তৃতীয় পর্ব
ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড
১৯১৪-১৯৪৫
১৬.
এটা হল সেই লাইব্রেরি, একদা যেখানে ব্রান্ডির গ্লাস হাতে জেমি বসে থাকতেন। এটাই বোধহয় সত্যিকারের মধুচন্দ্রিমা।
কেটি এবং ডেভিড বসে আছে।
কেটি কথা বলার চেষ্টা করছে। মাঝে মধ্যে ডেভিডের চুলে হাত বোলাচ্ছে। হা, পুরুষ শরীরের উষ্ণতা তাকে অবাক করে দিচ্ছে। এখন একে আমি সম্পূর্ণ অধিকার করেছি। সারাজীবন একে পাগলের মতো ভালোবাসব। তারা একে অন্যের দিকে এগিয়ে গেল। চোখে চোখ, কাছে আসতে চাইছে। হ্যাঁ, এই প্রথম ডেভিড অনুভব করল, কেটি অসাধারণ স্তনের অধিকারিনী। কেটির মুখ থেকে শিৎকারের শব্দ। ডেভিডের শরীর পৌঁছে গেছে এখানে সেখানে। শেষ পর্যন্ত সে নরম ত্রিভুজ ত্রিকোণে পৌঁছে গেল। আহা, কালো ভেলভেটের গালচে পাতা। ধীরে ধীরে সেখানে আঙুলের আদর দিল।
কেটি ফিসফিসিয়ে বলছে- আমাকে গ্রহণ করো, ডেভিড।
তারা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেছে। একজন অন্যজনের পৌরুষের পরিচয় পাচ্ছে। হ্যাঁ, ডেভিড তার শরীরটাকে কেটির ওপর সংস্থাপন করল। পুংদণ্ডটা ভেতরে প্রবেশ করাল। তালে তালে দুটো শরীর একবার ওপরে উঠছে, আবার নীচে নামছে। মনে হচ্ছে বোধহয় সমুদ্রে কোথাও ঝড় উঠেছে। হা, শেষ অব্দি কেটি এই অবস্থাটাকে সহ্য করতে পারল না। মুহূর্তের মধ্যে গহ্বরের অভ্যন্তরে বিপুল বিস্ফোরণ ঘটে গেল। আহা, আমার বোধহয় মৃত্যু হল। কেটি ক্ষণকালের জন্য ভাবল, আমি এক লহমায় স্বর্গের বাসিন্দা হয়ে গেলাম।
***
তারা সমস্ত পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াল। প্যারিস, জুরিখ, সিডনি, নিউইয়র্ক। কোম্পানির ব্যবসার জন্য যেখানেই তারা গেছে, নিজেদের জন্য কিছুটা সময় বের করেছে। সমস্ত রাত ধরে গল্প করেছে। ভালোবেসেছে, শরীর এবং মনকে অধিকার করার চেষ্টা করেছে। ডেভিডের সাহচর্যে কেটির মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রোজ সকালে সে স্বামীর ঘুম ভাঙিয়েছে। নতুন ছলাকলায় নিজেকে প্রকাশ করেছে। তারপর? শুরু হয়েছে ব্যবসায়িক সম্মেলন। সেখানে আরও বেশি সময় দিতে হয়েছে। ব্যবসা সম্পর্কে কেটির একটা স্বাভাবিক আগ্রহ আছে। সাধারণত এটা দেখা যায় না। মেয়েরা ব্যবসার ব্যাপারে উদাসীনতা অবলম্বন করে থাকে। কেটি কিন্তু সব ব্যাপারেই ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি সে মনোভাব পাল্টাতে পারে। নতুন নতুন মেশিন নিয়ে খেলতে ভালোবাসে। ডেভিড তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে অবাক হয়ে গেছে। হ্যাঁ, এই পৃথিবীতে কেটি বিজয়িনী হবার জন্য জন্মেছে। যে জিনিসকে সে করায়ত্ত করতে চায়, তা হল অপরিমাপ্য ক্ষমতা। শেষ পর্যন্ত আর একটা হনিমুন শেষ হল, ডাকহারবারে সেই সিডারহিল হাউসে।
***
১৯১৪ সালের ২৮শে জুন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা শোনা যাচ্ছে। কেটি এবং ডেভিড এসেছে সাসেকসে। এখানে একটি কাউন্ট্রি হাউসে তারা দিন কাটাচ্ছে। সপ্তাহ শেষে আনন্দের আসর। হৈ-হৈ শুরু হয়ে গেছে। আহা, এত অবসর, এত আনন্দ।
ডেভিড বলেছিল– এখানে আর কতদিন থাকব?
-হ্যাঁ, কিছুদিন তো কাটাতেই হবে। তারপর বাড়ি যাব। সেখানে না হয় আবার অন্যভাবে আদর করা যাবে।
ডিনারের আসরে একটা খারাপ খবর এল। অস্ট্রিয়ান হাঙ্গেরিয়ান সিংহাসনের উত্তরধিকারী ফ্রান্সিস ফার্দিনান্দ এবং তার স্ত্রী সোফিয়াকে হত্যা করা হয়েছে।
লর্ড ম্যানি, তার কর্তা। বললেন– এক মহিলাকে মেরে ফেলা হল। বালকান প্রদেশে যে কোনো সময় যুদ্ধ বেঁধে যাবে।
এরপর যুদ্ধ সম্বন্ধে আলোচনা হল।
বিছানাতে শুয়ে কেটি বলেছিল– সত্যি সত্যি ডেভিড, যুদ্ধ হবে কি?
-হ্যাঁ, ঠিক বুঝতে পারছি না। কে একজন আর্চ ডিউকের মৃত্যু হয়েছে তা নিয়ে যুদ্ধ।
***
অনুমানটা মিথ্যে প্রমাণিত হল। সার্বিয়াকে সন্দেহ করা হল। ভাবা হল ফার্দিনান্দকে সার্বিয়ার কোন আততায়ী হত্যা করেছে। অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। অক্টোবরের মধ্যে পৃথিবীর সবকটা শক্তি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। এটা এক নতুন ধরনের যুদ্ধ। এই প্রথম অতি উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করা হল। এরোপ্লেনের পাশাপাশি এয়ার এবং সাবমেরিন ব্যবহৃত হল।
যেদিন জার্মানি যুদ্ধে যোগ দিল, কেটি বলল- হ্যাঁ, একটা দারুণ সুযোগ এসেছে আমাদের হাতে।
ডেভিড জানতে চেয়েছিল– তুমি কী বোঝাতে চাইছ?
বিভিন্ন দেশ যুদ্ধ করছে। তাদের এখন অনেক অস্ত্র লাগবে।
-তারা ওই অস্ত্র আমাদের কাছ থেকে কিনবে কেন? কেটি, অনেক ব্যবসা হয়েছে, মানুষের রক্তের বিনিময়ে আর ব্যবসা করে কী লাভ?
-তুমি বোকার মতো কথা বলো না। আমরা এই ব্যবসা না করলে অন্য কেউ তো করবে?
না, যতদিন আমি এই কোম্পানির সঙ্গে থাকব, আমি বাধা দেব। এই ব্যাপারটা নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা না করলেই ভালো হবে, কেটি। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে গেল।
কেটির মনে হল, ডেভিডকে ব্যবসার মধ্যে না জড়ালেই বোধহয় ভালো হত।
বিয়ের পর এই প্রথম সে একলা শুলো। ভাবল, ডেভিড এত বোকা আর আদর্শবাদী হল কী করে?
ডেভিড ভেবেছিল, মেয়েটা এত পাল্টে গেল। ব্যবসাটাকে নির্মম হৃদয়হীন করে দিয়েছে। দিনগুলো কাটছে অস্থিরতার মধ্যে। হ্যাঁ, একটা আবেগ তাড়িত ঘৃণা দেখা দিয়েছে। ডেভিড জানে না, কীভাবে এই সম্পর্কটাকে আবার সেতু দিয়ে বাধা যেতে পারে। কেটিকে আরও গর্বিত মনে হচ্ছে। অহংকারে ফেলতে চাইছে না বুঝি।
***
প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ঘোষণা করেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধে যোগ দেবে না। শেষ পর্যন্ত তার সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। মিত্রপক্ষের তরফ থেকে মার্কিন দেশের কাছে অনুরোধ করা হল, এই যুদ্ধে যোগ দিতে। তখন একটা শ্লোগান উঠল- পৃথিবীটাকে গণতন্ত্রের পক্ষে আদর্শ স্থান করা উচিত।
ডেভিড দক্ষিণ আফ্রিকাতে বসে যুদ্ধের নানা খবর পাচ্ছে। বোঝা গেল, এবার যুদ্ধটা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। শেষ পর্যন্ত তাই হল।
একদিন কথা বলতে বলতে ডেভিড কেটিকে বলল- আমি এক আমেরিকান, আমার এখন যুদ্ধে সাহায্য করা উচিত।
তোমার বয়স ছেচল্লিশ বছর।
–তাতে কী হয়েছে, আমি প্লেন চালাতে পারি। আমার দেশ আমাকে ডাকছে।
কেটি কিছুতেই ডেভিডকে বাধা দিতে পারল না। কয়েক দিন তারা শান্তভাবে কাটাল। এই ঘৃণার কথা ভুলে গেল। আবার একে অন্যকে ভালোবাসল।
ডেভিড এবার ফ্রান্সে চলে যাবে, সে বলল- তুমি এবং ব্রাড রজারস ব্যবসাটা ভালোভাবে চালিও কিন্তু।
-তোমার কিছু হলে কী হবে?
না, আমার কিছুই হবে না, আমি মেডেল গলায় ঝুলিয়ে তোমার কাছে ফিরে আসব। পরের দিন সকালবেলা সে যুদ্ধক্ষেত্রে চলে গেল।
***
ডেভিডের অনুপস্থিতি কেটি কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। অনেক দিন ধরে অনেক অপেক্ষা এবং ষড়যন্ত্র করে সে ডেভিডকে অধিকার করেছে। এখন যদি ডেভিড তার জীবন থেকে চলে যায়, তাহলে কী হবে। সব সময় সে একটা অজ্ঞাত আততায়ীর কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। শান্ত রাস্তায় কে যেন হঠাৎ হেসে উঠেছে। একটা শব্দ, একটা গান, ডেভিডের উপস্থিতি সে সর্বত্র অনুভব করতে পারছে। ডেভিডকে প্রত্যেক দিন সে লম্বা চিঠি দেয়। ডেভিডের কাছ থেকে চিঠি এলে বারবার পড়তে থাকে পড়তে পড়তে কাগজ কুচি কুচি হয়ে যায়। হ্যাঁ, ডেভিড ভালো আছে। জার্মানরা আকাশ যুদ্ধে আধিপত্য দেখিয়েছে, আমেরিকা এখন এই লড়াইতে নেমে পড়বে। ডেভিড মাঝে মধ্যেই চিঠি লিখছে।
তোমার যেন কিছু না হয়, ডার্লিং, তুমি কেন আমাকে ছেড়ে যুদ্ধে গেলে।
নিঃসঙ্গতার অভিশাপ ভোলার জন্য এখন কেটি আরও বেশি করে ব্যবসায় মন দিয়েছে। যুদ্ধের প্রথম দিকে ফ্রান্স এবং জার্মানি ইওরোপের শক্তিশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু মিত্রশক্তির হাতে আরও বেশি সৈন্য আছে, তাদের রসদের অভাব নেই। রাশিয়া বিশ্বের সবথেকে বড় পদাতিক বাহিনীর অধিকর্তা। কিন্তু তাদের অভাব আছে অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রশাসনের।
কেটি ব্রাড রজারসকে বলেছিল ওদের সকলকে সাহায্য করতে হবে, ট্যাঙ্ক দরকার, বন্দুক দরকার, যুদ্ধের যন্ত্রপাতি।
ব্রাড রজারস অসহিষ্ণু হয়ে বলতে চেয়েছিল কেটি, ডেভিড কিন্তু এইভাবে চিন্তা করেনি।
–ডেভিড এখন নেই, ব্রাড, এটা তোমার আমার মধ্যে।
ব্রাড রজারস জানে, কেটি বলতে চেয়েছে, এটা তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
ডেভিডের এই মনোভাবটা কেটি বুঝতে পারছে না। মিত্রপক্ষের হাতে আরও অস্ত্র দিতেই হবে। কেটির মনে হল, তাকে দেশের প্রতি এই কর্তব্য করতেই হবে। সে অনেকগুলো বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের সাথে কথা বলার চেষ্টা করল। এক বছরের মধ্যে ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড কোম্পানি বন্দুক এবং ট্যাঙ্ক তৈরির কাজে লেগে পড়ল। এর পাশাপাশি তারা মারাত্মক বোম তৈরি করতে শুরু হল। কোম্পানি ট্রেন, ট্যাক্সি এবং ইউনিফর্ম ও বন্দুক পাঠাতে শুরু করল। ক্রুগার ব্রেষ্ট সারা পৃথিবীর অন্যতম সেরা কোম্পানিতে পরিণত হল।
ব্রাড রজারসের দিকে তাকিয়ে কেটি প্রশ্ন করল– এটা দেখেছ? ডেভিডের ধারণা যে ভুল সেটা তো নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?
দক্ষিণ আফ্রিকাতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ উদ্বেল হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দলের নেতারা মিত্রপক্ষকে সমর্থনের কথা বলছেন। তারা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে চাইছেন। অথচ আফ্রিকানদের বেশির ভাগ গ্রেট ব্রিটেনকে সাহায্য করতে চাইছে না। তারা অতি সহজে অতীত ইতিহাস ভুলতে পারবে না।
ইওরোপে যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ঘুরে গেছে। পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ একটা স্থিতাবস্থায় এসে গেছে। দু-পক্ষই ট্রেঞ্চ করে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য তৈরি হচ্ছে। ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সৈন্যদের অবস্থা শোচনীয়। প্রবল বৃষ্টিপাতে রণক্ষেত্রে জল এবং কাদার সমাবেশ। বড়ো বড়ো ইউঁর অনায়াসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ডেভিড যে বাতাস যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, সেই খবরটা কেটিকে মুগ্ধ করেছে।
১৯১৭ সালের ৬ এপ্রিল। প্রেসিডেন্ট উইলসন যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। হ্যাঁ, আমেরিকা সত্যি সত্যি যুদ্ধে নেমে পড়েছে।
২৬ জুন ফ্রান্সে আমেরিকার বিমান বাহিনী অবতরণ করল। নতুন নতুন প্লেনের নাম সবাইকার মুখে মুখে ঘুরছে। ১১ নভেম্বর যুদ্ধ শেষ হল। মিত্রশক্তিকে হারানো সম্ভব হল না। পৃথিবী আবার গণতন্ত্রের মহান ধারক হয়ে উঠতে পারল।
ডেভিড এবার বাড়িতে ফিরবে।
কেটি তাকে আনতে গেছে। তারা অনেকক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল। চারপাশের চিৎকারকে উপেক্ষা করল। একটু বাদে কেটি ডেভিডকে জড়িয়ে ধরল, অনেকটা রোগা হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে, ডেভিড খুব ক্লান্ত। কেটি ভাবল কতদিন আমি ওর সাহচর্য পাইনি। তার মনে অনেক প্রশ্নের ভিড়।
সে বলল– আমি তোমাকে সিডারহিল হাউসে নিয়ে যাব। সেখানেই তুমি ভালোভাবে বিশ্রাম নিতে পারবে।
***
ডেভিড আসবে বলে কেটি এই বাড়িটাকে সুন্দরভাবে সাজিয়েছে। ভালো ভালো সোফা পেতেছে, বাগানে ফুলের সমারোহ। ফায়ার প্লেসের ওপরে একটা সুন্দর ক্যানভাস রেখেছে, সেখানে নানা ফুল।
কেটি ডেভিডকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। তারা অনেকক্ষণ গল্প করল সুন্দরভাবে।
কেটি বলল- কী ভালো লাগছে।
–ভারী সুন্দর, কেটি। একটু বসো। তোমার সাথে আমার কথা আছে।
কেটির মনে আশঙ্কা, কিছু ভুল হয়েছে কি?
–তুমি পৃথিবীর সর্বত্র যুদ্ধাস্ত্র পাঠাচ্ছ, তাই তো?
কেটি বলল- হ্যাঁ, তুমি কি আমাদের হিসাবের খাতাপত্র দেখেছ? আমাদের লাভ কিন্তু আকাশ ছুঁয়েছে।
–আমি অন্য কথা বলছি। আগেও তো আমরা অনেক লাভ করতাম। আমি তোমায় বলেছিলাম, কখনও যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করব না। এটা নীতির প্রশ্ন।
এই কথা শুনে কেটি অত্যন্ত রাগ করল। সে বলল- ডেভিড, সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে সবকিছু পাল্টাতে হয়, তা না হলে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না।
ডেভিড কেটির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল– তুমিও কি বদলে গেছো নাকি?
বিছানাতে কেটি শুয়ে আছে, নিজেকে প্রশ্ন করছে, কে পাল্টে গেছে? সে, নাকি ডেভিড? সে কি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, নাকি ডেভিড হয়েছে দুর্বল। সে জানে না, এটা নীতির প্রশ্ন, নাকি নেহাতই লাভ লোকসানের খতিয়ান। হয়তো এর সপক্ষে কোনো কথাই বলা যাবে না। আমি তৈরি না করলে অন্য কোনো কোম্পানি তৈরি করত। তারা অনেক লাভ করত, ডেভিডের মাথায় কী এতটুকু বুদ্ধি নেই? এতদিন কেটি ভাবত, ডেভিড পৃথিবীর সবথেকে বুদ্ধিমান পুরুষ। এখন সেই ভাবনাটা পাল্টাতে হবে।
সকালবেলা কেটি এবং ডেভিড ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে আছে। তারা বাগানে চলে গেল। ডেভিড বলল ভারি ভালো লাগছে।
কেটি বলল–গতকাল রাতের কথাবার্তা?
–ওটা তো শেষ হয়ে গেছে। তুমি ঠিক কথাই বলেছ। আমি- কেন তোমার ব্যাপারে মত প্রকাশ করব?
কেটি অবাক হয়ে গেছে, এখন সে কোনো কথা বলতে চাইছে না। হ্যাঁ, কোম্পানি তো তার স্বার্থেই এসব কাজ করেছে। তা হলে? কোম্পানি কি আমার বিয়ের থেকে বড়ো? নিজের মনে এই প্রশ্নটা এসেছে, কেটি জানে না, কীভাবে উত্তর দেবে?
.
১৭.
পরবর্তী পাঁচ বছর সারা পৃথিবী অসাধারণ উন্নয়নকে প্রত্যক্ষ করেছে। ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড আরও উন্নত হয়ে উঠেছে। শুধু হিরে আর সোনা তুলেই তারা কাজ শেষ করছে না–সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন দিকে ব্যবসাকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এখন আর শুধুমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকাতেই তার মূল কেন্দ্র নেই। তারা একটা বিরাট প্রকাশনা জগতকে কিনেছে। ইনসিওরেন্স কোম্পানিও কিনে নিয়েছে।
একরাতে কেটি ডেভিডকে ঘুম থেকে তুলে বলল- ডার্লিং, চলো, আমরা এই কোম্পানির হেড কোয়ার্টারটাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাই।
ডেভিড জানতে চাইল তার মানে?
–আজকে পৃথিবীর ব্যবসার কেন্দ্র হয়েছে নিউইয়র্ক। সেখানে আমাদের হেড কোয়ার্টার স্থাপন করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকাতে কেউ চট করে আসতে চাইছে না। এখন তো আমরা টেলিফোন এবং কেবল ব্যবহার করতে পারব। এক মিনিটের মধ্যে যে কোনো অফিসের সঙ্গে সংযোগ করতে পারব।
–আগে একথাটা কেন ভাবোনি? ডেভিড কথা বলার চেষ্টা করে আবার ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেল।
***
হ্যাঁ, নিউইয়র্ক একটা নতুন জগৎ। আগে যারা নিউইয়র্কে গেছে, তারা অবাক হয়ে যাবে। কেটিও অবাক হয়ে গেল। পৃথিবী কত দ্রুত পাল্টাচ্ছে, নিউইয়র্ক দেখে এলে সেই সত্যটা উপলব্ধি করা যায়।
কেটি এবং ডেভিড নতুন কোম্পানির হেড কোয়ার্টারের জন্য একটা জায়গা নির্বাচন করল। সেটা ওয়াল স্ট্রিটে অবস্থিত। স্থপতিরা কাজ করতে শুরু করলেন। কেটি আর একজন স্থপতিকে ডেকে পাঠাল। ফিফথ এভিনিউতে যোড়শ শতাব্দীর একটা ফরাসি ম্যানসন স্থাপন করতে হবে।
ডেভিড অভিযোগ জানিয়ে বলেছিল– শহরটাতে এত শব্দ।
কথাটা সত্যি, হ্যাঁ, প্রত্যেক মুহূর্তে শব্দের উতরোল। মনে হচ্ছে এই শহরটা বুঝি স্বর্গের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠবে। হ্যাঁ, নিউইয়র্ক আজ ব্যবসার মক্কা হয়ে উঠেছে। বড়ো বড়ো কোম্পানির হেডকোয়ার্টার এই শহরে অবস্থিত। জাহাজ কোম্পানি থেকে ইনসিওরেন্স, যোগাযোগ এবং পরিবহন। হ্যাঁ, এই শহরের মধ্যে একটা আশ্চর্য জীবন উম্মাদন আছে। কেটি সেটাকে ভালোবাসে, তবে ডেভিড পছন্দ করতে পারে না।
-ডেভিড, এটাই হল ভবিষ্যৎ। এই জায়গাটা দ্রুত বাড়ছে। আমাদেরও তাল দিয়ে চলতে হবে।
-হায় ঈশ্বর, কেটি, তুমি আর কী চাও?
কোনো কথা না বলে কেটি বলেছিল– আমি সব কিছু করায়ত্ত করতে চাই।
ডেভিডের এই প্রশ্নের অন্তরালে কী আছে, কেটি জানত না, এটা একটা মজার খেলা, এই খেলাতে জিততেই হবে। ডেভিড কেন বুঝতে পারছে না। ডেভিড একজন ভালো ব্যবসাদার, কিন্তু তার মধ্যে কোনো কিছু একটার অভাব আছে, প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি, জেদ, যার সাহায্যে মানুষ বড়ো হয়ে ওঠে। সবথেকে বড়ড়া হতে হবে, এমন একটা অদম্য মনোভাব। তার বাবার মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাস ছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে কেটি সেটা পেয়েছে। কেটি জানে না, কী ঘটনা ঘটবে, কিন্তু তার জীবনে যে একটা পরিবর্তন আসছে, সেটা সে অনুভব করতে পারে। কোম্পানিটা এখন আরও উন্নত হয়েছে। আরও বেশি টাকা আয় করতে হবে।
একদিন ডেভিডের কাছে সে তার মনের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছিল।
ডেভিড হাসতে হাসতে বলল– তুমি তো খাটতে খাটতে জীবন শেষ করে দেবে।
না, বাবাকে আমি অনুসরণ করব। তার জন্য যদি কোনো অসুবিধা হয়, তাও আমাকে সহ্য করতে হবে।
কেটি অবাক হয়ে গেছে, কাজ করার মধ্যেই মানুষ জীবনের সব থেকে বেশি আনন্দ খুঁজে পায়। প্রত্যেক দিন সকালে তার সামনে অনেক সমস্যা দেখা দেয়, প্রত্যেকটি সমস্যা একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। এমন একটা ধাঁধা, যা সমাধান করতে হবে। এমন একটা খেলা, যা জিততে হবে। কেটি সেই খেলাতে অংশ নেয়, ভয়ে পালিয়ে যায় না। শেষ পর্যন্ত ওই খেলায় সে জিতে যায়। সে জানে, সে এখন এমন ক্ষমতা করায়ত্ত করেছে, যা লক্ষ মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে।
তাকে প্রায় রাজা এবং রানিদের সাথে নৈশভোজে মিলিত হতে হয়। বিভিন্ন দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতিরা পর্যন্ত তার কাছে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়ে দেন। সকলেই তার সাহায্য প্রার্থী। তার ভালোবাসা পেতে ইচ্ছুক। নতুন ক্রুগার ব্রেন্ট কোম্পানি মানে হাজার লোকের চাকরির বন্দোবস্ত। কোম্পানিটা সজীব, দৈত্যের মতো বেড়ে চলেছে। অনেক লোকের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে। এর জন্য কিছুটা পরিশ্রম তো করতেই হবে। এই দৈত্যকে কখনও স্থানচ্যুত করা যাবে না। কেটি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। এর মধ্যে একটা ছন্দ আছে। একটা স্পন্দন। এই খেলাটায় শেষ পর্যন্ত জিততেই হবে—
***
হঠাৎ কেটির শরীর খারাপ হল। পরবর্তী বছরের মার্চ মাসে। জন হার্টলে নামে একজন ডাক্তারের চেম্বারে ডেভিড তাকে নিয়ে গেল। জন তাকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে বললেন- বিশেষ কোনো চিন্তা করবেন না, কিছুদিন বাদে আমি আপনাকে রিপোর্টটা বলে দেব।
***
বুধবার সকালবেলা কেটি ডাক্তারকে ফোন করল।
ডাক্তার বললেন মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, আপনি মা হতে চলেছেন।
কেটির জীবনের অন্যতম উত্তেজক মুহূর্ত, ডেভিড আসা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে পারেনি। ডেভিড এই খবরটা শুনে খুবই আনন্দিত। সে কেটিকে জড়িয়ে ধরে বলল একটা মেয়ে হবে। তোমার মতো দেখতে।
হ্যাঁ, কেটির এটাই দরকার, এখন তাকে আরও বেশিক্ষণ বাড়িতে থাকতে হবে। সে এখন এক সত্যিকারের স্ত্রী হয়ে উঠবে।
কেটি ভাবল– এটা একটা ছেলে হবে। একদিন সে ক্রুগার ব্রেন্ট সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হবে।
***
ধীরে ধীরে বাচ্চাটার জন্মের সময় এগিয়ে আসছে। কেটি আর বেশিক্ষণ অফিসে কাজ করতে পারছে না। তা সত্ত্বেও প্রত্যেকদিন অফিসে যায়।
ডেভিড বলল- এখন ব্যবসার কথা ভুলে যাও।
কিন্তু ব্যবসাটা যে কেটির অবসর বিনোদনের জায়গা, ডেভিড কেন তা বুঝতে পারছে না।
ডিসেম্বরে শিশুটার জন্ম হবে। কেটি ডেভিডকে বলেছিল– আমি পঁচিশে ডিসেম্বরের আগেই ছেলেটাকে পৃথিবীতে আনব। সে হবে বড়োদিনের উপহার।
হ্যাঁ, এটা একটা সুন্দর বড়োদিন হবে। কেটি ভাবল। সে এমন একজন মানুষকে ভালোবেসেছিল, যাকে বিয়ে করে এখন সেই ভালোবাসা তাকে জীবনের পরম কাঙ্খিত উপহার দিচ্ছে। এর থেকে বড়ো প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?
***
তার সমস্ত শরীরটা বড়ো হয়ে গেছে। হ্যাঁ, কেটি অফিসে যেতে পারছে না। ডেভিড আর ব্রাড রজারস তাকে বাড়ি থাকার কথা বলছে। কিন্তু কেটি জবাব দিচ্ছে, আমার মাথা কিন্তু কাজ করছে।
দেখতে দেখতে আরও কয়েক মাস কেটে গেল। ডেভিড দক্ষিণ আফ্রিকাতে গেছে হিরের খনি পরিদর্শন করতে। পরবর্তী সপ্তাহে সে নিউইয়র্কে ফিরে আসবে।
***
কেটি রজারসের বিষাদঘন মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল কিছু হয়েছে কি? কোনো ক্ষতি?
না, কেটি, আমি এই মাত্র একটা খবর পেয়েছি, একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, পিনিয়েল খনিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে।
কেটির মনে আশঙ্কা কী হয়েছে? খারাপ কোনো খবর? কেউ কি মারা গেছে?
ব্রাড কোনোরকমে বলল– দু-জনের মৃত্যু হয়েছে, ডেভিড তাদের মধ্যে একজন।
শেষের শব্দগুলো কেটি যেন শুনতে পাচ্ছে না। এক মুহূর্তে মনে হল, সারা পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হয়ে গেছে। হ্যাঁ, সে অবচেতনার অন্ধকারে ডুবে গেল।
***
একঘণ্টা বাদে ছেলেটার জন্ম হল। দুমাস আগে। কেটি তার ছেলের নাম রেখেছে। অ্যান্থনি জেমস ব্ল্যাকওয়েল, ডেভিডের বাবার নামে। সে নবজাতক শিশুটির দিকে তাকিয়ে বলল- আমি তোমাকে ভালোবাসব আমার জন্য, আমি তোমাকে ভালোবাসব তোমার বাবার জন্য।
***
একমাস বাদে কেটি তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে ফিফথ এভিনিউ ম্যানসনে উঠে এসেছে। অনেক চাকর ঝি সঙ্গে এসেছে। ইতালি থেকে বিখ্যাত শিল্পীরা এসে বাড়িটাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিয়েছে। যোড়শ শতাব্দীর ইতালিয় ওয়ালনাটের ফার্নিচার রয়েছে। কারুকাজ করা সবকিছু। লাইব্রেরিতে অসাধারণ বই, অষ্টাদশ শতাব্দীর ফায়ার প্লেস। বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি। তার পাশে ডেভিডের স্মারক চিহ্ন। আর্ট গ্যালারিতে কেটির বিখ্যাত শিল্পীদের ছবি। হ্যাঁ, বাথরুমও তৈরি করেছে। ডাইনিং রুম এবং নার্সারি। অনেকগুলো বেডরুম আছে। এই বিরাট বাড়িটার মধ্যে। বাগানের ভেতর রডিনের তৈরি ভাস্কর্য। বিশ্বের বিখ্যাত শিল্পীদের ছবিও ঝুলছে চারপাশে। এটা সত্যিকারের রাজার প্রাসাদ। একজন রাজা তো এসে গেছে পৃথিবীর বুকে, তাকে ঠিক মতো বড়ো করে তুলতে হবে।
১৯২৮, টনির বয়স চার। কেটি তাকে নার্সারি স্কুলে পাঠাল। ছোট্ট ছেলেটি শান্ত, মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মায়ের মতোই মুখখানা পেয়েছে। কেটি তাকে মন দিয়ে গান শেখাচ্ছে, দশ বছর বয়সে ছেলেটা নাচের স্কুলে ভরতি হল। কখনও কখনও মা আর ছেলে সিডারহিল হাউসে চলে যায়, কেটি একটা সুন্দর প্রমোদ তরণী কিনেছে। ৮০ ফুট লম্বা একটা নৌকো। তার নাম দিয়েছে কর্সিয়ার। টনি মাঝে মধ্যেই উপকূলের ধারে ঘুরে বেড়ায়। টনির ভীষণ ভালো লাগে এই সমুদ্রযাত্রা।
তারপর? কোম্পনির সম্পর্কে কিছু খবর দেওয়া দরকার। জেমি ম্যাকগ্রেগর যে কোম্পনি স্থাপন করেছিলেন, সেটা এখনও ভীষণভাবে জীবন্ত। এই কোম্পানিই কেটির প্রথম এবং শেষ প্রেমিক। সে একদিনও কোম্পানি ছাড়া কিছু চিন্তা করতে পারে না। কেটি মনে মনে শপথ নিল, এই কোম্পানিকে আমি চিরদিন ভালোবাসব। একদিন এর দায়িত্ব আমি আমার ছেলের হাতে তুলে দেব।
***
কেটির জীবনে একটাই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, তার প্রিয় দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখানকার জাতিগত সমস্যা অকাশ ছুঁয়েছে। তাকে মাঝে মধ্যেই এই সমস্যার আগুন আঁচ পোহাতে হয়। দুদিকে দুটো রাজনৈতিক সংগঠন, তাদের মধ্যে দারুণ বৈরীতার সম্পর্ক। সবজায়গা থেকে কালো মানুষদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা ভোট দেবার অধিকার থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে বাধ্য হয়েছে। বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে অত্যাচারিত হতে হচ্ছে। নতুন আইন তাদের ওপর আঘাত করেছে। যেসব জায়গাতে কোনো খনিজ পদার্থ নেই, নেই কোনো শিল্পকারখানা, সেখানে কালো এবং ইন্ডিয়ানদের জোর করে পাঠানো হচ্ছে।
কেটি চেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন সরকারী আধিকারিদের সঙ্গে একটা উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের ব্যবস্থা করতে। সেই বৈঠকে কেটি বলেছিল, আপনারা টাইম বোমা নিয়ে খেলা করছেন। আপনারা কেন আশি লক্ষ মানুষকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন?
একজন বলেছিলেন– এটা ক্রীতদাস প্রথা নয়, মিসেস ব্ল্যাকওয়েল। আমরা আমাদের স্বার্থে নয়, তাদের স্বার্থেই এই আইন প্রণয়ন করতে চলেছি।
–আপনি কী পরিষ্কার করে বলে দেবেন?
প্রত্যেক জাতিকে কিছু না কিছু দিতে হবে। যদি কালোরা সাদাদের সমান হয়ে উঠতে চায়, তাহলে তারা তাদের স্বতন্ত্রতা হারাবে। আমরা তাদের স্থানীয় সত্তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছি।
ব্যাপারটার মধ্যে কোনো সারবত্তা নেই। কেটি বলেছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা কী শেষ পর্যন্ত একটা নরকে পরিরত হবে?
–আপনার অনুমান ঠিক নয়। কালোরা কেন এই দেশে এসেছে, নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে। তাদের ওপর কিছু ট্যাক্স বসানো হয়েছে। কিন্তু তা তো দিতেই হবে। পৃথিবীর আর কোথাও সাদাদের পাশাপাশি কালোরা কী মাথা উঁচু করে থাকতে পারে?
এইভাবে আলোচনা এগিয়ে গেল। কেটি বুঝতে পারল, এই আলোচনা করে কোনো লাভ নেই। আবার নিজের দেশের জন্য চিন্তিত হয়ে উঠল সে।
বান্দার কথা তার বারবার মনে পড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার খবরের কাগজে তাকে এক জঘন্য হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই গল্পগুলোর ভেতর কোনো সত্যি নেই, কেটি জানে, বান্দা নিজেকে শ্রমিক হিসেবে লুকিয়ে রেখেছে। কখনও সে ড্রাইভারের ছদ্মবেশ ধরে, সে গেরিলা আর্মি তৈরি করেছে। পুলিশের ওয়ান্টেড তালিকায় তার নাম আছে। কেপটাউন পত্রিকাতে বান্দা সম্পর্কে একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বলা হয়েছে, সে নাকি কালো মানুষদের নয়নের মনি। সে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে চলে যায়, ছাত্রদের সামনে জ্বালাময়ী ভাষায় ভাষণ দেয়। পুলিশ তাকে ধরতে পারছে না। বান্দা চট করে পালিয়ে যায়। বান্দার নাকি ব্যক্তিগত বডিগার্ড আছে। সে বিভিন্ন বাড়িতে রাত কাটায়। কেটি বুঝতে পারছে, মৃত্যুই হবে বান্দার এই অভিযানের একমাত্র ফলশ্রুতি।
কেটিকে যে করেই হোক বান্দার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। সে তার এক পুরোনো কৃষ্ণকায় ফোরম্যানকে ডেকে পাঠাল। এই লোকটিকে সে খুব বিশ্বাস করে।
সে বলল- উইলিয়াম, তুমি কি বান্দাকে বের করতে পারবে?
যদি বান্দা ইচ্ছে করে, তবেই সে ধরা দেবে।
–চেষ্টা করো, আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
–চেষ্টা করে দেখছি।
পরের দিন সকালবেলা ফোরম্যান বলল- আপনি কি আজ সন্ধ্যেবেলা ফাঁকা আছেন? আপনাকে একটা গাড়ি তুলে নিয়ে যাবে।
***
কেটিকে জোহানেসবার্গের সত্তর মাইল দূরে নিয়ে যাওয়া হল। ড্রাইভার গাড়িটাকে একটা ছোট্ট বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়েছে। কেটি ভেতরে ঢুকল। বান্দা ভেতরে ছিল। একই রকম দেখতে লাগছে তাকে। হ্যাঁ, তার বয়স এখন নিশ্চয়ই ষাট বছর, কেটি ভাবল, অনেক দিন ধরে সে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তার চেহারার মধ্যে উত্তেজনার চিহ্ন নেই।
সে কেটিকে জড়িয়ে ধরে বলল তুমি তো আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছ।
কেটি হাসল- হ্যাঁ, আমার বয়স হচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যেই চল্লিশে পা দেব।
বয়সগুলো তোমার পাশ দিয়ে পিছলে পালিয়ে গেছে, কেটি।
তারা কিচেন গেল। বান্দা কফি তৈরি করছে।
কেটি বলল- এসব ঘটনা কী ঘটছে বান্দা? তুমি এখনও কেন রাজনীতির মধ্যে নিজেকে জড়াচ্ছ?
–ভবিষ্যৎ আরও খারাপ, বান্দা শান্তভাবে বলল, সরকার কেন আমাদের হাতে সামান্য স্বাধীনতা তুলে দিচ্ছে না। সাদা মানুষরা আমাদের সবকিছু ধ্বংস করছে। তারা সেতুটা ভেঙে দিয়েছে। একদিন তারা দেখবে, কিছুতেই আর আমাদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারছে না। আমরা এখন নতুন নেতা পেয়ে গেছি কেটি। একের পর এক নতুনের জন্ম হচ্ছে। সাদারা আর আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। এতদিন তারা আমাদের সঙ্গে ছাগল কুকুরের মতো ব্যবহার করেছে।
কেটি আশ্বস্ত করে বলল- সবাই কিন্তু নয়। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা তোমাদের সংগ্রামে সাহায্য করে। দেখো, একদিন অবস্থাটা পাল্টে যাবে।
সময় হল বালির ঘড়ি, দ্রুত ফসকে যায়।
বান্দা, তোমার ছেলে আর. বউয়ের খবর কী?
আমার বউ আর ছেলে দুটোই আছে, পুলিশ এখন আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
–আমি কি তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারি? এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে খারাপ লাগছে। তোমার কি টাকার দরকার?
-হা, টাকার তো দরকার আছে।
–আমি ব্যবস্থা করছি।
পরের দিন সকালে কেটি নিউইয়র্কে ফিরে এল।
***
টনির এখন একটু বয়স বেড়েছে। সে এখন কেটির সঙ্গে এখানে সেখানে যেতে পারছে। স্কুলের যখন ছুটি থাকে, তখন কেটি তাকে সঙ্গে নিয়ে নানান জায়গায় যায়। টনি মিউজিয়াম দেখতে খুবই ভালোবাসে। বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বাড়িতে টনি দেওয়ালের গায়ে সেইসব ছবি আঁকার চেষ্টা করে। সে কিন্তু অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী।
জীবনের এত রঙ্গরস টনি উপলব্ধি করে। তার চরিত্রের মধ্যে একটা স্বভাবসুলভ লজ্জা আছে। কেটি তার ছেলেকে নিয়ে খুবই গর্বিত। সবসময় ক্লাসে সে প্রথম হয়। মাঝে মাঝেই মায়ের কাছে তার খুশির খবর শুনিয়ে যায়।
১৯৩৬- টনির বারোতম জন্মদিন। কেটি মধ্যপ্রাচ্য থেকে সবেমাত্র ব্যবসায়িক পরিভ্রমণ করে এসেছে। টনি কোথায়? টনিকে অনেকদিন দেখিনি। টনিকে জড়িয়ে ধরে আদর করল। বলল- শুভ জন্মদিন।
-হ্যাঁ মা, এই দিনটা আমার খুব ভালো লাগে।
টনি, তুমি কেমন আছো?
–আমার তো শরীর ভালো আছে।
–না, আস্তে আস্তে কথা বলছ কেন?
পরের কয়েক সপ্তাহে টনির শরীর আরও খারাপ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কেটি ডঃ হার্টলের সঙ্গে কথা বলল।
ডঃ হার্টলে বললেন- এই ছেলেটার মধ্যে খারাপ কিছু নেই। কিন্তু ওর মনের ওপর চাপ পড়েছে, কী?
–আমার ছেলের? আপনি এ প্রশ্ন করছেন কেন?
–উনি খুব অনুভবী ছেলে। মনে হচ্ছে ও বোধহয় এমন একটা চাপে আছে, যা সহ্য করতে পারছে না।
জন, আপনি ভুল বলছেন, টনি স্কুলে সবসময় প্রথম হয়, গত পরীক্ষায় ও তিনটে পুরস্কার পেয়েছে। স্কুলে ও সবার সেরা অ্যাথলেট। সবার সেরা স্কলার এবং আর্টসের সেরা ছাত্র।
ডাক্তার বললেন- টনি কেন এভাবে তোতলাচ্ছে বলুন তো?
–এই ব্যাপারটা আমিই দেখব।
না, এ ব্যাপারে আপনি কোনো কথা বলবেন না। কেটি এটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।
কেটি অবাক হয়ে বলল- টনির যদি কোনো মানসিক কষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে আমি সেই যন্ত্রণা দূর করব।
সমস্যা বাড়তে থাকল। ডাঃ হাটলে চার্টের দিকে তাকিয়ে বললেন- টনির এখন বারো বছর বয়স, এখন ওকে কোনো একটা প্রাইভেট স্কুলে পাঠালে ভালো হয়।
কেটি অবাক হয়ে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
হ্যাঁ, সেখানে গেলে ও নিজস্ব জগৎ খুঁজে পাবে। সুইজারল্যান্ডে এমন কয়েকটা ভালো স্কুল আছে।
সুইজারল্যান্ড? এত দূর? কেটি নিজেকে প্রশ্ন করল।
কেটি বলল- ঠিক আছে, আমি দেখছি।
সেই সন্ধ্যায় কেটি তার বোর্ড মিটিং-এ গেল না। তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরল। টনি বসে কাজ করছে।
তোতলাতে থাকে সে। কথা ঠিক মতো বলতে পারছে না।
কেটি সরাসরি তাকে বলল- টনি তোমাকে সুইজারল্যান্ডে পাঠালে কেমন হয়?
টনির চোখে বিস্ময় এবং আশার আলো। সে বলল- মা, আমি কি সত্যি যাব?
***
ছ-সপ্তাহ কেটে গেছে। টনিকে একটা জাহাজে তুলে দেওয়া হয়েছে। সে এখন লেক জেনেভার কাছে একটা স্কুলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। কেটি নিউইয়র্কের বন্দরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। আঃ, কতদিন আমি টনিকে দেখতে পাব না। তারপর সে লিমুজিনে করে অফিসে ফিরে গেল।
***
ব্রাড রজারসের সঙ্গে কাজ করতে ভালোই লাগে। ব্রাডের বয়স ছেচল্লিশ। কেটির থেকে বছর দুয়েকের বড়ো। অনেকদিন ধরে তারা পাশাপাশি বসে কাজ করছে। ক্রুগার ব্রেন্টের প্রতি ব্রাডের ভালোবাসা কেটিকে অবাক করে দিয়েছে। ব্রাড বিয়ে করেনি, আকর্ষণীয়া মেয়েদের সাথে নিয়মিত ঘুরে বেড়ায়। ধীরে ধীরে কেটি বুঝতে পারল, ব্রাড তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। মাঝে মধ্যে এমন কিছু কথা বলে, যার অন্তরালে আর একটা অর্থ থাকে। কিন্তু কেটি ব্রাডের সাথে সম্পর্কটাকে নেহাত ব্যবসায়িক পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করছে। একবারই সে এই গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, সেটা আজ ধূসর অতীত হয়ে গেছে।
ব্রাড রাতে দেরী করে ফেরে, কিন্তু সকালে যখন আসে, তখন খুবই ক্লান্ত থাকে। মনে হয়, তার মন অন্য কোথাও পড়ে আছে। এইভাবে একমাস কেটে গেল। ব্রাডের চরিত্রে কোনো একটা অসুবিধা দেখা দিয়েছে। কেটি ঠিক করল, কিছু একটা করতে হবে। সে বুঝতে পারল, ডেভিড এক সময় এক মেয়ের পাল্লায় পড়ে কোম্পানি ছাড়তে চেয়েছিল। এই ব্যাপারটা যেন ব্রাডের ক্ষেত্রে না হয়।
কেটি প্যারিসে যাবে বলে মনস্থ করল। একলাই যাবে। শেষ মুহূর্তে সে ব্রাডকে তার সঙ্গে যেতে বলল। সন্ধ্যেবেলা তারা একটা হোটেলে ডিনার খেল। ডিনার খাবার পর কেটি বলল- ব্রাড যেন তার সঙ্গে পঞ্চম জর্জ সুইটে যোগাযোগ করে।
যখন ব্রাড এল কেটি তাকে নিয়ে কথা বলতে শুরু করল।
কেটি শান্তভাবে বলল– ব্রাড, আমাদের একা থাকতে হবে।
-কেটি, কেন?
কেটি এগিয়ে এল, ব্রাডের হাতে হাত রাখল।
ব্রাড চিৎকার করে বলল- আমি তো অনেক দিন ধরেই তোমাকে ভালবেসেছি। কিন্তু আমি ভালোবাসা দেখাতে পারিনি।
–আমিও তাই ব্রাড, কিন্তু বলতে পারিনি।
তারা বেডরুমে চলে গেল।
কেটিকে এক যৌন আবেদনি রমণী বলা যেতে পারে। কিন্তু অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকাতে তার যৌন উদ্দীপনা অনেকটা স্তিমিত হয়ে গেছে। সে ব্রাডকে অন্য কারণে কাছে ডেকেছে। এর মধ্যে শারীরিক আকুতি নেই।
কেটির ওপর ব্রাড তার শরীরটাকে চাপিয়ে দিয়েছে। কেটি দুপা ফাঁক করে দিল। কেটি বুঝতে পারল, একটা কিছু তার ভেতর প্রবেশ করছে। ব্যাপারটা তার কাছে সুখ বা দুঃখের কিছুই হয়নি।
–কেটি, তোমাকে আমি অনেকদিন ধরে ভালোবেসেছি।
সে কেটির শরীরের ওপর চাপ দিল– অনন্তকাল ধরে আসা-যাওয়ার খেলা শুরু হল। চোখ বন্ধ করে কেটি ভাবল, এইভাবে ব্রাডকে আমি আটকে দিলাম। এটা কি ঠিক হল?
হ্যাঁ, এটাই বোধহয় ঠিক।
এখন স্পন্দনটা আরও দ্রুত হয়েছে। কেটি তার কোমর দোলাচ্ছে। ওই শরীরটাকে ঠেলে ওপরে রাখার চেষ্টা করছে। না, মনে মনে সে ভাবছে, আর একটা নতুন কোম্পানি চালু করতে হবে। এই কোম্পানির যদি কোনো অসুবিধা হয়, তাহলে?
ব্রাড মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করছে। আনন্দ এবং আর্তনাদ। কেটি তার শরীরটাকে আরও দ্রুত দোলাচ্ছে। ব্রাডকে পুলকের চরম শিখরে নিয়ে যাচ্ছে।
সে ভাবছে ওদের সব কথা বলতে হবে। ওদের সঙ্গে ব্যবসাটা ভালোভাবে করতে হবে।
ব্রাড হাঁপাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ব্রাড বলল- কেটি, তোমার কি ভালো লেগেছে?
কেটি হয়তো একটা মিথ্যে কথা বলল- ব্রাড মনে হচ্ছে, আমি বুঝি এতক্ষণ স্বর্গে ছিলাম।
সমস্ত রাত্রি কেটি ব্রাডকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল। চোখ বন্ধ করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা চিন্তা করছিল।
কেটি ও ব্রাড ঘুমিয়ে পড়ল, সকালে তাদের ঘুম ভাঙল।
কেটি বলল- ব্রাড, তোমার সেই প্রেমিকার খবর কী?
ব্রাড হেসে বলল- সে কী, তুমি এত হিংসুটে হলে কবে থেকে? ওর কথা ভুলে যাও। প্রতিজ্ঞা করছি, ওর কাছে কখনও যাব না।
***
ব্রাডের সাথে কেটি আর কখনও শয্যাতে যায়নি। ব্রাড হয়তো বুঝতে পেরেছে। কেটি কোনো কারণে তাকে এড়িয়ে চলেছে। এই ব্যাপারে ব্রাড প্রশ্ন করাতে কোটি জবাব দিয়েছে ব্রাড, তুমি কী জানো, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। কিন্তু তোমার সাথে এই সম্পর্ক স্থাপিত হলে আমরা পাশাপাশি বসে আর কাজ করতে পারব না। তুমি কী চাও আমাদের কোম্পানিটা নষ্ট হয়ে যাক। কোম্পানির স্বার্থে আমাদের এটুকু স্বার্থ ত্যাগ করতেই হবে।
শেষ পর্যন্ত ব্রাড কেটির কথা শুনতে বাধ্য হল।
কোম্পানিটা ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। কেটি বেশ কয়েকটা দাঁতব্য সংস্থা স্থাপন করেছে। বিভিন্ন কলেজ, চার্চ এবং স্কুলে অকাতরে অর্থ দান করছে। তার শিল্পসংগ্রহ এখন আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। নবজাগরণের পরবর্তী যুগের অনেক ছবি সে যত্নে কিনেছে। বিখ্যাত শিল্পীদের ছবি কেনা তার শখে দাঁড়িয়ে গেছে।
ব্ল্যাকওয়েলদের এই সংগ্রহশালা সারা বিশ্বে নাম করেছে। অনেকেই এই সংগ্রহশালা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেটি কোনো আলোকচিত্রীকে সেখানে ঢোকার অনুমতি দেয় না। সাংবাদিকদের সাথে এই নিয়ে আলোচনা করতে তার প্রবল অনীহা। হ্যাঁ, সংবাদপত্রকে এড়িয়ে চলতে সে ভালোবাসে। ব্ল্যাকওয়েল পরিবারের অন্তরঙ্গ জীবন সম্পর্কে সংবাদপত্রের কৌতূহল আকাশ ছুঁয়েছে। ব্ল্যাকওয়েল পরিবার সম্পর্কে কোনো পরিচারক আলোচনা করতে পারে না, এমন কী কোনো কর্মীও এ ব্যাপারে কথা বলতে পারে না। তবুও গুজবকে বন্ধ করা যায় না। আগাম অনুমানে তারা চলতে থাকে। কেটি বিশ্বের সবথেকে ধনী মহিলাতে পরিণত হয়েছে। তাই তার সম্পর্কে অসংখ্য প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোনো প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।
***
কেটি স্কুলের হেডমিসট্রেসকে ফোন করল টনি কেমন আছে?
–মিসেস ব্লকওয়েল, আপনার ছেলে পড়াশুনাতে ভীষণ ভালো।
–আমি তা বলছি না। কেটি কী যেন বলতে চাইল। সে কি এখনও তোতলায়?
–ম্যাডাম, সে তো এখন আর তোতলাচ্ছে না। সুন্দরভাবে কথা বলছে।
কেটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল না, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল- হ্যাঁ, ব্যাপারটা কিছুদিনের জন্য হয়েছিল। আঃ, ডাক্তাররা এমন ভয় পাইয়ে দেয়।
চার সপ্তাহ বাদে টনি ফিরে এল। কেটি এয়ারপোর্টে গেছে তাকে আনতে। টনিকে দেখতে খুব ভালো লাগছে।
কেটি বলল- হ্যালো, কেমন আছো তুমি?
টনি আবার আমতা আমতা করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বলে আ-মি-ভা-লো-আ-ছি। মা-মা!
***
টনির ছুটি, টনি নতুন নতুন ছবি দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে। এই বিশ্ববিখ্যাত শিল্পীরা তার মনকে সম্মোহিত করেছে। এটা হল টনির জাদুর জগত। সে নানা রং কিনেছে, ইজেল কিনেছে, এক মনে ছবি আঁকছে। ছবিগুলো হয়তো খুব একটা ভালো হচ্ছে না। তবু এই চেষ্টাটাকে ভালোবাসতেই হবে।
কেটি বলল- একদিন এই সব ছবি তোমার হবে, ডার্লিং।
তেরো বছরের ছেলের মনে একটা আনন্দ, মা হয়তো ঠিক বুঝতে পারছে না। কিন্তু এগুলো নিয়ে সে কী করবে? নিজের পায়ে নিজেকে দাঁড়াতে হবে। কিছু একটা করতে হবে। এমন কিছু যা তাকে উত্তেজনা দেবে। মার সম্পর্কে ভাবতে গেলে সে কেমন অবাক হয়ে যায়। টনি তার মা সম্পর্কে খুবই গর্বিত। মাকে বিশ্বের সবথেকে আকর্ষণীয়া মহিলা বলে মনে হয়। কিন্তু মা সামনে এলে সে কেমন যেন হয়ে যায়।
কেটি তার ছেলেকে খুবই ভালোবাসে। কিন্তু ছেলের এই অসুবিধাটা কবে যাবে? প্রতি কথায় সে দুবার তিনবার চিন্তা করে। একদিন মাকে সে প্রশ্ন করল- মা, তুমি কীভাবে সারা পৃথিবীটাকে পরিচালনা করছ?
কেটি হেসে বলল- না-, এসব প্রশ্ন কেন করছিস?
আমার স্কুলের ছেলেরা জানতে চাইছে। সত্যি তুমি এক বিরাট ব্যক্তি।
–আমি কেউ? আমি যে তোর মা রে?
টনি আর কোনো কথা বলল না। সে জানে, মাকে কীভাবে তুষ্ট করতে হয়।
ব্যাপারটা মায়ের কাছে বোঝাবার চেষ্টা করল, কিন্তু মা এই ব্যাপারে মজল না। বলল টনি, তোমার এখন বয়স খুবই কম। বড়ো হলে সবকিছু বুঝতে পারবে।
নতুন একটা জগত শুরু হল। টনি চেয়েছে শিল্পী হতে। শিল্পের মধ্যেই জীবনের আসল সত্তা লুকিয়ে আছে। সে বাইরে যাবে, প্যরিসে– প্যরিসে না গেলে তার আত্মা শান্তি পাবে না।
সময়টা ভালোয় ভালোয় কেটে গেল। পামবিচে কেটি বাড়ি কিনেছে। আর একটা সাউথক্যারোলিনাতে। কেনটাকিতে ফার্ম কিনল। টনি এবং সে, ওইখানে গেল। তারা নিউপোর্টে গিয়ে আমেরিকার কাপরেস দেখল। তারপর নিউইয়র্কে ফিরে এল। বিখ্যাত হোটেলে লাঞ্চ খেল। প্লাজাতে বিকেলে চা খেল। রোববারের ডিনার সারল আর একটা বিখ্যাত হোটেলে। কেটি ঘোড়ার দৌড় দেখতে খুবই ভালোবাসে। এবার সে একটা একটা করে অনেকগুলো দামি ঘোড়া কিনে ফেলল। তার আস্তাবলের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কেটির ঘোড়া তখন ছুটছে, টনি স্কুল থেকে বাড়িতে এসেছে। কেটি টনিকে নিয়ে ট্রাকে গেল। বাক্সে বসে থাকল, হ্যাঁ, মা আনন্দে হৈ-হৈ করছে। কেটি বুঝতে পারছে, টনি অবাক বিস্ময়ে ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
দেখো-দেখো, টনি, আমার ঘোড়াটা জিতবে, জেতাটাই জীবনের আসল ব্যাপার?
ডাকহারবারে তারা মাঝে মধ্যে চলে যায়, সেখানে গিয়ে শান্ত নিরুদ্বিগ্ন সময় কাটায়। কখনও বা ডাকহারবার শহরে গিয়ে আইসক্রিম খায়। মাঝে মাঝে রাতে ঘুমোত যাবার আগে কেটি তার ফেলে আসা দিনযাপনের গল্প বলে। মাদাম অ্যাগনেস, সবকিছু, বান্দার গল্প শোনা হয়ে গেছে।
টনি একদিন ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড তোমার হবে। তুমি এটাকে ভালোভাবে চালিও কিন্তু।
টনি আমতা আমতা করে বলল- মা, এসব ব্যবসা আমি বুঝি না। আমি বড়ো হয়ে শিল্পী হব।
কেটি রাগে বিস্ফোরিত হয়ে বলল- বোকা ছেলে কোথাকার। তুই কি জানিস, ব্যবসা করলে হাতে কত ক্ষমতা আসে। তুই পৃথিবীকে গড়বি কী করে? তুই কি ভাবছিস ক্রুগার ব্রেন্ট সংস্থাটা বন্ধ হয়ে যাবে? এটা একটা টাকা রোজগার করার কারখানা, এটাকে চালাতেই হবে।
টনি এসব কথা বুঝতে পারল না। সে অবাক হয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল না, আমাকে বড়ো হয়ে একজন শিল্পী হতেই হবে।
***
টনির বয়স পনেরো, কেটি ঠিক করল, গরমের ছুটিতে তাকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাতে যাবে। তখনও পর্যন্ত টনি সেখানে যায়নি।
কেটি বলল- টনি, আমি একটা সুন্দর জায়গায় তোকে নিয়ে যাব।
–হ্যাঁ, ডাকহারবার যাব না?
পরবর্তী গরমকালে, কেটি বলল- এ মাসে আমি তোকে জোহানেসবার্গে নিয়ে যাব।
কেটি জোহানেসবার্গে সব খবর পাঠিয়ে দিল। হাঁ, টনি সম্পর্কে সব খবরও পৌঁছে গেছে। কী কী দেখা হবে, তার একটা আগাম তালিকা করা হয়েছে।
কেটি তার ছেলে সম্পর্কে দৈনন্দিন রিপোর্ট পেয়েছে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সোনার খনিতে সে হিরের খনিতে দুদিন সময় কাটিয়েছে। ক্রুগার ব্রেন্টের কারখানাগুলো দেখেছে। কেনিয়াতে সাফারিতে গেছে।
শেষ অব্দি তার ছুটি ফুরিয়ে আসছে। টেলিফোন করল কেটি জোহানেসবার্গের ম্যানেজারকে।
উনি, এখন কেমন আছে?
মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, এই সকালে সে আরও কিছুদিন থাকার জন্য বায়না করেছিল।
কেটির মনে আনন্দ ঠিক আছে।
টনির ছুটি শেষ হয়ে গেল। সে ইংল্যান্ডের সাউদম্পটনে চলে গেল। সেখানে গিয়ে প্যান আমেরিকান এয়ারওয়েজের একটা প্লেনে চড়ে বসল। তার গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
কেটি তার দরকারি মিটিং ছেড়ে দিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে। একটু বাদেই হয়তো ছেলের সঙ্গে দেখা হবে।
প্লেনটা সেখানে এসে পৌঁছোল। দক্ষিণ আফ্রিকার কথা বলতে গিয়ে ছেলে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। কোথায় কোথায় সে গিয়েছিল সব কথা বলল। এমন কী সে যে নামিব মরুভূমিতে গিয়েছিল, সে কথাও বলল। সেখানে তার ঠাকুরদাদা একদিন হিরে চুরি করেছিল, সেকথাও জানাতে ভুল করল না।
টনি, সে কিন্তু চুরি করেনি, সে অনেক পরিশ্রম করে হিরেগুলো সংগ্রহ করেছিল।
টনি বলল- না, সেখানে রক্ষীদল আছে, ভীষণ কুকুর আছে। তা হলে? ওরা আমাকে কোনো স্যাম্পেল দেয়নি কেন?
কেটি হেসে বলল– এই স্যাম্পেল নিয়ে তোমার কী হবে? একদিন তুমি এসব হিরের খনির মালিক হবে।
-ওরা আমার কথা শোনেনি।
কেটি বলল- ঠিক আছে, আবার যখন যাবে, তখন আমি ভালো করে বলে দেব।
সেখানে গিয়ে প্রকৃতির রং-রূপ দেখে টনি অবাক হয়ে গেছে। মনের সুখে সবকিছু ক্যানভাসে আঁকার চেষ্টা করছে। হা, শখ হিসেবে এটা হয়তো ভালো। কিন্তু এটাকে কি জীবিকা করা যায়?
টনি কিন্তু দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, একদিন তাকে মস্ত বড় শিল্পী হতেই হবে।
***
সেপ্টেম্বর, ইউরোপে যুদ্ধ লেগেছে।
কেটি শেষ পর্যন্ত বলল- আমি চাইছি, তুমি একটা ভালো জায়গাতে ভরতি হও। দু-বছরের মধ্যে তুমি ভালোভাবে আঁকার বিষয়টা শিখতে পারবে।
কেটি জানত টনি হয়তো তার মত পরিবর্তন করবে। কিন্তু সত্যি কি তা হবে?
কেটি ব্ল্যাকওয়েলের কাছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ একটা আর্শীবাদ স্বরূপ বিরাজ করছে। পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ বাধলে আরও অনেক অস্ত্রের দরকার পড়বে। জুগার ব্রেস্ট তখন অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকবে।
কেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো শেষ পর্যন্ত নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট বলেছেন, এই দেশ মহান গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক। ১৯৪১ সালের ১১ মার্চ কংগ্রেসে একটা বিল পাশ করা হল। মিত্রপক্ষের জাহাজ আটলান্টিক মহাসাগর পার হচ্ছে। জার্মানরা সেখানে প্রতিরোধের সৃষ্টি করেছে। জার্মান সাবমেরিন একটির পর একটি জাহাজকে আঘাত করছে।
জার্মান বোধহয় বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেবে। এডলফ হিটলারের নাম সকলের মুখে মুখে ফিরছে।
কেটি বুঝতে পারছে না, কাকে সাহায্য করা উচিত। সব পক্ষই তার কাছ থেকে যুদ্ধের উপকরণ চাইছে। সে দুটো উল্লেখযোগ্য টেলিফোন করল- সুইজারল্যান্ডে। শেষ পর্যন্ত জুরিখে অবতরণ করল। কর্নেল ব্রিকম্যানের জন্য একটা খবর আছে। ব্রিম্যান জুগার ব্রেন্ট-এর বার্লিন শাখার ম্যানেজার। যখন এই ফ্যাক্টরিটা নাজি সরকার দখল করে, তখন ব্রিঙ্কম্যানকে তারা কর্নেলের পদ দেয়। তাকেই এই পদে রাখা হয়েছে।
তিনি এসে কেটির সাথে হোটেলে দেখা করলেন। পাতলা চেহারার মানুষ, লাল চুলের অধিকারী, মাথায় চুলের পরিমাণ কম।
মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, আপনার সঙ্গে দেখা করে আমি নিজেকে গর্বিত বলে বোধ করছি। আমার সরকারের তরফ থেকে একটা সুখবর আছে। আমরা এই যুদ্ধে জয়লাভ করব, সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাক্টরির দায়িত্ব ভার আপনাকে দেওয়া হবে। কিছুদিন বাদে জার্মানি বিশ্বের সব থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তখন আপনার মতো লোকের সহযোগিতা আমরা প্রার্থনা করব।
যদি জার্মানি এই যুদ্ধে হেরে যায়?
কর্নেল ব্রিঙ্কম্যানের ঠোঁটে একটা পাতলা হাসি– আমরা দুজনেই জানি, সেটা কখনওই সম্ভব নয়। মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাই ইউরোপের এই ঝামেলা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আমার মনে হয় মার্কিনরা কখনও এই যুদ্ধে যোগ দেবে না।
কর্নেল, কেটি ঝুঁকে পড়ে বলল, আমি শুনেছি অনেক ইহুদিকে নাকি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পুরে দেওয়া হয়েছে। তাদের হত্যা করা হচ্ছে। এটা কি ঠিক?
-না, এটা ব্রিটিশদের অপপ্রচার। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি। এই ধরনের ব্যাপার কখনওই ঘটেনি। ইহুদিদের ক্যাম্পে রাখা হচ্ছে, একথা ঠিক, কিন্তু অফিসারদের বলা আছে, তাদের প্রতি যেন ভালো ব্যবহার করা হয়।
কেটি জানে না, এই কথার আসল অর্থ কী, সে অর্থটা বের করার চেষ্টা করবে।
পরের দিন কেটি এক বিখ্যাত জার্মান ব্যবসায়ীর সাথে একটা বৈঠকে বসল। ভদ্রলোকের নাম অটো গুয়েলার। বছর পঞ্চাশ বয়স। দেখতে খুবই ব্যক্তিত্ব ব্যঞ্জক। মুখের ভেতর আত্মহমিকার ছাপ আছে। চোখের তারায় কিন্তু বিষণ্ণতার চিহ্ন। তারা একটা ছোট্ট কাফেতে গিয়ে বসল।
কেটি শান্তভাবে বলল- আপনি নাকি ইহুদিদের সাহায্য করছেন, যাতে তারা কোনো একটা নিরপেক্ষ দেশে পৌঁছোতে পারে। এজন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা কী সত্যি!
মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, এটা সত্যি নয়, এটা করা হলে তৃতীয় রাইকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।
–আমি শুনেছি, এই কাজ করতে আপনার টাকার দরকার।
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন- না, এটাও একটা বাজে খবর।
তার চোখের ভেতর একটা অনিশ্চিত অন্ধকার। তিনি কাফের চারিদিকে তাকালেন। হ্যাঁ, এই জাতীয় মানুষেরা প্রতিটি মুহূর্তে ভয় পান।
আমি কিন্তু আপনাকে সাহায্য করতে পারি, আমার সংস্থা ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড। অনেক নিরপেক্ষ দেশে আমাদের অফিস আছে। যেসব দেশগুলো মিত্রপক্ষের অধীন সেখানেও আমাদের অফিস আছে। যদি কেউ সেখানে উদ্বাস্তু হয়ে যেতে চায়, তাহলে, আমরা সেখানে তাদের চাকরির ব্যবস্থা করব।
শুয়েলার বসে বসে তেতো কফিতে মুখ দিলেন। শেষ পর্যন্ত বললেন– এসব ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। এখন রাজনীতির ব্যাপারটা এত নোংরা হয়ে গেছে… যদি আপনি সত্যি সাহায্য করতে চান, তাহলে আমার এক কাকাকে সাহায্য করুন। উনি ইংল্যান্ডে থাকেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। প্রতি মাসে পঞ্চাশ হাজার ডলার খরচ হয়।
–আচ্ছা, আমি ব্যবস্থা করছি।
–আপনি এমন ব্যবস্থা করুন, যাতে টাকাটা লন্ডনে জমা পড়ে এবং সুইসব্যাঙ্কে চলে আসে। তাহলেই আমার কাকা খুব খুশি হবেন।
আট সপ্তাহ কেটে গেছে, কিছু ইহুদি উদ্বাস্তু শেষ পর্যন্ত মিত্র দেশে প্রবেশের ছাড়পত্র পেল। ক্রুগার ব্রেন্টের বিভিন্ন কোম্পানিতে তারা চাকরি পেয়েছে।
দুবছর বাদে টনি স্কুল ছেড়ে দিল। সে সোজা কেটির অফিসে গিয়ে আমতা আমতা করে বলতে থাকে –আমি চেষ্টা করছি, মা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি আমার মন ঠিক করলাম। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে আমি প্যারিসে যাব।
প্রত্যেকটি কথা সে বলছে একটু থেমে থেমে। তার মানে, রোগটা এখনও একেবারে সারেনি।
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে টনি আবার বলতে শুরু করে মা, আমি জানি, তুমি আমার কথা শুনে খু-খুব হতাশ হয়েছ। কিন্তু আমাকে আমার জীবনটা নিজের মতো কাটাতে দাও। আমি এখন শিকাগোর একটা আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হব।
কেটির মনে নানা চিন্তা। টনি কেন এইভাবে সময় এবং অর্থ নষ্ট করছে।
কেটি বলল–তুমি কবে যেতে চাইছ?
-পনেরো তারিখ থেকে ক্লাস শুরু হবে।
–আজ কত তারিখ?
–আজ ডিসেম্বরের ছ তারিখ।
***
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর, রোববার, পার্ল হারবারের ওপর জাপান আক্রমণ করল। পরের দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা করল। সেদিন বিকেলবেলা টনিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন কর্পে যোগ দিতে হয়। তাকে ভার্জিনিয়াতে পাঠানো হল। সেখানকার অফিসারস ট্রেনিং স্কুল থেকে সে গ্র্যাজুয়েট হল। সেখান থেকে চলে গেল দক্ষিণ প্যাসিফিক অঞ্চলে।
কেটি বুঝতে পারল, এবার তার জীবনটা আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে কেটে যাবে। সারা দিন ধরে কাজের চাপ। প্রতি মুহূর্তে চিন্তা, উদ্বেলতা এবং আকুলতা, কেটি ভাবছে, এই হয়তো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একটা খারাপ খবর আসবে। টনি আহত হয়েছে কিংবা মারা গেছে। হয়তো বা…!
জাপানি বোম্বারগুলো গুয়ামের আমেরিকার বেসের ওপর আঘাত করছে। জাপান ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিঙ্গাপুর দখল করল। তারা নিউ ব্রিটেন, নিউ আয়ারল্যান্ড এবং অ্যাডমিরালটির ওপর বোমা বর্ষণ করল। জেনারেল ডগলার ম্যাকারথারকে ফিলি পাইনস থেকে চলে আসতে হচ্ছে। অক্ষশক্তি আস্তে আস্তে বিশ্বজুড়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে চলেছে। সর্বত্র অনিশ্চয়তার ঘন অন্ধকার।
কেটির কেবলই মনে হচ্ছে, টনিকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক করা হয়েছে। তাকে অত্যাচারের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। না, এত শক্তি এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে প্রার্থনা ছাড়া কিছুই করতে পারবে না। টনির কাছ থেকে যখন চিঠি আসে, কেটির মন আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, তার মানে কয়েক সপ্তাহ আগে টনি বেঁচে ছিল। টনি লিখেছে–এখানে আমরা ঘন অন্ধকারের মধ্যে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। রাশিয়ানরা এখন কী করছে? জাপানি সৈন্যরা অত্যন্ত নির্মম এবং হৃদয়হীন। কিন্তু তাদের শ্রদ্ধা করা উচিত। তারা মরতে ভয় পায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খবর কী? তোমার ফ্যাক্টরির লোকেরা কি আরও বেশি টাকা চাইছে?
আরও কত খবর কেটি পায় ওই চিঠিগুলো থেকে।
***
১৯৪২ সালের আগস্ট। মিত্রশক্তি আরও জোর লড়াইতে নেমে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিনারগুলো সলোমান দ্বীপপুঞ্জে নেমেছে। তারা জাপানকে হটিয়ে দেবার চেষ্টা করছে।
ইওরোপে মিত্রশক্তি জয়ের পথে এগিয়ে চলেছে। ১৯৪৪ সালের ৬ জুন মিত্রশক্তি পশ্চিম ইওরোপের অনেকটা অংশ দখল করল। নরম্যান্ডি সৈকতে পৌঁছে গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং কানাডার সৈন্যরা। ১৯৪৫ সালের ৭মে জার্মানি বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের ওপর আণবিক বোমা ফেলা হল। কুড়ি হাজার কম ক্ষমতা সম্পন্ন বোমা বিস্ফোরিত হল হিরোসিমাতে। তিনদিন বাদে আর একটা আণবিক বোমা ফাটল নাগাসাকি শহরে। ১৪ আগস্ট, জাপানিরা শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করল। এই ভাবেই বিরাট যুদ্ধটা শেষ হয়ে গেল।
***
তিনমাস বাদে টনি বাড়ি ফিরে এল। সে এবং কেটি ডাকহারবারে বেশ কিছুটা সময় কাটাল। টেরেসে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকল।
এই যুদ্ধ তাকে একেবারে পরিবর্তিত করে দিয়েছে। তার চরিত্রের মধ্যে একটা আভিজাত্য এবং গাম্ভীর্য এসেছে। হ্যাঁ, ছোট্ট গোঁফের আভা দেখা যাচ্ছে। চেহারাটা ভারী সুন্দর। চোখের তারায় একটা নতুন আত্মবিশ্বাস। কেটি জানে, এই অভিজ্ঞতা তাকে আরও প্রাজ্ঞ করে তুলেছে। এখন সে হয়তো কোম্পানিতে যোগ দেবে।
-তুমি এখন কী করতে চাইছ? কেটি জিজ্ঞাসা করল।
টনি হেসে বলল –আগেই তো আমি বলেছি মা, যুদ্ধ শেষ হলে আমি প্যারিসে যাব।
.
চতুর্থ খণ্ড
টনি
১৯৪৬-১৯৫০
১৮.
এর আগে টনি প্যারিসে এসেছিল কিন্তু এবারকার পরিবেশটা একেবারে আলাদা। জার্মানরা এখনও তাদের স্মৃতি চিহ্ন রেখে গেছে। হ্যাঁ, ধ্বংসের ইতিহাস। মানুষজনকে কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। নাজিরা সব কিছু লুট করেছে। কিন্তু প্যারিসের অবস্থা কেমন? জীবন এখানে কেমনভাবে কেটে চলেছে। ইচ্ছে করলে টনি কেটির প্যান্টহাউসে থাকতে পারত, কিন্তু সে ওখানে থাকবে না। সে একটা পুরোনো বাড়ি ভাড়া নিল। সেখান থেকে তার স্কুল খুব একটা দুরে নয়। এই অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে একটা লিভিং রুম আছে, আছে ছোটো বেডরুম এবং একটা কিচেন। কোনো রেফ্রিজারেটর নেই। বেডরুমে আর কিচেনের মাঝে একটা বাথরুম আছে। মোটামুটি চলে যেতে পারে।
বাড়িউলি বলেছিলেন–একটু কষ্ট হবে, কিন্তু চলে যেতে পারে।
শনিবার সমস্ত দিনটা টনি বাজারে কাটাল। সোমবার এবং মঙ্গলবার সে গেল পুরোনো দোকানে, পার্কের পাশে। বুধবার ফার্নিচার কিনে আনল। একটা সোফাসেট, দুটো চেয়ার, একটা পুরোনো ওয়াড্রাব, কিছু আলো, কিচেনের টেবিল ইত্যাদি। মা দেখলে হয়তো অবাক হয়ে যাবে, টনি ভাবল, এই সুন্দর অ্যাপার্টমেন্টটাকে সে আরও সুন্দর করে তুলতে পারত। কিন্তু তাতে কী বা হবে?
এবার তাকে একটা ভালো আর্টস্কুলের সন্ধান করতে হবে। সমস্ত ফ্রান্সের ভেতর সুব থেকে নামকরা স্কুল হল একোলে। এখানে যারা ভর্তি হয়, তাদের শিল্পবোধ খুবই উচ্চ ধরনের। টনি সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন করল। সে ভাবল, ওরা নিশ্চয়ই আমাকে নেবে না। সে তার আঁকা তিনটে ছবি জমা দিল। চার সপ্তাহ অপেক্ষা করল। চার সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর বলা হল, আগামী সোমবার তাকে দেখা করতে হবে।
একোলে স্কুলটা একটা বিরাট পাথরের বাড়িতে অবস্থিত। বারোটা ক্লাসরুমে ছাত্র গিজগিজ করছে। টনি সেই স্কুলের প্রধানের কাছে গেল। ভদ্রলোকের নাম মাট্রিগ্রেস্যান্ড। চোখে মুখে কেমন বিরক্তির ছাপ। নাকটা নেই বললেই চলে। এত পাতলা ঠোঁট টনি কখনও দেখেনি।
ভদ্রলোক বললেন তোমার আঁকার মধ্যে কেমন একটা অপেশাদারের গন্ধ আছে। তবে সম্ভাবনা আছে। আমাদের কমিটি তোমাকে নির্বাচন করেছে। তুমি কি বুঝতে পারছ?
-ঠিক বুঝতে পারছি না, স্যার।
-হ্যাঁ, সময় হলে বুঝতে পারবে। তুমি ক্যানটালের সঙ্গে যোগাযোগ করো। আগামী . পাঁচ বছর তুমি তারই অধীনে থাকবে। তবে যদি ততদিন টিকতে পারো।
হ্যাঁ, আমি পাঁচ বছর থাকব, টনি প্রতিজ্ঞা করল।
ক্যানটাল অত্যন্ত খর্বাকৃতি মানুষ। মাথায় চকচক করেছে টাক। ঘন বাদামী দুটি চোখ। নাকটা চ্যাপটা, ঠোঁটটা বাঁকানো।
তিনি টনিকে বললেন–আমেরিকানরা উদাসীন হয়ে থাকে। তারা তো বর্বর স্বভাবের। তুমি কেন এখানে এসেছ?
-কিছু শিখতে, স্যার।
ক্যানটাল হাসলেন।
ওই ক্লাসে পঁচিশ জন ছাত্র ছিল। বেশির ভাগই ফরাসি। ইজেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। বসার আসনও ইচ্ছে মতো। টনি জানলার ধারে গিয়ে বসল। জায়গাটা তার মোটেই ভালো লাগছে না। দেখা গেল বিভিন্ন গ্রিক স্ট্যাচু সাজানো আছে।
ক্যানটাল জিজ্ঞাসা করলেন এবার তুমি শুরু করতে পারো।
টনি বলল আমি তো রং আনিনি, স্যার।
-না, রং লাগবে না। তুমি প্রথম বছর খালি ছবি আঁকার চেষ্টা করবে, পেনসিল দিয়ে।
ভদ্রলোক একটা গ্রিক স্ট্যাচুর দিকে তাকিয়ে বললেন- ওই স্ট্যাচুটা তোমাকে আঁকতে হবে। ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে খুবই সহজ, কিন্তু যতই ভেতরে ঢুকবে, ততই অবাক হয়ে যাবে। এক বছর শেষ হবার আগেই অর্ধেক ছাত্র পালিয়ে যায়।
তিনি আবার বললেন তোমাকে মানুষের শরীর সংস্থান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। দ্বিতীয় বছরে তুমি জীবন্ত মডেলের ছবি আঁকার সুযোগ পাবে। তখন তৈলচিত্র আঁকবে। তৃতীয় বছরে তুমি আমার পাশে বসে কাজ করবে। আমি যে সৃজনশীলতা পালন করি, সেটাকে অনুধাবন করার চেষ্টা করবে। চতুর্থ এবং পঞ্চম বছরে তোমার নিজস্ব শিল্পীসত্তা গড়ে উঠবে। তুমি তখন একটা কণ্ঠস্বর পাবে। তোমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।
এবার ক্লাস শুরু হল। ভদ্রলোক চারদিকে ঘুরছেন। প্রত্যেকটা ইজেলের সামনে কিছুক্ষণ থামছেন। হয় সমালোচনা করছেন, নয় কোনো কথা বলছেন।
তিনি টনির কাছে এলেন। বললেন না, এটা এমন হবে না। তুমি হাতের বাইরের দিকটা করতে পারোনি। পেশিগুলো ভালোভাবে দেখতে হবে। হাড়ের সংস্থান, লিগাবেন সবকিছু দেখাতে হবে। তোমায় জানতে হবে, কীভাবে শরীরের ভেতর রক্ত সংবাহিত হয়। তুমি কি তা জানো?
-না। কিন্তু আমি শিখে ফেলব।
***
যখন টনির ক্লাস থাকে না, সে অ্যাপার্টমেন্টে বসে বসে ছবি আঁকে। সারাদিন ধরে ছবি আঁকতে ভালোবাসে। ছবি তাকে একধরনের স্বাধীনতা দিয়েছে। এই স্বাধীনতার স্বাদ সে কখনও পায়নি। তার জীবনের সব থেকে বড় কাজ হল ইজেলের সামনে বসে পেইন্ট আর ব্রাশ দিয়ে ছবি আঁকা। তখন নিজেকে ঈশ্বর বলে মনে হয়। সারা পৃথিবীকে সে এখন তৈরি করতে পারবে- এর থেকে বড়ো আনন্দ আর কী হতে পারে? সে গাছ আঁকছে, প্রস্ফুটিত ফুল, মানুষের শরীর, জগৎ, এটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। সে এই জন্যই জন্মেছে। যখন সে ছবি আঁকে না, তখন প্যারিসের রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়। প্রাণবন্ত যৌবনবতী শহর তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।
এখন এই শহরকে সে তার নিজস্ব শহর বলতে পারে। এখানে তার শিল্পসত্তার বিকাশ ঘটে গেছে। দুটো প্যারিস আছে, সাইন নদী তাকে ভাগ করে দিয়েছে। দুটো আলাদা জগত। সাইন নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী অঞ্চলে অর্থবান মানুষদের বসবাস। জীবনে তারা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বাঁদিকে থাকে ওই ছাত্রের দল, শিল্পী এবং সংগ্রামী জনতা। তাদের চোখে অনেক স্বপ্ন। কিন্তু তারা জানে না, শেষ পর্যন্ত এ স্বপ্ন সফল হবে কিনা। প্যারিসে আরও অনেক কিছু আছে, যা দেখে টনি অবাক হয়ে গেছে। তবে টনির কাছে কোনো কিছুই বিদেশ বলে মনে হয় না। অনেক সময় সে বুলেভার্দে বসে বসে ছবি আঁকে।
টনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়ে। বন্ধুদের সাথে ভাব হয়ে গেছে। অনেকেই তার সহজ সরল জীবনযাত্রাকে তারিফ করে।
টনি একটু একটু ফরাসি ভাষা শিখে গেছে। তাই কথা বলতে এখন খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। যারা দরিদ্র এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছাত্র, তারা কাফে ফ্লোরাতে ভিড় করে। আর যাদের হাতে একটু পয়সা, তারা অন্য কোথাও চলে যায়।
১৯৪৬–প্যারিসের শিল্পজগতে বিপ্লব ঘটে গেছে। টনি একদিন পাবলো পিকাসোকে দেখতে পেল। একদিন তার এক বন্ধু মার্ক সাগলকে দেখতে পেয়েছিল। বছর পঞ্চাশেক বয়স। ভদ্রলোক এখনও অসাধারণ ছবি আঁকেন। তিনি কাফের একটা কোণের টেবিলে বসেছিলেন। একদল লোকের সাথে কথা বলছিলেন।
টনির বন্ধু ফিসফিসিয়ে বলেছিল তাকে দেখতে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হয়েছে। উনি প্যারিসে খুব একটা আসেন না। উনি ভেনাসে থাকেন। ভূমধ্যসাগরের পাশে।
ম্যাক্স আওনেসকেও দেখা গেল। একটা কাফেতে। আলবার্তোর সাথে দেখা হয়ে গেল। টনি ক্রমশ অবাক হয়ে যাচ্ছে। একদিন হানা বেলমেডের সাথে টনি দেখা করল। ইতিমধ্যে উনি যৌন উত্তেজক ছবি এঁকে নাম করেছেন। বিশেষ করে কিশোরী কন্যাদের উন্মুক্ত বুকের ছবি। টনির সাথে গ্রাকের দেখা হল। এই মুহূর্তটা সে কখনও ভুলতে পারবে না। টনি কথা বলতে পারেনি।
বিভিন্ন আর্ট গ্যালারিতে সে নিয়মিত যাচ্ছে। এক একটা ছবির প্রদর্শনী দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে, ভাবছে, আমি কবে এঁদের মতো ছবি আঁকতে পারব?
***
কেটি টনির অ্যাপার্টমেন্ট দেখে অবাক হয়ে গেছে। সে কোনো কথা বলেনি। কিন্তু ভাবল–আমার ছেলে এই ভাবে থাকে কী করে? মুখে বলল –টনি, আমি একটা ব্রেফিজারেটর দেখতে পাচ্ছি না কেন? তুমি খাবার কোথায় রাখো?
আমতা আমতা করে টনি বলল –কেন, আমি তাকে রেখে দিই।
কেটি জানলার কাছে গিয়ে সেটা খুলে দিল। তারপর বলল –টনি, এভাবে কি থাকা যায়?
টনি হাসবার চেষ্টা করছে।
কেটি বলল তোমার ছবি আঁকার কথা বলল।
-এখনও তেমন কিছু বলার হয়নি। সবেমাত্র শুরু হয়েছে।
–ওই ক্যানটাল লোকটাকে তুমি কি পছন্দ করো?
–হা মা, উনি অসাধারণ প্রতিভা। উনি আমাকে খুবই ভালোবাসেন।
কেটি বলতে পারল না যে, টনিকে তার কোম্পানিতে যোগ দিতে হবে।
***
ক্যানটালকে এক বিদঘুটে স্বভাবের মানুষ বলা যায়। টনি তাকে খুবই শ্রদ্ধা করে।
স্কুলের টার্ম শেষ হয়ে আসছে। আটজনকে দ্বিতীয় বছরে প্রবেশের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। টনি তাদের মধ্যে একজন। এই আনন্দঘন মুহূর্তটাকে উদযাপিত করতে টনি এবং অন্য ছাত্ররা মমার্তের একটি নাইটক্লাবে গেল। সারা রাত ধরে তারা প্রচণ্ড মদ খেল। হৈ-হৈ করল। সেখানে কয়েকজন ইংরেজ যুবতীর সঙ্গে আলাপ হল। তারা প্যারিস দেখতে এসেছে।
***
স্কুল আবার শুরু হল। টনি এবার জীবন্ত মডেলের সামনে বসে কাজ করবে। এর পাশাপাশি তাকে তৈলচিত্রও শিখতে হবে। হা, কিন্ডারগার্টেন থেকে সে ছুটি পেয়েছে। মানুষের শরীর সংস্থান সম্পর্কে অনেক জ্ঞান সে ইতিমধ্যে অর্জন করেছে। এখন ব্যবহারিক শিখনের পালা। এখন একহাতে সে ব্রাশ নিয়ে বসে থাকে। তার সামনে এক জীবন্ত মডেল। টনি এবার নতুন কিছু সৃষ্টি করবে। তার আঁকা ছবি দেখে সান ক্যানটাল পর্যন্ত খুশি হয়েছেন।
উনি বললেন তোমাকে অনুভব করতে হবে। অনুভূতি ছাড়া কেউ শিল্পী হতে পারে না।
***
ক্লাসে প্রায় বারোজন মডেল বসে আছে। যে মডেলকে ক্যানটাল প্রায়ই ব্যবহার করেন, সে হল কালটস, এক অল্প বয়সী ছেলে, মেডিকেল স্কুলে পড়াশুনা করে। এরই পাশাপাশি আর এক মডেলের কথা বলা উচিত। সে হল আনেটে। খর্বাকৃতি, কিন্তু অসম্ভব স্তনবতী মহিলা। তার মাথায় লাল চুল আছে। শরীরের একটা আলাদা আকর্ষণ। আর এক মেয়ের কথাও আলাদাভাবে বলা উচিত। তার নাম ডোমিনিক ম্যাসন। মাথায় সোনালি চুলের বন্যা। চোখ মুখ খুবই উজ্জ্বল। দুটি চোখের তারায় সবুজাভ আভা। ডোমিনিক বেশ কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পীর মডেল হয়েছে। সকলেই তাকে ভালোবাসে। ক্লাস শেষ হয়ে যাবার পর সকলেই তার কাছে গিয়ে গল্প করে, সে ঘুরতে যাবে কিনা জানতে চায়।
সে বলে আমি কখনও আনন্দের সাথে ব্যবসাকে এক করতে চাই না। তবে খুব একটা খারাপ হবে না। আমার কাছ থেকে তোমরা কী নেবে বলো?
এভাবেই কথাবার্তা চলতে থাকে। কিন্তু ডোমিনিক স্কুলের কোনো ছাত্রের সাথে বাইরে কোথাও যায় না। এ ব্যাপারে তার নিয়মজ্ঞান বড় কড়া।
সন্ধের অবকাশ। ছাত্ররা বাড়ি যাবে, ডোমিনিকের সামনে বসে টনি তুলির শেষ টান দিচ্ছিল। টনি হঠাৎ দেখল ডোমিনিক পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার শরীর থেকে একটা দারুণ গন্ধ উঠে আসছে।
ডোমিনিক বলল আমার নাকটা বড্ড লম্বা হয়ে গেছে।
টনির মুখে লাল আভা–হ্যাঁ, আমি এটা পালটে দিচ্ছি।
-না-না, তুমি খুব ভালো এঁকেছ। এটা আমার লম্বা নাকের ছবি।
টনির মুখে হাসি–না, আমার ভয় হচ্ছে, আমি হয়তো ঠিক মতো আঁকতে পারিনি।
ফরাসি দেশের কেউ হলে বলতো, তোমার নাকটা তত খুবই সুন্দর, সোনা।
-আমি তোমার নাকটা ভালোবাসি, কিন্তু আমি ফরাসি নই।
–হ্যাঁ, তুমি তো আমার সাথে কখনও কথা বলতে চেষ্টা করো না। কেন বলো তো?
টনি অবাক–না, সকলেই তোমার সঙ্গে কথা বলে। আমি তোমার কাছে পৌঁছোব কেমন করে?
ডোমিনিক বলল –তাই নাকি? আচ্ছা, শুভরাত্রি।
মেয়েটি চলে গেল।
টনি দেখল, এরপর ডোমিনিক প্রায় অবাক চোখে তার ছবির দিকে তাকিয়ে আছে।
একদিন সন্ধেবেলা ডোমিনিক বলল–তোমার আঁকার হাত খুবই ভালো। মনে হচ্ছে, তুমি একজন নামকরা শিল্পী হবে।
-তোমাকে ধন্যবাদ, ভোমিনিক। তোমার আশা পূরণ হলেই ভালো হয়।
–তুমি কি সত্যি সত্যি ছবি আঁকতে চাও?
–হ্যাঁ, সারা জীবন ধরে।
–যে একজন নামী শিল্পী হবে, সে কি আমাকে ডিনার খাওয়াবে?
টনির চোখে মুখে এক অদ্ভুত প্রত্যাশার আলো।
-আমি কিন্তু বেশি খাই না, শরীরটা ঠিক রাখতে হয়।
টনি হেসে বলল–হ্যাঁ, আমি খুব খুশি হব।
তারা একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্টে বসল। তারা শুধু ছবি নিয়ে আলোচনা করল। ডোমিনিকের জ্ঞান দেখে টনি অবাক হয়ে গেছে। কত বিশিষ্ট শিল্পীদের সামনে সে মডেল হয়ে বসেছে।
ডোমিনিক বলল–আমি বলছি, তুমি কিন্তু একদিন এঁদের মতোই নামজাদা হবে।
টনি খুব অবাক হয়ে গেছে। সে বলল আমাকে অনেকটা পথ যেতে হবে।
রেস্টুরেন্টের বাইরে বেরিয়ে এসে ডোমিনিক বলল আমাকে তোমার অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যাবে?
-না, সেখানে দেখার মতো কিছুই নেই।
শেষ পর্যন্ত তারা অ্যাপার্টমেন্টে এল। ডোমিনিক চারদিকে তাকিয়ে দেখল। এটা একটা ছোট্ট থাকার জায়গা। সে মাথা নাড়ল–হ্যাঁ, তোমার দেখাশুনা কে করে?
কাজের মেয়ে সপ্তাহে একদিন আসে।
–ওকে ছুটি দিয়ে দাও। জায়গাটা খুবই নোংরা। তোমার কোনো মেয়ে বন্ধু নেই?
–না।
ডোমিনিক অবাক হয়ে বলল তুমি কেমন পুরুষ?
–আমি জানি না।
-ঠিক আছে। আমায় কিছু সাবান এনে দাও তো, আর জল দাও। আমি জায়গাটা পরিষ্কার করে দিচ্ছি।
ডোমিনিক কাজে হাত দিল। সবকিছু পরিষ্কার করল। যখন কাজ শেষ হয়ে গেছে সে বলল এখনকার মতো চলে যাবে, আমাকে এখন চান করতে হবে।
সে ছোট্ট বাথরুমে গেল। চানের চেষ্টা করল। তারপর চিৎকার করে বলল–তুমি এই টাবের ভেতর ঢোকো কেমন করে?
–আমি আমার পা দুটো নামাই।
মেয়েটি হেসে বলল আমি দেখতে চাই।
পনেরো মিনিট কেটে গেছে। বাথরুম থেকে ডোমিনিক বেরিয়ে এসেছে। তার কোমরে একটুকরো ভোয়ালে জড়ানো। তার লাল চুল উঁচু করে বাঁধা আছে। অসাধারণ সুন্দরী সে। পূর্ণ বিকশিত দুটি স্তন। এতটুকু স্থানচ্যুত হয়নি। সরু কোমর, লম্বা ঈপ্সিত দুটি পা। টনি অবাক হয়ে গেছে। এর আগে কখনও টনি ডোমিনিককে মেয়ে হিসেবে কল্পনা করেনি। এতদিন সে ছিল নেহাতই একটা মডেল, যার ছবি ক্যানভাসে আঁকতে হয়। এখন সে অবাক হয়ে গেল। হ্যাঁ, ছোট্ট একটা তোয়ালে সবকিছু পালটে দিয়েছে। হঠাৎ তার শরীরে রক্ত চলাচলের গতি বেড়ে গেল।
ডোমিনিক বলল তুমি কি আমায় ভালোবাসবে? তুমি কি জানো কীভাবে ভালোবাসতে হয়?
-হ্যাঁ, আমি জানি।
ডোমিনিক তোয়ালেটা সরিয়ে দিয়ে বলল আমাকে দেখাও তোমার কারুকাজ।
***
ডোমিনিকের মতো কোনো মেয়ের সংস্পর্শে কোনোদিন আসতে হবে, টনি তা ভাবতেও পারেনি। ডোমিনিক দুহাত তুলে সব কিছু দেয়, বিনিময়ে কিছুই প্রত্যাশা করে না। সে এখন প্রত্যেক দিন সন্ধেবেলা টনির জন্য রান্না করা খাবার নিয়ে আসে। মাঝে মধ্যে টনির ফ্ল্যাটে এসে একসঙ্গে ডিনার খায়।
ডোমিনিকের অন্তরঙ্গ ব্যবহারে টনি আপ্লুত হয়ে গেছে।
মাঝে মধ্যে কখনও সে বলে, তুমি কি টাকা জমাচ্ছো? হ্যাঁ, এভাবে জীবন কাটানোই ভালো।
তারা সকাল সন্ধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। একদিন মিউজিয়ামে গেল। একদিন এমন এক জায়গায় যেখানে সচরাচর টুরিস্টরা যেতে চায় না। টনি ক্রমশ অবাক হয়ে যাচ্ছে। এই শহরের গল্পকথা সে জানত না।
ডোমিনিককে কাছে পেয়ে টনির জীবন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তার মধ্যে একটা সহজাত কৌতুকবোধ আছে। টনির মনের আকাশে যখন দুঃখের মেঘের সঞ্চারণ, তখন ডোমিনিক এসে তাকে হাসির জগতে নিয়ে যায়। প্যারিস সম্পর্কে সব কিছু তার নখদর্পণে। সে মাঝে মধ্যে টনিকে নিয়ে পার্টিতে যায়। সেখানে বিখ্যাত মানুষদের সঙ্গে আলাপ হয়। আলাপ হল কবি এবং সাহিত্যিকদের সঙ্গে।
ডোমিনিক সবসময় তাকে উৎসাহ দেয়। সে বলে একদিন তুমি এঁদের সকলের থেকে ভালো আঁকবে, আমি বলছি।
টনির মন যখন খারাপ হয়ে যায়, সে ছবি আঁকতে বসে। মাঝে মধ্যে রাতের অন্ধকারে টনি ছবি আঁকে। ডোমিনিক ইচ্ছে করেই মড়েল সেজে বসে থাকে। সারাদিন কাজ করার পর ডোমিনিক এত শক্তি পায় কোথা থেকে? টনি ভাবে, এই প্রথম সে কাউকে ভালো বেসে ফেলেছে। ভালোবাসা, নাকি অন্য কিছু? টনি জানে না, এই ভালোবাসার পরিণতি কী হবে? কেটি ডোমিনিককে বলবে, সে পৃথিবীর একমাত্র বিত্তশালী মহিলার পুত্র। না, এভাবে বলা উচিত নয়। ডোমিনিকের জন্মদিন। শেষ পর্যন্ত উনি একটা ভারী সুন্দর রাশিয়ান কোট কিনল।
ভোমিনিক বলল –এত ভালো জিনিস, আমি আমার জীবনে কখনও দেখিনি। কোটটা পরে সে নাচতে শুরু করে দিল। একবার নিজের শরীরটাকে স্পন্দিত করে বলল- কোথা থেকে এনেছ টনি? তুমি টাকা কোথায় পেলে?
টনি বলল –এটা চুরি করে আনা হয়েছে। আমি রডিন মিউজিয়ামে এটা পেয়েছি। একটা লোক এটা বেচার জন্য ছটফট করছে। বেশি খরচ হয়নি।
ডোমিনিক অবাক হয়ে তাকাল। তারপর হেসে উঠল- আরে, এটা পরলে আমাদের। দুজনকে তো জেলে বন্দি হতে হবে।
তারপর সে হাত তুলে টনির কাছে চলে এল। বলল –টনি, তুমি একটা বোকা হাঁদা গবেট।
মিথ্যে কথা বলাটাই ভালো। টনি ভেবেছে।
এক রাতে ডোমিনিক বলল–টনি যেন তার সাথে বেড়াতে যায়।
তারা সমস্ত রাত ধরে প্যারিসের পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াল। ডোমিনিক একটা মস্ত বড়ো অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছে। সে বলেছিল টনি, তুমি এই ছোট্ট কামরায় থেকো না। আমার সঙ্গে থাকো। তোমাকে কিছু দিতে হবে না। আমি তোমার জামাকাপড়ের দায়িত্ব নেব। তোমার রান্না করে দেব। আর।
-না, ডোমিনিক, তোমাকে ধন্যবাদ।
–কিন্তু কেন?
টনি কী করে জবাব দেবে? সে যদি তার বড়োলোকি স্বভাবটা দেখায়, তাহলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। হয়তো প্রথমে করলে হত, কিন্তু এখন তা হওয়া সম্ভব নয়। তা হলে ডোমিনিক তাকে আর এইভাবে ভালোবাসতে পারবে না।
সে বলল তুমি তো আমাকে অনেক দিয়েছ, আর আমি কিছু নেব না।
-তাহলে আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টটা ছেড়ে দিয়ে এখানে চলে আসছি। তুমি কি আমায় থাকতে দেবে না?
পরের দিন সে চলে এল।
এটা একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা আরও গভীরতর হয়েছে। তারা সপ্তাহের শেষে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে বেড়াতে যায়। ছোটো ছোটো হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। টনি সেখানেই তার ইজেল নিয়ে বসে পড়ে। দূর আকাশের ছবি আঁকে। খিদে পেলে ডোমিনিক পিকনিক পার্টির ব্যবস্থা করে। তারা কোনো একটা কুঞ্জবনে বসে বসে খাবার খায়। তারপর? দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ভালোবাসার মুহূর্ত টনি তার জীবনে এত আনন্দ কখনও পায়নি।
তার কাজ অত্যন্ত দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে।
একদিন সকালে তার কাজ দেখে ক্যানটাল অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেন ভারী
সুন্দর এঁকেছ, তোমার আঁকা শরীরটা দেখে মনে হচ্ছে, তুমি বোধ হয় নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ পাবে।
টনি ডোমিনিকের কাছে খবরটা বলে দিল।
-আমি নিশ্বাসকে তুলে আনতে পেরেছি। কেন বলো তো? আমি মডেলকে রোজ রাতে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকি, তাই তো।
ডোমিনিক হেসে উঠল উত্তেজনায়। তারপর শান্ত স্বরে বলল–টনি, আরও কয়েক বছর তোমাকে হয়তো স্কুলে থাকতে হবে। তুমি এখনই তৈরি হচ্ছে, আমাদের স্কুলের সকলে তা দেখতে পাচ্ছে। এমনকি ক্যানটালের নজরে পর্যন্ত পড়েছ।
টনির মনে চিন্তা, না, এখনও অনেক কিছু আমাকে শিখতে হবে। এখন আমি অন্য সবার ভিড়ে হারিয়ে যাব। আমার নিজস্ব শিল্পীসত্তা এখনও জেগে ওঠেনি। টনির সবসময় মনে হয়েছে, জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করাটাই বড়ো ব্যাপার।
কোনো কোনো সময় টনি একটা ছবি আঁকা শেষ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে মনে মনে ভাবে, আমার মধ্যে কল্পনা শক্তি আছে। হ্যাঁ, আমার মধ্যে প্রতিভা আছে। আবার কখনও মনে হয়, না, এখনও কিছুই শিখতে পারিনি আমি।
ডোমিনিক ক্রমাগত তাকে উৎসাহ দিয়ে চলেছে। টনি আস্তে আস্তে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেই সে চব্বিশখানা নিজস্ব ছবি আঁকা শেষ করল। তার মধ্যে একদিকে যেমন ল্যান্ডস্কেপ আছে, অন্যদিকে আছে মানুষের প্রতিচ্ছবি। একটা ছবিতে ডোমিনিক নগ্নিকা হয়ে গাছের তলায় শুয়ে আছে। সূর্যের আলো তার শরীরকে আলোকিত করেছে।
এমনই অসাধারণ কিছু রূপকল্পতা।
ডোমিনিক এই ছবিটা দেখে বলল –আঃ, তোমার একটা প্রদর্শনী করা উচিত।
–তুমি কী পাগল হলে ডোমিনিক। আমি এখনও তৈরি হইনি।
–না, তুমি তৈরি হয়েছ।
টনি পরের দিন সন্ধেবেলা ওই অ্যাপার্টমেন্টে এল, একটু দেরি হয়েছে হয়তো। ডোমিনিক একা নেই। একটা পাতলা চেহারার লোক সেখানে বসে আছে। তার নাম অ্যান্টন জর্জ। তার চোখের তারা অদ্ভুত। সে বোধহয় কথা বলছে। ভদ্রলোক হলেন জর্জ গ্যালারির। অধিকর্তা। এই গ্যালারিটা উঠতি শিল্পীদের পক্ষে আদর্শ। সেখানে টনির ছবির প্রদর্শন হবে।
টনি জানতে চেয়েছিল–কী হচ্ছে?
ভদ্রলোক জবাব দিলেন –আপনার হাতের কাজ দারুণ। পিঠ চাপড়ে তিনি বললেন, আমি এই ছবিগুলো আমার গ্যালারিতে রাখতে চাইছি।
টনি ডোমিনিকের দিকে তাকাল। ডোমিনিক মুচকি মুচকি হাসছে।
-আমি জানি না, কী করব?
–হ্যাঁ, আপনার উত্তর আমি জেনে গেছি। ভদ্রলোক জবাব দিলেন।
সমস্ত রাত টনি এবং ডোমিনিক জেগে ছিল। উত্তেজনায় টগবগ করে তারা ফুটছে।
-মনে হচ্ছে সমালোচকরা আমাকে কেটে ফেলবে।
–তুমি ভুল করছ টনি।
সমস্ত রাত ধরে তারা আসন্ন প্রদর্শনীর বিষয়ে আলোচনা করল। টনি এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে, প্যারিসের বুকে তার একক প্রদর্শনী হতে চলেছে।
টনি বলল –ডোমিনিক, আমার মনে হচ্ছে, আমি এখনও তৈরি নই। সমালোচকরা আমাকে খেয়ে ফেলবে।
-তুমি ভুল করছ, এখনই তোমাকে সকলের সামনে হাজির হতে হবে। এটা একটা ছোটো গ্যালারি। স্থানীয় লোকেরা এখানে আসে, তারা তোমার ছবির বিচার করবে। তারা কোনোভাবেই তোমাকে আঘাত করবে না। ওই ভদ্রলোক অত্যন্ত সমঝদার মানুষ। তিনি তোমার মধ্যে সম্ভাবনা না দেখলে কখনোই এই প্রস্তাবে রাজী হতেন না। তিনি স্বীকার করেছেন, একদিন তুমি মস্ত বড়ড়া শিল্পী হবে।
টনি জানে না, হয়তো আমাকে একদিন শিল্পকর্ম বিক্রি করতে হবে।
***
এবার কেবিলটা এসে গেছে, শনিবার প্যারিসে আসছি, ডিনারে আমার সঙ্গে যোগ দিও। ভালোবাসা। মা।
টনির প্রথম চিন্তা হল, তার স্টুডিওতে এসে প্রবেশ করছে। হ্যাঁ, মা এখনও যথেষ্ট আকর্ষণীয়া। মধ্য পঞ্চাশ। চুলের কোথাও এতটুকু অযত্ন নেই। ভারী সুন্দর শরীর, হ্যাঁ, এখনও উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। টনি একবার মাকে প্রশ্ন করেছিল–মা, তুমি কেন আবার বিয়ে করছ না?
মা উত্তর দিয়েছিলেন জীবনে টনি এবং তার বাবা ছাড়া আর কোনো পুরুষের কথা তিনি ভাবতেই পারবেন না।
এখন প্যারিসে তার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে দাঁড়িয়ে সে মাকে বলল –মা, তোমাকে দেখে ভালোই লাগছে।
–টনি, তোমাকে দেখে এত উত্তেজিত বলে মনে হচ্ছে কেন? এসো, তুমি লিঙ্কনের ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছো। তুমি বোধহয় ভালো কাজের মেয়ে পেয়েছ? জায়গাটা একেবারে পালটে গেছে।
কেটি ইজেলের কাছে পৌঁছে গেলেন।
টনি একটা ছবির কাজ করছে। অনেকক্ষণ সে দিকে তাকিয়ে থাকলেন। হ্যাঁ, কেটি তার অহংকার চেপে রাখতে পারছেন না।
উনি বললেন–ছবি আরও দেখাও।
পরবর্তী দু ঘন্টা ধরে শুধু ছবিই দেখা হল। কেটি সব ছবির বিষয়ে খুঁটিনাটি জানতে চাইলেন। কণ্ঠস্বরের মধ্যে একটা দারুণ উত্তেজনা। হ্যাঁ, টনি কত বড় শিল্পী হবে, তিনি তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন।
কেটি বললেন আমি একটা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করব। কজন ডিলারের সাথে কথা বলতে হবে।
-মা, ধন্যবাদ। আসছে শুক্রবার আমার ছবির একটা প্রদর্শনী হবে। একটা গ্যালারি আমাকে সাহায্য করছে।
কেটি হাত তুলে সামনে এগিয়ে এসে বললেন একটা দারুণ খবর। কোন গ্যালারি?
-জর্জ গ্যালারি।
–না, আমি বিশ্বাস করছি না।।
–গ্যালারি ছোটো। কিন্তু এই দিয়েই তো আমাকে শুরু করতে হবে।
গাছের তলায় ডোমিনিকের ছবি। মা অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন। তার চাউনিতে বিরক্তি ঝরে পড়ছে। না, এই ছবিটা কিন্তু ঠিক হয়নি। তবে মুখে তিনি কোন বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। তিনি জানেন কীভাবে মনের ভাবকে গোপন রাখতে হয়।
ডোমিনিক হাসি মুখে এগিয়ে এল।
–মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, আপনি কেমন আছেন?
কেটি বললেন আমার ছেলে তোমার যে ছবিটা এঁকেছে, সেটা অসাধারণ।
বাকিটুকু আর বলা হল না।
–টনি কি আপনাকে বলেছে, ওর একটা প্রদর্শনী হবে?
–হ্যাঁ, খবরটা খুবই ভালো।
–মা, তুমি থাকবে তো?
–আমার একটা বোর্ডমিটিং আছে। পরশুদিন জোহানেসবার্গে। সেখানে আমাকে যেতেই হবে। তবে আগে জানলে আমি হয়তো অন্য কিছু করতাম। দেখা যাক, কী হয়?
–ঠিক আছে, টনি বলল, আমি বুঝতে পেরেছি। উনি একটু ইতস্তত করছে। ডোমিনিককে দেখে মার মনে কী হতে পারে? কিন্তু কেটি এখন শুধু ছবিগুলোর কথাই ভাবছেন।
–ঠিক লোক তোমার ছবি দেখতে আসবে তো?
–কারা সঠিক লোক বলে মনে করেন মিসেস ব্ল্যাকওয়েল।
কেটি ডোমিনিকের দিকে তাকিয়ে বললেন–যাদের কথায় শিল্পজগত ওঠা বসা করে। যেমন ধরো আন্দ্রের মতো একজন মহান সমালোচক।
আন্দ্রেকে শিল্পজগতের সেরা সমালোচক বলা হয়। তিনি হলেন এমন এক গর্জনশীল সিংহ, যিনি শিল্পমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর কলমের কয়েকটা শব্দ শিল্পীর জীবনধারা পালটে দিতে পারে। তাকে প্রত্যেকটা ছবি উদ্বোধনের জন্য ডাকা হয়। তিনি শুধু বড়ো বড়ো ছবিগুলোই উদ্বোধন করতে যান। গ্যালারির মালিক এবং শিল্পীরা তার উপস্থিতিতে শিহরিত হয়ে ওঠে। কখন কীভাবে তার সমালোচনা প্রকাশিত হবে, তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে থাকে। প্যারিসে সকলের কাছে তার নাম পৌঁছে গেছে। আন্দ্রেকে আবার অনেকে ঠিকমতো শ্রদ্ধা করতে পারে না। পাশাপাশি তিনি শ্রদ্ধা এবং নিন্দা একই সঙ্গে অর্জন করেছেন।
টনি ডোমিনিকের দিকে তাকিয়ে বলল এই ছোটো গ্যালারিতে উনি আসবেন কেন?
–ও টনি, ওনাকে আসতেই হবে। উনি রাতারাতি তোমাকে বিশ্ববিখ্যাত করে দেবেন।
অথবা, আমাকে ভেঙে ফেলবেন।
–নিজের ওপর বিশ্বাস নেই কেন?
ডোমিনিক বলল –ও ভীষণ আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু আমরা কী করে ওনাকে এখানে হাজির করব?
-দেখতে হবে ওনার সাথে কার যোগাযোগ আছে।
ডোমিনিকের মুখে হাজার আলো তাহলে তো সাংঘাতিক হবে। সে টনির দিকে ফিরে বলল, যদি উনি আসেন, তাহলে কী হবে বলো তো?
-হ্যাঁ, সকলের কাছে আমার নাম পৌঁছে যাবে।
–আমি ওনার শিল্পসত্তার কথা বলছি। টনি আমি জানি, উনি কী ভালোবাসেন। উনি তোমার ছবির প্রশংসা করবেন।
কেটি বললেন –তুমি কি চাইছ, উনি আসবে টনি? তাহলে আমি দেখব।
-হ্যাঁ, মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, আপনি চেষ্টা করুন। ডোমিনিক বলল।
টনি বলল আমি তো বুঝতেই পারছি না। চেষ্টা করা যাক।
কেটি আবার ছবির দিকে তাকালেন, অনেকক্ষণ, তারপর টনির দিকে তাকালেন। তারপর বললেন –আমি কাল প্যারিস ছেড়ে চলে যাব। তুমি কি আমার সাথে রাতে ডিনার খাবে?
টনি বলল, হ্যাঁ, আজ আমরা ফাঁকা আছি।
কেটি ডোমিনিকের দিকে তাকিয়ে বললেন ম্যাক্সিমে ডিনার খাবে তো?
টনি বলল –ডোমিনিক আর আমি একটা ছোট্ট কাফের কথা জানি। সেটা কিন্তু বেশি দূরে নয়।
তারা প্যালেস ভিটোরিতে গেল। এখানকার খাবার খুবই ভালো। ওয়াইন চমৎকার। দুজন কথা বলার চেষ্টা করছিল। টনি জানে, এই দুজনই আমার জীবনে সব থেকে বড়ো সম্পদ। এদের সাথেই আমি আমার জীবনের সেরা রাতগুলো কাটিয়েছি। একজন আমার মা, আর অন্য মেয়েটিকে আমি বিয়ে করতে চলেছি।
পরের দিন সকালে কেটি এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করলেন আমি অনেককে ফোন করেছি। কিন্তু আন্দ্রের ব্যাপারে কেউ ঠিক কিছু বলতে পারছে না। যাই হোক, তোমাকে নিয়ে আমি গর্ব করতে পারি। তোমার ছবিগুলো দারুণ হয়েছে।
***
জর্জ গ্যালারিটা খুব একটা বড়ো নয়। এখানে টনির আঁকা ছত্রিশটা ছবি টাঙানো হয়েছে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এককোণে চিজ রাখা হয়েছে, বিস্কুট এবং ওয়াইনের বোতল। অ্যান্টন দাঁড়িয়ে আছেন। টনি, ডোমিনিক আর এক সহকারিণীকে দেখা গেল। এখন প্রস্তুতি চলছে।
অ্যান্টন তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন সাতটার সময় উদ্বোধন, এখন থেকেই লোকের আসা শুরু হওয়া উচিত।
টনি একটু উত্তেজিত। কিন্তু সে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু আমার উত্তেজনা কেন থাকবে?
যদি কেউ না আসে, সে ভাবল। একজনও না আসে, তাহলে কী হবে?
ডোমিনিক হাসল- তাহলে এইসব চিজ আর ওয়াইন আমরা ভাগ করে খেয়ে নেব।
নোকজনের আগমন শুরু হয়ে গেছে। প্রথমে অল্প অল্প। তারপর অনেকে। গ্যালারির মালিক নিজে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রত্যেককে স্বাগত সম্ভাষণ জানাচ্ছেন। কিন্তু ওদের দেখে মনে হচ্ছে না, ওরা ছবি কিনবে। টনি ভাবল। সে তার ছবিগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করেছে –আটিস্ট এবং ছাত্রদেরও, দেখা গেল। এবার বোধহয় একটা প্রতিযোগিতা শুরু হবে। না, আমি একটা ছবি বিক্রি করব না, টনি ঠিক করল।
জর্জ হলের দিকে তাকিয়ে বললেন এই লোকগুলোর সাথে কথা বলা উচিত?
টনি ডোমিনিককে প্রশ্ন করল –এরা কে? এরা কি আমার ছবির সমালোচক।
-না, টনি, এরা তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে। তুমি এগিয়ে যাও।
টনি সকলের সঙ্গে কথা বলল। ছবি সম্পর্কে খুঁটিনাটি প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করল।
তখনও লোক আসছে। টনি বুঝতে পারছে না, এরা কেন আসছে? বিনা পয়সায় মদ এবং চিজ খাবে বলে? নাকি এরা সত্যিই শিল্পের সমঝদার। এখনও পর্যন্ত তার একটা ছবিও বিক্রি হয়নি। কিন্তু অত্যন্ত দ্রুত মদের বোতল খালি হচ্ছে। চিজ উড়ে যাচ্ছে।
জর্জ বললেন –ধৈর্য ধরতে হবে। ওরা উৎসাহী। প্রথম দিনই ছবি কেউ কেনে না। তোমার ছবি দেখবে, আবার আসবে, বাড়ি গিয়ে ভাববে, তারপর কিনবে।
-আমি কি সত্যি সত্যি এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছি, টনি ডোমিনিককে বলল।
-একটা বিক্রি হয়েছে, জর্জ আনন্দে চিৎকার করলেন। নরম্যান্ডি লাভস্কেপ, পাঁচশো ফ্রাঙ্কে।
যতদিন টনি বেঁচে থাকবে, এই মুহূর্তটাকে হয়তো ভুলতে পারবে না। কেউ একজন তার ছবি কিনেছে। কেউ একজন তার ছবি কিনে দাম দিয়েছে। আহা, অনেকের কথাই তার মনে পড়ে গেল। দ্য ভিঞ্চি এবং মাইকেল এঞ্জেলো। রেমব্রান্ট। সে এখন শিক্ষানবীশ ছাত্র নয়। সে একজন পেশাদার শিল্পী। কেউ তার ছবির জন্য পয়সা দিয়েছে।
ডোমিনিক ছুটে এল। ডমিনিকের চোখে উজ্জ্বল আলো। কণ্ঠে উত্তেজনা আর একটা বিক্রি হয়েছে।
-কোনটা?
–পুষ্পহার।
এখন লোক ভর্তি, লোকের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ থমথমে নীরবতা।
উনি এলেন আন্দ্রে। মধ্য পঞ্চাশ, সাধারণ ফরাসি মানুষদের থেকে আর একটু লম্বা। দৃঢ় কঠিন সংবদ্ধ মুখ। সাদা চুল। ভারী সুন্দর পোশাক পরেছেন। মাথায় হ্যাট। তার পেছনে অনুগত অনুরাগীর দল। সকলে তাকে জায়গা করে দিল।
ডোমিনিক টনির হাতে মুচকে বলল –উনি এসেছেন, উনি এসে গেছেন।
উনি এসে দাঁড়ালেন।
গ্যালারির মালিক বললেন–কী খাবেন স্যার? আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না, আপনি এসেছেন। কী দেব? একটু রেড ওয়াইন?
আরও ভালো মদ কেন রাখা হল না, গ্যালারির মালিক নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করছেন।
উনি বললেন না, আমি শুধু চোখের খিদে মেটাতে এসেছি। আর্টিস্ট কোথায়? তার সঙ্গে কথা বলব।
-এই হল টনি ব্ল্যাকওয়েল।
টনি তার হারানো কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়েছে –আপনি এসেছেন বলে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
আন্দ্রে একটির পর একটি ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছেন। প্রত্যেকটা ছবির দিকে অনেকক্ষণ তাকাচ্ছেন। পরবর্তীটা দেখছেন। টনি তার মুখের ভাষা পড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তিনি রাগছেন না, হাসছেন না। একটা ছবির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। ডোমিনিকের নগ্নিকা ছবি। তারপর এগিয়ে গেলেন। পুরো ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখলেন। টনির সমস্ত শরীর দিয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে।
আন্দ্রের ছবি দেখা শেষ হল। তিনি বললেন–এখানে আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি।
তারপর উনি চলে গেলেন। সব কটা ছবি বিক্রি হয়ে গেল। এক নতুন শিল্পীর জন্ম হচ্ছে। জন্ম মুহূর্তটিকে সকলে স্মরণযোগ্য করতে চাইছেন।
মঁসিয়ে জর্জ বললেন না, আমি এমনটি কখনও দেখিনি। আন্দ্রে এই প্রথম আমার গ্যালারিতে এসেছেন। কাল সমস্ত প্যারিসে আমার ছোট্ট গ্যালারির নাম ছড়িয়ে পড়বে।
সেই রাতে টনি এবং ডোমিনিক নিজেদের মতো করে আনন্দ করছিল। ডোমিনিক টনিকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল। সে বলল আমি এর আগে অনেক শিল্পীর সঙ্গে শুয়েছি। কিন্তু এমন কোনো শিল্পী নয় যে, তোমার মতো বিখ্যাত হতে চলেছে। কাল সমস্ত প্যারিসের সর্বত্র তোমার নাম ছড়িয়ে পড়বে।
ডোমিনিকের অনুমান সঠিক বলে প্রমাণিত হল।
***
পরের দিন সকালবেলা, টনি এবং ডোমিনিক পোশাক পরে নীচে নেমে গেল। ইয়সকের খবরের কাগজ এসেছে। টনি পাতাটা খুলে দেখল। হ্যাঁ, আন্ত্রের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। লেখা হয়েছে আমেরিকার তরুণ চিত্রকর অ্যান্থনি ব্ল্যাকওয়েলের ছবির প্রদর্শনী চলেছে জর্জ গ্যালারিতে। এটা একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমি এর আগে অপটু কাজের অনেক প্রদর্শন দেখতে গিয়েছি। কিন্তু সেগুলো ভুলে গিয়েছি। গতকাল রাত পর্যন্ত আমার মনে ছিল …টনির সমস্ত মুখে লজ্জা।
ডোমিনিক, বলল –তুমি কাগজটা আমাকে দাও।
টনি আবার পড়তে শুরু করে আমি ভেবেছিলাম এটা বোধ হয় এক ধরনের রসিকতা। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে, এই ধরনের বাজে ছবিগুলোকে কেন টাঙিয়ে লোক হাসানো হয়। আমি কোথাও প্রতিভার সামান্যতম বিচ্ছুরণ দেখলাম না। আহা, মনে হয়, শিল্পীকে টাঙিয়ে রাখলেই বোধহয় ভালো হত। মি. ব্ল্যাকওয়েলকে আমি একটাই উপদেশ দেব, তিনি যেন তার আসল কাজে ফিরে যান।
ডোমিনিক চিৎকার করে বলল আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এধরনের বাজে সমালোচনা?
টনির মনে হল, তার সমস্ত শরীরে বুঝি কঁপুনি ধরেছে। সে বলল আমি বিশ্বাস করি না। এত কষ্ট? আমি কী বোকা।
-তুমি কোথায় যাচ্ছো, টনি?
–আমি জানি না।
টনি ভোরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলল। সে জানে না, তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্যারিসের সমস্ত লোক এই সমালোচনা পড়বে। সকলে তার দিকে তাকিয়ে উপহাস করবে। কিন্তু? আমি কি নিজেকে প্রতারিত করলাম? তার মানে? শিল্পী হিসেবে আমার সামনে এখন কোনো ভবিষ্যৎ নেই? শেষ পর্যন্ত আন্দ্রে হয়তো আমাকে একটা মস্ত বড়ো ভুলের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। না, টনি ভাবল, আমি আর কখনও শিল্পী হবার স্বপ্ন দেখব না। এই বারটা এই মাত্র খুলেছে, টনি সেখানে ঢুকে গেল। তাকে এখন আকণ্ঠ মদ গিলে মাতাল হতে হবে।
***
টনি শেষ পর্যন্ত তার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসেছে। পরের দিন সকাল পাঁচটা।
ভোমিনিক সমস্ত রাত তার জন্য অপেক্ষা করেছে–তুমি কোথায় ছিলে টনি? তোমার মা কতবার ফোন করেছেন জানো? উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
-মা কি লেখাটা পড়েছেন?
–হ্যাঁ, আমি পড়ে শুনিয়েছি।
টেলিফোন বেজে উঠল। ডোমিনিক টনির দিকে তাকিয়ে বলল–মিসেস ব্ল্যাকওয়েল। ছেলে এই মাত্র ফিরেছে। সে রিসিভারটা টনির হাতে তুলে দিল।
-হ্যালো, মা?
কেটির কণ্ঠস্বরে হতাশা –টনি, আমি জানি না, এ ব্যাপারটা তুমি কেমনভাবে নিয়েছ?
–মা, এটা কোনো ব্যবসা নয়। এটা এক সমালোচকের মন্তব্য। তাঁর মন্তব্য হচ্ছে, আমাকে ফাঁসি দেওয়া উচিত।
–ডার্লিং, তুমি কি দুঃখ পেয়েছ?
কেটি আর কথা বলতে পারলেন না।
-মা, আমি চেষ্টা করেছিলাম, আমি পারলাম না। আমি হয়তো চলে যাব। তিনি আমাকে একটা মস্ত বড়ো বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।
–টনি, আমি কিছু বলতে চাইছি।
-হ্যাঁ, আজ থেকে দশ বছর পরে এই ঘটনাটা ঘটলে কী হত বলো তো? আমাকে এখুনি প্যারিস থেকে চলে যেতে হবে।
–আমার জন্য অপেক্ষা করো। আমি কাল জোহানেসবার্গ ছেড়ে যাচ্ছি। আমরা একসঙ্গে নিউইয়র্কে ফিরে যাব। কেমন?
–ঠিক আছে। টনি বলল। সে রিসভারটা রেখে ডোমিনিকের দিকে তাকাল–ডোমিনিক, আমি দুঃখিত, তুমি এক ভুল মানুষকে বেছে ছিলে।
ডোমিনিক কোনো কথা বলল না। সে দেখতে পেল, টনির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
***
পরের দিন বিকেলবেলা, ক্রুগার ব্রেন্টের অফিস। কেটি ব্ল্যাকওয়েল একটা চেক লিখছিলেন। উল্টোদিকের চেয়ারে বসে থাকা একজন মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
মিসেস ব্ল্যাকওয়েল। আপনার ছেলের মধ্যে অসাধারণ প্রতিভা ছিল। তাকে এভাবে হত্যা করা হল। ব্যাপারটা ভাবতে আমার খারাপ লাগছে।
কেটি ঠাণ্ডা ভাবে তাকিয়ে বললেন–আন্দ্রে, এই ধরনের হাজার হাজার শিল্পী সারা পৃথিবীতে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার ছেলে একজন তোক বাড়িয়ে কী করবে।
উনি চেকটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছিলেন–আপনার কাজ শেষ হয়ে গেছে। এবার আমাকে আমার কাজ করতে দিন। জুগার ব্রেন্ট লিমিটেড জোহানসবার্গে অনেকগুলো শিল্প সংগ্রহশালা খুলবে। এর পাশাপাশি লন্ডন এবং নিউইয়র্কে আমরা এই সংগ্রহশালাগুলো খুলব। আপনি ভালো ছবি নির্বাচন করবেন, কেমন? হ্যাঁ, আপনাকে ভালো কমিশন দেওয়া হবে।
আন্দ্রে চলে গেছেন। কেটি ডেস্কে গিয়ে বসলেন। মনের ভেতর ভীষণ বিষণ্ণতা। ছেলেকে তিনি ভালোবাসেন। যদি এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের কথা ছেলে কোনোদিন জানতে পারে, তাহলে কী হবে? কিন্তু টনি এইভাবে এক শিল্পী হবে, এটা তিনি সহ্য করবেন কী করে? হ্যাঁ, টনির জন্য একটু কষ্ট হচ্ছে বটে, কিন্তু কোম্পানিকে তো বাঁচাতে হবে।
কেটি উঠলেন, ক্লান্তি এসে গ্রাস করেছে সমস্ত শরীর। এখন টনিকে বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে।
হ্যাঁ, এবার টনি অন্য ভূমিকাতে অবতীর্ণ হবে।
.
১৯.
পরবর্তী দু বছর ধরে টনি ব্ল্যাকওয়েল ব্যবসার মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখল। প্রথমে এই বিশাল ব্যবসাটা কী, সে বুঝতে পারেনি। ক্রুগার ব্রেন্টের সাম্রাজ্য এখন আরও বিস্তৃত হয়েছে। অনেকগুলো কাগজের মিল কিনেছে। একটা ব্যক্তিগত বিমান সংস্থা। ব্যাঙ্ক এবং অনেকগুলো হাসপাতাল। টনি সব কিছু শান্তভাবে শিখছে। সে বিভিন্ন ক্লাব এবং সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। সে জানে, এগুলো তাকে কত সাহায্য করবে।
টনি সকাল থেকে রাত অব্দি পরিশ্রম করে। গাড়ি চালায়, আগেকার স্মৃতিকে ভুলে যাবার চেষ্টা করে। মাঝে মধ্যে ডোমিনিককে চিঠি লেখে। চিঠিগুলো ফেরত আসে ওই অবস্থায়। অ্যানকে ফোন করেছিল। অ্যান্টন বলেছেন, ডোমিনিক আর সেখানকার মডেল নয়। সে কোথায় হারিয়ে গেছে।
টনি এখন ভালো ভাবেই কাজ করছে। হা, এর মধ্যে তার কোনো আবেগ নেই। ভালোবাসা নেই। হয়তো এক সাংঘাতিক শূন্যতা। টনি সম্পর্কে নিয়মিত রিপোর্ট আসছে কেটির হাতে। কেটি ছেলের কাজে খুবই খুশি।
কেটি একদিন ব্রাড রজারসকে বললেন ব্যবসার প্রতি ছেলের আগ্রহ দেখে আমি অবাক হচ্ছি।
হ্যাঁ, কেটির কাছে এখন চরম নিশ্চিন্তির সময়। শেষ পর্যন্ত ব্যবসাটা ধ্বংস হবে না, এ ব্যাপারে উনি সুনিশ্চিত।
***
১৯৪০ সাল, দক্ষিণ আফ্রিকাতে জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতায় এসেছে। এখন অভিভাষণের ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়েছে। সরকার নতুন নতুন নিয়মনীতি প্রবর্তন করছে। দেশে গণতন্ত্রের শাসন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। পুলিশ দাঙ্গাকারীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করছে। কেটি মাঝে মধ্যে খবরের কাগজের পাতায় এইসব প্রতিবেদন পড়ে থাকেন। বান্দার নাম সবসময় লেখা থাকে। বান্দা এখনও অন্তরালে থেকে কাজ চালাচ্ছেন। অনেক বয়স হয়ে গেছে, তবুও হার মানছেন না। হ্যাঁ, কেটি ভাবলেন, বান্দাকে কেউ কখনও পরাস্ত করতে পারবে না।
কেটি তার ছাপান্নতম জন্মদিন পালন করলেন ফিফথ এভিনিউর বাড়িতে, টনির সঙ্গে। তিনি ভাবলেন, চব্বিশ বছরের ছেলেটি এখন আমার উত্তরাধিকারী। কিন্তু আমাকে দেখলে কেউ কি ওর মা বলে ভাববে?
ছেলে বলল–আনন্দ মুখর জন্মদিন।
–তুমি আমাকে আর একটু খুশি করবে.তো? আমি তো কিছুদিন বাদে সবকিছু ছেড়ে দেব। কেটি ভাবলেন, তোমাকে আমার জায়গা নিতে হবে।
কেটির ইচ্ছেতে, তারা এখন ফিফথ এভিনিউতে চলে এসেছেন।
কেটি বলেছিলেন তোমাকে একটু নিরাপদে থাকতে হবে।
টনি এই ব্যাপারে কোনো কথা বলতে পারেনি।
রোজ সকালবেলা টনি এবং কেটি এক সঙ্গে ব্রেকফাস্টের আসরে বসেন। ক্রুগার ব্রেস্ট লিমিটেড নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। টনি ইতিমধ্যেই তার কার্যকলাপের দ্বারা মাকে অবাক করে দিয়েছে। ব্যবসাটাকে আরও বড়ো করতে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
***
প্যান আমেরিকানের ফ্লাইট। রোম থেকে নিউইয়র্ক। এখানে কোনো ঘটনা ঘটেনি। টনি এই এয়ার লাইনকে ভালোবাসে। এরা খুব ভালো কাজ করে। সে মাঝে মধ্যেই এই প্লেনে চড়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়।
সেবার পাশে এক মধ্য বয়সিনী যাত্রীকে দেখতে পেল সে।
ফ্যাশান ম্যাগজিন পড়ছে। সে একটা পাতা ওলটাল, টনি দেখল, তার হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেছে। বল গাউন পরা এক মডেলের ছবি। ডোমিনিক। হ্যাঁ, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই চোখ, এই চিবুক, এই বুক–কেউ কী ভুলতে পারে?
-আমাকে ওই কাগজটা দেবেন?
পরের দিন সকালবেলা, টনি বিজ্ঞাপন সংস্থার নাম জানল। সে বলল আমি একজন মডেলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। আপনি কি সাহায্য করতে পারেন? আমি হোপ পত্রিকাতে তার ছবি দেখেছি। ব্ৰথম্যান স্টোরে বল গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছে।
-হ্যাঁ।
–ওই মডেল এজেন্সির নাম কী?
–কালটন ব্লেসিং এজেন্সি।
টেলিফোন নাম্বার টনির হাতে চলে এসেছে।
টনি এক মহিলার সাথে কথা বলল–ডোমিনিক ম্যাসেনের খবর কী?
-না, আমরা ব্যক্তিগত খবর দেব না।
টনি সেখানে বসে রইল। রিসিভারের দিকে তাকিয়ে। কী করে ডোমিনিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়? সে ব্রাড রজারসের অফিসে গেল।
–টনি কফি চলবে।
–না, ধন্যবাদ ব্রাড। কালটন ব্লেসিং মডেল এজেন্সির নাম শুনেছেন?
–হ্যাঁ, কী হয়েছে? এটা তো আমাদেরই।
–কী?
–হ্যাঁ, এটা আমাদের একটা সহযোগী সংস্থা।
–এটা আমরা কবে কিনেছি?
কয়েক বছর আগে, তখন তুমি সবেমাত্র এই সংস্থায় যোগ দিয়েছ। কেন কী হয়েছে?
–একজন মডেলের ঠিকানা চাই।
–বলো, আমি বলে দিচ্ছি।
সন্ধেবেলা, টনি কালটন ব্লেসিং এজেন্সির অফিসে গিয়ে তার নাম বলল। ষাট মিনিট বাদে তার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট মিস্টার ক্লিটনের দেখা হল। ক্লিটনের কাছ থেকে টনি জানতে পারল যে, তার মায়ের একান্ত অনুরোধ এবং আগ্রহে ডোমিনিককে মডেল হিসেবে নেওয়া হয়েছে।
ডোমিনিকের সাথে আগামীকাল দেখা হতে পারে।
***
টনি ডোমিনিকের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর বাইরে সে ডান গাড়িতে অপেক্ষা করছে।
ডোমিনিক বেরিয়ে এলহা, তার সাথে একটা মস্ত বড়ো চেহারার লোক। ডোমিনিক টনিকে দেখে অবাক হয়ে গেল।
-তুমি এখানে কী করছ?
–তোমার সঙ্গে কথা বলব।
বড়ো চেহারার লোকটা বলল –অন্য কোনো সময়, আমরা এখন ব্যস্ত আছি।
টনি বলল–তোমার বন্ধুকে এখন যেতে বলো।
-তুমি আমাকে তাড়িয়ে দেবার কে হে?
ডোমিনিক লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল –কেন, তুমি এখন চলে যাও। তোমাকে একটু পরে ডাকছি।
লোকটা চলে গেল গটগট করতে করতে।
ডোমিনিক টনির পাশে এসে বসেছে। ডোমিনিক বলল–তুমি ভেতরে এসো।
অ্যাপার্টমেন্টে একটা মস্ত বড়ো ডুপ্লেক্স। সুন্দর সাজানো। অনেক দাম পড়েছে নিশ্চয়ই।
টনি বলল তুমি কেমন আছো?
-হ্যাঁ, আমি এখন ভালো আছি। তুমি কি ড্রিঙ্ক নেবে?
–না, ধন্যবাদ। প্যারিস থেকে চলে আসার পর তোমার কথা খুব ভেবেছি।
–আমি চলে গিয়েছিলাম।
–কোথায়?
–আমেরিকায়।
–কালটন ব্লেসিং এজেন্সিতে কীভাবে কাজ পেলে?
–আমি কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম।
–তুমি আমার মার সাথে কখন দেখা করলে ডোমিনিক?
–কেন তোমার অ্যাপার্টমেন্টে? প্যারিসে? মনে নেই?
—না, সত্যি করে বলল, আমি কখনও কোনো মহিলাকে আঘাত করিনি। কিন্তু তুমি যদি মিথ্যে কথা বলল, তাহলে আমি তোমার মুখে আঘাত করব।
ডোমিনিক কথা বলতে পারছে না।
সে বলল–সত্যি করে বলো। আমার মায়ের সাথে তোমার কখন কোথায় দেখা হয়েছিল।
–যখন তুমি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলে। তোমার মা আমাকে তোমার মডেল হতে বলেছিল।
টনির পেটে অসম্ভব যন্ত্রণা। তবুও সে বলতে থাকে যাতে তোমার সাথে আমার দেখা হয়, তাই তো?
-হ্যাঁ।
–তুমি আমার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করেছিলে?
-হ্যাঁ, এটা একটা যুদ্ধ। ব্যাপারটা সাংঘাতিক। আমার হাতে কোনো টাকা ছিল না। টনি বিশ্বাস করো, শেষ পর্যন্ত তোমাকে আমি ভালবেসে ফেলেছিলাম।
–আর কতগুলো প্রশ্নের জবাব দেবে?
টনির কণ্ঠস্বরের মধ্যে তিক্ততা ঝরে পড়ছে। ডোমিনিক ভয় পেয়েছে।
–কী জানতে এসেছ?
–মা চেয়েছিল, আমার ওপর নজরদারি রাখতে, তাই তো?
–হ্যাঁ।
ডোমিনিকের ভালোবাসা মনে পড়ে গেল। এইসব টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে। মায়ের সৌজন্যে? টনির মরে যেতে ইচ্ছে করল। সে কি সারা জীবন মায়ের হাতের পুতুল হয়ে বেঁচে থাকবে? মায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? মা তাকে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে দেবে না।
সে ডোমিনিকের দিকে তাকাল। তারপর বেরিয়ে গেল। টনির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ডোমিনিকের চোখ জলে ভরে গেছে। টনি, আমি কিন্তু তোমাকে সত্যি ভালোবাসি, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
***
কেটি লাইব্রেরিতে বসে আছেন। টনি ঢুকল। মদ খেয়েছে।
–আমি ভোমিনিকের সঙ্গে কথা বলেছি। তোমরা হাসাহাসি করেছ আমাকে নিয়ে। কি তাই তো?
কেটি বিপদ সংকেত শুনতে পেলেন টনি?
-এখন থেকে আমি আমার জীবনটা নিজের মতো চালাব। তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?
টলতে টলতে টনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কেটি শান্তভাবে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর একটা আতঙ্ক এসে তাকে গ্রাস করল।
.
২০.
পরের দিন টনি রিমেজ ভিলেজে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করল। না, মার সঙ্গে সে আর থাকবে না। মার সাথে যেটুকু দেখা হবে, ব্যবসায়িক স্বার্থে। এছাড়া আর কখনও নয়।
কেটির হৃদয় ভেঙে গেছে। কিন্তু তিনি তো সঠিক পথের সন্ধান করতে চেয়েছিলেন।
ব্রাড রজারস কেটির অফিসে এসে বলল–কেটি, সমস্যা কিন্তু আরও বাড়বে।
-কী হয়েছে?
–দক্ষিণ আফ্রিকা সংসদ কালো মানুষদের অধিকার রাখতে চাইছে না। তারা কমিউনিস্ট অ্যাক্ট পাশ করেছে।
কেটি চিৎকার করে বললেন হায় ঈশ্বর।
এই আইনের সঙ্গে সাম্যবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকার যে কোনো সময় যে কোনো মানুষকে শাস্তি দিতে পারবে।
–এইভাবে কালোদের অধিকার ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কেটি বলার চেষ্টা করলেন।
–মি. পিয়ারস ফোন করেছেন জোহানেসবার্গ থেকে।
জোনাথন পিয়ারস হলেন জোহানেসবার্গ ব্রাঞ্চ অফিসের ম্যানেজার। কেটি ফোনটা ধরলেন হ্যালো জনি, কী খবর?
–একটা খবর দিতে চাইছি।
–খবর?
–এইমাত্র একটা রিপোর্ট পেলাম যে, পুলিশ বান্দাকে ধরে ফেলেছে।
***
কেটি ফ্লাইট ধরে জোহানেসবার্গের দিকে উড়ে চলেছেন। তিনি কোম্পানির সমস্ত আইনবিশারদকে সাবধান করে দিয়েছেন, তারা যেন এখনই বান্দার সপক্ষে কোর্টে হাজির হন। এর সাথে ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেডের স্থায়িত্ব এবং সম্মান জড়িয়ে আছে।
প্লেনটা জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টে থামল। কেটি তার অফিসে গেলেন। কারাধ্যক্ষকে ফোন করলেন।
-ওকে আলাদা ব্লকে রাখা হয়েছে, মিসেস ব্ল্যাকওয়েল। কোনো ভিজিটারকে যাবার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। তবে আপনার ব্যাপারটা আমি আলাদাভাবে দেখতে পারি।
পরের দিন সকালবেলায় কেটি জোহানেসবার্গ জেলখানায় গিয়ে বান্দার মুখোমুখি বসলেন। বান্দার হাতে পায়ে শেকল। সামনে একটা কাঁচের আবরণ। চুল সম্পূর্ণ সাদা হয়ে গেছে। হ্যাঁ, চোখের ভেতর হতাশা এবং উত্তেজনা।
-আমি জানি, তুমি আসবে, তুমি তোমার বাবার মতো। তুমি সমস্যা থেকে দূরে থাকবে, কেমন করে?
কেটি বললেন –হ্যাঁ, এখান থেকে বেরোতে হবে। কী করে বেরোনো যায়?
–আমি জানি না। হয়তো কফিনের একটা বাক্স করে।
–না, আমি ভালো ল ইয়ার লাগাব।
–কেটি এটা ভুলে যাও, আমাকে এরা কখনও ছাড়বে না। আমাকে মরতেই হবে।
–তুমি কেন একথা বলছ?
–আমি খাঁচাবন্দী জীবন ভালোবাসি না। আমি এখান থেকে মুক্তি পেতে চাইছি।
কেটি বললেন বান্দা চেষ্টা করতেই হবে। কিন্তু এমন কিছু করো না যাতে ওদের সন্দেহ হতে পারে।
-কোনো কিছু আমাকে মারতে পারবে না। তুমি এমন একজন মানুষের সাথে কথা বলছ, যে, হাঙরদের সঙ্গে লড়াই করে যুদ্ধে জিতেছে। ল্যান্ডমাইন তাকে ওড়াতে পারিনি, কুকুরের দল কামড়াতে পারেনি। তুমি সবকিছু জানো। সেটা আমার জীবনের সেরা সময়।
***
কেটি পরের দিন আবার দেখা করতে এলেন।
সুপারিটেনডেন্ট বললেন আমি দুঃখিত মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, এখন আর ওখানে যাওয়া যাবে না।
-কেন?
–সে কথা আমি বলব না।
***
পরের দিন সকালে কেটির ঘুম ভেঙে গেল। তিনি খবরের কাগজের সংবাদ পড়ে অবাক হলেন। ব্রেকফাস্ট খেতে পারলেন না। লেখা হয়েছে জেলখানা ভেঙে পালানোর সময় বিদ্রোহী নেতার মৃত্যু।
এক ঘণ্টা বাদে তিনি জেলখানায় পৌঁছে গেলেন।
সুপারিটেনডেন্ট বললেন উনি জেল ভেঙে পালাবার চেষ্টা করছিলেন, পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে।
কেটি জানেন, এটা একটা অসত্য কথা। বান্দার মতো মানুষ হয়তো মারা গেছেন, কিন্তু তার স্বপ্নরা চিরদিন বেঁচে থাকবে।
দুদিন কেটে গেছে, শোক যাত্রার প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। কেটি এবার প্লেনে চড়ে নিউইয়র্কের দিকে যাত্রা করেছেন। তিনি জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। আহা, এই পবিত্র প্রিয়ভূমির দিকে শেষবারের মতো তাকালেন। এই ভূমিখণ্ডের মধ্যে আছে অসাধারণ উর্বরতা। এখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হিরে লুকিয়ে আছে। এটা হল ঈশ্বরের নির্বাচিত পরম ভূমিখণ্ড। কিন্তু এখানকার মানুষ? কতদিন তারা অনাচার আর অত্যাচারের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হবে?
পরের দিন সকালে কেটি রজারসকে ডেকে পাঠালেন। বললেন তোমার সাথে, কিছু গোপন আলোচনা আছে। চার্লি এবং ফ্রেডরিক সম্পর্কে তোমার বক্তব্য কী?
ব্রাড ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে এসেছিল। সে বলল–চার্লি ডালাসে জন্মেছেন, উচ্চাঙ্কাখী পুরুষ, তিনি তার নিজস্ব সাম্রাজ্য চালিয়ে থাকেন। তবে তাকে হয়তো শয়তানের প্রতিভু বলা যেতে পারে।
–কত বয়স হবে?
–সাতচলিশ।
–সন্তান?
–একটি মেয়ে, পঁচিশ, মেয়েটি অসাধারণ সুন্দরী।
–মেয়েটির বিয়ে হয়েছে?
–হ্যাঁ, ডিভোর্স হয়ে গেছে।
–এবার ফ্রেডরিক হকম্যান?
-হকম্যানের বয়স চার্লির থেকে কম। তাকে দেখলে অনুভবী মানুষ বলে মনে হয়। তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ জার্মান পরিবার থেকে এসেছেন। তিনি বিপত্নীক। তার ঠাকুরদাদা একটি ইস্পাতের কারখানা শুরু করেছিলেন। ফ্রেডরিক হকম্যান ঠাকুরদাদার কাছ থেকে এই ব্যবসাটা পেয়েছেন। এছাড়া আরও কিছু সম্পত্তি পেয়েছিলেন। কমপিউটারের জগতে পদার্পণ করেছিলেন। অনেকগুলো মাইক্রো প্রসেসারের ওপরে পেটেন্ট নিয়েছেন।
-ছেলেমেয়ে?
–একটি মেয়ে আছে, বয়স তেইশ।
মেয়েটি কেমন?
–আমি এখনও জানতে পারিনি, ব্রাড রজারস একটু চিন্তা করে বলল। তারপর সে আরও বলল এই ব্যাপারে আলোচনা করে কী লাভ, কেটি? আমি হয়তো আরও তথ্য দিতে পারব, কিন্তু এই দুটো কোম্পানির কেউ তাদের ব্যবসা বিক্রি করতে চাইছে না। আমি হলফ করে বলতে পারি।
***
দশদিন কেটে গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেটিকে আমন্ত্রণ জানালেন। ওয়াশিংটনে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এখানে বিশিষ্ট শিল্পপতিদের ডেকে পাঠানো হয়েছে। কী করে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশকে সাহায্য করা যায়, সেটি হল আলোচনার মূল বিচার্য বিষয়।
দুজন মানুষ সম্পর্কে আরও উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। তিনি আরও বেশি খবর আনার চেষ্টা করছেন। হ্যাঁ, এতে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িয়ে আছে। তিনি দেখলেন ফ্রেডরিক এবং চার্লি চরিত্রের দিক থেকে বিপরীত গ্রহের বাসিন্দা। ফ্রেডরিককে এক সুপুরুষ বলা যায়। তার মধ্যে আভিজাত্যের ছাপ আছে, দেখলেই বুঝতে পারা যায়, তিনি একটা কঠিন নিয়মনীতি মেনে চলেন। হ্যাঁ, ফ্রেডরিকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করলে কী হয়?
***
ওয়াশিংটনের আলোচনা সভা তিনদিন ধরে চলেছিল। উপরাষ্ট্রপতি এই সভায় সভাপতির আসন অলংকৃত করেছিলেন। রাষ্ট্রপতিকেও কিছুক্ষণের জন্য দেখা গিয়েছিল। সকলেই কেটি ব্ল্যাকওয়েলের ব্যক্তিত্ব দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কেটির মধ্যে একটা আশ্চর্য জীবনসত্তা আছে, তিনি এত বড়ো এক বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী, কিন্তু পাঁচজনের মধ্যে তা প্রকাশ করেন না।
চার্লির সাথে কথা বলার সুযোগ এল।
মিস্টার চার্লি, আপনার পরিবারের সকলকে কি আপনার সঙ্গে এনেছেন?
–আমি আমার মেয়েকে এনেছি। তাকে কিছু বাজার করতে হবে।
-তাই নাকি? কেটি তার উচ্ছ্বাস দেখালেন। তারপর বললেন, শুক্রবার আমি, ডাকহারবারে একটা ছোট্ট ডিনার দিচ্ছি। আপনি কি মেয়েকে নিয়ে সেখানে আসবেন?
–হ্যাঁ, আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি, মিসেস ব্ল্যাকওয়েল। আমি নিশ্চয়ই যাব।
কেটি হাসলেন–আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব, যদি কাল রাতের বিমান ধরেন, তাহলে ভালো হয়।
দশ মিনিট বাদে কেটি হকম্যানের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন।
আপনি কি ওয়াশিংটনে এখনও রয়েছেন? আপনার স্ত্রী এসেছে নাকি?
-না, আমার স্ত্রী কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। আমি আমার মেয়ের সঙ্গে এসেছি।
কেটি জানতেন যে, তারা জে অ্যাডামস হোটেলে আছেন। ৪১৮ নম্বর স্ট্রিটে। তিনি বললেন–ডাকহারবারে আমি একটা ছোট্ট ডিনারের আয়োজন করেছি। আপনি মেয়েকে নিয়ে এলে খুব ভালো হবে।
–আমি তো জার্মানিতে ফিরে যাব। তারপর বললেন, ঠিক আছে, একদিন-দুদিন পরে গেলে কোনো অসুবিধা হবে না।
***
ডাকহারবারে পার্টি। প্রতি দুমাস অন্তর একবার করে কেটি এই আনন্দ আসরের আয়োজন করে থাকেন। এখানে পৃথিবীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষরা এসে উপস্থিত হন। তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। কেটি এবারের পার্টিটা দিচ্ছেন অন্য একটা উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য। তিনি টনির কাছে প্রস্তাবটা রাখলেন।
টনি বলেছিল না, আমি সোমবার কানাডা যাব। মনে হচ্ছে ফিরতে পারব না।
-ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কেটি বললেন। চার্লি এবং হকম্যান আসবেন, তোমাকে থাকতেই হবে।
-আমি জানি, ওঁরা কে। আমি ব্রাড রজারসের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কী হবে?
–এই ব্যাপারটা ওখানে আলোচনা করলেই ভালো হয়।
–তুমি কোন কোম্পানি কিনতে চাইছ?
-কেন? চার্লির যে তেল কোম্পানিটা আছে, সেটা। আরব দেশে এর মস্ত বড়ো চাহিদা আছে।
-তাহলে কি আমায় থাকতে হবে?
–হ্যাঁ, তুমি থাকলে ভালো হয়। কদিন বাদে না হয় কানাডাতে যেও।
টনি এসব ব্যাপারগুলো মোটেই ভালোবাসে না। তবুও সে বলল আচ্ছা, আমি থাকব।
***
অতিথিরা একে একে সিডারহিল হাউসে আসতে শুরু করেছেন। কেটি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রত্যেককে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছেন। ব্রাড রজারস চার্লির মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির নাম লুসি, হ্যাঁ, অসাধারণ সুন্দরী। লম্বা, কালো চুলের বন্যা, ভারী সুন্দর বাদামী চোখের তারা। দেখতে শুনতে সত্যি অতুলনীয়। চেহারার মধ্যে কোনো খুঁত নেই। পোশাকটাও তাকে ভারী সুন্দর মানিয়েছে। ব্রাড এর আগেই সব খবর কেটিকে জানিয়েছিল। সে এক ইতালিয় ছেলেকে বিয়ে করেছিল, দুবছর আগে ডিভোর্স হয়ে গেছে।
টনির সাথে লুসির কথা হল। কেটি তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মুখে কোনো আলাদা অভিব্যক্তি নেই।
লুসি সব কিছু দেখে অত্যন্ত আনন্দিত। তার কণ্ঠস্বরের ভেতর আনন্দ এবং উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ছে। সে টনিকে প্রশ্ন করল–তোমরা কি এখানে বেশি সময় থাকো?
-না।
আবার প্রশ্ন তুমি কি এখানে বড়ো হয়েছ?
–আমার জীবনের কিছুটা সময় এখানে কেটে গেছে। টুনি যেন এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে। সঙ্গে সঙ্গে কেটি বললেন টনির জীবনের অনেক শুভ মুহূর্ত এই বাড়িতে কেটে গেছে।
মায়ের দিকে তাকিয়ে টনি বলল–মা, আমার বোধহয় কানাডাতে গেলেই ভালো হত।
-না, তোমাকে এখানে থাকতে হবে।
চার্লি এই নিমন্ত্রণ পেয়ে খুবই খুশি হয়েছেন। তিনি বললেন আপনার সন্তান সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছিলাম। এখন তাকে স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।
এবার কাউন্ট হফম্যানের পালা। তার মেয়ের নাম মারিয়ানা। তিনি একটু দেরি করে এসেছেন। তিনি এসেই লজ্জিত সুরে বললেন –প্লেনটা লা গার্ডিয়াতে আটকে ছিল।
কেটি বললেন–কী লজ্জার বিষয়। হকম্যান মারিয়ানাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন। তিনি বললেন স্কচ পাওয়া যাবে?
মারিয়ানার দিকে তাকিয়ে কেটি বললেন তুমি কী নেবে?
–আমি এখন কিছুই নেব না।
অন্যান্য অতিথিরা এসে গেছেন। টনি সকলের সঙ্গে কথা বলছে। তাকেই আজ গৃহকর্তার ভূমিকাতে অভিনয় করতে হচ্ছে।
বিরাট ডাইনিং রুম, কেটি মারিয়ানা হকম্যানকে এক সুপ্রীম কোর্ট জাস্টিসের পাশে বসিয়ে দিলেন। তার পাশে এক সেনেটর বসে আছেন। টনির সামনে লুসিকে বসানো হল। সকলেই এসে গেছেন। বিবাহিত এবং অবিবাহিতরা, সকলেই লুসির দিকে তাকিয়ে আছে। কেটি লুসি এবং টনির কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করছেন। বোঝা যাচ্ছে, টনি হয়তো ধীরে ধীরে লুসির প্রতি আকর্ষিত হয়ে উঠছে। এভাবেই একটা সুন্দর গল্প শুরু হতে পারে।
পরের দিন সকালবেলা, শনিবার, ব্রেকফাস্টের আসর।
চার্লি কেটির কাছে জানতে চাইলেন মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, আপনার প্রমোদ তরণীতে একবার ভ্রমণ করলে কেমন হয়? এটা কত বড়ো?
কেটি তার ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন টনি? এটা কতটা হবে?
টনি শান্তভাবে বলল–আশি ফুট।
টেকসাসে আমরা এ ধরনের সুযোগ পাই না। একবার কি ভ্রমণ করা যেতে পারে?
চার্লির মুখে উদ্ভাসিত হাসি।
কেটি হেসে বললেন –ঠিক আছে। আমরা আগামীকাল ওই ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে পারি।
টনি দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে কিছুই বলল না। তার মনে হচ্ছে চার্লি বোধহয় এক চালাক ব্যবসাদার। তিনি কেটি ব্ল্যাকওয়েলের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক স্থাপন করতে চলেছেন। কেটি, টনি এবং লুসির দিকে তাকিয়ে বললেন তোমরা দুজন একটা ক্যাপবোটে ঘুরে এসো না।
টনি কিছু বলার আগেই লুসি বলল হ্যাঁ, যাব।
টনি শান্তভাবে বলল –আমি দুঃখিত। একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আমার।
মায়ের চোখে অবিশ্বাস এবং সন্দেহ।
কেটি মারিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল–তোমার বাবা কোথায়?
-বাবা তো সকালে উঠে দেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছে।
–তুমি ঘোড়ায় চড়তে ভালোবাসো? আমার একটা সুন্দর ঘোড়াশালা আছে।
–ধন্যবাদ, মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, আমি একটু ঘুরে দেখব কি?
-হ্যাঁ, দেখতে পারো। কেটি টনির দিকে তাকিয়ে বললেন –কী? তুমি কি লুসিকে নিয়ে বেরোবে না?
–হ্যাঁ, আজ আমি একটু ব্যস্ত আছি।
ছোট্ট একটা বিজয়, কেটি হাসলেন, অথবা টনি?
ব্রেকফাস্ট শেষ হয়ে গেছে। কেটি বললেন তোমার ফোনগুলো ধরার আগে তুমি লুসিকে নিয়ে বাগান থেকে ঘুরে এসো।
এবার টনি আর বাধা দিতে পারল না। কেটি চার্লির দিকে তাকিয়ে বললেন –আপনি কি পুরোনো বই পড়তে ভালোবাসেন? আমার লাইব্রেরিতে অনেক পুরোনো বই আছে।
টেকসাস ভদ্রলোক হেসে বললেন –আপনি যা দেখাবেন তাতেই আমি খুশি হব।
কেটি মারিয়ানার দিকে তাকিয়ে বললেন –তুমি কি ঠিক আছে?
–মিসেস ব্ল্যাকওয়েল, আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না।
টনি এবং লুসি বেশ কিছুক্ষণ বাগানে ঘুরে বেড়াল। এখানে অনেক ফুল ফুটেছে। রঙের খুন-খারাপি উৎসব। মনে হয় একটুকরো স্বর্গ বুঝি নেমে এসেছে।
***
বিরাট লাইব্রেরি, কেটি সব কিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। অলিভার গোল্ডস্মিথ, টবিয়ার স্মল জন ডন, সকলের বই আছে। ভদ্রলোক দেখে অবাক হয়ে গেছেন। উনি বুঝতে পারছেন, কেটি শুধু অর্থ উপার্জনের জন্যই সময় কাটান না। এসব কাজেও অনেকটা সময় দিতে হয় তাকে।
***
টনি তখন তার প্রাইভেট স্টাডিতে বসে আছে, হলওয়ের পাশে একটা ছোট্ট ঘর। আর্মচেয়ারে বসেছিল সে, দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেল। মারিয়ানা ঢুকে পড়েছে।
মারিয়ানা দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলোর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না, এত সুন্দর ছবি এখানে থাকতে পারে। যখন সে জানতে পারল, টনি এই ছবিগুলো এঁকেছে, তখন তার উচ্ছ্বাস হল আকাশ ছোঁয়া।
টনি ভাবছে, এই দুটি মেয়ের মধ্যে কে আমার কাছাকাছি আসতে পারে? লুসি কি আমাকে জয় করার চেষ্টা করছে? কিন্তু তাহলে সে সময় নষ্ট করবে। টনি প্রেমে আঘাত পেয়েছে। মা এবং ডোমিনিকের চক্রান্তের শিকার হয়েছে। এখন সে মেয়েদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে ভালোবাসে।
***
রবিবার সকালবেলা, টনি সাঁতার কাটতে গেছে। মারিয়ানা জলের ভেতর ছিল, একটা ছোট্ট বিকিনি করে। অসাধারণ দেহ সৌন্দর্য তার লম্বা এবং মেদবর্জিত। আভিজাত্যের ছাপ আছে। টনি জলের ভেতর ওই জলপরিকে দেখে অবাক হয়ে গেল। সুন্দর ছন্দে মেয়েটি সাঁতার কাটছে। সাঁতার কাটতে কাটতে মারিয়ানা টনির দিকে এগিয়ে এসে বলল সুপ্রভাত।
টনি বলল-সুপ্রভাত।
মারিয়ানা বলল–আমি সবরকম খেলা খেলতে ভালোবাসি। বাবার কাছ থেকেই এই স্বভাবটা পেয়েছি।
টনি একটা তোয়ালে ছুঁড়ে দিল। মারিয়ানা শরীর মুছছে।
টনি জিজ্ঞাসা করল–ব্রেকফাস্ট শেষ হয়েছে?
-না, এত তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট হয় না আমাদের।
এটা তো একটা হোলে, সব সময় খাবার পাওয়া যাবে।
টনি জানতে চাইল তুমি থাকো কোথায়?
বেশির ভাগ সময় মিউনিখে থাকি। শহরের বাইরে একটা দুর্গের ভেতর।
–তুমি কীভাবে বেড়ে উঠেছ?
মারিয়ানা বলল এটা একটা লম্বা গল্প, যুদ্ধের সময় আমাকে সুইজারল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর আমি অক্সফোর্ডে যাই। সরবোনে পড়াশুনা করি। লন্ডনে ছিলাম কয়েক বছর। টনির চোখে চোখ রেখে বলল, এবার তোমার কথা বলল।
নিউইয়র্ক, ইউরোপ, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, কয়েক বছর দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর, যুদ্ধের সময়। প্যারিস
টনি এবার কিছু বলার চেষ্টা করল। কিন্তু গল্প শেষ হয়ে গেছে।
-তুমি ছবি আঁকা ছেড়ে দিলে কেন?
মারিয়ানার এই প্রশ্নে টনি থতমত –ও ব্যাপারটা ছেড়ে দাও। চলো, আমরা ব্রেকফাস্টের আসরে যাই।
***
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তারা নিশ্চুপ হয়ে খেয়ে চলেছে। মারিয়ানা কিছু বলার চেষ্টা করছে, টনি এখন শুনছে না।
শেষ পর্যন্ত টনি বলল–তুমি কখন জার্মানিতে ফিরে যাবে?
–আগামী সপ্তাহে। আমার বিয়ে হবে।
টনি অবাক হয়ে গেছে –আহা, কার সঙ্গে?
-সে একজন ডাক্তার। আমার অনেক দিনের সাথী।
টনি জিজ্ঞাসা করল নিউইয়র্কে আমার সঙ্গে ডিনার খাবে?
-হ্যাঁ, আমার ভালোই লাগবে।
***
লং আইল্যান্ডে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট। সমুদ্রের ধারে, টনি মারিয়ানার মুখোমুখি বসে থাকতে চেয়েছিল। সে কেন জার্মানিতে ফিরে যাচ্ছে? আগামী সপ্তাহে। হ্যাঁ, তার তো বিয়ে হবে।
***
পরের পাঁচদিন ধরে টনি আর মারিয়ানা সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছে। টনি কানাডাতে যায়নি। কিন্তু কেন? সে জানে না। মারিয়ানা কি তাকে গ্রাস করেছে? তার হৃদয় হরণ করেছে?
মারিয়ানা এই প্রথম নিউইয়র্কে এসেছে, টনি তাকে সর্বত্র নিয়ে গেল। শেষ অব্দি? এসে গেল সেই ভয়ংকর দিনটি, সোমবার সকালে মারিয়ানা জার্মান দেশে চলে যাবে।
***
টনি হাউসটন থেকে চলে এল। মায়ের সঙ্গে সে কোম্পানির বিমানে যেতে পারত কিন্তু এই ব্যাপারটা সে এড়িয়ে চলতে ভালোবাসে। সে একা একা থাকতেই চায়।
একটা রোলস রয়েস দাঁড়িয়েছিল। হাউসটনের এয়ারপোর্টে। রোলস রয়েস ব্রাঞ্চের দিকে এগিয়ে চলল।
ড্রাইভার গল্প করছিল অনেকে সরাসরি ব্র্যাঞ্জে চলে যায়। ওই ভদ্রলোক মস্ত বড় ব্যবসাদার।
টনি ভাবল সবকিছু বাড়িয়ে বলা হয়েছে হয়তো। কিন্তু সত্যি সত্যি চার্লসের ব্যবসা দেখলে অবাক হতে হয়।
কেটি ইতিমধ্যে এসে গেছেন। তিনি এবং চার্লি টেরেসে বসে আছেন। সামনে একটা সুইমিং পুল, লেকের মতো আকারের। টনি প্রবেশ করল।
চার্লস তাকে দেখে উঠে এলেন, কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন।-টনি কেমন লাগল?
-অনেক ধন্যবাদ।
–তুমি আগের প্লেনটা ধরলে না কেন? মায়ের প্রশ্ন। লুসি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
টনি জিজ্ঞাসা করল –কোথায় সে?
চার্লি টনির দিকে তাকিয়ে বললেন–দেখো, কাছাকাছি কোথাও পেয়ে যাবে। হয়তো বারবিকিউতে আছে।
–অনেক ধন্যবাদ।
লুসিকে পাওয়া গেল। সাদা শার্ট এবং টাইট জিনস পরেছে। টনি স্বীকার করতে বাধ্য হল, মেয়েটির মধ্যে গুণ ও সৌন্দর্য আছে।
সে বলল –টনি, আমি তোমাকে কখন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
টনি বলল –হ্যাঁ, একটা দরকারি কাজ ছিল। আসতে দেরী হয়ে গেল।
লুসি হাসল ঠিক আছে। তুমি আমার সঙ্গে সমস্ত সময়টা কাটাবে তো?
কেটি এবং চার্লি চোখে চোখ রেখে হাসলেন।
***
বারবিকিউটা অসাধারণ। টেকসাসের ক্ষেত্রেও একটা আলাদা প্রাপ্তি হতে পারে। দুশোজন ইতিমধ্যেই এসে গেছেন। সকলেই এসেছেন ব্যক্তিগত বিমানে। অথবা মার্সিডিজ কিংবা রোলস রয়েসে। দুটো ব্যান্ড নানা সুর বাজিয়ে চলেছে। বারটেন্ডাররা শ্যাম্পেন, হুইস্কি, সফট ড্রিঙ্কস এবং বিয়ার পরিবেশন করেই চলেছে। খাবারের গন্ধ বেরিয়ে আসছে, নানাধরনের খাবার।
সব কিছুই টনির সম্মানার্থে।
টনি এবং লুসি একপাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। কত কথা বোধহয় জমে আছে। আধঘন্টা কেটে গেছে। লুসি তখনও টনির সঙ্গে গল্প করছে। কিন্তু উনি ভাবছে, এই মেলামেশার অন্তরালে কী আছে?
***
এয়ারপোর্ট থেকে টনি মারিয়ানাকে ফোন করল। বলল–আমি তোমাকে দেখতে চাইছি।
এক মুহূর্তের চিন্তা–হ্যাঁ, আমারও ইচ্ছে করছে তোমাকে দেখতে।
টনি মারিয়ানাকে তার চিন্তার জগৎ থেকে বাইরে বের করতে পারছে না। অনেক দিন সে একলা থেকেছে। কিন্তু একাকীত্বের যন্ত্রণা তাকে গ্রাস করতে পারেনি। মারিয়ানা তার জীবনে আসার পর সে কেমন যেন হয়ে গেছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে, কিছু একটা নেই তার জীবনে।
মারিয়ানা টনির সাথে তার অ্যাপার্টমেন্টে দেখা করল। টনি তাকিয়ে থাকল অবাক চোখে। একটা অদ্ভুত তৃষ্ণা, একটা পিয়াস।
মারিয়ানা টনিকে জড়িয়ে ধরল। আবেগ আকাশ ছুঁয়েছে। হ্যাঁ, একটা অবরুদ্ধ ইচ্ছা, একটা প্রচণ্ড জাগ্রত শক্তি।
-মারিয়ানা, আমি তোমাকে বিয়ে করব।
–তুমি কি ঠিক বলছ টনি? একটা সমস্যা আছে।
–তোমার এনগেজমেন্ট?
–না, সেটা আমি ভেঙে দিয়েছি। কিন্তু তোমার মা?
–তার কিছু বলার থাকবে না।
–না, আমি জানি, তোমার মা চাইছেন, তুমি যেন লুসিকে বিয়ে করো।
—এটা মায়ের ষড়যন্ত্র, টনি মারিয়ানাকে আরও ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার পরিকল্পনা আমি সফল করবই।
-উনি আমাকে ঘেন্না করবেন টনি, আমি সেটা চাইছি না।
–আমি যা চাইছি, তোমাকে তা মানতে হবে।
আবার একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটতে চলেছে।
***
কেটি ব্ল্যাকওয়েল খবরটা জানতে পারলেন টনির কাছ থেকে। হ্যাঁ, তিনি একটু অবাক হয়ে গেছেন। কিন্তু কেন? বিয়েটা হয়ে গেছে, গতকাল, মধুচন্দ্রিমার আসর।
মা অবাক হয়ে গেছেন। এত সাহস? ব্রাড রজারস অফিসে এসে বলল আপনি আমায়। ডেকেছেন? তারপর কেটির মুখের দিকে তাকিয়ে ব্রাড বলল –এ কী? আপনার কী হয়েছে?
কেটি হেসে বললেন টনি কাজটা করে দিয়েছে, হপম্যানের সাম্রাজ্য এখন আমাদের হাতে।
ব্রাড রজারস চেয়ারে বসে পড়ল আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। মারিয়ানা হপম্যানকে বিয়ে করা কী করে সম্ভব হল?
কেটি বললেন আমি টনিকে ভুল পথে চালনা করেছিলাম বলতে পারো, এটা আমারই একটা ষড়যন্ত্র।
কিন্তু কেটি জানেন, মারিয়ানা টনিকে সত্যি ভালোবাসবে। হ্যাঁ, লুসির শরীরে একটা খুঁত আছে, লুসি কোনোদিন মা হতে পারবে না।
আর মারিয়ানা? মারিয়ানা টনিকে তার ঈঙ্গিত পুত্রসন্তান উপহার দেবে।