০৫.
সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। সামনে মাইলের পর মাইল শুধু বিস্তৃত বালুকাভূমি। অনেক দূরে একটা পাহাড়ের শিখরচূড়া দেখা যাচ্ছে। এখানে কারা থাকে? এখানে থাকে, হিংস্র নরখাদকের দল। সমুদ্রের ওপর চাঁদের বিবর্ণ আলো। হ্যাঁ, এই হল সেই নিষিদ্ধ অঞ্চল।
চাঁদের আলোয় তারা স্পষ্ট দেখতে পেল, সেখানে লেখা আছে এখানে পা দিলেই সর্বনাশ।
হ্যাঁ, সমুদ্র এখানে ভয়ঙ্কর। কোথায় যাওয়া যায়? এখন বাঁ দিকে যেতে হবে, যে পথ চলে গেছে নামিব মরুভূমিতে।
-এবার এসো আমরা শেষ চেষ্টা করে দেখি। জেমি বলল।
বান্দা মাথা নাড়ল–না, প্রহরীরা দেখতে পেলেই আমাদের গুলি করবে। যদি আমরা কোনোরকমে প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে ঢুকে পড়তে পারি, তাহলে কুকুররা আছে। তারপর আছে ল্যান্ডমাইন। না, আমি যাব না।
জেমি বান্দার দিকে তাকাল। মনের ভেতর অনুশোচনা। আহা, এই লোকটাকে না আনলেই ভালো হত বোধহয়। এখন মনে হচ্ছে, মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই।
জেমি আবার সমুদ্রের দিকে তাকাল। উন্মত্ত জলরাশি ক্রমশই আঘাত করছে। রাত্রি দুটো বেজে গেছে। চার ঘন্টা বাদে সূর্য উঠবে। তখন আমরা ধরা পড়ে যাব। মাত্র চার ঘন্টা সময় আছে।
-বান্দা, কাজ শুরু করতে হবে।
বান্দা অবাক হয়ে জানতে চাইল–কী কাজ?
-আমরা এখানে কেন এসেছি? হিরে নেব বলে তো? কাজটা শুরু করা যাক।
বান্দা ওই পাগল লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকল–না, লোকটাকে ভূতের মতো দেখাচ্ছে।
বান্দা বলল–তুমি কী বলছ?
-তুমি বলেছ, ওরা আমাদের দেখতে পেলে হত্যা করবে। তাই তো? কিন্তু আমরা তো এমনিতেই মারা যাব। এখানে অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটবে। এসো আমরা সেই ঘটনাটা ঘটাবার চেষ্টা করি। আমরা এখান থেকে কিছুতেই খালি হাতে ফিরব না।
-তুমি কী পাগল হয়ে গেছে! বান্দার বিস্ময়।
–না, আমি পাগল হইনি। সত্যি কথাই বলছি।
বান্দা ঘাড় নেড়ে বলল–এখন বলল কী করতে হবে?
জেমি তার ছেঁড়া শার্টটার দিকে তাকাল। বান্দা বুঝতে পারল, কী কথা বলা হবে এখন।
–আমরা হিরেগুলো পাব কী করে?
-সেগুলো সব জায়গায় ছড়ানো আছে। বান্দা বলল। যেমন আছে ওই রক্ষীরা আর কুকুরদের দল।
–ওদের জন্য পরে চিন্তা করলে চলবে। ওরা কখন এখানে আসবে?
–সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে।
-তার মানে? কোনো একটা অঞ্চল আছে যেখানে প্রহরী কিংবা কুকুর নেই? যেখানে আমরা লুকিয়ে থাকতে পারব?
-না, এই দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের সর্বত্র তাদের উপস্থিতি। লুকোবার কোনো জায়গা নেই। এমন কী একটা মাছি পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে পারে না।
-তাহলে চলো, আমরা যাই।
— জেমি দেখল, বান্দা হাতে হাত রেখে যাবার চেষ্টা করছে। হাঁটতে পারছে না। ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
শেষ অব্দি সে একটা পেয়ে বলল–আমি একটা পেয়েছি।
জেমি মাথা নীচু করে দেখল–হ্যাঁ, এই তো এখানে সেখানে বালির মধ্যে হিরে ছড়ানো আছে। হ্যাঁ, এই হিরেটার ওজন অবশ্যই পনেরো ক্যারেট। সে বসে পড়ল। বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। এত সহজে অনেক অর্থ হাতে আসতে পারে। এ সবই ভ্যানডারের, জেমি অত্যন্ত দ্রুত হিরে সংগ্রহ করতে থাকল।
পরবর্তী তিন ঘন্টায় তারা প্রায় চল্লিশটার মতো হিরে সংগ্রহ করল। দুশো তিরিশ ক্যারেট ওজনের। পুবের আকাশ ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছে। এবার জেমিকে এই জায়গা থেকে চলে যেতে হবে। তাকে র্যাফটে পৌঁছোতে হবে। আবার সেই পার্বত্য অঞ্চল পেরিয়ে পালাতে হবে। না, একথা এখন চিন্তা করে লাভ নেই।
জেমি বলল–সকাল হয়ে এল, কটা হিরে জোগাড় হল বলো তো।
–এখানে যথেষ্ট হয়েছে। আর দরকার নেই।
তারপর? একটির পর একটি হিরককণা, গুনতে গুনতে মানুষ হয়তো পাগল হয়ে যাবে। ক্রমশ আরও হিরের সংখ্যা বাড়ছে। ষাটটার মতো হিরে পাওয়া গেল।
-এগুলো আমি নেব?
–না, আমরা ভাগাভাগি করে নেব।
জেমি বুঝতে পারল, বান্দা কী ভাবছে? হ্যাঁ, কেউই হিরের কর্তৃত্ব ছাড়তে চায় না।
-আমি এগুলো নিচ্ছি। জেমি বলল। সে হিরেগুলোকে নিয়ে একটা পুটলির মতো করল। তারপর শার্টের সঙ্গে বেঁধে নিল।
আকাশ ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে। পুব আকাশে আলোর ইশারা।
এবার কী? এটাই হল প্রশ্ন। উত্তর কোথায়? এখানে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য।
–আমরা কি ভেতর দিকে চলে যাব?
-চলো, যাই।
জেমি এবং বান্দা ধীরে ধীরে সমুদ্র থেকে দূরে চলে গেল।
–আমরা কি জানি কোথায় ল্যান্ডমাইন আছে?
-একশো গজ আগে। ওইখানে ওখানে পৌঁছোনোর আগেই বান্দার কথা শেষ হল না। কুকুরের হিংস্র গর্জন শোনা গেল।
ল্যান্ডমাইনের চিন্তা পরে করলেও চলবে। কুকুরগুলো কিন্তু এখুনি এখানে এসে যাবে। তার মানে সকালের কাজ শুরু হল।
-কতক্ষণ সময় হাতে পাওয়া যাবে?
–পনেরো মিনিট, অথবা দশ মিনিট।
হ্যাঁ, সকাল হয়েছে। এবার কী হবে? লুকোবার কোনো জায়গা নেই।
–এক এক শিফটে কত জন গার্ড থাকে?
–অন্তত দশজন।
–দশজন গার্ড কি এত বড়ো সমুদ্রসৈকত পাহারা দিতে পারে?
-একজন গার্ড যথেষ্ট। তাদের হাতে বন্দুক আছে। আর আছে ওই পাগলা কুকুরের দল। গার্ডগুলোর চোখ অন্ধ নয়। আর আমাদের তো সহজেই দেখা যাবে।
শব্দটা আরও কাছে এগিয়ে আসছে।
জেমি বলল –বান্দা, আমি দুঃখিত। আমি কখনও এই ব্যাপারে জড়াতাম না।
-সত্যি বলছ?
তারা শব্দটা শুনতে পেল।
জেমি এবং বান্দা একটা ছোটো গুহার কাছে এসে পৌঁছেছে।
হ্যাঁ, আমরা যদি বালির তলায় লুকিয়ে পড়ি, তাহলে কী হয়? জেমি জানতে চাইল।
বান্দা বলল–এটাও চেষ্টা করা হয়েছে। কুকুররা গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিক হাজির হবে। আমি এভাবে মরতে চাইছি না। ওরা আমাকে দেখুক, তারপর ছুটে আসুক। অথবা ওরা আমাকে গুলি করুক। না, কুকুরে আমাকে খাবে, ভাবতেই পারছি না।
জেমি বান্দার হাত শক্ত করে ধরে বলল–হয়তো আমরা মরে যাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁচার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
ওরা নানা কথা বলার চেষ্টা করছে। দূর থেকে শব্দ শোনা গেল। এই বেজম্মার দল। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমোস, এবার আয়, আমাকে অনুসরণ কর। সারারাত, তত ঘুমিয়েছিস।
হ্যাঁ, জেমি বুঝতে পারল, এ বার কণ্ঠস্বর ক্রমশ কেঁপে যাচ্ছে। সে সমুদ্রের দিকে তাকাল। ডুবে মরাই কী ভালো? হ্যাঁ, বিরাট পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে পালানো কোনোমতেই সম্ভব নয়।
এক মুহূর্তের জন্য কীসব চিন্তা করল।
হঠাৎ দেখা গেল সমুদ্রে ঝড় উঠেছে। প্রবল জলোচ্ছ্বাস।
বান্দা চিৎকার করল সপ্তাহে দু-তিনবার সে আসে, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস। এর হাত থেকে কারও মুক্তি নেই।
এসে গেল, এসে গেল ওই ঝড়ের উম্মাদনা। মনে হল, বিরাট এক দৈত্য বুঝি তার সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
আঃ আবার আবার এল, মনে হচ্ছে জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে যাবে।
লোকগুলো চিৎকার করছে।
জেমি বলল–আমরা বোধহয় একটা সুযোগ পেলাম।
–হ্যাঁ, মনে হচ্ছে।
–ওই জলোচ্ছ্বাস আমাদের বাঁচিয়ে দেবে। ওরা আমাদের দেখতে পাবে না।
–এতে কোনোই লাভ হবে না, আমরা তো ভেসে যাব। আর এক মুহূর্ত বেঁচে থাকতে পারব না।
***
আকাশ ক্রমশ অন্ধকার হয়ে উঠেছে। হ্যাঁ, ঝড়টা আরও বাড়তে শুরু করেছে। সমুদ্রকে আচ্ছাদিত করেছে। মনে হয়, সে বোধহয় গোটা উপকূলভাগকে গিলে খাবে। এগিয়ে আসছে। জেমি ভাবল, এটা কী আমাকে বাঁচাবে।
দূর থেকে একটা শব্দ শোনা গেল। তোমরা দুজন কোথা থেকে এলে?
জেমি এবং বান্দা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বালির পাহাড়ের ওপর একশো গজ দূরে একটা ইউনিফর্ম পরা গার্ডকে দেখা গেল। হাতে তার রাইফেল। জেমি সৈকতের দিকে তাকাল।
অত্যন্ত দ্রুত ঝড়টা ছুটে আসছে।
-তোমরা চলে এসো, লোকটা চিৎকার করল। রাইফেল তুলল।
জেমি তার হাত তুলে দিয়েছে। সে বলল–আমি যেতে পারছি না।
–যেখানে আছে সেখানে থাকো। গার্ড চিৎকার করে বলল, আমি এখুনি আসছি।
সে তার রাইফেল নামিয়ে দ্রুত হেঁটে আসার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। ঝড়ের তাণ্ডব তাকে সরিয়ে দিয়েছে।
-ছোটো, জেমি বলতে থাকল, এবার ছুটতে হবে।
–দাঁড়িয়ে যাও, রাইফেলের শব্দ, বিস্ফোরণ।
ওরা ছুটতে শুরু করেছে। না, আর বোধহয় বাঁচা সম্ভব নয়। আর একটা রাইফেলের শব্দ। বুলেট বর্ষণ হচ্ছে। একদম পাশে, আর একটা। এবং আর একটা। একদিকে সমুদ্র ঝড়ের তাণ্ডব, অন্যদিকে তপ্ত সীসার চুম্বন। তারা এখন কোথায় যাবে?
শব্দটা দূর থেকে আরও দূরে চলে যাচ্ছে। ঝড়টা এসে গেছে।
শোনা গেল, দুজন রক্ষীর মধ্যে কথাবার্তা। একজন বলল- গার, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? দুজন লোককে দেখা গেছে। একটা সাদা, একটা কালো। তারা বালুকাবেলায় আছে। তাড়াতাড়ি রক্ষীদের খবর দাও। দেখামাত্র গুলি করতে হবে।
জেমি ফিসফিসিয়ে বলল–হ্যাঁ, এবার পালাতে হবে।
বান্দা জানতে চাইল–কী করব?
-এখান থেকে পালাব।
জেমি কম্পাসটা সামনের দিকে রাখল। দেখাই যাচ্ছে না, বলল, এই দিকে।
–আমি হাঁটতে পারছি না।
–তোমাকে অন্তত কিছু দূর যেতেই হবে।
ওরা ছুটতে শুরু করল, এলোমেলো পায়ে। যেভাবে অন্ধ মানুষ হেঁটে যায়। কিন্তু কিছুতেই যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বালির বুকে পা গেঁথে যাচ্ছে। প্রত্যেক পদক্ষেপ ফেলার আগে জেমি তার কম্পাসের ওপর চোখ রাখছে। এপর্যন্ত একশো গজ হাঁটা শেষ হয়েছে। বেশ কিছুটা বাকি আছে।
-এখান থেকেই ল্যান্ডমাইনের যাত্রা শুরু, তাই তো?
-হ্যাঁ, এবার প্রার্থনা করো। এই ল্যান্ডমাইন অতিক্রম করে কেউ যেতে পারবে না। সব জায়গায় ছড়ানো ছেটানো আছে। ছ-ইঞ্চি অন্তর অন্তর। আমরা জানি না, কোথায় পা ফেলব।
ক্রুগার–আবার শব্দটা শোনা গেল।
-কী হয়েছে বেন্ট?
হ্যাঁ, শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কুয়াশার আবরণ ভেদ করে ছুটে আসছে বুলেট।
–ল্যান্ডমাইন কখনও তুমি দেখেছ? জেমি জানতে চাইল।
–হ্যাঁ, কয়েকটা ল্যান্ডমাইনকে আমি নিষ্ক্রিয় করেছি।
-কতখানি ওজন ধরে?
-একজন মানুষের ওজনের সমান। আশি পাউন্ডের বেশি। সব কিছুকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে নষ্ট করে দেয়। তবে তারা কুকুরদের হত্যা করে না।
-আমি একটা বুদ্ধি করেছি। তুমি কি আমার সঙ্গে জুয়া খেলবে? জেমি জানতে চাইল।
–তুমি কী বলতে চাইছ?
–এসো, আমরা হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটি।
–তাহলে কী হবে?
-তাহলে বেশি ওজন হবে না। তুমি তো বলেছ, ৮০ পাউন্ডের বেশি ওজন না হলে সেগুলো ফাটে না।
-এটা তো জীবন আর মৃত্যুর খেলা।
–এখন আর ভাববার উপায় নেই।
জেমি বালির ওপর শুয়ে পড়ল। বান্দা তার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। তারপর তাকে অনুসরণ করল। তারা হামাগুড়ি দিতে দিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলল।
-এবার কোথায় যাওয়া যেতে পারে, জেমি জানতে চাইল। হাত-পা ছুঁড়ো না কিন্তু, তোমার গোটা দেহটা ব্যবহার করার চেষ্টা করো।
এভাবেই তারা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
***
সামনে একটু অন্ধকার। দূরে দেখা গেল একজন গার্ডকে। আবার কুকুর এবং ল্যান্ডমাইন। জেমিকে যে করেই হোক এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অনেক কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে।
কোনরকমে হামাগুড়ি দিয়ে তারা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। শেষ পর্যন্ত সময় অনন্তে মিশে গেল। দূর থেকে তখনও শোনা যাচ্ছে সেই উন্মত্ত রক্ষীদের আর্তনাদ- ক্রুগার বেন্ট! ক্রুগার বেন্ট?
তারা কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিল। জেমি কম্পাসটা হাতে ধরে রেখেছে। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে। আবার শুরু হল এইভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। হ্যাঁ, চেতনা বোধহয় নষ্ট হয়ে যাবে। বিরাট একটা মরুভূমি, জেমি ভাবল, আমরা বোধহয় এবার জীবনের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছি।
এখানে কিছুই নেই, শুধু ধু-ধু বালি।
জেমির মনে হল, শরীরের সব শক্তি একত্রিত করতে হবে। যন্ত্রণা হচ্ছে, জেমি দেখতে পেল, বান্দা আর নড়তে চড়তে পারছে না। সে একটা মৃত কুকুরের কঙ্কালের পাশে শুয়ে আছে।
কুকুরটা অদ্ভুতভাবে মরে পড়ে আছে।
বান্দা জানতে চাইল–আমি আর কতদূর যাব?
জেমি জবাব দিতে পারল না। জেমি অনেকক্ষণ শুয়ে থাকল।
–আমাদের এভাবে এগোতে হবে। ওখানে আরও অনেক রক্ষী আছে। বান্দা বলল।
জেমি ঘাড় কাত করল।
এবার তারা অভিযানের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। শেষ পর্যন্ত অনেক দূরে পৌঁছে গিয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়েছিল।
জেমি চোখ খুলল। অনেক কিছু পালটে গেছে। সে সমুদ্রের পাশে বালির ওপর শুয়ে আছে। শরীরটা শক্ত। সর্বত্র ব্যথা। কী ঘটেছে বুঝতে পারছে না। দেখতে পেল, ছ ফুট দূরে বান্দা ঘুমিয়ে আছে। চারদিকে উন্মাদ উদ্দাম জলরাশি। আর নৌকোটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সমুদ্রের ঝড় সবকিছু ভাসিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সেটা কোথায় গেল। তার বুকের ভেতর কেমন একটা শব্দ। বান্দা? হ্যাঁ, সমুদ্র ঝড় চলে গেছে। কাছাকাছি শব্দ শোনা যাচ্ছে। কুয়াশা এখন আর আগের মতো নেই। তাহলে? জেমি উঠে বসার চেষ্টা করল। বান্দার কাছে চলে গেল। বান্দা উঠে বসল। হ্যাঁ, ঘুম ভেঙে গেছে।
-আমরা এসেছি কি? বান্দা জানতে চাইল।
–হ্যাঁ, হয়ে গেছে, আমাকে ওই হিরেগুলো দিয়ে দাও।
বান্দা তাকে হিরের পুঁটলিটা দিয়ে দিল।
-আমাকে অনুসরণ করো।
–গেটে কিন্তু ওই প্রহরীরা আছে, বান্দা নীচু স্বরে বলল। তারা দেখতে পেলেই সর্বনাশ।
–ঠিক আছে, আমি দেখছি।
দুজন এগিয়ে গেল, দুজন প্রহরীর দিকে। তারপর? ওদের কথাবার্তা শান্তভাবে শুনল।
জেমি এবং বান্দা গেট পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। দেখা গেল, বিরাট চেহারার দুজন বন্দুক বাজকে। তারা পায়চারি করছে।
জেমি বলল–এখানে তোমার চাকরি পাওয়া যেতে পারে?
বান্দা তার দিকে তাকিয়ে আছে।
একজন প্রহরী বলল–তোমরা এখানে কী করছ?
-আমরা চাকরির সন্ধানে এসেছি। আমরা শুনেছি, এখানে নাকি গার্ডের চাকরি পাওয়া যায়? আমার চাকরটা ভালোভাবে খননের কাজ করতে পারে।
লোকটার চোখের তারায় কেমন একটা উল্লাস।
সে বলল–বাইরে বেরিয়ে এসো।
–আমরা বাইরে যাব না। জেমি বলল, আমাদের চাকরি চাই।
–এটা সংরক্ষিত এলাকা। এখান থেকে বেরিয়ে এসো তোমরা দুজন।
বাইরে একটা গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। যারা কাজ শেষ করতে পারেনি, তারা এখন এই গাড়িতে উঠবে।
লোকটা আবার বলল- এই ওয়াগন তোমাদের পার্টনোলোথে নিয়ে যাবে। যদি চাকরির সন্ধান থাকে, তবে সেখানেই চলে যাও। সেখানেই আমাদের কোম্পানির অফিস।
-অনেক ধন্যবাদ, স্যার। জেমি বলল। সে বান্দার দিকে তাকাল। দুজন গেটের বাইরে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হল। এবার স্বাধীনতা–শুধুই স্বাধীনতা।
গার্ড বিড়বিড় করে বলল–বোকা হদ্দের দল।
***
দশ মিনিট কেটে গেছে। জেমি এবং বান্দা পোর্টনোলোথের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। হ্যাঁ, তাদের সঙ্গে এমন কিছু হিরে আছে, যার দাম পাঁচ লক্ষ পাউন্ডের কম হবে না।
.
০৬.
ক্লিপড্রিফটের নোংরা পথে দামী গাড়িটা গড়িয়ে চলেছে। শহরটা অনেকখানি পালটে গেছে। এক বছরর মধ্যে। জেমি ম্যাকগ্রেগর এক বছর আগে এই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ১৮৮৪, এই শহরটা এখন ক্যাম্প থেকে একটা ছোট্ট টাউনে পরিণত হয়েছে। কেপটাউন থেকে হোপটাউন পর্যন্ত রেলপথ চালু হয়েছে। তারই একটা স্টেশন হয়েছে ক্লিপড্রিফটে। এর ফলে শহরটার পরিবেশ একেবারে পালটে গেছে। আরও বেশি মানুষের আগমন ঘটেছে। এখনও হিরে সংগ্রহকারীরা এই শহরে আসছে। এর পাশাপাশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা মানুষদের দেখা যাচ্ছে। হা, ক্লিপড্রিফট আজ এক গৌরব করার মতো শহর।
জেমি নতুন ট্রানসলগুলোর পাশ দিয়ে চলে গেল। অনেকগুলো নতুন সেলুন দেখতে পেল। হ্যাঁ, নতুন তৈরি একটা চার্চ আর সেলুন। গ্র্যান্ড নামে একটা মস্ত বড়ো হোটেল।
জেমি সেখানে থামল, ব্যাঙ্কের ভেতর ঢুকে গেল। ম্যানেজারকে গিয়ে হেঁড়ে গলায় বলল –এক লক্ষ পাউন্ড জমা দিতে চাইছি।
***
কথারা দ্রুত বাতাসের বুকে ভর দিয়ে ভেসে গেছে অনেক দূরে। ব্যাঙ্ক থেকে জেমি সানটাউনার সেলুনে ঢুকল। সে-ই সকলের আকর্ষণ কেড়ে নিয়েছে। সেলুনের ভেতরটা একইরকম আছে। একইরকম লোকের সমারোহ। সকলেই উৎসুক চোখে জেমির দিকে তাকিয়ে আছে। স্মিথ উদাসীন ভাবে বলল–স্যার, কী দেব?
বারটেন্ডারকে দেখে মনে হচ্ছে, সে বোধহয় কখনও জেমিকে দেখেনি।
— হুইস্কি; সব থেকে ভালো মালটা চাই।
–হ্যাঁ, স্যার। লোকটা মাল ঢালতে ঢালতে বলল–আপনি কি এই শহরে নতুন নাকি?
–হ্যাঁ।
–কেন এসেছেন?
–শুনেছি এই শহরে নাকি নতুন নতুন ব্যবসা স্থাপিত হয়েছে। আমি টাকা ঢালতে চাইছি।
বারটেন্ডারের চোখের আলো জ্বলে উঠেছে–হ্যাঁ, এটাই হল মূলধন ঢালার সব থেকে ভালো জায়গা। হ্যাঁ, এক লক্ষ পাউন্ড যার হাতে আছে, পৃথিবীটা তার পায়ের তলায়। আমি কি আপনার কাজে লাগতে পারি?
-হ্যাঁ, কিন্তু কীভাবে?
স্মিথ নীচু হল, তার ঠোঁটের ভেতর ফিসফিসানি কণ্ঠস্বর- আমি একজন মানুষকে জানি, যিনি এই শহরটাকে চালান। তিনি হলেন বড়ো কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। সিটিজেনস কমিটির প্রধান। এই অঞ্চলে তার নাম সকলে জানে। তিনি হলেন ভ্যানডার।
জেমি মদ খেয়ে বলল–আমি….
স্মিথের কণ্ঠস্বরে আগ্রহ ঝরে পড়ছে। স্মিথ আরও বলতে থাকে–আপনি একবার তার সঙ্গে কথা বলবেন?
জেমি আর এক টোক মদ গিলে বলল–লোকটাকে এখানে আনা যাবে না?
বারটেন্ডার জেমির হাতের আঙুলে পরানো মস্ত বড়ো হিরের আংটিটার দিকে তাকাল। আংটিটা ঝলসে উঠছে। সে বলল–হ্যাঁ, স্যার। আপনার নাম কী বলব?
ট্রাভিস, ইয়ান ট্রাভিস।
–মি. ট্রাভিস, আমার মনে হয়, ভ্যানডার নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।
সে আরও খানিকটা মদ ঢেলে দিয়ে বলল–আমি ওনাকে ডেকে আনছি। আপনি ততক্ষণ এটাকে সাবাড় করুন।
জেমি বারে বসে রইল। ধীরে ধীরে হুইস্কি খেতে থাকল। সে বুঝতে পারছে, সেলুনে উপবিষ্ট সকলে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ক্লিপড্রিফট থেকে অনেকে টাকার সন্ধানে বাইরে বেরিয়ে যায়। কিন্তু এত টাকা আয় করে এর আগে কেউ এখানে আসেনি। এটা সম্পূর্ণ একটা নতুন অভিজ্ঞতা।
পনেরো মিনিট কেটে গেছে। বারটেন্ডার ফিরে এসেছে। তার সাথে সলোমন ভ্যানডার।
ভ্যানডার এই সাদা চুলের দাড়িওয়ালা লোকটার সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাতে হাত দিয়ে হেসে বললেন –মি ট্রাভিস, আমি সলোমন ভ্যানডার।
-ইয়ান ট্রাভিস।
জেমি ভেবেছিল, ভ্যানডার বোধহয় তাকে চিনতে পারবেন। কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না। জেমি ভাবল, আর তো কিছুই নেই। কত কিছু পালটে গেছে। আঠারো বছরের সেই বোকা সোকা অনভিজ্ঞ বালক আজ কত বদলে গেছে। স্মিথ দুজনকে একটা কোণের টেবিলে নিয়ে গেল।
তারা বসল।
ভ্যানডার বললেন আমি বুঝতে পারছি, আপনি ক্লিপড্রিফটে কিছু অর্থ ঢালতে চাইছেন, তাই তো মি. ট্রাভিস?
-হ্যাঁ, আপনি ঠিক অনুমান করেছেন।
-আমি হয়তো আপনাকে সাহায্য করব। একটা ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকবেন স্যার। এখানে বেশির ভাগই বাজে লোকের ভিড়। জোচ্চোর বদমাইস লুটেরা।
জেমি বলল–হ্যাঁ, আমি সব জানি।
ব্যাপারটা সত্যি অবাস্তব। দুজনের মধ্যে একটা অদ্ভুত আলোচনা চলছে। একজন অন্যজনকে ঠকিয়েছেন, তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছেন, ভ্যানডারের প্রতি অন্যজনের ঘৃণা আকাশ ছুঁয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সে প্রতিশোধের জাল বুনেছে। শেষ পর্যন্ত তার স্বপ্ন হয়তো সফল হতে চলেছে।
-মি. ট্রাভিস, আপনি কত টাকা ঢালতে চাইছেন? ব্যাপারটা বলবেন কী?
-আমি এক লক্ষ পাউন্ড দিয়ে শুরু করতে চাইছি। জেমি উদাসীনভাবে বলল। সে দেখল, ভ্যানডারের মুখ কেমন পালটে গেছে। তারপর হয়তো তিন-চার লক্ষ পাউন্ড ঢালব।
-হ্যাঁ, তাহলে তো খুব ভালো ব্যবসা হবে। অবশ্য ভালো একজন পথ নির্দেশক থাকা দরকার। ভ্যানডার বললেন। আপনি কী ভেবেছেন? কোন ব্যবসায় টাকা ঢালবেন?
-না, দেখা যাক কী সুযোগ পাওয়া যায়।
-হ্যাঁ, তা তো ভাবতেই হবে। ভ্যানডার বললেন। আপনি কি আজ রাতে আমার সাথে ডিনার খাবেন? তাহলে আমরা ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। আমার মেয়ে দারুণ রান্না করে। আপনাকে খাওয়াতে পারলে আমি নিজেকে গর্বিত বলে মনে করব।
জেমি হাসল–হ্যাঁ, আমারও ভালো লাগবে মি. ভ্যানডার।
এইভাবেই শুরু হল।
***
নামিব থেকে কেপটাউনের যাত্রাপথ ছিল ঘটনাহীন। জেমি এবং বান্দা একটা গ্রামে এসে থামল। জেমির হাতে চোট লেগেছে। স্থানীয় ডাক্তার সেই চোটের উপশম করলেন। তারা একটা ওয়াগানে চড়ে বসল। দীর্ঘ যাত্রা। কিন্তু তাদের অসুবিধা হয়নি। কেপটাউনে এসে জেমি রয়াল হোটেলে উঠে পড়ল। লেখা আছে–ডিউক অফ এডিনবরার দ্বারা সাহায্যকৃত। সে একটা রয়াল সাইটে গিয়ে থাকল।
-শহরের সেরা নাপিতকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। জেমি ম্যানজারকে বলল। তারপর একজন দরজির সন্ধান দেবে আর একটা মুচিও পাঠাতে হবে।
ম্যানেজার গদগদ হয়ে বলল–সবকিছুই করব স্যার।
-জেমি ভাবল, টাকা দিয়ে আমরা পৃথিবীটাকে পায়ের তলায় কিনে রাখতে পারি।
***
রয়াল স্যুইটের বাথরুমটা বুঝি. এক টুকরো স্বর্গ। জেমি অনেকক্ষণ গরম জলে শুয়ে ছিল। আহা, তার সমস্ত ক্লান্তি এক নিমেষে কোথায় উধাও হয়ে গেল। সে গত কয়েক সপ্তাহের অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো চিন্তা করল। বান্দা আর সে যখন থেকে ওই নৌকোটা তৈরি। করছিল। মনে হল অনেক বছর বুঝি কেটে গেছে। আহা, জেমি ভাবল, কীভাবে নৌকোটা উপকুলের দিকে চলে গিয়েছিল। সামুদ্রিক ঝড়ের কথাও মনে পড়ল তার। হ্যাঁ, ওই ঝড় হয়তো তাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। কতগুলো শব্দ সবসময় তার কানে ধ্বনিত হচ্ছে ক্রুগার বেন্ট! ক্রুগার বেন্ট ইত্যাদি।
কিন্তু, বান্দার কথা মনে রাখতেই হবে। বান্দা না থাকলে এ যাত্রায় সে বাঁচতে পারত না।
তারা কেপটাউনে পৌঁছোনোর পর জেমি বলেছিল, তুমি আমার সঙ্গে থাকো।
বান্দা হেসেছিল, ঝকঝক করছিল তার সুন্দর সাদা দাঁত।–না, জেমি, তোমার সঙ্গে থাকলে জীবনটা ঘটনাবিহীন অবস্থায় কেটে যাবে। আমাকে তো উত্তেজনা আনতে হবে।
-তুমি এখন কোথায় যাবে?
-আমি এখন একটা ফার্ম কিনব। একটা বউ জোগাড় করব। অনেকগুলো ছেলেপুলে চাই আমার।
-ঠিক আছে। তাহলে ওই হিরেগুলো বেচে দেবে?
–না, হিরে আমার চাই না।
জেমি অবাক হয়ে গেছে।–কী বলছ? যে কটা হিরে পাওয়া গেছে, তার আদ্ধেক তোমার। তুমি তো অনেক লক্ষ পাউন্ডের মালিক হলে।
-না, আমার গায়ের রঙের দিকে তাকাও, জেমি, যদি আমি অনেক লাখ টাকার মালিক, হয়ে যাই, আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাবে।
-তুমি এই হিরেগুলো কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারো।
-না, আমাকে একটা ছোটো খামার কিনতে হবে। দুটো ষাঁড় কিনব। আর একটা বউ চাই। দুটো বা তিনটে হিরে হলেই আমার চলবে। বাকি সবকিছু তোমার।
-না, এটা অসম্ভব। আমি তোমাকে তোমার অংশ দেবই।
–জেমি, তুমি তা দিতে পারো না। কারণ তুমি সলোমানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে।
জেমি অনেকক্ষণ বান্দার দিকে তাকিয়ে বলল –আমি প্রতিজ্ঞা করছি।
–তাহলে? তোমায় বিদায় জানাচ্ছি আমার বন্ধু।
দুজন হাতে হাত রাখল।
-আমাদের আবার দেখা হবে, আমরা একটা সত্যিকারের দুরন্ত অভিযানে অংশ নেব, কেমন?
বান্দা বলল। সে তিনটে হিরে নিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেল।
***
জেমি কুড়ি হাজার পাউন্ডের ব্যাঙ্ক ড্রাফট পাঠাল তার বাড়িতে, মা-বাবার কাছে উপহার। ভারী সুন্দর গাড়ি কিনল। এবার তাকে ক্লিপড্রিফটের দিকে এগোতে হবে।
প্রতিশোধের ঘণ্টা বেজে গেছে।
***
জেমি ম্যাকগ্রেগর ভ্যানডারের দোকানে ঢুকে পড়েছে। চারদিকে কেমন একটা অদ্ভুত পরিবেশ। ভ্যানডার তাকে দোকানের পেছন দিকে নিয়ে গেল। ভদ্রলোকের মুখে এক হাসির উদ্ভাস।
উনি বললেন মি. ট্রাভিস, স্বাগতম।
–আপনি কী যেন মিঃ… হ্যাঁ, আপনার নামটা আমি ভুলে গেছি।
-ভ্যানডার, আপনি আমাকে সলোমন বলে ডাকতে পারেন। এই ওলন্দাজ নামগুলো মনে রাখা খুব একটা সহজ নয়। মার্গারেট, খাবার কি তৈরি হয়েছে?
জেমি ভেতরের ঘরে চলে গেল। কোনো কিছুই বদলায়নি। মার্গারেট স্টোভের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে ফ্রাইপ্যান। তার মুখটা দেখা যাচ্ছে না।
-মার্গারেট, ইনি হলেন আমাদের নতুন অতিথি মি. ট্রাভিস।
মার্গারেট বলল–কী খাবার দেব?
না, মার্গারেট আমাকে চিনতে পারেনি।
জেমি মাথা নেড়ে বলল–আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াতে আমি খুশি হয়েছি।
খদ্দের এসে গেছে, ভ্যানডার বলল –আমি এক্ষুনি আসছি। এখানে কোনো অসুবিধা হবে না, মি. ট্রাভিস।
উনি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
মার্গারেটের হাতে সবজির বাটি। টেবিলের ওপর মাংস সাজানো আছে। সে তাড়াতাড়ি রুটি তৈরি করতে লেগে গেল। জেমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। শান্তভাবে মার্গারেটের দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যাঁ, আহা, সে মেয়েটি এখন আরও প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে। কিশোরী থেকে পরিপূর্ণা যুবতী। তার শরীরের সর্বত্র লেগেছে যৌবনের স্পন্দন। যৌনতার উষ্ণ ছোঁয়া।
–আপনার বাবা বলেছেন, আপনি নাকি দারুণ রান্না করতে পারেন?
মার্গারেটের মুখে প্রথম প্রভাতের আলো- না-না, বাবা বানিয়ে বলেছে।
-অনেকদিন আমি ভালো খাবার খাইনি। আমি ভালো খাবার খেতে আগ্রহী।
জেমি মার্গারেটের হাত থেকে একটা ডিশ নিয়ে নিল। টেবিলের ওপর রাখল। তার জন্য। মার্গারেট অবাক হয়ে গেছে। সে বোধহয় ডিশটা হাত থেকে ফেলেই দিচ্ছিল। এর আগে কোনো পুরুষ মেয়েদের কাজে সাহায্য করেনি। তার চোখের তারায় এক অদ্ভুত ভালোবাসার ছাপ। নাকটা একটুখানি ভেঙে গেছে, আর কপালে কাটা দাগ। তাতে কী হয়েছে? লোকটা তো খারাপ নয়। তার চোখের তারা হাল্কা ধূসর। বুদ্ধিদীপ্ত চাউনি। গভীরতা আছে। তার সাদা চুল বলছে, সে হয়তো কমবয়সী নয়। কিন্তু, তার মধ্যে এখনও যৌবনের উন্মাদনা আছে। লোকটা লম্বা এবং সুদেহ, মার্গারেট তাকাল, হ্যাঁ, এভাবে নিরীক্ষণ করা উচিত হয়নি।
ভ্যানডার অত্যন্ত দ্রুত ঘরে ঢুকে পড়েছেন। হাতে হাত রেখে বললেন –আমি দোকানটা বন্ধ করে দিলাম। আসুন, একসঙ্গে রাতের খাবার খাওয়া যাক।
জেমি একপাশে বসে বলল–হ্যাঁ, আমাদের কাজের কথা শুরু হোক।
মার্গারেট সবকিছু শোনার চেষ্টা করছে। হা, বাবার সেই কণ্ঠস্বর। বাবা বকবক করতে শুরু করেছ। বাবা বলছে–এভাবেই একদিন পাপীরা শাস্তি পায়। শেষ পর্যন্ত হয়তো পাপের শেষ হয়ে যায়। বংশ পরস্পরা এমনটি চলে আসছে। .
সলোমন আবার বলতে শুরু করলেন। আপনি কি এখানে প্রথম আসছেন মি. ট্রাভিস?
জেমি বলল–হ্যাঁ, প্রথমবার?
–আপনার শ্রীমতীকে সঙ্গে আনেননি?
-না, আমি এখনও বিয়ে করিনি। আসলে বিয়ে করার মতো কোনো মেয়েকে এখনও পাইনি।
-ক্লিপড্রিফট একটা সুন্দর শহর। এখানে অনেক সুযোগ পাবেন মি. ট্রাভিস।
–আমি তাই তো চাইছি।
জেমি হঠাৎ মার্গারেটের দিকে তাকাল। মার্গারেট আবার লজ্জা পেয়েছে।
-আমি একটা ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করব, মি. ট্রাভিস, আপনি এত টাকা কী করে পেলেন?
মার্গারেট বুঝতে পারছে, এ প্রশ্ন করা উচিত হয়নি। এই অজানা আগন্তুক একটু রেগে গেল কী?
-এটা আমি আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছি, জেমি শান্তভাবে বলল।
–বাঃ, মনে হচ্ছে, অভিজ্ঞতা আছে আপনার?
–খুবই অল্প। আমি কারোর সাহায্য এবং সহযোগিতা চাইছি।
ভ্যানডারের মুখ আশায় উদ্ভাস–ভাগ্য আমাদের এক জায়গায় নিয়ে এসেছে মি. ট্রাভিস। আমার খুব ভালো ভালো যোগাযোগ আছে। আমি আপনাকে সবরকমভাবে সাহায্য করব। আমি নিশ্চিন্তে বলতে পারি, আপনি যত টাকা লগ্নী করবেন, তিন-চার মাসের মধ্যে তা দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
উনি একটু নীচু হয়ে জেমির হাতে হাত দিলেন। তারপর বললেন আজ থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু হোক।
জেমি হাসল।
–আপনি কোথায় উঠেছেন? গ্র্যান্ড হোটেলে কি?
–হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।
–ওরা গলাকাটা দাম নেয়। তবে আপনার মতো লোক কোথায়-বা থাকবেন?
জেমি বললেন আমি এখানে কিছুদিন থাকব। আর এই শহরটার চারপাশ ঘুরে দেখব। হ্যাঁ, আপনার মেয়ের কি সময় হবে? আমি একজন ভালো গাইড চাইছি।
মার্গারেটের মনে হল তার হৃৎস্পন্দন বুঝি থেমে গেছে।
ভ্যানডার বললেন–আমি জানি না, ও পারবে কিনা।
সলোমন এখানে একটা লৌহ কঠিন নিয়ম চালু করেছেন। তিনি তার মেয়েকে এখনও পর্যন্ত কোনো পুরুষের সঙ্গে একা ছাড়েননি। ট্রাভিসের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা আলাদা হতে পারে।
তিনি বললেন –দেখছি, মার্গারেটকে ছুটি দেওয়া যায় কিনা। মার্গারেট, তুই কি যেতে পারবি?
-তুমি রাজী হলে আমি সময় দিতে পারব।
মার্গারেট শান্তভাবে বলল।
–তাহলে ঠিক থাকল, আমি সকাল দশটায় এখানে আসছি। ঠিক আছে?
***
শেষ পর্যন্ত ওই লম্বা সুন্দর পোশাক পরা অতিথিটা চলে গেল। মার্গারেট টেবিল পরিষ্কার করল। সব কিছু ধুয়ে মুছে সাফ করল। এক আচ্ছন্নের মতো অবস্থা হয়েছে তার। লোকটা নিশ্চয়ই ভাবছে আমি একটা বোকা। হ্যাঁ, আমি কোনো কথা বলিনি। কে যেন, আমার জিভের ডগায় আঠা লাগিয়ে দিয়েছে। আঃ, আমি কেন এমন করলাম? এখানে কত মানুষই তো আসে। তারা সবাই আমাকে বোকা ভাবে। কিন্তু ওই লোকটা আমার দিকে যে ভাবে তাকিয়েছিল! কী অন্তর্ভেদী চাউনি। অন্য কেউ তো তেমনভাবে তাকায়নি।
মা থাকলে হয়তো সব কিছু বুঝতে পারত। মা যে কেন মরে গেল। মার্গারেট তার বাবাকে ভালোবাসে। কিন্তু বাবার কাছে জীবন কাটাতে আর পারে না। মনে হয়, সে বুঝি কোনো বন্দিশালার বন্দিনী। কোনো পুরুষের সাথে কথা বলার অনুমতি পাওয়া যায় না। আমি কোনোদিন বিয়ে করব না, মার্গারেট বলেছিল। বাবার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত। এভাবেই আমি বাবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব।
-শুভরাত্রি বাবা।
ভ্যানডার তার সোনার চশমাটা খুলে রাখলেন। চোখ দুটো ভালো করে রগড়ে নিলেন। মেয়েকে শুভরাত জানালেন।
বেডরুমে ঢুকে মার্গারেট অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর আয়নায় তাকাল। হ্যাঁ, তার মুখখানা খুব একটা খারাপ নয়। সে খুব একটা সুন্দরী নয়। তবে তার মধ্যে একটা সহজাত লাবণ্য আছে। চোখ দুটিতে আছে দ্যুতি। চেহারাটা মোটামুটি ভালো। সে পায়ে পায়ে আয়নার আরও কাছে এগিয়ে এল। হ্যাঁ, ইয়ান ট্রাভিস আমার মধ্যে কী দেখেছিল। সে নিজেকে পোশাক বিযুক্ত করতে চেষ্টা করল। ভাবল, ইয়ান ট্রাভিস বোধহয় এই ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আমার নগ্ন দেহ দেখে তার চোখের তারায় একটা অদ্ভুত কামনাতুর চাউনি ফুটে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত মার্গারেট তার মসলিনের অন্তর্বাস খুলে ফেলল। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়াল। তাঁ, ওই তো, আমার শরীরের সর্বত্র স্পন্দন জেগেছে। হাতগুলো চারদিকে ঘুরছে। নিজেই নিজেকে আদর করতে চেষ্টা করল মার্গারেট। এই তো, আমার স্তনবৃন্ত কেমন দৃঢ় হয়ে উঠছে। এবার হাত নেমে যাচ্ছে যোনি প্রদেশে। এখানে কী আছে? এখানে আছে সাত রাজার ধন এক মানিক। হ্যাঁ, হাত পৌঁছে গেছে দুটি পায়ের মধ্যবর্তী ওই সংকীর্ণ ত্রিভুজ ত্রিকোণে। সেখানে আঘাত করছে, ঘর্ষণ করছে। প্রথমে আস্তে, তারপর জোরে জোরে। শেষ পর্যন্ত মার্গারেট আত্মরতির জগতে পৌঁছে গেল। তার শরীরের মধ্যে ছোট্ট একটা বিস্ফোরণ। সে ইয়ানের নাম স্মরণ করল। বিছানাতে শুয়ে পড়ল।
জেমির গাড়িটা ভারি সুন্দর। আহা, শহরটা কত পালটে গেছে। এখানে সেখানে কয়েকটা মাত্র তাঁবু চোখে পড়ছে। এখন সবজায়গাতেই নতুন নতুন বাড়ি।
-ক্লিপড্রিফট খুব উন্নত শহর। জেমি বলেছিল।
-আমার মনে হচ্ছে, নবাগতদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়। মার্গারেট জবাব দিল। মনে মনে সে এই শহরটাকে এখনও ঘেন্না করে।
তারা শহরের বাইরে চলে এল। ভাল নদীর তীরে। গত কয়েকদিনের বর্ষা শহরতলীকে সবুজ রঙে সাজিয়েছে। আহা, কত সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটেছে। এখন কী বসন্ত এল! তারা একদল হিরে সংগ্রহকারীকে দেখতে পেল।
জেমি জিজ্ঞাসা করল–এখানে কী কোনো হিরের খনি আছে নাকি?
-হ্যাঁ, কয়েকটা। যখনই নতুন কোনো খবর আসে, হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে। বেশির ভাগই এই লড়াইতে জিততে পারে না। তারা হতাশ হয়ে যায়।
মার্গারেটের মনে হল, সে বোধহয় এখানে একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছে।
সে বলল–বাবা, এসব কথা শুনলে রেগে যাবে। কিন্তু আমার মনে হয় মি. ট্রাভিস, এটা খুব বাজে ব্যবসা।
-হয়তো কারও কারও জন্য। জেমি বলল, সকলের জন্য নয়।
–এখানে আপনি কতদিন থাকবেন?
–কিছুদিন তো থাকবই।
মার্গারেটের হৃদয় যেন আনন্দে গান গাইছে।
-ঠিক আছে। তারপর সে বলল–বাবা খুবই খুশি হবে।
***
তারা সমস্ত সকালটা ঘুরে বেড়িয়েছে। মাঝে মধ্যে তারা থেমেছিল। জেমি ওইসব লোকেদের সঙ্গে কথা বলেছে। অনেকেই মার্গারেটকে চিনতে পেরেছে। তার সাথে শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালোবাসার কথা বলেছে। হা, মার্গারেটের মধ্যে একটা উষ্ণতা আছে। মার্গারেট, সহজেই কারও বন্ধু হতে পারে। কিন্তু বাবার আশ্রয়ে থাকার ফলে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো ঢাকা পড়ে গেছে।
গাড়ি এগিয়ে চলেছে। জেমি বলল–তোমাকে সকলেই চেনে দেখছি।
মার্গারেটের মুখে লাজুক আভা-হা, কারণ ওরা সবাই আমার বাবার সঙ্গে ব্যবসা করে। বাবাই তো বেশির ভাগ অভিযাত্রীদের হাতে জিনিসপত্র তুলে দেয়।
জেমি কোনো কথা বলল না। চারপাশে যেসব দৃশ্য চোখে পড়ছে, সবকিছু ভালোভাবে দেখতে চাইছে। রেলরোড শহরটাকে একেবারে পালটে দিয়েছে। সত্যি এই শহরটাকে আর চেনা যাচ্ছে না।
— এখানে অনেক ব্যবসায়ীর আবির্ভাব ঘটেছে। যেমন ডি পিয়ারস, আর, বারনাটো। দক্ষিণ আফ্রিকার এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে আমরা খনিজ সম্পদের রত্নভাণ্ডার বলতে পারি। একজন মানুষের মধ্যে যদি দূরদৃষ্টি থাকে, সাহস এবং শক্তি, তাহলে সে রাজা হয়ে উঠতে পারে।
জেমি এবং মার্গারেট এখন ফিরে আসছে। সবে মাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। জেমি তার গাড়িটা ভ্যানডারের দোকানের সামনে থামাল। সে বলল- আজ রাতে তুমি আর তোমার বাবা কি আমার হোটেলে আসবে? ডিনারের নিমন্ত্রণ।
মার্গারেট বলল–আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করছি। মনে হয় বাবা রাজি হবে। এই সুন্দর। দিনটা উপহার দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি, মি. ট্রাভিস।
তারপর মেয়েটি কোথায় যেন চলে গেল।
***
বিশাল সাজানো ডাইনিংরুম। নতুন এ্যান্ড হোটেল। তিনজন ডিনারের টেবিলে বসে আছে। আরও অনেককে দেখা যাচ্ছে।
ভ্যানডার বললেন আমি জানি না, এখানে খাওয়া-দাওয়া করতে কত খরচ হয়।
জেমি একটা মেনু কার্ডের দিকে তাকিয়েছে–হ্যাঁ, খুবই বেশী দাম।
ভ্যানডার চিৎকার করে উঠলেন–সত্যিই এরা ডাকাত।
জেমি দেখল, ভ্যানডার সব থেকে দামী খাবারের অর্ডার দিয়েছেন। মার্গারেট কিন্তু শুধুমাত্র স্যুপ খেতে চাইল। মার্গারেট খেতে খেতে উত্তেজিত হয়ে উঠছে। সে ভাবতেই পারছে না কীভাবে এই দিনটা তার কাছে এসেছে।
-যা কিছু খাবে, মন দিয়ে খাও। জেমি মার্গারেটকে বলেছিল। আর কিছু নেবে না তুমি?
মার্গারেটের মুখে লজ্জা –অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমার খুব একটা খিদে পায়নি।
ভ্যানডার মেয়ের মুখের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। তারপর বললেন আমার মেয়ে খুব ভালো। এমন মেয়ে আপনি কোথাও পাবেন না মি. ট্রাভিস।
জেমি মাথা নাড়ল- হ্যাঁ, আপনার কথায় আমি সায় দিচ্ছি।
মার্গারেট খুবই খুশি হয়েছে। সে স্যুপটা খেতে পর্যন্ত পারছে না। ইয়ান ট্রাভিস যে তাকে ভালোবেসেছে, এই খবরটা পেয়ে মার্গারেট আনন্দে আত্মহারা। সে তার সমস্ত উন্মাদনাকে লুকিয়ে রেখেছে। মাঝে মধ্যে ইয়ান মার্গারেটের দিকে তাকিয়ে হাসছে। তার মানে? ভালো লাগা আরও প্রগাঢ় হচ্ছে বোধহয়। যদি ইয়ানের চোখের তারায় বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে, তাহলে মার্গারেট দুঃখ পাচ্ছে।
ভ্যানডার জানতে চাইলেন- আজ কিছু ভালো জিনিস চোখে পড়ল?
জেমি উদাস হয়ে বলল- না, তেমন কিছু চোখে পড়েনি।
ভ্যানডার ঝুঁকে পড়ে বললেন আমার কথাটা খেয়াল রাখবেন, স্যার। এই জায়গাটার অত্যন্ত দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। এখানে টাকা ঢালাটা খুবই বুদ্ধিমানের কাজ। নতুন রেলপথ তৈরি হয়েছে, দেখবেন, কিছু দিনের মধ্যে এই শহরটা দ্বিতীয় কেপটাউন হয়ে উঠেছে।
জেমি বলল– আমি ঠিক জানি না, আমি শুনেছি এরকম শহর নাকি উন্নত হচ্ছে। আমি কোনো ভুতুড়ে শহরে টাকা লগ্নী করব না।
ভ্যানডার বললেন- না, ক্লিপড্রিফটকে আপনি সেই দলভুক্ত করতে পারেন না। এখানে সব সময় হিরে পাওয়া যাচ্ছে। চারপাশে সোনার খনি আছে।
জেমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল কতদিন এই অবস্থা চলবে?
–সেটা আমরা ঠিক বলতে পারছি না। তবে সহজে শেষ হবে না।
–আপনি কি ঠিক বলছেন?
-হ্যাঁ, চট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। ভ্যানডার বলতে চেষ্টা করলেন, আপনি এই সুযোগটা হারালে আমার খারাপ লাগবে।
জেমি কী যেন চিন্তা করে বলল- হ্যাঁ, আমার একটু তাড়া ছিল মার্গারেট, তুমি কি কাল আবার আমার সঙ্গে খাবে?
ভ্যানডার কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু চুপ করে গেলেন। ব্যাঙ্কারের কথা মনে পড়ে গেল। ব্যাঙ্কার বলেছেন, উনি এখানে এলেন, এক লক্ষ পাউন্ড জমা দিলেন। শান্ত, সলোমন, আরও অনেক টাকা আসছে।
ভ্যানডার বললেন- হ্যাঁ, ও যাবে, কোনো অসুবিধা হবে না।
***
পরের দিন সকালবেলা, মার্গারেট তার রবিবারের পোশাকটা পরেছে। এখনই জেমির সঙ্গে দেখা হবে।
বাবা তাকে দেখে বললেন–কী মনে হচ্ছে বলে তো? এই লোকটা কি তোমার পোশাক দেখে বিগলিত হবে? মনে রেখো, এটা একটা ব্যবসা। তুমি এই পোশাকটা খুলে ফেলল। রোজ যেটা পরে বাসন মাজো, সেটা পরে যেতে হবে।
-কিন্তু বাবা?
–আমি যা বলছি তাই শোনো।
মেয়েটি আর কথা বলতে পারল না। ঠিক আছে, আমি পোশাক পাল্টে ফেলছি। ভ্যানডার মার্গারেটের দিকে তাকালেন। জেমি ইতিমধ্যে গাড়ি চালিয়ে এসে গেছে।
***
জেমি গাড়িটা নিয়ে উল্টোদিকে চলেছে। হ্যাঁ, শহরটা সত্যি বেড়ে যাচ্ছে। সর্বত্র কর্ম উদ্দীপনা চোখে পড়ছে। যদি এভাবে হিরের খনি থেকে হিরে আবিষ্কৃত হতে থাকে, তাহলে সত্যি শহরটা আরও পাল্টে যাবে। এখানে একের পর এক ব্যবসা গড়ে উঠবে। ক্লিপড্রিফটে আরও অনেক ব্যাঙ্ক আসবে। হোটেল, সেলুন, দোকান, বেশ্যালয় সবকিছু। তালিকাটা শেষ হবে না। তাহলে? সুযোগ হাতে আসতেও পারে।
জেমি বুঝতে পারছে, মার্গারেট তার দিকে তাকিয়ে আছে। কী খারাপ লাগছে কিছু?
মাগারেট সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিল। লজ্জায় আবার লাল হয়েছে সে।
জেমি এবার মার্গারেটকে ভালোভাবে দেখছে। হ্যাঁ, এই মেয়েটির মধ্যে একটা আশ্চর্য উজ্জ্বলতা আছে, মাগারেট জানে, সে তাকিয়ে আছে জেমির মুখের দিকে। জেমির পৌরুষ তাকে আকর্ষণ করেছে। এই মেয়েটির অতীত ইতিহাস বলছে, এ কোনো দিন পুরুষ সংসর্গে আসেনি। জেমি ভাবল।
দুপুরবেলা জেমি প্রধান রাস্তায় এল। সেখানে একটা ছোটো ঝরনা আছে। একটা বাওয়াফ গাছ আছে। সে হোটেল থেকে পিকনিক লাঞ্চ প্যাকেট কিনে নিয়েছে।
মার্গারেট একটা টেবিল ক্লথ বিছিয়ে দিল। বাস্কেটটা খুলল। খাবার সাজিয়ে রাখল। আহা, কত সুন্দর সুন্দর খাবার। ফ্রায়েড চিকেন, হলুদ ভাত, জ্যাম আরও কত কী।
এই আমাদের ব্যাঙ্কোয়েট, মার্গারেট বলল। আমি এসবের যোগ্য নই মিঃ ট্রাভিস।
–তুমি আরও অনেক কিছু পাবার যোগ্য। জেমি বলল।
মার্গারেট চলে যাবার চেষ্টা করছিল। জেমি তার মুখখানা দু-হাতের মধ্যে ধরে বলল মার্গারেট, আমার দিকে তাকাও।
-না-না, আমাকে ছেড়ে দিন। ভয়ে লজ্জায়-অপমানে মার্গারেট থরথর করে কাঁপছে।
–তুমি আমার দিকে তাকাও।
এবার মার্গারেট মুখ তুলল। জেমির চোখে চোখ মেলে দিল। জেমি মার্গারেটকে শক্ত করে চেপে ধরেছে, এবার, দুটি ঠোঁট নেমে আসছে। হ্যাঁ, অনেকক্ষণ তারা এইভাবে আলিঙ্গনে আবদ্ধ ছিল।
শেষ অব্দি মার্গারেট নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল। মাথা নেড়ে সে বলল না, এটা উচিত নয়, আমরা নরকে চলে যাব।
–না।
–আমার ভয় করছে।
-ভয়ের কিছু নেই। তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়েছ। আমি তোমার মনের ভেতরের সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তুমি কি তা বুঝতে পারছ না। তুমি আমাকে ভালোবাসতে চাইছ, ভালোবাসা ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ অবদান। আমিও তোমাকে ভালোবাসব। তুমি আমার, তুমি কি তা জানো? নাকি জানো না? মাগারেট, তুমি ইয়ানকে সব দিয়ে দিয়েছ। তুমি আবার বলো।
–হ্যাঁ, আমি ইয়ানকে আমার সব দিয়ে দিলাম।
এবার আবার জেমির ঠোঁট নেমে এসেছে। সে মার্গারেটের বডিসের হুক খোলার চেষ্টা করল। একটু বাদে ঘটনা ঘটে গেল। আশেপাশে কেউ কোথাও নেই। বিস্তীর্ণ এই প্রান্তরে নগ্নিকা মার্গারেট। আহা, একটি মেয়ে তার বালিকা অবস্থা থেকে পূর্ণ যুবতীতে রূপাপ্তরিত হচ্ছে। মার্গারেটের মনে হল, সে বোধহয় আর বেঁচে নেই। এই মুহূর্তটাকে আমি চিরদিন মনে রাখব, মার্গারেট চোখ বন্ধ করে ভাবল। এখানে পাতার শয্যা, অসাধারণ বাতাস, কবোঞ্চতার আহ্বান, মার্গারেটের নগ্ন স্তনবৃন্তে হাওয়ার পরশ। বাওয়াফ গাছের ছায়ার তলায় রচিত হয়েছে স্বর্গশয্যা। তারা একে অন্যকে পাগলের মতো ভালোবাসছে। মার্গারেট ভাবল, আমি এই মানুষটিকে খুব বেশি ভালোবাসব। কোনো নারী এখনও পর্যন্ত কোনো পুরুষকে অতখানি ভালোবাসা উপহার দেয়নি।
সময়টা কেটে গেল। তখনও জেমি মার্গারেটকে শক্ত হাতে ধরে আছে। মার্গারেট ভাবছে, যদি এই মুহূর্তটা অনন্ত হত, তা হলে কেমন হত? সে জমির দিকে তাকিয়ে বলল- তুমি কী ভাবছ?
জেমি বলল– আমি অনেক দিন ক্ষুধার্ত, উপোসী এবং তৃষ্ণার্ত।
মার্গারেট হাসল। তারা গাছের ছায়ায় চলে গেল। এখানে কেউ দেখতে পাবে না। তারা শুয়ে রইল, ওই সুর্যদীপ্ত ভূমিখণ্ডের ওপর। মার্গারেটকে জেমি উন্মত্তের মতো আদর করল। হ্যাঁ, মার্গারেট শেষ পর্যন্ত ভাবল, এই দিনটাকে আমি চিরস্থায়ী এবং চিরস্মরণীয় করে রাখতে চাই।
***
সেদিন সন্ধ্যেবেলা, জেমি এবং ভ্যানডার সানটাউনারের কোণের টেবিলে বসে আছে।
জেমি বলল- আমি যা ভেবেছিলাম, তার থেকেও সম্ভাবনা বেশি।
ভ্যানডারের চোখে আলো। হ্যাঁ, আমি আপনাকে চালাক মানুষ বলেই ভাবি।
আমি কী করব বলুন তো?
ভ্যানডার চারদিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন- আমি আজ একটা ভালো খবর পেয়েছি। পিনেলেতে একটা নতুন হিরের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এখনও পর্যন্ত দশজন সেখানে গেছে। আমরা ব্যাপারটা নিজেদের মধ্যে ভাগ করতে পারি। আমি ৫০ হাজার পাউন্ড দিয়ে পাঁচজনের সবকিছু নিয়ে নেব। আপনি যদি ৫০ হাজার পাউন্ড ঢালেন, তাহলে বাকি পাঁচজনের সংগৃহীত হিরে আপনার পকেটে চলে আসবে। ওখানে আরও অনেক হিরে পাওয়া যাবে। আমরা রাতারাতি বড়োলোক হয়ে যাব। আপনি কী চিন্তা করছেন?
আবার সেই পুরোনো খেলা, জেমি বুঝতে পারল। ভ্যানডার সব টাকা নিজের পকেটে রেখে দেবেন, আর আমি পাব কাঁচকলা, না, এবার আর তা হবে না।
ব্যাপারটা ভালোই লাগছে। জেমি বলল, মোট কতজন দাবিদার আছে?
মাত্র দুজন।
–তাহলে এত টাকা লাগছে কেন?
–আহা, এটা ভালো প্রশ্ন। আপনি বুঝছেন না কেন, এটা তো ওরা দাবি করেছে। কিন্তু ওদের হাতে টাকা নেই। তাই তো আমরা এখানে ঢুকে পড়ব। আমরা ওদের হাতে একলক্ষ পাউন্ড দেব। আর তারা ওখানে কাজ করবে।
হ্যাঁ, আমি আবার বুঝতে পারছি, সেই পুরোনো দেওয়া নেওয়ার খেলা। জেমি জানে, এভাবেই এক-একজন হিরে অন্বেষককে আবার চোট করা হবে। সব টাকা ভ্যানডারের পকেটে চলে আসবে।
ভ্যানডার সাবধান করে দিয়ে বললেন- তাড়াতাড়ি কাজ করতে হবে। এই খবরটা ছড়িয়ে পড়লে সর্বনাশ।
-না, এটা আমরা করবই ভ্যানডারের মুখে হাসি–চিন্তা করবেন না। আমি কাজটা শুরু করব। ওই চুক্তিপত্রে সই করতে হবে।
জেমি মনে মনে ভাবল। আফ্রিকান ভাষায়, তাই তো!
–আমার হাতে আরও দু-একটা লোভনীয় ভালো ব্যবসা আছে, ইয়ান।
***
নতুন পার্টনারকে খুশি রাখতে হবে। তাই ভ্যানডার কোনো ভাবেই জেমিকে চটাতে চান না। যখন-তখন মার্গারেটের সাথে জেমি এখানে সেখানে বেরিয়ে পড়ে। দিনে দিনে মার্গারেটের ভালোবাসোর পরিমাণ আরও বাড়ছে। মার্গারেট বিছানায় শুয়ে শুয়ে জেমির কথা চিন্তা করে। চোখ খুললেই জেমির মুখখানা দেখে। জেমি তার জীবনে একটা বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছে। জীবন যে এত উত্তেজনাপূর্ণ হতে পারে বেচারী মার্গারেট তার খবর রাখত না। হঠাৎ এই শরীরটা নতুনভাবে দেখা দিয়েছে তার কাছে। সবকিছু এক নতুন আঙ্গিক পেয়েছে। এতদিন পর্যন্ত যৌনতা তার কাছে ছিল নরকের অন্ধকার। লুকোনো অভিজ্ঞতা। কিন্তু জেমির সংস্পর্শ তাকে অনেক কিছু বুঝিয়েছে। প্রেমের মতো পবিত্র আবেগ আর অনুভূতি আর কিছু নেই। প্রেম এক নতুন জগৎ। এতদিন পর্যন্ত সে নিষিদ্ধ উপত্যকায় ঘুরে বেড়িয়েছে। আজ মধুর সাগরে ভাসছে।
গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে একের পর এক ফাঁকা জায়গা পেয়েছে। সেখানে একে অন্যকে উন্মোচিত করেছে। মার্গারেট অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।
না, সেই পুরোনো পাপবোধ আর তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে না। সলোমন ভ্যানডার ডাচ রিফরম চার্চের এক ঘনিষ্ঠ সদস্য। মার্গারেট বাবার কাছ থেকে শুনেছিল, পাপ করলে শাস্তি ভোগ করতেই হবে। কিন্তু এখন পাপের সংজ্ঞাটা পাল্টে গেছে।
একদিন তারা ভাল নদীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। মার্গারেট বলল-ইয়ান, তুমি কি জানো, আমি তোমাকে কত ভালবাসি? তুমি কি বিয়ের কথা ভেবেছ?
জেমি হেসে বলল- মার্গারেট, আমি এ ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এবার দুজনে একই সঙ্গে হেসে উঠল। মার্গারেটের জীবনে সবথেকে সুখী মুহূর্ত এসে গেছে।
***
রবিবার সকালবেলা সলোমন জেমিকে তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছেন। তিনি জেমি আর মার্গারেটের সঙ্গে চার্চে যাবেন। একটা বিরাট বাড়িতে এই চার্চটা অবস্থিত। তারা সেখানে ঢুকে পড়ল। সেখানকার প্রধান যাজক ভ্যানডারকে অভিবাদন জানালেন।
–আমি এই চার্চটা তৈরি করতে সাহায্য করেছি। আমি এখানকার সম্মানীয় সদস্য।
ভ্যানডার জেমিকে গর্বিত হয়ে বললেন।
এবার ধর্মানুষ্ঠান শুরু হল। ভ্যানডার সেখানে বসে থাকলেন। প্রতি শব্দ উচ্চারণ করছেন।
জেমি ভাবল, শুধু রবিবার এই ভদ্রলোক ঈশ্বরের সান্নিধ্যে আসেন। বাকি দুদিন শয়তানের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব।
ভ্যানডারের দুপাশে দুজন বসে আছে, একদিকে মাগারেট, অন্যদিকে জেমি। মার্গারেট কিন্তু এক দৃষ্টিতে জেমির দিকে তাকিয়ে আছে, মাঝে মধ্যে হেসে উঠছে। আহা, মহান ধর্মযাজক কি জানেন, আমি কী বিষয়ে চিন্তা করছি?
***
সেই সন্ধ্যাবেলা মার্গারেট আর জেমি সানটাউনার সেলুনে গেল। স্মিথকে দেখা গেল, ড্রিঙ্ক দিচ্ছে। তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
–শুভ সন্ধ্যা, মিঃ ট্রাভিস, কী দেব? যা খান তাই তো?
না, স্মিথ, আজ আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি, তুমি কি একবার ভেতরের ঘরে যাবে?
–অবশ্যই যাব, স্যার। সে তার সহকারীর হাতে সবকিছু দায়িত্ব দিয়ে ভেতরে চলে গেল।
এটা এখন আর বন্ধ নয়, এখানে এখনও কিছু নিরাপত্তা আছে। একটা গোলটেবিল আছে, চারটে চেয়ার, টেবিলের ওপর একটা লণ্ঠন। স্মিথ আলো জ্বেলে দিল।
বসো।
স্মিথ চেয়ারে বসে বলল- হ্যাঁ, স্যার। কীভাবে সাহায্য করব?
–আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাইছি, স্মিথ।
–সত্যি?
–হা, সিগার থেকে ধোঁয়া ছেড়ে জেমি বলল- আমি তোমাকে বাঁচতে দেব না।
একটা অদ্ভুত ভয়ের চিহ্ন স্মিথের চোখে আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না মিঃ ট্রাভিস।
ট্রাভিস নয়, আমার নাম ম্যাকগ্রেগর। জেমি ম্যাকগ্রেগর। আমাকে মনে আছে? এক বছর আগে তুমি আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলে? ভ্যানডারের নির্দেশ মতো। ওই পরিত্যক্ত ওয়্যার হাউসে।
স্মিথ এবার কাঁপতে শুরু করেছে। সে বলল- আমি ভুলে গেছি।
–চুপ করো এবং আমার কথা শোনো। জেমির কণ্ঠস্বরে আগুন ঝরছে।
জেমি বুঝতে পারল, স্মিথ এখন ভয়ে কাঁপছে। তার মুখে একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি। একবছর আগের চেহারার সাথে এই সাদা চুলের মানুষটার সদৃশতা আনার চেষ্টা করছে।
-দেখো আমি বেঁচে আছি, আমি অনেক বড়োলোক। আমার হাতে এত টাকা আছে। যে, তোমার এই সেলুনটা পুড়িয়ে ফেলতে পারি। তোমার সাথে আমার শেষ বোঝাঁপড়াটা বাকি আছে।
স্মিথ অবাক হবার ভান করছিল। কিন্তু জেমি ম্যাকগ্রেগরের চোখের দিকে তাকিয়ে তার ভয় আকাশ ছুঁয়ে গেল। সে শান্তভাবে বলল- ইয়েস, স্যার।
–ভ্যানডার, তোমাকে অনেক টাকা দেয় যাতে ওই লোকগুলোকে প্রতারিত করা যেতে পারে। তাই তো? তোমাদের মধ্যে একটা গোপন চুক্তি আছে, তাই না? এক-একটা কাজের জন্য ও তোমাকে কত টাকা করে দেয়?
কিছুক্ষণের নীরবতা। স্মিথ বুঝতে পারছে না, এখন তার কী করা উচিত? কোন দিকে। সে ঝাঁপ দেবে?
জেমি চিৎকার করে বলল কত দেয়?
দু-শতাংশ।
–আমি তোমাকে পাঁচ শতাংশ দেব। তুমি এখন আমার হয়ে কাজ করবে। এখানে কোনো লোক এলেই তাকে পাকড়ে আমার কাছে নিয়ে যাবে। আমি টাকা দেব। তবে একটা তফাত, আমি কিন্তু ওই বুড়ো ভামের মতো লোকটাকে ঠকাব না। তার প্রাপ্য আমি মিটিয়ে দেব। তুমি যদি মনে করো, এখনও দু-শতাংশ নিয়ে ভ্যানডারের হয়ে কাজ করবে, তা হলে তোমাকে একটা গবেট বলতে হবে। আশা করি আমার কথা বুঝতে পারছ।
স্মিথ আমতা আমতা করে বলতে থাকে- হ্যাঁ, স্যার। মিঃ ট্রাভিস– মিঃ ম্যাকগ্রেগর আমি বুঝতে পারছি।
জেমি উঠে দাঁড়াল। বলল- না, এখনও পুরোটা বুঝতে পারোনি। সে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল- ভ্যানডারের কাছে গিয়ে আমাদের এই ছোট্ট কথাবার্তা জানিয়ে দাও। তাহলে তুমি দু-দিক থেকে টাকা পাবে। তাই তো? কিন্তু একটাই সমস্যা হবে স্মিথ…
কথাটা এখন ফিসফিসানিতে পরিণত হয়েছে তাহলে তুমি আর বেঁচে থাকার ছাড়পত্র পাবে না, বুঝলে তো?
.
০৭.
জেমি তখন পোশাক পরছিল। হঠাৎ দরজাতে ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দ। সে শুনল, শব্দটা আবার হচ্ছে। সে দরজার কাছে গিয়ে খুলে দিল মার্গারেট দাঁড়িয়ে আছে।
–ভেতরে এসো ম্যাগি, জেমি বলল। কিছু হয়েছে কি? এই প্রথম ম্যাগি তার হোটেল ঘরে এল।
সে ভেতরে ঢুকল, মুখোমুখি দাঁড়াল। কথা বলতে পারছে না। গতকাল সারারাত সে জেগে কাটিয়েছে। কীভাবে এই খবরটা দেবে। হয়তো এই খবর শুনে লোকটা আমাকে ফেলে পালিয়ে যাবে।
সে কোনোরকমে বলল- ইয়ান, আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি।
মার্গারেটের মুখে একটা ভয়ার্ত চাউনি। মনে হচ্ছে সে বোধহয় হারিয়ে যাবে।
হঠাৎ জেমির মনোভাব পাল্টে গেল। সে এগিয়ে এল। মাগারেটের ছোট্ট শরীরটা আকাশের দিকে তুলে দিয়ে, পরক্ষণে তাকে লুফে নিয়ে বলল- খবরটা দারুণ, ম্যাগি। তুমি কি তোমার বাবাকে বলেছ?
মার্গারেট বলল- না, এখনও বলিনি। সে সোফাতে গিয়ে বসে পড়ল। তুমি আমার বাবাকে চেনো না। বাবা কিছুই বুঝতে চাইবে না।
জেমি বলল- না-না, এসো, আমরা একসঙ্গে খবরটা দেব।
–তুমি বলবে তো?
–হ্যাঁ, আমি একথা তোমার বাবাকে জানাব।
***
ভ্যানডার আর একটা লোককে পাকড়াবার চেষ্টা করছিলেন। জেমি এবং মার্গারেট তার দোকানে গিয়ে পৌঁছোল।
তিনি কথা বলা শেষ করলেন– আমি আসছি।
জেমি বলল- একটা খবর দিচ্ছি। খবরটা শুনে আপনার ভালো লাগবে না। ম্যাগির পেটে বাচ্চা এসেছে।
বাতাসের ভেতর শনশনে নীরবতা। ভ্যানডার বললেন- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
ব্যাপারটা খুবই সহজ। আমি তাকে গর্ভবতী করেছি।
ভ্যানডারের মুখের রং পাল্টে গেছে। তিনি বিড়বিড় করে বললেন– ঘটনাটা কি সত্যি?
সলোমনের মাথায় নানা রকম চিন্তা–হ্যাঁ, হারিয়ে গেল, আমার প্রিয় কন্যার কুমারীত্ব? সে গর্ভবতী? শহরের সকলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। কিন্তু ইভান ট্রাভিস খুব বড়োলোক। তার বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব হবে না। যদি ওরা তাড়াতাড়ি বিয়ে করে…
ভ্যানডার জেমির দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনি তাড়াতাড়ি বিয়ে করবেন তো?
জেমি অবাক হল বিয়ে? তুমি তোমার মেয়ে ম্যাগিকে এমন একটা লোকের সাথে বিয়ে দিতে চাইছ, যাকে এক বছর আগে ঠকিয়েছিলে?
ভ্যানডারের মাথা ঘুরছে আপনি কী বলছেন ইয়ান, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমার নাম ইয়ান নয়, জেমি বলল, আমার নাম জেমি ম্যাকগ্রেগর। তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না?
ভ্যানডারের মুখে একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি না, সে লোকটা তো মরে গেছে।
–তুমি তাকে মেরে ফেলেছ, তাই তো? কিন্তু ভ্যানডার, আমি এখনও বেঁচে আছি। আমি তোমাকে এটা উপহার দিলাম। আমার বীজ তোমার মেয়ের পেটে বড়ো হবে।
জেমি বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। দুজনে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মার্গারেটের মনে হল, পৃথিবী বোধহয় ফাঁক হয়ে যাবে। না আমি সত্যি সত্যি ওকে ভালোবেসেছিলাম।
সলোমন তার মেয়ের দিকে তাকালেন। অসম্ভব রাগে কাঁপছেন। বলছেন– তুই কুত্তি, বেশ্যা। তারপর বললেন, যা বেশ্যা, এখান থেকে এক্ষুনি বেরিয়ে যা।
মার্গারেট থরথর করে কাঁপছে। এক্ষুনি যে ঘটনাটা ঘটে গেল, তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। ইয়ান তাকে এত ভালোবাসে? জেমি ম্যাকগ্রেগর কে?
চলে যা, ভ্যানডার তার মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। আমি তোর মুখ দেখতে চাইছি না।
মার্গারেট সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। তার হৃদয় ভেঙে গেছে। সে নিঃশ্বাস নেবার জন্য চেষ্টা করছে। তার মুখটা দেখে মনে হচ্ছে, সে বুঝি আর পারছে না। সে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। পেছন দিকে তাকাল না।
***
ভ্যানডার মেয়েকে চলে যেতে দেখলেন। তারপর হতাশ হয়ে ভেঙে পড়লেন। না, জীবনটা বোধহয় পাল্টে গেল। সকলের কাছে ব্যাপারটা রাষ্ট্র হবে। এখন কী হবে? হায় ঈশ্বর, ভ্যানডার ভাবলেন, তার চোখে মেয়ের নগ্ন দেহটা ফুটে উঠল। একজনের সাথে সঙ্গম করছে। জন্তুর মতো। ইস, ভাবতেই পারা যাচ্ছে না। কিন্তু তখনই হঠাৎ তার দণ্ডটা উখিত হল।
তিনি বুকের ওপর ক্রুশ চিহ্ন আঁকলেন। দরজার সামনে চলে এলেন। না, আর নড়তে পারছেন না। সত্যি, এখন আর পথে বেরোবেন কী করে? সকলেই তাঁর দিকে আঙুল তুলে তাকাবে। এটা অসহনীয়। হায় ঈশ্বর, তুমি এ কী করলে? আমি সারা জীবন তোমার সেবা করেছি। তুমি কেন আমাকে পরিত্যাগ করলে, ঈশ্বর? ওকে মরতে দাও, আমার মেয়েকে, আমাকেও মেরে ফেলো।
***
সানটাউনার সেলুনে অনেক মানুষের ভিড়। জেমি ঢুকল। সে বারের এককোণে চলে গেল। বলল- আপনারা অনুগ্রহ করে শুনবেন। আজ আমি সকলকে মদ খাওয়াব।
স্মিথ হাসল– কেন?
জেমি হেসে বলল- বন্ধু, সলোমনের অবিবাহিতা মেয়ে গর্ভবতী। এই ঘটনা ঘটানোর জন্য আমি গর্বিত। তাই আজ আনন্দ করব।
স্মিথ বলল- হায় যিশু।
–এর সাথে যিশুর কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু আছে জেমি ম্যাকগ্রেগর।
***
এক ঘণ্টার মধ্যে ক্লিপড্রিফটের সর্বত্র খবরটা ছড়িয়ে গেছে। ইয়ান ট্রাভিস আসলে জেমি ম্যাকগ্রেগর। কীভাবে সে ভ্যানডারের মেয়েকে গর্ভবতী করেছে।
ফিসফিসানি কানাকানি গুজব চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
বেশির ভাগ লোকই হাসাহাসি করতে শুরু করেছে।
***
ভ্যানডার বিকেলবেলা দোকান থেকে বেরোলেন। যে ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটেছে তার জন্য তিনি প্রস্তুত নন। তিনি মার্গারেটকে পরবর্তী কোচে কেপটাউনে পাঠিয়ে দেবেন। সেখানে হয়তো ওই জারজটার জন্ম হবে। কিন্তু ক্লিপড্রিফটের কেউ খবরটা জানতে পারবে না।
ভ্যানডার বাইরে এসে দাঁড়ালেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটলেন। হ্যাঁ, একজনকে দেখা গেল শুভ বিকেল, ভ্যানডার, কী হল? নাতির জন্য জামাকাপড় বুঝি?
-শুভদিন সলোমন, আমি কি আপনাকে সাহায্য করব? নাকি নাতিবাবু সব করবে?
–হ্যালো সলোমন, আমি শুনলাম, আপনার মেয়ে নাকি মা হতে চলেছে?
ভ্যানডার চারদিকে তাকালেন, দোকান বন্ধ করে দিলেন। সেখানে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন।
***
সানটাউনার সেলুন, জেমি হুইস্কি খাচ্ছে। চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। ক্লিপ ড্রিফটের সব থেকে বড়ো কেলেঙ্কারী আর কেচ্ছা। আহা, শহরটা টগবগ করে ফুটছে। জেমি ভাবল, বান্দা থাকলে কত ভালোই না হত। হ্যাঁ, এভাবেই সলোমনের বিরুদ্ধে আমার প্রতিশোধ নেওয়া শুরু হল। বান্দার বোনের ওপর যা অত্যাচার উনি করেছেন, এভাবেই শাস্তি দিতে হবে। এটা তো সবেমাত্র শুরু। এখনও অনেক কাজ বাকি আছে। ভ্যানডারকে আমি শেষ করে দেব। মার্গারেটের জন্য তার কোনো সহানুভূতি নেই। হ্যাঁ, সেও এই খেলার একটা অংশ। প্রথমদিন বলেছিল, আমার বাবা, আপনাকে সাহায্য করবেন। বাবা সব কিছু জানেন। তার মানে? এই মেয়েটিকেও ধ্বংস করতে হবে।
স্মিথ জেমির কাছে গিয়ে বলল– আপনার সঙ্গে এক মুহূর্ত কথা বলব, মিঃ ম্যাকগ্রেগর?
কী?
দুজন অভিযাত্রী আসছে। তারা পিনিয়ানের কাছে দশটা হিরের সন্ধান পেয়েছে। তাদের হাতে পয়সা নেই। জিনিসপত্র কিনতে পারছে না। তারা একজন অংশীদারকে চাইছে। আপনি কি রাজী হবেন?
জেমি বলল- ঠিক আছে, এই লোকগুলোর ব্যাপারে ভ্যানডারের সাথে কথা বলোনি
স্মিথ বলল- না স্যার। আমি আপনার প্রস্তাব নিয়ে ভেবে দেখেছি। আমি আপনার সঙ্গে ব্যবসা করব।
জেমি সিগার ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে বলল আচ্ছা, কথা চালিয়ে যাও।
***
প্রথম দিকে ক্লিপট্ৰিফটে বেশ্যাবৃত্তির খুব একটা চল ছিল না। এলোমেলোভাবে এই ব্যবসাটা চালানো হত। কালো মেয়েরাই লাইনে দাঁড়াত। রাস্তার ধারে টিনের শেডের মধ্যে এক-একটা গণিকালয়। পরে সাদা চেহারার বারাঙ্গনাদের আবির্ভাব ঘটল। তারা হল বারমেড। যখন হিরের খনির সন্ধানে আরও বেশি লোক আসতে শুরু করল, শহরটা বেড়ে গেল চারদিকে, আরও বেশি সাদা বেশ্যাদের দেখা গেল।
এখন ক্লিপড্রিফট শহরের এখানে সেখানে গোটা ছয়েক বেশ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। কাঠের বাড়ির ওপর টিনের ছাদ দেওয়া। মাদাম অ্যাগনেস কিন্তু একটা ভারী সুন্দর গণিকালয় স্থাপন করেছেন, ব্রিস্টিটের ওপর, দোতলা বাড়ির মধ্যে, লুপস্ট্রিটের পাশে। এখানে ভালো মেয়েদের আনা হয়। পয়সাও বেশি লাগে। আনন্দ পাওয়া যায় অনেক। মেয়েদের বয়স কম। বেশির ভাগই ছলাকলায় অভ্যস্তা। পয়সাটা পুরো উসুল হয়ে আসে। সুন্দর সাজানো ড্রয়িং রুমে বসে মাল খাওয়া যায়। মাদাম অ্যাগনেস সবসময় সকলের ওপর নজর রাখেন। তিনি নিজেও এক অত্যন্ত সুন্দরী মহিলা। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স, ভালো স্বাস্থ্য, মাথায় লাল চুল। তিনি লন্ডনের একটা গণিকালয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকাতে সহজে টাকা পাওয়া যায়, সেই গল্প শুনে ছুটে এসেছেন। শেষ অব্দি নিজেই একটা ব্যবসা স্থাপন করেছেন। শুরু থেকেই ব্যবসাটা ফুলে ফেঁপে বড়ো হয়ে গেছে।
মাদাম অ্যাগনেস মানুষকে বুঝতে পারেন, কিন্তু জেমি ম্যাকগ্রেগরকে তিনি কিছুতেই– চিনতে পারছেন না। জেমি এখানে প্রায়ই আসে। হৈ-হৈ করে টাকা খরচ করে। মেয়েদের কাছে তার একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। কিন্তু জেমিকে দেখে মনে হয়, সে সর্বদা উদাসীন, তাকে সহজে ধরাছোঁয়া যায় না। তার চোখের ভেতর এমন একটা আকর্ষণ আছে, যা অ্যাগনেসকে অবাক করে দেয়। চোখের ছায়া ধূসর, ঠাণ্ডা এবং দিশাহীন। অন্যান্য পুরুষদের মতো সে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। এমন কী ফেলে আসা দিনযাপনের গল্পকথা কখনও বলেনি। জেমি সম্পর্কে কিছু কথা মাদাম ইতিমধ্যেই শুনেছেন। এই ছেলেটি নাকি সলোমনের মেয়েকে ধর্ষণ করে, মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়ে, কিন্তু সে ওকে বিয়ে করতে চায়নি। বেজন্মার জাত আর কী! মাদাম অ্যাগনেস ভাবলেন, কিন্তু তার মধ্যে একটা আলাদা আকর্ষণ আছে।
জেমি লাল কার্পেটে ঢাকা সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। বলল– শুভরাত, এবং চলে গেল।
***
জেমি তার হোটেলে ফিরে এসেছে। মার্গারেট ঘরে বসেছিল। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সে জেমির দিকে তাকিয়ে বলল- হ্যালো জেমি।
-তুমি এখানে কী করছ?
–তোমার সঙ্গে কথা আছে।
–তোমার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই।
-আমি জানি, তুমি কেন এটা করেছ। তুমি আমার বাবাকে ঘেন্না করো, তাই তো? কিন্তু আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমাকে বিশ্বাস করো। আমাকে ঘেন্না করো না। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।
জেমি বলল- এটা তোমার সমস্যা, আমার নয়।
–এভাবে আমার দিকে তাকিও না। তুমিও তো আমাকে ভালোবাসো, নাকি?
জেমি কিছুই শুনছে না। আবার সেই মারাত্মক ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। সে প্রায় মরেই গিয়েছিল। শেষ অব্দি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে। হিরের খনির সন্ধান পেয়েছে। ভ্যানডার তার সবথেকে বড়ো শত্রু। ভ্যানডারের কণ্ঠস্বর তার মনে পড়ল তুমি আমার হয়ে কাজ করবে, আমি তোমাকে সাহায্য দেব। না, শকুনগুলো আবার আর্তনাদ করতে শুরু করেছে… মাংসগুলো খাবলে খাবলে খাচ্ছে।
অনেক দূর থেকে সে বোধহয় মার্গারেটের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল তোমার কি মনে পড়ছে না, আমি তোমাকে ভীষণভীষণ ভালোবাসি?
না, মার্গারেটের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। ভালোবাসা? এই শব্দটার আসল অর্থ জেমি কোনো দিন জানতে পারবে না। ভ্যানডার তার সমস্ত আবেগকে হত্যা করেছে। একটাই শব্দ শুধু দগদগে ঘায়ের মতো বেঁচে আছে– ঘৃণা। সে ঘৃণার মধ্যেই থাকবে। এটাই তার জীবনের নির্যাস। এই ব্যাপারটাই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। ঘৃণাকে ভর করে সে হাঙরদের সাথে লড়াইতে জয়যুক্ত হয়েছে। খাড়াই পাহাড়ের পথ ডিঙিয়ে হিরের খনিতে পৌঁছেছে। তারপর? নামিব মরুভূমির বুকে বিজয় অভিযানের নায়ক হয়েছে। কবিরা সব সময় ভালোবাসার কথা বলে থাকেন। সংগীতকাররা এ বিষয়ে গান লেখেন। কিন্তু এটা বোধহয় পৃথিবীতে নেই, যা আছে তাকে শুধুমাত্র ঘৃণা বলা যেতে পারে।
–তুমি ভ্যানডারের কন্যা, তুমি তার নাতিকে পেটে বহন করছ। এখান থেকে বেরিয়ে যাও!
***
– মার্গারেটের যাবার কোনো জায়গা নেই। বাবাকে সে ভালোবাসে। বাবা ক্ষমা না করলে সে কোথায় যাবে? কিন্তু সে জানে, বাবা তাকে ক্ষমা করবে না। বাবা তার জীবনটাকে নরক করে ছাড়বে, তাকে কোথাও যেতে হবে।
মার্গারেট হোটেল থেকে বেরিয়ে বাবার দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, সকলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসছে। সে মাথাটা উঁচু করে হাঁটতে থাকল। দোকানে পৌঁছে একটু ভাবল। ভেতরে ঢুকল। দোকান একেবারে ফাঁকা।
বাবা বেরিয়ে এলেন- তুমি? কণ্ঠস্বরে অপমান এবং ঘৃণা ঝরে পড়ছে। বাবার মুখে হুইস্কির গন্ধ। তুমি এই শহর থেকে অন্যত্র চলে যাও। এখানে আর কখনও এসো না। আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?
কিছু খুচরো পয়সা মেয়ের হাতে ছুঁড়ে দিয়ে উনি বললেন- এগুলো নিয়ে চলে যাও।
–আমার পেটে তোমার নাতি।
–তুমি শয়তানের ছেলেকে বহন করছ। উনি আরও কাছে এগিয়ে এলেন। হাতটা মুঠো বন্দি করলেন- তোমার দিকে সকলে তাকিয়ে কী বলে জানো? তোমায় বাজারের বেশ্যা কুত্তি বলে। তোমার কথা ভাবলে লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে যায়। তুমি শেষ হয়ে গেছো।
মেয়েটি তাকাল, অনেকক্ষণ ধরে। তারপর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
–বেশ্যা, তোর টাকাটা নিয়ে যা, কুত্তি!
***
শহরের উপকণ্ঠে অল্প দামের হোটেল আছে। মার্গারেট সেখানে ঢুকে পড়ল। তার মনের আকাশে ঝড় উঠেছে। সে মিসেস আওনসের দিকে তাকাল। বাড়িউলি।
মিসেস আওনসের বয়স বছর পঞ্চাশ, স্বামীর সঙ্গে এক দিন ক্লিপড্রিফটে এসেছিলেন। স্বামী তাকে ফেলে পালিয়ে গেছেন। এমন এক মহিলা, হয়তো মরে যেত। কিন্তু মিসেস আওনসের স্বভাব ছিল একেবারে অন্যরকম। তিনি দেখলেন, অনেক মানুষ এখানে ভিড় করেছে। দালাল, ফোড়ে, উটকো ব্যবসাদার আরও কত জন। কিন্তু সতেরো বছরের একটি মেয়ে? এখন কী হবে?
–তুমি এখানে কেন এসেছ?
–একটা কাজ পাওয়া যাবে?
কী কাজ?
–আমি ভালো রান্না করতে পারি। খাবার দাবার সরবরাহ করতে পারি। আমি ঘর মুছতে পারি, ঝাঁট দিতে পারি। যে কোনো একটা কাজ।
মিসেস আওনস থরথরিয়ে কাঁপতে থাকা ওই মেয়েটির দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, আমার মনে হচ্ছে, তোমাকে হয়তো কাজে লাগবে। তুমি কত দিয়ে শুরু করবে?
মার্গারেটের মুখে হাসি।, আপনি যা দেবেন।
এবার মিসেস আওনস বললেন- তোমাকে আমি এক পাউন্ড দু শিলিং এগারো পেন্স করে দেব। প্রতি মাসে। খাওয়া-থাকায় পয়সা লাগবে না।
মার্গারেট শান্তভাবে বলল- তা হলেই হবে।
***
ভ্যানডারকে এখন আর ক্লিপ ড্রিফটের রাস্তাঘাটে বিশেষ দেখা যায় না। মাঝে মধ্যেই দোকানটা বন্ধ থাকে। এখন খদ্দেররা অন্য জায়গায় যেতে শুরু করেছে।
কিন্তু ভ্যানডার প্রতি রবিবার চার্চে যান। তিনি এখন আর প্রার্থনা করেন না। তিনি ভগবানের কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করেন। এখন অনেকখানি পাল্টে গেছেন। অর্থ আর তার চারদিকে প্রাচীর তুলতে পারছে না। তিনি বুঝতে পারছেন, সকলেই আড়ালে আবডালে তাকে নিয়ে রসালো আলোচনা করছে। কোথা থেকে কী যেন হয়ে গেল। শেষ অব্দি কী হবে, ভ্যানডার তার জবাব জানেন না।
আবার তিনি ভাবলেন, এই চার্চে এসে কী লাভ?
একদিন চার্চে বাজে বাজে কথা শুনতে হল তাকে। তিনি সেই থেকে চার্চে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন!
ব্যবসার হাল ক্রমশ খারাপ হয়েছে। পাশাপাশি জেমি ম্যাকগ্রেগরের ব্যবসা হু-হু করে বাড়ছে। একটির পর একটি সোনার খনির খবর আসছে। জেমি ম্যাকগ্রেগর সবকিছু পাগলের মতো কিনে নিচ্ছে। একইরকম পদ্ধতিতে সে টাকা লগ্নী করছে। কিন্তু সে কখনও তার অংশীদারদের ঠকায়নি। এর পাশাপাশি সে সম্পত্তির ব্যবসায় নেমে পড়ল। সোনা কম দামে
আবার তিনি তার জবাব জাকেরছে। কোতে পারছেন পাল্টে গেছে কিনে বেশি দামে বেচতে লাগল। ব্যবসার ব্যাপারে তার সততা আকাশছোঁয়া। ধীরে ধীরে তার সুনাম চারদিকে বাড়তে লাগল। আরও বেশি লোক তার সঙ্গে হাত বাড়াতে উদগ্রীব।
শহরে দুটো ব্যাংক ছিল। একটা ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হল। ব্যাংকটা কিনে নিল। নিজের লোকজনকে চারদিকে বসাল। নিজেকে লেনদেনের মধ্যে জড়াল না।
সবকিছুই এখন এগিয়ে চলেছে তরতর করে। ছোটোবেলায় যে স্বপ্ন সে দেখেছিল, সেই স্বপ্নটা সফল হয়ে গেছে। সে ভ্যানডারের বিফলতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এখনও অবশ্য পুরোপুরি প্রতিশোধ নেওয়া হয়নি।
মাঝে মধ্যে জেমি মার্গারেটের দেখা পায়, কিন্তু মার্গারেটকে দেখে সে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়।
জেমি জানে না। মার্গারেটের সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করা উচিত। মার্গারেটকে দেখে বুঝতে পারা যায়, সে একেবারে ভেঙে পড়েছে। কিন্তু মার্গারেট এখনও তাকে ভালোবাসে এ বিষয়ে জেমির কোনো সন্দেহ নেই। কোনো কিছুই মার্গারেটকে পরিবর্তিত করতে পারল না। বাবাকে শাস্তি দিতে গিয়ে সে বোধহয় মেয়েটিকেও শাস্তি দিয়ে ফেলল। হ্যাঁ, মার্গারেট একটা দুদিকে ধারালো তরবারির মতো। তার গর্ভে জেমির সন্তান। যখন জেমি এই সন্তানকে দেখবে, তখন কী করবে? তখন হয়তো মার্গারেটকে বিয়ে করতে বাধ্য হবে। মার্গারেট একদিন কি শ্রীমতী জেমি ম্যাকগ্রেগর হিসেবে পরিচিত হবে? এসব নেহাতই কষ্টকল্পনা।
***
একরাতে শুতে যাবার আগে মার্গারেট ভাবল, এই সন্তানকে নিয়ে কী করা যায়? না, এটা কি এক পুত্র সন্তান হবে? সবাই তো ছেলেই চায়!
ক্রমশ পেটটা বাড়তে থাকল। মার্গারেট আরও ভয় পেয়ে গেল। কারও সঙ্গে কথা বলতে হবে। কিন্তু শহরের কোনো মহিলা তার সঙ্গে কথা বলবে না। ওদের ধর্মে কুমারি মাকে শাস্তি দেওয়া হয়। সে একা, চারপাশে অজ্ঞাত আততায়ীদের ভিড়। সমস্ত রাত ধরে সে কাঁদল। নিজের এবং অজাতক ওই শিশুটির জন্য।
***
জেমি ম্যাকগ্রেগর শহরের মাঝখানে দোতলা বাড়ি কিনেছে। এটাই তার ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র। একদিন জেমির প্রধান অ্যাকাউনট্যান্ট হারি ম্যাকমিলান তার সাথে কথা বলতে এল।
–আমরা অনেকগুলো কোম্পানিকে একসঙ্গে জুড়ে দেব। তার একটা সুন্দর নাম দিতে হবে। কী নাম দেওয়া যায় বলুন তো?
আমি ভাবব।
জেমি ভাবতে থাকল। অনেক আগে শোনা কতগুলো শব্দ তার মনে পড়ে গেল। যখন সে নামিব মরুভূমিতে মরতে বসেছিল। একটা নাম দিতে হবে। সে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকাউনট্যান্টকে ডেকে পাঠাল, বলল– আমরা নতুন কোম্পানির নাম দেব, ক্রুগার ব্রেন্ট ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড, কেমন?
***
অ্যালভিন কুরি, জেমির ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, একদিন দেখা করতে এলেন। তিনি বললেন আমি মিঃ ভ্যানডারের ঋণের কথা শুনেছি। তার অবস্থা খুবই খারাপ। তার এই ঋণ কী করে শোধ হবে?
-না।
কুরি অবাক হয়ে বললেন তিনি আজ সকালে আরও কিছু টাকা ধার চাইতে এসেছিলেন।
সবকিছু দেবেন, কিছু ইতস্তত করবেন না।
ম্যানেজার অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন– মিঃ ম্যাকগ্রেগর, আপনি কী বলছেন?
আমায় কিছু বলবেন না, সবসময় টাকা ধার দিতে থাকবেন।
***
প্রত্যেক দিন সকালবেলা পাঁচটার সময় মার্গারেটের ঘুম ভাঙত। তাকে অনেক কাজ করতে হত। একা হাতে ব্রেকফাস্ট তৈরি করা, সবকিছু বানানো। এখানে যারা থাকে, তারা সকলেই হিরের সন্ধানে চলেছে। তাদের অনেকে এই ব্যাপারে জিতেছে, কেউ কেউ জিততে পারেনি।
ক্লিপড্রিফটে একটা অলিখিত নিয়ম আছে তা হল, সুন্দরী মহিলাদের কখনও ধর্ষণ করা যাবে না, যদি কোনো পুরুষের মনে যৌনেচ্ছা জেগে ওঠে, তাহলে তাকে অবশ্যম্ভাবী ভাবে এক বেশ্যার কাছে যেতে হবে। মার্গারেট অবশ্য এ ব্যাপারে একটা বিস্ময়। কারণ তাকে কোন দলভুক্ত করা হবে, কেউ তা বলতে পারছে না। সুন্দরী মেয়েরা তো এভাবে গর্ভবতী হয়ে পড়ে না। মার্গারেট একবার ধর্ষিতা হয়েছে, তাই সকলের সঙ্গে বিছানাতে শুতে আগ্রহী, এমন কথাই বলা হল।
কেউ কেউ খোলাখুলি এবং সাহসী। কেউ আবার লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রেম করতে ভালোবাসে। মার্গারেট শান্তভাবে সকলের সঙ্গে কথা বলল। একরাতে মিসেস আওনস বিছানা তৈরি করছিলেন। তিনি মার্গারেটের ঘর থেকে আর্তনাদের শব্দ শুনতে পেলেন। দরজা খুলে ছুটে এলেন। একটা মাতাল খদ্দের মার্গারেটের নাইটি টেনে ছিঁড়ে নামিয়ে দিয়েছে। তাকে বিছানায় ফেলে দিয়েছে।
মিসেস আওনস তার ওপর বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তিনি লাঠিপেটা কতে শুরু করলেন। ওই লোকটার তুলনায় শরীরটা তার অর্ধেক। কিন্তু তাতে কী বা হবে। প্রচণ্ড রেগে গেছেন। ওই লোকটাকে মারতে মারতে অচেতন করে ফেললেন। তাকে রাস্তায় ফেলে দিলেন। তারপর মার্গারেটের দরজাতে এসে দাঁড়ালেন।
মার্গারেটের ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে। লোকটা মার্গারেটকে ভীষণভাবে মেরেছে।
মিসেস আওনসের সমস্ত শরীর কাঁপছে। তিনি বললেন- তুমি ঠিক আছে ম্যাগি?
-হ্যাঁ, অনেক ধন্যবাদ মিসেস আনস।
মার্গারেটের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। এই শহরে কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। কিন্তু এই মহিলা আমার প্রতি অনেক সমবেদনা দেখিয়েছেন।
মিসেস আওনস মার্গারেটের মোটা পেটটা দেখে ভাবলেন, আহা, জেমি ম্যাকগ্রেগর কোনোদিন একে বিয়ে করবে না!
***
মার্গারেট এখন খুব শান্ত। নীচু হতে পারছে না। হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয়। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, পেটের ভেতর বাচ্চাটা এবার নড়াচড়া করছে। হ্যাঁ, আমি আর আমার পুত্রসন্তান পৃথিবীতে একলা থাকব। আমি তার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলব। জীবনে কত উত্তেজনা আছে। তাকে সব কিছু বলব।
এক সন্ধ্যেবেলা, খাবার পরে কালো রঙের একটা ছেলে এসে বোর্ডিং হাউসে পৌঁছোল। সে মার্গারেটের হাতে একটা বন্ধ খাম তুলে দিয়েছে।
সে বলল আমি উত্তরের জন্য অপেক্ষা করব।
মার্গারেট চিঠিখানা পড়ল। আবার পড়ল। তারপর বলল- হ্যাঁ, আমি যাব!
***
পরের শুক্রবার, দুপুর হয়েছে, মার্গারেট মাদাম অ্যাগনেসের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। সামনে একটা চিহ্ন লেখা আছে–বন্ধ। মার্গারেট দরজাটা ঠেলল। কেউ তার দিকে তাকাল না। সে ভাবল, এখন এখানে আসা ঠিক হল কিনা। শেষ পর্যন্ত তাকে একটা কঠিন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। এই একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে।
চিঠির মধ্যে লেখা ছিল- ডিয়ার মিস ভ্যানডার, এটা আমার কথা নয়, আমি শুনেছি, তোমার অবস্থা খুবই খারাপ। তুমি লজ্জা করো না। তোমাকে এবং তোমার বেবিকে আমি সাহায্য করব। তুমি কি আমার কাছে একবার আসবে? শুক্রবার দিন এলে ভালো হয়।
তোমার বিশ্বস্ত
মাদাম অ্যাগনেস
পুনশ্চ- ব্যাপারটা গোপন রেখো।
মার্গারেট ভাবছে, চলে যাবে কিনা? শেষ পর্যন্ত দরজাটা খুলে গেল।
মাদাম অ্যাগনেস মার্গারেটের হাতে হাত রাখলেন–এসো, তোমার ব্যাপারটা শোনা যাক।
তিনি মার্গারেটকে পার্লারে নিয়ে গেলেন। ভারী সুন্দর কৌচ, চেয়ার এবং টেবিল আছে। রিবন দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো। নানারঙের বেলুন ঝুলছে। লেখা আছে ওয়েলকাম বেবি। হ্যাঁ, এটা একটা ছেলে হবে। শুভ জন্মদিন।
মাদাম অ্যাগনেসের আটজন তরুণী বসে আছে বিভিন্ন বয়স, আকার আর রঙের। তারা সকলেই ভারি সুন্দর পোশাকে সেজে উঠেছে। আহা, মার্গারেট ভাবল, কত সুন্দর, এই শহরের কোনো অভিজাত মহিলাও বোধহয় দেখতে এত সুন্দরী নয়।
মার্গারেট ওইসব বেশ্যাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। কী করতে হবে সে বুঝতেই পারছে না। হ্যাঁ, কতগুলি মুখ খুবই পরিচিত। যখন সে তার বাবার দোকানে কাজ করত। তখন এইসব মেয়েরা জিনিস কিনতে আসত। তখন তারা কিশোরী ছিল এবং আরও সুন্দরী। কয়েক জনের বয়স হয়েছে, চুলে রঙ পড়েছে, তবে সকলের মধ্যেই একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে। তাদের দেহের যত্ন করা হয়। তারা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করছে। তারা জীবনটাকে আনন্দে কাটাতে চায়।
মার্গারেটকে তারা ভালোভাবেই গ্রহণ করল। কোনো খারাপ কথা বলল না। তাদের মধ্যে এসে মার্গারেটের মনে হল, সে বোধহয় নতুন জীবন পাবে।
মাদাম অ্যাগনেস বললেন- তোমার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করি। মনে হচ্ছে, তোমার খুবই খিদে পেয়েছে।
আসলে অনেক দিন সে খিদে-তেষ্টার বাইরে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। কেউ তাকে আদর করে বসিয়ে খাওয়ায়নি।
দারুণ আয়োজন, সুস্বাদু খাবার। খেতে খেতে মার্গারেটের চোখে জল এসে গিয়েছিল। এ জল আনন্দের। মাদাম অ্যাগনেস নিজের হাতে পরিবেশন করছিলেন। পাশে বসেছিল আর একটি সুন্দরী মেয়ে। মার্গারেট অবাক হয়ে এইসব বারাঙ্গনাদের দিকে তাকিয়েছিল। সে ভাবতেই পারছে না, এখানে এত আনন্দ আর কৌতূহল লুকিয়ে আছে। তবে কেন আমরা মিছিমিছি এদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করি?
খাওয়ার পর তার জন্য একটা দারুণ বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। মাদাম অ্যাগনেস তাকে ভেতরের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। সেখানে টেবিলের ওপর অনেকগুলো প্যাকেট পাশাপাশি সাজানো রয়েছে। প্রত্যেকটা সুন্দরভাবে মোড়ক বন্দী।
মাদাম অ্যাগনেস একগাল হেসে বললেন– মার্গারেট, এসব তোমাকে দেওয়া হল। তোমার অনাগত শিশুর শুভ আগমনকে স্মরণে রেখে। তুমি একটা একটা করে সবকটা প্যাকেট খুলতে পারো।
মার্গারেটের বিস্ময় তখন আকাশ ছুঁয়েছে। হায় ঈশ্বর, আমার জন্য এত অন্ধ ভালোবাসা। আমি কী এর যোগ্য? অতীত ইতিহাসের কথা ভেবে মার্গারেট আবার কেঁদে ফেলল। সত্যি, কত যত্ন করে এইসব উপহারগুলো আনা হয়েছে।
এবার বিদায়ের পালা। মেয়েরা তাকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিল। মার্গারেটকে আবার ওই বোর্ডিং হাউসে ফিরে যেতে হবে। মার্গারেট ছলছল চোখে স্বার দিকে তাকাল। বুঝতে পারল, এই স্মৃতিকে সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। হয়তো অনেক দিন বাদে গল্পছলে সে তার ছেলেকে এই সুন্দর সন্ধ্যেটার কথা বলবে। বলবে, তুই না আসার আগেই তোকে নিয়ে সে কী উন্মাদনা, তুই তা কখনও জানতেও পারলি না!
.
০৮.
ফঁদটা ভালোভাবেই পাতা হয়েছে। গত ছমাস ধরে জেমি ম্যাকগ্রেগর ধীরে ধীরে ভ্যানডারের সমস্ত ব্যবসার ওপর তার প্রভাব এবং কর্তৃত্ব বিস্তার করে চলেছে। শুধু একটা স্বপ্ন এখনও সফল হয়নি, যে করেই হোক নামিবের ওই মরুভূমির ওপর দখলদারি কায়েম করতে হবে। এই মরুভূমির সঙ্গে তার জীবনের সবকিছু জড়িয়ে আছে। মৃত্যু এবং জীবন, কান্না ঘাম রক্ত– সবকিছু। সে ওই হিরেগুলো দিয়ে এক বিরাট সাম্রাজ্য রচনা করতে পারে, কিন্তু এটা তার আসল উদ্দেশ্য নয়। যে করেই হোক ভ্যানডারকে ধ্বংস করতে হবে। তা না হলে জেমি শান্তি পাবে না।
ভ্যানডার আরও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। এই শহরের কেউ তাকে আর টাকা ধার দিতে রাজি হচ্ছে না। কিন্তু যে ব্যাঙ্কের মালিকানা জেমি প্রথমে কিনে নিয়েছে, সে ব্যাঙ্ক দরাজ হাতে টাকা ধার দিয়ে চলেছে। ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের কাছে জেমি বলে দিয়েছে, ভ্যানডারকে সবকিছু দিয়ে দেবেন, কোনো কার্পণ্য করবেন না।
এখন আর ওই মুদিখানাটা একেবারেই ভোলা হয় না। ভোর থেকে ভ্যানডার মদ খেতে শুরু করেন। সন্ধ্যেবেলা উনি মাদাম অ্যাগনেসের কাছে গিয়ে হাজির হন। সমস্ত রাত সেখানে থাকতেই ভালোবাসেন।
একদিন সকালবেলা মার্গারেট মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছু মুরগি কিনতে হবে। মিসেস আওনস মুরগির জন্য বলেছেন। জানালা দিয়ে মার্গারেট তাকিয়ে দেখল, বাবা বেশ্যাখানা থেকে বেরিয়ে আসছে। হ্যাঁ, ওই লোকটা কদিনে এত বুড়ো হয়ে গেছে। হায় ঈশ্বর, এ কী হল?
ভ্যানডার জানতেন না, তার ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে। হ্যাঁ, নিজের জন্য বড্ড কষ্ট হয়। সব বিশ্বাস আজ হারিয়ে গেছে। এ জীবনে উনি আর উঠে দাঁড়াতে পারবেন না।
এখনও কিছু আছে কি? কয়েকটা হিরের খনির ওপর মালিকানা? তা দিয়ে আর কত দিন চলবে?
একদিন সকালে জেমি তার ব্যাংক ম্যানেজারকে ডেকে বলল- এক্ষুনি ওই লোকটাকে ডেকে পাঠান। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সব ধার শোধ করতে হবে।
পরের দিন বিকেল চারটে। সহকারী ম্যানেজার ওই মুদিখানায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। তার সাথে আইনের নির্দেশনামা আছে। সলোমনের সব পার্থিব সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হবে। জেমি অফিসে বসে ভ্যানডারের কথা ভাবতে থাকল– আহা, দোকান থেকে ভ্যানডারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বুড়ো লোকটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছেন পিটপিট চোখে। এখন কী করবেন বুঝতে পারছেন না। সব কিছুই নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এভাবেই জেমির প্রতিশোধের পালা শেষ হল। হ্যাঁ, আমি জিতে গেছি। যে লোকটা আমাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিলেন, আমি তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছি।
সেই রাতে জেমি মাদাম অ্যাগনেসের বারাঙ্গনা পল্লিতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল।
অ্যাগনেস বলেছিলেন- জেমি, তুমি কি খবরটা শুনেছ? ভ্যানডার একটু আগেই মারা গেছেন!
***
শোক অভিযান অথবা মিছিল। শহরের বাইরে। মাত্র দুজন মানুষকে দেখা গেল মার্গরেট এবং জেমি। মার্গারেট একটা কালো পোশাক পরেছে। তার অসাধারণ রূপ লাবণ্যকে ঢেকে রাখার জন্য। মুখে বিবর্ণতা। জেমি দাঁড়িয়ে আছে মাথা নীচু করে। হ্যাঁ, একটু উদাস হয়েছে বটে। দুজন দুদিকে দাঁড়িয়ে আছে, কফিনটা এসে গেছে। সেটা ধীরে ধীরে মাটিতে নামিয়ে দেওয়া হল। মাটি ফেলা হল। মার্গারেটের মনে হল, বাবা বোধহয় তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলছে- তুই একটা বেশ্যা। কুত্তি বেশ্যা!
সে বাবার কফিনের দিকে তাকাল। তারপর জেমির দিকে। চোখে চোখে মিলন। জেমির চোখের দৃষ্টিতে শীতলতা, মনে হচ্ছে, তারা কেউ যেন কাউকে চেনে না। কিন্তু মার্গারেট? সে এখনও জেমিকে অসম্ভব ভালোবাসে। সে মনে মনে নিজেকে জেমির স্ত্রীর ভূমিকাতে বসাতে চায়। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। সে কফিনের দিকে তাকাল, হ্যাঁ, শেষবারের মতো মাটি চাপা দেওয়া হচ্ছে।
পেছন ফিরে দেখল, কিন্তু জেমিকে কোথাও দেখতে পেল না।
***
ক্লিপড্রিফটে দুটো কাঠের বাড়িতে হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছে। ব্যবস্থাটা খুবই খারাপ। রোগীরা সেখানে গিয়ে আর বেঁচে ফিরতে পারে না। শিশুরা এখনও বাড়িতে জন্মায়। মার্গারেটের সময় এসে গেছে। মিসেস আওনস সবকিছু ব্যবস্থা করে দিলেন। একটা কৃষ্ণকায়া ধাত্রীর ব্যবস্থা করা হল। তার নাম হান্না, রাত্রি তিনটের সময় প্রসব যন্ত্রণা উঠল।
হান্না বলল এবার তোমাকে যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে।
–হ্যাঁ, প্রথমে মার্গারেটের মুখে হাসি, সে তার পুত্রসন্তানকে পৃথিবীর বুকে নিয়ে আসছে। তার একটা নাম দিতে হবে। সে জানে না, জেমি এই ছেলেটিকে স্বীকার করে নেবে কিনা। নাকি তার ছেলেকে শুধু শুধু শাস্তি দেওয়া হবে।
ঘন্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল। বোর্ডাররা কেউ কেউ মার্গারেটের বেডরুমে এসে উপস্থিত হল। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।
হান্না মার্গারেটেকে বলেছিল– আরও কিছুটা যন্ত্রণা সহ্য করো।
মার্গারেট জানতে চাইল- ছেলে হবে তো?
হান্না মার্গারেটের শরীরটা তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে বলল- আমি জানি না। হ্যাঁ, চেষ্টা করো।
এইভাবে আর কিছুটা সময় এগিয়ে গেল। যন্ত্রণায় সমস্ত শরীর বোধহয় ছিঁড়ে যাচ্ছে। হায় ঈশ্বর, কিছু একটা ভুল হয়েছে।
হান্না বলল- এবার চেষ্টা করো। না, তার কণ্ঠস্বরে কেমন উদ্বিগ্নতা। আমি এটাকে বার করতে পারছি না।
মার্গারেট দেখতে পেল, হান্না নীচু হয়েছে, দেহটাকে বেঁকিয়ে ধরেছে। তারপর চোখের সামনে অন্ধকার। আর কোনো যন্ত্রণা নেই। মনে হচ্ছে, মার্গারেট যেন মহাশূন্যে ভেসে চলেছে। একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে জেমি বোধহয় চিৎকার করে বলছে- এখানে আমি ম্যাগি, ডার্লিং, তুমি একটা সুন্দর শিশুসন্তান উপহার দিয়েছ। আমি একে বড্ড বেশি ভালোবাসি।
একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল ব্যাপারটা হয়ে গেছে। হ্যাঁ, একটা তীব্র আর্তনাদ। হান্না বলল– ওটা আসছে।
এক সেকেন্ড বাদে মার্গারেট বুঝতে পারল, কিছু একটা তার শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসছে।
হান্না একটা লাল কাপড় মেলে বলেছিল ক্লিপড্রিফট শহর তোমাকে স্বাগত সম্ভাষণ জানাচ্ছে। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত ছেলেই হয়েছে।
মার্গারেট আদর করে তার নাম রেখেছিল জেমি!
***
মার্গারেট জানে, এই শিশু সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর অচিরে জেমির কানে পৌঁছে যাবে। জেমি কেন আসছে না? কয়েক সপ্তাহ পার হল, মার্গারেট কোনো খবর পেল না। অবশেষে সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে একটা বার্তা পাঠাল। বাতাবাহক তিরিশ মিনিট বাদে ফিরে এল।
মার্গারেট অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল। সে বলল– ম্যাকগ্রেগরের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
-হ্যাঁ, ম্যাডাম।
খবরটা দিয়েছিলে?
–হ্যাঁ, ম্যাডাম।
–ও কী বলল?
ছেলেটা একটু বিরক্ত- উনি বললেন, ওনার কোনো ছেলে নেই মিস ভ্যানডার।
মার্গারেটের মনে হল, পৃথিবীটা একেবারে শূন্য হয়ে গেছে। কিন্তু এখন কী হবে? কিছু। তো একটা করতেই হবে।
পরের দিন সকালবেলা শ্রীমতী আওনস দরজায় ধাক্কা দিলেন। মার্গারেট দরজা খুলে দিল। মার্গারেট বেশ শান্ত মনে হচ্ছে।
ম্যাগি, তুমি ঠিক আছো?
–হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। জেমিকে একটু বাইরে নিয়ে যাব।
অ্যাওনস একটা সুন্দর ছোট্ট গাড়ি তৈরি করেছেন। এই গাড়িতে শিশুরা বেড়াতে পারে।
মার্গারেট ওই বেবি ক্যারেজটাকে ব্রুকস্ট্রিটে নিয়ে এল। কেউ কেউ ওই ছোট্ট শিশুর দিকে তাকিয়ে হাসছে। তবে শহরের মেয়েরা কিন্তু ভুলেও তাকাচ্ছে না। কেউ আবার অন্যদিক দিয়ে চলে যাচ্ছে। পাছে ওই খারাপ মেয়েটার মুখোমুখি হতে হয়।
মার্গারেট কোনো কিছুই দেখছে না। সে শুধু একজনের জন্য অপেক্ষা করে আছে। মার্গারেট ছেলেটাকে সুন্দর পোশাক পরিয়েছে। এক সপ্তাহ কেটে গেছে, না, জেমির সাথে কোথাও দেখা হচ্ছে না, মার্গারেট বুঝতে পারল, জেমি ইচ্ছে করেই তাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে।
শেষ পর্যন্ত মার্গারেট ভাবল, যদি বাবা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে না আসে, তাহলে আমি ছেলেটাকে নিয়ে বাবার কাছে যাব।
পরের দিন সকালবেলা মার্গারেট আওনসকে পার্লারে দেখতে পেল। মার্গারেট বলল আমি একটু বেরোচ্ছি। এক সপ্তাহ বাদে আসব।
-এইটুকু ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও যেও না ম্যাগি।
না, ছেলেটা এই শহরেই থাকবে।
মিসেস আওনস অবাক হয়ে গেছেন তার মানে? এখানে?
না, মিসেস আনস, এখানে, অবশ্য অন্য কোথাও!
***
জেমি ম্যাকগ্রেগর একটা সুন্দর বাড়ি তৈরি করেছে। ক্লিপড্রিফটের পাহাড়ি অঞ্চলে। বাংলো টাইপের বাড়ি। দুটো বড়ো বড়ো উইং-এ ভাগ করা আছে। বাড়ির চারপাশে সবুজ লন আছে, আছে ভারী সুন্দর গোলাপ বাগান। বাড়ির পেছন দিকে পরিচারকদের থাকার ব্যবস্থা।
মার্গারেট সেই বাড়িতে এসে উপস্থিত হল। ছোট্ট শিশুটিকে হাতে জড়িয়ে রেখেছে।
তখন সকাল দশটা। জেমি হয়তো অফিসে চলে গেছে। মিসেস ট্যালি দরজাটা খুলে দিল। সে অবাক হয়ে মার্গারেটকে এবং ওই ছোট্ট শিশুর দিকে তাকাল।
মার্গারেট কিছু বলার চেষ্টা করল। বলল- আমি দুঃখিত, মিঃ ম্যাকগ্রেগর তো এখন বাড়িতে নেই। হাউসকিপার জবাব দিল। দরজাটা বন্ধ করার চেষ্টা করল।
মার্গারেট বলল- আমি মিঃ ম্যাকগ্রেগরের সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। আমি তাকে তার ছেলে ফেরত দিতে এসেছি।
আমার ভয় হচ্ছে, এ ব্যাপারটা বোধহয় ঠিক নয়। আপনি কে?
আমি এক সপ্তাহ এখানে থাকব না। এক সপ্তাহ বাদে ফিরে আসব, কেমন?
মার্গারেট ছেলেটিকে তার হাতে তুলে দিয়ে বলল- এর নাম জেমি জুনিয়ার।
মিসেস ট্যালির মুখে আতঙ্কিত অভিব্যক্তি না-না, ওকে এখানে রেখে যাবেন না। মিঃ ম্যাকগ্রেগর জানতে পারলে রাগ করবেন।
না, তোমাকে একটা বিষয়ে ঠিক করতে হবে, হয় তুমি একে বাড়িতে নিয়ে যাও, অথবা একে আমি দরজায় গোড়ায় ফেলে রেখে চলে যাব।
মিঃ ম্যাকগ্রেগর সেটা কি ভালো চোখে দেখবেন?
আর কোনো কথা না বলে মার্গারেট শিশুটিকে ওই হাউসকিপারের কোলে ঠেলে দিয়ে অতি দ্রুত ছুটে সামনের দিকে চলে গেল।
এরকম কাজ করবেন না, মিস।
মার্গারেট পেছন দিকে তাকাল না। ট্যালি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ভাবছে, এখন কী হবে? ম্যাকগ্রেগরকে কী করে শান্ত করবে?
***
তাকে এমন অবস্থায় কখনও পড়তে হয়নি। সে ভাবল- আমি কী বোকা! দরজাটা কেন জোর করে বন্ধ করে দিলাম না।
হা, মিঃ ম্যাকগ্রেগর, আমি চেষ্টা করেছিলাম।
–ওই কুত্তিটার বাচ্চাটাকে আমি এখানে রাখতে দেব না।
রাগের চোটে ম্যাকগ্রেগর ভুল বকতে শুরু করেছে। সে হাউসকিপারের দিকে তাকাচ্ছে। আর চিৎকার করে বলছে- তোমার ফাইন হবে।
এক সপ্তাহ বাদে মেয়েটি ফিরে আসবে।
–আমি ওসব কথা জানতে চাই না। এই ছেলেটাকে চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাও।
আমি কী করব মিঃ ম্যাকগ্রেগর।
–ওকে ডাস্টবিনে ফেলে দাও। কোথাও একটা লুকিয়ে রাখতে পারবে?
–কোথায়?
—জাহান্নামে।
মিসেস ট্যালি ওই ছেলেটির দিকে তাকাল–আহা, শিশুটি কাঁদতে শুরু করেছে। মিসেস ট্যালি বলল, ক্লিপড্রিফটের কোনো অনাথ আশ্রম নেই? সে ছেলেটির গায়ে হাত রাখল। আবার চিল চিৎকার।
একে দেখাশুনা কে করবে?
জেমি হতাশ হয়ে সামনে এগিয়ে এল– আঃ, আমি আর পারছি না। সত্যি, তুমি ওর দেখাশুনা করার চেষ্টা করো, কেমন?
-হ্যাঁ, স্যার।
–আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও। ওকে আর এখানে রেখো না। ও যেন এই বাড়িতে না ঢোকে। ওর মা ফিরে এলে ওকে দিয়ে দিও। কিন্তু ওর মা যেন আমার মুখ দেখতে না পায়। কথাটা বুঝতে পারলে?
ছেলেটা চনমনে হয়ে উঠেছে।
–মিঃ ম্যাকগ্রেগর, আমি চলে যাচ্ছি।
জেমি তার ঘরে একলা বসে আছে। একটু আগে বেশ খানিকটা ব্র্যান্ডি খেয়েছে। এখন সিগারেটে টান দিচ্ছে। বোকা মেয়েটা, ভেবেছে, ওর ছোেটা ছেলেটাকে দেখে আমার হৃদয় গলে যাবে। আমি ওর কাছে গিয়ে ভুল স্বীকার করব। বলব, তোমাকে আমি ভালোবাসি, আমি তোমাকে বিয়ে করব। এসব ন্যাক-ন্যাকা কথা। না, আমি কখনও ওই শিশুর দিকে তাকাব না।
আমি প্রতিশোধ নিয়েছি, এখনও হয়তো কিছুটা বাকি আছে!
***
জেমির মনের ভেতর শূন্যতা। নতুন একটা উদ্দেশ্য সফল করতে হবে, সে ভাবল, কী উদ্দেশ্য সে জানে না। ক্লিপড্রিফটের অধিকাংশ সম্পত্তি সে দখল করে ফেলেছে। নামিব থেকে কেপটাউন পর্যন্ত অনেকটা অঞ্চলে এখন তারই একচ্ছত্র আধিপত্য। হ্যাঁ, এতে আনন্দ আছে, কিন্তু এর শেষ কোথায়? সে মা-বাবাকে এখানে ডেকে আনবে কি? কিন্তু ওরা হয়তো স্কটল্যান্ড থেকে এখানে আসবে না। ভাইবোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে। জেমি মা-বাবার। কাছে অনেক অর্থ পাঠিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, জীবনটা এখন সহজ সুন্দর শান্ত হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগে জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই ছিল। তখন জেমি বাঁচার মতো বাঁচত। এখন এত শান্ত জীবন ভালো লাগছে না।
সে আবার ব্রান্ডি ডিকানটারের কাছে গেল। দেখল, বোতলটা একেবারে খালি হয়ে গেছে। কী আশ্চর্য! মিসেস ট্যালির মাথায় কিছু নেই।
সে চিৎকার করতে থাকল।
মিসেস ট্যালি কিন্তু এখন ছেলেটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নানা ছড়া বলে ছেলেটির মন জয় করার চেষ্টা করছে। তাকে সুন্দর ছোট্ট পরী বলে ডাকা হচ্ছে।
ছেলেটি শান্ত হয়ে গেছে। জেমি মিসেস ট্যালির খোলা বেডরুমের সামনে গেল। ভেতর দিকে তাকাল। হ্যাঁ, একটা সুন্দর ছোটো খাট কিনে আনা হয়েছে। ছেলেটা সেখানে শুয়ে আছে। মিসেস ট্যালি তাকে আদর করছে।
ছোট্ট শয়তান, তুমি একদিন বড়ো হবে…
মিসেস ট্যালি অনেক কিছু বলছে।
–আঃ, মিঃ ম্যাকগ্রেগর, আপনি কখন এলেন?
ম্যাকগ্রেগর ছোটো খাটটির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল– এই শব্দে আমার তন্দ্রা ভেঙে গেল।
জেমি এই প্রথম তার সন্তানের দিকে তাকাল। হ্যাঁ, সে যা ভেবেছিল, তার থেকেও ছেলেটা আকারে বড়ো। বেশ সুগঠিত চেহারা। সে বোধহয় বাবার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
–আমি দুঃখিত মিঃ ম্যাকগ্রেগর। ছেলেটি সত্যিই সুন্দর, স্বাস্থ্যবান। দেখুন, আপনার দিকে তাকিয়ে কেমন হাসছে।
কোনো কথা না বলে জেমি ঘর থেকে বাইরে চলে গেল।
***
জেমি ম্যাকগ্রেগরের কোম্পানিতে পঞ্চাশ জন চাকরি করে। নানা কোম্পনি স্থাপন করেছে সে। সবথেকে বড়ো কোম্পানিটা হল ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড। সে ডেভিড ব্ল্যাকওয়েল নামে এক ফোরম্যানের মোলো বছরের ছেলেকে নিয়ে এসেছে। ফরগ্যান অরিগান থেকে আমেরিকান, যে দক্ষিণ আফ্রিকাতে এসেছে হিরের সন্ধানে। ব্ল্যাকওয়েলের টাকাপয়সা যখন শেষ হয়ে গেল, তখন জেমি তাকে ভাড়া করেছিল। একটা খনি দেখাশুনা করার জন্য। ছেলেটা চালাক চতুর, হ্যাঁ, এত ভালো ছেলে খুব একটা পাওয়া যায় না।
ডেভিড, তুমি কি একবার মিসেস আনস-এর বোর্ডিং হাউসে যাবে? সেখানে মার্গারেট নামে একটা মেয়ে থাকে।
ডেভিড ব্ল্যাকওয়েল ওই নামের সাথে পরিচিত কি? সে বলল- হ্যাঁ, স্যার।
তুমি শুধু মাত্র তার সঙ্গে কথা বলবে। সে তার ছোট্ট শিশুকে আমার হাউসকিপারের কাছে রেখে পালিয়ে গেছে। তাকে বলল, সে যেন আজই এসে ছেলেটাকে নিয়ে যায়।
-হ্যাঁ, মিঃ ম্যাকগ্রেগর।
আধঘণ্টা কেটে গেছে। ডেভিড ব্ল্যাকওয়েল ফিরে এল। জেমি তার দিকে তাকাল।
সে বলল- স্যার, আমি আপনার মনের মতো কাজটা করতে পারিনি।
–কেন? এ তো সহজ কাজ।
মিস ভ্যানডার ওখানে নেই।
–ওকে বার করতে হবে।
–তিনি ক্লিপড্রিফট ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছেন। পাঁচদিন বাদে ফিরে আসবেন। আর কিছু?
–না, জেমি বলল, ঠিক আছে, তুমি ভালো কাজ করেছ ডেভিড।
ওই মেয়েটির মাথায় বাজ পড়ুক, ফিরে আসার পর কী হবে? হঠাৎ চলে আসবে। ছেলেটাকে ফেরত নিয়ে যাবে তো?
***
সেদিন সন্ধ্যেবেলা জেমি একা একা খাবার খাচ্ছিল। ব্র্যান্ডি শেষ হয়ে গেছে। এবার কী খাওয়া যায়?
হাউসকিপার এসে বলল- ক্ষমা করবেন মিঃ ম্যাকগ্রেগর, জেমি জুনিয়ার কাঁদছে।
সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
জেমি তার ব্রান্ডি বোতলের দিকে তাকাল-হা, একেবারে শেষ হয়ে গেছে। ছেলেটা দেখছি, আমার মাথা না খেয়ে ছাড়বে না।
দশ মিনিট কেটে গেছে। মিসেস ট্যালি বলল- আমি কি আর একটু ব্র্যান্ডি দেব?
–আর দরকার নেই, কী কাজের জন্য তোমাকে রাখা হয়েছে, তা কী ভুলে গেছো? ওই ছেলেটাকে কবে তাড়াবে?
–আমি চেষ্টা করছি, স্যার।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাড়াবার চেষ্টা করো। তা না হলে অবস্থা খারাপ হবে। তুমি কি বুঝতে পারছ?
-হ্যাঁ, স্যার। আর কিছু?
না।
চলে যাবার জন্য মিসেস ট্যালি পা বাড়াল।
মিসেস ট্যালি?
–ইয়েস, ম্যাকগ্রেগর?
–সত্যি ছেলেটা কাঁদছে? ওর কি শরীর খারাপ হয়েছে?
না, স্যার। একটু ঠাণ্ডা লেগেছে। বায়ু পরিবর্তন করতে হবে।
জেমি বলল- হ্যাঁ, একটা বুদ্ধি মাথায় এসেছে।
জেমি ভাবল, অন্য কোথাও গেলে কেমন হয়? সে ভাবল, চাকরদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবে। কিন্তু কার কাছে গেলে বুদ্ধি পরামর্শ পাওয়া যাবে?
***
পরের দিন সন্ধ্যেবেলা জেমি একটা কাজে খুব ব্যস্ত ছিল। সে একটা নতুন কোম্পানিতে বেশ কিছু টাকা ঢালতে চলেছে। কোম্পানিটা ছোটো, কিন্তু একসময় বড়ো হয়ে উঠবে, নামিব ডেজার্ট পর্যন্ত রেলপথ চলে যাবে। কেপটাউন-কিম্বারলি লাইন পাতার পরিকল্পনা চলেছে। তখন আরও সহজে হীরে নিয়ে আসা যাবে। সোনাগুলোকেও বন্দরে আনা যাবে।
১৮৬০ সালে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকা রেলপথ খুলে দেওয়া হয়েছে তো৷ কেপটাউন থেকে ওয়েলিংটন। এখন অন্যান্য জায়গাতেও রেলপথ পাতার কাজ অত্যন্ত দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এভাবেই তার পরিকল্পনা সফল হবে, জেমি ভাবল, হ্যাঁ, বেশ কয়েকটা জাহাজ কিনতে হবে। আমার নিজস্ব জাহাজ অসংখ্য ধনরত্ন নিয়ে মহাসমুদ্রে ভেসে বেড়াবে।
সে আটটি বাড়ি করেছে, পোশাক পাল্টেছে, বিছানায় শুয়েছে। হ্যাঁ, লন্ডন থেকে সুন্দর সাজসজ্জা আনিয়েছে। সাজিয়েছে। এককোণে আছে স্পেন দেশীয় মস্ত বড়ো ক্যাবিনেট। দুটো বড়ো বড়ো ওয়াড্রোব আছে। সেখানে পঞ্চাশ জোড়া সুট এবং তিরিশ জোড়া জুতো থাকতে পারে। জেমি জামাকাপড়ের ব্যাপারে খুব একটা নজর দেয় না। কিন্তু সেগুলো ওখানে থাকা দরকার। সে অনেক সময় কম্বল পরে সময় কাটিয়ে দেয়।
হ্যাঁ, একটা কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। জেমি উঠে বসল এবং শান্তভাবে ভাবার চেষ্টা করল, ছেলেটা কি কাঁদছে? তার মানে? ছোট্ট খাট থেকে পড়ে গেছে নাকি? জেমি জানে, মিসেস ট্যালি ঘুমোলে আর জ্ঞান থাকে না। হ্যাঁ, যদি ছেলেটার কিছু হয়ে যায়? আমার বাড়িতে? না, তাহলে আমাকেই সবাই দায়বদ্ধ করবে।
মেয়েটার নিকুচি করেছে। আমি উঠব।
সে স্লিপার পরে এগিয়ে গেল। মিসেস ট্যালির ঘরের দরজা বন্ধ। একটু চিন্তা করে দরজাটা খুলে দিল। মিসেস ট্যালি গভীর ঘুমে অচেতন। হ্যাঁ, নাক ডাকছে। জেমি ছোট্ট খাটটার দিকে এগিয়ে গেল। ছেলেটা ঘুমোচ্ছে। না, ওই তো জেগে আছে। চোখ দুটো একদম খোলা, জেমি তার দিকে তাকাল। হ্যাঁ, একই রকম দেখতে। হায় ঈশ্বর, আমার মতোই মুখ আর চিবুক পেয়েছে। চোখ দুটো এখন নীল, সব শিশুরাই বোধহয় এইভাবে নীল চোখ নিয়ে জন্মায়। হ্যাঁ, পরবর্তীকালে এই চোখ ধূসর হয়ে উঠবে। ছেলেটা ছোট্ট দুটো হাত বাড়িয়ে সামনে ডাকার চেষ্টা করছে। মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত কু-কু শব্দ করছে। হা, সাহসী ছেলে, জেমি ভাবল, এখানে শুয়ে আছে, কোনো শব্দ করছে না। অন্য ছেলেরা যেমন চিল চিৎকার করে। তাও করছে না।
সে নীচু হল। হ্যাঁ, এর সাথে ম্যাকগ্রেগরের অনেক সাদৃশ্য আছে, তা মানতেই হবে।
জেমি একটা আঙুল বাড়িয়ে দিল। ছেলেটা আঙুলটা ধরার চেষ্টা করল। শেষ পর্যন্ত ধরে ফেলল, হ্যাঁ, ষাঁড়ের মতো শক্তিশালী, জেমি ভাবল, সেই মুহূর্তে তার মনে হল, এই ছেলেটার গা থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ বেরিয়ে আসছে।
মিসেস ট্যালি?
সে উঠে দাঁড়াল। বলল- কী হয়েছে স্যার?
–ছেলেটাকে ভালো করে দেখাশুনা করতে হবে। আমি কি ভাসব নাকি?
জেমি ম্যাকগ্রেগর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
***
ডেভিড, শিশুদের সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?
–কোন বিষয়ে স্যার?
–তুমি কি জানো, তারা কী খেলতে ভালোবাসে?
ওই আমেরিকান বলল, তারা ছোটো ছোটো খেলনা খেলতে ভালোবাসে, মিঃ ম্যাকগ্রেগর।
অনেকগুলো খেলনা কিনে আনবে, কেমন?
জেমি কথা আর বাড়াল না। ডেভিড ব্ল্যাকওয়েল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
***
সেই দিন বিকেলবেলা জেমি একটা ছোট্ট বাদামী রঙের প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকল।
মিসেস ট্যালি বলল- গতরাতের ঘটনার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন, স্যার। আমি জানতাম না, এতটা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ থেকে আর তেমন কিছু ঘটবে না। ও এত চিৎকার করেছে যে, আপনার ঘুম ভেঙে গেছে।
না, ও মনে হয় চিৎকার করেনি। জেমি বলল, আমি এমনি উঠে এসেছি। সে প্যাকেটটা তুলে দিয়ে বলল, ছেলেটাকে এই খেলনাটা দিও।
–আমি নিশ্চয়ই দেব।
–ওকে কেন বাইরে নিয়ে যাও না? বাগানে তো নিয়ে যেতে পারো?
–হ্যাঁ, তাই করব।
–শরীর খারাপ হলে বলবে কিন্তু।
–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলব।
স্যার, আমি কি ওঁকে এখানে নিয়ে আসব?-
-হ্যাঁ, এখানে নিয়ে এসো।
কিছুক্ষণ বাদে জেমি জুনিয়ারকে নিয়ে আসা হল। ছেলেটা মহা আনন্দে খেলতে শুরু করেছে।
–ওকে আমার কোলে দাও। শান্তভাবে মিসেস ট্যালি ছেলেটাকে জেমির কোলে বসিয়ে দিল। জেমি এই প্রথম নিজের ছেলেকে কোলে বসাল। হ্যাঁ, তার সমস্ত শরীরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি। মনে হচ্ছে, সে যেন দূর শৈশবে হারিয়ে গেছে। এ হল তার সন্তান। জেমি ম্যাকগ্রেগর জুনিয়ার। হ্যাঁ, আমার সবকিছু এ পেয়েছে। কিন্তু একে আমি কী করব?
মিসেস ট্যালি, ওর খাটটা আমার ঘরে নিয়ে এসো।
***
সাতদিন কেটে গেছে। মার্গারেটকে দেখা গেল।
মিসেস ট্যালি বলল- মিঃ ম্যাকগ্রেগর এখন অফিসে আছেন, মিস ভ্যানডার। তিনি আমাকে বলেছেন, ওই ছেলেটাকে আপনার হাতে তুলে দিতে। কিন্তু তার আগে উনি আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।
মার্গারেট লিভিংরুমে বসে অপেক্ষা করছে। ছোট্ট জেমিকে কোলে বসিয়ে রেখেছে। আঃ কতদিন এই ছেলেটার সঙ্গে দেখা হয়নি। একটা একটা করে সাতটা দিন কেটে গেছে। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত জেমি লিভিংরুমে ঢুকে পড়ল। মার্গারেটের মনে আবার আবেগ আমি এখনও কেন ওকে এত ভালোবাসি?
হ্যালো ম্যাগি?
-হ্যালো জেমি?
আমি আমার সন্তান চাইছি।
মার্গারেটের মনে আনন্দ- হ্যাঁ, এ তো তোমারই সন্তান জেমি, আমি তাতে আপত্তি করব না।
-হ্যাঁ, ওকে ঠিক মতো বড় করে তুলতে হবে। আমার কাছে রাখো। আমি সবরকম সুযোগ করে দেব। তুমি সেভাবে ওকে মানুষ করতে পারবে কি?
মার্গারেট বুঝতে পারল না, সে বলল- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমাকে আমার ছেলে ফেরত দাও।
–আমি জানি না। তুমি আর আমি…
–না, ও শুধু আমার ছেলে।
মার্গারেট ভীষণ রেগে গেছে– অসম্ভব, আমি কিছুতেই ওকে ছাড়ব না।
জেমি এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল, তারপর বলল- এসো, আমরা একটা আপোস করি। তুমি জেমিকে নিয়ে এখানে থাকতে পারবে। তুমি তার গভর্নের্স হবে।
জেমি মার্গারেটের মুখের দিকে তাকাল।
-তুমি কী চাইছ?
–আমি চাইছি, ও ওর বাবার পরিচয়ে পরিচিত হোক।
–ঠিক আছে, আমি ওকে দত্তক নেব।
মার্গারেট রাগত চোখে তাকাল আমার ছেলেকে দত্তক নেবে? না, তুমি আমার ছেলেকে স্পর্শ করতে পারবে না। তোমার অনেক টাকা আছে, প্রতিপত্তি আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তোমার কিছুই নেই। তোমাকে দেখে আমার করুণা করতে ইচ্ছে হয়।
জেমি দাঁড়িয়ে থাকল। মার্গারেট ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরেছে।
পরের দিন সকালবেলা মার্গারেট ভাবল, এবার আমি আমেরিকাতে চলে যাব।
***
মিসেস আওনস কথা বলার চেষ্টা করলেন। এভাবে সমস্যার সমাধান হয় না।
-আমাকে যেতেই হবে। সেখানে গিয়ে আমি আমার ছোট্ট শিশুসন্তানকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করব।
না, সে আর কিছুতেই জেমি ম্যাকগ্রেগরের অপমান সহ্য করবে না।
-কখন তুমি যাবে?
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমরা ট্রেন ধরে পোর্টসিস্টারে যাব, সেখান থেকে কেপটাউন। তারপর নিউইয়র্ক।
অনেক সময় লাগবে।
***
–তাতে কী হয়েছে? আমেরিকাতে গেলে আমি কিছু করতে পারব।
জেমি নিজেকে শান্ত স্বভাবের মানুষ বলে মনে করে। সবকিছু সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। অফিসটা আরও সুন্দর হয়েছে। সব তার হাতের মুঠোবন্দী, কিন্তু মার্গারেট? এটা এক জীবন্ত রহস্য। ছেলেটা কোথায় গেল? শেষ পর্যন্ত ডেভিড ব্ল্যাকওয়েলকে সে বলল তোমাকে একটা দরকারী কাজ দেব, করতে পারবে তো?
–হ্যাঁ, স্যার।
–তুমি মিস ভ্যানডারের সঙ্গে কথা বলবে। বলবে, আমি তাকে কুড়ি হাজার পাউন্ড দেব, সে যেন তার বিনিময়ে একটা জিনিস আমার হাতে তুলে দেয়।
জেমি একটা চেক লিখল। বলল- এটা ওকে দাও।
যাচ্ছি, স্যার।
পনেরো মিনিট বাদে ডেভিড ফিরে এল। চেকটা জেমি ম্যাকগ্রেগরের হাতে তুলে দিল। সেটা অর্ধেক ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। জেমি বুঝতে পারল, কী ঘটেছে। অপমানে তার মুখ লাল হয়েছে।
-তোমাকে ধন্যবাদ, ডেভিড। তোমার কাজ তুমি ঠিক করেছ।
তার মানে মার্গারেট আমার কথা শুনতে রাজী নয়। ঠিক আছে, এবার ওকে আমি শাস্তি দেব।
ব্যাপারটা আমি নিজেই পরিচালনা করব।
বিকেলবেলা জেমি ম্যাকগ্রেগর মিসেস আওনস-এর বোর্ডিং হাউসে গিয়ে উপস্থিত হল।
–এখনই মিস ভ্যানডারকে নিয়ে এসো।
–তা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। সে আমেরিকাতে চলে গেছে।
জেমির মনে হল, তার সমস্ত শরীরে ব্যথা– তা হতে পারে না। কখন সে গেছে?
–সে তার ছেলেকে নিয়ে আজ দুপুরবেলা ওডসিস্টারে চলে গেছে।
*
ওডসিস্টার স্টেশন, ভীষণ ভিড় হয়েছে। অসংখ্য মানুষের জমায়েত। চিৎকার শোনা যাচ্ছে। হ্যাঁ, নাবিকরা, তাদের বউ, বিক্রয় প্রতিনিধি, হিরের সন্ধানী, সাধারণ মানুষ, তাদের সকলেই। এই প্রথম ট্রেনে আসছে হয়তো। একটা উৎসব মুখর পরিবেশ। মার্গারেট কোনরকমে একটা ছোেট্ট বসার জায়গা পেয়েছে জানালার ধারে। জুনিয়ার জেমির যাতে অসুবিধা না হয় সেদিকে তার সতর্ক দৃষ্টি।
প্রতি মুহূর্তেই সে ভারছে, এই ছেলেটা বোধহয় কারও পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে যাবে।
কনডাক্টর বলল- এবার যাত্রা শুরু হবে।
মার্গারেট তাকাল– এ কী? জেমি দাঁড়িয়ে আছে।
জেমি বলল- তোমার জিনিসপত্র নিয়ে এক্ষুনি নেমে এসো।
ও আমাকে কিনবে? মার্গারেট বলল তুমি আমাকে কত দেবে?
জেমি তার ছেলের দিকে তাকাল, আহা, ছেলেটি মার্গারেটের কোলে ঘুমিয়ে আছে আমি বিয়ের বদলে তোমাকে কিনতে চাইছি।
.
০৯.
তিনদিন বাদে তারা একটা সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হল। এটা একান্ত ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান। ডেভিড ব্ল্যাঙ্কওয়েল ছাড়া আর কেউ সাক্ষী ছিল না।
বিয়ের অনুষ্ঠানে জেমি ম্যাকগ্রেগরের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সে নিজের রাগ এবং আবেগকে সুনিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। সে শান্ত স্বভাবের মানুষ। মাঝে মধ্যে মার্গারেটের দিকে তাকাল। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আহা, অসাধারণ সুন্দরী, মনে পড়ল সেই কামনাদগ্ধ প্রহরগুলির কথা। এটা একটা স্মৃতির উদ্বাটন ছাড়া আর কিছুই নয়। হ্যাঁ, মুহূর্তের বশে এ ঘটনা ঘটে গেছে। সে মার্গারেটকে ব্যবহার করেছে, প্রতিশোধের অন্যতম উপায় হিসেবে। এইভাবেই মার্গারেটের গর্ভে তার সন্তান এসেছে, তার সার্থক উত্তরাধিকারী হয়ে।
যাজক বললেন আমি তোমাদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করছি। তুমি এখন তোমার বউকে চুম্বন দাও।
জেমি উঠে গেল, মার্গারেটের চিবুকে চুমুর চিহ্ন এঁকে দিল।
জেমি বলল চলো, আমরা বাড়িতে যাব। ছেলেটা অপেক্ষা করছে।
তারা বাড়িতে ফিরে এল। জেমি মার্গারেটকে একটা বেডরুম দেখাল।
-এটা তোমার শোবার ঘর।
–ঠিক আছে।
-আমি আর একজন হাউসকিপার রাখছি, মিসেস ট্যালি জেমি জুনিয়ারের দায়িত্ব নেবে। কোনো কিছু দরকার হলে ডেভিডকে বলল, কেমন?
মার্গারেটের মনে হল, তাকে বারবার অপমানিত হতে হচ্ছে। হা, ও আমাকে ক্রীতদাসীর মতো ব্যবহার করছে। কিন্তু এটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নয়। শেষ অব্দি আমার সন্তানকে জারজ হিসেবে বেঁচে থাকতে হবে না, সে একটা পিতৃ পরিচয় পেল।
সেই ডিনারের আসরে জেমি ছিল না। মার্গারেট অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে। তারপর একা একা খেয়ে নিল। সমস্ত রাত সে জেগেছিল। বাড়িতে নানা ধরনের শব্দ হচ্ছে। ভোর চারটে, সে ঘুমিয়ে পড়ল। সে ভাবল, এখন আমার স্বামী মিসেস অ্যাগনেসের ঘরে কোনো বারাঙ্গনার সাথে সঙ্গমরত?
***
মার্গারেটের সম্পর্কটা এখন কেমন হয়ে গেছে। বিয়ের পরও কোনো পরিবর্তন হয়নি। ক্লিপড্রিফটের মানুষজন এই রূপান্তরে অবাক হয়ে গেছেন। মার্গারেট এখন এক গুরুত্বপূর্ণ মহিলা। তাকে আর নীচুস্তরের মেয়ে বলা যাবে না। এই শহরের সকলেই অর্থনৈতিক দিক থেকে জেমি ম্যাকগ্রেগরের ওপর নির্ভরশীল। তার কোম্পানিও অনেকের অন্নবস্ত্রের সংস্থান করছে। তাই মার্গারেটকে বুঝে সমঝে চলতে হবে। মার্গারেট মাঝে মধ্যেই জেমি জুনিয়ারকে নিয়ে বাইরে বেরোয়। সকলের সাথে সে কথা বলার চেষ্টা করে। হা; বাতাবরণ পালটে গেছে। অনেক জায়গাতে তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়। তাকে খুশি রাখার চেষ্টা করা হয়। কখনও চায়ের আসর, কখনও দাঁতব্যসভা, কখনও নৈশভোজ। কখনও কোনো কমিটির সদস্য হবার আমন্ত্রণ। হ্যাঁ, সে নানাভাবে নিজেকে সজ্জিত করে। এই শহরের অনেকে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। যখন সে নতুন হলুদ পোশাক কেনে, হলুদ পোশাক সহসা জনপ্রিয় হয়ে যায়।
***
জেমি মাঝে মধ্যেই তার ছেলের সাথে সময় কাটায়। মার্গারেটের প্রতি তার আচরণ আগের মতোই রয়ে গেছে। দূরবর্তী এবং শান্ত। প্রত্যেক সকালবেলা ব্রেকফাস্টের আসরে মার্গারেট সুখী স্ত্রীর ভূমিকা পালন করে। হ্যাঁ, চাকরদের সুবিধার্থে। তা না হলে তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করতো। জেমি চলে যাবার পর মার্গারেট ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তার সমস্ত শরীরে ঘাম জমেছে। নিজেকে ঘেন্না করতে ইচ্ছে হয়। এই কি আমার অহংকার? মার্গারেট জানে, সে এখনও জেমিকে ভালোবাসে। চিরকাল আমি ওকে ভালবাসবো। ভগবান, তুমি আমাকে সহায়তা করো।
***
জেমি কেপটাউনে গেছে। তিনদিনের ব্যবসায়িক কাজে। যখন সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল, একজন কালো ড্রাইভার বলল- গাড়ি লাগবে স্যার?
-না, আমি হাঁটব।
–বান্দা বলেছে, আপনি যেন গাড়িতে ওঠেন।
জেমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল–বান্দা!
–হা, মি. ম্যাকগ্রেগর।
জেমি গাড়িতে বসল। ড্রাইভার ঘোড়ার ওপর চাবুক চালিয়ে দিয়েছে। ঘোড়া চলতে শুরু করেছে। জেমি বান্দার কথা ভাবছে। বান্দার সাহস এবং বন্ধুত্ব। হ্যাঁ, গত দুবছর ধরে জেমি অনেক খুঁজেছে, কিন্তু পায়নি। এবার বোধহয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে।
গাড়িটা জলের ধার দিয়ে এগিয়ে চলেছে। জেমির মনে পড়ল, কত ঘটনা।
পনেরো মিনিট কেটে গেছে। গাড়িটা একটা পরিত্যক্ত ওয়্যার হাউসের সামনে থামল, একদা এখানে জেমি এবং বান্দা বসে বসে নামিব অভিযানের কথা ভেবেছিল। হ্যাঁ, আমরা কেমন বেহিসেবী যুবক ছিলাম, জেমি ভাবল। এখন সব কিছু পালটে গেছে। জেমি গাড়ি থেকে নেমে ওয়্যারহাউসের দিকে চলে গেল। বান্দা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। একই রকম দেখতে। কিন্তু সে এখন সুন্দর পোশাক পরেছে। শার্ট পরেছে, টাই বেঁধেছে।
তারা পরস্পরের দিকে তাকাল। তারা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরল।
জেমি বলল–তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, হাতে অনেক পয়সা এসেছে।
বান্দা মাথা নাড়ল–হ্যাঁ, খুব একটা খারাপ নয়। ফার্মটা আমি কিনে ফেলেছি। বউ আছে, দুটো ছেলে। আমি ওখানে গম উৎপাদন করি। আর উটপাখি।
উটপাখি?
–হ্যাঁ, উটপাখির পালক থেকে অনেক অর্থ আসে।
–তোমার পরিবারের সাথে দেখা করাবে না বান্দা?
জেমি তার নিজস্ব পরিবারের কথা ভাবল তারা কত দূরে? স্কটল্যান্ডে আছে। প্রতি মুহূর্তে ওদের কথা মনে পড়ে। চার বছর ধরে সে বাড়ি ছাড়া।
-তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি।
-আমিও ব্যস্ত ছিলাম। বান্দা কাছে এসে বলল–তোমাকে একটা ব্যাপারে সতর্ক করতে এলাম। সমস্যা দেখা দিয়েছে।
জেমি বলল–কী ধরনের সমস্যা?
-নামিব হিরকখনিতে যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার নাম হানস জিমারম্যান। লোকটা মোটেও ভালো নয়। সমস্ত শ্রমিকরা ওকে ঘেন্না করে। তারা লোকটার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চলেছে। যদি এই ঘটনা ঘটে তাহলে কী হবে? তাহলে তোমার রক্ষীরা হয়তো বাধা দেবার চেষ্টা করবে। দাঙ্গা বেধে যাবে।
জেমি বান্দার মুখের দিকে তাকাল।
–একবার একটা লোকের কথা তোমায় বলেছিলাম, মনে আছে তোমার? জন টেঙ্গো?
–হ্যাঁ, উনি একজন রাজনীতিক নেতা। ওনার সম্পর্কে কিছু প্রবন্ধ আমি পড়েছিলাম।
–উনি কিন্তু হানসের এক অনুগামী।
জেমি মাথা নাড়ল–কী করা যায় ভাবতে হবে।
-হ্যাঁ, তুমি তো এখন এক শক্তিশালী মানুষ হয়ে উঠেছ জেমি, এই ব্যাপারটা ভাবতে আমার ভালো লাগে।
-তোমাকে ধন্যবাদ, বান্দা।
-তোমার একটা সুন্দর ছেলে হয়েছে নাকি।
জেমি তার বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না–তুমি কী করে জানলে?
-আমি তো পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখি। আমাকে এখন যেতে হবে জেমি, নামিবের ব্যাপারে নজর দিও।
-হ্যাঁ, দেখব, কখন আবার দেখা হবে?
–আমি কাছাকাছি থাকব। তুমি আমার হাত থেকে এত সহজে নিস্তার পাবে না।
এক মুখ হাসি হেসে বান্দা চলে গেল।
***
জেমি ক্লিপট্ৰিফটে ফিরে এল। ডেভিড ব্ল্যাকওয়েলকে পাঠাল ওখানকার সমস্যা সমাধান করতে।
সুপারভাইজারের নামও বলে দেওয়া হল, যদি সুপারভাইজার শ্রমিকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে তাহলে তাকে সরিয়ে দিতে হবে।
পরের দিন সকালবেলা ব্ল্যাকওয়েল চলল হিরকখনির দিকে।
***
ডেভিড নামিবের হিরকখনিতে অবতরণ করল। দু ঘণ্টা সে সেখানে অতিবাহিত করল। শান্তভাবে প্রহরী এবং শ্রমিকদের সাথে কথা বলল। বুঝতে পারল, এখানে একটা চাপা উত্তেজনা আছে। এই উত্তেজনার কারণ হানস জিমারম্যান।
হানস মস্ত বড়ো চেহারার এক ভদ্রলোক। তিনশো পাউন্ড ওজন, ছ ফুট ছ ইঞ্চি লম্বা। মুখখানা পোরসিলিন দিয়ে তৈরি বলে মনে হয়। লাল আপেলের মতো চোখ দুটো। ডেভিড এ ধরনের অনাকর্ষক মানুষকে খুব একটা দেখেনি। হ্যাঁ, ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেডের অন্যতম সেরা সুপারভাইজার, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সে তার ছোট্ট অফিসে বসেছিল। ডেভিড ঢুকে পড়ল।
জিমারম্যান উঠে ডেভিডের হাতে হাত দিয়ে বলল–মি. ব্ল্যাকওয়েল, তুমি যে আসবে আমাকে বলোনি কেন?
ডেভিড জানে, তার আগমনের সংবাদ ইতিমধ্যে জিমারম্যানের কানে পৌঁছে গেছে।
— হুইস্কি চলবে?
–ধন্যবাদ।
জিমারম্যান আবার চেয়ারে বসে পড়ল কী করতে পারি বলো? এখানে কি খুব বেশি হিরে পাওয়া যাচ্ছে না? বস কি খুশি হচ্ছে না?
কিন্তু সকলেই জানে, নামিবের হিরে উত্তোলনের ব্যাপারটা দারুণ।
জিমারম্যান আবার বলতে থাকল আর কিছু নতুন করে করতে হবে কি?
-এখানকার অবস্থা সম্পর্কে কিছু অভিযোগ শুনতে পাচ্ছি।
জিমারম্যানের মুখ থেকে হাসির রেখা মিলিয়ে গেল–কী অভিযোগ?
-শ্রমিকদের ওপর নাকি অকথ্য অত্যাচার করা হচ্ছে।
এই কথা শুনে জিমারম্যান উঠে দাঁড়াল। সে তার উত্তেজনা আর দমন করতে পারছে না। মুখ রাগে থমথম করছে।
-না, এদের শ্রমিক বলে ভালোবেসো না। ওরা হল বুনো জন্তু জানোয়ারের দল। তোমরা হেডকোয়াটার বসে বসে কী ভাবোবা বলো তো? কাজ তো আমাকেই করতে হয়।
-আমার কথা শোনো, ডেভিড বলতে চেষ্টা করল।
-তুমি আমার কথা শুনবে, আমি সব থেকে বেশি হিরে তোমাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। আর তোমরা ওই শ্রমিকদের কী দিচ্ছ? কীভাবে আমি কাজ করি, তা কি তোমরা জানো?
অন্য খনিগুলোর কথা বলব কি? সেখানে আমরা প্রতি মাসে উনষাট শিলিং করে দিয়ে থাকি, আর এখানে কী দেওয়া হয়? মাসে মাত্র পঞ্চাশ শিলিং।
হ্যাঁ, তাহলে আমি কী করতে পারি? তোমরা তো শুধু পয়সা গুনছ।
-জেমি ম্যাকগ্রেগর এই ব্যাপারে রাজি হচ্ছেন না। যে করেই হোক বেতনটা বাড়াতে হবে।
জিমারম্যান শান্তভাবে বলল–বসের টাকা, আমি কী বা বলব?
–আমি শুনেছি, কাজ করতে না পারলে নাকি চাবুক মারা হয়?
জিমারম্যান নাকে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করে বলল–তুমি একথা কোথা থেকে শুনলে? হ্যাঁ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা করতে হয় বৈকি?
-না, এটা করা উচিত নয়, তাহলে তো তোমাকেই শ্রমিকদের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হবে।
জিমারম্যান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল–আমি ব্যাপারটা ভেবে দেখব।
ডেভিড ভাবল –লোকটা একটা কুকুরের বাচ্চা। ভয়ঙ্কর। সে ওই বিরাট চেহারার সুপারভাইজারের দিকে তাকাল–যদি আর কোনো সমস্যা হয়, তাহলে তোমাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। মানুষের সাথে মানুষের মতো ব্যবহার করার চেষ্টা করো। আর যেন অত্যাচার করা হয়।
জিমারম্যান তাকাল ডেভিডের দিকে। তার রাগ সংবরণ করে বলল–আর কিছু?
-তিন মাস বাদে আমি আবার ফিরে আসব। আমার মনে হয়, তুমি অন্য কোন কোম্পানিতে চাকরি দেখে নাও।
ডেভিড বেরিয়ে গেল। হানস অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। রাগে থরথর করে কাঁপছে। এখন সে কী করবে? সে জাতে বুয়ের, তার বাবাও তাই ছিল। এই জায়গাটা তাদের, আর ঈশ্বর তাকে পাঠিয়েছে ওদের সেবা করার জন্য। মানুষের মতো ব্যবহার, না, ভাবাই যাচ্ছে না। সে তো ওই লোকগুলোর গায়ের রং আর কালো করে দেয়নি। জেমি ম্যাকগ্রেগর এই অবস্থাটা বুঝতে পারছেন না কেন? না, কেউ যদি কালো কুত্তাদের ভালোবাসে, আমি কী করব? হানস জিমারম্যান বুঝতে পারল, ভবিষ্যতে তাকে আর একটু সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু নামিবের দায়িত্ব সে অন্য কারও হাতে তুলে দেবে না।
***
ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড ক্রমশ বেড়ে উঠছে। জেমি ম্যাকগ্রেগর এখন আরও ভালো কাজ করছে। সে কানাডাতে একটা পেপার মিল কিনে নিল। অস্ট্রেলিয়াতে কিনল একটা জাহাজ কারখানা। বাড়িতে থাকার সময় জেমি তার ছেলের সাথে সবটা সময় কাটায়। ছেলেটা বাবার মতো হয়ে উঠছে। জেমি মনে মনে খুব অহঙ্কার বোধ করে। সে ছেলেটাকে তার সাথে লম্বা ভ্রমণে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু মার্গারেট যেতে দিতে চায় না।
সে এখন খুবই ছোটো, আর একটু বড়ো হলে-যাবে। আর তুমি তখন রাগ করতে পারবে না।
জেমি ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। এর আগেই তার ছেলের প্রথম জন্মদিন পালিত হল। তারপর দ্বিতীয়। জেমি অবাক হয়ে গেল। সময় কী দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
১৮৮৭-মার্গারেটের কাছে গত দু বছর কোনোরকমে কেটে গেছে। প্রত্যেক সপ্তাহে একবার জেমি তার বন্ধু-বান্ধবদের আমন্ত্রণ করে। মার্গারেটকে তখন সুখী গৃহকত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়। অন্য লোকেরা তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। তার সঙ্গে কথা বলে। তারা খুবই আমোদ পায়। মার্গারেট জানে, কয়েকজন খুবই সুন্দর চেহারার, কিন্তু তাদেরকে ভালোবেসে কী লাভ? সে তো জেমি ম্যাকগ্রেগরের বিবাহিতা স্ত্রী।
শেষ অতিথি চলে যাবার পর মার্গারেট জিজ্ঞাসা করল-সন্ধ্যেটা কি ভালো কেটেছে?
জেমি উত্তর দিল–হ্যাঁ, শুভরাত্রি।
ছোট্ট জেমিকে তার কোলে নিল। কয়েক মিনিট কেটে গেছে। মার্গারেট শুনতে পেল, জেমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
রাতের পর রাত মার্গারেট ম্যাকগ্রেগর তার বিছানাতে শুয়ে থাকে এবং ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবে। সে জানে, এই শহরের সবাই তাকে কত ঈর্ষা করে। এই ব্যাপারটা তার মোটেই ভালো লাগে না। তার কাছে ঈর্ষা করার মতো কী আছে? সে একটা বন্দীশালায় জীবন যাপন করে। স্বামী তাকে মোটেই ভালোবাসে না। এটা বোধহয় একটা চুক্তি, না, এই জীবন সে কতদিন রাখবে? মাঝে মধ্যে সে একটা অদ্ভুত কষ্টকল্পনা জগতের বাসিন্দা হয়ে যায়। হো হো করে হেসে ওঠে। হাসিটা দূর থেকে আরও দূরে চলে যায়। হাসি শেষ পর্যন্ত কান্নাতে পরিণত হয়। আমি জানি না, সে কেন আমাকে ভালোবাসছে না।
***
১৮৯০- ক্লিপড্রিফট আরও বড়ো শহর হয়ে উঠছে। জেমি ভাবতেই পারেনি। গত সাত বছর ধরে সে এখানকার বাসিন্দা। এখন এটাকে একটা প্রাণসম্পন্ন শহর বলা যায়। আরও অনেক হিরক সন্ধানীরা পৃথিবীর নানা অংশ থেকে এখানে আসছে। সেই একই গল্প। তারা কোচ কিংবা ওয়াগনে আসে। কেউ আসে পায়ে হেঁটে। তাদের হাতে কিছুই থাকে না। শুধু পরনে একটুকরো কম্বল। খাবারের দরকার হয়। মাথার ওপর ছাদ এবং কিছু টাকা। জেমি একই ভাবে সবকিছু দিয়ে দেয়। সে এখন অনেকগুলো হিরে আর সোনার খনির মালিক। তার নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
একদিন সকালে অ্যাটর্নি ডে পিয়ারসের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ভদ্রলোক কিম্বারবলিতে বিরাট হিরক খনি চালিয়ে থাকেন।
জেমি জানতে চাইল- স্যার, আপনার জন্য কী করব।
-আমাকে একটা প্রস্তাব দিয়ে পাঠানো হয়েছে মি. ম্যাকগ্রেগর। ডে পিয়ারস আপনার সবকিছু কিনতে চাইছে। কত লাগবে বলুন?
একটা অদ্ভুত প্রস্তাব। জেমি দাঁত কিড়মিড় করে বলল –আপনি এখুনি এখান থেকে বেরিয়ে যান।
***
ডেভিড ব্ল্যাকওয়েল জেমির কাছে ক্রমশ আরও অপরিহার্য হয়ে উঠছে। ওই অল্পবয়সী আমেরিকান যথেষ্ট শক্তিশালী এবং অনুসন্ধানী। হ্যাঁ, এর মধ্যে সততা আছে, আছে বুদ্ধির দীপ্তি এবং আনুগত্য। জেমি ডেভিডকে তার সেক্রেটারির পদে বরণ করেছে। পরবর্তী কালে ডেভিড হল তার আত্মসহায়ক এবং শেষ পর্যন্ত ছেলেটার বয়স হল একুশ, তখন জেনারেল ম্যানেজার।
ডেভিড ব্ল্যাকওয়েলের কাছে জেমি বোধহয় বাবার মতো। ডেভিডের বাবার হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়। জেমি তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছিল এবং ডাক্তারের খরচ চালিয়েছিল। শুধু তাই নয়। মৃত্যুর পর সমস্ত খরচ জেমি ম্যাকগ্রেগর বহন করেছে। বিগত পাঁচ বছর ধরে ডেভিড ক্রুগার ব্রেন্টের হয়ে কাজ করছে। সে জেমিকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। শুধু তাই নয়, জেমি আর মার্গারেটের মধ্যে যে একটা ঠাণ্ডা লড়াই চলছে, সে ব্যাপারে ডেভিড অবগত। এ ব্যাপারে সে মনে মনে দুঃখ প্রকাশ করে। কারণ সে দুজনকেই ভালোবাসে। যদিও এটা তার ব্যবসার অন্তর্গত নয়। ডেভিড মনে মনে ভাবল, আমার কাজ হল জেমিকে সাহায্য করা।
***
জেমি আরও বেশি সময় তার ছেলের সঙ্গে কাটাচ্ছে। ছেলেটার বয়স এখন পাঁচ বছর। জেমি তাকে একদিন হিরের খনিতে নিয়ে গেল। জেমি জুনিয়ার কিছুই বুঝতে পারছে না। সে খুবই দুর্বল। সে টেন্টে তারা ভরা আকাশের তলায় ঘুমিয়ে পড়ল। জেমি স্কটল্যান্ডে থাকার সময় নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। এখানে দক্ষিণ আফ্রিকাতে আকাশের অবস্থান সে ঠিক বুঝতে পারছে না। সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। তবুও আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে।
সকালবেলা ওদের ঘুম ভেঙে গেছে। ওরা তিতির পাখি শিকার করল। গায়না, লাল ঝুঁটি মোরগ–আরও কত কী! ছোটো জেমির ছোটো টাটুঘোড়া আছে। বাবা আর ছেলে সেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। হ্যাঁ, কত কী দেখার আছে এখানে।
কোথাও কোথাও বিপদের সম্ভাবনা। একবার জেমি তার ছেলেকে নিয়ে নদীর ধারে তাবুর তলায় শুয়ে ছিল। সেখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। একদল বুনো বাইসন তাদের প্রায় মেরেই ফেলছিল।
হঠাৎ আকাশের দিকে কালো ধুলোর ঝড় উঠল। জেমি অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকল। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, এখনই এখান থেকে পালাতে হবে। জেমি জুনিয়ারকে কোলে করে সে তাঁবুর বাইরে চলে এল। তারপর ছুটতে ছুটতে টিলার ওপর চলে গেল। দেখতে পেল, সব জন্তুরা সভয়ে আর্তনাদ করতে করতে পালাচ্ছে। তার মানে? ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটছে বোধহয়। কিছু বোঝার আগেই কালো একটা রেখা ঝাঁপিয়ে পড়ল। হ্যাঁ, প্রায় তিনঘন্টা ধরে এই তাণ্ডব চলেছিল।
সব কিছু শেষ হয়ে যাবার পর জুনিয়ারকে বুকে চেপে ধরে জেমি বলল–তোকে একদিন কেপটাউনে নিয়ে যাব। সেখানে গেলে দেখবি, শহর কাকে বলে।
জুনিয়ার জানতে চাইল- বাবা, মাকে সঙ্গে নেবে না? মা স্বীকার করতে চায় না, কিন্তু শহর দেখতে ভালোবাসে।
ছেলেটিও অবাক হয়ে ভাবে, মা আর বাবার মধ্যে এত ব্যবধান কেন? কিন্তু সমস্যাটার সমাধান কী ভাবে হবে বা এই সমস্যাটার উৎস কোথায়, বেচারী বুঝতে পারে না।
***
জেমির নিজস্ব রেলওয়ে কারে চড়ে তারা বেড়াতে বেরিয়েছে।
১৮৯১–দক্ষিণ আফ্রিকার পরিবহন ব্যবস্থা রেল এখন আরও জনপ্রিয় হয়ে গেছে। কেন? এতে ভাড়া কম লাগে, সহজে যাওয়া যায়। দ্রুতগামী।
জেমি নিজের জন্য একটা সুন্দর রেল বানিয়েছে। একাত্তর ফুট লম্বা, তাতে চারটে বড়ো বড়ো কামরা আছে। বারোজন যেতে পারে। একটা সেলুন আছে, যেটা অফিস হিসেবে ব্যবহার করা যায়, একটা ডাইনিং কমপার্টমেন্ট, বাথরুম এবং সুন্দর সাজানো কিচেন। রাজকীয় আভিজাত্যের সমাহার।
ছোট্ট ছেলেটি জানতে চাইল অন্য যাত্রীরা কোথায়?
জেমি হাসল–আমরাই হলাম যাত্রী, এটা তোর নিজস্ব ট্রেন সোনামনি।
জুনিয়ার জেমি খুব মজা করতে শুরু করল। সে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। আহা, কত সুন্দর এই যাত্রাপথ।
বাবা তাকে বলেছে–এটা ভগবানের নিজস্ব জায়গা। এখানে দামি হিরে, সোনা আছে, চারপাশে ছড়ানো আছে আবিষ্কারের আশা। আমরা শুধুমাত্র শুরু করেছি জেমি জুনিয়ার।
***
তারা কেপটাউনে পৌঁছে গেল। এখানকার লোকজন আর বিরাট বিরাট বাড়ি দেখে ছোট্ট জেমি অবাক হয়ে গেছে। বড়ো জেমি তাকে ম্যাকগ্রেগর শিপিং লাইনে নিয়ে গেল। অনেকগুলো জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। সে ছোটো ছেলেকে বলল- এইগুলো দেখ, এসবই আমাদের।
***
তারা ক্লিপট্ৰিফটে ফিরে এল। জেমি জুনিয়ার আনন্দে ডগমগ। সে বলল–বাবা সমস্ত শহরটার মালিক। তুমি পরের বার যাবে তো?
মার্গারেট তার ছেলেকে আদর করে বলল–হ্যাঁ, যাব সোনা।
জেমি বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকে। মার্গারেট জানে সে মাদাম অ্যাগনেসের বেশ্যাখানায় রাত কাটায়। সে শুনেছে, জেমি একটা বাড়ি কিনেছে তার আদরের রক্ষিতাকে রাখার জন্য, যাতে সেখানে নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করতে পারে। সে জানে না, এই খবরটা সত্যি কিনা। মার্গারেট শুধু জানে, ওই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হলে সে ওই মেয়েটাকে খুন করবে।
***
মার্গারেট মাঝে মধ্যে শহরে বেড়াতে যায়। সে একটা নতুন চার্চের জন্য চাঁদা তুলছে। একটা মিশন তৈরি করতে হবে। যেসব হিরক সন্ধানীরা এখানে আসে, তাদের পরিবারকে সাহায্য করার জন্য।
তার এইসব কাজে জেমি খুবই রেগে যায়। একদিন জেমি চিৎকার করে বলল–এসব করে কেন টাকা নষ্ট করছ?
মার্গারেট বলল- কিছু ভালো কাজ তো করতেই হবে।
একবার সে একটা অদ্ভুত প্রস্তাব দিল। যেসব হিরক সন্ধানীরা যায়, তাদের কেপটাউনে ফিরিয়ে আনতে হবে। জেমি যেন তার ব্যক্তিগত রেলগাড়িটা এজন্য বিনা পয়সায় দিয়ে দেয়।
শেষ পর্যন্ত জেমি রাজী হয়েছিল, কিন্তু এই ব্যাপারে তার মত ছিল না।
মার্গারেট জেমির অফিসের বাইরে চলে গেল। একটা অদ্ভুত আচ্ছন্নতা জেমিকে গ্রাস করল। মনে হচ্ছে, ও বোধ হয় অন্য কারও স্ত্রী, আমার নয়।
***
জেমি যার জন্য একটা বাড়ি কিনেছে সেই মেয়েটির নাম ম্যাগি। সে হল এক অসাধারণ রূপবতী উপপত্নী, জেমি ভাবল, আহা, দুজনের এক নাম হল কী করে? তাদের মধ্যে কোন কিছুর মিল নেই। এই ম্যাগির বয়স একুশ বছর, সোনালি চুলের বন্যা আছে। অসাধারণ যৌবনবতী শরীর। বিছানায় শুলে বাঘিনীর মতো হিংস্র হয়ে যায়। জেমি মাদাম অ্যাগনেসের হাতে যথেষ্ট অর্থ তুলে দেবার পর তবে ম্যাগিকে অধিকার করতে পেরেছে। প্রতি মাসে সে ম্যাগিকে যথেষ্ট টাকা দেয়। জেমির মন যখন খারাপ থাকে, তখন সেই ছোট্ট বাড়িটাতে আসে। বেশির ভাগ সময় মাঝরাতে। সে জানে, কেউ তার ওপর নজর রাখেনি। কিন্তু আসলে তাকে অনেকেই দেখছে। কিন্তু কেউ তার এই চালচলনের ওপর মন্তব্য করতে চায় না। এটা জেমি ম্যাকগ্রেগরের নিজস্ব শহর। এখানে সে যা খুশি তাই করতে পারে।
সেই সন্ধ্যেবেলা জেমির মনে কোনো আনন্দ ছিল না। সে ভাবল, ওই বাড়িতে যাবে।
ম্যাগির মন ভালো নেই। সে পা ছড়িয়ে বিছানাতে শুয়ে আছে। তার লাল রঙের ড্রেসিং গাউনটার মধ্যে থেকে বুকের উদ্ভাস। আহা, এত সুন্দর ত্রিভুজ, তার দুটি উরুর মাঝে অবস্থান করছে।
ম্যাগি বলল আমার ভালো লাগছে না। এই বাড়ির মধ্যে বন্দিনী থাকতে। আমি কি তোমার ক্রীতদাসী নাকি? মাদাম অ্যাগনেসের ওখানে কত হৈ-হৈ হত। তুমি কেন আমাকে, সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে যাও না।
-আমি তো সেকথা তোমায় বুঝিয়ে বলেছি, ম্যাগি। আমি তা করতে পারি না।
ম্যাগি উপুড় হয়ে শুল। আর একটু কাছে এগিয়ে এল। তার ড্রেসিং গাউনটা অনেকটা খোলা। সে বলল–তুমি তোমার ছেলেকে সব জায়গায় নিয়ে যাও। আমি কি তোমার ছেলের মতো নই?
সে এগিয়ে গিয়ে ব্র্যান্ডি ঢেলে নিল। হ্যাঁ, এটা চার নম্বর। আরও বেশি সে খাবে কি?
-ভালো লাগছে না। আমি কি একটুকরো আসবাবপত্র? কী বলল, আমার এ জীবন ভালো লাগছে না। এভাবে আমি থাকব না।
জেমি এবার বলার সময় পেয়েছে–তুমি কাল সকালে মাদাম অ্যাগনেসের ওখানে ফিরে যেতে পারো। আমি মাদামকে খবর দিয়ে আসব।
সে হ্যাটটা তুলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
–কুত্তির বাচ্চা, তুমি কিছুতেই আমার হাত থেকে ছাড় পাবে না।
ম্যাগি উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে।
জেমি দরজার কাছে গিয়ে বলল –এই মাত্র আমি তোমাকে পরিত্যাগ করলাম। তারপর সে রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
অবাক হয়ে সে দেখল, তার পা ঠিক মতো পড়ছে না। তার মন কেমন আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কেন? ব্র্যান্ডির প্রভাব বোধহয়? হ্যাঁ, ম্যাগির নগ্ন শরীরটার কথা ভাবল। আহা, সে কেন ম্যাগিকে ত্যাগ করে এল। ম্যাগি তার সঙ্গে আনন্দের খেলা খেলতে চেয়ে ছিল। কীভাবে ম্যাগি আদর দেয়, দেহের প্রত্যেক অংশে জিভের পরশ রাখে, পুংদণ্ডটা মুখের ভেতর নিয়ে চুষতে শুরু করে। তারপর দুজনের মধ্যে একটা নকল যুদ্ধের মহড়া হয়ে যায়। একে অন্যকে হারিয়ে দেবার চেষ্টা করে। সেই রাতে অন্যরকম হয়ে গেল সব। ম্যাগির সান্নিধ্যে সে এল, কিন্তু তৃপ্তি পেল কই?
জেমি শেষ পর্যন্ত বাড়িতে পৌঁছোল। হলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেল। ঘরের ভেতর ঢুকবার চেষ্টা করল। মার্গারেটের বেডরুম। আলো জ্বলছে। মার্গারেট এখনও জেগে আছে। হঠাৎ মার্গারেটের দিকে চোখ পড়ে গেল জেমির। পাতলা রাত পোশাকে মার্গারেটের শরীরটা ঢাকা। অথবা সে হয়তো কিছুই পড়েনি। আহা, এক সময় তার সাথে কত সুন্দর মুহূর্ত কেটে গেছে। অরেঞ্জ নদীর তীরে গাছের ছায়ায় ছায়ায়। মদ তার কাজ করতে শুরু করেছে। সে মার্গারেটের বেডরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
কেরোসিনের আলো জ্বলছে। মার্গারেট কিছু পড়ছে মনে হয়। সে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল–জেমি, কিছু হয়েছে কী?
-আমি কি আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারি না? কণ্ঠস্বর জড়ানো।
হ্যাঁ, মার্গারেট একটা পাতলা ফিনফিনে রাতপোশাক পরেছে। জেমি তার পরিপূর্ণ স্তন দুটি দেখতে পাচ্ছে। দুটি বৃন্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হায় ঈশ্বর, এত সুন্দর চেহারা, সে পোশাক ছাড়তে শুরু করল।
মার্গারেট অবাক হয়ে প্রশ্ন করল–তুমি কী করছ?
জেমি দরজাটা বন্ধ করে দিল। মার্গারেটের কাছে হেঁটে এল। এক মুহূর্ত বাদে সে মার্গারেটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একেবারে নগ্ন অবস্থায়। তারপর বলল–ম্যাগি, আমি তোমাকে চাই।
মাতাল অবস্থায় সে কী যেন করে বসল। সে জানে না, কোন ম্যাগিকে সে চাইছে? হ্যাঁ, এই ছোট্ট বুনো বেড়ালনি? সে হো হো করে হেসে উঠল। হাত-পা ছড়িয়ে ম্যাগির ওপর গিয়ে পড়ল। ম্যাগি তাকে আরও জোরে আদর করছে। সে বলল–সোনামনি জেমি, তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে।
ব্যাপারটা কী, বুঝতে পারা যাচ্ছে না। মাদাম আগনেসের কাছে যাব নাকি? মার্গারেট মনে মনে ভাবল।
পরের দিন সকালবেলা মার্গারেটের ঘুম ভেঙেছে। অবাক হয়ে সে দেখল, বিছানাতে কেউ নেই। এ কী? সে এখনও অনুভব করছে জেমির উপস্থিতি। জেমির ওই দণ্ড তার মধ্যে প্রবেশ করানো হয়েছিল, এখন ম্যাগির মনে আনন্দ, পূর্ণ আনন্দ, সে ভাবল এ ভাবেই আমার আনন্দ পরিপূর্ণ হয়েছে। আমার স্বামী আমাকে ভালোবাসে। অনেক বছরের একাকীত্বের যন্ত্রণা কেটে গেছে।
সমস্ত দিনটা কেটে গেল অভাবিত উন্মাদনার মধ্যে। সে সুন্দর করে স্নান করল। প্রসাধন করল। তার মনে ভাবনার অনুরণন। আহা, জেমি আমাকে দেখে কত খুশি হবে। নিজের হাতে রান্না করল। জেমির ভালো লাগে, এমন খাবার। ডাইনিং টেবিল সাজাল। আবার আলো জ্বেলে দিল, মোমের আলো। সুগন্ধিত পুষ্প, সুন্দর একটা সন্ধ্যার স্বাগত সম্ভাষণ।
জেমি কিন্তু ডিনার খেতে আসেনি। রাতে আর ফিরল না। মার্গারেট সমস্ত রাত লাইব্রেরিতে বসে ছিল। ভাবছিল, জেমি যে কোনো সময় আসবে। রাত্রি তিনটে বাজল। একা একা সে তার শয্যায় চলে গেল।
পরের দিন সন্ধ্যাবেলা জেমি ফিরল। সে শান্তভাবে মার্গারেটের সঙ্গে কথা বলল। তার ছেলের ঘরে চলে গেল। মার্গারেট তাকিয়ে থাকল, অবাক হয়ে গেছে। তারপর আয়নাতে মুখ দেখল। আয়না বলল, তাকে এখনও সুন্দরী দেখতে। কিন্তু আরও কাছে গিয়ে সে তার চোখ দেখতে পেল। চোখের তারায় কী ধূসর বিষণ্ণতা!
.
১০.
মিসেস ম্যাগগ্রেগর, ডাঃ ট্রিগার বললেন, আপনার জন্য একটা ভালো খবর আছে। আপনি মা হতে চলেছেন।
মার্গারেটের মনে একটা অনাস্বাদিত আনন্দ। সে কাঁদবে, না হাসবে, বুঝতে পারছে না। ভালো খবর? আর একটা শিশুকে এই প্রেমহীন বিয়ের ফসল করতে হবে। এটা অসম্ভব। না, মার্গারেট আর অপমান সহ্য করতে পারবে না। যে কোনো একটা উপায় বের করতে হবে। তার সমস্ত শরীরে ঘাম।
ডাঃ ট্রিগার বললেন–অসুস্থ বোধ করছেন?
–একটু।
তিনি কয়েকটা ওষুধ তুলে দিলেন –এগুলো নিয়ে যান। এগুলো খেলে আপনার ভালো লাগবে। আপনার স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই ভালো, মিসেস ম্যাকগ্রেগর, কোনো বিষয়ে চিন্তা করবেন না। আপনি এখনই বাড়িতে গিয়ে আপনার স্বামীর কাছে সুসংবাদটা দিন।
-হ্যাঁ, আমি নিশ্চয়ই বলব।
***
ডিনার টেবিলে তারা মুখোমুখি বসে আছে।
মার্গারেট বলল–আজ আমি ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। আমি মা হতে চলেছি।
কোনো কথা না বলে জেমি তার ন্যাপকিনটা ফেলে দিল। চেয়ার থেকে উঠে ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল। মার্গারেট বুঝতে পারল। এবার জেমিকে ঘৃণা করার সময় এসেছে।
এটা এক কঠিন গর্ভাবস্থা। মার্গারেট বেশিরভাগ সময় শুয়ে কাটাচ্ছে। দুর্বল এবং ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা শুয়ে থাকতে বাধ্য হয়। মনে হয় জেমি তার পায়ের তলায় বসে আছে। ক্ষমা ভিক্ষা করছে। আবার ভালোবাসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে। কিন্তু এগুলো শুধুই স্বপ্ন বাস্তব হল, তাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। তার যাবার কোনো জায়গা নেই। জেমি কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। তার ছেলেকে হাতে দেবে না।
জুনিয়ার জেমির এখন সাত বছর। স্বাস্থ্যোজ্জ্বল এক শিশু। ভারি সুন্দর কথা বলতে পারে। তার মনের ভেতর কৌতুক বোধ আছে। সে মাঝে মধ্যে মায়ের কাছে আসে। মায়ের মনে দুঃখের কারণ কী, তা ভাবার চেষ্টা করে। ছোটো ছোটো উপহার নিয়ে আসে। আহা, মার্গারেট সেসব দেখে হেসে ওঠে। জুনিয়ার জেমি বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে। বাবা কেন রাতে আসে না, জানতে চায়। মা কোনো কথা বলে না। মাঝে মধ্যে বলে, জেমি তোমার বাবা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তাকে অনেক দামী কাজ করতে হয়।
বাবা আর আমার মধ্যে যেটা চলছে, সেটা ঠাণ্ডা যুদ্ধ, মার্গারেট ভাবল। আমি কেন ছোট্ট জেমিকে এ ব্যাপারে ঢোকাব। জেমি কেন তার বাবাকে ঘেন্না করতে শিখবে?
***
মার্গারেটের গর্ভাবস্থা আরও প্রকটিত হয়ে উঠেছে। এখন রাস্তায় গেলে সকলে তার দিকে তাকিয়ে বলে–কী মিসেস ম্যাকগ্রেগর, আর একটা ছেলে আসবে তো? আমার মনে হচ্ছে এটা পুত্রসন্তান হবে। তোমার স্বামী খুবই খুশী হবে।
আড়ালে তারা বলে, আহা, দেখো, মেয়েটাকে আবার ফাঁসানো হয়েছে। তাই তো হবে। বাজারের বেশ্যাকে কেউ কি বিয়ে করে?
মার্গারেট জুনিয়ার জেমিকে বোঝাবার চেষ্টা করে। সে বলে–জেমি, তোমার একটা ভাই কিংবা বোন আসছে। তোমরা একসঙ্গে খেলবে, তাই তো?
জেমি জুনিয়ার এগিয়ে এসে বলে–কবে আসবে? কিন্তু ওকে তো তুমি বেশি ভালোবাসবে।
মার্গারেট কেঁদে ফেলে।
***
শেষ অব্দি প্রসব যন্ত্রণা উঠল। রাত চারটের সময়। মিসেস ট্যালি হান্নাকে পাঠালেন। দুপুরবেলা মেয়েটার জন্ম হল। ফুটফুটে পরীর মতো। মায়ের মতো মুখ পেয়েছে। বাবার মতো চিবুক। কালো চুল, ছোট্ট লাল মুখ। মার্গারেট তার নাম দিল কেটি। আহা, সুন্দর নাম, মার্গারেট ভাবল, ওকে আরও শক্তি দিতে হবে। হ্যাঁ, আমি আমার ছেলেমেয়েকে এখান থেকে নিয়ে যাব। কিন্তু কীভাবে, তা জানি না।
***
ডেভিড ব্ল্যাকওয়েল জেমি ম্যাকগ্রেগরের অফিসে বসে আছে। সে প্রচণ্ড রেগে গেছে। সে বলল–নামিবে দাঙ্গা শুরু হয়েছে।
জেমি বলল–সে কী?
-একটা কালো ছেলে নাকি হিরে চুরি করেছিল। সে তার বগলের ভেতর হিরের টুকরোটা রেখে দেয়। তারপর হিরেটা পাথরের আড়ালে নিয়ে যায়। হানস তাকে সবার সামনে বেত মেরেছে। ছেলেটা মারা গেছে। তার বয়স মাত্র বারো বছর।
জেমির মুখ লাল হয়ে গেছে। হায় ঈশ্বর, এ কী হল? আমি তো বলেছিলাম, আমার খনিতে যেন চাবুক মারা বন্ধ হয়।
-আমি জিমারম্যানকে সাবধান করেছিলাম।
–এখুনি ওকে তাড়াতে হবে।
–ও তো আর বেঁচে নেই।
–সে কী?
জেমির বিস্ময়ের মাত্রা আকাশ ছুঁয়েছে।
–হ্যাঁ, কালো মানুষরা খেপে গিয়ে ওকে মেরে ফেলেছে।
জেমি বলল–আমি ওখানে যাচ্ছি। আমি ফিরে না আসা অব্দি তুমি অপেক্ষা করো।
-এখন আপনি ওখানে যাবেন না, মি ম্যাকগ্রেগর, জিমারম্যান যে ছেলেটাকে মেরেছে সে দুর্ধর্ষ উপজাতিদের একজন। লোকজন ক্ষেপে গেছে। প্রাণ ভয়ে জিমারম্যান পালিয়ে গেছে।
তবু জেমি চলে গেল।
***
হিরক খনির কাছাকাছি পৌঁছোনো মাত্র জেমি বুঝতে পারল, বাতাসে বারুদের গন্ধ। আকাশে কালো ধোঁয়া। হায় বোকার দল। নিজেদের তৈরি বারুদ তারা নিজেরাই পুড়িয়ে দিচ্ছে। সে এক সাংঘাতিক অবস্থা। গুলির শব্দ কানে এল তার। সারি সারি মৃতদেহ চারপাশে ছড়ানো ছেটানো পড়ে আছে। মানুষজন প্রাণভয়ে আর্তনাদ করতে করতে পালাবার চেষ্টা করছে। একটু পরে তার সঙ্গে হেড কনস্টেবলের দেখা হয়ে গেল।
হেড কনস্টেবল সামনে এগিয়ে এল। সে বলল –স্যার, চিন্তা করবেন না। আমি কিছুদিনের মধ্যেই এই ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলব।
জেমি খেপে গিয়ে বলল এখনই আপনার লোকদের বলুন, গুলি চালানো বন্ধ করতে।
হেড কনস্টেবল অবাক হয়ে গেছে এ কী কথা বলছেন? এখানে তো দাঙ্গা বেঁধে গেছে।
-আমি যা বলছি, তাই করুন। আর কালোদের নেতাকে আমার সামনে নিয়ে আসুন।
একটু বাদে গুলি চালানো বন্ধ হল। তার আগেই গুলির আঘাতে এক কালো মহিলার মৃত্যু হল। ছটফট করতে করতে সে মারা গেল।
ছেলেটিকে ধরে আনা হয়েছে। বেশি বয়স নয়, তার হাতে হাতকড়া পরানো। সমস্ত শরীরে রক্তের ছিটে দাগ। কিন্তু মনে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। সে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল। তার চোখের তারায় কী এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা। জেমির মনে পড়ল, বান্দা তাকে একটা শব্দ শিখিয়ে ছিল তাকে বলে ইশিকো অর্থাৎ আত্মাভিমান।
-আমি জেমি ম্যাকগ্রেগর।
লোকটা থুথু ফেলল।
-এখানে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য আমি দায়ী নই। এসব ঘটনার অন্তরালে আছে তোমার জাতিভুক্ত লোকেরা।
–এসব কথা ওদের বিধবাদের বলুন।
জেমি হেড কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে বলল –হানস জিমারম্যান কোথায়?
–ওঁকে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি, স্যার।
জেমি দেখতে পেল, কালোলোকটার চোখের তারায় এক অদ্ভুত দ্যুতি। সে জানে হানস জিমারম্যানকে আর কখনওই পাওয়া যাবে না।
জেমি বলল–আমি তিনদিনের জন্য হিরের খনি বন্ধ রাখব। তুমি তোমার লোকেদের সঙ্গে কথা বলো। তোমাদের কী অভিযোগ সব দাখিল করো। আমি দেখব। আমি কথা দিচ্ছি আমি সু-আচরণ করব। আমি অব্যবস্থা বন্ধ রাখব।
লোকটা তাকাল। তার চোখের ভেতর একটা সন্দেহতার ছাপ।
-নতুন একজন ফোরম্যানকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। কাজ করার পদ্ধতি এবং পরিবেশ পালটানো হবে। কিন্তু আমি চাইছি তোমার লোকেরা যেন তিনদিনের মধ্যে কাজে যোগ দেয়।
চিফ কনস্টেবল বলল–হ্যাঁ, এটা কখনও হবে না। আপনি কি জানেন, ও আমাদের কয়েকজন পুলিশকে মেরে ফেলেছে।
এ ব্যাপারে, পূর্ণ তদন্ত হবে।
ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা গেল। জেমি ঘুরে তাকাল। ডেভিড ব্ল্যাকওয়েল, কী আশ্চর্য, জেমির মনের ভেতর বিপদের ঘন্টাধ্বনি।
ডেভিড ঘোড়া থেকে নেমে বলল–মি. ম্যাকগ্রেগর, আপনার ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
এক মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত পৃথিবী আর একটু বেশি শীতল বলে মনে হল জেমির কাছে।
***
ক্লিপড্রিফট শহরের আদ্ধেক মানুষ অনুসন্ধানের কাজে লেগে পড়েছে। শহরের উপকণ্ঠে, তারা হানা দিয়েছে। প্রত্যেকটা উপত্যকা, না, কোথাও ছেলেটার কোনো চিহ্ন নেই।
জেমি অবাক হয়ে ভাবছে নিশ্চয়ই ও ফিরে আসবে। হয়তো কোথাও খেলতে গেছে। পথ হারিয়ে ফেলেছে।
সে মার্গারেটের বেডরুমে প্রবেশ করল। মার্গারেট বিছানায় শুয়ে। ছোট্ট মেয়েটিকে যত্ন করছে।
মার্গারেট জানতে চাইল–কোনো খবর আছে?
–এখনও পাইনি, কিন্তু আমি খবরটা বের করবই।
জেমি এক মুহূর্ত তার ছোট্ট মেয়েটির দিকে তাকাল। তারপর কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মিসেস ট্যালি ঘরে এসে ঢুকল। অ্যাপনে হাত মুছে বলল –মিসেস ম্যাকগ্রেগর, চিন্তা করবেন না, জেমি এখন বড়ো হয়েছে, সে জানে, কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে হয়?
মার্গারেটের চোখ জলে পরিপূর্ণ। আঃ, আমার ছোট্ট জেমিকে কে আঘাত করবে?
মিসেস ট্যালি এগিয়ে এল। মার্গারেটের কোল থেকে কেটিকে নিয়ে গেল।
-একে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করো তো।
সে ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে নার্সারিতে চলে গেল। কেটি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
–এখন ঘুমিয়ে পড়ো সোনা, তোমার সামনে ব্যস্ততাপূর্ণ জীবন।
মিসেস ট্যালি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘরটা বন্ধ করল।
মধ্যরাত, শোবার ঘরের জানালাটা হঠাৎ খুলে গেছে। একজন ঢুকে পড়েছে ঘরের মধ্যে। সে ধীরে ধীরে ওই দোলনার কাছে চলে গেল। ছোটো মেয়েটার ওপর কম্বল চাপা দিল। তারপর তাকে কোলে তুলে নিল।
বান্দা যত তাড়াতাড়ি এসেছিল, তত তাড়াতাড়ি চলে গেল।
মিসেস ট্যালি দেখল কেটিকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে ভাবল, মিসেস ম্যাকগ্রেগর হয়তো এসে তাকে নিয়ে গেছেন। সে মার্গারেটের ঘরে গেল এবং জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটি কোথায়?
মার্গারেটের মুখে একটা অদ্ভুত আতঙ্কের ছাপ। মার্গারেট হয়তো বুঝতে পেরেছে, কী ঘটে গেছে।
***
আর একটা দিন চলে গেল। ছেলেটার কোনো চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। জেমি তখন প্রায় পাগল হয়ে গেছে। সে বারবার ডেভিড ব্ল্যাকওয়েলকে বলছে–কী ঘটতে পারে বলো তো?
নিজের কণ্ঠস্বরকে সে দমন করতে পারছে না।
ডেভিড ভালোভাবে বলার চেষ্টা করল মি. ম্যাকগ্রেগর, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
হ্যাঁ, ডেভিড ক্লান্ত। ইতিমধ্যে সে জেমি ম্যাকগ্রেগরকে সাবধান করেছিল। বান্টুরা কখনও ক্ষমা করে না। কোনো অপমান তারা ভোলে না। একজন বান্টু একাজটা করেছে। করার অন্তরালে কারণ আছে। বান্টু যুবককে হত্যা করা হয়েছে। ডেভিড একটা ব্যাপারে সুনিশ্চিত। বান্টুরা যদি ছোটো জেমিকে নিয়ে যায়, তাকে নিশ্চয়ই মেরে ফেলা হয়েছে। কারণ তারা রক্তের বদলে রক্তই খুঁজে বেড়ায়।
জেমি পরের দিন সকালে ফিরে এল। বিধ্বস্ত অবস্থায়, সমস্ত রাত ধরে খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে। সর্বত্র লোক পাঠানো হয়েছে। কোথায় এই ছেলেটা লুকিয়ে থাকতে পারে? সম্ভাব্য সব জায়গায়। সবই ব্যর্থ এবং বিফল প্রয়াস।
ডেভিড সেই দুঃসংবাদটা জানাল–মি. ম্যাকগ্রেগর, আপনার মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে।
জেমি তাকিয়ে থাকল। তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। সে ধীরে ধীরে বেডরুমে প্রবেশ করল।
গত আটচল্লিশ ঘণ্টা জেমি বিছানাতে শোবার সুযোগ পায়নি। সে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় বিছানাতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। হ্যাঁ, তার মনে হল সে যেন একটা বিশাল বাওয়াফ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক দূরে একটা সিংহ বসে আছে। সিংহটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। জেমি জুনিয়ার তাকে জাগাবার চেষ্টা করছে।–বাবা, একটা সিংহ আসছে। হ্যাঁ, সিংহটার গতি আরও বেড়ে গেছে। হাত ঝাঁকানিটা আরও দ্রুত হয়েছে–বাবা ওঠো, জেমি চোখ খুলল। বান্দা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জেমি কিছু বলার চেষ্টা করেছিল। বান্দা জেমির মুখে হাত চাপা দিল।
–শান্তভাবে থাকার চেষ্টা করো।
–আমার ছেলে কোথায়, জেমি জানতে চাইল।
–ও মরে গেছে।
ঘরে অন্ধকার।
-আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি। তোমার লোকেরা বান্টুর রক্ত ঝরিয়েছে, আমার উপজাতির মানুষেরা এভাবে প্রতিহিংসা নিয়ে থাকে।
জেমি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলল–আমি কী করব?
বান্দার কণ্ঠস্বরে সীমাহীন দুঃখ–হ্যাঁ, আমি তার মৃতদেহটা দেখতে পেয়েছি, মরুভূমির মধ্যে পড়ে ছিল। তাকে সমাহিত করে দিয়েছি।
-আঃ! না, একথা বলো না।
–আমি তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছি, জেমি।
জেমি কথাটা শুনে বলল আমার মেয়ে?
-আমি তাকে নিয়ে গেছি, যাতে ওরা তার সন্ধান না পায়। তাকে আবার তোমার বেডরুমে পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু তোমাকে একটা শপথ নিতে হবে।
জেমি তাকাল। তার মুখে একটা অদ্ভুত অসহায়তা–আমি আমার শপথ রাখব। কিন্তু যারা আমার ছেলেকে হত্যা করল, তাদের শাস্তি দেব না?
বান্দা শান্তভাবে বলল–জেমি, তাহলে সমস্ত মানুষকে শাস্তি দিতে হবে। তুমি কি এত শক্তিশালী?
***
এটা বোধহয় একটা দুঃস্বপ্ন। কিন্তু সে তখনও চোখ বন্ধ রেখেছে। সে ভাবছে, চোখটা খুললেই বোধহয় দুঃস্বপ্নটা সত্যি হবে। হ্যাঁ, ছেলেমেয়েরা মারা যাবে। সে একটা অদ্ভুত খেলা খেলার চেষ্টা করল। সে কিছু বলতে চাইছে কি? ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না। এ কী আমার জেমি সোনা? মা, আমি ঠিক আছি, আমাদের কোনো খারাপ ঘটনা ঘটেনি।
তিনদিন ধরে তাকে বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছিল। কারও সাথে কথা বলছে না। ডাঃ ট্রিগার তাকে দেখতে এলেন। মার্গারেট এই ব্যাপারটাও জানতে পারল না।
মধ্যরাত। মার্গারেট তার বিছানাতে শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ। ছেলের ঘরে কীসের শব্দ? সে চোখ খুলল। হ্যাঁ, আর একটা শব্দ। ছোট্ট জেমি ফিরে এসেছে।
মার্গারেট বিছানা থেকে উঠে গেল। করিডর দিয়ে হেঁটে তার ছোটো ছেলের বন্ধ ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হ্যাঁ, সে শুনতে পেল জন্তুর বিচিত্র কণ্ঠস্বর।
তার মনের ভেতর ভয়ের বাতাবরণ। দরজাটা খুলল।
তার স্বামী বিছানাতে নেই, মেঝেতে পড়ে আছে। বুকে এবং মুখে আঁচড়ের দাগ। একটা চোখ বন্ধ। আর একটা চোখ কেমন যেন হয়ে গেছে। কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার গলা দিয়ে জন্তুর আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে।
মার্গারেট বলল–জেমি, তোমার কী হয়েছে?
***
ডাঃ ট্রিগার বললেন–খবরটা খুবই খারাপ। মিসেস ম্যাকগ্রেগর, আমি ভাবতে পারছি, আপনার স্বামীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। পঞ্চাশ শতাংশ বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেঁচে থাকলেও উনি একেবারে পঙ্গু হয়ে যাবেন। আমি ওনাকে একটা প্রাইভেট স্যানাটোরিয়ামে নিয়ে যাব। সেখানে হয়তো উপযুক্ত শুশ্রূষার ব্যবস্থা হবে।
না।
মার্গারেটের দিকে তাকিয়ে ডাঃ ট্রিগার বললেন কেন?
-না, কোনো হাসপাতাল নয়। আমি চাই যে, ওর এখানেই চিকিৎসা হোক।
ডাক্তার কী যেন চিন্তা করে বললেন –ঠিক আছে। একজন নার্সের ব্যবস্থা করতে হবে।
-না, আমার নার্স লাগবে না। আমি নিজে পরিচর্যা করতে পারব।
ডাঃ ট্রিগার মাথা নেড়ে বললেন মিসেস ম্যাকগ্রেগর, আপনি জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করবেন না। আপনার স্বামী কিন্তু এখন আর কর্মরত অবস্থায় নেই। তিনি সম্পূর্ণ অবশ হয়ে গেছেন। যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন, তাকে এইভাবে বেঁচে থাকতে হবে।
মার্গারেট বলল–আমি তার সেবা শুশ্রূষা করব।
অবাক বিস্ময়ে ডাক্তার চলে গেলেন। মার্গারেট ভাবল, জেমি এতদিনে আমার হাতে বন্দী হল।