সম্মিলিত প্রতিরোধ
কোরায়শরা লক্ষ্য করলো যে, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাবলীগে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে রাখার কৌশল কাজে আসছে না তখন তারা নতুন করে চিন্তা করলো। দ্বীনের দাওয়াত চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করলো। সে পন্থা ও পদ্ধতির সারর্মম নিম্নরূপ-
প্রতিরোধের প্রথম ধরণ
এটা ছিলো হাসি ঠাট্টা, বিদ্রুপ-উপহাস এবং মিথ্যাবাদী বলে তাকে অভিহিত করা। এর উদ্দেশ্য ছিলো মুসলমানদের মনোবল নষ্ট করা। এ লক্ষ্য অর্জন পৌত্তলিকরা নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অহেতুক অপবাদ গালাগাল দিতে শুরু করে। কখন কখনো তারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাগল বলতো। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ওসব কাফেররা বললো, যার ওপর কোরআন নাযিল হয়েছে, নিশ্চয়ই সে একটা পাগল।
কখনো কখনো তাঁর ওপর যাদুকর এবং মিথ্যাবাদী হওয়ার অপবাদ দেয়া হতো। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ওরা বিস্ময় বোধ করছে যে, ওদের কাছে ওদেরই মধ্য থেকে একজন সর্তককারী এলেন এবং কাফেররা বলে, এতো এক যাদু, মিথ্যাবাদী।
কাফেররা আল্লাহর রসূলের সামনে দিয়ে পেছনে দিয়ে ক্রুদ্ধভাবে চলাচল করতো এবং রোষ কষারিত চোখে তাঁর প্রতি তাকাতো। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, কাফেররা যখন শ্রবণ করে তখন তারা যেন তাদের তীক্ষ্ণদৃষ্টি দ্বারা তোমাকে আছড়িয়ে ফেলে দেবে এবং বলে, এতো পাগল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোথাও যেতেন এবং তাঁর সামনে পেছনে দুর্বল ও অত্যাচারিত সাহাবায়ে কেরাম থাকতেন, তখন পৌত্তলিকরা ঠাট্টা করে বলতো, আল্লাহ কি তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করলেন?
তাদের এ উক্তির জবাবে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহ কি কৃতজ্ঞ লোকদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত নন?
কোরআনে আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের অবস্থার চিত্র এভাবে অষ্কন করেছেন, যারা অপরাধী, তারা তো মোমেনদের উপহাস করতো এবং ওরা যখন মোমেনদের কাছ দিয়ে যেতো, তখন চোখ টিপে ইশরা করতো এবং যথন ওদের আপনজনের কাছে ফিরে আসতো, তখন ওরা ফিরতো উৎফুল্ল হয়ে এবং যখন ওদের আপজনের কাছে ফিরে আসতো, তখন ওরা ফিরতো উৎফুল্ল হয়ে এবং যখন ওদেরকে দেখতো, তথন বলতো, এরা তো পথভ্রষ্ট। এদেরকে তো তাদের তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠানো হয়নি।
প্রতিরোধের দ্বিতীয় ধরণ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষাকে বিকৃত করা, সন্দেহ অবিশ্বাস সৃষ্টি করা, মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করা, দ্বীনের শিক্ষা এবং প্রচারকারীদের ঘৃণ্য সমালোচনা করা ছিলো তাদের নৈমিত্তিক কাজ। এসব কাজ তারা বেশী করতো যাতে জনসাধারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করার সুযোগ না পায়। পৌত্তলিকদের সম্পর্কে পবিত্র কোরাআন বলতো, ওরা বলেছে, এগুলোতো সে কালের উপকথা, যা সে লিখেয়ে নিয়েছে, এগুলো সকাল সন্ধা তার কাছে পাঠ করা হয়।
কাফেররা বলে, এটা ব্যতীত কিছুই নয়, সে এটা উদ্ভাবন করেছে এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে।
পৌত্তলিকরা এ কথাও বলে যে, তাকে শিক্ষা দেয় এবং মানুষ।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর তাদের অভিযোগ ছিলো এই, ওরা বলে এ কেমন রসূল , যে আহার করে এবং হাটে বাজারে চলাফেরা করে।
প্রতিরোধের তৃতীয় ধরণ
পূর্ববর্তী লোকদের ঘটনাবলী এবং কাহিনী উল্লেখ করে কোরআন তার অবিশ্বাসীদের মোকাবেলা করেছে। নযির ইবনে হারেসের ঘটনা এই যে, একবার কোরায়শদের বললো, হে কোরায়শরা, আল্লাহর শপথ, তোমাদের ওপর এমন আপদ এসে পড়েছে যে, তোমরা এখনো তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন উপায় বের করতে পারোনি। মোহাম্মদ তোমাদের মধ্যে বড় হয়েছেন, তোমাদের সবচেয়ে পছন্দনীয় মানুষ ছিলেন, সবার চেয়ে বেশী সত্যবাদী এবং সবচেয়ে বড় আমানতদারও ছিলেন। আজ তাঁর কানের কাছে চুল যখন সাদা হয়েছে, তখন তিনি তোমাদের কাছে কিছু কথা নিয়ে এসেছেন। অথচ তোমরা বলছো, তিনি যাদুকর। আল্লাহ শপথ, তিনি যাদুকর নন। আমি যাদুকর দেখেছি এবং তাদের যাদুটোনাও দেখেছি। তোমরা বলছো যে, তিনি জ্যোতিষী, না তিনি জ্যোতিষীও নন। আমি জ্যোতিষীও দেখেছি। তাদের উল্টাপাল্টা কথাও শুনেছি। তোরা বলছো তিনি কবি, আল্লাহ শপথ, তিনি কবিও নন। আমি কবিদের দেখেছি এবং তাদের কবিতা শুনেছি। তোমরা বলছো তিনি পাগল, না, আললাহ শপথ, তিনি পাগলও নন। আমি পাগল দেখেছি, পাগলের পাগলামিও দেখেছি। তাঁর মধ্যে পাগলামির কোন প্রকার চিহ্ন নেই। কোরায়শদের লোকেরা, তোমরা গভীরভাবে চিন্তা করো, তোমাদের ওপর বিরাট আপদ এসে পড়েছে।
এরপর নযর ইবনে হারেস হীরার গিয়ে সেখানে বাদশাহদের বিভিন্ন ঘটনা বিশেষত রুস্তম এবং আলেকজান্ডারের কাহিনী শিখলো। এরপর সে মক্কায় ফিরে এলো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোন মজলিসে বসে আল্লাহর কথা বলতেন এবং তাঁর শাস্তি সম্পর্কে লোকদের ভয় দেখাতেন, তখন সে সেখানে গিয়ে বলতো, আল্লাহ শপথ,মোহাম্মদের কথা আমার কথার চেয়ে ভালো নয়। এরপর সে পারস্যের বাদশাহ এবং রুস্তম ও আলেকজান্ডারের কাহিনী শোনাতো। এরপর বলতো, মোহাম্মদের কথা আমার কথার চেয়ে কি কারণে ভালো হবে?
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের বর্ণনা থেকে এ কথাও জানা যায় যে, নযর ইবনে হারেস কয়েকজন দাসী ক্রয় করে রেখেছিলো। যখন সে শুনতো যে, কোন মানুষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, তখন তার ওপর একজন দাসীকে লেলিয়ে দিতো। সেই দাসী সেই লোককে পানাহার করতো, তাকে গান শোনাতো। একপর্যায় সেই লোকের ইসলামের প্রতি কোন আকর্ষণ অবশিষ্ট থাকতো না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন, কিছু লোক এমন রয়েছে, যারা ক্রীড়ার কথাবার্তা ক্রয় করে, যাতে আল্লাহ পথ থেকে দূরে সরানো যায়।
প্রতিরোধের চতুর্থ ধরণ
কোরায়শরা একপর্যায় এ রকম চেষ্টা করেছিলো যে, ইসলাম এবং জাহেলিয়াতের মধ্যে একটি সেতুকন্ধন রচনা করবে। অর্থাৎ পরস্পরকে কিছু ছাড় দেবে। আল্লাহ রাসূল পৌত্তলিকদের কিছু গ্রহণ করবেন এবং পৌত্তলিকরা ও আল্লাহর রসূলের কিছু আর্দশ গ্রহণ করবে। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে এ সম্পর্কে বলেন, ওরা চায় যে, আপনি নমনীয় হবেন, তাহলে তারাও নমনীয় হবে।
ইবনে জরীর এবং তিবরানির একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, পৌত্তলিকরা আল্লাহ রসূলের কাছে এ মর্মে প্রস্তাব দিল যে, এ বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের উপসনা করুন, আর এক বছর আমরা আপনার প্রভুর উপসনা করবো। আবদ ইবনে হোমায়েদের একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, পৌত্তলিকরা বললো, আপনি যদি আমাদের উপাস্যদের মেনে নেন, তবে আমরাও আপনার খোদার ইবাদাত করবো।
ইবনে ইসহাক বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাবাঘরের তওয়াফ করেছিলেন। এমন এক সময় আসওয়াদ ইবনে মোত্তালেব ইবনে আবদুল ওযযা, ওলীদ ইবনে মুগীরা, উমাইয়া ইবনে খালফ ও আসা ইবনে ওয়ায়েল ছাহমি তাঁর কাছে এলো। এরা ছিল নিজ নিজ গোত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তি। এরা বললো, এসো মোহাম্মদ, তুমি তাঁর পূঁজা করছো, আমরা তার পূজা করবো। আর আমরা যাকে পূজা করছি, তুমিও তাকে পূজা করবে। এতে আমরা উভয়ে সমপর্যায়ে উন্নীত হবো। যদি তোমার মাবুদ আমাদের মাবুদের চেয়ে ভালো হন তবে আমরা তার কাছ থেকে কল্যাণ লাভ করবো আর যদি আমাদের মাবুদ তোমার মাবুদের চেয়ে ভালো হন তবে তোমার কাছ থেকে কল্যাণ লাভ করবে । তাদের এ হাস্যকর কথার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা সূরা কাফেরুন নাযিল করেন। এতে ঘোষনা করা হয় যে, তোমরা যাদের উপসনা করো, আমি তাদের উপসনা করতে পারি না।
এ সিদ্ধান্তমূলক জবাবের মাধ্যমে পৌত্তলিকদের হাস্যকর বক্তব্যের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনায় সম্ভাব্য কারণ এই যে, এ ধরণের চেষ্টা সম্ভবত বারবার করা হয়েছে।