০৬.
পরের দিন রাত এগারোটা। হ্যারি লানজ একটা টেবিলের পাশে বসে আছেন, বাদাম চিবোচ্ছেন।
অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হচ্ছে। রাত দুটো বেজে গেছে। নেউসা মুনেজকে দেখা গেল, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, হয়তো যথেষ্ট মদ গিলেছেন ইতিমধ্যে। হ্যারির হৃৎপিণ্ড স্পন্দন করতে শুরু করেছে।
হাসছেন নেউসা, চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন।
–আপনার কী হয়েছিল?
হ্যারি জানতে চাইলেন, কণ্ঠস্বরে অসহিষ্ণুতা। রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেন।
নেউসার চোখে দুষ্টু ইশারা- হাই!
–গত রাত্রে আপনার এখানে আসার কথা ছিল, তাই না?
–হ্যাঁ।
নেউসার কী হল কী?
–আমি আমার এক মেয়েবন্ধুর সঙ্গে মুভি দেখতে গিয়েছিলাম। একটা নতুন মুভি। আহা, একটা মানুষ যাচ্ছেতাই কাণ্ড করেছে।
লানজ খুবই হতাশ হয়েছেন। হয়তো কেঁদে ফেলতেন। অ্যাঞ্জেল কী ভেবেছেন? এই মাতাল কুকুরির বাচ্চাটাকে বারবার পাঠাচ্ছে কেন? আহা, তবে আমার কাছে এই মেয়েটি একটা সোনালি বিড়াল হতে পারে।
লানজ জিজ্ঞাসা করলেন– নেউসা আপনি কি অ্যাঞ্জেলের সাথে যোগাযোগ করেছেন?
নেউসা লানজের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন। প্রশ্নটা বোঝার চেষ্টা করছেন– অ্যাঞ্জেল! আমি কি এক পাত্র মদ খেতে পারি লানজ?
লানজ ডাবল রামের অর্ডার দিলেন মেয়েটির জন্য। নিজের জন্য ডাবল স্কচ। এই মুহূর্তে তাকে মদ খেয়ে চাঙ্গা হতেই হবে।
-নেউসা, অ্যাঞ্জেল কী বললেন?
–অ্যাঞ্জেল? উনি হা বলেছেন।
–ঠিক আছে।
হ্যারির বুকে পাষাণ ভার চেপে বসেছিল। নেমে গেল।
ব্যাপারটা সুন্দর। এবার কাজটা শুরু করা যাবে।
ভাবনাটা পাখনা মেলে উড়ছে।
এই কুকুরির বাচ্চাটার কথা বিশ্বাস করা যাবে কী? দশলক্ষ ডলার? ভাবতেই কেমন লাগছে।
লানজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নেউসা মনের সুখে মদ গিলছেন। কিছুটা ব্লাউজে পড়ে গেছে।
–অ্যাঞ্জেল আর কিছু বলছেন?
ভুরু দুটি কুঁচকে উঠেছে অ্যাঞ্জেল? সব তথ্য না পেলে তিনি এই কাজটা করবেন কিনা ঠিক নেই।
লানজের মুখে মধুর হাসি বলুন ব্যাপারটা খুবই গোপনীয়, নেউসা, আমি তাকে সব খবর দিতে পারব না।
নেউসা মাথা নাড়লেন উদাসভাবে– তাহলে অ্যাঞ্জেল ব্যাপারটা করতে রাজি হবেন না। প্রস্তাবটার মধ্যে পেচ্ছাব করে দেবেন। আমাকে রাম খাওয়াতে পারেন?
হ্যারি লানজের মন অতি দ্রুত ছুটতে শুরু করেছে। যদি মেয়েটা এই মুহূর্তে হাওয়া হয়ে যান তাহলে কী হবে? ওঁকে তো পরবর্তীকালে আর কখনও পাওয়া যাবে না।
হ্যারি বললেন-নেউসা, আমার ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন। যে-সমস্ত লোক এই ব্যাপারটার সঙ্গে যুক্ত আছেন তাদের ফোন করতে হবে। তারা যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি নাম বলব।
কাঁধে ঝাঁকুনি ঠিক আছে, আপনার যা ইচ্ছে।
না, লানজ ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করলেন। অ্যাঞ্জেলকে রাগ করতে বলবেন না। কালকের মধ্যেই আমি জবাব দেব। কোথায় গেলে আপনার সঙ্গে দেখা হতে পারে বলুন তো?
-কেন এখানে?
মদ এসে গেছে, কুকুরির বাচ্চাটা এক চুমুকে সবটা মদ গিলে ফেললেন, মনে হচ্ছে। যেন একটা পশু।
লানজের ইচ্ছেহল, মেয়েটিকে এখনই মেরে ফেলে। এই বেয়াদপি আর তিনি সহ্য করতে পারছেন না।
.
লানজ পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করলেন। কনট্রোলারের কণ্ঠস্বর শোনা গেল–না, কোনো নাম বলা যাবে না।
ইয়েস স্যার, কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। অ্যাঞ্জেলের রক্ষিতা নেউসা মুনেজ জানিয়েছেন, পরিচয় না দিলে কাজটা করা সম্ভব হবে না। কার হয়ে অ্যাঞ্জেল কাজ করছেন সেটা নাকি তাকে জানাতেই হবে। আমি বলেছি, আপনার অনুমতি পেলে নামটা বলে দেব।
–এই ভদ্রমহিলা, দেখতে কেমন?
কনট্রোলার রিসিভার ধরে আছেন।
লানজ বললেন- মোটা, দেখতে বিচ্ছিরি, বোকাসোকা চেহারা স্যার।
আমার নাম বলাটা উচিত হবে না।
হ্যারি লানজ বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা কত ভয়ংকর। তিনি বললেন–ইয়েস স্যার, আমি বুঝতে পারছি।
তাহলে? অ্যাঞ্জেলের কর্মদক্ষতা কীভাবে যাচাই হবে?
দীর্ঘক্ষণ নীরবতা।
আবার লানজ বলতে শুরু করলেন–মনে হয় অ্যাঞ্জেল কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। একবার তিনি যদি অবিশ্বাসের কাজ করেন তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ তাঁকে কাজ দেবেন না। তিনি খাবেন কী?
আবার দীর্ঘক্ষণের নীরবতা।
–আপনি ঠিকই বলেছেন।
–ঠিক আছে অ্যাঞ্জেলকে আমার নাম বলতে পারেন। তবে দেখবেন অ্যাঞ্জেল যেন কারো কাছে নামটা প্রকাশ না করেন। আমাকে কখনও উনি যেন সরাসরি যোগাযোগ না করেন। উনি কেবল আপনার মাধ্যমেই কাজ করবেন।
হ্যারি লানজের মন আকাশে উড়ছে তখন– হ্যাঁ, স্যার, আমি সব বুঝিয়ে বলেছি। আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ।
রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন, মুখে শরৎ সূর্যের আলো। পঞ্চাশ হাজার ডলার, কত সহজে টাকাটা পকেটে আসবে।
তারপর? দশ লক্ষ ডলার, গুনগুনিয়ে একটা গান গেয়ে উঠলেন হ্যারি!
.
বেশি রাতে নেউসা মুনেজের সঙ্গে হ্যারি লানজের দেখা হল, ডাবল রামের অর্ডার দেওয়া হল।
হ্যারি বললেন–আমি অনুমতি পেয়েছি।
নেউসার দায়সারা অভিব্যক্তি।
–ঠিক বলছেন?
আসল লোকের নাম বলে দেওয়া হল। এই নামটা অনেকেই জানে, তাই লানজ ভেবেছিলেন নেউসা হয়তো খুশি হবেন। নেউসা কাঁধ ঝাঁকানি দিয়ে বললেন-”আমি কখনও এই নামটা শুনিনি।
-নেউসা, ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি করতে হবে। মারিন গ্রোজা নিওলির একটি ভিলাতে লুকিয়ে আছেন।
-কোথায়?
একটা মাতালের সাথে এভাবে কথা বলা যায় কী? তবুও না রাগ করে হ্যারি বললেন প্যারিসের পাশে একটা ছোট্ট শহর অ্যাঞ্জেল নিশ্চয়ই জানবেন।
–আমাকে আরেক পাত্তর মাল দিন প্লিজ!
.
এক ঘণ্টা কেটে গেছে, নেউসা তখনও মাল খাচ্ছে। হ্যারি লানজ তাকে আরও বেশি মাল খেতে উৎসাহিত করছেন। কেন? পুরোপুরি মাতাল হয়ে গেলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন, বয়ফ্রেন্ডের কাছে। বাকি কাজটুকু সহজেই করা যাবে।
লানজ মাঝেমধ্যেই নেউসার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। আহা, চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু।
অ্যাঞ্জেলকে ধরা আর শক্ত হবে না। সম্ভাবনা ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
–অ্যাঞ্জেল কবে শহরে ফিরে আসবেন?
–আগামী সপ্তাহে।
হ্যারি লানজ মেয়েটির হাতে হাত রেখে বললেন- চলুন না আপনার বাড়িতে যাই।
চোখমুখে একটা অদ্ভুত আমন্ত্রণ।
–ও.কে, ঠিক আছে।
ব্যাপারটা তাহলে শুরু হল।
.
নেউসা মুনেজ বাস করে একটা অপরিচ্ছন্ন ঘরে। দু ঘরের আপার্টমেন্ট। বুয়েন্স আয়ার্সের বেনগানো অঞ্চলে। দেখলেই বোঝা যায় দরিদ্রতার চিহ্ন মাখানো। এলোমেলো সবকিছু। বিশৃঙ্খলা। আর অবহেলা। দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। নেউসা এক কোণে হেঁটে গেলেন। হাঁটতে পারছেন না। বেশ কয়েকটা মদের বোতল সাজানো আছে।
–আপনি কী খাবেন?
–আমি আর খাব না, লানজ বললেন, আপনি চালিয়ে যান।
টলমল পায়ে নেউসা মদ ঢাললেন। দেখতে খারাপ, রাস্তার কুকুরি, কিন্তু ওর সাথে এখন ভালো ব্যবহার করতে হবে। কারণ–দশ লক্ষ ডলার। ডলারটাই এখন আমাকে উন্মাদ করে দিয়েছে।
দশ লক্ষ ডলার? ভাবতেই মনটা আনন্দের পাখা মেলে দেয়।
লানজ চারপাশে তাকালেন। কফি টেবিলের ওপর গাদাগুচ্ছের বই। একটির পর একটি বই খুলে পড়ার চেষ্টা করলেন লানজ। অ্যাঞ্জেলের মন সম্পর্কে জানা যাবে। অদ্ভুত! এ বইগুলো এখানে আছে কেন? ভাবতে অবাক লাগে, জর্জ আমানডোর গাব্রিয়েলা, ওমর কাবেজাসের ফায়ার অন দ্য মাউনটেন’, গার্সিয়া মারকুইজের ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউড, অ্যান্টিনিও কিসনারোসের অ্যাট নাইটস দ্য ক্যাট এবং আরও অনেক বই। এই ঘর অথবা ওই মহিলার সাথে বইগুলো মিলছে না।
লানজ এগিয়ে গেলেন। হাত রাখলেন ওই মহিলার মস্ত বড়ো কোমরে।
–আপনাকে দেখতে কত সুন্দর! আপনি কি তা জানেন?
আলতো করে স্তনবৃন্তে টোকা দিলেন। বিরাট আকারের দুটো বেলুন, লানজ এই বড়ো বুকওয়ালা মেয়েদের অপছন্দ করেন। তবু বললেন- আপনার সৌন্দর্য চেয়ে দেখার মতো।
নেউসার চোখের তারায় দ্যুতি- সত্যি বলছেন?
লানজ এগিয়ে গেলেন। মোটা মোটা দুটো উরুতে হাত দিলেন। পাতলা ফিনফিনে সুতির পোশাক বেশ্যাটা পরেছে।
একবার করতে ইচ্ছে করছে। আমি আমন্ত্রণ জানাব কী?
এই মোটা মেয়েছেলেটাকে বিছানায় ফেললে কী হবে? সাবধানে পা ফেলতে হবে। হয়তো অ্যাঞ্জেলের কাছে সব খবর পৌঁছে যাবে। ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হবে। না, এখন কথা বলা যাক।
লানজ খেলতে নেমে পড়লেন।
নেউসা জানতে চাইলেন কী করবে না?
ওঁর চোখে কেমন একটা আভা- বেবি, এটা একটা সুন্দর ব্যাপার।
তাহলে আমার বেডরুমে চলে এসো।
টলতে টলতে নেউসা এগিয়ে চলেছেন। লানজ তাকে অনুসরণ করতে থাকেন। ছোট্ট বেডরুম। একটা ক্লোসেট, একটা অগোছালো বিছানা, দুটো চেয়ার। ভাঙাচোরা আয়না দেওয়া একটা ড্রেসিং টেবিল।
হ্যারি লানজ দেখলেন, ক্লোসেটে পুরুষের পোশাক ঝুলছে। তার মানে, অ্যাঞ্জেল এখানে প্রায়ই এসে বাস করেন।
নেউসা বিছানার ধারে চলে গেছেন। ব্লাউজের বোতামে হাত রেখেছেন। অন্য সময় হলে হ্যারি ওখানে চলে যেতেন, একটা একটা করে বোতাম খুলে দিতেন। শরীরের এখানে সেখানে দুষ্টু মিষ্টি আদরের চিহ্ন আঁকতেন। কানে কানে অসভ্য কথা শোনাতেন। কিন্তু মুনেজের চেহারাই তাঁকে অসুস্থ করে তুলছে। তিনি দেখলেন, স্কার্টটা ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। ভেতরে কিছু নেই– প্যান্টি অথবা ব্রেসিয়ার। একেবারে উলঙ্গ। আরও খারাপ লাগছে। জঘন্য মহিলা, বড়ো বড়ো বুক দুটো ঝুলে পড়েছে। পেটটা বেরিয়ে আছে সামনের দিকে। মোটা দুটো উরু। এমন কুতসিৎ মহিলা আমি কখনও দেখিনি। লানজ মনকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, কয়েক মিনিটেই খেলাটা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ওই দশ লক্ষ ডলার? সারা জীবন আমার পকেটে থাকবে।
ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিজেকে ল্যাংটো করতে বাধ্য হলেন লানজ। মেয়েটি ইতিমধ্যেই বিছানাতে শুয়ে পড়েছেন, অপেক্ষা করছেন। হামাগুড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছে গেলেন লানজ।
কী ভালোবাসো তুমি?
চকোলেট, আমি চকোলেট ভালোবাসি।
–ঠিক আছে, এটাই ভালো লাগবে।
আঃ, তুমি কত সুন্দরী!
নেউসার চোখে জেগেছে অপূর্ব পরিতৃপ্তি।
–আমার জীবনটা কত সুন্দর, তুমি তা জানো কী?
–কেন?
–আমি অ্যাঞ্জেলের গার্লফ্রেন্ড।
এবার অনেক কিছু জানতে চাইলেন লানজ।
-বলো বলো, অ্যাঞ্জেল মানুষটি কেমন?
নীরবতা– নেউসা কি ঘুমিয়ে পড়েছেন? লানজ পায়ের ওপর আঘাত করলেন। হ্যাঁ, কাঁপছে।
–ঘুমিও না সুইটহার্ট, বলল, অ্যাঞ্জেল কেমন মানুষ? হ্যান্ডসাম কী?
–প্রচুর-প্রচুর টাকা আছে তার।
–তোমাকে ভালোবাসে?
–হ্যাঁ, আমাকে খুব ভালোবাসে।
–আমি কি তোমাকে জড়িয়ে ঘুমোব?
ব্যাপারটা খুবই খারাপ। সব কিছুই নেতিয়ে পড়েছে, দশ লক্ষ ডলারের উদ্দীপনা চাই। ডলি বোনেদের কথা মনে পড়ল। আহা, এখন ওদের কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। ওরা কত যৌন উদ্দীপক! সমস্ত শরীরটাকে জিভ দিয়ে চাটে। আমিও সাড়া দেবার চেষ্টা করি। স্তনবৃন্তে মৃদুমন্দ আঘাত। ভালো লাগছে না, ভালো লাগছে না এভাবে সঙ্গমে অংশ নিতে।
শেষ পর্যন্ত পুংদণ্ডটা খাড়া হয়ে উঠল। সবটা ঢুকে গেল মেয়েটির গহ্বরে। আঃ, এভাবে কি ভালো লাগে? হ্যারি লানজ ভাবলেন।
কেমন লাগছে?
—অসম্ভব ভালো।
অনেকক্ষণ দুটি শরীর এইভাবে একে অন্যকে জড়িয়ে শুয়েছিল। পৃথিবীতে কত ভালো ভালো মেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এই কুকুরি ভাবছে, আমি ওকে ভালেবাসি।
কোমর দোলানো শুরু হল, সামনে এবং পেছনে।
-বলো অ্যাঞ্জেল সম্পর্কে আরও কথা। তার বন্ধুরা কে কেমন?
–অ্যাঞ্জেলের কোনো বন্ধু নেই। আমি তার একমাত্র বান্ধবী।
–বেবি, তুমি তার প্রিয় বান্ধবী, আমি জানি। অ্যাঞ্জেল এখানে থাকতে আসে? নাকি নিজস্ব বাড়ি আছে তার?
–আমার ঘুম পাচ্ছে। তুমি কাল কখন আসবে?
—আমি কি আজ থাকব?
চলো আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুম এসেছে মেয়েটির চোখের তারায়। কিন্তু লানজের চোখে ঘুম নেই। আরও অনেক কথা বের করতে হবে। অনেকক্ষণ লানজ চুপচাপ তাকিয়েছিলেন। নেউসা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তার সমস্ত শরীর নিঃশ্বাসের তালে তালে কাঁপছে।
পায়ে পায়ে উঠে দাঁড়ালেন লানজ। ভালোভাবে ক্লোসেটটা পরীক্ষা করলেন। জ্যাকেট আছে, লেবেলগুলো দেখলেন। এভিনিউ লা প্লাটা থেকে তৈরি হয়েছে। জুতো এসেছে ভিল থেকে। আমি জ্যাকপট পেয়ে গেছি। ওখানে গেলেই অ্যাঞ্জেলের ঠিকানা পাওয়া যেতে পারে। সকালে ওখানে যেতে হবে। কিন্তু? প্রশ্ন তো করা যাবে না। তাহলে ব্যাপারটা কেঁচে যেতে পারে। তাহলে? চুপচাপ থাকতে হবে।
বিছানা থেকে একটা শব্দ এল। লানজ তাড়াতাড়ি ক্লোসেটের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। নেউসা ঘুমিয়ে আছেন।
লানজ ক্লোসেটের আলো বন্ধ করে দিলেন। বিছানাতে এসে বসলেন। ড্রয়ারের দিকে তাকাবার চেষ্টা করলেন। কোনো ফটোগ্রাফ আছে কী? না, তিনি আবার বিছানাতে এলেন। নেউসা নাক ডাকছেন।
হ্যারি লানজ ঘুমিয়ে পড়েছেন। স্বপ্ন, একটা সাদা প্রমোদ তরণী এগিয়ে চলেছে। চারপাশে সুন্দরী রূপসী স্বাস্থ্যবতী রমণীদের ভিড়। ভারি সুন্দর স্তনের অধিকারিণী তারা। ছোট্ট স্তন, যাকে মুঠোবন্দি করা যায়।
.
সকালবেলা হ্যারি লানজের ঘুম ভেঙেছে। নেউসা কোথাও নেই। এক মুহূর্তের জন্য হ্যারি ভয় পেয়েছিলেন। তাহলে? মেয়েটি কি অ্যাঞ্জেলের সাথে দেখা করতে গেল নাকি? কিচেনে শব্দ শোনা গেল।
লানজ বললেন- সকাল হয়েছে।
নেউসা বললেন– আমি কফি তৈরি করতে পারব না। এখুনি বেরোতে হবে। একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
অ্যাঞ্জেলের সঙ্গে? হ্যারি লানজ মনে মনে ভাবলেন।
-ঠিক আছে, আমার খিদে পায়নি। ডিনারের সময় দেখা হবে, কেমন?
একটু আদর, দুটো নেমে আসা বুকে টোকা।
-ডিনারে কী পছন্দ করবে? তাই আনব।
লানজ ভাবলেন, এখন আমাকে অভিনয় করতে হবে।
–আমি যা হোক কিছু খাব।
–তাহলে? তুমি কি ওই পাবটা চেনো? কাংগালো এভিনিউতে।
–না।
–এটা ভালো লাগবে। এখানে আটটার সময় আসব। সারা দিন অনেক কাজ আছে।
–ওকে।
একটি দীর্ঘ চুম্বন। নেউসা গুডবাই জানাল। তার ঠোঁট ভিজে গেছে।
-রাত আটটায়।
লানজ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। ট্যাক্সি ডাকলেন। তিনি জানেন,, নেউসা হয়তো জানালা দিয়ে সব দেখছে।
-পরের রাস্তায় চলুন। ড্রাইভারকে বললেন।
হ্যারি লানজ ভাবলেন, আমি এখান থেকে চলে যাব।
ড্রাইভার অবাক হয়ে গেছে মাত্র এইটুকু?
-হ্যাঁ, আমার শরীরটা ভালো নেই। পায়ে ব্যথা আছে। হ্যারি লানজ পয়সা দিলেন। তারপর নেউসার অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর পাশে এসে দাঁড়ালেন। সিগারেট ধরালেন। তাঁকে এখন অপেক্ষা করতে হবে।
কুড়ি মিনিট কেটে গেছে। নেউসা বেরিয়ে এলেন। তিনি কোথায় যাবেন? নিরাপদ দূরত্ব থেকে অনুসরণ করতে হবে। এই মেয়েটিকে এখন চোখের আড়ালে রাখা চলবে না।
নেউসাকে দেখে মনে হল, কোথাও কোনো তাড়া নেই। অ্যাভিনিডা বেলগানো দিয়ে উনি হেঁটে চলেছেন। স্প্যানিশ লাইব্রেরিকে পেছনে ফেলে এলেন। এবার অ্যাভিনিডা করোডোবা, বারেনেস, একটা চামড়ার দোকান। তখনও অনুসরণ করছেন লানজ। শেষ পর্যন্ত নেউসা ওই দোকানে ঢুকে গেলেন। লানজ ভাবলেন, ওই দোকানের সাথে নেউসার কী সম্পর্ক আছে?
নেউসা কয়েক মুহূর্ত বাদে ফিরে এলেন। হাতে একটা ছোট্ট প্যাকেট। এবার অন্য একটি দোকান। আইসক্রিমের দোকান। সান মার্টিন, হাঁটার গতি কমে এসেছে। উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটা, মনে হচ্ছে কোথাও যাবার জায়গা নেই।
তাহলে? অ্যাপয়নমেন্টের ব্যাপারে কী হল? অ্যাঞ্জেলের সঙ্গে দেখা করা? অ্যাঞ্জেল শহরের বাইরে? না, বিশ্বাস করা সম্ভব হচ্ছে না।
নেউসা মুনেজকে চোখের সামনে দেখা গেল না। কোথায় হারিয়ে গেল মেয়েটি? লানজ পায়ের গতি বাড়ালেন। চারপাশে ঘুরে দেখলেন। না, চিহ্নমাত্র নেই। রাস্তার দুপাশে নেই। সর্বত্র চোখ ঘুরছে। তাহলে? নেউসা কি আমাকে দেখতে পেয়েছে?
শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল এক মুদির দোকানে। কেন? আজ লাঞ্চে কেউ আসবে নাকি? অ্যাঞ্জেল নামের কেউ একজন?
দূর থেকে লানজ নেউসাকে নিরীক্ষণ করতে থাকলেন। অনেক কিছু কিনছে ওই মেয়েটি। বেশ কিছুটা ফলও কিনেছে সে।
অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর দিকে হাঁটতে হবে।
হ্যারি লানজ বিল্ডিং-এর সামনে এসে দাঁড়ালেন অনেকক্ষণ। তারপর? ভাবলেন, এবার একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে।
.
হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিস। বিকেল হয়েছে। পল এলিসনের দিনটা কর্মব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেছে। একাধিক কাউন্সিল তৈরি করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কথা হল বন্ধুদের সঙ্গে। বন্ধু স্টানের সাথে আলোচনা হল। দুজনে মিলে একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে।
ম্যারি অ্যাসলেকে নিয়ে আলোচনা শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
.
হ্যারি লানজ নেউসার অ্যাপার্টমেন্টে এসে পৌঁছোলেন ডিনারের জন্য তৈরি হয়ে। দরজায় আঘাত করলেন। কিন্তু শব্দ নেই, অসহায় অবস্থা।
কী আশ্চর্য, দরজাটা খোলা, অ্যাঞ্জেল কি ভেতরে আছেন? হয়তো এই শর্তের ব্যাপারে মুখোমুখি কথা বলতে চান।
হ্যারি ভেতরে প্রবেশ করলেন। ঘরটা ফাঁকা।
-হ্যালো?
প্রতিধ্বনি ফিরে এল। উনি বেডরুমে গেলেন। নেউসা বিছানাতে শুয়ে আছেন, মদ খেয়ে একেবারে বেসামাল।
কী ব্যাপার? উরুতে হাত রাখলেন। জাগাবার চেষ্টা করলেন।
নেউসা চোখ দুটি খুললেন– কী হয়েছে?
–আমি তোমার জন্য ভাবছিলাম। তোমাকে এ অবস্থায় দেখে খারাপ লাগছে। আমি জানি কেউ তোমাকে অসুস্থ করেছে। তুমি কি আমাকে অ্যাঞ্জেল সম্বন্ধে সব কথা বলবে?
ঠোঁট কাঁপছে অ্যাঞ্জেল।
-আমি জানি উনি একজন ভালো মানুষ। তবে বোধহয় আর কেউ?
হ্যাঁ, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
নেউসার চোখের তারায় রক্ত-আভা। বললেন- চলল, ওটা আবার শুরু হোক।
-না, রাতটা পড়ে আছে। তবে এখনই করতে চাইছ?
অনিচ্ছুকভাবে লানজ পোশাক খুলতে শুরু করলেন।
.
পরের দিন সকাল হয়েছে। লানজ শুয়ে আছেন একা। স্মৃতির তোলপাড়। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
মাঝরাতে নেউসা তাকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন।
–আমি কী চাইছি তুমি কি তা জানো?
এইভাবে? ভাবতেই পারা যাচ্ছে না। এই মেয়েটি কি এক বন্য বাঘিনি? লানজকে যা বলছে তাই করতে হবে।
বাথরুমে জলের শব্দ, গুন গুন গান। অনেক হয়েছে। আর ভালো লাগছে না।
নেউসার কাছে চলে গেলেন। বাথরুমে আয়নার সামনে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। চুলে জলের ছোঁয়া লেগেছে। আরও-আরও খারাপ লাগছে।
লানজ বললেন- এবার কথা বলা যাবে?
নেউসা বাথটবে নেমে গেলেন।
–আমি এখানেই থাকব। তারপর? এখানেই সব কিছু করতে হবে।
সকালে কী খাবে? ওমলেট?
–না, কিছু ভালো লাগছে না।
–আমি ওমলেট তৈরি করতে পারি। অ্যাঞ্জেল আমাকে শিখিয়েছে। বাথটবে দুটি শরীর, ভাসছে পাশাপাশি।
নেউসা একটা বিরাট ইলেকট্রিক ড্রায়ার হাতে নিল। প্লাগটাকে পুরে দিল। তারপরে চুল শুকোতে লাগল।
জল গরম হচ্ছে। এখানে? কী হতে পারে? অনেক কথাই মনে পড়ল। হ্যারি লানজ আর সইতে পারছেন না।
তারপর? সেই হেয়ার ড্রায়ারটা জলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হল। এক মুহূর্তের মধ্যে লানজের শরীরটা কেঁপে উঠল। মৃত্যুর কী বীভৎস উন্মাদনা!
.
০৭.
প্রেসিডেন্ট পল এলিসন, ম্যারি অ্যাসলে সম্বন্ধে রিপোর্ট পেয়েছেন। না, ব্যাপারটা ঠিকই আছে।
-না, আমার মনে হয় উনি এ ব্যাপারে সেরা কান্ডিডেট। আমরা কেউই অসুখী হব না।
–তাহলে? খবরটা এখনই পাঠাতে হবে।
.
ম্যারি অ্যাসলের অফিস। ছোট্ট গোছানো ঘর। মধ্য ইউরোপীয় দেশের ওপর অসংখ্য বই নিয়ে একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। ফার্নিচারগুলো চমৎকার। ডেস্ক আছে, রিভলবিং চেয়ার, জানালার ধারে ছোট্ট একটা টেবিল। একটি রিডিং ল্যাম্প। বলকান প্রদেশের বিরাট ম্যাপ, দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে। ম্যারির ঠাকুরদার ছবি ঝুলছে। পুরোনো ফটোগ্রাফ। কত বছর আগে নেওয়া হয়েছিল। অন্য ছবিগুলো কেমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তখনকার দিনের পোশাক পরা। এই ছবিটি ম্যারির অন্যতম সম্পত্তি।
রোমানিয়ার অনেক গল্প ম্যারি শুনেছিলেন তার ঠাকুরদার মুখে। রানি ম্যারির গল্প। ব্যারন কন্যাদের কাহিনি। আলবার্টের রূপকথা। এরই পাশাপাশি, ইংল্যান্ডের রাজা, দ্বিতীয় আলেকজান্ডার, রাশিয়ার জার, আরও অনেক উত্তেজক চরিত্র।
আমার রক্তে কোথাও এই রাজকীয় আভিজাত্য আছে। যদি বিপ্লব না হত, তাহলে আমি হতাম যুবরানি।
এখনও মাঝে মধ্যে ম্যারি এই স্বপ্নটা দেখতে ভালোবাসেন।
.
ম্যারি ব্যস্ত ছিলেন পরীক্ষার খাতা দেখতে। ডিন হান্টার প্রবেশ করলেন।
–এক মুহূর্ত সময় দিতে হবে।
কী হয়েছে? ম্যারির মনে উৎসাহ। কেন? হয়তো আমার পড়ানোর সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
-হ্যাঁ, বসুন।
উনি বসলেন।
আপনি কি এখন ক্লাসে যাবেন?
–হ্যাঁ, যাব। তবে
কিছু বলতে গিয়ে ম্যারি থেমে গেলেন।
ডিন হান্টার বললেন- কোনো সমস্যা হয়েছে কী?
না।
কয়েকজন ওয়াশিংটন থেকে এসেছেন, আপনার সম্বন্ধে প্রশ্ন করছিলেন।
ফ্লোরেন্সের কথা মনে পড়ে গেল। ওয়াশিংটনের ফেডারেল এজেন্ট।
তাহলে? মনে হচ্ছে এটা আমার বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত ব্যাপার নয়। কী হতে পারে?
ম্যারির মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে- ডিন হান্টার, ওঁরা কী বিষয়ে জানতে চাইছিলেন?
–অধ্যাপক হিসেবে আপনার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা। আপনার ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি প্রশ্ন।
–আমি বুঝতে পারছি না, কেন এমনটা ঘটছে।
ভদ্রলোকের চোখে সন্দেহের আগুন।
–ওঁরা কিছু বলেননি?
না, ওঁরা বলে গেছেন ব্যাপারটা গোপন রাখতে। কিন্তু আমি ভাবলাম আপনাকে সব কথা জানানো উচিত।
ম্যারি মাথা নাড়লেন– আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
–তাহলে তো চিন্তা করার কিছু নেই।
.
ডিনারের আসর, ম্যারি শান্ত থাকার চেষ্টা করলেন, এডওয়ার্ডের খাওয়া শেষ হল। ম্যারি খবরটা শুনিয়ে দিলেন। সমস্যাটা গম্ভীর হতে শুরু করেছে কী?
কী হতে পারে? দুজনের মুখেই আতঙ্ক।
টেলিফোনটা বাজল। বেথ লাফিয়ে উঠল– আমার ফোন। ছুটে গেল সে। তারপর বলল, না বুঝতে পারছি না। রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
এডওয়ার্ড জানতে চাইলেন।
সে বলল- একটা বাজে লোক। হোয়াইট হাউস, মাকে ডাকছে।
এডওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করলেন হোয়াইট হাউস?
টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল। ম্যারি বললেন– এবার আমি দেখব।
ম্যারি উঠে গেলেন– হ্যালো। তার মুখে একটা অদ্ভুত ভাব জেগেছে।
কী হয়েছে? প্রেসিডেন্ট? গুড ইভিনিং, মিঃ প্রেসিডেন্ট।
মুখের ভাব দেখে বুঝতে পারা যাচ্ছে ম্যারি অবাক হয়েছেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে আছেন।
-হ্যাঁ, আমি আপনার গলা চিনতে পেরেছি। আগে আপনি ফোন করেছিলেন, আমি বুঝতে পারিনি। ধন্যবাদ।
এডওয়ার্ড উঠে দাঁড়ালেন। ফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
–কোনো একটা ভুল হয়েছে, আমার নাম ম্যারি অ্যাসলে। আমি কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসার। আপনি প্রবন্ধটা পড়েছেন?
অনেকক্ষণের নীরবতা।
–স্যার, আমি বুঝতে পারছি না, আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। এটা একটা দারুণ সুযোগ। তবে, আপনার সঙ্গে কথা বলতে হবে। ঠিক আছে, আমি নাম্বারটা লিখে নিচ্ছি।
–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মিঃ প্রেসিডেন্ট। গুডবাই।
রিসিভারটা ম্যারি নামিয়ে রাখবেন। দাঁড়িয়ে আছেন। বোধহয় আঘাত পেয়েছেন।
-কে ফোন করেছেন?
টিম জানতে চাইল- সত্যিই প্রেসিডেন্ট?
ম্যারি চেয়ারে বসতে বসতে বললেন– হ্যাঁ, ঘটনাটা সত্যি।
এডওয়ার্ড ম্যারির হাতে হাত রেখে বললেন– কী হয়েছে?
তাহলে? ম্যারি কী উত্তর দেবেন?
এডওয়ার্ডের দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট আমার ফরেন আফিয়ার্স ম্যাগাজিনের প্রবন্ধটা পড়েছেন। লেখাটা দারুণ বলে প্রশংসা করেছেন। তিনি আমাকে রোমানিয়ার অ্যাম্বাসাডর হিসেবে নিযুক্ত করতে চান।
এডওয়ার্ডের মুখে অবিশ্বাস কিন্তু কেন?
উত্তরটা ম্যারির জানা নেই।
–তোমার তো কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই।
ম্যারি বললেন- হ্যাঁ, আমি কিছু কিছু জানি।
–সত্যি তুমি অ্যাম্বাসাডর হবে। আমরা রোমে যাব? টিম জানতে চাইল।
–না, রোমানিয়া।
রোমানিয়া কোথায়?
এডওয়ার্ড ছেলেমেয়ের দিকে তাকালেন- তোমাদের খাওয়া শেষ হয়েছে? তোমার মা আর আমি একটু কথা বলব।
টিম বলল- তাহলে? আমরা কি চলে যাব?
এডওয়ার্ড ম্যারিকে নিয়ে লাইব্রেরির দিকে হেঁটে গেলেন। বললেন– ঠিক বুঝতে পারছি না, কী হয়েছে বলে তো?
–এডওয়ার্ড, আমাকেই কেন নির্বাচিত করা হল, বলল তো?
বোঝা গেল, কোনো একটা সমস্যা হয়েছে।
–অ্যাম্বাসাডর? আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা অভাবিত।
বিনা মেঘে বজ্রপাত। এখনও অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। ফ্লোরেন্সকে সব কথা বলতে হবে। ফ্লোরেন্স বোধহয় শুনে মরেই যাবেন।
উত্তেজনা, শিহরণ, অবিশ্বাস্য অনুভূতি। তারপর, ব্যাপারটা শেষ করতে হবে।
কিন্তু এখান থেকে চলে যেতে হবে? ভাবতেই কেমন লাগে।
.
পরের দিন সকালবেলা, প্রেসিডেন্ট যে ফোন নাম্বার দিয়েছিলেন, ম্যারি সেখানে ফোন করলেন। অপারেটরের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
মিসেস এডওয়ার্ড অ্যাসলে, প্রেসিডেন্টের অ্যাসিসট্যান্ট মিঃ গ্রিনকে একবার দেবেন?
–এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন।
-হ্যালো, মিসেস অ্যাসলে?
প্রেসিডেন্টকে একটা মেসেজ দেবেন কী?
–নিশ্চয়ই, অবশ্যই।
তার এই আমন্ত্রণ পেয়ে আমি খুবই খুশি হয়েছি। কিন্তু আমার স্বামী একজন ডাক্তার। তাকে এখানেই থাকতে হবে। তাই এই আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করতে পারছি না। এজন্য দুঃখিত।
–আপনার সংবাদটা আমি বলে দেব, ধন্যবাদ মিসেস অ্যাসলে।
লাইনটা কেটে গেল। ম্যারি শান্তভাবে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। এক মুহর্তের মধ্যে স্বপ্নটা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। কিন্তু এটা তো স্বপ্নই। আমার নিজের জগৎটা অনেক ভালো। না, এবার ইতিহাস ক্লাসের জন্য তৈরি হতে হবে।
.
মানামা, বাহারিন।
–এই বাড়িটাকে আলাদা করে দেখলে চিনতে পারা যাবে না। অসংখ্য বাড়ির মধ্যে মুখ লুকিয়ে এটা দাঁড়িয়ে আছে।
টেলিফোনে একটা কণ্ঠস্বর– আমরা আর একদিন অপেক্ষা করব।
চেয়ারম্যানের গমগমে গলা– একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এটার সমাধান করতে হবে।
বালডার জানতে চাইলেন- কী ধরনের সমস্যা?
–হ্যারি লানজ, মরে গেছে।
–সে কী?
তাকে খুন করা হয়েছে। বুয়েন্স আয়াসের কাছে সমুদ্র সৈকতে তার মৃতদেহটা ভাসতে দেখা গেছে।
–পুলিশ কিছু বলেছে?
না, পুলিশ বুঝতে পারেনি। আমরা এখনও নিরাপদ স্থানে আছি।
থর জানতে চাইলেন তাহলে আমাদের পরিকল্পনা?
–অ্যাঞ্জেলের সঙ্গে কীভাবে দেখা হবে, বুঝতেই পারছি না! হ্যারি লানজকে সব তথ্য দেওয়া হয়েছিল। আমাদের নামও বলা হয়েছিল। জানি না অ্যাঞ্জেল সেই খবরটা পেয়েছেন কিনা। দেখা যাক, কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
.
জাংশন সিটির ডেইলি ইউনিয়ন-এ বড়ো বড়ো অক্ষরে খবরটা বেরিয়েছে ম্যারি অ্যাসলে অ্যাম্বাসাডরের পদে যেতে অস্বীকার করছেন।
দুটো কলম জুড়ে প্রতিবেদন। একটা ছবিও ছাপা হয়েছে। এখন সবাই একথাই আলোচনা করছেন।
ম্যারি দোকানে এলেন ডিনার সারতে হবে। শুনলেন, তার নামটা বাজছে গাড়ির রেডিয়োতে।
–প্রেসিডেন্ট এলিসন বলেছিলেন যে, রোমানিয়ার জনগণের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। কিন্তু ম্যারি অ্যাসলে কেন যে এই প্রস্তাবটা প্রত্যাখান করলেন তা আমরা ভাবতেই পারছি না।
অন্য একটা স্টেশন– উনি ডাঃ এডওয়ার্ড অ্যাসলেকে বিয়ে করেছেন।
ম্যারি রেডিয়োটা বন্ধ করে দিলেন। অন্তত তিন ডজন টেলিফোন পেয়েছেন সকাল থেকে। বন্ধুবান্ধবদের পাশাপাশি প্রতিবেশীরা, ছাত্র-ছাত্রী এবং অচেনা অজানা ভদ্রলোকেরা, রিপোর্টাররা ছেঁকে ধরেছেন, লন্ডন থেকে টোকিও পর্যন্ত। তারা নিজস্ব মতামতের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন লিখতে চাইছেন।
স্টেশন ওয়াগন থেকে একটা ডারবি ক্যাশ স্টেশনে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। সেলফ সার্ভিস পাম্প থেকে কিছু পেট্রল তুলতে হবে।
ম্যারি বেরিয়ে এলেন। মিঃ ব্রাউনের স্টেশন ম্যানেজার বললেন– আপনি অ্যাম্বাসাডর, আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
না-না, এভাবে সাহায্য করতে হবে না।
ট্যাঙ্ক ভরা হয়ে গেছে। ম্যারি ওয়াশিংটন স্ট্রিটে এলেন। শু বক্সের সামনে গাড়িটাকে দাঁড় করালেন।
ক্লার্ক বললেন– অ্যাম্বাসাডর, এই সকালে আপনি কী করছেন?
ম্যারি ভাবলেন, না, ব্যাপারটার এখানেই ইতি ঘটাতে হবে।
উনি বললেন– আমি অ্যাম্বাসাডর নই। তিনি মুচির হাতে জুতো তুলে দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি ঠিক করতে হবে কিন্তু।
.
এবার তিনি এলেন লং ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। ড্রেস ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার মিসেস থ্যাকার বললেন- রেডিয়োতে এইমাত্র আপনার নাম শুনতে পেলাম। আপনি জাংশন সিটিকে একটা আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন। আমার মনে হয় আপনি বোধহয় কানসাসের সবথেকে নামি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
–আমি এখনও অ্যাম্বাসাডর হইনি। ম্যারি বললেন। আমি সেই প্রস্তাবটা প্রত্যাখান করেছি। বেথের জন্য জিনসের প্যান্ট চাই, যাতে ইস্ত্রি করা যাবে, এমন কিছু।
–বেথের বয়স কত হল?
–ও বারো বছরের।
–সময় কি তাড়াতাড়ি কেটে যাচ্ছে। দেখুন ওই মেয়েটিও টিনএজে পা দিল।
.
এখানে সেখানে কিছু খুচরো কেনাকাটা। ডিলনের কাছ থেকে মুদির জিনিসপত্র কেনা হল। মিসেস ডিলন এগিয়ে এসে বললেন– সুপ্রভাত মিসেস অ্যাসলে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি অ্যাম্বাসাডর হচ্ছেন?
ম্যারি হাসলেন, খবরটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।
.
ম্যারি গাড়ি চালাচ্ছেন। মিল ফোর্ড লেকের পাশ দিয়ে চলে গেলেন। তাপমাত্রা শূন্য থেকে কয়েক ডিগ্রি তলায় নেমে গেছে। প্রচণ্ড জোরে হাওয়া বইছে, তুষার পড়তে শুরু করেছে। অনেকদিন ধরেই বিদ্যুতের ঝামেলা চলছে। এডওয়ার্ডের সঙ্গে আজ রাতে ভালোবাসার সুন্দর সুনিপুণ খেলা। আঃ, ভাগ্য কি আবার সুপ্রসন্ন হয়ে উঠল…
ম্যারি বাড়িতে ফিরলেন। এডওয়ার্ড তখনও হাসপাতাল থেকে ফেরেননি। টিম স্টাডিতে বসে একটা সায়েন্স ফিকসন অনুষ্ঠান দেখছে। ম্যারি মুদির জিনিসগুলো রান্নাঘরে রাখলেন। এবার ছেলের সাথে ঝগড়া করতে হবে।
-হোমওয়ার্ক হয়েছে?
করতে পারছি না।
–কেন?
–আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
–তুমি স্টারনিউজ দেখো, আমি তোমার পড়াশোনা দেখব।
টিম তার অঙ্ক বইটা দিল– এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারছি না।
–আমি দেখছি, আমাকে একবার দেখাও তো।
.
বেথের ঘর। শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বেথ মেঝের ওপর বসে আছে। টেলিভিশন দেখছে। রক রেকর্ড শুনছে, আর হোমওয়ার্ক করছে।
ম্যারি চিৎকার করে বললেন- এত হৈ-হট্টগোলের মধ্যে পড়ায় মন দাও কী করে?
ম্যারি টেলিভিশনটা বন্ধ করে দিলেন। রেকর্ড প্লেয়ারটাও বন্ধ করে দিলেন।
বেথ রেগে গিয়ে বলল- কেন বন্ধ করলে জর্জ মাইকেল?
বেথের ঘরে বড়ো বড়ো সংগ্ৰীত বিশেষজ্ঞদের ছবি। ম্যারি তাকালেন, মুখে একটা বিরক্তির ছাপ।
–বেথ, এরকম নোংরা ঘরে তুমি থাকো কী করে?
বেথ তাকাল– মা কী বলছ?
ম্যারি হাসার চেষ্টা করলেন।
কথাবার্তা চলতে থাকে। বেথ গানের জগতের সর্বশেষ খবর রাখে। কে কোথায় কী গান গাইছে, সব কিছু তার নখদর্পণে।
.
ম্যারি অ্যাসলে রান্না করতে খুবই ভালোবাসেন। নিত্যনতুন রান্না করে পরিবারের সবাইকে খাওয়াবেন। এটা তার অনেক দিনের অভ্যেস। তাই সেদিনও তিনি রান্নাঘরে চলে গেলেন। কাজের মেয়ে লুসিনডাকে ছুটি দিয়ে দিলেন।
.
হাসপাতাল থেকে এডওয়ার্ড ফিরে এলেন। ম্যারি তখনও কিচেনে। এখনও মুগ সেদ্ধ বাকি আছে। স্টোভটা বন্ধ করে দিলেন। এডওয়ার্ডকে আদর করলেন- হ্যালো ডার্লিং, দিনটা কেমন কাটলো?
–মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে? কেন এমন করছে বলে তো? দিনটা ভালো কাটেনি, তেরো বছরের এক কিশোরী এসেছিল। কিছু সমস্যা নিয়ে।
টমেটো এবং মটরশুটি, রান্নাটা রেডি।
.
ডিনার টেবিলে, টিম প্রশ্ন করল– ড্যাড, আমি আমার জন্মদিনে একটা সার্কবোট পাব কী?
টিম, তুমি সত্যি তাই চাইছ?
–হ্যাঁ, আমি হাওয়াই বেড়াতে যাব। সেখানে আমার বন্ধু জোহনিদের একটা বিচহাউস আছে।
এডওয়ার্ড বললেন– তা হলে সেখানে সার্কবাট পাবে।
টিম মায়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল– মা, আমি যাব।
পরে দেখা যাবে, এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।
–ভালো লাগছে না। এই খাবারগুলো খুবই খারাপ হয়েছে।
রাতের খাওয়া এগিয়ে চলেছে। একটি সুখী পরিতৃপ্ত সাংসারিক জীবনছবি।
.
খবরটা ছড়িয়ে পড়ল বিস্ফোরণের মতো। ইন্টারন্যাশনাল সিক্রেট সার্ভিসকে আঘাত করেছে। কিং হাসান দ্বিতীয়র বিরুদ্ধবাদী, মেহেদি বেন বার্গা প্যারিসে অন্তরীণ ছিলেন। তাকে হত্যা করা হয়েছে। ফ্রেঞ্চ সিক্রেট সার্ভিসের সহায়তায়।
প্রেসিডেন্ট চালর্স ডগল এই সার্ভিসের সর্বময় কর্তা হয়ে বসেছেন। এই সংগঠনটিকে প্রতিরক্ষা দপ্তরের অধীনে নিয়ে এসেছেন। এখন যিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী, সেই রোনাল্ড পাসির ওপর মারিন গ্রোজার নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাকে ফরাসি সরকার রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল। তিনি নিউলিতে থাকতেন, একটি ভিলাতে। চব্বিশ ঘণ্টা প্রহরীর ব্যবস্থা থাকত। লেফ পাসটেরনাফকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অনেকদিন ধরেই তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
কিছুদিন ধরেই বাতাসে গুজব ভাসছিল, মারিন গ্রোজা রোমানিয়াতে ফিরে যাবেন। আলেকজানড্রোসকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করানো হবে।
লেফ পাসটেরনাফ দরজায় শব্দ করলেন। মারিন গ্রোজার অফিস। গ্রোজা ডেস্কের পাশে বসে আছেন। কাজ করছেন। তিনি দেখলেন লেফ পাসটেরনাফকে প্রবেশ করতে।
সবাই জানতে চাইছেন কখন সত্যি সত্যি বিপ্লবটা ঘটবে? পাসটেরনাফ জানতে চাইলেন। এটা বোধহয় পৃথিবীর সবথেকে বাজে গোপন খবর।
–ওঁদের শান্ত থাকতে বলুন, আপনি কি আমার সঙ্গে বুখারেস্টে যাবেন?
লেফ পাসটেরনাফ কিছু বলতে এসেছিলেন। তিনি ইজরায়েলে গেলেই বোধহয় ভালো হয়। এই কাজটা বেশি দিন করবেন না। মারিন গ্রোজাকে সেকথা অনেকবার বলেছেন।
পৃথিবীর সব লোকই বোকা নাকি? এইভাবে কাউকে লুকিয়ে রাখা যায়? লেফ পাসটেরনাফের চোখে মারিন গ্রোজা এক মোটা বুদ্ধির মানুষ। সম্পূর্ণ আদর্শবাদী, ব্যবহারিক জ্ঞান একেবারে নেই।
যখন পাসটেরনাফ গ্রোজার সঙ্গে কাজ করতে এসেছিলেন, তিনি এই মানুষটির পারিবারিক গল্প শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। গ্রোজা কখনও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন না। গল্পটা শুনিয়েছিলেন ওই ভদ্রলোক যিনি লেফ পাসটেরনাফের সাথে মারিন গ্রোজার আলাপ করে দিয়েছেন।
গ্রোজাকে প্রতারিত করা হয়েছে। সিকিউরিটির লোকেরা তাঁকে পাঁচদিন আটকে রেখেছিল। তখন তাঁর ওপর শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করা হয়। বলা হয়েছিল, তিনি যেন কখনও কোথাও নাম প্রকাশ না করেন। করা হয়নি। গ্রোজার চোদ্দো বছরের মেয়েকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার স্ত্রীকেও আটক করা হয়। বলা হয়েছিল একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কথা বলতে হবে, অথবা চোখের সামনে স্ত্রী-কন্যার মৃত্যু দেখতে হবে। একটা মানুষের জীবনের সবথেকে কঠিন সিদ্ধান্ত একদিকে প্রিয়তমা স্ত্রী এবং পুত্রের জীবন, অন্য দিকে হাজার হাজার মানুষের জীবন, যারা তাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে।
ভদ্রলোক কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন- ভেবে দেখুন, ভালো করে ভেবে দেখুন।
ভবিষ্যৎ অজানা জেনেও গ্রোজা কিন্তু কথা বলতে রাজি হননি, প্রহরীরা তাকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। চোখের সামনে দেখানো হয়, কীভাবে তার স্ত্রী এবং কন্যাকে গণধর্ষণ করা হল। এইভাবেই ধর্ষিতা হয়ে তাদের মৃত্যু হয়। গ্রোজা তখনও কথা বলেন নি। ঘটনাটা ঘটে গেল, তারপর? আরও রক্ত, আরও বীভৎস উল্লাস।
অফিসার লেফ চোখের দিকে তাকালেন। মারিন গ্রোজার মন অত সহজে বোঝা সম্ভব নয়। তিনি তার জনগণের মধ্যে ফিরতে চাইছেন। তিনি সকলকে বোঝাবেন, এই মারাত্বক ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না।
লেফ পাসটেরনাফ তখন থেকেই গ্রোজার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তিনি ওই বিপ্লবীর সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা বলেন।
.
পাসটেরনাফ হলে এলেন, সন্ধেবেলা। মারিন গ্রোজার বেডরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভেতর থেকে একটা যন্ত্রণার আর্তনাদ। আজ শুক্রবার। পাসটেরনাফ ভাবলেন, এইদিন, ওই বারাঙ্গনাদের আমদানি ঘটে। ইংল্যান্ড, উত্তর আমেরিকা, ব্রাজিল, জাপান, থাইল্যান্ড থেকে তাদের বেছে আনা হয়েছে। তারা জানে না, কোথায় তারা চলেছে। তারা চালর্স ডগল এয়ারপোর্টে এসে জমা হয়। সেখান থেকে সোজা এই ভিলাতে। কয়েক ঘন্টা বাদে আবার তাদের এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। রিটার্ন ফ্লাইটের টিকিট ধরিয়ে দেওয়া হয়।
প্রতি শুক্রবার এক যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা। মারিন গ্রোজার আর্তনাদ। অথবা চিৎকার।
লেফ পাসটেরনাফ অবশ্য এখানে ঢুকতে পারেন। কিন্তু তিনি এসব ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নন। এক সপ্তাহের মধ্যে একবার গ্রোজা নিজেকে নগ্ন করেন। একজন রমণী তাকে চেয়ারের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে ফেলে। তার সর্বাঙ্গে চাবুকের আঘাত। রক্ত বেরিয়ে আসে। এইভাবেই তিনি হয়তো স্ত্রী এবং কন্যার মৃত্যু যন্ত্রণাটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। তারপর ঘটনাটা শেষ হয়ে যায়। সমস্ত শরীরে ঘাম জমে। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি আরও বেড়ে যায়।
.
দশদিন বাদে টেলিফোনটা এল, হ্যারি লানজের মৃতদেহটা পাওয়া গেছে।
–আমি বলেছি, আমাকে বিরক্ত না করতে।
বুয়েন্স আয়ার্স থেকে কোনো নেউসা মুনেজ কথা বলতে চাইছে?
–আমি তো বলেছি…
ইন্টারকমের শব্দ, কনট্রোলারের কাছে ফোন।
আবেগকে চেপে রাখা হল– আমি এই কলটা আমার প্রাইভেট অফিসে নিয়ে আসব।
কমিশনার, কনট্রোলার তার অফিসে চলে গেলেন। দরজা বন্ধ করলেন। টেলিফোন নিয়ে বললেন- হ্যাঁ, আমি কি মিস মুনেজের সঙ্গে কথা বলছি?
–হ, দক্ষিণ আমেরিকার উপভাষা ভাসছে বাতাসে, খ্যাড়খেড়ে এবং অশিক্ষিত।
–অ্যাঞ্জেলের কাছ থেকে একটা খবর আছে। আপনাকে দিতে হবে। ওই দুষ্টু লোকটাকে অ্যাঞ্জেল পছন্দ করে না।
–আমি দুঃখিত, এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
কবে দেখা হতে পারে?
যাক বাবা, একটা মস্ত বড় বিপদের হাত থেকে বাঁচা গেল।
মেয়েটি হেসে ওঠে– অ্যাঞ্জেল, তাকে কোনো আগাম টাকা দিতে হবে না। অ্যাঞ্জেলকে কেউ ঠকাতে পারে না। কাজটা শেষ হবার পর টাকাটা পেলেই চলবে।
ঠিক আছে, আমি লিখে নিচ্ছি। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ জুরিখ, সুইজারল্যান্ডের কোনো এক জায়গাতে।
–অ্যাকাউন্ট নাম্বার?
নাম্বার? হায় যিশু, আমি ভুলে গেছি! কোথায় লুকিয়ে রেখেছে?
একগোছা কাগজের খসখসানি শব্দ।
-বি 349077।
কত তাড়াতাড়ি?
কাজটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।
–ঠিক আছে, আমি আমার প্রাইভেট টেলিফোন নাম্বার দিয়ে দিলাম। প্রয়োজনে আমাকে যোগাযোগ করতে পারেন।
ধীরে ধীরে কনট্রোলার নাম্বারটা দিলেন।
.
০৮. বিলসি, রাশিয়া
একটা একক দ্বীপ, উরা নদীর ধারে, সেখানেই বিশেষ অধিবেশন। চেয়ারম্যান উপস্থিত আছেন। দুটো খবর এসেছে। কনট্রোলার অ্যাঞ্জেলের কাছ থেকে সম্মতি পেয়েছেন। কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট রোমানিয়াতে কাকে রাষ্ট্রদূত করবেন? ব্যাপারটা গোলমেলে। ম্যারি অ্যাসলে যেতে চাইছেন না। ছাত্রদের কাছে তিনি এখনই এক কিংবদন্তির নায়িকা। অসাধারণ অনুভূতি।
১৯৫৬- পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির কাছে স্মরণযোগ্য বছর। গুনিউসকা আবার শাসনে ফিরে এসেছেন। পোল্যান্ডে জাতীয় সাম্যবাদের জন্ম হয়েছে।
রোমানিয়া বুখারেস্ট, ছবি দেখে ম্যারি চিনতে পেরেছেন, ইউরোপের অন্যতম সেরা শহর। দাদুর কাছ থেকে শোনা গল্প তাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করত। কিন্তু সংসারের কাজ?
ঘরে নীরবতা, ক্লাস শুরু হতে চলেছে। আমি কতদিন এখানে দাঁড়িয়ে থেকে দিবাস্বপ্ন দেখব? লেকচার এগিয়ে চলল, রোমানিয়ার ইতিহাস। ওয়ার্কার পার্টির জন্ম।
ক্লাসের কি শেষ হবে না? বাড়ির কাজ, ছাত্রদের কী?
চোখ বন্ধ করলেন তিনি। রোমানিয়া, ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, আপনার লিমুজিন তৈরি আছে। আপনাকে এমব্যাসিতে নিয়ে যাবে।
না, ঘণ্টা পড়ে গেছে। ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। এডওয়ার্ড বোধহয় এতক্ষণে হাসপাতাল থেকে চলে এসেছে।
.
কোর্টরুম, লাউড স্পিকারের শব্দ শোনা যাচ্ছে হাসপাতাল করিডরে। কাকে ডাকা হচ্ছে? বিরাট এই হাসপাতালটি সেন্ট মেরি রোডের ওপর। জাংশন সিটির দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে।
ব্যস্ত শুক্রবার। ডাঃ এডওয়ার্ড আজকে ব্যস্ত আছেন, একজন আহত সৈনিককে পরিচর্যা করছেন। অনেক দিন ধরে এই হাসপাতালের সঙ্গে তিনি যুক্ত।
কাজটা শেষ হল। চারপাশে তাকালেন। শুনলেন, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। ডাঃ ডগলাস সিফার, তিনিও রোগীর চিকিৎসা করছিলেন।
এডওয়ার্ড অ্যাসলে বললেন– কী হল? যুদ্ধ লেগেছে নাকি? এ ধরনের শব্দ কেন?
–চলুন, আমরা এমারজেন্সিতে যাই। ডগলাস জবাব দিলেন।
.
আঠারো বছর বয়স, কোনো এক রোগী, প্রচণ্ডভাবে ঘামছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ডাঃ অ্যাসলে তার নাড়ি অনুভব করলেন, খুবই দুর্বল। ইউনিফর্ম জ্যাকেটে একঝলক রক্ত। এডওয়ার্ড অ্যাসলে ভাবলেন, এই পেশেন্টকে এবার ও.টিতে নিয়ে যেতে হবে।
–কী হয়েছে?
–বুকে ছুরির আঘাত।
–দেখা যাক, ফুসফুস ঠিক আছে কিনা? এখনই এক্সরে করতে হবে। তিন মিনিটের মধ্যে।
ডাঃ ডগলাস এগিয়ে গেলেন, এডওয়ার্ডের দিকে তাকালেন।
মনে হচ্ছে, অবস্থা খুবই খারাপ।
নার্স বললেন– ব্লাডপ্রেশার কমে আসছে। মনিটরে দেখা গেল।
আর একজন নার্স বললেন– সত্যি, বাঁচবে কিনা বুঝতে পারছি না।
ডাক্তার বললেন– একটা টিউব ঢুকিয়ে দিন। ফুসফুসকে বাড়াতে হবে।
কিন্তু, এত প্রয়াসের শেষে কী হবে? একটুবাদে ঘরে মৃত্যুর গন্ধ। কেউ কোনো কথা বলতে পারছেন না। ডাঃ অ্যাসলেকে এখনই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই মৃতদেহটিকে ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হবে।
তিনি হাতে একটা ছুরি নিলেন, মৃত রোগীর বুকের ওপর আঘাত করলেন। কোনো রক্ত নেই? কেন? সব রক্ত কি হারিয়ে গেছে?
–ডিটাকটর!
এই যন্ত্রটি তার হাতে দেওয়া হল। তিনি যন্ত্রটি বুকের ভেতর ঢোকালেন।
–ছুরি কই?
এখন আর চেষ্টা করে কী লাভ? মনিটর শব্দ করতে শুরু করেছে।
তিন মিনিটের মধ্যে রোগীকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া হল।
রক্ত পালটাতে হবে। এক হাজার সিসি।
ও নেগেটিভ, ইউনিভারসাল ডোনার দেওয়া হল।
রক্তের রূপান্তর শুরু হল। অ্যাসলে বললেন– বত্রিশ টেস্টটিউব।
নার্স তা দিলেন। ডক্টর স্বীকার করলেন, মনে হচ্ছে, কিছু একটা হবে।
মনিটরের দিকে তাকালেন, আবার কি হার্ট চলতে শুরু করেছে?
.
তিনি পোশাক পালটে নিলেন। মেডিকেল রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে নিলেন, বাড়ির জন্য মন কেমন করছে। এডওয়ার্ডের শরীরটা খুবই ক্লান্ত। সাংঘাতিক টেনশন গেছে। একই সময়ে তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছেন। সারাদিন মৃত্যু নিয়ে খেলা। আর ভালো লাগে না।
নিজেকে ভীষণ অপরাধী বলে মনে হল তার। স্ত্রী এত বড়ো একটা সুযোগ পেল, অথচ আমি কিনা বাধার সৃষ্টি করলাম। পরক্ষণেই ভাবলেন, যদি প্রেসিডেন্ট নিজে থেকে আমাকে। এই সুযোগটা দিতেন, তাহলে কী হত?
তারপর ভাবলেন, ঠিক আছে, গরমকালে প্যারিস এবং লন্ডন বেড়াতে যাবেন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে। একবার রোমানিয়ায় যেতে হবে। সত্যিকারের মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য।
.
জাংশন সিটি, কাউন্টি ক্লাব। বেলেপাথরের বাড়ি, এক সুন্দর পাহাড়ি টিলার ওপর। এখানে আঠারো গর্তের গলফ কোর্ট আছে। দুটি টেনিস কোর্ট, একটি সুইমিংপুল, একটি বার এবং ডাইনিং রুম। এককোণে বিরাট ফায়ার প্লেস। ওপরে তাস খেলার ঘর, নীচের তলায় লকার রুম।
এডওয়ার্ডের বাবা এই ক্লাবের সদস্য ছিলেন। ম্যারির বাবাও ছিলেন। ছোটো থেকেই এডওয়ার্ড এবং ম্যারি এই ক্লাবে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন। এখানে শহরের গণ্যমান্য সকলেই আসেন।
সেদিন যখন তারা পৌঁছোলেন, একটু দেরি হয়েছে। ডাইনিং রুমে দু-চারজন গেস্ট তখনও বসে আছেন। তারা দেখলেন ম্যারিকে। ম্যারি চেয়ারে বসলেন।
এডওয়ার্ড বললেন- কিছু বলবে কী?
দুঃখজনক ঘটনা?
না, স্বপ্ন দেখা শেষ হয়ে গেছে। ম্যারি বাস্তবের সাথে আপস করেছেন।
ম্যারি বললেন না, একথা আমাকে আর জিজ্ঞেস কোরো না। আমি তোমাকে বা ছেলেমেয়েদের ছেড়ে কোথাও থাকতে পারব না। প্রস্তাবটা প্রত্যাখান করতে পেরেছি বলে আমি খুশি। সত্যি বলছি।
ডাক্তার ঝুঁকে দাঁড়ালেন। বললেন- আমি তোমাকে এমন একটা প্রস্তাব দেব, তুমি তা ফেলতেই পারবে না।
এভাবেই তো শুরু হয়েছিল ভালোবাসা, প্রথম দিকের প্রেমে আগুন ছিল, কাছে আসার তাগিদ ছিল, একে অন্যের প্রতি তীব্র শারীরিক আকর্ষণ বোধ করতেন। চরম সন্তুষ্টিতে পৌঁছোনো না পর্যন্ত চলত শরীরের ভয়ংকর খেলা। তবে সব কিছুই এখন হারিয়ে গেছে। এখন শুধু কর্তব্যবোধ, আবেগের মৃত্যু ঘটছে।
তারা বাড়িতে ফিরে এলেন। অতি দ্রুত পোশাক ছাড়লেন। বিছানাতে চলে গেলেন। শুরু হল ভালোবাসাবাসির অবুঝ খেলা। ডাক্তার জানেন, মেয়ে-শরীরের কোন্ কোন্ অংশ সংবেদনশীল। স্তনবৃন্ত নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা করলেন। বৃন্তদুটিকে অকারণে বিরক্ত করলেন। তারপর? সেই সুন্দর কোমল উপত্যকায় হাত রাখলেন। ম্যারি আনন্দে চিৎকার করে বলছেন– ভীষণ ভালো লাগছে।
ম্যারি এবার ওপরে, ডাক্তার নীচে। শুরু হল কাছে আসা এবং দূরে যাওয়ার খেলা। ওটা খুব শক্ত হয়ে উঠেছে। দুজনেই এখন তৈরি হয়েছেন। তারপর ভালোবাসা, কেউ কাউকে কোনোমতেই ছাড়বেন না।
.
রাত্রি তিনটে, ফোনটা সশব্দে আর্তনাদ করছে। এডওয়ার্ড বললেন– হ্যালো।
একটি মেয়ের কণ্ঠস্বর- ডাক্তার অ্যাসলে?
–হ্যাঁ।
–পিটের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। আমার মনে হয় ও বাঁচবে না। আমি বুঝতে পারছি না, কী করব।
এডওয়ার্ড উঠে বসলেন– কিছু করবেন না। শক্ত করে শরীরটা ধরে থাকুন। আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি।
–এডওয়ার্ড? ম্যারির চোখে উদ্বিগ্নতা। কী হয়েছে?
–সব কিছু ঠিক আছে। ঘুমিয়ে পড়ো।
কখন আসবে? আমার আবার করতে ইচ্ছে করছে।
এডওয়ার্ড বললেন– ঠিক আছে, আমি আসছি। পাঁচ মিনিট।
এডওয়ার্ড এগিয়ে চলেছেন, ওল্ড মিলফোর্ড রোড ধরে, জে হিল রোডে এলেন। সকাল এখনও হয়নি। উত্তর-পশ্চিম থেকে তীক্ষ্ণ শীত-বাতাস ছুটে আসছে। তাপমাত্রা শূন্য থেকে কয়েক ডিগ্রি নীচে। এডওয়ার্ড কারহিটার জ্বালিয়ে দিলেন। ভাবলেন, একটা অ্যাম্বুলেন্সকে ডাকলেই মনে হয় ভালো হত। আগে দু বার পিটের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। কখন রক্তক্ষরণ শুরু হয়, আগে দেখতে হবে।
আঠারো নম্বর রুটে গাড়িটা ঢুকে পড়ল। জাংশন সিটির সবথেকে বড়ড়া রাস্তা। শহর এখনও ঘুমন্ত।
এডওয়ার্ড শেষ পর্যন্ত ছ নম্বর স্ট্রিটে এলেন। লু ৫৭-র দিকে তাকালেন। এবার তাকে গ্রান্ড ভিউ প্লাজার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
আগে কতবার তিনি এখানে এসেছেন গাড়ি করে, এখানে সিডার গাছ আছে, আছে রাশিয়ার অলিভ গাছ। আগস্ট মাসে জায়গাটা ভারি সুন্দর হয়ে ওঠে। মনে হয়, কে যেন গাছের অরণ্যে দাউদাউ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। কত শীতসকালে তিনি এখানে এসেছেন। দেখেছেন, তুষারের কারুকাজ।
এডওয়ার্ড খুব দ্রুত চালাচ্ছিলেন। এখনই তাকে ঠিক জায়গাতে পৌঁছোতে হবে। একবার ম্যারির কথা মনে পড়ল। তারই জন্য সে অপেক্ষা করছে। ফিরে গিয়ে ম্যারির ঘুম ভাঙাতে হবে। আমার মনেও আবার যৌনবোধ জেগেছে।
ঠিক আছে, আর কতক্ষণই? এবার এমন একটা সুন্দর মধুচন্দ্রিমা উপহার দেব, কোন মেয়ে সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না।
.
সামনে দুটো হাইওয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চল। এডওয়ার্ড সাবধানে এগিয়ে গেলেন। একটা ট্রাক উলটোদিক থেকে ছুটে আসছিল। তীব্র গর্জন শোনা গেল। গাড়িটা ওপর দিকে উঠে গেল। চোখের নিমেষে তিনি পাঁচটন আর্মি কারকে আসতে দেখলেন। শেষ মুহূর্তে তিনি নিজের আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলেন। তারপর ঘন অন্ধকার।
.
নিউলি, রবিবার।
ঘণ্টা ধ্বনি বেজে উঠেছে। মধ্য দুপুরের বাতাস। মারিন গ্রোজার ভিলা। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এখানে কে কেন এসেছেন?
মারিন গ্রোজাকে এখন এক মৃত মানুষ বলা যেতে পারে। আর্জেন্টিনাতে অ্যাঞ্জেলের মা তার সন্তানের জন্য অপেক্ষা করেন। অ্যাঞ্জেল অনেকদিন ধরেই দরিদ্রতাকে দেখেছেন। দেখেছেন মৃত্যুকে। তিনি জানেন, মৃত্যুই জীবনের শেষ গন্তব্য।
এইভাবে অ্যাঞ্জেল বড়ো হয়েছেন। আর বেছে নিয়েছেন এমন একটা পথ, যে পথে মৃত্যুই হতে পারে একমাত্র অবশেষ।
.
০৯.
তুষার ঢাকা কানসাস। গাড়ি ছুটে চলেছে, লাল আলোর ইশারা। বিশাল আকারের ট্রাক! অ্যাম্বুলেন্স, হাইওয়ে পেট্রল, গাড়ি শেরিফের গাড়ি, হেডলাইটের আলো, আরও কত কী। পুলিশ অফিসাররা এগিয়ে চলেছেন। শেরিফের গাড়ি পাশে দাঁড়াল। ম্যারি অ্যাসলে ছুটে এসেছেন। কাঁপছেন তিনি। দাঁড়াতে পারছেন না।
শেরিফ মুনস্টার বললেন মিসেস অ্যাসলে, দোহাই অমনটি করবেন না।
তখনও আর্তনাদ আমাকে আগে যেতে দিন।
-প্লিজ মিসেস অ্যাসলে, এই অবস্থায় দেখবেন না।
মিসেস অ্যাসলে অচেতন হয়ে গেলেন।
.
শেরিফের গাড়িতে তার ঘুম ভেঙে গেল। শেরিফ সামনের দিকে বসে আছেন।
কী হয়েছিল? ম্যারি জানতে চাইলেন।
–আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।
ম্যারি জানালা দিয়ে তাকালেন, গাড়ির ছুটোছুটি।
কীভাবে?…ম্যারি আর কথা বলতে পারছেন না। কীভাবে এটা ঘটল?
–আপনার স্বামী ভুল পথে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। একটি আর্মি ট্রাক ছুটে আসে। আপনার স্বামীর গাড়িটিকে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু… ।
ম্যারি চোখ বন্ধ করলেন। অ্যাকসিডেন্টের দৃশ্য তার চক্ষুপটে ভেসে উঠল। মনে পড়ে গেল, এডওয়ার্ডের হাসি মুখ।
এডওয়ার্ড কিন্তু খুব সাবধানে গাড়ি চালাত। এমন কাজ সে কেন করল?
শেরিফের কণ্ঠে সহানুভূতি– মিসেস অ্যাসলে, আমি তো এক প্রত্যক্ষদর্শী। একজন যাজক আর দুজন সিস্টার নিজের চোখে দেখেছেন। একজন কর্নেল, তারা সকলে একই কথা বলেছেন। আপনার স্বামী যে কেন এমন আচরণ করলেন?
.
সবকিছু ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। এডওয়ার্ডের মৃতদেহটা অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হল। একজন যাজককে পুলিশ প্রশ্ন করছে। ম্যারি ভাবলেন, হায় ঈশ্বর, শেষ পর্যন্ত আমার ভাগ্যে!
–দেহটা এখন মর্গে নিয়ে যাওয়া হবে।
ম্যারি বললেন- ঠিক আছে।
চোখের ভাষা তার হারিয়ে গেছে। তারপর?
শেরিফ বললেন–আপনাদের ফ্যামিলি ডক্টরের নাম কী?
ম্যারি বললেন– এডওয়ার্ড অ্যাসলে, বোঝা গেল কথা বলার শক্তিও তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।
.
শেরিফ তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। লিভিং রুমে ফ্লোরেন্স এবং ডগলাস বসে আছেন। ছেলেমেয়ের ঘুম ভাঙেনি।
ফ্লোরেন্স বললেন- ডার্লিং, আমি ভাবতেই পারছি না।
ম্যারি বললেন- ঠিক আছে, এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট।
ম্যারি হাসছিলেন।
ডগলাস বললেন– তোমাকে ওপরে নিয়ে যাব?
–আমি ঠিক আছি। আমার জন্য একটু চা আনবেন?
ডগলাস বললেন- আসুন, আমি বিছানা ঠিক করে দিচ্ছি।
–আমার ঘুম পাচ্ছে না। আমি ভালোই আছি!
.
ডগলাস ম্যারিকে সাহায্য করছিলেন, সিঁড়ি দিয়ে হাঁটবার সময়।
ম্যারি বললেন- এটা তো একটা দুর্ঘটনা, এডওয়ার্ড একটা দুর্ঘটনায় পড়েছিল।
ডগলাস তার চোখের দিকে তাকালেন। চোখ শূন্য, বোবা এবং ভাষাহীন।
এডওয়ার্ডের মেডিকেল ব্যাগটা নিয়ে আসা হল। ডগলাস ফিরে এলেন। ম্যারি তখনও ওপরে যাননি।
ডগলাস তাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিলেন। তার পাশে অনেকক্ষণ বসে রইলেন। এক ঘণ্টা কেটে গেছে, তখনও ম্যারি ঘুমোত পারেননি। দ্বিতীয় ওষুধ, তৃতীয়, শেষ পর্যন্ত ম্যারি ঘুমিয়ে পড়লেন।
.
জাংশন সিটিতে এই ধরনের ঘটনা খুব একটা ঘটে না। অনেকদিন আগে এমন এক ঘটনা ঘটেছিল। তাই সকলেই অবাক হয়ে গেছেন।
সিআইডি থেকে একদল ইন্সপেক্টর এসেছেন ব্যাপারটার তদন্ত করতে। শেরিফ মুনস্টারকে নানা প্রশ্ন করা হয়েছে। পাঁচজন প্রত্যক্ষদর্শী আছেন। একজন যাজক এবং দুজন সন্ন্যাসিনী, কর্নেল জেনকিন্স এবং ট্রাক ড্রাইভার সার্জেন্ট ওয়ালিশ। সকলেই বলেছেন, ডাক্তার অ্যাসলের গাড়িটা বিশ্রীভাবে ছুটে আসছিল। এটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা। মনে হচ্ছে, এটা বোধহয় অনিবার্য ছিল। পাঁচজন একই জবানবন্দি দিয়েছেন।
সিআইডির বিশেষ কিছু করার নেই। শেষ অব্দি তদন্তের কাজটা বন্ধ করে দেওয়া হল।
.
ম্যারি ছেলেমেয়ের চিৎকারের শব্দে ঘুম থেকে উঠলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়েছিলেন। ভাবছিলেন, না, এটা বোধহয় একটা দুঃস্বপ্ন, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, চোখ খুলতেই আবার এডওয়ার্ডকে দেখতে পাব।
কান্নাটা ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। ম্যারি শূন্য চোখে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। শেষ অব্দি তিনি অনিচ্ছুকভাবে বিছানা থেকে উঠলেন। টিমের বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। ফ্লোরেন্স এবং বেথ সেখানে বসে আছেন। তাঁরা তিনজনেই কাঁদছেন। ম্যারি ভাবলেন, আঃ আমার চোখের জল কি শুকিয়ে পাথর হয়ে গেল?
বেথ জানতে চাইল- মা, ড্যাডি সত্যি মারা গেছে?
ম্যারি মাথা নাড়লেন, কথা বলতে পারছেন না।
ফ্লোরেন্স বললেন- আমি বলতে বাধ্য হয়েছি।
ম্যারি মাথা নাড়লেন। টিমের মাথায় হাত দিয়ে বললেন– কেঁদো না, সব কিছু আগের মতোই চলবে।
না, কোনো কিছুই আর কিন্তু আগের মতো চলেনি।
.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি সিআইডি কমান্ড হেডকোয়ার্টারে এই দৃশ্যপট উন্মোচিত হচ্ছে। চারপাশে গাছের সারি। একটা পুরোনো লাইমস্টোনের বাড়ি। একতলায় একজন অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন। শেল প্ল্যানচাৰ্ড, তিনি কর্নেল জেনকিন্সের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
আমি একটা খবর শুনছি, ট্রাক ড্রাইভার নাকি এক ডাক্তারকে হত্যা করেছেন?
–খবরটা সত্যি? হা, ওই ভদ্রলোকের দেহ সমাহিত করা হয়েছে।
–খুবই খারাপ খবর। কিন্তু এর জন্য বোধহয় একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রোমোশন দরকার।
–অনেক-অনেক ধন্যবাদ, স্যার। অনেক কষ্টে এই প্রোমোশনটা জোগাড় করা হয়েছে।
.
ম্যারি অ্যাসলে অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করছিলেন। কীভাবে এই অবস্থার হাত থেকে বাঁচা যায়?
শ্রাদ্ধবাসর শেষ হয়ে গেল জেফারসন স্ট্রিটের ফিউরানেল হোমে। শোকস্তব্ধ পরিবেশ। অনেক পুষ্পস্তবক, সবথেকে বড়োটি এসেছে পল এলিসনের কাছ থেকে। লেখা আছে? আমার সহানুভূতি এবং সমবেদনা।
ম্যারি, বেথ আর টিমকে নিয়ে এককোণে বসেছিলেন। ছেলেমেয়ের চোখ কান্নায় ভেজা, রক্ত লাল।
ভাবা যাচ্ছে না, কীভাবে ঘটনাটা ঘটে গেল!
লাতিন ভাষায় মন্ত্র পড়া হচ্ছে। আহা, ম্যারি চোখ বন্ধ করলেন, তিনি আর এডওয়ার্ড মিলফোর্ড লেকে নৌকো ভ্রমণ করছেন।
প্রথম রাত, প্রথম দেখা হবার রাত। এডওয়ার্ড জানতে চেয়েছিলেন- তুমি কি সাঁতার । জানো?
–ঠিক আছে, আমি তোমাকে সাঁতার শেখাব।
এক সপ্তাহ পরে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
এডওয়ার্ড পেছনে লেগেছিলেন- তুমি কি জানো, আমি কেন তোমাকে বিয়ে করছি? তুমি সবকটা পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছ, তাই। তুমি আমার মতো একটা গোমড়া মুখের মানুষকে সহ্য করেছ।
শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষ হল। ম্যারি ছেলেমেয়েদের নিয়ে কালো লিমুজিনে উঠে পড়লেন। এবার শোকযাত্রা সমাধিক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যাবে।
বিশাল একটা পার্কের মধ্যে সমাধিস্থল। এটি হল জাংশন সিটির সবথেকে পুরোনো কবরখানা।
আবার লাতিন ভাষায় মন্ত্র– আমি বেঁচে আছি, আমি বেঁচে থাকব।
ম্যারি শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকালেন। গুডবাই মাই ডার্লিং, এ জীবনে আর কখনও তোমার সঙ্গে কোথাও দেখা হবে না আমার।
এই প্রথম, এই প্রথম কান্নার একটা উদ্বেগ-আকুল অনুভূতি। ম্যারি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না।
.
মৃত্যুতেই বোধহয় জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যায়, কিন্তু ম্যারি অ্যাসলের কাছে এটা নরক যন্ত্রণা। কতবার তিনি এবং এডওয়ার্ড মুখোমুখি বসে মৃত্যুকথা আলোচনা করেছেন। শেষ পর্যন্ত ওর মৃত্যু যে এভাবে আসবে, ম্যারি তা ভাবতেও পারেননি।
আমার বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। দুটি ছেলেমেয়ে আছে আমার। আমি জানি না, আমি কে? এতদিন পর্যন্ত আমি শ্রীমতী এডওয়ার্ড অ্যাসলে নামে পরিচিতা ছিলাম। আমার একটা চিহ্ন ছিল, একটা প্রতীক। আমি এমন একজনকে ভালোবাসতাম, যে আমাকে সত্যি সত্যি প্রেম নিবেদন করেছিল।
এখন চারপাশে নিদারুণ শূন্যতা, নৈঃশব্দ্যের হাহাকার।
ফ্লোরেন্স, ডগলাস এবং অন্য বন্ধুরা মাঝে মধ্যেই দেখা করতে আসেন। শোকস্তব্ধ পরিবেশকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। ম্যারি কিন্তু এখনও একাকিত্বের যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাতে চান।
শেষ অব্দি কী হবে ভাবতে ভাবতে ম্যারি শিহরিত হয়ে ওঠেন।
.
এবার বাস্তব পৃথিবী। এডওয়ার্ডের ইচ্ছাপত্র, বীমা কোম্পানি, ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট, ট্যাক্স এবং বিল। লইয়ার ও ব্যাঙ্কারদের আনাগোনা, শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা।
ম্যারি একা একা শুয়ে শুয়ে দেন। এডওয়ার্ড চলে গেছে, টাকাপয়সার হিসেব করে কী হবে?
শেষ অব্দি বাধ্য হলেন তিনি, এব্যাপারে আলোচনা করতে।
কিন্তু এই আলোচনার শেষে কী থাকল? শুধুই দুঃখ, শুধুই কষ্ট এবং হাহাকার।
দেখা গেল, বাড়িটা মর্টগেজ দেওয়া আছে, পঁয়ত্রিশ হাজার ডলারের অ্যাসেট আছে, এখন যদি বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়া যায় সেটাই বোধহয় ভালো হবে।
ম্যারি বললেন, এডওয়ার্ড কখনও এটা চাইত না। আমি কী করে এই কাজটা করব?
.
ফ্লোরেন্স সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কত কিছু ব্যক্তিগত জিনিস, একডজন পাইপ, একটা তামাকের বাক্স, দুটো চশমা, ভাষণের কপি, আরও কত কী। ম্যারি তাকালেন। ক্লোসেটে স্যুট ঝুলছে। স্যুটে হাত দিলেন। প্রিয়জনের পরশ। নীল টাই, শেষ রাতে ডাক্তার সাহেব পরেছিল। স্কার্ফটাও ঝুলছে। শীত বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে। আর কখনও এটার প্রয়োজন হবে না। ডাক্তারবাবু তো আর ওই ঠান্ডা করবখানা থেকে উঠে আসবে না।
দাড়ি কামানোর ব্রাশ আর টুথপেস্ট, আফটার শেভ লোশন-সব কিছু একই রকম আছে।
ছোটো ছোটো স্মৃতি, দু-একটি কথা, শব্দের বিশুদ্ধ উচ্চারণ, কার্ড, শুভেচ্ছাপত্র, কত স্মারক এবং প্রশংসা পদক। মনে হয়, কোনো এক ম্যাজিসিয়ানের খেলায় এই ঘটনাটা ঘটে গেছে।
ম্যারি ভাবতে বসলেন, সেই দীর্ঘ রাতের কথা। এই যন্ত্রণা এই একাকীত্ব।
শেষ পর্যন্ত ম্যারি ঠিক করলেন না, এভাবে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে গিয়ে কী লাভ? ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে বাঁচতে হবে। এডওয়ার্ড তাহলে হয়তো আমাকে ক্ষমা করবে!
.
কাজ করতে হবে, কিন্তু কীভাবে? এডওয়ার্ড তুমি নেই, এ যন্ত্রণা অসহ্য! তুমি আমাকে সাহায্য করো! তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো!
কী করব? পড়াব? অন্য কিছু? কিছুই ভালো লাগছে না। এই দুঃখ! এই যন্ত্রণা!
মাঝে মধ্যে ম্যারি ধমর্যাজকের কাছে যান। ভদ্রলোক গল্প বলেন, পৃথিবীর গল্প, মহাজীবনের গল্প। তিনি বলেন আমরা মহাবিশ্বের অংশবিশেষ। মৃত্যুতেই সবকিছু শেষ হয় না। মৃত্যু জীবনের এক স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। শান্তভাবে একে গ্রহণ করার চেষ্টা করো।
এডওয়ার্ডের ছবি, সর্বত্র। গানের মধ্যে, রেডিয়ো স্টেশনে, পাহাড়ের মধ্যে। কত সুখের স্মৃতি।
সকালবেলায় ঘুম ভেঙে যায়- হানি, তোমার কথাই মনে পড়ে।
মনে হয়, তোমার কণ্ঠস্বর আমি শুনতে পাচ্ছি।
ম্যারি নিজের সাথে নিজেই কথা বলেন এডওয়ার্ড, ছেলেমেয়েদের নিয়ে চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে।
ম্যারি প্রত্যেকদিন সমাধিক্ষেত্রে যান। তুষারস্নাত বাতাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রার্থনা করেন। শেষ পর্যন্ত এই ঘটনাও তাঁকে শান্তি দিল না।
তিনি জানতে চান- তুমি এখন কোথায়?
তারপর? দিন এগিয়ে চলেছে। ফ্লোরেন্স এবং ডগলাস তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেন। তারা বলেন, ডাক্তার এখন শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন। আরও কত কথা। কিন্তু এসব কথা– বলে কী লাভ?
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। ম্যারি ছেলেমেয়েদের ঘরে চলে যান। দেখেন, তারা নিরাপদে আছে কিনা। আমার ছেলেমেয়ের মৃত্যু হবে কী? আমরা সকলেই তো একদিন মারা যাব। কেন তাহলে এত চিন্তা? এত আনন্দ? এত সুখ? কাছে আসার তীব্র ইচ্ছা?
এই পৃথিবী একটা কসাইখানা। সকলকে হত্যা করা হচ্ছে। এটা একটা ষড়যন্ত্র।
বাইবেলে লেখা আছে, মৃত্যু জীবনের শেষ পরিণতি নয়। এটা একটা রূপান্তর মাত্র। এডওয়ার্ড কি সেই রূপান্তরের মাধ্যমে অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছে?
শেষ অব্দি ম্যারি আবার মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
মধ্যরাত। কত খবর ভেসে এল।
সকাল হল। এডওয়ার্ড তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? ডগলাস পোমোশন পেয়েছেন। তিনি এখন হাসপাতালের চিফ স্টাফ হয়েছেন।
ঈশ্বর কোথায়? সব কিছু ব্যর্থ? টিএসএলিয়ট বলেছিলেন– ঈশ্বর আছেন, মানুষ তার অস্তিত্ব বুঝতে পারে না।
.
প্রেসিডেন্ট পল এলিসন, স্টানটন রজার্স, হাওয়ার্ডবেকার ওভাল অফিসে বসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় মগ্ন।
সেক্রেটারি অফ স্টেট বললেন– মিঃ প্রেসিডেন্ট, আমাদের ওপর কাজের চাপ খুবই বেড়েছে। অ্যাম্বাসাডর কে হবেন রোমানিয়াতে, তা এখনই ঠিক করতে হবে। আর দেরি করা চলবে না।
–ধন্যবাদ ফয়েড, আমি ম্যারি অ্যাসলের কথাই ভাবছি। তার পারিবারিক অবস্থা এখন পালটে গেছে। তিনি এখন এক শোকস্তব্ধা মহিলা। আমি আর একবার চেষ্টা করব।
স্টানটন রজার্স বললেন– মিঃ প্রেসিডেন্ট, আমরা সেখানে চলে যাই না কেন? দেখা যাক, ওঁনাকে এই ব্যাপারে রাজি করানো যায় কিনা?
–দেখতে হবে।
.
ম্যারি ডিনারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। টেলিফোন বেজে উঠল। অপারেটর বললেন, হোয়াইট হাউস। প্রেসিডেন্ট আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।
এখন নয়, আমি এখন কারোর সঙ্গে কথা বলতে চাইছি না। ম্যারি মনে মনে ভেবেছিলেন, কিন্তু সেই ভাবনাটা প্রকাশ করলেন না। তিনি বললেন–আমি মিসেস আসলে বলছি।
–আপনি কি একটু ধরবেন?
এক মুহূর্তের অবসর।
আবার সেই গমগমে কণ্ঠস্বর– মিসেস অ্যাসলে, আমি পল এলিসন। আমি জানি, আপনার জীবনে এখন কতখানি শোক। আপনার স্বামী অত্যন্ত ভদ্রলোক ছিলেন।…
–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মিঃ প্রেসিডেন্ট। আপনি ফুলের স্তবক পাঠিয়েছেন, তার জন্যও ধন্যবাদ।
–আমি আপনার ব্যক্তিগত জীবনে হস্তাক্ষেপ করতে চাইছি না শ্রীমতী অ্যাসলে। আমি জানি, আপনার পারিবারিক অবস্থান এখন পালটে গেছে। আপনি কি আমার আমন্ত্রণটা গ্রহণ করবেন?
–অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু বোধহয় এখন পারব না…
–আমার কথা শুনুন প্লিজ, আমি কাউকে আপনার কাছে পাঠাব। আমার একান্ত বন্ধু স্টানটন রজার্স। সে আপনার সাথে কথা বলবে।
ম্যারি সহসা কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। হ্যাঁ, আমার পৃথিবীটা পালটে গেছে। আমার জীবন এখন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু বেথ আর টিমের দিকে নজর দিতে হবে। তাহলেও ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
–মিঃ প্রেসিডেন্ট, আমি ওঁনার সাথে নিশ্চয়ই কথা বলব। কিন্তু আমি দুঃখিত, এখনই সিদ্ধান্ত বদল করব না।
.
একটা অত্যন্ত জনপ্রিয় শুঁড়িখানা, বুলেভার্দ। লিনিউ তে। মারিন গ্রোজার রক্ষীরা সেখানে প্রায়ই যায়। লেফ পাসটেরনাফকেও এখানে মাঝে মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। অ্যাঞ্জেল একটি টেবিলে বসে আছেন। কথাবার্তা শোনা যাবে কী? প্রহরীরা চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এবার বোধহয় আলোচনাটা শুরু হবে।
অ্যাঞ্জেলের সাথে শেষ পর্যন্ত কথা হয়েছে। গ্রোজার বিষয়ে আলোচনা। আরও কিছু খুচরো খবর। কী দরকার? দরকার দুই-একটি সূত্র, লেফ সেটা নিজেই ব্যবস্থা করেছে। এক মেয়েকে দুবার ব্যবহার করা হয় না। তাই যে-কোনো মেয়েকেই মারিন গ্রোজার কাছে পাঠানো যেতে পারে। এটাই হতে পারে আমাদের তুরুপের তাস।
.
পরের দিন সকালবেলা, অ্যাঞ্জেল গাড়ি পালটালেন। ফিয়াট নিয়ে প্যারিসে ঢুকলেন। মনটি মারটের যৌন দোকান বি গ্যালেতে। এখানে শুধুই বেশ্যাদের ঘোরাঘুরি। দালালদের আনাগোনা।
অ্যাঞ্জেল ভেতরে গেলেন। দেখলেন কী কী বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে শেকল আর হেলমেট, চামড়ার প্যান্ট, আছে লিঙ্গবর্ধক তেল আর আনন্দ দিতে পারে এমন জেল। বড়ো বড়ো রবারের পুতুল চোখে পড়ল। পর্ণো ভিডিও টেপ। পায়ুতে লাগানো যায় এমন ক্রিম, ছ ফুট লম্বা চাবুক, যা দিয়ে অত্যাচার করা যেতে পারে।
অ্যাঞ্জেল একটা লম্বা চাবুক কিনলেন।
পরের দিন সকালবেলা। অ্যাঞ্জেল চলে গেলেন ওই দোকানে।
দোকানদার বললেন– কী জন্য এসেছেন?
আপনি কি এই চাবুকটা মেল করতে পারবেন? আমি বেশি টাকা দেব।
সেদিন বিকেলবেলা অ্যাঞ্জেল বুয়েন্স আয়ার্সের দিকে উড়ে গেলেন।
.
চাবুক এসেছে, ভালোভাবে ঢাকা দেওয়া, নিউলিতে।
পরের দিন, প্যাকেজের গায়ে নাম লেখা আছে- এই চাবুকটা ভালোভাবে পরীক্ষা করা হল।
এটা পাঠিয়ে দেওয়া হল মারিন গ্রোজার বেডরুম ক্লোসেটের মধ্যে।
.
১০.
ফোর্ট রিলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবথেকে পুরোনো আর্মি ফোর্ট। ১৮৫৩ সালে তৈরি হয়েছিল। কানসাস তখনও বিদ্রোহীদের কবলে পড়েনি।
স্টানটন রজার্সের ডিসি-সাত নামল। লিমুজিন দাঁড়িয়েছিল। স্টানটন মিসেস অ্যাসলের বাড়িতে চলে গেলেন। এর আগেই মিসেস অ্যাসলের সঙ্গে কথা হয়েছে।
মিসেস অ্যাসলে, আমি সংক্ষেপে আমার কথা বলব। আগামী সোমবার পৌঁছোতে চাইছি, বিকেলবেলা, আপনি সময় দেবেন তো?
ভদ্রলোক এত নম্র। অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। কেন প্রেসিডেন্ট ওঁনাকে পাঠাচ্ছেন?
প্রতিবর্তক্রিয়ায় ম্যারি বললেন- হ্যাঁ, আপনি কি আমাদের সঙ্গে ডিনার খাবেন?
-না, অনেক ধন্যবাদ।
বিকেলটা খুবই খারাপ কাটবে, স্টানটন ভাবলেন।
ফ্লোরেন্সের কানে খবরটা পৌঁছে গেল। তিনি উত্তেজিত। প্রেসিডেন্টের বৈদেশিক উপদেষ্টা আসছেন? এখানে ডিনার খেতে? ভাবতেই পারছি না। আমাদের কী সৌভাগ্য!
–ফ্লোরেন্স, ব্যাপারটা কিছুই নয়। আমি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তার সাথে কথা বলব।
ফ্লোরেন্স ম্যারির কাঁধে হাত রাখলেন– আহা, আজ সত্যি একটা আনন্দের দিন!
.
স্টানটন রজার্সকে এক পরিতৃপ্ত মানুষ বলা যেতে পারে। ম্যারি তাকে সাংবাদিকদের জন্য অনুষ্ঠানে দেখেছেন। খবরের কাগজের পাতায় তার ফটোগ্রাফ চোখে পড়েছে। এমন কী টাইম ম্যাগাজিনেও। কিন্তু মানুষটি সত্যি ভদ্র, তার মধ্যে একটা সুন্দর ব্যক্তিত্ব আছে।
–প্রেসিডেন্ট আরও একবার তার শোকতপ্ত অনুভূতি জ্ঞাপন করেছেন মিসেস অ্যাসলে।
–আপনাকে ধন্যবাদ।
বেথ এবং টিমের সাথে স্টানটনের আলাপ হল। ম্যারি কিচেনে চলে গেলেন। লুসিংড়া খাবার তৈরি করছে কী?
জাংশন সিটির গৌরবজনক ইতিহাস নিয়ে কথা হল। শেষ পর্যন্ত স্টানটন রজার্স রোমানিয়ার কথা পাড়লেন।
রোমানিয়ার প্রেসিডেন্টের সরকার সম্পর্কে আপনার কী অভিমত? তিনি জানতে চাইলেন।
রোমানিয়াতে সরকার বলে কিছুই নেই। একজনই এই সরকার চালাচ্ছেন। এটা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।
–আপনি কি মনে করেন, ওখানে আবার বিপ্লব হতে পারে?
না, এখনই তা হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। যদি মারিন গ্রোজা রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হন, তাহলে হতে পারে। কিন্তু তিনি এখন ফরাসি দেশে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন।
প্রশ্নোত্তরের পালা চলেছে। আসলে ইরান সম্পর্কে অনেক খবর রাখেন। স্টানটন রজার্স তার জ্ঞানের পরিসীমা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। মনে হচ্ছে, তাকে বোধহয় মাইক্রোস্কোপে রেখে কাটাছেঁড়া করা হচ্ছে।
পলই ঠিক বলেছিলেন। স্টানটন রজার্সের চিন্তা, রোমানিয়া সম্পর্কে এই ভদ্রমহিলা এক জীবন্ত অভিধান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হবে? উনি কি রাজি হবেন?
.
সন্ধে শেষ হয়ে আসছে। স্টানটন বললেন মিসেস অ্যাসলে, আমি আবার আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি কি রোমানিয়ার দায়িত্ব নেবেন? আমার মনে হয়, আপনি একাজটা ভালোভাবে করতে পারবেন।
ম্যারি মাথা নাড়লেন– আমি দুঃখিত মিঃ রজার্স। আমি কিন্তু রাজনীতিবিদ নই, শখের রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চা করি।
–প্রেসিডেন্ট এলিসন বলেছেন, আমাদের অনেক অ্যাম্বাসাডর ছিলেন অ্যামেচার। তারা ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। কত আর নাম বলব?
–আমি সেই দলভুক্ত নই।
একটির পর একটি নাম বলতে থাকেন স্টানটন। কিন্তু বরফ কিছুতেই গলছে না।
ম্যারি শুনতে থাকেন। তার মুখে নানা অভিব্যক্তি, শেষ পর্যন্ত তিনি বলেন–মিঃ রজার্স, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু বেথ আর টিমের কথা ভাবতে হবে। আমি এইভাবে এখান থেকে যাব কী করে?
কূটনীতিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য বুখারেস্টে একটা সুন্দর স্কুল আছে। টিম এবং বেথের পড়াশোনা নিয়ে আপনি কিছুই ভাববেন না। ওরা সেখানে ভালো শিক্ষা পাবে।
ম্যারি এবার একটু উৎসাহী।
–ঠিক আছে, আমি ভাবব।
স্টানটন রজার্স বললেন আমি এই শহরে আজ রাতে থাকব। আমি অল সিডনিজ মোটেলে উঠেছি। আমাকে বিশ্বাস করুন মিসেস অ্যাসলে। আমি বুঝতে পারছি, এটা আপনার পক্ষে বিরাট সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই আমন্ত্রণটা যদি আপনি গ্রহণ করেন, তাহলে সমস্ত আমেরিকাবাসী আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। অনুগ্রহ করে আমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখবেন।
.
স্টানটন রজার্স চলে গেলেন। ম্যারি ওপরে গেলেন। ছেলেমেয়েরা তার জন্য অপেক্ষা করছে। উত্তেজিত এবং জেগে আছে।
–মা, তুমি চাকরিটা নেবে? বেথ জানতে চাইল।
–আমাদের কথা বলতে হবে। যদি আমি এটা নিতে রাজি হই, তাহলে এই স্কুল তোমাদের ছাড়তে হবে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে না। তোমরা একটা বিদেশে গিয়ে থাকবে। নিজেদের ভাষায় কথা বলতে পারবে না। তোমাদের অন্য একটা স্কুলে ভর্তি করা হবে।
–টিম আর আমি এবিষয়ে কথা বলেছি। বেথ বলল, আমরা কী ভেবেছি জানো?
–কী ভেবেছ?
–তোমার মতো অ্যাম্বাসাডর পেলে যে-কোনো দেশই খুশি হত। এটাই আমাদের ধারণা মম্।
.
এডওয়ার্ডের সাথে কথা বললেন ম্যারি, মনে মনে– তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? প্রেসিডেন্ট কী চাইছেন? কেন? বুঝতে পারছি না। তুমি বলো এই কাজটা আমি নেব কিনা?
জানালার ধারে ম্যারি বসে রইলেন। তখনও পোশাক খোলেননি। গাছের পাতায় শীত বাতাসের কাঁপন। দুরন্ত বাস বয়ে চলেছে।
সকাল হল, ম্যারি তার সিদ্ধান্ত নিলেন।
.
সকাল নটা বেজেছে, ম্যারি স্টানটন রজার্সকে ফোন করলেন।
ম্যারি বললেন– মিঃ রজার্স, আপনি প্রেসিডেন্টকে বলবেন, এই কাজটা করতে পেরে আমি নিজেকে গৌরবান্বিত বোধ করব।
.
১১.
দিনটা পালটে গেছে। রাতটাও কী? মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে, এ বোধহয় বাজারের বেশ্যা নয়। অনায়াসে সে একজন অভিনেত্রী হতে পারত। কিংবা নামজাদা মডেল।
কতই বা বয়স হবে, কুড়ি পার হয়ে একুশ। একরাশ সোনালি চুল, দুধসাদা গায়ের রং। ভারি সুন্দর পোশাক পরেছে।
লেফ পাসটেরনাফ গেট পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। মেয়েটিকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। মেয়েটির নাম বিসেরা, যুগোশ্লোভিয়াতে জন্মেছিল। এই প্রথম ফ্রান্সে এসেছে। চারপাশে সিকিউরিটি গার্ডের পরিভ্রমণ। সে বেশ ভয় পেয়েছে। সে জানে, তাকে একটা এরোপ্লেনের টিকিট দেওয়া হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, এক ঘণ্টা কাজ করতে পারলে তাকে দু হাজার ডলার দেওয়া হবে।
লেফ পাসটেরনাফ গ্রোজার বেডরুমের দরজায় শব্দ করলেন। শোনা গেল, ভেতরে আসুন।
পাসটেরনাফ দরজা খুলে দিলেন। মেয়েটিকে ঠেলা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। মারিন গ্রোজা দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরনে আলখাল্লা, মেয়েটি বুঝতে পারল, ভেতরে কিছু পরা নেই।
লেফ পাসটেরনাফ বললেন- এ হল বিসেরা।
তিনি মারিন গ্রোজার নাম বললেন না।
এসো, এসো প্রিয়তমা আমার। ভেতরে এসো।
পাসটেরনাফ চলে গেলেন। দরজাটা বন্ধ করলেন। ভেতরে মারিন গ্রোজা আর ওই
নতুন মেয়েছিমন্ত্রণী হাসিলে দিই।
মেয়েটি আমন্ত্রণী হাসির টুকরো মেলে ধরল– তোমাকে কী করে সাহায্য করব? এসো, আমি তোমরা পোশাক খুলে দিই। তাহলে দুজনকেই আরও ভালো দেখাবে।
মেয়েটি এগিয়ে গেল।
মারিন বললেন- না, এখন তুমি পোশাক খুলো না কেমন?
মেয়েটি অবাক হয়েছে– কী আশ্চর্য, তুমি কি আমার সাথে ওইসব করতে চাও না?
গ্রোজা ক্লোসেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। একটা চাবুক নিলেন।
–আমি চাইছি, তুমি এটা ব্যবহার করবে।
আহা, এটা আবার কী ধরনের আবদার। মেয়েটি অবাক হয়েছে, মেয়েটি বলছে, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
মারিন গ্রোজা নিজের পোশাক খুললেন। নগ্ন শরীরে পৌরুষের উন্মাদনা। বিসেরা তাকিয়ে আছেন এই শরীর, এত দাগ কেন? রক্ত চিহ্ন? মেয়েটি আর্তনাদ করতে চাইল, কিন্তু পারল না। বোঝা গেল, এই পুরুষ অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছে। সে আবার চাবুক খাবে কেন?
মেয়েটি একটা টুলের ওপর বসল।
এবার কণ্ঠস্বরে ঔদ্ধত্য তাড়াতাড়ি, আমাকে চাবুক মারো। যত শক্তি আছে সব একসঙ্গে করে।
বিসেরা ওই লম্বা চাবুকটা হাতে তুলে নিল। শুরু হল তার আক্রমণ। বিসেরা ভাবল, এটা আমার কাজ নয়। আমি কি পালিয়ে যাব? না, দু হাজার ডলার। রাতের স্বপ্ন গম্ভীর হয়ে ওঠে।
নগ্ন শরীর, যেখানে-সেখানে চাবুকের আঘাত। চোখ বন্ধ মারিনের আরও জোরে, আরও জোরে।
যন্ত্রণাটা সমস্ত শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে। একবার-দুবার-তিনবার, বুঝতে পারছি। এবার ওই কষ্টকল্পনা, স্ত্রী এবং কন্যার মুখ, একদল মানুষ তাদের গণধর্ষণ করছে। আমি দাঁড়িয়ে দেখছি, হাসি, অত্যাচার, অপরাধ। ওই তো, ওরা প্যান্ট খুলছে, দাঁড়িয়ে আছে লাইন দিয়ে। মারিন গ্রোজা অজ্ঞান হবার চেষ্টা করলেন। আবার–আবার আঘাত। রক্ত উথলে উঠছে। ওঃ, আমার স্ত্রী, আমার কন্যা, ক্ষমা ভিক্ষা করছে, পারছে না, মুখে লিঙ্গ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্রীভাবে ধর্ষণ করা হচ্ছে। দুজন-তিনজন একসঙ্গে। ওঃ, এত রক্ত কেন!
শেষ পর্যন্ত মারিন আর কথা বলতে পারছেন না। তার রক্তাক্ত বিধ্বস্ত শরীরটা মেঝের ওপর পড়ে গেল।
মেয়েটি এবার ভয় পেয়েছে। চাবুকটা আর মারতে পারছে না। সে বলল- কী, তুমি ঠিক আছে তো?
মারিনের চোখ ভোলা। কোনো দিকে তাকাতে পারছেন না।
বিসেরা চিৎকার করল- হেল্প। হেল্প।
লেফ পাসটেরনাফ ঘরে ঢুকলেন। হাতে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র। তিনি ওই রক্তাক্ত শরীরটাকে দেখলেন। জানতে চাইলেন- কী হয়েছে?
বিসেরার আচরণে অস্বাভবিকতা লোকটা মরে গেছে। আমি কিছু করিনি। আমাকে যেমন বলছিল, আমি তেমনভাবে চাবুক মারছিলাম। যিশুর নামে দিব্যি করছি।
ডাক্তারকে ডেকে আনা হল, এক সেকেন্ডের মধ্যে। তিনি মারিন গ্রোজার দেহের দিকে তাকালেন। পরীক্ষা করলেন। চামড়ার রং নীল হতে শুরু করেছে। পেশি শক্ত হয়েছে। তিনি চাবুকটা হাতে নিলেন। গন্ধ শুকলেন, তারপর বললেন– এটাতে মারাত্মক বিষ মাখানো আছে। একসময় ইনকা উপজাতিরা এই বিষচাবুক মেরে শত্রুদের হত্যা করত। তিন মিনিটের মধ্যে গোটা স্নায়ুতন্ত্র অবশ হয়ে যায়।
দু-দুজন মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের প্রিয় নেতার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আছেন অসহায়ভাবে।
.
মারিন গ্রোজার হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারটা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল, উপগ্রহের মাধ্যমে। দেশের কাছে লেফ পাসটেরনাফ বক্তব্য রাখলেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রেসিডেন্ট স্টানটন রজার্সের সাথে গোপন বৈঠক সারলেন।
–স্টান, ষড়যন্ত্রের অন্তরালে কে আছে বলে মনে হয়?
–রাশিয়ানরা অথবা রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট।
-তাহলে? এবার কী করা উচিত বলো তো? ম্যারি অ্যাসলেকে এখনই পাঠানো উচিত। তাই না?
–পল, ওই ভদ্রমহিলা যে-কোনো মুহূর্তে এখানে এসে পড়বেন।
.
এই খবর শুনে অ্যাঞ্জেল হেসেছিলেন। যত তাড়াতাড়ি আমি ভেবেছিলাম, তারও আগে এটা ঘটে গেল।
.
রাত দশটা, কনট্রোলারের নিজস্ব ফোন বেজে উঠেছে– হ্যালো।
তিনি নেউসা মুনেজের জড়ানো কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন।
অ্যাঞ্জেল সকালের খবরের কাগজে দেখতে পেয়েছেন। টাকাটা যেন ঠিক মতো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যায়।
–ঠিক সময়ে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, মিস মুনেজ। অ্যাঞ্জেলকে বলবেন, তার এই অপারেশনে আমি খুব খুশি হয়েছি। তাকে আবার কাজে লাগাতে হবে। আপনার কি কোনো টেলিফোন নম্বর আছে। যাতে আপনার সঙ্গে কথা বলা যাবে।
অনেকক্ষণের নীরবতা– একটি নাম্বার।
লাইনটা মরে গেল।
.
জুরিখের সেই বিশেষ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাটা তুলে নেওয়া হল। জেনেভার একটা সৌদি আরবি ব্যাঙ্কে সেটা পাঠিয়ে দেওয়া হল। আহা, অ্যাঞ্জেল ভাবলেন, এইভাবে একটির পর একটি অপারেশন…
.
১২.
অনেক কাজ করতে হবে। এডওয়ার্ডকে বিদায় জানাতে হবে। সর্বত্র স্মৃতি এবং স্মৃতির বিচ্ছুরণ। ডগলাস আর ফ্লোরেন্স আন্তরিকভাবে খুশি হয়েছেন।
ফ্লোরেন্স বলেছেন– তোমাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে। বাচ্চা দুটোর কথা খুবই মনে পড়বে।
–তোমরা রোমানিয়াতে আসবে তো?
হাঁ, অবশ্যই যাব।
কত কী নিতে হবে, এটা সেটা, ছোটোখাটো কত কাজ বাকি আছে।
তারপর? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনির্দিষ্টকালের ছুটি। ডিন হান্টারের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
.
ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনা হল। এয়ারলাইন টিকিটের ব্যবস্থা করতে হল। ম্যারির হাতে ইতিমধ্যেই কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে, টিকিটের দাম হিসাবে।
বেথ এবং টিম সম্পর্কে চিন্তা। প্রথম দিকে তারা বিদেশের রাষ্ট্রে থাকবে বলে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন চরম বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে। মনে উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কা জেগেছে। তারা আলাদাভাবে ম্যারির সঙ্গে কথা বলেছে।
বেথ বলেছে- মম, আমি আমার বন্ধুদের ছেড়ে থাকতে পারব না। ভার্জিলের সঙ্গে আর দেখা হবে না। এই সেমিস্টারটা শেষ পর্যন্ত এখানে থাকলে ক্ষতি কী?
টিম বলেছে- লিটল লিগের খেলা এখনও বাকি আছে। মা, আমরা আসছে বছর গরমকালে গেলে কী হয়?
.
শেষ পর্যন্ত সবকিছু তৈরি হয়ে গেল। বাড়িটাকে লিজে দেওয়া হল।
.
এবার যেতে হবে।
ফ্লোরেন্স বললেন– আমি আর ডগলাস তোমাদের এয়ারপোর্টে দিয়ে আসব।
ছ-যাত্রীর ছোটো প্লেন। কানসাস সিটির মিসৌরি থেকে মানহাট্টান কানসাস।
ম্যারি বলেছিলেন- এক মুহূর্তের মধ্যে আমি আসছি।
ম্যারি দোতলায় উঠে গেলেন। এই সেই প্রিয় বেডরুম। এডওয়ার্ডের সাথে কাটানো কত স্মৃতি।
আমার প্রিয়তম, তোমাকে শেষবারের মতো গুডবাই বলছি। আমি জানি, তুমি আছো, আমার চারপাশে। তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?
.
ডগলাস দেখলেন লাগেজগুলো প্লেনে তুলে দেওয়া হয়েছে।
ম্যারি টারম্যাকে প্লেনটা দেখতে পেলেন।
চিৎকার করে উঠলেন।
ফ্লোরেন্স জানতে চাইলেন– কী হয়েছে?
ম্যারি বললেন- আমি কখনও আকাশে উড়িনি। এই ছোট্ট বিমানে করে যাব কী করে?
-ম্যারি, রোজই কত মানুষ এখান থেকে ওখানে যায়।
–ঠিক আছে, কিন্তু ট্রেন ধরলেই ভালো হত।
–তা কী করে হবে? আজ বিকেলের মধ্যে তোমাকে ওয়াশিংটনে পৌঁছোতে হবে।
.
কানসাস সিটি এয়ারপোর্ট, অনেক অনুরোধে ডি সি-১০-এ জায়গা করা হল। টিম আর বেথকে একসঙ্গে বসানো হয়েছে। ম্যারি ধারের দিকে বসেছেন। তার পাশে এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা।
তিনি বললেন- ভয় করছে, এই প্রথম আমি প্লেনে উঠেছি।
ম্যারির মুখে আশ্বাসের হাসি– ভয় পাবার কিছু নেই। রোজ কত মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় উড়ে যায়!