২৬. আবু তালেব সকাশে কোরাইশদের শেষ প্রতিনিধিদল

শা’বে আবু তালেব থেকে বেরুবার পর রসুলে মকবুল (সাঃ) পুনরায় দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ শুরু করলেন। বয়কট শেষ হলেও পৌত্তলিক দুর্বৃত্তরা ইসলাম প্রচারে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাচ্ছিলো। এদিকে আবু তালেব তাঁর ভাতিজাকে রক্ষা করার দীর্ঘকালিন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। কিন্ত তিনি ছিলেন বয়সের বারে ন্যুব্জ। তাঁর বয়স আশি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ক্রমাগত কয়েক বছর দুঃখ-দুর্দশা বিপদ-মুসিবতে তাঁর স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ভেঙ্গে পরেছিলো। বিশেষ করে গিরিপথে অবোরধ তাঁর শক্তি সামর্থ্য নিঃশেষ করে দিয়েছিলো। সেখান থেকে বেরুবার কয়েক মাস পরেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরেন। এ সময় পৌত্তলিকরা চিন্তা করলো যে, আবুতালেব দ্রুত অসুস্থ হচ্ছেন। যে কোন সময় তাঁর জীবনের শেষ দিন হতে পারে। তাঁর মৃত্যুর পর যদি আমরা তাঁর ভাতিজার উপর কোন বাড়াবাড়ি করি, তখন আমাদের দুর্নাম হবে। লোকে বলাবলি করবে যে, অভিভাবক নেই দেখে এখন সুযোগ নিচ্ছে। এ কারণে তারা আবু তালেবের জীবদ্দশাতেই নবী করিম (সাঃ) এর ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চচ্ছিলো। এ ক্ষেত্রে তারা ছার দিতে রাজি ছিল না। নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার পর একটি প্রতিনিধি দল আবু তালেবের কাছে হাজির হলো। এটা ছিলো কোরাইশদের শেষ প্রতিনিধিদল।
ইবনে ইসহাক প্রমুখ বর্ণনা করেছেন যে, আবু তালেব অসুস্থ হওয়ার পর কোরাইশরা আশংকা করেছিল যে, হঠাৎ করে আবুতালেব শেষ নিঃশ্বাষ ত্যাগ করবেন। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলো যে, দেখ হামযা, ওমর মুসলমান হয়ে গেছে এবং মোহাম্মদের ধর্ম সব কোরাইশ গোত্রে বিস্তার লাভ করেছে। কাজেই চলো, আবুতালেবের কাছে যাই। তিনি যেন তাঁর ভাতিজাকে নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রাখেন। এতে আমরা তার ব্যাপারে একটা চুক্তিতে উপনীত হতে পারবো। আমার আশংকা করছি যে, সাধারন মানুষ ভবিষ্যতে মোহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে কোন বাড়াবাড়ি করলে, সাধারন লোকেরা আমাদের সমালোচনা করবে। তারা বলাবলি করবে যে, আবুতালেব বেঁচে থাকতে কোন কিছু করার সাহস ছিলো না, এখন সুযোগ পেয়েছে। মোট কথা কোরাইশ প্রতিনিধিদল আবুতালেবের কাছে গিয়ে আলোচনা করলো। কোরাইশদের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও প্রতিনিধিদলে অর্ন্তভুক্ত ছিলো। এরা হলো আবুজেহেল ইবনে হেশাম, উমাইয়া ইবনে খালফ, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব এবং অন্যান্য। সংখ্যায় এরা ছিল পঁচিশজন। তারা বললো, হে আবুতালেব আমাদের কাছে আপনার যে মর্যাদা রয়েছে, সেটা আপনার অজানা নয়। বর্তমানে আপনি যে অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, সেটাও আপনি জানেন। আমরা আশংকা করছি যে, আপনার জীবনের দিন দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনার ভাতিজার সাথে আমাদের বিরোধ আপনার অজানা নয়। আমরা চাই, আপনি তাকে ডেকে আমাদের সাথে একটা সমঝোতার ব্যবস্থা করুন। আমরা তার সাথে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হতে এবং তাকেও কিছু অঙ্গীকারে আবদ্ধ করতে চাই। আমরা তাকে তার দ্বীনের উপর ছেড়ে দিব, তিনিও যেন আমাদেরকে আমাদের দ্বীনের উপর ছেড়ে দেন।
এসব কথা শুনার পর আবুতালেব তাঁর প্রিয় ভাতিজা মোহাম্মদ (সাঃ) কে ডেকে আনলেন। তিনি আসার পর বললেন, দেখো ভাতিজা, ওরা তোমার কওমের সম্মানীত লোক। তোমার জন্যই ওরা একত্রিত হয়েছে। তোমার কাছ থেকে ওরা কিছু অঙ্গীকার নিতে চায়। এরপর আবুতালেব ওদের উপস্থাপিত প্রস্তাব পেশ করলেন যে, তুমি তাদের ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না এবং ওরাও তোমার ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না।
এ কথা শুনে রসুলুল্লাহ (সাঃ) কোরাইশ প্রতিনিধিদলকে বললেন, আপনারা বলুন, আমি যদি এমন কোন কথা পেশ করি যে, কথা গ্রহণ করলে আপনারা আরবের বাদশাহ হবেন এবং অন্যরাও আপনাদের নিয়ন্ত্রনে থাকবে, তখন আপনারা কি করবেন ? অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনি আবুতালেবকে সম্বোধন করে বললেন, আমি তাদের কাছে এমন একটি কথার স্বীকারোক্তি চাই যদি সেই স্বীকারোক্তি করে, তবে সমগ্র আরবজাহান তাদের অধীনস্ত হবে এবং অন্যরাও তাদের জিযিয়া দিবে। বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনি বলেছেন, চাচা আপনি ওদের একটা বিষয়ের প্রতি ডাকুন, এতে ওদের ভাল হবে। আবুতালেব জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি ওদের কোন বিষয়ের প্রতি ডাকতে চাও ? রসুল করিম (সাঃ) বললেন, আমি ওদের এমন একটি বিষয়ের প্রতি ডাকতে চাই, যদি ওরা সেটা গ্রহণ করে , তবে সমগ্র আরব তাদের অনুগত হয়ে যাবে এবং অনারবের উপরও তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ইবনে ইসহাকের একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, রসুল (সাঃ) বলেছেন যে, আপনারা শুধু আমার একটি কথা মেনে নিন। এর ফলে আপনারা আরবের বাদশাহ হয়ে যাবেন এবং অনারবরাও আপনাদের নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে।
মোট কথা এ প্রস্তাব শুনার পর কোরাইশ প্রতিনিধিদল থমকে গেল। তারা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো যে, মাত্র একটি কথা মেনে নিলে যদি এতবড় লাভ হয়, তবে সেটা কিভাবে উপেক্ষা করা যায়, আবুজেহেল বললো, বলো সে কথা। তোমার পিতার শপথ এ ধরনের কথা একটি কেন দশটি বললেও আমরা মানতে প্রস্তুত রয়েছি। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বললেন, আপনারা বলুন “ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ“’ । আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নাই, অন্য সকলের আনুগত্য উপাসনা পরিত্যাগ করুন। এ কথা শুনে কোরাইশরা হাতে তালি দিতে দিতে বললো, মোহাম্মদ, আমরা এক খোদা মানবো ? আসলেই তোমার ব্যাপার স্যাপার বড় অদ্ভুত।
এরপর তারা একে অপরকে বললো, খোদার কসম, এই লোক তোমাদের কোন কথাই মানতে রাজী নয়। কাজেই এসো আমরা আমাদের পুর্বপুরুষের ধর্মবিশ্বাষের উপর অটল থাকি। এরপর আল্লাহ ওর এবং আমাদের মধ্যে একটা ফয়সালা করে দিবেন। একথা বলে তারা উঠে চলে গেল। এ ঘটনার পর মহান আল্লাহ ওদের ব্যাপারে এ আয়াত নাযিল করেনঃ ‘শপথ উপদেশ পুর্ন কোরআনের। তুমি অবশ্যই সত্যবাদী। কিন্ত কাফেররা ঔদ্ধত্য এবং বিরোধিতায় ডুবে আছে। এদের পুর্বে আমি কত জনগোষ্ঠি ধ্বংস করেছি, তখন ওরা আর্তচিৎকার করেছিল। কিন্ত তখন পরিত্রানের কোন উপায় ছিল না। এরা বিস্ময়বোধ করছে যে, এদের কাছে এদেরই মধ্যে থেকে একজন সতর্ককারী আসলো এবং কাফেররা বললো, এতো এক যাদুকর, মিথ্যাবাদী। সে কি বহু ইলাহের পরিবর্তে এক ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে ? এটাতো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। ওদের প্রধানেরা সরে পরে এই বলে, তোমরা চলে যাও, এবং তোমাদের দেবতাগুলোর পূজোয় অবিচল থাকো। নিশ্চয় এ ব্যাপারটি উদ্দেশ্যমুলক। আমরাতো অন্য ধর্মাদর্শে এরুপ কথা শুনিনি। নিশ্চয় এটা একটি মনগড়া উক্তি। ( ১-৭, ৩৮)