মুসলমানরা নিজেদের জীবন এবং ঈমান নিয়ে নিরাপদ এক জায়গায় চলে গেছে এটা ছিল কোরাইশদের মারাত্মক মনোবেদনার কারণ। অনেক আলোচনার পর তারা আমর ইবনুল আস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে রবিয়াকে এক গুরুত্বপুর্ণ মিশনে হাবসায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল। এই দু’জন তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। এরা যথেষ্ঠ বুদ্ধিমান ছিলেন। হাবশার বাদশাহকে দেয়ার জন্য কোরাইশার এ দুইজন দুতের মুল্যবান উপঢৌকন পাঠালো। এরা প্রথমে বাদশাহকে উপঢৌকন দিলেন, এরপর সেসব যুক্তি ও কারণ ব্যাখ্যা করলেন, যার ভিত্তিতে তারা মুসলমানদের মক্কা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান। তারা বললো, হে বাদশাহ, আপনার দেশে আমাদের কিছু নির্বোধ যুবক পালিয়ে এসেছে। তারা স্বজাতির ধর্ম বিশ্বাস পরিত্যাগ করেছে। কিন্ত আপনি যে ধর্ম বিশ্বাস পোষন করেন সেই ধর্ম বিশ্বাসও তারা গ্রহন করেনি। বরং তারা এক নব আবিস্কৃত ধর্ম বিশ্বাস গ্রহণ করেছে। এ ধর্ম বিশ্বাস আমরাও কিছু জানিনা আপনিও কিছু জানেন না। ওদের পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন আমাদেরকে ওদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। তারা চান যে, আপনারা তাদের নির্বোধ লোকদের আমাদের সাথে ফিরিয়ে দিবেন। তারা নিজেদের লোকদের ভালো-মন্দ সম্পর্কে ভালোভাবে বোঝেন। দরবারের সভাসদরাও চাচ্ছিলেন যে, বাদশাহ যেন মুসলমানদের ফিরিয়ে দেন।
নাজ্জাশি ভাবলেন যে, এ সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে সবদিক ভালোভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। তিনি মুসলমানদেরকে তার দরবারে ডেকে পাঠালেন। মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা র্নিভয়ে সত্য কথা বলবে। এতে পরিণাম যা হয় হবে। মুসলমানরা দ;রবারে আসার পর নাজ্জাশী জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা যে ধর্ম বিশ্বাসের কারণে নিজেদের স্বজাতীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছো, সেটা কি ? তোমরাতো আমার অনুসৃত ধর্ম বিশ্বাসেও প্রবেশ করোনি। মুসলমানদের মুখপাত্র হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব (রা) বললেন, হে বাদশাহ, আমরা ছিলাম মুর্তিপুজায় লিপ্ত এক মুর্খ জাতি। আমরা মৃত পশুর মাংস খেতাম, পাপ কাজে লিপ্ত থাকতাম, নিকটাত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক চিন্ন করতাম, প্রতিবশীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম, আমাদের মধ্যে শক্তিশালীরা দুর্বলদের উপর আত্যাচার করতো। আমরা যখন এরপু অবস্থায় ছিলাম, তখন আল্লাহ তাআলা আমাদের মধ্য থেকে একজনকে রসুলরুপে পাঠালেন। তাঁর উচ্চ বংশ মর্যাদা, সত্যবাদিতা, সচ্চরিত্র, আমানতদারী ও বিশ্বস্থতা সম্পর্কে আমরা আগে থেকেই জানতাম। তিনি আমাদেরকে আল্লাহর পথে ডেকে বুঝিয়েছেন যে, আমরা যেন এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহকে মানি এবং তাঁর এবাদত করি, যে সব মুর্তি ও পাথরকে আমাদ;এর পিতা-পিতামহ পুজা করতেন সেসব যেন পরিত্যাগ করি। তিনি আমাদেরকে সত্য বলা, আমানতদারী রক্ষা করা, নিকটাত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, পাপ না করা রক্তপাত হতে বিরত থাকার নির্দশ দিয়েছেন। অশ্লীল কাজে লিপ্ত হওয়া, মিথ্যা বলা, এতিমের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করা এবং সতী পুণ্যশীলা রমনীদের নামে মিথ্যা অপবাদ না দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমরা যেন শুধু আল্লাহর এবাদত করি। তাঁর সাথে কাউকে শরিক না করি। তিনি আমাদের নামাজ আদায়, রোযা রাখা এবং যাকাত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত জাফর (রা) এভাবে ইসলামের পরিচয় তুলে ধরার পর বললেন, ‘আমরা সেই পয়গম্বরকে সত্য বলে মেনেছি,তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন, আনিত দ্বীনের উপর বিশ্বাস স্থাপন ও আনুগত্য করেছি। আমরা শুধুমাত্র আল্লাহর এবাদত করেছি এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করিনি। সেই পয়গম্বর যেসব জিনিসকে নিষিদ্ধ বলেছেন, সেই গলুলিকে আমরা নিষিদ্ধ মনে করেছি যে গুলিকে হালাল বা বৈধ বলেছেন, সেগুলোকে হালাল মনে করেছি। এসব কারণে আমাদের স্বজাতীয় লোকেরা আমাদের উপর নাখোশ হয়েছে। তারা আমাদের উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং পুর্ববর্তী ধর্মে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । তারা চায় আমরা যেন আল্লাহর এবাদত পরিত্যাগ করে মুর্তিপুজার দিকে ফিরে যাই। যেসব নোংরা জিনিসকে ইতিপুর্বে হারাম মনে করেছিলাম, সেসব কিছুকে যেন হালাল মনে করি। ওরা যখন আমাদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা বহুলাংশে বাড়িয়ে পৃথিবীকে আমাদের জন্য সংকীর্ণ করে দিয়েছে এবং তারা আমাদের অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে, তখন আমরা আপনার দেশের উদ্যেশে রওনা হয়েছি এবং অন্যদের তুলনায় আপনাকে প্রাধান্য দিয়ে আপনার আশ্রয়ে থাকা পছন্দ করেছি। আমরা এ আশাও পোষন করেছি যে, আপনার এখানে আমাদের উপর কোন প্রকার যুলুম অত্যাচার করা হবে না।
নাজ্জাশী বললেন, আমাকে তোমাদের রসুলের আনীত গ্রন্থে থেকে পড়ে শুনাও। হযরত জাফর (রা) সূরা মরিয়মের প্রথম অংশের কয়েকটি আয়াত পাঠ করলেন। তা শুনে নাজ্জাশীর মন পরিবর্তন হলো। তিনি অবরাম কাঁদতে লাগলেন, তাঁর দাড়ি অশ্রুতে ভিজে গেল। তাঁর ধর্মীয় উপদেষ্টারাও এতো বেশী কাঁদলেন যে, তাদের সামনে মেলে রাখা ধর্মীয় গ্রন্থেন উপর অশ্রু গড়িয়ে পরলো। নাজাশী এরপর বললেন, এই বাণী এবং হযরত মুসা (আ) আনীত বাণী একই উৎস থেকে উৎসারিত। এরপর নাজ্জাশী আমর ইবনুল আস ও আব্দুল্লাহ ইবনে রবিয়াকে ডেকে বললেন, তোমরা চলে যাও, আমি ওইসব লোকদের তোমাদের হাতে তুলে দিতে পারব না। এখানে তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার কারসাজি আমি সহ্য করব না।
বাদশাহের নির্দেশের পর কোরাইশদের উভয় প্রতিনিধি দরবার থেকে বেরিয়ে এলো। এরপর আমর ইবনুল আস আব্দুল্লাহ ইবনে রবিয়াকে বললো, আগামীকাল ওদের বিরুদ্ধে এমন কথা বাদশাহকে বলবো যে , ওদের সব চালাকি ছুটিয়ে দিবে। আব্দুল্লাহ ইবনে রবিয়া বললেন, না তার দরকার নেই। ওরা যদিও আমাদের ধর্ম বিশ্বাস পরিত্যাগ করেছে কিন্ত ওরাতো আমাদের গোত্রেরই লোক। তবুও আমার ইবনুল আস তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।
পরদিন আমর ইবনুল আসবাদশাহের দরবারে গিয়ে বললেন, হে বাদশাহ ওরা ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ) এক অদ্ভুত কথা বলে, এ কথা শুনে নাজ্জাশী পুনরায় মুসলমানদে ডেকে পাঠালেন। তিনি হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে মুসলমানদের মতামত জানতে চাইলেন। মুসলমানরা এবার ভয় পেয়ে গেলেন। তবুও তারা ভাবলেন, আল্লাহর উপর ভরসা, যা হবার হবে, তারা কিন্ত সত্যি কথাই বললেন।
নাজ্জাশীর প্রশ্নের জবাবে হযরত জাফর (রা) বললেন, আমরা হযরত ঈসা (আ) সর্ম্কে সে কথাই বলে থাকি, যা আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (সা) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, হযরত ঈসা (আ) আল্লাহর বান্দা,তাঁর রসুল, তাঁর রুহ এবং তাঁর কলেমা। তাঁকে আল্লাহ তাআলা কুমারী সতী সাধ্বী হযরত মরিয়ম (আ) এর উপর ন্যস্ত করেছেন।
এ কথা শুনে নাজ্জাশী মাটি থেকে একটি কাঠের টুকরা তুলে নিয়ে বললেন, খোদার কসম, তোমরা যা কিছু বলেছো, হযরত ঈসা (আ) এই কাঠের টুকরার চাইতে বেশী কিছু ছিলেন না। এ কথা শুনে ধর্মীয় উপদেষ্টাগণ হুঁ হুঁ শব্দ উচ্চারণ করে বিরক্তি প্রকাশ করলো। বাদশাহ বললেন, তোমরা হুঁ হুঁ বললেও আমি যা বলেছি, এ কথাই সত্যি।
এরপর নাজ্জাশী মুসলমানদের বললেন, যাও তোমরা আমার দেশে সম্পুর্ণ নিরাপদ। যারা তোমাদের গালি দিবে, তাদের উপর জরিমানা ধার্য করা হবে। আমি চাইনা কেউ তোমাদের কষ্ট দিক, আর তার পরিবর্তে আমি সোনার পাহাড় লাভ করি।
এরপর নাজ্জাশী তার ভৃত্যদের বললেন, মক্কা থেকে আগত প্রতিনিধিদের আনীত উপঢৌকন তাদের ফেরত দাও, ওগুলোর কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহর শপথ, তিনি যখন আমাকে আমার দেশ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তখন আমার কাছ থেকে কোন ঘুষ নেননি। আমি কেন তাঁর পথে ঘুষ নেব। এ ছাড়া তিনি অর্থ্যাৎ আল্লাহ তাআলা আমার ব্যাপারে অণ্য লোকদের কথা গ্রহণ করেননি, আমি কেন আল্লাহর ব্যাপারে অন্য লোকদের কথা মানব।
এ ঘটনার প্রত্যক্ষদশী হযরত উম্মে সালমা (রা) বলেন, কোরাইশদের উভয় প্রতিনিধ এরপর তাদের আনীত উপঢৌকন সহ অসম্মানজনকভাবে দেশে ফিরে এলো । আমরা নাজ্জাশীর দেশে একজন ভাল প্রতিবেশীর ছত্রছায়ায় বসবাস করতে লাগলাম।
উল্লেখিত ঘটনার বর্ণনা ইবনে ইসহাক উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য সীরাত রচয়িতারা লিখেছেন, নাজ্জাশীর দরবারে হযরত আমর ইবনুল আস বদরের যুদ্ধের পর গিয়েছিলেন। কেউ কেউ উভয় বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য লিখেছেন, মুসলমানদের ফিরিয়ে আনার জন্য আমর ইবনুল আস নাজ্জাশীর দরবারে দু’বার গিয়েছিলেন। কিন্ত বদরের যুদ্ধের পরে নাজ্জাশী এবং হযরত জাফর (রা) এর মধ্যে কথোপকথনের যে বিববণ ইবনে ইসহাক উল্লেখ করেছেন, সেটা হাবশায় মুসলমানদের হিজরতের পরবর্তী সময়ের কথোপকথনের অনুরুপ। তাছাড়া নাজ্জাশীর প্রশ্নের ধরণ দেখে বুঝা যায় যে, তার সাথে মুসলমানদের কথাবার্তা একবারই হয়েছিল আর সেটা হয়েছিল হাবশায় মুসলমানদের হিজরতের পরপরই।
মোটকথা পৌত্তলিকদের কৌশল ব্যর্থ হলো। তারা বুঝতে পেরেছিলো যে, শত্রুতামুলক আচরণ যতোটা করার, সেটা নিজেদের সীমানার মধ্যেই করতে হবে। তবে, এসময় তারা একটা মারাত্মক বিষয় ভাবতে শুরু করলো। তারা ভালভাবে বুঝতে পেরেছিলো যে, এ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে তাদের সামনে দু’টিআ পথ খোলা আছে। হয় শক্তি প্রয়োগে আল্লাহর রাসুলের দ্বীনি তাবলীগ বন্ধ করে দিতে হবে অথবা তাঁর অস্তিত্বই নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। কিন্ত দ্বিতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজ ছিলোনা কারণ স্বয়ং আবুতালেব ছিলেন রাসুল (সা) এর জিম্মাদার। তিনি পৌত্তলিকদের সংকল্পের সামনে লৌহ যবনিকার মতো দাঁড়িয়েছিলেন। এমতবস্থায় তারা পুনরায় আবু তালেবের সাথে কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করলো।