিটে গেছে। অপমানিতা আর বিধ্বস্তা ওলগা শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। চোখ বন্ধ করে তিনি শুধু সুইজারল্যান্ডের কথাই ভেবেছেন। আহা, এমন সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, আমি কি সেখানেই একটা ছোটো বাড়ি তৈরি করব? জীবনের বাকি দিনগুলো সেখানেই কাটাব? শান্তি আর আনন্দের মধ্যে।
এ কী? ঘাড়ে একটা আক্রমণ। দুই পুলিশ অফিসার পালাক্রমে আক্রমণ করতে থাকেন। তারপর? চোখের সামনে নেমে আসে ঘন অন্ধকার।
.
পরের দিন সকালে খবরের কাগজের পাতায় বড়ো বড়ো হেডলাইন পার্কে ধর্ষিতা লাইব্রেরিয়ানের মৃতদেহ। সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে। এই শহরের তরুণী কন্যারা যেন একা একা পার্কে বেড়াতে না যান।
এরপরেই ফ্ল্যাশ আলো জ্বলে উঠেছে। কতগুলো সংবাদ ভেসে উঠল–অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গোপনীয়। বিষয় অপারেশন ডুমস ডে। আট নম্বর সাক্ষী ওলগা। কাজটা হয়ে গেছে।
.
৩২.
উইলার্ড স্টোন এবং মন্টে বাঙ্কস পারস্পরিক শত্রু। অনেকদিন ধরেই এই শত্রুতা। ওয়াল স্ট্রিটে এঁদের কথা বারবার লেখা হয়। একটির পর একটি ঝামেলায় তারা জড়িয়ে পড়তে ভালোবাসেন।
একটা বিরাট কোম্পানি কেনা হল, তারপর দুজনের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে গেল। উইলার্ড স্টোন প্রথম নিলামে ডাক দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, সমস্যা হবে না। তার হাতে এত শক্তি, তার নাম শুনে সকলে ভয়ে কাঁপতে থাকে। মাত্র কয়েকজন তার প্রতিদ্বন্দ্বি হবার। সাহস রাখেন। দেখা গেল, এক তরুণ উদ্যোগপতি এগিয়ে এসেছেন। তার নাম মন্টে বাঙ্কস। তিনি নিলামে অংশ নিলেন। স্টোন বাধ্য হয়ে দাম বাড়িয়ে দিলেন। বিরুদ্ধ পক্ষ দাম বাড়াতে থাকলেন। শেষ অব্দি অবশ্য উইলার্ড স্টোন এই রিবাট কোম্পানিটাকে কিনে ছিলেন। তবে এতে তাকে অনেক বেশি টাকা দিতে হয়েছিল।
ছমাস কেটে গেছে। এবার একটা মস্ত বড়ো ইলেকট্রনিক কারখানা বিক্রি হবে। স্টোনের সাথে আবার মন্টে বাঙ্কসের ঝগড়া বেঁধে গেল। নিলামের দর হু-হু করে চড়তে লাগল। এবার বাঙ্কস জিতে গেলেন।
উইলার্ড স্টোন বুঝতে পারলেন, মন্টে বাঙ্কস তার সাথে প্রতিক্ষেত্রে লড়াই করবেন। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। তারা বাহামার প্যারাডাইস দ্বীপে দেখা করলেন। উইলার্ড স্টোনের একটা সুন্দর বাহিনী ছিল। এর সাহায্যে তিনি তার প্রতিদ্বন্দী মন্টে বাঙ্কস সম্বন্ধে সব কথা জেনে নিয়েছেন। উনি একটা ধনী পরিবার থেকে এসেছেন। পৈত্রিক সূত্রে যা পেয়েছেন, সবকিছু অটুট রেখেছেন। বিশ্ববিখ্যাত হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেছেন।
দুজনে লাঞ্চের আসরে বসেছেন। উইলার্ড স্টোনের বয়স বেশি এবং তিনি একটু কম কথা বলেন। মন্টে বাঙ্কসের বয়স কম, সবসময় কোনো কিছু করার জন্য ছটফট করছেন।
উইলার্ড স্টোন কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন এইভাবে আপনি সব ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করছেন কেন?
মন্টে বাঙ্কস বললেন- শেষ পর্যন্ত আপনি যে আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে পারলেন, সেটা ভেবে আমি খুবই উত্তেজিত বোধ করছি।
–আপনি কী চাইছেন?
–আপনার যা স্বপ্ন, আমি পৃথিবীর রাজা হতে চাইছি।
–পৃথিবীরটা মস্ত বড়ো।
–তার মানে?
–এখানে আমরা দুজনেই পাশাপাশি বাস করতে পারব।
সেদিন থেকেই তারা অংশীদার হলেন। দুজনের সম্মিলিত ব্যবসা নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল। গড়ে উঠল একটা সুন্দর সম্পর্ক।
অপারেশন ডুমস ডে, তাদের মস্তিষ্কপ্রসূত এক পরিকল্পনা। তারা দুজনেই এর সঙ্গে যুক্ত হলেন। তারা এককোটি একর জায়গা কেনার চেষ্টা করলেন আমাজন অঞ্চলে। সেখানে মস্ত বড়ো ব্যবসায়িক প্রয়াস শুরু হবে।
এইভাবেই একটা স্বপ্নের জয়যাত্রা শুরু হল।
.
৩৩.
তেরো নম্বর দিন, ওয়াশিংটন ডিসি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেট, জুনিয়ার সেনেটর, দাঁড়িয়ে আছেন ফ্লোরের ওপর। তিনি বলছেন, এইভাবে আমাদের জাতীয় সম্পত্তি নষ্ট করা হচ্ছে। উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা যা পেয়েছি সেগুলোকে রক্ষা করা উচিত। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে নিরাপত্তা বলয় রচনা করব। এই ভূমি, এই বাতাস এবং সমুদ্রকে আমরা দূষিত হতে দেব না। আমরা এখন কী করছি? আমরা ইচ্ছে করে সবকিছু নষ্ট করছি।
কেভিন পারকার অতিথিদের গ্যালারিতে বসেছিলেন। গত পাঁচ মিনিটে তিনবারের মতো ঘড়ির দিকে তাকালেন। কতক্ষণ ধরে এই ভাষণ চলতে থাকবে। তিনি এখানে বসে আছেন। কারণ সেনেটরের সঙ্গে তাকে লাঞ্চ খেতে হবে। সেনেটরের কাছে কিছু সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। কেভিন পারকার ক্ষমতার অলিন্দে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। কংগ্রেস সদস্য এবং সেনেটরদের সঙ্গে তাঁর দহরম মহরম সম্পর্ক। তাদের কাছ থেকে অনেক রাজনৈতিক অনুগ্রহ নিয়েছেন।
ইউচিনে তাঁর জন্ম হয়েছিল, দরিদ্র পরিবারে। বাবা সব সময় মদ খেতেন। এক অসফল ব্যবসাদার।
সত্যি কথা বলতে কি, পারিবারিক জীবন বলতে তার কিছুই ছিল না। মা কয়েক বছর আগে অন্য একজনকে বিয়ে করে সংসার ছেড়েছেন। অবশ্য সেই বয়স থেকেই তিনি অসাধারণ রূপবান পুরুষ হয়ে ওঠেন। মাথায় সোনালী চুলের বন্যা। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। এটা তিনি পেয়েছেন তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। দেখা গেল, শহরের বিখ্যাত বাসিন্দারা এই কিশোরের প্রতি অকারণ করুণা প্রদর্শন করছেন। এই শহরের সবথেকে ধনী ব্যক্তির নাম জেব, তিনি কেভিনকে সাহায্য করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। তাকে একটা আংশিক সময়ের কাজ দিলেন। মাঝেমধ্যেই অবিবাহিত জেব কেভিনকে ডিনারের আসরে নেমন্তন্ন করতেন।
একদিন জেব বললেন- তুমি এইভাবে একটা জীবন কাটাতে পারবে না। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গ তোমাকে করতেই হবে।
–আমি জানি স্যার, আপনার বন্ধুত্ব আমার ভালো লাগে। আমি আপনাকে আরও সাহায্য করতে চাইছি।
জেব বললেন–হ্যাঁ আমি তোমার কাছে আরও বেশি কিছু আশা করছি। তিনি ছেলেটির হাতে হাত রাখলেন। তুমি খুব ভালো ছেলে জানো কি?
-হ্যাঁ।
কখনও একা মনে হয় না?
কেভিন সবসময় একা, তিনি বললেন- হা।
–তাহলে এসো আমার কাছে, তোমাকে আর একা থাকতে হবে না। তুমি তো জানো, আমিও বড় একা, আমি তোমাকে সব ব্যাপারে সাহায্য করব। তুমি কি কখনও কোনো মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করেছ?
–আমি সুত্ৰলেনার কাছে গিয়েছিলাম। কয়েকবার।
–তার সাথে শুয়েছ কি?
ছেলেটির মুখে রক্তিম আভা না, স্যার।
-তোমার বয়েস কত কেভিন?
–ষোলো।
–এখনই শুরু করতে হয়। এই বয়সেই তো পৃথিবীটা খুলে যায়। তুমি রাজনীতিতে আসবে?
রাজনীতি? আমি তো তার কিছুই বুঝি না।
যখন তুমি স্কুলে গিয়েছিলে তখন পড়াশোনা জানতে কি? আমি তোমাকে সাহায্য করব। এখানে অনেক কিছু করার আছে। তিনি কেভিনের পায়ের ওপর হাত রাখলেন। হাতটা ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। ইংগিত পূর্ণ চোখে তাকালেন পার্কারের চোখের দিকে। তারপর বললেন– আশা করি তুমি আমার কথার আসল অর্থ বুঝতে পারছ।
–হ্যাঁ, জেব আমি বুঝতে পারছি।
এভাবেই নিষিদ্ধ উপন্যাসটা শুরু হয়েছিল।
.
চার্চিল হাইস্কুল থেকে কেভিন পার্কার গ্রাজুয়েট হলেন। জেব তাকে অরিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালেন। উনি মন দিয়ে রাষ্ট্রনীতি বিজ্ঞানটা পড়লেন। জেব বুঝতে পারলেন, স্বপ্ন কীভাবে সফলতার দিকে এগিয়ে চলেছে। সকলেই এই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের পুরুষটির প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা প্রদর্শন করতে চলেছে। ধীরে ধীরে অনেক বিখ্যাত মানুষদের সাথে পার্কারের যোগাযোগ স্থাপিত হল। সব মানুষকে এক জায়গায় আনার একটা ক্ষমতা ছিল পার্কারের মধ্যে। ওয়াশিংটনে পৌঁছে গেলেন, পা ফেলে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
দু-বছর আগে জেবের মৃত্যু হয়েছে, ইতিমধ্যেই পার্কার তার কাছ থেকে বিরাট ঐশ্বর্য সংগ্রহ করেছেন। মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা, সকলকে সম্মোহিত করার যাদুদণ্ড এখন তার হাতে। তিনি মাঝেমধ্যেই কিশোর ছেলেদের নিয়ে কোনো এক অজ্ঞাত হোটলে চলে যান, যেখানে কেউ তাকে চিনতে পারবে না।
শেষ পর্যন্ত উটাহ থেকে এক সেনেটর হিসেবে নির্বাচিত হলেন। তিনি এখন ভাষণ দিচ্ছেন, তিনি বলছেন আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার কারণেই পরিবেশের বিষয়টির ওপর নজর দিতে হবে।
ভাষণ শেষ হল, কেভিন পার্কার ভাবলেন, এই সন্ধ্যেটা আমার সামনে পড়ে আছে। এখনই শুরু হয়েছে। গতকাল এক কিশোরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। জিস স্টেশনে। কিন্তু ওই ছেলেটির সাথে আরেকজন ছিল। পার্কার ভাবলেন, একে কী করে জব্দ করা যায়, ছোট্ট একটা চিরকুট হাতে দিয়েছিলেন। লেখা ছিল, কাল রাতে, ছেলেটি বুঝতে পেরেছিল, হেসে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
.
কেভিন পার্কার তাড়াতাড়ি পোশাক পরলেন। এখনই তাকে বারে ছুটতে হবে। ছেলেটি এখনই সেখানে এসে যাবে। এই ছেলেটি খুবই আকর্ষণীয়। পার্কার আর কারোর সাথে ভাব জমাবেন না। হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠল। পার্কার দরজা খুলে দিলেন।
একজন দাঁড়িয়ে আছেন আপনি কেভিন পার্কার?
-হ্যাঁ।
–আমার নাম বেলামি, আমি এক মিনিট আপনার সঙ্গে কথা বলব।
পার্কার অধৈর্য খুব জরুরী একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমার সেক্রেটারীর সাথে। আমি অফিসের বাইরে এ বিষয়ে আলোচনা করি না।
–এটা ব্যবসার ব্যাপারে নাম মি. পার্কার। আপনি সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিলেন, কয়েক সপ্তাহ আগে মনে আছে তো?
-হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তাতে কী?
আমার এজেন্সি, এই ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। সেখানে গিয়ে আপনি কাদের সঙ্গে দেখা করেছেন সেটা আমি জানতে চাইছি।
বেলামি সঙ্গে সঙ্গে তার সি আই এর কার্ডটা দেখালেন। কেভিন পার্কার এবার ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলেন। সি আই এর সাথে আমার কী দরকার? ব্যাপারটার মধ্যে রহস্যের গন্ধ আছে।
লোকটাকে চটিয়ে লাভ নেই। উনি হাসলেন– ভেতরে আসুন। আমার দেরি হয়ে গেছে, কিন্তু আপনি বলছেন এক মিনিটের বেশি সময় লাগবে না তাই তো?
না স্যার, আমি জানি আপনি একটা ট্যুরিস্ট বাসে করে জুরিখ শহরের বাইরে গিয়েছিলেন।
তার মানে? ওই উড়ন্ত চাকির ব্যাপার তো? আর কতবার এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতে হবে কে জানে।
কেভিন বললেন– আপনি বোধহয় ওই উড়ন্ত চাকি সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন? হ্যাঁ, এটা একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমি অস্বীকার করতে পারছি না।
আমাদের এজেন্সি ফ্লাইং সসারদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। আপনি কি জানেন আপনার সাথে আর কে কে ওই বাসে ছিলেন?
পার্কার অবাক হয়ে গেছেন। এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারব না। কারণ তাঁরা সকলেই ছিলেন অপরিচিত।
–আমি জানি মি. পার্কার, রবার্ট শান্তভাবে বললেন, কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই তাদের হাবভাব কিংবা স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে কিছু জেনেছিলেন। এখনও মনে আছে কি?
পার্কার কাধ ঝাঁকিয়ে বললেন- হ্যাঁ, কয়েকটা জিনিস আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি এ এক ইংরেজ ভদ্রলোকের সাথে কথা বলেছিলাম। তিনি আমাদের ছবি নিয়েছিলেন।
লেসলি মাদারশেড, রবার্ট বুঝতে পারলেন, আর কেউ?
হ্যাঁ, আমি এক রাশিয়ান মেয়ের সাথে কথা বলেছিলাম। ভারী সুন্দরী, আমার মনে হয় উনি বোধহয় ওলগা, লাইব্রেরীয়ান।
-ওলগা, বাহ, ভালো, আর কেউ, মি. পার্কার?
না, হা, আরও দুজনের কথা বেশ মনে আছে, একজন আমেরিকান, টেকসাসের বাসিন্দা।
ড্যান ওয়েনে। আর কেউ?
–একজন হাঙ্গেরির বাসিন্দা। তার একটা কার্নিভাল কিংবা সার্কাস জাতীয় কিছু আছে।
–হ্যাঁ, একটা কার্নিভাল আছে।
–এ ব্যাপারে আপনি একেবারে সুনিশ্চিত মি. পার্কার?
–হ্যাঁ, উনি আমাকে কার্নিভাল ব্যবসার গল্প বলছিলেন। উড়ন্ত চাকিটা দেখে তিনি উত্তেজনায় অধীর হয়ে পড়েন। মনে হয় তিনি বোধহয় এটাকে কার্নিভালে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। আমি বলব, ওঃ, ভয়ংকর দৃশ্য। আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না।
-ওঁর নাম মনে আছে?
না, নামগুলো উচ্চারণ করা খুবই খটমটে।
–আর কিছু?
উনি কার্নিভালে ফিরতে ব্যস্ত ছিলেন। এবার আমায় ছেড়ে দেবেন কি?
–হ্যাঁ, মি. পার্কার, আপনি আমায় অনেক সাহায্য করেছেন।
তারা হাতে হাত দিলেন। রবার্টের মুখে শুকনো হাসি।
কোনো সময়ে আমার অফিসে আসবেন কেমন? ভালোভাবে গল্প করব।
–চেষ্টা করব।
রবার্ট ভাবলেন, এবার? কী করে ওই লোকটিকে ধরব?
.
রবার্ট জেনারেল হিলিয়াডকে ফোন করলেন জেনারেল, কেভিন পাকারের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসির এক উঠতি রাজনীতিবিদ। আমি শেষ প্যাসেঞ্জারের সন্ধান করছি।
জেনারেল হিলিয়াডের কণ্ঠস্বর– ভারী ভালো কাজ করেছেন আপনি কমান্ডার, তাড়াতাড়ি জানাবেন।
মেসেজের আলোটা জ্বেলে দিলেন। অত্যন্ত গোপনীয়। অপারেশন ডুম শেডন নম্বর কেভিন পার্কার, ওয়াশিংটন ডিসি, মেসেজটা শেষ হয়ে গেল।
.
কেভিন পার্কার ড্যানিস ফ্রি স্ট্রিটে এলেন। দেখলেন অনেক লোকের ভিড়। এত বেশি লোক আজ কেন? বয়স্ক লোকেরা পুরোনো দিনের স্যুট পরেছে। তরুণরা নানা ধরনের আধুনিক পোশাকে সজ্জিত। অনেকে আবার কালো চামড়ার পোশাক পরে ঘোরাফেরা করছেন। পার্কার ভাবলেন হয়তো এই দৃশ্য দেখে সময় কেটে যাবে। আঃ, অনেকটা সময় বাজে কেটে গেল।
কেভিন পার্কার এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছেন। কোথায় যাবেন বুঝতে পারছেন না। অনেক লোকের কথাবার্তা তার কানে যাচ্ছে। এখন কি ড্যান স্কোয়ারে গিয়ে বসবেন?
কিছু কথাবার্তা তার কানে গেল।
–সে নিজেকে বিশ্বের সেরা সুন্দরী বলে মনে করে।
না, এত বেশি টাকা নিলে আমি দেব কেমন করে?
–আপনি কোষ্টা চাইছেন? ওপরের না নীচের দিকের?
–অবশ্যই ওপরের দিকের। আমি সব সময় আদেশ করতেই ভালোবাসি।
–আচ্ছা আমি দেখছি।
–জিনিসটা ভালো হওয়া চাই। আমার সবকিছু? আপনি দেখছেন তো?
রাত একটা বেজে গেছে, ছেলেটি হেঁটে হেঁটে এগিয়ে এল। সে চারপাশে তাকাল। পার্কারকে দেখতে পেল। পার্কার দেখছে, ছেলেটি সত্যিই সুন্দর।
শুভ সন্ধ্যা।
–আমার দেরী হয়েছে বলে দুঃখিত।
দাঁড়িয়ে থাকতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি।
ছেলেটি সিগারেট ধরাল, কেভিন আগুন ধরিয়ে দিলেন।
–আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম। পার্কার বললেন।
সত্যি সত্যি?
ছেলেটির চোখের তারায় বিস্ময় মেশানো চাউনি।
–তুমি কি ড্রিংক করবে?
–হ্যাঁ, একটু করলে ভালো হত।
–তুমি আর কিছু কি করবে আমার জন্য? যা আমাকে সত্যিকারের সুখী করবে।
ছেলেটি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল- হ্যাঁ, আমি করব।
–গতরাতে তোমার সাথে একজন ছিল, সে তোমার ঠিক বন্ধু নয়।
–আপনি কি আমাকে আনন্দ দিতে পারবেন?
–হ্যাঁ, কেন পারব না। চলো আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
–এটাই ভালো লাগছে।
পার্কারের মনে হল হৃদয়ে যেন উত্তেজনার আগুন।
আমরা একটা সুন্দর জায়গায় যাব। সেখানে আর কেউ থাকবে না।
–ভালো হবে। আমি কি আরেকটু ড্রিংক করব?
তারা সামনের দরজার দিকে এগিয়ে এল। দরজাটা খুলে গেল। দুজন অল্প বয়েসী ছেলে বারে ঢুকে পড়েছে। তারা ওই ছেলেটির সামনে রাস্তা আটকে দাঁড়াল। বলল- তুমি, এখানে। কী করছ? টাকাটা কখন দেবে?
ছেলেটা অবাক হয়ে গেছে। বুঝতে পারছে না কী ঘটেছে। সে বলল আপনারা কী বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি তো আপনাদের কখনও আগে দেখিনি।
একজন চীৎকার করে বলল– আর কথা বলতে হবে না। একজন তার কাঁধে হাত, রেখেছে। তাকে মারতে মারতে রাস্তায় নিয়ে এল।
পার্কার অবাক হয়ে গেছেন। ভীষণ রেগে গেছেন তিনি। এই ব্যাপারে তাকে হস্তক্ষেপ করতেই হবে। কিন্তু এমন ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লে বদনাম ছড়িয়ে পড়বে। তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। দেখলেন, ছেলেটা অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেলেন।
দ্বিতীয় মানুষটি কেভিন পার্কারের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
এবার থেকে আরও ভালোভাবে বন্ধু নির্বাচন করবেন কেমন?
পার্কার ওই লোকটির দিকে তাকালেন। আহা, মাথার চুল সোনালী, কী সুন্দর স্বভাবের। হ্যাঁ, দেহের কোথাও কোনো খুঁত নেই। পার্কারের মনে হল, সন্ধ্যেটা এভাবে নষ্ট করে কী লাভ? তিনি বললেন- তুমিও তো আমার আসল বন্ধু হতে পারো। কি পারো না?
জানি না আমাদের ভাগ্যে কী আছে। আমরা কী জানি?
লোকটি পার্কারের চোখের দিকে তাকাল।
–আমার নাম টম, তোমার নাম কী?
–পল।
–পল, এসো আমরা একসঙ্গে ড্রিংক করি।
অনেক ধন্যবাদ।
–আজ রাতে তুমি কী করবে?
–সেটা আপনার ওপর নির্ভর করছে।
–তুমি কি সারারাত আমার কাছে থাকবে?
ব্যাপারটা ভালোই লাগবে।
কাছে কত টাকা আছে?
দুশোর মতো হবে।
–এতেই হবে। তিরিশ মিনিট কেটে গেছে, পল সামনে এগিয়ে চলেছে। কেভিন পার্কার তাকে অনুসরণ করছেন। তারা জেপারসন সিটির একটা পুরোনো অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর কাছে পৌঁছে গেল। তারা তিনতলায় গেল। একটা ছোটো ঘরে ঢুকে গেল।
পার্কার চারিদিকে তাকিয়ে বললেন- ঠিক আছে, কিন্তু একটা হোটেল হলে কি ভালো হতো না? .
পল বলল- না টম, এখানে নিরাপত্তা অনেক বেশি, আমাদের তো একটা খাট দরকার, আর কিছু নয় তো।
–ঠিকই বলেছ, এখন তুমি শুরু করো। দেখি তোমার নগ্ন রূপ কেমন দেখায়।
পলের কণ্ঠস্বরে কী একটা অদ্ভুত আকুতি। তুমিও, আমি আর থাকতে পারছি না। আমি তোমাকে ভীষণভাবে কাছে চাইছি।
পার্কার তার জামাকাপড় খুলতে শুরু করেছেন।
পল জিজ্ঞাসা করল, তুমি কী পছন্দ করো? মুখ, নাকি অন্য কিছু।
এসো আমরা মিলেমিশে খাই। সারারাত এভাবেই আমরা আনন্দ করব।
–হ্যাঁ, আমি একটু বাথরুমে যাচ্ছি। পল বলল, আমি এক্ষুনি ফিরে আসছি।
পার্কার উলঙ্গ হয়ে বিছানাতে শুয়ে আছেন। ভাবছেন, শুভ মুহূর্তটি সমাগত হবে। তার সঙ্গী বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগিয়ে আসছে।
কেভিন হাত দুটো বাড়িয়ে দিলেন, বললেন- এসো বন্ধু, আমি আর থাকতে পারছি না।
–আমি আসছি।
হঠাৎ বুকে যন্ত্রণা, একটা ছুরি তার বুকের মধ্যে ঢুকে গেছে। চোখ দুটো খোলা, হায় ঈশ্বর এ কী?
পল পোশাক পরে নিচ্ছে।
–ভেবো না, টাকার জন্য ভেবো না। সবকিছু তুমি পেয়ে যাবে!
লাল আলো জ্বলে উঠেছে। গোপনীয়, অত্যন্ত গোপনীয়। অপারেশন ডুমস ডে, ন নম্বর কেভিন পার্কার। ওয়াশিংটন ডিসি। কাজটা হয়ে গেছে।
.
তখন রবার্ট বেলামি চলেছেন হাঙ্গেরীর দিকে। এমন একটি মানুষের সন্ধানে যে একটা কার্নিভালের মালিক। তাই এই নিউজ বুলেটিনটা তার চোখে পড়েনি।
.
৩৪.
চোদ্দ নম্বর দিন, বুদাপেস্ট।
প্যারিস থেকে বুদাপেস্ট, মালের এয়ার লাইনস। দু ঘণ্টা পাঁচ মিনিট। রবার্ট জানতেন না কিছুই হাঙ্গেরী সম্পর্কে। শুধু জানতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাঙ্গেরী অক্ষশক্তির অন্যতম ছিল। পরে রাশিয়ার অধীনে এক করদ রাজ্যে পরিণত হয়। রবার্ট এয়ারপোর্ট থেকে বাস নিয়ে বুদাপেস্ট শহরের কেন্দ্রে পৌঁছে গেলেন। বুদাপেস্ট দৃশ্যাবলী তাকে মুগ্ধ এবং মোহিত করেছে। পুরোনো শহরের মধ্যে আধুনিকতার স্পর্শ। পার্লামেন্ট হাউসটা দেখতে ভারী সুন্দর। নিও গ্রথিক স্থাপত্য শৈলীর অসাধারণ নিদর্শন। ক্যাসেল হিলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে রয়াল প্যালেস। রাস্তায় অসংখ্য মানুষের ভিড়। অটোমোবাইল আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে।
হোটেল লুনা ইন্টার কন্টিনেন্টাল, রবার্ট লবিতে হেঁটে গেলেন।
–আমাকে ক্ষমা করবেন। রবার্ট বললেন, আপনারা কি ইংরাজি বলতে পারেন?
কিছু কিছু পারি। বলুন আমি কি করব?
-কদিন আগে আমার এক বন্ধু বুদাপেস্টে এসেছেন, তিনি একটা সাংঘাতিক ভালো কার্নিভাল রেখেছেন। আমি এই শহরে কিছু দিন থাকব, কার্নিভালটা দেখতে পাব কি? কোথায় গেলে পাওয়া যাবে বলতে পারবেন কি?
ভদ্রলোক অবাক কার্নিভাল? তিনি কয়েকটা কাগজের দিকে তাকালেন। দেখা যাচ্ছে, বুদাপেস্টে এখন তো একটা অপেরা আছে, কয়েকটা থিয়েটার, ব্যালে সারা দিন ধরে শহরটা দেখতে পারেন। এই দেশের অন্য জায়গায় আসতে পারেন। কিন্তু কোনো কার্নিভাল তো নেই।
–আপনি কি ঠিক বলছেন?
ভদ্রলোক কাগজগুলো রবার্টের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন- আপনি নিজের চোখে দেখুন। এটা হাঙ্গেরী ভাষায় লেখা আছে।
রবার্ট বললেন- ঠিক আছে, আর কি কেউ এই বিষয়ে কথা বলতে পারবেন?
-আপনি একবার সংস্কৃতি মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
তিরিশ মিনিট কেটে গেছে, রবার্ট তখন সংস্কৃতি মন্ত্রকের এক করণিকের সাথে কথা বলছেন।
না, এখানে কোনো কার্নিভাল নেই। সত্যি আপনার বন্ধু হাঙ্গেরীতে কার্নিভাল রেখেছেন?
-হ্যাঁ।
–কিন্তু কোথায় উনি তা বলেছেন। না আমি দুঃখিত, আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব না। ভদ্রলোক অধৈর্য, আর কিছু বলার আছে?
না, রবার্ট দাঁড়ালেন, ধন্যবাদ, আরেকটা প্রশ্ন। আমি কার্নিভাল কি হাঙ্গেরিতে সার্কাস কিংবা আনতে পারি? অনুমতি পাবো কি?
-হ্যাঁ।
–কোথায় যোগাযোগ করতে হবে?
বুদাপেস্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিসে, লাইসেন্স বিভাগে।
.
লাইসেন্স বিভাগটা বুধাতে অবস্থিত। সেই প্রাচীন শহরের কাছে। রবার্ট তিরিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি অফিসে গেলেন।
কীভাবে আপনাকে সাহায্য করব?
রবার্টের মুখে হাসি আমি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। আমি আমার ছোটো ছেলের সঙ্গে এখানে এসেছি। সে শুনেছে হাঙ্গেরীতে নাকি কার্নিভাল উৎসব খুব জনপ্রিয়। আমি তাকে কার্নিভাল দেখাব বলেছিলাম। বলতে পারেন কোথায় গেলে কার্নিভালের সন্ধান পাব?
ভদ্রলোক রবার্টের দিকে তাকালেন– কী দেখতে চাইছেন?
-সত্যি কথা বলতে কী, কোথায় কার্নিভাল দেখা যায় এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। হাঙ্গেরী এত বড় সুন্দর একটা শহর। কেউ কি জানে কোথায় কার্নিভালের সন্ধান : পাওয়া যাবে?
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন- না, এখানে এ ধরনের কিছু করতে দেওয়া হয় না। তিনি একটা বোতাম টিপলেন। সেক্রেটারী প্রবেশ করলেন। হাঙ্গেরীয় ভাষায় তাঁরা কিছু কথা বললেন। সেক্রেটারী চলে গেলেন। দু মিনিট বাদে তিনি কিছু কাগজ নিয়ে এলেন। ভদ্রলোক রবার্টের দিকে তাকালেন। বললেন- তিন মাসে আমরা মাত্র দুটো পারমিট দিয়েছি। একটা দিয়েছি একমাস আগে, কিন্তু সেটা তো বন্ধ হয়ে গেছে।
আরেকটা?
আরেকটা সফ্রনে আছে। জার্মান সীমান্তের কাছে একটা ছোটো শহরে।
আপনারা কি মালিকের নাম জানেন?
ওই ভদ্রলোক বললেন- হ্যাঁ, উনি হলেন লাসলো।
.
লাসলো তার জীবনের সেরা সময়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। এত বেশি টাকা হাতে এসেছে তিনি ভাবতেই পারছেন না। কীভাবে খরচ করবেন সেটাই হচ্ছে সমস্যা। তিনি একজন লম্বা চওড়া মানুষ। ছ-ফুট চার ইঞ্চি, তিনশো পাউন্ড ওজন, হাতে হীরে, বাঁধানো একটি ঘড়ি, আঙুলে আছে হীরের আংটি। সোনার ব্রেসলেট পরেছেন। বাবার একটা ছোেট্ট কার্নিভাল ছিল। বাবা যখন মারা যান, তখন থেকেই এর দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। কার্নিভালকে কেন্দ্র করে তার জীবনের সবকিছু আবর্তিত হচ্ছে।
লাসলোর ভারী সুন্দর স্বপ্ন আছে। তিনি তার ছোট্ট কার্নিভালটিকে আরও বড়ো করতে চান। একদিন তা সমস্ত ইউরোপের সেরা কার্নিভালে পরিণত হবে। এই মুহূর্তে তিনি বেশি কিছু দেখাতে পারছেন না। এখানে এক লেডি আছে, আছে গায়ে অসংখ্য উল্কি আঁকা একটি মানুষ। শ্যামদেশ থেকে দুই যমজ কন্যাকে নিয়ে আসা হয়েছে। হাজার বছরের পুরোনো একটা মমিও আছে। সেটা নাকি ইজিপ্ট থেকে তুলে আনা। আরও কত কী আছে, এক ভদ্রলোক তলোয়ার গিলে ফেলতে পারে। মুখের ভেতর আগুন জ্বালাতে পারে। সাপের নাচন, কিন্তু এখানেই তিনি থামতে চান না।
সারারাত ধরে তিনি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। স্বপ্নকে সত্যি করতে চান।
তিনি সুইজারল্যান্ডে গেছেন, সেখানকার শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলতে। এরই পাশাপাশি কিছু জায়গা ঘুরে দেখেছেন। সুইজারল্যান্ড থেকে কিছু শিল্পীকে এখানে আনতেই হবে। তাহলে কার্নিভালটা জমে উঠবে।
আহা, লাসলো ভাবলেন, আবার কবে আমি বাইরে যাব। নতুন নতুন জগত দেখব।
অন্যান্য সহযাত্রীদের মতো তিনিও ওই বিস্ফোরণটা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ভাবতে পারেননি যে এমন একটা মহাকাশযান এভাবে আঘাত করতে পারে। শুনেছেন উড়ন্ত চাকি বলে কিছু আছে। কিন্তু তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেননি। শেষ অব্দি বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন।
তারপর? এখানে ফিরে আসার পর মাঝে মধ্যেই ভয়ংকর দৃশ্যটা তার মনকে আলোড়িত করে।
সুইজারল্যান্ডে যাবার আরও একটি কারণ ছিল। তিনি শুনেছিলেন একজন বিখ্যাত আর্টিস্ট নাকি সেখানে বন্দী জীবন যাপন করছেন। তাকে একবার যোগাড় করতে পারলে কেমন হয়?
ব্যাপারটা সম্ভব হবে কি?
লাসলো এভাবেই ভাবতে ভালোবাসেন।
সহযাত্রীদের কথা মনে পড়ছে। যারা ওই মারাত্মক বিস্ফোরণটা দেখেছিলেন। ছবি তোলা হয়েছিল। আঃ, দুটো সাংঘাতিক শরীর, জীবিত কী মৃত বুঝতে পারা যাচ্ছে না। লাসলো এখনও চোখ বন্ধ করে দেখতে পান। তখনই রুমালটার প্রয়োজন পড়ে। ঘাম মুছতে হয়। কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না।
.
বাড়িতে ফিরে এলেন, হাত থরথর করে কাঁপছে। কেন? পুরোনো কোনো কথা?
যখন কার্নিভালটা আরও বড় হবে, তিনি সারা পৃথিবী ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। বিজ্ঞানীদের জন্য আলাদা একটা শোয়ের ব্যবস্থা করবেন। সেখানে রাজনীতির বিখ্যাত মানুষজনও উপস্থিত হবেন। তাদের সকলের কাছ থেকে পয়সা নিতে হবে। হ্যাঁ, পয়সার পাহাড়ে আমাকে উঠতেই হবে, আসলো ভাবলেন।
এমনকি তিনি সৌভাগ্যের এই কথাটা তার প্রিয়তমা মারিটার কাছেও বলেননি। যৌনবতী ওই নর্তকী, অনায়াসে যে সাপিনীর সাথে খেলা করতে পারে। যদিও বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু দর্শকরা তা বুঝতে পারে না। কারণ লাসলো আরও একটা গোখরোকে রেখেছেন। অবিকৃতভাবে, যখন খেলা দেখানো হয়, তখন ওই সত্যিকারের গোখয়রাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যেই সে ইঁদুরকে মেরে ফেলে। লোকেরা সভয়ে আর্তনাদ করতে থাকে। মারিটা যখন মঞ্চে আসে, সঙ্গে থাকে তার পোষা নির্বিষ সাপ। তার অর্ধ উলঙ্গ দেহ, ভাবতে ভালো লাগে। সপ্তাহে দুবার অথবা তিনবার মারিটা আসলোর টেন্টে আসে। লাসলের সাথে অসভ্য খেলা খেলে। আহা, এই মেয়েটি সব ব্যাপারে এত পারদর্শিনী হল কী করে? একে একটা পোষা জন্তুর মতো মনে হয়।
গতকালই তারা ভালোবাসা বিনিময় করেছিল। লাসলো একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। মারিটার শরীরের মধ্যে অদ্ভুত সহনশীলতা আছে। আছে এমন এক অদম্য আকর্ষণ যা কখনও অগ্রাহ্য করা যায় না।
স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে গেল। রোমন্থনের সমুদ্রে আলোড়ন। এক অজ্ঞাত আততায়ী বুঝি জেগে উঠেছে।
–আপনি লাসলো?
–হ্যাঁ। আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?
-আপনি তো গত সপ্তাহে সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলেন, তাই না? সেখানে আপনার কী অভিজ্ঞতা হল সংক্ষেপে বলবেন কি?
কী বিষয়ে জানতে চাইছেন?
–আপনি তো বাসে করে নানা জায়গায় গিয়েছিলেন। রোববার। তাই না?
লাসলো বললেন- হ্যাঁ।
রবার্ট বেলামির মনে আনন্দ। শেষ পর্যন্ত খেলাটার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছি আমি। এটাই হল শেষতম সাক্ষী। একে একে সব সাক্ষীকে ধরতে আমি সফল হয়েছি। একটা অসম্ভব অভিযানকে সম্ভব করেছি। আঃ, বাকি জীবনটা শুয়ে শুয়ে কাটাব।
–আমার ওই ভ্রমণ পরিকল্পনা সম্পর্কে আপনি এত আগ্রহী কেন?
বেলামি বললেন- ব্যাপারটা খুব উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটা আমার কাছে আগ্রহজনক হতে পারে। আমি ভাবছি আপনার কাছ থেকে সব খবর সংগ্রহ করব।
লাসলো বললেন- কেন? খবর জেনে কী হবে? কারা কারা আমার সঙ্গে ছিলেন তাই তো? এক ইতালীয় ধর্মযাজক ছিলেন, তিনি অরভিয়েটে থেকে এসেছেন। জার্মান দেশের এক অধ্যাপক ছিলেন। তিনি এসেছেন মিউনিখ থেকে। এক রুশদেশীয় যুবতী ছিলেন, তিনি কিয়েভের একটি লাইব্রেরীতে কাজ করেন। টেকসাসের ওয়াকে থেকে এক ব্যবসায়ী এসেছিলেন। এক কানাডীয় ব্যাংকার। পার্কার নামে এক ভদ্রলোক এসে ছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
.
হায় ঈশ্বর, যদি এই ভদ্রলোককে প্রথম পেতাম তাহলে সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যেত। এ তো দেখছি খবরের খনি। তিনি বললেন আপনার স্মৃতি তো খুব পরিষ্কার।
লাসলো হাসলেন- হ্যাঁ, আরেকজন ভদ্রমহিলা এসেছিল।
–ওই রাশিয়ান মেয়েটি?
না-না, আরেকজন ভদ্রমহিলা, সম্পূর্ণ সাদা পোশাক পরা। লম্বা, চেহারাটা পাতলা। রবার্টের বুকের কাঁপন আরও বেড়ে গেছে। কেউ এতক্ষণ পর্যন্ত এই ভদ্রমহিলার কথা বলেননি কেন?
উনি বললেন- আপনি বোধহয় ভুল করছেন।
না, আমি ভুল করছি না, সব মিলিয়ে আমাদের সঙ্গে দুজন মহিলা ছিলেন।
রবার্টের মনে উত্তেজনা। উনি বললেন- কেউ তো ওনাকে দেখেননি?
-যখন ফটোগ্রাফাররা ছবি তুলছিলেন, তখন তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আহা, অসামান্য রূপবতী। সবথেকে মজার কথা হল, উনি বোধহয় আড়ালে থাকতেই ভালোবাসেন। ওনার শরীরটা রক্তশূন্য, মনে হচ্ছে, উনি যেন কারোর জন্য চিন্তিত ছিলেন।
রবার্টের মনে উৎকণ্ঠা– বাসে ফিরে আসার পর তিনি আপনার পাশেই বসেছিলেন?
না, তারপর তো আমি ওনাকে দেখতে পাইনি। আসলে তখন আমি ওই উড়ন্ত চাকিটা দেখে এত উত্তেজিত ছিলাম যে চারপাশে কী হচ্ছে বুঝতে পারিনি।
–আপনাকে ধন্যবাদ।
.
সে রাতে রবার্ট বেলামি তার শেষ রিপোর্টটা জেনারেল হিলিয়াডের কাছে তুলে দিলেন। নাম পাওয়া গেছে, লাসলো, তিনি সফরনে একটা কার্নিভালের মালিক।
–এটাই হল শেষতম সাক্ষী?
রবার্ট এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন, সাদা পোশাক পরা মেয়েটির কথা বলবেন কিনা ভাবলেন। তারপর বললেন- হ্যাঁ, স্যার, আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে।
দশ নম্বর যাত্রীকে সনাক্ত করা সম্ভব হল। তারপর? অনন্ত ছুটি আর কী?
অনেক ধন্যবাদ কমান্ডার, আপনি অসাধ্যকে সাধ্যাতীত করেছেন।
আলো জ্বলে উঠল, লাল আলো, গোপন খবর। অপারেশন ডুস ডে, দশ নম্বর লাসলো, সফরন, খবরটা শেষ হয়ে গেল।
.
মধ্যরাত, কার্নিভাল বন্ধ হয়ে গেছে। পনেরো মিনিট বাদে তারা এসেছে। অত্যন্ত নীরবতার মধ্যে। লাসলো স্বপ্ন দেখছেন। তিনি একটা বিরাট সাদা টেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে। আছেন। হাজার হাজার মানুষ আনন্দে হাত তুলছে, টিকিট কিনতে হবে। এইভাবে স্বপ্নটা সফল হবে, হ্যাঁ, দেখলাম, অন্য রো থেকে দুটো অজানা অচেনা প্রাণী নেমে এসেছে। তাদের চোখে জিঘাংসা। এমন দৃশ্য সারা জীবন আর কখনও দেখতে পাব না।
মারিটার সঙ্গে যখন তিনি শয্যায় শুয়ে থাকেন, দুজনেই সম্পূর্ণ ল্যাংটো, মনে হয়, আহা, ওই দুটো বৃন্ত আমার বুকের সাথে চেপে বসে আছে। ওর জিভ আমার শরীরের সবখানে স্বর্গের কারুকাজ আঁকছে। মেয়েটি হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছে আমার দেহের ওপর। আমার দুষ্টু খোকাটা উত্থিত হচ্ছে। আমি ওর কাছে এগিয়ে যাচ্ছি। ঠাণ্ডা কোনো কিছু একটা আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। আমি চোখ খুলছি। আমি চীৎকার করছি। এ কী? বিষাক্ত গোখরো সাপ আমাকে আক্রমণ করছে কেন?
সকালবেলা শরীরটা পাওয়া গেল, আর দেখা গেল, যে খাঁচার মধ্যে বিষাক্ত গোখরো সাপকে রাখা হয়েছিল, সেই খাঁচাটা ফাঁকা, সাপটার চিহ্ন কোথাও নেই।
লাল আলা জ্বলে উঠল, গোপনীয়, বিষয় অপারেশন ডুমসডে, দশ নম্বর লাসলো, কাজটা শেষ হয়ে গেছে।
.
জেনারেল হিলিয়াড় তার ফোনে একটা কল পেলেন, জেনাস, আমি শেষতম রিপোর্টটা কমান্ডার বেলামির কাছ থেকে পেয়েছি। শেষ সাক্ষ্যকেও পাওয়া গেছে। তার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
–আমি সকলকে খরব দিচ্ছি। এবার কাজটা শেষ করতে হবে। অবশ্যই। এখন একটুও সময় নষ্ট করা যাবে না।
.
৩৫.
পনেরো নম্বর দিন
রবার্ট বেলামি অবাক হয়ে গেছেন। এগারো নম্বর প্রত্যক্ষদর্শী সত্যি আছে কি? যদি বা থেকেও থাকে কেউ কেন তার কথা আগে বলেনি।
যে ক্লার্ক বাসের টিকিট বিক্রি করছিল, সে বলেছিল, মাত্র সাতজন যাত্রী ছিল। রবার্ট একথা বিশ্বাস করে, হাঙ্গেরীয় কার্নিভাল মালিকের কোনো ভুল হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা খুব খারাপ লাগছে। রবার্ট ভাবল, হানস বেকারম্যান, বাস ড্রাইভার নিশ্চয়ই ব্যাপারটা জানে।
সানসাইন ট্যুরিস্ট বাস কোম্পানিকে তিনি একটা ফোন করলেন। অফিসটা বন্ধ। এক মুহূর্তের জন্য রবার্ট ভাবলেন, আমি কি আবার সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাব? এই ব্যাপারটার শেষ না দেখা অব্দি তিনি ছটফট করতে থাকবেন।
.
মধ্যরাত, রবার্ট জুরিখে এসে পৌঁছেছেন। বাতাস ঠাণ্ডা। পূর্ণিমার তিথি। রবার্ট একটা গাড়ি ভাড়া করলেন। কাপ্পেল গ্রামের দিকে এগিয়ে গেলেন। চার্চের পাশ দিয়ে গাড়ি ছুটে গেল। এই তো হানস বেকারম্যানের বাড়ি। না, এভাবে খোঁজাখুঁজি করে কোনো লাভ নেই। রবার্ট দরজায় শব্দ করলেন এবং অপেক্ষা করতে থাকলেন।
শীতের কনকনে বাতাস সব কিছু কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
শ্ৰীমতী বেকারম্যান শেষ পর্যন্ত জবাব দিলেন।
মিসেস বেকারম্যান, আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি আপনার কাছে এসেছিলাম। হানস সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লেখার জন্য। আমি কি আপনার স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে পারি?
নীরবতা ভেঙে গেল। একটা শব্দ ভেসে এল হানস মারা গেছে।
কী বলছেন?
–আমার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। তার গাড়িটা পাহাড়ের ধারে চলে গিয়েছিল। কণ্ঠস্বরে তিক্ততা। পুলিশ বলছে, সে নাকি প্রচুর মদ খেয়েছিল।
না-না, আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না।
হানসের কথা মনে পড়ে গেল। হানসের পেটে আলসার ছিল। ডাক্তাররা তাকে কোনো কিছু খেতে বারণ করেছিল।
পুলিশ বলছে, এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট?
–হ্যাঁ।
তারা কি শব ব্যবচ্ছেদ করেছিল?
–হ্যাঁ, তারা পেটের ভেতর ড্রাগস পেয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না।
–আমি অত্যন্ত দুঃখিত, শ্রীমতী বেকারম্যান।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। রবার্ট দাঁড়িয়ে থাকলেন। শীতের রাতে একা।
তার মানে? একজন প্রত্যক্ষদশী চলে গেল। না-না, দুজন, লেসলি মাদারশেডেরও মৃত্যু হয়েছে দুর্ঘটনায়।
রবার্ট সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। দুজনের মৃত্যু হল! তাহলে? ব্যাপারটা কোন্ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?
সমস্যা? কেন? রবার্টের মনে নানা ভাবনার উতরোল। এটা কি নেহাত কাকতালীয় ব্যাপার? দেখা যাক, অন্য দিকে কী ঘটনা ঘটছে।
.
প্রথম ফোন করলেন ফোরথ স্ট্রিটে, কানাডাতে।
এক মহিলার কণ্ঠস্বর।
-কে বলছেন?
–উইলিয়াম মান আছেন?
–না, আমার স্বামী আমাদের মধ্যে আর নেই।
–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
–উনি আত্মহত্যা করেছেন।
–সে কী? ওই ভদ্রলোক আত্মহত্যা করেছেন? কী হচ্ছে?
তিনি একটির পর একটি ফোন করতে থাকলেন।
-প্রফেসার স্মিডটকে একবার দেবেন?
–প্রফেসার মারা গেছেন। ল্যাবোরেটারিতে বিস্ফোরণ হয়েছিল।
.
-আমি কি ড্যান ওয়েনের সাথে কথা বলতে পারি?
–আঃ, তার পোষা ঘোড়াটা খেপে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ঘোড়র আঘাতে তার মৃত্যু হয়।
.
লাসলো আছেন?
কাংভিনাল বন্ধ হয়ে গেছে। আসলে মারা গেছে।
.
–ফিজস ম্যানডেল আছেন?
–ফিজসের মৃত্যু হয়েছে একটা অ্যাকসিডেন্টে।
সংকেত চিহ্ন বাজছে জোরে জোরে।
.
–ওলগা আছেন কি?
আহা, অল্প বয়সেই চলে গেল বেচারী।
.
-কেভিন পারকারের সঙ্গে কথা বলা যাবে?
–কেভিনকে হত্যা করা হয়েছে।
.
মৃত, প্রত্যক্ষদর্শীরা সবাই মৃত। তা হলে? আমি একমাত্র বেঁচে আছি। হঠাৎ একটা শীতল শিহরণ, কে এইসব খুনের অন্তরালে? রবার্টের মনে পড়ল, তিনি একমাত্র জেনারেল হিলিয়াডের কাছে এইসব খবর পাঠিয়ে ছিলেন। অর্থাৎ এই জঘন্য হত্যাকান্ডের পেছনে একটা চক্র কাজ করছে। কে হতে পারে?
আমাকে ভাড়া করা হয়েছিল প্রত্যক্ষদর্শীদের খুঁজে বের করার জন্য। কিন্তু? অটোর মৃত্যু হয়েছে জার্মানিতে, হানস এবং ফিজ মারা গেছেন সুইজারল্যান্ডে। ওলগা রাশিয়াতে। ড্যান ওয়েনে এবং কেভিন পারকার আমেরিকাতে। উইলিয়াম মান কানাডাতে। লেসলি ইংল্যান্ডে। ফাদার প্যাটরিনি ইতালিতে। লাসলো হাঙ্গেরীতে। তার মানে ছটার বেশি দেশ এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। আলোচনা হচ্ছে, যে উড়ন চাকি দেখবে, তার মৃত্য অনিবার্য। কিন্তু কেন?
এটা একটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছাতে রবার্ট তার অংশীদার হয়ে গেছেন।
.
রবার্ট এখন ভাবছেন, এবার আমার মৃত্যুর পালা। হ্যাঁ, আমার হাতে সমস্ত তথ্য প্রমাণ আছে। আমি এখন আর কোনো সুযোগ নেব না। কোথায় যাওয়া যায়। একটা পাশপোর্ট জোগাড় করতে হবে।
রবার্ট পরবর্তী প্লেনটা ধরলেন। পালাতে হবে, এক্ষুনি পালাতে হবে। গত পনেরো দিন ধরে তার ওপর ভীষণ চাপ গেছে।
তিনি ভিঞ্চচি এয়ারপোর্টে নামলেন। লিওনার্দোর নামে নামাঙ্কিত। টারমিনালের দিকে হেঁটে গেলেন। সুশান, আহা! এ কী?
সুশান?
সুসানের চোখে বিস্ময়- রবার্ট? কী আশ্বর্য সমাপতন বলেতো?
–আমি ভেবেছিলাম, তোমরা জিব্রাল্টার চলে গেছে।
-হ্যাঁ, আমরা সেখানেই ছিলাম, মন্টের কিছু ব্যবসা আছে এখানে। আমরা আজই চলে যাব। তুমি রোমে কী করছ?
–আমি একটা কাজ শেষ করছি।
রবার্ট মনে মনে ভাবলেন, এটাই আমার শেষ কাজ। আমি ছেড়ে দেব ডার্লিং, আর কোনো কিছুই আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ আনতে পারবে না। মন্টেকে ছেড়ে দাও, আমার কাছে ফিরে এসো।
মনের এই ভাবনাগুলো কথায় বলতে পারলেন না। সুশানকে দেখে মনে হচ্ছে, নতুন জীবনে সে পরিতৃপ্ত।
আমাকে এখন একাই থাকতে হবে।
-তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে?
–হা, কদিন ধরে খুব পরিশ্রম হয়েছে।
তারা পরস্পরকে দেখলেন। হ্যাঁ, আকর্ষণ এখনও আছে। সেই অগ্নি উত্তেজনা, সেই হাসির উতরোল, কাছে আসার তীব্রতম আকাঙ্খ।
সুশান হাতে হাত রাখলেন রবার্ট! রবার্ট!
সুশান!
সেই সময় এক ভদ্রলোক সামনে এসে দাঁড়ালেন। ড্রাইভারের পোশাক পরা। সে বলল মিসেস বাঙ্কস, গাড়ি তৈরি আছে।
আহা, স্বপ্নটা ভেঙে গেল।
রবার্টের দিকে তাকিয়ে সুশান বললেন- আমি দুঃখিত, আমাকে এখন চলে যেতে হবে। শরীরের যত্ন নিও কেমন?
রবার্ট বললেন- হ্যাঁ, তুমি চিন্তা করো না।
জীবন কোথায় চলে গেছে, সবকিছু হারিয়ে গেছে। সমাপতন, শুধুই সমাপতন।
ট্যাক্সি নিয়ে রবার্ট চলেছেন হ্যাঁসলার হোটেলের দিকে।
.
কমান্ডার ফিরে এলেন?
হা, রাত দশটা বেজেছে। এবার রবার্ট ওপরে যাবেন। ঘুমোতে হবে। কিন্তু পাশপোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে।
রবার্ট বললেন আমি এখন আমার ঘরে যাব না। ব্যাগগুলো ওপরে পাঠিয়ে দেবেন?
রবার্ট বেরোতে যাচ্ছেন, এলিভেটর খুলে গেল, হৈ-হৈ করতে করতে কিছু মানুষ বেরিয়ে এসেছে। একজন রবার্টের দিকে হাত তুলে তাকাল।
রবার্ট লবি দিয়ে হেঁটে গেলেন। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে। ট্যাক্সিতে উঠতে যাবেন, দেখলেন একটা ধূসর রঙের ওভাল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কেন? গাড়িটাকে দেখে তাঁর সন্দেহ হল।
রবার্ট ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললেন- মনটিগ্রাঙ্গায় যেতে হবে।
কাঁচ দিয়ে তাকিয়ে থাকলেন, সে কি? ওভাল গাড়িটা কোথায় গেল?
রবার্ট ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেলেন। আবার ওই গাড়িটাকে দেখা গেল। তার মানে? কেউঁকি আমাকে অনুসরণ করছে? ধীরে ধীরে তিনি গাড়িটার সামনে চলে গেলেন। দেখতে পেলেন, গাড়িটা আরও কাছে এগিয়ে আসছে। হ্যাঁ, এবার তিনি নিশ্চিত, গাড়িটা তাকেই অনুসরণ করছে!
গাড়িটা পুরোনো, অনাকর্ষক। রবার্ট এখানে অনেক বার এসেছেন। বিভিন্ন কাজে। তিনি বেসমেন্টে চলে গেলেন। দরজায় শব্দ করলেন।
রবাট? একজন চিৎকার করলেন। তুমি কেমন আছো?
বছর ষাট বয়স, সাদা চুল, ভুরু দুটো মোটা, দাঁতে হলুদ ছোপ। দরজা বন্ধ করলেন।
-আমি ভালো আছি রিক্কো।
রিক্কোর কোনো আলাদা নাম নেই। তিনি বললেন- বন্ধু, আমি তোমার জন্য কী করব?
-আমাকে একটা পাশপোর্ট করে দেবে?
খুব তাড়াতাড়ি চাই?
তিনি এগিয়ে গেলেন, বললেন কোন দেশ থেকে আসতে চাইছ? বেশ কয়েকটা পাশপোর্ট রয়েছে তার হেপাজতে। তিনি বললেন- গ্রিস, তুরস্ক, যুগোশ্লোভিয়া নাকি ইংল্যান্ড?
আমেরিকা হবে?
রিক্কো নীল খামের ভেতর পাশপোর্ট পুরে দিলেন- হ্যাঁ, আর্থার বাটারফিল্ড, নামটা কেমন হয়েছে। আমি তোমার ছবি নেব।
রবার্ট দেওয়ালের ধারে চলে গেলেন। রিক্কো একটা ড্রয়ার খুললেন। বোলারের ক্যামেরা বের করলেন। এক মিনিট কেটে গেছে। ছবিটা হয়ে গেছে।
রবার্ট প্রশ্ন করলেন– আমি কি হাসছি?
না, আমার মুখে হাসি নেই কেন?
রিক্কো তাকিয়ে বললেন- আর কিছু বলবে?
আবার মুখে হাসি ছবিটা নেওয়া হল।
রিক্কো বললেন- এখন কাজটা খুবই ঝামেলার হয়েছে।
এবার ল্যামিনেশন করতে হবে। রবার্ট একটা টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলেন। সব ব্যবস্থা এখানে রয়েছে।
রিক্কো বললেন- বাঃ, সুন্দর হয়েছে। রবার্টের হাতে পাশপোর্টটা তুলে দিলেন। পাঁচ হাজার ডলার।
-হ্যাঁ, এটার দাম তুমি ঠিকই ধরেছ।
-তোমার মতো লোকের সাথে ব্যবসা করতে খুবই ভালো লাগে। রবার্ট মনে মনে আনন্দিত। হা, রিক্কোর হাতের কাজ দেখার মতো। জনা ছয়েক সরকারী নথিপত্র তুলে নিতে পারে। কারও প্রতি তার আনুগত্য নেই। রবার্ট পাশপোর্টটা পকেটে রাখলেন।
রিক্কো হাসলেন মি. বাটারফিল্ড, ধন্যবাদ।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। রিকো এবার টেলিফোন বুথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। কাউকে একটা খবর দিতে হবে। এই খবরটা দিয়েও তিনি অনেক টাকা পাবেন।
কুড়ি গজ দূরে রবার্ট দাঁড়িয়ে আছেন। নতুন পাশপোর্টটা পকেট থেকে বের করলেন। আঃ, এবার আমি অন্য মানুষ হয়ে গেছি। আর্থার বাটারফিল্ড।
ধূসর রঙের ওভাল গাড়িটা কয়েকটা ব্লক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও অপেক্ষা করছে।
রবার্টের মনে দৃঢ় ধারণা। এই গাড়িটা তাকেই অনুসরণ করছে। কিন্তু এখন? এখন কি গাড়িটা আর আসছে? কী করা যায়? রবার্ট কি আর হোটেলে ফিরে যাবেন?
না, কিছু বুঝতে পারছি না। গাড়িটাকে আর চোখের সামনে দেখা গেল না।
রাস্তায় অনেকগুলো ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। রবার্ট লাইসেন্স প্লেটগুলো দেখলেন। একটা ফরাসি নম্বর দেওয়া কার্ডটা পাওয়া গেল। হ্যাঁ, আমাকে কেউ দেখছে না। তিনি ট্যাক্সি ডাকলেন। লবিতে পৌঁছে গেলেন। বললেন- আজ রাতে প্যারিস যাওয়ার কোনো প্লেন আছে কি?
-হ্যাঁ, কমান্ডার, কোন এয়ারলাইন্সে আপনি যেতে চাইছেন?
–যে কোনো একটা হলেই হবে।
–আমি ব্যবস্থা করছি।
রবার্ট হোটেল ক্লার্কের কাছে এগিয়ে গেলেন। আমার চাবি? ৩১৪ নম্বর ঘর। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে আসব।
কমান্ডার বেলামি, ক্লার্ক বললেন, আপনার একটা চিঠি আছে।
রবার্টের শিরদাঁড়াতে শীতল উত্তেজনা। এনভেলাপটা বন্ধ করা। লেখা আছে, কমান্ডার রবার্ট বেলামি। মনে হল, ভেতরে বোধহয় একটা ধাতব পাত্র আছে। তিনি সাবধানে সেটা খুললেন। ইতালিয় রেস্টুরেন্টের বিজ্ঞাপন। আঃ, অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু নামটা ওপরে এল কী করে?
–কে এই চিঠিটা দিয়েছে বলতে পারবে কি?
না, খুব ব্যস্ত থাকি তো।
–এটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। হয়তো এর ভেতর কোনো কিছু নেই।
রবার্ট ওপরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল। তিনি রবার্টের সঙ্গে যেচে বন্ধুত্ব করলেন।
তিনি বললেন, আমি আমেরিকাকে কেন ভালোবাসি বলুন তো? তারা জীবনটাকে ভোগ করতে জানে। আসুন, আমরা একসঙ্গে আনন্দ করে সময় কাটাই।
রবার্ট দরজাটা খুললেন। একদিকে চলে গেলেন। ঘরটা অন্ধকার, আলো জ্বাললেন। ঘরের ভেতর এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। কী আশ্চর্য? হাতে সাইলেনসার, এক্ষুনি একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যাবে।
একজন চিৎকার করল- এখানে কী হচ্ছে? কয়েকজন হৈ-হৈ করতে করতে এগিয়ে এসেছে।
ওই রোগা লোকটা রবার্টের দিকে এগিয়ে এল। সবাই মিলে ওকে ধরার চেষ্টা করছে। রবার্ট দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছেন।
নীচের লবিতে হৈ-হৈ শুরু হয়ে গেছে।
কমান্ডার বেলামি, আমি তো রিজার্ভেশন করে দিয়েছি। এয়ার ফ্রান্সের ফ্লাইট, প্যারিসে যাবে। রাত একটায় ছাড়বে।
রবার্ট বললেন– ধন্যবাদ।
রবার্ট দরজা থেকে বেরিয়ে এলেন। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে।
রবার্ট এসে বললেন– ভায়া মনটিগ্রাপ্পা।
হ্যাঁ, এখন আর উত্তর নেই। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছে। ওরা আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমি কি বাঁচব?
রবার্ট ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললেন, রোমা টারমিনি। হ্যাঁ, সর্বত্র অনুসন্ধান শুরু হয়ে গেছে।
ট্যাক্সি এগিয়ে চলেছে। শেষ পর্যন্ত ড্রাইভার বলল- আমরা এসে গেছি।
এক মুহূর্ত দাঁড়াবেন কি? সবকিছু সাধারণ বলে মনে হচ্ছে। ট্যাক্সি আসছে। লিমুজিন গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। কুলিরা কাজ করতে ব্যস্ত। পুলিশরা নিজেদের কাজ করছেন।
রবার্ট শেষ পর্যন্ত বললেন- আমি আর কোথাও যাব না। না, একটা জায়গায় যাওয়া বাকি আছে। ভেনেটো, ১১০, পৃথিবীর এই অঞ্চলে রবার্টকে একবার যেতেই হবে।
আমেরিকান এমব্যাসি ভায়া ভেনেটোতে অবস্থিত। সামনে লোহার গেট। পাহারাদার জিজ্ঞাসা করল– কী আপনাকে সাহায্য করব, স্যার।
–আমি একটা নতুন পাশপোর্ট পেতে চাইছি। আমারটা হারিয়ে গেছে।
–আপনি কি আমেরিকার বাসিন্দা?
–হ্যাঁ।
–ওইখানে চলে যান স্যার, শেষ দরজা।
–ঠিক আছে।
অনেকে সেই ঘরে বসে কাজ করছেন। অনেকের সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা হচ্ছে। বলা হল, আমি আলবানে যেতে পারি কি? একটা ভিসা দরকার। সেখানে আমার আত্মীয়রা আছেন।
কেউ বলছেন, আমার পাশপোর্ট আজ রাতের মধ্যে রিনিউ করতে হবে। একটা প্লেন ধরতে হবে।
কত রকম কথা। রবার্ট দাঁড়িয়ে থাকলেন। কথাগুলো শুনছেন। পুরোনো চোরাই পাশপোর্ট সহজেই পাওয়া যায়। নতুন পাশপোর্ট জোগাড় করাটাও খুব একটা শক্ত নয়।
–মি. কোয়ান, এই আপনার নতুন পাশপোর্ট। ইস, আপনার এত খারাপ অভিজ্ঞতা হল। রোমে পকেটমারদের থেকে সাবধান থাকবেন।
কোয়ান বলল, এবার আমাকে আরও সাবধান থাকতে হবে।
রবার্ট লক্ষ্য করলেন, কোয়ান পাশপোর্টটা তার জ্যাকেটের পকেটে রেখেছেন। সে যাবার জন্য তৈরি হল। রবার্ট তাকে অনুসরণ করল। একটা মেয়ে মধ্যিখানে এসে দাঁড়িয়েছে। রবার্ট কোয়ানের দিকে এগিয়ে গেলেন। আস্তে করে তাকে ধাক্কা দিলেন। ভদ্রলোক মাটিতে পড়ে গেল, আমি ক্ষমা চাইছি। জ্যাকেটটা ফাঁক হয়েছে।
কোয়ান বলল না, কোনো সমস্যা নেই।
রবার্ট ঘুরে দাঁড়ালেন। বাথরুমে চলে গেলেন। ওই মানুষটির পাশপোর্ট এখন তার পকেটে, হ্যাঁ, আমি এখন একা। বুথে দাঁড়িয়ে আছি। এবার কী করব? প্লেট নিয়ে এসেছি। আঠার বোতল রিক্কোর ঘর থেকে চুরি করে।
তিনি প্লাসটিকটা আস্তে আস্তে খুলে ফেললেন। কোয়ানের ছবিটাও সরিয়ে ফেলা হল। নিজের ছবিটা সেখানে মেরে দেওয়া হল। আঠা লাগিয়ে দিলেন। বাঃ, হাতের কাজটা চমৎকার হয়েছে। এখন আমি হেনরি কোয়ান। পাঁচ মিনিট কেটে গেছে। ভায়া ভেনেটো দাঁড়িয়ে আছে। বললেন, আমি এয়ারপোর্টে যাব।
রাত বারোটা বেজে তিরিশ মিনিট, রবার্ট এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছেন। কোনো কিছু চোখে পড়ছে কি? না, সবই সাধারণভাবে এগিয়ে চলেছে। রবার্ট টারমিনালে ঢুকলেন। অনেক এয়ারলাইন্সের ব্যস্ততা।
এয়ার ফ্রান্সের কাউন্টার দেখা গেল।–শুভ সন্ধ্যা।
-শুভ সন্ধ্যা, আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি, সিনর?
হা, রবার্ট বললেন, আপনি কমান্ডার রবার্ট বেলামিকে একটা ফোন করতে দেবেন কি?
-হ্যাঁ।
মাইক্রোফোন নেওয়া হল। কয়েক ফুট দূরে এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা স্যুটকেসের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এয়ারলাইন্সের এক ভদ্রলোকের সাথে তার কথা কাটাকাটি হচ্ছে।
তিনি বলছেন আমেরিকাতে আমরা বেশি ওজনের জন্য পয়সা দিই না।
–আমি দুঃখিত, ম্যাডাম। আপনাকে বেশি টাকা দিতেই হবে।
রবার্ট কাছে এগিয়ে গেলেন। তিনি অ্যাটেনডেন্টের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন,লাউস্পিকারে গমগম করছে- কমান্ডার রবার্ট বেলামি, এই সাদা টেলিফোনের সামনে চলে আসুন। কমান্ডার রবার্ট বেলামি, সাদা ফোনের সামনে চলে আসুন।
চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে খবরটা। একজন লোক ক্যারিব্যাগ নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
রবার্ট বললেন– কী হয়েছে?
–আমার বউ আমাকে ডাকছে। কিন্তু আমি তো লাগেজ ছাড়তে পারছি না।
রবার্ট ওই ভদ্রমহিলার লাগেজের দিকে তাকালেন। লোকটির হাতে দশ ডলারের বিল দিলেন। বললেন, আপনি কি ওই সাদা টেলিফোনের কাছে গিয়ে একবার দাঁড়াবেন? ওনাকে বলবেন, আমি একঘণ্টা বাদে হোটেলে পৌঁছে যাচ্ছি। তা হলে খুবই ভালো হয়।
ভদ্রলোক দশ ডলার বিল পকেটে নিয়ে বললেন- হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি।
রবার্ট তাকিয়ে থাকলেন। তিনি রিসিভারটা নিয়ে বললেন- হ্যালো?
পরমুহূর্তে চারজন কালো পোশাক পরা মানুষ এসে গেছে। তারা মানুষটির দিকে তাকিয়ে আছে।
একজন বলল– এখনই কাজ শুরু করতে হবে। না, কমান্ডার, এখনই।
কমান্ডার! আপনারা ভুল লোককে পেয়েছেন। আমার নাম মেলভিন ডাভিচ। আমি ওমহা থেকে আসছি।
–অনেক খেলা হয়েছে। আর নয়।
এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন। যে মানুষটিকে আপনারা চাইছেন, সে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে।
না, রবার্টকে আর দেখতে পাওয়া গেল না।
টারমিনালের বাইরে এয়ারপোর্ট বাস রেডি হচ্ছে। রবার্ট সেই বাসে উঠে পড়লেন। অন্য প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। তিনি ব্যাক সিটে বসে আছেন। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছেন।
এখনই তাঁকে অ্যাডমিরাল হুইট্যাকারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কীভাবে এবং কেন এইসব অসহায় মানুষদের হত্যা করা হল? কে এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের অন্তরালে আছেন? জেনারেল হিলিয়াড? ডাসটিন ফরনটন? নাকি ফরনটনের শ্বশুর উইলার্ড স্টোন? মানুষটির মধ্যে একটা রহস্য আছে। নাকি এডওয়ার্ড হ্যাঁন্ডারসন। এন এস-এর ডিরেক্টর? প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত এই ব্যাপারটা পৌঁছে গেছে কি?
এইসব প্রশ্নের উত্তর আমাকে পেতেই হবে।
বাস ইডেন হোটেলে পৌঁছে গেল। রবার্ট নামলেন। আমি এখন এই দেশ থেকে পালাব কি? কাকে আমি ভরসা করব? হা, কর্নেল ফ্রানসেসকো সিজার, ইতালিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের প্রধান। উনি আমাকে সাহায্য করবেন।
.
কর্নেল সিজার অনেকক্ষণ পর্যন্ত কাজ করেন। নানা ব্যাপারে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। কমান্ডার রবার্ট বেলামি তার পূর্ব পরিচিত। এর আগে তিনি রবার্টের সঙ্গে কাজ করেছেন। সিজার শেষ মেসেজটার দিকে তাকালেন। শেষ হয়ে গেছে। সেক্রেটারি বলল, স্যার, কমান্ডার বেলামি আপনার সাথে কথা বলতে চাইছেন।
কর্নেল সিজার বললেন- বেলামি? আচ্ছা আমি কথা বলছি?
রবার্ট?
ফ্রানসেসকো, কী হয়েছে বলুন তো? অনেক খবর পাচ্ছি, আপনি পেয়েছেন কি?
হা, তোমার সাথে দেখা হলে ভালো হত। কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে।
–আমি শুনলাম, আপনি চিনা সরকারের সঙ্গে একটা কাজ করেছেন?
না-না, ব্যাপারটা মিথ্যে।
–কেন বলুন তো?
–অনেক খবর পেয়েছি। রবার্ট, এ নিয়ে ঠাট্টা করো না।
ফ্রানসেসকো, দশজন অসহায় মানুষকে আমি মৃত্যুর মুখে ফেলে দিয়েছি। আমি হলাম এগারো নম্বর।
–তুমি কোথায় আছো?
–আমি রোমে আছি। আমি এই শহর থেকে বেরোতে পারছি না।
–আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করব?
–আমাকে এমন একটা নিরাপদ আস্তানার সন্ধান দিন, যেখানে আমরা সাবধানে কথা বলতে পারব। পালাবার ষড়যন্ত্র করতে হবে। আপনি কি তার ব্যবস্থা করতে পারেন?
–তোমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। খুব সাবধান। আমি তোমাকে ঠিক জায়গা থেকে তুলে নেব।
রবার্টের দীর্ঘশ্বাস, অনেক ধন্যবাদ ফ্রানসেসকো।
তুমি ঠিক কোথায় আছে বলো তো?
হোটেল রুয়েতে।
–আমি এখনই যাচ্ছি। এক ঘণ্টার মধ্যে।
ধন্যবাদ। রবার্ট রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। এক ঘণ্টা? অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
তিরিশ মিনিট কেটে গেছে, দুটো গাড়ি এসে থেমেছে লিভো বারের সামনে। চারজন মানুষ নেমে এসেছে। সকলের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আছে।
কর্নেল সিজার প্রথমে গাড়ি থেকে নামলেন। তাড়াতাড়ি কাজটা করতে হবে। যেন আর কেউ আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।
এবার কাজ শুরু হবে।
রুফটপ থেকে রবার্ট সবকিছু দেখলেন। সিজার এবং তার লোকরা অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, বারে উত্তেজনা।
রবার্ট মুখে একটা বিশ্রী শব্দ উচ্চারণ করলেন।
.
১৬.
ষোলো নম্বর দিন, রোম, ইতালি।
রবার্ট কর্নেল সিজারকে ফোন করলেন রাস্তার বুথ থেকে। বললেন- কী হল? এমন কেন হল?
বন্ধু, আমাকে আদেশ করা হয়েছে। আমি বলতে পারি, তোমার আর বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তুমি সব গোপন খবর জেনে ফেলেছ। পৃথিবীর অন্তত ছটা দেশের সরকার তোমার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
–আপনি কি মনে করেন যে, আমি একজন বিশ্বাসঘাতক?
সিজারের দীর্ঘশ্বাস আমি কী বিশ্বাস করি, তাতে কিছুই আসে যায় না, রবার্ট। এটা কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। আমাকে আদেশ করা হয়েছে।
–আমাকে হত্যা করার জন্য?
-হ্যাঁ, এটা আমাকে করতেই হবে।
অনেক ধন্যবাদ, যদি কখনও আপনার সাহায্য দরকার হয়, আমি আপনাকে ফোন করব।
রবার্ট বুঝতে পারছেন, বিপদটা এবার আকাশ ছুঁয়েছে। তার মানে? এখন কোথায় যাওয়া যায়? কিছুই করা যাচ্ছে না।
রবার্ট পিজার দিকে তাকালেন। এখন প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে। তিনি ভাবলেন, জেনারেল হিলিয়াডের সঙ্গে কথা বললে কেমন হয়? ওই ভদ্রলোককেই তো রবার্ট তার দুঃস্বপ্নের জন্য দায়বদ্ধ করতে পারেন।
রবার্ট দেখলেন দুটো টেলিফোন পাশাপাশি আছে। একটা একেবারে ফাঁকা। জেনারেল হিলিয়াডের ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন করবেন কি? না, তিনি এন এস এর সুইচ বোর্ডে ফোন করলেন।
কিছুক্ষণ বাদে সেক্রেটারির কণ্ঠস্বর শোনা গেল জেনারেল হিলিয়াডের অফিস।
বলুন একটা সমুদ্রপারের কল আছে?
রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন।
পরবর্তী বুথে চলে গেলেন। নাম্বারটা আবার ডায়াল করলেন। আর একজন সেক্রেটারির কণ্ঠস্বর।
–জেনারেল হিলিয়াডের অফিস।
–একটা ওভারসিজ কল আছে।
রিসিভারটা ঝুলিয়ে রাখলেন। তিন নম্বর বুথে গিয়ে ডায়াল করলেন।
আর একজন সেক্রেটারির কণ্ঠস্বর। রবার্ট বললেন- আমি কমান্ডার বেলামি বলছি। জেনারেল হিলিয়াডের সঙ্গে কথা বলব।
এক মুহূর্ত– কমান্ডার, সেক্রেটারি ইন্টারকম বাজিয়ে দিলেন। জেনারেল কমান্ডার বেলামি লাইনে কথা বলছেন।
জেনারেল হিলিয়াড হ্যারিসন কেলারের দিকে তাকালেন। বেলামি কথা বলতে চাইছেন, আমি এক্ষুনি আসছি।
হ্যারিসন কেলার নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টারে ফোন করলেন। এই সেন্টার চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করে।
সিনিয়র অফিসার ফোন ধরেছেন।
–একটা কল এসেছে, কোথা থেকে এসেছে কী করে জানব? ..
দু মিনিটের মধ্যে জানতে পারব।
শুরু করে দিন। জেনারেল হিলিয়াডের অফিসে তিনটে লাইন আছে। আমি ঝুলিয়ে। রাখছি।
জেনারেল হিলিয়াড ফোন নিলেন– কমান্ডার।
-কে বলছেন?
অপারেশন সেন্টার। অ্যাডামস একটা নাম্বার ঢুকিয়ে দিলেন কম্পিউটারের মধ্যে। এবার কাজ করতে শুরু করবে।
কমিউনিকেশন রুম ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
কেলার জিজ্ঞাসা করলেন কী ঘটছে? সব কিছু ঠিক মতো হচ্ছে তো?
নিউজার্সির নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার কাজ করছে। একটুখানি ধরুন।
পর্দাটা একেবারে ফাঁকা। তারপর ওভারসিজ ট্রাঙ্কলাইন ওয়ান দেখা গেল।
–ইওরোপের কোনো একজায়গা থেকে এই কলটা এসেছে। আমরা দেশটাকে এক্ষুনি ধরে ফেলব।
জেনারেল হিলিয়াড বললেন– কমান্ডার বেলামি, আমার মনে হচ্ছে, কোথায় একটা ভুল হয়েছে।
রবার্ট রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন।
জেনারেল হিলিয়াড কেলারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি কি পেয়েছেন?
হ্যারিসন কেলার জানতে চাইলেন কী হয়েছে বলুন তো?
-ওই মানুষটিকে খুঁজে বের করা দরকার।
রবার্ট আর একটা বুথে গেলেন। টেলিফোনটা নিলেন জেনারেল হিলিয়াডের সেক্রেটারি বললেন- কমান্ডার বেলামি দু নম্বর লাইনে ডাকছেন।
দুজন মানুষ পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
কমান্ডার?
–আমি কি একটা কথা বলব?
জেনারেল হিলিয়াড মাউথপিসে হাত রাখলেন। বললেন– তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি বার করতে হবে রবার্ট কোথায় আছেন।
হ্যারিসন কেলার টেলিফোন নিয়ে অ্যাডমাসকে বললেন- আবার ওকে পাওয়া গেছে, দু-নম্বর লাইনে। তাড়াতাড়ি কাজ করতে হবে।
-ঠিক আছে দেখছি।
-জেনারেল, আমার একটা অনুরোধ হল, আপনি পেছনে লাগা বন্ধ করুন। আশা করি বুঝতে পারছেন।
আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না, কোনো সমস্যা থাকলে আসুন আমরা সমাধান করি।
–আমি একাই পারব। না, আমার জীবনে কোনো সমস্যা নেই।
নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার আবার কাজ করতে শুরু করেছে।
অ্যাডামস শেষ পর্যন্ত বললেন- রোম থেকে কলটা এসেছে।
অঞ্চলটা কোথায় বলতে হবে। কেলার বললেন।
–রোমে, রবার্ট তার ঘড়ির দিকে তাকালেন। আপনি আমাকে একটা কাজ দিয়েছিলেন, কাজটা আমি করেছি।
-হ্যাঁ, কমান্ডার, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
লাইনটা কেটে দেওয়া হল।
জেনারেল কেলারের দিকে তাকিয়ে বললেন- উনি আবার রেখে দিয়েছেন।
কেলার জানতে চাইলেন পাওয়া গেল?
এক্ষুনি বের করছি?
রবার্ট তিন নম্বর বুথে গেলেন, ফোন তুললেন। আবার কমান্ডার বেলামির সঙ্গে কথা বলা হল।
-জেনারেল, আপনি অনেক সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছেন। যদি এখনও এই কাজ বন্ধ না করেন, তাহলে আমি গণমাধ্যমের সামনে সব কিছু বলে দেব।
আমি আপনাকে শেষবারের মতো বলছি, একাজ করবেন না। আপনি কি বিশ্বজোড়া সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে চাইছেন? ওই বিদেশী শত্রুরা সত্যি। আমরা তাদের সঙ্গে লড়াই করব কেমন করে? তারা এক্ষুনি আক্রমণ করতে শুরু করবে। এই সংবাদটা প্রকাশিত হলে কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যাবে আপনি বুঝতে পারছেন কি?
না, আমি আপনাকে কোনো সুযোগ দেব না। আমার পেছনে লাগবেন না, কথা দিন। যদি আমার জীবনের ওপর আর একবারের জন্যও আক্রমণ করা হয়, আমি কিন্তু জনসমক্ষে সব কথা বলব।
জেনারেল হিলিয়াড বললেন- ঠিক আছে। আমি আমার ছেলেদের বলে দিচ্ছি, কখন দেখা হবে?
–আগে দেখি ব্যাপারটা কোথায় দাঁড়ায়।
লাইনটা কেটে গেল।
.কেলার বললেন পাওয়া গেছে?
অ্যাডামস বললেন- বন্ধ হয়ে গেছে, সেন্ট্রাল রোমের কোনো অঞ্চল থেকে উনি ফোন করেছিলেন। উনি বারবার নম্বর পরিবর্তন করছেন।
জেনারেল তাকালেন কেলারের দিকে কী খবর?
–জেনারেল, উনি রোমের কোথাও আছেন। কিন্তু ঠিক জায়গাটা ধরতে পারছি না।
–ঠিক আছে, ব্যাপারটা এখন বাদ দিন।
.
রবার্ট আবার ভাবনা চিন্তার জগতে প্রবেশ করছেন। কীভাবে এখান থেকে উনি চলে যাবেন? বুঝতে পারা যাচ্ছে না। একটা ট্যাক্সি কর্নারে এসে দাঁড়িয়েছে। রবার্ট ট্যাক্সিকে ডাকলেন মুখে শব্দ করে। ড্রাইভার অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
রবার্ট ড্রাইভারের হাতে কুড়ি ডলারের নোট তুলে দিলেন। বললেন, বন্ধু, আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে?
ড্রাইভারের চোখ ছোটো।
একটা ভালো মাল চাই কিন্তু?
–হ্যাঁ, ভালো মেয়েছেলে, যে আপনাকে আরাম দিতে পারবে।
রবার্ট গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়িটা চলে গেল বেশ্যাপাড়াতে।
কুড়ি মিনিট কেটে গেছে। বিখ্যাত এবং কুখ্যাত অঞ্চল।
–এখানে সুন্দরী মেয়েদের দেখা পাবেন।
মুখে দুষ্ট হাসি হেসে ড্রাইবার বলল।
–অনেক ধন্যবাদ, রবার্ট ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। চারপাশে তাকালেন। না, এখানে কোনো পুলিশ নেই। কয়েকটা গাড়ি আর অনেক মানুষ পায়ে হেঁটে চলেছে। বেশ্যাগুলি হি-হি করে হাসছে। কেউ হাত তুলে অসভ্যতা করছে। আহা, এই হল শহরের সবথেকে বিখ্যাত লাল আলোর দেশ। কোথায় যাওয়া যায়?
একটা মেয়েকে দেখা গেল, মোটামুটি ভালো দেখতে। পোশাক পরিচ্ছদ ভালো পরেছে।
বছর কুড়ি বয়স হবে তার। লম্বা কালো চুল আছে। কালো স্কার্ট পরেছে, সাদা রাউজ। ওপরে একটা কোট চাপিয়েছে। রবার্টের মনে হল, এ বোধহয় অভিনেত্রী কিংবা মডেল। সেও রবার্টকে দেখছিল।
রবার্ট বলল- হাই বেবি, তুমি কি ইংরাজি জানো?
মেয়েটির মুখে হাসি হ্যাঁ, আমি জানি। চলো কোথায় যাবে? ইতালিয় টান আছে। একশো ডলার এক্ষুনি লাগবে কিন্তু।
না না, কোনো সমস্যা নেই।
মেয়েটি আবার বলল- কাছাকাছি একটা হোটেল আছে।
-তোমার নাম কী?
-পিয়েরে।
আমার নাম হেনরি।
একটা পুলিশের গাড়ি দূরে দাঁড়িয়ে ছিল।
মেয়েটি তাড়াতাড়ি বলল- চলল, এখান থেকে চলে যাই।
অন্য মেয়েরা ঈর্ষার চোখে পিয়েরের দিকে তাকিয়ে আছে। আহা, কেমন একটা আমেরিকান খদ্দের পাকড়েছে।
হোটেলটা ফাঁকা, আলো আঁধারের খেলা। যে ছেলেটা কাউন্টারে বসেছিল, সে পাশপোর্ট দেখতে চাইল না। সে পিয়েরের হাতে চাবি তুলে দিল। বলল– পঞ্চাশ হাজার লিরা।
পিয়েরে রবার্টের কোমর জড়িয়ে ধরেছে। রবার্ট পকেট থেকে টাকাটা বের করলেন। ছেলেটির হাতে তুলে দিলেন।
বিরাট একটা খাট আছে এককোণে, ছোটো একটা টেবিল, দুটো কাঠের চেয়ার, একটা আয়না। বেসিনের ওপর।
দরজার পাশে জামাকাপড় রাখার একটা র্যাক আছে।
–আমাকে আগাম টাকা দেবে তো?
–হা, রবার্ট একশো ডলার গুনে হাতে তুলে দিলেন।
পিয়েরে ল্যাংটো হতে শুরু করছে। রবার্ট জানলার দিকে হেঁটে গেলেন। পর্দাটা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সবই স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। ভেবেছিলেন, পুলিশ অথবা অন্য কেউ এখনই এসে পড়বে। পর্দা ফেলে দিলেন। পিয়েরে একেবারে উলঙ্গ। আহা, ভারী সুন্দর শরীর তার। দুটি উদ্ধত স্তন, এতটুকু অবনত হয়নি। গোল নিতম্ব, সরু কোমর, লম্বা পা।
মেয়েটি অবাক চোখে রবার্টকে দেখছিল। তুমি কখন সবকিছু খুলবে, হেনরি?
-সত্যি কথা বলতে কী, আমার মনে হচ্ছে, অনেকটা মদ খেয়েছি। একটুবাদে আমার খেলা শুরু করব।
মেয়েটির চোখে রাগ- তাহলে আমাকে ভাড়া করলে কেন?
–তোমার পাশে সারারাত শুয়ে থাকব। জড়াজড়ি করে। কাল সকালে তোমায় ভালোবাসব।
মেয়েটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল– আমাকে কাজ করতে হবে। খাটতে হবে। আরও টাকা আয় করতে হবে।
–ভেবো না, আমি তার ব্যবস্থা করছি।
পকেট থেকে আরও কয়েকটা একশো ডলারের নোট বের করে মেয়েটির হাতে রবার্ট তুলে দিলেন।
এতে হবে তো?
পিয়েরে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে টাকার দিকে। মনে মনে কী যেন গণনা করছে সে। আহা, বাইরে বড্ড ঠাণ্ডা। ব্যবসাটায় মন্দা দেখা দিয়েছে। এখানে একটা নিরাপত্তা, উষ্ণতা, খদ্দেরটার মধ্যে একটা রহস্য আছে। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে না, ও মাতাল। ভালো পোশাক পরা, যথেষ্ট অর্থবান, তা হলে? ও একটা ভালো হোটেলে গেল না কেন? পিয়েরে ভাবল। ঠিক আছে, আমরা দুজন এখানেই শোবো তো।
পিয়েরে দেখল, রবার্ট আবার জানলার দিকে হেঁটে গেলেন, পর্দা তুলে বাইরের দিকে তাকালেন।
–তুমি কি কিছু দেখছ? কারোর জন্য অপেক্ষা?
–হোটেলের পেছনের কোনো দরজা আছে?
পিয়েরে এবার বুঝতে পারল, কোনো একটা সমস্যা আছে। হয়তো এই লোকটা একটা আততায়ী। খুনীও হতে পারে। প্রিয় বান্ধবীর মুখটা মনে পড়ে গেল। এরকম একটা বাজে কাছে যুক্ত থাকায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে লোকটাকে দেখে তো খুনে বদমাইস বলে মনে হচ্ছে না।
মেয়েটি বলল- হা, দরজা আছে।
হঠাৎ একটা আর্তনাদের শব্দ, রবার্ট ফিরে তাকালেন।
একটা মেয়ের গলা- পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে, পাতলা দেওয়াল।
রবার্ট জানতে চাইলেন– কী হয়েছে?
পিয়েরে হাসছে ওরা মজা করছে। এটা আর কিছু নয়।
রবার্ট আরও কিছু শব্দ শুনতে পেলেন।
পিয়েরে ল্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলছে, তুমি কখন শুতে যাবে?
চলো, এখনই যাচ্ছি। রবার্ট বললেন।
জামাকাপড় খুলবে না?
না।
পিয়েরে বিছানার এককোণে চলে গেল। রবার্টের পাশে শুয়ে পড়ল। বলল- তুমি নাক ডাকো না তো?
-না, কাল সকালে কথা হবে কেমন?
ঘুমোনোর কোনো ইচ্ছে রবার্টের ছিল না। তিনি রাতের আকাশ এবং শহর দেখতে চাইছিলেন, কীভাবে হোটেল থেকে বেরিয়ে যাওয়া যেতে পারে? এই জাতীয় বাজে হোটেলে তিনি কখনও আসেন না। কিন্তু এখন এখানে শুয়ে থাকতেই হবে। এবার তিনি কোথায় যাবেন? বুঝতে পারা যাচ্ছে না। সুশানের উষ্ণ শরীরটার কথা মনে পড়ে গেল। স্বপ্নের মধ্যে রবার্ট ভাবলেন, সুশান বোধহয় তার জীবনে আবার ফিরে এসেছে।
.
৩৭.
সতেরো নম্বর দিন, রোম, ইতালি
সূর্যের আলো রবার্টকে জাগিয়ে দিল। রবার্ট উঠে বসলেন। পিয়েরের দিকে তাকালেন। স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আঃ, পিয়েরে আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে।
না, তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি কিন্তু নাক ডাকোনি।
রবার্ট ঘড়ির দিকে তাকালেন। সকাল নটা। মূল্যবান সময় হারিয়ে গেছে।
–তুমি কি এখনও আমায় ভালোবাসবে? এর জন্য কিন্তু টাকা আমি পেয়ে গেছি।
রবার্ট বললেন- ঠিক আছে।
পিয়েরে এই অবস্থায় সামনে এগিয়ে এল। একই রকম আছে সে, শরীরের কোথাও সুতোটি পর্যন্ত নেই।
সে এবার পোশাক পরতে শুরু করল। বলল- সুশান কে?
রবার্ট অবাক সুশান? কেন এই প্রশ্ন?
-তুমি ঘুমের ঘোরে সুশানের নাম বলছিলে।
রবার্টের মনে পড়ল, হ্যাঁ, ঘুমন্ত অবস্থায় সে সুশানের স্বপ্ন দেখছিল। এটা কি সৌভাগ্যের লক্ষণ?
রবার্ট বললেন- ও আমার বন্ধু। বলতে পারলেন না, ও আমার স্ত্রী। এখন হয়তো নতুন স্বামীকে নিয়ে বিরক্ত। আমার কাছে আবার ফিরে আসতে চাইছে। তবে আমি কি অতদিন বেঁচে থাকব?
রবার্ট জানলার কাছে হেঁটে গেলেন। পর্দা তুলে তাকালেন। রাস্তায় নোক চলাচল শুরু হয়েছে, দোকানপাট খুলে গেছে। না, বিপদের চিহ্ন কোথাও নেই।
এবার ভাবনাটাকে কাজে পরিণত করতে হবে। রবার্ট পিয়েরের দিকে তাকিয়ে বললেন– পিয়েরে আমার সাথে দেশভ্রমণে যাবে?
পিয়েরে অবাক হয়ে গেছে কোথায়?
–আমাকে ব্যবসার কাছে ভেনিস যেতে হবে। একলা যেতে ভালো লাগে না। তুমি কি যাবে?
–হ্যাঁ।
–আমি তোমাকে যথেষ্ট টাকা দেব। আমরা দুজনে ছুটি কাটাব।
জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রবার্ট আবার বললেন- ওখানে একটা সুন্দর ছোট্ট হোটেল আছে। সিবরিয়ানি।
রবার্টের হঠাৎ মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগে তিনি আর সুশান ওই শহরের একটা হোটেলে ছিলেন। আবার সেখানে তাকে যেতে হচ্ছে। রোজ এক হাজার ডলার লাগবে কিন্তু। মেয়েটি মনে করিয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত পাঁচশো ডলারে রাজী হল সে। মনে মনে ভাবল, হ্যাঁ, এটা হলেই চলবে।
রবার্ট বললেন– ঠিক আছে, তিনি দু-হাজার ডলার মেয়েটির হাতে দিয়ে বললেন এটা দিয়ে কাজ শুরু হোক।
পিয়েরে চিন্তা করছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে, কোনো একটা গোলমাল আছে। তবে ব্যাপারটা যখন শুরু হয়ে গেল, সে আর কী করে পিছিয়ে আসবে।
.
পিয়েরে ট্যাক্সির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার হঠাৎ মনে হল, কেউ বা কারা নিশ্চয়ই এই লোকটাকে লক্ষ্য করছে। প্রাণভয়ে কাঁপছে এই লোকটা।
পিয়েরে বলল– আমি মত পরিবর্তন করেছি। তোমার সঙ্গে ভেনিসে যাব না।
রবার্টের মনে চিন্তা– কেন? তিনি জানতে চাইলেন।
উল্টোদিকে একটা জুয়েলারি দোকান। রবার্ট পিয়েরের হাতে হাত রেখে দোকানে ঢুকে পড়লেন। বললেন- এসো, তোমাকে একটা উপহার দিই।
কাউন্টারে বসে থাকা ছেলেটি বলল- কীভাবে আপনাকে সাহায্য করব, স্যার?
রবার্ট বললেন, এই মেয়েটির পক্ষে মানানসই কিছু দেখান তো?
পিয়েরের দিকে ফিরে তিনি বললেন- তুমি মরকত মনি পছন্দ করো।
-হ্যাঁ।
রবার্ট আবার ক্লার্ককে বললেন- মরকত মনির ব্রেসলেট আছে?
-হ্যাঁ, একটা সুন্দর ব্রেসলেট আছে, স্যার। এটাই আমাদের সবথেকে ভালো। পনেরো হাজার ডলার দাম।
রবার্ট পিয়েরের দিকে তাকিয়ে বললেন ভালো লাগছে?
পিয়েরের কথা বন্ধ হয়ে গেছে। সে মাথা নাড়ল।
রবার্ট বললেন- এটা আমি তোমাকে উপহার দেব।
রবার্ট ক্রেডিট কার্ডটা বের করলেন।
–এক মুহূর্ত, স্যার। ক্লার্ক কোথায় যেন হারিয়ে গেল। একটু বাদে ফিরে এল, এটা কি প্যাকেট করে দেব?
না, এটা আমার হাতে দিন। আমি বান্ধবীকে উপহার দেব।
মরকতের এমন সুন্দর একটা অলংকর, পিয়েরের কবজিতে বাধা হল। পিয়েরে আরও অবাক হয়ে গেছে।
রবার্ট বললেন- ভেনিসে তুমি যখন ঘুরে বেড়াবে, তোমাকে একটা উড়ন্ত জলপরী বলে মনে হবে।
পিয়েরের মুখে হাসি। নিজের এই সৌভাগ্য সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
রাস্তায় বেরিয়ে পিয়েরে বলল– কীভাবে তোমাকে ধন্যবাদ দেব, বুঝতে পারছি না।
রবার্ট বললেন- আমি আশা করি, আমাদের বন্ধুত্ব অনেক দিনের হবে।
রবার্ট আরও জানতে চাইলেন- তোমার কি গাড়ি আছে?
-না, আমার একটা পুরোনো গাড়ি ছিল। কিন্তু সেটা চুরি হয়ে গেছে।
–তোমার কাছে কি ড্রাইভার লাইসেন্স আছে?
পিয়েরে অবাক– গাড়ি যখন নেই, ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে কী হবে?
–এসো, আমরা এখান থেকে চলে যাই।
রবার্ট একটা ট্যাক্সি ডাকলেন, বললেন, ভায়াপোতে যাব।
পিয়েরে ট্যাক্সিতে উঠে বসল। রবার্টকে ভালোভাবে দেখল- লোকটা কেন আমার সাহচর্য প্রার্থনা করছে? এর অন্তরালে নিশ্চয়ই একটা রহস্য আছে।
রবার্ট ট্যাক্সিকে থামতে বললেন কার রেন্টাল এজেন্সির সামনে।
রবার্ট পিয়েরেকে বললেন– এসো, আমরা নেমে আসব। ড্রাইভারকে টাকা মিটিয়ে দিলেন।
ট্যাক্সিটা চোখের বাইরে চলে গেল।
পিয়েরের হাতে হাত রেখে রবার্ট বললেন- তুমি একটা গাড়ি ভাড়া করো। ফিয়াট কিংবা আলফা রোমিও নেবে, বলবে– চার-পাঁচদিনের জন্য লাগবে। এই টাকাটা হাতে রাখো। এটা আগাম বাবদ দেবে। তোমার নামে ভাড়া করবে। আমি উল্টোদিকের বারে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
দুজন ডিটেকটিভের চোখে সবকিছু পড়ল। তারা এক ড্রাইবারকে প্রশ্ন করছে। ফরাসি লাইসেন্স প্লেট লাগানো লাল ট্রাকের ড্রাইভার।
-না, স্যার। আমার কোনো ধারণা নেই। মনে হচ্ছে, এটা বোধহয় ভুল করে আমার গাড়িতে চলে এসেছে।
দুজন ডিটেকটিভ চোখ চাওয়া চাওয়ি করল। একজন বলল- আমি এক্ষুনি ফোন করছি।
.
ফ্রানসেসকো সিজার তার ডেস্কে বসেছিলেন। সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলেন। ব্যাপারটা এত সহজে সমাধান হবে কি? না, কমান্ডার বেলামিকে কম শক্তিশালী ভেবে কোনো লাভ নেই।
কর্নেল ফ্রাঙ্ক জনসন জেনারেল হিলিয়াডের অফিসে বসে আছেন।
ইওরোপের সব এজেন্টকে কাজে লাগানো হয়েছে। জেনারেল হিলিয়াড বললেন, এখনও অব্দি ভালো খবর যে ওই কমান্ডার আমাদের চোখের বাইরে যেতে পারেননি। বেলামি রোমে আছেন, কিছুক্ষণ আগে উনি এক বান্ধবীর জন্য পনেরো হাজার ডলার দিয়ে ব্রেসলেট কিনেছেন। উনি নজরবন্দি হয়ে গেছেন। কিছুতেই এই জাল থেকে বেরোতে পারবেন না। আমরা জানি পাশপোর্টে উনি যে জাল নামটা ব্যবহার করছেন, সেটা হল আর্থার বাটারফিল্ড।
কর্নেল জনসন মাথা ঝাঁকালেন, না, বেলামিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। আপনি জানেন না ও কত চালাক। মনে হয়, অত সহজে ওকে ধরা যাবে না। আর একটা কথা, উনি কিন্তু এখন আমাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কারণ ওনার হাতে চাবিকাঠি। গোলমাল হলে উনি সর্বসমক্ষে সবকিছু বলে দেবেন।
-হ্যাঁ, এটা একটা চিন্তা করার বিষয়। কী করা যায় বুঝতে পারছি না।
কর্নেল জনসন বললেন আমি কি রোমে যাব? আমি কি নিজের হাতে দায়িত্বটা নেব?
কর্নেল ফ্রাঙ্ক জনসন অফিসে ফিরে এলেন। ভয়ংকর একটা খেলায় তিনি কি অংশ নেবেন? না, এ বিষয়ে আর চিন্তা করার সময় নেই। যে করেই হোক কমান্ডার বেলামিকে খুঁজে বের করতে হবে।
.
৩৮.
ফোনটা বেজেই চলেছে। নিউইয়র্কে এখন সকাল ছটা বাজে। শেষ পর্যন্ত ছবারের পর অ্যাডমিরালের কণ্ঠস্বর শোনা গেল– হ্যালো?
–অ্যাডমিরাল, আমি।
রবার্ট? কী হয়েছে?
–কোনো কথা বলবেন না। আপনার ফোনের ওপর নজরদারি আছে। আমি খালি বলছি আপনাকে যে, এখনও আমি বেঁচে আছি। পরে হয়তো আপনার সাহায্য লাগতে পারে।
-রবার্ট, বলো, তোমার জন্য কী করব?
না, এখন কিছু করবেন না। পরে ডাকব আপনাকে।
রবার্ট রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। তিনি দেখলেন, একটা নীল রঙের ফিয়াট গাড়ি বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পিয়েরে বসে আছে।
রবার্ট গাড়িতে উঠে বললেন- স্যার যাও। আমি ড্রাইভ করব।
পিয়েরে জায়গা করে দিল।
–আমরা কি ভেনিস যাচ্ছি? পিয়েরের জিজ্ঞাসা।
–না, আমরা কয়েকটা জায়গায় থামব।
রবার্ট রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলেন। রোসিনি ট্রাভল সার্ভিস, রবার্ট বললেন– আমি একমিনিটের মধ্যে আসছি।
পিয়েরে দেখলেন, রবার্ট ট্রাভল এজেন্সির অফিসে ঢুকে পড়েছেন। পিয়েরে ভাবল, আমি এখন যদি গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যাই, তা হলে কী হবে? ও তো আমাকে আর কখনওই খুঁজে পাবে না। না, গাড়িটা আমার নামে ভাড়া করা হয়েছে। আমি একটা বোকার মতো কাজ করেছি।
রবার্ট রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে বললেন– আমি কমান্ডার রবার্ট বেলামি। আমাকে একটু সাহায্য করবেন? আমি কয়েকটা জায়গায় যাব। আগাম ব্যবস্থা করতে হবে।
–আপনি কোথায় যাবেন?
–বেজিং-এ যাব। ফার্স্ট ক্লাস এয়ারলাইন্স টিকিট লাগবে। একদিকের।
কবে উড়তে চাইছেন?
–এই শুক্রবার?
–ঠিক আছে। এয়ার চায়না ফ্লাইট। ৭-৪০ ছাড়বে। শুক্রবার রাতে।
বাঃ।
–আর কিছু?
আমি বুদাপেস্টের ট্রেন ধরব।
কবে?
সামনের সোমবার।
–কোন্ নামে?
–একই নামে।
রিসেপশনিস্ট মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আপনি তো শুক্রবার বেজিং যাচ্ছেন।…
–আমি এখনও শেষ করিনি, ম্যাডাম। রবার্ট বললেন। মিয়ামি যাব, রোববার। ফ্লোরিডাতে…।
এবার মেয়েটি অবাক হয়ে গেছে। সিনর, এভাবে কি ভ্রমণ করা যায়?
রবার্ট তার ও এন আই কার্ডটা বের করলেন। বললেন– এই কার্ডে টিকিটের চার্জ বাদ দিয়ে দিন।
ভদ্রমহিলা অবাক– সে ব্যাক অফিসে চলে গেল। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এল। সবকটা টিকিটই হয়ে গেছে। আমরা সব ব্যবস্থা করেছি। আপনি কি সব একই নামে সংরক্ষণ করতে চাইছেন?
–হ্যাঁ, কমান্ডার রবার্ট বেলামি।
রবার্ট দেখতে পেলেন। মেয়েটি বেশ কয়েকটা বোম টিপল। তারপর টিকিটগুলো চলে এল।
–আলাদা আলাদা এনভেলাপে পুরে দিন, কেমন?
–টিকিটগুলো কোথায় পাঠাতে হবে?
–আমি এগুলো নিয়ে যাচ্ছি।
রবার্ট ক্রেডিট কার্ড স্লিপে সই করলেন। টিকিটগুলো পেয়ে গেলেন।
–আহা, ভ্রমণটা ভালো হোক, কেমন?
পিয়েরে প্রশ্ন করল, এবার আমরা যাব তো?
–আরও কয়েকটা জায়গায় আমাকে থামতে হবে।
পিয়েরে অবাক চোখে রবার্টের দিকে তাকিয়ে আছে।
-তুমি কি আমার জন্য একটা কাজ করবে?
রবার্টের এই কথা শুনে পিয়েরে বুঝতে পারল, এবার আমাকে ভয়ঙ্কর ঝামেলায় জড়িয়ে দেওয়া হবে।
পিয়েরে জানতে চাইল– কী করতে হবে?
হোটেল ভিকটোরিয়া, রবার্ট পিয়েরের হাতে এনভেলাপ দিয়ে বললেন, তুমি ডেস্কে চলে যাও। কমান্ডার রবার্ট বেলামির নামে একটা স্যুট ভাড়া করো। তুমি নিজেকে সেক্রেটারি বলে পরিচয় দেবে। তুমি বলবে যে, উনি এক ঘণ্টার মধ্যে আসছেন। তুমি স্যুইটটা দেখতে এসেছ। তুমি ভেতরে যাবে। ঘরের একটা টেবিলের ওপর এই খামখানা রেখে আসবে।
ব্যস, আর কিছু নয়?
না, আর কিছু নয়।
মেয়েটি চলে গেল কে এই কমান্ডার রবার্ট বেলামি? পিয়েরে হোটেলের লবি দিয়ে হাঁটছে। একটু ভয় পেয়েছে। যে পেশার সঙ্গে সে যুক্ত, সেখানে এমন অনেক কাজ তাকে করতে হয়। যে ক্লার্ক বসেছিল, সে বলল– সিরিয়া, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করব?
–আমি কমান্ডার রবার্ট বেলামির সেক্রেটারি, তার জন্য একটা স্যুইট ভাড়া করতে হবে। এক ঘণ্টার মধ্যে উনি আসছেন।
-ঠিক আছে, একটা সুন্দর সুইট পাওয়া যাবে।
–আমি সেটা দেখতে পাব?
–হ্যাঁ, কেন নয়?
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছুটে এলেন। পিয়েরে ওপরে উঠে গেল। ওই স্যুইটের লিভিং রুমটা ভারী সুন্দর। পিয়েরের দিকে তাকিয়ে অ্যাসিন্ট্যান্ট ম্যানেজার জানতে চাইলেন এটা কি চলবে?
পিয়েরের এ ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই। সে বলল- হ্যাঁ, এটাই চলবে। সে তার পার্স থেকে এনভেলাপটা বের করে চুপিচুপি রেখে দিল। বলল- কমান্ডারের জন্য এটা রেখে গেলাম।
পিয়েরে আর একটু অবাক হয়েছে। সে খামটা খুলল। দেখল, বেজিং-এর একটা টিকিট আছে, রবার্ট বেলামির নামে। পিয়েরে টিকিটটা আবার এনভেলাপে রেখে দিল। নীচে নেমে এল।
নীল রঙের ফিয়াট গাড়িটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রবার্ট জানতে চাইলেন কোনো সমস্যা?
না।
–আরও দুজায়গায় আমাদের থামতে হবে। তারপর আমরা ভেনিসের দিকে যাত্রা করব।
এবার হোটেল ভালাডিয়ার। রবার্ট একইভাবে পিয়েরের হাতে একটা খাম তুলে দিলেন। একইভাবে বললেন– কমান্ডার রবার্ট বেলামির নামে ঘর বুক করতে হবে।
পিয়েরে কাজটা করে বেরিয়ে এল।
এবার শেষবারের মতো থামতে হবে হোটেলে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিতে।
রবার্ট একই কাজ করলেন।
মেয়েটি এখন সব জেনে গেছে।
এই স্যুইটটা ভারী সুন্দর। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার তাকে মস্ত বড়ো বেডরুমটা দেখালেন। মাঝে একটা সুন্দর বেড আছে।
পিয়েরে ভাবল, কী বাজে খরচ হচ্ছে। একদিন এখানে ঢুকতে পারলে আমার ভাগ্যের চাকাটা একেবারে খুলে যাবে। এবারেও সে এনভেলাপটা দেখল। হ্যাঁ, মিয়ামি ফ্লোরিডার একটা টিকিট আছে।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পিয়েরেকে লিভিংরুমে নিয়ে গেল। আমাদের কালার টিভি আছে। সে টেলিভিশন সেটটা চালিয়ে দিল।
কী আশ্চর্য? রবার্টের ছবি ভেসে উঠেছে টেলিভিশনের পর্দায়। সঞ্চালিকা ঘোষণা করছে ইন্টারপোল মনে করে, উনি এখন রোমে আছেন। তাকে আন্তর্জাতিক ড্রাগ চোরাচালানকারীদের অন্যতম বলা হচ্ছে। সি এন–এর তরফ থেকে খবর পড়ছি।
পিয়েরে অবাক হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কে তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে।
ম্যানেজার সেটটা বন্ধ করে দিল। বলল চলবে তো?
পিয়েরে বুঝতে পারল, তার সহযাত্রী আর কেউ নয়, স্মাগলার, এক ভয়ংকর স্মাগলার।
পিয়েরে রবার্টের পাশে এসে বসল। রবার্টকে এখন সে অন্য চোখে দেখছে।
.
হোটেল ভিকটোরিয়া, কালো স্যুটপরা একজন গেস্ট রেজিস্টাররা দেখল। সে ক্লার্কের দিকে তাকাল। বলল– কমান্ডার বেলামি কখন এসেছেন?
-উনি এখনও আসেননি, স্যার। ওনার সেক্রেটারি একটা স্যুইট বুক করেছেন। উনি এক ঘণ্টার মধ্যে আসবেন।
কালো পোশাক পরা লোকটি তার সহকর্মীদের দিকে তাকিয়ে বলল- এ হোটেলটার চারপাশ ঘিরে ফেলতে হবে। আমি ওপরতলায় বসে আছি। সে বলল ক্লার্ককে ওর স্যুইটটা আমার জন্য খুলে দিন।
তিন মিনিট কেটে গেছে। ক্লার্ক স্যুটের দরজা খুলে দিল। কালো স্যুট পরা লোকটি ভেতরে চলে গেল। তার হাতে বন্দুক। না, স্যুটটা একেবারে ফাঁকা, সে টেবিলের ওপর একটা এনভেলাপ দেখতে পেল। লেখা আছে কমান্ডার রবার্ট বেলামি। এনভেলাপটা সে খুলে ফেলল। একটু বাদে সে হেডকোয়ার্টারে ফোন করল।
ফ্রানসেসকো সিজার একটা সভায় ব্যস্ত ছিলেন। কর্নেল ফ্রাঙ্ক জনসন এসে গেছেন। দুঘন্টা আগে।
সিজার প্রশ্ন করলেন– বেলামি এখনও রোমে আছে, এ বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।
–সবকটা জায়গা দেখা হয়েছে?
ফোনটা বেজে উঠল আমি ভিকি বলছি কর্নেল, লোকটাকে পাওয়া গেছে। আমি তার হোটেল স্যুইটে বসে আছি। হোটেল ভিকটোরিয়াতে। সে বেজিং-এ যাবে। শুক্রবার।
সিজারের কণ্ঠে উত্তেজনা ভালো। ওখানেই থাকুন। আমরা এক্ষুনি আসছি।
রিসিভারটা নামিয়ে কর্নেল জনসনের দিকে তাকিয়ে বললেন- কর্নেল, শেষ পর্যন্ত ওনাকে পাওয়া গেছে। উনি হোটেল ভিকটোরিয়াতে থাকবেন। এয়ার লাইন্স টিকিট পাওয়া গেছে। শুক্রবার বেজিং যাবেন।
কর্নেল অবাক বেলামি নিজের নামে হোটেল বুক করেছে?
-হ্যাঁ।
–প্লেনের টিকিটটাও তার নামে?
–হ্যাঁ, কর্নেল জনসন বললেন- এ ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।
–কেন?
বেলামি কখনওই নিজের নাম ব্যবহার করবেন না!
আবার টেলিফোন বাজছে। সিজার ফোনটা ধরলেন।
কর্নেল আমি মারিও বলছি। আমরা বেলামিকে পেয়েছি। হোটেল ভালাডিয়ারে এক্ষুনি আসবেন। সোমবার ট্রেন ধরে উনি বুদাপেস্ট যাবেন। আমরা এখন কী করব?
–কিছুই করতে হবে না। কর্নেল সিজার বললেন, কর্নেল জনসনের দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা প্লেনের টিকিট পাওয়া গেছে। বেলামির নামে।
আবার টেলিফোন বাজল।
-আমি ব্রুনো বলছি। আমরা বেলামিকে পেয়েছি। তিনি হোটেল লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ঘর বুক করেছেন, তিনি রোববার মিয়ামি যাবেন।
সিজার বললেন- এখনই ফিরে এসো। আঃ এই খেলাটার শেষ কোথায় হবে।
কর্নেল জনসন হেসে বললেন– বন্ধু, বৃথা সময় নষ্ট করে কী লাভ?
–তা হলে আমরা কী করব?
–ওই বেজন্মাটাকে ফাঁদে ফেলতে হবে।
.
ভায়া ক্যাসিয়ার দিকে গাড়ি ছুটে চলেছে। ভেনিসের উত্তর প্রান্তের একটি অঞ্চল। পুলিশ সমস্ত জায়গা ঘিরে রেখেছে। যে কোনো সময়ে ধরা পড়তে হতে পারে। বিশেষ করে পশ্চিম সীমান্তে কড়া নজর রাখা হয়েছে। ফ্রান্স এবং সুইজারল্যান্ডের দিকে। রবার্ট ভাবছেন, কী করে পালাবেন। অস্ট্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলে কেমন হয়?
পিয়েরে বলল আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।
কী?
–ব্রেকফাস্ট খাইনি, লাঞ্চও খাইনি।
রবার্ট বললেন– হ্যাঁ, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে থামব।
পিয়েরে দেখছে, রবার্ট গাড়ি চালাচ্ছেন। পিয়েরে খুব অবাক হয়ে গেছে। না, এমন খদ্দেরের সন্ধান সে কখনও পায়নি।
– একটা ছোটো রেস্টুরেন্ট, অনেক লোকের ভিড়। একটা টেবিল ফাঁকা পেল, দরজার সামনে। ওয়েটার এসে মেনুকার্ড হাতে দিয়েছে।
রবার্ট পড়তে থাকলেন। তারপর বললেন- আমি এক্ষুনি আসছি তিনি পাবলিক টেলিফোন বুথের কাছে চলে গেলেন। একটা টাকা শটে ফেললেন। বললেন- জিব্রাল্টারের মেরিন অপারেটরের সাথে কথা বলতে হবে।
–কে জিব্রাল্টারে কথা বলছ? পিয়েরে ভাবল, এইভাবে লোকটা কি পালিয়ে যাবে?
–অপারেটর, আমেরিকান ইয়াচ হ্যালিকনের খবর কী? ধন্যবাদ।
কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে। অপারেটররা কথা বলছে।
সুশানের কণ্ঠস্বর।
সুশান?
রবার্ট, তুমি ভালো আছো?
–হ্যাঁ, ভালো আছি। আমি তোমায় কয়েকটা কথা বলতে চাই।
–আমি সব জেনে গেছি। রেডিও টেলিভিশনে তোমার মুখ দেখানো হচ্ছে। ইন্টারপোল কেন তোমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে?
–এটা একটা মস্ত বড়ো গল্প।
বলো, আমি শুনব।
–এটা রাজনৈতিক চক্রান্ত, সুশান। আমি এমন কিছু তথ্য হাতে পেয়েছি, সরকার যেটা চেপে ফেলার চেষ্টা করছে। তাই ইন্টারপোল আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
পিয়েরে সবকিছু শোনার চেষ্টা করল।
–আমি তোমাকে কী করে সাহায্য করব?
-না, তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে বড়ো সাধ জেগেছিল। যদি এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাই, তাহলে আবার তোমার সঙ্গে দেখা হবে।
এমন কথা বলো না, সুশানের কণ্ঠস্বরে ভয়ার্ত আর্তনাদ– তুমি কেন সবকথা গুছিয়ে বলছ না? বলো তো তুমি এখন কোথায় আছো?
–ইতালিতে।
–ঠিক আছে, আমরা বেশি দূরে নেই। আমরা জিব্রাল্টারের কিনারায় পৌঁছে গেছি। তোমাকে কি তুলে নিয়ে যাব?
না, আমিই পারব।
–শোনো, এটাই বোধহয় তোমার মুক্তি পাবার একমাত্র উপায়।
সুশান, আমি এইভাবে ভাবছি না। তোমাদের সমস্যা দেখা দেবে।
মন্টে সালুনে প্রবেশ করলেন। এই সংলাপের অংশবিশেষ শুনলেন। বললেন- এসো, আমি কথা বলছি।
–একমুহূর্ত রবার্ট, মন্টে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।
সুশান, আমি কথা বলতে চাইছি না।
মন্টের কণ্ঠস্বর ভেসে এল রবার্ট, আমি জানি, আপনি খুব সমস্যায় পড়েছেন।
–হ্যাঁ, তা ঠিক হয়তো।
–আমরা আপনাকে সাহায্য করতে চাইছি। আপনার জন্য একটা প্রমোদ তরণী দেব কি? বা আপনি সেখানে আসতে পারবেন? পুলিশ এইসব দিকে নজর দেবে না।
-ধন্যবাদ মন্টে, কিন্তু আমি এখন যে উত্তরটা দেব, সেটা হল, না।
-আপনি কিন্তু ভুল করছেন। এখানে আপনি নিরাপদে থাকবেন।
ও কেন আমাকে সাহায্য করতে চাইছে? ধন্যবাদ। আমি দেখছি কী করা যায়। সুশানের সাথে আবার কথা বলব কেমন?
মন্টে বাঙ্কস ফোনটা সুশানের হাতে দিলেন। বললেন– ও কথা বলতে চাইছে।
সুশান বলছেন এমন করো না রবার্ট। নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করো না।
সুশান, তুমি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছ। তুমি আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো কেড়ে নিয়েছ। আমি সব সময় তোমাকেই ভালোবাসব। আমি সবসময় তোমার সাথেই থাকব।
তার মানে কী?
–হ্যাঁ, বেঁচে থাকলে আমি আবার তোমাকে ভালোবাসা জানাব।
রবার্ট রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। এই কথাগুলো বলা কি ঠিক হল? তিনি টেবিলের দিকে চলে গেলেন। খাওয়া যাক।
–আমি তোমার কথা শুনেছি। পুলিশ তোমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে, তাই না?
রবার্টের চোখে-মুখে আতঙ্ক। হ্যাঁ, একটা ভুল হয়ে গেছে।
–আমাকে বোকা ভেবো না। আমি তোমায় সাহায্য করতে চাই।
–কীভাবে?
পিয়েরে ঝুঁকে বসল।তুমি আমাকে ভারী সুন্দর একটা জিনিস দিয়েছ। আমি পুলিশকে ঘেন্না করি। তুমি জানো পুলিশ আমাদের ওপর কী ধরনের অত্যাচার করে। তারা আমাদের ধরে নিয়ে যায়। তারা ধর্ষণ করে। তারা কুকুরের জাত। আমি কিছুতেই তাদের কাছে তোমার নাম বলব না।
–পিয়েরে, এমন করছ কেন?
ভেনিসে পুলিশ তোমায় ধরে ফেলবে। তুমি হোটেলে থাকলেও তোমায় ধরে ফেলবে। জাহাজে থাকলেও তুমি বাঁচতে পারবে না। কিন্তু আমি তোমাকে একটা সুন্দর জায়গা দেব। আমার মা আর ভাই নেপলসে থাকে। আমরা যেখানে থাকতে পারব। পুলিশ কখনও সেখানে যাবে না।
রবার্ট ব্যাপারটা ভেবে দেখলেন- হ্যাঁ, এই প্রস্তাবটা তো মন্দ নয়। একটা ব্যক্তিগত বাড়ি। সেখানে থাকলে কোনো সমস্যা হবে না। নেপলস একটা মস্ত বড়ো বন্দর। একটুখানি ভেবে রবার্ট বললেন– পিয়েরে, যদি পুলিশ আমার সন্ধান পায়, তারা কিন্তু আমায় মেরে ফেলবে। তোমাদেরও অনেক অত্যাচারের সামনে দাঁড়াতে হবে। তোমরা কেন এই ঝামেলা নেবে?
–না, পিয়েরে হাসল, পুলিশ কখনও তোমাকে খুঁজে পাবে না।
রবার্ট হাসি ফিরিয়ে দিলেন। বললেন- ঠিক আছে, খাওয়াটা সেরে নাও। আমরা নেপলসেই যাব।
.
কর্নেল ফ্রাঙ্ক জনসন বললেন–কোথায় উনি যেতে পারেন, সে বিষয়ে কোনো ধারণা আছে?
ফ্রানসেসকো সিজার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন– না, কিছুই বুঝতে পারছি না।
প্রাক্তন স্ত্রী সম্পর্কে খবর নিতে হবে?
না, খবর নিয়ে কোনো লাভ নেই।
কর্নেল জনসন জবাব দিলেন ওই মেয়েটি এখন মন্টে বাঙ্কসকে বিয়ে করেছে। না, আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হবে।
.
৩৯.
প্রশস্ত বুলেভাদর দিয়ে মেয়েটি নেমে আসছে। কতদিন তাকে এই অবস্থার মধ্যে থাকতে হয়েছিল। না, এই জীবনটা তার মোটেই ভালো লাগছে না। জল দরকার, জল ছাড়া সে বাঁচবে না। পৃথিবীর দূষিত জল নয়, পরিষ্কার পবিত্র বৃষ্টির জল। কোথায় পাওয়া যায়?
তার সঙ্গে এক মানুষের দেখা হয়ে গেল।
আমেরিকান ফোর্সম্যান তার দিকে তাকিয়ে বলল- আপনি কে? আপনি কি পুতুল নাকি?
–আমাকে তাই কি মনে হচ্ছে?
–আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
–সাত নম্বর সূর্য থেকে।
বাঃ, আপনার মধ্যে তো কৌতুকবোধ আছে। আপনি কোথায় যাবেন?
–আমি কিছুই জানি না। এখানে আমি এক আগন্তুক।
ডিনার হয়েছে?
–আমি তোমাদের খাবার খেতে পারি না।
আপনি কোথায় আছেন?
–আমি কোথায় থাকি না।
–কোনো হোটেলে?
–হোটেল? না, ঘুমোবার একটা জায়গা চাই। আমি খুবই ক্লান্ত।
ফোর্সম্যানের চওড়া হাসি। চলুন, বাবার কাছে চলুন, কিংবা আমার হোটেল ঘরে। আমার একটা সুন্দর শয্যা আছে। আপনার তা পছন্দ হবে।
–হ্যাঁ, চলো।
ছেলেটি তার ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল। অসাধারণ।
মেয়েটি ছেলেটির দিকে তাকাল। বলল- তোমার শয্যা কী দিয়ে তৈরি? খড় দিয়ে কি?
ছেলেটি অবাক না-না, আপনি কি এখনও মজা করবেন।
মেয়েটির চোখ বড়ো বড়ো– এখনই কি আমরা ঘুমোতে পারব?
হ্যাঁ, এই তো কাছেই আমার হোটেলটা।
ছেলেটি চাবি নিয়ে এলিভেটরে উঠল। বলল- একটু ড্রিঙ্ক করবেন?
পুতুল পুতুল মেয়েটি বলছে না, পৃথিবীর কোনো তরল পদার্থ আমি গ্রহণ করতে পারব না। বিছানাটা কোথায়? আঃ, একটা ছোটোখাটো যৌন আবেদনি বালিকা এসো, এসো, এখানে ওটা আছে প্রিয়া। ছেলেটির বুঝি আর তর সইছে না। সে চট করে বেডরুমে ঢুকে গেল।
সে বলল তুমি মদ খাবে না কেন?
ভালো লাগছে না।
ছেলেটি জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে। আঃ, তুমি পোশাক খুলবে কখন?
মেয়েটি মাথা নাড়ছে। সে পোশাকটা খুলে ফেলল। ভেতরে কিছুই পরেনি। শরীরটা ভারি সুন্দর।
ছেলেটি অবাক চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সে বলল- আঃ, এত সুন্দর তোমার চেহারা! মনে মনে বলল, আমি একটুবাদেই তোমার সবকিছু স্পর্শ করব। তোমাকে এত সুখ দেব, যা তুমি কখনও পাওনি।
সে তাড়াতাড়ি তার পোশাক খুলে ফেলল। বিছানাতে লাফিয়ে পড়ল।
সে বলল- এসো, আমি তোমাকে আসল খেলা দেখাব।
মেয়েটি এবার বলল- ঠিক আছে, আমার খেলা দেখবে না?
ছেলেটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হাত-পা, বরফ হচ্ছে। বিশাল ঘরের সর্বত্র ছড়িয়ে গেল তা। মনে হচ্ছে, অনেকগুলো আঁকশি যেন বেরিয়ে আসছে।
তারপর? তারপর শুধুই অন্ধকার। ভয়ের একটা আতঙ্ক এবং আর্তনাদ।
.
৪০.
গাড়ি এগিয়ে চলেছে নেপলসের দিকে। শেষ আধঘণ্টা দারুণ উত্তেজনায় কেটেছে। দুজনের মন দুধরনের চিন্তায় আচ্ছন্ন। পিয়েরে নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞাসা করল- কতদিন তুমি আমার বাড়িতে থাকবে?
–তিন-চার দিন।
–ঠিক আছে।
রবার্ট তার বেশি কখনও থাকবেন না। অবশ্য মনে মনে তার ইচ্ছে, মাত্র একরাত থাকবেন। খুব বেশি হলে দু-রাত। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছকে নিয়েছেন। একটা জাহাজ পেলেই জীবনটা নিরাপদ হবে। ইতালির বাইরে যেতে পারবেন।
পিয়েরে বলল- কতদিন বাদে মায়ের সঙ্গে দেখা হবে।
–তোমার এক ভাই আছে না?
–হ্যাঁ, কারলো, সে আমার থেকে ছোটো।
–তোমার পরিবারের কথা বলল।
–কিছুই বলার নেই। আমার বাবা সারাজীবন ডকে কাজ করেছে। একটা ক্রেন তার মাথায় পড়ে গিয়েছিল, যখন আমার পনেরো বছর বয়স, তখন বাবার মৃত্যু হয়। আমার মা ছিল খুব অসুস্থ। আমাকে এবং কারলোকে সংসারের দায়িত্ব দেওয়া হল। স্টুডিওতে আমার এক বন্ধু ছিল। সে আমাকে এই ব্যাপারে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। আমার মনে হয়েছিল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে খদ্দের ধরলে বোধহয় বেশি টাকা আসবে।
–পিয়েরে, আমার মতো এক অচেনা আগন্তুককে তুমি বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। মা-ভাই রাগ করবে না?
না, আমরা খুব ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছি। তোমাকে দেখলে মা খুশি হবে। তুমি কি ওকে খুব ভালোবাসবে?
রবার্ট অবাক হয়ে গেছে– কাকে? তোমার মাকে?
না, রেস্টুরেন্টের টেলিফোনে তুমি যার সঙ্গে কথা বলছিলে, সুশান?
–তোমার এই কথা মনে হওয়ার কী কারণ
?–তোমার কণ্ঠস্বর বলে দিচ্ছে। মেয়েটি কে?
–আমার বন্ধু।
–আহা, মেয়েটি খুব ভাগ্যবতী। রবার্ট বেলামি তোমার আসল নাম?
–হ্যাঁ।
–তুমি কমান্ডার?
–আমি ঠিক জানি না, পিয়েরে, একসময় আমি কমান্ডার ছিলাম।
–তুমি বলবে, কেন ইন্টারপোল তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে?
এ ব্যাপারে কোনো কথা তোমাকে বলা বোধহয় উচিত নয়। তাহলে তোমার অনেক সমস্যা হবে। কম জানলেই ভালো।
–ঠিক আছে রবার্ট।
অদ্ভুত একটা পরিস্থিতি। কী ঘটনা তাদের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
–তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, তুমি কি জানো, কিছু অচেনা অজানা মানুষ পৃথিবীতে লাফিয়ে পড়ছে। এই খবরটা শুনে তুমি কি ভয় পাবে।
পিয়েরে অবাক– তুমি সত্যি কথা বলছ?
-হ্যাঁ।
পিয়েরে মাথা নাড়ল– না, এটা খুব উত্তেজক ব্যবস্থা। এমন ঘটনা সত্যি ঘটবে?
–হ্যাঁ, সম্ভাবনা আছে।
আমি ভাবছি, তারা কি মানুষের মতো দেখতে?
–আমি ঠিক জানি না।
–এই ব্যাপারে পুলিশ তোমার পেছনে লেগেছে?
–না, আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না।
–আমি যদি কোনো প্রশ্ন করি, তুমি কি রাগ করবে?
–না, রাগ করব না।
কণ্ঠস্বর পাল্টে গেছে।
মেয়েটি বলল- আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি বোকা, আমি একথা কাউকে বলিনি।
–পিয়েরে, এমন কথা বলো না।
–তুমি মিথ্যে কথা বলছ। চলো আমরা আরও ভালোভাবে দিনগুলো কাটাই।
পনেরো মিনিট বাদে তারা একটা সার্ভিস স্টেশনের কাছে এসে গেছে।
রবার্ট বললেন– ট্যাঙ্ক ভরতি করতে হবে।
পিয়েরে হাসল- ঠিক আছে। আমি আমার মাকে জানিয়ে দিই, আমি একটা সুন্দর যুবককে বাড়িতে আনছি।
রবার্ট গ্যাস পাম্পের দিকে এগিয়ে গেলেন।
পিয়েরে পাশে বসে আছে। রবার্টের ঠোঁটে একটা চুমুর চিহ্ন এঁকে সে বলল- আমি এক্ষুনি আসছি।
রবার্ট দেখতে পেলেন, পিয়েরে টেলিফোন বুথের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আঃ, মেয়েটি দেখতে খুবই সুন্দরী, এবং বুদ্ধিমতী, আমি তাকে দুঃখ দেব না।
পিয়েরে ডায়াল করছে। সে রবার্টের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর অপারেটরকে বলল- ইন্টারপোলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এখনই। আমার হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই।